সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ্‌ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন। দুনিয়ার উপরটা তখনও কোন বিশেষ আকার পায় নি, আর তার মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না; তার উপরে ছিল অন্ধকারে ঢাকা গভীর পানি। আল্লাহ্‌র রূহ্‌ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হোক, আর তাতে পানি দু’ভাগ হয়ে যাক।” এইভাবে আল্লাহ্‌ পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করলেন এবং নীচের পানি ও উপরের পানি আলাদা করলেন। তাতে উপরের পানি ও নীচের পানি আলাদা হয়ে গেল। আল্লাহ্‌ যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করেছিলেন তার নাম তিনি দিলেন আসমান। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল দ্বিতীয় দিন। এর পর আল্লাহ্‌ বললেন, “আসমানের নীচের সব পানি এক জায়গায় জমা হোক এবং শুকনা জায়গা দেখা দিক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্‌ সেই শুকনা জায়গার নাম দিলেন ভূমি, আর সেই জমা হওয়া পানির নাম দিলেন সমুদ্র। আল্লাহ্‌ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “ভূমির উপরে ঘাস গজিয়ে উঠুক; আর এমন সব শস্য ও শাক-সবজীর গাছ হোক যাদের নিজের নিজের বীজ থাকবে। ভূমির উপর বিভিন্ন জাতের ফলের গাছও গজিয়ে উঠুক যেগুলোতে তাদের নিজের নিজের ফল ধরবে; আর সেই সব ফলের মধ্যে থাকবে তাদের নিজের নিজের বীজ।” আর তা-ই হল। ভূমির মধ্যে ঘাস, নিজের বীজ আছে এমন সব বিভিন্ন জাতের শস্য ও শাক-সবজীর গাছ এবং বিভিন্ন জাতের ফলের গাছের জন্ম হল; আর সেই সব ফলের মধ্যে তাদের নিজের নিজের বীজ ছিল। আল্লাহ্‌ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল তৃতীয় দিন। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “আসমানের মধ্যে আলো দেয় এমন সব কিছু দেখা দিক, আর তা রাত থেকে দিনকে আলাদা করুক। সেগুলো আলাদা আলাদা দিন, ঋতু আর বছরের জন্য চিহ্ন হয়ে থাকুক। আসমান থেকে সেগুলো দুনিয়ার উপর আলো দিক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্‌ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন। তিনি সেগুলোকে আসমানের মধ্যে স্থাপন করলেন যাতে সেগুলো দুনিয়ার উপর আলো দেয়, দিন ও রাতের উপর রাজত্ব করে আর অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে রাখে। আল্লাহ্‌ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল চতুর্থ দিন। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “পানি বিভিন্ন প্রাণীর ঝাঁকে ভরে উঠুক, আর দুনিয়ার উপরে আসমানের মধ্যে বিভিন্ন পাখী উড়ে বেড়াক।” এইভাবে আল্লাহ্‌ সমুদ্রের বড় বড় প্রাণী এবং পানির মধ্যে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন জাতের প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন জাতের পাখীও সৃষ্টি করলেন। তাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের জাতি অনুসারে বংশ বৃদ্ধি করবার ক্ষমতা রইল। আল্লাহ্‌ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। আল্লাহ্‌ তাদের এই বলে দোয়া করলেন, “বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হয়ে তোমরা নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলো, আর তা দিয়ে সমুদ্রের পানি পূর্ণ কর। দুনিয়ার উপরে পাখীরাও নিজের নিজের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলুক।” এইভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল পঞ্চম দিন। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “মাটি থেকে এমন সব প্রাণীর জন্ম হোক যাদের নিজের নিজের জাতকে বাড়িয়ে তুলবার ক্ষমতা থাকবে। তাদের মধ্যে গৃহপালিত, বন্য ও বুকে-হাঁটা প্রাণী থাকুক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্‌ দুনিয়ার সব রকমের বন্য, গৃহপালিত এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এদের সকলেরই নিজের নিজের জাতকে বাড়িয়ে তুলবার ক্ষমতা রইল। আল্লাহ্‌ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তারপর আল্লাহ্‌ বললেন, “আমরা আমাদের মত করে এবং আমাদের সংগে মিল রেখে এখন মানুষ তৈরী করি। তারা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী, পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং সমস্ত দুনিয়ার উপর রাজত্ব করুক।” পরে আল্লাহ্‌ তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন। হ্যাঁ, তিনি তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে। আল্লাহ্‌ তাঁদের দোয়া করে বললেন, “তোমরা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হও, আর নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে দুনিয়া ভরে তোলো এবং দুনিয়াকে নিজেদের শাসনের অধীনে আন। এছাড়া তোমরা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী এবং মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো প্রত্যেকটি প্রাণীর উপরে রাজত্ব কর।” এর পরে আল্লাহ্‌ বললেন, “দেখ, দুনিয়ার উপরে প্রত্যেকটি শস্য ও শাক-সবজী যার নিজের বীজ আছে এবং প্রত্যেকটি গাছ যার ফলের মধ্যে তার বীজ রয়েছে সেগুলো আমি তোমাদের দিলাম। এগুলোই তোমাদের খাবার হবে। দুনিয়ার উপরের প্রত্যেকটি পশু, আসমানের প্রত্যেকটি পাখী এবং বুকে-হাঁটা প্রত্যেকটি প্রাণী, এক কথায় সমস্ত প্রাণীর খাবারের জন্য আমি সমস্ত শস্য ও শাক-সবজী দিলাম।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের তৈরী সব কিছু দেখলেন। সেগুলো সত্যিই খুব চমৎকার হয়েছিল। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই হল ষষ্ঠ দিন। এইভাবে আসমান ও জমীন এবং তাদের মধ্যেকার সব কিছু তৈরী করা শেষ হল। আল্লাহ্‌ তাঁর সব সৃষ্টির কাজ ছয় দিনে শেষ করলেন; তিনি সপ্তম দিনে সৃষ্টির কোন কাজ করলেন না। এই সপ্তম দিনটিকে তিনি দোয়া করে পবিত্র করলেন, কারণ ঐ দিনে তিনি কোন সৃষ্টির কাজ করেন নি। তবে মাটির তলা থেকে পানি উঠত এবং তাতেই মাটি ভিজত। পরে মাবুদ আল্লাহ্‌ মাটি দিয়ে একটি পুরুষ মানুষ তৈরী করলেন এবং তার নাকে ফুঁ দিয়ে তার ভিতরে জীবন্তবায়ু ঢুকিয়ে দিলেন। তাতে সেই মানুষ একটি জীবন্ত প্রাণী হল। এর আগে মাবুদ আল্লাহ্‌ পূর্ব দিকে আদন দেশে একটা বাগান করেছিলেন, আর সেখানেই তিনি তাঁর গড়া মানুষটিকে রাখলেন। সেখানকার মাটিতে তিনি এমন সব গাছ জন্মিয়েছিলেন যা দেখতেও সুন্দর এবং যার ফল খেতেও ভাল। তা ছাড়া বাগানের মাঝখানে তিনি “জীবন-গাছ” ও “নেকী-বদী-জ্ঞানের গাছ” নামে দু’টি গাছও জন্মিয়েছিলেন। সেই বাগানে পানির যোগান দিত এমন একটা নদী যেটা আদন দেশের মধ্য থেকে বের হয়েছিল এবং চারটা শাখানদীতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম নদীটার নাম পীশোন। এটা হবীলা দেশের চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে। সেখানে সোনা পাওয়া যায়, আর সেই দেশের সোনা খুব ভাল। এছাড়া সেখানে গুগ্‌গুলু ও বৈদূর্য মণিও পাওয়া যায়। দ্বিতীয় নদীটার নাম জিহোন। এই নদী কূশ দেশের চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে। তৃতীয় নদীটার নাম দজলা। এটা আশেরিয়া দেশের পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গেছে। চতুর্থ নদীটার নাম হল ফোরাত। মাবুদ আল্লাহ্‌ সেই মানুষটিকে নিয়ে আদন বাগানে রাখলেন যাতে তিনি তাতে চাষ করতে পারেন ও তার দেখাশোনা করতে পারেন। পরে মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁকে হুকুম দিয়ে বললেন, “তুমি তোমার খুশীমত এই বাগানের যে কোন গাছের ফল খেতে পার; কিন্তু নেকী-বদী-জ্ঞানের যে গাছটি রয়েছে তার ফল তুমি খাবে না, কারণ যেদিন তুমি তার ফল খাবে সেই দিন নিশ্চয়ই তোমার মৃত্যু হবে।” পরে মাবুদ আল্লাহ্‌ বললেন, “মানুষটির পক্ষে একা থাকা ভাল নয়। আমি তার জন্য একজন উপযুক্ত সংগী তৈরী করব।” মাবুদ আল্লাহ্‌ মাটি থেকে ভূমির যে সব জীবজন্তু ও আকাশের পাখী তৈরী করেছিলেন সেগুলো সেই মানুষটির কাছে আনলেন। মাবুদ দেখতে চাইলেন তিনি সেগুলোকে কি বলে ডাকেন। তিনি সেই সব প্রাণীগুলোর যেটিকে যে নামে ডাকলেন সেটির সেই নামই হল। তিনি প্রত্যেকটি গৃহপালিত ও বন্য পশু এবং আকাশের পাখীর নাম দিলেন, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সেই পুরুষ মানুষটির, অর্থাৎ আদমের কোন উপযুক্ত সংগী দেখা গেল না। সেইজন্য মাবুদ আল্লাহ্‌ আদমের উপর একটা গভীর ঘুম নিয়ে আসলেন, আর তাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তিনি তাঁর একটা পাঁজর তুলে নিয়ে সেই জায়গাটা বন্ধ করে দিলেন। আদম থেকে তুলে নেওয়া সেই পাঁজরটা দিয়ে মাবুদ আল্লাহ্‌ একজন স্ত্রীলোক তৈরী করে তাঁকে আদমের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে আদম বললেন, “এবার হয়েছে। এঁর হাড়-মাংস আমার হাড়-মাংস থেকেই তৈরী। পুরুষ লোকের শরীরের মধ্য থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে এঁকে স্ত্রীলোক বলা হবে।” এইজন্যই মানুষ পিতা-মাতাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন এক শরীর হবে। তখন আদম এবং তাঁর স্ত্রী উলংগ থাকতেন, কিন্তু তাতে তাঁদের কোন লজ্জাবোধ ছিল না। মাবুদ আল্লাহ্‌র তৈরী ভূমির জীবজন্তুদের মধ্যে সাপ ছিল সবচেয়ে চালাক। এই সাপ একদিন সেই স্ত্রীলোকটিকে বলল, “আল্লাহ্‌ কি সত্যি তোমাদের বলেছেন যে, বাগানের সব গাছের ফল তোমরা খেতে পারবে না?” জবাবে স্ত্রীলোকটি বললেন, “বাগানের গাছের ফল আমরা খেতে পারি। তবে বাগানের মাঝখানে যে গাছটি রয়েছে তার ফল সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘তোমরা তার ফল খাবেও না, ছোঁবেও না। তা করলে তোমাদের মৃত্যু হবে।’ ” তখন সাপ স্ত্রীলোকটিকে বলল, “কখনও না, কিছুতেই তোমরা মরবে না। আল্লাহ্‌ জানেন, যেদিন তোমরা সেই গাছের ফল খাবে সেই দিনই তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তাতে নেকী-বদীর জ্ঞান পেয়ে তোমরা আল্লাহ্‌র মতই হয়ে উঠবে।” স্ত্রীলোকটি যখন বুঝলেন যে, গাছটার ফলগুলো খেতে ভাল হবে এবং সেগুলো দেখতেও সুন্দর আর তা ছাড়া জ্ঞান লাভের জন্য কামনা করবার মতও বটে, তখন তিনি কয়েকটা ফল পেড়ে নিয়ে খেলেন। সেই ফল তিনি তাঁর স্বামীকেও দিলেন এবং তাঁর স্বামীও তা খেলেন। এতে তখনই তাঁদের দু’জনের চোখ খুলে গেল। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা উলংগ অবস্থায় আছেন। তখন তাঁরা কতগুলো ডুমুরের পাতা একসংগে জুড়ে নিয়ে নিজেদের জন্য খাটো ঘাগ্‌রা তৈরী করে নিলেন। যখন সন্ধ্যার বাতাস বইতে শুরু করল তখন তাঁরা মাবুদ আল্লাহ্‌র গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বাগানের মধ্যে বেড়াচ্ছিলেন। তখন আদম ও তাঁর স্ত্রী বাগানের গাছপালার মধ্যে নিজেদের লুকালেন যাতে মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তাঁদের পড়তে না হয়। মাবুদ আল্লাহ্‌ আদমকে ডেকে বললেন, “তুমি কোথায়?” তিনি বললেন, “বাগানের মধ্যে আমি তোমার গলার আওয়াজ শুনেছি। কিন্তু আমি উলংগ, তাই ভয়ে লুকিয়ে আছি।” তখন মাবুদ আল্লাহ্‌ বললেন, “তুমি যে উলংগ সেই কথা কে তোমাকে বলল? যে গাছের ফল খেতে আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তা কি তুমি খেয়েছ?” আদম বললেন, “যে স্ত্রীলোককে তুমি আমার সংগিনী হিসাবে দিয়েছ সে-ই আমাকে ঐ গাছের ফল দিয়েছে আর আমি তা খেয়েছি।” তখন মাবুদ আল্লাহ্‌ সেই স্ত্রীলোককে বললেন, “তুমি এ কি করেছ?” স্ত্রীলোকটি বললেন, “ঐ সাপ আমাকে ছলনা করে ভুলিয়েছে আর সেইজন্য আমি তা খেয়েছি।” তখন মাবুদ আল্লাহ্‌ সেই সাপকে বললেন, “তোমার এই কাজের জন্য ভূমির সমস্ত গৃহপালিত আর বন্য প্রাণীদের মধ্যে তোমাকে সবচেয়ে বেশী বদদোয়া দেওয়া হল। তুমি সারা জীবন পেটের উপর ভর করে চলবে এবং ধুলা খাবে। আমি তোমার ও স্ত্রীলোকের মধ্যে এবং তোমার বংশ ও স্ত্রীলোকের মধ্য দিয়ে আসা বংশের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করব। সেই বংশের একজন তোমার মাথা পিষে দেবে আর তুমি তার পায়ের গোড়ালীতে ছোবল মারবে।” তারপর তিনি সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “আমি তোমার গর্ভকালীন অবস্থায় তোমার কষ্ট অনেক বাড়িয়ে দেব। তুমি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্তান প্রসব করবে। স্বামীর জন্য তোমার খুব কামনা হবে, আর সে তোমার উপর কর্তৃত্ব করবে।” তারপর তিনি আদমকে বললেন, “যে গাছের ফল খেতে আমি নিষেধ করেছিলাম তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে তা খেয়েছ। তাই তোমার দরুন মাটিকে বদদোয়া দেওয়া হল। সারা জীবন ভীষণ পরিশ্রম করে তবে তুমি মাটির ফসল খাবে। তোমার জন্য মাটিতে কাঁটাগাছ ও শিয়ালকাঁটা গজাবে, কিন্তু তোমার খাবার হবে ক্ষেতের ফসল। যে মাটি থেকে তোমাকে তৈরী করা হয়েছিল সেই মাটিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমাকে খেতে হবে। তোমার এই ধুলার শরীর ধুলাতেই ফিরে যাবে।” আদম তাঁর স্ত্রীর নাম দিলেন হাওয়া (যার মানে “জীবন”), কারণ তিনি সমস্ত জীবিত লোকদের মা হবেন। আদম ও তাঁর স্ত্রীর জন্য মাবুদ আল্লাহ্‌ পশুর চামড়ার পোশাক তৈরী করে তাঁদের পরিয়ে দিলেন। তারপর মাবুদ আল্লাহ্‌ বললেন, “দেখ, নেকী-বদীর জ্ঞান পেয়ে মানুষ আমাদের একজনের মত হয়ে উঠেছে। এবার তারা যেন জীবন্তগাছের ফল পেড়ে খেয়ে চিরকাল বেঁচে না থাকে সেইজন্য আমাদের কিছু করা দরকার।” এই বলে মাবুদ আল্লাহ্‌ মাটির তৈরী মানুষকে মাটি চাষ করবার জন্য আদন বাগান থেকে বের করে দিলেন। এইভাবে তিনি তাঁদের তাড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি জীবন্তগাছের কাছে যাওয়ার পথ পাহারা দেবার জন্য আদন বাগানের পূর্ব দিকে কারুবীদের রাখলেন, আর সেই সংগে সেখানে একখানা জ্বলন্ত তলোয়ারও রাখলেন যা অনবরত ঘুরতে থাকল। আদম তাঁর স্ত্রী হাওয়ার কাছে গেলে পর হাওয়া গর্ভবতী হলেন, আর কাবিল নামে তাঁর একটি ছেলে হল। তখন হাওয়া বললেন, “মাবুদ আমাকে একটি পুরুষ সন্তান দিয়েছেন।” পরে তাঁর গর্ভে কাবিলের ভাই হাবিলের জন্ম হল। হাবিল ভেড়ার পাল চরাত আর কাবিল জমি চাষ করত। পরে এক সময়ে কাবিল মাবুদের কাছে তার জমির ফসল এনে কোরবানী করল। হাবিলও তার পাল থেকে প্রথমে জন্মেছে এমন কয়েকটা ভেড়া এনে তার চর্বিযুক্ত অংশগুলো কোরবানী দিল। মাবুদ হাবিল ও তার কোরবানী কবুল করলেন, কিন্তু কাবিল ও তার কোরবানী কবুল করলেন না। এতে কাবিলের খুব রাগ হল আর সে মুখ কালো করে রইল। এই অবস্থা দেখে মাবুদ কাবিলকে বললেন, “কেন তুমি রাগ করেছ আর কেনই বা মুখ কালো করে আছ? যদি তুমি ভাল কাজ কর তাহলে কি তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না? কিন্তু যদি ভাল কাজ না কর তবে তো গুনাহ্‌ তোমাকে পাবার জন্য তোমার দরজায় এসে বসে থাকবে; কিন্তু তাকে তোমার বশে আনতে হবে।” এর পর একদিন মাঠে থাকবার সময় কাবিল তার ভাই হাবিলের সংগে কথা বলছিল, আর তখন সে হাবিলকে হামলা করে হত্যা করল। তখন মাবুদ কাবিলকে বললেন, “তোমার ভাই হাবিল কোথায়?” কাবিল বলল, “আমি জানি না। আমার ভাইয়ের দেখাশোনার ভার কি আমার উপর?” তখন মাবুদ বললেন, “এ তুমি কি করেছ? দেখ, জমি থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত আমার কাছে কাঁদছে। জমি যখন তোমার হাত থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত গ্রহণ করবার জন্য মুখ খুলেছে তখন জমির বদদোয়াই তোমার উপর পড়ল। তুমি যখন জমি চাষ করবে তখন তা আর তোমাকে তেমন ফসল দেবে না। তুমি পলাতক হয়ে দুনিয়াতে ঘুরে বেড়াবে।” তখন কাবিল মাবুদকে বলল, “এই শাস্তি আমার সহ্যের বাইরে। আজ তুমি আমাকে জমি থেকে তাড়িয়ে দিলে, যার ফলে আমি তোমার চোখের আড়াল হয়ে যাব। পলাতক হয়ে যখন আমি দুনিয়াতে ঘুরে বেড়াব তখন যার সামনে আমি পড়ব সে-ই আমাকে খুন করতে পারে।” তখন মাবুদ তাকে বললেন, “তাহলে যে তোমাকে খুন করবে তার উপর সাতগুণ প্রতিশোধ নেওয়া হবে।” এই বলে মাবুদ কাবিলের জন্য এমন একটা চিহ্নের ব্যবস্থা করলেন যাতে কেউ তাকে হাতে পেয়েও খুন না করে। এর পরে কাবিল মাবুদের সামনে থেকে চলে গিয়ে আদনের পূর্ব দিকে নোদ নামে একটা দেশে বাস করতে লাগল। পরে কাবিল তার স্ত্রীর কাছে গেলে সে গর্ভবতী হল এবং হনোকের জন্ম হল। তখন কাবিল একটা শহর তৈরী করছিল। সে তার ছেলের নাম অনুসারে শহরটার নাম রাখল হনোক। হনোকের ছেলের নাম ঈরদ; ঈরদের ছেলের নাম মহূয়ায়েল; মহূয়ায়েলের ছেলের নাম মথূশায়েল; মথূশায়েলের ছেলের নাম লেমক। লেমকের দু’টি স্ত্রী ছিল। তার একজনের নাম আদা, অন্যজনের নাম সিল্লা। আদার গর্ভে যাবলের জন্ম হল। যারা তাম্বুতে তাম্বুতে বাস করে এবং পশুপালন করে জীবন কাটায় এই যাবল তাদের পূর্বপুরুষ। যাবলের ভাইয়ের নাম ছিল যূবল। যারা বীণা ও বাঁশী বাজায় যূবল তাদের সকলের পূর্বপুরুষ। সিল্লার গর্ভে তূবল-কাবিলের জন্ম হল। ব্রোঞ্জ আর লোহার সব রকমের যন্ত্রপাতি তৈরী করা ছিল তার কাজ। তূবল-কাবিলের বোনের নাম ছিল নয়মা। একদিন লেমক তার দুই স্ত্রীকে বলল, “আদা আর সিল্লা, তোমরা আমার কথা শোন; লেমকের স্ত্রীরা, আমার কথায় কান দাও। যে লোক আমাকে জখম করেছে, অর্থাৎ যে যুবক আমার গায়ে হাত তুলেছে, আমি তাকে খুন করেছি। কাবিলকে খুন করবার প্রতিশোধ যদি সাতগুণ হয়, তবে লেমককে খুন করবার প্রতিশোধ হবে সাতাত্তর গুণ।” পরে আদম আবার তাঁর স্ত্রীর কাছে গেলেন এবং তাঁর স্ত্রীর একটি ছেলে হল। তাঁর স্ত্রী তার নাম রাখলেন শিস। হাওয়া বললেন, “কাবিল হাবিলকে খুন করেছে বলে আল্লাহ্‌ হাবিলের জায়গায় আমাকে আর একটি সন্তান দিলেন।” পরে শিসের একটি ছেলে হল। তিনি তার নাম রাখলেন আনুশ। সেই সময় থেকে লোকেরা মাবুদের এবাদত করতে শুরু করল। এই হল আদমের বংশের কথা। মানুষ সৃষ্টি করবার সময় আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর নিজের মত করে সৃষ্টি করলেন; সৃষ্টি করলেন পুরুষ এবং স্ত্রীলোক করে এবং তাঁদের দোয়া করলেন। সৃষ্টির সময়ে তিনি তাঁদের নাম দিলেন “মানুষ”। একশো ত্রিশ বছর বয়সে আদমের একটি ছেলের জন্ম হল। ছেলেটি বাইরে এবং ভিতরে তাঁরই মত হয়েছিল। আদম তার নাম দিলেন শিস। শিসের জন্মের পর আদম আরও আটশো বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছিল। মোট ন’শো ত্রিশ বছর বেঁচে থাকবার পর আদম ইন্তেকাল করলেন। শিসের একশো পাঁচ বছর বয়সে তাঁর ছেলে আনুশের জন্ম হল। আনুশের জন্মের পর শিস আরও আটশো সাত বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট ন’শো বারো বছর বেঁচে থাকবার পর শিস ইন্তেকাল করলেন। আনুশের নব্বই বছর বয়সে তাঁর ছেলে কীনানের জন্ম হল। কীনানের জন্মের পর আনুশ আরও আটশো পনেরো বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট ন’শো পাঁচ বছর বেঁচে থাকবার পর আনুশ ইন্তেকাল করলেন। কীনানের সত্তর বছর বয়সে তাঁর ছেলে মাহলাইলের জন্ম হল। মাহলাইলের জন্মের পর কীনান আরও আটশো চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট ন’শো দশ বছর বেঁচে থাকবার পর কীনান ইন্তেকাল করলেন। মাহলাইলের পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তাঁর ছেলে ইয়ারুদের জন্ম হল। ইয়ারুদের জন্মের পর মাহলাইল আরও আটশো ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট আটশো পঁচানব্বই বছর বেঁচে থাকবার পর মাহলাইল ইন্তেকাল করলেন। ইয়ারুদের একশো বাষট্টি বছর বয়সে তাঁর ছেলে ইনোকের জন্ম হল। ইনোকের জন্মের পর ইয়ারুদ আরও আটশো বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট ন’শো বাষট্টি বছর বেঁচে থাকবার পর ইয়ারুদ ইন্তেকাল করলেন। ইনোকের পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তাঁর ছেলে মুতাওশালেহের জন্ম হল। মুতাওশালেহের জন্মের পর তিনশো বছর পর্যন্ত আল্লাহ্‌র সংগে ইনোকের যোগাযোগ-সম্বন্ধ ছিল। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। ইনোক মোট তিনশো পঁয়ষট্টি বছর এই দুনিয়াতে ছিলেন। তারপর তাঁকে আর দেখা গেল না। আল্লাহ্‌র সংগে তাঁর যোগাযোগ-সম্বন্ধ ছিল বলে আল্লাহ্‌ তাঁকে নিজের কাছেই নিয়ে গিয়েছিলেন। মুতাওশালেহের একশো সাতাশি বছর বয়সে তাঁর ছেলে লামাকের জন্ম হল। লামাকের জন্মের পর মুতাওশালেহ আরও সাতশো বিরাশি বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছিল। মোট ন’শো উনসত্তর বছর বেঁচে থাকবার পর মুতাওশালেহ ইন্তেকাল করলেন। লামাকের একশো বিরাশি বছর বয়সে তাঁর একটি ছেলের জন্ম হল। তিনি বললেন, “আমাদের সব পরিশ্রমের মধ্যে, বিশেষ করে মাবুদ মাটিকে বদদোয়া দেবার পর তার উপর আমাদের যে পরিশ্রম করতে হয় তার মধ্যে এই ছেলেটিই আমাদের সান্ত্বনা দেবে।” এই বলে তিনি তাঁর নাম দিলেন নূহ্‌। নূহের জন্মের পর লামাক আরও পাঁচশো পঁচানব্বই বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট সাতশো সাতাত্তর বছর বেঁচে থাকবার পর লামাক ইন্তেকাল করলেন। নূহের বয়স পাঁচশো বছর পার হয়ে গেলে পর তাঁর ছেলে সাম, হাম আর ইয়াফসের জন্ম হয়েছিল। এই অবস্থা দেখে মাবুদ বললেন, “আমার রূহ্‌ চিরকাল ধরে মানুষকে চেতনা দিতে থাকবেন না, কারণ মানুষ মৃত্যুর অধীন। আমি তাদের আরও একশো বিশ বছর সময় দিচ্ছি।” আল্লাহ্‌র সন্তানদের সংগে এই মেয়েদের মিলনের ফলে যে সন্তানদের জন্ম হল তারা ছিল পুরানো দিনের নাম-করা শক্তিশালী লোক। সেই সময় এবং তার পরেও দুনিয়াতে নেফিলীয় নামে এক জাতের লোক ছিল। মাবুদ দেখলেন দুনিয়াতে মানুষের নাফরমানী খুবই বেড়ে গেছে, আর তার দিলের সব চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই কেবল খারাপীর দিকে ঝুঁকে আছে। কিন্তু নূহের উপরে মাবুদ সন্তুষ্ট রইলেন। এই হল নূহের জীবনের কথা। নূহ্‌ একজন সৎ লোক ছিলেন। তাঁর সময়কার লোকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন খাঁটি। আল্লাহ্‌র সংগে তাঁর যোগাযোগ-সম্বন্ধ ছিল। সাম, হাম আর ইয়াফস নামে নূহের তিনটি ছেলে ছিল। সেই সময় আল্লাহ্‌র কাছে সারা দুনিয়াটাই গুনাহের দুর্গন্ধে এবং জোর-জুলুমে ভরে উঠেছিল। আল্লাহ্‌ দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, তা দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে, কারণ দুনিয়ার মানুষের স্বভাবে পচন ধরেছে। এই অবস্থা দেখে আল্লাহ্‌ নূহ্‌কে বললেন, “গোটা মানুষ জাতটাকেই আমি ধ্বংস করে ফেলব বলে ঠিক করেছি। মানুষের জন্যই দুনিয়া জোর-জুলুমে ভরে উঠেছে। মানুষের সংগে দুনিয়ার সব কিছুই আমি ধ্বংস করতে যাচ্ছি। তুমি গোফর কাঠ দিয়ে তোমার নিজের জন্য একটা জাহাজ তৈরী কর। তার মধ্যে কতগুলো কামরা থাকবে; আর সেই জাহাজের বাইরে এবং ভিতরে আল্‌কাত্‌রা দিয়ে লেপে দেবে। জাহাজটা তুমি এইভাবে তৈরী করবে: সেটা লম্বায় হবে তিনশো হাত, চওড়ায় পঞ্চাশ হাত, আর তার উচ্চতা হবে ত্রিশ হাত। জাহাজটার ছাদ থেকে নীচে এক হাত পর্যন্ত চারদিকে একটা খোলা জায়গা রাখবে আর দরজাটা হবে জাহাজের এক পাশে। জাহাজটাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থাকবে। আর দেখ, আমি দুনিয়াতে এমন একটা বন্যার সৃষ্টি করব যাতে আসমানের নীচে যে সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে তারা সব ধ্বংস হয়ে যায়। দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীই তাতে মারা যাবে। “কিন্তু আমি তোমার জন্য আমার ব্যবস্থা স্থাপন করব। তুমি গিয়ে জাহাজে উঠবে আর তোমার সংগে থাকবে তোমার ছেলেরা, তোমার স্ত্রী ও তোমার ছেলেদের স্ত্রীরা। তোমার সংগে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তুমি প্রত্যেক জাতের প্রাণী থেকে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে এক এক জোড়া করে জাহাজে তুলে নেবে। প্রত্যেক জাতের পাখী, জীবজন্তু ও বুকে-হাঁটা প্রাণী এক এক জোড়া করে তোমার কাছে আসবে যাতে তুমি তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পার; আর তুমি সব রকমের খাবার জিনিস জোগাড় করে মজুদ করে রাখবে। সেগুলোই হবে তোমার ও তাদের খাবার।” নূহ্‌ তা-ই করলেন। আল্লাহ্‌র হুকুম মত তিনি সব কিছুই করলেন। এর পরে মাবুদ নূহ্‌কে আবার বললেন, “তুমি ও তোমার পরিবারের সবাই জাহাজে উঠবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, এখনকার লোকদের মধ্যে কেবল তুমিই সৎ আছ। তুমি পাক পশুর প্রত্যেক জাতের মধ্য থেকে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সংগে নেবে, আর নাপাক পশুর মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে এক জোড়া করে নেবে। আকাশে উড়ে বেড়ায় এমন পাক পাখীদের মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সংগে নেবে। দুনিয়ার উপর তাদের বংশ বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই তুমি তা করবে। আমি আর সাত দিন পরে দুনিয়ার উপরে বৃষ্টি পড়বার ব্যবস্থা করব। তাতে চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত ধরে বৃষ্টি পড়তে থাকবে। আমি ভূমিতে যে সব প্রাণী সৃষ্টি করেছি তাদের প্রত্যেকটিকে দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেলব।” মাবুদের হুকুম মতই নূহ্‌ সব কাজ করলেন। দুনিয়াতে বন্যা শুরু হওয়ার সময় নূহের বয়স ছিল ছ’শো বছর। বন্যা থেকে রক্ষা পাবার জন্য নূহ, তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেরা এবং ছেলেদের স্ত্রীরা সেই জাহাজে গিয়ে উঠলেন। সেই সাত দিন পার হয়ে গেলে পর দুনিয়াতে বন্যা হল। নূহের বয়স যখন ছ’শো বছর চলছিল, সেই বছরের দ্বিতীয় মাসের সতেরো দিনের দিন মাটির নীচের সমস্ত পানি হঠাৎ বের হয়ে আসতে লাগল আর আকাশেও যেন ফাটল ধরল। চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত ধরে দুনিয়ার উপরে বৃষ্টি পড়তে থাকল। যেদিন বৃষ্টি পড়তে শুরু করল সেই দিন নূহ, তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলে সাম, হাম ও ইয়াফস এবং তাঁর তিন ছেলের স্ত্রীরা গিয়ে জাহাজে উঠেছিলেন। তাঁদের সংগে প্রত্যেক জাতের এক এক জোড়া করে বন্য ও গৃহপালিত পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী আর সব রকম পাখীও উঠেছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা সব প্রাণীই জোড়ায় জোড়ায় নূহের কাছে জাহাজে গিয়ে উঠেছিল। আল্লাহ্‌ নূহ্‌কে হুকুম দেবার সময় যা বলেছিলেন সেই অনুসারে স্ত্রী-পুরুষ মিলেই তারা উঠেছিল। এর পর মাবুদ জাহাজের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর থেকে চল্লিশ দিন ধরে দুনিয়াতে বন্যার পানি বেড়েই চলল। পানি বেড়ে যাওয়াতে জাহাজটা মাটি ছেড়ে উপরে ভেসে উঠল। পরে দুনিয়ার উপরে পানি আরও বেড়ে গেল এবং জাহাজটা পানির উপরে ভাসতে লাগল। দুনিয়ার উপরে পানি কেবল বেড়েই চলল; ফলে যেখানে যত বড় বড় পাহাড় ছিল সব ডুবে গেল। সমস্ত পাহাড়-পর্বত ডুবিয়ে পানি আরও পনেরো হাত উপরে উঠে গেল। এর ফলে মাটির উপরে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণী, পাখী, গৃহপালিত আর বন্য পশু, ঝাঁক বেঁধে চরে বেড়ানো ছোট ছোট প্রাণী এবং সমস্ত মানুষ মারা গেল। শুকনা মাটির উপর যে সব প্রাণী বাস করত, অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে যারা বেঁচে ছিল তারা সবাই মরে গেল। আল্লাহ্‌ এইভাবে ভূমির সমস্ত প্রাণী দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেললেন। তাতে মানুষ, পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং আকাশের পাখী দুনিয়ার উপর থেকে মুছে গেল। কেবল নূহ্‌ এবং তাঁর সংগে যাঁরা জাহাজে ছিলেন তাঁরাই বেঁচে রইলেন। দুনিয়া একশো পঞ্চাশ দিন পানিতে ডুবে রইল। জাহাজে নূহ্‌ এবং তাঁর সংগে যে সব গৃহপালিত ও বন্য পশু ছিল আল্লাহ্‌ তাদের কথা ভুলে যান নি। তিনি দুনিয়ার উপরে বাতাস বহালেন, তাতে পানি কমতে লাগল। এর আগেই মাটির নীচের সমস্ত পানি বের হওয়া এবং আকাশের সব ফাটলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়াও থেমে গিয়েছিল। তাতে মাটির উপরকার পানি সরে যেতে থাকল, আর বন্যা শুরু হওয়ার একশো পঞ্চাশ দিন পরে দেখা গেল পানি অনেক কমে গেছে। সপ্তম মাসের সতেরো দিনের দিন জাহাজটা আরারাতের পাহাড়শ্রেণীর উপরে গিয়ে আট্‌কে রইল। এর পরেও পানি কমে যেতে লাগল, আর দশম মাসের প্রথম দিনে পাহাড়শ্রেণীর চূড়া দেখা দিল। এর চল্লিশ দিন পরে নূহ্‌ জাহাজের যে জানালাটা তৈরী করেছিলেন সেটা খুললেন, আর সেই জানালা দিয়ে তিনি একটা দাঁড়কাক ছেড়ে দিলেন। মাটির উপর থেকে পানি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়কাকটা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল। মাটির উপর থেকে পানি কমে গেছে কিনা তা জানবার জন্য নূহ্‌ এর পর একটা কবুতর ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তখনও গোটা দুনিয়ার উপরে পানি ছিল, তাই কোথাও পা রাখবার জায়গা না পেয়ে সেটা জাহাজে নূহের কাছে ফিরে আসল। নূহ্‌ হাত বাড়িয়ে সেই কবুতরকে জাহাজে নিজের কাছে নিলেন। তারপর তিনি আরও সাত দিন অপেক্ষা করে আবার সেই কবুতরটা জাহাজ থেকে ছেড়ে দিলেন। সন্ধ্যাবেলা কবুতরটা জাহাজে নূহের কাছে ফিরে আসল আর তাঁর ঠোঁটে ছিল জলপাই গাছ থেকে এইমাত্র ছিঁড়ে আনা একটা পাতা। এতে নূহ্‌ বুঝতে পারলেন মাটির উপর থেকে পানি কমে গেছে। তিনি আরও সাত দিন অপেক্ষা করে আবার সেই কবুতরটা ছেড়ে দিলেন, কিন্তু এবার সেটা আর তাঁর কাছে ফিরে আসল না। নূহের বয়স তখন ছ’শো এক বছর চলছিল। সেই বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনেই মাটির উপর থেকে পানি সরে গিয়েছিল। তখন নূহ্‌ জাহাজের ছাদ খুলে ফেলে তাকিয়ে দেখলেন যে, মাটির উপরটা শুকাতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় মাসের সাতাশ দিনের মধ্যে মাটি একেবারে শুকিয়ে গেল। তখন আল্লাহ্‌ নূহ্‌কে বললেন, “তুমি তোমার স্ত্রীকে আর তোমার ছেলেদের ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজ থেকে বের হয়ে এস, আর সেই সংগে সমস্ত পশু-পাখী এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী, অর্থাৎ যত জীবজন্তু আছে তাদের সকলকেই বের করে নিয়ে এস। আমি চাই যেন দুনিয়াতে তাদের বংশ অনেক বেড়ে যায় এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা দ্বারা তারা সংখ্যায় বেড়ে ওঠে।” তখন নূহ্‌ তাঁর স্ত্রীকে আর তাঁর ছেলেদের ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজ থেকে বের হয়ে আসলেন। তাঁদের সংগে সব পশু-পাখী এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী, অর্থাৎ মাটির উপরে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণী নিজের নিজের জাত অনুসারে বের হয়ে গেল। তারপর নূহ্‌ মাবুদের উদ্দেশ্যে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং প্রত্যেক জাতের পাক পশু ও পাখী থেকে কয়েকটা নিয়ে সেই কোরবানগাহের উপরে পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। মাবুদ সেই কোরবানীর গন্ধে খুশী হলেন এবং মনে মনে বললেন, “মানুষের দরুন আর কখনও আমি মাটিকে বদদোয়া দেব না, কারণ ছোটবেলা থেকেই তো মানুষের মনের ঝোঁক খারাপীর দিকে। এবার যেমন আমি সমস্ত প্রাণীকে ধ্বংস করেছি তেমন আর কখনও করব না। যতদিন এই দুনিয়া থাকবে ততদিন নিয়ম মত বীজ বোনা আর ফসল কাটা, ঠাণ্ডা আর গরম, শীতকাল আর গরমকাল এবং দিন ও রাত হতেই থাকবে।” আল্লাহ্‌ নূহ্‌ আর তাঁর ছেলেদের দোয়া করে বললেন, “তোমরা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা দ্বারা সংখ্যায় বেড়ে ওঠো এবং দুনিয়া ভরে তোলো। দুনিয়ার সব জীবজন্তু, আকাশের পাখী, বুকে-হাঁটা প্রাণী, আর সমুদ্রের মাছ তোমাদের ভীষণ ভয় করে চলবে। এগুলো তোমাদের হাতেই দেওয়া হল। জীবন্ত ও ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণীই তোমাদের খাবার হবে। খাবার হিসাবে আমি আগে যেমন তোমাদের শস্য ও শাক-সবজী দিয়েছিলাম তেমনি এখন এই সবও তোমাদের দিলাম; কিন্তু প্রাণ সুদ্ধ, অর্থাৎ রক্তসুদ্ধ গোশ্‌ত তোমরা খাবে না। কেউ যদি তোমাদের খুন করে তবে আমি নিশ্চয়ই তোমাদের রক্তের বদলে তার রক্ত, অর্থাৎ তার প্রাণ দাবি করব, সে পশু হোক বা মানুষ হোক। মানুষের প্রাণ যে মানুষ নেয় তারও প্রাণ নিতে হবে- এ-ই আমার দাবি। আল্লাহ্‌ মানুষকে তাঁর মত করেই সৃষ্টি করেছেন; সেইজন্য কোন মানুষকে যদি কেউ খুন করে তবে অন্য একজনকে সেই খুনীর প্রাণ নিতে হবে। তোমরা তোমাদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা দ্বারা নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলো। তোমরা দুনিয়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড় এবং নিজেদের সংখ্যা আরও বাড়াও।” সেই ব্যবস্থা হল এই যে, বন্যার পানি দিয়ে আর কখনও সমস্ত প্রাণীকে মেরে ফেলা হবে না এবং গোটা দুনিয়া ধ্বংস করে দেবার মত বন্যাও আর হবে না।” যখন আমি উপরে মেঘ জমা করব তখন তার মধ্যে এই রংধনু দেখা দেবে, আর তখনই তোমার এবং সমস্ত জীবজন্তুর জন্য আমার এই ব্যবস্থার কথা আমি মনে করব। এতে পানি আর কখনও বন্যা হয়ে সমস্ত প্রাণীকে ধ্বংস করবে না। মেঘের মধ্যে যখন সেই রংধনু দেখা দেবে তখন আমি তা দেখে দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর জন্য আমার এই চিরস্থায়ী ব্যবস্থার কথা মনে করব।” আল্লাহ্‌ তারপর নূহ্‌কে বললেন, “দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর জন্য আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছি এটাই হল তার চিহ্ন।” জাহাজ থেকে নূহের ছেলে সাম, হাম আর ইয়াফস বের হয়ে এসেছিলেন। পরে কেনান নামে হামের একটি ছেলে হয়েছিল। নূহের এই তিন ছেলের বংশধরেরাই সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল। নূহ্‌ চাষ-আবাদ করতে শুরু করলেন এবং একটা আংগুর ক্ষেত করলেন। তিনি একদিন আংগুর-রস খেয়ে মাতাল হলেন এবং নিজের তাম্বুর মধ্যে উলংগ হয়ে পড়ে রইলেন। কেনানের পিতা হাম তাঁর পিতার এই অবস্থা দেখলেন এবং বাইরে গিয়ে তাঁর দুই ভাইকে তা জানিয়ে দিলেন। কিন্তু সাম আর ইয়াফস নিজেদের কাঁধের উপরে একটা কাপড় নিলেন এবং পিছু হেঁটে গিয়ে তাঁদের পিতাকে ঢেকে দিয়ে আসলেন। তাঁদের মুখ উল্টাদিকে ফিরানো ছিল বলে পিতার উলংগ অবস্থা তাঁদের চোখে পড়ল না। নেশা কেটে গেলে পর নূহ্‌ তাঁর ছোট ছেলের ব্যবহারের কথা জানতে পারলেন। তখন তিনি বললেন, “কেনানের উপর বদদোয়া পড়ুক। সে তার ভাইদের সবচেয়ে নীচু ধরনের গোলাম হোক।” তিনি আরও বললেন, “সমস্ত প্রশংসা মাবুদের, যিনি সামের আল্লাহ্‌। কেনান সামের গোলাম হোক। আল্লাহ্‌ করুন, ইয়াফস যেন অনেক জায়গা জুড়ে থাকে। সে সামের তাম্বুতে বাস করুক আর কেনান তার গোলাম হোক।” বন্যার পরে নূহ্‌ আরও সাড়ে তিনশো বছর বেঁচে ছিলেন। মোট সাড়ে ন’শো বছর বেঁচে থাকবার পর তিনি ইন্তেকাল করলেন। এই হল নূহের ছেলে সাম, হাম আর ইয়াফসের বংশের কথা। বন্যার পরে তাঁদেরও ছেলে হয়েছিল। ইয়াফসের ছেলেরা হল গোমর, মাজুজ, মাদয়, যবন, তূবল, মেশক ও তীরস। গোমরের ছেলেরা হল অস্কিনস, রীফৎ ও তোগর্ম। যবনের ছেলেরা হল ইলীশা, তর্শীশ, কিত্তীম ও দোদানীম। এদের বংশের লোকেরাই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষা, পরিবার ও জাতি অনুসারে সাগর পারের ভিন্ন ভিন্ন দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। হামের ছেলেরা হল কূশ, মিসর, পূট ও কেনান। কূশের ছেলেরা হল সবা, হবীলা, সপ্তা, রয়মা ও সপ্তকা। রয়মার ছেলেরা হল সাবা ও দদান। কূশের একটি ছেলে হয়েছিল যাঁর নাম ছিল নমরূদ। এই নমরূদ দুনিয়াতে একজন ক্ষমতাশালী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। মাবুদের চোখে তিনি ছিলেন একজন বেপরোয়া শিকারী। সেইজন্য কথায় বলে, “লোকটা যেন মাবুদের চোখে একজন বেপরোয়া শিকারী নমরূদ।” ব্যাবিলন দেশের ব্যাবিলন শহর, এরক, অক্কদ ও কল্‌নী নামে জায়গাগুলো নিয়ে তিনি রাজত্ব করতে শুরু করলেন। কেনানের বড় ছেলের নাম ছিল সিডন। তার পরে হেতের জন্ম হয়েছিল। যিবূষীয়, আমোরীয়, গির্গাশীয়, হিব্বীয়, অর্কীয়, সীনীয়, অর্বদীয়, সমারীয় এবং হমাতীয়রাও ছিল কেনানের বংশের লোক। পরে এই সব কেনানীয় পরিবারগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল। সিডন শহর থেকে গরারে যাওয়ার পথে গাজা পর্যন্ত এবং গাজা থেকে সাদুম, আমুরা, অদ্‌মা ও সবোয়ীমে যাওয়ার পথে লাশা পর্যন্ত কেনানীয়দের দেশের সীমা ছিল। পরিবার, ভাষা, দেশ ও জাতি হিসাবে এরাই ছিল হামের বংশের লোক। ইয়াফসের বড় ভাই সামেরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। সাম ছিলেন আবের ও তাঁর সন্তানদের পূর্বপুরুষ। সামের ছেলেরা হল ইলাম, আশুর, আরফাখশাদ, লূদ ও ইরাম। ইরামের ছেলেরা হল আওস, হূল, গেথর ও মশ। আরফাখশাদের ছেলের নাম শালেখ এবং শালেখের ছেলের নাম আবের। আবেরের দু’টি ছেলে হয়েছিল। তাদের একজনের নাম ছিল ফালেজ। তার সময়ে দুনিয়া ভাগ হয়েছিল বলেই তার এই নাম দেওয়া হয়েছিল। ফালেজের ভাইয়ের নাম ছিল ইয়াকতান। ইয়াকতানের ছেলেরা হল অল্‌মোদদ, শেলফ, হাযরামাওত, যেরহ, হদোরাম, ঊষল, দিক্ল, ওবল, অবীমায়েল, সাবা, ওফীর, হবীলা ও যোবব। এরা সবাই ছিল ইয়াকতানের ছেলে। মেষা থেকে পূর্ব দিকে সফারে যাওয়ার পথে যে পাহাড়ী এলাকা ছিল তার সমস্ত জায়গায় এরা বাস করত। পরিবার, ভাষা, দেশ ও জাতি হিসাবে এরাই ছিল সামের বংশের লোক। এরাই হল বংশ এবং জাতি হিসাবে নূহের ছেলেদের বিভিন্ন পরিবার। বন্যার পরে এদের বংশের লোকেরাই বিভিন্ন জাতি হয়ে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার দিনে সারা দুনিয়ার মানুষ কেবল একটি ভাষাতেই কথা বলত এবং তাদের শব্দগুলোও ছিল একই। পরে তারা পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ব্যাবিলন দেশে একটা সমভূমি পেয়ে সেখানেই বাস করতে লাগল। তারা একে অন্যকে বলল, “চল, আমরা ইট তৈরী করে আগুনে পুড়িয়ে নিই।” এই বলে তারা পাথরের বদলে ইট এবং চুন-সুরকির বদলে আল্‌কাত্‌রা ব্যবহার করতে লাগল। তারা বলল, “এস, আমরা নিজেদের জন্য একটা শহর তৈরী করি এবং এমন একটা উঁচু ঘর তৈরী করি যার চূড়া গিয়ে আকাশে ঠেকবে। এতে আমাদের সুনামও হবে আর আমরা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েও পড়ব না।” মানুষ যে শহর ও উঁচু ঘর তৈরী করছিল তা দেখবার জন্য মাবুদ নেমে আসলেন। তিনি বলেছিলেন, “এরা একই জাতির লোক এবং এদের ভাষাও এক; সেইজন্যই এই কাজে তারা হাত দিয়েছে। নিজেদের মতলব হাসিল করবার জন্য এর পর এরা আর কোন বাধাই মানবে না। কাজেই এস, আমরা নীচে গিয়ে তাদের ভাষায় গোলমাল বাধিয়ে দিই যাতে তারা একে অন্যের কথা বুঝতে না পারে।” তারপর মাবুদ সেই জায়গা থেকে তাদের সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিলেন। এতে তাদের সেই শহর তৈরীর কাজও বন্ধ হয়ে গেল। এইজন্য সেই জায়গার নাম হল ব্যাবিলন, কারণ সেখানেই মাবুদ সারা দুনিয়াতে ভাষার মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই তিনি তাদের দুনিয়ার সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই হল সামের বংশের কথা। বন্যার দু’বছর পরে যখন সামের বয়স একশো বছর তখন তাঁর ছেলে আরফাখশাদের জন্ম হল। আরফাখশাদের জন্মের পরে সাম আরও পাঁচশো বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। আরফাখশাদের পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে শালেখের জন্ম হল। শালেখের জন্মের পরে আরফাখশাদ আরও চারশো তিন বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। শালেখের ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে আবেরের জন্ম হল। আবেরের জন্মের পরে শালেখ আরও চারশো তিন বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। আবেরের চৌত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে ফালেজের জন্ম হল। ফালেজের জন্মের পরে আবের আরও চারশো ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। ফালেজের ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে রাউর জন্ম হল। রাউর জন্মের পরে ফালেজ আরও দু’শো নয় বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। রাউর বত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে সারূজের জন্ম হল। সারূজের জন্মের পরে রাউ আরও দু’শো সাত বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। সারূজের ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে নাহুরের জন্ম হল। নাহুরের জন্মের পরে সারূজ আরও দু’শো বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। নাহুরের উনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে তারেখের জন্ম হল। তারেখের জন্মের পরে নাহুর আরও একশো উনিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরও ছেলেমেয়ে হয়েছিল। তারেখের সত্তর বছর বয়সের পর তাঁর ছেলে ইব্রাম, নাহুর ও হারণের জন্ম হয়েছিল। এই হল তারেখের বংশের কথা। তারেখের ছেলেদের নাম ছিল ইব্রাম, নাহুর ও হারণ, আর হারণের ছেলের নাম লুত। হারণ তাঁর পিতা বেঁচে থাকতেই তাঁর জন্মস্থান ক্যালডিয়া দেশের উর শহরে ইন্তেকাল করেছিলেন। ইব্রাম আর নাহুর দু’জনেই বিয়ে করেছিলেন। ইব্রামের স্ত্রীর নাম ছিল সারী আর নাহুরের স্ত্রীর নাম ছিল মিল্‌কা। মিল্‌কা আর যিষ্কা ছিল হারণের মেয়ে। সারী বন্ধ্যা ছিলেন; তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। ইব্রাম, লুত ও সারীকে নিয়ে তারেখ কেনান দেশে যাবার জন্য ক্যালডিয়া দেশের উর শহর থেকে যাত্রা করলেন। ইব্রাম ছিলেন তারেখের ছেলে, লুত ছিলেন তারেখের নাতি, অর্থাৎ হারণের ছেলে, আর সারী ছিলেন তারেখের ছেলে ইব্রামের স্ত্রী। প্রথমে তাঁরা হারণ নামে এক শহর পর্যন্ত গেলেন এবং সেখানে বাস করতে লাগলেন। তারেখ দু’শো পাঁচ বছর বয়সে হারণ শহরেই ইন্তেকাল করলেন। পরে মাবুদ ইব্রামকে বললেন, “তুমি তোমার নিজের দেশ, তোমার আত্মীয়-স্বজন এবং তোমার পিতার বাড়ী-ঘর ছেড়ে আমি তোমাকে যে দেশ দেখাব সেই দেশে যাও। তোমার মধ্য থেকে আমি একটি মহাজাতি সৃষ্টি করব। আমি তোমাকে দোয়া করব এবং এমন করব যাতে তোমার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর তোমার মধ্য দিয়ে লোকে দোয়া পায়। যারা তোমাকে দোয়া করবে আমি তাদের দোয়া করব, আর যারা তোমাকে বদদোয়া দেবে আমি তাদের বদদোয়া দেব। তোমার মধ্য দিয়েই দুনিয়ার প্রত্যেকটি জাতি দোয়া পাবে।” মাবুদের কথামতই ইব্রাম তখন বেরিয়ে পড়লেন আর লুতও তাঁর সংগে গেলেন। হারণ শহর ছেড়ে যাবার সময় ইব্রামের বয়স ছিল পঁচাত্তর বছর। তিনি তাঁর স্ত্রী সারী আর ভাইপো লুতকে নিয়ে বের হলেন। নিজেদের সব কিছু নিয়ে এবং যে সব গোলামের তাঁরা হারণে পেয়েছিলেন তাদের নিয়ে তিনি কেনান দেশের দিকে যাত্রা করে সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। কেনান দেশের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ইব্রাম শিখিম শহরের কাছে মোরির এলোন গাছ পর্যন্ত গেলেন। তখনও কেনানীয়রা সেই দেশে বাস করছিল। পরে মাবুদ ইব্রামকে দেখা দিয়ে বললেন, “এই দেশটাই আমি তোমার বংশকে দেব।” যিনি তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন সেই মাবুদের প্রতি ইব্রাম তখন সেখানে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বেথেল শহরের পূর্ব দিকের পাহাড়ী এলাকায় এগিয়ে গেলেন এবং পশ্চিমে বেথেল আর পূর্বে অয় শহরের মাঝামাঝি এক জায়গায় তাঁর তাম্বু ফেললেন। মাবুদের প্রতি সেখানেও তিনি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং মাবুদের এবাদত করলেন। পরে তিনি সেখান থেকে সরতে সরতে নেগেভ নামে দক্ষিণের মরুভূমির দিকে চলে গেলেন। পরে কেনান দেশে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সেই দুর্ভিক্ষ এত ভীষণ হয়ে উঠল যে, ইব্রাম কিছুকালের জন্য মিসর দেশে বাস করতে গেলেন। মিসর দেশের কাছাকাছি এসে ইব্রাম তাঁর স্ত্রী সারীকে বললেন, “শোন, আমি জানি তুমি খুব সুন্দরী। তুমি যখন মিসরীয়দের চোখে পড়বে তখন তারা ভাববে তুমি আমার স্ত্রী। আর এই ভেবে তারা তোমাকে রেখে আমাকে হত্যা করবে। সেইজন্য তুমি তাদের বোলো যে, তুমি আমার বোন। তাতে তোমার দরুন তারা আমার সংগে ভাল ব্যবহার করবে এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।” ইব্রাম যখন মিসরে গেলেন তখন মিসরীয়রা দেখল সারী খুব সুন্দরী। ফেরাউনের, অর্থাৎ বাদশাহ্‌র দরবারের লোকেরাও তাঁকে দেখে ফেরাউনের কাছে তাঁর তারিফ করে অনেক কথা বলল। ফলে সারীকে রাজমহলে নিয়ে যাওয়া হল। আর সারীর দরুন ফেরাউন ইব্রামের সংগে ভাল ব্যবহার করতে লাগলেন। তিনি ইব্রামকে অনেক ভেড়া, গরু, গাধা, গাধী, উট এবং গোলাম ও বাঁদী দিলেন। কিন্তু ইব্রামের স্ত্রী সারীর দরুন মাবুদ ফেরাউন ও তাঁর বাড়ীর সমস্ত লোকের মধ্যে নানা রকমের ভীষণ অসুখের সৃষ্টি করলেন। এই বলে ফেরাউন তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন আর তারা ইব্রামের সব কিছু সুদ্ধ তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে বিদায় দিল। তখন ইব্রাম তাঁর স্ত্রী ও তাঁর সব কিছু নিয়ে মিসর দেশ থেকে বের হয়ে নেগেভ নামে দক্ষিণের মরুভূমির দিকে গেলেন, আর লুতও তাঁর সংগে গেলেন। লুত, যিনি ইব্রামের সংগে গিয়েছিলেন, তাঁর নিজেরও অনেক গরু, ভেড়া, ছাগল এবং তাম্বু ছিল। তবে জায়গাটা এমন ছিল না যাতে তাঁরা দু’জনে এক জায়গায় বাস করতে পারেন। পশু এবং তাম্বু তাঁদের দু’জনেরই এত বেশী ছিল যে, তা নিয়ে তাঁদের এক জায়গায় থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে ইব্রাম আর লুতের রাখালদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ দেখা দিল। তা ছাড়া সেই সময় কেনানীয় ও পরিষীয়রাও সেই দেশে বাস করছিল। তখন ইব্রাম লুতকে বললেন, “দেখ, আমরা দু’জনে নিকট আত্মীয়। সেইজন্য তোমার ও আমার মধ্যে এবং তোমার ও আমার রাখালদের মধ্যে কোন ঝগড়া-বিবাদ না হওয়াই উচিত। গোটা দেশটাই তো তোমার সামনে পড়ে আছে। তাই এস, আমরা আলাদা হয়ে যাই। তুমি বাঁ দিকটা বেছে নিলে আমি ডান দিকে যাব, আর ডান দিকটা বেছে নিলে আমি বাঁ দিকে যাব।” তখন লুত চেয়ে দেখলেন জর্ডান নদীর দক্ষিণ দিকের সমভূমিতে প্রচুর পানি আছে এবং জায়গাটা দেখতে প্রায় মাবুদের বাগানের মত, আর তা না হলেও অন্ততঃ সোয়রে যাবার পথে মিসর দেশের মত। তখনও মাবুদ সাদুম ও আমুরা শহর ধ্বংস করে ফেলেন নি। তখন লুত জর্ডান নদীর দক্ষিণ দিকের সমস্ত সমভূমিটা নিজের জন্য বেছে নিয়ে পূর্ব দিকে সরে গেলেন। এইভাবে তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। ইব্রাম কেনান দেশে এবং লুত সেই সমভূমির শহরগুলোর মাঝখানে বাস করতে লাগলেন। তিনি সাদুম শহরের কাছে তাম্বু ফেলেছিলেন। সাদুমের লোকেরা খুব খারাপ ছিল এবং মাবুদের বিরুদ্ধে তারা ভীষণ গুনাহ্‌ করছিল। লুত আলাদা হয়ে যাবার পর মাবুদ ইব্রামকে বললেন, “তুমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ সেখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে একবার চেয়ে দেখ। যে সব জায়গা তুমি দেখবে তা আমি তোমাকে ও তোমার বংশকে চিরকালের জন্য দেব। আমি তোমার বংশের লোকদের দুনিয়ার ধূলিকণার মত অসংখ্য করব। দুনিয়ার ধূলিকণা যদি কেউ গুণে শেষ করতে পারে তবে তোমার বংশের লোকদেরও গোণা যাবে। সারা দেশটা তুমি একবার ঘুরে এস, কারণ এই দেশটাই আমি তোমাকে দেব।” তখন ইব্রাম তাঁর তাম্বু তুলে নিলেন এবং হেবরন এলাকার মম্রি নামে একজন লোকের এলোন বনের কাছে তা খাটালেন। সেখানেও তিনি মাবুদের প্রতি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন। ব্যাবিলন দেশের বাদশাহ্‌ অম্রাফল, ইল্লাসরের বাদশাহ্‌ অরিয়োক, ইলামের বাদশাহ্‌ কদর্লায়োমর এবং গোয়ীমের বাদশাহ্‌ তিদিয়ল- এই চারজন বাদশাহ্‌ এক হয়ে একবার সাদুমের বাদশাহ্‌ বিরা, আমুরার বাদশাহ্‌ বির্শা, অদ্‌মার বাদশাহ্‌ শিনাব, সবোয়িমের বাদশাহ্‌ শিমেবর এবং বিলার, অর্থাৎ সোয়রের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। এই পাঁচজন বাদশাহ্‌ তাঁদের সৈন্যদল একত্র করে সিদ্দীম উপত্যকায় গেলেন। এই জায়গাটাকে মরু-সাগর বলা হয়। এর আগে এই বাদশাহ্‌রা বারো বছর পর্যন্ত বাদশাহ্‌ কদর্লায়োমরের অধীনে ছিলেন, কিন্তু তেরো বছরে এসে তাঁরা বিদ্রোহ করলেন। তারপর এই বাদশাহ্‌রা ঘুরে গিয়ে ঐনমিষ্পটে, অর্থাৎ কাদেশে গেলেন। তাঁরা আমালেকীয়দের সমস্ত দেশটা জয় করে নিলেন এবং হৎসসোন্ততামর শহরে যে আমোরীয়রা ছিল তাদের হারিয়ে দিলেন। সিদ্দীম উপত্যকাতে আল্‌কাত্‌রায় ভরা অনেক গর্ত ছিল। যখন সাদুম আর আমুরার বাদশাহ্‌রা পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁদের লোকদের মধ্যে কেউ কেউ সেই আল্‌কাত্‌রার গর্তে পড়ে গেল, আর অন্যেরা পাহাড়ে পালিয়ে গেল। যে বাদশাহ্‌রা জয়ী হয়েছিলেন তাঁরা সাদুম ও আমুরার সমস্ত ধন-সম্পদ ও খাবার-দাবার লুট করে নিয়ে চলে গেলেন। ইব্রামের ভাইপো লুত তখন সাদুমে বাস করছিলেন। সেই বাদশাহ্‌রা তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ সুদ্ধ তাঁকেও ধরে নিয়ে গেলেন। পরে একজন লোক পালিয়ে এসে ইবরানী ইব্রামকে সেই খবর দিল। ইব্রাম সেই সময় আমোরীয় মম্রির এলোন বনের কাছে বাস করছিলেন। মম্রি ছিলেন ইষ্কোল ও আনেরের ভাই। ইব্রামের সংগে এঁরা বন্ধুত্বের চুক্তিতে বাঁধা ছিলেন। ইব্রাম যখন শুনলেন যে, তাঁর আত্মীয়কে সেই বাদশাহ্‌রা ধরে নিয়ে গেছেন তখন তিনি যুদ্ধের শিক্ষা পাওয়া তাঁর তিনশো আঠারো জন গোলামকে যুদ্ধে নামালেন এবং দান শহর পর্যন্ত শত্রুদের তাড়া করে নিয়ে গেলেন। এই গোলামেরা তাঁর বাড়ীতেই জন্মেছিল। তিনি নিজের লোকজনদের কয়েকটি দলে ভাগ করলেন এবং তাদের নিয়ে রাতের বেলা শত্রুদের হামলা করে তাঁদের হারিয়ে দিলেন। তারপর তাঁদের তাড়া করতে করতে তিনি দামেস্কের উত্তরে হোবা পর্যন্ত গেলেন। লুট-করা সমস্ত জিনিস তিনি ফিরিয়ে আনলেন এবং তাঁর ভাইপো লুতকে তাঁর ধন-সম্পদ সুদ্ধ উদ্ধার করলেন। সেই সংগে সমস্ত স্ত্রীলোক ও অন্যান্য লোকদেরও উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল। কদর্লায়োমর এবং তাঁর সংগী-বাদশাহ্‌দের হারিয়ে দিয়ে যখন ইব্রাম ফিরে আসলেন তখন সাদুমের বাদশাহ্‌ তাঁর সংগে দেখা করবার জন্য শাবী উপত্যকায়, অর্থাৎ বাদশাহ্‌র উপত্যকায় বের হয়ে আসলেন। শালেমের, অর্থাৎ জেরুজালেমের বাদশাহ্‌ মাল্‌কীসিদ্দিক ইব্রামের জন্য রুটি ও আংগুর-রস নিয়ে আসলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌তা’লার ইমাম। তিনি ইব্রামকে দোয়া করে বললেন, “যিনি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহ্‌তা’লা ইব্রামকে দোয়া করুন। যিনি আপনার শত্রুদের আপনার হাতে দিয়েছেন সেই আল্লাহ্‌তা’লার প্রশংসা হোক।” তখন ইব্রাম তাঁর উদ্ধার করা জিনিসের দশভাগের একভাগ মাল্‌কীসিদ্দিককে দিলেন। পরে সাদুমের বাদশাহ্‌ ইব্রামকে বললেন, “আপনি ধন-সম্পদ সব রেখে দিন কিন্তু লোকজন আমাকে ফিরিয়ে দিন।” জবাবে ইব্রাম সাদুমের বাদশাহ্‌কে বললেন, “যিনি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছেন সেই মাবুদ, যিনি আল্লাহ্‌তা’লা, তাঁর নিকট হাত তুলে আমি ওয়াদা করে বলছি যে, আপনার কোন জিনিস, এমন কি, একটু সুতা কিংবা পায়ের চটির একটা বাঁধন পর্যন্ত আমি নেব না। এই ওয়াদা আমি করছি যাতে আপনি বলতে না পারেন, ‘আমার ধনেই ইব্রাম ধনী হয়েছে।’ আমার লোকেরা যা খেয়েছে তা ছাড়া আমি আর কিছুই নিচ্ছি না; তবে আনের, ইষ্কোল ও মম্রি, যাঁরা আমার সংগে গিয়েছিলেন, তাঁদের পাওনা ভাগ তাঁদের নিতে দিন।” এর পর মাবুদ ইব্রামকে দর্শনের মধ্য দিয়ে বললেন, “ইব্রাম, ভয় কোরো না। ঢালের মত করে আমিই তোমাকে রক্ষা করব, আর তোমার পুরস্কার হবে মহান।” ইব্রাম বললেন, “হে মাবুদ, আমার মালিক, তুমি আমাকে কি দেবে? আমার তো কোন ছেলেমেয়ে নেই। আমার মৃত্যুর পরে দামেস্কের ইলীয়েষর আমার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে। তুমি কি আমাকে কোন সন্তান দিয়েছ? কাজেই আমার বাড়ীর একজন গোলামই তো আমার পরে আমার বিষয়-সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।” তখন মাবুদ ইব্রামকে বললেন, “না, ওয়ারিশ সে হবে না। তোমার নিজের সন্তানই তোমার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।” পরে মাবুদ ইব্রামকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বললেন, “আসমানের দিকে তাকাও এবং যদি পার ঐ তারাগুলো গুণে শেষ কর। তোমার বংশের লোকেরা ঐ তারার মতই অসংখ্য হবে।” ইব্রাম মাবুদের কথার উপর ঈমান আনলেন আর মাবুদ সেইজন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন। মাবুদ ইব্রামকে বললেন, “আমি মাবুদ। এই দেশের অধিকারী হবার জন্য আমিই তোমাকে ক্যালডীয়দের উর শহর থেকে বের করে এনেছি।” তখন ইব্রাম বললেন, “হে মাবুদ, আমার মালিক, আমি কি করে জানব যে, এই দেশটা আমার অধিকারে আসবে?” জবাবে মাবুদ বললেন, “তুমি আমার কাছে একটা বক্‌না বাছুর, একটা ছাগী আর একটা পুরুষ ভেড়া নিয়ে এস। সেগুলোর প্রত্যেকটার বয়স যেন তিন বছর হয়। সেই সংগে একটা ঘুঘু আর একটা কবুতরের বাচ্চাও নিয়ে এস।” ইব্রাম তা-ই করলেন। তিনি সেগুলো এনে সমান দু’টুকরা করে প্রত্যেকটা টুকরা তার অন্য টুকরার উল্টাদিকে সাজিয়ে রাখলেন, কিন্তু পাখীগুলো তিনি টুকরা করলেন না। তখন শকুন এসে মরা পশুগুলোর উপর পড়ল, কিন্তু ইব্রাম সেগুলো তাড়িয়ে দিলেন। যখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল তখন ইব্রাম ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুমের মধ্যে একটা ভয়ংকর অন্ধকার তাঁর উপর নেমে আসল। তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি এই কথা নিশ্চয় করে জেনো, তোমার বংশের লোকেরা এমন একটা দেশে গিয়ে বাস করবে যা তাদের নিজেদের নয়। সেখানে তারা অন্যদের গোলাম হয়ে চারশো বছর পর্যন্ত জুলুম ভোগ করবে। কিন্তু যে জাতি তাদের গোলাম করে রাখবে সেই জাতির উপর আমি গজব নাজেল করব। পরে তারা অনেক ধন-দৌলত নিয়ে সেই দেশ থেকে বের হয়ে আসবে। তবে তার আগেই তুমি অনেক বয়সে শান্তিতে মারা গিয়ে কবর পাবে এবং তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবে। কিন্তু তোমার বংশের চতুর্থ পুরুষের লোকেরা এখানে ফিরে আসবে, কারণ গুনাহ্‌ করতে করতে আমোরীয়রা এখনও এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় নি যার জন্য আমাকে তাদের উপর গজব নাজেল করতে হবে।” সূর্য ডুবে গিয়ে যখন একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল তখন ধোঁয়ায় ভরা একটা জ্বলন্ত চুলা এবং একটা জ্বলন্ত মশাল দেখা দিল। সেগুলো সেই সাজিয়ে রাখা পশুর টুকরাগুলোর মধ্য দিয়ে চলে গেল। মাবুদ সেই দিনই ইব্রামের জন্য এই বলে একটা ব্যবস্থা স্থাপন করলেন, “মিসরের নদী থেকে শুরু করে মহানদী ফোরাত পর্যন্ত সমস্ত দেশটা আমি তোমার বংশকে দিলাম। এর মধ্যে থাকবে কেনীয়, কনিষীয়, কদ্‌মোনীয়, হিট্টীয়, পরিষীয়, রফায়ীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, গির্গাশীয় ও যিবূষীয়দের দেশ।” ইব্রামের স্ত্রী সারীর তখনও কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। হাজেরা নামে তাঁর একজন মিসরীয় বাঁদী ছিল। একদিন সারী ইব্রামকে বললেন, “দেখ, মাবুদ আমাকে বন্ধ্যা করেছেন। সেইজন্য তুমি আমার বাঁদীর কাছে যাও। হয়তো তার মধ্য দিয়ে আমি সন্তান লাভ করব।” ইব্রাম সারীর কথায় রাজী হলেন। তাই কেনান দেশে ইব্রামের দশ বছর কেটে যাওয়ার পর সারী তাঁর মিসরীয় বাঁদী হাজেরার সংগে ইব্রামের বিয়ে দিলেন। ইব্রাম হাজেরার কাছে গেলে পর সে গর্ভবতী হল। যখন হাজেরা বুঝতে পারল যে, সে গর্ভবতী হয়েছে তখন সে তার বেগম সাহেবাকে তুচ্ছ করতে লাগল। এতে সারী ইব্রামকে বললেন, “আমার প্রতি তার এই অন্যায়ের জন্য আসলে তুমিই দায়ী। আমার এই বাঁদীকে আমি তোমার বিছানায় তুলে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন গর্ভবতী হয়েছে জেনে সে আমাকে তুচ্ছ করতে শুরু করেছে। তাহলে তোমার ও আমার মধ্যে কে দোষী তা এখন মাবুদই বিচার করুন।” জবাবে ইব্রাম সারীকে বললেন, “দেখ, তোমার বাঁদী তো তোমার হাতেই আছে। তোমার যা ভাল মনে হয় তার প্রতি তুমি তা-ই কর।” তখন সারী হাজেরার প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে লাগলেন যে, হাজেরা তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে গেল। পথে মরুভূমির মধ্যে একটা পানির ঝর্ণার কাছে মাবুদের ফেরেশতা হাজেরাকে দেখতে পেলেন। ঝর্ণাটা ছিল শূর নামে একটা জায়গায় যাবার পথে। ফেরেশতা বললেন, “সারীর বাঁদী হাজেরা, তুমি কোথা থেকে আসছ আর কোথায়ই বা যাচ্ছ?” জবাবে হাজেরা বলল, “আমি আমার বেগম সাহেবা সারীর কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছি।” তখন মাবুদের ফেরেশতা বললেন, “তোমার বেগম সাহেবার কাছে ফিরে গিয়ে আবার তার অধীনতা স্বীকার করে নাও।” তিনি তাকে আরও বললেন, “আমি তোমার বংশের লোকদের সংখ্যা এমন বাড়িয়ে তুলব যে, তাদের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না।” তিনি তাকে আরও বললেন, “দেখ, তুমি গর্ভবতী। তোমার একটি ছেলে হবে। আর সেই ছেলেটির নাম তুমি ইসমাইল (যার মানে ‘আল্লাহ্‌ শোনেন’) রাখবে, কারণ তোমার দুঃখের কান্নায় মাবুদ কান দিয়েছেন। তবে মানুষ হলেও সে বুনো গাধার মত হবে। সে সকলকে শত্রু করে তুলবে আর অন্যেরাও তাকে শত্রু বলে মনে করবে। সে তার ভাইদের দেশের কাছে বাস করবে।” এই কথা শুনে হাজেরা মনে মনে বলল, “আমি কি তাহলে সত্যিই তাঁকে দেখলাম যাঁর চোখের সামনে আমি আছি?” মাবুদ, যিনি হাজেরার সংগে কথা বলছিলেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করে হাজেরা তখন বলল, “তুমি আল্লাহ্‌, যাঁর চোখের সামনে আমি আছি।” সেইজন্য কাদেশ ও বেরদের মধ্যে যে কূয়াটা রয়েছে তার নাম হল বের্‌-লহয়-রোয়ী (যার মানে “যিনি জীবন্ত এবং আমায় দেখছেন, তাঁর কূয়া”)। পরে হাজেরার একটি ছেলে হল, আর ইব্রাম ছেলেটির নাম দিলেন ইসমাইল। ইব্রামের ছিয়াশি বছর বয়সে ইসমাইলের জন্ম হয়েছিল। ইব্রামের বয়স যখন নিরানব্বই বছর তখন মাবুদ তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “আমিই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তুমি আমার সংগে যোগাযোগ-সম্বন্ধ রাখ এবং আমার ইচ্ছামত চল। তোমার জন্য আমি আমার ব্যবস্থা স্থির করব আর তোমার বংশ অনেক বাড়িয়ে দেব।” এতে ইব্রাম সেজদায় পড়লেন, আর আল্লাহ্‌ তাঁর সংগে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “তোমার জন্য আমার এই ব্যবস্থাতে আমার যা করবার রয়েছে তা এই: তুমি অনেক জাতির পিতা হবে। তোমাকে ইব্রাম (যার মানে ‘মহান পিতা’) বলে আর ডাকা হবে না, কিন্তু এখন থেকে তোমার নাম হবে ইব্রাহিম (যার মানে ‘অনেক লোকের পিতা’); কারণ আমি তোমাকে অনেকগুলো জাতির আদিপিতা করে রেখেছি। আমি তোমার বংশ অনেক বাড়িয়ে দেব। তোমার মধ্য থেকে আমি অনেক জাতি সৃষ্টি করব, আর তোমার মধ্য থেকে অনেক বাদশাহ্‌র জন্ম হবে। এই ব্যবস্থার সম্বন্ধ যে কেবল তোমার আর আমার মধ্যে চলবে তা নয়; তা চলবে তোমার সন্তানদের ও আমার মধ্যে বংশের পর বংশ ধরে। এটা হবে একটা চিরকালের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় আমি তোমার এবং তোমার পরে তোমার বংশের লোকদেরও আল্লাহ্‌ হলাম। যে কেনান দেশে তুমি এখন বিদেশী হয়ে বাস করছ তার সবটাই চিরকালের সম্পত্তি হিসাবে আমি তোমাকে ও তোমার বংশকে দিলাম। আমি তাদের সকলেরই আল্লাহ্‌ হলাম।” আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে আরও বললেন, “এই ব্যবস্থায় তোমার যা করবার রয়েছে তা এই: তুমি ও তোমার সমস্ত সন্তান বংশের পর বংশ ধরে এই ব্যবস্থা মেনে চলবে। আমার এই যে ব্যবস্থা, যার চিহ্ন হিসাবে তোমাদের প্রত্যেকটি পুরুষের খৎনা করাতে হবে, তা তোমার ও তোমার বংশের লোকদের মেনে চলতে হবে। তোমাদের প্রত্যেকের পুরুষাংগের সামনের চামড়া কেটে ফেলতে হবে। তোমার ও আমার মধ্যে এই যে ব্যবস্থা স্থির করা হল, এটাই হবে তার চিহ্ন। বংশের পর বংশ ধরে তোমাদের প্রত্যেকটি পুরুষ সন্তানের জন্মের আট দিনের দিন এই খৎনা করাতে হবে। তোমার বংশের কেউ না হয়ে তোমার বাড়ীর গোলাম হলেও তাদের সবাইকে এই খৎনা করাতে হবে, তা তারা তোমার বাড়ীতে জন্মেছে এমন কোন গোলামের সন্তানই হোক বা টাকা দিয়ে বিদেশীর কাছ থেকে কিনে নেওয়া গোলামই হোক। আমি আবার বলছি, যে গোলাম তোমার বাড়ীতে জন্মেছে কিংবা যাকে টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে খৎনা করাতেই হবে। এটাই হবে তোমাদের শরীরে আমার চিরকালের ব্যবস্থার চিহ্ন। যে লোকের পুরুষাংগের সামনের চামড়া কাটা নয় তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলা হবে, কারণ সে আমার ব্যবস্থা অমান্য করেছে।” আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে আরও বললেন, “তোমার স্ত্রী সারীকে আর সারী বলে ডাকবে না। তার নাম হবে সারা। আমি তাকে দোয়া করে তারই মধ্য দিয়ে তোমাকে একটা পুত্রসন্তান দেব। আমি তাকে আরও দোয়া করব যাতে সে অনেক জাতির এবং তাদের বাদশাহ্‌দের আদিমাতা হয়।” এই কথা শুনে ইব্রাহিম মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন এবং হেসে মনে মনে বললেন, “তাহলে সত্যিই একশো বছরের বুড়োর সন্তান হবে, আর তা হবে নব্বই বছরের স্ত্রীর গর্ভে!” পরে ইব্রাহিম আল্লাহ্‌কে বললেন, “আহা, ইসমাইলই যেন তোমার রহমতে বেঁচে থাকে!” তখন আল্লাহ্‌ বললেন, “তোমার স্ত্রী সারার সত্যিই ছেলে হবে, আর তুমি তার নাম রাখবে ইসহাক (যার মানে ‘হাসা’)। তার ও তার বংশের লোকদের জন্য আমি আমার চিরকালের ব্যবস্থা চালু রাখব। তবে ইসমাইল সম্বন্ধে তুমি যা বললে তা আমি শুনলাম। শোন, আমি তাকেও দোয়া করব এবং অনেক সন্তান দিয়ে তার বংশের লোকদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেব। সে-ও বারোজন গোষ্ঠী-নেতার আদিপিতা হবে এবং তার মধ্য থেকে আমি একটা মহাজাতি গড়ে তুলব। কিন্তু ইসহাকের জন্যই আমি আমার ব্যবস্থা চালু রাখব। সামনের বছর এই সময়ে সে সারার কোলে আসবে।” ইব্রাহিমের সংগে কথা বলা শেষ করে আল্লাহ্‌ তাঁর কাছ থেকে উপরের দিকে উঠে গেলেন। আল্লাহ্‌র কথামত ইব্রাহিম সেই দিনই ইসমাইলের খৎনা করালেন। সেই সংগে তিনি তাঁর কেনা কিংবা ঘরে জন্মেছে এমন সব গোলামের, অর্থাৎ তাঁর বাড়ীর প্রত্যেকটি পুরুষের খৎনা করালেন। ইব্রাহিমের নিজের যখন খৎনা করানো হল তখন তাঁর বয়স ছিল নিরানব্বই বছর, আর তাঁর ছেলে ইসমাইলের বয়স ছিল তেরো। একই দিনে ইব্রাহিম ও তাঁর ছেলে ইসমাইলের খৎনা করানো হয়েছিল। সেই সংগে বাড়ীর অন্য সব পুরুষের, অর্থাৎ যারা তাঁর বাড়ীতে জন্মেছিল এবং বিদেশীদের কাছ থেকে যাদের কেনা হয়েছিল তাদের সকলেরই খৎনা করানো হয়েছিল। ইব্রাহিম যখন মম্রির এলোন বনের কাছে বাস করছিলেন তখন মাবুদ একদিন তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম সেই দিন দুপুরের রোদে তাঁর তাম্বুর দরজায় বসে ছিলেন। আমি একটু পানি আনিয়ে দিচ্ছি, আপনারা পা ধুয়ে নিন। তারপর আপনারা এই গাছের তলায় একটুক্ষণ বিশ্রাম করুন। আপনাদের এই গোলামের এখানে যখন এসেছেন তখন আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি, তাতে সতেজ হয়ে আপনারা আবার যাত্রা করতে পারবেন।” জবাবে তাঁরা বললেন, “খুব ভাল, আপনি যা বললেন তা-ই করুন।” ইব্রাহিম তখনই তাম্বুর ভিতরে গিয়ে সারাকে বললেন, “তাড়াতাড়ি করে আঠারো কেজি ভাল ময়দা নিয়ে মেখে কিছু রুটি তৈরী করে দাও।” ইব্রাহিম তারপর দৌড়ে গিয়ে গরুর পাল থেকে ভাল দেখে একটা কচি বাছুর নিয়ে তাঁর গোলামকে দিলেন। সেই গোলামও তাড়াতাড়ি সেটা রান্না করতে নিয়ে গেল। পরে ইব্রাহিম দই, টাট্‌কা দুধ এবং রান্না করা গোশ্‌ত নিয়ে তাঁদের পরিবেশন করলেন। তাঁরা যখন খাচ্ছিলেন তখন ইব্রাহিম তাঁদের পাশে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা ইব্রাহিমকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার স্ত্রী সারা কোথায়?” তিনি বললেন, “তাম্বুর ভিতরে আছেন।” তখন তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, “সামনের বছর এই সময়ে আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে আবার আসব। তখন আপনার স্ত্রী সারার কোলে একটি ছেলে থাকবে।” সারা ইব্রাহিমের পিছনে তাম্বুর দরজার কাছ থেকে সব কথা শুনছিলেন। তখন ইব্রাহিম আর সারার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল এবং সারার ছেলেমেয়ে হবার বয়স আর ছিল না। তাই সারা মনে মনে হেসে বললেন, “আমার স্বামী এখন বুড়ো হয়ে গেছেন আর আমিও ক্ষয় হয়ে এসেছি; সহবাসের আনন্দ কি আবার আমার কাছে ফিরে আসবে?” তখন মাবুদ ইব্রাহিমকে বললেন, “সারা কেন এই কথা বলে হাসল যে, এই বুড়ো বয়সে সত্যিই কি তার সন্তান হবে? মাবুদের কাছে অসম্ভব বলে কি কিছু আছে? সামনের বছর ঠিক এই সময়ে আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসব আর তখন সারার কোলে একটি ছেলে থাকবে।” সারা তখন ভয় পেয়ে হাসবার কথা অস্বীকার করে বললেন, “না, আমি তো হাসি নি।” কিন্তু মাবুদ বললেন, “তা সত্যি নয়; তুমি হেসেছ বৈকি!” এর পরে সেই তিনজন সেখান থেকে উঠলেন এবং নীচে সাদুমের দিকে চেয়ে দেখলেন। ইব্রাহিম তাঁদের এগিয়ে দেবার জন্য তাঁদের সংগে কিছু দূর গেলেন। পরে মাবুদ বললেন, “আমি যা করতে যাচ্ছি তা কি ইব্রাহিমের কাছ থেকে লুকাব? ইব্রাহিম আর তার বংশের লোকদের মধ্য থেকেই তো একটা মহান শক্তিশালী জাতির সৃষ্টি হবে এবং তারই মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত জাতি দোয়া পাবে। আমি মাবুদ এই উদ্দেশ্যেই তাকে বেছে নিয়েছি যেন সে তার সন্তান আর বাড়ীর অন্য সবাইকে সৎ এবং ন্যায় কাজ করে আমার ইচ্ছা মেনে চলবার উপদেশ দেয়। যদি তারা ইব্রাহিমের কথা শুনে সেইভাবে চলে, তবে আমি মাবুদ ইব্রাহিম সম্বন্ধে যা বলেছি তা সবই করব।” তারপর মাবুদ বললেন, “সাদুম ও আমুরার বিরুদ্ধে ভীষণ হৈ চৈ চলছে, আর তাদের গুনাহ্‌ও জঘন্য রকমের। সেইজন্য আমি এখন নীচে গিয়ে দেখতে চাই যে, তারা যা করেছে বলে আমি শুনছি তা সত্যিই অতটা খারাপ কি না। আর যদি তা না হয় তাও আমি জানতে পারব।” তখন অন্য দু’জন ঘুরে সাদুমের দিকে চলতে লাগলেন আর ইব্রাহিম মাবুদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরে ইব্রাহিম মাবুদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “কিন্তু আপনি কি খারাপ লোকদের সংগে সৎ লোকদেরও মুছে ফেলবেন? শহরের মধ্যে যদি পঞ্চাশজন সৎ লোক থাকে তবে সেই পঞ্চাশজনের দরুন গোটা শহরটাকে রেহাই না দিয়ে কি সত্যিই আপনি তা ধ্বংস করে ফেলবেন? এটা আপনার পক্ষে অসম্ভব। সৎ আর খারাপের প্রতি একই রকম ব্যবহার করে তাদের একসংগে মেরে ফেলা যে আপনার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। সমস্ত দুনিয়ার যিনি বিচারকর্তা তিনি কি ন্যায়বিচার না করে পারেন?” তখন মাবুদ বললেন, “যদি সাদুম শহরে পঞ্চাশজনও সৎ লোক পাওয়া যায়, তবে তাদের দরুন গোটা শহরটাকেই আমি রেহাই দেব।” ইব্রাহিম বললেন, “দেখুন, আমি ধুলা ও ছাই ছাড়া আর কিছুই নই, তবুও আমি সাহস করে আমার মালিকের সংগে কথা বলছি। ধরুন, যদি পঞ্চাশজন সৎ লোক না হয়ে পাঁচজন কম হয় তাহলে কি সেই পাঁচজন কম হওয়ার জন্য আপনি গোটা শহরটা ধ্বংস করে ফেলবেন?” তিনি বললেন, “আমি যদি সেখানে পঁয়তাল্লিশজনকেও পাই তবে আমি তা ধ্বংস করব না।” ইব্রাহিম তাঁকে আবার বললেন, “ধরুন, যদি সেখানে মাত্র চল্লিশজন সৎ লোক পাওয়া যায়?” তিনি বললেন, “সেই চল্লিশজনের জন্যই আমি তা ধ্বংস করব না।” ইব্রাহিম বললেন, “আমার মালিক যেন আমার কথায় অসন্তুষ্ট না হন। আচ্ছা, যদি সেখানে ত্রিশজনকে পাওয়া যায়?” তিনি বললেন, “যদি আমি ত্রিশজনকেও সেখানে পাই তবে আমি তা ধ্বংস করব না।” ইব্রাহিম বললেন, “আমি যখন সাহস করে দীন-দুনিয়ার মালিকের সংগে কথা বলছি তখন আরও বলছি, যদি সেখানে বিশজনকে পাওয়া যায়?” তিনি বললেন, “সেই বিশজনের জন্যই আমি তা ধ্বংস করব না।” তখন ইব্রাহিম বললেন, “আমার মালিক যেন অসন্তুষ্ট না হন, আমি আর একবার মাত্র বলছি, যদি সেখানে দশজনকে পাওয়া যায়?” তিনি বললেন, “সেই দশজনের জন্যই আমি তা ধ্বংস করব না।” ইব্রাহিমের সংগে কথা বলা শেষ করে মাবুদ সেখান থেকে চলে গেলেন আর ইব্রাহিমও তাঁর বাড়ীতে ফিরে গেলেন। সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় সেই দু’জন ফেরেশতা সাদুম শহরে গিয়ে পৌঁছালেন। লুত তখন শহরের সদর দরজার কাছে বসে ছিলেন। তাঁদের দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং মাটিতে উবুড় হয়ে সালাম জানিয়ে বললেন, “দেখুন, আর এগিয়ে না গিয়ে আপনারা দয়া করে আপনাদের এই গোলামের ঘরে আসুন এবং হাত-পা ধুয়ে নিয়ে রাতটুকু কাটান। খুব ভোরে উঠেই না হয় আবার চলতে শুরু করবেন।” জবাবে তাঁরা বললেন, “না, আমরা এই শহর-চকেই রাত কাটাব।” কিন্তু লুত যখন খুব সাধাসাধি করতে লাগলেন তখন তাঁরা তাঁর সংগে গিয়ে তাঁর বাড়ীতে ঢুকলেন। পরে লুত খামিহীন রুটি সেঁকে তাঁদের জন্য একটা মেজবানীর আয়োজন করলেন, আর তাঁরাও খাওয়া-দাওয়া করলেন। কিন্তু তাঁরা শুতে যাবার আগেই সাদুম শহরের সব জোয়ান ও বুড়োরা এসে বাড়ীটা ঘেরাও করল। তারা লুতকে ডেকে বলল, “আজ রাতে যে দু’জন লোক তোমার এখানে এসেছে তারা কোথায়? তাদের বের করে আমাদের কাছে নিয়ে এস। আমরা ঐ দু’জন পুরুষের সংগে জেনা করব।” তখন লুত দরজার বাইরে লোকদের সামনে গেলেন এবং তাঁর পিছনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “ভাইয়েরা আমার, আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা এই রকম খারাপ কাজ কোরো না। দেখ, আমার দু’টি মেয়ে আছে। তারা কখনও কোন পুরুষের সংগে থাকে নি। তাদের আমি তোমাদের কাছে বের করে নিয়ে আসছি। তাদের সংগে তোমরা যা খুশী কর, কিন্তু এই লোকদের উপর কিছু কোরো না, কারণ তাঁরা আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।” কিন্তু তারা বলল, “যা, যা, পথ থেকে সরে দাঁড়া!” তারা আরও বলল, “লোকটা আমাদের এখানে এসেছে বিদেশী হিসাবে, আর তারপর থেকে আমাদের উপর কেবল মোড়লি করে বেড়াচ্ছে। এখন আমরা ওদের চেয়েও তোর সংগে আরও খারাপ ব্যবহার করব।” এই বলে তারা এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভেংগে ফেলবার উদ্দেশ্যে লুতকে ভীষণভাবে ঠেলতে লাগল। তখন সেই দু’জন লোক হাত বাড়িয়ে লুতকে ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তাঁরা আলোর ঝলক দিলেন, আর তাতে দরজার বাইরে দাঁড়ানো জোয়ান ও বুড়ো লোকেরা হঠাৎ চোখে আর দেখতে পেল না। ফলে সেই লোকগুলো দরজা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে পড়ল। পরে সেই দু’জন লোক লুতকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই শহরে তোমার জামাই, ছেলে, মেয়ে কিংবা আর কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কি? তাদের সবাইকে নিয়ে এই জায়গা থেকে তুমি বের হয়ে যাও, কারণ এই এলাকা ধ্বংস করে ফেলবার জন্য আমরা তৈরী হয়ে আছি। এই এলাকার লোকদের বিরুদ্ধে মাবুদের কাছে এত ভীষণ হৈ চৈ হচ্ছে যে, তিনি তা ধ্বংস করবার জন্য আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।” তখন লুত বাইরে গিয়ে যারা তাঁর জামাই হবে তাদের বললেন, “তোমরা তাড়াতাড়ি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাও, কারণ মাবুদ এই শহরটা ধ্বংস করবার জন্য তৈরী হয়ে আছেন।” কিন্তু তারা মনে করল তিনি তামাশা করছেন। সকাল হলে পর সেই ফেরেশতারা লুতকে তাগাদা দিয়ে বললেন, “শীঘ্র কর। তোমার স্ত্রী এবং তোমার দুই মেয়ে যারা এখানে আছে তাদের নিয়ে বের হয়ে যাও। তা না হলে যে গজব এই শহরের উপর নেমে আসছে তুমিও তার মধ্যে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।” লুত কিন্তু যাই-যাচ্ছি করতে লাগলেন। কিন্তু মাবুদের রহমত তাঁর উপর ছিল বলে সেই দু’জন তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী ও মেয়েদের হাত ধরে টেনে শহরের বাইরে নিয়ে আসলেন। সবাইকে বের করে নিয়ে আসবার পর সেই দু’জনের একজন বললেন, “বাঁচতে চাও তো পালাও। পিছনে তাকিয়ো না এবং এই সমভূমির কোন জায়গায় থেমো না। পাহাড়ে পালিয়ে যাও; তা না হলে তোমরাও মারা পড়বে।” তখন লুত বললেন, “না, না। দেখুন, আপনার এই গোলামের উপর আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর আমার প্রাণ রক্ষা করে আপনি আমার জন্য যা করবার তার চেয়েও বেশী করেছেন। কিন্তু আমি পাহাড়ে পালিয়ে যেতে পারব না। তার আগেই হয়তো এই বিপদ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে আর আমি মারা যাব। দেখুন, পালিয়ে যেতে হলে ঐ ছোট গ্রামটাই তো কাছে। প্রাণ বাঁচাবার জন্য আমাকে ওখানে পালিয়ে যেতে দিন। গ্রামটা মোটেই বড় নয়।” ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “আমি তোমার এই অনুরোধ রাখলাম। যে গ্রামটার কথা তুমি বললে সেটা আমি ধ্বংস করব না। কিন্তু তাড়াতাড়ি করে সেখানে পালিয়ে যাও। তুমি সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি কিছুই করতে পারছি না।” লুতের কথার জন্যই সেই গ্রামটার নাম হল সোয়র (যার মানে “ছোট”)। লুত যখন সোয়রে গিয়ে পৌঁছালেন তখন সূর্য উঠে গেছে। তার পরেই মাবুদ আসমান থেকে সাদুম ও আমুরার উপর গন্ধক ও আগুনের বৃষ্টি শুরু করলেন। তিনি সেই শহর দু’টি, সমস্ত সমভূমিটা, শহরের সমস্ত লোক এবং সেখানকার জমির উপর জন্মেছে এমন সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন। লুতের স্ত্রী লুতের পিছনে পড়ে পিছন দিকে ফিরে তাকালেন, আর তাতে তিনি লবণের একটা থাম হয়ে গেলেন। পরের দিন ইব্রাহিম খুব ভোরে উঠে সেই জায়গায় গেলেন যেখানে আগের দিন তিনি মাবুদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নীচে সাদুম, আমুরা এবং সমস্ত সমভূমিটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, প্রকাণ্ড চুলা থেকে যেমন ধোঁয়া ওঠে তেমনি সেই সব এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠছে। এইভাবে লুত যেখানে বাস করতেন আল্লাহ্‌ সেই সমভূমির শহরগুলো ধ্বংস করবার সময় ইব্রাহিমের কথা ভেবে লুতকে ঐখানকার বিপদের মাঝখান থেকে সরিয়ে এনেছিলেন। সোয়রে থাকতে সাহস হল না বলে লুত তাঁর মেয়ে দু’টিকে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে পাহাড়ী এলাকায় চলে গেলেন। সেখানে একটা গুহায় তাঁরা থাকতে লাগলেন। পরে একদিন বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে বলল, “বাবা তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। এই এলাকায় এমন কোন পুরুষ লোক নেই যিনি এসে দুনিয়ার নিয়ম মত আমাদের বিয়ে করতে পারেন। চল, আমরা আমাদের বাবাকে আংগুর-রস খাইয়ে মাতাল করে তাঁর কাছে যাই। তাতে বাবার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বংশ রক্ষা করতে পারব।” সেই কথামত সেই দিন রাতের বেলা তারা তাদের পিতাকে আংগুর-রস খাইয়ে মাতাল করল। তারপর বড় মেয়েটি তার পিতার সংগে শুতে গেল, কিন্তু কখন সে শুলো আর কখনই বা উঠে গেল লুত তা টেরও পেলেন না। পরের দিন বড়টি ছোটটিকে বলল, “দেখ, কাল রাতে আমি বাবার সংগে শুয়েছিলাম। চল, আজ রাতেও তাঁকে তেমনি করে মাতাল করি, তারপর তুমি গিয়ে তাঁর সংগে শোবে। তাহলে বাবার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বংশ রক্ষা করতে পারব।” এইভাবে তারা সেই রাতেও তাদের পিতাকে আংগুর-রস খাইয়ে মাতাল করল এবং ছোট মেয়েটি বাবার সংগে শুতে গেল। মেয়েটি কখন যে তাঁর কাছে শুলো এবং কখনই বা উঠে গেল তিনি তা টেরও পেলেন না। এইভাবে লুতের দুই মেয়েই তাদের পিতার দ্বারা গর্ভবতী হল। পরে বড় মেয়েটির একটি ছেলে হলে সে তার নাম রাখল মোয়াব (যার মানে “বাবার কাছ থেকে”)। এই মোয়াবই এখনকার মোয়াবীয়দের আদিপিতা। পরে ছোট মেয়েটিরও একটি ছেলে হল, আর সে তার নাম রাখল বিন্‌-অম্মি (যার মানে “আমার বংশের সন্তান”)। সে এখনকার অম্মোনীয়দের আদিপিতা। পরে ইব্রাহিম মম্রি থেকে নেগেভ নামে দক্ষিণের মরুভূমির দিকে চলে গেলেন। সেখানে তিনি কাদেশ শহর আর শূরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বাস করতে লাগলেন। সেখান থেকে তিনি কিছু দিনের জন্য গরার শহরে গিয়ে রইলেন। সেখানে তিনি তাঁর স্ত্রী সারাকে আবার নিজের বোন বলে পরিচয় দিলেন। সেইজন্য সেখানকার বাদশাহ্‌ আবিমালেক লোক পাঠিয়ে সারাকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু রাতের বেলা আল্লাহ্‌ আবিমালেককে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, “যে স্ত্রীলোকটিকে তুমি নিয়ে এসেছ, তার স্বামী আছে। তাকে নিয়ে আসবার দরুন তুমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আছ।” আবিমালেক কিন্তু তখনও সারার কাছে যান নি; তাই জবাবে তিনি বললেন, “হে মালিক, নির্দোষ হলেও কি একটা জাতিকে আপনি ধ্বংস করে ফেলবেন? সেই লোকটি তো নিজেই আমাকে বলেছে যে, সে তার বোন, আর সেই স্ত্রীলোকটিও বলেছে যে, সে তার ভাই। আমি সরল মনে এই কাজ করেছি; তা ছাড়া বাইরেও আমার ব্যবহারের মধ্যে কোন দোষ ছিল না।” আল্লাহ্‌ স্বপ্নের মধ্যেই তাঁকে বললেন, “হ্যাঁ, আমি জানি তুমি সরল মনেই এই কাজ করেছ। আমি তোমাকে সেইজন্যই তাকে ছুঁতে দিই নি এবং আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ কাজ থেকে তোমাকে ঠেকিয়ে রেখেছি। এখন তুমি তাকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দাও। লোকটি একজন নবী। সে তোমার জন্য মুনাজাত করবে, আর তাতে তোমার প্রাণ রক্ষা পাবে। কিন্তু যদি তাকে ফিরিয়ে না দাও, তবে মনে রেখো, তুমি ও তোমার লোকেরা একজনও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবে না।” এতে আবিমালেক খুব ভোরে উঠে তাঁর অধীনে যারা কাজ করত তাদের সকলকে ডেকে সব কিছু জানালেন। এই কথা শুনে তাঁর লোকেরা খুব ভয় পেল। তখন আবিমালেক ইব্রাহিমকে ডেকে বললেন, “আপনি আমাদের সংগে এ কি রকম ব্যবহার করলেন? আমি আপনার কাছে কি দোষ করেছি যে, আপনি আমাকে এবং আমার রাজ্যকে এত বড় গুনাহের দায়ে ফেললেন? এই রকম ব্যবহার করা আপনার মোটেই উচিত হয় নি।” আবিমালেক আরও বললেন, “আপনি কি মনে করে এই কাজ করলেন?” জবাবে ইব্রাহিম বললেন, “আমি ভেবেছিলাম, এই জায়গার লোকদের আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় বলে কিছু নেই। কাজেই আমার স্ত্রীকে পাবার জন্য তারা হয়তো আমাকে হত্যা করবে। তা ছাড়া সে আমার বোনও বটে, কারণ মা আলাদা হলেও আমরা দু’জন একই পিতার সন্তান, যদিও এখন সে আমার স্ত্রী। আল্লাহ্‌ যখন আমাকে আমার পিতার বাড়ী থেকে বের করে আনলেন তখন আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘তুমি যে আমাকে ভালবাস তা এইভাবে দেখিয়ো। আমরা যেখানেই যাই না কেন, তুমি আমাকে তোমার ভাই বলে পরিচয় দিয়ো।’ ” এর পর আবিমালেক কতগুলো ভেড়া, গরু এবং গোলাম ও বাঁদী ইব্রাহিমকে দিলেন, আর সেই সংগে তাঁর স্ত্রী সারাকেও তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। পরে তিনি ইব্রাহিমকে বললেন, “দেখুন, আমার গোটা দেশটাই আপনার সামনে রয়েছে। আপনার যেখানে খুশী সেখানে আপনি বাস করুন।” তারপর তিনি সারাকে বললেন, “দেখুন, আমি আপনার প্রতি যে অন্যায় করেছি তা আপনার সব লোকদের সামনে যেন ঢাকা পড়ে যায় সেইজন্য আপনার ভাইকে এক হাজার রূপার টুকরা দিচ্ছি। এতে সকলের সামনেই প্রমাণ হবে যে, আপনি কোন দোষ করেন নি।” এর পর ইব্রাহিম আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করলেন। তাতে আল্লাহ্‌ আবিমালেক, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর অন্যান্য স্ত্রীলোকদের সুস্থ করলেন। এতে তাঁরা সন্তান লাভের ক্ষমতা ফিরে পেলেন। ইব্রাহিমের স্ত্রী সারার দরুন মাবুদ আবিমালেকের বাড়ীর সমস্ত স্ত্রীলোকের সন্তান ধারণের ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মাবুদ তাঁর কথামতই সারার দিকে মনোযোগ দিলেন এবং তিনি তাঁর জন্য যা করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন তা করলেন। এতে সারা গর্ভবতী হলেন। ইব্রাহিমের বুড়ো বয়সে সারার গর্ভে তাঁর ছেলের জন্ম হল। আল্লাহ্‌ যে সময়ের কথা বলেছিলেন সেই সময়েই তার জন্ম হল। ইব্রাহিম সারার গর্ভের এই সন্তানের নাম রাখলেন ইসহাক। আল্লাহ্‌র হুকুম অনুসারে ইব্রাহিম আট দিনের দিন তাঁর ছেলে ইসহাকের খৎনা করালেন। ইব্রাহিমের বয়স যখন একশো বছর তখন তাঁর ছেলে ইসহাকের জন্ম হয়েছিল। সারা বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌ আমার মুখে হাসি ফুটালেন, আর সেই কথা শুনে অন্যের মুখেও হাসি ফুটবে।” তিনি আরও বলেছিলেন, “সারা যে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াবে এই কথা এর আগে কে ইব্রাহিমকে বলতে পারত? অথচ তাঁর এই বুড়ো বয়সেই তাঁর সন্তান আমার কোলে আসল।” ইসহাক বড় হলে পর যেদিন তাকে মায়ের দুধ ছাড়ানো হল সেই দিন ইব্রাহিম একটা বড় মেজবানী দিলেন। সারা দেখলেন, মিসরীয় হাজেরার গর্ভে ইব্রাহিমের যে সন্তানটি জন্মেছে সে ইসহাককে নিয়ে তামাশা করছে। এই অবস্থা দেখে তিনি ইব্রাহিমকে বললেন, “ছেলে সুদ্ধ ঐ বাঁদীকে বের করে দাও, কারণ ঐ ছেলে আমার ইসহাকের সংগে বিষয়-সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারবে না।” ছেলে ইসমাইলের এই ব্যাপার নিয়ে ইব্রাহিমের মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, “তোমার বাঁদী ও তার ছেলেটির কথা ভেবে তুমি মন খারাপ কোরো না। সারা তোমাকে যা বলছে তুমি তা-ই কর, কারণ ইসহাকের বংশকেই তোমার বংশ বলে ধরা হবে। তবে সেই বাঁদীর ছেলের মধ্য দিয়েও আমি একটা জাতি গড়ে তুলব, কারণ সে-ও তো তোমার সন্তান।” তখন ইব্রাহিম খুব ভোরে উঠে কিছু খাবার আর পানিতে-ভরা একটা চামড়ার থলি হাজেরার কাঁধে তুলে দিলেন। তারপর ছেলেটিকে তাঁর হাতে দিয়ে তাকে বিদায় করে দিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে হাজেরা বের্‌-শেবার মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। থলির পানি যখন শেষ হয়ে গেল তখন তিনি ছেলেটিকে একটা ঝোপের তলায় শুইয়ে রাখলেন। তারপর একটা তীর ছুঁড়লে যতদূর যায় আনুমানিক ততটা দূরে গিয়ে তিনি বসে রইলেন। “ছেলেটির মৃত্যু যেন আমাকে দেখতে না হয়,” মনে মনে এই কথা বলে সেখানে বসেই তিনি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। ছেলেটির কান্না কিন্তু আল্লাহ্‌র কানে গিয়ে পৌঁছাল। তখন আল্লাহ্‌র ফেরেশতা বেহেশত থেকে হাজেরাকে ডেকে বললেন, “হাজেরা, তোমার কি হয়েছে? ভয় কোরো না, কারণ ছেলেটি যেখানে আছে সেখান থেকেই তার কান্না আল্লাহ্‌র কানে গিয়ে পৌঁছেছে। তুমি উঠে ছেলেটিকে তুলে শান্ত কর, কারণ আমি তার মধ্য দিয়ে একটা মহাজাতি গড়ে তুলব।” তারপর আল্লাহ্‌ হাজেরার চোখ খুলে দিলেন, তাতে তিনি একটা পানিতে-ভরা কূয়া দেখতে পেলেন। সেই কূয়ার কাছে গিয়ে তিনি তার চামড়ার থলিটা ভরে নিয়ে ছেলেটিকে পানি খাওয়ালেন। আল্লাহ্‌ সেই ছেলেটির দেখাশোনা করতে থাকলেন, আর সে বড় হয়ে উঠতে লাগল। সে মরুভূমিতে বাস করত আর তীর-ধনুক ব্যবহারে পাকা হয়ে উঠল। পারণ নামে এক মরুভূমিতে সে বাস করতে লাগল। মিসর দেশের এক মেয়ের সংগে তার মা তার বিয়ে দিল। সেই সময় আবিমালেক ও তাঁর প্রধান সেনাপতি ফীখোল ইব্রাহিমের কাছে এসে বললেন, “দেখা যাচ্ছে, আপনার সব কাজের মধ্যে আল্লাহ্‌ আপনার সংগে আছেন। কাজেই আল্লাহ্‌র নামে আপনি এখন আমার কাছে এই কসম খান যে, আমার বা আমার সন্তানদের সংগে কিংবা আমার বংশধরদের কারও সংগে আপনি কোন ছলনার কাজ করবেন না। আমি যেমন করে আপনার সংগে বিশ্বস্তভাবে ব্যবহার করেছি, ঠিক তেমনি করে আপনিও আমার সংগে এবং যে দেশে আপনি বিদেশী হয়ে বাস করছেন সেই দেশের লোকদের সংগে বিশ্বস্তভাবে ব্যবহার করবেন।” ইব্রাহিম বললেন, “জ্বী, আমি কসম খাচ্ছি।” তবে তিনি একটা কূয়ার ব্যাপারে নালিশ জানিয়ে আবিমালেককে বললেন যে, তাঁর গোলামেরা তা জোর করে তাঁর কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে। জবাবে আবিমালেক বললেন, “এই কাজ কে করেছে তা আমি জানি না। আগে তো আপনি এই কথা আমাকে বলেন নি। আজকেই আমি এই কথা শুনলাম।” তারপর ইব্রাহিম কতগুলো ভেড়া ও গরু এনে আবিমালেককে দিলেন এবং তাঁরা দু’জনে একটা চুক্তি করলেন। পরে ইব্রাহিম তাঁর ভেড়ার পাল থেকে সাতটা বাচ্চা-ভেড়ী আলাদা করে নিলেন। এ দেখে আবিমালেক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কি? এই সাতটা আলাদা করা বাচ্চা-ভেড়ীর মানে?” ইব্রাহিম বললেন, “আপনি এগুলো গ্রহণ করুন। এই কূয়াটা যে আমিই খুঁড়েছি এগুলো তার প্রমাণ।” সেইজন্যই সেই জায়গাটার নাম হল বের্‌-শেবা (যার মানে “কসমের কূয়া”), কারণ এখানেই তাঁরা দু’জনে কসম খেয়েছিলেন। বের্‌-শেবাতে এই চুক্তি করবার পর আবিমালেক ও তাঁর প্রধান সেনাপতি ফীখোল তাঁদের দেশে, অর্থাৎ ফিলিস্তিনীদের দেশে ফিরে গেলেন। ইব্রাহিম বের্‌-শেবাতে মাবুদের, অর্থাৎ যাঁর শুরু এবং শেষ নেই সেই আল্লাহর এবাদত করলেন। তিনি সেখানে একটা ঝাউ গাছ লাগালেন। ইব্রাহিম ফিলিস্তিনীদের দেশে বেশ কিছুকাল রইলেন। এই সমস্ত ঘটনার পর আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে এক পরীক্ষায় ফেললেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে ডাকলেন, “ইব্রাহিম।” ইব্রাহিম জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” আল্লাহ্‌ বললেন, “তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলে ইসহাককে, যাকে তুমি এত ভালবাস তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া এলাকায় যাও। সেখানে যে পাহাড়টার কথা আমি তোমাকে বলব তার উপরে তুমি তাকে পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে কোরবানী দাও।” সেইজন্য ইব্রাহিম খুব ভোরে উঠে একটা গাধার পিঠে গদি চাপালেন। তারপর তাঁর ছেলে ইসহাক ও দু’জন গোলামকে সংগে নিলেন, আর পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠ কেটে নিয়ে যে জায়গার কথা আল্লাহ্‌ তাঁকে বলেছিলেন সেই দিকে রওনা হলেন। তিন দিনের দিন ইব্রাহিম চোখ তুলে চাইতেই দূর থেকে সেই জায়গাটা দেখতে পেলেন। তখন তিনি তাঁর গোলামদের বললেন, “তোমরা গাধাটা নিয়ে এখানেই থাক; আমার ছেলে আর আমি ওখানে যাব। ওখানে আমাদের এবাদত শেষ করে আবার আমরা তোমাদের কাছে ফিরে আসব।” এই বলে ইব্রাহিম পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠের বোঝাটা তাঁর ছেলে ইসহাকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আগুনের পাত্র ও ছোরা নিলেন। তারপর তাঁরা দু’জনে একসংগে হাঁটতে লাগলেন। তখন ইসহাক তাঁর পিতা ইব্রাহিমকে ডাকলেন, “আব্বা।” ইব্রাহিম বললেন, “জ্বী বাবা, কি বলছ?” ইসহাক বললেন, “পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠ আর আগুন রয়েছে দেখছি, কিন্তু ভেড়ার বাচ্চা কোথায়?” ইব্রাহিম বললেন, “ছেলে আমার, পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আল্লাহ্‌ নিজেই ভেড়ার বাচ্চা যুগিয়ে দেবেন।” এই সব কথা বলতে বলতে তাঁরা এগিয়ে গেলেন। যে জায়গার কথা আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে বলে দিয়েছিলেন তাঁরা সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে পৌঁছে ইব্রাহিম একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে তার উপর কাঠ সাজালেন। পরে ইসহাকের হাত-পা বেঁধে তাঁকে সেই কোরবানগাহের কাঠের উপর রাখলেন। তারপর ইব্রাহিম ছেলেটিকে মেরে ফেলবার জন্য ছোরা হাতে নিলেন। এমন সময় মাবুদের ফেরেশতা বেহেশত থেকে তাঁকে ডাকলেন, “ইব্রাহিম, ইব্রাহিম!” ইব্রাহিম জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” ফেরেশতা বললেন, “ছেলেটির উপর তোমার হাত তুলো না বা তার প্রতি আর কিছুই কোরো না। তুমি যে আল্লাহ্‌ভক্ত তা এখন বুঝা গেল, কারণ আমার কাছে তুমি তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলেকেও কোরবানী দিতে পিছ্‌পা হও নি।” ইব্রাহিম তখন চারদিকে তাকালেন এবং দেখলেন তাঁর পিছনে একটা ভেড়া রয়েছে আর তার শিং ঝোপে আট্‌কে আছে। তখন ইব্রাহিম গিয়ে ভেড়াটা নিলেন এবং ছেলের বদলে সেই ভেড়াটাই তিনি পোড়ানো-কোরবানীর জন্য ব্যবহার করলেন। তিনি সেই জায়গাটার নাম দিলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌-যিরি (যার মানে “মাবুদ যোগান”)। সেইজন্য আজও লোকে বলে, “মাবুদের পাহাড়ে মাবুদই যুগিয়ে দেন।” আমি নিশ্চয়ই তোমাকে অনেক দোয়া করব, আর আসমানের তারার মত এবং সমুদ্র-পারের বালুকণার মত তোমার বংশের লোকদের অসংখ্য করব। তোমার বংশের লোকেরা তাদের শত্রুদের শহরগুলো জয় করে নেবে, আর তোমার বংশের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত জাতি দোয়া পাবে। তুমি আমার হুকুম পালন করেছ বলেই তা হবে।” এর পর ইব্রাহিম তাঁর গোলামদের কাছে ফিরে আসলেন। তখন সকলে একসংগে সেখান থেকে বের্‌-শেবাতে ফিরে গেলেন; এখানেই ইব্রাহিম বাস করতেন। এই সব ঘটনার পরে ইব্রাহিম শুনতে পেলেন যে, এর মধ্যে তাঁর ভাই নাহুরের স্ত্রী মিল্‌কার কয়েকটি ছেলে হয়েছে। নাহুরের বড় ছেলের নাম ছিল আওস। পরে বূষ আর কমূয়েলের জন্ম হয়েছিল। কমূয়েলের ছেলের নাম ছিল ইরাম। নাহুরের অন্য ছেলেদের নাম কেষদ, হসো, পিল্‌দশ, যিদ্‌লফ ও বথূয়েল। বথূয়েলের মেয়ের নাম ছিল রেবেকা। ইব্রাহিমের ভাই নাহুরের স্ত্রী মিল্‌কার গর্ভে এই আটটি ছেলের জন্ম হয়েছিল। নাহুরের একজন উপস্ত্রী ছিল; তার নাম ছিল রূমা। তার গর্ভে টেবহ, গহম, তহশ ও মাখার জন্ম হয়েছিল। পরে তিনি তাঁর মৃতা স্ত্রীর পাশ থেকে উঠে গিয়ে সেখানকার হিট্টীয়দের বললেন, “আমি অন্য দেশ থেকে এসে বিদেশী হিসাবে আপনাদের মধ্যে বাস করছি। সেইজন্য দয়া করে কবরস্থান করবার জন্য আমাকে আপনাদের মধ্যে একটু জায়গা ছেড়ে দিন যেন সেখানে আমি আমার মৃতা স্ত্রীকে দাফন করতে পারি।” এর জবাবে হিট্টীয়রা বলল, “দেখুন, আপনি আমাদের কথা শুনুন। আপনি এখানে আমাদের মধ্যে আল্লাহ্‌র নিযুক্ত একজন নেতা হয়ে আছেন। আমাদের সবচেয়ে ভাল কবরটাতেই আপনি আপনার মৃতা স্ত্রীর দাফন করুন। আপনার স্ত্রীকে দাফন করবার জন্য আমাদের মধ্যে কেউই তার নিজের কবর ছেড়ে দিতে আপত্তি করবে না।” তখন ইব্রাহিম উঠে দাঁড়ালেন এবং সেই এলাকার হিট্টীয় বাসিন্দাদের সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে সম্মান দেখালেন। ইব্রাহিম আবার মাটিতে উবুড় হয়ে তাদের সম্মান দেখালেন। তারপর সবাই যাতে শুনতে পায় সেইভাবে তিনি ইফ্রোণকে বললেন, “আপত্তি না থাকলে আপনি দয়া করে আমার কথা শুনুন। জমিটা আমি দাম দিয়ে নিতে চাই। দয়া করে আপনি জমির দামটা গ্রহণ করুন যাতে আমি ওখানে আমার মৃতা স্ত্রীকে দাফন করতে পারি।” জবাবে ইফ্রোণ ইব্রাহিমকে বললেন, “আপনি আমার কথা শুনুন। ঐ জমিটার দাম হল চার কেজি আটশো গ্রাম রূপা, কিন্তু আমার বা আপনার কাছে ওটা তেমন কিছু নয়। আপনি বরং গিয়ে ওখানেই আপনার মৃতা স্ত্রীকে দাফন করুন।” ইফ্রোণের কথা শুনে ইব্রাহিম ব্যবসায়ীদের মাপ অনুসারে চার কেজি আটশো গ্রাম রূপা তাঁকে মেপে দিলেন। ইফ্রোণ হিট্টীয়দের সামনে এই চার কেজি আটশো গ্রাম রূপার কথাই বলেছিলেন। এর পরে ইব্রাহিম কেনান দেশের মম্রি শহরের কাছে, অর্থাৎ হেবরনের কাছে মক্‌পেলার গুহাতে তাঁর স্ত্রী সারাকে দাফন করলেন। এমনি করে মক্‌পেলার ঐ গুহাসুদ্ধ জমিটা কবরস্থান হিসাবে হিট্টীয়দের হাত থেকে ইব্রাহিমের হাতে আসল। ইব্রাহিম তখন বেশ বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন আর বয়সও তাঁর অনেক হয়েছিল। মাবুদ তাঁকে সব দিক থেকেই দোয়া করেছিলেন। বাড়ীর সবচেয়ে পুরানো যে গোলামের উপর তাঁর সব কিছুর ভার ছিল তাকে তিনি একদিন বললেন, “তোমার হাতখানা আমার রানের নীচে রাখ। যিনি বেহেশত ও দুনিয়ার আল্লাহ্‌ সেই মাবুদের সামনে আমি তোমাকে এই কসম খাওয়াচ্ছি: আমি যে কেনানীয়দের মধ্যে বাস করছি তাদের মধ্য থেকে কোন মেয়েকে আমার ছেলের স্ত্রী হিসাবে তুমি বেছে নেবে না। তার বদলে তুমি আমার দেশে গিয়ে আমার বংশের লোকদের মধ্য থেকে একটি মেয়েকে আমার ছেলে ইসহাকের জন্য বেছে নেবে।” এই কথা শুনে সেই গোলাম ইব্রাহিমকে বলল, “যদি সেই মেয়ে আমার সংগে এই দেশে আসতে রাজী না হয়, তাহলে যে দেশ ছেড়ে আপনি এসেছেন সেই দেশেই কি আবার আপনার ছেলেকে আমি নিয়ে যাব?” ইব্রাহিম বললেন, “সাবধান, আমার ছেলেকে তুমি কখনও সেখানে নিয়ে যাবে না। বেহেশতের আল্লাহ্‌ মাবুদ আমাকে আমার পিতার বাড়ী-ঘর ও আমার জন্মস্থান থেকে বের করে এনেছেন। তিনি আমার সংগে কথা বলেছিলেন এবং কসম খেয়ে বলেছিলেন যে, এই দেশ তিনি আমার বংশকে দেবেন। তিনি তোমার আগেই তাঁর ফেরেশতাকে সেখানে পাঠিয়ে দেবেন যাতে আমার ছেলের স্ত্রী হওয়ার জন্য তুমি সেখান থেকে একটি মেয়ে নিয়ে আসতে পার। কিন্তু সেই মেয়ে যদি তোমার সংগে আসতে রাজী না হয়, তবে আমার এই কসম থেকে তুমি মুক্ত। কিন্তু আমার ছেলেকে তুমি কখনও সেখানে নিয়ে যাবে না।” তখন সেই গোলাম তার মালিক ইব্রাহিমের ঊরুর নীচে হাত রেখে এই ব্যাপারে তাঁর কাছে কসম খেল। এর পর সেই গোলাম তার মালিকের উটের পাল থেকে দশটা উট নিল। পরে মালিকের সব রকম জিনিস থেকে কিছু কিছু নিয়ে সে ইরাম-নহরয়িম দেশের দিকে রওনা হল। সেখানকার যে শহরটিতে নাহুর বাস করতেন সে সেখানে গেল। শহরটার বাইরে একটা কূয়া ছিল। সেই গোলাম সেখানে পৌঁছে তার উটগুলোকে সেই কূয়ার পাশে হাঁটু পেতে বসাল। তখন প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি, মেয়েদের পানি তুলে নেবার সময়। সেই গোলাম এই বলে মুনাজাত করল, “হে মাবুদ, আমার মালিক ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, আজ এর সব কিছু তুমি তোমার হাতে নাও এবং আমার মালিক ইব্রাহিমকে দেওয়া তোমার কথা রাখ। দেখ, এই শহরের মেয়েরা পানি নিতে বের হয়ে আসছে, আর আমি এই কূয়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ঐ মেয়েদের একজনকে আমি বলব, ‘আপনার কলসী নামিয়ে আমাকে পানি খেতে দিন।’ তার জবাবে যদি সেই মেয়ে বলে, ‘আপনি পানি খান, আর আপনার উটগুলোকেও আমি পানি খাওয়াব,’ তাহলে সেই মেয়েই যেন তোমার গোলাম ইসহাকের জন্য তোমার বেছে রাখা মেয়ে হয়। এতেই আমি জানতে পারব যে, তুমি আমার মালিককে দেওয়া তোমার কথা রেখেছ।” তার কথা শেষ হতে না হতেই রেবেকা কলসী কাঁধে শহর থেকে বের হয়ে আসলেন। তিনি ছিলেন বথূয়েলের মেয়ে। বথূয়েল ছিলেন ইব্রাহিমের ভাই নাহুরের স্ত্রী মিল্‌কার ছেলে। রেবেকা বললেন, “এই নিন, পানি খান।” এই কথা বলেই তিনি তাড়াতাড়ি করে কলসীটা কাঁধ থেকে হাতে নিয়ে তাকে পানি খেতে দিলেন। পানি খাওয়াবার পর রেবেকা তাকে বললেন, “আমি আপনার উটগুলোর জন্যও পানি তুলে দেব যতক্ষণ না ওদের পানি খাওয়া শেষ হয়।” এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি করে পশুদের পানি খাওয়াবার গামলাটায় তাঁর কলসীর পানি ঢেলে দিয়ে আবার দৌড়ে কূয়ার কাছে গেলেন। এইভাবে তিনি সব উটগুলোর জন্য পানি তুলে দিলেন। মাবুদ তার এই যাত্রা সফল করেছেন কি না তা জানবার জন্য সেই গোলাম চুপ করে রেবেকাকে লক্ষ্য করতে লাগল। উটগুলোর পানি খাওয়া শেষ হলে পর সে প্রায় ছয় গ্রাম ওজনের একটা সোনার নথ আর দুই হাতের জন্য একশো বিশ গ্রাম ওজনের দু’টি সোনার বালা বের করে রেবেকাকে দিয়ে বলল, “আপনি কার মেয়ে? আপনি কি বলতে পারেন আপনার পিতার বাড়ীতে আমাদের থাকবার জায়গা হবে কি না?” রেবেকা বললেন, “আমার পিতার নাম বথূয়েল। তিনি মিল্‌কা ও নাহুরের ছেলে।” তিনি আরও বললেন, “আমাদের বাড়ীতে যথেষ্ট খড় ও ভূষি আছে এবং থাকবার জায়গাও রয়েছে।” তখন সেই গোলাম মাবুদকে সেজদা করে বলল, “সমস্ত প্রশংসা মাবুদের, যিনি আমার মালিক ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌! তিনি আমার মালিককে তাঁর দেওয়া কথা রাখতে ও বিশ্বস্ততা দেখাতে ভুলে যান নি। আমাকেও তিনি পথ দেখিয়ে আমার মালিকের ভাইয়ের বাড়ীতে নিয়ে এসেছেন।” রেবেকা কিন্তু দৌড়ে গিয়ে বাড়ীর সবাইকে আর বাড়ীর প্রধান তাঁর মাকে এই কথা জানালেন। লাবন তাকে বললেন, “হে মাবুদের দোয়ার পাত্র, আসুন। কেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন? আমি আপনাদের জন্য ঘর এবং উটগুলোর জন্য জায়গা ঠিক করে রেখে এসেছি।” এই কথা শুনে সেই গোলাম তাঁদের বাড়ীতে গেল। লাবন উটগুলোর বোঝা নামিয়ে রেখে তাদের খড় আর ভূষি খেতে দিলেন। তারপর তিনি সেই গোলাম ও তার সংগের লোকদের পা ধোয়ার পানি দিলেন। কিন্তু যখন তার সামনে খাবার দেওয়া হল তখন সে বলল, “আমি কেন এখানে এসেছি তা খুলে না বলা পর্যন্ত কিছুই মুখে দেব না।” লাবন বললেন, “আচ্ছা, বলুন।” তখন সে বলল, “আমি ইব্রাহিমের গোলাম। আমার মালিককে মাবুদ অনেক দোয়া করেছেন; আজ তিনি খুব বড়লোক। মাবুদ তাঁকে অনেক গরু-ভেড়া, সোনা-রূপা, গোলাম ও বাঁদী এবং উট ও গাধা দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সারার অনেক বয়সে তাঁরই গর্ভে আমার মালিকের একটি ছেলের জন্ম হয়েছে, আর সেই ছেলেকেই তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দিয়েছেন। তিনি আমাকে এই বলে কসম খাইয়ে নিয়েছেন যে, তিনি যে দেশে বাস করছেন সেই কেনান দেশের কোন মেয়েকে আমি যেন তাঁর ছেলের স্ত্রী হবার জন্য বেছে না নিই। তার বদলে যেন আমি তাঁর পিতার বাড়ীতে গিয়ে তাঁর বংশের লোকদের মধ্য থেকেই একটি মেয়েকে তাঁর ছেলের জন্য বেছে নিই। তখন আমি আমার মালিককে বললাম, ‘কিন্তু মেয়েটি যদি আমার সংগে আসতে না চায়?’ “তিনি আমাকে বললেন, ‘মাবুদ, যাঁকে আমি মেনে চলি, তিনিই তাঁর ফেরেশতাকে তোমার সংগে পাঠিয়ে দেবেন যাতে তোমার যাত্রা সফল হয়। এতে তুমি আমার পিতার বাড়ীতে গিয়ে আমার নিজের লোকদের মধ্য থেকে একটি মেয়েকে আমার ছেলের জন্য বেছে নিতে পারবে। তাঁদের কাছে গেলে পর যদি তাঁরা কোন মেয়েকে না দেন তবে তুমি আমার এই কসম থেকে মুক্ত হবে।’ “সেইজন্য আমি আজ ঐ কূয়াটার কাছে এসে মনে মনে মুনাজাত করে বললাম, ‘হে মাবুদ, আমার মালিক ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, দয়া করে তুমি আমার এই যাত্রা সফল কর। দেখ, আমি এই কূয়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। শহর থেকে যদি কোন মেয়ে বের হয়ে পানি তুলতে আসে তবে আমি তাকে বলব যেন সে তার কলসী থেকে আমাকে একটু পানি খেতে দেয়। তাতে যদি সে আমাকে বলে যে, সে আমাকে পানি খাওয়াবে আর আমার উটগুলোর জন্যও পানি তুলে দেবে, তবে সে-ই যেন আমার মালিকের ছেলের জন্য তোমার বেছে রাখা মেয়ে হয়।’ “আমার মুনাজাত শেষ হওয়ার আগেই রেবেকা কলসী কাঁধে কূয়ায় এসে পানি তুলতে লাগলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘দয়া করে আমাকে একটু পানি খেতে দিন।’ “তিনি তাড়াতাড়ি করে কাঁধ থেকে কলসীটা নামিয়ে বললেন, ‘এই নিন, পানি খান। আমি আপনার উটগুলোকেও পানি খাওয়াব।’ তখন আমি পানি খেলাম আর তিনি আমার উটগুলোকেও পানি খাওয়ালেন। “তারপর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কার মেয়ে?’ “তিনি বললেন, ‘আমি নাহুর ও মিল্‌কার ছেলে বথূয়েলের মেয়ে।’ “এই কথা শুনে আমি তাঁর নাকে নথ ও দুই হাতে বালা পরিয়ে দিলাম। তারপর আমি মাবুদকে সেজদা করলাম। মাবুদ, যিনি আমার মালিক ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, আমি তাঁর শুকরিয়া আদায় করলাম, কারণ তিনিই আমাকে ঠিক পথে চালিয়ে এনেছেন যাতে আমি আমার মালিকের ভাইয়ের ছেলের মেয়েকে তাঁর ছেলের জন্য নিয়ে যেতে পারি। এখন আপনারা আমার মালিকের প্রতি বিশ্বস্তভাবে কর্তব্য করবেন কি না তা আমাকে বলুন। যদি তা না করেন তবে আমাকে তা-ও জানিয়ে দিন যাতে আমি অন্য কোথাও যেতে পারি।” তখন লাবন ও বথূয়েল বললেন, “ব্যাপারটা তবে মাবুদ থেকেই হয়েছে। কাজেই এতে আপনাকে আমাদের হ্যাঁ বা না বলবার কিছুই নেই। রেবেকা তো এখানেই রয়েছে; ওকে আপনি নিয়ে যান। মাবুদের কথামতই আপনার মালিকের ছেলের সংগে তার বিয়ে হোক।” ইব্রাহিমের গোলাম এই কথা শুনে মাবুদকে সেজদা করল। তারপর সে সোনা ও রূপার গহনা এবং কাপড়-চোপড় বের করে রেবেকাকে দিল, আর রেবেকার ভাই এবং মাকেও অনেক দামী দামী জিনিস দিল। পরে সে ও তার সংগের লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করে রাতটা সেখানেই কাটাল। পরদিন তারা যখন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল তখন সেই গোলাম বলল, “এবার আমাকে বিদায় দিন যাতে আমি আমার মালিকের কাছে ফিরে যেতে পারি।” কিন্তু রেবেকার মা ও ভাই বললেন, “মেয়েটা আরও দিন দশেক আমাদের কাছে থাকুক, তারপর সে যাবে।” সেই গোলাম তাঁদের বলল, “মাবুদ যখন আমার এই যাত্রা সফল করেছেন তখন আমাকে আর ধরে রাখবেন না। আমাকে বিদায় দিন যাতে আমি আমার মালিকের কাছে ফিরে যেতে পারি।” তাঁরা বললেন, “তাহলে আমরা মেয়েটিকে ডেকে তার মুখ থেকেই তার মতটা শুনি।” তাঁরা রেবেকাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি এই লোকটির সংগে যেতে চাও?” রেবেকা বললেন, “জ্বী, যাব।” তখন তাঁর ভাইয়েরা ইব্রাহিমের গোলাম ও তার লোকদের সংগে তাঁদের বোন ও তাঁর ধাইমাকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা রেবেকাকে দোয়া করে বললেন, “বোন, তুমি অসংখ্য সন্তানের মা হও। তোমার সন্তানেরা যেন শত্রুদের সমস্ত শহর জয় করে নিতে পারে।” এর পর রেবেকা ও তাঁর বাঁদীরা প্রস্তুত হয়ে উটে চড়ে ইব্রাহিমের গোলামের পিছনে পিছনে চলল। এইভাবে সেই গোলাম রেবেকাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইসহাক তখন নেগেভে থাকতেন। এর মধ্যে তিনি বের্‌-লহয়-রোয়ী নামে জায়গাটার কাছে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সেই দিনই বিকাল বেলায় ধ্যান করবার জন্য তিনি মাঠে গেলেন। সেখানে চোখ তুলে চাইতেই তিনি দেখলেন কতগুলো উট আসছে। রেবেকাও চোখ তুলে চাইলেন, আর দূর থেকে ইসহাককে দেখে তিনি উটের পিঠ থেকে নেমে পড়লেন। তারপর তিনি সেই গোলামকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঐ যে লোকটি মাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন উনি কে?” জবাবে সেই গোলাম বলল, “উনিই তো আমার মালিক।” এই কথা শুনে রেবেকা চাদর দিয়ে নিজেকে ঢাকলেন। তখন সেই গোলাম যা যা করে এসেছে সব কথা ইসহাককে জানাল। ইসহাক তখন রেবেকাকে তাঁর মা সারার তাম্বুতে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে বিয়ে করলেন। রেবেকার প্রতি ভালবাসাই মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। ইব্রাহিম কাতুরা নামে আর একটি স্ত্রীলোককে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর গর্ভে সিম্রণ, যক্‌ষণ, মদান, মাদিয়ান, যিশ্‌বক ও শূহের জন্ম হয়েছিল। সাবা ও দদান ছিল যক্‌ষণের সন্তান। আশুরীয়, লটূশীয় ও লিয়ূম্মীয়রা ছিল দদানের বংশের লোক। ঐফা, এফর, হনোক, অবীদ ও ইল্‌দায়া ছিল মাদিয়ানের সন্তান। এরা সবাই ছিল কাতুরার সন্তান এবং তাঁর সন্তানদের বংশ। ইব্রাহিম তাঁর সমস্ত ধন-সম্পত্তি ইসহাককে দিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর উপস্ত্রীদের সন্তানদেরও তিনি বেঁচে থাকতেই অনেক কিছু দান করেছিলেন। এই সন্তানদের তিনি ইসহাকের সংগে না রেখে দূরে পূর্ব দিকের একটা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম মোট একশো পঁচাত্তর বছর বেঁচে ছিলেন। একটি সুন্দর ও সুখী জীবন কাটিয়ে অনেক বয়সে তিনি ইন্তেকাল করে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। মম্রি শহরের পূর্ব দিকে হিট্টীয় সোহরের ছেলে ইফ্রোণের জমিতে মক্‌পেলার গুহায় তাঁর ছেলে ইসহাক ও ইসমাইল তাঁকে দাফন করলেন। এই জমিটাই তিনি হিট্টীয়দের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। এখানেই তাঁর স্ত্রী সারাকে এবং তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। ইব্রাহিমের ইন্তেকালের পর তাঁর ছেলে ইসহাককে আল্লাহ্‌ দোয়া করলেন। ইসহাক বের্‌-লহয়-রোয়ীর কাছে বাস করতে থাকলেন। সারার বাঁদী মিসরীয় হাজেরার গর্ভে ইব্রাহিমের ছেলে ইসমাইলের জন্ম হয়েছিল। এই হল ইসমাইলের বংশের কথা: জন্ম অনুসারে তাঁর ছেলেদের নাম হল, প্রথমে নাবায়ুত, তারপর কায়দার, অদ্‌বেল, মিব্‌সম, মিশ্‌ম, দূমা, মসা, হদদ, তেমা, যিটূর, নাফীশ ও কেদমা। ইসমাইলের এই বারোজন ছেলেই ছিলেন বারো গোষ্ঠীর সর্দার। তাঁদের নাম অনুসারেই তাঁদের গ্রাম এবং গ্রামের বাইরে তাম্বু-ফেলা জায়গাগুলোর নাম রাখা হয়েছিল। ইসমাইল মোট একশো সাঁইত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। তারপর তিনি ইন্তেকাল করে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। হবীলা থেকে শূর পর্যন্ত যে জায়গাটা ছিল তাঁর বংশের লোকেরা সেখানে বাস করত। জায়গাটা ছিল মিসরের কাছে, আশেরিয়া যাবার পথে। তাদের ভাই ইসহাকের বংশধরদের দেশের কাছে তারা বাস করত। এই হল ইব্রাহিমের ছেলে ইসহাকের জীবনের ইতিহাস। ইব্রাহিমের ছেলে ইসহাক। ইসহাক চল্লিশ বছর বয়সে রেবেকাকে বিয়ে করেছিলেন। রেবেকা ছিলেন পদ্দন-ইরাম দেশের সিরীয় বথূয়েলের মেয়ে এবং সিরীয় লাবনের বোন। ইসহাকের স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন বলে ইসহাক তাঁর জন্য মাবুদের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। মাবুদ তা কবুল করলেন এবং রেবেকা গর্ভবতী হলেন। তাঁর গর্ভের মধ্যে যমজ সন্তান ছিল এবং তারা একে অন্যের সংগে ঠেলাঠেলি করতে লাগল। সেইজন্য রেবেকা বললেন, “আমার এই রকম হচ্ছে কেন?” এই বলে ব্যাপারটা কি, তা জানবার জন্য তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করতে গেলেন। মাবুদ তাঁকে বললেন, “তোমার গর্ভে দু’টি ভিন্ন জাতির শুরু হয়েছে, জন্ম থেকেই তারা দু’টি ভিন্ন বংশ হবে। একটির চেয়ে আর একটির শক্তি বেশী হবে, বড়টি তার ছোটটির গোলাম হবে।” সন্তান প্রসবের সময় দেখা গেল সত্যিই তাঁর গর্ভে যমজ সন্তান রয়েছে। প্রথমে যে ছেলেটির জন্ম হল তার গায়ের রং ছিল লাল এবং তার শরীর পশমের কোর্তার মত লোমে ঢাকা। এইজন্য তার নাম রাখা হল ইস্‌ (যার মানে “লোমশ”)। তারপর ইসের পায়ের গোড়ালি-ধরা অবস্থায় তার ভাইয়ের জন্ম হল। এইজন্য তার নাম রাখা হল ইয়াকুব (যার মানে “গোড়ালি-ধরা”)। ইসহাকের ষাট বছর বয়সে তাঁর স্ত্রীর গর্ভে এদের জন্ম হয়েছিল। এই ছেলেরা বড় হলে পর ইস্‌ খুব ভাল শিকারী হলেন। তিনি বাইরে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন, কিন্তু ইয়াকুব ছিলেন শান্ত স্বভাবের। তিনি বাড়ীতে থাকতেই ভালবাসতেন। শিকার করা গোশ্‌ত খাওয়ার দিকে ইসহাকের একটা ঝোঁক ছিল বলে তিনি ইস্‌কে খুব ভালবাসতেন, কিন্তু রেবেকা ইয়াকুবকে খুব ভালবাসতেন। একদিন ইয়াকুব ডাল রান্না করছেন, এমন সময় ইস্‌ মাঠ থেকে ফিরে আসলেন। তখন তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ইয়াকুবকে বললেন, “আমি খুব ক্লান্ত। তোমার ঐ লাল জিনিস থেকে আমাকে কিছুটা খেতে দাও।” এই কথার জন্য ইসের আর এক নাম হল ইদোম (যার মানে “লাল”)। ইয়াকুব বললেন, “কিন্তু বড় ছেলে হিসাবে তোমার যে অধিকার সেটা আজ তুমি আমার কাছে বিক্রি কর।” ইস্‌ বললেন, “দেখ, আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, বড় ছেলের অধিকার দিয়ে আমি কি করব?” ইয়াকুব বললেন, “আগে তুমি আমার কাছে কসম খাও।” তখন ইস্‌ কসম খেয়ে বড় ছেলের অধিকার ইয়াকুবের কাছে বিক্রি করে দিলেন। ইয়াকুব এর পর ইস্‌কে রুটি ও ডাল খেতে দিলেন, আর ইস্‌ খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেলেন। এইভাবে ইস্‌ তাঁর বড় ছেলে হওয়ার অধিকারকে কোন দামই দিলেন না। ইব্রাহিমের সময়ের মত এবারও দেশে একটা দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সেইজন্য ইসহাক গরার শহরে ফিলিস্তিনীদের বাদশাহ্‌ আবিমালেকের কাছে চলে গেলেন। তখন মাবুদ ইসহাককে দেখা দিয়ে বললেন, “তুমি মিসরে যেয়ো না। আমি তোমাকে যে দেশের কথা বলব সেই দেশেই থাক। এখন এই দেশে তুমি কিছুকালের জন্য বাস করবে। আমি নিজে তোমার সংগে থেকে তোমাকে দোয়া করব। এই সব দেশ আমি তোমাকে ও তোমার বংশের লোকদেরই দেব। এছাড়া আমি তোমার পিতা ইব্রাহিমের কাছে যে কসম খেয়েছিলাম তাও বজায় রাখব। আমি তোমার বংশের লোকদের আসমানের তারার মত অসংখ্য করব এবং এই সব দেশ তাদের দেব। তোমার বংশের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত জাতি দোয়া পাবে, কারণ ইব্রাহিম আমার বাধ্য থেকে আমার সমস্ত দাবি, হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ পালন করেছিল।” সেইজন্য ইসহাক গরার শহরেই রয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানকার লোকেরা যখন তাঁর স্ত্রীর কথা জিজ্ঞাসা করল তখন তিনি তাঁকে তাঁর বোন বলে পরিচয় দিলেন। তাঁকে তাঁর স্ত্রী বলতে তিনি ভয় পেলেন; মনে করলেন রেবেকা সুন্দরী বলে সেখানকার লোকেরা রেবেকাকে পাবার জন্য তাঁকে হত্যা করবে। ইসহাক অনেক দিন সেখানে কাটালেন। একদিন ফিলিস্তিনীদের বাদশাহ্‌ আবিমালেক জানালা দিয়ে তাকালেন। তিনি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, ইসহাক তাঁর স্ত্রী রেবেকাকে আদর করছেন। এতে তিনি ইসহাককে ডেকে বললেন, “দেখুন, রেবেকা নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রী; আপনি কেন তাঁকে আপনার বোন বলেছেন?” জবাবে ইসহাক বললেন, “কারণ আমি মনে করেছিলাম তাঁর জন্যই হয়তো আমাকে মারা পড়তে হবে।” আবিমালেক বললেন, “কিন্তু আমাদের সংগে আপনি এ কি ব্যবহার করলেন? যে কোন লোক তো আপনার স্ত্রীকে তার সহবাসের সংগিনী করতে পারত। এতে আপনি গুনাহের দায়ে আমাদের দায়ী করতেন।” এর পরে আবিমালেক সমস্ত লোকের উপর এই বলে এক কড়া হুকুম জারি করলেন যে, কেউ যদি ইসহাক কিংবা তাঁর স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে তবে নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করা হবে। ইসহাক সেই বছরেই সেই দেশে চাষ করে একশো গুণ ফসল পেলেন। মাবুদ তাঁকে দোয়া করলেন, আর তাতে তিনি ধনী হয়ে উঠলেন। তাঁর অবস্থা দিন দিন ভাল হতে হতে শেষে তিনি এক বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠলেন। তাঁর ভেড়া, গরু ও গোলামদের সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে, তা দেখে ফিলিস্তিনীরা তাঁকে হিংসা করতে লাগল। ইব্রাহিমের সময়ে তাঁর গোলামেরা যে সব কূয়া খুঁড়েছিল ফিলিস্তিনীরা সেগুলো মাটি ফেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আবিমালেক ইসহাককে বললেন, “আপনি আমাদের কাছ থেকে চলে যান, কারণ আপনি আমাদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন।” কাজেই ইসহাক সেখান থেকে সরে গিয়ে গরারের শুকনা নদীর উপরে তাম্বু ফেলে বাস করতে লাগলেন। সেখানে তাঁর পিতা ইব্রাহিমের সময়ে যে সব কূয়া খোঁড়া হয়েছিল ইসহাক আবার সেই কূয়াগুলো খুঁড়িয়ে নিলেন, কারণ ইব্রাহিমের ইন্তেকালের পর ফিলিস্তিনীরা সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। তাঁর পিতা সেই কূয়াগুলোর যেটির যে নাম দিয়েছিলেন তিনি সেটির সেই নামই দিলেন। ইসহাকের গোলামেরা সেই শুকনা নদীতে কূয়া খুঁড়তে গিয়ে এমন একটা কূয়া খুঁজে পেল যার তলা থেকে পানি উঠছিল। কিন্তু গরারের রাখালেরা ইসহাকের রাখালদের সংগে ঝগড়া করে বলল, “এই পানি আমাদের।” এই ঝগড়ার জন্য ইসহাক সেই কূয়ার নাম দিলেন এষক (যার মানে “ঝগড়া”)। পরে ইসহাকের রাখালেরা আর একটা কূয়া খুঁড়ল, কিন্তু সেটা নিয়েও তারা ঝগড়া করতে লাগল। এ দেখে ইসহাক সেটার নাম দিলেন সিট্‌না (যার মানে “শত্রুতা”)। তারপর ইসহাক সেখান থেকে সরে গিয়ে আর একটা কূয়া খুঁড়ালেন। এবার কিন্তু ফিলিস্তিনীরা তা নিয়ে কোন ঝগড়া-বিবাদ করল না। ইসহাক সেই কূয়াটার নাম রাখলেন রহোবোৎ (যার মানে “অনেক জায়গা”)। তিনি বললেন, “শেষ পর্যন্ত মাবুদই আমাদের জায়গা করে দিলেন যাতে আমরা এখানেই সংখ্যায় বেড়ে উঠতে পারি।” পরে ইসহাক সেখান থেকে সরে বের্‌-শেবাতে গেলেন। সেই রাতেই মাবুদ তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “আমি তোমার পিতা ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌। কোন ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমার সংগে আছি। আমার গোলাম ইব্রাহিমের জন্যই আমি তোমাকে দোয়া করব এবং তোমার বংশ বাড়িয়ে দেব।” তখন ইসহাক সেখানে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং মাবুদের এবাদত করলেন। সেখানেই তিনি তাঁর তাম্বু ফেললেন এবং তাঁর গোলামেরা আর একটা কূয়া খুঁড়ল। এর পর আবিমালেক তাঁর মন্ত্রী অহূষৎ ও প্রধান সেনাপতি ফীখোলকে নিয়ে গরার থেকে ইসহাকের কাছে আসলেন। ইসহাক তাঁদের বললেন, “আপনারা আমার কাছে কেন এসেছেন? আপনারা তো হিংসা করে আমাকে আপনাদের কাছ থেকে দূর করে দিয়েছেন।” তাঁরা বললেন, “আমরা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মাবুদ আপনার সংগে আছেন। তাই আমরা ঠিক করেছি আপনার ও আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হওয়া দরকার। আসুন, আমরা এই কসম খাই যে, আমরা যেমন আপনার কোন ক্ষতি করি নি বরং ভাল ব্যবহার করে আপনাকে শান্তিতে বিদায় দিয়েছি তেমনি আপনিও আমাদের কোন ক্ষতি করবেন না। আপনি এখন মাবুদের দোয়ার পাত্র।” এর পর ইসহাক তাঁদের জন্য একটা মেজবানীর আয়োজন করলেন, আর তাঁরাও খাওয়া-দাওয়া করলেন। পরদিন খুব ভোরে উঠে তাঁরা একে অন্যের কাছে কসম খেলেন। তারপর ইসহাক যখন তাঁদের বিদায় দিলেন তখন তাঁরা মনে শান্তি নিয়ে রওনা হলেন। সেই দিনই ইসহাকের গোলামেরা এসে তাদের খোঁড়া একটা কূয়ার কথা তাঁকে জানিয়ে বলল, “আমরা পানির খোঁজ পেয়েছি।” ইসহাক সেই কূয়াটার নাম দিলেন শিবিয়া (যার মানে “কসম”)। সেইজন্য আজও সেই শহরটার নাম বের্‌-শেবা রয়ে গেছে। ইস্‌ চল্লিশ বছর বয়সে হিট্টীয় বেরির মেয়ে যিহূদীৎ এবং হিট্টীয় এলোনের মেয়ে বাসমত্‌কে বিয়ে করলেন। এই দু’জন স্ত্রীলোক ইসহাক ও রেবেকার জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। ইসহাক ইয়াকুবকে দোয়া করলেন বুড়ো বয়সে ইসহাকের চোখে দেখবার ক্ষমতা এত কমে গেল যে, শেষে তিনি আর দেখতেই পেতেন না। একদিন তিনি তাঁর বড় ছেলে ইস্‌কে ডেকে বললেন, “বাবা আমার।” ইস্‌ জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” ইসহাক বললেন, “দেখ, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি; কবে যে মারা যাই তা বলতে পারি না। তুমি এক কাজ কর; তোমার অস্ত্র, অর্থাৎ তীর-ধনুক নিয়ে শিকার করবার জন্য মাঠে যাও আর আমার জন্য কিছু শিকার করে আন। তারপর আমার পছন্দমত ভাল খাবার তৈরী করে আমার কাছে নিয়ে এস, যাতে তা খেয়ে মারা যাবার আগে আমি তোমাকে দোয়া করে যেতে পারি।” ইসহাক যখন তাঁর আদরের ছেলে ইসের সংগে কথা বলছিলেন তখন রেবেকা তা শুনছিলেন। তাই ইস্‌ যখন শিকার করতে গেলেন, তখন রেবেকাও তাঁর আদরের ছেলে ইয়াকুবকে বললেন, “দেখ, আমি শুনলাম, তোমার বাবা তোমার ভাই ইস্‌কে বলেছেন, ‘তুমি আমার জন্য কিছু শিকার করে এনে ভাল খাবার তৈরী কর। তা খেয়ে আমি মারা যাবার আগে মাবুদকে সাক্ষী রেখে তোমাকে দোয়া করে যেতে চাই।’ তাই বাবা, আমি তোমাকে এখন যা করতে বলি তুমি ঠিক তা-ই কর। তুমি এখনই গিয়ে ছাগলের পাল থেকে দু’টা মোটাসোটা বাচ্চা এনে আমাকে দাও। আমি তা দিয়ে তোমার বাবার পছন্দমত ভাল খাবার তৈরী করে দেব। পরে তুমি তা তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবে যেন তা খেয়ে তিনি মারা যাবার আগে তোমাকে দোয়া করেন।” তখন ইয়াকুব তাঁর মাকে বললেন, “কিন্তু আমার ভাই ইসের শরীর তো লোমে ভরা, আর আমার গায়ে লোম নেই। বাবা হয়তো আমার গায়ে হাত বুলাবেন আর ভাববেন আমি তাঁর সংগে ঠাট্টা করছি। ফলে দোয়ার বদলে আমি নিজের উপর বদদোয়াই ডেকে আনব।” কিন্তু তাঁর মা তাঁকে বললেন, “বাবা, তোমার সেই বদদোয়া আমার উপরে পড়ুক। তুমি কেবল আমার কথা শোন আর গিয়ে দু’টা ছাগলের বাচ্চা আমাকে এনে দাও।” কাজেই ইয়াকুব গিয়ে ছাগলের বাচ্চা এনে তাঁর মাকে দিলেন, আর রেবেকা ইয়াকুবের পিতার পছন্দমত ভাল খাবার তৈরী করলেন। তারপর তিনি তাঁর বড় ছেলের সবচেয়ে ভাল জামা-কাপড় নিয়ে তাঁর ছোট ছেলেকে পরিয়ে দিলেন; কাপড়গুলো ঘরেই ছিল। ইয়াকুবের হাতে ও গলায় যেখানে লোম ছিল না সেখানে তিনি ছাগলের বাচ্চার চামড়া জড়িয়ে দিলেন। তারপর নিজের তৈরী সেই ভাল খাবার ও রুটি ইয়াকুবের হাতে তুলে দিলেন। ইয়াকুব তাঁর পিতার কাছে গিয়ে ডাকলেন, “বাবা।” জবাবে ইসহাক বললেন, “এই যে আমি। তুমি কে, বাবা?” ইয়াকুব তাঁর পিতাকে বললেন, “আমি তোমার বড় ছেলে ইস্‌। তুমি আমাকে যা করতে বলেছিলে আমি তা করেছি। এখন তুমি উঠে বস আর আমার শিকার করে আনা গোশ্‌ত খাও যাতে তুমি আমাকে দোয়া করতে পার।” জবাবে ইসহাক তাঁর ছেলেকে বললেন, “বাবা, তুমি কি করে এত তাড়াতাড়ি শিকার পেয়ে গেলে?” জবাবে ইয়াকুব বললেন, “পেলাম তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র পরিচালনায়।” তখন ইসহাক ইয়াকুবকে বললেন, “আমার কাছে এস বাবা, যাতে তোমার গায়ে হাত দিয়ে আমি বুঝতে পারি তুমি সত্যিই আমার ছেলে ইস্‌ কিনা।” ইয়াকুব তাঁর পিতা ইসহাকের আরও কাছে গেলেন। ইসহাক তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখে বললেন, “গলার স্বরটা ইয়াকুবের বটে, কিন্তু হাত দু’টা তো ইসের।” ইয়াকুবের হাত তাঁর ভাই ইসের মতই লোমে ভরা ছিল বলে ইসহাক তাঁকে চিনতে পারলেন না। যাহোক, তিনি তাঁকে দোয়া করবার জন্য তৈরী হলেন। তবুও তিনি তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি সত্যিই আমার ছেলে ইস্‌?” ইয়াকুব বললেন, “জ্বী, বাবা।” ইসহাক বললেন, “তাহলে তোমার শিকার-করা গোশ্‌তের কিছুটা আমার কাছে নিয়ে এস, যাতে আমি তা খেয়ে তোমাকে দোয়া করে যেতে পারি।” তখন ইয়াকুব ইসহাকের কাছে খাবার নিয়ে গেলেন, আর ইসহাক তা থেকে খেলেন। এর পর ইয়াকুব তাঁকে আংগুর-রস দিলেন আর ইসহাক তা খেলেন। তারপর তাঁর পিতা ইসহাক তাঁকে বললেন, “বাবা, কাছে এসে তুমি আমাকে চুম্বন কর।” তখন ইয়াকুব কাছে গিয়ে তাঁকে চুম্বন করলেন, আর ইসহাক তাঁর গায়ের কাপড়ের গন্ধ পেয়ে তাঁকে এই বলে দোয়া করলেন: “এই তো আমার ছেলের গন্ধ, মাবুদের দোয়া-করা জমির মতই এই গন্ধ। আল্লাহ্‌ যেন তোমাকে আকাশের শিশির দেন, আর তোমার জমিতে উর্বরতা দেন; তাতে তুমি প্রচুর ফসল আর নতুন আংগুর-রস পাবে। বিভিন্ন জাতি তোমার সেবা করুক, আর সব লোক তোমাকে মাটিতে উবুড় হয়ে সম্মান দিক। তোমার গোষ্ঠীর লোকদের তুমি প্রভু হও, তারা তোমাকে মাটিতে উবুড় হয়ে সম্মান দিক। যারা তোমাকে বদদোয়া দেবে তাদের উপর বদদোয়া পড়ুক; যারা তোমাকে দোয়া করবে তাদের উপরে দোয়া নেমে আসুক।” ইসহাক ইয়াকুবকে দোয়া করা শেষ করলেন। ইয়াকুব তাঁর পিতা ইসহাকের সামনে থেকে যেতে না যেতেই তাঁর ভাই ইস্‌ শিকার করে ঘরে ফিরে আসলেন। তিনিও ভাল খাবার তৈরী করে তাঁর পিতার কাছে এনে বললেন, “আব্বা, উঠে বসে তোমার ছেলের শিকার করে আনা গোশ্‌ত খেয়ে আমাকে দোয়া কর।” তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, “তুমি কে?” ইস্‌ বললেন, “আমি তোমার বড় ছেলে ইস্‌।” এই কথা শুনে ইসহাকের গায়ে ভীষণ কাঁপুনি ধরে গেল। তিনি বললেন, “তবে যে আমার কাছে শিকারের গোশ্‌ত নিয়ে এসেছিল সে কে? তুমি আসবার আগেই আমি তা খেয়েছি এবং তাকে দোয়াও করেছি, আর সেই দোয়ার ফল সে পাবেই।” ইস্‌ তাঁর পিতার কথা শুনে এক বুক-ফাটা কান্নায় ভেংগে পড়লেন। তারপর তিনি তাঁর পিতাকে বললেন, “আব্বা, আমাকে, আমাকেও দোয়া কর।” ইসহাক বললেন, “তোমার ভাই এসে ছলনা করে তোমার পাওনা দোয়া নিয়ে গেছে।” ইস্‌ বললেন, “তার এই ইয়াকুব নামটা দেওয়া ঠিকই হয়েছে, কারণ এই নিয়ে দু’বার সে আমাকে আমার জায়গা থেকে সরিয়ে দিল। বড় ছেলে হিসাবে আমার যে অধিকার তা সে আগেই নিয়ে নিয়েছে আর এবার আমার দোয়াও নিয়ে গেল।” ইস্‌ আরও বললেন, “আমার জন্য কি কোন দোয়াই রাখ নি?” জবাবে ইসহাক বললেন, “দেখ, আমি তাকে তোমার প্রভু করেছি এবং তার গোষ্ঠীর সবাইকে তার গোলাম করেছি। আমি তার জন্য ফসল ও নতুন আংগুর-রসের ব্যবস্থা করেছি। এর পর বাবা, আমি তোমার জন্য আর কি করতে পারি?” তখন ইস্‌ তাঁর পিতাকে কাকুতি-মিনতি করে বললেন, “আব্বা, তোমার কাছে কি ঐ একটা দোয়াই ছিল? আব্বা, তুমি আমাকে, আমাকেও দোয়া কর।” এই বলে ইস্‌ গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন তাঁর পিতা বললেন, “যে জমিতে তুমি বাস করবে সেই জমি উর্বর হবে না; সেখানে আকাশের শিশিরও পড়বে না। তলোয়ারই হবে তোমার জীবন, তুমি তোমার ভাইয়ের গোলাম হয়ে থাকবে। কিন্তু যখন তুমি অধৈর্য হয়ে উঠবে তখন তুমি তোমার ঘাড় থেকে তার জোয়াল ঠেলে ফেলে দেবে।” ইয়াকুব তাঁর পিতার কাছ থেকে দোয়া লাভ করেছিলেন বলে ইস্‌ তাঁকে হিংসা করতে লাগলেন। তিনি মনে মনে বললেন, “আমার বাবার জন্য শোক করবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তার পরেই আমি আমার ভাই ইয়াকুবকে খুন করব।” রেবেকা তাঁর বড় ছেলে ইসের এই সব কথা জানতে পেরে লোক পাঠিয়ে ছোট ছেলে ইয়াকুবকে ডেকে এনে বললেন, “শোন, তোমার ভাই ইস্‌ তোমাকে হত্যা করবার আশায় নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিছু দিন পরে যখন তার রাগ পড়ে যাবে এবং সে ভুলে যাবে তুমি তার বিরুদ্ধে কি করেছ, তখন আমি লোক পাঠিয়ে তোমাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনব। কেন আমি একই দিনে তোমাদের দু’জনকে হারাব?” পরে রেবেকা ইসহাককে বললেন, “এই হিট্টীয় মেয়েগুলোর জন্য আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না। এর উপর ইয়াকুবও যদি এই দেশের কোন হিট্টীয় মেয়েকে বিয়ে করে তবে আমার বেঁচে থেকে কি লাভ?” রেবেকার কথা শুনে ইসহাক ইয়াকুবকে ডেকে দোয়া করলেন এবং তাঁকে এই হুকুম দিলেন, “তুমি কেনান দেশের কোন মেয়েকে বিয়ে কোরো না। তুমি পদ্দন-ইরাম দেশে তোমার নানা বথূয়েলের বাড়ীতে যাও। সেখানে থাকবার সময় তোমার মামা লাবনের কোন মেয়েকে তুমি বিয়ে কোরো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ তোমাকে দোয়া করুন আর তোমাকে অনেক সন্তানের পিতা হবার ক্ষমতা দিন। তিনি তোমার বংশের লোকদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলুন। তাতে তারা হবে একটা বহু গোষ্ঠীর জাতি। যে দোয়া তিনি ইব্রাহিমকে দান করেছিলেন সেই দোয়াই তিনি তোমাকে এবং তোমার পরে তোমার বংশের লোকদের দান করুন। যে দেশ আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে দিয়েছিলেন, যেখানে তুমি এখন বিদেশী হিসাবে আছ, সেই দেশটা যেন তোমার অধিকারে আসে।” এই বলে ইসহাক ইয়াকুবকে পাঠিয়ে দিলেন, আর ইয়াকুবও পদ্দন-ইরামে সিরীয় বথূয়েলের ছেলে লাবনের কাছে গেলেন। লাবন ছিলেন ইয়াকুব ও ইসের মা রেবেকার ভাই। পরে ইস্‌ শুনলেন যে, ইসহাক ইয়াকুবকে দোয়া করে পদ্দন-ইরামের কোন মেয়েকে বিয়ে করবার জন্য সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও শুনলেন, ইসহাক ইয়াকুবকে দোয়া করবার সময় হুকুম দিয়ে বলেছিলেন যেন সে কোন কেনানীয় মেয়েকে বিয়ে না করে। ইস্‌ দেখলেন, ইয়াকুব তাঁর পিতা-মাতার কথামত পদ্দন-ইরামে চলে গেছেন। এতে ইস্‌ বুঝলেন যে, তাঁর পিতা ইসহাক কেনানীয় স্ত্রীলোকদের উপর খুশী নন। তাই দু’টি স্ত্রী থাকলেও তিনি ইব্রাহিমের ছেলে ইসমাইলের বাড়ীতে গিয়ে তাঁর মেয়ে মহলত্‌কে বিয়ে করলেন। মহলৎ ছিল নাবায়ুতের বোন। এদিকে ইয়াকুব বের্‌-শেবা ছেড়ে হারণ শহরের দিকে যাত্রা করলেন। পথে এক জায়গায় বেলা ডুবে গেলে পর তিনি সেখানেই রাতটা কাটালেন। সেখানে কতগুলো পাথর পড়ে ছিল। ইয়াকুব সেগুলোর একটা মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন মাটির উপরে একটা সিঁড়ি দাঁড়িয়ে আছে এবং তার মাথাটা গিয়ে বেহেশতে ঠেকেছে। তিনি দেখলেন আল্লাহ্‌র ফেরেশতারা তার উপর দিয়ে ওঠা-নামা করছেন, আর মাবুদ তার উপরে দাঁড়িয়ে বলছেন, “আমি মাবুদ। আমি তোমার পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌ এবং ইসহাকেরও আল্লাহ্‌। তুমি যেখানে শুয়ে আছ সেই দেশ আমি তোমাকে এবং তোমার বংশের লোকদের দেব। তোমার বংশের লোকেরা দুনিয়ার ধূলিকণার মত অসংখ্য হবে। পূর্ব-পশ্চিমে এবং উত্তর-দক্ষিণে তোমার বংশ ছড়িয়ে পড়বে। দুনিয়ার সমস্ত জাতি তোমার ও তোমার বংশের মধ্য দিয়ে দোয়া পাবে। আমি তোমার সংগে সংগে আছি; তুমি যেখানেই যাও না কেন আমি তোমাকে রক্ষা করব। এই দেশেই আবার আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনব। আমি তোমাকে যা বলেছি তা পূর্ণ না করা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।” পরে ইয়াকুব ঘুম থেকে উঠে বললেন, “তাহলে মাবুদ নিশ্চয়ই এই জায়গায় আছেন অথচ আমি তা বুঝতে পারি নি।” এই কথা ভেবে তাঁর মনে ভয় হল। তিনি বললেন, “কি ভয়ংকর এই জায়গা! এটা আল্লাহ্‌র থাকবার জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়; বেহেশতের দরজা এখানেই।” ইয়াকুব খুব ভোরে উঠলেন এবং যে পাথরটা তিনি মাথার নীচে দিয়েছিলেন সেটা থামের মত করে দাঁড় করিয়ে তার উপরে তেল ঢেলে দিলেন। তিনি জায়গাটার নাম দিলেন বেথেল (যার মানে “আল্লাহ্‌র ঘর”)। এই জায়গাটার কাছের শহরটার আগের নাম ছিল লূস। এর পর ইয়াকুব কসম খেয়ে বললেন, “যদি আল্লাহ্‌ আমার এই যাত্রাপথে আমাকে রক্ষা করেন, যদি তিনি আমাকে খোরাক-পোশাক যুগিয়ে দেন, যদি আমি আবার আমার পিতার বাড়ীতে সহিসালামতে ফিরে আসতে পারি, তবে এই মাবুদকেই আমি আমার আল্লাহ্‌ বলে মানব। এই যে পাথর আমি এখানে থামের মত করে দাঁড় করিয়ে রাখলাম এখানেই হবে আল্লাহ্‌র ঘর। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে যা কিছু দেবে তার দশ ভাগের এক ভাগ নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব।” পরে ইয়াকুব চলতে চলতে পূর্বদেশীয় লোকদের জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে চারদিকে তাকিয়ে তিনি মাঠের মধ্যে একটা কূয়া দেখতে পেলেন। সেই কূয়ার পাশে ভেড়ার তিনটা পাল শুয়ে ছিল। রাখালেরা সেখান থেকেই তাদের পানি খাওয়াত। কূয়াটার মুখে খুব বড় একটা পাথর বসানো ছিল। যখন সমস্ত ভেড়ার পাল জড়ো হত তখন রাখালেরা কূয়ার মুখ থেকে পাথরটা সরিয়ে দিয়ে ভেড়াগুলোকে পানি খাওয়াত। তারপর পাথরটা আবার কূয়ার মুখে বসিয়ে রাখত। ইয়াকুব রাখালদের জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাইয়েরা, আপনারা কোথাকার লোক?” তারা বলল, “হারণ শহরের।” ইয়াকুব তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কি নাহুরের নাতি লাবনকে চেনেন?” তারা বলল, “জ্বী, চিনি।” ইয়াকুব তাদের বললেন, “তিনি কি ভাল আছেন?” তারা বলল, “জ্বী, তিনি ভালই আছেন। ঐ তো তাঁর মেয়ে রাহেলা ভেড়ার পাল নিয়ে আসছে।” ইয়াকুব বললেন, “দেখুন, বেলা পড়তে এখনও অনেক দেরি আছে। সব পশু এক জায়গায় জড়ো হওয়ার সময় এখনও হয় নি। আপনারা বরং আপনাদের ভেড়াগুলোকে পানি খাইয়ে আবার চরাতে নিয়ে যান।” কিন্তু তারা বলল, “না, আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সব পশুর পাল একসংগে জড়ো হলে পর কূয়ার মুখ থেকে পাথরটা সরানো হবে, আর তখন আমরা ভেড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে পারব।” ইয়াকুব তখনও সেই লোকদের সংগে কথা বলছেন এমন সময় রাহেলা তাঁর পিতার ভেড়াগুলো নিয়ে সেখানে আসলেন, কারণ তিনি সেই পাল চরাতেন। ইয়াকুব তাঁর মামা লাবনের মেয়ে ও তাঁর ভেড়ার পাল দেখে কূয়ার কাছে গেলেন এবং কূয়ার মুখ থেকে পাথরটা সরিয়ে দিয়ে ভেড়াগুলোকে পানি খাওয়ালেন। তারপর তিনি রাহেলাকে চুম্বন করে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। তিনি রাহেলাকে জানালেন যে, তিনি তাঁর পিতার আত্মীয়, রেবেকার ছেলে। এই কথা শুনে রাহেলা দৌড়ে গিয়ে তাঁর পিতাকে সেই খবর দিলেন। লাবন তাঁর বোনের ছেলে ইয়াকুবের আসবার খবর পেয়ে দৌড়ে তাঁর সংগে দেখা করতে গেলেন। তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন এবং তাঁকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। তখন ইয়াকুব লাবনকে তাঁর আসবার সব কথা জানালেন। লাবন তাঁকে বললেন, “সত্যিই আমাদের শরীরে একই রক্ত বইছে।” এর পর ইয়াকুব লাবনের বাড়ীতে এক মাস কাটালেন। একদিন লাবন বললেন, “তুমি আমার আত্মীয় বলেই কি বিনা বেতনে আমার কাজ করবে? তোমাকে কি দিতে হবে আমাকে বল।” লাবনের দু’টি মেয়ে ছিল। বড়টির নাম লেয়া আর ছোটটির নাম রাহেলা। লেয়ার থাকবার মধ্যে ছিল শুধু দু’টি সুন্দর চোখ, কিন্তু রাহেলার শরীরের গড়ন ও চেহারা সবই ছিল সুন্দর। ইয়াকুব রাহেলাকে ভালবাসতেন বলে তিনি বললেন, “আপনার ছোট মেয়ে রাহেলার জন্য সাত বছর আমি আপনার কাজ করব।” লাবন বললেন, “রাহেলাকে অন্য কোন লোকের হাতে দেবার চেয়ে তোমার হাতে দেওয়াই ভাল। তুমি আমার কাছেই থাক।” এর পর ইয়াকুব রাহেলার জন্য সাত বছর কাজ করলেন। ইয়াকুব রাহেলাকে ভালবাসতেন বলে সেই বছরগুলো তাঁর কাছে মাত্র কয়েক দিন বলে মনে হল। তারপর ইয়াকুব লাবনকে বললেন, “আমার কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যাঁর জন্য আমি কাজ করেছি এবার তাঁকে আমার হাতে তুলে দিন যেন তাঁকে নিয়ে আমি বাস করতে পারি।” তখন লাবন সেই এলাকার সব লোকদের ডেকে একটা মেজবানী দিলেন। পরে রাত হলে তিনি তাঁর মেয়ে লেয়াকে ইয়াকুবের কাছে দিয়ে আসলেন, আর ইয়াকুবও তাঁর সংগে থাকলেন। লাবন তাঁর বাঁদী সিল্পাকেও লেয়ার বাঁদী হিসাবে দিয়েছিলেন। সকাল হলে পর ইয়াকুব আশ্চর্য হয়ে দেখলেন যে, তিনি লেয়া। সেইজন্য তিনি লাবনকে বললেন, “আপনি আমার সংগে এ কি রকম ব্যবহার করলেন? এতদিন কি আমি রাহেলার জন্যই আপনার কাজ করি নি? তবে কেন আপনি আমাকে ঠকালেন?” লাবন বললেন, “বড় মেয়ের আগে ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া আমাদের দেশের নিয়ম নয়। তুমি এই বিয়ের উৎসব-সপ্তাটা পার হতে দাও। তারপর অন্য মেয়েটিকেও তোমাকে দেওয়া হবে। তবে তার জন্য তোমাকে আরও সাত বছর আমার কাজ করতে হবে।” ইয়াকুব তাঁর কথা মেনে নিয়ে সেই উৎসব-সপ্তাটা শেষ করলেন। তারপর লাবন তাঁর মেয়ে রাহেলাকেও ইয়াকুবের সংগে বিয়ে দিলেন, আর তাঁর বাঁদী বিল্‌হাকে রাহেলার বাঁদী হিসাবে দিলেন। ইয়াকুব রাহেলার সংগেও থাকলেন। তিনি লেয়ার চেয়ে রাহেলাকে বেশী ভালবাসতেন। এর পর তিনি আরও সাত বছর লাবনের অধীনে কাজ করলেন। লেয়াকে অবহেলা করা হচ্ছে দেখে মাবুদ তাঁকে গর্ভধারণ করবার ক্ষমতা দিলেন, কিন্তু রাহেলা বন্ধ্যা হয়ে রইলেন। লেয়া গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর একটি ছেলে হল। তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন রূবেণ (যার মানে “ঐ দেখ, একটি ছেলে”), কারণ তিনি বলেছিলেন, “মাবুদ আমার দুঃখ দেখেছেন, তাই এখন থেকে আমার স্বামী নিশ্চয়ই আমাকে ভালবাসবেন।” এর পর লেয়া আবার গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর আর একটি ছেলে হল। তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন শিমিয়োন (যার মানে “তিনি শোনেন”), কারণ তিনি বলেছিলেন, “আমাকে অবহেলা করবার কথা মাবুদের কানে গিয়ে পৌঁছেছে, সেইজন্য তিনি আমাকে এই ছেলেটিও দিলেন।” তার পরে তিনি আবার গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর আর একটি ছেলে হল। তিনি বললেন, “এইবার আমার স্বামী আমার সংগে যুক্ত হবেন, কারণ আমি তাঁর তিনটি ছেলে গর্ভে ধারণ করেছি।” এই বলে তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন লেবি (যার মানে “যুক্ত”)। পরে তিনি আবার গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর আর একটি ছেলে হল। তিনি বললেন, “এইবার আমি মাবুদের প্রশংসা করব।” তাই তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন এহুদা (যার মানে “প্রশংসা”)। তারপর কিছুকালের জন্য তাঁর আর কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। রাহেলা যখন দেখলেন তিনি ইয়াকুবের কোন সন্তানের মা হতে পারছেন না তখন তাঁর বোনের প্রতি তাঁর মনে হিংসা জাগল। তিনি ইয়াকুবকে বললেন, “আমাকে সন্তান দাও, তা না হলে আমি মরব।” তখন রাহেলার উপর ইয়াকুবের খুব রাগ হল। তিনি বললেন, “আমি আল্লাহ্‌ নাকি? তিনিই তো তোমাকে বন্ধ্যা করেছেন।” রাহেলা বললেন, “আমার বাঁদী বিল্‌হাকে নাও। তুমি তার কাছে যাও যাতে তার মধ্য দিয়ে আমি সন্তান কোলে পাই, আর এইভাবে আমিও একটা পরিবার গড়ে তুলতে পারি।” এই বলে রাহেলা তাঁর বাঁদী বিল্‌হার সংগে ইয়াকুবের বিয়ে দিলেন, আর ইয়াকুবও তার কাছে গেলেন। এতে বিল্‌হা গর্ভবতী হল এবং তার একটি ছেলে হল। তখন রাহেলা বললেন, “আল্লাহ্‌ আমার প্রতি সুবিচার করেছেন এবং আমার ফরিয়াদ শুনে আমাকে একটি ছেলে দিয়েছেন।” এইজন্য তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন দান (যার মানে “সুবিচার”)। পরে রাহেলার বাঁদী বিল্‌হা আবার গর্ভবতী হল, আর এই নিয়ে দুইবার সে ইয়াকুবের ছেলের মা হল। তখন রাহেলা বললেন, “আল্লাহ্‌কে আমার পক্ষে রেখে আমি আমার বোনের সংগে পাল্লা দিয়েছি আর তাতে আমি জয়ী হয়েছি।” তাই তিনি ছেলেটির নাম দিলেন নপ্তালি (যার মানে “আমার পাল্লা”)। এদিকে লেয়া যখন দেখলেন তাঁর নিজের আর সন্তান হচ্ছে না তখন তিনি তাঁর বাঁদী সিল্পার সংগে ইয়াকুবের বিয়ে দিলেন। তাতে লেয়ার বাঁদী সিল্পার গর্ভে ইয়াকুবের একটি ছেলে হল। তখন লেয়া বললেন, “কি সৌভাগ্য আমার!” এই বলে তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন গাদ (যার মানে “সৌভাগ্য”)। পরে সিল্পা আর একবার ইয়াকুবের ছেলের মা হল। তখন লেয়া বললেন, “কি সুখ আমার! স্ত্রীলোকেরা সবাই আমাকে সুখী বলবে।” তাই তিনি ছেলেটির নাম দিলেন আশের (যার মানে “সুখী”)। গম কাটবার সময় রূবেণ মাঠে গিয়ে কতগুলো দূদাফল পেল এবং সেগুলো এনে তার মা লেয়াকে দিল। তখন রাহেলা লেয়াকে বললেন, “তোমার ছেলে যে দূদাফল এনেছে তা থেকে আমাকে কয়েকটা দাও।” কিন্তু লেয়া তাঁকে বললেন, “তুমি আমার স্বামীকে দখল করে নিয়েছ, সেটা কি যথেষ্ট হয় নি? আবার তুমি আমার ছেলের আনা দূদাফলও নিতে চাও?” জবাবে রাহেলা বললেন, “তাহলে তোমার ছেলের আনা দূদাফলের বদলে আজ রাতে তিনি তোমার সংগে থাকবেন।” সন্ধ্যাবেলা ইয়াকুবকে মাঠ থেকে ফিরে আসতে দেখেই লেয়া বের হয়ে এসে তাঁকে বললেন, “আজ তুমি আমার সংগে থাকবে, কারণ আমার ছেলের আনা দূদাফল দিয়ে আমি তোমাকে কিনে নিয়েছি।” কাজেই সেই রাতে ইয়াকুব লেয়ার ঘরে শুতে গেলেন। আল্লাহ্‌ লেয়ার মুনাজাত শুনলেন আর তিনি গর্ভবতী হয়ে পঞ্চমবারের মত ইয়াকুবের ছেলের মা হলেন। তখন লেয়া বললেন, “আমি আমার স্বামীর হাতে আমার বাঁদীকে দিয়েছিলাম বলে আল্লাহ্‌ আমাকে তার পুরস্কার দিলেন।” সেইজন্য তিনি ছেলেটির নাম দিলেন ইষাখর (যার মানে “পুরস্কার”)। এর পর লেয়া আবার গর্ভবতী হয়ে ষষ্ঠবার ইয়াকুবের ছেলের মা হলেন। তখন লেয়া বললেন, “আল্লাহ্‌ আমাকে খুব ভাল একটা উপহার দিলেন। এখন থেকে আমার স্বামী আমাকে আমার পাওনা সম্মান দেবেন, কারণ আমার গর্ভে তাঁর ছয়টি ছেলের জন্ম হয়েছে।” এই বলে তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন সবূলূন (যার মানে “সম্মান”)। তারপর লেয়ার একটি মেয়ে হল। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন দীণা। এর পরে আল্লাহ্‌ রাহেলার দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি রাহেলার মুনাজাতের জবাবে তাঁকে গর্ভধারণের ক্ষমতা দান করলেন। এতে রাহেলা গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর একটি ছেলে হল। তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌ আমার অসম্মান দূর করেছেন।” তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন ইউসুফ (যার মানে “তিনি যেন আরও দেন”), কারণ তিনি বলেছিলেন, “মাবুদ আমাকে আরও একটি ছেলে দান করুন।” রাহেলার গর্ভে ইউসুফের জন্ম হলে পর ইয়াকুব লাবনকে বললেন, “এবার আমাকে বিদায় দিন যাতে আমি নিজের দেশে এবং নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে পারি। আমার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদের জন্যই আমি আপনার কাজ করেছি। এবার তাদের নিয়ে আমাকে চলে যেতে দিন। আপনি তো নিজেই জানেন কিভাবে আমি আপনার কাজ করেছি।” কিন্তু লাবন তাঁকে বললেন, “যদি আমার উপর তোমার অসন্তুষ্ট হবার কোন কারণ না থাকে তবে যেয়ো না। নানা রকম লক্ষণ থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমার জন্যই মাবুদ আমাকে দোয়া করেছেন।” তিনি আরও বললেন, “তোমার নিজের বেতন তুমি নিজেই স্থির কর। আমি তা-ই তোমাকে দেব।” কিন্তু ইয়াকুব তাঁকে বললেন, “আমি কিভাবে আপনার কাজ করেছি এবং আমার হাতে আপনার পশুপালের অবস্থা কি হয়েছে, তা আপনি নিজেই জানেন। আমি আসবার আগে আপনার পশুধন বেশী ছিল না, কিন্তু এখন তা বেড়ে গিয়ে অনেক বেশী হয়েছে। আমি যেখানেই পা ফেলেছি সেখানেই মাবুদ আপনাকে দোয়া করেছেন। কিন্তু এখন আমার নিজের পরিবারের কথা ভাববার সময় হয়েছে।” তখন লাবন বললেন, “তোমাকে আমার কি দিতে হবে?” ইয়াকুব বললেন, “আমাকে আপনার কিছুই দিতে হবে না। তবে আপনি যদি আমার একটা কথা রাখেন তাহলে আমি আবার আপনার পশুর পাল চরাব ও তাদের যত্ন করব। আমি আজই আপনার সমস্ত পশুপালের মধ্যে গিয়ে সেখান থেকে ছোট ছোট এবং বড় বড় ছাপের ভেড়া ও ছাগল আর ভেড়ার কালো বাচ্চাগুলো আলাদা করে রাখতে চাই। সেগুলোই হবে আমার বেতন। ভবিষ্যতে যখনই আপনি আমার বেতনের কথা ভাববেন তখন এগুলো থেকেই প্রমাণ হবে যে, আমি কোন অন্যায় করি নি। ছোট ছোট এবং বড় বড় ছাপ নেই এমন কোন ছাগল আর কালো নয় এমন কোন ভেড়ার বাচ্চা যদি আমার পশুপালের মধ্যে পাওয়া যায় তবে সেগুলো চুরির মাল বলে ধরে নেওয়া হবে।” লাবন বললেন, “খুব ভাল কথা। তুমি যা বলেছ তা-ই হোক।” লাবন কিন্তু সেই দিনই তাঁর পশুপাল থেকে ইয়াকুবের পাওনা ডোরাকাটা ও বড় বড় ছাপের সব ছাগল এবং ছোট ছোট ও বড় বড় ছাপের সব ছাগী, অর্থাৎ যাদের গায়ে জায়গায় জায়গায় সাদা লোম ছিল সেগুলো আর ভেড়ার কালো বাচ্চাগুলো সরিয়ে রাখলেন। এগুলোর দেখাশোনার ভার তিনি তাঁর ছেলেদের হাতে দিলেন। তারপর তিনি ইয়াকুবের কাছ থেকে তিন দিনের পথ দূরে সরে গেলেন, আর ইয়াকুব লাবনের বাকী পশুগুলোর দেখাশোনা করতে লাগলেন। পরে ইয়াকুব লিব্‌নী, লূস ও আর্মোণ গাছের কাঁচা ডাল নিয়ে তার উপর থেকে রেখার মত করে ছাল ছাড়িয়ে নিলেন। তাতে মধ্যে মধ্যে তার নীচের সাদা কাঠ দেখা যেতে লাগল। পশুর পাল যখন পানি খেতে আসত তখন তিনি সেই ডালগুলো নিয়ে তাদের সামনে পানির গামলাগুলোর মধ্যে রাখতেন। এখানেই তারা পানি খাবার জন্য জড়ো হত এবং মিলিত হত। এইভাবে সেই ডালগুলোর সামনে মিলিত হবার পর তাদের যে সব বাচ্চা হত সেগুলো হত ডোরাকাটা না হয় বড় বড় কিংবা ছোট ছোট ছাপের। ইয়াকুব বাচ্চা-ছাগল ও বাচ্চা-ভেড়াগুলোকে আলাদা করতেন, আর বাচ্চা-ছাগী ও বাচ্চা-ভেড়ীগুলো নিয়ে লাবনের ডোরাকাটা এবং কালো রংয়ের ছাগল-ভেড়ার পালের মধ্যে রাখতেন। এইভাবে তিনি তাঁর নিজের জন্য আলাদা একটা পশুপাল গড়ে তুললেন আর সেটাকে তিনি লাবনের পশুপালের সংগে মেশাতেন না। এছাড়া বেশী শক্তিশালী পশুগুলো মিলিত হওয়ার সময় তিনি তাদের পানির গামলার মধ্যে তাদের চোখের সামনে ঐ ডালগুলো রাখতেন যাতে সেই ডালগুলোর সামনেই তারা মিলিত হয়। কিন্তু তিনি দুর্বল ভেড়া বা ছাগলগুলোর সামনে সেই ডালগুলো রাখতেন না। তাতে লাবনের পশুগুলো হত দুর্বল আর ইয়াকুবের পশুগুলো হত শক্তিশালী। ইয়াকুব এইভাবে খুব ধনী হয়ে উঠলেন। তাঁর পশুপাল, উট, গাধা এবং গোলাম ও বাঁদীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। ইয়াকুব শুনলেন লাবনের ছেলেরা এই সব কথা বলে বেড়াচ্ছে যে, ইয়াকুব তাদের পিতার সব কিছু নিয়ে নিয়েছে এবং তাদের পিতার সম্পত্তি দিয়েই সে তার এই সব সম্পত্তি করেছে। ইয়াকুব এ-ও লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর প্রতি লাবনের আগের সেই মনোভাব আর নেই। তখন মাবুদ ইয়াকুবকে বললেন, “তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের দেশে নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাও। আমি তোমার সংগে সংগে আছি।” তখন ইয়াকুব লোক পাঠিয়ে মাঠে যেখানে তাঁর পশুপাল ছিল সেখানে রাহেলা ও লেয়াকে ডেকে আনালেন। তারপর তিনি তাঁদের বললেন, “আমি লক্ষ্য করেছি আমার প্রতি তোমাদের বাবার আগের সেই মনোভাব আর নেই, কিন্তু আমার বাবার আল্লাহ্‌ আমার সংগে সংগে আছেন। তোমরা তো জান যে, আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়েই তোমাদের বাবার কাজ করেছি, অথচ তিনি আমাকে ঠকিয়েছেন এবং দশ-দশবার আমার বেতন বদল করেছেন। যাহোক, আল্লাহ্‌ তাঁকে আমার কোন ক্ষতি করতে দেন নি। যখন তোমাদের বাবা বলেছেন, ‘তোমার বেতন হবে এমন সব পশু যাদের গায়ে ছোট ছোট ছাপ আছে,’ তখন পালের সব পশুগুলোই সেই রকম বাচ্চা দিয়েছে। আবার যখন তিনি বলেছেন, ‘তোমার বেতন হবে ডোরাকাটা পশু,’ তখন পালের সব পশুগুলোই ডোরাকাটা বাচ্চা দিয়েছে। আল্লাহ্‌ এইভাবে তোমাদের বাবার পালের পশু নিয়ে আমাকে দিয়েছেন। “একবার পশুগুলো মিলিত হবার সময় আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। চারদিকে তাকিয়ে আমি যেন দেখলাম, ছাগীদের উপর যে সব ছাগলগুলো উঠছে সেগুলো ডোরাকাটা এবং বড় বড় ও ছোট ছোট ছাপের। স্বপ্নের মধ্যে আল্লাহ্‌র ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন, ‘ইয়াকুব।’ আমি বললাম, ‘এই যে আমি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি চোখ তুলে দেখ, ছাগীদের উপর যে সব ছাগলগুলো উঠছে সেগুলো ডোরাকাটা এবং বড় বড় ও ছোট ছোট ছাপের। লাবন তোমার প্রতি যা করেছে তা সবই আমি দেখেছি। আমি সেই বেথেলের আল্লাহ্‌ যেখানে তুমি থামের উপর তেল ঢেলে দিয়ে আমার কাছে কসম খেয়েছিলে। এখন এই দেশ ছেড়ে তোমার জন্মস্থানে ফিরে যাও।’ ” এই কথা শুনে রাহেলা ও লেয়া বললেন, “বাবার সম্পত্তির কোন অংশ আমাদের এখনও নেই আর পরেও থাকবে না। তিনি তো আমাদের বাইরের লোক বলেই মনে করেন, কারণ তিনি আমাদের বিক্রি করে দিয়েছেন এবং যা পেয়েছেন তা খেয়ে বসে আছেন। সেইজন্য আমাদের বাবার সম্পত্তি থেকে আল্লাহ্‌ যা নিয়েছেন সেগুলো নিশ্চয়ই এখন আমাদের এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের। কাজেই আল্লাহ্‌ তোমাকে যা বলেছেন তুমি এখন তা-ই কর।” এই সময় লাবন তাঁর ভেড়াগুলোর লোম কাটবার জন্য গিয়েছিলেন, আর এই সুযোগে রাহেলা তাঁর পিতার পারিবারিক দেবমূর্তিগুলো চুরি করে নিলেন। ইয়াকুব তাঁর যাওয়ার কথা সিরীয় লাবনকে না জানিয়ে তাঁর উপর একটা চালাকি খাটালেন। এইভাবে ইয়াকুব তাঁর নিজের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেলেন। তিনি ফোরাত নদী পার হয়ে গিলিয়দ এলাকার পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে যেতে লাগলেন। এর তিন দিনের দিন লাবন জানতে পারলেন যে, ইয়াকুব পালিয়েছেন। তখন তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ইয়াকুবের পিছনে ধাওয়া করে সাত দিনের পথ গেলেন, আর গিলিয়দের পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে তাঁর নাগাল পেলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ রাতের বেলা স্বপ্নে সিরীয় লাবনের কাছে এসে বললেন, “সাবধান! ইয়াকুবকে ভাল-মন্দ কিছুই বোলো না।” ইয়াকুব পাহাড়ের উপর তাম্বু ফেলেছিলেন, আর সেখানেই লাবন গিয়ে তাঁকে ধরলেন। লাবন ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরাও গিলিয়দের সেই একই পাহাড়ে তাঁদের তাম্বু ফেললেন। পরে লাবন ইয়াকুবকে বললেন, “তুমি এ কি করলে? কেন আমাকে ঠকালে আর আমার মেয়েদের যুদ্ধে বন্দীর মত করে নিয়ে আসলে? কেন তুমি চালাকি করে আমাকে না বলে গোপনে পালিয়ে আসলে? আমাকে বললে তো আমি আনন্দের সংগে, গান করে, খঞ্জনি ও বীণা বাজিয়ে তোমাকে বিদায় দিতাম। তুমি আমার মেয়েদের ও নাতি-নাত্‌নীদের চুম্বন করতেও আমাকে দিলে না; তুমি বোকার মত কাজ করেছ। তোমাদের ক্ষতি করবার ক্ষমতা যে আমার হাতে নেই, তা নয়। কিন্তু তোমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ গত রাতে আমাকে বলেছেন, ‘সাবধান! ইয়াকুবকে ভাল-মন্দ কিছুই বোলো না।’ বেশ, তোমার বাবার বাড়ী যাবার জন্যই না হয় তোমার প্রাণ কাঁদছিল আর তাই তুমি বেরিয়ে পড়েছ, কিন্তু আমার পারিবারিক দেবতাগুলো চুরি করে এনেছ কেন?” ইয়াকুব জবাবে তাঁকে বললেন, “আমার ভয় হয়েছিল, কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো জোর করে আপনার মেয়েদের আমার কাছ থেকে কেড়ে রেখে দেবেন। তাই আমি পালিয়ে এসেছি। আপনি যার কাছে আপনার ঐ দেবতাগুলো পাবেন তাকে হত্যা করা হবে। আমার সমস্ত জিনিসপত্রের মধ্যে যদি আপনার কোন কিছু থেকে থাকে তবে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সামনে তা তালাশ করে নিয়ে নিন।” সেই দেবমূর্তিগুলো যে রাহেলাই চুরি করে এনেছেন তা ইয়াকুব জানতেন না। তখন লাবন একে একে ইয়াকুব, লেয়া ও দুই বাঁদীর তাম্বুতে ঢুকলেন কিন্তু সেখানে তিনি সেগুলো পেলেন না। পরে তিনি লেয়ার তাম্বু থেকে বের হয়ে রাহেলার তাম্বুতে গিয়ে ঢুকলেন। রাহেলা কিন্তু সেই দেবমূর্তিগুলো নিয়ে উটের গদির নীচে রেখেছিলেন এবং সেই সময় তিনি সেই গদির উপরে বসে ছিলেন। লাবন তাঁর তাম্বুর সব জায়গায় হাত্‌ড়ে দেখলেন কিন্তু সেখানেও সেগুলো পেলেন না। শেষে রাহেলা তাঁর পিতাকে বললেন, “দেখুন, আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না বলে আপনি বিরক্ত হবেন না, কারণ এখন আমার মাসিকের সময়।” কাজেই লাবন তালাশ করেও সেই দেবমূর্তিগুলো পেলেন না। তখন ইয়াকুব রেগে গিয়ে ঝগড়ার সুরে লাবনকে বললেন, “আমার অপরাধ কোথায়, আর আমার অন্যায়ই বা কোথায় যে, আপনি এমনি করে আমার পিছনে তাড়া করে এসেছেন? আমার সমস্ত জিনিসপত্র হাত্‌ড়ে দেখে আপনার সংসারের কোন্‌ জিনিসটা পেলেন? পেয়ে থাকলে তা আমার ও আপনার আত্মীয়-স্বজনদের সামনে রাখুন যাতে তাঁরা আমাদের দুই পক্ষেরই বিচার করতে পারেন। আমি এই বিশ বছর আপনার সংগে কাটিয়েছি। এর মধ্যে আপনার কোন ভেড়ী বা ছাগীর গর্ভ নষ্ট হয় নি, কিংবা আপনার পালের কোন ভেড়াও আমি মেরে খাই নি। এমন কি, বুনো জন্তুর মেরে ফেলা কোন পশুও আমি আপনার কাছে নিয়ে যাই নি। সেই ক্ষতি আমি নিজেই বহন করেছি। কোন পশু চুরি হয়ে গেলে- তা দিনে হোক বা রাতে হোক- আপনি আমার কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ নিয়েছেন। আমি দিনে পুড়েছি গরমে আর রাতে কেঁপেছি ঠাণ্ডায়, আমার চোখে ঘুম ছিল না। এ-ই ছিল আমার অবস্থা। যে বিশ বছর আমি আপনার বাড়ীতে ছিলাম তার চৌদ্দ বছর আমি আপনার কাজ করেছি আপনার দুই মেয়ের জন্য, আর ছয় বছর কেটেছে আপনার পশুপালের পিছনে। এর মধ্যে আপনি দশ-দশবার আমার বেতন বদল করেছেন। আমার বাবার আল্লাহ্‌, যিনি ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌ এবং ইসহাকের ভয়ের পাত্র, তিনি যদি আমার সংগে না থাকতেন তবে নিশ্চয়ই আপনি এখন আমাকে খালি হাতেই বিদায় করতেন। আল্লাহ্‌ আমার কষ্ট ও কঠিন পরিশ্রম দেখেছেন। সেইজন্যই তিনি গত রাতে এর সুবিচার করেছেন।” এই কথার জবাবে লাবন ইয়াকুবকে বললেন, “এই মেয়েরা আমারই মেয়ে, এই ছেলেমেয়েরা আমারই নাতি-নাত্‌নী, আর এই সব পশুর পালও আমার। তুমি এখানে যা কিছু দেখছ তা সবই আমার; তবু আজকে আমার এই মেয়েদের বা তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে আমার করবার কিছু নেই। তার চেয়ে এস, আমরা দু’জনে একটা চুক্তি করি যা তোমার ও আমার মধ্যে সাক্ষী হয়ে থাকবে।” লাবন সেই ঢিবির নাম রাখলেন যিগর্‌-সাহদূথা (যার মানে “সাক্ষ্য-ঢিবি”), কিন্তু ইয়াকুব তাঁর নিজের ভাষায় তার নাম দিলেন গল্‌-এদ (যার মানেও “সাক্ষ্য-ঢিবি”)। লাবন বললেন, “এই ঢিবিটাই আজ তোমার ও আমার মধ্যে সাক্ষী হয়ে রইল।” এইজন্য এই ঢিবিটার নাম দেওয়া হয়েছিল গল্‌-এদ। তা ছাড়া এর আর একটা নাম দেওয়া হয়েছিল মিসপা (যার মানে “পাহারা-স্থান”), কারণ লাবন বলেছিলেন, “আমরা যখন আর একে অন্যকে দেখব না তখন মাবুদই যেন আমার ও তোমার উপর চোখ রাখেন। যদি তুমি আমার মেয়েদের সংগে খারাপ ব্যবহার কর, কিংবা আমার মেয়েরা থাকতেও অন্য স্ত্রী গ্রহণ কর, তবে আর কেউ আমাদের সংগে না থাকলেও মনে রেখো, আল্লাহ্‌ আমাদের সাক্ষী হয়ে রইলেন।” লাবন ইয়াকুবকে আরও বললেন, “এই ঢিবির দিকে চেয়ে দেখ, আর এই যে থামটা আমি আমার ও তোমার মধ্যে রেখেছি সেটার দিকেও চেয়ে দেখ। এই ঢিবি আর থাম দু’টাই এই কথার সাক্ষী হয়ে রইল যে, এই ঢিবি পার হয়ে আমি তোমার ক্ষতি করতে যাব না, আর তুমিও এই ঢিবি কিংবা থাম পার হয়ে আমার ক্ষতি করতে আসবে না। তা করলে ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌ এবং নাহুর ও তাঁদের বাবার দেবতারাই যেন আমাদের বিচার করেন।” ইয়াকুব কিন্তু তাঁরই নামে কসম খেলেন যিনি তাঁর পিতা ইসহাকের ভয়ের পাত্র ছিলেন। এর পর ইয়াকুব সেই পাহাড়ে পশু-কোরবানী দিলেন এবং তাঁর আত্মীয়দের খাওয়া-দাওয়া করতে ডাকলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর সেই পাহাড়ের উপরেই তাঁরা রাতটা কাটালেন। পরদিন খুব ভোরে উঠে লাবন তাঁর মেয়েদের ও নাতি-নাত্‌নীদের চুম্বন ও দোয়া করলেন। তারপর বিদায় নিয়ে তিনি তাঁর বাড়ীর দিকে ফিরে চললেন। ইয়াকুবও তাঁর পথে চললেন। পথে এক জায়গায় তিনি আল্লাহ্‌র ফেরেশতাদের দেখলেন। তাঁদের দেখে তিনি বললেন, “এটা আল্লাহ্‌র ছাউনি।” এইজন্য তিনি সেই জায়গার নাম রাখলেন মহনয়িম (যার মানে “দুই ছাউনি”)। ইয়াকুব তাঁর আগে আগে সেয়ীর, অর্থাৎ ইদোম দেশে তাঁর ভাই ইসের কাছে কয়েকজন লোক পাঠালেন। তিনি তাদের বলে দিলেন যেন তারা তাঁর প্রভু ইস্‌কে জানায় যে, তাঁর গোলাম ইয়াকুব বলছে, “আমি এই পর্যন্ত লাবনের কাছে ছিলাম। আমার গরু-গাধা, ছাগল-ভেড়া এবং গোলাম ও বাঁদী সবই আছে। আমার প্রভুর কাছে দয়া পাব এই আশা করেই আমি আগে থেকেই আপনাকে খবর দিচ্ছি।” লোকগুলো ফিরে এসে ইয়াকুবকে বলল, “আমরা আপনার ভাই ইসের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি এখন চারশো লোক নিয়ে আপনার সংগে দেখা করতে আসছেন।” এই কথা শুনে ভীষণ ভয়ে ইয়াকুবের মন অস্থির হয়ে উঠল। তিনি তাঁর সংগের লোকজন, ছাগল-ভেড়া, গরু-গাধা ও উট দুই দলে ভাগ করলেন। তিনি ভাবলেন, ইস্‌ যদি এসে এক দলকে হামলা করে তবে অন্য দলটি পালাতে পারবে। ইয়াকুব আল্লাহ্‌র কাছে এই বলে মুনাজাত করলেন, “হে মাবুদ, আমার পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, আমার বাবা ইসহাকের আল্লাহ্‌, তুমিই তো আমাকে বলেছ আমার দেশে, আমার নিজের লোকদের কাছে ফিরে যেতে, আর সেখানেই তুমি আমার মংগল করবে। তোমার এই গোলামকে তুমি যে সমস্ত রহমত ও বিশ্বস্ততা দেখিয়েছ আমি তার যোগ্য নই। কেবল একখানা লাঠি হাতে নিয়ে আমি এই জর্ডান নদী পার হয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমার সংগে রয়েছে দু’টা বড় দল। আমি মিনতি জানাই, আমার ভাই ইসের হাত থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমার ভয় হচ্ছে সে এসে আমাদের হত্যা করবে, মা-শিশু কাউকেই রেহাই দেবে না। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, ‘আমি নিশ্চয়ই তোমার উন্নতি করব এবং তোমার বংশের লোকদের সমুদ্র পারের বালুকণার মত করব যা গুণে শেষ করা যায় না।’ ” ইয়াকুব সেই রাতটা সেখানেই কাটালেন। তাঁর যা কিছু ছিল তার মধ্য থেকে তিনি তাঁর ভাই ইসের জন্য একটা উপহার ঠিক করে রাখলেন। সেগুলো বিভিন্ন দলে ভাগ করে গোলামদের হাতে দিয়ে তিনি তাদের বলে দিলেন, “প্রত্যেকটি দলের শেষে কিছু জায়গা রেখে তোমরা আমার আগে আগে যাও।” প্রথম দলের গোলামকে তিনি হুকুম দিয়ে বললেন, “আমার ভাই ইসের সংগে দেখা হলে তিনি যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কোথায় যাচ্ছ? তুমি কার লোক? তোমার সামনের ঐ পশুগুলোই বা কার?’ তখন তুমি বলবে, ‘এগুলো আপনার গোলাম ইয়াকুবের। তিনি আমার প্রভু ইসের জন্য এই উপহার পাঠিয়েছেন, আর তিনি আমাদের পিছনেই আছেন।’ ” এইভাবে তিনি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং অন্যান্য গোলাম যারা পশুর দল নিয়ে যাচ্ছিল তাদের প্রত্যেককেই হুকুম দিলেন, “ইসের সংগে দেখা হলে তোমরাও ঠিক এই কথাই বলবে। আর শেষে বলবে, ‘আপনার গোলাম ইয়াকুব আমাদের পিছনেই আছেন।’ ” ইয়াকুব মনে মনে এই চিন্তা করলেন, “আমার আগে আগে যে উপহার যাচ্ছে তা দিয়ে আমি তাঁকে শান্ত করে নেব। তার পরে যখন তাঁর সংগে আমার দেখা হবে তখন আমাকে গ্রহণ করতে হয়তো তাঁর কোন আপত্তি থাকবে না।” কাজেই উপহারের জিনিসগুলো তাঁর আগে চলে গেল, কিন্তু সেই রাতটা তিনি সেখানেই কাটালেন। সেই রাতেই ইয়াকুব উঠে তাঁর দুই স্ত্রী, দুই বাঁদী ও এগারোজন ছেলেকে হেঁটে পার হওয়া যায় এমন একটা জায়গা দিয়ে যব্বোক নদীর ওপারে রেখে আসলেন। তাঁর আর যা কিছু ছিল সেই সবও তাদের সংগে পাঠিয়ে দিলেন। তাতে ইয়াকুব একাই রয়ে গেলেন। তখন একজন লোক এসে ভোর না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সংগে কুস্তি করলেন। সেই লোকটি যখন দেখলেন যে, তিনি ইয়াকুবকে হারাতে পারছেন না তখন কুস্তি চলবার সময় তিনি ইয়াকুবের রানের জোড়ায় আঘাত করলেন। তাতে তাঁর রানের হাড় ঠিক জায়গা থেকে সরে গেল। তখন সেই লোকটি বললেন, “ফজর হয়ে আসছে, এবার আমাকে ছেড়ে দাও।” ইয়াকুব বললেন, “আমাকে দোয়া না করা পর্যন্ত আমি আপনাকে ছাড়ব না।” লোকটি বললেন, “তোমার নাম কি?” তিনি বললেন, “আমার নাম ইয়াকুব।” লোকটি বললেন, “তুমি আল্লাহ্‌ ও মানুষের সংগে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছ বলে তোমার নাম আর ইয়াকুব থাকবে না, তোমার নাম হবে ইসরাইল (যার মানে ‘যিনি আল্লাহ্‌র সংগে যুদ্ধ করেন’)।” ইয়াকুব তাঁকে বললেন, “মিনতি করি, আপনি বলুন আপনার নাম কি?” তিনি বললেন, “তুমি আমার নাম জিজ্ঞাসা করছ কেন?” এই কথা বলেই তিনি ইয়াকুবকে দোয়া করলেন। তখন ইয়াকুব সেই জায়গাটার নাম রাখলেন পনূয়েল (যার মানে “আল্লাহ্‌র মুখ”)। তিনি বললেন, “আমি আল্লাহ্‌কে সামনাসামনি দেখেও বেঁচে রয়েছি।” ইয়াকুব যখন পনূয়েল থেকে রওনা দিলেন তখন সূর্য উঠে গেছে। তাঁর রানের অবস্থার জন্য তিনি খোঁড়াতে লাগলেন। এইজন্যই বনি-ইসরাইলরা আজও রানের জোড়ার উপরকার গোশ্‌ত খায় না, কারণ রানের জোড়ার উপরেই ইয়াকুবকে আঘাত করা হয়েছিল। পথ চলতে চলতে ইয়াকুব দেখলেন যে, ইস্‌ চারশো লোক সংগে নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি তখন লেয়া, রাহেলা আর সেই দুই বাঁদীর মধ্যে সন্তানদের ভাগ করে দিলেন। বাঁদী ও তাদের সন্তানদের তিনি প্রথমে রাখলেন। তারপর রাখলেন লেয়া ও তাঁর সন্তানদের এবং শেষে রাখলেন রাহেলা ও ইউসুফকে। কিন্তু তিনি নিজে তাঁদের আগে আগে গেলেন। যেতে যেতে তিনি মাটিতে উবুড় হয়ে সাতবার ভাইকে সালাম জানালেন এবং এইভাবে তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন ইস্‌ তাঁর কাছে দৌড়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কাঁধে মাথা রাখলেন এবং তাঁকে চুম্বন করলেন। তারপর তাঁরা দু’জনেই কাঁদতে লাগলেন। পরে ইস্‌ মুখ তুলে ঐ সব স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সংগে এরা কারা?” ইয়াকুব বললেন, “আল্লাহ্‌ রহমত করে আপনার গোলামকে এই সব ছেলেমেয়ে দিয়েছেন।” প্রথমে বাঁদীরা তাদের সন্তানদের নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ইস্‌কে সালাম জানাল। তারপর লেয়া তাঁর সন্তানদের নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। শেষে রাহেলা আর ইউসুফ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তখন ইস্‌ বললেন, “যে সব দলবলের সংগে পথে আমার দেখা হল সেগুলো কিসের জন্য?” ইয়াকুব বললেন, “ওগুলো আমার প্রভুর কাছ থেকে দয়া পাবার জন্য।” কিন্তু ইস্‌ বললেন, “ভাই, আমার যথেষ্ট আছে। তোমার যা আছে তা তোমারই থাক্‌।” ইয়াকুব বললেন, “না, না, আমি আপনাকে মিনতি করে বলছি, যদি আমার উপর আপনার দয়া থাকে তবে আমার দেওয়া এই উপহার আপনি নিন। যখন আপনি আমাকে খুশী মনে কবুলই করেছেন তখন আমার কাছে আপনার মুখ দেখা আল্লাহ্‌র মুখ দেখার মতই। আল্লাহ্‌ আমাকে রহমত দান করেছেন, আর আমার যথেষ্ট আছে। সেইজন্য এই যে উপহার আপনার কাছে আনা হয়েছে তা আপনি নিন।” ইয়াকুব এইভাবে সাধাসাধি করবার পর ইস্‌ তা কবুল করলেন। পরে ইস্‌ বললেন, “চল, এবার আমরা যাই। আমি তোমার সংগে সংগেই যাব।” ইয়াকুব তাঁকে বললেন, “কিন্তু প্রভু, আপনি তো জানেন যে, এই সব ছেলেমেয়েদের বয়স বেশী নয়। তা ছাড়া যে সব গরু ও ভেড়া তাদের বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে তাদের কথাও আমাকে ভাবতে হবে। যদি একদিনও এদের তাড়াহুড়া করে নিয়ে যাওয়া হয় তবে সবগুলোই মরে যাবে। না প্রভু, তার চেয়ে বরং আপনি আমার আগে আগেই যান। সেয়ীরে আপনার কাছে গিয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত সামনের পশুপাল এবং ছেলেমেয়েদের চলবার ক্ষমতা বুঝে আমাকে ধীরে সুস্থেই চলতে হবে।” তখন ইস্‌ বললেন, “তাহলে আমার সংগের কয়েকজন লোককে আমি তোমার কাছে রেখে যাই।” ইয়াকুব বললেন, “তার কি দরকার? আমার প্রভুর কাছ থেকে আমি দয়া পেয়েছি সেটাই তো যথেষ্ট।” কাজেই ইস্‌ সেই দিনই সেয়ীরের পথে রওনা হয়ে গেলেন, আর ইয়াকুব যাত্রা করে সুক্কোতে গিয়ে পৌঁছালেন। তিনি নিজের জন্য সেখানে একটা ঘর তৈরী করলেন এবং তাঁর পশুপালের জন্য কয়েকটা কুঁড়ে-ঘর তৈরী করলেন। এইজন্যই সেই জায়গাটার নাম হয়েছিল সুক্কোৎ (যার মানে “কুঁড়ে-ঘর”)। সেখানে তিনি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে তার নাম দিলেন এল্‌-ইলাহী-ইসরাইল (যার মানে “ইসরাইলের আল্লাহ্‌ই আল্লাহ্‌”)। দীণার প্রতি তার টান খুব বেশী হল। সে তাকে ভালবেসে ফেলল এবং তার কাছে ভালবাসার কথা বলতে লাগল। পরে শিখিম তার পিতা হমোরকে বলল, “এই মেয়েটির সংগে আমার বিয়ের বন্দোবস্ত কর।” শিখিম যে তাঁর মেয়ে দীণার ইজ্জত নষ্ট করেছে সেই কথা ইয়াকুবের কানে গেল। কিন্তু তাঁর ছেলেরা তখন পশুপাল নিয়ে মাঠে ছিল, কাজেই তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি চুপ করে রইলেন। শিখিমের পিতা হমোর ইয়াকুবের সংগে কথা বলবার জন্য শহর থেকে বের হয়ে আসল। এর মধ্যে কথাটা শুনে ইয়াকুবের ছেলেরা মাঠ থেকে ফিরে আসল। তারা যেমন মনে কষ্ট পেল তেমনি ভীষণ রেগেও গেল, কারণ ইয়াকুবের মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করে শিখিম ইসরাইলের প্রতি একটা অপমানের কাজ করেছিল, যা করা তার মোটেই উচিত ছিল না। কিন্তু হমোর ইয়াকুব ও তাঁর ছেলেদের বলল, “আপনার মেয়ের প্রতি আমার ছেলের প্রাণের টান রয়েছে। আমার ছেলের সংগে আপনার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিন। আমাদের সংগে আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা চালু করুন। আপনাদের মেয়েদের আমাদের দিন এবং আমাদের মেয়েদের আপনারা নিন। আপনারা আমাদের মধ্যে বাস করুন। গোটা দেশটাই তো আপনাদের সামনে পড়ে আছে। আপনারা এখানেই থাকুন, খুশী মত চলাফেরা করুন এবং ধন-সম্পত্তির মালিক হন।” এছাড়া শিখিমও মেয়েটির পিতা ও ভাইদের বলল, “আমার উপর যদি আপনাদের দয়া হয়, তবে আপনারা আমার কাছে যা চাইবেন আমি তা-ই দেব। এই বিয়ের মহরানা আর উপহার হিসাবে আপনারা যা দাবি করবেন আমি তা সবই দেব। আপনারা কেবল মেয়েটিকে আমার সংগে বিয়ে দিন।” তবে একটা কাজ করলে আমরা এতে রাজী হতে পারি। সেটা হল, আপনাদের প্রত্যেকটি পুরুষকে খৎনা করিয়ে আমাদের মত হতে হবে। তাহলে আমাদের মেয়েদের আপনাদের দেব এবং আপনাদের মেয়েদের আমরা নেব; আর আমরা আপনাদের সংগে এক জাতি হয়ে বাস করব। কিন্তু যদি আপনারা আমাদের কথা না শোনেন এবং খৎনা করাবার কথা মেনে না নেন, তবে আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমরা এখান থেকে চলে যাব।” তাদের এই কথায় হমোর ও তার ছেলে শিখিম খুশী হল। পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানী লোক শিখিম আর দেরি না করে কথাটা মেনে নিল, কারণ ইয়াকুবের মেয়ের প্রতি তার খুব টান ছিল। সেইজন্য শহরের সদর দরজার কাছে গিয়ে হমোর ও তার ছেলে শিখিম সেখানকার লোকদের বলল, “এই লোকেরা আমাদের বন্ধু। আমাদের দেশে তাদের থাকবার জন্য অনেক জায়গাও রয়েছে। এরা এখানেই থাকুক আর খুশীমত চলাফেরা করুক। চলুন, আমরা তাদের মেয়েদের নিই এবং আমাদের মেয়েদেরও তাদের দিই। শুধুমাত্র একটা কাজ করলে তারা আমাদের সংগে বাস করে এক জাতি হতে রাজী আছে। সেটা হল, তাদের মত করে আমাদের মধ্যেকার প্রত্যেকটি পুরুষের খৎনা করাতে হবে। তাদের গরু-ভেড়া, বিষয়-সম্পত্তি এবং সমস্ত পশুপাল আমাদের মধ্যেই থাকবে। তাই আসুন, আমরা তাদের কথায় রাজী হই। তাহলে তারা আমাদের সংগে বাস করবে।” এতে শহরের পুরুষ লোকেরা সকলেই হমোর ও তার ছেলে শিখিমের কথায় রাজী হল, আর তাদের সকলের খৎনা করানো হল। এর তিন দিনের দিন যখন পুরুষেরা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিল তখন দীণার নিজের ভাই, অর্থাৎ ইয়াকুবের দুই ছেলে শিমিয়োন ও লেবি তলোয়ার নিয়ে শহরে ঢুকে প্রতিটি পুরুষকে হত্যা করল। এই রকম কিছু হবে বলে শহরের কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না। তারা হমোর আর তার ছেলেকেও হত্যা করল এবং শিখিমের ঘর থেকে দীণাকে নিয়ে চলে আসল। যে শহরে তাদের বোনের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছিল ইয়াকুবের অন্য সব ছেলে সেখানে ঢুকে লাশগুলো দেখতে পেল এবং শহরটা লুট করল। শহরের ভিতরে এবং বাইরে লোকদের যত গরু-ভেড়া এবং গাধা ছিল তারা সেগুলোও নিয়ে নিল। তারা তাদের সমস্ত ধন্তদৌলত এবং তাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদের লুট করে নিল; এমন কি, তাদের ঘরের মধ্যে যা ছিল তাও বাদ পড়ল না। ইয়াকুব এর পরে শিমিয়োন ও লেবিকে বললেন, “তোমরা এই দেশের লোকদের কাছে, বিশেষ করে কেনানীয় ও পরিষীয়দের কাছে আমাকে ঘৃণার পাত্র করে তুলে বিপদে ফেলেছ। আমার লোকেরা সংখ্যায় কম। তারা একত্র হয়ে আমাকে হামলা করবে, আর তাতে পরিবারসুদ্ধ আমি মারা পড়ব।” এতে শিমিয়োন ও লেবি বলল, “কিন্তু আমাদের বোনকে কি কারও বেশ্যা ভাবা উচিত?” এর পর আল্লাহ্‌ ইয়াকুবকে বললেন, “তুমি এখন বেথেলে গিয়ে থাক। তোমার ভাই ইসের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার সময় যিনি তোমাকে দেখা দিয়েছিলেন সেই আল্লাহ্‌র প্রতি তুমি সেখানে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী কর।” তখন ইয়াকুব তাঁর নিজের লোকদের ও সংগের অন্যান্য লোকদের বললেন, “তোমাদের কাছে যে সব দেবমূর্তি আছে তা ফেলে দাও ও নিজেদের পাক-সাফ করে নাও এবং তোমাদের কাপড়-চোপড়ও বদলে ফেল। তারপর চল, আমরা বেথেলে যাই। সেখানে আমি আল্লাহ্‌র প্রতি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করব যিনি আমার বিপদের দিনে এগিয়ে এসেছিলেন এবং সব জায়গাতেই আমার সংগে সংগে থেকেছেন।” তখন তাদের কাছে যত দেবমূর্তি ছিল সেগুলো তারা ইয়াকুবের হাতে তুলে দিল। সেই সংগে কানের গহনাগুলোও দিল। ইয়াকুব সেগুলো নিয়ে শিখিম শহরের কাছে এলোন গাছটার নীচে পুঁতে রাখলেন। তারপর তারা রওনা হল। তাদের যাওয়ার পথে আল্লাহ্‌ আশেপাশের শহরের লোকদের মধ্যে এমন একটা ভয়ের ভাব সৃষ্টি করলেন যার ফলে ইয়াকুবের লোকদের পিছনে কেউ তাড়া করে গেল না। ইয়াকুব ও তাঁর সংগের অন্য সবাই কেনান দেশের লূস শহরে, অর্থাৎ বেথেলে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে তিনি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন। তিনি সেই জায়গাটার নাম দিলেন এল্‌-বেথেল (যার মানে “বেথেলের আল্লাহ্‌”), কারণ ভাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে আসবার সময় আল্লাহ্‌ সেখানেই তাঁর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে রেবেকার ধাইমা দবোরা ইন্তেকাল করলেন। তাঁকে বেথেলের কাছে একটা এলোন গাছের নীচে দাফন করা হল। সেইজন্য সেই জায়গাটার নাম রাখা হল অলোন্‌-বাখুৎ (যার মানে “কান্না-গাছ”)। আল্লাহ্‌ তাঁকে আরও বললেন, “আমিই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌। তুমি অনেক সন্তানের পিতা হয়ে সংখ্যায় বেড়ে ওঠো। তোমার মধ্য থেকেই একটা জাতি গড়ে উঠবে, আর গড়ে উঠবে একটা বহু গোষ্ঠীর জাতি। তোমার বংশে অনেক বাদশাহ্‌র জন্ম হবে। যে দেশ আমি ইব্রাহিম আর ইসহাককে দিয়েছিলাম সেই দেশ আমি তোমাকে দেব। সেই দেশ আমি তোমার পরে তোমার বংশের লোকদের দেব।” আল্লাহ্‌ যে জায়গায় ইয়াকুবের সংগে কথা বলেছিলেন পরে তিনি সেখান থেকে উপরের দিকে উঠে গেলেন। ঠিক সেই জায়গাতেই ইয়াকুব একটা পাথর থামের মত করে উচু করলেন এবং তার উপর তিনি ঢালন-কোরবানী করলেন। তার উপর তিনি তেলও ঢেলে দিলেন। আল্লাহ্‌ যেখানে তাঁর সংগে কথা বলেছিলেন ইয়াকুব সেই জায়গার নাম রাখলেন বেথেল। তারপর ইয়াকুব ও তাঁর পরিবার বেথেল থেকে যাত্রা করলেন। তাঁরা ইফ্রাথের পথে কিছু দূর যেতেই রাহেলার প্রসব-বেদনা শুরু হল এবং তাঁর খুব কষ্ট হতে লাগল। প্রসব কালে তাঁর যন্ত্রণা যখন ভীষণ বেড়ে গেল তখন ধাত্রী তাঁকে বলল, “ভয় কোরো না, এবারও তোমার একটা ছেলে হবে।” কিন্তু রাহেলা মারা গেলেন। মারা যাবার সময় তিনি ছেলেটির নাম রাখলেন বিনোনী (যার মানে “আমার দুঃখের ছেলে”)। কিন্তু তার বাবা তার নাম রাখলেন বিন্‌ইয়ামীন (যার মানে “সৌভাগ্যের ছেলে”)। রাহেলার মৃত্যু হলে পর ইফ্রাথে, অর্থাৎ বেথেলহেমে যাবার পথেই তাঁকে দাফন করা হল। ইয়াকুব তাঁর কবরের উপরে থামের মত করে একটা পাথর স্থাপন করলেন। সেটা আজও রাহেলার কবরের চিহ্ন হিসাবে সেখানেই আছে। এর পর ইসরাইল, অর্থাৎ ইয়াকুব আবার চলতে লাগলেন। তিনি মিগ্‌দল-এদর নামে জায়গাটা পিছনে ফেলে এসে তাঁর তাম্বু ফেললেন। ইসরাইল যখন সেই এলাকায় বাস করছিলেন তখন রূবেণ তার পিতার উপস্ত্রী বিল্‌হার সংগে জেনা করল। কথাটা ইসরাইলের কানে গেল। ইয়াকুবের বারোজন ছেলে ছিল। লেয়ার গর্ভে ইয়াকুবের প্রথম সন্তান রূবেণের জন্ম হয়েছিল। তারপর জন্মেছিল শিমিয়োন, লেবি, এহুদা, ইষাখর ও সবূলূন। রাহেলার গর্ভে জন্মেছিল ইউসুফ আর বিন্‌ইয়ামীন। রাহেলার বাঁদী বিল্‌হার গর্ভে জন্মেছিল দান আর নপ্তালি। লেয়ার বাঁদী সিল্পার গর্ভে জন্মেছিল গাদ আর আশের। পদ্দন-ইরামে ইয়াকুবের এই সব ছেলের জন্ম হয়েছিল। শেষে ইয়াকুব কিরিয়ৎ-অর্বের, অর্থাৎ হেবরনের কাছে মম্রি শহরে তাঁর পিতা ইসহাকের কাছে আসলেন। এই এলাকাতেই ইব্রাহিম ও ইসহাক বাস করতেন। ইসহাক একশো আশি বছর বেঁচে ছিলেন। একটি পরিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে তিনি বুড়ো বয়সে ইন্তেকাল করে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। তাঁর ছেলে ইস্‌ আর ইয়াকুব তাঁকে দাফন করলেন। এই হল ইসের, অর্থাৎ ইদোমের বংশের কথা। ইস্‌ কেনানীয় মেয়েদের বিয়ে করেছিলেন। সেই মেয়েরা হল হিট্টীয় এলোনের মেয়ে আদা আর হিব্বীয় সিবিয়োনের নাত্‌নী, অর্থাৎ অনার মেয়ে অহলীবামা। এছাড়া তিনি ইসমাইলের মেয়ে, অর্থাৎ নাবায়ুতের বোন বাসমত্‌কেও বিয়ে করেছিলেন। এদের মধ্যে আদার গর্ভে ইলীফস এবং বাসমতের গর্ভে রূয়েলের জন্ম হয়েছিল; আর অহলীবামার গর্ভে যিয়ূশ, যালম ও কোরহের জন্ম হয়েছিল। কেনান দেশেই ইসের এই সব ছেলেদের জন্ম হয়েছিল। পরে ইস্‌ তাঁর স্ত্রীদের, ছেলেমেয়েদের এবং বাড়ীর অন্য সবাইকে আর গরু, ভেড়া, অন্যান্য পশু ও কেনান দেশে আয় করা সমস্ত ধন্তদৌলত নিয়ে তাঁর ভাই ইয়াকুবের কাছ থেকে অনেক দূরে আর একটা দেশে চলে গেলেন। ইস্‌ আর ইয়াকুবের পশুধন এত বেশী ছিল যে, তাঁদের পক্ষে এক সংগে বাস করা সম্ভব হল না; তাঁরা যেখানে ছিলেন সেখানে তাঁদের দু’জনের পশুপাল চরাবার মত যথেষ্ট জায়গা ছিল না। সেইজন্য ইস্‌ সেয়ীরের পাহাড়ী এলাকাতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে লাগলেন। ইসের আর এক নাম ছিল ইদোম। এই হল সেয়ীরের পাহাড়ী এলাকায় ইদোমীয়দের পূর্বপুরুষ ইসের বংশের কথা। ইসের ছেলেদের নাম ইলীফস আর রূয়েল। ইলীফস আদার ছেলে ও রূয়েল বাসমতের ছেলে। ইলীফসের ছেলেরা হল তৈমন, ওমার, সফো, গয়িতম ও কনস। ইসের ছেলে ইলীফসের তিম্না নামে একজন উপস্ত্রী ছিল। তার গর্ভে আমালেকের জন্ম হয়েছিল। এরা সবাই ইসের স্ত্রী আদার নাতি। রূয়েলের ছেলেরা হল নহৎ, সেরহ, শম্ম ও মিসা। এরা ইসের স্ত্রী বাসমতের নাতি। সিবিয়োনের নাত্‌নীর, অর্থাৎ অনার মেয়ে অহলীবামার ছেলেরা হল যিয়ূশ, যালম ও কোরহ। ইসের ছেলেদের মধ্যে কয়েকজন গোষ্ঠীর সর্দার হয়েছিলেন। ইসের বড় ছেলে ইলীফসের যে ছেলেরা সর্দার হয়েছিলেন তাঁরা হলেন তৈমন, ওমার, সফো, কনস, কোরহ, গয়িতম ও আমালেক। ইদোম দেশে এঁরাই ছিলেন আদার ছেলে ইলীফসের বংশধর। রূয়েলের যে ছেলেরা গোষ্ঠী-সর্দার হয়েছিলেন তাঁরা হলেন নহৎ, সেরহ, শম্ম ও মিসা। এঁরা ছিলেন ইসের স্ত্রী বাসমতের ছেলে রূয়েলের বংশধর। ইদোম দেশে এঁদের জন্ম হয়েছিল। ইসের স্ত্রী অহলীবামার যে ছেলেরা গোষ্ঠী-সর্দার হয়েছিলেন তাঁরা হলেন যিয়ূশ, যালম ও কোরহ। এঁরা ছিলেন অনার মেয়ে অহলীবামার সন্তান। এঁরা ইসের, অর্থাৎ ইদোমের বংশ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী-সর্দার। লোটনের ছেলেদের নাম হল হোরী আর হেমম। লোটনের বোনের নাম তিম্না। শোবলের ছেলেদের নাম হল অল্‌বন, মানহৎ, এবল, শফো এবং ওনম। সিবিয়োনের ছেলেদের নাম হল অয়া ও অনা। এই অনাই তাঁর পিতা সিবিয়োনের গাধা চরাতে গিয়ে মরুভূমির মধ্যে গরম পানির ঝর্ণার খোঁজ পেয়েছিলেন। অনার ছেলের নাম হল দিশোন ও মেয়ের নাম অহলীবামা। দিশোনের ছেলেদের নাম হল হিম্‌দন, ইশ্‌বন, যিত্রণ ও করাণ। এৎসরের ছেলেদের নাম হল বিল্‌হন, সাবন ও আকন। দীশনের ছেলেদের নাম হল আওস ও অরাণ। হোরীয় সর্দারদের নাম ছিল লোটন, শোবল, সিবিয়োন, অনা, দিশোন, এৎসর ও দীশন। এঁরাই ছিলেন সেয়ীর, অর্থাৎ ইদোম দেশের হোরীয় জাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর সর্দার। ইসরাইলীদের মধ্যে রাজশাসন শুরু হবার আগে ইদোম দেশে যে সব বাদশাহ্‌ রাজত্ব করেছিলেন এই হল তাঁদের কথা: বাউরের ছেলে বেলা ইদোমের বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন; তাঁর রাজধানীর নাম ছিল দিন্‌হাবা। বেলার ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় বস্রা শহরের সেরহের ছেলে যোবব বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। যোববের ইন্তেকালের পর তৈমনীয়দের দেশের হূশম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। হূশমের ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় বদদের ছেলে হদদ বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। তিনি মোয়াব দেশের মাদিয়ানীয়দের হারিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল অবীৎ। হদদের ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় মস্রেকা শহরের সম্ল বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। সম্লের ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় সেই এলাকার নদীর পারের রহোবোৎ শহরের শৌল বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। শৌলের ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় অক্‌বোরের ছেলে বাল-হানন বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। অক্‌বোরের ছেলে বাল-হাননের ইন্তেকালের পর তাঁর জায়গায় হদর বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল পায়ূ, আর তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল মহেটবেল। তিনি মট্রেদের মেয়ে এবং মেষাহবের নাত্‌নী। ইসের যে সব বংশের লোক বিভিন্ন গোষ্ঠী ও এলাকার সর্দার ছিলেন তাঁদের নাম হল তিম্ন, অল্‌বা, যিথেৎ, অহলীবামা, এলা, পীনোন, কনস, তৈমন, মিব্‌সর, মগ্‌দীয়েল ও ঈরম। এঁরা ছিলেন ইদোমীয়দের পূর্বপুরুষ ইসের বংশের লোক এবং ইদোমীয় সর্দার। দেশের যে সব এলাকায় তাঁরা বাস করতেন তাঁদের নাম অনুসারেই সেই সমস্ত এলাকার নাম দেওয়া হয়েছিল। ইয়াকুব কেনান দেশেই বাস করতে লাগলেন। তাঁর পিতাও সেখানে বাস করতেন। এই হল ইয়াকুবের পরিবারের কাহিনী। ইউসুফ তাঁর ভাইদের সংগে ছাগল ও ভেড়ার পাল চরাতেন। তাঁর এই ভাইয়েরা ছিল তাঁর সৎমা বিল্‌হা ও সিল্পার ছেলে। তাঁর বয়স যখন সতেরো বছর তখন তিনি তাঁর এই ভাইদের খারাপ চালচলনের কথা তাঁর পিতাকে জানালেন। বুড়ো বয়সের সন্তান বলে ইউসুফকে ইসরাইল তাঁর অন্য ছেলেদের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন। তিনি তাঁকে একটা পুরো হাতার লম্বা কোর্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন। ভাইয়েরা যখন বুঝল যে, পিতা তাদের চেয়ে ইউসুফকেই বেশী ভালবাসেন তখন তারা তাঁকে হিংসা করতে লাগল। তারা কোন কথাই তাঁর সংগে ভাল মনে বলতে পারত না। একদিন ইউসুফ একটা স্বপ্ন দেখলেন। তিনি সেই কথা তাঁর ভাইদের বলাতে তারা তাঁকে আরও বেশী হিংসা করতে লাগল। ইউসুফ তাদের বলেছিলেন, “শোন, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম, আমরা ক্ষেতে কেটে রাখা শস্যের আঁটি বাঁধছি; কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আমার আঁটিটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর তোমাদের আঁটিগুলো আমার আঁটিটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে সম্মান দেখাল।” তখন তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে বলল, “তুই কি সত্যিই ভাবছিস্‌ তুই বাদশাহ্‌ হবি আর আমাদের উপর হুকুম চালাবি?” এইভাবে তাঁর স্বপ্ন আর তাঁর কথার জন্য তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে আরও বেশী করে হিংসা করতে লাগল। এর পর ইউসুফ আরও একটা স্বপ্ন দেখলেন এবং তাঁর ভাইদের জানালেন। তিনি বললেন, “দেখ, আমি আবার একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম সূর্য, চাঁদ আর এগারোটা তারা আমাকে মাটিতে উবুড় হয়ে সম্মান দেখাছে।” এই স্বপ্নের কথা তিনি তাঁর পিতা ও ভাইদের কাছে বললে পর তাঁর পিতা তাঁকে বকুনি দিয়ে বললেন, “তুমি এ কি রকম স্বপ্ন দেখলে? তোমার আম্মা, ভাইয়েরা এবং আমি কি সত্যিই এসে তোমার সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সম্মান দেখাব?” এর পর ইউসুফের প্রতি তাঁর ভাইদের মন হিংসায় ভরে উঠল, কিন্তু তাঁর পিতা কথাগুলো মনে গেঁথে রাখলেন, কাউকে বললেন না। পরে ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতার ছাগল ও ভেড়া চরাবার জন্য শিখিমে গেল। তখন একদিন ইসরাইল ইউসুফকে বললেন, “তোমার ভাইয়েরা শিখিমে ছাগল ও ভেড়ার পাল চরাচ্ছে। আমি চাই যেন তুমি তাদের কাছে যাও।” ইউসুফ বললেন, “আচ্ছা, আমি যাব।” ইউসুফ বললেন, “আমি আমার ভাইদের তালাশ করছি। আপনি কি জানেন তাঁরা কোথায় ছাগল ও ভেড়ার পাল চরাচ্ছেন?” লোকটি বলল, “তারা এখান থেকে চলে গেছে। আমি তাদের বলতে শুনেছিলাম, ‘চল, আমরা দোথনে যাই।’ ” তখন ইউসুফ তাঁর ভাইদের তালাশে দোথনে গিয়ে তাদের দেখা পেলেন। ভাইয়েরা দূর থেকে ইউসুফকে দেখতে পেল এবং তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছাবার আগেই তারা তাঁকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করল। তারা একে অন্যকে বলল, “ঐ দেখ, স্বপ্নদর্শক আসছে। চল, এখনই আমরা ওকে শেষ করে একটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিই। পরে আমরা বলব, কোন বুনো জানোয়ার তাকে খেয়ে ফেলেছে, আর তার পরে আমরা দেখব ওর স্বপ্নের দশাটা কি হয়।” কিন্তু রূবেণ এই কথা শুনে তাদের হাত থেকে তাঁকে উদ্ধার করবার চেষ্টায় বলল, “ওকে প্রাণে মেরো না।” সে তাদের পরামর্শ দিয়ে বলল, “খুন-খারাবি করতে যেয়ো না। ওর গায়ে হাত না তুলে বরং ওকে এই মরুভূমির এই গর্তটার মধ্যে ফেলে দাও।” পরে ইউসুফকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে পিতার হাতে তুলে দেবে মনে করেই সে এই কথাটা বলল। ইউসুফ তাঁর ভাইদের কাছে এসে পৌঁছামাত্র তারা জোর করে তাঁর শরীর থেকে সেই পুরো হাতার লম্বা কোর্তাটা খুলে নিল। তারপর তারা তাঁকে ধরে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে দিল। গর্তটায় কোন পানি ছিল না, সেটা খালি ছিল। এর পর ইউসুফের ভাইয়েরা খাওয়া-দাওয়া করতে বসে দেখতে পেল গিলিয়দ থেকে একদল ইসমাইলীয় ব্যবসায়ী আসছে। উটের পিঠে করে তারা খোশবু-মসলা, গুগ্‌গুলু ও গন্ধরস নিয়ে মিসর দেশে যাচ্ছিল। তখন এহুদা তার ভাইদের বলল, “ধর, ভাইকে হত্যা করে আমরা কথাটা গোপন করলাম। তাতে আমাদের লাভটা কি? ও তো আমাদের নিজের ভাই, আমাদেরই রক্ত-মাংস। তাই ওর গায়ে হাত না দিয়ে বরং এস, আমরা ওকে ইসমাইলীয়দের কাছে বিক্রি করে দিই।” ভাইয়েরা তার কথাটা মেনে নিল। সেই মাদিয়ানীয় ব্যবসায়ীরা কাছে আসতেই ভাইয়েরা ইউসুফকে গর্ত থেকে টেনে তুলল এবং বিশ টুকরা রূপার বদলে ইসমাইলীয়দের কাছে তাঁকে বেঁচে দিল। সেই ব্যবসায়ীরা ইউসুফকে মিসরে নিয়ে গেল। তারা তখন একটা ছাগল কেটে তার রক্তে ইউসুফের সেই কোর্তাটা ডুবাল। পরে তারা সেটা তাদের পিতার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা এটা কুড়িয়ে পেয়েছি। তুমি ভাল করে দেখ, কোর্তাটা তোমার ছেলের কি না।” ইয়াকুব কোর্তাটা চিনতে পেরে বললেন, “এই কোর্তাটা আমার ছেলেরই। তাকে কোন বুনো জানোয়ারে খেয়ে ফেলেছে। জানোয়ারটা যে তাকে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।” ইয়াকুব তাঁর কাপড় ছিঁড়ে কোমরে ছালার চট জড়িয়ে তাঁর ছেলের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত শোক করলেন। তাঁর অন্য সব ছেলেমেয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোন সান্ত্বনার কথাই তিনি শুনলেন না। তিনি বললেন, “শোক করতে করতেই আমি কবরে আমার ছেলের কাছে যাব।” এইভাবে ইয়াকুব ইউসুফের জন্য কাঁদতে লাগলেন। এদিকে মাদিয়ানীয়রা ইউসুফকে মিসরে নিয়ে গিয়ে পোটীফরের কাছে বিক্রি করে দিল। পোটীফর ছিলেন ফেরাউনের একজন কর্মচারী, তাঁর রক্ষীদলের প্রধান। এর পর এহুদা তার ভাইদের ছেড়ে অদুল্লম গ্রামের একজন লোকের সংগে বাস করতে গেল। লোকটির নাম ছিল হীরা। সেখানে থাকবার সময় শূয় নামে একজন কেনানীয় লোকের মেয়ে তার নজরে পড়ে গেল। মেয়েটিকে সে বিয়ে করল। পরে মেয়েটি গর্ভবতী হল এবং তাঁর একটি ছেলে হল। এহুদা ছেলেটির নাম রাখল এর। পরে সে আবার গর্ভবতী হল এবং তার একটি ছেলে হল। মা ছেলেটির নাম রাখল ওনন। তারপর আবার সে গর্ভবতী হল এবং তার আর একটি ছেলে হল। সে তার নাম রাখল শেলা। এই ছেলেটির জন্মের সময় তারা কষীব গ্রামে ছিল। পরে এহুদা তার বড় ছেলে এরের সংগে তামর নামে একটি মেয়ের বিয়ে দিল। কিন্তু এহুদার এই ছেলে এর মাবুদের চোখে এত খারাপ ছিল যে, তিনি তাকে আর বাঁচতে দিলেন না। এহুদা তখন ওননকে বলল, “তোমার ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে তুমি বিয়ে কর। তার দেবর হিসাবে তোমার যা করা উচিত তা কর এবং তোমার ভাইয়ের হয়ে তার বংশ রক্ষা কর।” ওনন জানত যে, সেই বংশ তার নিজের হবে না। ভাইয়ের হয়ে বংশ রক্ষা করবার অনিচ্ছার দরুন যতবার সে তার ভাইয়ের স্ত্রীর কাছে গেল ততবারই সে বাইরে মাটিতে বীর্যপাত করল। কিন্তু তার এই ব্যবহারে মাবুদ নারাজ হলেন। সেইজন্য তাকেও তিনি আর বাঁচতে দিলেন না। তখন এহুদা তার ছেলের স্ত্রী তামরকে বলল, “যতদিন না আমার ছেলে শেলা বড় হয় ততদিন তুমি তোমার বাবার বাড়ীতে গিয়ে বিধবা হিসাবে বাস করতে থাক।” এহুদার মনে এই ভয় হয়েছিল, হয়তো শেলাও তার অন্য ভাইদের মত মারা যাবে। এহুদার কথায় তামর তার পিতার বাড়ীতে গিয়ে থাকতে লাগল। এর অনেক দিন পরে এহুদার স্ত্রী, অর্থাৎ শূয়ের মেয়ে মারা গেল। তার জন্য শোক প্রকাশের সময় শেষ হয়ে গেলে পর এহুদা ও তাঁর অদুল্লমীয় বন্ধু হীরা তিম্না গ্রামে গেল। যে লোকেরা এহুদার ভেড়ার লোম কাটত তারা সেই গ্রামেই ছিল। এর আগে একজন লোক তামরকে গিয়ে বলেছিল, “দেখ, তোমার শ্বশুর তাঁর ভেড়ার লোম ছাঁটাইয়ের জন্য তিম্নায় যাচ্ছেন।” তামর লক্ষ্য করেছিল যে, শেলার বয়স হলেও শ্বশুর তাঁর কথামত শেলার সংগে তার বিয়ে দেন নি। সেইজন্য সে বিধবার কাপড়-চোপড় ছেড়ে মুখ ঢেকে গায়ে কাপড় জড়িয়ে ঐনয়িমের সদর দরজার কাছে গিয়ে বসে রইল। ঐনয়িম ছিল তিম্না যাবার পথে। সে মুখ ঢেকে রেখেছিল বলে এহুদা তাকে দেখে বেশ্যা মনে করল। তাই সে রাস্তার ধারে তামরের কাছে গিয়ে বলল, “এস, তোমার সংগে শুতে যাই।” নিজের ছেলের স্ত্রীকে সে চিনতেই পারল না। তামর বলল, “এইজন্য আপনি আমাকে কি দেবেন?” এহুদা বলল, “আমার পাল থেকে আমি তোমাকে একটা ছাগলের বাচ্চা পাঠিয়ে দেব।” তামর বলল, “সেটা না পাঠানো পর্যন্ত আপনি আমার কাছে কিছু বন্ধক রেখে যাবেন কি?” এহুদা বলল, “কি বন্ধক রাখব?” সে বলল, “দড়ি সুদ্ধ আপনার সীলমোহরখানা আর আপনার হাতের লাঠিটা।” তখন এহুদা সেগুলো তার কাছে জমা রেখে তার সংগে মিলিত হল, আর তার ফলে তামর গর্ভবতী হল। এর পর তামর উঠে চলে গেল, আর মাথার কাপড় খুলে ফেলে সে আবার বিধবার কাপড়-চোপড় পরল। পরে স্ত্রীলোকটির কাছ থেকে সেই বন্ধক রাখা জিনিসগুলো ফেরৎ আনবার জন্য এহুদা তার অদুল্লমীয় বন্ধুকে দিয়ে একটা ছাগলের বাচ্চা পাঠিয়ে দিল। কিন্তু সে তাকে খুঁজে পেল না। তখন সে সেখানকার লোকদের জিজ্ঞাসা করল, “ঐনয়িমে রাস্তার ধারে যে মন্দির-বেশ্যাটি ছিল সে কোথায়?” তারা বলল, “এখানে তো কোন মন্দির-বেশ্যা নেই।” তখন সে এহুদার কাছে ফিরে গিয়ে বলল, “আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। এছাড়া ওখানকার লোকেরা বলল যে, ওখানে কোন মন্দির-বেশ্যা নেই।” এহুদা বলল, “তাহলে ঐ জিনিসগুলো ওর কাছেই থাক্‌, না হলে লোকে আমাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে। তা ছাড়া ছাগলের বাচ্চাটা তো আমি পাঠিয়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তাকে খুঁজে পাও নি।” এর প্রায় তিন মাস পরে এহুদা শুনতে পেল যে, তার ছেলের স্ত্রী তামর জেনা করেছে, আর তার ফলে সে এখন গর্ভবতী হয়েছে। এই কথা শুনে এহুদা বলল, “ওকে বের করে এনে পুড়িয়ে ফেলা হোক।” তামরকে যখন বের করে আনা হচ্ছিল তখন সে তার শ্বশুরকে বলে পাঠাল, “আমার গর্ভে যাঁর সন্তান আছে এই সব জিনিস তাঁর।” তারপর সে বলল, “দয়া করে একবার পরীক্ষা করে দেখবেন কি, এই দড়ি সুদ্ধ সীলমোহরখানা ও লাঠিটা কার?” এহুদা সেগুলো চিনতে পেরে বলল, “সে তো তাহলে আমার তুলনায় অনেক ভাল, কারণ আমার ছেলে শেলার সংগে আমি তার বিয়ে দিই নি।” এর পর সে আর কখনও তামরের সংগে শোয় নি। সন্তান প্রসবের সময় দেখা গেল তামরের গর্ভে যমজ সন্তান রয়েছে। প্রসবের সময় একটি সন্তান তার হাত বের করল। তখন ধাত্রী একটা লাল সুতা তার হাতে বেঁধে দিয়ে বলল, “এটির জন্ম আগে হল।” কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সেই সন্তানটি যখন তার হাত ভিতরে টেনে নিল তখনই তার ভাই বের হয়ে আসল। তখন ধাত্রী বলল, “কি করে তুমি বাধা ভেংগে বেরিয়ে আসলে?” এইজন্য তার নাম রাখা হল পেরস (যার মানে “বাধা ভাংগা”)। তারপর তার ভাই হাতে লাল সুতা বাঁধা অবস্থায় বের হয়ে আসল। তার নাম দেওয়া হল সেরহ। এর মধ্যে ইউসুফকে মিসর দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইসমাইলীয়রাই তাঁকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে পোটীফর নামে ফেরাউনের একজন মিসরীয় কর্মচারী ইউসুফকে তাদের কাছ থেকে কিনে নিলেন। পোটীফর ছিলেন ফেরাউনের রক্ষীদলের প্রধান। মাবুদ ইউসুফের সংগে সংগে ছিলেন। সেইজন্য তিনি সব কাজে সফল হতে লাগলেন। তাঁকে তাঁর মিসরীয় মালিকের বাড়ীতেই রাখা হল। মাবুদ যে তাঁর সংগে সংগে আছেন এবং তাঁর হাতের সব কাজই সফল করে তুলছেন তা তাঁর মালিকের চোখ এড়ালো না। তাতে ইউসুফ তাঁর সুনজরে পড়লেন এবং তিনি তাঁকে তাঁর ব্যক্তিগত সেবাকারী করে নিলেন। তাঁর ঘর-সংসার ও বিষয়-সম্পত্তির দেখাশোনার ভারও তিনি তাঁর উপর দিলেন। ইউসুফকে এই সব ভার দেবার পর থেকে ইউসুফের দরুন মাবুদ সেই মিসরীয় মালিকের সব কিছুকে দোয়া করতে লাগলেন। পোটীফরের ঘর-বাড়ীর এবং ক্ষেত-খামারের সব কিছুকেই মাবুদ দোয়া করলেন। এ দেখে পোটীফর তাঁর সব কিছুর ভার ইউসুফের উপর ছেড়ে দিলেন। ইউসুফের উপর সব ভার ছিল বলে পোটীফর একমাত্র নিজের খাওয়া ছাড়া আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতেন না। ইউসুফের শরীরের গড়ন এবং চেহারা সুন্দর ছিল। কিছু দিনের মধ্যে ইউসুফ তাঁর মালিকের স্ত্রীর নজরে পড়ে গেলেন। একদিন সে ইউসুফকে বলল, “আমার বিছানায় এস।” কিন্তু ইউসুফ তাতে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, “দেখুন, আমি এই বাড়ীতে আছি বলেই আমার মালিক কোন কিছুর জন্য চিন্তা করেন না। তাঁর সব কিছুর ভার তিনি আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এই বাড়ীতে আমার উপরে আর কেউ নেই। আপনি তাঁর স্ত্রী, সেইজন্য একমাত্র আপনাকে ছাড়া আর সবাইকে তিনি আমার অধীন করেছেন। এই অবস্থায় আমি কি করে এত বড় একটা জঘন্য কাজ করে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করতে পারি?” পোটীফরের স্ত্রী দিনের পর দিন সেই একই কথা বলতে লাগল। কিন্তু ইউসুফ তার সংগে শোবার এই অনুরোধে কান দিলেন না, এমন কি, তার কাছাকাছি থাকতেও রাজি হলেন না। একদিন কোন কাজের জন্য ইউসুফ বাড়ীর ভিতরে গেলেন। তখন বাড়ীর কেউই সেখানে ছিল না। এমন সময় পোটীফরের স্ত্রী ইউসুফের কাপড় টেনে ধরে বলল, “আমার বিছানায় এস।” ইউসুফ তখন কাপড়টা তার হাতে ফেলে রেখেই বাইরে পালিয়ে গেলেন। আমার চিৎকার আর হাঁকডাক শুনে সে তার কাপড়টা আমার কাছে ফেলে রেখেই বাইরে পালিয়ে গেছে।” ইউসুফের মালিক বাড়ী ফিরে না আসা পর্যন্ত কাপড়টা সে তার কাছেই রেখে দিল। পরে সে পোটীফরের কাছে এই কথা জানাতে গিয়ে বলল, “তুমি যে ইবরানী গোলামকে আমাদের কাছে এনেছ সে আমাকে অপমান করবার মতলবে আমার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু আমি চিৎকার ও হাঁকডাক করাতে সে আমার কাছে তার কাপড় ফেলে রেখেই বাইরে পালিয়ে গেছে।” স্ত্রীর কথা শুনে ইউসুফের মালিক রেগে আগুন হয়ে গেলেন, কারণ তাঁর স্ত্রী বলেছিল, “এমনি ধরনের ব্যবহারই তোমার গোলাম আমার সংগে করেছে।” প্রধান জেল-রক্ষক জেলখানার সমস্ত কয়েদীদের ভার ইউসুফের উপরে দিলেন যেন সেখানকার সব কাজকর্ম ইউসুফের ইচ্ছামত হয়। ইউসুফের হাতে যে সব কাজের ভার ছিল সেগুলো প্রধান জেল-রক্ষককে আর দেখাশোনা করতে হত না, কারণ মাবুদ ইউসুফের সংগে ছিলেন, আর এইজন্য ইউসুফ যাতে হাত দিতেন তা মাবুদ সফল করতেন। এই সব ঘটনার পরে মিসরের বাদশাহ্‌র দু’জন কর্মচারী বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে অন্যায় করে বসল। এদের মধ্যে একজন ছিল প্রধান রুটিকার আর অন্যজন ছিল প্রধান পানীয় পরিবেশক। ফেরাউন এই দু’জনের উপর এত বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি ইউসুফের মালিকের, অর্থাৎ রক্ষীদল-প্রধানের বাড়ীর জেলখানার ভিতরে তাদের আটক করে রাখলেন। ইউসুফও সেই একই জায়গায় বন্দী ছিলেন। সকালবেলা ইউসুফ সেই দু’জনের কাছে গিয়ে দেখলেন তারা খুব মনমরা হয়ে আছে। তা দেখে ইউসুফ তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাদের আজ এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন?” জবাবে তারা তাঁকে বলল, “আমরা দু’জনেই একটা করে স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু তার মানে বলে দেয় এমন কেউ এখানে নেই।” ইউসুফ তাদের বললেন, “মানে বলে দেবার ক্ষমতা কি আল্লাহ্‌র হাতে নেই? আপনাদের স্বপ্নের কথা আমাকে বলুন।” তখন সেই প্রধান পানীয় পরিবেশক ইউসুফকে তার স্বপ্নের কথা বলল। সে বলল, “স্বপ্নে আমি আমার সামনে একটা আংগুর গাছ দেখলাম। তার তিনটা ডাল। সেই ডালে কুঁড়ি ধরবার সংগে সংগে ফুল ফুটল আর থোকায় থোকায় আংগুর ধরে পেকে উঠল। ফেরাউনের আংগুর-রসের পেয়ালাটা তখন আমার হাতেই ছিল। আমি সেই আংগুরগুলো নিয়ে তাতে রস বের করে সেটা ফেরাউনের হাতে দিলাম।” ইউসুফ তাকে বললেন, “এই হল আপনার স্বপ্নের মানে। তিনটা ডাল মানে তিন দিন। এই তিন দিনের মধ্যে ফেরাউন আপনাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে আগের কাজে বহাল করবেন। পানীয় পরিবেশক হিসাবে আপনি আগের মত করে আবার ফেরাউনের হাতে পেয়ালা তুলে দেবেন। তবে সুদিনে আমার কথা ভুলে যাবেন না। এর বদলে ফেরাউনের কাছে আপনি আমার কথা বলবেন, যাতে আপনার সাহায্যে আমি এই কয়েদখানা থেকে বের হয়ে যেতে পারি। সত্যি বলতে কি, ইবরানীদের দেশ থেকে আমাকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে, আর এই দেশে এসেও আমি এমন কিছু করি নি যার জন্য আমাকে এই গর্তে আটক করে রাখা যায়।” প্রধান রুটিকার যখন দেখল যে, পানীয় পরিবেশকের স্বপ্নের একটা ভাল অর্থ রয়েছে তখন সে ইউসুফকে বলল, “আমিও একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম আমার মাথার উপরে তিন টুকরি ময়দার রুটি রয়েছে। উপরের টুকরিতে ছিল ফেরাউনের জন্য অনেক রকমের রুটি আর পিঠা। কিন্তু পাখীরা এসে আমার মাথার উপরের সেই টুকরি থেকে খেতে লাগল।” জবাবে ইউসুফ বললেন, “এই হল আপনার স্বপ্নের মানে। তিনটা টুকরি মানে তিন দিন। এই তিন দিনের মধ্যে ফেরাউন আপনার মাথা কেটে নিয়ে শরীরটা গাছে ঝুলিয়ে রাখবেন, আর পাখীরা এসে আপনার শরীর থেকে গোশ্‌ত ঠুক্‌রে খাবে।” এর তিন দিনের দিন ফেরাউন তাঁর অধীনে যে সব লোক কাজ করত তাদের একটা মেজবানী দিলেন। সেই দিন ছিল তাঁর জন্মদিন। ফেরাউন সেই দিন তাঁর প্রধান পানীয় পরিবেশক ও তাঁর প্রধান রুটিকারকে বের করে সেই সব লোকের সামনে আনলেন। তিনি তাঁর প্রধান পানীয় পরিবেশককে তার আগের কাজে বহাল করলেন, আর তারপর থেকে সে তাঁর হাতে পেয়ালা তুলে দিতে লাগল। কিন্তু প্রধান রুটিকারের শরীরটা তিনি গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। ইউসুফ তাদের স্বপ্নের মানে যেমন বলেছিলেন তাদের প্রতি তেমনই ঘটল। কিন্তু ইউসুফের কথা সেই প্রধান পানীয় পরিবেশকের মনে রইল না; তাঁর কথা সে একেবারে ভুলে গেল। এই ঘটনার পুরো দু’বছর পরে ফেরাউন একটা স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন, তিনি নীল নদের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আশ্চর্য এই যে, তখন নদীর মধ্য থেকে সাতটা সুন্দর, মোটাসোটা গরু উঠে এসে নল বনে চরে বেড়াতে লাগল। এই গরুগুলোর পরে সেই নদী থেকে আরও সাতটা গরু উঠে আসল। সেগুলো ছিল বিশ্রী ও রোগা। সেগুলো এসে নদীর ধারে অন্য গরুগুলোর পাশে দাঁড়াল। তারপর ঐ বিশ্রী, রোগা গরুগুলো সেই সুন্দর, মোটাসোটা সাতটা গরু খেয়ে ফেলল। এরপর ফেরাউনের ঘুম ভেংগে গেল। পরে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন এবং দ্বিতীয়বার স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন একই গমের বোঁটায় সাতটা পুষ্ট ও তাজা শীষ গজালো। তারপর গজালো আরও সাতটা অপুষ্ট শীষ। এগুলো পূবের বাতাসের গরমে শুকিয়ে গিয়েছিল। সেই অপুষ্ট শীষগুলো ঐ সাতটা পুষ্ট এবং বড় শীষ গিলে ফেলল। তারপর ফেরাউনের ঘুম ভেংগে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি যা দেখেছেন তা স্বপ্নমাত্র। কিন্তু সকালের দিকে তাঁর মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল। তিনি লোক পাঠিয়ে মিসর দেশের সব জাদুকর ও গুণিনকে ডেকে আনালেন। তিনি স্বপ্নে যা দেখেছেন তা তাদের কাছে বললেন, কিন্তু কেউই তার মানে বলতে পারল না। তখন ফেরাউনের প্রধান পানীয় পরিবেশক তাঁকে বলল, “মহারাজ, আজ আমার একটা দোষের কথা আমার মনে পড়েছে। একবার মহারাজ তাঁর বাড়ীর গোলামদের উপরে রেগে গিয়েছিলেন। তিনি রক্ষীদল-প্রধানের বাড়ীর বন্দীখানায় প্রধান রুটিকারের সংগে আমাকেও বন্দী করে রেখেছিলেন। তখন একই রাতে আমরা দু’জনেই একটা করে স্বপ্ন দেখলাম। প্রত্যেকটি স্বপ্নেরই বিশেষ অর্থ ছিল। রক্ষীদল-প্রধানের গোলাম একজন ইবরানী যুবকও সেখানে ছিল। আমরা তাকে আমাদের স্বপ্নের কথা বললাম। তখন সে আমাদের দু’জনের স্বপ্নের অর্থ আমাদের বলে দিল। সে আমাদের স্বপ্নের যে অর্থ বলেছিল ঠিক সেইমত সব কিছু ঘটল। মহারাজ আবার আমাকে আমার কাজে বহাল করলেন কিন্তু রুটিকারকে গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন।” তখন ফেরাউন ইউসুফকে ডেকে আনবার জন্য লোক পাঠালেন, আর তারা তাড়াতাড়ি করে জেলখানা থেকে তাঁকে বের করে আনল। ইউসুফ দাড়ি কামিয়ে কাপড়-চোপড় বদলে ফেরাউনের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন ফেরাউন ইউসুফকে বললেন, “আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু কেউই তার মানে বলতে পারছে না। আমি শুনেছি যে, তোমার কাছে স্বপ্নের ঘটনা বললে পর তুমি তার মানে বলতে পার।” জবাবে ইউসুফ ফেরাউনকে বললেন, “সেই ক্ষমতা আমার নেই। তবে আল্লাহ্‌ মহারাজের স্বপ্নের অর্থ বলে দিয়ে তাঁর মন শান্ত করবেন।” তখন ফেরাউন ইউসুফকে বললেন, “স্বপ্নে দেখলাম, আমি নীল নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি, আর আশ্চর্য এই যে, নদীর মধ্য থেকে সাতটা সুন্দর, মোটাসোটা গরু উঠে এসে নল বনে চরে বেড়াতে লাগল। এর পর আরও সাতটা গরু উঠে আসল। সেগুলো ছিল রোগা, বিশ্রী ও দেখতে মরার মত। সারা মিসর দেশের কোথাও এই ধরনের বিশ্রী গরু কখনও আমার চোখে পড়ে নি। পরে সেই রোগা, বিশ্রী গরুগুলো আগেকার সাতটা মোটাসোটা গরুগুলো খেয়ে ফেলল, অথচ তাদের দেখে মনে হল না যে, সেই মোটাসোটা গরুগুলো তারা খেয়েছে, কারণ আগের মত তারা দেখতে বিশ্রীই রয়ে গেল। তার পরেই আমার ঘুম ভেংগে গেল। পরে আমি আবার স্বপ্ন দেখলাম। আমি দেখলাম একটা বোঁটায় সাতটা বড় এবং তাজা গমের শীষ গজালো। তার পরে সাতটা শুকনা, অপুষ্ট শীষ গজালো। সেগুলো পূর্বের বাতাসের গরমে শুকিয়ে গিয়েছিল। এই সাতটা অপুষ্ট শীষ সেই তাজা সাতটা শীষ গিলে ফেলল। আমি এই সব কথা জাদুকরদের বলেছিলাম, কিন্তু কেউই এর মানে আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারল না।” তখন ইউসুফ ফেরাউনকে বললেন, “মহারাজের এই দু’টি স্বপ্নই আসলে এক। আল্লাহ্‌ যা করতে যাচ্ছেন তা তিনি মহারাজের কাছে প্রকাশ করেছেন। সাতটা মোটাসোটা গরুর মানে সাত বছর আর তাজা সাতটা গমের শীষের মানেও সাত বছর। আপনার দু’টি স্বপ্নই আসলে এক। পরে উঠে আসা সাতটা রোগা, বিশ্রী গরু আর পূবের বাতাসের গরমে শুকিয়ে যাওয়া অপুষ্ট সাতটা শীষ, এ দু’টার মানে হল সাতটা দুর্ভিক্ষের বছর। আল্লাহ্‌ যা করতে যাচ্ছেন তা তিনি মহারাজকে দেখিয়েছেন, আর সেই কথাই আমি মহারাজকে বলেছি। সারা মিসর দেশে এমন সাতটা বছর আসছে যখন প্রচুর ফসল জন্মাবে, আর তার পরেই আসছে সাতটা দুর্ভিক্ষের বছর। তখন আগেকার প্রচুর ফসলের কথা লোকের মন থেকে মুছে যাবে, কারণ এই দুর্ভিক্ষ দেশকে শেষ করে দেবে। এই দুর্ভিক্ষের দরুন দেশের সুদিনের কথা লোকের মনেও থাকবে না। এই দুর্ভিক্ষ হবে ভয়ংকর। এই স্বপ্ন মহারাজকে দু’বার দেখানো হয়েছে। এর মানে হল, আল্লাহ্‌ এই ব্যাপারে তাঁর মন স্থির করে ফেলেছেন এবং শীঘ্রই তিনি তা ঘটাবেন। “সেইজন্য এখন মহারাজ এমন একজন লোককে খুঁজে বের করুন যিনি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান। তাঁর উপর আপনি মিসর দেশের ভার দিন। তা ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীও আপনি নিযুক্ত করুন। দেশে ঐ সাত বছরে যখন প্রচুর ফসল হবে, তখন তাঁরাই তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সংগ্রহ করবেন। সেই লোকেরা যেন ঐ সব সুদিনের বাড়তি শস্য সংগ্রহ করে মহারাজের অধীনে প্রত্যেকটি শহরে ভবিষ্যতে খাওয়ার জন্য মজুদ করে রাখেন এবং তা রক্ষা করবার ব্যবস্থা করেন। সাত বছর মিসর দেশে যে দুর্ভিক্ষ হবে তখনকার খাবার হিসাবে যেন শস্য মজুদ করে রাখা হয়, যাতে দুর্ভিক্ষের সময় দেশের লোক মারা না যায়।” ইউসুফের এই ব্যবস্থার কথাটা ফেরাউন ও তাঁর সব কর্মচারীর কাছে ভাল বলে মনে হল। ফেরাউন তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “এই লোকটির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা এই দুনিয়ার নয়। এর মত আর কাকে আমরা খুঁজে পাব?” এর পর ফেরাউন ইউসুফকে বললেন, “তোমার আল্লাহ্‌ যখন তোমার কাছেই এই সব প্রকাশ করেছেন তখন তোমার মত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান আর কে আছে? কাজেই রাজবাড়ীর সমস্ত ভার তোমাকেই নিতে হবে। তোমার মুখের হুকুম মেনেই আমার সমস্ত লোক চলবে। কেবল বাদশাহ্‌ হিসাবে আমি তোমার উপরে থাকব।” ফেরাউন ইউসুফকে আরও বললেন, “মনে রেখ, আমি সারা মিসর দেশের উপর তোমাকে নিযুক্ত করলাম।” তারপর ফেরাউন নিজের হাত থেকে সীলমোহর দেওয়ার আংটিটা খুলে নিয়ে ইউসুফের হাতে পরিয়ে দিলেন। তিনি তাঁকে সুন্দর কাপড় পরিয়ে তাঁর গলায় একটা সোনার হার দিলেন। এর পর তিনি ইউসুফকে তাঁর রাজ্যের দ্বিতীয় রথে বসালেন। রথ চলবার সময় ইউসুফের আগে আগে ঘোষণা করা হল, “হাঁটু পাত, হাঁটু পাত।” এইভাবে ফেরাউন ইউসুফের উপর সমস্ত মিসর দেশের ভার দিলেন। পরে তিনি ইউসুফকে বললেন, “যদিও আমি এখনও বাদশাহ্‌ই আছি তবুও সারা মিসর দেশের লোক তোমার হুকুমেই ওঠা-বসা করবে।” ফেরাউন ইউসুফের নতুন নাম দিলেন সাফনৎ-পানেহ। হেলিওপলিস শহরের পুরোহিত পোটীফেরের মেয়ে আসনতের সংগে তিনি ইউসুফের বিয়ে দিলেন। এর পর ইউসুফ গোটা মিসর দেশটা ঘুরে আসবার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। ইউসুফ যখন মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের কাজে নিযুক্ত হলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ত্রিশ বছর। তিনি ফেরাউনের রাজসভা থেকে বের হয়ে মিসর দেশের সমস্ত জায়গা ঘুরে আসলেন। প্রচুর ফসলের সেই সাত বছরে দেশে অনেক ফসল হল। তখন ইউসুফ সেই সাত বছর ধরে মিসরের সমস্ত বাড়তি শস্য শহরের গোলাঘরগুলোতে মজুদ করলেন। তিনি প্রত্যেক শহরে তার চারপাশের ক্ষেতগুলো থেকে ফসল এনে জমা করলেন। এইভাবে তিনি সমুদ্রের বালুকণার মত প্রচুর শস্য মজুদ করলেন। এত বেশী শস্য জমা হতে লাগল যে, তা আর মাপা সম্ভব হল না। তাই তিনি তা মেপে নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। দুর্ভিক্ষের আগে হেলিওপলিস শহরের পুরোহিত পোটীফেরের মেয়ে আসনতের গর্ভে ইউসুফের দু’টি ছেলের জন্ম হয়েছিল। ইউসুফ তাঁর বড় ছেলের নাম রাখলেন মানশা (যার মানে “ভুলে যাওয়া”)। তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌ আমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট এবং আমার বাবার বাড়ীর কথা আমার মন থেকে মুছে ফেলেছেন।” তারপর তিনি তাঁর দ্বিতীয় ছেলের নাম রাখলেন আফরাহীম (যার মানে “ফলবান”)। তিনি বললেন, “যে দেশে আমি দুঃখ-কষ্ট পেয়েছি সেই দেশেই আল্লাহ্‌ আমাকে ফলবান করেছেন।” এর পর মিসর দেশে প্রচুর ফসলের সাত বছর শেষ হয়ে গেল। তারপর শুরু হল দুর্ভিক্ষের সাত বছর। ইউসুফের কথামতই সব কিছু হল। আশেপাশের দেশগুলোও এই দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পেল না, কিন্তু সারা মিসর দেশে কোথাও খাবারের অভাব হল না। ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে মিসর দেশের লোকেরা যখন ফেরাউনের কাছে গিয়ে খাবার চাইল তখন ফেরাউন তাদের বললেন, “তোমরা ইউসুফের কাছে যাও। তিনি তোমাদের যা করতে বলেন, তোমরা তা-ই কর।” এই দুর্ভিক্ষ দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। মিসর দেশে দুর্ভিক্ষ যখন ভয়ংকর হয়ে উঠল তখন ইউসুফ সমস্ত গোলাঘরগুলো খুলে দিলেন এবং মিসরীয়দের কাছে শস্য বিক্রি করতে লাগলেন। অন্যান্য দেশেও দুর্ভিক্ষ এত ভীষণ হয়ে উঠল যে, সেখানকার লোকেরাও ইউসুফের কাছ থেকে শস্য কিনবার জন্য মিসরে আসতে লাগল। ইয়াকুব যখন শুনতে পেলেন যে, মিসর দেশে খাবার শস্য রয়েছে তখন তিনি তাঁর ছেলেদের বললেন, “তোমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?” তিনি আরও বললেন, “শোন, আমি শুনেছি মিসর দেশে শস্য আছে। তোমরা সেখানে গিয়ে আমাদের জন্য কিছু শস্য কিনে আন যাতে আমরা প্রাণে বেঁচে থাকি, মারা না যাই।” তখন ইউসুফের দশজন ভাই শস্য কিনে আনবার জন্য মিসরে গেল। ইয়াকুব কিন্তু ইউসুফের নিজের ভাই বিন্‌ইয়ামীনকে তাদের সংগে পাঠালেন না। তার কোন বিপদ ঘটতে পারে বলে তাঁর ভয় হচ্ছিল। অন্য যে সব লোক শস্য কিনতে মিসর দেশে যাচ্ছিল তাদের দলে ইসরাইলের ছেলেরাও ছিল, কারণ কেনান দেশেও দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ইউসুফ ছিলেন মিসর দেশের শাসনকর্তা। দেশের সমস্ত লোকের কাছে শস্য বিক্রির ভার তাঁরই উপর ছিল। তাই ইউসুফের ভাইয়েরা তাঁর কাছে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সম্মান দেখাল। ইউসুফ ভাইদের দেখে চিনতে পারলেন, কিন্তু না চেনার ভান করে কর্কশভাবে তাদের বললেন, “তোমরা কোথা থেকে এসেছ?” তারা বলল, “আমরা কেনান দেশ থেকে শস্য কিনতে এসেছি।” ইউসুফ তাঁর ভাইদের চিনতে পারলেও ভাইয়েরা কিন্তু তাঁকে চিনতে পারল না। তাদের সম্বন্ধে তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই কথা তখন তাঁর মনে পড়ল। তিনি তাদের বললেন, “তোমরা গোয়েন্দা। আমাদের দেশের কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় রক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই তোমরা তা দেখে নেওয়ার জন্য এসেছ।” তারা তাঁকে বলল, “না, হুজুর, আপনার গোলামেরা শস্য কিনতে এসেছে। আমরা সবাই একই বাবার সন্তান। আমরা অসৎ নই। আপনার গোলামেরা গোয়েন্দা নয়।” তখন ইউসুফ আবার তাদের বললেন, “না, না, আমাদের দেশের কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় রক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, তোমরা তা দেখে নিতে এসেছ।” কিন্তু তারা বলল, “আপনার গোলামেরা সবসুদ্ধ বারো ভাই। আমরা কেনান দেশের একজন লোকেরই সন্তান। আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাইটি এখন বাবার কাছে রয়েছে, আর আমাদের অন্য এক ভাই বেঁচে নেই।” ইউসুফ তাদের বললেন, “আমি তোমাদের সম্বন্ধে যা বলেছি তা-ই ঠিক, তোমরা গোয়েন্দা। এতেই তোমাদের পরীক্ষা হয়ে যাবে- তোমাদের ছোট ভাই যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এখান থেকে ছাড়া পাবে না। আমার এই কথাটা আমি ফেরাউনের জীবনের কসম খেয়েই বলছি। তোমাদের ছোট ভাইকে নিয়ে আসবার জন্য তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে পাঠিয়ে দাও, আর বাকীরা সব বন্দী থাক। তোমাদের কথা সত্যি কি না এতেই তার প্রমাণ হবে। কিন্তু যদি তাকে নিয়ে না আস তবে ফেরাউনের জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, তোমরা গোয়েন্দা।” এই বলে ইউসুফ তিন দিন পর্যন্ত তাদের সবাইকে জেলখানায় বন্দী করে রাখলেন। তৃতীয় দিনে ইউসুফ তাদের বললেন, “আমি যা বলছি তা কর এবং প্রাণ রক্ষা কর, কারণ আমি আল্লাহ্‌কে ভয় করি। তোমরা যদি সত্যিই সৎ লোক হও তবে তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকে একজন এই জেলখানায় বন্দী থাকুক, আর বাকী সবাই তোমাদের উপবাসী পরিবারের জন্য খাবার নিয়ে চলে যাক। তোমাদের কথা যে সত্যি তা প্রমাণ করবার জন্য তোমাদের ছোট ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এস। তা হলেই তোমরা মৃত্যু থেকে রেহাই পাবে।” তারা তাতেই রাজী হল। তারপর তারা একে অন্যকে বলল, “সত্যিই আমাদের সেই ভাইয়ের প্রতি আমরা যা করেছি তাতে আমরা দোষী। সে যখন আমাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করছিল তখন তার মনের কষ্ট দেখেও আমরা তার কথায় কান দিই নি। সেইজন্য আমাদের উপর এই কষ্ট এসেছে।” রূবেণ তাদের বলল, “আমি তো তোমাদের বলেছিলাম, ‘তার প্রতি কোন অন্যায় কোরো না,’ কিন্তু তোমরা তা শোন নি। এখন তার রক্তের শোধ দেবার সময় এসেছে।” ইউসুফ যে তাদের কথাগুলো বুঝতে পারছেন তা তারা বুঝল না, কারণ দোভাষীর মধ্য দিয়ে তিনি তাদের সংগে কথাবার্তা বলছিলেন। ইউসুফ তখন তাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন, তারপর ফিরে এসে তাদের সংগে আবার কথা বললেন। তিনি তাদের মধ্য থেকে শিমিয়োনকে বেছে নিয়ে তাদের চোখের সামনেই তাকে বাঁধবার হুকুম দিলেন। পরে ইউসুফ হুকুম দিলেন যেন তাদের বস্তাগুলো শস্য দিয়ে ভরে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেকের টাকা তার বস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া পথের জন্য তাদের যা দরকার তা দেবার হুকুমও তিনি দিলেন। ইউসুফের হুকুম মতই তাদের জন্য সব কিছু করা হল। এর পর তারা তাদের গাধার পিঠে শস্যের বোঝা চাপিয়ে রওনা হয়ে গেল। বিশ্রামের জায়গায় পৌঁছে তাদের মধ্যে একজন যখন গাধাকে খাবার দিতে গিয়ে বস্তা খুলল তখনই সে তার টাকাটা দেখতে পেল। টাকাটা বস্তার মুখেই ছিল। তখন সে তার ভাইদের বলল, “দেখ, দেখ, আমার টাকা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। আমার বস্তাতেই সেই টাকা রয়েছে।” এই ব্যাপার দেখে ভয়ে যেন তাদের প্রাণ উড়ে গেল। তারা কাঁপতে কাঁপতে একে অন্যের দিকে ফিরে বলল, “আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতি এ কি করলেন!” কেনান দেশে ফিরে গিয়ে তারা তাদের বাবাকে সব কথা জানিয়ে বলল, “যে লোকটি সেই দেশের কর্তা তিনি খুব কর্কশভাবে আমাদের সংগে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেছেন আমরা গোয়েন্দা হিসাবে সেই দেশে গিয়েছি। কিন্তু আমরা তাঁকে বলেছি, ‘আমরা সৎ লোক, গোয়েন্দা নই। আমরা বারো ভাই, একই বাবার বারোটি ছেলে। আমাদের মধ্যে একজন মারা গেছে, আর সবচেয়ে ছোটটি এখন কেনান দেশে বাবার কাছে রয়েছে।’ “তখন সেই লোকটি, যিনি দেশের কর্তা, তিনি আমাদের বললেন, ‘আমি এর থেকেই বুঝে নেব যে, তোমরা সৎ লোক। তোমরা তোমাদের এক ভাইকে আমার কাছে রেখে তোমাদের উপবাসী পরিবারের জন্য যা দরকার তা নিয়ে চলে যাও, আর তোমাদের ছোট ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এস। তাহলেই আমি বুঝতে পারব যে, তোমরা সৎ লোক, গোয়েন্দা নও। তখন আমি তোমাদের ভাইকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেব, আর তোমরা এই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে।’ ” এর পর তারা তাদের বস্তা খালি করবার সময় অবাক হয়ে দেখল যে, তাদেরও প্রত্যেকের টাকার থলি প্রত্যেকের বস্তার মধ্যেই রয়েছে। এই ব্যাপার দেখে তারা ও তাদের পিতা ভয় পেলেন। তিনি তাদের বললেন, “তোমরা আমাকে সন্তানহারা করেছ। ইউসুফ নেই, শিমিয়োন নেই, আর এখন আবার তোমরা বিন্‌ইয়ামীনকেও নিতে চাইছ। এই সব কষ্টের বোঝা আমাকেই বইতে হবে।” তখন রূবেণ তার বাবাকে বলল, “আমি যদি বিন্‌ইয়ামীনকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনতে না পারি তবে তুমি আমার দুই ছেলেকে হত্যা কোরো। বিন্‌ইয়ামীনকে তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবই।” কিন্তু ইয়াকুব বললেন, “না, আমার এই ছেলে তোমাদের সংগে যাবে না। তার ভাই মারা গেছে, আর সে এখন একাই বেঁচে আছে। তোমাদের যাত্রাপথে যদি তার কোন বিপদ হয় তবে এই বুড়ো বয়সে অনেক দুঃখ দিয়ে তোমরা আমাকে কবরে পাঠাবে।” কেনান দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা আরও ভীষণ হয়ে উঠল। মিসর দেশ থেকে ইসরাইলের, অর্থাৎ ইয়াকুবের ছেলেরা যে শস্য এনেছিল তা শেষ হয়ে গেলে পর তাদের পিতা বললেন, “তোমরা আবার গিয়ে আমাদের জন্য কিছু শস্য কিনে আন।” এহুদা তাঁকে বলল, “কিন্তু সেই লোকটি আমাদের কড়াভাবে হুম্‌কি দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের ভাই তোমাদের সংগে না থাকলে তোমরা আর আমার সামনে আসবে না।’ তুমি যদি আমাদের ভাইকে আমাদের সংগে যেতে দাও তবেই আমরা গিয়ে তোমার জন্য শস্য কিনে আনতে পারব। কিন্তু তাকে যেতে না দিলে আমরাও যাব না। লোকটি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের ভাই তোমাদের সংগে না থাকলে তোমরা আর আমার সামনে আসবে না।’ ” তখন ইসরাইল বললেন, “তোমরা আমার সংগে কেন এমন খারাপ ব্যবহার করলে? তোমাদের যে আর একজন ভাই আছে সেই কথা কেন বলতে গেলে?” তারা বলল, “কিন্তু লোকটি আমাদের ও আমাদের পরিবার সম্বন্ধে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের পিতা কি এখনও বেঁচে আছেন? তোমাদের কি আর কোন ভাই আছে?’ কাজেই আমরা সেইভাবেই তাঁর কথার জবাব দিয়েছিলাম। তখন আমরা কি করে জানব যে, তিনি বলবেন, ‘তোমাদের ভাইকে নিয়ে এস’?” তখন এহুদা তার বাবাকে বলল, “ওকে আমার সংগে যেতে দাও। আমরা তাড়াতাড়ি করে রওনা হয়ে যাই যাতে তুমি ও আমরা এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রাণে বেঁচে থাকি, মারা না যাই। আমি নিজেই ওর জন্য জামিন রইলাম। ওর জন্য তুমি আমাকেই দায়ী কোরো। আমি যদি ওকে তোমার কাছে ফিরিয়ে না এনে দিই তবে চিরকাল আমি তোমার কাছে দোষী হয়ে থাকব। যদি আমরা এত দেরি না করতাম তবে নিশ্চয়ই এতদিনে আমরা আরও দু’বার গিয়ে ফিরে আসতে পারতাম।” তাদের পিতা তখন বললেন, “যদি তা-ই করতে হয়, তবে এক কাজ কর। উপহার হিসাবে সেই লোকটির জন্য তোমাদের বস্তায় করে এই দেশের সবচেয়ে ভাল ভাল জিনিস থেকে কিছু কিছু করে নিয়ে যাও, যেমন গুগ্‌গুলু, মধু, খোশবু-মসলা, গন্ধরস, পেস্তা ও বাদাম। আর তোমরা সংগে করে দ্বিগুণ টাকা নাও, কারণ বস্তার মুখে যে টাকা তারা ফিরিয়ে দিয়েছে তা-ও ফেরৎ দিতে হবে। হয়তো তারা ভুল করে তা দিয়ে দিয়েছে। তোমাদের ভাইকে সংগে নিয়ে তোমরা তাড়াতাড়ি করে সেই লোকটির কাছে ফিরে যাও। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ করুন যেন সেই লোকটি তোমাদের দয়া করেন, আর তোমাদের সেই ভাই ও বিন্‌ইয়ামীনকে তোমাদের হাতে ছেড়ে দেন; আর যদি আমাকে সন্তানহারা হতেই হয় তবে না হয় তা-ই হলাম।” তখন তারা সেই উপহার, দ্বিগুণ টাকা ও বিন্‌ইয়ামীনকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। মিসর দেশে পৌঁছে তারা ইউসুফের সামনে উপস্থিত হল। তাদের সংগে বিন্‌ইয়ামীনকে দেখে ইউসুফ তাঁর বাড়ীর তদারককারীকে বললেন, “ঐ লোকদের বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাও আর গোশ্‌ত রান্নার ব্যবস্থা কর। এই সব লোক দুপুরবেলা আমার সংগে খাবে।” ইউসুফ যা বললেন তদারককারী তা-ই করল। সে ঐ লোকদের ইউসুফের বাড়ীতে নিয়ে চলল। ইউসুফের বাড়ীতে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে সেই লোকেরা ভয়ে বলাবলি করতে লাগল, “আগের বারে যে টাকা আমাদের বস্তার মধ্যে ফেরৎ গিয়েছিল তারই জন্য আমাদের ওখানে নেওয়া হচ্ছে। এইবার তিনি আমাদের দোষ দেখিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে যাবেন, আর আমাদের গাধাগুলো কেড়ে নিয়ে আমাদের তাঁর গোলাম বানিয়ে রাখবেন।” কাজেই তারা ইউসুফের বাড়ীর দরজার সামনে এসে বাড়ীর তদারককারীকে বলল, “হুজুর, আমরা এর আগেও একবার শস্য কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু ফিরে যাবার পথে বিশ্রামের জায়গায় পৌঁছে আমাদের বস্তা খুলতেই দেখি আমাদের পুরো টাকাই যার যার বস্তার মুখে রয়েছে। আমরা এখন সেই টাকা ফিরিয়ে এনেছি। এছাড়া শস্য কিনবার জন্য সংগে করে আমরা আরও টাকা এনেছি। সেই টাকা আমাদের বস্তায় কে দিয়ে দিয়েছিল তা আমরা জানি না।” সেই তদারককারী বলল, “সব ঠিক আছে, ভয় নেই। তোমাদের ও তোমাদের বাবার আল্লাহ্‌ই সেই দান তোমাদের বস্তায় রেখেছিলেন। তোমাদের টাকা আমি পেয়েছি।” এই বলে সে শিমিয়োনকে বের করে তাদের কাছে নিয়ে আসল। তারপর সে সবাইকে ইউসুফের বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গিয়ে পানি দিল আর তারা পা ধু’ল। সে তাদের গাধাগুলোকেও খেতে দিল। ইউসুফ দুপুরে আসবেন বলে তারা তাদের উপহারগুলো ঠিক করে রাখল। তারা শুনেছিল তাদের খাওয়া-দাওয়া সেখানেই হবে। ইউসুফ যখন বাড়ী আসলেন তখন তারা তাদের সেই উপহার বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে দিল এবং মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানাল। তারা ভাল আছে কিনা সেই খবর নেবার পরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের যে বুড়ো বাবার কথা তোমরা বলেছিলে তিনি কি ভাল আছেন? তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন?” জবাবে তারা বলল, “আপনার গোলাম আমাদের পিতা এখনও বেঁচে আছেন এবং ভালই আছেন।” এই বলে তারা মাটিতে উবুড় হয়ে ইউসুফকে সম্মান দেখাল। ইউসুফ চারদিকে চেয়ে তাঁর নিজের ভাই বিন্‌ইয়ামীনকে দেখে বললেন, “এ-ই কি তোমাদের সেই ছোট ভাই যার কথা তোমরা আমাকে বলেছিলে?” তারপর তিনি বিন্‌ইয়ামীনকে বললেন, “আল্লাহ্‌ তোমাকে রহমত দান করুন!” ভাইকে দেখে ইউসুফের অন্তর ভীষণভাবে দুলে উঠল। তিনি একটা কাঁদবার জায়গার খোঁজে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন এবং নিজের কামরায় ঢুকে কাঁদতে লাগলেন। পরে চোখ-মুখ ধুয়ে তিনি বের হয়ে আসলেন এবং নিজেকে সামলে নিয়ে খাবার পরিবেশনের হুকুম দিলেন। পরিবেশনকারীরা ইউসুফকে, তাঁর ভাইদের এবং যে মিসরীয়রা ইউসুফের বাড়ীতে খেত, তাদের আলাদা আলাদা জায়গায় খেতে দিল। মিসরীয়রা ইবরানীদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করত না, কারণ সেটা ছিল তাদের কাছে একটা ঘৃণার কাজ। ইউসুফের সামনে তাঁর ভাইদের বয়স অনুসারে পর পর বসানো হয়েছিল। এতে তারা আশ্চর্য হয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। ইউসুফ তাঁর নিজের টেবিল থেকে কিছু কিছু খাবার ভাইদের দেবার ব্যবস্থা করলেন। অন্য যে কোন ভাইয়ের চেয়ে বিন্‌ইয়ামীনকে পাঁচগুণ বেশী দেওয়া হল। এইভাবে তারা ইউসুফের সংগে খাওয়া-দাওয়া করল। প্রচুর পরিমাণে আংগুর-রস খেয়ে তারা খুশী হয়ে উঠল। তারপর ইউসুফ তাঁর বাড়ীর তদারককারীকে এই বলে হুকুম দিলেন, “শস্য এরা যা নিয়ে যেতে পারে তা-ই তাদের বস্তায় ভরে দিয়ো, আর প্রত্যেকের টাকা তার বস্তার মুখে দিয়ে দিয়ো। যে সবচেয়ে ছোট তার বস্তার মুখে আমার রূপার পেয়ালাটা আর শস্যের জন্য তার দেওয়া টাকাও দিয়ে দিয়ো।” ইউসুফ তাকে যা করতে বললেন সে তা-ই করল। পর দিন খুব ভোরেই গাধায় করে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল। তারা সবেমাত্র শহর থেকে বের হয়েছে কিন্তু বেশী দূরে যায় নি, এমন সময় ইউসুফ তাঁর বাড়ীর তদারককারীকে বললেন, “তাড়াতাড়ি করে ঐ লোকদের পিছনে যাও। ওদের নাগাল পেলে পর বলবে, ‘তোমরা উপকারের বদলে অপকার করে আসলে কেন? ঐ পেয়ালাতে করেই তো আমার কর্তা পান করেন এবং ওটা দিয়েই গোণাপড়ার কাজ করেন। তোমরা এই কাজ করে খুব অন্যায় করেছ।’ ” পথে সেই তদারককারী তাদের নাগাল পেয়ে সেই কথা বলল। কিন্তু তারা তাকে বলল, “হুজুর, আপনি এই সব কথা কেন বলছেন? আপনার গোলামেরা এই রকম কাজ কখনও করবে না। দেখুন, গতবারে আমাদের বস্তার মুখে যে টাকা পেয়েছিলাম তা আমরা কেনান দেশ থেকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলাম। এর পর আপনার কর্তার বাড়ী থেকে আমরা রূপা বা সোনা চুরি করে আনব কেন? যদি সেই পেয়ালা আপনার এই গোলামদের কারও কাছে পাওয়া যায় তবে তাকে যেন মেরে ফেলা হয়, আর তখন আমরাও আমাদের প্রভুর গোলাম হয়ে থাকব।” সেই তদারককারী বলল, “বেশ, তোমরা যা বললে তা-ই হোক। কিন্তু যার কাছে সেই পেয়ালা পাওয়া যাবে কেবল সে-ই আমার গোলাম হয়ে থাকবে। অন্য কারও কোন দোষ থাকবে না।” তখন প্রত্যেকে তাড়াতাড়ি করে তার বস্তা মাটিতে নামিয়ে খুলল। সেই তদারককারী তখন বড় ভাইয়ের বস্তা থেকে শুরু করে ছোট ভাইয়ের বস্তা পর্যন্ত খুঁজে দেখল, আর বিন্‌ইয়ামীনের বস্তায় সেই পেয়ালা পাওয়া গেল। এই ব্যাপার দেখে তারা তাদের কাপড় ছিঁড়ল। তারপর তারা তাদের গাধার পিঠে প্রত্যেকের বস্তা চাপিয়ে আবার শহরে ফিরে গেল। এহুদা ও তার ভাইয়েরা যে সময় ইউসুফের বাড়ীতে গেল ইউসুফ তখনও সেখানে ছিলেন। তারা তাঁর সামনে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ল। তখন ইউসুফ তাদের বললেন, “তোমরা এ কি করেছ? আমার মত লোক যে সত্যিই সব কিছু গুণে বের করতে পারে তা কি তোমরা জানতে না?” এহুদা বলল, “হুজুরকে আমরা আর কি বলব? কি জবাবই বা দেব? আর কেমন করেই বা নিজেদের নির্দোষ বলে প্রমাণ করব? আপনার গোলামদের দোষ তো আল্লাহ্‌ই দেখিয়ে দিয়েছেন। যার কাছে সেই পেয়ালাটা পাওয়া গেছে সে আর আমরা সবাই হুজুরের গোলাম হলাম।” কিন্তু ইউসুফ বললেন, “এই কাজ আমি কখনও করতে পারি না। যার কাছে সেই পেয়ালা পাওয়া গেছে কেবল সে-ই আমার গোলাম হবে। কিন্তু তোমরা নিশ্চিন্তে তোমাদের বাবার কাছে ফিরে যাও।” তখন এহুদা ইউসুফের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “হুজুর, আপনি ফেরাউনের জায়গায় আছেন, সেইজন্য আপনার গোলামকে আপনার কাছে দু’টি কথা বলবার অনুমতি দিন। আপনার গোলামের উপর আপনি রাগ করবেন না। হুজুর, আপনার গোলামদের আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমাদের বাবা কি বেঁচে আছেন এবং তোমাদের আর কোন ভাই আছে কি?’ তাতে আমরা হুজুরকে বলেছিলাম, ‘আমাদের বুড়ো পিতা বেঁচে আছেন এবং তাঁর বুড়ো বয়সের একটি ছেলে আছে। তার ভাই মারা গেছে, আর একই মায়ের সন্তান হিসাবে এখন সে একাই কেবল পড়ে আছে। তাই তার বাবা তাকে খুব ভালবাসেন।’ “তারপর আপনি আপনার গোলামদের বলেছিলেন, ‘তাকে আমার কাছে নিয়ে এস; আমি তাকে দেখতে চাই।’ কিন্তু আমরা হুজুরকে বলেছিলাম, ‘ছেলেটি তার বাবাকে ছেড়ে আসতে পারবে না। যদি আসে তবে তার পিতা মারা যাবেন।’ কিন্তু আপনি আপনার গোলামদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের ছোট ভাইকে সংগে করে না আনলে তোমরা আর আমার সামনে আসবে না।’ সেইজন্য আমরা ফিরে গিয়ে আপনার গোলামকে, অর্থাৎ আমার বাবাকে হুজুরের সব কথাই জানিয়েছিলাম। “পরে আমাদের পিতা বললেন, ‘তোমরা ফিরে গিয়ে আমাদের জন্য আরও কিছু শস্য কিনে নিয়ে এস।’ তখন আমরা বললাম, ‘আমাদের ছোট ভাই যদি আমাদের সংগে যায় তবেই আমরা যাব। তা না হলে আমরা সেখানে যেতে পারব না। আমাদের ছোট ভাই যদি আমাদের সংগে না থাকে তবে আমরা সেই লোকটির সামনেই যেতে পারব না।’ “তখন আপনার গোলাম, অর্থাৎ আমার পিতা আমাদের বললেন, ‘তোমরা তো জান আমার ঐ স্ত্রীর দু’টি ছেলে হয়েছিল। একবার তাদের একজন আমার সামনে থেকে বেরিয়ে গেল, আর শেষে আমি বুঝতে পারলাম যে, নিশ্চয়ই কোন জানোয়ার তাকে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেছে। তারপর থেকে তাকে আমি আর দেখতে পাই নি। এখন যদি তোমরা একেও আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও আর তার কোন ক্ষতি হয়, তবে এই বুড়ো বয়সে অনেক দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়ে তোমরা আমাকে কবরে পাঠাবে।’ আপনার গোলাম আমি আমার বাবার কাছে ছেলেটির জন্য এই বলে জামিন রয়েছি, ‘যদি আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে না আনি তবে বাবা, চিরকালের জন্য আমি তোমার কাছে দোষী হয়ে থাকব।’ কাজেই হুজুর, দয়া করে ছেলেটির বদলে আমাকে আপনার গোলামের মত করে রাখুন, আর ছেলেটিকে তার ভাইদের সংগে ফিরে যেতে দিন। এই ছেলেটিকে না নিয়ে আমি কি করে আমার বাবার কাছে ফিরে যাব? তা করলে তাঁর দুঃখ-বেদনা আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে।” তখন ইউসুফ তাঁর কর্মচারীদের সামনে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। তিনি জোর গলায় বললেন, “আমার সামনে থেকে সবাই সরে যাক।” কাজেই ভাইদের কাছে যখন তিনি নিজের পরিচয় দিলেন তখন সেখানে আর কেউ ছিল না। তিনি এত জোরে কাঁদতে লাগলেন যে, মিসরীয়রা তা শুনতে পেল এবং সেই খবর ফেরাউনের বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছাল। ইউসুফ তাঁর ভাইদের বললেন, “আমি ইউসুফ! আমার বাবা কি এখনও বেঁচে আছেন?” এই কথা শুনে তাঁর ভাইয়েরা ভয়ে কাঁপতে লাগল; তারা তাঁর কথার জবাবই দিতে পারল না। তখন ইউসুফ তাঁর ভাইদের বললেন, “তোমরা আমার কাছে এস।” তারা কাছে আসলে পর তিনি বললেন, “আমিই তোমাদের সেই ভাই ইউসুফ; যারা মিসরে যাচ্ছিল তাদের কাছে তোমরা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিলে। তবে তোমরা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিলে বলে এখন দুঃখ পেয়ো না বা নিজেদের উপর রাগ কোরো না। মানুষের প্রাণ রক্ষা করবার জন্যই আল্লাহ্‌ তোমাদের আগে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ চলছে এই দু’বছর ধরে। এটা আরও পাঁচ বছর চলবে। তখন ফসল বোনাও হবে না কাটাও হবে না। দুনিয়াতে বিশেষ করে তোমাদের বংশ বাঁচিয়ে রাখবার জন্য এবং ধ্বংসের হাত থেকে আশ্চর্যভাবে উদ্ধার করে তোমাদের প্রাণ রক্ষা করবার জন্য আল্লাহ্‌ই তোমাদের আগে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, তোমরা আমাকে এখানে পাঠাও নি, আল্লাহ্‌ই পাঠিয়েছেন। তিনি আমাকে ফেরাউনের বাবার জায়গায় রেখেছেন এবং তাঁর পরিবারের কর্তা করেছেন। এছাড়া তিনি আমাকে সারা মিসর দেশের শাসনকর্তা করেছেন। “এখন তোমরা তাড়াতাড়ি করে বাবার কাছে গিয়ে বল যে, তাঁর ছেলে ইউসুফ এই কথা বলছে, ‘আল্লাহ্‌ আমাকে সারা মিসর দেশের কর্তা করেছেন। তুমি আর দেরি না করে আমার কাছে চলে এস। তুমি এসে গোশন এলাকায় বাস কর। তাতে তুমি, তোমার ছেলেমেয়ে, তোমার নাতিপুতি, তোমার পশু ও ভেড়ার পাল এবং তোমার যা কিছু আছে সব নিয়ে আমার কাছে থাকতে পারবে। তোমার, তোমার পরিবারের ও তোমার আর সকলের যাতে কোন অভাব না হয় সেইজন্য আমি সেখানেই তোমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করব, কারণ দুর্ভিক্ষ শেষ হতে এখনও পাঁচ বছর বাকী আছে।’ “আমি যে নিজের মুখেই এই সব বলছি তা তোমরা নিজের চোখেই দেখছ, আর আমার ভাই বিন্‌ইয়ামীনও দেখছে। মিসর দেশে আমার যত মান-সম্মান আর যা কিছু দেখছ তার সবই গিয়ে বাবাকে নিশ্চয় জানাবে। এখন তোমরা তাড়াতাড়ি করে গিয়ে বাবাকে এখানে নিয়ে এস।” এর পর ইউসুফ তাঁর ভাই বিন্‌ইয়ামীনের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন আর বিন্‌ইয়ামীনও তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তারপর ইউসুফ তাঁর সব ভাইকে চুম্বন করলেন এবং তাদেরও গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। তখন তাঁর ভাইয়েরা তাঁর সংগে কথা বলল। ইউসুফের ভাইদের আসবার খবর ফেরাউনের বাড়ীতে পৌঁছালে পর ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীরা খুশী হলেন। ফেরাউন ইউসুফকে বললেন, “তোমার ভাইদের বল যেন তারা তাদের গাধার পিঠে শস্য বোঝাই করে কেনান দেশে ফিরে যায়, আর তাদের পিতা ও তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে তোমার কাছে চলে আসে। তুমি তাদের জানিয়ে দাও যে, মিসর দেশের সবচেয়ে ভাল ভাল জিনিস তুমি তাদের দেবে আর দেশের সবচেয়ে ভাল খাবার তারা খেতে পাবে। এছাড়া তোমার উপর আমার এই হুকুম রইল যে, তুমি তোমার ভাইদের বলবে যেন তারা তাদের স্ত্রী ও ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য মিসর দেশ থেকে গাড়ী নিয়ে যায়, আর তাদের বাবাকে নিয়ে চলে আসে। তারা যেন সংসারের জিনিসপত্রের জন্য না ভাবে, কারণ সারা মিসর দেশের ভাল ভাল জিনিসই তো তাদের।” ইসরাইলের ছেলেরা তা-ই করল। ফেরাউনের হুকুম অনুসারে ইউসুফ তাদের জন্য গাড়ী ও পথের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের প্রত্যেককে এক সেট করে কাপড় দিলেন, কিন্তু বিন্‌ইয়ামীনকে দিলেন পাঁচ সেট কাপড় আর তিনশো রূপার টুকরা। তিনি তাঁর বাবার জন্য দশটা গাধা এবং দশটা গাধী পাঠিয়ে দিলেন। সেই দশটা গাধার পিঠে মিসরের ভাল ভাল জিনিস বোঝাই করা ছিল, আর গাধীগুলোর পিঠে ছিল শস্য, রুটি আর অন্যান্য খাবার জিনিস। এগুলো ছিল তাঁর বাবার যাত্রা পথের খাবার। এই সব ব্যবস্থা করে তিনি তাঁর ভাইদের পাঠিয়ে দিলেন। যাবার সময় তিনি তাদের বলে দিলেন, “তোমরা পথে ঝগড়া-বিবাদ কোরো না।” কিন্তু ইউসুফ তাদের যা যা বলেছিলেন তা শুনে এবং তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য ইউসুফ যে গাড়ী পাঠিয়েছিলেন তা দেখে তাদের পিতা ইয়াকুবের সেই ভাবটা কেটে গেল। তিনি বললেন, “আমার ছেলে ইউসুফ যে এখনও বেঁচে আছে সেটাই যথেষ্ট। মরবার আগে আমি গিয়ে তাকে একবার দেখব।” ইসরাইল তাঁর সব কিছু নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বের্‌-শেবাতে এসে তিনি তাঁর পিতা ইসহাকের আল্লাহ্‌র প্রতি কয়েকটা কোরবানী দিলেন। আল্লাহ্‌ রাতের বেলায় ইসরাইলকে দর্শনের মধ্য দিয়ে তাঁর সংগে কথা বললেন। তিনি ডাকলেন, “ইয়াকুব, ইয়াকুব।” ইয়াকুব জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” আল্লাহ্‌ বললেন, “আমি আল্লাহ্‌, তোমার বাবার আল্লাহ্‌। মিসর দেশে যেতে ভয় কোরো না, কারণ আমি সেখানে তোমার মধ্য থেকে একটা মস্ত বড় জাতির সৃষ্টি করব। আমি তোমার সংগে সংগে মিসরে যাব এবং আবার আমি তোমাকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিয়ে আসব। মৃত্যুকালে ইউসুফ নিজের হাতে তোমার চোখ বন্ধ করে দেবে।” এর পর ইয়াকুব বের্‌-শেবা ছেড়ে রওনা হলেন। ফেরাউন তাঁদের নিয়ে যাবার জন্য যে সব গাড়ী পাঠিয়েছিলেন ইসরাইলের ছেলেরা তাতে করেই তাদের বাবাকে এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলল। যে সব পশু ও ধন-সম্পত্তি তারা কেনান দেশে লাভ করেছিল সেই সব নিয়ে ইয়াকুব ও তাঁর পরিবারের সবাই মিসরে গেলেন। ইয়াকুব তাঁর ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাত্‌নীদের, অর্থাৎ তাঁর বংশের সবাইকে নিয়ে মিসরে গেলেন। ইসরাইলীয়রা, অর্থাৎ ইয়াকুব ও তাঁর বংশের লোকেরা যারা মিসরে গিয়েছিল তাদের তালিকা: ইয়াকুবের বড় ছেলে রূবেণ। রূবেণের ছেলে হনোক, পল্‌লু, হিষ্রোণ ও কর্মি। শিমিয়োনের ছেলে যিমূয়েল, যামীন, ওহদ, যাখীন, সোহর ও শৌল। শৌল একজন কেনানীয় স্ত্রীলোকের সন্তান। লেবির ছেলে গের্শোন, কহাৎ ও মরারি। এহুদার ছেলে এর, ওনন, শেলা, পেরস ও সেরহ। এর ও ওনন কেনান দেশেই মারা গিয়েছিল। পেরসের ছেলে হিষ্রোণ ও হামূল। ইষাখরের ছেলে তোলয়, পূয়, যোব ও শিম্রোণ। সবূলূনের ছেলে সেরদ, এলোন ও যহলেল। মেয়ে দীণাসুদ্ধ এরা ছিল লেয়ার মধ্য দিয়ে ইয়াকুবের বংশধর। এরা পদ্দন-ইরামে জন্মেছিল। ইয়াকুবের এই বংশধরেরা ছিল মোট তেত্রিশজন। গাদের ছেলে সিফিয়োন, হগি, শূনী, ইষ্‌বোন, এরি, অরোদী ও অরেলী। আশেরের ছেলে যিম্না, যিশ্‌বা, যিশ্‌বি, বরিয় ও তাদের বোন সেরহ। বরিয়ের ছেলে হেবর ও মল্কীয়েল। লাবন তাঁর মেয়ে লেয়াকে সিল্পা নামে যে বাঁদী দিয়েছিলেন এরা সবাই তার মধ্য দিয়ে ইয়াকুবের বংশধর। সিল্পা ও ইয়াকুবের এই বংশধরেরা ছিল মোট ষোলজন। ইয়াকুবের স্ত্রী রাহেলার ছেলে ইউসুফ ও বিন্‌ইয়ামীন। ইউসুফের ছেলে মানশা ও আফরাহীম মিসর দেশে জন্মেছিল। এদের মা ছিলেন হেলিওপলিস শহরের পুরোহিত পোটীফেরের মেয়ে আসনৎ। বিন্‌ইয়ামীনের ছেলে বেলা, বেখর, অস্‌বেল, গেরা, নামন, এহী, রোশ, মুপ্‌পীম, হুপ্‌পীম ও অর্দ। এরা ছিল রাহেলার মধ্য দিয়ে ইয়াকুবের বংশধর। এরা ছিল মোট চৌদ্দজন। দানের ছেলে হূশীম। নপ্তালির ছেলে যহসিয়েল, গূনি, যেৎসর ও শিল্লেম। লাবন তাঁর মেয়ে রাহেলকে বিল্‌হা নামে যে বাঁদী দিয়েছিলেন, এরা সবাই তার মধ্য দিয়ে ইয়াকুবের বংশধর। ইয়াকুব ও বিল্‌হার এই বংশধরেরা মোট ছিল সাতজন। ইয়াকুবের সংগে যারা মিসর দেশে গিয়েছিল, অর্থাৎ তাঁর নিজের বংশধরেরা ছিল মোট ছেষট্টিজন; এই সংখ্যার মধ্যে তাঁর ছেলেদের স্ত্রীদের ধরা হয় নি। মিসর দেশে ইউসুফের যে দু’টি ছেলের জন্ম হয়েছিল এবং ইয়াকুবের পরিবারের যারা মিসরে গিয়েছিল তারা ছিল মোট সত্তরজন। ইয়াকুব আগে এহুদাকে ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ইউসুফ এহুদাকে গোশনে যাবার পথ দেখিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সবাই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ইউসুফ তাঁর বাবা ইসরাইলের সংগে দেখা করবার জন্য তাঁর রথ সাজিয়ে নিয়ে গোশনে গেলেন। বাবার সংগে দেখা হতেই তিনি তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। পরে ইসরাইল ইউসুফকে বললেন, “তুমি যে এখনও বেঁচে আছ তা আমি নিজের চোখেই দেখলাম। এখন আমি মরতে প্রস্তুত আছি।” এর পর ইউসুফ তাঁর ভাইদের ও তাঁর বাবার পরিবারের অন্যান্য লোকদের বললেন, “আমি ফেরাউনের কাছে গিয়ে বলব, ‘আমার ভাইয়েরা ও আমার বাবার বংশের লোকজন কেনান দেশ থেকে আমার কাছে এসেছেন। পশুপালনই তাঁদের কাজ; তাঁরা ছাগল-ভেড়া চরান, আর সেইজন্য সংগে করে তাঁরা তাঁদের ছাগল, ভেড়া, গরু ও সমস্ত জিনিসপত্র এনেছেন।’ ফেরাউন তোমাদের ডেকে যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আপনারা কি কাজ করেন?’ তখন তোমরা বলবে, ‘আপনার এই গোলামেরা ও তাদের পূর্বপুরুষেরা ছোটকাল থেকে এই পর্যন্ত পশু পালন করে আসছে।’ তাতে তোমরা গোশনে বাস করবার অনুমতি পাবে। যারা ছাগল-ভেড়া চরায় মিসরীয়রা তাদের ঘৃণার চোখে দেখে।” ইউসুফ ফেরাউনের কাছে গিয়ে বললেন, “আমার বাবা ও ভাইয়েরা তাঁদের ছাগল, ভেড়া, গরু এবং তাঁদের সব কিছু নিয়ে কেনান দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন। তাঁরা এখন গোশনে এসে পৌঁছেছেন।” ভাইদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে তিনি ফেরাউনের সামনে উপস্থিত করলেন। ফেরাউন তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কি কাজ করেন?” তারা বলল, “আপনার এই গোলামেরা ছাগল-ভেড়া চরায়। তাদের পূর্বপুরুষেরাও তাই করতেন।” তারা আরও বলল, “আমরা এই দেশে কিছুকালের জন্য থাকতে এসেছি। কেনান দেশে এখন ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছে বলে সেখানে আমাদের ছাগল-ভেড়ার চরে খাবার ঘাস নেই। তাই দয়া করে আপনার গোলামদের গোশনে থাকবার অনুমতি দিন।” ফেরাউন ইউসুফকে বললেন, “তোমার পিতা ও ভাইয়েরা তোমার কাছেই এসেছেন। গোটা মিসর দেশটাই তো তোমার সামনে পড়ে আছে। দেশের সবচেয়ে ভাল জায়গায় তোমার পিতা ও ভাইদের বাস করতে দাও। তাঁরা গোশনেই বাস করুন। তাঁদের মধ্যে যোগ্য লোক পেলে তাঁদের উপর আমার পশুপালেরও ভার দাও।” এর পর ইউসুফ তাঁর পিতা ইয়াকুবকে এনে ফেরাউনের সামনে উপস্থিত করলেন, আর ইয়াকুব ফেরাউনকে দোয়া করলেন। ফেরাউন ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার বয়স কত হল?” ইয়াকুব বললেন, “এই দুনিয়াতে কিছুদিনের বাসিন্দা হিসাবে আমার একশো ত্রিশ বছর কেটে গেছে। এই দিনগুলোর সংখ্যা খুব বেশী নয়, আর তা দুঃখেই কেটেছে। তবে কিছুদিনের বাসিন্দা হিসাবে আমার পূর্বপুরুষেরা যতদিন কাটিয়ে গেছেন আমি ততদিন কাটাতে পারি নি।” এর পর ইয়াকুব ফেরাউনকে দোয়া করে সেখান থেকে বিদায় নিলেন। ইউসুফ তাঁর পিতা ও ভাইদের স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। ফেরাউনের হুকুম মত মিসর দেশের সবচেয়ে ভাল জায়গাটাই তিনি তাঁদের সম্পত্তি হিসাবে দান করলেন। জায়গাটার নাম ছিল রামিষেষ। ইউসুফ তাঁর বাবা, ভাইদের ও তাঁদের পরিবারগুলোকে খাবারের যোগান দিতে লাগলেন। ছেলেমেয়েদের সংখ্যা হিসাবেই তা দেওয়া হত। পরে দুর্ভিক্ষের অবস্থা এমন ভীষণ হয়ে উঠল যে, সারা দেশের কোথাও আর খাবার রইল না। দুর্ভিক্ষের দরুন মিসর এবং কেনান দেশ একেবারে কাহিল হয়ে পড়ল। মিসর এবং কেনান দেশের লোকেরা যে শস্য কিনল তার দাম বাবদ ইউসুফ ঐ দু’টা দেশে যত টাকা ছিল তা তুলে নিয়ে ফেরাউনের রাজবাড়ীতে জমা দিলেন। যখন মিসর ও কেনান দেশের সব টাকা ফুরিয়ে গেল তখন মিসরীয়রা ইউসুফের কাছে এসে বলল, “আমাদের খেতে দিন। আমরা কি আপনার চোখের সামনেই মারা যাব? টাকা-পয়সা আমাদের যা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে।” ইউসুফ বললেন, “তাহলে তোমাদের গরু-ভেড়া সব আমাকে দাও। তোমাদের টাকা যখন ফুরিয়ে গেছে তখন ওগুলোর বদলেই আমি তোমাদের খাবার দেব।” তখন তারা তাদের সব গরু-ভেড়া ইউসুফের কাছে আনতে লাগল। ছাগল, ভেড়া, গরু, ঘোড়া ও গাধার বদলে তিনি তাদের খাবার দিতে লাগলেন। সমস্ত পশু জমা রেখে তিনি গোটা বছরটাই তাদের খাওয়ালেন। সেই বছরটা কেটে গেলে পর তার পরের বছরে লোকেরা এসে ইউসুফকে বলল, “হুজুরের কাছে আমরা লুকাব না যে, আমাদের টাকা-পয়সা সব খরচ হয়ে গেছে, আর আমাদের পশুগুলোও হুজুরের। এখন আমাদের এই শরীর এবং জায়গা-জমি ছাড়া হুজুরকে দেবার মত আর আমাদের কিছুই নেই। তাই জমিসুদ্ধ আমরা সবাই আপনার চোখের সামনেই শেষ হয়ে যাব কেন? সেইজন্য আপনি আমাদের ও আমাদের জায়গা-জমি সব নিয়ে নিন, আর তার বদলে আমাদের খাবার দিন। জায়গা-জমিসুদ্ধ আমরা সবাই ফেরাউনের গোলাম হয়ে থাকব। এর পরে আমরা যাতে মারা না গিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকতে পারি সেইজন্য আপনি আমাদের কিছু বীজও দিন। তাহলে আমাদের জমিও নষ্ট হবে না।” তখন ইউসুফ মিসর দেশের সমস্ত জমি ফেরাউনের নামে কিনে নিলেন। দুর্ভিক্ষ এমন ভীষণ হল যে, মিসরীয়রা সকলেই তাদের জায়গা-জমি বিক্রি করে দিল। এইভাবেই মিসর দেশের সমস্ত জায়গা-জমি ফেরাউনের হাতে এসে গেল। ইউসুফ মিসর দেশের এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত যত লোক ছিল তাদের সবাইকে শহরে সরিয়ে আনলেন। তিনি কেবল ইমামদের জায়গা-জমি কিনলেন না। এই ইমামেরা ফেরাউনের কাছ থেকে ভাতা পেতেন এবং তা দিয়েই তাঁরা চলতেন। সেইজন্য তাঁরা তাঁদের জমি বিক্রি করেন নি। ইউসুফ লোকদের বললেন, “দেখ, ফেরাউনের পক্ষ থেকে আমি আজ তোমাদের এবং তোমাদের জায়গা-জমি কিনে নিলাম। তোমরা এখন এই বীজ নাও, আর তা নিয়ে জমিতে বোন। ফসল কাটবার পর তোমরা সব ফসলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ফেরাউনকে দেবে, আর বাকী চার ভাগ জমির বীজের জন্য এবং নিজের ও পরিবারের লোকদের আর ছেলেমেয়েদের খাবারের জন্য রাখবে।” তখন লোকেরা বলল, “আপনি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। হুজুরের দয়া পেয়ে আমরা ফেরাউনের গোলাম হয়ে থাকব।” পরে ইউসুফ মিসর দেশের জায়গা-জমি সম্বন্ধে এই আইন পাশ করলেন যে, সব ফসলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ফেরাউনের হবে। এই আইনটা আজও মিসর দেশে চলছে। কেবল ইমামদের জমিগুলোই ফেরাউনের সম্পত্তির মধ্যে পড়ে নি। ইসরাইলীয়রা মিসর দেশের গোশনে বাস করতে লাগল। সেখানে তারা জায়গা-জমি করল। তাদের অনেক সন্তান হল এবং তারা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠল। ইয়াকুব মিসর দেশে আরও সতেরো বছর বেঁচে রইলেন। কাজেই তিনি মোট একশো সাতচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ইসরাইল তাঁর ছেলে ইউসুফকে ডেকে বললেন, “যদি আমার প্রতি তোমার টান থাকে তবে আমার ঊরুর নীচে তোমার হাত রেখে আমাকে কথা দাও যে, তুমি আমার প্রতি তোমার কর্তব্যে বিশ্বস্ত থাকবে। আমাকে মিসরে দাফন কোরো না, কারণ আমি আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কবর পেতে চাই। তুমি আমার মৃতদেহ মিসর দেশ থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে আমার পূর্বপুরুষেরা যেখানে কবর পেয়েছেন সেখানেই আমাকে দাফন কোরো।” ইউসুফ বললেন, “তুমি যা বললে আমি তা-ই করব।” তখন ইয়াকুব বললেন, “তাহলে তুমি আমার কাছে কসম খাও।” ইউসুফ তাঁর কাছে কসম খেলেন। তখন ইসরাইল বিছানার মাথার দিকে সেজদায় পড়ে আল্লাহর এবাদত করলেন। এর কিছু দিন পরে ইউসুফ খবর পেলেন যে, তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন তিনি তাঁর দুই ছেলে মানশা আর আফরাহীমকে সংগে নিয়ে সেখানে গেলেন। যখন ইয়াকুবকে বলা হল যে, তাঁর ছেলে ইউসুফ তাঁর কাছে এসেছেন, তখন তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে টেনে তুলে বিছানার উপর উঠে বসলেন। তারপর ইয়াকুব ইউসুফকে বললেন, “সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ কেনান দেশের লূস শহরে আমাকে দেখা দিয়ে দোয়া করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে অনেক সন্তানের পিতা হবার ক্ষমতা দিলাম এবং তোমার বংশের লোকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেব। আমি তোমার মধ্য থেকে একটা বহুগোষ্ঠীর জাতি সৃষ্টি করব, আর তোমার পরে এই দেশটা আমি চিরকালের সম্পত্তি হিসাবে তোমার বংশের লোকদের দেব।’ আমি তোমার কাছে আসবার আগে তোমার যে দু’টি ছেলের মিসরে জন্ম হয়েছে তাদের আমার সন্তানদের মধ্যেই ধরা হবে। রূবেণ আর শিমিয়োন যেমন আমার তেমনি আফরাহীম আর মানশাও আমার। কিন্তু এদের পরে তোমার আর যে সব সন্তান হবে তাদের তোমার বলেই ধরা হবে। সম্পত্তির ওয়ারিশ হওয়ার সময় মানশা অথবা আফরাহীমের নামে তাদের তা হতে হবে। পদ্দন থেকে বের হয়ে কেনান দেশের ইফ্রাথা থেকে কিছু দূরে থাকতেই রাহেলা ইন্তেকাল করলেন, আর তাতে আমি খুব দুঃখ পেলাম। ইফ্রাথের পথে, অর্থাৎ বেথেলহেমের পথে আমি তাঁকে দাফন করলাম।” এর পরে ইউসুফের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ইসরাইল জিজ্ঞাসা করলেন, “ওরা কারা?” জবাবে ইউসুফ তাঁর বাবাকে বললেন, “ওরা আমার ছেলে। আল্লাহ্‌ এই দেশেই ওদের আমাকে দিয়েছেন।” ইসরাইল বললেন, “ওদের আমার কাছে নিয়ে এস। আমি ওদের দোয়া করতে চাই।” বুড়ো বয়সে চোখে দেখবার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ইসরাইল ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না। সেইজন্য ইউসুফ তাঁর ছেলেদের তাঁর বাবার কাছে নিয়ে গেলেন। তখন ইসরাইল তাদের জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন। তিনি ইউসুফকে বললেন, “আমি আর তোমার মুখ দেখতে পাব বলে ভাবি নি, কিন্তু আল্লাহ্‌ কেবল তোমাকে নয়, তোমার ছেলেদেরও আমাকে দেখতে দিলেন।” তখন ইউসুফ তাঁর বাবার হাঁটুর পাশ থেকে তাঁর ছেলেদের সরিয়ে দিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁর বাবাকে সম্মান দেখালেন। ইউসুফ তারপর তাঁর দুই ছেলেকে আবার ইসরাইলের কাছে আনলেন। তিনি আফরাহীমকে ডান হাতে ধরে ইসরাইলের বাঁ দিকে এবং মানশাকে বাঁ হাতে ধরে তাঁর ডান দিকে রাখলেন। কিন্তু ইসরাইল আড়াআড়ি ভাবে হাত বাড়িয়ে ডান হাত ইউসুফের ছোট ছেলে আফরাহীমের মাথায় রাখলেন; আর মানশা ইউসুফের বড় ছেলে হলেও তার মাথায় রাখলেন তাঁর বাঁ হাত। তারপর তিনি ইউসুফকে দোয়া করে বললেন, “সেই আল্লাহ্‌, যাঁর ইচ্ছামত আমার পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম আর ইসহাক চলতেন, আমার জীবনের প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত যিনি আমাকে রাখালের মত পালন করে আসছেন, সেই ফেরেশতা, যিনি আমাকে সমস্ত বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন, তিনি এই ছেলেদের দোয়া করুন। এদের মধ্য দিয়েই আমার ও আমার পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসহাকের নাম বেঁচে থাকুক। আমাদের দেশের মধ্যে তাদের বংশের লোকেরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠুক।” কিন্তু তাঁর পিতা তাতে আপত্তি জানিয়ে বললেন, “আমি তা জানি বাবা, আমি তা জানি। সেও মহান হবে এবং তার বংশের লোকেরা একটা জাতি হয়ে গড়ে উঠবে। কিন্তু তার ছোট ভাই তার চেয়েও মহান হবে এবং তার বংশের লোকদের মধ্য থেকে অনেকগুলো জাতি গড়ে উঠবে।” ইসরাইল তারপর ছেলে দু’টিকে দোয়া করলেন এবং বললেন, “ইসরাইলীয়রা কাউকে দোয়া করবার সময় তোমাদের নাম করে বলবে, ‘আল্লাহ্‌ তোমাকে আফরাহীম ও মানশার মত করুন।’ ” এই বলে তিনি মানশার চেয়ে আফরাহীমকে বড় স্থান দিলেন। তারপর ইসরাইল ইউসুফকে বললেন, “দেখ, আমার মৃত্যুর সময় প্রায় এসে গেছে। কিন্তু আল্লাহ্‌ তোমাদের সংগে থাকবেন এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের দেশে তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তোমার ভাইদের চেয়ে কিছু বেশী সম্পত্তি আমি তোমাকে দিলাম। যে জায়গাটা আমি তলোয়ার ও ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করে আমোরীয়দের হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম সেই জায়গাটাই আমি তোমাকে দিলাম।” পরে ইয়াকুব তাঁর ছেলেদের ডেকে বললেন, “তোমরা সবাই আমার কাছে এস। ভবিষ্যতে তোমাদের জীবনে যা ঘটবে তা আমি তোমাদের বলে যাচ্ছি। “ইয়াকুবের ছেলেরা, তোমরা সবাই আমার কাছে এস; তোমাদের পিতা ইসরাইল কি বলছেন তা শোন। “রূবেণ, তুমি আমার বড় ছেলে; তুমি আমার বল, আমার যৌবনের শক্তির প্রথম ফল; তুমি সম্মান ও শক্তিতে তোমার ভাইদের সবার উপরে। কিন্তু তুমি যেন অশান্ত পানির মাতামাতি, সেইজন্য তোমার সেই উঁচু স্থান আর থাকবে না। আমার স্ত্রীর কাছে গিয়ে তুমি আমার বিছানা অপবিত্র করেছ। “শিমিয়োন আর লেবি দুই ভাই; তারা অনিষ্ট করবার জন্যই তলোয়ার ধরে। তাদের গোপন ষড়যন্ত্রে আমার কোন অংশ নেই, আমি তাদের দলে নই। তারা রাগের বশে মানুষ খুন করেছে, আর নিজেদের খেয়াল-খুশী মত গরুর পায়ের শিরা কেটে দিয়েছে। তাদের এই ভয়ংকর রাগ, এই নিষ্ঠুর ক্রোধের উপর বদদোয়া পড়ুক। আমি তাদের গোষ্ঠী ইয়াকুবের বংশগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেব, আর ইসরাইলীয়দের মধ্যে তাদের ছড়িয়ে দেব। “এহুদা, তোমার ভাইয়েরা তোমার প্রশংসা করবে। শত্রুদের ঘাড় ধরে তুমি তাদের জব্দ করবে; তোমার ভাইয়েরা মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সম্মান দেখাবে। এহুদা, তুমি সিংহের বাচ্চা; শিকারের গোশ্‌ত খাওয়া শেষ করে আমার এই ছেলে উঠে আসে; সিংহ ও সিংহীর মত করে সে বসে আর শুয়ে পড়ে। কে তাকে জাগাবে? যতদিন না শীলো আসেন এবং সমস্ত জাতি তাঁর হুকুম মেনে চলে, ততদিন রাজদণ্ড এহুদারই বংশে থাকবে; আর তার দু’হাঁটুর মাঝখানে থাকবে বিচার দণ্ড। এহুদা আংগুর গাছে তার গাধা বাঁধবে, আর আংগুরের সেরা ডালে বাঁধবে গাধার বাচ্চাটা। আংগুর-রসে সে তার কাপড় কাচবে, আর আংগুরের রাংগা রসে কাচবে পোশাক। তার চোখের রং আংগুর-রসের রংয়ের চেয়েও গাঢ় হবে, আর তার দাঁত দুধের চেয়েও সাদা হবে। “সবূলূন সাগরের ধারে বাস করবে; সে জাহাজ ভিড়বার বন্দর হবে; তার দেশের সীমানা সিডনের দিকে চলে যাবে। “ইষাখর যেন একটা শক্তিশালী গাধা। তার শোবার জায়গা হবে ভেড়ার খোঁয়াড় দু’টার মাঝখানে। সে দেখবে তার বিশ্রামের দেশটা সুন্দর ও আরামের, তাই বোঝা বইবার জন্য সে কাঁধ নীচু করবে আর গোলামের মত কঠিন পরিশ্রমকেও মেনে নেবে। “দান ইসরাইলের একটা গোষ্ঠী হিসাবে তার লোকদের বিচার করবে। সে হবে চলার পথের সাপ, ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ; সে ঘোড়ার পায়ে ছোবল মারবে, আর ঘোড়সওয়ার উল্টে পিছন দিকে পড়ে যাবে। “হে মাবুদ, তুমি উদ্ধার করবে আমি সেই অপেক্ষায় আছি। “গাদকে সৈন্যের দল হামলা করবে, কিন্তু সে-ও তাদের পাল্টা হামলা করবে। “আশেরের জমিতে প্রচুর পরিমাণে ভাল ফসল জন্মাবে; সে বাদশাহ্‌র উপযুক্ত খাবার যোগান দেবে। “নপ্তালি যেন বাঁধন-ছাড়া হরিণী; তার মুখে আছে সুন্দর সুন্দর কথা। “ইউসুফ যেন ফলে ভরা গাছ, পানির কিনারার ফলে ভরা গাছ; তার ডালগুলো দেয়াল ছাড়িয়ে গেছে। ধনুকধারীরা তাকে ভীষণভাবে হামলা করেছে, তীর ছুঁড়ে তাকে বিপদে ফেলেছে। কিন্তু তার ধনুক তেমনি স্থির রয়েছে আর হাত রয়েছে তেমনি পটু, কারণ ইয়াকুবের সেই শক্তিশালী আল্লাহ্‌র হাত তার পিছনে রয়েছে। তার পিছনে রয়েছে সেই পালক, ইসরাইলের সেই পাথর। তোমার বাবার আল্লাহ্‌ তোমাকে সাহায্য করবেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ তোমাকে উপর থেকে আসমানের দোয়া আর মাটির তলা থেকে ঝর্ণার দোয়া দেবেন। স্ত্রীর গর্ভে সন্তান দিয়ে আর তার বুকে দুধ দিয়ে তিনি তোমাকে দোয়া করবেন। তোমার বাবার পাওয়া দোয়া তার পূর্বপুরুষদের পাওয়া দোয়াকে ছাড়িয়ে গেছে; তা অনেক কাল আগের পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। সেই দোয়া ইউসুফের মাথার উপর পড়ুক; পড়ুক তারই মাথায় যে তার ভাইদের মধ্যে প্রধান। “বিন্‌ইয়ামীন যেন একটা হিংস্র নেকড়ে বাঘ; সকালে সে খায় শিকারের পশু আর সন্ধ্যায় লুটের জিনিস ভাগ করে।” এরাই হল ইসরাইলের বারোটি গোষ্ঠী। তাদের পিতা তাদের দোয়া করবার সময় এই সব কথাই বলেছিলেন। তিনি প্রত্যেককেই তার পাওনা দোয়া দিয়েছিলেন। পরে ইয়াকুব তাঁর ছেলেদের এই নির্দেশ দিলেন, “পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবার সময় আমার এসে গেছে। হিট্টীয় ইফ্রোণের জমিতে যে গুহা আছে সেই গুহাতে আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে আমাকে দাফন কোরো। এটাই কেনান দেশের মম্রির কাছে মক্‌পেলার জমির সেই গুহা। কবরস্থান করবার জন্য ইব্রাহিম জমি সুদ্ধ এই গুহা হিট্টীয় ইফ্রোণের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। সেখানেই ইব্রাহিম ও তাঁর স্ত্রী সারাকে দাফন করা হয়েছে। ইসহাক ও তাঁর স্ত্রী রেবেকাকেও সেখানে দাফন করা হয়েছে। সেখানেই আমি লেয়াকে দাফন করেছি। গুহাসুদ্ধ এই জমিটাই হিট্টীয়দের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল।” ইয়াকুব তাঁর ছেলেদের নির্দেশ দেওয়া শেষ করে বিছানার উপর তাঁর পা দু’টা তুলে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। তারপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। তখন ইউসুফ তাঁর বাবার মুখের উপর পড়ে কাঁদতে লাগলেন এবং তাঁকে চুম্বন করলেন। পরে তিনি তাঁর অধীন ডাক্তারদের হুকুম দিলেন যেন তাঁরা তাঁর বাবার মৃতদেহটা খোশবু-মসলা দিয়ে রক্ষা করবার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা তা-ই করলেন। এতে তাঁদের চল্লিশ দিন কেটে গেল। এই কাজে চল্লিশ দিনই লাগত। মিসরীয়রা ইসরাইলের জন্য সত্তর দিন ধরে শোক-প্রকাশ করল। এই শোক-প্রকাশের সময় পার হয়ে গেলে পর ইউসুফ ফেরাউনের বাড়ীর কর্মচারীদের বললেন, “যদি তোমরা আমার উপর সন্তুষ্ট থাক তবে ফেরাউনকে গিয়ে আমার এই কথাটা জানাও যে, পিতা মারা যাবার সময় আমাকে এই বলে কসম খাইয়েছেন, আমি যেন কেনান দেশে তাঁর ঠিক করে রাখা কবরটিতে তাঁকে দাফন করি। তাঁকে এই অনুরোধ কর যেন তিনি সেই কাজের জন্য আমাকে যেতে দেন। তাঁকে বল কাজ শেষ করেই আমি আবার ফিরে আসব।” এর জবাবে ফেরাউন বলে পাঠালেন, “তিনি তোমাকে যে কসম খাইয়েছেন সেইমতই তুমি গিয়ে তাঁকে দাফন কর।” তখন ইউসুফ তাঁর বাবাকে দাফন করবার জন্য গেলেন। ফেরাউনের সব কর্মচারী, অর্থাৎ তাঁর দরবারের এবং মিসরের সমস্ত সম্মানিত লোক ইউসুফের সংগে গেলেন। এছাড়া ইউসুফের নিজের এবং তাঁর বাবার পরিবারের সকলে ও তাঁর ভাইয়েরাও তাঁর সংগে গেল। গোশনে তারা কেবল রেখে গেল তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের ও তাদের গরু-ভেড়ার পাল। অনেক রথ ও ঘোড়সওয়ার নিয়ে তারা একটা বিরাট দল হয়ে ইউসুফের সংগে চলল। জর্ডান নদীর অন্য পারে আটদের খামার বাড়ী পর্যন্ত গিয়ে ইউসুফ সাত দিন ধরে তাঁর বাবার জন্য শোক-প্রকাশ করলেন। লোকেরাও খুব জোরে জোরে কান্নাকাটি করল। আটদের খামারে তাদের এইভাবে শোক প্রকাশ করতে দেখে সেই দেশের বাসিন্দারা, অর্থাৎ কেনানীয়রা বলল, “মিসরীয়দের এটা একটা গভীর শোক-প্রকাশ।” সেইজন্য জর্ডান নদীর অন্য পারের এই জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল আবেল্‌-মিস্‌রয়ীম (যার মানে “মিসরীয়দের শোক-প্রকাশ”)। ইসরাইল তাঁর ছেলেদের যা করতে বলেছিলেন তা তারা করল। তারা তাঁর দেহ কেনান দেশে নিয়ে গেল এবং মম্রির কাছে মক্‌পেলার জমির গুহাতে তাঁকে দাফন করল। কবরস্থান করবার জন্য জমি সুদ্ধ এই গুহাটাই ইব্রাহিম হিট্টীয় ইফ্রোণের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। বাবাকে দাফন করবার পর ইউসুফ, তাঁর ভাইয়েরা এবং যত লোক তাঁর বাবাকে দাফন করতে গিয়েছিল তারা সবাই মিসরে ফিরে গেল। পিতা মারা গেছেন দেখে ইউসুফের ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, “ইউসুফের মনে যদি আমাদের উপর প্রতিশোধ নেবার ভাব থাকে, আর আমরা তার প্রতি যে অন্যায় করেছি যদি সে তার শোধ নেয়, তখন আমরা কি করব?” এর পর তাঁর ভাইয়েরা তাঁর সামনে এসে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বলল, “আমরা তোমার গোলাম।” কিন্তু ইউসুফ তাদের বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না। আল্লাহ্‌র জায়গায় দাঁড়াবার আমি কে? তোমরা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলে, কিন্তু আল্লাহ্‌ তার ভিতর দিয়ে ভালোর পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে অনেক লোকের প্রাণ রক্ষা পায়; আর আজ তা-ই হচ্ছে। কাজেই তোমরা ভয় কোরো না। আমি তোমাদের ও তোমাদের ছেলেমেয়েদের খাবারের যোগান দেব।” এই সব আশার কথা বলে তিনি তাদের সান্ত্বনা দিলেন। ইউসুফ ও তাঁর বাবার পরিবারের লোকেরা মিসরেই বাস করতে লাগলেন। ইউসুফ একশো দশ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি আফরাহীমের তিন পুরুষ পর্যন্ত দেখে গিয়েছিলেন। এছাড়া মাখীরের ছেলেমেয়েদেরও জন্মের পর ইউসুফের কোলেই রাখা হয়েছিল। মাখীর ছিল মানশার ছেলে। পরে এক সময় ইউসুফ তাঁর ভাইদের বললেন, “আমার মরবার সময় হয়ে এসেছে, তবে এটা নিশ্চয় যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের দেখাশোনা করবেন। তিনি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবকে যে দেশ দেবেন বলে কসম খেয়ে ওয়াদা করেছিলেন সেই দেশেই তিনি তোমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবেন।” তারপর ইউসুফ ইসরাইলীয়দের কসম খাইয়ে বললেন, “আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই তোমাদের দেখাশোনা করবেন। এখান থেকে যাবার সময় তোমরা আমার হাড়গুলো তুলে নিয়ে যেয়ো।” একশো দশ বছর বয়সে ইউসুফ ইন্তেকাল করলেন। তখন তাঁর মৃতদেহটা খোশবু-মসলা দিয়ে একটা কফিন বাক্সে করে মিসরেই রাখা হল। পরে ইউসুফ, তাঁর ভাইয়েরা এবং তাঁদের সময়কার সবাই ইন্তেকাল করলেন। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা কম ছিল না; তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল, আর তাদের দিয়ে মিসর দেশটা ভরে গেল। পরে এক সময় মিসর দেশের সমস্ত ক্ষমতা এমন একজন নতুন বাদশাহ্‌র হাতে গেল যিনি ইউসুফের বিষয় কিছুই জানতেন না। তিনি তাঁর প্রজাদের বললেন, “দেখ, বনি-ইসরাইলরা আমাদের চেয়ে সংখ্যায় এবং শক্তিতে বেড়ে উঠেছে। তাদের সংখ্যা যেন আর বাড়তে না পারে সেইজন্য এস, আমরা তাদের সংগে কৌশল খাটিয়ে চলি; তা না হলে যুদ্ধের সময়ে তারা হয়তো আমাদের শত্রুদের সংগে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং পরে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।” তাই কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের উপর জুলুম করবার উদ্দেশ্যে মিসরীয়রা তাদের উপর সর্দার নিযুক্ত করল। ফেরাউনের শস্য মজুদ করবার জন্য বনি-ইসরাইলরা পিথোম ও রামিষেষ নামে দু’টা শহর তৈরী করল। কিন্তু তাদের উপর যতই জুলুম করা হল ততই তারা সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে দেশের সব দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এতে বনি-ইসরাইলদের দরুন মিসরীয়দের মনে খুব ভয় হল। তারা তাদের আরও কঠিন পরিশ্রম করতে বাধ্য করল। ক্ষেতের অন্য সব কাজের সংগে তারা তাদের উপর চুনসুরকি আর ইটের কাজের কঠিন পরিশ্রমও চাপিয়ে দিল এবং তাদের জীবন তেতো করে তুলল। এই সব কঠিন কাজ করাতে গিয়ে মিসরীয়রা তাদের প্রতি খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করত। এছাড়া শিফ্রা ও পূয়া নামে দু’জন ইবরানী, অর্থাৎ ইসরাইলীয় ধাত্রীকে মিসরের বাদশাহ্‌ বলে দিলেন, “সন্তান প্রসব করবার সময় ইবরানী স্ত্রীলোকদের সাহায্য করতে গিয়ে তোমরা ভাল করে লক্ষ্য করবে তাদের সন্তানেরা ছেলে না মেয়ে; ছেলে হলে তাদের মেরে ফেলবে আর মেয়ে হলে বাঁচিয়ে রাখবে।” কিন্তু সেই ধাত্রীরা আল্লাহ্‌কে ভয় করে চলত। তাই মিসরের বাদশাহ্‌র হুকুম মত কাজ না করে তারা ছেলেদেরও বাঁচিয়ে রাখতে লাগল। তখন বাদশাহ্‌ সেই ধাত্রীদের ডাকিয়ে এনে বললেন, “কেন তোমরা এই কাজ করছ? ছেলেদের বাঁচিয়ে রাখছ কেন?” জবাবে তারা ফেরাউনকে বলল, “ইবরানী স্ত্রীলোকেরা মিসরীয় স্ত্রীলোকদের মত নয়। তাদের শক্তি এত বেশী যে, ধাই তাদের কাছে পৌঁছাবার আগেই তাদের সন্তান হয়ে যায়।” আল্লাহ্‌ সেই ধাত্রীদের রহমত দান করলেন। বনি-ইসরাইলদের লোকসংখ্যা বাড়তেই থাকল এবং তারা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল। সেই ধাত্রীরা আল্লাহ্‌কে ভয় করত বলে তিনি তাদের সন্তানদের দিয়ে বংশ গড়ে তুললেন। পরে ফেরাউন তাঁর প্রজাদের উপর এই হুকুম জারি করলেন, “ইবরানীদের মধ্যে কোন ছেলের জন্ম হলে তোমরা তাকে নীল নদে ফেলে দেবে, কিন্তু মেয়েদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখবে।” এই সময়ে লেবির গোষ্ঠীর একজন লোক একই গোষ্ঠীর একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন। মেয়েটি গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর একটি ছেলে হল। ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর ছিল। সেইজন্য তার মা তাকে তিন মাস পর্যন্ত লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু যখন তাকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হল না তখন তিনি নল দিয়ে বোনা একটা টুকরি নিয়ে তাতে মেটে তেল ও আল্‌কাত্‌রা লেপে দিলেন আর ছেলেটিকে তার মধ্যে শুইয়ে সেটা নীল নদের পারে পানির মধ্যে একটা নলবনে রেখে আসলেন। ছেলেটির দশা কি হয় তা দেখবার জন্য তার বোন সেখান থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে ফেরাউনের মেয়ে নদীতে গোসল করতে আসলেন। তাঁর বাঁদীরা তখন নদীর পারে ঘোরাফেরা করছিল। এমন সময় তিনি নলবনের মধ্যে সেই টুকরিটা দেখতে পেয়ে সেটা তাঁর কাছে নিয়ে আসবার জন্য একজন বাঁদীকে পাঠিয়ে দিলেন। সেটা খুলে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন একটা ছেলে তার মধ্যে কাঁদছে। ছেলেটির উপর শাহজাদীর খুব মায়া হল। তিনি বললেন, “এটি ইবরানীদের কোন ছেলে।” তখন ছেলেটির বোন এসে ফেরাউনের মেয়েকে বলল, “আমি কি আপনার জন্য একজন ইবরানী স্ত্রীলোক ডেকে আনব, যে একে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, যাও।” তখন মেয়েটি গিয়ে ছেলেটির মাকেই ডেকে আনল। ফেরাউনের মেয়ে তাঁকে বললেন, “এই ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে আমার হয়ে তোমার বুকের দুধ খাইয়ে লালন-পালন কর। এর জন্য আমি তোমাকে বেতন দেব।” তখন সেই স্ত্রীলোকটি ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে দুধ খাইয়ে তাকে লালন-পালন করতে লাগলেন। ছেলেটি একটু বড় হলে পর স্ত্রীলোকটি তাকে ফেরাউনের মেয়ের কাছে নিয়ে গেলেন, আর তিনি তাকে নিজের ছেলে হিসাবে গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, “ওকে আমি পানি থেকে তুলে এনেছি।” সেইজন্য তিনি তার নাম দিলেন মূসা। পরে বড় হয়ে মূসা একদিন তাঁর নিজের জাতির লোকদের সংগে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন, কি ভীষণ পরিশ্রম তাদের করতে হচ্ছে। তাঁর চোখে পড়ল যে, তাঁর নিজের ইবরানী জাতির একজন লোককে একজন মিসরীয় মারধর করছে। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন তিনি সেই মিসরীয়কে হত্যা করে বালি চাপা দিয়ে রাখলেন। পরদিন মূসা আবার বাইরে গিয়ে দু’জন ইবরানীকে মারামারি করতে দেখলেন। যে দোষী তাকে তিনি বললেন, “কেন তুমি তোমার ভাইকে মারছ?” লোকটি বলল, “কে তোমাকে আমাদের নেতা ও শাসনকর্তা করেছে? সেই মিসরীয়ের মত আমাকেও হত্যা করতে চাও নাকি?” এই কথা শুনে মূসা ভয় পেলেন। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। ফেরাউন এই ঘটনা জানতে পেরে মূসাকে হত্যা করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু মূসা ফেরাউনের কাছ থেকে পালিয়ে মাদিয়ান দেশে বাস করবার জন্য চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি একটা কূয়ার ধারে বসে রইলেন। সেখানকার মাদিয়ানীয় ইমামের সাতটি মেয়ে ছিল। তারা তাদের পিতার ভেড়াগুলোকে পানি খাওয়াবার জন্য পানি তুলে গামলা ভরতে সেই জায়গায় গেল। কিন্তু কয়েকজন রাখাল এসে কূয়ার কাছ থেকে সেই মেয়েদের তাড়িয়ে দিল। এই ব্যাপার দেখে মূসা উঠে তাদের সাহায্য করলেন এবং তাদের ভেড়াগুলোকে পানি খেতে দিলেন। সেই মেয়েরা তাদের পিতা রূয়েল অর্থাৎ শোয়াইবের কাছে ফিরে গেলে পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আজ তোমরা এত তাড়াতাড়ি কি করে ফিরে আসলে?” তারা বলল, “রাখালদের হাত থেকে একজন মিসরীয় আমাদের রক্ষা করেছেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি পানি তুলে আমাদের ভেড়াগুলোকেও পানি খাইয়েছেন।” তিনি তাঁর মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকটি কোথায়? তোমরা তাকে ফেলে আসলে কেন? তাকে ডেকে এনে কিছু খেতে দাও।” পরে মূসা সেই ইমামের সংগে থাকতে রাজী হলেন এবং তিনি মূসার সংগে তাঁর মেয়ে সফুরার বিয়ে দিলেন। সফুরার একটি ছেলে হলে পর মূসা তার নাম রাখলেন গের্শোম, কারণ তিনি বলেছিলেন, “আমি পরদেশের বাসিন্দা হয়ে আছি।” এর অনেক দিন পরে মিসরের বাদশাহ্‌ ইন্তেকাল করলেন। এদিকে বনি-ইসরাইলরা তাদের গোলামীর দরুন কাতর হয়ে হাহাকার করতে লাগল। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য তাদের এই ফরিয়াদ উপরে আল্লাহ্‌র কাছে গিয়ে পৌঁছাল। আল্লাহ্‌ তাদের কাতর স্বর শুনলেন এবং ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের জন্য যে ব্যবস্থা তিনি স্থাপন করেছিলেন সেই কথা ভাবলেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের দিকে চেয়ে দেখলেন এবং তাদের দিকে মনোযোগ দিলেন। একদিন মূসা তাঁর শ্বশুর শোয়াইব, অর্থাৎ রূয়েলের ছাগল-ভেড়ার পাল চরাচ্ছিলেন। শোয়াইব ছিলেন মাদিয়ানীয়দের একজন ইমাম। ছাগল-ভেড়ার পাল চরাতে চরাতে মূসা মরুভূমির অন্য ধারে আল্লাহ্‌র পাহাড়, তুর পাহাড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে একটা ঝোপের মাঝখানে জ্বলন্ত আগুনের মধ্য থেকে মাবুদের ফেরেশতা তাঁকে দেখা দিলেন। মূসা দেখলেন যে, ঝোপটাতে আগুন জ্বললেও সেটা পুড়ে যাচ্ছে না। এই ব্যাপার দেখে তিনি মনে মনে বললেন, “আমি এক পাশে গিয়ে এই আশ্চর্য ব্যাপারটা দেখব, দেখব ঝোপটা পুড়ে যাচ্ছে না কেন।” ঝোপটা দেখবার জন্য মূসা একপাশে যাচ্ছেন দেখে মাবুদ আল্লাহ্‌ ঝোপের মধ্য থেকে ডাকলেন, “মূসা, মূসা।” মূসা বললেন, “এই যে আমি।” মাবুদ বললেন, “আর কাছে এসো না। তুমি পবিত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেল। আমি তোমার পিতার আল্লাহ্‌; আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহ্‌।” তখন মূসা তাঁর মুখ ঢেকে ফেললেন, কারণ আল্লাহ্‌র দিকে তাকাতে তাঁর ভয় হল। মাবুদ বললেন, “মিসর দেশে আমার লোকদের উপরে যে জুলুম হচ্ছে তা আমার নজর এড়ায় নি। মিসরীয় সর্দারদের জুলুমে বনি-ইসরাইলরা যে হাহাকার করছে তা আমি শুনেছি। তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা আমি জানি। মিসরীয়দের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবার জন্য আমি নেমে এসেছি। আমি তাদের সেই দেশ থেকে বের করে কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের দেশে নিয়ে যাব। দেশটা বেশ বড় এবং সুন্দর; সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই। বনি-ইসরাইলদের ফরিয়াদ এখন আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। মিসরীয়রা কিভাবে তাদের উপর জুলুম করছে তা-ও আমি দেখেছি। কাজেই তুমি এখন যাও। আমি তোমাকে ফেরাউনের কাছে পাঠাচ্ছি। তুমি গিয়ে আমার বান্দাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের মিসর থেকে বের করে আনবে।” কিন্তু মূসা আল্লাহ্‌কে বললেন, “আমি এমন কেউ নই যে, ফেরাউনের কাছে গিয়ে মিসর থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে আনতে পারি।” আল্লাহ্‌ বললেন, “আমিই তোমার সংগে থাকব। তুমি মিসর থেকে লোকদের বের করে আনবে আর তোমরা এই পাহাড়েই আমার এবাদত করবে। আমিই যে তোমাকে পাঠালাম এটাই হবে তোমার কাছে তার চিহ্ন।” তখন মূসা আল্লাহ্‌কে বললেন, “কিন্তু আমি গিয়ে বনি-ইসরাইলদের যখন বলব তাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ আমাকে তাদের কাছে পাঠিয়েছেন, তখন তারা হয়তো আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তাঁর নাম কি?’ সেই সময়ে আমি তাদের কি জবাব দেব?” আল্লাহ্‌ মূসাকে বললেন, “যিনি ‘আমি আছি’ আমিই তিনি। তুমি বনি-ইসরাইলদের বলবে যে, ‘আমি আছি’ তাদের কাছে তোমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি তাদের আরও বলবে যে, তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাকে তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমার চিরকালের নাম ‘মাবুদ।’ বংশের পর বংশ ধরে আমাকে এই নামেই লোকে মনে রাখবে। তুমি গিয়ে ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের একসংগে জমায়েত করে তাদের বলবে যে, তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তোমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের দিকে এবং মিসরে তোমাদের প্রতি যা করা হচ্ছে তার দিকে আমার খেয়াল আছে। সেইজন্যই আমি বলছি, মিসরের জুলুম থেকে বের করে আমি তোমাদের কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের দেশে নিয়ে যাব। সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই।’ “ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতারা তোমার কথায় কান দেবে। তুমি ও তারা মিলে মিসরের বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বলবে, ‘ইবরানীদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই আমাদের সংগে দেখা দিয়ে কথা বলেছেন। কাজেই আপনি দয়া করে আমাদের যেতে দিন, যাতে আমরা মরুভূমির মধ্যে তিন দিনের পথ গিয়ে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিতে পারি।’ আমি জানি শক্ত হাতে পড়লেও মিসরের বাদশাহ্‌ তোমাদের যেতে দেবে না। কাজেই আমার শক্তি ব্যবহার করে আমি এমন সব কুদরতির মধ্য দিয়ে মিসরকে আঘাত করব যার ফলে ফেরাউন তোমাদের যেতে দেবে। বনি-ইসরাইলদের প্রতি মিসরীয়দের মনে আমি এমন একটা দয়ার মনোভাব সৃষ্টি করব যাতে মিসর থেকে বের হয়ে যাবার সময় তোমাদের খালি হাতে যেতে না হয়। প্রত্যেক ইবরানী স্ত্রীলোক তার প্রতিবেশী এবং নিজের ঘরে আছে এমন সব মিসরীয় স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে সোনা ও রূপার জিনিস আর কাপড়-চোপড় চেয়ে নেবে। তারপর সেগুলো দিয়ে তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের সাজাবে। এইভাবেই মিসরীয়দের জিনিস বনি-ইসরাইলরা অধিকার করে নেবে।” এই কথার জবাবে মূসা বললেন, “কিন্তু যদি বনি-ইসরাইলরা আমাকে অবিশ্বাস করে আর আমার কথা না শোনে? তারা তো বলতে পারে, ‘না, মাবুদ তোমাকে দেখা দেন নি।’ ” তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, “তোমার হাতে ওটা কি?” তিনি বললেন, “একটা লাঠি।” মাবুদ বললেন, “ওটা মাটিতে ফেল।” মূসা লাঠিটা মাটিতে ফেলতেই সেটা একটা সাপ হয়ে গেল। তখন মূসা সেটার কাছ থেকে দৌড়ে পালালেন। কিন্তু মাবুদ মূসাকে বললেন, “তোমার হাত বাড়িয়ে ওটার লেজ ধর।” মূসা তা করতেই তাঁর হাতে আবার সেটা লাঠি হয়ে গেল। তারপর মাবুদ বললেন, “তুমি এটা করবে যাতে তারা বিশ্বাস করতে পারে যে, তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মাবুদ আল্লাহ্‌ সত্যিসত্যিই তোমাকে দেখা দিয়েছেন।” মাবুদ তাঁকে আবার বললেন, “তোমার হাত কোমর-বাঁধনির উপরের দিকে কাপড়ের ভাঁজের ভিতরে রাখ।” মূসা তা-ই করলেন। কিন্তু যখন তিনি তা বের করে আনলেন তখন দেখা গেল চর্মরোগে তাঁর হাতের উপর যেন তুষারের আস-র পড়ে গেছে। তখন মাবুদ বললেন, “তোমার হাত আবার ওখানে রাখ।” তিনি তা-ই করলেন। যখন তিনি হাতটা বের করে আনলেন তখন দেখা গেল তাঁর হাতটা তাঁর শরীরের অন্যান্য অংশের মত সুস্থ হয়ে গেছে। তখন মাবুদ বললেন, “যদি তারা তোমাকে অবিশ্বাস করে কিংবা প্রথম চিহ্নটার কোন দাম না দেয় তবে হয়তো তারা দ্বিতীয়টা বিশ্বাস করবে। কিন্তু যদি তারা এই দু’টার কোনটাই বিশ্বাস না করে কিংবা তোমার কথায় কান না দেয় তবে তুমি নীল নদ থেকে কিছুটা পানি তুলে নিয়ে মাটির উপর ঢেলে দেবে। তাতে মাটির উপরকার সেই পানিটুকু রক্ত হয়ে যাবে।” মূসা মাবুদকে বললেন, “কিন্তু মালিক, আমি কোন কালেই ভাল করে কথা বলতে পারি না। আগেও পারি নি আর তোমার এই গোলামের সংগে তুমি কথা বলবার পরেও পারছি না। আমার মুখে কথা আট্‌কে যায়, আমার জিভ্‌ ভারী।” কিন্তু মাবুদ তাকে বললেন, “মানুষের মুখ কে তৈরী করেছেন? কে তাকে বোবা, বয়রা বা অন্ধ করেছেন? আর কে-ই বা তাকে চোখে দেখবার শক্তি দিয়েছেন? সে কি আমি মাবুদ নই? তুমি এবার যাও। আমি নিজেই তোমাকে কথা বলতে সাহায্য করব আর যা বলবার তা তোমাকে শিখিয়ে দেব।” জবাবে মূসা বললেন, “হে মালিক, আমি মিনতি করছি, আর কাউকে দিয়ে তুমি এই খবর পাঠিয়ে দাও।” এই কথা শুনে মাবুদ মূসার উপর রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি বললেন, “তোমার ভাই লেবীয় হারুন কি নেই? আমি জানি সে খুব ভাল করে কথা বলতে পারে। সে তোমার সংগে দেখা করতে আসছে। তোমাকে দেখে সে খুব খুশী হবে। তুমি যখন তার সংগে কথা বলবে তখন তাকে বলে দেবে কি বলতে হবে। আমি তোমাদের দু’জনকে কথা বলতে সাহায্য করব এবং কি করতে হবে তা তোমাদের শিখিয়ে দেব। তোমার হয়ে হারুনই লোকদের সংগে কথা বলবে, যেন তার মুখই তোমার মুখ আর তুমিই যেন তার আল্লাহ্‌। তোমার এই লাঠিটা তুমি হাতে করে নিয়ে যাবে আর ওটা দিয়েই ঐ সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ দেখাবে।” এর পর মূসা তাঁর শ্বশুর শোয়াইবের কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে বললেন, “মিসর দেশে আমার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আমাকে ফিরে যেতে দিন। আমি গিয়ে দেখতে চাই তাঁরা এখনও বেঁচে আছেন কিনা।” শোয়াইব মূসাকে বললেন, “আচ্ছা, সহিসালামতে যাও।” মাদিয়ান দেশে থাকতেই মাবুদ মূসাকে বলেছিলেন, “তুমি এখন মিসরে ফিরে যাও। যে সব লোক তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা আর বেঁচে নেই।” তখন মূসা তাঁর স্ত্রী ও ছেলেদের একটা গাধার পিঠে বসালেন এবং তাদের নিয়ে মিসর দেশে ফিরে চললেন। আল্লাহ্‌র সেই লাঠিটাও তিনি হাতে করে নিলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “আমি তোমাকে যে সব কুদরতি কাজ করবার ক্ষমতা দিয়েছি তুমি মিসর দেশে ফিরে গিয়ে ফেরাউনের সামনে তার সবগুলোই করবে। কিন্তু আমি তার মন এমন কঠিন করে দেব যার ফলে সে লোকদের যেতে দেবে না। তার পরে তুমি ফেরাউনকে বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘ইসরাইল আমার প্রথম ছেলে। আমার এবাদত করবার জন্য আমার প্রথম ছেলেকে যেতে দিতে আমি তোমাকে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তাকে যেতে দিলে না বলে আমি তোমার প্রথম ছেলেকে হত্যা করতে যাচ্ছি।’ ” মিসরে যাবার পথে একটা রাত কাটাবার জায়গায় মাবুদ মূসাকে হত্যা করবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হলেন। তখন সফুরা একটা ধারালো পাথর দিয়ে তাঁর ছেলের পুরুষাংগের সামনের চামড়া কেটে নিলেন। তারপর সেটা মূসার পায়ে ছুঁইয়ে বললেন, “তুমি রক্তপাত করে পাওয়া আমার স্বামী।” তখন মাবুদ মূসাকে রেহাই দিলেন। খৎনা করাবার ব্যাপারে সফুরা সেই কথা বলেছিলেন। এর পরে মাবুদ হারুনকে বললেন, “মরুভূমিতে গিয়ে তুমি মূসার সংগে দেখা কর।” তখন তিনি গেলেন এবং আল্লাহ্‌র পাহাড়ে মূসার দেখা পেয়ে তাঁকে চুম্বন করলেন। মাবুদ মূসাকে যা বলতে পাঠিয়েছেন তা মূসা হারুনকে জানালেন। এছাড়া যে সব অলৌকিক চিহ্ন দেখাবার হুকুম মাবুদ তাঁকে দিয়েছেন তা-ও মূসা হারুনকে বুঝিয়ে বললেন। এর পরে মূসা ও হারুন মিসরে গিয়ে সমস্ত ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের একসংগে জমায়েত করলেন। মাবুদ মূসাকে যে সব কথা বলেছিলেন তা সবই হারুন তাঁদের জানালেন এবং লোকদের সামনে সেই অলৌকিক চিহ্নগুলো দেখালেন। তাতে লোকেরা বিশ্বাস করল। তারা যখন শুনল যে, মাবুদ বনি-ইসরাইলদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেছেন এবং তাদের কথা ভেবেছেন তখন তারা মাবুদকে সেজদা করলেন। পরে মূসা ও হারুন গিয়ে ফেরাউনকে বললেন, “আল্লাহ্‌, যিনি বনি-ইসরাইলদের মাবুদ, তিনি বলছেন, ‘আমার বান্দারা যাতে মরুভূমিতে গিয়ে আমার প্রতি একটা ঈদ পালন করতে পারে সেইজন্য তাদের যেতে দাও।’ ” কিন্তু ফেরাউন বললেন, “কে আবার এই মাবুদ, যে আমি তার হুকুম মেনে বনি-ইসরাইলদের যেতে দেব? এই মাবুদকেও আমি চিনি না আর ইসরাইলীয়দেরও আমি যেতে দেব না।” তখন তাঁরা বললেন, “ইবরানীদের আল্লাহ্‌ আমাদের দেখা দিয়েছেন। তাই আপনি দয়া করে আমাদের যেতে দিন যাতে আমরা মরুভূমিতে তিন দিনের পথ গিয়ে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিতে পারি। তা না হলে তিনি হয়তো কোন মহামারী বা তলোয়ারের মধ্য দিয়ে আমাদের উপর শাস্তি আনবেন।” জবাবে মিসরের বাদশাহ্‌ তাঁদের বললেন, “মূসা ও হারুন, তোমরা কাজ থেকে লোকদের মন সরিয়ে দিচ্ছ কেন? যাও, তোমরা কাজে ফিরে যাও। দেখ, দেশে তোমাদের লোকসংখ্যা এখন বেড়ে গেছে, আর তোমাদের দরুন তারা কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে।” ফেরাউন সেই দিনই গোলামদের উপর নিযুক্ত-করা জুলুমবাজ সর্দারদের ও ইসরাইলীয় পরিচালকদের এই হুকুম দিলেন, “ইট তৈরীর জন্য লোকদের তোমরা আর খড়কুটা দেবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের খড় যোগাড় করে নেবে। কিন্তু তবুও তারা আগে যতগুলো ইট তৈরী করত ঠিক ততগুলোই তোমরা তাদের কাছ থেকে বুঝে নেবে, একটাও কমাবে না। লোকগুলো অলস বলেই তারা গিয়ে তাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পশু-কোরবানী দেওয়ার কথা নিয়ে হৈ-চৈ করছে। তোমরা তাদের উপর আরও ভারী কাজ চাপিয়ে দাও, যাতে মিথ্যা কথায় কান না দিয়ে তারা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।” তখন গোলামদের উপর নিযুক্ত-করা জুলুমবাজ সর্দারেরা ও ইসরাইলীয় পরিচালকেরা বাইরে গিয়ে লোকদের বলল, “ফেরাউন বলছেন যে, তিনি আর তোমাদের খড়ের যোগান দেবেন না। তোমরা যেখানে পাও সেখান থেকে খড়কুটা যোগাড় করে নেবে। কিন্তু তাতে তোমাদের কাজ একটুও কমিয়ে দেওয়া হবে না।” কাজেই লোকেরা খড়ের বদলে নাড়া যোগাড় করবার জন্য মিসর দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। সেই সর্দারেরা তাদের তাড়া দিয়ে বলতে লাগল, “আগে খড় যোগান দেবার সময় তোমরা রোজ যতগুলো ইট তৈরী করতে এখনও তোমাদের ঠিক ততগুলোই তৈরী করে দিতে হবে।” পরে একদিন ফেরাউনের সেই সর্দারেরা তাদের নিযুক্ত ইসরাইলীয় পরিচালকদের মারধর করে বলল, “যতগুলো করে ইট রোজ তোমাদের তৈরী করবার কথা তোমরা আগের মত তা করছ না কেন? তোমরা আজকেও তা কর নি আর তার আগের দিনও কর নি।” এতে ইসরাইলীয় পরিচালকেরা ফেরাউনের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলল, “আপনার গোলামদের সংগে আপনি এ কি রকম ব্যবহার করছেন? কোন খড়কুটা আমাদের দেওয়া হয় না, অথচ সর্দারেরা আমাদের ইট তৈরী করতে বলেন। আর দেখুন, আপনার গোলামদের মারধর করা হচ্ছে, কিন্তু দোষটা আপনার নিজের লোকদেরই।” জবাবে ফেরাউন তাদের বললেন, “তোমরা অলস, খুব কুঁড়ে। সেইজন্যই তোমরা বলছ, ‘মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী দেওয়ার জন্য আমাদের যেতে দিন।’ যাও, কাজ কর গিয়ে। তোমাদের আর খড়কুটা দেওয়া হবে না, তবুও তোমাদের যতগুলো ইট তৈরী করবার কথা তা করতেই হবে।” তখন ইসরাইলীয় পরিচালকেরা বুঝল যে, তারা বিপদে পড়েছে, কারণ তাদের বলা হয়েছিল আগে প্রতিদিন তারা যতগুলো করে ইট তৈরী করত এখনও ঠিক ততগুলোই করতে হবে। তারা ফেরাউনের সামনে থেকে বের হয়ে এসে মূসা ও হারুনের দেখা পেল। তাঁরা তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। পরিচালকেরা তাঁদের বলল, “মাবুদ যেন আপনাদের শাস্তি দেন, কারণ ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীদের কাছে আপনারা আমাদের একটা দুর্গন্ধের মত করে তুলেছেন, আর তাতে আমাদের হত্যা করবার তলোয়ার তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।” তখন মূসা ফিরে গিয়ে মাবুদকে বললেন, “হে দীন-দুনিয়ার মালিক, এই জাতিকে কেন তুমি কষ্টে ফেলেছ? কেনই বা তুমি আমাকে পাঠিয়েছ? তোমার নামে ফেরাউনের কাছে কথা বলবার পর থেকেই এই লোকদের উপর বিপদ নেমে এসেছে। কই তুমি তোমার বান্দাদের রক্ষা করলে?” মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি দেখে নিয়ো, ফেরাউনের অবস্থা এবার আমি কি করি। আমার শক্ত হাতে পড়ে সে লোকদের ছেড়ে দেবে। হ্যাঁ, আমার শক্ত হাতে পড়ে সে তার দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে বের করবে।” আল্লাহ্‌ মূসাকে আরও বললেন, “আমি মাবুদ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ হিসাবে আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবকে দেখা দিতাম, কিন্তু মাবুদ হিসাবে আমি যে কি, তা তাদের কাছে প্রকাশ করতাম না। আমি তাদের জন্য আমার ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম। সেই ব্যবস্থায় আমি বলেছিলাম যে, তারা বিদেশী হিসাবে যেখানে বাস করত সেই কেনান দেশটা আমি তাদের দেব। মিসরীয়রা বনি-ইসরাইলদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তাদের ফরিয়াদ শুনে সেই ব্যবস্থার কথা আমি ভাবলাম। সেইজন্য তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমি মাবুদ। মিসরীয়দের চাপিয়ে দেওয়া বোঝার তলা থেকে আমি তোমাদের বের করে নিয়ে আসব। তাদের গোলামী থেকে আমি তোমাদের উদ্ধার করব। হাত বাড়িয়ে তাদের ভীষণ শাস্তি দিয়ে আমি তোমাদের মুক্ত করব। তারপর আমার নিজের বান্দা হিসাবে আমি তোমাদের কবুল করব আর তোমাদের আল্লাহ্‌ হব। তখন তোমরা জানতে পারবে যে, আমি আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ, আর মিসরীয়দের বোঝার তলা থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি। যে দেশ দেবার কসম আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে খেয়েছিলাম সেই দেশেই আমি তোমাদের নিয়ে যাব এবং সেই দেশের অধিকার আমি তোমাদের দেব। আমিই মাবুদ।’ ” মূসা গিয়ে এই সব কথা বনি-ইসরাইলদের জানালেন, কিন্তু নিষ্ঠুরতার মধ্যে গোলামের কাজ করতে করতে মনমরা হয়ে পড়েছিল বলে তারা মূসার কথায় কান দিল না। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনকে গিয়ে বল যেন সে তার দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের যেতে দেয়।” জবাবে মূসা মাবুদকে বললেন, “কিন্তু বনি-ইসরাইলরাই যদি আমার কথা না শোনে তবে ফেরাউন আমার কথায় কান দেবেন কেন, বিশেষ করে আমার কথা যখন জড়িয়ে যায়?” তখন মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা বনি-ইসরাইলদের এবং মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনকে জানাও যে, মাবুদ তোমাদের হুকুম দিয়েছেন যাতে তোমরা বনি-ইসরাইলদের মিসর থেকে বের করে নিয়ে যাও।” এঁরাই ছিলেন রূবেণ, শিমিয়োন ও লেবি বংশের প্রধান: ইসরাইলের বড় ছেলে রূবেণের ছেলেরা হল হনোক, পল্লু, হিষ্রোণ ও কর্মি। এঁরা রূবেণের গোষ্ঠীর বংশ-পিতা ছিলেন। শিমিয়োনের ছেলেরা হল যিমূয়েল, যামীন, ওহদ, যাখীন, সোহর ও তাঁর কেনানীয় স্ত্রীর গর্ভের ছেলে শৌল। এঁরা শিমিয়োনের গোষ্ঠীর বংশ-পিতা ছিলেন। জন্ম অনুসারে পর পর লেবির ছেলেরা হল গের্শোন, কহাৎ ও মরারি। লেবি একশো সাঁইত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। ইমরানের ছেলেরা হল হারুন ও মূসা। ইমরান তাঁর পিতার বোন ইউখাবেজকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর গর্ভে এঁদের জন্ম হয়েছিল। ইমরান একশো সাঁইত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। যিষ্‌হরের ছেলেরা হল কারুন, নেফগ ও সিখ্রি। উষীয়েলের ছেলেরা হল মীশায়েল, ইল্‌সাফন ও সিথ্রী। হারুনের ছেলেরা হল নাদব, অবীহূ, ইলিয়াসর ও ঈথামর। হারুন অম্মীনাদবের মেয়ে নহশোনের বোন ইলীশেবাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর গর্ভে এঁদের জন্ম হয়েছিল। কারুনের ছেলেরা হল অসীর, ইল্‌কানা, অবীয়াসফ। এঁরা কারুনীয়দের বংশ-পিতা ছিলেন। ইলিয়াসরের ছেলে হল পীনহস। হারুনের ছেলে ইলিয়াসর পূটীয়েলের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর গর্ভে পীনহসের জন্ম হয়েছিল। এঁরাই ছিলেন লেবি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের প্রধান লোক। এই হারুন ও মূসাকেই মাবুদ বলেছিলেন যেন তাঁরা সৈন্যদলের মত করে বনি-ইসরাইলদের মিসর দেশ থেকে বের করে নিয়ে আসেন। এই মূসা ও হারুনই মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে নিয়ে যাবার কথা মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনকে বলেছিলেন। কিন্তু মূসা তখন মাবুদকে বলেছিলেন, “ফেরাউন আমার কথায় কান দেবেন কেন, বিশেষ করে আমার কথা যখন জড়িয়ে যায়?” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “দেখ, ফেরাউনের কাছে আমি তোমাকে আল্লাহ্‌র মত করব, আর তোমার ভাই হারুন হবে তোমার নবী। আমি তোমাকে যে সব হুকুম দিচ্ছি তা সবই তুমি প্রকাশ করবে। তোমার ভাই হারুন ফেরাউনকে বলবে, যেন সে তার দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের যেতে দেয়। আমি যখন আমার কুদরত ব্যবহার করে মিসর দেশের মধ্য থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে আনব তখন মিসরীয়রা বুঝতে পারবে যে, আমি মাবুদ।” মাবুদ মূসা ও হারুনকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন তাঁরা ঠিক তেমনই করলেন। ফেরাউনের সংগে কথা বলবার সময়ে মূসার বয়স ছিল আশি আর হারুনের তিরাশি। মাবুদ মূসা ও হারুনকে আরও বললেন, “ফেরাউন যখন তোমাদের কোন অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করে দেখাতে বলবে, তখন তুমি হারুনকে বোলো, ‘ফেরাউনের সামনে তোমার লাঠিটা ফেল,’ আর তাতে সেটা সাপ হয়ে যাবে।” মাবুদ তাঁদের যা বলেছিলেন মূসা ও হারুন ফেরাউনের কাছে গিয়ে ঠিক তা-ই করলেন। হারুন তাঁর লাঠিটা ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীদের সামনে ফেললেন, আর সেটা সাপ হয়ে গেল। ফেরাউন গুণিনদের এবং নেশার জিনিস কাজে লাগানো কুহকীদের, অর্থাৎ তাঁর জাদুকরদের ডেকে পাঠালেন। তারাও তাদের জাদুমন্ত্রের জোরে সেই একই কাজ করল। তারা প্রত্যেকেই তাদের লাঠি মাটিতে ফেলল এবং সেগুলো সাপ হয়ে গেল, কিন্তু হারুনের লাঠিটা তাদের লাঠিগুলোকে গিলে ফেলল। তবে মাবুদ তাঁদের যা বলেছিলেন তা-ই হল। ফেরাউনের মন কঠিন হয়ে রইল; তিনি মূসা ও হারুনের কথা শুনলেন না। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “ফেরাউনের মন শক্ত হয়ে আছে, তাই সে লোকদের যেতে দিচ্ছে না। কাল সকালে ফেরাউন যখন বাইরে নদীর ঘাটে যাবে, তখন তুমি তার সংগে দেখা করবার জন্য নীল নদের ধারে দাঁড়িয়ে থেকো। যে লাঠিটা সাপ হয়ে গিয়েছিল সেটাও হাতে রেখো। তাকে বোলো, ‘ইবরানীদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাকে এই কথা বলতে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন যে, তাঁর লোকেরা যাতে মরুভূমিতে তাঁর এবাদত করতে পারে সেইজন্য আপনি যেন তাদের যেতে দেন। কিন্তু এই পর্যন্ত আপনি তাঁর কথায় কান দেন নি। সেইজন্য মাবুদ বলছেন, তিনিই যে মাবুদ তা আপনি এই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারবেন।’ তুমি বলবে, ‘আমি এখন আমার হাতের এই লাঠিটা দিয়ে নীল নদের পানিতে আঘাত করতে যাচ্ছি আর তাতে নদীর পানি রক্ত হয়ে যাবে। এর ফলে সব মাছ মরে যাবে আর এমন পচা দুর্গন্ধ বের হবে যে, পানি খেতে গিয়ে মিসরীয়রা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে।’ ” পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “হারুনকে বল যেন সে তার লাঠিটা হাতে নেয় এবং মিসরের সমস্ত নদী, খাল, পুকুর ও জমা করে রাখা পানির দিকে তার হাতখানা বাড়িয়ে ঘুরিয়ে আনে। তাতে সমস্ত পানি রক্ত হয়ে যাবে। মিসর দেশের সব জায়গাতেই রক্ত দেখা যাবে; এমন কি, কাঠ ও পাথরের পাত্রের পানিও বাদ যাবে না।” মূসা ও হারুন মাবুদের হুকুম মত সব কিছু করলেন। ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীদের সামনে হারুন তাঁর লাঠিটা তুলে নীল নদের পানিতে আঘাত করলেন। তাতে নীল নদের সমস্ত পানি রক্ত হয়ে গেল। নদীর সব মাছ মরে গিয়ে এমন দুর্গন্ধ বের হতে লাগল যে, মিসরীয়রা সেই পানি খেতে পারল না। মিসর দেশের সব জায়গাতেই রক্ত দেখা গেল। তখন মিসরীয় জাদুকরেরা তাদের জাদুমন্ত্রের জোরে সেই একই কাজ করল। তাই ফেরাউনের মন আরও কঠিন হয়ে উঠল। মাবুদ যা বলেছিলেন তা-ই হল; মূসা ও হারুনের কথা ফেরাউন শুনলেন না, বরং পিছন ফিরে নিজের বাড়ীতে গিয়ে ঢুকলেন। তিনি সেই দিকে খেয়ালই করলেন না। নদীর পানি খাওয়া গেল না দেখে মিসরীয়রা পানির জন্য নদীর আশেপাশে মাটি খুঁড়ল। নীল নদের উপর মাবুদের এই গজব নেমে আসবার পর সাত দিন কেটে গেল। তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “ফেরাউনকে গিয়ে এই কথা বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমার এবাদত করবার জন্য আমার বান্দাদের যেতে দাও। যদি তুমি তাদের যেতে না দাও তবে সারা দেশের উপর আমি ব্যাঙের উৎপাত সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। নীল নদ ব্যাঙে ভরে যাবে, আর নদী থেকে সেগুলো উঠে আসবে এবং তোমার ঘর-বাড়ীতে, তোমার শোবার ঘরে, তোমার বিছানাতে, তোমার কর্মচারীদের ঘরে, তোমার লোকদের ঘরে, তোমার চুলাতে এবং তোমার ময়দা মাখবার পাত্রে গিয়ে উঠবে। সেই ব্যাঙগুলো তোমার উপর এবং তোমার লোকদের ও তোমার কর্মচারীদের উপর গিয়ে উঠবে।’ ” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুনকে এই কথা বলবে, ‘মিসর দেশের সব নদী, খাল ও পুকুরের উপরে লাঠিসুদ্ধ তোমার হাতখানা বাড়িয়ে দেশের উপর ব্যাঙ তুলে নিয়ে এস।’ ” তখন হারুন মিসরের সব পানির উপর তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাতে ব্যাঙ উঠে এসে দেশটা ছেয়ে ফেলল। জাদুকরেরাও তাদের জাদুমন্ত্রের জোরে সেই একই কাজ করল। তারাও মিসর দেশে ব্যাঙ আনল। ফেরাউন তখন মূসা ও হারুনকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “তোমরা মাবুদের কাছে মিনতি কর যেন তিনি আমার ও আমার লোকদের উপর থেকে এই ব্যাঙের উৎপাত সরিয়ে নেন। তখন আমি লোকদের যেতে দেব যাতে তারা গিয়ে মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিতে পারে।” মূসা ফেরাউনকে বললেন, “ব্যাঙগুলো যাতে আপনাকে ও আপনার ঘর-বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়ে কেবল নদীর মধ্যে থাকে, সেইজন্য বলুন কখন আমি আপনার ও আপনার কর্মচারী ও লোকদের জন্য মিনতি করব। সময়টা আপনিই ঠিক করুন।” জবাবে ফেরাউন বললেন, “তবে সেটা কালকেই হোক।” মূসা বললেন, “তা-ই হবে। এতে আপনি বুঝতে পারবেন যে, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র মত কেউ নেই। ব্যাঙগুলো আপনাকে এবং আপনার বাড়ী-ঘর, আপনার কর্মচারী ও আপনার লোকদের ছেড়ে চলে যাবে। সেগুলো কেবল নীল নদের মধ্যেই থাকবে।” এই কথা বলে মূসা ও হারুন ফেরাউনের কাছ থেকে চলে গেলেন। ফেরাউনের উপর মাবুদ যে ব্যাঙের উৎপাত এনেছিলেন সেই সম্বন্ধে মূসা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানালেন। তখন মাবুদ তাঁর কথামতই কাজ করলেন। ঘর-বাড়ি, উঠান ও জায়গা-জমিতে যত ব্যাঙ ছিল সব মরে গেল। লোকেরা সেগুলো এনে নানা জায়গায় জড়ো করল আর তাতে দেশের মধ্যে এক ভীষণ দুর্গন্ধের সৃষ্টি হল। কিন্তু ব্যাঙের উৎপাত থেকে রেহাই পেয়ে ফেরাউন আবার তাঁর মন শক্ত করে মূসা ও হারুনের কথা শুনলেন না। মাবুদ যা বলেছিলেন তা-ই হল। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “হারুনকে তার লাঠি তুলে মাটিতে ধুলার উপর আঘাত করতে বল। তাতে সেই ধুলা মশা হয়ে সারা মিসর দেশটা ছেয়ে ফেলবে।” হারুন ও মূসা তা-ই করলেন। হারুন তাঁর হাতখানা বাড়িয়ে লাঠি দিয়ে মাটিতে ধুলার উপর আঘাত করলেন আর তাতে মানুষ ও পশুর উপর মশার উৎপাত দেখা দিল। মিসর দেশের সমস্ত ধুলাই মশা হয়ে গেল। জাদুকরেরা তাদের জাদুমন্ত্রের জোরে মশা নিয়ে আসবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মানুষ এবং পশুর উপর মশা বসতে লাগল। এই অবস্থা দেখে জাদুকরেরা ফেরাউনকে বলল, “এতে আল্লাহ্‌র আংগুলের ছোঁয়া রয়েছে।” কিন্তু তবুও ফেরাউনের মন কঠিনই রয়ে গেল; তিনি মূসা ও হারুনের কথায় কান দিলেন না। মাবুদ যা বলেছিলেন তা-ই হল। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি খুব ভোরে উঠবে এবং ফেরাউন যখন বাইরে নদীর ঘাটে যাবে তখন তুমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তাকে বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমার এবাদত করবার জন্য আমার বান্দাদের যেতে দাও। যদি তা না দাও তবে আমি তোমার উপর এবং তোমার সব কর্মচারী ও তোমার লোকদের উপর আর তোমার বাড়ী-ঘরে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা পাঠাচ্ছি। মিসরীয়দের বাড়ী-ঘর এবং সব জায়গা নানা রকম পোকায় ভরে যাবে। কিন্তু সেই দিন গোশন এলাকাটা আমি বাদ দেব, কারণ আমার বান্দারা সেখানে বাস করছে। সেখানে কোন পোকার উৎপাত থাকবে না। তা থেকে তোমরা জানতে পারবে যে, আমি মাবুদই এই দেশে আছি। আমার লোকদের আমি রেহাই দেব, তোমার লোকদের নয়। আগামী কাল এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যাবে।’ ” মাবুদ তা-ই করলেন। ফেরাউনের রাজবাড়ীতে এবং তাঁর কর্মচারীদের বাড়ীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা ঢুকল। এই সব পোকার উৎপাতে সারা মিসর দেশটার সর্বনাশ হতে লাগল। তখন ফেরাউন মূসা ও হারুনকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “তোমরা এই দেশের মধ্যেই কোথাও গিয়ে তোমাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পশু-কোরবানী দাও।” মূসা বললেন, “কিন্তু এটা করা কি ঠিক হবে? আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আমরা যা কোরবানী করব তা মিসরীয়দের কাছে ঘৃৃণার জিনিস। মিসরীয়রা যা ঘৃণা করে তা-ই যদি আমরা তাদের চোখের সামনে কোরবানী করি তবে কি তারা আমাদের পাথর মারবে না? সেইজন্য আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম মতই মরুভূমির মধ্যে তিন দিনের পথ গিয়ে তাঁর উদ্দেশে আমাদের পশু-কোরবানী দিতে হবে।” ফেরাউন বললেন, “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পশু-কোরবানীর জন্য আমি মরুভূমিতেই তোমাদের যেতে দেব। কিন্তু তোমরা বেশী দূরে যাবে না। এবার তোমরা আমার জন্য মিনতি কর।” মূসা বললেন, “আমি আপনার কাছ থেকে গিয়েই মাবুদের কাছে মিনতি করব যেন কালই মহারাজ এবং তাঁর কর্মচারীদের ও তাঁর লোকদের উপর থেকে এই পোকার উৎপাত চলে যায়। কিন্তু মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী দেওয়ার জন্য যেতে না দিয়ে মহারাজ যেন আমাদের আবার ফাঁকি না দেন।” এর পর মূসা ফেরাউনের কাছ থেকে গিয়ে মাবুদের কাছে মিনতি করলেন, আর মাবুদও মূসার কথামত কাজ করলেন। তিনি ফেরাউন এবং তাঁর কর্মচারী ও তাঁর লোকদের উপর থেকে পোকার উৎপাত সরিয়ে দিলেন। একটা পোকাও আর রইল না। কিন্তু এবারও ফেরাউন তাঁর মন শক্ত করলেন এবং লোকদের যেতে দিলেন না। এর পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “ফেরাউনের কাছে গিয়ে বল যে, ইবরানীদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আমার এবাদত করবার জন্য আমার বান্দাদের যেতে দাও। কিন্তু তা না দিয়ে যদি তুমি তাদের ধরেই রাখ, তবে মাঠে তোমার ঘোড়া, গাধা, উট, গরু, ভেড়া, ছাগল, এক কথায় তোমার সব পশুপালের উপর আমি শীঘ্রই নিজের হাতে এক ভীষণ মহামারীর ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমি বনি-ইসরাইলদের পশুপালগুলোকে মিসরীয়দের পশুপাল থেকে আলাদা করে দেখব। তাদের যে সব পশু আছে তার একটাও মরবে না।’ ” মহামারীটা কখন হবে তা-ও মাবুদ ঠিক করলেন। তিনি বললেন, “কালকেই এই দেশের উপর আমি এটা ঘটাব।” পরের দিন মাবুদ তা-ই করলেন। তাতে মিসরীয়দের সব পশু মরে গেল, কিন্তু বনি-ইসরাইলদের পাল থেকে একটা পশুও মরল না। ফেরাউন লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে, বনি-ইসরাইলদের একটা পশুও মরে নি। তবুও ফেরাউনের মন শক্ত হয়ে রইল; তিনি লোকদের যেতে দিলেন না। তারপর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “চুলা থেকে তোমরা কয়েক মুঠো কালি নাও। ফেরাউনের চোখের সামনেই মূসা তা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিক। সেগুলো মিহি ধুলার মত হয়ে সারা মিসর দেশে নেমে আসবে। তাতে সারা মিসর দেশের মানুষ ও পশুর গায়ে ফোড়া উঠে ঘা হয়ে যাবে।” তখন মূসা ও হারুন চুলা থেকে কালি নিয়ে ফেরাউনের সামনে দাঁড়ালেন। মূসা তা আকাশে ছুঁড়ে দিলে পর মানুষ ও পশুর গায়ে ফোড়া উঠে ঘা হয়ে গেল। জাদুকরেরা মূসার সামনে দাঁড়াতে পারল না, কারণ অন্যান্য মিসরীয়দের মত তাদেরও ফোড়া হয়েছিল। কিন্তু মাবুদ ফেরাউনের মন কঠিন করলেন। তাতে মাবুদ যা বলেছিলেন তা-ই হল। মূসা ও হারুনের কথায় ফেরাউন কান দিলেন না। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি খুব সকালে উঠে ফেরাউনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, আর তাকে বলবে যে, ইবরানীদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আমার এবাদত করবার জন্য আমার বান্দাদের যেতে দাও, কারণ এর পর তোমার উপরে এবং তোমার কর্মচারী ও লোকদের উপরে আমি আমার সমস্ত গজবের ব্যবস্থা করব। তখন তুমি বুঝতে পারবে যে, সারা দুনিয়াতে আমার মত কেউ নেই। এর মধ্যেই আমি আমার কুদরত ব্যবহার করে তোমার ও তোমার লোকদের উপর এমন এক মহামারীর ব্যবস্থা করতে পারতাম যাতে তোমরা দুনিয়া থেকে ধ্বংস হয়ে যেতে। কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি যেন তোমাকে আমার কুদরত দেখাতে পারি এবং সারা দুনিয়াতে যেন আমার নাম প্রচারিত হয়। তুমি এখনও আমার বান্দাদের বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছ আর তাদের যেতে দিচ্ছ না। সেইজন্য কালকে ঠিক এই সময়ে আমি এমন এক ভয়ংকর শিলাবৃষ্টি পাঠিয়ে দেব যা মিসর দেশের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনও হয় নি। এইজন্য মাঠে তোমার যত পশু এবং মানুষ আছে লোক পাঠিয়ে তাদের আশ্রয়ের জায়গায় নিয়ে এস। কোন লোক বা পশু ঘরে না এসে যদি মাঠে থেকে যায় তবে শিলের আঘাতে তারা মারা যাবে।’ ” তখন ফেরাউনের কর্মচারীদের মধ্যে যারা মাবুদের কথায় ভয় পেল তারা তাড়াতাড়ি তাদের গোলামদের ও পশুপাল ঘরে নিয়ে আসল। কিন্তু যারা তা অগ্রাহ্য করল তারা তাদের গোলামদের ও পশুপাল মাঠেই রেখে দিল। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “আকাশের দিকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও। তাতে সারা মিসর দেশের মানুষ, পশু ও মাঠের গাছ-গাছড়ার উপর শিল পড়বে।” তখন মূসা আকাশের দিকে তাঁর লাঠি উঁচু করে ধরলেন। তাতে মাবুদ এমন করলেন যার ফলে মেঘ গর্জন করতে ও শিলাবৃষ্টি হতে লাগল এবং মাটির উপর বাজ পড়তে লাগল। এইভাবেই মাবুদ মিসর দেশের উপর শিলাবৃষ্টি পাঠালেন। শুধু যে কেবল শিল পড়ল তা নয়, তার সংগে সংগে অনবরত বিদ্যুৎ চম্‌কাতে লাগল। মিসর রাজ্যের শুরু থেকে এই পর্যন্ত সারা দেশে এই রকম ভীষণ ঝড় আর কখনও হয় নি। মিসর দেশের মাঠগুলোতে যে সব মানুষ ও পশু ছিল শিল তাদের কাউকে রেহাই দিল না। শিলের আঘাতে মাঠের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল এবং গাছের ডালপালা ভেংগে পড়ল। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা যেখানে থাকত সেই গোশন এলাকায় শিল পড়ল না। ফেরাউন তখন মূসা ও হারুনকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “এবার আমি গুনাহ্‌ করেছি। মাবুদ ঠিক কাজ করেছেন। আমি আর আমার লোকেরাই দোষী। তুমি মাবুদের কাছে মিনতি কর। মেঘের গর্জন ও শিল পড়া যথেষ্ট হয়েছে। এবার আমি তোমাদের যেতে দেব। এখানে আর তোমাদের থাকতে হবে না।” মূসা তাঁকে বললেন, “শহর থেকে বের হয়ে গিয়েই আমি মাবুদের কাছে হাত তুলে মুনাজাত করব। তাতে মেঘের গর্জনও থেমে যাবে, শিলও আর পড়বে না। এতে আপনি বুঝতে পারবেন যে, দুনিয়াটা মাবুদেরই। কিন্তু আমি জানি যে, আপনি এবং আপনার কর্মচারীরা মাবুদ আল্লাহ্‌কে এখনও ভয় করেন না।” শিলাবৃষ্টির দরুন মিসরের সব মসীনা আর যব একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় যবের শীষ বের হয়েছিল আর মসীনা গাছে ফুল এসেছিল, কিন্তু সরস এবং নীরস গমের কোনটাই নষ্ট হয় নি কারণ তখনও সেগুলো পাকবার সময় হয় নি। এর পর মূসা ফেরাউনের কাছ থেকে চলে গেলেন। শহর থেকে বের হয়ে তিনি মাবুদের কাছে হাত তুলে মুনাজাত করলেন। তখন মেঘের গর্জন ও শিল পড়া বন্ধ হল। মাটির উপর মুষলধারে বৃষ্টি পড়াও থেমে গেল। কিন্তু ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীরা যখন দেখলেন যে, বৃষ্টি, শিল ও মেঘের গর্জন বন্ধ হয়ে গেছে তখন তাঁরা আবার গুনাহ্‌ করতে লাগলেন। তাঁরা আবার তাদের মন শক্ত করলেন। মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে যেমন বলেছিলেন তেমনি ফেরাউনের মন কঠিন হয়ে রইল; তিনি বনি-ইসরাইলদের যেতে দিলেন না। মূসা ও হারুন তখন ফেরাউনের কাছে গিয়ে বললেন, “ইবরানীদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আর কতদিন তুমি আমার সামনে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করবে? আমার এবাদত করবার জন্য আমার বান্দাদের যেতে দাও। যদি তুমি আমার বান্দাদের যেতে দিতে রাজী না হও তবে কালকেই আমি তোমার দেশের মধ্যে পংগপাল নিয়ে আসব। সেগুলো এসে দেশটা এমনভাবে ঢেকে ফেলবে যে, মাটি পর্যন্ত দেখা যাবে না। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে যা রেহাই পেয়েছে সেগুলো সব এই পংগপাল খেয়ে ফেলবে। মাঠে যে সব গাছপালা গজাচ্ছে সেগুলোও তারা খেয়ে ফেলবে। তারপর তোমার ও তোমার সব কর্মচারীর এবং অন্যান্য সমস্ত মিসরীয়দের বাড়ী-ঘর এই সব পংগপালে ভরে যাবে। এই দেশে আসবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার বাপ-দাদারা এবং তাদের বাপ-দাদারাও কখনও এমন হতে দেখে নি।’ ” এই কথা বলবার পর মূসা পিছন ফিরে ফেরাউনের কাছ থেকে চলে গেলেন। তখন ফেরাউনের কর্মচারীরা তাঁকে বলল, “এই লোকটা আর কতদিন আমাদের ফাঁদ হয়ে থাকবে? ঐ লোকগুলো যেন তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করতে পারে সেইজন্য তাদের যেতে দিন। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে, মিসর দেশটা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল?” কাজেই মূসা ও হারুনকে আবার ফেরাউনের কাছে নিয়ে আসা হল। ফেরাউন তাঁদের বললেন, “যাও, তোমরা গিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত কর। কিন্তু তোমাদের সংগে আর কারা যাবে?” জবাবে মূসা বললেন, “আমাদের শিশু ও বৃদ্ধ, আমাদের ছেলেমেয়ে এবং আমাদের গরু-ভেড়া সবই আমাদের সংগে যাবে, কারণ মাবুদের উদ্দেশে আমাদের একটা ঈদ পালন করতে হবে।” তখন ফেরাউন তাঁদের বললেন, “যদি কখনও আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে তোমাদের যেতে দিই তবে তোমাদের ঐ মাবুদটাও যেন তোমাদের সংগে থাকে। সাবধান! তোমাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। না, তা হবে না। তোমরা তো মাবুদের এবাদত করতে যেতে চাইছ, তবে কেবল পুরুষেরাই যাক।” এর পর ফেরাউনের সামনে থেকে মূসা এবং হারুনকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “মিসর দেশের উপর তোমার হাত বাড়িয়ে দাও। তাতে মাঠের সবুজ সব কিছু, অর্থাৎ শিলাবৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া সব কিছু পংগপাল এসে খেয়ে ফেলবে।” তখন মূসা মিসর দেশের উপরে তাঁর লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন; আর মাবুদ এমন করলেন যার দরুন সেই দেশের উপর সারা দিন ও সারা রাত ধরে পূবের বাতাস বইল। সকালবেলা সেই পূবের বাতাস ঝাঁকে ঝাঁকে পংগপাল নিয়ে আসল। এতে সারা মিসর দেশের উপর অসংখ্য পংগপাল এসে সব জায়গায় বসল। এত বেশী পংগপাল আগে আর কখনও দেখা যায় নি, কখনও দেখা যাবেও না। সেই সব পংগপাল সারা দেশটা এমনভাবে ঢেকে ফেলল যে, মাটির উপরটা কালো দেখাতে লাগল। মাঠে সবুজ সব কিছু আর গাছে যে সব ফল শিলাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পেয়েছিল সেগুলো সব তারা খেয়ে ফেলল। সারা মিসর দেশের গাছপালাতে সবুজ বলতে কিছুই রইল না। তখন ফেরাউন তাড়াতাড়ি মূসা ও হারুনকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ ও তোমাদের বিরুদ্ধে আমি গুনাহ্‌ করেছি। তাই দয়া করে তোমরা কেবল এবারের মত আমার গুনাহ্‌ মাফ কর। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মিনতি কর যেন তিনি আমার উপর থেকে এই মৃত্যুর ছায়া সরিয়ে নেন।” তখন মূসা ফেরাউনের কাছ থেকে গিয়ে মাবুদের কাছে মিনতি করলেন। তাতে মাবুদ বাতাসের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন আর পশ্চিম দিক থেকে একটা জোর বাতাস এসে পংগপালগুলো উড়িয়ে নিয়ে লোহিত সাগরে ফেলল। সারা মিসর দেশে আর একটাও পংগপাল রইল না। কিন্তু মাবুদ ফেরাউনের মন কঠিন করলেন; তিনি বনি-ইসরাইলদের যেতে দিলেন না। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “আকাশের দিকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও। তাতে হাত দিয়ে ছোঁয়ার মত অন্ধকারে দেশটা ডুবে যাবে।” তখন মূসা আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আর তাতে তিন দিন পর্যন্ত গাঢ় অন্ধকারে সারা মিসর দেশটা ডুবে রইল। ঐ তিন দিন পর্যন্ত কেউ কাউকে দেখতেও পেল না এবং ঘর ছেড়ে কেউ বাইরেও গেল না। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা যেখানে ছিল সেখানে আলোর অভাব হল না। তখন ফেরাউন মূসাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “যাও, গিয়ে মাবুদের এবাদত কর। তোমাদের ছেলেমেয়েরাও তোমাদের সংগে যেতে পারবে, কিন্তু তোমাদের গরু-ভেড়ার পাল এখানে থাকবে।” জবাবে মূসা বললেন, “আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো ও অন্যান্য কোরবানীর পশু আপনাকেই যুগিয়ে দিতে হবে। আমাদের গরু-ভেড়াগুলোও আমাদের সংগে নিয়ে যেতে হবে। তাদের একটা খুরও আমরা এখানে ফেলে যেতে পারব না। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদতের জন্য এগুলোর মধ্য থেকে কতগুলো আমাদের দরকারে লাগবে। সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারছি না মাবুদের এবাদতের জন্য কোন্‌ কোন্‌ পশু আমাদের লাগবে।” মাবুদ কিন্তু ফেরাউনের মন কঠিন করলেন আর তাতে তাদের যেতে দিতে তিনি রাজী হলেন না। ফেরাউন মূসাকে বললেন, “আমার কাছ থেকে দূর হও। সাবধান! আর কখনও আমার সামনে এসো না। যেদিন তুমি আমার সামনে পড়বে সেই দিনই তোমার মরণ হবে।” মূসা বললেন, “আপনি যা বলছেন তা-ই হবে। আমার নিজের ইচ্ছায় আমি আর আপনার সামনে আসব না।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “আমি ফেরাউন ও মিসর দেশের উপর আর একটা গজব নাজেল করব। তার পরে ফেরাউন এখান থেকে তোমাদের যেতে দেবে। তবে সে যখন তোমাদের যেতে দেবে তখন এখান থেকে তোমাদের সে একেবারে তাড়িয়েই বিদায় করবে। তুমি বনি-ইসরাইলদের বলবে, স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যেন তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সোনা ও রূপার জিনিস চেয়ে নেয়।” এদিকে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের প্রতি মিসরীয়দের মনে একটা দয়ার ভাব জাগিয়ে দিলেন। এছাড়া মূসাও ফেরাউনের কর্মচারীদের ও মিসরের লোকদের চোখে একজন মহান লোক ছিলেন। মূসা ফেরাউনকে বললেন, “মাবুদ বলছেন, তিনি মাঝরাতে মিসর দেশের মধ্য দিয়ে যাবেন। তাতে মিসর দেশের সব পরিবারের প্রথম ছেলে মারা যাবে। সিংহাসনের অধিকারী ফেরাউনের প্রথম ছেলে থেকে শুরু করে জাঁতা ঘুরানো বাঁদীর প্রথম ছেলে পর্যন্ত কেউ বাদ যাবে না। এছাড়া পশুদেরও প্রথম পুরুষ বাচ্চা মরে যাবে। এতে গোটা মিসর দেশে এমন কান্নার রোল উঠবে যা আগে কখনও ওঠে নি এবং আর কখনও উঠবেও না। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের মধ্যে একটা কুকুরের ডাক পর্যন্ত শোনা যাবে না, তা মানুষ দেখেই হোক বা পশু দেখেই হোক। এতে আপনারা জানতে পারবেন যে, মাবুদ মিসরীয় এবং বনি-ইসরাইলদের আলাদা করে দেখেন। আপনার এই সব কর্মচারী এসে আমার সামনে হাঁটু পেতে বলবে, ‘আপনি আপনার সব লোকজন নিয়ে বের হয়ে যান!’ তারপর আমি চলে যাব।” এই কথা বলে মূসা রেগে আগুন হয়ে ফেরাউনের কাছ থেকে চলে গেলেন। মাবুদ মূসাকে বলেছিলেন, “মিসর দেশে আমার কুদরতি কাজের সংখ্যা যেন বেড়ে যায় সেইজন্যই ফেরাউন তোমার কথা শুনবে না।” এই সব কুদরতি কাজ মূসা ও হারুন ফেরাউনের সামনে করলেন, কিন্তু মাবুদ ফেরাউনের মন কঠিন করলেন বলে তিনি তাঁর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের যেতে দিলেন না। পরে মাবুদ মিসর দেশে মূসা ও হারুনকে বললেন, “এই মাসটাই হবে তোমাদের প্রথম মাস, তোমাদের বছরের প্রথম মাস। তোমরা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করে বলে দাও যেন এই মাসের দশ তারিখে প্রত্যেকটি পরিবারের কর্তা নিজের পরিবারের জন্য একটা করে ভেড়ার বাচ্চা বেছে নেয়। প্রত্যেক বাড়ীর জন্য একটা করে ভেড়ার বাচ্চা নিতে হবে। কোন পরিবারের জন্য যদি একটা গোটা ভেড়ার বাচ্চা না লাগে, তবে পাশের বাড়ীর লোকদের সংগে তা ভাগ করে নিতে হবে। দুই পরিবারের লোকসংখ্যা অনুসারে প্রত্যেকে কি পরিমাণে খেতে পারবে তা বুঝে ভেড়ার বাচ্চাটা নিতে হবে। সেই বাচ্চাটা হবে ছাগল বা ভেড়ার পাল থেকে বেছে নেওয়া একটা এক বছরের পুরুষ বাচ্চা। তার শরীরে যেন কোথাও কোন খুঁত না থাকে। বাচ্চাটা এই মাসের চৌদ্দ তারিখ পর্যন্ত রাখতে হবে। তারপর সেই দিন বেলা ডুবে গেলে পর গোটা ইসরাইল সমাজের প্রত্যেকটি পরিবার নিজের নিজের ভেড়ার বাচ্চা জবাই করবে। তারপর যে সব ঘরে তারা সেই ভেড়ার গোশ্‌ত খাবে সেই সব ঘরের দরজার চৌকাঠের দু’পাশে এবং উপরে কিছু রক্ত নিয়ে লাগিয়ে দেবে। সেই রাতেই তারা সেই গোশ্‌ত আগুনে সেঁকে খামিহীন রুটি এবং তেতো শাকের সংগে খাবে। সেই গোশ্‌ত তোমরা কাঁচা বা পানিতে সিদ্ধ করে খাবে না, কিন্তু মাথা, পা এবং ভিতরের অংশগুলো সুদ্ধ তা আগুনে সেঁকে নিয়ে খাবে। সকাল পর্যন্ত তার কোন কিছুই ফেলে রেখো না। যদি কিছু বাকী থাকে তবে তা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। তোমরা এই অবস্থায় তা খাবে: তোমাদের কাপড় থাকবে কোমরে গুটানো, পায়ে থাকবে জুতা এবং হাতে লাঠি। তোমরা তাড়াহুড়া করে খাবে। এটা হল মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদের মেজবানী। সেই রাতেই আমি মিসর দেশের ভিতর দিয়ে যাব এবং মানুষের প্রথম ছেলে ও পশুর প্রথম পুরুষ বাচ্চাকে মেরে ফেলব। আমি মিসরের সব দেব-দেবীদের উপর গজব নাজেল করব; আমি মাবুদ। কিন্তু তোমাদের ঘরে যে রক্ত লাগানো থাকবে সেটাই হবে তোমাদের চিহ্ন। আর আমি সেই রক্ত দেখে তোমাদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যাব। তাতে মিসর দেশের উপর আমার গজবের বিপদ থেকে তোমরা রেহাই পেয়ে যাবে। তোমাদের জন্য সেই দিনটা হবে একটা স্মরণীয় দিন। মাবুদের উদ্দেশে এই ঈদটি একটা চিরকালের নিয়ম হিসাবে তোমরা বংশের পর বংশ ধরে পালন করবে। “তোমরা সাত দিন পর্যন্ত খামিহীন রুটি খাবে। তোমাদের বাড়ীতে যত খামি আছে প্রথম দিনেই তোমরা তা সব সরিয়ে ফেলবে। এই সাত দিনের মধ্যে যদি কেউ খামি দেওয়া রুটি খায় তবে তাকে বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে মুছে ফেলা হবে। প্রথম এবং সপ্তম দিনে তোমরা পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করবে। এই দু’দিন তোমরা নিজেদের খাবার তৈরী করা ছাড়া আর কোন কাজ করবে না। খামিহীন রুটির এই যে ঈদ তা একটা চিরকালের নিয়ম হিসাবে তোমরা বংশের পর বংশ ধরে পালন করবে, কারণ এই দিনেই সৈন্যদলের মত করে আমি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে আনব। তোমরা প্রথম মাসের চৌদ্দ তারিখের সন্ধ্যাবেলা থেকে শুরু করে সেই মাসের একুশ তারিখের সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত খামিহীন রুটি খাবে। এই সাত দিন তোমাদের বাড়ীতে যেন কোন খামি না থাকে। যদি কেউ খামি-দেওয়া কোন কিছু খায়, তবে তাকে ইসরাইলীয় সমাজ থেকে মুছে ফেলা হবে, সে তোমাদের জাতির লোকই হোক বা অন্য জাতির লোকই হোক। তোমরা যেখানেই থাক না কেন এই সাত দিন তোমরা খামি দেওয়া কোন কিছু খাবে না; রুটিও খাবে খামিহীন।” তখন মূসা বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতাদের ডেকে বললেন, “তোমাদের পরিবারের জন্য ভেড়ার বাচ্চা বেছে নিয়ে উদ্ধার-ঈদের উদ্দেশ্যে তা জবাই করবে। তারপর এসোব ঝোপ থেকে এক গোছা ডাল নিয়ে পেয়ালাতে রাখা রক্তে ডুবিয়ে সেই রক্ত দরজার চৌকাঠের দু’পাশে ও উপরের কাঠে লাগিয়ে দেবে; আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে যাবে না। মিসরীয়দের আঘাত করবার সময় মাবুদ যখন মিসর দেশের ভিতর দিয়ে যাবেন তখন তোমাদের দরজার চৌকাঠে রক্ত দেখে তিনি তোমাদের দরজা বাদ দিয়ে এগিয়ে যাবেন। যিনি এই ধ্বংসের কাজ করবেন তাঁকে তিনি তোমাদের বাড়ীতে ঢুকে তোমাদের আঘাত করতে দেবেন না। “এই ঈদ সব সময় তোমরা ও তোমাদের বংশধরেরা একটা নিয়ম হিসাবে পালন করবে। মাবুদ যে দেশ তোমাদের দেবার ওয়াদা করেছেন সেই দেশে গিয়েও তোমরা এই ঈদ পালন করবে। তোমাদের ছেলেমেয়েরা যখন তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে, ‘এই ঈদের মানে কি?’ তখন তোমরা বলবে, ‘এটা হল মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদের কোরবানী, কারণ মিসর দেশে থাকবার সময় তিনি বনি-ইসরাইলদের বাড়ীগুলো বাদ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মিসরীয়দের মেরে ফেলেছিলেন কিন্তু আমাদের রক্ষা করেছিলেন।’ ” এর পর বনি-ইসরাইলরা মাবুদকে সেজদা করল। মূসা ও হারুনকে মাবুদ যে হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা ফিরে গিয়ে সেইমত কাজ করল। তারপর চৌদ্দ তারিখের মাঝরাতে মাবুদ মিসর দেশের প্রত্যেকটি প্রথম ছেলেকে মেরে ফেললেন। এতে রাজ-সিংহাসনের অধিকারী ফেরাউনের প্রথম ছেলে থেকে জেলখানার কয়েদীর প্রথম ছেলে পর্যন্ত, এমন কি, পশুদেরও প্রথম পুরুষ বাচ্চা মারা পড়ল। সেই রাতে ফেরাউন ও তাঁর সব কর্মচারী এবং মিসরের প্রত্যেকটি লোক ঘুম থেকে জেগে উঠল; আর সারা মিসর দেশে একটা কান্নার রোল পড়ে গেল, কারণ এমন একটাও বাড়ী ছিল না যেখানে কেউ মারা যায় নি। ফেরাউন সেই রাতেই মূসা ও হারুনকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “তোমরা বনি-ইসরাইলদের সংগে নিয়ে আমার লোকদের মধ্য থেকে বের হয়ে যাও। তোমরা যেমন বলেছ সেইভাবে গিয়ে মাবুদের এবাদত কর। তোমাদের কথামত যাবার সময়ে তোমাদের গরু-ভেড়ার পালও নিয়ে যেয়ো, আর আমাকেও দোয়া কোরো।” মিসরীয়দেরও ভয় হল যে, তারাও হয়তো মারা পড়বে। এইজন্য তারা বনি-ইসরাইলদের তাগাদা দিতে লাগল যেন তারা তাড়াতাড়ি করে তাদের দেশ থেকে বের হয়ে যায়। এতে বনি-ইসরাইলরা খামি মেশাবার আগেই তাদের ময়দা মাখবার পাত্র সুদ্ধ ময়দার তালগুলো তাদের কাপড়ে বেঁধে নিয়ে কাঁধে ফেলল। বনি-ইসরাইলরা মূসার কথামত মিসরীয়দের কাছ থেকে সোনা-রূপার জিনিস এবং কাপড়-চোপড় চেয়ে নিল। তারা যা চাইবে মিসরীয়রা যাতে তাদের তা-ই দেয় সেইজন্য মাবুদ আগেই মিসরীয়দের মনে বনি-ইসরাইলদের প্রতি একটা দয়ার মনোভাব সৃষ্টি করেছিলেন। এইভাবে তারা মিসরীয়দের অনেক কিছু অধিকার করে নিলেন। তারপর বনি-ইসরাইলরা রামিষেষ থেকে সুক্কোতের দিকে রওনা হল। প্রায় ছয় লক্ষ পুরুষ লোক হেঁটে চলল। তাদের সংগে স্ত্রীলোক এবং ছেলেমেয়েরাও ছিল। বনি-ইসরাইলরা ছাড়া আরও অনেক লোক এবং গরু-ভেড়া সুদ্ধ একটা বিরাট পশুর দলও তাদের সংগে ছিল। যে খামিহীন ময়দার তাল তারা মিসর থেকে নিয়ে এসেছিল পথে তারা তা দিয়ে রুটি তৈরী করে নিল। এত তাড়াহুড়ো করে মিসর থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয়েছিল যে, তারা ময়দার সংগে খামি মেশাবারও সময় পায় নি আর পথে খাবার জন্য কোন কিছু তৈরীও করে নিতে পারে নি। মিসর দেশে বনি-ইসরাইলরা মোট চারশো ত্রিশ বছর বাস করেছিল। চারশো ত্রিশ বছর শেষ হবার দিনই মাবুদের সমস্ত বান্দা সৈন্যদলের মত করে মিসর দেশ ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল। মাবুদ সেই রাতে পাহারা দিয়ে মিসর দেশ থেকে তাদের বের করে এনেছিলেন বলে বংশের পর বংশ ধরে বনি-ইসরাইলদেরও মাবুদের কথা মনে করে সেই রাতটা জেগে কাটাতে হয়। পরে মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “উদ্ধার-ঈদের ভেড়ার বাচ্চা সম্বন্ধে কতগুলো নিয়ম আমি তোমাদের দিচ্ছি। অন্য কোন জাতির লোক এর গোশ্‌ত খেতে পারবে না। টাকা দিয়ে কেনা গোলাম খৎনা করাবার পরে তা খেতে পারবে। তোমাদের মধ্যে বাস করতে এসেছে কিংবা টাকা দিয়ে খাটানো হচ্ছে এমন অন্য কোন জাতির লোক তা খেতে পারবে না। যে বাড়ীতে ভেড়ার বাচ্চা জবাই করা হবে সেই বাড়ীতেই তা খেতে হবে। বাড়ীর বাইরে তা নেওয়া চলবে না এবং সেই ভেড়ার একটা হাড়ও ভাংগা চলবে না। “ইসরাইলীয়দের সকলকেই এই ঈদ পালন করতে হবে। তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যদি মাবুদের উদ্দেশে করা এই উদ্ধার-ঈদ পালন করতে চায় তবে আগে তার পরিবারের সব পুরুষের খৎনা করাতে হবে। তারপর সে বনি-ইসরাইলদের মতই তা পালন করতে পারবে। কিন্তু খৎনা করানো হয় নি এমন কোন লোক এই ঈদের গোশ্‌ত খেতে পারবে না। বনি-ইসরাইলদের জন্য এবং তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্যান্য জাতির লোকদের জন্য এই একই নির্দেশ রইল।” মাবুদ মূসা ও হারুনকে যে হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা ঠিক তা-ই করেছিল। মাবুদ সেই দিনই সৈন্যদলের মত করে বনি-ইসরাইলদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের মধ্যে প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তান আমার উদ্দেশ্যে আলাদা কর, সে মানুষের হোক বা পশুর হোক। প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তান আমার।” তখন মূসা লোকদের বললেন, “এই দিনটির কথা স্মরণ করবার জন্য তোমরা দিনটি পালন করবে, কারণ এই দিনেই তোমরা মিসরের গোলামী থেকে বের হয়ে এসেছ। মাবুদই তাঁর শক্তি দেখিয়ে সেই দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন। এই দিনে তোমরা খামি দেওয়া কিছু খাবে না। আবীব মাসের এই দিনেই তোমরা বের হয়ে এসেছ। যখন মাবুদ তোমাদের কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের দেশে নিয়ে যাবেন তখন তোমরা বছরের এই মাসেই এই ঈদ পালন করবে। ওটাই সেই দেশ যা মাবুদ তোমাদের দেবেন বলে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়েছিলেন। সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই। “এই ঈদ পালন করবার সময় সাত দিন ধরে তোমরা খামিহীন রুটি খাবে। তারপর সাত দিনের দিন মাবুদের উদ্দেশে একটা ঈদ পালন করবে। এই সাত দিন তোমাদের খাওয়ার রুটি হবে খামিহীন। তোমাদের সারা দেশের মধ্যে সেই দিন যেন খামি এবং খামি দেওয়া কোন কিছু পাওয়া না যায়। সেই দিন তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের ছেলেকে বলবে, ‘আমি যখন মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিলাম তখন মাবুদ আমার জন্য যা করেছিলেন তা মনে করে আমি এটা করছি।’ এইভাবে তোমরা মাবুদের দেওয়া এই নির্দেশের কথা শিক্ষা দেবে। এই নিয়ম পালন এমন একটা চিহ্ন হবে যা হাত ও কপালের স্মরণ-চিহ্নের মত তোমাদের মনে করিয়ে দেবে যে, মাবুদ তাঁর শক্তি দেখিয়ে মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন। বছরের পর বছর ধরে নির্দিষ্ট সময়ে তোমরা এই নিয়ম পালন করবে। মাবুদ তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়ে যে ওয়াদা করেছিলেন সেই ওয়াদা অনুসারে তিনি যখন কেনানীয়দের দেশে তোমাদের নিয়ে গিয়ে অধিকার হিসাবে তা তোমাদের দেবেন, তখন তোমরাও তোমাদের প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তানকে মাবুদের উদ্দেশে দিয়ে দেবে। পশুর প্রত্যেকটা প্রথম পুরুষ বাচ্চা মাবুদের। কিন্তু তোমরা গাধার প্রথম পুরুষ বাচ্চার বদলে একটা ভেড়ার বাচ্চা দিয়ে তা ছাড়িয়ে নেবে। যদি তা করা না যায় তবে তোমরা গাধার বাচ্চাটার ঘাড় ভেংগে দেবে। তোমরা তোমাদের প্রত্যেকটি প্রথম ছেলেকেও ছাড়িয়ে নেবে। “ভবিষ্যতে যখন তোমাদের ছেলেরা এর মানে তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে তখন তোমরা প্রত্যেকে বলবে, ‘মাবুদ মিসরের গোলামীর হাত থেকে তাঁর শক্তি দেখিয়ে আমাদের বের করে এনেছিলেন। ফেরাউন একগুঁয়েমি করে যখন আমাদের আসতে দিচ্ছিল না তখন মাবুদ মিসর দেশের মানুষ ও পশুর প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তানকে মেরে ফেলেছিলেন। সেইজন্য আমি আমার পশুর প্রত্যেকটা প্রথম পুরুষ বাচ্চা মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিচ্ছি এবং আমার প্রথম ছেলেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি। এটা এমন একটা চিহ্ন হবে যা হাত ও কপালের স্মরণ-চিহ্নের মত তোমাকে মনে করিয়ে দেবে যে, মাবুদ তাঁর শক্তি দেখিয়ে মিসর থেকে আমাদের বের করে এনেছিলেন।’ ” ফেরাউন যখন বনি-ইসরাইলদের বিদায় করে দিলেন তখন আল্লাহ্‌ তাদের ফিলিস্তিনীদের দেশের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন না, যদিও সেটাই ছিল সবচেয়ে সোজা পথ। আল্লাহ্‌ বলেছিলেন সেই দেশের মধ্য দিয়ে যাবার সময়ে যদি তারা যুদ্ধ করবার অবস্থায় পড়ে তবে হয়তো মন বদলিয়ে তারা আবার মিসর দেশে ফিরে যাবে। সেইজন্য আল্লাহ্‌ তাদের মরুভূমির মধ্য দিয়ে লোহিত সাগরের দিকে নিয়ে চললেন। বনি-ইসরাইলরা সৈন্যদলের মত করে মিসর দেশ থেকে বের হয়ে গেল। মূসা ইউসুফের হাড়গুলো সংগে নিলেন, কারণ এই ব্যাপারে ইউসুফ বনি-ইসরাইলদের কসম খাইয়ে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই তোমাদের দেখাশোনা করবেন। এখান থেকে যাবার সময় তোমরা আমার হাড়গুলো তুলে সংগে করে নিয়ে যেয়ো।” এর পর তারা সুক্কোৎ শহর থেকে যাত্রা শুরু করে মরুভূমির কিনারায় এথম নামে এক জায়গায় গিয়ে তাদের ছাউনি ফেলল। মাবুদ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য দিনের বেলায় মেঘের থামের মধ্যে আর রাতের বেলায় আলো দেবার জন্য আগুনের থামের মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের আগে আগে যেতেন। এতে তারা দিনে ও রাতে সব সময়েই চলতে পারত। দিনের বেলায় মেঘের থাম আর রাতের বেলায় আগুনের থাম সব সময় লোকদের সামনে থাকত। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যেন তারা ঘুরে গিয়ে সমুদ্র ও মিগ্‌দোলের মাঝামাঝি পী-হহীরোৎ নামে জায়গাটার কাছে তাদের ছাউনি ফেলে। জায়গাটা সমুদ্রের ধারে বাল-সফোনের সামনের দিকে। এ দেখে ফেরাউন মনে করবে বনি-ইসরাইলরা কি করবে তা ঠিক করতে না পেরে দেশের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে করতে মরুভূমিতে আট্‌কা পড়েছে। আমি ফেরাউনের মন কঠিন করব আর সে তাদের পিছনে তাড়া করবে। কিন্তু ফেরাউন ও তার সৈন্যদল হবে আমার প্রশংসা প্রকাশের উপায়। এতেই মিসরীয়রা জানতে পারবে যে, আমি মাবুদ।” বনি-ইসরাইলরা মাবুদের কথামতই কাজ করল। মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনকে যখন বলা হল যে, বনি-ইসরাইলরা পালিয়ে গেছে তখন তাদের সম্বন্ধে ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারীদের মন বদলে গেল। তাঁরা বললেন, “এ আমরা কি করলাম? তাদের বিদায় করে দিয়ে তো আমরা আমাদের সব গোলাম হারালাম।” এই কথা বলে ফেরাউন তাঁর রথ সাজাবার হুকুম দিয়ে তাঁর সৈন্যদের একত্র করে সংগে নিয়ে গেলেন। তিনি ছ’শো বাছাই করা রথ তো নিলেনই, তা ছাড়া মিসরীয় অন্যান্য সব রথও সংগে নিলেন। এক একটা রথ এক একজন সেনাপতি চালাচ্ছিলেন। মাবুদ মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের মন কঠিন করে দিয়েছিলেন। ফলে বনি-ইসরাইলরা যখন সাহসের সংগে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি তাদের পিছনে তাড়া করে গেলেন। তাঁর সব ঘোড়া, রথ, ঘোড়সওয়ার ও সৈন্যদল নিয়ে মিসরীয়রা তাদের পিছনে তাড়া করে তাদের কাছাকাছি এসে গেল। বনি-ইসরাইলরা এই সময় সমুদ্রের ধারে বাল-সফোনের সামনের দিকে পী-হহীরোতের কাছে ছিল। ফেরাউন ও তাঁর দলবলকে তাদের পিছনে আসতে দেখে বনি-ইসরাইলরা খুব ভয় পেয়ে মাবুদের কাছে কান্নাকাটি করতে লাগল। তারা মূসাকে বলল, “মিসরে কবর দেবার জায়গা নেই বলেই কি মরবার জন্য আপনি এই মরুভূমিতে আমাদের এনেছেন? মিসর থেকে বের করে এনে আপনি আমাদের এ কি করলেন? মিসরে থাকতেই কি আমরা আপনাকে বলি নি, ‘আমাদের এখানেই থাকতে দিন; আমরা মিসরীয়দের গোলামীই করব’? এখানে এই মরুভূমির মধ্যে মরবার চেয়ে মিসরীয়দের গোলামী করা আমাদের পক্ষে অনেক ভাল ছিল।” মূসা তাদের বললেন, “ভয় কোরো না। তোমরা যেখানে আছ সেখানেই থাক এবং মাবুদের উদ্ধার করবার কাজটা একবার দেখ। তিনি আজকেই তোমাদের জন্য তা করবেন। যে মিসরীয়দের আজকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ এর পর তাদের আর কোন কালেই দেখতে পাবে না। তোমরা কেবল চুপ করে থাক। মাবুদই তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।” এর পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি আমার কাছে কান্নাকাটি করছ কেন? বনি-ইসরাইলদের এগিয়ে যেতে বল। তুমি তোমার লাঠিটা তুলে নাও এবং সমুদ্রের উপর তোমার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সমুদ্রকে দু’ভাগ কর। তাতে সমুদ্রের মধ্যে শুকনা জমির উপর দিয়ে বনি-ইসরাইলরা হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু আমি মিসরীয়দের মন এমন কঠিন করব যে, তারা বনি-ইসরাইলদের পিছনে পিছনে সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে যাবে। এতে ফেরাউন ও তার সমস্ত সৈন্যদল, রথ ও ঘোড়সওয়ার আমার প্রশংসা প্রকাশের উপায় হবে। তা দেখে মিসরীয়রা বুঝতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।” পরে মূসা সমুদ্রের উপরে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন; আর মাবুদ সারা রাত ধরে একটা পূবের বাতাস জোরে বইয়ে সমুদ্রের পানি দু’পাশে সরিয়ে দিলেন। তিনি পানিকে দু’ভাগ করে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে একটা শুকনা পথ তৈরী করলেন। বনি-ইসরাইলরা সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে শুকনা মাটির পথ ধরে হেঁটে চলল। তাদের ডানে-বাঁয়ে সমুদ্রের পানি দেয়ালের মত হয়ে দু’পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এই ব্যাপার দেখে মিসরীয়রা পিছন থেকে বনি-ইসরাইলদের তাড়া করল। ফেরাউনের সব ঘোড়া, রথ ও ঘোড়সওয়ার তাদের পিছনে পিছনে সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। ভোর রাতে মাবুদ মেঘ ও আগুনের থামের মধ্য থেকে মিসরীয় সৈন্যদলের দিকে চেয়ে দেখলেন আর তাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলেন। এছাড়া তিনি রথের চাকাগুলোও খুলে ফেললেন; তাতে রথ চালাতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। মিসরীয়রা তখন বলল, “চল, আমরা বনি-ইসরাইলদের ছেড়ে পালাই, কারণ মাবুদই বনি-ইসরাইলদের হয়ে মিসরীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “সমুদ্রের উপরে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও। তাতে পানি আবার ফিরে এসে মিসরীয়দের উপর এবং তাদের রথ ও ঘোড়সওয়ারদের উপর পড়বে।” তখন মূসা তাঁর হাত সমুদ্রের উপরে বাড়িয়ে দিলেন। খুব ভোরে সমুদ্রের পানি নিজের জায়গায় ফিরে আসল। মিসরীয়রা তখন ডানে-বাঁয়ে ছুটাছুটি করছিল, কিন্তু মাবুদ তাদের সাগরের ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। সমুদ্রের পানি ফিরে এসে রথ ও ঘোড়সওয়ারদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের পিছনে তাড়া করে আসা ফেরাউনের গোটা সৈন্যদলটাকে ডুবিয়ে দিল। তাদের একজনও আর বেঁচে রইল না। বনি-ইসরাইলরা কিন্তু সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে শুকনা পথ ধরে চলে গিয়েছিল। তাদের ডানে-বাঁয়ে পানি দেয়ালের মত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাবুদ এইভাবেই সেই দিন মিসরীয়দের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করেছিলেন। বনি-ইসরাইলরা মিসরীয়দের লাশ সমুদ্রের কিনারে পড়ে থাকতে দেখল। মাবুদ মিসরীয়দের বিরুদ্ধে তাঁর যে মহাশক্তি ব্যবহার করলেন তা দেখে বনি-ইসরাইলদের মনে তাঁর প্রতি একটা ভয়ের ভাব জেগে উঠল। তারা মাবুদের ও তাঁর গোলাম মূসার উপর সম্পূর্ণ ঈমান রেখে চলতে লাগল। এর পর মূসা ও বনি-ইসরাইলরা মাবুদের উদ্দেশে এই কাওয়ালী গাইলেন: “আমি মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব, কারণ লোকের চোখে তাঁর মহিমা বেড়ে গেল। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের দলগুলোকে তিনিই সাগরের পানিতে ফেলে দিলেন। মাবুদই আমার শক্তি, তিনিই আমার কাওয়ালী; আমার উদ্ধার তাঁরই মধ্যে রয়েছে। মাবুদই আমার আল্লাহ্‌; আমি তাঁরই প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। তিনি আমার পিতার আল্লাহ্‌; আমি তাঁর মহিমা কাওয়ালী গাইব। তাঁর নাম ‘মাবুদ’, তিনি বীর যোদ্ধা। ফেরাউনের রথ আর সৈন্যদলগুলোকে তিনিই সাগরের পানিতে ফেলে দিলেন; ফেরাউনের বাছাই করা কর্মচারীর দল লোহিত সাগরে ডুবে মরল। তারা গভীর পানিতে ঢাকা পড়ল আর পাথরের মত করে সাগরের তলায় ডুবে গেল। “হে মাবুদ, ক্ষমতায় মহান তোমার ঐ ডান হাতখানা, হ্যাঁ, ঐ ডান হাতখানা শত্রুকে চুরমার করল। যারা তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াল তোমার মহান মহিমায় তুমি তাদের নীচে ফেলে দিলে; তোমার পাঠানো জ্বলন্ত গজব খড়কুটার মত তাদের পুড়িয়ে ফেলল। তোমার নিঃশ্বাসের ঝাপটায় পানি জড়ো হয়ে উঠল। ঢেউ ভরা সব পানি ঢিবির মত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আর অথৈ পানি জমাট বাঁধল সাগরের বুকে। “শত্রু বলল, ‘আমি ওদের তাড়া করব, ধরে ফেলব আর ওদের জিনিস ভাগ করে নেব; আমি নিজেকে পূর্ণ করে নেব ঐ সব জিনিস দিয়ে। আমি তলোয়ার হাতে ওদের তাড়া করব।’ কিন্তু তুমি ফুঁ দিয়ে বাতাস বহালে, আর সাগরও তাদের ঢেকে ফেলল। তারা গভীর পানির তলায় সীসার মত করে ডুবে গেল। “হে মাবুদ, দেবতাদের মধ্যে কে আছে তোমার মত? কে আছে তোমার মত এমন পবিত্রতায় মহান আর মহিমায় ভয়ংকর? এমন কুদরতি কাজের শক্তি কার আছে? তোমার ডান হাতখানা তুমি বাড়িয়ে দিলে, আর দুনিয়া তাদের গিলে ফেলল। তোমার অটল মহব্বতে তুমি যাদের ছাড়িয়ে আনলে তাদের তুমিই চালিয়ে নেবে। তোমার নিজের শক্তিতে তোমার পবিত্র বাসস্থানে তুমি তাদের চালিয়ে আনবে। সেই কথা শুনে অন্য জাতিরা ভীষণ ভয়ে কাঁপবে, আর ফিলিস্তিনীদের মন দারুণ ব্যথায় কাতর হবে। তুমিই তোমার বান্দাদের এনে চারার মত করে লাগিয়ে দেবে তোমার নিজের পাহাড়ে। হে মাবুদ, তোমার নিজের হাতে করা ওটাই তোমার বাসস্থান; হে মালিক, তোমার নিজের হাতে গড়া ওটাই সেই পবিত্র স্থান; হে মাবুদ, যুগ যুগ ধরে তুমিই রাজত্ব করবে।” ফেরাউনের সমস্ত ঘোড়া, রথ আর ঘোড়সওয়ার যখন সমুদ্রের মধ্যে ঢুকল তখন মাবুদ সমুদ্রের পানি তাদের উপর ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা সমুদ্রের মাঝখানে শুকনা জমির উপর দিয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল। হারুনের বোন মরিয়ম ছিলেন একজন মহিলা-নবী। তিনি খঞ্জনি হাতে নিলেন, আর তাঁর পিছনে পিছনে অন্যান্য স্ত্রীলোকেরাও খঞ্জনি হাতে নাচতে নাচতে বের হয়ে আসল। মূসার কাওয়ালীর জবাবে মরিয়ম এই কাওয়ালী গাইলেন: “তোমরা মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, কারণ লোকের চোখে তাঁর মহিমা বেড়ে গেল। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের দলগুলোকে তিনিই ফেলে দিলেন সাগরের পানিতে।” পরে মূসা লোহিত সাগর থেকে বনি-ইসরাইলদের নিয়ে চললেন। তারা প্রথমে শূর নামে এক মরুভূমিতে গেল। সেই মরুভূমিতে তিন দিন পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে তারা কোথাও পানি পেল না। পরে তারা মারা নামে একটা মরুদ্যানের কাছে উপস্থিত হল, কিন্তু তেতো বলে সেখানকার পানি তারা খেতে পারল না। সেইজন্য সেই জায়গার নাম হয়েছিল মারা (যার মানে “তেতো”)। এতে লোকেরা বিরক্তির সংগে মূসাকে বলল, “এখন আমরা খাবার পানি পাব কোথায়?” এই কথা শুনে মূসা গিয়ে মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন। তিনি মূসাকে একটা গাছ দেখিয়ে দিলেন। মূসা সেটা পানিতে ফেলে দিলেন আর সেই পানি খাবার উপযুক্ত হল। মাবুদ সেখানে তাদের পরীক্ষায় ফেলেছিলেন এবং তাদের জন্য একটা নিয়ম ও আইন স্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা যদি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা মেনে তাঁর চোখে যা উচিত তা-ই কর এবং তাঁর হুকুমে কান দাও ও তাঁর দেওয়া সমস্ত নিয়ম পালন কর, তাহলে মিসরীয়দের উপর আমি যে সব রোগ এনেছিলাম তা তোমাদের উপর আনব না। আমি মাবুদই তোমাদের সুস্থতা দান করি।” এর পর তারা এলীম নামে একটা মরুদ্যানের কাছে উপস্থিত হল। সেখানে বারোটা ঝর্ণা এবং সত্তরটা খেজুর গাছ ছিল। সেই ঝর্ণার পানির কাছেই তারা ছাউনি ফেলল। বনি-ইসরাইলদের দলটা এলীম থেকে আবার যাত্রা শুরু করল। মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর দ্বিতীয় মাসের পনের দিনের দিন তারা সিন মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছাল। এই জায়গাটা ছিল এলীম ও তুর পাহাড়ের মাঝখানে। সিন মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের গোটা দলটা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে লাগল। তারা তাঁদের বলল, “মিসর দেশে মাবুদের হাতে আমরা কেন মরলাম না। সেখানে আমরা গোশ্‌তের হাঁড়ি সামনে নিয়ে পেট ভরে রুটি-গোশ্‌ত খেতাম। আমাদের এই গোটা দলটাকে না খাইয়ে মেরে ফেলবার জন্যই আপনারা আমাদের এই মরুভূমির মধ্যে এনেছেন।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “আমি এমন করব যাতে তোমাদের জন্য বেহেশত থেকে বৃষ্টির মত করে খাবার ঝরে পড়ে। লোকেরা প্রতিদিন বাইরে গিয়ে সেখান থেকে মাত্র সেই দিনের খাবার কুড়িয়ে নেবে। তারা আমার নির্দেশ মত চলবে কি না সেই বিষয়ে আমি তাদের পরীক্ষা নেব। সপ্তার ষষ্ঠ দিনে তারা যেন অন্য দিনের চেয়ে দুই গুণ কুড়িয়ে এনে খাবার তৈরী করে।” মূসা আরও বললেন, “সন্ধ্যাবেলায় যখন মাবুদ তোমাদের গোশ্‌ত দেবেন আর সকালবেলায় দেবেন প্রচুর রুটি তখনই তোমরা বুঝবে যে, মাবুদই তোমাদের মিসর থেকে বের করে এনেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে তোমরা যত কথা বলেছ তা সব তিনি শুনেছেন। আমরা কে? এই সব কথা তোমরা আসলে আমাদের বিরুদ্ধে বলছ না, বলছ মাবুদেরই বিরুদ্ধে।” তারপর মূসা হারুনকে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের এই কথা বলতে বললেন, “মাবুদ তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের অনেক কথা বলতে শুনেছেন, কাজেই তোমরা তাঁর সামনে এগিয়ে যাও।” হারুন যখন বনি-ইসরাইলদের কাছে কথা বলছিলেন তখন তারা মরুভূমির দিকে তাকিয়ে দেখল; আর আশ্চর্য এই যে, সেখানে মেঘের মধ্যে তারা মাবুদের মহিমা দেখতে পেল। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা আমার বিরুদ্ধে যে সব কথা বলেছে তা আমি শুনেছি। তাদের এই কথা বল যে, তারা সন্ধ্যাবেলায় গোশ্‌ত খাবে আর সকালবেলায় খাবে পেট ভরে রুটি। এতে তারা জানতে পারবে যে, আমি আল্লাহ্‌ই তাদের মাবুদ।” সন্ধ্যাবেলায় অনেক ভারুই পাখী এসে তাদের ছাউনি-এলাকাটা ছেয়ে ফেলল। সকালবেলায় দেখা গেল শিবিরের চারপাশটা শিশিরে ঢাকা পড়ে গেছে। যখন সেই শিশির মিলিয়ে গেল তখন মাটিতে মাছের আঁশের মত পাতলা এক রকম জিনিস দেখা গেল। সেগুলো দেখতে ছিল পড়ে থাকা তুষারের মত। তা দেখে বনি-ইসরাইলরা একজন অন্যজনকে বলল, “ওগুলো কি?” ওগুলো যে কি, তা তারা জানত না। তখন মূসা তাদের বললেন, “ওগুলোই সেই রুটি যা মাবুদ তোমাদের খেতে দিয়েছেন। মাবুদ তোমাদের এই হুকুম দিয়েছেন, প্রত্যেকে যেন তার পরিবারের দরকার মত কুড়ায়। তাম্বুর প্রত্যেকের জন্য যেন এক ওমর করে কুড়ানো হয়।” বনি-ইসরাইলরা তা-ই করল। কেউ কুড়ালো বেশী, কেউ কুড়ালো কম। কিন্তু ওমরের মাপে দেখা গেল, যারা অনেক কুড়ালো তাদের বেশী হল না আর যারা অল্প কুড়ালো তাদের কম পড়ল না। প্রত্যেকেই পরিবারের দরকার মত তা কুড়িয়েছিল। তারপর মূসা তাদের বললেন, “সকালের জন্য তোমরা এর কিছুই রেখে দিয়ো না।” কিন্তু কেউ কেউ মূসার কথা না শুনে সকালের জন্য কিছু রেখে দিল। তাতে সেগুলোতে পোকা ধরল আর দুর্গন্ধ হয়ে গেল। এই অবস্থা দেখে মূসা তাদের উপর রাগে জ্বলে উঠলেন। লোকেরা প্রত্যেক দিন সকালে যার পরিবারে যতটুকু দরকার ততটুকুই কুড়িয়ে আনত। কিন্তু রোদ কড়া হলে সেগুলো গলে যেত। সপ্তার ছয় দিনের দিন তারা দুই গুণ করে, অর্থাৎ দুই ওমর করে প্রত্যেকের জন্য কুড়াল, আর বনি-ইসরাইলদের নেতারা এসে সেই কথা মূসাকে জানালেন। তখন মূসা তাঁদের বললেন, “এটা মাবুদেরই কথা। আগামী কাল বিশ্রামবার, মাবুদেরই পবিত্র বিশ্রামবার। কাজেই যতটা সেঁকে নেবার নাও আর যতটুকু সিদ্ধ করবার সিদ্ধ করে নাও; বাকীটা পরের দিন সকালের জন্য রেখে দিয়ো।” মূসার হুকুম মতই তারা সকালের জন্য বাকী অংশটা রেখে দিল। সেই দিন ওগুলোতে গন্ধও হল না, পোকাও ধরল না। মূসা তখন বললেন, “আজ তোমরা ওগুলোই খাও কারণ আজকে মাবুদের নির্দিষ্ট করা বিশ্রাম দিন। আজকে তোমরা মাঠের মধ্যে ওগুলো দেখতে পাবে না। তোমরা সপ্তার ছয় দিন তা কুড়াবে কিন্তু সাত দিনের দিন তা পাবে না, কারণ সেই দিন হল বিশ্রামবার।” তবুও সপ্তম দিনে কিছু লোক ওগুলো কুড়াবার জন্য বাইরে গেল, কিন্তু কিছুই পেল না। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “আর কতদিন তোমরা আমার হুকুম ও নির্দেশ অমান্য করে চলবে? দেখ, তোমাদের জন্য বিশ্রামবারের এই ব্যবস্থা তোমাদের মাবুদই করেছেন। সেইজন্য ছয় দিনের দিন তিনি দু’দিনের খাবার তোমাদের যোগান দিচ্ছেন। তাই সপ্তম দিনে তোমরা কেউ ঘরের বাইরে যাবে না, ভিতরেই থাকবে।” কাজেই লোকেরা সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিল। বনি-ইসরাইলরা সেই খাবারকে বলত মান্না (যার মানে “ওগুলো কি?”)। এগুলোর আকার ছিল ধনে বীজের মত আর তা দেখতে সাদাটে; তার স্বাদ ছিল মধু দেওয়া পিঠার মত। পরে মূসা বললেন, “মাবুদ হুকুম করেছেন যেন তোমরা তোমাদের বংশধরদের জন্য এক ওমর পরিমাণ মান্না তুলে রাখ, যাতে তারা দেখতে পায় মাবুদ মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে আনবার পরে মরুভূমিতে কি খাবার তোমাদের খেতে দিয়েছিলেন।” মূসা হারুনকে বললেন, “তুমি একটা পাত্রে করে এক ওমর মান্না নিয়ে মাবুদের সামনে রাখ যেন বংশের পর বংশ ধরে তা থাকে।” সেই মান্না যাতে বংশের পর বংশ ধরে তোলা থাকে সেইজন্য হারুন পরে মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম অনুসারে সাক্ষ্য-ফলকের সামনে তা নিয়ে রেখেছিলেন। লোকে বাস করে এমন একটা জায়গায়, অর্থাৎ কেনান দেশের সীমানায় না আসা পর্যন্ত বনি-ইসরাইলরা চল্লিশ বছর ধরে এই মান্না খেয়েছিল। এক ওমরের মাপ হল এক কেজি আটশো গ্রামের সমান। পরে মাবুদের হুকুমে বনি-ইসরাইলদের দলটা সিন মরুভূমি থেকে যাত্রা করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় এগিয়ে যেতে যেতে শেষে রফীদীমে গিয়ে ছাউনি ফেলল। কিন্তু সেখানে খাবার পানি ছিল না। এইজন্য তারা মূসার সংগে ঝগড়া করে বলল, “আমাদের খাবার পানি দিন।” মূসা তাদের বললেন, “তোমরা আমার সংগে কেন ঝগড়া করছ, আর কেনই বা তোমরা মাবুদকে পরীক্ষা করে দেখছ?” কিন্তু লোকেরা পিপাসায় কাতর হয়েছিল, সেইজন্য তারা মূসার বিরুদ্ধে নানা কথা বলল। তারা বলল, “আমরা যাতে পানির অভাবে মারা যাই সেইজন্যই কি আপনি আমাদের এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের ও পশুগুলো মিসর থেকে নিয়ে এসেছেন?” এই কথা শুনে মূসা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বললেন, “আমি এই লোকদের নিয়ে কি করব? আর একটু হলেই তো তারা আমাকে পাথর মারবে।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের কয়েকজন বৃদ্ধ নেতাকে সংগে নিয়ে তুমি লোকদের আগে চলে যাও। যে লাঠি দিয়ে তুমি নীল নদকে আঘাত করেছিলে সেটাই হাতে নিয়ে এগিয়ে যাও। তারপর আমি তুর পাহাড়ের কাছে তোমার সামনে একটা পাথরের উপর গিয়ে দাঁড়াব। তুমি সেই পাথরের গায়ে আঘাত করবে আর তাতে লোকদের খাবার জন্য সেখান থেকে পানি বের হয়ে আসবে।” ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের সামনে মূসা তা-ই করলেন। লোকেরা এই রফীদীমে ঝগড়া করেছিল এবং বলেছিল, “মাবুদ কি আমাদের সংগে আছেন, না নেই?” এই কথাগুলো দিয়ে মাবুদকে তারা পরীক্ষা করে দেখেছিল। সেইজন্য মূসা এই জায়গাটার দু’টা নাম দিয়েছিলেন মঃসা (যার মানে “পরীক্ষা”) এবং মরীবা (যার মানে “ঝগড়া”)। এই সময়ে আমালেকীয় সৈন্যেরা বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য রফীদীমে উপস্থিত হল। তখন মূসা ইউসাকে বললেন, “তুমি আমাদের মধ্য থেকে লোক বেছে নিয়ে আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাও। আমি কালকে আল্লাহ্‌র সেই লাঠিটা আমার হাতে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়াব।” মূসা ইউসাকে যা বলেছিলেন তিনি তা-ই করলেন। তিনি আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। এর মধ্যে মূসা, হারুন ও হূর সেই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠলেন। যুদ্ধের সময়ে মূসা যতক্ষণ তাঁর হাত তুলে রাখতেন ততক্ষণ বনি-ইসরাইলরা জয়ী হত; আবার যখনই হাত নামাতেন তখন আমালেকীয়রা জয়ী হত। এইভাবে মূসার হাত ভারী হয়ে উঠল। তখন তাঁরা একটা পাথর নিয়ে আসলেন, আর মূসা তার উপরে বসলেন। হারুন ও হূর দু’পাশে থেকে তাঁর হাত দু’টা উঁচু করে ধরে রাখলেন। এতে বেলা ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁর হাত দু’টা একই অবস্থায় রইল। তাতে ইউসা যুদ্ধে আমালেকীয়দের হারিয়ে দিলেন। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “এই যুদ্ধের কথা মনে রাখবার জন্য তুমি একটা বইয়ে তা লিখে রাখ এবং ইউসাকে বলে দাও যে, দুনিয়ার উপর থেকে আমালেকীয়দের নাম আমি একেবারেই মুছে ফেলব।” পরে মূসা একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে তার নাম দিলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌-নিঃষি (যার মানে “মাবুদই আমার পতাকা”)। মূসা বললেন, “মাবুদের সিংহাসনের বিরুদ্ধে হাত তোলা হয়েছে, সেইজন্য বংশের পর বংশ ধরে মাবুদ আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে থাকবেন।” আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের ও মূসার জন্য যা করেছিলেন তা সবই মূসার শ্বশুর মাদিয়ানীয় ইমাম শোয়াইবের কানে গিয়েছিল। মাবুদ কেমন করে মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে এনেছিলেন তিনি তা-ও শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি অন্য ছেলেটার নাম দিয়েছিলেন ইলীয়েষর (যার মানে “আল্লাহ্‌ আমার সহায়”); কারণ তিনি বলেছিলেন, “আমার পিতার আল্লাহ্‌ আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনিই যুদ্ধে ফেরাউনের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন।” আল্লাহ্‌র পাহাড়ের কাছে যে মরুভূমিতে মূসা তাম্বু ফেলেছিলেন সেখানে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে তাঁর শ্বশুর শোয়াইব উপস্থিত হলেন। এর আগেই তিনি মূসাকে বলে পাঠিয়েছিলেন, “আমি তোমার শ্বশুর শোয়াইব। তোমার স্ত্রী ও ছেলে দু’টি নিয়ে আমি তোমার কাছে আসছি।” খবর পেয়ে মূসা তাঁর শ্বশুরের সংগে দেখা করবার জন্য বের হয়ে আসলেন। তিনি মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানালেন ও চুম্বন করলেন। তাঁরা একে অন্যের খবরাখবর জিজ্ঞাসা করে তাম্বুর ভিতরে গেলেন। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের পক্ষ হয়ে ফেরাউন ও মিসরীয়দের প্রতি যা করেছেন তা সবই মূসা তাঁর শ্বশুরকে জানালেন। যাত্রাপথে তাঁদের কষ্টের কথা এবং কিভাবে আল্লাহ্‌ তাঁদের উদ্ধার করেছেন সেই সব কথাও তিনি তাঁকে জানালেন। তাই এখন আমি বুঝতে পারছি যে, সব দেবতার চেয়ে মাবুদই মহান, কারণ দেবতারা যে সব বিষয়ে বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে গর্ব করত সেই সব বিষয়ে মাবুদই মহান।” এর পর শোয়াইব আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী ও অন্যান্য কোরবানীর জন্য পশু নিয়ে আসলেন। পরে হারুন ও বনি-ইসরাইলদের সব বৃদ্ধ নেতারা আল্লাহ্‌র সামনে মূসার শ্বশুরের সংগে খেতে বসলেন। পরের দিন মূসা লোকদের বিচার করবার জন্য বসলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকেরা মূসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। লোকদের নিয়ে মূসাকে এই সব করতে দেখে তাঁর শ্বশুর বললেন, “তুমি লোকদের নিয়ে এ কি করছ? তুমি কেন একা বিচার করতে বসেছ, আর সব লোক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে?” এর জবাবে মূসা তাঁর শ্বশুরকে বললেন, “আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানবার জন্যই লোকেরা আমার কাছে আসে। কোন ঝগড়া-বিবাদ দেখা দিলে তারা আমার কাছে আসে আর আমি দু’পক্ষেরই বিচার করি, আর আল্লাহ্‌র নিয়ম ও নির্দেশ তাদের বুঝিয়ে দিই।” তখন মূসার শ্বশুর বললেন, “তুমি যেভাবে তা করছ তা ভাল নয়। এতে তুমি ও তোমার লোকেরা নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। কাজটা এত ভারী যে, তোমার একার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। এবার আমার একটা পরামর্শ শোন, আর তাতে আল্লাহ্‌ও তোমার সংগে থাকবেন। তুমি বরং আল্লাহ্‌র কাছে লোকদের প্রতিনিধি হয়ে লোকদের ঝগড়া-বিবাদ আল্লাহ্‌র সামনে নিয়ে যেয়ো। তারপর তুমি তাঁর সমস্ত নিয়ম ও নির্দেশ সম্বন্ধে তাদের হুঁশিয়ার করে দেবে। এছাড়া কিভাবে চলতে হবে এবং কি কাজ তাদের করতে হবে তা তুমি তাদের বুঝিয়ে দেবে। তুমি সমস্ত লোকদের মধ্য থেকে এমন সব যোগ্য লোকদের বেছে নেবে যারা আল্লাহ্‌ভক্ত, সত্যবাদী এবং অন্যায় লাভ ঘৃণা করে। তাদের তুমি লোকদের নেতা হিসাবে নিযুক্ত করবে- কাউকে কাউকে হাজারের উপর, কাউকে কাউকে শয়ের উপর, কাউকে কাউকে পঞ্চাশের উপর এবং কাউকে কাউকে দশের উপর। এরাই সব সময় লোকদের বিচার করবে। ছোটখাটো ব্যাপারের বিচার তারা করবে আর বড় বড় ব্যাপারগুলো তোমার কাছে আনবে। এতে তোমার কাজ সহজ হবে কারণ তারাও তোমার বোঝার কিছুটা বইবে। আল্লাহ্‌র হুকুম পেয়ে যদি তুমি এই রকম কর তবেই তুমি এই কাজের চাপ সহ্য করতে পারবে আর লোকেরাও শান্তিতে যে যার জায়গায় ফিরে যাবে।” মূসা তাঁর শ্বশুরের পরামর্শ মেনে নিলেন এবং তিনি যা বললেন তা-ই করলেন। তিনি সমস্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে যোগ্য লোকদের বেছে নিয়ে নেতা হিসাবে তাঁদের নিযুক্ত করলেন- কাউকে কাউকে হাজারের উপর, কাউকে কাউকে শয়ের উপর, কাউকে কাউকে পঞ্চাশের উপর এবং কাউকে কাউকে দশের উপর। তাঁরাই সব সময় লোকদের বিচার করতেন। তাঁরা কঠিন ব্যাপারগুলো মূসার কাছে নিয়ে যেতেন, কিন্তু ছোটখাটো ব্যাপারগুলোর মীমাংসা নিজেরাই করতেন। পরে মূসা তাঁর শ্বশুরকে বিদায় দিলেন আর তিনি নিজের দেশে চলে গেলেন। মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পরে তৃতীয় মাসে বনি-ইসরাইলরা সিনাই মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছাল। তারা রফীদীম ছেড়ে এসে তুর পাহাড়ের সামনে সিনাই মরুভূমিতে ছাউনি ফেলল। পরে মূসা পাহাড়ের উপরে আল্লাহ্‌র কাছে উঠে গেলেন। সেই সময় মাবুদ পাহাড়ের উপর থেকে তাঁকে ডেকে বললেন, “তুমি ইয়াকুবের বংশধর বনি-ইসরাইলদের বল যে, তারা নিজেরাই দেখেছে, মিসরীয়দের দশা আমি কি করেছি। ঈগল পাখীর ডানায় বয়ে নেবার মত করে আমি বনি-ইসরাইলদের নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। সেইজন্য যদি তারা আমার সব কথা মেনে চলে এবং আমার ব্যবস্থা পালন করে তবে দুনিয়ার সব জাতির মধ্য থেকে তারাই হবে আমার নিজের বিশেষ সম্পত্তি, কারণ দুনিয়ার সব লোকই আমার অধিকারে। আমার এই লোকদের দিয়েই গড়া হবে আমার ইমামদের রাজ্য এবং এই জাতিই হবে আমার পবিত্র জাতি। এই কথাগুলো তুমি বনি-ইসরাইলদের জানিয়ে দাও।” তখন মূসা নেমে এসে ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের ডেকে একত্র করলেন এবং মাবুদ তাঁকে যে সব কথা বলতে বলেছিলেন তা সবই তাঁদের বললেন। এই কথা শুনে সব লোক একসংগে বলল, “মাবুদ যা বলেছেন আমরা তা সবই করব।” লোকেরা যা বলল মূসা গিয়ে তা মাবুদকে জানালেন। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “আমি তোমার সংগে যখন কথা বলব তখন লোকেরা যাতে তা শুনতে পায় সেইজন্য আমি একটা ঘন মেঘের মধ্যে থেকে তোমাদের কাছে আসব। তাহলে লোকেরা সব সময় তোমার উপর সম্পূর্ণ ঈমান রাখবে।” লোকেরা যা বলেছিল মূসা পরে তা মাবুদকে বললেন। লোকদের জন্য তুমি পাহাড়ের চারদিকে একটা সীমানা ঠিক করে দেবে এবং তাদের সাবধান করে দিয়ে বলবে, যেন তারা পাহাড়ের উপর না আসে কিংবা পাহাড়ের গায়ে হাত না দেয়। যে ঐ পাহাড় ছোঁবে তাকে নিশ্চয়ই হত্যা করা হবে। তবে তার গায়ে হাত না দিয়ে তাকে পাথর মেরে কিংবা তীর দিয়ে হত্যা করতে হবে। মানুষ হোক বা পশু হোক তাকে আর বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে না। কেবলমাত্র একটানা কতক্ষণ শিংগা বাজাবার পরই তারা পাহাড়ের কাছে আসতে পারবে।” এর পর মূসা পাহাড় থেকে নেমে এসে লোকদের পাক-সাফ করলেন আর লোকেরা তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিল। তারপর মূসা তাদের বললেন, “তৃতীয় দিনের জন্য তোমরা প্রস্তুত হও। এই সময়ের মধ্যে তোমরা কেউ স্ত্রীর সংগে মিলিত হবে না।” তৃতীয় দিনের সকালবেলা মেঘের গর্জন হতে লাগল এবং বিদ্যুৎ চম্‌কাতে থাকল আর পাহাড়ের উপরে একখণ্ড ঘন মেঘ দেখা দিল। এছাড়া খুব জোরে জোরে শিংগার আওয়াজ হতে লাগল। এই সব দেখেশুনে ছাউনির মধ্যেকার সমস্ত লোক কেঁপে উঠল। তখন আল্লাহ্‌র সামনে যাবার জন্য মূসা ছাউনি থেকে লোকদের বের করে নিয়ে গেলেন। লোকেরা পাহাড়ের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তুর পাহাড়টা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, কারণ মাবুদ পাহাড়ের উপর আগুনের মধ্যে নেমে আসলেন। চুলা থেকে যেমন ধোঁয়া ওঠে ঠিক সেইভাবে ধোঁয়া উঠতে লাগল আর গোটা পাহাড়টা ভীষণভাবে কাঁপতে লাগল। শিংগার আওয়াজ আরও জোরে জোরে হতে লাগল। তখন মূসা আল্লাহ্‌র সংগে কথা বললেন আর আল্লাহ্‌ও জোরে কথা বলে তাঁর জবাব দিলেন। মাবুদ তুর পাহাড়ের চূড়ায় নেমে এসে মূসাকে ডাকলেন আর মূসা পাহাড়ের উপর উঠে গেলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি নীচে নেমে গিয়ে লোকদের সাবধান করে দাও যেন তারা মাবুদকে দেখবার জন্য সীমানা ডিংগিয়ে চলে না আসে। তা করলে অনেকেই মারা পড়বে। এমন কি, মাবুদের কাছে যাওয়াই যাদের কাজ, সেই ইমামদেরও নিজেদের পাক-সাফ করে নিতে হবে। তা না করলে মাবুদ তাদের ভীষণ শাস্তি দেবেন।” জবাবে মূসা মাবুদকে বললেন, “কিন্তু লোকেরা তো তুর পাহাড়ের উপর আসতে পারবে না। তুমিই তো আমাদের সাবধান করে বলে দিয়েছ, যেন আমরা পাহাড়ের চারদিকে সীমানা-চিহ্ন দিয়ে তা তোমার জন্য আলাদা করে রাখি।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি নীচে নেমে যাও। তারপর তুমি ও হারুন আবার উপরে উঠে এসো। কিন্তু ইমামেরা বা লোকেরা যেন সীমানা ডিংগিয়ে আমার কাছে উঠে না আসে। তা করলে আমি তাদের ভীষণ শাস্তি দেব।” এই কথা শুনে মূসা নেমে গিয়ে সব কথা লোকদের জানালেন। এর পর আল্লাহ্‌ বললেন, “হে বনি-ইসরাইলরা, আমি আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ। মিসর দেশের গোলামী থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি। “আমার জায়গায় কোন দেবতাকে দাঁড় করাবে না। “পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোন মূর্তি তৈরী করবে না, তা আকাশের কোন কিছুর মত হোক বা মাটির উপরকার কোন কিছুর মত হোক কিংবা পানির মধ্যেকার কোন কিছুর মত হোক। তোমরা তাদের পূজাও করবে না, তাদের সেবাও করবে না, কারণ কেবলমাত্র আমি আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ। আমার পাওনা এবাদত আমি চাই। যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের গুনাহের শাস্তি আমি তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকি। কিন্তু যারা আমাকে মহব্বত করে এবং আমার সব হুকুম পালন করে, হাজার হাজার পুরুষ পর্যন্ত তাদের প্রতি আমার বুক ভরা দয়া থাকবে। “কোন বাজে উদ্দেশ্যে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নাম নেবে না। যে তা করবে তাকে মাবুদ শাস্তি দেবেন। “বিশ্রামবার পবিত্র করে রাখবে এবং তা পালন করবে। সপ্তার ছয় দিন তোমরা পরিশ্রম করবে এবং তোমাদের সমস্ত কাজ করবে, কিন্তু সপ্তম দিনটা হল তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে বিশ্রামের দিন। সেই দিন তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়ে, তোমাদের গোলাম ও বাঁদী, তোমাদের পশু বা তোমাদের শহর ও গ্রামে বাস-করা অন্য জাতির লোক, মোট কথা, কারও কোন কাজ করা চলবে না। মাবুদ ছয় দিনে আসমান, জমীন, সমুদ্র এবং সেগুলোর মধ্যেকার সব কিছু তৈরী করেছিলেন, কিন্তু সপ্তম দিনে সেই কাজ আর করেন নি। সেইজন্য তিনি এই বিশ্রাম দিনটাকে দোয়া করে পবিত্র করেছিলেন। “তোমাদের পিতা-মাতাকে সম্মান করে চলবে। তাতে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া দেশে তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকবে। “খুন কোরো না। “জেনা কোরো না। “চুরি কোরো না। “কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না। “অন্যের ঘর-দুয়ার, স্ত্রী, গোলাম ও বাঁদী, গরু-গাধা কিংবা আর কিছুর উপর লোভ কোরো না।” বনি-ইসরাইলরা যখন বিদ্যুৎ চম্‌কাতে এবং পাহাড় থেকে ধুমা উঠতে দেখল আর মেঘের গর্জন ও শিংগার আওয়াজ শুনল তখন তারা দূরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তারা মূসাকে বলল, “আপনি আমাদের সংগে কথা বলুন, আমরা শুনব; কিন্তু আল্লাহ্‌ যদি আমাদের সংগে কথা বলেন তবে আমরা মারা পড়ব।” তখন মূসা লোকদের বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না। আল্লাহ্‌ তোমাদের পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন যাতে তোমাদের মনে ভয়ের ভাব থাকে এবং তার ফলে তোমরা গুনাহ্‌ না কর। সেইজন্যই তিনি এসেছেন।” লোকেরা দূরে দাঁড়িয়ে রইল আর মূসা আল্লাহ্‌র কাছে সেই ঘন মেঘের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের এই কথা বল, ‘আমি মাবুদ বেহেশত থেকে যে তোমাদের সংগে কথা বলেছি তা তোমরা নিজের চোখে দেখেছ। তাই এবাদতের জন্য তোমরা কোন কিছু তৈরী করে আমার সংগে দাঁড় করাবে না। সোনা বা রূপা দিয়ে নিজেদের জন্য কোন দেব-দেবীও তৈরী করবে না। তোমরা মাটি দিয়ে আমার জন্য একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করবে, আর তার উপর তোমাদের পোড়ানো-কোরবানী এবং যোগাযোগ-কোরবানীর গরু-ছাগল-ভেড়া কোরবানী দেবে। যে সব জায়গায় আমি আমার নাম স্মরণ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব সেই সব জায়গায় আমি উপস্থিত হয়ে তোমাদের দোয়া করব। পাথর দিয়ে আমার জন্য কোন কোরবানগাহ্‌ তৈরী করতে গিয়ে সেই পাথরগুলো কাটবে না। তার উপর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে তোমরা তা নাপাক করে ফেলবে। আমার কোরবানগাহ্‌ এমনভাবে তৈরী কোরো যাতে তার উপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে না হয়, কারণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে তোমাদের উলংগতা প্রকাশ পাবে।’ ” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের সামনে তুমি আমার এই সব নিয়ম তুলে ধরবে। “গোলাম হিসাবে যদি কোন ইবরানী লোককে তোমরা কিনে নাও, তবে ছয় বছর সে তোমাদের অধীনে কাজ করবে, কিন্তু সাত বছরের সময় তার কাছ থেকে কিছু না নিয়ে এমনিই তাকে ছেড়ে দিতে হবে। যদি সে একা তোমাদের কাছে এসে থাকে তবে সে একাই চলে যাবে, কিন্তু যদি সে তার স্ত্রীকেও সংগে এনে থাকে তবে তাকেও তার সংগে যেতে দিতে হবে। সেই গোলামের বিয়ে যদি তার মালিকই দিয়ে থাকে আর তার ছেলেমেয়ে হয়ে থাকে তবে সেই স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে মালিকেরই থেকে যাবে; সে একাই বের হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সেই গোলাম স্পষ্ট করে জানায় যে, সে তার মালিক, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ভালবাসে এবং তাদের ছেড়ে চলে যাবার ইচ্ছা তার নেই, তবে তার মালিক তাকে আল্লাহ্‌র কাছে উপস্থিত করবে। তারপর দরজা বা দরজার চৌকাঠের কাছে তাকে নিয়ে গিয়ে তুরপুন দিয়ে তার কানটা ফুটা করে দেবে। তাতে সে সারা জীবন তার মালিকের গোলাম হয়ে থাকবে। “যদি কেউ তার মেয়েকে বাঁদী হিসাবে বিক্রি করে তবে গোলামের মত করে সেই বাঁদীকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু যে মালিক তাকে নিজের জন্য পছন্দ করে নিয়েছে সে যদি তার উপর খুশী হতে না পারে তবে টাকার বদলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্য জাতির কোন লোকের কাছে তাকে বিক্রি করা চলবে না, কারণ তার প্রতি মালিক তার কর্তব্য করে নি। যদি মালিক তার ছেলের জন্য তাকে পছন্দ করে নিয়ে থাকে তবে নিজের মেয়ের মত সব অধিকার তাকে দিতে হবে। সেই মালিক সেই বাঁদীকে বিয়ে করবার পরেও যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবুও সে তার খোরাক-পোশাক দিতে বাধ্য থাকবে এবং শরীরের দিক থেকে তার যা পাওনা তা-ও তাকে দিতে হবে। সে যদি এই সব কর্তব্য পালন না করে তবে কোন টাকা না নিয়েই তাকে চলে যেতে দিতে হবে। “কোন লোককে আঘাত করবার ফলে যদি তার মৃত্যু হয় তবে আঘাতকারীকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। কিন্তু খুন করবার মতলব যদি তার না থেকে থাকে, যদি এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা হয় যাতে আমি বাধা দিই নি, তবে সে এমন একটা জায়গায় পালিয়ে যেতে পারবে যা আমি তোমাদের জন্য ঠিক করে দেব। যদি কেউ আগে থেকে ভেবে-চিন্তে ইচ্ছা করেই অন্য কাউকে হত্যা করে কোরবানগাহের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়, তবে সেখান থেকেও তাকে ধরে এনে হত্যা করতে হবে। “পিতাকে কিংবা মাকে যে আঘাত করে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। “যদি কেউ কাউকে চুরি করে নিয়ে এসে বিক্রি করে দেয় কিংবা যদি তাকে তার সংগে পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই তাকে হত্যা করতে হবে। “যার কথায় মা-বাবার প্রতি অসম্মান থাকে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। “যদি কেউ তার গোলাম বা বাঁদীকে লাঠি দিয়ে মারে আর তার ফলে সে মারা যায় তবে আঘাতকারীকে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু যদি সে তার পরে দু-এক দিন বেঁচে থাকে তবে আঘাতকারীকে শাস্তি দেওয়া চলবে না, কারণ সে তার নিজেরই সম্পত্তি। “মারামারি করতে গিয়ে যদি কেউ কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোককে এমনভাবে আঘাত করে যাতে তার গর্ভ নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু আর কোন ক্ষতি না হয়, তবে সেই স্ত্রীলোকটির স্বামীর দাবি এবং বিচারকেরা যা ঠিক করে দেবে সেই অনুসারেই আঘাতকারীকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু যদি এছাড়া অন্য কোন ক্ষতি হয় তবে এইভাবে তাকে শাস্তি দিতে হবে, যেমন প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, হাতের বদলে হাত, পায়ের বদলে পা; পোড়ানোর বদলে পোড়ানো, ঘায়ের বদলে ঘা এবং কালশিরার বদলে কালশিরা। “যদি কেউ তার গোলাম বা বাঁদীর কোন চোখে আঘাত করলে তা নষ্ট হয়ে যায় তবে তার বদলে তাকে এমনিই চলে যেতে দিতে হবে। যদি সে আঘাত করে তার দাঁত ফেলে দেয় তবে তার বদলেও তাকে এমনি চলে যেতে দিতে হবে। “যদি কোন গরু গুঁতিয়ে কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোককে মেরে ফেলে তবে পাথর ছুঁড়ে সেই গরুটাকে অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে। সেই গরুর গোশ্‌ত কেউ খাবে না এবং গরুর মালিক কোন শাস্তি পাবে না। তবে গরুটার যদি গুঁতানোর অভ্যাস থাকে আর তার মালিককে সাবধান করে দেবার পরেও সে তাকে আট্‌কে না রাখে আর সেই গরুটা কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোককে মেরে ফেলে, তবে পাথর ছুঁড়ে সেই গরুটাকে মেরে ফেলতে হবে এবং তার মালিককেও মেরে ফেলতে হবে। কিন্তু যদি মালিকের কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় তবে সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে মালিক তার নিজের জীবন রক্ষা করতে পারবে। সেই গরুটা যদি কোন ছেলে বা মেয়েকে গুঁতিয়ে মেরে ফেলে তবে তার বেলায়ও একই নিয়ম খাটবে। কোন গরু যদি কোন গোলাম বা বাঁদীকে গুঁতিয়ে মেরে ফেলে তবে তার মালিককে সেই গরুর মালিক তিনশো ষাট গ্রাম রূপা দেবে, আর সেই গরুটাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতে হবে। “যদি কোন জমির মালিক তার জমির কোন গর্তের মুখ খুলে রাখে কিংবা কোন গর্ত খুঁড়ে ঠিক মত তার মুখ ঢাকা দিয়ে না রাখে আর সেই গর্তে যদি কোন গরু বা গাধা পড়ে যায়, তবে তাকেই তার ক্ষতিপুরণ দিতে হবে। সেই গরু বা গাধার মালিককে সেই ক্ষতিপুরণ দিতে হবে; তবে মরা গরু বা গাধাটা তার হয়ে যাবে। “কোন লোকের গরু যদি অন্য কোন লোকের গরুকে গুঁতিয়ে মেরে ফেলে, তবে জীবিত গরুটাকে বিক্রি করে তার টাকা ও মরা গরুটা তারা দু’জনে সমান ভাগে ভাগ করে নেবে। কিন্তু যদি আগে থেকে জানা থাকে যে, গরুটা গুঁতায় কিন্তু তার মালিক তাকে আট্‌কে না রেখে থাকে তবে সেই মালিককে গরুর বদলে গরু দিতে হবে এবং মরা গরুটা তার হয়ে যাবে। “যদি কোন লোক কোন গরু বা ভেড়া চুরি করে এনে মেরে ফেলে কিংবা বিক্রি করে দেয়, তবে তাকে একটা গরুর বদলে পাঁচটা গরু এবং একটা ভেড়ার বদলে চারটা ভেড়া ফিরিয়ে দিতে হবে। “যদি কোন চোর চুরি করবার জন্য ঘরে ঢুকবার সময়ে ধরা পড়ে আর আহত হয়ে মারা যায়, তবে যার আঘাতে সে মারা গেল সে খুনের দায়ে দায়ী হবে না। কিন্তু যদি সূর্য উঠবার পরে তা হয় তবে সে সেই খুনের জন্য দায়ী হবে। “চোরকে চুরি করা জিনিসের জন্য অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কিন্তু যদি তার কিছু না থাকে তবে তাকেই বিক্রি করে সেই টাকা আদায় করে নিতে হবে। চুরি করা গরু, গাধা বা ভেড়া যদি চোরের কাছে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় তবে চোরকে সেগুলো একটার বদলে দু’টা করে ফিরিয়ে দিতে হবে। “যদি কেউ তার গরু-ভেড়া কোন মাঠে বা আংগুর ক্ষেতে চরাতে গিয়ে ছেড়ে দেয় আর সেগুলো অন্য কোন লোকের ক্ষেতে ঢুকে ফসল খেয়ে ফেলে, তবে তার নিজের শস্য ক্ষেতের বা আংগুর ক্ষেতের সবচেয়ে ভাল ফসল দিয়ে তার ক্ষতিপূরণ করতে হবে। “যদি কোন জায়গা থেকে আগুন কাঁটাঝোপে গিয়ে লাগে এবং পরে ছড়িয়ে গিয়ে গাদা করে রাখা কিংবা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা শস্য কিংবা গোটা ক্ষেতখানা পুড়িয়ে ফেলে, তবে আগুনটা যে জ্বালিয়েছিল তাকেই তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি কেউ কারও কাছে টাকা-পয়সা বা জিনিসপত্র রাখতে দেয় আর তার ঘর থেকে তা চুরি হয়ে যায়, তবে চোর ধরা পড়লে চোর তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু যদি চোর ধরা না পড়ে তবে ঘরের কর্তা নিজেই সেই সব নিয়েছে কিনা তা স্থির করবার জন্য তাকে আল্লাহ্‌র কাছে উপস্থিত হতে হবে। অন্যের দখলে আছে এমন কোন গরু বা গাধা বা ভেড়া বা পরনের কাপড় কিংবা অন্য যে কোন হারানো জিনিস দেখে যদি কেউ বলে সেটা তার, তবে তা মীমাংসার জন্য দুই পক্ষকেই আল্লাহ্‌র কাছে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। আল্লাহ্‌ যাকে দোষী বলে স্থির করবেন সে অন্যজনকে তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবে। “যদি কেউ তার গাধা, গরু, ভেড়া কিংবা অন্য কোন পশু কারও কাছে রাখতে দেয় আর তা মরে যায় বা আঘাত পায় কিংবা কেড়ে নেওয়া হয় অথচ কেউ এই সব হতে দেখে নি, তবে সেই লোকই যে সেটা করে নি তা মাবুদের সামনে কসম খেয়ে তাকে ব্যাপারটার মীমাংসা করতে হবে। সেই পশুর মালিককে তখন তা মেনে নিতে হবে এবং কোন ক্ষতিপূরণ সে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু সেই লোকের কাছ থেকে যদি সেটা চুরি হয়ে যায় তবে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে। যদি কোন হিংস্র জন্তু সেই পশুটাকে ছিঁড়ে ফেলে তবে তা প্রমাণ করবার জন্য তাকে পড়ে থাকা অংশগুলো নিয়ে এসে দেখাতে হবে। এই অবস্থায় তাকে আর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। “কারও কাছ থেকে চেয়ে আনা কোন পশু যদি মালিকের অনুপস্থিতিতে আহত হয় বা মরে যায় তবে যে তা চেয়ে এনেছে তাকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু মালিকের সামনেই যদি তা হয় তবে তাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কিন্তু পশুটা যদি টাকা দিয়ে ভাড়া করে আনা হয়ে থাকে তবে সেই টাকাই তার ক্ষতিপূরণ হবে। “কারও সংগে বিয়ের সম্বন্ধ হয় নি এমন কোন সতী মেয়েকে যদি কেউ ভুলিয়ে এনে তার সংগে জেনা করে, তবে সেই লোকটাকে তার বিয়ের মহরানা দিতে হবে এবং মেয়েটা তার স্ত্রী হবে। যদি মেয়েটির পিতা কিছুতেই তার কাছে মেয়ে দিতে রাজী না হয় তা হলেও তাকে এই বিয়ের মহরানা দিতে হবে। “কোন জাদুকারিণীকে বেঁচে থাকতে দেবে না। “কোন পশুর সংগে যদি কেউ জেনা করে তবে অবশ্যই তাকে হত্যা করতে হবে। “মাবুদকে ছাড়া যদি কেউ কোন দেবতার কাছে কিছু কোরবানী দেয় তবে তাকেও হত্যা করতে হবে। “কোন বিদেশীর সংগে খারাপ ব্যবহার কোরো না বা তার উপর জুলুম কোরো না, কারণ মিসর দেশে তোমরাও একদিন বিদেশী ছিলে। “কোন বিধবা বা কোন এতিম ছেলে বা মেয়েকে কষ্ট দিয়ো না। যদি তা কর এবং সে আমার কাছে কাঁদে তবে নিশ্চয়ই আমি তার কান্নায় কান দেব। তখন আমার রাগ জ্বলে উঠবে এবং তোমরা যুদ্ধে মারা পড়বে। তাতে তোমাদের স্ত্রীরা বিধবা হবে এবং ছেলেমেয়েরা তাদের পিতাকে হারাবে। “আমার কোন অভাবী লোককে যদি তুমি টাকা ধার দাও তবে মহাজনের মত করে তার কাছ থেকে কোন সুদ নিয়ো না। যদি তুমি কারও গায়ের চাদর বন্ধক রাখ তবে সূর্য ডুবে যাবার আগেই তা ফিরিয়ে দিতে হবে, কারণ ওটাই তার গায়ে দেবার জন্য একমাত্র কাপড়। ওটা না থাকলে সে কি গায়ে দিয়ে শোবে? যদি সে এইজন্য আমার কাছে কাঁদে তবে আমি তার কান্না শুনব, কারণ আমার অন্তর রহমতে পূর্ণ। “আল্লাহ্‌কে অপমান কোরো না কিংবা তোমাদের শাসনকর্তাকে বদদোয়া দিয়ো না। “তোমাদের ফসল এবং আংগুর-রস থেকে আমাকে যা দেবার তা দিতে দেরি কোরো না। তোমাদের প্রথম ছেলে আমাকে দিতে হবে। তোমাদের গরু ও ভেড়ার বেলায়ও তা-ই করবে। সাত দিন পর্যন্ত তাদের বাচ্চাগুলো মায়ের কাছে থাকবে, তারপর আট দিনের দিন সেগুলো আমাকে দিয়ে দিতে হবে। “তোমরা হবে আমার পাক-পবিত্র বান্দা। সেইজন্য এমন কোন পশুর গোশ্‌ত তোমরা খাবে না যা কোন হিংস্র জানোয়ারে ছিঁড়ে মাঠে ফেলে রেখেছে; তা কুকুরকে খেতে দেবে। “মিথ্যা গুজব রটাবে না। তা করে অন্যায়ের পক্ষ নিয়ে দুষ্ট লোককে সাহায্য করবে না। দশজনে অন্যায় করছে বলে তুমিও তা করতে যেয়ো না। কোন মকদ্দমায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বেশীর ভাগ লোকের সাথে মিলে ন্যায়বিচারে বাধা দিয়ো না। কোন গরীব লোকের বিচার করতে গিয়ে সে গরীব বলেই তার পক্ষ নেবে না। “তোমার শত্রুর কোন গরু বা গাধাকে যদি অন্য কোথাও চলে যেতে দেখ তবে সেটা অবশ্যই তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তোমাকে ঘৃণা করে এমন কোন লোকের গাধাকে যদি বোঝার ভারে পড়ে যেতে দেখ তবে সেই লোককে সেই অবস্থায় রেখে চলে যেয়ো না। তুমি অবশ্যই তাকে তা তুলতে সাহায্য করবে। “কোন গরীব লোকের মকদ্দমায় অন্যায় বিচার কোরো না। সাজানো মামলা থেকে দূরে থাকবে এবং কোন নির্দোষ কিংবা সৎ লোককে মৃত্যুর শাস্তি দিয়ো না। এই অন্যায় যে করবে তাকে আমি রেহাই দেব না। ঘুষ খেয়ো না, কারণ যার চোখ আছে তাকেও ঘুষ অন্ধ করে দেয়। ঘুষ সৎ লোকের কথায়ও প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। “বিদেশীর উপর জুলুম কোরো না। বিদেশী হওয়া যে কেমন তা তোমরা নিজেরাই জান, কারণ মিসর দেশে তোমরাও একদিন বিদেশী ছিলে। “পর পর ছয় বছর তোমরা ক্ষেতে চাষ করবে এবং ফসল কাটবে, কিন্তু সপ্তম বছরে জমি চাষও করবে না এবং কোন কিছু বুনবেও না। তাতে এমনি যা জন্মাবে তোমাদের মধ্যেকার গরীব লোকেরা তা থেকে খাবার পাবে আর যা পড়ে থাকবে তা বুনো পশুরা খেতে পারবে। তোমাদের আংগুর ও জলপাই বাগানের ব্যাপারেও ঐ একই নিয়ম পালন করবে। “তোমরা সপ্তার ছয় দিন কাজ করবে কিন্তু সপ্তম দিনে কোন কাজ করবে না। তাতে তোমাদের গরু ও গাধা বিশ্রাম পাবে এবং তোমাদের ঘরে জন্মেছে এমন গোলাম আর অন্যান্য জাতির লোকেরাও পরিশ্রম থেকে রেহাই পাবে। “আমি তোমাদের যে যে নির্দেশ দিলাম তার প্রত্যেকটা অবশ্যই পালন করবে। কোন দেবতার নাম মুখে আনবে না, তা যেন তোমাদের মুখে শোনা না যায়। “প্রতি বছর তোমরা আমার উদ্দেশে তিনটা করে ঈদ পালন করবে। তোমরা খামিহীন রুটির ঈদ পালন করবে। আমি তোমাদের যে হুকুম দিয়েছি সেইমতই তোমরা সাত দিন ধরে খামিহীন রুটি খাবে। আবীব মাসের নির্দিষ্ট সময়ে এটা পালন করবে, কারণ সেই মাসেই তোমরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছ। কেউ যেন তখন খালি হাতে আমার কাছে না আসে। তোমরা ক্ষেতে যা বুনবে তার প্রথম ফসল দিয়ে ফসল কাটবার ঈদ পালন করবে। কৃষিকাজের শেষ মাসে ক্ষেত থেকে ফসল তুলবার সময়ে তোমরা ফসল মজুদের ঈদ পালন করবে। বছরে তিনবার করে তোমাদের সব পুরুষ লোক আল্লাহ্‌ মালিকের সামনে উপস্থিত হবে। “যখন তোমরা আমার উদ্দেশে পশুর রক্ত কোরবানী দেবে তখন তার সংগে যেন কোন খামি-দেওয়া রুটি কোরবানী করা না হয়। ঈদের সময় আমার উদ্দেশে যে সব পশু-কোরবানী দেবে তার কোন চর্বিযুক্ত অংশ যেন সকাল পর্যন্ত পড়ে না থাকে। তোমাদের ক্ষেত থেকে কেটে আনা প্রথম ফসলের সবচেয়ে ভাল অংশটা তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরে নিয়ে যাবে। ছাগলের বাচ্চার গোশ্‌ত তার মায়ের দুধে রান্না করবে না। “যে জায়গা আমি ঠিক করে রেখেছি সেখানে তোমাদের নিয়ে যাবার জন্য এবং পথে রক্ষা করবার জন্য আমি তোমাদের আগে আগে একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমরা তার কথা শুনবে এবং তা মেনে চলবে। তোমরা তার বিরুদ্ধে মন তেতো কোরো না। তোমাদের বিদ্রোহ তিনি মাফ করবেন না, কারণ আমিই তার মধ্যে আছি। তোমরা যদি তার কথায় কান দাও এবং আমি যা যা বলেছি তা কর তবে আমি তোমাদের শত্রুদের শত্রু হব এবং যারা তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে আমি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। আমোরীয়, হিট্টীয়, পরিষীয়, কেনানীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়রা যে দেশে বাস করে আমার ফেরেশতা তোমাদের আগে আগে থেকে সেই দেশে তোমাদের নিয়ে যাবে। আমি তাদের সকলকেই ধ্বংস করে ফেলব। তোমরা তাদের দেবতাদের পূজা কিংবা সেবা করবে না এবং সেখানকার লোকেরা যা করে তা করবে না। তোমরা তাদের দেব-দেবীর মূর্তিগুলো ভেংগে ফেলবে এবং তাদের পূজার পাথরগুলোও টুকরা টুকরা করে ফেলবে। তোমরা কেবল তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌রই, অর্থাৎ আমারই এবাদত করবে। তাতে তোমাদের খাবার ও পানির উপরে আমার দোয়া থাকবে এবং আমিই তোমাদের সব অসুখ-বিসুখ দূর করে দেব। তখন তোমাদের দেশের কারও গর্ভের সন্তান নষ্ট হবে না এবং কেউ বন্ধ্যা থাকবে না। আমি তোমাদের পূর্ণ আয়ু পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখব। “তোমরা যে সব জাতির কাছে যাবে তাদের মনে আমার সম্বন্ধে একটা ভয়ের ভাব আমি আগেই জাগিয়ে দেব এবং তাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করব। তোমাদের সব শত্রুরা পিছন ফিরে পালিয়ে যাবে। হিব্বীয়, কেনানীয় ও হিট্টীয়দের তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য আমি তোমাদের আগে আগে ভিমরুল পাঠিয়ে দেব। তবে আমি যে তাদের এক বছরের মধ্যেই সবাইকে তাড়িয়ে দেব তা নয়, কারণ তা করলে দেশটা খালি পড়ে থাকবে আর বুনো জীব-জানোয়ারের সংখ্যা তোমাদের পক্ষে অনেক বেশী হয়ে যাবে। তোমরা সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে সারা দেশটা অধিকার করে না নেওয়া পর্যন্ত আমি সেই জাতিদের কিছু কিছু করে দেশ থেকে তাড়িয়ে বের করে দেব। “এক দিকে লোহিত সাগর থেকে ফিলিস্তিনীদের দেশের সাগর পর্যন্ত এবং অন্য দিকে মরুভূমি থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত তোমাদের দেশের সীমানা আমি স্থির করে দেব। সেই দেশে যারা বাস করছে তাদের আমি তোমাদের হাতে তুলে দেব আর তোমাদের সামনে থেকে তোমরা তাদের তাড়িয়ে বের করে দেবে। তাদের সংগে কিংবা তাদের দেবতাদের সংগে কোন চুক্তি করবে না। তোমাদের দেশের মধ্যে তাদের বাস করতে দেবে না। তা করলে তারা আমার বিরুদ্ধে তোমাদের গুনাহে টেনে নিয়ে যাবে, কারণ যদি তোমরা তাদের দেব-দেবীর পূজা কর তবে নিশ্চয়ই তোমরা তার ফাঁদে আট্‌কা পড়ে যাবে।” পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “হারুন, নাদব, অবীহূ আর বনি-ইসরাইলদের সত্তরজন বৃদ্ধ নেতা এবং তুমি আমার কাছে উঠে এস। আসবার সময়ে তোমরা দূরে থেকে আমাকে সেজদা করবে। কিন্তু তুমি একাই আমার কাছে এগিয়ে আসবে, অন্যেরা আসবে না। এরা ছাড়া অন্য বনি-ইসরাইলরা যেন তোমার সংগে উঠে না আসে।” মূসা যখন ফিরে গিয়ে লোকদের কাছে মাবুদের সমস্ত কথা বললেন এবং তাঁর সব আইন ঘোষণা করলেন তখন লোকেরা একসংগে বলল, “মাবুদ যা যা বলেছেন আমরা তা সবই করব।” মাবুদ যে সব কথা বলেছিলেন মূসা তা লিখে রাখলেন। পরের দিন মূসা খুব সকালে উঠে পাহাড়ের নীচে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং ইসরাইলীয় বারো গোষ্ঠীর কথা মনে করে বারোটা পাথরের থাম তৈরী করলেন। তারপর তিনি কয়েকজন ইসরাইলীয় যুবককে পাঠিয়ে দিলেন আর তারা গিয়ে মাবুদের উদ্দেশে অনেকগুলো পোড়ানো-কোরবানী দিল এবং যোগাযোগ-কোরবানী হিসাবে অনেক ষাঁড়ও কোরবানী দিল। মূসা কোরবানীর রক্তের অর্ধেকটা নিয়ে কয়েকটা পাত্রে রাখলেন এবং বাকী অর্ধেক তিনি কোরবানগাহের উপরে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর তিনি ব্যবস্থা-লেখা কিতাবটা নিয়ে লোকদের তেলাওয়াত করে শোনালেন। এর জবাবে লোকেরা বলল, “আমরা বাধ্য থাকব এবং মাবুদ যা যা বলেছেন তা সবই পালন করব।” এই কথা শুনে মূসা রক্ত নিয়ে লোকদের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, “এই সেই ব্যবস্থার রক্ত, যে ব্যবস্থা মাবুদ তোমাদের জন্য এই সব কথা অনুসারে স্থির করেছেন।” বনি-ইসরাইলদের এই সব নেতারা যদিও আল্লাহ্‌কে দেখলেন তবু তিনি তাঁদের মেরে ফেললেন না। তাঁরা তাঁকে দেখলেন এবং খাওয়া-দাওয়া করলেন। তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি পাহাড়ের উপরে আমার কাছে উঠে এসে কিছুকাল এখানেই থাক। লোকদের শিক্ষা দেবার জন্য পাথরের যে ফলকের উপর আমি শরীয়ত ও হুকুম লিখে রেখেছি তা আমি তোমাকে দেব।” এই কথা শুনে মূসা তাঁর সাহায্যকারী ইউসাকে নিয়ে রওনা হলেন। তারপর তিনি আল্লাহ্‌র পাহাড়ে গিয়ে উঠলেন। তিনি বৃদ্ধ নেতাদের বলে গেলেন, “আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। হারুন আর হূর আপনাদের সংগে রইলেন। ঝগড়া-বিবাদ হলে লোকেরা যেন তাঁদের কাছে যায়।” মূসা পাহাড়ে উঠবার সময় পাহাড়টা মেঘে ঢেকে গেল, আর তুর পাহাড়ের উপর মাবুদের মহিমা স্থির হয়ে রইল। ছয় দিন পর্যন্ত পাহাড়টা মেঘে ঢাকা রইল। তারপর সপ্তম দিনে সেই মেঘের মধ্য থেকে মাবুদ মূসাকে ডাকলেন। বনি-ইসরাইলদের চোখে মাবুদের মহিমা জ্বলন্ত আগুনের মত হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় দেখা দিল। পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে মূসা সেই মেঘের ভিতরে ঢুকে গেলেন। তিনি চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত সেই পাহাড়ে রইলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের বল যেন তারা আমার জন্য দান নিয়ে আসে। নিজের ইচ্ছায় যারা তা আনবে তুমি তাদের কাছ থেকে তা বুঝে নেবে। তারা যেন এই সব দান আনে: সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জ; নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং মসীনা সুতা; ছাগলের লোম; লাল রং-করা ভেড়ার চামড়া এবং শুশুকের চামড়া; বাব্‌লা কাঠ; আলো জ্বালাবার জন্য জলপাইয়ের তেল; অভিষেক-তেল ও খোশবু ধূপের জন্য মসলা; এফোদ ও বুক-ঢাকনের উপরে বসাবার জন্য বৈদূর্যমণি এবং অন্যান্য দামী পাথর। বনি-ইসরাইলদের দিয়ে তুমি আমার থাকবার জন্য একটা পবিত্র জায়গা তৈরী করিয়ে নেবে। তাতে আমি তাদের মধ্যে বাস করব। যে নমুনা আমি তোমাকে দেখাতে যাচ্ছি ঠিক সেই রকম করেই তুমি আমার এই আবাস-তাম্বু ও সব আসবাবপত্র তৈরী করাবে। “বাব্‌লা-কাঠ দিয়ে তারা একটা সিন্দুক তৈরী করবে। সেটা লম্বায় হবে আড়াই হাত, চওড়ায় ও উচ্চতায় দেড় হাত। তার ভিতর ও বাইর খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে এবং তার চার কিনারা ধরে থাকবে সোনার নক্‌শা। ছাঁচে ফেলে চারটা সোনার কড়া তৈরী করে তার চারটা পায়ায় লাগাতে হবে- এপাশে দু’টা, ওপাশে দু’টা। তারপর বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দু’টা ডাণ্ডা তৈরী করে তা সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। সিন্দুকটা বয়ে নেবার জন্য তার দুই পাশের কড়ার মধ্য দিয়ে সেই ডাণ্ডা দু’টা ঢুকিয়ে দেবে। ডাণ্ডা দু’টা সেই সিন্দুকের কড়ার মধ্যে ঢুকানোই থাকবে; সেগুলো খুলে নেওয়া চলবে না। যে সাক্ষ্য-ফলক আমি তোমাকে দেব তা তুমি এই সিন্দুকের মধ্যে রাখবে। “খাঁটি সোনা দিয়ে সেই সিন্দুকের জন্য একটা ঢাকনা তৈরী করাবে, যার উপর গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হবে। এই ঢাকনাটা লম্বায় হবে আড়াই হাত এবং চওড়ায় দেড় হাত। সেই ঢাকনার কিনারায় সোনা পিটিয়ে দু’টি কারুবী তৈরী করাতে হবে। কারুবী দু’টি সিন্দুকের দুই কিনারায় থাকবে। সেই কারুবী দু’টি এমনভাবে ঢাকনা থেকে তৈরী করাতে হবে যাতে সমস্তটা মিলে মাত্র একটা জিনিসই হয়। তাদের ডানাগুলো উপর দিকে মেলে দেওয়া থাকবে এবং তার ছায়ার নীচে থাকবে সিন্দুকের ঢাকনাটা। কারুবীরা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকবে এবং তাদের চোখ থাকবে ঢাকনাটার দিকে। এই ঢাকনাটা সিন্দুকের উপর রাখতে হবে এবং যে সাক্ষ্য-ফলক আমি তোমাকে দেব সেটা তুমি সেই সিন্দুকের মধ্যে রাখবে। এই সাক্ষ্য-সিন্দুকের ঢাকনার উপরে কারুবী দু’টির মাঝখানে আমি তোমার সংগে দেখা করে বনি-ইসরাইলদের জন্য আমার সমস্ত হুকুম তোমাকে দেব। “বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দুই হাত লম্বা, এক হাত চওড়া ও দেড় হাত উঁচু করে একটা টেবিল তৈরী করাতে হবে। খাঁটি সোনা দিয়ে সেটা মুড়িয়ে দেবে এবং তার চার কিনারা ধরে থাকবে সোনার নক্‌শা। টেবিলটার চারপাশের কিনারায় চার আংগুল উঁচু করে একটা বেড় তৈরী করাতে হবে, আর তার উপরেও সোনা দিয়ে নক্‌শার কাজ করাতে হবে। টেবিলের চার কোণাতে চার পায়ার উপরে চারটা সোনার কড়া তৈরী করিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে। সেই কড়াগুলো টেবিলের কিনারায় ঐ উঁচু বেড়ের কাছাকাছি থাকবে যাতে টেবিলটা বয়ে নেবার জন্য সেগুলোর মধ্য দিয়ে ডাণ্ডা ঢুকানো যায়। ডাণ্ডা দু’টা বাব্‌লা কাঠ দিয়ে তৈরী করে সোনা দিয়ে মুড়াতে হবে এবং তা দিয়ে টেবিলটা বয়ে নিতে হবে। টেবিলের বড় এবং ছোট থালাগুলো আর যে সব কলসী ও পেয়ালা থেকে ঢালন-কোরবানীর জিনিস ঢালতে হবে তা সবই খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরী করাতে হবে। সেই টেবিলের উপরে আমার সামনে পবিত্র-রুটি রাখতে হবে, আর তা যেন সব সময় সেখানে থাকে। “খাঁটি সোনা দিয়ে একটা বাতিদান তৈরী করাতে হবে। তার নীচের অংশ এবং তা থেকে উঠে যাওয়া ডাঁটিটা সোনা পিটিয়ে তৈরী করাবে। তার ফুলের মত পেয়ালাগুলো, কুঁড়ি ও ফুল বাতিদান থেকে বের হয়ে আসবে এবং সমস্তটা মিলে মাত্র একটা জিনিসই হবে। বাতিদানের দু’পাশ দিয়ে তিনটা তিনটা করে মোট ছয়টা ডাল থাকবে। ফুল ও কুঁড়িসুদ্ধ বাদাম ফুলের মত দেখতে তিনটা পেয়ালা প্রথম ডালের মাঝে মাঝে থাকবে। তার পরের ডালেও ঐ রকম তিনটা পেয়ালা থাকবে। বাতিদান থেকে বের হয়ে আসা ছয়টা ডাল একই রকম হবে। বাতিদানের ডাঁটিটার মাঝে মাঝেও ফুল ও কুঁড়িসুদ্ধ বাদাম ফুলের মত দেখতে চারটা পেয়ালা থাকবে। বাতিদান থেকে বের হয়ে আসা মোট ছয়টা ডালের মধ্যে প্রথম দু’টা যেখানে মিশবে তার নীচে থাকবে একটা কুঁড়ি, দ্বিতীয় দু’টার নীচে আর একটা কুঁড়ি এবং তৃতীয় দু’টার নীচে আর একটা কুঁড়ি। কুঁড়ি এবং ডাল সবই বাতিদান থেকে বের হয়ে আসবে এবং সমস্তটা মিলে একটা জিনিসই হবে। সবটাই খাঁটি সোনা পিটিয়ে তৈরী করাতে হবে। তারপর খাঁটি সোনা দিয়ে সাতটা বাতি তৈরী করিয়ে ঐ বাতিদানের উপর এমনভাবে বসাতে হবে যাতে বাতিগুলো জ্বালালে পর বাতিদানের সামনের জায়গাটায় আলো পড়ে। সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা এবং সল্‌তের পোড়া অংশ রাখবার জন্য কয়েকটা পাত্রও খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরী করাতে হবে। সব কিছু সুদ্ধ বাতিদানটা তৈরী করবার জন্য ত্রিশ কেজি খাঁটি সোনা দরকার হবে। এই পাহাড়ের উপরে তোমাকে যে নমুনা দেখানো হল ঠিক সেইমতই যেন সব কিছু তৈরী করা হয় তা দেখো। “আমার আবাস-তাম্বু দশ টুকরা কাপড় দিয়ে তৈরী করাতে হবে। টুকরাগুলো পাকানো মসীনা সুতা এবং নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা দিয়ে তৈরী করাতে হবে। ওস্তাদ কারিগর দিয়ে তার মধ্যে কারুবীদের ছবি বুনিয়ে নেবে। টুকরাগুলো সব একই মাপের হবে- লম্বায় আটাশ হাত এবং চওড়ায় চার হাত। টুকরাগুলো পাঁচটা পাঁচটা করে একসংগে জুড়ে দু’টা বড় টুকরা করতে হবে। প্রথম বড় টুকরাটার একপাশের চওড়ার দিকের কিনারা ধরে নীল সুতা দিয়ে কতগুলো ফাঁস তৈরী করাবে। দ্বিতীয় বড় টুকরাতেও ঠিক তা-ই করাতে হবে। এইভাবে পঞ্চাশটা ফাঁস প্রথম বড় টুকরার কিনারায় এবং আরও পঞ্চাশটা ফাঁস দ্বিতীয় বড় টুকরার কিনারায় থাকবে। দুই বড় টুকরার এই ফাঁসগুলো একটা আর একটার ঠিক উল্টা দিকে থাকবে। তারপর পঞ্চাশটা সোনার আংটা তৈরী করে সেগুলো ফাঁসের মধ্যে ঢুকিয়ে সেই বড় টুকরা দু’টা আট্‌কে দিতে হবে। তাতে দু’টা বড় টুকরা দিয়ে একটা আবাস-তাম্বু হবে। “আবাস-তাম্বুর উপরের অংশ ঢেকে দেবার জন্য ছাগলের লোম দিয়ে চাদরের মত করে এগারটা টুকরা বুনিয়ে নিতে হবে। টুকরাগুলো একই মাপের হবে- ত্রিশ হাত লম্বা ও চার হাত চওড়া। তা থেকে পাঁচটা টুকরা একসংগে জুড়ে নিয়ে একটা বড় টুকরা করতে হবে। বাকী ছয়টা টুকরা একসংগে জুড়ে নিয়ে আর একটা বড় টুকরা করতে হবে। এই বড় টুকরার মধ্যে যে টুকরাটা বেশী থাকবে সেটা তাম্বুর সামনের দিকে দু’ভাঁজ করে দিতে হবে। প্রথম বড় টুকরাটা একপাশের চওড়ার দিকের কিনারা ধরে পঞ্চাশটা ফাঁস তৈরী করাতে হবে; দ্বিতীয় বড় টুকরাতেও ঠিক তা-ই করাতে হবে। তারপর ব্রোঞ্জ দিয়ে পঞ্চাশটা আংটা তৈরী করিয়ে তা ফাঁসের মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে সেই বড় টুকরা দু’টা একসংগে আট্‌কে দিতে হবে। তাতে বড় টুকরা দু’টা মিলে একটা তাম্বু-ঢাকন হবে। প্রথম বড় টুকরাটার যে অর্ধেকটা পিছন দিকে ঝুলে পড়বে সেটা সেইভাবেই থাকবে। ছাগলের লোমের টুকরাখানা তলার কাপড় থেকে দু’পাশে এক হাত করে বড় হবার দরুন তা দু’পাশে ঝুলে পড়ে গোটা আবাস-তাম্বুটা ঢেকে ফেলবে। তার উপরটা ঢেকে দেবার জন্য লাল রং করা ভেড়ার চামড়া দিয়ে একটা ঢাকনি তৈরী করাতে হবে, আর তার উপরটা ঢেকে দিতে হবে শুশুকের চামড়ার ঢাকনি দিয়ে। “আবাস-তাম্বুর জন্য বাব্‌লা কাঠ দিয়ে কতগুলো খাড়া ফ্রেম তৈরী করাতে হবে। প্রত্যেকটা ফ্রেম দশ হাত লম্বা আর দেড় হাত চওড়া হবে। প্রত্যেক ফ্রেমের দু’টা করে পায়া থাকবে। আবাস-তাম্বুর সব ফ্রেমগুলো একই রকম করে তৈরী করাতে হবে। দক্ষিণ দিকের জন্য বিশটা ফ্রেম তৈরী করাতে হবে। ঐ ফ্রেমগুলোর প্রত্যেকটা পায়ার নীচে বসাবার জন্য চল্লিশটা রূপার পা-দানি তৈরী করাবে- প্রত্যেকটা ফ্রেমের জন্য দু’টা করে, অর্থাৎ প্রত্যেকটা পায়ার জন্য একটা করে। তাম্বুর পশ্চিম দিকের জন্য, অর্থাৎ পিছন দিকের জন্য ছয়টা ফ্রেম, আর পিছন দিকের দুই কোণার জন্যও আরও দু’টা ফ্রেম তৈরী করাবে। এই ফ্রেম দু’টার প্রত্যেকটা দুই কোণার দু’টা ফ্রেমের সংগে একত্র করে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত জোড়া দিতে হবে। প্রত্যেকটি কোণার দুই ফ্রেম ও পাশের ফ্রেমটা আংটা দিয়ে একসংগে জুড়ে দিতে হবে। দুই কোণা একই রকম হবে। এতে পিছন দিকে আটটা ফ্রেম হবে এবং প্রত্যেকটা ফ্রেমের নীচে দেবার জন্য দু’টা করে মোট ষোলটা রূপার পা-দানি থাকবে। উপর এবং নীচের হুড়কাগুলোর মধ্যেকার লম্বা হুড়কাটা ফ্রেমের মাঝখান দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত চলে যাবে। ফ্রেমগুলো সোনা দিয়ে মুড়াতে হবে এবং হুড়কাগুলো ঢুকাবার জন্য সোনার কড়া তৈরী করে ফ্রেমে লাগাতে হবে। সেই হুড়কাগুলোও সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নেবে। “এই পাহাড়ের উপরে তোমাকে আবাস-তাম্বুর যে নমুনা দেখানো হল তুমি ঠিক সেইমত করেই সেটা তৈরী করাবে। “নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে একটা পর্দা তৈরী করাবে। ওস্তাদ কারিগর দিয়ে তার উপরে কারুবীদের ছবি বুনিয়ে নেবে। সেই পর্দাটা বাব্‌লা কাঠের চারটা খুঁটির সংগে লাগানো সোনার হুক থেকে ঝুলিয়ে দিতে হবে। খুঁটিগুলো সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে এবং সেগুলো রূপার পা-দানির উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। পর্দাটা উপরের মসীনার কাপড়ে লাগানো আংটার নীচে ঝুলানো থাকবে। এই পর্দার পিছনে সাক্ষ্য-সিন্দুকটি রাখবে। পর্দাটা মহাপবিত্র স্থান ও পবিত্র স্থানের মাঝখানে থেকে দু’টি স্থানকে আলাদা করে রাখবে। এই মহাপবিত্র স্থানের ভিতরে সাক্ষ্য-সিন্দুকের উপরে তার ঢাকনাটা রাখবে। এই পর্দাটার বাইরে পবিত্র স্থানের মধ্যে উত্তর পাশে টেবিলটা রাখতে হবে আর তার উল্টাদিকে দক্ষিণ পাশে থাকবে বাতিদানটা। “তাম্বুর দরজার জন্যও একটা পর্দা তৈরী করাতে হবে। সেটা হবে নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে সেলাই করে নক্‌শা করা জিনিস। এই পর্দার জন্য সোনার হুক এবং বাব্‌লা কাঠের পাঁচটা খুঁটি তৈরী করাবে। খুঁটিগুলো সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে। সেই খুঁটিগুলো বসাবার জন্য ব্রোঞ্জ দিয়ে পাঁচটা পা-দানি তৈরী করাবে। “বাব্‌লা কাঠ দিয়ে পাঁচ হাত লম্বা, পাঁচ হাত চওড়া ও তিন হাত উঁচু করে একটা চারকোনা বিশিষ্ট কোরবানগাহ্‌ তৈরী করাবে। কোরবানগাহ্‌টি তৈরী করবার সময় তার চার কোণার কাঠ এমনভাবে চেঁছে ফেলতে হবে যাতে চারটা শিং তৈরী হয়। তাতে শিংসুদ্ধ কোরবানগাহ্‌টি একটা গোটা জিনিস হবে। ব্রোঞ্জ দিয়ে সমস্ত কোরবানগাহ্‌টি মুড়ে দেবে। কোরবানগাহের ছাই ফেলবার পাত্র ও হাতা, কোরবানীর রক্ত রাখবার পেয়ালা, গোশ্‌ত তুলবার কাঁটা এবং আগুন রাখবার পাত্র সবই ব্রোঞ্জের তৈরী হবে। ব্রোঞ্জ দিয়ে একটা ঝাঁঝরি, অর্থাৎ জাল্‌তি তৈরী করাবে। তার চার কোণায় চারটা ব্রোঞ্জের কড়া লাগাবে। কোরবানগাহের চারপাশ থেকে বের হয়ে আসা তাকের নীচে এই ঝাঁঝরি রাখবে। সেটা কোরবানগাহের নীচ থেকে উপরের দিকে মাঝামাঝি জায়গায় থাকবে। কোরবানগাহের জন্য বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দু’টা ডাণ্ডা তৈরী করাতে হবে এবং সেই ডাণ্ডা দু’টা ব্রোঞ্জ দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে। এই ডাণ্ডাগুলো কড়ার মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাতে কোরবানগাহ্‌টি বয়ে নেবার সময় ডাণ্ডাগুলো কোরবানগাহের দু’পাশে থাকবে। কোরবানগাহ্‌টি তক্তা দিয়ে তৈরী হবে এবং তার ভিতরটা ফাঁকা থাকবে। এই পাহাড়ের উপরে তোমাকে যেমন দেখানো হল ঠিক তেমনি করেই তুমি সেটা তৈরী করাবে। “আবাস-তাম্বুর চারদিকে একটা উঠান থাকবে। এর দক্ষিণ দিকটা হবে একশো হাত। সেই দিকে থাকবে পাকানো মসীনা সুতার পর্দা। সেই পর্দাগুলো খাটাবার জন্য বিশটা খুঁটি থাকবে। খুঁটির নীচে থাকবে একটা করে ব্রোঞ্জের পা-দানি, আর খুঁটির সংগে লাগানো থাকবে রূপার হুক আর বাঁধন-পাত। উঠানের উত্তর দিকটাও হবে একশো হাত। সেখানেও থাকবে পর্দা, বিশটা খুঁটি, বিশটা ব্রোঞ্জের পা-দানি এবং খুঁটির সংগে থাকবে রূপার হুক আর বাঁধন-পাত। “উঠানের পশ্চিম দিকটা হবে পঞ্চাশ হাত। সেখানেও কতগুলো পর্দা ও দশটা খুঁটি থাকবে আর খুঁটির নীচে থাকবে একটা করে পা-দানি। উঠানের পূর্ব দিকটাও হবে পঞ্চাশ হাত। “উঠানের দরজার জন্য চারটা খুঁটি, চারটা পা-দানি এবং বিশ হাত লম্বা একটা পর্দা থাকবে। পর্দাটা হবে নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতার একটা নক্‌শা করা জিনিস। উঠানের চারদিকের সব খুঁটিতে রূপার হুক ও বাঁধন-পাত এবং ব্রোঞ্জের পা-দানি থাকবে। উঠানটা লম্বায় হবে একশো হাত এবং পাশে পঞ্চাশ হাত। তার চারদিকের পর্দাগুলো পাঁচ হাত করে উঁচু হবে এবং সেগুলো তৈরী হবে পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে, আর খুঁটিগুলোতে থাকবে ব্রোঞ্জের পা-দানি। আবাস-তাম্বুতে যে সব জিনিসপত্র ব্যবহার করা হবে, সেগুলো যে কাজেই ব্যবহার করা হোক না কেন সবই ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী করাতে হবে। এমন কি, তাম্বুর এবং উঠানের পর্দার গোঁজগুলোও হবে ব্রোঞ্জের। “বাতিদানে যাতে আলো জ্বালিয়ে রাখা যায় সেইজন্য তুমি বনি-ইসরাইলদের হুকুম দাও যেন তারা ছেঁচা জলপাইয়ের খাঁটি তেল তোমার কাছে নিয়ে আসে। এই মিলন-তাম্বুর সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে যে পর্দা থাকবে সেই পর্দার বাইরে হারুন ও তার ছেলেরা সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত মাবুদের সামনে বাতিগুলোর দেখাশোনা করবে। বনি-ইসরাইলরা যেন বংশের পর বংশ ধরে স্থায়ী নিয়ম হিসাবে এটা পালন করে। “তুমি বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে তোমার ভাই হারুন ও তার ছেলে নাদব, অবীহূ, ইলীয়াসর এবং ঈথামরকে তোমার কাছে ডেকে পাঠাও। তারা ইমাম হয়ে আমার এবাদত-কাজ করবে। সম্মান এবং সাজের উদ্দেশ্যে তোমার ভাই হারুনের জন্য তুমি পবিত্র পোশাক তৈরী করাবে। আমি যে সব ওস্তাদ কারিগরকে জ্ঞানদানকারী পাক-রূহ্‌কে দিয়ে পূর্ণ করে রেখেছি, তুমি তাদের বলে দাও যেন তারা হারুনের জন্য এমন পোশাক তৈরী করে যা তাকে ইমাম হিসাবে আমার এবাদত-কাজ করবার উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখবে। তার এই পোশাকের মধ্যে থাকবে বুক-ঢাকন, এফোদ, বাইরের কোর্তা, চেক্‌ কাপড়ের ভিতরের লম্বা কোর্তা, পাগড়ি ও কোমর-বাঁধনি। তোমার ভাই হারুন ও তাঁর ছেলেরা যাতে আমার ইমাম হতে পারে সেইজন্য তুমি তাদের জন্য পবিত্র পোশাক তৈরী করাবে। পোশাক তৈরী করবার কাজে তারা সোনা আর নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা ও মসীনা সুতা ব্যবহার করবে। “এফোদটা তৈরী করাতে হবে সোনা আর নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে। এটা হবে একটা ওস্তাদী হাতের কাজ। এফোদের কাঁধের অংশটা বেঁধে রাখবার জন্য দু‘টা ফিতা তৈরী করে এফোদের দুই কোণায় জুড়ে দিতে হবে। এফোদের সংগে জোড়া লাগানো কোমরের পটিটাও এফোদের মতই সোনা আর নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে তৈরী করাতে হবে। তুমি দু’টা বৈদুর্যমণি নিয়ে তার উপর ইসরাইলের ছেলেদের নাম খোদাই করাবে। তাদের জন্ম অনুসারে পর পর ছয়টা নাম একটা পাথরে আর বাকী ছয়টা নাম অন্য পাথরে খোদাই করাতে হবে। “আমার নির্দেশ জানবার জন্য বুক-ঢাকন তৈরী করাতে হবে। এটা হবে একটা ওস্তাদী হাতের কাজ। এফোদের মত এটাও তৈরী করাতে হবে সোনা আর নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে। এটা হবে লম্বায় আধ হাত ও চওড়ায় আধ হাত একটা চারকোনা বিশিষ্ট দুই ভাঁজ করা কাপড়। এর উপর চার সারি দামী পাথর বসাতে হবে। প্রথম সারিতে থাকবে সার্দীয়মণি, পীতমণি ও পান্না; দ্বিতীয় সারিতে চুনি, নীলকান্তমণি ও হীরা; তৃতীয় সারিতে গোমেদ, অকীকমণি ও পদ্মরাগ; চতুর্থ সারিতে পোখরাজ, বৈদূর্যমণি ও সূর্যকান্তমণি। পাথরগুলো সোনার জালির উপর বসাতে হবে। ইসরাইলের বারোটি ছেলের জন্য মোট বারোটা পাথর থাকবে। তার প্রত্যেকটিতে বারোটি গোষ্ঠীর একটি করে নাম খোদাই করানো থাকবে, যেমন করে সীলমোহর খোদাই করা হয়। “এই বুক-ঢাকনের জন্য খাঁটি সোনা দড়ির মত পাকিয়ে দু’টা শিকল তৈরী করাবে। সোনার দু’টা কড়া তৈরী করিয়ে বুক-ঢাকনের উপরের দুই কোণায় লাগিয়ে দেবে, আর শিকল দু’টা সেই কড়া দু’টার সংগে আট্‌কে দেবে। এফোদের সামনের দিকে কাঁধের ফিতার উপরে সোনার যে জালি থাকবে সেই জালির সংগে শিকলের অন্য দিকটা আট্‌কে দেবে। তা ছাড়া আরও দু’টা সোনার কড়া তৈরী করিয়ে বুক-ঢাকনের অন্য দুই কোণায় লাগাবে। এই দু’টা থাকবে এফোদের কাছে বুক-ঢাকনের তলায়। তা ছাড়াও আরও দু’টা সোনার কড়া তৈরী করিয়ে এফোদের কাঁধের ফিতার সোজাসুজি নীচের দিকে এফোদের কোমরের পটির ঠিক উপরে যে সেলাই থাকবে তার কাছে লাগিয়ে দেবে। তারপর বুক-ঢাকনের তলায় যে কড়া থাকবে তার সংগে কোমরের পটির কড়াটা নীল দড়ি দিয়ে বেঁধে দেবে। তাতে বুক-ঢাকনটা এফোদের উপর থেকে সরে যাবে না। “পবিত্র স্থানে ঢুকবার সময় হারুন আমার নির্দেশ জানবার জন্য এই বুক-ঢাকনখানার উপর লেখা ইসরাইলের ছেলেদের নাম বুকে বয়ে নিয়ে যাবে। এই বুক-ঢাকনখানা সব সময় মাবুদের সামনে তাদের তুলে ধরবে। বুক-ঢাকনের ভাঁজের ভিতরে রাখবে ঊরীম ও তুম্মীম। তাতে হারুন যখন মাবুদের সামনে উপস্থিত হবে তখন সেগুলো তার বুকে থাকবে। এতে হারুন মাবুদের সামনে সব সময়েই বনি-ইসরাইলদের জন্য আমার নির্দেশ জানবার উপায় তার বুকে বইবে। “এফোদের নীচে যে লম্বা কোর্তাটা থাকবে তার পুরোটাই নীল সুতা দিয়ে তৈরী করাবে। মাথা ঢুকাবার জন্য তার মাঝখানটা খোলা থাকবে। এই খোলা জায়গাটা যাতে ছিঁড়ে না যায় সেইজন্য তার চারদিকের কিনারা বুনে শক্ত করে দিতে হবে। নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা দিয়ে ডালিম ফল তৈরী করে এই কোর্তাটার নীচের মুড়ির চারপাশে ঝুলিয়ে দেবে। সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেবে সোনার ঘণ্টা। নীচের সমস্ত মুড়িটা ধরে থাকবে একটা করে ডালিম আর একটা করে ঘণ্টা। ইমাম-কাজ করবার সময়ে হারুন এই পোশাক পরবে। সে যখন পবিত্র স্থানে মাবুদের সামনে যাবে এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসবে তখন এই ঘণ্টাগুলোর আওয়াজ শোনা যাবে আর তাতে তার জীবন রক্ষা পাবে। “একটা খাঁটি সোনার পাত তৈরী করিয়ে তার উপর সীলমোহর খোদাই করবার মত করে এই কথাগুলো খোদাই করিয়ে নেবে: ‘মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র।’ সেই পাতটা পাগড়ির সামনের দিকে থাকবে এবং নীল দড়ি দিয়ে তা বাঁধা থাকবে। এটা থাকবে হারুনের কপালের উপর। যে সব পাক-পবিত্র জিনিস বনি-ইসরাইলরা কোরবানী করবার জন্য নিয়ে আসবে তার সমস্ত দোষ-ত্রুটির বোঝা হারুনই বইবে। মাবুদ যাতে তাদের কবুল করেন সেইজন্য হারুনের কপালের উপর এই সোনার পাতটা সব সময় থাকবে। “ইমামের ভিতরের কোর্তাটা তৈরী করাবে মসীনা সুতার চেক্‌ কাপড় দিয়ে আর পাগড়িটা তৈরী করাবে সেই একই সুতা দিয়ে। কোমর-বাঁধনিটা হবে একটা নক্‌শা করা জিনিস। “সম্মান ও সাজের উদ্দেশ্যে তুমি হারুনের ছেলেদের জন্যও কোর্তা, কোমর-বাঁধনি ও মাথার টুপি তৈরী করাবে। তোমার ভাই হারুন ও তার ছেলেদের এই সব পোশাক পরিয়ে নিয়ে তুমি তাদের মাথায় তেল দিয়ে অভিষেক করে ইমামের পদে বহাল করবে। তুমি তাদের পাক-পবিত্র করবে যাতে তারা আমার ইমাম হতে পারে। কোমর থেকে রান পর্যন্ত ঢাকবার জন্য মসীনার কাপড়ের জাংগিয়া তৈরী করাবে। হারুন ও তার ছেলেরা যখন মিলন-তাম্বুতে ঢুকবে কিংবা পবিত্র স্থানের ধূপগাহে এবাদত-কাজ করবার জন্য এগিয়ে যাবে তখন তারা এই জাংগিয়া পরবে। এতে তারা দোষমুক্ত থাকবে এবং মারা পড়বে না। হারুন এবং তার বংশধরদের জন্য এটা হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। “ইমাম হয়ে যাতে তারা আমার এবাদত-কাজ করতে পারে সেইজন্য তুমি তাদের এইভাবে পাক-পবিত্র করে নেবে। তুমি একটা ষাঁড় ও দু‘টা ভেড়া নেবে। সেগুলোর গায়ে যেন কোন খুঁত না থাকে। তারপর মিহি ময়দা দিয়ে রুটি, তেলের ময়ান দেওয়া পিঠা আর তেল লাগানো চাপাটি তৈরী করবে। এর কোনটাতেই খামি দেবে না। সেগুলো একটা টুকরির মধ্যে রাখবে এবং সেই ষাঁড় ও ভেড়া দু’টার সংগে টুকরিটা আমার সামনে রাখবে। তারপর হারুন ও তার ছেলেদের মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে নিয়ে যাবে এবং পানি দিয়ে তাদের শরীর ধুয়ে দেবে। পরে সেই বিশেষ পোশাকগুলো নিয়ে হারুনকে ভিতরের কোর্তা, এফোদের নীচে পরবার লম্বা কোর্তা, এফোদ এবং বুক-ঢাকনটা পরিয়ে দেবে। পাকা হাতে বোনা কোমরের পটির সংগে এফোদটা বেঁধে দেবে। তারপর তার মাথার উপর পাগড়ি পরিয়ে দিয়ে তার উপর সেই সোনার পাতের পবিত্র তাজটা লাগিয়ে দেবে। এর পর অভিষেকের তেল নিয়ে তার মাথায় ঢেলে দিয়ে তাকে অভিষেক করবে। “পরে সেই ষাঁড়টাকে তুমি মিলন-তাম্বুর সামনে আনবে, আর হারুন ও তার ছেলেরা ওটার মাথার উপর তাদের হাত রাখবে। তারপর মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে তুমি ষাঁড়টা জবাই করবে। পরে কিছুটা রক্ত নিয়ে তুমি আংগুল দিয়ে কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে আর বাকী রক্ত কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দেবে। তারপর পেটের ভিতরের অংশগুলোর উপরকার চর্বি, কলিজার উপরের অংশ এবং চর্বিসুদ্ধকিড্‌নি দু’টা নিয়ে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে ফেলবে। ষাঁড়টার গোশ্‌ত, চামড়া এবং গোবর সুদ্ধ নাড়ীভুঁড়ি বনি-ইসরাইলদের ছাউনি থেকে দূরে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। এটা একটা গুনাহের জন্য কোরবানী। “তারপর সেই ভেড়া দু’টার একটা নিয়ে আসবে। হারুন ও তার ছেলেরা সেই ভেড়াটার মাথার উপর তাদের হাত রাখবে। এর পর ভেড়াটা জবাই করে তার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। পরে ভেড়াটা কেটে টুকরা টুকরা করে তার পা এবং পেটের ভিতরকার অংশগুলো ধুয়ে নিয়ে মাথা ও অন্যান্য টুকরাগুলোর সংগে রাখবে। তারপর তার সবটাই কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে ফেলবে। এটা মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী, অর্থাৎ মাবুদের উদ্দেশে আগুনে করা কোরবানী, যার গন্ধে তিনি খুশী হন। “তারপর অন্য ভেড়াটাও নেবে এবং হারুন ও তার ছেলেরা তার মাথার উপরে তাদের হাত রাখবে। পরে ভেড়াটা জবাই করে তার কিছু রক্ত নিয়ে হারুন ও তার ছেলেদের ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও পায়ের বুড়ো আংগুলে লাগিয়ে দেবে। এছাড়া আরও কিছু রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। তারপর কিছু অভিষেকের তেল এবং কোরবানগাহ্‌ থেকে কিছু রক্ত নিয়ে হারুন ও তার ছেলেদের শরীরে এবং পোশাকের উপর ছিটিয়ে দেবে। এতে পোশাকসুদ্ধ তাকে ও তার ছেলেদের পাক-পবিত্র করা হবে। “তারপর তুমি সেই ভেড়াটার চর্বি, চর্বিভরা লেজ, পেটের ভিতরের অংশগুলোর উপরকার চর্বি, কলিজার উপরের অংশ, চর্বি-জড়ানো কিড্‌নি দু’টা এবং ডান দিকের রানটা নেবে। এটা হল পদে বহাল করবার কাজের ভেড়া। তারপর মাবুদের সামনে রাখা খামিহীন রুটির টুকরি থেকে একটা রুটি, একটা তেলে ময়ান দেওয়া পিঠা ও চাপাটি নেবে। এগুলো সব হারুন ও তার ছেলেদের হাতে দিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে মাবুদের সামনে তা দোলাবে। তারপর সেগুলো তাদের হাত থেকে নিয়ে কোরবানগাহের উপর পোড়ানো-কোরবানীর সংগে পুড়িয়ে ফেলবে। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে করা কোরবানী যার গন্ধে তিনি খুশী হন। হারুনের ইমাম-পদে বহাল করবার কাজের এই ভেড়াটার বুকের অংশ নিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে মাবুদের সামনে তা দোলাবে। এটা তোমার ভাগে পড়বে। “হারুন ও তার ছেলেদের ইমাম-পদে বহাল করবার ভেড়াটা থেকে নেওয়া দোলন-কোরবানীর গোশ্‌ত এবং কোরবানী দেওয়া রানের গোশ্‌ত পাক-পবিত্র করবে। এইভাবে বনি-ইসরাইলদের দেওয়া সব যোগাযোগ-কোরবানীর এই অংশগুলো সব সময় হারুন ও তার ছেলেদের দেওয়া হবে। এই অংশগুলোই হবে মাবুদের উদ্দেশে বনি-ইসরাইলদের দান। “হারুনের পবিত্র পোশাকগুলো তার বংশধরেরা পাবে। এগুলো পরিয়েই তাদের অভিষেক ও ইমামের পদে বহাল করতে হবে। হারুনের পরে তার যে ছেলে ইমাম হয়ে মিলন-তাম্বুর পবিত্র স্থানে এবাদত-কাজ করতে যাবে তাকে সাত দিন পর্যন্ত এই পোশাক গায়ে রাখতে হবে। “বহাল করবার কাজের এই ভেড়াটার গোশ্‌ত নিয়ে একটা পবিত্র জায়গায় সিদ্ধ করতে হবে। মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে হারুন ও তার ছেলেরা টুকরিতে রাখা রুটির সংগে এই গোশ্‌ত খাবে। তাদের ইমামের কাজে বহাল করবার জন্য এবং পাক-পবিত্র করবার জন্য যে সব কোরবানী দেওয়া খাবার গুনাহ্‌ ঢাকবার কাজে ব্যবহার করা হবে তা হারুন ও তার ছেলেদের খেতে হবে। অন্য কেউ তা খেতে পারবে না, কারণ তা পবিত্র খাবার। এই বহাল করবার কাজের ভেড়ার কোন গোশ্‌ত বা রুটি যদি সকাল পর্যন্ত থেকে যায় তবে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা যেন কেউ না খায়, কারণ সেটা পবিত্র খাবার। “হারুন ও তার ছেলেদের প্রতি আমি যা যা তোমাকে করতে বললাম তা সবই তুমি করবে। এই বহাল করবার কাজটা তুমি সাত দিন ধরে করবে। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য গুনাহের কোরবানী হিসাবে তুমি সেই সাত দিনের প্রত্যেক দিন একটা করে ষাঁড় কোরবানী দেবে। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কোরবানী দ্বারা কোরবানগাহ্‌টা পাক-সাফ করবে এবং তেল ঢেলে সেটা পাক-পবিত্র করে নেবে। কোরবানগাহ্‌টা পাক-সাফ করে নেবার জন্য সাত দিন পর্যন্ত প্রতিদিন গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কোরবানী দ্বারা সেটা পাক-পবিত্র করে নিতে হবে। তাতে সেই কোরবানগাহ্‌টা একটা মহাপবিত্র জিনিস হবে। তার ছোঁয়ায় যা কিছু আসবে তা পাক-পবিত্র হতে হবে। “এর পর থেকে সেই কোরবানগাহের উপর প্রত্যেক দিন নিয়মিত ভাবে দু’টা করে ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী দিতে হবে; তার প্রত্যেকটার বয়স হবে এক বছর। একটা কোরবানী দিতে হবে সকালবেলায় আর অন্যটি সন্ধ্যাবেলায়। প্রথম ভেড়াটার সংগে এক কেজি আটশো গ্রাম মিহি ময়দা প্রায় এক লিটার ছেঁচা জলপাইয়ের তেলের সংগে মিশিয়ে কোরবানী করতে হবে। এছাড়া ঢালন-কোরবানী হিসাবে প্রায় এক লিটার আংগুর-রসও কোরবানী করতে হবে। সন্ধ্যাবেলায় যে ভেড়াটা কোরবানী দেওয়া হবে তার সংগে সকালবেলার মত সেই একই রকমের শস্য-কোরবানী এবং ঢালন-কোরবানী করতে হবে। এটা হবে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে করা কোরবানী যার গন্ধে তিনি খুশী হন। “বংশের পর বংশ ধরে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের, অর্থাৎ আমার সামনে নিয়মিত ভাবে এই পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। সেখানেই আমি তোমাদের সংগে দেখা করব এবং তোমার সংগে কথা বলব। বনি-ইসরাইলদের সংগে আমি সেখানে দেখা করব এবং আমার মহিমা সেই জায়গাটাকে পবিত্র করবে। “আমি মিলন-তাম্বু ও কোরবানগাহ্‌ পাক-পবিত্র করব এবং আমার ইমাম হবার জন্য হারুন ও তার ছেলেদেরও পাক-পবিত্র করব। আমি বনি-ইসরাইলদের মাবুদ হয়ে তাদের মধ্যে বাস করব। তখন তারা জানতে পারবে যে, আমি আল্লাহ্‌ই তাদের মাবুদ। আমি তাদের মধ্যে বাস করব বলেই মিসর দেশ থেকে তাদের বের করে এনেছি। আমি আল্লাহ্‌ই তাদের মাবুদ। “ধূপ জ্বালাবার জন্য তুমি বাব্‌লা কাঠ দিয়ে একটা ধূপগাহ্‌ তৈরী করাবে। ধূপগাহ্‌টি হবে চারকোনা বিশিষ্ট- এক হাত লম্বা, এক হাত চওড়া আর দু’হাত উঁচু। শিংসুদ্ধ গোটা ধূপগাহ্‌টি মাত্র একটা জিনিসই হবে। ধূপগাহের উপরটা, তার চারপাশ এবং শিংগুলো খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে আর তার চার কিনারা ধরে থাকবে সোনার নক্‌শা। ধূপগাহের দু’পাশে নক্‌শার নীচে দু’টা করে সোনার কড়া লাগাতে হবে যাতে তার ভিতর দিয়ে ডাণ্ডা ঢুকিয়ে সেটা বয়ে নেওয়া যায়। সেই ডাণ্ডাগুলো বাব্‌লা কাঠ দিয়ে তৈরী করে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। সাক্ষ্য-সিন্দুকের কাছে, অর্থাৎ সাক্ষ্য-ফলকের উপরকার ঢাকনাটার কাছে যে পর্দা থাকবে এই ধূপগাহ্‌টা তার সামনে রাখবে; সেখানেই আমি তোমার সংগে দেখা করব। “প্রত্যেক দিন সকালে বাতিগুলো ঠিক করে রাখবার সময় হারুন ঐ ধূপগাহের উপর খোশবু ধূপ জ্বালাবে। বেলা শেষে বাতি ধরাবার সময়েও আবার সে ধূপ জ্বালাবে। এতে তোমাদের বংশের পর বংশ ধরে মাবুদের সামনে নিয়মিত ভাবে ধূপ জ্বলবে। এই ধূপগাহের উপর অন্য কোন ধূপ জ্বালাবে না কিংবা কোন পোড়ানো-কোরবানী বা শস্য-কোরবানী বা ঢালন-কোরবানী করবে না। গুনাহ্‌ ঢাকবার জন্য গুনাহের কোরবানীর রক্ত ধূপগাহের শিংগুলোর উপরে লাগিয়ে দিয়ে হারুন বছরে একবার করে ধূপগাহ্‌টি পাক-সাফ করে নেবে। এইভাবে বছরে একবার করে বংশের পর বংশ ধরে মহা-ইমামকে এই কাজ করে যেতে হবে। এটা মাবুদের উদ্দেশ্যে মহাপবিত্র ধূপগাহ্‌।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের লোকসংখ্যা জানবার জন্য যখন আদমশুমারী করা হবে সেই সময় প্রত্যেককেই মাবুদকে রূপা দিয়ে তার জীবন-মূল্য দিতে হবে। এতে আদমশুমারীর দরুন যে বিপদ আসবার কথা তা তাদের উপর আসবে না। গুণে রাখা লোকদের দলে যাবার আগে প্রত্যেককে দশ গ্রাম ওজনের ধর্মীয় শেখেলের আধা শেখেল করে দিতে হবে। এই আধা শেখেল হবে মাবুদের। যারা গুণে রাখা দলে যাবে, অর্থাৎ যাদের বয়স বিশ বছর কিংবা তার বেশী, মাবুদকে তাদের এটা দিতেই হবে। জীবন-মূল্য হিসাবে মাবুদকে এটা দেবার সময় ধনীরও আধা শেখেলের বেশী দিতে হবে না, আবার গরীবেরও এর কম দেওয়া চলবে না। বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে এই সব জীবন-মূল্যের রূপা নিয়ে মিলন-তাম্বুর কাজে ব্যবহার করতে হবে। এই সব জীবন-মূল্য যা তোমাদের জীবনের বদলে দেওয়া হবে তা মাবুদের সামনে বনি-ইসরাইলদের তুলে ধরবে।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “হাত-পা ধোয়ার জন্য ব্রোঞ্জ দিয়ে একটা গামলা আর তা বসাবার জন্য ব্রোঞ্জেরই একটা আসন তৈরী করাতে হবে। মিলন-তাম্বু ও কোরবানগাহের মাঝামাঝি জায়গায় সেটা বসিয়ে তার মধ্যে পানি রাখবে। ঐ পানি দিয়ে হারুন ও তাঁর ছেলেরা হাত-পা ধোবে। তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি কতগুলো ভাল জাতের মসলা, অর্থাৎ পাঁচ কেজি গন্ধরস, আড়াই কেজি খোশবু দারচিনি, আড়াই কেজি বচ, আর পাঁচ কেজি দারচিনি ফুলের কুঁড়ি নেবে। এছাড়া সাড়ে তিন লিটার জলপাইয়ের তেলও নেবে। খোশবু জিনিস তৈরী করবার মত করে তুমি এই সব খোশবু মসলা একসংগে মিশিয়ে নিয়ে অভিষেকের জন্য তেল তৈরী করাবে। এটাই হবে পবিত্র অভিষেক-তেল। এই অভিষেক-তেল দিয়ে তুমি মিলন-তাম্বু, সাক্ষ্য-সিন্দুক, টেবিল ও তার উপরকার জিনিসপত্র, বাতিদান ও তার সাজ-সরঞ্জাম, ধূপগাহ্‌, কোরবানগাহ্‌ ও তার সব পাত্র এবং আসনসুদ্ধ গামলাটা পাক-পবিত্র করবে। তাতে সেগুলো মহাপবিত্র জিনিস হবে। তার ছোঁয়ায় যা আসবে তা পাক-পবিত্র হতে হবে। “হারুন ও তার ছেলেরা যাতে আমার ইমাম হতে পারে সেইজন্য তুমি তাদের অভিষেক করে পাক-পবিত্র করে নেবে। তুমি বনি-ইসরাইলদের জানাবে যে, বংশের পর বংশ ধরে এটাই হবে তাদের পবিত্র অভিষেক-তেল। সাধারণ লোকদের গায়ে তারা যেন তা না দেয় এবং ঐ সব মসলা দিয়ে তারা যেন এই নিয়মে কোন তেলও তৈরী না করে। এই তেল পবিত্র; সেইজন্য তাদেরও সেটা সেইভাবেই দেখতে হবে। যদি কেউ এই রকম খোশবু জিনিস তৈরী করে কিংবা ইমাম ছাড়া আর কারও গায়ে তা দেয় তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে।” এর কিছুটা নিয়ে গুঁড়া করে মিলন-তাম্বুর মধ্যে সাক্ষ্য-ফলকের সামনে রাখবে। সেখানেই আমি তোমার সংগে দেখা করব। এই ধূপ তোমরা মহাপবিত্র জিনিস বলে মনে করবে। কেউ যেন এই নিয়মে এই সব খোশবু জিনিস দিয়ে নিজের ব্যবহারের জন্য কোন ধূপ তৈরী না করে। এটা যে মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র তা তোমরা মনে রাখবে। খোশবু জিনিস হিসাবে ব্যবহারের জন্য যদি কেউ তা তৈরী করে তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “দেখ, আমি এহুদা-গোষ্ঠীর ঊরির ছেলে বৎসলেলকে বেছে নিয়েছি। ঊরি হল হূরের ছেলে। আমি এই বৎসলেলকে আল্লাহ্‌র রূহ্‌ দিয়ে পূর্ণ করেছি। আমি তাকে জ্ঞান, বিবেচনাশক্তি, অভিজ্ঞতা এবং সব রকম কারিগরী কাজের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছি। তাতে সে নিজের মন থেকে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের উপর সুন্দর সুন্দর নক্‌শা তৈরী করতে পারবে, দামী দামী পাথর কাটতে ও বসাতে পারবে আর কাঠের এবং অন্য সব রকম হাতের কাজও করতে পারবে। এছাড়া তাকে সাহায্য করবার জন্য আমি দান-গোষ্ঠীর অহীষামকের ছেলে অহলীয়াবকেও বেছে নিয়েছি। যে সব ওস্তাদ কারিগর এই কাজ করবে তাদেরও আমি এমন জ্ঞান দিয়ে রেখেছি যাতে তোমাকে দেওয়া আমার হুকুম মতই তারা সব জিনিস তৈরী করতে পারে। এই সব জিনিস এই: মিলন-তাম্বু, সাক্ষ্য-সিন্দুক ও তার উপরকার ঢাকনা, তাম্বুর আসবাবপত্র, টেবিল ও তার সংগের জিনিসপত্র, খাঁটি সোনার বাতিদান ও তার জিনিসপত্র, ধূপগাহ্‌, অভিষেকের তেল আর পবিত্র স্থানের জন্য খোশবু ধূপও এই সব জিনিসের মধ্যে রয়েছে। তোমাকে দেওয়া আমার হুকুম অনুসারেই যেন তারা সেগুলো তৈরী করে।” “তোমরা বিশ্রামবার পালন করবে, কারণ এই দিনটা তোমাদের জন্য পবিত্র করা হয়েছে। যদি কেউ এই দিনটা পালন না করে তবে তাকে মেরে ফেলতে হবে; যদি কেউ এই দিনে কোন কাজ করে তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। তোমরা সপ্তার ছয় দিন কাজ করবে কিন্তু সপ্তম দিনটা হবে বিশ্রামের দিন, আর মাবুদের উদ্দেশ্যে সেটা একটা পবিত্র দিন। যদি কেউ এই দিনে কাজ করে তবে তাকে হত্যা করতে হবে। একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে এই বিশ্রামবার বনি-ইসরাইলদের বংশের পর বংশ ধরে পালন করতে হবে। এই দিনটা আমার ও বনি-ইসরাইলদের মধ্যে চিরকালের জন্য একটা চিহ্ন হয়ে থাকবে, কারণ আমি ছয় দিনের মধ্যে আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছি এবং সপ্তম দিনে আমি কোন কাজ করি নি।” তুর পাহাড়ের উপর মূসার কাছে এই সব কথা বলা শেষ করে মাবুদ তাঁকে দু’খানা সাক্ষ্য-ফলক দিলেন। এই দু’টা পাথরের ফলকের উপর আল্লাহ্‌ নিজেই তাঁর হুকুম লিখেছিলেন। পাহাড় থেকে নেমে আসতে মূসার দেরি হচ্ছে দেখে লোকেরা হারুনের চারপাশে জড়ো হয়ে বলল, “পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনি আমাদের দেব-দেবী তৈরী করে দিন কারণ ঐ মূসা, যে আমাদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছে, তার কি হয়েছে আমরা জানি না।” জবাবে হারুন তাদের বললেন, “তোমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কানের সোনার গহনা খুলে এনে আমাকে দাও।” তাতে সকলে তাদের কানের গহনা খুলে এনে হারুনকে দিল। লোকেরা হারুনকে যা দিল তা গলিয়ে ছাঁচে ফেলে যন্ত্রপাতির সাহায্যে তিনি বাছুরের আকারে একটা মূর্তি তৈরী করলেন। সেটা দেখে বনি-ইসরাইলরা বলল, “ভাইয়েরা, এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের দেব-দেবী। মিসর দেশ থেকে এই দেব-দেবীই তোমাদের বের করে এনেছেন।” এই ব্যাপার দেখে হারুন সেই বাছুরের সামনে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে এই কথা ঘোষণা করলেন, “আগামী কাল মাবুদের উদ্দেশে ঈদ হবে।” পরের দিন লোকেরা খুব সকালে উঠে পোড়ানো-কোরবানী এবং যোগাযোগ-কোরবানী দিল। তার পরে তারা খাওয়া-দাওয়া করতে বসল এবং পরে হৈ-হল্লা করে আমোদ-প্রমোদ করবার জন্য উঠে দাঁড়াল। এতে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি নীচে নেমে যাও। তোমার ঐ সব লোক যাদের তুমি মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছ তারা জঘন্য হয়ে গেছে। এর মধ্যেই তারা আমার হুকুম থেকে দূরে সরে গেছে। তারা নিজেদের জন্য বাছুরের আকারে একটা মূর্তি তৈরী করে নিয়েছে। তারা মাটিতে পড়ে তাকে সেজদা করেছে এবং তার উদ্দেশে পশু-কোরবানী করে বলেছে, ‘ভাইয়েরা, এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের দেব-দেবী। এই দেব-দেবীই মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন।’ ” মাবুদ মূসাকে আরও বললেন, “এই সব লোকদের আমি জানি। এরা একটা একগুঁয়ে জাতি। তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না। তাদের বিরুদ্ধে আমার রাগ আগুনের মত জ্বলতে থাকুক। আমি তাদের ধ্বংস করে ফেলব। তারপর তোমার মধ্য দিয়ে আমি একটা মহাজাতি র সৃষ্টি করব।” মূসা তখন তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌কে কাকুতি-মিনতি করে বললেন, “মাবুদ, তোমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে মহা শক্তিতে যাদের তুমি মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছ তোমার সেই বান্দাদের উপর কেন তোমার এত রাগ? কেন মিসরীয়রা এই কথা বলবার সুযোগ পাবে যে, পাহাড়ী এলাকার মাঝখানে এনে তাদের হত্যা করে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে ফেলবার খারাপ ইচ্ছা নিয়েই তুমি তাদের বের করে এনেছ? তোমার এই ভীষণ রাগ তুমি থামাও। দয়া কর, তোমার বান্দাদের উপর তুমি এই বিপদ এনো না। তোমার গোলাম ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইসরাইলের কথা মনে কর। তুমি নিজের নামেই কসম খেয়ে তাঁদের বলেছিলে, তাঁদের বংশধরদের আসমানের তারার মতই অসংখ্য করে তুলবে আর তোমার ওয়াদা করা দেশের গোটাটাই চিরকালের অধিকার হিসাবে তাঁদের বংশধরদের দেবে।” এই কথা শুনে মাবুদের মনে দয়া হল। তাঁর বান্দাদের উপর যে বিপদ আনবার কথা তিনি বলেছিলেন তা আর আনলেন না। এর পর মূসা সাক্ষ্য-ফলক দু’টি হাতে করে পাহাড় থেকে নীচে নেমে গেলেন। ফলক দু’টার সামনে এবং পিছনে দু’দিকেই লেখা ছিল। সেই দু’টা ছিল আল্লাহ্‌র নিজের হাতের কাজ, আর তার উপর খোদাই করা লেখাটিও ছিল তাঁর। ইউসা লোকদের চেঁচামেচি শুনে মূসাকে বললেন, “ছাউনি থেকে যুদ্ধের আওয়াজ আসছে।” জবাবে মূসা বললেন, “সেটা যুদ্ধে জয়লাভের আওয়াজও নয়, যুদ্ধে হেরে যাবার আওয়াজও নয়। আমি যা শুনতে পাচ্ছি তা গানের আওয়াজ।” তারপর মূসা ছাউনির কাছাকাছি গিয়ে ঐ বাছুরটা আর লোকদের নাচানাচি দেখতে পেলেন। তা দেখে তিনি রাগে জ্বলে উঠলেন এবং হাতের পাথর-ফলক দু’টা ছুঁড়ে ফেললেন। তাতে সেই দু’টা পাহাড়ের নীচে পড়ে টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে গেল। মূসা তাদের তৈরী সেই বাছুরের মূর্তিটা আগুনে পুড়িয়ে দিলেন। তারপর সেটা গুঁড়া করে পানির উপর ছড়িয়ে দিয়ে বনি-ইসরাইলদের খাওয়ালেন। তিনি হারুনকে বললেন, “ঐ লোকেরা তোমার কি করেছিল যে, তুমি তাদের এই রকম ভীষণ গুনাহের মধ্যে টেনে আনলে?” জবাবে হারুন বললেন, “তুমি রাগ কোরো না, তোমার তো জানা আছে খারাপীর দিকেই এই সব লোকের ঝোঁক। তারা এসে আমাকে বলল, ‘পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনি আমাদের দেব-দেবী তৈরী করে দিন, কারণ ঐ মূসা, যে মিসর দেশ থেকে আমাদের বের করে এনেছে, তার কি হয়েছে আমরা জানি না।’ এই কথা শুনে আমি তাদের বললাম, যাদের সোনার গহনা আছে তারা যেন তা খুলে আমার কাছে নিয়ে আসে। তারা আমাকে সোনা এনে দেবার পর আমি তা আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আর এই বাছুরটা বের হয়ে আসল।” মূসা দেখলেন লোকগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তিনি বুঝতে পারলেন হারুন তাদের হাতের বাইরে যেতে দিয়েছে আর তাতেই শত্রুর কাছে তারা হাসির পাত্র হয়ে উঠেছে। মূসা ছাউনিতে ঢুকবার পথে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা যারা মাবুদের পক্ষে আছ তারা আমার কাছে এস।” তাতে লেবি-গোষ্ঠীর সবাই তাঁর কাছে জমায়েত হল। তখন তিনি তাদের বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের কোমরে তলোয়ার বেঁধে নাও, আর ছাউনির সমস্ত জায়গায় গিয়ে যাকে সামনে পাও তাকেই হত্যা কর- সে ভাই হোক, বন্ধু হোক বা প্রতিবেশী হোক।’ ” লেবীয়রা মূসার হুকুম মতই কাজ করল। তাতে সেই দিন প্রায় তিন হাজার লোক মারা পড়ল। তারপর মূসা বললেন, “তোমরা আজই মাবুদের উদ্দেশ্যে নিজেদের পাক-পবিত্র করে নাও, কারণ তোমরা নিজের নিজের ছেলে ও ভাইদের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পিছপা হও নি। সেইজন্য আজ তোমরা মাবুদের দোয়া পেলে।” পরের দিন মূসা লোকদের বললেন, “তোমরা ভীষণ গুনাহ্‌ করেছ। কিন্তু আমি এখন মাবুদের কাছে উঠে যাচ্ছি। হয়তো তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার একটা ব্যবস্থা আমি করতে পারব।” মূসা মাবুদের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, “হায় মাবুদ! এই লোকেরা ভীষণ গুনাহ্‌ করে ফেলেছে। তারা নিজেদের জন্য সোনার দেব-দেবী তৈরী করে নিয়েছে। কিন্তু তুমি এখন দয়া করে তাদের গুনাহ্‌ মাফ করে দাও, আর যদি তা না কর তবে তোমার লেখা কিতাব থেকে আমার নামটাও মুছে দাও।” জবাবে মাবুদ মূসাকে বললেন, “যারা আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে কেবল তাদের নামই আমি আমার কিতাব থেকে মুছে ফেলব। শোন, যে জায়গার কথা আমি বলেছি তুমি এখন গিয়ে লোকদের সেখানে নিয়ে যাও। আমার ফেরেশতা তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যখন শাস্তি দেবার সময় আসবে তখন আমি তাদের গুনাহের শাস্তি দেব।” হারুনের তৈরী বাছুরটা নিয়ে লোকেরা যা করেছিল তার জন্য মাবুদ তাদের উপর মহা বিপদ পাঠিয়ে দিলেন। তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তোমার যে লোকদের তুমি মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছ তাদের নিয়ে তুমি এই জায়গা ছেড়ে আমার ওয়াদা করা দেশে যাও। সেই দেশ সম্বন্ধে আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে এই ওয়াদা করেছিলাম যে, আমি তাদের বংশধরদের তা দেব। আমি তোমাদের আগে আগে একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে সেই দেশ থেকে কেনানীয়, আমোরীয়, হিট্টীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের তাড়িয়ে দেব। সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই। কিন্তু তোমরা একটা একগুঁয়ে জাতি বলে আমি তোমাদের সংগে যাব না, গেলে পথেই আমি তোমাদের শেষ করে দেব।” এই বিপদের কথা শুনে লোকেরা কান্নাকাটি করতে লাগল। তারা কেউ আর কোন গহনাগাঁটি পরল না, কারণ মাবুদ মূসাকে বলেছিলেন, “বনি-ইসরাইলদের বল যে, তারা একটা একগুঁয়ে জাতি। সেইজন্য যদি আমি এক মুহূর্তের জন্যও তাদের সংগে থাকি, তবে আমি তাদের শেষ করে দেব। তাদের গায়ে গহনাগাঁটি যা আছে তা এখন তারা খুলে ফেলুক। তারপর আমি ঠিক করব তাদের নিয়ে আমি কি করব।” কাজেই বনি-ইসরাইলরা তুর পাহাড়েই তাদের গহনাগাঁটি খুলে ফেলল; তারা আর কখনও তা পরে নি। মূসা বনি-ইসরাইলদের ছাউনির বাইরে দূরে একটা বিশেষ তাম্বু খাটাতেন আর সেটাকে তিনি বলতেন “মিলন-তাম্বু।” মাবুদের কাছ থেকে কেউ কিছু জানতে চাইলে সে ঐ মিলন-তাম্বুর কাছে যেত। মূসা যখন সেই মিলন-তাম্বুতে যেতেন তখন লোকেরা নিজের নিজের তাম্বুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত এবং তিনি সেই তাম্বুতে না ঢোকা পর্যন্ত তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। মূসা সেই তাম্বুতে ঢুকবার পর মেঘের থামটি নেমে আসত এবং মাবুদ যতক্ষণ মূসার সংগে কথা বলতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা তাম্বুর দরজার কাছে থাকত। লোকেরা যখনই এই থামটিকে তাম্বুর দরজার কাছে দেখত তখন প্রত্যেকে উঠে নিজের নিজের তাম্বুর দরজার কাছে থেকে মাবুদকে সেজদা করত। মানুষ যেমন মুখোমুখি হয়ে বন্ধুর সংগে কথা বলে মাবুদ ঠিক তেমনি করেই মূসার সংগে কথা বলতেন। পরে মূসা বনি-ইসরাইলদের ছাউনিতে ফিরে যেতেন কিন্তু নূনের ছেলে ইউসা মিলন-তাম্বু ছেড়ে যেতেন না। ইউসা নামে এই যুবকটি ছিলেন মূসার সাহায্যকারী। পরে মূসা মাবুদকে বললেন, “তুমি আমাকে এই লোকদের নিয়ে যেতে বলেছ, কিন্তু আমার সংগে কাকে পাঠাবে তা তো বলছ না। তুমি বলেছ তুমি আমাকে তোমার নিজের বলেই জান আর আমার উপর তোমার রহমত রয়েছে। যদি আমি তোমার রহমত পেয়েই থাকি তবে তুমি কি উদ্দেশ্যে কি কর তা আমাকে জানতে দাও যাতে আমি তোমাকে বুঝতে পারি আর তোমার রহমতের মধ্যে থাকতে পারি। মনে রেখ, এই জাতি তোমারই।” জবাবে মাবুদ বললেন, “আমি নিজেই তোমার সংগে যাব এবং তোমাকে বিশ্রাম দেব।” মূসা তাঁকে বললেন, “তুমি যদি আমাদের সংগে না যাও তবে এখান থেকে আমাদের পাঠিয়ো না। তুমি আমাদের সংগে না গেলে লোকে কি করে বুঝবে যে, আমার উপর ও তোমার বান্দাদের উপর তোমার রহমত রয়েছে? আমি ও তোমার বান্দারা যে দুনিয়ার অন্যান্য লোকদের চেয়ে আলাদা তা আর কি দিয়ে বুঝা যাবে?” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি যা বললে আমি তা করব, কারণ আমার রহমত তোমার উপর রয়েছে আর আমি তোমাকে আমার নিজের বলেই জানি।” মূসা বললেন, “তা হলে তোমার মহিমা আমাকে দেখাও।” মাবুদ বললেন, “আমি আমার সব মহত্ত্ব তোমার সামনে তুলে ধরব। তোমার সামনে আমি আমার ‘মাবুদ’ নাম ঘোষণা করব। আমার যাকে ইচ্ছা তাকে রহমত দান করব, যাকে ইচ্ছা তাকে মমতা করব। কিন্তু তুমি আমার মুখ দেখতে পাবে না, কারণ আমাকে দেখবার পর কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।” তারপর মাবুদ বললেন, “তুমি আমার কাছে এই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখ। এই পাথরের পাহাড়ের থাকটার উপরে গিয়ে তুমি দাঁড়াবে। আমার মহিমা যখন তোমার সামনে দিয়ে চলে যাবে তখন আমি তোমাকে পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে সরিয়ে দেব এবং আমি চলে না যাওয়া পর্যন্ত তোমাকে আমার হাত দিয়ে ঢেকে রাখব। তারপর আমি আমার হাত সরিয়ে নিলে তুমি আমার পিছনের দিকটা দেখতে পাবে, কিন্তু আমার মুখ দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি প্রথম পাথর-ফলকের মত আবার দু’টা পাথর-ফলক তৈরী করে নাও। তোমার ভেংগে ফেলা ফলক দু’টার উপর যে কথাগুলো লেখা ছিল তা আমি আবার এই নতুন ফলক দু’টার উপর লিখে দেব। সকালবেলা প্রস্তুত হয়ে তুমি তুর পাহাড়ে উঠবে। সেখানে পাহাড়ের চূড়ায় তুমি আমার সামনে উপস্থিত হবে। কেউ যেন তোমার সংগে না থাকে কিংবা পাহাড়ের কোনখানে যেন কাউকে দেখা না যায়; এমন কি, পাহাড়ের সামনেও যেন কোন গরু, ছাগল বা ভেড়া ঘাস খেতে না আসে।” মূসা তখন প্রথম পাথর-ফলকের মত আবার দু’টা পাথর-ফলক তৈরী করে নিলেন এবং মাবুদের হুকুম মত খুব সকালে তুর পাহাড়ে উঠলেন। সেই দু’টা পাথরের ফলক তিনি হাতে করে নিয়ে গেলেন। মাবুদ মেঘের মধ্যে থেকে নেমে এসে মূসার কাছে দাঁড়ালেন এবং তাঁর “মাবুদ” নাম ঘোষণা করলেন। তিনি মূসার সামনে দিয়ে এই কথা ঘোষণা করতে করতে গেলেন, “মাবুদ, মাবুদ, তিনি মমতায় পূর্ণ দয়াময় আল্লাহ্‌। তিনি সহজে রাগ করেন না। তাঁর অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার সীমা নেই। তাঁর অটল মহব্বত হাজার হাজার পুরুষ পর্যন্ত থাকে। তিনি অন্যায়, বিদ্রোহ ও গুনাহ্‌ মাফ করেন, কিন্তু দোষীকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। তিনি পিতার অন্যায়ের শাস্তি তার বংশের তিন্তচার পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।” এর জবাবে মাবুদ বললেন, “আমি এক ব্যবস্থা স্থাপন করছি। তোমার সমস্ত লোকের সামনে আমি এমন সব কুদরতি কাজ করব যা এর আগে দুনিয়ার কোন জাতির সামনে করা হয় নি। যে লোকদের মধ্যে তুমি বাস করছ তারা দেখতে পাবে যে, আমি মাবুদ তোমাদের জন্য যে কাজ করতে যাচ্ছি তা মানুষের মনে কত ভয় জাগায়। আজ আমি তোমাদের যে হুকুম দেব তা তোমরা পালন করবে। আমোরীয়, কেনানীয়, হিট্টীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবুষীয়দের আমি তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেব। সাবধান! যে দেশে তোমরা যাচ্ছ সেই দেশের লোকদের সংগে তোমরা কোন চুক্তি করবে না; তা করলে তারা তোমাদের মধ্যে একটা ফাঁদ হয়ে থাকবে। তোমরা তাদের বেদীগুলো ভেংগে ফেলবে, তাদের পূজার পাথরগুলো টুকরা টুকরা করে ফেলবে আর তাদের পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেলবে। তোমরা কোন দেবতার পূজা করবে না, কারণ মাবুদের নাম হল পাওনা এবাদত পাবার আগ্রহী আল্লাহ্‌; তিনি তাঁর পাওনা এবাদত চান। “যারা সেই দেশে বাস করে তাদের সংগে কোন চুক্তি করবে না, কারণ তারা যখন অসতীর মনোভাব নিয়ে তাদের দেব-দেবীর পূজায় নিজেদের তুলে দেবে আর তাদের উদ্দেশে পশু-বলি দেবে তখন তারা তোমাদের দাওয়াত করবে আর তোমরা তাদের বলি-দেওয়া গোশ্‌ত খাবে। এছাড়া তোমরা তাদের মেয়েদের সংগে যখন তোমাদের ছেলেদের বিয়ে দেবে তখন ঐ সব মেয়ে অসতীর মনোভাব নিয়ে তাদের দেব-দেবীর পূজায় নিজেদের তুলে দেবে এবং তোমাদের ছেলেদেরও তাতে টেনে নেবে। “তোমরা ধাতু দিয়ে কোন মূর্তি তৈরী করবে না। “তোমরা খামিহীন রুটির ঈদ পালন করবে। আমি তোমাদের যেমন হুকুম দিয়েছি সেইমতই তোমরা সাত দিন খামিহীন রুটি খাবে। আবীব মাসের নির্দিষ্ট সময়ে তোমরা এই ঈদ পালন করবে, কারণ ঐ মাসেই তোমরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিলে। “গর্ভের প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তান আমার। এমন কি, তোমাদের সমস্ত পশুপালের প্রত্যেকটি পুরুষ বাচ্চাও আমার। তবে গাধার প্রথম পুরুষ বাচ্চার বদলে একটা ভেড়ার বাচ্চা দিয়ে গাধার বাচ্চাটাকে ছাড়িয়ে নেবে। সেই বাচ্চাটাকে যদি ছাড়িয়ে নেওয়া না যায় তবে তার ঘাড় ভেংগে দিতে হবে। তোমাদের প্রত্যেকটি প্রথম ছেলেকেও ছাড়িয়ে নিতে হবে। “ঈদের সময়ে কেউ যেন খালি হাতে আমার কাছে না আসে। “সপ্তার ছয় দিন তোমরা কাজ করবে কিন্তু সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেবে। এমন কি, চাষ করবার ও ফসল কাটবার মৌসুমেও তা করতে হবে। গম কাটবার সময়ে প্রথমে কাটা গম দিয়ে সাত সপ্তাহের ঈদ পালন করবে আর কৃষিকাজের শেষ মাসে পালন করবে ফসল মজুদের ঈদ। বছরে তিনবার তোমাদের সব পুরুষদের আল্লাহ্‌ মালিকের সামনে উপস্থিত হতে হবে। তিনিই বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌। দেশের ভিতরকার সব জাতিকেই আমি তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেব এবং তোমাদের দেশের সীমানা বাড়িয়ে দেব। বছরে তিনবার করে যখন তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত হবার জন্য যাবে তখন কেউ তোমাদের জায়গা-জমির উপর লোভ করবে না। “যখন তোমরা আমার উদ্দেশে পশুর রক্ত কোরবানী দেবে তখন তার সংগে যেন খামি-দেওয়া কোন কিছু কোরবানী করা না হয়। উদ্ধার-ঈদের কোরবানী-দেওয়া কোন কিছুই সকাল পর্যন্ত যেন পড়ে না থাকে। তোমাদের ক্ষেত থেকে কেটে আনা প্রথম ফসলের সবচেয়ে ভাল অংশটা তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরে নিয়ে যাবে। “ছাগলের বাচ্চার গোশ্‌ত তার মায়ের দুধে রান্না করবে না।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “এই সব কথা তুমি লিখে রাখ কারণ এই সব কথা অনুসারেই তোমার ও বনি-ইসরাইলদের জন্য আমি আমার ব্যবস্থা স্থাপন করেছি।” তুর পাহাড়ের উপরে মূসা মাবুদের কাছে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি রুটি কিংবা পানি কিছুই খান নি। মাবুদ সেই পাথরের ফলক দু’টির উপর তাঁর ব্যবস্থার কথাগুলো আবার লিখে দিলেন, আর সেগুলোই হল সেই দশটি বিশেষ হুকুম। মূসা যখন সাক্ষ্য-ফলক দু’টা হাতে নিয়ে তুর পাহাড় থেকে নেমে আসলেন তখন তিনি টের পান নি যে, মাবুদের সংগে কথা বলবার দরুন তাঁর মুখ নূরানী হয়ে উঠেছে। হারুন ও সমস্ত বনি-ইসরাইল মূসার এই নূরানী মুখ দেখে তাঁর কাছে যেতে ভয় পেল। কিন্তু মূসা তাঁদের ডাকলে পর হারুন ও বনি-ইসরাইলদের নেতারা তাঁর কাছে আসলেন। তখন মূসা তাঁদের সংগে কথা বললেন। এর পর বনি-ইসরাইলরা সকলে তাঁর কাছে আসল আর তিনি তুর পাহাড়ে দেওয়া মাবুদের সমস্ত হুকুম তাদের জানালেন। মূসা লোকদের সংগে কথা বলা শেষ করে নিজের মুখটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। কিন্তু এর পর থেকে যখনই তিনি মাবুদের সংগে কথা বলবার জন্য তাঁর সামনে যেতেন তখন তিনি তাঁর মুখের উপরকার কাপড়টা সরিয়ে ফেলতেন। মাবুদের সামনে থেকে বের হয়ে না আসা পর্যন্ত তাঁর মুখ খোলাই থাকত। সেখানে তিনি যে সব হুকুম পেতেন সেখান থেকে বের হয়ে এসে তিনি বনি-ইসরাইলদের তা জানাতেন। লোকেরা দেখত যে, মূসার মুখ নূরানী হয়ে গেছে। মূসা আবার তাঁর মুখ ঢেকে দিতেন এবং মাবুদের সংগে কথা বলতে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁর মুখ ঢাকাই থাকত। পরে মূসা বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করে বললেন, “মাবুদ তোমাদের পালন করবার জন্য এই সব হুকুম দিয়েছেন। সপ্তার ছয় দিন তোমরা কাজ করবে কিন্তু সপ্তম দিনটি হবে তোমাদের একটা পবিত্র দিন, মাবুদের উদ্দেশে বিশ্রামের দিন। সেই দিনে যে কাজ করবে তাকে হত্যা করতে হবে। বিশ্রামবারে তোমাদের কোন ঘরে যেন আগুন জ্বালানো না হয়।” নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা আর মসীনা সুতা; ছাগলের লোম; লাল রং করা ভেড়ার চামড়া, শুশুকের চামড়া; বাব্‌লা কাঠ; আলো জ্বালাবার জন্য জলপাইয়ের তেল; অভিষেক-তেল ও খোশবু ধূপের জন্য মসলা; এফোদ ও বুক-ঢাকনের উপরে বসাবার জন্য বৈদূর্যমণি ও অন্যান্য দামী পাথর। “তোমাদের মধ্যে যারা ওস্তাদ কারিগর তারা এসে মাবুদ যা হুকুম দিয়েছেন তা তৈরী করবে। সেগুলো হল আবাস-তাম্বু ও তার উপরকার ছাউনি; সমস্ত আংটা, ফ্রেম, হুড়কা, খুঁটি এবং পা-দানি; ডাণ্ডাসুদ্ধ সাক্ষ্য-সিন্দুক, তার ঢাকনা এবং তা আড়াল করে রাখবার পর্দা; ডাণ্ডাসুদ্ধ টেবিল ও তার জিনিসপত্র এবং মাবুদের পবিত্র-রুটি; আলোর জন্য বাতিদান ও তার জিনিসপত্র, তার বাতি আর আলো জ্বালাবার তেল; ডাণ্ডাসুদ্ধ ধূপগাহ্‌; অভিষেক-তেল এবং খোশবু ধূপ; আবাস-তাম্বুর দরজার পর্দা; ব্রোঞ্জের ঝাঁঝরিসুদ্ধ পোড়ানো-কোরবানীর কোরবানগাহ্‌, তার ডাণ্ডা ও বাসন-কোসন; আসনসুদ্ধ ব্রোঞ্জের গামলা; খুঁটি ও খুঁটির পা-দানিসুদ্ধ উঠানের পর্দা ও উঠানে ঢুকবার দরজার পর্দা; উঠানের পর্দার ও আবাস-তাম্বুর গোঁজ ও দড়ি; পবিত্র তাম্বু-ঘরে এবাদত-কাজের জন্য পোশাক, অর্থাৎ ইমাম হারুনের জন্য বুনানো পবিত্র পোশাক এবং তার ছেলেদের ইমাম হিসাবে এবাদত-কাজের পোশাক।” এর পর বনি-ইসরাইলরা মূসার কাছ থেকে চলে গেল। অন্তর থেকে সাড়া পেয়ে তারা নিজের ইচ্ছায় মাবুদকে দেবার উদ্দেশ্যে মিলন-তাম্বু তৈরী ও তার এবাদত-কাজের জন্য এবং ইমামের পবিত্র পোশাকের জন্য দরকার মত সব কিছু নিয়ে ফিরে আসল। পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের মধ্যে যাদের মনে ইচ্ছা হল তারা নানা রকম সোনার গহনাও নিয়ে আসল। তার মধ্যে ছিল কাপড় আট্‌কাবার পিন, কানের গহনা, আংটি এবং অন্যান্য রকমের গহনা। মাবুদের উদ্দেশে দোলন-কোরবানীর জন্য তারা এই সব দিল। যাদের কাছে নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং মসীনা সুতা কিংবা ছাগলের লোম, লাল রং করা ভেড়ার চামড়া কিংবা শুশুকের চামড়া ছিল তারা সেগুলো নিয়ে আসল। যাদের কাছে রূপা ও ব্রোঞ্জ ছিল তারা সেগুলো মাবুদকে দেবার জন্য নিয়ে আসল। আবাস-তাম্বু তৈরীর কাজে লাগতে পারে এমন বাব্‌লা কাঠ যাদের কাছে ছিল তারা তা নিয়ে আসল। যে স্ত্রীলোকেরা সুতা কাটবার কাজে ওস্তাদ তারা নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং মসীনা সুতা নিজের হাতে কেটে আনল। যারা অন্তর থেকে সাড়া পেল এবং সুতা কাটবার কাজ জানত সেই সব স্ত্রীলোকেরা ছাগলের লোম দিয়ে সুতা তৈরী করে আনল। এফোদ ও বুক-ঢাকনের উপরে বসাবার জন্য নেতারা বৈদূর্যমণি ও অন্যান্য দামী পাথর নিয়ে আসলেন। বাতি জ্বালাবার তেল এবং অভিষেক-তেল ও খোশবু ধূপ তৈরী করবার জন্য তাঁরা মসলা ও জলপাইয়ের তেলও নিয়ে আসলেন। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ যা করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই সব কাজ করবার জন্য ইসরাইলীয় স্ত্রীলোক এবং পুরুষদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা হল তারা মাবুদকে দেবার জন্য যার যা খুশী নিয়ে আসল। তাতে তিনি নিজের মন থেকে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের উপর সুন্দর সুন্দর নক্‌শা তৈরী করতে পারবেন, দামী দামী পাথর কাটতে ও বসাতে পারবেন আর কাঠের এবং অন্যান্য সুন্দর সুন্দর হাতের কাজও করতে পারবেন। এছাড়া অন্যদের এই সব কাজ শিখাবার ক্ষমতাও মাবুদ বৎসলেলকে ও দান-গোষ্ঠীর অহীষামকের ছেলে অহলীয়াবকে দিয়েছেন। তিনি তাঁদের নানা রকম হাতের কাজ, নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা ও মসীনা সুতা দিয়ে সেলাই করে নক্‌শা তোলার কাজ এবং তাঁতের কাজ করবার ক্ষমতা দিয়েছেন। তাঁরা সব রকম হাতের কাজ করতে পারবেন এবং নিজের মন থেকে নানা রকম নক্‌শাও করতে পারবেন। “সেইজন্য কি করে এই পবিত্র তাম্বু-ঘরটা তৈরী করতে হবে তা বুঝবার জন্য মাবুদ বৎসলেল, অহলীয়াব এবং অন্যান্য যে সব কারিগরদের জ্ঞান ও বিবেচনাশক্তি দিয়েছেন তাঁরা যেন মাবুদের হুকুম মতই সেই সব কাজ করেন।” মূসা এর পর এই সমস্ত কাজ করবার জন্য বৎসলেল ও অহলীয়াবকে ডাকলেন এবং এমন সব ওস্তাদ কারিগরদের ডাকলেন যাদের মাবুদ কাজের ক্ষমতা দিয়েছেন এবং যারা অন্তর থেকে সাড়া পেয়েছে। পবিত্র তাম্বু-ঘরটা তৈরী করবার জন্য বনি-ইসরাইলদের আনা সমস্ত জিনিস তাঁরা মূসার কাছ থেকে বুঝে নিলেন। লোকেরা কিন্তু প্রত্যেক দিন সকালে নিজেদের ইচ্ছামত আরও জিনিস আনতেই থাকল। তখন মূসার হুকুমে তারা বনি-ইসরাইলদের ছাউনির সব জায়গায় বলে পাঠাল, পুরুষ বা স্ত্রীলোক কেউই পবিত্র তাম্বু-ঘরের জন্য যেন আর কোন জিনিস নিয়ে না আসে। এতে লোকেরা জিনিস আনা বন্ধ করল, কারণ যে সব জিনিস তাদের জমা হয়েছিল কাজটা শেষ করবার পক্ষে তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশী ছিল। যারা কাজ করছিল তাদের মধ্যেকার ওস্তাদ কারিগরেরা পাকানো মসীনা সুতা এবং নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতার তৈরী দশ টুকরা কাপড় দিয়ে আবাস-তাম্বুটা তৈরী করল। ওস্তাদ কারিগর দিয়ে তার মধ্যে কারুবীদের ছবি বুনানো হল। টুকরাগুলো সব একই মাপের তৈরী করা হল- লম্বায় আটাশ হাত এবং চওড়ায় চার হাত। টুকরাগুলো পাঁচটা পাঁচটা করে জুড়ে নিয়ে দু’টা বড় টুকরা তৈরী করা হল। প্রথম বড় টুকরাটার চওড়ার দিকের এক পাশের কিনারা ধরে নীল সুতা দিয়ে কতগুলো ফাঁস তৈরী করা হল। দ্বিতীয় বড় টুকরাতেও ঠিক তা-ই করা হল। এইভাবে পঞ্চাশটা ফাঁস প্রথম বড় টুকরার কিনারায় এবং পঞ্চাশটা ফাঁস দ্বিতীয় বড় টুকরার কিনারায় তৈরী করা হল। এই দুই বড় টুকরার ফাঁসগুলো একটা আর একটার ঠিক উল্টাদিকে রইল। তারপর পঞ্চাশটা সোনার আংটা তৈরী করে সেগুলো ফাঁসের মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে সেই বড় টুকরা দু’টা আট্‌কে দেওয়া হল। তাতে দু’টা বড় টুকরা দিয়ে একটা আবাস-তাম্বু হল। আবাস-তাম্বুর উপরটা ঢেকে দেবার জন্য ছাগলের লোম দিয়ে চাদরের মত করে এগারটা টুকরা বুনিয়ে নেওয়া হল। টুকরাগুলো একই মাপের করা হল- ত্রিশ হাত লম্বা ও চার হাত চওড়া। তা থেকে পাঁচটা টুকরা একসংগে জুড়ে নিয়ে একটা বড় টুকরা তৈরী করা হল। বাকী ছয়টা টুকরা একসংগে জুড়ে নিয়ে আর একটা বড় টুকরা তৈরী করা হল। প্রথম বড় টুকরাটার চওড়ার দিকের এক পাশের কিনারা ধরে পঞ্চাশটা ফাঁস তৈরী করা হল, আর দ্বিতীয় বড় টুকরাতেও ঠিক তা-ই করা হল। তারপর ব্রোঞ্জ দিয়ে পঞ্চাশটা আংটা তৈরী করে সেই বড় টুকরা দু’টা একসংগে আট্‌কে দেওয়া হল। তাতে বড় টুকরা দু’টা মিলে একটা তাম্বু-ঢাকন হল। লাল রং করা ভেড়ার চামড়া দিয়ে তার উপরকার ছাউনি তৈরী করা হল আর তার উপরকার ছাউনি দেওয়া হল শুশুকের চামড়া দিয়ে। আবাস-তাম্বুর জন্য বাব্‌লা কাঠ দিয়ে কতগুলো খাড়া ফ্রেম তৈরী করা হল। প্রত্যেকটা ফ্রেম দশ হাত লম্বা আর দেড় হাত চওড়া করা হল, আর প্রত্যেকটা ফ্রেমে দু’টা করে পায়া দেওয়া হল। আবাস-তাম্বুর সব ফ্রেম একই রকম করে তৈরী করা হল। দক্ষিণ দিকের জন্য বিশটা ফ্রেম তৈরী করা হল। ঐ ফ্রেমগুলোর প্রত্যেকটার পায়ার নীচে বসাবার জন্য চল্লিশটা রূপার পা-দানি তৈরী করা হল- প্রত্যেকটা ফ্রেমের জন্য দু’টা করে, অর্থাৎ প্রত্যেকটা পায়ার জন্য একটা করে। এই ফ্রেম দু’টার প্রত্যেকটি দুই কোণার দু’টা ফ্রেমের সংগে একত্র করে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত জোড়া দেওয়া হল। প্রত্যেকটি কোণার দুই ফ্রেম ও পাশের ফ্রেমটা আংটা দিয়ে একসংগে জুড়ে দেওয়া হল। দুই কোণা একই রকম করা হল। এতে পিছন দিকে আটটা ফ্রেম এবং প্রত্যেকটা ফ্রেমের নীচে দেবার জন্য দু’টা করে মোট ষোলটা রূপার পা-দানি তৈরী করা হল। উপর এবং নীচের হুড়কাগুলোর মধ্যেকার লম্বা হুড়কাটা ফ্রেমের মাঝখান দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত চলে গেল। ফ্রেমগুলো সোনা দিয়ে মুড়ানো হল এবং হুড়কাগুলো ঢুকাবার জন্য সোনার কড়া তৈরী করে ফ্রেমে লাগিয়ে দেওয়া হল। হুড়কাগুলোও সোনা দিয়ে মুড়ানো হল। কারিগরেরা নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে একটা পর্দা তৈরী করল। ওস্তাদ কারিগর দিয়ে তার উপরে কারুবীদের ছবি বুনিয়ে নেওয়া হল। সেই পর্দার জন্য চারটা বাব্‌লা কাঠের খুঁটি তৈরী করা হল এবং খুঁটিগুলো সোনা দিয়ে মুড়ানো হল। সেই খুঁটিগুলোর জন্য কতগুলো সোনার হুক তৈরী করা হল এবং খুঁটিগুলো বসাবার জন্য চারটা রূপার পা-দানি তৈরী করা হল। তাম্বুর দরজার জন্যও সেলাই করে নক্‌শা তোলার মত করে নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে একটা পর্দা তৈরী করা হল। এই পর্দার জন্য হুকসুদ্ধ পাঁচটা খুঁটি তৈরী করা হল। খুঁটির মাথা ও তার বাঁধন-পাত সোনা দিয়ে মুড়ানো হল। খুঁটিগুলো বসাবার জন্য ব্রোঞ্জ দিয়ে পাঁচটা পা-দানি তৈরী করা হল। বৎসলেল বাব্‌লা কাঠ দিয়ে সাক্ষ্য-সিন্দুকটা তৈরী করলেন। সেটা আড়াই হাত লম্বা, দেড় হাত চওড়া এবং দেড় হাত উঁচু করে তৈরী করা হল। তার ভিতর এবং বাইরে খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়ানো হল এবং তার চার কিনারা ধরে রইল সোনার নক্‌শা। ছাঁচে ফেলে চারটা সোনার কড়া তৈরী করে তার চারটা পায়ায় লাগানো হল- এপাশে দু’টা, ওপাশে দু’টা। তারপর বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দু’টা ডাণ্ডা তৈরী করে তা সোনা দিয়ে মুড়ানো হল। সিন্দুকটা বয়ে নেবার জন্য তার দু’পাশের কড়ার মধ্য দিয়ে সেই দু’টা ডাণ্ডা ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তারপর বৎসলেল খাঁটি সোনা দিয়ে সিন্দুকের ঢাকনাটা তৈরী করলেন। সেটা লম্বায় হল আড়াই হাত এবং চওড়ায় দেড় হাত। ঢাকনাটার কিনারার সোনা পিটিয়ে দু’টি কারুবী তৈরী করা হল। কারুবী দু’টি সিন্দুকের দুই কিনারায় রইল। সেই কারুবী দু’টি ঢাকনা থেকে এমনভাবে তৈরী করা হল যাতে সমস্তটা মিলে মাত্র একটা জিনিসই হয়। তাদের ডানাগুলো উপর দিকে মেলে দেওয়া হল এবং সেই ডানার ছায়ার নীচে রইল সিন্দুকের ঢাকনাটা। কারুবীরা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে রইল এবং তাদের চোখ রইল ঢাকনাটার দিকে। বৎসলেল বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দুই হাত লম্বা, এক হাত চওড়া ও দেড় হাত উঁচু করে একটা টেবিল তৈরী করলেন। তিনি সেটা খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নিলেন এবং তার চার কিনারা ধরে রইল সোনার নক্‌শা। টেবিলটার চারপাশের কিনারায় চার আংগুল উঁচু করে একটা বেড় তৈরী করা হল। সেই বেড়ের উপর সোনা দিয়ে নক্‌শার কাজ করা হল। ছাঁচে ফেলে চারটা সোনার কড়া তৈরী করে টেবিলের চার কোণায় চারটা পায়ার উপরে লাগিয়ে দেওয়া হল। সেই কড়াগুলো টেবিলের কিনারায় ঐ উঁচু বেড়ের কাছাকাছি লাগানো হল যাতে টেবিলটা বয়ে নেবার জন্য কড়ার মধ্য দিয়ে ডাণ্ডা ঢুকানো যায়। টেবিলটা বয়ে নেবার ডাণ্ডাগুলো বাব্‌লা কাঠ দিয়ে তৈরী করে সোনা দিয়ে মুড়ানো হল। টেবিলের জিনিসপত্র খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরী করা হল। সেগুলো হল বড় ও ছোট থালা আর ঢালন-কোরবানীর সব কলসী ও পেয়ালা। খাঁটি সোনা দিয়ে বৎসলেল একটা বাতিদান তৈরী করলেন। তার নীচের অংশ এবং তা থেকে উঠে যাওয়া ডাঁটিটা সোনা পিটিয়ে তৈরী করা হল। তার ফুলের মত পেয়ালাগুলো, কুঁড়ি ও ফুল বাতিদান থেকে বের হয়ে আসল এবং সমস্তটা মিলে মাত্র একটা জিনিসই হল। বাতিদানের দু’পাশ দিয়ে তিনটা তিনটা করে মোট ছয়টা ডাল তৈরী করা হল। প্রথম ডালের মাঝে মাঝে ফুল ও কুঁড়িসুদ্ধ বাদাম ফুলের মত দেখতে তিনটা পেয়ালা তৈরী করা হল। তার পরের ডালেও তা-ই করা হল। বাতিদান থেকে বের হয়ে আসা ছয়টা ডাল একই রকম হল। বাতিদানের ডাঁটিটার মাঝে মাঝেও ফুল ও কুঁড়িসুদ্ধ বাদাম ফুলের মত দেখতে চারটা পেয়ালা তৈরী করা হল। বাতিদান থেকে বের হয়ে আসা মোট ছয়টা ডালের মধ্যে প্রথম দু’টি যেখানে মিশেছে তার নীচে রইল একটা কুঁড়ি, দ্বিতীয় দু’টির নীচে আর একটা কুঁড়ি এবং তৃতীয় দু’টির নীচে আর একটা কুঁড়ি। কুঁড়ি এবং ডাল সবই বাতিদান থেকে বের হয়ে আসল এবং সমস্তটা মিলে একটা জিনিসই হল। সবটাই খাঁটি সোনা পিটিয়ে তৈরী করা হল। খাঁটি সোনা দিয়ে সাতটা বাতি, সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা ও সল্‌তের পোড়া অংশ রাখবার জন্য কয়েকটা পাত্র তৈরী করা হল। ত্রিশ কেজি খাঁটি সোনা দিয়ে এই বাতিদানটা ও তার সব জিনিসপত্র তৈরী করা হল। বৎসলেল বাব্‌লা কাঠ দিয়ে চারকোনা বিশিষ্ট একটা ধূপগাহ্‌ তৈরী করলেন। এক হাত লম্বা, এক হাত চওড়া ও দুই হাত উঁচু করে ধূপগাহ্‌টা তৈরী করা হল। শিংসুদ্ধ গোটা ধূপগাহ্‌টা মাত্র একটা জিনিসই হল। ধূপগাহের উপরটা, তার চারপাশ এবং শিংগুলো খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হল। ধূপগাহ্‌টার চার কিনারা ধরে রইল সোনার নক্‌শা। ধূপগাহের দু’পাশে নক্‌শার নীচে দু’টা করে সোনার কড়া লাগানো হল যাতে তার ভিতর দিয়ে ডাণ্ডা ঢুকিয়ে সেটা বয়ে নেওয়া যায়। সেই ডাণ্ডাগুলো বাব্‌লা কাঠ দিয়ে তৈরী করে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নেওয়া হল। এছাড়া খোশবু জিনিস তৈরী করবার মত করে খাঁটি খোশবু ধূপ এবং পবিত্র অভিষেক-তেলও তৈরী করা হল। বৎসলেল পোড়ানো-কোরবানীর জন্য বাব্‌লা কাঠ দিয়ে পাঁচ হাত লম্বা, পাঁচ হাত চওড়া ও তিন হাত উঁচু করে একটা চারকোনা বিশিষ্ট কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন। কোরবানগাহ্‌টা তৈরী করবার সময় তার চার কোণার কাঠ এমনভাবে চেঁছে ফেলা হল যার ফলে চারটা শিং তৈরী হল। তাতে শিংসুদ্ধ কোরবানগাহ্‌টা একটা গোটা জিনিসই হল। তারপর ব্রোঞ্জ দিয়ে গোটা কোরবানগাহ্‌টা মুড়ে দেওয়া হল। কোরবানগাহের ছাই ফেলবার পাত্র, হাতা, কোরবানীর রক্ত রাখবার পেয়ালা, গোশ্‌ত তুলবার কাঁটা এবং আগুন রাখবার পাত্র- সবই ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী করা হল। কোরবানগাহের জন্য ব্রোঞ্জ দিয়ে একটা ঝাঁঝরি, অর্থাৎ একটা জালতি তৈরী করা হল। কোরবানগাহের চারপাশ থেকে বের হয়ে আসা তাকের নীচে এই ঝাঁঝরিটা রাখা হল। তাতে সেটা কোরবানগাহের নীচ থেকে উপরের দিকে মাঝামাঝি জায়গায় রইল। ডাণ্ডা ঢুকাবার জন্য ব্রোঞ্জের সেই ঝাঁঝরির চার কোণায় ব্রোঞ্জেরই চারটা কড়া তৈরী করা হল। বাব্‌লা কাঠ দিয়ে দু’টা ডাণ্ডা তৈরী করা হল এবং সেই ডাণ্ডা দু’টা ব্রোঞ্জ দিয়ে মুড়ানো হল। এই ডাণ্ডাগুলো কড়ার মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হল যাতে কোরবানগাহ্‌টা বয়ে নেবার সময় ডাণ্ডাগুলো কোরবানগাহের দু’পাশে থাকে। কোরবানগাহ্‌টা তক্তা দিয়ে তৈরী করা হল এবং তার ভিতরটা ফাঁকা রইল। ব্রোঞ্জ দিয়ে একটা গামলা তৈরী করা হল। যে সব মেয়েরা এবাদত-কাজের জন্য মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে আসত তাদের ব্রোঞ্জের আয়না দিয়ে সেই গামলাটা ও তার আসন তৈরী করা হল। এর পরে বৎসলেল আবাস-তাম্বুর চারদিকের উঠানের ব্যবস্থা করলেন। উঠানের দক্ষিণ দিকের একশো হাত জায়গার জন্য পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে কতগুলো পর্দা তৈরী করা হল। সেই পর্দাগুলো খাটাবার জন্য বিশটা খুঁটি তৈরী করা হল। খুঁটি বসাবার জন্য ব্রোঞ্জের বিশটা পা-দানি আর খুঁটির সংগে লাগাবার জন্য রূপার হুক আর বাঁধন-পাত তৈরী করা হল। উঠানের উত্তর দিকের একশো হাত জায়গার জন্যও বিশটা খুঁটি, খুঁটি বসাবার জন্য ব্রোঞ্জের বিশটা পা-দানি আর খুঁটির সংগে লাগাবার জন্য রূপার হুক আর বাঁধন-পাত তৈরী করা হল। উঠানের পশ্চিম দিকের পঞ্চাশ হাত জায়গার জন্য কতগুলো পর্দা, দশটি খুঁটি, দশটা পা-দানি এবং খুঁটির সংগের রূপার হুক আর বাঁধন-পাত তৈরী করা হল। উঠানের পূর্ব দিকটাও হল পঞ্চাশ হাত। উঠানের চারপাশের সমস্ত পর্দা পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে তৈরী করা হল। খুঁটি বসাবার পা-দানিগুলো ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী করা হল। খুঁটির সংগে লাগাবার হুক আর বাঁধন-পাত তৈরী করা হল রূপা দিয়ে। খুঁটির মাথাও রূপা দিয়ে মুড়ানো হল। উঠানের সব খুঁটিতে রূপার বাঁধন-পাত লাগানো হল। উঠানের দরজার জন্যও একটা পর্দা তৈরী করা হল। এটা নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা ও পাকানো মসীনা সুতার একটা নক্‌শা করা জিনিস। এই পর্দা বিশ হাত লম্বা এবং উঠানের অন্যান্য পর্দার মত পাঁচ হাত উঁচু করে তৈরী করা হল। এই পর্দার জন্য চারটা খুঁটি ও চারটা ব্রোঞ্জের পা-দানি তৈরী করা হল। খুঁটির হুক ও বাঁধন-পাত রূপা দিয়ে তৈরী করা হল। খুঁটির মাথাও রূপা দিয়ে মুড়ানো হল। আবাস-তাম্বুর এবং উঠানের পর্দার গোঁজগুলো ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী করা হল। আবাস-তাম্বু, অর্থাৎ সাক্ষ্য-তাম্বুটা তৈরী করতে যে সব জিনিস লেগেছিল মূসার হুকুমে প্রথম থেকেই ইমাম হারুনের ছেলে ঈথামরের পরিচালনায় লেবীয়রা তার হিসাব রেখেছিল। মাবুদ মূসাকে যা তৈরী করতে হুকুম দিয়েছিলেন সেই হুকুম অনুসারে এহুদা-গোষ্ঠীর ঊরির ছেলে বৎসলেল সব কিছু তৈরী করেছিলেন। তিনি ছিলেন হূরের নাতি। বৎসলেলকে সাহায্য করেছিলেন দান-গোষ্ঠীর অহীষামকের ছেলে অহলীয়াব। তিনি ছিলেন হাতের কাজ ও নমুনা তৈরীর কাজে ওস্তাদ। এছাড়া তিনি নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং মসীনা সুতা দিয়ে নক্‌শা তুলবার কাজেও ওস্তাদ ছিলেন। দোলন-কোরবানীর মোট আটশো সাতাত্তর কেজি তিনশো গ্রাম সোনা এই পবিত্র তাম্বু-ঘরের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এই মাপ ছিল ধর্মীয় মাপ। তার মধ্যে তিন হাজার কেজি রূপা দিয়ে আবাস-তাম্বু ও পর্দার জন্য পা-দানি তৈরী করা হয়েছিল। এক একটা পা-দানির জন্য ত্রিশ কেজি করে রূপা দিয়ে মোট একশোটা পা-দানি তৈরী করা হয়েছিল। আর বাকী সতেরো কেজি সাড়ে সাতশো গ্রাম রূপা খুঁটির হুক, খুঁটির মাথা মুড়ানো এবং খুঁটির বাঁধন-পাতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। দোলন-কোরবানী থেকে দুই হাজার একশো চব্বিশ কেজি ব্রোঞ্জ পাওয়া গিয়েছিল। তা দিয়ে তারা মিলন-তাম্বুর দরজার জন্য পা-দানি, ব্রোঞ্জের কোরবানগাহ্‌, ব্রোঞ্জের ঝাঁঝরি ও সমস্ত বাসন-কোসন, চারদিকের উঠানের ও সেখানকার দরজার জন্য পা-দানি এবং আবাস-তাম্বু ও চারদিকের উঠানের সমস্ত গোঁজ তৈরী করেছিল। পবিত্র তাম্বু-ঘরে এবাদত-কাজের সময় পরবার জন্য তারা নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা দিয়ে পোশাক বুনল। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেই অনুসারেই তারা হারুনের জন্য ইমামের কাজের পবিত্র পোশাক তৈরী করল। সোনা আর নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে বৎসলেল এফোদটা তৈরী করলেন। তারা সোনা পিটিয়ে পাতলা পাত তৈরী করল এবং তা সুতার মত করে কেটে নিল যাতে নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং মসীনা সুতার সংগে সোনার সুতাও ব্যবহার করা যায়। এটা একটা ওস্তাদী হাতের কাজ। এফোদের কাঁধের অংশটা বেঁধে রাখবার জন্য ফিতা তৈরী করে এফোদের দুই কোণায় জুড়ে দেওয়া হল। এফোদের সংগে জোড়া লাগানো কোমরের পটিটাও দেখতে এফোদের মতই হল। সেটাও সোনা এবং নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে তৈরী করা হল। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই সব কিছু করা হল। তারপর বুক-ঢাকনটা তৈরী করা হল। এটা একটা ওস্তাদী হাতের কাজ। এফোদের মতই সেটা সোনা এবং নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা এবং পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে তৈরী করা হল। এটা লম্বায় আধ হাত ও চওড়ায় আধ হাত একটা চারকোনা বিশিষ্ট দুই ভাঁজ করা কাপড়। এর উপর তারা চার সারি দামী পাথর বসাল। প্রথম সারিতে রইল সার্দীয়মণি, পীতমণি ও পান্না; দ্বিতীয় সারিতে চুণি, নীলকান্তমণি ও হীরা; তৃতীয় সারিতে গোমেদ, অকীকমণি ও পদ্মরাগ, আর চতুর্থ সারিতে পোখরাজ, বৈদূর্যমণি ও সূর্যকান্তমণি। পাথরগুলো সোনার জালির উপর বসানো হল। ইসরাইলের বারোজন ছেলের জন্য মোট বারোটা পাথর বসানো হল। তার প্রত্যেকটির মধ্যে বারোটা গোষ্ঠীর একটি করে নাম খোদাই করা হয়েছিল, যেমন করে সীলমোহর খোদাই করা হয়। বুক-ঢাকনের জন্য তারা খাঁটি সোনা দড়ির মত পাকিয়ে দু’টা শিকল তৈরী করল। তারা দু’টা সোনার জালি ও দু’টা সোনার কড়া তৈরী করল এবং কড়া দু’টা বুক-ঢাকনের উপরের দুই কোণায় লাগিয়ে দিল, আর শিকল দু’টা সেই কড়া দু’টার সংগে আট্‌কে দিল। এফোদের সামনের দিকে কাঁধের ফিতার উপর সোনার জালির সংগে শিকলের অন্য দিকটা আট্‌কে দেওয়া হল। তা ছাড়া তারা আরও দু’টা সোনার কড়া তৈরী করে বুক-ঢাকনের অন্য দুই কোণায় লাগিয়ে দিল। এই দু’টা রইল এফোদের কাছে বুক-ঢাকনের তলায়। তা ছাড়া তারা আরও দু’টা সোনার কড়া তৈরী করে এফোদের কাঁধের ফিতার সোজাসুজি নীচের দিকে এফোদের কোমরের পটির ঠিক উপরে যে সেলাই আছে তার কাছে লাগিয়ে দিল। তারপর বুক-ঢাকনের তলার কড়ার সংগে কোমরের পটির কড়াটা নীল দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। তাতে বুক-ঢাকনটা এফোদের উপর ঠিক জায়গায় রইল। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই সব কিছু করা হল। এফোদের নীচে পরবার লম্বা কোর্তাটার পুরোটাই তারা নীল সুতা দিয়ে বুনে নিল। মাথা ঢুকাবার জন্য কোর্তার মাঝখানটা খোলা রইল এবং যাতে সেটা ছিঁড়ে না যায় সেইজন্য তার চারদিকে পটির মত করে বুনে নেওয়া হল। নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের পাকানো সুতা দিয়ে ডালিম ফল তৈরী করে এই কোর্তাটার নীচের মুড়ির চারপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তারপর খাঁটি সোনা দিয়ে ঘণ্টা তৈরী করে সেই ডালিমগুলোর ফাঁকে ফাঁকে লাগিয়ে দেওয়া হল। এবাদত-কাজের সময় পরবার এই কোর্তাটার নীচের সমস্ত মুড়ি ধরে রইল একটা করে ডালিম আর একটা করে ঘণ্টা। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই সব কিছু করা হল। হারুন ও তাঁর ছেলেদের জন্য মসীনা সুতা দিয়ে কোর্তা বোনা হল। তাদের পাগড়ি ও মাথার টুপি মসীনা সুতা দিয়ে তৈরী করা হল আর জাংগিয়া তৈরী করা হল পাকানো মসীনা সুতা দিয়ে। তাদের কোমর-বাঁধনি পাকানো মসীনা সুতা এবং নীল, বেগুনে ও লাল রংয়ের সুতা দিয়ে তৈরী করা হল। এটা একটা নক্‌শা করা জিনিস। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই সব কিছু করা হল। তারপর তারা খাঁটি সোনা দিয়ে একটা পাত তৈরী করল। এটা একটা পবিত্র তাজ। সীলমোহর খোদাই করবার মত করে সেই পাতের উপর এই কথা খোদাই করা হল, “মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র।” মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেই অনুসারেই সেটা তারা নীল দড়ি দিয়ে পাগড়ির সংগে বেঁধে দিল। এই রকম করেই আবাস-তাম্বুর, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর সব কিছু তৈরীর কাজ শেষ হল। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই বনি-ইসরাইলরা সব কাজ করল। তারপর তারা সেই আবাস-তাম্বুর জন্য তৈরী করা সব কিছু মূসার কাছে নিয়ে গেল। সেগুলো হল আবাস-তাম্বু ও তার সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম, আংটা, ফ্রেম, হুড়কা, খুঁটি ও পা-দানি; লাল রং করা ভেড়ার চামড়া ও শুশুকের চামড়ার ছাউনি দু’টা এবং মহাপবিত্র স্থান আড়াল করবার পর্দা; ডাণ্ডাসুদ্ধ সাক্ষ্য-সিন্দুক এবং তার ঢাকনা; টেবিল ও তার জিনিসপত্র এবং মাবুদের পবিত্র-রুটি; বাতির সারি সুদ্ধ খাঁটি সোনার বাতিদান এবং তার জিনিসপত্র ও আলো জ্বালাবার তেল; সোনার ধূপগাহ্‌, অভিষেকের তেল, খোশবু ধূপ ও আবাস-তাম্বুর দরজার পর্দা; ব্রোঞ্জের ঝাঁঝরি ও ব্রোঞ্জের কোরবানগাহ্‌, তার ডাণ্ডাগুলো এবং তার সব বাসন-কোসন; গামলা ও তা বসাবার আসন; উঠানের খুঁটি, পা-দানি ও তার পর্দা এবং উঠানে ঢুকবার দরজার পর্দা; উঠানের পর্দার গোঁজ ও দড়ি; আবাস-তাম্বুর, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর সব সাজ-সরঞ্জাম; পবিত্র তাম্বু-ঘরে এবাদত-কাজের জন্য পোশাক, অর্থাৎ ইমাম হারুনের জন্য বুনানো পবিত্র পোশাক এবং তাঁর ছেলেদের ইমাম হিসাবে এবাদত-কাজের পোশাক। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই বনি-ইসরাইলরা সমস্ত কাজ করেছিল। মূসা তাদের সব কাজ দেখে বুঝলেন যে, মাবুদের হুকুম মতই সব কাজ করা হয়েছে। এতে মূসা বনি-ইসরাইলদের দোয়া করলেন। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে তুমি আবাস-তাম্বুটা, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুটা দাঁড় করাবে। তার মধ্যে সাক্ষ্য-সিন্দুকটা রেখে তার পর্দা দিয়ে সেটা আড়াল করে দেবে। টেবিলটাও ভিতরে এনে তার উপর যা রাখবার তা সাজিয়ে রাখবে। পরে বাতিদানটা এনে বাতিগুলো জ্বালিয়ে দেবে। সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে সোনার ধূপগাহ্‌টা রাখবে এবং আবাস-তাম্বুর দরজায় পর্দা টাংগাবে। আবাস-তাম্বুর, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে পোড়ানো-কোরবানগাহ্‌টা রাখবে। এই কোরবানগাহ্‌ এবং মিলন-তাম্বুর মাঝামাঝি জায়গায় গামলাটা রেখে তাতে পানি রাখবে। তারপর উঠানের চারপাশ ঘিরে পর্দা টাংগাবে এবং তার দরজায়ও পর্দা দেবে। “পরে অভিষেক-তেল নেবে এবং আবাস-তাম্বু ও তার মধ্যেকার সব কিছুর উপরে সেই তেল দিয়ে তা পবিত্র করে নেবে। তাতে সেগুলো পবিত্র জিনিস হবে। সব বাসন-কোসন সুদ্ধ পোড়ানো-কোরবানগাহ্‌টার উপরও অভিষেক-তেল দিয়ে কোরবানগাহ্‌টা পাক-পবিত্র করে নেবে। তাতে সেটা মহাপবিত্র জিনিস হবে। আসনসুদ্ধ গামলাটার উপর অভিষেক-তেল দিয়ে তা পাক-পবিত্র করবে। “তারপর হারুন ও তাঁর ছেলেদের মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে এনে পানি দিয়ে তাদের শরীর ধোয়াবে। পরে হারুনকে পবিত্র পোশাকগুলো পরিয়ে অভিষেক করে পাক-পবিত্র করবে যাতে সে আমার ইমাম হতে পারে। হারুনের ছেলেদের কাছে এনে তাদের ইমামের কোর্তা পরিয়ে দেবে। তারপর তাদের পিতার মত করে তাদেরও অভিষেক করবে যাতে তারা আমার ইমাম হতে পারে। এই অভিষেক দ্বারা যে ইমাম-পদের সৃষ্টি হবে তা বংশের পর বংশ ধরে চলতে থাকবে।” মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন মূসা সেইমতই সব কিছু করলেন। দ্বিতীয় বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে আবাস-তাম্বুটা দাঁড় করানো হল। সেটা দাঁড় করাতে গিয়ে মূসা পা-দানিগুলো বসিয়ে ফ্রেমগুলো খাড়া করলেন। তিনি হুড়কাগুলো লাগালেন এবং খুঁটিগুলো বসালেন। তারপর মাবুদের হুকুম মত তিনি আবাস-তাম্বুর উপরে ছাগলের লোম দিয়ে বুনানো টুকরাটি বিছিয়ে দিলেন এবং তার উপর দিলেন ছাউনি দু’টা। তারপর মূসা সাক্ষ্য-ফলক দু’টা নিয়ে সিন্দুকের ভিতরে রাখলেন এবং সিন্দুকটার গায়ে ডাণ্ডা লাগালেন আর তার উপরে রাখলেন তার ঢাকনাখানা। তারপর মাবুদের হুকুম মত তিনি সিন্দুকটা আবাস-তাম্বুর ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং তার পর্দাটা ঝুলিয়ে সেটা আড়াল করে রাখলেন। তারপর তিনি আবাস-তাম্বুর দরজায় পর্দা টাংগালেন। আবাস-তাম্বুর, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে তিনি পোড়ানো-কোরবানগাহ্‌টা রাখলেন এবং মাবুদের হুকুম মত তিনি তার উপর পোড়ানো-কোরবানীর এবং শস্য-কোরবানী দিলেন। সেই কোরবানগাহ্‌ এবং মিলন-তাম্বুর মাঝামাঝি জায়গায় তিনি গামলাটা বসালেন এবং হাত-পা ধোয়ার জন্য তাতে পানি রাখলেন। সেই গামলার পানিতেই মূসা, হারুন ও তাঁর ছেলেরা হাত-পা ধুতেন। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই মিলন-তাম্বুতে ঢুকবার আগে কিংবা কোরবানগাহের কাছে যাবার আগে তাঁরা তাঁদের হাত-পা ধুয়ে নিতেন। কোরবানগাহ্‌ ও আবাস-তাম্বুর চারপাশে তিনি পর্দা খাটিয়ে উঠানের ব্যবস্থা করলেন এবং তার দরজায় পর্দা দিলেন। এইভাবে মূসা তাঁর কাজ শেষ করলেন। তারপর মেঘ এসে মিলন-তাম্বুটা ঢেকে ফেলল এবং মাবুদের মহিমায় আবাস-তাম্বুটা পূর্ণ হয়ে গেল। আবাস-তাম্বুটা, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুটা মেঘে ঢাকা এবং মাবুদের মহিমায় পূর্ণ ছিল বলে মূসা সেখানে ঢুকতে পারলেন না। বনি-ইসরাইলদের সারা যাত্রাপথে যখনই আবাস-তাম্বুর উপর থেকে মেঘ উঠে যেত কেবল তখনই তারা বের হয়ে পড়ত; কিন্তু মেঘ উঠে না গেলে তারা বের না হয়ে মেঘ উঠবার জন্য অপেক্ষা করে থাকত। বনি-ইসরাইলদের সমস্ত যাত্রাপথে দিনের বেলায় তাদের চোখের সামনে আবাস-তাম্বুর উপরে থাকত মাবুদের এই মেঘ আর রাতের বেলায় সেই মেঘের মধ্যে থাকত আগুন। “যদি সে গরু দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দিতে চায় তবে সেটা হতে হবে একটা নিখুঁত ষাঁড়। মাবুদ যাতে তার উপর সন্তুষ্ট হন সেইজন্য তাকে সেই ষাঁড়টা মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে উপস্থিত করতে হবে। পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আনা সেই ষাঁড়টার মাথার উপরে সে তার হাত রাখবে; আর সেটা তার জায়গায় তার গুনাহ্‌ ঢাকবার জন্য কবুল করা হবে। তারপর মাবুদের সামনে সে সেই ষাঁড়টা জবাই করবে আর হারুনের যে ছেলেরা ইমাম তারা তার রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে রাখা কোরবানগাহ্‌টার চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। কোরবানীদাতা ঐ পোড়ানো-কোরবানীর ষাঁড়টার চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তার গোশ্‌ত টুকরা টুকরা করে কাটবে। ইমাম হারুনের ছেলেরা সেই কোরবানগাহের উপরে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর কাঠ সাজাবে। তারপর তারা কোরবানগাহের উপরকার জ্বলন্ত কাঠের উপরে সেই ষাঁড়ের মাথা, চর্বি ও গোশ্‌তের টুকরাগুলো সাজাবে। কোরবানীদাতা সেটার পা এবং পেটের ভিতরের সমস্ত অংশ পানিতে ধুয়ে দেবে এবং ইমাম সেগুলো সুদ্ধ গোটা ষাঁড়টাই কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে ফেলবে। এটা পোড়ানো-কোরবানী, আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। “যদি ভেড়া বা ছাগল দিয়ে এই পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া হয় তবে সেটা হতে হবে একটা নিখুঁত পুরুষ ভেড়া বা ছাগল। কোরবানীদাতা সেটা কোরবানগাহের উত্তর পাশে নিয়ে গিয়ে মাবুদের সামনে জবাই করবে, আর হারুনের যে ছেলেরা ইমাম তারা তার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। কোরবানীদাতা সেটা টুকরা টুকরা করে কাটবে আর ইমাম তার চর্বি, মাথা ও গোশ্‌তের টুকরাগুলো নিয়ে কোরবানগাহের উপরকার জ্বলন্ত কাঠের উপর সাজাবে। কোরবানীদাতা সেটার পা ও পেটের ভিতরের অংশগুলো পানিতে ধুয়ে দেবে আর ইমাম সেগুলো সুদ্ধ গোটা পশুটাই কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে ফেলবে। এটা পোড়ানো-কোরবানী, আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। “মাবুদের উদ্দেশে এই পোড়ানো-কোরবানী যদি কোন পাখী দিয়ে দেওয়া হয় তবে কোরবানীদাতাকে একটা ঘুঘু বা কবুতর আনতে হবে। ইমাম সেটা কোরবানগাহের কাছে নিয়ে যাবে এবং তার মাথাটা মুচ্‌ড়ে গলা থেকে আলাদা করে নিয়ে কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দেবে আর রক্তটা চেপে বের করে কোরবানগাহের একপাশের গায়ের উপর ফেলবে। কোরবানীদাতা পাখীটার গলার থলি ও তার মধ্যেকার সব কিছু কোরবানগাহের পূর্ব দিকে ছাইয়ের গাদায় ফেলে দেবে। সে ডানা ধরে পাখীটা এমন ভাবে ছিঁড়বে যেন সেটা দুই টুকরা হয়ে না যায়। তারপর ইমাম সেটা নিয়ে কোরবানগাহের উপরকার জ্বলন্ত কাঠের উপর পুড়িয়ে দেবে। এটা পোড়ানো-কোরবানী, আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। এই শস্য-কোরবানীর জিনিসের বাদবাকী যা থাকবে তা হারুন ও তার ছেলেদের পাওনা হবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে-দেওয়া সমস্ত কোরবানীর মধ্যে শস্য-কোরবানীর এই বাকী অংশটুকু মহাপবিত্র জিনিস। “যদি কেউ তন্দুরে সেঁকা কোন জিনিস দিয়ে শস্য-কোরবানী করতে চায় তবে সেটা হতে হবে খামিহীন মিহি ময়দা দিয়ে তৈরী। সেটা তেলের ময়ান দেওয়া পিঠা হতে পারে কিংবা তেল লাগানো চাপাটি হতে পারে। সেই শস্য-কোরবানী যদি তাওয়ায় ভাজা কোন জিনিস হয় তবে সেটা হতে হবে তেলের ময়ান দেওয়া খামিহীন মিহি ময়দা দিয়ে তৈরী। তারপর তা টুকরা টুকরা করে তার উপর তেল ঢেলে দিতে হবে; এটা একটা শস্য-কোরবানী। সেই শস্য-কোরবানী যদি কড়াইতে ভাজা কোন জিনিস হয় তবে সেটা হতে হবে তেল ও মিহি ময়দা দিয়ে তৈরী। মাবুদের উদ্দেশে শস্য-কোরবানীর জন্য এই সব জিনিস এনে ইমামের হাতে দিতে হবে আর ইমাম তা কোরবানগাহের কাছে নিয়ে যাবে। শস্য-কোরবানীর যে অংশটা পুরো কোরবানীর বদলে দেওয়া হবে ইমাম তা আলাদা করে নিয়ে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দেবে। এটা আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার গন্ধে মাবুদ খুশী হন। এই শস্য-কোরবানীর জিনিসের বাদবাকী যা থাকবে তা হারুন ও তার ছেলেদের পাওনা হবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুন্তেদেওয়া সমস্ত কোরবানীর মধ্যে শস্য-কোরবানীর এই বাকী অংশটুকু মহাপবিত্র জিনিস। “মাবুদের উদ্দেশে শস্য-কোরবানীর জন্য তারা যা কিছু আনবে তা যেন খামি ছাড়া তৈরী করা হয়। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসের মধ্যে খামি বা মধু দেওয়া চলবে না। প্রথমে তোলা ফসল কোরবানী করবার জন্য তারা খামি ও মধু মাবুদের কাছে নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু যে কোরবানীর গন্ধে তিনি খুশী হন এমন কোরবানী হিসাবে খামি ও মধু কোরবানগাহের উপর পোড়ানো চলবে না। শস্য-কোরবানীর জন্য যে সব জিনিস আনা হবে তার মধ্যে লবণ দিতে হবে। বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌ তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন তার দরুন শস্য-কোরবানী থেকে লবণ বাদ দেওয়া চলবে না; তাদের সমস্ত কোরবানীর মধ্যে লবণ দিতেই হবে। “মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী করবার জন্য যদি তারা প্রথমে তোলা ফসলের মধ্য থেকে কোন শস্য আনে তবে সেই নতুন শস্য মোটা করে ভেংগে নিয়ে আগুনে ঝল্‌সে আনতে হবে। তার উপর তেল ঢেলে দিতে হবে এবং লোবান রাখতে হবে; এটা একটা শস্য-কোরবানী। সেই ভেংগে নেওয়া শস্য ও তেলের যে অংশটা পুরো কোরবানীর বদলে দেওয়া হবে ইমাম সেই অংশটা এবং সমস্ত লোবান নিয়ে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে পুড়িয়ে ফেলবে। “যদি কেউ মাবুদের উদ্দেশে কোন যোগাযোগ-কোরবানী দিতে চায় আর তার কোরবানীর পশুটা যদি গরুর পাল থেকে নেওয়া হয়, তবে সেটা স্ত্রী বা পুরুষ যা-ই হোক না কেন তার গায়ে যেন কোন খুঁত না থাকে। কোরবানীর জন্য আনা সেই পশুটার মাথার উপর কোরবানীদাতা তার হাত রাখবে এবং মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে সেটা জবাই করবে। তারপর হারুনের ছেলেরা, অর্থাৎ ইমামেরা তার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জন্য কোরবানীদাতাকে এই যোগাযোগ-কোরবানীর পশু থেকে কতগুলো অংশ বের করে ইমামকে দিতে হবে। এই অংশগুলো হল সেই পশুর পেটের ভিতরের বিভিন্ন অংশের উপরকার চর্বি এবং সেগুলোর সংগে জড়ানো চর্বি, কিড্‌নি দু’টি ও তার সংগে জড়ানো কোমরের কাছের চর্বি এবং কিড্‌নির সংগে বের করে আনা কলিজার উপরের অংশ। কোরবানগাহের জ্বলন্ত কাঠের উপরে যেখানে পোড়ানো-কোরবানী জ্বলতে থাকবে তার উপরে হারুনের ছেলেরা এগুলো রেখে পুড়িয়ে ফেলবে। এটা আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। “মাবুদের উদ্দেশে যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য যদি কেউ পাল থেকে কোন ভেড়া বা ছাগল নিয়ে আসে তবে সেটা স্ত্রী বা পুরুষ যা-ই হোক না কেন তার গায়ে যেন কোন খুঁত না থাকে। কোরবানীর জন্য যদি সে একটা ভেড়ার বাচ্চা আনে তবে তাকে সেটা মাবুদের সামনে উপস্থিত করতে হবে। সেই ভেড়ার বাচ্চার মাথার উপরে সে তার হাত রাখবে এবং মিলন-তাম্বুর সামনে সেটা কাটবে। তারপর হারুনের ছেলেরা তার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জন্য কোরবানীদাতাকে এই যোগাযোগ-কোরবানীর পশু থেকে কতগুলো অংশ বের করে ইমামকে দিতে হবে। এই অংশগুলো হল সেই পশুটার চর্বি, মেরুদণ্ডের নীচ থেকে কেটে নেওয়া চর্বিভরা গোটা লেজটা, পেটের ভিতরের বিভিন্ন অংশের উপরকার চর্বি এবং সেগুলোর সংগে জড়ানো চর্বি, কিড্‌নি দু’টি ও তার সংগে জড়ানো কোমরের কাছের চর্বি এবং কিড্‌নির সংগে বের করে আনা কলিজার উপরের অংশ। ইমাম এগুলো নিয়ে কোরবানী দেওয়া খাবার হিসাবে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে ফেলবে। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা। “যদি সে এই কোরবানীর জন্য একটা ছাগল নিয়ে আসে তবে সেটা তাকে মাবুদের সামনে উপস্থিত করতে হবে। তার মাথার উপরে সে হাত রাখবে এবং মিলন-তাম্বুর সামনে সেটা জবাই করবে। এর পর হারুনের ছেলেরা তার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। কোরবানীদাতা যে পশুটা কোরবানী দেবে তা থেকে কতগুলো অংশ তাকে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জন্য বের করে ইমামকে দিতে হবে। এই অংশগুলো হল সেই পশুটার পেটের ভিতরের বিভিন্ন অংশের উপরকার চর্বি এবং সেগুলোর সংগে জড়ানো চর্বি, কিড্‌নি দু’টি ও তার সংগে জড়ানো কোমরের কাছের চর্বি এবং কিড্‌নির সংগে বের করে আনা কলিজার উপরের অংশ। ইমাম এগুলো নিয়ে কোরবানী দেওয়া খাবার হিসাবে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে ফেলবে। এটা আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। কোরবানী করা পশুর চর্বির সমস্তটাই মাবুদের। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন তোমরা কোন চর্বি বা রক্ত খাবে না। এটাই হবে বংশের পর বংশ ধরে তোমাদের জন্য একটা চিরস্থায়ী নিয়ম।” “কোন মহা-ইমাম যদি ঐরকম কোন অন্যায় করে ফেলে যার দরুন সমস্ত লোক দোষী হয়, তবে তার জন্য তাকে গুনাহের কোরবানী হিসাবে মাবুদের কাছে একটা নিখুঁত ষাঁড় নিয়ে আসতে হবে। মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে সেটা তাকে উপস্থিত করতে হবে। সে তার মাথার উপরে হাত রাখবে এবং মাবুদের সামনে সেটা জবাই করবে। তারপর মহা-ইমাম সেই ষাঁড়ের কিছুটা রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর মধ্যে যাবে। সে সেই রক্তে নিজের আংগুল ডুবিয়ে কিছুটা রক্ত মাবুদের সামনে পবিত্র স্থানের পর্দার দিকে সাতবার ছিটিয়ে দেবে। এর পর সে কিছু রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর মধ্যে মাবুদের সামনে যে খোশবু ধূপগাহ্‌ আছে তার শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে। বাকী রক্তটা নিয়ে সে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে যে পোড়ানো-কোরবানগাহ্‌ আছে তার গোড়ায় ঢেলে দেবে। গুনাহের কোরবানীর জন্য আনা সেই ষাঁড়ের সমস্ত চর্বি সে বের করে নেবে। এই চর্বি হল পেটের ভিতরের অংশগুলোর উপরকার চর্বি এবং সেগুলোর সংগে জড়ানো চর্বি, কিড্‌নি দু’টি ও তার সংগে জড়ানো কোমরের কাছের চর্বি এবং কিড্‌নির সংগে বের করে আনা কলিজার উপরের অংশ। যোগাযোগ-কোরবানীর গরুর মধ্য থেকে চর্বি বের করবার মত করে এই কোরবানীর ষাঁড়ের চর্বিও বের করে নিতে হবে। তারপর ইমাম সেই চর্বিগুলো নিয়ে পোড়ানো-কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দেবে। “গোটা ইসরাইল জাতি যদি মনে অন্যায়ের ইচ্ছা না রেখে মাবুদের নিষেধ করা কোন কিছু করে ফেলে তবে তারা তা না জানলেও দোষী হবে। যখন তারা জানতে পারবে যে, তারা অন্যায় করেছে তখন গুনাহের কোরবানীর জন্য তাদের সকলের তরফ থেকে একটা ষাঁড় এনে মিলন-তাম্বুর সামনে উপস্থিত করতে হবে। তারপর বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতারা মাবুদের সামনে সেই ষাঁড়ের মাথার উপর হাত রাখবে। ইমাম মাবুদের সামনেই সেটা জবাই করবে। তারপর মহা-ইমাম সেই ষাঁড়ের কিছুটা রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর মধ্যে যাবে। সেই রক্তে নিজের আংগুল ডুবিয়ে কিছুটা রক্ত মাবুদের সামনে পবিত্র স্থানের পর্দার দিকে সাত বার ছিটিয়ে দেবে। তারপর সে কিছু রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর মধ্যে মাবুদের সামনে যে খোশবু ধূপগাহ্‌ আছে তার শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে। তারপর মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে যে পোড়ানো-কোরবানগাহ্‌ আছে তার গোড়ায় সে বাকী রক্ত ঢেলে দেবে। ইমাম সেই ষাঁড়ের বাদবাকী অংশ ছাউনির বাইরে নিয়ে গুনাহের কোরবানীর অন্য ষাঁড়টার অংশগুলোর মত করেই পুড়িয়ে ফেলবে। এটাই হল গোটা ইসরাইল জাতির গুনাহের জন্য কোরবানী। “কোন নেতা যদি মনে অন্যায়ের ইচ্ছা না রেখে তার মাবুদ আল্লাহ্‌র নিষেধ করা কোন কিছু করে ফেলে তবে সে দোষী হবে। যখন তাকে তার অন্যায় দেখিয়ে দেওয়া হবে তখন কোরবানী দেবার জন্য তাকে একটা নিখুঁত পুরুষ ছাগল আনতে হবে। সে ঐ ছাগলটার মাথার উপরে হাত রাখবে এবং পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটবার জায়গায় মাবুদের সামনে সেটা জবাই করবে; এটা একটা গুনাহের কোরবানী। তারপর ইমাম গুনাহের কোরবানীর জন্য আনা পশুটার কিছু রক্ত আংগুলে করে নিয়ে পোড়ানো-কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে; বাকী রক্ত সে কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দেবে। যোগাযোগ-কোরবানীর পশুর চর্বির মত করেই এর সমস্ত চর্বি কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দিতে হবে। এইভাবে ইমাম সেই নেতার অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে আর তাতে তাকে মাফ করা হবে। “ইসরাইলীয়দের মধ্যে অন্য কোন লোক যদি মনে অন্যায়ের ইচ্ছা না রেখে মাবুদের নিষেধ করা কোন কিছু করে ফেলে তবে সে দোষী হবে। যখন তাকে তার অন্যায় দেখিয়ে দেওয়া হবে তখন সেই অন্যায়ের জন্য কোরবানী হিসাবে তাকে একটা নিখুঁত ছাগী আনতে হবে। সে সেই গুনাহের কোরবানীর ছাগীটার মাথার উপর হাত রাখবে এবং পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটবার জায়গায় সেটা জবাই করবে। তারপর ইমাম আংগুলে করে তার কিছুটা রক্ত নিয়ে পোড়ানো-কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে; বাকী রক্ত সে কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দেবে। যোগাযোগ-কোরবানীর পশুর চর্বি বের করবার মত করে সে এই কোরবানীর পশুর সমস্ত চর্বি বের করে নিয়ে তা কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দেবে। এর গন্ধে মাবুদ খুশী হন। এইভাবে ইমাম সেই লোকের অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে এবং তাতে তাকে মাফ করা হবে। “গুনাহের কোরবানীর জন্য যদি কেউ ভেড়ার বাচ্চা আনে, তবে সেটা নিখুঁত এবং স্ত্রীজাতের হতে হবে। তার মাথার উপর সে হাত রাখবে এবং পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটবার জায়গায় সে গুনাহের জন্য কোরবানীর ভেড়ীটা জবাই করবে। তারপর ইমাম তার আংগুলে করে গুনাহের কোরবানীর ভেড়ীটা থেকে কিছু রক্ত নিয়ে পোড়ানো-কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে; বাকী রক্ত সে কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দেবে। যোগাযোগ-কোরবানীর ভেড়ার চর্বি বের করবার মত করেই সে এর সমস্ত চর্বি বের করে নেবে। তারপর মাবুদের উদ্দেশে আগুন্তেদেওয়া জিনিসের উপরে এই চর্বিও সে কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে ফেলবে। এইভাবে ইমাম সেই লোকের অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে এবং তাতে তাকে মাফ করা হবে। “নিজের দেখা বা শোনা কোন ব্যাপারের বিচারের সময়ে সাক্ষ্য দেবার সুযোগ পেয়েও যদি কেউ চুপ করে থাকে তবে সেটা তার পক্ষে গুনাহ্‌ হবে এবং সেই অন্যায়ের জন্য তাকে দায়ী করা হবে। “যদি কেউ না জেনে কোন নাপাক কিছু ছুঁয়ে ফেলে তবে সে নিজেও নাপাক হবে এবং দোষী হবে, সেটা কোন নাপাক বুনো বা পোষা প্রাণীর মৃতদেহই হোক কিংবা যে কোন ছোটখাটো প্রাণীর মৃতদেহই হোক। “যা মানুষকে নাপাক করে মানুষের শরীরের এমন নাপাক কোন কিছু যদি কেউ না জেনে ছুঁয়ে ফেলে তবে তা জানবার পরে সে দোষী হবে। “অসাবধান হয়ে কসম খেয়ে ফেলতে পারে এমন কোন বিষয়ে কেউ যদি চিন্তা না করে ভাল-মন্দ কিছু করবার কসম খেয়ে বসে তবে সেটা না জেনে করলেও তা জানবার পরে সে দোষী হবে। “এই সব অন্যায়ের কোন একটা করে যদি কেউ দোষী হয় তবে যে অন্যায় সে করেছে তা তাকে স্বীকার করতে হবে। তখন সেই অন্যায়ের জরিমানা হিসাবে তাকে মাবুদের উদ্দেশে গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা বাচ্চা-ভেড়ী কিংবা বাচ্চা-ছাগী নিয়ে আসতে হবে, আর ইমাম তার অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। “যদি সে বাচ্চা-ভেড়ী আনতে না পারে, তবে তার সেই অন্যায়ের জরিমানা হিসাবে মাবুদের উদ্দেশে তাকে দু’টা ঘুঘু না হয় দু’টা কবুতর আনতে হবে। তার মধ্যে একটা হবে গুনাহের কোরবানীর জন্য আর অন্যটা পোড়ানো-কোরবানীর জন্য। সে তা এনে ইমামের হাতে দেবে আর ইমাম প্রথমে গুনাহের কোরবানীর জন্য আনা পাখীটা কোরবানী দেবে। সে সেটা দুই টুকরা না করে মাথাটা গলা থেকে মুচ্‌ড়ে আলগা করে নেবে। তারপর সে পাখীটা থেকে কিছু রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে, আর বাকী রক্ত চেপে বের করে কোরবানগাহের গোড়ায় ফেলবে; এটা একটা গুনাহের কোরবানী। অন্য পাখীটা দিয়ে নিয়ম অনুসারে পোড়ানো-কোরবানী করে ইমাম তার সেই অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে; তাতে তাকে মাফ করা হবে। “যদি সে দু’টা ঘুঘু বা দু’টা কবুতর আনতে না পারে, তবে গুনাহের কোরবানীর জন্য তাকে এক কেজি আটশো গ্রাম মিহি ময়দা আনতে হবে। এটা গুনাহের কোরবানী বলে সে তার উপর তেলও ঢালবে না বা লোবানও রাখবে না। সেই ময়দা সে ইমামের কাছে নিয়ে যাবে। পুরো কোরবানীর বদলে ইমাম তা থেকে এক মুঠো ময়দা তুলে নিয়ে কোরবানগাহে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসের উপর পুড়িয়ে ফেলবে; এটা একটা গুনাহের কোরবানী। সে যে অন্যায় করেছে ইমাম এইভাবে তা ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে আর তাতে তাকে মাফ করা হবে। এই কোরবানীর জিনিসের বাদবাকী অংশ শস্য-কোরবানীর জিনিসের মতই ইমামের পাওনা হবে।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “মনে অন্যায়ের ইচ্ছা না রেখে যদি কেউ পাক-পবিত্র জিনিসের ব্যাপারে মাবুদের হুকুম অমান্য করে, তবে তার অন্যায়ের জরিমানা হিসাবে মাবুদের কাছে তাকে একটা নিখুঁত পুরুষ ভেড়া আনতে হবে। এটা একটা দোষের কোরবানী। তা ছাড়া ধর্মীয় শেখেল অনুসারে যতটা রূপা তুমি ভেড়াটার দাম ঠিক করে দেবে সেই পরিমাণ রূপা তাকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে হবে। সেই পাক-পবিত্র জিনিসের ব্যাপারে সে অন্যায় করেছে বলে তাকে এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া ভেড়াটার দামের সংগে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম তাকে ইমামের হাতে দিতে হবে। ইমাম সেই ভেড়াটা নিয়ে দোষের কোরবানী হিসাবে তা কোরবানী দিয়ে তার অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে আর তাতে তাকে মাফ করা হবে। “যদি কেউ না জেনে মাবুদের নিষেধ করা কোন কিছু করে অন্যায় করে ফেলে তবে সে দোষী হবে এবং সেইজন্য তাকে দায়ী হতে হবে। তখন সে তার দোষের কোরবানীর জন্য তোমার ঠিক করে দেওয়া মূল্যের একটা নিখুঁত ভেড়া এনে ইমামের হাতে দেবে। সে না জেনে যে অন্যায় করেছে তার জন্য ইমাম তার অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে; তাতে তাকে মাফ করা হবে। এটা একটা দোষের কোরবানী, কারণ সে মাবুদের কাছে দোষী।” অন্যায়ের জরিমানা হিসাবে সে তোমার ঠিক করে দেওয়া মূল্যের একটা নিখুঁত পুরুষ ভেড়া মাবুদের উদ্দেশে দোষের কোরবানীর জন্য ইমামের কাছে নিয়ে আসবে। ইমাম তা দিয়ে মাবুদের সামনে তার গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। এই সব গুনাহের যেটা করেই সে দোষী হোক না কেন, তাকে মাফ করা হবে।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “হারুন ও তার ছেলেদের জানিয়ে দাও যে, এই হল পোড়ানো-কোরবানীর নিয়ম। পোড়ানো-কোরবানীর জিনিস সারা রাত ধরে সকাল পর্যন্ত কোরবানগাহের আগুনের উপর থাকবে, আর কোরবানগাহের আগুন জ্বালিয়েই রাখতে হবে। সকালবেলায় ইমাম তার মসীনার কোর্তা ও জাংগিয়া পরে কোরবানগাহের উপরকার পোড়ানো-কোরবানীর ছাই তুলে নিয়ে কোরবানগাহের পাশে রাখবে। তারপর সে এই কাপড় ছেড়ে অন্য কাপড় পরে ছাউনির বাইরে কোন পাক-সাফ জায়গায় সেই ছাই নিয়ে যাবে। কোরবানগাহের উপরে আগুন জ্বালিয়েই রাখতে হবে, তা নিভতে দেওয়া চলবে না। প্রত্যেক দিন সকালবেলায় ইমাম সেই আগুনের উপর কাঠ দেবে এবং তাতে পোড়ানো-কোরবানী সাজিয়ে তার উপর যোগাযোগ-কোরবানীর চর্বি পোড়াবে। কোরবানগাহের আগুন সব সময় জ্বলতেই থাকবে, তা নিভে গেলে চলবে না। “এই হল শস্য-কোরবানীর নিয়ম। হারুনের ছেলেরা শস্য-কোরবানীর জিনিস কোরবানগাহের কাছে মাবুদের সামনে নিয়ে যাবে। ইমাম তা থেকে এক মুঠো মিহি ময়দা, তেল এবং শস্য-কোরবানীর জিনিসের উপরে রাখা সমস্ত লোবান তুলে নিয়ে পুরো কোরবানীর বদলে তা কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দেবে। এর গন্ধে মাবুদ খুশী হন। কোরবানীর জিনিসের বাদবাকী অংশ হারুন ও তার ছেলেরা খাবে। তা তাদের খেতে হবে খামি না মিশিয়ে কোন পবিত্র জায়গায়, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর উঠানে। তা যেন খামি মিশিয়ে সেঁকা না হয়। আমার উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসের এই অংশ আমি তাদের দিলাম। গুনাহের কোরবানী এবং দোষের কোরবানীর মত শস্য-কোরবানীর এই অংশটাও মহাপবিত্র জিনিস। হারুনের বংশের সব পুরুষ লোকই তা খেতে পারবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসের এই অংশটা বংশের পর বংশ ধরে তাদের পাওনা। এই অংশটা যে ছোঁবে তাকে পাক-পবিত্র হতে হবে।” এর পর মাবুদ মূসাকে আরও বললেন, “হারুনের অভিষেকের দিনে হারুন ও তার ছেলেরা নিয়মিত শস্য-কোরবানীর মত এক কেজি আটশো গ্রাম মিহি ময়দা মাবুদের উদ্দেশে নিয়ে আসবে। তার অর্ধেকটা সকালে আর অর্ধেকটা সন্ধ্যায় কোরবানী করতে হবে। শস্য-কোরবানী হিসাবে সেই ময়দা তেলের ময়ান দিয়ে তাওয়ায় ভেজে টুকরা টুকরা অবস্থায় মাবুদের কাছে উপস্থিত করতে হবে। এর গন্ধে মাবুদ খুশী হন। হারুনের পরে তার যে ছেলেকে মহা-ইমাম-পদের জন্য অভিষেক করা হবে তাকেও এই কোরবানী করতে হবে। এটা মাবুদের নিয়মিত পাওনা, আর তার সবটাই পুড়িয়ে দিতে হবে। ইমামের আনা শস্য-কোরবানীর সবটাই পুড়িয়ে ফেলতে হবে; তা খাওয়া চলবে না।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “হারুন ও তার ছেলেদের বল যে, এই হল গুনাহের কোরবানীর নিয়ম। পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটবার জায়গায় মাবুদের সামনে গুনাহের কোরবানীর পশুও জবাই করতে হবে। এই কোরবানীর গোশ্‌ত মহাপবিত্র জিনিস। যে ইমাম এই কোরবানী দেবে সে এই গোশ্‌ত খাবে। কোন পবিত্র জায়গায়, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর উঠানে তা খেতে হবে। এই গোশ্‌ত যে ছোঁবে তাকে পাক-পবিত্র হতে হবে। যদি কাপড়ে পশুটার রক্তের ছিটা লাগে তবে পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় তা ধুয়ে ফেলতে হবে। যে মাটির হাঁড়ীতে এই কোরবানীর গোশ্‌ত সিদ্ধ করা হবে তা ভেংগে ফেলতে হবে, কিন্তু যদি ব্রোঞ্জের পাত্রে তা সিদ্ধ করা হয় তবে সেটা মেজে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। ইমাম-পরিবারের যে কোন পুরুষ লোক তা খেতে পারবে। এটা মহাপবিত্র জিনিস। পবিত্র স্থানে গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে যদি গুনাহের কোরবানীর কোন পশুর রক্ত মিলন-তাম্বুতে নিয়ে যাওয়া হয় তবে তার গোশ্‌ত খাওয়া চলবে না, তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। “এই হল দোষের কোরবানীর নিয়ম। এই কোরবানীর গোশ্‌ত মহাপবিত্র জিনিস। পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটবার জায়গায় দোষের কোরবানীর পশুও জবাই করতে হবে এবং তার রক্ত কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর সমস্ত চর্বিই কোরবানী দিতে হবে, অর্থাৎ চর্বিভরা লেজ, পেটের ভিতরের অংশগুলোর উপরকার চর্বি, কিড্‌নি দু’টি ও তার সংগে জড়ানো কোমরের কাছের চর্বি এবং কিড্‌নির সংগে বের করে আনা কলিজার উপরের অংশ। ইমাম সেগুলো নিয়ে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে কোরবানগাহের উপর তা পুড়িয়ে দেবে। এটা একটা দোষের কোরবানী। ইমাম-পরিবারের যে কোন পুরুষ লোক তা খেতে পারবে, কিন্তু তা খেতে হবে পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায়। এটা মহাপবিত্র জিনিস। “গুনাহের কোরবানী ও দোষের কোরবানী একই নিয়মে করতে হবে। যে ইমাম এই দু’টা কোরবানীর যে কোন একটা কোরবানী দিয়ে কোরবানীদাতার গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে কোরবানীর গোশ্‌ত সেই ইমামেরই পাওনা হবে। পোড়ানো-কোরবানী যে ইমাম করবে সে তার নিজের জন্য সেই কোরবানীর পশুর চামড়া রেখে দিতে পারবে। তন্দুরে সেঁকা কিংবা কড়াইতে বা তাওয়ায় ভাজা শস্য-কোরবানীর জিনিস সেই ইমামেরই পাওনা হবে যে সেই শস্য-কোরবানী করবে। তেল মিশানো হোক বা শুকনা হোক প্রত্যেকটি শস্য-কোরবানীর জিনিস থেকে হারুনের সব ছেলেরা সমান অংশ পাবে। “এই হল মাবুদের উদ্দেশে আনা যোগাযোগ-কোরবানীর নিয়ম। যদি এই যোগাযোগ-কোরবানী কেউ মাবুদকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য করতে চায় তবে এই কৃতজ্ঞতার কোরবানীর সংগে থাকবে তেলের ময়ান দেওয়া খামিহীন পিঠা, তেল লাগানো খামিহীন চাপাটি এবং তেলের ময়ান দেওয়া ভাল করে ঠাসা মিহি ময়দার পিঠা। কৃতজ্ঞতার জন্য এই যোগাযোগ-কোরবানীর জিনিসের সংগে কিছু খামি দেওয়া রুটিও থাকতে হবে। মাবুদকে দেবার জন্য সে ঐ প্রত্যেক রকমের জিনিস থেকে এক একটা করে আনবে। যে ইমাম যোগাযোগ-কোরবানীর পশুর রক্ত ছিটাবে এগুলো তারই পাওনা হবে। কৃতজ্ঞতা জানাবার এই কোরবানীর গোশ্‌ত কোরবানীর দিনেই খেয়ে ফেলতে হবে, সকাল পর্যন্ত তা রেখে দেওয়া চলবে না। “এই যোগযোগ-কোরবানী যদি কোন মানত পূরণ করবার জন্য করা হয় কিংবা কোরবানীদাতা নিজের ইচ্ছায় তা করে তবে সেই কোরবানীর গোশ্‌ত সেই দিনেই খেতে হবে। যদি কিছু বাকী থেকে যায় তবে তা পরের দিনও খাওয়া চলবে, কিন্তু যদি তৃতীয় দিন পর্যন্ত থেকে যায় তবে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যদি সেই গোশ্‌ত তৃতীয় দিনেও খাওয়া হয় তবে মাবুদ সেই কোরবানী কবুল করবেন না। কোরবানীদাতার পক্ষে সেটা ধরা হবে না, কারণ সেই গোশ্‌ত তখন একটা নাপাক জিনিস হয়ে দাঁড়াবে। যে সেই গোশ্‌ত খাবে তাকে সেই অন্যায়ের জন্য দায়ী করা হবে। “যোগাযোগ-কোরবানীর গোশ্‌তে যদি কোন নাপাক জিনিসের ছোঁয়া লাগে তবে তা খাওয়া চলবে না, তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তবে ছোঁয়া না লাগলে যারা পাক-সাফ আছে তারা তা খেতে পারবে। কেউ যদি নাপাক অবস্থায় মাবুদের কাছে কোরবানী দেওয়া যোগাযোগ-কোরবানীর গোশ্‌ত খায় তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। যদি কেউ মানুষের বা পশুর কোন নাপাক জিনিস কিংবা অন্য কোন নাপাক ঘৃণার জিনিস ছুঁয়ে ফেলে আর তার পরে মাবুদের কাছে কোরবানী দেওয়া যোগাযোগ-কোরবানীর গোশ্‌ত খায় তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে।” মরা পশুর কিংবা বুনো জন্তুর ছিঁড়ে ফেলা পশুর চর্বি তোমরা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু তা খেতে পারবে না। যে সব পশু দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দেওয়া যায় তার চর্বি যে খাবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। কোন পাখী বা পশুর রক্ত খাওয়া তোমাদের চলবে না, তা তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন। যদি কেউ রক্ত খায় তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে।” যোগাযোগ-কোরবানীর পশুর ডান পাশের রানের গোশ্‌তটা ইমামকে দিয়ে দিতে হবে। হারুনের যে ছেলে যোগাযোগ-কোরবানীর পশুর রক্ত ও চর্বি কোরবানী দেবে সে-ই তার পাওনা হিসাবে ডান দিকের রানের গোশ্‌তটা পাবে। বনি-ইসরাইলদের সমস্ত যোগাযোগ-কোরবানী থেকে আমার উদ্দেশে দুলিয়ে রাখা বুকের গোশ্‌ত আর কোরবানী দেওয়া রানের গোশ্‌ত আমি ইমাম হারুন ও তার ছেলেদের দিলাম। এটা বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে তাদের নিয়মিত পাওনা অংশ হবে।” হারুন ও তাঁর ছেলেদের যেদিন মাবুদের ইমাম হবার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল সেই দিনে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর পশু থেকে এই অংশটা তাঁদের পাওনা বলে ঠিক করে রাখা হয়েছিল। যেদিন তাঁদের অভিষেক করা হয়েছিল সেই দিনই মাবুদ বনি-ইসরাইলদের হুকুম দিয়েছিলেন যেন তারা বংশের পর বংশ ধরে নিয়মিত ভাবে এই অংশটা তাঁদের দেয়। এই হল পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী, গুনাহের কোরবানী, দোষের কোরবানী, বহাল-অনুষ্ঠানের কোরবানী এবং যোগাযোগ-কোরবানীর নিয়ম। মাবুদ সিনাই মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের যেদিন তাঁর উদ্দেশে কোরবানীর জিনিস আনবার হুকুম দিয়েছিলেন সেই দিনই তিনি তুর পাহাড়ের উপরে মূসাকে এই সব নিয়ম দিয়েছিলেন। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুন ও তার ছেলেদের এখানে নিয়ে এস। সেই সংগে তাদের পোশাক, অভিষেকের তেল, গুনাহের কোরবানীর ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং খামিহীন রুটির টুকরিও নিয়ে এস। মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জমায়েত কর।” মাবুদের হুকুম মতই মূসা সব কিছু করলেন। মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে সমস্ত বনি-ইসরাইলরা এসে জমায়েত হল। তখন মূসা তাদের বললেন, “মাবুদ এই সব করবার হুকুম দিয়েছেন।” এই কথা বলে তিনি হারুন ও তাঁর ছেলেদের সামনে নিয়ে এসে পানি দিয়ে তাঁদের গোসল করালেন। তারপর তিনি হারুনকে ভিতরের আলখাল্লা পরিয়ে কোমর-বাঁধনিটা বেঁধে দিলেন। তিনি এফোদের নীচের কোর্তা ও তার উপর এফোদটা তাঁকে পরিয়ে দিলেন আর এফোদের সংগে জোড়া লাগানো কোমরের পটি দিয়ে এফোদটা বেঁধে দিলেন। তাতে এফোদটা তাঁর গায়ে আট্‌কে রইল। তার উপর তিনি বুক-ঢাকনটা পরিয়ে দিয়ে তার ভিতরে ঊরীম আর তুম্মীম রাখলেন। তারপর পাগড়িটা হারুনের মাথার উপর রেখে পবিত্র তাজটা, অর্থাৎ সেই সোনার পাতটা পাগড়ির সামনের দিকে বসিয়ে দিলেন। সব কিছু মূসা মাবুদের হুকুম মতই করলেন। তারপর তিনি আবাস-তাম্বু আর তার ভিতরকার সব কিছুর উপরে অভিষেক-তেল দিলেন এবং এইভাবে তিনি সেগুলো পবিত্র করলেন। সেই তেলের কিছুটা নিয়ে তিনি কোরবানগাহের উপর সাতবার ছিটিয়ে দিলেন। সেই তেল দিয়ে তিনি কোরবানগাহ্‌ ও তার সমস্ত বাসন-কোসন এবং আসনসুদ্ধ গামলাটা পাক-পবিত্র করে নিলেন। তারপর তিনি অভিষেক-তেলের কিছুটা নিয়ে হারুনের মাথার উপর ঢেলে দিয়ে তাঁকে পাক-পবিত্র করবার জন্য অভিষেক করলেন। পরে তিনি হারুনের ছেলেদের সামনে এনে তাঁদের গায়ে আলখাল্লা পরিয়ে দিলেন এবং কোমরে কোমর-বাঁধনি বেঁধে মাথায় টুপি পরিয়ে দিলেন। সব কিছুই মূসা মাবুদের হুকুম মত করলেন। তারপর তিনি গুনাহের কোরবানীর ষাঁড়টা নিয়ে আসলেন। হারুন ও তাঁর ছেলেরা ষাঁড়টার মাথার উপর তাঁদের হাত রাখলেন। তারপর মূসা সেই ষাঁড়টা জবাই করে তা থেকে কিছুটা রক্ত নিলেন এবং কোরবানগাহ্‌টি পাক-সাফ করবার জন্য আংগুল দিয়ে সেই রক্ত কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দিলেন। বাকী রক্ত তিনি কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দিলেন। এইভাবে তিনি গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কোরবানীর রক্ত দ্বারা কোরবানগাহ্‌টি পাক-পবিত্র করে নিলেন। তারপর তিনি ষাঁড়টার পেটের ভিতরের সমস্ত চর্বি, কলিজার উপরের অংশ আর চর্বিসুদ্ধ কিড্‌নি দু’টা নিয়ে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দিলেন। কিন্তু ষাঁড়টার চামড়া, গোশ্‌ত ও গোবর তিনি ছাউনির বাইরে নিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন। মূসা সব কিছু মাবুদের হুকুম মতই করলেন। তারপর তিনি পোড়ানো-কোরবানীর ভেড়াটা আনলেন। হারুন ও তাঁর ছেলেরা ভেড়াটার মাথার উপর তাঁদের হাত রাখলেন। মূসা সেই ভেড়াটা জবাই করে কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে রক্ত ছিটিয়ে দিলেন। তিনি ভেড়াটা কয়েক টুকরা করে নিয়ে তার মাথা, গোশ্‌তের টুকরা এবং চর্বি পুড়িয়ে দিলেন। ভেড়াটার পেটের ভিতরকার অংশ ও পাগুলো তিনি পানি দিয়ে ধুয়ে নিয়ে গোটা ভেড়াটাই পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দিলেন। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার গন্ধে মাবুদ খুশী হন। মূসা সব কিছু মাবুদের হুকুম মতই করলেন। তারপর তিনি অন্য ভেড়াটা, অর্থাৎ বহাল-অনুষ্ঠানের ভেড়াটা নিয়ে আসলেন। হারুন ও তাঁর ছেলেরা ভেড়াটার মাথার উপর হাত রাখলেন। মূসা সেই ভেড়াটা জবাই করলেন এবং তা থেকে কিছুটা রক্ত নিয়ে হারুনের ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে লাগিয়ে দিলেন। তারপর তিনি হারুনের ছেলেদের সামনে নিয়ে আসলেন এবং তাঁদের ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে কিছুটা রক্ত লাগিয়ে দিলেন। এর পর তিনি কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে রক্ত ছিটিয়ে দিলেন। তিনি ভেড়াটার চর্বি, চর্বিভরা লেজটা, পেটের ভিতরের সমস্ত চর্বি, কলিজার উপরের অংশ, চর্বি জড়ানো কিড্‌নি দু’টা এবং ডানপাশের রানটা নিলেন। তারপর মাবুদের সামনে রাখা খামিহীন রুটির টুকরি থেকে তিনি একটা রুটি, তেলের ময়ান দেওয়া একটা পিঠা ও একটা চাপাটি নিয়ে সেই চর্বি ও রানের উপর রাখলেন। সেগুলো তিনি হারুন ও তাঁর ছেলেদের হাতে দিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে তা মাবুদের সামনে দোলালেন। তারপর তিনি সেগুলো তাঁদের হাত থেকে নিয়ে বহাল-অনুষ্ঠানের কোরবানী হিসাবে কোরবানগাহের উপরকার পোড়ানো-কোরবানীর উপরে সেগুলো পুড়িয়ে দিলেন। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। তারপর তিনি তাঁর নিজের পাওনা অংশটা, অর্থাৎ বহাল-অনুষ্ঠানের ভেড়ার বুকের অংশটা নিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে মাবুদের সামনে দোলালেন। সব কিছু মূসা মাবুদের হুকুম মতই করলেন। এর পর মূসা কিছুটা অভিষেকের তেল ও কোরবানগাহ্‌ থেকে কিছুটা রক্ত নিয়ে হারুন ও তাঁর ছেলেদের উপর এবং তাঁদের পোশাকের উপর ছিটিয়ে দিলেন। এইভাবে হারুন ও তাঁর ছেলেদের এবং তাঁদের পোশাক পাক-পবিত্র করা হল। মূসা তারপর হারুন ও তাঁর ছেলেদের বললেন, “তোমরা মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে এই গোশ্‌ত সিদ্ধ কর এবং সেখানেই বহাল-অনুষ্ঠানের টুকরির রুটি দিয়ে তা খাও, কারণ আমি এই হুকুম দিয়েছিলাম যে, তোমার ও তোমার ছেলেদের তা খেতে হবে। খাওয়ার পর যে গোশ্‌ত ও রুটি বাকী থাকবে তা তোমরা পুড়িয়ে ফেলবে। তোমাদের এই বহাল-অনুষ্ঠান সাত দিন ধরে চলবে। সেইজন্য এই অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সাত দিন তোমরা মিলন-তাম্বুর দরজার বাইরে যাবে না। আজকে যা করা হল তা মাবুদের হুকুমেই তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা হিসাবে করা হল। তোমরা যাতে মারা না পড় সেইজন্য আজ থেকে সাত দিন পর্যন্ত তোমরা দিনরাত মিলন-তাম্বুর ভিতরে থাকবে এবং মাবুদের চাহিদা অনুসারে কাজ করবে। আমি এই হুকুমই পেয়েছি।” মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ যা করতে হুকুম দিয়েছিলেন হারুন ও তাঁর ছেলেরা তা সবই করলেন। বহাল-অনুষ্ঠানের আট দিনের দিন হারুন ও তাঁর ছেলেদের এবং ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের মূসা ডেকে পাঠালেন। তিনি হারুনকে বললেন, “তোমার গুনাহের কোরবানীর জন্য তুমি একটা এঁড়ে বাছুর ও পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ভেড়া এনে মাবুদের সামনে উপস্থিত কর। তাদের গায়ে যেন কোন খুঁত না থাকে। তারা মূসার হুকুম মত সমস্ত জিনিস মিলন-তাম্বুর সামনে নিয়ে আসল আর বনি-ইসরাইলরা সবাই গিয়ে মাবুদের সামনে দাঁড়াল। মূসা তখন তাদের বললেন, “মাবুদের মহিমা যাতে তোমাদের সামনে প্রকাশ পায় সেইজন্যই তিনি তোমাদের এই সব করবার হুকুম দিয়েছেন।” তারপর তিনি হারুনকে বললেন, “তুমি কোরবানগাহের কাছে গিয়ে তোমার গুনাহের কোরবানী ও পোড়ানো-কোরবানী দিয়ে তোমার নিজের ও সেই সংগে লোকদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা কর। এছাড়া লোকদের ঐ সব কোরবানী দিয়েও তুমি তাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা কর; মাবুদ তা-ই হুকুম দিয়েছেন।” এতে হারুন কোরবানগাহের কাছে গিয়ে তাঁর নিজের গুনাহের কোরবানীর বাছুরটা জবাই করলেন। তাঁর ছেলেরা তার রক্ত নিয়ে তাঁর কাছে গেল। হারুন সেই রক্তে তাঁর আংগুল ডুবিয়ে কিছু রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দিলেন আর বাকী রক্ত তিনি কোরবানগাহের গোড়ায় ঢেলে দিলেন। মূসাকে মাবুদ যে হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই হারুন সেই গুনাহের কোরবানীর বাছুরের চর্বি, কিড্‌নি দু’টি এবং কলিজার উপরের অংশ কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দিলেন। গোশ্‌ত আর চামড়া তিনি ছাউনির বাইরে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর হারুন পোড়ানো-কোরবানীর ভেড়াটা জবাই করলেন। তাঁর ছেলেরা তার রক্ত এনে তাঁর হাতে দিলেন আর তিনি তা কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। তাঁরা পোড়ানো-কোরবানীর ভেড়াটার মাথা এবং গোশ্‌তের টুকরাগুলো এক এক করে হারুনের হাতে দিলেন আর হারুন সেগুলো কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে ফেললেন। ভেড়াটার পেটের ভিতরের অংশ ও পা তিনি ধুয়ে নিয়ে কোরবানগাহের উপরকার পোড়ানো-কোরবানীর উপরে রেখে সেগুলো পুড়িয়ে দিলেন। হারুন তারপর লোকদের কোরবানীর পশুগুলো আনলেন। তিনি লোকদের গুনাহের কোরবানীর ছাগলটা নিয়ে জবাই করলেন এবং আগের মত করে এটা দিয়েও গুনাহের কোরবানী দিলেন। তারপর তিনি তাদের পোড়ানো-কোরবানীর পশু দু’টা এনে মাবুদের দেওয়া নিয়ম অনুসারে কোরবানী দিলেন। সকালবেলার পোড়ানো-কোরবানী ছাড়াও শস্য-কোরবানীর জন্য আনা জিনিস থেকে তিনি এক মুঠো তুলে নিয়ে কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দিলেন। তিনি লোকদের যোগাযোগ-কোরবানীর গরু ও ভেড়াটা জবাই করলেন। তাঁর ছেলেরা সেগুলোর রক্ত এনে তাঁর হাতে দিলেন আর তিনি তা কোরবানগাহের চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। মূসা তাঁকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই তিনি দোলন-কোরবানী হিসাবে বুকের গোশ্‌ত এবং ডানপাশের রানটা নিয়ে মাবুদের সামনে দোলালেন। তারপর হারুন লোকদের দিকে হাত বাড়িয়ে তাদের দোয়া করলেন। তিনি গুনাহের কোরবানী, পোড়ানো-কোরবানী এবং যোগাযোগ-কোরবানী শেষ করে কোরবানগাহ্‌ থেকে নেমে আসলেন। এর পর মূসা ও হারুন মিলন-তাম্বুর ভিতরে গেলেন। সেখান থেকে বের হয়ে এসে তাঁরা লোকদের দোয়া করলেন। তখন সমস্ত লোকের সামনে মাবুদের মহিমা দেখা দিল। মাবুদের কাছ থেকে আগুন বের হয়ে এসে কোরবানগাহের উপরকার পোড়ানো-কোরবানী আর সমস্ত চর্বি পুড়িয়ে ফেলল। এই ব্যাপার দেখে লোকেরা চিৎকার করে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ল। হারুনের ছেলে নাদব ও অবীহূ তাদের আগুনের পাত্রে করে আগুন নিয়ে তার উপর ধূপ দিল। তারা মাবুদের হুকুমের বাইরে অন্য আগুনে মাবুদের উদ্দেশে ধূপ কোরবানী করল। এর দরুন মাবুদের কাছ থেকে আগুন বের হয়ে এসে তাদের পুড়িয়ে দিল, আর তারা মাবুদের সামনেই মারা গেল। তখন মূসা হারুনকে বললেন, “মাবুদ বলেছেন, ‘যারা আমার কাছে আসে তারা যেন আমাকে পবিত্র বলে মান্য করে। লোকদের চোখে তারা যেন আমার সম্মান তুলে ধরে।’ ” হারুন চুপ করে রইলেন। পরে মূসা মীশায়েল ও ইলীষাফণকে ডেকে বললেন, “এখানে এস; পবিত্র তাম্বু-ঘরের সামনে থেকে তোমাদের ভাইয়ের ছেলেদের লাশগুলো ছাউনির বাইরে নিয়ে যাও।” মীশায়েল ও ইলীষাফণ ছিল হারুনের চাচা উষীয়েলের ছেলে। মূসার হুকুমে তারা এসে নাদব ও অবীহূর লাশ দু’টা ছাউনির বাইরে নিয়ে গেল। তখনও তাদের গায়ে ইমামের আলখাল্লা ছিল। মূসা তারপর হারুন ও তাঁর দুই ছেলে ইলীয়াসর ও ঈথামরকে বললেন, “দুঃখে তোমাদের চুলের বাঁধন খুলে দিয়ো না আর কাপড়ও ছিঁড়ো না। তা করলে তোমরা মারা পড়বে আর গোটা ইসরাইল জাতির উপর মাবুদ রেগে যাবেন। তবে মাবুদ যাদের আগুন দিয়ে হত্যা করেছেন তাদের জন্য তোমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা, অর্থাৎ অন্যান্য বনি-ইসরাইলরা শোক-প্রকাশ করতে পারে। তোমাদের গায়ে মাবুদের অভিষেক-তেল দেওয়া হয়েছে, কাজেই তোমরা মিলন-তাম্বুর দরজার বাইরে যাবে না, গেলে মারা পড়বে।” তাঁরা মূসার কথা মেনে নিলেন। এর পর মাবুদ হারুনকে বললেন, “তুমি ও তোমার ছেলেরা আংগুর-রস বা মদানো-রস খেয়ে মিলন-তাম্বুতে ঢুকো না, ঢুকলে তোমরা মারা যাবে। বংশের পর বংশ ধরে এটা হবে তোমাদের একটা চিরস্থায়ী নিয়ম। কোন্‌টা পাক আর কোন্‌টা নাপাক নয় এবং কোন্‌টা হালাল আর কোন্‌টা হারাম তা বুঝে তোমাদের চলতে হবে। এছাড়া মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের যে সব নিয়ম দিয়েছেন তা-ও তোমরা তাদের শিখাবে।” মূসা তারপর হারুন ও তাঁর বাকী দু’জন ছেলে ইলীয়াসর ও ঈথামরকে বললেন, “মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর মধ্য থেকে শস্য-কোরবানীর যে অংশটা বাকী আছে তা তোমরা কোরবানগাহের পাশে নিয়ে গিয়ে খাও, কিন্তু সেটা খামি ছাড়াই খেতে হবে। এটা মহাপবিত্র জিনিস। এটা তোমরা পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় নিয়ে খাবে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর এই অংশটুকু তোমার ও তোমার ছেলেদের পাওনা। এই হুকুমই আমি পেয়েছি। তবে মাবুদের উদ্দেশে দুলিয়ে রাখা বুকের গোশ্‌ত এবং রান তুমি ও তোমার ছেলেমেয়েরা সবাই খেতে পারবে। এগুলো তোমরা কোন পাক-সাফ জায়গায় খাবে। বনি-ইসরাইলদের সমস্ত যোগাযোগ-কোরবানীর এই অংশটুকু তোমাকে ও তোমার ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয়েছে। আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জন্য যখন চর্বি আনা হবে তখন মাবুদের সামনে দোলন-কোরবানী হিসাবে দোলাবার জন্য রান ও বুকের গোশ্‌তও আনতে হবে। মাবুদের হুকুম মত এই রান ও বুকের গোশ্‌ত তোমার ও তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়মিত পাওনা।” যে ছাগলটা দিয়ে গুনাহের কোরবানী দেওয়া হয়েছিল তার গোশ্‌ত সম্বন্ধে তালাশ করে মূসা জানতে পারলেন যে, তা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এতে তিনি হারুনের বাকী দুই ছেলে ইলীয়াসর ও ঈথামরের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “গুনাহের কোরবানীর গোশ্‌ত কেন তোমরা পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকার মধ্যে খেয়ে ফেল নি? এটা তো মহাপবিত্র জিনিস। মাবুদের সামনে বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ ঢেকে তাদের শাস্তি থেকে মুক্ত করবার জন্যই তা তোমাদের দেওয়া হয়েছিল। ঐ ছাগলের রক্ত যখন পবিত্র স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় নি তখন আমার হুকুম মত পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকার মধ্যেই তার গোশ্‌ত তোমাদের খেয়ে ফেলা উচিত ছিল।” এর জবাবে হারুন মূসাকে বললেন, “আজ মাবুদের সামনে তাদের গুনাহের কোরবানী ও পোড়ানো-কোরবানীর দেওয়ার পরে আমার উপর এই সব ঘটনা ঘটে গেল। আজকের দিনে আমি সেই গুনাহের কোরবানীর গোশ্‌ত খেলে কি মাবুদ খুশী হতেন?” জবাবটা শুনে মূসা খুশী হলেন। কোন কোন পশু কেবল জাবর কাটে, আবার কোন কোন পশুর কেবল চেরা খুর আছে; সেগুলো তোমাদের জন্য হারাম। উট জাবর কাটলেও তার খুর চেরা নয়, সেইজন্য তা তোমাদের পক্ষে নাপাক। শাফনও জাবর কাটে কিন্তু তার খুর চেরা নয়, সেইজন্য তা-ও তোমাদের পক্ষে নাপাক। খরগোশ জাবর কাটলেও তার খুর চেরা নয়, সেইজন্য তা-ও নাপাক। শূকরের খুর একেবারে দু’ভাগে চেরা, কিন্তু সে জাবর কাটে না, তাই তা তোমাদের পক্ষে নাপাক। এগুলোর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হারাম এবং তাদের মৃতদেহও ছোঁবে না। এগুলো তোমাদের পক্ষে নাপাক। “সমুদ্র ও নদীর পানিতে যে সব প্রাণী বাস করে তাদের মধ্যে যাদের ডানা এবং গায়ে আঁশ আছে সেগুলো তোমাদের জন্য হালাল। কিন্তু যেগুলোর ডানা আর আঁশ নেই সেগুলো ঘৃণার জিনিস বলে তোমাদের ধরে নিতে হবে- তা পানিতে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীই হোক কিংবা অন্যান্য প্রাণীই হোক। ঘৃণার জিনিস বলে সেগুলো তোমাদের জন্য হারাম এবং সেগুলোর মৃতদেহও ঘৃণার জিনিস বলে তোমাদের ধরে নিতে হবে। পানিতে বাস করে অথচ ডানা আর আঁশ নেই এমন সব প্রাণীদের ঘৃণার জিনিস বলে ধরে নিতে হবে। “কতগুলো পাখীও আছে যেগুলো ঘৃণার জিনিস বলে তোমাদের ধরে নিতে হবে, আর সেইজন্য সেগুলো তোমাদের খাওয়া চলবে না। সেগুলো হল ঈগল, শকুন, কালো শকুন, কালপেঁচা, হাড়গিলা, হুতুম পেঁচা, সাদা পেঁচা, মরু-পেঁচা, সিন্ধুবাজ, সারস, সব রকমের বক, হুপ্‌পু পাখী আর বাদুড়। “যে সব চার পায়ে হাঁটা পোকা উড়ে বেড়ায় সেগুলোকে ঘৃণার জিনিস বলে ধরে নিতে হবে। তবে তার মধ্যে যেগুলোর হাঁটু আছে বলে মাটির উপর লাফিয়ে বেড়াতে পারে সেগুলোর কোন কোনটা তোমাদের জন্য হালাল। সেগুলো হল সব রকমের পংগপাল, বাঘা-ফড়িং, ঝিঁঝি কিংবা ঘাস-ফড়িং। কিন্তু অন্য যে সব উড়ে বেড়ানো পোকার চারটা করে পা আছে সেগুলোকে ঘৃণার জিনিস বলে ধরে নিতে হবে। “এগুলো দিয়ে তোমরা নাপাক হবে। যে কেউ তাদের মৃতদেহ ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যদি কেউ তাদের কোন একটার মৃতদেহ হাত দিয়ে তোলে তবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। “যে সব পশুর খুর চেরা হলেও পুরোপুরি দুই ভাগে ভাগ করা নয় কিংবা যে সব পশু জাবর কাটে না সেগুলো তোমাদের পক্ষে নাপাক। যে এগুলো ছোঁবে সে নাপাক হবে। চার পায়ে হাঁটা জীবজন্তুর মধ্যে যেগুলো থাবায় ভর করে চলে সেগুলো তোমাদের পক্ষে নাপাক। যে তাদের মৃতদেহ ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে কেউ তাদের মৃতদেহ হাত দিয়ে তুলবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এই সব জীবজন্তু তোমাদের পক্ষে নাপাক। “যে সব ছোটখাটো প্রাণী মাটির উপর ঘুরে বেড়ায় সেগুলোর মধ্যে বেজী, ইঁদুর, সব রকমের গিরগিটি; তক্ষক, গোসাপ, টিকটিকি, রক্তচোষা এবং কাঁকলাস তোমাদের পক্ষে নাপাক। ছোটখাটো প্রাণীদের মধ্যে এগুলোই হবে তোমাদের পক্ষে নাপাক। এদের মৃতদেহ যে ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এগুলোর যে কোন একটা মরে কোন জিনিসের উপর পড়লে সেটা নাপাক হবে- সেটা কাঠ, কাপড়, চামড়া কিংবা চট যা দিয়েই তৈরী হোক না কেন আর যে কোন কাজেরই হোক না কেন। সেই জিনিসটা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। সেটা সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে, তারপর তা পাক-সাফ হবে। এগুলোর মধ্যে কোন একটা যদি কোন মাটির পাত্রের মধ্যে পড়ে তবে তার ভিতরকার সব কিছু নাপাক হয়ে যাবে। সেই পাত্রটা ভেংগে ফেলতে হবে। সেই পাত্রের পানি যদি কোন খাওয়ার জিনিসের উপর পড়ে তবে সেই খাওয়ার জিনিসও নাপাক হয়ে যাবে। সেই পাত্রের মধ্যে যদি কোন পানীয় থাকে তবে তা-ও নাপাক হয়ে যাবে। এগুলোর মৃতদেহ কোন কিছুর উপর পড়লে তা-ও নাপাক হয়ে যাবে। এগুলো কোন তন্দুরে বা কোন চুলায় পড়লে তা ভেংগে ফেলতে হবে। সেই তন্দুর বা চুলা নাপাক, আর তোমাদের তা নাপাক বলেই মানতে হবে। তবে সেগুলো যদি কোন ঝর্ণা কিংবা কূয়ার মধ্যে পড়ে তবে সেই ঝর্ণা বা কূয়া নাপাক হবে না; কিন্তু এদের মৃতদেহ যে ছোঁবে সে নিজে নাপাক হবে। জমিতে বুনবার জন্য রাখা কোন বীজের উপর যদি এগুলোর কোন মৃতদেহ পড়ে তবে তা নাপাক হবে না; কিন্তু বীজের উপর পানি দেওয়া হলে পর যদি তা পড়ে তবে সেই বীজ তোমাদের পক্ষে নাপাক হবে। “তোমাদের হালাল কোন পশু মরে গেলে যে তার মৃতদেহ ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। কেউ যদি সেই মরা পশুর গোশ্‌ত খায় তবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে এবং সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। কেউ যদি সেই মরা পশু হাত দিয়ে তোলে তবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে এবং সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। “যে সব ছোটখাটো প্রাণী মাটির উপর ঘুরে বেড়ায় তোমাদের তা ঘৃণার জিনিস বলে ধরে নিতে হবে। সেগুলো তোমাদের জন্য হারাম। মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো ছোটখাটো কোন প্রাণীই তোমরা খাবে না। সেগুলো সবই ঘৃণার জিনিস- সেগুলো পেটের উপর ভর দিয়েই চলুক আর চার পায়ে বা অনেক পায়েই হাঁটুক। সেগুলোর কোনটা দিয়ে তোমরা নিজেদের ঘৃণার পাত্র করে তুলবে না। তোমরা সেগুলো দিয়ে নিজেদের নাপাক করবে না কিংবা সেগুলোকে তোমাদের নাপাক করতে দেবে না। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। সেইজন্য তোমরা আমার উদ্দেশ্যে নিজেদের আলাদা করে রাখবে এবং পবিত্র হবে, কারণ আমি পবিত্র। মাটির উপরে ঘুরে বেড়ানো ছোটখাটো কোন প্রাণী দিয়ে তোমরা নিজেদের নাপাক করবে না, কারণ আমি মাবুদ; তোমাদের আল্লাহ্‌ হওয়ার জন্য আমি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। আমি পবিত্র বলে তোমাদেরও পবিত্র হতে হবে। “পশু, পাখী এবং পানির মধ্যেকার প্রাণী আর মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো সব ছোটখাটো প্রাণীদের সম্বন্ধে এই হল আমার আইন। কোন্‌টা পাক আর কোন্‌টা নাপাক, কোন্‌ পশুর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হালাল আর কোন্‌ পশুর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হারাম তা বুঝে তোমাদের চলতে হবে।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল, যদি কোন স্ত্রীলোক গর্ভবতী হয় এবং তার ছেলে হয় তবে সে তার মাসিকের সময়ের মতই নাপাক হবে। তার এই নাপাক অবস্থা সাত দিন চলবে। আট দিনের দিন ছেলেটির খৎনা করাতে হবে। তারপর সেই স্ত্রীলোককে তার রক্তস্রাব থেকে পাক-সাফ হবার জন্য তেত্রিশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার পাক-সাফ হওয়ার আগের এই দিনগুলো কেটে না যাওয়া পর্যন্ত সে কোন পবিত্র জিনিস ছুঁতে পারবে না কিংবা পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় যেতে পারবে না। কিন্তু যদি তার মেয়ে হয় তবে তার মাসিকের সময়ের মতই সে নাপাক হবে, কিন্তু তার এই নাপাক অবস্থা চলবে দু’সপ্তা। তারপর তাকে তার রক্তস্রাব থেকে পাক-সাফ হওয়ার জন্য ছেষট্টি দিন অপেক্ষা করতে হবে। “ছেলে বা মেয়ের জন্মের পরে তার পাক-সাফ হওয়ার আগের দিনগুলো কেটে যাবার পর তাকে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে ইমামের কাছে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য এক বছরের একটা ভেড়ার বাচ্চা এবং গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা কবুতর কিংবা একটা ঘুঘু নিয়ে যেতে হবে। ইমাম সেগুলো মাবুদের সামনে কোরবানী দিয়ে তার নাপাকী ঢাকা দেবে, আর তারপর সে তার রক্তস্রাবের নাপাক অবস্থা থেকে পাক-সাফ হবে। সন্তান জন্মের পর স্ত্রীলোকের জন্য এই হল নিয়ম। কোরবানীর জন্য যদি সে ভেড়ার বাচ্চা আনতে না পারে তবে তাকে দু’টা ঘুঘু না হয় দু’টা কবুতর আনতে হবে। তার মধ্যে একটা হবে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আর অন্যটা হবে গুনাহের কোরবানীর জন্য। এইভাবে ইমাম তার নাপাকী ঢাকা দেবে আর সে পাক-সাফ হবে।” এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “যদি কারও গায়ের চামড়ার কোন জায়গা ফুলে ওঠে কিংবা ফুসকুড়ি দেখা দেয় কিংবা কিছুটা জায়গা চক্‌চকে বলে মনে হয় যা পরে কোন খারাপ চর্মরোগে দাঁড়াতে পারে, তবে তাকে ইমাম হারুন কিংবা তার ছেলেদের, অর্থাৎ ইমামদের কারও কাছে নিয়ে যেতে হবে। ইমাম তার চামড়ার সেই জায়গাটা দেখবে। সেখানকার লোম যদি সাদা হয়ে গিয়ে থাকে আর রোগটা চামড়া ছাড়িয়ে আরও গভীরে চলে গেছে বলে মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে ওটা একটা খারাপ চর্মরোগ। ইমাম তাকে দেখবার পর তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে। তবে তার চামড়ার সেই চক্‌চকে জায়গাটুকু যদি সাদা হয় কিন্তু চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে না গিয়ে থাকে আর সেখানকার লোমও যদি সাদা না হয়ে গিয়ে থাকে, তবে ইমাম সেই লোককে সাত দিন পর্যন্ত অন্য লোকদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। সেই সাত দিনের শেষ দিন ইমাম তাকে আবার দেখবে। যদি এর মধ্যে সেই রোগটা চামড়ার উপরে ছড়িয়ে না গিয়ে যেমন ছিল তেমনিই থেকে যায় তবে সে আরও সাত দিন তাকে সরিয়ে রাখবে। সেই সাত দিনের শেষ দিন ইমাম তাকে আবার দেখবে। যদি এর মধ্যে তার রোগটা চামড়ার উপর ছড়িয়ে না গিয়ে প্রায় মিলিয়ে গিয়ে থাকে তবে সে তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা কেবল একটা ফুসকুড়ি, আর কিছু নয়। তখন লোকটাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে আর তারপর সে পাক-সাফ হবে। “কিন্তু ইমাম তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবার পরে যদি সেই ফুসকুড়ি তার চামড়ার উপরে ছড়িয়ে পড়ে তবে আবার তাকে ইমামের কাছে যেতে হবে। তখন ইমাম তাকে আবার দেখবে। যদি এর মধ্যে সত্যিই সেটা চামড়ার উপর ছড়িয়ে গিয়ে থাকে তবে সে তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা একটা খারাপ চর্মরোগ। তবে বুঝতে হবে ওটা একটা পুরানো খারাপ চর্মরোগ। তখন ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে। তাকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার দরকার নেই, কারণ সে তো নাপাক হয়েই আছে। কিন্তু যদি লক্ষণটা অন্য রকম হয়ে রোগটা তার সারা গায়ে বেরিয়ে গিয়ে থাকে আর ইমামের যতটা চোখে পড়ে তাতে যদি মনে হয় রোগীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা গায়েই তা আছে, তবে সে তাকে ভাল করে দেখবে। তাতে যদি দেখা যায় সত্যিই তা তার সারা গায়েই রয়েছে কিন্তু তা সাদা হয়ে গেছে তবে সে তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে। তার সারা গা সাদা হয়ে গেছে বলে সে নাপাক নয়। কিন্তু তার পরে যদি তার গায়ে কোন কাঁচা ঘা দেখা দেয় তবে সে নাপাক হবে। ইমাম সেই ঘা দেখবার পর তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে। সেই ঘা নাপাক; তার খারাপ চর্মরোগ হয়েছে। পরে সেই কাঁচা ঘায়ের অবস্থা বদলে গিয়ে যদি তা সাদা হয়ে যায় তবে তাকে আবার ইমামের কাছে যেতে হবে। তখন ইমাম তাকে আবার দেখবে। তার সারা গায়ে বেরিয়ে যাওয়া রোগটা যদি সত্যিই সাদা হয়ে গিয়ে থাকে তবে সে তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে, কারণ সে পাক-সাফ। ইমাম তাকে দেখবে। যদি সেটা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে চলে গিয়ে থাকে এবং সেখানকার লোমও সাদা হয়ে গিয়ে থাকে তবে ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ সেটা ফোড়ার জায়গায় বের হওয়া খারাপ চর্মরোগ। কিন্তু ইমাম যদি কোন সাদা লোম সেখানে দেখতে না পায় এবং সেটা যদি চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে না গিয়ে প্রায় মিলিয়ে যাবার মত হয়ে গিয়ে থাকে তবে ইমাম তাকে সাত দিন পর্যন্ত অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। কিন্তু যদি দেখা যায় সেটা চামড়ার উপর ছড়িয়ে যাচ্ছে তবে ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা একটা রোগ। কিন্তু সেটার যদি কোন পরিবর্তন না হয় এবং ছড়িয়েও না পড়ে তবে বুঝতে হবে যে, ওটা ফোড়াটার একটা দাগ মাত্র। ইমাম তখন তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে। “যদি কারও গায়ে কোন জায়গা পুড়ে যায় আর সেই পোড়া জায়গার কাঁচা ঘায়ের মধ্যে লাল্‌চে-সাদা কিংবা সাদা চক্‌চকে কোন কিছু দেখা যায়, তবে ইমাম সেটা পরীক্ষা করে দেখবে। যদি দেখা যায় সেখানকার লোম সাদা হয়ে গেছে আর সেই অংশটা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে চলে গেছে তবে বুঝতে হবে যে, সেই পোড়া জায়গায় খারাপ চর্মরোগ ফুটে বেরিয়েছে। ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা একটা খারাপ চর্মরোগ। কিন্তু ইমাম পরীক্ষা করে যদি দেখতে পায় যে, সেখানকার লোম সাদা হয় নি এবং সেই অংশটা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে চলে যায় নি বরং প্রায় মিলিয়ে গেছে, তবে ইমাম তাকে সাত দিনের জন্য অন্যদের থেকে সরিয়ে রাখবে। ঐ সাত দিনের শেষ দিন ইমাম তাকে আবার পরীক্ষা করে যদি দেখতে পায় যে, চামড়ার উপর সেটা ছড়িয়ে পড়েছে তবে ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা একটা খারাপ চর্মরোগ। কিন্তু সেই অংশটা যদি যেমন ছিল তেমনি থেকে যায় এবং রোগটা চামড়ার উপর না ছড়িয়ে প্রায় মিলিয়ে যাবার মত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে বুঝতে হবে পুড়বার দরুন ওটা ফুলে উঠেছে। তখন ইমাম তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা একটা পোড়া দাগ মাত্র। “যদি কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোকের মাথা বা দাড়ির মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে ইমাম তাকে পরীক্ষা করে দেখবে। যদি তার মনে হয় তা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে চলে গেছে এবং তার মধ্যেকার লোমও হলুদ আর সরু হয়ে গেছে তবে সে সেই লোককে নাপাক বলে ঘোষণা করবে, কারণ ওটা এক রকম চুলকানি- মাথা এবং দাড়ির খারাপ চর্মরোগ। কিন্তু রোগ পরীক্ষা করবার সময় ইমামের যদি মনে হয় যে, তা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে চলে যায় নি কিন্তু তার মধ্যে যে লোম রয়েছে তা কালো নয়, তবে সেই রোগীকে সে সাত দিন পর্যন্ত অন্যদের থেকে সরিয়ে রাখবে। তারপর সেই সাত দিনের শেষ দিনে ইমাম আবার তা পরীক্ষা করে যদি দেখে সেই চুলকানি ছড়িয়ে পড়ে নি এবং তার মধ্যেকার লোমও হলুদ নয় আর মনে হয় তা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে যায় নি, তবে চুলকানির জায়গাটা বাদ দিয়ে সেই লোকের বাদবাকী চুল বা লোম কামিয়ে ফেলতে হবে। এর পর ইমাম আরও সাত দিন তাকে অন্যদের থেকে সরিয়ে রাখবে। ঐ সাত দিনের শেষ দিন ইমাম তার সেই চুলকানি আবার পরীক্ষা করে যদি দেখে যে, সেটা চামড়ার উপরে ছড়িয়ে পড়ে নি আর মনে হয় সেটা চামড়া ছাড়িয়ে গভীরে যায় নি, তবে ইমাম তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে। তারপর তাকে কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে আর তখন সে পাক-সাফ হবে। তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবার পর যদি তার গায়ে সেই চুলকানি ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, তবে ইমাম তাকে আবার দেখবে। যদি দেখা যায় সেই চুলকানি ছড়িয়ে পড়েছে তবে লোম হলুদ হয়েছে কি না তা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার দরকার নেই, কারণ লোকটি নাপাক। কিন্তু ইমাম যদি মনে করে তা যেমন ছিল তেমনই আছে আর সেই চুলকানির জায়গায় কালো লোম গজিয়েছে তাহলে বুঝতে হবে সেটা ভাল হয়ে গেছে। সে পাক-সাফ হয়েছে এবং ইমাম তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে। “কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোকের চামড়ার উপর যদি কোন চক্‌চকে, অর্থাৎ সাদা চক্‌চকে দাগ দেখা দেয়, তাহলে ইমাম তা পরীক্ষা করে দেখবে। যদি সেই দাগগুলো ফ্যাকাশে সাদা হয় তাহলে বুঝতে হবে চামড়ার উপরে শ্বেতী হয়েছে আর তাতে কোন ক্ষতি হবে না, সে পাক-সাফ। “যদি কোন লোকের চুল উঠে গিয়ে মাথায় টাক পড়ে যায় তবে সে নাপাক হবে না। মাথার সামনের চুল উঠে গিয়ে যদি কারও কপালের উপরটায় টাক পড়ে যায় তাহলেও সে নাপাক হবে না। কিন্তু যদি তার টাকপড়া মাথায় বা কপালে রোগের কোন লাল্‌চে-সাদা রংয়ের লক্ষণ দেখা দেয় তবে বুঝতে হবে তার মাথায় বা কপালে খারাপ চর্মরোগ বের হয়েছে। ইমাম তাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি দেখে যে, খারাপ চর্মরোগের মত তার মাথার বা কপালের লাল্‌চে-সাদা অংশটা ফুলে উঠেছে, তবে বুঝতে হবে লোকটির খারাপ চর্মরোগ হয়েছে এবং সে নাপাক। তার মাথার সেই রোগের জন্য ইমাম তাকে নাপাক বলে ঘোষণা করবে। “এই রকম রোগ যার হবে তাকে ছেঁড়া কাপড় পরতে হবে। সে চুল খুলে রাখবে। তাকে তার মুখের নীচের দিকটা ঢেকে চিৎকার করে বলতে হবে, ‘নাপাক, নাপাক।’ তার শরীরে যতদিন সেই ছোঁয়াচে রোগ থাকবে ততদিন সে নাপাক থাকবে। তাকে ছাউনির বাইরে একা থাকতে হবে। আর সেই জায়গাটা দেখতে যদি কিছুটা সবুজ কিংবা লাল্‌চে হয় তবে বুঝতে হবে সেটা এক রকমের ক্ষয়-করা ছাৎলা। সেটা তখন ইমামকে দেখাতে হবে। ইমাম সেটা ভাল করে দেখে সাত দিনের জন্য সেই জিনিসটা অন্য সব জিনিস থেকে সরিয়ে রাখবে। “কিন্তু ইমাম যদি দেখে যে, সেই কাপড় কিংবা টানা-পোড়েনের সুতা কিংবা চামড়া বা চামড়ার জিনিসের উপরে সেটা না ছড়িয়ে একই জায়গায় রয়ে গেছে, তবে সে ঐ জিনিসটা ধুয়ে ফেলবার হুকুম দেবে। তারপর সে ওটা আরও সাত দিন পর্যন্ত অন্য সব জিনিস থেকে সরিয়ে রাখবে। তারপর ইমাম আবার তা দেখবে। সেটা ছড়িয়ে না পড়লেও যদি দেখতে একই রকম থেকে যায় তবে বুঝতে হবে জিনিসটা নাপাক। জিনিসটার ভিতরে-বাইরে যেদিকেই সেই ছাৎলা থাকুক না কেন, সেটা আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। জিনিসটা ধোয়ার পরে ইমাম যদি দেখে যে, জায়গাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তবে সেই ফ্যাকাশে জায়গাটা তাকে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু ঐ জিনিসটাতে যদি আবার ছাৎলা দেখা দেয় তবে বুঝতে হবে ওটা ছড়িয়ে পড়ছে। ঐ ছাৎলা-ধরা জিনিসটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। জিনিসটা ধোয়ার পরে যদি দেখা যায় ছাৎলা মিলিয়ে গেছে তবে সেটা আবার ধুয়ে নিতে হবে, আর তাতে সেটা পাক-সাফ হবে।” এই সব নিয়ম অনুসারে ক্ষয়-করা ছাৎলা-ধরা পশমী বা মসীনার কাপড়, টানা বা পোড়েনের কোন সুতা কিংবা চামড়ার কোন জিনিস পাক বা নাপাক বলে ঘোষণা করতে হবে। তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “খারাপ চর্মরোগ হয়েছে এমন কোন লোকের পাক-সাফ হবার দিনে এই নিয়ম পালন করতে হবে। তাকে ইমামের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ইমাম ছাউনির বাইরে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে দেখবে। যদি দেখা যায় সেই চর্মরোগ থেকে লোকটি সুস্থ হয়েছে, তবে তাকে পাক-সাফ করবার জন্য ইমাম দু’টা জীবিত পাক-পবিত্র পাখী, কিছু এরস কাঠ, লাল রংয়ের সুতা এবং এসোব গাছের ডাল নিয়ে আসতে বলবে। তারপর ইমাম হুকুম দেবে যেন স্রোত থেকে তুলে আনা এবং মাটির পাত্রে রাখা পানির উপরে সেই পাখী দু’টার একটাকে জবাই করা হয়। ইমাম জীবিত পাখীটা, এরস কাঠ, লাল রংয়ের সুতা এবং এসোব গাছের ডাল স্রোতের পানির উপরে জবাই করা সেই পাখীটার রক্তে ডুবাবে। যাকে সেই চর্মরোগ থেকে পাক-সাফ করা হবে তার উপর ইমাম সাতবার সেই রক্ত ছিটিয়ে দিয়ে তাকে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে। এর পর ইমামকে খোলা মাঠে সেই জীবিত পাখীটাকে ছেড়ে দিতে হবে। যাকে পাক-সাফ করা হবে সে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলবে, শরীর ও মাথার সমস্ত লোম ও চুল কামাবে এবং পানিতে গোসল করে ফেলবে। তারপর সে পাক-সাফ হবে। এর পর সে ছাউনিতে ঢুকতে পারবে কিন্তু তাকে সাত দিন তার নিজের তাম্বুর বাইরে থাকতে হবে। সেই সাত দিনের শেষ দিন তাকে তার শরীরের সব চুল, অর্থাৎ তার মাথার চুল, দাড়ি, ভুরু এবং শরীরের লোম কামিয়ে ফেলতে হবে। তারপর তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর তারপর সে সম্পূর্ণ পাক-সাফ হবে। “তার পরের দিন সে দু’টা ভেড়ার বাচ্চা আর একটা এক বছরের ভেড়ী নিয়ে আসবে। সেগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। সেই সংগে শস্য-কোরবানীর জন্য সে পাঁচ কেজি চারশো গ্রাম তেল মিশানো মিহি ময়দা ও পৌনে দুই লিটার তেল নিয়ে আসবে। যে ইমাম তার পাক-সাফ হওয়ার কাজ করছে সে তাকে এবং কোরবানীর জন্য আনা তার জিনিসগুলো মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে উপস্থিত করবে। “ইমাম সেই ভেড়া দু’টার একটা আর সেই পৌনে দুই লিটার তেল নিয়ে দোষের কোরবানী দেবে এবং দোলন-কোরবানী হিসাবে মাবুদের সামনে তা দোলাবে। পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় যেখানে গুনাহের কোরবানী ও পোড়ানো-কোরবানীর পশু কাটা হয় সেখানে সেই ভেড়াটা জবাই করতে হবে। গুনাহের কোরবানীর গোশ্‌তের মত দোষের কোরবানীর গোশ্‌তও ইমামের পাওনা। এই গোশ্‌ত মহাপবিত্র জিনিস। যে লোকটিকে পাক-সাফ করা হবে ইমাম দোষের কোরবানীর পশু থেকে কিছুটা রক্ত নিয়ে তার ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে লাগিয়ে দেবে। এর পরে সেই তেলের কিছুটা সে তার বাঁ হাতের তালুতে ঢেলে নেবে। তারপর ডান হাতের বুড়ো আংগুলের পরের আংগুল দিয়ে বাঁ হাত থেকে তেল তুলে নিয়ে সাতবার তা মাবুদের সামনে ছিটাবে। তারপর তার হাতের বাকী তেল থেকে কিছুটা নিয়ে সে লোকটির ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে দোষের কোরবানীর রক্তের উপরে লাগিয়ে দেবে। হাতের বাকী তেলটুকু সে লোকটির মাথায় দেবে। এইভাবে মাবুদের সামনে সে তার নাপাকী ঢাকা দেবে। তারপর আট দিনের দিন পাক-সাফ হবার জন্য লোকটিকে এই সব জিনিস এনে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে ইমামের কাছে দিতে হবে। ইমাম দোষের কোরবানীর ভেড়াটা এবং ঐ তেল নিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে মাবুদের সামনে দোলাবে। সেই কোরবানীর জন্য জবাই করে নেওয়া ভেড়াটার কিছু রক্ত নিয়ে ইমাম লোকটির ডান কানের লতিতে এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে লাগিয়ে দেবে। লোকটির ডান কানের লতি এবং ডান হাত ও ডান পায়ের বুড়ো আংগুলের যে সব জায়গায় ইমাম দোষের কোরবানীর পশুর রক্ত লাগিয়েছে সেই সব জায়গাতেই সেই তেলের কিছুটা নিয়ে সে লাগিয়ে দেবে। মাবুদের সামনে তার নাপাকী ঢাকা দেবার জন্য সে তার হাতের বাকী তেলটুকু লোকটির মাথায় দেবে। যাদের খারাপ চর্মরোগ হয়েছে অথচ পাক-সাফ হওয়ার জন্য যে কোরবানীর জিনিস আনবার কথা বলা হয়েছে তা আনবার ক্ষমতা নেই তাদের জন্য এই হল নিয়ম। তারপর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “যে কেনান দেশটা সম্পত্তি হিসাবে আমি তোমাদের দিতে যাচ্ছি সেই দেশে তোমরা ঢুকবার পর সেখানকার কোন বাড়িতে আমি যদি ছড়িয়ে পড়া ক্ষয়-করা ছাৎলা পড়বার ব্যবস্থা করি, তবে ঘরের মালিক ইমামের কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমার বাড়িতে ছাৎলার মত কি একটা দেখতে পাচ্ছি।’ ইমাম তা দেখবার জন্য ঘরে ঢুকবার আগেই হুকুম দেবে যেন ঘর থেকে সব কিছু বের করে ফেলা হয়, যাতে ঘরের কোন কিছুই নাপাক বলে ঘোষণা করা না হয়। তারপর ইমাম সেই ঘরে ঢুকে তা পরীক্ষা করে দেখবে। দেয়ালের ছাৎলা পরীক্ষা করবার সময় যদি দেখা যায় জায়গাটা দেয়ালের গা থেকে নীচু হয়ে গেছে আর ছাৎলার রং সবুজ বা লাল্‌চে এবং সেটা যদি আরও গভীরে চলে গেছে বলে তার মনে হয়, তবে সে সেই ঘর থেকে বের হয়ে এসে ঘরের দরজাটা সাত দিনের জন্য বন্ধ করে দেবে। সেই সাত দিনের শেষের দিন সে ফিরে এসে ঘরটা আবার পরীক্ষা করে দেখবে। যদি সেই ছাৎলা দেয়ালের উপর ছড়িয়ে গিয়ে থাকে, তবে সে হুকুম দেবে যেন সেখানকার ছাৎলা-ধরা পাথরগুলো বের করে শহরের বাইরে কোন নাপাক জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। ঘরের ভিতরের সব দেয়াল চেঁছে ফেলে সেই চাঁছা অংশগুলো শহরের বাইরে কোন নাপাক জায়গায় ফেলে দিতে হবে। তারপর যেখান থেকে পাথর খুলে নেওয়া হয়েছে সেখানে নতুন পাথর বসিয়ে নতুন মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে। “দেয়ালটা থেকে পাথর খুলে ফেলে, চেঁছে, মাটি দিয়ে লেপবার পর ঘরের দেয়ালে যদি আবার ছাৎলা দেখা দেয়, তবে ইমাম আবার গিয়ে তা দেখবে। যদি দেখা যায় সেই ছাৎলা ঘরটায় ছড়িয়ে পড়েছে, তবে বুঝতে হবে সেটা একটা ক্ষয়-করা ছাৎলা, আর সেই ঘরটা নাপাক। তখন ঘরটার পাথর, লেপে দেওয়া মাটি এবং কাঠ সবই ভেংগে ফেলতে হবে এবং শহরের বাইরে কোন নাপাক জায়গায় নিয়ে সেগুলো ফেলে দিতে হবে। “সাত দিন বন্ধ রাখবার সময় যদি কেউ ঘরটার ভিতরে যায় তবে সে সেই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যদি কেউ সেই ঘরে খায় বা ঘুমায় তবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে। “তবে সেই ঘরটা লেপে দেওয়ার পরে ইমাম তা পরীক্ষা করতে এসে যদি দেখে ছাৎলা ছড়িয়ে পড়ে নি তাহলে ঘরটা সে পাক-সাফ বলে ঘোষণা করবে, কারণ সেই ঘরটা আর ছাৎলা-ধরা অবস্থায় নেই। ঘরটা পাক-সাফ করবার জন্য ইমামকে দু’টা পাখী, কিছু এরস কাঠ, লাল রংয়ের সুতা এবং এসোব গাছের ডাল নিতে হবে। তারপর মাটির পাত্রে রাখা স্রোত থেকে তুলে আনা পানির উপরে একটা পাখী তাকে কাটতে হবে; আর সেই এরস কাঠ, এসোবের ডাল, লাল রংয়ের সুতা এবং জীবিত পাখীটা নিয়ে কেটে ফেলা অন্য পাখীটার রক্ত-মেশা স্রোতের পানিতে ডুবাতে হবে এবং ঘরটার উপরে সাতবার তা ছিটিয়ে দিতে হবে। পাখীর রক্ত, স্রোতের পানি, জীবিত পাখী, এরস কাঠ, এসোবের ডাল এবং লাল রংয়ের সুতা দিয়ে সে সেই ঘরটা পাক-সাফ করবে। তারপর সেই জীবিত পাখীটা সে শহরের বাইরে খোলা মাঠে ছেড়ে দেবে। এইভাবে সে ঘরটার নাপাকী ঢাকা দিলে পর ঘরটা পাক-সাফ হবে।” এই সব দিক থেকে মানুষ বা জিনিস কখন পাক আর কখন নাপাক হয় এই নিয়মের মধ্যে সেই নির্দেশ রয়েছে। এই হল খারাপ চর্মরোগ ও ক্ষয়-করা ছাৎলা সম্বন্ধে নিয়ম। মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা বনি-ইসরাইলদের জানিয়ে দাও, কোন লোকের পুরুষাংগের যে কোন রকমের অস্বাভাবিক স্রাব নাপাক। এই স্রাব পুরুষকে এমন এক নাপাক অবস্থায় ফেলবে যে, তা চলতেই থাকুক বা আট্‌কে থাকুক সে নাপাক থাকবেই। এই অবস্থায় সে যে বিছানায় শোবে বা যে আসনে বসবে তা নাপাক হয়ে যাবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে তার বিছানা যে ছোঁবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে তার বসা কোন আসনে বসবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে সেই লোককে যে ছোঁবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে সে যদি কোন পাক-সাফ লোকের গায়ে থুথু ফেলে তবে সেই পাক-সাফ লোকটিকে কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে সে কিছুতে চড়ে কোথাও যাবার সময়ে যে আসনের উপর বসবে তা নাপাক হয়ে যাবে। তার বসা কোন আসন যদি কেউ ছোঁয় তবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। সেই আসন যে তুলবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে সে যদি পানিতে হাত না ধুয়ে কাউকে ছোঁয় তবে সেই লোকটিকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। যে লোকের স্রাব হচ্ছে সে যদি কোন মাটির পাত্র ছোঁয় তবে তা ভেংগে ফেলতে হবে, আর কাঠের পাত্র হলে তা পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। “যখন কোন লোকের স্রাব থেমে যাবে তখন থেকে পাক-সাফ হবার জন্য সাত দিন গুণে সপ্তম দিনে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে স্রোতের পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে আর তখন সে পাক-সাফ হবে। আট দিনের দিন তাকে দু’টা ঘুঘু না হয় দু’টা কবুতর নিয়ে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে আসতে হবে এবং তা ইমামের কাছে দিতে হবে। ইমাম সেই দু’টার একটা দিয়ে গুনাহের কোরবানীর এবং অন্যটা দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেবে। স্রাবের দরুন লোকটির যে নাপাক অবস্থা হয়েছিল তার জন্য ইমাম এইভাবে মাবুদের সামনে তার নাপাকী ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। “কোন পুরুষের বীর্যপাত হলে তাকে পানি দিয়ে তার গোটা শরীরটা ধুয়ে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। কোন কাপড় বা চামড়ার জিনিসে বীর্য লাগলে সেটা পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সেটা নাপাক থাকবে। কোন পুরুষ যখন কোন স্ত্রীলোককে নিয়ে শোয় তখন বীর্যপাত হলে দু’জনকেই পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। “স্ত্রীলোকের নিয়মিত মাসিকের রক্তের দরুন নাপাক অবস্থা সাত দিন ধরে চলবে। এই সময় যে তাকে ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এই সময়ের মধ্যে সে যেটার উপর শোবে বা বসবে তা সবই নাপাক হবে। যে তার বিছানা ছোঁবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। সেই স্ত্রীলোক যার উপর বসেছে তা যদি কেউ ছোঁয়, তবে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে তাকে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। তার বিছানা বা আসন যে ছোঁবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। যদি কোন পুরুষ এই রকম স্ত্রীলোককে নিয়ে শোয় এবং তার মাসিকের রক্ত তার গায়ে লাগে তবে সে সাত দিন পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এই সাত দিনের মধ্যে সে যে বিছানায় শোবে তা-ও নাপাক হবে। “মাসিক ছাড়াও যদি কোন স্ত্রীলোকের অনেক দিন ধরে রক্তস্রাব হতে থাকে কিংবা মাসিকের নিয়মিত সময় পার হয়ে যাবার পরেও যদি তার স্রাব হতে থাকে তবে যতদিন ধরে তা চলবে ততদিন পর্যন্ত সে তার মাসিকের সময়ের মতই নাপাক অবস্থায় থাকবে। মাসিকের সময়ে যেমন হয় তেমনি এই স্রাবের সময়েও সে যে বিছানায় শোবে এবং যার উপর বসবে তা নাপাক হবে। যে সেই বিছানা বা আসন ছোঁবে সে-ও নাপাক হবে; তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। তার সেই রক্তস্রাব থেমে যাবার পরেও তাকে গুণে সাতটা দিন কাটাতে হবে এবং ঐ দিনেই সে পাক-সাফ হবে। আট দিনের দিন তাকে দু’টা ঘুঘু না হয় দু’টা কবুতর নিয়ে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে ইমামের কাছে যেতে হবে। ইমাম সেই দু’টার একটা দিয়ে গুনাহের কোরবানীর এবং অন্যটা দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেবে। এইভাবে ইমাম মাবুদের সামনে তার রক্তস্রাবের নাপাকী ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে।” শেষে মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আমার আবাস-তাম্বু রয়েছে। তোমরা সমস্ত নাপাকী থেকে তাদের দূরে রাখবে যাতে তারা আবাস-তাম্বুটা নাপাক করে তাদের নাপাকীর মধ্যে মারা না পড়ে।” হারুনের দুই ছেলে অন্যায়ভাবে মাবুদের সামনে উপস্থিত হয়ে মারা যাবার পরে মাবুদ মূসার সংগে কথা বললেন। তিনি বললেন, “তোমার ভাই হারুনকে বল, সাক্ষ্য-সিন্দুকের উপরকার ঢাকনার সামনে যে পর্দা রয়েছে তার পিছনে সেই পবিত্র জায়গায় সে যেন তার খুশীমত যখন-তখন না যায়। তা করলে সে মারা যাবে, কারণ সেই ঢাকনার উপরে মেঘের মধ্যে আমি প্রকাশিত থাকি। “সেখানে ঢুকবার আগে সে যেন নিজেকে এইভাবে তৈরী করে নেয়। তাকে গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড় ও পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ভেড়া নিতে হবে। তার পরনে থাকবে পবিত্র মসীনার আলখাল্লা আর নীচে থাকবে মসীনার তৈরী জাংগিয়া। তাকে মসীনার কোমর-বাঁধনি কোমরে বাঁধতে হবে আর মাথায় দিতে হবে মসীনার পাগড়ি। এগুলো পবিত্র পোশাক। তা পরবার আগে তাকে পানিতে গোসল করে নিতে হবে। গুনাহের কোরবানীর জন্য বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে তাকে দু’টা ছাগল এবং পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ভেড়া নিতে হবে। হারুনকে তার নিজের ও তার বংশধরদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য গুনাহের কোরবানীর ষাঁড়টা কোরবানী দিতে হবে। তারপর সেই ছাগল দু’টা নিয়ে তাকে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে নিয়ে যেতে হবে। তাকে গুলিবাঁট করে দেখতে হবে যে, তার মধ্যে কোন্‌ ছাগলটা মাবুদের জন্য আর কোন্‌টা আজাজীলের জন্য। যে ছাগলটা মাবুদের বলে দেখা যাবে হারুন সেটা নিয়ে গুনাহের কোরবানী দেবে। কিন্তু গুলিবাঁটে যে ছাগলটা আজাজীলের জন্য উঠবে সেটা জীবিত অবস্থাতেই মাবুদের সামনে উপস্থিত করতে হবে এবং গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে আজাজীলের জন্য মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিতে হবে। “হারুন তার নিজের ও তার বংশধরদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে তার নিজের গুনাহের কোরবানীর জন্য আনা সেই ষাঁড়টা নিয়ে জবাই করবে। মাবুদের সামনে যে কোরবানগাহ্‌ রয়েছে সে সেই কোরবানগাহ্‌ থেকে আগুনের পাত্রে জ্বলন্ত কয়লা ভরে নেবে আর মিহি করে গুঁড়ো করা দু’মুঠো খোশবু ধূপও নেবে। এগুলো নিয়ে সে পর্দার পিছনে যাবে। সেখানে মাবুদের সামনে সে আগুনের উপরে ধূপ দেবে। সেই ধূপের ধোঁয়ায় সাক্ষ্য-সিন্দুকের উপরের ঢাকনাটা ঢাকা পড়ে যাবে আর তাতে সে মারা পড়বে না। তারপর তাকে সেই ষাঁড়ের কিছুটা রক্ত নিয়ে আংগুল দিয়ে ঢাকনাটার সামনের দিকের কিনারায় তা ছিটিয়ে দিতে হবে। এর পর আংগুল দিয়ে তাকে আরও কিছুটা রক্ত নিয়ে ঢাকনার সামনে সাতবার ছিটিয়ে দিতে হবে। “তারপর তাকে লোকদের গুনাহের কোরবানীর ছাগলটা জবাই করতে হবে এবং তার রক্ত নিয়ে পর্দার পিছনে গিয়ে ষাঁড়ের রক্ত দিয়ে যা করবার কথা বলা হয়েছে তা-ই করতে হবে। সিন্দুকের ঢাকনার উপরে ও সামনে সেই রক্ত তাকে ছিটিয়ে দিতে হবে। বনি-ইসরাইলরা যে গুনাহ্‌ই করে থাকুক না কেন, তাদের সেই নাপাকী এবং অবাধ্যতার দরুন মহাপবিত্র স্থানের নাপাকী হারুন এইভাবেই ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। বনি-ইসরাইলদের নাপাকীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মিলন-তাম্বুর জন্যও তাকে সেই একই ব্যবস্থা করতে হবে। মহাপবিত্র স্থানে ঢুকে যতক্ষণ পর্যন্ত হারুন তার নিজের ও তার বংশধরদের এবং গোটা ইসরাইল জাতির গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কাজ শেষ করে বের হয়ে না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ মিলন-তাম্বুতে থাকতে পারবে না। মিলন-তাম্বু থেকে বের হয়ে এসে হারুন মাবুদের সামনে যে কোরবানগাহ্‌ রয়েছে সেখানে গিয়ে কোরবানগাহ্‌টার নাপাকী ঢাকা দেবে। সেই ষাঁড় ও ছাগলটার কিছু রক্ত নিয়ে সে তা কোরবানগাহের শিংগুলোতে লাগিয়ে দেবে। কোরবানগাহ্‌টি পাক-সাফ করবার জন্য এবং সেটা বনি-ইসরাইলদের নাপাকী থেকে পাক-পবিত্র করবার জন্য সে আংগুল দিয়ে তার উপর সাতবার রক্ত ছিটিয়ে দেবে। “মহাপবিত্র স্থান, মিলন-তাম্বু এবং কোরবানগাহের নাপাকী ঢাকা দেবার কাজ শেষ করে হারুন সেই জীবিত ছাগলটা নিয়ে আসবে। সে তার দুই হাত সেই জীবিত ছাগলটার মাথার উপর রাখবে এবং বনি-ইসরাইলদের সমস্ত অন্যায় ও অবাধ্যতা, অর্থাৎ তাদের সমস্ত গুনাহ্‌ স্বীকার করে তা ছাগলটার মাথার উপর চাপিয়ে দেবে। তারপর এই কাজের জন্য তৈরী হয়ে আছে এমন একজন লোককে দিয়ে সে সেটা মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেবে। সেই লোকটিই সেটাকে মরুভূমিতে ছেড়ে দিয়ে আসবে। ছাগলটা কোন নির্জন জায়গায় তাদের সমস্ত অন্যায় বয়ে বেড়াবে। “মহাপবিত্র স্থানে ঢুকবার আগে হারুন যে সব মসীনার কাপড় পরবে মিলন-তাম্বুতে ফিরে এসে সেগুলো তাকে খুলে সেখানেই রেখে দিতে হবে। তারপর সে পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় গিয়ে পানিতে গোসল করে ইমামের নিয়মিত কাপড়-চোপড় পরবে। এর পর সে বের হয়ে এসে তার নিজের ও লোকদের জন্য একটা করে পোড়ানো-কোরবানী দিয়ে তার নিজের ও লোকদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। গুনাহের কোরবানীর পশুর চর্বি তাকে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দিতে হবে। যে লোকটি আজাজীলের জন্য ছাগলটাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে, আর তারপর সে ছাউনির মধ্যে ঢুকতে পারবে। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য গুনাহের কোরবানীর যে ষাঁড় ও ছাগলের রক্ত মহাপবিত্র স্থানে নিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে সেগুলোর দেহ ছাউনির বাইরে নিয়ে গিয়ে চামড়া, গোশ্‌ত এবং গোবর সুদ্ধ সব কিছু পুড়িয়ে দিতে হবে। যে লোকটি তা পোড়াবার জন্য নিয়ে যাবে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে আর তার পরে সে ছাউনির মধ্যে ঢুকতে পারবে। “এর পর যা বলছি তা তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম হয়ে থাকবে। বছরের সপ্তম মাসের দশম দিনের দিন তোমরা প্রত্যেকে নিজের অন্তর ভেংগেচুরে কষ্টস্বীকার করবে। সেই দিন কোন কাজ করা চলবে না। ইসরাইলীয়ই হোক কিংবা বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকই হোক, সকলকেই তা মানতে হবে, কারণ এই দিনেই তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কাজ করে তোমাদের পাক-সাফ করে নেওয়া হবে, আর তার পরে তোমরা মাবুদের সামনে তোমাদের সমস্ত গুনাহ্‌ থেকে পাক-সাফ হবে। এই দিনটা হবে তোমাদের কাজ থেকে বিশ্রামের দিন। এই দিনে তোমরা প্রত্যেকে নিজের অন্তর ভেংগেচুরে কষ্টস্বীকার করবে। এটা হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। “এটা হবে তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। বছরে একবার করে বনি-ইসরাইলদের সব গুনাহের জন্য এই গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কাজ করতে হবে।” মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম মতই সব কিছু করা হয়েছিল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “মাবুদের এই হুকুম তুমি হারুন ও তার ছেলেদের এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জানিয়ে দাও। তাদের বল, বনি-ইসরাইলরা এখন যে সব পশু মাঠে-ময়দানে কোরবানী দিচ্ছে তা যাতে তারা মাবুদের কাছে নিয়ে আসে সেইজন্য এই হুকুম দেওয়া হল। তাদের সেগুলো মিলন-তাম্বুর দরজায় ইমামের কাছে এনে মাবুদের উদ্দেশে যোগাযোগ-কোরবানী হিসাবে কোরবানী দিতে হবে। মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের যে কোরবানগাহ্‌ রয়েছে তার গায়ে সেই পশুর রক্ত ইমামকে ছিটিয়ে দিতে হবে আর মাবুদকে খুশী করবার গন্ধ হিসাবে সেই পশুর চর্বি পুড়িয়ে দিতে হবে। মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে ছাগ-দেবতাদের উদ্দেশে পশু কোরবানী দিয়ে তাদের আর নিজেদের বিকিয়ে দেওয়া চলবে না। এটা একটা স্থায়ী নিয়ম হিসাবে বংশের পর বংশ ধরে তাদের পালন করতে হবে। “কোন ইসরাইলীয় কিংবা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যদি রক্ত খায় তবে তার দিক থেকে আমি আমার মুখ ফিরিয়ে নেব এবং তার জাতি থেকে তাকে মুছে ফেলব, কারণ রক্তেই থাকে প্রাণীর প্রাণ। সেইজন্যই তোমাদের প্রাণের বদলে আমি তা দিয়ে কোরবানগাহের উপরে তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা দিয়েছি। রক্তের মধ্যে প্রাণ আছে বলেই তা গুনাহ্‌ ঢাকা দেয়। সেইজন্যই আমি বনি-ইসরাইলদের বলছি, তারা এবং তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যেন রক্ত না খায়। কোন ইসরাইলীয় কিংবা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যদি খাওয়ার মত কোন পশু বা পাখী শিকার করে আনে তবে তাকে তার রক্ত বের করে সেই রক্ত মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হবে, কারণ সমস্ত প্রাণীর প্রাণ রয়েছে তার জীবন্ত দেহের রক্তে। সেইজন্যই আমি বনি-ইসরাইলদের বলেছি যেন তারা কোন প্রাণীর রক্ত না খায়, কারণ রক্তই হল প্রত্যেকটি প্রাণীর প্রাণ। যে সেই রক্ত খাবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। “কেউ যদি মরা পশুর বা বুনো জন্তুতে ছিঁড়ে ফেলা পশুর গোশ্‌ত খায়- সে ইসরাইলীয়ই হোক বা তাদের মধ্যে বাস-করা অন্য জাতির লোকই হোক- তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে। সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে, তারপর সে পাক-সাফ হবে। কিন্তু সে যদি কাপড়-চোপড় না ধোয় এবং গোসল না করে তবে তাকে তার অন্যায়ের জন্য দায়ী করা হবে।” সেইজন্য তোমরা যেখানে বাস করতে সেই মিসর দেশের লোকেরা যা করে তোমরা তা করবে না এবং আমি যেখানে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি সেই কেনান দেশের লোকেরা যা করে তা-ও তোমরা করবে না। তোমরা সেই সব লোকদের চালচলন অনুসারে চলবে না। তোমাদের চলতে হবে আমার শরীয়ত অনুসারে। আমার দেওয়া নিয়ম তোমাদের যত্নের সংগে পালন করতে হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। আমার নিয়ম ও শরীয়ত তোমাদের পালন করতে হবে, কারণ যে তা পালন করবে সে তার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে। আমি মাবুদ। “নিকট সম্বন্ধ আছে এমন কোন আত্মীয়ার সংগে সহবাস করা চলবে না। আমি মাবুদ। তোমাদের মধ্যে কেউ যেন নিজের মায়ের সংগে সহবাস করে পিতার অসম্মান না করে। সে তার মা; মায়ের সংগে সহবাস করা চলবে না। সৎমায়ের সংগে সহবাস করা চলবে না। তা করলে পিতাকে অসম্মান করা হবে। নিজের বোন বা সৎবোনের সংগে সহবাস করা চলবে না- সে পিতার মেয়ে হোক বা মায়ের মেয়ে হোক, আর তাদের জন্ম একই বাড়ীতে হোক বা ভিন্ন ভিন্ন জায়গাতেই হোক। ছেলে বা মেয়ের ঘরের নাতনীর সংগে সহবাস করা চলবে না; তাতে নিজেরই অসম্মান হবে। সৎমায়ের গর্ভে যে বোনের জন্ম হয়েছে তার সংগে সহবাস করা চলবে না। সে বোন। ফুফুর সংগে সহবাস করা চলবে না, কারণ তার সংগে পিতার রক্তের সম্বন্ধ রয়েছে। খালার সংগে সহবাস করা চলবে না, কারণ তার সংগে মায়ের রক্তের সম্বন্ধ রয়েছে। পিতার কোন ভাইয়ের স্ত্রীর সংগে সহবাস করা চলবে না, কারণ সে চাচী। ছেলের স্ত্রীর সংগে সহবাস করা চলবে না। সে ছেলের স্ত্রী বলেই তার সংগে সহবাস করা চলবে না। ভাইয়ের স্ত্রীর সংগে সহবাস করা চলবে না। তা করলে ভাইকে অসম্মান করা হবে। একই সংগে কোন স্ত্রীলোক ও তার মেয়ের সংগে সহবাসের সম্বন্ধ রাখা চলবে না। সেই স্ত্রীলোকের ছেলে বা মেয়ের ঘরের নাতনীর সংগে সহবাস করা চলবে না, কারণ সেই স্ত্রীলোকের সংগে তাদের রক্তের সম্বন্ধ রয়েছে। এটা একটা নোংরা কাজ। স্ত্রী বেঁচে থাকতে স্ত্রীর বোনকে সতীন হিসাবে বিয়ে করা চলবে না। “মাসিকের নাপাক অবস্থার সময় কোন স্ত্রীলোকের সংগে সহবাস করবার জন্য যাওয়া চলবে না। অন্য কারও স্ত্রীর সংগে সহবাস করে নিজেকে নাপাক করা চলবে না। “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার ছেলে বা মেয়েকে মোলক-দেবতার কাছে আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী না করে কিংবা অন্য কোন ভাবে নিজের আল্লাহ্‌র নামের পবিত্রতা নষ্ট না করে। আমি মাবুদ। “স্ত্রীলোকের সংগে সহবাস করবার মত করে পুরুষের সংগে পুরুষের সহবাস করা চলবে না। এটা একটা জঘন্য কাজ। পশুর সংগে সহবাস করে কোন পুরুষের নিজেকে নাপাক করা চলবে না। কোন পশুর সংগে কোন স্ত্রীলোকের সহবাস করা চলবে না। এই সব সহবাস স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে। “এই রকমের কোন কাজ করে তোমাদের মধ্যে কেউ যেন নিজেকে নাপাক না করে, কারণ তোমাদের সামনে থেকে যে সব জাতিকে আমি তাড়িয়ে দেব তারাও ঐভাবে নিজেদের নাপাক করেছে। এতে তাদের দেশটা পর্যন্ত নাপাক হয়ে গেছে। তাই অন্যায়ের জন্য দেশটাকে আমি শাস্তি দিচ্ছি আর দেশটাও তার লোকদের বমি করে ফেলে দিতে যাচ্ছে। কিন্তু তোমরা আমার নিয়ম ও শরীয়ত মেনে চলবে। তোমাদের জাতির কিংবা তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যেন এই রকমের কোন জঘন্য কাজ না করে। আগে থেকে যারা ঐদেশে বাস করে আসছে তারা ঐ সব কাজ করে দেশটাকে নাপাক করে ফেলেছে। তোমরাও যদি দেশটা নাপাক কর তবে সেখানকার আগের জাতিদের মত দেশটা তোমাদেরও বমি করে ফেলে দেবে। “যদি কেউ এই ধরনের কোন জঘন্য কাজ করে তবে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। আমার হুকুমগুলো তোমরা মেনে চলবে এবং সেখানে পৌঁছে আগের বাসিন্দাদের জঘন্য চালচলনের কোনটাই তোমরা গ্রহণ করবে না। এই সব দিয়ে তোমরা নিজেদের নাপাক করবে না। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ।” তোমরা তোমাদের পিতা-মাতাকে সম্মান করবে এবং আমার বিশ্রামবার পালন করবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। মূর্তিপূজা করা তোমাদের চলবে না কিংবা নিজেদের এবাদতের জন্য ছাঁচে ফেলে ধাতু দিয়ে কোন দেব-দেবী তৈরী করা চলবে না। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “তোমরা যখন মাবুদের উদ্দেশে কোন যোগাযোগ-কোরবানী দেবে তখন তা এমন ভাবে দেবে যাতে মাবুদ তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হন। কোরবানীর দিনে কিংবা তার পরের দিনের মধ্যেই কোরবানীর গোশ্‌ত তোমাদের খেয়ে ফেলতে হবে। তৃতীয় দিনে যদি কিছু বাকী থেকেই যায় তবে তা পুড়িয়ে দিতে হবে, কারণ তৃতীয় দিনে সেই গোশ্‌ত নাপাক হয়ে যায়। যদি কেউ সেই গোশ্‌ত খায় তবে মাবুদ সেই কোরবানী আর কবুল করবেন না। যে তা খাবে তাকে তার অন্যায়ের জন্য দায়ী করা হবে, কারণ তাতে আমার পাক-পবিত্র জিনিসকে অপবিত্র করা হবে। সেই লোককে তার জাতি থেকে মুছে ফেলতে হবে। “ফসল কাটবার সময়ে তোমরা ক্ষেতের কিনারার ফসল কাটবে না এবং ক্ষেতে যা পড়ে থাকবে তা-ও কুড়াবে না। আংগুর ক্ষেত থেকে আংগুর তোলা হয়ে গেলে আবার তোমরা সেই ক্ষেতে আংগুর তুলতে যাবে না এবং পড়ে থাকা আংগুর কুড়াবে না। গরীব ও ভিন্ন জাতির লোকদের জন্য তা রেখে দিতে হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “চুরি করা চলবে না, কাউকে ঠকানো চলবে না, মিথ্যা কথা বলা চলবে না। আমার নাম নিয়ে মিথ্যা ওয়াদা করে তোমাদের আল্লাহ্‌র নামের পবিত্রতা নষ্ট করা চলবে না। আমি মাবুদ। “কোন মানুষের উপর অন্যায় সুবিধা নেওয়া কিংবা জুলুম করে তার জিনিস নেওয়া চলবে না। মজুরের দিনের পাওনা দিনেই দিয়ে দিতে হবে; তা সকাল পর্যন্ত আট্‌কে রাখা চলবে না। যে কানে শোনে না তাকে বদদোয়া দেবে না কিংবা যে চোখে দেখে না তার পথে উচোট খাবার মত কোন জিনিস রাখবে না। তোমরা তোমাদের আল্লাহ্‌কে ভয় করে চলবে। আমি মাবুদ। “অন্যায় বিচার করা চলবে না। বিচারে ছোট-বড় কারও পক্ষ নেওয়া চলবে না; তোমরা প্রত্যেকের প্রতি ন্যায়বিচার করবে। কারও নিন্দা করে বেড়ানো চলবে না। কোন মানুষের প্রাণের ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু করা চলবে না। আমি মাবুদ। “অন্যের প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা পুষে রাখা চলবে না। অন্যের দোষ অবশ্যই দেখিয়ে দিতে হবে যাতে তার দরুন তোমরা নিজেরা দোষী না হও। প্রতিশোধ নেওয়া চলবে না, কিংবা কারও বিরুদ্ধে মনের মধ্যে হিংসার ভাব পুষে রাখা চলবে না। প্রত্যেক মানুষকে নিজের মত করে মহব্বত করতে হবে। আমি মাবুদ। “আমার নিয়ম মেনে চলতে হবে। বিভিন্ন জাতের পশুদের মধ্যে সহবাস ঘটানো চলবে না। একই ক্ষেতে দুই রকম বীজ বোনা চলবে না। দুই জাতের সুতায় বোনা কাপড় পরা চলবে না। “অন্যের সংগে বিয়ের সম্বন্ধ করা হয়েছে অথচ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয় নি কিংবা মুক্তি দেওয়া হয় নি এমন কোন বাঁদীর সংগে যদি কেউ সহবাস করে তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হবে। সেই দু’জনকে হত্যা করা চলবে না কারণ মেয়েটিকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয় নি। কিন্তু সেই লোককে মাবুদের উদ্দেশে তার দোষের কোরবানী হিসাবে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে একটা ভেড়া নিয়ে আসতে হবে। দোষের কোরবানীর সেই ভেড়াটা দিয়ে ইমামকে মাবুদের সামনে তার সেই গুনাহ্‌ ঢাকা দিতে হবে। তাতে তার সেই গুনাহ্‌ মাফ করা হবে। “তোমাদের দেশে গিয়ে যদি তোমরা কোন ফলের গাছ লাগাও তবে তার ফল তোমাদের তিন বছর পর্যন্ত হারাম ফল বলে ধরতে হবে। ঐ সময়ের মধ্যে ঐ ফল খাওয়া তোমাদের চলবে না। চতুর্থ বছরে গাছের সমস্ত ফল মাবুদের প্রশংসার জন্য তাঁর উদ্দেশে কোরবানী করতে হবে। পঞ্চম বছর থেকে সেই গাছের ফল তোমাদের জন্য হালাল হবে। এতে তোমাদের গাছে প্রচুর ফলন হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “রক্তসুদ্ধ কোন গোশ্‌ত খাওয়া চলবে না। লক্ষণ-বিদ্যা কিংবা মায়াবিদ্যা ব্যবহার করা চলবে না। মাথার দু’পাশের চুল কাটা বা দাড়ির আগা ছাঁটা চলবে না। মৃত লোকদের জন্য শোক-প্রকাশ করতে গিয়ে শরীরের কোন জায়গা ক্ষত করা চলবে না। শরীরে কোন উল্‌কি-চিহ্ন দেওয়া চলবে না। আমি মাবুদ। “নিজের মেয়েকে বেশ্যা বানিয়ে তাকে নীচে নামানো চলবে না। তা করলে দেশে বেশ্যাগিরি বেড়ে যাবে এবং শেষে দেশ নোংরামিতে ভরে যাবে। আমার হুকুম করা বিশ্রামের দিনগুলো পালন করতে হবে এবং আমার আবাস-তাম্বুর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আমি মাবুদ। “যারা ভূতের মাধ্যম হয় কিংবা যারা ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে তাদের কাছে যাওয়া চলবে না, কারণ তারা তোমাদের নাপাক করে তুলবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “যারা বৃদ্ধ তারা কাছে আসলে উঠে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সম্মান করতে হবে। তোমরা তোমাদের আল্লাহ্‌কে ভয় করবে। আমি মাবুদ। “তোমাদের দেশে তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকের সংগে খারাপ ব্যবহার করা চলবে না। নিজের জাতির লোকের সংগে যেমন ব্যবহার করা হয় তার সংগে তেমনই ব্যবহার করতে হবে। তাকে নিজের মত করে মহব্বত করতে হবে, কারণ তোমরাও মিসরীয়দের মধ্যে অন্য জাতির লোক ছিলে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “বিচারে রায় দিতে অথবা কোন কিছু লম্বায় কিংবা ওজনে কিংবা পরিমাণে কতখানি তা মাপতে গিয়ে তোমরা অন্যায় কোরো না। তোমাদের দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা এবং অন্যান্য মাপের জিনিস যেন ঠিক হয়। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। মিসর দেশ থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি। আমার সমস্ত নিয়ম তোমাদের পালন করতে হবে এবং সমস্ত শরীয়ত মেনে চলতে হবে। আমি মাবুদ।” তার দিক থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নেব এবং তার জাতি থেকে আমি তাকে মুছে ফেলব, কারণ মোলক-দেবতার কাছে তার সন্তান কোরবানী করে সে আমার পবিত্র তাম্বু নাপাক করেছে এবং আমার পবিত্র নামের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। মোলক-দেবতার কাছে সন্তান কোরবানী করবার সময়ে যদি দেশের লোকেরা তা দেখেও না দেখে এবং কোরবানীদাতাকে হত্যা না করে, তবে সেই কোরবানীদাতা এবং তার পরিবার থেকে আমি নিজেই মুখ ফিরিয়ে নেব। তাকে এবং তার সংগে যারা আমার প্রতি বেঈমানী করে মোলক-দেবতার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে তাদের আমি ইসরাইল জাতি থেকে মুছে ফেলব। “যে লোক আমার প্রতি বেঈমানী করে ভূতের মাধ্যমের কাছে যায় কিংবা ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে এমন লোকের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয় আমি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব এবং তার জাতি থেকে তাকে মুছে ফেলব। তোমরা আমার উদ্দেশ্যে নিজেদের আলাদা করে নিয়ে পাক-পবিত্র হও, কারণ আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। আমার নিয়ম তোমাদের ধরে রাখতে হবে এবং সেইমত চলতে হবে। আমি মাবুদ, আমিই তোমাদের পাক-পবিত্র করেছি। “যার কথায় মা-বাবার প্রতি অসম্মান থাকে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। সেই অসম্মানের দরুন সে নিজের মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী। “যদি কেউ তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সংগে, অর্থাৎ অন্য কোন লোকের স্ত্রীর সংগে জেনা করে তবে জেনাকারী এবং জেনাকারিণী দু’জনকেই হত্যা করতে হবে। যে তার সৎমায়ের সংগে সহবাস করে সে তার পিতাকে অসম্মান করে। তা করলে তাকে এবং তার সৎমাকে হত্যা করতে হবে। তারা নিজেদের মৃত্যুর জন্য নিজেরাই দায়ী। কেউ যদি তার ছেলের স্ত্রীর সংগে সহবাস করে তবে তাদের দু’জনকেই হত্যা করতে হবে। তাদের সহবাস স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে। তারা নিজেদের মৃত্যুর জন্য নিজেরাই দায়ী। স্ত্রীলোকের সংগে সহবাস করবার মত করে যদি কেউ পুরুষের সংগে সহবাস করে তবে তা দু’জনের পক্ষেই একটা জঘন্য ব্যাপার। তাদের হত্যা করতে হবে। তারা নিজেদের মৃত্যুর জন্য নিজেরাই দায়ী। যে লোক কোন মেয়েকে এবং তার মাকেও বিয়ে করে সে নোংরা কাজ করে। যদি কেউ তা করে তবে সেই লোক ও সেই দু’জন স্ত্রীলোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে যাতে এই রকম নোংরা ব্যাপার তোমাদের মধ্যে না ঘটে। কোন পশুর সংগে কেউ যদি সহবাস করে তবে তাকে ও সেই পশুটাকে হত্যা করতে হবে। কোন স্ত্রীলোক যদি কোন পশুর সংগে সহবাস করবার চেষ্টা করে তবে সেই স্ত্রীলোক ও সেই পশুটাকে হত্যা করতে হবে। তাদের হত্যা করতেই হবে। তারা নিজেদের মৃত্যুর জন্য নিজেরাই দায়ী। “নিজের বোনকে অথবা সৎবোনকে বিয়ে করে তার সংগে সহবাস করা একটা লজ্জার কাজ- সেই বোন মায়ের দিক থেকেই হোক কিংবা পিতার দিক থেকেই হোক। যারা তা করবে লোকদের চোখের সামনেই তাদের হত্যা করতে হবে। এই কাজ করে বোনকে অসম্মান করবার জন্য তাকে দায়ী করা হবে। কোন স্ত্রীলোকের মাসিকের সময়ে যে লোক তার সংগে সহবাস করে সে সেই স্ত্রীলোকটির রক্তস্রাবের মর্যাদা দেয় না আর সেই স্ত্রীলোকটি নিজেও তার মর্যাদা রাখে না। তাদের দু’জনকেই তাদের জাতি থেকে মুছে ফেলতে হবে। কেউ যেন খালা বা ফুফুর সংগে সহবাস না করে। এতে রক্তের সম্বন্ধ রয়েছে এমন একজন আত্মীয়াকে অসম্মান করা হয়। এর জন্য তাদের দু’জনকেই দায়ী করা হবে। যদি কেউ চাচী বা মামীর সংগে সহবাস করে, তবে সে তার চাচা বা মামার অসম্মান করে। এর জন্য তাদের দু’জনকেই দায়ী করা হবে। তারা সন্তানহীন অবস্থায় মরবে। ভাই জীবিত থাকতে যে তার স্ত্রীকে বিয়ে করে সে একটা জঘন্য কাজ করে। এতে সে তার ভাইয়ের অসম্মান করে। তাদের কোন সন্তান হবে না। “আমি তোমাদের যে দেশে বাস করবার জন্য নিয়ে যাচ্ছি সেই দেশ যাতে তোমাদের বমি করে ফেলে না দেয় সেইজন্য আমার সমস্ত নিয়ম ও শরীয়ত তোমাদের পালন করতে হবে। তোমাদের সামনে থেকে আমি যে সব জাতিকে তাড়িয়ে দিতে যাচ্ছি তোমরা ঐ সব জাতির চালচলন অনুসারে চলবে না। তাদের ঐ সব চালচলনের জন্যই আমি তাদের খুব ঘৃণার চোখে দেখি। আমি তোমাদের বলেছিলাম যে, তাদের দেশ তোমাদের অধীনে আসবে। দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই এমন একটা দেশ সম্পত্তি হিসাবে আমি তোমাদের দেব। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। অন্য সব জাতি থেকে আমিই তোমাদের আলাদা করেছি। সেইজন্য পশু এবং পাখীর মধ্যে কোন্‌গুলো পাক আর কোন্‌গুলো নাপাক তা বুঝে তোমাদের চলতে হবে। যে সব পশু-পাখী বা মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো ছোটখাটো প্রাণী তোমাদের জন্য আমি নাপাক বলে আলাদা করে দিয়েছি, সেগুলোর কোনটা দিয়েই যেন তোমরা নিজেদের ঘৃণার পাত্র করে না তোল। আমি মাবুদ পবিত্র বলে তোমাদেরও পবিত্র হতে হবে; আর আমিই তোমাদের আমার নিজের বান্দা হওয়ার জন্য অন্য সব জাতি থেকে আলাদা করে নিয়েছি। “যে সব পুরুষ বা স্ত্রীলোক ভূতের মাধ্যম হয় কিংবা যারা ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে তাদের শাস্তি হবে মৃত্যু। তাদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। নিজেদের মৃত্যুর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি ইমামদের, অর্থাৎ হারুনের ছেলেদের বল যে, তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কেউ মারা গেলে তার দরুন কোন ইমামের নিজেকে নাপাক করা চলবে না। তবে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই- এই রকম কাছে সম্বন্ধের লোকদের জন্য তার নিজেকে নাপাক করা চলবে। তা ছাড়া বিয়ে হয় নি বলে যে বোন তার সংসারে আছে তার জন্যও তার নিজেকে নাপাক করা চলবে। স্ত্রীর দিক থেকে যারা আত্মীয় তাদের জন্য নিজেকে নাপাক করে পাক-পবিত্র অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় তার নেমে আসা চলবে না। “ইমামদের মাথা কামানো, দাড়ির আগা ছাঁটা কিংবা শরীরের কোন জায়গা ক্ষত করা চলবে না। তা করে তারা তাদের আল্লাহ্‌র নামের পবিত্রতা নষ্ট করতে পারবে না। তারা যেন পাক-পবিত্র হয়ে থাকে। ইমামেরাই মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দেয়, আর সেইজন্যই তাদের পাক-পবিত্র হয়ে থাকতে হবে। এই কোরবানীর জিনিসই হল তাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী দেওয়া খাবার। বেশ্যা, পতিতা বা স্বামীর তালাক দেওয়া কোন স্ত্রীলোককে তাদের বিয়ে করা চলবে না। যিনি তাদের আল্লাহ্‌ তাঁর উদ্দেশ্যে তারা পাক-পবিত্র। হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরাও ইমামদেরকে পাক-পবিত্র লোক হিসাবে দেখবে, কারণ তারা তোমাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে খাবার কোরবানী দেবার কাজ করে। পাক-পবিত্র লোক বলেই তাদের দেখতে হবে, কারণ আমি মাবুদ নিজেই পবিত্র এবং আমিই তোমাদের পাক-পবিত্র করেছি। কোন ইমামের মেয়ের যদি বেশ্যাগিরির দরুন পতন হয় তবে সে তার পিতাকেই পাক-পবিত্র অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় নামিয়ে আনে। সেই মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। “মহা-ইমাম, অর্থাৎ ভাইদের মধ্যে যার মাথায় অভিষেক-তেল ঢালা হয়েছে এবং বহাল করবার কাজ দ্বারা যে মহা-ইমামের পবিত্র পোশাক পরবার অধিকার পেয়েছে, শোক-প্রকাশের জন্য তার চুলের বাঁধন খুলে দেওয়া কিংবা তার কাপড় ছেঁড়া চলবে না। একমাত্র কুমারী মেয়েকে সে বিয়ে করতে পারবে। বিধবা কিংবা স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে কিংবা বেশ্যা হয়ে যে নিজেকে নাপাক করেছে এমন কোন স্ত্রীলোককে তার বিয়ে করা চলবে না। কেবলমাত্র নিজের জাতির কুমারী মেয়েকেই তার বিয়ে করা চলবে, যাতে সে গোটা বংশের মধ্যে তার নিজের সন্তানদের পাক-পবিত্র অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় নামিয়ে না আনে। আমি মাবুদ, আমিই মহা-ইমামকে পাক-পবিত্র করেছি।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুনকে বল যে, শরীরে খুঁত নিয়ে তার কোন বংশধর তার আল্লাহ্‌র উদ্দেশে খাবার কোরবানী দিতে কোরবানগাহের কাছে যেতে পারবে না। শরীরে খুঁত নিয়ে ইমাম হারুনের কোন বংশধর কোরবানগাহের কাছে গিয়ে মাবুদের উদ্দেশে আগুন্তেদেওয়া কোন কোরবানী দিতে পারবে না। খুঁত রয়েছে বলে সে কোরবানগাহের কাছে গিয়ে তার আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোন খাবার কোরবানী দিতে পারবে না। অবশ্য আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী দেওয়া খাবারের মধ্যে পবিত্র এবং মহাপবিত্র সব খাবারই সে খেতে পারবে, কিন্তু তার শরীরে খুঁত আছে বলে সে পবিত্র স্থানের পর্দার কাছে কিংবা কোরবানগাহের সামনে গিয়ে আমার পবিত্র জায়গাগুলোর পবিত্রতা নষ্ট করতে পারবে না। আমি মাবুদ, আমিই ইমামদের পাক-পবিত্র করেছি।” মূসা গিয়ে এই সব কথা হারুন ও তাঁর ছেলেদের এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জানালেন। এর পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুন ও তার ছেলেদের বল, আমার উদ্দেশে বনি-ইসরাইলদের কোরবানী-দেওয়া পবিত্র জিনিস তাদের সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তা না করলে তারা আমার পবিত্র নামের পবিত্রতা নষ্ট করবে। আমি মাবুদ। তুমি তাদের বলবে তাদের বংশধরদের মধ্যে যদি কেউ নাপাক অবস্থায় মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেওয়া কোন পবিত্র জিনিসের কাছে আসে তবে তাকে আমার সামনে থেকে মুছে ফেলতে হবে। আমি মাবুদ। সূর্য ডুববার পর যখন সে পাক-সাফ হবে তখন সে তা খেতে পারবে, কারণ ওগুলোই তার খাবার। সে কোন মরা পশু কিংবা বুনো জন্তুতে ছিঁড়ে ফেলা পশুর গোশ্‌ত খেয়ে নিজেকে নাপাক করতে পারবে না। আমি মাবুদ। “আমি ইমামদের যে সব নির্দেশ দিয়েছি তা তাদের পালন করতে হবে। তা না করলে তারা দোষী হবে এবং নাপাক হওয়ার দরুন তারা মারা যাবে। আমি মাবুদই তাদের পাক-পবিত্র করেছি। “ইমামের পরিবারের লোক ছাড়া আর কেউ কোরবানী দেওয়া পবিত্র জিনিস খেতে পারবে না। ইমামের কোন মেহমান বা মজুর তা খেতে পারবে না। কিন্তু ইমামের কেনা কোন গোলাম এবং তার বাড়ীতে জন্মেছে এমন কোন গোলাম তা খেতে পারবে। ইমামের মেয়ে যদি ইমাম ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করে তবে সে কোরবানী দেওয়া পবিত্র জিনিস খেতে পারবে না। কিন্তু ইমামের কোন বিধবা মেয়ে কিংবা স্বামীর ছেড়ে দেওয়া সন্তানহীন মেয়ে যদি পিতার বাড়ীতে আগের মত থাকবার জন্য ফিরে আসে তবে সে তার পিতার খাবারের অংশ পাবে। ইমামের পরিবারের নয় এমন কেউ তা খেতে পারবে না। যদি সে ভুল করে কোরবানী দেওয়া পবিত্র জিনিস খেয়ে ফেলে তবে সে ইমামকে ক্ষতিপূরণ দেবে। সেই জিনিসের দামের সংগে তাকে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিতে হবে। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুন ও তার ছেলেদের এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বল, কোন ইসরাইলীয় কিংবা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যদি মানত পূরণের জন্য কিংবা নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানী হিসাবে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর কোন দান নিয়ে আসে, তবে সেটা হতে হবে একটা নিখুঁত ষাঁড়, ভেড়া কিংবা ছাগল। তা না হলে সেই কোরবানীতে তিনি তার উপর সন্তুষ্ট হবেন না। খুঁত রয়েছে এমন কিছু যেন সে না আনে, কারণ তাতে তার কোন উপকার হবে না। যদি কেউ মানত পূরণের জন্য কিংবা নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানী হিসাবে মাবুদের কাছে যোগাযোগ-কোরবানী দিতে চায় এবং তার জন্য গরু, ভেড়া বা ছাগল নিয়ে আসে তবে সেটা হতে হবে নিখুঁত। তার দেহে কোন খুঁত থাকলে সেটা কোরবানী হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। মাবুদের উদ্দেশে কোরবানীর জন্য কেউ যেন এমন কোন পশু না আনে যার চোখ অন্ধ কিংবা যার হাড় ভেংগে গেছে কিংবা যার দেহের কোন অংশ কাটা বা কেটে ফেলা হয়েছে কিংবা যার দেহে পুঁজ-পড়া ঘা কিংবা চুলকানি রোগ কিংবা খোস-পাঁচড়া রয়েছে। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে এগুলোর কোনটাই যেন কোরবানগাহের উপর তোলা না হয়। কিন্তু যে গরু বা ভেড়ার দেহের কোন অংশ অস্বাভাবিক ভাবে লম্বা বা খাটো তেমন গরু বা ভেড়া নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানীর মধ্যে থাকতে পারে, তবে মানত পূরণ করবার কোরবানী হিসাবে তা গ্রহণ করা হবে না। কোন পশুর অণ্ডকোষ যদি থেঁৎলে কিংবা পিষে কিংবা ছিঁড়ে কিংবা কেটে গিয়ে থাকে তবে তা তোমরা মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিয়ো না। তোমাদের নিজেদের দেশে গিয়েও তোমরা তা কোরো না। অন্য জাতির কোন লোকের হাত থেকে তোমরা এই রকম পশু নিয়ে তোমাদের আল্লাহ্‌র কোরবানী দেওয়া খাবার হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। সেগুলোতে খুঁত এবং দোষ রয়েছে বলে তাতে তোমাদের কোন উপকার হবে না।” তারপর মাবুদ মূসাকে বললেন, “জন্মের পরে গরু, ভেড়া বা ছাগলের বাচ্চাকে তার মায়ের সংগে সাত দিন পর্যন্ত থাকতে দিতেই হবে। আট দিনের দিন থেকে সেগুলো মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে। গাভী ও তার বাছুর কিংবা ভেড়ী ও তার বাচ্চা একই দিনে কাটা চলবে না। মাবুদের উদ্দেশে যদি তোমরা কোন কৃতজ্ঞতা-কোরবানী দাও তবে তা এমনভাবে করতে হবে যাতে তিনি তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হন। কোরবানীর দিনেই তার গোশ্‌ত খেয়ে ফেলতে হবে; পরের দিন সকাল পর্যন্ত তার কিছু রেখে দেওয়া চলবে না। আমি মাবুদ। আমার হুকুম তোমাদের মানতে হবে এবং সেইমত চলতে হবে। আমি মাবুদ। তোমরা আমার পবিত্র নামের পবিত্রতা নষ্ট কোরো না। তোমরা আমাকে পবিত্র বলে মান্য করবে। আমি মাবুদই তোমাদের পাক-পবিত্র করেছি। তোমাদের আল্লাহ্‌ হওয়ার জন্যই আমি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। আমি মাবুদ।” সপ্তার ছয় দিন তোমরা কাজ করতে পারবে কিন্তু সপ্তম দিনটা হবে বিশ্রামবার, অর্থাৎ পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিলের দিন। এই দিন তোমরা কোন কাজ করবে না। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন এই দিনটা হবে মাবুদের উদ্দেশে বিশ্রামবার।” মাবুদের যে সব নির্দিষ্ট করা ঈদ, অর্থাৎ যে সব পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল তোমরা সেগুলোর নির্দিষ্ট দিনে ঘোষণা করবে তা এই: বছরের প্রথম মাসের চৌদ্দ তারিখের সন্ধ্যাবেলায় মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ শুরু হবে। সেই মাসেরই পনেরো তারিখে মাবুদের উদ্দেশে খামিহীন রুটির ঈদ শুরু হবে। সাত দিন পর্যন্ত তোমাদের খামিহীন রুটি খেতে হবে। এই সাত দিনের প্রথম দিনে পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। এই সাত দিনের প্রত্যেক দিন মাবুদের উদ্দেশে তোমাদের একটা করে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। সপ্তম দিনে তোমাদের পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে এবং সেই দিন তোমরা কোন পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে না। ইমাম সেই আঁটি নিয়ে মাবুদের সামনে দোলাবে। তাতে মাবুদ তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। ইমামকে তা দোলাতে হবে বিশ্রামবারের পরের দিন। ইমাম যেদিন সেই আঁটি দোলাবে সেই দিন মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে এক বছরের একটা নিখুঁত ভেড়ার বাচ্চা তোমাদের কোরবানী দিতে হবে। তার সংগে শস্য-কোরবানী হিসাবে তেলের ময়ান দেওয়া তিন কেজি ছ’শো গ্রাম মিহি ময়দা কোরবানী করতে হবে। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। এর সংগে ঢালন-কোরবানী হিসাবে এক লিটার আংগুর-রস দিতে হবে। তোমাদের আল্লাহ্‌র কাছে এই কোরবানী করবার দিন পর্যন্ত তোমাদের এই নতুন শস্য থেকে খাওয়া চলবে না। তা ছাড়া তা থেকে তৈরী কোন রুটি কিংবা তা আগুনে ঝল্‌সে নিয়েও খাওয়া চলবে না। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন বংশের পর বংশ ধরে এটা হবে তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। “বিশ্রামবারের পরের দিন, অর্থাৎ যেদিন তোমরা দোলন-কোরবানীর জন্য শস্যের আঁটি নিয়ে আসবে, সেই দিন থেকে গুণে পর পর সাতটা সপ্তা বাদ দিতে হবে। এই সপ্তম সপ্তার বিশ্রামবারের পরের দিন, অর্থাৎ দোলন-কোরবানীর পর পঞ্চাশ দিনের দিন মাবুদের উদ্দেশে তোমরা নতুন গম কোরবানী করবে। তোমরা বাড়ী থেকে মাবুদের উদ্দেশে দোলন-কোরবানী হিসাবে তোমাদের প্রথমে তোলা ফসলের কিছু অংশ নিয়ে আসবে। সেই দোলন-কোরবানীর জিনিস হবে সাড়ে তিন কেজি মিহি ময়দার তৈরী খামি দেওয়া দু’টা রুটি। এই রুটির সংগে সাতটা এক বছরের নিখুঁত ভেড়ার বাচ্চা, একটা ষাঁড় এবং দু’টা ভেড়া আনতে হবে। এই পশুগুলো দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে, আর তার সংগে থাকবে তার সংগেকার নিয়মিত শস্য-কোরবানী এবং ঢালন-কোরবানী। এগুলো সব আগুনে দেওয়া-কোরবানী, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। তারপর তোমরা গুনাহের কোরবানী হিসাবে একটা ছাগল এবং যোগাযোগ-কোরবানী হিসাবে এক বছরের দু’টা ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী করবে। ইমাম মাবুদের সামনে দোলন-কোরবানী হিসাবে সেই দু’টা ভেড়ার বাচ্চা এবং প্রথমে তোলা ফসলের তৈরী রুটি নিয়ে দোলাবে। এগুলো মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেওয়া পবিত্র জিনিস যা ইমামের পাওনা। সেই দিন তোমরা একটা পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল ঘোষণা করবে। সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন বংশের পর বংশ ধরে এটা হবে তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। “তোমরা যখন তোমাদের জমির ফসল কাটবে তখন জমির কিনারার ফসলগুলো তোমরা কাটবে না এবং পড়ে থাকা শস্য কুড়িয়ে নেবে না। সেগুলো গরীব এবং দেশে বাস করা অন্য জাতির লোকদের জন্য ফেলে রাখতে হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ।” সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। সেই দিন মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “এই সপ্তম মাসের দশ দিনের দিনটা হবে গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ঈদ। সেই দিন তোমাদের একটা পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে এবং নিজেদের অন্তর ভেংগেচুরে কষ্টস্বীকার করতে হবে। তোমাদের সেই দিন মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। সেই দিন তোমাদের কোন কাজ করা চলবে না, কারণ সেটাই হল গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ঈদ। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে সেই দিন তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হবে। সেই দিন যে কষ্টস্বীকার করবে না তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। সেই দিন যদি কেউ কোন কাজ করে তবে আমি তাকে তার জাতির মধ্য থেকে ধ্বংস করে ফেলব। সেই দিন তোমাদের কোন কাজই করা চলবে না। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন বংশের পর বংশ ধরে এটাই হল তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। সেই দিনটা হবে তোমাদের জন্য একটা বিশ্রামের দিন। সেই দিন তোমাদের কষ্টস্বীকার করতে হবে। সেই মাসের নবম দিনের সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরের দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমরা এই বিশ্রামের দিন পালন করবে।” এই সাত দিনের প্রথম দিনে তোমাদের পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে। সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। এই সাত দিনের প্রত্যেক দিন মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। তারপর অষ্টম দিনেও তোমাদের পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে এবং মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। এটা শেষ দিনের বিশেষ মাহ্‌ফিল; সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। “এই ঈদগুলো সবই মাবুদ ঠিক করে দিয়েছেন। তোমরা যাতে এই সময় আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে পার সেইজন্য তোমাদের পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল হবে। যে সব কোরবানী তোমাদের করতে হবে তা হল পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী, পশু-কোরবানী এবং ঢালন-কোরবানী। এই সব কোরবানী নির্দিষ্ট করা দিনে তোমাদের করতে হবে। যে কোরবানীগুলোর কথা আগেই বলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই কোরবানীগুলো ধরা হবে না। সেগুলো হল, মাবুদের বিশ্রামবারের কোরবানী, মাবুদকে দেওয়া অন্যান্য সমস্ত দান, মানত এবং নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানী। “সপ্তম মাসের পনেরো দিনের দিন জমি থেকে ফসল তুলে নেওয়ার পর মাবুদের উদ্দেশে সাত দিন ধরে এই কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করতে হবে। এই সাত দিনের প্রথম দিনটা এবং অষ্টম দিনটা হবে তোমাদের বিশ্রামের দিন। প্রথম দিনে তোমাদের নিজেদের জন্য গাছের সবচেয়ে ভাল ফল, খেজুর পাতা, উইলো গাছ এবং অন্যান্য পাতা ভরা গাছের ডাল নিয়ে আসবে। তারপর সাত দিন ধরে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে আনন্দ-উৎসব করবে। প্রত্যেক বছর সাত দিন ধরে মাবুদের উদ্দেশে তোমাদের এই ঈদ পালন করতে হবে। বংশের পর বংশ ধরে এটা হবে তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। সপ্তম মাসে তোমাদের এই ঈদ পালন করতে হবে। সাত দিন তোমরা কুঁড়ে-ঘরে বাস করবে। ইসরাইল বংশে যারা জন্মেছে তাদের সবাইকেই এই সময় কুঁড়ে-ঘরে থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তোমাদের বংশধরেরা জানবে যে, আমি মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে এনে কুঁড়ে-ঘরে বাস করিয়েছিলাম। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ।” এর পর মূসা গিয়ে মাবুদের ঠিক করে দেওয়া সব ঈদের কথা বনি-ইসরাইলদের জানালেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের হুকুম দাও যেন তারা বাতিদানের জন্য তোমার কাছে ছেঁচা জলপাইয়ের খাঁটি তেল নিয়ে আসে যাতে বাতিগুলো নিয়মিত ভাবে জ্বালিয়ে রাখা যায়। মিলন-তাম্বুর মধ্যে সাক্ষ্য-সিন্দুকের পর্দার বাইরে হারুনকে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত মাবুদের সামনে বাতিগুলোর দেখাশোনা করতে হবে। বংশের পর বংশ ধরে এটা হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। মাবুদের সামনে রাখা খাঁটি সোনার বাতিদানের উপরকার বাতিগুলোর নিয়মিত ভাবেই দেখাশোনা করতে হবে। “মিহি ময়দা দিয়ে বারোটা রুটি সেঁকে নিতে হবে। প্রত্যেকটা রুটির জন্য তিন কেজি ছ’শো গ্রাম ময়দা নিতে হবে। তারপর মাবুদের সামনে রাখা খাঁটি সোনার টেবিলের উপর ঐ রুটিগুলো ছয়টা ছয়টা করে দুই সারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রত্যেকটি রুটির সারির কাছে খাঁটি লোবান রাখতে হবে। রুটির বদলে এই লোবান দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। বনি-ইসরাইলদের পক্ষ থেকে এই রুটি প্রত্যেক বিশ্রামবারে নিয়মিত ভাবে মাবুদের সামনে সাজিয়ে রাখতে হবে। তাদের এই রুটি রাখবার কাজটা হবে একটা চিরকালের নিয়ম। এই রুটি হারুন ও তার ছেলেরা পবিত্র তাম্বু-ঘরের এলাকায় খাবে, কারণ মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসের মধ্যে এটা একটা মহাপবিত্র জিনিস। এটা তাদের সব সময়কার পাওনা।” বনি-ইসরাইলদের মধ্যে এমন একজন লোক বাস করত যার মা ছিল ইসরাইলীয় আর পিতা মিসরীয়। ছাউনির মধ্যে সেই লোকটির সংগে একজন ইসরাইলীয়ের মারামারি বেধে গেল। এতে মাবুদ মূসাকে বললেন, “যে লোকটি কুফরী করেছে তাকে ছাউনির বাইরে নিয়ে যাও। যারা তাকে কুফরী করতে শুনেছে তারা সবাই তার মাথার উপর হাত রাখুক, তারপর বনি-ইসরাইলরা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করুক। তুমি বনি-ইসরাইলদের জানিয়ে দাও যদি কেউ তার আল্লাহ্‌কে বদদোয়া দেয় তবে তাকে তার জন্য দায়ী করা হবে। যে মাবুদের নাম নিয়ে কুফরী করবে তাকে হত্যা করতেই হবে। বনি-ইসরাইলরা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে। ইসরাইলীয়ই হোক বা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকই হোক, যে কেউ কুফরী করবে তাকে হত্যা করতেই হবে। “যদি কেউ কাউকে খুন করে তবে তাকেও হত্যা করতে হবে। যদি কেউ অন্যের পশু মেরে ফেলে তবে তাকে একটা প্রাণের বদলে আর একটা প্রাণ দিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি কেউ কাউকে আঘাত করে আর তাতে তার শরীরের ক্ষতি হয় তবে সে যা করেছে তার প্রতিও তা-ই করতে হবে- হাড় ভাংগার বদলে হাড় ভাংগা, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত। সে অন্যের যে ক্ষতি করেছে তারও সেই ক্ষতি করতে হবে। পশু মেরে ফেললে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কিন্তু মানুষ হত্যা করলে মরতে হবে। ইসরাইলীয় এবং তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোক, সকলের উপরে এই একই নিয়ম খাটবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ।” মূসা বনি-ইসরাইলদের এই সব কথা জানালেন। যে লোকটি বদদোয়া দিয়েছিল লোকেরা তাকে তার পরেই ছাউনির বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা তা-ই করল। ছয় বছর তোমরা জমিতে বীজ বুনবে আর আংগুর গাছের ডাল ছেঁটে দেবে এবং ফসল তুলে আনবে। কিন্তু সপ্তম বছরে জমিগুলোকে বিশ্রামের সময় দিতে হবে। এটা হবে মাবুদের উদ্দেশে বিশ্রাম। সেই সময় তোমরা জমিতে বীজ বুনবে না এবং আংগুর গাছের ডাল ছাঁটবে না। তখন জমিতে যা নিজে থেকে জন্মাবে তা তোমরা কেটে মজুদ করবে না কিংবা অযত্নের মধ্যে যে সব আংগুর হবে তা-ও তুলে আনবে না। জমিগুলোকে এক বছর বিশ্রাম দিতে হবে। বিশ্রাম-বছরে জমিতে যা নিজে থেকে জন্মাবে তা-ই তোমাদের নিজেদের, গোলাম ও বাঁদীদের, তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির মজুর ও অন্যান্য লোকদের, পোষা প্রাণীদের এবং দেশের মধ্যেকার বুনো পশুদের খাবার হবে। এই সময় জমিতে যা জন্মাবে তা-ই তোমরা খাবে। “সাতটা সপ্তম বছর, অর্থাৎ সাতটা বিশ্রাম-বছর পর পর তোমাদের গুণে যেতে হবে। এইভাবে সাতটা বিশ্রাম বছর পার হয়ে গেলে ঊনপঞ্চাশ বছর হবে। তার পরের বছরের সাত মাসের দশ দিনের দিন, অর্থাৎ গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার দিনে তোমাদের দেশের সব জায়গায় শিংগা বাজাতে হবে। এই পঞ্চাশ বছরের বছরটা পবিত্র করে নিয়ে দেশের সমস্ত লোকের কাছে মুক্তি ঘোষণা করতে হবে। তোমাদের জন্য এই বছরটা হবে ‘ফিরে পাওয়ার বছর।’ এই বছরে তোমরা প্রত্যেকে যে যার বংশে এবং পরিবারের সম্পত্তিতে ফিরে যাবে। প্রত্যেক পঞ্চাশ বছরের শেষ বছরটা তোমাদের জন্য ফিরে পাওয়ার বছর হবে। এই বছরে তোমরা বীজ বুনবে না এবং নিজে থেকে জমিতে যা জন্মাবে তা কেটে আনবে না কিংবা অযত্নের মধ্যে যে সব আংগুর জন্মাবে তা তুলে আনবে না। এটা হবে একটা ফিরে পাওয়ার বছর এবং তোমাদের তা পবিত্র বলে মানতে হবে। জমি থেকে এমনি যা পাওয়া যাবে তা-ই তোমাদের খেতে হবে। “ফিরে পাওয়ার বছরে তোমরা প্রত্যেকে যে যার পরিবারের সম্পত্তিতে ফিরে যাবে। তোমরা নিজেদের মধ্যে জমি কেনা-বেচা করবার সময়ে কারও উপর অন্যায় কোরো না। যে জমি কিনবে তাকে ফিরে পাওয়ার বছরের পর কত বছর হয়ে গেছে তা হিসাব করে সেই জমি কিনতে হবে এবং যে সেই জমি বিক্রি করবে তাকেও হিসাব করে দেখতে হবে সামনের ফিরে পাওয়ার বছর আসবার আগে কত বছর পর্যন্ত জমিটা থেকে ফসল তোলা যাবে। যদি দেখা যায় বেশ কিছু বছর ফসল কাটা যাবে তবে জমির দাম বাড়াতে হবে কিন্তু কম হলে দাম কমাতে হবে, কারণ আসলে জমি থেকে কতবার ফসল তোলা যাবে সেই সংখ্যাটাই বিক্রি করা হচ্ছে। তোমরা কেউ কারও উপর অন্যায় কোরো না। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের আল্লাহ্‌কে ভয় করে চল, কারণ আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “তোমরা আমার নিয়মগুলো পালন করবে এবং আমার শরীয়ত মেনে চলবে; তাতে তোমরা দেশে নিরাপদে বাস করতে পারবে। তখন তোমরা জমি থেকে পুরো ফসল পাবে এবং পেট ভরে খেয়ে নিরাপদে সেখানে বাস করতে পারবে। তোমরা হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, ‘সপ্তম বছরে আমরা যদি বীজ না বুনি এবং ফসল না কাটি তবে কি খাব?’ এর জবাব হল ষষ্ঠ বছরে আমি তোমাদের এমনভাবে বরকত দান করব যাতে সেই বছর তিন বছর চলবার মত ফসল হয়। ফলে অষ্টম বছরে বীজ বুনবার সময়েও পুরানো ফসল থেকে তোমাদের খাওয়া চলবে এবং নবম বছরে ফসল না তোলা পর্যন্ত সেই জমা ফসল থেকেই তোমরা খেতে পারবে। “চিরদিনের জন্য কারও জমি বিক্রি করা চলবে না, কারণ সব জমি আমার আর আমার সামনে তোমরা সেখানে পরদেশী বাসিন্দা হয়ে বাস করবে। তোমাদের প্রত্যেকের কিনে নেওয়া জমি যাতে আবার ছাড়িয়ে নেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। তোমাদের কোন ইসরাইলীয় ভাই যদি গরীব হয়ে গিয়ে তার পরিবারের জমির কিছু অংশ বিক্রি করে দেয় তবে তার সবচেয়ে নিকট আত্মীয়কে এসে সেই বিক্রি করা সম্পত্তি ছাড়িয়ে নিতে হবে। তার হয়ে তা ছাড়িয়ে নেবার মত কেউ না থাকলেও যদি সে নিজেই নিজের অবস্থার উন্নতি করে তা ছাড়িয়ে নিতে পারে, তবে তা বিক্রি করবার পরের বছরগুলো তাকে গুণে দেখতে হবে এবং বাকী বছরগুলোর টাকা যে জমি কিনেছিল তাকে ফেরৎ দিতে হবে। এর পরে সে তার নিজের জমিতে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু টাকা ফিরিয়ে দেবার মত অবস্থা যদি সে করতে না পারে তবে যে জমি সে বিক্রি করেছে তা ফিরে পাওয়ার বছর পর্যন্ত যে তা কিনেছে তার হাতেই থাকবে। ফিরে পাওয়ার বছরে সেই জমি ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তখন সে নিজের জমিতে ফিরে যেতে পারবে। “দেয়াল-ঘেরা কোন শহরের কোন বাড়ী যদি কেউ বিক্রি করে তবে বিক্রি করবার পর সম্পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত তা ছাড়িয়ে নেবার অধিকার তার থাকবে। এই সময়ের মধ্যে সে তা ছাড়িয়ে নিতে পারবে। বাড়ীটা যদি এক বছরের মধ্যে ছাড়িয়ে নেওয়া না হয় তবে যে তা কিনেছে স্থায়ীভাবে সেটা তার ও তার বংশধরদের হয়ে যাবে। ফিরে পাওয়ার বছরেও সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু যে সব গ্রামের চারপাশে দেয়াল নেই সেখানকার বাড়ীগুলো খোলা জায়গা-জমির মতই ধরে নিতে হবে। সেগুলো ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে এবং ফিরে পাওয়ার বছরে সেগুলো ফেরতও দিতে হবে। তবে সম্পত্তি হিসাবে পাওয়া লেবীয়দের সব গ্রাম ও শহর এবং সেগুলোর মধ্যেকার বাড়ীগুলো তাদের সব সময়েই ছাড়িয়ে নেবার অধিকার থাকবে। লেবীয়দের বিক্রি করা সম্পত্তি, অর্থাৎ লেবীয়দের গ্রামে ও শহরে তাদের বিক্রি করা বাড়ী-ঘর যদি কোন লেবীয় ছাড়িয়ে নিতে চায়, তবে ফিরে পাওয়ার বছরে সে তা ছাড়িয়ে নিতে পারবে, কারণ বনি-ইসরাইলদের মধ্যে লেবীয়দের গ্রাম ও শহরের বাড়ী-ঘরই তাদের সম্পত্তি। কিন্তু তাদের গ্রাম ও শহরের পশু চরাবার মাঠ বিক্রি করতে পারবে না; সেগুলো তাদের চিরকালের সম্পত্তি। “তোমাদের কোন ইসরাইলীয় ভাই যদি গরীব অবস্থায় পড়ে নিজের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে না পারে, তবে যাতে সে তোমাদের মধ্যেই বাস করতে পারে সেইজন্য পরদেশী বাসিন্দাকে যেভাবে সাহায্য করা হয় তাকেও সেইভাবে সাহায্য করতে হবে। তোমরা তার কাছ থেকে কোন রকম সুদ নিতে পারবে না, বরং লোকটি যাতে তোমাদের মধ্যে বাস করতে পারে সেইজন্য তোমাদের আল্লাহ্‌কে তোমরা ভয় করে চলবে। তবে টাকা ধার দিলে কোন সুদ নেওয়া চলবে না এবং তার কাছে কোন খাবার জিনিস বিক্রি করলে কোন লাভ নেওয়া চলবে না। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। কেনান দেশ দেবার জন্য এবং তোমাদের আল্লাহ্‌ হওয়ার জন্য আমিই মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। “তোমাদের কোন ইসরাইলীয় ভাই যদি গরীব অবস্থায় পড়ে নিজেকে তোমাদের কারও কাছে বিক্রি করে দেয় তবে তোমরা তাকে গোলামের মত খাটাবে না। অন্য জাতির মজুরের সংগে, অর্থাৎ অন্য জাতির বাসিন্দার সংগে যে রকম ব্যবহার করা হয় তার সংগে সেই রকমই ব্যবহার করতে হবে। সে তার জন্য ফিরে পাওয়ার বছর পর্যন্ত কাজ করবে। তারপর তাকে ও তার ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিতে হবে। সে তখন তার নিজের বংশের ও পূর্বপুরুষদের জমিতে ফিরে যাবে। বনি-ইসরাইলরা আমারই গোলাম; আমিই তাদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছি; তাই আর কারও গোলাম হিসাবে তাদের বিক্রি করা চলবে না। তোমরা কেউ কারও প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার কোরো না; তোমরা তোমাদের আল্লাহ্‌কে ভয় করে চলবে। “তোমাদের আশেপাশে যে জাতিগুলো থাকবে তাদের মধ্য থেকে তোমরা গোলাম ও বাঁদী কিনে নিতে পারবে। তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকদের মধ্য থেকে এবং তাদের বংশের যারা তোমাদের দেশে জন্মেছে তাদের মধ্য থেকেও তোমরা নিজের সম্পত্তি হিসাবে গোলাম ও বাঁদী নিতে পারবে। এই সব গোলাম ও বাঁদীদের তোমরা সম্পত্তির অংশ হিসাবে ছেলেমেয়েদের দিয়ে যেতে পারবে। তোমরা তাদের সারা জীবন গোলাম হিসাবে রাখতে পারবে, কিন্তু তোমাদের নিজের জাতি বনি-ইসরাইলদের প্রতি তোমরা নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে পারবে না। “তোমাদের মধ্যে কোন পরদেশী বাসিন্দা যদি ধনী হয়ে ওঠে আর তোমাদের কেউ যদি গরীব অবস্থায় পড়ে তার কাছে কিংবা তার বংশেরও কারও কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়, তবে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার অধিকার তার থাকবে। তার নিজের কোন ভাই তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। তা ছাড়া চাচা বা জেঠা কিংবা চাচাত-জেঠাত ভাই কিংবা বংশের এমন কেউ যার সংগে তার রক্তের সম্বন্ধ আছে সে-ও তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। অবস্থার উন্নতি করতে পারলে সে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। যে বছর সে নিজেকে বিক্রি করবে সেই বছর থেকে শুরু করে ফিরে পাওয়ার বছর পর্যন্ত কত বছর হয় সেটা সে আর তার মালিক হিসাব করে দেখবে। সেই কয় বছর একজন মজুরের যা পাওনা হবে সেই হিসাবে তার মুক্তি-মূল্য ঠিক করতে হবে। ফিরে পাওয়ার বছর আসতে যদি অনেক বছর বাকী থেকে যায় তবে যে দামে সে নিজেকে বিক্রি করেছে সেই দামের একটা মোটা অংশ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য তার দিতে হবে। ফিরে পাওয়ার বছর আসতে যদি অল্প কয়েক বছর বাকী থাকে তবে হিসাব করে সেইমত টাকা দিয়ে সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। বছর হিসাবে রাখা মজুরের মত করে তাকে দেখতে হবে এবং তোমাদের নজর রাখতে হবে যাতে তার মালিক তার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার না করে। এগুলোর কোন উপায়েই যদি তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া না হয় তবে তাকে ও তার ছেলেমেয়েদের ফিরে পাওয়ার বছরে ছেড়ে দিতেই হবে। বনি-ইসরাইলরা একমাত্র আমারই গোলাম। আমিই তাদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছি; তারা আমারই গোলাম। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। “কোন রকম দেব-দেবীর মূর্তি তোমাদের তৈরী করা চলবে না। নিজেদের জন্য কাঠে খোদাই-করা মূর্তি কিংবা কোন পূজার পাথর তোমাদের স্থাপন করা চলবে না। পূজা করবার জন্য তোমরা পাথরে খোদাই করা কোন মূর্তি তোমাদের দেশে রাখবে না। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। আমার বিশ্রামের দিন ও বছরগুলো তোমাদের পালন করতে হবে; আমার পবিত্র তাম্বুর প্রতি তোমাদের সম্মান দেখাতে হবে। আমি মাবুদ। তখন তোমাদের গম মাড়াই করা চলবে আংগুর তুলবার সময় পর্যন্ত এবং আংগুর তোলা চলবে বীজ বুনবার সময় পর্যন্ত। তোমরা তখন পেট ভরে খেতে পাবে এবং দেশের মধ্যে নিরাপদে বাস করবে। “দেশে তখন আমি শান্তি দেব। তোমরা শান্তিতে ঘুমাবে; কারও কাছ থেকে কোন ভয়ের কারণ তোমাদের থাকবে না। আমি দেশ থেকে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার দূর করে দেব। কোন সৈন্য-সামন্ত তোমাদের দেশ হামলা করতে আসবে না। তোমরা তোমাদের শত্রুদের তাড়া করবে এবং শত্রুরা তোমাদের সামনেই মারা পড়বে। মাত্র পাঁচজন মিলে তোমরা একশোজন শত্রুকে এবং একশোজন মিলে দশ হাজার শত্রুকে তাড়া করবে, আর শত্রুরা তোমাদের সামনে মারা পড়বে। আমি তোমাদের তখন দয়ার চোখে দেখব এবং বংশবৃদ্ধি করে তোমাদের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে তুলব, আর তোমাদের সংগে আমি আমার ব্যবস্থা ঠিক রাখব। নতুন শস্য রাখবার জন্য গোলাঘর খালি করবার সময়েও আগের বছরের শস্য থেকেই তোমাদের খাওয়া চলতে থাকবে। আমি তোমাদের দিক থেকে আমার মুখ ফিরাব না। তোমাদের মধ্যেই আমি আমার বাসস্থান করব। আমি তোমাদের সংগে চলাফেরা করব এবং তোমাদের আল্লাহ্‌ হব আর তোমরা আমার নিজের বান্দা হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। মিসর দেশ থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি যাতে মিসরীয়দের গোলাম হয়ে আর তোমাদের থাকতে না হয়। কাঁধের জোয়াল ভেংগে ফেলে আমিই তোমাদের মাথা উঁচু করে হাঁটবার অবস্থায় এনেছি। “কিন্তু তোমরা যদি আমার কথা না শোন এবং এই সব হুকুম পালন না কর, যদি তোমরা আমার নিয়মগুলো অগ্রাহ্য কর এবং আমার শরীয়ত তুচ্ছ কর, যদি তোমরা আমার হুকুম পালন না করে আমার ব্যবস্থা অমান্য কর, তবে আমি তোমাদের উপর যা করব তা এই- আমি তোমাদের উপর হঠাৎ কোন দেহ ক্ষয় করা রোগ এবং ভীষণ রকমের জ্বর নিয়ে আসব। এই সব রোগে তোমাদের দেখবার ক্ষমতা এবং গায়ের শক্তি কমতে থাকবে। তখন তোমরা বীজ বুনলেও কোন লাভ হবে না, তোমাদের ফসল শত্রুরাই খাবে। আমি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব আর তোমরা তোমাদের শত্রুদের কাছে হেরে যাবে। তোমাদের ঘৃণাকারীরাই তোমাদের শাসন করবে এবং কেউ তোমাদের তাড়া না করলেও তোমরা পালিয়ে যাবে। “এই সবের পরেও যদি তোমরা আমার কথা না শোন তবে আমি তোমাদের গুনাহের সাতগুণ শাস্তি দেব। আমি তোমাদের শক্তির অহংকার চুরমার করে দেব। আমি তোমাদের মাথার উপরকার আকাশ লোহার মত আর পায়ের তলার মাটি ব্রোঞ্জের মত শক্ত করে দেব। তখন তোমরা মিছামিছিই খেটে মরবে; তোমাদের জমিতে তখন ফসলও হবে না, গাছ-গাছড়ায় ফলও ধরবে না। “তোমাদের মনে যদি আমার প্রতি শত্রুভাব থাকে এবং যদি তোমরা আমার কথায় কান দিতে না চাও তবে তোমাদের গুনাহের শাস্তি আমি সাতগুণ বাড়িয়ে দেব। আমি তোমাদের মধ্যে হিংস্র জন্তু পাঠিয়ে দেব। সেগুলো তোমাদের ছেলেমেয়েদের খেয়ে ফেলবে, তোমাদের পশুপাল ধ্বংস করবে আর তোমাদের লোকসংখ্যা কমিয়ে দেবে। এতে তোমাদের রাস্তাঘাটগুলো খালি পড়ে থাকবে। “এই সব ঘটনার পরেও যদি তোমরা আমার শাসন মেনে না নিয়ে আমার বিরুদ্ধে চলতে থাক, তবে আমি নিজে তোমাদের শত্রু হয়ে তোমাদের গুনাহের সাতগুণ শাস্তি দেব। আমার ব্যবস্থা অমান্য করবার দরুন আমি তোমাদের উপর যুদ্ধ নিয়ে আসব। শত্রু দেখে যখন তোমরা শহরে গিয়ে ঢুকবে তখন তোমাদের মধ্যে আমি মহামারী লাগিয়ে দেব, আর তাতে তোমরা শত্রুর হাতে গিয়ে পড়বে। আমি তোমাদের খাবারের অভাব ঘটাব। তখন দশজন স্ত্রীলোকের রুটি সেঁকতে একটার বেশী তন্দুর লাগবে না, আর খাবার সময়ে তোমরা রুটি মেপে মেপে দেবে। তোমরা পেট ভরে খেতে পাবে না। “এই সবের পরেও যদি তোমরা আমার কথায় কান না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে চলতেই থাক, তবে আমিও ভীষণ রেগে গিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে চলব এবং তোমাদের গুনাহের সাতগুণ শাস্তি দেব। তখন খিদের জ্বালায় তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের গোশ্‌ত খাবে। আমি তোমাদের পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করে ফেলব, ধূপগাহ্‌ ভেংগে ফেলব এবং তোমাদের প্রাণহীন দেব-দেবীর উপর তোমাদের লাশগুলো গাদা করব, আর আমি তোমাদের ভীষণ ঘৃণার চোখে দেখব। আমি তোমাদের গ্রাম ও শহরগুলো এবং এবাদতের ঘরগুলো ধ্বংস করে ফেলব। তোমাদের কোরবানীর গন্ধ আমি কবুল করব না। আমি তোমাদের দেশ এমন ধ্বংসের অবস্থায় ফেলে রাখব যা দেখে তোমাদের শত্রু-বাসিন্দারাও আঁত্‌কে উঠবে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে আমি তোমাদের ছড়িয়ে রাখব এবং তলোয়ার হাতে তোমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করব। তোমাদের দেশের সব জমি, শহর ও গ্রাম ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকবে। “যখন তোমরা তোমাদের শত্রুদের দেশে থাকবে তখন ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকা তোমাদের সেই দেশটা তার পাওনা সব বিশ্রাম-বছর ভোগ করতে থাকবে। হ্যাঁ, তখন তোমাদের দেশটা বিশ্রাম পাবে এবং তার পাওনা বিশ্রাম-বছরগুলো ভোগ করবে। তোমরা নিজেরা দেশে বাস করবার সময় তোমাদের জমিগুলো বিশ্রাম-বছরগুলোতেও বিশ্রাম পায় নি বলে যখন দেশ ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকবে তখন জমিগুলো বিশ্রাম পাবে। তোমাদের মধ্যে যারা শত্রুদের দেশে বেঁচে থাকবে তাদের অন্তরে আমি এমন ভয় ঢুকিয়ে দেব যে, বাতাসে পাতা নড়বার শব্দেও তারা ছুটে পালাবে। যুদ্ধের ভয়ে যেমন করে মানুষ ছুটে পালায় তেমনি করেই তারা ছুটে পালাবে। পিছনে কেউ তাড়া করে না গেলেও তারা ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। কেউ তাদের পিছনে তাড়া না করলেও তলোয়ারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ছুটে যাওয়া লোকের মত করে দৌড়াতে গিয়ে তারা একে অন্যের উপর পড়বে। শত্রুদের সামনে তোমরা দাঁড়াতে পারবে না। বিভিন্ন জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তোমরা মারা যাবে, শত্রুদের দেশ তোমাদের গিলে খাবে। তার পরেও তোমাদের মধ্যে যারা সেখানে পড়ে থাকবে তারা তাদের নিজেদের এবং পূর্বপুরুষদের দোষের দরুন শেষ হয়ে যেতে থাকবে। তাহলে আমি ইয়াকুব, ইসহাক ও ইব্রাহিমের সংগে আমার ব্যবস্থার কথা এবং তাদের দেশের কথা মনে করব। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরে ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকা তাদের দেশটা তার পাওনা সব বিশ্রাম-বছর ভোগ করতে থাকবে। আমার শরীয়ত অগ্রাহ্য এবং নিয়ম ঘৃণা করবার দরুন দোষের শাস্তি তাদের পেতেই হবে। তবুও শত্রুদের দেশে থাকবার সময়ে আমি তাদের এমনভাবে অগ্রাহ্য করব না বা ঘৃণার চোখে দেখব না যাতে তারা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং এইভাবে তাদের সংগে আমার ব্যবস্থা খেলাপ হয়ে যায়। আমি আল্লাহ্‌ তাদের মাবুদ। তাদের জন্যই তাদের পূর্বপুরুষদের সংগে আমার ব্যবস্থার কথা আমি মনে করব। এই পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ হব বলে অন্যান্য জাতির চোখের সামনে দিয়ে মিসর দেশ থেকে আমি তাদের বের করে এনেছি। আমি মাবুদ।” এগুলোই হল সেই সব হুকুম, শরীয়ত ও নিয়ম যা তুর পাহাড়ে মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ তাঁর ব্যবস্থা হিসাবে বনি-ইসরাইলদের জন্য স্থাপন করেছিলেন। ঐ বয়সের স্ত্রীলোকের জন্য তিনশো গ্রাম রূপা; পাঁচ থেকে বিশ বছর বয়সের ছেলের জন্য দু’শো গ্রাম রূপা, ঐ বয়সের মেয়ের জন্য একশো গ্রাম রূপা; এক মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সের ছেলের জন্য পঞ্চাশ গ্রাম রূপা, ঐ বয়সের মেয়ের জন্য ত্রিশ গ্রাম রূপা; ষাট বছর বা তার বেশী বয়সের পুরুষের জন্য দেড়শো গ্রাম রূপা, ঐ বয়সের স্ত্রীলোকের জন্য একশো গ্রাম রূপা। “মানতকারী যদি গরীব হয় আর এই নির্দিষ্ট করা মূল্য দিতে না পারে তবে তাকে কোরবানী করবার লোকটিকে নিয়ে ইমামের কাছে যেতে হবে। ইমাম তখন মানতকারীর দেবার ক্ষমতা বুঝে তার মূল্য ঠিক করে দেবে। “সে যদি মাবুদের গ্রহণযোগ্য কোরবানীর কোন পশু মানত করে থাকে তবে মাবুদকে দেওয়া সেই পশুটা পবিত্র বলে ধরতে হবে। সেই পশুটার বদলে অন্য পশু সে দিতে পারবে না। সেটা ভাল হলে তার বদলে খারাপটা কিংবা খারাপ হলে তার বদলে ভালটা দেওয়া চলবে না। যদি সে একটা পশুর বদলে অন্য একটা পশু দেয় তবে দু’টা পশুই পবিত্র বলে ধরা হবে। মাবুদের গ্রহণযোগ্য কোরবানী নয় এমন কোন নাপাক পশু যদি কেউ মানত করে তবে পশুটাকে ইমামের কাছে নিয়ে যেতে হবে। পশুটা কি অবস্থায় আছে ইমাম তা বিচার করে তার যে দাম ঠিক করে দেবে সেটাই হবে তার দাম। মানতকারী যদি সেটা ছাড়িয়ে নিতে চায় তবে সেই পশুর দামের সংগে তাকে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিতে হবে। “যদি কেউ তার বাড়ীটা মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র বলে কোরবানী করে তবে ইমাম বাড়ীটার অবস্থা বিচার করে তার যে দাম ঠিক করে দেবে সেটাই হবে তার দাম। পবিত্র করা বাড়ীটা যদি সে ছাড়িয়ে নিতে চায় তবে বাড়ীটার দামের সংগে তাকে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিতে হবে। তারপর বাড়ীটা আবার তার হয়ে যাবে। “কেউ যদি তার পরিবারের সম্পত্তির একটা অংশ মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করে রাখে তবে সেই জমিতে যতটা বীজ বোনা যায় সেই অনুসারে তার দাম ধরতে হবে। প্রতি একশো আশি কেজি যবের বীজের জন্য আধা কেজি করে রূপা ধরতে হবে। ফিরে পাওয়ার বছরে যদি সে তার জমি পবিত্র করে তবে ইমাম এই নিয়মে যে দাম ঠিক করে দেবে জমিটার দাম তা-ই থাকবে। কিন্তু ফিরে পাওয়ার বছরের পরে যদি সে তার জমি পবিত্র করে তবে তার পরের ফিরে পাওয়ার বছর আসতে যত বছর বাকী থাকবে সেটা হিসাব করে ইমাম তার দাম ঠিক করবে। তাতে ঐ নিয়মে ঠিক করা পুরো দামের চেয়ে এই দাম কম হবে। কোন জমি-উৎসর্গদাতা যদি তার জমি ছাড়িয়ে নিতে চায় তবে সেই জমির ঠিক করা দামের সংগে তাকে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিতে হবে। এর পর জমিটা আবার তার হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে জমিটা ছাড়িয়ে না নেয় কিংবা আর কারও কাছে বিক্রি করে দেয় তবে সেটা আর ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে না। ফিরে পাওয়ার বছরে যখন জমিটা খালাস হবে তখন সেটা মাবুদের উদ্দেশ্যে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন জমির মতই মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র হয়ে যাবে। তখন সেটা হবে ইমামের সম্পত্তি। নিজের পরিবারের জমির কোন অংশ নয় এমন কোন কিনে নেওয়া জমি যদি কেউ মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করে, তবে ইমাম ফিরে পাওয়ার বছর পর্যন্ত হিসাব করে তার দাম ঠিক করে দেবে। সেই দিনই সেই জমির দাম তাকে মাবুদের উদ্দেশে পবিত্র জিনিস হিসাবে দিয়ে দিতে হবে। জমিটা সে যার কাছ থেকে কিনবে ফিরে পাওয়ার বছরে তা আবার তার কাছে, অর্থাৎ জমির আগের মালিকের কাছে চলে যাবে। সব কিছুর দাম ধর্মীয় শেখেলের ওজন অনুসারেই ঠিক করতে হবে। দশ গ্রামে একটা ধর্মীয় শেখেল হয়। “কোন পশুর প্রথম পুরুষ বাচ্চা কেউ মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করতে পারবে না, কারণ সব পশুর প্রথম বাচ্চাই মাবুদের। বাচ্চাটা গরুরই হোক বা ভেড়ারই হোক সেটা মাবুদের। যদি সেটা কোন নাপাক পশুর প্রথম বাচ্চা হয় তবে ইমামের ঠিক করে দেওয়া দামের সংগে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিয়ে সেটা সে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। যদি সে সেটা ছাড়িয়ে না নেয় তবে সেই ঠিক করে দেওয়া দামেই সেটা বিক্রি করে দিতে হবে। “কিন্তু যদি কেউ তার নিজের কোন কিছু মাবুদের উদ্দেশ্যে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন বলে ঘোষণা করে তবে সে সেটা আর বিক্রি করতে বা ছাড়িয়ে নিতে পারবে না- সেটা পরিবারের জমিই হোক অথবা মানুষ কিংবা পশুই হোক। এই রকম ভাবে যা কিছু ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন বলে ঘোষণা করা হয় তা সবই মাবুদের উদ্দেশে মহাপবিত্র জিনিস বলে ধরতে হবে। যদি কোন লোককে মাবুদের উদ্দেশ্যে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন বলে ঘোষণা করা হয় তবে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া চলবে না, তাকে হত্যা করতে হবে। “জমি থেকে যা পাওয়া যাবে তার দশ ভাগের এক ভাগ মাবুদের- তা জমির ফসলই হোক কিংবা গাছের ফলই হোক। তা মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র। কেউ যদি তার সেই দশ ভাগের এক ভাগ ছাড়িয়ে নিতে চায় তবে তার দামের সংগে তাকে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম বেশী দিতে হবে। প্রত্যেকের পশুপালের দশ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ রাখালের লাঠির নীচ দিয়ে চলে যাওয়া প্রতিটি দশম পশু হবে মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র। এই দশম পশুগুলো ভাল কি খারাপ তা দেখা চলবে না কিংবা একটার বদলে অন্য একটা দেওয়া চলবে না। যদি কেউ তা করে তবে সেই দশম পশুটা এবং তার বদলে যে পশুটা সে দেবে সেটাও মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র হয়ে যাবে এবং তা আর ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে না।” মাবুদ বনি-ইসরাইলদের জন্য এই সব হুকুম তুর পাহাড়ে মূসার কাছে দিয়েছিলেন। বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর দ্বিতীয় বছরের দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিনে মাবুদ সিনাই মরুভূমিতে মিলন-তাম্বুর মধ্যে মূসার সংগে কথা বললেন। তিনি বললেন, প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে একজন করে লোক তোমাকে সাহায্য করবে, আর সেই লোকটিকে হতে হবে তার বংশের নেতা। যারা তোমাকে সাহায্য করবে তাদের নাম হল রূবেণ-গোষ্ঠীর শদেয়ূরের ছেলে ইলীষূর, শিমিয়োন-গোষ্ঠীর সূরীশদ্দয়ের ছেলে শলুমীয়েল, এহুদা-গোষ্ঠীর অম্মীনাদবের ছেলে নহশোন, ইষাখর-গোষ্ঠীর সূয়ারের ছেলে নথনেল, সবূলূন-গোষ্ঠীর হেলোনের ছেলে ইলীয়াব, ইউসুফের ছেলেদের মধ্যে আফরাহীম-গোষ্ঠীর অম্মীহূদের ছেলে ইলীশামা আর মানশা-গোষ্ঠীর পদাহসূরের ছেলে গমলীয়েল, বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গিদিয়োনির ছেলে অবীদান, দান-গোষ্ঠীর অম্মীশদ্দয়ের ছেলে অহীয়েষর, আশের-গোষ্ঠীর অক্রণের ছেলে পগীয়েল, গাদ-গোষ্ঠীর দ্যূয়েলের ছেলে ইলীয়াসফ, আর নপ্তালি-গোষ্ঠীর ঐননের ছেলে অহীরঃ।” বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এই সব লোকদের নিযুক্ত করা হল। এঁরা হলেন তাঁদের পূর্বপুরুষদের গোষ্ঠীর নেতা এবং বনি-ইসরাইলদের বিভিন্ন বংশের কর্তা। সিনাই মরুভূমিতে মূসা মাবুদের হুকুম অনুসারে লোকদের গণনা করলেন। ইসরাইলের বড় ছেলে রূবেণের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে এক এক করে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। রূবেণ-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল ছেচল্লিশ হাজার পাঁচশো। শিমিয়োনের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে গণনা করে এক এক করে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। শিমিয়োন-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল ঊনষাট হাজার তিনশো। গাদের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। গাদ-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল পঁয়তাল্লিশ হাজার ছ’শো পঞ্চাশ। এহুদার বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। এহুদা-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল চুয়াত্তর হাজার ছ’শো। ইষাখরের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। ইষাখর-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল চুয়ান্ন হাজার চারশো। সবূলূনের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। সবূলূন-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল সাতান্ন হাজার চারশো। ইউসুফের ছেলেদের মধ্যে আফরাহীমের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। আফরাহীম-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল চল্লিশ হাজার পাঁচশো। মানশার বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। মানশা-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল বত্রিশ হাজার দু’শো। বিন্‌ইয়ামীনের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। বিন্যামীন-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল পঁয়ত্রিশ হাজার চারশো। দানের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। দান-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল বাষট্টি হাজার সাতশো। আশেরের বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। আশের-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল একচল্লিশ হাজার পাঁচশো। নপ্তালির বংশধরদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল, বংশ ও পরিবারের পরিচয় অনুসারে তাদের নাম লিখে নেওয়া হল। নপ্তালি-গোষ্ঠী থেকে যাদের পাওয়া গেল তাদের সংখ্যা হল তিপ্পান্ন হাজার চারশো। মূসা, হারুন ও বনি-ইসরাইলদের বারোজন নেতা এই সব লোকদের সংখ্যা গণনা করলেন। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁর নিজের বংশের নেতা ছিলেন। সমস্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাওয়ার মত হয়েছিল পরিবার অনুসারে তাদের গণনা করা হল। তাদের মোট সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ তিন হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ। কিন্তু এদের সংগে লেবি-গোষ্ঠীর লোকদের গণনা করা হয় নি। মাবুদ মূসাকে বলেছিলেন, “তুমি লেবি-গোষ্ঠীকে গণনা করবে না, কিংবা আদমশুমারীর সময় অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের মধ্যে তাদের ধরবে না। সাক্ষ্য-তাম্বুর সাজ-সরঞ্জাম ও তার সমস্ত কিছুর দেখাশোনার ভার তুমি তাদের উপর দেবে। তাদের কাজ হবে আবাস-তাম্বু এবং তার সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম বয়ে নেওয়া। এর দেখাশোনার ভার তাদেরই নিতে হবে এবং তাদেরই এর চারপাশে তাম্বু খাটিয়ে থাকতে হবে। আবাস-তাম্বুটা যখন অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে তখন লেবীয়রাই সেটা খুলে নেবে এবং যখন সেটা খাটাতে হবে তখন তাদেরই তা খাটাতে হবে। অন্য কেউ তার কাছে গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে। নিজের নিজের দল অনুসারে বনি-ইসরাইলরা তাদের তাম্বু খাটাবে। প্রত্যেককেই তার নিজের বিভাগীয় জায়গায় বিভাগীয় নিশানের নীচে থাকতে হবে। যাতে বনি-ইসরাইলদের উপর মাবুদের গজব নেমে না আসে সেইজন্য সাক্ষ্য-তাম্বুর চারপাশে লেবীয়দের তাম্বু খাটিয়ে থাকতে হবে। সাক্ষ্য-তাম্বুর দেখাশোনার জন্য লেবীয়রাই দায়ী থাকবে।” মাবুদ মূসাকে যা হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা ঠিক তা-ই করল। এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “মিলন-তাম্বু থেকে কিছু দূরে তার চারপাশে বনি-ইসরাইলরা তাদের ছাউনি ফেলবে। প্রত্যেকজনকে তার বিভাগীয় নিশান এবং বংশের নিশানের কাছে থাকতে হবে। এহুদা-বিভাগের গণনা করা মোট লোকসংখ্যা হল এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার চারশো। এদেরই প্রথমে রওনা হতে হবে। রূবেণ-বিভাগের গণনা করা মোট লোকসংখ্যা হল এক লক্ষ একান্ন হাজার চারশো পঞ্চাশ। এদেরই দ্বিতীয় দল হিসাবে রওনা হতে হবে। “তারপর মিলন-তাম্বু নিয়ে রওনা হবে লেবি-গোষ্ঠীর লোকেরা। এরা থাকবে সব বিভাগের মাঝখানে। একের পর এক যেভাবে তারা তাম্বু খাটাবে সেইভাবেই তাদের পর পর রওনা হতে হবে। প্রত্যেকজনকে তার নিজের বিভাগের সংগে থাকতে হবে। আফরাহীম-বিভাগের গণনা করা মোট লোকসংখ্যা হল এক লক্ষ আট হাজার একশো। এদেরই তৃতীয় দল হিসাবে রওনা হতে হবে। দান-বিভাগের গণনা করা মোট লোকসংখ্যা হল এক লক্ষ সাতান্ন হাজার ছ’শো। এদেরই সবার শেষে নিজেদের বিভাগের সংগে রওনা হতে হবে।” এই সব বনি-ইসরাইলদের বংশ অনুসারে গণনা করা হয়েছিল। বিভিন্ন বিভাগের গণনা করা মোট লোকসংখ্যা হল ছয় লক্ষ তিন হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ। মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছিলেন সেই অনুসারে বনি-ইসরাইলদের গণনার সময়ে লেবীয়দের বাদ দেওয়া হয়েছিল। মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম মতই বনি-ইসরাইলরা সমস্ত কিছু করত। তাঁর হুকুম মতই তারা নিজ নিজ বিভাগে তাম্বু খাটাত এবং তাঁর হুকুম মতই তারা নিজ নিজ বংশ ও পরিবার অনুসারে যাত্রা করত। এই হল হারুন ও মূসার বংশের কথা যখন মাবুদ তুর পাহাড়ে মূসার সংগে কথা বলেছিলেন। কিন্তু নাদব আর অবীহূ সিনাই মরুভূমিতে মাবুদের উদ্দেশে নিয়মের বাইরের আগুনে ধূপ জ্বালাবার সময় মাবুদের সামনেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের কোন ছেলে ছিল না বলে ইলীয়াসর ও ইথামর তাঁদের পিতা বেঁচে থাকতেই ইমাম হিসাবে এবাদত-কাজ করেছিলেন। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “লেবি-গোষ্ঠীর লোকদের ডেকে এনে হারুনের হাতে দাও যেন তারা তাকে সাহায্য করতে পারে। তারা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের হয়ে মিলন-তাম্বুতে হারুনের অধীনে আবাস-তাম্বুর কাজ করবে। তারাই মিলন-তাম্বুর সাজ-সরঞ্জামের দেখাশোনা এবং আবাস-তাম্বুর কাজ করে বনি-ইসরাইলদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। লেবীয়দের তুমি হারুন ও তার ছেলেদের হাতে দিয়ে দাও। বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এদের সবাইকে হারুনের হাতে দিয়ে দিতে হবে। ইমাম হিসাবে কাজ করবার জন্য তুমি হারুন ও তার ছেলেদের নিযুক্ত কর। তারা ছাড়া আর কেউ যদি ইমামের কাজ করতে যায় তবে তাকে হত্যা করা হবে।” মাবুদ মূসাকে আরও বললেন, “ইসরাইলীয় স্ত্রীলোকদের প্রথম ছেলের জায়গায় আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে লেবীয়দের নিয়েছি। লেবীয়রা আমার, কারণ বনি-ইসরাইলদের সব প্রথম ছেলেই আমার। মিসর দেশের প্রথম ছেলেদের মেরে ফেলবার সময় আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যেকার প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তানকে আমার জন্য পবিত্র করে রেখেছি- সে মানুষের হোক বা পশুর হোক। তারা আমার; আমি মাবুদ।” সিনাই মরুভূমিতে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি পরিবার ও বংশ অনুসারে লেবীয়দের সংখ্যা গণনা কর। এক মাস ও তার বেশী বয়সের সমস্ত পুরুষদের গণনা কর।” মাবুদের হুকুম অনুসারে মূসা লেবীয়দের গণনা করলেন। লেবির ছেলেদের নাম ছিল গের্শোন, কহাৎ ও মরারি। গের্শোনের ছেলে লিব্‌নি ও শিমিয়ি ছিলেন দু’টি বংশের পিতা। কহাতের ছেলে ইমরান, যিষ্‌হর, হেবরন ও উষীয়েল ছিলেন চারটি বংশের পিতা। মরারির ছেলে মহলি ও মূশি ছিলেন দু’টি বংশের পিতা। এই হল বংশ-পিতা অনুসারে লেবি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের পরিচয়। গের্শোন ছিলেন লিব্‌নি ও শিমিয়ি বংশের পূর্বপুরুষ। এই বংশগুলোর এক মাস ও তার বেশী বয়সের সমস্ত পুরুষদের গণনার পর দেখা গেল যে, তাদের সংখ্যা সাত হাজার পাঁচশো। পশ্চিম দিকে আবাস-তাম্বুর পিছনে গের্শোনীয়দের তাম্বু ফেলতে বলা হয়েছিল। গের্শোনীয় বংশগুলোর নেতা ছিলেন লায়েলের ছেলে ইলীয়াসফ। মিলন-তাম্বু সম্বন্ধে গের্শোনীয়দের দায়িত্ব ছিল আবাস-তাম্বু, তার উপর বিছানো ছাগলের লোমের ঢাকন, তার উপরকার ছাউনি দু’টা, মিলন-তাম্বুতে ঢুকবার দরজার পর্দা, উঠানের পর্দাগুলো, আবাস-তাম্বু ও কোরবানগাহের চারপাশে যে উঠান আছে সেখানে ঢুকবার দরজার পর্দা এবং আবাস-তাম্বুর সমস্ত দড়িগুলোর দেখাশোনা করা আর এগুলোর সংগেকার অন্য সমস্ত কাজ করা। কহাৎ ছিলেন ইমরান, যিষহর, হেবরন ও উষীয়েলের বংশের পূর্বপুরুষ। এই বংশগুলোর এক মাস ও তার বেশী বয়সের সমস্ত পুরুষদের সংখ্যা হল আট হাজার ছ’শো। পবিত্র তাম্বুর দেখাশোনার ভার ছিল কহাতীয়দের উপর। আবাস-তাম্বুর দক্ষিণ দিকে কহাতীয়দের তাম্বু ফেলতে বলা হয়েছিল। কহাতীয় বংশগুলোর নেতা ছিলেন উষীয়েলের ছেলে ইলীষাফণ। কহাতীয়দের দায়িত্ব ছিল সাক্ষ্য-সিন্দুক, টেবিল, বাতিদান, কোরবানগাহ্‌ ও ধূপগাহ্‌, পবিত্র তাম্বুর এবাদত-কাজে ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং মহাপবিত্র স্থানের পর্দার দেখাশোনা করা আর এগুলোর সংগেকার অন্য সমস্ত কাজ করা। লেবীয়দের প্রধান নেতা ছিলেন ইমাম হারুনের ছেলে ইলীয়াসর। পবিত্র তাম্বুর দেখাশোনা করবার ভার যাদের দেওয়া হয়েছিল তাদের দেখাশোনা করবার জন্য ইলীয়াসরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মরারি ছিলেন মহলি ও মূশির বংশের পূর্বপূরুষ। এই বংশগুলোর এক মাস ও তার বেশী বয়সের সমস্ত পুরুষদের গণনার পর দেখা গেল যে, তাদের সংখ্যা ছয় হাজার দু’শো। মরারীয় বংশগুলোর নেতা ছিলেন অবীহয়িলের ছেলে সূরীয়েল। আবাস-তাম্বুর উত্তর দিকে তাদের তাম্বু ফেলতে বলা হয়েছিল। মরারীয়দের দায়িত্ব ছিল আবাস-তাম্বুর ফ্রেম, তার হুড়কা, খুঁটি, পা-দানি ও তার সমস্ত জিনিসপত্র, চারদিকের উঠানের খুঁটি আর পা-দানি, উঠানের পর্দার গোঁজ ও দড়িগুলো দেখাশোনা করা এবং এগুলোর সংগেকার অন্য সব কাজ করা। মিলন-তাম্বুর সামনে, অর্থাৎ আবাস-তাম্বুর পূর্ব দিকে মূসা, হারুন ও তাঁর ছেলেদের তাম্বু ফেলতে বলা হয়েছিল। তাঁদের দায়িত্ব ছিল বনি-ইসরাইলদের হয়ে পবিত্র তাম্বুর সমস্ত কাজ পরিচালনা করা। তাঁরা ছাড়া আর কেউ পবিত্র তাম্বুর কাছে গেলে তাকে হত্যা করতে বলা হয়েছিল। মাবুদের হুকুমে বংশ অনুসারে মূসা ও হারুনের গণনা করা লেবীয় পুরুষদের মোট সংখ্যা হয়েছিল বাইশ হাজার। এরা প্রত্যেকেই ছিল এক মাস ও তার বেশী বয়সের। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে প্রথমে জন্মেছে এমন সব এক মাস ও তার বেশী বয়সের সমস্ত পুরুষদের সংখ্যা গণনা করে তাদের নামের একটি তালিকা তৈরী কর। বনি-ইসরাইলদের সমস্ত প্রথম পুরুষ সন্তানদের জায়গায় লেবীয়দের এবং বনি-ইসরাইলদের পশুর প্রথম বাচ্চার জায়গায় লেবীয়দের পশুর প্রথম বাচ্চা আমার বলে ধরে নেবে। আমি মাবুদ।” মাবুদের দেওয়া হুকুম অনুসারে মূসা বনি-ইসরাইলদের মধ্যে প্রথমে জন্মেছে এমন সব পুরুষদের গণনা করলেন। প্রথমে জন্মেছে এমন সব এক মাস ও তার বেশী বয়সের পুরুষদের নাম লিখবার পর দেখা গেল যে, তাদের মোট সংখ্যা বাইশ হাজার দু’শো তিয়াত্তর। মাবুদ মূসাকে আরও বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের সমস্ত প্রথম পুরুষ সন্তানদের জায়গায় লেবীয়দের এবং বনি-ইসরাইলদের পশুর প্রথম বাচ্চার জায়গায় লেবীয়দের পশুর প্রথম বাচ্চা ধরে নেবে। লেবীয়রা হবে আমার; আমি মাবুদ। তাদের ছাড়িয়ে নেবার এই রূপা তুমি হারুন ও তার ছেলেদের দিয়ে দেবে।” লেবীয়দের দিয়ে বনি-ইসরাইলদের ছাড়িয়ে নেবার পরে বনি-ইসরাইলদের যে সংখ্যাটা বাড়তি রইল মূসা তাদের ছাড়িয়ে নেবার রূপা আদায় করলেন। বনি-ইসরাইলদের প্রথম পুরুষ সন্তানদের কাছ থেকে তিনি ধর্মীয় মাপের ওজন অনুসারে তের কেজি ছ’শো পঞ্চাশ গ্রাম রূপা আদায় করলেন। মূসা মাবুদের হুকুম অনুসারে এই ছাড়িয়ে নেবার রূপা হারুন ও তাঁর ছেলেদের দিলেন। মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা লেবীয়দের মধ্য থেকে বংশ ও পরিবার অনুসারে কহাতীয়দের সংখ্যা গণনা কর। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের যে কহাতীয় পুরুষেরা মিলন-তাম্বুর কাজ করতে আসবে কেবল তাদের সংখ্যা গণনা করবে। “মিলন-তাম্বুতে কহাতীয়দের কাজ হবে মহাপবিত্র জিনিসগুলোর দেখাশোনা করা। তাম্বু তুলে যাত্রার সময় হলে হারুন ও তার ছেলেরা আবাস-তাম্বুর ভিতরে গিয়ে সাক্ষ্য-সিন্দুক আড়াল করবার পর্দাটা নামিয়ে তা দিয়ে সিন্দুকটা ঢেকে দেবে। তারপর তারা শুশুকের চামড়া দিয়ে সেটা ঢেকে তার উপর এমন একটা কাপড় বিছিয়ে দেবে যার সবটাই নীল রংয়ের, আর সাক্ষ্য-সিন্দুকের ডাণ্ডাগুলো জায়গামত ঢুকিয়ে দেবে। পবিত্র-রুটি রাখবার টেবিলের উপর তারা একটা নীল কাপড় বিছিয়ে তার উপর টেবিলের বড় ও ছোট বাসনগুলো, পেয়ালা এবং ঢালন-কোরবানীর কলসীগুলো রাখবে। যে রুটিগুলো সব সময় টেবিলের উপর থাকে সেগুলো টেবিলের উপরেই থাকবে। এগুলোর উপর একটি লাল রংয়ের কাপড় বিছিয়ে শুশুকের চামড়া দিয়ে ঢেকে দেবে আর টেবিলের ডাণ্ডাগুলো জায়গামত ঢুকিয়ে দেবে। আলো দেবার জন্য যে বাতিদানটা আছে সেটা ও তার সব বাতি, সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা ও সল্‌তের পোড়া অংশ রাখবার পাত্র এবং বাতিতে তেল যোগান দেবার পাত্র তারা একটা নীল কাপড় দিয়ে ঢেকে দেবে। তারপর তারা সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম সুদ্ধ বাতিদানটা শুশুকের চামড়ায় জড়িয়ে সেটা তার বয়ে নেবার তক্তার উপর রাখবে। সোনার ধূপগাহের উপর একটা নীল কাপড় বিছিয়ে তারা সেটা শুশুকের চামড়া দিয়ে ঢেকে দেবে এবং ধূপগাহের ডাণ্ডাগুলো জায়গামত ঢুকিয়ে দেবে। পবিত্র তাম্বুর কাজে ব্যবহার করবার সমস্ত জিনিসপত্র তারা নীল কাপড়ে জড়িয়ে শুশুকের চামড়া দিয়ে ঢেকে সেটা তার বয়ে নেবার তক্তার উপরে রাখবে। কোরবানগাহ্‌টার সমস্ত ছাই ফেলে দিয়ে তারা একটা বেগুনী রংয়ের কাপড় তার উপর বিছিয়ে দেবে। তারপর তার উপর তারা কোরবানগাহের কাজের সমস্ত বাসন-কোসন, আগুন রাখবার পাত্র, গোশ্‌ত তুলবার কাঁটা, হাতা ও কোরবানীর রক্ত রাখবার গামলা রাখবে। তারা তার উপর শুশুকের চামড়া বিছিয়ে দেবে এবং তার ডাণ্ডাগুলো জায়গামত ঢুকিয়ে দেবে। “হারুন ও তার ছেলেরা যখন এই সব পাক-পবিত্র জিনিসপত্র ও পবিত্র তাম্বুর সাজ-সরঞ্জাম ঢাকা দেওয়া শেষ করবে এবং লোকেরা তাম্বু তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হবে তখন কহাতীয়রা এই সব বয়ে নেবার জন্য আসবে। কিন্তু কোন পাক-পবিত্র জিনিসে তাদের হাত দেওয়া চলবে না। তা করলে তারা মারা পড়বে। মিলন-তাম্বুতে যে সব জিনিস থাকবে কহাতীয়দের সেগুলো বয়ে নিতে হবে। বাতির তেল, খোশবু ধূপ, নিয়মিত শস্য-কোরবানী এবং অভিষেক-তেলের ভার থাকবে ইমাম হারুনের ছেলে ইলীয়াসরের উপর। পুরো আবাস-তাম্বু ও তার মধ্যেকার সমস্ত কিছুর, অর্থাৎ পবিত্র তাম্বুর ও তার সাজ-সরঞ্জামের ভার থাকবে ইলীয়াসরের উপর।” এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা দেখো যেন লেবি-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে কহাতীয় বংশগুলো মুছে না যায়। যাতে তারা মহাপবিত্র জিনিসগুলোর কাছে গিয়ে মারা না পড়ে বরং বেঁচে থাকে সেই উদ্দেশ্যে হারুন ও তার ছেলেরা পবিত্র তাম্বুর মধ্যে গিয়ে প্রত্যেকের কাজ এবং কি তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে তা ঠিক করে দেবে। কিন্তু সেই সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস দেখবার জন্য কহাতীয়দের ভিতরে যাওয়া চলবে না, এক মুহূর্তের জন্যও না। তা করলে তারা মারা পড়বে।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “পরিবার ও বংশ অনুসারে তুমি গের্শোনীয়দেরও সংখ্যা গণনা কর। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের যে গের্শোনীয় পুরুষেরা মিলন-তাম্বুর কাজ করতে আসবে কেবল তাদের সংখ্যা গণনা করবে। এছাড়া আবাস-তাম্বু ও কোরবানগাহের চারপাশের উঠানের পর্দা, উঠানে ঢুকবার দরজার পর্দা, আবাস-তাম্বু খাটাবার দড়ি এবং এগুলো কাজে লাগাবার সমস্ত দরকারী জিনিসও তাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই সম্পর্কে আর যত কাজ আছে তার সমস্তই গের্শোনীয়দের করতে হবে। বোঝা বইবার কাজ হোক কিংবা আর অন্য যে কোন কাজ হোক, সমস্ত কাজই হারুন ও তার ছেলেদের নির্দেশমত তাদের করতে হবে। যে সব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের দায়িত্ব তা তোমরাই তাদের বলে দেবে। মিলন-তাম্বুতে গের্শোনীয় বংশগুলোর এই হল কাজ। তাদের কাজকর্মের দেখাশোনা করবার ভার থাকবে ইমাম হারুনের ছেলে ঈথামরের উপর। “বংশ ও পরিবার অনুসারে তোমরা মরারীয়দের সংখ্যা গণনা কর। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের যে মরারীয় পুরুষেরা মিলন-তাম্বুর কাজ করতে আসবে কেবল তাদের সংখ্যা গণনা করবে। মিলন-তাম্বুর কাজে মরারীয়দের দায়িত্ব হল আবাস-তাম্বুর সমস্ত ফ্রেম, হুড়কা, খুঁটি ও পা-দানিগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়া। এছাড়া, চারপাশের উঠানের সমস্ত পা-দানি সুদ্ধ খুঁটি, তাম্বুর গোঁজ, উঠানের পর্দার দড়ি ও সেগুলোর সমস্ত যন্ত্রপাতি এবং সেগুলো কাজে লাগাবার সমস্ত দরকারী জিনিসও তাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে। কে কি বয়ে নিয়ে যাবে তা তোমরাই তাদের ঠিক করে দেবে। এই হল মিলন-তাম্বুর কাজে মরারীয় বংশগুলোর দায়িত্ব। তাদের কাজকর্মের দেখাশোনা করবার ভার থাকবে ইমাম হারুনের ছেলে ঈথামরের উপর।” বংশ ও পরিবার অনুসারে মূসা, হারুন ও ইসরাইলীয় নেতারা কহাতীয়দের গণনা করলেন। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত যাদের মিলন-তাম্বুতে কাজ করতে আসবার কথা, বংশ অনুসারে তাদের গণনা করবার পর দেখা গেল তাদের সংখ্যা দু’হাজার সাতশো পঞ্চাশ। এটাই ছিল ঐ সব কহাতীয় বংশগুলোর মোট সংখ্যা। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদের দেওয়া হুকুম অনুসারেই মূসা ও হারুন তাদের সংখ্যা গণনা করেছিলেন। বংশ ও পরিবার অনুসারে গের্শোনীয়দের গণনা করা হয়েছিল। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত যাদের মিলন-তাম্বুতে কাজ করতে আসবার কথা, বংশ ও পরিবার অনুসারে তাদের গণনা করবার পর দেখা গেল তাদের সংখ্যা দু’হাজার ছ’শো ত্রিশ। এটাই হয়েছিল ঐ সব গের্শোনীয় বংশগুলোর মোট সংখ্যা। মাবুদের হুকুম অনুসারে মূসা ও হারুন তাদের গণনা করেছিলেন। বংশ ও পরিবার অনুসারে মরারীয়দের গণনা করা হয়েছিল। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত যাদের মিলন-তাম্বুতে কাজ করতে আসবার কথা, বংশ অনুসারে তাদের গণনা করবার পর দেখা গেল তাদের সংখ্যা তিন হাজার দু’শো। এটাই হয়েছিল ঐ সব মরারীয় বংশগুলোর মোট সংখ্যা। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদের দেওয়া হুকুম অনুসারে মূসা ও হারুন তাদের গণনা করেছিলেন। মূসা, হারুন ও ইসরাইলীয় নেতারা এইভাবে বংশ ও পরিবার অনুসারে সমস্ত লেবীয়দের গণনা করেছিলেন। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদের দেওয়া হুকুম অনুসারে প্রত্যেককেই তার কাজ এবং কি বয়ে নিয়ে যেতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। মূসাকে মাবুদ যে হুকুম দিয়েছিলেন সেই অনুসারে এইভাবে লেবীয়দের লোকসংখ্যা গণনা করা হয়েছিল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের এই হুকুম দাও যেন তারা ছাউনি থেকে এমন সব লোকদের সরিয়ে দেয় যাদের কোন চর্মরোগ রয়েছে কিংবা যাদের শরীর থেকে কোন রকম স্রাব হচ্ছে কিংবা মৃতদেহের দরুন যারা নাপাক হয়ে পড়েছে। সে স্ত্রীলোক হোক বা পুরুষ হোক তাকে সরিয়ে দিতে হবে। এই সব লোকেরা যাতে ছাউনি নাপাক না করে সেইজন্য ছাউনি থেকে তাদের বাইরে সরিয়ে দিতে হবে, কারণ সেখানে আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করি।” বনি-ইসরাইলরা তা-ই করল। তারা সেই সব লোকদের ছাউনির বাইরে সরিয়ে দিল। মাবুদ মূসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা তা-ই করেছিল। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল, মানুষ সাধারণত যে সব গুনাহ্‌ করে তার কোন একটা করে যদি কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে তবে তাকে দোষী বলে ধরা হবে। সে যে গুনাহ্‌ করেছে তা তাকে স্বীকার করতে হবে। সে যার উপর অন্যায় করেছে তাকে তার অন্যায়ের পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যে জিনিস সম্বন্ধে সে অন্যায় করেছে সেই জিনিসের দামের সংগে আরও পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম যোগ করে তাকে দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ নেবার জন্য যদি সেই লোকের কোন নিকট আত্মীয় না থাকে তবে তা মাবুদের পাওনা হবে। সেই ক্ষতিপূরণ এবং তার গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ভেড়াটা ইমামকে দিতে হবে। যে সব পাক-পবিত্র জিনিস বনি-ইসরাইলরা ইমামের কাছে নিয়ে আসবে তা সবই ইমামের হবে। প্রত্যেকের কোরবানী দেওয়া জিনিস ইমামের হবে। ইমামের হাতে দেওয়া জিনিস ইমামেরই হবে।” “ইমাম সেই স্ত্রীলোকটিকে মাবুদের সামনে দাঁড় করাবে। তারপর সে একটা মাটির পাত্রে কিছু পবিত্র পানি নেবে এবং আবাস-তাম্বুর মেঝে থেকে কিছু ধুলা তুলে নিয়ে সেই পানির মধ্যে দেবে। স্ত্রীলোকটিকে মাবুদের সামনে দাঁড় করাবার পর ইমাম তার চুল খুলে দেবে এবং অন্যায় তুলে ধরবার জন্য আনা কোরবানীর জিনিস, অর্থাৎ সন্দেহের দরুন শস্য-কোরবানীর জিনিস তার হাতে দেবে। ইমাম তার নিজের হাতে রাখবে বদদোয়া নিয়ে আসা তেতো পানি। তারপর ইমাম স্ত্রীলোকটিকে কসম খাইয়ে নিয়ে তাকে বলবে, ‘বিয়ের পর কোন লোক যদি তোমার সংগে জেনা না করে থাকে এবং তুমি যদি কুপথে গিয়ে অসতী না হয়ে থাক তবে বদদোয়া আনা এই তেতো পানি যেন তোমার কোন ক্ষতি না করে। কিন্তু বিয়ের পর কুপথে গিয়ে কারও সংগে জেনা করে যদি তুমি অসতী হয়ে থাক’- এই পর্যন্ত বলে ইমাম সেই স্ত্রীলোকটিকে দিয়ে তার নিজের উপর বদদোয়া ডেকে আনবার একটা কসম খাইয়ে নিয়ে আবার বলবে, ‘তবে মাবুদ এমন করুন যাতে স্ত্রী-অংগ অকেজো হয়ে তোমার পেট ফুলে ওঠে, যার ফলে তোমার লোকেরাই বদদোয়া এবং কসমের সময়ে তোমার নাম ব্যবহার করবে। এই বদদোয়ার পানি তোমার শরীরে ঢুকে যেন এমনভাবে কাজ করে যাতে তোমার পেট ফুলে ওঠে ও তোমার স্ত্রী-অংগ অকেজো হয়ে যায়।’ “এর জবাবে স্ত্রীলোকটিকে বলতে হবে, ‘তা-ই হোক।’ “ইমাম এই সমস্ত বদদোয়া চামড়ার উপর লিখে পানি ঢেলে লেখাটা সেই তেতো পানিতে ফেলবে। বদদোয়ার সেই তেতো পানি সেই স্ত্রীলোকটিকে খাওয়ালে পর সেই পানি তার পেটে গিয়ে তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেবে। প্রথমে ইমাম স্ত্রীলোকটির হাত থেকে সন্দেহের দরুন আনা সেই শস্য-কোরবানী নিয়ে মাবুদের সামনে দুলিয়ে তা কোরবানগাহের কাছে নিয়ে যাবে। ইমাম তারপর পুরো কোরবানীর বদলে তা থেকে এক মুঠো তুলে নিয়ে কোরবানগাহের উপর পুড়িয়ে দেবে। তারপর সে সেই পানি স্ত্রীলোকটিকে খেতে দেবে। স্ত্রীলোকটি যদি অসতী হয়ে স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়ে থাকে তবে বদদোয়ার এই পানি তাকে খাওয়াবার পর তা তার পেটে গিয়ে তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেবে। তার পেট ফুলে উঠবে এবং স্ত্রী-অংগ অকেজো হয়ে যাবে আর তার লোকেরা তার নাম বদদোয়া হিসাবে ব্যবহার করবে। কিন্তু স্ত্রীলোকটি যদি অসতী না হয়ে নির্দোষ থাকে তবে তাকে যে দোষ দেওয়া হয়েছিল তা থেকে সে খালাস পাবে এবং সন্তানের মা হবার ক্ষমতা তার থেকেই যাবে। এতে স্বামী অন্যায় করবার নালিশ থেকে মুক্ত থাকবে, কিন্তু অন্যায় করে থাকলে স্ত্রীলোকটি তার ফল ভোগ করবে।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের জানিয়ে দাও, যদি কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক নাসরীয় হিসাবে মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থাকবার বিশেষ কসম খায়, তবে তার আংগুর-রস কিংবা কোন রকমের মদানো-রস খাওয়া চলবে না। সে আংগুর-রস কিংবা মদানো-রস থেকে তৈরী সিরকাও খেতে পারবে না। এমন কি, টাটকা আংগুর-রস, আংগুর কিংবা কিসমিস খাওয়াও তার চলবে না। মোট কথা, সে যতদিন নাসরীয় থাকবে ততদিন আংগুর ফলের কোন কিছুই সে খেতে পারবে না, এর বীচিও নয় কিংবা খোসাও নয়। “যতদিন পর্যন্ত সে নাসরীয় হিসাবে নিজেকে আলাদা করে রাখবে বলে কসম খেয়েছে ততদিন পর্যন্ত তার মাথায় ক্ষুর লাগানো চলবে না। মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থাকবার সময়ে তাকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে। তার চুল লম্বা হতে দিতে হবে। এই সময় সে কোন মৃতদেহের কাছে যেতে পারবে না। মা-বাবা-ভাই-বোনদের কেউ মারা গেলেও তার নিজেকে নাপাক করা চলবে না, কারণ তার মাথায় রয়েছে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থাকবার চিহ্ন। তার এই আলাদা হয়ে থাকবার সম্পূর্ণ সময়ে তাকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে। “যদি কেউ হঠাৎ তার সামনে মারা যায় এবং তাতে মাবুদের উদ্দেশ্যে রাখা তার চুল নাপাক হয়ে যায় তবে সাত দিনের দিন, অর্থাৎ তার পাক-পবিত্র হবার দিন তাকে মাথা কামিয়ে ফেলতে হবে। আট দিনের দিন তাকে মিলন-তাম্বুর দরজায় ইমামের কাছে দু’টা ঘুঘু না হয় দু’টা কবুতর নিয়ে যেতে হবে। মৃতদেহের কাছে উপস্থিত থাকবার দরুন সে নাপাক হয়েছে বলে তার নাপাকী ঢাকা দেবার জন্য ইমাম একটা পাখী দিয়ে গুনাহের কোরবানী এবং অন্যটা দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেবে। ঐ দিনই তার মাথার চুল তাকে মাবুদের উদ্দেশ্যে নতুন করে রাখতে হবে, আর সেই সংগে তার নিজেকে আগের মত মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখবার কসম খেতে হবে। এছাড়া দোষের কোরবানীর জন্য তাকে এক বছরের একটা ভেড়ার বাচ্চা আনতে হবে। এর আগে যতদিন সে মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থেকেছে সেই দিনগুলো বাতিল হয়ে যাবে, কারণ সেই সময়ে সে নাপাক হয়েছিল। “মাবুদের উদ্দেশ্যে একজন নাসরীয়ের আলাদা হয়ে থাকবার সময়টা পার হয়ে যাওয়ার পর এই নিয়ম পালন করতে হবে। তাকে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে যেতে হবে। সেখানে মাবুদের উদ্দেশে তাকে কোরবানী হিসাবে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য এক বছরের একটা নিখুঁত বাচ্চা-ভেড়া, গুনাহের কারবানীর জন্য এক বছরের একটা নিখুঁত বাচ্চা-ভেড়ী এবং যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য একটা নিখুঁত ভেড়া আনতে হবে। এগুলোর সংগে থাকবে এর সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর জিনিস এবং এক টুকরি খামিহীন রুটি। এই রুটিগুলো হবে তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দার পিঠা ও তেল লাগানো চাপাটি। ইমামকে এগুলো মাবুদের সামনে নিয়ে রাখতে হবে এবং তাকে গুনাহের কোরবানীর ও পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। এছাড়া তাকে যোগাযোগ-কোরবানীর ভেড়াটা জবাই করে তা কোরবানী দেবার সময় টুকরির খামিহীন রুটিগুলোও কোরবানী করতে হবে আর এর সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীও করতে হবে। তারপর মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে নাসরীয়কে তার মাবুদের উদ্দেশ্যে রাখা চুল কামিয়ে ফেলতে হবে। এই চুল নিয়ে সে যোগাযোগ-কোরবানীর নীচে আগুনে ফেলে দেবে। মাবুদের উদ্দেশ্যে রাখা চুল কামানো হয়ে গেলে পর ইমাম ভেড়াটার একটা সিদ্ধ করা কাঁধ আর টুকরি থেকে একটা খামিহীন পিঠা ও চাপাটি নিয়ে সেই নাসরীয়ের হাতে দেবে। তারপর ইমাম দোলন-কোরবানী হিসাবে তা মাবুদের সামনে দোলাবে। এগুলো পবিত্র এবং ইমামের পাওনা। এছাড়া দুলিয়ে রাখা বুকের গোশ্‌ত এবং কোরবানী দেওয়া রানও ইমামের পাওনা। এই সব হয়ে গেলে পর সেই নাসরীয় আংগুর-রস খেতে পারবে। “নাসরীয়ের জন্য এই হল নিয়ম। মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থাকবার কসম অনুসারে তাকে এই সব কোরবানী দিতে হবে। এছাড়া যদি সে নিজের ক্ষমতামত আরও কিছু দেবার কসম খেয়ে থাকে তবে তা-ও তাকে দিতে হবে। সে যা ওয়াদা করেছে মাবুদের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে থাকবার নিয়ম অনুসারে তাকে এর সবই দিতে হবে।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুন ও তার ছেলেদের বল যে, তারা এই কথা বলে বনি-ইসরাইলদের উপর দোয়া উচ্চারণ করবে: ‘মাবুদ তোমাকে দোয়া করুন ও রক্ষা করুন; মাবুদের রহমত আলোর মত তোমার উপর পড়ুক; তাঁর মেহেরবানী তোমার উপর থাকুক। মাবুদ তাঁর মুখ তোমার দিকে ফিরান এবং তোমাকে শান্তি দিন।’ “এইভাবে তারা বনি-ইসরাইলদের উপর আমার নাম উচ্চারণ করবে, তাতে আমিই তাদের দোয়া করব।” যেদিন আবাস-তাম্বুটা খাটানো শেষ হল সেই দিন মূসা তার উপর অভিষেক-তেল দিয়ে গোটা তাম্বুটা এবং তার সাজ-সরঞ্জাম পাক-পবিত্র করে নিলেন। তিনি কোরবানগাহ্‌ ও তার বাসন-কোসনের উপর অভিষেক তেল দিয়ে সেগুলোও পাক-পবিত্র করে নিলেন। তারপর বনি-ইসরাইলদের নেতারা, অর্থাৎ বংশের নেতারা উপহার আনলেন। এঁরাই হলেন সেই সব গোষ্ঠী-নেতা যাঁদের উপর গণনা করা লোকদের দেখাশোনার ভার ছিল। উপহার হিসাবে তাঁরা ছয়টা ছই দেওয়া গরুর গাড়ি এবং বারোটা বলদ মাবুদের সামনে এনে রাখলেন। তাতে প্রত্যেক নেতার পক্ষ থেকে একটা করে বলদ আর প্রতি দু’জনের পক্ষ থেকে একটা করে গরুর গাড়ি দেওয়া হল। তাঁরা সেগুলো এনে আবাস-তাম্বুর সামনে রাখলেন। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি এদের কাছ থেকে এগুলো গ্রহণ কর যাতে সেগুলো মিলন-তাম্বুর কাজে লাগানো যায়। লেবীয়দের কাজ অনুসারে তুমি এগুলো তাদের মধ্যে ভাগ করে দাও।” সেইজন্য মূসা সেই গাড়ি ও বলদগুলো লেবীয়দের ভাগ করে দিলেন। গের্শোনীয়দের কাজ অনুসারে তিনি দু’টা গাড়ি ও চারটা বলদ তাদের দিলেন, আর মরারীয়দের কাজ অনুসারে তিনি তাদের চারটা গাড়ি ও আটটা বলদ দিলেন। এদের সকলের দেখাশোনার ভার ছিল ইমাম হারুনের ছেলে ঈথামরের উপর। মূসা কহাতীয়দের কিছুই দিলেন না, কারণ পাক-পবিত্র জিনিসগুলোর দেখাশোনার ভার ছিল তাদের উপর এবং সেগুলোই ছিল তাদের কাঁধে করে বয়ে নেওয়ার কথা। অভিষেক-তেল দিয়ে কোরবানগাহ্‌-উৎসর্গের অনুষ্ঠান আরম্ভ হবার পর থেকে নেতারা তাঁদের উপহার এনে কোরবানগাহের সামনে রাখতে লাগলেন। মাবুদ মূসাকে বলেছিলেন, “প্রতিদিন এক একজন করে নেতা কোরবানগাহ্‌-দানের উদ্দেশ্যে তার উপহার নিয়ে আসবে।” প্রথম দিন যে নেতা তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন তিনি হলেন এহুদা-গোষ্ঠীর নেতা অম্মীনাদবের ছেলে নহশোন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল অম্মীনাদবের ছেলে নহশোনের উপহার। দ্বিতীয় দিনে ইষাখর-গোষ্ঠীর নেতা সূয়ারের ছেলে নথনেল তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল সূয়ারের ছেলে নথনেলের উপহার। তৃতীয় দিনে সবূলূন-গোষ্ঠীর নেতা হেলোনের ছেলে ইলীয়াব তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল হেলোনের ছেলে ইলীয়াবের উপহার। চতুর্থ দিনে রূবেণ-গোষ্ঠীর নেতা শদেয়ূরের ছেলে ইলীষূর তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল শদেয়ূরের ছেলে ইলীষূরের উপহার। পঞ্চম দিনে শিমিয়োন-গোষ্ঠীর নেতা সূরীশদ্দয়ের ছেলে শলুমীয়েল তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল সূরীশদ্দয়ের ছেলে শলুমীয়েলের উপহার। ষষ্ঠ দিনে গাদ-গোষ্ঠীর নেতা দ্যূয়েলের ছেলে ইলীয়াসফ তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল দ্যূয়েলের ছেলে ইলীয়াসফের উপহার। সপ্তম দিনে আফরাহীম-গোষ্ঠীর নেতা অম্মীহূদের ছেলে ইলীশামা তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল অম্মীহূদের ছেলে ইলীশামার উপহার। অষ্টম দিনে মানশা-গোষ্ঠীর নেতা পদাহসূরের ছেলে গমলীয়েল তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল পদাহসূরের ছেলে গমলীয়েলের উপহার। নবম দিনে বিন্যামীন-গোষ্ঠীর নেতা গিদিয়োনির ছেলে অবীদান তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল গিদিয়োনির ছেলে অবীদানের উপহার। দশম দিনে দান-গোষ্ঠীর নেতা অম্মীশদ্দয়ের ছেলে অহীয়েষর তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল অম্মীশদ্দয়ের ছেলে অহীয়েষরের উপহার। একাদশ দিনে আশের-গোষ্ঠীর নেতা অক্রণের ছেলে পগীয়েল তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল অক্রণের ছেলে পগীয়েলের উপহার। দ্বাদশ দিনে নপ্তালি-গোষ্ঠীর নেতা ঐননের ছেলে অহীরঃ তাঁর উপহার নিয়ে আসলেন। তাঁর উপহার ছিল শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দায় ভরা ধর্মীয় মাপের এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার বাসন এবং একই জিনিসে ভরা সাতশো গ্রাম ওজনের একটা রূপার গামলা; ধূপে ভরা একশো গ্রাম ওজনের একটা সোনার ছোট বাসন; পোড়ানো-কোরবানীর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, একটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া; গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল; যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, পাঁচটা ভেড়া, পাঁচটা ছাগল ও পাঁচটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। এগুলো ছিল ঐননের ছেলে অহীরয়ের উপহার। অভিষেক-তেল দিয়ে কোরবানগাহ্‌-উৎসর্গের অনুষ্ঠান আরম্ভ হবার পর থেকে ইসরাইলীয় নেতারা যে সমস্ত উপহার এনেছিলেন সেগুলো হল বারোটা রূপার বাসন, বারোটা রূপার গামলা এবং বারোটা সোনার ছোট বাসন। ধর্মীয় মাপ অনুসারে প্রত্যেকটা রূপার বাসনের ওজন ছিল এক কেজি তিনশো গ্রাম এবং প্রত্যেকটা রূপার গামলার ওজন ছিল সাতশো গ্রাম। রূপার সমস্ত পাত্রগুলোর মোট ওজন হয়েছিল চব্বিশ কেজি। ধর্মীয় মাপ অনুসারে প্রত্যেকটা ধূপে ভরা সোনার ছোট বাসনের ওজন ছিল একশো গ্রাম। সোনার বারোটা ছোট বাসনের মোট ওজন হয়েছিল এক কেজি দু’শো গ্রাম। এছাড়া পোড়ানো-কোরবানীর জন্য মোট দেওয়া হয়েছিল বারোটা ষাঁড়, বারোটা ভেড়া এবং এক বছরের বারোটা বাচ্চা-ভেড়া। এগুলোর সংগে ছিল এর সংগেকার শস্য-কোরবানীর জিনিস। গুনাহের কোরবানীর জন্য দেওয়া হয়েছিল বারোটা ছাগল। যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য মোট দেওয়া হয়েছিল চব্বিশটা ষাঁড়, ষাটটা ভেড়া, ষাটটা ছাগল এবং ষাটটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া। কোরবানগাহের অভিষেকের পর এর দানের জন্য এই সমস্ত উপহার আনা হয়েছিল। এর পর মূসা যখন মাবুদের সংগে কথা বলবার জন্য মিলন-তাম্বুতে ঢুকতেন তখন সাক্ষ্য-সিন্দুকের উপরকার ঢাকনার কিনারার কারুবী দু’টির মাঝখানের জায়গা থেকে তাঁর কথা শুনতে পেতেন। এইভাবে মাবুদ মূসার সংগে কথা বলতেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি হারুনকে বল, বাতিদানের সাতটা বাতি তাকে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে সেগুলোর আলো বাতিদানের সামনের জায়গাটায় পড়ে।” হারুন তা-ই করলেন। মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম মতই তিনি বাতিগুলো এমনভাবে বসালেন যাতে বাতিদানের উপর সেগুলোর সল্‌তে সামনের দিকে থাকে। বাতিদানটার গোড়া থেকে আগার ফুলগুলো পর্যন্ত সবটাই সোনা পিটিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। মাবুদ মূসাকে যে নমুনা দেখিয়েছিলেন ঠিক সেইরকম করেই বাতিদানটা তৈরী করা হয়েছিল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে লেবীয়দের বের করে নিয়ে তাদের পাক-সাফ কর। এইভাবে তুমি তাদের পাক-সাফ করবে: তাদের উপর পাক-সাফ করবার পানি ছিটিয়ে দেবে। তারপর তারা তাদের সারা শরীর কামিয়ে কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিজেদের পাক-সাফ করে নেবে। পরে তারা একটা ষাঁড় এবং এর সংগেকার শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া মিহি ময়দা নিয়ে আসবে। গুনাহের কোরবানীর জন্য তোমাকে আর একটা ষাঁড় আনিয়ে নিতে হবে। এর পরে তুমি মিলন-তাম্বুর সামনে লেবীয়দের নিয়ে আসবে এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সেখানে জমায়েত করবে। লেবীয়দের তুমি মাবুদের সামনে আনবে এবং বনি-ইসরাইলরা তাদের উপর হাত রাখবে। হারুন বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে দোলন-কোরবানী হিসাবে লেবীয়দের মাবুদের সামনে উপস্থিত করবে যেন তারা মাবুদের কাজে হাত দিতে পারে। তারপর লেবীয়রা সেই দু’টা ষাঁড়ের উপর হাত রাখবে আর তুমি তার একটা দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে গুনাহের কোরবানী এবং অন্যটা দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী করে তাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করবে। লেবীয়দের তুমি হারুন ও তার ছেলেদের সামনে দাঁড় করাবে এবং মাবুদের কাছে দোলন-কোরবানী হিসাবে তাদের কোরবানী করবে। এইভাবে তুমি অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের থেকে লেবীয়দের আলাদা করে নেবে, আর তাতে তারা আমার হবে। “এইভাবে লেবীয়দের পাক-সাফ করে নিয়ে দোলন-কোরবানী হিসাবে দান করবার পরে তারা মিলন-তাম্বুতে কাজ করবার জন্য আসবে। সমস্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এরাই সম্পূর্ণভাবে আমার, আর কারও নয়। প্রত্যেক ইসরাইলীয় স্ত্রীলোকের প্রথম পুরুষ সন্তানের বদলে আমি লেবীয়দের আমার নিজের করে নিচ্ছি। প্রথমে জন্মেছে এমন প্রত্যেকটি ইসরাইলীয় পুরুষ সন্তান আমার- সে মানুষেরই হোক বা পশুরই হোক। মিসরীয়দের প্রথম পুরুষ সন্তান মেরে ফেলবার সময় আমি বনি-ইসরাইলদের প্রথম পুরুষ সন্তান আমার জন্য পবিত্র করে রেখেছিলাম। প্রথমে জন্মেছে সেই সমস্ত ইসরাইলীয় সন্তানদের জায়গায় আমি এখন লেবীয়দের কবুল করছি। বনি-ইসরাইলদের মধ্যেকার এই লেবীয়দের আমি হারুন ও তার ছেলেদের দান করছি, যাতে তারা বনি-ইসরাইলদের হয়ে মিলন-তাম্বুতে কাজ করে এবং তাদের গুনাহ্‌ ঢাকবার ব্যবস্থা করে। তার ফলে বনি-ইসরাইলরা পবিত্র তাম্বুর কাছে গেলেও তাদের উপর কোন বিপদ নেমে আসবে না।” মাবুদ লেবীয়দের সম্বন্ধে মূসাকে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন মূসা, হারুন এবং অন্য সমস্ত বনি-ইসরাইল লেবীয়দের নিয়ে তা-ই করলেন। লেবীয়রা নিজেদের পাক-সাফ করে নিল এবং কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলল। তারপর হারুন মাবুদের উদ্দেশে দোলন-কোরবানী হিসাবে তাদের দান করলেন এবং পাক-সাফ করে নেবার জন্য তাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করলেন। এর পর লেবীয়রা হারুন ও তার ছেলেদের অধীনে মিলন-তাম্বুতে তাদের কাজ করতে গেল। মাবুদ মূসাকে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন তারা লেবীয়দের নিয়ে ঠিক তা-ই করলেন। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “লেবীয়দের সম্বন্ধে এই নিয়ম থাকবে যে, তাদের মধ্যে পঁচিশ কিংবা তার বেশী বয়সের লোকেরা মিলন-তাম্বুর কাজ করতে আসবে, কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে ঐ কাজ থেকে তাদের অবসর নিতে হবে; তারা আর কাজ করবে না। তখন এই লোকেরা মিলন-তাম্বুতে তাদের ভাইদের সংগে দেখাশোনার কাজে সাহায্য করতে পারবে কিন্তু নিজেরা কোন কাজে হাত দিতে পারবে না। এই নিয়ম অনুসারে তুমি লেবীয়দের কাজ ঠিক করে দেবে।” বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার দ্বিতীয় বছরের প্রথম মাসে সিনাই মরুভূমিতে মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা যেন নির্দিষ্ট সময়ে উদ্ধার-ঈদ পালন করে। তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে, অর্থাৎ এই মাসের চৌদ্দ দিনের দিন বেলা ডুবে গেলে পর সমস্ত নিয়ম-কানুন অনুসারে এই ঈদ পালন করে।” এই কথা শুনে মূসা বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার-ঈদ পালন করতে বললেন। তাতে তারা বছরের প্রথম মাসের চৌদ্দ দিনের দিন বেলা ডুবে গেলে পর সিনাই মরুভূমিতে তা পালন করল। মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা ঠিক সেইমতই সব কিছু করল। সেই সময় তাদের মধ্যে কয়েকজন লোক একটা মৃতদেহের ছোঁয়া লাগবার দরুন নাপাক অবস্থায় পড়ে সেই দিন উদ্ধার-ঈদ পালন করতে পারল না। তারা সেই দিনই মূসা ও হারুনের কাছে গেল। তারা মূসাকে বলল, “একটা মৃতদেহের ছোঁয়া লাগবার দরুন আমরা নাপাক অবস্থায় আছি। তাই বলে অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের সংগে আমরা নির্দিষ্ট সময়ে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিতে পারব না কেন?” জবাবে মূসা বললেন, “তোমাদের সম্বন্ধে মাবুদের হুকুম জেনে না নেওয়া পর্যন্ত তোমরা অপেক্ষা কর।” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “বনি-ইসরাইলদের বল যে, তাদের কিংবা তাদের বংশধরদের মধ্যে যদি কেউ কেউ মৃতদেহের ছোঁয়া লাগবার দরুন নাপাক অবস্থায় পড়ে কিংবা তারা যদি লম্বা যাত্রাপথে থাকে তবুও তারা মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করতে পারবে। দ্বিতীয় মাসের চৌদ্দ দিনের দিন বেলা ডুবে গেলে পর তাদের এই ঈদ পালন করতে হবে। খামিহীন রুটি আর তেতো শাকের সংগে তাদের উদ্ধার-ঈদের গোশ্‌ত খেতে হবে। সকাল পর্যন্ত কিছু ফেলে রাখা চলবে না কিংবা কোন হাড় ভাংগা চলবে না। উদ্ধার-ঈদ পালনের সময় সমস্ত নিয়ম তাদের মেনে চলতে হবে। কিন্তু নাপাক নয় কিংবা যাত্রাপথেও নয় এমন কোন লোক যদি উদ্ধার-ঈদ পালন না করে, তবে সে নির্দিষ্ট সময়ে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেয় নি বলে তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। তাকে তার গুনাহের ফল ভোগ করতেই হবে। “ইসরাইলীয়দের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যদি মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করতে চায়, তবে তাকে এই ঈদের নিয়ম-কানুন অনুসারেই তা পালন করতে হবে। ইসরাইলীয় এবং অন্য জাতির সবাইকে একই নিয়ম পালন করতে হবে।” যেদিন আবাস-তাম্বু, অর্থাৎ সাক্ষ্য-তাম্বু খাটানো হল সেই দিন সেটি মাবুদের মেঘে ঢেকে গেল। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত আবাস-তাম্বুর উপরকার সেই মেঘ আগুনের মত দেখাল। তারপর থেকে অবস্থাটা ঐরকমই হতে লাগল। আবাস-তাম্বুটি সেই মেঘে ঢাকা থাকত আর রাতের বেলায় তা আগুনের মত দেখাত। আবাস-তাম্বুর উপর থেকে যখন মেঘ সরে যেত তখন বনি-ইসরাইলরা যাত্রা শুরু করত। কিন্তু যেখানে সেই মেঘ স্থির হয়ে দাঁড়াত সেখানে তারা তাম্বু ফেলত। মাবুদের হুকুমেই তারা যাত্রা করত আবার মাবুদের হুকুমেই তাম্বু ফেলত। আবাস-তাম্বুর উপর যতক্ষণ মেঘ থাকত বনি-ইসরাইলরা ততক্ষণ তাম্বু ফেলে সেখানেই থাকত। আবাস-তাম্বুর উপরে মেঘ যখন বেশী দিন ধরে থাকত বনি-ইসরাইলরা তখন মাবুদের নির্দেশ মেনে নিয়ে যাত্রা বন্ধ রাখত। কখনও কখনও মেঘ আবাস-তাম্বুর উপরে মাত্র কয়েক দিন থাকত। বনি-ইসরাইলরা মাবুদের হুকুমে তাম্বু ফেলত আবার তাঁরই হুকুমে যাত্রা শুরু করত। কখনও কখনও মেঘ মাত্র সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত থাকত। সকালবেলায় মেঘ সরে গেলে পর তারা আবার যাত্রা শুরু করত। মেঘ সরে গেলেই তারা চলতে শুরু করত- তা দিনেই হোক বা রাতেই হোক। দু’দিন হোক বা এক মাস হোক কিংবা তার বেশী সময় হোক, যতদিন মেঘ আবাস-তাম্বুর উপরে থাকত বনি-ইসরাইলরা তাম্বু ফেলে সেখানেই থাকত, যাত্রা করত না। কিন্তু মেঘ সরে গেলেই তারা আবার চলতে শুরু করত। মাবুদের হুকুমেই তারা তাম্বু ফেলত আবার মাবুদের হুকুমেই যাত্রা করত। মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া হুকুম অনুসারেই তারা মাবুদের নির্দেশ মেনে চলত। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি রূপা পিটিয়ে দু’টা শিংগা তৈরী করে নাও। বনি-ইসরাইলদের ডেকে জমায়েত করবার জন্য এবং বিভিন্ন দলের যাত্রা শুরু করবার জন্য তুমি তা বাজাবে। যখন দু’টা শিংগাই বাজানো হবে তখন বনি-ইসরাইলরা সকলে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে তোমার সামনে এসে জমায়েত হবে। যখন একটা শিংগা বাজানো হবে তখন ইসরাইলের বিভিন্ন বংশের নেতারা তোমার সামনে এসে জমায়েত হবে। শিংগা যখন প্রথমবার বাজানো হবে তখন যে দলগুলো পূর্ব দিকে তাম্বু ফেলে আছে তারা রওনা হবে। দ্বিতীয় বার বাজানো হলে দক্ষিণ দিকের দলগুলো রওনা হবে। এটা হল বেরিয়ে পড়বার সংকেত। লোকদের একসংগে জমায়েত করতে হলে তুমি দু’টা শিংগাই বাজাবে কিন্তু তার সংকেত হবে আলাদা রকমের। “এই শিংগা বাজাবে হারুনের ছেলেরা, অর্থাৎ ইমামেরা। এটা হবে তোমাদের ও তোমাদের বংশধরদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। নিজের দেশে থাকবার সময় যখন তোমরা কোন জুলুমবাজ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাবে তখন দু’টা শিংগাই বাজিয়ে সংকেত দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তখন তোমাদের কথা ভেবে শত্রুদের হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করবেন। তোমাদের আনন্দ-উৎসবের সময়ে, তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা বিভিন্ন ঈদের সময়ে ও মাসের শুরুতে যখন তোমরা পোড়ানো-কোরবানীর ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবে তখন তোমরা শিংগা বাজাবে। তা দিয়ে তোমাদের আল্লাহ্‌র সামনে তোমাদের তুলে ধরা হবে। আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ।” দ্বিতীয় বছরের দ্বিতীয় মাসের বিশ দিনের দিন সাক্ষ্য-তাম্বুর উপর থেকে মেঘ সরে গেল। তখন বনি-ইসরাইলরা সিনাই মরুভূমি ছেড়ে বের হয়ে পড়ল। সেই মেঘ পারণ মরুভূমিতে এসে স্থির হয়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তারা চলতেই থাকল। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদের দেওয়া হুকুম অনুসারে তারা এই প্রথম বারের মত যাত্রাপথে পা বাড়াল। প্রথমেই রওনা হল এহুদা-বিভাগের বিভিন্ন দল তাদের বিভাগীয় নিশানের তলায়। এহুদা-গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন অম্মীনাদবের ছেলে নহশোন। ইষাখর-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল সূয়ারের ছেলে নথনেলের উপর, আর সবূলূন-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল হেলোনের ছেলে ইলীয়াবের উপর। তারপর আবাস-তাম্বুটা খুলে ফেলা হল আর গের্শোনীয় ও মরারীয়রা সেটা বয়ে নিয়ে চলল। এদের পরে রওনা হল রূবেণ-বিভাগের বিভিন্ন দল তাদের বিভাগীয় নিশানের তলায়। রূবেণ-গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন শদেয়ূরের ছেলে ইলীষূর। শিমিয়োন-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল সূরীশদ্দয়ের ছেলে শলুমীয়েলের উপর, আর গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল দ্যূয়েলের ছেলে ইলীয়াসফের উপর। এদের পরে আবাস-তাম্বুর পাক-পবিত্র জিনিসপত্র নিয়ে কহাতীয়রা রওনা হল। কহাতীয়রা পৌঁছাবার আগেই আবাস-তাম্বুটা খাটিয়ে ফেলবার কথা ছিল। এদের পরে রওনা হল আফরাহীম-বিভাগের বিভিন্ন দল তাদের বিভাগীয় নিশানের তলায়। আফরাহীম-গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন অম্মীহূদের ছেলে ইলীশামা। মানশা-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল পদাহসূরের ছেলে গমলীয়েলের উপর, আর বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল গিদিয়োনির ছেলে অবীদানের উপর। সবার শেষে রওনা হল দান-বিভাগের বিভিন্ন দল তাদের বিভাগীয় নিশানের তলায়। এরা রক্ষীদল হিসাবে সমস্ত দলগুলোর পিছনে গেল। দান-গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন অম্মীশদ্দয়ের ছেলে অহীয়েষর। আশের-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল অক্রণের ছেলে পগীয়েলের উপর, আর নপ্তালি-গোষ্ঠীর লোকদের ভার ছিল ঐননের ছেলে অহীরয়ের উপর। ইসরাইলীয় বিভিন্ন দলগুলো এইভাবে পর পর রওনা হয়ে গিয়েছিল। এর পর মূসা তাঁর শ্বশুর মাদিয়ানীয় শোয়াইবের ছেলে হোববকে বললেন, “মাবুদ যে দেশ আমাদের দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন আমরা সেই দেশের দিকে রওনা হচ্ছি। তুমি আমাদের সংগে চল। আমরা তোমাকে মেহেরবানীই করব, কারণ মাবুদ বনি-ইসরাইলদের অনেক মেহেরবানী করবেন বলে ওয়াদা করেছেন।” জবাবে হোবব বলল, “না, আমি যাব না। আমি আমার নিজের দেশে নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাচ্ছি।” কিন্তু মূসা বললেন, “না, না, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেয়ো না। তোমার জানা আছে মরুভূমির মধ্যে কোথায় আমাদের তাম্বু ফেলা উচিত, কাজেই তুমি হবে আমাদের চোখ। তুমি যদি আমাদের সংগে আস তবে মাবুদ আমাদের যে মেহেরবানী করবেন বলে ওয়াদা করেছেন তার ভাগ আমরা তোমাকেও দেব।” এইভাবে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের পাহাড়ের কাছ থেকে রওনা হয়ে তিন দিনের পথ এগিয়ে গেল। তাদের বিশ্রামের জন্য একটা জায়গা খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যে সেই তিন দিন পর্যন্ত মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি তাদের আগে আগে গেল। ছাউনি তুলে রওনা হওয়ার পর দিনের বেলা মাবুদের মেঘ বনি-ইসরাইলদের উপরে থাকত। যখনই সাক্ষ্য-সিন্দুকটি রওনা হত মূসা বলতেন, “হে মাবুদ, ওঠো। তোমার শত্রুরা সব ছড়িয়ে পড়ুক আর যারা তোমাকে ঘৃণার চোখে দেখে তারা তোমার সামনে থেকে পালিয়ে যাক।” যখনই সেটি থামত তিনি বলতেন, “হে মাবুদ, অসংখ্য বনি-ইসরাইলদের কাছে তুমি ফিরে এস।” বনি-ইসরাইলদের যে সব দুঃখ-কষ্ট হচ্ছিল তা নিয়ে তারা মাবুদের সামনে চেঁচামেচি করতে লাগল। তা শুনে মাবুদ রেগে গেলেন। তাঁর পাঠানো আগুন তাদের মধ্যে জ্বলতে লাগল এবং ছাউনির কিনারার কিছু লোককে পুড়িয়ে মারল। এতে লোকেরা মূসার কাছে কান্নাকাটি করতে লাগল আর তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করলেন। তাতে আগুন নিভে গেল। মাবুদের এই আগুন তাদের মধ্যে জ্বলেছিল বলে সেই জায়গাটার নাম হল তবেরা। বনি-ইসরাইলদের সংগে অন্যান্য জাতির যে লোকেরা ছিল তারা অন্য রকম খাবারের লোভে পাগল হয়ে উঠল। তাদের দেখাদেখি বনি-ইসরাইলরা আবার কান্নাকাটি করে বলতে লাগল, “হায়, যদি আমরা গোশ্‌ত খেতে পেতাম! মিসর দেশে বিনা পয়সায় মাছ খাবার কথা আমাদের মনে পড়ছে। এছাড়া শসা, তরমুজ, পিঁয়াজ, সবজী পিঁয়াজ এবং রসুনের কথাও আমাদের মনে পড়ছে। কিন্তু এখন আমাদের ভিতরটা শুকিয়ে গেছে। মান্না ছাড়া আমাদের চোখে আর কিছুই পড়ছে না।” মান্নার আকার ছিল ধনে বীজের মত, আর তা দেখতে ছিল গুগ্‌গুলুর মত। লোকেরা ঘুরে ঘুরে সেগুলো কুড়িয়ে আনত আর জাঁতায় কিংবা হামানদিস্তায় গুঁড়া করে নিত। সেগুলো তারা হাঁড়ির মধ্যে সিদ্ধ করত কিংবা তা দিয়ে রুটি বানাত। তার স্বাদ ছিল জলপাইয়ের তেল দিয়ে বানানো পিঠার মত। রাতে ছাউনি-এলাকায় শিশির পড়ত আর তার উপর পড়ত মান্না। মূসা শুনতে পেলেন প্রত্যেক পরিবারের লোকেরা তাদের নিজের নিজের তাম্বুর দরজার কাছে কাঁদছে। এতে মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন আর মূসাও বিরক্ত হলেন। তিনি মাবুদকে বললেন, “তুমি তোমার গোলামকে কেন এই বিপদে ফেলেছ? তোমাকে নারাজ করবার মত আমি এমন কি করেছি যে, তুমি এই সমস্ত লোকদের বোঝা আমার উপর চাপিয়েছ? আমি কি এই সব লোকদের পেটে ধরেছি? আমি কি এদের প্রসব করেছি? তুমি এদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে দেশ দেবার কসম খেয়েছিলে সেখানে কেন তুমি আমাকে পালক-পিতার মত করে তাদের কোলে করে নিয়ে যেতে বলছ? এই সমস্ত লোকদের জন্য আমি কোথায় গোশ্‌ত পাব? তারা আমার কাছে কেবলই ‘গোশ্‌ত খেতে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। তাদের বোঝা খুব ভারী, আমার একার পক্ষে তা বয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি যদি আমার অবস্থা এই রকমই কর তবে এখনই তুমি আমাকে মেরে ফেল। যদি আমি তোমার রহমত পেয়েই থাকি তবে নিজের চোখে আমার নিজের সর্বনাশ আমাকে দেখতে দিয়ো না।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের মধ্যে যাদের তুমি নেতা এবং সম্মানিত লোক বলে জান তাদের মধ্য থেকে সত্তরজন বৃদ্ধ নেতাকে আমার কাছে নিয়ে এস। তুমি তাদের মিলন-তাম্বুর কাছে এসে তোমার সংগে দাঁড়াতে বল। আমি সেখানে নেমে এসে তোমার সংগে কথা বলব। তোমার উপর যে রূহ্‌ রয়েছেন আমি তাঁকে তাদের উপরেও দেব। লোকদের বোঝা বয়ে নিতে তারাই তোমাকে সাহায্য করবে। তাতে তোমাকে আর একা বোঝা বইতে হবে না। তুমি লোকদের বল, ‘তোমরা নিজেদের পাক-পবিত্র করে নিয়ে কালকের জন্য প্রস্তুত হও, কারণ কালকেই তোমরা গোশ্‌ত খেতে পাবে। তোমরা মাবুদের কাছে কেঁদে কেঁদে গোশ্‌ত খাবার কথা বলেছিলে আর জানিয়েছিলে যে, এর চেয়ে মিসর দেশেই তোমরা ভাল ছিলে। তাই এখন তিনি তোমাদের গোশ্‌ত দেবেন আর তোমরা তা খাবে। সেই গোশ্‌ত যে তোমরা কেবল একদিন, দু’দিন, পাঁচ দিন, দশ দিন কিংবা বিশ দিন খাবে তা নয়, খাবে গোটা এক মাস ধরে। তখন সেই গোশ্‌ত তোমাদের নাক দিয়ে বেরিয়ে আসবে আর গোশ্‌তে তোমাদের অরুচি ধরে যাবে। এই সব হবে কারণ যিনি তোমাদের মধ্যে রয়েছেন সেই মাবুদকে তোমরা অগ্রাহ্য করেছ আর তাঁর সামনে কেঁদে কেঁদে বলেছ যে, মিসর দেশ ছেড়ে আসা তোমাদের উচিত হয় নি।’ ” এই কথা শুনে মূসা বললেন, “যুদ্ধ করবার মত লোকই আমার সংগে রয়েছে ছয় লক্ষ, আর তুমি বলছ পুরো এক মাস ধরে তুমি তাদের গোশ্‌ত খেতে দেবে। তাদের গরু-ভেড়া সমস্ত কাটলেও তাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে না। সমুদ্রের সমস্ত মাছ ধরে আনলেও তাতে তাদের কুলাবে না।” জবাবে মাবুদ মূসাকে বললেন, “মাবুদের কুদরত কি এতই কম? আমার কথাটা তোমার কাছে সত্যি হয়ে ওঠে কি না তা তুমি এবার দেখতে পাবে।” এই কথা শুনে মূসা বাইরে গিয়ে মাবুদ যা বলেছেন তা লোকদের জানালেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের সত্তরজন বৃদ্ধ নেতাকে এনে মিলন-তাম্বুর সামনে দাঁড় করালেন। তখন মাবুদ সেই মেঘে ঘেরাও হয়ে নেমে এসে মূসার সংগে কথা বললেন। মূসার উপর যে রূহ্‌ ছিলেন তাঁকে তিনি ঐ সত্তরজন বৃদ্ধ নেতার উপরেও দিলেন। যখন সেই রূহ্‌ তাঁদের উপর আসলেন তখন কিছুকালের জন্য তাঁরা নবী হিসাবে কথা বললেন। ইল্‌দদ আর মেদদ নামে দু’জন লোক ছাউনির মধ্যেই রয়ে গিয়েছিলেন। বেছে নেওয়া বৃদ্ধ নেতাদের মধ্যে এই দু’জনও ছিলেন, কিন্তু তারা মিলন-তাম্বুর কাছে যান নি। তবুও তাঁদের উপর সেই রূহ্‌ এসেছিলেন। তাতে তাঁরাও ঐ সময় ছাউনির মধ্যে নবী হিসাবে কথা বলতে লাগলেন। একজন যুবক দৌড়ে গিয়ে মূসাকে বললেন, “ইল্‌দদ আর মেদদ ছাউনির ভিতরে নবী হিসাবে কথা বলছেন।” তখন নূনের ছেলে ইউসা মূসাকে বললেন, “হে আমার প্রভু, ওদের চুপ করবার নির্দেশ দিন।” ইউসা যুবা বয়স থেকে মূসার সাহায্যকারী ছিলেন। জবাবে মূসা বললেন, “আমার মান-সম্মান টাই তোমার কাছে বড় হয়ে উঠল? আমি চাই মাবুদের সব লোকেরাই যেন নবী হয় এবং মাবুদ যেন তাঁর রূহ্‌ তাদের উপর দেন।” এর পর মূসা ও ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতারা ছাউনিতে ফিরে গেলেন। পরে মাবুদ একটা বাতাস বহালেন। সেই বাতাস সমুদ্র থেকে ভারুই পাখী ঠেলে এনে ছাউনির চারপাশে এক দিনের পথ জুড়ে এমনভাবে ফেলে দিল যে, সেগুলো মাটি থেকে দু’হাত পর্যন্ত উঁচু হয়ে গাদা হয়ে রইল। সেই দিন ও সেই রাত এবং তার পরের সারাটা দিন লোকেরা বাইরে গিয়ে ভারুই পাখী কুড়িয়ে আনল। তারা প্রত্যেকেই কমপক্ষে এক হাজার আটশো কেজি করে কুড়াল। সেগুলো তারা ছাউনির চারপাশে বিছিয়ে রাখল। কিন্তু সেই গোশ্‌ত মুখে দিয়ে চিবাতে না চিবাতেই লোকদের বিরুদ্ধে মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি তাদের উপর একটা ভীষণ মহামারী পাঠিয়ে দিলেন। সেইজন্য সেই জায়গাটার নাম দেওয়া হল কিব্রোৎ-হত্তাবা (যার মানে “লোভীদের কবর”), কারণ লোকেরা সেখানে লোভীদের দাফন করেছিল। এর পর লোকেরা কিব্রোৎ-হত্তাবা ছেড়ে হৎসেরোতে গিয়ে সেখানে রইল। মূসা একজন ইথিওপীয় স্ত্রীলোককে বিয়ে করেছিলেন। এই ইথিওপীয় স্ত্রীলোকটির দরুন মরিয়ম ও হারুন মূসার বিরুদ্ধে বলতে লাগলেন, “মাবুদ কি শুধু মূসার মধ্য দিয়েই কথা বলেছেন? আমাদের মধ্য দিয়ে কি তিনি কথা বলেন নি?” মাবুদ এই সব কথা শুনলেন। আসলে মূসা ছিলেন একজন নম্র লোক, দুনিয়ার যে কোন লোকের চেয়ে নম্র। হারুন ও মরিয়মের কথা শোনামাত্র মাবুদ মূসা, হারুন ও মরিয়মকে বললেন, “তোমরা তিনজনই বের হয়ে মিলন-তাম্বুর কাছে এস।” এই কথা শুনে তাঁরা তিনজন বের হয়ে আসলেন। কিন্তু আমার গোলাম মূসার সংগে আমি তা করি না। সে আমার পরিবারের সমস্ত কাজ বিশ্বস্তভাবে করে। আমি তার সংগে সামনাসামনি পরিষ্কার ভাবে কথা বলি, কোন ধাঁধার ভিতর দিয়ে নয়। মাবুদ যে আকারে দেখা দেন সে তা দেখতে পায়। এর পরেও তোমরা আমার গোলাম মূসার বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেলে না?” হারুন ও মরিয়মের উপর মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন। পরে তিনি চলে গেলেন। সেই মেঘটা যখন মিলন-তাম্বু ছেড়ে উপরে উঠে গেল তখন দেখা গেল যে, মরিয়মের শরীর খারাপ চর্মরোগে বরফের মত সাদা হয়ে গেছে। হারুন মরিয়মের দিকে ফিরে তাঁর গায়ে চর্মরোগ দেখতে পেলেন। এই অবস্থা দেখে তিনি মূসাকে বললেন, “হে আমার প্রভু, আমরা বোকামি করে যে গুনাহ্‌ করে ফেলেছি তা আমাদের বিরুদ্ধে তুমি ধরে রেখো না। যে শিশু মৃত অবস্থায় অর্ধেকটা ক্ষয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে জন্মেছে মরিয়মকে তুমি সেই রকম থাকতে দিয়ো না।” তখন মূসা চিৎকার করে মাবুদকে ডেকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌, তুমি তাকে সুস্থ করে দাও।” জবাবে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তার বাবা যদি তার মুখে থুথু দিত তবে কি সে সাত দিন সেই লজ্জা বয়ে বেড়াত না? সাত দিন তাকে ছাউনির বাইরে বন্ধ করে রাখ, তারপর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।” সেইজন্য মরিয়মকে সাত দিন পর্যন্ত ছাউনির বাইরে বন্ধ করে রাখা হল। তাকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত লোকেরা যাত্রা বন্ধ রাখল। এর পর বনি-ইসরাইলরা হৎসেরোৎ ছেড়ে পারণ মরুভূমিতে গিয়ে তাম্বু ফেলল। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “যে কেনান দেশ আমি বনি-ইসরাইলদের দিতে যাচ্ছি তার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে আসবার জন্য তুমি বারো গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি থেকে একজন করে নেতা পাঠিয়ে দাও।” মাবুদের হুকুম পেয়ে মূসা তা-ই করলেন। তিনি পারণ মরুভূমি থেকে যাঁদের পাঠিয়ে দিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন বনি-ইসরাইলদের নেতা। এঁরা হলেন, রূবেণ-গোষ্ঠীর সক্কূরের ছেলে শম্মূয়; শিমিয়োন-গোষ্ঠীর হোরির ছেলে শাফট; এহুদা-গোষ্ঠীর যিফুন্নির ছেলে কালুত; ইষাখর-গোষ্ঠীর ইউসুফের ছেলে যিগাল; আফরাহীম-গোষ্ঠীর নূনের ছেলে হোসিয়া; বিন্যামীন-গোষ্ঠীর রাফূর ছেলে পল্‌টি; সবূলূন-গোষ্ঠীর সোদির ছেলে গদ্দীয়েল; ইউসুফ-গোষ্ঠীর, অর্থাৎ মানশা-গোষ্ঠীর সূষির ছেলে গদ্দি; দান-গোষ্ঠীর গমল্লির ছেলে অম্মীয়েল; মূসা এই লোকদেরই কেনান দেশের খোঁজ-খবর নিয়ে আসবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি নূনের ছেলে হোসিয়ার নাম দিয়েছিলেন ইউসা। কেনান দেশে পাঠাবার সময় মূসা তাঁদের বলে দিলেন, “তোমরা নেগেভের মধ্য দিয়ে গিয়ে পাহাড়ী এলাকায় ঢুকবে। দেশটা কেমন তা তোমরা দেখবে। তোমরা দেখবে, সেখানে যারা বাস করে তারা দুর্বল না শক্তিশালী এবং সংখ্যায় তারা বেশী না কম, কি রকম দেশে তারা বাস করে এবং সেটা ভাল, না মন্দ। যে সব শহরে তারা বাস করে সেগুলো কি দেয়াল ছাড়া, না দেয়াল ঘেরা? সেখানকার মাটিতে কি ভাল ফসল জন্মায়, না জন্মায় না? সেখানে গাছপালা আছে, না নেই? সেখানকার কিছু ফল নিয়ে আসবার জন্য তোমরা খুব চেষ্টা করবে।” সেই সময় আংগুর তোলা মাত্র শুরু হয়েছিল। তখন তারা গিয়ে সীন মরুভূমি থেকে শুরু করে হামার দিকে রহোব পর্যন্ত দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে আসলেন। তাঁরা নেগেভের মধ্য দিয়ে গিয়ে হেবরন শহরে উপস্থিত হলেন। হেবরন শহরটা গড়ে উঠেছিল মিসরের সোয়ন শহর গড়ে উঠবার সাত বছর আগে। সেখানে অনাকের বংশের অহীমান, শেশয় ও তল্‌ময় নামে তিনজন লোক ছিল। নেতারা ইষ্কোল উপত্যকাতে গিয়ে এক থোকা আংগুর সুদ্ধ একটা ডাল কেটে নিলেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন সেটা লাঠিতে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া তাঁরা কিছু ডালিম আর ডুমুরও নিয়ে এসেছিলেন। বনি-ইসরাইলরা সেখানে সেই আংগুরের থোকাটা কেটেছিলেন বলে সেই জায়গার নাম হয়েছিল ইষ্কোল উপত্যকা। দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে তাঁরা চল্লিশ দিন পরে ফিরে আসলেন। সেই নেতারা পারণ মরুভূমির কাদেশে মূসা, হারুন এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে ফিরে আসলেন। তাঁরা মূসা, হারুন এবং অন্যান্য লোকদের কাছে সব কথা জানালেন এবং সেই দেশের ফল দেখালেন। তাঁরা মূসাকে বললেন, “আপনি আমাদের যে দেশে পাঠিয়েছিলেন আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। দেশটাতে সত্যিই দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই। এই হল সেখানকার ফল। কিন্তু যারা সেখানে বাস করে তাদের গায়ে শক্তি বেশী এবং তাদের শহরগুলোও বেশ বড় বড় আর দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অনাকের বংশের লোকদেরও আমরা সেখানে দেখেছি। আমালেকীয়রা থাকে নেগেভে; হিট্টীয়, যিবূষীয় ও আমোরীয়রা থাকে পাহাড়ী এলাকায় আর কেনানীয়রা থাকে সমুদ্রের কাছে এবং জর্ডান নদীর কিনারা ধরে।” তখন মূসার সামনে যে সব লোক ছিল কালুত তাদের গোলমাল থামিয়ে বললেন, “সেখানে গিয়ে দেশটা আমাদের দখল করে নেওয়া উচিত। আমরা তা নিশ্চয়ই করতে পারব।” কিন্তু যাঁরা তাঁর সংগে গিয়েছিলেন তাঁরা বললেন, “ঐ লোকদের সংগে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়; আমাদের চেয়ে তাদের গায়ে শক্তি বেশী।” তাঁরা যে দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছিলেন বনি-ইসরাইলদের কাছে সেই দেশ সম্বন্ধে একটা বাজে কথা রটিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা যে দেশের খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছি সেই দেশটা তার বাসিন্দাদের গিলে খেয়ে ফেলে। যে সব লোক আমরা সেখানে দেখেছি তারা দেখতে খুব বড়। আমরা সেখানে নেফিলীয়দের দেখেছি। অনাকের বংশের লোকেরা তো জাতে নেফিলীয়। তাদের দেখে আমরা নিজেদের মনে করলাম ঘাস-ফড়িং আর তারাও আমাদের তা-ই মনে করল।” এই কথা শুনে বনি-ইসরাইলরা সকলে চেঁচামেচি করতে লাগল। তারা সারা রাত ধরে কান্নাকাটি করল। মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে তারা অনেক কথা বলল। তারা সবাই মিলে তাঁদের বলল, “মিসর দেশে বা এই মরুভূমিতে মারা যাওয়াই ছিল আমাদের পক্ষে ভাল। যুদ্ধে মারা যাবার জন্য কেন মাবুদ আমাদের সেই দেশে নিয়ে যাচ্ছেন? তারা আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কেড়ে নেবে। এর চেয়ে মিসরে ফিরে যাওয়া কি আমাদের ভাল নয়?” তারা একে অন্যকে বলল, “চল, একজন নেতা ঠিক করে নিয়ে আমরা মিসরেই ফিরে যাই।” এই অবস্থা দেখে মূসা ও হারুন বনি-ইসরাইলদের গোটা দলটার সামনেই মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন। মাবুদ যদি আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকেন তবে সেই দেশটায় তিনি আমাদের নিয়ে যাবেন যেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই, আর তিনি সেটা আমাদের দেবেন। তবে তোমরা মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কোরো না। তোমরা সেই দেশের লোকদের ভয় কোরো না; তাদের গিলে খেতে আমাদের দেরি হবে না। তাদের আর রক্ষার উপায় নেই। তাদের তোমরা ভয় কোরো না কারণ মাবুদ আমাদের সংগে রয়েছেন।” কিন্তু দলের সবাই ইউসা ও কালুতকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবার কথা বলতে লাগল। তখন মিলন-তাম্বু থেকে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সামনে মাবুদের মহিমা দেখা দিল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “আর কত কাল এই লোকগুলো আমাকে তুচ্ছ করে চলবে? তাদের মধ্যে আমি যে সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ দেখিয়েছি তার পরেও আর কতকাল তারা আমাকে অবিশ্বাস করবে? আমি একটা মহামারী আনব আর ওয়াদা করা দেশের অধিকার তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেব, কিন্তু তোমার মধ্য থেকে আমি তাদের চেয়েও বড় এবং শক্তিশালী একটা জাতি সৃষ্টি করব।” এই কথা শুনে মূসা মাবুদকে বললেন, “তা যদি কর তবে কথাটা মিসরীয়দের কানে যাবে। তাদের মধ্য থেকেই তো তুমি তোমার নিজের শক্তিতে এই সব লোকদের নিয়ে এসেছ। সেই কথা তখন মিসরীয়রা এই দেশের লোকদেরও বলবে। হে মাবুদ, এর মধ্যেই এই দেশের লোকেরা শুনেছে যে, তুমি বনি-ইসরাইলদের সংগে সংগে আছ, আর হে মাবুদ, তোমাকে খুব কাছেই দেখা যায়। তারা শুনেছে যে, তোমার মেঘ এদের উপর আছে আর দিনের বেলা তুমি মেঘের থামের মধ্যে এবং রাতের বেলা আগুনের থামের মধ্যে থেকে এদের আগে আগে চল। তাই তুমি যদি এদের সবাইকে একসংগে মেরে ফেল তবে যে সব জাতি তোমার সম্বন্ধে ঐ সব কথা শুনেছে তারা বলবে যে, মাবুদ ঐ লোকদের কাছে যে দেশ দেবার কসম খেয়েছিলেন সেখানে নিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই বলেই তিনি মরুভূমিতে তাদের মেরে ফেলেছেন। “এখন হে দীন-দুনিয়ার মালিক, তুমি তোমার কুদরত দেখাও। তুমি তো ঘোষণা করেছিলে, ‘মাবুদ সহজে রেগে উঠেন না, তাঁর মহব্বতের সীমা নেই এবং তিনি অন্যায় ও বিদ্রোহ মাফ করেন, কিন্তু দোষীকে তিনি শাস্তি দিয়ে থাকেন; তিনি পিতার অন্যায়ের শাস্তি তার বংশের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।’ মিসর দেশ ছেড়ে আসবার সময় থেকে এই পর্যন্ত তুমি যেমন তাদের মাফ করে আসছ তেমনি তোমার সেই অটল মহব্বতের সংগে মিল রেখে তুমি এই লোকদের অন্যায় মাফ কর।” তখন মাবুদ বললেন, “তোমার কথামত আমি তাদের গুনাহ্‌ মাফ করলাম। কিন্তু আমি বেঁচে আছি এই কথা যেমন সত্যি এবং সারা দুনিয়া আমার মহিমায় পরিপূর্ণ এই কথা যেমন সত্যি তেমনই সত্যি যে, কিন্তু আমার গোলাম কালুতের মনে সেই রকম ভাব নেই এবং সে আমার কথা পুরোপুরি মেনে চলে। সেইজন্য যে দেশে সে গিয়েছিল আমি তাকে সেই দেশে নিয়ে যাব আর তার বংশধরেরা তা সম্পত্তি হিসাবে পাবে। সেই সব উপত্যকায় এখন আমালেকীয় ও কেনানীয়রা বাস করছে। তোমরা আগামী কাল পিছন ফিরে আকাবা উপসাগরের রাস্তা ধরে মরুভূমির দিকে যাত্রা করবে।” এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “আর কতকাল এই দুষ্ট জাতি আমার বিরুদ্ধে বক্‌বক্‌ করবে? তাদের বক্‌বক্‌ করা আমি শুনেছি।” মাবুদ মূসা ও হারুনকে বনি-ইসরাইলদের বলতে বললেন, “আমার জীবনের কসম দিয়ে বলছি যে, আমি মাবুদ তোমাদের যা বলতে শুনেছি তা-ই আমি তোমাদের প্রতি করব। তোমাদের মধ্যে বিশ বছর বা তারও বেশী বয়সের যাদের আদমশুমারীর সময় গোণা হয়েছিল, অর্থাৎ যারা আমার বিরুদ্ধে বক্‌বক্‌ করেছিল, তাদের মৃতদেহ এই মরুভূমিতেই পড়ে থাকবে। বাস করবার জন্য যে দেশ তোমাদের দেব বলে আমি কসম খেয়েছিলাম একমাত্র যিফুন্নির ছেলে কালুত ও নূনের ছেলে ইউসা ছাড়া আর কেউ সেই দেশে ঢুকতে পারবে না। তোমাদের যে ছেলেমেয়েদের কেড়ে নেওয়া হবে বলে তোমরা বলেছিলে সেই ছেলেমেয়েদেরই আমি সেই দেশে নিয়ে যাব। এই ছেলেমেয়েরাই সেই দেশ ভোগ করবে যা তোমরা পায়ে ঠেলে দিয়েছ। তোমাদের মৃতদেহ এই মরুভূমিতে পড়ে থাকবে। তোমাদের শেষ লোকটি এই মরুভূমিতে মরে না যাওয়া পর্যন্ত তোমাদের বেঈমানীর জন্য তোমাদের ছেলেমেয়েরা চল্লিশ বছর ধরে এখানে ভেড়া চরিয়ে বেড়াবে। দেশটা দেখে আসতে যে চল্লিশ দিন লেগেছিল তার প্রত্যেক দিনের জন্য এক বছর করে মোট চল্লিশ বছর পর্যন্ত তোমরা তোমাদের অন্যায়ের জন্য কষ্ট ভোগ করবে এবং বুঝবে যে, আমি বিরুদ্ধে থাকলে অবস্থাটা কেমন হয়। এই দুষ্ট জাতির লোকেরা যারা আমার বিরুদ্ধে দল পাকিয়েছে তারা সবাই এই মরুভূমিতেই শেষ হয়ে যাবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে আসবার জন্য মূসার পাঠিয়ে দেওয়া যে দলটা ফিরে এসে বাজে কথা ছড়িয়ে দিয়ে মূসার বিরুদ্ধে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বক্‌বক্‌ করবার উসকানি দিয়েছিল, অর্থাৎ যে লোকেরা সেই দেশ সম্বন্ধে বাজে কথা ছড়িয়ে দেবার জন্য দায়ী ছিল তারা সবাই মাবুদের সামনে মহামারীতে মারা গেল। বেঁচে রইলেন কেবল নূনের ছেলে ইউসা এবং যিফুন্নির ছেলে কালুত। মূসা মাবুদের কথা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জানালেন। তাতে মনের দুঃখে তারা ভেংগে পড়ল। পরের দিন খুব সকালে তারা সেই পাহাড়ী এলাকার দিকে যাবার জন্য তৈরী হয়ে বলল, “এই যে আমরা যাচ্ছি। আমরা গুনাহ্‌ করে ফেলেছি; এখন আমরা মাবুদের ওয়াদা করা দেশেই যাব।” কিন্তু মূসা বললেন, “তোমরা মাবুদের হুকুমের বিরুদ্ধে যাচ্ছ কেন? তোমাদের এই কাজ সফল হবে না। তোমরা যেয়ো না, কারণ মাবুদ তোমাদের সংগে নেই। শত্রুদের কাছে তোমরা হেরে যাবে। সেখানে তোমরা আমালেকীয় ও কেনানীয়দের সামনে পড়বে। তোমরা মাবুদের কাছ থেকে সরে গেছ বলে তিনি তোমাদের সংগে থাকবেন না। তাতে তোমরা যুদ্ধে মারা পড়বে।” তবুও তারা দুঃসাহস করে সেই পাহাড়ী এলাকার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু মূসা গেলেন না আর মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকও ছাউনির মধ্যে রয়ে গেল। তাদের দেখে সেই পাহাড়ী এলাকার আমালেকীয় ও কেনানীয়রা নেমে এসে তাদের হামলা করল এবং হর্মা শহর পর্যন্ত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল। পশুটা ভেড়া হলে তার সংগে শস্য-কোরবানীর জন্য তেল মিশানো মিহি ময়দা আনতে হবে। ময়দার পরিমাণ হবে তিন কেজি ছ’শো গ্রাম আর তেলের পরিমাণ হবে সোয়া লিটার। ঢালন-কোরবানীর জন্য আনতে হবে সোয়া লিটার আংগুর-রস। তারপর মাবুদকে খুশী করবার গন্ধের জন্য তা মাবুদের কাছে কোরবানী করতে হবে। যদি তোমরা পোড়ানো-কোরবানী কিংবা বিশেষ মানত পূরণের কোরবানী কিংবা যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য আমার কাছে কোন গরু নিয়ে আস, তবে তার সংগে শস্য-কোরবানীর জন্য তেল মিশানো মিহি ময়দা আনতে হবে। ময়দার পরিমাণ হবে পাঁচ কেজি চারশো গ্রাম আর তেলের পরিমাণ হবে পৌনে দুই লিটার। এর সংগে ঢালন-কোরবানীর জন্য পৌনে দুই লিটার আংগুর-রসও আনতে হবে। এটা একটা আগুনে দেওয়া-কোরবানী যার খোশবুতে আমি খুশী হই। “প্রত্যেকটা ষাঁড় কিংবা ভেড়া, প্রত্যেকটা বাচ্চা-ভেড়া কিংবা ছাগল এইভাবে কোরবানী দিতে হবে। তোমরা যত পশুই কোরবানী দাও না কেন প্রত্যেকটা পশু এই নিয়মে কোরবানী দিতে হবে। মাবুদকে খুশী করবার খোশবুর জন্য আগুনে দেওয়া-কোরবানী দেওয়ার সময় প্রত্যেক ইসরাইলীয়কে এই নিয়মে কোরবানী দিতে হবে। অন্য জাতির কোন লোক কিংবা তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য কেউ যদি মাবুদকে খুশী করবার খোশবুর জন্য আগুনে দেওয়া-কোরবানী দেয় তবে তাকে ঠিক তোমাদের মতই সমস্ত কিছু করতে হবে। বংশের পর বংশ ধরে এই নিয়ম চলবে। তোমাদের সমাজে সকলের জন্য একই নিয়ম চালু থাকবে- সে তোমরাই হও কিংবা তোমাদের মধ্যে বাস করা ভিন্ন জাতির লোকই হোক। বংশের পর বংশ ধরে তা হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। এই ব্যাপারে আমার কাছে তোমরাও যা ভিন্ন জাতির লোকেরাও তা। তোমাদের জন্য এবং তোমাদের মধ্যে বাস করা ভিন্ন জাতির লোকদের জন্য একই নির্দেশ ও একই শরীয়ত চলবে।” প্রথমে তোলা শস্যের ময়দা ঠেসে নিয়ে তা দিয়ে একখানা পিঠা তৈরী করে খামার-বাড়ীর দান হিসাবে তা কোরবানী করতে হবে। প্রথমে তোলা শস্যের এই কোরবানী বংশের পর বংশ ধরে আমার উদ্দেশে তোমাদের করতে হবে। ইমামকে গোটা ইসরাইল জাতির সেই অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে তাদের মাফ করা হবে, কারণ তারা ইচ্ছা করে তা করে নি এবং তাদের ভুলের জন্য তারা মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী এবং গুনাহের কোরবানীর ব্যবস্থা করেছে। এতে গোটা ইসরাইল জাতিকে এবং তার মধ্যে বাস করা ভিন্ন জাতির লোকদের মাফ করা হবে, কারণ এই ভুলের মধ্যে তারা সবাই জড়িত ছিল। “কিন্তু যদি মাত্র একজন লোক ভুল করে কোন অন্যায় করে ফেলে তবে গুনাহের কোরবানীর জন্য তাকে এক বছরের একটা ছাগী আনতে হবে। ভুল করে যে লোক এইভাবে অন্যায় করবে ইমামকে মাবুদের সামনে সেই লোকটির অন্যায় ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই অন্যায় ঢাকা দেওয়া হলে পর তাকে মাফ করা হবে। ভুল করে অন্যায় করে ফেলেছে এমন প্রত্যেকটি লোকের জন্য এই একই নিয়ম খাটবে- সেই লোক ইসরাইলীয়ই হোক কিংবা অন্য জাতির লোকই হোক। “কিন্তু ইসরাইলীয় কিংবা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকদের মধ্য থেকে যদি কেউ ইচ্ছা করে অন্যায় করে তবে সে মাবুদকে অপমান করে। তাকে তার জাতির মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। মাবুদের কথা তুচ্ছ করবার এবং তাঁর হুকুম অমান্য করবার দরুন তাকে অবশ্যই মুছে ফেলতে হবে, আর তার দোষ তার উপরেই থেকে যাবে।” বনি-ইসরাইলরা মরুভূমিতে থাকবার সময় একজন লোককে বিশ্রামবারে কাঠ কুড়াতে দেখা গেল। যারা তাকে কাঠ কুড়াতে দেখল তারা তাকে মূসা, হারুন এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে নিয়ে গেল। এই রকম লোককে নিয়ে কি করতে হবে তা বলা হয় নি বলে তাঁরা তাকে আটক করে রাখলেন। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “লোকটাকে হত্যা করতে হবে। ছাউনির বাইরে নিয়ে গিয়ে সমস্ত বনি-ইসরাইল তাকে পাথর মারবে।” কাজেই বনি-ইসরাইলরা মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া মাবুদের হুকুম মত তাকে ছাউনির বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। সেই থোপ্‌নাগুলো বাঁধবে যেন সেগুলোর দিকে চোখ পড়লে আমার সমস্ত হুকুমের কথা তোমাদের মনে পড়ে এবং তোমরা তা মেনে চল। তাহলে তোমরা আমার প্রতি বেঈমানী করে তোমাদের অন্তরের আর চোখের কামনার কাছে নিজেদের তুলে দেবে না। তখন আমার সমস্ত হুকুম পালন করবার কথা তোমাদের মনে থাকবে এবং তোমাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে তোমরা পাক-পবিত্র বান্দা হয়ে থাকবে। আমি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। তোমাদের আল্লাহ্‌ হওয়ার জন্য আমিই মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। আমিই মাবুদ তোমাদের আল্লাহ্‌।” তারা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে দল বেঁধে এসে বলল, “আপনারা খুব বাড়াবাড়ি করছেন। গোটা ইসরাইলীয় সমাজের প্রত্যেকেই পাক-পবিত্র এবং মাবুদও তাদের সংগে আছেন। তবে আপনারা কেন মাবুদের বান্দাদের উপরে নিজেদের তুলে ধরেছেন?” এই কথা শুনে মূসা মাটির উপর উবুড় হয়ে পড়লেন। তিনি কারুন ও তার দলের লোকদের বললেন, “কাল সকালেই মাবুদ দেখিয়ে দেবেন কে তাঁর বান্দা এবং কে পাক-পবিত্র। তিনিই সেই বান্দাকে তাঁর সামনে যেতে দেবেন। যাকে তিনি বেছে নেবেন তাকে তিনি তাঁর সামনে যেতে দেবেন। মূসা কারুনকে আরও বললেন, “তোমরা লেবীয়রা এখন আমার কথা শোন। এটাই কি তোমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয় যে, বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌ সমাজের অন্য লোকদের থেকে তোমাদের আলাদা করে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন যাতে তোমরা মাবুদের আবাস-তাম্বুর কাজ করতে পার এবং সমাজের লোকদের সেবা করবার জন্য তাদের সামনে দাঁড়াতে পার? তিনি তোমাকে এবং অন্য সব লেবীয়দের নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তোমরা এখন ইমামের পদটাও দখল করে নিতে চাইছ। তুমি ও তোমার দলের সব লোকেরা মাবুদের বিরুদ্ধেই দল পাকিয়েছ। হারুন কে যে, তোমরা তার বিরুদ্ধে বক্‌বক্‌ করছ?” এর পর মূসা ইলীয়াবের ছেলে দাথন ও অবীরামকে ডেকে পাঠালেন কিন্তু তারা বলে পাঠাল, “আমরা যাব না। তুমি এই মরুভূমিতে মেরে ফেলবার জন্যই এমন দেশ থেকে আমাদের বের করে এনেছ যেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব ছিল না। এটাই কি যথেষ্ট নয়? তার উপর এখন আবার আমাদের কর্তা হতে চাইছ। এছাড়া তুমি তো সেই রকম কোন দুধ আর মধুতে ভরা দেশে আমাদের নিয়ে যাও নি কিংবা জমাজমি এবং আংগুর ক্ষেতের অধিকারও দাও নি। তুমি কি এই লোকদের অন্ধ করে রাখতে চাইছ? না, আমরা যাব না।” এই কথা শুনে মূসা ভীষণ রেগে গিয়ে মাবুদকে বললেন, “তুমি ওদের কোরবানী কবুল কোরো না। আমি ওদের কাছ থেকে একটা গাধা পর্যন্ত নিই নি আর ওদের কোন ক্ষতিও করি নি।” তারপর মূসা কারুনকে বললেন, “কাল তোমাকে ও তোমার দলের সবাইকে মাবুদের সামনে উপস্থিত হতে হবে। তুমি ও তোমার দলের লোকদের এবং সেই সংগে হারুনকেও উপস্থিত হতে হবে। প্রত্যেককে তার ধূপদানিতে ধূপ দিতে হবে; মোট দু’শো পঞ্চাশটা ধূপদানিতে ধূপ দিয়ে মাবুদের সামনে তা কোরবানী করতে হবে। তোমাকে এবং হারুনকেও ধূপদানিতে ধূপ কোরবানী করতে হবে।” মূসার কথামত প্রত্যেকে নিজের নিজের ধূপদানিতে আগুন ও ধূপ নিয়ে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে মূসা ও হারুনের সংগে গিয়ে দাঁড়াল। কারুন যখন মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে সমাজের সমস্ত লোকদের জমায়েত করে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তখন তাদের সকলের সামনে মাবুদের মহিমা দেখা দিল। মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা অন্য সমস্ত লোক থেকে আলাদা হয়ে যাও, যাতে আমি তাদের এই মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারি।” কিন্তু মূসা ও হারুন সেজদায় পড়ে বললেন, “হে আল্লাহ্‌, তুমি সমস্ত মানুষের জীবনদাতা। কেবল একজন মানুষ গুনাহ্‌ করেছে বলে কি তুমি গোটা ইসরাইলীয় সমাজের উপর তোমার গজব নাজেল করবে?” তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যেন তারা কারুন, দাথন আর অবীরামের তাম্বুর কাছ থেকে সরে যায়।” এই কথা শুনে মূসা উঠে দাথন ও অবীরামের কাছে গেলেন আর ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতারা তাঁর পিছনে পিছনে গেলেন। মূসা বনি-ইসরাইলদের বললেন, “তোমরা এই দুষ্ট লোকদের তাম্বুর কাছ থেকে সরে যাও। তাদের কোন জিনিস তোমরা ছুঁয়ো না; যদি তা কর তবে তাদের গুনাহের জন্য তোমাদেরও শেষ করে ফেলা হবে।” এই কথা শুনে লোকেরা কারুন, দাথন ও অবীরামের তাম্বুর কাছ থেকে সরে গেল। এর মধ্যে দাথন ও অবীরাম তাদের স্ত্রী ও ছোট-বড় ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাম্বুর দরজার কাছে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মূসা তখন বনি-ইসরাইলদের বললেন, “এতেই তোমরা বুঝতে পারবে যে, আমি যা করছি তা করবার জন্য মাবুদই আমাকে পাঠিয়েছেন; এটা আমার মনগড়া কিছু নয়। এই সমস্ত লোকদের যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, আর অন্য মানুষের যা হয় তা থেকে আলাদা কিছু না হয় তাহলে বুঝতে হবে মাবুদ আমাকে পাঠান নি। কিন্তু মাবুদ যদি সম্পূর্ণ নতুন কিছু করেন এবং দুনিয়া মুখ খুলে যদি তাদের এবং তাদের সব কিছু গিলে ফেলে আর যদি তারা জীবিত অবস্থায় কবরে চলে যায় তবে তোমরা বুঝবে যে, এই লোকেরা মাবুদকে তুচ্ছ করেছে।” মূসার এই কথা বলা শেষ হওয়ার সংগে সংগে ঐ সব লোকদের পায়ের নীচের মাটি দু’ভাগ হয়ে গেল, আর দুনিয়া মুখ খুলে কারুনের পরিবারের সমস্ত লোক এবং সব কিছু গিলে ফেলল। তাদের যা কিছু ছিল সব নিয়ে তারা জীবিত অবস্থায় কবরে চলে গেল। তারপর তাদের উপরকার সেই ফাটলটা বন্ধ হয়ে গেল। তারা বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের কান্নায় চারপাশের সমস্ত বনি-ইসরাইল চিৎকার করে এই কথা বলতে বলতে ছুটে পালাল, “দুনিয়া হয়তো আমাদেরও গিলে ফেলবে।” এদিকে যে দু’শো পঞ্চাশজন লোক ধূপ কোরবানী করছিল মাবুদের কাছ থেকে আগুন বের হয়ে এসে তাদের পুড়িয়ে ফেলল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি ইমাম হারুনের ছেলে ইলীয়াসরকে বল যেন সে ঐ পোড়া জায়গা থেকে ধুপদানিগুলো বের করে নিয়ে কয়লাগুলো কিছু দূরে নিয়ে ছড়িয়ে দেয়, কারণ ধূপদানিগুলো পাক-পবিত্র হয়ে গেছে। গুনাহ্‌ করবার দরুন যে সমস্ত লোককে মরতে হয়েছে ধূপদানিগুলো তাদেরই। কিন্তু সেগুলো মাবুদের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল বলে সেগুলো পাক-পবিত্র হয়ে গেছে। সেইজন্য তুমি সেগুলো পিটিয়ে পাত তৈরী করে তা দিয়ে কোরবানগাহ্‌টি মুড়িয়ে দিয়ো। এটা যেন বনি-ইসরাইলদের কাছে একটা চিহ্ন হয়ে থাকে।” যে লোকদের পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল তাদের আনা ব্রোঞ্জের ধূপদানিগুলো ইমাম ইলীয়াসর জড়ো করলেন। তারপর কোরবানগাহ্‌টি মুড়াবার জন্য তিনি সেগুলো পিটিয়ে পাত তৈরী করালেন। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ তাঁকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি তা-ই করলেন। এটা করা হল যাতে বনি-ইসরাইলরা মনে রাখে যে, হারুনের বংশধর ছাড়া আর কেউ ধূপ জ্বালাবার জন্য মাবুদের সামনে যেতে পারবে না; যদি কেউ যায় তবে তার অবস্থা কারুন ও তার দলের লোকদের মতই হবে। এর পরের দিন ইসরাইলীয় সমাজের সবাই মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে বক্‌বক্‌ করতে লাগল এবং বলল, “তোমরাই মাবুদের বান্দাদের হত্যা করেছ।” কিন্তু যখন সমাজের সব লোকেরা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে জমায়েত হয়ে মিলন-তাম্বুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল তখন হঠাৎ মিলন-তাম্বুটা সেই মেঘে ঢেকে গেল এবং মাবুদের মহিমা প্রকাশ পেল। তখন মূসা ও হারুন মিলন-তাম্বুর সামনে গেলেন, আর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তোমরা এদের কাছ থেকে সরে যাও; আমি এখনই এদের শেষ করে দেব।” এই কথা শুনে তাঁরা সেজদায় পড়লেন। তারপর মূসা হারুনকে বললেন, “তোমার ধূপদানি নিয়ে তাতে কোরবানগাহের আগুন ভরে তার উপর ধূপ দাও আর তাড়াতাড়ি করে ঐ লোকদের কাছে গিয়ে তাদের গুনাহ্‌ ঢাকবার ব্যবস্থা কর। মাবুদের রাগ প্রকাশ পেয়েছে, মহামারী শুরু হয়ে গেছে।” তখন হারুন মূসার কথামতই ধূপদানিতে আগুন আর ধূপ দিয়ে ঐ সব লোকদের মধ্যে ছুটে গেলেন। এর মধ্যেই লোকদের মাঝে মহামারী শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হারুন ধূপ কোরবানী করে তাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি জীবিত ও মৃতদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন আর মহামারী থেমে গেল। কারুনের দরুন যারা মারা গিয়েছিল তারা ছাড়া আরও চৌদ্দ হাজার সাতশো লোক মহামারীতে মারা গেল। মহামারী থেমে যাবার পরে হারুন মিলন-তাম্বুর দরজায় মূসার কাছে ফিরে গেলেন। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের কাছে গিয়ে বল যেন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের গোষ্ঠী অনুসারে প্রত্যেক গোষ্ঠীর নেতার কাছ থেকে একটা করে মোট বারোটা লাঠি তোমাকে দেয়। নেতাদের প্রত্যেকের নাম তুমি তার লাঠির উপর লিখবে। লেবি-গোষ্ঠীর লাঠিতে লিখবে হারুনের নাম, কারণ পূর্বপুরুষদের গোষ্ঠী অনুসারে প্রত্যেক গোষ্ঠীর নেতার জন্য একটা করেই লাঠি থাকবে। মিলন-তাম্বুর মধ্যে সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে যেখানে তোমাদের সংগে আমার দেখা হয় সেখানে লাঠিগুলো রাখবে। আমার বেছে নেওয়া বান্দার লাঠির গায়ে অংকুর দেখা দেবে। এইভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে বনি-ইসরাইলদের অনবরত বক্‌বক করবার হাত থেকে আমি রেহাই পাব।” কাজেই মূসা সব কথা বনি-ইসরাইলদের জানালেন, আর পূর্বপুরুষদের গোষ্ঠী অনুসারে তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠী-নেতা তাঁকে একটা করে মোট বারোটা লাঠি দিলেন। সেই লাঠিগুলোর মধ্যে হারুনের লাঠিও ছিল। মূসা সেই লাঠিগুলো নিয়ে সাক্ষ্য-তাম্বুর মধ্যে মাবুদের সামনে রাখলেন। পরের দিন মূসা সাক্ষ্য-তাম্বুতে ঢুকে দেখলেন, লেবি-গোষ্ঠীর পক্ষে রাখা হারুনের লাঠির গায়ে কেবল যে অংকুর দেখা দিয়েছে তা নয় তাতে কুঁড়ি হয়ে, ফুল ফুটে বাদামও ধরেছে। মূসা তখন মাবুদের সামনে থেকে সমস্ত লাঠি বের করে এনে বনি-ইসরাইলদের সামনে রাখলেন। তারা সেই লাঠিগুলো দেখল, আর নেতারা প্রত্যেকে নিজের নিজের লাঠি তুলে নিলেন। এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “বিদ্রোহকারীদের কাছে একটা স্মরণচিহ্ন হয়ে থাকবার জন্য তুমি হারুনের লাঠিটা আবার সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে রেখে দাও। এতে তুমি আমার বিরুদ্ধে তাদের বক্‌বক করা থামিয়ে দিতে পারবে, যার ফলে তারা আর মারা পড়বে না।” মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিলেন তিনি ঠিক তা-ই করলেন। এই সব দেখে বনি-ইসরাইলরা মূসাকে বলল, “আমরা মরে গেলাম, ধ্বংস হয়ে গেলাম, সবাই ধ্বংস হয়ে গেলাম! কেউ যদি মাবুদের আবাস-তাম্বুর কাছে যায় তবে সে মারা পড়বে; তাহলে আমরা কি সবাই মারা পড়ব?” মাবুদ হারুনকে বললেন, “পবিত্র তাম্বুর বিরুদ্ধে যে সব অন্যায় করা হবে তার দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাকে, তোমার ছেলেদের এবং তোমার বংশের অন্যান্য লোকদের। এছাড়া ইমামের কাজের মধ্যে যে সমস্ত অন্যায় হবে তার দায়িত্বও তোমাকে ও তোমার ছেলেদের বহন করতে হবে। তুমি তোমার পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী থেকে অন্য সব লেবীয়দের নিয়ে এস, যাতে তোমার সংগে যোগ দিয়ে তারা সাক্ষ্য-তাম্বুর সামনে এবাদত-কাজে তোমাকে ও তোমার ছেলেদের সাহায্য করতে পারে। তোমার অধীনে থেকে সাক্ষ্য-তাম্বুর সমস্ত কাজ তাদের করতে হবে, কিন্তু পবিত্র তাম্বুর কোন জিনিসের কাছে কিংবা কোরবানগাহের কাছে তাদের যাওয়া চলবে না। তা করলে তোমরা ও তারা সবাই মারা পড়বে। তারা তোমার কাজে যোগ দেবে; মিলন-তাম্বুর দেখাশোনার ভার, অর্থাৎ সেই তাম্বুর সমস্ত কাজের ভার তাদের উপর থাকবে। কিন্তু তোমাদের কাছে লেবীয়রা ছাড়া অন্য কারও যাওয়া চলবে না। বনি-ইসরাইলদের উপর যাতে আবার আমার রাগ প্রকাশ না পায় সেইজন্য পবিত্র তাম্বুর ও কোরবানগাহের দেখাশোনার ভার থাকবে তোমাদের উপর। দান হিসাবে তোমাদের হাতে তুলে দেবার জন্য আমি নিজেই বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে লেবীয়দের বেছে নিয়েছি। মিলন-তাম্বুর কাজ করবার জন্য মাবুদের কাছে তাদের দান করা হয়েছে। কিন্তু ইমাম হিসাবে কেবল তুমি ও তোমার ছেলেরা কোরবানগাহের ও পর্দার ভিতরকার কাজকর্ম করতে পারবে। ইমামের পদ আমি দান হিসাবে তোমাদের দিচ্ছি। লেবীয়রা ছাড়া আর কেউ যদি মিলন-তাম্বুর এলাকার কাছে আসে তবে তাকে হত্যা করা হবে।” এর পর মাবুদ হারুনকে বললেন, “আমার কাছে যে সব জিনিস কোরবানী করা হয় তার সমস্ত দায়িত্বভার আমি নিজেই তোমাকে দিয়েছি। আমার উদ্দেশে বনি-ইসরাইলদের কোরবানী-করা সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস আমি তোমার ও তোমার বংশধরদের সব সময়কার পাওনা হিসাবে দিলাম। মহাপবিত্র কোরবানীর জন্য, অর্থাৎ শস্য-কোরবানী, গুনাহের কোরবানী এবং দোষের কোরবানীর জন্য বনি-ইসরাইলরা আমার কাছে যা নিয়ে আসবে আর যে অংশ কোরবানগাহের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে না তা তোমরা নেবে; তা হবে তোমার ও তোমার বংশধরদের পাওনা। পাক-পবিত্র জিনিস যেভাবে খেতে হয় তোমরা সেইভাবেই তা খাবে। তোমাদের সমস্ত পুরুষ লোক তা খেতে পারবে। সেগুলো পবিত্র বলে তাদের মনে করতে হবে। বনি-ইসরাইলদের দেওয়া সমস্ত দোলন-কোরবানীর জিনিসও তোমার হবে। সেগুলো আমি তোমাকে ও তোমার বংশের সকলকে সব সময়কার পাওনা হিসাবে দিচ্ছি। তোমার পরিবারের মধ্যে যারা পাক-সাফ অবস্থায় থাকবে তারা তা খেতে পারবে। “বনি-ইসরাইলরা তাদের প্রথমে তোলা ফসলের সবচেয়ে ভাল যে জলপাই তেল, নতুন আংগুর-রস ও শস্য মাবুদকে দেবে তা সবই আমি তোমাকে দিলাম। মাবুদের কাছে আনা তাদের জমির প্রথম ফসল তোমার হবে। তোমার পরিবারে যারা পাক-সাফ অবস্থায় থাকবে তারা তা খেতে পারবে। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন বলে ঘোষণা করা প্রত্যেকটি জিনিস তোমার হবে। মাবুদের কাছে বনি-ইসরাইলদের দান করা প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তান তোমার হবে- সে মানুষের হোক বা পশুর হোক। মানুষের প্রথম পুরুষ সন্তানকে তুমি অবশ্যই ছাড়িয়ে নিতে দেবে এবং নাপাক পশুর প্রথম পুরুষ বাচ্চাকেও তুমি ছাড়িয়ে নিতে দেবে। একমাস বয়স হলে পর ঠিক করা মুক্তির মূল্যে, অর্থাৎ দশ গ্রাম ওজনের ধর্মীয় শেখেলের পাঁচ শেখেল রূপা দিয়ে, মানুষের প্রথম পুরুষ সন্তানকে তুমি ছাড়িয়ে নিতে দেবে। কিন্তু প্রথমে জন্মেছে এমন এঁড়ে বাছুর কিংবা ভেড়া বা ছাগলের পুরুষ বাচ্চা ছাড়িয়ে নিতে দেওয়া চলবে না। এগুলো পবিত্র। তুমি কোরবানগাহের উপরে সেগুলোর রক্ত ছিটিয়ে দেবে এবং আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে তাদের চর্বি পুড়িয়ে দেবে। এর খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। দোলন-কোরবানীর বুকের গোশ্‌ত ও ডান দিকের রানের গোশ্‌তের মত এগুলোর গোশ্‌তও তোমার পাওনা হবে। মাবুদের উদ্দেশে বনি-ইসরাইলদের কোরবানী করা সমস্ত পবিত্র জিনিস আমি তোমাকে ও তোমার ছেলেমেয়েদের সব সময়কার পাওনা হিসাবে দিলাম। এটা মাবুদের চোখে তোমার ও তোমার বংশের সকলের জন্য একটা চিরকালের অটল ব্যবস্থা।” এর পর মাবুদ হারুনকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের দেশে তুমি কোন সম্পত্তির অধিকারী হবে না এবং জমাজমির কোন অংশও তুমি পাবে না। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আমিই তোমার পাওনা অংশ, আমিই তোমার সম্পত্তি। “বনি-ইসরাইলরা তাদের আয়ের যে দশ ভাগের এক ভাগ আমাকে দেবে তা আমি পাওনা হিসাবে লেবীয়দের দিলাম। মিলন-তাম্বুর এবাদত-কাজের বদলে তারা তা পাবে। এখন থেকে অন্য বনি-ইসরাইলরা আর মিলন-তাম্বুর কাছে যেতে পারবে না। তা করলে তারা তাদের গুনাহের ফল ভোগ করবে আর মারা যাবে। লেবীয়রাই মিলন-তাম্বুর কাজ করবে এবং সেই সম্পর্কে তাদের সব অন্যায়ের জন্য তারাই দায়ী হবে। বংশের পর বংশ ধরে এটাই হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের মধ্যে লেবীয়রা কোন সম্পত্তির অধিকারী হবে না। তার বদলে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের কাছে দান হিসাবে তাদের আয়ের যে দশ ভাগের এক ভাগ উপস্থিত করবে তা-ই আমি পাওনা হিসাবে তাদের দিলাম। সেইজন্যই আমি মাবুদ তাদের সম্বন্ধে বলেছি, লেবীয়রা অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের মধ্যে কোন সম্পত্তির অধিকারী হবে না।” এই কোরবানীই তোমাদের পক্ষে তোমাদের নিজেদের খামার-বাড়ীর ফসল এবং নিজেদের মাড়াই করা আংগুর-রস হিসাবে ধরা হবে। তোমরা অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে তাদের আয়ের যে দশ ভাগের এক ভাগ পাবে তার মধ্য থেকে এইভাবে তোমাদেরও মাবুদের উদ্দেশে কিছু কোরবানী করতে হবে। এই দশ ভাগের এক ভাগ থেকে মাবুদের অংশটা তোমরা ইমাম হারুনের হাতে দেবে। যা কিছু তোমাদের দেওয়া হবে তার মধ্য থেকে সবচেয়ে ভাল অংশটা, যা পবিত্র, তার সবটাই তোমরা মাবুদের পাওনা হিসাবে দেবে। “সবচেয়ে ভাল অংশটা মাবুদকে দেবার পরে যা বাকী থাকবে তা তোমাদের পক্ষে তোমাদের নিজেদের খামার-বাড়ীর ফসল এবং নিজেদের মাড়াই করা আংগুর-রস হিসাবে ধরা হবে। তোমরা ও তোমাদের পরিবার যে কোন জায়গায় তা খেতে পারবে কারণ সেটা হবে মিলন-তাম্বুতে তোমাদের কাজের বেতন। এতে তোমাদের কোন দোষ হবে না, কারণ সবচেয়ে ভাল অংশটাই তোমরা মাবুদকে দিয়েছ। তাহলে তোমরা বনি-ইসরাইলদের দেওয়া পাক-পবিত্র জিনিস অপবিত্র করবার দোষে দোষী হবে না এবং তোমরা মারাও যাবে না।” এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “এ হল আমার দেওয়া শরীয়তের একটা ধারা: তোমরা বনি-ইসরাইলদের এমন একটা লাল রংয়ের বক্‌না গরু তোমাদের কাছে আনতে বলবে যার গায়ে কোন দোষ বা খুঁত নেই এবং যার কাঁধে কখনও জোয়াল চাপানো হয় নি। সেটা তোমরা ইমাম ইলীয়াসরকে দেবে। ছাউনির বাইরে নিয়ে তার সামনে এটা জবাই করতে হবে। তারপর ইমাম ইলীয়াসর তার আংগুলে করে কিছু রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর সামনের দিকে সাত বার ছিটিয়ে দেবে। তার সামনেই গরুটার চামড়া, গোশ্‌ত, রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি সুদ্ধ গোবর পুড়িয়ে দিতে হবে। গরুটা যখন পুড়তে থাকবে তখন ইমামকে কিছু এরস কাঠ, এসোব ও লাল রংয়ের সুতা তার উপর ছুঁড়ে দিতে হবে। এর পর ইমামকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে। তারপর সে ছাউনির মধ্যে যেতে পারবে, তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে নাপাক অবস্থায় থাকতে হবে। যে সেই গরুটা পোড়াবে তাকেও তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। পাক-সাফ অবস্থায় আছে এমন কোন লোক সেই গরুটার ছাই তুলে নিয়ে ছাউনির বাইরে কোন পাক-সাফ জায়গায় রাখবে। সেই ছাই বনি-ইসরাইলরা পাক-সাফ করবার পানি তৈরী করবার জন্য রেখে দেবে। এটা নাপাকী থেকে পাক-সাফ হওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে। যে লোকটি সেই গরুর ছাই তুলে নেবে তাকেও তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে এবং সে-ও সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এটা হবে ইসরাইলীয় এবং তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম। “যদি কেউ কারো মৃতদেহ ছোঁয় তবে সে সাত দিন পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। তৃতীয় ও সপ্তম দিনে তাকে পাক-সাফ করবার পানি দিয়ে নিজেকে পাক-সাফ করিয়ে নিতে হবে আর তারপর সে পাক-সাফ হবে। কিন্তু যদি সে তৃতীয় ও সপ্তম দিনে এইভাবে নিজেকে পাক-সাফ করিয়ে না নেয় তবে সে নাপাকই থেকে যাবে। যদি কেউ কারও মৃতদেহ ছোঁবার পর নিজেকে পাক-সাফ করিয়ে না নেয় তবে সে মাবুদের আবাস-তাম্বু নাপাক করে। সেই লোককে বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে। তার গায়ে পাক-সাফ করবার পানি ছিটানো হয় নি বলে সে নাপাকই থাকবে এবং তার নাপাকী তার উপরে থেকে যাবে। “কোন লোক তাম্বুর ভিতরে মারা গেলে এই আইন মানতে হবে- যারা সেই তাম্বুর ভিতরে ঢুকবে আর যারা ঐ তাম্বুতেই ছিল তারা সাত দিন পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। সেখানকার যে সমস্ত পাত্র ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা হয় নি বলে খোলা অবস্থায় ছিল সেগুলোও নাপাক হয়ে গেছে। “যুদ্ধে কিংবা স্বাভাবিক ভাবে মারা গিয়ে খোলা মাঠে পড়ে আছে এমন কাউকে যদি কেউ ছোঁয় তবে সে সাত দিন পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। কেউ যদি মানুষের হাড় কিংবা কবর ছোঁয় তবে সে-ও সাত দিন পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। “এই সব নাপাক লোকদের নাপাকী থেকে পাক-সাফ করবার উদ্দেশ্যে যে পশু পোড়ানো হয়েছে তার কিছু ছাই একটা পাত্রের মধ্যে রেখে তার উপর স্রোতের পানি ঢেলে দিতে হবে। তারপর পাক-সাফ অবস্থায় আছে এমন একজন লোক এসোবের কয়েকটা ডাল সেই পানিতে ডুবিয়ে নিয়ে সেই তাম্বু, তার ভিতরকার জিনিসপত্র ও লোকদের উপর তা ছিটিয়ে দেবে। মানুষের হাড় কিংবা কবর কিংবা মেরে ফেলা বা মরে যাওয়া লোককে ছুঁয়েছে এমন লোকের উপরেও সেই পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। পাক-সাফ অবস্থায় থাকা লোকটি নাপাক অবস্থায় পড়া লোকের উপর তৃতীয় ও সপ্তম দিনে সেই পানি ছিটিয়ে দেবে এবং সপ্তম দিনে সে তাকে পাক-সাফ করবে। যাকে পাক-সাফ করা হচ্ছে তাকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে এবং সেই দিন সন্ধ্যা থেকে সে পাক-সাফ হবে। নাপাক হওয়ার পর যদি কেউ নিজেকে পাক-সাফ করিয়ে না নেয় তবে তাকে তার সমাজের মধ্য থেকে মুছে ফেলতে হবে, কারণ নিজেকে পাক-সাফ না করে সে মাবুদের পবিত্র তাম্বু নাপাক করেছে। পাক-সাফ করবার পানি তার উপর ছিটানো হয় নি বলে সে নাপাক। বনি-ইসরাইলদের জন্য এটা হবে একটা স্থায়ী নিয়ম। “যে লোক এই পাক-সাফ করবার পানি ছিটাবে তাকেও তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে। যদি কেউ এই পাক-সাফ করবার পানি ছোঁয় তবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। নাপাক অবস্থায় থাকা লোকটি যা কিছু ছোঁবে তা নাপাক হয়ে যাবে এবং তার ছোঁয়া জিনিস যে ছোঁবে সে-ও সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে।” বছরের প্রথম মাসে সমস্ত বনি-ইসরাইল সীন মরুভূমিতে পৌঁছে কাদেশের কাছে গিয়ে রইল। বিবি মরিয়ম সেখানে ইন্তেকাল করলেন এবং তাঁকে দাফন করা হল। সেখানে পানি না থাকায় বনি-ইসরাইলরা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে দল পাকালো। তারা মূসার সংগে ঝগড়া করে বলল, “আমাদের ভাইয়েরা যখন মাবুদের সামনে মারা গেল তখন যদি আমরাও মরতাম তবে ভাল হত। কেন তুমি মাবুদের বান্দাদের এই মরুভূমিতে নিয়ে আসলে যাতে পশুপাল সুদ্ধ আমরা মারা যাই? মিসর দেশ থেকে কেন তুমি আমাদের এই ভীষণ জায়গায় নিয়ে আসলে? এই জায়গায় না আছে কোন শস্য বা ডুমুর ফল, না আছে আংগুর লতা বা ডালিম ফল; তার উপর খাবার পানিও এখানে নেই।” এতে মূসা ও হারুন তাদের কাছ থেকে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে গিয়ে সেজদায় পড়লেন। তখন মাবুদের মহিমা তাঁদের সামনে প্রকাশ পেল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি সেই লাঠিটা নাও আর তুমি ও তোমার ভাই হারুন বনি-ইসরাইলদের এক জায়গায় জমায়েত কর। ঐ যে বিরাট পাথরটা রয়েছে তুমি বনি-ইসরাইলদের সামনে ওটাকে বল আর তাতে ওটা পানি দেবে। বনি-ইসরাইলরা এবং তাদের পশুপাল যাতে খেতে পারে সেইজন্য তুমি তাদের জন্য পাথর থেকে পানি বের করে আনবে।” মাবুদের হুকুম মতই তাঁর সামনে থেকে মূসা সেই লাঠিটা তুলে নিলেন। মূসা ও হারুন সেই পাথরটার কাছে লোকদের একসংগে জমায়েত করলেন। তারপর মূসা তাদের বললেন, “বিদ্রোহীরা শোন, আমরা কি তোমাদের জন্য এই পাথরটা থেকে পানি বের করে আনব?” এই কথা বলে মূসা হাত উঠিয়ে তাঁর লাঠি দিয়ে সেই পাথরটাকে দু’বার আঘাত করলেন; তাতে সেখান থেকে জোরে অনেক পানি বের হয়ে আসতে লাগল আর বনি-ইসরাইলরা ও তাদের পশুপাল তা খেল। কিন্তু মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “তোমরা আমার উপর ভরসা কর নি এবং বনি-ইসরাইলদের সামনে আমাকে পবিত্র বলে মান্য কর নি। তাই যে দেশ আমি বনি-ইসরাইলদের দেব তোমরা তাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না।” সেই পানিকে বলা হল মরীবা (যার মানে “ঝগড়া”)। এখানে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের সংগে ঝগড়া করেছিল আর মাবুদ এখানেই তাদের মধ্যে নিজের পবিত্রতা প্রকাশ করেছিলেন। পরে মূসা কাদেশ থেকে লোক পাঠিয়ে ইদোম দেশের বাদশাহ্‌কে বলে পাঠালেন, “আমরা, আপনার ইসরাইলীয় ভাইয়েরা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আপনি আমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা জানেন। আপনি আপনার দেশের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে দিন। আমরা কোন শস্য ক্ষেত কিংবা আংগুর ক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাব না, কিংবা কোন কূয়া থেকে পানিও খাব না। আমরা রাজপথ দিয়ে চলে যাব এবং আপনার রাজ্য পার হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ডানে কি বাঁয়ে পা বাড়াব না।” কিন্তু জবাবে ইদোমের বাদশাহ্‌ বললেন, “না, তোমরা এখান দিয়ে যেতে পারবে না। যদি তোমরা যাওয়ার চেষ্টা কর তবে আমরা যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়ে তোমাদের উপর হামলা করব।” বনি-ইসরাইলরা তাঁর জবাবে বলে পাঠাল, “আমরা সদর রাস্তা ধরে যাব। আমাদের পশুপাল কিংবা আমরা যদি আপনার দেশ থেকে কোন পানি খাই তবে আমরা তার দাম দিয়ে দেব। আমরা কেবল পায়ে হেঁটে পার হয়ে যেতে চাই, আর কিছু নয়।” ইদোমীয়রা আবার বলে পাঠাল, “না, এখান দিয়ে তোমাদের যাওয়া চলবে না।” এর পর ইদোমীয়রা অনেক সৈন্য নিয়ে তাদের ক্ষমতা জাহির করে বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে বের হয়ে আসল। ইদোমীয়রা তাদের দেশের মধ্য দিয়ে যেতে দিতে অস্বীকার করল বলে বনি-ইসরাইলরা তাদের কাছ থেকে ফিরে চলে গেল। এর পর বনি-ইসরাইলরা কাদেশ থেকে রওনা হয়ে হোর পাহাড়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে ইদোমের সীমানার কাছে মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, “হারুনকে তার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যেতে হবে। যে দেশ আমি বনি-ইসরাইলদের দেব তার সেখানে যাওয়া হবে না, কারণ মরীবাতে সেই পানির ব্যাপারে তোমরা আমার হুকুমের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলে। হারুন ও তার ছেলে ইলীয়াসরকে নিয়ে তুমি হোর পাহাড়ের উপরে যাও। সেখানে হারুনের শরীর থেকে ইমামের পোশাক খুলে নিয়ে সেটা তার ছেলে ইলীয়াসরকে পরিয়ে দাও, কারণ হারুন তার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবে; সে সেখানেই মারা যাবে।” মূসা মাবুদের হুকুম মত কাজ করলেন। তাঁরা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সামনে হোর পাহাড়ে উঠে গেলেন। তারপর মূসা হারুনের শরীর থেকে ইমামের পোশাক খুলে নিয়ে সেটা তাঁর ছেলে ইলীয়াসরকে পরিয়ে দিলেন। হারুন সেই পাহাড়ের চূড়ায় ইন্তেকাল করলেন। তারপর মূসা ও ইলীয়াসর পাহাড় থেকে নেমে আসলেন। বনি-ইসরাইলরা সবাই যখন জানতে পারল যে, হারুন ইন্তেকাল করেছেন তখন গোটা ইসরাইল জাতি ত্রিশ দিন পর্যন্ত তাঁর জন্য শোক করল। অরাদের কেনানীয় বাদশাহ্‌ নেগেভে বাস করতেন। বনি-ইসরাইলরা অথারীমের পথ ধরে আসছে শুনে তিনি তাদের উপর হামলা করে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেলেন। তখন বনি-ইসরাইলরা মাবুদের কাছে মানত করে বলল, “অরাদের এই লোকদের তুমি যদি আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দাও, তবে আমরা তাদের গ্রাম ও শহরগুলো একেবারে ধ্বংস করে ফেলব।” মাবুদ তাদের এই বিশেষ অনুরোধ শুনলেন এবং সেই কেনানীয়দের তাদের হাতের মুঠোয় এনে দিলেন। বনি-ইসরাইলরা তাদের এবং তাদের গ্রাম ও শহরগুলো একেবারে ধ্বংস করে ফেলল। সেইজন্য ঐ জায়গাটার নাম হল হর্মা (যার মানে “ধ্বংসের অধীন”)। তখন মাবুদ তাদের মধ্যে এক রকম বিষাক্ত সাপ পাঠিয়ে দিলেন। সেগুলোর কামড়ে অনেক ইসরাইলীয় মারা গেল। তখন লোকেরা গিয়ে মূসাকে বলল, “মাবুদ ও আপনার বিরুদ্ধে কথা বলে আমরা গুনাহ্‌ করেছি। আপনি এখন মাবুদের কাছে অনুরোধ করুন যেন তিনি এই সব সাপ আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেন।” তখন মূসা লোকদের জন্য অনুরোধ করলেন। এর জবাবে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি একটা সাপ তৈরী করে একটা খুঁটির উপরে রাখ। যাকে সাপে কামড়াবে সে ওটার দিকে তাকালে বেঁচে যাবে।” তখন মূসা একটা ব্রোঞ্জের সাপ তৈরী করে একটা খুঁটির উপরে লাগিয়ে রাখলেন। কাউকে সাপে কামড়ালে সে ঐ ব্রোঞ্জের সাপের দিকে চেয়ে দেখত আর তাতে সে বেঁচে যেত। এর পর বনি-ইসরাইলরা যাত্রা করে ওবোতে গিয়ে ছাউনি ফেলল। তারপর তারা ওবোৎ থেকে যাত্রা করে মরুভূমির মধ্যে ইয়ী-অবারীমে গিয়ে ছাউনি ফেলল। ইয়ী-অবারীম ছিল মোয়াবের পূর্ব দিকে মরুভূমির মধ্যে। তারপর সেখান থেকে যাত্রা করে তারা সেরদ উপত্যকাতে গিয়ে ছাউনি ফেলল। সেখান থেকে যাত্রা করে তারা অর্ণোন নদীর ওপারে গিয়ে ছাউনি ফেলল। আমোরীয়দের দেশ থেকে যে মরুভূমিটা শুরু হয়েছে তার মধ্যে ছিল এই অর্ণোন নদীটা। নদীটার এক পাশে ছিল মোয়াব আর অন্য পাশে ছিল আমোরীয়দের দেশ। সেখান থেকে যাত্রা করে বনি-ইসরাইলরা বের নামে একটা কূয়ার কাছে আসল। এই কূয়ার কাছে মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি লোকদের একসংগে জমায়েত কর, আমি তাদের পানি দেব।” তখন বনি-ইসরাইলরা এই গজলটি করল: “হে কূয়া, তুমি পানিতে ভরে ওঠো। তোমরা এই কূয়ার বিষয় নিয়ে গজল গাও। এটা সেই কূয়া যা শাসনকর্তারা শাসনদণ্ডের জোরে খুঁড়েছেন, যা গণ্যমান্য লোকেরা লাঠির জোরে করেছেন।” তারপর বনি-ইসরাইলরা সেই মরুভূমি থেকে মত্তানায়, বনি-ইসরাইলরা আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের কাছে লোক পাঠিয়ে অনুরোধ করল, “আপনার রাজ্যের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে দিন। আমরা রাস্তা ছেড়ে কোন জমির মধ্যে বা আংগুর ক্ষেতে যাব না, কিংবা কোন কূয়া থেকে পানিও খাব না। আপনার রাজ্য পার হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ধরেই চলতে থাকব।” কিন্তু সীহোন তাঁর রাজ্যের মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের যেতে দিলেন না। তিনি তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। তিনি যহস শহরে উপস্থিত হয়ে বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করলেন। এই যুদ্ধে বনি-ইসরাইলরা তাঁকে হত্যা করে অর্ণোন নদী থেকে যব্বোক নদী পর্যন্ত তাঁর দেশটা অধিকার করে নিল। তারা কেবল অম্মোনীয়দের সীমানা পর্যন্ত অধিকার করতে পেরেছিল, কারণ অম্মোনীয়দের দেশের সীমানাটা এমন ছিল যা ডিংগিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। বনি-ইসরাইলরা হিষ্‌বোন ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো সুদ্ধ আমোরীয়দের সমস্ত শহর দখল করে নিল এবং সেখানে বাস করতে লাগল। হিষ্‌বোন ছিল আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের রাজধানী। তিনি মোয়াব দেশের আগেকার বাদশাহ্‌র সংগে যুদ্ধ করে তাঁর কাছ থেকে অর্ণোন নদী পর্যন্ত সমস্ত দেশটা দখল করে নিয়েছিলেন। এইজন্যই কবিরা বলেছেন: “তোমরা হিষ্‌বোনে এসে শহরটা আবার গড়ে তোলো। সীহোনের শহরটা আবার গড়ে তোলা হোক। সীহোনের শহর হিষ্‌বোন থেকে আগুন বেরিয়ে এসে মোয়াব দেশের আর্‌ শহরটা পুড়িয়ে দিল আর অর্ণোন নদীর কাছের উঁচু জায়গার বাসিন্দাদের পুড়িয়ে দিল। হায় মোয়াব! হে কমোশ-দেবতার লোকেরা, তোমরা ধ্বংস হয়ে গেছ। কমোশের ছেলেরা পালিয়ে গিয়েছে আর মেয়েরা আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের বন্দিনী হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। দীবোন পর্যন্ত হিষ্‌বোন ধ্বংস হয়ে গেছে। মেদবা পর্যন্ত চলে গেছে যে নোফঃ সেই জায়গা পর্যন্ত আমরা ধ্বংস করেছি।” এর পর বনি-ইসরাইলরা আমোরীয়দের দেশে বাস করতে লাগল। মূসা যাসের শহরে গোয়েন্দা পাঠিয়ে দেবার পর বনি-ইসরাইলরা সেই শহরের আশেপাশের গ্রামগুলো দখল করে নিল এবং সেখানকার আমোরীয়দের তাড়িয়ে দিল। তারপর তারা ঘুরে বাশন দেশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। তখন বাশনের বাদশাহ্‌ উজ তাঁর সমস্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বের হয়ে তাদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য ইদ্রিয়ী শহরে উপস্থিত হলেন। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “বাদশাহ্‌ উজকে ভয় কোরো না, কারণ আমি তার দেশ এবং তাকে ও তার সমস্ত সৈন্য-সামন্তকে তোমার হাতের মুঠোয় দিয়ে দিয়েছি। আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোন, যে হিষ্‌বোনে রাজত্ব করত, তুমি তার অবস্থা যা করেছ এর অবস্থাও তা-ই করবে।” তখন তারা উজকে এবং তাঁর ছেলেদের ও তাঁর সমস্ত সৈন্য-সামন্তদের হত্যা করল। শেষ পর্যন্ত তাঁর আর কেউ বেঁচে রইল না। তারা তাঁর দেশটাও অধিকার করে নিল। এর পর বনি-ইসরাইলরা মোয়াবের সমভূমিতে গিয়ে জেরিকো শহরের উল্টা দিকে জর্ডান নদীর ওপারে তাদের ছাউনি ফেলল। বনি-ইসরাইলরা আমোরীয়দের যে অবস্থা করেছিল তা সবই সিপ্পোরের ছেলে মোয়াবের বাদশাহ্‌ বালাক দেখেছিলেন। এত লোক দেখে মোয়াবীয়রা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বনি-ইসরাইলদের দেখে সত্যিই মোয়াবীয়রা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। এই লোকেরা আমার চেয়ে শক্তিশালী; সেইজন্য আপনি এসে এই লোকদের বদদোয়া দিন। তাহলে হয়তো আমি তাদের হারিয়ে দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারব। আমি এই কথা জানি যে, আপনি যাদের দোয়া করেন তারা সত্যিই দোয়া পায় আর যাদের বদদোয়া দেন তাদের উপর বদদোয়া পড়ে।” তখন ভাগ্য গণনা করবার টাকা নিয়ে মোয়াব ও মাদিয়ানের বৃদ্ধ নেতারা রওনা হয়ে গেলেন। বালাক যা বলেছিলেন তা তাঁরা গিয়ে বালামের কাছে বললেন। তখন বালাম তাঁদের বললেন, “আপনারা এখানে রাতটা কাটান। মাবুদ আমাকে যে জবাব দেবেন তা আমি আপনাদের জানাব।” কাজেই মোয়াবীয় নেতারা তাঁর সংগে রইলেন। আল্লাহ্‌ এসে বালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সংগে এই লোকগুলো কারা?” জবাবে বালাম আল্লাহ্‌কে বললেন, “মোয়াবের বাদশাহ্‌ সিপ্পোরের ছেলে বালাক আমার কাছে খবর পাঠিয়ে বলেছেন, ‘মিসর দেশ থেকে একদল লোক বের হয়ে এসে দেশটা ছেয়ে ফেলেছে। এখন আপনি এসে আমার হয়ে এই লোকদের বদদোয়া দিন। তাহলে হয়তো আমি যুদ্ধ করে এদের তাড়িয়ে দিতে পারব।’ ” কিন্তু আল্লাহ্‌ বালামকে বললেন, “তুমি ওদের সংগে যাবে না এবং ঐ লোকদের কোন বদদোয়াও দেবে না, কারণ ওরা আমার দোয়া-পাওয়া বান্দা।” পরের দিন সকালে বালাম ঘুম থেকে উঠে বালাকের পাঠানো নেতাদের বললেন, “আপনারা নিজেদের দেশে ফিরে যান। মাবুদ আমাকে আপনাদের সংগে যেতে দিতে রাজী নন।” কাজেই মোয়াবীয় নেতারা ফিরে গিয়ে বালাককে বললেন, “বালাম আমাদের সংগে আসতে অস্বীকার করেছেন।” তখন বালাক অন্য নেতাদের পাঠালেন। তাঁরা আগের নেতাদের চেয়ে সংখ্যায় যেমন বেশী তেমনি আরও সম্মানিত। তাঁরা বালামের কাছে গিয়ে বললেন, “সিপ্পোরের ছেলে বালাক এই কথা বলেছেন যে, কোন কিছুই যেন আপনাকে তাঁর কাছে যেতে বাধা না দেয়। তিনি আপনাকে অনেক সম্মানের অধিকারী করবেন এবং আপনি যা বলবেন তা-ই করবেন। তিনি চান যেন আপনি গিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে ঐ লোকদের বদদোয়া দেন।” জবাবে বালাম তাঁদের বললেন, “বালাক যদি সোনা-রূপায় ভরা তাঁর রাজবাড়ীটাও আমাকে দেন তবুও আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুমের বাইরে গিয়ে আমি কোন কাজই করতে পারব না- কাজটা ছোটই হোক বা বড়ই হোক। তবে আপনারাও রাতটা এখানে কাটান; মাবুদ আমাকে আর কি বলেন তা আমি জেনে নেব।” সেই রাতে আল্লাহ্‌ এসে বালামকে বললেন, “এই লোকেরা যখন তোমাকে ডাকতে এসেছে তখন তুমি তাদের সংগে যাও, কিন্তু আমি তোমাকে যা বলব তুমি কেবল তা-ই করবে।” পরদিন সকালে বালাম ঘুম থেকে উঠে তাঁর গাধীর উপর গদি চাপিয়ে মোয়াবীয় নেতাদের সংগে চললেন, কিন্তু তাঁকে যেতে দেখে আল্লাহ্‌ তাঁর উপর রেগে গেলেন। তাঁকে বাধা দেবার জন্য মাবুদের ফেরেশতা পথে দাঁড়িয়ে রইলেন। বালাম গাধীর উপর চড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর দু’জন গোলাম তাঁর সংগে ছিল। মাবুদের ফেরেশতাকে তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাধীটা রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে গেল। গাধীটাকে আবার রাস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বালাম তাকে মারতে লাগলেন। মাবুদের ফেরেশতা তারপর দু’টা আংগুর ক্ষেতের মাঝখানের একটা সরু পথের উপর গিয়ে দাঁড়ালেন। পথটার দু’দিকেই দেয়াল ছিল। মাবুদের ফেরেশতাকে দেখে গাধীটা দেয়ালের গা ঘেঁষে চলল। তাতে বালামের একটা পায়ে ভীষণ ঘষা লাগল। তখন বালাম আবার গাধীটাকে মারতে লাগলেন। এর পর মাবুদের ফেরেশতা এগিয়ে গিয়ে পথের এমন একটা সরু জায়গায় দাঁড়ালেন যেখানে ডানে-বাঁয়ে ঘুরবার পথ ছিল না। মাবুদের ফেরেশতাকে দেখে গাধীটা বালামকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। এতে বালাম রেগে গিয়ে লাঠি দিয়ে গাধীটাকে মারলেন। তখন মাবুদ গাধীটার মুখ খুলে দিলেন। সে বালামকে বলল, “আমি আপনার কি করেছি যে, আপনি এই নিয়ে তিনবার আমাকে মারলেন?” জবাবে বালাম সেই গাধীকে বললেন, “তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছ। আমার হাতে যদি একটা তলোয়ার থাকত তাহলে এখনই আমি তোমাকে মেরে ফেলতাম।” গাধীটা বালামকে বলল, “আমি কি আপনার সেই গাধী নই যার উপর আপনি সারা জীবন চড়ে আসছেন? আপনার সংগে কি এই রকম ব্যবহার করা আমার অভ্যাস?” বালাম বললেন, “না, তা কর নি।” এর পর মাবুদ বালামের চোখ খুলে দিলেন আর তিনি মাবুদের ফেরেশতাকে তলোয়ার হাতে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তাতে তিনি মাথা নীচু করে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন। মাবুদের ফেরেশতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার গাধীটাকে তুমি এই নিয়ে তিনবার মারলে কেন? তুমি আমার সামনেই আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছ বলে আমি তোমাকে বাধা দিতে এখানে এসেছি। গাধীটা আমাকে দেখে এই তিনবার আমার সামনে থেকে সরে গেছে। যদি সে সরে না যেত, তবে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে এতক্ষণে মেরে ফেলতাম আর গাধীটাকে বাঁচিয়ে রাখতাম।” তখন বালাম মাবুদের ফেরেশতাকে বললেন, “আমি গুনাহ্‌ করেছি। আমি বুঝতে পারি নি যে, আপনি আমাকে বাধা দেবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আপনি যদি অসন্তুষ্ট হন তবে আমি ফিরে যাব।” মাবুদের ফেরেশতা বালামকে বললেন, “তুমি ঐ লোকদের সংগে যাও, কিন্তু আমি তোমাকে যা বলতে বলব তুমি কেবল তা-ই বলবে।” বালাম তখন বালাকের পাঠানো নেতাদের সংগে গেলেন। বালামের আসবার কথা শুনে বালাক তাঁকে এগিয়ে নেবার জন্য অর্ণোন নদীর তীরে মোয়াবীয়দের শহরে গেলেন। এই শহরটা ছিল তাঁর রাজ্যের শেষ সীমানায়। বালাক বালামকে বললেন, “আমি কি আপনাকে জরুরী তলব পাঠাই নি? তবে কেন আপনি আমার কাছে আসেন নি? আপনাকে পুরস্কার দেবার ক্ষমতা কি আমার নেই?” জবাবে বালাম বললেন, “আমি এখন আপনার কাছে এসেছি। কিন্তু আমার নিজের কোন কথা বলবার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ্‌ যে কথা আমার মুখে যুগিয়ে দেবেন আমাকে কেবল তা-ই বলতে হবে।” এর পর বালাম বালাকের সংগে কিরিয়ৎ-হুষোৎ গ্রামে গেলেন। বালাক গরু ও ভেড়া কোরবানী করে কিছু গোশ্‌ত বালাম ও তাঁর সংগে যে নেতারা ছিলেন তাঁদের দিলেন। পরের দিন সকালবেলায় বালাক বালামকে নিয়ে বামোৎ-বাল পাহাড়ে গেলেন। বালাম সেখান থেকে বনি-ইসরাইলদের একটা অংশ দেখতে পেলেন। তারপর বালাম বালাককে বললেন, “আপনি আমার জন্য এখানে সাতটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে সাতটা ষাঁড় ও সাতটা ভেড়া কোরবানীর জন্য প্রস্তুত করুন।” বালাক বালামের কথামতই কাজ করলেন এবং দু’জনে মিলে প্রত্যেকটি কোরবানগাহের উপরে একটা করে ষাঁড় ও একটা করে ভেড়া কোরবানী দিলেন। তারপর বালাম বালাককে বললেন, “যে পশুগুলো দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া হল আপনি সেগুলোর কাছে থাকুন আর আমি ওদিকে যাচ্ছি। হয়তো মাবুদ আমার সংগে দেখা করতে আসবেন। তিনি আমার কাছে যা প্রকাশ করবেন আমি তা আপনার কাছে বলব।” এই কথা বলে বালাম এমন একটা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলেন যেখানে কোন গাছপালা ছিল না। তখন আল্লাহ্‌ তাঁর সংগে দেখা করলেন। বালাম বললেন, “আমি সাতটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছি এবং প্রত্যেকটি কোরবানগাহের উপর একটা করে ষাঁড় ও একটা করে ভেড়া কোরবানী দিয়েছি।” তখন মাবুদ বালামের মুখে কতগুলো কথা যুগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি বালাকের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে এই সব বল।” বালাম বালাকের কাছে ফিরে গেলেন। তিনি দেখলেন, বালাক মোয়াবের সমস্ত নেতাদের নিয়ে তাঁর কোরবানী-দেওয়া পশুর কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন বালাম আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “বালাক আমাকে সিরিয়া দেশ থেকে নিয়ে আসলেন, পূর্বের পাহাড়গুলোর কাছ থেকে মোয়াব-বাদশাহ্‌ আমাকে নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, ‘আমার হয়ে আপনি ইয়াকুবকে বদদোয়া দিন, ইসরাইল জাতিকে বদদোয়া দিন।’ আল্লাহ্‌ যাদের কোন বদদোয়া দেন নি, কেমন করে আমি তাদের বদদোয়া দেব? মাবুদ যাদের বিরুদ্ধে অপকারের কথা বলেন নি, কেমন করে আমি তাদের বিরুদ্ধে অপকারের কথা বলব? পাহাড়ের চূড়া থেকে আমি তাদের দেখছি; তাদের আমি পাহাড়ের উপর থেকে লক্ষ্য করছি। আমি দেখছি এমন একটা জাতিকে যে অন্যদের থেকে দূরে থাকে; অন্য সব জাতির সংগে নিজেদের এক করে দেখে না। ইয়াকুবের বংশধরেরা ধূলিকণার মত অসংখ্য, কে তাদের গুণে দেখতে পারে? বনি-ইসরাইলদের চার ভাগের একভাগও কি কারও পক্ষে গোণা সম্ভব? ঐ সৎ লোকদের মতই যেন আমার মৃত্যু হয়; আমার শেষ যেন হয় তাদেরই মত।” এই কথা শুনে বালাক বালামকে বললেন, “আপনি আমার এ কি করলেন? আমার শত্রুদের বদদোয়া দেবার জন্য আমি আপনাকে আনলাম আর আপনি কি না তাদের দোয়া করলেন।” জবাবে বালাম বললেন, “মাবুদ আমার মুখে যে কথা যুগিয়ে দিয়েছেন তা কি আমি না বলে থাকতে পারি?” পরে বালাক বালামকে বললেন, “আপনি আমার সংগে আর এক জায়গায় আসুন। সেখান থেকে আপনি বনি-ইসরাইলদের দেখতে পাবেন। আপনি তাদের সবাইকে যে দেখতে পাবেন তা নয়, কেবল তাদের একটা অংশই দেখতে পাবেন। সেখান থেকে আপনি আমার পক্ষ থেকে তাদের বদদোয়া দেবেন।” এই বলে বালাক তাঁকে পিস্‌গা পাহাড়শ্রেণীর উপরে যে সোফীম মাঠ আছে সেখানে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি সাতটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে প্রত্যেকটার উপরে একটা করে ষাঁড় আর একটা করে ভেড়া কোরবানী দিলেন। তারপর বালাম বালাককে বললেন, “যে পশুগুলো দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া হল আপনি সেগুলোর কাছে থাকুন, আর আমি ঐদিকে গিয়ে মাবুদের সংগে দেখা করি।” মাবুদ বালামের সংগে দেখা করে তাঁর মুখে কতগুলো কথা যুগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি বালাকের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে এই কথা বল।” কাজেই বালাম বালাকের কাছে গেলেন। তিনি দেখলেন বালাক মোয়াবের নেতাদের নিয়ে তাঁর কোরবানী দেওয়া পশুর কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। বালাক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মাবুদ আপনাকে কি বলেছেন?” বালাম তখন আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “বালাক বাদশাহ্‌ উঠুন, শুনুন; হে সিপ্পোরের ছেলে, আমার কথায় কান দিন। আল্লাহ্‌ তো মানুষ নন যে, মিথ্যা বলবেন; মানুষ থেকে তাঁর জন্মও নয় যে, মন বদলাবেন। তিনি যা বলেন করেনও তা, তাঁর ওয়াদা তিনি সর্বদা পূর্ণ করেন। আমি দোয়া করবার জন্য হুকুম পেয়েছি। তিনি ইসরাইল জাতিকে দোয়া করেছেন, আমি তা বদলাতে পারি না। ইয়াকুবের মধ্যে তিনি কোন অন্যায় দেখেন নি, ইসরাইল জাতির ভাগ্যে কোন দুঃখ রাখেন নি। তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের সংগে আছেন, আর তাদের বাদশাহ্‌র জয়ধ্বনি রয়েছে তাদের মধ্যে। মিসর থেকে তিনি তাদের বের করে এনেছেন, তিনি তাদের পক্ষে বুনো ষাঁড়ের শক্তির মত। ইয়াকুবের উপর কোন জাদুবিদ্যা খাটবে না; ইসরাইল জাতির উপর খাটবে না কোন মন্ত্রতন্ত্র। ইয়াকুব, অর্থাৎ ইসরাইল জাতি সম্বন্ধে এখন এই কথা বলা যায়, ‘আল্লাহ্‌ যা করেছেন তা দেখ।’ এই সব লোক উঠে দাঁড়াবে সিংহীর মত করে, আর সিংহের মত করে নিজেদের তুলে ধরবে। শিকার করা প্রাণীর রক্ত ও গোশ্‌ত খেয়ে না ফেলা পর্যন্ত তারা বিশ্রাম করবে না।” এই কথা শুনে বালাক বলে উঠলেন, “থামুন, আপনি তাদের বদদোয়াও দেবেন না, দোয়াও করবেন না।” জবাবে বালাম বললেন, “আমি কি আপনাকে বলি নি যে, মাবুদ যা বলবেন তা আমাকে করতেই হবে?” পরে বালাক বালামকে বললেন, “চলুন, আমি আপনাকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাই। হয়তো আল্লাহ্‌ খুশী হয়ে সেখান থেকে আপনাকে আমার পক্ষ থেকে তাদের বদদোয়া দিতে দেবেন।” এই বলে বালাক তাঁকে পিয়োর পাহাড়ের উপরে নিয়ে গেলেন যেখান থেকে মরুভূমির যিশীমোন দেখা যায়। তখন বালাম বললেন, “এখানে আমার জন্য সাতটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করুন আর সাতটা ষাঁড় ও সাতটা ভেড়া কোরবানীর জন্য প্রস্তুত করুন।” বালামের কথামত বালাক তা-ই করলেন। তিনি প্রত্যেকটি কোরবানগাহের উপরে একটা করে ষাঁড় ও একটা করে ভেড়া কোরবানী দিলেন। বালাম যখন দেখলেন যে, বনি-ইসরাইলদের দোয়া করাই মাবুদের ইচ্ছা তখন তিনি অন্যান্য বারের মত জাদুমন্ত্রের সাহায্য নেবার চেষ্টা করলেন না। তিনি মরুভূমির দিকে তাঁর মুখ ফিরালেন। তিনি চেয়ে দেখলেন, বনি-ইসরাইলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর তাম্বু পর পর খাটানো রয়েছে। তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তাঁর উপর আসলেন, আর তিনি আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “বাউরের ছেলে বালাম এই কথা বলছে, যার চোখ খোলা রয়েছে সে এই কথা বলছে, যে লোক আল্লাহ্‌র কালাম শুনছে আর সর্বশক্তিমানের দেওয়া দর্শন দেখছে, যে সেজদায় পড়েছে আর যার চোখের ঠুলি খুলে গেছে, সে এই কথা বলছে: হে ইয়াকুব, তোমার তাম্বুগুলো কি সুন্দর! হে ইসরাইল, কি সুন্দর তোমার থাকবার জায়গা! সেগুলো পড়ে আছে উপত্যকার মত, পড়ে আছে নদীর ধারের বাগানের মত, মাবুদের লাগানো অগুরু গাছের মত, পানির ধারের এরস গাছের মত। ভারে বওয়া কলসী থেকে পানি উপ্‌চে পড়বে, তাদের বীজ অনেক পানি পেতে থাকবে। তাদের বাদশাহ্‌ হবে অগাগের চেয়েও মহান, তাদের রাজ্য মহিমায় অনেক উঁচুতে থাকবে। আল্লাহ্‌ মিসর থেকে তাদের বের করে এনেছেন, তিনিই তাদের পক্ষে বুনো ষাঁড়ের শক্তির মত। তাদের বিরুদ্ধে যে সব জাতি দাঁড়াবে তারা তাদের গিলে ফেলবে, তাদের হাড় টুকরা টুকরা করবে, তীর দিয়ে তাদের বিঁধে ফেলবে। সিংহ ও সিংহীর মত তারা গুঁড়ি মারবে আর শুয়ে পড়বে, তখন কে তাদের জাগাতে সাহস করবে? যারা তোমাদের দোয়া করে তাদের উপর তেমনি দোয়া পড়ুক; আর যারা বদদোয়া দেয়, তাদের উপর তেমনি বদদোয়া পড়ুক।” এই কথা শুনে বালাক বালামের উপর রেগে আগুন হয়ে উঠলেন। তিনি হাতে হাত চাপড়ে তাঁকে বললেন, “আমার শত্রুদের বদদোয়া দেবার জন্য আমি আপনাকে ডেকে এনেছিলাম কিন্তু এই নিয়ে তিনবার আপনি তাদের দোয়া করলেন। আপনি এক্ষুনি বাড়ী চলে যান। আমি আপনাকে অনেক পুরস্কার দেব বলেছিলাম কিন্তু মাবুদ তা আপনাকে পেতে দিলেন না।” জবাবে বালাম বালাককে বললেন, “আমি কি আপনার পাঠানো লোকদের বলি নি যে, যদিও বালাক সোনা-রূপায় ভরা রাজবাড়ীটা আমাকে দেন তবুও আমার নিজের ইচ্ছায় আমি ভাল-মন্দ কিছুই করতে পারব না বা মাবুদের হুকুমের বাইরে যেতে পারব না, আর মাবুদ যা বলবেন কেবল তা-ই আমাকে বলতে হবে? আমি এখন আমার লোকদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু তার আগে আমি আপনাকে সাবধান করে বলে দিয়ে যাচ্ছি এই জাতি ভবিষ্যতে আপনার জাতির প্রতি কি করবে।” বালাম তখন আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “বাউরের ছেলে বালাম এই কথা বলছে, যার চোখ খোলা রয়েছে সে এই কথা বলছে, যে লোক আল্লাহ্‌র কালাম শুনছে আর আল্লাহ্‌তা’লার কাছ থেকে জ্ঞান পাচ্ছে, যে সর্বশক্তিমানের দেওয়া দর্শন দেখছে, যে সেজদায় পড়েছে, আর যার চোখের ঠুলি খুলে গেছে, সে এই কথা বলছে: ‘এখন না হলেও আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি, যদিও তিনি কাছে নন তবুও তাঁর উপর আমার চোখ পড়ছে। একটা তারা উঠবে ইয়াকুবের বংশে, একটা রাজদণ্ড উঠবে ইসরাইল জাতির মধ্য থেকে। মোয়াবীয়দের আর শিসের সন্তানদের মাথা তিনি চুরমার করে দেবেন। শত্রুরা ইদোমকে, অর্থাৎ সেয়ীরকে দখল করবে, কিন্তু বনি-ইসরাইলরা বীরের মত কাজ করবে। ইয়াকুবের বংশ থেকে একজন শাসনকর্তা আসবেন, শহরের বাকী বেঁচে থাকা ইদোমীয়দের তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন।’ ” আমালেকীয়দের দেখে বালাম আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “সব জাতির মধ্যে আমালেকীয়রা ছিল প্রধান, কিন্তু ধ্বংসেই তার শেষ হবে।” তারপর বালাম কেনীয়দের দেখে আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “তোমাদের থাকবার জায়গা চিরস্থায়ী; পাহাড়ে তোমাদের বাসা রয়েছে। কিন্তু কেনীয়রা, শেষে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে; আশেরিয়া কতকাল তোমাদের আর বন্দী করে রাখবে?” তারপর বালাম আল্লাহ্‌র দেওয়া এই কালাম বলতে লাগলেন: “হায়! আল্লাহ্‌ যখন এই সব করবেন, তখন কি কেউ বেঁচে থাকতে পারবে? সাইপ্রাস দ্বীপের কিনারা থেকে জাহাজ এসে দমন করবে আশেরীয় আর আবেরীয়দের; কিন্তু সাইপ্রাসের লোকেরা ধ্বংস হয়ে যাবে।” এর পর বালাম উঠে বাড়ীর দিকে রওনা হলেন আর বালাকও তাঁর নিজের পথে চলে গেলেন। শিটীম শহরের কাছে থাকবার সময় বনি-ইসরাইলরা মোয়াবীয় স্ত্রীলোকদের সংগে জেনা শুরু করেছিল। এই সব স্ত্রীলোকেরা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশে কোরবানীর উৎসবে বনি-ইসরাইলদের দাওয়াত করেছিল, আর বনি-ইসরাইলরাও তাদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করে সেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করেছিল। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা পিয়োর পাহাড়ের বাল-দেবতার পূজায় যোগ দিতে লাগল। তাতে তাদের উপর মাবুদের গজবের আগুন জ্বলে উঠল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি সমস্ত ইসরাইলীয় নেতাদের ধরে হত্যা কর এবং দিনের আলোতে আমার সামনে তাদের লাশগুলো ফেলে রাখ। এতে বনি-ইসরাইলদের উপর থেকে আমার সেই ভীষণ গজব দূর হবে।” তখন মূসা ইসরাইলীয় বিচারকর্তাদের বললেন, “তোমাদের অধীন যে সব লোকেরা পিয়োরের বাল-দেবতার পূজায় যোগ দিয়েছে তাদের প্রত্যেককেই তোমাদের হত্যা করতে হবে।” এতে মূসা ও বনি-ইসরাইলরা সবাই যখন মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে কান্নাকাটি করছিল সেই সময় একজন ইসরাইলীয় তাদের চোখের সামনে দিয়েই একজন মাদিয়ানীয় স্ত্রীলোককে তার পরিবারের লোকদের মধ্যে নিয়ে গেল। কিন্তু যারা ঐ মহামারীতে মারা গেল তাদের সংখ্যা ছিল চব্বিশ হাজার। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, “ইমাম হারুনের নাতি, অর্থাৎ ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস বনি-ইসরাইলদের উপর থেকে আমার গজব দূর করেছে। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে সে আমার পাওনা সম্মান সম্বন্ধে আমারই মত আগ্রহী। তাই আমার পাওনা সম্মান সম্বন্ধে আমার গভীর আগ্রহ থাকলেও আমি তাদের শেষ করে দিই নি। সেইজন্য তুমি তাকে বল যে, আমি তার জন্য একটা সহিসালমতী-ব্যবস্থা স্থাপন করছি। সে তার আল্লাহ্‌র পাওনা সম্মান সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার কাজ করেছে বলে আমি তার জন্য এমন ব্যবস্থা স্থাপন করছি যাতে ইমামের পদ তার ও তার বংশধরদের মধ্যে চিরকাল ধরে থাকে।” যে ইসরাইলীয় লোকটিকে সেই মাদিয়ানীয় স্ত্রীলোকের সংগে হত্যা করা হয়েছিল তার নাম ছিল সিম্রি। সে ছিল শালূর ছেলে এবং শিমিয়োন-গোষ্ঠীর একটি বংশের নেতা। যে মাদিয়ানীয় স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করা হয়েছিল তার নাম ছিল কস্‌বী। সে ছিল মাদিয়ান দেশের সূর নামে একটি বংশের নেতার মেয়ে। পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, “মাদিয়ানীয়দের তোমরা শত্রু হিসাবে দেখবে এবং তাদের হত্যা করবে, কারণ পিয়োরের দেবতার পূজা এবং কস্‌বীর ব্যাপার নিয়ে কৌশল খাটিয়ে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়ে তারা তোমাদের শত্রু হয়েছে। তুমি তো জান যে, এই কস্‌বী ছিল তাদের আত্মীয়া এবং একজন মাদিয়ানীয় সর্দারের মেয়ে। পিয়োরের বাল-দেবতার পূজার ফলে যখন তোমাদের মধ্যে মহামারী দেখা দিয়েছিল তখন ঐ স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করা হয়েছিল।” মহামারী থেমে যাওয়ার পরে মাবুদ মূসা ও ইমাম হারুনের ছেলে ইলিয়াসরকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের মধ্যে যাদের বয়স বিশ বা তার বেশী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধে যাবার মত হয়েছে, পরিবার অনুসারে তোমরা তাদের সংখ্যা গণনা কর।” কাজেই জেরিকোর উল্টা দিকে জর্ডান নদীর ধারে মোয়াবের যে সমভূমি আছে সেখানে ইমাম ইলিয়াসর ও মূসা নেতাদের বললেন, “মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছেন সেই অনুসারে তোমরা বিশ বছর বা তার বেশী বয়সের পুরুষ লোকদের গণনা কর।” যে বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিল লোক গণনার সময় তাদের নাম লেখা হয়েছিল। ইয়াকুবের প্রথম ছেলে রূবেণের বংশধর: এরা হল হনোক থেকে হনোকীয় বংশ, পল্লু থেকে পল্লুয়ীয় বংশ, হিষ্রোণ থেকে হিষ্রোণীয় বংশ এবং কর্মী থেকে কর্মীয় বংশ। এগুলো রূবেণ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল তেতাল্লিশ হাজার সাতশো ত্রিশ। পল্লুর ছেলের নাম ছিল ইলীয়াব, আর ইলীয়াবের ছেলেদের নাম হল নমূয়েল, দাথন ও অবীরাম। এই দাথন আর অবীরাম ছিল বনি-ইসরাইলদের সেই দু’জন নেতা যারা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। আবার কারুনের দল যখন মাবুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তখন এরাও সেই দলের মধ্যে ছিল। কারুনের সংগে এই দু’জনকেও দুনিয়া হাঁ করে গিলে ফেলেছিল; আর কারুনের দলের দু’শো পঞ্চাশ জন আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। এগুলো বনি-ইসরাইলদের জন্য সতর্ক করবার চিহ্ন হয়ে রইল। তবে কারুনের ছেলেরা সেই সময় মারা যায় নি। শিমিয়োনের বংশধর: এরা হল নমূয়েল থেকে নমূয়েলীয় বংশ, যামীন থেকে যামীনীয় বংশ, যাখীন থেকে যাখীনীয় বংশ, সেরহ থেকে সেরহীয় বংশ এবং শৌল থেকে শৌলীয় বংশ। এগুলো শিমিয়োন-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল বাইশ হাজার দু’শো। গাদের বংশধর: এরা হল সিফোন থেকে সিফোনীয় বংশ, হগি থেকে হগীয় বংশ, শূনি থেকে শূনীয় বংশ, ওষ্ণি থেকে ওষ্ণীয় বংশ, এরি থেকে এরীয় বংশ, আরোদ থেকে আরোদীয় বংশ এবং অরেলি থেকে অরেলীয় বংশ। এগুলো গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল চল্লিশ হাজার পাঁচশো। পেরসের বংশধরদের বংশ হল হিষ্রোণ থেকে হিষ্রোণীয় বংশ এবং হামূল থেকে হামূলীয় বংশ। এগুলো এহুদা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল ছিয়াত্তর হাজার পাঁচশো। ইষাখরের বংশধর: এরা হল তোলয় থেকে তোলয়ীয় বংশ, পূয় থেকে পূনীয় বংশ, যাশূব থেকে যাশূবীয় বংশ এবং শিম্রোণ থেকে শিম্রোণীয় বংশ। এগুলো ইষাখর-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল চৌষট্টি হাজার তিনশো। সবূলূনের বংশধর: এরা হল সেরদ থেকে সেরদীয় বংশ, এলোন থেকে এলোনীয় বংশ এবং যহলেল থেকে যহলেলীয় বংশ। এগুলো সবূলূন-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল ষাট হাজার পাঁচশো। মানশা আর আফরাহীমের মধ্য দিয়ে ইউসুফের বংশধর: মানশার বংশধরদের বংশ হল মাখীর থেকে মাখীরীয় বংশ এবং গিলিয়দ থেকে গিলিয়দীয় বংশ। গিলিয়দ ছিল মাখীরের ছেলে। গিলিয়দের বংশধরদের বংশ হল ঈয়েষর থেকে ঈয়েষরীয় বংশ, হেলক থেকে হেলকীয় বংশ, অস্রীয়েল থেকে অস্রীয়েলীয় বংশ, শেখম থেকে শেখমীয় বংশ, শিমীদা থেকে শিমীদায়ীয় বংশ এবং হেফর থেকে হেফরীয় বংশ। হেফরের ছেলে সলফাদের কোন ছেলে ছিল না, কেবল মেয়ে ছিল। সেই মেয়েদের নাম হল মহলা, নোয়া, হগ্‌লা, মিল্কা ও তির্সা। এগুলো মানশা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল বাহান্ন হাজার সাতশো। আফরাহীমের বংশধরদের বংশ হল শূথলহ থেকে শূথলহীয় বংশ, বেখর থেকে বেখরীয় বংশ এবং তহন থেকে তহনীয় বংশ। শূথলহের বংশধরদের বংশ হল এরণ থেকে এরণীয় বংশ। এগুলো আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকদের বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল বত্রিশ হাজার পাঁচশো। বংশ অনুসারে এরাই ছিল ইউসুফের বংশধর। বিন্‌ইয়ামীনের বংশধর: এরা হল বেলা থেকে বেলায়ীয় বংশ, অস্‌বেল থেকে অস্‌বেলীয় বংশ, অহীরাম থেকে অহীরামীয় বংশ, শূফম থেকে শূফমীয় বংশ এবং হূফম থেকে হূফমীয় বংশ। অর্দ ও নামানের মধ্য দিয়ে বেলার বংশধরদের বংশ হল অর্দ থেকে অর্দীয় বংশ এবং নামান থেকে নামানীয় বংশ। এগুলো বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকদের বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল পয়তাল্লিশ হাজার ছ’শো। দানের বংশধর: এরা হল শূহম থেকে শূহমীয় বংশ। এরাই ছিল দান-গোষ্ঠীর লোক। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল চৌষট্টি হাজার চারশো। আশেরের বংশধর: এরা হল যিম্ন থেকে যিম্নীয় বংশ, যিস্‌বি থেকে যিস্‌বীয় বংশ এবং বরিয় থেকে বরিয়ীয় বংশ। বরিয়ের বংশধরদের বংশ হল হেবর থেকে হেবরীয় বংশ আর মল্কীয়েল থেকে মল্কীয়েলীয় বংশ। আশেরের মেয়ের নাম ছিল সারহ। এগুলো আশের-গোষ্ঠীর লোকদের বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা ছিল তিপ্পান্ন হাজার চারশো। নপ্তালির বংশধর: এরা হল যহসীয়েল থেকে যহসীয়েলীয় বংশ, গূনি থেকে গূনীয় বংশ, যেৎসর থেকে যেৎসরীয় বংশ এবং শিল্লেম থেকে শিল্লেমীয় বংশ। এগুলো নপ্তালি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশ। এদের মধ্য থেকে গণনা করা লোকদের সংখ্যা হল পঁয়তাল্লিশ হাজার চারশো। গণনা করা বনি-ইসরাইলদের মোট সংখ্যা হয়েছিল ছয় লক্ষ এক হাজার সাতশো ত্রিশ। মাবুদ মূসাকে বললেন, “গণনা করা লোকদের সংখ্যা অনুসারে দেশটা ভাগ করে দিতে হবে যাতে তারা তার অধিকারী হয়। যে গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা বেশী সেই গোষ্ঠীকে বেশী এবং যে গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা কম সেই গোষ্ঠীকে কম জায়গা দিতে হবে। প্রত্যেক গোষ্ঠী তার গণনা করা লোকদের সংখ্যা অনুসারে জায়গার অধিকারী হবে। কোথায় কোন্‌ গোষ্ঠী জায়গা পাবে তা গুলিবাঁট করে ঠিক করতে হবে। প্রত্যেক বংশের পাওনা অংশ তার গোষ্ঠীর নামে দেওয়া এলাকার মধ্যেই থাকবে। গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক গুলিবাঁটের মধ্য দিয়েই জায়গা ঠিক করা হবে।” বংশ হিসাবে গণনা করা লেবীয়রা হল গের্শোন থেকে গের্শোনীয় বংশ, কহাৎ থেকে কহাতীয় বংশ এবং মরারি থেকে মরারীয় বংশ। গের্শোন, কহাৎ ও মরারির বংশধরদের বংশ হল লিব্‌নীয় বংশ, হেবরনীয় বংশ, মহলীয় বংশ, মূশীয় বংশ এবং কারুনীয় বংশ। কহাতের এক বংশধরের নাম ছিল ইমরান। ইমরানের স্ত্রীর নাম ছিল ইউখাবেজ। মিসর দেশে লেবি-গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর গর্ভে ইমরানের ছেলে হারুন ও মূসা এবং তাঁদের বোন মরিয়মের জন্ম হয়েছিল। হারুনের ছেলেদের নাম ছিল নাদব, অবীহূ, ইলিয়াসর ও ঈথামর। মাবুদের কাছে নিয়মের বাইরের আগুনে ধূপ কোরবানী করতে গিয়ে নাদব আর অবীহূ মারা গিয়েছিলেন। এক মাস বা তার বেশী বয়সের লেবীয় পুরুষের সংখ্যা ছিল তেইশ হাজার। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে এদের কোন জায়গার অধিকার দেওয়া হয় নি বলে অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের সংগে এদের গোণা হয় নি। জেরিকোর উল্টাদিকে জর্ডান নদীর ধারে মোয়াবের সমভূমিতে আদমশুমারীর সময় মূসা ও ইমাম ইলিয়াসর এই লোকদেরই গণনা করেছিলেন। কিন্তু মূসা ও ইমাম হারুন যখন সিনাই মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের গণনা করেছিলেন তখন এই সব লোকদের কেউ তাদের মধ্যে ছিল না। ঐ সব বনি-ইসরাইলদের সম্বন্ধেই মাবুদ বলেছিলেন যে, তারা নিশ্চয়ই মরুভূমিতে মারা পড়বে। আর সত্যিই তাদের মধ্যে যিফুন্নির ছেলে কালুত ও নূনের ছেলে ইউসা ছাড়া আর কেউই বেঁচে ছিল না। সলফাদের মেয়েরা ছিল ইউসুফের ছেলে মানশার বংশের। মানশার ছেলের নাম মাখীর, মাখীরের ছেলের নাম গিলিয়দ, গিলিয়দের ছেলের নাম হেফর এবং হেফরের ছেলের নাম সলফাদ। সলফাদের মেয়েদের নাম হল মহলা, নোয়া, হগ্‌লা, মিল্কা ও তির্সা। এই মেয়েরা মিলন-তাম্বুতে ঢুকবার পথে গিয়ে মূসা আর ইমাম ইলিয়াসর এবং সমস্ত নেতা ও বনি-ইসরাইলদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের পিতা মরুভূমিতে মারা গেছেন। কারুনের যে সব লোকেরা মাবুদের বিরুদ্ধে দল পাকিয়েছিল তিনি তাদের মধ্যে ছিলেন না; তিনি নিজের গুনাহেই মারা গেছেন। তাঁর কোন ছেলে নেই, কিন্তু তাই বলে কেন আমাদের পিতার নাম তাঁর বংশ থেকে মুছে যাবে? পিতার বংশের লোকদের সংগে আমাদের সম্পত্তির অধিকার দিন।” তখন মূসা তাদের এই ব্যাপারটা মাবুদের সামনে তুলে ধরলেন। এর জবাবে মাবুদ তাঁকে বললেন, “সলফাদের মেয়েরা ঠিক কথাই বলেছে। তাদের পিতার বংশের লোকদের সংগে তাদেরও নিশ্চয়ই সম্পত্তির অধিকার তোমাকে দিতে হবে। তারা যাতে তাদের বাবার সম্পত্তি পায় তা তোমাকে দেখতে হবে। তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যদি কেউ ছেলে না রেখে মারা যায় তবে তার সম্পত্তির অধিকার তার মেয়ে পাবে। যদি তার মেয়ে না থাকে তবে তার ভাইয়েরা তার সম্পত্তির অধিকারী হবে। যদি তার ভাই না থাকে তবে সম্পত্তির অধিকার তার বাবার ভাইয়েরা পাবে। যদি পিতার কোন ভাই না থাকে তবে তার বংশের সবচেয়ে নিকট জনকে সেই সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে। সেই সম্পত্তি সে-ই পাবে। মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম অনুসারে এটা হবে বনি-ইসরাইলদের আইনের একটা ধারা।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি অবারীম পাহাড়শ্রেণীর মধ্যেকার এই পাহাড়টায় উঠে যে দেশ আমি বনি-ইসরাইলদের দিয়েছি সেটা দেখে নাও। তোমার ভাই হারুন যেমন তার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেছে দেশটা দেখবার পর তোমাকেও তেমনি তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যেতে হবে। এর কারণ হল, সীন মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলরা যখন পানির জন্য বিদ্রোহ করেছিল তখন বনি-ইসরাইলদের সামনে আমাকে পবিত্র বলে মান্য করবার হুকুম তোমরা অমান্য করেছিলে।” এটা সীন মরুভূমিতে কাদেশের মরীবার পানির কথা। এর জবাবে মাবুদ মূসাকে বললেন, “নূনের ছেলে ইউসার মধ্যে আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আছেন। তুমি তাকে এনে তার উপর তোমার হাত রাখ। তুমি তাকে ইমাম ইলিয়াসর ও বনি-ইসরাইলদের সামনে উপস্থিত করে তাদের সামনেই তাকে কাজের ভার দাও। তোমাকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার কিছুটা তুমি তার হাতে দাও যাতে বনি-ইসরাইলরা সবাই তাকে মেনে চলে। তাকে ইমাম ইলিয়াসরের কাছে যেতে হবে, আর ইলিয়াসর তার হয়ে ঊরীমের সাহায্যে মাবুদের নির্দেশ জেনে নেবে। ইলিয়াসরের হুকুমেই তাকে এবং বনি-ইসরাইলদের অন্য সবাইকে চলতে হবে।” মূসা আল্লাহ্‌র হুকুম মতই কাজ করলেন। তিনি ইউসাকে ইমাম ইলিয়াসর ও বনি-ইসরাইলদের সামনে উপস্থিত করলেন। তারপর মাবুদের নির্দেশ মত তাঁর উপর হাত রেখে তাঁকে কাজের ভার দিলেন। তিনি তাদের এই কথাও বলতে বললেন, “আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জন্য মাবুদের সামনে প্রত্যেক দিনের নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানীর জন্য তোমাদের এক বছরের দু’টা নিখুঁত বাচ্চা-ভেড়া আনতে হবে। তার একটা বাচ্চা সকালে কোরবানী দেবে ও অন্যটা দেবে বেলা ডুবে গেলে পর। এর সংগে থাকবে শস্য-কোরবানীর জন্য এক কেজি আটশো গ্রাম মিহি ময়দা। এই ময়দার সংগে প্রায় এক লিটার জলপাই-ছেঁচা তেল মিশিয়ে আনতে হবে। এটা সেই নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী যা তুর পাহাড়ে স্থাপন করা হয়েছিল। এটা মাবুদের উদ্দেশে আগুন্তেদেওয়া একটা কোরবানী যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। প্রত্যেকটা ভেড়ার সংগে প্রায় এক লিটার মদানো-রস দিয়ে ঢালন-কোরবানী করতে হবে। পবিত্র তাম্বুর উঠানে মাবুদের উদ্দেশে এই ঢালন-কোরবানীর জিনিস ঢেলে দিতে হবে। ভেড়ার অন্য বাচ্চাটা বেলা ডুবে গেলে পর কোরবানী দিতে হবে। তার সংগে থাকবে সকালবেলার মত শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী। এটা একটা আগুনে দেওয়া-কোরবানী যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। “বিশ্রামবারে দু’টা এক বছরের নিখুঁত ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী দিতে হবে। তার সংগে থাকবে তার সংগেকার ঢালন-কোরবানীর জিনিস এবং শস্য-কোরবানীর জন্য তেলের ময়ান দেওয়া তিন কেজি ছ’শো গ্রাম মিহি ময়দা। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী এবং তার সংগেকার ঢালন-কোরবানী ছাড়াও প্রত্যেক বিশ্রামবারে এই পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। “প্রত্যেক মাসের প্রথম দিনে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য দু’টা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং এক বছরের সাতটা বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। সেগুলোর প্রত্যেকটাকেই নিখুঁত হতে হবে। ঢালন-কোরবানীর জন্য প্রত্যেকটা ষাঁড়ের সংগে পৌনে দুই লিটার আংগুর-রস দিতে হবে; ভেড়াটার সংগে দিতে হবে সোয়া লিটার এবং প্রত্যেকটা বাচ্চা-ভেড়ার সংগে দিতে হবে প্রায় এক লিটার। এটা হল মাসিক পোড়ানো-কোরবানী। বছরের প্রত্যেক মাসে এটা দিতে হবে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী এবং তার সংগেকার ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানী দিতে হবে। “বছরের প্রথম মাসের চৌদ্দ তারিখে মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করতে হবে। সেই মাসের পনেরো তারিখে একটা ঈদ করতে হবে। তখন সাত দিন ধরে খামিহীন রুটি খেতে হবে। প্রথম দিনে একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করতে হবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। সেই দিন মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী হিসাবে দু’টা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং সাতটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। সেগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এগুলোর সংগে তোমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে গুনাহের কোরবানীর জন্য একটি ছাগলও আনতে হবে। সকালবেলার নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ছাড়া এই সব কোরবানীও দিতে হবে। এইভাবে সাত দিনের প্রত্যেক দিন মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে এই সব খাবার দিয়ে আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। নিয়মিত যে পোড়ানো-কোরবানী এবং তার সংগেকার ঢালন-কোরবানী রয়েছে তার উপর এটাও দিতে হবে। সপ্তম দিনে একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। “সাত সপ্তাহের ঈদের দিনে, অর্থাৎ প্রথমে তোলা ফসল কোরবানী করবার দিনে যখন তোমরা মাবুদের উদ্দেশে নতুন ফসল কোরবানী করবে সেই দিন তোমাদের একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করতে হবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। সেই দিন মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে তোমাদের দু’টা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং সাতটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য এগুলোর সংগে তোমাদের একটা ছাগলও আনতে হবে। এই সব কোরবানী এবং তার সংগেকার ঢালন-কোরবানীর সংগে নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানীও করতে হবে। পশুগুলোর দেহে যেন কোন খুঁত না থাকে। “সপ্তম মাসের পয়লা তারিখে তোমরা একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করবে। সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। ঐ দিনটা হবে তোমাদের শিংগা বাজাবার দিন। মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে তোমরা সেই দিন একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং সাতটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দেবে। এগুলো হতে হবে নিখুঁত। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে গুনাহের কোরবানীর জন্য তোমাদের একটা ছাগলও আনতে হবে। প্রত্যেক মাসের ও প্রত্যেক দিনের নির্দিষ্ট করা পোড়ানো-কোরবানী এবং তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া এই সব কোরবানীও দিতে হবে। এগুলো মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানী যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন। “এই সপ্তম মাসের দশ তারিখেও একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করতে হবে। এই দিনে তোমরা প্রত্যেকে নিজের অন্তর ভেংগেচুরে কষ্ট স্বীকার করবে এবং সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ রাখবে। মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে তোমাদের একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং সাতটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। তার প্রত্যেকটাকেই নিখুঁত হতে হবে। গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার গুনাহের কোরবানী ও নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানীর সংগেকার শস্য-কোরবানী এবং এগুলোর সংগেকার ঢালন-কোরবানী ছাড়া আরও একটি গুনাহের জন্য কোরবানীর জন্য একটি ছাগলও আনতে হবে। “সপ্তম মাসের পনেরো তারিখেও একটি পবিত্র মিলন-মাহ্‌ফিল করতে হবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। তোমরা মাবুদের উদ্দেশে সাত দিন ধরে উৎসব পালন করবে। মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে একটা আগুনে দেওয়া-কোরবানী করতে হবে। এর জন্য তেরটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগলও আনতে হবে। “ঈদের দ্বিতীয় দিনে বারোটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানী দিতে হবে এবং এগুলোর সংগে দিতে হবে তাদের সংগেকার ঢালন-কোরবানী। “ঈদের তৃতীয় দিনে এগারোটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “ঈদের চতুর্থ দিনে দশটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “ঈদের পঞ্চম দিনে নয়টা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “ঈদের ষষ্ঠ দিনে আটটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “ঈদের সপ্তম দিনে সাতটা ষাঁড়, দু’টা ভেড়া এবং চৌদ্দটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। এই সব ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “অষ্টম দিনে শেষ দিনের বিশেষ মাহ্‌ফিল করতে হবে এবং সেই দিন তোমাদের কোন পরিশ্রমের কাজ করা চলবে না। মাবুদকে খুশী করবার খোশবু হিসাবে তাঁর উদ্দেশে একটি আগুনে দেওয়া-কোরবানী দিতে হবে। এর জন্য একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া এবং সাতটা এক বছরের বাচ্চা-ভেড়া দিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটাকে নিখুঁত হতে হবে। ষাঁড়, ভেড়া ও বাচ্চা-ভেড়ার সংখ্যা যত হবে তাদের সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর সংখ্যাও তত হবে; আর তা হবে আগের দেওয়া নিয়ম অনুসারে। নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানী ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী ছাড়া একটা ছাগল দিয়ে গুনাহের কোরবানীও দিতে হবে। “মানত পূরণ এবং নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানী হিসাবে তোমরা যে সমস্ত পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী, ঢালন-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবে সেগুলো ছাড়াও প্রত্যেকটা নির্দিষ্ট ঈদের সময়ে তার উপযুক্ত কোরবানী মাবুদের উদ্দেশে তোমাদের দিতে হবে।” মাবুদ যে সমস্ত হুকুম মূসাকে দিয়েছিলেন তা তিনি বনি-ইসরাইলদের জানালেন। কিন্তু সেই কথা শুনবার সংগে সংগে যদি তার পিতা তাকে নিষেধ করে তবে তার মানত বা যে সব ওয়াদার দ্বারা সে নিজেকে বেঁধেছে তা বাতিল হয়ে যাবে। তার পিতা নিষেধ করেছে বলে মাবুদ তার মানত বা ওয়াদা ভাংগা মাফ করবেন। কিন্তু সেই কথা শুনবার সংগে সংগে যদি তার স্বামী তাকে নিষেধ করে তবে তার সেই মানত বা চিন্তা-ভাবনা না করে করা ওয়াদার বাঁধন নাকচ হয়ে যাবে আর মাবুদও তার মানত বা ওয়াদা ভাংগা মাফ করবেন। “বিধবা কিংবা স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে এমন কোন স্ত্রীলোক যদি কোন মানত করে কিংবা ওয়াদার দ্বারা নিজেকে বাঁধে তবে তাকে তা পূরণ করতেই হবে। কিন্তু যদি তার স্বামী সেই কথা শুনবার সংগে সংগে তা নাকচ করে দেয় তবে তার সেই মানত কিংবা ওয়াদা বাতিল হয়ে যাবে। তার স্বামী সেই সব নাকচ করেছে বলে মাবুদ তার মানত বা ওয়াদা ভাংগা মাফ করবেন। স্ত্রী যে মানত করবে কিংবা কসম খেয়ে কোন কিছু ত্যাগ করবার ওয়াদা করবে তা মেনে নেওয়া বা নাকচ করে দেবার অধিকার স্বামীর থাকবে। কিন্তু যদি তার স্বামী দিনের পর দিন সেই বিষয়ে কিছু না বলে চুপ করে থাকে তবে তাতে তার স্ত্রীর মানত বা ওয়াদার বাঁধন পাকা হয়ে যায়। সব কথা শুনবার সংগে সংগে তার এই যে চুপ করে থাকা তা তার স্ত্রীর মানত বা ওয়াদাকে পাকা করে দেয়। কিন্তু সব কথা শুনবার পরে সেই দিনই যেতে দিয়ে যদি স্বামী সেই সব নাকচ না করে তবে স্ত্রীর তা পূরণ না করবার দোষ গিয়ে পড়বে তার স্বামীর উপর।” এই সব ব্যাপারে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক এবং পিতা ও পিতার বাড়ীতে থাকা মেয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মাবুদ মূসাকে এই সমস্ত নিয়ম দিয়েছিলেন। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের পক্ষ থেকে মাদিয়ানীয়দের অন্যায়ের জন্য তাদের পাওনা শাস্তি দাও। তারপর তোমাকে তোমার পূর্বপরুষদের কাছে চলে যেতে হবে।” তখন মূসা বনি-ইসরাইলদের বললেন, “মাদিয়ানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে নাও, যাতে তারা মাবুদের হয়ে মাদিয়ানীয়দের পাওনা শাস্তি দিতে পারে। বনি-ইসরাইলদের প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে এক হাজার করে লোক নিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে দাও।” কাজেই বনি-ইসরাইলদের বারোটা গোষ্ঠী থেকে এক হাজার করে বারো হাজার লোককে যুদ্ধের সাজে সাজানো হল। মূসা প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে এক হাজার করে লোক নিয়ে তাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের সংগে গেলেন ইমাম ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস। সংকেত দেবার শিংগাগুলো এবং কয়েকটি পাক-পবিত্র জিনিস তিনি সংগে নিলেন। মূসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম মতই তারা মাদিয়ানীয়দের সংগে যুদ্ধ করে সমস্ত পুরুষ লোকদের হত্যা করল। অন্যান্যদের সংগে মাদিয়ানীয়দের পাঁচজন বাদশাহ্‌কেও তারা হত্যা করল। তাঁদের নাম হল ইবি, রেকম, সূর, হূর ও রেবা। বনি-ইসরাইলরা বাউরের ছেলে বালামকেও হত্যা করল। তারা মাদিয়ানীয়দের স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের বন্দী করল আর তাদের সমস্ত গরু, ছাগল ও ভেড়ার পাল এবং জিনিসপত্র লুট করে নিল। মাদিয়ানীয়রা যে সব শহরে বাস করত সেই সব শহরগুলো এবং শহরের বাইরে তাম্বু খাটিয়ে বাস করবার জায়গাগুলো তারা পুড়িয়ে দিল। মূসা, ইমাম ইলিয়াসর এবং বনি-ইসরাইলদের নেতারা সবাই ছাউনির বাইরে তাদের সংগে দেখা করতে গেলেন। পিয়োর পাহাড়ের ঘটনায় এরাই তো বালামের পরামর্শে বনি-ইসরাইলদের মাবুদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার ফলে মাবুদের বান্দাদের মধ্যে মহামারী দেখা দিয়েছিল। এখন তোমরা এই সব ছেলেদের এবং যারা অবিবাহিতা সতী মেয়ে নয় এমন সব স্ত্রীলোকদের হত্যা কর; কিন্তু যারা অবিবাহিতা সতী মেয়ে তাদের তোমরা নিজেদের জন্য বাঁচিয়ে রাখ। “তোমাদের মধ্যে যারা কাউকে মেরেছে কিংবা হত্যা করা কাউকে ছুঁয়েছে তাদের সাত দিন পর্যন্ত ছাউনির বাইরে থাকতে হবে। তৃতীয় এবং সপ্তম দিনে তোমাদের নিজেদের ও বন্দী করে আনা লোকদের পাক-সাফ করে নিতে হবে। সমস্ত কাপড়-চোপড় এবং চামড়া, কাঠ ও ছাগলের লোমের তৈরী সমস্ত জিনিসপত্র তোমরা পাক-সাফ করে নেবে।” যে সব সৈন্যেরা যুদ্ধে গিয়েছিল ইমাম ইলিয়াসর তাদের বললেন, “এই হল মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া মাবুদের শরীয়তের একটা ধারা। সপ্তম দিনে তোমরা তোমাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলবে আর তখন তোমরা পাক-সাফ হবে এবং ছাউনির মধ্যে যেতে পারবে।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “ইমাম ইলিয়াসর, বনি-ইসরাইলদের বংশের নেতারা এবং তুমি বন্দী করে আনা সমস্ত মানুষ ও পশুদের সংখ্যা গণনা কর। লুটের সব কিছু দু’ভাগ করে এক ভাগ দাও সৈন্যদের যারা যুদ্ধ করেছে আর অন্য ভাগ দাও সমাজের বাদবাকী লোকদের। সেই সব সৈন্যদের ভাগে যত মানুষ, গরু, গাধা, ভেড়া ও ছাগল পড়বে তার প্রতি পাঁচশো থেকে একটা করে মাবুদের খাজনা হিসাবে আলাদা করে রাখতে হবে। সৈন্যদের ভাগের এই খাজনা তুমি মাবুদের পাওনা অংশ হিসাবে ইমাম ইলিয়াসরের হাতে দেবে। বনি-ইসরাইলদের ভাগে যে সমস্ত মানুষ, গরু, গাধা, ভেড়া, ছাগল বা অন্য যে কোন পশু পড়বে তার প্রতি পঞ্চাশটা থেকে একটা করে আলাদা করে রাখবে। সেগুলো তুমি লেবীয়দের হাতে দেবে যাদের উপর আবাস-তাম্বুর দেখাশোনার ভার রয়েছে।” মাবুদ মূসাকে যে সব হুকুম দিলেন সেইমতই তিনি ও ইমাম ইলিয়াসর সব কিছু করলেন। সৈন্যদের আনা লুট থেকে যা বাকী রইল তা হল ছয় লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ভেড়া ও ছাগল, মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই তিনি মাবুদের এই পাওনা খাজনা নিয়ে ইমাম ইলিয়াসরের হাতে দিলেন। সেই বনি-ইসরাইলরা যে অর্ধেক ভাগ পেল তার মধ্য থেকে মূসা প্রতি পঞ্চাশজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে থেকে একজন করে এবং প্রতি পঞ্চাশটা পশু থেকে একটা করে নিয়ে মাবুদের হুকুম মত লেবীয়দের দিলেন, যাদের উপর মাবুদের আবাস-তাম্বুর দেখাশোনার ভার ছিল। তাই আমরা প্রত্যেকে যে সমস্ত সোনার বাজু, বালা, সীলমোহর করবার আংটি, কানের দুল ও গলার হার পেয়েছি, আমাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে আমরা সেগুলো মাবুদের কাছে কোরবানী করতে নিয়ে এসেছি।” তখন মূসা ও ইমাম ইলিয়াসর তাদের কাছ থেকে সেই সব সোনার গহনাগুলো নিলেন। মূসা ও ইলিয়াসর হাজারপতি ও শতপতিদের যে সব সোনা মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী করলেন তার ওজন হল প্রায় একশো আটষট্টি কেজি। এছাড়া সৈন্যেরা সকলেই নিজের নিজের জন্য জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে এসেছিল। মাবুদ যাতে বনি-ইসরাইলদের প্রতি খেয়াল রাখেন সেইজন্য মূসা ও ইমাম ইলিয়াসর হাজারপতি ও শতপতিদের কাছ থেকে সোনার জিনিসগুলো নিয়ে মিলন-তাম্বুতে রাখলেন। রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের গরু, ছাগল ও ভেড়ার বড় বড় পাল ছিল। তারা দেখতে পেল যাসের ও গিলিয়দ দেশ পশু পালন করবার পক্ষে খুব উপযুক্ত জায়গা। তা দেখে তারা মূসা ও ইমাম ইলিয়াসর এবং ইসরাইলীয় সমাজের নেতাদের গিয়ে বলল, যদি আমাদের উপর আপনার দয়া হয় তবে আপনার এই গোলামদের এই জায়গাগুলো সম্পত্তি হিসাবে দিন। জর্ডান নদীর ওপারে আমাদের নিয়ে যাবেন না।” এতে মূসা গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর লোকদের বললেন, “তোমাদের ভাইয়েরা যুদ্ধ করতে যাবে আর তোমরা এখানে বসে থাকবে? মাবুদ বনি-ইসরাইলদের যে দেশ দিয়েছেন তোমরা তাদের সেখানে যাবার উৎসাহ ভেংগে দিচ্ছ কেন? দেশটা দেখে আসবার জন্য যখন আমি তোমাদের বাপ-দাদাদের কাদেশ-বর্ণেয় থেকে পাঠিয়েছিলাম তখন তারাও ঠিক এই রকমই করেছিল। ইষ্কোল উপত্যকা পর্যন্ত গিয়ে দেশটা দেখে আসবার পর তারা মাবুদের দেওয়া দেশে বনি-ইসরাইলদের যাওয়ার উৎসাহ ভেংগে দিয়েছিল। সেই দিন মাবুদ রাগে জ্বলে উঠেছিলেন এবং তিনি কসম খেয়ে বলেছিলেন, ‘যে দেশ দেবার কথা আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে কসম খেয়ে ওয়াদা করেছিলাম মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসা বিশ বা তার বেশী বয়সের লোকদের মধ্যে কেউ তা দেখতে পাবে না, কারণ তারা আমার কথা পুরোপুরি মেনে চলে নি। একমাত্র কনিসীয় যিফুন্নির ছেলে কালুত ও নূনের ছেলে ইউসা সেই দেশ দেখতে পাবে, কারণ তারাই আমার কথা পুরোপুরি মেনে চলেছে।’ বনি-ইসরাইলদের প্রতি মাবুদ রাগে জ্বলে উঠেছিলেন এবং তাঁর চোখে খারাপ কাজ করা সেই সব লোকগুলো শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে তিনি তাদের মরুভূমির মধ্যে নানা জায়গায় ঘুরিয়েছেন। “আর তোমরা, গুনাহ্‌গার বান্দারা, তোমাদের বাপ-দাদাদের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছ আর বনি-ইসরাইলদের প্রতি মাবুদের রাগের আগুন আরও বাড়িয়ে তুলছ। তোমরা যদি তাঁর কথামত না চল, তবে তিনি এবারও এই সব লোকদের মরুভূমিতেই ফেলে রাখবেন, আর তোমরা হবে তাদের ধ্বংসের কারণ।” তখন তারা মূসার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা কেবল এখানে আমাদের পশুপালের ঘর ও আমাদের পরিবারের জন্য শহর তৈরী করতে চাইছি। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের তাদের নিজেদের জায়গায় পৌঁছিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধের সাজে তাদের আগে আগে যেতে প্রস্তুত আছি। এর মধ্যে আমাদের পরিবার দেয়াল-ঘেরা শহরে বাস করবে যাতে এই সব দেশের লোকদের হাত থেকে তারা রক্ষা পায়। বনি-ইসরাইলরা প্রত্যেকে তার সম্পত্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের ঘরে ফিরে আসব না। জর্ডান নদীর ওপারে বনি-ইসরাইলদের সংগে আমরা কোন সম্পত্তি নেব না, কারণ নদীর পূর্ব পারেই তো আমরা তা পেয়ে যাচ্ছি।” তবে দেশটা মাবুদের অধীনে আসলে পর তোমরা ফিরে আসতে পারবে এবং মাবুদ ও ইসরাইল জাতির প্রতি তোমাদের কর্তব্য থেকে রেহাই পাবে; আর তখন মাবুদের ইচ্ছায় এই জায়গাটা তোমাদের সম্পত্তি হবে। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তবে মাবুদের বিরুদ্ধে তোমরা গুনাহ্‌ করবে। তোমরা এটা জেনে রেখো যে, তোমাদের গুনাহ্‌ তোমাদের রেহাই দেবে না। তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য শহর তৈরী করতে পার এবং ছাগল-ভেড়ার ঘরও বানাতে পার, কিন্তু যে কাজ করবার ওয়াদা তোমরা করেছ তা তোমাদের করতে হবে।” তখন গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর লোকেরা মূসাকে বলল, “আপনি আমাদের মালিক, আপনি আমাদের যে হুকুম দিলেন আমরা, আপনার গোলামেরা, তা পালন করব। আমাদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ছাগল-ভেড়া ও গরুর পাল ওখানে গিলিয়দের শহরগুলোতেই থাকবে। কিন্তু আমরা আমাদের মালিকের কথামত যুদ্ধ করবার জন্য যুদ্ধের সাজে মাবুদের সামনে নদী পার হয়ে যাব।” তখন মূসা এই লোকদের সম্বন্ধে ইমাম ইলিয়াসর, নূনের ছেলে ইউসা এবং ইসরাইলীয় গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন বংশের নেতাদের হুকুম দিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর পুরুষেরা যদি সবাই যুদ্ধের সাজে মাবুদের সামনে যুদ্ধ করবার জন্য তোমাদের সংগে জর্ডান নদী পার হয়ে যায়, তবে যখন দেশটা তোমাদের অধীনে আসবে তখন তোমরা সম্পত্তি হিসাবে গিলিয়দ দেশটা তাদের দিয়ে দেবে। কিন্তু যদি তারা তা না করে তবে কেনান দেশেই তোমাদের সংগে তাদের সম্পত্তি নিতে হবে।” এই কথা শুনে গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর লোকেরা বলল, “মাবুদ যা বলেছেন আপনার গোলামেরা তা করবে। আমরা মাবুদের সামনে যুদ্ধের সাজ পরে নদী পার হয়ে কেনান দেশে যাব, কিন্তু নদীর এই পারেই থাকবে আমাদের সম্পত্তি।” মূসা তখন আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের রাজ্য ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজের রাজ্য গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর লোকদের এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের ভাগে রাখলেন। এই মানশা ইউসুফের ছেলে। গ্রাম ও শহর এবং সেগুলোর চারদিকের জায়গা সুদ্ধ সমস্ত দেশটাই তিনি তাদের জন্য রাখলেন। গাদ-গোষ্ঠীর লোকেরা দীবোন, অটারোৎ, অরোয়ের, অট্‌রোৎ-শোফন, যাসের, যগ্‌বিহ, বৈৎ-নিম্রা ও বৈৎ-হারণ নামে কতগুলো গ্রাম ও শহর দেয়াল দিয়ে ঘিরে ঠিক করে নিল আর তাদের গরু-ভেড়ার ঘরও তৈরী করল। মানশার ছেলে মাখীরের বংশধরেরা গিলিয়দে গিয়ে দেশটা আগেই দখল করে নিয়েছিল এবং যে সব আমোরীয়রা সেখানে ছিল তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেইজন্য মূসা মানশার বংশধর মাখীরীয়দের ভাগে গিলিয়দ এলাকাটা রাখলেন। তারা সেখানে থাকতে লাগল। যায়ীর নামে মানশার এক বংশধর গিয়ে আমোরীয়দের গ্রামগুলো দখল করে নিয়েছিল এবং সেগুলোর নাম দিয়েছিল হব্বোৎ-যায়ীর। নোবহ গিয়ে কনাৎ ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো দখল করে নিয়ে নিজের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দিয়েছিল নোবহ। মূসা ও হারুনের পরিচালনায় বনি-ইসরাইলরা সৈন্যদলের মত করে মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে চলছিল। যাত্রাপথে তারা যে সমস্ত জায়গায় থেমেছিল মাবুদের হুকুমে মূসা তা লিখে রাখলেন। তারা যে সমস্ত জায়গায় থেমেছিল তা এই: উদ্ধার-ঈদের পরের দিন বছরের প্রথম মাসের পনেরো তারিখে বনি-ইসরাইলরা রামিষেষ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। সমস্ত মিসরীয়দের চোখের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে তারা বের হয়ে গিয়েছিল। মিসরীয়রা তখন তাদের প্রথম ছেলেদের দাফন করছিল। মাবুদ তাদের প্রথম সন্তানদের হত্যা করেছিলেন এবং তাদের দেব-দেবীদের উপর গজব নাজেল করেছিলেন। বনি-ইসরাইলরা রামিষেষ ছেড়ে এসে সুক্কোতে ছাউনি ফেলেছিল। তারপর তারা সুক্কোৎ ছেড়ে গিয়ে মরুভূমির ধারে এথম বলে একটি জায়গায় তাদের ছাউনি ফেলেছিল। এথম ছেড়ে তারা বাল-সফোনের সামনে পী-হহীরোতে ফিরে এসে মিগ্‌দোলের কাছে ছাউনি ফেলেছিল। তারা পী-হহীরোৎ ছেড়ে সাগর পার হয়ে এথম মরুভূমিতে গিয়ে উঠেছিল এবং তার মধ্য দিয়ে তিন দিনের পথ গিয়ে মারাতে ছাউনি ফেলেছিল। মারা ছেড়ে তারা এলীমে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। সেখানে বারোটা পানির ঝর্ণা ও সত্তরটা খেজুর গাছ ছিল। পরে তারা এলীম ছেড়ে সুয়েজ উপসাগরের ধারে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। তারপর তারা সুয়েজ উপসাগরের কাছ থেকে গিয়ে সিন মরুভূমিতে ছাউনি ফেলেছিল। সিন মরুভূমি ছেড়ে তারা দপ্‌কাতে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। দপ্‌কা ছেড়ে তারা আলূশে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। আলূশ ছেড়ে তারা রফীদীমে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। এখানে লোকদের জন্য কোন খাবার পানি ছিল না। এর পর তারা সীন মরুভূমির মধ্যে কাদেশে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। কাদেশ ছেড়ে তারা ইদোমের সীমানার কাছে হোর পাহাড়ে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর চল্লিশ বছরের পঞ্চম মাসের প্রথম দিনে মাবুদের হুকুমে ইমাম হারুন হোর পাহাড়ের উপরে উঠে গিয়েছিলেন এবং সেখানে ইন্তেকাল করেছিলেন। হোর পাহাড়ের উপর হারুনের ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল একশো তেইশ বছর। এর মধ্যে অরাদের কেনানীয় বাদশাহ্‌ বনি-ইসরাইলদের আসবার খবর শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি কেনান দেশের নেগেভে বাস করতেন। তারপর তারা অবারীম পাহাড়শ্রেণী ছেড়ে জেরিকোর উল্টাদিকে জর্ডান নদীর ধারে মোয়াবের সমভূমিতে গিয়ে ছাউনি ফেলেছিল। এই ছাউনি তারা ফেলেছিল জর্ডান নদীর কিনারা ধরে মোয়াবের সমভূমিতে বৈৎ-যিশীমোৎ থেকে আবেল-শিটীম শহর পর্যন্ত। “তারপর তোমরা সেই দেশটা দখল করে নিয়ে সেখানে বাস করবে কারণ দখল করবার জন্যই দেশটা আমি তোমাদের দিয়েছি। তোমরা গুলিবাঁট করে বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে নেবে। বংশের লোকসংখ্যা বেশী হলে বেশী জায়গা এবং কম হলে কম জায়গা দিতে হবে। গুলিবাঁটে যে বংশের জায়গা যেখানে পড়বে সেই বংশকে সেখানেই জায়গা নিতে হবে। গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশগুলো গোষ্ঠীর এলাকার মধ্যেই জায়গা পাবে। “কিন্তু তোমরা যদি ঐ দেশের বাসিন্দাদের দূর করে না দাও তবে যাদের তোমরা থাকতে দেবে তারা তোমাদের চোখে বড়শীর মত এবং পাঁজরে কাঁটার মত হবে। তোমরা ঐ দেশে বাস করবার সময় তারা তোমাদের কষ্ট দেবে। তখন আমি তোমাদের প্রতি তা-ই করব যা আমি তাদের প্রতি করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম।” তারপর তা সেখান থেকে ঘুরে মিসর নামে যে শুকনা নদী আছে তা ধরে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হবে। “তোমাদের দেশের পশ্চিম দিকের সীমানা হবে ভূমধ্যসাগর। এটাই হবে তোমাদের পশ্চিম দিকের শেষ সীমা। “পূর্ব দিকের সীমানার জন্য তোমরা হৎসর-ঐনন থেকে শফাম পর্যন্ত একটা সীমারেখা ঠিক করে নেবে। এই সীমারেখা শফাম থেকে ঐনের পূর্ব দিকের রিব্লা পর্যন্ত নেমে যাবে এবং গালীল সাগরের ঢালু জায়গাগুলো ধরে চলতে থাকবে। তারপর এই সীমারেখা জর্ডান নদী ধরে মরু-সাগরে গিয়ে শেষ হবে। “চারদিকের এই সব সীমারেখার ভিতরে এটাই হবে তোমাদের দেশ।” এর পর মূসা বনি-ইসরাইলদের হুকুম দিয়ে বললেন, “তোমরা গুলিবাঁটের মধ্য দিয়ে মাবুদের হুকুম মত দেশটা তোমাদের নয় গোষ্ঠী এবং মানশার অর্ধেক গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে নিয়ে তোমাদের সম্পত্তি করে নেবে, কারণ রূবেণ-গোষ্ঠী, গাদ-গোষ্ঠী ও মানশার অর্ধেক গোষ্ঠীর বংশগুলো তাদের সম্পত্তি আগেই পেয়ে গেছে। পথে জেরিকোর উল্টাদিকে জর্ডানের পূর্ব পারে তারা সেই সম্পত্তি পেয়েছে।” মাবুদ মূসাকে বললেন, “যারা সম্পত্তি হিসাবে দেশটা তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবে তারা হল ইমাম ইলিয়াসর ও নূনের ছেলে ইউসা। সম্পত্তি ভাগ করবার কাজে সাহায্য করবার জন্য প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে একজন করে নেতা নিতে হবে। সেই নেতারা হল এহুদা-গোষ্ঠীর যিফুন্নির ছেলে কালুত; শিমিয়োন-গোষ্ঠীর অম্মীহূদের ছেলে শামুয়েল; বিন্যামীন-গোষ্ঠীর কিশ্‌লোনের ছেলে ইলীদদ; দান-গোষ্ঠীর নেতা যগ্‌লির ছেলে বুক্কি; ইউসুফের ছেলে মানশা-গোষ্ঠীর নেতা এফোদের ছেলে হন্নীয়েল; ইউসুফের ছেলে আফরাহীম-গোষ্ঠীর নেতা শিপ্তনের ছেলে কমূয়েল; সবূলূন-গোষ্ঠীর নেতা পর্ণকের ছেলে ইলীষাফণ; ইষাখর-গোষ্ঠীর নেতা অস্‌সনের ছেলে পল্‌টিয়েল; আশের-গোষ্ঠীর নেতা শলোমির ছেলে অহীহূদ; নপ্তালি-গোষ্ঠীর নেতা অম্মীহূদের ছেলে পদহেল।” কেনান দেশে বনি-ইসরাইলদের মধ্যে সম্পত্তি হিসাবে জায়গা ভাগ করে দেবার জন্য মাবুদ এই সমস্ত লোকদের নিযুক্ত করেছিলেন। এতে লেবীয়রা বাস করবার জন্য গ্রাম ও শহর পাবে আর তাদের গরু-ভেড়া-ছাগল ও অন্যান্য পশু চরাবার মাঠও পাবে। “যে সব গ্রাম ও শহর তোমরা লেবীয়দের দেবে তার চারপাশের পশু চরাবার মাঠের জায়গাগুলো যেন গ্রাম বা শহরের দেওয়াল থেকে এক হাজার হাত পর্যন্ত হয়। প্রত্যেকটা গ্রাম বা শহর মাঝখানে রেখে তার বাইরে উত্তর ও দক্ষিণে দু’হাজার এবং পূর্ব ও পশ্চিমে দু’হাজার হাত মেপে দেবে। এই সব জায়গাগুলো তারা তাদের গ্রাম বা শহরের পশু চরাবার মাঠ হিসাবে পাবে। “তোমরা যে সব গ্রাম ও শহর লেবীয়দের দেবে তার মধ্যে ছয়টা হবে আশ্রয়-শহর। কেউ কাউকে হত্যা করলে ঐ সমস্ত আশ্রয়-শহরের কোন একটাতে সে পালিয়ে যেতে পারবে। এগুলো ছাড়া তোমরা তাদের আরও বেয়াল্লিশটা গ্রাম দেবে। মোট আটচল্লিশটা গ্রাম ও শহর লেবীয়দের দিতে হবে এবং তার প্রত্যেকটার চারপাশে পশু চরাবার মাঠ থাকবে। বনি-ইসরাইলদের সম্পত্তি থেকে লেবীয়দের যে সব গ্রাম ও শহর দেওয়া হবে তা প্রত্যেক গোষ্ঠীর পাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ বুঝে দিতে হবে। যে গোষ্ঠীর ভাগে বেশী গ্রাম ও শহর পড়বে সেই গোষ্ঠী থেকে বেশী এবং যে গোষ্ঠীর ভাগে কম গ্রাম ও শহর পড়বে সেই গোষ্ঠী থেকে কম নেবে।” যার প্রতিশোধ নেবার কথা, এগুলো হবে তার হাত থেকে রক্ষা পাবার আশ্রয়-শহর, যাতে খুনের দায়ে পড়া লোক বনি-ইসরাইলদের বিচার-সভার সামনে দাঁড়াবার আগে মারা না পড়ে। এই যে ছয়টা শহর তোমরা লেবীয়দের দেবে সেগুলো হবে তোমাদের আশ্রয়-শহর। এগুলোর তিনটা থাকবে জর্ডান নদীর পূর্ব পারে আর তিনটা থাকবে কেনান দেশের মধ্যে। এই ছয়টা হবে বনি-ইসরাইলদের, ইসরাইলীয় করে নেওয়া বাসিন্দাদের এবং পরদেশী বাসিন্দাদের আশ্রয়-শহর। কোন লোক হঠাৎ কাউকে হত্যা করলে সেখানে পালিয়ে যেতে পারবে। “কোন লোক যদি লোহার কিছু দিয়ে কাউকে আঘাত করে আর তাতে সে মারা যায় তবে সে খুনী। সেই খুনীকে হত্যা করতে হবে। যা দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায় এমন কোন পাথর যদি কারও হাতে থাকে আর তা দিয়ে যদি সে কাউকে আঘাত করে আর তাতে সে মারা যায় তবে সে খুনী। সেই খুনীকে হত্যা করতে হবে। যা দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায় এমন কোন কাঠের জিনিস যদি কারও হাতে থাকে আর তা দিয়ে যদি সে কাউকে আঘাত করে আর তাতে সে মারা যায় তবে সে খুনী। সেই খুনীকে হত্যা করতে হবে। খুন হওয়া লোকটার রক্তের প্রতিশোধ যার নেবার কথা তাকেই সেই খুনীকে হত্যা করতে হবে; দেখা পেলেই সে যেন তাকে হত্যা করে। বিচার-সভার লোকেরা তখন রক্তের প্রতিশোধ যার নেবার কথা তার হাত থেকে খুনের জন্য দায়ী করা লোকটাকে রক্ষা করে আবার তাকে সেই আশ্রয়-শহরে পাঠিয়ে দেবে যেখানে সে পালিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র তেল দিয়ে অভিষেক করা মহা-ইমামের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেই লোকটাকে সেখানে থাকতে হবে। মহা-ইমামের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেই লোকটিকে আশ্রয়-শহরের ভিতরেই থাকতে হবে। কেবলমাত্র মহা-ইমামের মৃত্যুর পরেই সে নিজের জায়গাতে ফিরে আসতে পারবে। তোমরা দেশের মধ্যে যেখানেই বাস কর না কেন, বংশের পর বংশ ধরে তোমাদের জন্য এগুলো হল শরীয়তের কতগুলো ধারা। “সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর ভরসা করেই খুনীকে হত্যা করা চলবে। তবে কেবলমাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর ভরসা করে কাউকে হত্যা করা চলবে না। মৃত্যুই যার পাওনা শাস্তি এমন কোন খুনীকে টাকা নিয়ে মুক্তি দেওয়া চলবে না। তাকে হত্যা করতেই হবে। আশ্রয়-শহরে পালিয়ে যাওয়া কোন লোককে টাকার বদলে মহা-ইমামের মৃত্যুর আগে তার জায়গা-জমিতে ফিরে গিয়ে বাস করতে দেওয়া চলবে না। তোমরা তোমাদের দেশকে নাপাক করবে না, কারণ রক্তপাত হলে দেশ নাপাক হয়। যে দেশে রক্তপাত হয়েছে রক্তপাতকারীর রক্ত ছাড়া আর কোনভাবেই সেই দেশের নাপাকী ঢাকা দেওয়া যায় না। তোমরা যে দেশে থাকবে আমিও সেখানে থাকব বলে সেই দেশ নাপাক করা চলবে না। আমি মাবুদ বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করি।” ইউসুফের বংশধরদের বংশ থেকে গিলিয়দের বিভিন্ন বংশের নেতারা এসে মূসা এবং বনি-ইসরাইলদের অন্যান্য বংশের নেতাদের সংগে কথা বললেন। গিলিয়দ ছিল মাখীরের ছেলে এবং মানশার নাতি। তাঁরা বললেন, “ইসরাইলীয়দের মধ্যে দেশের জায়গা-জমি গুলিবাঁট করে ঠিক করবার হুকুম দেবার সময় মাবুদ আমাদের মালিককে বলেছিলেন আমাদের ভাই সলফাদের সম্পত্তি যেন তার মেয়েদের দেওয়া হয়। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের অন্য গোষ্ঠীর লোকদের সংগে যদি এই মেয়েদের বিয়ে হয় তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি থেকে তাদের সম্পত্তি বের হয়ে গিয়ে যোগ হবে তাদের স্বামীদের গোষ্ঠীর সম্পত্তিতে, আর তাতে আমাদের গোষ্ঠীর সম্পত্তির ভাগ থেকে কিছু অংশ চলে যাবে। বনি-ইসরাইলদের ফিরে পাওয়ার বছরে তাদের সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত গিয়ে যোগ হবে তাদের স্বামীদের গোষ্ঠীর সম্পত্তিতে। এইভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের গোষ্ঠীর সম্পত্তি থেকে তাদের সম্পত্তি বের করে নেওয়া হবে।” তখন মাবুদের হুকুম মত মূসা বনি-ইসরাইলদের বললেন, “ইউসুফের ছেলেদের এই গোষ্ঠীর লোকেরা যা বলছে তা ঠিক। তাই সলফাদের মেয়েদের সম্বন্ধে মাবুদ এই হুকুম দিচ্ছেন যে, তারা প্রত্যেকে যাকে খুশী তাকে বিয়ে করতে পারে, তবে যাকে সে বিয়ে করবে তাকে তার পিতার গোষ্ঠীর লোক হতে হবে। বনি-ইসরাইলদের সম্পত্তি এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে যেতে পারবে না। প্রত্যেক ইসরাইলীয়কেই তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া গোষ্ঠীর সম্পত্তি ধরে রাখতে হবে। বনি-ইসরাইলদের প্রত্যেকে যাতে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তির মালিক থাকতে পারে সেইজন্য ইসরাইলীয় গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি মেয়ে-ওয়ারিশকে তার পিতার গোষ্ঠীর কাউকে বিয়ে করতে হবে। কোন সম্পত্তিই এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে চলে যেতে পারবে না। বনি-ইসরাইলদের প্রত্যেক গোষ্ঠীকেই তার পাওয়া সম্পত্তি ধরে রাখতে হবে।” ইউসুফের ছেলে মানশার বংশধরদের বংশের মধ্যেই তারা বিয়ে করল। তাতে তাদের সম্পত্তি তাদের পিতার বংশ ও গোষ্ঠীর মধ্যেই থেকে গেল। জেরিকোর উল্টাদিকে জর্ডান নদীর ধারে মোয়াবের সমভূমিতে মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের এই সব হুকুম ও নিয়ম দিয়েছিলেন। মূসা জর্ডান নদীর পূর্ব দিকের মরুভূমিতে, অর্থাৎ আরবাতে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে অনেক কথা বলেছিলেন। তিনি যেখানে সেই সব কথা বলেছিলেন সেই জায়গাটা ছিল সূফের সামনের দিকে। তার এক দিকে ছিল পারণ এবং অন্য দিকে ছিল তোফল, লাবন, হৎসেরোৎ ও দীষাহব। হোরেব থেকে সেয়ীর পাহাড়ের রাস্তা ধরে কাদেশ-বর্ণেয় পর্যন্ত যেতে এগারো দিন লাগে। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সম্বন্ধে মূসাকে যে সব নির্দেশ দিয়েছিলেন তা তিনি তাদের যাত্রার চল্লিশ বছরের এগারো মাসের পয়লা তারিখে তাদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনকে এবং ইদ্রিয়ী শহরে বাশন দেশের বাদশাহ্‌ উজকে হারিয়ে দেবার পরে তিনি তা প্রকাশ করেছিলেন। সীহোন রাজত্ব করতেন হিষ্‌বোনে এবং উজ রাজত্ব করতেন অষ্টারোতে। শরীয়তের এই সব কথা মূসা জর্ডান নদীর পূর্ব দিকে মোয়াব দেশে বনি-ইসরাইলদের বুঝিয়ে বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তুর পাহাড়ে আমাদের বলেছিলেন, ‘এই পাহাড়ে তোমাদের অনেক দিন কেটে গেছে। এখন তোমরা ছাউনি তুলে নিয়ে আমোরীয়দের পাহাড়ী এলাকা এবং তার আশেপাশের জায়গার লোকদের কাছে যাও। তারা আরবাতে, উঁচু পাহাড়ী এলাকায়, নীচের পাহাড়ী এলাকায়, নেগেভে এবং সাগরের কিনারায় বাস করে। এই জায়গাগুলো হল কেনানীয়দের দেশ সুদ্ধ লেবানন হয়ে মহানদী ফোরাত পর্যন্ত সম্পূর্ণ জায়গাটা। দেখ, আমি ঐ জায়গাগুলো তোমাদের দিয়ে রেখেছি। আমি মাবুদ তোমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের পরে তাদের বংশধরদের যে দেশ দেবার কসম খেয়েছিলাম তোমরা সেখানে গিয়ে সেই দেশ অধিকার কর।’ “সেই সময় আমি তোমাদের বলেছিলাম, ‘আমার একার পক্ষে তোমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের লোকসংখ্যা এত বাড়িয়ে দিয়েছেন যে, আজকে তোমরা আসমানের তারার মত অসংখ্য হয়ে উঠেছ। তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সংখ্যা আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে দিন এবং তাঁর ওয়াদা অনুসারেই তিনি তোমাদের দোয়া করুন। কিন্তু আমি একা কি করে তোমাদের সব ঝগড়া-বিবাদ মিটাবার ভার ও বোঝা বহন করব? তোমরা তোমাদের প্রত্যেকটা গোষ্ঠী থেকে কয়েকজন করে জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোক বেছে নাও; আমি তাদের উপর তোমাদের দেখাশোনার ভার দেব।’ “তোমরা তার জবাবে বলেছিলে, ‘আপনি যা বলছেন তা-ই করা ভাল।’ সেইজন্য আমি তোমাদের গোষ্ঠীগুলো থেকে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ সর্দারদের নিয়ে তোমাদের উপরে হাজারপতি, শতপতি, পঞ্চাশপতি, দশপতি এবং অন্যান্য কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলাম। এই সব বিচারকদের তখন আমি বলেছিলাম, ‘তোমরা ঝগড়া-বিবাদের সময়ে দু’পক্ষের কথা শুনে ন্যায়ভাবে বিচার করবে- সেই ঝগড়া ইসরাইলীয় ভাইদের মধ্যেই হোক কিংবা ইসরাইলীয় এবং ভিন্ন জাতির লোকদের মধ্যেই হোক। বিচারের ব্যাপারে তোমরা কারও পক্ষ নেবে না এবং বড়-ছোট সবার কথাই শুনবে। বিচারের কাজটা আসলে আল্লাহ্‌র; তাই কোন মানুষকে তোমরা ভয় করবে না। যদি কোন বিচার তোমাদের কাছে শক্ত বলে মনে হয় তবে তোমরা তা আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি সেই বিচার করব।’ তোমাদের যা করতে হবে তা-ও আমি তখন তোমাদের বলে দিয়েছিলাম। “এর পর আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুমে আমরা হোরেব পাহাড় ছেড়ে আমোরীয়দের পাহাড়ী এলাকার দিকে রওনা হলাম। কত বড় এবং কত ভয়ানক মরুভূমির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল তা তোমরা দেখেছ। এইভাবে আমরা কাদেশ-বর্ণেয়তে গিয়ে পৌঁছালাম। তারপর আমি তোমাদের বললাম, ‘তোমরা আমোরীয়দের পাহাড়ী এলাকাতে এসে গেছ; এটা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাদের দিতে যাচ্ছেন। দেখ, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া গোটা দেশটাই তোমাদের সামনে রয়েছে। তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথামত তোমরা গিয়ে দেশটা দখল কর। তোমরা ভয় কোরো না, নিরাশও হয়ো না।’ “তখন তোমরা সবাই এসে আমাকে বললে, ‘কয়েকজন লোককে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হোক, যাতে তারা দেশটা দেখে এসে আমাদের বলতে পারে কোন্‌ পথে আমাদের সেখানে যেতে হবে এবং কোন্‌ কোন্‌ শহর আমাদের সামনে পড়বে।’ “তোমাদের কথাটা আমার কাছে ভালই মনে হল। তাই আমি তোমাদের প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে একজন করে মোট বারোজন লোক বেছে নিলাম। তারা তোমাদের ছেড়ে ঐ পাহাড়ী এলাকায় উঠে গেল এবং ইষ্কোল উপত্যকায় গিয়ে ভাল করে সব কিছু দেখে আসল। তারা সেই দেশের কিছু ফল সংগে করে নিয়ে এসে আমাদের বলল, ‘আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা আমাদের দিতে যাচ্ছেন তা সত্যিই চমৎকার।’ “কিন্তু তোমরা সেই দেশে যেতে চাইলে না। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে। তোমরা নিজেদের তাম্বুর মধ্যে বক্‌বক্‌ করতে শুরু করলে এবং বললে, ‘মাবুদ আমাদের ঘৃণা করেন। সেইজন্য আমোরীয়দের হাতে তুলে দিয়ে ধ্বংস করে ফেলবার জন্যই তিনি আমাদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছেন। আমরা কি করে সেখানে যাই? আমাদের ভাইয়েরাই আমাদের মন ভেংগে দিয়েছে। তারা বলেছে, ওখানকার লোকগুলো তাদের চেয়ে শক্তিশালী ও লম্বা; তাদের শহরগুলোও বড় বড় এবং তাদের চারদিকে রয়েছে আকাশ-ছোঁয়া দেয়াল। সেখানে তারা অনাকীয়দেরও দেখেছে।’ “তা শুনে আমি তোমাদের বললাম, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, ঐ লোকদের ভয় কোরো না। তবুও তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা কর নি। তিনিই তো তাম্বু ফেলবার জায়গা ঠিক করবার জন্য এবং পথ দেখিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবার জন্য রাতে আগুনের মধ্যে ও দিনে মেঘের মধ্যে থেকে যাত্রাপথে তোমাদের আগে আগে গিয়েছিলেন। “তোমাদের দরুন মাবুদ আমার উপরও রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঐ দেশে তোমারও ঢোকা হবে না, কিন্তু তোমার সাহায্যকারী নূনের ছেলে ইউসা ঢুকবে। তুমি ইউসাকে উৎসাহ দাও, কারণ সে-ই দেশটা দখল করে বনি-ইসরাইলদের অধিকার হিসাবে দেবে। যে সব ছেলেমেয়েদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে বলে তোমরা বলেছিলে তোমাদের সেই সব ছেলেমেয়েরা, যাদের নেকী-বদীর জ্ঞান এখনও হয় নি, তারাই সেই দেশে ঢুকবে। আমি দেশটা তাদেরই দেব এবং তারা তা দখল করবে। এখন তোমরা পিছন ফিরে আকাবা উপসাগরের পথ ধরে মরুভূমির দিকে রওনা হয়ে যাও।’ “এই কথা শুনে তোমরা বলেছিলে, ‘আমরা মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। এখন আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম অনুসারে আমরা গিয়ে যুদ্ধ করব।’ এই বলে তোমরা সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিলে। তোমরা ভেবেছিলে পাহাড়ী এলাকায় উঠে যাওয়া খুব সহজ। “কিন্তু মাবুদ আমাকে বললেন, ‘তুমি তাদের বলে দাও যেন তারা যুদ্ধ করবার জন্য ওখানে উঠে না যায় কারণ আমি তাদের সংগে থাকব না; তাই তারা শত্রুদের কাছে হেরে যাবে।’ “আমি তোমাদের সেই কথা জানালাম কিন্তু তোমরা তাতে কান দিলে না। তোমরা মাবুদের হুকুমের বিরুদ্ধে গিয়ে বুক ফুলিয়ে পাহাড়ী এলাকায় উঠে গেলে। তা দেখে যে সব আমোরীয়রা ঐ পাহাড়ী এলাকায় বাস করত তারা তোমাদের বিরুদ্ধে বের হয়ে আসল। এক ঝাঁক মৌমাছির মত তারা তোমাদের তাড়া করল আর সেয়ীরের মধ্যে হর্মা পর্যন্ত তোমাদের মারতে মারতে নিয়ে গেল। তোমরা ফিরে এসে মাবুদের কাছে কাঁদতে লাগলে, কিন্তু তিনি তোমাদের কান্না শুনলেন না; তিনি কান বন্ধ করে রইলেন। এইভাবে তোমরা কাদেশে অনেক দিন রইলে এবং সেখানেই তোমাদের অনেক দিন কেটে গেল। “মাবুদ আমাকে যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন সেইভাবে আমরা তারপর পিছন ফিরে আকাবা উপসাগরের পথ ধরে মরুভূমির দিকে রওনা হলাম। সেয়ীরের পাহাড়ী এলাকা ঘুরে যেতে আমাদের অনেক দিন কেটে গেল। তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, ‘তোমরা অনেক দিন ধরে এই পাহাড়ী এলাকায় ঘুরছ; এইবার উত্তর দিকে ফের।’ তারপর তিনি আমাকে তোমাদের বলতে বললেন, ‘তোমাদের ভাই সেয়ীরের বাসিন্দা ইসের বংশধরদের রাজ্যের মধ্য দিয়ে এখন তোমাদের যেতে হবে। তোমাদের দেখে তারা ভয় পাবে কিন্তু তোমরা খুব সাবধান থেকো। তোমরা ইসের বংশধরদের যুদ্ধের উসকানি দেবে না, কারণ আমি তাদের দেশের কোন অংশই তোমাদের দেব না, এমন কি, পা রাখবার জায়গা পর্যন্ত না। আমি সেয়ীরের এই পাহাড়ী এলাকা ইস্‌কে তার নিজের দেশ হিসাবে দিয়েছি। তাদের কাছ থেকে খাবার ও পানি তোমাদের টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে।’ “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব কাজেই তোমাদের দোয়া করেছেন। এই মস্ত বড় মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাবার সময়ে তিনি তোমাদের দেখাশোনা করেছেন। এই চল্লিশটা বছর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সংগেই থেকেছেন আর তোমাদের কোন কিছুর অভাব হয় নি। “কাজেই আমরা আমাদের ভাই সেয়ীরের বাসিন্দা ইসের বংশধরদের ছেড়ে চলে আসলাম। আরবার যে পথটা এলৎ ও ইৎসিয়োন-গেবর থেকে বের হয়ে এসেছে সেই পথ ছেড়ে আমরা মোয়াবের মরুভূমির পথ ধরে চলতে লাগলাম। তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, ‘তোমরা মোয়াবীয়দের বিরক্ত কোরো না কিংবা যুদ্ধের উসকানি দিয়ো না, কারণ তাদের দেশের কোন অংশই আমি তোমাদের দেব না। আমি সম্পত্তি হিসাবে আর্‌ শহরটা লুতের বংশধরদের দিয়েছি।’ ” (আগে এমীয়রা ঐ এলাকায় বাস করত। এমীয় জাতির লোকেরা ছিল শক্তিশালী, সংখ্যায় অনেক এবং অনাকীয়দের মত লম্বা। অনাকীয়দের মত এমীয়দেরও রফায়ীয় বলা হত কিন্তু মোয়াবীয়রা তাদের বলত এমীয়। সেয়ীরে হোরীয়রা বাস করত, কিন্তু পরে ইসের বংশধরেরা তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মাবুদ সম্পত্তি হিসাবে বনি-ইসরাইলদের যে দেশ দিয়েছিলেন সেখানে তারা যা করেছিল ইসের বংশধরেরাও ঠিক তা-ই করল; তারা হোরীয়দের ধ্বংস করে দিয়ে তাদের জায়গায় নিজেরা বাস করতে লাগল।) “তারপর মাবুদ বললেন, ‘এখন তোমরা উঠে সেরদ উপত্যকা পার হয়ে যাও।’ আর আমরা সেটা পার হয়ে আসলাম। কাদেশ-বর্ণেয় ছেড়ে সেরদ উপত্যকা পার হয়ে আসতে আমাদের আটত্রিশ বছর কেটে গিয়েছিল। কাদেশ-বর্ণেয় ছেড়ে আসবার আগে ছাউনিতে যে সব সৈন্য ছিল তারা সবাই এই আটত্রিশ বছরের মধ্যে মাবুদের কসম খেয়ে বলা কথা অনুসারে মারা গিয়েছিল। ছাউনি থেকে তাদের একেবারে ধ্বংস করে ফেলবার জন্য মাবুদ তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন, যে পর্যন্ত না তারা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তোমরা যখন অম্মোনীয়দের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে তখন তাদের বিরক্ত করবে না বা যুদ্ধের উসকানি দেবে না, কারণ অম্মোনীয়দের দেশের কোন অংশই আমি তোমাদের দেব না। লুতের বংশধরদের আমি সেটা সম্পত্তি হিসাবে দিয়ে দিয়েছি।’ ” ঐ দেশটাকে রফায়ীদের দেশ বলেও মনে করা হত, কারণ সেখানে তারা আগে বাস করত; অম্মোনীয়রা তাদের সম্‌সুম্মীয় জাতির লোক বলত। রফায়ীয়রা শক্তিশালী এবং সংখ্যায় অনেক ছিল। তারা ছিল অনাকীয়দের মত লম্বা। মাবুদ অম্মোনীয়দের দিয়ে তাদের ধ্বংস করে ফেলেছিলেন; অম্মোনীয়রা রফায়ীয়দের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় বাস করছিল। মাবুদ ইসের বংশধরদের ব্যাপারেও সেই একই কাজ করেছিলেন। তিনি তাদের দিয়ে হোরীয়দের ধ্বংস করেছিলেন। তারা হোরীয়দের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জায়গা সেয়ীরে আজও বাস করছে। ক্রীট থেকে ক্রীটীয়রা এসে অব্বীয়দের ধ্বংস করে দিয়ে তাদের জায়গায় বাস করছিল। অব্বীয়রা তখন গাজা পর্যন্ত সমস্ত গ্রামে বাস করত। “তারপর মাবুদ বলেছিলেন, ‘তোমরা বের হয়ে পড় এবং অর্ণোন নদী পার হয়ে যাও। দেখ, আমি হিষ্‌বোনের আমোরীয় বাদশাহ্‌ সীহোন ও তার দেশ তোমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছি। তোমরা তার দেশটা দখল করতে শুরু করে তাকে যুদ্ধে নামতে বাধ্য কর। আজ থেকে আমি দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্যে তোমাদের সম্বন্ধে একটা ভয়ের ভাব ও কাঁপুনি ধরাতে শুরু করব। তারা তোমাদের কথা শুনলে কাঁপতে থাকবে এবং তোমাদের দরুন তাদের মনে ভীষণ দুশ্চিন্তা জাগবে।’ “এর পর আমি শান্তি বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে কদেমোৎ মরুভূমি থেকে হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোনের কাছে বলে পাঠালাম, ‘আপনার দেশের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে দিন। আমরা ডানে-বাঁয়ে না গিয়ে সদর রাস্তা ধরেই চলে যাব। কিন্তু হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোন তাতে রাজী হলেন না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর মন কঠিন করেছিলেন ও অন্তর একগুঁয়েমিতে ভরে দিয়েছিলেন যাতে তিনি তোমাদের হাতে পড়েন, আর এখন তা-ই ঘটেছে। “পরে মাবুদ আমাকে বললেন, ‘দেখ, সীহোন ও তার রাজ্য আমি তোমার হাতে তুলে দিতে শুরু করেছি। তুমি এখন গিয়ে তার দেশটা জয় করবার কাজে হাত দাও এবং সেখানে বাস করতে শুরু কর।’ সেই সময়ে আমরা তাঁর সমস্ত গ্রাম ও শহর দখল করে নিলাম এবং তাদের পুরুষ, স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের একেবারে ধ্বংস করে ফেললাম; তাদের কাউকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখি নি। কিন্তু পশুপাল এবং শহর থেকে লুট করা জিনিসপত্র আমরা নিজেদের জন্য নিয়ে আসলাম। অর্ণোন উপত্যকার কিনারায় অরোয়ের শহর এবং সেই উপত্যকার মধ্যেকার গ্রামটা থেকে শুরু করে গিলিয়দ পর্যন্ত এমন কোন শক্তিশালী গ্রাম বা শহর রইল না যা আমরা জয় করে নিতে পারি নি। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সেগুলো সবই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কেবল অম্মোনীয়দের জায়গা, যব্বোক নদীর কিনারার জায়গা, পাহাড়ের মধ্যেকার জায়গা এবং অন্যান্য যে সব জায়গায় যেতে তিনি নিষেধ করেছিলেন, সেই সব জায়গায় তোমরা যাও নি। “এর পর আমরা ঘুরে বাশন দেশের দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। আমাদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বাশনের বাদশাহ্‌ উজ তাঁর সমস্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বের হয়ে ইদ্রিয়ী শহরে আসলেন। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, ‘তুমি তাকে ভয় কোরো না, কারণ তাকে ও তার দেশ ও সৈন্য-সামন্ত আমি তোমার হাতে দিয়ে দিয়েছি। তুমি হিষ্‌বোনে বাসকারী আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের অবস্থা যা করেছিলে এর অবস্থাও তা-ই করবে।’ “এইভাবে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বাশনের বাদশাহ্‌ উজ ও তাঁর সমস্ত সৈন্য-সামন্তকে আমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তাদের সবাইকে হত্যা করেছিলাম; কাউকেই বাঁচিয়ে রাখি নি। সেই সময় আমরা তাঁর সব গ্রাম ও শহরগুলো নিয়ে নিয়েছিলাম। তাঁর ষাটটা শহরের সবগুলোই আমরা দখল করে নিয়েছিলাম; একটাও বাদ রাখি নি। গোটা অর্গোব এলাকাটা, অর্থাৎ বাশনের মধ্যে উজের গোটা রাজ্যটা আমরা দখল করে নিয়েছিলাম। এই সব শহরগুলো উঁচু উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল আর তাতে ছিল দরজা আর হুড়কা। অনেকগুলো দেয়াল ছাড়া গ্রামও সেখানে ছিল। আমরা সেই সব গ্রাম ও শহর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোনের প্রতি আমরা যেমন করেছিলাম তেমনি করে তাদের পুরুষ, স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়ে এবং প্রত্যেকটা গ্রাম ও শহর আমরা একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে সমস্ত পশুপাল এবং লুট করে আনা জিনিসপত্র আমরা নিজেদের জন্য নিয়ে এসেছিলাম। “সেই সময় আমরা অর্ণোন নদী থেকে হর্মোণ পাহাড় পর্যন্ত জর্ডান নদীর পূর্ব দিকের এলাকাটা এই দু’জন আমোরীয় বাদশাহ্‌র হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম। (সিডনীয়রা হর্মোণকে সিরিয়োণ বলে আর আমোরীয়রা বলে সনীর।) ঐ মালভূমির সমস্ত গ্রাম ও শহর, সব গিলিয়দ এলাকা এবং বাশনের বাদশাহ্‌ উজের রাজ্যের সল্‌খা ও ইদ্রিয়ী শহর পর্যন্ত গোটা বাশন দেশটা আমরা দখল করে নিয়েছিলাম। রফায়ীয়দের বাকী লোকদের মধ্যে কেবল বাশনের বাদশাহ্‌ উজই বেঁচে ছিলেন। তাঁর লোহার তৈরী শোবার খাটটা ছিল লম্বায় প্রমাণ হাতের নয় হাত আর চওড়ায় চার হাত। ওটা এখনও অম্মোনীয়দের রব্বা শহরে আছে। “আমাদের অধিকার করা জায়গা থেকে আমি তখন অর্ণোন নদীর কাছে অরোয়ের শহরের বাইরে উত্তর দিকের এলাকাটা এবং গিলিয়দের পাহাড়ী এলাকার অর্ধেক ও সেখানকার সব গ্রাম ও শহর রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের দিলাম। গিলিয়দ দেশের বাকী অংশ এবং বাদশাহ্‌ উজের গোটা বাশন রাজ্যটা আমি মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে দিলাম। “বাশনের মধ্যেকার সমস্ত অর্গোব এলাকাটাকে রফায়ীদের দেশ বলা হত। যায়ীর নামে মানশার এক বংশধর গশূরীয় ও মাখাথীয়দের সীমানা পর্যন্ত গোটা অর্গোব এলাকাটা দখল করে নিজের নাম অনুসারে তার নাম রেখেছিল। তাই এখন বাশনকে হব্বোৎ-যায়ীর বলা হয়ে থাকে। “আমি মাখীরকে গিলিয়দ এলাকাটা দিলাম। কিন্তু গিলিয়দ থেকে অর্ণোন উপত্যকার মাঝখানের সীমারেখাটা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা এবং সেখান থেকে অম্মোনীয়দের সীমানা যব্বোক নদী পর্যন্ত আমি রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের দিলাম। পশ্চিম দিকে তাদের শেষ সীমানা ছিল আরবার জর্ডান নদীর যে অংশটা গালীল সাগর থেকে পিস্‌গা পাহাড়শ্রেণীর ঢালু অংশের নীচে আরবার সমুদ্র, অর্থাৎ মরু-সাগর পর্যন্ত চলে গেছে সেই অংশটা। “তারপর আমি তাদের বললাম, ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই জায়গাটা তোমাদের দখল করবার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যাদের গায়ে জোর আছে সেই সব লোকদের যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে ইসরাইলীয় ভাইদের আগে আগে নদী পার হয়ে যেতে হবে। তবে তোমাদের যে সব গ্রাম ও শহর দেওয়া হল সেখানে তোমাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আর পশুপাল রেখে যেতে পারবে। আমি জানি তোমাদের পশু অনেক। মাবুদ যতদিন পর্যন্ত তোমাদের মত করে তোমাদের ভাইদেরও বিশ্রামের সুযোগ না দেন এবং জর্ডানের ওপারে যে দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের দিতে যাচ্ছেন তা তারা অধিকার না করে ততদিন পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ করে যেতে হবে। তার পরে এই যে জায়গা-জমি তোমাদের দেওয়া হল এখানে তোমরা ফিরে আসতে পারবে।’ “সেই সময় আমি ইউসাকে বললাম, ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই দু’জন বাদশাহ্‌র অবস্থা কি করেছেন তা তো তুমি নিজের চোখেই দেখেছ। তোমরা যেখানে যাচ্ছ সেখানকার সব রাজ্যগুলোর অবস্থাও মাবুদ তা-ই করবেন। তোমরা তাদের ভয় কোরো না; তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজে তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।’ “সেই সময় আমি মাবুদকে মিনতি করে বলেছিলাম, ‘হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি যে কত মহান এবং শক্তিশালী তা তোমার গোলামকে দেখাতে শুরু করেছ। বেহেশতে বা দুনিয়াতে কোন্‌ দেবতা আছে যে, তুমি যে সব কাজ করেছ তা করতে পারে এবং তুমি যে শক্তি দেখিয়েছ তা দেখাতে পারে? জর্ডান নদী পার হয়ে গিয়ে ঐ চমৎকার দেশটা, অর্থাৎ ঐ পাহাড়ী দেশটা আর লেবানন আমাকে দেখতে দাও।’ “কিন্তু তোমাদের দরুন মাবুদ আমার উপর বিরক্ত হওয়াতে আমার কথা তিনি শুনলেন না। তিনি বললেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। এই বিষয়ে আমাকে আর বোলো না। তুমি পিস্‌গার চূড়ায় উঠে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে চেয়ে দেখ। জর্ডান নদী পার হয়ে যখন তোমার যাওয়া হবে না তখন নিজের চোখে দেশটা একবার দেখে নাও। ইউসাকে কি করতে হবে তা তুমি তাকে বলে দাও; তাকে উৎসাহ ও সাহস দাও, কারণ সে-ই আগে আগে গিয়ে লোকদের পার করে নিয়ে যাবে এবং যে দেশটা তুমি দেখতে যাচ্ছ তা তাদের দিয়ে অধিকার করাবে।’ সেইজন্য আমরা বৈৎ-পিয়োরের উল্টা দিকের উপত্যকায় থেকে গেলাম। “বনি-ইসরাইলরা, আমি তোমাদের যে সব নিয়ম ও শরীয়ত শিক্ষা দিতে যাচ্ছি তা তোমরা এখন শোন। এগুলো তোমাদের মেনে চলতে হবে যাতে তোমরা বেঁচে থাক এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেখানে গিয়ে তা অধিকার করে নিতে পার। আমি তোমাদের যে হুকুম দিচ্ছি তার সংগে কিছু যোগ কোরো না এবং তা থেকে কিছু বাদও দিয়ো না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র যে সব হুকুম আমি তোমাদের দিচ্ছি তা তোমরা মেনে চলবে। “মাবুদ বাল-পিয়োরে যা করেছিলেন তা তো তোমরা নিজের চোখেই দেখেছ। তোমাদের মধ্যে যারা পিয়োরের বাল-দেবতার পূজা করেছিল তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের প্রত্যেককে তোমাদের মধ্য থেকে ধ্বংস করেছেন, কিন্তু তোমরা যারা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে আঁকড়ে ধরেছিলে, তোমরা সবাই এখনও বেঁচে আছ। “আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম মেনে আমি তোমাদের নিয়ম ও শরীয়ত শিক্ষা দিয়েছি, যাতে যে দেশ তোমরা অধিকার করতে যাচ্ছ সেই দেশে তা পালন করতে পার। তোমরা এই সব যত্নের সংগে পালন করবে। এগুলো পালন করবার মধ্য দিয়ে অন্যান্য জাতির লোকদের সামনে তোমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি প্রকাশ পাবে। তারা এই সব নিয়মের বিষয় শুনে বলবে, ‘জাতি হিসাবে এরা সত্যিই মহান এবং জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান।’ এমন আর কোন্‌ মহান জাতি আছে যাদের দেব-দেবী তাদের কাছে থাকে, যেমন করে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডাকলে তাঁকে কাছে পাওয়া যায়? এমন আর কোন্‌ মহান জাতি আছে যাদের নিয়ম ও শরীয়ত তোমাদের কাছে আজকে আমার দেওয়া নিয়ম-কানুনের মত ন্যায়ে ভরা? “যতদিন তোমরা বেঁচে থাকবে ততদিন তোমরা সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের উপর কড়া নজর রাখবে যাতে তোমরা চোখে যা দেখেছ তা ভুলে না যাও এবং তোমাদের অন্তর থেকে তা মুছে না যায়। এই সব তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের এবং তাদের পরে তাদের ছেলেমেয়েদের শিখাবে। তোমরা সেই দিনের কথা মনে কর যেদিন তোমরা তুর পাহাড়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত হয়েছিলে। সেই দিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার কথা শুনবার জন্য তুমি লোকদের আমার সামনে জমায়েত কর যাতে তারা এই দুনিয়াতে সারা জীবন আমাকেই ভয় করে চলতে শিখতে পারে আর তাদের ছেলেমেয়েদের আমার হুকুমের কথা শিক্ষা দিতে পারে।’ তখন তোমরা কাছে গিয়ে সেই পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলে; আর তখন অন্ধকারে ঘেরা পাহাড়টা মেঘ ও ঘন অন্ধকারে ভরা আকাশ পর্যন্ত জ্বলছিল। সেই সময় আগুনের মধ্য থেকে মাবুদ তোমাদের কাছে কথা বলেছিলেন। তোমরা তাঁর কথা শুনেছিলে কিন্তু কোন চেহারা দেখতে পাও নি, কেবল গলার আওয়াজই শুনেছিলে। তিনি তোমাদের কাছে তাঁর ব্যবস্থা, অর্থাৎ তাঁর দশটি বিশেষ হুকুম ঘোষণা করেছিলেন। তিনি সেই দশটি হুকুম তোমাদের মেনে চলতে বলেছিলেন এবং তা দু’টি পাথরের ফলকের উপর লিখে দিয়েছিলেন। জর্ডান নদী পার হয়ে যে দেশ তোমরা অধিকার করতে যাচ্ছ সেই দেশে গিয়ে তোমাদের যে নিয়ম ও শরীয়ত পালন করে চলতে হবে তা তোমাদের শিক্ষা দেবার জন্য সেই সময় মাবুদ আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। “তুর পাহাড়ে যেদিন মাবুদ আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কথা বলেছিলেন সেই দিন তোমরা কোন চেহারা দেখতে পাও নি। সেইজন্য তোমরা নিজেদের উপর খুব কড়া নজর রাখবে, যাতে তোমরা কুপথে গিয়ে পূজার উদ্দেশ্যে কোন মূর্তি খোদাই না কর কিংবা কোন চেহারার মূর্তি তৈরী না কর- তা পুরুষের বা স্ত্রীলোকেরই হোক, কিংবা মাটির উপরকার কোন জন্তুর বা আকাশে উড়ে বেড়ানো কোন পাখীরই হোক, কিংবা বুকে-হাঁটা কোন প্রাণীর বা পানির নীচের কোন মাছেরই হোক। আসমানের দিকে তাকিয়ে সূর্য, চাঁদ ও তারা, এক কথায় আসমানে সাজিয়ে রাখা সমস্ত আলোদানকারী জিনিসগুলো যখন তোমাদের চোখে পড়বে তখন দুনিয়ার সমস্ত জাতিকে দেওয়া তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এই সব জিনিসগুলোকে সেবা এবং পূজা করে তোমরা বিপথে চলে যেয়ো না। মনে রেখো, মাবুদ তোমাদের বেছে নিয়েছেন এবং লোহা গলানো হাপরের মত যে মিসর দেশ সেখান থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন যেন তোমরা তাঁরই বান্দা হতে পার, আর তোমরা এখন তা-ই হয়েছ। “তোমাদের দরুন মাবুদ আমার উপর রাগ করলেন। তিনি কসম খেয়ে বলেছিলেন যে, সম্পত্তি হিসাবে যে চমৎকার দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন, জর্ডান নদী পার হয়ে আমার সেখানে যাওয়া হবে না। আমি এখানেই মারা যাব, জর্ডান নদী পার হতে পারব না; কিন্তু তোমরা নদী পার হয়ে সেই চমৎকার দেশটা অধিকার করতে যাচ্ছ। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন, সাবধান, তা তোমরা ভুলে যেয়ো না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নিষেধ করা কোন কিছুর মূর্তি তৈরী করা তোমাদের চলবে না, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ হলেন সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া আগুন; তাঁর পাওনা এবাদত সম্বন্ধে তিনি খুব আগ্রহী। “তোমরা এবং তোমাদের বংশধরেরা সেই দেশে অনেক দিন বাস করবার পর যখন তোমরা কুপথে গিয়ে পূজার জন্য মূর্তি তৈরী করবে আর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা খারাপ তা করে তাঁকে অসন্তুষ্ট করে তুলবে, সেই সময়ের জন্য আমি আজকের এই দিনে আসমান ও জমীনকে তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী রেখে বলছি, তোমরা জর্ডান নদী পার হয়ে যে দেশ অধিকার করতে যাচ্ছ সেই দেশে তোমরা অল্প দিনেই শেষ হয়ে যাবে। তোমরা সেখানে বেশী দিন বাস করতে পারবে না, নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ নানা জাতির মধ্যে তোমাদের ছড়িয়ে দেবেন এবং যাদের মধ্যে তিনি তোমাদের তাড়িয়ে দেবেন তোমাদের খুব কম লোকই তাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে। সেখানে তোমরা মানুষের তৈরী কাঠের ও পাথরের দেবতার পূজা করবে যারা না পারে দেখতে, না পারে শুনতে, না পারে খেতে, না পারে গন্ধ নিতে। কিন্তু সেখান থেকে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে মন ফিরাবে এবং তাতে তোমরা তাঁর কাছ থেকে সাড়া পাবে, অবশ্য যখন তোমরা তোমাদের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তা করবে। যখন তোমরা কষ্টে পড়বে এবং এই সব তোমাদের উপর ঘটে যাবে তখন ভবিষ্যতের সেই দিনগুলোতে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে আসবে এবং তাঁর বাধ্য হয়ে চলবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ মেহেরবান; তিনি তোমাদের ছেড়ে যাবেন না বা ধ্বংস করবেন না, কিংবা কসম খেয়ে তোমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন তা ভুলে যাবেন না। “আল্লাহ্‌ দুনিয়াতে মানুষ সৃষ্টি করবার পর থেকে তোমাদের সময়কার অনেক আগের দিনগুলোতে তোমরা খুঁজে দেখ; আসমানের এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত খুঁজে দেখ যে, যা যা ঘটেছে তার মত মহান আর কিছু ঘটেছে কি না, কিংবা তার মত আর কোন কিছুর কথা শোনা গেছে কি না, কিংবা তোমাদের মত করে অন্য কোন জাতির লোক আগুনের মধ্য থেকে আল্লাহ্‌কে কথা বলতে শুনে বেঁচে আছে কি না। তোমরা খুঁজে দেখ যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের চোখের সামনে মিসর দেশে তোমাদের জন্য যা করেছিলেন কোন দেবতা কখনও সেইভাবে পরীক্ষা দ্বারা, কুদরতি ও চিহ্ন দ্বারা, যুদ্ধ দ্বারা, কঠোর ও শক্তিশালী হাত দ্বারা এবং মহান ও ভয় জাগানো কাজ দ্বারা কোন জাতিকে অন্য জাতির মধ্য থেকে নিজের জন্য বের করে এনেছে কি না। “তোমরা যাতে জানতে পার যে, আল্লাহ্‌ই মাবুদ এবং তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, সেইজন্যই এই সব তোমাদের দেখানো হয়েছিল। তোমাদের তাঁর শাসনের আওতায় আনবার জন্য তিনি বেহেশত থেকে তাঁর স্বর তোমাদের শুনতে দিয়েছিলেন আর দুনিয়াতে দেখিয়েছিলেন তাঁর মহান আগুন, আর সেই আগুনের মধ্য থেকে তোমরা তাঁর কথা শুনতে পেয়েছিলে। তিনি তোমাদের পূর্বপুরুষদের মহব্বত করতেন এবং তাঁদের পরে তাঁদের বংশধরদের বেছে নিয়েছেন। সেইজন্য তিনি নিজে উপস্থিত থেকে তাঁর মহাশক্তি দ্বারা মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন। তিনি তা করেছেন যাতে তোমাদের চেয়েও বড় এবং শক্তিশালী জাতিগুলোকে তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের দেশে তোমাদের নিয়ে যেতে পারেন এবং সম্পত্তি হিসাবে তা তোমাদের দিতে পারেন; আর আজ তা-ই হয়েছে। “আজকে তোমরা এই কথাটা জেনে রাখ এবং অন্তরে গেঁথে রাখ যে, আল্লাহ্‌ই উপরে আসমানের এবং নীচে দুনিয়ার মাবুদ, আর তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমাদের ও তোমাদের পরে তোমাদের সন্তানদের যেন উন্নতি হয় এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ চিরকালের জন্য তোমাদের দিচ্ছেন তাতে যেন তোমরা অনেকদিন বেঁচে থাকতে পার সেইজন্য আমি যে সব শরীয়ত ও হুকুম আজ তোমাদের দিচ্ছি তা তোমরা মেনে চলবে।” তাঁরা সীহোনের ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজের দেশ অধিকার করে নিয়েছিলেন। এই দুই আমোরীয় বাদশাহ্‌র রাজ্য দু’টি ছিল জর্ডানের পূর্ব দিকে। অর্ণোন উপত্যকার কিনারার অরোয়ের শহর থেকে সীওন পাহাড়, অর্থাৎ হর্মোণ পাহাড় পর্যন্ত ছিল এই দুই রাজ্য। তার মধ্যে রয়েছে জর্ডানের পূর্ব দিকের গোটা আরবা এলাকাটা। এটা পিস্‌গা পাহাড়শ্রেণীর ঢালু অংশের নীচে আরবার সাগর পর্যন্ত চলে গেছে। মূসা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের ডেকে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা, আজ আমি তোমাদের কাছে যে সব নিয়ম ও নির্দেশ প্রকাশ করছি তোমরা তা শোন। তোমরা সেগুলো শিখে রাখবে এবং তা যত্নের সংগে পালন করবে। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তুর পাহাড়ে আমাদের জন্য একটি ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন। সেই ব্যবস্থা তিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে দেন নি, দিয়েছেন আমাদের কাছে, আজ আমরা যারা এখানে বেঁচে রয়েছি আমাদের সকলের কাছে। মাবুদ সেই পাহাড়ের উপরে আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের সামনেই কথা বলেছিলেন। সেই সময় আগুনের ভয়ে তোমরা পাহাড়ের উপর ওঠো নি বলে আমি তোমাদের ও মাবুদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা তোমাদের কাছে প্রকাশ করেছিলাম। তখন মাবুদ বলেছিলেন, ‘আমি আল্লাহ্‌ তোমাদের মাবুদ। মিসর দেশের গোলামী থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি। ‘আমার জায়গায় কোন দেব-দেবী দাঁড় করাবে না। ‘পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোন মূর্তি তৈরী করবে না, তা আসমানের কোন কিছুর মত হোক বা মাটির উপরকার কোন কিছুর মত হোক কিংবা পানির মধ্যেকার কোন কিছুর মত হোক। তোমরা তাদের পূজাও করবে না, তাদের সেবাও করবে না, কারণ কেবলমাত্র আমি আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ। আমার পাওনা এবাদত আমি চাই। যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের গুনাহের শাস্তি আমি তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকি। কিন্তু যারা আমাকে মহব্বত করে এবং আমার হুকুম পালন করে হাজার হাজার পুরুষ পর্যন্ত তাদের প্রতি আমার অটল মহব্বত থাকবে। ‘কোন বাজে উদ্দেশ্যে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নাম নেবে না। যে তা করবে তাকে মাবুদ শাস্তি দেবেন। ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাকে যেমন হুকুম দিয়েছেন তেমনি করে তোমরা বিশ্রামবার পবিত্র করে রাখবে এবং তা পালন করবে। সপ্তার ছয় দিন তোমরা পরিশ্রম করবে এবং তোমাদের সমস্ত কাজ করবে, কিন্তু সপ্তম দিনটি হল তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে বিশ্রামের দিন। সেই দিন তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়ে, তোমাদের গোলাম ও বাঁদী, তোমাদের গরু ও গাধা কিংবা অন্য কোন পশু কিংবা তোমাদের গ্রাম ও শহরে বাস করা অন্য জাতির লোক- কারও কোন কাজ করা চলবে না। এতে তোমাদের গোলাম ও বাঁদীও তোমাদের মত বিশ্রাম পাবে। মনে রেখো, তোমরাও মিসর দেশে গোলামই ছিলে এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর কঠোর এবং শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে সেখান থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন। সেইজন্যই তিনি বিশ্রামবার পালন করবার হুকুম তোমাদের দিয়েছেন। ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম মেনে তোমরা তোমাদের পিতা-মাতাকে সম্মান করে চলবে। তাতে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া দেশে তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকবে এবং তোমাদের উন্নতি হবে। ‘খুন কোরো না। ‘জেনা কোরো না। ‘চুরি কোরো না। ‘কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না। ‘অন্যের স্ত্রীর উপর লোভ কোরো না। অন্যের ঘর-দুয়ার, জমা-জমি, গোলাম ও বাঁদী, গরু-গাধা কিংবা আর কিছুর উপর লোভ কোরো না।’ “সেই পাহাড়ের উপর আগুন, মেঘ ও গাঢ় অন্ধকারের মধ্য থেকে মাবুদ এই হুকুমগুলোই তোমাদের সকলের কাছে জোরে ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া তিনি তোমাদের কাছে আর কিছু বলেন নি। পরে তিনি সেগুলো দু’টি পাথরের ফলকের উপর লিখে আমার কাছে দিয়েছিলেন। “সেই দিন যখন পাহাড়টা জ্বলছিল আর অন্ধকারের মধ্য থেকে তোমরা তাঁর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলে তখন তোমাদের সব গোষ্ঠী-সর্দারেরা আর বৃদ্ধ নেতারা আমার কাছে উঠে এসেছিলেন। তোমরা তখন বলেছিলে, ‘আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে কত গৌরবময় ও মহান তা তিনি আমাদের দেখিয়েছেন আর আগুনের মধ্য থেকে আমরা তাঁর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। আজকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ্‌ কারও কাছে কথা বলবার পরেও সে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু এর পর আমরা মারা পড়তে যাব কেন? এই মহান আগুন তো আমাদের পুড়িয়ে ফেলবে; আর বেশীক্ষণ যদি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র গলার আওয়াজ শুনতে পাই তবে আমরা মারা পড়বই। মানুষের মধ্যে এমন কে আছে যে, আমাদের মত করে আগুনের মধ্য থেকে জীবন্ত আল্লাহ্‌র গলার আওয়াজ শুনবার পরেও বেঁচে আছে? আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যা বলেছেন, আপনিই কাছে গিয়ে তা শুনে আসুন। তিনি আপনাকে যা বলবেন তা আমাদের জানিয়ে দেবেন; আমরা তা শুনে সেইমতই চলব।’ “আমার সংগে যখন তোমরা কথা বলছিলে তখন মাবুদ তোমাদের কথা শুনেছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন, ‘এই লোকেরা তোমাকে যা বলেছে তা আমি শুনেছি। তারা যা বলেছে তা ভালই। আমাকে ভয় করবার এবং আমার হুকুম পালন করে চলবার এই মনোভাব যেন তাদের সব সময় থাকে। তাতে তাদের ও তাদের সন্তানদের চিরস্থায়ী উন্নতি হবে। “‘তুমি তাদের তাম্বুতে ফিরে যেতে বল, কিন্তু তুমি এখানে আমার কাছে থাক। আমি তোমাকে সেই সমস্ত হুকুম, আইন ও নিয়ম দেব যা তোমাকে তাদের শিখাতে হবে, যেন অধিকার করবার জন্য যে দেশ আমি তাদের দিতে যাচ্ছি সেখানে তারা সেগুলো পালন করে চলে।’ “কাজেই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যা করবার হুকুম দিয়েছেন তা তোমাদের যত্নের সংগে পালন করতে হবে; তা থেকে একটুও এদিক-সেদিক হওয়া চলবে না। যাতে তোমরা বাঁচতে পার এবং তোমাদের উন্নতি হয় আর যে দেশ তোমরা অধিকার করবে সেখানে অনেক দিন বেঁচে থাকতে পার সেইজন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে যে পথে তোমাদের চলবার হুকুম দিয়েছেন তোমরা সেই সব পথেই চলবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ তোমাদের শিক্ষা দেবার জন্য আমাকে হুকুম দিয়েছেন, যেন জর্ডান নদী পার হয়ে যে দেশ তোমরা অধিকার করতে যাচ্ছ সেখানে তোমরা তা পালন করে চল। এতে তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েরা ও তাদের বংশধরেরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করে তাঁর দেওয়া এই সব নিয়ম ও হুকুম সারা জীবন পালন করবে এবং তার ফলে অনেক দিন বেঁচে থাকবে। বনি-ইসরাইলরা, তোমরা আমার কথা শোন এবং সতর্ক হয়ে এই সব মেনে চল, যাতে দুধ আর মধুতে ভরা সেই দেশে যাবার পরে তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তোমাদের উন্নতি হয় আর তোমরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠতে পার। “বনি-ইসরাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে। এই সব হুকুম যা আজ আমি তোমাদের দিচ্ছি তা যেন তোমাদের অন্তরে থাকে। তোমাদের ছেলেমেয়েদের তোমরা বার বার করে সেগুলো শিখাবে। ঘরে বসে থাকবার সময়, পথে চলবার সময়, শোবার সময় এবং বিছানা থেকে উঠবার সময় তোমরা এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। তোমরা তা মনে রাখবার চিহ্ন হিসাবে তোমাদের হাতে বেঁধে রাখবে এবং কপালে লাগিয়ে রাখবে। তোমাদের বাড়ীর দরজায় ও চৌকাঠে তোমরা সেগুলো লিখে রাখবে। “তোমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে দেশ দেবার কথা কসম খেয়ে বলেছিলেন সেখানে তিনি তোমাদের নিয়ে যাবেন। সেখানে রয়েছে এমন সব সুন্দর ও বড় বড় শহর যা তোমরা নিজেরা তৈরী কর নি, “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তোমরা ভয় করবে, কেবল তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর নামেই কসম খাবে। তোমাদের আশেপাশে যে সব জাতি থাকবে তোমরা তাদের দেব-দেবীদের পিছনে যাবে না, কারণ তোমাদের মধ্যে তোমাদের যে মাবুদ আল্লাহ্‌ রয়েছেন তিনি তাঁর পাওনা এবাদত সম্বন্ধে খুব আগ্রহী; দেব-দেবীদের পিছনে গেলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাঁর রাগের আগুন জ্বলে উঠবে, আর তিনি দুনিয়ার উপর থেকে তোমাদের ধ্বংস করে ফেলবেন। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করতে যেয়ো না, যেমন তোমরা মঃসাতে করেছিলে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে সব হুকুম, সাবধানের কথা আর নিয়ম দিয়েছিলেন তা অবশ্যই তোমাদের পালন করতে হবে। “ভবিষ্যতে যখন তোমাদের ছেলেরা তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে, ‘আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই যে সব সাবধানের কথা, নিয়ম ও নির্দেশ তোমাদের দিয়েছেন সেই সবের মানে কি?’ তখন তোমরা তাদের বলবে, ‘মিসর দেশে আমরা ফেরাউনের গোলাম ছিলাম, কিন্তু মাবুদ শক্তিশালী হাত ব্যবহার করে সেখান থেকে আমাদের বের করে এনেছেন। মাবুদ আমাদের চোখের সামনে ফেরাউন ও তাঁর বাড়ীর সকলের উপর এবং মিসর দেশের উপর বড় বড় এবং ভয়ংকর অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে তিনি আমাদের বের করে এনেছিলেন যাতে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে দেশ দেবার কসম তিনি খেয়েছিলেন সেই দেশে নিয়ে গিয়ে আমাদের তা দিতে পারেন। আজকের মত যেন সব সময় আমাদের উন্নতি হয় আর আমরা বেঁচে থাকতে পারি সেইজন্য মাবুদ আমাদের এই সব নিয়ম পালন করতে এবং আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করতে হুকুম দিয়েছেন। আমরা যদি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তাঁর হুকুম মত এই শরীয়ত মেনে চলবার দিকে মন দিই, তবে সেটাই হবে আমাদের পক্ষে তাঁর ইচ্ছামত চলা।’ “তোমরা যে দেশ অধিকার করবার জন্য যাচ্ছ সেখানে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তোমাদের নিয়ে যাবেন এবং অনেক জাতিকে তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেবেন। এই জাতিগুলো হল হিট্টীয়, গির্গাষীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়। এই সাতটি জাতিই লোকসংখ্যায় এবং শক্তিতে তোমাদের চেয়ে বড়। তিনি যখন তাদের তোমাদের হাতের মুঠোয় এনে দেবেন এবং তোমরা তাদের হারিয়ে দেবে তখন তোমরা তাদের একেবারে ধ্বংস করে ফেলবে। তোমরা তাদের সংগে কোন সন্ধি করবে না এবং তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাবে না। তোমরা তাদের সংগে কোন বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করবে না। তোমাদের মেয়েদেরও তোমরা তাদের ছেলেদের হাতে দেবে না এবং তাদের মেয়েদেরও তোমরা তোমাদের ছেলেদের জন্য আনবে না, কারণ সেই মেয়েরা তোমাদের ছেলেদের আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে এবং দেব-দেবীর পূজা করাবে। তাতে মাবুদের রাগের আগুন তোমাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবে এবং সংগে সংগে তোমাদের ধ্বংস করে ফেলবে। তোমরা ঐ সব জাতির বেদীগুলো ভেংগে ফেলবে, পূজার পাথরগুলো চুরমার করে দেবে, পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেলবে এবং মূর্তিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেবে। তোমরা এমন একটি জাতি যাকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখা হয়েছে। তোমরা যেন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নিজের বান্দা ও সম্পত্তি হও সেইজন্য দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্য থেকে তিনি তোমাদের বেছে নিয়েছেন। “অন্য জাতির চেয়ে তোমাদের লোকসংখ্যা বেশী মনে করে যে মাবুদ তোমাদের সংগে নিজেকে মহব্বতের বাঁধনে বেঁধেছেন কিংবা তোমাদের বেছে নিয়েছেন তা নয়, কারণ অন্য সব জাতির চেয়ে তোমাদের লোকসংখ্যা কম। তিনি তা করেছেন তোমাদের প্রতি তাঁর অটল মহব্বতের জন্য এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে তিনি যে কসম খেয়েছিলেন তা রক্ষা করবার জন্য। সেইজন্যই তিনি শক্তিশালী হাত ব্যবহার করে তোমাদের বের করে এনেছেন এবং মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের হাত থেকে আর গোলামীর দেশ থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন। কাজেই তোমরা জেনে রেখো যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই মাবুদ। তিনি বিশ্বস্ত; যারা তাঁকে মহব্বত করে ও তাঁর হুকুমগুলো পালন করে তাদের জন্য তিনি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন তা তিনি হাজার হাজার পুরুষ পর্যন্ত রক্ষা করেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অটল মহব্বত দেখান। কিন্তু যারা তাঁকে মহব্বত করে না তাদের ধ্বংস করে তিনি তার শোধ দেন; আর তা করতে তিনি দেরি করেন না। কাজেই আজ আমি তোমাদের যে সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ দিচ্ছি তা তোমরা যত্নের সংগে পালন করবে। “যদি তোমরা এই সব নিয়মের দিকে মনোযোগ দাও এবং তা যত্নের সংগে পালন কর, তবে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে কসম খেয়েছিলেন সেই অনুসারে তোমাদের জন্য তিনি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন তা তিনি রক্ষা করবেন এবং তোমাদের প্রতি অটল মহব্বত দেখাবেন। তিনি তোমাদের মহব্বত করবেন, দোয়া করবেন এবং তোমাদের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন। যে দেশ তোমাদের দেবার কথা তিনি তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়ে বলেছিলেন সেই দেশে তিনি তোমাদের দোয়া করবেন। তাতে তোমাদের অনেক সন্তান হবে, তোমাদের জমি থেকে তোমরা প্রচুর পরিমাণে শস্য, আংগুর-রস ও তেল পাবে, আর তোমাদের গরু, ছাগল ও ভেড়ারও অনেক বাচ্চা হবে। অন্য সব লোকদের চেয়ে তোমরা বেশী দোয়া পাবে। তোমাদের কেউই সন্তানহীন থাকবে না এবং তোমাদের পালের কোন পশুই বাচ্চাহীন থাকবে না। মাবুদ সব রোগ থেকে তোমাদের মুক্ত রাখবেন। মিসরে যে সব ভীষণ রোগ তোমরা দেখেছ তা তিনি তোমাদের উপর হতে দেবেন না, কিন্তু যারা তোমাদের ঘৃণা করে তাদের উপর সেই সব হতে দেবেন। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের হাতের মুঠোয় যে সব জাতি এনে দেবেন তাদের সবাইকে তোমাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে। তাদের তোমরা দয়া দেখাবে না এবং তাদের দেবতাদেরও পূজা করবে না, কারণ তা তোমাদের পক্ষে ফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে। “তোমরা মনে মনে বলতে পার, ‘এই সব জাতির লোকেরা আমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী; আমরা কেমন করে তাদের তাড়িয়ে বের করে দেব?’ কিন্তু তোমরা তাদের ভয় কোরো না। ফেরাউন ও সারা মিসর দেশের উপর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ কি করেছিলেন তা ভুলে যেয়ো না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে সব ভীষণ পরীক্ষা দ্বারা, কুদরতি ও অলৌকিক চিহ্ন দ্বারা এবং তাঁর কঠোর এবং শক্তিশালী হাত দ্বারা তোমাদের বের করে এনেছেন তা তো তোমরা নিজেদের চোখেই দেখেছ। তোমরা এখন যে সব জাতিদের দেখে ভয় পাচ্ছ তাদের উপরও তিনি তা-ই করবেন। এর পরেও তাদের মধ্যে যারা বেঁচে যাবে এবং তোমাদের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখবে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের মধ্যে ভিমরুল পাঠিয়ে দেবেন আর তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা তাদের ভয় কোরো না, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যিনি তোমাদের মধ্যে আছেন, তিনি ভয় জাগানো আল্লাহ্‌তা’লা। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তোমাদের সামনে থেকে ঐ সব জাতিকে আস্তে আস্তে তাড়িয়ে দেবেন। তাদের সবাইকে তোমরা একসংগে তাড়িয়ে দেবে না, কারণ তাহলে তোমাদের চারপাশে বুনো জানোয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ ভীষণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে তোমাদের হাতে তাদের তুলে দেবেন যতক্ষণ না তারা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের বাদশাহ্‌দের তিনি তোমাদের হাতে তুলে দেবেন আর তোমরা তাদের নাম দুনিয়া থেকে মুছে ফেলবে। কেউ তোমাদের বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না; তোমরা তাদের ধ্বংস করে ফেলবে। তাদের দেব-দেবীর মূর্তিগুলো তোমরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। তোমরা তাদের গায়ের সোনা-রূপার লোভ করবে না। নিজেদের জন্য তোমরা তা নেবে না, কারণ তা করলে তোমরা ওগুলোর ফাঁদে পড়বে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ওগুলো ঘৃণার জিনিস। কোন ঘৃণার জিনিস তোমাদের ঘরে আনবে না। ওগুলো তোমরা মনেপ্রাণে ঘৃণা ও তুচ্ছ করবে, কারণ ওগুলোর উপর রয়েছে ধ্বংসের বদদোয়া। ওগুলো যদি তোমরা ঘরে আন তবে তোমাদের উপরও ধ্বংসের বদদোয়া নেমে আসবে। “আজ আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিচ্ছি তার প্রত্যেকটা পালন করবার দিকে তোমরা মন দাও, যাতে তোমরা বেঁচে থাক ও সংখ্যায় বেড়ে ওঠো আর মাবুদ তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে দেশ দেবার কথা কসম খেয়ে ওয়াদা করেছিলেন সেখানে ঢুকে তা অধিকার করতে পার। মনে করে দেখ, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই চল্লিশটা বছর কিভাবে মরুভূমির মধ্য দিয়ে সারাটা পথ তোমাদের চালিয়ে এনেছেন। তোমাদের অহংকার ভেংগে দেবার জন্য এবং তোমাদের মনে কি আছে, অর্থাৎ তোমরা তাঁর হুকুম পালন করবে কি না, তা পরীক্ষায় ফেলে দেখাবার জন্য তিনি এই কাজ করেছেন। ক্ষুধায় কষ্ট দিয়ে এবং যে মান্নার কথা তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের জানা ছিল না তা খাইয়ে তিনি তোমাদের অহংকার ভেংগে দিয়েছেন। এতে তিনি তোমাদের এই শিক্ষা দিতে চেয়েছেন যে, মানুষ কেবল রুটিতেই বাঁচে না, কিন্তু মাবুদের মুখের প্রত্যেকটি কথাতেই বাঁচে। এই চল্লিশ বছর তোমাদের গায়ের কাপড় নষ্ট হয় নি এবং পা-ও ফুলে যায় নি। এই কথা তোমাদের দিলে জেনে রেখো যে, বাবা যেমন ছেলেকে শাসন করেন ঠিক সেইভাবে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের শাসন করেন। “তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করবে, তাঁর পথে চলবে এবং তাঁকে ভয় করবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে চমৎকার দেশটিতে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে রয়েছে পাহাড় ও উপত্যকা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, ঝর্ণা আর মাটির তলার পানি। সেখানে রয়েছে প্রচুর গম ও যব, আংগুর ও ডুমুর গাছ এবং ডালিম, জলপাইয়ের তেল আর মধু। সেই দেশে তোমরা পাবে প্রচুর খাবার এবং কোন কিছুরই অভাব তোমাদের থাকবে না। সেখানকার পাথরে রয়েছে লোহা। সেখানকার পাহাড় থেকে তোমরা তামা খুঁড়ে তুলতে পারবে। “তোমরা সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে তৃপ্ত হবার পর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া ঐ চমৎকার দেশটির জন্য তাঁর প্রশংসা করবে। তোমরা সতর্ক থাকবে যেন আজ আমি তাঁর যে সব হুকুম, নির্দেশ ও নিয়ম তোমাদের দিচ্ছি তা অমান্য করে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভুলে না যাও। যদি তোমরা সতর্ক না থাক, তবে তোমরা যখন খাওয়া-দাওয়া করে তৃপ্ত হবে আর সুন্দর সুন্দর বাড়ী-ঘর তৈরী করে সেখানে বাস করতে থাকবে, যখন তোমাদের পালের গরু-ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা বেড়ে যাবে আর তোমাদের অনেক সোনা-রূপা হবে এবং তোমাদের সব কিছু বেড়ে যাবে, তখন তোমরা অহংকারী হয়ে উঠবে এবং যিনি মিসর দেশের গোলামী থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন তোমাদের সেই মাবুদ আল্লাহ্‌কে তোমরা ভুলে যাবে। তিনি তোমাদের এক বিরাট, ভয়ংকর, শুকনা, পানিহীন এবং বিষাক্ত সাপ ও কাঁকড়া-বিছায় ভরা মরুভূমির মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি শক্ত পাথরের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য পানি বের করেছেন। তিনি সেই মরুভূমিতে তোমাদের মান্না খেতে দিয়েছেন যার কথা তোমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনও জানেন নি। তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্য ও অহংকার ভেংগে দেবার জন্য তিনি তা দিয়েছিলেন যাতে শেষ পর্যন্ত তোমাদের উন্নতি হয়। তোমরা হয়তো কেউ মনে মনে বলতে পার, ‘আমার নিজের শক্তিতে, নিজের হাতে কাজ করে আমি এই সব ধন-সম্পত্তি করেছি।’ কিন্তু তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা ভুলে যেয়ো না; তিনিই এই সব করবার ক্ষমতা তোমাদের দিয়েছেন, আর এইভাবে তিনি তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে ব্যবস্থার কথা কসম খেয়ে বলেছিলেন তা তিনি এখন পূর্ণ করে চলেছেন। “যদি তোমরা কখনও তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভুলে গিয়ে দেব-দেবীদের পিছনে যাও এবং তাদের সেবা ও পূজা কর, তবে আজ আমি তোমাদের বিরুদ্ধে এই কথা নিশ্চয় করে বলছি যে, তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ তোমাদের সামনে যে সব জাতিকে ধ্বংস করছেন তাদের মত তোমরাও তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র অবাধ্য হওয়ার দরুন ধ্বংস হয়ে যাবে। “বনি-ইসরাইলরা, শোন। যে সব জাতি তোমাদের চেয়ে লোকসংখ্যায় এবং শক্তিতে বড় তোমরা এখন গিয়ে তাদের আকাশ ছোঁয়া দেয়াল দিয়ে ঘেরা বড় বড় শহরগুলো দখল করবার জন্য জর্ডান নদী পার হতে যাচ্ছ। সেখানকার লোকেরা অনাকীয়; তারা লম্বা ও শক্তিশালী। তোমরা অনাকীয়দের বিষয়ে জান; তাদের সম্বন্ধে তোমরা এই কথা বলতে শুনেছ, ‘অনাকীয়দের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এমন লোক কোথায়?’ কিন্তু তোমরা এই কথা জেনে রেখো যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই ধ্বংসকারী আগুনের মত তোমাদের আগে আগে জর্ডান নদী পার হয়ে যাচ্ছেন। তিনি তাদের ধ্বংস করে দেবেন; তিনিই তোমাদের কাছে তাদের হার মানাবেন। তোমাদের কাছে মাবুদ যে আশ্বাস দিয়েছেন সেই অনুসারে তোমরা তাদের তাড়িয়ে দেবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের শেষ করে ফেলবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সামনে থেকে তাদের তাড়িয়ে দেবার পর তোমাদের কেউ যেন মনে মনে না বলে, ‘আমি ধার্মিক বলেই মাবুদ এই দেশ অধিকার করবার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।’ আসলে তা নয়; এই সব জাতির লোকদের খারাপীর জন্যই মাবুদ তোমাদের সামনে থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে যাচ্ছেন। ধার্মিক কিংবা সৎ বলেই যে তোমরা তাদের দেশ অধিকার করতে যাচ্ছ তা নয়, বরং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে যে কথা ওয়াদা করে বলেছিলেন তা পূরণ করবার জন্যই তিনি এই সব জাতির খারাপীর দরুন তোমাদের সামনে থেকে তাদের তাড়িয়ে দেবেন। কাজেই তোমরা জেনে রেখো, তোমরা ধার্মিক বলেই যে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই চমৎকার দেশটা তোমাদের অধিকার করতে দিচ্ছেন তা নয়। তোমরা তো একটা একগুঁয়ে জাতি। “তোমরা মরুভূমিতে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র রাগ কিভাবে জাগিয়ে তুলেছিলে তা মনে রেখো, কখনও ভুলে যেয়ো না। মিসর দেশ ছেড়ে আসবার দিন থেকে শুরু করে এখানে পৌঁছানো পর্যন্ত তোমরা মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ভাব মনে পুষে আসছ। তোমরা তুর পাহাড়ে এমন ভাবে মাবুদের রাগ জাগিয়ে তুলেছিলে যে, তার দরুন তিনি তোমাদের ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিলেন। মাবুদ যে ব্যবস্থা তোমাদের জন্য স্থাপন করেছেন সেই ব্যবস্থা লেখা পাথরের ফলক দু’টা গ্রহণ করবার জন্য আমি পাহাড়ের উপর উঠে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত সেখানেই ছিলাম। তখন আমি পানি বা রুটি কিছুই খাই নি। মাবুদের নিজের লেখা রয়েছে এমন দু’টা পাথরের ফলক মাবুদ আমাকে দিয়েছিলেন। তোমরা সবাই যেদিন মাবুদের সামনে জমায়েত হয়েছিলে সেই দিন তিনি পাহাড়ের উপরে আগুনের মধ্য থেকে যে সব হুকুম তোমাদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন সেগুলো ঐ ফলক দু’টার উপর লেখা ছিল। “সেই চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত কেটে যাওয়ার পর মাবুদ ঐ ব্যবস্থা লেখা পাথরের ফলক দু’টা আমাকে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আর দেরি না করে এখনই নীচে নেমে যাও, কারণ যে লোকদের তুমি মিসর থেকে বের করে এনেছ তারা কুপথে গেছে। যে পথে চলবার হুকুম আমি দিয়েছিলাম এর মধ্যেই তারা তা থেকে দূরে সরে গেছে এবং পূজার জন্য ছাঁচে ফেলে একটা মূর্তি তৈরী করে নিয়েছে।’ “মাবুদ আমাকে আরও বললেন, ‘আমি এই লোকগুলোকে দেখেছি; এরা একটা একগুঁয়ে জাতি। না, তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না; আমি তাদের ধ্বংস করে ফেলব এবং দুনিয়া থেকে তাদের নাম মুছে ফেলব। তারপর তোমার মধ্য দিয়ে আমি আরও শক্তিশালী এবং আরও বড় একটা জাতির সৃষ্টি করব।’ “এর পর আমি পাহাড় থেকে নেমে আসলাম; তখনও পাহাড়ে আগুন জ্বলছিল, আর আমার হাতে ছিল ব্যবস্থা লেখা সেই ফলক দু’টা। আমি চেয়ে দেখলাম, তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছ; পূজার জন্য তোমরা ছাঁচে ফেলে একটা বাছুরের মূর্তি তৈরী করে নিয়েছ। মাবুদ তোমাদের যে পথে চলবার হুকুম দিয়েছিলেন তোমরা ঐটুকু সময়ের মধ্যেই সেই পথ থেকে সরে গেছ। কাজেই আমি সেই পাথরের ফলক দু’টা আমার হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। তোমাদের চোখের সামনেই সেই দু’টি টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে গেল। “মাবুদের চোখে খারাপ এমন সব গুনাহ্‌ করে তোমরা তাঁর রাগ জাগিয়ে তুলেছিলে বলে আমি আগের বারের মত আবার চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত মাবুদের সামনে উবুড় হয়ে পড়ে রইলাম; পানি বা রুটি কিছুই মুখে দিলাম না। মাবুদের ভীষণ রাগকে আমি ভয় করেছিলাম, কারণ তোমাদের ধ্বংস করে ফেলবার মত রাগ তাঁর হয়েছিল। কিন্তু এবারও মাবুদ আমার কথা শুনেছিলেন। হারুনকে ধ্বংস করে ফেলবার মত রাগও তাঁর হয়েছিল কিন্তু সেই সময় আমি হারুনের জন্যও মিনতি করেছিলাম। তোমাদের সেই গুনাহের জিনিসটা, অর্থাৎ তোমাদের তৈরী সেই বাছুরটা নিয়ে আমি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমি সেটা ধুলার মত গুঁড়া করে নিয়ে পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদীর স্রোতে ফেলে দিয়েছিলাম। “তবিয়েরাতে, মঃসাতে ও কিব্রোৎ-হত্তাবাতেও তোমরা মাবুদের রাগ জাগিয়ে তুলেছিলে। মাবুদ কাদেশ-বর্ণেয় থেকে তোমাদের রওনা করে দেবার সময়ে বলেছিলেন, ‘যে দেশ আমি তোমাদের দিয়েছি তোমরা গিয়ে তা অধিকার কর।’ কিন্তু তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে। তোমরা তাঁকে বিশ্বাসও কর নি, তাঁর কথায় কানও দাও নি। আমি যখন থেকে তোমাদের জেনেছি তখন থেকেই দেখছি যে, তোমরা মাবুদের বিরুদ্ধে কেবল বিদ্রোহই করে চলেছ। “মাবুদ তোমাদের ধ্বংস করে দেবার কথা বলেছিলেন বলে আমি সেই চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত মাবুদের সামনে উবুড় হয়ে পড়ে ছিলাম। তাঁর কাছে আমি এই বলে মুনাজাত করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ্‌ মালিক, তোমার বান্দাদের তুমি ধ্বংস করে ফেলো না। তারা তো তোমারই সম্পত্তি যাদের তুমি তোমার মহাশক্তি দ্বারা মুক্ত করেছ এবং তোমার শক্তিশালী হাত ব্যবহার করে মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছ। তোমার গোলাম ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কথা মনে কর। এই লোকদের একগুঁয়েমি, খারাপী ও গুনাহের দিকে চেয়ে দেখো না। তা করলে যে দেশ থেকে তুমি আমাদের বের করে এনেছ সেই দেশের লোকেরা বলবে, মাবুদ তাঁর ওয়াদা করা দেশে তাদের নিয়ে যেতে পারেন নি বলে কিংবা তিনি তাদের ঘৃণা করেন বলে তাদের মেরে ফেলবার জন্য এই মরুভূমিতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এরা তো তোমারই বান্দা, তোমারই সম্পত্তি যাদের তুমি তোমার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মহাশক্তিতে বের করে এনেছ।’ “সেই সময় মাবুদ আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি দুই টুকরা পাথর কেটে আগের পাথর-ফলক দু’টার মত করে নাও এবং পাহাড়ের উপরে আমার কাছে উঠে এস। সেই সংগে কাঠের একটি সিন্দুকও তৈরী করে নিয়ো। আগের যে ফলক দু’টা তুমি ভেংগে ফেলেছ তার উপর যে কথা লেখা ছিল আমি তা-ই এই ফলক দু’টার উপর লিখে দেব। তারপর তুমি সেই দু’টা নিয়ে সিন্দুকটির মধ্যে রাখবে।’ “সেইজন্য আমি বাবলা কাঠ দিয়ে একটি সিন্দুক তৈরী করলাম এবং দুই টুকরা পাথর কেটে আগের ফলক দু’টার মত করে নিলাম। তারপর সেই দু’টা হাতে করে পাহাড়ের উপর উঠে গেলাম। মাবুদ প্রথম ফলক দু’টার উপর যে কথা লিখেছিলেন এই দু’টার উপরও তা-ই লিখে ফলক দু’টা আমাকে দিলেন। সেই কথাগুলোই হল তাঁর সেই দশ হুকুম যা তিনি তোমাদের সকলের একসংগে জমায়েত হওয়ার দিনে পাহাড়ের উপর আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন। তারপর মাবুদের হুকুম মত আমি পাহাড় থেকে নীচে নেমে এসে আমার তৈরী করা সেই সিন্দুকটার মধ্যে ফলক দু’টা রাখলাম। সেগুলো এখনও সেখানে আছে।” বনি-ইসরাইলরা পরে বেরোৎ-বনে-যাকন থেকে রওনা হয়ে মোষেরোতে পৌঁছেছিল। সেখানেই হারুন মারা গিয়েছিলেন এবং তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। তাঁর ছেলে ইলিয়াসর তাঁর জায়গায় মহা-ইমাম হয়েছিলেন। তারপর বনি-ইসরাইলরা গুধগোদায় গিয়েছিল এবং সেখান থেকে গিয়েছিল যট্‌বাথায়। যট্‌বাথায় অনেকগুলো ছোট নদী ছিল। সেই সময় মাবুদ তাঁর সাক্ষ্য-সিন্দুক বয়ে নেবার জন্য এবং ইমাম-কাজের উদ্দেশ্যে তাঁর সামনে দাঁড়াবার জন্য আর তাঁর নামে দোয়া উচ্চারণ করবার জন্য লেবীয়দের বেছে নিয়েছিলেন। এই সব কাজ তারা আজও করছে। সেইজন্যই লেবীয়রা তাদের ইসরাইলীয় ভাইদের মধ্যে সম্পত্তির কোন ভাগ বা অধিকার পায় নি; তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা অনুসারে মাবুদই তাদের সম্পত্তি। “আগের বারের মত সেই বারও আমি চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত পাহাড়ের উপর ছিলাম আর সেই বারও মাবুদ আমার কথা শুনেছিলেন। তোমাদের ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। মাবুদ আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি গিয়ে তাদের পরিচালনা করে নিয়ে যাও, যাতে তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আমি যে দেশ দেবার কসম খেয়েছিলাম সেখানে গিয়ে তারা তা অধিকার করে নিতে পারে।’ “আসমান ও তার উপরকার সব কিছু এবং দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব কিছুই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র। তবুও তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি তাঁর টান ছিল বলে তিনি তাদের মহব্বত করেছিলেন। তিনি সমস্ত জাতির মধ্য থেকে তাদের বংশধরদের, অর্থাৎ তোমাদের বেছে নিয়েছেন আর আজও তোমরা সেই বেছে নেওয়া জাতিই আছ। সেইজন্য তোমরা তোমাদের দিলের খৎনা করাও; একগুঁয়ে হয়ে আর থেকো না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব দেব-দেবীর উপরে এবং তিনি মালিকদের মালিক। তিনি মহান, শক্তিশালী এবং ভয় জাগানো আল্লাহ্‌। তিনি কারও পক্ষ নেন না এবং ঘুষও খান না। এতিম ও বিধবাদের অধিকার তিনি রক্ষা করেন এবং তোমাদের মধ্যে বাস করা বিদেশীদের খেতে পরতে দিয়ে তাঁর মহব্বত দেখান। তিনি তাদের খেতে পরতে দেন। তোমরাও বিদেশী বাসিন্দাদের মহব্বত কোরো, কারণ মিসরে তোমরাও বিদেশী বাসিন্দা ছিলে। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করবে এবং তাঁর এবাদত করবে; তাঁকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং তাঁর নামেই কসম খাবে। তিনিই তোমাদের প্রশংসা, তিনিই তোমাদের আল্লাহ্‌। তোমরা নিজেদের চোখে যে সব মহৎ ও ভয় জাগানো কুদরতি দেখেছ তা তিনি তোমাদের জন্যই করেছেন। তোমাদের যে পূর্বপুরুষেরা মিসরে গিয়েছিলেন তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন মাত্র সত্তরজন আর এখন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সংখ্যা করেছেন আসমানের তারার মত অসংখ্য। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে আর তিনি যা চান তা করবে এবং তাঁর নিয়ম, নির্দেশ ও হুকুম সব সময় পালন করবে। আজ তোমরা মনে রেখো যে, আমি এই সব কথা তোমাদেরই বলছি, তোমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে বলছি না, কারণ তারা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র গড়ে তুলবার কাজ জানেও নি দেখেও নি। তারা তাঁর মহিমা এবং তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া কঠোর ও শক্তিশালী হাত দেখে নি। মিসরের মধ্যে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন ও তাঁর সারা দেশের উপর তিনি যে সব চিহ্ন কাজ এবং অন্যান্য কাজ করেছিলেন তা-ও তারা দেখে নি। মিসরীয় সৈন্যদল, তাদের ঘোড়া ও রথগুলোর প্রতি তিনি যা করেছিলেন এবং তারা যখন তোমাদের পিছনে তাড়া করে আসছিল তখন কেমন করে তিনি লোহিত সাগরের পানিতে তাদের ডুবিয়ে দিয়েছিলেন আর কেমন করে তাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তা-ও তারা দেখে নি। তোমরা এখানে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি মরুভূমিতে তোমাদের জন্য যা করেছিলেন তা-ও তোমাদের ছেলেমেয়েরা দেখে নি। তিনি রূবেণ-গোষ্ঠীর ইলীয়াবের ছেলে দাথন ও অবীরামের প্রতি যা করেছিলেন, অর্থাৎ যেভাবে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের মাঝখানে দুনিয়া মুখ খুলে তাদের ও তাদের পরিবারের লোকজন, তাদের তাম্বু এবং তাদের সমস্ত প্রাণীকে গিলে ফেলেছিল তা-ও তারা দেখে নি। কিন্তু মাবুদের এই সব বড় বড় কাজ তোমরাই নিজেদের চোখে দেখেছ। তোমরা যে দেশটা দখল করতে যাচ্ছ সেটা মিসর দেশের মত নয় যেখান থেকে তোমরা এসেছ। তোমরা সেখানে বীজ বুনতে, আর সবজী ক্ষেতে যেমন করা হয় তেমনি করে সেখানে পা দিয়ে পানি সেচের কাজ করতে। কিন্তু জর্ডান নদী পার হয়ে যে দেশটা তোমরা দখল করতে যাচ্ছ সেটা পাহাড় আর উপত্যকায় ভরা; সেই দেশ পানি পায় আসমান থেকে। সেই দেশের দেখাশোনা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই করেন। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময় তাঁর চোখ সেই দেশের উপর রয়েছে। “কাজেই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করা ও সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর এবাদত করবার যে হুকুম আজ আমি তোমাদের দিলাম তা তোমরা বিশ্বস্তভাবে পালন করবে। তা করলে মাবুদ সময়মত, অর্থাৎ শরৎ ও বসন্তকালে তোমাদের দেশের উপর বৃষ্টি দেবেন যার ফলে তোমরা প্রচুর শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল পাবে। মাবুদ তোমাদের পশুপালের জন্য মাঠে ঘাস হতে দেবেন। তা ছাড়া তোমরাও প্রাণ ভরে খেতে পাবে। “তোমরা কিন্তু সতর্ক থেকো, তা না হলে তোমরা ছলনায় পড়ে মাবুদের কাছ থেকে সরে যাবে এবং দেব-দেবীর সেবা ও পূজা করবে। এতে তোমাদের উপর মাবুদের রাগের আগুন জ্বলে উঠবে এবং তিনি আসমানের দরজা বন্ধ করে দেবেন, যার ফলে বৃষ্টিও হবে না এবং জমিতে ফসলও হবে না। যে চমৎকার দেশটা মাবুদ তোমাদের দিচ্ছেন সেখান থেকে তোমরা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তোমাদের দিল ও মনে আমার এই কথাগুলো গেঁথে রাখবে, তা মনে রাখবার চিহ্ন হিসাবে হাতে বেঁধে রাখবে এবং কপালে লাগিয়ে রাখবে। তোমাদের ছেলেমেয়েদের সেগুলো শিখাবে। ঘরে বসে থাকবার সময়, পথে চলবার সময়, শোবার সময় এবং বিছানা থেকে উঠবার সময় তোমরা এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। তোমাদের বাড়ীর দরজায় ও চৌকাঠে তোমরা সেগুলো লিখে রাখবে। যদি তোমরা এই সব কর তবে যে দেশ দেবার কসম মাবুদ তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে খেয়েছিলেন সেই দেশে তোমরা ও তোমাদের ছেলেমেয়েরা ততকাল বেঁচে থাকবে যতকাল এই দুনিয়ার উপর আসমান থাকবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবার, তাঁর পথে চলবার এবং তাঁকে আঁকড়ে ধরে রাখবার এই যে সব হুকুম আমি তোমাদের দিলাম তা তোমরা যত্নের সংগে পালন করবে। তা করলে মাবুদই তোমাদের সামনে থেকে ঐ সব জাতিগুলোকে বের করে দেবেন, আর তোমরা তোমাদের চেয়েও বড় বড় এবং শক্তিশালী জাতিকে বেদখল করবে। দক্ষিণের মরুভূমি থেকে লেবানন পর্যন্ত এবং ফোরাত নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত তোমরা যেখানে পা ফেলবে সেই জায়গাই তোমাদের হবে। কোন লোকই তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তোমরা সেই দেশের যেখানেই যাবে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর ওয়াদা অনুসারে সেখানকার লোকদের মনে তোমাদের সম্বন্ধে একটা ভয়ের ভাব ও কাঁপুনি ধরিয়ে দেবেন। “দেখ, আজ আমি তোমাদের সামনে একটা দোয়া ও একটা বদদোয়া তুলে ধরছি। আজ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র যে হুকুমগুলো দিলাম তা যদি তোমরা পালন কর, তবে এই দোয়া তোমরা পাবে। কিন্তু যদি তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য কর এবং যে পথে চলবার হুকুম আমি আজ দিয়েছি তা থেকে সরে গিয়ে তোমাদের কাছে নতুন এমন দেব-দেবীর পিছনে যাও, তবে তোমাদের উপর বদদোয়া পড়বে। দখল করবার জন্য তোমরা যে দেশে ঢুকতে যাচ্ছ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যখন সেই দেশে তোমাদের নিয়ে যাবেন তখন গরিষীম পাহাড়ের উপর থেকে সেই দোয়ার কথা তোমরা ঘোষণা করবে আর বদদোয়ার কথা ঘোষণা করবে এবল পাহাড়ের উপর থেকে। তোমরা তো জান, জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের রাস্তার পশ্চিমে গিল্‌গলের কাছাকাছি আরবার বাসিন্দা কেনানীয়দের দেশের মধ্যে মোরির এলোন গাছগুলোর কাছে ঐ পাহাড় দু’টা রয়েছে। “তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ তোমাদের দখল করবার জন্য দিয়েছেন সেখানে সারা জীবন এই সব নিয়ম ও নির্দেশ যত্নের সংগে তোমাদের পালন করতে হবে। তোমরা যে সমস্ত জাতিদের বেদখল করতে যাচ্ছ তারা যে সব ছোট-বড় পাহাড়ের উপরে ও ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে তাদের দেব-দেবীর পূজা করে সেই জায়গাগুলো তোমরা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবে। তাদের বেদীগুলো ভেংগে দেবে, পূজার পাথরগুলো চুরমার করে দেবে, পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো পুড়িয়ে দেবে, দেব-দেবীর মূর্তিগুলো ভেংগে ফেলে দেবে এবং এইভাবে সেই সব জায়গা থেকে তাদের দেব-দেবীদের নাম মুছে ফেলবে। “তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত তাদের পূজার মত করে করবে না। কিন্তু তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য তোমাদের সব গোষ্ঠীকে দেওয়া জায়গা থেকে যে জায়গাটা তাঁর বাসস্থান হিসাবে বেছে নেবেন তোমরা সেখানেই তাঁর এবাদতের জন্য যাবে। তোমরা তোমাদের পোড়ানো-কোরবানী এবং অন্যান্য পশু-কোরবানী, তোমাদের আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ, তোমাদের বিশেষ দান এবং মানত-পূরণের কোরবানী, তোমাদের নিজেদের ইচ্ছায় করা কোরবানী এবং তোমাদের গরু-ছাগল-ভেড়ার প্রথম বাচ্চা সেখানেই নিয়ে যাবে। সেখানেই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমরা ও তোমাদের পরিবারের লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করবে এবং তাঁর দোয়া অনুসারে পাওয়া তোমাদের পরিশ্রমের ফল নিয়ে তোমরা আনন্দ করবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সম্পত্তি হিসাবে যে দেশ তোমাদের দিচ্ছেন তোমরা জর্ডান নদী পার হয়ে গিয়ে যখন সেই দেশে বাস করতে থাকবে তখন তিনি তোমাদের চারপাশের শত্রুদের সংগে লড়াই থেকে তোমাদের বিশ্রাম দেবেন, আর তোমরা নিরাপদে সেখানে বাস করতে পারবে। তখন তিনি নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য যে জায়গাটা তাঁর বাসস্থান হিসাবে বেছে নেবেন সেখানে তোমরা আমার হুকুম করা সব জিনিস নিয়ে আসবে- তোমাদের পোড়ানো-কোরবানী ও অন্যান্য পশু-কোরবানী, তোমাদের আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ, বিশেষ দান এবং তোমাদের বাছাই করা জিনিস যা তোমরা মাবুদের কাছে মানত করেছ। সেখানে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েরা, তোমাদের গোলামেরা এবং তোমাদের গ্রাম ও শহরের লেবীয়রা যাদের নিজের বলতে কোন জায়গা-জমি কিংবা সম্পত্তি নেই তোমরা সবাই আনন্দ করবে। দেখো, যেন তোমাদের খুশীমত যে কোন জায়গায় তোমরা পোড়ানো-কোরবানী না কর। তোমাদের গোষ্ঠীগুলোকে দেওয়া জায়গা থেকে যে জায়গাটা মাবুদ বেছে নেবেন সেখানেই তোমরা ঐ সব পোড়ানো-কোরবানী দেবে আর সেখানেই তোমরা আমার হুকুম করা সব কিছু করবে। “তবে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দোয়া করে যে সব পশু দেবেন তা তোমরা যে কোন গ্রামে বা শহরে জবাই করে তোমাদের খুশীমত গোশ্‌ত খেতে পারবে, যেমন করে তোমাদের পাক-নাপাক সব লোকেরা কৃষ্ণসার কিংবা হরিণের গোশ্‌ত খায়। কিন্তু তোমাদের জন্য রক্ত খাওয়া হারাম; তা পানির মত করে মাটিতে ঢেলে দিতে হবে। এছাড়া তোমাদের শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেলের দশ ভাগের এক ভাগ, গরু-ছাগল-ভেড়ার প্রথম বাচ্চা, তোমাদের মানত করা জিনিস, তোমাদের নিজের ইচ্ছায় করা কোন কোরবানী এবং বিশেষ দান তোমাদের নিজেদের গ্রাম বা শহরের মধ্যে খাওয়া চলবে না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বেছে নেওয়া জায়গায় তাঁর সামনে এগুলো তোমাদের খেতে হবে। তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েরা, তোমাদের গোলামেরা এবং তোমাদের গ্রাম ও শহরের লেবীয়রা তা খাবে এবং তোমাদের পরিশ্রমের ফল নিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে আনন্দ করবে। তোমাদের দেশে তোমরা যতদিন বাস করবে ততদিন লেবীয়দের প্রতি তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর ওয়াদা অনুসারে তোমাদের দেশের সীমানা বাড়িয়ে দেবার পরে যখন তোমরা গোশ্‌ত খাবার ইচ্ছা নিয়ে বলবে, ‘গোশ্‌ত খাব,’ তখন তোমরা খুশীমত গোশ্‌ত খেতে পারবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য যে জায়গাটা বেছে নেবেন সেটা যদি তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে হয়, তবে আমার দেওয়া হুকুম অনুসারে তোমরা মাবুদের দেওয়া গরু-ভেড়ার পাল থেকে পশু নিয়ে জবাই করতে পারবে এবং যার যার গ্রাম ও শহরে খুশীমত গোশ্‌ত খেতে পারবে। কৃষ্ণসার কিংবা হরিণের গোশ্‌তের মতই তোমরা তা খাবে। পাক-নাপাক সবাই তা খেতে পারবে। কিন্তু সাবধান! রক্ত খাবে না, কারণ রক্তই হল প্রাণ, আর তোমরা গোশ্‌তের সংগে সেই প্রাণ খাবে না। তোমরা রক্ত খাবে না, তা পানির মত করে মাটিতে ঢেলে দেবে। তোমাদের ও তোমাদের পরে তোমাদের সন্তানদের যাতে উন্নতি হয় সেইজন্য তোমরা রক্ত খাবে না; তাহলে মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করা হবে। “মাবুদের বেছে নেওয়া জায়গায় তোমাদের পাক-পবিত্র জিনিস এবং মানতের জিনিস নিয়ে যেতে হবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোরবানগাহের উপর তোমরা তোমাদের পোড়ানো-কোরবানীর গোশ্‌ত ও রক্ত কোরবানী দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোরবানগাহের গায়ে তোমাদের কোরবানী করা পশুর রক্ত ঢেলে দিতে হবে, কিন্তু তার গোশ্‌ত তোমরা খেতে পারবে। তোমাদের ও তোমাদের পরে তোমাদের ছেলেমেয়েদের যাতে সব সময় উন্নতি হয় সেইজন্য আমার দেওয়া এই সব হুকুম তোমরা যত্নের সংগে পালন করবে, কারণ তা করলে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা ন্যায় এবং ভাল তা-ই করা হবে। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত তাদের পূজার মত করে করবে না, কারণ তাদের দেব-দেবীর পূজায় তারা এমন সব জঘন্য কাজ করে যা মাবুদ ঘৃণা করেন। এমন কি, তারা তাদের দেব-দেবীর কাছে তাদের ছেলেমেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী করে। “আমি তোমাদের যে যে হুকুম দিলাম সেই সব তোমরা পালন করবে; এর সংগে কিছু যোগও দেবে না, আবার এর থেকে কিছু বাদও দেবে না। তবে তোমরা সেই নবী বা স্বপ্নদেখা লোকের কথা শুনো না। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তোমাদের সব মনপ্রাণ দিয়ে মহব্বত কর কিনা তা তিনি তোমাদের পরীক্ষায় ফেলে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথামতই তোমাদের চলতে হবে এবং তাঁকেই ভয় করতে হবে। তোমরা তাঁর হুকুম পালন করবে ও তাঁর বাধ্য হয়ে চলবে; তোমরা তাঁর এবাদত করবে ও তাঁকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে। সেই নবী বা সেই স্বপ্নদেখা লোকটাকে হত্যা করতে হবে, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি মিসর থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন এবং সেই গোলামীর দেশ থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন, সে তাঁরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উসকানি দিয়েছে এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে পথে চলতে তোমাদের হুকুম দিয়েছেন সেই পথ থেকে তোমাদের ফিরাতে চেষ্টা করেছে। তোমাদের মধ্য থেকে সেই খারাপী তোমরা শেষ করে দেবে। তবে তার ডাকে সাড়া দিয়ো না বা তার কথায় কান দিয়ো না। তাকে কোন দয়া দেখাবে না; তাকে রেহাই দেবে না, কিংবা তাকে রক্ষাও করবে না। তাকে হত্যা করতেই হবে। তাকে হত্যা করবার কাজটা তুমি নিজের হাতেই শুরু করবে, তারপর অন্য সবাই যোগ দেবে। যিনি তোমাকে মিসর দেশের গোলামী থেকে বের করে এনেছেন তোমার সেই মাবুদ আল্লাহ্‌র দিক থেকে সে তোমাকে ফিরাবার চেষ্টা করেছে বলে তাকে তুমি পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে। তাতে বনি-ইসরাইলরা সকলে সেই কথা শুনে ভয় পাবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ আর এই রকম খারাপ কাজ করবে না। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে সব গ্রাম বা শহর তোমাদের বাস করবার জন্য দিতে যাচ্ছেন তার কোনটা সম্বন্ধে হয়তো তোমরা শুনতে পাবে যে, সেখানকার বনি-ইসরাইলদের মধ্যে কিছু দুষ্ট লোক দেখা দিয়েছে যারা সেখানকার লোকদের এই বলে বিপথে টেনে নিয়ে গিয়েছে, ‘চল, আমরা দেব-দেবীর পূজা করি,’ যে দেব-দেবী তোমাদের কাছে নতুন। তা-ই যদি হয় তবে ব্যাপারটা তোমাদের খুব ভাল করে খোঁজ-খবর নিয়ে পরীক্ষা ও তদন্ত করে দেখতে হবে। আর তা যদি সত্যি বলে প্র্রমাণিত হয় যে, এই জঘন্য কাজ তোমাদের মধ্যে করা হয়েছে, তবে সেখানকার সব বাসিন্দাদের অবশ্যই হত্যা করতে হবে। সেই গ্রাম বা শহর এবং তার লোকজন ও পশুপাল তোমরা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবে। সেখানকার সব লুট করা জিনিস তোমরা শহর-চকের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে সমস্ত জিনিস ও সেই গ্রাম বা শহর তোমরা তোমাদের মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর মত করে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেবে। সেই জায়গাটা চিরদিনের জন্য যেন একটা ধ্বংসের স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে; আর কখনও যেন সেটা তৈরী করা না হয়। মাবুদ যাতে তাঁর ভয়ংকর রাগ থেকে ফেরেন সেইজন্য তোমাদের হাতে যেন এই সব জিনিসের একটাও দেখা না যায়, কারণ তার উপর রয়েছে ধ্বংসের বদদোয়া। তাহলে তিনি তোমাদের রহমত ও মমতা করবেন এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খাওয়া ওয়াদা অনুসারে তোমাদের বংশ বাড়িয়ে দেবেন, কারণ আজ আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিচ্ছি তা পালন করে এবং তাঁর চোখে যা ভাল তা-ই করে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য হয়েছ। “তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সন্তান। সেইজন্য মৃত লোকদের জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে শরীরের কোন জায়গায় তোমাদের ক্ষত করা চলবে না, কিংবা মাথার সামনের চুল কামানো চলবে না। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে একটা পবিত্র জাতি। দুনিয়ার সমস্ত জাতিগুলোর মধ্য থেকে মাবুদ তোমাদের বেছে নিয়েছেন যাতে তোমরা তাঁর নিজের বিশেষ সম্পত্তি হও। “তোমরা কোন ঘৃণার জিনিস খাবে না। যে সব পশুর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হালাল সেগুলো হল গরু, ভেড়া, ছাগল, হরিণ, কৃষ্ণসার, চিতি-হরিণ, বুনো ছাগল, পিছন সাদা হরিণ, সাদা হরিণ এবং পাহাড়ী ভেড়া। যে সব পশুর খুর পুরোপুরি দুই ভাগে চেরা এবং যারা জাবর কাটে সেই সব পশুর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হালাল। কিন্তু মাত্র জাবর কাটা কিংবা শুধু খুর চেরা পশুর গোশ্‌ত তোমাদের জন্য হারাম। তোমরা উট, খরগোস ও শাফন খাবে না, কারণ সেগুলো জাবর কাটলেও তাদের খুর চেরা নয়। তাই সেগুলো তোমাদের পক্ষে নাপাক। শূকরও নাপাক; খুর চেরা হলেও সে জাবর কাটে না। তোমাদের জন্য এগুলোর গোশ্‌ত হারাম এবং তাদের মৃতদেহও ছোঁবে না। “পানিতে বাস করা প্রাণীদের মধ্যে যেগুলোর ডানা ও আঁশ আছে সেগুলো তোমাদের জন্য হালাল, কিন্তু যেগুলোর ডানা ও আঁশ নেই সেগুলো তোমাদের জন্য হারাম। তোমাদের পক্ষে সেগুলো নাপাক। “ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায় এমন সব পোকা তোমাদের পক্ষে নাপাক। সেগুলো তোমাদের জন্য হারাম; কিন্তু যে সব প্রাণীর ডানা আছে এবং পাক-পবিত্র সেগুলো তোমাদের জন্য হালাল। “মরে পড়ে থাকা যে কোন প্রাণী তোমাদের জন্য হারাম, কারণ তোমরা তোমাদের মাবুদের উদ্দেশ্যে একটা পবিত্র জাতি। তোমাদের গ্রাম বা শহরে বাস করা অন্য জাতির কোন লোককে তোমরা সেটা দিয়ে দিতে পারবে এবং সে তা খেতে পারবে, কিংবা তোমরা কোন বিদেশীর কাছে সেটা বিক্রি করে দিতে পারবে। “ছাগলের বাচ্চার গোশ্‌ত তার মায়ের দুধে রান্না করবে না। “প্রত্যেক বছর তোমাদের জমিতে যে সব ফসল হবে তার দশ ভাগের এক ভাগ তোমরা অবশ্যই আলাদা করে রাখবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে যাতে তোমরা ভয় করতে শেখ সেইজন্য তোমাদের শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেলের দশ ভাগের এক ভাগ এবং তোমাদের পালের গরু-ভেড়া-ছাগলের প্রথম বাচ্চার গোশ্‌ত তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমাদের এমন জায়গায় খেতে হবে যে জায়গাটা তিনি নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য তাঁর বাসস্থান হিসাবে বেছে নেবেন। কিন্তু যদি সেই জায়গা খুব দূরে হয় এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের এত দোয়া করে থাকেন যে, সেই দশ ভাগের এক ভাগ মাবুদের সেই জায়গা অনেক দূর বলে তোমাদের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তবে তা বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সেই বেছে নেওয়া জায়গায় যাবে। সেই টাকা দিয়ে তোমরা তোমাদের খুশীমত জিনিস কিনবে, যেমন গরু-ছাগল-ভেড়া, আংগুর-রস, অন্য কোন মদানো রস কিংবা তোমাদের খুশীমত আর কিছু। তারপর তোমরা তোমাদের পরিবার নিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে খাওয়া-দাওয়া করে আনন্দ করবে। যে লেবীয়রা তোমাদের গ্রাম বা শহরে বাস করে তাদের কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না, কারণ নিজেদের বলতে তাদের কোন জায়গা-জমি বা সম্পত্তি নেই। “প্রত্যেক তৃতীয় বছরের শেষে তোমাদের সেই বছরের ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ শহরে নিয়ে এসে তোমরা জমা করবে। এতে লেবীয়রা, যাদের নিজেদের বলতে কোন জায়গা-জমি বা সম্পত্তি নেই এবং সেখানকার বিদেশী বাসিন্দারা, বিধবারা আর এতিম ছেলেমেয়েরা প্রাণ ভরে খেতে পাবে। এতে তোমাদের সব কাজে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দোয়া করবেন। “প্রতি সপ্তম বছরের শেষে অন্যদের কাছ থেকে তোমাদের পাওনা সব মাফ করে দেবে। এই নিয়মে তা মাফ করতে হবে: প্রত্যেক ইসরাইলীয় পাওনাদার অন্য ইসরাইলীয়কে দেওয়া সব ঋণ মাফ করে দেবে। ঋণ মাফ করে দেবার জন্য মাবুদ যে সময় ঠিক করে দিয়েছেন তা ঘোষণা করা হয়েছে বলে কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে না। ভিন্ন জাতির লোকদের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে, কিন্তু তোমাদের ভাইদের ঋণ তোমাদের মাফ করে দিতে হবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর ওয়াদা অনুসারে তোমাদের দোয়া করবেন, আর তাতে তোমরা অনেক জাতির লোককে ঋণ দেবে, কিন্তু কারও কাছ থেকে তোমাদের ঋণ নিতে হবে না। তোমরা অনেক জাতিকে শাসন করবে কিন্তু কেউ তোমাদের শাসন করবে না। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেই দেশের কোন জায়গায় যদি তোমাদের ভাইদের মধ্যে কেউ গরীব থাকে, তবে তার উপর তোমাদের দিল কঠিন কোরো না, কিংবা সেই গরীব ভাইয়ের জন্য তোমাদের হাত মুঠো করে রেখো না। তোমাদের হাত যেন খোলা থাকে; তার দরকার মত তাকে অবশ্যই ধার দেবে। সাবধান, তোমাদের মনে এই খারাপ চিন্তাকে আমল দিয়ো না যে, সপ্তম বছর, অর্থাৎ ঋণ মাফের বছর প্রায় এসে গেছে। এই চিন্তা করে তোমাদের সেই অভাবী ভাইয়ের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে তাকে খালি হাতে বিদায় কোরো না। যদি তা কর তবে তা নিয়ে সে তোমাদের বিরুদ্ধে মাবুদের কাছে কাতর হয়ে বিচার চাইবে আর তোমরা অন্যায়ের জন্য দোষী হবে। মনে অনিচ্ছার ভাব না রেখে খোলা হাতে তাকে দেবে; তাহলে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সব কাজে দোয়া করবেন এবং তোমরা যাতে হাত দেবে তাতেই দোয়া পাবে। গরীব লোক অবশ্য দেশে সব সময়ই থাকবে। সেইজন্য আমি তোমাদের এই হুকুম দিচ্ছি যে, তোমাদের ভাইদের প্রতি এবং দেশের গরীব ও অভাবী লোকদের প্রতি তোমাদের হাত যেন খোলা থাকে। “যদি কোন ইবরানী পুরুষ বা স্ত্রীলোককে তোমাদের কাছে বিক্রি করা হয়, তবে ছয় বছর কাজ করবার পরে সপ্তম বছরে তাকে অবশ্যই তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়ে দেবার সময়ে তাকে খালি হাতে বিদায় করবে না। তোমরা তাকে খোলা হাতে তোমাদের পাল থেকে ছাগল ও ভেড়া, খামার থেকে শস্য এবং আংগুর মাড়াইয়ের জায়গা থেকে আংগুর-রস দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে পরিমাণে দোয়া করেছেন তোমরা সেই পরিমাণেই তাকে দেবে। মনে রেখো, মিসর দেশে তোমরাও গোলাম ছিলে এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের মুক্ত করেছেন। সেইজন্য আজ আমি তোমাদের এই হুকুম দিচ্ছি। “কিন্তু তোমাদের ও তোমাদের পরিবারের লোকদের প্রতি ভালবাসার দরুন এবং তোমাদের কাছে সুখে আছে বলে যদি সেই গোলাম জানায় যে, সে তোমাদের ছেড়ে যাবে না, তবে তোমরা তার কানের লতি দরজার উপর রেখে তুরপুণ দিয়ে ছেঁদা করে দেবে; তাতে সে সারা জীবন তোমাদের গোলাম হয়ে থাকবে। তোমাদের বাঁদীর বেলায়ও তা-ই করবে। “গোলাম কিংবা বাঁদীকে মুক্ত করে দেওয়াটা তোমার কোন কষ্টের ব্যাপার বলে মনে কোরো না, কারণ এই ছয় বছর সে তোমাদের জন্য যে কাজ করেছে তার দাম দু’জন মজুরের মজুরির সমান। তাদের মুক্ত করে দিলে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সব কিছুতে দোয়া করবেন। “তোমাদের গরু-ভেড়া ও ছাগলের প্রত্যেকটা প্রথম পুরুষ বাচ্চা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখবে। তোমাদের গরুর প্রথম বাচ্চাকে কাজে লাগাবে না এবং ছাগল ও ভেড়ার প্রথম বাচ্চার লোম কাটবে না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বেছে নেওয়া জায়গায় প্রত্যেক বছর তোমরা তোমাদের পরিবার নিয়ে তাঁর সামনে সেগুলোর গোশ্‌ত খাবে। কিন্তু সেই সব পশুর কোনটার যদি কোন খুঁত থাকে, অর্থাৎ যদি সেটা খোঁড়া কিংবা অন্ধ হয় কিংবা তার গায়ে আর কোন বড় রকমের দোষ থাকে, তবে সেটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী দেবে না। সেটা তোমরা নিজের জায়গাতেই খাবে। পাক-নাপাক যে কোন লোকই তা কৃষ্ণসার বা হরিণের গোশ্‌তের মতই খেতে পারবে। কিন্তু তোমরা তার রক্ত খাবে না; পানির মত করে তা মাটিতে ঢেলে দেবে। “আবীব মাসে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে তোমরা উদ্ধার-ঈদ পালন করবে। এই আবীব মাসেই একদিন রাতের বেলায় তিনি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছিলেন। নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য মাবুদ তাঁর বাসস্থান হিসাবে যে জায়গাটা বেছে নেবেন, সেখানে তোমরা তোমাদের গরু বা ছাগল-ভেড়ার পাল থেকে পশু নিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদের কোরবানী দেবে। সেই পশুর গোশ্‌ত তোমরা খামি দেওয়া রুটির সংগে খাবে না। সাত দিন ধরে তোমাদের দুঃখ স্মরণ করানো খামিহীন রুটি খেতে হবে, কারণ ভয়ে তাড়াহুড়া করে তোমরা মিসর দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলে। এতে মিসর দেশ থেকে বেরিয়ে আসবার কথা তোমাদের সারা জীবন মনে থাকবে। এই সাত দিন সারা দেশে তোমাদের মধ্যে যেন খামি দেওয়া কোন কিছু পাওয়া না যায়। ঈদের প্রথম দিনের সন্ধ্যাবেলায় তোমরা যে গোশ্‌ত কোরবানী দেবে তা যেন সকাল পর্যন্ত পড়ে না থাকে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া আর কোন শহরে তোমরা উদ্ধার-ঈদের পশু-কোরবানী দেবে না; যে জায়গাটা তিনি নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য তাঁর বাসস্থান হিসাবে বেছে নেবেন কেবল সেখানেই তা কোরবানী দেবে। যেদিন তোমরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছ প্রত্যেক বছরের সেই দিনে সূর্য ডুববার সময় সন্ধ্যাবেলায় উদ্ধার-ঈদের পশু-কোরবানী দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে জায়গাটা বেছে নেবেন সেখানেই তোমরা সেই গোশ্‌ত রান্না করে খাবে। তার পরের দিন সকালে তোমরা তোমাদের ঘরে ফিরে যাবে। ছয় দিন ধরে তোমরা খামিহীন রুটি খাবে আর সাত দিনের দিন তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে শেষ দিনের মিলন-মাহ্‌ফিলের আয়োজন করবে এবং সেই দিন কোন কাজ করবে না। “মাঠের ফসল কাটা শুরু করা থেকে তোমরা গুণে সাতটা সপ্তা বাদ দেবে। তারপর তোমাদের নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানী দিয়ে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে সাত সপ্তাহের ঈদ পালন করবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে পরিমাণে দোয়া করেছেন তা বুঝে তোমরা এই কোরবানীর জিনিস দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য তাঁর বাসস্থান হিসাবে যে জায়গাটা বেছে নেবেন সেখানে তাঁর সামনে তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েরা, তোমাদের গোলাম ও বাঁদীরা এবং তোমাদের মধ্যে বাস করা লেবীয়রা, বিদেশী বাসিন্দারা, এতিম ছেলেমেয়েরা আর বিধবারা- তোমরা সবাই আনন্দ করবে। মিসর দেশে তোমরাও যে গোলাম ছিলে সেই কথাটা মনে রেখে তোমরা এই সব নিয়ম যত্নের সংগে পালন করবে। “তোমাদের খামার এবং আংগুর মাড়াই করবার জায়গা থেকে সব কিছু তুলে রাখবার পরে সাত দিন তোমরা কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করবে। তোমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েরা, তোমাদের গোলাম ও বাঁদীরা এবং তোমাদের মধ্যে বাস করা লেবীয়রা, বিদেশী বাসিন্দারা, এতিম ছেলেমেয়েরা আর বিধবারা- তোমরা সবাই এই পর্বে আনন্দ করবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে জায়গা বেছে নেবেন সেখানেই তোমরা তাঁর উদ্দেশে সাত দিন ধরে এই ঈদ পালন করবে, কারণ তোমাদের তোলা সব ফসল এবং সব কাজে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দোয়া করবেন আর তোমাদের আনন্দ পূর্ণ হবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বেছে নেওয়া জায়গায় বছরে তিনবার, অর্থাৎ খামিহীন রুটির ঈদের সময়, সাত সপ্তাহের ঈদের সময় এবং কুঁড়ে-ঘরের ঈদের সময় তোমাদের সব পুরুষ লোকদের মাবুদের সামনে উপস্থিত হতে হবে। কেউ যেন খালি হাতে মাবুদের সামনে উপস্থিত না হয়। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে পরিমাণে দোয়া করেছেন তা বুঝে তোমাদের প্রত্যেকেই যেন কিছু না কিছু নিয়ে আসে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে সব গ্রাম ও শহর দিতে যাচ্ছেন তার প্রত্যেকটিতে প্রত্যেক গোষ্ঠীর জন্য তোমরা বিচারক ও কর্মচারী নিযুক্ত করবে। তারা ন্যায়ভাবে লোকদের বিচার করবে। তোমরা অন্যায় বিচার করবে না কিংবা কারও পক্ষ নেবে না। তোমরা ঘুষ নেবে না, কারণ ঘুষ জ্ঞানীদের চোখ অন্ধ করে দেয় এবং নির্দোষ লোকদের কথায় প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। যে দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিচ্ছেন, তোমরা যাতে বেঁচে থেকে তা ভোগ-দখল করতে পার সেইজন্য তোমরা কেবল ন্যায়কেই মেনে চলবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে তোমরা এমন কোন গরু বা ছাগল বা ভেড়া কোরবানী দেবে না যার কোন খুঁত বা দোষ আছে, কারণ তিনি তা ঘৃণা করেন। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া গ্রাম বা শহরগুলোর কোনটাতে হয়তো দেখা যাবে যে, তোমাদের মধ্যেকার কোন পুরুষ অথবা স্ত্রীলোক তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া ব্যবস্থা অমান্য করে তাঁর চোখে যা খারাপ তা করছে। সে হয়তো আমার হুকুমের বিরুদ্ধে গিয়ে দেব-দেবীর সেবা করছে এবং সেই সব দেব-দেবী কিংবা সূর্য, চাঁদ বা আসমানের তারাগুলোর পূজা করছে। যদি এই সব তোমাদের জানানো হয়, তবে তোমরা তা ভাল করে তদন্ত করে দেখবে। যদি তা সত্যি হয় এবং এই রকম ঘৃণার কাজ বনি-ইসরাইলদের মধ্যে করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তবে যে পুরুষ বা স্ত্রীলোক এই রকম জঘন্য কাজ করেছে তোমরা তাকে গ্রাম বা শহরের সদর দরজার কাছে নিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে। কোন মানুষকে হত্যা করতে হলে দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথার উপর ভরসা করে তা করতে হবে; মাত্র একজন সাক্ষীর কথার উপর ভরসা করে তা করা চলবে না। সেই লোকটিকে হত্যা করবার জন্য সাক্ষীরাই প্রথমে পাথর ছুঁড়বে, তারপর ছুঁড়বে অন্যান্য সব লোকেরা। এইভাবে তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে সেই খারাপী শেষ করে দেবে। “যদি এমন সব মামলা তোমাদের আদালতে আসে যেগুলোর বিচার করা তোমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়- সেটা রক্তপাতের জন্যই হোক কিংবা ঝগড়া-বিবাদের জন্যই হোক কিংবা আঘাতের জন্যই হোক- তবে সেই মামলা নিয়ে মাবুদের বেছে নেওয়া জায়গায় তোমাদের যেতে হবে। তোমরা তখন সেই সময়কার বিচারক এবং লেবীয়দের মধ্যে যারা ইমাম তাদের কাছে যাবে। তোমরা বিষয়টা তাদের বুঝিয়ে বলবে আর তারাই তোমাদের সেই বিচারের রায় দেবে। মাবুদের বেছে নেওয়া জায়গাতে তারা তোমাদের কাছে যে রায় জানাবে তোমরা তা কাজে লাগাবে। তবে সাবধান, তারা তোমাদের যা যা করতে বলবে তার কোনটাই তোমরা বাদ দেবে না। তারা শরীয়ত সম্বন্ধে তোমাদের যা শিক্ষা দেবে এবং যে রায় দেবে সেই মতই তোমরা কাজ করবে। তারা তোমাদের যা করতে বলবে তোমরা ঠিক তা-ই করবে, এদিক ওদিক করবে না। যদি কোন লোক অহংকারের বশে সেই বিচারকের কথা কিংবা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র খেদমতকারী সেই ইমামের কথা শুনতে রাজী না হয়, তবে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। তোমরা বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এই রকমের খারাপী শেষ করে দেবে। তাহলে সমস্ত লোক সেই কথা শুনে ভয় পাবে এবং এই রকম অহংকারের ভাব আর দেখাবে না। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেখানে গিয়ে তা দখল করে যখন তোমরা সেখানে বাস করতে থাকবে এবং বলবে, ‘আমাদের আশেপাশের জাতিগুলোর মত এস, আমরা আমাদের জন্য একজনকে বাদশাহ্‌ হিসাবে বেছে নিই,’ তখন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যাকে ঠিক করে দেবেন তাকেই তোমরা তোমাদের বাদশাহ্‌ করবে। সে যেন তোমাদের ইসরাইলীয় ভাইদের মধ্যে একজন হয়। যে তোমাদের ইসরাইলীয় ভাই নয় এমন ভিন্ন জাতির কোন লোককে তোমরা তোমাদের বাদশাহ্‌ করবে না। সেই বাদশাহ্‌ যেন নিজের জন্য অনেক ঘোড়া জোগাড় করবার দিকে মন না দেয় এবং তার পরে আরও ঘোড়া জোগাড় করবার জন্য বনি-ইসরাইলদের মিসর দেশে না পাঠায়, কারণ মাবুদ তোমাদের বলেছেন, ‘তোমরা ঐ পথে আর ফিরে যাবে না।’ সে যেন অনেক বিয়ে না করে; তাতে তার মন বিপথে যাবে। সে যেন নিজের জন্য অতিরিক্ত সোনা ও রূপা জড়ো না করে। “লেবীয়দের মধ্যে যারা ইমাম তাদের কাছে শরীয়তের যে কিতাব আছে সিংহাসনে বসবার সময় তাকে সেই কিতাব থেকে তার নিজের জন্য সব শরীয়ত একটি বইয়ে লিখে নিতে হবে। সেটা তার কাছেই থাকবে এবং সারা জীবন তাকে তা পড়তে হবে যাতে সে তার মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করতে শেখে এবং এই শরীয়ত ও নিয়মের কথাগুলো মেনে চলে। এর ফলে অন্যান্য ইসরাইলীয় ভাইদের চেয়ে নিজেকে বড় করে দেখবার ভাব তার মনে আসবে না এবং শরীয়ত থেকে সে এদিক ওদিক সরে যাবে না। এতে সে ও তার বংশধরেরা বনি-ইসরাইলদের উপর অনেক দিন রাজত্ব করতে পারবে। “লেবীয় ইমামেরা এবং লেবি-গোষ্ঠীর অন্যান্য লোকেরা বাকী বনি-ইসরাইলদের মত কোন জায়গা-জমি কিংবা সম্পত্তি পাবে না। মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া কোরবানীর জন্য যে সব জিনিস আনা হবে এবং মাবুদকে আর যা কিছু দেওয়া হবে তা-ই তারা খাবে। ইসরাইলীয় ভাইদের মধ্যে তাদের সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে না। মাবুদের ওয়াদা অনুসারে মাবুদই হবেন তাদের সম্পত্তি। “লোকেরা যে সব গরু-ছাগল-ভেড়া কোরবানী দেবে সেগুলোর কাঁধ, চোয়ালের গোশ্‌ত এবং পাকস্থলী তারা ইমামকে দেবে; এগুলো হবে ইমামের পাওনা। তোমাদের প্রথমে তোলা ফসল, নতুন আংগুর-রস ও তেল আর ছাগল-ভেড়ার গা থেকে প্রথমবার কেটে নেওয়া লোম তোমরা ইমামদের দেবে, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্য থেকে লেবীয়দের এবং তাদের বংশধরদের বেছে নিয়েছেন, যেন তারা সব সময় মাবুদের নামে এবাদত-কাজ করতে পারে। “ইসরাইলীয়দের দেশের কোন লেবীয় যদি তার বাসস্থান ছেড়ে সত্যিকারের ইচ্ছা নিয়ে মাবুদের বেছে নেওয়া জায়গায় যায়, তবে অন্যান্য লেবীয় ভাইদের মত সে-ও সেখানে তার মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে এবাদত-কাজ করতে পারবে। তার পিতার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র বিক্রি করে টাকা পেলেও সেখানকার লেবীয়দের সংগে সে সমান ভাগের অধিকারী হবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে দেশ দিতে যাচ্ছেন সেখানে গিয়ে সেখানকার জাতিগুলো যে সব জঘন্য কাজ করে তোমরা তা করতে শিখবে না। তোমাদের মধ্যে যেন এমন কোন লোক না থাকে যে তার নিজের সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী করে, যে গোণাপড়া করে কিংবা মায়াবিদ্যা খাটায় কিংবা লক্ষণ দেখে ভবিষ্যতের কথা বলে, যে জাদু করে, যে মন্ত্রতন্ত্র খাটায়, যে ভূতের মাধ্যম হয়, যে ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে এবং যে মৃত লোকের সংগে যোগাযোগ রাখে। এই সব কাজ যে করে মাবুদ তাকে জঘন্য মনে করেন। এই সব জঘন্য কাজের জন্যই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ ঐ সব জাতি তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেবেন। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমাদের নির্দোষ থাকতে হবে। “তোমরা যে সব জাতিদের বেদখল করবে তারা মায়াবিদ্যা ব্যবহারকারী ও গণকদের কথায় কান দেয়, কিন্তু তোমাদের বেলায় এই সব ব্যাপারে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নিষেধ রয়েছে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের মধ্য থেকে, তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন। তাঁর কথামত তোমাদের চলতে হবে। তুর পাহাড়ের কাছে যেদিন তোমরা সবাই মাবুদের সামনে জমায়েত হয়েছিলে সেই দিন তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে তা-ই চেয়েছিলে। তোমরা বলেছিলে, ‘আর আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা শুনতে কিংবা এই মহান আগুন দেখতে চাই না; তা হলে আমরা মারা যাব।’ “মাবুদ আমাকে বলেছিলেন, ‘তারা ভালই বলেছে। আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তাদের জন্য তোমার মত একজন নবী দাঁড় করাব। তার মুখ দিয়েই আমি আমার কথা বলব, আর আমি যা বলতে তাকে হুকুম দেব সে তা-ই তাদের বলবে। সেই নবী আমার নাম করে যে কথা বলবে কেউ যদি আমার সেই কথা না শোনে, তবে আমি নিজেই সেই লোককে দায়ী করব। কিন্তু আমি হুকুম দিই নি এমন কোন কথা যদি কোন নবী আমার নাম করে বলতে সাহস করে কিংবা সে যদি দেব-দেবীর নামে কথা বলে, তবে তাকে হত্যা করতে হবে।’ “কোন একটা কথা সম্বন্ধে তোমরা মনে মনে বলতে পার, ‘মাবুদ এই কথা বলেছেন কিনা তা আমরা কি করে জানব?’ কোন নবী যদি মাবুদের নাম করে কোন কথা বলে আর তা যদি অসত্য হয় কিংবা না ঘটে, তবে বুঝতে হবে সেই কথা মাবুদ বলেন নি। সেই নবী দুঃসাহস করে ঐ কথা বলেছে। তাকে তোমরা ভয় কোরো না। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ তোমাদের দখল করবার জন্য দেবেন সেখানকার জাতিদের যখন তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন এবং তোমরা তাদের বদলে তাদের গ্রামে বা শহরে ও বাড়ী-ঘরে বাস করতে থাকবে, “মনে কোন হিংসা না রেখে যদি কেউ হঠাৎ কাউকে হত্যা করে এবং নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তার কাছের আশ্রয়-শহরটিতে পালিয়ে যায় তবে তার সম্বন্ধে এই হল নিয়ম। ধরে নাও, একজন লোক অন্য আর একজনের সংগে বনে কাঠ কাটতে গেল। সেখানে গাছ কাটতে গিয়ে কুড়াল দিয়ে কোপ দেবার সময়ে কুড়ালের ফলাটা ফস্‌কিয়ে গিয়ে অন্য লোকটিকে আঘাত করল এবং তাতে সে মারা গেল। এই অবস্থায় ঐ লোকটি তার কাছের আশ্রয়-শহরটিতে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারবে। তা না হলে রক্তের শোধ যার নেবার কথা সে রাগের বশে তাকে তাড়া করতে পারে আর আশ্রয়-শহর কাছে না হলে তাকে হত্যা করতে পারে, যদিও মনে হিংসা নিয়ে হত্যা করে নি বলে মৃত্যু তার পাওনা শাস্তি নয়। সেইজন্য আমি তোমাদের নিজেদের জন্য তিনটা শহর আলাদা করে রাখবার হুকুম দিচ্ছি। তোমরা এটা করবে যাতে সম্পত্তি হিসাবে যে দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেই দেশের উপর নির্দোষ লোকের রক্তপাত না হয় এবং রক্তপাতের দোষে তোমরা দোষী না হও। “কিন্তু যদি কেউ হিংসা করে কাউকে হত্যা করবার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে এবং তাকে হামলা করে হত্যা করে আর তার পরে তার কাছের আশ্রয়-শহরটিতে পালিয়ে যায়, তবে তার শহরের বৃদ্ধ নেতারা লোক পাঠিয়ে সেই শহর থেকে তাকে ধরে আনবে এবং রক্তের শোধ যার নেবার কথা তার হাতে তাকে হত্যা করবার জন্য তুলে দেবে। তাকে তোমরা কোন দয়া দেখাবে না। তোমরা বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে নির্দোষ লোকের রক্তপাতের দোষ মুছে ফেলবে। তাতে তোমাদের জন্য ভাল হবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা দখল করবার জন্য তোমাদের দিচ্ছেন সেখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের রাখা কোন সীমানা-চিহ্ন তোমরা সরাবে না। “যদি কারও বিরুদ্ধে দোষ বা অন্যায় করবার নালিশ আনা হয়, তবে মাত্র একজন সাক্ষী দাঁড়ালে চলবে না; দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথা ছাড়া কোন বিষয় সত্যি বলে প্রমাণিত হতে পারবে না। “যদি কেউ ক্ষতি করবার মনোভাব নিয়ে কারও বিরুদ্ধে কোন অন্যায় কাজের নালিশ আনে, তবে সেই ব্যাপারে জড়িত সেই দু’জনকে তখনকার ইমাম ও বিচারকদের কাছে গিয়ে মাবুদের সামনে দাঁড়াতে হবে। বিচারকেরা ব্যাপারটা ভাল করে তদন্ত করে দেখবে। যদি সে তার ইসরাইলীয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার দরুন মিথ্যাবাদী বলে ধরা পড়ে, তবে সে তার ভাইয়ের প্রতি যা করতে চেয়েছিল তা-ই তার প্রতি করতে হবে। তোমাদের মধ্য থেকে এই রকমের খারাপী শেষ করে দিতে হবে। এই কথা শুনে অন্য সব বনি-ইসরাইলরা ভয় পাবে এবং এই রকম অন্যায় আর কখনও তারা করবে না। তোমরা তার প্রতি কোন দয়া দেখাবে না- প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, হাতের বদলে হাত এবং পায়ের বদলে পা নেবে। “যুদ্ধ করতে গিয়ে শত্রুর পক্ষে তোমাদের চেয়ে বেশী ঘোড়া, রথ ও সৈন্যদল দেখে তোমরা ভয় পেয়ো না, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন তিনি তোমাদের সংগে থাকবেন। শত্রুদের সংগে যুদ্ধ করে তোমাদের জয়ী করবার জন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তোমাদের সংগে যাচ্ছেন।’ “তারপর তাদের নেতারা সৈন্যদের বলবে, ‘তোমাদের মধ্যে যদি কেউ নতুন ঘর তৈরী করে তা প্রতিষ্ঠা না করে থাকে তবে সে বাড়ী যাক; তা না হলে সে যুদ্ধে মারা গেলে অন্য কেউ সেই ঘর প্রতিষ্ঠা করবে। কেউ যদি আংগুর ক্ষেত করে তার ফল না খেয়ে থাকে তবে সে-ও বাড়ী যাক; তা না হলে সে যুদ্ধে মারা গেলে অন্যে সেই ক্ষেত ভোগ করবে। বিয়ের সম্বন্ধের পরে যদি কেউ বিয়ে না করে থাকে তবে সে-ও বাড়ী যাক; তা না হলে সে যুদ্ধে মারা গেলে অন্যে সেই স্ত্রীলোককে বিয়ে করবে।’ সেই নেতারা আরও বলবে, ‘তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ভয় পেয়ে থাকে কিংবা সাহস হারিয়ে থাকে, তবে তা দেখে যাতে অন্য ইসরাইলীয় ভাইদের মনোবল নষ্ট হয়ে না যায় সেইজন্য সে বাড়ী ফিরে যাক।’ সৈন্যদের কাছে কথা বলা শেষ করে নেতারা সৈন্যদের বিভিন্ন দলের উপরে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করবে। “তোমরা কোন গ্রাম বা শহর আক্রমণ করতে যাওয়ার আগে সেখানকার লোকদের কাছে বিনা যুদ্ধে অধীনতা মেনে নেবার প্রস্তাব করবে। যদি তাতে তারা রাজী হয়ে তাদের দরজা খুলে দেয় তবে সেখানকার সমস্ত লোকেরা তোমাদের অধীন হবে এবং তোমাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা যদি সেই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে তবে সেই জায়গা তোমরা আক্রমণ করবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যখন সেই জায়গাটা তোমাদের হাতে তুলে দেবেন তখন সেখানকার সব পুরুষ লোকদের তোমরা হত্যা করবে। তবে স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে, পশুপাল এবং সেই জায়গার অন্য সব কিছু তোমরা লুটের জিনিস হিসাবে নিজেদের জন্য নিতে পারবে। শত্রুদের দেশ থেকে লুট করা যে সব জিনিস তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দেবেন তা তোমরা ভোগ করতে পারবে। যে সব শহর তোমাদের দেশ থেকে দূরে আছে, যেগুলো তোমাদের কাছের জাতিগুলোর শহর নয়, সেগুলোর প্রতি তোমরা এই রকম করবে। কিন্তু তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সম্পত্তি হিসাবে যে সব জাতিদের গ্রাম ও শহর তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেখানকার কাউকেই তোমরা বাঁচিয়ে রাখবে না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম অনুসারে তোমরা হিট্টীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়দের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলবে। তা না করলে তারা তাদের দেব-দেবীর পূজা করবার সময়ে যে সব জঘন্য কাজ করে তা তোমরাও শিখবে আর তাতে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবে। “তোমরা অনেক দিন ধরে যখন কোন গ্রাম বা শহর ঘেরাও করে রেখে তা দখল করবার জন্য যুদ্ধ করতে থাকবে তখন কুড়াল দিয়ে সেখানকার কোন গাছ নষ্ট করবে না, কারণ সেগুলোর ফল তোমরা খেতে পারবে। সেগুলো তোমরা কেটে ফেলবে না। মাঠের সেই গাছগুলো তো আর মানুষ নয় যে, সেগুলোর উপর তোমাদের হামলা করতে হবে। তবে যেগুলো ফলের গাছ নয় বলে তোমাদের জানা থাকবে সেগুলো তোমরা কেটে ফেলতে পারবে এবং যে জায়গার লোকেরা তোমাদের সংগে যুদ্ধ করছে তারা হেরে না যাওয়া পর্যন্ত সেই গাছগুলো তোমরা হামলা করবার কাজে ব্যবহার করতে পারবে। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ দখল করবার জন্য তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেখানকার কোন মাঠে হয়তো কাউকে খুন হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেতে পারে, কিন্তু কে তাকে খুন করেছে তা জানা নেই। এই অবস্থায় তোমাদের বৃদ্ধ নেতারা ও বিচারকেরা বাইরে গিয়ে সেই লাশ থেকে কাছের গ্রাম বা শহরগুলো কত দূরে তা মেপে দেখবে। লাশ থেকে যে জায়গাটা সবচেয়ে কাছে পড়বে সেখানকার বৃদ্ধ নেতাদের এমন একটা বক্‌না বাছুর নিতে হবে যাকে কখনও কাজে লাগানো হয় নি এবং যার কাঁধে কখনও জোয়াল দেওয়া হয় নি। যেখানে কখনও চাষ করা কিংবা বীজ বোনা হয় নি এবং যেখানে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে, বক্‌না বাছুরটাকে তেমন একটা উপত্যকায় তাদের নিয়ে যেতে হবে। সেই উপত্যকায় তারা বক্‌না বাছুরটার ঘাড় ভেংগে দেবে। তারপর ইমামেরা, অর্থাৎ লেবি-গোষ্ঠীর লোকেরা সামনে এগিয়ে যাবে, কারণ এবাদত-কাজ করবার জন্য, মাবুদের নামে দোয়া উচ্চারণ করবার জন্য এবং ঝগড়া-বিবাদ ও মারধরের বিচার করবার জন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদেরই বেছে নিয়েছেন। তারপর সবচেয়ে কাছের গ্রাম বা শহরের বৃদ্ধ নেতারা সেই ঘাড় ভাংগা বাছুরটার উপর তাদের হাত ধুয়ে ফেলবে। এর পর তারা বলবে, ‘এই রক্তপাত আমরা নিজেরা করি নি এবং হতেও দেখি নি। হে মাবুদ, তোমার মুক্ত করা বনি-ইসরাইলদের তুমি মাফ কর। এই লোকটির রক্তপাতের জন্য তুমি তোমার বান্দাদের দায়ী কোরো না।’ এতে সেই রক্তপাতের দোষ মাফ করা হবে। এইভাবে তোমরা নিজেদের মধ্য থেকে নির্দোষ লোকের রক্তপাতের দোষ মুছে ফেলতে পারবে, কারণ তখন মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করা হবে। “শত্রুদের সংগে যুদ্ধ করতে গিয়ে যখন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের হাতে তাদের তুলে দেবেন আর তোমরা তাদের বন্দী করবে, তখন যদি তাদের মধ্যেকার কোন সুন্দরী স্ত্রীলোককে দেখে তোমাদের কারও তাকে ভাল লাগে তবে সে তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবে। স্ত্রীলোকটিকে সে তার বাড়ীতে নিয়ে যাবে। তারপর স্ত্রীলোকটি তার চুল কামিয়ে ফেলবে ও নখ কেটে ফেলবে, আর বন্দী হবার সময়ে তার গায়ে যে সব কাপড়-চোপড় ছিল তা খুলে ফেলবে। এর পর তার বাড়ীতে থেকে সেই স্ত্রীলোকটি পুরো এক মাস তার মা-বাবার জন্য শোক করবে। তারপর সেই লোকটি তাকে বিয়ে করে তার স্বামী হবে এবং স্ত্রীলোকটিও তার স্ত্রী হবে। পরে যদি স্ত্রীলোকটির উপর সে অখুশী হয় তবে তাকে যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে দিতে হবে। সে তাকে বিক্রি করতে পারবে না কিংবা বাঁদী হিসাবে রাখতে পারবে না, কারণ সে তার অসম্মান করেছে। “এমন হতে পারে যে, একজন লোকের দু’জন স্ত্রী আছে, আর তাদের একজনকেই সে ভালবাসে অন্যজনকে নয়। তাদের দু’জনেরই যদি ছেলে হয় আর প্রথম ছেলের জন্ম হয় সেই স্ত্রীর গর্ভে যাকে সে ভালবাসে না, তবে সম্পত্তি উইল করে দেবার সময়ে যে স্ত্রীকে সে ভালবাসে না তার ছেলেকে বাদ দিয়ে অন্য স্ত্রীর ছেলেটিকে প্রথম ছেলের পাওনা অধিকার দেওয়া চলবে না, কারণ যে স্ত্রীকে সে ভালবাসে না তার ছেলেটিই আসলে তার প্রথম ছেলে। যে স্ত্রীকে সে ভালবাসে না তার ছেলেকে তার সম্পত্তি থেকে অন্য যে কোন ছেলের চেয়ে দ্বিগুণ ভাগ দিয়ে সেই ছেলেই যে প্রথম ছেলে তা তাকে স্বীকার করতে হবে। সেই ছেলেই তার বাবার পুরুষ-শক্তির প্রথম ফল। প্রথম ছেলের অধিকার তারই পাওনা। “যদি কারও ছেলে একগুঁয়ে এবং বিদ্রোহী হয়, যদি সে কিছুতেই মা-বাবার কথা না শোনে এবং তাদের শাসন না মানে, তবে তার মা-বাবা তাকে তাদের গ্রাম বা শহরের সদর দরজায় বৃদ্ধ নেতাদের কাছে নিয়ে যাবে। তারা সেই বৃদ্ধ নেতাদের বলবে, ‘আমাদের এই ছেলে ভীষণ একগুঁয়ে এবং বিদ্রোহী; সে আমাদের অগ্রাহ্য করে চলে। সে মাতাল এবং টাকা-পয়সা উড়িয়ে দেয়।’ তখন সেই জায়গার সমস্ত পুরুষেরা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে। এইভাবে তোমাদের মধ্য থেকে সেই খারাপী শেষ করে দিতে হবে। তাতে বনি-ইসরাইলরা সবাই এই কথা শুনে ভয় পাবে। “যদি কোন লোক মৃত্যুর শাস্তি পাবার মত কোন দোষ করে এবং তাকে হত্যা করে গাছে টাংগিয়ে রাখা হয়, তবে সকাল পর্যন্ত তার লাশ গাছে টাংগিয়ে রাখা চলবে না। সেই দিনই তাকে দাফন করে ফেলতে হবে, কারণ গাছে টাংগিয়ে রাখা লোক আল্লাহ্‌র বদদোয়াপ্রাপ্ত। সম্পত্তি হিসাবে যে দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন তা তোমরা নাপাক করবে না। “তোমাদের ইসরাইলীয় ভাইয়ের কোন গরু বা ভেড়াকে পথ হারিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখলে তোমরা চুপ করে বসে থাকবে না। তোমরা অবশ্যই সেটা তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। যদি সেই ভাই তোমাদের বাড়ীর পাশের কেউ না হয় কিংবা ভাইটি কে তা যদি জানা না থাকে, তাহলে সেটা তোমরা নিয়ে যাবে এবং সেই ভাই সেটার খোঁজে না আসা পর্যন্ত নিজের বাড়ীতে রেখে দেবে। সে আসলে পর সেটা তাকে ফিরিয়ে দেবে। তোমাদের ভাইয়ের গাধা কিংবা গায়ের কাপড় কিংবা তার হারিয়ে যাওয়া অন্য কিছু চোখে পড়লেও তোমরা ঐ রকম করবে, চুপ করে বসে থাকবে না। “তোমাদের ভাইয়ের গাধা কিংবা গরু রাস্তায় পড়ে গেছে দেখতে পেলে চুপ করে বসে থাকবে না। সেটা যাতে উঠে দাঁড়ায় সেইজন্য অবশ্যই তুমি তাকে সাহায্য করবে। “কোন স্ত্রীলোক যেন পুরুষের সাজে না সাজে কিংবা কোন পুরুষ যেন স্ত্রীলোকের পোশাক না পরে। যে তা করে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাকে ঘৃণা করেন। “তোমরা চলতে চলতে পথের পাশে কোন গাছে কিংবা মাটির উপরে যদি এমন কোন পাখীর বাসা দেখতে পাও যেখানে পাখীর মা বাচ্চাদের উপর বসে আছে কিংবা ডিমের উপর তা দিচ্ছে, তবে বাচ্চাসুদ্ধ মাকে তোমরা ধরে নিয়ে যাবে না। তোমরা বাচ্চাগুলো নিতে পার কিন্তু মাকে অবশ্যই তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে। এতে তোমাদের উন্নতি হবে আর তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকবে। “বাড়ী তৈরী করবার সময় তোমরা সেটার ছাদের চারপাশটা দেয়ালের মত করে কিছুটা উঁচু করে দেবে, যাতে কেউ ছাদের উপর থেকে পড়ে মারা গেলে বাড়ীর লোকেরা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী না হয়। “আংগুর ক্ষেতে তোমরা দুই জাতের বীজ লাগাবে না; তা করলে সেই বীজের ফসল এবং ক্ষেতের আংগুর দুই-ই তোমাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে। “তোমরা বলদ আর গাধা একসংগে জুড়ে চাষ করবে না। “তোমরা পশম আর মসীনা সুতা মিশিয়ে বোনা কাপড় পরবে না। “তোমাদের গায়ের চাদরের চার কোণায় থোপ্‌না লাগাবে। আর এখন সে তার নিন্দা করে বলছে যে, সে তাকে সতী অবস্থায় পায় নি। কিন্তু এই দেখুন, আমার মেয়ের সতীত্বের প্রমাণ।’ এই বলে তারা বৃদ্ধ নেতাদের সামনে তার ব্যবহার করা কাপড় মেলে ধরবে। তখন বৃদ্ধ নেতারা তার স্বামীকে শাস্তি দেবে। তার কাছ থেকে তারা জরিমানা হিসাবে এক কেজি রূপা আদায় করে মেয়েটির বাবাকে দেবে, কারণ সে একজন ইসরাইলীয় সতী মেয়ের নামে বদনাম করেছে। এছাড়া মেয়েটি তার স্ত্রী-ই থাকবে এবং তার স্বামী জীবনে কখনও তাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। “কিন্তু কথাটা যদি সত্যি হয় এবং মেয়েটির সতীত্বের কোন প্রমাণ পাওয়া না যায়, তবে মেয়েটিকে তার বাবার বাড়ীর দরজার কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেই জায়গার পুরুষ লোকেরা সেখানে পাথর ছুঁড়ে তাকে হত্যা করবে। বাবার বাড়ীতে থাকবার সময়ে জেনা করে সে বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ভীষণ ঘৃণার কাজ করেছে। তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে এই রকম খারাপী শেষ করে দেবে। “কোন লোককে যদি অন্য কারও স্ত্রীর সংগে সহবাস করতে দেখা যায় তবে যে তার সংগে সহবাস করেছে সেই পুরুষ ও সেই স্ত্রীলোক দু’জনকেই হত্যা করতে হবে। তোমরা বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এই রকম খারাপী শেষ করে দেবে। “বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এমন কোন মেয়েকে গ্রাম বা শহরের মধ্যে পেয়ে যদি কেউ তার সংগে সহবাস করে, তবে তাদের দু’জনকেই সেখানকার সদর দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। মেয়েটিকে হত্যা করতে হবে কারণ গ্রাম বা শহরের মধ্যে থেকেও সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে নি, আর পুরুষটিকে হত্যা করতে হবে কারণ সে অন্যের স্ত্রীকে নষ্ট করেছে। তোমাদের মধ্য থেকে এই রকম খারাপী তোমরা শেষ করে দেবে। “বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এমন কোন মেয়েকে নির্জন খোলা মাঠে পেয়ে যদি কেউ জোর করে তার সংগে সহবাস করে তবে যে লোকটি তা করবে কেবল তাকেই হত্যা করতে হবে। মেয়েটির প্রতি তোমরা কিছু করবে না; মৃত্যুর শাস্তি পাবার মত কোন গুনাহ্‌ সে করে নি। এটা একজন আর একজনকে ধরে হত্যা করবার মতই, কারণ লোকটি মেয়েটিকে খোলা মাঠে পেয়েছিল আর বিয়ের কথা দেওয়া মেয়েটি যদিও চিৎকার করেছিল তবুও তাকে রক্ষা করবার মত কেউ সেখানে ছিল না। “বিয়ে ঠিক হয় নি এমন কোন সতী মেয়েকে পেয়ে যদি কেউ জোর করে তার সংগে সহবাস করে আর যদি তারা ধরা পড়ে, তবে লোকটিকে মেয়ের বাবাকে আধা কেজি রূপা দিতে হবে। মেয়েটিকে নষ্ট করেছে বলে তাকে তার বিয়ে করতে হবে। সে জীবনে কখনও তাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। “সৎমাকে কারও বিয়ে করা চলবে না; তাতে সে বাবার স্ত্রীর সংগে জেনা করে বাবাকে অসম্মান করবে। “যার অণ্ডকোষ থেঁৎলে দেওয়া কিংবা পুরুষাংগ কেটে ফেলা হয়েছে সে মাবুদের বান্দাদের সমাজে যোগ দিতে পারবে না। “কোন জারজ লোক মাবুদের বান্দাদের সমাজে যোগ দিতে পারবে না; তার চৌদ্দ পুরুষেও কেউ তা করতে পারবে না। “কোন অম্মোনীয় কিংবা মোয়াবীয় মাবুদের বান্দাদের সমাজে যোগ দিতে পারবে না; তার চৌদ্দ পুরুষেও কেউ তা কখনও করতে পারবে না। মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পরে তোমাদের যাত্রার পথে তারা খাবার ও পানি নিয়ে তোমাদের কাছে এগিয়ে আসে নি, বরং তোমাদের বদদোয়া দেবার জন্য তারা ইরাম-নহরয়িম দেশের পথোর শহর থেকে বাউরের ছেলে বালামকে টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বালামের কথায় সায় দেন নি; তোমাদের মহব্বত করেন বলে তিনি বরং এমন করলেন যাতে সেই বদদোয়া তোমাদের দোয়া হয়ে ওঠে। তোমরা যতদিন বাঁচবে ততদিন এদের কোন উপকার বা উন্নতির চেষ্টা করবে না। “কিন্তু ইদোমীয়দের তোমরা ঘৃণা করবে না, কারণ তারা তোমাদের ভাই। মিসরীয়দেরও ঘৃণা করবে না, কারণ তাদের দেশে তোমরা বিদেশী হিসাবে বাস করতে। তোমাদের মধ্যে বাস করবার পরে তৃতীয় পুরুষ থেকে এরা মাবুদের বান্দাদের সমাজে যোগ দিতে পারবে। “শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ছাউনি ফেলবার পরে সমস্ত রকম নাপাকী থেকে তোমরা দূরে থাকবে। রাতে বীর্যপাতের দরুন যদি তোমাদের কেউ নাপাক হয়, তবে তাকে ছাউনির বাইরে গিয়ে থাকতে হবে। বিকাল হয়ে আসলে তাকে গোসল করে ফেলতে হবে। সূর্য ডুবে গেলে পর সে ছাউনিতে ফিরে যেতে পারবে। “পায়খানার জন্য ছাউনির বাইরে তোমাদের একটা জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। তোমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে মাটি খুঁড়বার জন্য একটা কিছু রাখতে হবে। পায়খানা করবার আগে তোমরা সেটা দিয়ে গর্ত করে পায়খানা মাটি চাপা দিয়ে দেবে। তোমাদের রক্ষা করবার জন্য এবং তোমাদের শত্রুদের তোমাদের হাতে তুলে দেবার জন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের ছাউনির মধ্যে ঘুরে বেড়ান। সেইজন্য তোমাদের ছাউনি পাক-পবিত্র অবস্থায় রাখতে হবে যাতে তোমাদের মধ্যে জঘন্য কিছু দেখে তিনি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেন। “কারও গোলাম যদি তোমাদের কাছে এসে আশ্রয় নেয় তবে তার মালিকের হাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়ো না। সেই গোলাম তোমাদের মধ্যে যেখানে বাস করতে চায় তাকে সেখানেই বাস করতে দিয়ো; তাকে কষ্ট দিয়ো না। “কোন ইসরাইলীয় স্ত্রীলোক যেন মন্দির-বেশ্যা না হয়; কোন ইসরাইলীয় পুরুষও যেন মন্দির-বেশ্যার জীবন না কাটায়। পুরুষ হোক বা স্ত্রীলোক হোক যে বেশ্যার জীবন কাটায় তার রোজগারের টাকা মানত পূরণের জন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরে আনা চলবে না, কারণ এই রকম পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের মাবুদ ঘৃণা করেন। “তোমরা কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে সুদ নেবে না- সেই সুদ টাকা-পয়সার উপরেই হোক কিংবা খাবার জিনিসের উপরেই হোক কিংবা অন্য যে কোন জিনিসের উপরেই হোক। অন্য জাতির লোকদের কাছ থেকে তোমরা সুদ নিতে পার কিন্তু কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে নয়। এইভাবে চললে তোমরা যে দেশ দখল করতে যাচ্ছ সেখানে তোমরা যাতে হাত দেবে তাতেই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দোয়া করবেন। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে যদি তোমরা কোন মানত কর তবে তা পূরণ করতে দেরি কোরো না, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ কখনও তা ছেড়ে দেবেন না। তা পূরণ না করলে তোমাদের গুনাহ্‌ হবে; কিন্তু মানত না করলে গুনাহ্‌ হবে না। তোমরা মুখ দিয়ে যে মানতের কথা উচ্চারণ করবে তা তোমাদের পূরণ করতেই হবে, কারণ তোমরা নিজের ইচ্ছায় নিজের মুখেই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে সেই মানত করেছ। “অন্য কারো আংগুর ক্ষেতে গিয়ে তোমরা খুশীমত আংগুর খেতে পারবে, কিন্তু তা নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন কিছুতে তুলে রাখা চলবে না। কারও শস্য ক্ষেতে গিয়ে তোমরা হাত দিয়ে শীষ ছিঁড়তে পারবে, কিন্তু ফসলের গায়ে কাসে- লাগানো চলবে না। “বিয়ে করবার পরে যদি কেউ স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখে তার উপর অসন্তুষ্ট হয় আর তালাক-নামা লিখে তার হাতে দিয়ে তাকে বাড়ী থেকে বিদায় করে দেয়, তবে তার প্রথম স্বামী, যে তাকে বিদায় করে দিয়েছিল সে তাকে আর বিয়ে করতে পারবে না, কারণ সে নাপাক হয়ে গেছে। এই রকমের বিয়ে মাবুদ ঘৃণা করেন। সম্পত্তি হিসাবে যে দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন তোমরা এইভাবে তার উপর গুনাহ্‌ ডেকে আনবে না। “অল্পদিন হয় বিয়ে করেছে এমন কোন লোককে যুদ্ধে পাঠানো চলবে না কিংবা তার উপর অন্য কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সে যাকে বিয়ে করেছে তার সন্তুষ্টির জন্য এক বছর পর্যন্ত এই সব কাজ থেকে রেহাই দিয়ে তাকে বাড়ীতে থাকতে দিতে হবে। “ঋণের বন্ধক হিসাবে কারও জাঁতা কিংবা তার উপরের পাথরটাও নেওয়া চলবে না, কারণ তাতে লোকটির বেঁচে থাকবার উপায়টাই বন্ধক নেওয়া হবে। “যদি দেখা যায়, কোন লোক কোন ইসরাইলীয় ভাইকে চুরি করে নিয়ে গোলাম হিসাবে ব্যবহার করছে কিংবা বিক্রি করে দিয়েছে, তবে সেই চোরকে মরতে হবে। তোমাদের মধ্য থেকে তোমরা এই রকম খারাপী শেষ করে দেবে। “চর্মরোগ দেখা দিলে তোমাদের সতর্ক হতে হবে এবং লেবীয় ইমামেরা যে নির্দেশ দেবে তা যত্নের সংগে পালন করতে হবে। আমি তাদের যে হুকুম দিয়েছি তোমাদের সাবধান হয়ে সেইমত চলতে হবে। মিসর দেশ থেকে বেরিয়ে আসবার পরে পথে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ মরিয়মের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা দিয়েছিলেন তা ভুলে যেয়ো না। “কাউকে কিছু ধার দিয়ে বন্ধক হিসাবে কোন জিনিস নেবার জন্য তার বাড়ীর মধ্যে যেয়ো না। তোমরা বাইরে থেকো এবং যাকে তুমি ধার দিচ্ছ তাকেই বন্ধক দেবার জিনিসটা বাইরে তোমাদের কাছে নিয়ে আসতে দিয়ো। লোকটি যদি গরীব হয় তবে তার বন্ধক রাখা কাপড়টা নিজের কাছে রেখে দিয়ে ঘুমাতে যেয়ো না। সন্ধ্যার সময় তাকে তা ফিরিয়ে দিতেই হবে যাতে সে তা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে পারে। এতে সে তোমাদের ভাল চাইবে, আর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে সেই ফিরিয়ে দেবার কাজটা হবে তোমাদের পক্ষে তাঁর ইচ্ছামত চলা। “পাওনার ব্যাপারে কোন গরীব এবং অভাবী মজুরের প্রতি অন্যায় করবে না- সে তোমাদের কোন ইসরাইলীয় ভাই হোক কিংবা তোমাদের দেশের ভিন্ন জাতির কোন বাসিন্দাই হোক। সূর্য ডুববার আগেই তোমরা তার মজুরি দিয়ে দেবে, কারণ সে গরীব এবং সেই মজুরির উপরেই সে ভরসা করছে। তা না করলে তোমাদের গুনাহ্‌ হবে, আর সে তোমাদের বিরুদ্ধে মাবুদের কাছে কাতর হয়ে বিচার চাইতে পারে। “ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদের হত্যা করা চলবে না। প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে। “বিদেশী বাসিন্দা কিংবা এতিমের প্রতি অন্যায় বিচার হতে দিয়ো না। কোন বিধবার কাছ থেকে বন্ধক হিসাবে তার গায়ের কাপড় নিয়ো না। মনে রেখো, মিসর দেশে তোমরা গোলাম ছিলে আর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করে এনেছেন। সেইজন্যই আমি তোমাদের এই সব করবার হুকুম দিচ্ছি। “তোমাদের জমির ফসল কাটবার পরে যদি শস্যের কোন আঁটি তোমরা সংগে নিতে ভুলে যাও তবে সেটা আর ফিরে আনতে যেয়ো না। বিদেশী বাসিন্দা, এতিম এবং বিধবাদের জন্য সেটা ফেলে রেখো। তাতে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব কাজেই তোমাদের দোয়া করবেন। জলপাই পাড়বার সময় তোমরা একই ডাল থেকে দু’বার ফল পাড়তে যেয়ো না। যা থেকে যাবে তা বিদেশী বাসিন্দা, এতিম ও বিধবাদের জন্য রেখে দিয়ো। তোমাদের আংগুর ক্ষেতের আংগুর তুলবার সময় তোমরা একই ডাল থেকে দু’বার আংগুর তুলো না। যা থেকে যাবে তা বিদেশী বাসিন্দা, এতিম ও বিধবাদের জন্য রেখে দিয়ো। ভুলে যেয়ো না তোমরা মিসর দেশে গোলাম ছিলে। সেইজন্য আমি তোমাদের এই সব করতে হুকুম দিচ্ছি। “যদি লোকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয় আর তা আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তবে বিচারকেরা তার বিচার করে নির্দোষকে নির্দোষ এবং দোষীকে দোষী বলে রায় দেবে। সেই রায়ে দোষীকে যদি মার দেবার নির্দেশ দেওয়া হয় তবে বিচারক তাকে মাটিতে শুইয়ে দোষ অনুসারে যে কয়টা আঘাত তার পাওনা তা তাঁর নিজের সামনেই দেওয়াবে, কিন্তু চল্লিশটার বেশী আঘাত তাকে দেওয়া চলবে না। এর বেশী দিলে একজন ইসরাইলীয় ভাইকে সকলের সামনে অসম্মান করা হবে। “শস্য মাড়াই করবার সময়ে বলদের মুখে জাল্‌তি বেঁধো না। “ভাইয়েরা এক পরিবার হয়ে বাস করবার সময়ে যদি এক ভাই ছেলে না রেখে মারা যায়, তবে তার বিধবা স্ত্রী পরিবারের বাইরে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। তার স্বামীর ভাই তাকে বিয়ে করবে এবং তার প্রতি স্বামীর ভাইয়ের যে কর্তব্য তা পালন করবে। তাহলে তার যে প্রথম ছেলে হবে সে সেই মৃত ভাইয়ের নাম রক্ষা করবে আর সেই ভাইয়ের নাম বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে মুছে যাবে না। কিন্তু সে যদি ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করতে না চায় তবে সেই স্ত্রী গ্রাম বা শহরের সদর দরজায় বৃদ্ধ নেতাদের কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমার স্বামীর ভাই বনি-ইসরাইলদের মধ্যে তার ভাইয়ের নাম রক্ষা করতে রাজী নয়। আমার প্রতি তার যে কর্তব্য তা সে পালন করতে চায় না।’ তখন সেখানকার বৃদ্ধ নেতারা সেই লোকটিকে ডেকে বুঝাবেন। এর পরেও যদি সে বলতে থাকে যে, সে তাকে বিয়ে করতে রাজী নয়, তবে তার ভাইয়ের স্ত্রী বৃদ্ধ নেতাদের সামনেই লোকটির কাছে গিয়ে তার পা থেকে এক পাটি জুতা খুলে নেবে এবং তার মুখে থুথু দিয়ে বলবে, ‘ভাইয়ের বংশ যে রক্ষা করতে চায় না তার প্রতি এ-ই করা হয়।’ বনি-ইসরাইলদের মধ্যে সেই লোকের বংশকে বলা হবে ‘জুতাহারার বংশ।’ “দু’জন লোক মারামারি করবার সময়ে যদি তাদের একজনের স্ত্রী তার স্বামীকে অন্যজনের হাত থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে কাছে গিয়ে অন্য লোকটির পুরুষাংগ চেপে ধরে, তবে তোমরা সেই স্ত্রীলোকের হাত কেটে ফেলবে। তাকে তোমরা কোন দয়া দেখাবে না। “তোমাদের থলিতে যেন একই ওজন দেখাবার জন্য দু’টা করে বাট্‌খারা না থাকে, একটা বেশী ওজনের আর একটা কম ওজনের। তোমাদের বাড়ীতে যেন একই মাপ দেখাবার জন্য দু’টা করে পাত্র না থাকে, একটা বেশী মাপের আর একটা কম মাপের। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের যে দেশ দিতে যাচ্ছেন সেখানে যেন তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পার সেইজন্য তোমাদের ঠিক এবং উচিত মাপের বাট্‌খারা ও পাত্র রাখতে হবে। এর কারণ হল, যে এই সব করে, অর্থাৎ যে ঠকিয়ে বেড়ায় তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাকে ঘৃণা করেন। “তোমরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পরে আমালেকীয়রা পথে তোমাদের সংগে যা করেছিল তা ভুলে যেয়ো না। তোমাদের শ্রান্ত-ক্লান্ত অবস্থায় যারা পিছনে পড়েছিল তারা তাদের উপর হামলা চালিয়েছিল। তারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে নি। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা সম্পত্তি হিসাবে দখল করবার জন্য তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেখানে তোমাদের চারপাশের শত্রুদের সংগে লড়াই থেকে তিনি যখন তোমাদের বিশ্রাম দেবেন তখন দুনিয়ার উপর থেকে আমালেকীয়দের চিহ্ন তোমাদের একেবারে মুছে ফেলতে হবে। এই কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা সম্পত্তি হিসাবে তোমাদের দিতে যাচ্ছেন তোমরা সেটা দখল করে যখন সেখানে বাস করতে থাকবে, তখন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া সেই দেশের জমিতে তোমরা যে সব ফসল ফলাবে তার প্রথমে তোলা কিছু ফসল টুকরিতে রাখবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য যে জায়গাটা তাঁর বাসস্থান হিসাবে বেছে নেবেন সেই ফসল তোমরা সেখানে নিয়ে যাবে। তখন যে ইমাম থাকবে তোমরা প্রত্যেকে তাকে বলবে, ‘আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে আজ আমি স্বীকার করছি যে, তিনি যে দেশটা আমাদের দেবেন বলে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়েছিলেন সেই দেশে আমি এসে গেছি।’ তখন ইমাম তোমাদের হাত থেকে সেই সব টুকরি নিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোরবানগাহের সামনে রাখবে। তারপর তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে বলবে, ‘আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন ইরামীয় যাযাবর। তিনি মাত্র কয়েকজন লোক নিয়ে মিসর দেশে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে বাস করবার সময় তাঁর মধ্য দিয়ে একটি মহান ও শক্তিশালী জাতির সৃষ্টি হয়েছিল যার লোকসংখ্যা ছিল অনেক। কিন্তু মিসরীয়রা আমাদের সংগে ভাল ব্যবহার করে নি। তারা আমাদের কষ্ট দিয়েছিল এবং আমাদের উপর একটা কঠিন পরিশ্রমের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। তখন আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে কান্নাকাটি করলাম। তিনি আমাদের কান্না শুনলেন, আমাদের কষ্ট ও পরিশ্রম দেখলেন; আরও দেখলেন আমাদের উপর কি রকম জুলুম করা হচ্ছে। সেইজন্য তিনি তাঁর কঠোর এবং শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে ভয় জাগানো কাজ এবং অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়ে মিসর দেশ থেকে আমাদের বের করে আনলেন। তিনি আমাদের এখানে এনেছেন এবং দুধ আর মধুতে ভরা এই দেশ আমাদের দিয়েছেন। সেইজন্য হে মাবুদ, তোমার দেওয়া জমির প্রথমে তোলা ফসল আমি তোমার কাছেই এনেছি।’ এই বলে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমরা তোমাদের টুকরি রাখবে এবং তাঁকে সেজদা করবে। তোমাদের এবং তোমাদের পরিবারকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে সব ভাল ভাল জিনিস দিয়ে দোয়া করেছেন তা নিয়ে তোমরা, লেবীয়রা এবং তোমাদের মধ্যেকার বিদেশী বাসিন্দারা আনন্দ করবে। “প্রত্যেক তৃতীয় বছরে তোমাদের সব ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করা শেষ হলে পর সেগুলো তোমরা লেবীয়, বিদেশী বাসিন্দা, এতিম এবং বিধবাদের দেবে। তাতে ঐ সব লোকেরা তোমাদের দেশের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করে তৃপ্ত হবে। তারপর তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে বলবে, ‘আমি তোমার হুকুম অনুসারে আমার আয় থেকে পবিত্র অংশটা বাড়ী থেকে বের করে এনে লেবীয়, বিদেশী বাসিন্দা, এতিম এবং বিধবাদের দিয়েছি। তোমার হুকুম আমি অমান্য করি নি কিংবা সেগুলোর একটাও আমি ভুলে যাই নি। মৃতদের জন্য শোক প্রকাশের অবস্থায় আমি পবিত্র অংশ থেকে কোন কিছু খাই নি, কিংবা নাপাক অবস্থায় তা বাড়ী থেকে বের করি নি, কিংবা তা থেকে কোন অংশ মৃত লোকদের উদ্দেশে দান করি নি। আমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কথামত কাজ করেছি। তোমার হুকুম করা সব কিছুই আমি করেছি। হে মাবুদ, তোমার পবিত্র বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি নীচে তাকিয়ে দেখ আর তোমার বান্দাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের তুমি দোয়া কর। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে তোমার কসম খাওয়া ওয়াদা অনুসারে দুধ আর মধুতে ভরা যে দেশ তুমি আমাদের দিয়েছ সেই দেশকেও দোয়া কর।’ “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আজ তোমাদের এই সমস্ত নিয়ম ও নির্দেশ মেনে চলবার হুকুম দিচ্ছেন। তোমরা সতর্ক হয়ে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তা পালন করবে। আজকেই তোমরা স্বীকার করেছ যে, আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ আর তাঁর পথেই তোমরা চলবে। তোমরা স্বীকার করেছ যে, তাঁর নিয়ম, হুকুম ও নির্দেশ তোমরা পালন করবে এবং তাঁর কথামতই চলবে। আর মাবুদও আজকে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর ওয়াদা অনুসারে তোমরা তাঁরই বান্দা এবং তাঁর নিজের বিশেষ সম্পত্তি হয়েছ। তাঁর সব হুকুম তোমাদের মেনে চলতে হবে। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, প্রশংসা, সুনাম ও গৌরবের দিক থেকে তাঁর সৃষ্ট অন্যান্য জাতিদের উপরে তিনি তোমাদের স্থান দেবেন এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তোমরা হবে তাঁর উদ্দেশ্যে একটা পবিত্র জাতি।” মূসা ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের সংগে নিয়ে লোকদের বললেন, “যে সব হুকুম আজ আমি তোমাদের দিচ্ছি তা তোমরা পালন করবে। তোমরা জর্ডান নদী পার হয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া দেশে গিয়ে কতগুলো বড় বড় পাথর খাড়া করে নেবে এবং সেগুলো চুন দিয়ে লেপে দেবে, আর সেগুলোর উপর এই শরীয়তের সব কথাগুলো লিখবে। তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের কাছে করা তাঁর ওয়াদা অনুসারে দুধ আর মধুতে ভরা যে দেশটি তোমাদের দিতে যাচ্ছেন তোমরা সেখানে যাওয়ার পর, অর্থাৎ জর্ডান নদী পার হয়ে যাওয়ার পর আমার আজকের হুকুম অনুসারে তোমরা এবল পাহাড়ের উপর সেই পাথরগুলো খাড়া করে নিয়ে চুন দিয়ে লেপে দেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে তোমরা সেখানে একটা পাথরের কোরবানগাহ্‌ তৈরী করবে। পাথরগুলোর উপর তোমরা কোন লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এই কোরবানগাহ্‌টি তোমরা গোটা গোটা পাথর দিয়ে তৈরী করবে আর তার উপর তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দেবে। সেখানে তোমরা যোগাযোগ-কোরবানী দেবে ও সেই কোরবানীর জিনিস খেয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে আনন্দ করবে। যে পাথরগুলো তোমরা খাড়া করে নেবে তার উপর এই শরীয়তের সব কথাগুলো খুব স্পষ্ট করে লিখবে।” এর পর মূসা লেবীয় ইমামদের নিয়ে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বললেন, “হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা চুপ করে শোন। আজ তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নিজের বান্দা হয়েছ। তোমরা তাঁর বাধ্য হয়ে চলবে। আজ আমি যে সব হুকুম ও নিয়ম তোমাদের দিচ্ছি তা তোমরা পালন করে চলবে।” ঐ দিনই মূসা লোকদের এই হুকুম দিলেন, “তোমরা জর্ডান নদী পার হয়ে যাবার পর যখন মাবুদের দোয়া উচ্চারণ করা হবে তখন শিমিয়োন, লেবি, এহুদা, ইষাখর, ইউসুফ ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকেরা গরিষীম পাহাড়ের উপরে থাকবে। আর যখন তাঁর বদদোয়া উচ্চারণ করা হবে তখন রূবেণ, গাদ, আশের, সবূলূন, দান ও নপ্তালি-গোষ্ঠীর লোকেরা এবল পাহাড়ের উপরে থাকবে। “লেবীয়রা তখন সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সামনে চিৎকার করে এই কথা বলবে: ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে ছাঁচে ফেলে কিংবা কাঠ বা পাথর খোদাই করে কোন মূর্তি তৈরী করে এবং পূজার জন্য তা গোপন জায়গায় স্থাপন করে। এই সব মূর্তি মাবুদের ঘৃণার জিনিস, কারিগরের হাতের কাজ মাত্র।’ তখন সবাই বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে মা কিংবা বাবাকে অসম্মান করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে অন্য লোকের জমির সীমানা-চিহ্ন সরিয়ে দেয়।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে অন্ধকে ভুল পথে নিয়ে যায়।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে বিদেশী বাসিন্দা, এতিম এবং বিধবাদের প্রতি অন্যায় বিচার হতে দেয়।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে তার সৎমায়ের সংগে জেনা করে, কারণ তাতে তার বাবাকে সে অসম্মান করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে পশুর সংগে সহবাস করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে তার সৎবোনের সংগে জেনা করে- সে বাবার মেয়ে হোক কিংবা মায়ের মেয়ে হোক।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে তার শাশুড়ীর সংগে জেনা করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে কাউকে গোপনে খুন করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে নির্দোষ লোককে খুন করবার জন্য ঘুষ নেয়।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে এই শরীয়তের কথাগুলো পালন করে না এবং তার ক্ষমতাকে অস্বীকার করে।’ তখন সকলে বলবে, ‘আমিন।’ “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রতি যদি তোমাদের পূর্ণ বাধ্যতা থাকে এবং আজ আমি তাঁর যে সব হুকুম তোমাদের দিচ্ছি তা যদি তোমরা যত্নের সংগে পালন কর, তবে তিনি দুনিয়ার অন্য সব জাতির উপরে তোমাদের স্থান দেবেন। তোমরা যদি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য হও তবে এই সব দোয়া তোমরা পাবে আর তা তোমাদের সংগে থাকবে: তোমাদের বাসস্থান ও ক্ষেত-খামারের সব কিছুতে তোমরা দোয়া পাবে। তোমরা দোয়া পাবে যার ফলে তোমাদের পরিবারের অনেক সন্তান, ক্ষেতে প্রচুর ফসল এবং পালের গরু-ছাগল-ভেড়ার অনেক বাচ্চা হবে। তোমাদের ফসলের ঝুড়ি ও ময়দা ঠাঁসবার পাত্র দোয়া পাবে। প্রতিদিনকার জীবনে তোমরা দোয়া পাবে। “যারা শত্রু হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে মাবুদ এমন করবেন যাতে তারা তোমাদের কাছে হেরে যায়। তারা এক দিক দিয়ে তোমাদের আক্রমণ করতে এসে সাত দিক দিয়ে পালিয়ে যাবে। “তোমাদের গোলাঘরের উপর মাবুদের দোয়া থাকবে এবং যে কাজে তোমরা হাত দেবে তাতেই তিনি দোয়া করবেন। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর দেওয়া দেশে তোমাদের দোয়া করবেন। “যদি তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুমগুলো পালন কর এবং তাঁর পথে চল তবে তিনি তাঁর কসম খেয়ে ওয়াদা অনুসারে, তাঁর পবিত্র জাতি হিসাবে তোমাদের দাঁড় করাবেন। তখন দুনিয়ার সমস্ত জাতি দেখতে পাবে যে, মাবুদের নামেই তোমাদের পরিচয়, আর তাতে তারা তোমাদের ভয় করে চলবে। যে দেশটা তোমাদের দেবেন বলে মাবুদ তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়েছিলেন সেই দেশে তিনি তোমাদের প্রচুর দান করবেন, অর্থাৎ তিনি তোমাদের পরিবারে অনেক ছেলেমেয়ে, পশুপালে অনেক বাচ্চা ও ক্ষেতে অনেক ফসল দেবেন। “তোমাদের দেশে সময়মত বৃষ্টি দিয়ে তোমাদের হাতের সব কাজে দোয়া করবার জন্য মাবুদ তাঁর দানের ভাণ্ডার, অর্থাৎ আসমান খুলে দেবেন। তোমরা অনেক জাতিকে ঋণ দিতে পারবে, কিন্তু কারও কাছ থেকে তোমাদের ঋণ নিতে হবে না। মাবুদ এমন করবেন যাতে তোমরা সকলের মাথার উপরে থাক, পায়ের তলায় নয়। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র যে সব হুকুম আজ আমি তোমাদের দিচ্ছি তাতে যদি তোমরা কান দাও এবং যত্নের সংগে তা পালন কর, তবে সব সময় তোমাদের স্থান থাকবে উপরে, নীচে নয়। আজ আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিচ্ছি, দেব-দেবীর পিছনে গিয়ে এবং তাদের পূজা করে তোমরা তা থেকে এদিক ওদিক সরে যাবে না। “কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথায় কান না দাও এবং আজকের দেওয়া আমার এই সব হুকুম ও নিয়ম যত্নের সংগে পালন না কর, তবে এই সব বদদোয়া তোমাদের উপর নেমে আসবে এবং তোমাদের সংগে থাকবে: তোমাদের বাসস্থান ও ক্ষেত-খামারের সব কিছুতে তোমরা বদদোয়াপ্রাপ্ত হবে। তোমাদের ফসলের ঝুড়ি ও ময়দা ঠাঁসবার পাত্র বদদোয়াপ্রাপ্ত হবে। তোমরা বদদোয়াপ্রাপ্ত হবে যার ফলে তোমাদের পরিবারে কম ছেলেমেয়ে, ক্ষেতে কম ফসল এবং পালের গরু, ছাগল ও ভেড়ার কম বাচ্চা হবে। প্রতিদিনকার জীবনে তোমরা বদদোয়াপ্রাপ্ত হবে। “খারাপ কাজ করে মাবুদকে ত্যাগ করবার অপরাধে তোমাদের সমস্ত কাজে তিনি তোমাদের বদদোয়া দেবেন, বিশৃঙ্খলায় ফেলবেন আর তিরস্কার করবেন, যার ফলে তোমরা ক্ষয় হতে হতে অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা যে দেশ দখল করতে যাচ্ছ মাবুদ সেখানে এমন করবেন যাতে তোমাদের মধ্যে মহামারী লেগেই থাকে আর শেষ পর্যন্ত তোমরা দেশ থেকে একেবারে শেষ হয়ে যাও। ক্ষয় রোগ, তিন রকমের মারাত্মক জ্বর, যুদ্ধ, গরম শুকনা বাতাস এবং ছাৎলা- এই সব মাবুদ তোমাদের উপর নিয়ে আসবেন এবং তোমাদের কষ্ট দেবেন যতক্ষণ না তোমরা ধ্বংস হয়ে যাও। তোমাদের মাথার উপরের আসমান হবে ব্রোঞ্জের মত শক্ত, আর পায়ের তলার মাটি হবে লোহার মত শক্ত। মাবুদ এমন করবেন যাতে তোমাদের দেশে বৃষ্টির বদলে আসমান থেকে ধুলা আর বালি পড়ে। সেগুলো তোমাদের উপর পড়বে যতক্ষণ না তোমরা শেষ হয়ে যাও। “মাবুদ এমন করবেন যাতে তোমরা তোমাদের শত্রুদের সামনে হেরে যাও। তোমরা এক দিক দিয়ে তাদের আক্রমণ করবে কিন্তু তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাবে সাত দিক দিয়ে। দুনিয়ার অন্য সব রাজ্যের লোকেরা তোমাদের অবস্থা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠবে। তোমাদের লাশ হবে আকাশের পাখী এবং দুনিয়ার পশুদের খাবার, আর তাদের তাড়িয়ে দেবার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। মাবুদ মিসরীয়দের সেই ফোড়া, আব, চুলকানি আর পাঁচড়া দিয়ে তোমাদের কষ্ট দেবেন যা থেকে কেউ তোমাদের ভাল করতে পারবে না। তিনি পাগলামি ও অন্ধতা দিয়ে এবং চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দিয়ে তোমাদের আরও কষ্ট দেবেন। অন্ধ লোক যেমন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় তেমনি করে তোমরা দিনের বেলাতেই হাতড়ে বেড়াবে; তোমাদের কোন কাজই সফল হবে না। তোমাদের উপর সব সময় জুলুম আর লুট চলবে; তা থেকে তোমাদের উদ্ধার করবার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। “যে স্ত্রীলোকের সংগে তোমার বিয়ে ঠিক হবে অন্য লোকে তার ইজ্জত নষ্ট করবে। তোমরা বাড়ী তৈরী করবে কিন্তু তাতে থাকতে পারবে না। তোমরা আংগুর ক্ষেত করবে কিন্তু তার ফল মুখে দিতে পারবে না। তোমাদের চোখের সামনেই তোমাদের গরু জবাই করা হবে, কিন্তু তার এক টুকরা গোশ্‌তও তোমাদের পেটে যাবে না। তোমাদের গাধাকে জোর করে তোমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু তা আর ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। তোমাদের ভেড়া তোমাদের শত্রুদের হাতে গিয়ে পড়বে; আর এই বিপদে তোমাদের উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। তোমাদের ছেলেমেয়েরা অন্য জাতির হাতে পড়বে। দিনের পর দিন তাদের আসবার পথ চেয়ে তোমাদের চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু কিছু করবার শক্তি তোমাদের হাতে থাকবে না। তোমাদের অচেনা জাতির লোকেরা তোমাদের জমির ফসল ও পরিশ্রমের ফল ভোগ করবে আর তোমাদের সারাটা জীবন ধরে তোমরা কেবল জুলুম ও খারাপ ব্যবহার ভোগ করবে। তোমরা যা দেখবে তা তোমাদের পাগল করে দেবে। মাবুদ তোমাদের হাঁটুতে ও পায়ে এমন সব বিষফোড়া দিয়ে কষ্ট দেবেন যা কখনও ভাল হবে না। সেই ফোড়া তোমাদের পায়ের তলা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত সব জায়গায় হবে। “যাকে তোমরা বাদশাহ্‌ করে তোমাদের উপরে বসাবে মাবুদ তাকে এবং তোমাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমন এক জাতির হাতে ফেলবেন যাকে তোমরাও জান না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরাও জানত না। সেখানে তোমরা কাঠ আর পাথরের দেব-মূর্তির পূজা করবে। মাবুদ তোমাদের যে সব জাতির মধ্যে তাড়িয়ে দেবেন তারা তোমাদের অবস্থা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠবে, আর তারা তোমাদের ঠাট্টা-তামাশা করবে ও কটুকথায় বিঁধবে। “তোমরা বুনবে অনেক কিন্তু কাটবে কম, কারণ পংগপালে ফসল খেয়ে ফেলবে। তোমরা আংগুর ক্ষেত করবে এবং তার যত্নও নেবে কিন্তু পোকায় তার ফল খেয়ে ফেলবে বলে তোমরা তা তুলতেও পারবে না কিংবা তার রসও খেতে পারবে না। তোমাদের সারা দেশে জলপাই গাছ থাকবে কিন্তু তার ফল ঝরে পড়ে যাবে বলে জলপাই তেল মাখা তোমাদের হবে না। যে সব ছেলেমেয়ে তোমাদের হবে তারা তোমাদের কাছে থাকবে না, কারণ তাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে। ঝাঁকে ঝাঁকে পংগপাল এসে তোমাদের দেশের গাছ-গাছড়া ও ফসল খেয়ে ফেলবে। “তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্যান্য জাতির লোকেরা তোমাদের উপরে উঠতে থাকবে আর তোমরা নামতে থাকবে তাদের নীচে। তারাই তোমাদের ঋণ দেবে কিন্তু তোমরা তাদের ঋণ দিতে পারবে না। তারা থাকবে তোমাদের মাথার উপরে আর তোমরা থাকবে তাদের পায়ের তলায়। “এই সব বদদোয়া তোমাদের উপরে নেমে আসবে। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য না হওয়ার দরুন এবং তিনি যে সব হুকুম ও নিয়ম দিয়েছেন তা পালন না করবার দরুন এই সব বদদোয়া তোমাদের পিছনে তাড়া করে আসবে ও তোমাদের ধরে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বদদোয়াগুলো অলৌকিক চিহ্ন ও অলৌকিক কাজ হিসাবে তোমাদের ও তোমাদের বংশধরদের উপর চিরকাল থাকবে। “মাবুদ দূর থেকে, দুনিয়ার শেষ সীমানা থেকে এমন এক জাতিকে তোমাদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসবেন যাদের ভাষা তোমরা বুঝবে না। ঈগল পাখীর মত করে সেই জাতি ছোঁ মেরে তোমাদের উপর নেমে আসবে। তারা হবে ভীষণ চেহারার লোক। তারা বুড়োদের সম্মান করবে না আর ছেলেমেয়েদের দয়ামায়া করবে না। তারা তোমাদের পশুর বাচ্চা ও ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা তোমাদের জন্য কোন ফসল, নতুন আংগুর-রস কিংবা তেল কিংবা গরুর বাছুর বা ভেড়ার বাচ্চা বাকী রাখবে না, আর শেষ পর্যন্ত তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা তোমাদের গ্রাম ও শহরগুলো ঘেরাও করে রাখবে, আর শেষ পর্যন্ত তোমাদের উঁচু ও শক্ত দেয়ালগুলো ভেংগে পড়বে যার উপর তোমরা এত ভরসা করছ। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেই দেশের সমস্ত গ্রাম ও শহর তারা ঘেরাও করবে। “সেগুলো ঘেরাও করে রাখবার সময় শত্রুরা তোমাদের এমন কষ্টে ফেলবে যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের সন্তানদেরই খাবে, অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া ছেলেমেয়েদের গোশ্‌ত খাবে। তখন তোমাদের মধ্যে যে লোক কোমল স্বভাবের আর ভাল অবস্থায় মানুষ হয়েছে, তার অন্তরও এমন হবে যে, নিজের ভাইয়ের প্রতি, কিংবা প্রিয় স্ত্রীর প্রতি, কিংবা জীবিত ছেলেমেয়েদের প্রতি তার কোন দয়ামায়া থাকবে না। যে সন্তানের গোশ্‌ত সে খাবে তার একটুও সে তাদের দেবে না, কারণ শত্রুরা যখন তোমাদের গ্রাম বা শহর ঘেরাও করে রেখে তোমাদের কষ্টে ফেলবে তখন এছাড়া আর কোন খাবারই তার কাছে থাকবে না। তোমাদের মধ্যে যে স্ত্রীলোক কোমল স্বভাবের এবং এমন ভাল অবস্থায় মানুষ হয়েছে যে তাকে কোন দিন মাটিতে পা ফেলতে হয় নি, তারও তার প্রিয় স্বামী ও ছেলেমেয়েদের প্রতি কোন দয়ামায়া থাকবে না। সন্তান জন্মের পর সেই সন্তান এবং তার পরে শরীর থেকে বের হয়ে আসা ফুল, এর কোনটাই সে তাদের খেতে দেবে না। তোমাদের ঘেরাও করে রাখবার সময় তোমাদের শত্রুরা যখন তোমাদের কষ্টে ফেলবে তখন সে নিজেই সেই ফুল ও সন্তান চুপিচুপি খাবে। “এই কিতাবে যে সব শরীয়ত লেখা রয়েছে তা যদি তোমরা যত্নের সংগে মেনে না চল, অর্থাৎ ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌’ বলে তাঁর এই যে গৌরবপূর্ণ ও ভয় জাগানো নামটি রয়েছে যদি তোমরা সেই নামের সম্মান না কর, তবে মাবুদ তোমাদের ও তোমাদের বংশধরদের উপর এমন সব ভীষণ ও অদ্ভুত রকমের আঘাত ও কষ্ট দেওয়া রোগ নিয়ে আসবেন যা অনেক দিন ধরে চলবে। মিসর দেশে যে সব রোগ দেখে তোমরা ভয় পেতে, তিনি সেই সবই তোমাদের উপর আনবেন আর সেগুলো তোমাদের ছাড়বে না। এছাড়া মাবুদ এমন সব রোগ ও আঘাত তোমাদের উপর আনবেন যার কথা এই তৌরাত কিতাবের মধ্যে লেখা নেই, আর শেষ পর্যন্ত তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমাদের লোকসংখ্যা আসমানের তারার মত হলেও তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রতি অবাধ্যতার দরুন তোমরা তখন মাত্র অল্প কয়েকজনই বেঁচে থাকবে। যে আনন্দে মাবুদ তোমাদের উন্নতি করেছেন ও তোমাদের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছেন সেই আনন্দে তখন তিনি তোমাদের ধ্বংস করে শেষ করে দেবেন। যে দেশ তোমরা দখল করতে যাচ্ছ সেই দেশ থেকে শিকড়সুদ্ধ তোমাদের তুলে ফেলা হবে। “তারপর মাবুদ দুনিয়ার এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত সমস্ত জাতির মধ্যে তোমাদের ছড়িয়ে দেবেন। তোমরা সেখানে তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের অজানা কাঠের ও পাথরের দেব-মূর্তির পূজা করবে। সেই সব জাতির মধ্যে তোমরা শান্তি পাবে না, আর তোমাদের বিশ্রাম করবার নিজের কোন জায়গা থাকবে না। সেখানে মাবুদ তোমাদের মন দুশ্চিন্তায় ভরে তুলবেন এবং আশা করে চেয়ে থাকা চোখ তোমাদের ক্লান্ত করে তুলবেন, আর তোমাদের অন্তর নিরাশায় ভরে দেবেন। কি হবে না হবে এই ভাবটা তোমাদের পেয়ে বসবে; আর দিনরাত ভয়-ভরা অন্তরে তোমরা বেঁচে থাকা সম্বন্ধে কখনও নিশ্চিত হতে পারবে না। তোমরা সকালবেলা বলবে, ‘সন্ধ্যা হোক,’ আর সন্ধ্যাবেলা বলবে, ‘সকাল হোক,’ কারণ তোমাদের অন্তর ভয়ে ভরা থাকবে আর চোখ অনেক কিছু দেখবে। মিসরে যাওয়া সম্বন্ধে আমি তোমাদের বলেছিলাম যে, সেই পথে আর কখনও তোমাদের পা দিতে হবে না; কিন্তু মাবুদ তখন জাহাজ ভরে ভরে তোমাদের মিসরে ফেরৎ পাঠাবেন। সেখানে তোমরা গোলাম ও বাঁদী হিসাবে শত্রুদের কাছে নিজেদের বিক্রি করতে চাইবে কিন্তু কেউ তোমাদের কিনবে না।” মাবুদ তুর পাহাড়ে মূসার মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের জন্য একটা ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন, আর এগুলো হল তাঁর দ্বিতীয় ব্যবস্থার শর্ত যা তিনি মূসাকে মোয়াব দেশে বনি-ইসরাইলদের জন্য স্থাপন করতে বলেছিলেন। মূসা সব বনি-ইসরাইলদের ডেকে বললেন, “মাবুদ মিসর দেশের ফেরাউন ও তাঁর সমস্ত কর্মচারীর প্রতি এবং তাঁর গোটা দেশটার প্রতি যা করেছিলেন তা তোমরা নিজেরাই দেখেছ। তাঁদের সেই মহাপরীক্ষা এবং মাবুদের দেখানো অলৌকিক চিহ্ন এবং তাঁর বড় বড় কুদরতি তোমরা নিজেদের চোখেই দেখেছ। কিন্তু তোমরা মাবুদের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত সেগুলো বুঝবার মন, দেখবার চোখ ও শুনবার কান পাও নি। চল্লিশ বছর মরুভূমির মধ্য দিয়ে মাবুদই তোমাদের চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে তোমাদের গায়ের কাপড় এবং জুতা নষ্ট হয়ে যায় নি। রুটি, আংগুর-রস কিংবা অন্য কোন মদানো রস তোমরা খেতে পাও নি। মাবুদই তা করেছেন যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, তিনিই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। “তোমরা এই জায়গায় পৌঁছালে পর হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোন ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজ আমাদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু আমরা তাঁদের হারিয়ে দিয়েছি। আমরা তাঁদের দেশ নিয়ে সম্পত্তি হিসাবে তা রূবেণীয়, গাদীয় ও মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে দিয়েছি। সেইজন্য তোমরা এই ব্যবস্থার সব হুকুমগুলো যত্নের সংগে মেনে চলবে যাতে সব কাজেই তোমাদের উন্নতি হয়। “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে আজ তোমরা সবাই এসে দাঁড়িয়েছ- দাঁড়িয়েছে তোমাদের সর্দারেরা ও প্রধানেরা, তোমাদের বৃদ্ধ নেতারা ও কর্মচারীরা এবং অন্যান্য সব বনি-ইসরাইলরা। তোমাদের সংগে রয়েছে তোমাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীলোকেরা; আর রয়েছে তোমাদের ছাউনিতে বাস-করা অন্য জাতির লোকেরা যারা তোমাদের কাঠ কাটে ও পানি তোলে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য আজ নিশ্চয়তার কসম খেয়ে যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন সেই কসম ও ব্যবস্থা মেনে নেবার জন্য তোমরা এখানে এসে দাঁড়িয়েছ। মাবুদ আজ তা স্থাপন করছেন যাতে তোমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে খাওয়া কসম এবং তোমাদের কাছে করা ওয়াদা অনুসারে তিনি তোমাদের আল্লাহ্‌ হতে পারেন এবং আজকের দিনে পাকাপাকি ভাবে তোমাদের তাঁর নিজের লোক করে নিতে পারেন। “তোমরা নিজেরাই জান, মিসর দেশে আমরা কি রকম জীবন কাটিয়েছি এবং কিভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছি। কাঠ, পাথর, সোনা ও রূপার তৈরী জঘন্য মূর্তি ও প্রতিমা তোমরা ঐ সব লোকদের মধ্যে দেখেছ। তোমরা দেখে নাও যেন তোমাদের মধ্যে আজ এমন কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক কিংবা কোন বংশ বা গোষ্ঠী না থাকে যার অন্তর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ফেলে ঐ সব জাতির দেব-দেবীর পূজা করতে আগ্রহী। যদি সেই রকম কেউ থাকে তবে তোমাদের মধ্যে সে হবে এমন একটা শিকড়ের মত যা পরে বিষাক্ত তেতো গাছ হয়ে উঠবে। এই রকম লোক এই কসম খাওয়া কথাগুলো শুনবার সময় যদি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করে এবং মনে মনে ভাবে, নিজের ইচ্ছামত চলতে থাকলেও সে নিরাপদে থাকবে, তাহলে তোমাদের সকলের উপরেই সে সর্বনাশ ডেকে আনবে। মাবুদ কখনও তাকে মাফ করতে রাজী হবেন না। সেই লোকের বিরুদ্ধে তাঁর রাগ জ্বলে উঠবে আর তাঁর অন্তরে তাঁর পাওনা এবাদতের আগ্রহ জেগে উঠবে। এই কিতাবে যে সব বদদোয়ার কথা লেখা আছে তা সবই তার উপর পড়বে। মাবুদ দুনিয়া থেকে তার নাম মুছে ফেলবেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্য থেকে দুঃখকষ্টের জন্য তাকেই বেছে নেবেন, আর তিনি এই তৌরাত কিতাবে লেখা ব্যবস্থার মধ্যে যে সব বদদোয়ার কথা বলা হয়েছে সেই কথা অনুসারে তা করবেন। “এইভাবে এই দেশের উপর যে সব গজব নেমে আসবে এবং মাবুদ যে সব রোগ দেশের উপর পাঠিয়ে দেবেন সেই বিষয়ে তোমাদের বংশধরেরা আর দূর দেশ থেকে আসা বিদেশীরা তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে। গোটা দেশটা লবণ আর গন্ধকে পুড়ে পড়ে থাকবে। তাতে কিছুই বোনা হবে না, কিছুই গজাবে না আর কোন ঘাস বা ঝোপ-ঝাড় তার উপর থাকবে না। এই দেশের অবস্থা হবে সাদুম, আমুরা, অদ্‌মা ও সবোয়িমের মত, যা মাবুদ তাঁর ভয়ংকর রাগে জ্বলে উঠে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তা দেখে অন্য সব জাতি জিজ্ঞাসা করবে, ‘মাবুদ কেন এই দেশটার এই দশা করেছেন? কেন তাঁর এই ভয়ংকর জ্বলন্ত রাগ?’ “এর জবাব হবে, ‘কারণ এই জাতি তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ব্যবস্থা ত্যাগ করেছে, যে ব্যবস্থা মিসর দেশ থেকে তাদের বের করে আনবার পর তিনি তাদের জন্য স্থাপন করেছিলেন। তারা তাঁকে ফেলে তাদের কাছে নতুন দেব-দেবীর পূজা করেছে ও তাদের সামনে মাথা নীচু করেছে, যাদের পূজা করবার নির্দেশ মাবুদ দেন নি। সেইজন্যই মাবুদের রাগ এই দেশের উপর জ্বলে উঠেছে আর তিনি এই কিতাবে লেখা সব বদদোয়া এই দেশের উপর ঢেলে দিয়েছেন। ভীষণ গজবে, ভয়ংকর জ্বলন্ত রাগে, তিনি দেশ থেকে তাদের উপ্‌ড়ে নিয়ে অন্য দেশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, আর আজও তারা সেখানেই আছে।’ “গোপন সব কিছু আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ব্যাপার, কিন্তু প্রকাশিত সব কিছু চিরকালের জন্য আমাদের ও আমাদের সন্তানদের, যেন এই শরীয়তের সমস্ত কথা আমরা পালন করে চলতে পারি। “আমি তোমাদের সামনে যে দোয়া ও বদদোয়া তুলে ধরলাম তা সবই তোমাদের উপর আসবে। তারপর তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে সব জাতির মধ্যে তোমাদের ছড়িয়ে দেবেন তাদের মধ্যে বাস করবার সময় এই সব কথায় তোমরা মন দেবে। সেই সময় যখন তোমরা ও তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে আসবে এবং আজ আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিচ্ছি তা পালন করে মনেপ্রাণে তাঁর ইচ্ছামত চলবে, তখন মাবুদ বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে তোমাদের ফিরিয়ে আনবেন। তিনি তোমাদের প্রতি মমতা করবেন এবং যে সব জাতিদের মধ্যে তোমাদের ছড়িয়ে দেবেন তাদের মধ্য থেকে তিনি আবার তোমাদের কুড়িয়ে আনবেন। আসমানের শেষ সীমানায়ও যদি তোমাদের ফেলে দেওয়া হয় সেখান থেকেও তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের কুড়িয়ে আনবেন। তোমাদের পূর্বপুরুষদের দেশেই তিনি তোমাদের ফিরিয়ে আনবেন আর তোমরা তা আবার দখল করবে। তিনি তোমাদের অনেক উন্নতি করবেন এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়েও তোমাদের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন। তোমরা যাতে তোমাদের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে মহব্বত করে বেঁচে থাক সেইজন্য তিনি তোমাদের ও তোমাদের বংশধরদের অন্তরের খৎনা করাবেন। এই সব বদদোয়া তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের শত্রুদের উপর আনবেন যারা তোমাদের ঘৃণা ও জুলুম করবে। তখন তোমরা আবার মাবুদের বাধ্য হয়ে চলবে আর তাঁর যে সব হুকুম আজ আমি তোমাদের দিচ্ছি তা মেনে চলবে। “তখন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব দিক থেকে তোমাদের উন্নতি করবেন। তিনি তোমাদের কাজকর্মে দোয়া করবেন এবং তোমাদের সন্তানের সংখ্যা, পশুর বাচ্চা এবং জমির ফসল বাড়িয়ে দেবেন। তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর তাঁর যে আনন্দ ছিল তোমাদের উপর আবার সেই আনন্দ নিয়ে তিনি তোমাদের উন্নতি করবেন- অবশ্য যদি তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য হয়ে এই তৌরাত কিতাবে লেখা তাঁর সব হুকুম ও নিয়ম পালন কর আর মনেপ্রাণে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে ফেরো। “আজ আমি তোমাদের যে হুকুম দিচ্ছি তা পালন করা তোমাদের পক্ষে তেমন শক্ত নয় কিংবা এই হুকুম তোমাদের নাগালের বাইরেও নয়। এই হুকুম বেহেশতে তুলে রাখা কোন জিনিস নয় যে, তোমরা বলবে, ‘কে বেহেশতে গিয়ে তা এনে আমাদের শোনাবে যাতে আমরা তা পালন করতে পারি?’ এটা সমুদ্রের ওপারের কোন জিনিসও নয় যে, তোমরা বলবে, ‘কে সমুদ্র পার হয়ে গিয়ে তা এনে আমাদের শোনাবে যাতে আমরা তা পালন করতে পারি?’ মাবুদের কথা তোমাদের সংগেই রয়েছে; রয়েছে তোমাদের মুখে ও দিলে যাতে তোমরা তা পালন করতে পার। “দেখ, আজ আমি তোমাদের সামনে যা তুলে ধরছি তা হল জীবন ও উন্নতি কিংবা মৃত্যু ও দুঃখকষ্ট। আজ তোমাদের কাছে আমার হুকুম এই যে, তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে, তাঁর পথে চলবে এবং তাঁর হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ মেনে চলবে। তাহলে তোমরা বাঁচবে এবং সংখ্যায় বেড়ে উঠবে, আর যে দেশ তোমরা দখল করবার জন্য যাচ্ছ সেখানে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দোয়া করবেন। “কিন্তু যদি তোমাদের অন্তর তাঁর কাছ থেকে সরে যায় এবং তোমরা তাঁর অবাধ্য হও আর যদি তোমরা দেব-দেবীর পূজার টানে তাদের সেজদা কর, তবে আজ আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি যে, তোমরা নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে। জর্ডান নদী পার হয়ে যে দেশ তোমরা দখল করতে যাচ্ছ সেখানে তোমরা বেশী দিন বেঁচে থাকবে না। পরে মূসা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বললেন, “আমার বয়স একশো বিশ বছর হয়ে গেছে। আমার কাজ আর আমি করতে পারছি না। মাবুদও আমাকে বলেছেন যে, জর্ডান নদী পার হয়ে যাওয়া আমার হবে না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেই নদী পার হয়ে তোমাদের আগে আগে যাবেন। তোমাদের সামনে থেকে ঐ সব জাতিদের তিনিই ধ্বংস করে দেবেন আর তোমরা তাদের দেশ দখল করে নেবে। মাবুদের কথা অনুসারে ইউসাই নদী পার হয়ে তোমাদের আগে আগে যাবে। আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোন এবং উজ আর তাঁদের দেশ যেমন মাবুদ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তেমনি করে তিনি সেই সব জাতিও ধ্বংস করে ফেলবেন। তাদের তিনি তোমাদের হাতে তুলে দেবেন আর আমি তাদের প্রতি যা করবার হুকুম দিয়েছি তোমরা তাদের প্রতি তা-ই করবে। তোমরা শক্ত হও ও মনে সাহস আন। তাদের দেখে তোমরা ভয় পেয়ো না কিংবা কেঁপে উঠো না, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তোমাদের সংগে যাবেন। তিনি কখনও তোমাদের ছেড়ে যাবেন না বা ত্যাগ করবেন না।” এর পর মূসা ইউসাকে ডাকলেন এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সামনে তাঁকে বললেন, “তুমি শক্তিশালী হও ও মনে সাহস আন, কারণ তোমাকেই এই লোকদের সংগে সেই দেশে যেতে হবে যে দেশটা এদের দেবার কসম মাবুদ এদের পূর্বপুরুষদের কাছে খেয়েছিলেন। তোমাকেই সেই দেশটা সম্পত্তি হিসাবে এদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। মাবুদ নিজেই তোমার আগে আগে যাবেন এবং তোমার সংগে থাকবেন। তিনি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাবেন না বা ত্যাগ করবেন না। তুমি ভয় কোরো না, উৎসাহ হারায়ো না।” লেবি-গোষ্ঠীর ইমামেরা, যাঁরা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি বয়ে নিয়ে যেতেন, মূসা সমস্ত শরীয়ত লিখে তাঁদের হাতে ও বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতাদের হাতে দিলেন। পুরুষ, স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে এবং তোমাদের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের ভিন্ন জাতির লোকদের ডেকে তোমরা একসংগে জমায়েত করবে, যাতে তারা তা শুনতে পারে এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করতে শেখে আর এই শরীয়তের সমস্ত কথা যত্নের সংগে পালন করে। এইভাবে তাদের ছেলেমেয়েরা, যাদের এই শরীয়তের কথা জানা থাকবে না, তারাও তা শুনতে পাবে এবং এই শিক্ষা পাবে যে, জর্ডান পার হয়ে যে দেশটা তোমরা দখল করতে যাচ্ছ সেখানে সারা জীবন তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তাদের ভয় করতে হবে।” এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, “তোমার মৃত্যুর দিন কাছে এসে গেছে। ইউসাকে ডেকে নিয়ে তুমি মিলন-তাম্বুতে যাও। সেখানে আমি তাকে তার কাজের ভার দেব।” কাজেই মূসা ও ইউসা মিলন-তাম্বুতে মাবুদের সামনে উপস্থিত হলেন। তখন মাবুদ মেঘের থামের মধ্যে সেই তাম্বুতে উপস্থিত হলেন এবং সেই থামটি তাম্বুর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে বিশ্রাম করতে যাচ্ছ, কিন্তু এই লোকেরা যে দেশে ঢুকতে যাচ্ছে সেখানে খুব শীঘ্রই তারা আমার প্রতি বেঈমানী করে সেখানকার দেবপূজায় নিজেদের বিকিয়ে দেবে। তারা আমাকে ত্যাগ করবে এবং আমি তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছি তারা তার অগ্রাহ্য করবে। যেদিন তারা তা করবে সেই দিন রাগে আমি তাদের ত্যাগ করব। আমি তাদের কাছ থেকে আমার মুখ ফিরিয়ে নেব আর তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন তাদের উপর অনেক বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট নেমে আসবে। সেই দিন তারা বলবে, ‘আমাদের আল্লাহ্‌ আমাদের সংগে নেই বলেই আমাদের উপর এই সব বিপদ এসেছে।’ তারা দেব-দেবীদের দিকে ফিরে যে সব খারাপ কাজ করবে সেইজন্য আমি নিশ্চয়ই সেই দিন আমার মুখ ফিরিয়ে নেব। “তোমরা এখন এই গজলটি লিখে নাও। এটা বনি-ইসরাইলদের শিখাবে এবং তাদের দিয়ে গাওয়াবে, যাতে তাদের বিরুদ্ধে এটা আমার পক্ষে একটা সাক্ষী হয়ে থাকে। তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আমার কসম খাওয়া সেই দুধ আর মধুতে ভরা দেশে যখন আমি তাদের নিয়ে যাব আর যখন তারা পেট ভরে খেয়ে সুখে থাকবে তখন তারা আমাকে তুচ্ছ করে আমার ব্যবস্থার অগ্রাহ্য করে দেব-দেবীর পিছনে গিয়ে তাদের পূজা করবে। ফলে তাদের উপর যখন অনেক বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট নেমে আসবে তখন এই গজলটাই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তাদের বংশধরেরা গজলটি ভুলে যাবে না। আমার কসম খেয়ে ওয়াদা করা দেশে তাদের নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি জানি যে, তাদের অন্তরে এখন কি রয়েছে।” মূসা ঐ দিন গজলটি লিখে বনি-ইসরাইলদের শিখিয়েছিলেন। নূনের ছেলে ইউসাকে মাবুদ এই হুকুম দিলেন, “তুমি শক্তিশালী হও ও মনে সাহস আন। যে দেশ দেবার ওয়াদা আমি কসম খেয়ে বনি-ইসরাইলদের কাছে করেছিলাম সেখানে তুমিই তাদের নিয়ে যাবে। আমি নিজেই তোমার সংগে থাকব।” মূসা এই শরীয়ত আগাগোড়া একটি কিতাবে লিখে নিলেন। তারপর মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী লেবীয়দের তিনি বললেন, “এই তৌরাত কিতাব নিয়ে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকের পাশে রাখ। এটা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে সেখানে থাকবে। তোমরা যে কেমন একগুঁয়ে ও বিদ্রোহী তা আমার জানা আছে। আমি তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকতেই যখন তোমরা মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছ তখন আমি মারা যাওয়ার পরে আরও কত বেশী করেই না তা করবে। তোমরা তোমাদের গোষ্ঠীর বৃদ্ধ নেতাদের ও কর্মচারীদের সবাইকে আমার সামনে জমায়েত কর। আমি তাদের এই সব কথা বলতে চাই আর আসমান ও জমীনকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী রেখে যেতে চাই। আমি জানি যে, আমার মৃত্যুর পরে তোমরা একেবারেই খারাপ হয়ে যাবে এবং যে পথে আমি তোমাদের চলবার নির্দেশ দিয়েছি তোমরা তা থেকে সরে যাবে। ভবিষ্যতে তোমাদের উপর বিপদ নেমে আসবে, কারণ মাবুদের চোখে যা খারাপ তোমরা তা করবে এবং তোমাদের নিজের হাতে গড়া মূর্তি দিয়ে তোমরা তাঁকে রাগিয়ে তুলবে।” তারপর মূসা এই গজলের কথাগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বনি-ইসরাইলদের শোনালেন: হে আসমান, আমার কথায় কান দাও; হে দুনিয়া, আমার মুখের কথা শোন। আমার শিক্ষা বৃষ্টির মত করে ঝরে পড়ুক, আমার কথা শিশিরের মত করে নেমে আসুক। হালকা এক পস্‌লা বৃষ্টির মত করে তা নতুন ঘাসের উপর ঝরে পড়ুক, আর গাছ-গাছড়ার উপর ভারী বৃষ্টি হয়ে তা পড়ুক। আমি মাবুদের নাম ঘোষণা করব। তোমরা আমাদের আল্লাহ্‌র মহিমা-কাওয়ালী গাও। তিনিই আশ্রয়-পাহাড়, তাঁর কাজ নিখুঁত; তাঁর সমস্ত পথ ন্যায়ের পথ। তিনি নির্ভরযোগ্য আল্লাহ্‌, তিনি কোন অন্যায় করেন না; তিনি ন্যায়বান ও সৎ। তাঁর প্রতি তাঁর বান্দারা জঘন্য ব্যবহার করেছে। তাদের অন্তরের কলংকের জন্য তারা আর তাঁর সন্তান নয়। তারা বেঈমান, তাদের মন সরল নয়। হে অবুঝ, বুদ্ধিহীন জাতি! এমনি করেই কি তোমরা মাবুদকে শোধ দেবে? তিনি কি তোমাদের পিতা ও সৃষ্টিকর্তা নন? তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন; তিনিই জাতি হিসাবে তোমাদের স্থাপন করেছেন। সেই পুরানো দিনগুলোর কথা মনে কর; তোমাদের অনেক দিন আগেকার পূর্বপুরুষদের কথা ভেবে দেখ। সেই সব দিনের কথা তোমাদের পিতাদের জিজ্ঞাসা কর, তাঁরা তোমাদের বলবেন; বুড়ো লোকদের জিজ্ঞাসা কর, তাঁরা তোমাদের বুঝিয়ে বলবেন। আল্লাহ্‌তা’লা যখন বিভিন্ন জাতিকে সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন, আর মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে ভাগ করলেন, তখন ইসরাইল জাতির লোকসংখ্যা মনে রেখে তিনি অন্য জাতিদের সীমানা ঠিক করে দিলেন। মাবুদের পাওনা ভাগই হল তাঁর বান্দারা; ইয়াকুব, হ্যাঁ, ইসরাইল জাতি হল তাঁর পাওনা সম্পত্তি। তিনি তাকে এক মরুভূমিতে পেলেন, পেলেন গর্জন্তভরা এক নির্জন জায়গায়। তিনি তাকে ঘিরে রাখলেন, যত্ন করলেন; তাকে চোখের মণির মত করে পাহারা দিয়ে রাখলেন, যেমন করে ঈগল পাখী তার বাসায় বাচ্চাদের চঞ্চল করে তোলে, যেমন করে তাদের উপর সে আস্তে আস্তে উড়তে থাকে, যেমন করে তাদের তুলে নেবার জন্য তার ডানা মেলে দেয়, আর যেমন করে তার পাখার উপর তাদের বয়ে নিয়ে যায়। মাবুদ একাই তাকে চালিয়ে নিয়ে আসলেন, তাঁর সংগে ছিল না কোন দেব-দেবী। বিজয়ী হিসাবে তাকে তিনি চালিয়ে নিয়ে গেলেন দেশের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে; তাকে ক্ষেতের ফসল খেতে দিলেন। তিনি তাকে খাওয়ালেন সেই মধু যা পাহাড়ের ফাটলে পাওয়া যায়, আর তাকে শক্ত পাথুরে জমির জলপাইয়ের তেল খাওয়ালেন। তিনি তাকে খাওয়ালেন গরুর দুধের দই আর ছাগল ও ভেড়ার দুধ, আর খাওয়ালেন মোটাসোটা ভেড়ার বাচ্চার গোশ্‌ত, ছাগলের গোশ্‌ত আর বাশন দেশের পুরুষ ভেড়ার গোশ্‌ত। তিনি তাকে খাওয়ালেন পরিপুষ্ট গম। হে ইসরাইল, তুমি গেঁজে ওঠা আংগুর-রস খেয়েছ। কিন্তু মোটা হয়ে যিশুরূণ লাথি মারল। হে যিশুরূণ, তুমি অতিরিক্ত খেয়ে ভারী ও মোটা হয়েছ। তারপর সে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করল, আর ছোট করে দেখল তার আশ্রয়-পাহাড়কে। দেবতা পূজায় তাঁর বান্দারা তাঁর পাওনা এবাদতের আগ্রহে আগুন লাগাল, জঘন্য মূর্তি পূজায় তাঁর রাগ জাগাল। তারা কোরবানী দিল ভূতদের উদ্দেশে যারা মাবুদ নয়, তারা কোরবানী দিল নতুন দেব-দেবীর উদ্দেশে, যারা মাত্র কিছুদিন আগে দেখা দিয়েছে, যাদের তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ভয় করত না। সেই আশ্রয়-পাহাড় তোমরা অবহেলা করেছ যিনি তোমাদের পিতা; সেই আল্লাহ্‌কে তোমরা ভুলে গেছ যিনি মায়ের মত প্রসব-বেদনার মধ্য দিয়ে তোমাদের দুনিয়াতে এনেছেন। তা দেখে মাবুদ তাঁর ছেলেমেয়েদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কারণ তারা তাঁর রাগ জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি বললেন, “আমি তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব, শেষে তাদের দশা কি হয় দেখব; কারণ এরা উল্টা পথে চলা জাতি, বেঈমান সন্তান। আল্লাহ্‌ নয় এমন দেবতার পূজা করে তারা আমার পাওনা এবাদতের আগ্রহে আগুন লাগিয়েছে; অসার মূর্তির পূজা করে তারা আমার রাগ জাগিয়ে তুলেছে। জাতিই নয় এমন জাতির হাতে ফেলে আমিও তাদের অন্তরে আগুন জ্বালাব; একটা অবুঝ জাতির হাতে ফেলে তাদের রাগ জাগাব। আমার রাগের আগুন জ্বলে উঠেছে; সেই আগুন জ্বলছে কবরের সবচেয়ে নীচু জায়গা পর্যন্ত। সেই আগুন দুনিয়া ও তার সব ফসল খেয়ে ফেলবে আর আগুন লাগাবে সব পাহাড়ের তলায়। “আমি সমস্ত বিপদ এনে তাদের উপর জড়ো করব; আমার সব তীর আমি তাদেরই উপর শেষ করব। আমি তাদের উপর দেহ ক্ষয় করা দুর্ভিক্ষ, ধ্বংসকারী মহামারী আর কষ্ট ভরা রোগ পাঠিয়ে দেব। তাদের বিরুদ্ধে আমি বুনো দাঁতাল পশু আর বুকে ভর করে চলা বিষাক্ত সাপ পাঠিয়ে দেব। শহরের বাইরে তলোয়ারের আঘাতে তাদের সন্তানেরা মারা পড়বে, আর বাড়ীর ভিতরে ভয়ের রাজত্ব চলবে। তাদের সব যুবক-যুবতী, ছোট ছেলেমেয়ে আর বুড়োরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম, আমি তাদের টুকরা টুকরা করে ফেলব, তাদের কথা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলব। কিন্তু আমি জানতাম এতে শত্রু বড়াই করবে আর না বুঝে বলবে যে, তাদেরই জয় হয়েছে; মাবুদ এই সব কিছুই করেন নি।” ইসরাইল জাতির মধ্যে ভাল বুদ্ধি দেবার লোক নেই, তাদের বিচারবুদ্ধি বলে কিছু নেই। বুদ্ধি থাকলে এই কথাটা তারা বুঝত, বুঝত তাদের শেষ দশা কি হবে। কি করে একজন হাজার জনকে তাড়ায়, কি করে দু’জনকে দেখে দশ হাজার পালায়, যদি না তাদের আশ্রয়-পাহাড় শত্রুদের হাতে তাদের বিকিয়ে দিয়ে থাকেন, যদি না মাবুদ শত্রুদের হাতে তাদের তুলে দিয়ে থাকেন? শত্রুদের আশ্রয়-পাহাড় আমাদের আশ্রয়-পাহাড়ের মত নয়, এটা আমাদের শত্রুদেরও রায়। মাবুদ বললেন, “তাদের আংগুর গাছ সাদুমের আংগুর গাছ থেকে আর আমুরার ক্ষেত থেকে এসেছে। তাদের আংগুরে রয়েছে বিষ, তাদের আংগুরের থোকা তেতো। তাদের আংগুর-রস হল সাপের বিষ, গোখ্‌রা সাপের ভয়ংকর বিষ। আমার কাছেই তা তোলা আছে, আমার ভাণ্ডার ঘরে সীলমোহর করা আছে। অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকার আমারই; যার যা পাওনা আমি তাকে তা-ই দেব। সময় হলেই শত্রুদের পা পিছ্‌লে যাবে; তাদের ধ্বংসের দিন তাদের কাছে এসে গেছে। তাদের জন্য যা ঠিক করে রাখা হয়েছে, তা শীঘ্রই তাদের উপর এসে পড়বে।” মাবুদ যখন দেখবেন, তাঁর বান্দাদের শক্তি ফুরিয়ে গেছে, গোলাম বা স্বাধীন কারও আর শক্তি নেই, তখন তিনি তাঁর বান্দাদের পক্ষ নেবেন, তাঁর গোলামদের উপর মমতা করবেন। তিনি তখন বলবেন, “কোথায় এখন তাদের দেব-দেবী? কোথায় তাদের সেই পাহাড় যাঁর কাছে তারা আশ্রয় নিয়েছিল? কোথায় সেই দেব-দেবী যারা তাদের কোরবানীর পশুর চর্বি খেয়েছিল, খেয়েছিল তাদের ঢালন-কোরবানীর আংগুর-রস? এখন তারা এসে তোমাদের সাহায্য করুক, আর তোমাদের আশ্রয় দিক। এবার তোমরা ভেবে দেখ যে, আমিই তিনি; আমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। মরণ-বাঁচন আমারই হাতে, আমি ক্ষত করেছি, আমিই সুস্থ করব; আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারে এমন কেউ নেই। আমি হাত তুলে কসম খেয়ে বলছি, আমার জীবনের কসম যে, যখন আমার ঝক্‌ঝকে তলোয়ারে আমি শান দেব, আমার বিচারের রায়কে কাজে লাগাবার জন্য তা হাতে নেব, তখন আমার শত্রুদের আমি শাস্তি দেব, আর যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের যা পাওনা তা তাদের দেব। মেরে ফেলা আর বন্দী লোকদের রক্ত খাইয়ে আমার তীরগুলোকে আমি মাতাল করে তুলব; আমার তলোয়ার গোশ্‌ত খাবে, লম্বা-চুলওয়ালা শত্রুর মাথার গোশ্‌ত খাবে।” হে সমস্ত জাতির লোকেরা, তোমরা মাবুদের বান্দাদের সংগে তাঁর প্রশংসা কর, কারণ তিনি তাঁর গোলামদের রক্তের শোধ নেবেন, তাঁর শত্রুদের শাস্তি দেবেন আর তাঁর দেশ ও তাঁর বান্দাদের গুনাহ্‌ ঢাকবার ব্যবস্থা করবেন। মূসা আর নূনের ছেলে ইউসা গিয়ে এই গজলের সব কথা লোকদের শোনালেন। তোমাদের জন্য এগুলো বাজে কথা নয়, এগুলো তোমাদের জীবন। জর্ডান নদী পার হয়ে তোমরা যে দেশ দখল করতে যাচ্ছ সেখানে এই কথাগুলো পালন করে তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারবে।” সেই দিনই মাবুদ মূসাকে বললেন, “তুমি জেরিকোর উল্টা দিকে মোয়াব দেশের অবারীম পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে নবো পাহাড়ে গিয়ে ওঠো এবং সম্পত্তি হিসাবে যে কেনান দেশটা আমি বনি-ইসরাইলদের দিচ্ছি তা একবার দেখে নাও। তোমার ভাই হারুন যেমন হোর পাহাড়ে মারা গিয়ে তার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেছে তেমনি করে তুমিও নবো পাহাড়ে উঠে মারা যাবে এবং তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবে। এর কারণ হল, সীন মরুভূমিতে কাদেশের মরীবার পানির কাছে বনি-ইসরাইলদের সামনে তোমরা আমার প্রতি অবিশ্বস্ততার কাজ করেছিলে এবং বনি-ইসরাইলদের সামনে আমাকে পবিত্র বলে মান্য কর নি। সেইজন্য যে দেশটা আমি বনি-ইসরাইলদের দিতে যাচ্ছি তা তুমি কেবল দূর থেকে দেখতে পাবে কিন্তু সেখানে তোমার ঢোকা হবে না।” আল্লাহ্‌র বান্দা মূসা ইন্তেকাল করবার আগে বনি-ইসরাইলদের এই বলে দোয়া করেছিলেন, “মাবুদ তুর পাহাড় থেকে আসলেন, তিনি সেয়ীর থেকে তাদের উপর আলো দিলেন; তাঁর আলো পারণ পাহাড় থেকে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি লক্ষ লক্ষ পবিত্র ফেরেশতাদের মাঝখান থেকে আসলেন; তাঁর ডান হাতে রয়েছে তাদের জন্য আগুন ভরা আইন। “সত্যিই তিনি তাঁর নিজের বান্দাদের মহব্বত করেন। পবিত্র ফেরেশতারা তাঁর অধীনে রয়েছেন, তাঁরা সবাই তাঁর পায়ে নত হয়ে আছেন; তাঁরই কাছে তাঁরা হুকুম পান। আমাদের কাছে মূসা যে শরীয়ত দিয়েছিলেন, সেটাই হল ইয়াকুব-গোষ্ঠীর ধন। যখন ইসরাইলীয় সর্দারেরা জমায়েত হলেন, তাদের সংগে ইসরাইলীয় সব গোষ্ঠী জমায়েত হল, তখন মাবুদই ছিলেন ইসরাইলের বাদশাহ্‌।” রূবেণ সম্বন্ধে মূসা বলেছিলেন, “রূবেণকে বাঁচিয়ে রাখ, মৃত্যু তার দূরে রাখ; তার লোকসংখ্যা যেন কম থাকে।” এহুদা সমন্ধে তিনি বলেছিলেন, “হে মাবুদ, তুমি এহুদার কথা শোন; তার লোকদের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে আন। তার নিজের দু’হাত সে যুদ্ধে লাগায়; শত্রুর বিরুদ্ধে তুমি তার সহায় হও।” লেবি সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “তোমার ভক্তের কাছে তোমার তূম্মীম ও ঊরীম আছে; মঃসাতে তুমি তার পরীক্ষা করেছিলে, মরীবার পানির কাছে তার সংগে ঝগড়া করেছিলে। নিজের পিতা-মাতাকে বড় করে না দেখে, নিজের ভাইদের স্বীকার না করে, নিজের ছেলেমেয়েদের অস্বীকার করে, সে তোমার কালাম পাহারা দিয়েছে আর তোমার ব্যবস্থা রক্ষা করেছে। তোমার হুকুম সে ইয়াকুবকে শিখায়, আর শরীয়ত শিখায় ইসরাইলকে। সে তোমার সামনে ধূপ জ্বালায়, তোমার কোরবানগাহের উপরে পোড়ানো-কোরবানী দেয়। হে মাবুদ, তুমি তার সম্পত্তিতে দোয়া কর, তার সব কাজে তুমি খুশী হও। তুমি তার শত্রুর কোমর ভেংগে দাও; যারা তাকে ঘৃণা করে তাদের কোমর ভেংগে দাও, যেন তারা আর দাঁড়াতে না পারে।” বিন্‌ইয়ামীন সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “মাবুদ যাকে মহব্বত করেন সে নিরাপদে তাঁর কাছে থাকবে; তিনি সব সময় তাকে আড়ালে রাখেন; তাঁরই পিঠের উপর তার স্থান।” ইউসুফ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “মাবুদ তার দেশকে যেন দোয়া করেন আসমানের মহামূল্য শিশির দিয়ে, মাটির নীচের পানি দিয়ে, সূর্যের সেরা দান দিয়ে, মৌসুমের সেরা ফসল দিয়ে, পুরানো পাহাড়ের সম্পদ দিয়ে, চিরকালের পাহাড়ের ধন দিয়ে, ভরা দুনিয়ার ভাল ভাল জিনিস দিয়ে, আর জ্বলন্ত ঝোপে যিনি ছিলেন তাঁর রহমত দিয়ে। ইউসুফের মাথায় এই সব দোয়া ঝরে পড়ুক; ভাইদের মধ্যে যে মহৎ তাঁরই মাথায় ঝরে পড়ুক এই সব দোয়া। তার মহিমা প্রথমে জন্মানো ষাঁড়ের মত, তার মাথায় রয়েছে বুনো ষাঁড়ের শিং। তা দিয়ে সে গুঁতাবে দুনিয়ার সব জাতিকে, এমন কি, এর শেষ সীমানার জাতিকেও। এই রকমই হবে আফরাহীমের লক্ষ লক্ষ আর মানশার হাজার হাজার লোক।” সবূলূন সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “সবূলূন বাইরের কাজে খুশী হোক, আর ইষাখর খুশী হোক ঘরের কাজে। লোকদের তারা পাহাড়ের ধারে ডাকবে; সেখানে যোগ্য মনোভাব নিয়ে তারা পশু-কোরবানী দেবে। সাগর থেকে তারা তুলবে সাগরের ধন, আর বালি থেকে তুলে আনবে বালির তলার ধন।” গাদ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “ধন্য তিনি, যিনি গাদের রাজ্যের সীমা বাড়াবেন। সে সিংহের মত বসবে আর শত্রুর মাথা ও হাত ছিঁড়বে। সব জায়গার সেরা জায়গা সে বেছে নিয়েছে; নেতার যোগ্য পাওনা তার জন্য রাখা আছে। যুদ্ধে জমায়েত হওয়া সর্দারদের মধ্যে সে-ই মাবুদের ন্যায়-ভরা হুকুম পালন করেছে, পালন করেছে ইসরাইলকে দেওয়া মাবুদের নিয়ম।” দান সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “সে যেন বাশন থেকে লাফিয়ে আসা সিংহের বাচ্চা।” নপ্তালি সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “নপ্তালি মাবুদের মমতায় পূর্ণ; তাঁরই দোয়ায় সে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তুমি তোমার সীমানার মধ্যে নিয়ে এস গালীল সাগর ও তার দক্ষিণের দেশ।” আশের সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “আশের অন্যের চেয়ে বেশী দোয়া পাবে; সে যেন ভাইদের প্রিয় হয়, তার পা দু’খানা যেন জলপাই তেলের মধ্যে ডুবে থাকে। লোহা আর ব্রোঞ্জের আগল দিয়ে তার সদর দরজা বাঁধা থাকবে। যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন তার গায়ে শক্তি থাকবে।” মূসা বলেছিলেন, “ইসরাইলের আল্লাহ্‌র মত আর কেউ নেই। তোমার সাহায্যকারী হবার জন্য মেঘের উপর চড়ে নিজের মহিমায় তিনি আসমান-পথে চলেন। যিনি আদিকালের আল্লাহ্‌ তিনিই তোমার আশ্রয়; তাঁর চিরকালের হাতে তিনিই তোমাকে ধরে আছেন। তোমার সামনে যত শত্রু আছে তিনি তাদের তাড়িয়ে দেবেন; তিনি বলবেন, ‘এদের ধ্বংস কর।’ ইসরাইল জাতি তাই নিরাপদে থাকবে। ইয়াকুবের ঝর্ণা থাকবে বিপদ-সীমার বাইরে; সেখানে থাকবে প্রচুর শস্য ও নতুন আংগুর-রস, তার উপরে আকাশের শিশির ঝরে পড়বে। হে ইসরাইল জাতি, ধন্য তুমি! তুমিই মাবুদের উদ্ধার-করা জাতি, তোমার মত আর কোন জাতি নেই। তিনিই তোমার সাহায্যের ঢাল, তোমার গৌরবের তলোয়ার। শত্রুরা তোমার সামনে থর থর করে কাঁপবে, আর তুমি তাদের পিঠ মাড়িয়ে চলে যাবে।” এর পর মূসা মোয়াবের সমভূমি থেকে জেরিকোর উল্টাদিকে পিস্‌গা পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু নবো পাহাড়ে উঠে গেলেন। সেখান থেকে মাবুদ তাঁকে গোটা দেশটা দেখালেন। তিনি তাঁকে গিলিয়দ থেকে দান পর্যন্ত সমস্ত জায়গা, নপ্তালির সমস্ত জায়গা, আফরাহীম ও মানশার জায়গা এবং পশ্চিম দিকে সমুদ্র পর্যন্ত এহুদার সমস্ত জায়গাটা দেখালেন। এছাড়া তিনি তাঁকে নেগেভ এবং খেজুর-শহর জেরিকো এবং তার কাছের জর্ডান নদীর দক্ষিণ দিকের সমভূমি থেকে সোয়র পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটা দেখালেন। তারপর মাবুদ তাঁকে বললেন, “এই সেই দেশ যা আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কাছে কসম খেয়ে বলেছিলাম, ‘দেশটা আমি তোমার বংশধরদের দেব।’ দেশটা আমি তোমাকে নিজের চোখে দেখে নেবার সুযোগ দিলাম, কিন্তু নদী পার হয়ে তোমার সেখানে যাওয়া হবে না।” মাবুদ যা বলেছিলেন সেই অনুসারে মাবুদের গোলাম মূসা ঐ মোয়াব দেশেই ইন্তেকাল করলেন। মোয়াব দেশের বৈৎ-পিয়োরের কাছে যে উপত্যকা ছিল সেখানে মাবুদই তাঁকে দাফন করলেন, কিন্তু তাঁর কবরটা যে কোথায় তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। ইন্তেকাল করবার সময়ে মূসার বয়স ছিল একশো বিশ বছর। তখনও তাঁর দেখবার শক্তি দুর্বল হয় নি কিংবা তাঁর গায়ের জোরও কমে যায় নি। বনি-ইসরাইলরা মোয়াবের সমভূমিতে ত্রিশ দিন পর্যন্ত মূসার জন্য কান্নাকাটি করেছিল। তারপর তাদের কান্নাকাটি ও শোক-প্রকাশের সময় শেষ হল। নূনের ছেলে ইউসার উপর মূসা হাত রেখেছিলেন বলে তিনি জ্ঞানদানকারী পাক-রূহে পূর্ণ হয়েছিলেন। সেইজন্য বনি-ইসরাইলরা তাঁর কথামত চলতে লাগল এবং মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ তাদের যে হুকুম দিয়েছিলেন তা পালন করতে লাগল। আজ পর্যন্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে মূসার মত আর কোন নবীর জন্ম হয় নি যাঁর কাছে মাবুদ বন্ধুর মত সামনাসামনি কথা বলতেন। মাবুদ মূসাকে মিসর দেশে ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারী এবং তাঁর গোটা দেশের উপর যে সব অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন সেই রকম কাজ আর কেউ করে নি। সমস্ত বনি-ইসরাইলদের চোখের সামনে মূসা যে মহাশক্তি দেখিয়েছিলেন কিংবা যে সব ভয় জাগানো কাজ করেছিলেন তা আর কেউ কখনও করে নি। মাবুদের গোলাম মূসার ইন্তেকালের পর মাবুদ মূসার সাহায্যকারী নূনের ছেলে ইউসাকে বললেন, “আমার গোলাম মূসার মৃত্যু হয়েছে। সেইজন্য এখন তুমি ও এই সব বনি-ইসরাইলরা ঐ জর্ডান নদী পার হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হও এবং যে দেশ আমি বনি-ইসরাইলদের দিতে যাচ্ছি সেখানে যাও। তোমরা যে সব জায়গায় পা ফেলবে তা সবই আমি তোমাদের দেব। মূসার কাছে সেই ওয়াদাই আমি করেছিলাম। তোমাদের দেশ হবে মরুভূমি থেকে লেবানন পর্যন্ত এবং পূর্বে মহানদী ফোরাত ও পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত, অর্থাৎ হিট্টীয়দের গোটা এলাকাটা। তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে কেউ তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। আমি যেমন মূসার সংগে ছিলাম তেমনি তোমার সংগেও থাকব; আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না কিংবা ত্যাগ করব না। “তুমি শক্তিশালী হও, মনে সাহস আন, কারণ যে দেশ দেবার কথা আমি এই লোকদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়ে বলেছিলাম, সেই দেশ এই লোকদের অধিকার হিসাব তোমাকেই ভাগ করে দিতে হবে। তুমি শক্তিশালী হও ও সাহসে বুক বাঁধ। আমার গোলাম মূসা তোমাকে যে শরীয়ত দিয়ে গেছে সেই সব শরীয়ত পালন করবার দিকে মন দেবে, তা থেকে একটুও এদিক ওদিক সরবে না। এতে তুমি যেখানেই যাবে সেখানেই সফল হবে। এই তৌরাত কিতাবের মধ্যে যা লেখা আছে তা যেন সব সময় তোমার মুখে থাকে। এর মধ্যে যা লেখা আছে তা যাতে তুমি পালন করবার দিকে মন দিতে পার সেইজন্য দিনরাত তা নিয়ে তুমি গভীরভাবে চিন্তা করবে। তাতে সব কিছুতে তুমি সফল হবে এবং তোমার উন্নতি হবে। আমি তোমাকে হুকুম দিয়েছি, কাজেই তুমি শক্তিশালী হও ও মনে সাহস আন। ভয় কোরো না কিংবা নিরাশ হোয়ো না, কারণ তুমি যেখানেই যাও না কেন তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমার সংগে থাকবেন।” এই কথা শুনে ইউসা লোকদের নেতাদের বললেন, “তোমরা ছাউনিতে গিয়ে লোকদের বল যেন তারা তাদের খাবার-দাবার নিয়ে প্রস্তুত থাকে। তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা তাদের সম্পত্তি হিসাবে দিতে যাচ্ছেন সেখানে গিয়ে তা দখল করে নেবার জন্য তিন দিনের মধ্যেই তাদের এখান থেকে জর্ডান নদী পার হয়ে যেতে হবে।” রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর সবাইকে এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে ইউসা বললেন, “মাবুদের গোলাম মূসা যে ওয়াদা তোমাদের কাছে করেছিলেন তা তোমরা মনে করে দেখ। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব কিছু থেকে তোমাদের বিশ্রাম দিয়েছেন এবং এই দেশটাও তোমাদের দিয়েছেন।’ জর্ডানের পূর্ব দিকের যে জায়গাটা মূসা তোমাদের দিয়েছেন সেখানে তোমাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং পশুপাল থাকতে পারবে, কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করতে পারে তাদের সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে তোমাদের ভাইদের আগে আগে নদী পার হয়ে যেতে হবে। মাবুদ যতদিন তোমাদের মত করে তোমাদের ভাইদেরও সব কিছু থেকে বিশ্রাম না দেন এবং যতদিন তারা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দেওয়া দেশটা দখল করে না নেয় ততদিন তোমরা ভাইদের সাহায্য করতে থাকবে। তার পরে তোমরা ফিরে এসে তোমাদের নিজেদের জায়গা সম্পূর্ণভাবে দখল করতে পারবে যা মাবুদের গোলাম মূসা জর্ডানের পূর্ব দিকে তোমাদের দিয়ে গেছেন।” জবাবে তারা ইউসাকে বলল, “আপনি আমাদের যে সব হুকুম দিয়েছেন তা আমরা পালন করব আর আমাদের যেখানে পাঠাবেন সেখানেই যাব। আমরা যেমন মূসার সব কথা মেনে চলতাম, আপনার বেলায়ও তা-ই করব। আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ যেমন মূসার সংগে ছিলেন তেমনি যেন আপনার সংগেও থাকেন। কেউ যদি আপনার কোন হুকুমের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনার কথামত না চলে তবে তাকে হত্যা করা হবে। আপনি শুধু শক্তিশালী হন এবং সাহস করুন।” নূনের ছেলে ইউসা শিটীম থেকে দু’জন গোয়েন্দাকে এই কথা বলে গোপনে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা গিয়ে সেই দেশটা এবং বিশেষ করে জেরিকো শহরটা ভাল করে দেখে এস।” এই কথা শুনে তারা জেরিকো শহরে গেল। সেখানে তারা রাহব নামে এক বেশ্যার বাড়ীতে গিয়ে রইল। এর মধ্যে জেরিকো শহরের বাদশাহ্‌র কানে গেল যে, দেশের খোঁজ-খবর নেবার জন্য সন্ধ্যাবেলায় কয়েকজন ইসরাইলীয় এখানে এসেছে। বাদশাহ্‌ এই কথা শুনে রাহবের কাছে বলে পাঠালেন, “যারা এসে তোমার ঘরে ঢুকেছে তাদের বের করে আন, কারণ তারা গোটা দেশটার খোঁজ-খবর নেবার জন্য এসেছে।” রাহব কিন্তু ঐ দু’জন লোককে লুকিয়ে রেখেছিল। সে বলল, “জ্বী, লোকগুলো আমার এখানে এসেছিল বটে, কিন্তু তারা কোথা থেকে এসেছিল তা আমি জানি না। সন্ধ্যাবেলায় শহরের দরজা বন্ধ করবার একটু আগেই তারা চলে গেছে। তারা কোন্‌ পথে গেছে তা আমি জানি না। আপনারা এখনই তাদের পিছনে পিছনে গেলে হয়তো তাদের ধরে ফেলতে পারবেন।” আসলে রাহব ঐ দু’জনকে ছাদের উপরে নিয়ে গিয়ে সেখানে তার মেলে দেওয়া মসীনার ডাঁটা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। রাহবের কথা শুনে সেই লোকেরা গোয়েন্দাদের ধরবার জন্য বেরিয়ে পড়ল। জর্ডান নদীর যেখান দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায় তারা সেখানে যাওয়ার পথ ধরে চলল। তারা শহরের বাইরে যাবার সংগে সংগেই শহরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মিসর দেশ থেকে আপনাদের বের হয়ে আসবার পর মাবুদ কেমন করে লোহিত সাগরের পানি আপনাদের সামনে থেকে শুকিয়ে ফেলেছিলেন তা আমরা শুনেছি। সীহোন আর উজ নামে জর্ডানের পূর্ব পারের দু’জন আমোরীয় বাদশাহ্‌কে ধ্বংস করে দিয়ে আপনারা তাদের কি দশা করেছিলেন তা-ও আমরা শুনেছি। এই সব শুনে আমাদের দিলের সব আশা-ভরসা ফুরিয়ে গেছে এবং আপনাদের ভয়ে সবাই সাহস হারিয়ে ফেলেছে। আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই বেহেশতের এবং দুনিয়ার আল্লাহ্‌। আমি আপনাদের প্রতি বিশ্বস্ত হয়েছি, তাই এখন আপনারা আমার কাছে আল্লাহ্‌র কসম খান যে, আমাদের পরিবারের প্রতিও আপনারা বিশ্বস্ত থাকবেন। এই ব্যাপারে আপনারা আমাকে এমন একটা চিহ্ন দিন যা থেকে আমি বুঝতে পারি যে, আপনারা আমার মা-বাবা, ভাই-বোন এবং তাদের সব লোকদের প্রাণ বাঁচাবেন এবং মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবেন।” এই কথা শুনে সেই দু’জন তাকে বলল, “আমরা যদি আমাদের কথামত কাজ না করি তবে তোমাদের বদলে আমাদের প্রাণ যাক। তুমি যদি আমাদের এই সব কথা প্রকাশ না কর তবে মাবুদ যখন এই দেশটা আমাদের দেবেন তখন আমরা তোমাদের সংগে ভাল ব্যবহার করব এবং তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।” স্ত্রীলোকটি যে বাড়ীতে বাস করত সেটা ছিল শহরের চারপাশের দেয়ালের একটা অংশ; তাই সে জানালার ভিতর দিয়ে দড়ির সাহায্যে তাদের নীচে নামিয়ে দিল। সে তাদের বলল, “আপনাদের যারা ধরতে গেছে তারা যাতে আপনাদের খুঁজে না পায় সেইজন্য আপনারা পাহাড়ে চলে যান। আপনারা তিন দিন সেখানে লুকিয়ে থাকবেন; তারপর সেই লোকেরা ফিরে আসলে পর আপনারা আপনাদের পথে চলে যাবেন।” তখন যদি কেউ তোমার বাড়ী থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যায় তবে সে নিজেই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবে। আমরা তার জন্য দায়ী হব না। কিন্তু যারা তোমার সংগে এই বাড়ীর মধ্যে থাকবে তাদের কারও উপর যদি হাত দেওয়া হয় তবে তার মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী থাকব। তবে যদি তুমি আমাদের এই সব কথা প্রকাশ করে দাও তাহলে তুমি আমাদের দিয়ে যে কসম খাইয়ে নিয়েছ তা থেকে আমরা মুক্ত হব।” জবাবে স্ত্রীলোকটি বলল, “ঠিক আছে, আপনারা যা বললেন তা-ই হোক।” এই বলে স্ত্রীলোকটি তাদের বিদায় দিল আর তারা চলে গেল। সেই লাল দড়িটা রাহব জানালায় বেঁধে রাখল। সেই দু’জন ইসরাইলীয় ঐ জায়গা ছেড়ে পাহাড়ে গেল এবং তিন দিন সেখানে রইল। যারা তাদের ধরতে বের হয়েছিল এর মধ্যে তারা সারা রাস্তায় তাদের খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল। তারপর সেই দু’জন ইসরাইলীয়ও ফিরে গেল। তারা পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসল এবং নদী পার হয়ে নূনের ছেলে ইউসার কাছে গিয়ে তাদের যা যা ঘটেছিল তা সব বলল। তারা ইউসাকে বলল, “এই কথা ঠিক যে, মাবুদ গোটা দেশটাই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমাদের ভয়ে সেখানকার সমস্ত লোক একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।” ইউসা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সংগে শিটীম থেকে রওনা হয়ে জর্ডান নদীর কাছে গেলেন। নদীটা পার না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে রইল। তাতে তোমরা বুঝতে পারবে তোমাদের কোন্‌ পথে যেতে হবে, কারণ তোমরা এর আগে কখনও এই পথে যাও নি। কিন্তু তোমরা সাক্ষ্য-সিন্দুকের কাছ থেকে প্রায় দু’হাজার হাত দূরে থাকবে, তার কাছে যাবে না।” এর পর ইউসা লোকদের বললেন, “তোমরা নিজেদের পাক-সাফ করে নাও, কারণ কালকে মাবুদ তোমাদের মধ্যে অনেক অলৌকিক চিহ্ন দেখাবেন।” পরে তিনি ইমামদের বললেন, “আপনারা সাক্ষ্য-সিন্দুকটি তুলে নিয়ে লোকদের আগে আগে নদী পার হয়ে যান।” কাজেই তাঁরা সাক্ষ্য-সিন্দুকটি তুলে নিয়ে লোকদের আগে আগে যেতে লাগলেন। তখন মাবুদ ইউসাকে বললেন, “আজ থেকে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের চোখে আমি তোমার সম্মান বৃদ্ধি করতে শুরু করব, যাতে তারা বুঝতে পারে যে, আমি যেমন মূসার সংগে ছিলাম তেমনি তোমার সংগেও আছি। তুমি সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামদের বলে দাও যেন তারা জর্ডান নদীর কিনারায় পৌঁছে এগিয়ে গিয়ে পানির মধ্যে দাঁড়ায়।” ইউসা বনি-ইসরাইলদের বললেন, “তোমরা এখানে এস এবং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যা বলেছেন তা শোন। জীবন্ত আল্লাহ্‌ যে তোমাদের মধ্যে আছেন আর তিনিই যে কেনানীয়, হিট্টীয়, হিব্বীয়, পরিষীয়, গির্গাষীয়, আমোরীয় আর যিবূষীয়দের নিশ্চয়ই তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেবেন তা তোমরা এইভাবে বুঝতে পারবে। যিনি সমস্ত দুনিয়ার মালিক তাঁর সাক্ষ্য-সিন্দুকটি তোমাদের আগে আগে জর্ডান নদীর মধ্যে যাবে। এখন তোমরা ইসরাইলীয় বারোটি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি থেকে একজন করে মোট বারোজন লোক বেছে নাও। তোমরা দেখবে সমস্ত দুনিয়ার মালিক মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামেরা যেই জর্ডানের পানিতে পা দেবে অমনি তার ভাটির দিকে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত থেমে যাবে আর তার পানি উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে।” লোকেরা জর্ডান নদী পার হওয়ার জন্য যখন ছাউনি তুলে ফেলল তখন সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামেরা তাদের আগে আগে চললেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত ইসরাইলীয় জর্ডান নদী পার না হল ততক্ষণ পর্যন্ত মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামেরা জর্ডান নদীতে শুকনা মাটির উপর দাঁড়িয়ে রইলেন; আর গোটা জাতিই শুকনা মাটির উপর দিয়ে পার হয়ে গেল। এইভাবে গোটা ইসরাইল জাতি জর্ডান পার হওয়ার পর মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে একজন করে মোট বারোজন লোক বেছে নাও। তাদের বল, নদীর মধ্যে যে জায়গায় ইমামেরা দাঁড়িয়ে আছে তারা যেন সেই জায়গা থেকে বারোটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে তোমাদের সংগে যায় এবং আজ রাতে তোমরা যে জায়গায় থাকবে সেখানে ওগুলো রাখে।” বনি-ইসরাইলরা ইউসার হুকুম মতই কাজ করল। মাবুদ ইউসাকে যা বলেছিলেন সেই মতই বনি-ইসরাইলরা তাদের বারোটা গোষ্ঠীর জন্য জর্ডান নদীর মাঝখান থেকে বারোটা পাথর কুড়িয়ে নিল। তারপর সেগুলো নিয়ে তারা যেখানে রাতটা কাটাল সেখানে রেখে দিল। জর্ডান নদীর যে জায়গায় সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন ইউসা সেখানে আরও বারোটা পাথর রাখলেন। পাথরগুলো আজও সেখানে আছে। নদী পার হওয়ার হুকুম সম্বন্ধে মূসা ইউসাকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই লোকদের বলবার জন্য ইউসাকে দেওয়া মাবুদের হুকুম অনুসারে লোকেরা সব কিছু না করা পর্যন্ত সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামেরা নদীতে দাঁড়িয়েই রইলেন আর লোকেরা তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে গেল। তারা সবাই পার হওয়ার পর মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক নিয়ে ইমামেরা লোকদের চোখের সামনে এপারে এসে উঠলেন। মূসা যে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন সেই অনুসারে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর সবাই এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে বনি-ইসরাইলদের আগে আগে পার হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ করবার জন্য প্রায় চল্লিশ হাজার লোক অস্ত্র হাতে মাবুদকে সামনে রেখে নদী পার হয়ে জেরিকোর সমভূমিতে গেল। সেই দিন মাবুদ সমস্ত বনি-ইসরাইলদের চোখে ইউসাকে সম্মানিত করলেন। তার ফলে লোকেরা মূসার মত করে ইউসার সারা জীবন ধরে তাঁকে সম্মান করেছিল। মাবুদ ইউসাকে বলেছিলেন, “সাক্ষ্য-সিন্দুক বহনকারী ইমামদের জর্ডান নদী থেকে উঠে আসবার হুকুম দাও।” সেইজন্য ইউসা ইমামদের জর্ডান নদী থেকে উঠে আসবার হুকুম দিয়েছিলেন। তাতে যে ইমামেরা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা নদীর মাঝখান থেকে উঠে এসে শুকনা মাটিতে পা দেওয়ার সংগে সংগে নদীর স্রোত আবার বইতে লাগল এবং আগের মতই তার দু’পার পানিতে ভেসে গেল। বছরের প্রথম মাসের দশ দিনের দিন লোকেরা জর্ডান থেকে উঠে এসে জেরিকোর পূর্ব সীমানায় গিল্‌গলে গিয়ে ছাউনি ফেলল, আর ইউসা এই গিল্‌গলেই জর্ডান থেকে তুলে আনা বারোটা পাথর রাখলেন। তারপর তিনি বনি-ইসরাইলদের বললেন, “ভবিষ্যতে তোমাদের বংশধরেরা যখন এই পাথরগুলোর মানে তাদের পিতাদের জিজ্ঞাসা করবে, তখন তোমরা তাদের বলবে, ‘বনি-ইসরাইলরা শুকনা মাটির উপর দিয়ে হেঁটে এই জর্ডান নদী পার হয়ে গিয়েছিল।’ আমরা লোহিত সাগর পার হয়ে না আসা পর্যন্ত তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যেমন আমাদের সামনে সাগরটা শুকনা অবস্থায় রেখেছিলেন তেমনি জর্ডান নদীতেও তা-ই করলেন। তোমরা নদীটা পার হয়ে না আসা পর্যন্ত তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের সামনে জর্ডান নদী শুকনা অবস্থায় রেখেছিলেন। তিনি এই কাজ করেছিলেন যাতে দুনিয়ার সমস্ত জাতি জানতে পারে যে, মাবুদের হাত শক্তিশালী আর যাতে তোমরা সব সময় তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভয় করে চল।” জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের আমোরীয়দের সমস্ত বাদশাহ্‌রা এবং সাগর পারের সমস্ত কেনানীয় বাদশাহ্‌রা যখন শুনলেন যে, আমরা পার হয়ে আসবার সময় মাবুদ কিভাবে জর্ডানের পানি আমাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে শুকিয়ে দিয়েছিলেন তখন তাদের আশা-ভরসা সব ফুরিয়ে গেল; বনি-ইসরাইলদের সামনে দাঁড়াবার সাহস আর তাঁদের রইল না। সেই সময় মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি চক্‌মকি পাথরের কতগুলো ছুরি তৈরী করিয়ে নাও এবং তা দিয়ে আগের মত এই বনি-ইসরাইলদের খৎনা করাও।” এই কথা শুনে ইউসা চক্‌মকি পাথরের কতগুলো ছুরি তৈরী করালেন এবং তা দিয়ে গিবিয়োৎ হারালোতে (যার মানে “খৎনা করবার পাহাড়”) বনি-ইসরাইলদের খৎনা করালেন। যে জন্য তিনি এই কাজ করলেন তা এই: যুদ্ধে যাবার বয়স হয়েছে এমন যে সব পুরুষ লোক মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিল তারা মিসর ছেড়ে আসবার পর পথে মরুভূমিতে মারা গিয়েছিল। যারা মিসর ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল তাদের খৎনা করানো হয়েছিল; কিন্তু মিসর থেকে বের হয়ে আসবার পর যাত্রাপথে মরুভূমিতে যাদের জন্ম হয়েছিল তাদের কারও খৎনা করানো হয় নি। মিসর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় যাদের যুদ্ধ করবার মত বয়স হয়েছিল তারা সবাই মারা না যাওয়া পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে বনি-ইসরাইলদের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল, কারণ তারা মাবুদের কথা মেনে চলে নি। মাবুদ তাদের কসম খেয়ে বলেছিলেন যে, তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে দুধ আর মধুতে ভরা যে দেশটা আমাদের দেবেন বলে তিনি ওয়াদা করেছিলেন তা তারা দেখতে পাবে না। তাই তাদের জায়গায় তাদের ছেলেদের তিনি দাঁড় করালেন আর ইউসা এদেরই খৎনা করালেন। যাত্রাপথে তাদের খৎনা করানো হয় নি বলে তারা তখনও খৎনা-না-করানো অবস্থায় ছিল। সব লোকদের খৎনা করানো হল আর তারা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সেই জায়গাতে ছাউনির মধ্যেই রইল। এর পর মাবুদ ইউসাকে বললেন, “মিসরে তোমাদের যে অসম্মান ছিল তা আমি আজ তোমাদের কাছ থেকে দূর করে দিলাম।” সেইজন্য আজও ঐ জায়গাটাকে গিল্‌গল বলা হয়ে থাকে। সেই মাসের চৌদ্দ দিনের দিন সন্ধ্যাবেলায় জেরিকোর সমভূমির গিল্‌গলে ছাউনি ফেলে থাকবার সময় বনি-ইসরাইলরা উদ্ধার-ঈদ পালন করল। তার পরের দিনই তারা সেই দেশের ফসল থেকে তৈরী খামিহীন রুটি আর ভাজা শস্য খেল। যেদিন তারা ঐ দেশের খাবার খেল তার পরের দিন থেকে মান্না পড়া বন্ধ হয়ে গেল। এর পর বনি-ইসরাইলরা আর মান্না পায় নি। সেই বছর থেকে তারা কেনান দেশের ফসল খেতে লাগল। জেরিকোর কাছাকাছি গেলে পর ইউসা খোলা তলোয়ার হাতে একজন লোককে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। ইউসা তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কার পক্ষের লোক- আমাদের, না আমাদের শত্রুদের?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি কারও পক্ষের লোক নই। আমি মাবুদের সৈন্যদলের সেনাপতি; এখন আমি এখানে এসেছি।” এই কথা শুনে ইউসা মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার প্রভু তাঁর গোলামকে কি কিছু বলতে চান?” মাবুদের সৈন্যদলের সেনাপতি জবাবে বললেন, “তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেল, কারণ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেই জায়গাটা পবিত্র।” ইউসা তা-ই করলেন। সেই সময় বনি-ইসরাইলদের জন্য জেরিকো শহরের দরজাগুলো শক্ত করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে কেউ বের হয়েও আসত না আবার কেউ ভিতরেও ঢুকত না। মাবুদ তখন ইউসাকে বললেন, “দেখ, আমি জেরিকো শহরটা, তার বাদশাহ্‌ এবং তার সমস্ত বীর যোদ্ধাদের তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তোমরা সমস্ত সৈন্যেরা মিলে শহরের বাইরের চারদিকটা একবার ঘুরে এস; ছয় দিন ধরে তা-ই করবে। সাতজন ইমাম সাতটা শিংগা নিয়ে সাক্ষ্য-সিন্দুকের আগে আগে যাবে। সপ্তম দিনে তোমরা শহরের চারদিকটা সাতবার ঘুরবে এবং তার সংগে ইমামেরা শিংগা বাজাবে। যখন তোমরা শুনবে সেই ইমামেরা শিংগায় একটানা আওয়াজ তুলেছে তখন সব লোকেরা খুব জোরে চিৎকার করে উঠবে। তাতে শহরের দেয়াল ধ্বসে পড়ে যাবে আর তখন বনি-ইসরাইলরা তার উপর দিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে যাবে।” তখন নূনের ছেলে ইউসা ইমামদের ডেকে বললেন, “আপনারা সাক্ষ্য-সিন্দুকটি তুলে নিন এবং সাতজন ইমাম সাতটা শিংগা নিয়ে মাবুদের সিন্দুকের আগে আগে যান।” তারপর তিনি লোকদের হুকুম দিলেন, “তোমরা এগিয়ে যাও এবং শহরের বাইরের চারদিকে একবার ঘুরে এস। সৈন্যেরা মাবুদের সিন্দুকের আগে আগে যাবে।” লোকদের কাছে ইউসার কথা বলা শেষ হলে পর মাবুদের সামনে সাতজন ইমাম সাতটা শিংগা নিয়ে বাজাতে বাজাতে চললেন আর তাঁদের পিছনে পিছনে চলল মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক। যে ইমামেরা শিংগা বাজাচ্ছিলেন তাঁদের আগে আগে চলল অস্ত্র হাতে একদল সৈন্য আর সিন্দুকের পিছনে পিছনে চলল পিছনে থাকা রক্ষীদল। ইমামেরা সারা পথেই শিংগা বাজাতে থাকলেন। ইউসা আগেই লোকদের এই হুকুম দিয়েছিলেন, “তোমরা চিৎকার করবে না কিংবা জোরে কথা বলবে না কিংবা মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করবে না। যেদিন আমি তোমাদের চিৎকার করতে বলব কেবল সেই দিনই তোমরা চিৎকার করবে।” এইভাবে ইউসার হুকুমে মাবুদের সিন্দুকটি শহরের চারদিকে একবার ঘুরিয়ে আনা হল। তারপর লোকেরা তাদের ছাউনিতে ফিরে গেল এবং রাতটা সেখানেই কাটাল। পরের দিন ইউসা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেন আর ইমামেরা মাবুদের সিন্দুকটি তুলে নিলেন। সাতজন ইমাম সাতটা শিংগা নিয়ে বাজাতে বাজাতে মাবুদের সিন্দুকের আগে আগে চললেন। অস্ত্র হাতে একদল সৈন্য তাঁদের আগে আগে চলল আর মাবুদের সিন্দুকের পিছনে চলল পিছনে থাকা রক্ষীদল; পুরো সময় ধরে শিংগার আওয়াজ শোনা গেল। এইভাবে দ্বিতীয় দিনেও তারা শহরের চারদিকটা একবার ঘুরে এসে ছাউনিতে ফিরে গেল। তারা ছয় দিন সেই রকম করল। সপ্তম দিনে তারা ভোর হতেই উঠে পড়ল আর ঐ একইভাবে সাতবার শহরের চারদিকটা ঘুরল। কেবল সেই দিনই তারা শহরের চারদিকটা সাতবার ঘুরল। সপ্তম বার ঘুরবার সময় যখন ইমামেরা শিংগাতে একটানা আওয়াজ তুললেন তখন ইউসা লোকদের হুকুম দিলেন, “তোমরা খুব জোরে চিৎকার কর, কারণ মাবুদ শহরটা তোমাদের দিয়েছেন। শহর ও তার মধ্যেকার সব কিছু মাবুদের দেওয়া ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন। কেবল বেশ্যা রাহব ও তার ঘরে যে সব লোক রয়েছে তারা বেঁচে থাকবে, কারণ আমাদের পাঠানো লোকদের সে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু যে সব জিনিস ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন তা থেকে তোমরা দূরে থাকবে যাতে সেখান থেকে কোন কিছু নিজের জন্য নিয়ে তোমরা নিজেদের উপর সর্বনাশ ডেকে না আন। তা করলে তোমরা বনি-ইসরাইলদের ছাউনির উপর সর্বনাশ ডেকে আনবে এবং তাদের বিপদের মধ্যে ফেলবে। সমস্ত সোনা, রূপা এবং ব্রোঞ্জ ও লোহার জিনিসপত্র মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র; সেইজন্য সেগুলো তাঁর ধনভাণ্ডারে যাবে।” শিংগা বেজে উঠবার সংগে সংগে লোকেরা খুব জোরে চিৎকার করে উঠল। শিংগার আওয়াজে যখন লোকেরা ভীষণভাবে চিৎকার করে উঠল তখন জেরিকো শহরের দেয়াল ধ্বসে পড়ে গেল। তাতে সমস্ত লোক শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং তা দখল করে নিল। তারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, গরু, ভেড়া, গাধা ইত্যাদি সমস্ত প্রাণীদের শেষ করে দিল। যে দু’জন গোয়েন্দা দেশটা দেখে নেবার জন্য এসেছিল ইউসা তাদের বললেন, “তোমরা ঐ বেশ্যার কাছে যে কসম খেয়েছিলে সেই অনুসারে তোমরা তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে এবং তার সমস্ত লোকদের বের করে নিয়ে এস।” এই কথা শুনে সেই যুবক গোয়েন্দারা রাহবের বাড়ীর ভিতরে ঢুকে তাকে, তার পিতা-মাতাকে, তার ভাইদের এবং বাড়ীর অন্যান্যদের বের করে নিয়ে আসল। তারা রাহবের পরিবারের সবাইকে বের করে এনে বনি-ইসরাইলদের ছাউনির বাইরে একটা জায়গায় থাকতে দিল। তারপর তারা গোটা শহরটা এবং তার মধ্যেকার সব কিছু পুড়িয়ে দিল, কিন্তু সোনা, রূপা এবং ব্রোঞ্জ ও লোহার জিনিসপত্র মাবুদের ঘরের ধনভাণ্ডারে জমা দিল। ইউসা যে দু’জন গোয়েন্দাকে জেরিকোতে পাঠিয়েছিলেন রাহব বেশ্যা তাদের লুকিয়ে রেখেছিল বলে ইউসা তাকে, তার পিতার পরিবারের লোকদের এবং বাড়ীর অন্যান্যদের রক্ষা করেছিলেন। রাহব আজও বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করছে। এর পর ইউসা কসম খেয়ে বলেছিলেন, “এই জেরিকো শহরটা যে লোক আবার গড়ে তুলবে তার উপর মাবুদের এই বদদোয়া পড়বে: প্রথম ছেলের জীবন দিয়ে সে তার ভিত্তি গাঁথবে, আর ছোট ছেলের জীবন দিয়ে তার দরজাগুলো গড়ে তুলবে।” মাবুদ ইউসার সংগে রইলেন, আর দেশের সব জায়গায় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। জেরিকো শহরের ধ্বংসের বদদোয়ার অধীনে থাকা জিনিসের ব্যাপারে বনি-ইসরাইলরা বেঈমানী করেছিল। এহুদা-গোষ্ঠীর কর্মির ছেলে আখন ঐ সব জিনিস থেকে কয়েকটা নিজের জন্য নিয়েছিল। কর্মি ছিল সব্দির ছেলে আর সেরহের নাতি। আখনের এই কাজের জন্য বনি-ইসরাইলদের উপর মাবুদের রাগ জ্বলে উঠেছিল। ইউসা জেরিকো থেকে অয় শহরে লোক পাঠালেন। সেই শহরটা ছিল বেথেল শহরের পূর্ব দিকে বৈৎ-আবন শহরের কাছে। সেই লোকদের পাঠাবার সময় তিনি তাদের বলে দিলেন, “তোমরা গিয়ে দেশটা ভাল করে দেখে এস।” কাজেই লোকগুলো গিয়ে গোপনে অয় শহরের খোঁজ-খবর নিল। পরে তারা ইউসার কাছে ফিরে এসে বলল, “অয় শহরের বিরুদ্ধে সব লোকদের যাওয়ার দরকার নেই। ওটা দখল করবার জন্য দুই কিংবা তিন হাজার লোক পাঠিয়ে দিন। এই নিয়ে সব লোকদের কষ্ট দেবেন না, কারণ সেখানকার লোকসংখ্যা খুব কম।” সেইজন্য কমবেশি তিন হাজার লোক সেখানে গেল; কিন্তু তারা অয় শহরের লোকদের কাছে হেরে গিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হল। শহরের দরজার কাছ থেকে অয় শহরের লোকেরা বনি-ইসরাইলদের তাড়া করে শবারীম পর্যন্ত নিয়ে গেল এবং শবারীমের ঢালু জায়গায় তাদের ছত্রিশজনকে মেরে ফেলল। এতে বনি-ইসরাইলদের মনোবল একেবারে ভেংগে পড়ল। তখন ইউসা ও বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতারা নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে মাবুদের সিন্দুকের সামনে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটির উপর উবুড় হয়ে পড়ে রইলেন। তাঁরা নিজেদের মাথার উপর ধুলা ছিটিয়ে দিলেন। ইউসা বললেন, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি কেন আমাদের এই জাতিকে জর্ডান পার করে এনে ধ্বংস করবার জন্য আমোরীয়দের হাতে তুলে দিলে? হায়, আমরা যদি জর্ডানের ওপারে থেকেই খুশী থাকতাম! হে মালিক, বনি-ইসরাইলরা শত্রুদের কাছে হার মেনে পালিয়ে আসবার পরে আমার আর বলবার কি থাকতে পারে? কেনানীয়রা এবং এই দেশের অন্যান্য লোকেরা এই কথা শুনতে পাবে আর তারা আমাদের ঘেরাও করবে এবং দুনিয়ার বুক থেকে আমাদের নাম মুছে ফেলবে। এর পর তুমি কি করে তোমার সুনাম রক্ষা করবে?” তখন মাবুদ ইউসাকে বললেন, “উঠে দাঁড়াও। কেন তুমি উবুড় হয়ে পড়ে আছ? বনি-ইসরাইলরা গুনাহ্‌ করেছে; আমি তাদের আমার যে ব্যবস্থা পালন করতে বলেছিলাম তা তারা পালন করে নি। যে সব জিনিস ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন তার কতগুলো তারা নিয়েছে; তারা চুরি করেছে, মিথ্যা কথা বলেছে আর সেই সব জিনিস নিয়ে তারা তাদের নিজেদের জিনিসের সংগে রেখেছে। সেইজন্যই বনি-ইসরাইলরা তাদের শত্রুদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না; তারা পিছন ফিরে পালাচ্ছে, কারণ তারা ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন হয়ে পড়েছে। ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন কতগুলো জিনিস তোমাদের কাছে আছে। যদি তোমরা সেগুলো ধ্বংস করে না ফেল তবে আমি আর তোমাদের সংগে থাকব না। “তুমি গিয়ে লোকদের পাক-পবিত্র করে নাও। তাদের বল যেন তারা কালকের জন্য নিজেদের পাক-সাফ করে। বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘হে ইসরাইল, তোমাদের মধ্যে এমন কতগুলো জিনিস রয়েছে যা ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন। সেগুলো তোমাদের মধ্য থেকে দূর করে না ফেলা পর্যন্ত তোমরা তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। কাজেই, সকালবেলা তোমরা গোষ্ঠী অনুসারে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। যে গোষ্ঠী আমার হাতে ধরা পড়বে সেই গোষ্ঠী বংশ অনুসারে এগিয়ে আসবে; তার মধ্যে যে বংশ আমার হাতে ধরা পড়বে সেই বংশের লোকেরা পরিবার অনুসারে এগিয়ে আসবে; তার মধ্যে যে পরিবার আমার হাতে ধরা পড়বে সেই পরিবারের লোকেরা এক একজন করে এগিয়ে আসবে। যা ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন তা যে লোকটির কাছে আছে বলে ধরা পড়বে তাকে তার সব কিছু সুদ্ধ আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সে মাবুদের ব্যবস্থা অমান্য করেছে এবং এমন একটা কাজ করেছে যা বনি-ইসরাইলদের পক্ষে একটা লজ্জার ব্যাপার।’ ” পরের দিন খুব ভোরে ইউসা গোষ্ঠী অনুসারে বনি-ইসরাইলদের মাবুদের সামনে আনলেন, তাতে এহুদা-গোষ্ঠী ধরা পড়ল। তারপর এহুদা-গোষ্ঠীর বংশগুলো এগিয়ে আসলে পর সেরহীয় বংশ ধরা পড়ল। তারপর সেরহীয় বংশের নেতারা এক এক করে এগিয়ে আসলে পর সব্দি ধরা পড়ল। পরে সব্দির পরিবারের লোকেরা এক এক করে সামনে আসলে পর এহুদা-গোষ্ঠীর কর্মির ছেলে আখন ধরা পড়ল। কর্মি ছিল সব্দির ছেলে আর সেরহের নাতি। ইউসা তখন আখনকে বললেন, “বাবা, সত্যি কথা বলে বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র গৌরব কর, তাঁর প্রশংসা কর; তুমি যা করেছ তা আমাকে বল, গোপন কোরো না।” জবাবে আখন বলল, “এই কথা সত্যি যে, আমি বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। আমি যে কাজ করেছি তা এই: আমি লুটের মালের মধ্যে শিনিয়র দেশের সুন্দর একটা কাপড়, প্রায় আড়াই কেজি রূপা আর ছ’শো গ্রাম ওজনের একটা সোনার খণ্ড দেখে লোভ সামলাতে না পেরে তা নিয়েছি। ওগুলো আমার তাম্বুর ভিতরে মাটির নীচে লুকানো আছে আর সবগুলোর নীচে আছে রূপা।” এই কথা শুনে ইউসা লোক পাঠিয়ে দিলেন। তারা দৌড়ে সেই তাম্বুর মধ্যে গিয়ে দেখল সেখানে জিনিসগুলো লুকানো রয়েছে, আর সব কিছুর নীচে রয়েছে রূপা। তারা সেগুলো তাম্বু থেকে বের করে ইউসা ও সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে নিয়ে আসল এবং মাবুদের সামনে সেগুলো বিছিয়ে রাখল। পরে ইউসা ও সমস্ত বনি-ইসরাইল সেরহের বংশধর আখনকে নিয়ে আখোর উপত্যকায় গেল। তারা সংগে নিল সেই রূপা, কাপড়, সোনার খণ্ড, আখনের ছেলেমেয়ে, তার গরু-গাধা-ভেড়া, তার তাম্বু আর তার যা কিছু ছিল সব। তারপর ইউসা বললেন, “কেন তুমি আমাদের উপর এই বিপদ ডেকে আনলে? আজ মাবুদও তোমার উপর বিপদ আনবেন।” তখন সমস্ত বনি-ইসরাইল প্রথমে আখনকে ও পরে তার পরিবারের সবাইকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। তারপর সব কিছু সুদ্ধ তাদের পুড়িয়ে ফেলল। আখনের মৃতদেহের উপরে তারা অনেক পাথর জড়ো করে একটা স্তূপ করে রাখল। সেটা আজও রয়েছে। এর পর মাবুদ তাঁর রাগ থেকে ফিরলেন। এইজন্যই ঐ জায়গাটাকে এর পর থেকে আখোর উপত্যকা বলা হয়ে থাকে। পরে মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি ভয় কোরো না এবং নিরাশ হোয়ো না। তোমার সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে তুমি অয় শহরটা আবার আক্রমণ করতে যাও। অয় শহরের বাদশাহ্‌, তার লোকজন, তার শহর এবং দেশটা আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। জেরিকো শহর এবং তার বাদশাহ্‌র প্রতি তুমি যা করেছিলে অয় শহর ও তার বাদশাহ্‌র প্রতিও তা-ই করবে। তবে সেখানকার লুটের জিনিসপত্র ও পশুর পাল তোমরা নিজেদের জন্য নিতে পারবে। শহরের পিছন দিকে তুমি একদল সৈন্য লুকিয়ে রাখবে।” আমি আমার সংগের লোকজন নিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে যাব। তারা যখন আগের বারের মত আমাদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়ে আসবে তখন আমরা তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাব। তারা আমাদের পিছনে তাড়া করবে, বলবে, ‘ওরা আগের মতই আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।’ এইভাবে আমরা শহর থেকে তাদের দূরে নিয়ে যাব। আমরা যখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাব, তখন তোমরা সেই গোপন জায়গা থেকে উঠে গিয়ে শহরটা দখল করে নেবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই সেটা তোমাদের হাতে তুলে দেবেন। তোমরা শহরটা দখল করে নিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেবে। মাবুদ যা হুকুম দিয়েছেন তোমরা তা-ই করবে। তোমাদের উপর এই আমার হুকুম।” এর পর ইউসা তাদের পাঠিয়ে দিলেন। তারা গিয়ে অয় শহরের পশ্চিম দিকে একটা জায়গায় লুকিয়ে থাকল। জায়গাটা ছিল বেথেল আর অয়ের মাঝামাঝি। ইউসা কিন্তু সেই রাতটা বাকী সৈন্যদের সংগেই কাটালেন। পরের দিন খুব ভোরে ইউসা তাঁর সৈন্যদের জমায়েত করলেন। তারপর তিনি এবং ইসরাইলীয় নেতারা তাদের আগে আগে অয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইউসার সংগের সৈন্যেরা সব এগিয়ে গেল এবং শহরের কাছাকাছি গিয়ে শহরের সামনের দিকটায় উপস্থিত হল। অয় শহরের উত্তর দিকে তারা ছাউনি ফেলল। শহর এবং তাদের ছাউনির মাঝখানে ছিল আখোর উপত্যকা। ইউসা প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য শহরের পশ্চিম দিকে বেথেল ও অয়ের মাঝামাঝি একটা জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা তাদের সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে রাখল- যারা ছাউনিতে থাকবে তাদের রাখল অয় শহরের উত্তর দিকে আর যারা লুকিয়ে থাকবে তাদের রাখল শহরের পশ্চিম দিকে। সেই রাতে ইউসা উপত্যকায় ছিলেন। বনি-ইসরাইলদের দেখে অয়ের বাদশাহ্‌ তাদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য খুব ভোরে তাড়াতাড়ি করে উঠে সমস্ত লোকদের নিয়ে শহর থেকে বের হয়ে আরবা সমভূমির কাছে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গেলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, শহরের পিছন দিকে তাঁর বিরুদ্ধে একদল সৈন্য লুকিয়ে রয়েছে। ইউসা এবং সমস্ত ইসরাইলীয় তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাওয়ার ভান করে মরুভূমির পথ দিয়ে ছুটে গেল। তখন বনি-ইসরাইলদের তাড়া করবার জন্য অয়ের সমস্ত লোকদের ডাকা হল। তারা ইউসার পিছনে তাড়া করল এবং এইভাবে শহর থেকে তাদের দূরে নিয়ে যাওয়া হল। বনি-ইসরাইলদের পিছনে ছুটে যায় নি এমন একজন পুরুষ লোকও অয় কিংবা বেথেলে রইল না। তারা শহরের সদর দরজা খোলা রেখেই বনি-ইসরাইলদের পিছনে পিছনে ছুটে গেল। তখন মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তোমার হাতের ঐ তলোয়ারখানা অয় শহরের দিকে বাড়িয়ে ধর, কারণ তোমার হাতেই আমি শহরটা তুলে দেব।” ইউসা তখন তাঁর তলোয়ার অয় শহরের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন; সংগে সংগে লুকিয়ে থাকা সেই সৈন্যেরা তাদের জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে শহরের দিকে দৌড়ে গেল। তারা সেখানে ঢুকে তা দখল করে নিল এবং অল্প সময়ের মধ্যেই শহরে আগুন ধরিয়ে দিল। অয়ের লোকেরা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তাদের শহর থেকে ধোঁয়া আকাশে উঠছে; কিন্তু তাদের আর কোন দিকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না, কারণ যে বনি-ইসরাইলরা মরুভূমির দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল তারা এর মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ইউসা এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলরা যখন দেখল যে, তাদের লুকিয়ে থাকা সৈন্যেরা শহরটা দখল করে নিয়েছে এবং শহর থেকে ধোঁয়া উঠছে তখন তারা অয় শহরের লোকদের আক্রমণ করল। লুকিয়ে থাকা সৈন্যেরাও অয়ের লোকদের আক্রমণ করবার জন্য শহর থেকে বের হয়ে আসল। তাতে অয়ের লোকেরা দু’টা ইসরাইলীয় দলের মাঝখানে আট্‌কা পড়ে গেল। বনি-ইসরাইলরা তাদের সবাইকে হত্যা করল, কাউকে বাঁচিয়ে রাখল না কিংবা যেতেও দিল না। তবে অয় শহরের বাদশাহ্‌কে তারা জীবন্ত অবস্থায় ধরে ইউসার কাছে নিয়ে গেল। যে মাঠে, অর্থাৎ যে মরুভূমিতে অয় শহরের লোকেরা বনি-ইসরাইলদের তাড়া করে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে অয়ের লোকদের সবাইকে হত্যা করবার পর সমস্ত ইসরাইলীয় অয় শহরে ফিরে আসল এবং শহরের মধ্যে যারা ছিল তারা তাদেরও হত্যা করল। সেই দিন অয় শহরের সমস্ত লোক, অর্থাৎ বারো হাজার স্ত্রী-পুরুষ মারা পড়ল। অয় শহরে যারা ছিল তারা সবাই শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ইউসা তলোয়ার সুদ্ধ হাতখানা বাড়িয়ে রাখলেন। মাবুদ ইউসাকে যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন সেইমতই বনি-ইসরাইলরা সেই শহরের পশুপাল এবং লুট করা জিনিস নিজেদের জন্য নিয়ে নিল। এইভাবে ইউসা অয় শহরটা পুড়িয়ে দিয়ে সেটাকে চিরকালের জন্য একটা ধ্বংসের স্তূপ করে রাখলেন; আজও সেটা একটা পোড়ো জায়গা হয়ে আছে। তিনি অয় শহরের বাদশাহ্‌কে হত্যা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছে টাংগিয়ে রাখলেন। সন্ধ্যাবেলায় তিনি তাঁর লাশটা গাছ থেকে নামিয়ে শহরের সদর দরজায় ঢুকবার পথে ছুঁড়ে ফেলবার হুকুম দিলেন। লোকেরা তাঁর উপর পাথর দিয়ে একটা বড় স্তূপ করে রাখল। সেটা আজও রয়েছে। এবল পাহাড়ের উপরে বনি-ইসরাইলদের সামনে ইউসা পাথরের উপরে মূসার শরীয়ত লিখলেন। বনি-ইসরাইলরা এবং তাদের মধ্যে বাসকারী অন্য জাতির লোকেরা, তাদের বৃদ্ধ নেতারা, কর্মচারীরা এবং বিচারকর্তারা, অর্থাৎ ইসরাইলীয় সমাজের সমস্ত লোক মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল; তারা সিন্দুক বহনকারী লেবীয় ইমামদের সামনে ছিল। তাদের অর্ধেক লোক দাঁড়াল গরিষীম পাহাড়ের সামনে আর অর্ধেক লোক দাঁড়াল এবল পাহাড়ের সামনে। মাবুদের গোলাম মূসা এই কথা আগেই বলেছিলেন যখন তিনি বনি-ইসরাইলদের উপর দোয়া করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর ইউসা তৌরাত কিতাবে যে সমস্ত দোয়া এবং বদদোয়ার কথা লেখা ছিল তা হুবহু তেলাওয়াত করে শোনালেন। মূসা এই ব্যাপারে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন তার একটি শব্দও বাদ না দিয়ে ইউসা গোটা ইসরাইল সমাজকে তা তেলাওয়াত করে শোনালেন। এই সমাজের মধ্যে স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে এবং তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকেরাও ছিল। জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের বাদশাহ্‌রা এই সব কথা শুনতে পেলেন। এঁরা ছিলেন উঁচু পাহাড়ী এলাকার এবং তার নীচের পাহাড়ী এলাকার দেশগুলোর আর লেবানন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের সমস্ত কিনারা ধরে যে দেশগুলো ছিল সেগুলোর বাদশাহ্‌। এঁরা ছিলেন হিট্টীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়দের বাদশাহ্‌। বনি-ইসরাইলদের সম্বন্ধে সব কথা শুনে তাঁরা এক মন হয়ে ইউসা এবং বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য একজোট হলেন। তারা পায়ে দিল পুরানো ও তালি দেওয়া জুতা এবং গায়ে পরল পুরানো কাপড়। পথে খাবার হিসাবে তারা যে সব রুটি নিল তা ছিল টুকরা টুকরা শুকনা রুটি। এইভাবে তারা গিল্‌গলে বনি-ইসরাইলদের ছাউনিতে ইউসার সামনে উপস্থিত হল। তারা তাঁকে ও বনি-ইসরাইলদের বলল, “আমরা অনেক দূর দেশ থেকে এসেছি; আপনারা আমাদের সংগে সন্ধি করুন।” তখন বনি-ইসরাইলরা সেই হিব্বীয়দের বলল, “খুব সম্ভব আপনারা আমাদের কাছাকাছিই থাকেন। যদি তা-ই হয় তবে কেমন করে আমরা আপনাদের সংগে সন্ধি করব?” তারা ইউসাকে বলল, “দেখুন, আমরা আপনার গোলাম।” তখন ইউসা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কারা, আর কোথা থেকেই বা এসেছেন?” জবাবে তারা বলল, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র সুনাম শুনে আপনার এই গোলামেরা অনেক দূর দেশ থেকে এসেছে। তিনি মিসর দেশে যা করেছিলেন তার খবর আমরা পেয়েছি। এছাড়া তিনি হিষবোনের বাদশাহ্‌ সীহোন এবং অষ্টারোতে বাসকারী বাশনের বাদশাহ্‌ উজ- জর্ডানের পূর্ব দিকের এই দুই আমোরীয় বাদশাহ্‌র যে দশা করেছিলেন তার কথাও আমরা শুনেছি। আমাদের বৃদ্ধ নেতারা এবং আমাদের দেশের বাসিন্দারা সবাই আমাদের এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন যাত্রাপথের জন্য খাবার সংগে নিয়ে আপনাদের সংগে দেখা করে বলি, ‘আমরা আপনাদের গোলাম এবং আপনারা আমাদের সংগে একটা সন্ধি করুন।’ আপনাদের কাছে রওনা হওয়ার দিনে আমরা বাড়ী থেকে গরম গরম রুটি বেঁধে নিয়ে বের হয়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখুন, সেই রুটি শুকিয়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। আংগুর-রস রাখবার থলিগুলোও ভরে নিয়েছিলাম এবং সেগুলো নতুন ছিল কিন্তু দেখুন, এখন সেগুলো কি রকম ফেটে গেছে। এত দূরের পথ আসতে আমাদের পায়ের জুতা আর গায়ের কাপড়ও পুরানো হয়ে গেছে।” বনি-ইসরাইলরা তাদের খাবার নিয়ে দেখল বটে কিন্তু মাবুদের মতামত জিজ্ঞাসা করল না। ইউসা তাদের সংগে সন্ধি করলেন এবং তাদের হত্যা করবেন না বলে একটা চুক্তি করলেন, আর ইসরাইলীয় সমাজের নেতারাও সেই সম্বন্ধে কসম খেলেন। গিবিয়োনীয়দের সংগে সন্ধি করবার তিন দিন পরেই বনি-ইসরাইলরা শুনতে পেল যে, তারা আসলে তাদের প্রতিবেশী আর তারা কাছেই বাস করে। তখন বনি-ইসরাইলরা তাদের এলাকার দিকে রওনা হল আর তিন দিনের দিন সেখানে গিয়ে পেীঁছাল। তাদের এলাকায় ছিল গিবিয়োন, কফীরা, বেরোৎ ও কিরিয়ৎ-যিয়ারীম শহর। বনি-ইসরাইলরা কিন্তু তাদের আক্রমণ করল না, কারণ তাদের সমাজের নেতারা বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে তাদের কাছে কসম খেয়েছিলেন। এতে নেতাদের বিরুদ্ধে গোটা ইসরাইল সমাজটাই বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। তাতে সমস্ত নেতারা তাদের বললেন, “আমরা বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে তাদের কাছে কসম খেয়েছি তাই এখন আমরা তাদের গায়ে হাত তুলতে পারি না। তবে আমরা তাদের জন্য এই কাজ করব, আমরা তাদের প্রাণে মারব না যেন আমরা তাদের কাছে যে কসম খেয়েছি তা ভাংবার দরুন মাবুদের গজব আমাদের উপর না পড়ে।” তাঁরা আরও বললেন, “তারা বেঁচে থাকুক।” সেইজন্য গিবিয়োনীয়দের সম্বন্ধে নেতাদের কথা অনুসারে তারা ইসরাইলীয় সমাজের সমস্ত লোকদের জন্য কাঠ কাটবার এবং পানি আনবার লোক হল। এর পর ইউসা গিবিয়োনীয়দের ডেকে বললেন, “তোমরা আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাক এই কথা বলে কেন আমাদের ঠকালে? আসলে তোমরা তো আমাদের কাছেই বাস কর। সেইজন্য তোমাদের উপর এই বদদোয়া রইল যে, আমার আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য তোমরা কাঠ কাটবার আর পানি আনবার কাজ করবে। এই গোলামের কাজ করা থেকে তোমরা কখনো রেহাই পাবে না।” জবাবে তারা ইউসাকে বলল, “এই গোটা দেশটাই আপনাদের দেবার জন্য এবং আপনাদের সামনে থেকে এই দেশের সবাইকে মুছে ফেলবার জন্য যে হুকুম আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর গোলাম মূসাকে দিয়েছিলেন তা পরিষ্কার ভাবেই আপনার এই গোলামদের কাছে বলা হয়েছিল। সেইজন্য আপনাদের বিষয়ে সব কথা শুনে প্রাণের ভয়ে আমরা এই কাজ করেছি। আমরা এখন আপনার হাতেই আছি; আপনার যা ভাল এবং উচিত বলে মনে হয় আমাদের প্রতি আপনি তা-ই করুন।” সেইজন্য ইউসা বনি-ইসরাইলদের হাত থেকে তাদের বাঁচালেন; তারা তাদের হত্যা করল না। ইউসা গিবিয়োনীয়দের সেই দিনই হুকুম দিলেন যেন তারা বনি-ইসরাইলদের জন্য এবং মাবুদ যে জায়গা বেছে নেবেন সেই জায়গায় মাবুদের কোরবানগাহের জন্য কাঠ কাটবার ও পানি আনবার কাজ করে। আজও তারা সেই কাজ করছে। জেরুজালেমের বাদশাহ্‌ অদোনী-সিদ্দিক শুনতে পেলেন যে, ইউসা অয় শহরটা অধিকার করে নিয়ে তা একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং তিনি জেরিকো ও তার বাদশাহ্‌র দশা যা করেছিলেন অয় ও তার বাদশাহ্‌র দশাও তা-ই করেছেন। তিনি আরও শুনলেন যে, গিবিয়োনীয়রা বনি-ইসরাইলদের সংগে সন্ধি করেছে এবং তারা তাদের সংগে আছে। এতে তিনি ও তাঁর লোকেরা খুব ভয় পেলেন, কারণ গিবিয়োন ছিল রাজধানীর মতই একটা বড় শহর। এটা ছিল অয় শহরের চেয়েও বড় এবং তার সব পুরুষ লোকেরাই ছিল শক্তিশালী। সেইজন্য হেবরনের বাদশাহ্‌ হোহম, যর্মূতের বাদশাহ্‌ পিরাম, লাখীশের বাদশাহ্‌ যাফিয় এবং ইগ্লোনের বাদশাহ্‌ দবীরের কাছে জেরুজালেমের বাদশাহ্‌ অদোনী-সিদ্দিক এই অনুরোধ করে পাঠালেন, “আপনারা এসে আমাকে গিবিয়োন শহরটা আক্রমণ করতে সাহায্য করুন, কারণ তারা ইউসা এবং বনি-ইসরাইলদের সংগে সন্ধি করেছে।” এই কথা শুনে সেই পাঁচজন আমোরীয় বাদশাহ্‌, অর্থাৎ জেরুজালেম, হেবরন, যর্মূত, লাখীশ ও ইগ্লোনের বাদশাহ্‌ তাঁদের সৈন্যদল এক জায়গায় জমায়েত করলেন। তারপর তাঁদের সৈন্যদল নিয়ে তাঁরা এগিয়ে গিয়ে গিবিয়োনের কাছাকাছি ছাউনি ফেললেন এবং শহরটা আক্রমণ করলেন। তখন গিবিয়োনীয়রা গিল্‌গলের ছাউনিতে ইউসার কাছে এই খবর পাঠাল, “আপনার গোলামদের ত্যাগ করবেন না। আপনারা তাড়াতাড়ি এসে আমাদের রক্ষা করুন, আমাদের সাহায্য করুন, কারণ পাহাড়ী এলাকা থেকে আমোরীয় বাদশাহ্‌রা এসে আমাদের বিরুদ্ধে তাদের সৈন্যদল একসংগে জমায়েত করেছে।” এই খবর পেয়ে ইউসা তাঁর গোটা সৈন্যদল নিয়ে গিল্‌গল থেকে এগিয়ে গেলেন। তার মধ্যে ছিল বনি-ইসরাইলদের সমস্ত বীর যোদ্ধারা। মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি তাদের ভয় কোরো না; আমি তাদের তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তারা কেউ তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।” গিল্‌গল থেকে বেরিয়ে সারা রাত হাঁটবার পর ইউসা হঠাৎ তাদের আক্রমণ করলেন। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে তাদের একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলে দিলেন। তাতে মাবুদ গিবিয়োনে বনি-ইসরাইলদের দিয়ে তাদের অনেককে হত্যা করলেন। বৈৎ-হোরোণে উঠে যাবার রাস্তা ধরে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের দিয়ে তাদের তাড়া করালেন এবং অসেকা ও মক্কেদা পর্যন্ত সারা রাস্তা তাদের মারতে মারতে নিয়ে গেলেন। বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে তারা যখন বৈৎ-হোরোণ ছেড়ে অসেকায় নেমে আসবার পথ ধরে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন মাবুদ আসমান থেকে বড় বড় শিলা তাদের উপরে ফেললেন। ফলে বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধে যত না লোক মরল তার চেয়ে বেশী মরল এই শিলাতে। যেদিন মাবুদ বনি-ইসরাইলদের হাতে আমোরীয়দের তুলে দিলেন সেই দিন বনি-ইসরাইলদের সামনেই ইউসা মাবুদকে বললেন, “হে সূর্য, গিবিয়োনের উপর তুমি স্থির হয়ে দাঁড়াও, হে চাঁদ, অয়ালোন উপত্যকায় তুমি গিয়ে দাঁড়াও।” তাই সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়াল আর চাঁদের গতি থেমে গেল, যে পর্যন্ত না ইসরাইল তার শত্রুদলের উপর শোধ নিল।” এই কথা যাশেরের বইতে লেখা আছে। তখন সূর্য আকাশের মাঝখানে গিয়ে থেমে রইল এবং অস্ত যেতে প্রায় পুরো একটা দিন দেরি করল। এর আগে বা পরে এমন দিন আর কখনও আসে নি যখন মাবুদ এমনিভাবে মানুষের কথা রেখেছেন। সেই দিন মাবুদ বনি-ইসরাইলদের হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। এর পর ইউসা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের নিয়ে গিল্‌গলের ছাউনিতে ফিরে গেলেন। সেই পাঁচজন আমোরীয় বাদশাহ্‌ পালিয়ে গিয়ে মক্কেদা শহরের কাছে একটা গুহাতে লুকিয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা থেমো না; তোমাদের শত্রুদের তাড়া করে নিয়ে যাও, পিছন দিক থেকে তাদের আক্রমণ কর এবং তাদের নিজেদের শহরে ফিরে যেতে দিয়ো না। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের হাতে তাদের তুলে দিয়েছেন।” এইভাবে ইউসা ও বনি-ইসরাইলরা আমোরীয়দের ধ্বংস করে ফেলল। এতে প্রায় সবাই মারা পড়ল; কিন্তু যে কয়েকজন বাকী ছিল তারা তাদের দেয়াল-ঘেরা শহরে গিয়ে ঢুকল। এর পর বনি-ইসরাইলদের সৈন্যেরা সবাই মক্কেদার ছাউনিতে নিরাপদে ইউসার কাছে ফিরে গেল। বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলবার সাহস পেল না। তারপর ইউসা বললেন, “গুহার মুখ খুলে ঐ পাঁচজন বাদশাহ্‌কে বের করে আমার কাছে নিয়ে এস।” তাতে সেই গুহা থেকে সেই পাঁচজন বাদশাহ্‌কে তারা বের করে নিয়ে আসল। এঁরা ছিলেন জেরুজালেম, হেবরন, যর্মূত, লাখীশ ও ইগ্লোনের বাদশাহ্‌। তারা যখন সেই বাদশাহ্‌দের ইউসার কাছে নিয়ে আসল তখন তিনি সমস্ত বনি-ইসরাইলদের ডাকলেন এবং তাঁর সংগে যে সেনাপতিরা যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের বললেন, “তোমরা এখানে এসে ঐ বাদশাহ্‌দের ঘাড়ে তোমাদের পা রাখ।” এতে তারা এগিয়ে গিয়ে ঐ বাদশাহ্‌দের ঘাড়ের উপর তাদের পা রাখল। ইউসা তাদের বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না, হতাশ হোয়ো না। তোমরা শক্তিশালী হও ও মনে সাহস আন। তোমরা যে সব শত্রুদের সংগে যুদ্ধ করতে যাবে তাদের সকলের অবস্থা মাবুদ এই রকম করবেন।” তারপর ইউসা সেই বাদশাহ্‌দের হত্যা করে পাঁচটা গাছে তাঁদের টাংগিয়ে দিলেন। বিকাল পর্যন্ত তাঁদের লাশ গাছে টাংগানোই রইল। সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় ইউসার হুকুমে লোকেরা গাছ থেকে তাঁদের লাশগুলো নামিয়ে ফেলল এবং যে গুহাতে তাঁরা লুকিয়ে ছিলেন তার মধ্যে সেই দেহগুলো ছুঁড়ে ফেলল। গুহার মুখটা তারা বড় বড় পাথর দিয়ে ঢেকে দিল। সেগুলো আজও সেখানে রয়েছে। ইউসা সেই দিনই মক্কেদা অধিকার করে নিলেন। তিনি সেই শহরের বাদশাহ্‌ ও সমস্ত লোকদের হত্যা করলেন এবং সেখানকার সব প্রাণীদের শেষ করে দিলেন, কাউকেই বাঁচিয়ে রাখলেন না। তিনি জেরিকোর বাদশাহ্‌র যে অবস্থা করেছিলেন মক্কেদার বাদশাহ্‌র অবস্থাও তা-ই করলেন। পরে ইউসা বনি-ইসরাইলদের সকলকে নিয়ে মক্কেদা থেকে লিব্‌নার দিকে এগিয়ে গিয়ে তা আক্রমণ করলেন। মাবুদ সেই শহর ও সেখানকার বাদশাহ্‌কে বনি-ইসরাইলদের হাতে তুলে দিলেন। ইউসা সেই শহরের লোকদের ও সব প্রাণীদের মেরে ফেললেন, কাউকেই বাঁচিয়ে রাখলেন না। তিনি জেরিকোর বাদশাহ্‌র যে অবস্থা করেছিলেন সেখানকার বাদশাহ্‌র অবস্থাও তা-ই করলেন। এর পর ইউসা বনি-ইসরাইলদের সবাইকে নিয়ে লিব্‌না থেকে লাখীশের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি লাখীশ ঘেরাও করে তা আক্রমণ করলেন। মাবুদ লাখীশ বনি-ইসরাইলদের হাতে তুলে দিলেন। দ্বিতীয় দিনে ইউসা সেটা অধিকার করে নিলেন। ইউসা লিব্‌না শহরে যেমন করেছিলেন সেইভাবে লাখীশের লোকদের ও সব প্রাণীদের মেরে ফেললেন। এর মধ্যে গেষরের বাদশাহ্‌ হোরম লাখীশের লোকদের সাহায্য করতে এসেছিলেন কিন্তু ইউসা তাঁকে ও তাঁর সৈন্যদলকে হারিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত আর কেউই বেঁচে রইল না। তারপর ইউসা বনি-ইসরাইলদের সবাইকে নিয়ে লাখীশ থেকে ইগ্লোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারা ইগ্লোন ঘেরাও করে তা আক্রমণ করল। সেই দিনই তারা ইগ্লোন অধিকার করে নিল এবং সেখানকার লোকদের হত্যা করল। লাখীশে ইউসা যেমন করেছিলেন সেইভাবেই তিনি ইগ্লোনের সব প্রাণীদের একেবারে শেষ করে দিলেন। এর পর ইউসা বনি-ইসরাইলদের সবাইকে নিয়ে ইগ্লোন থেকে হেবরনে গিয়ে শহরটা আক্রমণ করলেন। তারা শহরটা অধিকার করে নিয়ে সেখানকার লোকদের, তাদের বাদশাহ্‌কে, তার আশেপাশের গ্রামগুলোর সমস্ত লোকদের ও হেবরনের সব প্রাণীদের মেরে ফেলল। ইউসা ইগ্লোনে যেমন করেছিলেন তেমনি সেখানে কাউকেই বাঁচিয়ে রাখলেন না; তিনি হেবরন ও তার সমস্ত লোকদের একেবারে শেষ করে দিলেন। পরে ইউসা বনি-ইসরাইলদের সবাইকে নিয়ে ঘুরে গিয়ে দবীর শহর আক্রমণ করলেন। তারা সেই শহর, তার বাদশাহ্‌ এবং তার গ্রামগুলো অধিকার করে নিয়ে সেখানকার সবাইকে হত্যা করল। তারা সেখানকার সব প্রাণীদের একেবারে শেষ করে দিল। ইউসা কাউকেই বাঁচিয়ে রাখলেন না; তিনি লিব্‌না ও তার বাদশাহ্‌ এবং হেবরনের অবস্থা যা করেছিলেন দবীর ও তার বাদশাহ্‌র অবস্থাও তা-ই করলেন। এইভাবে ইউসা সমস্ত এলাকাটা জয় করে নিলেন। তার মধ্যে ছিল উঁচু পাহাড়ী এলাকা, নেগেভ, নীচু পাহাড়ী এলাকা ও পাহাড়ের গায়ের ঢালু জায়গা। তিনি সেই এলাকার বাদশাহ্‌দেরও হারিয়ে দিলেন এবং সেখানকার কাউকেই বাঁচিয়ে রাখলেন না। বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যেমন হুকুম দিয়েছিলেন সেইভাবে তিনি সমস্ত প্রাণীদের একেবারে শেষ করে দিয়েছিলেন। ইউসা কাদেশ-বর্ণেয় থেকে গাজা পর্যন্ত এবং গোটা গোশন এলাকা, এমন কি, গিবিয়োন পর্যন্ত সমস্ত লোকদের হারিয়ে দিয়েছিলেন। এইভাবে একবার যুদ্ধ করতে বেরিয়ে ইউসা এই সব বাদশাহ্‌দের ও তাঁদের দেশগুলো জয় করে নিয়েছিলেন, কারণ বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এর পর ইউসা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের নিয়ে গিল্‌গলের ছাউনিতে ফিরে গেলেন। হাৎসোরের বাদশাহ্‌ যাবীন এই সব শুনে মাদোনের বাদশাহ্‌ যোবব এবং শিম্রোণের ও অক্‌ষফের বাদশাহ্‌দের কাছে খবর পাঠালেন। এছাড়া তিনি উত্তর দিকের অন্যান্য যে সব বাদশাহ্‌ ছিলেন তাঁদের কাছেও খবর পাঠালেন। সেই রাজ্যগুলো ছিল উঁচু পাহাড়ী এলাকায়, কিন্নেরতের দক্ষিণে আরবা সমভূমিতে, নীচু পাহাড়ী এলাকায় এবং পশ্চিমে দোরের পাহাড়ী জায়গায়। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম দিকের কেনানীয়দের কাছে এবং পাহাড়ী এলাকার আমোরীয়, হিট্টীয়, পরিষীয় ও যিবূষীয়দের কাছে আর হর্মোণ পাহাড়ের নীচে মিসপা এলাকার হিব্বীয়দের কাছেও খবর পাঠালেন। এই সব বাদশাহ্‌রা তাঁদের সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে বের হয়ে আসলেন। তাতে সাগরের কিনারার বালুকণার মত অনেক সৈন্যের একটা মস্ত বড় দল হল। তাঁদের সংগে ছিল অনেক ঘোড়া এবং রথ। এই সব বাদশাহ্‌রা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একত্র হয়ে বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য মেরোম নামে এক ঝর্ণার কাছে ছাউনি ফেললেন। তখন মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি তাদের ভয় কোরো না, কারণ কালকে আমি এই সময়ের মধ্যে বনি-ইসরাইলদের সামনে তাদের সবাইকে শেষ করে দেব। তুমি তাদের ঘোড়াগুলোর পায়ের শিরা কেটে দেবে এবং রথগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।” তখন ইউসা তাঁর সমস্ত সৈন্য নিয়ে মেরোম ঝর্ণার কাছে তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালালেন। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের হাতে তাদের তুলে দিলেন। বনি-ইসরাইলরা তাদের মারতে মারতে মহাসীদোন, মিষ্রফোৎ-ময়িম এবং পূর্ব দিকে মিসপী উপত্যকা পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আর কেউ বেঁচে রইল না। মাবুদ ইউসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইউসা শত্রুদের প্রতি তা-ই করলেন। তিনি তাদের ঘোড়াগুলোর পায়ের শিরা কেটে দিলেন এবং রথগুলো পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর ইউসা ফিরে গিয়ে হাৎসোর অধিকার করে নিলেন এবং সেখানকার বাদশাহ্‌কে হত্যা করলেন। হাৎসোর ছিল ঐ সব রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রধান। বনি-ইসরাইলরা হাৎসোরের সবাইকে একেবারে ধ্বংস করে দিল, একটা প্রাণীকেও বাঁচিয়ে রাখল না। এর পর ইউসা শহরটা পুড়িয়ে ফেললেন। ইউসা ঐ সব বাদশাহ্‌দের শহরগুলো দখল করে নিয়ে সেখানকার বাদশাহ্‌দের বন্দী করলেন। তিনি সেই বাদশাহ্‌দের ও সেখানকার লোকদের হত্যা করলেন। মাবুদের গোলাম মূসার হুকুম অনুসারে তিনি তাদের একেবারে ধ্বংস করে দিলেন। কিন্তু টিলার উপর যে সব শহর ছিল সেগুলোর কোনটাই বনি-ইসরাইলরা পোড়ালো না, কেবল হাৎসোর ইউসা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই শহরগুলো থেকে যে সব জিনিসপত্র ও পশুপাল লুট করা হয়েছিল সেগুলো বনি-ইসরাইলরা নিজেদের জন্য নিয়ে গেল; কিন্তু সমস্ত লোককে তারা একেবারে শেষ করে দিল, একটা প্রাণীকেও তারা বাঁচিয়ে রাখল না। মাবুদ তাঁর গোলাম মূসাকে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন মূসা ইউসাকে তা জানিয়েছিলেন, আর ইউসা সেই সব হুকুম পালন করেছিলেন। মাবুদ মূসাকে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন ইউসা তার একটাও অমান্য করেন নি। এইভাবে ইউসা গোটা দেশটাই দখল করে নিলেন। তার মধ্যে ছিল উঁচু পাহাড়ী এলাকা, সমস্ত নেগেভ, সমস্ত গোশন এলাকা, নীচু পাহাড়ী জায়গাগুলো, আরবা সমভূমি এবং ইসরাইলের উত্তর দিকের উঁচু পাহাড়ী এলাকা ও তার নীচের জায়গাগুলো। এক কথায় সেয়ীর পাহাড়শ্রেণীর দিকে উঠে যাওয়া হালক পাহাড় থেকে হর্মোণ পাহাড়ের নীচে লেবানন উপত্যকার বাল্‌গাদ পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটাই ইউসা অধিকার করে নিলেন। তিনি ঐ সব জায়গার বাদশাহ্‌দের ধরে হত্যা করলেন। ইউসা অনেক দিন ধরে এই সব বাদশাহ্‌দের সংগে যুদ্ধ করেছিলেন। একমাত্র গিবিয়োনের বাসিন্দা হিব্বীয়রা ছাড়া আর কোন শহরের লোকেরা বনি-ইসরাইলদের সংগে সন্ধি করে নি; বনি-ইসরাইলরা যুদ্ধ করে তাদের সবাইকে হারিয়ে দিয়েছিল। মাবুদ ঐ সব লোকদের মন কঠিন করে দিয়েছিলেন যাতে তারা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আর তাতে তারা যেন ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন হয় এবং কোন রকম দয়া না পেয়ে মারা যায়। এই হুকুমই মাবুদ মূসাকে দিয়েছিলেন। এর পর ইউসা গিয়ে পাহাড়ী এলাকার অনাকীয়দেরও হত্যা করলেন। এই এলাকার মধ্যে ছিল হেবরন, দবীর ও অনাব শহর এবং এহুদা ও ইসরাইলের সমস্ত পাহাড়ী জায়গাগুলো। তিনি অনাকীয়দের এবং তাদের শহর ও গ্রামগুলো একেবারে ধ্বংস করে দিলেন। বনি-ইসরাইলদের দেশের মধ্যে কোন অনাকীয় আর বেঁচে রইল না; কেবল গাজা, গাৎ ও অস্‌দোদে কিছু কিছু অনাকীয় বেঁচে রইল। মাবুদ মূসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই অনুসারে ইউসা গোটা দেশটা দখল করে নিলেন এবং গোষ্ঠী অনুসারে সম্পত্তি হিসাবে তা বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। দেশে তখনকার মত যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল। আরবা সমভূমির সমস্ত পূর্ব অংশটা সুদ্ধ অর্ণোন উপত্যকা থেকে হর্মোণ পাহাড় পর্যন্ত জর্ডান নদীর পূর্ব দিকের আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোন ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজকে বনি-ইসরাইলরা হারিয়ে দিয়ে তাঁদের এলাকা দখল করে নিয়েছিল। আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোন হিষ্‌বোনে থেকে রাজত্ব করতেন। অর্ণোন উপত্যকার কিনারার অরোয়ের থেকে, অর্থাৎ উপত্যকার মাঝখান থেকে অম্মোনীয়দের দেশের সীমানা যব্বোক নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটা তাঁর শাসনের অধীনে ছিল। এই এলাকার মধ্যে ছিল গিলিয়দের অর্ধেক অংশ। এছাড়া গালীল সাগর থেকে আরবার সাগর, অর্থাৎ মরু-সাগর এবং বৈৎ-যিশীমোতের পথ পর্যন্ত আর দক্ষিণ দিকে পিস্‌গা পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত আরবা সমভূমির পূর্ব অংশটা তাঁর শাসনের অধীনে ছিল। রফায়ীয়দের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল বাশনের বাদশাহ্‌ উজ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি অষ্টারোৎ এবং ইদ্রিয়ীতে থেকে রাজত্ব করতেন। হর্মোণ পাহাড়, সল্‌খা, গশূরীয় ও মাখাথীয়দের সীমানা পর্যন্ত সমস্ত বাশন দেশটা এবং হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোনের রাজ্যের সীমা পর্যন্ত গিলিয়দের বাকী অর্ধেক অংশ তাঁর শাসনের অধীনে ছিল। বনি-ইসরাইলরা এবং মাবুদের গোলাম মূসা এই দু’জন বাদশাহ্‌কে হারিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের জায়গাগুলো সম্পত্তি হিসাবে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর সবাইকে এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে দিয়ে গিয়েছিলেন। লেবানন উপত্যকার বাল্‌গাদ থেকে সেয়ীর পাহাড়শ্রেণীর দিকে উঠে যাওয়া হালক পাহাড় পর্যন্ত জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের এলাকার বাদশাহ্‌দের ইউসা এবং বনি-ইসরাইলরা হারিয়ে দিয়েছিল। তাদের জায়গাগুলো ইউসা সম্পত্তি হিসাবে বনি-ইসরাইলদের বিভিন্ন গোষ্ঠী অনুসারে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এই জায়গাগুলো হল উঁচু পাহাড়ী এলাকা, নীচু পাহাড়ী জায়গা, আরবা, পাহাড়ের ঢালু জায়গা, পূর্ব দিকের মরুভূমি এবং নেগেভ। এগুলো ছিল হিট্টীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়দের জায়গা। এই সব জায়গার যে বাদশাহ্‌দের হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা হলেন: জেরিকোর বাদশাহ্‌, বেথেলের কাছে অয়ের বাদশাহ্‌, দবীরের বাদশাহ্‌, গেদরের বাদশাহ্‌, হর্মার বাদশাহ্‌, অরাদের বাদশাহ্‌, অফেকের বাদশাহ্‌, লশারোণের বাদশাহ্‌, মাদোনের বাদশাহ্‌, হাৎসোরের বাদশাহ্‌, শিম্রোণ-মরোণের বাদশাহ্‌, অক্‌ষফের বাদশাহ্‌, তানকের বাদশাহ্‌, মগিদ্দোর বাদশাহ্‌, বয়স বেড়ে গিয়ে ইউসা যখন বুড়ো হয়ে গেলেন তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি বুড়ো হয়েছ, তোমার বয়স হয়ে গেছে, অথচ দেশের এমন অনেক অংশ রয়ে গেছে যা এখনও দখল করা হয় নি। বনি-ইসরাইলদের নয় গোষ্ঠী এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে তুমি সম্পত্তি হিসাবে তা ভাগ করে দেবে।” মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক এবং রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকেরা জর্ডানের পূর্ব দিকের জায়গাটা সম্পত্তি হিসাবে আগেই পেয়েছিল। মাবুদের গোলাম মূসা তাদের জন্য সেই জায়গা ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলেন। গিলিয়দ এলাকা, গশূরীয় ও মাখাথীয়দের জায়গা, গোটা হর্মোণ পাহাড় আর সল্‌খা পর্যন্ত সমস্ত বাশন দেশটাও তার মধ্যে রয়েছে। এটা ছিল বাশনের বাদশাহ্‌ উজের রাজ্য। তিনি অষ্টারোৎ ও ইদ্রিয়ীতে থেকে রাজত্ব করতেন। রফায়ীয়দের মধ্যে তখনও যাঁরা বেঁচে ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। মূসা তাদের হারিয়ে দিয়ে তাদের দেশটা অধিকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা এই গশূরীয় ও মাখাথীয়দের তাড়িয়ে দেয় নি; সেইজন্য তারা আজও বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করছে। লেবি-গোষ্ঠীকে মূসা কিন্তু কোন সম্পত্তির অধিকারী করেন নি, কারণ মাবুদের ওয়াদা অনুসারে বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আগুনে দেওয়া-কোরবানীর জিনিসই হল তাদের সম্পত্তি। হিষ্‌বোন ও সমভূমির মধ্যেকার গ্রাম ও শহরগুলো। এই গ্রাম ও শহরগুলো হল দীবোন, বামোৎ-বাল, বৈৎ-বাল-মিয়োন, যহস, কদেমোৎ, মেফাৎ, কিরিয়াথয়িম, সিব্‌মা, উপত্যকার মধ্যে পাহাড়ের উপরের সেরৎ-শহর, বৈৎ-পিয়োর, পিস্‌গা পাহাড়ের ঢালু জায়গা এবং বৈৎ-যিশীমোৎ। এগুলো ছিল সমভূমির মধ্যেকার গ্রাম ও শহর এবং হিষ্‌বোনের আমোরীয় বাদশাহ্‌ সীহোনের গোটা রাজ্য। মূসা এই বাদশাহ্‌কে এবং ইবি, রেকম, সুর, হূর ও রেবা নামে মাদিয়ানীয় সর্দারদের হারিয়ে দিয়েছিলেন। এঁরা ঐ এলাকায় বাস করতেন এবং সীহোনের অধীনে শাসনকর্তা ছিলেন। যুদ্ধে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা ছাড়া বনি-ইসরাইলরা বাউরের ছেলে গণক বালামকেও হত্যা করেছিল। জর্ডান নদী ছিল রূবেণীয়দের এলাকার পশ্চিম সীমানা। এই সব শহর ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো রূবেণ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের লোকেরা সম্পত্তি হিসাবে পেয়েছিল। এছাড়া তার মধ্যে ছিল হিষ্‌বোন থেকে রামৎ-মিসপী ও বটোনীম পর্যন্ত এবং মহনয়িম থেকে দবীরের সীমা পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটা, আর উপত্যকার মধ্যেকার বৈৎ-হারম, বৈৎ-নিম্রা, সুক্কোৎ, সাফোন এবং হিষ্‌বোনের বাদশাহ্‌ সীহোনের রাজ্যের বাকী অংশ এবং গালীল সাগরের দক্ষিণ দিক পর্যন্ত জর্ডান নদীর পূর্বের কিনারা ধরে সমস্ত এলাকাটা। এই সব শহর ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো গাদ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের লোকেরা সম্পত্তি হিসাবে পেয়েছিল। গিলিয়দের অর্ধেক জায়গা এবং অষ্টারোৎ ও ইদ্রিয়ী শহর। এই দুই শহর থেকে বাশনের বাদশাহ্‌ উজ রাজত্ব করতেন। এই জায়গাগুলো মানশার ছেলে মাখীরের অর্ধেক লোকের বিভিন্ন বংশগুলোকে দেওয়া হয়েছিল। মূসা জর্ডানের ওপারে জেরিকোর পূর্ব দিকে মোয়াবের সমভূমিতে ঐ সব জায়গা সম্পত্তি হিসাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু লেবি-গোষ্ঠীকে তিনি কোন সম্পত্তি দেন নি; তাদের কাছে মাবুদ যে ওয়াদা করেছিলেন সেই অনুসারে বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই ছিলেন তাদের সম্পত্তি। অন্যান্য বনি-ইসরাইলরা কেনান দেশে সম্পত্তি হিসাবে জায়গা-জমি পেল। ইমাম ইলীয়াসর, নূনের ছেলে ইউসা এবং বনি-ইসরাইলদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর পরিবার-কর্তারা তাদের তা ভাগ করে দিলেন। মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই মতই বনি-ইসরাইলদের সাড়ে নয় গোষ্ঠীর মধ্যে গুলিবাঁট করে সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। মূসা আড়াই গোষ্ঠীর সম্পত্তি জর্ডানের পূর্ব দিকে আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি লেবি-গোষ্ঠীকে বনি-ইসরাইলদের মধ্যে কোন সম্পত্তি দেন নি। মানশা আর আফরাহীম নামে ইউসুফের দুই ছেলের মধ্য দিয়ে দু’টি গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল। লেবীয়রা জমির ভাগ পেল না বটে, কিন্তু তারা বাস করবার ও জিনিসপত্র রাখবার জন্য কতগুলো গ্রাম ও শহর এবং গরু-ভেড়া চরাবার জন্য আশেপাশের মাঠ পেল। মাবুদ মূসাকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন বনি-ইসরাইলরা সেই অনুসারেই দেশটা ভাগ করে নিয়েছিল। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা গিল্‌গলে ইউসার কাছে গেল এবং কনিসীয় যিফুন্নির ছেলে কালুত তাঁকে বললেন, “মাবুদ কাদেশ-বর্ণেয়তে আল্লাহ্‌র বান্দা মূসার কাছে আমার ও আপনার সম্বন্ধে যা বলেছিলেন তা আপনার জানা আছে। মাবুদের গোলাম মূসা দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে আসবার জন্য যখন আমাকে কাদেশ-বর্ণেয় থেকে পাঠিয়েছিলেন তখন আমার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। দেশটা দেখেশুনে আমি যা বুঝতে পেরেছিলাম সেই অনুসারেই আমি তাঁর কাছে খবর এনে দিয়েছিলাম, কিন্তু যে ভাইয়েরা আমার সংগে গিয়েছিল তারা লোকদের নিরাশ করে তুলেছিল। তবে আমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা পুরোপুরিই মেনে চলেছিলাম। সেইজন্য মূসা সেই দিন আমার কাছে কসম খেয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি যে জায়গাটা ঘুরে দেখে এসেছ তা চিরকালের জন্য তোমার ও তোমার বংশধরদের সম্পত্তি হয়ে থাকবে, কারণ তুমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা পুরোপুরিই মেনে চলেছিলে।’ “মরুভূমিতে যখন বনি-ইসরাইলরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর মাবুদ মূসাকে এই কথা বলেছিলেন তখন থেকে তাঁর ওয়াদা অনুসারে এই পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আর এখন আমার বয়স পঁচাশি বছর হয়েছে। মূসা যেদিন আমাকে পাঠিয়েছিলেন সেই দিনের মত আজও আমি শক্তিশালী আছি; তখনকার মত এখনও আমার যুদ্ধে যাবার এবং সমস্ত কাজ করবার শক্তি আছে। এই যে পাহাড়ী এলাকাটা দেবার ওয়াদা মাবুদ সেদিন আমার কাছে করেছিলেন তা আপনি আমাকে দিন। সেই সময় আপনি নিজেই শুনেছিলেন যে, অনাকীয়রা সেখানে বাস করে আর তাদের শহরগুলোও বেশ বড় বড় এবং দেয়াল-ঘেরা। কিন্তু মাবুদ আমার সংগে থাকলে তাঁর কথা অনুসারেই আমি তাদের তাড়িয়ে দেব।” এই কথা শুনে ইউসা যিফুন্নির ছেলে কালুতকে দোয়া করলেন এবং সম্পত্তি হিসাবে হেবরন শহরটা তাঁকে দিলেন। সেই থেকে হেবরন কনিসীয় যিফুন্নির ছেলে কালুতের অধিকারে রয়েছে, কারণ তিনি বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা পুরোপুরিই মেনে চলেছিলেন। অনাকীয়দের মধ্যে অর্ব নামে একজন ক্ষমতাশালী লোকের নাম অনুসারে হেবরনকে আগে কিরিয়ৎ-অর্ব বলা হত। এর পর দেশে যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল। গুলিবাঁট অনুসারে এহুদা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশগুলোকে যে জায়গা দেওয়া হল তার সীমানা ইদোমীয়দের দেশের সীমানা পর্যন্ত, অর্থাৎ সীন মরুভূমির দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাল। সেখান থেকে অস্‌মোন বরাবর গিয়ে মিসর নামে যে শুকনা নদী আছে তার সংগে যুক্ত হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হল। এটাই হল তোমাদের দক্ষিণের সীমা। সেখান থেকে সীমারেখাটা আখোর উপত্যকা থেকে দবীর পর্যন্ত উঠে গেল এবং তা উত্তর দিকে উপত্যকার দক্ষিণে অদুম্মীমে উঠে যাওয়ার পথের উল্টাদিকে গিল্‌গল পর্যন্ত চলে গেল। গিল্‌গল থেকে ঐন্‌-শেমশের স্রোত পর্যন্ত গিয়ে সেটা ঐন্‌-রোগেলে বের হয়ে আসল। সেখান থেকে সেটা যিবূশীয়দের শহরের, অর্থাৎ জেরুজালেমের দক্ষিণের ঢালু জায়গাটা বরাবর গিয়ে বেন্তহিন্নোমের উপত্যকায় উঠে গেল। সেখান থেকে সীমারেখাটা রফায়ীম উপত্যকার উত্তর সীমার হিন্নোম উপত্যকার পশ্চিমে যে পাহাড় আছে সেখানে উঠে গেল। সেই সীমারেখাটা তারপর পাহাড়ের উপর থেকে নিপ্তোহের ঝর্ণার দিকে চলে গেল। সেখান থেকে ইফ্রোণ পাহাড়ের গ্রামগুলোর কাছ দিয়ে বের হয়ে সেটা বালার দিকে, অর্থাৎ কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের দিকে নেমে গেল। বালা থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে সেটা সেয়ীর পাহাড়ে গেল; তারপর যিয়ারীম পাহাড়ের, অর্থাৎ কসালোনের উত্তর দিকের ঢালু জায়গা বরাবর গিয়ে সেটা বৈৎ-শেমশে নেমে তিম্না পর্যন্ত গেল। তারপর সেই সীমারেখাটা ইক্রোণের উত্তর দিকের ঢালু জায়গায় গিয়ে শিক্করোণের দিকে ঘুরে সোজা বালা পাহাড়ে গেল এবং যব্‌নিয়েলে পৌঁছে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হল। পশ্চিম দিকের সীমানা হল ভূমধ্যসাগরের কিনারা। এই হল এহুদা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের জায়গার চারপাশের সীমারেখা। ইউসা মাবুদের হুকুম অনুসারে যিফুন্নির ছেলে কালুতকে এহুদা-গোষ্ঠীর জায়গার মধ্যে কিরিয়ৎ-অর্ব, অর্থাৎ হেবরন শহরটা দিয়েছিলেন। অর্ব ছিল অনাকীয়দের পূর্বপুরুষ। পরে শেশয়, অহীমান ও তল্‌ময় নামে তিনজন অনাকীয়কে কালুত হেবরন থেকে তাড়িয়ে দিলেন। এরা ছিল অনাকের বংশধর। কালুত সেখান থেকে দবীরের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। আগে দবীরের নাম ছিল কিরিয়ৎ-সেফর। কালুত বলেছিলেন, “যে কেউ কিরিয়ৎ-সেফর আক্রমণ করে অধিকার করতে পারবে তার সংগে আমি আমার মেয়ে অক্‌ষার বিয়ে দেব।” এই কথা শুনে কনষের বংশধর কালুতের ভাই অৎনীয়েল তা অধিকার করল। তাই কালুত তার মেয়ে অক্‌ষাকে অৎনীয়েলের সংগে বিয়ে দিলেন। অৎনীয়েলের কাছে যাওয়ার পর অক্‌ষা তাকে উসকানি দিতে লাগল যাতে সে অক্‌ষার বাবার কাছ থেকে একটা জমি চেয়ে নেয়। পরে অক্‌ষা গাধার পিঠ থেকে নামলে পর কালুত তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, তুমি কি চাও?” সে বলল, “আব্বা, তুমি আমার একটা কথা রাখ। তুমি আমাকে যখন নেগেভ মরুভূমিতে জায়গা দিয়েছ তখন পানির ঝর্ণাগুলোও আমাকে দাও।” এই কথা শুনে কালুত তাকে সেখানকার উঁচু ও নীচু জায়গার ঝর্ণাগুলো দিলেন। এহুদা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশগুলোকে যে সম্পত্তি দেওয়া হল তা এই। ইদোমের কাছে নেগেভে তাদের এলাকার একেবারে দক্ষিণে তারা যে শহর ও গ্রামগুলো পেয়েছিল সেগুলোর নাম হল: কব্‌সেল, এদর, যাগুর, কীনা, দীমোনা, অদাদা, কেদশ, হাৎসোর, যিৎনন, সীফ, টেলম, বালোৎ, হাৎসোর-হদত্তা, করিয়োৎ-হিষ্রোণ অর্থাৎ হাৎসোর, লবায়োৎ, শিল্‌হীম, ঐন ও রিম্মোণ। মোট ঊনত্রিশটা শহর এবং তাদের আশেপাশের গ্রামগুলো তারা পেয়েছিল। নীচু পাহাড়ী এলাকার মধ্যে তারা যে সব শহর ও গ্রাম পেয়েছিল সেগুলো হল: ইষ্টায়োল, সরা, অশ্‌না, সানোহ, ঐন্‌-গন্নীম, তপূহ, ঐনম, যর্মূৎ, অদুল্লম, সোখো, অসেকা, শারয়িম, অদীথয়িম, গদেরা ও গদেরোথয়িম। এই চৌদ্দটা শহর ও তাদের আশেপাশের গ্রামগুলো তারা পেয়েছিল। কব্বন, লহমম, কিৎলীশ, গদেরোৎ, বৈৎ-দাগোন, নয়মা ও মক্কেদা। এই ষোলটা শহর এবং এগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। ইক্রোণ শহর এবং তার আশেপাশের জায়গা ও গ্রামগুলো, ইক্রোণের পশ্চিম দিকে অস্‌দোদের সমস্ত গ্রাম, অস্‌দোদ এবং তার আশেপাশের সমস্ত জায়গা ও গ্রাম এবং মিসরের শুকনা নদী ও ভূমধ্যসাগরের কিনারা পর্যন্ত গাজা ও তার আশেপাশের সমস্ত জায়গা ও এই সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। ঊঁচু পাহাড়ী এলাকার মধ্যে তারা যে সব শহর ও গ্রাম পেয়েছিল সেগুলো হল: শামীর, যত্তীর, সোখো, দন্না, কিরিয়ৎ-সন্না অর্থাৎ দবীর, অনাব, ইষ্টিমোয়, আনীম, গোশন, হোলোন ও গীলো। এই এগারটা শহর ও এগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। হল্‌হূল, বৈৎ-সূর, গদোর, মারৎ, বৈৎ-অনোৎ ও ইল্‌তকোন। এই ছয়টা শহর ও এগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। কিরিয়ৎ-বাল, অর্থাৎ কিরিয়ৎ-যিয়ারিম আর রব্বা। এই দু’টা শহর ও এগুলোর আশেপাশের জায়গা তারা পেয়েছিল। মরুভূমিতে তারা যে সব শহর ও গ্রাম পেয়েছিল সেগুলো হল: বৈৎ-আরবা, মিদ্দীন, সকাখা, নিব্‌শন, লবণ-নগর ও ঐন্‌-গদী। এই ছয়টা শহর ও এগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। এহুদা-গোষ্ঠী কিন্তু যিবূষীয়দের তাড়িয়ে দিতে পারে নি। যিবূশীয়রা ছিল জেরুজালেমের বাসিন্দা। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে যিবূশীয়রা আজও সেখানে বাস করছে। গুলিবাঁট অনুসারে ইউসুফ-গোষ্ঠীর লোকদের যে জায়গা দেওয়া হল তার সীমানা শুরু হল জেরিকোর উল্টাদিকে জেরিকোর ঝর্ণাটার পূর্ব দিকে জর্ডান নদী থেকে। তারপর সীমারেখাটা মরুভূমির মধ্য দিয়ে গিয়ে বেথেলের পাহাড়ী এলাকায় উঠে গেল। বেথেল থেকে সেটা লূসে গেল এবং লূস থেকে অটারোতে অর্কীয়দের জায়গা পর্যন্ত গেল। তারপর সীমারেখাটা পশ্চিমে নেমে গিয়ে নীচের বৈৎ-হোরোণের এলাকা পর্যন্ত যফ্‌লেটীয়দের জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে গেষরে গেল এবং ভূমধ্যসাগরে গিয়ে সীমানাটা শেষ হল। ইউসুফের ছেলে মানশা ও আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকেরা এই সব সম্পত্তি পেল। যানোহ থেকে সেটা নেমে গিয়ে অটারোৎ এবং নারঃ হয়ে জেরিকোর সীমা ঘেঁসে জর্ডানে গিয়ে পড়ল। উত্তর দিকের সেই সীমারেখা তপূহ থেকে পশ্চিম দিকে কান্না শুকনা নদী হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হল। এই হল আফরাহীম-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি। এছাড়া মানশা-গোষ্ঠীর সম্পত্তির মধ্যেকার কতগুলো শহর ও তাদের আশেপাশের গ্রামগুলো আফরাহীম-গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছিল। গেষরে যে সব কেনানীয়রা বাস করত তাদের তারা তাড়িয়ে বের করে দেয় নি। আজও তারা আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে বাস করছে; তবে আফরাহীম-গোষ্ঠীর গোলাম হিসাবে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। মানশা ইউসুফের বড় ছেলে ছিল বলে গুলিবাঁট দ্বারা তার গোষ্ঠীকেও একটা জায়গা দেওয়া হয়েছিল। মানশার বড় ছেলের নাম ছিল মাখীর। মাখীর হল গিলিয়দের পিতা। মাখীর একজন বড় যোদ্ধা ছিল বলে সে গিলিয়দ ও বাশনের অধিকার আগেই পেয়েছিল। কিন্তু মানশা-গোষ্ঠীর বাকী সব বংশের লোকদের, অর্থাৎ অবীয়েষর, হেলক, অস্রীয়েল, শেখম, হেফর এবং শমীদার বংশের লোকদের কেনান দেশে জায়গা-জমি দেওয়া হয়েছিল। বংশের দিক থেকে এরাই ছিল ইউসুফের ছেলে মানশার বাকী সব পুরুষ বংশধর। মানশার ছেলে মাখীর, মাখীরের ছেলে গিলিয়দ, গিলিয়দের ছেলে হেফর, এবং হেফরের ছেলে সল্‌ফাদ। সল্‌ফাদের কেবল মেয়ে ছিল, ছেলে ছিল না। সেই মেয়েদের নাম হল মহলা, নোয়া, হগ্‌লা, মিল্কা ও তির্সা। এই মেয়েরা ইমাম ইলিয়াসর ও নূনের ছেলে ইউসা এবং নেতাদের কাছে গিয়ে বলল, “আমাদের গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে আমাদেরও সম্পত্তির একটা অংশ দেবার হুকুম মাবুদ মূসাকে দিয়েছিলেন।” এই কথা শুনে ইউসা মাবুদের হুকুম অনুসারে তাদের বাবার ভাইদের সংগে তাদেরও সম্পত্তির অধিকার দিলেন। জর্ডানের পূর্ব দিকের গিলিয়দ ও বাশন ছাড়াও মানশা-গোষ্ঠীর ভাগে পড়ল আরও দশ খণ্ড জমি, কারণ মানশা-গোষ্ঠীর এই মেয়েরা তাদের গোষ্ঠীর ছেলেদের সংগে সম্পত্তির অধিকার পেল; আর মানশা-গোষ্ঠীর বাকী বংশধরেরা গিলিয়দ এলাকাটা পেল। মানশা-গোষ্ঠীর জায়গার সীমারেখা আশের থেকে শুরু হয়ে শিখিমের কাছে মিক্‌মথৎ পর্যন্ত গেল। তারপর সেটা দক্ষিণ দিকে গেল, যার ফলে ঐন্‌-তপূহের বাসিন্দারা মানশা-গোষ্ঠীর এলাকার মধ্যে পড়ে গেল। তপূহের আশেপাশের জায়গা অবশ্য মানশা-গোষ্ঠীর ভাগে পড়েছিল কিন্তু মানশা-গোষ্ঠীর সীমারেখার সংগে লাগানো তপূহ শহরটা আফরাহীম-গোষ্ঠীর অধিকারে পড়ল। তারপর সেই সীমারেখাটা দক্ষিণে কান্না শুকনা নদী পর্যন্ত নেমে গেল। আফরাহীম-গোষ্ঠীর কতগুলো শহর ও গ্রাম মানশা-গোষ্ঠীর সীমানায় পড়ে গিয়েছিল। মানশা-গোষ্ঠীর সীমারেখা সেই শুকনা নদীর উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছিল ভূমধ্যসাগরে। শুকনা নদীর দক্ষিণে ছিল আফরাহীম-গোষ্ঠীর জায়গা আর উত্তরে ছিল মানশা-গোষ্ঠীর জায়গা। মানশা-গোষ্ঠীর পশ্চিম সীমানা ছিল ভূমধ্যসাগর, উত্তর দিকে ছিল আশের-গোষ্ঠীর সীমানা এবং পূর্ব দিকে ছিল ইষাখর-গোষ্ঠীর সীমানা। ইষাখর ও আশের-গোষ্ঠীর সীমানার মধ্যেকার বৈৎ-শান, যিব্‌লিয়ম ও সেগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম মানশা-গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া দোর, ঐন্‌-দোর, তানক ও মগিদ্দোর লোক সুদ্ধ এই সব শহর এবং সেগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম মানশা-গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছিল। শেষ তিনটা শহর ও তাদের সংগেকার গ্রামগুলো ছিল পাহাড়ী এলাকায়। মানশা-গোষ্ঠীর লোকেরা কিন্তু ঐ সব শহর ও গ্রাম দখল করতে পারে নি, কারণ কেনানীয়রা স্থির করেছিল যে, তারা ঐ জায়গা ছেড়ে যাবে না। তবে বনি-ইসরাইলরা যখন শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন তারা কেনানীয়দের তাদের গোলাম হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু দেশ থেকে তাদের সবাইকে তারা তাড়িয়ে দিল না। ইউসুফ-গোষ্ঠীর লোকেরা গিয়ে ইউসাকে বলল, “সম্পত্তি হিসাবে কেন আপনি আমাদের মাত্র একটা ভাগ দিয়েছেন? মাবুদের দোয়ায় আমাদের লোকসংখ্যা অনেক।” জবাবে ইউসা বললেন, “লোকসংখ্যা যদি তোমাদের এতই বেশী এবং আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকাতে যদি তোমাদের না কুলায় তবে পরীষীয় ও রফায়ীয়দের দেশের বন্তজংগল কেটে ফেলে নিজেদের জন্য জমি তৈরী করে নাও।” ইউসুফ-গোষ্ঠীর লোকেরা জবাবে বলল, “পাহাড়ী এলাকার জায়গায় আমাদের কুলায় না এবং যে সব কেনানীয়রা সমভূমির বৈৎ-শান ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে এবং যিষ্রিয়েল উপত্যকায় বাস করে তাদের সকলেরই লোহার রথ আছে।” ইউসা ইউসুফের বংশধরদের, অর্থাৎ আফরাহীম ও মানশা-গোষ্ঠীর লোকদের বললেন, “তোমাদের লোকও বেশী, শক্তিও বেশী। তোমরা কেবল একটা ভাগ পাবে না। বন্তজংগলে ভরা পাহাড়ী এলাকাটাও তোমরা পাবে। তোমাদের সেটা কেটে পরিষ্কার করে নিতে হবে। জংগল ও তার সংগেকার সব জমিজমা তোমাদের অধিকারে থাকবে। কেনানীয়দের লোহার রথ থাকলেও এবং তারা শক্তিশালী হলেও তোমরা তাদের তাড়িয়ে দেবে।” সেইজন্য ইউসা বনি-ইসরাইলদের বললেন, “তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যে দেশটা তোমাদের দিয়েছেন তোমরা সম্পত্তি হিসাবে তার দখল নিতে আর কতদিন দেরি করবে? তোমরা প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে তিনজন করে লোক নিযুক্ত কর। দেশটা ভাল করে দেখেশুনে সব কিছু লিখে আনবার জন্য আমি তাদের পাঠিয়ে দেব যাতে তাদের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া যায়। কাজ শেষ করে তারা আমার কাছে ফিরে আসবে। গোটা দেশটা তারা সাত ভাগে ভাগ করবে। দক্ষিণ দিকে এহুদা-গোষ্ঠীকে যে জায়গা দেওয়া হয়েছে তারা সেখানে থাকবে, আর উত্তর দিকে থাকবে ইউসুফের বংশধরেরা। দেশের সেই সাতটা ভাগের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে সব কিছু লিখে তোমরা তা আমার কাছে নিয়ে আসবে, আর আমি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তোমাদের জন্য গুলিবাঁট করব। তবে লেবীয়রা তোমাদের সংগে কোন ভাগ পাবে না, কারণ মাবুদের ইমাম হিসাবে এবাদত-কাজ করাই হল তাদের সম্পত্তি। গাদ ও রূবেণ-গোষ্ঠীর লোকেরা এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক আগেই জর্ডান নদীর পূর্ব দিকে তাদের সম্পত্তি পেয়ে গেছে। মাবুদের গোলাম মূসাই তা তাদের দিয়ে গেছেন।” সেই লোকেরা দেশটা সম্বন্ধে সব কিছু লিখে আনবার জন্য রওনা হবার সময়ে ইউসা তাদের বলে দিলেন, “তোমরা গিয়ে দেশটা ভাল করে দেখেশুনে তার সব কিছু লিখে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তারপর আমি এখানে, এই শীলোতে, মাবুদের সামনে তোমাদের জন্য গুলিবাঁট করব।” কাজেই সেই লোকেরা দেশের সব জায়গায় গেল। তারা দেশটার বাকী অংশ সাত ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের শহর ও গ্রামগুলোর নাম ও সেগুলোর সম্বন্ধে সব কিছু এক এক করে বইয়ের মধ্যে লিখে নিয়ে শীলোর ছাউনিতে ইউসার কাছে ফিরে আসল। ইউসা শীলোতে মাবুদের সামনে বনি-ইসরাইলদের জন্য গুলিবাঁট করলেন এবং সেখানে তাদের গোষ্ঠী অনুসারে দেশটা ভাগ করে দিলেন। গুলিবাঁট করলে পর বিন্যামীন-গোষ্ঠীর নাম উঠল। সেই গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশকে যে জায়গা দেওয়া হল তা গুলিবাঁট অনুসারে এহুদা এবং ইউসুফ-গোষ্ঠীর জায়গার মাঝখানে পড়ল। উত্তর দিকে তাদের জমির সীমারেখা জর্ডান নদী থেকে শুরু হয়ে জেরিকোর উত্তর দিকের ঢালু জায়গা পার হয়ে পশ্চিম দিকে পাহাড়ী এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়ে বৈৎ-আবনের মরুভূমি পর্যন্ত চলে গেল। সেখান থেকে সীমারেখাটা লূসের, অর্থাৎ বেথেলের দক্ষিণের ঢালু জায়গাটায় গিয়ে নীচের বৈৎ-হোরোণের দক্ষিণে যে পাহাড় আছে সেই পাহাড়ের উপরে অটারোৎ-অদ্দরে নেমে গেল। তারপর সেই সীমারেখাটা বৈৎ-হোরোণের দক্ষিণের পাহাড়ের পশ্চিম দিক হয়ে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেল এবং কিরিয়ৎ-বাল, অর্থাৎ কিরিয়ৎ-যিয়ারীম পর্যন্ত গেল। কিরিয়ৎ-যিয়ারীম ছিল এহুদা-গোষ্ঠীর একটা শহর। এটা হল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর পশ্চিম দিকের সীমানা। তাদের দক্ষিণ দিকের সীমারেখা পশ্চিমে কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের সীমানা থেকে শুরু হয়ে নিপ্তোহের ঝর্ণা পর্যন্ত গেল। তারপর সেই সীমারেখাটা রফায়ীম উপত্যকার উত্তরে বেন্তহিন্নোম উপত্যকার সামনের পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত নেমে গেল। তারপর সেটা হিন্নোম উপত্যকার মধ্য দিয়ে যিবূশীয়দের শহরের দক্ষিণ দিকের ঢালু জায়গা বরাবর গিয়ে ঐন্‌-রোগেল পর্যন্ত চলে গেল। তারপর সেই সীমারেখাটা উত্তর দিকে ঘুরে ঐন্‌-শেমশ হয়ে অদুম্মীমে উঠে যাওয়ার পথের সামনে গলীলোতে গিয়ে রূবেণের বংশধর বোহনের পাথর পর্যন্ত নেমে গেল। তারপর সেটা আরবার উত্তর দিকের ঢালু জায়গাটায় গিয়ে আরবাতে নেমে গেল। তারপর সেই সীমারেখা বৈৎ-হগ্লার উত্তর দিকের ঢালু জায়গাটা ধরে মরু-সাগরের উত্তর দিকের উপসাগরে, অর্থাৎ জর্ডান নদীর মোহনায় গিয়ে পড়ল। এটাই ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর দক্ষিণ দিকের সীমানা। তাদের পূর্ব দিকের সীমানা ছিল জর্ডান নদী। এটাই ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তির চারপাশের সীমানা। বিন্যামীন-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের ভাগে যে গ্রাম ও শহরগুলো পড়েছিল সেগুলো হল জেরিকো, বৈৎ-হগ্লা, এমক-কশিশ, বৈৎ-আরবা, সমারয়িম, বেথেল, অব্বীম, পারা, অফ্রা, কফর-অম্মোনী, অফ্‌নি ও গেবা। এই বারোটা শহর এবং সেগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তারা পেয়েছিল। এছাড়া তারা গিবিয়োন, রামা, বেরোৎ, দ্বিতীয় বার গুলিবাঁট করলে পর শিমিয়োন-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের সম্পত্তি এহুদা-গোষ্ঠীর জায়গার মধ্যে পড়ল। শিমিয়োন-গোষ্ঠীর সম্পত্তির মধ্যে পড়ল বের্‌-শেবা, শেবা, মোলাদা, বৈৎ-লবায়োৎ ও শারূহন নামে তেরটা শহর ও সেগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম। সেই সম্পত্তি এহুদা-গোষ্ঠীর ভাগ থেকে নেওয়া হয়েছিল, কারণ এহুদা-গোষ্ঠীর দরকারের চেয়েও বেশী জায়গা তাদের ভাগে পড়েছিল। সেইজন্যই এহুদা-গোষ্ঠীর জায়গার মধ্যে শিমিয়োন-গোষ্ঠী তাদের সম্পত্তি পেয়েছিল। তৃতীয় বার গুলিবাঁট করলে পর সবূলূন-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের জায়গার সীমানা ছিল সারীদ পর্যন্ত। সেখান থেকে সীমারেখাটা পশ্চিম দিকে মারালা পর্যন্ত গিয়ে দব্বেশৎ হয়ে যকিয়ামের কাছের স্রোতে গিয়ে পড়ল। সেই সীমারেখাটা সারীদ থেকে পূর্ব দিকে ঘুরে কিশ্‌লোৎ-তাবোর গ্রাম পর্যন্ত গেল এবং তারপর দাবরৎ হয়ে যাফিয়তে উঠে গেল। সবূলূন-গোষ্ঠীর জায়গার মধ্যে ছিল কটৎ, নহলাল, শিম্রোণ, যিদালা ও বৈৎ-লেহম গ্রাম। তাদের ভাগে পড়েছিল বারোটা শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম। এই সব শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম সবূলূন-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি হল। চতুর্থ বার গুলিবাঁট করলে পর ইষাখর-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের জায়গার মধ্যে পড়ল যিষ্রিয়েল, কসুল্লোৎ, শূনেম, তাদের জায়গার সীমারেখা তাবোর, শহৎসূমা ও বৈৎ-শেমশ হয়ে জর্ডানে গিয়ে শেষ হল। ষোলটা শহর ও সেগুলোর আশেপাশের সব গ্রাম তাদের ভাগে পড়ল। এই সব শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম ইষাখর-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি হল। পঞ্চম বার গুলিবাঁট করলে পর আশের-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের জায়গার মধ্যে পড়ল হিল্‌কৎ, হলী, বেটন, অক্‌ষফ, তারপর সেই সীমারেখা এব্রোণ, রহোব, হম্মোন ও কান্না হয়ে মহাসীদোন পর্যন্ত চলে গেল। এই সব শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম আশের-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি হল। ষষ্ঠ বার গুলিবাঁট করলে পর নপ্তালি-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের জায়গার সীমারেখা হেলফ এবং সানন্নীমের এলোন গাছ থেকে শুরু হয়ে অদামী-নেকব ও যব্‌নিয়েল পেরিয়ে লক্কুম পর্যন্ত গেল এবং জর্ডান নদীতে গিয়ে শেষ হল। তারপর সেই সীমারেখাটা পশ্চিম দিকে গিয়ে অস্‌নোৎ-তাবোরের মধ্য দিয়ে হুক্কোকে বের হয়ে আসল। দক্ষিণে সবূলূন-গোষ্ঠীর সীমা পর্যন্ত, পশ্চিমে আশের-গোষ্ঠীর সীমা পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে জর্ডানের কাছে এহুদা পর্যন্ত ছিল নপ্তালি-গোষ্ঠীর সীমানা। তাদের জায়গার মধ্যে এই দেয়াল-ঘেরা গ্রামগুলো ছিল: সিদ্দীম, সের, হম্মৎ, রক্কৎ, কিন্নেরৎ, অদামা, রামা, হাৎসোর, কেদশ, ইদ্রিয়ী, ঐন্‌-হাৎসোর, যিরোণ, মিগ্‌দল-এল, হোরেম, বৈৎ-অনাৎ ও বৈৎ-শেমশ। ঊনিশটা শহর ও সেুগলোর আশেপাশের গ্রাম তাদের ভাগে পড়ল। এই সব শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম নপ্তালি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি হল। সপ্তম বার গুলিবাঁট করলে পর দান-গোষ্ঠীর নাম উঠল এবং তার বিভিন্ন বংশের জায়গা ঠিক করে দেওয়া হল। তাদের সম্পত্তির মধ্যে পড়ল: সরা, ইষ্টায়োল, ঈর্‌-শেমশ, যিহূদ, বন্তেবরক, গাৎ-রিম্মোণ, মেয়র্কোণ, রক্কোন এবং জাফার সামনের এলাকা। দান-গোষ্ঠী তাদের ভাগের জায়গাটার সবটুকুর দখল নেয় নি বলে তাদের পক্ষে জায়গাটা ছোট হয়েছিল। সেইজন্য তারা লেশম শহরটা আক্রমণ করে সেখানকার লোকদের হারিয়ে দিল এবং সবাইকে হত্যা করে তা দখল করল। তারা লেশমে বাস করতে লাগল এবং তাদের পূর্বপুরুষের নাম অনুসারেই সেই জায়গাটার নাম রাখল “দান।” এই সব শহর ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রাম দান-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের সম্পত্তি হল। ইমাম ইলিয়াসর, নূনের ছেলে ইউসা এবং বনি-ইসরাইলদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বংশ-কর্তারা শীলোতে মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে মাবুদের সামনে গুলিবাঁট করে এই সব জায়গাগুলোই ঠিক করে দিয়েছিলেন। এইভাবেই তাঁরা দেশটা ভাগ করবার কাজ শেষ করলেন। এর পর মাবুদ ইউসাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল, ‘মূসার মধ্য দিয়ে আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছি সেইমতই তারা যেন কতগুলো আশ্রয়-শহর ঠিক করে নেয়। যদি কেউ হঠাৎ করে কিংবা খুন করবার ইচ্ছা মনে না রেখে কাউকে হত্যা করে তাহলে সে সেখানে পালিয়ে যেতে পারবে এবং রক্তের শোধ যার নেবার কথা তার হাত থেকে রক্ষা পাবে। এই সব আশ্রয়-শহরের কোন একটার কাছে পৌঁছে শহরের সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেখানকার বৃদ্ধ নেতাদের কাছে সে নিজের সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলবে। তারপর তারা তাকে তাদের শহরে ঢুকতে দেবে এবং তার থাকবার জন্য একটা জায়গা দেবে। রক্তের শোধ যার নেবার কথা সে যদি তার পিছনে তাড়া করে আসে তবে খুনের দায়ে পড়া লোকটিকে তারা তার হাতে ছেড়ে দেবে না, কারণ সেই লোককে হত্যা করবার পিছনে আগে থেকে তার মনে কোন ইচ্ছা বা হিংসা ছিল না। বিচার-সভায় যতদিন না তার বিচার হয় এবং সেই সময়কার মহা-ইমামের যতদিন না মৃত্যু হয় ততদিন পর্যন্ত তাকে সেই আশ্রয়-শহরে থাকতে হবে। এর পর যেখান থেকে সে পালিয়ে এসেছিল সেখানে তার নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে পারবে।’ ” সেইজন্য বনি-ইসরাইলরা আশ্রয়-শহর হিসাবে নপ্তালি-গোষ্ঠীর ভাগের পাহাড়ী এলাকার গালীলের কেদশ, আফরাহীম-গোষ্ঠীর ভাগের পাহাড়ী এলাকার শিখিম এবং এহুদা-গোষ্ঠীর ভাগের পাহাড়ী এলাকার কিরিয়ৎ-অর্ব, অর্থাৎ হেবরন আলাদা করে রাখল। জেরিকোর উল্টাদিকে জর্ডানের পূর্ব দিকে তারা রূবেণ-গোষ্ঠীর ভাগের সমভূমির মরুভূমির মধ্যে বেৎসর, গাদ-গোষ্ঠীর ভাগের গিলিয়দের রামোৎ এবং মানশা-গোষ্ঠীর ভাগের বাশনের গোলান আশ্রয়-শহর হিসাবে ঠিক করল। কোন ইসরাইলীয় কিংবা তাদের মধ্যে বাস করা অন্য কোন জাতির লোক যদি কাউকে হঠাৎ মেরে ফেলে তবে সে এই সব ঠিক করা শহরগুলোর কোন একটাতে পালিয়ে যেতে পারবে। রক্তের শোধ যার নেবার কথা বিচার-সভায় খুনের দায়ে পড়া লোকটির বিচার না হওয়া পর্যন্ত সে তাকে হত্যা করতে পারবে না। লেবি-গোষ্ঠীর বংশকর্তারা ইমাম ইলিয়াসর, নূনের ছেলে ইউসা এবং বনি-ইসরাইলদের অন্যান্য গোষ্ঠীর বংশ-কর্তাদের কাছে গেলেন। তাঁরা কেনান দেশের শীলোতে তাঁদের বললেন, “আমাদের বাস করবার জন্য গ্রাম এবং আমাদের পশুপাল চরাবার জন্য গ্রামের আশেপাশের মাঠ দেবার কথা মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে আপনাদের হুকুম দিয়েছিলেন।” কাজেই মাবুদের হুকুম অনুসারে বনি-ইসরাইলরা তাদের নিজেদের সম্পত্তি থেকে কতগুলো গ্রাম ও পশু চরাবার মাঠ লেবীয়দের দিল। গুলিবাঁট করলে পর প্রথমে কহাতীয় বংশের নাম উঠল। এই লেবীয়দের মধ্যে যারা ইমাম হারুনের বংশধর তারা এহুদা, শিমিয়োন ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে তেরটা গ্রাম ও শহর পেল। কহাতের বংশের বাকী লোকদের আফরাহীম-গোষ্ঠীর পরিবারগুলোর জায়গা থেকে ও দান-গোষ্ঠীর এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের জায়গা থেকে দশটা গ্রাম ও শহর দেওয়া হল। গুলিবাঁট করে ইষাখর-গোষ্ঠীর পরিবারগুলোর জায়গা থেকে, আশের ও নপ্তালি-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে এবং বাশন দেশের বাসিন্দা মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের জায়গা থেকে গের্শোনের বংশধরদের তেরটা গ্রাম ও শহর দেওয়া হল। রূবেণ, গাদ ও সবূলূন-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে মরারির বংশধরদের বিভিন্ন পরিবার বারোটা গ্রাম ও শহর পেল। মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া মাবুদের হুকুম অনুসারে বনি-ইসরাইলরা গুলিবাঁট করে এই সব গ্রাম ও শহর এবং সেগুলোর সংগেকার পশু চরাবার মাঠ লেবীয়দের দিল। এহুদা-গোষ্ঠীর পাহাড়ী এলাকার কিরিয়ৎ-অর্ব, অর্থাৎ হেবরন ও তার চারপাশের পশু চরাবার মাঠ তাদের দেওয়া হল। অর্ব ছিল অনাকীয়দের পূর্বপুরুষ। তবে হেবরনের চারপাশের জায়গা ও গ্রামগুলো আগেই যিফুন্নির ছেলে কালুতকে সম্পত্তি হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। ইমামেরা, অর্থাৎ হারুনের বংশধরেরা মোট তেরটা গ্রাম ও শহর এবং সেগুলোর সংগেকার পশু চরাবার মাঠ পেল। লেবীয়দের কহাতীয় বংশের বাকী পরিবারগুলোকে আফরাহীম-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে কতগুলো গ্রাম ও শহর দেওয়া হল। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের জায়গা থেকে তানক ও গাৎ-রিম্মোণ নামে দু’টা গ্রাম ও সেগুলোর সংগেকার পশু চরাবার মাঠ তাদের দেওয়া হল। পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ এই দশটা গ্রাম ও শহর কহাতীয় বংশের বাকী পরিবারগুলোকে দেওয়া হল। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের জায়গা থেকে বাশন দেশের গোলান ও বীষ্টরা নামে দু’টা গ্রাম ও সেগুলোর সংগেকার পশু চরাবার মাঠ লেবি-গোষ্ঠীর গের্শোনীয়দের দেওয়া হল। এর মধ্যে গোলান ছিল খুনের আসামীর আশ্রয়-শহর। নপ্তালি-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে তাদের দেওয়া হল গালীলের কেদশ, হম্মোৎ-দোর ও কর্তন নামে তিনটা গ্রাম ও সেগুলোর সংগেকার পশু চরাবার মাঠ। এর মধ্যে কেদশ ছিল খুনের আসামীর আশ্রয়-শহর। পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ এই তেরটা গ্রাম ও শহর গের্শোনীয়দের বিভিন্ন পরিবারকে দেওয়া হল। মোট বারোটা গ্রাম লেবীয়দের বাকী বংশটিকে, অর্থাৎ মরারীয়দের বিভিন্ন পরিবারকে দেওয়া হল। বনি-ইসরাইলদের অধিকার করা জায়গার মধ্যে পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ মোট আটচল্লিশটা গ্রাম ও শহর ছিল লেবীয়দের। এগুলোর প্রত্যেকটার চারপাশে পশু চরাবার মাঠ ছিল। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে সব জায়গা দেবার কসম খেয়েছিলেন তার সবগুলোই তিনি তাদের দিয়েছিলেন। বনি-ইসরাইলরা সেই সব দেশ দখল করে নিয়ে সেখানে বাস করতে লাগল। তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে মাবুদের কসম অনুসারে তিনি চারদিকের সব যুদ্ধ থেকে তাদের বিশ্রাম দিলেন। কোন শত্রুই তাদের সামনে দাঁড়াতে পারে নি। মাবুদ তাদের সমস্ত শত্রুদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের উন্নতি করবার যে সব ওয়াদা করেছিলেন তার একটাও অপূর্ণ থাকে নি, সবগুলোই পূর্ণ হয়েছিল। অনেক দিন পর্যন্ত, এমন কি, আজ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের ভাইদের ছেড়ে যাও নি, বরং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর যে কাজের ভার দিয়েছিলেন তা তোমরা শেষ করেছ। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তিনি যুদ্ধ থেকে তোমাদের ভাইদের বিশ্রাম দিয়েছেন; কাজেই মাবুদের গোলাম মূসা জর্ডানের ওপারে তোমাদের যে জায়গা দিয়েছেন সেখানকার বাড়ীতে এবার তোমরা ফিরে যাও। কিন্তু যে সব হুকুম ও শরীয়ত মাবুদের গোলাম মূসা তোমাদের দিয়ে গেছেন তা পালন করবার দিকে মন দিয়ো। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত কোরো, তাঁর সমস্ত পথে চোলো, তাঁর সব হুকুম পালন কোরো, তাঁকে আঁকড়ে ধোরো এবং তোমাদের সমস্ত মন ও প্রাণ দিয়ে তাঁর এবাদত কোরো।” এর পর ইউসা তাদের দোয়া করে বিদায় দিলেন আর তারা তাদের বাড়ীতে ফিরে গেল। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের মূসা বাশন দেশটা দিয়েছিলেন, আর ইউসা বাকী অর্ধেক লোকদের জায়গা দিয়েছিলেন তাদের ইসরাইলীয় ভাইদের সংগে জর্ডানের পশ্চিম দিকে। ইউসা তাদের বাড়ীতে যাবার জন্য বিদায় দেবার সময় দোয়া করে বলেছিলেন, “তোমাদের প্রচুর ধন-সম্পদ হয়েছে, যেমন পশুর বড় বড় পাল, সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, লোহা ও অনেক কাপড়-চোপড়। এগুলো নিয়ে এবার তোমরা তোমাদের বাড়ীতে ফিরে যাও। তোমাদের শত্রুদের কাছ থেকে লুট করা এই সব জিনিস তোমরা তোমাদের ভাইদের সংগে ভাগ করে নিয়ো।” কাজেই মাবুদ মূসাকে যে হুকুম দিয়েছিলেন সেই অনুসারে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর সবাই এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক নিজেদের জন্য যে জায়গা পেয়েছিল সেই গিলিয়দ এলাকায় ফিরে যাবার জন্য কেনান দেশে শীলোতে বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে বিদায় নিল। তারপর তারা কেনান দেশের জর্ডান এলাকায় উপস্থিত হয়ে নদীর কাছেই সকলের চোখে পড়বার মত বড় একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করল। বাকী বনি-ইসরাইলরা যখন শুনল যে, তাদের জায়গায় কেনান দেশের সীমায় জর্ডান এলাকার নদীর কাছে তারা একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছে, তখন বাকী বনি-ইসরাইলরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্য শীলোতে জমায়েত হল। তারা ইমাম ইলিয়াসরের ছেলে পীনহসকে গিলিয়দে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের কাছে পাঠাল। তারা তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠী থেকে একজন করে মোট দশজন নেতাকে পীনহসের সংগে পাঠাল। এই দশজনের প্রত্যেকে ছিলেন ইসরাইলীয় বংশের কর্তা। তাঁরা গিলিয়দে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকদের এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের কাছে গিয়ে বললেন, “মাবুদের সমাজের সকলেই বলছেন, ‘আপনারা কেমন করে এইভাবে বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র সংগে বেঈমানী করলেন? কেমন করে আপনারা আজ মাবুদের পথ থেকে সরে গেলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের জন্য এই কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন? পিয়োরে আমরা যে গুনাহ্‌ করেছিলাম তার জন্য মাবুদের সমাজের লোকদের মধ্যে মহামারী দেখা দিয়েছিল; আজও আমরা সেই গুনাহ্‌ থেকে নিজেদের পাক-সাফ করি নি। সেই গুনাহের ফলে কি আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয় নি যে, এখন আবার আপনারা মাবুদের পথ থেকে সরে যেতে চাইছেন? আজকে যদি আপনারা মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন তবে কালকেই তিনি আমাদের গোটা ইসরাইলীয় সমাজের উপর রাগ প্রকাশ করবেন। যে দেশ আপনাদের অধিকারে রয়েছে তা যদি নাপাক হয়ে গিয়ে থাকে তবে আপনারা পার হয়ে মাবুদের দেশে আসুন। এখানে মাবুদের আবাস-তাম্বু রয়েছে। আপনারা আমাদের সংগেই বাস করুন। কিন্তু আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোরবানগাহ্‌ ছাড়া আর কোন কোরবানগাহ্‌ নিজেদের জন্য তৈরী করে মাবুদের এবং আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন না। যে সব জিনিস ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন ছিল সেই সম্বন্ধে সেরহের ছেলে আখন অবিশ্বস্ত হয়েছিল বলে মাবুদের গজব কি গোটা ইসরাইল সমাজের উপর পড়ে নি? সে তো তার গুনাহের জন্য একা মারা যায় নি।’ ” এই কথা শুনে রূবেণ ও গাদ-গোষ্ঠীর লোকেরা এবং মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকেরা জবাবে ইসরাইলীয় বিভিন্ন বংশের কর্তাদের বলল, “সর্বমহান মাবুদ আল্লাহ্‌! সর্বমহান মাবুদ আল্লাহ্‌! তিনি তো জানেনই আর ইসরাইলীয়রাও জানুক। এটা যদি মাবুদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ কিংবা অবাধ্যতার কাজ হয়ে থাকে তবে আপনারা আজকে আমাদের রেহাই দেবেন না। যদি আমরা মাবুদের পথ থেকে সরে যাবার জন্য এবং পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী কিংবা যোগাযোগ-কোরবানী দেবার উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্য এই কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে থাকি তবে মাবুদ নিজেই আমাদের শাস্তি দিন। “আমরা এই কোরবানগাহ্‌টি তৈরী করেছি এই ভয়ে যে, হয়তো বা কোনদিন আপনাদের বংশধরেরা আমাদের বংশধরদের বলবে, ‘ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌র সংগে তোমাদের কি সম্বন্ধ? রূবেণীয় ও গাদীয়রা, মাবুদ তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে জর্ডান নদীকে সীমানা হিসাবে রেখেছেন। মাবুদের উপর তোমাদের কোন দাবি নেই।’ এইভাবে হয়তো আপনাদের বংশধরেরা মাবুদের প্রতি আমাদের বংশধরদের ভয়ের মনোভাব নষ্ট করে দেবে। “কাজেই আমরা বলেছিলাম, ‘এস, আমরা একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করি।’ কিন্তু সেটা কোন পোড়ানো-কোরবানী কিংবা অন্যান্য পশু-কোরবানীর উদ্দেশ্যে নয়। এটা আপনাদের ও আমাদের মধ্যে এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যে এই সাক্ষ্যই দেবে যে, আমরা মাবুদের সামনেই আমাদের পোড়ানো-কোরবানী ও অন্যান্য পশু-কোরবানী এবং যোগাযোগ-কোরবানী দিয়ে তাঁর এবাদত করব। তাহলে ভবিষ্যতে আপনাদের বংশধরেরা আমাদের বংশধরদের এই কথা বলতে পারবে না, ‘মাবুদের উপর তোমাদের কোন দাবি নেই।’ “আমরা ভেবেছিলাম যে, তারা যদি আমাদের বা আমাদের বংশধরদের ঐ কথা বলে তবে তার জবাবে আমরা বলব, ‘মাবুদের কোরবানগাহের মত দেখতে অবিকল এই কোরবানগাহ্‌টার দিকে তোমরা চেয়ে দেখ। পোড়ানো-কোরবানী এবং অন্যান্য পশু-কোরবানীর জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা এটা তৈরী করেন নি কিন্তু করেছিলেন তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এটা যেন একটা সাক্ষী হয়ে থাকে।’ “আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র আবাস-তাম্বুর সামনে যে কোরবানগাহ্‌ আছে সেটা ছাড়া পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী এবং অন্যান্য পশু-কোরবানী দেবার জন্য অন্য কোন কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে আমরা যে মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে তাঁর পথ থেকে আজ সরে যাব তা আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকুক।” রূবেণ, গাদ ও মানশা-গোষ্ঠীর লোকেরা ইমাম পীনহস এবং ইসরাইলীয় সমাজের নেতাদের, অর্থাৎ ইসরাইলীয় বংশগুলোর কর্তাদের যা বলল তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট হলেন। ইমাম ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস তাঁদের বললেন, “আজকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মাবুদ আমাদের সংগেই আছেন, কারণ আপনারা এই ব্যাপারে মাবুদের প্রতি বেঈমানী করেন নি। আপনারা মাবুদের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের বাঁচালেন।” এর পর ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস এবং নেতারা গিলিয়দে রূবেণীয় ও গাদীয়দের কাছ থেকে কেনান দেশে ফিরে গিয়ে সব কথা বনি-ইসরাইলদের জানালেন। তা শুনে তারা খুশী হল এবং আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাল। রূবেণীয় এবং গাদীয়রা যে দেশে বাস করত তা ধ্বংস করে দেবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার কথা তারা আর বলল না। রূবেণীয় ও গাদীয়রা সেই কোরবানগাহ্‌টার নাম দিল, “আমাদের মধ্যে এটাই হল সাক্ষী যে, মাবুদই আল্লাহ্‌।” বনি-ইসরাইলদের চারপাশের শত্রুদের হাত থেকে মাবুদ তাদের বিশ্রাম দেবার পর বেশ অনেক দিন কেটে গেল। এর মধ্যে ইউসার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল, তিনি বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন তিনি সমস্ত বনি-ইসরাইলদের, অর্থাৎ তাদের বৃদ্ধ নেতাদের, কর্তাদের, বিচারকর্তাদের ও কর্মচারীদের ডেকে বললেন, “দেখ, আমার বয়স অনেক হয়েছে, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য এই সব জাতির প্রতি যা করেছেন তা তো তোমরা নিজেদের চোখেই দেখেছ। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেই তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। জর্ডান নদী থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে সব জাতিদের আমি ধ্বংস করে দিয়েছি এবং যে সব জাতি এখনও বাকী রয়ে গেছে তাদের সকলের জায়গা আমি তোমাদের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পত্তি হিসাবে ভাগ করে দিয়েছি। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেই বাকী ঐ সব জাতিগুলোকে তোমাদের পথ থেকে সরিয়ে দেবেন। তোমাদের সামনে থেকে তিনি তাদের তাড়িয়ে বের করে দেবেন আর তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তাদের জায়গা দখল করে নেবে। “কাজেই তোমরা তোমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে মূসার তৌরাত কিতাবে যা লেখা আছে তার সবই পালন কোরো; তা থেকে এদিক ওদিক সরে যেয়ো না। যে জাতিগুলো তোমাদের মধ্যে রয়ে গেছে তাদের সংগে মেলামেশা কোরো না; তাদের দেব-দেবীদের নাম পর্যন্ত মুখে এনো না বা তাদের নামে কসম খেয়ো না। সেগুলোর পূজা কোরো না কিংবা তাদের সামনে মাথা নীচু কোরো না। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে আঁকড়ে ধরে রেখো, যেমন আজ পর্যন্ত তোমরা করে আসছ। “বড় বড় এবং শক্তিশালী জাতিগুলোকে তোমাদের সামনে থেকে মাবুদই তাড়িয়ে দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত কেউ তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। তোমাদের একজন এক হাজার জনকে তাড়িয়ে দিতে পারছে, কারণ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তিনি তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করছেন। সেইজন্য তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবার ব্যাপারে তোমরা পুরোপুরি মনোযোগী হও। “কিন্তু এই জাতিগুলোর মধ্যে যে সব লোক প্রাণে বেঁচে গিয়ে তোমাদের মধ্যে রয়েছে তোমরা যদি মাবুদকে ছেড়ে তাদের সংগে যোগ দাও, কিংবা তাদের সংগে বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন কর, কিংবা তাদের সংগে মেলামেশা কর, তাহলে তোমরা এই কথা নিশ্চয় করে জেনো যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই সব জাতিদের তোমাদের সামনে থেকে আর তাড়িয়ে দেবেন না। তার বদলে তারা এমন জাল আর ফাঁদ হয়ে উঠবে যার মধ্যে তোমরা গিয়ে ধরা পড়বে এবং তারা হবে তোমাদের পিঠের চাবুক আর চোখের কাঁটা। এই যে চমৎকার দেশটা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। “দুনিয়ার সবাই যে পথে যায় এখন আমিও সেই পথে যাচ্ছি। এই কথা তোমাদের বেশ ভাল করে জানা আছে যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের উন্নতি করবার যে সব ওয়াদা করেছিলেন তার একটাও বিফল হয় নি। প্রত্যেকটি ওয়াদা পূর্ণ হয়েছে, একটাও অপূর্ণ থাকে নি। এর পর ইউসা বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীকে শিখিমে এক জায়গায় জমায়েত করলেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতাদের, কর্তাদের, বিচারকর্তাদের এবং কর্মচারীদের ডাকলেন। তাতে তাঁরা আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত হলেন। ইউসা সমস্ত লোকদের বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘অনেক কাল আগে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ফোরাত নদীর ওপারে বাস করত এবং দেব-দেবীর পূজা করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল ইব্রাহিম ও নাহুরের পিতা তারেখ। কিন্তু আমি তোমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমকে নদীর ওপার থেকে নিয়ে এসে কেনান দেশের সব জায়গায় ঘুরালাম এবং তার বংশ অনেক বাড়িয়ে দিলাম। আমি তাকে ইসহাককে দান করলাম, আর ইসহাককে দান করলাম ইয়াকুব আর ইস্‌কে। সেয়ীরের পাহাড়ী এলাকাটা আমি ইস্‌কে সম্পত্তি হিসাবে দিলাম, কিন্তু ইয়াকুব ও তার ছেলেরা গেল মিসর দেশে। “ ‘তারপর আমি মূসা ও হারুনকে পাঠালাম। আমার কাজ দ্বারা আমি মিসরীয়দের আঘাত করলাম, আর তার পরে আমি তোমাদের বের করে আনলাম। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা মিসর থেকে বের হয়ে সমুদ্রের কাছে আসল। এদিকে মিসরীয়রা রথ ও ঘোড়সওয়ার নিয়ে লোহিত সাগর পর্যন্ত তাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে আসল। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা আমার কাছে ফরিয়াদ জানালে পর আমি তাদের ও মিসরীয়দের মাঝখানে অন্ধকার করে দিলাম। আমি মিসরীয়দের উপর সাগরের পানি ফিরিয়ে এনে তাদের তলিয়ে দিলাম। মিসরীয়দের অবস্থা আমি কি করেছিলাম তা তো তোমরা নিজেরাই দেখেছ। তারপর তোমরা অনেক দিন মরুভূমিতে বাস করেছ। “ ‘এর পর আমি জর্ডানের পূর্ব দিকের বাসিন্দা আমোরীয়দের দেশে তোমাদের নিয়ে আসলাম। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল কিন্তু আমি তোমাদের হাতে তাদের তুলে দিলাম। তোমাদের সামনে থেকে আমি তাদের ধ্বংস করে ফেললাম আর তোমরা তাদের দেশ দখল করে নিলে। পরে সিপ্পোরের ছেলে মোয়াবের বাদশাহ্‌ বালাক বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হল এবং তোমাদের বদদোয়া দেবার জন্য বাউরের ছেলে বালামকে ডেকে আনল। কিন্তু বালামের কথায় কান দিতে আমি রাজী হই নি, তাই সে বারবারই তোমাদের দোয়া করেছিল। বালাকের হাত থেকে আমিই তোমাদের উদ্ধার করলাম। “ ‘তারপর তোমরা জর্ডান পার হয়ে জেরিকোতে আসলে। জেরিকো শহরের লোকেরা এবং আমোরীয়, পরিষীয়, কেনানীয়, হিট্টীয়, গির্গাশীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়রা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, কিন্তু আমি তাদের সবাইকে তোমাদের হাতে তুলে দিলাম। আমি তোমাদের আগে আগে ভিমরুল পাঠিয়ে দিলাম; ভিমরুলগুলো তোমাদের সামনে থেকে সেই দু’জন আমোরীয় বাদশাহ্‌কে তাড়িয়ে দিল। তোমরা যে তোমাদের তলোয়ার বা তীর-ধনুক দিয়ে এটা করেছ তা নয়। যে জমিতে তোমরা কোন পরিশ্রম কর নি এবং যে শহর ও গ্রাম তোমরা গড়ে তোল নি আমি সেগুলো তোমাদের দিলাম। তোমরা সেই সব শহর ও গ্রামে এখন বাস করছ; তা ছাড়া যে আংগুর ক্ষেত তোমরা কর নি আর যে জলপাই গাছ তোমরা লাগাও নি সেগুলোর ফলও তোমরা খা"ছ।’ ” তারপর ইউসা বললেন, “এখন তোমরা খাঁটি অন্তরে বিশ্বস্তভাবে মাবুদকে ভয় কর এবং তাঁর এবাদত কর। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ফোরাত নদীর ওপারে ও মিসর দেশে যে সব দেব-দেবীর পূজা করতেন সেগুলো তোমরা দূর করে দিয়ে মাবুদের এবাদত কর। কিন্তু মাবুদের এবাদত করতে যদি তোমাদের পছন্দ না হয় তবে যার এবাদত তোমরা করবে তা আজই ঠিক করে নাও। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ফোরাত নদীর ওপারে থাকতে যে সব দেব-দেবীর পূজা করতেন তাদের এবাদত করবে, না কি যাদের দেশে তোমরা বাস করছ সেই আমোরীয়দের দেব-দেবীদের এবাদত করবে? তবে আমি ও আমার পরিবারের সবাই মাবুদের এবাদত করব।” জবাবে লোকেরা বলল, “মাবুদকে ত্যাগ করে দেব-দেবীর পূজা করা যেন আমাদের দ্বারা কখনও না হয়। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেই আমাদের ও আমাদের পূর্বপুরুষদের মিসর দেশ থেকে, সেই গোলামীর দেশ থেকে বের করে এনেছেন এবং আমাদের চোখের সামনেই সেই সব বড় বড় অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছেন। আমাদের সারা যাত্রা পথে এবং যে সব জাতির মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি তাদের হাত থেকে তিনিই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই দেশের বাসিন্দা আমোরীয়দের এবং অন্যান্য সব জাতিদের মাবুদই আমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরাও মাবুদের এবাদত করব, কারণ তিনিই আমাদের আল্লাহ্‌।” এই কথা শুনে ইউসা লোকদের বললেন, “কিন্তু তোমরা তাঁর এবাদত করতে পারবে না, কারণ তিনি আল্লাহ্‌ পাক, তাঁর পাওনা এবাদত তিনি আর কাউকে পেতে দেবেন না। তোমাদের বিদ্রোহ ও তোমাদের গুনাহ্‌ তিনি মাফ করবেন না। তোমরা যদি মাবুদকে ত্যাগ করে দেব-দেবীর সেবা কর তবে তিনি তোমাদের দিক থেকে ফিরবেন এবং যদিও তিনি আগে তোমাদের মেহেরবানী করেছেন কিন্তু তখন তোমাদের উপর গজব এনে তোমাদের শেষ করে দেবেন।” এতে লোকেরা ইউসাকে বলল, “না, আমরা মাবুদেরই এবাদত করব।” তখন ইউসা বললেন, “এই কথার দ্বারা তোমরা নিজেরাই নিজেদের সাক্ষী হয়ে রইলে যে, মাবুদকেই তোমরা এবাদত করবার জন্য বেছে নিয়েছ।” জবাবে তারা বলল, “জ্বী, আমরা সাক্ষী রইলাম।” ইউসা বললেন, “তাহলে তোমাদের মধ্যে যে সব দেব-দেবী আছে তা এখনই তোমরা দূর করে দাও এবং বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপরেই তোমাদের মন রাখ।” তখন সবাই ইউসাকে বলল, “আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌রই এবাদত করব এবং তাঁরই হুকুম পালন করব।” ইউসা সেই দিন বনি-ইসরাইলদের জন্য একটা ব্যবস্থা স্থির করলেন এবং শিখিমে আইন ও নিয়ম পালন করবার জন্য তাদের নির্দেশ দিলেন। সমস্ত কিছু তিনি আল্লাহ্‌র শরীয়তের একটা কিতাবে লিখে রাখলেন। তিনি একটা বড় পাথর নিয়ে মাবুদের পবিত্র জায়গার কাছে এলোন গাছের তলায় স্থাপন করলেন। পরে তিনি সমস্ত লোকদের বললেন, “এই পাথরটা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে থাকবে। মাবুদ আমাদের কাছে যে সব কথা বলেছেন তা এই পাথরটা শুনেছে। যদি তোমরা তোমাদের আল্লাহ্‌কে অস্বীকার কর তবে এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।” এর পর ইউসা সবাইকে তাদের নিজের নিজের জায়গা-জমিতে পাঠিয়ে দিলেন। এই সব ঘটনার পর মাবুদের গোলাম নূনের ছেলে ইউসা একশো দশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলেন। লোকেরা গাশ পাহাড়ের উত্তরে তাঁর সম্পত্তির মধ্যে, অর্থাৎ আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার তিম্নৎ-সেরহে তাঁকে দাফন করল। ইউসার জীবনকালে এবং তাঁর পরে যে সব বৃদ্ধ নেতারা বনি-ইসরাইলদের জন্য মাবুদ যা কিছু করেছিলেন তা দেখেছিলেন তাঁদের জীবনকালে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের এবাদত করেছিল। ইউসুফের হাড়গুলো, যা বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল, সেগুলো তারা শিখিমে দাফন করে রেখেছিল। ইয়াকুব এই জায়গাটা শিখিমের বাবা হমোরের ছেলেদের কাছ থেকে একশো কসীতা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন। এই জায়গাটা ইউসুফের বংশধরদের সম্পত্তির মধ্যে পড়েছিল। পরে হারুনের ছেলে ইলিয়াসর ইন্তেকাল করলে তাঁকে গিবিয়াতে দাফন করা হল। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার এই জায়গাটা তাঁর ছেলে পীনহসকে দেওয়া হয়েছিল। ইউসার ইন্তেকালের পর বনি-ইসরাইলরা মাবুদকে জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের হয়ে কেনানীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য প্রথমে কারা যাবে?” জবাবে মাবুদ বললেন, “প্রথমে যাবে এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা; আমি তাদের হাতেই দেশটা তুলে দিয়েছি।” এই কথা শুনে এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ভাই শিমিয়োন-গোষ্ঠীর লোকদের বলল, “যে জায়গাটা আমাদের ভাগে পড়েছে সেখানকার কেনানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য তোমরা আমাদের সংগে চল, আর আমরাও তোমাদের জায়গা দখলের জন্য তোমাদের সংগে যাব।” এতে শিমিয়োন-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের সংগে গেল। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা আক্রমণ করলে পর মাবুদ তাদের হাতে কেনানীয় ও পরিষীয়দের তুলে দিলেন। তাদের দশ হাজার লোককে তারা বেষক শহরে হত্যা করল। সেখানে তারা অদোনী-বেষককে দেখতে পেয়ে তাঁর সংগে যুদ্ধ করল এবং কেনানীয় ও পরিষীয়দের হারিয়ে দিল। অদোনী-বেষক যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তারা তাঁকে তাড়া করে ধরে তাঁর হাত ও পায়ের বুড়ো আংগুল কেটে ফেলল। এতে অদোনী-বেষক বললেন, “আমি সত্তরজন বাদশাহ্‌র হাত ও পায়ের বুড়ো আংগুল কেটে ফেলেছিলাম। তারা আমার টেবিলের তলা থেকে এঁটোকাঁটা কুড়িয়ে খেত। আমি তাদের প্রতি যা করেছিলাম আল্লাহ্‌ও আমার প্রতি তা-ই করলেন।” পরে তারা অদোনী-বেষককে জেরুজালেমে নিয়ে গেলে পর তিনি সেখানে মারা গেলেন। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা জেরুজালেম আক্রমণ করে তা অধিকার করে নিল। তারা শহরের লোকদের হত্যা করে শহরটাতে আগুন লাগিয়ে দিল। এর পর তারা উঁচু পাহাড়ী এলাকা, নেগেভ ও নীচু পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দা কেনানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল। হেবরনের বাসিন্দা কেনানীয়দের বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়ে তারা শেশয়, অহীমান ও তল্‌ময়কে হারিয়ে দিল। হেবরনের আগের নাম ছিল কিরিয়ৎ-অর্ব। সেখান থেকে তারা দবীর শহরের লোকদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেল। দবীরের আগের নাম ছিল কিরিয়ৎ-সেফর। কালুত বললেন, “যে লোক কিরিয়ৎ-সেফর আক্রমণ করে অধিকার করতে পারবে তার সংগে আমি আমার মেয়ে অক্‌ষার বিয়ে দেব।” এই কথা শুনে কালুতের ছোট ভাই কনষের বংশধর অৎনীয়েল তা অধিকার করল। তাই কালুত তাঁর মেয়ে অক্‌ষাকে অৎনীয়েলের সংগে বিয়ে দিলেন। অৎনীয়েলের কাছে যাওয়ার পর অক্‌ষা তাকে উসকানি দিতে লাগল যেন সে তার বাবার কাছ থেকে একটা জমি চেয়ে নেয়। পরে অক্‌ষা গাধার পিঠ থেকে নামলে পর কালুত তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, তুমি কি চাও?” অক্‌ষা বলল, “আব্বা, তুমি আমার একটা কথা রাখ। তুমি আমাকে যখন নেগেভে জায়গা দিয়েছ তখন ঝর্ণাগুলোও আমাকে দাও।” এই কথা শুনে কালুত তাকে সেখানকার উঁচু ও নীচু জায়গার ঝর্ণাগুলো দিলেন। মূসার শ্বশুরের বংশধরেরা, যারা জাতিতে কেনীয় ছিল, তারা খেজুর-শহর অর্থাৎ জেরিকো থেকে বের হয়ে অরাদ এলাকার দক্ষিণে এহুদা-গোষ্ঠীর মরুভূমিতে গেল এবং সেখানকার লোকদের সংগে বাস করতে লাগল। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ভাই শিমিয়োন-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে গিয়ে সফাৎ শহরের বাসিন্দা কেনানীয়দের আক্রমণ করল এবং তাদের শহরটা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিল। সেইজন্য শহরটার নাম দেওয়া হল হর্মা (যার মানে “ধ্বংস”)। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা গাজা, অস্কিলোন ও ইক্রোণ শহর এবং সেগুলোর আশেপাশের জায়গা দখল করে নিল। মাবুদ এহুদা-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে ছিলেন। তারা পাহাড়ী এলাকা দখল করে নিয়েছিল বটে, কিন্তু সমভূমি থেকে লোকদের তাড়িয়ে দিতে পারে নি, কারণ তাদের লোহার রথ ছিল। মূসার ওয়াদা অনুসারে কালুতকে হেবরন শহরটা দেওয়া হল। অনাকের তিন ছেলেকে কালুত হেবরন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকেরা জেরুজালেমে বাসকারী যিবূষীয়দের বেদখল করতে পারে নি। বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সংগে যিবূষীয়রা আজও সেখানে বাস করছে। ইউসুফের বংশধরেরা বেথেল শহর আক্রমণ করতে গেল। মাবুদ তাদের সংগে ছিলেন। তারা শহরটা ভাল করে দেখেশুনে আসবার জন্য সেখানে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিল। বেথেলের আগের নাম ছিল লূস। সেই লোকেরা শহর থেকে একজন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখে তাকে বলল, “শহরে ঢুকবার পথটা তুমি আমাদের দেখিয়ে দাও, তাহলে আমরা তোমার কোন ক্ষতি করব না।” সে তাদের পথ দেখিয়ে দিলে পর তারা গিয়ে শহরের লোকদের হত্যা করল, কিন্তু সেই লোক ও তার বংশের লোকদের রেহাই দিল। এর পর সেই লোকটি হিট্টীয়দের দেশে গিয়ে একটা শহর তৈরী করল এবং তার নাম দিল লূস। আজও শহরটার ঐ নামই আছে। মানশা-গোষ্ঠীর লোকেরা বৈৎ-শান, তানক, দোর, যিব্লিয়ম ও মগিদ্দো শহরের এবং সেগুলোর চারপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিতে পারে নি, কারণ এই সব জায়গার কেনানীয়রা স্থির করেছিল যে, তারা ঐ দেশ ছেড়ে যাবে না। বনি-ইসরাইলরা যখন শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন তারা ঐ সব লোকদের তাদের গোলাম হতে বাধ্য করল কিন্তু তাদের একেবারে তাড়িয়ে দিল না। আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকেরাও গেষর থেকে কেনানীয়দের বের করে দেয় নি। তারা সেখানে তাদের মধ্যেই রয়ে গেল। সবূলূন-গোষ্ঠীর লোকেরাও কিট্‌রোণ ও নহলোল থেকে কেনানীয়দের বের করে দেয় নি। তারা সেখানে তাদের মধ্যেই রয়ে গেল, তবে সবূলূন-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের গোলাম হতে বাধ্য করল। আশের-গোষ্ঠীর লোকেরাও অক্কো, সিডন, অহলব, অক্‌ষীব, হেল্‌বা, অফীক ও রহোবের লোকদের তাড়িয়ে দেয় নি। তারা সেই দেশের বাসিন্দা কেনানীয়দের মধ্যে বাস করতে লাগল, কারণ তারা তাদের বের করে দেয় নি। নপ্তালি-গোষ্ঠীর লোকেরাও বৈৎ-শেমশ ও বৈৎ-অনাতের লোকদের তাড়িয়ে দেয় নি; তারা সেখানকার কেনানীয় লোকদের মধ্যে বাস করতে লাগল এবং তাদের গোলাম হতে বাধ্য করল। আমোরীয়রা দান-গোষ্ঠীর লোকদের পাহাড়ী এলাকায় আটক রাখল; সমভূমিতে তাদের নামতে দিল না। আমোরীয়রা হেরস পাহাড়, অয়ালোন ও শাল্‌বীমে থাকবে বলেই স্থির করল; কিন্তু ইউসুফের বংশের লোকদের শক্তি যখন বেড়ে গেল তখন তারা আমোরীয়দের গোলাম হতে বাধ্য করল। অক্রব্বীম নামে উঠে যাওয়ার পথ থেকে সেলা ছাড়িয়ে ছিল আমোরীয়দের এলাকা। মাবুদের ফেরেশতা গিল্‌গল থেকে বোখীমে এসে বনি-ইসরাইলদের বললেন, “আমি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি আর যে দেশ দেবার কসম আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে খেয়েছিলাম সেই দেশে তোমাদের নিয়ে এসেছি। আমি বলেছিলাম, ‘তোমাদের জন্য আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা আমি কখনও ভাঙ্গব না। তোমরা এই দেশের লোকদের সংগে কোন চুক্তি করবে না বরং তাদের বেদীগুলো ভেংগে ফেলবে।’ কিন্তু তোমরা আমার কথার অবাধ্য হয়েছ। তোমরা কেমন করে এই রকম কাজ করলে? সেইজন্য এখন আমি তোমাদের বলছি যে, আমি তোমাদের কাছ থেকে এই লোকদের তাড়িয়ে দেব না; তারা তোমাদের জন্য ফাঁদ হবে, কারণ তোমরা তাদের দেব-দেবীদের ফাঁদে পড়বে।” মাবুদের ফেরেশতা যখন বনি-ইসরাইলদের কাছে এই সব কথা বললেন তখন তারা জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। তারা সেই জায়গাটার নাম দিল বোখীম (যার মানে “বিলাপকারী”)। মাবুদের উদ্দেশে সেখানে তারা পশু-কোরবানী দিল। ইউসা বনি-ইসরাইলদের বিদায় দেওয়ার পর তারা যে যার ভাগের জায়গা দখল করবার জন্য চলে গেল। ইউসা যত দিন বেঁচে ছিলেন এবং তাঁর পরে বৃদ্ধ নেতারা যত দিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বনি-ইসরাইলরা মাবুদের এবাদত করেছিল। বনি-ইসরাইলদের জন্য মাবুদ যে সমস্ত মহৎ কাজ করেছিলেন সেই বৃদ্ধ নেতারা তা দেখেছিলেন। মাবুদের গোলাম নূনের ছেলে ইউসা একশো দশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। লোকেরা তাঁকে তাঁর নিজের সম্পত্তির মধ্যে তিম্নৎ-হেরস নামে একটা জায়গায় দাফন করেছিল। জায়গাটা ছিল আফরাহীম-গোষ্ঠীর পাহাড়ী এলাকার গাশ পাহাড়ের উত্তর দিকে। ইউসার সময়কার বনি-ইসরাইলরা মারা গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবার পর তাদের জায়গায় আসল তাদের বংশধরেরা। এরা মাবুদকে জানত না এবং মাবুদ বনি-ইসরাইলদের জন্য যা করেছিলেন তা-ও জানত না। মাবুদের চোখে যা খারাপ তারা তা-ই করত। তারা বাল-দেবতাদের পূজা করত। তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি তাদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন তাঁকে তারা বার বার ত্যাগ করত। তারা তাদের চারপাশের জাতিদের বিভিন্ন দেব-দেবীর দিকে ঝুঁকে পড়ত এবং সেগুলোর পূজা করত, আর তাতে তারা মাবুদের রাগ জাগিয়ে তুলত। এইভাবে তারা মাবুদকে ত্যাগ করে বাল-দেবতা ও অষ্টারোৎ দেবীর পূজা করত। সেইজন্য মাবুদ রাগে লুটকারীদের হাতে বনি-ইসরাইলদের তুলে দিতেন। তারা তাদের জিনিসপত্র লুট করে নিত। তাদের চারপাশের শত্রুদের হাতে তিনি তাদের তুলে দিতেন, কাজেই তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে আর দাঁড়াতে পারত না। বনি-ইসরাইলরা যখন যুদ্ধে যেত তখন মাবুদ কসম খেয়ে যে ওয়াদা করেছিলেন সেই অনুসারে তাঁর হাত তাদের ক্ষতির জন্য তাদের বিরুদ্ধে থাকত, তাই তারা মহা বিপদের মধ্যে ছিল। তখন মাবুদ তাদের মধ্যে শাসনকর্তা দাঁড় করাতেন। তাঁরা লুটকারীদের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করতেন, কিন্তু তবুও বনি-ইসরাইলরা এই শাসনকর্তাদের কথায় কান দিত না। মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে তারা দেব-দেবীদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিত এবং তাদের পূজা করত। তাদের পূর্বপুরুষেরা মাবুদের হুকুম পালন করে যে বাধ্যতার পথে চলতেন তারা সেই পথে না চলে অল্পকালের মধ্যেই সেই পথ থেকে সরে যেত। মাবুদ যখনই তাদের জন্য কোন শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন তখন তিনি তাঁর সংগে থাকতেন। সেই শাসনকর্তা যতদিন বেঁচে থাকতেন ততদিন পর্যন্ত মাবুদ শত্রুদের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করতেন। অত্যাচারীদের হাতে যন্ত্রণা ও কষ্ট পেয়ে তারা যখন কান্নাকাটি করত তখন তাদের উপর মাবুদের দয়া হত। কিন্তু সেই শাসনকর্তা মারা গেলে লোকেরা আবার দেব-দেবীর দিকে ঝুঁকে পড়ত এবং তাদের সেবা ও পূজা করে তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে আরও জঘন্য পথে ফিরে যেত। তারা কিছুতেই তাদের খারাপ অভ্যাস আর একগুঁয়েমির পথ ছাড়ত না। সেইজন্য মাবুদ বনি-ইসরাইলদের উপর রাগে জ্বলে উঠে বললেন, “এই জাতির পূর্বপুরুষদের সময় আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম তা এরা পালন করে নি এবং আমার কথাও শোনে নি। সেইজন্য ইউসা মারা যাবার সময়ে যে সব জাতি দেশে রয়ে গেছে তাদের আমি বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেব না। বনি-ইসরাইলরা তাদের পূর্বপুরুষদের মত আমার পথে চলে কি না আমি এই সব জাতিদের দিয়েই তাদের পরীক্ষা করব।” মাবুদ ঐ সব জাতিগুলোকে সংগে সংগে তাড়িয়ে বের করে না দিয়ে দেশে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি ইউসার হাতে তাদের তুলে দেন নি। যে সব ইসরাইলীয়দের কেনান দেশের কোন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না তাদের পরীক্ষায় ফেলে শিক্ষা দেবার জন্য মাবুদ কতগুলো জাতিকে দেশের মধ্যেই রেখে দিয়েছিলেন। বনি-ইসরাইলদের বংশধরেরা যারা আগে কোন দিন যুদ্ধ করে নি তাদের যুদ্ধের ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলবার জন্য তিনি তা করেছিলেন। সেই সব জাতিগুলো হল, ফিলিস্তিনীরা ও তাদের পাঁচজন শাসনকর্তা, সমস্ত কেনানীয়রা এবং সিডনীয় ও হিব্বীয়রা। বাল-হর্মোণ পাহাড় থেকে হামা গ্রাম পর্যন্ত লেবাননের যে পাহাড়ী এলাকাটা আছে এই হিব্বীয়রা সেখানে থাকত। মাবুদ মূসার মধ্য দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের যে হুকুম দিয়েছিলেন তা এই বনি-ইসরাইলরা মেনে চলে কি না তা পরীক্ষা করবার জন্য এই সব জাতিকে রেখে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে বনি-ইসরাইলরা কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় এবং যিবূষীয়দের মধ্যে বাস করতে লাগল। তারা তাদের মেয়েদের বিয়ে করত এবং নিজেদের মেয়েদের তাদের ছেলেদের সংগে বিয়ে দিত আর তাদের দেব-দেবীদের পূজা করত। বনি-ইসরাইলরা মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতে লাগল। তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভুলে গিয়ে বাল-দেবতাদের আর আশেরা দেবীদের পূজা করতে লাগল। সেইজন্য ইসরাইলের প্রতি মাবুদের রাগ জ্বলে উঠল এবং তিনি ইরাম-নহরয়িমের বাদশাহ্‌ কূশন্তরিশিয়াথয়িমের হাতে তাদের তুলে দিলেন। তারা আট বছর তাঁর অধীনে রইল। কিন্তু তারা মাবুদের কাছে কান্নাকাটি করলে পর তিনি তাদের উদ্ধার করবার জন্য একজন উদ্ধারকর্তা দাঁড় করালেন। তিনি হলেন কালুতের ছোট ভাই কনষের বংশধর অৎনীয়েল। মাবুদের রূহ্‌ তাঁর উপর আসলে পর তিনি বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হলেন। তিনি যখন যুদ্ধ করতে গেলেন তখন মাবুদ ইরামের বাদশাহ্‌ কূশন্তরিশিয়াথয়িমকে তাঁর হাতে তুলে দিলেন, আর তিনি তাঁকে হারিয়ে দিলেন। কনষের বংশধর অৎনীয়েলের ইন্তেকাল পর্যন্ত দেশে চল্লিশ বছর শান্তি ছিল। পরে মাবুদের চোখে যা খারাপ বনি-ইসরাইলরা আবার তা-ই করতে শুরু করল। কাজেই মাবুদ মোয়াবের বাদশাহ্‌ ইগ্লোনকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তুললেন। অম্মোনীয় ও আমালেকীয়দের সংগে নিয়ে ইগ্লোন বনি-ইসরাইলদের হামলা করলেন এবং জেরিকো অধিকার করে নিলেন। বনি-ইসরাইলরা আঠারো বছর মোয়াবের বাদশাহ্‌ ইগ্লোনের অধীনে রইল। এর পর বনি-ইসরাইলরা আবার মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে লাগল, আর তিনি তাদের জন্য এহূদ নামে একজন উদ্ধারকর্তা দাঁড় করালেন। তিনি ছিলেন বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গেরার ছেলে। তিনি বাঁ হাতে কাজ করতেন। মোয়াবের বাদশাহ্‌ ইগ্লোনকে খাজনা দেবার জন্য বনি-ইসরাইলরা তাঁকে পাঠিয়ে দিল। তিনি এক হাত লম্বা দু’দিকে ধার দেওয়া একটা ছোরা বানিয়ে তাঁর কাপড়ের নীচে ডান রানের সংগে বেঁধে নিলেন। তিনি গিয়ে মোয়াবের বাদশাহ্‌ ইগ্লোনকে সেই খাজনা দিলেন। বাদশাহ্‌ ইগ্লোন ছিলেন খুব মোটা। খাজনা দেবার পর যারা খাজনা বয়ে এনেছিল এহূদ তাদের বিদায় করে দিলেন, কিন্তু তিনি নিজে গিল্‌গলের কাছের খোদাই করা পাথরগুলো পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে বললেন, “মহারাজ, আপনাকে আমার একটা গোপন খবর দেবার আছে।” বাদশাহ্‌ তাঁর লোকদের বললেন, “তোমরা চুপ কর”; এতে তাঁর লোকেরা তাঁর কাছ থেকে চলে গেল। তখন বাদশাহ্‌ তাঁর ছাদের ঠাণ্ডা-ঘরে একা বসে ছিলেন, আর এহূদ তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনাকে আমার একটা খবর দেবার আছে; খবরটা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছে।” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ উঠে দাঁড়ালেন, আর এহূদ বাঁ হাত দিয়ে তাঁর ডান দিকের রান থেকে ছোরাটা টেনে বের করে নিয়ে বাদশাহ্‌র পেটে সেটা ঢুকিয়ে দিলেন। বাঁট সুদ্ধ ছোরাটা পেটে ঢুকে গিয়ে চর্বিতে ঢাকা পড়ে গেল, কারণ এহূদ ছোরাটা টেনে বের করে নেন নি। ছোরাটা পিছন দিকে খানিকটা বের হয়ে ছিল। তারপর এহূদ বারান্দায় বের হয়ে এসে ঘরের দরজা টেনে দিয়ে তালা বন্ধ করে দিলেন। এহূদ চলে যাবার পর চাকরেরা এসে দেখল উপরের ঘরের দরজা তালা দেওয়া। তারা বলল, “নিশ্চয় তিনি ভিতরের ঘরে পায়খানায় গেছেন।” তারা অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করল, কিন্তু তবুও তিনি দরজা খুলছেন না দেখে তারা লজ্জা ভেংগে চাবি এনে দরজা খুলে ফেলল। তারা দেখল তাদের মালিক মরা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। চাকরেরা অপেক্ষা করবার সময় এহূদ পালিয়ে গিয়ে খোদাই করা পাথরগুলো পিছনে ফেলে সিয়ীরাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় তিনি শিংগা বাজালে পর বনি-ইসরাইলরা তাঁর সংগে পাহাড় থেকে নীচে নেমে এসে তাঁর পিছনে পিছনে চলল, কারণ তিনি তাদের হুকুম দিয়েছিলেন, “আমার পিছনে পিছনে এস; মাবুদ তোমাদের শত্রু মোয়াবীয়দের তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।” কাজেই তারা তাঁর পিছনে পিছনে নেমে গিয়ে মোয়াবের কাছে জর্ডান নদীর যে জায়গাগুলো হেঁটে পার হওয়া যায় সেগুলো দখল করে নিল। তারা কাউকে সেই সব জায়গা দিয়ে পার হতে দিল না। সেই সময় তারা দশ হাজার মোয়াবীয়কে হত্যা করল। এই মোয়াবীয়রা সবাই স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তাদের একজন লোকও পালিয়ে যেতে পারে নি। সেই দিনই মোয়াব দেশটা বনি-ইসরাইলদের অধীনে আনা হল, আর আশি বছর দেশে শান্তি বজায় রইল। এহূদের পরে অনাতের ছেলে শম্‌গর শাসনকর্তা হলেন। তিনি গরু চরানো লাঠি দিয়ে ফিলিস্তিনীদের ছ’শো লোককে হত্যা করেছিলেন। তিনিও বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করেছিলেন। এহূদ ইন্তেকাল করবার পরে বনি-ইসরাইলরা আবার মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতে লাগল। কাজেই মাবুদ যাবীন নামে একজন কেনানীয় বাদশাহ্‌র হাতে তাদের তুলে দিলেন। যাবীন হাৎসোরে থেকে রাজত্ব করতেন। তাঁর সেনাপতির নাম ছিল সীষরা। তিনি হরোশৎ-হগোয়িম নামে একটা জায়গায় বাস করতেন। যাবীনের ন’শো লোহার রথ ছিল এবং তিনি বিশ বছর ধরে বনি-ইসরাইলদের উপর ভীষণভাবে জুলুম করে আসছিলেন। সেইজন্য বনি-ইসরাইলরা মাবুদের কাছে সাহায্যের জন্য ফরিয়াদ জানাতে লাগল। সেই সময় লপ্পীদোতের স্ত্রী দবোরা একজন মহিলা-নবী ছিলেন। তিনিই তখন বনি-ইসরাইলদের শাসন করতেন। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার রামা ও বেথেলের মাঝামাঝি একটা জায়গায় দবোরা তাঁর খেজুর গাছের তলায় বসতেন, আর বনি-ইসরাইলরা নিজেদের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার জন্য তাঁর কাছে আসত। তিনি নপ্তালি দেশের কেদশ শহর থেকে অবীনোয়মের ছেলে বারককে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌ আপনাকে এই হুকুম দিচ্ছেন, ‘তুমি নপ্তালি আর সবূলূন-গোষ্ঠী থেকে দশ হাজার লোক সংগে নাও এবং তাবোর পাহাড়ের দিকে তাদের নিয়ে যাও। আমি যাবীনের সেনাপতি সীষরাকে তার সৈন্যদল ও রথ সুদ্ধ কীশোন নদীর কাছে নিয়ে যাব এবং তোমার হাতে তাদের তুলে দেব।’ ” বারক দবোরাকে বললেন, “আপনি যদি আমার সংগে যান তবেই আমি যাব, তা না হলে আমি যাব না।” দবোরা বললেন, “ঠিক আছে, আমি আপনার সংগে যাব, কিন্তু এই যুদ্ধে জয়ের গৌরব আপনি পাবেন না, কারণ মাবুদ একজন স্ত্রীলোকের হাতে সীষরাকে তুলে দেবেন।” এই কথা বলে দবোরা বারকের সংগে কেদশে গেলেন। বারক সেখানে সবূলূন ও নপ্তালি-গোষ্ঠীর লোকদের ডাকলেন। তাতে দশ হাজার লোক তাঁর সংগে গেল আর দবোরাও তাঁর সংগে গেলেন। এর আগেই হেবর নামে একজন কেনীয় অন্যান্য কেনীয়দের, অর্থাৎ মূসার শ্বশুর শোয়াইবের বংশধরদের ছেড়ে কেদশের কাছে সানন্নীমের এলোন গাছের পাশে তাঁর তাম্বু ফেলেছিলেন। তখন দবোরা বারককে বললেন, “আপনি এগিয়ে যান, মাবুদ আজকেই সীষরাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছেন। মাবুদ তো আপনার আগে আগে গেছেন।” তখন বারক তাবোর পাহাড় থেকে নীচে নেমে গেলেন আর তাঁর পিছনে পিছনে দশ হাজার লোক গেল। বারক যখন হামলা করলেন তখন তাঁর সামনে মাবুদ সীষরা ও তাঁর সমস্ত রথ ও সৈন্য-সামন্তকে বিশৃঙ্খল করে দিলেন। তখন সীষরা তাঁর রথ ফেলে পালিয়ে গেলেন। বারক কিন্তু হরোশৎ-হগোয়িম পর্যন্ত তাদের রথ এবং সৈন্যদলের পিছনে তাড়া করে গেলেন। সীষরার সমস্ত সৈন্যদের হত্যা করা হল, একজনও বাকী রইল না। সীষরা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে কেনীয় হেবরের স্ত্রী যায়েলের তাম্বুতে গিয়ে উঠলেন, কারণ হাৎসোরের বাদশাহ্‌ যাবীন এবং কেনীয় হেবরের বংশের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সীষরাকে ডেকে আনবার জন্য যায়েল তাম্বু থেকে বের হয়ে তাঁকে বলল, “হে আমার প্রভু, আসুন, ভিতরে আসুন; আপনি ভয় পাবেন না।” কাজেই সীষরা তার তাম্বুতে ঢুকলেন আর যায়েল তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখল। সীষরা বললেন, “আমার পিপাসা পেয়েছে, আমাকে একটু পানি দাও।” যায়েল দুধ রাখবার চামড়ার থলি খুলে তাঁকে দুধ খেতে দিল ও তারপর আবার তাঁকে ঢেকে রাখল। তারপর সীষরা তাকে বললেন, “তুমি তাম্বুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাক। যদি কেউ এসে জিজ্ঞাসা করে ভিতরে কেউ আছে কি না তবে তাকে বলবে, ‘নেই।’ ” পরে সীষরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে সেখানে ঘুমিয়ে পড়লেন। এমন সময় যায়েল তাম্বুর একটা গোঁজ আর হাতুড়ী নিল। তারপর চুপিচুপি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর কপালের একপাশ দিয়ে গোঁজটা এমনভাবে ঢুকিয়ে দিল যে, সেটা মাটিতে গেঁথে গেল। তাতে সীষরা মারা গেলেন। বারক সীষরাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তখন যায়েল তাঁকে ডেকে আনবার জন্য বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, “আসুন, আপনি যাকে তালাশ করছেন আমি তাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।” বারক তার সংগে ভিতরে গিয়ে দেখলেন সীষরা মরে পড়ে আছেন আর তাঁর কপালে তাম্বুর গোঁজটা ঢুকে আছে। ঐ দিনই আল্লাহ্‌ কেনানীয় বাদশাহ্‌ যাবীনকে বনি-ইসরাইলদের অধীনে আনলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বনি-ইসরাইলরা দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল আর শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধ্বংস করে ফেলল। সেই দিন দবোরা আর অবীনোয়মের ছেলে বারক এই কাওয়ালী গাইলেন: ইসরাইলের নেতারা যুদ্ধে লোকদের পরিচালনা করলেন, আর লোকেরাও নিজের ইচ্ছায় এগিয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ্‌! ওহে বাদশাহ্‌রা, আপনারা শুনুন; ওহে শাসনকর্তারা, আপনারা শুনুন; আমি মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসার গজল গাইব। হে মাবুদ, তুমি যখন সেয়ীর থেকে রওনা হলে, ইদোম দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে, তখন দুনিয়া কেঁপে উঠল আর আসমান থেকে মেঘ পানিধারা ঢেলে দিল। তখন মাবুদের সামনে পাহাড়-পর্বত কেঁপে উঠল, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে তুর পাহাড় কেঁপে উঠল। অনাতের ছেলে শম্‌গর আর যায়েলের সময়ে সদর রাস্তা ছেড়ে পথিকেরা ঘুর পথে চলত। তখন বনি-ইসরাইলদের গ্রামে কেউ বাস করত না; যতদিন না আমি দবোরা বনি-ইসরাইলদের মায়ের মত হলাম, ততদিন তাদের গ্রামগুলো জনশূন্য ছিল। তারা যখন নতুন দেব-দেবীর দিকে মন দিল তখন তাদের শহর-দরজার কাছে যুদ্ধ হল। চল্লিশ হাজার ইসরাইলীয়দের হাতে একটা ঢালও ছিল না, একটা বর্শাও ছিল না। আমার মন চলে গেল ইসরাইলের সেই সব নেতাদের কাছে যারা নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধ করতে গেল; আলহামদুলিল্লাহ্‌! তোমরা যারা সাদা গাধীর উপর চড়ে আর কম্বলের গদির উপর বসে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছ, তোমরা এই সব বিষয় নিয়ে কাওয়ালী গাও। শোন, পানি তুলবার জায়গায় লোকেরা বলাবলি করছে; তারা ইসরাইলের গ্রামের লোকদের জন্য মাবুদের উদ্ধার-কাজের কথা বলছে। এসব শুনে মাবুদের বান্দারা শহরের দরজাগুলোর কাছে গেল। জাগো দবোরা, জাগো! জাগো, জাগো, কাওয়ালী গাও। ওহে অবীনোয়মের ছেলে বারক, ওঠো; যুদ্ধে যারা ধরা পড়েছে তাদের নিয়ে যাও। তারপর বেঁচে থাকা লোকেরা গণ্যমান্য লোকদের কাছে আসল; মাবুদের বান্দারা যুদ্ধ করবার জন্য আসল আমার কাছে। কিছু লোক আসল আফরাহীম থেকে যেখানে আমালেকীয়রা বাস করত; তারা আসল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকদের পিছনে। মাখীর থেকে নেতারা আসলেন, আর সবূলূন থেকে শাসনকর্তারা আসলেন দণ্ড হাতে নিয়ে। ইষাখরের সেনাপতিরা দবোরার সংগে গেলেন; ইষাখরের লোকেরা দৌড়ে উপত্যকায় নেমে গেল বারকের পিছে পিছে। রূবেণের সৈন্যদল শক্তভাবে মন স্থির করল। হে রূবেণের লোকেরা, কেন তোমরা ভেড়ার খোঁয়াড় দু’টার মাঝখানে বসে ছিলে? তোমরা কি রাখালদের বাঁশী শুনতে চেয়েছিলে? রূবেণের সৈন্যদলের মধ্যে ভীষণ মতের অমিল হল। গিলিয়দের লোকেরা রয়ে গেল জর্ডানের ওপারে। দান-গোষ্ঠী কেন রয়ে গেল জাহাজের কাছে? আশের-গোষ্ঠীর লোকেরা সাগরের পারে রয়ে গেল; তারা বন্দরের কাছেই রয়ে গেল। যুদ্ধে সবূলূনের লোকেরা জীবনের ঝুঁকি নিল; যুদ্ধের মাঠের উঁচু জায়গাগুলোতে নপ্তালির লোকেরাও জীবনের ঝুঁকি নিল। বাদশাহ্‌রা, কেনানের বাদশাহ্‌রা এসে যুদ্ধ করল; মগিদ্দোর পানির কাছে তানকে তারা যুদ্ধ করল, কিন্তু কোন রূপা তারা লুটে নিতে পারল না। আসমান থেকে তারাগুলোই যুদ্ধ করল, নিজের নিজের বাঁধা পথে থেকে যুদ্ধ করল সীষরার বিরুদ্ধে। সেই পুরাকালের নদীর পানি, সেই কীশোন নদীর পানি শত্রুদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। হে আমার দিল, শক্ত হয়ে এগিয়ে চল। তারপর মাটি কেঁপে উঠল ঘোড়ার খুরের ঘায়ে আর শক্তিশালী ঘোড়াগুলো চলল খট্‌-খটা-খট্‌ করে। মাবুদের ফেরেশতা বললেন, “মেরোসকে বদদোয়া দাও, ভীষণভাবে বদদোয়া দাও সেখানকার লোকদের; তারা কেউ যুদ্ধে মাবুদের সংগে যোগ দেয় নি, যোগ দেয় নি শক্তিশালীদের বিরুদ্ধে। ধন্যা কেনীয় হেবরের স্ত্রী যায়েল, ধন্যা সে স্ত্রীলোকদের মধ্যে; সে তাম্বুবাসী স্ত্রীলোকদের মধ্যে ধন্যা । সীষরা পানি চাইলে সে তাকে এনে দিল দুধ; সুন্দর বাটিতে করে এনে দিল ঘন করা দুধ। পরে সে হাতে নিল তাম্বু বাঁধার গোঁজ, আর ডান হাতে ধরল কামারের হাতুড়ী; সে সীষরাকে আঘাত করে তার মাথা ফাটিয়ে দিল আর কপালে বিঁধিয়ে দিল সেই গোঁজখানা। তার পায়ের কাছে সীষরা পড়ে গেল আর যেখানে পড়ল সেখানেই সে পড়ে রইল; তার পায়ের কাছে যেখানে সে পড়েছিল সেখানেই সে মরে গেল। সীষরার মা জানালা দিয়ে চেয়ে দেখল, জালির পিছন থেকে সে চেঁচিয়ে বলল, “তার রথ আসতে কেন এত দেরি হচ্ছে? তার রথের চাকার শব্দ কেন এখনও শোনা যাচ্ছে না?” তার বুদ্ধিমতী সংগিনীরা এর জবাব দিল; সেও মনে মনে বলতে লাগল, “নিশ্চয়ই তারা লুটের জিনিস পেয়েছে আর ভাগ করে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে; প্রত্যেক পুরুষের জন্য একটা বা দু’টা করে মেয়ে আর সীষরার জন্য রংগীন পোশাক, ফুল তোলা রংগীন পোশাক, গলার চারপাশে সুন্দর করে ফুল তোলা পোশাক- এ সবই কি তারা লুট হিসাবে পায় নি?” হে মাবুদ, তোমার শত্রুরা সকলেই এভাবে ধ্বংস হয়ে যাক; কিন্তু যারা তোমাকে মহব্বত করে তারা যেন সূর্যের মত শক্তিমান হয়ে ওঠে। এর পর দেশে চল্লিশ বছর শান্তি ছিল। পরে বনি-ইসরাইলরা আবার মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতে লাগল। এতে তিনি মাদিয়ানীয়দের হাতে তাদের তুলে দিলেন আর তারা সাত বছর পর্যন্ত তাদের অধীনে রইল। বনি-ইসরাইলদের উপর মাদিয়ানীয়দের জুলুম এত বেড়ে গেল যে, বনি-ইসরাইলরা পাহাড়ের ফাটলে, গুহায় এবং পাহাড়ের উপরকার কেল্লাগুলোতে আশ্রয়ের জায়গা করে নিল। বনি-ইসরাইলরা যখন তাদের ফসল বুনত তখন মাদিয়ানীয়, আমালেকীয় এবং পূর্ব দেশের লোকেরা এসে তাদের দেশ হামলা করত। তারা বনি-ইসরাইলদের দেশ হামলা করে গাজা পর্যন্ত সমস্ত জায়গার ফসল নষ্ট করে দিত। বনি-ইসরাইলরা খেয়ে বাঁচতে পারে এমন কোন কিছুই মাদিয়ানীয়দের হাত থেকে রেহাই পেত না, এমন কি, ভেড়া, গরু আর গাধাও না। তারা তাদের পশুর পাল ও তাম্বু নিয়ে পংগপালের ঝাঁকের মত আসত; তাদের লোক ও উটের সংখ্যা গোণা যেত না। তারা দেশটা ধ্বংস করে দেবার উদ্দেশ্যেই আসত। মাদিয়ানীয়রা বনি-ইসরাইলদের অবস্থা এমন খারাপ করে তুলল যে, তারা সাহায্যের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ফরিয়াদ জানাতে লাগল। মিসরের ক্ষমতা থেকে আর সমস্ত জুলুমবাজদের হাত থেকে আমিই তোমাদের রক্ষা করেছি। তোমাদের সামনে থেকে আমিই তাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের দেশ তোমাদের দিয়েছি। আমি তোমাদের বলেছিলাম যে, আমি আল্লাহ্‌ই তোমাদের মাবুদ। যাদের দেশে তোমরা বাস করছ সেই আমোরীয়দের দেব-দেবীদের পূজা তোমরা করবে না;’ কিন্তু তোমরা আমার কথা শোন নি।” একদিন মাবুদের ফেরেশতা এসে অফ্রা গ্রামের এলোন গাছের তলায় বসলেন। এই জায়গাটা ছিল অবিয়েষ্রীয় বংশের যোয়াশের অধিকারে। সেখানে তার ছেলে গিদিয়োন মাদিয়ানীয়দের কাছ থেকে গম লুকাবার জন্য আংগুর মাড়াবার জায়গায় তা ঝাড়ছিলেন। সেই সময় মাবুদের ফেরেশতা গিদিয়োনকে দেখা দিয়ে বললেন, “হে শক্তিশালী যোদ্ধা, মাবুদ তোমার সংগে আছেন।” জবাবে গিদিয়োন বললেন, “কিন্তু হে আমার প্রভু, যদি মাবুদ আমাদের সংগে থাকেন তবে এই সব আমাদের উপর ঘটল কেন? কোথায় গেল তাঁর সেই সব কুদরতি যার কথা বলতে গিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের বলতেন যে, মাবুদই মিসর দেশ থেকে তাঁদের বের করে এনেছেন? কিন্তু তিনি তো এখন আমাদের ত্যাগ করেছেন এবং মাদিয়ানীয়দের হাতে তুলে দিয়েছেন।” মাবুদ তাঁর দিকে ফিরে বললেন, “তোমার এই শক্তিতেই তুমি যাও এবং মাদিয়ানীয়দের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার কর, কারণ আমিই তোমাকে পাঠাচ্ছি।” গিদিয়োন বললেন, “কিন্তু হে আমার প্রভু, আমি কেমন করে বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করব? মানশা-গোষ্ঠীর মধ্যে আমাদের বংশটাই সবচেয়ে নীচু, আর আমাদের পরিবারের মধ্যে আমার কোন দাম নেই।” জবাবে মাবুদ বললেন, “আমি তোমার সংগে থাকব, আর তাতে তুমি সমস্ত মাদিয়ানীয়দের একটা লোকের মত করে হারিয়ে দেবে।” গিদিয়োন বললেন, “যদি আমি আপনার দয়া পেয়ে থাকি, তবে আমি যাতে বুঝতে পারি যে, সত্যিই আপনি আমার সংগে কথা বলছেন তার একটা চিহ্ন আপনি আমাকে দেখান। আমি ফিরে এসে আপনার সামনে আমার দান না রাখা পর্যন্ত আপনি চলে যাবেন না।” তিনি বললেন, “তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।” গিদিয়োন ভিতরে গিয়ে একটা ছাগলের বাচ্চা জবাই করে রান্না করলেন এবং আঠারো কেজি পরিমাণ ময়দা দিয়ে কিছু খামিহীন রুটি তৈরী করলেন। তিনি গোশ্‌ত একটা ডালাতে রেখে ঝোল একটা পাত্রে রাখলেন। তারপর সেগুলো বাইরে এনে এলোন গাছের তলায় মাবুদের ফেরেশতার সামনে রাখলেন। তখন আল্লাহ্‌র ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “গোশ্‌ত আর খামিহীন রুটি নিয়ে তুমি এই পাথরটার উপরে রাখ, আর ঝোল ঢেলে দাও।” গিদিয়োন তা-ই করলেন। তখন মাবুদের ফেরেশতার হাতে যে লাঠিটা ছিল সেটার আগা দিয়ে তিনি ঐ গোশ্‌ত আর খামিহীন রুটি ছুঁলেন। তাতে পাথরটা থেকে আগুন উঠে সেই গোশ্‌ত ও রুটি পুড়িয়ে দিল, আর মাবুদের ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গিদিয়োন যখন বুঝতে পারলেন যে, উনি ছিলেন মাবুদের ফেরেশতা তখন তিনি বললেন, “হায় হায়, হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমি যে মাবুদের ফেরেশতাকে মুখোমুখি দেখলাম!” কিন্তু মাবুদ তাঁকে বললেন, “তোমার শান্তি হোক, তুমি ভয় কোরো না। তুমি মারা যাবে না।” তখন গিদিয়োন সেখানে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে তার নাম দিলেন ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌-শালোম (যার মানে “মাবুদই শান্তি”)। কোরবানগাহ্‌টি এখনও অবীয়েষ্রীয়দের অফ্রাতে আছে। সেই রাতেই মাবুদ গিদিয়োনকে বললেন, “তোমার বাবার গরুর পাল থেকে তুমি দ্বিতীয় ষাঁড়টা নাও যেটার বয়স সাত বছর। তারপর বাল-দেবতার উদ্দেশে যে কোরবানগাহ্‌টি তোমার বাবা কেল্লার মত জায়গাটার উপরে তৈরী করেছেন সেটা ভেংগে ফেল এবং তার পাশে যে আশেরা-খুঁটি আছে তা কেটে ফেল। তারপর সেই জায়গার উপরে তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে ভাল করে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী কর। তারপর সেই দ্বিতীয় ষাঁড়টা দিয়ে তোমার কেটে ফেলা ঐ আশেরা-খুঁটির কাঠ জ্বালিয়ে একটা পোড়ানো-কোরবানী দাও।” সেইজন্য গিদিয়োন তাঁর চাকরদের মধ্য থেকে দশজনকে সংগে নিয়ে মাবুদের কথামত কাজ করলেন। কিন্তু নিজের পরিবার ও গ্রামের লোকদের ভয়ে তিনি কাজটা দিনে না করে রাতের বেলায় করলেন। সকালবেলায় গ্রামের লোকেরা ঘুম থেকে উঠে দেখল বাল-দেবতার কোরবানগাহ্‌টি ভেংগে ফেলা হয়েছে আর তার পাশের আশেরা-খুঁটিটাও কেটে ফেলা হয়েছে এবং একটা নতুন করে তৈরী করা কোরবানগাহের উপরে দ্বিতীয় ষাঁড়টা কোরবানী দেওয়া হয়েছে। তখন তারা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করল, “এই কাজ কে করেছে?” তারা ভাল করে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারল যে, যোয়াশের ছেলে গিদিয়োন এই সব করেছে। তখন তারা যোয়াশের কাছে গিয়ে বলল, “তোমার ছেলেকে বের করে নিয়ে এস। তাকে মরতে হবে, কারণ সে বাল-দেবতার কোরবানগাহ্‌ ভেংগে ফেলেছে এবং তার পাশের আশেরা-খুঁটিটা কেটে ফেলেছে।” কিন্তু যে সব লোক তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল যোয়াশ তাদের বললেন, “তোমরা কি বাল-দেবতার পক্ষে ওকালতি করতে এসেছ? তাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করছ? যে তার পক্ষ নেবে তাকে কাল সকাল হবার আগেই মেরে ফেলা হবে। বাল যদি সত্যিই কোন দেবতা হয়ে থাকে তবে সে নিজের পক্ষে ওকালতি করুক, কারণ তারই কোরবানগাহ্‌ ভেংগে ফেলা হয়েছে।” সেই দিন তিনি গিদিয়োনের নাম দিলেন যিরুব্বাল (যার মানে “বাল-দেবতা ওকালতি করুক”)। গিদিয়োন বাল-দেবতার কোরবানগাহ্‌ ভেংগে ফেলেছেন বলে যোয়াশ বললেন, “গিদিয়োনের বিরুদ্ধে বাল-দেবতাই তার নিজের পক্ষে ওকালতি করুক।” পরে মাদিয়ানীয়, আমালেকীয় এবং পূর্ব দেশের সৈন্য-সামন্ত সব এক হয়ে জর্ডান নদী পেরিয়ে যিষ্রিয়েল-উপত্যকায় গিয়ে ছাউনি ফেলল। তখন মাবুদের রূহ্‌ গিদিয়োনকে শক্তিশালী করলেন। গিদিয়োন শিংগা বাজালেন আর অবীয়েষ্রীয়রা তাঁর পিছনে জমায়েত হল। তিনি মানশা-গোষ্ঠীর এলাকার লোকদের কাছে খবর পাঠালেন আর তারাও তাঁর পিছনে জমায়েত হল। আশের, সবূলূন ও নপ্তালি-গোষ্ঠীর কাছেও তিনি খবর পাঠালেন আর তাতে তারা তাদের সংগে যোগ দেবার জন্য এগিয়ে আসল। আর তা-ই ঘটল; পরের দিন গিদিয়োন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই ভেড়ার লোম নিংড়ে শিশির বের করে ফেললেন। তাতে এক বাটি পানি হল। তারপর গিদিয়োন আল্লাহ্‌কে বললেন, “আমার উপর আপনি রাগ করবেন না। আমি কেবল আর একবার অনুরোধ করব। ভেড়ার লোম দিয়ে আমাকে আর একটা পরীক্ষা করতে দিন। এবার ভেড়ার লোম শুকনা থাকুক আর মাটির উপর শিশির পড়ুক।” সেই রাতে আল্লাহ্‌ তা-ই করলেন। কেবল ভেড়ার লোমই শুকনা রইল কিন্তু বাকী সব জায়গায় শিশির পড়ল। যিরুব্বাল, অর্থাৎ গিদিয়োন এবং তাঁর সমস্ত লোকেরা খুব ভোরে উঠে হারোদ এলাকার ঝর্ণার কাছে ছাউনি ফেলল। তাদের উত্তর দিকে মোরি পাহাড়ের কাছে উপত্যকার মধ্যে মাদিয়ানীয়দের ছাউনি ছিল। মাবুদ গিদিয়োনকে বললেন, “তোমার লোকদের সংখ্যা এত বেশী যে, আমি তাদের হাতে মাদিয়ানীয়দের তুলে দিতে পারি না। তা করলে আমাকে বাদ দিয়ে বনি-ইসরাইলরা বড়াই করে বলবে যে, তাদের নিজেদের শক্তিতেই তারা উদ্ধার পেয়েছে। সেইজন্য তুমি লোকদের কাছে ঘোষণা কর, যারা ভয়ে কাঁপছে তারা গিলিয়দ পাহাড় ছেড়ে বাড়ী ফিরে যেতে পারে।” তাতে বাইশ হাজার লোক চলে গেল আর দশ হাজার লোক বাকী থাকল। তখন মাবুদ গিদিয়োনকে বললেন, “এখনও অনেক লোক রয়ে গেছে। তাদের নিয়ে তুমি পানির কাছে যাও। সেখানেই আমি তোমার হয়ে তাদের বাছাই করব। আমি যদি বলি, ‘এই লোক তোমার সংগে যাবে,’ তবে সে যাবে; কিন্তু যদি বলি, ‘এই লোক তোমার সংগে যাবে না,’ তবে সে যাবে না।” কাজেই গিদিয়োন লোকদের নিয়ে পানির কাছে গেলেন। সেখানে মাবুদ তাঁকে বললেন, “যারা কুকুরের মত জিভ দিয়ে পানি চেটে খাবে তাদের থেকে যারা পানি খাবার জন্য হাঁটু পাতবে তাদের আলাদা কর।” তিনশো লোক হাতে পানি নিয়ে চেটে খেল আর বাকী সবাই পানি খাবার জন্য হাঁটু পাতল। তখন মাবুদ গিদিয়োনকে বললেন, “যে তিনশো লোক পানি চেটে খেয়েছে তাদের দিয়েই আমি তোমাদের উদ্ধার করব এবং মাদিয়ানীয়দের তোমার হাতে তুলে দেব। অন্য সব লোকেরা যে যার বাড়ীতে চলে যাক।” কাজেই গিদিয়োন তিনশো লোক রেখে বাকী বনি-ইসরাইলদের তাদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। সমস্ত খাবার জিনিস ও শিংগা ঐ তিনশো লোকের কাছে রইল। মাদিয়ানীয়দের ছাউনি ছিল গিদিয়োনের ছাউনির নীচের উপত্যকার মধ্যে। সেই রাতে মাবুদ গিদিয়োনকে বললেন, “ওঠো, তুমি নেমে গিয়ে ওদের ছাউনিটা হামলা কর। আমি ওটা তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তুমি যদি হামলা করতে ভয় পাও তা হলে তোমার চাকর ফুরাকে সংগে নিয়ে নেমে ওদের ছাউনির কাছে যাও, আর শোন ওরা কি বলে। তাতে তুমি ছাউনিটা হামলা করতে সাহস পাবে।” কাজেই গিদিয়োন তাঁর চাকর ফুরাকে সংগে নিয়ে ছাউনির কিনারার সৈন্যদের কাছে নেমে গেলেন। মাদিয়ানীয়, আমালেকীয় এবং পূর্ব দেশের লোকেরা সেই উপত্যকার মধ্যে পংগপালের ঝাঁকের মত ছিল। তাদের উটগুলো সংখ্যায় ছিল সাগর পারের বালুকণার মত যা গোণা যায় না। গিদিয়োন যখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন তখন একজন লোক তার এক বন্ধুকে তার স্বপ্নের কথা বলছিল। সে বলছিল, “আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম যবের তৈরী একখানা রুটি যেন গড়াতে গড়াতে গিয়ে মাদিয়ানীয়দের ছাউনির মধ্যে পড়ল। সেটা মাদিয়ানীয়দের তাম্বুতে এত জোরে গিয়ে আঘাত করল যে, তাম্বুটা উল্টে ধ্বসে পড়ে গেল।” এর জবাবে তার বন্ধু বলল, “এটা ইসরাইলীয় যোয়াশের ছেলে গিদিয়োনের তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ্‌ মাদিয়ানীয়দের এবং তাদের গোটা ছাউনিটা গিদিয়োনের হাতে তুলে দিয়েছেন।” গিদিয়োন সেই স্বপ্নের কথা ও তার মানে শুনে সেজদায় পড়ে আল্লাহর এবাদত করলেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের ছাউনিতে ফিরে এসে জোরে হাঁক দিয়ে বললেন, “তোমরা ওঠ, আল্লাহ্‌ মাদিয়ানীয়দের ছাউনিটা তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।” সেই তিনশো লোককে তিনি তিনটা দলে ভাগ করলেন আর প্রত্যেকের হাতে একটা করে শিংগা, একটা করে খালি কলসী ও তার মধ্যে মশাল দিলেন। তারপর তিনি তাদের বললেন, “তোমরা আমার উপর লক্ষ্য রাখবে এবং আমি যা করি তোমরাও তা-ই করবে। ছাউনির কাছে পৌঁছে আমি যা করব তোমরা ঠিক তা-ই করবে। আমি ও আমার সংগের সবাই যখন শিংগা বাজাব তখন ছাউনির চারপাশ থেকে তোমরাও তোমাদের শিংগা বাজাবে এবং চিৎকার করে বলবে, ‘মাবুদ এবং গিদিয়োনের জন্য।’ ” মাঝরাতের পাহারার শুরুতে যখন মাদিয়ানীয়রা পাহারাদার বদল করছিল ঠিক তার পরেই গিদিয়োন ও তাঁর সংগের একশো লোক ছাউনির কাছে গিয়ে পৌঁছাল। তারা তাদের শিংগা বাজিয়ে হাতের কলসীগুলো ভেংগে ফেলল। তিনটা দলই একসংগে তা করল। বাঁ হাতে মশাল আর ডান হাতে বাজাবার জন্য শিংগা নিয়ে তারা চিৎকার করে বলে উঠল, “মাবুদ ও গিদিয়োনের তলোয়ার।” ছাউনির চারদিকে গিদিয়োনের লোকেরা যখন তাদের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াল তখন সমস্ত মাদিয়ানীয়রা দৌড়াদৌড়ি করে চিৎকার করে পালাতে লাগল। তিনশো শিংগা বেজে উঠবার সময় মাবুদ এমন করলেন যার ফলে ছাউনির ভিতরকার সমস্ত লোকেরা একজন অন্যজনকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করল। তাতে মাদিয়ানীয় সৈন্যেরা টব্বতের কাছে আবেল-মহোলার সীমারেখা পর্যন্ত এবং সরোরার দিকে বৈৎ-শিট্টা পর্যন্ত ছুটে পালিয়ে গেল। তখন বনি-ইসরাইলদের মধ্যেকার নপ্তালি, আশের ও মানশা-গোষ্ঠীর সমস্ত লোকদের ডাকা হল আর তারা মাদিয়ানীয়দের তাড়া করল। পরে গিদিয়োন আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার সমস্ত জায়গায় লোক পাঠিয়ে বললেন, “তোমরা মাদিয়ানীয়দের বিরুদ্ধে নেমে এস এবং তাদের পৌঁছাবার আগে বৈৎ-বারা পর্যন্ত সমস্ত ছোট নদীর ও জর্ডান নদীর হেঁটে পার হওয়ার জায়গাগুলো অধিকার করে নাও।” তাতে আফরাহীমের সমস্ত লোকেরা একত্র হয়ে বৈৎ-বারা পর্যন্ত সমস্ত ছোট নদীর ও জর্ডান নদীর হেঁটে পার হওয়ার জায়গাগুলো দখল করে নিল। তারা ওরেব ও সেব নামে দু’জন মাদিয়ানীয় নেতাকে ধরল এবং ওরেবকে ওরেবের পাথরের কাছে এবং সেবকে সেবের আংগুর মাড়াই করবার জায়গাতে হত্যা করল। তারা মাদিয়ানীয়দের তাড়া করে নিয়ে গেল এবং ওরেব ও সেবের মাথা জর্ডানের ওপারে গিদিয়োনের কাছে নিয়ে গেল। আফরাহীমের লোকেরা গিদিয়োনকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি আমাদের সংগে এই রকম ব্যবহার করলেন কেন? মাদিয়ানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার সময় আপনি কেন আমাদের ডাকেন নি?” এইভাবে তারা গিদিয়োনকে খুব কড়া কড়া কথা বলল। জবাবে তিনি তাদের বললেন, “তোমাদের তুলনায় আমি আর তেমন কি করেছি? আফরাহীম যে পড়ে থাকা আংগুর কুড়িয়ে এনেছে তা কি অবিয়েষরের তোলা সমস্ত আংগুরের চেয়ে অনেক ভাল নয়? আল্লাহ্‌ তোমাদের হাতে মাদিয়ানীয়দের নেতা ওরেব ও সেবকে তুলে দিয়েছেন। তোমাদের তুলনায় আমি আর কি বেশী করতে পেরেছি?” এতে গিদিয়োনের বিরুদ্ধে তাদের রাগ পড়ে গেল। গিদিয়োন ও তাঁর তিনশো লোক মাদিয়ানীয়দের তাড়া করতে করতে জর্ডানের কাছে এসে নদীটা পার হয়ে গেল। তখন তারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই গিদিয়োন সুক্কোতের লোকদের বললেন, “আমার সৈন্যদের কিছু রুটি খেতে দাও; তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমি এখনও মাদিয়ানীয়দের বাদশাহ্‌ সেবহ ও সল্‌মুন্নের পিছনে তাড়া করছি।” কিন্তু সুক্কোতের নেতারা বলল, “কেন আমরা তোমার সৈন্যদের রুটি খেতে দেব? সেবহ ও সল্‌মুন্নের কেটে ফেলা হাত কি তোমার হাতের মুঠোয় এসে গেছে?” জবাবে গিদিয়োন বললেন, “যখন মাবুদ সেবহ ও সল্‌মুন্নকে আমার হাতে তুলে দেবেন তখন তোমাদের এই কথার জন্য আমি মরুভূমির কাঁটা ও কাঁটাগাছের আঘাতে তোমাদের গায়ের গোশ্‌ত ছিঁড়ে ফেলব।” গিদিয়োন সেখান থেকে পনূয়েলে উঠে গেলেন এবং সেখানকার লোকদের কাছেও রুটি চাইলেন। কিন্তু সুক্কোতের লোকেরা যা বলেছিল তারাও জবাবে তা-ই বলল। তখন গিদিয়োন পনূয়েলের লোকদের বললেন, “আমি যখন জয় করে ফিরে আসব তখন এই কেল্লাটা চুরমার করে দেব।” সেবহ ও সল্‌মুন্ন প্রায় পনেরো হাজার সৈন্যের একটা দল নিয়ে কর্কোরে ছিলেন। পূর্ব দেশের সৈন্যদের মধ্যে কেবল এরাই তখন বাকী ছিল এবং এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য মারা পড়েছিল। নোবহ ও যগ্‌বিহের পূর্ব দিকে তাম্বুবাসী লোকদের পথ ধরে গিদিয়োন হঠাৎ গিয়ে সেই সৈন্যদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন তারা নিশ্চিন্ত মনে ছিল। সেবহ ও সল্‌মুন্ন নামে মাদিয়ানীয়দের সেই দু’জন বাদশাহ্‌ পালিয়ে গেলেন। কিন্তু গিদিয়োন তাড়া করে গিয়ে তাঁদের ধরে ফেললেন, আর তাঁদের গোটা সৈন্যদল গিদিয়োনের দরুন ভীষণ ভয় পেল। এর পর যোয়াশের ছেলে গিদিয়োন হেরস নামে উঠে যাবার পথ দিয়ে যুদ্ধ থেকে ফিরলেন। তিনি পথে সুক্কোতের একজন যুবককে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলেন। যুবকটি সুক্কোতের সাতাত্তরজন প্রধান লোক ও বৃদ্ধ নেতার নাম লিখে দিল। পরে গিদিয়োন সুক্কোতে গিয়ে সেখানকার লোকদের বললেন, “এই দেখ সেবহ ও সল্‌মুন্ন। এদের জন্যই তোমরা আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিলে, ‘কেন আমরা তোমার ক্লান্ত সৈন্যদের রুটি খেতে দেব? সেবহ ও সল্‌মুন্নের কেটে ফেলা হাত কি তোমার হাতের মুঠোয় এসে গেছে?’ গিদিয়োন সুক্কোতের বৃদ্ধ নেতাদের ধরলেন এবং মরুভূমির কাঁটা ও কাঁটাগাছের আঘাত মেরে তাদের শাস্তি দিলেন। তিনি পনূয়েলের কেল্লাটা ভেংগে দিলেন এবং সেখানকার লোকদের হত্যা করলেন। তারপর তিনি সেবহ ও সল্‌মুন্নকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাবোরে কি রকমের লোক আপনাদের হাতে মারা পড়েছে?” তাঁরা জবাব দিলেন, “আপনার মত লোক, প্রত্যেকেই রাজপুত্রের মত।” গিদিয়োন বললেন, “ওরা ছিল আমার ভাই, আমার মায়ের পেটের ভাই। আল্লাহ্‌র কসম, আপনারা যদি তাঁদের বাঁচিয়ে রাখতেন তবে আমি আপনাদের মেরে ফেলতাম না।” এর পর তিনি তাঁর বড় ছেলে যেথরকে বললেন, “ওদের মেরে ফেল।” কিন্তু যেথরের বয়স অল্প ছিল বলে সে ভয় পেয়ে তলোয়ারই বের করল না। তখন সেবহ ও সল্‌মুন্ন বললেন, “আপনি নিজেই এসে আমাদের মেরে ফেলুন, কারণ যেমন মানুষ তেমনি তার কাজ।” কাজেই গিদিয়োন নিজে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের হত্যা করলেন এবং তাঁদের উটের গলা থেকে চন্দ্রহারগুলো খুলে নিলেন। পরে বনি-ইসরাইলরা গিদিয়োনকে বলল, “আপনি মাদিয়ানীয়দের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন, সেইজন্য আপনি ও আপনার বংশধরেরাই আমাদের শাসনকর্তা হন।” গিদিয়োন তাদের বললেন, “আমরা কেউ তোমাদের শাসনকর্তা হব না- আমিও না, আমার ছেলেও না; মাবুদই হবেন তোমাদের শাসনকর্তা।” তিনি আরও বললেন, “তবে আমার একটা অনুরোধ আছে। তোমাদের লুটের ভাগ থেকে তোমরা প্রত্যেকে আমাকে একটা করে কানের গহনা দাও।” তিনি এই কথা বললেন, কারণ মাদিয়ানীয়রা ছিল ইসমাইলের বংশের লোক এবং তখনকার দিনে ইসমাইলীয়দের কানে সোনার গহনা পরবার চল ছিল। জবাবে তারা বলল, “আমরা খুশী হয়েই তা দেব।” কাজেই তারা একটা কাপড় পাতল এবং প্রত্যেকে তার লুটের জিনিস থেকে তার উপর একটা করে কানের গহনা ফেলল। তাতে যে পরিমাণ সোনা তিনি পেলেন তার ওজন গিয়ে দাঁড়াল প্রায় বিশ কেজি পাঁচশো গ্রাম। এছাড়া তাঁর পাওয়া চন্দ্রহার, পদক, মাদিয়ানীয় বাদশাহ্‌দের পরনের বেগুনে পোশাক কিংবা উটের গলার হার এর মধ্যে ধরা হয় নি। গিদিয়োন সেই সব সোনা দিয়ে একটা এফোদ তৈরী করে তাঁর নিজের গ্রাম অফ্রাতে রাখলেন। বনি-ইসরাইলরা সকলে সেখানে মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে এফোদের পূজায় নিজেদের বিকিয়ে দিল। সেটাই হয়ে দাঁড়াল গিদিয়োন ও তাঁর পরিবারের জন্য একটা ফাঁদ। এইভাবেই বনি-ইসরাইলরা মাদিয়ানীয়দের দমন করে রাখল; তারা আর মাথা তুলতে পারল না। গিদিয়োনের জীবনের বাকী চল্লিশ বছর দেশে শান্তি ছিল। সেই যুদ্ধের পরে যোয়াশের ছেলে যিরুব্বাল বাড়ী ফিরে গেলেন। তাঁর অনেকগুলো স্ত্রী ছিল বলে তাঁর নিজেরই সত্তরজন ছেলে ছিল। শিখিমে তাঁর একজন উপস্ত্রী ছিল। তার ঘরেও তাঁর একটি ছেলে হয়েছিল। গিদিয়োন তাঁর নাম দিয়েছিলেন আবিমালেক। যোয়াশের ছেলে গিদিয়োন বুড়ো বয়সে ইন্তেকাল করলেন। অবীয়েষ্রীয়দের অফ্রাতে তাঁর বাবা যোয়াশের কবরে তাঁকে দাফন করা হল। গিদিয়োনের ইন্তেকালের পর পরই বনি-ইসরাইলরা আবার মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে বাল-দেবতাদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিল। তারা বাল-বরীৎকে নিজেদের দেবতা করে নিল। যিনি তাদের চারপাশের সমস্ত শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তাদের সেই মাবুদ আল্লাহ্‌কে তারা ভুলে গেল। যিরুব্বাল, অর্থাৎ গিদিয়োন তাদের যে সব উপকার করেছিলেন সেই অনুসারে তাঁর পরিবারের প্রতি তারা বিশ্বস্ততা দেখায় নি। যিরুব্বালের ছেলে আবিমালেক শিখিমে তাঁর মামাদের কাছে গিয়ে তাদের এবং তাঁর মায়ের বংশের অন্য সবাইকে বললেন, “শিখিমের সমস্ত বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করুন কোন্‌টা তাদের পক্ষে ভাল- যিরুব্বালের সত্তরজন ছেলে তাদের শাসনকর্তা হবে, নাকি একজন লোক হবে? ভুলে যাবেন না আমি আপনাদেরই রক্ত-মাংস।” আবিমালেকের মামারা শিখিমের লোকদের এই সব কথা বলবার পরে তাদের মধ্যে আবিমালেকের পক্ষে থাকবার একটা ঝোঁক দেখা গেল। তারা বলল যে, আবিমালেক তাদের আত্মীয়। তারা বাল-বরীতের মন্দির থেকে তাঁকে সত্তর টুকরা রূপা দিল। আবিমালেক তা দিয়ে কতগুলো বাজে দুঃসাহসী লোক ভাড়া করলেন। এরা তাঁর সংগী হল। অফ্রাতে তিনি তাঁর বাবার বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সত্তরজন ভাইদের প্রত্যেককে, অর্থাৎ যিরুব্বালের ছেলেদের প্রত্যেককে একই পাথরের উপরে হত্যা করলেন। কিন্তু যিরুব্বালের সবচেয়ে ছোট ছেলে যোথম লুকিয়ে থেকে বেঁচে গেল। তারপর শিখিম ও বৈৎ-মিল্লোর সমস্ত লোক একত্র হয়ে শিখিমের থামের কাছে এলোন গাছটার পাশে গিয়ে আবিমালেককে বাদশাহ্‌ করল। যোথমকে এই কথা জানানো হল। সে তখন গরিষীম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার করে লোকদের বলল, “শিখিমের লোকেরা, আমার কথা শুনুন, তাতে আল্লাহ্‌ও আপনাদের কথা শুনবেন। গাছেরা সবাই একদিন নিজেদের জন্য একজন বাদশাহ্‌কে অভিষেক করবার উদ্দেশ্যে বের হল। তারা জলপাই গাছকে বলল, ‘তুমি আমাদের বাদশাহ্‌ হও।’ কিন্তু জলপাই গাছ জবাবে বলল, ‘আমার যে তেলে আল্লাহ্‌ ও মানুষ সম্মানিত হন তা বাদ দিয়ে কি আমি সমস্ত গাছের উপর দুলতে যাব?’ এর পর গাছগুলো ডুমুর গাছকে বলল, ‘তুমি আমাদের বাদশাহ্‌ হও।’ কিন্তু ডুমুর গাছ জবাবে বলল, ‘আমি আমার এই ভাল ও মিষ্টি ফল দেওয়া বাদ দিয়ে কি সমস্ত গাছের উপর দুলতে যাব?’ এর পর গাছগুলো আংগুর লতাকে বলল, ‘তুমি আমাদের বাদশাহ্‌ হও।’ কিন্তু জবাবে আংগুর লতা বলল, ‘আমার ফলের যে রসে আল্লাহ্‌ ও মানুষ আনন্দ পান তা বাদ দিয়ে কি আমি সমস্ত গাছের উপর দুলতে যাব?’ শেষে সব গাছগুলো কাঁটাঝোপকে বলল, ‘তুমি আমাদের বাদশাহ্‌ হও।’ তখন কাঁটাঝোপ তাদের বলল, ‘যদি সত্যিই তোমরা আমাকে তোমাদের বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করতে চাও তবে তোমরা এসে আমার ছায়ায় আশ্রয় নাও। তা যদি না কর তবে যেন কাঁটাঝোপ থেকে আগুন বেরিয়ে এসে লেবাননের এরস গাছগুলো পুড়িয়ে দেয়।’ “তবে শুনুন, আবিমালেককে বাদশাহ্‌ করে আপনারা কি বিশ্বস্ততা ও সততার কাজ করেছেন? আপনারা কি যিরুব্বাল ও তাঁর পরিবারের প্রতি ভাল এবং উপযুক্ত ব্যবহার করেছেন? আমার পিতা তো তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের জন্য যুদ্ধ করে মাদিয়ানীয়দের হাত থেকে আপনাদের রক্ষা করেছেন। কিন্তু আজ আপনারা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন। একই পাথরের উপরে তাঁর সত্তরজন ছেলের প্রত্যেককে খুন করেছেন আর তাঁর বাঁদীর ছেলে আবিমালেককে শিখিমের লোকদের উপরে বাদশাহ্‌ করেছেন, কারণ সে আপনাদের আত্মীয়। কিন্তু আজ যদি যিরুব্বাল ও তাঁর পরিবারের প্রতি আপনারা বিশ্বস্ততা ও সততার কাজ করে থাকেন তবে আবিমালেক যেন আপনাদের আনন্দের কারণ হয় এবং আপনারাও যেন তার আনন্দের কারণ হন! কিন্তু তা যদি আপনারা না করে থাকেন তবে আবিমালেকের মধ্য থেকে যেন আগুন বের হয়ে এসে আপনাদের, অর্থাৎ শিখিমের ও বৈৎ-মিল্লোর লোকদের পুড়িয়ে দেয়; আর আপনাদের, অর্থাৎ শিখিমের ও বৈৎ-মিল্লোর লোকদের মধ্য থেকেও যেন আগুন বের হয়ে এসে আবিমালেককে পুড়িয়ে দেয়।” এর পর যোথম পালিয়ে বের্‌ নামে একটা জায়গায় চলে গেল। সে তার ভাই আবিমালেকের ভয়ে সেখানেই বাস করতে লাগল। আবিমালেক তিন বছর বনি-ইসরাইলদের শাসন করলেন। তারপর আল্লাহ্‌ আবিমালেক ও শিখিমের লোকদের মধ্যে একটা খারাপ রূহ্‌ পাঠিয়ে দিলেন। তাতে শিখিমের লোকেরা আবিমালেকের সংগে বেঈমানী করল। আল্লাহ্‌ এটা করলেন যাতে যিরুব্বালের সত্তরজন ছেলের উপর রক্তপাতের যে অন্যায় করা হয়েছে তার দরুন তাদের ভাই আবিমালেকের উপর এবং তাদের হত্যা করবার কাজে তাঁর ও তাঁর সাহায্যকারী শিখিমের লোকদের উপর প্রতিশোধ নেওয়া হয়। শিখিমের লোকেরা আবিমালেকের বিরুদ্ধে পাহাড়ের উপরে কিছু লোক রাখল, আর তারা লুকিয়ে থেকে সেই পথে যারা যেত তাদের লুটপাট করত। কথাটা আবিমালেককে জানানো হল। সেই সময় এবদের ছেলে গাল তার ভাইদের সংগে নিয়ে শিখিমে আসল আর শিখিমের লোকেরা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করল। তারা নিজেদের ক্ষেতে গিয়ে আংগুর তুলে মাড়াই করল এবং উৎসব করল। তারা তাদের দেবতার মন্দিরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবিমালেককে বদদোয়া দিল। এবদের ছেলে গাল বলল, “আবিমালেক কে যে, আমরা শিখিমের লোকেরা তার অধীন হয়ে থাকব? সে কি যিরুব্বালের ছেলে নয়? সবূল কি তার সেনাপতি নয়? তোমরা বরং শিখিমের পিতা হমোরের বংশধরদের অধীনে থাক। কেন আমরা আবিমালেকের অধীনে থাকব? যদি কেবল লোকেরা আমার হুকুম মেনে চলত তবে আমি আবিমালেককে দূর করে দিতাম। তাকে বলা যেত, ‘তোমার সৈন্য-সামন্ত সব ডেকে নিয়ে বের হয়ে এস।’ ” এবদের ছেলে গালের সেই কথা শিখিমের শাসনকর্তা সবূলের কানে গেল এবং তিনি খুব রেগে গেলেন। তিনি গোপনে আবিমালেককে এই কথা বলে পাঠালেন, “এবদের ছেলে গাল ও তার ভাইয়েরা শিখিমে এসে আপনার বিরুদ্ধে সেখানকার লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। কাজেই আপনি ও আপনার লোকেরা রাতের বেলায় এসে মাঠের মধ্যে ওৎ পেতে বসে থাকুন। সকালে সূর্য উঠবার সময় আপনি শহরের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাবেন। গাল ও তার লোকেরা যখন আপনার বিরুদ্ধে বের হয়ে আসবে তখন আপনি যা করবার তা করবেন।” কাজেই আবিমালেক ও তাঁর সমস্ত সৈন্যদল রাতের বেলায় বের হয়ে চার দলে ভাগ হয়ে শিখিমের কাছে লুকিয়ে রইল। শহর থেকে বেরিয়ে এবদের ছেলে গাল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় আবিমালেক ও তাঁর সৈন্যেরা তাদের লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসল। গাল তাদের দেখে সবূলকে বলল, “দেখুন, পাহাড়ের উপর থেকে কত লোক নেমে আসছে।” সবূল জবাবে বললেন, “তুমি পাহাড়ের ছায়াগুলোকে মানুষ বলে ভাবছ।” কিন্তু গাল আবার বলল, “দেখুন, লোকগুলো আসছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় থেকে, আর গণকদের গাছের দিক থেকে আরও একদল লোক আসছে।” তখন সবূল তাকে বললেন, “এখন কোথায় তোমার সেই বড় বড় কথা? তুমি বলেছিলে, ‘আবিমালেক কে যে, আমরা তার অধীনে থাকব?’ এই সব লোকদেরই তো তুমি তুচ্ছ করেছিলে। এখন বের হয়ে তাদের সংগে যুদ্ধ কর।” তখন গাল শিখিমের লোকদের পরিচালনা করে নিয়ে গিয়ে আবিমালেকের সংগে যুদ্ধ করল। আবিমালেক গালকে তাড়া করলেন, তাতে সে পালিয়ে গেল। পালাবার পথে তার দলের অনেকেই আঘাত পেয়ে শহরের দরজা পর্যন্ত সারা পথে পড়ে রইল। আবিমালেক অরূমাতে রয়ে গেলেন আর সবূল শিখিম থেকে গাল ও তার ভাইদের তাড়িয়ে বের করে দিলেন। পরের দিন শিখিমের লোকেরা বের হয়ে মাঠে যাচ্ছিল, আর সেই খবর আবিমালেককে জানানো হল। তখন আবিমালেক তাঁর লোকদের তিন দলে ভাগ করলেন এবং তারা মাঠে ওৎ পেতে রইল। শহর থেকে লোকদের বের হয়ে আসতে দেখে তিনি তাদের আক্রমণ করলেন। আবিমালেক ও তাঁর দলের লোকেরা সামনের দিকে ছুটে গিয়ে শহরে ঢুকবার পথে দাঁড়াল। মাঠের মধ্যে যারা ছিল অন্য দু’দল সৈন্য তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করল। সারাদিন ধরে আক্রমণ চালিয়ে আবিমালেক শহরটা অধিকার করে নিয়ে সেখানকার লোকদের হত্যা করলেন। তারপর শহরটা ধ্বংস করে তার উপর তিনি লবণ ছিটিয়ে দিলেন। এই খবর শুনে শিখিমের কেল্লার লোকেরা এল-বরীৎ দেবতার মন্দিরের ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকল। কাজেই সকলে গাছ থেকে ডাল কেটে নিয়ে আবিমালেকের পিছনে পিছনে চলল। তারপর তারা সেই ভিতরের ঘরের উপরে সেগুলো জড়ো করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। এতে শিখিমের কেল্লার সমস্ত লোক পুড়ে মারা গেল। সেখানে প্রায় এক হাজার পুরুষ এবং স্ত্রীলোক ছিল। এর পর আবিমালেক তেবেসে গিয়ে তা ঘেরাও করে দখল করে নিলেন। শহরের মধ্যে ছিল একটা শক্ত কেল্লা; শহরের সমস্ত পুরুষ ও স্ত্রীলোক সেখানে পালিয়ে গেল। তারা কেল্লায় ঢুকে সেখানকার দরজা বন্ধ করে ছাদে গিয়ে উঠল। আবিমালেক সেই কেল্লার কাছে গিয়ে সেটা হামলা করলেন; কিন্তু কেল্লাটাতে আগুন লাগাবার জন্য যখন তিনি কেল্লার দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একজন স্ত্রীলোক জাঁতার উপরের পাথরটা আবিমালেকের মাথার উপর ফেলে তাঁর মাথাটা ফাটিয়ে দিল। আবিমালেক তাড়াতাড়ি করে তাঁর অস্ত্রবহনকারী যুবককে বললেন, “তোমার তলোয়ার বের করে আমাকে মেরে ফেল যাতে ওরা বলতে না পারে, ‘একজন স্ত্রীলোকের হাতে সে মারা পড়েছে।’ ” কাজেই সেই যুবক তাঁকে তলোয়ার দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল আর তিনি মারা গেলেন। আবিমালেক মারা গেছেন দেখে বনি-ইসরাইলরা বাড়ী ফিরে গেল। সত্তরজন ভাইকে হত্যা করে আবিমালেক তাঁর বাবার প্রতি যে অন্যায় করেছিলেন আল্লাহ্‌ এইভাবেই তার পাওনা শাস্তি দিলেন। শিখিমের লোকেরা যে সব অন্যায় করেছিল তার পাওনা শাস্তি আল্লাহ্‌ তাদেরও দিলেন। এইভাবে যিরুব্বালের ছেলে যোথমের বদদোয়া তাদের উপর পড়েছিল। আবিমালেকের পরে তোলয় নামে ইষাখর-গোষ্ঠীর একজন লোক বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করতে আসলেন। তোলয় ছিলেন পূয়ার ছেলে আর দোদয়ের নাতি। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার শামীরে তিনি বাস করতেন। তিনি তেইশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। পরে তিনি ইন্তেকাল করলেন এবং শামীরেই তাঁকে দাফন করা হল। তোলয়ের পরে গিলিয়দ এলাকার যায়ীর বাইশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। যায়ীরের ত্রিশজন ছেলে ছিল; তারা ত্রিশটা গাধায় চড়ে বেড়াত। গিলিয়দের ত্রিশটা গ্রাম তাদের অধীনে ছিল। আজও সেই গ্রামগুলোকে হবোৎ-যায়ীর বলা হয়। যায়ীর ইন্তেকাল করলে পর তাঁকে কামোনে দাফন করা হল। পরে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের চোখে যা খারাপ আবার তা-ই করতে লাগল। তারা বাল-দেবতাদের এবং অষ্টারোৎ দেবীদের এবং সিরীয়, সিডনীয়, মোয়াবীয়, অম্মোনীয় ও ফিলিস্তিনীদের দেব-দেবীদের পূজা করতে লাগল। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা মাবুদকে ত্যাগ করল এবং তাঁর এবাদত করল না। সেইজন্য তিনি তাদের উপর রাগে জ্বলে উঠলেন এবং ফিলিস্তিনী ও অম্মোনীয়দের হাতে তাদের তুলে দিলেন। সেই বছরে তারা বনি-ইসরাইলদের যেন দলে-পিষে মারল। তারা জর্ডানের পূর্ব দিকে আমোরীয়দের দেশ গিলিয়দে বাসকারী বনি-ইসরাইলদের আঠারো বছর ধরে কষ্ট দিয়েছিল। এহুদা, বিন্‌ইয়ামীন ও আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অম্মোনীয়রা জর্ডান পার হয়ে আসল। তখন বনি-ইসরাইলরা মহা কষ্টে পড়ল। তারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বলল, “আমাদের আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করে বাল-দেবতাদের পূজা করে সত্যি আমরা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি।” জবাবে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের বললেন, “মিসরীয়, আমোরীয়, অম্মোনীয় ও ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে আমি কি তোমাদের উদ্ধার করি নি? যখন সিডনীয়, আমালেকীয় এবং মায়োনীয়দের জুলুমে তোমরা সাহায্যের জন্য আমার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলে তখন তাদের হাত থেকেও আমি তোমাদের উদ্ধার করেছি। কিন্তু তোমরা আমাকে ত্যাগ করে দেবতাদের পূজা করেছ, সেইজন্য আর আমি তোমাদের উদ্ধার করব না। যে দেব-দেবীদের তোমরা বেছে নিয়েছিলে তাদের কাছে গিয়ে কাঁদ। বিপদের সময়ে তারাই তোমাদের উদ্ধার করুক।” কিন্তু বনি-ইসরাইলরা মাবুদকে বলল, “আমরা গুনাহ্‌ করেছি। তোমার যা ভাল মনে হয় আমাদের প্রতি তা-ই কোরো, কিন্তু দয়া করে এবার তুমি আমাদের রক্ষা কর।” এর পর তাদের মধ্যে অন্য জাতিদের যে সব দেব-দেবী ছিল তাদের দূর করে দিয়ে তারা মাবুদের এবাদত করতে লাগল। বনি-ইসরাইলদের কষ্ট দেখে মাবুদের মনে দুঃখ হল। এর পর যুদ্ধে যাবার জন্য অম্মোনীয়দের ডাক পড়ল আর তাতে তারা গিয়ে গিলিয়দে ছাউনি ফেলল। এতে ইসরাইলীয়রাও জমায়েত হয়ে মিসপাতে গিয়ে তাদের ছাউনি ফেলল। গিলিয়দের নেতারা একে অন্যকে বলল, “যে লোক অম্মোনীয়দের প্রথমে হামলা করবে সে-ই গিলিয়দের বাসিন্দাদের কর্তা হবে।” সেই সময় গিলিয়দীয় যিপ্তহ খুব শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মা ছিল একজন বেশ্যা আর তাঁর বাবার নাম ছিল গিলিয়দ। গিলিয়দের নিজের স্ত্রীর গর্ভের কতগুলো ছেলে ছিল। তারা বড় হয়ে যিপ্তহকে এই বলে তাড়িয়ে দিল, “তুমি আমাদের পরিবারের সম্পত্তির অধিকার পাবে না, কারণ তুমি অন্য এক স্ত্রীলোকের সন্তান।” কাজেই যিপ্তহ তাঁর ভাইদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে টোব দেশে বাস করতে লাগলেন। সেখানে কতগুলো বাজে লোক তাঁর চারপাশে এসে জমায়েত হল এবং তাঁর সংগে চলাফেরা করতে লাগল। তাঁরা বললেন, “আমরা অম্মোনীয়দের সংগে যুদ্ধ করব, তাই তুমি এসে আমাদের সেনাপতি হও।” যিপ্তহ তাঁদের বললেন, “তোমরা কি ঘৃণা করে আমাকে আমার বাবার বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দাও নি? এখন বিপদে পড়ে কেন আমার কাছে এসেছ?” গিলিয়দের বৃদ্ধ নেতারা তাঁকে বললেন, “কিন্তু এখন আমরা তোমার কাছে ফিরে এসেছি যেন তুমি আমাদের সংগে গিয়ে অম্মোনীয়দের সংগে যুদ্ধ কর। এতে তুমি গিলিয়দে বাসকারী আমাদের সকলের কর্তা হবে।” জবাবে যিপ্তহ বললেন, “ধর, অম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য তোমরা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে আর মাবুদও আমার হাতে তাদের তুলে দিলেন; তাহলে তখন সত্যিই কি আমি তোমাদের কর্তা হব?” গিলিয়দের বৃদ্ধ নেতারা জবাবে বললেন, “মাবুদই আমাদের সাক্ষী রইলেন যে, তুমি যা বললে আমরা তা-ই করব।” এতে যিপ্তহ গিলিয়দের বৃদ্ধ নেতাদের সংগে গেলেন আর লোকেরা তাঁকে তাদের কর্তা ও সেনাপতি করল। তিনি মিসপাতে গিয়ে মাবুদের সামনে সেই সব কথা বললেন। এর পর যিপ্তহ লোক পাঠিয়ে অম্মোনীয় বাদশাহ্‌কে এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার ও আপনার মধ্যে এমন কি হয়েছে যার জন্য আপনি আমার দেশ আক্রমণ করতে এসেছেন?” অম্মোনীয় বাদশাহ্‌ যিপ্তহের পাঠানো লোকদের বললেন, “বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসে জর্ডান নদীর কিনারা ধরে অর্ণোন নদী থেকে যব্বোক নদী পর্যন্ত আমার সমস্ত জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। এখন সহিসালামতে তা ফিরিয়ে দাও।” মিসর থেকে বেরিয়ে আসবার পর বনি-ইসরাইলরা মরুভূমির মধ্য দিয়ে লোহিত সাগর পর্যন্ত গিয়েছিল এবং তারপর গিয়েছিল কাদেশে। তারপর বনি-ইসরাইলরা ইদোমের বাদশাহ্‌র কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছিল, ‘আপনার দেশের মধ্য দিয়ে আমাদের যাবার অনুমতি দিন।’ কিন্তু ইদোমের বাদশাহ্‌ সেই কথায় কান দেন নি। তারা মোয়াবের বাদশাহ্‌র কাছেও লোক পাঠিয়েছিল কিন্তু তিনিও রাজী হন নি। কাজেই বনি-ইসরাইলরা কাদেশেই রয়ে গেল। তারপর তারা মরুভূমির মধ্য দিয়ে গিয়ে ইদোম ও মোয়াব দেশ ঘুরে মোয়াব দেশের পূর্ব দিক দিয়ে গিয়ে অর্ণোন নদীর অন্য পাশে ছাউনি ফেলেছিল। তারা মোয়াব দেশে ঢোকে নি, কারণ অর্ণোন নদীই ছিল মোয়াবের সীমানা। তারপর বনি-ইসরাইলরা আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোন, যিনি হিষ্‌বোনে থেকে রাজত্ব করতেন, তাঁর কাছে লোক দিয়ে বলে পাঠাল, ‘আমাদের দেশে যাবার জন্য আপনার দেশের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে দিন।’ কিন্তু সীহোন বনি-ইসরাইলদের বিশ্বাস না করে তাঁর দেশের মধ্য দিয়ে তাদের যাবার অনুমতি দিলেন না। তিনি তাঁর সমস্ত লোকজন জমায়েত করে যহসে ছাউনি ফেললেন এবং বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করলেন। তখন বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বনি-ইসরাইলদের হাতে সীহোন ও তাঁর সমস্ত লোকদের তুলে দিলেন আর তারা তাদের হারিয়ে দিল। সেই দেশে বাসকারী সমস্ত আমোরীয়দের জায়গা বনি-ইসরাইলরা দখল করে নিল। তারা অর্ণোন থেকে যব্বোক পর্যন্ত এবং মরুভূমি থেকে জর্ডান পর্যন্ত আমোরীয়দের সমস্ত জায়গাটা অধিকার করে নিল। ইসরাইল জাতির মাবুদ আল্লাহ্‌ যখন তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে আমোরীয়দের তাড়িয়ে দিয়েছেন তখন সেটা ফিরিয়ে নেবার কি অধিকার আপনার আছে? আপনার কমোশ-দেবতা আপনাকে যা অধিকার করতে দিয়েছেন তা কি আপনার অধিকারে নেই? ঠিক সেইভাবে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাদের সামনে থেকে যাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন আমরা তাদেরই জায়গা অধিকার করে আছি। আপনি কি মোয়াবের বাদশাহ্‌ সিপ্পোরের ছেলে বালাকের চেয়েও ভাল? তিনি কখনও ইসরাইলের সংগে ঝগড়া কিংবা যুদ্ধ করেন নি। আজ তিনশো বছর বনি-ইসরাইলরা হিষ্‌বোন ও অরোয়ের শহর এবং তাদের আশেপাশের গ্রাম এবং অর্ণোন নদীর কিনারা ধরে সমস্ত গ্রামে বাস করে আসছে। সেই সময়ের মধ্যে আপনি সেগুলো কেন আবার দখল করে নেন নি? এই ব্যাপারে আমি আপনার প্রতি কোন অন্যায় করি নি, বরং আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আপনিই আমার প্রতি অন্যায় করছেন। বিচারকর্তা মাবুদই এখন ইসরাইলীয় ও অম্মোনীয়দের মধ্যে বিচার করুন।” কিন্তু যিপ্তহের পাঠানো এই খবরে অম্মোনের বাদশাহ্‌ কান দিলেন না। তখন মাবুদের রূহ্‌ যিপ্তহের উপরে আসলেন। তাতে যিপ্তহ গিলিয়দ ও মানশা এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়ে গিলিয়দের মিসপাতে আসলেন এবং সেখান থেকে অম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেলেন। এর পর যিপ্তহ অম্মোনীয়দের সংগে যুদ্ধ করতে গেলেন আর মাবুদ তাঁর হাতে অম্মোনীয়দের তুলে দিলেন। তিনি অরোয়ের থেকে মিন্নীতের কাছাকাছি আবেল-করামীম পর্যন্ত বিশটা শহর ও গ্রামের লোকদের ভীষণভাবে আঘাত করে হত্যা করলেন। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা অম্মোনীয়দের দমন করল। যিপ্তহ যখন মিসপাতে নিজের বাড়ীতে ফিরে আসলেন তখন যে তাঁকে এগিয়ে নিতে আসল সে ছিল তাঁরই মেয়ে। সে খঞ্জনীর তালে তালে নেচে নেচে আসছিল। সে ছিল যিপ্তহের একমাত্র সন্তান, আর এই মেয়েটি ছাড়া তাঁর অন্য কোন ছেলে বা মেয়ে ছিল না। যিপ্তহ মেয়েকে দেখে তাঁর কাপড় ছিঁড়ে বললেন, “হায় হায়, মা আমার, তুমি এ কি সর্বনাশ করলে! তুমি আমাকে ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলে দিলে, কারণ আমি মাবুদের কাছে এমন একটা মানত করেছি যা আমার পক্ষে ভাংগা সম্ভব নয়।” জবাবে মেয়েটি বলল, “আব্বা, তুমি মাবুদকে কথা দিয়েছ। কাজেই তোমার কথা অনুসারে আমার প্রতি যা করবার তা কর, কারণ মাবুদ তোমাকে তোমার শত্রু অম্মোনীয়দের উপর প্রতিশোধ নিতে দিয়েছেন।” তারপর সে বলল, “তবে আমার একটা অনুরোধ রাখ। আমি তো সন্তানের মা হতে পারব না; তাই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে সখীদের সংগে বিলাপ করে বেড়াবার জন্য আমাকে দু’মাস সময় দাও।” যিপ্তহ বললেন, “যাও, মা।” এই বলে তিনি তাকে দু’মাসের জন্য বিদায় দিলেন। তখন সে আর অন্য মেয়েরা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বিলাপ করতে লাগল, কারণ সে কখনও সন্তানের মা হতে পারবে না। দু’মাস পার হয়ে গেলে পর সে তার বাবার কাছে ফিরে আসল। যিপ্তহ মাবুদের কাছে যা মানত করেছিলেন তিনি তাঁর মেয়ের প্রতি তা-ই করলেন। মেয়েটি অবিবাহিতা অবস্থায় মারা গেল। এই ঘটনা থেকে বনি-ইসরাইলদের মধ্যে একটা রীতি চালু হয়ে গেল। গিলিয়দীয় যিপ্তহের মেয়ের কথা স্মরণ করে বিলাপ করবার জন্য ইসরাইলীয় যুবতী মেয়েরা প্রত্যেক বছর চার দিনের জন্য বাড়ী থেকে বের হয়ে যেত। পরে আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের সৈন্যদের ডেকে নিয়ে নদী পার হয়ে সাফোনে গেল। সেখানে তারা যিপ্তহকে বলল, “অম্মোনীয়দের সংগে যুদ্ধ করতে তোমার সংগে যাবার জন্য কেন তুমি আমাদের ডাক নি? আমরা তোমাকে সুদ্ধ তোমার বাড়ী পুড়িয়ে দেব।” জবাবে যিপ্তহ বললেন, “আমি আমার লোকদের নিয়ে অম্মোনীয়দের সংগে ভীষণ যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলাম। আমি তোমাদের ডেকেছিলাম কিন্তু তোমরা তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর নি। আমি যখন দেখলাম তোমরা আমাকে সাহায্য করবে না তখন আমি আমার প্রাণ হাতে করে অম্মোনীয়দের সংগে যুদ্ধ করতে গেলাম আর মাবুদও আমাকে তাদের উপর জয়ী করলেন। এখন কেন তোমরা আমার সংগে যুদ্ধ করবার জন্য উপস্থিত হয়েছ?” যিপ্তহ তখন গিলিয়দের সব লোকদের ডেকে জমায়েত করে নিয়ে আফরাহীমের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, কারণ আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকেরা বলেছিল, “ওহে গিলিয়দীয়রা, তোমরা তো আফরাহীম ও মানশা-গোষ্ঠীর দল ত্যাগ করে আসা লোক।” সেই যুদ্ধে গিলিয়দীয়রা তাদের হারিয়ে দিল। জর্ডান নদীর যে জায়গাগুলো হেঁটে পার হয়ে আফরাহীম এলাকার দিকে যাওয়া যায় সেই জায়গাগুলো গিলিয়দীয়রা দখল করে নিল। আফরাহীম-গোষ্ঠীর বেঁচে থাকা কোন লোক যখন বলত, “আমাকে পার হতে দাও,” তখন গিলিয়দের লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করত, “তুমি কি আফরাহীমীয়?” জবাবে সে যদি বলত, “না,” তবে তারা বলত, “খুব ভাল, তাহলে বল দেখি, ‘শিব্বোলেৎ।’ ” কথাটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে না পেরে যদি সে বলত, “ছিব্বোলেৎ,” তবে তারা তাকে ধরে জর্ডান নদীর ঐ হেঁটে পার হওয়ার জায়গাতেই হত্যা করত। এইভাবে সেই সময় বিয়াল্লিশ হাজার আফরাহীমীয়কে হত্যা করা হয়েছিল। গিলিয়দীয় যিপ্তহ ছয় বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করলে পর তাঁকে গিলিয়দের একটা গ্রামে দাফন করা হল। যিপ্তহের পরে বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হলেন বেথেলহেম গ্রামের ইব্‌সন। তাঁর ত্রিশজন ছেলে ও ত্রিশজন মেয়ে ছিল। তিনি নিজের বংশের বাইরে তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিলেন এবং বংশের বাইরে থেকে তাঁর ছেলেদের স্ত্রী হিসাবে ত্রিশজন যুবতী মেয়ে আনলেন। ইব্‌সন সাত বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। পরে ইব্‌সন ইন্তেকাল করলে পর তাঁকে বেথেলহেমে দাফন করা হল। ইব্‌সনের পর সবূলূন-গোষ্ঠীর এলোন দশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করলে পর সবূলূন এলাকার অয়ালোনে তাঁকে দাফন করা হল। এলোনের পর পিরিয়াথোনের হিল্লেলের ছেলে অব্‌দোন বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হয়েছিলেন। তাঁর চল্লিশজন ছেলে ও ত্রিশজন নাতি ছিল। তারা সত্তরটা গাধায় চড়ে বেড়াত। অব্‌দোন আট বছর বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করলে পর আমালেকীয়দের পাহাড়ী এলাকার মধ্যে আফরাহীম এলাকার পিরিয়াথোনে তাঁকে দাফন করা হল। পরে বনি-ইসরাইলরা মাবুদের চোখে যা খারাপ আবার তা-ই করতে লাগল। কাজেই মাবুদ তাদের চল্লিশ বছর ফিলিস্তিনীদের অধীন করে রাখলেন। সেই সময় সরা গ্রামে মানোহ নামে দান-গোষ্ঠীর একজন লোক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন বলে তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। মাবুদের ফেরেশতা তাঁর স্ত্রীকে দেখা দিয়ে বললেন, “তুমি বন্ধ্যা বলে তোমার কোন সন্তান হয় নি, কিন্তু তুমি গর্ভবতী হবে এবং তোমার একটি ছেলে হবে। আংগুর-রস কিংবা কোন মদানো রস কিংবা নাপাক কিছু যাতে তুমি না খাও সেইজন্য তোমাকে সাবধান থাকতে হবে। তোমার যে ছেলে হবে তুমি তার মাথায় কখনও ক্ষুর লাগাবে না, কারণ জন্ম থেকেই ছেলেটি আল্লাহ্‌র উদ্দেশে নাসরীয় হবে। ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে সে-ই বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করবার কাজ শুরু করবে।” স্ত্রীলোকটি তখন তাঁর স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, “আল্লাহ্‌র একজন বান্দা আমার কাছে এসেছিলেন। আল্লাহ্‌র ফেরেশতার মতই তাঁর চেহারা, তাঁকে দেখলে খুব ভয় লাগে। তিনি কোথা থেকে এসেছেন তা আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি নি আর তিনিও তাঁর নাম আমাকে বলেন নি। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি গর্ভবতী হবে এবং তোমার একটি ছেলে হবে। সেইজন্য এখন থেকে তুমি আংগুর-রস কিংবা কোন মদানো রস কিংবা নাপাক কিছু খাবে না, কারণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছেলেটি আল্লাহ্‌র উদ্দেশে নাসরীয় হবে।’ ” এই কথা শুনে মানোহ মাবুদের কাছে এই বলে মুনাজাত করলেন, “হে দীন-দুনিয়ার মালিক, তোমার যে বান্দাকে তুমি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলে, আমি মিনতি করি আবার যেন তিনি আসেন এবং যে ছেলেটির জন্ম হবে তার প্রতি আমাদের কি করতে হবে তা আমাদের শিখিয়ে দেন।” আল্লাহ্‌ মানোহের মুনাজাত শুনলেন এবং আল্লাহ্‌র ফেরেশতা আবার সেই স্ত্রীলোকটির কাছে আসলেন। তিনি তখন ক্ষেতের মধ্যে বসে ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বামী মানোহ তখন তঁাঁর কাছে ছিলেন না। স্ত্রীলোকটি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর স্বামীকে বললেন, “সেই দিন যে লোকটি আমাকে দেখা দিয়েছিলেন তিনি এসেছেন।” এই কথা শুনে মানোহ উঠে তাঁর স্ত্রীর সংগে গেলেন এবং লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, “আমার স্ত্রীর সংগে যিনি কথা বলেছিলেন আপনিই কি সেই লোক?” তিনি বললেন, “জ্বী, আমিই সেই লোক।” মানোহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কথা যখন সফল হবে তখন কিভাবে ছেলেটি জীবন কাটাবে আর তার কাজই বা কি হবে?” জবাবে মাবুদের ফেরেশতা বললেন, “আমি তোমার স্ত্রীকে যা বলেছি তার সবই যেন সে যত্নের সংগে পালন করে। আংগুর গাছ থেকে যা হয় তার কোন কিছুই তার খাওয়া চলবে না। আংগুর-রস কিংবা কোন মদানো রস কিংবা নাপাক কিছু তার খাওয়া চলবে না। আমি তাকে যে সব হুকুম দিয়েছি তার প্রত্যেকটি তাকে পালন করতে হবে।” তখন মানোহ মাবুদের ফেরেশতাকে বললেন, “আপনি কিছুক্ষণ থাকুন; আমরা ততক্ষণ আপনার জন্য একটা ছাগলের বাচ্চার গোশ্‌ত রান্না করি।” জবাবে মাবুদের ফেরেশতা বললেন, “আমাকে ধরে রাখলেও আমি তোমাদের কোন খাবার খাব না। কিন্তু যদি তোমরা পোড়ানো-কোরবানী দিতে চাও তবে তা মাবুদের উদ্দেশেই দিয়ো।” তিনি যে মাবুদের ফেরেশতা মানোহ তা বুঝতে পারেন নি। এর পর মানোহ মাবুদের ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার নাম কি? আপনার কথা যখন সফল হবে তখন আমরা আপনাকে সম্মান দেখাতে চাই।” তিনি বললেন, “তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞাসা করছ? আমার নাম কেউ বুঝতে পারে না।” মানোহ তখন একটা ছাগলের বাচ্চা ও তার সংগেকার শস্য-কোরবানীর জিনিস নিয়ে মাবুদের উদ্দেশে একটা পাথরের উপরে তা কোরবানী দিলেন। সেই ফেরেশতা তখন একটা অলৌকিক চিহ্ন দেখালেন, আর মানোহ ও তাঁর স্ত্রী তা দেখছিলেন। আগুনের শিখা যখন কোরবানগাহ্‌ থেকে উপরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল তখন মাবুদের ফেরেশতা সেই আগুনের শিখায় উঠে চলে গেলেন। এই ব্যাপার দেখে মানোহ ও তাঁর স্ত্রী সেজদায় পড়লেন, আর মানোহ বুঝতে পারলেন যে, তিনি ছিলেন মাবুদের ফেরেশতা। মাবুদের ফেরেশতা তাঁদের আর দেখা দিলেন না। তখন মানোহ তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “আমরা আল্লাহ্‌কে দেখেছি, নিশ্চয়ই আমাদের মরতে হবে।” কিন্তু তাঁর স্ত্রী বললেন, “আমাদের মেরে ফেলবারই ইচ্ছা যদি মাবুদের থাকত তবে আমাদের হাত থেকে তিনি পোড়ানো-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী গ্রহণ করতেন না, কিংবা এই সবও আমাদের দেখাতেন না, কিংবা এই সব কথাও এই সময়ে আমাদের বলতেন না।” পরে স্ত্রীলোকটির একটি ছেলে হল আর তিনি তাঁর নাম রাখলেন শামাউন। শামাউন বড় হতে লাগলেন এবং আল্লাহ্‌ তাঁকে দোয়া করলেন। শামাউন যখন সরা আর ইষ্টায়োলের মাঝখানে মহন্তেদান বলে একটা জায়গায় ছিলেন তখন থেকে মাবুদের রূহ্‌ তাঁকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। পরে শামাউন তিম্নায় গেলেন, আর সেখানে একটি ফিলিস্তিনী যুবতী তাঁর নজরে পড়ল। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি তাঁর মা-বাবাকে বললেন, “আমি তিম্নাতে একটি ফিলিস্তিনী মেয়ে দেখে এসেছি; তোমরা তার সংগে আমার বিয়ে দাও।” জবাবে তাঁর মা-বাবা বললেন, “তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কিংবা আমাদের সমস্ত জাতির মধ্যে কি কোন মেয়ে নেই যে, বিয়ের জন্য তোমাকে খৎনা-না-করানো ফিলিস্তিনীদের কাছে যেতে হবে?” কিন্তু শামাউন তাঁর বাবাকে বললেন, “না, আমার জন্য তাকেই তোমরা নিয়ে এস। তাকেই আমার পছন্দ।” তাঁর মা-বাবা বুঝতে পারেন নি যে, এটা মাবুদ থেকেই হয়েছে, কারণ তিনি ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। সেই সময় ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের শাসন করছিল। পরে শামাউন তাঁর মা-বাবার সংগে তিম্নায় গেলেন। তিম্নার আংগুর ক্ষেতগুলোর কাছে যেতেই হঠাৎ একটা যুব সিংহ গর্জন করতে করতে শামাউনের দিকে এগিয়ে আসল। তখন মাবুদের রূহ্‌ তাঁর উপর পূর্ণ শক্তিতে আসলেন, যার ফলে তিনি সেই সিংহটাকে খালি হাতেই ছাগলের বাচ্চার মত করে ছিঁড়ে ফেললেন। কিন্তু তিনি কি করেছেন তা তাঁর মা-বাবাকে জানালেন না। পরে তিনি সেই মেয়েটির কাছে গিয়ে তার সংগে কথা বললেন এবং মেয়েটিকে তাঁর ভাল লাগল। এর কিছুদিন পরে তিনি ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করবার জন্য তিম্নায় গেলেন। যাওয়ার পথে তিনি সেই সিংহের মৃতদেহটা দেখবার জন্য একটু ঘুরে গেলেন। তিনি সিংহের দেহের মধ্যে এক ঝাঁক মৌমাছি আর কিছু মধু দেখতে পেলেন। তিনি দু’হাতে সেই মধু তুলে নিয়ে খেতে খেতে চললেন। তারপর তিনি মা-বাবার কাছে গিয়ে তাঁদেরও সেই মধু দিলেন এবং তাঁরাও তা খেলেন। কিন্তু সেই মধু যে তিনি সিংহের মৃতদেহের মধ্য থেকে নিয়েছিলেন তা তাঁদের বললেন না। পরে শামাউনের বাবা মেয়েটিকে দেখতে গেলেন। তখন শামাউন সেখানে একটা মেজবানীর ব্যবস্থা করলেন যা বরেরা সাধারণতঃ করত। শামাউন সেখানে পৌঁছালে পর ফিলিস্তিনীরা তাঁকে ত্রিশজন সংগী দিল। শামাউন সেই সংগীদের বললেন, “আমি তোমাদের একটা ধাঁধা বলি। তোমরা মেজবানীর এই সাত দিনের মধ্যে যদি এর জবাব দিতে পার তবে আমি তোমাদের ত্রিশটা মসীনার চাদর ও ত্রিশ সেট পোশাক দেব। কিন্তু তোমরা যদি তা না পার তবে তোমরা আমাকে ত্রিশটা মসীনার চাদর আর ত্রিশ সেট পোশাক দেবে।” তারা বলল, “আপনার ধাঁধাটা বলুন, আমরা তা শুনি।” শামাউন বললেন, “খাদক থেকে আসল খাদ্য, বলবান থেকে আসল মিষ্টি।” তিন দিন পর্যন্ত তাঁর এই ধাঁধার জবাব তারা দিতে পারল না। সপ্তম দিনে তারা গিয়ে শামাউনের স্ত্রীকে বলল, “তোমার স্বামীকে ফুসলিয়ে বল যেন তিনি এই ধাঁধাটার জবাব আমাদের বলে দেন। তা না হলে আমরা তোমাকে ও তোমার বাবার পরিবারের লোকদের পুড়িয়ে মারব। আমাদের গরীব করে দেওয়ার জন্যই তুমি আমাদের এখানে দাওয়াত করেছ, তাই না?” শামাউনের স্ত্রী তখন শামাউনের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি আমাকে কেবল ঘৃণাই কর, ভালবাস না। তুমি আমার লোকদের একটা ধাঁধা বলেছ অথচ তার জবাব আমাকে বলে দাও নি।” জবাবে শামাউন বললেন, “আমার মা-বাবাকে পর্যন্ত আমি তার জবাব বলি নি, তবে তোমাকে কেন আমি তা বলতে যাব?” মেজবানীর শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী তাঁর কাছে কান্নাকাটি করল। শেষে সাত দিনের দিন শামাউন তাঁর স্ত্রীকে তা বললেন, কারণ এর জন্য সে তাঁকে খুব বিরক্ত করছিল। তাঁর স্ত্রী তখন সেই ধাঁধার জবাব তার লোকদের বলে দিল। সাত দিনের দিন সূর্য ডুবে যাবার আগে গ্রামের সেই লোকগুলো শামাউনকে বলল, “মধুর চেয়ে মিষ্টি কি? আর সিংহের চেয়ে বলবান কে?” শামাউন তাদের বললেন, “আমার গাভী দিয়ে যদি তোমরা চাষ না করতে তবে তোমরা এই ধাঁধার জবাব দিতে পারতে না।” এর পর মাবুদের রূহ্‌ পূর্ণ শক্তিতে শামাউনের উপর আসলেন। তিনি অস্কিলোনে গিয়ে সেখানকার ত্রিশজন লোককে হত্যা করে তাদের সব কিছু লুটে নিলেন এবং তাদের কাপড়-চোপড় নিয়ে যারা তাঁর ধাঁধার জবাব দিয়েছিল তাদের দিলেন। তারপর তিনি রাগে জ্বলতে জ্বলতে তাঁর বাবার বাড়ীতে চলে গেলেন। তখন তাঁর সংগীদের মধ্যেকার তাঁর বন্ধুর হাতে তাঁর স্ত্রীকে তুলে দেওয়া হল। পরে গম কাটবার সময়ে শামাউন একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সংগে দেখা করতে গেলেন। তিনি বললেন, “আমি ভিতরে আমার স্ত্রীর ঘরে যাচ্ছি।” কিন্তু মেয়েটির পিতা তাঁকে ভিতরে যেতে দিল না। তার পিতা বলল, “আমি সত্যিই ভেবেছিলাম যে, তার প্রতি তোমার খুব ঘৃণা জন্মেছে, সেইজন্য আমি তাকে তোমার বন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছি। তার ছোট বোন তার চেয়েও সুন্দরী; তার বদলে তুমি তার ছোট বোনকে নাও।” তখন শামাউন তাদের বললেন, “এবার আমি ফিলিস্তিনীদের ক্ষতি করতে পারব, আর তাতে আমার কোন দোষ হবে না।” এই বলে তিনি বেরিয়ে গিয়ে তিনশো শিয়াল ধরলেন এবং তাদের প্রতি জোড়ার লেজে লেজে জুড়ে তার মাঝখানে একটা করে মশাল বেঁধে দিলেন। তারপর মশালে আগুন ধরিয়ে ফিলিস্তিনীদের ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ফসলের মধ্যে তাদের ছেড়ে দিলেন। এইভাবে তিনি তাদের বাঁধা আঁটি ও দাঁড়িয়ে থাকা ফসল এবং তাদের জলপাইয়ের বাগান পুড়িয়ে দিলেন। ফিলিস্তিনীরা যখন জিজ্ঞাসা করল, “কে এই কাজ করেছে?” তখন তাদের বলা হল, “তিম্নায়ীয়ের জামাই শামাউন এই কাজ করেছে, কারণ তার শ্বশুর তার স্ত্রীকে তার বন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছে।” এতে ফিলিস্তিনীরা গিয়ে তাঁর স্ত্রী আর তাঁর শ্বশুরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করল। শামাউন তখন তাদের বললেন, “তোমাদের এই রকম কাজের দরুন আমি তোমাদের উপর প্রতিশোধ না নিয়ে থামব না।” এই বলে তিনি ভীষণভাবে তাদের আক্রমণ করলেন এবং অনেককে হত্যা করলেন। তারপর তিনি গিয়ে ঐটম পাহাড়ের ফাটলে থাকতে লাগলেন। ফিলিস্তিনীরা তখন গিয়ে এহুদা এলাকায় ছাউনি ফেলল এবং লিহী ঘেরাও করল। এহুদার লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, “কেন তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে এসেছ?” জবাবে তারা বলল, “আমরা শামাউনকে বন্দী করে নিয়ে যেতে এসেছি। সে আমাদের উপর যা করেছে আমরাও তার উপর তা-ই করব।” তখন এহুদার তিন হাজার লোক ঐটম পাহাড়ের সেই ফাটলের কাছে গিয়ে শামাউনকে বলল, “তুমি কি জান না যে, ফিলিস্তিনীরা আমাদের শাসন করছে? তুমি আমাদের প্রতি এ কি করলে?” জবাবে শামাউন বললেন, “তারা আমার উপর যা করেছে আমি তাদের উপর কেবল তা-ই করেছি।” তারা তাঁকে বলল, “আমরা তোমাকে বেঁধে ফিলিস্তিনীদের হাতে তুলে দেবার জন্য এসেছি।” শামাউন বললেন, “তাহলে তোমরা আমার কাছে কসম খেয়ে বল যে, তোমরা নিজেরা আমাকে হত্যা করবে না।” জবাবে তারা বলল, “আমরা তা করব না। আমরা কেবল তোমাকে বেঁধে তাদের হাতে তুলে দেব; সত্যিই আমরা তোমাকে হত্যা করব না।” এই বলে তারা তাঁকে দু’টা নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধে পাহাড়ের কাছ থেকে নিয়ে চলল। তিনি যখন লিহীর কাছে পৌঁছালেন তখন ফিলিস্তিনীরা আনন্দধ্বনি করতে করতে তাঁর দিকে আসতে লাগল। তখন মাবুদের রূহ্‌ পূর্ণ শক্তিতে তাঁর উপর আসলেন। তাতে তাঁর হাতের দড়িগুলো পুড়ে যাওয়া শনের মত হল এবং তাঁর হাতের বাঁধন খুলে পড়ে গেল। তখন তিনি সদ্য মরা গাধার একটা চোয়াল পেয়ে সেটা হাতে নিলেন এবং তা দিয়ে এক হাজার লোককে হত্যা করলেন। শামাউন বললেন, “একটা গাধার চোয়াল দিয়ে তাদের করলাম গাদা, একটা গাধার চোয়ালে হাজার পড়ল মারা।” এই কথা বলা শেষ করে তিনি সেই চোয়ালটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তিনি ঐ জায়গাটার নাম দিলেন রামৎ-লিহী (যার মানে “চোয়াল-পাহাড়”)। এর পর শামাউনের খুব পিপাসা পেল। তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “তুমি তোমার গোলামকে মহাজয় দান করেছ। এখন কি আমাকে পিপাসায় মরে এই খৎনা-না-করানো লোকদের হাতে পড়তে হবে?” তখন আল্লাহ্‌ লিহীতে একটা গর্ত খুলে দিলেন এবং তার মধ্য থেকে পানি বের হয়ে আসল। সেই পানি খাবার পর শামাউনের শক্তি ফিরে আসল আর তিনি যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। সেইজন্য ঐ ঝর্ণাটার নাম হল ঐন্‌-হক্কোরী (যার মানে “মুনাজাতকারীর ঝর্ণা”)। ঝর্ণাটা এখনও লিহীতে আছে। ফিলিস্তিনীদের সময় শামাউন বিশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসন করেছিলেন। শামাউন একদিন গাজা শহরে গিয়ে একটা বেশ্যাকে দেখলেন এবং তার কাছে গেলেন। শামাউন সেখানে গেছেন শুনে গাজার লোকেরা জায়গাটা ঘেরাও করে রাখল এবং সারা রাত শহরের সদর দরজার কাছে তাঁর জন্য ওৎ পেতে বসে রইল। রাতের বেলায় তারা চুপচাপ রইল আর বলল, “সকাল হলে পর আমরা তাকে মেরে ফেলব।” কিন্তু শামাউন সেখানে কেবল মাঝরাত পর্যন্ত শুয়ে ছিলেন। তারপর উঠে তিনি হুড়কা সুদ্ধ শহরের সদর দরজার দু’টা খুঁটি ও দরজা উপ্‌ড়ে ফেললেন। সেগুলো তিনি তাঁর কাঁধের উপর তুলে নিয়ে হেবরনের সামনের পাহাড়ের উপরে গেলেন। পরে সোরেক উপত্যকার একটি স্ত্রীলোকের উপর শামাউনের মন পড়ল। তার নাম ছিল দলীলা। ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা সেই স্ত্রীলোকের কাছে গিয়ে বললেন, “তুমি শামাউনের এই মহাশক্তির গোপন কথাটা আর কিভাবে আমরা তাকে ধরে এনে বেঁধে কষ্ট দিতে পারি তা তার কাছ থেকে ফুসলিয়ে জেনে নাও। তাতে আমরা প্রত্যেকে তোমাকে তেরো কেজি দু’শো গ্রাম করে রূপা দেব। এই কথা শুনে দলীলা শামাউনকে বলল, “তোমার এই মহাশক্তির গোপন কথাটা কি, আর কি দিয়ে তোমাকে বেঁধে কষ্ট দেওয়া যায় তা আমাকে বল।” জবাবে শামাউন তাকে বললেন, “ধনুকের না-শুকানো সাতটা নতুন ছিলা দিয়ে যদি কেউ আমাকে বাঁধে তবে আমি অন্য যে কোন লোকের মতই দুর্বল হয়ে পড়ব।” ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা তখন দলীলাকে সেই রকম সাতটা নতুন ছিলা দিলেন। সে তা দিয়ে শামাউনকে বাঁধল। তখন কতগুলো লোক ওৎ পেতে তার ভিতরের ঘরে ছিল। দলীলা শামাউনকে ডেকে বলল, “শামাউন, ফিলিস্তিনীরা তোমাকে ধরতে এসেছে।” আগুনের ছোঁয়ায় শনের দড়ি যেমন করে ছিঁড়ে যায় তেমনি করেই শামাউন ঐ ছিলাগুলো ছিঁড়ে ফেললেন। এইভাবে তাঁর শক্তির গোপন কথাটা গোপনই রয়ে গেল। তখন দলীলা শামাউনকে বলল, “তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছ, আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছ। এবার তুমি আমাকে ঠিক করে বল কি দিয়ে তোমাকে বাঁধা যায়।” শামাউন বললেন, “কখনও ব্যবহার করা হয় নি এমন কয়েকটা নতুন দড়ি দিয়ে যদি আমাকে বাঁধা হয় তবে আমি অন্য যে কোন লোকের মতই দুর্বল হয়ে পড়ব।” দলীলা তখন কয়েকটা নতুন দড়ি দিয়ে শামাউনকে বাঁধল। তার ভিতরের ঘরে কতগুলো লোক ওৎ পেতে ছিল। দলীলা বলল, “শামাউন, ফিলিস্তিনীরা তোমাকে ধরতে এসেছে।” কিন্তু শামাউন সুতার মত করে তাঁর হাত থেকে দড়িগুলো ছিঁড়ে ফেললেন। দলীলা তখন শামাউনকে বলল, “তুমি এই পর্যন্ত আমার কাছে মিথ্যা কথা বলে আমাকে বোকা বানিয়েছ। কি দিয়ে তোমাকে বাঁধা যায় তা আমাকে ঠিক করে বল।” জবাবে শামাউন বললেন, “আমার মাথার সাত গোছা চুল যদি তুমি তাঁতে বোনো তবে তা সম্ভব হবে।” তখন দলীলা তাঁর চুল তাঁতে বুনে গোঁজের সংগে আঁটকে রেখে তাঁকে বলল, “শামাউন, ফিলিস্তিনীরা তোমাকে ধরতে এসেছে।” তখন শামাউন ঘুম থেকে জেগে উঠে গোঁজ আর তাঁতটা উপ্‌ড়ে ফেললেন। এতে দলীলা তাঁকে বলল, “কেমন করে তুমি আমাকে বলতে পার যে, তুমি আমাকে ভালবাস? তোমার মন তো আমার উপরে নেই। এই নিয়ে তৃতীয়বার তুমি আমাকে বোকা বানালে। তোমার এই মহাশক্তির গোপন কথাটা আমাকে জানালে না।” এইভাবে দিনের পর দিন সে তার কথা দিয়ে তাঁকে এমনভাবে জ্বালাতে লাগল যে, তাঁর জীবনের উপর একটা বিরক্তি এসে গেল। কাজেই তিনি তাকে সব কথা খুলে বললেন। তিনি বললেন, “আমার মাথায় কখনও ক্ষুর দেওয়া হয় নি। জন্ম থেকেই আমি আল্লাহ্‌র উদ্দেশে একজন নাসরীয়। আমার মাথা কামানো হলে আমার শক্তি আমাকে ছেড়ে যাবে। তাতে আমি অন্য যে কোন লোকের মতই দুর্বল হয়ে পড়ব।” দলীলা যখন বুঝল যে, তিনি তাকে সব কথা খুলে বলেছেন তখন সে ফিলিস্তিনী শাসনকর্তাদের কাছে এই বলে খবর পাঠাল, “আপনারা আর একবার আসুন। সে আমাকে সব কথা খুলে বলেছে।” কাজেই ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা রূপা সংগে নিয়ে আসলেন। দলীলা শামাউনকে তার কোলে ঘুম পাড়াল এবং তাঁর সাত গোছা চুল কামিয়ে ফেলবার জন্য একজন লোককে ডাকল। এইভাবে সে তাঁকে কষ্টের মধ্যে ফেলল এবং তাঁর শক্তিও তাঁকে ছেড়ে গেল। তারপর দলীলা তাঁকে বলল, “শামাউন, ফিলিস্তিনীরা তোমাকে ধরতে এসেছে।” শামাউন ঘুম থেকে জেগে উঠে ভাবলেন যে, তিনি আগের মতই বাইরে যাবেন এবং ঝাড়া দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেবেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, মাবুদ তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। তখন ফিলিস্তিনীরা তাঁকে ধরে তাঁর চোখ দু’টা তুলে ফেলল এবং তাঁকে গাজা শহরে নিয়ে গেল। তারা তাঁকে ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বাঁধল এবং জেলখানার মধ্যে তাঁকে দিয়ে জাঁতা ঘুরাবার কাজ করাতে লাগল। কিন্তু তাঁর মাথার চুল কামিয়ে ফেলবার পর আবার তা গজাতে লাগল। এর পর ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা তাঁদের দেবতা দাগোনের কাছে একটা মস্ত বড় উৎসর্গ করে আনন্দ করবার জন্য এক জায়গায় জমায়েত হলেন। তাঁরা বললেন, “আমাদের দেবতা আমাদের শত্রু শামাউনকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।” লোকেরা শামাউনকে দেখে এই কথা বলে তাদের দেবতার প্রশংসা করতে লাগল, “আমাদের দেবতা আমাদের হাতে আমাদের শত্রুকে তুলে দিয়েছেন; সে আমাদের জমি নষ্ট করেছে আর আমাদের অনেক লোককে মেরে ফেলেছে।” তারপর তারা আনন্দে মেতে উঠে এই বলে চিৎকার করল, “শামাউনকে বের করে আনা হোক; আমরা তামাশা দেখব।” কাজেই তারা জেলখানা থেকে শামাউনকে বের করে আনল আর শামাউন তাদের তামাশা দেখাতে লাগলেন। তারা শামাউনকে থামগুলোর মাঝখানে দাঁড় করাল। যে ছেলেটি তাঁর হাত ধরে ছিল শামাউন তাকে বললেন, “যে থামগুলোর উপর মন্দিরটা দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো আমাকে ছুঁতে দাও যাতে আমি সেখানে হেলান দিতে পারি।” সেই মন্দিরে অনেক পুরুষ ও স্ত্রীলোক জমা হয়েছিল, আর ফিলিস্তিনীদের সমস্ত শাসনকর্তারাও সেখানে ছিলেন। ছাদের উপর থেকে প্রায় তিন হাজার পুরুষ ও স্ত্রীলোক শামাউনের তামাশা দেখছিল। তখন শামাউন মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমার কথা একবার মনে কর। হে আল্লাহ্‌, দয়া করে আর একটিবার মাত্র আমাকে শক্তি দাও যাতে আমার দু’টা চোখের জন্য একবারেই আমি ফিলিস্তিনীদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারি।” মাঝখানে যে দু’টা থামের উপর মন্দিরটা দাঁড়িয়ে ছিল শামাউন সেই দু’টা আঁকড়ে ধরলেন। তিনি ডান হাতটা একটা থামের উপর এবং বাঁ হাতটা অন্য থামের উপরে রেখে নিজের ভার থামগুলোর উপর দিলেন। তারপর তিনি চিৎকার করে বললেন, “ফিলিস্তিনীদের সংগে আমারও মৃত্যু হোক!” এই বলে তিনি নীচু হয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে থাম দু’টা টান দিলেন। তাতে সব শাসনকর্তা ও ভিতরকার লোকদের উপর মন্দিরটা ভেংগে পড়ল। এইভাবে তিনি জীবিত থাকতে যত না লোক হত্যা করেছিলেন তার চেয়েও বেশী মারলেন তাঁর মৃত্যুর সময়ে। শামাউনের ভাইয়েরা এবং তাঁর বাবার পরিবারের সবাই তাঁর মৃতদেহটা নিয়ে যাবার জন্য আসল। তারা তাঁকে নিয়ে গিয়ে সরা ও ইষ্টায়োলের মাঝখানে তাঁর বাবা মানোহের কবরের মধ্যে দাফন করল। শামাউন বিশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসন করেছিলেন। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় মিকাহ্‌ নামে একজন লোক ছিল। সে তার মাকে বলল, “তোমার যে তেরো কেজি দু’শো গ্রাম রূপা চুরি হয়ে গিয়েছিল এবং যার জন্য তোমাকে আমি বদদোয়া দিতে শুনেছি তা আমার কাছে আছে, আমিই তা নিয়েছিলাম।” তখন তার মা বলল, “বাবা, মাবুদ তোমাকে দোয়া করুন!” সেই তেরো কেজি দু’শো গ্রাম রূপা সে তার মাকে ফিরিয়ে দিল। তখন তার মা বলল, “এই রূপা আমি মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী করছি যাতে আমার ছেলে তা দিয়ে খোদাই করে একটা প্রতিমা এবং ছাঁচে ঢেলে আর একটা প্রতিমা তৈরী করে। কাজেই আমি এই রূপা তোমাকেই ফিরিয়ে দেব।” মিকাহ্‌ সেই রূপা তার মায়ের হাতে ফিরিয়ে দিলে পর তার মা প্রায় আড়াই কেজি রূপা নিয়ে স্বর্ণকারকে দিল। সে তা দিয়ে একটা মূর্তি ও একটা প্রতিমা তৈরী করে দিল, আর সেগুলো মিকাহ্‌র বাড়ীতেই রাখা হল। মিকাহ্‌র একটা মন্দির ছিল। সে একটা এফোদ ও কতগুলো দেবমূর্তি তৈরী করে তার একজন ছেলেকে ইমাম-পদে বহাল করল। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে তখনও কোন বাদশাহ্‌ ছিল না। যে যা ভাল মনে করত তা-ই করত। সেই সময় এহুদা এলাকার বেথেলহেমের একজন লেবীয় যুবক এহুদা-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে বাস করছিল। সে অন্য কোথাও থাকবার জায়গার খোঁজ করবার জন্য বেথেলহেম ছেড়ে বের হল। যাত্রাপথে সে আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় মিকাহ্‌র বাড়ীতে গেল। মিকাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” সে বলল, “আমি এহুদা এলাকার বেথেলহেমের একজন লেবীয়। আমি যেখানে থাকবার জায়গা পাব সেখানেই থাকব।” মিকাহ্‌ সেই লেবীয়কে তার কাজে বহাল করলে পর সে তার ইমাম হয়ে তার বাড়ীতেই থাকল। মিকাহ্‌ বলল, “একজন লেবীয় যখন আমার ইমাম হয়েছে তখন আমি জানি যে, মাবুদ আমার উন্নতি করবেন।” সেই সময় বনি-ইসরাইলদের মধ্যে কোন বাদশাহ্‌ ছিল না। ইসরাইলীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দান-গোষ্ঠীর লোকেরা তখনও কোন সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে নি। কাজেই তারা বসবাস করবার উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্য একটা জায়গার খোঁজ করছিল। সেইজন্য দানীয়রা সরা ও ইষ্টায়োল থেকে তাদের পাঁচজন শক্তিশালী যোদ্ধাকে খোঁজ-খবর নেবার জন্য পাঠিয়ে দিল যাতে তারা দেশটা ভাল করে দেখে আসতে পারে। এই পাঁচজনকে তারা বলে দিল, “তোমরা দেশটার খোঁজ-খবর নিয়ে দেখে এস।” তাতে সেই লোকেরা আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে ঢুকল এবং রাতে মিকাহ্‌র বাড়ীর কাছে রইল। সেই সময় তারা সেই লেবীয় যুবকের গলার আওয়াজ চিনতে পারল। সেইজন্য তারা ভিতরে ঢুকে তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাকে এখানে কে এনেছে? এখানে তুমি কি করছ আর কেনই বা এখানে এসেছ?” সে বলল, “মিকাহ্‌ আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। তিনি আমাকে বেতন দিয়ে রেখেছেন এবং আমি তাঁর ইমাম।” তারা তাকে বলল, “দয়া করে তুমি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে জেনে নাও আমাদের যাত্রা সফল হবে কি না।” জবাবে ইমাম তাদের বলল, “তোমরা শান্তিতে যাও; মাবুদের ইচ্ছা অনুসারে তোমরা যাচ্ছ।” সেই পাঁচজন লোক তখন সেখান থেকে লয়ীশে গেল। তারা দেখল সেখানকার লোকেরা সিডনীয়দের মত নির্ভয়ে, শান্তিতে এবং নিরাপদে বাস করছে। সেই জায়গায় এমন কেউ নেই যে, তাদের উপরে জুলুম করতে পারে। এছাড়া তারা সিডনীয়দের থেকে অনেক দূরে বাস করছে এবং অন্য কারও সংগে তাদের কোন সম্বন্ধ নেই। সেই পাঁচজন যখন সরা ও ইষ্টায়োলে ফিরে আসল তখন তাদের লোকেরা তাদের জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি দেখলে?” জবাবে তারা বলল, “আমরা যে জায়গা দেখে এসেছি তা চমৎকার। চল, আমরা তাদের হামলা করি। তোমরা কি চুপ করে বসে থাকবে? সেখানে গিয়ে জায়গাটা দখল করে নিতে দেরি কোরো না। তোমরা সেখানে গেলে দেখতে পাবে যে, সেখানকার লোকেরা একটা মস্ত বড় জায়গায় নিরাপদে বাস করছে। আল্লাহ্‌ তোমাদের হাতে জায়গাটা দিয়ে রেখেছেন। দুনিয়ার কোন জিনিসের অভাব সেখানে নেই।” এই কথা শুনে দান-গোষ্ঠীর ছ’শো লোক যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সরা আর ইষ্টায়োল থেকে যাত্রা করল। পথে তারা এহুদা দেশের কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের কাছে ছাউনি ফেলল। সেইজন্য কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের পশ্চিম দিকটাকে আজও বলা হয় মহন্তেদান (যার মানে “দানের ছাউনি”)। সেখান থেকে তারা আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় ঢুকে মিকাহ্‌র বাড়ীতে গেল। যে পাঁচজন লোক লয়ীশে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছিল তারা তাদের লোকদের বলল, “তোমরা কি জান যে, এই ঘরগুলোর একটাতে একখানা এফোদ, কতগুলো দেবমূর্তি, একটা খোদাই করা মূর্তি ও একটা ছাঁচে ঢালা প্রতিমা আছে? এখন তোমাদের কি করতে হবে তা তোমরা ভেবে দেখ।” এই কথা শুনে তারা মিকাহ্‌র বাড়ীর সেই লেবীয় যুবকের ঘরে গেল এবং তার ভাল-মন্দের খবরাখবর নিল। দান-গোষ্ঠীর সেই ছ’শো লোক যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়ীতে ঢুকবার পথে গিয়ে দাঁড়াল। সেই ইমামও সেই ছ’শো লোকের সংগে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন দেশটার খোঁজ-খবর যারা নিয়ে এসেছিল সেই পাঁচজন লোক ভিতরে ঢুকে খোদাই করা মূর্তিটা, এফোদটা, দেবমূর্তিগুলো এবং ছাঁচে ঢালা প্রতিমাটা নিয়ে নিল। এই লোকেরা যখন মিকাহ্‌র ঘর থেকে সেগুলো নিয়ে আসছিল তখন সেই ইমাম তাদের বলল, “তোমরা এ কি করছ?” জবাবে তারা তাকে বলল, “চুপ, মুখে হাত চাপা দিয়ে তুমি আমাদের সংগে এস; আমাদের ইমাম হয়ে পিতার মত হও। একজন লোকের পরিবারের ইমাম হওয়ার চেয়ে কি বনি-ইসরাইলদের একটা গোষ্ঠীর ইমাম হওয়া ভাল নয়?” এই কথা শুনে সেই ইমাম খুব খুশী হল। সে নিজেই সেই এফোদ, দেবমূর্তিগুলো এবং খোদাই করা মূর্তিটা নিয়ে সেই লোকদের সংগে গেল। লোকেরা তাদের ছোট ছেলেমেয়ে, পশুপাল এবং তাদের অন্যান্য জিনিসপত্র দলের সামনের দিকে রেখে সেখান থেকে চলে গেল। মিকাহ্‌র বাড়ী থেকে তারা বেশ কিছু দূরে গেলে পর মিকাহ্‌র প্রতিবেশীরা একসংগে জমায়েত হল। তারপর তারা গিয়ে দান-গোষ্ঠীর লোকদের নাগাল পেল। তারা দান-গোষ্ঠীর লোকদের পিছনে পিছনে চেঁচাতে লাগল। তখন দান-গোষ্ঠীর লোকেরা পিছন ফিরে মিকাহ্‌কে বলল, “তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে যে, তুমি যুদ্ধ করবার জন্য তোমার লোকদের জমায়েত করেছ?” জবাবে মিকাহ্‌ বলল, “তোমরা তো আমার তৈরী করা প্রতিমাগুলো এবং আমার ইমামকে নিয়ে চলে এসেছ। এর পর আমার আর কি রইল? তোমরা কেমন করে বলতে পারছ যে, আমার কি অসুবিধা হচ্ছে?” জবাবে দান-গোষ্ঠীর লোকেরা বলল, “তুমি আর কথা বোলো না। এখানে কতগুলো বদমেজাজী লোক আছে যারা তোমার কথা শুনে তোমাদের আক্রমণ করে বসবে আর তাতে তুমি ও তোমার পরিবারের লোকেরা মারা পড়বে।” এই বলে দান-গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের নিজেদের পথ ধরে চলল। মিকাহ্‌ দেখল যে, তার চেয়ে তাদের জোর বেশী। সেইজন্য সে ঘুরে নিজের বাড়ীতে ফিরে গেল। মিকাহ্‌র তৈরী সব মূর্তি এবং তার ইমামকে নিয়ে তারা লয়ীশে গেল। সেখানকার শান্তিতে ও নিরাপদে থাকা লোকদের তারা আক্রমণ করে হত্যা করল এবং তাদের শহরটা পুড়িয়ে দিল। লয়ীশের লোকদের রক্ষা করবার মত কেউ ছিল না, কারণ তাদের শহরটা সিডন থেকে অনেক দূরে ছিল এবং অন্য কোন লোকদের সংগে তাদের সম্বন্ধ ছিল না। তাদের শহরটা ছিল বৈৎ-রহোব শহরের কাছে একটা উপত্যকায়। দান-গোষ্ঠীর লোকেরা শহরটা আবার তৈরী করে নিয়ে সেখানে বাস করতে লাগল। শহরটার আগের নাম লয়ীশ হলেও তারা তাদের পূর্বপুরুষের নাম অনুসারে তার নাম রাখল দান। দান ছিলেন ইয়াকুবের ছেলে। দান-গোষ্ঠীর লোকেরা সেখানে নিজেদের জন্য সেই খোদাই করা প্রতিমাটা স্থাপন করল। দেশের লোকেরা বন্দীদশায় না যাওয়া পর্যন্ত দান-গোষ্ঠীর লোকদের জন্য যোনাথন ও তার বংশধরেরা ইমামের কাজ করত। যোনাথন ছিল গের্শোম বংশের আর গের্শোম ছিল মূসার ছেলে। শীলোতে যতকাল আল্লাহ্‌র ঘরটা রইল ততকাল পর্যন্ত দান-গোষ্ঠীর লোকেরা মিকাহ্‌র তৈরী সেই খোদাই করা প্রতিমাটা নিজেদের জন্য রেখে দিল। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে যখন কোন বাদশাহ্‌ ছিল না তখন আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার ভিতরে একজন লেবীয় বাস করত। সে এহুদা এলাকার বেথেলহেম গ্রামের একজন মেয়েকে উপস্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল। মেয়েটির বাবা তাকে সেখানে থাকবার জন্য অনুরোধ করল। তাতে সে তার শ্বশুর বাড়ীতে তিন দিন থাকল এবং খাওয়া-দাওয়া করল। চতুর্থ দিনে তারা খুব সকালে উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল কিন্তু তার শ্বশুর তাকে বলল, “আগে খাওয়া-দাওয়া কর, তারপর যেয়ো।” কাজেই তারা দু’জনে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য বসল। মেয়েটির বাবা বলল, “আজ রাতটা থাক এবং একটু আমোদ-প্রমোদ কর।” সে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেও তার শ্বশুর যখন তাকে অনুরোধ করল তখন সে সেই রাতটাও সেখানে থাকল। পঞ্চম দিনের ভোরবেলা সে যখন যাবার জন্য ঘুম থেকে উঠল তখন মেয়েটির বাবা তাকে বলল, “খাওয়া-দাওয়া কর, আর বিকাল পর্যন্ত থেকে যাও।” কাজেই তারা দু’জনে খাওয়া-দাওয়া করল। তারপর যখন সেই লোকটি তার উপস্ত্রী এবং চাকরকে নিয়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হল তখন তার শ্বশুর বলল, “দেখ, এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রাতটা এখানেই কাটাও; বেলা তো প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখানেই থাক এবং আমোদ-প্রমোদ কর। কাল খুব ভোরে উঠে তোমার বাড়ীর পথে রওনা হয়ে যেয়ো।” জবাবে তার মালিক তাকে বলল, “না, যারা ইসরাইলীয় নয় তাদের শহরে আমরা যাব না। আমরা বরং এগিয়ে গিয়ে গিবিয়াতে যাব।” সে আরও বলল, “চল, আমরা গিবিয়াতে কিংবা রামাতে পৌঁছাবার চেষ্টা করি এবং রাতটা ঐ শহর দু’টার একটাতে কাটাই।” কাজেই তারা চলতেই থাকল। বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গিবিয়ার কাছে পৌঁছাতেই সূর্য ডুবে গেল। রাতটা কাটাবার জন্য তখন তারা পথ ছেড়ে গিবিয়াতে গেল আর শহর-চকে গিয়ে বসল, কিন্তু রাত কাটাবার জন্য কেউ নিজের বাড়ীতে তাদের ডেকে নিল না। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার একজন বুড়ো লোক তার ক্ষেতের কাজের পর গিবিয়া শহরে ঢুকল। সে গিবিয়াতে বাস করত, কিন্তু সেখানকার লোকেরা ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোক। শহর-চকে সেই পথিককে দেখে বুড়ো লোকটি জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কোথায় যাবে আর কোথা থেকেই বা এসেছ?” জবাবে সে বলল, “আমরা এহুদার বেথেলহেম থেকে এসেছি আর আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার ভিতরে যাব। আমার বাড়ী সেখানেই। আমি এহুদার বেথেলহেমে গিয়েছিলাম আর এখন আমি মাবুদের ঘরে যাচ্ছি, কিন্তু কেউ আমাকে তার বাড়ীতে ডেকে নিচ্ছে না। আমাদের গাধার জন্য খড় ও ভূষি আমাদের কাছে আছে এবং আমার জন্য ও আপনার এই বাঁদীর জন্য এবং আমাদের সংগেকার এই যুবকটির জন্য রুটি এবং আংগুর-রসও আছে। আপনার গোলামদের আর কিছুরই দরকার নেই।” তখন সেই বুড়ো লোকটি বলল, “তোমার শান্তি হোক। তোমার যা কিছু দরকার তার ভার আমার উপর রইল। কিন্তু রাতটা তোমরা কিছুতেই এই চকে কাটায়ো না।” এই বলে বুড়ো লোকটি তার বাড়ীতে তাদের নিয়ে গেল এবং তাদের গাধাগুলোকে খেতে দিল। তারা পা ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া করল। এইভাবে যখন তারা আরামে সময় কাটাচ্ছিল তখন শহরের কয়েকজন দুষ্ট লোক এসে বাড়ীটা ঘেরাও করল। তারা দরজায় আঘাত করতে করতে বাড়ীর মালিক, অর্থাৎ সেই বুড়ো লোকটিকে বলল, “যে লোকটি তোমার বাড়ীতে এসেছে তাকে বের করে দাও। আমরা তার সংগে জেনা করব।” তখন বাড়ীর মালিক বাইরে বের হয়ে তাদের বলল, “না না, আমার ভাইয়েরা; মিনতি করি, এমন জঘন্য কাজ তোমরা কোরো না। ঐ লোকটি আমার মেহমান; এই খারাপ কাজ তোমরা কোরো না। আমার অবিবাহিতা মেয়ে এবং লোকটির উপস্ত্রী এখানে রয়েছে। আমি এখনই তাদের তোমাদের কাছে বের করে আনছি। তোমরা তাদের ইজ্জত নষ্ট কর এবং তোমাদের যা ইচ্ছা তা-ই তাদের প্রতি কর, কিন্তু এই লোকের উপর তোমরা এই খারাপ কাজ কোরো না।” তবুও তারা তার কথা শুনতে রাজী হল না। তখন সেই লোকটি তার উপস্ত্রীকে ধরে বাইরে তাদের কাছে বের করে দিল। তারা সারারাত ধরে জোর করে তার সংগে জেনা করল এবং তার শরীরের উপর অত্যাচার করল। তারপর তারা ভোরের দিকে তাকে ছেড়ে দিল। অন্ধকার যখন কেটে যাচ্ছিল তখন সেই স্ত্রীলোকটি ফিরে গিয়ে তার স্বামী যেখানে ছিল সেই বুড়ো লোকের বাড়ীর দরজার সামনে পড়ে গেল। সূর্য না ওঠা পর্যন্ত সে সেখানেই পড়ে রইল। সকালবেলায় তার স্বামী উঠে যাত্রা করবার জন্য যখন ঘরের দরজা খুলে বের হল তখন দেখতে পেল যে, তার উপস্ত্রী ঘরের দরজার চৌকাঠের উপর হাত রেখে পড়ে আছে। সে তাকে বলল, “ওঠো, চল আমরা যাই,” কিন্তু কোন জবাব সে পেল না। তখন লোকটি তাকে তার গাধার উপর তুলে নিয়ে বাড়ীর পথে রওনা হল। বাড়ী পৌঁছে সে একটা ছুরি নিয়ে তার হাড় দেখে দেখে তাকে কেটে বারোটা টুকরা করল এবং বনি-ইসরাইলদের সমস্ত এলাকায় সেগুলো পাঠিয়ে দিল। যারা তা দেখল তারা প্রত্যেকেই বলল, “বনি-ইসরাইলরা মিসর থেকে বের হয়ে আসবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত এমন কাজ কখনও হয় নি আর দেখাও যায় নি। তোমরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা কর, পরামর্শ কর এবং কি করা উচিত তা বল।” এর পর গিলিয়দের বনি-ইসরাইলরা এবং দান থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত সমস্ত জায়গার বনি-ইসরাইলরা সবাই বের হয়ে আসল এবং মিসপাতে মাবুদের কাছে জমায়েত হল। তখন লেবি-গোষ্ঠীর ঐ লোকটি, অর্থাৎ মেরে ফেলা স্ত্রীলোকটির স্বামী বলল, “আমি ও আমার উপস্ত্রী রাত কাটাবার জন্য বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গিবিয়াতে গিয়েছিলাম। রাতের বেলায় গিবিয়ার লোকেরা আমার খোঁজে এসে বাড়ীটা ঘেরাও করল। তারা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার বদলে তারা আমার উপস্ত্রীকে নিয়ে জোর করে তার সংগে জেনা করল, আর তাতে সে মারা গেল। ইসরাইলের মধ্যে তারা এমন লমপটতা এবং খারাপ কাজ করেছে বলে আমি আমার উপস্ত্রীকে কেটে টুকরা টুকরা করে বনি-ইসরাইলদের ভাগে পড়া প্রত্যেকটি জায়গায় একটা করে টুকরা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখন হে বনি-ইসরাইলরা, আপনারা সকলে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আপনাদের রায় দিন।” এতে সমস্ত লোক একসংগে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “আমরা কেউ বাড়ী যাব না; আমাদের মধ্যে একজনও ফিরে যাবে না। আমরা গুলিবাঁট করে গিবিয়ার লোকদের বিরুদ্ধে যাব। ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর প্রত্যেক একশো জন থেকে দশ, হাজার থেকে একশো এবং দশ হাজার থেকে এক হাজার জন লোক বেছে নেব। তারা গিয়ে সৈন্যদের জন্য খাবার-দাবার নিয়ে আসবে; আর আমরা বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গিবিয়াতে গিয়ে ইসরাইল জাতির মধ্যে তারা যে সব জঘন্য কাজ করেছে তার উচিত শাস্তি দেব।” কাজেই বনি-ইসরাইলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা সবাই একসংগে জমায়েত হয়ে গিবিয়ার বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়াল। তারা বিন্‌ইয়ামীন এলাকার সব জায়গায় লোক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে পাঠাল, “তোমাদের মধ্যে এ কি জঘন্য কাজ করা হয়েছে? গিবিয়ার ঐ সব দুষ্ট লোকদের তোমরা আমাদের হাতে তুলে দাও যাতে আমরা তাদের মেরে ফেলে বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে এই জঘন্যতা দূর করে দিতে পারি।” কিন্তু বিন্‌ইয়ামীনীয়রা তাদের ইসরাইলীয় ভাইদের কথায় কান দিল না। তারা ঐ সব বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য তাদের শহর ও গ্রামগুলো থেকে বের হয়ে গিবিয়াতে গিয়ে জমায়েত হল। সেই দিনই তারা তাদের শহর ও গ্রামগুলো থেকে ছাব্বিশ হাজার সৈন্য জমায়েত করল। এছাড়া তাদের সংগে ছিল গিবিয়ার সাতশো বাছাই করা সৈন্য। সমস্ত সৈন্যদের মধ্যে সাতশো বাঁহাতি দক্ষ লোক ছিল যারা চুল লক্ষ্য করে ফিংগা দিয়ে ঠিক চুলটির উপরেই পাথর মারতে পারত। বাকী ইসরাইলীয় সৈন্যদের সংখ্যা ছিল চার লক্ষ। তারা সকলেই ছিল যুদ্ধে পাকা। তারা বেথেলে গিয়ে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে জানতে চাইল বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য তাদের মধ্যে কে আগে যাবে। জবাবে মাবুদ জানালেন যে, এহুদা-গোষ্ঠী আগে যাবে। পরের দিন সকালে উঠে বনি-ইসরাইলরা গিবিয়ার কাছে ছাউনি ফেলল। তারপর তারা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়ে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য সাজাল। বিন্‌ইয়ামীনীয়রা গিবিয়া থেকে বের হয়ে আসল এবং সেই দিন বাইশ হাজার ইসরাইলীয়কে হত্যা করল। দ্বিতীয় দিনে তারা বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেল। এইবার বিন্‌ইয়ামীনীয়রা তাদের বাধা দেবার জন্য গিবিয়া থেকে বের হয়ে এসে আরও আঠারো হাজার ইসরাইলীয়কে হত্যা করল। তারা সবাই ছিল তলোয়ারধারী সৈন্য। তখন বনি-ইসরাইলদের সমস্ত লোক বেথেলে গিয়ে মাবুদের সামনে বসে কাঁদতে লাগল। তারা সেই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজা রাখল এবং মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানী দিল। তখন বনি-ইসরাইলরা গিবিয়ার চারপাশে সৈন্যদের লুকিয়ে রাখল। তৃতীয় দিনে বাকী সৈন্যেরা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সংগে যুদ্ধের জন্য আগের মত করেই গিবিয়ার কাছে সৈন্য সাজাল। বনি-ইসরাইলদের বাধা দেবার জন্য বিন্‌ইয়ামীনীয়রা বেরিয়ে এসে শহর থেকে দূরে গেল। তারা আগের মতই বনি-ইসরাইলদের হত্যা করতে লাগল। তাতে মাঠের উপর এবং যে রাস্তা দু’টার একটা বেথেলের দিকে এবং অন্যটা গিবিয়ার দিকে চলে গেছে তার উপর প্রায় ত্রিশজন লোক মারা পড়ল। এতে বিন্‌ইয়ামীনীয়রা বলতে লাগল, “আমরা ওদের আগের মতই হারিয়ে দিচ্ছি,” আর বনি-ইসরাইলরা বলল, “এস, আমরা পিছু হটে গিয়ে শহরের কাছ থেকে ওদের সরিয়ে রাস্তার উপর নিয়ে যাই।” তারপর ইসরাইলীয় সৈন্যেরা তাদের জায়গা থেকে সরে গিয়ে বাল-তামরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। এদিকে বনি-ইসরাইলদের লুকিয়ে থাকা সৈন্যেরা তাদের জায়গা, অর্থাৎ মারে-গেবা ছেড়ে বেরিয়ে আসল। তখন বনি-ইসরাইলদের দশ হাজার বাছাই করা লোক গিবিয়ার সামনের দিকে হামলা চালাল, আর তাতে ভীষণভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল; কিন্তু বিন্‌ইয়ামীনীয়রা বুঝতে পারল না যে, তারা প্রায় সর্বনাশের মুখে এসে পড়েছে। মাবুদ সেই দিন বনি-ইসরাইলদের কাছে বিন্যামীন-গোষ্ঠীকে হার মানালেন এবং তারা পঁচিশ হাজার একশো বিন্‌ইয়ামীনীয় লোককে হত্যা করল। তারা সবাই ছিল তলোয়ারধারী সৈন্য। এর পরে বিন্‌ইয়ামীনীয়রা বুঝতে পারল যে, তারা হেরে গেছে। গিবিয়ার কাছে যে সৈন্যদের লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের উপর ভরসা করেই বনি-ইসরাইলরা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সামনে হটে গিয়েছিল। সেই লুকিয়ে থাকা সৈন্যেরা গিবিয়ার উপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শহরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার সমস্ত লোকদের হত্যা করল। কিন্তু তাদের শহর থেকে যখন থামের মত হয়ে ধোঁয়া উঠতে লাগল তখন তারা ঘুরে দেখল যে, গোটা শহর থেকে ধোঁয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে। সেই সময়েই বনি-ইসরাইলরা ঘুরে দাঁড়াল আর তাতে বিন্‌ইয়ামীনীয়রা খুব ভয় পেল। তারা বুঝতে পারল যে, তাদের উপর সর্বনাশ এসে পড়েছে। কাজেই তারা বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে মরুভূমির দিকে পালাতে লাগল, কিন্তু যুদ্ধ থেকে রেহাই পেল না। অন্যান্য বনি-ইসরাইলরা শহর ও গ্রাম থেকে বের হয়ে এসে সেখানেই তাদের হত্যা করল। তারা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের তাড়া করে ঘিরে ফেলল এবং গিবিয়ার পূর্ব দিকে তাদের বিশ্রামের জায়গায় তাদের শেষ করে দিল। এতে আঠারো হাজার বিন্‌ইয়ামীনীয় মারা পড়ল; তারা সবাই ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা। যখন বাকী বিন্‌ইয়ামীনীয়রা ঘুরে মরুভূমির রিম্মোণ পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন বনি-ইসরাইলরা পথের মধ্যেই তাদের পাঁচ হাজার লোককে হত্যা করল। তার পরেও তারা গিদোম পর্যন্ত বিন্‌ইয়ামীনীয়দের তাড়া করে নিয়ে গেল এবং আরও দু’হাজার লোককে হত্যা করল। সেই দিন মোট পঁচিশ হাজার বিন্‌ইয়ামীনীয় সৈন্য মারা পড়ল। তারা সবাই ছিল ভাল যোদ্ধা। কিন্তু বিন্‌ইয়ামীনীয়দের ছ’শো লোক ঘুরে মরুভূমির রিম্মোণ পাহাড়ে পালিয়ে গিয়ে চার মাস সেখানে রইল। এর মধ্যে বনি-ইসরাইলরা ফিরে বিন্‌ইয়ামীনীয়দের বাকী লোকদের সবাইকে হত্যা করল এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে পশু আর অন্যান্য যাদের পেল সবাইকে শেষ করে দিল। তারা যে সব শহর ও গ্রামে গেল তার সবগুলোতেই আগুন লাগিয়ে দিল। বনি-ইসরাইলরা আগে মিসপাতে কসম খেয়ে বলেছিল যে, তাদের মধ্যে কেউ বিন্যামীন-গোষ্ঠীর কোন লোকের সংগে মেয়ের বিয়ে দেবে না। পরের দিন ভোরবেলায় লোকেরা একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করে পোড়ানো আর যোগাযোগ-কোরবানী দিল। মিসপাতে তারা এই বলে একটা কঠিন কসম খেয়েছিল যে, কেউ যদি মিসপাতে মাবুদের সামনে উপস্থিত না হয় তবে তাকে নিশ্চয়ই হত্যা করা হবে। কাজেই তারা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “ইসরাইলীয়দের সমস্ত গোষ্ঠী থেকে কারা মিসপাতে মাবুদের সামনে যায় নি?” তারা তাদের ভাই বিন্‌ইয়ামীনীয়দের জন্য দুঃখ করে বলল, “ইসরাইলীয়দের মধ্য থেকে আজ একটা গোষ্ঠীকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যারা রয়ে গেছে কিভাবে আমরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব? আমরা তো আল্লাহ্‌র কসম খেয়েছি যে, আমাদের কোন মেয়েকে তাদের সংগে বিয়ে দেব না।” তারা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করল, “ইসরাইলীয় গোষ্ঠীর মধ্যে কি এমন কোন লোক আছে, যে মিসপাতে মাবুদের সামনে উপস্থিত হয় নি?” তখন তারা জানতে পারল, যাবেশ-গিলিয়দ থেকে কেউই সেখানে যায় নি, কারণ লোক গণনা করবার সময় তারা দেখেছিল যে, যাবেশ-গিলিয়দের কোন লোকই সেখানে ছিল না। কাজেই তারা তাদের শক্তিশালী যোদ্ধাদের মধ্য থেকে বারো হাজার লোককে পাঠিয়ে দিল যেন তারা যাবেশ-গিলিয়দে গিয়ে ছোট ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীলোক সুদ্ধ সেখানকার সব লোকদের হত্যা করে। তারা বলল, “তোমরা প্রত্যেকটি পুরুষ এবং অবিবাহিত নয় এমন প্রত্যেকটি স্ত্রীলোককে মেরে ফেলবে।” সেই যোদ্ধারা যাবেশ-গিলিয়দের বাসিন্দাদের মধ্যে চারশো যুবতী অবিবাহিতা মেয়ে পেল; তারা সেই মেয়েদের কেনান দেশের শীলোর ছাউনিতে নিয়ে গেল। এর পর সেই জমায়েত হওয়া বনি-ইসরাইলরা রিম্মোণ পাহাড়ে লোক পাঠিয়ে বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সংগে কথা বলল এবং শান্তি ঘোষণা করল। এতে বিন্‌ইয়ামীনীয়রা ফিরে আসল। যাবেশ-গিলিয়দের বাঁচিয়ে রাখা মেয়েদের সংগে তাদের বিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু মেয়েরা সংখ্যায় কম পড়ে গেল। লোকেরা বিন্যামীন-গোষ্ঠীর জন্য দুঃখ করতে লাগল, কারণ মাবুদ ইসরাইলীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটা ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের বৃদ্ধ নেতারা বললেন, “বিন্‌ইয়ামীনীয় স্ত্রীলোকদের ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন যে পুরুষেরা বেঁচে রয়েছে তাদের বিয়ের জন্য আমরা কোথায় মেয়ে পাব? বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে যাতে একটা গোষ্ঠী মুছে না যায় সেইজন্য বেঁচে থাকা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের বংশ রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেয়েদের তো তাদের সংগে বিয়ে দিতে পারি না, কারণ আমরা কসম খেয়ে বলেছি যে, কেউ যদি কোন বিন্‌ইয়ামীনীয়কে মেয়ে দেয় তবে তাকে বদদোয়া দেওয়া হবে।” তারপর তারা বলল, “প্রতি বছর শীলোতে মাবুদের উদ্দেশে একটা ঈদ হয়।” শীলো শহরটা রয়েছে বেথেলের উত্তর দিকের যে রাস্তাটা বেথেল থেকে শিখিমের দিকে গেছে তার পূর্ব দিকে এবং লবোনার দক্ষিণে। তারা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের এই পরামর্শ দিল, “তোমরা গিয়ে শীলোর আংগুর ক্ষেতে লুকিয়ে থাক এবং নজর রাখ। যখন সেখানকার মেয়েরা নাচে যোগ দেবার জন্য বেরিয়ে আসবে তখন তোমরা প্রত্যেকে আংগুর ক্ষেত থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে তাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নিয়ে বিন্‌ইয়ামীন এলাকায় চলে যাবে। যখন তাদের বাবা কিংবা ভাইয়েরা আমাদের কাছে নালিশ করতে আসবে তখন আমরা তাদের বলব, ‘তোমরা এই সব মেয়েদের দান করে আমাদের পক্ষে তাদের প্রতি দয়া দেখাও। যুদ্ধের সময়ে আমরা তাদের জন্য যথেষ্ট মেয়ে পাই নি। এই ব্যাপারে তোমাদের কোন দোষ নেই, কারণ তোমরা নিজেরা তো তোমাদের মেয়েদের তাদের দাও নি।’ ” কাজেই বিন্‌ইয়ামীনীয়রা তা-ই করল। মেয়েরা যখন নাচছিল তখন তারা প্রত্যেকে বিয়ে করবার জন্য একজন করে মেয়ে ধরে নিয়ে গেল। তারপর তারা তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরে গিয়ে শহর ও গ্রামগুলোর ঘর-বাড়ী আবার তৈরী করে নিয়ে সেখানে বাস করতে লাগল। এর পর বনি-ইসরাইলরা সেই জায়গা ছেড়ে যে যার গোষ্ঠী এবং বংশের জায়গায় নিজের সম্পত্তিতে চলে গেল। তখনও বনি-ইসরাইলদের মধ্যে কোন বাদশাহ্‌ ছিল না। যে যা ভাল মনে করত সে তা-ই করত। শাসনকর্তাদের শাসনকালে বনি-ইসরাইলদের দেশে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তখন এহুদা দেশের বেথেলহেম গ্রামের একজন লোক তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে কিছুকালের জন্য মোয়াব দেশে বাস করতে গিয়েছিল। লোকটির নাম ছিল ইলীমেলক। তার স্ত্রীর নাম নয়মী আর দুই ছেলের নাম মহলোন ও কিলিয়োন। তারা ছিল এহুদা দেশের বেথেলহেমের ইফ্রাথীয় লোক। তারা মোয়াব দেশে গিয়ে সেখানেই রয়ে গেল। পরে নয়মীর স্বামী ইলীমেলক মারা গেল, আর তাতে বাকী রইল কেবল নয়মী ও তার দুই ছেলে। মোয়াব দেশে থাকতেই নয়মী শুনতে পেয়েছিল যে, মাবুদ তাঁর বান্দাদের খাবারের ব্যবস্থা করে তাদের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। তাই সে তার দুই ছেলের স্ত্রীদের নিয়ে মোয়াব দেশ থেকে বাড়ী ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। তারা যেখানে থাকত সেখান থেকে দুই ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে সে বের হল এবং এহুদা দেশে ফিরে যাবার পথ ধরে চলতে লাগল। পরে নয়মী তার দুই ছেলের স্ত্রীকে বলল, “তোমরা নিজের নিজের মায়ের ঘরে ফিরে যাও। তোমরা যেমন তোমাদের মৃত স্বামী এবং আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলে তেমনি মাবুদও যেন তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন। মাবুদ তোমাদের দোয়া করুন যেন তোমরা দু’জনেই আবার শান্তিতে স্বামীর ঘর করতে পার।” এই কথা বলে সে তাদের চুম্বন করল আর তারা জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। তারা বলল, “না, আমরা আপনার সংগে আপনার লোকদের কাছেই ফিরে যাব।” নয়মী বলল, “না, মা, তোমরা বাড়ী ফিরে যাও। তোমরা কেন আমার সংগে যাবে? আমার গর্ভে কি আর ছেলে হওয়ার আশা আছে যারা তোমাদের স্বামী হতে পারবে? মা, তোমরা বাড়ী ফিরে যাও। বিয়ে করবার বয়স আর আমার নেই। ধর, ছেলে হওয়ার আশা আছে মনে করে যদি আজ রাতেই আমি আমার স্বামীর কাছে যাই এবং আমার ছেলে হয়ও, তবে তারা বড় হওয়া পর্যন্ত কি তোমরা অপেক্ষা করবে? তাদের জন্য কি তোমরা বিয়ে না করে থাকবে? না, মা, না। তোমাদের চেয়ে আমার জীবন আরও অনেক তেতো, কারণ মাবুদ আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।” এই কথা শুনে তারা আবার জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। তারপর অর্পা তার শাশুড়ীকে চুম্বন করে বিদায় নিল কিন্তু রূত তাকে ছেড়ে গেল না। তখন নয়মী বলল, “দেখ, তোমার জা তার নিজের লোকদের ও তার দেবতার কাছে ফিরে যাচ্ছে। তুমিও তার সাথে যাও।” কিন্তু রূত বলল, “আপনাকে ছেড়ে চলে যাবার জন্য আপনি আমাকে জোর করবেন না, কিংবা আপনার সংগে যেতে আমাকে নিষেধ করবেন না। আপনি যেখানে যাবেন আমিও সেখানে যাব আর আপনি যেখানে থাকবেন আমিও সেখানে থাকব। আপনার লোকেরাই হবে আমার লোক আর আপনার আল্লাহ্‌ হবেন আমার আল্লাহ্‌। আপনি যেখানে মরবেন আমিও সেখানে মরব আর সেখানেই যেন আমার কবর হয়। এক মৃত্যু ছাড়া আর অন্য কিছু যদি আমাদের আলাদা করে তবে মাবুদ যেন আমাকে শাস্তি দেন এবং তা ভীষণভাবেই দেন।” নয়মী যখন বুঝতে পারল যে, রূত তার সংগে যাবার জন্য মন স্থির করে ফেলেছে তখন সে তাকে আর কিছু বলল না। এর পর সেই দু’জন চলতে লাগল এবং শেষে বেথেলহেমে গিয়ে উপস্থিত হল। তারা বেথেলহেমে উপস্থিত হলে পর সমস্ত গ্রামে একটা সাড়া পড়ে গেল। গ্রামের স্ত্রীলোকেরা বলল, “এ-ই কি সেই নয়মী?” নয়মী বলল, “আমাকে নয়মী (যার মানে ‘হাস্তিখুশী’) বলে আর ডেকো না, বরং মারা (যার মানে ‘তেতো’) বলে ডাক, কারণ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ আমার জীবনকে তেতো করে দিয়েছেন। আমি ভরা হাতে গিয়েছিলাম কিন্তু মাবুদ আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে এনেছেন। মাবুদ যখন আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ যখন আমাকে কষ্টে ফেলেছেন তখন তোমরা আমাকে কেন আর নয়মী বলে ডাকছ?” এইভাবে নয়মী তার ছেলের স্ত্রী মোয়াবীয় রূতকে সংগে নিয়ে মোয়াব দেশ থেকে ফিরে আসল। যব কাটবার সময় শুরু হতেই তারা বেথেলহেমে এসে পৌঁছেছিল। স্বামীর দিক থেকে নয়মীর একজন সম্মানিত ধনী আত্মীয় ছিলেন। তিনি ইলীমেলকের বংশের লোক। তাঁর নাম ছিল বোয়স। একদিন মোয়াবীয় রূত নয়মীকে বলল, “আমি ক্ষেতে গিয়ে পড়ে-থাকা শস্যের শীষ কুড়িয়ে আনব কি? যে আমাকে দয়া করে তা কুড়িয়ে নিতে দেবে আমি তারই পিছনে পিছনে থাকব।” নয়মী তাকে বলল, “জ্বী মা, যাও।” তখন রূত বের হয়ে গেল এবং ক্ষেতে গিয়ে যারা ফসল কাটছিল তাদের পিছনে পিছনে শীষ কুড়াতে লাগল; আর এমন হল যে, সে যেখানে শীষ কুড়াচ্ছিল সেটা ছিল ইলীমেলকের বংশের বোয়সের ক্ষেত। এমন সময় বোয়স বেথেলহেম থেকে আসলেন এবং যারা ফসল কাটছিল তাদের বললেন, “মাবুদ তোমাদের সংগে থাকুন।” তারাও ফিরে তাঁকে বলল, “মাবুদ আপনাকে দোয়া করুন।” বোয়সের যে চাকর ফসল কাটবার কাজ তদারক করছিল বোয়স তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই যুবতী মেয়েটি কার?” যে লোকটি কাজের তদারক করছিল জবাবে সে বলল, “মোয়াব দেশ থেকে নয়মীর সংগে যে মোয়াবীয় স্ত্রীলোকটি এসেছে এ সে-ই। স্ত্রীলোকটি বলেছিল, যারা ফসল কাটছে তাদের পিছনে পিছনে আঁটির মধ্যে মধ্যে পড়ে-থাকা শীষ যেন তাকে দয়া করে কুড়িয়ে নিতে দেওয়া হয়। এইভাবে সে সকাল থেকে এই পর্যন্ত এখানে আছে; মাত্র অল্পক্ষণ সে চালার নীচে বিশ্রাম করেছে।” তখন বোয়স রূতকে বললেন, “এই যে বাছা, শোন। তুমি এই ক্ষেত ছেড়ে অন্য কোন ক্ষেতে শীষ কুড়াতে না গিয়ে আমার কাজের মেয়েদের সংগে এখানেই থেকো। জমির কোন্‌খানে লোকেরা ফসল কাটছে তা খেয়াল রেখে তুমি কাজের মেয়েদের পিছনে পিছনে সেখানে যেয়ো। আমি লোকদের বলে দিয়েছি যেন তারা তোমাকে জ্বালাতন না করে। আমার লোকেরা যে পানি তুলেছে, পিপাসা পেলে তুমি সেখান থেকে পানি খেয়ো।” এই কথা শুনে রূত মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম করে বলল, “আপনি দয়া করে আমার প্রতি এত মনোযোগ দিচ্ছেন, এটা কেমন করে হল? আমি তো একজন বিদেশিনী।” জবাবে বোয়স বললেন, “তোমার স্বামীর মৃত্যুর পর তুমি তোমার শাশুড়ীর জন্য যা করেছ তা সবই আমি শুনেছি, আর এ-ও শুনেছি যে, তোমার মা-বাবা এবং জন্মস্থান ছেড়ে তোমার অজানা একটা জাতির মধ্যে তুমি বাস করতে এসেছ। এইজন্য মাবুদ যেন তোমাকে দোয়া করেন। বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌, যাঁর ডানার নীচে তুমি আশ্রয় নিতে এসেছ, তিনি যেন তোমাকে তোমার পাওনা পুরোপুরিই দেন।” তখন রূত বলল, “হে আমার প্রভু, আপনি যেন আমাকে দয়ার চোখে দেখেন। আপনার এই বাঁদীর কাছে উৎসাহের কথা বলে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, যদিও আপনার এই সব কাজের মেয়েদের কারও সংগে দাঁড়াবার যোগ্যতাও আমার নেই।” খাবার সময় হলে বোয়স তাকে বললেন, “তুমি এখানে এসে এখান থেকে রুটি নিয়ে সিরকায় ডুবিয়ে খাও।” যারা ফসল কাটছিল রূত তাদের কাছে গিয়ে বসলে পর বোয়স হাত বাড়িয়ে তাকে কিছু ভাজা শস্য দিলেন। সে পেট ভরে খাবার পরেও কিছু বাকী রইল। তারপর সে যখন শীষ কুড়াতে উঠল তখন বোয়স তাঁর লোকদের বলে দিলেন, “যদি সে আঁটিগুলোর মাঝখান থেকেও কুড়িয়ে নেয় তবুও তাকে তোমরা গালাগালি দেবে না। তোমরা বরং ফসল কাটবার সময় কিছু কিছু শীষ টেনে বের করে রেখে যেয়ো আর তাকে তা কুড়াতে দিয়ো, ধমক দিয়ো না।” রূত সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই ক্ষেতে শীষ কুড়াল। যে যব সে কুড়িয়েছিল তা ঝেড়ে মাপলে পর তার ওজন হল প্রায় আঠারো কেজি। সে সেই যব নিয়ে গ্রামে ফিরে গেল। সে যে পরিমাণ শীষ কুড়িয়েছিল তার শাশুড়ী তা দেখলেন। পেট ভরে খাবার পর বাকী যে খাবার সে রেখে দিয়েছিল তা বের করে তার শাশুড়ীকে দিল। তার শাশুড়ী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আজ কোথায় কুড়িয়েছ, কোথায় কাজ করেছ? যিনি তোমার প্রতি নজর রেখেছেন আল্লাহ্‌ তাঁকে দোয়া করুন।” তখন রূত কার জমিতে কাজ করেছে তা তার শাশুড়ীকে জানাল। সে বলল, “আমি যাঁর ক্ষেতে কাজ করেছি তাঁর নাম বোয়স।” এই কথা শুনে নয়মী তার ছেলের স্ত্রীকে বলল, “মাবুদ, যিনি জীবিত বা মৃত কারও প্রতি বেঈমানী করেন না তিনি তাঁকে দোয়া করুন।” সে আরও বলল, “ঐ লোকটি আমাদের নিকট আত্মীয়। যে আত্মীয়দের উপর আমার স্বামীর সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে নেবার ও রক্ষা করবার দায়িত্ব রয়েছে উনি তাঁদের মধ্যে একজন।” মোয়াবীয় রূত বলল, “তিনি আমাকে আরও বলেছেন যে, তাঁর সমস্ত ফসল কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন তাঁর লোকদের সংগে সংগেই থাকি।” তখন নয়মী তার ছেলের স্ত্রীকে বলল, “মা, অন্য কোন ক্ষেতে যেন তোমাকে কেউ জ্বালাতন করতে না পারে সেইজন্য তাঁর কাজের মেয়েদের সংগে সংগে থাকাই তোমার পক্ষে ভাল।” কাজেই যতদিন না যব আর গম কাটা শেষ হল ততদিন রূত বোয়সের কাজের মেয়েদের সংগে সংগে থেকে শীষ কুড়াবার কাজ করল। সে তার শাশুড়ীর সংগেই বাস করত। কিছুদিন পরে নয়মী রূতকে বলল, “মা, তোমার ভালোর জন্য আমাকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে যেন তুমি সংসারী হতে পার। যাঁর কাজের মেয়েদের সংগে তুমি এতদিন কাজ করেছ সেই বোয়স আমাদের আত্মীয়। আজ রাতে তিনি তাঁর খামারে যব ঝাড়বেন। তুমি গোসল করে খোশবু তেল মাখ ও ভাল কাপড়-চোপড় পরে সেই খামারে যাও। তবে তাঁর খাওয়া-দাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন তোমাকে দেখতে না পান। তিনি যখন শুতে যাবেন তখন তুমি তাঁর শোবার জায়গাটা দেখে রাখবে। পরে সেখানে গিয়ে তুমি তাঁর পায়ের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে সেখানে শুয়ে পড়বে। কি করতে হবে তখন তিনি তা তোমাকে বলে দেবেন।” জবাবে রূত বলল, “আপনি যা বললেন, তা সবই আমি করব।” পরে সে খামারে গিয়ে তার শাশুড়ী তাকে যা করতে বলেছিল তা সবই করল। খাওয়া-দাওয়ার পরে বোয়সের মনটা যখন খুশী হয়ে উঠল তখন তিনি গাদা-করা শস্যের এক পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। রূত চুপি চুপি গিয়ে তাঁর পায়ের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে সেখানে শুয়ে পড়ল। মাঝ রাতে বোয়স হঠাৎ চম্‌কে উঠে পাশ ফিরলেন। তিনি দেখলেন একজন স্ত্রীলোক তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কে তুমি?” রূত বলল, “আমি আপনার বাঁদী রূত। আপনি আপনার চাদরের নীচে আপনার এই বাঁদীকে আশ্রয় দিন, কারণ আপনি আমার দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয়দের মধ্যে একজন।” জবাবে বোয়স বললেন, “মাবুদ তোমাকে দোয়া করুন। এই পর্যন্ত তুমি যে বিশ্বস্ততা দেখিয়েছ তার চেয়ে এইবার আরও বেশী বিশ্বস্ততা দেখালে, কারণ ধনী-গরীব কোন যুবকের পিছনেই তুমি যাও নি। তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি যা চাইবে আমি তোমার জন্য তা-ই করব। আমার গ্রামের সকলেই জানে যে, তুমি একজন ভাল মেয়ে। আমি তোমার দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয়দের একজন বটে, কিন্তু আমার চেয়েও নিকট আত্মীয় আর একজন আছেন। তুমি আজ রাতটা এখানেই থাক। আগামীকাল সকালে যদি তিনি তোমার দায়িত্ব বহন করতে রাজী হন তবে ভালই; তিনিই তা করুন। কিন্তু যদি তিনি রাজী না হন তবে আমি আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি যে, আমি তোমার দায়িত্ব বহন করব। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই শুয়ে থাক।” কাজেই রূত শেষ রাত পর্যন্ত তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে রইল। বোয়স বলেছিলেন, একজন স্ত্রীলোক যে খামারে এসেছিল তা যেন কেউ জানতে না পারে। সেইজন্য একে অন্যকে চিনবার মত আলো হওয়ার আগেই রূত উঠে পড়ল। সে আরও বলল, “তিনি আমাকে এই ছয় খুঁচি যব দিলেন আর বললেন, ‘খালি হাতে তোমার শাশুড়ীর কাছে ফিরে যেয়ো না।’ ” এই কথা শুনে নয়মী বলল, “মা, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি হয় তা দেখ। আজই এর একটা ব্যবস্থা না করে তিনি থামবেন না।” বোয়স গ্রামের দরজায় গিয়ে বসলেন। দায়িত্ব বহনকারী যে আত্মীয়ের কথা বোয়স বলেছিলেন তিনি তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। বোয়স তাঁকে ডেকে বললেন, “ভাই, এখানে এসে বসুন।” লোকটি তখন সেখানে গিয়ে বসলেন। বোয়স তারপর গ্রামের দশজন বৃদ্ধ নেতাকে ডেকে বললেন, “আপনারা এখানে বসুন।” তখন তাঁরাও বসলেন। বোয়স সেই আত্মীয়কে বললেন, “নয়মী মোয়াব দেশ থেকে ফিরে এসে আমাদের ভাই ইলীমেলকের জমিটুকু বিক্রি করতে চাইছেন। তাই আমি ভাবলাম ব্যাপারটা আপনাকে জানানো দরকার। এখানে উপস্থিত লোকদের সামনে এবং আমার জাতির বৃদ্ধ নেতাদের সামনে আপনিই সেটা কিনুন। আপনি যদি জমিটা ছাড়িয়ে নিতে চান তবে নিন। কিন্তু আপনি যদি তা না চান তবে আমাকে বলুন, কারণ তা ছাড়িয়ে নেবার অধিকার প্রথমে আপনার, আর আপনার পরে আমার।” তখন সেই আত্মীয় বললেন, “ঠিক আছে, আমিই ওটা ছাড়িয়ে নেব।” এতে বোয়স বললেন, “আপনি যেদিন সেই জমিটা নয়মীর কাছ থেকে কিনবেন সেই দিন মৃত লোকটির সম্পত্তির সংগে তাঁর নাম রক্ষা করবার জন্য মোয়াবীয় বিধবা রূতকেও আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।” এই কথা শুনে সেই আত্মীয় বললেন, “আমি তা করতে পারব না, কারণ আমার নিজের সম্পত্তি নিয়ে তখন আমি বিপদে পড়ে যাব। আমি যখন তা ছাড়িয়ে নিতে পারছি না তখন আপনিই নিন।” ছাড়িয়ে নেওয়া এবং সম্পত্তি বেচা-কেনার সমস্ত ব্যাপারটা আইনগত করবার জন্য আগেকার দিনে বনি-ইসরাইলদের দেশের নিয়ম ছিল এই: একজন তার জুতা খুলে অন্যকে দিত, আর এইভাবে তাদের কাজ-কারবার আইনের আওতায় আনা হত। কাজেই সেই আত্মীয় বোয়সকে বললেন, “আপনিই ওটা কিনে নিন।” এই বলে তিনি তাঁর জুতা খুললেন। তখন বোয়স বৃদ্ধ নেতাদের এবং সেখানকার সবাইকে বললেন, “আমি যে নয়মীর কাছ থেকে ইলীমেলক, কিলিয়োন ও মহলোনের সমস্ত সম্পত্তি কিনে নিলাম আজ আপনারা তার সাক্ষী হলেন। মৃত লোকের সম্পত্তি ও নাম যাতে রক্ষা পায় সেইজন্য আমি মহলোনের বিধবা স্ত্রী মোয়াবীয় রূতকেও স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করলাম। এতে বংশের মধ্য থেকে এবং গ্রামের মধ্য থেকে মৃত লোকটির নাম মুছে যাবে না। আপনারা আজ এই সমস্ত বিষয়ের সাক্ষী হলেন।” তখন যাঁরা গ্রামের দরজায় বসে ছিলেন তাঁরা আর সেই বৃদ্ধ নেতারা সবাই বললেন, “জ্বী, আমরা সাক্ষী হলাম। যে স্ত্রীলোকটি আপনার ঘরে যাচ্ছে মাবুদ করুন যেন সে রাহেলা ও লেয়ার মত হয়, যাঁরা ইসরাইল জাতি গড়ে তুলেছিলেন। ইফ্রাথায় আপনি ধন লাভ করুন এবং বেথেলহেমে সবাই আপনার সুনাম করুক। এই স্ত্রীলোকের গর্ভে মাবুদ আপনাকে যে সন্তান দেবেন তার মধ্য দিয়ে আপনার বংশ যেন তামরের গর্ভের এহুদার ছেলে পেরসের বংশের মত হয়।” এর পর বোয়স রূতকে বিয়ে করলেন এবং রূত তাঁর স্ত্রী হল। বোয়স তার কাছে গেলে পর মাবুদ রূতের গর্ভে সন্তান দিলেন এবং তার একটি ছেলে হল। এতে অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা নয়মীকে বলল, “সমস্ত প্রশংসা মাবুদের, কারণ তিনি তোমাকে আজ একজন দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয় দিলেন। বনি-ইসরাইলদের দেশের মধ্যে সবাই তার সুনাম করুক। ছেলেটি যেন তোমাকে সতেজ করে তোলে এবং তোমার বুড়ো বয়সে তোমার দেখাশোনা করে, কারণ তোমার ছেলের স্ত্রী, যে তোমাকে ভালবাসে এবং যে তোমার কাছে সাত ছেলের চেয়েও বেশী, তারই গর্ভে ছেলেটির জন্ম হয়েছে।” তখন নয়মী ছেলেটিকে কোলে নিল এবং তার দেখাশোনা করতে লাগল। প্রতিবেশী স্ত্রীলোকেরা বলল, “নয়মীর একটা ছেলে হয়েছে।” তারা ছেলেটির নাম রাখল ওবেদ। ওবেদ ছিলেন ইয়াসির পিতা আর ইয়াসি ছিলেন দাউদের পিতা। এই হল পেরসের বংশের তালিকা: পেরসের ছেলে হিষ্রোণ; হিষ্রোণের ছেলে রাম; রামের ছেলে অম্মীনাদব; অম্মীনাদবের ছেলে নহশোন; নহশোনের ছেলে সল্‌মোন; সল্‌মোনের ছেলে বোয়স; বোয়সের ছেলে ওবেদ; ওবেদের ছেলে ইয়াসির এবং ইয়াসিরের ছেলে দাউদ। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় রামাথয়িম-সোফীম শহরে ইল্‌কানা নামে একজন লোক আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকদের সংগে বাস করতেন। তাঁর পিতার নাম ছিল যিরোহম। যিরোহম ছিলেন ইলীহূর ছেলে, ইলীহূ ছিলেন তোহের ছেলে এবং তোহ ছিলেন সুফের ছেলে। ইল্‌কানার দুইজন স্ত্রী ছিল; একজনের নাম হান্না আর অন্যজনের নাম পনিন্না। পনিন্নার ছেলেমেয়ে হয়েছিল কিন্তু হান্নার কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। ইল্‌কানা প্রত্যেক বছর তাঁর শহর থেকে শীলোতে যেতেন। তিনি সেখানে গিয়ে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের এবাদত ও তাঁর উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিতেন। তখন সেখানে ইমাম আলীর দুই ছেলে মাবুদের ইমাম ছিল। তাদের নাম ছিল হফ্‌নি ও পীনহস। পশু-কোরবানীর দিনে ইল্‌কানা তাঁর স্ত্রী পনিন্না ও তাঁর সব ছেলেমেয়েদের তাঁর কোরবানী করা গোশ্‌তের একটা করে ভাগ দিতেন। কিন্তু হান্নাকে দিতেন দুই ভাগ, কারণ তিনি হান্নাকে ভালবাসতেন। মাবুদ কিন্তু হান্নাকে বন্ধ্যা করে রেখেছিলেন। মাবুদ তা করেছিলেন বলে তাঁর সতীন তাঁকে খোঁচা মেরে কথা বলে তাঁর মন অস্থির করে তুলত। বছরের পর বছর এইভাবেই চলছিল। হান্না যখনই মাবুদের ঘরে যেতেন পনিন্না তাঁকে ঐভাবে খোঁচা মেরে কথা বলত। তাই তিনি কান্নাকাটি করতেন আর কিছুই খেতেন না। এ দেখে তাঁর স্বামী ইল্‌কানা তাঁকে বলতেন, “হান্না, তুমি কেন কাঁদছ? কেন কিছু খা"ছ না? কেন তোমার এত দুঃখ? আমি কি তোমার কাছে দশটা ছেলের চেয়েও বেশী নই?” এক সময় শীলোতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হান্না উঠে এবাদত-খানায় গেলেন। ইমাম আলী তখন মাবুদের সেই ঘরের দরজার কাছে একটা আসনে বসে ছিলেন। মনের কষ্টে হান্না মাবুদের কাছে খুব কেঁদে কেঁদে মুনাজাত করতে লাগলেন। তিনি মাবুদের কাছে মানত করে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি যদি তোমার এই বাঁদীর মনের কষ্টের দিকে চেয়ে দেখ এবং আমার প্রতি মনোযোগ দাও আর আমাকে ভুলে না গিয়ে যদি তোমার এই বাঁদীকে একটা ছেলে দাও তবে সারা জীবনের জন্য আমি তাকে তোমার উদ্দেশে দান করব। তার মাথায় কখনো ক্ষুর লাগানো হবে না।” হান্না অনেকক্ষণ ধরে মাবুদের কাছে যখন মুনাজাত করছিলেন তখন আলী তাঁর মুখের দিকে লক্ষ্য করছিলেন। হান্না মনে মনে মুনাজাত করছিলেন বলে তাঁর ঠোঁট নড়ছিল কিন্তু গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না। সেইজন্য আলী ভাবলেন স্ত্রীলোকটি মাতাল হয়েছে। তিনি তাঁকে বললেন, “তুমি মদ খেয়ে আর কতক্ষণ নিজেকে মাতাল করে রাখবে? মদ আর খেয়ো না।” জবাবে হান্না তাঁকে বললেন, “হে হুজুর, তা নয়। আমি বড় দুঃখিনী; আমি আংগুর-রসও খাই নি, মদও খাই নি। আমি মাবুদের সামনে আমার অন্তর ঢেলে দিচ্ছিলাম। আপনার এই বাঁদীকে আপনি একজন বাজে স্ত্রীলোক মনে করবেন না। গভীর দুশ্চিন্তা ও মনের কষ্টে আমি এতক্ষণ মুনাজাত করছিলাম।” তখন আলী বললেন, “তোমার মন শান্ত হোক। বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র কাছে তুমি যা চেয়েছ তা যেন তিনি তোমাকে দেন।” হান্না বললেন, “এই বাঁদীর উপর আপনার দয়া থাকুক।” এই বলে তিনি চলে গেলেন এবং খাওয়া-দাওয়া করলেন। তাঁর মুখে আর দুঃখের ছায়া রইল না। পরের দিন খুব ভোরে তাঁরা ঘুম থেকে উঠে এবাদত-খানায় গিয়ে মাবুদের এবাদত করলেন। তারপর তাঁরা রামায় তাঁদের নিজেদের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। পরে ইল্‌কানা তাঁর স্ত্রী হান্নার সংগে মিলিত হলেন আর মাবুদও হান্নার দিকে মনোযোগ দিলেন। তাতে হান্না গর্ভবতী হলেন এবং সময় হলে তাঁর একটি ছেলে হল। “আমি মাবুদের কাছ থেকে তাকে চেয়ে নিয়েছি,” এই বলে হান্না ছেলেটির নাম রাখলেন শামুয়েল। পরে ইল্‌কানা প্রতি বছরের মত আবার তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী ও মানত পূরণ করতে গেলেন, কিন্তু হান্না গেলেন না। তিনি তাঁর স্বামীকে বললেন, “ছেলেটিকে বুকের দুধ ছাড়ানোর পর আমি তাকে নিয়ে মাবুদের সামনে উপস্থিত হব যাতে সে সারা জীবন সেখানেই থাকতে পারে।” তাঁর স্বামী ইল্‌কানা তাঁকে বললেন, “তোমার যা ভাল মনে হয় তা-ই কর। ছেলেটিকে দুধ না ছাড়ানো পর্যন্ত তুমি এখানে থাক। মাবুদ যেন তাঁর ওয়াদা পূরণ করেন।” কাজেই হান্না বাড়ীতেই রয়ে গেলেন এবং ছেলেটিকে দুধ না ছাড়ানো পর্যন্ত তার দেখাশোনা করতে থাকলেন। ছেলেটিকে দুধ ছাড়ানোর পর হান্না তিনটা ষাঁড়, আঠারো কেজি ময়দা, চামড়ার থলিতে করে এক থলি আংগুর-রস এবং ছেলেটিকে সংগে নিয়ে শীলোতে মাবুদের ঘরে গেলেন। ছেলেটি তখনও ছোট ছিল। তাঁরা সেখানে একটা ষাঁড় জবাই করে কোরবানী দিলেন এবং ছেলেটিকে আলীর কাছে নিয়ে গেলেন। হান্না বললেন, “হে হুজুর, আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি কসম খেয়ে বলছি, আমিই সেই স্ত্রীলোক, যে এখানে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে মাবুদের কাছে মুনাজাত করেছিল। আমি এই ছেলেটিকে চেয়েই মুনাজাত করেছিলাম, আর মাবুদের কাছে যা চেয়েছিলাম তা তিনি আমাকে দিয়েছেন। সেইজন্য ছেলেটিকে আমিও মাবুদকে দিলাম। সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন মাবুদেরই থাকবে।” পরে তাঁরা সেখানে সেজদা করে মাবুদের এবাদত করলেন। তারপর হান্না মুনাজাত করে বললেন, “মাবুদকে নিয়েই আমি আনন্দ করি; মাবুদই আমাকে জয় দান করেছেন। আমার শত্রুদের সামনেই আমি মুখ খুলে আনন্দ-কাওয়ালী গাচ্ছি; তুমি আমাকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করেছ বলে আমি আনন্দিতা। মাবুদের মত পবিত্র আর কেউ নেই, কারণ তুমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই; আমাদের আল্লাহ্‌র মত আশ্রয়-পাহাড় আর নেই। তোমরা আর গর্বের কথা বোলো না, অহংকারের কথা তোমাদের মুখ থেকে বের না হোক; কারণ আল্লাহ্‌ এমন মাবুদ যিনি সব কিছু জানেন, আর তিনিই কাজের ওজন করেন। শক্তিমানদের ধনুক ভেংগে গেছে, কিন্তু যারা পড়ে গিয়েছিল তারা শক্তিশালী হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। যাদের পেট ভরা ছিল তারা খাবারের জন্য এখন অন্যের কাজ করছে; কিন্তু যাদের পেটে খিদে ছিল তাদের খিদে মিটে গেছে। যে বন্ধ্যা ছিল সে সাত সন্তানের মা হয়েছে, কিন্তু যার অনেক সন্তান সে এখন দুর্বল, সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। মাবুদই মারেন আর মাবুদই বাঁচান; তিনিই কবরে নামান আর তিনিই সেখান থেকে তোলেন। মাবুদই মানুষকে ধনী বা গরীব করেন; হ্যাঁ, তিনিই নীচু করেন আর তিনিই উঁচু করেন। তিনি গরীবকে ধুলার মধ্য থেকে তোলেন, আর অভাবীকে তোলেন ছাইয়ের গাদা থেকে। উঁচু পদের লোকদের সংগে তিনি তাদের বসতে দেন, আর দেন সম্মানের সিংহাসন; কারণ দুনিয়ার থামগুলো মাবুদেরই, তিনি সেগুলোর উপরে জমীনকে স্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর ভক্তদের উচোট খাওয়া থেকে রক্ষা করেন, কিন্তু দুষ্ট লোকেরা অন্ধকারে ধ্বংস হয়ে যায়; কারণ নিজের শক্তিতে কোন মানুষ জয়ী হয় না। মাবুদের শত্রুরা চুরমার হয়ে যাবে, তিনি আসমানে তাদের বিরুদ্ধে গর্জন করবেন; দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত তিনি লোকদের বিচার করবেন। তিনি তাঁর বাদশাহ্‌কে শক্তি দেবেন আর তাঁর অভিষেক-করা বান্দাকে জয়ী করবেন।” এর পর ইল্‌কানা রামায় তাঁর নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন, কিন্তু শামুয়েল ইমাম আলীর অধীনে থেকে মাবুদের এবাদত-কাজ করতে লাগলেন। আলীর ছেলেরা ছিল ভীষণ দুষ্ট। মাবুদের প্রতি তাদের কোন মনোযোগ ছিল না। ইমাম হিসাবে লোকদের সংগে তাদের ব্যবহার ছিল এই রকম: কোন লোকের পশু-কোরবানীর গোশ্‌ত যখন সিদ্ধ হতে থাকত তখন ইমামের চাকর তিন কাঁটাযুক্ত একটা বড় চামচ নিয়ে আসত। সেটা দিয়ে সে হাঁড়িতে কিংবা গামলাতে কিংবা কড়াইতে কিংবা পাত্রে খোঁচা মারত এবং সেই কাঁটাতে যে গোশ্‌ত উঠে আসত তা সবই ইমাম নিজের জন্য নিয়ে যেত। বনি-ইসরাইলদের যত লোক শীলোতে আসত তাদের প্রতি তারা এই রকম ব্যবহারই করত। তা ছাড়া, চর্বি আগুনে দেবার আগেই ইমামের চাকর এসে যে লোকটি পশু-কোরবানী দিচ্ছে তাকে বলত, “আগুনে ঝল্‌সাবার জন্য ইমামকে গোশ্‌ত দাও। তিনি তোমার কাছ থেকে সিদ্ধ করা গোশ্‌ত নেবেন না, কাঁচা গোশ্‌তই নেবেন।” সেই লোকটি যদি বলত, “প্রথমে চর্বি পোড়াতে হবে, তারপর তুমি তোমার ইচ্ছামত গোশ্‌ত নিয়ে যেয়ো,” তবে সে বলত, “না, এখনই তা দিতে হবে; না দিলে আমি জোর করে নিয়ে যাব।” মাবুদের চোখে সেই যুবক ইমামদের গুনাহ্‌ ভীষণ হয়ে দেখা দিল, কারণ তারা মাবুদের উদ্দেশে এই সব কোরবানীর জিনিসগুলো তুচ্ছ করত। ছোট ছেলে শামুয়েল কিন্তু মসীনা সুতার এফোদ পরে মাবুদের এবাদত-কাজ করতে থাকলেন। প্রত্যেকবার স্বামীর সংগে বাৎসরিক পশু-কোরবানী দিতে যাওয়ার সময় শামুয়েলের মা একটা ছোট কোর্তা তৈরী করে তাঁর জন্য নিয়ে যেতেন। তখন ইল্‌কানা ও তাঁর স্ত্রীকে দোয়া করে আলী বলতেন, “এই স্ত্রীলোকটি মাবুদের কাছে যে সন্তানকে দিয়েছে তার বদলে মাবুদ এই স্ত্রীর গর্ভে তোমাকে আরও সন্তান দিন।” এর পরে তাঁরা তাঁদের বাড়ী চলে যেতেন। মাবুদ সত্যিই হান্নাকে রহমত দান করলেন। তাতে হান্না গর্ভবতী হলেন এবং তাঁর মোট তিন ছেলে ও দুই মেয়ে হল। এদিকে ছোট শামুয়েল মাবুদের কাছে কাছে থেকে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। আলী তখন খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। বনি-ইসরাইলদের প্রতি তাঁর ছেলেদের সমস্ত ব্যবহারের কথা এবং যে সব স্ত্রীলোকেরা এবাদত-কাজের জন্য মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে আসত তাদের সংগে তাদের জেনার কথা তাঁর কানে গেল। তিনি তাদের বললেন, “তোমরা এ কি করছ? তোমাদের খারাপ কাজের কথা আমি এই সব লোকদের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি। না, না, আমার ছেলেরা, মাবুদের বান্দাদের যে সব কথা বলাবলি করতে শুনছি তা ভাল নয়। মানুষ যদি মানুষের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করে তবে আল্লাহ্‌ তার মীমাংসা করতে পারেন; কিন্তু মানুষ যদি মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করে তবে তার জন্য কে মিনতি করতে পারবে?” কিন্তু তারা তাদের বাবার কথায় কান দিল না, কারণ মাবুদ তাদের হত্যা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ছোট ছেলে শামুয়েল বড় হয়ে উঠতে লাগলেন এবং মাবুদ ও মানুষের কাছে ভালবাসা পেতে থাকলেন। একদিন আল্লাহ্‌র একজন লোক আলীর কাছে এসে বললেন, “মাবুদ বলছেন, ‘তোমার পূর্বপুরুষেরা যখন মিসরে ফেরাউনের অধীন ছিল তখন তাদের কাছে কি আমি নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করি নি? বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্য থেকে কি আমি লেবীয়দের বেছে নেই নি, যাতে তারা আমার ইমাম হয়ে আমার কোরবানগাহের কাছে গিয়ে ধূপ জ্বালাতে পারে এবং এফোদ পরে আমার সামনে আসতে পারে? বনি-ইসরাইলদের সমস্ত পোড়ানো-কোরবানীর ভাগ কি আমি তাদের ও তাদের বংশকে দেই নি? তাহলে আমার ঘরে যে সব কোরবানী দিতে আমি হুকুম দিয়েছি তোমরা কেন সেই সব পশু-কোরবানী এবং অন্যান্য কোরবানীগুলোর অসম্মান করছ? আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের কোরবানীগুলোর সবচেয়ে ভাল অংশটুকু দিয়ে নিজেদের মোটাসোটা করে কেন তুমি আমার চেয়ে তোমার ছেলেদের বড় করে দেখছ?’ “সেইজন্য বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আমি অবশ্য বলেছিলাম যে, তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের বংশের লোকেরা চিরকাল আমার এবাদত-কাজ করবে’; কিন্তু এখন মাবুদ বলছেন, ‘তা আর চলবে না। যারা আমাকে সম্মান করবে আমি তাদের সম্মান করব এবং যারা আমাকে তুচ্ছ করবে তাদের তুচ্ছ করা হবে। দেখ, সময় আসছে যখন আমি তোমার বংশের ও তোমার পূর্বপুরুষদের বংশের লোকদের শক্তি এমনভাবে শেষ করে দেব যে, তোমার বংশে একটি লোকও বুড়ো বয়স পর্যন্ত বাঁচবে না। তুমি আমার ঘরের দুর্দশা দেখতে পাবে। বনি-ইসরাইলদের যত উন্নতিই আমি করি না কেন তোমার বংশের কেউ কখনও বুড়ো বয়স পর্যন্ত বাঁচবে না। তবুও তোমার বংশের সবাইকে আমি আমার কোরবানগাহ্‌ থেকে ছেঁটে ফেলব না যাতে তাদের দরুন চোখের পানিতে তোমার দেখবার শক্তি নষ্ট হয় এবং তুমি অন্তরে যন্ত্রণা পাও; আর তোমার বংশের সমস্ত লোক যুবা বয়সেই মারা যাবে। “ ‘তোমার দুই ছেলে হফ্‌নি ও পীনহস একই দিনে মারা যাবে, আর সেটাই হবে তোমার জন্য একটা চিহ্ন। কিন্তু আমি আমার জন্য একজন বিশ্বস্ত ইমাম দাঁড় করাব, যে আমার মন বুঝে আমার ইচ্ছামত কাজ করবে। আমি তার বংশকে স্থায়ী করব এবং সে সব সময় আমার অভিষেক-করা বান্দার সেবা করবে। তোমার বংশের যারা বেঁচে থাকবে তারা এক টুকরা রূপা ও একটা রুটির জন্য তার কাছে এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করবে এবং একটি ইমাম-পদ পাবার জন্য অনুরোধ করবে যাতে সে কিছু খেতে পায়।’ ” ছোট ছেলে শামুয়েল আলীর অধীনে থেকে মাবুদের এবাদত-কাজ করতে লাগলেন। সেই সময় মাবুদের কালাম খুব কমই নাজেল হত এবং তাঁর দর্শনও যখন-তখন পাওয়া যেত না। সেই সময় আলীর চোখ এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি প্রায় দেখতেই পেতেন না। একদিন রাতের বেলায় আলী তাঁর নিজের জায়গায় শুয়ে ছিলেন। আল্লাহ্‌র উদ্দেশে যে বাতি জ্বালানো থাকত তা তখনও নিভে যায় নি। শামুয়েল মাবুদের ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিলেন। সেই ঘরে আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকটি ছিল। এমন সময় মাবুদ শামুয়েলকে ডাকলেন। শামুয়েল জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” এই বলে তিনি দৌড়ে আলীর কাছে গিয়ে বললেন, “এই যে আমি, আপনি আমাকে ডেকেছেন?” আলী বললেন, “না, আমি তো তোমাকে ডাকি নি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।” শামুয়েল তখন গিয়ে শুয়ে পড়লেন। মাবুদ আবার শামুয়েলকে ডাকলেন আর শামুয়েল উঠে আলীর কাছে গিয়ে বললেন, “এই তো আমি; আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?” আলী বললেন, “না বাবা, আমি তোমাকে ডাকি নি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।” তখনও শামুয়েল মাবুদকে চিনতেন না; মাবুদ তখনও তাঁর কাছে কথা বলেন নি। মাবুদ তৃতীয়বার শামুয়েলকে ডাকলেন আর শামুয়েল উঠে আলীর কাছে গিয়ে বললেন, “এই যে আমি, আপনি তো আমাকে ডেকেছেন।” তখন আলী বুঝতে পারলেন মাবুদই ছেলেটিকে ডাকছিলেন। সেইজন্য আলী শামুয়েলকে বললেন, “তুমি গিয়ে শুয়ে পড়। এবার যদি তিনি তোমাকে ডাকেন তবে বলবে, ‘বলুন মাবুদ, আপনার গোলাম শুনছে।’ ” তখন শামুয়েল গিয়ে তাঁর নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লেন। তারপর মাবুদ এসে সেখানে দাঁড়ালেন এবং অন্য বারের মত ডাকলেন, “শামুয়েল, শামুয়েল।” তখন শামুয়েল বললেন, “বলুন, আপনার গোলাম শুনছে।” মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “দেখ, আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে এমন কিছু করতে যাচ্ছি যার কথা শুনে সবাই শিউরে উঠবে। আমি আলীর বংশের বিষয়ে যা কিছু বলেছি তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবই আলীর বিরুদ্ধে পূর্ণ করব। আমি তাকে বলেছি, অন্যায়ের দরুন তার বংশকে আমি চিরকালের জন্য শাস্তি দিতে যাচ্ছি। সে জানত যে, তার ছেলেরা নিজেদের মাথায় বদদোয়া ডেকে আনছে, অথচ সে তাদের সংশোধনের চেষ্টা করে নি। সেইজন্য আলীর বংশের বিষয় আমি কসম খেয়ে বলছি যে, পশু-কোরবানী কিংবা অন্য কোন কোরবানীর দ্বারা তার বংশের অন্যায় কখনই ঢাকা দেওয়া যাবে না।” এর পর শামুয়েল সকাল পর্যন্ত শুয়ে রইলেন, তারপর উঠে মাবুদের ঘরের দরজাগুলো খুললেন; কিন্তু এই দর্শনের কথা আলীর কাছে বলতে তাঁর সাহস হল না। তখন আলী তাঁকে বললেন, “বাবা শামুয়েল।” শামুয়েল জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” আলী জিজ্ঞাসা করলেন, “আল্লাহ্‌ তোমাকে কি বলেছেন? আমার কাছ থেকে তুমি তা লুকায়ো না। তিনি যা বলেছেন তার কিছু যদি তুমি আমার কাছ থেকে লুকাও তবে তিনি যেন তোমাকে ভীষণ শাস্তি দেন।” তখন শামুয়েল আলীকে সব কথা খুলে বললেন, কিছুই লুকালেন না। তা শুনে আলী বললেন, “তিনি মাবুদ; তাঁর কাছে যা ভাল মনে হয় তিনি তা-ই করুন।” এইভাবে শামুয়েল বেড়ে উঠতে লাগলেন আর মাবুদ তাঁর সংগে রইলেন এবং নবী হিসাবে বলা তাঁর কোন কথাই মাবুদ বিফল হতে দিতেন না। তাতে দান এলাকা থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত সমস্ত বনি-ইসরাইলরা জানতে পারল যে, শামুয়েল মাবুদের নবী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন। তখন থেকে মাবুদ শীলোতে আবার দর্শন দিতে লাগলেন, কারণ শীলোতে তিনি তাঁর কালামের মধ্য দিয়ে শামুয়েলের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতেন; আর শামুয়েল যা বলতেন তা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে পৌঁছে যেত। একবার বনি-ইসরাইলরা ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বের হল। তারা এবন্‌-এষরে ছাউনি ফেলল আর ফিলিস্তিনীরা ছাউনি ফেলল অফেকে। ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য সৈন্য সাজাল। যুদ্ধটা যখন বেশ ছড়িয়ে পড়ল তখন বনি-ইসরাইলরা ফিলিস্তিনীদের কাছে হেরে গেল। যুদ্ধের মাঠে ফিলিস্তিনীরা প্রায় চার হাজার ইসরাইলীয় সৈন্য হত্যা করল। ইসরাইলীয় সৈন্যেরা তাদের ছাউনিতে ফিরে গেলে পর তাদের বৃদ্ধ নেতারা বললেন, “ফিলিস্তিনীদের কাছে কেন মাবুদ আজ আমাদের পরাজিত করলেন? চল, আমরা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি শীলো থেকে নিয়ে আসি যাতে মাবুদ আমাদের সংগে থেকে শত্রুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন।” কাজেই তারা শীলোতে লোক পাঠিয়ে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, যিনি দুই কারুবীর মাঝখানে থাকেন, তাঁর সাক্ষ্য-সিন্দুকটি আনিয়ে নিল। আল্লাহ্‌র সেই সাক্ষ্য-সিন্দুকের সংগে ছিল আলীর দুই ছেলে, হফ্‌নি ও পীনহস। মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি ছাউনিতে আনা হলে পর বনি-ইসরাইলরা সবাই এমন জোরে চিৎকার করে উঠল যে, দেশের সব জায়গায় সাড়া পড়ে গেল। ফিলিস্তিনীরা এই আওয়াজ শুনে জিজ্ঞাসা করল, “ইবরানীদের ছাউনিতে এ কিসের চিৎকার হচ্ছে?” তারা জানতে পারল যে, মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি বনি-ইসরাইলদের ছাউনিতে এসেছে। এই কথা জানতে পেরে তারা ভয় পেয়ে বলল, “আল্লাহ্‌ ওদের ছাউনিতে এসেছেন।” তারা আরও বলল, “সর্বনাশ! এর আগে তো কখনও এমন হয় নি। হায়, হায়, এই শক্তিশালী দেবতাদের হাত থেকে কে আমাদের রক্ষা করবে? মরুভূমিতে নানা রকমের মহামারী দিয়ে এই সব দেবতারাই তো মিসরীয়দের মেরে ফেলেছিলেন। হে ফিলিস্তিনীরা, তোমরা সাহসে বুক বাঁধো। তোমরা যে পুরুষ তা দেখিয়ে দাও। তা না হলে ঐ ইবরানীরা যেমন তোমাদের গোলাম হয়েছিল তেমনি তোমরাও তাদের গোলাম হয়ে থাকবে। তোমরা যে পুরুষ তা দেখিয়ে দাও এবং যুদ্ধ কর।” তখন ফিলিস্তিনীরা যুদ্ধ করল আর বনি-ইসরাইলরা হেরে গিয়ে নিজের নিজের বাড়ীতে পালিয়ে গেল। বনি-ইসরাইলদের অনেককে হত্যা করা হল; তাদের ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য মারা পড়ল। আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকটি শত্রুরা নিয়ে গেল। আলীর দুই ছেলে হফ্‌নি আর পীনহস মারা পড়ল। সেই দিন বিন্যামীন-গোষ্ঠীর একজন লোক সৈন্যদলের মধ্য থেকে বের হয়ে দৌড়ে শীলোতে গিয়ে উপস্থিত হল। তার কাপড়-চোপড় ছেঁড়া ছিল এবং সে মাথায় মাটি দিয়েছিল। সে যখন শীলোতে পৌঁছাল তখন আলী পথের পাশে তাঁর আসনে বসে ছিলেন। তিনি ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কারণ আল্লাহ্‌র সিন্দুকের জন্য তাঁর বুক কাঁপছিল। লোকটি শহরে ঢুকে যখন সব কথা লোকদের জানাল তখন তাদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। আলী সেই কান্নাকাটি শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই গোলমাল কিসের?” তখন লোকটি তাড়াতাড়ি গিয়ে আলীকে খবর দিল। আলীর বয়স তখন আটানব্বই বছর। তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলে দেখতে পেতেন না। লোকটি আলীকে বলল, “আমি সৈন্যদল থেকে এসেছি, আজই পালিয়ে এসেছি।” আলী জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা, খবর কি?” যে লোকটি সংবাদ এনেছিল সে তখন বলল, “ফিলিস্তিনীদের সামনে থেকে বনি-ইসরাইলরা পালিয়ে গেছে আর অনেক লোক মারা পড়েছে। আপনার দুই ছেলে হফ্‌নি আর পীনহসও মারা গেছে এবং আল্লাহ্‌র সিন্দুক শত্রুরা নিয়ে গেছে।” আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকের কথা শোনামাত্র আলী দরজার পাশে তাঁর আসন থেকে পিছন দিকে পড়ে গেলেন। তাতে তাঁর ঘাড় ভেংগে গিয়ে তিনি মারা গেলেন, কারণ তিনি বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর শরীর ভারী ছিল। তিনি চল্লিশ বছর বনি-ইসরাইলদের শাসন করেছিলেন। আলীর ছেলের স্ত্রী, অর্থাৎ পীনহসের স্ত্রী তখন গর্ভবতী ছিল এবং তার প্রসবের সময়ও ঘনিয়ে এসেছিল। আল্লাহ্‌র সিন্দুক শত্রুদের হাতে গেছে এবং তার শ্বশুর ও স্বামী মারা গেছেন শুনে হঠাৎ তার প্রসব-বেদনা শুরু হল। হাঁটুর উপর বসে সে প্রসব করল। সে তখন মারা যাচ্ছিল বলে যে স্ত্রীলোকেরা তার কাছে ছিল তারা তাকে বলল, “ভয় নেই, তোমার ছেলে হয়েছে।” কিন্তু সে এর কোন জবাবও দিল না এবং কোন কথায় মনোযোগও দিল না। আল্লাহ্‌র সিন্দুক শত্রুদের হাতে যাবার দরুন এবং তার স্বামী ও শ্বশুর মারা যাবার দরুন সে বলল, “ইসরাইলীয়দের গৌরব চলে গেল।” সেইজন্য সে ছেলেটির নাম রাখল ঈখাবোদ। সে বলল, “ইসরাইলীয়দের গৌরব চলে গেছে, কারণ আল্লাহ্‌র সিন্দুক শত্রুদের হাতে গেছে।” ফিলিস্তিনীরা আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি এবন্‌-এষর থেকে অস্‌দোদ শহরে নিয়ে গেল। আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি তারা দাগোন্তদেবতার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে দাগোনের মূর্তির পাশেই রাখল। পরদিন অস্‌দোদের লোকেরা খুব ভোরে উঠে দেখল দাগোন মাবুদের সিন্দুকের সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে আছে। তারা তখন দাগোনের মূর্তিটা তুলে নিয়ে তার জায়গায় রাখল। তার পরের দিনও তারা খুব ভোরে উঠে দেখল দাগোন মাবুদের সিন্দুকের সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে আছে। তার মাথা ও হাত ভেংগে দরজার চৌকাঠের উপর পড়ে আছে, কেবল শরীরের বাকী অংশটুকু আস- আছে। এইজন্য দাগোনের পুরোহিত এবং অন্য যে সব লোক অস্‌দোদের দাগোনের মন্দিরে ঢোকে তারা আজ পর্যন্ত কেউই সেই মন্দিরের দরজার চৌকাঠের উপর পা দেয় না। মাবুদ অস্‌দোদ ও তার আশেপাশের জায়গার লোকদের মলদ্বারের মধ্যে টিউমার-রোগ দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে তাদের মেরে ফেললেন। এই অবস্থা দেখে অস্‌দোদের লোকেরা বলল, “আমরা বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র সিন্দুক আমাদের কাছে আর রাখব না, কারণ তিনি আমাদের ও আমাদের দেবতা দাগোনকে ভীষণভাবে আঘাত করছেন।” কাজেই তারা লোক পাঠিয়ে ফিলিস্তিনীদের সব শাসনকর্তাদের এক জায়গায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করল, “ইসরাইলীয়দের আল্লাহ্‌র সিন্দুকটা নিয়ে আমরা কি করব?” তাঁরা বললেন, “ইসরাইলীয়দের আল্লাহ্‌র সিন্দুকটা গাৎ শহরে নিয়ে যাওয়া হোক।” তাতে অস্‌দোদের লোকেরা বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি গাৎ শহরে নিয়ে গেল। তারা সিন্দুকটি সেখানে নিয়ে গেলে পর মাবুদ সেই শহরের বিরুদ্ধে হাত উঠালেন। তাতে সেখানকার লোকেরা ভীষণ ভয় পেল। তিনি শহরের ছোট-বড় সব লোককে আঘাত করলেন, আর তাতে সকলের সেই টিউমার-রোগ হল। তখন তারা আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি ইক্রোণ শহরে পাঠিয়ে দিল। আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি ইক্রোণে নেওয়া হলে পর ইক্রোণের লোকেরা চিৎকার করে বলল, “আমাদের ও আমাদের লোকদের মেরে ফেলবার জন্যই এরা বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র সিন্দুক আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে।” তারা লোক পাঠিয়ে ফিলিস্তিনীদের সব শাসনকর্তাদের এক জায়গায় ডেকে এনে বলল, “ইসরাইলীয়দের আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি এখান থেকে পাঠিয়ে দিন। ওটা তার নিজের জায়গাতেই ফিরে যাক। তা না হলে ওটা আমাদের ও আমাদের লোকদের মেরে ফেলবে।” আল্লাহ্‌ সেই শহরকে ভীষণভাবে আঘাত করাতে লোকদের মনে মৃত্যুর দারুণ ভয় ঢুকেছিল। যে সব লোক মারা যায় নি তাদেরও সেই টিউমার-রোগ হয়েছিল। তাতে শহরের লোকদের কান্নাকাটির শব্দ যেন আসমান পর্যন্ত পৌঁছাল। মাবুদের সিন্দুকটি সাত মাস পর্যন্ত ফিলিস্তিনীদের দেশে রইল। পরে ফিলিস্তিনী শাসনকর্তারা পুরোহিত ও গণকদের ডেকে বললেন, “আমরা মাবুদের সিন্দুকটি নিয়ে কি করব? আমাদের বল, কিভাবে আমরা এটাকে তার নিজের জায়গায় পাঠিয়ে দেব?” তারা বলল, “আপনারা যদি ইসরাইলের আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি পাঠিয়েই দেন তবে তা খালি পাঠাবেন না। আপনারা অবশ্যই তাঁর কাছে একটা দোষের কোরবানী পাঠিয়ে দেবেন। তাহলে আপনারা সুস্থ হবেন আর জানতে পারবেন যে, কেন তাঁর কঠোর হাত আপনাদের উপর থেকে সরে যাচ্ছে না।” তখন শাসনকর্তারা জিজ্ঞাসা করলেন, “দোষের কোরবানী হিসাবে আমরা তাঁর কাছে কি পাঠিয়ে দেব?” তারা বলল, “ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তাদের সংখ্যা অনুসারে আপনারা পাঁচটা সোনার টিউমার ও পাঁচটা সোনার ইঁদুর পাঠিয়ে দিন, কারণ লোকদের উপরে এবং তাদের শাসনকর্তাদের উপরে একই আঘাত এসেছে। যে টিউমার-রোগ আপনাদের শরীরে দেখা দিয়েছে এবং যে ইঁদুর আপনাদের দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে আপনারা সেগুলোর মূর্তি তৈরী করুন আর বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুন। তাহলে হয়তো তিনি আপনাদের উপর থেকে এবং আপনাদের দেবতাদের ও দেশের উপর থেকে তাঁর কঠোর হাত সরিয়ে নেবেন। আপনারা কেন ফেরাউন ও মিসরীয়দের মত করে নিজেদের মনকে কঠিন করছেন? বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌ যখন মিসরীয়দের বোকা বানিয়েছিলেন তখন তারা বনি-ইসরাইলদের যেতে দিয়েছিল, আর তারা চলে গিয়েছিল। “এখন আপনারা একটা নতুন গাড়ী তৈরী করুন এবং দুধ দেয় এমন দু’টা গাভী নিন যাদের উপর কখনও জোয়াল চাপানো হয় নি। সেগুলো আপনারা সেই গাড়ীতে জুড়ে দেবেন, কিন্তু তাদের বাছুরগুলো তাদের কাছ থেকে সরিয়ে ঘরে নিয়ে যাবেন। তারপর মাবুদের সিন্দুকটি আপনারা সেই গাড়ীর উপর বসাবেন এবং দোষের কোরবানীর জন্য যে সব সোনার জিনিস আপনারা মাবুদকে পাঠাবেন সেগুলো একটা বাক্সের মধ্যে করে সিন্দুকের পাশে রাখবেন। এইভাবে সিন্দুকটি পাঠিয়ে দেবেন যাতে সেটি চলে যায়। তবে নজর রাখবেন, সিন্দুকটি যদি নিজের দেশের পথ ধরে বৈৎ-শেমশে যায় তবে বুঝবেন যে, আমাদের উপর এই ভীষণ গজব মাবুদই এনেছেন। কিন্তু যদি সেই পথে না যায় তবে আমরা বুঝতে পারব যে, আমাদের উপর এই আঘাত তাঁর হাত থেকে আসে নি, এমনিই তা আমাদের উপর এসেছে।” তাঁরা তখন তা-ই করলেন। লোকেরা দুধ দেওয়া দু’টা গাভী নিয়ে গাড়ীতে জুড়ে দিল আর তাদের বাছুরগুলোকে ঘরে আট্‌কে রাখল। তারপর তারা সেই গাড়ীর উপরে মাবুদের সিন্দুকটি রাখল এবং তার পাশে রাখল সেই বাক্সটা যার মধ্যে ছিল সোনার ইঁদুর ও সোনার টিউমারগুলো। তখন গাভী দু’টা ডানে-বাঁয়ে না ঘুরে ডাকতে ডাকতে রাজপথ দিয়ে সোজা বৈৎ-শেমশের দিকে চলল। ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা গাড়ীটার পিছনে পিছনে বৈৎ-শেমশের সীমা পর্যন্ত গেলেন। বৈৎ-শেমশের লোকেরা তখন উপত্যকার মধ্যে গম কাটছিল। তারা চোখ তুলে চাইতেই সিন্দুকটি তাদের চোখে পড়ল এবং তারা খুশী হল। বৈৎ-শেমশে এসে গাড়ীটা ইউসার ক্ষেতের মধ্যে একটা বড় পাথরের পাশে গিয়ে থামল। বনি-ইসরাইলরা সেই গাড়ীটার কাঠ কেটে নিয়ে ঐ দু’টা গাভী দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিল। এর আগে লেবীয়রা মাবুদের সিন্দুকটি এবং সোনার জিনিস সুদ্ধ বাক্সটা নামিয়ে সেই বড় পাথরটার উপর রেখেছিল। সেই দিন বৈৎ-শেমশের লোকেরা মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো এবং অন্যান্য কোরবানী দিল। ফিলিস্তিনীদের সেই পাঁচজন শাসনকর্তা সব কিছু দেখে সেই দিনই আবার ইক্রোণে ফিরে গেলেন। মাবুদের উদ্দেশে দোষের কোরবানী হিসাবে ফিলিস্তিনীরা যে সব শহরগুলোর পক্ষ থেকে একটা করে সোনার টিউমার পাঠিয়েছিল সেগুলো হল অস্‌দোদ, গাজা, অস্কিলোন, গাৎ ও ইক্রোণ। সেই পাঁচজন শাসনকর্তার অধীনে ফিলিস্তিনীদের পাঁচটা দেয়াল-ঘেরা শহর ও সেগুলোর সংগেকার দেয়াল-ছাড়া গ্রামগুলোর পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনীরা সোনার ইঁদুর পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনীদের এলাকা ছিল বৈৎ-শেমশে ইউসার ক্ষেতের মধ্যেকার বড় পাথরটা পর্যন্ত, যার উপর তারা মাবুদের সিন্দুকটি নামিয়ে রেখেছিল। সেটা আজও সেখানে রয়েছে। বৈৎ-শেমশের কিছু লোক মাবুদের সিন্দুকের ভিতরে চেয়ে দেখেছিল বলে মাবুদ তাদের মেরে ফেললেন। তিনি তখন সেখানকার পঞ্চাশ হাজার সত্তর জনকে মেরে ফেলেছিলেন। তিনি এই ভীষণ আঘাত করেছিলেন বলে লোকেরা বিলাপ করতে লাগল। তারা বলল, “এই পবিত্র মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে কে টিকে থাকতে পারবে? এখান থেকে এখন তাঁকে কার কাছে পাঠানো যায়?” তারপর তারা কয়েকজন লোককে দিয়ে কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের লোকদের কাছে বলে পাঠাল, “ফিলিস্তিনীরা মাবুদের সিন্দুক ফিরিয়ে দিয়েছে। তোমরা নেমে এসে সিন্দুকটি তোমাদের কাছে নিয়ে যাও।” কাজেই কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের লোকেরা এসে মাবুদের সিন্দুকটি নিয়ে গেল। তারা সিন্দুকটি নিয়ে পাহাড়ের উপরকার তাদের শহরে অবীনাদবের বাড়ীতে রাখল এবং তা দেখাশোনা করবার জন্য অবীনাদবের ছেলে ইলিয়াসরকে মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র করে নিল। মাবুদের সিন্দুকটি কিরিয়ৎ-যিয়ারীমে রাখবার পর অনেক দিন পার হয়ে গেল, অর্থাৎ বিশ বছর কেটে গেল। সেই সময় মাবুদের কাছে ফিরে আসবার জন্য বনি-ইসরাইলদের প্রাণ কাঁদছিল। তাতে হযরত শামুয়েল সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বললেন, “যদি তোমরা তোমাদের সমস্ত অন্তরের সংগে আবার মাবুদের কাছে ফিরে আসতে চাও, তবে তোমাদের মধ্য থেকে অন্য জাতিদের দেব-দেবী এবং অষ্টারোৎ-দেবীর মূর্তিগুলো দূর করে দাও এবং মাবুদের দিকে নিজেদের অন্তর স্থির করে কেবল তাঁরই এবাদত কর। তাহলে তিনি ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করবেন।” এই কথা শুনে বনি-ইসরাইলরা তাদের বাল-দেবতা ও অষ্টারোৎ-দেবীর মূর্তিগুলো দূর করে দিয়ে কেবল মাবুদের এবাদত করতে লাগল। তখন শামুয়েল বললেন, “মিসপাতে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জমায়েত কর। আমি তোমাদের জন্য মাবুদের কাছে মিনতি করব।” এতে তারা সবাই মিসপাতে জমায়েত হল। তারা পানি তুলে মাবুদের সামনে ঢেলে দিয়ে সেই দিন সেখানে রোজা রাখল এবং বলল, “আমরা মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি।” শামুয়েল মিসপাতে থেকে বনি-ইসরাইলদের শাসন করতেন। বনি-ইসরাইলরা মিসপাতে জমায়েত হয়েছে শুনে ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য গেলেন। সেই কথা শুনে বনি-ইসরাইলরা ফিলিস্তিনীদের দরুন ভয় পেল। তারা শামুয়েলকে বলল, “আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যেন ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেন সেইজন্য মাবুদের কাছে আপনি ফরিয়াদ জানাতে থাকুন।” তখন শামুয়েল এমন একটা ভেড়ার বাচ্চা নিলেন যেটা দুধ ছাড়ে নি আর গোটা বাচ্চাটা দিয়ে তিনি মাবুদের উদ্দেশে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের হয়ে মাবুদকে ডাকলেন এবং মাবুদও তাঁকে জবাব দিলেন। শামুয়েল যখন পোড়ানো-কোরবানী দিচ্ছিলেন সেই সময় বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য ফিলিস্তিনীরা এগিয়ে আসল। কিন্তু সেই দিন মাবুদ ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে বাজ পড়বার মত ভীষণ শব্দে গর্জন করে উঠলেন। তাতে ভয়ে তাদের দল ভেংগে গেল এবং তারা বনি-ইসরাইলদের কাছে হেরে গেল। বনি-ইসরাইলরা তখন মিসপা থেকে বের হয়ে ফিলিস্তিনীদের তাড়া করল এবং তাদের মারতে মারতে বৈৎ-কর গ্রামের নীচু জায়গা পর্যন্ত নিয়ে গেল। শামুয়েল তখন একটা পাথর নিয়ে মিসপা ও শেন নামে একটা জায়গার মাঝখানে খাড়া করে রাখলেন এবং বললেন, “এই পর্যন্ত মাবুদ আমাদের সাহায্য করেছেন।” এই বলে তিনি সেটার নাম দিলেন এবন্‌-এষর (যার মানে “সাহায্যের পাথর”)। এইভাবে ফিলিস্তিনীদের দমন করা হল। এর পরে তারা আর বনি-ইসরাইলদের সীমানায় ঢোকে নি। শামুয়েল যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত মাবুদ ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ছিলেন। ইক্রোণ থেকে গাৎ পর্যন্ত বনি-ইসরাইলদের যে শহর ও গ্রামগুলো ফিলিস্তিনীরা অধিকার করে নিয়েছিল তা আবার বনি-ইসরাইলরা ফিরে পেল। বনি-ইসরাইলরা সেগুলোর চারপাশের সমস্ত জায়গাও ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিল। এতে ইসরাইলীয় ও আমোরীয়দের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হল। এর পর শামুয়েল যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বনি-ইসরাইলদের শাসন করেছিলেন। তিনি প্রত্যেক বছর বেথেল, গিল্‌গল ও মিসপাতে গিয়ে বনি-ইসরাইলদের শাসন করতেন। তারপর তিনি রামায় তাঁর বাড়ীতে ফিরে যেতেন। তিনি সেখানেও বনি-ইসরাইলদের শাসন করতেন। সেখানে মাবুদের উদ্দেশে তিনি একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছিলেন। শামুয়েল বুড়ো বয়সে বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হিসাবে তাঁর ছেলেদের নিযুক্ত করলেন। তাঁর বড় ছেলের নাম ছিল যোয়েল এবং দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল অবিয়। তারা বের্‌-শেবাতে শাসনকর্তার কাজ করত, কিন্তু তারা তাদের বাবার মত চলত না। তারা অন্যায়ভাবে ধন লাভের আশায় ন্যায়ের পথ ছেড়ে দিয়েছিল। তারা ঘুষ নিয়ে ন্যায়কে অন্যায় এবং অন্যায়কে ন্যায় বলে রায় দিত। “আমাদের শাসন করবার জন্য একজন বাদশাহ্‌ নিযুক্ত করুন,” লোকদের এই কথাটা শামুয়েলের কাছে ভাল মনে হল না। সেইজন্য তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করতে লাগলেন। তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, “লোকেরা তোমাকে যা বলছে তুমি তা-ই কর। তারা তোমাকে অগ্রাহ্য করে নি, আসলে আমাকেই অগ্রাহ্য করেছে যেন আমি তাদের উপর রাজত্ব না করি। মিসর দেশ থেকে তাদের বের করে আনবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তারা আমার প্রতি যা করেছে তোমার প্রতিও তা-ই করেছে; আমাকে বাদ দিয়ে তারা দেব-দেবীর পূজা করেছে। এখন তুমি তাদের কথা মেনে নাও; তবে তুমি তাদের সাবধান করে বলে দাও যে, তাদের উপর যে বাদশাহ্‌ রাজত্ব করবে সে তাদের উপর কি রকম ব্যবহার করবে।” যারা শামুয়েলের কাছে একজন বাদশাহ্‌ চেয়েছিল তাদের কাছে শামুয়েল মাবুদের সমস্ত কথা জানালেন। তিনি বললেন, “যিনি বাদশাহ্‌ হয়ে তোমাদের উপরে রাজত্ব করবেন তাঁর ব্যবহার এই রকম হবে: তিনি তোমাদের ছেলেদের নিয়ে সৈন্য হিসাবে কাজে লাগাবেন; তাদের কেউ কেউ হবে রথ-চালক, কেউ কেউ হবে ঘোড়সওয়ার এবং কেউ কেউ তাঁর সমস্ত রথের আগে আগে দৌড়াবে। তিনি নিজের জন্য কাউকে কাউকে হাজার সৈন্যের উপরে, কাউকে কাউকে পঞ্চাশজন সৈন্যের উপরে সেনাপতি নিযুক্ত করবেন। অন্যদের তিনি তাঁর জমি চাষের ও ফসল কাটবার কাজে এবং যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও রথের সাজসরঞ্জাম তৈরী করবার কাজে লাগাবেন। তোমাদের মেয়েদের দিয়ে তিনি খোশবু তৈরী, রান্নাবান্না ও রুটি সেঁকবার কাজ করাবেন। তিনি তোমাদের সবচেয়ে ভাল জমি, আংগুর ক্ষেত ও জলপাই বাগান নিয়ে তাঁর কর্মচারীদের দেবেন। তোমাদের শস্য ও আংগুরের দশ ভাগের এক ভাগ নিয়ে তিনি তাঁর রাজকর্মচারী ও অন্যান্য কর্মচারীদের দেবেন। তিনি তোমাদের গোলাম ও বাঁদী এবং তোমাদের সেরা যুবকদের ও গাধাগুলো নিয়ে নিজের কাজে লাগাবেন। তোমাদের ভেড়ার পালের দশ ভাগের এক ভাগ তিনি নিয়ে নেবেন আর তোমরা তাঁর গোলাম হবে। সেই দিন তোমরা তোমাদের চেয়ে নেওয়া বাদশাহ্‌র দরুন কাঁদবে, কিন্তু তখন মাবুদ তোমাদের ডাকে সাড়া দেবেন না।” লোকেরা কিন্তু শামুয়েলের এই সব কথা শুনতে রাজী হল না। তারা বলল, “না, আমরা একজন বাদশাহ্‌ চাই। তাহলে আমরা অন্য সব জাতির মত হতে পারব। আমাদের বাদশাহ্‌ আমাদের শাসন করবেন এবং আমাদের আগে আগে থেকে যুদ্ধ করবেন।” শামুয়েল লোকদের সব কথা শুনলেন এবং মাবুদের কাছে তা বললেন। তাতে মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “তুমি তাদের কথা শোন এবং তাদের জন্য তুমি একজন বাদশাহ্‌ নিযুক্ত কর।” তখন শামুয়েল বনি-ইসরাইলদের বললেন, “তোমরা নিজের নিজের বাড়ীতে ফিরে যাও।” কীশ নামে বিন্যামীন-গোষ্ঠীর একজন সম্মানিত ধনী লোক ছিলেন। কীশ অবীয়েলের ছেলে, অবীয়েল সরোরের ছেলে, সরোর বখোরতের ছেলে আর বখোরত অফীহের ছেলে। তালুত নামে কীশের একটি ছেলে ছিল। তিনি ছিলেন বয়সে যুুবক এবং দেখতে সুন্দর। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে তাঁর মত সুন্দর আর কেউ ছিল না। তিনি অন্য সকলের চেয়ে প্রায় এক ফুট লম্বা ছিলেন। তালুতের পিতা কীশের যে সব গাধী ছিল সেগুলো একদিন হারিয়ে গেল। তাতে কীশ তাঁর ছেলে তালুতকে বললেন, “তুমি একজন চাকরকে সংগে নিয়ে গাধীগুলো খুঁজতে যাও।” তালুত তখন সেগুলো খুঁজতে খুঁজতে আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকা এবং শালিশা এলাকার মধ্য দিয়ে গেলেন, কিন্তু সেগুলোকে পেলেন না। তারপর তাঁরা শালীম এলাকায় গেলেন, কিন্তু গাধীগুলো সেখানেও পাওয়া গেল না। তারপর তাঁরা বিন্‌ইয়ামীনীয়দের এলাকায় গেলেন, আর সেখানেও সেগুলোকে পেলেন না। তাঁরা যখন সূফ এলাকায় গেলেন তখন তালুত তাঁর সংগের চাকরকে বললেন, “চল, আমরা ফিরে যাই। তা না হলে বাবা হয়তো গাধীগুলোর চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা করবেন।” কিন্তু সেই চাকর তাঁকে বলল, “দেখুন, এই শহরে আল্লাহ্‌র একজন বান্দা থাকেন। তাঁকে সবাই সম্মান করে এবং তিনি যা বলেন তা সত্যিসত্যিই ঘটে। চলুন, আমরা এখন সেখানে যাই। তিনি হয়তো বলে দিতে পারবেন কোন্‌ পথে আমাদের যেতে হবে।” তালুত তাঁর চাকরকে বললেন, “কিন্তু যদি আমরা সেখানে যাই তবে লোকটির জন্য কি নিয়ে যাব? আমাদের থলির মধ্যে যে খাবার ছিল তা তো শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ্‌র বান্দাকে দেবার জন্য কোন উপহারও আমাদের কাছে নেই। কি আছে আমাদের?” জবাবে সেই চাকর তাঁকে বলল, “দেখুন, আমার কাছে তিন গ্রাম রূপা আছে। আল্লাহ্‌র বান্দাকে আমি তা-ই দেব, আর তিনি আমাদের বলে দেবেন কোন্‌ পথে আমাদের যেতে হবে।” (আগেকার দিনে ইসরাইল দেশের কোন লোক যদি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কোন বিষয় জানতে চাইত তবে সে যাবার আগে বলত, “চল, আমরা দর্শকের কাছে যাই।” এখন যাঁকে নবী বলা হয় আগেকার দিনে তাঁকে বলা হত দর্শক।) তালুত তাঁর চাকরকে বললেন, “খুব ভাল বলেছ; চল, আমরা যাই।” এই বলে তাঁরা আল্লাহ্‌র বান্দাটি যে শহরে ছিলেন সেখানে গেলেন। যে পথটা শহরের দিকে উঠে গেছে তাঁরা যখন সেই পথ ধরে উঠে যাচ্ছিলেন তখন কয়েকজন মেয়ের সংগে তাঁদের দেখা হল। সেই মেয়েরা পানি নেবার জন্য বেরিয়ে এসেছিল। তাঁরা সেই মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন, “দর্শক কি এখানে আছেন?” জবাবে তারা বলল, “জ্বী আছেন; আর একটু সামনে এগিয়ে যান। আপনারা তাড়াতাড়ি যান। তিনি আজই আমাদের শহরে এসেছেন, কারণ এবাদতের উঁচু স্থানে আজ লোকেরা পশু-কোরবানী দেবে। আপনারা শহরে ঢুকলেই তাঁর সংগে আপনাদের দেখা হবে। আপনারা দেখবেন তিনি পাহাড়ের উপরে খেতে যাচ্ছেন। তিনি না যাওয়া পর্যন্ত লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করবে না, কারণ তাঁকে কোরবানীর জিনিস দোয়া করতে হবে; তারপর যাদের ডাকা হয়েছে তারা খাবে। আপনারা এখনই উঠে যান, এখনই তাঁর দেখা পাবেন।” এই কথা শুনে তাঁরা শহরে উঠে গেলেন। তাঁরা শহরের মধ্যে গিয়ে দেখলেন শামুয়েল এবাদতের উঁচু স্থানে যাবার জন্য তাঁদের দিকেই আসছেন। পথে শামুয়েলের সংগে তাঁদের দেখা হল। তালুত আসবার আগের দিন মাবুদ শামুয়েলের কাছে এই কথা প্রকাশ করেছিলেন, “আগামী কাল এই সময়ে আমি বিন্যামীন-গোষ্ঠীর এলাকার একজন লোককে তোমার কাছে পাঠাব। আমার বান্দাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের নেতা হবার জন্য তুমি তাকে অভিষেক করবে। ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে সে-ই আমার বান্দাদের উদ্ধার করবে। আমার বান্দাদের দিকে আমি মনোযোগ দিয়েছি, কারণ তাদের ফরিয়াদ আমার কানে এসে পৌঁছেছে।” তালুতকে দেখবার সংগে সংগেই মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “দেখ, এ-ই সেই লোক, যার কথা আমি তোমাকে বলেছিলাম। এ-ই আমার বান্দাদের শাসন করবে।” তালুত দরজার মধ্যে শামুয়েলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “দর্শকের বাড়ীটা কোথায় দয়া করে আমাকে বলে দিন।” জবাবে শামুয়েল তালুতকে বললেন, “আমিই দর্শক। তুমি আমার আগে আগে এবাদতের উঁচু স্থানে যাও, কারণ আজ তোমরা আমার সংগে খাবে। কাল সকালে আমি তোমাকে বিদায় দেব আর তোমার মনে যা আছে তা তোমাকে বলব। তিন দিন আগে তোমার যে গাধীগুলো হারিয়ে গেছে তা নিয়ে তুমি আর চিন্তা কোরো না; সেগুলো পাওয়া গেছে। ইসরাইল দেশের মধ্যে সমস্ত ভাল ভাল জিনিস কার জন্য? তা কি তোমার আর তোমার বাবার বংশের লোকদের জন্য নয়?” জবাবে তালুত বললেন, “আপনি কেন আমাকে এই সব কথা বলছেন? বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে বিন্‌ইয়ামীনই হল সবচেয়ে ছোট, আর আমি সেই গোষ্ঠীর লোক। আবার বিন্যামীন-গোষ্ঠীতে যতগুলো বংশ আছে তার মধ্যে আমাদের বংশটা একেবারেই ধরবার মধ্যে নয়।” শামুয়েল তখন তালুত ও তাঁর চাকরকে নিয়ে খাবার ঘরে গেলেন এবং দাওয়াতীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত জায়গায় তাঁদের বসালেন। দাওয়াতী লোকেরা সংখ্যায় প্রায় ত্রিশজন ছিল। যে লোকটি রান্না করেছে শামুয়েল তাকে বললেন, “যে গোশ্‌ত আলাদা করে রাখবার জন্য তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা নিয়ে এস।” তাতে সে গিয়ে রান আর তার সংগেকার গোশ্‌ত এনে তালুতের সামনে রাখল। শামুয়েল তালুতকে বললেন, “এটা তোমারই জন্য রাখা হয়েছিল; তুমি খাও। আজকে তুমি এখানে খাবে বলে লোকদের দাওয়াত করবার সময়েই আমি এটা তোমার জন্য আলাদা করে রাখতে বলেছিলাম।” তালুত সেই দিন শামুয়েলের সংগে খাওয়া-দাওয়া করলেন। এর পর তাঁরা সেই উঁচু স্থান থেকে শহরে ফিরে আসলেন। তারপর শামুয়েল তাঁর বাড়ীর ছাদে তালুতের সংগে কথাবার্তা বললেন। পরের দিন খুব ভোরে তাঁরা সবাই ঘুম থেকে উঠলেন। আলো হলে পর তালুত ছাদে থাকতেই শামুয়েল তাঁকে ডেকে বললেন, “প্রস্তুত হও, আমি তোমাকে এখন বিদায় দেব।” তালুত ও শামুয়েল প্রস্তুত হয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়লেন। শহরের সীমানার কাছাকাছি এসে শামুয়েল তালুতকে বললেন, “তোমার চাকরকে এগিয়ে যেতে বল, কিন্তু তুমি কিছুক্ষণের জন্য এখানে দাঁড়াও। আল্লাহ্‌ যা বলেছেন তা আমি তোমাকে শোনাব।” তাতে তাঁর চাকর এগিয়ে গেল। তারপর শামুয়েল একটা তেলের শিশি নিয়ে তালুতের মাথার উপর তেল ঢেলে দিলেন। তিনি তাঁকে চুম্বন করে বললেন, “মাবুদ তাঁর বান্দাদের উপরে তোমাকে নেতা হিসাবে অভিষেক করলেন। তুমি আমার কাছ থেকে চলে যাবার পর আজ বিন্‌ইয়ামীন এলাকার সীমানায় সেল্‌সহ নামে জায়গাটায় রাহেলার কবরের কাছে দু’জন লোকের দেখা পাবে। তারা তোমাকে বলবে, ‘আপনি যে গাধীগুলোর খোঁজে বেরিয়েছিলেন সেগুলো পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন আপনার পিতা গাধীগুলোর চিন্তা ছেড়ে আপনার চিন্তায় পড়েছেন। তিনি বলছেন যে, তাঁর ছেলে সম্বন্ধে এখন তিনি কি করবেন?’ “তারপর তুমি সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে তাবোর এলাকার এলোন গাছের কাছে গেলে দেখতে পাবে তিনজন লোক আল্লাহ্‌র এবাদতের জন্য বেথেলে উঠে যাচ্ছে। তুমি দেখবে, তাদের একজন তিনটা ছাগলের বাচ্চা, আর একজন তিনটা রুটি ও আর একজন এক পাত্র আংগুর-রস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা তোমাকে সালাম জানিয়ে দু’টা রুটি দেবে এবং তুমি তা তাদের হাত থেকে নেবে। “তারপর তুমি গিবিয়া-হা-এলোহিম শহরে যাবে। সেখানে ফিলিস্তিনী সৈন্যদের একটা ছাউনি আছে। শহরে পৌঁছালে পর এমন এক দল নবীর সংগে তোমার দেখা হবে যারা আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলতে বলতে এবাদতের উঁচু স্থান থেকে নেমে আসছে। তাদের দলের সামনের লোকেরা বীণা, খঞ্জনি, বাঁশী ও সুরবাহার বাজাতে বাজাতে চলতে থাকবে। তখন মাবুদের রূহ্‌ সম্পূর্ণভাবে তোমাকে নিজের বশে আনবেন, আর তাতে তুমিও তাদের সংগে আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলবে। তখন তুমি অন্য ধরনের মানুষ হয়ে যাবে। এই সব চিহ্ন ঘটলে পর তোমার তখন যা করা উচিত তুমি তা-ই কোরো; আল্লাহ্‌ তোমার সংগে থাকবেন। “তুমি আমার আগে নেমে গিল্‌গলে যাও। আমি পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবার জন্য তোমার কাছে আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি সাত দিন আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি এসে বলব তোমাকে কি করতে হবে।” শামুয়েলের কাছ থেকে চলে যাবার উদ্দেশ্যে তালুত ঘুরে দাঁড়াতেই আল্লাহ্‌ তাঁর মন বদলে দিলেন। সেই দিনই চিহ্ন হিসাবে বলা ঘটনাগুলো ঘটল। তালুত ও তাঁর চাকর গিবিয়াতে পৌঁছালে এক দল নবীর সংগে তাঁদের দেখা হল। তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তালুতকে সম্পূর্ণভাবে নিজের বশে আনলেন, আর তাতে তিনি ঐ নবীদের মাঝখানে গিয়ে আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলতে লাগলেন। যারা তালুতকে আগে থেকেই চিনত তারা তাঁকে নবীদের সংগে আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলতে দেখে একে অন্যকে বলতে লাগল, “কীশের ছেলের এ কি হল? তালুতও কি তবে নবীদের মধ্যে একজন?” তাতে সেখানকার একজন লোক বলল, “কিন্তু এরা কাদের ছেলে?” সেইজন্য “তালুতও কি নবীদের মধ্যে একজন?” এই কথাটা চল্‌তি কথা হয়ে উঠল। আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলা শেষ করে তালুত এবাদতের উঁচু স্থানে উঠে গেলেন। তালুতের চাচা তালুত ও তাঁর চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?” তালুত বললেন, “গাধীগুলো খুঁজতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো কোথাও না পেয়ে আমরা শামুয়েলের কাছে গিয়েছিলাম।” তালুতের চাচা বললেন, “আমাকে বল, শামুয়েল তোমাদের কি বলেছেন?” তালুত তাঁর চাচাকে বললেন, “তিনি আমাদের স্পষ্টই বলে দিলেন যে, গাধীগুলো পাওয়া গেছে।” কিন্তু তাঁর রাজত্ব করা সম্বন্ধে শামুয়েল তাঁকে যে কথা বলেছিলেন তা তিনি তাঁর চাচাকে বললেন না। পরে শামুয়েল মিসপাতে মাবুদের সামনে বনি-ইসরাইলদের ডেকে জমায়েত করলেন। তিনি তাদের বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘মিসর দেশ থেকে আমিই তোমাদের বের করে এনেছি, আর মিসরীয়দের হাত থেকে এবং যে রাজ্যগুলো তোমাদের উপর জুলুম করত তাদের হাত থেকে আমিই তোমাদের উদ্ধার করেছি।’ ” শামুয়েল আরও বললেন, “কিন্তু তোমাদের আল্লাহ্‌, যিনি সমস্ত বিপদ ও দুর্দশা থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন, আজকাল তাঁকেই তোমরা অগ্রাহ্য করছ আর বলছ, ‘আমাদের উপরে একজন বাদশাহ্‌ নিযুক্ত করুন।’ কাজেই এখন তোমরা যে যার গোষ্ঠী ও বংশ অনুসারে মাবুদের সামনে উপস্থিত হও।” শামুয়েল বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীকে কাছে ডাকলেন। তাদের মধ্য থেকে বিন্যামীন-গোষ্ঠীকে বেছে নেওয়া হল। তারপর বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত বংশকে সামনে আনা হল। তাদের মধ্য থেকে মট্রীয়ের বংশকে বেছে নেওয়া হল। এইভাবে শেষ পর্যন্ত কীশের ছেলে তালুতকে বেছে নেওয়া হল। কিন্তু তাঁর খোঁজ করা হলে তাঁকে পাওয়া গেল না। তখন লোকেরা মাবুদকে জিজ্ঞাসা করল, “আর কেউ কি এখানে আছে?” মাবুদ বললেন, “দেখ, সে মালপত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে।” তখন লোকেরা দৌড়ে গিয়ে সেখান থেকে তালুতকে নিয়ে আসল। তিনি এসে লোকদের মধ্যে দাঁড়ালে পর দেখা গেল তিনি সকলের চেয়ে প্রায় এক ফুট লম্বা। শামুয়েল তখন সবাইকে বললেন, “তোমরা কি মাবুদের বেছে নেওয়া বান্দাটিকে দেখতে পাচ্ছ? সমস্ত লোকের মধ্যে তাঁর মত আর কেউ নেই।” তখন লোকেরা বলল, “বাদশাহ্‌ চিরজীবী হোন।” শামুয়েল তখন রাজ্য শাসনের নিয়ম-কানুনগুলো লোকদের কাছে ঘোষণা করলেন। তিনি সেগুলো একটা বইয়ে লিখে মাবুদের সামনে রাখলেন। তারপর তিনি সমস্ত লোককে যার যার বাড়ীতে বিদায় করে দিলেন। তালুতও গিবিয়াতে তাঁর নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। যে সব বীর পুরুষদের অন্তরে আল্লাহ্‌ সাড়া জাগিয়েছিলেন তারাও তাঁর সংগে গেল। কিন্তু কতগুলো বাজে লোক বলল, “এই লোকটা কি করে আমাদের রক্ষা করবে?” তারা তাঁকে তুচ্ছ করল এবং কোন উপহার দিল না। তালুত কিন্তু মুখ বন্ধ করে রইলেন। পরে অম্মোনীয় নাহশ গিয়ে যাবেশ-গিলিয়দ ঘেরাও করল। তখন যাবেশের লোকেরা নাহশকে বলল, “আপনি আমাদের সংগে একটা চুক্তি করুন, তাহলে আমরা আপনার অধীন হয়ে থাকব।” অম্মোনীয় নাহশ জবাবে তাদের বলল, “আমি একটা শর্তে তোমাদের সংগে চুক্তি করতে পারি। সেটা হল, তোমাদের প্রত্যেকের ডান চোখ তুলে ফেলা হবে। তা করে আমি সমস্ত ইসরাইল জাতিকে অসম্মানিত করব।” এই কথা শুনে যাবেশের বৃদ্ধ নেতারা নাহশকে বলল, “আপনি আমাদের সাত দিন সময় দিন। এর মধ্যে আমরা ইসরাইল দেশের সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে খবর দেব। যদি কেউ আমাদের রক্ষা করতে না আসে তবে আমরা আপনার অধীন হব।” লোকেরা যখন খবর দেবার জন্য তালুতের নিজের শহর গিবিয়াতে গিয়ে সেখানকার লোকদের ঐ সব কথা বলল তখন লোকেরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। সেই সময় তালুত মাঠ থেকে তাঁর গরুর পাল নিয়ে ফিরে আসছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে? লোকেরা কান্নাকাটি করছে কেন?” তারা তখন যাবেশের লোকেরা যা বলেছিল তা তাঁকে জানাল। লোকদের কথা শুনবার পর আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তালুতের উপর আসলেন, আর তিনি রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি দু’টা গরু নিয়ে টুকরা টুকরা করে কাটলেন। তারপর সেই টুকরাগুলো লোক দিয়ে ইসরাইল দেশের সব জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন এবং তাদের এই কথা ঘোষণা করতে বললেন, “যে কেউ তালুত ও শামুয়েলের সংগে যোগ না দেবে তার গরুর অবস্থা এই রকম হবে।” মাবুদ বনি-ইসরাইলদের মনে একটা ভয় জাগিয়ে দিলেন, আর তারা সবাই এক হয়ে বের হয়ে আসল। তালুত বেষকে তাদের গণনা করলেন। তাতে ইসরাইলের সৈন্যদের সংখ্যা হল তিন লক্ষ আর এহুদার হল ত্রিশ হাজার। যাবেশ থেকে যে লোকেরা খবর নিয়ে এসেছিল গিবিয়ার লোকেরা তাদের বলল, “যাবেশ-গিলিয়দের লোকদের গিয়ে জানাবে যে, আগামী কাল দুপুরের মধ্যে তাদের উদ্ধার করা হবে।” এই কথা যাবেশের লোকদের জানানো হলে পর তারা খুব খুশী হল। তারা অম্মোনীয়দের বলল, “কাল আমরা তোমাদের অধীন হব। তোমাদের যা খুশী তা-ই তোমরা আমাদের প্রতি কোরো।” পরের দিন তালুত তাঁর লোকদের তিন দলে ভাগ করলেন। তারপর শেষ রাতে তারা অম্মোনীয়দের ছাউনিতে ঢুকে দুপুর পর্যন্ত তাদের হত্যা করতে লাগল। যারা প্রাণে বাঁচল তারা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে, তাদের দু’জন আর একসংগে রইল না। লোকেরা এসে শামুয়েলকে বলল, “কে বলেছিল তালুত আমাদের উপর বাদশাহ্‌ হতে পারে না? আপনি তাদের আমাদের হাতে তুলে দিন; আমরা তাদের মেরে ফেলব।” কিন্তু তালুত বললেন, “আজ কাউকেই মেরে ফেলা চলবে না, কারণ আজকের দিনে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করেছেন।” তখন শামুয়েল লোকদের বললেন, “চল, আমরা গিল্‌গলে গিয়ে তালুতের রাজপদের কথা আবার ঘোষণা করি।” এতে লোকেরা সবাই গিল্‌গলে গিয়ে মাবুদের সামনে তালুতকে রাজপদে বহাল করল। সেখানে তারা মাবুদের উদ্দেশে যোগাযোগ-কোরবানী দিল এবং তালুত ও বনি-ইসরাইলরা খুব আনন্দ-উৎসব করল। এর পর শামুয়েল ইসরাইলের সমস্ত লোককে বললেন, “তোমরা আমাকে যা যা বলেছ আমি তা সবই শুনেছি এবং তোমাদের উপরে একজন বাদশাহ্‌ নিযুক্ত করেছি। দেখ, এখন তোমাদের পরিচালনা করবার জন্য তোমাদের একজন বাদশাহ্‌ আছেন। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, আমার চুল পেকে গেছে, আর আমার ছেলেরা তোমাদের সংগেই রয়েছে। সেই যুবা বয়স থেকে আজ পর্যন্ত আমি তোমাদের পরিচালনা করে আসছি। আমি এখানেই আছি; আমার বিরুদ্ধে যদি তোমাদের কিছু বলবার থাকে তবে মাবুদ ও তাঁর অভিষেক-করা বান্দার সামনেই তা বল। তোমরা সাক্ষ্য দাও, আমি কার বলদ বা কার গাধা অন্যায়ভাবে নিয়েছি? আমি কার উপর জুলুম করেছি? কার উপর খারাপ ব্যবহার করেছি? কার কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছি? এর কোনটা যদি আমি করে থাকি তবে তার ক্ষতিপূরণ দেব।” লোকেরা বলল, “না, আপনি আমাদের কারও উপর জুলুম করেন নি, কারও উপর খারাপ ব্যবহার করেন নি এবং কারও কাছ থেকে কিছু নেন নি।” শামুয়েল তাদের বললেন, “আজ মাবুদ সাক্ষী এবং তাঁর অভিষেক-করা বান্দাও সাক্ষী যে, তোমরা আমার কাছে তোমাদের কোন জিনিস পাও নি।” তখন লোকেরা বলল, “তিনি সাক্ষী।” শামুয়েল লোকদের আরও বললেন, “জ্বী, মাবুদই সাক্ষী, যিনি মূসা ও হারুনকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন। তাহলে এবার তোমরা প্রস্তুত হও। মাবুদ তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপূরুষদের জন্য যে সব ন্যায় কাজ করেছেন আমি সেই সব বিষয় নিয়ে মাবুদের সামনেই তোমাদের দোষ দেখিয়ে দেব। “ইয়াকুব মিসর দেশে গেলেন, আর পরে যখন তোমাদের পূর্বপুরুষেরা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাল তখন মাবুদ মূসা ও হারুনকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা মিসর দেশ থেকে তোমাদের পূর্বপুরুষদের বের করে আনলেন এবং এই দেশে তাদের বাস করবার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ভুলে গেল। কাজেই তিনি গোলাম হবার জন্য হাৎসোরের সেনাপতি সীষরার হাতে, ফিলিস্তিনীদের হাতে এবং মোয়াব দেশের বাদশাহ্‌র হাতে তাদের তুলে দিলেন। তোমাদের পূর্বপুরুষদের সংগে তারা যুদ্ধ করল। তখন তোমাদের পূর্বপুরুষেরা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বলল, ‘আমরা গুনাহ্‌ করেছি; আমরা মাবুদকে ছেড়ে বাল-দেবতাদের ও অষ্টারোৎ-দেবীদের পূজা করেছি; এখন তুমি শত্রুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা কর, আমরা তোমারই এবাদত করব।’ তখন মাবুদ যিরুব্বাল, বদান, যিপ্তহ ও শামুয়েলকে পাঠিয়ে তোমাদের চারপাশের শত্রুদের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করলেন। তারপর তোমরা নিরাপদে বাস করতে লাগলে। “কিন্তু অম্মোনীয়দের বাদশাহ্‌ নাহশকে যখন তোমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসতে দেখলে তখন যদিও তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই ছিলেন তোমাদের বাদশাহ্‌ তবুও তোমরা আমাকে বললে, ‘না, আমরা চাই আমাদের উপরে একজন বাদশাহ্‌ রাজত্ব করুক।’ এখন দেখ, ইনিই তোমাদের বাদশাহ্‌, যাঁকে তোমরা চেয়েছ আর বেছে নিয়েছ। মাবুদ তোমাদের উপরে একজন বাদশাহ্‌ নিযুক্ত করেছেন। তোমরা যদি মাবুদকে ভয় কর, তাঁর এবাদত কর ও তাঁর বাধ্য হয়ে তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে না চল, আর যিনি তোমাদের শাসন করবেন সেই বাদশাহ্‌ ও তোমরা যদি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চল, তবে ভালই। কিন্তু যদি তোমরা মাবুদের বাধ্য না হও এবং তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে চল, তবে তিনি যেমন তোমাদের পূর্বপুরুষদের শাস্তি দিয়েছিলেন তেমনি তোমাদেরও দেবেন। “এবার তোমরা তৈরী হও; মাবুদ তোমাদের চোখের সামনে যে মহৎ কাজ করবেন তা দেখ। এখন তো গম কাটবার সময়, তাই না? আমি মাবুদকে বলব যেন তিনি মেঘের গর্জন এবং বৃষ্টি পাঠিয়ে দেন। তখন তোমরা জানবে এবং দেখতে পাবে যে, বাদশাহ্‌ চেয়ে তোমরা মাবুদের কাছে কত বড় অন্যায় করেছ।” এর পর শামুয়েল মাবুদের কাছে মুনাজাত করলেন এবং তিনি সেই দিনই মেঘের গর্জন ও বৃষ্টি পাঠিয়ে দিলেন। তখন সবাই মাবুদ ও শামুয়েলকে ভয় করতে লাগল। সবাই তখন শামুয়েলকে বলল, “আপনি আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে আপনার এই গোলামদের জন্য মুনাজাত করুন যাতে আমরা মারা না পড়ি, কারণ বাদশাহ্‌ চেয়ে আমরা আমাদের অন্য সব গুনাহের সংগে এই গুনাহ্‌ও যুক্ত করেছি।” জবাবে শামুয়েল বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না। তোমরা যদিও এই সব অন্যায় করেছ তবুও মাবুদের কাছ থেকে সরে না গিয়ে সমস্ত দিল দিয়ে তাঁর এবাদত কর। তোমরা তাঁর কাছ থেকে সরে যেয়ো না, কারণ তা করলে তোমরা অসার দেব-দেবীর পিছনে যাবে। সেগুলো অসার বলে তোমাদের কোন উপকারও করতে পারবে না এবং তোমাদের রক্ষাও করতে পারবে না। মাবুদ তাঁর মহানামের দরুন তাঁর বান্দাদের কখনও ত্যাগ করবেন না, কারণ তিনি নিজের ইচ্ছাতেই তোমাদের তাঁর নিজের বান্দা করে নিয়েছেন। আমি যেন কখনও তোমাদের জন্য মুনাজাত করা বন্ধ করে মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ না করি। আমি তোমাদের সৎ ও ন্যায়পথে চলতে শিক্ষা দেব। তোমরা কেবল মাবুদকে ভয় করবে এবং তোমাদের সমস্ত দিল দিয়ে বিশ্বস্তভাবে তাঁর এবাদত করবে। ভেবে দেখ, তিনি তোমাদের জন্য কত বড় বড় কাজ করেছেন। কিন্তু যদি তোমরা অন্যায় কাজ করতেই থাক তবে তোমরা ও তোমাদের বাদশাহ্‌ সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।” গেবা গ্রামে ফিলিস্তিনী সৈন্যদের যে ছাউনি ছিল যোনাথন তা আক্রমণ করলেন আর ফিলিস্তিনীরা সেই কথা শুনতে পেল। তখন তালুত দেশের সব জায়গায় শিংগা বাজিয়ে বললেন, “ইবরানীরা শুনুক।” এতে সমস্ত ইসরাইলীয় শুনল যে, তালুত ফিলিস্তিনীদের সৈন্য-ছাউনি আক্রমণ করেছেন এবং ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের ঘৃণার চোখে দেখছে। তখন বনি-ইসরাইলদের ডাকা হল যাতে তারা গিল্‌গলে গিয়ে তালুতের সংগে যোগ দেয়। ফিলিস্তিনীরা তখন বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য একসংগে জমায়েত হল। তাদের সংগে ছিল ত্রিশ হাজার রথ, ছয় হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্য ও সমুদ্র-পারের বালুকণার মত অসংখ্য পদাতিক সৈন্য। তারা সবাই বৈৎ-আবনের পূর্ব দিকে মিক্‌মসে ছাউনি ফেলল। ইসরাইলের সৈন্যেরা যখন দেখল যে, তারা ভীষণ চাপের মুখে পড়ে বিপদে পড়ে গেছে তখন তারা গিয়ে গুহায়, ঝোপ-ঝাড়ে, পাহাড়ের ফাটলে, খাদে ও গর্তে লুকিয়ে রইল। অনেক ইবরানী জর্ডান নদী পার হয়ে গাদ ও গিলিয়দ এলাকায় চলে গেল। তালুত গিল্‌গলেই রয়ে গেলেন, আর তাঁর সংগের সৈন্যেরা ভয়ে কাঁপতে লাগল। শামুয়েল তাঁকে যে সময়ের কথা বলেছিলেন সেই অনুসারে তালুত তাঁর জন্য সাত দিন অপেক্ষা করলেন, কিন্তু শামুয়েল গিল্‌গলে আসলেন না। এদিকে তাঁর সৈন্যেরাও তাঁকে ছেড়ে এদিক-সেদিক চলে যেতে লাগল। কাজেই তালুত পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানীর জিনিস তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বললেন। তারপর তিনি নিজেই পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। তিনি কোরবানী শেষ করবার সংগে সংগে শামুয়েল এসে পৌঁছালেন। তখন তালুত তাঁকে সালাম জানাবার জন্য তাঁর সংগে দেখা করতে গেলেন। শামুয়েল তাঁকে বললেন, “তুমি এটা কি করেছ?” জবাবে তালুত বললেন, “আমি দেখলাম যে, লোকেরা আমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে এবং ঠিক সময়ে আপনিও আসলেন না, আবার ফিলিস্তিনীরাও এদিকে মিক্‌মসে এসে জমায়েত হয়েছে। সেইজন্য আমি ভাবলাম, ফিলিস্তিনীরা গিল্‌গলে আমাকে আক্রমণ করতে আসছে অথচ আমি মাবুদের রহমত পাবার চেষ্টা করি নি। কাজেই আমার ইচ্ছা না থাকলেও আমি পোড়ানো-কোরবানী দিলাম।” শামুয়েল বললেন, “তুমি বোকার মত কাজ করেছ। তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌ যে হুকুম তোমাকে দিয়েছিলেন তা তুমি পালন কর নি। যদি তুমি তা করতে তবে ইসরাইলের উপর তোমার রাজত্ব তিনি চিরকাল স্থায়ী করতেন। কিন্তু এখন তোমার রাজত্ব আর বেশী দিন টিকবে না। মাবুদ তাঁর মনের মত একজন লোককে খুঁজে নিয়েছেন এবং তাঁকেই তাঁর বান্দাদের নেতা নিযুক্ত করেছেন, কারণ তাঁর হুকুম তুমি পালন কর নি।” এর পর শামুয়েল গিল্‌গল ছেড়ে বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গিবিয়াতে চলে গেলেন। তালুত তাঁর সংগের লোকদের গুণে দেখলেন যে, তারা সংখ্যায় প্রায় ছ’শো। পরে তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথন এবং তাঁদের সংগের লোকেরা বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গেবাতে গিয়ে থাকতে লাগলেন আর এদিকে ফিলিস্তিনীরা মিক্‌মসে ছাউনি ফেলে রইল। ফিলিস্তিনীদের ছাউনি থেকে তিন দল হানাদার সৈন্য বের হল। তাদের এক দল অফ্রা গ্রামের পথে শূয়াল এলাকায় গেল। আর এক দল গেল বৈৎ-হোরোণের দিকে এবং অন্য দলটি গেল সেই পাহাড়ী এলাকায় যেখান থেকে মরুভূমির সিবোয়িম উপত্যকা দেখা যায়। সেই সময় ইসরাইল দেশের মধ্যে কোন কামার পাওয়া যেত না, কারণ ফিলিস্তিনীরা মনে করত কামার থাকলে ইবরানীরা তলোয়ার কিংবা বর্শা তৈরী করিয়ে নেবে। তাই লাংগলের ফাল, হাত-কোদাল, কুড়াল ও কাসে- শাণ দেবার জন্য তাদের সবাইকে ফিলিস্তিনীদের কাছে যেতে হত। লাংগলের ফাল, হাত-কোদাল, ত্রিশূল, কুড়াল ও কাঁটা বসানো লাঠিতে শান দেবার দাম হিসাবে আট গ্রাম রূপা লাগত। তাই যুদ্ধের সময় দেখা গেল যে, তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথন ছাড়া তাঁদের সংগেকার কোন সৈন্যের হাতে তলোয়ার বা বর্শা নেই। ফিলিস্তিনীদের ছাউনির সৈন্যেরা বের হয়ে মিক্‌মসের গিরিপথে গিয়ে রইল। এদিকে তালুতের ছেলে যোনাথন একদিন তাঁর অস্ত্র বহনকারী যুবকটিকে বললেন, “চল, আমরা ওপাশে ফিলিস্তিনীদের ছাউনিতে যাই।” কথাটা কিন্তু তিনি তাঁর বাবাকে জানালেন না। তালুত তখন গিবিয়ার সীমানায় মিগ্রোণ বলে একটা জায়গার একটা ডালিম গাছের নীচে বসে ছিলেন। তাঁর সংগে ছিল ছ’শো লোক, আর তাদের মধ্যে ছিলেন অহিয়, যাঁর পরনে ছিল এফোদ। অহিয় ছিলেন অহীটুবের ছেলে, অহীটুব ছিলেন ঈখাবোদের ভাই, ঈখাবোদ ছিলেন পীনহসের ছেলে আর পীনহস ছিলেন আলীর ছেলে; আলী শীলোতে মাবুদের ইমাম ছিলেন। যোনাথন যে বের হয়ে গেছেন তা কেউ জানত না। যে গিরিপথ পার হয়ে যোনাথন ফিলিস্তিনীদের সৈন্য-ছাউনির কাছে যাওয়ার কথা বলেছিলেন সেই গিরিপথের দু’পাশটা ছিল খাড়া উঁচু পাথরের দেয়ালের মত। তার এক পাশের নাম বোৎসেস ও অন্য পাশের নাম সেনি। তার এক পাশ ছিল উত্তরে মিক্‌মসের দিকে আর অন্য পাশ ছিল দক্ষিণে গেবার দিকে। যোনাথন তাঁর অস্ত্র বহনকারী যুবকটিকে বললেন, “চল, আমরা ওপাশে ঐ খৎনা-না-করানো লোকদের ছাউনিতে যাই। হয়তো মাবুদ আমাদের জন্য কিছু করবেন, কারণ তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছামতই কম লোক দিয়ে হোক বা বেশী লোক দিয়ে হোক জয়ী হতে পারেন।” অস্ত্র বহনকারী লোকটি তখন বলল, “আপনার মন যা বলে তা-ই করুন। চলুন, আপনার ইচ্ছামতই আমি চলব।” যোনাথন বললেন, “তাহলে চল, আমরা ওপাশে ওদের দিকে গিয়ে ওদের দেখা দেব। ওরা যদি আমাদের বলে, ‘দাঁড়াও, আমরা তোমাদের কাছে আসছি,’ তাহলে আমরা যেখানে থাকব সেখান থেকে আর ওদের কাছে উঠে যাব না। কিন্তু যদি ওরা বলে, ‘আমাদের কাছে উঠে এস,’ তাহলে আমরা উঠে যাব। মাবুদ যে আমাদের হাতে ওদের তুলে দিয়েছেন ওটাই হবে আমাদের কাছে তার চিহ্ন।” এই বলে ফিলিস্তিনী সৈন্যদের সামনে গিয়ে তাঁরা দু’জন দেখা দিলেন। তখন ফিলিস্তিনীরা বলল, “ঐ দেখ, গর্তে লুকানো ইবরানীরা বের হয়ে আসছে।” তাদের সৈন্য-ছাউনির লোকেরা যোনাথন ও তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিকে বলল, “আমাদের কাছে উঠে আয়, তোদের দেখিয়ে দিচ্ছি।” তখন যোনাথন তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিকে বললেন, “আমার পিছনে পিছনে উঠে এস। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের হাতে ওদের দিয়ে রেখেছেন।” যোনাথন চার হাত-পায়ে উপরে উঠে গেলেন আর তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিও তাঁর পিছনে পিছনে উঠে গেল। ফিলিস্তিনীরা যোনাথনের হাতে মারা পড়তে লাগল আর তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিও তাঁর পিছনে পিছনে ফিলিস্তিনীদের মারতে লাগল। যোনাথন ও তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটির আক্রমণের শুরুতেই কমবেশী আধা একর জমির মধ্যে প্রায় বিশজন লোক মারা পড়ল। এর ফলে ফিলিস্তিনীদের যুদ্ধের মাঠের ছাউনিতে এবং সমস্ত সৈন্যদের মধ্যে একটা ভীষণ ভয় দেখা দিল; এমন কি, তাদের মিক্‌মসের ছাউনির ও হানাদার দলের সৈন্যেরা ভয়ে কাঁপতে লাগল, আর সেই সংগে ভূমিকমপও হল। সেই ভীষণ ভয় আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছিল। বিন্‌ইয়ামীন এলাকার গিবিয়াতে তালুতের পাহারাদার সৈন্যেরা দেখতে পেল যে, ফিলিস্তিনী সৈন্যেরা দলছাড়া হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তালুত তখন তাঁর সংগের লোকদের বললেন, “সৈন্যদের জমায়েত করে সাজিয়ে দেখ, কে আমাদের মধ্য থেকে চলে গেছে।” তাতে তারা দেখতে পেল যোনাথন ও তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটি সেখানে নেই। তালুত তখন অহিয়কে বললেন, “আপনি আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি নিয়ে আসুন।” (সেই সময় সিন্দুকটি বনি-ইসরাইলদের কাছেই ছিল।) তালুত যখন ইমামের সংগে কথা বলছিলেন তখন ফিলিস্তিনীদের ছাউনিতে গোলমাল চলছিল এবং তা বেড়ে যাচ্ছিল। কাজেই তালুত ইমামকে বললেন, “থাক্‌, লাগবে না।” তারপর তালুত ও তাঁর সব সৈন্যেরা যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে একত্র হয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন। তাঁরা দেখলেন যে, ফিলিস্তিনীরা একজন আর একজনের উপর তলোয়ার চালাচ্ছে এবং তাদের মধ্যে ভীষণ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এর আগে যে সব ইবরানীরা ফিলিস্তিনীদের মধ্যে থাকত এবং তাদের সংগে ছাউনিতে গিয়েছিল তারাও তখন ফিরে গিয়ে তালুত ও যোনাথনের সংগেকার বনি-ইসরাইলদের সংগে যোগ দিল। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় লুকিয়ে থাকা ইসরাইলীয়রাও যখন শুনল ফিলিস্তিনীরা পালিয়ে যাচ্ছে তখন তারাও বেরিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিল এবং ফিলিস্তিনীদের পিছনে তাড়া করল। এইভাবে মাবুদ সেই দিন বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করলেন, আর বৈৎ-আবন পার হয়েও যুদ্ধ চলতে লাগল। সেই দিনটা বনি-ইসরাইলদের খুব কষ্টে কাটল, কারণ তালুত তাদের দিয়ে একটা কসম খাইয়ে নিয়েছিলেন যে, তিনি সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত, শত্রুদের উপর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত যদি কেউ কিছু খায় তবে তার উপর যেন বদদোয়া পড়ে। কাজেই সেই দিন লোকেরা কেউ কিছু খায় নি। তারা সবাই গিয়ে এমন এক জায়গায় ঢুকল যেখানে গাছপালা আছে। সেখানে মাটির উপর কিছু মধু তাদের চোখে পড়ল। তারা দেখল, একটা চাক থেকে মধু ঝরে পড়ছে কিন্তু কসম ভাংবার ভয়ে তা মুখে দিল না। যোনাথন শোনেন নি যে, তাঁর পিতা লোকদের দিয়ে এই রকম একটা কসম খাইয়ে নিয়েছেন। তাই তিনি তাঁর হাতের লাঠির আগাটা বাড়িয়ে মৌচাকে ঢুকালেন এবং মধু হাতে নিয়ে খেতে লাগলেন। তাতে তাঁর শরীরে শক্তি ফিরে আসল। তখন সৈন্যদের একজন তাঁকে বলল, “আপনার বাবা সৈন্যদের দিয়ে একটা কঠিন কসম খাইয়ে নিয়েছেন আর বলেছেন, ‘আজ যদি কেউ কিছু খায় তবে তার উপর বদদোয়া পড়বে।’ তাই লোকেরা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে।” তখন যোনাথন বললেন, “আমার বাবা তো লোকদের কষ্ট দিচ্ছেন। দেখ, এই মধু একটুখানি মুখে দেওয়াতে আমার শরীরে কেমন শক্তি ফিরে এসেছে। শত্রুদের কাছ থেকে লুটে নেওয়া খাবার থেকে যদি আজ লোকেরা খেতে পারত তাহলে কত ভাল হত, আর ফিলিস্তিনীরাও আরও অনেক বেশী মারা পড়ত।” বনি-ইসরাইলরা সেই দিন মিক্‌মস থেকে অয়ালোন পর্যন্ত ফিলিস্তিনীদের মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তারা লুটের জিনিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেড়া, গরু, বাছুর ধরে মাটিতে ফেলে জবাই করে রক্তসুদ্ধই গোশ্‌ত খেতে লাগল। তখন লোকেরা গিয়ে তালুতকে বলল, “দেখুন, ওরা সবাই রক্তসুদ্ধ গোশ্‌ত খেয়ে মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করছে।” তিনি বললেন, “তোমরা বেঈমানী করেছ। এখন আর দেরি না করে একটা বড় পাথর গড়িয়ে এখানে নিয়ে এস।” তারপর তিনি বললেন, “তোমরা লোকদের মধ্যে গিয়ে বল যেন তারা তাদের বলদ বা ভেড়া এখানে আমার কাছে নিয়ে এসে জবাই করে আর তার পরে খায়। রক্তসুদ্ধ গোশ্‌ত খেয়ে কেউ যেন মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ না করে।” সেই রাতে লোকেরা যে যার বলদ নিয়ে এসে সেখানে জবাই করল। মাবুদের উদ্দেশে তালুত সেখানে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন। এটাই হল মাবুদের উদ্দেশে তাঁর তৈরী প্রথম কোরবানগাহ্‌। পরে তালুত বললেন, “চল, আজ রাতে আমরা ফিলিস্তিনীদের তাড়া করি এবং সকাল পর্যন্ত তাদের জিনিসপত্র লুট করি। তাদের একজনকেও আমরা বাঁচিয়ে রাখব না।” জবাবে লোকেরা বলল, “আপনি যা ভাল মনে করেন তা-ই করুন।” কিন্তু ইমাম বললেন, “চলুন, এখানে আমরা প্রথমে আল্লাহ্‌র কাছে জিজ্ঞাসা করি।” তখন তালুত আল্লাহ্‌কে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি ফিলিস্তিনীদের তাড়া করব? বনি-ইসরাইলদের হাতে কি তুমি তাদের তুলে দেবে?” কিন্তু আল্লাহ্‌ সেই দিন তালুতকে কোন জবাব দিলেন না। সেইজন্য তালুত বললেন, “সৈন্যদলের নেতারা, আপনারা এখানে আসুন। আজকের এই গুনাহ্‌ কি করে হল আসুন, আমরা তাঁর খোঁজ করি। বনি-ইসরাইলদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌র কসম যে, আমার ছেলে যোনাথনও যদি তা করে থাকে নিশ্চয়ই তাকেও মরতে হবে।” কিন্তু লোকেরা সবাই চুপ করে রইল। তালুত তখন সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বললেন, “আপনারা এক দিকে দাঁড়ান, আর আমি ও আমার ছেলে যোনাথন অন্য দিকে দাঁড়াই।” লোকেরা বলল, “আপনি যা ভাল মনে করেন তা-ই করুন।” তালুত তখন বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে বললেন, “এর সঠিক জবাব আমাদের দাও।” তাতে দোষ পড়ল তালুত ও যোনাথনের উপর আর বাকী লোকেরা ছাড়া পেল। তালুত বললেন, “আমার ও আমার ছেলে যোনাথনের মধ্যে গুলিবাঁট করা হোক।” তাতে যোনাথনের উপর দোষ পড়ল। তালুত তখন যোনাথনকে বললেন, “আমাকে বল, তুমি কি করেছ?” যোনাথন তাঁকে বললেন, “আমার লাঠির আগা দিয়ে আমি একটুখানি মধু খেয়েছি, তাই আমাকে মরতে হবে।” তালুত বললেন, “জ্বী যোনাথন, তোমাকে মরতেই হবে। আল্লাহ্‌ যেন তোমাকে শাস্তি দেন, অবশ্যই শাস্তি দেন।” কিন্তু লোকেরা তালুতকে বলল, “কি? যাঁর জন্য বনি-ইসরাইলরা এই মহা উদ্ধার পেয়েছে সেই যোনাথনকে মরতে হবে? কখনও না; আল্লাহ্‌র কসম যে, তাঁর একটা চুলও মাটিতে পড়বে না, কারণ তিনি আজ যা করেছেন তা আল্লাহ্‌র সংগে থেকেই করেছেন।” লোকেরা এইভাবে যোনাথনকে রক্ষা করল, তাঁকে হত্যা করা হল না। এর পর তালুত আর ফিলিস্তিনীদের তাড়া করলেন না, আর ফিলিস্তিনীরাও নিজেদের দেশে চলে গেল। তালুত বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ হবার পর দেশের চারপাশের সমস্ত শত্রুদের সংগে, অর্থাৎ মোয়াবীয়, অম্মোনীয়, ইদোমীয়, সোবার বাদশাহ্‌দের ও ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি যেদিকে যেতেন সেদিকেই ভীষণ ক্ষতি করতেন। তিনি বীরের মত যুদ্ধ করে আমালেকীয়দের হারিয়ে দিয়ে লুটেরাদের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করেছিলেন। যোনাথন, যিশ্‌বি ও মল্কীশূয় নামে তালুতের তিনজন ছেলে ছিল। তাঁর বড় মেয়ের নাম ছিল মেরব ও ছোট মেয়ের নাম ছিল মীখল। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল অহীনোয়ম। তিনি ছিলেন অহীমাসের মেয়ে। তালুতের প্রধান সেনাপতির নাম ছিল অবনের। তিনি তালুতের চাচা নেরের ছেলে। তালুতের পিতা কীশ ও অবনেরের পিতা নের ছিলেন অবীয়েলের ছেলে। তালুতের রাজত্বকালে ফিলিস্তিনীদের সংগে ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল। কোন শক্তিশালী লোক বা বীর পুরুষ দেখলেই তিনি তাকে তাঁর সৈন্যদলে নিয়ে নিতেন। শামুয়েল তালুতকে বললেন, “মাবুদ তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের উপরে তোমাকে রাজপদে অভিষেক করবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলেন। এখন তুমি মাবুদের কথায় কান দাও। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘বনি-ইসরাইলরা মিসর থেকে চলে আসবার পথে আমালেকীয়রা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলে আমি তাদের শাস্তি দেব। এখন তুমি গিয়ে আমালেকীয়দের আক্রমণ করবে এবং তাদের যা কিছু আছে সব ধ্বংস করে ফেলবে; তাদের প্রতি কোন দয়া করবে না। তাদের স্ত্রী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, দুধ-খাওয়া শিশু, গরু-ভেড়া, উট, গাধা সব মেরে ফেলবে।’ ” তালুত তখন লোকদের টলায়ীম শহরে ডেকে জমায়েত করলেন। তাতে ইসরাইলের পদাতিক সৈন্যের সংখ্যা হল দুই লক্ষ এবং এহুদা-গোষ্ঠীর সৈন্যের সংখ্যা হল দশ হাজার। তালুত আমালেকীয়দের শহরের কাছে গিয়ে সেখানকার শুকিয়ে যাওয়া নদীর খাদের মধ্যে ওৎ পেতে রইলেন। তিনি কেনীয়দের বললেন, “বনি-ইসরাইলরা যখন মিসর থেকে বের হয়ে এসেছিল তখন তোমরা তাদের প্রতি দয়া দেখিয়েছিলে। তোমরা আমালেকীয়দের মধ্য থেকে অন্য কোথাও চলে যাও, যাতে আমালেকীয়দের সংগে আমি তোমাদেরও ধ্বংস করে না ফেলি।” তখন কেনীয়রা আমালেকীয়দের মধ্য থেকে চলে গেল। তালুত তখন হবীলা এলাকা থেকে মিসরের পূর্ব দিকে শূর মরুভূমি পর্যন্ত সমস্ত আমালেকীয়দের হারিয়ে দিলেন। তিনি আমালেকীয়দের বাদশাহ্‌ অগাগকে জীবিত অবস্থায় ধরলেন এবং অন্য সব লোকদের হত্যা করলেন। কিন্তু তালুত ও তাঁর সৈন্যেরা অগাগকে বাঁচিয়ে রাখলেন এবং আমালেকীয়দের ভাল ভাল গরু, ভেড়া, মোটাসোটা বাছুর এবং ভেড়ার বাচ্চা, এক কথায় তাদের যা কিছু ভাল ছিল সেগুলো তাঁরা বাঁচিয়ে রাখলেন। সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে তাঁরা রাজী হলেন না, কিন্তু অকেজো এবং রোগাগুলোকে তাঁরা একেবারে শেষ করে দিলেন। তখন মাবুদের এই কালাম শামুয়েলের উপর নাজেল হল, “তালুতকে বাদশাহ্‌ করাটা আমার দুঃখের কারণ হয়েছে, কারণ সে আমার কাছ থেকে সরে গেছে এবং আমার হুকুম অমান্য করেছে।” এই কথা শুনে শামুয়েল উত্তেজিত হলেন এবং গোটা রাতটা তিনি মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে কাটালেন। পরদিন খুব ভোরে উঠে শামুয়েল তালুতের সংগে দেখা করতে গেলেন। সেখানে তাঁকে বলা হল যে, তালুত কর্মিল পাহাড়ে গিয়ে নিজের সম্মানের জন্য সেখানে একটা স-ম্ভ তৈরী করবার পর গিল্‌গলে চলে গেছেন। শামুয়েল তখন তালুতের কাছে গেলেন। তালুত তাঁকে বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম। মাবুদের হুকুম আমি পালন করেছি।” শামুয়েল বললেন, “তবে ভেড়ার ডাক আমার কানে আসছে কেন? গরুর ডাকই বা আমি শুনতে পাচ্ছি কেন?” জবাবে তালুত বললেন, “আমালেকীয়দের কাছ থেকে ওগুলো আনা হয়েছে। আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী করবার জন্য সৈন্যেরা ভাল ভাল গরু ও ভেড়া রেখে দিয়েছে; তবে বাকী সব কিছু আমরা একেবারে শেষ করে দিয়েছি।” শামুয়েল তখন তালুতকে বললেন, “চুপ কর। গত রাতে মাবুদ আমাকে যা বলেছেন তা আমি তোমাকে বলি।” তালুত বললেন, “বলুন।” শামুয়েল বললেন, “একদিন তুমি নিজের চোখে খুবই সামান্য ছিলে, কিন্তু তবুও কি তুমি বনি-ইসরাইলদের সমস্ত গোষ্ঠীর মাথা হও নি? মাবুদই তোমাকে ইসরাইল দেশের উপরে বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করেছেন। তিনি তোমাকে একটা কাজে পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘তুমি গিয়ে সেই গুনাহ্‌গারদের, অর্থাৎ আমালেকীয়দের একেবারে শেষ করে ফেলবে। তারা একেবারে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংগে যুদ্ধ করবে।’ তুমি মাবুদের হুকুম পালন কর নি কেন? কেন তুমি লুটের জিনিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে এবং মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করলে?” তালুত বললেন, “কিন্তু আমি তো মাবুদের হুকুম পালন করেছি। যে কাজে মাবুদ আমাকে পাঠিয়েছিলেন আমি সেই কাজ করেছি। আমি আমালেকীয়দের একেবারে শেষ করে দিয়েছি এবং তাদের বাদশাহ্‌ অগাগকে ধরে নিয়ে এসেছি। তবে ধ্বংসের জন্য ঠিক করে রাখা জিনিস থেকে সৈন্যেরা কতগুলো ভাল ভাল গরু ও ভেড়া এনেছে, যাতে গিল্‌গলে আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে সেগুলো তারা কোরবানী করতে পারে।” তখন শামুয়েল বললেন, “মাবুদের হুকুম পালন করলে তিনি যত খুশী হন, পোড়ানো-কোরবানী ও পশু-কোরবানী কি তিনি তত খুশী হন? পশু-কোরবানীর চেয়ে তাঁর হুকুম পালন করা আর ভেড়ার চর্বির চেয়ে তাঁর কথার বাধ্য হওয়া অনেক ভাল। বিদ্রোহ করা আর গোণাপড়ার কাজ করা একই গুনাহ্‌; অবাধ্যতা আর প্রতিমাপূজা একই অন্যায়। তুমি মাবুদের হুকুম অগ্রাহ্য করেছ তাই তিনিও তোমাকে বাদশাহ্‌ হিসাবে অগ্রাহ্য করেছেন।” তালুত তখন শামুয়েলকে বললেন, “আমি গুনাহ্‌ করেছি। মাবুদের হুকুম আর আপনার নির্দেশ আমি সত্যিই অমান্য করেছি। লোকদের ভয়ে আমি তাদের কথামতই কাজ করেছি। এখন আমার প্রতি দয়া করে আমার গুনাহ্‌ আপনি মাফ করে দিন, আর আমার সংগে চলুন যাতে আমি মাবুদের এবাদত করতে পারি।” কিন্তু শামুয়েল তাঁকে বললেন, “আমি তোমার সংগে যাব না। তুমি মাবুদের হুকুম অগ্রাহ্য করেছ তাই মাবুদও তোমাকে বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ হিসাবে অগ্রাহ্য করেছেন।” এই বলে শামুয়েল চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তালুত তাঁর কাপড়ের একটা অংশ টেনে ধরলেন; তাতে তাঁর কাপড় ছিঁড়ে গেল। তখন শামুয়েল তাঁকে বললেন, “মাবুদ আজ তোমার কাছ থেকে বনি-ইসরাইলদের রাজ্যটাও এইভাবে ছিনিয়ে নিলেন আর তোমার চেয়ে ভাল তোমার এক দেশবাসীকে তা দিলেন। যিনি ইসরাইলের প্রশংসা তিনি মিথ্যা কথা বলেন না কিংবা মনও বদলান না। তিনি মানুষ নন যে, মন বদলাবেন।” তালুত বললেন, “আমি গুনাহ্‌ করেছি; তবুও আমার অনুরোধ এই যে, আমার জাতির বৃদ্ধ নেতাদের ও বনি-ইসরাইলদের সামনে আমার সম্মান রাখুন। আমি যাতে আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করতে পারি সেইজন্য আপনি আমার সংগে চলুন।” কাজেই শামুয়েল তালুতের সংগে গেলেন আর তালুত মাবুদের এবাদত করলেন। পরে শামুয়েল বললেন, “আমালেকীয়দের বাদশাহ্‌ অগাগকে আমার কাছে নিয়ে এস।” এই কথা শুনে অগাগ তাঁর মোটা শরীর নিয়ে হেলে-দুলে শামুয়েলের কাছে আসলেন। তিনি ভাবলেন মৃত্যুর যন্ত্রণা এখন আর নেই। কিন্তু শামুয়েল বললেন, “তোমার তলোয়ারে অনেক স্ত্রীলোক যেমন সন্তানহারা হয়েছে, তেমনি স্ত্রীলোকদের মধ্যে তোমার মা-ও সন্তানহারা হবে।” এই কথা বলে শামুয়েল গিল্‌গলে মাবুদের সামনে অগাগকে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেললেন। তারপর তিনি রামায় চলে গেলেন আর তালুত গিবিয়া-তালুত শহরে তাঁর নিজের বাড়ীতে গেলেন। শামুয়েল যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি তালুতের সংগে আর দেখা করেন নি। বনি-ইসরাইলদের উপর তালুতকে বাদশাহ্‌ করাটা মাবুদের দুঃখের কারণ হয়েছিল বলে শামুয়েল তাঁর জন্য দুঃখ করতেন। পরে মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “আমি তালুতকে বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ হিসাবে অগ্রাহ্য করেছি, কাজেই তুমি আর কতকাল তার জন্য দুঃখ করবে? এখন তুমি তোমার শিংগায় তেল ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়। আমি তোমাকে বেথেলহেম গ্রামের ইয়াসির কাছে পাঠাচ্ছি। আমি তার ছেলেদের মধ্য থেকে আমার নিজের উদ্দেশ্যে একজনকে বাদশাহ্‌ হবার জন্য বেছে রেখেছি।” শামুয়েল বললেন, “আমি কি করে যাব? তালুত এই কথা শুনলে তো আমাকে মেরে ফেলবে।” মাবুদ বললেন, “তুমি একটা বক্‌না বাছুর তোমার সংগে নিয়ে যাবে এবং বলবে যে, তুমি মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিতে এসেছ। সেই কোরবানীতে তুমি ইয়াসিকে দাওয়াত করবে। তারপরে তোমাকে যা করতে হবে তা আমি বলে দেব। আমি যার কথা তোমাকে বলব তুমি তাকেই আমার উদ্দেশে অভিষেক করবে।” শামুয়েল মাবুদের কথামতই কাজ করলেন। তিনি যখন বেথেলহেমে উপস্থিত হলেন তখন গ্রামের বৃদ্ধ নেতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর সংগে দেখা করতে আসলেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি শান্তির মনোভাব নিয়ে এসেছেন?” জবাবে শামুয়েল বললেন, “জ্বী, আমি শান্তির মনোভাব নিয়েই এসেছি। মাবুদের উদ্দেশে আমি একটা পশু-কোরবানী দিতে এসেছি। তোমরা নিজেদের পাক-সাফ করে আমার সংগে এই কোরবানীতে যোগ দাও।” এই বলে তিনি ইয়াসি ও তাঁর ছেলেদের পাক-সাফ করলেন এবং সেই কোরবানীতে যোগ দেবার জন্য তাঁদের দাওয়াত করলেন। তাঁরা আসলে পর শামুয়েল ইলীয়াবকে দেখে মনে মনে ভাবলেন নিশ্চয়ই মাবুদের অভিষেক-করা বান্দাটি তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “তার চেহারা কি রকম কিংবা সে কতটা লম্বা তা তুমি দেখতে যেয়ো না, কারণ আমি তাকে অগ্রাহ্য করেছি। মানুষ যা দেখে তাতে কিছু যায়-আসে না, কারণ মানুষ দেখে বাইরের চেহারা কিন্তু মাবুদ দেখেন অন্তর।” তারপর ইয়াসি অবীনাদবকে ডেকে শামুয়েলের সামনে দিয়ে যেতে বললেন। শামুয়েল বললেন, “মাবুদ একেও বেছে নেন নি।” ইয়াসি তারপর শম্মকে তাঁর সামনে দিয়ে যেতে বললেন; কিন্তু শামুয়েল বললেন, “মাবুদ একেও বেছে নেন নি।” এইভাবে ইয়াসি তাঁর সাতজন ছেলেকে শামুয়েলের সামনে দিয়ে যেতে বললেন, কিন্তু শামুয়েল ইয়াসিকে বললেন, “মাবুদ এদের কাউকেই বেছে নেন নি।” তারপর তিনি ইয়াসিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এরা ছাড়া কি তোমার আর ছেলে নেই?” ইয়াসি বললেন, “সবচেয়ে ছোটটি বাকী আছে; সে ভেড়া চরাচ্ছে।” শামুয়েল বললেন, “তাকে ডাকতে পাঠাও। সে এখানে না আসা পর্যন্ত আমরা খেতে বসব না।” কাজেই ইয়াসি লোক পাঠিয়ে ছেলেটিকে আনালেন। তাঁর গায়ের রং ছিল লাল্‌চে, চোখ দু’টা সুন্দর এবং চেহারা ভাল। তখন মাবুদ বললেন, “এ-ই সেই বান্দা, তুমি গিয়ে তাকে অভিষেক কর।” শামুয়েল তখন তেলের শিংগা নিয়ে তাঁর ভাইদের মাঝখানে তাঁকে অভিষেক করলেন। সেই দিন থেকে মাবুদের রূহ্‌ দাউদের উপর আসলেন। এর পর শামুয়েল রামায় ফিরে গেলেন। তখন মাবুদের রূহ্‌ তালুতকে ছেড়ে চলে গেলেন আর মাবুদের কাছ থেকে এক খারাপ রূহ্‌ এসে তাঁকে ভীষণ ভয় দেখাতে লাগল। তা দেখে তালুতের কর্মচারীরা তাঁকে বলল, “আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এক খারাপ রূহ্‌ এসে আপনাকে ভীষণ ভয় দেখাচ্ছে। হুজুর, আপনার সামনে উপস্থিত এই গোলামদের হুকুম দিন যেন তারা গিয়ে এমন একজন লোকের খোঁজ করে যে ভাল বীণা বাজাতে পারে। যখন সেই খারাপ রূহ্‌ আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আপনার উপর আসবে তখন সে আপনাকে বীণা বাজিয়ে শোনাবে আর তাতে আপনার ভাল লাগবে।” এতে তালুত তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “তাহলে তোমরা এমন একজন লোকের খোঁজ কর যে ভাল বীণা বাজাতে পারে এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে এস।” তাঁর কর্মচারীদের মধ্যে একজন বলল, “আমি বেথেলহেমে ইয়াসির এক ছেলেকে দেখেছি। সে ভাল বীণা বাজায়। সে একজন সাহসী বীর এবং যোদ্ধা। সে সুন্দর করে কথা বলতে পারে এবং সে দেখতেও সুন্দর, আর মাবুদ তার সংগে আছেন।” এই কথা শুনে তালুত ইয়াসির কাছে লোক পাঠিয়ে বললেন যেন তিনি তাঁর রাখাল ছেলে দাউদকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। ইয়াসি তখন কিছু রুটি, চামড়ার থলিতে করে এক থলি আংগুর-রস ও একটা ছাগলের বাচ্চা একটা গাধার পিঠে চাপালেন এবং সেটা তার ছেলে দাউদকে দিয়ে তালুতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দাউদ তালুতের কাছে এসে তাঁর কাজে বহাল হলেন। তালুত তাঁকে খুব ভালবাসতে লাগলেন এবং তিনি তালুতের একজন অস্ত্র বহনকারী হলেন। পরে তালুত ইয়াসিকে বলে পাঠালেন, “দাউদকে আমার কাজে বহাল থাকতে দাও, কারণ তাকে আমার ভাল লেগেছে।” আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যখন সেই খারাপ রূহ্‌ তালুতের উপর আসত তখন দাউদ তাঁর বীণা বাজাতেন। এতে তালুতের ভাল লাগত এবং তিনি শান্তি পেতেন, আর সেই খারাপ রূহ্‌ও তাঁকে ছেড়ে চলে যেত। ফিলিস্তিনীরা যুদ্ধের জন্য সৈন্য জমায়েত করে নিয়ে এহুদা-গোষ্ঠীর এলাকার সোখোতে গেল। তারা গিয়ে সোখো ও অসেখা গ্রামের মাঝামাঝি এফস্‌দম্মীম গ্রামে ছাউনি ফেলল। তালুত ও বনি-ইসরাইলরা জমায়েত হয়ে এলা উপত্যকায় ছাউনি ফেলল এবং ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য সৈন্য সাজাল। এক দিকের পাহাড়ে দাঁড়াল ফিলিস্তিনীরা এবং অন্য দিকের পাহাড়ে দাঁড়াল বনি-ইসরাইলরা। তাদের মাঝখানে রইল এলা উপত্যকা। ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে জালুত নামে এক বীর যোদ্ধা তাদের সৈন্যদল থেকে বের হয়ে আসল। সে ছিল গাৎ শহরের লোক। লম্বায় সে ছিল সাড়ে ছয় হাত। তার মাথায় ছিল একটা ব্রোঞ্জের টুপী আর গায়ে ছিল মাছের আঁশের মত তৈরী ব্রোঞ্জের জামা, যার ওজন ছিল ষাট কেজি। তাঁর হাঁটু থেকে গোড়ালী পর্যন্ত ব্রোঞ্জ দিয়ে ঢাকা ছিল, আর তার কাঁধে ঝুলানো ছিল ব্রোঞ্জের তলোয়ার। তার বর্শার ডাঁটিটা ছিল তাঁতীদের বীমের মত আর সেটার লোহার ফলাটার ওজন ছিল সাত কেজি দু’শো গ্রাম। তার ঢাল বহনকারী তার আগে আগে চলত। জালুত দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ইসরাইলের সৈন্যদলকে বলল, “কেন তোমরা যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজাতে এসেছ? আমি একজন ফিলিস্তিনী আর তোমরা তো মাত্র তালুতের চাকর। তোমাদের পক্ষ থেকে তোমরা একজনকে বেছে নাও; সে আমার কাছে নেমে আসুক। যদি সে আমার সংগে যুদ্ধ করে আমাকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে আমরা তোমাদের চাকর হব; কিন্তু যদি আমি তাকে মেরে ফেলতে পারি তবে তোমরা আমাদের চাকর হয়ে চাকরের কাজ করবে।” সেই ফিলিস্তিনী আরও বলল, “আমি আজ ইসরাইলের সৈন্যদলকে টিটকারি দিয়ে বলছি, আমার সংগে যুদ্ধ করবার জন্য তোমরা একজন লোক দাও।” তার এই সব কথা শুনে তালুত ও অন্যান্য বনি-ইসরাইলরা ভীষণ ভয় পেলেন। দাউদের পিতা ইয়াসি এহুদা এলাকার ইফ্রাথা, অর্থাৎ বেথেলহেম গ্রামে বাস করতেন। তাঁর আটটি ছেলে ছিল। তালুতের রাজত্বের সময়ে তিনি বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াসির ছেলেদের মধ্যে প্রথম তিনজন তালুতের সংগে যুদ্ধে গিয়েছিল। যে তিনজন যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের মধ্যে বড়টির নাম ইলীয়াব, দ্বিতীয়টির নাম অবীনাদব এবং তৃতীয়টির নাম শম্ম। তাঁর ছেলেদের মধ্যে দাউদই ছিলেন সবার ছোট। প্রথম তিনজন তালুতের সংগে গিয়েছিল, কিন্তু দাউদ তালুতের কাছেও থাকতেন, আবার তাঁর বাবার ভেড়া চরাবার জন্য বেথেলহেমেও যেতেন। সেই ফিলিস্তিনী চল্লিশ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্য উঠবার ও ডুববার সময় এগিয়ে এসে নিজেকে দেখাত। একদিন ইয়াসি তাঁর ছেলে দাউদকে বললেন, “তুমি তোমার ভাইদের জন্য এই আঠারো কেজি ভাজা শস্য আর এই দশটা রুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি সৈন্য-ছাউনিতে তাদের কাছে যাও, আর এই দশ তাল পনীর তাদের হাজারপতির জন্য নিয়ে যাও। তোমার ভাইয়েরা কেমন আছে তা দেখে এস আর তাদের কাছ থেকে কোন একটা চিহ্ন নিয়ে এস। তালুত ও তোমার ভাইয়েরা আর সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্যেরা এলা উপত্যকায় আছে এবং ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ করছে।” দাউদ খুব ভোরে উঠেই অন্য একজন রাখালের হাতে তাঁর ভেড়ার পালের ভার দিলেন। তারপর ইয়াসির হুকুম মত তিনি সব জিনিস নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। তিনি যখন ছাউনির কাছে পৌঁছালেন তখন ইসরাইলীয় সৈন্যেরা সারি বেঁধে যুদ্ধের হাঁক দিতে দিতে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বনি-ইসরাইলরা ও ফিলিস্তিনীরা যুদ্ধ করবার জন্য মুখোমুখি তাদের সৈন্য সাজাল। তখন দাউদ তাঁর জিনিসগুলো মাল-রক্ষকের কাছে রেখে দৌড়ে সৈন্যদলের মধ্যে ঢুকে ভাইদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তারা কেমন আছে। তিনি যখন ভাইদের সংগে কথা বলছিলেন তখন গাৎ শহরের সেই ফিলিস্তিনী বীর জালুত তার সৈন্যদল থেকে বের হয়ে আগের মতই কথা বলতে লাগল, আর দাউদ তা শুনলেন। এদিকে ইসরাইলীয় সৈন্যেরা সবাই ঐ লোকটিকে দেখে ভীষণ ভয়ে তার সামনে থেকে পালিয়ে গেল। বনি-ইসরাইলরা বলাবলি করছিল, “ঐ যে লোকটা বার বার বের হয়ে আসে, ওকে তোমরা দেখেছ তো? সে বনি-ইসরাইলদের টিটকারি দিতে আসে। ঐ লোকটিকে যে মেরে ফেলতে পারবে বাদশাহ্‌ তাকে প্রচুর ধন-সম্পত্তি দেবেন। তাঁর মেয়েকেও তিনি তার সংগে বিয়ে দেবেন আর ইসরাইল দেশে তার পরিবারকে খাজনা ও বাদশাহ্‌র অন্যান্য দাবি-দাওয়া থেকে রেহাই দেবেন।” যে লোকেরা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল দাউদ তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “যে এই ফিলিস্তিনীকে মেরে ফেলে বনি-ইসরাইলদের উপর থেকে এই অসম্মান দূর করবে তার প্রতি কি করা হবে? এই খৎনা-না-করানো ফিলিস্তিনীটা কে, যে জীবন্ত আল্লাহ্‌র সৈন্যদলকে টিটকারি দেয়?” তাতে লোকেরা যা বলাবলি করছিল সেইমতই তাঁকে জানানো হল যে, সেই ফিলিস্তিনীকে যে হত্যা করবে তার জন্য কি কি করা হবে। দাউদের বড় ভাই ইলীয়াব লোকদের সংগে তাঁর কথাবার্তা শুনে রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি বললেন, “তুই কেন এখানে এসেছিস? মরুভূমিতে ভেড়াগুলো কার কাছে রেখে এসেছিস? তোর দেমাক আর মনের দুষ্টামির কথা আমার জানা আছে। তুই যুদ্ধ দেখতে এসেছিস, তাই না?” দাউদ বললেন, “বাঃ, আমি কি করলাম? আমি তো কেবল একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছি।” এই বলে তিনি অন্য লোকের কাছে গিয়ে তাকে সেই একই কথা জিজ্ঞাসা করলেন আর লোকেরা তাঁকে আগের মতই জবাব দিল। দাউদ যা বলছিলেন তা অন্যেরা শুনে তালুতকে জানাল। তখন তালুত তাঁকে ডেকে পাঠালেন। দাউদ তালুতকে বললেন, “ঐ ফিলিস্তিনীটাকে দেখে কারও ঘাবড়াবার দরকার নেই। আপনার এই গোলাম গিয়ে তার সংগে যুদ্ধ করবে।” তালুত বললেন, “তুমি ঐ ফিলিস্তিনীটার সংগে কি করে যুদ্ধ করবে? তুমি তো মাত্র সেদিনকার ছেলে, আর ঐ ফিলিস্তিনীটা অল্প বয়স থেকেই যোদ্ধা।” সিংহ, ভল্লুক দুই-ই আপনার এই গোলামের হাতে মারা পড়েছে, আর এই খৎনা-না-করানো ফিলিস্তিনীটার দশাও ঐগুলোর মত হবে, কারণ সে জীবন্ত আল্লাহ্‌র সৈন্যদলকে টিটকারি দিয়েছে।” দাউদ আরও বললেন, “মাবুদ, যিনি আমাকে সিংহ আর ভল্লুকের থাবা থেকে রক্ষা করেছেন, তিনিই আমাকে ঐ ফিলিস্তিনীটার হাত থেকেও রক্ষা করবেন।” তখন তালুত দাউদকে বললেন, “তবে যাও, মাবুদ তোমার সংগে থাকুন।” এই বলে তালুত তাঁর নিজের পোশাক দাউদকে পরিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর মাথায় দিলেন ব্রোঞ্জের টুপী আর গায়ে দিলেন যুদ্ধের সাজ। দাউদ তাঁর পোশাকের উপরে তালুতের তলোয়ারটা বেঁধে হাঁটতে চেষ্টা করলেন, কারণ আগে তিনি তা কখনও করেন নি। তিনি তালুতকে বললেন, “এই সব পরে আমি যেতে পারব না, কারণ এর আগে আমি কখনও তা করি নি।” এই বলে তিনি সেগুলো খুলে ফেললেন। তারপর তাঁর লাঠিখানা তিনি হাতে নিলেন এবং ছোট্ট পাহাড়ী নদীর মধ্য থেকে পাঁচটা মসৃণ পাথর বেছে নিয়ে তাঁর চামড়ার থলির মধ্যে রাখলেন। এই রকম থলি রাখালেরা ব্যবহার করত। তারপর তাঁর ফিংগাটা নিয়ে তিনি সেই ফিলিস্তিনীর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন, আর সেই ফিলিস্তিনীও দাউদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তার ঢাল বহনকারী ঢাল নিয়ে তার সামনে সামনে আসছিল। সেই ফিলিস্তিনী দাউদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে তাকে তুচ্ছ করল, কারণ দাউদের বয়স অল্প ছিল। তাঁর গায়ের রং লাল্‌চে এবং চেহারা সুন্দর ছিল। জালুত দাউদকে বলল, “আমি কি কুকুর যে, তুই লাঠি নিয়ে আমার কাছে আসছিস্‌?” সে তার দেব-দেবীর নাম করে দাউদকে বদদোয়া দিতে লাগল। সে দাউদকে আরও বলল, “এগিয়ে আয়; আমি তোর গায়ের গোশ্‌ত আকাশের পাখী আর বুনো পশুদের খেতে দিই।” তখন দাউদ সেই ফিলিস্তিনীকে বললেন, “তুমি আমার কাছে আসছ তলোয়ার, বর্শা আর ছোরা নিয়ে, কিন্তু আমি তোমার কাছে যাচ্ছি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, ইসরাইলীয় সৈন্যদলের মাবুদের নাম নিয়ে, যাঁকে তুমি টিটকারি দিয়েছ। মাবুদ আজকের দিনেই তোমাকে আমার হাতে তুলে দেবেন। আমি তোমাকে আঘাত করব আর তোমার মাথা কেটে নেব। আজকেই আমি ফিলিস্তিনী সৈন্যদের লাশ আকাশের পাখী ও দুনিয়ার পশুদের খেতে দেব। তা দেখে দুনিয়ার সবাই জানতে পারবে যে, বনি-ইসরাইলদের পক্ষে আল্লাহ্‌ বলতে একজন আছেন। যে সমস্ত লোক আজ এখানে রয়েছে তারাও জানতে পারবে যে, মাবুদ কোন তলোয়ার বা বর্শা দিয়ে উদ্ধার করেন না, কারণ এই যুদ্ধ মাবুদের; আর তিনি আমাদের হাতে তোমাদের তুলে দেবেন।” ঐ ফিলিস্তিনী যখন দাউদকে আক্রমণ করবার জন্য এগিয়ে আসতে লাগল তখন দাউদও তার কাছে যাবার জন্য বিপক্ষের সৈন্যদলের দিকে দৌড়ে গেলেন, আর তাঁর থলি থেকে একটা পাথর নিয়ে ফিংগাতে বসিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে সেই ফিলিস্তিনীর কপালে সেটা ছুঁড়ে মারলেন। পাথরটা তার কপালে বসে গেলে সে মুখ থুব্‌ড়ে মাটিতে পড়ে গেল। তখন ইসরাইল আর এহুদার লোকেরা চিৎকার করে উঠল এবং গয় ও ইক্রোণের দরজা পর্যন্ত ফিলিস্তিনীদের তাড়া করে নিয়ে গেল। ফিলিস্তিনীদের আহত লোকেরা গাৎ ও ইক্রোণ পর্যন্ত শারয়িমের পথে পথে পড়ে রইল। পরে বনি-ইসরাইলরা ফিলিস্তিনীদের পিছনে তাড়া করা বন্ধ করে ফিরে এসে তাদের ছাউনি লুট করতে লাগল। দাউদ সেই ফিলিস্তিনী জালুতের মাথাটা জেরুজালেমে নিয়ে গেলেন, আর তার অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের পোশাক তিনি নিজের তাম্বুতে রাখলেন। দাউদকে সেই ফিলিস্তিনীর সংগে যুদ্ধ করতে যেতে দেখে তালুত তাঁর সেনাপতি অবনেরকে বলেছিলেন, “আচ্ছা অবনের, এই যুবকটি কার ছেলে?” জবাবে অবনের বলেছিলেন, “মহারাজ, আপনার প্রাণের কসম খেয়ে বলছি যে, আমি জানি না।” তখন বাদশাহ্‌ বলেছিলেন, “তুমি খোঁজ নাও যুবকটি কার ছেলে।” তারপর দাউদ সেই ফিলিস্তিনীকে মেরে ফিরে আসতেই অবনের তাঁকে নিয়ে তালুতের কাছে গেলেন। তাঁর হাতে তখন জালুতের মুণ্ডটা ছিল। তালুত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যুবক, তুমি কার ছেলে?” দাউদ বললেন, “আমি বেথেলহেম গ্রামের আপনার গোলাম ইয়াসির ছেলে।” তালুতের সংগে দাউদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেলে পর যোনাথনের প্রাণ আর দাউদের প্রাণ যেন একসংগে বাঁধা পড়ে গেল। তিনি দাউদকে নিজের মতই ভালবাসতে লাগলেন। তালুত সেই দিন থেকে দাউদকে নিজের কাছে রাখলেন; তাঁর বাবার কাছে আর তাঁকে ফিরে যেতে দিলেন না। দাউদকে নিজের মত ভালবাসতেন বলে যোনাথন তাঁর সংগে একটা চুক্তি করলেন। তিনি তাঁর গায়ের উপরকার লম্বা কোর্তা খুলে দাউদকে দিলেন, আর তাঁর যুদ্ধের পোশাক, এমন কি, তাঁর তলোয়ার, ধনুক ও কোমর-বাঁধনিও তাঁকে দিলেন। তালুত দাউদকে যেখানে পাঠাতেন দাউদ সেখানে যেতেন এবং বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সফলতা লাভ করতেন। সেইজন্য তালুত তাঁকে সৈন্যদলের একজন সেনাপতি করলেন। এতে সমস্ত লোক খুশী হল এবং তালুতের কর্মচারীরাও খুশী হল। দাউদ সেই ফিলিস্তিনী জালুতকে হত্যা করবার পর লোকেরা যখন বাড়ী ফিরে আসছিল তখন ইসরাইলের সমস্ত গ্রাম ও শহর থেকে মেয়েরা নেচে নেচে আনন্দের গান গেয়ে এবং খঞ্জনী ও তিনতারা বাজাতে বাজাতে বাদশাহ্‌ তালুতকে সালাম জানাতে বের হয়ে আসল। তারা নাচতে নাচতে এই গান গাইছিল, “তালুত মারলেন হাজার হাজার, আর দাউদ মারলেন অযুত অযুত।” এই গান শুনে তালুতের খুব রাগ হল। তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “ওরা দাউদের বিষয়ে অযুত অযুতের কথা বলল অথচ আমার বিষয়ে বলল হাজার হাজার। এর পর রাজ্য ছাড়া দাউদের আর কি পাওয়ার বাকী রইল?” সেই সময় থেকে তালুত দাউদকে হিংসার চোখে দেখতে লাগলেন। পর দিন আল্লাহ্‌র কাছ থেকে একটা খারাপ রূহ্‌ তালুতের উপর আসল। তিনি নিজের বাড়ীর মধ্যে আবোল-তাবোল কথাবার্তা বলতে লাগলেন। তখন দাউদ অন্যান্য দিনের মত তাঁর সামনে বীণা বাজাতে লাগলেন। তালুতের হাতে ছিল একটা বর্শা। তিনি মনে মনে বললেন, “আমি দাউদকে দেয়ালের সংগে গেঁথে ফেলব।” এই ভেবে তিনি বর্শাটা ছুঁড়ে মারলেন, কিন্তু দাউদ দু’বার তা এড়িয়ে গেলেন। তালুত দাউদকে ভয় করতে লাগলেন, কারণ মাবুদ দাউদের সংগে ছিলেন কিন্তু তালুতকে তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেইজন্য তালুত দাউদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলেন এবং তাঁকে সৈন্যদলে হাজারপতির পদে নিযুক্ত করলেন। তাতে দাউদ সৈন্যদলের নেতা হয়ে তাদের পরিচালনা করতে লাগলেন। মাবুদ তাঁর সংগে ছিলেন বলে তিনি সব কিছুতেই বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সফলতা লাভ করতে লাগলেন। দাউদ বেশ সফলতা লাভ করেছেন দেখে তালুত তাঁকে ভয়ের চোখে দেখতে লাগলেন। কিন্তু ইসরাইল ও এহুদার সমস্ত লোক দাউদকে ভালবাসত, কারণ সৈন্যদের নেতা হয়ে তিনি তাদের পরিচালনা করতেন। তালুত একদিন দাউদকে বললেন, “আমার বড় মেয়ে মেরবকে আমি তোমার সংগে বিয়ে দেব। তুমি কেবল আমার পক্ষে থেকে বীরের মত মাবুদের জন্য যুদ্ধ করবে।” কিন্তু তালুতের মনের কথাটা ছিল এই যে, তিনি দাউদের উপর হাত না উঠালেও দাউদ যেন ফিলিস্তিনীদের হাতে মারা পড়ে। দাউদ তালুতকে বললেন, “আমিই বা কে আর আমার পরিবার ও ইসরাইলের মধ্যে আমার বাবার বংশই বা এমন কি যে, আমি বাদশাহ্‌র জামাই হতে পারি?” কিন্তু দাউদের সংগে তালুতের মেয়ে মেরবের বিয়ের সময় উপস্থিত হলে দেখা গেল দাউদকে বাদ দিয়ে মহোলাৎ গ্রামের অদ্রীয়েলের সংগে মেরবের বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। তবে তালুতের আর এক মেয়ে মীখল দাউদকে ভালবাসতেন। লোকেরা যখন সেই কথা তালুতকে জানাল তখন তালুত খুশীই হলেন। তিনি মনে মনে বললেন, “আমি দাউদকে আমার মেয়ে দেব যাতে মেয়েটি তার কাছে একটা ফাঁদ হয় আর ফিলিস্তিনীরা তার বিরুদ্ধে ওঠে।” এই ভেবে তালুত দাউদকে বললেন, “আমার জামাই হবার জন্য এই তোমার দ্বিতীয় সুযোগ।” তালুত তাঁর কর্মচারীদের এই হুকুম দিলেন, “তোমরা গোপনে দাউদের সংগে আলাপ করে তাকে এই কথা বল, ‘বাদশাহ্‌ আপনার উপর খুশী হয়েছেন, আর তাঁর কর্মচারীরা সবাই আপনাকে পছন্দ করে। কাজেই আপনি এবার বাদশাহ্‌র জামাই হন।’ ” তারা এই সব কথা দাউদকে জানালে পর তিনি বললেন, “বাদশাহ্‌র জামাই হওয়াটা কি তোমরা একটা সামান্য ব্যাপার বলে মনে কর? আমি তো গরীব, একজন সামান্য লোক।” দাউদ যা বলেছিলেন তালুতের কর্মচারীরা তা তালুতকে বলল। তখন তালুত বললেন, “তোমরা দাউদকে বল যে, বাদশাহ্‌ কেবল তাঁর শত্রুদের উপর প্রতিশোধ হিসাবে একশো জন ফিলিস্তিনীর পুরুষাংগের সামনের চামড়া চান, অন্য কোন মহরানা চান না।” এইভাবে ফিলিস্তিনীদের হাতে যেন দাউদ শেষ হয়ে যায়, এটাই ছিল তালুতের মতলব। তালুত যখন বুঝতে পারলেন যে, মাবুদ দাউদের সংগে আছেন এবং তাঁর মেয়ে মীখলও দাউদকে ভালবাসে, তখন দাউদের প্রতি তাঁর ভয় আরও বেড়ে গেল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দাউদের শত্রু হয়ে রইলেন। এর পর ফিলিস্তিনীদের সেনাপতিরা যুদ্ধ করবার জন্য বেরিয়ে আসতে লাগল। যতবার তারা বেরিয়ে আসল ততবারই তালুতের অন্যান্য কর্মচারীদের চেয়ে দাউদ বেশী বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সফলতা লাভ করলেন। এতে তাঁর খুব সুনাম হল। তালুত তাঁর ছেলে যোনাথনকে ও সমস্ত কর্মচারীদের বললেন যেন তারা দাউদকে হত্যা করে। কিন্তু দাউদের প্রতি তালুতের ছেলে যোনাথনের খুব টান ছিল। তিনি দাউদকে বললেন, “আমার বাবা তালুত তোমাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করছেন। শোন, তুমি কাল সকালে সাবধানে থেকো। একটা গোপন জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে থেকো। তুমি যে মাঠে লুকিয়ে থাকবে আমি আমার বাবাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াব। আমি তাঁর কাছে তোমার কথা বলব আর যা জানতে পারব তা তোমাকে জানাব।” যোনাথন তাঁর পিতা তালুতের কাছে দাউদের সুনাম করে বললেন, “মহারাজ, আপনার গোলাম দাউদের বিরুদ্ধে আপনি কোন গুনাহ্‌ করবেন না। সে তো আপনার বিরুদ্ধে কোন গুনাহ্‌ করে নি, বরং সে যা করেছে তাতে আপনার অনেক উপকার হয়েছে। সে তার প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেই ফিলিস্তিনীকে মেরে ফেলেছে, আর মাবুদ সমস্ত ইসরাইলকে মহাজয় দান করেছেন; আপনি তো তা দেখে খুশী হয়েছিলেন। তবে এখন আপনি অকারণে দাউদকে মেরে ফেলে কেন একজন নির্দোষ লোকের রক্তপাত করে তার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবেন?” তখন তালুত যোনাথনের কথা শুনে কসম খেয়ে বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম তাকে মেরে ফেলা হবে না।” পরে যোনাথন দাউদকে ডেকে তাঁকে সমস্ত কথা জানালেন। তিনি তাঁকে তালুতের কাছে নিয়ে গেলেন এবং দাউদ আগের মতই তালুতের কাছে রইলেন। তারপর আবার যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন দাউদ বের হয়ে ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি তাদের এত লোককে হত্যা করলেন যে, তারা তাঁর সামনে থেকে পালিয়ে গেল। পরে মাবুদের কাছ থেকে একটা খারাপ রূহ্‌ তালুতের উপর আসল। তালুত তখন তাঁর ঘরে বসে ছিলেন এবং তাঁর হাতে একটা বর্শা ছিল, আর দাউদ বীণা বাজাচ্ছিলেন। তিনি বর্শা দিয়ে দাউদকে দেয়ালে গেঁথে ফেলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দাউদ তাঁর সামনে থেকে সরে গেলেন বলে বর্শাটা দেয়ালে ঢুকে গেল। সেই রাতে দাউদ পালিয়ে রক্ষা পেলেন। দাউদের উপর নজর রাখবার জন্য তালুত তাঁর বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে দিলেন যাতে পরের দিন সকালে তাঁকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মীখল তাঁকে সব কিছু জানিয়ে বললেন, “আজ রাতে তুমি যদি প্রাণ নিয়ে না পালাও তবে কালই তুমি মারা পড়বে।” কাজেই মীখল দাউদকে জানালা দিয়ে নীচে নামিয়ে দিলেন আর তিনি পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেলেন। মীখল তখন পারিবারিক দেবমূর্তিগুলো নিয়ে বিছানায় রাখলেন এবং বিছানার মাথার দিকে দিলেন ছাগলের লোমের একটা বালিশ; তারপর সেগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। দাউদকে ধরবার জন্য তালুত লোক পাঠালে মীখল বললেন, “উনি অসুস্থ।” এই খবর শুনে তালুত দাউদকে দেখবার জন্য সেই লোকদেরই আবার পাঠালেন এবং বলে দিলেন, “দাউদকে খাট সুদ্ধই নিয়ে এস; আমি তাকে মেরে ফেলব।” লোকগুলো ঘরে ঢুকে বিছানার উপর সেই দেবমূর্তিগুলো এবং বিছানার মাথার দিকে ছাগলের লোমের বালিশটা দেখতে পেল। পরে তালুত মীখলকে বললেন, “তুমি কেন এইভাবে আমাকে ঠকালে? তুমি আমার শত্রুকে ছেড়ে দেওয়াতে সে পালিয়ে গেছে।” মীখল তাঁকে বললেন, “তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে যেতে দাও, নইলে আমি তোমাকে খুন করব।’ ” এদিকে দাউদ পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। তিনি রামায় শামুয়েলের কাছে গেলেন এবং তালুত তাঁর উপর যা যা করেছেন তা সবই তাঁকে জানালেন। এর পর দাউদ আর শামুয়েল গিয়ে নায়োৎ পাড়ায় বাস করতে লাগলেন। তালুত খবর পেলেন যে, দাউদ রামার নায়োৎ পাড়ায় আছেন। এই কথা শুনে তিনি দাউদকে ধরে আনবার জন্য লোক পাঠিয়ে দিলেন। সেই লোকেরা গিয়ে দেখল একদল নবী শামুয়েলের অধীনে আল্লাহ্‌র কথা বলছেন। আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তখন তালুতের লোকদের উপরেও আসলেন আর তারাও নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কথা বলতে লাগল। তালুতকে সেই খবর জানানো হলে তিনি আরও লোক পাঠালেন কিন্তু তারাও গিয়ে নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কথা বলতে লাগল। তালুত তৃতীয়বার লোক পাঠালেন আর তারাও গিয়ে নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কথা বলতে লাগলেন। শেষে তালুত নিজেই রামায় গেলেন এবং সেখূতে পানি জমা করে রাখবার যে বড় জায়গা ছিল সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “শামুয়েল আর দাউদ কোথায়?” একজন বলল, “রামার নায়োৎ পাড়ায়।” কাজেই তালুত রামার নায়োৎ পাড়ার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তাঁর উপরেও আসলেন; তাতে তিনি সারাটা পথ নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কথা বলতে বলতে নায়োতে পৌঁছালেন। তিনি তাঁর পোশাক খুলে ফেলে শামুয়েলের সামনে নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কথা বলতে লাগলেন। তিনি সারা দিন ও সারা রাত কাপড়-চোপড় ছাড়াই পড়ে রইলেন। সেইজন্যই লোকে বলে, “তালুতও কি তবে নবীদের মধ্যে একজন?” এর পর দাউদ রামার নায়োৎ পাড়া থেকে পালিয়ে যোনাথনের কাছে গেলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি করেছি? আমার দোষ কি? তোমার বাবার বিরুদ্ধে আমি কি গুনাহ্‌ করেছি যে, তিনি আমাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছেন?” যোনাথন বললেন, “কখনও না, তোমাকে মেরে ফেলা হবে না। দেখ, আমার বাবা আমাকে না জানিয়ে ছোট-বড় কোন কাজই করেন না। তবে এই কথা তিনি আমার কাছ থেকে কেন লুকাবেন? এ হতেই পারে না।” কিন্তু দাউদ আবার কসম খেয়ে বললেন, “তোমার বাবা খুব ভাল করেই জানেন যে, তুমি আমাকে ভালবাস। তাই হয়তো তিনি মনে মনে ভেবেছেন, যোনাথনকে এই বিষয়ে না জানানোই ভাল, সে দুঃখ পাবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র কসম এবং তোমার প্রাণের কসম খেয়ে আমি বলছি যে, মৃত্যু আমার কাছ থেকে মাত্র এক পা দূরে।” তখন যোনাথন দাউদকে বললেন, “তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তোমার জন্য তা-ই করব।” দাউদ বললেন, “দেখ, কাল অমাবস্যার উৎসব। বাদশাহ্‌র সংগে আমার খেতে বসবার কথা আছে। কিন্তু তুমি আমাকে যেতে দাও। আমি পরশু রাত পর্যন্ত মাঠের মধ্যে লুকিয়ে থাকব। যদি তোমার বাবা আমার খোঁজ করেন তবে তুমি তাঁকে বলবে, ‘দাউদ বেথেলহেমে তার বাড়ীতে তাড়াতাড়ি যাবে বলে আমার কাছে মিনতি করে অনুমতি চেয়েছিল, কারণ সেখানে তাদের বংশের বাৎসরিক পশু-কোরবানী হচ্ছে।’ তিনি যদি বলেন, ‘ভাল,’ তবে তোমার গোলাম আমি নিরাপদ; কিন্তু যদি খুব রেগে ওঠেন তবে তুমি জেনো যে, তিনি আমার ক্ষতি করবেন বলে মন স্থির করেছেন। কাজেই তুমি এখন আমার প্রতি বিশ্বস্ত হও, কারণ মাবুদকে সাক্ষী রেখে তুমি আমার সংগে একটা চুক্তি করেছ। আমি যদি দোষ করে থাকি তবে তুমি নিজেই আমাকে মেরে ফেল, তোমার বাবার হাতে আমাকে তুলে দেবার দরকার কি?” যোনাথন বললেন, “তুমি কখনও এমন চিন্তা কোরো না। যদি আমি জানতে পারি যে, আমার পিতা তোমার ক্ষতি করাই স্থির করেছেন, তবে নিশ্চয়ই আমি তা তোমাকে জানাব।” তখন দাউদ বললেন, “এই ব্যাপারে তোমার বাবা যদি তোমার সংগে খারাপ ব্যবহার করেন, তবে কে তা আমাকে জানাবে?” যোনাথন বললেন, “চল, আমরা মাঠে যাই।” এই বলে তাঁরা দু’জন বের হয়ে একসংগে মাঠে গেলেন। তারপর যোনাথন দাউদকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌ সাক্ষী, কাল কিংবা পরশু এই সময়ে আমি আমার বাবার সংগে কথা বলে দেখব। যদি তোমার পক্ষে ভাল বুঝি তবে আমি তখনই লোক পাঠিয়ে তোমাকে জানাব। যদি আমার বাবা তোমার ক্ষতিই করতে চান আর আমি তোমাকে না জানাই এবং নিরাপদে তোমাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা না করি তবে মাবুদ যেন আমাকে শাস্তি দেন এবং তা ভীষণভাবেই দেন। মাবুদ যেমন আমার বাবার সংগে ছিলেন তেমনি তোমার সংগেও থাকুন। যোনাথন তখন দাউদ ও তাঁর বংশধরদের সংগে এই বলে চুক্তি করলেন, “মাবুদ যেন দাউদের শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।” যোনাথন দাউদকে নিজের মতই ভালবাসতেন বলে তিনি দাউদকে দিয়ে তাঁর প্রতি দাউদের ভালবাসার কসম আবার খাইয়ে নিলেন। পরে যোনাথন দাউদকে বললেন, “আগামীকাল অমাবস্যার উৎসব। সেখানে তোমার আসন খালি থাকলে তুমি যে নেই তা চোখে পড়বে। তুমি আগে যেখানে লুকিয়ে ছিলে পরশু দিন তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে এষল নামে বড় পাথরটার কাছে অপেক্ষা কোরো। আমি যেন কোন কিছু লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ছি এইভাবে সেই পাথরের পাশে তিনটা তীর ছুঁড়ব। তারপর একটা ছেলেকে এই বলে পাঠিয়ে দেব, ‘যাও, তীরগুলো খুঁজে নিয়ে এসো।’ যদি আমি তাকে বলি, ‘তীরগুলো তোমার এদিকে আছে, নিয়ে এস,’ তাহলে তুমি চলে এসো, কারণ আল্লাহ্‌র কসম তুমি নিরাপদ, তোমার কোন ভয় নেই। কিন্তু যদি ছেলেটিকে বলি, ‘তোমার ঐদিকে তীরগুলো রয়েছে,’ তাহলে তুমি চলে যেয়ো, বুঝবে মাবুদই তোমাকে চলে যেতে বলছেন। মনে রেখো, তোমার ও আমার মধ্যে এই যে চুক্তি হল মাবুদই তার চিরকালের সাক্ষী হয়ে রইলেন।” তালুত সেই দিন কিছুই বললেন না, কারণ তিনি ভাবলেন, হয়তো এমন কিছু হয়ে গেছে যাতে দাউদ নাপাক হয়েছে; নিশ্চয়ই সে পাক-সাফ অবস্থায় নেই। পরের দিন, অর্থাৎ অমাবস্যা-উৎসবের দ্বিতীয় দিনেও দাউদের আসনটা খালি পড়ে রইল। তখন তালুত তাঁর ছেলে যোনাথনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়াসির ছেলে খেতে আসে নি কেন? কালও আসে নি, আজও আসে নি।” যোনাথন জবাবে বললেন, “দাউদ বেথেলহেমে যাবার অনুমতি চেয়ে আমাকে খুব মিনতি করেছিল। সে আমাকে বলেছিল, ‘দয়া করে আমাকে যেতে দাও; আমাদের বংশের লোকেরা গ্রামে একটা কোরবানী দিচ্ছে এবং আমার ভাই আমাকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হুকুম দিয়েছেন। যদি আমার প্রতি তোমার মনে একটু দয়া থাকে তবে আমাকে গিয়ে আমার ভাইদের দেখে আসবার অনুমতি দাও।’ সেইজন্যই সে মহারাজার ভোজে আসে নি।” এই কথা শুনে তালুত যোনাথনের উপর রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ওরে বিদ্রোহিনী স্ত্রীলোকের জারজ সন্তান! আমি কি জানি না যে, তুই ইয়াসির ছেলের পক্ষ নিয়েছিস্‌ আর তাতে তুই নিজের উপর এবং তোর মায়ের উপর লজ্জা ডেকে এনেছিস? যতদিন ইয়াসির ছেলে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে ততদিন তুই স্থির থাকবি না, তোর রাজ্যও স্থির থাকবে না। কাজেই এখনই লোক পাঠিয়ে তাকে আমার কাছে নিয়ে আয়, তাকে মরতেই হবে।” যোনাথন তাঁর বাবাকে বললেন, “কেন তাকে মরতে হবে? সে কি করেছে?” তখন তালুত যোনাথনকে হত্যা করার জন্য বর্শা ছুঁড়লেন। এতে যোনাথন বুঝতে পারলেন, তাঁর পিতা দাউদকে হত্যা করবেন বলে ঠিক করেছেন। তখন যোনাথন ভীষণ রেগে গিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন এবং সেই দিনের ভোজে কিছুই খেলেন না। তাঁর পিতা দাউদকে অপমান করেছিলেন বলে তাঁর মনে খুব দুঃখ হল। দাউদের সংগে যোনাথনের যে ব্যবস্থা হয়েছিল সেই অনুসারে পরদিন সকালে যোনাথন বের হয়ে মাঠে গেলেন। তাঁর সংগে একটি ছোট ছেলে ছিল। তিনি ছেলেটিকে বললেন, “আমি যে তীর ছুঁড়ব তুমি দৌড়ে গিয়ে তা খুঁজে আন।” ছেলেটি যখন দৌড়াচ্ছিল তখন তিনি ছেলেটিকে ছাড়িয়ে সামনের দিকে তীর ছুঁড়লেন। যোনাথনের তীরটা যেখানে পড়েছিল ছেলেটি সেখানে গেলে পর তিনি তাকে ডেকে বললেন, “তীরটা তোমার ঐদিকে।” তারপর তিনি চেঁচিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাও, থেমো না।” ছেলেটি তীর কুড়িয়ে নিয়ে তার মালিকের কাছে ফিরে আসল। ছেলেটি এই সব বিষয়ের কিছুই বুঝল না, বুঝলেন কেবল যোনাথন আর দাউদ। এর পর যোনাথন তাঁর তীর-ধনুক ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি এগুলো নিয়ে শহরে ফিরে যাও।” ছেলেটি চলে গেলে পর দাউদ সেই পাথরটার দক্ষিণ দিক থেকে উঠে আসলেন। তিনি যোনাথনের সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তিনবার তাঁকে সালাম জানালেন। তারপর তাঁরা একে অন্যকে চুম্বন করে কাঁদতে লাগলেন, তবে দাউদই বেশী কাঁদলেন। যোনাথন দাউদকে বললেন, “তুমি নির্ভয়ে চলে যাও, কারণ আমরা মাবুদের নাম করে একে অন্যের কাছে কসম খেয়ে বলেছি, ‘মাবুদ তোমার ও আমার মধ্যে এবং তোমার ও আমার বংশধরদের মধ্যে চিরকাল সাক্ষী থাকবেন।’ ” এর পর দাউদ বিদায় নিলেন আর যোনাথন শহরে ফিরে গেলেন। এর পর দাউদ নোব গ্রামে ইমাম অহীমেলকের কাছে গেলেন। অহীমেলক তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে দাউদের সামনে আসলেন। তিনি দাউদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি একা কেন? কেন আপনার সংগে আর কেউ নেই?” জবাবে দাউদ ইমাম অহীমেলককে বললেন, “বাদশাহ্‌ আমাকে একটা কাজের ভার দিয়ে বলেছেন, তিনি যে কাজের হুকুম দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন তার কিছুই যেন আর কেউ জানতে না পারে। সেইজন্য আমার লোকদের আমি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছি। আপনার কাছে কি আছে? পাঁচখানা রুটি আমাকে দিন, কিংবা যা আছে তা-ই দিন।” ইমাম জবাবে দাউদকে বললেন, “আমার কাছে কোন সাধারণ রুটি নেই, তবে পবিত্র-রুটি আছে। যদি আপনার লোকেরা কোন স্ত্রীলোকের কাছে না গিয়ে থাকে তবে তা খেতে পারবে।” দাউদ বললেন, “আমাদের নিয়ম মত আমরা সত্যিই কোন স্ত্রীলোকের কাছে যাই নি। সৈন্যদের নিয়ে আমি যখন কোন সাধারণ কাজে বের হই তখনও আমার সৈন্যেরা পাক-সাফ থাকে। তবে আজ তারা কত না বেশী পাক-সাফ আছে।” কাজেই ইমাম দাউদকে সেই পবিত্র-রুটি দিলেন, কারণ সেই রুটি ছাড়া আর অন্য কোন রুটি তাঁর কাছে ছিল না। ঐ দিনই সেই রুটি মাবুদের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় গরম রুটি রাখা হয়েছিল। দোয়েগ নামে তালুতের একজন ইদোমীয় কর্মচারী সেই দিন মাবুদের উদ্দেশে কোন কাজে সেখানে আট্‌কে গিয়েছিল। সে ছিল তালুতের প্রধান রাখাল। দাউদ অহীমেলককে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে আপনার কাছে কোন বর্শা বা তলোয়ার নেই? বাদশাহ্‌র কাজ জরুরী ছিল বলে আমি নিজের তলোয়ার বা অন্য কোন অস্ত্র সংগে আনতে পারি নি।” ইমাম বললেন, “এলা উপত্যকায় আপনি যে ফিলিস্তিনী জালুতকে মেরে ফেলেছিলেন তার তলোয়ারখানা এখানে আছে। ওটা এফোদের পিছনে কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। ইচ্ছা করলে আপনি ওটা নিতে পারেন। ওটা ছাড়া আর কোন তলোয়ার এখানে নেই।” দাউদ বললেন, “ওটার মত তলোয়ার আর কোথায় আছে? ওটাই আমাকে দিন।” দাউদ সেই দিনই তালুতের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে গাৎ শহরের বাদশাহ্‌ আখীশের কাছে উপস্থিত হলেন; কিন্তু আখীশের লোকেরা আখীশকে বলল, “ইনি কি তাঁর দেশের বাদশাহ্‌ নন? এর সম্বন্ধেই কি লোকেরা নেচে নেচে গান গেয়ে বলে নি, ‘তালুত মারলেন হাজার হাজার আর দাউদ মারলেন অযুত অযুত?’ ” এই কথা শুনে দাউদ চিনি-ত হলেন এবং গাতের বাদশাহ্‌ আখীশকে খুব ভয় করতে লাগলেন। সেইজন্যই যতদিন তিনি তাদের কাছে ছিলেন ততদিন তাদের সামনে পাগলের ভান করতে লাগলেন। যখন তারা তাঁকে ধরল তখন তিনি পাগলের মত দরজার উপর হাবিজাবি আঁকতে এবং নিজের দাড়ির উপর মুখের লালা ফেলতে লাগলেন। তখন আখীশ তাঁর লোকদের বললেন, “তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ লোকটা পাগল, তবে কেন ওকে আমার কাছে এনেছ? পাগলের কি আমার এতই অভাব হয়েছে যে, তোমরা আমার সামনে পাগলামী করবার জন্য এই লোকটাকে ধরে এনেছ? এই রকমের একটা লোককে আমার বাড়ীতে এনেছ কেন?” দাউদ গাৎ থেকে পালিয়ে অদুল্লমের কাছে একটা গুহাতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেই কথা শুনে তাঁর ভাইয়েরা এবং তাঁর পিতার বংশের লোকেরা তাঁর কাছে গেলেন। যারা বিপদে এবং ঋণের ভারে কষ্ট পাচ্ছিল এবং যাদের মনে অসন্তোষের ভাব ছিল তারা সবাই দাউদের কাছে গিয়ে জমায়েত হল। দাউদ তাদের সেনাপতি হলেন। এইভাবে প্রায় চারশো পুরুষ লোক তাঁর সংগী হল। পরে তিনি সেখান থেকে মোয়াব দেশের মিসপী গ্রামে গেলেন। তিনি মোয়াবের বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমার সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কি যতদিন আমি তা জানতে না পারি ততদিন দয়া করে আমার মা-বাবাকে আপনার কাছে রাখুন।” তারপর তিনি তাঁর মা-বাবাকে এনে মোয়াবের বাদশাহ্‌র কাছে রাখলেন। যতদিন দাউদ কেল্লা নামে পাহাড়টায় রইলেন ততদিন তাঁরা মোয়াবের বাদশাহ্‌র কাছে থাকলেন। পরে গাদ নামে একজন নবী দাউদকে বললেন, “তুমি কেল্লা পাহাড়ে আর থেকো না, এহুদা এলাকায় চলে যাও।” তখন দাউদ সেই জায়গা ছেড়ে হেরেৎ এলাকায় যে বন ছিল সেখানে চলে গেলেন। তালুত শুনতে পেলেন যে, দাউদ ও তাঁর সংগীদের খোঁজ পাওয়া গেছে। তালুত তখন গিবিয়া শহরে পাহাড়ের উপরে একটা ঝাউ গাছের নীচে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল বর্শা আর তাঁর সমস্ত কর্মচারীরা তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তাদের বললেন, “বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকেরা শোন, ইয়াসির ছেলে কি তোমাদের সবাইকে জায়গা-জমি ও আংগুর ক্ষেত দেবে? সে কি তোমাদের সবাইকে হাজার সৈন্য বা শত সৈন্যের উপরে সেনাপতি নিযুক্ত করবে? তোমরা সবাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ আর সেইজন্যই ইয়াসির ছেলের সংগে যে আমার ছেলে চুক্তি করেছে তা আমাকে তোমরা কেউ জানাও নি। আমার ছেলে যে আজ আমার চাকরকে আমারই বিরুদ্ধে ওৎ পেতে বসে থাকবার উসকানি দিচ্ছে সেই কথা আমাকে তোমরা কেউ জানাও নি কিংবা আমার জন্য কারও দুঃখ নেই।” ইদোমীয় দোয়েগ সেই সময় তালুতের কর্মচারীদের পাশেই ছিল। সে বলল, “আমি ইয়াসির ছেলেকে নোব গ্রামে অহীটূবের ছেলে অহীমেলকের কাছে যেতে দেখেছি। তার সম্বন্ধে মাবুদের ইচ্ছা কি অহীমেলক তা মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি তাকে খাবার-দাবার দিয়েছেন আর ফিলিস্তিনী জালুতের তলোয়ারটাও দিয়েছেন।” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ তালুত অহীটূবের ছেলে ইমাম অহীমেলককে ও তাঁর পিতার বংশের লোকদের, অর্থাৎ নোবের সমস্ত ইমামদের ডেকে আনবার জন্য লোক পাঠালেন। তাঁরা সবাই বাদশাহ্‌র কাছে আসলেন। তখন তালুত বললেন, “শোন, অহীটূবের ছেলে।” তিনি বললেন, “বলুন, মহারাজ।” তালুত তাঁকে বললেন, “তুমি ও ইয়াসির ছেলে কেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ? সে যাতে আজ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে এবং ওৎ পেতে বসে থাকতে পারে সেইজন্য তুমি তাকে রুটি দিয়েছ, তলোয়ার দিয়েছ আর তার জন্য আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কি তা জিজ্ঞাসা করেছ।” এর জবাবে অহীমেলক বাদশাহ্‌কে বললেন, “মহারাজ, আপনার সমস্ত কর্মচারীদের মধ্যে আপনার জামাই দাউদের মত বিশ্বস্ত কে? তিনি আপনার দেহরক্ষী সৈন্যদের নেতা এবং আপনার পরিবারের মধ্যে একজন সম্মানিত লোক। আমি কি সেই দিনই প্রথম বার তাঁর সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কি তা জিজ্ঞাসা করেছি? কখনও না। মহারাজ, আপনার এই গোলামকে কিংবা তার পিতার বংশের লোকদের কাউকে দোষ দেবেন না। এই সব ব্যাপার সম্বন্ধে আপনার এই গোলাম কিছুই জানে না।” কিন্তু বাদশাহ্‌ বললেন, “অহীমেলক, তুমি ও তোমার পিতার বংশের সমস্ত লোকদের অবশ্যই মরতে হবে।” তারপর বাদশাহ্‌ তাঁর পাশে দাঁড়ানো সৈন্যদের বললেন, “তোমরা গিয়ে মাবুদের এই সব ইমামদের মেরে ফেল। এরা দাউদের পক্ষে গেছে। এরা জানত যে, দাউদ পালাচ্ছে, তবুও এরা আমাকে সেই কথা জানায় নি।” কিন্তু বাদশাহ্‌র কর্মচারীরা মাবুদের ইমামদের গায়ে হাত তুলতে রাজী হল না। তখন বাদশাহ্‌ দোয়েগকে বললেন, “তবে তুমিই গিয়ে ইমামদের মেরে ফেল।” ইদোমীয় দোয়েগ সেই দিন পঁচাশিজন ইমামকে হত্যা করল। ইমামদের সকলের গায়ে ছিল মসীনার এফোদ। তারপর সে ইমামদের গ্রাম নোবের উপর আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার স্ত্রী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে-শিশু, গরু-গাধা-ভেড়া সব শেষ করে দিল। অহীটূবের নাতি, অর্থাৎ অহীমেলকের একটি ছেলে কোন রকমে রক্ষা পেয়ে দাউদের কাছে পালিয়ে গেলেন। তাঁর নাম ছিল অবিয়াথর। অবিয়াথর দাউদকে খবর দিলেন যে, তালুত মাবুদের ইমামদের হত্যা করেছেন। এই কথা শুনে দাউদ অবিয়াথরকে বললেন, “ইদোমীয় দোয়েগকে সেই দিন সেখানে দেখে আমি বুঝেছিলাম যে, সে নিশ্চয়ই গিয়ে তালুতকে সব জানাবে। আপনার বাবার বংশের লোকদের সকলের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আপনি আমার কাছে থাকুন, ভয় করবেন না। যে আপনার প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে সে আমারও প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে। আপনি আমার কাছে নিরাপদে থাকতে পারবেন।” লোকেরা দাউদকে গিয়ে বলল, “দেখুন, ফিলিস্তিনীরা কিয়ীলা শহরটা আক্রমণ করেছে এবং সেখানকার খামারগুলোর শস্য লুট করছে।” দাউদ তখন মাবুদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি গিয়ে ঐ ফিলিস্তিনীদের আক্রমণ করব?” জবাবে মাবুদ তাঁকে বললেন, “জ্বী, যাও। ফিলিস্তিনীদের আক্রমণ করে কিয়ীলা রক্ষা কর।” কিন্তু দাউদের লোকেরা বলল, “এই এহুদা এলাকাতেই আমরা ভয়ে ভয়ে আছি; তার উপর কিয়ীলাতে ফিলিস্তিনী সৈন্যদের আক্রমণ করতে যাওয়া কি আরও ভয়ের ব্যাপার নয়?” তখন দাউদ আবার মাবুদকে জিজ্ঞাসা করলেন আর মাবুদ জবাবে তাঁকে বললেন, “তুমি কিয়ীলাতে যাও, আমি তোমার হাতে ফিলিস্তিনীদের তুলে দেব।” দাউদ তখন তাঁর লোকদের নিয়ে কিয়ীলাতে গেলেন এবং ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ করে তাদের গরু-ভেড়া সব নিয়ে আসলেন। তিনি ফিলিস্তিনীদের অনেক লোককে হত্যা করে কিয়ীলার লোকদের রক্ষা করলেন। অহীমেলকের ছেলে অবিয়াথর কিয়ীলাতে দাউদের কাছে পালিয়ে আসবার সময় সংগে করে মহা-ইমামের এফোদখানা নিয়ে এসেছিলেন। দাউদ কিয়ীলাতে আছেন শুনে তালুত বললেন, “আল্লাহ্‌ দাউদকে এবার আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, কারণ শহরের দরজাগুলো হুড়কা দিয়ে বন্ধ করা যায় এমন একটা জায়গায় ঢুকে সে নিজেই নিজেকে আটক করে ফেলেছে।” কিয়ীলাতে গিয়ে দাউদ ও তাঁর লোকদের ঘেরাও করবার জন্য তালুত তাঁর সমস্ত সৈন্যদের যুদ্ধ করবার ডাক দিলেন। দাউদ যখন জানতে পারলেন যে, তালুত তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তখন তিনি ইমাম অবিয়াথরকে বললেন, “আপনার এফোদটা এখানে নিয়ে আসুন।” পরে তিনি বললেন, “হে বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার গোলাম আমি নিশ্চয় করে জেনেছি যে, তালুত আমারই দরুন কিয়ীলা ধ্বংস করবার জন্য এখানে আসবার পরিকল্পনা করছেন। কিয়ীলার লোকেরা কি আমাকে তাঁর হাতে তুলে দেবে? আমি যেমন শুনেছি সেইভাবে তালুত কি সত্যিই এখানে আসবেন? হে বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার এই গোলামকে তুমি তা বলে দাও।” মাবুদ বললেন, “জ্বী, সে আসবে।” তখন দাউদ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কিয়ীলার লোকেরা কি আমাকে ও আমার লোকদের তালুতের হাতে তুলে দেবে?” মাবুদ বললেন, “জ্বী, দেবে।” এই কথা শুনে দাউদ তাঁর সংগের প্রায় ছ’শো লোক নিয়ে কিয়ীলা ছেড়ে চলে গেলেন এবং এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। দাউদ কিয়ীলা থেকে পালিয়ে গেছেন শুনে তালুত আর সেখানে গেলেন না। দাউদ মরুভূমির কেল্লার মত জায়গাগুলোতে এবং সীফ মরুভূমির পাহাড়ী জায়গায় থাকতে লাগলেন। দিনের পর দিন তালুত তাঁর খোঁজ করে চললেন কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর হাতে দাউদকে পড়তে দিলেন না। সীফ মরুভূমির হরেশে থাকবার সময় দাউদ শুনলেন যে, তালুত তাঁকে হত্যা করবার জন্য বের হয়েছেন। এদিকে তালুতের ছেলে যোনাথন হরেশে দাউদের কাছে গিয়ে তাঁকে আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করতে উৎসাহ দিলেন। যোনাথন বললেন, “তুমি ভয় কোরো না; আমার বাবা তালুতের হাতে তুমি ধরা পড়বে না। তুমিই ইসরাইল দেশের উপরে রাজত্ব করবে, আর আমার স্থান হবে তোমার পরেই। আমার বাবাও সেই কথা জানেন।” তাঁরা দু’জনেই মাবুদকে সাক্ষী রেখে একটা চুক্তি করলেন। পরে যোনাথন বাড়ী চলে গেলেন কিন্তু দাউদ হরেশেই রয়ে গেলেন। এদিকে সীফ গ্রামের লোকেরা গিবিয়াতে তালুতের কাছে গিয়ে বলল, “দাউদ আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সে হরেশের কাছে যিশীমোনের দক্ষিণে হখীলা পাহাড়ের কেল্লার মত জায়গাগুলোতে থাকে। মহারাজ, আপনার ইচ্ছামতই আপনি আসুন। তাকে বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়াই আমাদের কাজ।” জবাবে তালুত বললেন, “মাবুদ তোমাদের দোয়া করুন, কারণ আমার জন্য তোমাদের মমতা আছে। তোমরা গিয়ে আরও ভাল করে তার খোঁজ-খবর নাও; সে কোথায় থাকে আর কোথায় যায় এবং সেখানে কে তাকে দেখেছে তা জেনে নাও। আমি শুনেছি সে নাকি খুব চালাক। তার লুকাবার সমস্ত জায়গাগুলো খুঁজে বের করবে। তারপর সঠিক সংবাদ নিয়ে ফিরে আসলে পর আমি তোমাদের সংগে যাব। সে যদি দেশের মধ্যে থাকে তবে আমি এহুদার সমস্ত বংশগুলোর মধ্য থেকে তাকে খুঁজে বের করবই।” সেই লোকেরা তখন তালুতের আগেই রওনা হয়ে সীফে ফিরে গেল। দাউদ তাঁর লোকদের নিয়ে তখন যিশীমোনের দক্ষিণে আরবায় মায়োন মরুভূমিতে ছিলেন। তালুত ও তাঁর লোকেরা দাউদের খোঁজ করতে গেলেন। দাউদ সেই খবর পেয়ে সেখান থেকে মায়োন মরুভূমির পাথুরে-পাহাড়ে গিয়ে রইলেন। তালুত সেই খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দাউদের পিছনে তাড়া করলেন। তালুত গেলেন পাহাড়ের এই পাশ দিয়ে আর দাউদ তাঁর লোকজন নিয়ে পাহাড়ের ওপাশে গেলেন। তাঁরা তালুতের কাছ থেকে পালাবার জন্য তাড়াহুড়া করছিলেন। এদিকে তালুত ও তাঁর সৈন্যেরা দাউদ ও তাঁর লোকদের ধরে ফেলবার জন্য তাঁদের ঘেরাও করছিলেন। এমন সময় একজন লোক এসে তালুতকে খবর দিল, “ফিলিস্তিনীরা দেশ আক্রমণ করেছে, আপনি শীঘ্রই চলে আসুন।” এই কথা শুনে তালুত দাউদের পিছনে তাড়া করা বন্ধ করে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেলেন। এইজন্য লোকে ঐ জায়গাটাকে বলে সেলা-হম্মলকোৎ (যার মানে “আলাদা হওয়ার পাহাড়”)। দাউদ সেখান থেকে ঐন্তগদীর কেল্লার মত জায়গাগুলোতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। তালুত ফিলিস্তিনীদের তাড়া করা শেষ করে ফিরে আসলে পর লোকেরা তাঁকে খবর দিল যে, দাউদ ঐন্তগদীর মরুভূমিতে আছেন। তালুত তখন বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে তিন হাজার লোক বেছে নিলেন এবং দাউদ ও তাঁর লোকদের খোঁজে বুনো ছাগলের পাহাড় নামে জায়গাটার কাছে গেলেন। পথে যেতে যেতে তিনি এমন একটা জায়গায় আসলেন যেখানে ভেড়া রাখবার কয়েকটা খোঁয়াড় ছিল। সেই জায়গার কাছে ছিল একটা গুহা। তালুত মলত্যাগের জন্য সেই গুহায় ঢুকলেন। সেই গুহার একেবারে ভিতরের দিকে ছিলেন দাউদ ও তাঁর লোকেরা। দাউদের লোকেরা বলল, “মাবুদ যে দিনের কথা আপনাকে বলেছিলেন আজ সেই দিন এসে গেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার শত্রুকে তোমার হাতে তুলে দেব আর তার প্রতি তোমার যা ভাল মনে হয় তুমি তা-ই করবে।’ ” তখন দাউদ উঠে চুপি চুপি তালুতের পোশাক থেকে একটা টুকরা কেটে নিলেন। তালুতের পোশাক থেকে একটা টুকরা কেটে নেওয়ার দরুন দাউদের বিবেক তাঁকে দোষী করতে লাগল। তিনি তাঁর লোকদের বললেন, “আমার মালিকের বিরুদ্ধে, মাবুদের অভিষেক-করা বান্দার বিরুদ্ধে হাত তুলতে মাবুদ কখনও আমাকে অনুমতি দেবেন না, কারণ তিনি তো মাবুদের অভিষেক-করা বান্দা।” এই কথা বলে দাউদ তাঁর লোকদের থামিয়ে দিলেন এবং তালুতকে তাদের আক্রমণ করতে দিলেন না। পরে তালুত গুহা থেকে বের হয়ে চলতে শুরু করলেন। তারপর দাউদও গুহা থেকে বের হলেন এবং জোরে তালুতকে ডেকে বললেন, “প্রভু মহারাজ!” তালুত যখন পিছন ফিরে তাকালেন তখন দাউদ মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তিনি তালুতকে বললেন, “যে সব লোক আপনাকে বলে দাউদ আপনার ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে, আপনি কেন তাদের কথা শোনেন? আজকে তো আপনি নিজের চোখেই দেখলেন যে, মাবুদ কিভাবে এই গুহার মধ্যে আপনাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমাকে কেউ কেউ আপনাকে মেরে ফেলতে বলেছিল, কিন্তু আপনার উপর আমার মমতা হল। আমি বললাম, আমার প্রভুর উপরে আমি হাত তুলব না, কারণ তিনি মাবুদের অভিষেক-করা বান্দা। হে আমার পিতা, এই দেখুন, আমার হাতে আপনার পোশাকের একটা টুকরা। আমিই আপনার পোশাক থেকে টুকরাটা কেটে নিয়েছি কিন্তু আপনাকে মেরে ফেলি নি। তাহলে আপনি এবার বুঝতে এবং জানতে পারলেন যে, আপনার প্রতি কোন অন্যায় বা বিদ্রোহের ভাব আমার মধ্যে নেই। আমি আপনার বিরুদ্ধে কোন গুনাহ্‌ করি নি, কিন্তু আপনি আমাকে মেরে ফেলবার জন্য ওৎ পেতে আছেন। মাবুদই যেন আমার ও আপনার বিচার করেন এবং আমার প্রতি আপনি যে অন্যায় করেছেন তার প্রতিফল দেন; তবুও আমি আপনার বিরুদ্ধে হাত তুলব না। আগেকার লোকদের চল্‌তি কথায় আছে, ‘দুষ্টের মধ্য থেকেই আসে দুষ্টতা,’ তাই আমি আপনার বিরুদ্ধে হাত তুলতে যাব না। “ইসরাইলের বাদশাহ্‌ কার পিছনে বের হয়ে এসেছেন? কার পিছনে আপনি তাড়া করে ফিরছেন? কেন আপনি একটা মরা কুকুরের পিছনে, একটা পোকার পিছনে তাড়া করছেন? মাবুদই যেন বিচার করে আমার ও আপনার ব্যাপারে রায় দেন। তিনিই যেন আমার কাজ দেখে আমার পক্ষে দাঁড়ান এবং আপনার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন।” দাউদের কথা শেষ হলে পর তালুত বললেন, “বাবা দাউদ, এ কি তুমিই কথা বলছ?” এই বলে তিনি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। তিনি দাউদকে বললেন, “তুমি আমার চেয়ে ন্যায়বান, কারণ আমি তোমার সংগে খারাপ ব্যবহার করলেও তুমি আমার সংগে ভাল ব্যবহার করেছ। তুমি যে আমার প্রতি ভাল ব্যবহার করে আসছ তা তুমি আজ আমাকে জানালে। মাবুদ তোমার হাতে আমাকে তুলে দিয়েছিলেন কিন্তু তুমি আমাকে মেরে ফেল নি। কেউ যদি শত্রুকে হাতে পায় তবে সে কি তার কোন ক্ষতি না করেই তাকে ছেড়ে দেয়? আজ তুমি আমার প্রতি যে ব্যবহার করেছ তার জন্য মাবুদ যেন তোমার ভাল করেন। আমি এখন জানি যে, তুমি নিশ্চয় বাদশাহ্‌ হবে আর তোমার দ্বারাই ইসরাইল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই এখন তুমি মাবুদের নামে আমার কাছে এই কসম খাও যে, তুমি আমার পরে আমার বংশধরদের ধ্বংস করবে না আর আমার পিতার বংশ থেকে আমার নামও মুছে ফেলবে না।” দাউদ তালুতের কাছে সেই কসমই খেলেন। এর পর তালুত ঘরে ফিরে গেলেন, আর দাউদ তাঁর লোকজন নিয়ে তাঁর সেই কেল্লা নামে পাহাড়টায় উঠে গেলেন। পরে শামুয়েল ইন্তেকাল করলেন। সমস্ত বনি-ইসরাইল এক জায়গায় জমায়েত হয়ে তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করল। তারা রামায় তাঁর নিজের বাড়ীতেই তাঁকে দাফন করল। এর পর দাউদ পারণ মরুভূমিতে গেলেন। তখন মায়োন গ্রামে একজন খুব ধনী লোক ছিল। তার কাজ-কারবার ছিল কর্মিল গ্রামে। তার তিন হাজার ভেড়া ও এক হাজার ছাগল ছিল। সেই সময় কর্মিলে সে তার ভেড়ার লোম ছাঁটাই করছিল। লোকটির নাম ছিল নাবল ও তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল অবীগল। স্ত্রীলোকটি বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বামীর ব্যবহার ছিল কর্কশ ও খারাপ। সে ছিল কালুত বংশের লোক। দাউদ সেই মরুভূমিতে থাকতেই খবর পেলেন যে, নাবল তার ভেড়ার লোম ছাটাই করছে। তারপর তাঁকে বলবে যে, আমি এখন শুনতে পেলাম তাঁর ওখানে লোম ছাঁটাইয়ের কাজ চলছে। তাঁর রাখালেরা যতদিন আমাদের সংগে ছিল আমরা তাদের সংগে খারাপ ব্যবহার করি নি এবং যতদিন তারা কর্র্মিলে ছিল তাদের কিছুই চুরি যায় নি। তাঁর কর্মচারীদের জিজ্ঞাসা করলেই তিনি সেই কথা জানতে পারবেন। কাজেই তিনি যেন আমার এই যুবকদের সুনজরে দেখেন, কারণ তাঁরা তাঁর আনন্দের দিনেই তাঁর কাছে এসেছে। সেইজন্য তিনি যা পারেন তা-ই যেন তাঁর এই গোলামদের ও তাঁর সন্তান দাউদকে দান করেন।” দাউদের লোকেরা গিয়ে দাউদের নাম করে নাবলকে ঐ সব কথা বলে অপেক্ষা করতে লাগল। জবাবে নাবল দাউদের লোকদের বলল, “কে এই দাউদ? আর ইয়াসির ছেলেই বা কে? আজকাল অনেক গোলাম তাদের মালিককে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যারা আমার ভেড়ার লোম ছাঁটাই করছে তাদের জন্য আমি যে খাবার ও পানি রেখেছি এবং পশু জবাই করেছি তা নিয়ে কি আমি এমন লোকদের দেব যাদের সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা নেই?” এই কথা শুনে দাউদের লোকেরা ফিরে গিয়ে সমস্ত কথা দাউদকে জানাল। দাউদ তাঁর লোকদের বললেন, “তোমরা প্রত্যেকে কোমরে তলোয়ার বেঁধে নাও।” এতে তারা প্রত্যেকেই কোমরে তলোয়ার বেঁধে নিল আর দাউদও তা-ই করলেন। তারপর প্রায় চারশো লোক দাউদের সংগে গেল আর দু’শো লোক রইল মালপত্র পাহারা দেবার জন্য। তখন একজন চাকর নাবলের স্ত্রী অবীগলকে বলল, “মরুভূমি থেকে দাউদ আমাদের মালিকের কাছে তাঁর সালাম জানাবার জন্য কয়েকজন লোক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের মালিক তাদের ভীষণ গালাগালি করেছেন। ঐ লোকগুলো কিন্তু আমাদের সংগে খুব ভাল ব্যবহারই করেছিল। আমরা যতদিন মাঠের মধ্যে তাদের কাছে ছিলাম তারা আমাদের সংগে খারাপ ব্যবহারও করে নি এবং আমাদের কোন জিনিসও চুরি হয় নি। আমরা যতদিন তাদের কাছে থেকে ভেড়া চরিয়েছি ততদিন দিনরাত তারা আমাদের চারপাশে রক্ষা-দেয়ালের মত ছিল। এখন আপনি কি করবেন তা ভেবে দেখুন, কারণ আমাদের মালিক ও তাঁর সমস্ত লোকজনদের ভীষণ ক্ষতি করবার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মালিক এমন একজন বদমেজাজী লোক যে, তিনি কারও কথা শোনেন না।” এই কথা শুনে অবীগল আর দেরি করলেন না। তিনি দু’শো রুটি, চামড়ার দু’থলি আংগুর-রস, পাঁচটা ভেড়ার গোশ্‌ত, পাঁচ বস্তা ভাজা শস্য, একশো তাল কিশমিশ এবং দু’শো তাল ডুমুর নিয়ে গাধার পিঠে চাপালেন। তারপর তিনি তার চাকরদের বললেন, “তোমরা আমার আগে আগে যাও, আমি তোমাদের পিছনে পিছনে আসছি।” এই সব কথা কিন্তু তিনি তাঁর স্বামী নাবলকে জানালেন না। অবীগল যখন তাঁর গাধায় চড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছিলেন তখন দাউদও তাঁর লোকদের নিয়ে আর একটা ঢাল বেয়ে তাঁর দিকেই নেমে আসছিলেন। তাতে অবীগল তাঁদের সামনে গিয়ে পড়লেন। এর কিছু আগে দাউদ বলছিলেন, “মিথ্যাই আমি এই লোকটার সব কিছু সেই মরুভূমিতে পাহারা দিয়ে মরেছি যাতে তার কোন কিছু চুরি না হয়। আমি তার উপকার করেছি কিন্তু সে তার বদলে আমার অপকার করেছে। আল্লাহ্‌ যেমন দাউদের শত্রুদের নিশ্চয়ই ভীষণভাবে শাস্তি দেবেন তেমনি আমিও নিশ্চয়ই কাল সকাল পর্যন্ত নাবলের বাড়ীর একটি পুরুষ লোককেও বাঁচিয়ে রাখব না।” অবীগল দাউদকে দেখে তাড়াতাড়ি করে তাঁর গাধার পিঠ থেকে নামলেন এবং দাউদের সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তারপর তিনি দাউদের পায়ের উপর পড়ে তাঁকে বললেন, “হে হুজুর, সব দোষই আমার। দয়া করে আপনার বাঁদীকে দু’টা কথা বলতে দিন এবং তার কথা আপনি শুনুন। হুজুর যেন সেই জঘন্য লোকের, অর্থাৎ নাবলের কথা না ধরেন। তার নামও যেমন সেও তেমন। তার নামের অর্থ একগুঁয়ে, আর তার মধ্যে রয়েছে শুধু একগুঁয়েমী। হুজুর যে সব লোক পাঠিয়েছিলেন তাদের সংগে আপনার এই বাঁদীর দেখা হয় নি। “হে হুজুর, আল্লাহ্‌র কসম ও আপনার প্রাণের কসম যে, আপনার শত্রুদের এবং যারা আপনার ক্ষতি করতে চায় তাদের দশা নাবলের মত হবে, কারণ মাবুদ আপনাকে রক্তপাত করতে দেন নি এবং নিজের হাতে প্রতিশোধ নিতে দেন নি। এই বাঁদী হুজুরের জন্য যে উপহার এনেছে তা যেন তাঁর সংগের লোকদের দেওয়া হয়। আপনার বাঁদীর অন্যায় আপনি দয়া করে মাফ করে দিন। মাবুদ নিশ্চয়ই হুজুরের বংশকে স্থায়ী করবেন, কারণ তিনি মাবুদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করছেন। এই পর্যন্ত আপনার মধ্যে কোন খারাপী দেখা যায় নি আর যাবেও না। হুজুরকে মেরে ফেলবার জন্য লোকে তাড়া করলেও আমি জানি তাঁর প্রাণ তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র ধনভাণ্ডারে যত্নের সংগে রাখা আছে। কিন্তু আপনার শত্রুদের প্রাণ তিনি ফিংগা দিয়ে পাথর ছুঁড়বার মত করেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। মাবুদ হুজুরের উন্নতি করবার ওয়াদাগুলো পূর্ণ করবেন এবং তাঁকে বনি-ইসরাইলদের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই সময় হুজুর অকারণে রক্তপাত করেছেন কিংবা নিজের হাতে প্রতিশোধ নিয়েছেন ভেবে তাঁর বিবেক তাঁকে দোষী করবে না কিংবা তিনি অন্তরে কোন দুঃখবোধ করবেন না। তবে মাবুদ যখন হুজুরের উন্নতি করবেন তখন তিনি যেন তাঁর এই বাঁদীর কথা ভুলে না যান।” দাউদ তখন অবীগলকে বললেন, “ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, কারণ তিনি আজ আমার সংগে দেখা করবার জন্য তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন। ধন্য তোমার বিচারবুদ্ধি, ধন্য তুমি, কারণ তুমি আজ আমাকে রক্তপাত করতে আর নিজের হাতে প্রতিশোধ নিতে বাধা দিলে। তোমার ক্ষতি করা থেকে যিনি আমাকে দূরে রেখেছেন সেই বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কসম যে, তুমি যদি তাড়াতাড়ি এসে আমার সংগে দেখা না করতে তাহলে সকাল পর্যন্ত নাবলের বাড়ীর কোন পুরুষলোক বেঁচে থাকত না।” এর পর দাউদ তাঁর জন্য আনা সমস্ত জিনিস অবীগলের হাত থেকে গ্রহণ করলেন আর বললেন, “তুমি এবার শান্তিতে বাড়ী ফিরে যাও। আমি তোমার সব কথা শুনেছি এবং তোমার অনুরোধ মেনে নিয়েছি।” অবীগল যখন নাবলের কাছে ফিরে গেলেন তখন রাজবাড়ীতে যেমন চলে সেই রকম একটা মেজবানী তার বাড়ীতে চলছিল। নাবল মদ খেয়ে খুশী হয়ে উঠল এবং পরে ভীষণ মাতাল হয়ে পড়ল। সেইজন্য অবীগল সকাল হওয়ার আগে তাকে কিছুই বললেন না। সকালবেলায় যখন নাবলের নেশা কেটে গেল তখন তার স্ত্রী তাকে সব কথা জানালেন। এতে নাবলের অন্তর যেন মরে গেল আর সে পাথরের মত হয়ে গেল। এর প্রায় দশ দিন পরে মাবুদের শাস্তি নাবলের উপর নেমে আসলে পর সে মারা গেল। নাবলের মৃত্যুর খবর পেয়ে দাউদ বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌। তিনি নাবলের বিরুদ্ধে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কারণ নাবল আমাকে অপমান করেছিল। অন্যায় করা থেকে তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন, আর নাবলের অন্যায়কে নাবলের উপরেই ফিরিয়ে দিয়েছেন।” পরে দাউদ অবীগলকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তাঁর কাছে লোক পাঠিয়ে দিলেন। দাউদের লোকেরা কর্মিলে অবীগলের কাছে গিয়ে বলল, “দাউদ আপনাকে বিয়ে করতে চান, সেইজন্য তিনি আপনার কাছে আমাদের পাঠিয়েছেন।” এই কথা শুনে অবীগল মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে দাউদের উদ্দেশে বললেন, “আমি আপনার বাঁদী; আপনার গোলামদের সেবা করবার ও পা ধোয়াবার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।” এই কথা বলে অবীগল তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হলেন এবং গাধায় চড়ে পাঁচজন বাঁদী নিয়ে দাউদের পাঠানো লোকদের সংগে গেলেন। সেখানে গেলে পর দাউদের সংগে তাঁর বিয়ে হল। এর আগে দাউদ যিষ্রিয়েল গ্রামের অহীনোয়মকে বিয়ে করেছিলেন। অহীনোয়ম ও অবীগল দু’জনেই তাঁর স্ত্রী হলেন। এদিকে তালুত তাঁর মেয়ে, দাউদের স্ত্রী মীখলকে পল্‌টির সংগে বিয়ে দিয়েছিলেন। পল্‌টি ছিল গল্লীম গ্রামের লয়িশের ছেলে। পরে সীফের লোকেরা গিবিয়াতে তালুতের কাছে গিয়ে বলল, “যিশীমোনের কাছে হখীলা পাহাড়ে দাউদ লুকিয়ে আছে।” তালুত তখন তিন হাজার বাছাই করা ইসরাইলীয় সৈন্য নিয়ে সীফের মরুভূমিতে দাউদকে খুঁজতে গেলেন। যিশীমোনের কাছে রাস্তার পাশে হখীলা পাহাড়ের উপরে তালুত ছাউনি ফেললেন আর দাউদ ছিলেন মরুভূমিতে। দাউদ বুঝতে পারলেন হয়তো তালুত তাঁর খোঁজে মরুভূমিতে এসেছেন। সেইজন্য তিনি লোক পাঠিয়ে জানতে পারলেন যে, তালুত সত্যিই এসেছেন। তালুত যেখানে ছাউনি ফেলেছিলেন দাউদ সেখানে গেলেন এবং তালুত ও তাঁর সৈন্যদলের সেনাপতি নেরের ছেলে অবনের যেখানে শুয়ে ছিলেন তা দেখে নিলেন। তালুত ছাউনির মধ্যে মালপত্রের মাঝখানে শুয়ে ছিলেন, আর তাঁর চারদিকে শুয়ে ছিল তাঁর সৈন্যেরা। দাউদ তখন হিট্টীয় অহীমেলক ও সরূয়ার ছেলে যোয়াবের ভাই অবীশয়কে বললেন, “ঐ ছাউনির মধ্যে তালুতের কাছে তোমরা কে আমার সংগে যাবে?” অবীশয় বলল, “আমি যাব।” রাতের বেলায় দাউদ ও অবীশয় তালুতের সৈন্যদের মধ্যে গেলেন। তালুত ছাউনিতে মালপত্রের মাঝখানে ঘুমিয়ে ছিলেন। তাঁর বর্শাটা তাঁর মাথার কাছে মাটিতে পোঁতা ছিল। অবনের ও সৈন্যেরা তাঁর চারপাশে শুয়ে ছিল। এই অবস্থা দেখে অবীশয় দাউদকে বলল, “আল্লাহ্‌ আজ আপনার শত্রুকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছেন। অনুমতি দিন, আমার বর্শার এক ঘায়ে ওঁকে মাটিতে গেঁথে ফেলি। আমাকে দু’বার আঘাত করতে হবে না।” দাউদ তাকে বললেন, “না, ওঁকে মেরে ফেলো না। মাবুদের অভিষেক-করা বান্দার উপর হাত তুলে কে নির্দোষ থাকতে পারে? আল্লাহ্‌র কসম যে, মাবুদ নিজেই ওকে শাস্তি দেবেন। হয় তিনি এমনিই মারা যাবেন, না হয় যুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়ে যাবেন। কিন্তু মাবুদের অভিষেক-করা বান্দার উপর হাত তুলতে মাবুদ কখনও আমাকে অনুমতি দেবেন না। চল, এখন আমরা তাঁর মাথার কাছ থেকে বর্শাটা এবং পানির পাত্রটা তুলে নিয়ে ফিরে যাই।” দাউদ তারপর তালুতের মাথার কাছ থেকে তাঁর বর্শা ও পানির পাত্রটা নিয়ে চলে গেলেন। কেউ তা দেখল না, জানল না, কেউ জেগেও উঠল না। তারা সবাই ঘুমাচ্ছিল, কারণ মাবুদ তাদের একটা গভীর ঘুমের মধ্যে ফেলে রেখেছিলেন। এর পর দাউদ ছাউনি থেকে বেশ কিছুটা দূরের একটা পাহাড়ের উপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর দাউদ সৈন্যদের এবং নেরের ছেলে অবনেরকে ডাক দিয়ে বললেন, “অবনের, আপনি কি কিছু বলবেন না?” জবাবে অবনের বলল, “কে তুমি, বাদশাহ্‌কে ডাকাডাকি করছ?” দাউদ বললেন, “আপনি তো একজন বীর, তাই না? বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আপনার সমান আর কে আছে? কেন আপনি শত্রুর বিপক্ষে আপনার মালিক মহারাজকে পাহারা দিয়ে রাখলেন না? আপনার মালিক মহারাজকে মেরে ফেলবার জন্য একজন লোক গিয়েছিল। আপনি যা করেছেন তা মোটেই ঠিক হয় নি। আল্লাহ্‌র কসম যে, আপনি ও আপনার লোকদের মরা উচিত, কারণ আপনাদের মালিক, যিনি মাবুদের অভিষেক-করা বান্দা, তাঁকে শত্রুর বিপক্ষে আপনারা পাহারা দিয়ে রাখেন নি। বাদশাহ্‌র মাথার কাছে তাঁর যে বর্শা ও পানির পাত্র ছিল সেগুলো কোথায়?” তালুত দাউদের গলার আওয়াজ চিনে বললেন, “বাবা দাউদ, এ কি সত্যিই তোমার গলার আওয়াজ?” দাউদ বললেন, “জ্বী মহারাজ, এ আপনার গোলামেরই গলার আওয়াজ।” তারপর তিনি আরও বললেন, “কেন আমার মালিক তাঁর গোলামের পিছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছেন? আমি কি করেছি? কি অন্যায় করেছি? আমার মহারাজ, আমার প্রভু, এখন দয়া করে আপনার গোলামের কথা শুনুন। যদি মাবুদই আপনাকে আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে থাকেন তবে আমার দেওয়া কোরবানী তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হোক। কিন্তু যদি মানুষ তা করে থাকে তবে তাদের উপর যেন মাবুদের গজব নেমে আসে, কারণ তারা আজ মাবুদের দেওয়া সম্পত্তিতে আমার যে ভাগ আছে তা থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, ‘চলে যাও, দেব-দেবীর পূজা কর গিয়ে।’ কিন্তু আপনার কাছে আমার এই মিনতি যে, মাবুদ নেই এমন দূরের কোন জায়গায় যেন আমার রক্তপাত না হয়। লোকে পাহাড়ে যেমন করে তিতির পাখী ধরতে যায় বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ তেমনি করে একটা পোকার খোঁজে বের হয়ে এসেছেন।” তখন তালুত বললেন, “আমি গুনাহ্‌ করেছি। বাবা দাউদ, তুমি ফিরে এস। আজ তুমি আমার জীবনের কত দাম দিলে; আমি আর তোমার ক্ষতি করতে চেষ্টা করব না। সত্যিই এই মহা অন্যায় করে আমি বোকামি করেছি।” জবাবে দাউদ বললেন, “মহারাজ, এই যে সেই বর্শা, আপনার কোন লোক এসে ওটা নিয়ে যাক। মাবুদ প্রত্যেক লোককে তার বিশ্বস্ততা ও সততার পুরস্কার দেন। মাবুদ আজ আপনাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি মাবুদের অভিষেক-করা বান্দার উপর হাত তুলতে চাই নি। আজ আমার কাছে আপনার জীবন যেমন মহামূল্যবান হল তেমনি মাবুদের কাছেও যেন আমার জীবন মহামূল্যবান হয়। তিনি যেন সমস্ত বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেন।” তখন তালুত দাউদকে বললেন, “বাবা দাউদ, ধন্য তুমি! তুমি অবশ্যই অনেক বড় বড় কাজ করবে আর জয়ী হবে।” এর পর দাউদ তাঁর পথে চলে গেলেন আর তালুতও নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। দাউদ মনে মনে ভাবলেন, “এই তালুতের হাতেই আমাকে একদিন মারা পড়তে হবে, তাই ফিলিস্তিনীদের দেশে পালিয়ে যাওয়াই আমার পক্ষে সবচেয়ে ভাল হবে। তাহলে ইসরাইল দেশের মধ্যে তিনি আর আমাকে খুঁজে বেড়াবেন না, আর আমিও তাঁর হাত থেকে রক্ষা পাব।” এই ভেবে দাউদ তাঁর সংগের ছ’শো লোক নিয়ে সেই জায়গা ছেড়ে মায়োকের ছেলে আখীশের কাছে গেলেন। আখীশ ছিলেন গাতের বাদশাহ্‌। দাউদ ও তাঁর লোকেরা গাতে আখীশের কাছে বাস করতে লাগলেন। তাঁর লোকদের প্রত্যেকের সংগে ছিল তাদের পরিবার, আর দাউদের সংগে ছিলেন তাঁর দুই স্ত্রী, যিষ্রীয়েল গ্রামের অহীনোয়ম এবং কর্মিল গ্রামের অবীগল। অবীগল ছিলেন নাবলের বিধবা স্ত্রী। তালুত যখন জানতে পারলেন যে, দাউদ গাতে পালিয়ে গেছেন তখন তিনি তাঁর খোঁজ করা বন্ধ করে দিলেন। একদিন দাউদ আখীশকে বললেন, “আপনি যদি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই দেশের কোন একটা গ্রামে আমাকে কিছু জায়গা দিন যাতে আমি সেখানে গিয়ে বাস করতে পারি। আপনার এই গোলাম কেন আপনার সংগে রাজধানীতে বাস করবে?” তখন আখীশ সিক্লগ শহরটা দাউদকে দান করলেন। সেই থেকে আজও সিক্লগ এহুদার বাদশাহ্‌দের অধিকারে আছে। দাউদ ফিলিস্তিনীদের দেশে এক বছর চার মাস ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর লোকদের নিয়ে গশূরীয়, গির্ষীয় ও আমালেকীয়দের দেশে লুটপাট করতে গিয়েছিলেন। এই সব জাতির লোকেরা অনেক কাল আগে শূর থেকে মিসর পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটায় বাস করত। দাউদ কোন স্ত্রীলোক কিংবা পুরুষকে গাতে নিয়ে আসবার জন্য বাঁচিয়ে রাখতেন না, কারণ তিনি মনে করতেন, তারা তাদের বিষয় সব কথা জানিয়ে দিয়ে বলবে যে, দাউদ এই কাজ করেছে। ফিলিস্তিনীদের দেশে আসবার পর থেকে দাউদ বরাবরই এই রকম করতেন, কিন্তু আখীশ দাউদকে বিশ্বাস করতেন আর ভাবতেন দাউদ এই সব কাজ করে তাঁর নিজের জাতি বনি-ইসরাইলদের কাছে নিজেকে খুব ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে আর তাতে সে চিরকাল তাঁর গোলাম হয়ে থাকবে। দাউদ সিক্লগে থাকবার সময় ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য সৈন্য জমায়েত করল। তখন আখীশ দাউদকে বললেন, “তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, তোমাকে ও তোমার লোকদের সৈন্যদলে যোগ দিয়ে আমার সংগে যেতে হবে।” দাউদ বললেন, “ভাল, আপনি নিজেই দেখতে পাবেন আপনার গোলাম কি করতে পারে।” আখীশ বললেন, “খুব ভাল। আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য আমার দেহরক্ষীর পদে নিযুক্ত করব।” এর আগেই শামুয়েল ইন্তেকাল করেছিলেন, আর বনি-ইসরাইলরা সবাই তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করে তাঁকে তাঁর নিজের শহর রামাতে দাফন করেছিল। যারা মৃত লোকের রূহের সংগে কথাবার্তা বলে এবং যারা ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে তালুত দেশ থেকে এমন সব লোকদের বের করে দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনীরা একসংগে জমায়েত হয়ে শূনেমে গিয়ে ছাউনি ফেলল। এদিকে তালুতও সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্যদের জমায়েত করে নিয়ে গিলবোয় পাহাড়ে গিয়ে ছাউনি ফেললেন। ফিলিস্তিনীদের সৈন্যসংখ্যা দেখে তালুত ভয় পেলেন আর তাঁর বুক ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। তিনি কি করবেন তা মাবুদের কাছে জানতে চাইলেন, কিন্তু মাবুদ তাঁকে কোনভাবেই জবাব দিলেন না- স্বপ্ন দিয়েও না, ঊরীম দিয়েও না কিংবা নবীদের দিয়েও না। তালুত তখন তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “তোমরা এমন একজন স্ত্রীলোকের খোঁজ কর, যে মৃত লোকের রূহের সংগে কথাবার্তা বলতে পারে, যেন তার কাছে গিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি আমি কি করব।” তারা বলল, “ঐন্‌দোরে ঐরকম একজন স্ত্রীলোক আছে।” এই কথা শুনে তালুত অন্যরকম কাপড়-চোপড় পরে নিজের পরিচয় গোপন করে রাতের বেলায় দু’জন লোককে সংগে নিয়ে সেই স্ত্রীলোকের কাছে গেলেন। তিনি সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তুমি মন্ত্র পড়ে মৃত লোকের রূহের সংগে যোগাযোগ করে আমি যাঁর নাম করব তাঁকে এখানে তুলে আন।” তখন স্ত্রীলোকটি তাঁকে বলল, “তালুত এই সব ব্যাপারে যা করেছেন তা আপনার নিশ্চয়ই অজানা নেই। যারা মৃত লোকের রূহের সংগে কথা বলে বা ভূতের সংগে সম্বন্ধ রাখে এমন সব লোকদের তিনি দেশ থেকে দূর করে দিয়েছেন। তাহলে কেন আপনি আমার জন্য এমন একটা ফাঁদ পাতছেন যা আমার মৃত্যু ঘটাবে?” তালুত তখন মাবুদের নামে কসম খেয়ে বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম যে, এর জন্য তোমার উপর কোন শাস্তি আসবে না।” তখন স্ত্রীলোকটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “আমি তাহলে আপনার জন্য কাকে তুলে আনব?” তালুত বললেন, “শামুয়েলকে আন।” পরে শামুয়েলকে দেখতে পেয়ে স্ত্রীলোকটি চিৎকার করে তালুতকে বলল, “আপনি আমাকে কেন ঠকালেন? আপনিই তো তালুত।” বাদশাহ্‌ তাকে বললেন, “তোমার কোন ভয় নেই; তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” স্ত্রীলোকটি বলল, “আমি দেখতে পাচ্ছি, একজন দেবতা মাটির তলা থেকে উঠে আসছেন।” তালুত জিজ্ঞাসা করলেন, “তিনি দেখতে কেমন?” সে বলল, “একজন বুড়ো লোক উঠে আসছেন; তাঁর গায়ে রয়েছে লম্বা পোশাক।” এতে তালুত বুঝতে পারলেন যে, তিনি শামুয়েল। তিনি মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে সালাম জানালেন। শামুয়েল তালুতকে বললেন, “কেন তুমি আমাকে তুলে নিয়ে এসে বিরক্ত করলে?” তালুত বললেন, “আমি খুব বিপদে পড়েছি। এদিকে ফিলিস্তিনীরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে আর ওদিকে আল্লাহ্‌ আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আর আমার ডাকে সাড়া দেন না- নবীদের মধ্য দিয়েও দেন না, স্বপ্নের মধ্য দিয়েও দেন না। সেইজন্য এখন আমার কি করা উচিত তা জানবার জন্য আপনাকে ডাকিয়ে এনেছি।” শামুয়েল বললেন, “মাবুদই যখন তোমাকে ছেড়ে তোমার বিপক্ষে গেছেন তখন আমাকে আর জিজ্ঞাসা করছ কেন? তিনি আমাকে দিয়ে যা বলিয়েছিলেন তা-ই করেছেন। তোমার রাজ্য তিনি তোমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তোমার জাতি-ভাই দাউদকে দিয়েছেন। তুমি মাবুদের কথা শোন নি এবং আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে তাঁর যে ভীষণ রাগ তা তোমার কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ কর নি, সেইজন্য তিনি আজ তোমার প্রতি এই রকম করেছেন। মাবুদ ফিলিস্তিনীদের হাতে তোমাকে এবং তোমার সংগে বনি-ইসরাইলদের তুলে দেবেন। কাল তুমি ও তোমার ছেলেরা আমার সংগে থাকবে। তিনি ইসরাইলের সৈন্যদলকেও ফিলিস্তিনীদের হাতে তুলে দেবেন।” শামুয়েলের কথা শুনে তালুত খুব ভয় পেয়ে তখনই মাটিতে লম্বা হয়ে পড়ে গেলেন। সারা দিন ও সারা রাত কিছু না খাওয়ার দরুন তাঁর শরীরে কোন শক্তি রইল না। সেই স্ত্রীলোকটি তালুতের কাছে গিয়ে দেখল যে, তিনি ভীষণ ভয় পেয়েছেন। তাই সে বলল, “দেখুন, আপনার বাঁদী আপনার হুকুম পালন করেছেন। আপনি আমাকে যা করতে বলেছিলেন প্রাণ হাতে করে আমি তা করেছি। এখন আপনিও দয়া করে আপনার বাঁদীর একটা কথা শুনুন। আমি আপনার সামনে কিছু খাবার রাখব। আপনি তা খেলে পর পথ চলবার শক্তি পাবেন।” কিন্তু তালুত রাজী না হয়ে বললেন, “না, আমি খাব না।” কিন্তু তাঁর লোকেরা সেই স্ত্রীলোকটির সংগে তাঁকে খুব সাধাসাধি করতে লাগল। শেষে তিনি তাদের কথা শুনলেন এবং মাটি থেকে উঠে খাটে বসলেন। সেই স্ত্রীলোকটির ঘরে মোটা-সোটা একটা বাছুর ছিল। সে তাড়াতাড়ি করে সেটা জবাই করল আর কিছু ময়দা নিয়ে মেখে খামিহীন রুটি তৈরী করল। তারপর তালুত ও তাঁর লোকদের সামনে সে তা আনল এবং তাঁরা তা খেলেন। পরে রাত থাকতেই তাঁরা উঠে সেখান থেকে চলে গেলেন। ফিলিস্তিনীরা অফেকে তাদের সমস্ত সৈন্য জমায়েত করল। এদিকে বনি-ইসরাইলরা যিষ্রিয়েলের ঝর্ণার কাছে তাদের ছাউনি ফেলল। ফিলিস্তিনী শাসনকর্তারা শত-সৈন্য এবং হাজার-সৈন্যের দল নিয়ে এগিয়ে চলল, আর তাদের পিছনে আখীশের সংগে দাউদ তাঁর লোকজন নিয়ে চললেন। তা দেখে ফিলিস্তিনী সেনাপতিরা জিজ্ঞাসা করল, “এই সব ইবরানীরা এখানে কেন?” আখীশ বললেন, “এ তো বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ তালুতের গোলাম দাউদ। সে দু’এক বছর ধরে আমার কাছে আছে। তালুতকে ছেড়ে চলে আসবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি তার মধ্যে কোন দোষ পাই নি।” এই কথা শুনে ফিলিস্তিনী সেনাপতিরা আখীশের উপর রেগে গিয়ে বলল, “লোকটাকে আপনি ফেরৎ পাঠিয়ে দিন। আপনি তাকে যে জায়গাটা দিয়েছেন সে সেখানেই ফিরে যাক। সে আমাদের সংগে যুদ্ধে যেতে পারবে না। তাহলে যুদ্ধে গিয়ে সে আমাদের বিপক্ষে দাঁড়াবে। তার মালিককে খুশী করতে হলে তাকে তো আমাদের লোকদের মুণ্ড দিয়েই তা করতে হবে। এ কি সেই দাউদ নয়, যার বিষয়ে তারা নেচে নেচে গেয়েছিল, ‘তালুত মারলেন হাজার হাজার আর দাউদ মারলেন অযুত অযুত’?” আখীশ তখন দাউদকে ডেকে বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম যে, আমি জানি তুমি সৎ লোক। এই সৈন্যদলের মধ্যে তুমি যা কিছু করেছ তা আমাকে খুশী করেছে। তোমার আসবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি তোমার মধ্যে অন্যায় কিছু দেখতে পাই নি, কিন্তু অন্যান্য শাসনকর্তারা তোমার উপর সন্তুষ্ট নন। তাই তুমি শান্তভাবে ফিরে যাও; তুমি এমন কিছু কোরো না যাতে ফিলিস্তিনী শাসনকর্তারা অসন্তুষ্ট হন।” তখন দাউদ জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু আমি কি করেছি? আমার আসবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আপনার এই গোলামের মধ্যে আপনি কি দোষ পেয়েছেন যার জন্য আমি আমার প্রভু মহারাজের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেতে পারব না?” জবাবে আখীশ বললেন, “আমি জানি তুমি আমার কাছে আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতার মতই ভাল; তবুও ফিলিস্তিনী সেনাপতিরা বলছেন তুমি যেন আমার সংগে যুদ্ধে না যাও। কাজেই তুমি ও তোমার মালিকের যে সব লোক তোমার সংগে এসেছে তোমরা কাল খুব ভোরে উঠো এবং আলো হওয়ার সংগে সংগে চলে যেয়ো।” তাই দাউদ ও তাঁর লোকেরা ফিলিস্তিনীদের দেশে ফিরে যাবার জন্য খুব ভোরে উঠলেন, আর ফিলিস্তিনীরা যিষ্রিয়েলে চলে গেল। দাউদ তাঁর লোকদের নিয়ে সিক্লগে ফিরে এসে দেখলেন শহরটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই অবস্থা দেখে দাউদ ও তাঁর লোকেরা জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। শেষে এমন হল যে, তাদের কাঁদবার শক্তিও আর রইল না। দাউদের দুই স্ত্রী, যিষ্রীয়েলের অহিনোয়ম আর কর্মিলের বাসিন্দা নাবলের বিধবা অবীগল বন্দী হয়েছিলেন। তখন দাউদ মহা বিপদে পড়লেন, কারণ ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর লোকদের মন দাউদের প্রতি এমন তেতো হয়ে উঠেছিল যে, তারা দাউদকে পাথর মারবার কথা বলাবলি করছিল। কিন্তু দাউদ তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে দিলে শক্তি পেলেন। তখন দাউদ তাঁর ছ’শো লোক সংগে নিলেন। তাঁরা বিষোর নামে একটা পাহাড়ী খাদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে কিছু লোককে রেখে যেতে হল। প্রায় দু’শো লোক ক্লান্ত হয়ে পড়াতে সেই খাদ পার হতে পারল না। দাউদ চারশো লোক নিয়ে শত্রুদের পিছনে তাড়া করে গেলেন। পরে একটা মাঠের মধ্যে তাঁর লোকেরা একজন মিসরীয় লোককে দেখতে পেল। তারা তাকে দাউদের কাছে নিয়ে গেল এবং খাবার ও পানি খেতে দিলে সে তা খেল। তারপর তারা তাকে ডুমুরের তালের এক টুকরা ও দুই তাল কিশমিশ খেতে দিল। তিন দিন তিন রাত সে খাবার কিংবা পানি কিছুই খায় নি, তাই এই সব খেয়ে সে যেন প্রাণ ফিরে পেল। দাউদ লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কার লোক? কোথা থেকে এসেছ?” লোকটি বলল, “আমি একজন মিসরীয় যুবক, একজন আমালেকীয়ের গোলাম। আজ তিন দিন হল আমার অসুখ হয়েছে, তাই আমার মালিক আমাকে ফেলে চলে গেছেন। আমরা নেগেভে করেথীয়দের এলাকা, এহুদা এলাকা ও কালুত এলাকায় লুটপাট করতে গিয়েছিলাম আর সিক্লগ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি।” দাউদ বললেন, “ঐ লুটেরাদের কাছে কি তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?” জবাবে সে বলল, “আপনি আল্লাহ্‌র নামে কসম খেয়ে বলুন যে, আপনি আমাকে মেরেও ফেলবেন না কিংবা আমার মালিকের হাতে তুলেও দেবেন না। তাহলে আমি আপনাকে তাদের কাছে নিয়ে যাব।” পরে সে দাউদকে ঐ দলের কাছে নিয়ে গেল। তারা তখন একটা মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং খাওয়া-দাওয়া করছিল ও মদ খেয়ে আমোদ-প্রমোদ করছিল, কারণ ফিলিস্তিনীদের দেশ ও এহুদা এলাকা থেকে তারা অনেক জিনিসপত্র লুটপাট করে এনেছিল। দাউদ সেই দিনের বিকালবেলা থেকে শুরু করে পর দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সংগে যুদ্ধ করলেন। তাদের মধ্যে কেউই রক্ষা পেল না, কেবল চারশো যুবক উটের পিঠে করে পালিয়ে গেল। আমালেকীয়রা যা কিছু লুট করে নিয়ে এসেছিল তা সবই তিনি উদ্ধার করলেন। তাঁর দুই স্ত্রীকেও তিনি উদ্ধার করলেন। তাদের কম বা বেশী বয়সের লোক, তাদের ছেলে বা মেয়ে আর যে সব জিনিস আমালেকীয়রা লুট করেছিল বা নিয়ে এসেছিল তার কিছুই বাদ পড়ল না; দাউদ সবই ফিরিয়ে আনলেন। তিনি আমালেকীয়দের সমস্ত গরু-ভেড়াও নিয়ে নিলেন। তাঁর লোকেরা সেগুলোকে অন্যান্য পশুপালের আগে আগে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। তারা বলল, “এগুলো দাউদের লুটের জিনিস।” যে দু’শো লোক ক্লান্ত হয়ে দাউদের সংগে যেতে পারে নি, যাদের বিষোর খাদের কাছে রেখে যাওয়া হয়েছিল, দাউদ তাদের কাছে ফিরে আসলেন। সেই লোকেরা দাউদ ও তাঁর সংগের লোকদের এগিয়ে নেবার জন্য এসেছিল। দাউদ ও তাঁর লোকেরা তাদের কাছে গেলে পর দাউদ তাদের খবরাখবর নিলেন। কিন্তু দাউদের সংগে যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে যারা দুষ্ট ও গোলমেলে লোক ছিল তারা বলল, “ওরা আমাদের সংগে যায় নি বলে আমরা যা উদ্ধার করে ফিরিয়ে এনেছি তা ওদের দেব না। ওরা কেবল যে যার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যাক।” জবাবে দাউদ বললেন, “না, না, আমার ভাইয়েরা, মাবুদ আমাদের যা দিয়েছেন তা নিয়ে তোমরা এই রকম কোরো না। তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন এবং আমাদের লুটকারীদের আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তোমাদের এই সব কথায় কেউ রাজী হবে না। যারা যুদ্ধে গিয়েছিল আর যারা জিনিসপত্র পাহারা দিয়েছিল তারা সবাই একই রকম ভাগ পাবে।” সেই দিন থেকে দাউদ বনি-ইসরাইলদের জন্য সেই অনুসারে নিয়ম ঠিক করে দিলেন আর তা আজও চালু আছে। সিক্লগে ফিরে এসে দাউদ এহুদা-গোষ্ঠীর বৃদ্ধ নেতাদের কাছে লুটের মালের কিছু কিছু অংশ পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ছিলেন তাঁর বন্ধু। তিনি তাঁদের কাছে এই কথা বলে পাঠালেন, “মাবুদের শত্রুদের কাছ থেকে লুটে আনা জিনিসের মধ্য থেকে আমি আপনাদের কাছে কিছু উপহার পাঠালাম।” যে সব বৃদ্ধ নেতাদের কাছে সেগুলো পাঠানো হল তাঁরা ছিলেন বেথেলের, রামোৎ-নেগেভের, যত্তীরের, এর মধ্যে ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল আর বনি-ইসরাইলরা তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে গিলবোয় পাহাড়ে ফিলিস্তিনীদের হাতে মারা পড়তে লাগল। ফিলিস্তিনীরা তালুত ও তাঁর ছেলেদের পিছনে তাড়া করে গিয়ে তাঁর ছেলে যোনাথন, অবীনাদব ও মল্কীশূয়কে হত্যা করল। তারপর তালুতের বিরুদ্ধে আরও ভীষণভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল। ধনুকধারী সৈন্যেরা তাঁকে দেখতে পেয়ে আঘাত করল। তালুত তখন তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিকে বললেন, “তোমার তলোয়ার বের করে আমার শরীরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাও। তা না হলে ঐ খৎনা-না-করানো লোকেরা এসে আমার শরীরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করবে এবং আমাকে অপমান করবে।” কিন্তু তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটি তা করতে রাজী হল না, কারণ সে খুব ভয় পেয়েছিল। তখন তালুত তাঁর তলোয়ার নিয়ে নিজেই তার উপরে পড়লেন। তালুত মারা গেছেন দেখে তাঁর অস্ত্রবহনকারীও নিজের তলোয়ারের উপর পড়ে তালুতের সংগে মারা গেল। এইভাবে সেই দিন তালুত, তাঁর তিন ছেলে, তাঁর অস্ত্র বহনকারী এবং তাঁর সংগের লোকেরা একসংগে মারা গেলেন। যে সব ইসরাইলীয় উপত্যকার অন্য দিকে ছিল আর যারা জর্ডান নদীর ওপারে ছিল তারা যখন দেখল যে, ইসরাইলীয় সৈন্যেরা পালিয়ে গেছে এবং তালুত ও তাঁর ছেলেরা মারা পড়েছেন তখন তারাও তাদের শহর ও গ্রামগুলো ছেড়ে পালিয়ে গেল, আর ফিলিস্তিনীরা এসে সেগুলো দখল করে নিল। পরের দিন ফিলিস্তিনীরা মৃত লোকদের সব কিছু লুট করতে এসে দেখল গিলবোয় পাহাড়ের উপরে তালুত ও তাঁর তিন ছেলের লাশ পড়ে আছে। তারা তালুতের মাথা কেটে ফেলল এবং তাঁর সাজ-পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র খুলে নিল। এই খবর তাদের সমস্ত দেব-মন্দিরে এবং লোকদের কাছে ঘোষণা করবার জন্য তারা ফিলিস্তিনীদের দেশের সব জায়গায় সেগুলো পাঠিয়ে দিল। তারপর তারা তালুতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অষ্টারোৎ-দেবীর মন্দিরে রাখল আর তাঁর শরীরটা বৈৎ-শান শহরের দেয়ালে টাংগিয়ে দিল। ফিলিস্তিনীরা তালুতের প্রতি যা করেছে যাবেশ-গিলিয়দের লোকেরা তা শুনতে পেল। তখন সেখানকার বীর সৈন্যেরা সারারাত হেঁটে বৈৎ-শানে গিয়ে তালুত ও তাঁর ছেলেদের লাশগুলো দেয়াল থেকে নামিয়ে নিল এবং যাবেশে নিয়ে গিয়ে তা পুড়িয়ে দিল। তারপর তারা তাঁদের হাড়গুলো নিয়ে সেখানকার একটা ঝাউ গাছের তলায় দাফন করল এবং সাত দিন রোজা রেখে কাটাল। তালুতের মৃত্যুর পর দাউদ আমালেকীয়দের হারিয়ে দিয়ে সিক্লগে ফিরে আসলেন এবং সেখানে দু’দিন রইলেন। তৃতীয় দিনে তালুতের সৈন্য-ছাউনি থেকে একজন লোক দাউদের কাছে আসল। শোকের চিহ্ন হিসাবে তার গায়ের কাপড়-চোপড় ছেঁড়া ছিল এবং মাথায় ধুলা ছিল। সে দাউদের কাছে গিয়ে মাটিতে পড়ে তাঁকে সালাম জানাল। দাউদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোথা থেকে এসেছ?” সে বলল, “আমি বনি-ইসরাইলদের ছাউনি থেকে পালিয়ে এসেছি।” দাউদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে? আমাকে বল।” সে বলল, “লোকেরা যুদ্ধের জায়গা থেকে পালিয়ে গেছে। অনেকে মারা গেছে আর তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথনও মারা গেছেন।” যে যুবকটি এই খবর এনেছিল দাউদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি করে জানলে যে, তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথন মারা গেছেন?” যুবকটি তাঁকে বলল, “আমি সেই সময় গিলবোয় পাহাড়ে ছিলাম আর তালুত তখন তাঁর বর্শার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই সময় রথ এবং ঘোড়সওয়ারেরা প্রায় তাঁর উপর এসে পড়েছিল। তিনি পিছন ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিলেন। আমি বললাম, ‘এই তো আমি।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’ জবাবে আমি বললাম, ‘আমি একজন আমালেকীয়।’ তিনি আমাকে বললেন, ‘দয়া করে আমার কাছে এসে আমাকে মেরে ফেল, কারণ আমার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে কিন্তু আমি এখনও বেঁচে আছি।’ কাজেই আমি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে মেরে ফেললাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর যে অবস্থা তাতে তিনি আর বাঁচবেন না। আমি তাঁর মাথার তাজ ও তাঁর হাতের বাজু খুলে এখানে আমার প্রভু আপনার কাছে নিয়ে আসলাম।” এই কথা শুনে দাউদ ও তাঁর সংগের লোকেরা নিজেদের কাপড় ছিঁড়লেন। তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথন এবং মাবুদের সৈন্যদলের যে সমস্ত ইসরাইলীয় যুদ্ধে মারা গেছেন তাঁদের জন্য তাঁরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁদতে ও শোক করতে লাগলেন এবং কিছুই খেলেন না। যে যুবকটি এই খবর এনেছিল দাউদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোথাকার লোক?” জবাবে সে বলল, “আমি এই দেশে বাসকারী একজন বিদেশী লোকের ছেলে, একজন আমালেকীয়।” দাউদ তাকে বললেন, “মাবুদের অভিষেক-করা বান্দাকে মেরে ফেলবার জন্য হাত তুলতে তোমার কি একটুও ভয় হল না?” দাউদ তাঁর একজন লোককে ডেকে বললেন, “তুমি কাছে গিয়ে ওকে হত্যা করে ফেল।” এতে সে তাকে হত্যা করে ফেলল। দাউদ সেই যুবকটিকে বলেছিলেন, “তোমার মৃত্যুর জন্য তুমি নিজেই দায়ী, কারণ তোমার মুখের কথাই তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, মাবুদের অভিষেক-করা বান্দাকে তুমি মেরে ফেলেছ।” তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথনের জন্য দাউদ তখন এই বিলাপের গজলটি গাইতে লাগলেন। তিনি হুকুম দিলেন যেন ধনুক নামে এই বিলাপের গজলটি এহুদা-গোষ্ঠীর লোকদের শিখানো হয়। এই গজল যাশের নামে একটা বইয়ে লেখা রয়েছে। “হে ইসরাইল, যাঁরা তোমার গৌরব তাঁরা তোমার ঐ উঁচু জায়গায় মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। হায়, কিভাবে বীরেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন! তোমরা গাতে এই খবর দিয়ো না, আর অস্কিলোনের পথে পথে ঘোষণা কোরো না; তা করলে ফিলিস্তিনীদের মেয়েরা আনন্দ করবে, ঐ খৎনা-না-করানো লোকদের মেয়েরা আমোদ করবে। ওহে গিলবোয়ের পাহাড়শ্রেণী, তোমাদের উপর শিশির বা বৃষ্টি না পড়ুক, তোমাদের মধ্যে উর্বর শস্যক্ষেতও না থাকুক; কারণ ওখানেই তো বীরদের ঢাল অসম্মানিত হয়েছে, তালুতের ঢালে আর তেল মাখানো হচ্ছে না। নিহত লোকদের রক্ত আর বীরদের গোশ্‌ত না পেলে যোনাথনের ধনুক ফিরে আসত না; তৃপ্ত না হয়ে তালুতের তলোয়ার ফিরে আসত না। বেঁচে থাকা কালে তালুত আর যোনাথন প্রিয় ও ভাল ছিলেন; তাঁরা মরণেও আলাদা হলেন না। তাঁদের গতি ছিল ঈগল পাখীর চেয়েও বেশী, আর শক্তিও ছিল সিংহের চেয়ে অনেক। হে ইসরাইলের মেয়েরা, তালুতের জন্য কাঁদ। তিনি তোমাদের দামী লাল কাপড় পরিয়েছেন, তোমাদের কাপড়ের উপর সোনার কারুকাজ করেছেন। হায়, সেই বীরেরা যুদ্ধের মধ্যে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেলেন! ঐ উঁচু জায়গায় যোনাথন মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। হায় যোনাথন, আমার ভাই! তোমার জন্য আমার বড় দুঃখ। আমার কাছে তুমি কত প্রিয়; আমার জন্য তোমার ভালবাসা ছিল মেয়েদের প্রতি ভালবাসার চেয়েও চমৎকার। হায়, কিভাবে বীরেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন, আর নষ্ট হয়ে গেল তাঁদের যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র!” পরে দাউদ মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি এহুদা এলাকার কোন একটা শহরে চলে যাব?” মাবুদ বললেন, “জ্বী, যাও।” দাউদ জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কোথায় যাব?” জবাবে মাবুদ বললেন, “হেবরনে যাও।” তখন দাউদ তাঁর দুই স্ত্রীকে, অর্থাৎ যিষ্রিয়েলের অহীনোয়ম ও কর্মিলের নাবলের বিধবা অবীগলকে নিয়ে হেবরনে গেলেন। যে সব লোক তাঁর সংগে সংগে থাকত তিনি পরিবারসুদ্ধ তাদেরও নিয়ে গেলেন। তারা হেবরনের গ্রামগুলোতে বাস করতে লাগল। তখন এহুদার লোকেরা হেবরনে এসে দাউদকে এহুদা-গোষ্ঠীর লোকদের বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করল। লোকেরা দাউদকে এই খবর দিল যে, যাবেশ-গিলিয়দের লোকেরাই তালুতকে দাফন করেছে। তখন তিনি লোক পাঠিয়ে যাবেশ-গিলিয়দের লোকদের এই কথা বললেন, “আপনারা যে আপনাদের মালিক তালুতকে দাফন করে তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছেন সেইজন্য মাবুদ যেন আপনাদের দোয়া করেন। তিনি যেন এখন তাঁর অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততা আপনাদের দেখান, আর আপনাদের সেই কাজের জন্য আমিও আপনাদের সংগে ভাল ব্যবহার করব। কাজেই এখন আপনারা শক্ত হন ও বুকে সাহস রাখুন। আপনাদের মালিক তালুত মারা গেছেন এবং এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা আমাকে তাদের উপর বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করেছে।” এই সময়ের মধ্যে তালুতের সৈন্যদলের সেনাপতি নেরের ছেলে অবনের তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশত্‌কে জর্ডান নদীর ওপারে মহনয়িমে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ঈশ্‌বোশত্‌কে গিলিয়দ, অশূর, যিষ্রিয়েল, আফরাহীম, বিন্‌ইয়ামীন, এমন কি, সমস্ত ইসরাইল দেশের উপর বাদশাহ্‌ করেছিলেন। তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশৎ চল্লিশ বছর বয়সে ইসরাইল দেশের বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং দু’বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা দাউদের অধীনে ছিল। দাউদ হেবরনে থেকে এহুদা-গোষ্ঠীর উপর সাড়ে সাত বছর রাজত্ব করেছিলেন। এক দিন নেরের ছেলে অবনের তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশতের লোকদের নিয়ে মহনয়িম থেকে গিবিয়োনে গেলেন। তখন সরূয়ার ছেলে যোয়াব ও দাউদের লোকেরা বের হয়ে আসলেন। গিবিয়োনের পুকুরের কাছে এই দুই দল সামনাসামনি হল। এক দল বসল পুকুরের এপারে আর অন্য দল বসল পুকুরের ওপারে। তখন অবনের যোয়াবকে বললেন, “দু’দলের কয়েকজন যুবক উঠে আমাদের সামনে যুদ্ধ করুক।” যোয়াব বললেন, “ভাল, তা-ই হোক।” বিন্যামীন-গোষ্ঠীর ও তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশতের পক্ষ থেকে বারোজনকে আর দাউদের পক্ষ থেকে বারোজনকে যুদ্ধ করবার জন্য বেছে নেওয়া হল। তখন দুই দলের লোকেরা প্রত্যেকেই একে অন্যের মাথা ধরে পাঁজরে ছোরা ঢুকিয়ে দিল এবং একসংগে মাটিতে পড়ে মারা গেল। সেইজন্য গিবিয়োনের সেই জায়গাটার নাম দেওয়া হল হিল্‌কৎ-হৎসূরীম (যার মানে “ছোরার মাঠ”)। সেই দিন এক ভীষণ যুদ্ধ হল আর তাতে অবনের ও ইসরাইলের লোকেরা দাউদের লোকদের কাছে হেরে গেল। যোয়াব, অবীশয় ও অসাহেল নামে সরূয়ার তিন ছেলে সেখানে ছিল। অসাহেল বুনো হরিণের মত জোরে দৌড়াতে পারত। সে অবনেরের পিছনে তাড়া করল এবং ডানে-বাঁয়ে না গিয়ে সোজা তাঁর পিছনে পিছনে ছুটল। অবনের পিছন ফিরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি অসাহেল?” অসাহেল বলল, “জ্বী, ঠিক বলেছেন।” তখন অবনের তাকে বললেন, “তুমি ডানে বা বাঁয়ে ফিরে কোন যুবককে হারিয়ে দিয়ে তার যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে নাও।” কিন্তু অসাহেল তাঁর পিছনে তাড়া করেই চলল। অবনের অসাহেলকে আবার বললেন, “থাম, আমাকে তাড়া কোরো না। আমি তোমাকে মেরে ফেলতে চাই না। তা করলে আমি কেমন করে তোমার ভাই যোয়াবকে মুখ দেখাব?” অসাহেল তবুও ফিরতে রাজী হল না। তখন অবনের তাঁর বর্শার পিছন দিকটা অসাহেলের পেটের ভিতরে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিলেন যে, বর্শাটা তার পিঠ ফুঁড়ে বের হল। অসাহেল সেখানেই পড়ে মারা গেল। অসাহেল যে জায়গায় পড়ে মারা গিয়েছিল যত লোক সেই জায়গায় আসল তারা প্রত্যেকে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু যোয়াব ও অবীশয় অবনেরের পিছনে তাড়া করে গেলেন। এইভাবে তাঁরা গিবিয়োনের মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাবার পথে গীহের সামনে অম্মা পাহাড়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। অবনেরের পিছনে তখন বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকেরা জমায়েত হয়েছিল। তারা এক দল হয়ে একটা পাহাড়ের উপরে গিয়ে দাঁড়াল। তখন অবনের যোয়াবকে ডেকে বললেন, “তলোয়ার কি চিরকাল গিলতেই থাকবে? শেষে যে সব কিছু তেতো হয়ে উঠবে তা কি তুমি বুঝতে পারছ না? কখন তুমি তোমার লোকদের তাদের ভাইদের পিছনে তাড়া করা বন্ধ করতে হুকুম দেবে?” জবাবে যোয়াব বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম, তুমি কথা না বললেও সকালে লোকেরা তাদের ভাইদের তাড়া করা বন্ধ করত।” এই বলে তিনি শিংগা বাজালেন। তখন সমস্ত লোক থেমে গেল। তারা আর বনি-ইসরাইলদের পিছনে তাড়া করল না এবং যুদ্ধও করল না। অবনের ও তাঁর লোকেরা সারা রাত আরবা সমভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে জর্ডান নদী পার হল। তারপর বিথ্রোণের মধ্য দিয়ে হেঁটে তারা মহনয়িমে গিয়ে উপস্থিত হল। যোয়াব অবনেরের পিছনে তাড়া করা বাদ দিয়ে ফিরে গেলেন। তিনি তাঁর লোকদের জমায়েত করলে পর দেখা গেল অসাহেল নেই আর দাউদের ঊনিশজন লোক নেই। তবে যে বিন্‌ইয়ামীনীয়রা অবনেরের সংগে ছিল দাউদের লোকেরা তাদের তিনশো ষাটজনকে হত্যা করেছিল। তারা অসাহেলকে তুলে নিয়ে বেথেলহেমে গেল এবং তার পিতার কবরের মধ্যে তাকে দাফন করল। তারপর যোয়াব ও তাঁর লোকেরা সারা রাত হেঁটে ভোর বেলায় হেবরনে গিয়ে পৌঁছাল। তালুত ও দাউদের সৈন্যদলের মধ্যে অনেকদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। দাউদ শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলেন আর তালুতের সৈন্যদল দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। হেবরনে থাকবার সময়ে দাউদের কয়েকটি ছেলের জন্ম হয়েছিল। দাউদের বড় ছেলের নাম অম্নোন; সে ছিল যিষ্রিয়েলের অহীনোয়মের ছেলে। তাঁর দ্বিতীয় ছেলের নাম কিলাব; সে ছিল কর্মিলের নাবলের বিধবা অবীগলের ছেলে। তৃতীয় ছেলের নাম অবশালোম; সে ছিল গশূরের বাদশাহ্‌ তল্‌ময়ের মেয়ে মাখার ছেলে। চতুর্থ ছেলের নাম আদোনিয়; সে ছিল হগীতের ছেলে। পঞ্চম ছেলের নাম শফটিয়; সে ছিল অবীটলের ছেলে। ষষ্ঠ ছেলের নাম যিত্রিয়ম; সে ছিল দাউদের স্ত্রী ইগ্‌লার ছেলে। দাউদের এই সব ছেলের জন্ম হয়েছিল হেবরনে। তালুত ও দাউদের সৈন্যদলের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন তালুতের লোকদের মধ্যে অবনের নিজেকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। রিস্‌পা নামে তালুতের একজন উপস্ত্রী ছিল। সে ছিল অয়ার মেয়ে। একদিন ঈশ্‌বোশৎ অবনেরকে বললেন, “আপনি আমার পিতার উপস্ত্রীর সংগে কেন শুয়েছিলেন?” ঈশ্‌বোশতের কথা শুনে অবনের ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, “আমি কি এহুদা পক্ষের কুকুরের মাথা? আজ পর্যন্ত আমি তোমার বাবা তালুতের পরিবারের প্রতি এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের প্রতি বিশ্বস্ত রয়েছি। আমি তোমাকে দাউদের হাতে তুলে দিই নি। এর পরেও তুমি ঐ স্ত্রীলোকটি সম্বন্ধে আমাকে দোষী করছ! ঈশ্‌বোশৎ অবনেরকে আর একটা কথাও বলতে সাহস করলেন না, কারণ তিনি তাঁকে ভয় করলেন। এর পর অবনের নিজের পক্ষ থেকে দাউদের কাছে লোক পাঠিয়ে তাঁকে এই কথা বললেন, “এই দেশটা কার? আপনি আমার সংগে একটি চুক্তি করুন। আমি সমস্ত বনি-ইসরাইলদের আপনার পক্ষে নিয়ে আসতে আপনাকে সাহায্য করব।” দাউদ বললেন, “খুব ভাল, আমি আপনার সংগে একটা চুক্তি করব, কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা শর্ত আছে। আপনি যখন আবার আমার কাছে আসবেন তখন তালুতের মেয়ে মীখলকে না নিয়ে আমার সামনে আসবেন না।” তারপর দাউদ তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশতের কাছে লোক পাঠিয়ে এই দাবি জানালেন, “আমার স্ত্রী মীখলকে দাও। আমি ফিলিস্তিনীদের একশো পুরুষাংগের সামনের চামড়া মহরানা দিয়ে তাকে বিয়ে করেছিলাম।” তখন ঈশ্‌বোশতের হুকুমে মীখলের স্বামী লয়িশের ছেলে পল্‌টিয়েলের কাছ থেকে মীখলকে নিয়ে আসা হল। তাঁর স্বামী সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পিছন পিছন বহুরীম পর্যন্ত গেল। তখন অবনের তাকে বললেন, “তুমি বাড়ী ফিরে যাও।” সে তখন বাড়ী ফিরে গেল। এর আগে অবনের ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতাদের কাছে বলেছিলেন, “আগে আপনারা দাউদকে আপনাদের বাদশাহ্‌ করতে চেয়েছিলেন। এখন তা-ই করুন। মাবুদ দাউদের বিষয়ে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাঁর গোলাম দাউদকে দিয়ে ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে এবং তাদের আর সব শত্রুর হাত থেকে তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করবেন।” অবনের বিন্‌ইয়ামীনীয়দের সংগেও কথা বললেন। এছাড়া তিনি ইসরাইল ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোক যা করতে চায় তা সব দাউদকে জানাবার জন্য হেবরনে গেলেন। অবনের তাঁর সংগের বিশজন লোক নিয়ে যখন হেবরনে দাউদের কাছে উপস্থিত হলেন তখন তাঁর ও তাঁর লোকদের জন্য দাউদ একটা মেজবানীর ব্যবস্থা করলেন। পরে অবনের দাউদকে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা সকলে যাতে আপনার সংগে একটা চুক্তিতে আসে আর আপনি আপনার ইচ্ছামত তাদের সকলের উপর রাজত্ব করতে পারেন তাই আমার প্রভু মহারাজের কাছে তাদের জমায়েত করবার জন্য আমাকে এখনই যেতে দিন।” এই কথা শুনে দাউদ অবনেরকে যেতে দিলেন আর অবনের শান্তিতে চলে গেলেন। ঠিক সেই সময়ে দাউদের লোকেরা ও যোয়াব শত্রুদের হামলা করা শেষ করে অনেক লুটের মাল নিয়ে ফিরে আসলেন। তখন অবনের হেবরনে দাউদের কাছে ছিলেন না, কারণ দাউদ তাঁকে বিদায় করে দিয়েছিলেন আর তিনি শান্তিতে চলে গিয়েছিলেন। যোয়াব ও তাঁর সংগের সৈন্যেরা ফিরে আসলে পর লোকেরা যোয়াবকে বলল যে, নেরের ছেলে অবনের বাদশাহ্‌র কাছে এসেছিলেন এবং বাদশাহ্‌ তাঁকে বিদায় করে দিয়েছেন এবং তিনি শান্তিতে চলে গেছেন। যোয়াব তখন বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বললেন, “এ আপনি কি করলেন? অবনের তো আপনার কাছে এসেছিল, আপনি কেন তাকে চলে যেতে দিলেন? সে এখন চলে গেছে। আপনি তো নেরের ছেলে অবনেরকে জানেন; সে আপনার সংগে ছলনা করে আপনার খোঁজ খবর নিতে এবং আপনি কি করছেন না করছেন তা জানতে এসেছিল।” এই বলে যোয়াব দাউদের কাছ থেকে বের হয়ে গিয়ে অবনেরের খোঁজে লোক পাঠালেন। তারা সিরা নামে একটা কূয়ার কাছ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনল। দাউদ কিন্তু এই সব জানতেন না। অবনের হেবরনে ফিরে আসলে পর যোয়াব তাঁর সংগে গোপনে আলাপ করবার ছল করে শহরের দরজার মধ্যে নিয়ে গেলেন। তারপর তাঁর পেটে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করলেন। এইভাবে তিনি তাঁর ভাই অসাহেলের রক্তের শোধ নিলেন। এর পর দাউদ যোয়াব ও তাঁর সংগের সব লোকদের বললেন, “তোমরা নিজের নিজের কাপড় ছিঁড়ে চট পর এবং শোক প্রকাশ করতে করতে অবনেরের লাশের আগে আগে চল।” লাশ বহনকারী খাটের পিছনে পিছনে বাদশাহ্‌ দাউদ নিজেও চললেন। অবনেরকে হেবরনে দাফন করা হল। অবনেরের কবরের কাছে বাদশাহ্‌ জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন, আর লোকেরাও সবাই কাঁদতে লাগল। বাদশাহ্‌ তখন অবনেরের বিষয়ে এই বিলাপের কাওয়ালীটি গাইলেন: “বোকা লোকের মতই কি মরলেন অবনের? তোমার তো হাত বাঁধা ছিল না, তোমার পায়ে শিকলও ছিল না। দুষ্ট লোকের হাতে যেমন করে মানুষ মরে, তেমনি করেই তো তুমি মরে গেলে।” এই কথা শুনে লোকেরা আবার অবনেরের জন্য কাঁদতে লাগল। বেলা থাকতে থাকতে যাতে দাউদ কিছু খান সেইজন্য লোকেরা তাঁকে সাধাসাধি করতে লাগল; কিন্তু দাউদ কসম খেয়ে বললেন, “সূর্য ডুববার আগে যদি আমি রুটি বা অন্য কিছু খাই তবে যেন আল্লাহ্‌ আমাকে শাস্তি দেন আর তা ভীষণভাবেই দেন।” সমস্ত লোক এই সব লক্ষ্য করে খুশী হল। সত্যি, বাদশাহ্‌ যা যা করলেন তাতে তারা খুশীই হল। সেই দিন দাউদের সংগের লোকেরা এবং বনি-ইসরাইলরা সবাই জানতে পারল যে, নেরের ছেলে অবনেরকে হত্যা করবার ব্যাপারে বাদশাহ্‌র কোন হাত ছিল না। বাদশাহ্‌ তাঁর লোকদের বললেন, “তোমরা কি জান না যে, আজকে ইসরাইল দেশের একজন মহান নেতা মারা গেলেন? বাদশাহ্‌ হিসাবে আমাকে অভিষেক করা হলেও আজ আমি দুর্বল আর সরূয়ার ছেলেদের আমি দমন করতে পারি না। মাবুদ যেন অন্যায়কারীদের অন্যায় কাজ অনুসারে ফল দেন।” অবনের হেবরনে মারা গেছেন শুনে তালুতের ছেলে ঈশ্‌বোশৎ সাহস হারিয়ে ফেললেন এবং ইসরাইলীয়রাও সবাই ভয় পেল। তালুতের ছেলের পক্ষে ছিল হানাদার বাহিনীর দুইজন সরদার। তাদের একজনের নাম ছিল বানা আর অন্যজনের নাম রেখব। তারা ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর বেরোতীয় রিম্মোণের ছেলে। বেরোতকে বিন্‌ইয়ামীন এলাকার অংশ বলে ধরা হত, কারণ বেরোতের লোকেরা গিত্তয়িমে পালিয়ে গিয়ে আজও সেখানে বিদেশী হিসাবে বাস করছে। তালুতের ছেলে যোনাথনের একটি ছেলে ছিল। তার দু’টি পা-ই ছিল খোঁড়া। যিষ্রিয়েল থেকে যখন তালুত ও যোনাথনের মৃত্যুর খবর এসেছিল তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। খবর শুনে ছেলেটির ধাইমা তাকে কোলে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে যাবার সময় ছেলেটি পড়ে গিয়ে তার পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির নাম ছিল মফীবোশৎ। বেরোতীয় রিম্মোণের ছেলে রেখব আর বানা একদিন দুপুর বেলায় ঈশ্‌বোশতের বিশ্রামের সময় তাঁর বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল। জবাবে দাউদ বেরোতীয় রিম্মোণের ছেলে রেখব ও তার ভাই বানাকে বললেন, “যিনি সমস্ত বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি, যে লোকটি শুভ সংবাদ এনেছে ভেবে আমাকে তালুতের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল আমি তাকে ধরে সিক্লগে হত্যা করেছিলাম। তার খবরের জন্য সেটাই ছিল তাকে দেওয়া আমার পুরস্কার। তাহলে যারা একজন নির্দোষ লোককে তাঁর নিজের বাড়ীতে তাঁর নিজের বিছানার উপর খুন করেছে, আমি সেই দুষ্ট লোকদের আরও কত বেশী করেই না শাস্তি দেব। সেইজন্য আমি তোমাদের হাত থেকে তাঁর রক্তের শোধ দাবি করব আর দুনিয়ার উপর থেকে তোমাদের মুছে ফেলব।” এই বলে দাউদ তাঁর লোকদের হুকুম দিলে পর তারা গিয়ে তাদের হত্যা করল। তারা তাদের হাত ও পা কেটে ফেলে লাশগুলো হেবরনের পুকুরের ধারে টাংগিয়ে দিল। কিন্তু তারা ঈশ্‌বোশতের মাথাটা নিয়ে হেবরনে অবনেরের কবরের মধ্যে দাফন করল। ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠী হেবরনে দাউদের কাছে এসে বলল, “আপনার ও আমাদের গায়ে একই রক্ত বইছে। এর আগে যখন তালুত আমাদের বাদশাহ্‌ ছিলেন তখন যুদ্ধের সময় আপনিই বনি-ইসরাইলদের সৈন্য পরিচালনা করতেন; আর মাবুদ আপনাকে বলেছেন যেন আপনিই তাঁর বান্দাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের দেখাশোনা করেন ও তাদের নেতা হন।” ইসরাইল দেশের সমস্ত বৃদ্ধ নেতারা হেবরনে বাদশাহ্‌ দাউদের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন বাদশাহ্‌ মাবুদকে সাক্ষী রেখে তাঁদের সংগে একটা চুক্তি করলেন। তাঁরা দাউদকে ইসরাইলের উপর বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করলেন। দাউদ যখন বাদশাহ্‌ হলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ত্রিশ বছর; তিনি চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি হেবরনে থেকে এহুদা দেশের উপরে সাড়ে সাত বছর আর জেরুজালেমে থেকে সমস্ত ইসরাইল ও এহুদার উপরে তেত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। বাদশাহ্‌ দাউদ ও তাঁর সৈন্যেরা যিবূষীয়দের হামলা করবার জন্য জেরুজালেমের দিকে যাত্রা করলেন। যিবূষীয়রা জেরুজালেমে বাস করত। যিবূষীয়রা দাউদকে বলল, “তুমি এখানে ঢুকতে পারবে না; অন্ধ আর খোঁড়ারাই তোমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে।” তারা ভেবেছিল দাউদ সেখানে ঢুকতে পারবেন না। কিন্তু দাউদ সিয়োনের কেল্লাটা অধিকার করে নিলেন; সেইজন্য ওটাকে দাউদ-শহর বলা হয়। সেই দিন দাউদ বলেছিলেন, “যদি কেউ যিবূষীয়দের, অর্থাৎ সেই অন্ধ ও খোঁড়াদের আক্রমণ করতে চায় তবে তাকে পানির সুড়ংগ দিয়ে যেতে হবে। আমি তাদের ঘৃণা করি।” সেইজন্যই লোকে বলে, “অন্ধ আর খোঁড়ারা মাবুদের ঘরে ঢুকবে না।” এর পর দাউদ সেই কেল্লায় বাস করতে লাগলেন এবং তার নাম দিলেন দাউদ-শহর। মিল্লো থেকে শুরু করে সেই কেল্লার চারপাশে তিনি শহর গড়ে তুললেন। তিনি দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, কারণ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর সংগে ছিলেন। টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরম দাউদের কাছে কয়েকজন লোক পাঠালেন এবং তাদের সংগে এরস কাঠ, ছুতার মিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রি পাঠিয়ে দিলেন। তারা দাউদের জন্য একটা রাজবাড়ী তৈরী করে দিল। দাউদ তখন বুঝলেন যে, মাবুদ ইসরাইলের উপরে তাঁর রাজপদ স্থির করেছেন এবং তাঁর লোকদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের জন্য তাঁর রাজ্যের উন্নতি করেছেন। দাউদ হেবরন ছেড়ে জেরুজালেমে গিয়ে আরও স্ত্রী ও উপস্ত্রী গ্রহণ করলেন এবং তাঁর আরও ছেলেমেয়ের জন্ম হল। জেরুজালেমে তাঁর যে সব ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছিল তাদের নাম হল সম্মূয়, শোবব, নাথন, সোলায়মান, যিভর, ইলীশূয়, নেফগ, যাফিয়, ইলীশামা, ইলিয়াদা ও ইলীফেলট। ফিলিস্তিনীরা যখন শুনতে পেল যে, ইসরাইলের উপরে দাউদকে রাজপদে অভিষেক করা হয়েছে তখন তারা সমস্ত সৈন্য নিয়ে তাঁকে হামলা করবার জন্য খুঁজতে লাগল। দাউদ সেই কথা শুনে কেল্লা নামে পাহাড়টায় গেলেন। ফিলিস্তিনীরা এসে রফায়ীম উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ল। দাউদ তখন মাবুদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি ফিলিস্তিনীদের হামলা করব? তুমি কি তাদের আমার হাতে তুলে দেবে?” জবাবে মাবুদ বললেন, “জ্বী, যাও। আমি নিশ্চয়ই তোমার হাতে ফিলিস্তিনীদের তুলে দেব।” দাউদ তখন বাল-পরাসীমে গেলেন এবং সেখানে তাদের হারিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “মাবুদ আমার সামনে পানির বাঁধ ভাংগার মত করে আমার শত্রুদের ভেংগে ফেললেন।” এইজন্য সেই জায়গার নাম হল বাল-পরাসীম। ফিলিস্তিনীরা তাদের দেবমূর্তিগুলো সেখানে ফেলে গিয়েছিল, আর দাউদ ও তাঁর লোকেরা সেগুলো নিয়ে গেলেন। পরে ফিলিস্তিনীরা আবার এসে রফায়ীম উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ল। তখন দাউদ মাবুদকে জিজ্ঞাসা করলে পর তিনি বললেন, “সোজাসুজি তাদের দিকে যেয়ো না; তাদের পিছন দিকটা ঘিরে ফেলে বাকা গাছগুলোর সামনের দিক দিয়ে তাদের হামলা কর। বাকা গাছগুলোর মাথায় যখনই তুমি সৈন্যদলের চলবার মত শব্দ শুনবে তখনই বেরিয়ে পড়বে। এর মানে হল, ফিলিস্তিনী সৈন্যদের আঘাত করবার জন্য মাবুদ তোমার আগে আগে গেছেন।” দাউদ মাবুদের হুকুম মতই কাজ করলেন। তিনি গেবা থেকে গেষর পর্যন্ত সারা পথ ফিলিস্তিনীদের মারতে মারতে গেলেন। দাউদ আবার বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে ত্রিশ হাজার বাছাই-করা লোককে একত্র করলেন। দাউদ ও তাঁর সমস্ত লোক আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি বালি-এহুদা থেকে জেরুজালেমে নিয়ে যাবার জন্য বালি-এহুদা থেকে রওনা হলেন। এই সিন্দুকটি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের নামে পরিচিত, কারণ মাবুদ সেই সিন্দুকের উপরে দুই কারুবীর মাঝখানে থাকেন। আল্লাহ্‌র সেই সিন্দুকটি তারা পাহাড়ের উপরে অবীনাদবের ঘর থেকে বের করে একটা নতুন গাড়ির উপরে বসাল। উষ ও অহিয়ো নামে অবীনাদবের দুই ছেলে হেঁটে হেঁটে সেই নতুন গাড়িটাকে নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়িটার উপরে ছিল আল্লাহ্‌র সেই সিন্দুক আর অহিয়ো তার আগে আগে হাঁটছিল। দাউদ ও ইসরাইল জাতির সমস্ত লোক মাবুদের সামনে দেবদারু কাঠের তৈরী সব বাজনা আর সুরবাহার, বীণা, খঞ্জনী, ঝুম্‌ঝুমি ও করতাল বাজিয়ে আনন্দ করছিল। নাখোনের খামারের কাছে আসলে পর গরু দু’টা উচোট খেল; তখন উষ হাত বাড়িয়ে আল্লাহ্‌র সিন্দুকটা ধরল। উষের এই ভয়হীন কাজের জন্য তার উপর মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন। সেইজন্য মাবুদ তাকে আঘাত করলেন, আর তাতে সে মাবুদের সিন্দুকের পাশে মরে গেল। উষের উপর মাবুদের এই রাগ দেখে দাউদ অসন্তুষ্ট হলেন। আজও সেই জায়গাটাকে বলা হয় পেরস-উষ। দাউদ সেই দিন মাবুদকে খুব ভয় করলেন। তিনি বললেন, “মাবুদের সিন্দুকটি তবে কি করে আমার কাছে আনা যাবে?” মাবুদের সিন্দুকটি তিনি দাউদ-শহরে নিজের কাছে নিয়ে আসতে রাজী হলেন না। তিনি সেটি নিয়ে গাতীয় ওবেদ-ইদোমের বাড়ীতে রাখলেন। গাতীয় ওবেদ-ইদোমের বাড়ীতে মাবুদের সিন্দুকটি তিন মাস রইল। এতে মাবুদ তাকে ও তার বাড়ীর সবাইকে দোয়া করলেন। বাদশাহ্‌ দাউদ শুনতে পেলেন আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি ওবেদ-ইদোমের বাড়ীতে থাকবার দরুন মাবুদ তার বাড়ীর সবাইকে এবং তার সব কিছুকে দোয়া করেছেন। তখন দাউদ গিয়ে ওবেদ-ইদোমের বাড়ী থেকে আনন্দ করতে করতে আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি দাউদ-শহরে নিয়ে আসলেন। যারা মাবুদের সিন্দুকটি বয়ে নিয়ে আসছিল তারা ছয় পা এগিয়ে যেতেই দাউদ একটা বলদ ও একটা মোটাসোটা বাছুর কোরবানী করলেন। দাউদ মসীনার এফোদ পরে মাবুদের সামনে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নাচতে লাগলেন। এইভাবে দাউদ ও বনি-ইসরাইলরা সকলে আনন্দে চিৎকার করতে করতে এবং শিংগা বাজাতে বাজাতে মাবুদের সিন্দুকটি নিয়ে আসলেন। মাবুদের সিন্দুকটি যখন দাউদ-শহরে এসে পৌঁছাল তখন তালুতের মেয়ে মীখল জানালা দিয়ে তা দেখছিলেন। মাবুদের সামনে বাদশাহ্‌ দাউদকে লাফাতে আর নাচতে দেখে তিনি মনে মনে তাঁকে তুচ্ছ করলেন। মাবুদের সিন্দুকটি এনে লোকেরা সেটি দাউদের খাটিয়ে-রাখা তাম্বুর ভিতরে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখল। দাউদ তখন মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানী দিলেন। পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানী শেষ করে দাউদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের নামে লোকদের দোয়া করলেন। তারপর তিনি সমস্ত লোককে, অর্থাৎ উপস্থিত বনি-ইসরাইলদের সমস্ত পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের প্রত্যেককে একটা করে রুটি, এক টুকরা গোশ্‌ত ও এক তাল কিশমিশ দিলেন। তারপর সবাই তাদের নিজের নিজের বাড়ীতে ফিরে গেল। এর পর দাউদ তাঁর নিজের বাড়ীর লোকদের দোয়া করবার জন্য যখন ফিরে আসলেন তখন তালুতের মেয়ে মীখল তাঁকে এগিয়ে নেবার জন্য বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, “ইসরাইল দেশের বাদশাহ্‌ আজ নিজেকে কেমন সম্মানিত করে তুললেন! তিনি খারাপ লোকের মত সাধারণ লোকদের বাঁদীদের সামনে শরীরের কাপড়-চোপড় খুলে ফেললেন।” দাউদ মীখলকে বললেন, “মাবুদের সামনেই আমি তা করেছি। তিনি তাঁর বান্দাদের উপরে, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের উপরে শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করবার জন্য তোমার বাবা কিংবা তাঁর বাড়ীর কাউকে বেছে না নিয়ে আমাকেই বেছে নিয়েছেন। সেইজন্য মাবুদের সামনেই আমি আনন্দ করব। আমি নিজেকে এর চেয়ে আরও নীচু করব আর নিজের কাছে নিজে আরও ছোট হব। কিন্তু তুমি যে বাঁদীদের কথা বললে তারা আমাকে সম্মানের চোখে দেখবে।” তালুতের মেয়ে মীখলের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয় নি। তারপর বাদশাহ্‌ দাউদ রাজবাড়ীতে থাকতে লাগলেন আর মাবুদ তাঁর চারপাশের শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে রেহাই দিলেন। বাদশাহ্‌ তখন একদিন নবী নাথনকে বললেন, “দেখুন, আমি বাস করছি এরস কাঠের ঘরে আর আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি রয়েছে তাম্বুতে।” জবাবে নাথন বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনার মনে যা আছে আপনি তা-ই করুন। মাবুদ আপনার সংগে আছেন।” কিন্তু সেই রাতেই মাবুদের কালাম নাথনের উপর নাজেল হল; আল্লাহ্‌ বললেন, “তুমি গিয়ে আমার গোলাম দাউদকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘তুমি কি আমার থাকবার জন্য একটি ঘর তৈরী করবে? মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে আনবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি তো কোন ঘরে বাস করি নি। আমি তাম্বুতে থেকেই এক বাসস্থান থেকে অন্য বাসস্থানে গিয়েছি। যে সব নেতাদের উপর আমি আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের পালন করবার ভার দিয়েছিলাম, বিভিন্ন জায়গায় বনি-ইসরাইলদের সংগে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি সেই নেতাদের কাউকে বলি নি যে, কেন তারা এরস কাঠ দিয়ে আমার জন্য ঘর তৈরী করছে না।’ “এখন তুমি আমার গোলাম দাউদকে বল যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছেন, ‘আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হবার জন্য আমিই তোমাকে পশু চরাবার মাঠ থেকে, ভেড়ার পালের পিছন থেকে নিয়ে এসেছি। তুমি যে সব জায়গায় গিয়েছ আমিও সেখানে তোমার সংগে গিয়েছি এবং তোমার সামনে থেকে তোমার সমস্ত শত্রুদের শেষ করে দিয়েছি। আমি তোমার নাম দুনিয়ার মহান লোকদের নামের মত বিখ্যাত করব। তোমার আয়ু শেষ হলে পর যখন তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবে তখন আমি তোমার জায়গায় তোমার বংশের একজনকে, তোমার নিজের সন্তানকে বসাব এবং তার রাজ্য স্থির রাখব। তোমার সেই সন্তানই আমার সুনামের জন্য একটা ঘর তৈরী করবে। তার রাজ-সিংহাসন আমি চিরকাল স্থায়ী করব। আমি হব তার পিতা আর সে হবে আমার পুত্র। যখন সে অন্যায় করবে তখন অন্য মানুষ যেমন শাস্তি পায় তেমনিভাবেই আমি তাকে শাস্তি দেব। কিন্তু আমার মহব্বত আমি কখনও তার উপর থেকে তুলে নেব না, যেমন করে আমি তালুতের উপর থেকে তুলে নিয়েছিলাম আর তোমার পথ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার বংশ ও রাজ্য তোমার সামনে চিরকাল স্থির থাকবে। তোমার সিংহাসন হবে চিরস্থায়ী।’ ” এই দর্শনের সমস্ত কথাগুলো নাথন দাউদকে বললেন। এই সব কথা শুনে বাদশাহ্‌ দাউদ তাম্বুর ভিতরে গেলেন এবং মাবুদের সামনে বসে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমিই বা কি আর আমার বংশই বা কি যে, তুমি আমাকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছ। আর হে আল্লাহ্‌ মালিক, এও তোমার চোখে যথেষ্ট হয় নি; এর সংগে তোমার গোলামের বংশের ভবিষ্যতের কথাও তুমি বলেছ। হে আল্লাহ্‌ মালিক, এটাই যেন মানুষের জন্য তোমার ব্যবস্থা হয়। “দাউদ তোমার কাছে আর বেশী কি বলতে পারে? হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি তো তোমার গোলামকে জান। তোমার কথার জন্য ও তোমার ইচ্ছা অনুসারে এই মহৎ কাজ তুমি করেছ আর তোমার গোলামকে তা জানিয়েছ। হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, তুমি কত মহান! তোমার মত আর কেউ নেই এবং তুমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই; সেই কথা আমরা নিজেদের কানেই শুনেছি। তোমার ইসরাইল জাতির মত দুনিয়াতে আর কোন্‌ জাতি আছে যাকে তুমি তোমার নিজের বান্দা করবার জন্য এবং নিজের গৌরব প্রকাশের জন্য মুক্ত করতে গিয়েছিলে? আর কোন্‌ জাতির সামনে তুমি নিজের উদ্দেশ্যে তোমার দেশের জন্য মহৎ ও ভয় জাগানো কাজ করেছ, যেমন তোমার বান্দাদের জন্য করেছ যাদের তুমি মিসর দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি ও দেব-দেবীদের হাত থেকে মুক্ত করেছ? তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের তুমি নিজের উদ্দেশ্যে চিরকাল তোমার নিজের লোক হবার জন্য স্থাপন করেছ, আর তুমি, হে আল্লাহ্‌, তুমি তাদের মাবুদ হয়েছ। “এখন হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, তোমার গোলাম ও তার বংশের বিষয়ে তুমি যে ওয়াদা করেছ তা চিরকাল রক্ষা কর। তোমার ওয়াদা অনুসারেই তা কর। এতে তোমার গোলাম দাউদের বংশ তোমার সামনে স্থির থাকবে এবং চিরকাল তোমার গৌরব হবে। তখন লোকে বলবে, ‘আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই বনি-ইসরাইলদের মাবুদ।’ “হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, বনি-ইসরাইলদের মাবুদ, তুমি তোমার গোলামের কাছে এই বিষয় প্রকাশ করে বলেছ, ‘আমি তোমার জন্য একটা বংশ গড়ে তুলব।’ তাই তোমার কাছে এই মুনাজাত করতে তোমার এই গোলামের মনে সাহস হয়েছে। হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমিই মাবুদ। তোমার কথা সত্য, আর এই উন্নতির ওয়াদা তুমিই তোমার গোলামের কাছে করেছ। এখন তুমি খুশী হয়ে তোমার গোলামের বংশকে দোয়া কর যাতে সেই বংশ চিরকাল তোমার সামনে থাকে। হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি নিজেই সেই কথা বলেছ আর তোমার দোয়ায় তোমার এই গোলামের বংশ চিরকাল দোয়াযুক্ত থাকবে।” পরে দাউদ ফিলিস্তিনীদের হারিয়ে দিয়ে তাদের নিজের অধীনে আনলেন। তিনি ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে মেথেগ-আম্মা দখল করে নিলেন। দাউদ মোয়াবীয়দেরও হারিয়ে দিলেন। তিনি মোয়াবীয়দের মাটিতে পাশাপাশি শুইয়ে একপাশ থেকে শুরু করে তাদের শেষ পর্যন্ত দড়ি দিয়ে মাপলেন। প্রথম দুই দড়ির মাপের লোকদের হত্যা করা হল এবং তারপরের এক দড়ির মাপের লোকদের বাঁচিয়ে রাখা হল। এর পর মোয়াবীয়রা দাউদের অধীন হয়ে তাঁকে খাজনা দিতে লাগল। পরে সোবার বাদশাহ্‌ রহোবের ছেলে হদদেষর যখন ফোরাত নদী বরাবর তাঁর জায়গাগুলোতে আবার তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে গেলেন তখন দাউদ তাঁর সংগে যুদ্ধ করলেন। দাউদ তাঁর এক হাজার সাতশো ঘোড়সওয়ার এবং বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য আটক করলেন। তাদের একশোটা রথের ঘোড়া রেখে তিনি বাকী সব ঘোড়ার পায়ের শিরা কেটে দিলেন। দামেস্কের সিরীয়রা যখন সোবার বাদশাহ্‌ হদদেষরকে সাহায্য করতে আসল তখন দাউদ তাদের বাইশ হাজার লোককে হত্যা করলেন। দাউদ সিরিয়া রাজ্যের দামেস্কে তাঁর সৈন্যদল রাখলেন। তাতে সিরীয়রা তাঁর অধীন হয়ে তাঁকে খাজনা দিতে লাগল। এইভাবে দাউদ যে কোন জায়গায় যেতেন মাবুদ সেখানেই তাঁকে জয়ী করতেন। হদদেষরের লোকদের সোনার ঢালগুলো দাউদ জেরুজালেমে নিয়ে আসলেন। বেটহ ও বেরোথা নামে হদদেষরের দু’টা শহর থেকে বাদশাহ্‌ দাউদ প্রচুর পরিমাণে ব্রোঞ্জও নিয়ে আসলেন। হামার বাদশাহ্‌ তয়ি শুনতে পেলেন যে, দাউদ হদদেষরের গোটা সৈন্যদলকে হারিয়ে দিয়েছেন। দাউদ হদদেষরের সংগে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বলে তাঁকে সালাম ও অভিনন্দন জানাবার জন্য তয়ি তাঁর ছেলে যোরামকে বাদশাহ্‌ দাউদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এই হদদেষরের সংগে তয়ির অনেকবার যুদ্ধ হয়েছিল। যোরাম দাউদের জন্য সংগে করে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। দাউদ লবণ-উপত্যকার আঠারো হাজার সিরীয়কে হত্যা করে ফিরে আসলে পর চারদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ইদোম দেশের সব জায়গায় তিনি নিজের সৈন্যদল রাখলেন আর তাতে ইদোমীয়রা তাঁর অধীন হল। দাউদ যে কোন জায়গায় যেতেন মাবুদ সেখানেই তাঁকে জয়ী করতেন। দাউদ সমস্ত ইসরাইল দেশের উপর রাজত্ব করতে লাগলেন। তাঁর লোকদের তিনি ন্যায়ভাবে বিচার ও শাসন করতেন। সরূয়ার ছেলে যোয়াব ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি আর অহীলূদের ছেলে যিহোশাফট তাঁর রাজত্বের সব ইতিহাস লিখে রাখতেন। অহীটূবের ছেলে সাদোক ও অবিয়াথরের ছেলে অহীমেলক ছিলেন ইমাম আর সরায় ছিলেন বাদশাহ্‌র লেখক। যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন দাউদের দেহরক্ষী করেথীয় ও পলেথীয়দের প্রধান, আর দাউদের ছেলেরা ছিলেন বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা ইমাম। একদিন দাউদ জিজ্ঞাসা করলেন, “তালুতের পরিবারের কেউ কি বেঁচে আছে, যাকে আমি ভালবাসা দেখিয়ে যোনাথনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারি?” সীবঃ নামে তালুতের বাড়ীর একজন চাকর ছিল। লোকেরা তাকে ডেকে দাউদের কাছে নিয়ে গেল। বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি সীবঃ?” জবাবে সে বলল, “জ্বী হুজুর, আপনার গোলাম আমিই সেই সীবঃ।” বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “তালুতের পরিবারের এমন কেউ কি বেঁচে নেই যাকে আমি ভালবাসা দেখিয়ে আল্লাহ্‌র মত বিশ্বস্ত হতে পারি?” জবাবে সীবঃ বাদশাহ্‌কে বলল, “যোনাথনের একটি ছেলে এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর দু’টা পা-ই খোঁড়া।” বাদশাহ্‌ বললেন, “কোথায় সে?” সীবঃ বলল, “তিনি লো-দবারে অম্মীয়েলের ছেলে মাখীরের বাড়ীতে আছেন।” তখন বাদশাহ্‌ দাউদ লো-দবারে লোক পাঠিয়ে অম্মীয়েলের ছেলে মাখীরের বাড়ী থেকে তাঁকে আনালেন। তালুতের নাতি, অর্থাৎ যোনাথনের ছেলে মফীবোশৎ দাউদের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে মাটির উপর উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন। দাউদ বললেন, “মফীবোশৎ।” তিনি বললেন, “বলুন হুজুর, আমি আপনার গোলাম।” দাউদ তাঁকে বললেন, “তুমি ভয় কোরো না। আমি তোমাকে ভালবাসা দেখিয়ে তোমার পিতা যোনাথনের প্রতি অবশ্যই বিশ্বস্ত থাকব। তোমার দাদু তালুতের সমস্ত জমি-জায়গা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব, আর তুমি সব সময় আমার টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করবে।” এই কথা শুনে মফীবোশৎ মাটিতে উবুড় হয়ে বললেন, “আপনার এই গোলাম এমন কি যে, আপনি আমার মত একটা মরা কুকুরের দিকে খেয়াল করবেন?” বাদশাহ্‌ তখন তালুতের চাকর সীবঃকে ডেকে বললেন, “তালুত ও তাঁর পরিবারের যা কিছু ছিল তা সব আমি তোমার মালিকের নাতিকে দিলাম। তুমি, তোমার ছেলেরা এবং তোমার চাকরেরা তার জমি চাষ করে ফসল তুলবে যাতে তোমার মালিকের নাতির খাবারের যোগান থাকে; কিন্তু তোমার মালিকের নাতি মফীবোশৎ সব সময় আমার টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করবে।” সীবের পনেরটি ছেলে এবং বিশজন চাকর ছিল। এই কথা শুনে সীবঃ বাদশাহ্‌কে বলল, “আমার প্রভু মহারাজ তাঁর গোলামকে যা করতে বলবেন সে তা-ই করবে।” মফীবোশৎ এর পর থেকে বাদশাহ্‌র একজন ছেলের মতই বাদশাহ্‌র টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলেন। মিকাহ্‌ নামে মফীবোশতের একটি ছোট ছেলে ছিল; সীবের ঘরের সবাই ছিল মফীবোশতের চাকর। বাদশাহ্‌র টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করতেন বলে মফীবোশৎ জেরুজালেমে থাকতেন। তাঁর দু’টা পা-ই ছিল খোঁড়া। পরে অম্মোনীয় বাদশাহ্‌ মারা গেলে পর তাঁর ছেলে হানূন তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। দাউদ বললেন, “হানূনের পিতা নাহশ আমার প্রতি যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন তেমনি আমিও হানূনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।” সেইজন্য তাঁর পিতার মৃত্যুতে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তিনি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিলেন। তাতে দাউদের লোকেরা অম্মোনীয়দের দেশে গেল। কিন্তু অম্মোনীয় নেতারা তাঁদের মালিক হানূনকে বললেন, “আপনি কি মনে করেন যে, দাউদ আপনার পিতার প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য আপনাকে সান্ত্বনা দিতে লোক পাঠিয়েছে? সে আসলে তাদের আপনার কাছে পাঠিয়েছে যাতে তারা গোয়েন্দা হিসাবে শহরটার খোঁজ-খবর নিয়ে পরে সেটা ধ্বংস করে দিতে পারে।” হানূন তখন দাউদের লোকদের ধরে তাদের দাড়ির একপাশ কামিয়ে দিলেন এবং তাদের লম্বা কোর্তা অর্ধেকটা, অর্থাৎ কোমর পর্যন্ত কেটে দিয়ে তাদের বিদায় করে দিলেন। দাউদকে এই কথা জানানো হলে পর তাঁর পাঠানো সেই লোকদের সংগে দেখা করবার জন্য তিনি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিলেন, কারণ সেই লোকেরা খুব লজ্জায় পড়েছিল। বাদশাহ্‌ তাদের বলে পাঠালেন, “তোমাদের দাড়ি বেড়ে না ওঠা পর্যন্ত তোমরা জেরিকো শহরেই থাক; তারপর তোমরা ফিরে এসো।” অম্মোনীয়রা বুঝতে পারল যে, তারা দাউদের ঘৃণার পাত্র হয়েছে। তাই তারা বৈৎ-রহোব ও সোবা থেকে বিশ হাজার সিরীয় পদাতিক সৈন্য, এক হাজার সৈন্যসহ মাখার বাদশাহ্‌কে এবং টোব থেকে বারো হাজার লোককে ভাড়া করল। এই সব শুনে দাউদ যোয়াবকে এবং তাঁর সমস্ত সৈন্যদলকে পাঠিয়ে দিলেন। তখন অম্মোনীয়রা বের হয়ে তাদের শহরের দরজায় ঢুকবার পথে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজাল। এদিকে সোবা আর রহোবের সিরীয়রা এবং টোব আর মাখার সৈন্যেরা খোলা মাঠে রইল। যোয়াব দেখলেন তাঁর সামনে এবং পিছনে সিরীয় সৈন্যদের সাজানো হয়েছে। সেইজন্য তিনি তাঁর সৈন্যদের মধ্য থেকে কতগুলো বাছাই-করা সৈন্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাজালেন। বাকী সৈন্যদের তিনি তাঁর ভাই অবীশয়ের অধীনে অম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে সাজালেন। যোয়াব তাঁর ভাইকে বললেন, “যদি সিরীয়রা আমার চেয়ে শক্তিশালী হয় তবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে আসবে, আর যদি অম্মোনীয়রা তোমার চেয়ে শক্তিশালী হয় তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে যাব। সাহস কর; আমাদের লোকদের জন্য এবং আমাদের আল্লাহ্‌র শহরগুলোর জন্য এস, আমরা সাহসের সংগে যুদ্ধ করি। মাবুদের চোখে যা ভাল তিনি তা-ই করুন।” এই বলে যোয়াব তাঁর সৈন্যদল নিয়ে সিরীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য এগিয়ে গেলে পর সিরীয়রা তাঁর সামনে থেকে পালিয়ে গেল। সিরীয়দের পালিয়ে যেতে দেখে অম্মোনীয়রাও অবীশয়ের সামনে থেকে পালিয়ে গিয়ে শহরের ভিতরে গিয়ে ঢুকল। কাজেই যোয়াব অম্মোনীয়দের সংগে আর যুদ্ধ না করে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। সিরীয়রা বনি-ইসরাইলদের কাছে হেরে গেছে দেখে আবার একসংগে জমায়েত হল। বাদশাহ্‌ হদদেষর লোক পাঠিয়ে ফোরাত নদীর ওপারে বাস করা সিরীয়দের আনালেন। তারা হেলমে আসল। হদদেষরের সৈন্যদলের সেনাপতি শোবক তাদের পরিচালনা করে নিয়ে আসলেন। দাউদকে সেই কথা জানালে পর তিনি সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্যদের জমায়েত করলেন এবং জর্ডান নদী পার হয়ে হেলমে গেলেন। তাতে সিরীয়রা তাদের সৈন্য সাজিয়ে নিয়ে দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, কিন্তু বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে তারা পালিয়ে গেল। তখন দাউদ তাদের সাতশো রথচালক ও চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ারকে হত্যা করলেন। তিনি তাদের সেনাপতি শোবককেও আঘাত করলেন; তাতে শোবক সেখানে মারা গেলেন। হদদেষরের অধীন সমস্ত বাদশাহ্‌রা যখন দেখলেন যে, তাঁরা বনি-ইসরাইলদের কাছে হেরে গেছেন তখন বনি-ইসরাইলদের সংগে তাঁরা শান্তি-চুক্তি করে তাদের অধীন হলেন। সেই থেকে সিরীয়রা ভয়ে অম্মোনীয়দের আর সাহায্য করে নি। বসন্তকালে যখন বাদশাহ্‌রা সাধারণতঃ যুদ্ধ করতে বের হন তখন দাউদও যুদ্ধ করবার জন্য যোয়াবকে ও তাঁর অন্যান্য সেনাপতিদের এবং সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্যদের পাঠিয়ে দিলেন। তারা অম্মোনীয়দের ধ্বংস করে রব্বা শহরটা ঘেরাও করল। দাউদ কিন্তু জেরুজালেমেই রয়ে গেলেন। তখন একদিন বিকাল বেলায় দাউদ তাঁর বিছানা থেকে উঠে রাজবাড়ীর ছাদে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি ছাদের উপর থেকে একজন স্ত্রীলোককে গোসল করতে দেখলেন। স্ত্রীলোকটি দেখতে ছিল খুব সুন্দরী। দাউদ স্ত্রীলোকটির খোঁজ নেবার জন্য লোক পাঠিয়ে দিলেন। একজন লোক বলল, “সে তো ইলিয়ামের মেয়ে হিট্টীয় উরিয়ার স্ত্রী বৎশেবা।” দাউদ তাকে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠালেন। সে তাঁর কাছে আসলে পর দাউদ তার সংগে সহবাস করলেন। স্ত্রীলোকটি তখন তার মাসিকের নাপাকী থেকে পাক-সাফ হয়েছিল। এর পর স্ত্রীলোকটি তার বাড়িতে ফিরে গেল। সে যখন বুঝতে পারল যে, সে গর্ভবতী হয়েছে তখন সেই খবর সে দাউদকে পাঠাল। তখন দাউদ যোয়াবকে এই কথা বলে পাঠালেন, “হিট্টীয় উরিয়াকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” এতে যোয়াব তাকে দাউদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। উরিয়া আসলে পর দাউদ তাকে যোয়াব ও সৈন্যদের ভাল-মন্দের খবর এবং যুদ্ধ কেমন চলছে তা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর তিনি উরিয়াকে বললেন, “তুমি নিজের বাড়ীতে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে বিশ্রাম কর।” উরিয়া রাজবাড়ী থেকে বের হয়ে গেল আর বাদশাহ্‌ তার জন্য কিছু উপহার পাঠিয়ে দিলেন। উরিয়া কিন্তু নিজের বাড়ীতে গেল না। সে বাদশাহ্‌র সমস্ত কর্মচারীদের সংগে রাজবাড়ীর দরজায় শুয়ে রইল। দাউদকে সেই কথা জানানো হলে পর দাউদ উরিয়াকে বললেন, “তুমি তো যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছ, তবে কেন তোমার বাড়ীতে গেলে না?” উরিয়া দাউদকে বলল, “সাক্ষ্য-সিন্দুক নিয়ে ইসরাইল ও এহুদার সৈন্যেরা তাম্বুতে রয়েছে, আর আমার সেনাপতি যোয়াব ও আপনার লোকেরা খোলা মাঠে ছাউনি ফেলে রয়েছেন। এই অবস্থায় আমি কি করে বাড়ী গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আমার স্ত্রীর সংগে বিছানায় যাব? আপনার প্রাণের কসম যে, আমি এমন কাজ কখনও করব না।” তখন দাউদ তাকে বললেন, “আজকের দিনটাও তুমি এখানে থাক; কালকে আমি তোমাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেব।” কাজেই উরিয়া সেই দিনটা এবং তার পরের দিনও জেরুজালেমে রয়ে গেল। দাউদ তাকে দাওয়াত করলে পর সে দাউদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করল আর দাউদ তাকে মদানো রস খাইয়ে মাতাল করে তুললেন। কিন্তু রাত হলে উরিয়া বাদশাহ্‌র কর্মচারীদের মধ্যে নিজের বিছানায় শুয়ে রইল, বাড়ী গেল না। পরদিন সকালে দাউদ যোয়াবকে একটা চিঠি লিখে উরিয়ার হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তার মধ্যে তিনি এই কথা লিখেছিলেন, “যেখানে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হচ্ছে সেখানে সৈন্যদের সামনের সারিতে উরিয়াকে পাঠাবে, তারপর তার পিছন থেকে তোমরা সরে যাবে যাতে সে আঘাত পেয়ে মারা যায়।” কাজেই শহর ঘেরাও করবার সময় যোয়াব উরিয়াকে এমন একটা জায়গায় পাঠালেন যেখানে বিপক্ষের শক্তিশালী যোদ্ধারা ছিল বলে তিনি জানতেন। পরে শহরের লোকেরা বের হয়ে এসে যখন যোয়াবের সংগে যুদ্ধ করতে লাগল তখন দাউদের সৈন্যদলের কিছু লোক মারা পড়ল আর সেই সংগে হিট্টীয় উরিয়াও মারা গেল। কে যিরূব্বেশতের ছেলে আবিমালেককে হত্যা করেছিল? একজন স্ত্রীলোক দেয়ালের উপর থেকে জাঁতার উপরের পাথরটা তার উপর ফেলেছিল আর তাতেই তিনি তেবেষে মারা গিয়েছিলেন। কেন তোমরা দেয়ালের এত কাছে গিয়েছিলে?’ যদি তিনি সেই কথা তোমাকে বলেন তবে তুমি তাঁকে বলবে যে, তাঁর গোলাম হিট্টীয় উরিয়া মারা গেছে।” সেই লোকটি তখন রওনা হয়ে গেল এবং দাউদের কাছে পৌঁছে যোয়াব তাকে যা বলতে পাঠিয়েছিলেন তা বলল। দাউদকে সেই লোকটি বলল, “লোকগুলো প্রথমে আমাদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে খোলা মাঠে বের হয়ে এসেছিল, কিন্তু আমরা তাদের তাড়া করতে করতে শহরের সদর দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এতে ধনুকধারীরা দেয়ালের উপর থেকে আপনার গোলামদের উপর তীর ছুঁড়তে লাগল। তাতে বাদশাহ্‌র কিছু লোক মারা পড়েছে। আপনার গোলাম হিট্টীয় উরিয়াও মারা পড়েছে।” দাউদ তাকে বললেন, “তুমি যোয়াবকে বলবে সে যেন এতে মন খারাপ না করে, কারণ যুদ্ধের সময় তলোয়ার কাউকেই বাদ দেয় না। শহরটার বিরুদ্ধে আরও ভীষণভাবে যুদ্ধ করে সে যেন সেটা একেবারে ধ্বংস করে ফেলে। এই কথা তুমি যোয়াবকে বলে তাকে উৎসাহ দেবে।” এদিকে উরিয়ার স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে শোক করতে লাগল। শোক করবার সময় পার হয়ে যাওয়ার পর দাউদ তাকে তাঁর বাড়ীতে আনালেন। সে তাঁর স্ত্রী হল এবং তার একটা ছেলে হল। কিন্তু দাউদ যা করেছিলেন তাতে মাবুদ নারাজ হয়েছিলেন। মাবুদ তখন নবী নাথনকে দাউদের কাছে পাঠালেন। তিনি দাউদের কাছে গিয়ে বললেন, “কোন এক শহরে দু’জন লোক ছিল। তাদের একজন ছিল ধনী আর অন্যজন গরীব। ধনী লোকটির অনেক গরু ও ভেড়া ছিল। কিন্তু সেই গরীব লোকটির আর কিছুই ছিল না, ছিল কেবল একটা বাচ্চা-ভেড়ী। সে সেটা কিনে পালন করছিল। সেটা তার ও তার ছেলেমেয়েদের সংগে থেকে বড় হয়ে উঠতে লাগল। গরীব লোকটি যা খেত বাচ্চা-ভেড়ীটাও তা-ই খেত আর তার পাত্র থেকেই সে পানি খেত। তার কোলের কাছে সে শুয়ে থাকত। সে তার কাছে তার মেয়ের মতই ছিল। একদিন একজন মেহমান সেই ধনী লোকটির কাছে আসল। কিন্তু ধনী লোকটি সেই মেহমানের জন্য খাবার প্রস্তুত করতে নিজের গরু বা ভেড়া নিতে চাইল না। তার বদলে সে সেই গরীব লোকটির বাচ্চা-ভেড়ীটা নিয়ে তার মেহমানের জন্য খাবার তৈরী করল।” এই কথা শুনে দাউদ সেই ধনী লোকটির উপর রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি নবী নাথনকে বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম, যে লোকটি এই কাজ করেছে তাকে মেরে ফেলাই উচিত। সে একটুও দয়া না করে এই কাজ করেছে বলে তাকে ঐ ভেড়ার বাচ্চাটার চারগুণ দাম দিতে হবে।” তখন নবী নাথন দাউদকে বললেন, “আপনিই সেই লোক। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘আমিই ইসরাইলের উপরে তোমাকে রাজপদে অভিষেক করেছি এবং তালুতের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করেছি। তোমার মালিকের সব কিছু আমি তোমাকে দিয়েছি আর তার স্ত্রীদেরও আমি তোমার কাছে দিয়েছি। ইসরাইল ও এহুদার সমস্ত গোষ্ঠীর লোকদের ভার আমি তোমাকে দিয়েছি। এই সব যদি তোমার পক্ষে যথেষ্ট না হত তবে আমি তোমাকে আরও অনেক কিছু দিতাম। তবে মাবুদের চোখে যা খারাপ তা করে কেন তুমি তাঁর কথা তুচ্ছ করলে? তুমি হিট্টীয় উরিয়াকে মেরে ফেলেছ এবং তার স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী করে নিয়েছ, আর অম্মোনীয়দের দিয়ে তুমি উরিয়াকে মেরে ফেলেছ। তুমি আমাকে তুচ্ছ করেছ এবং হিট্টীয় উরিয়ার স্ত্রীকে নিয়ে নিজের স্ত্রী করেছ, সেইজন্য তোমার পরিবার কখনও খুনের হাত থেকে রেহাই পাবে না।’ “মাবুদ আরও বলছেন, ‘আমি তোমার পরিবার থেকেই তোমার জন্য বিপদ নিয়ে আসব। তোমার চোখের সামনেই আমি তোমার স্ত্রীদের নিয়ে তোমার নিজের লোককে দেব। সে সকলের চোখের সামনে তাদের নিয়ে শোবে। তুমি সেই কাজ করেছ গোপনে কিন্তু আমি এই কাজ করব সকলের সামনে, সমস্ত বনি-ইসরাইলদের চোখের সামনে।’ ” তখন দাউদ নাথনকে বললেন, “আমি মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি।” জবাবে নাথন বললেন, “মাবুদ আপনার গুনাহ্‌ মাফ করলেন; আপনি মারা যাবেন না। কিন্তু এই কাজ করে আপনি মাবুদের শত্রুদের কুফরী করবার একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছেন। সেইজন্য আপনার যে ছেলেটি জন্মেছে সে অবশ্যই মারা যাবে।” নাথন নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। পরে উরিয়ার স্ত্রীর গর্ভে দাউদের যে ছেলেটির জন্ম হয়েছিল মাবুদের আঘাতে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন দাউদ ছেলেটির জন্য আল্লাহ্‌র কাছে মিনতি করতে লাগলেন। তিনি রোজা রাখলেন এবং তাঁর ঘরে গিয়ে মাটিতে শুয়ে রাত কাটাতে লাগলেন। রাজবাড়ীর উঁচু পদের কর্মচারীরা তাঁকে মাটি থেকে উঠাবার জন্য তাঁর কাছে গেলেন, কিন্তু তিনি রাজী হলেন না এবং তাঁদের সংগে খাওয়া-দাওয়াও করলেন না। অসুখের সাত দিনের দিন ছেলেটি মারা গেল। ছেলেটি যে মারা গেছে সেই কথা দাউদকে জানাতে তাঁর সেই কর্মচারীদের সাহস হল না। তাঁরা বললেন, “ছেলেটি যখন বেঁচে ছিল তখন আমরা তাঁকে বললেও তিনি আমাদের কথা কানে তোলেন নি। এখন আমরা কেমন করে বলব যে, ছেলেটি মারা গেছে? বললে হয়তো তিনি নিজের কোন ক্ষতি করে বসবেন।” কর্মচারীদের মধ্যে এই কানাকানি দেখে দাউদ বুঝতে পারলেন যে, ছেলেটি মারা গেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলেটি কি মারা গেছে?” জবাবে তাঁরা বললেন, “জ্বী, মারা গেছে।” দাউদ তখন মাটি থেকে উঠে গোসল করে তেল মাখলেন এবং কাপড়-চোপড় বদলে তিনি মাবুদের ঘরে গিয়ে সেজদায় পড়ে তাঁর এবাদত করলেন। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে খাবার আনবার হুকুম দিলেন। পরে তাঁর সামনে খাবার রাখা হলে তিনি খেলেন। এতে তাঁর সেই কর্মচারীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এই রকম করলেন কেন? ছেলেটি বেঁচে থাকতে আপনি রোজা রাখলেন ও কাঁদলেন, কিন্তু সে যখন মারা গেল তখন আপনি উঠে খাওয়া-দাওয়া করলেন।” দাউদ বললেন, “ছেলেটি বেঁচে থাকতে আমি রোজা রেখেছি আর কেঁদেছি, কারণ আমি ভেবেছিলাম, কি জানি মাবুদ আমাকে রহমত দান করবেন আর তাতে সে বেঁচে যাবে। কিন্তু এখন যখন সে মারাই গেল তখন আমি আর কি জন্য রোজা রাখব? আমি কি তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারব? আমাকেই তার কাছে যেতে হবে। সে আর আমার কাছে ফিরে আসবে না।” এদিকে যোয়াব অম্মোনীয়দের রাজধানী রব্বা শহরটা হামলা করে দখল করে নিলেন। যোয়াব দাউদের কাছে লোক পাঠিয়ে এই কথা বললেন, “আমি রব্বা শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেখানে খাবার পানি জমা করে রাখা হয় সেই এলাকাটা দখল করে নিয়েছি। আপনি বাকী সৈন্যদের জমায়েত করে নিয়ে শহরটা হামলা করে দখল করুন। তা না হলে আমাকেই শহরটা দখল করতে হবে আর তাতে আমার নামেই শহরটার নাম হবে।” তখন দাউদ সমস্ত সৈন্যদের জমায়েত করে নিয়ে রব্বা শহরে গেলেন এবং শহরটা হামলা করে দখল করে নিলেন। তিনি সেখানকার বাদশাহ্‌র মাথা থেকে তাজটা খুলে নিলেন। সেটা ঊনচল্লিশ কেজি সোনা দিয়ে তৈরী ছিল আর তাতে দামী পাথর বসানো ছিল। তাজটা দাউদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হল। দাউদ সেই শহর থেকে অনেক লুটের মাল নিয়ে গেলেন। তিনি শহরের লোকদের বের করে আনলেন এবং করাত, লোহার খন্তা ও কুড়াল দিয়ে তাদের কাজ করালেন। তিনি তাদের ইট তৈরীর কাজে লাগালেন। অম্মোনীয়দের সমস্ত শহরে তিনি তা-ই করলেন। এর পর দাউদ তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। পরে এই ঘটনা হল। দাউদের ছেলে অবশালোমের তামর নামে একটি সুন্দরী বোন ছিল। দাউদের ছেলে অম্নোন তাকে ভালবাসল। অম্নোন তার বোন তামরের জন্য এমন আকুল হল যে, সে অসুখে পড়বার মত হল। মেয়েটি অবিবাহিতা ছিল, তাই তাকে কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব মনে হল না। দাউদের ভাই শিমিয়ার ছেলে যোনাদব ছিল অম্নোনের বন্ধু। সে ছিল খুব চালাক। সে অম্নোনকে বলল, “রাজপুত্র, তুমি দিন দিন এত রোগা হয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি কি আমাকে তা বলবে না?” অম্নোন তাকে বলল, “আমার ভাই অবশালোমের বোন তামরকে আমি ভালবাসি।” যোনাদব বললেন, “তুমি অসুখের ভান করে বিছানায় পড়ে থাক। তোমার পিতা যখন তোমাকে দেখতে আসবেন তখন তুমি তাঁকে বলবে, ‘দয়া করে আমার বোন তামরকে পাঠাবেন যেন সে এসে আমাকে কিছু খেতে দেয়। সেই খাবার সে আমার সামনেই তৈরী করুক যাতে আমি তা দেখে তার হাত থেকে তা খেতে পারি।’ ” অম্নোন অসুখের ভান করে শুয়ে রইল। বাদশাহ্‌ তাকে দেখতে আসলে পর সে বলল, “দয়া করে আমার বোন তামরকে পাঠাবেন যেন সে এসে আমার সামনে কয়েকটা পিঠা তৈরী করে। আমি তার হাত থেকে তা খেতে চাই।” তখন দাউদ এই বলে তামরের কাছে লোক পাঠিয়ে দিলেন, “তোমার ভাই অম্নোনের ঘরে গিয়ে তুমি তাকে কিছু খাবার তৈরী করে দাও।” এই কথা শুনে তামর তার ভাই অম্নোনের ঘরে গেল। সে তখন শুয়ে ছিল। তামর তার সামনেই ময়দা নিয়ে মেখে পিঠা তৈরী করে সেঁকে নিল। তারপর তাওয়াতে করেই সে পিঠা নিয়ে গিয়ে তার সামনে দিল, কিন্তু অম্নোন তা খেতে চাইল না। অম্নোন সবাইকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলল, তাতে সবাই বের হয়ে গেল। তখন অম্নোন তামরকে বলল, “খাবার নিয়ে তুমি আমার শোবার কামরায় এস। আমি তোমার হাতেই খাব।” কাজেই তামর তার তৈরী করা পিঠাগুলো নিয়ে তার ভাই অম্নোনের শোবার কামরায় গেল। কিন্তু খাওয়ার জন্য যখন সে তা তার কাছে নিয়ে গেল তখন সে তাকে ধরে বলল, “বোন, তুমি আমার সংগে শোও।” তামর তাকে বলল, “না ভাই, না; তুমি আমার ইজ্জত নষ্ট কোরো না। ইসরাইলীয়দের মধ্যে এমন কাজ করা উচিত নয়। এই রকম জঘন্য কাজ তুমি কোরো না। আমার কি হবে? কেমন করে আমি এই কলঙ্কের মুখ লোকদের দেখাব? আর তোমাকেও ইসরাইলীয়দের মধ্যে একজন খারাপ লোক বলে সবাই জানবে। মিনতি করি, তুমি বরং বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বল; তাহলে তিনি তোমার হাতে আমাকে দিতে অমত করবেন না।” কিন্তু অম্নোন তামরের কথা শুনল না। তামরের চেয়ে শক্তিশালী হওয়াতে সে তার ইজ্জত নষ্ট করল। এর পরে অম্নোন তাকে ভীষণ ঘৃণা করতে লাগল। আসলে সে তাকে যতখানি ভালবেসেছিল এখন তার চেয়েও বেশী ঘৃণা করতে লাগল। অম্নোন তাকে বলল, “তুমি উঠে চলে যাও।” তামর তাকে বলল, “না, তুমি আমার প্রতি যে অন্যায় করেছ এখন আমাকে বের করে দিলে তার চেয়েও বেশী অন্যায় করা হবে।” কিন্তু অম্নোন তার কথা শুনতে চাইল না। সে তার নিজের চাকরকে ডেকে বলল, “এই মেয়েছেলেটিকে বাইরে বের করে দিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে দাও।” চাকরটি তখন তামরকে বের করে দিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে দিল। মেয়েটির গায়ে জুব্বা ছিল, কারণ বাদশাহ্‌র অবিবাহিতা মেয়েরা এই রকম পোশাকই পরত। তখন তামর নিজের মাথায় ছাই দিল এবং তার পরনের জুব্বা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর সে মাথায় হাত দিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। তামরের ভাই অবশালোম তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ভাই অম্নোন কি তোমার ইজ্জত নষ্ট করেছে? বোন আমার, তুমি এই ব্যাপার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বোলো না, কারণ সে তোমার ভাই। তুমি এই বিষয় নিয়ে মন খারাপ কোরো না।” সেই থেকে তামর তার ভাই অবশালোমের বাড়ীতে মন মরা হয়ে থাকতে লাগল। বাদশাহ্‌ দাউদ এই কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন। অবশালোম অম্নোনকে ভাল-মন্দ কিছুই বলল না। তার বোন তামরের ইজ্জত নষ্ট করেছে বলে সে অম্নোনকে ঘৃণা করতে লাগল। এর দু’বছর পর আফরাহীমের সীমানার কাছে বাল-হাৎসোরে অবশালোমের ভেড়ার লোম কাটা হচ্ছিল। তখন অবশালোম বাদশাহ্‌র সব ছেলেদের সেখানে যাবার দাওয়াত করল। সে বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বলল, “আপনার গোলামের ভেড়ার লোম কাটা হচ্ছে। বাদশাহ্‌ কি তাঁর কর্মচারীদের নিয়ে আমার কাছে আসবেন?” জবাবে বাদশাহ্‌ বললেন, “না বাবা, আমরা সবাই যাব না; গেলে কেবল তোমার বোঝাই বাড়বে।” অবশালোম তাঁকে পীড়াপীড়ি করলেও তিনি যেতে রাজী হলেন না, কিন্তু তাকে দোয়া করলেন। অবশালোম তখন বাদশাহ্‌কে বলল, “যদি আপনি না-ই যান তবে আমার ভাই অম্নোনকে আমাদের সংগে যেতে দিন।” বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন সে তোমাদের সংগে যাবে?” কিন্তু অবশালোম পীড়াপীড়ি করলে তিনি অম্নোনকে এবং তার সংগে সব রাজপুত্রদের পাঠিয়ে দিলেন। অবশালোম তার লোকদের এই হুকুম দিল, “দেখ, আংগুর-রস খেয়ে যখন অম্নোনের মন খুব খুশী হয়ে উঠবে তখন আমি তোমাদের বলব, ‘অম্নোনকে হত্যা কর,’ আর তোমরা তাকে হত্যা করবে। তোমরা ভয় কোরো না। আমিই তো তোমাদের সেই হুকুম দিচ্ছি। তোমরা সাহস কর ও শক্তিশালী হও।” কাজেই অবশালোমের হুকুম অনুসারেই তার লোকেরা অম্নোনকে হত্যা করল। এই ঘটনা দেখে বাদশাহ্‌র আর সব ছেলেরা যে যার খ"চরে চড়ে পালিয়ে গেল। তারা পথে থাকতেই দাউদের কানে এই খবর আসল যে, অবশালোম বাদশাহ্‌র সব ছেলেদের হত্যা করেছে, তাদের একজনও বেঁচে নেই। এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কাপড় ছিঁড়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। তাঁর কর্মচারীরা সবাই নিজের নিজের কাপড় ছিঁড়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু দাউদের ভাই শিমিয়ার ছেলে যোনাদব বলল, “আমার মালিক মনে করবেন না যে, সব রাজপুত্রদেরই হত্যা করা হয়েছে; কেবল অম্নোনকে হত্যা করা হয়েছে। এর কারণ হল, যেদিন সে অবশালোমের বোন তামরের ইজ্জত নষ্ট করেছে সেই দিন থেকে অবশালোম এটাই ঠিক করে রেখেছিল। রাজপুত্রেরা সবাই মারা গেছে ভেবে আমার প্রভু মহারাজ যেন দুঃখ না করেন, কারণ কেবল অম্নোনই মারা পড়েছে।” এর মধ্যে অবশালোম পালিয়ে গিয়েছিল। যে লোকটি বাদশাহ্‌র পাহারাদার ছিল সে চেয়ে দেখল যে, পাহাড়ের পাশ থেকে তার পিছনের রাস্তা দিয়ে অনেক লোক আসছে। তখন যোনাদব বাদশাহ্‌কে বলল, “ঐ দেখুন, রাজপুত্রেরা এসে গেছেন। আপনার গোলাম আমি যা বলেছিলাম তা-ই হয়েছে।” তার কথা শেষ হওয়ার সংগে সংগেই বাদশাহ্‌র ছেলেরা এসে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। বাদশাহ্‌ ও তাঁর সব কর্মচারীরাও খুব কাঁদতে লাগলেন। অবশালোম পালিয়ে গশূরের বাদশাহ্‌ অম্মীহূদের ছেলে তল্‌ময়ের কাছে গেল। দাউদ কিন্তু তাঁর ছেলে অম্নোনের জন্য প্রতিদিন শোক করতে লাগলেন। অবশালোম পালিয়ে গশূরে গিয়ে সেখানে তিন বছর রইল। তার কাছে যাবার জন্য বাদশাহ্‌ দাউদের খুব ইচ্ছা হল, কারণ অম্নোনের মৃত্যুর বিষয়ে বাদশাহ্‌ সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। সরূয়ার ছেলে যোয়াব জানতে পারলেন যে, অবশালোমের জন্য বাদশাহ্‌র প্রাণ কাঁদছে। যোয়াব তখন তকোয়ে লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে একজন চালাক স্ত্রীলোককে আনালেন। তিনি তাকে বললেন, “তোমাকে শোক করবার ভান করতে হবে। তুমি শোকের পোশাক পরবে এবং গায়ে তেল মাখবে না। তুমি যেন মৃতের জন্য অনেক দিন শোক করছ নিজেকে সেই রকম স্ত্রীলোকের মত দেখাবে। তারপর বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে তাঁকে এই সব কথা বলবে।” এই বলে যোয়াব তাকে শিখিয়ে দিলেন কি বলতে হবে। তকোয়ের সেই স্ত্রীলোকটি তখন বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখিয়ে বলল, “মহারাজ, আমাকে বাঁচান!” বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, “আমি সত্যি কথা বলছি যে, আমার স্বামী মারা গেছেন, আমি বিধবা। আপনার এই বাঁদীর দু’টি ছেলে ছিল। তারা একদিন মাঠে মারামারি করছিল আর সেখানে এমন কেউ ছিল না যে তাদের ছাড়িয়ে দেয়। তাই তাদের একজন অন্যজনকে মেরে ফেলল। এখন আমার স্বামীর বংশের সবাই আপনার এই বাঁদীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে আর বলছে, ‘ভাইকে যে ভাই মেরে ফেলেছে তাকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তার ভাইয়ের প্রাণের বদলে আমরা তার প্রাণ নেব। তাহলে সম্পত্তির অধিকারী বলতে আর কেউ থাকবে না।’ তারা আমার একমাত্র জ্বলন্ত কয়লাটাকে নিভিয়ে ফেলতে চাইছে। তাহলে দুনিয়াতে আমার স্বামীর নামও থাকবে না এবং তাঁর বংশও থাকবে না।” বাদশাহ্‌ স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তুমি বাড়ী যাও। আমি তোমার বিষয়ে একটা ব্যবস্থা করব।” তখন তকোয়ের স্ত্রীলোকটি বাদশাহ্‌কে বলল, “আমার প্রভু মহারাজ, বাদশাহ্‌ ও তাঁর সিংহাসন নির্দোষ থাকুক; সব দোষ গিয়ে পড়ুক আমার ও আমার পিতার পরিবারের উপর।” বাদশাহ্‌ বললেন, “যদি কেউ তোমাকে কিছু বলে থাকে তুমি তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে; তাহলে সে তোমাকে আর কষ্ট দেবে না।” স্ত্রীলোকটি বলল, “মহারাজ তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে কসম খান যেন রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী আর সর্বনাশ না করে। তা না হলে সে আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে।” বাদশাহ্‌ বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম, তোমার ছেলের একটা চুলও মাটিতে পড়বে না।” তখন স্ত্রীলোকটি বলল, “আমাকে আমার প্রভু মহারাজের কাছে একটা কথা বলতে দিন।” তিনি বললেন, “বল।” স্ত্রীলোকটি বলল, “তাহলে আপনি আল্লাহ্‌র বান্দাদের বিরুদ্ধে সেই রকম একটা কাজ করবার মতলব করেছেন কেন? মহারাজ যখন এই রকম কথা বলেন তখন কি তিনি নিজেকেই দোষী করছেন না? তিনি তো দেশ থেকে বের করে দেওয়া তাঁর ছেলেটিকে ফিরিয়ে আনছেন না। মাটিতে পানি ঢাললে যেমন তা আর তুলে নেওয়া যায় না সেইভাবেই তো আমরা মরব। আল্লাহ্‌ কিন্তু প্রাণ কেড়ে নেন না বরং তিনি এমন ব্যবস্থা করেন যাতে দূর করে দেওয়া লোক তাঁর কাছ থেকে দূরে না থাকে। “লোকেরা আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল বলে আমার প্রভু মহারাজকে আমি এই কথা বলতে এসেছি। আমি ভেবেছিলাম যে, আমি বাদশাহ্‌র সংগে কথা বলে দেখব; হয়তো তিনি আমার কথা শুনবেন। আমাকে ও আমার ছেলেকে আল্লাহ্‌র সম্পত্তি থেকে, অর্থাৎ তাঁর নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে সরিয়ে ফেলবার জন্য যে লোকটি চেষ্টা করছে তার হাত থেকে মহারাজ হয়তো আমাকে উদ্ধার করতে রাজী হবেন। “এখন আপনার বাঁদী আমি বলছি যে, আমার মহারাজের কথা যেন আমাকে শান্তি দেয়, কারণ ভাল-মন্দ বিচার করতে আমার প্রভু মহারাজ আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতার মতই। আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ আপনার সংগে থাকুন।” তখন বাদশাহ্‌ সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “আমি তোমাকে যা জিজ্ঞাসা করব তার জবাব তুমি আমার কাছ থেকে গোপন কোরো না।” স্ত্রীলোকটি বলল, “আমার প্রভু মহারাজ বলুন।” বাদশাহ্‌ বললেন, “এই সব ব্যাপারে তোমার সংগে কি যোয়াবের হাত আছে?” জবাবে স্ত্রীলোকটি বলল, “হে আমার প্রভু মহারাজ, আপনার প্রাণের কসম যে, আপনি যা বলেছেন তা থেকে কারও ডানে বা বাঁয়ে সরে যাবার ক্ষমতা নেই। জ্বী, আপনার গোলাম যোয়াবই এই কাজ করতে বলেছেন আর আমাকে এই সব কথা বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্যই আপনার গোলাম যোয়াব এই কাজ করেছেন। দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা আমার মালিক জানেন। তাঁর জ্ঞান আল্লাহ্‌র ফেরেশতার মতই।” পরে বাদশাহ্‌ যোয়াবকে বললেন, “খুব ভাল, আমি তোমার অনুরোধ রাখলাম। তুমি গিয়ে যুবক অবশালোমকে নিয়ে এস।” যোয়াব মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বাদশাহ্‌কে সম্মান দেখালেন এবং তাঁকে শুকরিয়া জানালেন। তারপর যোয়াব বললেন, “হে আমার প্রভু মহারাজ, আজকে আপনার গোলাম আমি জানতে পারলাম যে, আমি আপনার কাছে দয়া পেয়েছি, কারণ মহারাজ আমার অনুরোধ রক্ষা করেছেন।” এর পর যোয়াব গশূরে গিয়ে অবশালোমকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে আনলেন। বাদশাহ্‌ বললেন, “সে তার নিজের বাড়ীতেই যাক। সে যেন আমার মুখ না দেখে।” কাজেই অবশালোম নিজের বাড়ীতে গেল; বাদশাহ্‌র মুখ সে দেখতে পেল না। সারা ইসরাইল দেশে অবশালোমের মত এত সুন্দর আর কেউ ছিল না। সুন্দর চেহারার জন্য সে সকলের চেয়ে বেশী প্রশংসা পেত। তার মাথার তালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত কোথাও কোন খুঁত ছিল না। বছরের শেষে সে তার চুল কেটে ফেলত, কারণ তার চুলের ওজন বেশী হয়ে যেত। তারপর সে তা মাপলে তার ওজন হত আড়াই কেজি। অবশালোমের তিন ছেলে ও এক মেয়ে জন্মেছিল। মেয়েটির নাম ছিল তামর। সে দেখতে সুন্দরী ছিল। অবশালোম দু’বছর জেরুজালেমে ছিল; এর মধ্যে সে বাদশাহ্‌র মুখ দেখতে পায় নি। তারপর সে বাদশাহ্‌র কাছে যাবার জন্য যোয়াবকে ডেকে পাঠাল, কিন্তু যোয়াব তার কাছে যেতে রাজী হলেন না। পরে সে দ্বিতীয় বার যোয়াবকে ডেকে পাঠাল, কিন্তু এবারও যোয়াব তার কাছে যেতে রাজী হলেন না। তখন অবশালোম তার চাকরদের বলল, “দেখ, আমার ক্ষেতের পাশেই রয়েছে যোয়াবের ক্ষেত। সে তাতে যব বুনেছে। তোমরা গিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দাও।” এতে অবশালোমের চাকরেরা গিয়ে সেই ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিল। তখন যোয়াব অবশালোমের বাড়ীতে গিয়ে তাকে বললেন, “তোমার চাকরেরা কেন আমার ক্ষেতে আগুন লাগিয়েছে?” জবাবে অবশালোম যোয়াবকে বলল, “এখানে আসবার জন্য আমি আপনার কাছে লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আপনি গিয়ে বাদশাহ্‌কে এই কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘কেন আমি গশূর থেকে আসলাম? সেখানে থাকাই তো আমার পক্ষে ভাল ছিল।’ এখন যাতে আমি বাদশাহ্‌র মুখ দেখতে পাই আপনি সেই ব্যবস্থা করুন। যদি আমার কোন দোষ হয়ে থাকে তবে তিনি যেন আমাকে মেরে ফেলেন।” তখন যোয়াব গিয়ে বাদশাহ্‌কে সেই সব কথা বললেন। বাদশাহ্‌ অবশালোমকে ডেকে পাঠালে পর সে বাদশাহ্‌র সামনে এসে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ল। তখন বাদশাহ্‌ অবশালোমকে চুম্বন করলেন। পরে অবশালোম নিজের জন্য রথ ও ঘোড়া যোগাড় করল এবং তার আগে আগে যাবার জন্য পঞ্চাশজন লোক নিযুক্ত করল। অবশালোম খুব সকালে উঠে শহরের সদর দরজার দিকে যাবার রাস্তার একপাশে দাঁড়াত। কেউ যখন কোন নালিশ নিয়ে বাদশাহ্‌র কাছে বিচারের জন্য আসত অবশালোম তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করত, “তুমি কোন্‌ গ্রামের লোক?” জবাবে লোকটি বলত, “আপনার গোলাম আমি ইসরাইলের অমুক গোষ্ঠীর লোক।” তখন অবশালোম তাকে বলত, “দেখ, তোমার নালিশ ন্যায্য ও ঠিক, কিন্তু তোমার কথা শুনবার জন্য বাদশাহ্‌র কোন লোক নেই।” তারপর সে আরও বলত, “হায়, আমাকে যদি দেশের বিচারক করে নিযুক্ত করা হত! তাহলে যারা আমার কাছে নালিশ নিয়ে আসত আমি তাদের প্রত্যেকের পক্ষে ন্যায়বিচার করতাম।” এছাড়া যদি কেউ কদমবুচি করবার জন্য তার সামনে যেত তবে সে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে চুম্বন করত। বনি-ইসরাইলদের যত লোক বাদশাহ্‌র কাছে বিচারের জন্য আসত অবশালোম তাদের সংগে এই রকম ব্যবহার করত। এইভাবে সে বনি-ইসরাইলদের মন জয় করে নিল। চার বছর পরে অবশালোম বাদশাহ্‌কে বলল, “আমি মাবুদের কাছে যে মানত করেছি তা পূরণ করবার জন্য আমাকে হেবরনে যেতে দিন। আপনার গোলাম আমি সিরিয়া দেশের গশূরে থাকবার সময় মানত করে বলেছিলাম, ‘মাবুদ যদি আমাকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে নিয়ে যান তবে আমি হেবরনে গিয়ে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেব।’ ” বাদশাহ্‌ তাকে বললেন, “সহিসালামতে যাও।” তখন অবশালোম হেবরনে গেল। অবশালোম ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর কাছে এই কথা বলে গোপনে লোক পাঠাল, “তোমরা যখনই শিংগার আওয়াজ শুনবে তখনই বলবে, ‘অবশালোম হেবরনে বাদশাহ্‌ হলেন।’ ” জেরুজালেম থেকে দু’শো লোক অবশালোমের সংগে গিয়েছিল। মেহমান হিসাবে তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর তারা কোন কিছু না জেনেই সরল মনে তার সংগে গিয়েছিল। কোরবানী দেবার সময় অবশালোম দাউদের গীলোনীয় মন্ত্রী অহীথোফলকে তার গ্রাম গীলো থেকে ডেকে আনাল। ষড়যন্ত্রটা খুব জোরালো হয়ে উঠল, কারণ অবশালোমের পক্ষের লোক একের পর এক বেড়ে যেতে লাগল। পরে একজন লোক দাউদের কাছে এসে বলল, “ইসরাইলীয়দের মন অবশালোমের দিকে গেছে।” জেরুজালেমে দাউদের যে সব কর্মচারীরা তাঁর সংগে ছিল তিনি তাদের বললেন, “চল, আমরা পালিয়ে যাই। তা না হলে আমরা কেউই অবশালোমের হাত থেকে রক্ষা পাব না। আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে সে তাড়াতাড়ি এসে আমাদের ভীষণ বিপদে ফেলবে আর শহরের সবাইকে শেষ করে দেবে।” বাদশাহ্‌র কর্মচারীরা তাঁকে বলল, “আমাদের প্রভু মহারাজের যা ইচ্ছা আমরা তা-ই করতে প্রস্তুত আছি।” তখন বাদশাহ্‌ রওনা হলেন আর তাঁর বাড়ীর সবাই তাঁর পিছনে পিছনে চলল। রাজবাড়ীটা দেখাশোনা করবার জন্য তিনি দশজন উপস্ত্রীকে রেখে গেলেন। বাদশাহ্‌ ও তাঁর সংগের সমস্ত লোক যেতে যেতে শহরের শেষ সীমানায় গিয়ে থামলেন। দাউদের সমস্ত লোক তাঁর সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল। তাদের মধ্যে ছিল করেথীয়, পলেথীয় আর ছ’শো গাতীয় লোক যারা আগে গাৎ থেকে বাদশাহ্‌র সংগে চলে এসেছিল। বাদশাহ্‌ তখন গাতীয় ইত্তয়কে বললেন, “আমাদের সংগে কেন তুমি যাচ্ছ? তুমি ফিরে গিয়ে বাদশাহ্‌ অবশালোমের সংগে থাক। তুমি তো বিদেশী; তোমার নিজের দেশ থেকে তুমি বের হয়ে এসেছ। তুমি তো মাত্র সেদিন এসেছ। আর আজকেই কি তোমাকে আমাদের সংগে ঘুরে বেড়াবার জন্য আমার নেওয়া উচিত? আমি নিজেই জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। তুমি ফিরে যাও আর তোমার দেশের লোকদেরও সংগে নিয়ে যাও। অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততা তোমাদের সংগী হোক।” কিন্তু জবাবে ইত্তয় বাদশাহ্‌কে বলল, “আল্লাহ্‌র কসম এবং আমার প্রভু মহারাজের প্রাণের কসম, আমার প্রভু মহারাজ যেখানে থাকবেন সেখানে আপনার গোলাম আমিও থাকব, তাতে আমি বেঁচেই থাকি বা মারাই পড়ি।” এই কথা শুনে দাউদ ইত্তয়কে বললেন, “তবে এগিয়ে যাও।” তখন গাতীয় ইত্তয় তার সমস্ত লোক ও তার সংগের সমস্ত পরিবার নিয়ে এগিয়ে চলল। দাউদের সমস্ত লোক যখন চলে যাচ্ছিল তখন দেশের সব লোক জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। বাদশাহ্‌ ও তাঁর সমস্ত লোক কিদ্রোণ উপত্যকা পার হয়ে মরুভূমির দিকে এগিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ যখন শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ইমাম সাদোক ও সমস্ত লেবীয়রাও তাঁর সংগে ছিল। লেবীয়রা আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। শহর থেকে সমস্ত লোক বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত লেবীয়রা আল্লাহ্‌র সিন্দুকটা নামিয়ে রাখল আর ইমাম অবিয়াথরও তাদের সংগে ছিলেন। সমস্ত লোক বেরিয়ে যাবার পর বাদশাহ্‌ দাউদ সাদোককে বললেন, “আল্লাহ্‌র সিন্দুকটা শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মাবুদ যদি আমাকে দয়ার চোখে দেখেন তবে তিনি আমাকে ফিরিয়ে আনবেন আর এই সিন্দুক ও তাঁর থাকবার জায়গা আবার আমাকে দেখতে দেবেন। কিন্তু যদি তিনি বলেন, ‘আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট নই,’ তবে তিনি যা ভাল মনে করেন তা-ই আমার প্রতি করুন।” তারপর বাদশাহ্‌ ইমাম সাদোককে বললেন, “আপনি তো সবই দেখতে পাচ্ছেন। আপনার ছেলে অহীমাস ও অবিয়াথরের ছেলে যোনাথনকে সংগে করে আপনি সহিসালামতে শহরে ফিরে যান। যে পর্যন্ত না আমাকে জানাবার জন্য আপনাদের কাছ থেকে খবর আসে সেই পর্যন্ত আমি মরুভূমির মধ্যে নদীর যে জায়গাটা হেঁটে পার হওয়া যায় সেখানে অপেক্ষা করতে থাকব।” কাজেই সাদোক ও অবিয়াথর আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি নিয়ে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন এবং সেখানেই থাকলেন। এদিকে দাউদ কাঁদতে কাঁদতে জৈতুন পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলেন। তিনি মাথা ঢেকে খালি পায়ে হাঁটছিলেন। লোকেরাও সকলে তাঁর সংগে মাথা ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে উপরে উঠতে লাগল। তখন দাউদকে কেউ বলল, “অবশালোমের সংগে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে অহীথোফলও আছে।” এই কথা শুনে দাউদ এই বলে মুনাজাত করলেন, “হে মাবুদ, তুমি অহীথোফলের পরামর্শকে বিফল করে দাও।” লোকেরা পাহাড়ের উপরে যে জায়গায় আল্লাহ্‌র এবাদত করত দাউদ সেখানে উপস্থিত হলে পর অর্কীয় হূশয় তাঁর সংগে দেখা করতে আসলেন। তাঁর পোশাক ছেঁড়া এবং মাথায় ধুলা ছিল। দাউদ তাঁকে বললেন, “তুমি আমার সংগে গেলে আমার বোঝা বাড়বে। কিন্তু তুমি শহরে ফিরে গিয়ে যদি অবশালোমকে বল, ‘হে মহারাজ, আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব; আমি যেমন আগে আপনার পিতার গোলাম ছিলাম তেমনি এখন আপনার গোলাম হব,’ তাহলে তুমি অহীথোফলের দেওয়া পরামর্শকে অকেজো করে দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। ইমাম সাদোক ও অবিয়াথর সেখানে তোমার সংগে থাকবেন। রাজবাড়ীতে তুমি যা শুনবে তা তাঁদের জানাবে। সাদোকের ছেলে অহীমাস ও অবিয়াথরের ছেলে যোনাথনও সেখানে তাঁদের সংগে আছেন। কিছু শুনলে পর তাঁদের দিয়েই তা আমাকে জানিয়ে দেবে।” দাউদের বন্ধু হূশয় যখন জেরুজালেমে ঢুকলেন তখন অবশালোমও সেখানে পৌঁছাল। দাউদ পাহাড়ের উপর থেকে একটু এগিয়ে যেতেই মফীবোশতের গোলাম সীবের সংগে তাঁর দেখা হল। তার সংগে ছিল পিঠে গদি লাগানো দু’টা গাধা। সেই গদির উপরে ছিল দু’শো রুটি, একশো তাল কিশমিশ, একশো তাল ডুমুর এবং চামড়ার থলির এক থলি আংগুর-রস। বাদশাহ্‌ সীবঃকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এগুলো এনেছ কেন?” জবাবে সীবঃ বলল, “গাধা দু’টা বাদশাহ্‌র পরিবারের লোকদের চড়বার জন্য, রুটি আর ফল লোকদের খাওয়ার জন্য আর আংগুর-রস হল তাদেরই জন্য যারা মরুভূমিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।” বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মালিকের নাতি কোথায়?” সীবঃ তাঁকে বললেন, “তিনি জেরুজালেমেই রয়েছেন, কারণ তিনি বললেন, ‘আজ বনি-ইসরাইলরা আমার দাদার রাজ্য আমাকে ফিরিয়ে দেবে।’ ” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ সীবঃকে বললেন, “এখন মফীবোশতের সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমাকে দিলাম।” সীবঃ বলল, “আমি তো আপনার পায়ের ধুলারও যোগ্য নই; আমার প্রভু মহারাজ যেন আমাকে দয়ার চোখে দেখেন।” বাদশাহ্‌ দাউদ যখন বহুরীমে উপস্থিত হলেন তখন তালুতের বংশের একজন লোক সেখান থেকে বের হয়ে আসল। সে ছিল গেরার ছেলে শিমিয়ি। সে বদদোয়া দিতে দিতে আসছিল। যদিও দাউদের ডানে-বাঁয়ে সমস্ত সৈন্যদল এবং রক্ষীদল ছিল তবুও সে দাউদ ও তাঁর সব কর্মচারীদের পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল। শিমিয়ি বদদোয়া দিতে দিতে বলল, “দূর হ, দূর হ, খুনী, বদমাইশ কোথাকার! তুই যাঁর জায়গায় রাজত্ব করছিস সেই তালুতের বংশের সমস্ত লোকের রক্তপাতের প্রতিফল মাবুদ তোকে দিয়েছেন। সেই রাজ্যই মাবুদ তোর ছেলে অবশালোমকে দিয়েছেন। তুই খুনী বলেই তোর দশা এমন হয়েছে!” এই সব কথা শুনে সরূয়ার ছেলে অবীশয় বাদশাহ্‌কে বললেন, “এই মরা কুকুরটা কেন আমার প্রভু মহারাজকে বদদোয়া দিচ্ছে? আমাকে ওর মাথা কেটে ফেলতে অনুমতি দিন।” বাদশাহ্‌ বললেন, “হে সরূয়ার ছেলেরা, এই বিষয়ে তোমাদের সংগে আমার সম্বন্ধ কি? মাবুদই যদি তাকে বলে থাকেন ‘দাউদকে বদদোয়া দাও’ আর তাই সে বদদোয়া দেয়, তবে কে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, ‘কেন তুমি এই কাজ করছ?’ ” দাউদ তখন অবীশয় ও তাঁর সমস্ত কর্মচারীদের বললেন, “আমার নিজের ছেলেই যখন আমার প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে তখন বিন্যামীন-গোষ্ঠীর এই লোকটি তো আরও বেশী করে তা করবে। সে যা করছে তাকে তা করতে দাও; বদদোয়া দিতে দাও, কারণ মাবুদই তাকে তা করতে বলেছেন। হতে পারে মাবুদ আমার এই কষ্ট দেখবেন, আর আজকে আমি যে বদদোয়া পাচ্ছি তার বদলে আমার ভাল করবেন।” এর পর দাউদ তাঁর লোকজন নিয়ে পথ দিয়ে যেতে লাগলেন আর শিমিয়ি বদদোয়া দিতে দিতে এবং বাদশাহ্‌র দিকে পাথর ও ধুলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাহাড়ের গা দিয়ে চলতে লাগল। বাদশাহ্‌ ও তাঁর সংগের লোকেরা যেখানে যাচ্ছিলেন তাঁরা ক্লান্ত অবস্থায় সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। তারপর সেই জায়গায় দাউদ বিশ্রাম করলেন। এদিকে অবশালোম ও ইসরাইলের সমস্ত লোক জেরুজালেমে গেল। অহীথোফলও তাদের সংগে ছিল। তখন দাউদের বন্ধু অর্কীয় হূশয় অবশালোমের কাছে গিয়ে তাকে বললেন, “মহারাজ চিরজীবী হোন! মহারাজ চিরকাল বেঁচে থাকুন।” অবশালোম হূশয়কে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বন্ধুর প্রতি কি আপনি এইভাবে বিশ্বস্ততা দেখাচ্ছেন? কেন আপনি আপনার বন্ধুর সংগে যান নি?” হূশয় অবশালোমকে বললেন, “মাবুদ এবং এই লোকেরা, অর্থাৎ ইসরাইলের সমস্ত লোক যাঁকে বেছে নিয়েছেন, আমি তাঁরই হব। আমি তাঁর সংগেই থাকব। তা ছাড়া আমি কার সেবা করব? তাঁর ছেলের নয় কি? আমি যেমন আপনার পিতার সেবা করেছি তেমনি আপনারও সেবা করব।” পরে অবশালোম অহীথোফলকে বলল, “এবার আমরা কি করব? আপনি কি পরামর্শ দেন?” জবাবে অহীথোফল বলল, “রাজবাড়ীর দেখাশোনা করবার জন্য আপনার পিতা তাঁর যে সব উপস্ত্রীদের রেখে গেছেন আপনি তাদের সংগে সহবাস করুন। তাহলে ইসরাইলের সবাই জানতে পারবে যে, আপনি নিজেকে আপনার পিতার কাছে ঘৃণার পাত্র করে তুলেছেন। তাতে আপনার সংগের সমস্ত লোক সম্পূর্ণভাবে আপনার পক্ষে থাকবে।” লোকেরা তখন ছাদের উপর অবশালোমের জন্য একটা তাম্বু খাটিয়ে দিল আর সে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের চোখের সামনে তাঁর পিতার উপস্ত্রীদের সংগে সহবাস করবার জন্য সেখানে ঢুকল। তখনকার দিনে অহীথোফলের দেওয়া পরামর্শকে মনে করা হত যেন তা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছে। অহীথোফলের পরামর্শকে দাউদ ও অবশালোম দু’জনে তা-ই মনে করতেন। অহীথোফল অবশালোমকে আরও বলল, “আমাকে আজ রাতে বারো হাজার লোক নিয়ে দাউদের পিছনে তাড়া করতে যেতে দিন। যখন তিনি ক্লান্ত ও দুর্বল থাকবেন তখনই আমি তাঁকে হামলা করব। আমি তাঁকে এমন ভয় ধরিয়ে দেব যে, তাঁর সংগের লোকেরা পালিয়ে যাবে। তখন আমি কেবলমাত্র বাদশাহ্‌কেই হত্যা করব, আর সমস্ত লোককে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনব। আপনি যাঁর মৃত্যু চাইছেন তিনি ছাড়া আর সব লোক যখন ফিরে আসবে তখন শান্তি হবে।” অবশালোম ও ইসরাইলের সমস্ত বৃদ্ধ নেতাদের কাছে এই পরামর্শটা ভাল বলে মনে হল। কিন্তু অবশালোম বলল, “অর্কীয় হূশয়কে ডাক, তাঁর কি বলবার আছে তা আমরা শুনি।” হূশয় আসলে পর অবশালোম তাকে বলল, “অহীথোফল আমাদের এই পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তা কি আমরা করব? যদি তা না হয়, আপনার মতামত কি?” হূশয় অবশালোমকে বললেন, “এইবার অহীথোফল যে পরামর্শ দিয়েছেন তা ভাল নয়। আপনি তো জানেন যে, আপনার পিতা ও তাঁর লোকেরা যোদ্ধা। তাঁরা বাচ্চা কেড়ে নেওয়া বুনো ভল্লুকের মতই ভয়ংকর। তা ছাড়া আপনার পিতা একজন পাকা যোদ্ধা; তিনি তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে রাত কাটাবেন না। তিনি এখন কোন গর্তে বা অন্য কোন জায়গায় লুকিয়ে আছেন। যুদ্ধের শুরুতে যদি আপনার সৈন্যের কয়েকজন মারা পড়ে তবে যারা সেই কথা শুনবে তারা বলবে, ‘অবশালোমের পক্ষের সৈন্যদলের অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে।’ তখন সবচেয়ে শক্তিশালী ও সিংহের মত সাহসী যে সৈন্য সে-ও ভয়ে দিশাহারা হবে, কারণ ইসরাইলের সবাই জানে যে, আপনার পিতা একজন যোদ্ধা এবং তাঁর সংগে যারা আছে তারাও শক্তিশালী। “তাই আমি আপনাকে এই পরামর্শ দিই: দান থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত সাগর পারের অসংখ্য বালুকণার মত সমস্ত ইসরাইলীয় আপনার কাছে জমায়েত হোক আর তাদের নিয়ে আপনি নিজেই যুদ্ধে যান। তাতে যেখানেই তিনি থাকুন না কেন সেখানেই আমরা তাঁকে হামলা করব আর মাটিতে শিশির পড়বার মত করে আমরা তাঁর উপর পড়ব। তিনি কিংবা তাঁর লোকদের কাউকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখব না। তিনি যদি কোন শহরে গিয়ে ঢোকেন তবে আমরা সব বনি-ইসরাইলরা সেখানে দড়ি নিয়ে যাব আর শহরটাকে টেনে এমনভাবে উপত্যকার মধ্যে ফেলব যে, শহরের পাথরের একটা টুকরাও সেখানে পড়ে থাকবে না।” অবশালোম ও ইসরাইলের সব লোকেরা বলল, “অহীথোফলের পরামর্শের চেয়ে অর্কীয় হূশয়ের পরামর্শ ভাল।” আসলে অবশালোমের উপর ধ্বংস নিয়ে আসবার জন্য মাবুদই অহীথোফলের ভাল পরামর্শকে বিফল করে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। হূশয় ইমাম সাদোক আর অবিয়াথরকে বললেন, “অবশালোম ও ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতাদের অহীথোফল এই পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি তাঁদের এই এই পরামর্শ দিয়েছি। আপনারা এখনই দাউদের কাছে খবর পাঠিয়ে এই কথা বলুন, ‘মরুভূমির যে জায়গায় হেঁটে নদী পার হওয়া যায় সেখানে আজকে রাত কাটাবেন না; নদী পার হয়ে যেতেই হবে। তা নইলে বাদশাহ্‌ ও তাঁর সংগের সমস্ত লোক মারা পড়বেন।’ ” সেই সময় যোনাথন ও অহীমাস ঐন্‌-রোগেলে ছিল। একজন চাকরানী তাদের খবর জানাত আর তারা গিয়ে বাদশাহ্‌ দাউদকে সেই খবর দিত, কারণ শহরে যাওয়া-আসার ঝুঁকি তারা নিতে পারত না। কিন্তু একজন যুবক তাদের দেখে ফেলল এবং অবশালোমকে গিয়ে খবর দিল। কাজেই তারা তাড়াতাড়ি চলে গেল এবং বহুরীমে একজন লোকের বাড়ীতে গেল। তার উঠানে একটা কূয়া ছিল। তারা সেই কূয়াতে নেমে গেল। সেই লোকটির স্ত্রী একটা ঢাকনা নিয়ে কূয়ার মুখটা ঢেকে দিল এবং তার উপরে শস্য ছড়িয়ে রাখল। কেউ এই সব ঘটনার কিছু জানতে পারল না। অবশালোমের লোকেরা সেই বাড়ীতে এসে স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, “অহীমাস ও যোনাথন কোথায়?” জবাবে স্ত্রীলোকটি বলল, “তারা পানির স্রোত পার হয়ে চলে গেছে।” সেই লোকেরা খোঁজ করে কাউকেই পেল না, কাজেই তারা জেরুজালেমে ফিরে গেল। লোকেরা চলে গেলে পর সেই দু’জন কূয়া থেকে উঠে এসে বাদশাহ্‌ দাউদকে খবর দেবার জন্য চলে গেল। তারা তাঁকে বলল, “আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ুন এবং নদী পার হয়ে যান; অহীথোফল আপনার বিরুদ্ধে এই এই পরামর্শ দিয়েছে।” কাজেই দাউদ ও তাঁর সংগের সব লোকেরা বেরিয়ে পড়লেন এবং জর্ডান নদী পার হয়ে গেলেন। ভোর হবার আগেই তারা সবাই জর্ডান নদী পার হয়ে গেল, একজনও বাকী রইল না। অহীথোফল যখন দেখল যে, তার পরামর্শ মত কাজ করা হল না তখন সে তার গাধার উপরে গদি চাপিয়ে তার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেল। তার বাড়ীর সব কিছুর ব্যবস্থা করে সে গলায় দড়ি দিয়ে মরল। তার পিতার কবরে তাকে দাফন করা হল। দাউদ মহনয়িমে গেলেন আর এদিকে অবশালোম ইসরাইলের সব লোক নিয়ে জর্ডান নদী পার হয়ে গেল। অবশালোম তার সৈন্যদলের উপরে যোয়াবের বদলে অমাসাকে নিযুক্ত করেছিল। অমাসা ছিল যিথ্র নামে একজন ইসমাইলীয়ের ছেলে। যিথ্র নাহশের মেয়ে অবীগলকে বিয়ে করেছিল। অবীগল ছিল যোয়াবের মা সরূয়ার বোন। অবশালোম এবং বনি-ইসরাইলরা গিলিয়দ এলাকায় গিয়ে ছাউনি ফেলল। মধু, দই, গরুর দুধের পনীর এবং ভেড়া নিয়ে আসল। তারা ভেবেছিল যে, মরুভূমিতে ঐ সব লোকদের খিদে ও পিপাসা পেয়েছে এবং তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দাউদ তাঁর সংগের লোকদের জমায়েত করলেন এবং তাদের হাজারের উপরে এবং শ’য়ের উপরে সেনাপতিদের নিযুক্ত করলেন। দাউদ তাঁর সৈন্যদলকে তিন ভাগ করে এইভাবে পাঠিয়ে দিলেন্ত যোয়াবের অধীনে একভাগ, যোয়াবের ভাই, অর্থাৎ সরূয়ার ছেলে অবীশয়ের অধীনে একভাগ এবং গাতীয় ইত্তয়ের অধীনে একভাগ। বাদশাহ্‌ সৈন্যদের বললেন, “আমিও নিশ্চয়ই তোমাদের সংগে যাব।” কিন্তু লোকেরা বলল, “আপনি যাবেন না। যদি আমাদের পালিয়ে যেতেই হয় তবে তাদের কিছু যাবে-আসবে না। যদি আমাদের অর্ধেক লোকও মারা যায় তাতেও তাদের কিছু হবে না, কিন্তু আপনি তো আমাদের দশ হাজারের সমান। আপনি এখন শহরে থেকে আমাদের সাহায্য করলে ভাল হবে।” জবাবে বাদশাহ্‌ বললেন, “তোমাদের কাছে যা ভাল মনে হয় আমি তা-ই করব।” কাজেই বাদশাহ্‌ শহরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন, আর লোকেরা হাজারে হাজারে, শ’য়ে শ’য়ে ভাগ হয়ে বের হয়ে গেল। যোয়াব, অবীশয় ও ইত্তয়কে বাদশাহ্‌ হুকুম দিয়ে বললেন, “আমার মুখ চেয়ে তোমরা সেই যুবক অবশালোমের সংগে নরম ব্যবহার কোরো।” অবশালোম সম্বন্ধে বাদশাহ্‌ যখন সেনাপতিদের হুকুম দিচ্ছিলেন তখন সৈন্যেরা সবাই তা শুনেছিল। বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য সৈন্যদল বের হয়ে গেল। আফরাহীমের বনে যুদ্ধ হল। সেখানে দাউদের লোকদের কাছে ইসরাইলের সৈন্যদল হেরে গেল। সেই দিন ভীষণ যুদ্ধ হল এবং বিশ হাজার লোক মারা পড়ল। যুদ্ধটা সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল এবং যুদ্ধে যত না লোক মরল তার চেয়ে বেশী মরল বনের জন্য। অবশালোম হঠাৎ দাউদের লোকদের সামনে পড়ল। সে তখন তার খ"চরে চড়ে যাচ্ছিল। খ"চরটা বড় একটা এলোন গাছের ঘন ডালপালার তলা দিয়ে যাবার সময় অবশালোমের মাথাটা গাছে আটকে গেল। যে খ"চরের উপর সে চড়ে যাচ্ছিল সেটা চলে গেল আর সে শূন্যে ঝুলে রইল। একজন লোক তা দেখে যোয়াবকে গিয়ে বলল, “আমি এক্ষুনি দেখলাম অবশালোম একটা এলোন গাছে ঝুলে রয়েছেন।” যোয়াব সেই লোকটিকে বললেন, “কি বললে? তুমি তাকে দেখেছ? তুমি সেখানেই তাকে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিলে না কেন? তা করলে আমি তো তোমাকে দশ শেখেল রূপা আর যোদ্ধার একটা কোমর-বাঁধনি দিতাম।” লোকটি জবাবে বলল, “আমার হাতে এক হাজার শেখেল রূপা মেপে দিলেও আমি বাদশাহ্‌র ছেলের শরীরে হাত তুলতাম না। আমরা শুনেছি বাদশাহ্‌ আপনাকে, অবীশয়কে ও ইত্তয়কে এই হুকুম দিয়েছেন, ‘তোমরা সেই যুবক অবশালোমকে রক্ষা কোরো।’ আমি যদি তাঁর প্রতি বেঈমানী করতাম তাহলে বাদশাহ্‌ নিশ্চয়ই জানতে পারতেন, কারণ বাদশাহ্‌র কাছে তো কিছুই লুকানো থাকে না, আর তখন আপনিও আমার পক্ষে থাকতেন না।” যোয়াব বললেন, “আমি তোমার সংগে এইভাবে সময় নষ্ট করতে পারি না।” এই বলে তিনি তিনটা ধারালো খোঁচা হাতে নিয়ে অবশালোমের বুকে বিঁধিয়ে দিলেন। তখনও অবশালোম এলোন গাছের মধ্যে জীবিত ছিল। যোয়াবের দশজন অস্ত্র বহনকারী অবশালোমকে ঘিরে ফেলল এবং তাকে আঘাত করে হত্যা করল। তারপর যোয়াব শিংগা বাজালেন। তখন সৈন্যেরা বনি-ইসরাইলদের তাড়া করা বন্ধ করল, কারণ যোয়াব তাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। তারা অবশালোমকে নিয়ে বনের মধ্যে একটা বড় গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং তাঁর উপর পাথর জড়ো করে একটা বড় ঢিবি বানিয়ে রাখল। এর মধ্যে বনি-ইসরাইলরা সবাই নিজের নিজের বাড়ীতে পালিয়ে গেল। অবশালোম যখন জীবিত ছিল তখন সে তার নিজের জন্য একটা থাম এনে বাদশাহ্‌র উপত্যকায় স্থাপন করেছিল। সে বলেছিল, “আমার নাম রক্ষার জন্য আমার কোন ছেলে নেই।” তাই সে তার নিজের নামেই থামটার নাম দিয়েছিল। আজও সেই থামটাকে অবশালোমের থাম বলা হয়। পরে সাদোকের ছেলে অহীমাস বলল, “আমি দৌড়ে গিয়ে বাদশাহ্‌কে এই সংবাদ দিই যে, মাবুদ তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন।” যোয়াব তাকে বললেন, “আজকে তুমি খবর নিয়ে যাবে না, অন্য দিন তা কোরো। বাদশাহ্‌র ছেলে মারা গেছে, কাজেই আজকে তুমি সেই কাজ করতে পারবে না।” এর পর যোয়াব একজন ইথিওপীয়কে বললেন, “তুমি যা দেখেছ তা গিয়ে বাদশাহ্‌কে বল।” এই কথা শুনে সেই ইথিওপীয় যোয়াবকে সালাম জানিয়ে দৌড়ে চলে গেল। সাদোকের ছেলে অহীমাস আবার যোয়াবকে বলল, “যা হয় হোক, আমাকে এই ইথিওপীয়ের পিছনে পিছনে ছুটে যেতে দিন।” জবাবে যোয়াব বললেন, “কেন তুমি যেতে চাইছ বাবা? পুরস্কার পাবার মত কোন খবরই তো তোমার নেই।” অহীমাস বলল, “যা হয় হোক, আমি দৌড়ে যেতে চাই।” কাজেই যোয়াব বললেন, “আচ্ছা, যাও।” তখন অহীমাস সমভূমির উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সেই ইথিওপীয়কে পিছনে ফেলে গেল। সেই সময় দাউদ শহরের ভিতরের ও বাইরের দরজার মাঝামাঝি জায়গায় বসে ছিলেন। তাঁর পাহারাদার দেয়াল বেয়ে দরজার ছাদের উপর উঠল। সে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল একজন লোক একা দৌড়ে আসছে। পাহারাদার বাদশাহ্‌কে জোরে ডেকে সেই কথা জানাল। বাদশাহ্‌ বললেন, “যদি সে একাই হয় তবে সে ভাল খবরই নিয়ে আসছে।” লোকটা কাছাকাছি এসে পড়ল। পরে পাহারাদার দেখল আরও একজন লোক দৌড়ে আসছে। সে দারোয়ানকে জোরে ডেকে বলল, “দেখ, আর একজন লোক একা দৌড়ে আসছে।” বাদশাহ্‌ বললেন, “সে-ও ভাল খবরই আনছে।” তখন পাহারাদার বলল, “প্রথম লোকটি সাদোকের ছেলে অহীমাসের মত দৌড়াচ্ছে বলে মনে হয়।” বাদশাহ্‌ বললেন, “লোকটি ভাল মানুষ, সে ভাল খবরই আনছে।” অহীমাস বাদশাহ্‌কে জোরে ডেকে বলল, “সব ভাল।” তারপর সে বাদশাহ্‌র সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বলল, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। আমার প্রভু মহারাজের বিরুদ্ধে যারা হাত তুলেছিল তাদের তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।” বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “যুবক অবশালোম নিরাপদে আছে তো?” জবাবে অহীমাস বলল, “যোয়াব যখন মহারাজের গোলামকে ও আমাকে পাঠাতে যাচ্ছিলেন তখন আমি ভীষণ গোলমাল হতে দেখেছি। কিন্তু সেটা যে কিসের জন্য তা আপনার গোলাম আমি জানি না।” বাদশাহ্‌ বললেন, “এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর।” কাজেই সে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সেই ইথিওপীয় সেখানে পৌঁছে বলল, “আমার প্রভু মহারাজ, ভাল খবরই এনেছি। যারা আপনার বিরুদ্ধে উঠেছিল তাদের সকলের উপরে মাবুদ আজ আপনাকে জয় দান করেছেন।” বাদশাহ্‌ সেই ইথিওপীয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “যুবক অবশালোম নিরাপদে আছে তো?” জবাবে সেই ইথিওপীয় বলল, “আমার প্রভু মহারাজের শত্রুরা এবং যারা আপনার ক্ষতি করবার জন্য উঠবে তাদের সকলের অবস্থা যেন সেই যুবকের মত হয়।” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌র মন দুঃখে ভরে গেল। তিনি দরজার উপরকার ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি এই কথা বলতে বলতে গেলেন, “হায়, আমার ছেলে অবশালোম, আমার ছেলে, আমার ছেলে অবশালোম! তোমার বদলে যদি আমি মরতে পারতাম! হায়, অবশালোম, আমার ছেলে, আমার ছেলে!” পরে যোয়াবকে জানানো হল যে, অবশালোমের জন্য বাদশাহ্‌ কাঁদছেন আর শোক করছেন। এই কথা শুনে সেই জয়ের দিনটা সৈন্যদলের কাছে একটা শোকের দিন হয়ে উঠল, কারণ সেই দিনই সৈন্যেরা শুনতে পেল যে, বাদশাহ্‌ তাঁর ছেলের জন্য দুঃখ করছেন। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকেরা যেমন লজ্জায় চুপি চুপি ফিরে আসে তেমনি করেই দাউদের সৈন্যেরা সেই দিন চুপি চুপি শহরে গিয়ে ঢুকল। বাদশাহ্‌ তাঁর মুখ ঢেকে এই বলে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন, “হায়, আমার ছেলে অবশালোম! হায়, অবশালোম, আমার ছেলে, আমার ছেলে!” তখন যোয়াব ঘরের ভিতরে গিয়ে বাদশাহ্‌কে বললেন, “যারা আপনার জীবন, আপনার ছেলেমেয়েদের জীবন এবং আপনার স্ত্রী ও উপস্ত্রীদের জীবন রক্ষা করেছে আপনি আজ আপনার সেই সব লোকদের অপমান করলেন। যারা আপনাকে ঘৃণা করে তাদেরই আপনি ভালবাসছেন, আর যারা আপনাকে ভালবাসে তাদের আপনি ঘৃণা করছেন। আজকে আপনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন যে, সেনাপতিরা ও তাদের লোকেরা আপনার কাছে কিছুই নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমরা সবাই মরে গিয়ে যদি অবশালোম বেঁচে থাকত তাহলে আপনি খুশী হতেন। এখন আপনি বাইরে গিয়ে আপনার লোকদের উৎসাহ দিন। আমি মাবুদকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আপনি যদি সৈন্যদের কাছে না যান তবে আজ রাতে একজন লোকও আপনার সংগে থাকবে না। আপনার অল্প বয়স থেকে আজ পর্যন্ত আপনার উপর যত বিপদ ঘটেছে সেগুলোর চেয়ে এটাই হবে বড় বিপদ।” তখন বাদশাহ্‌ উঠে শহরের সদর দরজার কাছে গিয়ে বসলেন। লোকেরা যখন জানতে পারল যে, বাদশাহ্‌ সদর দরজার কাছে বসেছেন তখন সবাই তাঁর কাছে আসল। এদিকে অবশালোমের পক্ষের ইসরাইলীয় সৈন্যেরা যে যার বাড়ীতে পালিয়ে গিয়েছিল। ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে লোকেরা তর্কাতর্কি করে বলতে লাগল, “বাদশাহ্‌ শত্রুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন; ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে তিনিই আমাদের উদ্ধার করেছেন। কিন্তু এখন তিনি অবশালোমের জন্যই দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। যাঁকে আমরা আমাদের উপরে রাজত্ব করবার জন্য অভিষেক করেছিলাম সেই অবশালোম যুদ্ধে মারা গেছেন। তাহলে বাদশাহ্‌কে ফিরিয়ে আনবার জন্য তোমরা কোন কিছু বলছ না কেন?” গোটা ইসরাইল দেশে যা বলাবলি হচ্ছে তা বাদশাহ্‌র কানে গিয়ে পৌঁছাল। সেইজন্য বাদশাহ্‌ দাউদ ইমাম সাদোক ও অবিয়াথরের কাছে এই কথা বলে পাঠালেন, “আপনারা এহুদার বৃদ্ধ নেতাদের এই কথা জিজ্ঞাসা করুন, ‘কেন আপনারা বাদশাহ্‌কে তাঁর রাজবাড়ীতে ফিরিয়ে আনতে পিছিয়ে রয়েছেন? আপনারা তো তাঁরই ভাই, তাঁর নিজেরই রক্ত-মাংস। তাহলে বাদশাহ্‌কে ফিরিয়ে আনতে কেন আপনারা পিছিয়ে রয়েছেন?’ আপনারা আমার হয়ে অমাসাকে এই কথা বলুন, ‘তুমিও কি আমার রক্ত-মাংস নও? এখন থেকে যোয়াবের জায়গায় তুমি যদি আমার সৈন্যদলের সেনাপতি না হও তবে আল্লাহ্‌ যেন আমাকে শাস্তি দেন, আর তা ভীষণভাবেই দেন।’ ” এইভাবে দাউদ এহুদার সমস্ত লোকের মন মাত্র একটি লোকের মনের মত করে জয় করে নিলেন। তারা বাদশাহ্‌কে এই কথা বলে পাঠাল, “আপনি ও আপনার সমস্ত লোক ফিরে আসুন।” তখন বাদশাহ্‌ ফিরবার পথে জর্ডান নদী পর্যন্ত আসলেন। এহুদার লোকেরা বাদশাহ্‌র সংগে দেখা করে তাঁকে জর্ডান নদী পার করে নিয়ে আসবার জন্য গিল্‌গলে এসেছিল। বহুরীম গ্রামের বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গেরার ছেলে শিমিয়ি দেরি না করে এহুদার লোকদের সাথে বাদশাহ্‌ দাউদের সংগে দেখা করতে আসল। তার সংগে ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর এক হাজার লোক এবং তালুতের পরিবারের চাকর সীবঃ ও তার পনেরজন ছেলে আর বিশজন চাকর। বাদশাহ্‌ জর্ডান নদী পার হওয়ার আগেই তারা তাড়াতাড়ি করে জর্ডান নদীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। বাদশাহ্‌র পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসবার জন্য এবং বাদশাহ্‌র ইচ্ছামত কাজ করবার জন্য তারা হেঁটে পার হওয়ার জায়গা দিয়ে নদী পার হল। বাদশাহ্‌ যখন জর্ডান নদী পার হবেন ঠিক সেই সময় গেরার ছেলে শিমিয়ি এসে বাদশাহ্‌র সামনে উবুড় হয়ে পড়ে বলল, “হুজুর যেন আমার দোষ না ধরেন। আমার প্রভু মহারাজ যেদিন জেরুজালেম ছেড়ে যান সেই দিন আপনার গোলাম আমি যে অন্যায় করেছিলাম তা যেন আপনি মনে না রাখেন। মহারাজ যেন তাঁর মন থেকে তা দূর করে দেন। আমি জানি যে, আমি গুনাহ্‌ করেছি। সেইজন্য আজ ইউসুফের বংশের মধ্যে আমিই সকলের আগে আমার প্রভু মহারাজের সংগে দেখা করবার জন্য এখানে এসেছি।” তখন সরূয়ার ছেলে অবীশয় বললেন, “মাবুদের অভিষেক-করা বান্দাকে শিমিয়ি বদদোয়া দিয়েছিল বলে কি তাকে হত্যা করা উচিত নয়?” জবাবে দাউদ বললেন, “হে সরূয়ার ছেলেরা, এই বিষয়ে তোমাদের সংগে আমার সম্বন্ধ কি? আজ কেন তোমরা আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছ? আজ কি ইসরাইল দেশে কাউকে হত্যা করা উচিত? আমি কি এই কথা জানি না যে, আজও আমি বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌?” তারপর বাদশাহ্‌ ওয়াদা করে শিমিয়িকে বললেন, “তোমাকে হত্যা করা হবে না।” এর পর তালুতের নাতি মফীবোশৎ বাদশাহ্‌র সংগে দেখা করবার জন্য আসল। বাদশাহ্‌ চলে যাবার পর থেকে তাঁর নিরাপদে ফিরে আসবার দিন পর্যন্ত সে নিজের পায়ের যত্ন করে নি, দাড়ি ছাঁটে নি এবং কাপড়-চোপড়ও ধোয় নি। বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে ফিরে আসলে পর মফীবোশৎ তাঁর সংগে দেখা করবার জন্য আসল। তখন বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মফীবোশৎ, তুমি আমার সংগে কেন গেলে না?” সে বলল, “আমার প্রভু মহারাজ, আপনার গোলাম আমি খোঁড়া, তাই বলেছিলাম, ‘আমার গাধার উপর গদি চাপিয়ে আমি তার উপরে চড়ে বাদশাহ্‌র সংগে যাব।’ কিন্তু আমার চাকর সীবঃ আমার সংগে বেঈমানী করেছিল। আমার প্রভু মহারাজের কাছে সে আমার দুর্নাম করেছে। আমার প্রভু মহারাজ আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতার মত; তাই আমার উপর আপনার যা খুশী তা-ই করুন। আমার দাদার বংশধরেরা আমার প্রভু মহারাজের কাছে মৃত্যুর উপযুক্ত, কিন্তু তবুও আপনার যে লোকেরা আপনার টেবিলে খেতে বসে আপনি আপনার এই গোলামকেও তাদের মধ্যে একটা জায়গা দিয়েছিলেন। তাহলে মহারাজের কাছে আর অনুরোধ করবার আমার কি অধিকার আছে?” বাদশাহ্‌ তাকে বললেন, “তোমার আর কিছু বলবার দরকার নেই। তুমি আর সীবঃ জমাজমি ভাগ করে নাও।” মফীবোশৎ বাদশাহ্‌কে বলল, “সে-ই সব কিছু নিক। আমার প্রভু মহারাজ নিরাপদে বাড়ী ফিরে এসেছেন সেটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।” বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে ফিরে আসবার আগে গিলিয়দীয় বর্সিল্লয় রোগলীম থেকে এসে বাদশাহ্‌কে বিদায় দেবার জন্য তাঁর সংগে জর্ডান নদীর পারে এসেছিলেন। বর্সিল্লয় খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন; তাঁর বয়স ছিল আশি বছর। বাদশাহ্‌ যখন মহনয়িমে ছিলেন তখন তিনিই তাঁর জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন, কারণ তিনি খুব ধনী লোক ছিলেন। বাদশাহ্‌ বর্সিল্লয়কে বললেন, “আমার সংগে পার হয়ে এসে জেরুজালেমে আমার কাছে থাকুন। আমিই আপনাকে পালন করব।” কিন্তু জবাবে বর্সিল্লয় বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমি আর কয় বছরই বা বাঁচব যে, আমি বাদশাহ্‌র সংগে জেরুজালেমে যাব? আমার বয়স এখন আশি বছর। কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ তা কি এখন আর আমি বলতে পারি? আপনার গোলাম আমি এখন যা খাই তার স্বাদ কি আমি বুঝতে পারি? গায়ক-গায়িকাদের গান কি আমি এখনও শুনতে পাই? আপনার এই গোলাম কেন আমার প্রভু মহারাজের একটা বাড়তি বোঝা হবে? মহারাজ কেন আমাকে এইভাবে পুরস্কার দেবেন? না, না, আমি মাত্র আপনার সংগে জর্ডান পার হয়ে যাব, তারপর আমাকে ফিরে যেতে দিন যাতে আমি নিজের বাড়ীতে আমার মা-বাবার কবরের কাছে মরতে পারি। এই দেখুন, আপনার গোলাম কিম্‌হম; সে-ই আপনার সংগে জর্ডান নদী পার হয়ে যাক। আপনার যা ভাল বলে মনে হয় তার প্রতি আপনি তা-ই করবেন।” বাদশাহ্‌ বললেন, “ঠিক আছে, কিম্‌হম আমার সংগে নদী পার হয়ে যাবে, আর আপনি যা চান আমি তার প্রতি তা-ই করব। এছাড়া আপনি আমার কাছ থেকে যা চান আপনার জন্য আমি তা-ই করব।” এর পর সমস্ত লোক নদী পার হয়ে গেল, তারপর বাদশাহ্‌ নদী পার হলেন। বাদশাহ্‌ বর্সিল্লয়কে চুম্বন করে দোয়া করলেন আর বর্সিল্লয় আবার নদী পার হয়ে নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। এইভাবে এহুদার সমস্ত লোক এবং ইসরাইলের কিছু লোক বাদশাহ্‌কে নদী পার করে নিয়ে আসল। তারপর বাদশাহ্‌ গিল্‌গলে গেলেন আর কিম্‌হমও তাঁর সংগে গেল। ইসরাইলের বাকী লোকেরা বাদশাহ্‌র কাছে এসে বলল, “কেন আমাদের ভাই এহুদার লোকেরা আপনাকে চুরি করে নিয়ে আসল? তারা আপনাকে, আপনার পরিবার ও আপনার সংগের সব লোকদের নদী পার করে নিয়ে আসল কেন?” জবাবে এহুদার সব লোকেরা ইসরাইলের লোকদের বলল, “বাদশাহ্‌র সংগে আমাদের নিকট সম্বন্ধ রয়েছে বলে আমরা তা করেছি। তোমরা কেন এতে রাগ করছ? আমরা কি বাদশাহ্‌র কোন খাবার থেকে কিছু খেয়েছি? নাকি তিনি আমাদের কিছু উপহার দিয়েছেন?” জবাবে ইসরাইলের লোকেরা এহুদার লোকদের বলল, “আমরা দশ গোষ্ঠী বলে বাদশাহ্‌ দাউদের উপরে তোমাদের চেয়ে আমাদের অধিকার বেশী। কাজেই তোমরা কেন আমাদের এইভাবে তুচ্ছ করছ? আমাদের বাদশাহ্‌কে ফিরিয়ে আনবার কথা কি আমরাই প্রথমে বলি নি?” কিন্তু ইসরাইলের লোকদের চেয়ে এহুদার লোকদের কথা বেশী কড়া বলে মনে হল। বিন্যামীন-গোষ্ঠীর বিখ্রির ছেলে শেবঃ নামে একজন দুষ্ট লোক তখন সেখানে ছিল। সে শিংগা বাজিয়ে বলল, “দাউদের উপর আমাদের কোন দাবি নেই, ইয়াসির ছেলের উপর কোন অধিকার নেই। হে ইসরাইল, তোমরা যে যার বাড়ীতে ফিরে যাও।” তখন ইসরাইলের সমস্ত লোক দাউদকে ছেড়ে বিখ্রির ছেলে শেবের পিছনে গেল। কিন্তু জর্ডান থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত সমস্ত পথটাই এহুদার লোকেরা বাদশাহ্‌র সংগে সংগে গেল। দাউদ জেরুজালেমে তাঁর নিজের বাড়ীতে ফিরে আসলে পর যে দশজন উপস্ত্রীকে তিনি রাজবাড়ী দেখাশোনা করবার জন্য রেখে গিয়েছিলেন তাদের তিনি একটা বাড়ীতে রাখলেন এবং বাড়ীটা পাহারা দেবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের খাওয়া-পরা দিলেন কিন্তু আর তাদের সংগে থাকলেন না। সেখানে তারা বিধবা হিসাবে মৃত্যু পর্যন্ত আটক রইল। এর পর বাদশাহ্‌ অমাসাকে বললেন, “তিন দিনের মধ্যে তুমি এহুদার লোকদের আমার কাছে ডেকে আনবে আর তুমিও এখানে থাকবে।” অমাসা এহুদার লোকদের ডাকতে গেলেন বটে কিন্তু বাদশাহ্‌ এইজন্য যে সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন তার চেয়ে তিনি বেশী সময় নিলেন। তখন দাউদ অবীশয়কে বললেন, “অবশালোম আমাদের যত না ক্ষতি করেছে তার চেয়ে এখন বেশী ক্ষতি করবে এই বিখ্রির ছেলে শেবঃ। এখন তুমি আমার লোকদের নিয়ে তার পিছনে তাড়া করে যাও। নইলে সে কোন দেয়াল-ঘেরা শহর খুঁজে নিয়ে আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে।” তখন যোয়াব ও তাঁর লোকেরা, করেথীয় ও পলেথীয়রা এবং বাকী যোদ্ধারা অবীশয়ের অধীনে বিখ্রির ছেলে শেবঃকে তাড়া করবার জন্য জেরুজালেম থেকে বের হয়ে গেল। তারা গিবিয়োনের বড় পাথরটার কাছে উপস্থিত হলে পর অমাসার সংগে তাদের দেখা হল। যোয়াবের পরনে ছিল তখন সৈনিকের পোশাক এবং তাঁর কোমরে কোমর-বাঁধনির সংগে বাঁধা খাপের মধ্যে ছিল ছোরা। তিনি এগিয়ে গেলে খাপ থেকে ছোরাটা মাটিতে পড়ে গেল। যোয়াব অমাসাকে বললেন, “ভাই, কেমন আছ?” এই বলে তাঁকে চুম্বন করবার জন্য তিনি ডান হাত দিয়ে তাঁর দাড়ি ধরলেন। যোয়াবের হাতে যে সেই ছোরাটা ছিল সেই দিকে অমাসা খেয়াল করে নি। যোয়াব সেই ছোরা তাঁর পেটে ঢুকিয়ে দিলেন। তাতে তাঁর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে মাটিতে পড়ল। অমাসাকে আর আঘাত করবার দরকার হল না। তিনি মারা গেলেন। এর পর যোয়াব ও তাঁর ভাই অবীশয় বিখ্রির ছেলে শেবের পিছনে তাড়া করে গেলেন। যোয়াবের একজন লোক অমাসার লাশের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “যে যোয়াবকে ভালবাসে এবং যে দাউদের পক্ষের লোক সে যেন যোয়াবের পিছনে পিছনে যায়।” অমাসার লাশটা তখন রাস্তার মাঝখানে রক্তের মধ্যে পড়ে ছিল। যোয়াবের সেই লোকটি দেখল যে, সৈন্যেরা সবাই অমাসার কাছে এসে থেমে যাচ্ছে, তাই সে অমাসাকে রাস্তা থেকে টেনে একটা মাঠে নামিয়ে নিয়ে গেল এবং একখানা কাপড় দিয়ে তাকে ঢেকে দিল। অমাসাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিলে পর সব লোকেরা যোয়াবের পিছনে পিছনে বিখ্রির ছেলে শেবঃকে তাড়া করতে গেল। শেবঃ ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর এলাকার মধ্য দিয়ে এবং বেরীয়দের সমস্ত এলাকা দিয়ে আবেল-বৈৎমাখা পর্যন্ত গেল। সেখানে লোকেরা জমায়েত হয়ে শেবের পিছনে পিছনে শহরে ঢুকল। যোয়াব তার দিকে এগিয়ে গেলে পর সে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি যোয়াব?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি যোয়াব।” স্ত্রীলোকটি বলল, “আপনার বাঁদীর কথা শুনুন।” তিনি বললেন, “শুনছি।” স্ত্রীলোকটি বলল, “আগেকার দিনে লোকে বলত, ‘আবেলে গিয়ে তোমার প্রশ্নের জবাব জেনে নাও।’ আর এইভাবে তারা সব ব্যাপারের মীমাংসা করত। আমরা ইসরাইলের মধ্যে শান্তিপ্রিয় ও বিশ্বস্ত। আপনি ইসরাইলের মধ্যে মায়ের মত এই শহরটাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছেন। মাবুদের সম্পত্তি এই বনি-ইসরাইলদের কেন আপনি গিলে ফেলবার চেষ্টা করছেন?” জবাবে যোয়াব বললেন, “গিলে ফেলা বা ধ্বংস করবার কাজ আমার থেকে দূরে থাকুক, দূরে থাকুক। ব্যাপারটা ঐরকম নয়। আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার বিখ্রির ছেলে শেবঃ নামে একজন লোক বাদশাহ্‌ দাউদের বিরুদ্ধে হাত তুলেছে। সেই লোকটাকে কেবল আমার হাতে তুলে দাও, তাহলে আমি এই শহর থেকে চলে যাব।” স্ত্রীলোকটি যোয়াবকে বলল, “দেয়ালের উপর দিয়ে তার মাথাটা আপনার কাছে ছুঁড়ে দেওয়া হবে।” তারপর সেই স্ত্রীলোকটি সমস্ত লোকের কাছে গিয়ে জ্ঞানপূর্ণ উপদেশ দিল। লোকেরা বিখ্রির ছেলে শেবের মাথাটা কেটে নিয়ে যোয়াবের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিল। যোয়াব তখন শিংগা বাজিয়ে দিলেন আর তাঁর লোকেরা শহরের কাছ থেকে চলে গিয়ে প্রত্যেকে যে যার বাড়ীতে চলে গেল। যোয়াব জেরুজালেমে বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে গেলেন। যোয়াব ছিলেন ইসরাইলের গোটা সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতি আর যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন দাউদের দেহরক্ষী করেথীয় ও পলেথীয়দের প্রধান; যাদের কাজ করতে বাধ্য করা হত তাদের দেখাশোনার ভার ছিল অদোরামের উপর; অহীলূদের ছেলে যিহোশাফট ছিলেন ইতিহাস লেখক; শবা ছিলেন বাদশাহ্‌র লেখক; সাদোক ও অবিয়াথর ছিলেন ইমাম এবং যায়ীরীয় ঈরা ছিলেন দাউদের পরামর্শদাতা ইমাম। দাউদের রাজত্বের সময় পর পর তিন বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেইজন্য দাউদ মাবুদের কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে মাবুদ বললেন, “এটা হয়েছে তালুত ও তার বংশের জন্য। তারা রক্তপাতের দোষে দোষী; তালুত গিবিয়োনীয়দের মেরে ফেলেছিল।” বাদশাহ্‌ তখন গিবিয়োনীয়দের ডেকে তাদের সংগে কথা বললেন। গিবিয়োনীয়রা ইসরাইলীয় ছিল না। আসলে তারা ছিল আমোরীয়দের বেঁচে থাকা লোক। তাদের ধ্বংস করবে না বলে বনি-ইসরাইলরা কসম খেয়েছিল, কিন্তু ইসরাইল ও এহুদার প্রতি বিশেষ আগ্রহের জন্য তালুত তাদের সবাইকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। দাউদ গিবিয়োনীয়দের জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি তোমাদের জন্য কি করব? কিভাবে আমি ক্ষতিপূরণ করতে পারি যাতে তোমরা মাবুদের সম্পত্তি বনি-ইসরাইলদের দোয়া কর?” জবাবে গিবিয়োনীয়রা তাঁকে বলল, “তালুত বা তার বংশের কাছে আমাদের যে দাবি তা সোনা বা রূপার ব্যাপার নয় কিংবা বনি-ইসরাইলদের মেরে ফেলবার ব্যাপারও নয়।” দাউদ জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে তোমরা আমাকে তোমাদের জন্য কি করতে বল?” জবাবে তারা বাদশাহ্‌কে বলল, “যে লোকটি আমাদের ধ্বংস করেছে এবং ইসরাইলের সীমার মধ্য থেকে আমাদের মুছে ফেলবার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে কুমতলব করেছে, তার বংশের সাতজন পুরুষ লোককে আমাদের হাতে তুলে দিন। আমরা মাবুদের বেছে নেওয়া সেই লোকের, অর্থাৎ তালুতের শহর গিবিয়াতে মাবুদকে সাক্ষী রেখে তাদের মেরে ফেলব এবং সকলের সামনে তাদের লাশগুলো ফেলে রাখব।” এতে বাদশাহ্‌ বললেন, “আমি তোমাদের হাতে তাদের তুলে দেব।” তালুতের নাতিকে, অর্থাৎ যোনাথনের ছেলে মফীবোশতকে বাদশাহ্‌ বাঁচিয়ে রাখলেন, কারণ তালুতের ছেলে যোনাথনের কাছে দাউদ মাবুদকে সাক্ষী রেখে একটা কসম খেয়েছিলেন। অয়ার মেয়ে রিসপা চট নিয়ে একটা পাথরের উপরে তার নিজের জন্য বিছিয়ে রাখল। প্রথম ফসল কাটবার সময় থেকে শুরু করে যতদিন না সেই লাশগুলোর উপর আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ল ততদিন পর্যন্ত সে দিনের বেলায় পাখীদের এবং রাতের বেলায় বুনো জন্তুদের সেই লাশগুলো ছুঁতে দিল না। তালুতের উপস্ত্রী অয়ার মেয়ে রিসপা যা করেছে তা দাউদকে বলা হল। দাউদ তখন যাবেশ-গিলিয়দের লোকদের কাছ থেকে তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথনের হাড়গুলো তুলে আনলেন। ফিলিস্তিনীরা গিল্‌বোয়ে তালুতকে হত্যা করবার পর তাঁদের দু’জনের লাশ বৈৎশানের শহর-চকে টাংগিয়ে দিয়েছিল। যাবেশ-গিলিয়দের লোকেরা সেখান থেকে লাশগুলো চুরি করে এনেছিল। দাউদ সেখান থেকে তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথনের হাড়গুলো নিয়ে আসলেন। যাদের সকলের সামনে হত্যা করা হয়েছিল তাদের হাড়গুলোও জড়ো করা হল। দাউদের লোকেরা তালুত ও তাঁর ছেলে যোনাথনের হাড় বিন্‌ইয়ামীন এলাকার সেলাতে তাঁর পিতা কীশের কবরে রাখল। বাদশাহ্‌র হুকুম মতই তারা সব কিছু করল। তার পরে দেশের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করা হলে পর তিনি জবাব দিলেন। ফিলিস্তিনী এবং বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হল। দাউদ তাঁর লোকদের নিয়ে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। যুদ্ধ করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন যিশ্‌বী-বনোব নামে একজন রফায়ীয় নতুন সাজে সেজে দাউদকে হত্যা করতে আসল। তার বর্শার ব্রোঞ্জের মাথাটার ওজন ছিল প্রায় চার কেজি। কিন্তু সরূয়ার ছেলে অবীশয় দাউদকে রক্ষা করলেন। তিনি সেই ফিলিস্তিনীকে আঘাত করে হত্যা করলেন। তখন দাউদের লোকেরা কসম খেয়ে দাউদকে বলল, “আপনি আর কখনও আমাদের সংগে যুদ্ধে যাবেন না, ইসরাইলের বাতিটা আপনি নিভিয়ে দেবেন না।” এর পরে গোবে ফিলিস্তিনীদের সংগে আবার একটা যুদ্ধ হল। সেই সময় হূশাতীয় সিব্বখয় সফ নামে একজন রফায়ীয়কে হত্যা করল। গোবে ফিলিস্তিনীদের সংগে আর একটা যুদ্ধে বেথেলহেমীয় যারে-ওরগীমের ছেলে ইল্‌হানন গাতীয় জালুতকে হত্যা করল। এই জালুতের বর্শা ছিল তাঁতীদের বীমের মত। আর একটা যুদ্ধ গাতে হয়েছিল। সেই যুদ্ধে একজন লম্বা-চওড়া লোক ছিল যার দু’হাতে ও দু’পায়ে ছয়টা করে মোট চব্বিশটা আংগুল ছিল। সে-ও ছিল একজন রফায়ীয়। সে যখন ইসরাইল জাতিকে টিট্‌কারি দিল তখন দাউদের ভাই শিমিয়ার ছেলে যোনাথন তাকে হত্যা করল। এই চারজন ছিল গাতে বাসকারী রফায়ীয়। দাউদ ও তাঁর লোকদের হাতে এরা মারা পড়েছিল। মাবুদ যখন দাউদকে তালুত ও তাঁর অন্যান্য শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করলেন তখন তিনি মাবুদের উদ্দেশে এই কাওয়ালী গেয়েছিলেন: মাবুদই আমার উঁচু পাহাড়, আমার কেল্লা ও আমার মুক্তিদাতা; আমার আল্লাহ্‌ আমার উঁচু পাহাড়, তাঁরই মধ্যে আমি আশ্রয় নিই। তিনিই আমার ঢাল, আমার রক্ষাকারী শিং, আমার উঁচু কেল্লা, আমার আশ্রয়-স্থান। জুলুমবাজদের হাত থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। মাবুদ প্রশংসার যোগ্য, আমি তাঁকে ডাকি; তাতে আমার শত্রুদের হাত থেকে আমি রক্ষা পাই। মৃত্যুর ঢেউ আমাকে ঘিরে ধরেছিল, ধ্বংসের স্রোতে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম। কবরের দড়িতে আমি বাঁধা পড়েছিলাম, আমার জন্য পাতা হয়েছিল মৃত্যুর ফাঁদ। আমি এই বিপদে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডাকলাম এবং সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে ফরিয়াদ জানালাম। তাঁর বাসস্থান থেকে তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনলেন; আমার ফরিয়াদ তাঁর কানে পৌঁছাল। তখন দুনিয়া কেঁপে উঠল আর টলতে লাগল, কেঁপে উঠল আসমানের ভিত্তি; তাঁর রাগে সেগুলো কাঁপতে থাকল। তাঁর নাক থেকে ধোঁয়া উপরে উঠল, তাঁর মুখ থেকে ধ্বংসকারী আগুন বেরিয়ে আসল, তাঁর মুখের আগুনে কয়লা জ্বলে উঠল। তিনি আকাশ নুইয়ে নেমে আসলেন; তাঁর পায়ের নীচে ছিল ঘন কালো মেঘ। তিনি কারুবীতে চড়ে উড়ে আসলেন, দেখা দিলেন বাতাসের ডানায় ভর করে। তিনি অন্ধকার দিয়ে নিজেকে ঘিরে ফেললেন; তাঁর চারপাশে রইল আকাশের ঘন কালো বৃষ্টির মেঘ। তাঁর আলোময় উপস্থিতির সামনে বিদ্যুৎ চম্‌কে চম্‌কে উঠতে লাগল। মাবুদ আসমান থেকে গর্জন করলেন; আল্লাহ্‌তা’লার আওয়াজ শোনা গেল। তিনি তীর ছুঁড়ে শত্রুদের ছড়িয়ে ফেললেন আর বিদ্যুৎ চম্‌কিয়ে তাদের বিশৃঙ্খল করলেন। মাবুদের ধমকে আর নিঃশ্বাসের ঝাপ্‌টায় সাগরের তলা দেখা গেল, দুনিয়ার ভিতরটা বেরিয়ে পড়ল। তিনি উপর থেকে হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরলেন, গভীর পানির মধ্য থেকে আমাকে টেনে তুললেন। আমার শক্তিমান শত্রুর হাত থেকে তিনি আমাকে বাঁচালেন; বাঁচালেন বিপক্ষদের হাত থেকে যাদের শক্তি আমার চেয়েও বেশী। বিপদের দিনে তারা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু মাবুদই আমাকে ধরে রাখলেন। তিনি আমাকে একটা খোলা জায়গায় বের করে আনলেন; আমার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই তিনি আমাকে উদ্ধার করলেন। আমার ন্যায় কাজ অনুসারেই মাবুদ আমাকে দান করলেন, আমার কাজের পবিত্রতা অনুসারে পুরস্কার দিলেন; কারণ মাবুদের পথেই আমি চলাফেরা করেছি; খারাপ কাজ করে আমার আল্লাহ্‌র কাছ থেকে সরে যাই নি। তাঁর সমস্ত শরীয়ত আমার সামনে রয়েছে; তাঁর নিয়ম থেকে আমি সরে যাই নি। তাঁর সামনে আমি নির্দোষ ছিলাম, আমি গুনাহ্‌ থেকে দূরে থেকেছি। তাই মাবুদ আমাকে পুরস্কার দিয়েছেন তাঁর চোখে আমার ন্যায় কাজ অনুসারে, আমার পবিত্রতা অনুসারে। তুমি বিশ্বস্তদের সংগে বিশ্বস্ত ব্যবহার কর, নির্দোষদের সংগে কর নির্দোষ ব্যবহার, খাঁটি লোকদের সংগে খাঁটি ব্যবহার কর, আর কুটিলদের দেখাও তোমার বুদ্ধির কৌশল। তুমি দুঃখীদের রক্ষা করে থাক, আর অহংকারীদের নীচে নামাবার জন্য তোমার চোখ তাদের দিকে আছে। হে মাবুদ, তুমিই আমার বাতি; তুমিই আমার অন্ধকারকে আলো করে থাক। তোমার সাহায্যেই আমি সৈন্যদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, আর আমার আল্লাহ্‌র সাহায্যে লাফ দিয়ে দেয়াল পার হতে পারি। আল্লাহ্‌র পথে কোন খুঁত নেই; মাবুদের কালাম খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনিই তাঁর মধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী সকলের ঢাল। একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া মাবুদ আর কে? আমাদের আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কি কোন আশ্রয়-পাহাড় আছে? আল্লাহ্‌ আমার শক্ত আশ্রয়; তিনি আমার চলার পথ নিখুঁত করেছেন। তিনি আমাকে হরিণীর মত করে লাফিয়ে চলার শক্তি দিয়েছেন; সব উঁচু জায়গায় তিনিই আমাকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই আমার হাত যুদ্ধ করতে শিখেছে, তাই আমার হাত ব্রোঞ্জের ধনুক বাঁকাতে পারে। হে মাবুদ, তোমার রক্ষাকারী ঢাল তুমি আমাকে দিয়েছ; তোমার যত্ন দিয়ে তুমি আমাকে মহান করেছ। তুমি আমার চলার পথ চওড়া করেছ, তাই আমার পায়ে উচোট লাগে নি। আমার শত্রুদের তাড়া করে আমি তাদের ধ্বংস করেছি; তারা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমি পিছন ফিরি নি। আমি তাদের ধ্বংস করেছি, তাদের চুরমার করে দিয়েছি, যাতে তারা আর উঠতে না পারে; তারা আমার পায়ের তলায় পড়েছে। তুমিই আমার কোমরে যুদ্ধ করার শক্তি দিয়েছ, আমার বিপক্ষদের আমার পায়ে নত করেছ। আমার শত্রুদের তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে বাধ্য করেছ; যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের আমি ধ্বংস করেছি। তারা সাহায্যের জন্য তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু কেউ তাদের রক্ষা করতে আসে নি। তারা মাবুদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু তিনিও তাদের জবাব দেন নি। দুনিয়ার ধুলার মত আমি তাদের গুঁড়া করেছি; রাস্তার কাদা-মাটির মত পায়ে মাড়িয়ে আমি তাদের চুরমার করেছি। হে মাবুদ, আমার লোকদের বিদ্রোহ থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার করেছ, অন্য জাতিদের উপর আমাকে কর্তা হিসাবে রেখেছ; আমি যাদের চিনতাম না তারাও আমার অধীন হয়েছে। বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে বিদেশীরা আমার বাধ্য হয়; আমার কথা শুনলেই তারা আমার অধীনতা স্বীকার করে। তারা নিরাশ হয়ে পড়ে; তারা কাঁপতে কাঁপতে কেল্লা থেকে বের হয়। মাবুদ জীবন্ত। আমার আশ্রয়-পাহাড়ের প্রশংসা হোক। আমার আল্লাহ্‌, যিনি আমার রক্ষাকারী পাহাড়, তাঁর সম্মান বৃদ্ধি হোক। তিনিই অন্য জাতিদের আমার অধীনে আনেন আর আমার হয়ে তাদের পাওনা শাস্তি দেন। তিনি শত্রুদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে শত্রুদের উপরে তুলেছ, জুলুমবাজ লোকদের হাত থেকে তুমিই আমাকে রক্ষা করেছ। হে মাবুদ, এইজন্য অন্য জাতিদের মধ্যে আমি তোমার প্রশংসা করব আর তোমার সুনাম গাইব। মাবুদ তাঁর বাদশাহ্‌কে অনেকবার মহাজয় দান করেন; জ্বী, তাঁর অভিষেক-করা বান্দার প্রতি, দাউদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতি, তিনি চিরকাল তাঁর অটল মহব্বত দেখান। ইয়াসির ছেলে দাউদের শেষ কথা এই: “যাঁকে তুলে ধরা হয়েছে, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ যাঁকে অভিষেক করেছেন, যিনি ইসরাইলের মধ্যে মধুর কাওয়াল, তিনি বলছেন, মাবুদের রূহ্‌ আমার মধ্য দিয়ে কথা বলেছেন, আমার মুখে আছে তাঁর কালাম। ইসরাইলের আল্লাহ্‌ বলেছেন, ইসরাইলের আশ্রয়-পাহাড় আমাকে বলেছেন, ‘যে লোক সৎভাবে লোকদের শাসন করে আর আল্লাহ্‌কে ভয় করে, সে মেঘশূন্য ভোরে ওঠা সূর্যের আলোর মত; বৃষ্টির পরে সূর্যের যে আলোতে মাটি থেকে ঘাস গজায় সে তারই মত।’ আল্লাহ্‌র কাছে আমার বংশ কি তেমন নয়? আমার জন্য তিনি তো একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করেছেন। সেই ব্যবস্থার সব কথা ঠিকভাবে সাজানো এবং সুরক্ষিত। আমার উদ্ধার তিনি সফল করবেন, আমার ইচ্ছা তিনি পূরণ করবেন। কিন্তু দুষ্ট লোকেরা সবাই উপ্‌ড়ে ফেলা কাঁটার মত, যাদের হাত দিয়ে ধরা যায় না। যে লোক তাদের ধরতে যায় তাকে ব্যবহার করতে হয় লোহার অস্ত্রশস্ত্র কিংবা বর্শা; তাই তারা যেখানে আছে সেখানেই তাদের পুড়িয়ে ফেলা হবে।” দাউদের শক্তিশালী লোকদের নাম এই: তখমোনীয় যোশেব-বশেবৎ নাম-করা তিনজন বীরের মধ্যে প্রধান ছিলেন; একটা যুদ্ধে তিনি আটশো লোককে হত্যা করেছিলেন বলে তাঁকে ইস্‌নীয় আদীনো বলা হত। তাঁর পরের জন ছিলেন ইলিয়াসর। ইনি ছিলেন অহোহীয়ের বংশের দোদার ছেলে। যখন ফিলিস্তিনীরা যুদ্ধের জন্য জমায়েত হয়েছিল তখন তাদের টিট্‌কারি দেবার জন্য যে তিনজন শক্তিশালী লোক দাউদের সংগে ছিলেন ইলিয়াসর ছিলেন তাঁদের একজন। বনি-ইসরাইলরা পিছু হটে গেল, কিন্তু ইলিয়াসর যুদ্ধের জায়গায় দাঁড়িয়েই ফিলিস্তিনীদের আঘাত করতে থাকলেন। শেষে তাঁর হাত ক্লান্ত হয়ে তলোয়ারের সংগে লেগে রইল। সেই দিন মাবুদ মহাজয় দান করলেন। সৈন্যেরা ইলিয়াসরের কাছে যখন ফিরে আসল তখন লাশগুলোর কাছ থেকে লুট করা ছাড়া তাদের আর কিছু করবার ছিল না। তাঁর পরের জন হলেন হরারীয় আগির ছেলে শম্ম। একবার ফিলিস্তিনীরা মসুর ডালের ক্ষেতে এসে জমায়েত হল, আর ইসরাইলের সৈন্যেরা তাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেল। কিন্তু শম্ম সেই ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই ক্ষেতটা রক্ষা করলেন এবং ফিলিস্তিনীদের শেষ করে দিলেন। মাবুদ সেই দিন তাদের মহাজয় দান করলেন। একবার ফসল কাটবার সময় ত্রিশ জন বীরের মধ্যে সেই তিনজন নাম-করা বীর অদুল্লম গুহাতে দাউদের কাছে আসলেন। তখন এক দল ফিলিস্তিনী সৈন্য রফায়ীম উপত্যকায় ছাউনি ফেলেছিল। সেই সময় দাউদ মরুভূমির কেল্লার মত একটা জায়গায় ছিলেন আর ফিলিস্তিনী সৈন্যদল ছিল বেথেলহেমে। এমন সময় দাউদের খুব পিপাসা পেল, তাই তিনি বললেন, “আহা, যদি কেউ বেথেলহেমের দরজার কাছের কূয়াটা থেকে আমাকে একটু খাবার পানি এনে দিত!” এই কথা শুনে সেই তিনজন শক্তিশালী লোক ফিলিস্তিনী সৈন্যদলের ভিতর দিয়ে গিয়ে বেথেলহেমের দরজার কাছের কূয়াটা থেকে পানি তুলে দাউদের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু দাউদ তা খেলেন না; তার বদলে তিনি সেই পানি মাবুদের উদ্দেশে মাটিতে ঢেলে দিলেন। তিনি বললেন, “হে মাবুদ, আমি যে এই পানি খাব তা দূরে থাক্‌। এ কি সেই লোকদের রক্ত নয় যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা আনতে গিয়েছিল?” দাউদ তা খেতে রাজী হলেন না। সেই তিনজন নাম-করা বীরের কাজই ছিল এই রকম। সরূয়ার ছেলে যোয়াবের ভাই অবীশয় ছিলেন সেই তিনজনের উপরে প্রধান। তিনি বর্শা চালিয়ে তিনশো লোককে হত্যা করেছিলেন এবং তিনিও ঐ তিনজনের মত নাম-করা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সেই তিনজনের চেয়ে বেশী সম্মান পেয়েছিলেন। সেইজন্য সেই তিনজনের মধ্যে তাঁকে ধরা না হলেও তিনি তাঁদের সেনাপতি হয়েছিলেন। কব্‌সেলীয় যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। তিনিও বড় বড় কাজ করেছিলেন। মোয়াবীয় অরীয়েলের দুই ছেলেকে তিনি হত্যা করেছিলেন। এক তুষার-পড়া দিনে তিনি একটা গর্তের মধ্যে নেমে গিয়ে একটা সিংহকে মেরে ফেলেছিলেন। আবার একজন লম্বা-চওড়া মিসরীয়কেও তিনি হত্যা করেছিলেন। সেই মিসরীয়ের হাতে ছিল একটা বর্শা, কিন্তু তবুও তিনি গদা হাতে তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সেই মিসরীয়ের হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিয়ে সেই বর্শা দিয়ে তাকে হত্যা করেছিলেন। যিহোয়াদার ছেলে বনায়ের কাজই ছিল এই রকম। তিনিও সেই তিনজন বীরের মত নাম-করা হয়ে উঠেছিলেন। সেই তিনজনের মধ্যে তাঁকে ধরা না হলেও তিনি “ত্রিশ” নামে দলটার লোকদের চেয়ে বেশী সম্মান পেয়েছিলেন। দাউদ তাঁর দেহরক্ষীদের ভার বনায়ের উপরেই দিয়েছিলেন। “ত্রিশ” নামে দলটির মধ্যে ছিলেন যোয়াবের ভাই অসাহেল, বেথেলহেমের দোদয়ের ছেলে ইল্‌হানন, হরোদীয় শম্ম, হরোদীয় ইলীকা, পল্টীয় হেলস, তকোয়ীয় ইক্কেশের ছেলে ঈরা, অনাথোতীয় অবীয়েষর, হূশাতীয় মবুন্নয়, অহোহীয় সল্‌মোন, নটোফাতীয় মহরয়, নটোফাতীয় বানার ছেলে হেলব, বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গিবিয়ার রীবয়ের ছেলে ইত্তয়, পিরিয়াথোনীয় বনায়, গাশ উপত্যকার হিদ্দয়, অর্বতীয় অবি-অলবোন, বরহূমীয় অস্‌মাবৎ, শাল্‌বোনীয় ইলিয়হবা, যাশেনের ছেলেরা, যোনাথন, হরারীয় শম্ম, হরারীয় সাররের ছেলে অহীয়াম, মাখাথীয় অহস্‌বয়ের ছেলে ইলীফেলট, গীলোনীয় অহীথোফলের ছেলে ইলীয়াম, কর্মিলীয় হিষ্রয়, অর্বীয় পারয়, সোবা গ্রামের নাথনের ছেলে যিগাল, গাদীয় বানী, অম্মোনীয় সেলক, সরূয়ার ছেলে যোয়াবের অস্ত্র বহনকারী বেরোতীয় নহরয়, মাবুদ আবার বনি-ইসরাইলদের উপর রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি দাউদকে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলে বললেন, “তুমি গিয়ে ইসরাইল ও এহুদার লোকদের গণনা কর।” তখন বাদশাহ্‌ তাঁর সংগের সেনাপতি যোয়াবকে বললেন, “তোমরা দান থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গিয়ে লোকদের গণনা করে এস যাতে আমি তাদের মোট সংখ্যা জানতে পারি।” জবাবে যোয়াব বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ যেন লোকদের সংখ্যা শতগুণ বাড়িয়ে দেন, আর আমার প্রভু মহারাজ যেন তা নিজের চোখেই দেখতে পান। কিন্তু আমার প্রভু মহারাজ এই রকম কাজ কেন করতে চাইছেন?” কিন্তু যোয়াব ও সেনাপতিদের কাছে বাদশাহ্‌র হুকুম বহাল রইল; কাজেই ইসরাইলের লোকদের গণনা করবার জন্য তাঁরা বাদশাহ্‌র সামনে থেকে চলে গেলেন। তাঁরা জর্ডান পার হয়ে গিয়ে গাদ এলাকার উপত্যকার মধ্যেকার শহরের দক্ষিণে অরোয়েরে গিয়ে তাম্বু ফেললেন, তারপর যাসেরে গেলেন। তারপর তাঁরা গিলিয়দ এবং তহতীম-হদ্‌শি এলাকায় গেলেন। তারপর তাঁরা দান্তযানে গিয়ে ঘুরে সিডনের দিকে গেলেন। তারপর তাঁরা টায়ারের কেল্লায় এবং হিব্বীয় ও কেনানীয়দের সমস্ত শহরে গেলেন। শেষে তাঁরা এহুদার দক্ষিণ দিকের বের্‌-শেবাতে গেলেন। এইভাবে তাঁরা গোটা দেশটা ঘুরে নয় মাস বিশ দিন পরে জেরুজালেমে ফিরে আসলেন। যোয়াব বাদশাহ্‌র কাছে লোকদের সংখ্যার হিসাব দিলেন। তাতে দেখা গেল, তলোয়ার চালাতে পারে এমন বলবান লোক ইসরাইলে রয়েছে আট লক্ষ আর এহুদাতে রয়েছে পাঁচ লক্ষ। লোকদের গণনা করবার পরে দাউদের বিবেকে আঘাত লাগল। তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “আমি এই কাজ করে ভীষণ গুনাহ্‌ করেছি। হে মাবুদ, মিনতি করি, তুমি তোমার গোলামের এই অন্যায় দূর করে দাও। আমি খুবই বোকামির কাজ করেছি।” পরের দিন সকালে দাউদ ঘুম থেকে উঠলে পর তাঁর দর্শক নবী গাদের উপর মাবুদের এই কালাম নাজেল হল, “তুমি গিয়ে দাউদকে এই কথা বল, ‘আমি মাবুদ বলছি যে, আমি তোমার জন্য তিনটি শাস্তি ঠিক করেছি। তুমি তার মধ্য থেকে যেটা বেছে নেবে আমি তোমার প্রতি তা-ই করব।’ ” গাদ তখন দাউদের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনার দেশে কি সাত বছর ধরে দুর্ভিক্ষ হবে? নাকি আপনি শত্রুদের তাড়া খেয়ে তিন মাস পালিয়ে বেড়াবেন? নাকি তিন দিন ধরে আপনার দেশে মহামারী চলবে? যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁকে আমি কি জবাব দেব আপনি এখন চিন্তা করে আমাকে বলুন।” তখন দাউদ গাদকে বললেন, “আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমি যেন মানুষের হাতে না পড়ি; তার চেয়ে বরং আসুন, আমরা মাবুদের হাতে পড়ি, কারণ তাঁর মমতা অসীম।” মাবুদ তখন সকাল থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট করা সময় পর্যন্ত ইসরাইলের উপর এক মহামারী পাঠিয়ে দিলেন। তাতে দান থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত গোটা দেশের লোকদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোক মারা গেল। জেরুজালেম ধ্বংস করবার জন্য ফেরেশতা যখন হাত বাড়ালেন তখন মাবুদ সেই ভীষণ শাস্তি দেওয়া থেকে মন ফিরালেন। যে ফেরেশতা লোকদের ধ্বংস করছিলেন তিনি তাঁকে বললেন, “থাক্‌, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার হাত গুটিয়ে নাও।” সেই সময় মাবুদের ফেরেশতা যিবূষীয় অরৌণার খামারের কাছে ছিলেন। যে ফেরেশতা লোকদের আঘাত করছিলেন দাউদ তাঁকে দেখে মাবুদকে বললেন, “গুনাহ্‌ এবং অন্যায় করেছি আমি। ওরা তো ভেড়ার মত। ওরা কি করেছে? কাজেই আমাকে ও আমার পিতার বংশকে তুমি শাস্তি দাও।” সেই দিন গাদ দাউদের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি যিবূষীয় অরৌণার খামারে গিয়ে আল্লাহ্‌র উদ্দেশে সেখানে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করুন।” তখন দাউদ মাবুদের হুকুম মতই গাদের কথা অনুসারে সেখানে গেলেন। অরৌণা যখন বাদশাহ্‌ ও তাঁর লোকদের তার দিকে আসতে দেখল তখন সে গিয়ে বাদশাহ্‌র সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সালাম জানাল। অরৌণা বলল, “আমার প্রভু মহারাজ তাঁর গোলামের কাছে কি জন্য এসেছেন?” জবাবে দাউদ বললেন, “মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করবার জন্য আমি তোমার খামারটা কিনে নিতে চাই, যাতে লোকদের উপরে আসা এই মহামারীটা থেমে যায়।” অরৌণা দাউদকে বলল, “আমার প্রভু মহারাজের যা ভাল মনে হয় তা-ই আমার এখান থেকে নিয়ে কোরবানী করুন। পোড়ানো-কোরবানীর জন্য এখানে ষাঁড় রয়েছে আর কাঠের জন্য রয়েছে ফসল মাড়াইয়ের যন্ত্র ও ষাঁড়গুলোর জোয়াল। হে মহারাজ, অরৌণা বাদশাহ্‌কে এই সবই দিচ্ছে।” অরৌণা তাঁকে আরও বলল, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ যেন আপনার কোরবানী কবুল করেন।” জবাবে বাদশাহ্‌ অরৌণাকে বললেন, “না, তা হবে না। আমি নিশ্চয়ই দাম দিয়ে এগুলো কিনে নেব। বিনামূল্যে পাওয়া এমন কোন কিছু আমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে দেব না।” এই বলে দাউদ পঞ্চাশ শেখেল রূপা দিয়ে সেই খামারটা এবং ষাঁড়গুলো কিনে নিলেন। তারপর তিনি সেখানে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দিলেন। এইভাবে দেশের জন্য মুনাজাত করা হলে পর মাবুদ তা শুনলেন আর ইসরাইল দেশের মহামারী থেমে গেল। বাদশাহ্‌ দাউদ বুড়ো হয়ে গেলেন এবং তাঁর বয়সও অনেক হয়ে গেল। তাঁর শরীর অনেক কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেও তা আর গরম হত না। সেইজন্য তাঁর কর্মচারীরা তাঁকে বলল, “আমাদের প্রভু মহারাজের জন্য আমরা একজন যুবতী অবিবাহিতা মেয়ের তালাশ করি। সে বাদশাহ্‌র কাছে থেকে তাঁর সেবা-যত্ন করুক। আমাদের প্রভু মহারাজের শরীর যাতে গরম হয় সেইজন্য সে তাঁর বুকের কাছে শুয়ে থাকুক।” তাতে তারা গোটা ইসরাইল দেশে একটা সুন্দরী মেয়ের তালাশ করতে লাগল। পরে তারা শূনেমীয়া অবীশগকে পেল এবং তাকে বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেল। মেয়েটি খুব সুন্দরী ছিল। সে বাদশাহ্‌র কাছে থেকে তাঁর সেবা-যত্ন করতে লাগল, কিন্তু বাদশাহ্‌ তার সংগে সহবাস করলেন না। দাউদের স্ত্রী হগীতের ছেলে আদোনিয় বড়াই করে বলতে লাগল, “আমিই বাদশাহ্‌ হব।” এই বলে সে কতগুলো রথ ও ঘোড়সওয়ার যোগাড় করে নিল এবং তার আগে আগে যাবার জন্য পঞ্চাশজন লোকও নিযুক্ত করল। তার বাবা কোন কাজে তাকে কখনও বাধা দেন নি, বলেন নি, “কেন তুমি এই কাজ করেছ?” সে অবশালোমের মত দেখতে সুন্দর ছিল; তার জন্ম হয়েছিল অবশালোমের পরে। সরূয়ার ছেলে যোয়াব ও ইমাম অবিয়াথরের সংগে আদোনিয় পরামর্শ করল, আর তাঁরাও তার পক্ষ হয়ে তাকে সাহায্য করলেন। কিন্তু ইমাম সাদোক যিহোয়াদার ছেলে বনায়, নবী নাথন, শিমিয়ি, রেয়ি এবং দাউদের বীর যোদ্ধারা আদোনিয়ের পক্ষে যোগ দিলেন না। ঐন্‌-রোগেলের পাশে সোহেলৎ পাথরের কাছে আদোনিয় কতগুলো ভেড়া, ষাঁড় এবং মোটাসোটা বাছুর কোরবানী দিয়ে তার সব ভাইদের, অর্থাৎ বাদশাহ্‌র ছেলেদের ও এহুদার সমস্ত রাজকর্মচারীদের দাওয়াত করল। কিন্তু সে নবী নাথন, বনায়, দাউদের বীর যোদ্ধাদের আর তার ভাই সোলায়মানকে দাওয়াত করল না। তখন নাথন সোলায়মানের মা বৎশেবাকে বললেন, “আমাদের প্রভু দাউদের অজান্তে হগীতের ছেলে আদোনিয় যে বাদশাহ্‌ হয়েছে তা কি আপনি শোনেন নি? আপনি কেমন করে আপনার নিজের ও আপনার ছেলে সোলায়মানের প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন আমি এখন আপনাকে সেই পরামর্শ দিচ্ছি। আপনি এখনই বাদশাহ্‌ দাউদের কাছে গিয়ে বলুন, ‘আমার প্রভু মহারাজ, আপনার বাঁদীর কাছে কি আপনি এই বলে ওয়াদা করেন নি যে, আপনার পরে নিশ্চয়ই আপনার ছেলে সোলায়মানই বাদশাহ্‌ হবে এবং সে-ই আপনার সিংহাসনে বসবে? তাহলে কেন আদোনিয় বাদশাহ্‌ হয়েছে?’ আপনি যখন বাদশাহ্‌র সংগে কথা বলতে থাকবেন তখন আমিও সেখানে গিয়ে আপনার কথায় সায় দেব।” তখন বৎশেবা বাদশাহ্‌র সংগে দেখা করবার জন্য তাঁর ঘরে গেলেন। সেই সময় বাদশাহ্‌ খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন এবং শূনেমীয়া অবীশগ তাঁর দেখাশোনা করছিল। বৎশেবা বাদশাহ্‌র সামনে উবুড় হয়ে সালাম জানালেন। বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি চাও?” বৎশেবা তাঁকে বললেন, “হে আমার প্রভু, আপনি নিজেই আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে কসম খেয়ে আপনার এই বাঁদীকে বলেছিলেন যে, আপনার ছেলে সোলায়মানই আপনার পরে বাদশাহ্‌ হবে এবং সে-ই আপনার সিংহাসনে বসবে। কিন্তু এখন আদোনিয় বাদশাহ্‌ হয়েছে আর আপনি, আমার প্রভু মহারাজ, এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। সে অনেক গরু, মোটাসোটা বাছুর ও ভেড়া কোরবানী দিয়েছে এবং বাদশাহ্‌র সব ছেলেদের, ইমাম অবিয়াথরকে ও সেনাপতি যোয়াবকে দাওয়াত করেছে, কিন্তু আপনার গোলাম সোলায়মানকে সে দাওয়াত করে নি। হে আমার প্রভু মহারাজ, সমস্ত ইসরাইলের চোখ আপনার উপর রয়েছে। তারা আপনার কাছ থেকে জানতে চায় আপনার পরে কে আমার প্রভু মহারাজের সিংহাসনে বসবে। তা না হলে যখনই আমার প্রভু মহারাজ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবেন তখনই আমাকে ও আমার ছেলে সোলায়মানকে দোষী বলে ধরা হবে।” বাদশাহ্‌র সংগে বৎশেবার কথা শেষ হতে না হতেই নবী নাথন সেখানে উপস্থিত হলেন। কেউ একজন বাদশাহ্‌কে বলল, “নবী নাথন এখানে এসেছেন।” তখন নাথন বাদশাহ্‌র সামনে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তারপর তিনি বাদশাহ্‌কে বললেন, “হে আমার প্রভু মহারাজ, আপনি কি ঘোষণা করেছেন যে, আপনার পরে আদোনিয় বাদশাহ্‌ হবে, আর সে-ই আপনার সিংহাসনে বসবে? সে তো আজ গিয়ে অনেক ষাঁড়, মোটাসোটা বাছুর এবং ভেড়া কোরবানী দিয়ে বাদশাহ্‌র সব ছেলেদের, সেনাপতিদের এবং ইমাম অবিয়াথরকে দাওয়াত করেছে। এখন তারা তার সংগে খাওয়া-দাওয়া করছে আর বলছে, ‘বাদশাহ্‌ আদোনিয় চিরজীবী হোন।’ আপনার গোলাম আমাকে, ইমাম সাদোককে, যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে এবং আপনার গোলাম সোলায়মানকে সে দাওয়াত করে নি। আমার প্রভু মহারাজের পরে কে সিংহাসনে বসবে তা কি আমার প্রভু মহারাজ তাঁর গোলামদের না জানিয়েই ঠিক করেছেন?” তখন বাদশাহ্‌ দাউদ বললেন, “বৎশেবাকে ডাক।” তাতে বৎশেবা বাদশাহ্‌র সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাদশাহ্‌ তখন কসম খেয়ে বললেন, “যিনি আমাকে সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, সেই আল্লাহ্‌র কসম যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে যে কসম আমি তোমার কাছে খেয়েছিলাম আজ আমি নিশ্চয়ই তা পালন করব। তোমার ছেলে সোলায়মান আমার পরে বাদশাহ্‌ হবে আর সে-ই আমার জায়গায় সিংহাসনে বসবে।” তখন বৎশেবা মাটিতে উবুড় হয়ে সালাম জানিয়ে বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমার প্রভু মহারাজ দাউদ চিরজীবী হোন।” বাদশাহ্‌ দাউদ বললেন, “ইমাম সাদোক, নবী নাথন এবং যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে আমার কাছে ডেকে আন।” তাঁরা বাদশাহ্‌র কাছে আসলেন। বাদশাহ্‌ তাঁদের বললেন, “আপনারা আমার রক্ষীদলকে সংগে নিন এবং আমার ছেলে সোলায়মানকে আমার নিজের খ"চরে বসিয়ে তাকে নিয়ে জিহোন উপত্যকায় যান। ইমাম সাদোক ও নবী নাথন সেখানে তাকে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করুন। তারপর আপনারা শিংগা বাজিয়ে চিৎকার করে বলুন, ‘বাদশাহ্‌ সোলায়মান চিরজীবী হোন।’ এর পর আপনারা তার পিছনে পিছনে ফিরে আসবেন। সে এসে আমার সিংহাসনে বসবে এবং আমার জায়গায় রাজত্ব করবে। আমি তাকে ইসরাইল ও এহুদার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলাম।” তখন যিহোয়াদার ছেলে বনায় বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমিন। আমাদের প্রভু মহারাজের মাবুদ আল্লাহ্‌ তা-ই করুন। মাবুদ যেমন আমার প্রভু মহারাজের সংগে থেকেছেন তেমনি সোলায়মানের সংগেও থাকুন এবং আমার প্রভু বাদশাহ্‌ দাউদের রাজ্যের চেয়েও তাঁর রাজ্য আরও গৌরবযুক্ত করুন!” তখন ইমাম সাদোক, নবী নাথন, যিহোয়াদার ছেলে বনায়, করেথীয় ও পলেথীয়রা গিয়ে সোলায়মানকে বাদশাহ্‌ দাউদের খ"চরে বসিয়ে জিহোনে নিয়ে গেলেন। ইমাম সাদোক পবিত্র তাম্বু থেকে তেলের শিংগাটা নিয়ে এসে সোলায়মানকে অভিষেক করলেন। তারপর তাঁরা তূরী বাজালেন এবং সমস্ত লোকেরা চিৎকার করে বলল, “বাদশাহ্‌ সোলায়মান চিরজীবী হোন।” তারপর সমস্ত লোক বাঁশী বাজাতে বাজাতে এবং খুব আনন্দ করতে করতে সোলায়মানের পিছনে পিছনে ফিরে আসল। তারা এমনভাবে আনন্দ করল যে, তার শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। সেই সময় আদোনিয় ও সমস্ত দাওয়াতী লোকেরা খাওয়ার শেষের দিকে সেই শব্দ শুনল। তূরীর আওয়াজ শুনে যোয়াব জিজ্ঞাসা করলেন, “শহরে এই সব গোলমাল হচ্ছে কেন?” তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই ইমাম অবিয়াথরের ছেলে যোনাথন সেখানে উপস্থিত হল। আদোনিয় তাকে বলল, “আসুন, আসুন। আপনি তো ভাল লোক, নিশ্চয়ই ভাল সংবাদ এনেছেন।” জবাবে যোনাথন বলল, “মোটেই না। আমাদের প্রভু মহারাজ দাউদ সোলায়মানকে বাদশাহ্‌ করেছেন। বাদশাহ্‌ তাঁর সংগে ইমাম সাদোক, নবী নাথন, যিহোয়াদার ছেলে বনায়, করেথীয় ও পলেথীয়দের পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাঁকে বাদশাহ্‌র খ"চরের উপর বসিয়েছেন, আর ইমাম সাদোক ও নবী নাথন জিহোনে তাঁকে রাজপদে অভিষেক করেছেন। সেখান থেকে লোকেরা আনন্দ করতে করতে ফিরে গিয়েছে আর শহরে সেই গোলমালই হচ্ছে। সেই আওয়াজই আপনারা শুনতে পাচ্ছেন। এই কথা শুনে আদোনিয়ের দাওয়াতী সব লোকেরা খুব ভয় পেল এবং উঠে যে যার পথে চলে গেল। কিন্তু আদোনিয় সোলায়মানের ভয়ে গিয়ে কোরবানগাহের শিং ধরে রইল। তখন সোলায়মানকে কেউ একজন বলল যে, আদোনিয় তাঁর ভয়ে কোরবানগাহের শিং আঁকড়ে ধরেছে। সে বলেছে, “বাদশাহ্‌ সোলায়মান আজ আমার কাছে কসম খান যে, তিনি তাঁর গোলামকে হত্যা করবেন না।” জবাবে সোলায়মান বললেন, “সে যদি নিজেকে ভাল লোক হিসাবে দেখাতে পারে তবে তার মাথার একটা চুলও মাটিতে পড়বে না; কিন্তু যদি তার মধ্যে খারাপ কিছু পাওয়া যায় তবে সে মরবে।” এই বলে বাদশাহ্‌ সোলায়মান লোক পাঠিয়ে দিলেন আর তারা গিয়ে আদোনিয়কে কোরবানগাহ্‌ থেকে নিয়ে আসল। আদোনিয় এসে বাদশাহ্‌ সোলায়মানের সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ল। সোলায়মান বললেন, “তুমি নিজের ঘরে চলে যাও।” মৃত্যুর সময় কাছে আসলে পর দাউদ তাঁর ছেলে সোলায়মানকে এই সব নির্দেশ দিয়ে বললেন, “দুনিয়ার সকলেই যে পথে যায় আমিও এখন সেই পথে যাচ্ছি। কাজেই তুমি শক্ত হও, নিজেকে উপযুক্ত পুরুষ হিসাবে দেখাও। তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত তুমি তাঁর পথে চলবে এবং মূসার শরীয়তে লেখা মাবুদের সব নিয়ম, হুকুম, নির্দেশ ও দাবি মেনে চলবে। এতে তুমি যা কিছু কর না কেন এবং যেখানেই যাও না কেন সফল হতে পারবে। তাহলে মাবুদ যে ওয়াদা আমার কাছে করেছেন তা পূরণ করবেন। সেই ওয়াদা হল, ‘যদি তোমার বংশধরেরা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বস্তভাবে আমার সামনে চলাফেরা করবার জন্য সাবধানে জীবন কাটায় তবে ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য তোমার বংশে লোকের অভাব হবে না।’ “সরূয়ার ছেলে যোয়াব আমার প্রতি যা করেছে এবং ইসরাইলীয় সৈন্যদলের দুই সেনাপতির প্রতি, অর্থাৎ নেরের ছেলে অবনের ও যেথরের ছেলে অমাসার প্রতি যা করেছে তা তো তুমি জানই। সে তাদের খুন করেছে, শান্তির সময়েও যুদ্ধের সময়ের মত করে সে তাদের রক্তপাত করেছে আর সেই রক্ত তাঁর কোমর-বাঁধনিতে ও পায়ের জুতাতে লেগেছে। তুমি তার সংগে বুদ্ধি করে চলবে, তবে বুড়ো বয়সে তুমি তাকে শান্তিতে কবরে যেতে দেবে না। কিন্তু গিলিয়দের বর্সিল্লয়ের ছেলেদের প্রতি বিশ্বস্ত থেকো। তোমার টেবিলে যারা তোমার সংগে খাওয়া-দাওয়া করে তাদের মধ্যে তুমি তাদেরও স্থান দিয়ো। তোমার ভাই অবশালোমের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার সময় তারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। মনে রেখো, বহুরীমের বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গেরার ছেলে শিমিয়ি তোমার সংগে আছে। আমি যেদিন মহনয়িমে যাই সেই দিন সে আমাকে ভীষণ বদদোয়া দিয়েছিল। জর্ডানে সে আমার সংগে দেখা করতে আসলে পর আমি মাবুদের নামে তার কাছে কসম খেয়েছিলাম যে, আমি তাকে হত্যা করব না। কিন্তু এখন তুমি তাকে নির্দোষ বলে মনে কোরো না। তুমি বুদ্ধিমান; তার প্রতি তুমি কি করবে তা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। তার বুড়ো বয়সে রক্তপাতের মধ্য দিয়েই তাকে কবরে পাঠিয়ে দেবে।” এর পর দাউদ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে দাফন করা হল। তিনি ইসরাইলের উপরে চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন্ত সাত বছর হেবরনে আর তেত্রিশ বছর জেরুজালেমে। পরে সোলায়মান তাঁর পিতা দাউদের সিংহাসনে বসলেন এবং তাঁর রাজত্ব শক্তভাবে স্থাপিত হল। তখন সে বলল, “আপনি তো জানেন রাজ্যটা আমারই ছিল। সমস্ত ইসরাইলীয়রা ভেবেছিল আমি বাদশাহ্‌ হব। কিন্তু অবস্থাটা বদলে গিয়ে রাজ্যটা আমার ভাইয়ের হাতে গেছে, কারণ এটা মাবুদের কাছ থেকেই সে পেয়েছে। এখন আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।” তিনি বললেন, “বল।” সে তখন বলতে লাগল, “আপনি বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে বলুন যেন তিনি শূনেমীয়া অবীশগকে আমার সংগে বিয়ে দেন। তিনি আপনার কথা ফেলবেন না।” জবাবে বৎশেবা বললেন, “খুব ভাল, আমি তোমার কথা বাদশাহ্‌কে বলব।” বৎশেবা যখন আদোনিয়ের কথা বলবার জন্য বাদশাহ্‌ সোলায়মানের কাছে গেলেন তখন বাদশাহ্‌ উঠে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে সালাম জানালেন এবং তারপর তাঁর সিংহাসনে বসলেন। বাদশাহ্‌ তাঁর মায়ের জন্য একটা আসন আনিয়ে তাঁর ডান পাশে রাখলেন এবং তাঁর মা সেখানে বসলেন। বৎশেবা বললেন, “আমি তোমাকে একটা ছোট্ট অনুরোধ করব; তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না।” জবাবে বাদশাহ্‌ বললেন, “বল মা, আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব না।” বৎশেবা তখন বললেন, “তোমার ভাই আদোনিয়ের সংগে শূনেমীয়া অবীশগের বিয়ে দেওয়া হোক।” জবাবে বাদশাহ্‌ সোলায়মান তাঁর মাকে বললেন, “আদোনিয়ের জন্য কেন তুমি শূনেমীয়া অবীশগকে চাইছ? তুমি তার জন্য রাজ্যটাও তো চাইতে পারতে, কারণ সে আমার বড় ভাই; জ্বী, তার জন্য, ইমাম অবিয়াথরের জন্য আর সরূয়ার ছেলে যোয়াবের জন্যও তা চাইতে পারতে।” এর পর বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের নামে কসম খেয়ে বললেন, “এই অনুরোধের জন্য যদি আদোনিয়ের প্রাণ নেওয়া না হয় তবে মাবুদ যেন আমাকে শাস্তি দেন, আর তা ভীষণভাবেই দেন। যিনি আমার পিতা দাউদের সিংহাসনে আমাকে শক্তভাবে স্থাপিত করেছেন এবং তাঁর ওয়াদা অনুসারে আমার জন্য একটা রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি, আজই আদোনিয়কে হত্যা করা হবে।” তারপর বাদশাহ্‌ সোলায়মান যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে হুকুম দিলেন, আর বনায় আদোনিয়কে হত্যা করলেন। পরে বাদশাহ্‌ ইমাম অবিয়াথরকে বললেন, “আপনি অনাথোতে নিজের জায়গায় ফিরে যান। আপনি মৃত্যুর যোগ্য, কিন্তু এখন আমি আপনাকে হত্যা করব না, কারণ আপনি আমার পিতা দাউদের সময়ে আল্লাহ্‌ মালিকের সিন্দুকটা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমার বাবার সমস্ত দুঃখ-কষ্টের ভাগী হয়েছিলেন।” এইভাবে সোলায়মান অবিয়াথরকে মাবুদের ইমাম পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। মাবুদ শীলোতে আলীর বংশ সম্বন্ধে যা বলেছিলেন তাঁর সেই কথা এইভাবে পূর্ণ হল। এই সব খবর যোয়াবের কানে গেল। তিনি অবশালোমের পক্ষে না গেলেও আদোনিয়ের পক্ষে গিয়েছিলেন, তাই তিনি পালিয়ে মাবুদের তাম্বুতে গিয়ে কোরবানগাহের শিং ধরে রইলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে বলা হল যে, যোয়াব পালিয়ে মাবুদের তাম্বুতে গেছেন এবং কোরবানগাহের কাছে আছেন। তখন সোলায়মান যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে এই হুকুম দিলেন, “আপনি গিয়ে তাঁকে হত্যা করুন।” কাজেই বনায় মাবুদের তাম্বুতে ঢুকে যোয়াবকে বললেন, “বাদশাহ্‌ আপনাকে বের হয়ে আসতে বলেছেন।” কিন্তু যোয়াব বললেন, “না, আমি এখানেই মরব।” বনায় বাদশাহ্‌কে সেই খবর জানিয়ে বললেন, “যোয়াব আমাকে এই জবাব দিয়েছেন।” তখন বাদশাহ্‌ বনায়কে এই হুকুম দিলেন, “তিনি যা বলেছেন তা-ই করুন। তাঁকে হত্যা করে দাফন করে দিন। যোয়াব যে নির্দোষ লোকদের রক্তপাত করেছেন তার দোষ আপনি আমার ও আমার বাবার বংশ থেকে এইভাবে দূর করে দিন। যে রক্তপাত তিনি করেছেন তার শোধ মাবুদ নেবেন, কারণ আমার পিতা দাউদের অজান্তে তিনি দু’জন লোককে হামলা করে হত্যা করেছিলেন। তাঁরা হলেন ইসরাইলের সৈন্যদলের সেনাপতি নেরের ছেলে অবনের আর এহুদার সৈন্যদলের সেনাপতি যেথরের ছেলে অমাসা। এই দু’জনই ছিলেন তাঁর চেয়ে আরও খাঁটি এবং আরও ভাল লোক। তাঁদের রক্তপাতের দোষ যোয়াবের ও তাঁর বংশের লোকদের মাথার উপরে চিরকাল থাকুক। কিন্তু দাউদ ও তাঁর বংশের লোকদের উপর এবং তাঁর পরিবার ও তাঁর সিংহাসনের উপর মাবুদের শান্তি চিরকাল থাকুক।” তখন যিহোয়াদার ছেলে বনায় গিয়ে যোয়াবকে হত্যা করলেন। তাঁকে মরুভূমিতে তাঁর নিজের বাড়ীতে দাফন করা হল। বাদশাহ্‌ তখন যোয়াবের জায়গায় যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করলেন এবং অবিয়াথরের জায়গায় বসালেন ইমাম সাদোককে। তারপর বাদশাহ্‌ লোক পাঠিয়ে শিমিয়িকে ডেকে এনে বললেন, “তুমি জেরুজালেমে একটা বাড়ী তৈরী করে সেখানেই থাকবে, অন্য কোথাও তোমার যাওয়া চলবে না। যেদিন তুমি সেখান থেকে বের হয়ে কিদ্রোণ উপত্যকা পার হবে সেই দিন তুমি নিশ্চয় করে জেনে রেখো যে, তোমাকে মরতেই হবে; তোমার রক্তপাতের দোষ তোমার নিজের মাথার উপরেই পড়বে।” জবাবে শিমিয়ি বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনি ভালই বলেছেন। আমার প্রভু মহারাজ যা বললেন আপনার গোলাম তা-ই করবে।” এর পর শিমিয়ি অনেক দিন জেরুজালেমে রইল। কিন্তু তিন বছর পরে শিমিয়ির দু’জন গোলাম মাখার ছেলে গাতের বাদশাহ্‌ আখীশের কাছে পালিয়ে গেল। শিমিয়িকে বলা হল যে, তার গোলামেরা গাৎ শহরে আছে। তখন শিমিয়ি তার গাধার উপর গদি চাপিয়ে তার গোলামদের তালাশে গাতে আখীশের কাছে গেল এবং সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনল। পরে সোলায়মানকে জানানো হল যে, শিমিয়ি জেরুজালেম থেকে গাতে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। বাদশাহ্‌ তখন শিমিয়িকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “আমি কি মাবুদের নামে তোমাকে কসম খাইয়ে সাবধান করে দিই নি যে, যেদিন তুমি বেরিয়ে আর কোথাও যাবে সেই দিন তোমাকে নিশ্চয়ই মরতে হবে? সেই সময় তুমি আমাকে বলেছিলে যে, আমি ভালই বলেছি আর তুমি সেই মতই চলবে। তাহলে কেন তুমি মাবুদের কাছে খাওয়া কসম ও আমার হুকুম পালন কর নি?” সোলায়মান শিমিয়িকে আরও বললেন, “আমার পিতা দাউদের প্রতি তুমি যে সব অন্যায় করেছ তা তো তোমার অন্তর জানে। এখন মাবুদই তোমাকে তোমার অন্যায় কাজের প্রতিফল দেবেন। কিন্তু বাদশাহ্‌ সোলায়মানের উপরে দোয়া থাকবে, আর দাউদের সিংহাসন মাবুদের সামনে চিরকাল অটল থাকবে।” বাদশাহ্‌ এর পর যিহোয়াদার ছেলে বনায়কে হুকুম দিলেন আর বনায় গিয়ে শিমিয়িকে হত্যা করলেন। এইভাবে সোলায়মানের হাতে রাজ্যটা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। সোলায়মান মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের মেয়েকে বিয়ে করে তাঁর সংগে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। সোলায়মানের রাজবাড়ী, মাবুদের ঘর এবং জেরুজালেমের চারপাশের দেয়াল গাঁথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর স্ত্রীকে দাউদ-শহরেই রাখলেন। লোকেরা তখনও এবাদতের উঁচু স্থানগুলোতে তাদের পশু-কোরবানী দিত, কারণ তখনও মাবুদের এবাদতের জন্য কোন ঘর তৈরী করা হয় নি। সোলায়মান মাবুদকে মহব্বত করতেন, সেইজন্য তাঁর বাবা দাউদের হুকুম অনুসারে চলাফেরা করতেন; কিন্তু তিনি এবাদতের উঁচু স্থানগুলোতে পশু-কোরবানী দিতেন এবং ধূপ জ্বালাতেন। বাদশাহ্‌ একদিন পশু-কোরবানীর জন্য গিবিয়োনে গিয়েছিলেন, কারণ কোরবানীর জন্য সেখানকার এবাদতের উঁচু স্থানটা ছিল প্রধান। সোলায়মান সেখানে এক হাজার পশু দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী করলেন। গিবিয়োনে রাতের বেলায় মাবুদ স্বপ্নের মধ্যে সোলায়মানের কাছে উপস্থিত হলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, “তুমি আমার কাছে যা চাইবে আমি তা-ই তোমাকে দেব।” জবাবে সোলায়মান বললেন, “তোমার গোলাম আমার বাবাকে তুমি অনেক বিশ্বস্ততা দেখিয়েছ, কারণ তিনি তোমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন এবং খাঁটি ও সৎ ছিলেন। আজ তাঁর সিংহাসনে বসবার জন্য তুমি তাঁকে একটি ছেলে দিয়েছ এবং এইভাবে তোমার সেই সীমাহীন বিশ্বস্ততা তাঁকে দেখিয়ে যাচ্ছ। “হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, আমার পিতা দাউদের জায়গায় তুমি এখন তোমার গোলামকে বাদশাহ্‌ করেছ। কিন্তু বয়স আমার খুবই কম, তাই জানি না কি করে আমার কর্তব্য পালন করতে হবে। এখানে তোমার গোলাম তোমার বেছে নেওয়া বান্দাদের মধ্যে রয়েছে। তারা এমন একটা মহাজাতি যে, তাদের সংখ্যা গণনা করা যায় না। সেইজন্য তোমার বান্দাদের শাসন করবার জন্য এবং কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল তা জানবার জন্য তুমি তোমার গোলামের অন্তরে বুঝবার ক্ষমতা দাও; কারণ কার সাধ্য আছে তোমার এই মহাজাতিকে শাসন করে?” সোলায়মান এটাই চেয়েছেন দেখে মাবুদ খুশী হলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, “তুমি অনেক আয়ু, কিংবা নিজের জন্য ধন-সম্পদ, কিংবা তোমার শত্রুদের মৃত্যু না চেয়ে যখন সুবিচার করবার জন্য বুঝবার ক্ষমতা চেয়েছ, তখন তুমি যা চেয়েছ তা-ই আমি তোমাকে দেব। আমি তোমার অন্তরে এমন জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি দিলাম যার জন্য দেখা যাবে যে, এর আগে তোমার মত আর কেউ ছিল না আর পরেও হবে না। এছাড়া যা তুমি চাও নি তাও আমি তোমাকে দিলাম। আমি তোমাকে এমন ধন-দৌলত ও সম্মান দিলাম যার ফলে তোমার জীবনকালে বাদশাহ্‌দের মধ্যে আর কেউ তোমার সমান হবে না। তোমার পিতা দাউদের মত করে যদি তুমি আমার সব নিয়ম ও হুকুম পালন কর এবং আমার পথে চল তবে আমি তোমাকে অনেক আয়ু দেব।” এর পর সোলায়মান জেগে উঠলেন আর বুঝতে পারলেন যে, ওটা একটা স্বপ্ন ছিল। পরে সোলায়মান জেরুজালেমে ফিরে গিয়ে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে দাঁড়ালেন এবং অনেক পশু দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দিলেন। তারপর তাঁর সমস্ত কর্মচারীদের জন্য একটা মেজবানী দিলেন। এক সময়ে দু’জন বেশ্যা স্ত্রীলোক এসে বাদশাহ্‌র সামনে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “হে হুজুর, এই স্ত্রীলোকটি এবং আমি একই ঘরে থাকি। সে সেখানে থাকবার সময় আমার একটি ছেলে হল। আমার ছেলের জন্মের তিন দিন পরে এই স্ত্রীলোকটিরও একটি ছেলে হল। ঘরে আর কেউ ছিল না, কেবল আমরা দু’জনই ছিলাম। “রাতের বেলায় এই স্ত্রীলোকটির চাপে তার ছেলেটি মারা গেল। মাঝ রাতে আপনার বাঁদী আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন সে উঠে আমার পাশ থেকে আমার ছেলেটিকে নিয়ে নিজের বুকের কাছে রাখল আর তার মরা ছেলেটিকে নিয়ে আমার বুকের কাছে রাখল। শেষ রাতে আমার ছেলেকে দুধ খাওয়াতে উঠে দেখলাম ছেলেটি মরা। সকালের আলোতে আমি যখন তাকে ভাল করে দেখলাম তখন বুঝলাম সে আমার নিজের ছেলে নয়।” তখন অন্য স্ত্রীলোকটি বলল, “না, না, জীবিত ছেলেটি আমার আর মরাটা তোমার।” কিন্তু প্রথমজন জোর দিয়ে বলল, “না, মরাটা তোমার আর জীবিতটা আমার।” এইভাবে বাদশাহ্‌র সামনেই তারা কথা কাটাকাটি করতে লাগল। বাদশাহ্‌ বললেন, “এ বলছে, ‘আমার ছেলে বেঁচে আছে আর তোমারটা মারা গেছে।’ আবার ও বলছে, ‘না, না, তোমার ছেলে মারা গেছে আমারটা বেঁচে আছে।’ ” তখন বাদশাহ্‌ বললেন, “আমাকে একটা তলোয়ার দাও।” তখন বাদশাহ্‌র কাছে একটা তলোয়ার আনা হল। তিনি হুকুম দিলেন, “জীবিত ছেলেটিকে কেটে দু’ভাগ কর এবং একে অর্ধেক আর ওকে অর্ধেক দাও।” যার ছেলেটি বেঁচে ছিল ছেলের জন্য সেই স্ত্রীলোকের মন ব্যাকুল হওয়াতে সে বাদশাহ্‌কে বলল, “হে হুজুর, মিনতি করি, ওকেই আপনি জীবিত ছেলেটি দিয়ে দিন; ছেলেটিকে হত্যা করবেন না।” কিন্তু অন্য স্ত্রীলোকটি বলল, “ও তোমারও না হোক আর আমারও না হোক। ওকে কেটে দু’টুকরা কর।” বাদশাহ্‌ তখন তাঁর রায় দিয়ে বললেন, “জীবিত ছেলেটি ঐ প্রথম স্ত্রীলোকটিকে দাও। ওকে কেটো না; ও-ই ওর মা।” বাদশাহ্‌র দেওয়া রায় শুনে ইসরাইলের সকলের মনে বাদশাহ্‌র প্রতি ভয় জেগে উঠল, কারণ তারা দেখতে পেল যে, সুবিচার করবার জন্য তাঁর মনে আল্লাহ্‌র দেওয়া জ্ঞান রয়েছে। বাদশাহ্‌ সোলায়মান গোটা ইসরাইলের উপর রাজত্ব করতেন। এরাই ছিলেন তাঁর প্রধান কর্মচারী: সাদোকের ছেলে অসরিয় ছিলেন বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা ইমাম; শীশার দুই ছেলে ইলীহোরফ ও অহিয় ছিলেন বাদশাহ্‌র লেখক; অহীলুদের ছেলে যিহোশাফট ছিলেন ইতিহাস লেখক; যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন প্রধান সেনাপতি; সাদোক ও অবিয়াথর ছিলেন ইমাম; নাথনের ছেলে অসরিয়ের উপর ছিল বিভিন্ন শাসনকর্তাদের ভার; নাথনের ছেলে সাবূদ ছিলেন বাদশাহ্‌র ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা; অহীশারের উপর ছিল রাজবাড়ীর দেখাশোনার ভার; অব্দের ছেলে অদোনীরামের উপর ছিল সেই সব লোকদের ভার যাদের কাজ করবার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল। সমস্ত ইসরাইলের উপর সোলায়মান বারোজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁরা বাদশাহ্‌ ও রাজপরিবারের জন্য খাবার-দাবারের যোগান দিতেন। তাঁদের প্রত্যেককেই বছরে এক মাস করে খাবারের যোগান দিতে হত। তাঁদের নাম এই: আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় বিন্‌-হূর। মাকসে, শালবীমে, বৈৎ-শেমশে ও এলোন্তবৈৎ-হাননে বিন্‌-দেকর। অরুব্বোতে, সোখোতে ও হেফরের সমস্ত এলাকায় বিন্‌-হেষদ। নাফৎ-দোরের সমস্ত এলাকায় বিন্‌-অবীনাদব। ইনি সোলায়মানের মেয়ে টাফৎকে বিয়ে করেছিলেন। তানকে, মগিদ্দোতে এবং সর্তনের কাছে ও যিষ্রিয়েলের দক্ষিণে বৈৎ-শান শহর থেকে আবেল-মহোলা ও যক্‌মিয়াম পর্যন্ত বৈৎ-শানের সমস্ত এলাকায় অহীলূদের ছেলে বানা। রামোৎ গিলিয়দে বিন্‌-গেবর। তিনি ছিলেন গিলিয়দের মানশার ছেলে যায়ীরের সমস্ত গ্রামের এবং বাশনের অর্গোব এলাকার শাসনকর্তা। অর্গোব এলাকায় ছিল দেয়াল-ঘেরা এবং ব্রোঞ্জের হুড়কা দেওয়া দরজা সুদ্ধ ষাটটা বড় বড় গ্রাম। মহনয়িমে ইদ্দোর ছেলে অহীনাদব। নপ্তালিতে অহীমাস। তিনি সোলায়মানের মেয়ে বাসমৎকে বিয়ে করেছিলেন। আশেরে ও বালোতে হূশয়ের ছেলে বানা। ইষাখরে পারূহের ছেলে যিহোশাফট। বিন্‌ইয়ামীনে এলার ছেলে শিমিয়ি। গিলিয়দে, অর্থাৎ আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনের ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজের দেশে ঊরির ছেলে গেবর। এই এলাকায় তিনিই ছিলেন একমাত্র শাসনকর্তা। এহুদা ও ইসরাইলের লোকসংখ্যা ছিল সাগরের কিনারার বালুকণার মত অসংখ্য। তারা খাওয়া-দাওয়া করে সুখেই ছিল। ফোরাত নদী থেকে শুরু করে মিসর ও ফিলিস্তিনীদের দেশের সীমা পর্যন্ত সমস্ত রাজ্যগুলো সোলায়মানের শাসনের অধীনে ছিল। সোলায়মান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এই দেশগুলো তাঁকে খাজনা দিত এবং তাঁর অধীনে ছিল। সোলায়মানের জন্য প্রতিদিন যে সব খাবার লাগত তা এই: প্রায় সাড়ে পাঁচ টন মিহি ময়দা, প্রায় এগারো টন সুজি, ঘরে খাওয়ানো দশটা গরু, চরে খাওয়ানো বিশটা গরু এবং একশোটা ভেড়া; তাছাড়া হরিণ, কৃষ্ণসার, চিতা হরিণ এবং মোটা-তাজা হাঁস-মুরগী। সোলায়মান ফোরাত নদীর পশ্চিম দিকের সমস্ত রাজ্যগুলো, অর্থাৎ তিপ্‌সহ থেকে গাজা পর্যন্ত রাজত্ব করতেন এবং তার রাজ্যের সব জায়গায় শান্তি ছিল। সোলায়মানের জীবনকালে এহুদা ও ইসরাইল, অর্থাৎ দান থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত সকলেরই নিজের নিজের আংগুর গাছ ও ডুমুর গাছ ছিল আর তারা নিরাপদে বাস করত। সোলায়মানের রথের ঘোড়াগুলোর জন্য ছিল চল্লিশ হাজার ঘর আর বারো হাজার ঘোড়সওয়ার। শাসনকর্তাদের প্রত্যেকে তাঁর পালার মাসে বাদশাহ্‌ সোলায়মান ও তাঁর টেবিলে যারা খেতেন তাঁদের সকলের জন্য খাবারের যোগান দিতেন। তাঁরা খেয়াল রাখতেন যেন কোন কিছুরই অভাব না হয়। রথের ঘোড়া ও অন্যান্য ঘোড়াগুলোর জন্য তাঁদের প্রত্যেকের কাজের ভার অনুসারে তাঁরা যব ও খড় নির্দিষ্ট জায়গায় আনতেন। আল্লাহ্‌ সোলায়মানকে সাগর পারের বালুকণার মত প্রচুর পরিমাণে জ্ঞান, বিচারবুদ্ধি ও বুঝবার ক্ষমতা দান করলেন। পূর্বদেশের এবং মিসরের সমস্ত জ্ঞানী লোকদের চেয়ে সোলায়মানের জ্ঞান ছিল বেশী। সমস্ত লোকের চেয়ে, এমন কি, ইষ্রাহীয় এথন এবং মাহোলের ছেলে হেমন, কল্‌কোল ও দর্দার চেয়েও তিনি বেশী জ্ঞানবান ছিলেন। তাঁর সুনাম আশেপাশের সমস্ত জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি তিন হাজার সৎ উপদেশের কথা বলেছিলেন এবং এক হাজার পাঁচটা গজল রচনা করেছিলেন। তিনি লেবাননের এরস গাছ থেকে শুরু করে দেয়ালের গায়ে গজানো হিস্যোপ গাছ পর্যন্ত সমস্ত গাছের বর্ণনা করেছেন। তিনি জীব-জন্তু, পাখী, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও মাছেরও বর্ণনা করেছেন। দুনিয়ার যে সব বাদশাহ্‌রা সোলায়মানের জ্ঞানের বিষয় শুনেছিলেন তাঁরা তাঁর জ্ঞানপূর্ণ কথা শুনবার জন্য লোকদের পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে সমস্ত জাতির লোক তাঁর কাছে আসত। টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরম যখন শুনলেন যে, সোলায়মানকে তাঁর বাবার জায়গায় রাজপদে অভিষেক করা হয়েছে তখন তাঁর লোকদের তিনি সোলায়মানের কাছে পাঠালেন, কারণ দাউদের সংগে তাঁর সব সময়ই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সোলায়মান হীরমকে বলে পাঠালেন, “আমার পিতা দাউদের বিরুদ্ধে চারদিক থেকে যুদ্ধ হয়েছিল, তাই যতদিন মাবুদ তাঁর শত্রুদের তাঁর পায়ের তলায় না আনলেন ততদিন তিনি তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোন এবাদত-খানা তৈরী করতে পারেন নি। আপনি তো এই সব কথা জানেন। কিন্তু এখন আমার মাবুদ আল্লাহ্‌ সব দিক থেকেই আমাকে শান্তি দিয়েছেন। এখন আমার কোন শত্রু নেই এবং কোন দুর্ঘটনাও ঘটে নি। সেইজন্য আমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে একটা এবাদত-খানা তৈরী করতে চাই। মাবুদ আমার পিতা দাউদকে বলেছিলেন, ‘তোমার যে ছেলেকে আমি সিংহাসনে তোমার জায়গায় বসাব সে-ই আমার উদ্দেশে এবাদত-খানা তৈরী করবে।’ “কাজেই আপনি হুকুম দিন যাতে আমার জন্য লেবানন দেশের এরস গাছ কাটা হয়। অবশ্য আমার লোকেরা আপনার লোকদের সংগে থাকবে এবং আপনি যে মজুরী ঠিক করে দেবেন আমি সেই মজুরীই আপনার লোকদের দেব। আপনার তো জানা আছে যে, গাছ কাটবার কাজে সিডনীয়দের মত পাকা লোক আমাদের মধ্যে কেউ নেই।” সোলায়মানের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে হীরম খুব খুশী হয়ে বললেন, “আজ মাবুদের প্রশংসা হোক, কারণ এই মহান জাতির উপরে রাজত্ব করবার জন্য দাউদকে তিনি এমন একটি জ্ঞানী ছেলে দান করেছেন।” হীরম সোলায়মানকে এই খবর পাঠালেন, “আপনার পাঠানো খবর আমি পেয়েছি। এরস ও বেরস কাঠের ব্যাপারে আপনার সব ইচ্ছাই আমি পূর্ণ করব। আমার লোকেরা সেগুলো লেবানন থেকে নামিয়ে সমুদ্রে আনবে। তারপর তারা সেগুলো দিয়ে ভেলা তৈরী করে সমুদ্রে ভাসিয়ে আপনার নির্দিষ্ট করা জায়গায় নিয়ে যাবে। সেখানে তারা সেগুলো খুলে ফেলবে আর তখন আপনি সেগুলো নিয়ে যেতে পারবেন। আমি চাই যেন আপনি আমার রাজবাড়ীর লোকদের জন্য খাবারের যোগান দেন।” এইভাবে হীরম সোলায়মানের চাহিদামত সমস্ত এরস ও বেরস কাঠ দিতে লাগলেন, আর সোলায়মান হীরমকে তাঁর রাজবাড়ীর লোকদের খাবারের জন্য তিন হাজার ছ’শো টন গম ও চার হাজার আটশো লিটার জলপাইয়ের খাঁটি তেল দিলেন। সোলায়মান এইভাবে বছরের পর বছর তা দিতে থাকলেন। মাবুদ তাঁর ওয়াদা অনুসারে সোলায়মানকে জ্ঞান দিলেন। হীরম ও সোলায়মানের মধ্যে শান্তির সম্বন্ধ ছিল এবং তাঁরা দু’জনে একটা চুক্তি করলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান সমস্ত ইসরাইল থেকে ত্রিশ হাজার লোককে কাজ করতে বাধ্য করলেন। প্রতি মাসে পালা পালা করে তাদের মধ্য থেকে তিনি দশ হাজার লোককে লেবাননে পাঠাতেন। তারা একমাস লেবাননে থাকত আর দু’মাস থাকত নিজের বাড়ীতে। তাদের এই কাজের দেখাশোনার ভার ছিল অদোনীরামের উপর। সোলায়মানের অধীনে ছিল সত্তর হাজার ভারবহনকারী লোক ও পাহাড়ে পাথর কাটবার জন্য আশি হাজার লোক। তাদের কাজের দেখাশোনা করবার জন্য তিন হাজার তিনশো কর্মচারী ছিল। বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিত্তি গাঁথবার জন্য তারা বাদশাহ্‌র হুকুমে খাদ থেকে বড় বড় দামী পাথর কেটে তুলে আনত। সোলায়মান ও হীরমের মিস্ত্রিরা ও গিব্লীয়রা সেই পাথরগুলো সুন্দর করে কেটে এবাদত-খানাটি তৈরী করবার জন্য কাঠ ও পাথর প্রস্তুত করত। মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বেরিয়ে আসবার পর চারশো আশি বছরের সময় বনি-ইসরাইলদের উপর সোলায়মানের রাজত্বের চতুর্থ বছরের সিব মাসে, অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসে সোলায়মান মাবুদের ঘরটি তৈরী করতে শুরু করলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের জন্য যে ঘরটি তৈরী করেছিলেন তা লম্বায় ছিল ষাট হাত, চওড়ায় বিশ হাত ও উচ্চতায় ত্রিশ হাত। বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কামরাটির সামনে যে বারান্দা ছিল সেটি ঘরের চওড়ার মাপ অনুসারে বিশ হাত চওড়া আর ঘরের সামনে থেকে তার লম্বার দিকটা ছিল দশ হাত। ঘরটার দেয়ালের মধ্যে তিনি জানালার মত করে সরু জালি-দেওয়া জায়গা তৈরী করলেন। প্রধান কামরা ও মহাপবিত্র স্থানের তিন পাশের দেয়ালের গা ঘেঁষে তিনি একটা তিন তলা ঘর তৈরী করলেন। তার মধ্যে অনেকগুলো কামরা ছিল। নীচের তলার কামরাগুলো ছিল পাঁচ হাত চওড়া, দ্বিতীয় তলার কামরাগুলো ছিল ছয় হাত চওড়া এবং তৃতীয় তলার কামরাগুলো ছিল সাত হাত চওড়া, কারণ বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের বাইরের দিকের গায়ে কয়েকটা তাক তৈরী করা হয়েছিল। তার ফলে ঐ তিন তলা ঘর তৈরী করবার জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের গায়ে কোন বীম লাগাবার দরকার হল না। খাদের যে সব পাথর কেটে ঠিক করা হয়েছিল কেবল সেগুলোই এনে বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হল। বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরী করবার সময় সেখানে কোন হাতুড়ি, কুড়াল কিংবা অন্য কোন লোহার যন্ত্রপাতির আওয়াজ শোনা গেল না। নীচের তলায় ঢুকবার পথ ছিল বায়তুল-মোকাদ্দসের দক্ষিণ দিকে; সেখান থেকে একটা সিঁড়ি দোতালা এবং তার পরে তিন তলায় উঠে গেছে। এইভাবে তিনি বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরী করেছিলেন এবং তা শেষও করেছিলেন। তিনি এরস কাঠের তক্তা ও বীম দিয়ে তার ছাদও দিয়েছিলেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের তিন পাশের সেই ঘরে তিনি কতগুলো কামরা তৈরী করেছিলেন। সেই কামরাগুলোর প্রত্যেকটার উচ্চতা ছিল পাঁচ হাত এবং এরস কাঠের বীম দিয়ে ঘরের সিলিং তৈরী করা হয়েছিল। সেই বীমগুলোর এক মাথা বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের তাকের উপর রাখা হয়েছিল। সোলায়মানের উপর মাবুদের এই কালাম নাজেল হল, “তুমি যদি আমার নির্দেশ মত চল, আমার সব নিয়ম পালন কর এবং আমার সমস্ত হুকুমের বাধ্য হও তাহলে যে এবাদত-খানাটি তুমি তৈরী করছ তার বিষয়ে আমি তোমার পিতা দাউদের কাছে যা ওয়াদা করেছি তা আমি তোমার মধ্য দিয়ে পূর্ণ করব। আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করব এবং আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের আমি ত্যাগ করব না।” সোলায়মান বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরী করে এইভাবে শেষ করলেন। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত এরস কাঠের তক্তা দিয়ে তিনি দেয়ালের ভিতরের দিকটা ঢেকে দিলেন এবং মেঝেটা ঢেকে দিলেন বেরস কাঠের তক্তা দিয়ে। বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে মহাপবিত্র স্থান নামে একটা ভিতরের কামরা তৈরী করবার জন্য তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের পিছনের অংশের বিশ হাত জায়গা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত এরস কাঠের তক্তা দিয়ে আলাদা করে নিলেন। মহাপবিত্র স্থানের সামনে প্রধান বড় কামরাটি ছিল চল্লিশ হাত লম্বা। বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যেকার এরস কাঠের উপরে লতানো গাছের ফল ও ফোটা ফুল খোদাই করা হল। সব কিছু এরস কাঠের ছিল, কোন পাথর দেখা যাচ্ছিল না। বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি বসাবার জন্য সোলায়মান এইভাবে মহাপবিত্র স্থানটা প্রস্তুত করলেন। সেই স্থানটা ছিল বিশ হাত লম্বা, বিশ হাত চওড়া ও বিশ হাত উঁচু। খাঁটি সোনা দিয়ে তিনি তার ভিতরটা মুড়িয়ে দিলেন এবং ধূপগাহ্‌টাও তিনি এরস কাঠ দিয়ে ঢেকে দিলেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কামরার দেয়াল তিনি খাঁটি সোনা দিয়ে ঢেকে দিলেন এবং মহাপবিত্র স্থানের সামনে সোনার শিকল লাগিয়ে দিলেন। সেই মহাপবিত্র স্থানের দেয়ালও তিনি সোনা দিয়ে ঢেকে দিলেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিতরের সমস্ত জায়গাটা তিনি এইভাবে সোনা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। মহাপবিত্র স্থানের ধূপগাহ্‌ও তিনি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন। মহাপবিত্র স্থানে তিনি সেই কারুবী দু’টি ডানা মেলে দেওয়া অবস্থায় রাখলেন। একটি কারুবীর ডানা এক দেয়াল ও অন্য কারুবীটির ডানা অন্য দেয়াল ছুঁয়ে রইল আর ঘরের মাঝখানে তাদের অন্য ডানা দু’টি একটি অন্যটির আগা ছুঁয়ে রইল। তিনি কারুবী দু’টিকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের দু’টি কামরার সমস্ত দেয়ালে কারুবী, খেজুর গাছ এবং ফোটা ফুল খোদাই করা ছিল। কামরা দু’টির মেঝেও তিনি সোনা দিয়ে ঢেকে দিলেন। মহাপবিত্র স্থানের দরজাটা তিনি জলপাই কাঠ দিয়ে তৈরী করলেন। সেই দরজার ফ্রেমের পাঁচটা কোণা ছিল। দরজার দুই পাল্লাতে তিনি কারুবী, খেজুর গাছ ও ফোটা ফুল খোদাই করে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন এবং সেই কারুবী ও খেজুর গাছের উপরকার সোনা পিটিয়ে সেগুলোর আকার দিলেন। সেই পাল্লাগুলোর উপর তিনি কারুবী, খেজুর গাছ ও ফোটা ফুল খোদাই করে সোনার পাত দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে কাটা তিন সারি পাথর ও এরস গাছের এক সারি মোটা কাঠ দিয়ে তিনি ভিতরের উঠানের চারপাশের দেয়াল তৈরী করলেন। চতুর্থ বছরের সিব মাসে মাবুদের ঘরের ভিত্তি গাঁথা হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুসারে বায়তুল-মোকাদ্দসের সমস্ত কাজ এগারো বছরের বূল মাসে, অর্থাৎ অষ্টম মাসে শেষ হয়েছিল। বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরী করতে সোলায়মানের সাত বছর সময় লেগেছিল। রাজবাড়ীটা তৈরী করতে সোলায়মানের তেরো বছর লেগেছিল। রাজবাড়ীতে তিনি লেবানন্তবন্তকুটির নামে একটা ঘর তৈরী করেছিলেন। এই ঘরটা একশো হাত লম্বা, পঞ্চাশ হাত চওড়া ও ত্রিশ হাত উঁচু ছিল। এরস কাঠের চার সারি থামের উপর এরস কাঠের ছেঁটে নেওয়া বীমগুলো বসানো ছিল। থামের উপর বসানো বীমগুলোর উপরে এরস কাঠ দিয়ে ছাদ দেওয়া হল; এক এক সারিতে পনেরোটা করে পঁয়তাল্লিশটা বীম ছিল। ঘরের চারপাশের দেয়ালে মুখোমুখি তিন সারি জানালা দেওয়া হল। সমস্ত দরজার ফ্রেমগুলো ছিল চারকোণা; জানালাগুলো তিন সারিতে মুখোমুখি করে তৈরী করা হয়েছিল। তারপর তিনি থাম-কুটির নামে একটা ঘর তৈরী করলেন। সেটা লম্বায় ছিল পঞ্চাশ হাত আর চওড়ায় ত্রিশ হাত। তার সামনে ছিল একটা ছাদ-দেওয়া বারান্দা, আর সেই ছাদ কতগুলো থামের উপর বসানো ছিল। সেই থামগুলোর সামনে ছাদের নীচে একটা বীম ছিল। বিচার-কুটির নামে তিনি একটা ঘর তৈরী করলেন; সেখানে তাঁর সিংহাসন ছিল। বিচার করবার জন্য এই ঘরটা তৈরী করা হল। ঘরের দেয়াল নীচ থেকে উপর পর্যন্ত তিনি এরস কাঠ দিয়ে ঢেকে দিলেন। যে ঘরে তিনি বাস করবেন সেটা বিচার-কুটিরের পিছনে একই নমুনায় তৈরী করা হল। ফেরাউনের যে মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন তাঁর জন্য সেই রকম করেই আর একটা ঘর তৈরী করলেন। রাজবাড়ীর বড় উঠান এবং সমস্ত দালানগুলোর ভিত্তি থেকে ছাদের কার্ণিশ পর্যন্ত সবই ঠিক মাপে কাটা দামী পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। সেই পাথরগুলো করাত দিয়ে সমান করে কেটে নেওয়া হয়েছিল। দালানগুলোর ভিত্তি গাঁথা হয়েছিল বড় বড় দামী পাথর দিয়ে। সেগুলোর কোন কোনটা ছিল দশ হাত আবার কোন কোনটা আট হাত। ভিত্তির পাথরগুলোর উপর ছিল ঠিক মাপে কাটা দামী পাথর ও এরস কাঠ। বারান্দা সুদ্ধ মাবুদের ঘরের ভিতরের উঠানের মতই রাজবাড়ীর বড় উঠানের চারপাশের দেয়াল সুন্দর করে কাটা তিন সারি পাথর ও এরস গাছের এক সারি মোটা কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। বাদশাহ্‌ সোলায়মান টায়ারে লোক পাঠিয়ে হীরামকে আনালেন। তাঁর মা ছিলেন বিধবা এবং নপ্তালি-গোষ্ঠীর মেয়ে। তাঁর পিতা ছিলেন টায়ারের লোক। হীরাম ব্রোঞ্জের কারিগর ছিলেন। হীরাম ব্রোঞ্জের সমস্ত রকম কাজ জানতেন এবং সেই কাজে তিনি খুব পাকা ছিলেন। তিনি বাদশাহ্‌ সোলায়মানের কাছে আসলেন এবং তাঁকে যে সব কাজ দেওয়া হল তা করলেন। হীরাম ব্রোঞ্জের দু’টা থাম তৈরী করলেন। তার প্রত্যেকটা লম্বায় ছিল আঠারো হাত আর বেড়ে বারো হাত। সেই দু’টা থামের উপরে দেবার জন্য তিনি ব্রোঞ্জ ছাঁচে ফেলে দু’টা মাথা তৈরী করলেন। মাথা দু’টার প্রত্যেকটা পাঁচ হাত করে উঁচু ছিল। থামের উপরকার মাথা দু’টার উপরের চার হাত ছিল লিলি ফুলের আকারের। মাথার নীচের অংশটা গোলাকার ছিল। সেই গোলাকার অংশের চারপাশে শিকলগুলো লাগানো ছিল। প্রত্যেকটি মাথার চারপাশে শিকলের সংগে সারি সারি করে ব্রোঞ্জের দু’শো ডালিম ফল লাগানো ছিল। হীরাম সেই দু’টা ব্রোঞ্জের থাম বায়তুল-মোকাদ্দসের বারান্দায় স্থাপন করলেন। দক্ষিণ দিকে যেটা রাখলেন তার নাম দেওয়া হল যাখীন (যার মানে “যিনি স্থাপন করেন”) এবং উত্তর দিকে যেটা রাখলেন তার নাম দেওয়া হল বোয়স (যার মানে “তাঁর মধ্যেই শক্তি”)। লিলি ফুলের আকারের ব্রোঞ্জের মাথা দু’টা সেই থাম দু’টার উপরে বসানো ছিল। এইভাবে সেই থাম তৈরীর কাজ শেষ করা হল। তারপর হীরাম ব্রোঞ্জ ছাঁচে ঢেলে পানি রাখবার জন্য একটা গোল বিরাট পাত্র তৈরী করলেন। পাত্রটার এক দিক থেকে সোজাসুজি অন্য দিকের মাপ ছিল দশ হাত, গভীরতা পাঁচ হাত এবং বেড়ের চারপাশের মাপ ত্রিশ হাত। পাত্রটার মুখের বাইরের কিনারার নীচে প্রতি হাত জায়গায় দশটা করে দুই সারি ব্রোঞ্জের লতানো গাছের ফল ছিল। যে ছাঁচের মধ্যে পাত্রটা তৈরী করা হয়েছিল সেই ছাঁচের মধ্যেই ফলগুলোর আকার ছিল বলে সবটা মিলে একটা জিনিসই হল। পাত্রটা বারোটা ব্রোঞ্জের গরুর পিঠের উপর বসানো ছিল। সেগুলোর তিনটা উত্তরমুখী, তিনটা পশ্চিমমুখী, তিনটা দক্ষিণমুখী ও তিনটা পূর্বমূখী ছিল এবং তাদের পিছনগুলো ছিল ভিতরের দিকে। পাত্রটা ছিল চার আংগুল পুরু। তার মুখটা একটা পেয়ালার মুখের মত ছিল এবং লিলি ফুলের পাপড়ির মত বাইরের দিকে উল্টানো ছিল। তাতে চুয়াল্লিশ হাজার লিটার পানি ধরত। হীরাম ব্রোঞ্জের দশটা বাক্সের মত জিনিস তৈরী করলেন। সেগুলোর প্রত্যেকটা চার হাত লম্বা, চার হাত চওড়া ও তিন হাত উঁচু ছিল। বাক্সের চারপাশের ব্রোঞ্জের পাত ফ্রেমের মধ্যে বসানো ছিল। সেই পাতগুলোর উপরে সিংহ, গরু ও কারুবী ছিল এবং সিংহ ও গরুর নীচে ফুলের মত নক্‌শা করা ছিল। বাক্সের উপরের ফ্রেমের সংগে লাগানো একটা গামলা বসাবার আসন ছিল। প্রত্যেকটা বাক্সে ব্রোঞ্জের ধুরা সুদ্ধ ব্রোঞ্জের চারটা চাকা ছিল। গামলা বসাবার জন্য চার কোণায় ব্রোঞ্জের চারটা ঠেক্‌না ছিল। সেগুলোতেও ফুলের মত নক্‌শা করা ছিল। গামলা বসাবার আসনের মধ্যে একটা গোলাকার ফাঁকা জায়গা ছিল। সেই ফাঁকা জায়গাটার এক দিক থেকে সোজাসুজি অন্য দিকের মাপ হল দেড় হাত। সেই ফাঁকা জায়গার চারদিকে খোদাই করা কারুকাজ ছিল। গামলাটা সেই ফাঁকা জায়গার মধ্যে বসানো হলে পর আসন থেকে গামলাটার উচ্চতা হল এক হাত। বাক্সের পাতগুলো গোল ছিল না, চারকোনা বিশিষ্ট ছিল। পাতগুলোর নীচে চারটা চাকা ছিল আর চাকার ধুরাগুলো বাক্সের সংগে লাগানো ছিল। প্রত্যেকটা চাকা দেড় হাত উঁচু ছিল। চাকাগুলো রথের চাকার মত ছিল; ধুরা, চাকার বেড়, শিক ও মধ্যের নাভি সবই ছাঁচে ঢালাই করা ছিল। প্রত্যেকটা বাক্সের চার কোণায় চারটা ঠেক্‌না লাগানো ছিল। বাক্সের উপরে ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী আধ হাত উঁচু একটা গোলাকার জিনিস ছিল। সেই গোলাকার জিনিসের বাইরের দিকে ভাগে ভাগে কারুবী, সিংহ ও খেজুর গাছ খোদাই করা হয়েছিল। প্রতিটি ভাগের ফাঁকে ঠেক্‌না ছিল, আর সেই ঠেক্‌নার উপরে তৈরী করা ছিল ফুলের মত নক্‌শা। এই গোলাকার জিনিসটা বাক্সের সংগেই তৈরী করা হয়েছিল। এইভাবেই তিনি দশটা বাক্স তৈরী করলেন। সেগুলো একই ছাঁচে ঢালা হয়েছিল এবং আয়তন ও আকারে একই রকম ছিল। তিনি প্রত্যেকটা বাক্সের জন্য একটা করে ব্রোঞ্জের দশটা গামলা তৈরী করলেন। প্রত্যেকটা গামলার বেড় ছিল চার হাত এবং তাতে আটশো আশি লিটার পানি ধরত। তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের দক্ষিণ দিকে পাঁচটা এবং উত্তর দিকে পাঁচটা বাক্স রাখলেন; আর দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় রাখলেন সেই বিরাট পাত্রটা। এছাড়া তিনি অন্যান্য পাত্র, হাতা ও পেয়ালা তৈরী করলেন। এইভাবে বাদশাহ্‌ সোলায়মানের জন্য হীরাম মাবুদের ঘরের যে যে কাজ শুরু করেছিলেন তা শেষ করলেন। সেগুলো হল: দু’টা থাম, থামের উপরকার গোলাকার দু’টা মাথা, সেই মাথার উপরটা সাজাবার জন্য দুই সারি কারুকাজ করা পাকানো শিকল; সেই শিকলগুলোর জন্য চারশো ডালিম- থামের উপরকার মাথার গোলাকার অংশটা সাজাবার জন্য প্রত্যেক সারি শিকলের জন্য দুই সারি ডালিম; দশটা বাক্স ও দশটা গামলা; বিরাট পাত্র ও তার নীচের বারোটা গরু; পাত্র, হাতা ও পেয়ালা। হীরাম যে সব জিনিস বাদশাহ্‌ সোলায়মানের নির্দেশে মাবুদের ঘরের জন্য তৈরী করেছিলেন সেগুলো ছিল চক্‌চকে ব্রোঞ্জের। জর্ডানের সমভূমিতে সুক্কোৎ ও সর্তনের মাঝামাঝি এক জায়গায় বাদশাহ্‌ এই সব জিনিস মাটির ছাঁচে ফেলে তৈরী করিয়েছিলেন। জিনিসগুলোর সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, সোলায়মান সেগুলো ওজন করেন নি; সেইজন্য ব্রোঞ্জের পরিমাণ জানা যায় নি। মাবুদের ঘরের যে সব জিনিসপত্র সোলায়মান তৈরী করিয়েছিলেন সেগুলো হল: সোনার ধূপগাহ্‌, পবিত্র-রুটি রাখবার সোনার টেবিল; খাঁটি সোনার বাতিদান্ত সেগুলো ছিল মহাপবিত্র স্থানের সামনে, ডানে পাঁচটা ও বাঁয়ে পাঁচটা; সোনার ফুল, বাতি এবং চিম্‌টা; খাঁটি সোনার পেয়ালা, সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা, পেয়ালা, হাতা ও আগুন রাখবার পাত্র; ভিতরের কামরার, অর্থাৎ মহাপবিত্র স্থানের দরজার জন্য এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কামরার দরজার জন্য সোনার কব্‌জা। এইভাবে বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করলেন। তারপর তিনি তাঁর পিতা দাউদ যে সব জিনিস মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করে রেখেছিলেন সেগুলো নিয়ে আসলেন। সেগুলো ছিল সোনা, রূপা এবং বিভিন্ন পাত্র। সেগুলো তিনি মাবুদের ঘরের ধনভাণ্ডারে রেখে দিলেন। এর পর বাদশাহ্‌ সোলায়মান দাউদ-শহর, অর্থাৎ সিয়োন থেকে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি নিয়ে আসবার জন্য ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতাদের, গোষ্ঠী-সর্দারদের ও ইসরাইলীয় বংশের প্রধান লোকদের জেরুজালেমে তাঁর কাছে উপস্থিত করলেন। তাতে এথানীম মাসে, অর্থাৎ সপ্তম মাসে ঈদের সময়ে ইসরাইলের ঐ সমস্ত লোক বাদশাহ্‌ সোলায়মানের কাছে উপস্থিত হলেন। ইসরাইলের সব বৃদ্ধ নেতারা উপস্থিত হলে পর ইমামেরা সিন্দুকটি তুলে নিলেন। তাঁরা এবং লেবীয়রা মাবুদের সিন্দুক, মিলন-তাম্বু এবং সমস্ত পবিত্র পাত্র বয়ে নিলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান ও তাঁর কাছে জমায়েত হওয়া সমস্ত বনি-ইসরাইলরা সিন্দুকটির সামনে সামনে থেকে এত ভেড়া ও গরু কোরবানী দিলেন যে, সেগুলোর সংখ্যা গোণা গেল না। তারপর ইমামেরা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি নির্দিষ্ট জায়গায়, বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিতরের কামরায়, অর্থাৎ মহাপবিত্র স্থানে কারুবীদের ডানার নীচে নিয়ে রাখলেন। তাতে কারুবীদের মেলে দেওয়া ডানায় সিন্দুক ও তা বহন করবার ডাণ্ডাগুলো ঢাকা পড়ল। এই ডাণ্ডাগুলো এত লম্বা ছিল যে, সেগুলোর মাথা ভিতরের কামরার সামনের প্রধান কামরা, অর্থাৎ পবিত্র স্থান থেকে দেখা যেত, কিন্তু পবিত্র স্থানের বাইরে থেকে দেখা যেত না। সেগুলো আজও সেখানে রয়েছে। বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর মাবুদ তুর পাহাড়ে তাদের জন্য যখন ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন তখন মূসা সিন্দুকের মধ্যে যে পাথরের ফলক দু’টি রেখেছিলেন সেই দু’টি ছাড়া আর কিছুই তার মধ্যে ছিল না। পবিত্র স্থান থেকে ইমামেরা বের হয়ে আসবার পরেই মাবুদের ঘরের ভিতরটা মেঘে ভরে গেল। সেই মেঘের জন্য ইমামেরা এবাদত-কাজ করতে পারলেন না, কারণ মাবুদের মহিমায় তাঁর ঘরটা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তখন সোলায়মান বললেন, “মাবুদ, তুমি বলেছিলে তুমি ঘন মেঘে বাস করবে। আমি এখন তোমার জন্য একটা চমৎকার ঘর তৈরী করেছি; এটা হবে তোমার চিরকালের বাসস্থান।” এই বলে বাদশাহ্‌ জমায়েত হওয়া সমস্ত বনি-ইসরাইলদের দিকে ঘুরে তাদের দোয়া করলেন। তখন লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর তিনি বললেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। তিনি আমার পিতা দাউদের কাছে নিজের মুখে যা ওয়াদা করেছিলেন তা নিজেই পূর্ণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের মিসর থেকে বের করে আনবার পর আমি বনি-ইসরাইলদের কোন গোষ্ঠীর শহর বেছে নিই নি যেখানে নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য বাসস্থান হিসাবে একটা ঘর তৈরী করা যায়। কিন্তু আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের শাসন করবার জন্য আমি দাউদকে বেছে নিয়েছি।’ “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য একটা ঘর তৈরী করবার ইচ্ছা আমার পিতা দাউদের অন্তরে ছিল। কিন্তু মাবুদ আমার পিতা দাউদকে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য একটা ঘর তৈরী করবার ইচ্ছা যে তোমার অন্তরে আছে তা ভাল। তবে ঘরটি তুমি তৈরী করবে না, করবে তোমার ছেলে, যে তোমার নিজের সন্তান। সে-ই আমার জন্য সেই ঘর তৈরী করবে।’ “মাবুদ তাঁর ওয়াদা রক্ষা করেছেন। আমার পিতা যে পদে ছিলেন আমি সেই পদ পেয়েছি। মাবুদের ওয়াদা অনুসারে আমি ইসরাইলের সিংহাসনে বসেছি এবং ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য আমি এই ঘরটি তৈরী করেছি। আমি সেখানে সেই সাক্ষ্য-সিন্দুকটি রাখবার জায়গা ঠিক করেছি যার মধ্যে রয়েছে মাবুদের দেওয়া ব্যবস্থা, যা তিনি মিসর থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের বের করে আনবার পর তাঁদের জন্য স্থাপন করেছিলেন।” তারপর সোলায়মান সেখানে জমায়েত হওয়া বনি-ইসরাইলদের সামনে মাবুদের কোরবানগাহের কাছে দাঁড়িয়ে আসমানের দিকে হাত তুললেন। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্‌, ইসরাইলের মাবুদ, উপরে বেহেশতে কিংবা নীচে দুনিয়াতে তোমার মত মাবুদ আর কেউ নেই। তোমার যে গোলামেরা মনেপ্রাণে তোমার পথে চলে তুমি তাদের পক্ষে তোমার অটল মহব্বতের ব্যবস্থা রক্ষা করে থাক। তোমার গোলাম আমার পিতা দাউদের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছিলে তা তুমি রক্ষা করেছ। তুমি মুখে যা বলেছ কাজেও তা করেছ, আর আজকে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। “এখন হে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার গোলাম আমার পিতা দাউদের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছিলে তা রক্ষা কর। তুমি বলেছিলে যদি তাঁর ছেলেরা তাঁর মত করে তাদের সব কাজে তোমার ইচ্ছামত চলে তবে ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য তাঁর বংশে লোকের অভাব হবে না। হে ইসরাইলের আল্লাহ্‌, যে ওয়াদা তুমি তোমার গোলাম আমার পিতা দাউদের কাছে করেছিলে তা সফল হোক। “কিন্তু সত্যিই কি আল্লাহ্‌ দুনিয়াতে বাস করবেন? আসমানে, এমন কি, আসমানের সমস্ত জায়গা জুড়েও যখন তোমার স্থান অকুলান হয় তখন আমার তৈরী এই ঘরে কি তোমার জায়গা হবে? তবুও হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার গোলামের মুনাজাত ও অনুরোধে তুমি কান দাও। তোমার গোলাম আজ তোমার কাছে কাকুতি-মিনতি করে যে মুনাজাত করছে তা তুমি শোন। যে জায়গার বিষয় তুমি বলেছ, ‘এই জায়গায় আমার বাসস্থান হবে,’ সেই জায়গার দিকে, অর্থাৎ এই বায়তুল-মোকাদ্দসের দিকে তোমার চোখ দিনরাত খোলা থাকুক; আর এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গোলাম যখন মুনাজাত করবে তখন তুমি তা শুনো। এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গোলাম ও তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলরা যখন অনুরোধ করবে তখন তাতে তুমি কান দিয়ো। তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তা তুমি শুনো এবং তাদের মাফ কোরো। “কোন লোককে অন্যের বিরুদ্ধে অন্যায় করবার দোষে দোষী করা হলে তার নিজের উপর বদদোয়া ডেকে আনবার জন্য যদি তাকে কসম খেতে বাধ্য করা হয় এবং সে গিয়ে তোমার এই ঘরের কোরবানগাহের সামনে সেই কসম খায়, তবে তুমি বেহেশত থেকে সেই কথা শুনো এবং সেইমত কাজ কোরো। তখন তোমার গোলামদের তুমি বিচার করে দোষীর কাজের ফল তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে দোষী বলে প্রমাণ কোরো আর নির্দোষীকে তার কাজ অনুসারে ফল দিয়ে তাকে নির্দোষ বলে প্রমাণ কোরো। “তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবার দরুন যখন তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলরা শত্রুর কাছে হেরে গিয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে এবং বায়তুল-মোকাদ্দসে তোমার গৌরব করে তোমার কাছে মুনাজাত ও অনুরোধ করবে, তখন বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো এবং তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ মাফ করে যে দেশ তুমি তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছ সেখানে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসো। “তোমার বিরুদ্ধে তোমার বান্দাদের গুনাহ্‌ করবার দরুন যখন আকাশ বন্ধ হয়ে বৃষ্টি পড়বে না, তখন তারা যদি এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গৌরব করে ও তোমার কাছে মুনাজাত করে এবং তোমার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে গুনাহ্‌ থেকে ফেরে, তবে তুমি বেহেশত থেকে তা শুনো এবং তোমার গোলামদের, অর্থাৎ তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ মাফ করে দিয়ো। জীবনে ঠিক ভাবে সৎ পথে চলতে তাদের শিক্ষা দিয়ো এবং সম্পত্তি হিসাবে যে দেশ তুমি তাদের দিয়েছ সেই দেশের উপর বৃষ্টি দিয়ো। “যদি দেশে দুর্ভিক্ষ কিংবা মহামারী দেখা দেয়, যদি ফসল শুকিয়ে-যাওয়া রোগ কিংবা ছাৎলা-পড়া রোগ হয়, যদি ফসলে ফড়িং বা পংগপাল লাগে, যদি শত্রু তাদের কোন শহর ঘেরাও করে- যে কোন রকম বিপদ কিংবা রোগ দেখা দিক না কেন, তখন যদি তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের কেউ অনুতপ্ত হয়ে মনের কষ্টে এই এবাদত-খানার দিকে হাত বাড়িয়ে কোন মুনাজাত বা অনুরোধ করে, তবে তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো। তুমি তাকে মাফ কোরো ও সেইমত কাজ কোরো; তার সব কাজ অনুসারে বিচার কোরো, কারণ তুমি তো তার দিলের অবস্থা জান্ত কেবল তুমিই সমস্ত মানুষের দিলের খবর জান। তুমি তা কোরো যাতে আমাদের পূর্বপুরুষদের তুমি যে দেশ দিয়েছ সেখানে সারা জীবন তোমার বান্দারা তোমাকে ভয় করে চলে। তখন তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো। সে যা চায় তার জন্য তা কোরো যেন দুনিয়ার সমস্ত লোক তোমাকে জানতে পারে এবং তোমার নিজের বান্দা বনি-ইসরাইলদের মত তারাও তোমাকে ভয় করতে পারে আর জানতে পারে যে, আমার তৈরী এই ঘর তোমারই ঘর। “তুমি যখন তোমার বান্দাদের তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠাবে তখন তারা যেখানেই থাকুক না কেন সেখান থেকে যদি তোমার বেছে নেওয়া এই শহরের দিকে ও তোমার জন্য আমার তৈরী এই ঘরের দিকে ফিরে মুনাজাত করে, তবে বেহেশত থেকে তুমি তাদের মুনাজাত ও অনুরোধ শুনো এবং তাদের পক্ষ নিয়ো। “তারা যখন তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবে- অবশ্য গুনাহ্‌ করে না এমন লোক নেই- আর তুমি তাদের উপর রাগ করে শত্রুর হাতে তাদের তুলে দেবে ও শত্রুরা তাদের বন্দী করে কাছে বা দূরে তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে, তখন বন্দী হয়ে থাকা সেই দেশে যদি তারা তওবা করে এবং অনুতপ্ত হয়ে তোমাকে অনুরোধ করে বলে, ‘আমরা গুনাহ্‌ করেছি, অন্যায় করেছি এবং খারাপভাবে চলেছি,’ তবে তুমি তাদের মুনাজাত শুনো। ঐ দেশে যদি তারা মনেপ্রাণে তোমার দিকে ফেরে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের যে দেশ তুমি দিয়েছ সেই দেশের দিকে, তোমার বেছে নেওয়া শহরের দিকে, তোমার জন্য আমার তৈরী এই ঘরের দিকে ফিরে তোমার কাছে মুনাজাত করে, তবে তুমি তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তাদের মুনাজাত ও অনুরোধ শুনো এবং তাদের পক্ষ নিয়ো। তোমার যে বান্দারা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে সেই বান্দাদের তুমি মাফ কোরো এবং তোমার বিরুদ্ধে করা তাদের সমস্ত দোষও মাফ কোরো। তাদের যারা বন্দী করে নিয়ে গেছে সেই লোকদের মন এমন কোরো যাতে তারা তাদের প্রতি দয়া করে; কারণ বনি-ইসরাইলরা তো তোমারই বান্দা, তোমারই সম্পত্তি যাদের তুমি মিসর থেকে বের করে এনেছ, বের করে এনেছ লোহা গলানো চুলার ভিতর থেকে। “তোমার গোলামের ও তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের অনুরোধের প্রতি তুমি মনোযোগ দিয়ো, আর যখন তারা তোমাকে ডাকবে তখন তুমি তাদের কথা শুনো। হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমাদের পূর্বপুরুষদের মিসর থেকে বের করে আনবার সময় তোমার গোলাম মূসার মধ্য দিয়ে তোমার ঘোষণা অনুসারে তোমার নিজের সম্পত্তি হবার জন্য দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্য থেকে তুমি বনি-ইসরাইলদের আলাদা করে নিয়েছ।” মাবুদের কাছে এই সব মুনাজাত ও মিনতি শেষ করবার পর সোলায়মান মাবুদের কোরবানগাহের সামনে থেকে উঠলেন; এতক্ষণ তিনি হাঁটু পেতে বেহেশতের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে জমায়েত হওয়া সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জোর গলায় এই বলে দোয়া করলেন, “সমস্ত প্রশংসা মাবুদের, যিনি তাঁর ওয়াদা অনুসারে তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের বিশ্রাম দিয়েছেন। তাঁর গোলাম মূসার মধ্য দিয়ে তিনি যে সব মেহেরবানী করবার ওয়াদা করেছিলেন তার একটা কথাও তিনি খেলাপ করেন নি। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যেমন আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগে ছিলেন তেমনি তিনি আমাদের সংগেও থাকুন। তিনি যেন কখনও আমাদের ছেড়ে না যান কিংবা ছেড়ে না দেন। আমরা তাঁর সব পথে চলবার জন্য এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে তিনি যে সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ দিয়েছিলেন তা মেনে চলবার জন্য তিনি আমাদের দিল তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত রাখুন। আমি যে সব কথা বলে মাবুদের কাছে মুনাজাত করেছি তা দিনরাত আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র মনে থাকুক যাতে তিনি তাঁর গোলামের ও তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের প্রতিদিনের প্রয়োজন অনুসারে ব্যবস্থা করেন। এতে দুনিয়ার সমস্ত জাতিই জানতে পারবে যে, আল্লাহ্‌ই মাবুদ এবং তিনি ছাড়া মাবুদ আর কেউ নেই। আজকে যেমন মাবুদের নিয়ম ও হুকুম মেনে চলবার জন্য তোমাদের অন্তর সম্পূর্ণভাবে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে আছে তেমনি সব সময় থাকুক।” তারপর বাদশাহ্‌ ও তাঁর সংগে সমস্ত বনি-ইসরাইল মাবুদের সামনে কোরবানী দিলেন। সোলায়মান বাইশ হাজার গরু ও এক লক্ষ বিশ হাজার ভেড়া দিয়ে যোগাযোগ-কোরবানী দিলেন। এইভাবে বাদশাহ্‌ ও সমস্ত বনি-ইসরাইল মাবুদের ঘর উদ্বোধন করলেন। সেই একই দিনে বাদশাহ্‌ মাবুদের ঘরের সামনের উঠানের মাঝখানের অংশ পবিত্র করলেন। সেখানে তিনি পোড়ানো-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী দিলেন এবং যোগাযোগ-কোরবানীর চর্বি কোরবানী দিলেন, কারণ মাবুদের সামনে থাকা কোরবানগাহ্‌টা এই সব কোরবানী দেবার পক্ষে ছোট ছিল। এইভাবে সোলায়মান ও তাঁর সংগে সমস্ত বনি-ইসরাইল সেই সময় আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে সাত দিন ও আরও সাত দিন, মোট চৌদ্দ দিন ধরে একটা উৎসব করলেন। তারা ছিল এক বিরাট জনসংখ্যা; তারা হামা এলাকা থেকে মিসরের শুকনা নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা থেকে এসে যোগ দিয়েছিল। তার পরের দিন বাদশাহ্‌ লোকদের বিদায় দিলেন। মাবুদ তাঁর গোলাম দাউদ ও তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের প্রতি যে সব মেহেরবানী করেছেন তার জন্য আনন্দিত ও খুশী হয়ে লোকেরা বাদশাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে বাড়ী চলে গেল। এইভাবে সোলায়মান মাবুদের ঘর, রাজবাড়ী আর নিজের ইচ্ছামত যে সব কাজ করতে চেয়েছিলেন তা শেষ করলেন। তারপর মাবুদ দ্বিতীয়বার তাঁকে দেখা দিলেন যেমন গিবিয়োনে একবার তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন। মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি যে মুনাজাত ও অনুরোধ আমার কাছে করেছ তা আমি শুনেছি। তোমার তৈরী এই এবাদত-খানাটি চিরকাল আমার বাসস্থান হিসাবে পবিত্র করেছি। এর উপর সব সময় আমার চোখ ও মন থাকবে। “আর তুমি, তুমি যদি তোমার পিতা দাউদের মত খাঁটি দিলে, সৎভাবে আমার সামনে চল এবং আমার সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ পালন কর, তবে আমি চিরকালের জন্য ইসরাইলের উপর তোমার রাজসিংহাসন স্থায়ী করব। এই কথা আমি তোমার পিতা দাউদকে ওয়াদা করে বলেছিলাম, ‘ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য তোমার বংশে লোকের অভাব হবে না।’ “কিন্তু যদি তোমরা কিংবা তোমাদের সন্তানেরা আমার কাছ থেকে ফিরে যাও এবং তোমাদের কাছে দেওয়া আমার হুকুম ও নিয়ম পালন না করে দেব-দেবীর সেবা ও পূজা কর, তবে বনি-ইসরাইলদের যে দেশ আমি দিয়েছি তা থেকে আমি তাদের দূর করে দেব। এই যে এবাদত-খানাটি আমি আমার বাসস্থান হিসাবে পবিত্র করেছি সেটাও আমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দেব। তখন ইসরাইল অন্যান্য সব জাতির কাছে টিট্‌কারির ও তামাশার পাত্র হবে। এই এবাদত-খানাটি এখন মহান হলেও তখন যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা চম্‌কে উঠবে এবং ঠাট্টা করে বলবে, ‘কেন মাবুদ এই দেশ ও এই এবাদত-খানাটির প্রতি এই রকম করলেন?’ এর জবাবে লোকে বলবে, ‘এর কারণ হল, যিনি তাদের পূর্বপুরুষদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন সেই পূর্বপূরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তারা ত্যাগ করেছে। তারা দেব-দেবীর পিছনে গিয়ে তাদের পূজা ও সেবা করেছে। সেইজন্যই মাবুদ এই সব বিপদ তাদের উপর এনেছেন।’ ” মাবুদের ঘর ও রাজবাড়ী তৈরী করতে সোলায়মানের বিশ বছর লেগেছিল। টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরম সোলায়মানের ইচ্ছামত এরস ও বেরস কাঠ ও সোনা যুগিয়েছিলেন বলে বাদশাহ্‌ সোলায়মান গালীল দেশের বিশটা গ্রাম তাঁকে দান করলেন। হীরম সেই গ্রামগুলো দেখবার জন্য টায়ার থেকে আসলেন, কিন্তু সেগুলো দেখে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি সোলায়মানকে বললেন, “ভাই, এগুলো কি রকম গ্রাম আপনি আমাকে দিলেন?” তিনি সেগুলোর নাম দিলেন কাবূল দেশ (যার মানে “কোন কাজের নয়”)। আজও সেগুলোর সেই নামই রয়ে গেছে। হীরম মোট সাড়ে চার টনেরও বেশী সোনা বাদশাহ্‌কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের ঘর, নিজের রাজবাড়ী, মিল্লো, জেরুজালেমের দেয়াল, হাৎসোর, মগিদ্দো ও গেষর তৈরী করবার জন্য অনেক লোকদের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। এর আগে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন গেষর অধিকার করে সেটা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন আর সেখানকার বাসিন্দা কেনানীয়দের হত্যা করেছিলেন। পরে তিনি জায়গাটা তাঁর মেয়েকে, অর্থাৎ সোলায়মানের স্ত্রীকে বিয়ের যৌতুক হিসাবে দিয়েছিলেন। সেইজন্য সোলায়মান গেষর আবার তৈরী করে নিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি নীচের বৈৎ-হোরোণ, বালৎ, এহুদার মরুভূমির তামর, তাঁর সমস্ত ভাণ্ডার-শহর এবং রথ ও ঘোড়সওয়ারদের জন্য শহর তৈরী করলেন, অর্থাৎ জেরুজালেম, লেবানন ও তাঁর শাসনের অধীনে যে সব রাজ্য ছিল সেগুলোর মধ্যে যা যা তিনি তৈরী করতে চেয়েছিলেন তা সবই করলেন। কিন্তু তিনি কোন ইসরাইলীয়কে গোলাম করেন নি; তারা ছিল তাঁর যোদ্ধা, তাঁর কর্মচারী, তাঁর অধীন শাসনকর্তা, তাঁর সেনাপতি এবং তাঁর রথচালক ও ঘোড়সওয়ারদের সেনাপতি। এছাড়া সোলায়মানের সব কাজের দেখাশোনার ভার-পাওয়া পাঁচশো পঞ্চাশ জন প্রধান কর্মচারী ছিল। যে লোকেরা কাজ করত এরা তাদের কাজ তদারক করত। ফেরাউনের মেয়ে দাউদ-শহর ছেড়ে তাঁর জন্য সোলায়মানের তৈরী করা রাজবাড়ীতে চলে আসলে পর সোলায়মান মিল্লো তৈরী করলেন। মাবুদের উদ্দেশে সোলায়মান যে কোরবানগাহ্‌টা তৈরী করেছিলেন সেখানে বছরে তিনবার তিনি পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দিতেন। সেই সংগে তিনি মাবুদের সামনে ধূপও জ্বালাতেন। তাহলে দেখা যায়, সোলায়মান বায়তুল-মোকাদ্দসের সব কাজ শেষ করেছিলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান আকাবা উপসাগরের তীরে ইদোমের এলৎ শহরের কাছে ইৎসিয়োন-গেবরে কতগুলো জাহাজ তৈরী করলেন। সোলায়মানের লোকদের সংগে নৌবহরে কাজ করবার জন্য হীরম তাঁর কয়েকজন দক্ষ নাবিক পাঠিয়ে দিলেন। তারা ওফীরে গিয়ে প্রায় সাড়ে ষোল টন সোনা নিয়ে এসে বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে দিল। সোলায়মানের সুনাম ও তাঁর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত মাবুদের গৌরবের কথা শুনে সাবা দেশের রাণী কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য আসলেন। তিনি অনেক লোক ও উট নিয়ে জেরুজালেমে এসে পৌঁছালেন। উটের পিঠে ছিল খোশবু মসলা, প্রচুর পরিমাণে সোনা ও মণি-মুক্তা। তিনি সোলায়মানের কাছে এসে তাঁর মনে যা যা ছিল তা সবই তাঁকে বললেন। সোলায়মান তাঁর সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। বাদশাহ্‌র কাছে কোন কিছুই এমন কঠিন ছিল না যা তিনি তাঁকে বুঝিয়ে বলতে পারেন নি। সাবার রাণী সোলায়মানের সমস্ত জ্ঞান ও তাঁর তৈরী রাজবাড়ী দেখলেন। তিনি আরও দেখলেন তাঁর টেবিলের খাবার, তাঁর কর্মচারীদের থাকবার জায়গা, সুন্দর পোশাক পরা তাঁর সেবাকারীদের, তাঁর পানীয় পরিবেশকদের এবং মাবুদের ঘরে তাঁর পোড়ানো-কোরবানীর পশুর সংখ্যা। এই সব দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমার নিজের দেশে থাকতে আপনার কাজ ও জ্ঞানের বিষয় যে খবর শুনেছি তা সত্যি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত আমি সেই সব কথা বিশ্বাস করি নি। সত্যি, এর অর্ধেকও আমাকে বলা হয় নি। যে খবর আমি পেয়েছি আপনার জ্ঞান ও ধন তার চেয়ে অনেক বেশী। আপনার লোকেরা কত সুখী! যারা সব সময় আপনার সামনে থাকে ও আপনার জ্ঞানের কথা শোনে আপনার সেই কর্মচারীরা কত ভাগ্যবান! আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, যিনি আপনার উপর খুশী হয়ে আপনাকে ইসরাইলের সিংহাসনে বসিয়েছেন। বনি-ইসরাইলদের তিনি চিরকাল মহব্বত করেন বলে তিনি সুবিচার ও ন্যায় রক্ষার জন্য আপনাকে বাদশাহ্‌ করেছেন।” তিনি বাদশাহ্‌কে সাড়ে চার টনেরও বেশী সোনা, অনেক খোশবু মসলা ও মণি-মুক্তা দিলেন। সাবার রাণী বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে যত মসলা দিয়েছিলেন তত মসলা আর কখনও দেশে আনা হয় নি। এছাড়া হীরমের যে জাহাজগুলো ওফীর থেকে সোনা নিয়ে আসত সেগুলো প্রচুর বেরস কাঠ আর মণি-মুক্তাও নিয়ে আসত। বাদশাহ্‌ সেই সব বেরস কাঠ দিয়ে মাবুদের ঘরের ও রাজবাড়ীর রেলিং এবং কাওয়ালদের জন্য বীণা ও সুরবাহার তৈরী করালেন। আজ পর্যন্ত এত বেরস কাঠ কখনও দেশে আনা হয় নি আর দেখাও যায় নি। বাদশাহ্‌ সোলায়মান দান হিসাবে সাবার রাণীকে অনেক কিছু দিয়েছিলেন। তা ছাড়াও রাণী যা কিছু চেয়েছিলেন তা সবই দিয়েছিলেন। এর পর রাণী তাঁর লোকজন নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন। প্রতি বছর সোলায়মানের কাছে যে সোনা আসত তার ওজন ছিল প্রায় ছাব্বিশ টন। এছাড়া বণিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, আরবীয় বাদশাহ্‌দের কাছ থেকে ও দেশের শাসনকর্তাদের কাছ থেকেও সোনা আসত। বাদশাহ্‌ সোলায়মান পিটানো সোনা দিয়ে দু’শো বড় ঢাল তৈরী করালেন। প্রত্যেকটা ঢালে সাত কেজি আটশো গ্রাম সোনা লেগেছিল। পিটানো সোনা দিয়ে তিনি তিনশো ছোট ঢালও তৈরী করিয়েছিলেন। তার প্রত্যেকটাতে সোনা লেগেছিল প্রায় দুই কেজি করে। তিনি সেগুলো লেবানন্তবন্তকুটিরে রাখলেন। এর পরে বাদশাহ্‌ হাতির দাঁতের একটা বড় সিংহাসন তৈরী করিয়ে খাঁটি সোনা দিয়ে তা মুড়িয়ে নিলেন। সেই সিংহাসনের সিঁড়ির ছয়টা ধাপ ছিল এবং সিংহাসনের পিছন দিকের উপর দিকটা ছিল গোল। বসবার জায়গার দু’দিকে ছিল হাতল এবং হাতলের পাশে ছিল দাঁড়ানো সিংহমূর্তি। সেই ছয়টা ধাপের প্রত্যেকটার দু’পাশে একটা করে মোট বারোটা সিংহমূর্তি ছিল। অন্য কোন রাজ্যে এই রকম সিংহাসন কখনও তৈরী হয় নি। সোলায়মানের পানীয়ের সমস্ত পাত্রগুলো ছিল সোনার আর লেবানন্তবন্তকুটিরের সমস্ত পাত্রগুলোও ছিল খাঁটি সোনার তৈরী। রূপার তৈরী কিছুই ছিল না, কারণ সোলায়মানের সময়ে রূপার তেমন কোন দাম ছিল না। সাগরে হীরমের জাহাজের সংগে বাদশাহ্‌রও বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ ছিল। প্রতি তিন বছর পর পর সেই জাহাজগুলো সোনা, রূপা, হাতির দাঁত, বানর ও বেবুন নিয়ে ফিরে আসত। বাদশাহ্‌ সোলায়মান দুনিয়ার অন্য সব বাদশাহ্‌দের চেয়ে ধনী ও জ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। আল্লাহ্‌ সোলায়মানের দিলে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন সেই জ্ঞানপূর্ণ কথাবার্তা শুনবার জন্য দুনিয়ার সব দেশের লোক তাঁর সংগে দেখা করতে চেষ্টা করত। যারা আসত তারা প্রত্যেকে কিছু না কিছু উপহার আনত। সেগুলোর মধ্যে ছিল সোনা-রূপার পাত্র, কাপড়-চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, খোশবু মসলা, ঘোড়া আর খ"চর। বছরের পর বছর এই রকম চলত। সোলায়মান অনেক রথ ও ঘোড়া জোগাড় করলেন। তাঁর রথের সংখ্যা ছিল এক হাজার চারশো আর ঘোড়ার সংখ্যা ছিল বারো হাজার। তিনি সেগুলো রথ রাখবার শহরে এবং জেরুজালেমে নিজের কাছে রাখতেন। বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে রূপাকে করলেন পাথরের মত প্রচুর, আর এরস কাঠকে করলেন নীচু পাহাড়ী এলাকায় গজানো ডুমুর গাছের মত প্রচুর। মিসর ও কিলিকিয়া থেকে সোলায়মানের ঘোড়াগুলো আনা হত। বাদশাহ্‌র বণিকেরা কিলিকিয়া থেকে সেগুলো কিনে আনত। মিসর থেকে আনা প্রত্যেকটা রথের দাম পড়ত সাত কেজি আটশো গ্রাম রূপা এবং প্রত্যেকটা ঘোড়ার দাম পড়ত সাত কেজি আটশো গ্রাম রূপা। সেই বণিকেরা হিট্টীয় ও সিরীয় সব বাদশাহ্‌দের কাছে সেগুলো বিক্রি করত। বাদশাহ্‌ সোলায়মান ফেরাউনের মেয়েকে ছাড়া আরও অনেক বিদেশী স্ত্রীলোকদের ভালবাসতেন। তারা জাতিতে ছিল মোয়াবীয়, অম্মোনীয়, ইদোমীয়, সিডনীয় ও হিট্টীয়। তারা সেই সব জাতি থেকে এসেছিল যাদের সম্বন্ধে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের বলেছিলেন, “তোমরা তাদের বিয়ে করবে না, কারণ তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মন তাদের দেব-দেবীদের দিকে টেনে নেবে।” কিন্তু সোলায়মান তাদেরই ভালবেসে আঁকড়ে ধরে রইলেন। তাঁর সাতশো স্ত্রী ছিল, যারা ছিল রাজপরিবারের মেয়ে; এছাড়া তাঁর তিনশো উপস্ত্রী ছিল। তাঁর স্ত্রীরা তাঁকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল। সোলায়মানের বুড়ো বয়সে তাঁর স্ত্রীরা তাঁর মন দেব-দেবীদের দিকে টেনে নিয়েছিল। তার ফলে তাঁর বাবা দাউদের মত তাঁর দিল তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ে পূর্ণ ছিল না। তিনি সিডনীয়দের দেবী অষ্টোরতের ও অম্মোনীয়দের জঘন্য দেবতা মিল্‌কমের সেবা করতে লাগলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ সোলায়মান তা-ই করলেন। তাঁর পিতা দাউদ যেমন মাবুদকে সম্পূর্ণভাবে ভয় করতেন তিনি তেমন করতেন না। জেরুজালেমের পূর্ব দিকের পাহাড়ের উপরে তিনি মোয়াবের জঘন্য দেবতা কমোশ ও অম্মোনীয়দের জঘন্য দেবতা মোলকের উদ্দেশে পূজার উঁচু স্থান তৈরী করলেন। তাঁর সমস্ত বিদেশী স্ত্রী যারা নিজের নিজের দেবতাদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাত ও পশু বলি দিত তাদের সকলের জন্য তিনি তা-ই করলেন। এতে মাবুদ সোলায়মানের উপরে রেগে গেলেন, কারণ যিনি তাঁকে দু’বার দেখা দিয়েছিলেন সেই ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিক থেকে তাঁর মন ফিরে গিয়েছিল। তিনি দেব-দেবীদের পিছনে যেতে তাঁকে মানা করেছিলেন কিন্তু সোলায়মান মাবুদের হুকুম পালন করেন নি। কাজেই মাবুদ সোলায়মানকে বললেন, “তোমার এই ব্যবহারের জন্য এবং আমার দেওয়া ব্যবস্থা ও নিয়ম অমান্য করবার জন্য আমি অবশ্যই তোমার কাছ থেকে রাজ্য চিরে নিয়ে তোমার একজন কর্মচারীকে দেব। তবে তোমার পিতা দাউদের কথা মনে করে তোমার জীবনকালে আমি তা করব না, কিন্তু তোমার ছেলের হাত থেকে আমি তা চিরে নেব। অবশ্য রাজ্যের সবটা আমি তার কাছ থেকে চিরে নেব না, কিন্তু আমার গোলাম দাউদের কথা এবং আমার বেছে নেওয়া জেরুজালেমের কথা মনে করে একটা গোষ্ঠী আমি তোমার ছেলেকে দেব।” এর পর মাবুদ সোলায়মানের বিরুদ্ধে ইদোমীয় হদদকে শত্রু হিসাবে দাঁড় করালেন। ইদোমের রাজবংশে তার জন্ম হয়েছিল। দাউদ যখন ইদোম দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন তখন তাঁর সেনাপতি যোয়াব মৃত লোকদের দাফন করবার জন্য ইদোমে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকবার সময় তিনি ইদোমীয় সব পুরুষ লোককে হত্যা করেছিলেন। যোয়াব ও ইসরাইলের সব সৈন্যেরা ছয় মাস ইদোমে ছিলেন এবং সেখানকার সব পুরুষ লোককে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু হদদ তার বাবার কয়েকজন ইদোমীয় কর্মচারীর সংগে মিসরে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় সে ছোট ছিল। তারা মাদিয়ান থেকে রওনা হয়ে পারণে গিয়েছিল এবং পরে সেখান থেকে কিছু লোক নিয়ে তারা মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের কাছে গিয়েছিল। ফেরাউন হদদকে বাড়ী, জায়গা-জমি ও খাবার দিয়েছিলেন। ফেরাউন হদদের উপর এত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, ফেরাউনের স্ত্রী রাণী তহ্‌পনেষের বোনের সংগে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। তহ্‌পনেষের বোনের গর্ভে হদদের একটি ছেলের জন্ম হয়েছিল; সেই ছেলের নাম ছিল গনুবৎ। তহ্‌পনেষ ছেলেটিকে রাজবাড়ীতে রাখলেন এবং সেখানেই সে মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ল। গনুবৎ সেখানে ফেরাউনের ছেলেমেয়েদের সংগেই থাকত। মিসরে থাকতেই হদদ শুনল যে, দাউদকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হয়েছে এবং সেনাপতি যোয়াবও মারা গেছেন। তখন হদদ ফেরাউনকে বলল, “এবার আমাকে যেতে দিন যাতে আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যেতে পারি।” ফেরাউন জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে তোমার কিসের অভাব হয়েছে যে, তুমি নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইছ?” জবাবে হদদ বলল, “কিছুরই অভাব হয় নি, কিন্তু তবুও আমাকে যেতে দিন।” সোলায়মানের বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌ আর একজন শত্রু দাঁড় করালেন। সে হল ইলিয়াদার ছেলে রষোণ। সে তার মালিক সোবার বাদশাহ্‌ হদদেষরের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। দাউদ যখন সোবার সৈন্যদের হত্যা করেছিলেন তখন রষোণ কিছু লোক জোগাড় করে নিয়ে একটা লুটেরা দল তৈরী করে তার নেতা হয়ে বসল। এই লোকেরা দামেস্ক দখল করে সেখানে রাজত্ব করতে লাগল। সোলায়মান যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন রষোণ ইসরাইলের সংগে শত্রুতা করেছিল আর সেই সময় হদদও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কাজ করছিল। ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটা শত্রুভাব নিয়ে রষোণ সিরিয়া দেশে রাজত্ব করত। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমও বাদশাহ্‌ সোলায়মানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। তিনি ছিলেন সোলায়মানের একজন কর্মচারী, সরেদা গ্রামের একজন আফরাহীমীয় লোক। তাঁর মায়ের নাম ছিল সরূয়া; তিনি বিধবা ছিলেন। বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে ইয়ারাবিমের বিদ্রোহের একটা কারণ ছিল। যে সময় সোলায়মান মিল্লো তৈরী করছিলেন এবং তাঁর পিতা দাউদের শহরের দেয়ালের ভাংগা অংশ মেরামত করছিলেন, সেই সময় ইয়ারাবিম সেখানে কাজ করছিলেন এবং তাঁর কাজের বেশ সুনাম ছিল। সোলায়মান যখন দেখলেন যে, যুবকটি বেশ কাজের লোক তখন তিনি তাঁকে ইউসুফের বংশের সমস্ত মজুরদের দেখাশোনার ভার দিলেন। সেই সময় ইয়ারাবিম এক দিন জেরুজালেমের বাইরে গেলেন। পথে তাঁর সংগে শীলোর নবী অহিয়ের দেখা হল। অহিয়ের গায়ে ছিল একটা নতুন চাদর। পথে তাঁরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না। তখন অহিয় তাঁর গায়ের চাদরটা নিয়ে ছিঁড়ে বারোটা টুকরা করলেন। তারপর তিনি ইয়ারাবিমকে বললেন, “দশটা টুকরা তুমি তুলে নাও, কারণ ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাকে বলছেন, ‘দেখ, আমি সোলায়মানের হাত থেকে রাজ্যটা চিরে নেব এবং তোমাকে দশটা গোষ্ঠীর ভার দেব। কিন্তু আমার গোলাম দাউদের জন্য ও ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর এলাকা থেকে আমার বেছে নেওয়া জেরুজালেমের জন্য কেবল একটা গোষ্ঠী সোলায়মানের হাতে থাকবে। আমি এটা করব, কারণ সেই দশ গোষ্ঠী আমাকে ত্যাগ করে সিডনীয়দের দেবী অষ্টোরতের, মোয়াবের দেবতা কমোশের ও অম্মোনীয়দের দেবতা মিল্‌কমের পূজা করেছে। সোলায়মানের পিতা দাউদ যেমন করতেন তারা তেমন করে নি। তারা আমার পথে চলে নি, আমার চোখে যা ঠিক তা করে নি এবং আমার নিয়ম ও নির্দেশ পালন করে নি। তবুও আমি সোলায়মানের হাত থেকে গোটা রাজ্যটা নিয়ে নেব না। আমার গোলাম দাউদ, যাকে আমি বেছে নিয়েছিলাম এবং যে আমার হুকুম ও নিয়ম পালন করত তার জন্যই আমি সোলায়মানকে সারা জীবনের জন্য রাজপদে রাখব। আমি তার ছেলের হাত থেকে রাজ্যটা নিয়ে তোমার হাতে দশটা গোষ্ঠীর ভার দেব। আমার বাসস্থান হিসাবে বেছে নেওয়া জেরুজালেম শহরে যেন আমার সামনে আমার গোলাম দাউদের একটা বাতি থাকে সেইজন্য আমি তার ছেলেকে একটা গোষ্ঠীর ভার দেব। কিন্তু আমি তোমাকেই ইসরাইলের উপর বাদশাহ্‌ করব আর তুমি তোমার প্রাণের সমস্ত ইচ্ছা অনুসারে রাজত্ব করবে। যদি তুমি আমার হুকুম অনুসারে কাজ কর এবং আমার পথে চল আর আমার গোলাম দাউদের মত আমার নিয়ম ও হুকুম পালন করে আমার চোখে যা ঠিক তা-ই কর তবে আমি তোমার সংগে থাকব। আমি দাউদের মতই তোমার বংশে রাজপদ স্থায়ী করব এবং তোমার হাতে ইসরাইলকে দেব। তাদের অবাধ্যতার জন্য আমি দাউদের বংশধরদের নীচু করব, কিন্তু চিরদিনের জন্য নয়।’ ” সেইজন্য সোলায়মান ইয়ারাবিমকে হত্যা করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি মিসরের বাদশাহ্‌ শীশকের কাছে পালিয়ে গেলেন এবং সোলায়মানের ইন্তেকাল না হওয়া পর্যন্ত সেখানে রইলেন। সোলায়মানের রাজত্বের অন্যান্য ঘটনার কথা, অর্থাৎ তাঁর কাজ ও জ্ঞানের কথা তাঁর রাজত্বের ইতিহাসের কিতাবে লেখা আছে। সোলায়মান জেরুজালেমে চল্লিশ বছর ধরে গোটা ইসরাইল জাতির উপর রাজত্ব করেছিলেন। তারপর তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। তাঁকে তাঁর বাবা দাউদের শহরে দাফন করা হল। তারপর তাঁর ছেলে রহবিয়াম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। রহবিয়াম শিখিমে গেলেন, কারণ বনি-ইসরাইলরা সকলে তাঁকে বাদশাহ্‌ করবার জন্য সেখানে গিয়েছিল। তখন নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম মিসর দেশে ছিলেন, কারণ তিনি বাদশাহ্‌ সোলায়মানের কাছ থেকে পালিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালে তিনি রহবিয়ামের বাদশাহ্‌ হওয়ার খবর শুনলেন। লোকেরা ইয়ারাবিমকে ডেকে পাঠালে পর তিনি এবং বনি-ইসরাইলরা সবাই রহবিয়ামের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনার পিতা আমাদের উপর একটা ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এখন আপনি আমাদের উপর চাপানো সেই কঠিন পরিশ্রম কমিয়ে ভারী জোয়ালটা হালকা করে দিন; তাহলে আমরা আপনার সেবা করব।” জবাবে রহবিয়াম বললেন, “তোমরা এখন চলে যাও, তিন দিনের দিন এসো।” তাতে লোকেরা চলে গেল। যে সব বৃদ্ধ নেতারা তাঁর পিতা সোলায়মানের জীবনকালে তাঁর সেবা করতেন রহবিয়াম তাঁদের সংগে পরামর্শ করবার জন্য বললেন, “এই লোকদের জবাব দেবার জন্য আপনারা আমাকে কি পরামর্শ দেন?” জবাবে তাঁরা বললেন, “আজকে যদি আপনি এই সব লোকদের সেবাকারী হয়ে তাদের সেবা করেন এবং তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন তবে তারা সব সময় আপনার গোলাম হয়ে থাকবে।” কিন্তু রহবিয়াম বৃদ্ধ নেতাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে সেই সব যুবকদের সংগে পরামর্শ করলেন যারা তাঁর সংগে বড় হয়েছিল এবং তাঁর সেবা করত। তিনি তাদের বললেন, “লোকেরা বলছে, ‘আপনার পিতা যে ভারী জোয়াল আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন তা হালকা করুন।’ এই ব্যাপারে তোমাদের পরামর্শ কি? আমরা তাদের কি জবাব দেব?” জবাবে সেই যুবকেরা বলল, “যে সব লোকেরা আপনার পিতার চাপিয়ে দেওয়া ভারী জোয়াল হালকা করে দেবার কথা বলেছে তাদের আপনি বলুন যে, আপনার পিতার কোমরের চেয়েও আপনার কড়ে আংগুলটা মোটা। আপনার পিতা তাদের উপর যে ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছিলেন তা আপনি আরও ভারী করবেন। আপনার পিতা তাদের মেরেছিলেন চাবুক দিয়ে কিন্তু আপনি তাদের মারবেন কাঁকড়া-বিছা দিয়ে।” বাদশাহ্‌র কথামত তিন দিনের দিন ইয়ারাবিম ও সমস্ত লোকেরা রহবিয়ামের কাছে ফিরে আসল। বাদশাহ্‌ বৃদ্ধ নেতাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে লোকদের খুব কড়া জবাব দিলেন। তিনি সেই যুবকদের পরামর্শ মত বললেন, “আমার পিতা তোমাদের জোয়াল ভারী করেছিলেন, আমি তা আরও ভারী করব। আমার পিতা চাবুক দিয়ে তোমাদের মেরেছিলেন, আমি তোমাদের মারব কাঁকড়া-বিছা দিয়ে।” এইভাবে বাদশাহ্‌ লোকদের কথায় কান দিলেন না। শীলোনীয় অহিয়ের মধ্য দিয়ে মাবুদ নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমকে যে কথা বলেছিলেন তা পূর্ণ করবার জন্য মাবুদ থেকেই ঘটনাটা এইভাবে ঘটল। বনি-ইসরাইলরা যখন বুঝল যে, বাদশাহ্‌ তাদের কথা শুনবেন না তখন তারা বাদশাহ্‌কে বলল, “দাউদের উপর আমাদের কোন দাবি নেই। ইয়াসির ছেলের উপর আমাদের কোন অধিকার নেই। হে ইসরাইল, তোমরা যে যার বাড়ীতে ফিরে যাও। হে দাউদ, এখন তোমার নিজের গোষ্ঠী তুমি নিজেই দেখ।” কাজেই বনি-ইসরাইলরা যে যার বাড়ীতে ফিরে গেল। তবে এহুদা-গোষ্ঠীর গ্রাম ও শহরগুলোতে যে সব ইসরাইলীয় বাস করত রহবিয়াম তাদের উপরে রাজত্ব করতে থাকলেন। যাদের কাজ করতে বাধ্য করা হত তাদের ভার যার উপরে ছিল সেই অদোরামকে বাদশাহ্‌ রহবিয়াম বনি-ইসরাইলদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু তারা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। তখন বাদশাহ্‌ রহবিয়াম তাড়াতাড়ি তাঁর রথে উঠে জেরুজালেমে পালিয়ে গেলেন। এইভাবে ইসরাইলীয়রা দাউদের বংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল; অবস্থাটা আজও তা-ই আছে। ইয়ারাবিমের ফিরে আসবার খবর শুনে ইসরাইলীয়রা লোক পাঠিয়ে তাঁকে তাদের সভায় ডেকে আনল এবং সমস্ত ইসরাইলীয়দের উপর তারা তাঁকেই বাদশাহ্‌ করল। কেবল এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরাই দাউদের বংশের প্রতি বিশ্বস্ত রইল। জেরুজালেমে পৌঁছে রহবিয়াম এহুদা ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে যুদ্ধের জন্য জমায়েত করলেন। তাতে এক লক্ষ আশি হাজার সৈন্য হল। এটা করা হল যাতে ইসরাইলীয়দের সংগে যুদ্ধ করে রাজ্যটা আবার সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামের হাতে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু আল্লাহ্‌র বান্দা শময়িয়ের উপর আল্লাহ্‌র এই কালাম নাজেল হল, “তুমি এহুদার বাদশাহ্‌ সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামকে, এহুদা ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে এবং বাকী সব লোকদের বল যে, মাবুদ বলছেন তারা যেন নিজের ভাই বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না যায়। তারা প্রত্যেকেই যেন বাড়ী ফিরে যায়, কারণ এটা মাবুদেরই কাজ।” কাজেই তারা মাবুদের কথা মেনে নিয়ে মাবুদের হুকুম মত বাড়ী ফিরে গেল। পরে ইয়ারাবিম আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার শিখিম কেল্লার মত করে গড়ে নিয়ে সেখানে বাস করতে লাগলেন। তিনি সেখান থেকে গিয়ে পনূয়েলও কেল্লার মত করে গড়ে নিলেন। ইয়ারাবিম ভাবলেন, “এবার হয়তো রাজ্যটা আবার দাউদের বংশের হাতে ফিরে যাবে। লোকেরা যদি জেরুজালেমে মাবুদের এবাদত-খানায় কোরবানী দেবার জন্য যায় তবে আবার তারা তাদের মালিক এহুদার বাদশাহ্‌ রহবিয়ামের অধীনতা মেনে নেবে। তারা আমাকে হত্যা করে বাদশাহ্‌ রহবিয়ামের কাছে ফিরে যাবে।” বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিম তখন পরামর্শ করে দু’টা সোনার বাছুর তৈরী করালেন। তারপর তিনি লোকদের বললেন, “জেরুজালেমে যাওয়া তোমাদের জন্য খুব কষ্টের ব্যাপার। হে ইসরাইল, এঁরাই তোমাদের দেবতা, এঁরাই মিসর থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন।” বাছুর দু’টার একটাকে তিনি রাখলেন বেথেলে এবং অন্যটাকে রাখলেন দানে, তাই লোকেরা পূজা করবার জন্য দান পর্যন্তও যেতে লাগল। এই ব্যাপারটা তাদের গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়াল। ইয়ারাবিম পূজার উঁচু স্থানগুলোতে মন্দির তৈরী করলেন এবং এমন সব লোকদের মধ্য থেকে পুরোহিত নিযুক্ত করলেন যারা লেবির বংশের লোক ছিল না। এহুদা এলাকার মধ্যে যে ঈদ হত সেই ঈদের মত অষ্টম মাসের পনের দিনের দিন তিনি বেথেলেও একটা ঈদের ব্যবস্থা করলেন এবং নিজের তৈরী বাছুরের উদ্দেশে বেদীর উপর পশু উৎসর্গ দিলেন। তিনি বেথেলে পূজার উঁচু স্থানগুলোতে তাঁর তৈরী মন্দিরে পুরোহিতও নিযুক্ত করলেন। অষ্টম মাসের পনের দিনের দিন বেথেলে তাঁর তৈরী বেদীতে তিনি পশু উৎসর্গ দিলেন। সময়টা তাঁর নিজেরই বেছে নেওয়া। এইভাবে তিনি বনি-ইসরাইলদের জন্য ঈদের ব্যবস্থা করলেন এবং পশু উৎসর্গ দেবার জন্য বেদীতে উঠলেন। পশু বলির জন্য ইয়ারাবিম যখন বেদীর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন মাবুদের কথামত আল্লাহ্‌র একজন বান্দা এহুদা থেকে বেথেলে উপস্থিত হলেন। তিনি মাবুদের কথামত বেদীর বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন, “ওহে বেদী, ওহে বেদী, মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘দাউদের বংশে ইউসিয়া নামে একটি ছেলের জন্ম হবে। পূজার উঁচু স্থানগুলোর যে পুরোহিতেরা এখন তোমার উপর পশু বলি দিচ্ছে সেই পুরোহিতদের সে তোমার উপরেই কোরবানী দেবে এবং মানুষের হাড়ও পোড়াবে।’ ” ঐ একই দিনে আল্লাহ্‌র বান্দাটি একটা চিহ্নের কথা বললেন। তিনি বললেন, “মাবুদ এই চিহ্নের কথা ঘোষণা করেছেন যে, এই বেদীটা ফেটে যাবে এবং তার উপরকার ছাই সব পড়ে যাবে।” বেথেলে বেদীর বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌র বান্দাটির কথা শুনে বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিম বেদীর উপরে হাত বাড়িয়ে বললেন, “ওকে ধর।” কিন্তু যে হাতখানা তিনি লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেটা শুকিয়ে গেল। তিনি আর সেটা কাছে টেনে নিতে পারলেন না। তাছাড়া মাবুদের কথামত আল্লাহ্‌র বান্দাটির বলা চিহ্ন অনুসারে বেদীটা ফেটে গেল এবং তার ছাই পড়ে গেল। তখন বাদশাহ্‌ আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে বললেন, “আপনি আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌কে অনুরোধ করুন এবং আমার জন্য মুনাজাত করুন যাতে আমার হাত আবার ভাল হয়ে যায়।” তাতে আল্লাহ্‌র বান্দাটি মাবুদকে অনুরোধ করলেন আর বাদশাহ্‌র হাতটা আবার ভাল হয়ে আগের মত হয়ে গেল। বাদশাহ্‌ আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে বললেন, “আপনি আমার বাড়ীতে এসে কিছু খাওয়া-দাওয়া করুন আর আমি আপনাকে একটা উপহার দেব।” কিন্তু আল্লাহ্‌র বান্দাটি জবাবে বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনার সম্পত্তির অর্ধেকটা দিলেও আমি আপনার সংগে যাব না কিংবা কোন খাবার বা পানিও এখানে খাব না। এর কারণ হল, মাবুদের কথামত আমি এই হুকুম পেয়েছি যে, আমি যেন কোন খাবার বা পানি না খাই এবং যে পথে এসেছি সেই পথে ফিরে না যাই।” কাজেই তিনি যে পথে বেথেলে এসেছিলেন সেই পথে ফিরে না গিয়ে অন্য পথ ধরলেন। বেথেলে একজন বুড়ো নবী বাস করতেন। আল্লাহ্‌র বান্দাটি সেই দিন সেখানে যা করেছিলেন তাঁর ছেলেরা গিয়ে তাঁকে তা সবই জানাল। বাদশাহ্‌কে তিনি যা বলেছিলেন তা-ও তারা তাদের বাবাকে বলল। তাদের বাবা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তিনি কোন্‌ পথে গেছেন?” এহুদার সেই আল্লাহ্‌র বান্দাটি যে পথ ধরে চলে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলেরা তা দেখেছিল। তখন তিনি তাঁর ছেলেদের বললেন, “আমার জন্য গাধার উপরে গদি চাপাও।” তারা তা করলে পর তিনি তাতে চড়লেন। তারপর তিনি আল্লাহ্‌র বান্দাটির তালাশে গেলেন। তিনি তাঁকে একটা এলোন গাছের তলায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনিই কি আল্লাহ্‌র সেই বান্দা যিনি এহুদা দেশ থেকে এসেছেন?” জবাবে তিনি বললেন, “জ্বী, আমিই সেই লোক।” তখন নবী তাঁকে বললেন, “আমার সংগে বাড়ী চলুন, খাওয়া-দাওয়া করুন।” আল্লাহ্‌র বান্দাটি বললেন, “আমি আপনার সংগে ফিরেও যেতে পারি না কিংবা আপনার সংগে এই জায়গায় খাবার বা পানি খেতেও পারি না। আল্লাহ্‌ আমাকে হুকুম দিয়ে বলেছেন যে, আমি যেন সেখানে খাবার বা পানি না খাই কিংবা যে পথে এসেছি সেই পথে ফিরে না যাই।” জবাবে সেই নবী বললেন, “আমি আপনার মতই একজন নবী। মাবুদের কথামত একজন ফেরেশতা আমাকে বলেছেন যেন আমি আপনাকে আমার বাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাই যাতে আপনি খাবার ও পানি খেতে পারেন।” কিন্তু তিনি তাঁকে মিথ্যা কথা বললেন। আল্লাহ্‌র বান্দাটি তখন তাঁর সংগে ফিরে গেলেন এবং তাঁর বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করলেন। তাঁরা তখনও টেবিলের কাছে বসে আছেন, এমন সময় যিনি আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই নবীর উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। এহুদা থেকে আসা আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে সেই নবী চিৎকার করে বললেন, “মাবুদ এই কথা বলছেন যে, আপনি মাবুদের কথা অমান্য করেছেন এবং আপনাকে দেওয়া আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম আপনি পালন করেন নি। যে জায়গায় তিনি আপনাকে খাওয়া-দাওয়া করতে নিষেধ করেছিলেন আপনি সেখানে ফিরে গিয়ে খাবার ও পানি খেয়েছেন। কাজেই আপনার পূর্বপুরুষদের কবরস্থানে আপনার মৃতদেহ রাখা হবে না।” আল্লাহ্‌র বান্দাটি খাওয়া-দাওয়া শেষ করলে পর তাঁর জন্য সেই নবী তাঁর একটা গাধার উপর গদি চাপালেন। আল্লাহ্‌র বান্দাটি রওনা হলে পর পথে একটা সিংহ তাঁকে রাস্তার উপরে পেয়ে মেরে ফেলল। তাঁর লাশটা রাস্তার উপরে পড়ে রইল আর সেই লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল সেই গাধা আর সিংহ। কিছু লোক সেই পথ দিয়ে যাবার সময় সেই পড়ে থাকা লাশটা দেখল আর দেখল তার পাশে একটা সিংহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা গিয়ে সেই বুড়ো নবীর গ্রামে খবর দিল। সেই কথা শুনে যে নবী তাঁকে তাঁর পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি বললেন, “তিনি আল্লাহ্‌র সেই বান্দা যিনি মাবুদের হুকুম অমান্য করেছিলেন। মাবুদ তাঁকে যে কথা বলেছিলেন সেই অনুসারেই তিনি তাঁকে সিংহের হাতে তুলে দিয়েছেন এবং সিংহ তাঁকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে মেরে ফেলেছে।” তারপর সেই নবী তাঁর ছেলেদের বললেন, “আমার জন্য গাধার উপর গদি চাপাও।” ছেলেরা তা-ই করল। তারপর তিনি গিয়ে দেখলেন রাস্তার উপরে লাশটা পড়ে রয়েছে আর তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাধা আর সিংহটা। সিংহটা সেই লাশ খায় নি আর গাধাটাকেও আঘাত করে নি। আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে দাফন করতে ও তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করতে সেই নবী তাঁর লাশটা তুলে নিয়ে গাধার উপর চাপিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেলেন। তিনি নিজের জন্য তৈরী করা কবরেই তাঁকে দাফন করলেন। তিনি ও তাঁর ছেলেরা এই বলে তাঁর জন্য শোক করতে লাগলেন, “হায়, ভাই আমার!” তাঁকে দাফন করবার পর সেই নবী তাঁর ছেলেদের বললেন, “আল্লাহ্‌র বান্দাটিকে যেখানে দাফন করা হয়েছে আমি মারা গেলে পর আমাকে সেই কবরেই দাফন কোরো, আমার হাড় তাঁর হাড়ের পাশেই রেখো; কারণ বেথেলের বেদী ও সামেরিয়ার সব গ্রামের পূজার উঁচু স্থানগুলোর মন্দিরের বিরুদ্ধে মাবুদের কথামত তিনি যে বিষয় ঘোষণা করেছেন তা নিশ্চয়ই সফল হবে।” এর পরেও ইয়ারাবিম তাঁর কুপথ থেকে ফিরলেন না বরং পূজার উঁচু স্থানগুলোর জন্য সব লোকদের মধ্য থেকে পুরোহিত নিযুক্ত করলেন। যে কেউ পুরোহিত হতে চাইত তাকেই তিনি পূজার উঁচু স্থানের পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করতেন। এই সব কাজ ইয়ারাবিমের বংশের পক্ষে গুনাহ্‌ হয়ে দাঁড়াল যেন তারা ধ্বংস হয়ে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে যেতে পারে। সেই সময় ইয়ারাবিমের ছেলে অবিয় অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন ইয়ারাবিম তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “তুমি এমন কাপড়-চোপড় পর যাতে তোমাকে ইয়ারাবিমের স্ত্রী বলে চেনা না যায়। তারপর তুমি শীলোতে যাও। নবী অহিয় সেখানে আছেন। তিনিই আমাকে বলেছিলেন যে, আমি এই লোকদের বাদশাহ্‌ হব। তুমি সংগে করে দশটা রুটি, কিছু পিঠা ও এক ভাঁড় মধু নিয়ে তাঁর কাছে যাও। ছেলেটির কি হবে তা তিনি তোমাকে বলে দেবেন।” ইয়ারাবিমের স্ত্রী তাঁর কথামতই কাজ করলেন এবং শীলোতে অহিয়ের বাড়ীতে গেলেন। তখন অহিয় চোখে দেখতে পেতেন না; বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর দেখবার শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাবুদ অহিয়কে বলেছিলেন, “ইয়ারাবিমের স্ত্রী তোমার কাছে তার ছেলের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে আসছে। ছেলেটির অসুখ হয়েছে। তুমি তার কথার এই এই জবাব দেবে। এখানে এসে সে অন্য আর একজন স্ত্রীলোক বলে ভান করবে।” সেইজন্য দরজার কাছে তাঁর পায়ের শব্দ শুনে অহিয় বললেন, “এস, ইয়ারাবিমের স্ত্রী। তুমি কেন এই ভান করছ? তোমাকে খারাপ খবর দেবার জন্য আমাকে বলা হয়েছে। তুমি গিয়ে ইয়ারাবিমকে এই কথা বল যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আমি লোকদের মধ্য থেকে তোমাকে উঁচুতে তুলেছি এবং আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের উপরে নেতা করেছি। আমি দাউদের বংশ থেকে রাজ্য চিরে নিয়ে তোমাকে দিয়েছি, কিন্তু তুমি আমার গোলাম দাউদের মত হও নি। দাউদ আমার হুকুম মেনে চলত এবং মনেপ্রাণে আমার বাধ্য ছিল। আমার চোখে যা ঠিক সে কেবল তা-ই করত। তোমার আগে যারা ছিল তুমি তাদের চেয়েও বেশী খারাপ কাজ করেছ। তুমি নিজের জন্য দেব-দেবী বানিয়ে নিয়েছ আর ছাঁচে ঢেলে মূর্তি তৈরী করেছ। তুমি আমাকে রাগিয়ে তুলেছ এবং আমাকে তোমার পিছনে ফেলে রেখেছ। এইজন্য আমি ইয়ারাবিমের বংশের উপর শীঘ্রই বিপদ নিয়ে আসব। তার বংশ থেকে প্রত্যেকটি পুরুষকে আমি শেষ করে দেব- সে গোলাম হোক বা স্বাধীন হোক। লোকে যেমন করে ঘুঁটে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে তেমনি করে আমি ইয়ারাবিমের বংশকে একেবারে শেষ করে দেব। তার বংশের যে সব লোক শহরে মরবে তাদের খাবে কুকুরে আর যারা মাঠের মধ্যে মরবে তাদের খাবে পাখীতে। আমি মাবুদই এই কথা বলেছি।’ “তুমি এখন বাড়ী ফিরে যাও। তুমি শহরে পা দেওয়া মাত্রই ছেলেটি মারা যাবে। ইসরাইলের সবাই তার জন্য শোক করতে করতে তাকে দাফন করবে। ইয়ারাবিমের নিজের লোকদের মধ্যে কেবল সে-ই দাফন পাবে, কারণ ইয়ারাবিমের বংশে কেবলমাত্র সেই ছেলেটির মধ্যেই ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি ভয় দেখতে পেয়েছেন। “মাবুদ নিজের উদ্দেশ্যে ইসরাইলের লোকদের উপরে এমন একজনকে বাদশাহ্‌ করবেন যে ইয়ারাবিমের বংশকে একেবারে ধ্বংস করে দেবে। আজকেই সেই দিন, জ্বী, এখনই। মাবুদ ইসরাইলকে আঘাত করবেন, আর তাতে তা পানির মধ্যে দুলতে থাকা নল-খাগড়ার মত হবে। যে দেশ তিনি তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলেন সেই সুন্দর দেশ থেকে তিনি তাদের উপ্‌ড়ে তুলে ফোরাত নদীর ওপারে ছড়িয়ে দেবেন, কারণ আশেরা-খুঁটি স্থাপন করে তারা মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছে। ইয়ারাবিম নিজে যে সব গুনাহ্‌ করেছে এবং ইসরাইলের লোকদের দিয়ে করিয়েছে তার জন্য মাবুদ তাদের ত্যাগ করবেন।” এর পর ইয়ারাবিমের স্ত্রী চলে গেলেন এবং তির্সা শহরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি বাড়ীর দরজার চৌকাঠে পা দেওয়া মাত্রই ছেলেটি মারা গেল। মাবুদ তাঁর গোলাম নবী অহিয়ের মধ্য দিয়ে যেমন বলেছিলেন তেমনই ইসরাইলের সমস্ত লোক ছেলেটির জন্য শোক করতে করতে তাকে দাফন করল। ইয়ারাবিমের অন্যান্য কাজ, তাঁর সব যুদ্ধ এবং রাজত্ব করবার কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। বাইশ বছর রাজত্ব করবার পর তিনি তাঁর পূর্বপরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে নাদব বাদশাহ্‌ হলেন। এদিকে এহুদা দেশে সোলায়মানের ছেলে রহবিয়াম রাজত্ব করছিলেন। তিনি যখন বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল একচল্লিশ। ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর সমস্ত জায়গার মধ্য থেকে যে শহরটা মাবুদ নিজের বাসস্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সেই জেরুজালেম শহরে রহবিয়াম সতেরো বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল নয়মা; তিনি জাতিতে ছিলেন একজন অম্মোনীয়। মাবুদের চোখে যা খারাপ এহুদার লোকেরা তা-ই করতে লাগল। তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে তাদের গুনাহের মধ্য দিয়ে তারা মাবুদের দিলের জ্বালা আরও বেশী করে জাগিয়ে তুলেছিল। এছাড়া তারা নিজেদের জন্য প্রত্যেকটা উঁচু পাহাড়ের উপরে ও প্রত্যেকটা ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে পূজার উঁচু স্থান ঠিক করেছিল এবং পবিত্র পাথর ও আশেরা-খুঁটি স্থাপন করেছিল। এমন কি, তাদের দেশে পুরুষ মন্দির-বেশ্যাও ছিল। যে জাতিগুলোকে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে দূর করে দিয়েছিলেন তাদের সমস্ত ঘৃণার কাজ এহুদার লোকেরা করতে লাগল। বাদশাহ্‌ রহবিয়ামের রাজত্বের পঞ্চম বছরে মিসরের বাদশাহ্‌ শীশক জেরুজালেম আক্রমণ করলেন। তিনি মাবুদের ঘরের ও রাজবাড়ীর ধন-দৌলত নিয়ে গেলেন। তিনি সব কিছুই নিয়ে গেলেন, এমন কি, সোলায়মানের তৈরী সোনার সব ঢালগুলোও নিয়ে গেলেন। কাজেই বাদশাহ্‌ রহবিয়াম সেগুলোর বদলে ব্রোঞ্জের ঢাল তৈরী করালেন। রাজবাড়ীর দরজায় যে সব সৈন্যেরা পাহারা দিত তাদের সেনাপতিদের কাছে তিনি সেগুলো রক্ষা করবার ভার দিলেন। বাদশাহ্‌ যখন মাবুদের ঘরে যেতেন তখন পাহারাদার সৈন্যেরা সেই ঢালগুলো ধরে নিয়ে তাঁর সংগে যেত এবং পরে সেগুলো তারা পাহারা-ঘরে জমা দিত। রহবিয়ামের অন্যান্য কাজ, অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছিলেন তা সব “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। রহবিয়াম ও ইয়ারাবিমের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ চলত। পরে রহবিয়াম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে দাফন করা হয়েছিল। তাঁর মায়ের নাম ছিল নয়মা; তিনি জাতিতে ছিলেন একজন অম্মোনীয়। রহবিয়ামের পরে তাঁর ছেলে অবিয়াম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের রাজত্বের আঠারো বছরের সময় অবিয়াম এহুদার বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি তিন বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মাখা; তিনি অবীশালোমের মেয়ে। অবিয়ামের বাবা যে সব গুনাহ্‌ করেছিলেন তিনিও সেই সব করতে থাকলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের মত তাঁর দিল তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ে পূর্ণ ছিল না। তবুও দাউদের কথা মনে করে তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁকে জেরুজালেমে একটা বাতি দিলেন, অর্থাৎ তাঁর সিংহাসনে বসবার জন্য তাঁকে একটা ছেলে দিলেন এবং জেরুজালেমকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন, কারণ মাবুদের চোখে যা ঠিক দাউদ তা-ই করতেন। কেবল হিট্টীয় উরিয়ার ব্যাপারটা ছাড়া তাঁর সারা জীবনে তিনি মাবুদের কোন হুকুমই অমান্য করেন নি। রহবিয়াম ও ইয়ারাবিমের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা অবিয়ামের সারা জীবন ধরে চলেছিল। অবিয়ামের অন্যান্য কাজ, অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছিলেন তা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। অবিয়াম ও ইয়ারাবিমের মধ্যে যুদ্ধ হত। পরে অবিয়াম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন, আর দাউদ-শহরে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে আসা বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিমের রাজত্বের বিশ বছরের সময়ে আসা এহুদার বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি একচল্লিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর দাদীর নাম ছিল মাখা। তিনি ছিলেন অবীশালোমের মেয়ে। তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের মত আসা মাবুদের চোখে যা ঠিক তা-ই করতেন। তিনি দেশ থেকে পুরুষ মন্দির-বেশ্যাদের তাড়িয়ে দিলেন এবং পূর্বপুরুষদের তৈরী সব মূর্তিগুলোও দূর করলেন। এমন কি, তিনি তাঁর দাদী মাখাকেও রাজমাতার পদ থেকে সরিয়ে দিলেন, কারণ তিনি একটা জঘন্য আশেরা-মূর্তি তৈরী করিয়েছিলেন। আসা সেই মূর্তিটা কেটে ফেলে কিদ্রোণ উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে সেটা পুড়িয়ে দিলেন। পূজার উঁচু স্থানগুলো যদিও তিনি ধ্বংস করেন নি তবুও সারা জীবন তাঁর দিল মাবুদের প্রতি ভয়ে পূর্ণ ছিল। তিনি ও তাঁর বাবা যে সব সোনা, রূপা ও অন্যান্য জিনিস মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করেছিলেন সেগুলো তিনি মাবুদের ঘরে নিয়ে গেলেন। আসা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশার গোটা রাজত্বকাল ধরে তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ চলেছিল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশা এহুদার লোকদের বিরুদ্ধে গিয়ে রামা শহরটা কেল্লার মত করে গড়ে তুলতে লাগলেন যাতে কেউ এহুদার বাদশাহ্‌ আসার কাছে যাওয়া-আসা করতে না পারে। মাবুদের ঘরে এবং নিজের রাজবাড়ীর ভাণ্ডারে যে সব সোনা ও রূপা ছিল আসা সেগুলো সব বের করে নিলেন। সেগুলো তাঁর কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বিন্‌হদদ ছিলেন টব্রিম্মোণের ছেলে হিষিয়োণের নাতি। তিনি তখন দামেস্কে রাজত্ব করছিলেন। আসা তাঁকে বলে পাঠালেন, “আমার ও আপনার বাবার মত আসুন, আমরাও আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি করি। আমি আপনাকে এই সব সোনা ও রূপা উপহার পাঠালাম। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশার সংগে আপনি এখন চুক্তি ভেংগে ফেলুন, তাতে সে আমার কাছ থেকে চলে যাবে।” বাদশাহ্‌ আসার কথায় বিন্‌হদদ রাজী হয়ে তাঁর সেনাপতিদের ইসরাইলের গ্রামগুলোর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ইয়োন, দান, আবেল-বৈৎ-মাখা ও সমস্ত গালীল এবং তার সংগে নপ্তালি-এলাকাটা দখল করে নিলেন। বাশা এই কথা শুনে রামা শহর শক্তিশালী করে গড়ে তুলবার কাজ বন্ধ করে তির্সাতে ফিরে গেলেন। তারপর বাদশাহ্‌ আসা এহুদার সকলের উপর একটা হুকুম জারি করলেন, কাউকে বাদ দিলেন না। তাতে লোকেরা রামায় বাশার ব্যবহার করা পাথর ও কাঠ সব নিয়ে গেল। বাদশাহ্‌ আসা সেই সব দিয়ে বিন্‌ইয়ামীনের গেবা ও মিসপা গ্রাম কেল্লার মত করে গড়ে তুললেন। আসার অন্যান্য সব কাজ, যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা, তিনি যা কিছু করেছিলেন এবং যে সব গ্রাম তিনি নতুনভাবে গড়ে তুলেছিলেন তা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। বুড়ো বয়সে আসার পায়ে একটা রোগ হল। পরে আসা তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর ছেলে যিহোশাফট তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে ইয়ারাবিমের ছেলে নাদব ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি ইসরাইলে দু’বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তিনি তাঁর বাবার মত চলতেন, অর্থাৎ তাঁর পিতা ইসরাইলীয়দের দিয়ে যেমন গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনিও তা-ই করেছিলেন। ইষাখর-গোষ্ঠীর অহিয়ের ছেলে বাশা নাদবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। নাদব ও সমস্ত ইসরাইলীয়রা যখন ফিলিস্তিনীদের গিব্বথোন ঘেরাও করেছিল তখন বাশা গিব্বথোনে নাদবকে হত্যা করলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের তৃতীয় বছরে বাশা নাদবকে হত্যা করে তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি বাদশাহ্‌ হয়েই ইয়ারাবিমের পরিবারের সবাইকে হত্যা করলেন। মাবুদ তাঁর গোলাম শীলোনীয় নবী অহিয়ের মধ্য দিয়ে যে কথা বলেছিলেন সেই অনুসারে বাশা ইয়ারাবিমের পরিবারের সবাইকে ধ্বংস করে ফেললেন। এর কারণ হল, ইয়ারাবিম নিজে গুনাহ্‌ করেছিলেন এবং ইসরাইলকে দিয়েও গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন আর তা করে তিনি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌কে রাগিয়ে তুলেছিলেন। নাদবের অন্যান্য কাজ, অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছিলেন তা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। আসা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশার গোটা রাজত্বকাল ধরে তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের তৃতীয় বছরে গোটা ইসরাইল দেশের উপরে অহিয়ের ছেলে বাশা তির্সায় রাজত্ব করতে শুরু করেছিলেন। তিনি চব্বিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। তিনি ইয়ারাবিমের মত চলতেন, অর্থাৎ ইয়ারাবিম যেমন ইসরাইলীয়দের দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনিও তা-ই করেছিলেন। তখন বাশার বিরুদ্ধে হনানির ছেলে যেহূর উপর মাবুদের এই কালাম নাজেল হল, “হে বাশা, আমি তোমাকে ধুলা থেকে তুলে এনে আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের নেতা করেছি। কিন্তু তুমি ইয়ারাবিমের পথে চলেছ ও আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছ আর তাদের সেই গুনাহের দরুন আমাকে রাগিয়ে তুলেছ। কাজেই তুমি ও তোমার বংশকে আমি ধ্বংস করতে যাচ্ছি। আমি তোমার বংশকে নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের বংশের মত করব। তোমার যে লোকেরা শহরে মরবে তাদের খাবে কুকুরে আর মাঠের মধ্যে যারা মরবে তাদের খাবে পাখীতে।” বাশার অন্যান্য কাজ, যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা এবং তিনি যা কিছু করেছিলেন তা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে বাশা তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তির্সায় তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে এলা বাদশাহ্‌ হলেন। হনানির ছেলে নবী যেহূর মধ্য দিয়ে বাশা ও তাঁর বংশের বিরুদ্ধে মাবুদের কালাম প্রকাশিত হয়েছিল, কারণ ইয়ারাবিমের বংশের মত তিনি মাবুদের চোখে যা খারাপ তা করে মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছিলেন এবং ইয়ারাবিমের বংশকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের ছাব্বিশ বছরের সময় বাশার ছেলে এলা ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি তির্সায় দু’বছর রাজত্ব করেছিলেন। সিম্রি নামে তাঁর একজন সেনাপতি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এলার যত রথ ছিল তার অর্ধেকের ভার ছিল সিম্রির উপর। এলা এই সময় অর্সার ঘরে মাতাল হবার জন্য মদানো রস খাচ্ছিলেন। এই অর্সার উপর তির্সার রাজবাড়ীর তদারকের ভার ছিল। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের সাতাশ বছরের সময় সিম্রি সেই ঘরে ঢুকে এলাকে হত্যা করলেন। তারপর তিনি এলার জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। সিংহাসনে বসে রাজত্বের শুরুতেই সিম্রি বাশার বংশের সবাইকে হত্যা করলেন। আত্মীয়-বন্ধু কোন পুরুষকেই তিনি বাঁচিয়ে রাখলেন না। নবী যেহূর মধ্য দিয়ে মাবুদ বাশার বিরুদ্ধে যে কথা বলেছিলেন সেই অনুসারে সিম্রি বাশার বংশের সবাইকে ধ্বংস করে দিলেন। এর কারণ হল, বাশা ও তাঁর ছেলে এলা নিজেরা অনেক গুনাহ্‌ করেছিলেন এবং ইসরাইলকে দিয়েও গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন। তাঁরা অসার প্রতিমা দিয়ে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌কে রাগিয়ে তুলেছিলেন। এলার অন্যান্য কাজ, অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছিলেন তা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের সাতাশ বছরের সময় সিম্রি তির্সায় সাত দিন রাজত্ব করেছিলেন। সেই সময় ইসরাইলীয় সৈন্যদল ফিলিস্তিনীদের গিব্বথোন ঘেরাও করে ছিল। ইসরাইলীয়রা ছাউনির মধ্যে যখন শুনতে পেল যে, সিম্রি বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেছেন তখন সেই দিনই তারা ছাউনির মধ্যে প্রধান সেনাপতি অম্রিকে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বলে ঘোষণা করল। তখন অম্রি ও তাঁর সংগে সমস্ত ইসরাইলীয়রা গিব্বথোন থেকে সরে এসে তির্সা ঘেরাও করল। শহরটা অধিকার করা হয়ে গেছে দেখে সিম্রি রাজবাড়ীর কেল্লায় গেলেন এবং আগুন লাগিয়ে গোটা রাজবাড়ী পুড়িয়ে দিলেন। সেই সময় তিনি নিজেও পুড়ে মরলেন। তাঁর গুনাহের জন্যই তাঁকে মরতে হল, কারণ মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তিনি ইয়ারাবিমের মত চলতেন, অর্থাৎ ইয়ারাবিম ইসরাইলীয়দের দিয়ে যেমন গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনিও তা-ই করেছিলেন। সিম্রির অন্যান্য কাজ এবং তাঁর বিদ্রোহের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। এর পর বনি-ইসরাইলরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। তাদের অর্ধেক লোক চাইল গীনতের ছেলে তিব্‌নিকে বাদশাহ্‌ করতে আর বাকী অর্ধেক চাইল অম্রিকে বাদশাহ্‌ করতে। কিন্তু অম্রির পক্ষের লোকেরা গীনতের ছেলে তিব্‌নির পক্ষের লোকদের হারিয়ে দিল। এতে তিব্‌নি মারা গেল আর অম্রি বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের একত্রিশ বছরের সময় অম্রি ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন, তার মধ্যে ছয় বছর রাজত্ব করেছিলেন তির্সায়। তিনি আটাত্তর কেজি রূপা দিয়ে সামেরের কাছ থেকে সামেরিয়া পাহাড়টা কিনলেন এবং পাহাড়ের উপরে একটা শহর তৈরী করলেন এবং পাহাড়টার আগেকার মালিক সামেরের নাম অনুসারে শহরটার নাম রাখলেন সামেরিয়া। অম্রি মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন এবং তাঁর আগে যাঁরা বাদশাহ্‌ ছিলেন তাঁদের সকলের চেয়ে তিনি বেশী গুনাহ্‌ করতেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের মত চলতেন, অর্থাৎ ইয়ারাবিম যেমন ইসরাইলীয়দের দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন অম্রিও তা-ই করেছিলেন। তাতে ইসরাইলীয়রা অসার প্রতিমা দিয়ে তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে রাগিয়ে তুলেছিল। অম্রির অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে অম্রি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে সামেরিয়ায় দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে আহাব বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আসার রাজত্বের আটত্রিশ বছরের সময় অম্রির ছেলে আহাব ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি বাইশ বছর সামেরিয়ায় থেকে ইসরাইলের উপর রাজত্ব করেছিলেন। অম্রির ছেলে আহাব মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন, এমন কি, তাঁর আগে যাঁরা বাদশাহ্‌ ছিলেন তাঁদের সকলের চেয়ে আরও বেশী করে তা করতেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম যে সব গুনাহ্‌ করেছিলেন সেগুলোকে তিনি সামান্য ব্যাপার বলে মনে করতেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি সিডনীয়দের বাদশাহ্‌ ইৎবালের মেয়ে ঈষেবলকে বিয়ে করলেন এবং বাল-দেবতার সেবা ও পূজা করতে লাগলেন। তিনি সামেরিয়াতে বাল-দেবতার জন্য যে মন্দির তৈরী করেছিলেন সেখানে তার জন্য একটা বেদী তৈরী করলেন। তিনি একটা আশেরা-খুঁটিও তৈরী করলেন এবং তাঁর আগে ইসরাইলীয়দের সমস্ত বাদশাহ্‌রা ইসরাইলীয়দের মাবুদ আল্লাহ্‌কে যতটা রাগিয়েছিলেন তিনি তাঁর কাজের দ্বারা তাঁকে আরও বেশী রাগালেন। আহাবের সময়ে বেথেলীয় হীয়েল জেরিকো শহরটা আবার তৈরী করলেন। নূনের ছেলে ইউসার মধ্য দিয়ে মাবুদের কালাম অনুসারে সেই শহরের ভিত্তি গাঁথার জন্য হীয়েলের বড় ছেলে অবীরামকে প্রাণ দিতে হল এবং তার সদর দরজা লাগাবার জন্য তার ছোট ছেলে সগূবকে প্রাণ দিতে হল। গিলিয়দের তিশ্‌বী গ্রামের ইলিয়াস আহাবকে বললেন, “আমি যাঁর এবাদত করি ইসরাইলীয়দের সেই মাবুদ আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি যে, আমি না বলা পর্যন্ত আগামী কয়েক বছরে শিশিরও পড়বে না, বৃষ্টিও পড়বে না।” পরে মাবুদ ইলিয়াসকে বললেন, “তুমি এই জায়গা ছেড়ে পূর্ব দিকে যাও এবং জর্ডানের পূর্ব দিকে করীৎ স্রোতের ধারে লুকিয়ে থাক। তুমি সেই স্রোতের পানি খাবে আর সেখানে তোমাকে খাবার দেবার জন্য আমি দাঁড়কাকদের ঠিক করে রেখেছি।” কাজেই মাবুদ ইলিয়াসকে যা বললেন তিনি তা-ই করলেন। তিনি জর্ডানের পূর্ব দিকে করীৎ স্রোতের ধারে গিয়ে থাকতে লাগলেন। দাঁড়কাকেরা সকালে ও বিকালে তাঁর জন্য রুটি ও গোশ্‌ত আনত এবং তিনি সেই স্রোতের পানি খেতেন। দেশে বৃষ্টি না হওয়াতে কিছুকাল পরে সেই স্রোতের পানি শুকিয়ে গেল। তখন মাবুদের এই কালাম ইলিয়াসের উপর নাজেল হল, “তুমি এখন সিডনের সারিফতে গিয়ে থাক। তোমাকে খাবার যোগাবার জন্য আমি সেখানকার এক বিধবাকে ঠিক করে রেখেছি।” সেইজন্য তিনি সারিফতে গেলেন। গ্রামে ঢুকবার পথে পৌঁছে তিনি একজন বিধবাকে কাঠ কুড়াতে দেখলেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, “আমার খাবার জন্য পাত্রে করে একটু পানি আনতে পারবে?” সে যখন যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে আবার ডেকে বললেন, “দয়া করে আমার জন্য এক টুকরা রুটিও এনো।” জবাবে সেই বিধবা বলল, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি যে, আমার কাছে একটাও রুটি নেই। পাত্রে কেবল এক মুঠো ময়দা আর ভাঁড়ে একটুখানি তেল রয়েছে। বাড়ী নিয়ে যাবার জন্য আমি কতগুলো কাঠ কুড়াচ্ছি; তা দিয়ে আমার ও আমার ছেলের জন্য কিছু খাবার তৈরী করব। তারপর তা খেয়ে আমরা মরব।” ইলিয়াস তাকে বললেন, “ভয় কোরো না। যা বললে বাড়ী গিয়ে তা-ই কর। কিন্তু তোমার যা আছে তা থেকে আগে আমার জন্য একটা ছোট রুটি তৈরী করে নিয়ে এস। তারপর তোমার ও তোমার ছেলের জন্য রুটি তৈরী কোরো। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন যে, তিনি বৃষ্টি না দেওয়া পর্যন্ত ঐ ময়দার পাত্রটাও খালি হবে না আর তেলের ভাঁড়ও খালি হবে না।” তখন সে গিয়ে ইলিয়াস তাকে যা করতে বলেছিলেন তা-ই করল। তাতে ইলিয়াস আর সেই স্ত্রীলোক ও তার ছেলেটি অনেক দিন পর্যন্ত খাবার খেতে থাকল। ইলিয়াসের মধ্য দিয়ে মাবুদ যে কথা বলেছিলেন সেই অনুসারে ঐ ময়দার পাত্রটাও খালি হল না, তেলের ভাঁড়ও খালি হল না। কিছুদিন পরে সেই ঘরের মালিক ঐ স্ত্রীলোকটির ছেলের অসুখ হল। তার অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল যে, শেষে সে মারা গেল। স্ত্রীলোকটি তখন ইলিয়াসকে বলল, “হে আল্লাহ্‌র বান্দা, আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি? আপনি কি আমাকে আমার গুনাহের কথা মনে করিয়ে দিতে আর আমার ছেলেকে হত্যা করতে এসেছেন?” জবাবে ইলিয়াস বললেন, “তোমার ছেলেটিকে আমার কাছে দাও।” তিনি ছেলেটিকে সেই স্ত্রীলোকের কোল থেকে নিয়ে উপরের যে ঘরে তিনি থাকতেন সেখানে গেলেন এবং তাকে নিজের বিছানার উপর শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি মাবুদকে ডেকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ আমার মাবুদ, আমি যে বিধবার বাড়ীতে থাকি তার ছেলের মৃত্যু ঘটিয়ে কেন তুমি তার উপর এই দুঃখ নিয়ে আসলে?” তারপর তিনি তিন বার ছেলেটির উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে মাবুদকে ডেকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ আমার মাবুদ, ছেলেটির প্রাণ তার মধ্যে ফিরে আসুক।” মাবুদ ইলিয়াসের কথা শুনলেন এবং ছেলেটির প্রাণ তার মধ্যে ফিরে আসল আর সে বেঁচে উঠল। ইলিয়াস তখন ছেলেটিকে তুলে নিয়ে ঐ ঘর থেকে নীচে নেমে বাড়ীর ভিতরে গেলেন। তারপর তাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে বললেন, “এই দেখ, তোমার ছেলে বেঁচে আছে।” তখন সেই স্ত্রীলোকটি ইলিয়াসকে বলল, “আমি এখন বুঝতে পারলাম আপনি আল্লাহ্‌র বান্দা, আর মাবুদ আপনার মধ্য দিয়ে যা বলেন তা সত্য।” এর অনেক দিন পরে, বৃষ্টি না হওয়ার তৃতীয় বছরের সময় মাবুদ ইলিয়াসকে বললেন, “তুমি গিয়ে আহাবকে দেখা দাও। আমি দেশে বৃষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” কাজেই ইলিয়াস আহাবকে দেখা দিতে গেলেন। তখন সামেরিয়াতে ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছিল। আহাব ওবদিয়কে ডেকে পাঠালেন। রাজবাড়ীর দেখাশোনার ভার ওবদিয়ের উপরে ছিল। মাবুদের উপর ওবদিয়ের ভয়পূর্ণ ঈমান খুব বেশী ছিল। ঈষেবল যখন মাবুদের নবীদের হত্যা করছিলেন তখন ওবদিয় একশোজন নবীকে নিয়ে পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে দু’টা গুহায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি তাঁদের খাবার ও পানির যোগান দিতেন। ওবদিয় আসলে পর আহাব তাঁকে বললেন, “তুমি দেশের সব ঝর্ণা ও উপত্যকার কাছে যাও। ঘোড়া আর খ"চরগুলোর প্রাণ রক্ষার জন্য হয়তো কিছু ঘাস পাওয়া যাবে। তাতে আমাদের কোন পশুকে মেরে ফেলতে হবে না।” তাঁরা দু’জন ঘুরে দেখবার জন্য দেশটা ভাগ করে নিলেন। আহাব নিজে গেলেন এক দিকে আর ওবদিয় গেলেন অন্য দিকে। ওবদিয় পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় ইলিয়াসের সংগে তাঁর দেখা হল। ওবদিয় তাঁকে চিনতে পেরে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বললেন, “আমার প্রভু ইলিয়াস, এ কি সত্যিই আপনি?” জবাবে তিনি বললেন, “জ্বী, আমিই। তুমি তোমার মালিককে গিয়ে জানাও যে, ইলিয়াস এখানে আছেন।” ওবদিয় বললেন, “আমি কি অন্যায় করেছি যে, আপনি আপনার গোলাম আমাকে হত্যা করবার জন্য আহাবের হাতে তুলে দিচ্ছেন? আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলছি যে, এমন কোন জাতি বা রাজ্য নেই যেখানে আমার মালিক আপনার তালাশে লোক পাঠান নি। সেই সব জাতি বা রাজ্য যখনই ঘোষণা করেছে যে, আপনি সেখানে নেই তখনই তিনি তাদের দিয়ে এই কসম খাইয়ে নিয়েছেন যে, তারা সত্যিই আপনাকে তালাশ করে পায় নি। আর এখন আপনি আমাকে আমার মালিকের কাছে গিয়ে বলতে বলছেন যে, ইলিয়াস এখানে আছেন। আমি আপনাকে ছেড়ে চলে গেলে মাবুদের রূহ্‌ আপনাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন যা আমি জানব না। আমি গিয়ে আহাবকে বললে পর যদি তিনি আপনাকে খুঁজে না পান তবে তিনি আমাকে হত্যা করবেন। কিন্তু অল্প বয়স থেকেই আপনার গোলাম আমি মাবুদকে ভয় করে আসছি। ঈষেবল যখন মাবুদের নবীদের হত্যা করছিলেন তখন আমি কি করেছি তা কি হুজুর শোনেন নি? মাবুদের নবীদের একশোজনকে পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে দু’টা গুহায় লুকিয়ে রেখেছি এবং তাদের খাবার ও পানির যোগান দিয়েছি। আর আপনি এখন আমাকে আমার মালিকের কাছে গিয়ে বলতে বলছেন যে, ইলিয়াস এখানে আছেন। তিনি তো আমাকে হত্যা করবেন।” ইলিয়াস বললেন, “আমি যাঁর এবাদত করি, অর্থাৎ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কসম খেয়ে বলছি যে, আমি আজই আহাবের সামনে নিশ্চয় উপস্থিত হব।” তখন ওবদিয় আহাবের সংগে দেখা করে কথাটা তাঁকে বললেন আর আহাব ইলিয়াসের সংগে দেখা করতে গেলেন। ইলিয়াসকে দেখে আহাব বললেন, “হে ইসরাইলের কাঁটা, এ কি তুমি?” জবাবে ইলিয়াস বললেন, “আমি কাঁটা নই, কিন্তু আপনি ও আপনার পিতার বংশের লোকেরাই ইসরাইলের কাঁটা। আপনারা মাবুদের হুকুম ত্যাগ করে বাল-দেবতাদের পিছনে গিয়েছেন। এখন লোক পাঠিয়ে ইসরাইলের সবাইকে কর্মিল পাহাড়ে আমার কাছে জমায়েত করুন। ঈষেবলের টেবিলে বাল-দেবতার যে চারশো পঞ্চাশজন নবী এবং আশেরার চারশোজন নবী খাওয়া-দাওয়া করে তাদের নিয়ে আসুন।” তখন আহাব ইসরাইলের সব জায়গায় খবর পাঠিয়ে দিলেন এবং কর্মিল পাহাড়ে ঐ নবীদের জমায়েত করলেন। ইলিয়াস লোকদের সামনে গিয়ে বললেন, “আর কতদিন তোমরা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবে? যদি আল্লাহ্‌ই মাবুদ হন তবে তাঁর এবাদত কর, আর যদি বাল-দেবতাই মাবুদ হয় তবে তার এবাদত কর।” কিন্তু লোকেরা কোন জবাব দিল না। তখন ইলিয়াস তাদের বললেন, “মাবুদের নবীদের মধ্যে কেবল আমিই বাকী আছি, কিন্তু বাল-দেবতার নবী রয়েছে সাড়ে চারশো জন। এখন আমাদের জন্য দু’টা ষাঁড় নিয়ে আসা হোক। ওরা নিজেদের জন্য একটা ষাঁড় বেছে নিয়ে জবাই করে টুকরা টুকরা করে কাঠের উপর রাখুক, কিন্তু তাতে আগুন না দিক। আমি অন্য ষাঁড়টা নিয়ে জবাই করে প্রস্তুত করে কাঠের উপরে রাখব কিন্তু তাতে আগুন দেব না। তারপর ওরা ওদের দেবতাকে ডাকবে আর আমি ডাকব আল্লাহ্‌কে। যিনি আগুন পাঠিয়ে এর জবাব দেবেন তিনিই মাবুদ।” এই কথা শুনে সবাই বলল, “আপনি ভালই বলেছেন।” ইলিয়াস বাল-দেবতার নবীদের বললেন, “তোমরা একটা ষাঁড় বেছে নিয়ে প্রথমে সেটা জবাই করে প্রস্তুত করে নাও, কারণ তোমরা সংখ্যায় অনেক। তারপর তোমরা তোমাদের দেবতাকে ডাক, কিন্তু আগুন দেবে না।” যে ষাঁড়টা তাদের দেওয়া হল তারা সেটা জবাই করে প্রস্তুত করে নিল। তারপর তারা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাল-দেবতাকে ডাকতে লাগল। তারা জোরে জোরে বলতে লাগল, “হে বালদেব, আমাদের জবাব দাও।” কিন্তু কোন সাড়া মিলল না, কেউ জবাব দিল না। যে বেদী তারা তৈরী করেছিল তার চারপাশে তারা নাচতে লাগল। দুপুর বেলায় ইলিয়াস তাদের ঠাট্টা করে বললেন, “জোরে চিৎকার কর, সে তো দেবতা। হয়তো সে গভীর চিন্তা করছে, না হয় পায়খানায় গেছে, না হয় পথে চলেছে। হয়তো সে ঘুমাচ্ছে, তাকে জাগাতে হবে।” কাজেই তারা আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল এবং তাদের নিয়ম অনুসারে শরীরে রক্তের ধারা বয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ছোরা ও কাঁটা দিয়ে নিজেদের আঘাত করতে থাকল। দুপুর গড়িয়ে গেল আর বিকাল বেলার পশু-কোরবানীর সময় পর্যন্ত ভাবে-ধরা লোকের মত তারা আবোল-তাবোল বলতেই থাকল। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না, কেউ জবাব দিল না, কেউ মনোযোগও দিল না। তখন ইলিয়াস সমস্ত লোকদের বললেন, “তোমরা আমার কাছে এস।” তারা তাঁর কাছে গেল। ইলিয়াস মাবুদের ভেংগে-পড়া কোরবানগাহ্‌ মেরামত করে নিলেন। তিনি ইয়াকুবের ছেলেদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর জন্য একটা করে বারোটা পাথর নিলেন। এই ইয়াকুবকেই মাবুদ বলেছিলেন, “তোমার নাম হবে ইসরাইল।” সেই পাথরগুলো দিয়ে ইলিয়াস মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং তার চারপাশে এমন নালা কাটলেন যার মধ্যে বারো কেজি বীজে ভরা একটা থলি বসানো যায়। তারপর তিনি কোরবানগাহের উপরে কাঠ সাজিয়ে ষাঁড়টা টুকরা টুকরা করে সেই কাঠের উপর রাখলেন এবং তাদের বললেন, “তোমরা চারটা কলসী পানিতে ভরে এই পোড়ানো-কোরবানীর গোশ্‌ত ও কাঠের উপরে ঢেলে দাও।” তারপর তিনি বললেন, “আবার কর।” লোকেরা তা-ই করল। তিনি হুকুম দিলেন, “তৃতীয়বার কর।” তারা তৃতীয়বার তা-ই করল। তখন কোরবানগাহের উপর থেকে পানি গড়িয়ে নালা ভরতি হয়ে গেল। বিকালের কোরবানীর সময় হলে পর নবী ইলিয়াস সামনে এগিয়ে এসে মুনাজাত করলেন, “হে আল্লাহ্‌, ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইসরাইলের মাবুদ, আজকে তুমি জানিয়ে দাও যে, ইসরাইলের মধ্যে তুমিই মাবুদ এবং আমি তোমার গোলাম, আর তোমার হুকুমেই আমি এই সব করেছি। হে আল্লাহ্‌, আমাকে জবাব দাও, জবাব দাও, যাতে এই সব লোকেরা জানতে পারে যে, হে আল্লাহ্‌, তুমিই মাবুদ আর তুমিই তাদের মন ফিরিয়ে এনেছ।” তখন উপর থেকে আল্লাহ্‌র আগুন পড়ে কোরবানীর গোশ্‌ত, কাঠ, পাথর ও মাটি পুড়িয়ে ফেলল এবং নালার পানিও চুষে নিল। এ দেখে লোকেরা সবাই মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে চিৎকার করে বলল, “আল্লাহ্‌ই মাবুদ, আল্লাহ্‌ই মাবুদ।” তখন ইলিয়াস তাদের এই হুকুম দিলেন, “বাল দেবতার নবীদের ধর। তাদের একজনকেও পালিয়ে যেতে দিয়ো না।” তখন লোকেরা তাদের ধরে ফেলল। ইলিয়াস তাদের কীশোন উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে সেখানে তাদের হত্যা করলেন। তারপর ইলিয়াস আহাবকে বললেন, “আপনি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করুন, কারণ ভীষণ বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে।” এতে আহাব খাওয়া-দাওয়া করতে গেলেন, কিন্তু ইলিয়াস গিয়ে কর্মিল পাহাড়ের উপরে উঠলেন। তিনি মাটিতে হাঁটু পেতে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ রাখলেন। পরে তিনি তাঁর চাকরকে বললেন, “তুমি গিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে দেখ।” সে গিয়ে দেখে বলল, “ওখানে কিছু নেই।” সাতবার ইলিয়াস তাকে ফিরে গিয়ে দেখতে বললেন। সপ্তম বারে চাকরটি এসে বলল, “মানুষের হাতের মত ছোট একটা মেঘ সমুদ্র থেকে উঠছে।” তখন ইলিয়াস তাকে বললেন, “তুমি গিয়ে আহাবকে বল যেন তিনি তাঁর রথ ঠিক করে নিয়ে চলে যান, নাহলে বৃষ্টি তাঁকে যেতে বাধা দেবে।” এর মধ্যে আকাশ মেঘে কালো হয়ে গেল, বাতাস উঠল এবং ভীষণ বৃষ্টি এসে গেল। আহাব রথে করে যিষ্রিয়েলে রওনা হলেন। তখন মাবুদের শক্তি ইলিয়াসের উপর আসল। তিনি তাঁর কাপড়খানা কোমর-বাঁধনিতে গুঁজে নিয়ে আহাবের আগে আগে দৌড়ে যিষ্রিয়েলে গেলেন। ইলিয়াস যা যা করেছেন এবং কেমন করে সমস্ত নবীদের হত্যা করেছেন তা সবই আহাব ঈষেবলকে বললেন। সব কথা শুনে ঈষেবল লোক দিয়ে ইলিয়াসকে বলে পাঠালেন, “কাল এই সময়ের মধ্যে তোমার প্রাণের দশা যদি তাদের একজনের মত না করি তবে দেবতারা যেন আমাকে শাস্তি দেন আর তা ভীষণভাবেই দেন।” ইলিয়াস এতে ভয় পেয়ে তাঁর প্রাণ বাঁচাবার জন্য পালিয়ে গেলেন। তিনি এহুদা-এলাকার বের্‌-শেবাতে পৌঁছে তাঁর চাকরকে সেখানে রাখলেন, কিন্তু তিনি নিজে মরুভূমির মধ্যে একদিনের পথ এগিয়ে গেলেন। সেখানে একটা রোতম গাছের নীচে বসে মৃত্যুর জন্য মুনাজাত করলেন। তিনি বললেন, “হে মাবুদ, যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি আমার প্রাণ নাও; আমি তো আমার পূর্বপুরুষদের চেয়ে ভাল নই।” তারপর তিনি সেই গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই সময় একজন ফেরেশতা তাঁকে ছুঁয়ে বললেন, “ওঠ, খাও।” তিনি চেয়ে দেখতে পেলেন তাঁর মাথার কাছে গরম পাথরে সেঁকা একখানা রুটি ও এক পাত্র পানি রয়েছে। তা খেয়ে তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। মাবুদের ফেরেশতা দ্বিতীয়বার এসে তাঁকে ছুঁয়ে বললেন, “ওঠ, খাও, কারণ এতটা পথ চলবার শক্তি তোমার নেই।” কাজেই তিনি উঠে খেলেন। সেই খাবার খেয়ে শক্তিলাভ করে তিনি চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত হেঁটে আল্লাহ্‌র পাহাড় তুর পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে একটা গুহার মধ্যে ঢুকে তিনি রাতটা কাটালেন। সেখানে ইলিয়াসের কাছে মাবুদ উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইলিয়াস, তুমি এখানে কি করছ?” জবাবে তিনি বললেন, “মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যেন তাঁর পাওনা এবাদত পান সেইজন্য আমি খুবই আগ্রহী হয়েছি, কারণ বনি-ইসরাইলরা তোমার স্থাপন করা ব্যবস্থা ত্যাগ করেছে, তোমার সব কোরবানগাহ্‌ ভেংগে ফেলেছে এবং তোমার নবীদের হত্যা করেছে। কেবল আমিই বাকী আছি আর আমাকেও এখন তারা হত্যা করবার চেষ্টা করছে।” তখন মাবুদ বললেন, “তুমি বাইরে গিয়ে পাহাড়ের উপরে আমার সামনে দাঁড়াও।” সেই সময় মাবুদ ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর সামনে একটা ভীষণ শক্তিশালী বাতাস পাহাড়গুলোকে চিরে দু’ভাগ করল এবং সব পাথর ভেংগে টুকরা টুকরা করল, কিন্তু সেই বাতাসের মধ্যে মাবুদ ছিলেন না। সেই বাতাসের পরে একটা ভূমিকমপ হল, কিন্তু সেই ভূমিকমেপর মধ্যেও মাবুদ ছিলেন না। ভূমিকমেপর পরে দেখা দিল আগুন, কিন্তু সেই আগুনের মধ্যেও মাবুদ ছিলেন না। সেই আগুনের পরে ফিস্‌ ফিস্‌ শব্দের মত সামান্য শব্দ শোনা গেল। ইলিয়াস তা শুনে তাঁর গায়ের চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন এবং বাইরে গিয়ে গুহার মুখের কাছে দাঁড়ালেন। তারপর তিনি এই কথা শুনলেন, “ইলিয়াস, তুমি এখানে কি করছ?” জবাবে তিনি বললেন, “মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যেন তাঁর পাওনা এবাদত পান সেইজন্য আমি খুবই আগ্রহী হয়েছি, কারণ বনি-ইসরাইলরা তোমার স্থাপন করা ব্যবস্থা ত্যাগ করেছে, তোমার সব কোরবানগাহ্‌ ভেংগে ফেলেছে এবং তোমার নবীদের হত্যা করেছে। কেবল আমিই বাকী আছি আর আমাকেও এখন তারা হত্যা করবার চেষ্টা করছে।” তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি যে পথে এসেছ সেই পথে ফিরে গিয়ে দামেস্কের মরুভূমিতে যাও। সেখানে পৌঁছে তুমি হসায়েলকে সিরিয়ার বাদশাহ্‌র পদে অভিষেক কর। এছাড়া নিম্‌শির নাতি যেহূকে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র পদে অভিষেক কর, আর তোমার পদে নবী হওয়ার জন্য আবেল-মহোলার শাফটের ছেলে আল-ইয়াসাকে অভিষেক কর। হসায়েলের তলোয়ার যারা এড়িয়ে যাবে যেহূ তাদের হত্যা করবে আর যেহূর তলোয়ার যারা এড়িয়ে যাবে আল-ইয়াসা তাদের হত্যা করবে। তবে ইসরাইলে আমি সাত হাজার লোককে রেখে দিয়েছি যারা বাল দেবতার সামনে হাঁটু পাতে নি এবং তাকে চুম্বনও করে নি।” পরে ইলিয়াস সেখান থেকে চলে গিয়ে শাফটের ছেলে আল-ইয়াসার দেখা পেলেন। তিনি বারো জোড়া বলদ দিয়ে জমি চাষ করছিলেন এবং তিনি নিজে শেষ জোড়াটি চালাচ্ছিলেন। ইলিয়াস তাঁর কাছে গিয়ে নিজের গায়ের চাদরখানা তাঁর গায়ে ফেলে দিলেন। আল-ইয়াসা তখন তাঁর বলদ ফেলে ইলিয়াসের পিছনে পিছনে দৌড়ে গেলেন। আল-ইয়াসা বললেন, “মিনতি করি, আমাকে আমার মা-বাবাকে চুম্বন করে আসতে দিন। তারপর আমি আপনার সংগে যাব।” জবাবে ইলিয়াস বললেন, “আচ্ছা যাও, কিন্তু মনে রেখো, এটা আল্লাহ্‌র কাজ।” কাজেই আল-ইয়াসা তাঁকে ছেড়ে ফিরে গেলেন। তিনি তাঁর বলদ জোড়াটা নিয়ে জবাই করলেন এবং লাংগলের কাঠ দিয়ে গোশ্‌ত রান্না করে লোকদের দিলেন আর লোকেরা তা খেল। তারপর তিনি ইলিয়াসের সংগে যাবার জন্য বের হলেন এবং তাঁর সেবাকারী হলেন। সিরিয়া দেশের বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদ তাঁর সমস্ত সৈন্য জমায়েত করলেন। তিনি বত্রিশজন বাদশাহ্‌ ও অনেক ঘোড়া আর রথ সংগে নিয়ে সামেরিয়া আক্রমণ করবার জন্য ঘেরাও করলেন। তিনি কয়েকজন লোককে শহরে পাঠিয়ে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবকে এই কথা জানালেন, “বিন্‌হদদ বলছেন, ‘আপনার সোনা ও রূপা আমার, আর আপনার সুন্দরী সুন্দরী স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও আমার।’ ” জবাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বললেন, “আমি বলছি, আমার প্রভু মহারাজ, আপনি যা বলেছেন তা ঠিক। আমি এবং আমার সব কিছুই আপনার।” পরে সেই লোকেরা আহাবের কাছে আবার ফিরে এসে বলল, “বিন্‌হদদ বলছেন, ‘আপনার সোনা-রূপা, স্ত্রীদের ও ছেলেমেয়েদের যে আমাকে দিতে হবে সেই দাবি জানাতে আমি লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আগামী কাল এই সময়ে আমার কর্মচারীদের আমি পাঠিয়ে দেব। তারা আপনার রাজবাড়ী ও আপনার কর্মচারীদের বাড়ীতে তল্লাশী চালাবে এবং যে সমস্ত জিনিস আপনার চোখে মূল্যবান তা সবই নিয়ে আসবে।’ ” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দেশের সমস্ত বৃদ্ধ নেতাদের ডেকে বললেন, “দেখুন, এই লোকটি অনিষ্ট করবার চেষ্টা করছে, কারণ সে যখন আমার স্ত্রীদের ও ছেলেমেয়েদের এবং সোনা-রূপা দিয়ে দেবার দাবি জানিয়েছে তখন আমি তা দিতে অস্বীকার করি নি।” জবাবে বৃদ্ধ নেতারা এবং সমস্ত লোকেরা বলল, “ওর কথা শুনবেন না কিংবা ওর দাবিও মেনে নেবেন না।” কাজেই আহাব বিন্‌হদদের লোকদের বললেন, “আমার প্রভু মহারাজকে বলবে যে, তাঁর প্রথম দাবি অনুসারে আমি সবই করব, কিন্তু দ্বিতীয় দাবি আমি পূরণ করতে পারব না।” লোকেরা তখন সেই জবাব নিয়ে বিন্‌হদদের কাছে চলে গেল। বিন্‌হদদ তখন আহাবের কাছে এই সংবাদ পাঠালেন, “আমার সব লোকদের এক এক মুঠো করে দেবার মত ধুলাও যদি সামেরিয়াতে থেকে যায় তাহলে দেবতারা যেন আমাকে শাস্তি দেন আর তা ভীষণভাবেই দেন।” জবাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বললেন, “তাঁকে বলবে, ‘যে লোক তলোয়ার নিয়ে এখনও যুদ্ধে নামে নি সে যেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসা লোকের মত বড়াই না করে।’ ” বিন্‌হদদের কাছে এই খবর গিয়ে যখন পৌঁছাল তখন তিনি ও অন্যান্য বাদশাহ্‌রা তাঁদের তাম্বুতে মদানো রস খাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, “আক্রমণের জন্য তোমরা তৈরী হও।” কাজেই তারা শহরটা আক্রমণ করবার জন্য তৈরী হল। এর মধ্যে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের কাছে একজন নবী এসে এই কথা ঘোষণা করলেন, “মাবুদ বলছেন, ‘তুমি মস্ত বড় ঐ সৈন্যদলটা দেখতে পাচ্ছ কি? আজই আমি ওদের তোমার হাতে তুলে দেব আর তখন তুমি জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আহাব জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু কাকে দিয়ে তিনি তা করাবেন?” নবী জবাবে বললেন, “মাবুদ বলছেন যে, বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তাদের অধীনে যে যুবক সৈন্যেরা আছে তারাই তা করবে।” আহাব জিজ্ঞাসা করলেন, “যুদ্ধটা শুরু করবে কে?” জবাবে নবী বললেন, “আপনিই করবেন।” আহাব এই কথা শুনে বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তাদের অধীন যুবক সৈন্যদের জমায়েত করলেন। তাতে তারা মোট দু’শো বত্রিশজন হল। তারপর তিনি সব ইসরাইলীয় সৈন্যদের একত্র করলে পর সাত হাজার সৈন্য হল। তিনি বললেন, “তারা সন্ধির জন্য এসে থাকলে তাদের জীবন্ত ধরবে, আবার যুদ্ধের জন্য এসে থাকলেও তাদের জীবন্ত ধরবে।” এর মধ্যে সেই যুবক সৈন্যেরা তাদের পিছনে থাকা সৈন্যদল নিয়ে আক্রমণ করতে শুরু করল। তারা প্রত্যেকে তাদের বাধাদানকারীকে হত্যা করল। তা দেখে সিরীয়রা পালিয়ে গেল আর ইসরাইলীয়রা তাদের পিছনে তাড়া করল। কিন্তু সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদ তাঁর কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে সংগে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে করে পালিয়ে গেলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ এগিয়ে গিয়ে বাকী ঘোড়া ও রথ সব ধ্বংস করে দিলেন এবং সিরীয়দের খুব ক্ষতি করলেন। পরে ঐ নবী ইসরাইলের বাদশাহ্‌র কাছে এসে বললেন, “আপনার শক্তি বাড়ান এবং কি করতে হবে তা ভেবে দেখুন, কারণ আগামী বসন্তকালে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ আপনাকে আবার আক্রমণ করবেন।” এর মধ্যে সিরিয়ার বাদশাহ্‌র কর্মচারীরা তাঁকে এই পরামর্শ দিল, “ওদের দেবতাগুলো পাহাড়ের দেবতা, তাই আমাদের চেয়ে ওরা বেশী শক্তিশালী। কিন্তু আমরা যদি সমভূমিতে ওদের সংগে যুদ্ধ করি তবে নিশ্চয়ই আমরা ওদের চেয়ে শক্তিশালী হব। আপনি এক কাজ করুন। বাদশাহ্‌দের সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় সেনাপতিদের নিযুক্ত করুন। তাছাড়া যে সৈন্যদল আপনি হারিয়েছেন ঠিক সেই রকম আর একটা সৈন্যদল আপনাকে গড়ে তুলতে হবে, ঘোড়ার বদলে ঘোড়া এবং রথের বদলে রথ। তাহলে আমরা সমভূমিতে ইসরাইলের সংগে যুদ্ধ করতে পারব। তখন নিশ্চয়ই আমরা তাদের চেয়ে শক্তিশালী হব।” তিনি তাদের কথায় রাজী হয়ে সেইমতই কাজ করলেন। পরের বছর বসন্তকালে বিন্‌হদদ সিরীয়দের জমায়েত করে নিয়ে ইসরাইলের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য অফেকে গেলেন। এদিকে বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করা হল। তাদের খাবার-দাবার যোগান দেবার ব্যবস্থা করা হলে পর তারাও সিরীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বেরিয়ে গেল। বনি-ইসরাইলরা সিরীয়দের সামনের দিকে তাদের ছাউনি ফেলল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল ছোট দু’টা ছাগলের পাল, আর এদিকে সিরীয়রা গোটা দেশটা জুড়ে রইল। তখন আল্লাহ্‌র একজন বান্দা এসে ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে বললেন, “আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘সিরীয়রা মনে করছে আল্লাহ্‌ পাহাড়ের মাবুদ, উপত্যকার মাবুদ নন; সেইজন্য আমি এই বিরাট সৈন্যদলকে তোমার হাতে তুলে দেব, আর এতে তোমরা জানতে পারবে যে, আমিই আল্লাহ্‌।’ ” সাত দিন পর্যন্ত তারা একে অন্যের সামনাসামনি ছাউনি ফেলে রইল। তারপর সপ্তম দিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বনি-ইসরাইলরা এক দিনেই এক লক্ষ সিরীয় পদাতিক সৈন্য হত্যা করল। বাদবাকী সৈন্যেরা অফেকে পালিয়ে গেল আর সেখানে তাদের সাতাশ হাজার সৈন্যের উপরে দেয়াল ধ্বসে পড়ল। বিন্‌হদদ সেখানে পালিয়ে গিয়ে বাড়ীর ভিতরের একটা কামরায় লুকিয়ে রইলেন। বিন্‌হদদের কর্মচারীরা তাঁকে বলল, “দেখুন, আমরা শুনেছি যে, ইসরাইলের বাদশাহ্‌রা দয়ালু। চলুন, আমরা কোমরে চট পরে আর মাথায় দড়ির বিড়া বেঁধে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র কাছে যাই। হয়তো তিনি আপনার প্রাণ রক্ষা করবেন।” তাঁরা কোমরে চট পরে ও মাথায় দড়ির বিড়া বেঁধে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বললেন, “আপনার গোলাম বিন্‌হদদ বলছেন যে, আপনি যেন দয়া করে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন।” জবাবে বাদশাহ্‌ বললেন, “তিনি কি এখনও জীবিত আছেন? তিনি আমার ভাই।” সেই লোকেরা এটাকে ভাল লক্ষণ মনে করে তাড়াতাড়ি করে তাঁর কথা ধরে বলল, “জ্বী, বিন্‌হদদ নিশ্চয়ই আপনার ভাই।” বাদশাহ্‌ বললেন, “আপনারা গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসুন।” বিন্‌হদদ বের হয়ে আসলে পর আহাব তাঁকে তাঁর রথে তুলে নিলেন। বিন্‌হদদ বললেন, “আপনার বাবার কাছ থেকে আমার বাবা যে সব গ্রাম নিয়ে নিয়েছেন আমি সেগুলো আপনাকে ফিরিয়ে দেব। আমার পিতা যেমন সামেরিয়াতে বাজার বসিয়েছিলেন তেমনি আপনিও দামেস্কের বিভিন্ন জায়গায় বাজার বসাতে পারবেন।” আহাব বললেন, “একটা সন্ধি করে আপনাকে আমি ছেড়ে দেব।” এই বলে তিনি বিন্‌হদদের সংগে একটা সন্ধি করে তাঁকে ছেড়ে দিলেন। মাবুদের হুকুমে শাগরেদ-নবীদের মধ্যে একজন তাঁর সংগীকে বললেন, “দয়া করে আমাকে আঘাত কর।” লোকটি তাতে রাজী হল না। তখন সেই নবী বললেন, “তুমি মাবুদের কথার বাধ্য হলে না বলে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সংগে সংগেই একটা সিংহ তোমাকে হত্যা করবে।” লোকটি চলে যাওয়ার পরেই একটা সিংহ তাকে দেখতে পেয়ে হত্যা করল। সেই নবী আর একজন লোককে দেখতে পেয়ে তাকে বললেন, “দয়া করে আমাকে আঘাত কর।” লোকটি তাঁকে আঘাত করে ক্ষত করল। তারপর সেই নবী রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাদশাহ্‌র জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি তাঁর মাথায় কাপড় বেঁধে তা চোখের উপরে নামিয়ে এনে নিজের পরিচয় গোপন করলেন। বাদশাহ্‌ ঐ পথে যাওয়ার সময় সেই নবী তাঁকে ডেকে বললেন, “আপনার গোলাম আমি যুদ্ধের মাঝখানে গিয়েছিলাম। তখন একজন লোক একজন বন্দীকে আমার কাছে এনে বলল, ‘এই লোকটাকে পাহারা দিয়ে রাখ। যদি সে হারিয়ে যায় তবে তার প্রাণের বদলে তোমার প্রাণ নেওয়া হবে, আর তা না হলে ঊনচল্লিশ কেজি রূপা জরিমানা দিতে হবে।’ কিন্তু আপনার গোলাম যখন কাজে ব্যস্ত ছিল তখন সে কোথায় চলে গেছে।” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বললেন, “ঐ শাস্তিই তোমার হবে। তুমি নিজের মুখেই তা বলেছ।” তখন সেই নবী তাড়াতাড়ি চোখের উপর থেকে মাথার কাপড়টা সরিয়ে ফেললেন আর ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাঁকে নবীদের একজন বলে চিনতে পারলেন। সেই নবী বাদশাহ্‌কে বললেন, “মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘আমি যাকে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন করেছিলাম তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছ। কাজেই তার প্রাণের বদলে তোমার প্রাণ আর তার লোকদের বদলে তোমার লোকদের প্রাণ যাবে।’ ” এতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ মুখ কালো করে ও বিরক্ত হয়ে সামেরিয়ায় তাঁর রাজবাড়ীতে চলে গেলেন। এর পরে যিষ্রিয়েলীয় নাবোতের আংগুর ক্ষেত নিয়ে একটা ঘটনা ঘটে গেল। এই আংগুর ক্ষেতটা ছিল যিষ্রিয়েলে সামেরিয়ার বাদশাহ্‌ আহাবের রাজবাড়ীর কাছেই। আহাব নাবোৎকে বললেন, “সবজীর বাগান করবার জন্য তোমার আংগুর ক্ষেতটা আমাকে দিয়ে দাও, কারণ ওটা আমার রাজবাড়ীর কাছেই। এর বদলে আমি তোমাকে আরও ভাল একটা আংগুর ক্ষেত দেব কিংবা যদি চাও তবে তার উচিত মূল্যও তোমাকে দেব।” কিন্তু জবাবে নাবোৎ বলল, “আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি যে আমি আপনাকে দিয়ে দিই মাবুদ যেন তা হতে না দেন।” “আমার বাপ-দাদাদের সম্পত্তি আমি আপনাকে দেব না,” যিষ্রিয়েলীয় নাবোতের এই কথার জন্য আহাব মুখ কালো করে ও বিরক্ত হয়ে বাড়ী চলে গেলেন। তিনি বিছানায় শুয়ে মুখ ফিরিয়ে রইলেন, খেতে চাইলেন না। এ দেখে তাঁর স্ত্রী ঈষেবল তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন তুমি মন খারাপ করে আছ? কেন খেতে চাইছ না?” জবাবে বাদশাহ্‌ তাঁকে বললেন, “আমি যিষ্রিয়েলীয় নাবোৎকে বলেছিলাম তার আংগুর ক্ষেতটা আমার কাছে বিক্রি করে দিতে কিংবা সে চাইলে তার বদলে আমি তাকে আর একটা আংগুর ক্ষেতও দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে বলল যে, সে তার আংগুর ক্ষেতটা আমাকে দেবে না।” তখন তাঁর স্ত্রী ঈষেবল তাঁকে বললেন, “তুমি না ইসরাইলের বাদশাহ্‌? ওঠো, খাওয়া-দাওয়া কর, আনন্দিত হও। যিষ্রিয়েলীয় নাবোতের আংগুর ক্ষেত আমি তোমাকে দেব।” ঈষেবল তখন আহাবের নাম করে কতগুলো চিঠি লিখে সেগুলোর উপর আহাবের সীলমোহর দিলেন এবং নাবোতের শহরে বাসকারী বৃদ্ধ নেতা ও গণ্যমান্য লোকদের কাছে চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিলেন। সেই চিঠিগুলোতে তিনি লিখেছিলেন, “আপনারা রোজা রাখবার কথা ঘোষণা করুন এবং লোকদের মধ্যে নাবোৎকে একটা বিশেষ স্থান দিন। তার সামনে দু’টা আসনে দু’জন খারাপ লোককে বসান। তারা এই বলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিক যে, সে আল্লাহ্‌ ও বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে অপমানের কথা বলেছে। তারপর তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করুন।” কাজেই নাবোতের শহরে বাসকারী বৃদ্ধ নেতারা ও গণ্যমান্য লোকেরা ঈষেবলের চিঠিতে লেখা নির্দেশমত কাজ করলেন। তাঁরা রোজা রাখবার কথা ঘোষণা করে নাবোৎকে লোকদের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান দিলেন। তারপর দু’জন খারাপ লোক এসে নাবোতের সামনে বসে লোকদের কাছে তার বিরুদ্ধে এই সাক্ষ্য দিল যে, সে আল্লাহ্‌ ও বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে অপমানের কথা বলেছে। তারপর লোকেরা তাকে শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। এর পর সেই নেতারা ঈষেবলের কাছে খবর পাঠালেন যে, নাবোৎকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। নাবোৎকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে শুনেই ঈষেবল আহাবকে বললেন, “যাও, যিষ্রিয়েলীয় নাবোৎ যে আংগুর ক্ষেতটা তোমার কাছে বিক্রি করতে চায় নি তার দখল নাও। সে আর বেঁচে নেই, মরে গেছে।” নাবোৎ মারা গেছে শুনে আহাব নাবোতের আংগুর ক্ষেতের দখল নিতে গেলেন। তখন তিশ্‌বীয় ইলিয়াসের উপর মাবুদের এই কালাম নাজেল হল, “সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের সংগে দেখা করতে যাও। সে এখন নাবোতের আংগুর ক্ষেতে আছে। সে ওটার দখল নেবার জন্য সেখানে গেছে। তুমি তাকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘তুমি কি একজন লোককে হত্যা করে তার সম্পত্তি দখল কর নি?’ তারপর তাকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘কুকুরেরা যেখানে নাবোতের রক্ত চেটে খেয়েছে সেখানে তারা তোমার রক্ত, জ্বী, তোমারই রক্ত চেটে খাবে।’ ” আহাব সেই কথা শুনে ইলিয়াসকে বললেন, “হে আমার শত্রু, এবার তুমি আমাকে পেয়েছ।” জবাবে ইলিয়াস বললেন, “জ্বী, পেয়েছি, কারণ মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করবার জন্য আপনি নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। সেইজন্য মাবুদ বলছেন, ‘আমি তোমার উপর বিপদ নিয়ে আসব। তোমাকে আমি একেবারে ধ্বংস করব। গোলাম হোক বা স্বাধীন হোক তোমার বংশের প্রত্যেকটি পুরুষ লোককে আমি শেষ করে দেব। আমি তোমার বংশকে নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম এবং অহিয়ের ছেলে বাশার বংশের মত করব, কারণ তুমি আমার রাগ জাগিয়ে তুলেছ এবং ইসরাইলকে দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছ। এছাড়া ঈষেবলের সম্বন্ধেও আমি বলছি যে, যিষ্রিয়েলের দেয়ালের কাছে কুকুরেরা তাকে খেয়ে ফেলবে। তোমার যে সব লোক শহরে মরবে তাদের খাবে কুকুরে আর যারা মাঠের মধ্যে মরবে তাদের খাবে পাখীতে।’ ” স্ত্রীর উস্কানিতে মাবুদের চোখে যা খারাপ আহাব তা-ই করবার জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মত আর কেউ এই রকম কাজ করে নি। বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে মাবুদ যে আমোরীয়দের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মত মূর্তি পূজা করে তিনি জঘন্য কাজ করতেন। আহাব মাবুদের কথা শুনে নিজের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে চট পরলেন এবং রোজা রাখলেন। তিনি চট পরেই শুয়ে থাকতেন এবং নম্রভাবে চলাফেরা করতে লাগলেন। তখন মাবুদ তিশ্‌বীয় ইলিয়াসকে বললেন, “তুমি কি লক্ষ্য করেছ আহাব আমার সামনে নিজেকে কেমন নত করেছে? সে নিজেকে নত করেছে বলে এই বিপদ আমি তার জীবনকালে আনব না, কিন্তু তার ছেলের জীবনকালে তার বংশের উপরে আনব।” সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে তিন বছর পর্যন্ত কোন যুদ্ধ হয় নি। তৃতীয় বছরে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট ইসরাইলের বাদশাহ্‌র সংগে দেখা করতে গেলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “আপনারা কি জানেন যে, রামোৎ-গিলিয়দ আমাদের? অথচ আমরা সিরিয়ার বাদশাহ্‌র কাছ থেকে সেটা ফিরিয়ে নেবার জন্য কিছুই করছি না।” তখন তিনি যিহোশাফটকে বললেন, “আপনি কি যুদ্ধ করবার জন্য আমার সংগে রামোৎ-গিলিয়দে যাবেন?” জবাবে যিহোশাফট তাঁকে বললেন, “আমি ও আপনি, আমার লোক ও আপনার লোক সবাই এক, আর আমার ঘোড়া আপনারই ঘোড়া।” তবে যিহোশাফট তাঁকে এই কথাও বললেন, “আপনি প্রথমে মাবুদের পরামর্শ নিন।” কাজেই ইসরাইলের বাদশাহ্‌ নবীদের ডেকে একত্র করলেন। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার’শো। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “রামোৎ-গিলিয়দের বিরুদ্ধে কি আমি যুদ্ধ করতে যাব, না যাব না?” তারা বলল, “যান, কারণ দীন-দুনিয়ার মালিক ওটা বাদশাহ্‌র হাতেই তুলে দেবেন।” কিন্তু যিহোশাফট বললেন, “এখানে কি মাবুদের কোন নবী নেই যার কাছে আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি?” জবাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটকে বললেন, “এখনও এমন একজন লোক আছে যার মধ্য দিয়ে আমরা মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারি, কিন্তু আমি তাকে ঘৃণা করি, কারণ সে আমার সম্বন্ধে উপকারের কথা বলে না, অপকারের কথাই বলে। সে হল য্নিের ছেলে মিকায়।” জবাবে যিহোশাফট বললেন, “বাদশাহ্‌ যেন ঐ রকম কথা না বলেন।” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাঁর একজন কর্মচারীকে ডেকে বললেন, “তুমি এখনই য্নিের ছেলে মিকায়কে ডেকে নিয়ে এস।” ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ও এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট রাজপোশাক পরে সামেরিয়া শহরের দরজার কাছে গম ঝাড়বার জায়গায় তাঁদের সিংহাসনের উপরে বসে ছিলেন আর নবীরা সবাই তাঁদের সামনে ভবিষ্যতের কথা বলছিল। তখন কনানার ছেলে সিদিকিয় লোহার শিং তৈরী করে নিয়ে এই কথা ঘোষণা করল, “মাবুদ বলছেন যে, সিরীয়রা শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আপনি এগুলো দিয়েই তাদের আঘাত করতে থাকবেন।” অন্যান্য নবীরাও একই রকম কথা বলল। তারা বলল, “রামোৎ-গিলিয়দ হামলা করে তা জয় করে নিন, কারণ মাবুদ সেটা বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেবেন।” যে লোকটি মিকায়কে ডেকে আনতে গিয়েছিল সে তাঁকে বলল, “দেখুন, অন্যান্য নবীরা সবাই একবাক্যে বাদশাহ্‌র সফলতার কথা বলছেন। আপনার কথাও যেন তাঁদের কথার মতই হয়। আপনি উপকারের কথাই বলবেন।” কিন্তু মিকায় বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম যে, মাবুদ আমাকে যা বলবেন আমি কেবল সেই কথাই বলব।” মিকায় আসলে পর বাদশাহ্‌ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মিকায়, আমরা কি রামোৎ-গিলিয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাব, না যাব না?” জবাবে মিকায় বললেন, “জ্বী, যান যান, হামলা করে জয়লাভ করুন, কারণ মাবুদ ওটা আপনার হাতেই দিয়ে রেখেছেন।” বাদশাহ্‌ তাঁকে বললেন, “কতবার আমি তোমাকে এই কসম খেতে বলব যে, মাবুদের নামে তুমি সত্যি কথা ছাড়া আর কিছু বলবে না?” জবাবে মিকায় বললেন, “আমি দেখলাম, বনি-ইসরাইলরা সবাই রাখালহীন ভেড়ার মত পাহাড়ের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই মাবুদ বললেন, ‘এদের কোন মালিক নেই, কাজেই তারা শান্তিতে যে যার বাড়ীতে চলে যাক।’ ” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোশাফটকে বললেন, “আমি কি আপনাকে আগেই বলি নি যে, সে আমার সম্বন্ধে অপকার ছাড়া উপকারের কথা বলবে না?” মিকায় বলতে লাগলেন, “তাহলে আপনি মাবুদের কথা শুনুন। আমি দেখলাম, মাবুদ তাঁর সিংহাসনে বসে আছেন এবং তাঁর ডান ও বাঁ দিকে সমস্ত ফেরেশতারা রয়েছেন। তখন মাবুদ বললেন, ‘রামোৎ-গিলিয়দ হামলা করবার জন্য কে আহাবকে ভুলিয়ে সেখানে নিয়ে যাবে যাতে সে মারা যায়?’ তখন এক একজন এক এক কথা বললেন। শেষে একটি রূহ্‌ এগিয়ে এসে মাবুদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাব।’ মাবুদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন করে করবে?’ সে বলল, ‘আমি গিয়ে তার সব নবীদের মুখে মিথ্যা বলবার রূহ্‌ হব।’ মাবুদ বললেন, ‘তুমিই তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তুমি গিয়ে তা-ই কর।’ এইজন্যই মাবুদ এখন আপনার এই সব নবীদের মুখে মিথ্যা বলবার রূহ্‌ দিয়েছেন। আপনার সর্বনাশ হবার জন্য মাবুদ রায় দিয়েছেন।” তখন কনানার ছেলে সিদিকিয় গিয়ে মিকায়ের গালে চড় মেরে বলল, “মাবুদের রূহ্‌ তোর সংগে কথা বলবার জন্য আমার কাছ থেকে বেরিয়ে কোন পথে গিয়েছিলেন?” জবাবে মিকায় বললেন, “তুমি সেই দিন তা জানতে পারবে যেদিন তুমি নিজেকে লুকাবার জন্য ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকবে।” ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তখন এই হুকুম দিলেন, “মিকায়কে শহরের শাসনকর্তা আমোন ও রাজপুত্র যোয়াশের কাছে আবার পাঠিয়ে দাও। তাদের বল বাদশাহ্‌ বলেছেন এই লোকটিকে যেন জেলে রাখা হয় এবং বাদশাহ্‌ নিরাপদে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে অল্প পানি আর অল্প রুটি ছাড়া যেন আর কিছু দেওয়া না হয়।” তখন মিকায় বললেন, “যদি আপনি সত্যিই নিরাপদে ফিরে আসেন তবে জানবেন মাবুদ আমার মধ্য দিয়ে কথা বলেন নি।” তারপর তিনি আবার বললেন, “আপনারা সবাই আমার কথাটা শুনে রাখুন।” এর পরে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ও এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট রামোৎ-গিলিয়দ হামলা করতে গেলেন। আহাব যিহোশাফটকে বললেন, “আমাকে যাতে লোকেরা চিনতে না পারে সেইজন্য আমি অন্য পোশাক পরে যুদ্ধে যোগ দেব, কিন্তু আপনি আপনার রাজপোশাকই পরে নিন।” এই বলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ অন্য পোশাক পরে যুদ্ধ করতে গেলেন। সিরিয়ার বাদশাহ্‌ তাঁর রথগুলোর বত্রিশজন সেনাপতিকে এই হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, “একমাত্র ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ছাড়া আপনারা ছোট কি বড় আর কারও সংগে যুদ্ধ করবেন না।” রথের সেনাপতিরা যিহোশাফটকে দেখে ভেবেছিলেন যে, তিনি নিশ্চয়ই ইসরাইলের বাদশাহ্‌। কাজেই তাঁরা ফিরে তাঁকে আক্রমণ করতে গেলেন কিন্তু যিহোশাফট চেঁচিয়ে উঠলেন। এতে সেনাপতিরা বুঝলেন যে, তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌ নন সেইজন্য তাঁরা আর তাঁর পিছনে তাড়া করলেন না। কিন্তু একজন লোক লক্ষ্য স্থির না করেই তার ধনুকে টান দিয়ে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র বুক ও পেটের বর্মের মাঝামাঝি ফাঁকে আঘাত করে বসল। তখন বাদশাহ্‌ তাঁর রথ চালককে বললেন, “রথ ঘুরিয়ে তুমি যুদ্ধের জায়গা থেকে আমাকে বাইরে নিয়ে যাও। আমি আঘাত পেয়েছি।” সারা দিন ধরে ভীষণ যুদ্ধ চলল আর বাদশাহ্‌কে সিরীয়দের মুখোমুখি করে রথের মধ্যে বসিয়ে রাখা হল। তাঁর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে রথের মেঝের উপর পড়তে লাগল আর বিকালের দিকে তিনি মারা গেলেন। সূর্য ডুবে যাবার সময় সৈন্যদলের মধ্যে এই কথা ঘোষণা করা হল, “তোমরা প্রত্যেকেই যে যার গ্রামে ও বাড়ীতে ফিরে যাও।” এইভাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ মারা গেলেন এবং তাঁকে সামেরিয়াতে আনা হল। লোকেরা তাঁকে সেখানেই দাফন করল। সামেরিয়ার পুকুরে তাঁর রথটা ধোয়া হল এবং মাবুদের ঘোষণা অনুসারে কুকুরেরা সেখানে তাঁর রক্ত চেটে খেল আর বেশ্যারা সেই পুকুরে গোসল করল। আহাবের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা, অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছিলেন সেই সব কথা, হাতীর দাঁতের কাজ করা যে রাজবাড়ী তিনি তৈরী করেছিলেন তার কথা এবং যে শহরগুলো তিনি শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলেন সেগুলোর কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। আহাব তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবার পর তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে অহসিয় বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের রাজত্বের চার বছরের সময় আসার ছেলে যিহোশাফট এহুদা দেশের বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। যিহোশাফট পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং পঁচিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মা ছিলেন শিল্‌হির মেয়ে অসূবা। যিহোশাফট সব ব্যাপারেই তাঁর পিতা আসার পথ ধরেই চলতেন, কখনও সেই পথ ছেড়ে যান নি। মাবুদের চোখে যা ঠিক তিনি তা-ই করতেন। কিন্তু পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করা হয় নি এবং লোকেরা সেখানে পশু কোরবানী করতে ও ধূপ জ্বালাতে থাকল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌র সংগে তিনি সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। যিহোশাফটের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। তাঁর বাবা আসার রাজত্বের পরেও যে সব পুরুষ মন্দির-বেশ্যারা বাকী রয়ে গিয়েছিল তিনি দেশ থেকে তাদের দূর করে দিয়েছিলেন। সেই সময় ইদোম দেশে কোন বাদশাহ্‌ ছিল না। একজন রাজ-প্রতিনিধি সেখানে রাজত্ব করতেন। ওফীরে গিয়ে সোনা আনবার জন্য যিহোশাফট কতগুলো বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ তৈরী করলেন, কিন্তু সেগুলোর আর যাওয়া হল না, কারণ ইৎসিয়োন-গেবরে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তখন আহাবের ছেলে অহসিয় যিহোশাফটকে বললেন, “আমার লোকেরা আপনার লোকদের সংগে জাহাজে যাক।” কিন্তু যিহোশাফট তাতে রাজী হলেন না। পরে যিহোশাফট তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোরাম বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটের রাজত্বের সতের বছরের সময় আহাবের ছেলে অহসিয় সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি ইসরাইলের উপরে দুই বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তিনি তাঁর পিতা ও মায়ের মত এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের মত চলতেন। এই ইয়ারাবিম যেমন ইসরাইলের লোকদের দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন অহসিয়ও তা-ই করেছিলেন। তিনি বাল দেবতার সেবা ও পূজা করতেন এবং তাঁর পিতা যেমন করেছিলেন তিনিও তেমনি করে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌কে রাগিয়ে তুলেছিলেন। আহাবের মৃত্যুর পর মোয়াব দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। অহসিয় সামেরিয়াতে তাঁর বাড়ীর উপরের তলার কামরার জানালা দিয়ে নীচে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন। তখন তিনি কয়েকজন লোককে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা গিয়ে ইক্রোণের দেবতা বাল-সবূবের কাছে জিজ্ঞাসা কর যে, এই আঘাত থেকে আমি সুস্থ হয়ে উঠব কি না।” কিন্তু মাবুদের ফেরেশতা তিশ্‌বীয় ইলিয়াসকে বললেন, “তুমি গিয়ে সামেরিয়ার বাদশাহ্‌র পাঠানো লোকদের সংগে দেখা করে তাদের বল, ‘ইসরাইল দেশে কি আল্লাহ্‌ নেই যে, তোমরা ইক্রোণের দেবতা বাল-সবূবের কাছে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছ? এইজন্য মাবুদ বলছেন, যে বিছানায় তুমি শুয়ে আছ তা থেকে তুমি আর উঠবে না। তুমি নিশ্চয়ই মারা যাবে।’ ” এই বলে ইলিয়াস চলে গেলেন। সেই লোকেরা বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে আসলে পর তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কেন ফিরে আসলে?” জবাবে তারা বলল, “একজন লোক আমাদের সংগে দেখা করে বলল, যিনি আমাদের পাঠিয়েছেন আমরা যেন সেই বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে গিয়ে বলি যে, মাবুদ বলছেন, ‘ইসরাইল দেশে কি আল্লাহ্‌ নেই যে, তুমি ইক্রোণের দেবতা বাল-সবূবের কাছে জিজ্ঞাসা করবার জন্য লোক পাঠা"ছ? কাজেই তুমি যে বিছানায় শুয়ে আছ সেখান থেকে আর উঠবে না। তুমি নিশ্চয়ই মারা যাবে।’ ” বাদশাহ্‌ তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “যে লোকটা তোমাদের সংগে দেখা করে এই কথা বলেছে সে দেখতে কেমন?” জবাবে তারা বলল, “তার গা লোমে ভরা ছিল আর কোমরে ছিল চামড়ার কোমর-বাঁধনি।” বাদশাহ্‌ বললেন, “উনি হলেন তিশ্‌বীয় ইলিয়াস।” এর পর বাদশাহ্‌ একজন সেনাপতি ও তাঁর পঞ্চাশজন সৈন্যকে ইলিয়াসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইলিয়াস তখন একটা পাহাড়ের উপরে বসে ছিলেন। সেই সেনাপতি ইলিয়াসের কাছে উঠে গিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র বান্দা, বাদশাহ্‌ আপনাকে নেমে আসতে বলছেন।” জবাবে ইলিয়াস সেই সেনাপতিকে বললেন, “আমি যদি আল্লাহ্‌রই বান্দা হই তবে আসমান থেকে আগুন নেমে এসে যেন তোমাকে ও তোমার পঞ্চাশজন সৈন্যকে পুড়িয়ে ফেলে।” তখন আসমান থেকে আগুন পড়ে সেই সেনাপতি ও তাঁর পঞ্চাশজন সৈন্যকে পুড়িয়ে ফেলল। এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ আর একজন সেনাপতি ও তাঁর পঞ্চাশজন সৈন্যকে ইলিয়াসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সেনাপতি ইলিয়াসকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র বান্দা, বাদশাহ্‌ আপনাকে এখনই নেমে আসতে বলেছেন।” জবাবে ইলিয়াস বললেন, “আমি যদি আল্লাহ্‌রই বান্দা হই তবে আসমান থেকে আগুন নেমে এসে যেন তোমাকে ও তোমার পঞ্চাশজন সৈন্যকে পুড়িয়ে ফেলে।” তখন আসমান থেকে আল্লাহ্‌র আগুন পড়ে তাঁকে ও তাঁর পঞ্চাশজন সৈন্যকে পুড়িয়ে ফেলল। এর পরে বাদশাহ্‌ আর একজন সেনাপতি ও তাঁর পঞ্চাশজন সৈন্যকে পাঠিয়ে দিলেন। এই তৃতীয় সেনাপতি উপরে উঠে গিয়ে ইলিয়াসের সামনে হাঁটু পেতে মিনতি করে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র বান্দা, আপনি দয়া করে আমার ও আপনার এই পঞ্চাশজন গোলামের প্রাণ রক্ষা করুন। দেখুন, আসমান থেকে আগুন পড়ে প্রথম দু’জন সেনাপতি ও তাঁদের সব সৈন্যদের পুড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু এবার আপনি আমার প্রাণ রক্ষা করুন।” তখন মাবুদের ফেরেশতা ইলিয়াসকে বললেন, “তুমি ওর সংগে নেমে যাও, ওকে ভয় কোরো না।” কাজেই ইলিয়াস তাঁর সংগে নেমে বাদশাহ্‌র কাছে গেলেন। তিনি বাদশাহ্‌কে বললেন, “মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘জিজ্ঞাসা করবার জন্য ইসরাইল দেশে কি আল্লাহ্‌ নেই যে, তুমি ইক্রোণের দেবতা বাল-সবূবের কাছে লোক পাঠিয়েছিলে? তুমি এই কাজ করেছ বলে তুমি যে বিছানায় শুয়ে আছ তা থেকে আর উঠবে না। তুমি নিশ্চয়ই মারা যাবে।’ ” ইলিয়াসকে দিয়ে মাবুদ যে কথা বলিয়েছিলেন সেই অনুসারে অহসিয় মারা গেলেন। অহসিয়ের কোন ছেলে ছিল না বলে তাঁর জায়গায় যোরাম বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটের ছেলে যিহোরামের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে তিনি বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। অহসিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। মাবুদ যখন একটা ঘূর্ণিবাতাসে করে ইলিয়াসকে বেহেশতে তুলে নিতে চাইলেন তখন ইলিয়াস ও আল-ইয়াসা গিল্‌গল থেকে বের হলেন। ইলিয়াস আল-ইয়াসাকে বললেন, “তুমি এখানে থাক; মাবুদ আমাকে বেথেলে যেতে বলেছেন।” আল-ইয়াসা বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম ও আপনার প্রাণের কসম যে, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।” কাজেই তাঁরা বেথেলে গেলেন। বেথেলের শাগরেদ-নবীরা আল-ইয়াসার কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি কি জানেন যে, মাবুদ আপনার ওস্তাদকে আজ আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “জ্বী, আমি জানি। আপনারা এই বিষয় নিয়ে আর কিছু বলবেন না।” এর পর ইলিয়াস তাঁকে বললেন, “আল-ইয়াসা, তুমি এখানে থাক; মাবুদ আমাকে জেরিকোতে যেতে বলেছেন।” আল-ইয়াসা বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম ও আপনার প্রাণের কসম যে, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।” কাজেই তাঁরা জেরিকোতে গেলেন। জেরিকোর শাগরেদ-নবীরা আল-ইয়াসার কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি কি জানেন যে, মাবুদ আপনার ওস্তাদকে আজ আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “জ্বী, আমি জানি। আপনারা এই বিষয় নিয়ে আর কিছু বলবেন না।” এর পর ইলিয়াস তাঁকে বললেন, “তুমি এখানে থাক; মাবুদ আমাকে জর্ডান নদীর পারে যেতে বলেছেন।” জবাবে তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম ও আপনার প্রাণের কসম যে, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।” কাজেই তাঁরা দু’জন চলতে লাগলেন। ইলিয়াস ও আল-ইয়াসা জর্ডান নদীর ধারে গিয়ে থামলেন আর তাঁদের কাছ থেকে কিছু দূরে পঞ্চাশজন শাগরেদ-নবী এসে দাঁড়ালেন। ইলিয়াস তাঁর গায়ের চাদরটা গুটিয়ে নিয়ে তা দিয়ে পানির উপর আঘাত করলেন। তাতে পানি ডানে ও বাঁয়ে দু’ভাগ হয়ে গেল আর তাঁরা দু’জনে শুকনা মাটির উপর দিয়ে পার হয়ে গেলেন। পার হয়ে এসে ইলিয়াস আল-ইয়াসাকে বললেন, “আমাকে বল, তোমার কাছ থেকে আমাকে তুলে নেবার আগে আমি তোমার জন্য কি করব?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “আপনার রূহের দ্বিগুণ রূহ্‌ যেন আমি পাই।” ইলিয়াস বললেন, “তুমি একটা কঠিন জিনিস চেয়েছ। তবুও তোমার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে যাবার সময় যদি তুমি আমাকে দেখতে পাও তবে তুমি তা পাবে; যদি দেখতে না পাও তবে পাবে না।” তাঁরা কথা বলতে বলতে চলেছেন এমন সময় হঠাৎ একটা আগুনের রথ ও আগুনের কতগুলো ঘোড়া এসে তাঁদের দু’জনকে আলাদা করে দিল এবং ইলিয়াস একটা ঘূর্ণিবাতাসে করে বেহেশতে চলে গেলেন। আল-ইয়াসা তা দেখে চিৎকার করে বললেন, “হে আমার পিতা, আমার পিতা, দেখুন, ইসরাইলের রথ ও ঘোড়সওয়ার।” এর পর আল-ইয়াসা আর তাঁকে দেখতে পেলেন না। তখন তিনি নিজের কাপড় ধরে ছিঁড়ে দু’ভাগ করলেন। তারপর ইলিয়াসের গা থেকে পড়ে যাওয়া চাদরখানা কুড়িয়ে নিয়ে তিনি ফিরে জর্ডানের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই চাদরখানা দিয়ে তিনি পানিতে আঘাত করে বললেন, “এখন ইলিয়াসের মাবুদ আল্লাহ্‌ কোথায়?” তিনি পানিতে আঘাত করলে পর পানি ডানে ও বাঁয়ে দু’ভাগ হয়ে গেল, আর তিনি পার হয়ে গেলেন। জেরিকোর যে শাগরেদ-নবীরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা আল-ইয়াসাকে দেখে বললেন, “ইলিয়াসের রূহ্‌ আল-ইয়াসার উপর ভর করেছেন।” তাঁরা আল-ইয়াসার সংগে দেখা করতে গেলেন এবং তাঁর সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সালাম জানিয়ে বললেন, “দেখুন, আমরা এখানে আপনার পঞ্চাশজন শক্তিশালী গোলাম রয়েছি; আমরা গিয়ে আপনার ওস্তাদকে তালাশ করে দেখি। মাবুদের রূহ্‌ হয়তো তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোন পাহাড়ে কিংবা কোন উপত্যকায় নামিয়ে রেখেছেন।” আল-ইয়াসা বললেন, “না, যেয়ো না।” কিন্তু তাঁরা পীড়াপীড়ি করতে থাকলে তিনি লজ্জায় পড়ে বললেন, “আচ্ছা, যাও।” তখন সেই পঞ্চাশজন লোক ইলিয়াসকে তালাশ করতে গেলেন। সেই লোকেরা তিন দিন ধরে তালাশ করেও তাঁকে পেলেন না। আল-ইয়াসা তখন জেরিকোতে ছিলেন। তাঁরা আল-ইয়াসার কাছে ফিরে আসলে পর তিনি তাঁদের বললেন, “আমি কি তোমাদের যেতে নিষেধ করি নি?” একদিন সেই শহরের লোকেরা আল-ইয়াসাকে বলল, “হে হুজুর, আপনি তো দেখতে পাচ্ছেন এই শহরের জায়গাটা চমৎকার, কিন্তু এর পানি ভাল নয় আর জমির দরুন গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়।” আল-ইয়াসা বললেন, “তোমরা আমার কাছে একটা নতুন পাত্র এনে তাতে কিছু লবণ রাখ।” তখন তারা তাঁর কাছে তা আনল। আল-ইয়াসা তখন পানির ঝর্ণার কাছে গিয়ে তার মধ্যে সেই লবণ ফেলে দিয়ে বললেন, “মাবুদ বলছেন, ‘আমি এই পানি ভাল করে দিয়েছি। এই পানি আর কারও মৃত্যু ঘটাবে না এবং সন্তানও নষ্ট হবে না।’ ” আল-ইয়াসার কথামত আজ পর্যন্ত সেই পানি ভালই আছে। আল-ইয়াসা সেখান থেকে বেথেলে গেলেন। পথে যাওয়ার সময় শহর থেকে অনেকগুলো ছেলে বের হয়ে এসে তাঁকে ঠাট্টা করে বলতে লাগল, “ও টাকপড়া, টাকপড়া, উপরে উঠে যা।” আল-ইয়াসা ঘুরে তাদের দিকে চেয়ে দেখলেন এবং মাবুদের নামে তাদের বদদোয়া দিলেন। তখন বন থেকে দু’টা ভল্লুকী বেরিয়ে এসে তাদের মধ্য থেকে বিয়াল্লিশজন ছেলেকে ছিঁড়ে ফেলল। এর পর তিনি কর্মিল পাহাড়ে গেলেন এবং সেখান থেকে সামেরিয়াতে ফিরে গেলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটের রাজত্বের আঠারো বছরের সময় ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের ছেলে যোরাম বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি সামেরিয়াতে থেকে বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন, তবে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের মত ছিলেন না। তাঁর বাবা বাল দেবতার পূজার জন্য যে পাথর দাঁড় করিয়েছিলেন তা তিনি দূর করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন যোরামও তা করতে থাকলেন। তিনি তা থেকে ফিরলেন না। মোয়াবের বাদশাহ্‌ মেশার অনেক ভেড়া ছিল। তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে খাজনা হিসাবে এক লক্ষ ভেড়ার বাচ্চা ও এক লক্ষ ভেড়ার লোম দিতেন। কিন্তু আহাবের মৃত্যুর পর মোয়াবের বাদশাহ্‌ ইসরাইলের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। কাজেই বাদশাহ্‌ যোরাম তখন সামেরিয়া থেকে বের হয়ে সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্য জমায়েত করলেন। এছাড়া এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটকেও তিনি এই খবর পাঠালেন, “মোয়াবের বাদশাহ্‌ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আপনি কি আমার সংগে মোয়াবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাবেন?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি আপনার সংগে যাব। আমিও যা আপনিও তা, আমার লোক আপনারই লোক, আমার ঘোড়া আপনারই ঘোড়া।” যিহোশাফট এও জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা কোন্‌ পথে হামলা করব?” জবাবে যোরাম বললেন, “ইদোমের মরুভূমির মধ্য দিয়ে।” তখন এহুদার বাদশাহ্‌ ও ইদোমের বাদশাহ্‌র সংগে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বের হয়ে পড়লেন। তাঁরা সাত দিন ধরে ঘুরপথে চললেন। তখন সৈন্যদলের জন্য কিংবা তাদের সংগেকার পশুগুলোর জন্য কোন পানি ছিল না। তা দেখে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বললেন, “হায়, হায়! মাবুদ মোয়াবের হাতে তুলে দেবার জন্যই কি আমাদের এই তিন বাদশাহ্‌কে একসংগে ডেকেছেন?” যিহোশাফট বললেন, “এখানে কি মাবুদের কোন নবী নেই যাঁর মধ্য দিয়ে আমরা মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারি?” ইসরাইলের বাদশাহ্‌র একজন কর্মচারী জবাবে বলল, “শাফটের ছেলে আল-ইয়াসা এখানে আছেন। তিনি ইলিয়াসের সেবাকারী ছিলেন।” যিহোশাফট বললেন, “মাবুদের কালাম তাঁর কাছে আছে।” কাজেই ইসরাইলের বাদশাহ্‌, ইদোমের বাদশাহ্‌ ও যিহোশাফট আল-ইয়াসার কাছে গেলেন। আল-ইয়াসা ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনার সংগে আমার সম্বন্ধ কি? আপনি আপনার বাবা অথবা মায়ের নবীদের কাছে যান।” জবাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বললেন, “না, যাব না, কারণ মোয়াবের হাতে তুলে দেবার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের তিন বাদশাহ্‌কে ডেকে একত্র করেছেন।” আল-ইয়াসা বললেন, “আমি যাঁর এবাদত করি সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র কসম যে, এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট যদি এখানে না থাকতেন তবে আমি আপনার দিকে চেয়েও দেখতাম না, খেয়ালও করতাম না। এখন বীণা বাজায় এমন একজন লোককে আমার কাছে নিয়ে আসুন।” লোকটি যখন বীণা বাজাচ্ছিল তখন মাবুদের শক্তি আল-ইয়াসার উপর আসল। এটা মাবুদের কাছে সহজ কাজ। তা ছাড়া তিনি মোয়াব দেশটাও আপনাদের হাতে তুলে দেবেন। দেয়াল-ঘেরা প্রত্যেকটা শহর এবং প্রত্যেকটা বড় গ্রাম আপনারা ধ্বংস করে দেবেন। প্রত্যেকটা ভাল গাছ আপনারা কেটে ফেলবেন, পানির সমস্ত ঝর্ণাগুলো বন্ধ করে দেবেন এবং সব ভাল ভাল ক্ষেত পাথর দিয়ে নষ্ট করে দেবেন।” পরের দিন সকালবেলার কোরবানীর সময় ইদোম দেশের দিক থেকে পানি বয়ে এসে দেশটা পানিতে ভরে গেল। এর মধ্যে মোয়াবীয়রা শুনেছিল যে, সেই তিনজন বাদশাহ্‌ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছেন। কাজেই অস্ত্র ধরতে পারে এমন সব ছেলে-বুড়ো সবাইকে ডেকে এনে দেশের সীমানায় দাঁড় করানো হল। খুব সকালে যখন তারা ঘুম থেকে উঠল তখন সূর্য পানির উপর চক্‌মক্‌ করছিল। মোয়াবীয়দের কাছে সেই পানি রক্তের মত লাল মনে হল। তারা বলল, “ঐ যে রক্ত! বাদশাহ্‌রা যুদ্ধ করে নিশ্চয়ই একে অন্যকে হত্যা করেছেন। মোয়াবীয়রা, চল, আমরা গিয়ে লুট করি।” কিন্তু যখন মোয়াবীয়রা ইসরাইলের ছাউনির কাছে গেল তখন বনি-ইসরাইলরা বের হয়ে তাদের আক্রমণ করল আর মোয়াবীয়রা তাদের সামনে থেকে পালিয়ে গেল। বনি-ইসরাইলরা মোয়াবীয়দের মারতে মারতে তাদের দেশে ঢুকে পড়ল। তারা শহরগুলো ধ্বংস করে ফেলল আর প্রত্যেকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে সমস্ত ভাল ক্ষেতগুলো ঢেকে ফেলল। তারা পানির সমস্ত ঝর্ণাগুলো বন্ধ করে দিল এবং ভাল ভাল গাছপালা সব কেটে ফেলল। কেবল মাত্র কীর্‌-হরাসত শহরটা তারা ধ্বংস করতে পারে নি, সেইজন্য ফিংগা হাতে সৈন্যেরা সেটা ঘেরাও করে আক্রমণ করল। মোয়াবের বাদশাহ্‌ যখন দেখলেন তিনি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন তখন সৈন্যদলের মধ্য দিয়ে ইদোমের বাদশাহ্‌র কাছে যাবার জন্য তাঁর সংগে সাতশো তলোয়ারধারীকে নিলেন, কিন্তু যেতে পারলেন না। তখন তিনি তাঁর প্রথম ছেলে, যে তাঁর পরে বাদশাহ্‌ হবে তাকে নিয়ে শহরের দেয়ালের উপরে বলি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী করলেন। ইসরাইলের উপর ভয়ংকর রাগ হল, তাই বনি-ইসরাইলরা সেখান থেকে চলে গিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে গেল। শাগরেদ-নবীদের দলের একজনের স্ত্রী চিৎকার করে আল-ইয়াসাকে বলল, “আপনার গোলাম আমার স্বামী মারা গেছেন আর আপনি জানেন যে, তিনি মাবুদকে ভয় করতেন। কিন্তু এখন আমার স্বামীর একজন পাওনাদার আমার দুই ছেলেকে তার গোলাম বানাবার জন্য নিয়ে যেতে এসেছে।” জবাবে আল-ইয়াসা তাকে বললেন, “কিভাবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি? আমাকে বল তো তোমার ঘরে কি আছে?” স্ত্রীলোকটি বলল, “একটুখানি তেল ছাড়া আপনার বাঁদীর ঘরে আর কিছুই নেই।” আল-ইয়াসা বললেন, “তুমি ঘুরে ঘুরে তোমার সমস্ত প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অনেকগুলো খালি পাত্র চেয়ে আনবে, মাত্র অল্প কয়েকটা আনবে না। তারপর তুমি ও তোমার ছেলেরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে। পরে তুমি ঐ সব পাত্রগুলোতে তেল ঢালবে আর একটা করে পাত্র ভর্তি হলে পর সেটা সরিয়ে রাখবে।” স্ত্রীলোকটি তখন তাঁর কাছ থেকে চলে গিয়ে ছেলেদের নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ছেলেরা তার কাছে পাত্র আনতে লাগল আর সে তেল ঢালতেই থাকল। সব পাত্র ভরে গেলে পর সে তার একজন ছেলেকে বলল, “আর একটা পাত্র নিয়ে এস।” জবাবে ছেলেটি বলল, “আর একটাও পাত্র বাকী নেই।” তখন তেল পড়া বন্ধ হয়ে গেল। স্ত্রীলোকটি তখন আল্লাহ্‌র বান্দার কাছে গিয়ে সব কথা বলল। তিনি বললেন, “তুমি গিয়ে তেল বিক্রি করে তোমার দেনা শোধ করে দাও। যা বাকী থাকবে তা দিয়ে তোমার ও তোমার ছেলেদের খাওয়া-পরা চলবে।” একদিন আল-ইয়াসা শূনেমে গেলেন। সেখানকার একজন ধনী স্ত্রীলোক তাঁকে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য সাধাসাধি করেছিলেন। পরে যতবার তিনি সেই পথ দিয়ে যেতেন ততবারই সেই বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য থামতেন। স্ত্রীলোকটি তাঁর স্বামীকে বললেন, “এই যে লোকটি প্রায়ই আমাদের এখানে আসেন আমি বুঝতে পেরেছি যে, তিনি আল্লাহ্‌র একজন পবিত্র বান্দা। চল, আমরা ছাদের উপরে একটা ছোট কামরা তৈরী করে তার মধ্যে তাঁর জন্য একটা খাট ও বিছানা, একটা টেবিল, একটা চেয়ার ও একটা বাতিদান রাখি। তাহলে তিনি আমাদের কাছে আসলে ওখানে থাকতে পারবেন।” একদিন আল-ইয়াসা এসে সেই উপরের কামরায় গিয়ে শুয়ে রইলেন। তিনি তাঁর চাকর গেহসিকে বললেন, “তুমি ঐ শূনেমীয় স্ত্রীলোকটিকে ডাক।” সে তাঁকে ডাকলে পর তিনি এসে গেহসির সামনে দাঁড়ালেন। আল-ইয়াসা তাঁর চাকরকে বললেন, “ওঁকে বল যে, তিনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করেছেন, এখন আমরা তাঁর জন্য কি করতে পারি? আমরা কি তাঁর জন্য বাদশাহ্‌ বা সেনাপতির কাছে কোন অনুরোধ করব?” জবাবে স্ত্রীলোকটি বললেন, “আমি তো আমার নিজের লোকদের মধ্যে ভালই আছি।” আল-ইয়াসা বললেন, “তবে তাঁর জন্য কি করা যাবে?” গেহসি বলল, “তাঁর কোন ছেলে নেই আর তাঁর স্বামীও বুড়ো হয়ে গেছেন।” পরে আল-ইয়াসা বললেন, “তাঁকে ডাক।” সে তাঁকে ডাকলে পর তিনি এসে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। আল-ইয়াসা বললেন, “আগামী বছরের এই সময়ে আপনার কোলে একটা ছেলে থাকবে।” স্ত্রীলোকটি বললেন, “না, হে হুজুর, হে আল্লাহ্‌র বান্দা, আপনার বাঁদীকে মিথ্যা আশা দেবেন না।” পরে স্ত্রীলোকটি গর্ভবতী হলেন এবং আল-ইয়াসা যেমন বলেছিলেন ঠিক সেইমতই পরের বছর একই সময়ে তিনি ছেলের মা হলেন। সেই চাকর তাকে তুলে নিয়ে তার মায়ের কাছে দিলে পর সে দুপুর পর্যন্ত মায়ের কোলে বসে রইল, তারপর মারা গেল। স্ত্রীলোকটি উপরে গিয়ে ছেলেটাকে আল্লাহ্‌র বান্দার বিছানায় শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি দরজা বন্ধ করে বের হয়ে গেলেন। তিনি গিয়ে তাঁর স্বামীকে ডেকে বললেন, “তুমি এখনই একজন চাকর ও একটা গাধা আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি তাড়াতাড়ি করে আল্লাহ্‌র বান্দার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসব।” তাঁর স্বামী বললেন, “তাঁর কাছে আজকে যাবে কেন? আজকে তো অমাবস্যাও নয়, বিশ্রামবারও নয়।” তিনি বললেন, “তাতে ভাল হবে।” তারপর তিনি গাধার উপর গদি চাপিয়ে তাঁর চাকরকে বললেন, “গাধাটা জোরে চালাও, আমি না বললে আস্তে চালাবে না।” এইভাবে তিনি বের হয়ে পড়লেন এবং কর্মিল পাহাড়ে আল্লাহ্‌র বান্দার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। স্ত্রীলোকটি দূরে থাকতেই আল্লাহ্‌র বান্দা তাঁকে দেখে তাঁর চাকর গেহসিকে বললেন, “ঐ দেখ, সেই শূনেমীয় স্ত্রীলোকটি। তুমি দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা কর যে, তিনি, তাঁর স্বামী ও তাঁর ছেলেটি ভাল আছে কি না।” স্ত্রীলোকটি বললেন, “সবাই ভাল আছে।” কিন্তু কর্মিল পাহাড়ে আল্লাহ্‌র বান্দার কাছে পৌঁছে তিনি তাঁর পা জড়িয়ে ধরলেন। গেহসি তাঁকে সরিয়ে দেবার জন্য আসলে আল্লাহ্‌র বান্দা বললেন, “ওঁকে বাধা দিয়ো না। ওঁর মনে খুব কষ্ট, কিন্তু মাবুদ আমার কাছ থেকে তা লুকিয়ে রেখেছেন, আমাকে বলেন নি।” স্ত্রীলোকটি বললেন, “হে হুজুর, আমি কি আপনার কাছে একটা ছেলে চেয়েছিলাম? আমি কি আপনাকে বলি নি যে, আমাকে আপনি মিথ্যা আশা দেবেন না?” তখন আল-ইয়াসা গেহসিকে বললেন, “তোমার কাপড় তোমার কোমর-বাঁধনিতে গুঁজে নাও আর আমার লাঠিটা হাতে নিয়ে ছুটে যাও। কারও সংগে দেখা হলে তাকে সালাম জানাবে না এবং কেউ তোমাকে সালাম জানালে তার জবাবও দেবে না। আমার লাঠিটা ছেলেটির মুখের উপর রেখে দিয়ো।” কিন্তু ছেলেটির মা বললেন, “আল্লাহ্‌র ও আপনার প্রাণের কসম যে, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।” কাজেই আল-ইয়াসা উঠে স্ত্রীলোকটির পিছনে পিছনে চললেন। গেহসি আগে আগে গিয়ে ছেলেটির মুখের উপর লাঠিটা রাখল কিন্তু কোন শব্দ বা কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কাজেই গেহসি আল-ইয়াসার সংগে দেখা করবার জন্য ফিরে গেল এবং তাঁকে বলল, “ছেলেটি জাগে নি।” আল-ইয়াসা ঘরে গিয়ে দেখলেন তাঁরই বিছানার উপর মরা ছেলেটি শোয়ানো রয়েছে। তখন তিনি একা সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং মাবুদের কাছে মুনাজাত করলেন। তারপর তিনি বিছানার উপর উঠে ছেলেটির মুখের উপরে মুখ, চোখের উপরে চোখ এবং হাতের উপরে হাত রেখে শুলেন। তিনি যখন ছেলেটির উপর নিজে লম্বা হয়ে শুলেন তখন ছেলেটির গা গরম হয়ে উঠল। তারপর তিনি সরে এসে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর আবার তিনি বিছানায় উঠে আর একবার ছেলেটির উপর লম্বা হয়ে শুলেন। এবার ছেলেটি সাতবার হাঁচি দিয়ে চোখ খুলল। তখন আল-ইয়াসা গেহসিকে ডেকে বললেন, “শূনেমীয় স্ত্রীলোকটিকে ডাক।” গেহসি তা-ই করল। স্ত্রীলোকটি আসলে পর আল-ইয়াসা বললেন, “আপনার ছেলেকে নিয়ে যান।” স্ত্রীলোকটি ঘরে ঢুকে তাঁর পায়ে পড়লেন এবং মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তারপর তাঁর ছেলেকে নিয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন। আল-ইয়াসা গিল্‌গলে ফিরে গেলেন। তখন সেই এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছিল। একদিন একদল শাগরেদ-নবী তাঁর সংগে বসে ছিলেন। তখন তিনি তাঁর চাকরকে বললেন, “বড় হাঁড়িটা চড়িয়ে এদের জন্য কিছু তরকারি রান্না কর।” তখন শাগরেদ-নবীদের মধ্যে একজন শাক তুলে আনবার জন্য ক্ষেতে গিয়ে বুনো শসার লতা দেখতে পেলেন। তিনি তা থেকে কিছু ফল তুলে কোঁচড় ভরলেন। তারপর ফিরে এসে সেগুলো কেটে তিনি তরকারির হাঁড়িতে দিলেন, কিন্তু সেগুলো কি তা কারও জানা ছিল না। সেই তরকারি লোকদের খেতে দেওয়ার জন্য ঢালা হল, কিন্তু তা খেতে শুরু করে তাঁরা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “হে আল্লাহ্‌র বান্দা, হাঁড়ির মধ্যে মৃত্যু!” তাঁরা তা খেতে পারলেন না। তখন আল-ইয়াসা বললেন, “কিছু ময়দা নিয়ে এস।” তিনি সেই ময়দা হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে বললেন, “এবার ওটা লোকদের খেতে দাও।” এতে ক্ষতি করবার মত কিছু হাঁড়ির মধ্যে রইল না। বাল-শালিশা থেকে একজন লোক আল্লাহ্‌র বান্দার জন্য প্রথমে কাটা ফসল থেকে কুড়িটা যবের রুটি সেঁকে নিয়ে আসল, আর তার সংগে নিয়ে আসল কিছু নতুন ফসল। আল-ইয়াসা বললেন, “এগুলো লোকদের খেতে দাও।” তাঁর চাকর বলল, “একশো জন লোকের সামনে আমি কি করে এটা রাখব?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “তুমি লোকদের ওটাই খেতে দাও, কারণ মাবুদ বলছেন, ‘ওরা খাবে আবার কিছু বাকীও থাকবে।’ ” সেই চাকর তখন তা নিয়ে লোকদের সামনে রাখল। মাবুদ যা বলেছিলেন সেইমতই তারা খেল আবার কিছু বাকীও রইল। নামান ছিলেন সিরিয়ার বাদশাহ্‌র সৈন্যদলের সেনাপতি। তাঁর মালিকের চোখে তিনি ছিলেন একজন মহান ও সম্মানিত লোক, কারণ তাঁরই মধ্য দিয়ে মাবুদ সিরিয়াকে জয়ী করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা, কিন্তু তাঁর গায়ে ছিল খারাপ চর্মরোগ। সিরীয় হানাদারেরা দলে দলে ইসরাইল দেশে যেত। একবার তারা একটা ছোট মেয়েকে বন্দী করে নিয়ে এসেছিল। সে নামানের স্ত্রীর বাঁদী হয়েছিল। একদিন মেয়েটি তার মালিকের স্ত্রীকে বলল, “আমার মালিক যদি কেবল একবার সামেরিয়ার নবীর সংগে দেখা করতে পারতেন, তাহলে তিনি তাঁর চর্মরোগ ভাল করে দিতেন।” ইসরাইল থেকে আনা সেই মেয়েটি যা বলেছিল তা নামান গিয়ে তাঁর মালিকের কাছে বললেন। জবাবে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বললেন, “ঠিক আছে, তুমি যাও। ইসরাইলের বাদশাহ্‌র কাছে আমি একটা চিঠি দেব।” কাজেই নামান তিনশো নব্বই কেজি রূপা, আটাত্তর কেজি সোনা আর দশ সেট কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যে চিঠিটা তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেলেন তাতে লেখা ছিল, “আমি আমার সেনাপতি নামানকে এই চিঠি দিয়ে আপনার কাছে পাঠালাম যাতে আপনি তাঁকে তাঁর চর্মরোগ থেকে সুস্থ করেন।” ইসরাইলের বাদশাহ্‌ সেই চিঠি পড়েই তাঁর কাপড় ছিঁড়ে বললেন, “আমি কি আল্লাহ্‌? আমি কি হত্যা করে আবার জীবন দিতে পারি? চর্মরোগ থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য কেন এই লোকটি আমার কাছে একজনকে পাঠিয়েছে? দেখ, কিভাবে সে আমার সংগে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে।” আল্লাহ্‌র বান্দা আল-ইয়াসা যখন শুনলেন যে, ইসরাইলের বাদশাহ্‌ কাপড় ছিঁড়েছেন তখন তিনি তাঁকে এই সংবাদ পাঠালেন, “কেন আপনি আপনার কাপড় ছিঁড়েছেন? লোকটিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। তাতে সে জানতে পারবে যে, ইসরাইল দেশে একজন নবী আছে।” কাজেই নামান তাঁর সব রথ ও ঘোড়া নিয়ে আল-ইয়াসার বাড়ীর দরজার কাছে গিয়ে থামলেন। আল-ইয়াসা একজন লোক দিয়ে তাঁকে বলে পাঠালেন, “আপনি গিয়ে সাতবার জর্ডান নদীতে গোসল করুন। তাতে আপনি সুস্থ ও পাক-সাফ হবেন।” কিন্তু নামান ভীষণ রাগ করে সেখান থেকে চলে গেলেন এবং বললেন, “আমি ভেবেছিলাম তিনি নিশ্চয়ই বের হয়ে আমার কাছে আসবেন এবং দাঁড়িয়ে তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডাকবেন আর চর্মরোগের জায়গার উপরে তাঁর হাত দুলিয়ে আমার চর্মরোগ ভাল করে দেবেন। দামেস্কের অবানা ও পর্পর নদী কি ইসরাইলের সমস্ত নদীর পানির চেয়ে ভাল নয়? সেখানে গোসল করে কি আমি পাক-সাফ হতে পারতাম না?” এই বলে তিনি রাগ করে ফিরে চললেন। নামানের গোলামেরা তখন তাঁর কাছে গিয়ে বলল, “হুজুর, ঐ নবী যদি আপনাকে কোন মহৎ কাজ করতে বলতেন তাহলে কি আপনি তা করতেন না? তবে তিনি যখন আপনাকে গোসল করে পাক-সাফ হতে বলেছেন তা কি আপনার বেশী করে করা উচিত নয়?” তখন নামান আল্লাহ্‌র বান্দার কথামত গিয়ে জর্ডানে সাতবার ডুব দিলেন। তাতে তাঁর শরীর সুস্থ হল এবং ছোট ছেলের গায়ের চামড়ার মত তাঁর চামড়া সুন্দর হয়ে গেল। তখন নামান ও তাঁর সংগের সমস্ত লোকেরা আল্লাহ্‌র বান্দার কাছে ফিরে গেলেন। নামান তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এখন জানতে পারলাম যে, একমাত্র ইসরাইলের আল্লাহ্‌ ছাড়া সারা দুনিয়ায় আর কোন মাবুদ নেই। এখন আপনি আপনার গোলামের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করুন।” জবাবে নবী বললেন, “আমি যাঁর এবাদত করি সেই আল্লাহ্‌র কসম যে, আমি একটা জিনিসও গ্রহণ করব না।” নামান জোর করলেও তিনি রাজী হলেন না। নামান বললেন, “আপনি যদি কিছু না-ই নেন তবে দয়া করে দু’টা গাধা বয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন মাটি আপনার গোলামকে দিন, কারণ আপনার এই গোলাম মাবুদ ছাড়া আর কখনও কোন দেবতার কাছে পোড়ানো ও অন্যান্য কোরবানী দেবে না। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে যেন মাবুদ তাঁর গোলাম আমাকে মাফ করেন। আমার মালিক যখন রিম্মোণ দেবতার মন্দিরে ঢুকে আমার সাহায্যে রিম্মোণের উদ্দেশে মাটিতে মাথা ঠেকান তখন আমাকেও সেখানে মাটিতে মাথা ঠেকাতে হয়। এই ব্যাপারে যেন মাবুদ আমাকে মাফ করেন।” এই বলে গেহসি নামানের পিছনে পিছনে দৌড়ে গেল। তাকে তাঁর দিকে দৌড়ে আসতে দেখে নামান তাঁর সংগে দেখা করবার জন্য রথ থেকে নামলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সব কিছু ঠিক আছে তো?” জবাবে গেহসি বলল, “সবই ঠিক আছে। তবে আমার মালিক আপনাকে এই কথা বলবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন যে, আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকা থেকে শাগরেদ-নবীদের দু’জন যুবক এখনই তাঁর কাছে এসেছেন। তাই আপনি যেন দয়া করে তাদের জন্য ঊনচল্লিশ কেজি রূপা আর দুই সেট পোশাক দেন।” নামান বললেন, “ঊনচল্লিশ কেজি কেন? তুমি আটাত্তর কেজি নাও।” তিনি সেগুলো নেবার জন্য গেহসিকে সাধাসাধি করতে লাগলেন এবং আটাত্তর কেজি রূপা দু’টা থলিতে বেঁধে দিলেন ও দুই সেট কাপড় দিলেন। সেগুলো তিনি তাঁর দুই গোলামের হাতে দিলেন আর তারা গেহসির আগে আগে সেগুলো বয়ে নিয়ে যেতে লাগল। কেল্লার পাহাড়ের কাছে এসে গেহসি সেই গোলামদের কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে ঘরের মধ্যে রাখল। তারপর সে তাদের বিদায় করে দিলে তারা চলে গেল। এর পরে সে ভিতরে গিয়ে তার মালিক আল-ইয়াসার সামনে দাঁড়াল। আল-ইয়াসা জিজ্ঞাসা করলেন, “গেহসি, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” গেহসি বলল, “আপনার গোলাম কোথাও যায় নি।” কিন্তু আল-ইয়াসা তাকে বললেন, “ঐ লোকটি যখন তোমার সংগে দেখা করবার জন্য রথ থেকে নেমেছিল তখন আমার মন কি তোমার সংগে যায় নি? টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, জলপাইয়ের বাগান, আংগুর ক্ষেত, গরু-ছাগল-ভেড়া ও গোলাম ও বাঁদী নেবার এটাই কি সময়? কাজেই নামানের চর্মরোগ তোমার ও তোমার বংশধরদের মধ্যে চিরকাল লেগে থাকবে।” তখন গেহসি আল-ইয়াসার সামনে থেকে চলে গেল আর তার গা চর্মরোগে তুষারের মত হয়ে গেল। এক দিন শাগরেদ-নবীরা আল-ইয়াসাকে বললেন, “দেখুন, যে জায়গায় আমরা আপনার সংগে বসে আলোচনা করি সেই জায়গাটা আমাদের জন্য খুবই ছোট। আপনি অনুমতি দিলে আমরা জর্ডান নদীর কাছে গিয়ে প্রত্যেকে একটা করে খুঁটি যোগাড় করে নিয়ে সেখানে আমাদের জন্য একটা থাকবার জায়গা তৈরী করব।” তিনি বললেন, “আচ্ছা, যাও।” তখন তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, “আপনিও আপনার গোলামদের সংগে চলুন।” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “আচ্ছা, চল।” এই বলে তিনি তাঁদের সংগে গেলেন। তাঁরা জর্ডানের কাছে গিয়ে গাছ কাটতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে একজন যখন গাছ কাটছিলেন তখন তাঁর কুড়ালের লোহার ফলাটা পানির মধ্যে পড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে বললেন, “হায়, হায়! হে হুজুর, ওটা যে আমি ধার করে এনেছিলাম।” তখন আল্লাহ্‌র বান্দা জিজ্ঞাসা করলেন, “ওটা কোথায় পড়েছে?” তিনি জায়গাটা দেখিয়ে দিলে পর আল-ইয়াসা একটা কাঠ কেটে নিয়ে সেখানে ছুঁড়ে ফেললেন এবং তাতে লোহার ফলাটা ভেসে উঠল। তখন তিনি বললেন, “ওটা তুলে নাও।” তাই লোকটি হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিলেন। সেই সময় সিরিয়ার বাদশাহ্‌ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি তাঁর সেনাপতিদের সংগে পরামর্শ করে বললেন, “অমুক অমুক জায়গায় আমি ছাউনি ফেলব।” তখন আল্লাহ্‌র বান্দা ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে বলে পাঠালেন, “সাবধান, অমুক জায়গায় যাবেন না, কারণ সিরীয়রা সেখানে যাচ্ছে।” এতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আল্লাহ্‌র বান্দার নির্দেশ-করা জায়গাটায় লোক পাঠিয়ে লোকদের সাবধান করে দিলেন। এইভাবে বাদশাহ্‌ বারবার নিজেকে রক্ষা করতেন। এতে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ ভীষণ রেগে গেলেন। তাঁর সেনাপতিদের ডেকে তিনি বললেন, “বল, আমাদের মধ্যে কে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র পক্ষে রয়েছে?” তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে একজন বললেন, “হে আমার প্রভু মহারাজ, আমাদের মধ্যে কেউই না; কিন্তু আপনি শোবার ঘরে যে কথা বলেন সেই কথা পর্যন্ত ইসরাইলের নবী আল-ইয়াসা ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে বলে দেন।” তখন বাদশাহ্‌ এই হুকুম দিলেন, “সে কোথায় আছে তোমরা গিয়ে তা তালাশ করে বের কর যাতে লোক পাঠিয়ে আমি তাকে ধরে আনতে পারি।” পরে খবর আসল যে, তিনি দোথনে আছেন। বাদশাহ্‌ তখন ঘোড়া, রথ ও একটা বড় সৈন্যদল সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। তারা রাতের বেলায় গিয়ে শহরটা ঘেরাও করল। পরের দিন খুব ভোরে আল্লাহ্‌র বান্দার চাকর উঠে যখন বাইরে গেল তখন সে দেখতে পেল ঘোড়া ও রথ নিয়ে একদল সৈন্য শহর ঘেরাও করে ফেলেছে। সেই চাকর তখন বলল, “হায়, হায়! হে হুজুর, আমরা কি করব?” জবাবে নবী বললেন, “ভয় কোরো না। যারা আমাদের সংগে আছে তারা ওদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী।” তারপর আল-ইয়াসা এই মুনাজাত করলেন, “হে মাবুদ, তার চোখ খুলে দাও যেন সে দেখতে পায়।” তখন মাবুদ সেই চাকরের চোখ খুলে দিলেন। সে চেয়ে দেখতে পেল আল-ইয়াসার চারপাশে পাহাড়গুলো আগুনের রথ ও ঘোড়ায় ভরা। শত্রুরা যখন আল-ইয়াসার দিকে নেমে আসছিল তখন তিনি মাবুদের কাছে এই মুনাজাত করলেন, “এই লোকগুলোকে তুমি আলোর ঝলকে অন্ধ করে দাও।” আল-ইয়াসার মুনাজাত অনুসারে মাবুদ তাদের অন্ধ করে দিলেন। আল-ইয়াসা তাদের বললেন, “এটা সেই রাস্তাও নয় এবং সেই শহরও নয়। তোমরা আমার পিছনে পিছনে এস; যে লোকের তালাশ তোমরা করছ আমি তার কাছে তোমাদের নিয়ে যাব।” এই বলে তিনি সামেরিয়াতে তাদের নিয়ে গেলেন। শহরে ঢুকবার পর আল-ইয়াসা বললেন, “হে মাবুদ, এবার ওদের চোখ খুলে দাও যেন ওরা দেখতে পায়।” তখন মাবুদ তাদের চোখ খুলে দিলেন আর তারা দেখতে পেল যে, তারা সামেরিয়ার মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাদের দেখে আল-ইয়াসাকে বললেন, “পিতা, আমি কি ওদের হত্যা করব?” জবাবে তিনি বললেন, “না, ওদের মারবেন না। আপনার নিজের তলোয়ার ও ধনুক দিয়ে আপনি যাদের বন্দী করেছেন তাদের কি হত্যা করবেন? ওদের আপনি খাবার ও পানি দিন, যাতে তারা খেয়েদেয়ে তাদের মালিকের কাছে ফিরে যেতে পারে।” কাজেই বাদশাহ্‌ তাদের জন্য একটা বড় মেজবানীর আয়োজন করলেন। তারা খাওয়া-দাওয়া শেষ করলে পর তিনি তাদের বিদায় করে দিলেন আর তারা তাদের মালিকের কাছে ফিরে গেল। এতে সিরিয়ার সৈন্যদল ইসরাইলের রাজ্যের মধ্যে লুটপাট করা বন্ধ করে দিল। এর কিছুকাল পরে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদ তাঁর সমস্ত সৈন্যদল জমায়েত করলেন এবং তাদের নিয়ে গিয়ে সামেরিয়া ঘেরাও করলেন। তখন শহরে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এই ঘেরাও এতদিন ধরে চলল যে, একটা গাধার মাথা পর্যন্ত প্রায় এক কেজি রূপাতে এবং এক কেজির চার ভাগের এক ভাগ কবুতরের পায়খানা সাত গ্রাম রূপায় বিক্রি হতে লাগল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ একদিন যখন শহরের দেয়ালের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একজন স্ত্রীলোক চিৎকার করে তাঁকে বলল, “হে আমার প্রভু মহারাজ, আমাকে সাহায্য করুন।” জবাবে বাদশাহ্‌ বললেন, “মাবুদ যদি সাহায্য না করেন তবে আমি কোথা থেকে তোমাকে সাহায্য করব? খামার থেকে, না আংগুর মাড়াইয়ের যন্ত্র থেকে?” তারপর তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে?” স্ত্রীলোকটি বলল, “এই স্ত্রীলোকটি আমাকে বলেছিল, ‘আজ তোমার ছেলেকে আমাদের খেতে দাও, কাল আমরা আমার ছেলেকে খাব।’ কাজেই আমরা আমার ছেলেকে রান্না করে খেয়েছি। পরের দিন আমি তাকে বললাম, ‘এবার তোমার ছেলেকে আমাদের খেতে দাও।’ কিন্তু সে তাকে লুকিয়ে রেখেছে।” স্ত্রীলোকটির কথা শুনে বাদশাহ্‌ তাঁর পোশাক ছিঁড়লেন। তিনি তখনও দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটছিলেন। তাতে লোকেরা দেখতে পেল যে, তাঁর পোশাকের তলায় তিনি ছালার চট পরে আছেন। তিনি বললেন, “আজ যদি শাফটের ছেলে আল-ইয়াসার মাথা তাঁর কাঁধের উপর থাকে তবে আল্লাহ্‌ যেন আমাকে শাস্তি দেন, আর তা ভীষণভাবেই দেন!” আল-ইয়াসা তখন তাঁর ঘরে বসে ছিলেন আর তাঁর সংগে ছিলেন বৃদ্ধ নেতারা। বাদশাহ্‌ একজন লোককে আল-ইয়াসার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু লোকটা সেখানে পৌঁছাবার আগেই আল-ইয়াসা বৃদ্ধ নেতাদের বললেন, “আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না সেই খুনী আমার মাথা কেটে ফেলবার জন্য কিভাবে একজন লোককে পাঠাচ্ছে? দেখুন, লোকটা আসলে পর আপনারা দরজাটা বন্ধ করে দেবেন এবং তার সামনে দরজাটা বন্ধই রাখবেন। তার পিছন পিছন কি তার মালিকের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না?” আল-ইয়াসা তখনও কথা বলছেন এমন সময় সেই লোকটি তাঁর কাছে আসল। তারপর বাদশাহ্‌ এসে বললেন, “এই বিপদ মাবুদের কাছ থেকেই এসেছে। তবে মাবুদের জন্য আর আমি দেরি করব কেন?” আল-ইয়াসা বললেন, “মাবুদ কি বলছেন তা শুনুন। তিনি বলছেন, আগামী কাল সামেরিয়ার দরজায় বারো গ্রাম রূপায় ছয় কেজি ময়দা ও বারো গ্রাম রূপায় বারো কেজি যব বিক্রি হবে।” বাদশাহ্‌কে যে কর্মচারী সাহায্য করছিল সে আল্লাহ্‌র বান্দাকে বলল, “দেখুন, মাবুদ যদি আসমানের দরজাও খুলে দেন তবুও কি এটা হতে পারে?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “তুমি নিজের চোখেই তা দেখতে পাবে, কিন্তু তার কিছুই তুমি খেতে পারবে না।” তখন শহর-দরজায় ঢুকবার পথে চারজন চর্মরোগী ছিল। তারা একে অন্যকে বলল, “আমরা এখানে থেকে কেন মরব? যদি বলি আমরা শহরে যাব তবে সেখানেও দুর্ভিক্ষ আর আমরা মারা যাব। যদি এখানে থাকি তবুও মরব। তার চেয়ে বরং চল, আমরা সিরীয়দের ছাউনিতে গিয়ে তাদের হাতে নিজেদের তুলে দিই। যদি তারা আমাদের বাঁচায় তবে তো আমরা বাঁচলাম, নইলে মরব আর কি।” এই বলে সন্ধ্যার আগে তারা সিরীয়দের ছাউনিতে গেল। ছাউনির ধারে গিয়ে দেখল সেখানে একজন লোকও নেই। মাবুদ রথ, ঘোড়া, ও মস্ত বড় একদল সৈন্যের আওয়াজ সিরীয়দের শুনিয়েছিলেন। এতে সিরীয় সৈন্যেরা একে অন্যকে বলেছিল, “দেখ, আমাদের হামলা করবার জন্য ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হিট্টীয় ও মিসরীয় বাদশাহ্‌দের টাকা দিয়েছে।” এই বলে তারা সন্ধ্যার আগেই তাদের তাম্বু, ঘোড়া, গাধা সব ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। ছাউনি যেমন ছিল তেমনি রেখে তারা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই চর্মরোগীরা ছাউনির ধারে পৌঁছে একটা তাম্বুর ভিতরে গেল। তারা খাওয়া-দাওয়া করে সোনা, রূপা আর কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে গেল এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখল। তারপর তারা ফিরে এসে আর একটা তাম্বুতে ঢুকে কতগুলো জিনিস নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখল। পরে তারা একে অন্যকে বলল, “আমাদের কাজটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না। আজ একটা সুখবরের দিন আর আমরা কাউকে কিছু না বলে চুপ করে আছি। আমরা যদি সকাল পর্যন্ত দেরি করি তবে শাস্তি আমাদের উপর নেমে আসবে। চল, আমরা এখনই গিয়ে রাজবাড়ীতে খবরটা জানাই।” কাজেই তারা গিয়ে শহর-দরজার পাহারাদারদের ডেকে বলল, “আমরা সিরীয়দের ছাউনিতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা লোকও নেই, কারও শব্দও নেই; কেবল ঘোড়া আর গাধাগুলো বাঁধা রয়েছে আর তাম্বুগুলো যেমন ছিল তেমনি রেখেই তারা চলে গেছে।” দরজার পাহারাদারেরা খবরটা জানিয়ে দিল আর তা রাজবাড়ীর ভিতরেও জানানো হল। বাদশাহ্‌ রাতের বেলায় উঠে তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “সিরীয়রা কি করেছে তা আমি তোমাদের বলছি। আমরা যে না খেয়ে আছি তা তারা জানে; তাই তারা ছাউনি ছেড়ে মাঠের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। তারা ভাবছে আমরা এতে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসব আর তখন তারা আমাদের জীবিত অবস্থায় ধরবে এবং শহরে ঢুকবে।” তাঁর একজন কর্মচারী বলল, “শহরে যে কয়টা ঘোড়া বাকী আছে তার মধ্য থেকে পাঁচটা ঘোড়া নিয়ে কয়েকজন লোক বের হয়ে যাক। এখানকার সব বনি-ইসরাইলদের মত তারা তো নিশ্চয়ই মারা যাবে, কাজেই কি হয়েছে তা জানবার জন্য আমরা তাদের পাঠিয়ে দিই।” তখন তারা ঘোড়া সুদ্ধ দু’টা রথ বেছে নিল, আর বাদশাহ্‌ সিরীয় সৈন্যদের তালাশে তাদের পাঠিয়ে দিলেন। রথ-চালকদের তিনি এই হুকুম দিলেন, “তোমরা গিয়ে জেনে এস কি হয়েছে।” তারা জর্ডান নদী পর্যন্ত তাদের তালাশ করল আর দেখল সিরীয়রা তাড়াহুড়া করে পালিয়ে যাবার সময় সমস্ত রাস্তায় তাদের কাপড়-চোপড় ও সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে গেছে। যাদের পাঠানো হয়েছিল তারা ফিরে গিয়ে বাদশাহ্‌কে সব খবর জানাল। তখন লোকেরা বের হয়ে গিয়ে সিরীয়দের ছাউনি লুট করল। তাতে মাবুদের কথামতই ছয় কেজি ময়দা বারো গ্রাম রূপায় এবং বারো কেজি যব বারো গ্রাম রূপায় বিক্রি হল। যে কর্মচারী বাদশাহ্‌কে সাহায্য করেছিল তার উপর তিনি দরজা দেখাশোনা করবার ভার দিলেন, কিন্তু লোকেরা এমনভাবে বেরিয়ে গেল যে, সে দরজার পথে লোকদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল। আল্লাহ্‌র বান্দা আল-ইয়াসা তাঁর ঘরে বাদশাহ্‌কে যে কথা বলেছিলেন সেইভাবেই সে মারা গেল। তিনি বাদশাহ্‌কে যা বলেছিলেন সেইভাবেই ঘটনাটা ঘটল। তিনি বলেছিলেন, “আগামী কাল এই সময়ে সামেরিয়ার দরজায় ছয় কেজি ময়দা বারো গ্রাম রূপায় এবং বারো কেজি যব বারো গ্রাম রূপায় বিক্রি হবে।” জবাবে সেই কর্মচারী আল্লাহ্‌র বান্দাকে বলেছিল, “দেখুন, মাবুদ যদি আসমানের দরজাও খুলে দেন তবুও কি এটা হতে পারে?” আল্লাহ্‌র বান্দা জবাবে বলেছিলেন, “তুমি নিজের চোখেই তা দেখতে পাবে, কিন্তু তার কিছুই তুমি খেতে পারবে না।” আর ঠিক তা-ই তার প্রতি ঘটল, কারণ দরজার পথে সে লোকদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল। আল-ইয়াসা যে স্ত্রীলোকটির ছেলেকে জীবিত করে তুলেছিলেন তাঁকে তিনি বললেন, “আপনি আপনার পরিবার নিয়ে যেখানে পারেন সেখানে গিয়ে কিছুকাল থাকুন, কারণ মাবুদ এই দেশে দুর্ভিক্ষ পাঠিয়ে দেবেন, আর তা সাত বছর ধরে চলবে।” স্ত্রীলোকটি আল্লাহ্‌র বান্দার কথামতই কাজ করলেন। তিনি ও তাঁর পরিবার সেখান থেকে চলে গিয়ে সাত বছর ফিলিস্তিনীদের দেশে বাস করলেন। সাত বছরের শেষে তিনি ফিলিস্তিনীদের দেশ থেকে ফিরে এসে তাঁর বাড়ী ও জমি ফিরে পাওয়ার জন্য বাদশাহ্‌র কাছে গেলেন। বাদশাহ্‌ তখন আল্লাহ্‌র বান্দার চাকর গেহসির সংগে কথা বলছিলেন। তিনি তাকে বলছিলেন, “আল-ইয়াসা যে সব বড় বড় কাজ করেছেন তা আমাকে বল।” গেহসি যখন বাদশাহ্‌কে বলছিল কেমন করে আল-ইয়াসা মৃতকে জীবিত করেছিলেন ঠিক সেই সময়ে যে স্ত্রীলোকটির ছেলেকে আল-ইয়াসা মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন সেই স্ত্রীলোকটি বাদশাহ্‌র কাছে তাঁর বাড়ী ও জমি ফিরে পাওয়ার জন্য মিনতি করতে আসলেন। গেহসি তখন বলল, “হে আমার প্রভু মহারাজ, ইনিই সেই স্ত্রীলোক এবং এ-ই তাঁর ছেলে যাঁকে আল-ইয়াসা বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।” বাদশাহ্‌ তখন স্ত্রীলোকটিকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে পর তিনি তাঁকে সব কথা বললেন। এতে বাদশাহ্‌ সেই স্ত্রীলোকটির ব্যাপারে একজন কর্মচারীকে নিযুক্ত করে তাকে বললেন, “তার সব কিছু তাকে ফিরিয়ে দাও আর সে দেশ ছেড়ে যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার জমি থেকে যা আয় হয়েছে তাও ফিরিয়ে দাও।” এরপর আল-ইয়াসা দামেস্কে চলে গেলেন। সেই সময় সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদ অসুস্থ ছিলেন। বাদশাহ্‌কে বলা হল, “আল্লাহ্‌র বান্দাটি এখানে এসেছেন।” বাদশাহ্‌ তখন হসায়েলকে বললেন, “তুমি একটা উপহার নিয়ে আল্লাহ্‌র বান্দার সংগে দেখা করতে যাও। তাঁর মধ্য দিয়ে মাবুদের কাছ থেকে জেনে নাও যে, আমি এই অসুখ থেকে ভাল হয়ে উঠব কি না।” হসায়েল তখন উপহার হিসাবে দামেস্কের সবচেয়ে ভাল ভাল জিনিস চল্লিশটা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে আল-ইয়াসার সংগে দেখা করতে গেলেন। তিনি আল-ইয়াসার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বললেন, “আপনার পুত্র সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদ এই কথা জিজ্ঞাসা করতে আমাকে পাঠিয়েছেন যে, তিনি এই অসুখ থেকে ভাল হবেন কি না।” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “তুমি গিয়ে তাঁকে বল যে, তিনি নিশ্চয়ই ভাল হয়ে উঠবেন, কিন্তু মাবুদ আমার কাছে প্রকাশ করেছেন যে, আসলে তিনি মারা যাবেন।” এই বলে হসায়েল লজ্জা না পাওয়া পর্যন্ত আল-ইয়াসা তার দিকে তাকিয়েই রইলেন। তারপর আল্লাহ্‌র বান্দা কাঁদতে শুরু করলেন। হসায়েল জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর কেন কাঁদছেন?” জবাবে আল-ইয়াসা বললেন, “কারণ তুমি বনি-ইসরাইলদের কি ক্ষতি করবে তা আমি জানি। তুমি তাদের কেল্লাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেবে, তলোয়ারের আঘাতে তাদের যুবকদের হত্যা করবে, তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাটিতে আছাড় মারবে এবং তাদের গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের পেট চিরে দেবে।” তখন হসায়েল বললেন, “মাত্র একটা কুকুরের মত আপনার এই গোলাম কেমন করে এই সাহসের কাজ করবে?” আল-ইয়াসা বললেন, “তুমি যে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হবে তা মাবুদই আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন।” এর পর হসায়েল আল-ইয়াসার কাছ থেকে তাঁর মালিকের কাছে ফিরে গেলেন। বিন্‌হদদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আল-ইয়াসা তোমাকে কি বলেছেন?” হসায়েল জবাবে বললেন, “তিনি আমাকে বলেছেন আপনি নিশ্চয়ই ভাল হবেন।” কিন্তু তার পরের দিন হসায়েল একটা কম্বল পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে বাদশাহ্‌র মুখের উপর চাপা দিলেন, আর তাতে বাদশাহ্‌ মারা গেলেন। তারপর হসায়েল বিন্‌হদদের জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের ছেলে যোরামের রাজত্বের পঞ্চম বছরে যখন যিহোশাফট এহুদার বাদশাহ্‌ ছিলেন তখন যিহোশাফটের ছেলে যিহোরাম এহুদায় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। যিহোরাম বত্রিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং আট বছর ধরে জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। আহাবের বংশের লোকদের মতই তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের পথে চলতেন, কারণ তিনি আহাবের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তবুও মাবুদ নিজের গোলাম দাউদের কথা মনে করে এহুদাকে ধ্বংস করতে চাইলেন না, কারণ তিনি দাউদ ও তাঁর বংশধরদের চিরকাল একটা বাতি দেবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। যিহোরামের সময়ে ইদোম দেশের লোকেরা এহুদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের জন্য একজন বাদশাহ্‌ ঠিক করে নিয়েছিল। কাজেই যিহোরাম তাঁর সব রথ নিয়ে সায়ীরে গেলেন। ইদোমীয়রা তাঁকে ও তাঁর রথের সেনাপতিদের ঘেরাও করল, কিন্তু তিনি রাতের বেলায় উঠে ঘেরাও ভেংগে বেরিয়ে গেলেন আর তাঁর সৈন্যেরা পালিয়ে বাড়ী চলে আসল। ইদোম আজও এহুদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে আছে। একই সময়ে লিব্‌নাও বিদ্রোহ করেছিল। যিহোরামের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে যিহোরাম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল। তাঁর ছেলে অহসিয় তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবের ছেলে যোরামের রাজত্বের বারো বছরের সময় এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোরামের ছেলে অহসিয় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। তিনি যখন বাদশাহ্‌ হলেন তখন তাঁর বয়স ছিল বাইশ বছর এবং তিনি এক বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মা অথলিয়া ছিলেন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ অম্রির নাত্‌নী। অহসিয় আহাবের বংশের লোকদের মতই চলতেন এবং তাদের মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন, কারণ বিয়ের মধ্য দিয়ে আহাবের পরিবারের সংগে তাঁর সম্বন্ধ হয়েছিল। আল-ইয়াসা শাগরেদ-নবীদের মধ্য থেকে একজনকে ডেকে বললেন, “তোমার কাপড় তোমার কোমর-বাঁধনিতে গুঁজে নাও এবং এই তেলের শিশিটা নিয়ে তুমি রামোৎ-গিলিয়দে যাও। সেখানে গিয়ে নিম্‌শির নাতি, অর্থাৎ যিহোশাফটের ছেলে যেহূর তালাশ কর। তার কাছে গিয়ে তাকে তার সংগীদের কাছ থেকে সরিয়ে একটা ভিতরের কামরায় নিয়ে যাবে। তারপর সেই শিশিটা থেকে তার মাথায় তেল ঢেলে দিয়ে বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হিসাবে আমি তোমাকে অভিষেক করলাম।’ তারপর দরজা খুলে দৌড় দেবে, দেরি করবে না।” এতে সেই যুবক নবী রামোৎ-গিলিয়দে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন সেনাপতিরা এক জায়গায় বসে আছেন। তিনি বললেন, “হে সেনাপতি, আপনার জন্য একটা খবর নিয়ে এসেছি।” যেহূ জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের মধ্যে সেই খবর কার জন্য?” তিনি বললেন, “সেনাপতি, আপনারই জন্য।” এতে যেহূ উঠে ঘরের মধ্যে গেলেন। তখন সেই নবী যেহূর মাথায় সেই তেল ঢেলে দিয়ে বললেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘মাবুদের বান্দাদের উপরে, অর্থাৎ ইসরাইলের উপরে বাদশাহ্‌ হিসাবে আমি তোমাকে অভিষেক করলাম। তোমার মালিক আহাবের বংশকে তুমি ধ্বংস করবে। ঈষেবল আমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের এবং মাবুদের অন্য সব গোলামদের যে রক্তপাত করেছে তার প্রতিশোধ আমি নেব। আহাবের বংশের সবাই ধ্বংস হবে। গোলাম হোক বা স্বাধীন হোক, আহাবের বংশের প্রত্যেকটি পুরুষকে আমি হত্যা করব। আমি তার বংশকে করব নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের বংশের মত ও অহিয়ের ছেলে বাশার বংশের মত। কুকুরেরা ঈষেবলকে যিষ্রিয়েল এলাকায় খেয়ে ফেলবে, তাকে কেউ কবর দেবে না।’ ” এই কথা বলে সেই নবী দরজা খুলে দৌড়ে পালালেন। যেহূ বেরিয়ে যখন তাঁর সংগী সেনাপতিদের কাছে গেলেন তখন তাঁদের মধ্যে একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সব কিছু ভাল তো? ঐ পাগলটা তোমার কাছে কেন এসেছিল?” জবাবে যেহূ বললেন, “তোমরা তো লোকটিকে চেন এবং সে কি ধরনের কথা বলে তা-ও তোমাদের জানা আছে।” তাঁরা বললেন, “এই কথা ঠিক নয়, আমাদের খুলে বল।” তখন যেহূ বললেন, “সে আমাকে বলল যে, মাবুদ বলছেন, ‘ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হিসাবে আমি তোমাকে অভিষেক করছি।’ ” তখন সেই সেনাপতিরা তাড়াতাড়ি করে তাঁদের গায়ের কাপড় নিয়ে সিঁড়ির উপর যেহূর পায়ের নীচে পেতে দিলেন। তারপর শিংগা বাজিয়ে তাঁরা চিৎকার করে বললেন, “যেহূই বাদশাহ্‌।” তারপর যিহোশাফটের ছেলে, অর্থাৎ নিম্‌শির নাতি যেহূ যোরামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। সেই সময় যোরাম ও সমস্ত বনি-ইসরাইল রামোৎ-গিলিয়দ রক্ষা করবার জন্য সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েলের সংগে যুদ্ধ করবার সময় সিরীয়রা যোরামের গায়ে যে আঘাত করেছিল তা থেকে সুস্থ হয়ে উঠবার জন্য তিনি যিষ্রিয়েলে ফিরে গিয়েছিলেন। যেহূ তাঁর সংগী সেনাপতিদের বললেন, “আপনারা যদি আমার পক্ষে থাকেন তবে দেখবেন খবরটা যিষ্রিয়েলে দেবার জন্য যেন কোন লোক শহর থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে না যায়।” তারপর যেহূ তাঁর রথে চড়ে যিষ্রিয়েলে গেলেন, কারণ যোরাম সেখানে বিছানায় শুয়ে ছিলেন এবং এহুদার বাদশাহ্‌ অহসিয় সেখানে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। যেহূর সৈন্যদলকে আসতে দেখে যিষ্রিয়েলের কেল্লার উপর দাঁড়ানো পাহারাদার চিৎকার করে বলল, “আমি একদল সৈন্য আসতে দেখছি।” তখন যোরাম হুকুম দিলেন, “একজন ঘোড়সওয়ারকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দাও। সে তাদের জিজ্ঞাসা করুক, ‘আপনাদের আসবার উদ্দেশ্য ভাল তো?’ ” সেই ঘোড়সওয়ারটি যেহূর সংগে দেখা করতে চলে গেল এবং তাঁকে বলল, “বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘আপনাদের আসবার উদ্দেশ্য ভাল তো?’ ” জবাবে যেহূ বললেন, “আমার আসবার উদ্দেশ্য দিয়ে তোমার দরকার কি? তুমি আমার পিছনে পিছনে এস।” সেই পাহারাদার তখন খবর দিল, “সংবাদ নিয়ে লোকটি তাদের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু সে তো ফিরে আসছে না।” তখন বাদশাহ্‌ দ্বিতীয় আর একজন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালেন। সে সেই সৈন্যদলের কাছে গিয়ে বলল, “বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘আপনাদের আসবার উদ্দেশ্য ভাল তো?’ ” জবাবে যেহূ বললেন, “আমার আসবার উদ্দেশ্য দিয়ে তোমার দরকার কি? তুমি আমার পিছনে পিছনে এস।” সেই পাহারাদারটি খবর দিল, “সে তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, কিন্তু সে-ও তো ফিরে আসছে না। রথ চালানো দেখে মনে হচ্ছে নিম্‌শির নাতি যেহূ রথ চালাচ্ছে। সে পাগলের মতই রথ চালাচ্ছে।” তখন যোরাম হুকুম দিলেন, “আমার রথে ঘোড়া লাগাও।” ঘোড়া লাগানো হলে পর ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যোরাম ও এহুদার বাদশাহ্‌ অহসিয় নিজের নিজের রথে চড়ে যেহূর সংগে দেখা করবার জন্য বের হলেন। যিষ্রিয়েলীয় নাবোতের জমিতে যেহূর সংগে তাঁদের দেখা হল। যোরাম যেহূকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “যেহূ, তোমার আসবার উদ্দেশ্য ভাল তো?” জবাবে যেহূ বললেন, “আপনার মা ঈষেবলের প্রতিমাপূজা ও জাদুবিদ্যার কাজ যখন এত বেশী করে চলছে তখন আমার আসবার উদ্দেশ্য কেমন করে ভাল হতে পারে?” এই কথা শুনে যোরাম ঘুরে পালাবার সময় অহসিয়কে ডেকে বললেন, “অহসিয়, এ বেঈমানী।” তখন যেহূ সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের ধনুকে টান দিয়ে যোরামের দুই কাঁধের মাঝখানে তীর ছুঁড়লেন। তীর গিয়ে তাঁর হৃদপিণ্ডে বিঁধল এবং তিনি রথের মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন যেহূ তাঁর সংগের সেনাপতি বিদ্‌করকে বললেন, “ওকে তুলে নিয়ে যিষ্রিয়েলীয় নাবোতের জমিতে ফেলে দাও। মনে করে দেখ, আমি আর তুমি তাঁর পিতা আহাবের পিছনে রথে করে যখন যাচ্ছিলাম তখন মাবুদ আহাবের বিরুদ্ধে এই কথা বলেছিলেন, ‘আমি মাবুদ বলছি, গতকাল আমি নাবোত ও তার ছেলেদের রক্ত দেখেছি, আর এই জমির উপরেই তোমার কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমি তার প্রতিশোধ নেব।’ তাহলে তুমি এখন মাবুদের কথা অনুসারে ওকে তুলে নিয়ে ঐ জমিতে ফেলে দাও।” যা ঘটেছে তা দেখে এহুদার বাদশাহ্‌ অহসিয় বৈৎ-হাগ্‌গানের পথ ধরে পালিয়ে গেলেন। যেহূ তাঁর পিছনে তাড়া করে যেতে যেতে চিৎকার করে বললেন, “ওকেও মেরে ফেল।” তখন লোকেরা যিব্‌লিয়মের কাছে গূর নামে উঠবার পথে অহসিয়কে তাঁর রথের মধ্যে আঘাত করল, কিন্তু তিনি মগিদ্দোতে পালিয়ে গেলেন আর সেখানেই মারা গেলেন। তাঁর কর্মচারীরা তাঁকে রথে করে জেরুজালেমে নিয়ে গেল এবং দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁর জন্য ঠিক করা কবরে তাঁকে দাফন করল। আহাবের ছেলে যোরামের রাজত্বের এগারো বছরের সময় অহসিয় এহুদার বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। এর পর যেহূ যিষ্রিয়েলে গেলেন। ঈষেবল সেই কথা শুনে চোখে কাজল দিয়ে ও সুন্দর করে চুল বেঁধে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলেন। যেহূ যখন দরজা দিয়ে ঢুকছিলেন তখন ঈষেবল তাঁকে বললেন, “ওহে সিম্রির মত খুনী, নিজের মালিকের হত্যাকারী! তোমার আসবার উদ্দেশ্য কি ভাল?” যেহূ তখন উপরে জানালার দিকে চেয়ে বললেন, “আমার পক্ষে কে আছে? কে আছে?” তখন দুই-তিনজন খোজা উপর থেকে তাঁর দিকে চেয়ে দেখল। যেহূ বললেন, “ওকে নীচে ফেলে দাও।” তখন তারা ঈষেবলকে নীচে ফেলে দিল আর যেহূর রথের ঘোড়াগুলো তাঁকে পায়ে মাড়িয়ে গেল। তাতে তাঁর রক্ত ছিট্‌কে গিয়ে দেয়ালে আর ঘোড়ার গায়ে লাগল। তারপর যেহূ ভিতরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করলেন। পরে তিনি বললেন, “তোমরা ঐ বদদোয়াপ্রাপ্ত স্ত্রীলোকটিকে দাফন করবার ব্যবস্থা কর, কারণ সে একজন রাজকন্যা ছিল।” কিন্তু লোকেরা যখন তাঁকে দাফন করবার জন্য বাইরে গেল তখন তাঁর মাথার খুলি, হাত ও পা ছাড়া আর কিছুই পেল না। এই কথা তারা ফিরে গিয়ে যেহূকে জানালে পর তিনি বললেন, “মাবুদ নিজের গোলাম তিশ্‌বীয় ইলিয়াসের মধ্য দিয়ে ঠিক এই কথাই বলেছিলেন, ‘যিষ্রিয়েলের জমিতে কুকুরেরা ঈষেবলের গোশ্‌ত খাবে। সেই জমির মাটিতে ঈষেবলের লাশ এমন গোবর-সারের মত পড়ে থাকবে যে, কেউ চিনতে পারবে না ওটা ঈষেবলের লাশ।’ ” সামেরিয়াতে আহাবের সত্তরজন বংশধর ছিল। যেহূ চিঠি লিখে সামেরিয়াতে যিষ্রিয়েলের শাসনকর্তাদের কাছে, বৃদ্ধ নেতাদের কাছে এবং আহাবের বংশধরদের রক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁরা ভীষণ ভয় পেয়ে বললেন, “দু’জন বাদশাহ্‌ যখন যেহূর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলেন না তখন আমরা কি করে পারব?” কাজেই রাজবাড়ীর পরিচালক, শহরের শাসনকর্তা, বৃদ্ধ নেতারা এবং আহাবের বংশধরদের রক্ষকেরা যেহূকে এই কথা বলে পাঠালেন, “আমরা আপনার গোলাম। আপনি যা বলবেন আমরা তা-ই করব। আমরা কাউকেই বাদশাহ্‌ করব না; আপনি যা ভাল মনে করেন তা-ই করুন।” তখন যেহূ তাদের কাছে এই বলে দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন, “আপনারা যদি আমার পক্ষে থাকেন এবং আমার হুকুম পালন করতে চান তবে আপনাদের মালিকের বংশধরদের মাথাগুলো কেটে নিয়ে আগামী কাল এই সময়ে যিষ্রিয়েলে আমার কাছে চলে আসুন।” আহাবের সেই সত্তরজন বংশধর তখন শহরের প্রধান লোকদের কাছে ছিল। তাঁরা তাদের দেখাশোনা করতেন। যেহূর চিঠিটা পৌঁছাবার পর সেই লোকেরা সেই সত্তরজনের সবাইকে ধরে হত্যা করলেন। তারপর টুকরিতে করে মাথাগুলো যিষ্রিয়েলে যেহূর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন একজন লোক এসে যেহূকে বলল, “ওরা তাদের মাথা নিয়ে এসেছে।” তখন যেহূ হুকুম দিলেন, “ওগুলো দু’টা গাদা করে শহর-দরজায় ঢুকবার পথে সকাল পর্যন্ত রেখে দাও।” পরের দিন সকালে যেহূ বাইরে গেলেন। তিনি সমস্ত লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনাদের কোন দোষ নেই। আমিই আমার মালিকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেছি, কিন্তু এদের সবাইকে হত্যা করল কে? আপনারা জেনে রাখুন, আহাবের বংশের বিরুদ্ধে মাবুদের বলা একটা কথাও মিথ্যা হবে না। মাবুদ তাঁর গোলাম ইলিয়াসের মধ্য দিয়ে যা করবার কথা বলেছিলেন তা করেছেন।” পরে যেহূ যিষ্রিয়েলে আহাবের বংশের বাকী লোকদের, তাঁর সমস্ত গণ্যমান্য লোকদের, তাঁর বিশেষ বন্ধুদের এবং তাঁর ইমামদের হত্যা করলেন। তাঁদের আর কেউ বেঁচে রইলেন না। তখন যেহূ হুকুম দিলেন, “ওদের জীবন্ত ধর।” লোকেরা তাদের জীবন্তই ধরল এবং সেখানকার কূয়ার কাছে তাদের হত্যা করল। তারা সংখ্যায় ছিল বিয়াল্লিশজন। তাদের মধ্যে একজনকেও তিনি বাঁচিয়ে রাখলেন না। সেখান থেকে চলে যাবার পর রেখবের ছেলে যিহোনাদবের সংগে যেহূর দেখা হল। তিনি যেহূর সংগে দেখা করতে আসছিলেন। যেহূ তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, “আমি যেমন আপনার পক্ষে আছি তেমনি আপনিও কি আমার পক্ষে আছেন?” জবাবে যিহোনাদব বললেন, “জ্বী, আছি।” যেহূ বললেন, “যদি তা-ই হয় তবে আপনার হাত বাড়িয়ে দিন।” যিহোনাদব তা-ই করলেন আর যেহূ তাঁকে রথে তুলে নিলেন। তারপর যেহূ বললেন, “আমার সংগে আসুন এবং মাবুদের জন্য আমার আগ্রহ কতখানি তা দেখুন।” এই বলে তিনি তাঁকে তাঁর রথে করে নিয়ে চললেন। যেহূ সামেরিয়াতে এসে আহাবের বংশের বাদবাকী সব লোকদের হত্যা করলেন। মাবুদ ইলিয়াসকে যেমন বলেছিলেন সেই অনুসারেই যেহূ তাদের ধ্বংস করলেন। তারপর যেহূ সমস্ত লোকদের জমায়েত করে তাদের বললেন, “আহাব বাল দেবতার পূজা সামান্যই করেছেন, কিন্তু যেহূ তাঁর পূজা করবে অনেক বেশী। এখন বাল দেবতার সব নবী, পূজাকারী ও পুরোহিতদের আপনারা ডেকে আনুন। দেখবেন যেন কেউ বাদ না পড়ে, কারণ বাল দেবতার উদ্দেশে আমি একটা মস্ত বড় পশুবলির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। এতে কেউ যদি না আসে তবে তাকে হত্যা করা হবে।” কিন্তু আসলে যেহূ বাল দেবতার পূজাকারীদের ধ্বংস করবার জন্যই এই ছলনা করছিলেন। যেহূ বললেন, “বাল দেবতার উদ্দেশে একটা সভা ডাকা হোক।” কাজেই সেই কথা লোকেরা ঘোষণা করে দিল। যেহূ তখন ইসরাইলের সব জায়গায় খবর পাঠালেন। তাতে বাল দেবতার সমস্ত পূজাকারীরা এসে হাজির হল, কেউই অনুপস্থিত রইল না। তারা বাল দেবতার মন্দিরে ঢুকলে পর এমন ভীড় হল যে, মন্দিরের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত লোকে ভরে গেল। তখন যেহূ পোশাক-রক্ষককে বললেন, “বাল দেবতার পূজাকারী সকলের জন্য পোশাক নিয়ে আসুন।” তাতে সে তাদের জন্য পোশাক বের করে আনল। তারপর যেহূ ও রেখবের ছেলে যিহোনাদব বাল দেবতার মন্দিরে ঢুকলেন। যেহূ বাল দেবতার পূজাকারীদের বললেন, “আপনারা ভাল করে খুঁজে দেখুন যাতে মাবুদের গোলামদের মধ্যে কেউ এখানে আপনাদের মধ্যে না থাকে, শুধু বাল দেবতার পূজাকারীরাই থাকবে।” তখন তাঁরা পশুবলি ও পোড়ানো-উৎসর্গ করতে গেলেন। যেহূ আশিজন লোককে এই বলে সাবধান করে দিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, “আমি তোমাদের হাতে যাদের ভার দিচ্ছি তাদের একজনকেও যদি কেউ পালিয়ে যেতে দেয় তবে পালিয়ে যাওয়া লোকের প্রাণের বদলে তার প্রাণ যাবে।” যেহূ পোড়ানো-উৎসর্গ শেষ করবার সংগে সংগে পাহারাদার ও সেনাপতিদের হুকুম দিলেন, “তোমরা ভিতরে ঢুকে ওদের হত্যা কর; একজনও যেন পালিয়ে যেতে না পারে।” তখন তারা তলোয়ার দিয়ে তাদের কেটে ফেলল। পাহারাদার ও সেনাপতিরা লাশগুলো মন্দিরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভিতরের ঘরে গেল। বাল দেবতার মন্দির থেকে পূজার পাথরগুলো তারা বের করে এনে পুড়িয়ে দিল। তারপর তারা বাল দেবতার পূজার পাথরটা চুরমার করে দিল এবং মন্দিরটা ভেংগে ফেলল। লোকেরা তখন থেকে আজ পর্যন্ত সেটাকে পায়খানা-ঘর হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। এইভাবে যেহূ ইসরাইলের মধ্যে বাল দেবতার পূজা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তা থেকে তিনি সরে আসেন নি। সেটা হল বেথেল ও দানে সোনার বাছুরের পূজা করা। মাবুদ যেহূকে বললেন, “আমার চোখে যা ন্যায্য তা করে তুমি ভাল করেছ এবং আহাবের বংশের প্রতি আমি যা করতে চেয়েছি তা-ও তুমি করেছ, সেইজন্য চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত তোমার বংশধরেরা ইসরাইলের সিংহাসনে বসতে পারবে।” তবুও যেহূ সমস্ত দিল দিয়ে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র শরীয়ত মেনে চলবার দিকে সতর্ক হলেন না। ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তা থেকে তিনি সরে আসলেন না। যেহূর অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে যেহূ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে সামেরিয়াতে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোয়াহস বাদশাহ্‌ হলেন। যেহূ সামেরিয়াতে আটাশ বছর ইসরাইলের উপর রাজত্ব করেছিলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ অহসিয়ের মা অথলিয়া যখন দেখলেন যে, তাঁর ছেলে মারা গেছে তখন তিনি গোটা রাজবংশকে ধ্বংস করলেন। কিন্তু সব রাজপুত্রদের হত্যা করবার আগে বাদশাহ্‌ যিহোরামের মেয়ে অহসিয়ের বোন যিহোশেবা অহসিয়ের ছেলে যোয়াশকে রাজপুত্রদের মধ্য থেকে চুরি করে নিয়ে আসলেন। অথলিয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবার জন্য যিহোশেবা যোয়াশ ও তাঁর ধাইমাকে একটা শোবার ঘরে রাখলেন। কাজেই যোয়াশ মারা পড়লেন না। তিনি তাঁর ধাইমার সংগে ছয় বছর মাবুদের ঘরে লুকানো অবস্থায় ছিলেন; তখন দেশে অথলিয়া রাজত্ব করছিলেন। সপ্তম বছরে ইমাম যিহোয়াদা রক্ষীদলের শত-সেনাপতিদের ও পাহারাদারদের শত-সেনাপতিদের ডেকে পাঠালেন এবং মাবুদের ঘরে তাঁদের নিজের কাছে আনালেন। তিনি তাঁদের সংগে একটা চুক্তি করলেন এবং মাবুদের ঘরে তাঁদের দিয়ে একটা কসম খাইয়ে নিয়ে তারপর বাদশাহ্‌র ছেলেকে তাঁদের দেখালেন। তারপর তিনি তাঁদের হুকুম দিয়ে বললেন, “আপনাদের যা করতে হবে তা এই: আপনারা যাঁরা বিশ্রামবারে কাজ করতে যাবেন, আপনাদের তিন ভাগের এক ভাগ রাজবাড়ী পাহারা দেবেন, এক ভাগ সূর-দরজায় থাকবেন আর এক ভাগ পাহারাদারদের পিছনের দরজায় থাকবেন। এইভাবে আপনারা বায়তুল-মোকাদ্দস পাহারা দেবেন। আপনাদের অন্য দু’টা দল যাঁরা বিশ্রামবারে ছুটি পাবেন তাঁরা সবাই বায়তুল-মোকাদ্দসে বাদশাহ্‌কে পাহারা দেবেন। আপনাদের প্রত্যেককে নিজের নিজের অস্ত্র হাতে নিয়ে বাদশাহ্‌র চারপাশ ঘিরে থাকতে হবে। যে কেউ আপনাদের কাছে আসবে তাকে হত্যা করতে হবে। বাদশাহ্‌ যেখানেই যান না কেন আপনারা তাঁর কাছে কাছে থাকবেন।” ইমাম যিহোয়াদা শত-সেনাপতিদের যা হুকুম করলেন তাঁরা তা-ই করলেন। সেনাপতিরা প্রত্যেকে নিজের নিজের লোকদের নিয়ে, অর্থাৎ যারা বিশ্রামবারে কাজের পালা বদল করতে আসছিল এবং যারা কাজ থেকে ফিরছিল তাদের নিয়ে ইমাম যিহোয়াদার কাছে আসলেন। যিহোয়াদা তখন বাদশাহ্‌ দাউদের যে সব বর্শা ও ঢাল মাবুদের ঘরে ছিল সেগুলো নিয়ে সেনাপতিদের হাতে দিলেন। বাদশাহ্‌কে রক্ষা করবার জন্য পাহারাদারেরা প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে কোরবানগাহের কাছে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত দাঁড়াল। তখন যিহোয়াদা বাদশাহ্‌র ছেলেকে বের করে এনে তাঁর মাথায় তাজ পরিয়ে দিয়ে তাঁর হাতে ব্যবস্থার কিতাবখানা দিলেন। তাঁরা তাঁকে বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করলেন এবং লোকেরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে বলল, “বাদশাহ্‌ চিরজীবী হোন।” পাহারাদার ও লোকদের এই চিৎকার শুনে অথলিয়া মাবুদের ঘরে লোকদের কাছে গেলেন। তিনি চেয়ে দেখলেন নিয়ম অনুসারে বাদশাহ্‌ থামের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সেনাপতিরা ও শিংগা বাদকেরা বাদশাহ্‌র পাশে রয়েছে এবং দেশের সব লোক আনন্দ করছে ও শিংগা বাজাচ্ছে। এ দেখে অথলিয়া তাঁর পোশাক ছিঁড়ে চিৎকার করে বললেন, “এ তো বেঈমানী! বেঈমানী!” তখন ইমাম যিহোয়াদা যাদের উপর সৈন্যদলের ভার ছিল সেই শত-সেনাপতিদের এই হুকুম দিলেন, “ওঁকে সৈন্যদের সারির মাঝখানে রেখে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। যে ওঁর পিছনে পিছনে আসবে তাকে হত্যা করবেন।” এর আগে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন যে, মাবুদের ঘরের মধ্যে অথলিয়াকে হত্যা করা উচিত হবে না। কাজেই অথলিয়াকে ধরা হল এবং ঘোড়া যেখান দিয়ে রাজবাড়ীর মাঠে ঢোকে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর হত্যা করা হল। যিহোয়াদা তারপর মাবুদ এবং বাদশাহ্‌ ও লোকদের মধ্যে এই চুক্তি করলেন যে, তারা মাবুদের বান্দা হিসাবে চলবে। তিনি বাদশাহ্‌ ও লোকদের মধ্যেও একটা চুক্তি করলেন। তারপর দেশের সব লোক বাল দেবতার মন্দিরে গিয়ে সেটা ভেংগে ফেলল। তারা সেখানকার বেদী ও মূর্তিগুলো ভেংগে টুকরা টুকরা করে ফেলল আর বাল দেবতার পুরোহিত মত্তনকে বেদীগুলোর সামনে হত্যা করল। পরে ইমাম যিহোয়াদা মাবুদের ঘরে পাহারাদার নিযুক্ত করলেন। তারপর তিনি শত-সেনাপতিদের, রক্ষীদের, বাকী পাহারাদারদের এবং দেশের সব লোকদের সংগে নিয়ে মাবুদের ঘর থেকে বাদশাহ্‌কে বের করে আনলেন। তাঁরা পাহারদারদের দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকে রাজবাড়ীতে গেলেন এবং বাদশাহ্‌কে রাজ-সিংহাসনে বসালেন। এতে দেশের সব লোক আনন্দ করল এবং শহরটা শান্ত হল। অথলিয়াকে রাজবাড়ীতে হত্যা করা হয়েছিল। যোয়াশ যখন রাজত্ব করতে শুরু করলেন তখন তাঁর বয়স ছিল সাত বছর। যেহূর রাজত্বের সপ্তম বছরে যোয়াশ বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং তিনি জেরুজালেমে চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল সিবিয়া; তিনি ছিলেন বের্‌-শেবা শহরের মেয়ে। ইমাম যিহোয়াদা যতদিন যোয়াশের পরামর্শদাতা ছিলেন ততদিন যোয়াশ মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করেছিলেন। কিন্তু এবাদতের উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করা হয় নি; লোকেরা তখনও সেখানে পশু-কোরবানী করত ও ধূপ জ্বালাত। যোয়াশ ইমামদের বললেন, “মাবুদের ঘরে পবিত্র দান হিসাবে যত টাকা আনা হয় আপনারা সেগুলো নিয়ে জমা করুন। তা হল- লোক গণনা করবার সময় আনা টাকা, মানত-পূরণের জন্য আনা টাকা এবং বায়তুল-মোকাদ্দসে নিজের ইচ্ছায় আনা টাকা। প্রত্যেক ইমাম যেন তাঁর লোকদের কাছ থেকে টাকা নেন এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের ভাংগা জায়গার মেরামতের কাজে তা ব্যবহার করেন।” কিন্তু যোয়াশের রাজত্বের তেইশ বছরের সময় দেখা গেল ইমামেরা তখনও বায়তুল-মোকাদ্দসের মেরামতের কাজ করেন নি। সেইজন্য বাদশাহ্‌ যোয়াশ ইমাম যিহোয়াদা ও অন্যান্য ইমামদের ডেকে পাঠালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা বায়তুল-মোকাদ্দসের ভাংগা জায়গার মেরামত করছেন না কেন? আপনারা আপনাদের লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর নিজেদের কাছে রাখবেন না বরং বায়তুল-মোকাদ্দসের মেরামতের কাজে তা দিয়ে দেবেন।” ইমামেরা রাজী হলেন যে, তাঁরা লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর নিজেদের কাছে রাখবেন না এবং নিজেরা বায়তুল-মোকাদ্দসের মেরামতের কাজও করবেন না। ইমাম যিহোয়াদা তখন একটা বাক্স নিয়ে তার ঢাকনিতে একটা ফুটা করলেন। তিনি সেটা কোরবানগাহের পাশে মাবুদের ঘরে ঢুকবার জায়গার ডান দিকে রাখলেন। যে ইমামেরা বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকবার দরজা পাহারা দিতেন তাঁরা মাবুদের ঘরে আনা সব টাকা সেই বাক্সে রাখতেন। এইভাবে যখন তাঁরা দেখতেন সেই বাক্সে অনেক টাকা জমা হয়েছে তখন বাদশাহ্‌র লোক ও মহা-ইমাম এসে মাবুদের ঘরে আনা টাকাগুলো গুণে থলিতে রাখতেন। কত টাকা হয়েছে তা ওজন করে দেখবার পর তাঁরা সেই টাকা মাবুদের ঘরের কাজ তদারকের জন্য নিযুক্ত করা লোকদের হাতে দিতেন। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা মাবুদের ঘরের মেরামতকারী লোকদের, অর্থাৎ ছুতার মিস্ত্রি, ঘর তৈরী করবার মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি ও পাথর কাটবার মিস্ত্রিদের মজুরী দিতেন। এছাড়া মাবুদের ঘরের মেরামতের কাজের জন্য তাঁরা কাঠ ও সমান করে কাটা পাথর কিনতেন এবং সেই কাজের জন্য আর যা যা লাগত তার জন্য খরচ করতেন। বায়তুল-মোকাদ্দসে যে টাকা আনা হত তা দিয়ে রূপার পেয়ালা, সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা, বাটি, শিংগা কিংবা মাবুদের ঘরের সোনা-রূপার অন্য কোন পাত্র তৈরী করা হয় নি। তদারককারীরা সেই টাকা মিস্ত্রিদের দিতেন যাতে তারা বায়তুল-মোকাদ্দস মেরামতের কাজে ব্যবহার করতে পারে। সেই তদারককারীদের কাছ থেকে হিসাব নেবার দরকার হত না, কারণ তাঁরা সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে কাজ করতেন। দোষের কোরবানীর ও গুনাহের জন্য কোরবানীর টাকা মাবুদের ঘরের বাক্সে রাখা হত না; সেগুলো হত ইমামদের পাওনা। এই সময় সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েল গিয়ে গাৎ শহর হামলা করে তা অধিকার করে নিলেন। তারপর তিনি জেরুজালেম হামলা করবার জন্য এগিয়ে গেলেন। তখন এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশ তাঁর নিজের ও তাঁর পূর্বপুরুষদের, অর্থাৎ এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট, যিহোরাম ও অহসিয়ের দেওয়া আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে পবিত্র করা সমস্ত জিনিস সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েলের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এছাড়া সেই সংগে তিনি মাবুদের ঘরের ধনভাণ্ডারের ও রাজবাড়ীর সমস্ত সোনাও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাতে হসায়েল জেরুজালেম ছেড়ে চলে গেলেন। যোয়াশের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। তাঁর কর্মচারীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সিল্লা যাবার পথে বৈৎ-মিল্লোতে তাঁকে হত্যা করল। যে কর্মচারীরা তাঁকে হত্যা করেছিল তারা হল শিমিয়তের ছেলে যোষাখর ও শোমরের ছেলে যিহোষাবদ। যোয়াশ মারা গেলে পর দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে অমৎসিয় বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ অহসিয়ের ছেলে যোয়াশের রাজত্বের তেইশ বছরের সময় যেহূর ছেলে যিহোয়াহস সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হয়ে সতেরো বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনিও তা-ই করতেন; তা থেকে তিনি ফিরলেন না। সেইজন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে মাবুদের রাগ জ্বলে উঠল; আর তিনি সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েল ও তাঁর ছেলে বিন্‌হদদের হাতে বার বার তাদের তুলে দিলেন। এর পর যিহোয়াহস মাবুদের কাছে মিনতি করলেন এবং মাবুদ তাঁর কথা শুনলেন, কারণ সিরিয়ার বাদশাহ্‌ ভীষণভাবে ইসরাইলের উপর যে জুলুম করছিলেন তা তিনি দেখেছিলেন। তখন মাবুদ ইসরাইলকে একজন উদ্ধারকারী দিলেন। তাতে বনি-ইসরাইলরা সিরিয়ার হাত থেকে রেহাই পেল। তার ফলে তারা আগের মতই আবার শান্তিতে বাস করতে লাগল। কিন্তু ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তারা তাঁর বংশের সেই সব গুনাহ্‌ থেকে সরে আসল না, তা করতেই থাকল। এছাড়া আশেরা-খুঁটিটা তখনও সামেরিয়াতে রয়েই গেল। পঞ্চাশজন ঘোড়সওয়ার, দশটা রথ ও দশ হাজার পদাতিক সৈন্য ছাড়া যিহোয়াহসের সৈন্যদলে আর কেউ ছিল না, কারণ সিরিয়ার বাদশাহ্‌ বাকী সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের মাটির মতই পায়ে মাড়িয়েছিলেন। যিহোয়াহসের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে যিহোয়াহস তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে সামেরিয়াতে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোয়াশ বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশের রাজত্বের সাঁইত্রিশ বছরের সময় যিহোয়াহসের ছেলে যিহোয়াশ সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি ষোল বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন যিহোয়াশ তা-ই করতে থাকলেন, তা থেকে ফিরলেন না। যিহোয়াশের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং যে শক্তি দিয়ে তিনি এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয়ের সংগে যুদ্ধ করেছিলেন সেই কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে যিহোয়াশ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর ছেলে ইয়ারাবিম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের সংগে যিহোয়াশকে দাফন করা হয়েছিল। এর আগে আল-ইয়াসা অসুখে পড়েছিলেন এবং সেই অসুখেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, “হে আমার পিতা, আমার পিতা, রথ আর ঘোড়সওয়ারদের মত আপনি ইসরাইলের রক্ষাকারী।” “পূর্ব দিকের জানালাটা খুলে দিন।” তিনি খুললেন। তারপর আল-ইয়াসা বললেন, “তীর ছুঁড়ুন।” যিহোয়াশ জানালা খুলে তীর ছুঁড়লেন। তখন আল-ইয়াসা ঘোষণা করলেন, “এটা হল মাবুদের জয়লাভের তীর, সিরিয়ার উপরে জয়লাভের তীর। আপনি অফেকে সিরীয়দের হারিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবেন।” তারপর আল-ইয়াসা বললেন, “আপনি তীরগুলো হাতে নিন।” বাদশাহ্‌ সেগুলো হাতে নিলে পর আল-ইয়াসা বললেন, “মাটিতে আঘাত করুন।” বাদশাহ্‌ তিনবার আঘাত করে থামলেন। তখন আল্লাহ্‌র বান্দা রাগ করে বললেন, “পাঁচ বা ছয়বার মাটিতে আঘাত করা আপনার উচিত ছিল; তাহলে আপনি সিরীয়দের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারতেন। কিন্তু এখন আপনি মাত্র তিনবার তাদের হারিয়ে দিতে পারবেন।” পরে আল-ইয়াসা ইন্তেকাল করলেন এবং তাঁকে দাফন করা হল। প্রত্যেকবার বসন্তকালে মোয়াবীয় হানাদারেরা ইসরাইল দেশে ঢুকত। একবার বনি-ইসরাইলরা যখন একজনকে দাফন করছিল তখন হঠাৎ একদল হানাদারকে দেখে তারা লাশটা আল-ইয়াসার কবরে ফেলে দিল। লোকটার লাশ আল-ইয়াসার হাড়গুলোতে ছোঁয়া লাগা মাত্রই বেঁচে উঠে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। যিহোয়াহসের সমস্ত রাজত্বকাল ধরেই সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েল ইসরাইলের উপর জুলুম করেছিলেন। কিন্তু মাবুদ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন সেইজন্য তিনি বনি-ইসরাইলদের উপর রহমত ও মমতা করলেন এবং তাদের দিকে মনোযোগ দিলেন। আজ পর্যন্তও তাদের ধ্বংস করে ফেলতে কিংবা নিজের সামনে থেকে দূর করে দিতে তিনি চান নি। সিরিয়ার বাদশাহ্‌ হসায়েল মারা গেলে পর তাঁর ছেলে বিন্‌হদদ তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। তখন যিহোয়াহসের ছেলে যিহোয়াশ সেই সব শহরগুলো আবার দখল করে নিলেন যেগুলো হসায়েলের ছেলে বিন্‌হদদ তাঁর পিতা যিহোয়াহসের কাছ থেকে যুদ্ধে জয় করে নিয়েছিলেন। যিহোয়াশ তিনবার বিন্‌হদদকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে ইসরাইলীয় শহরগুলো উদ্ধার করে নিয়েছিলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াহসের ছেলে যিহোয়াশের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশের ছেলে অমৎসিয় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। বাদশাহ্‌ হবার সময় তাঁর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। তিনি জেরুজালেমে ঊনত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিহোয়দ্দিন; তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের মেয়ে। মাবুদের চোখে যা ভাল অমৎসিয় তা-ই করতেন, তবে তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের মত নয়। তিনি তাঁর বাবা যোয়াশের মতই সমস্ত কাজ করতেন। কিন্তু এবাদতের উঁচু স্থানগুলো তিনি ধ্বংস করেন নি; লোকেরা সেখানে পশু-কোরবানী করতে ও ধূপ জ্বালাতে থাকল। রাজ্যটা তাঁর হাতের মুঠোয় আসলে পর যে কর্মচারীরা বাদশাহ্‌কে, অর্থাৎ তাঁর বাবাকে হত্যা করেছিল তাদের তিনি হত্যা করলেন। কিন্তু মূসার তৌরাত কিতাবে যা লেখা আছে সেইমত তিনি তাদের ছেলেদের হত্যা করলেন না। সেই কিতাবে মাবুদের এই হুকুম লেখা ছিল, “ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদের হত্যা করা চলবে না, কিন্তু প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে।” অমৎসিয় লবণ-উপত্যকায় দশ হাজার ইদোমীয়কে হত্যা করলেন এবং যুদ্ধ করে সেলা শহর দখল করে তার নাম রাখলেন যক্তেল; সেই নাম আজও আছে। তারপর তিনি যেহূর নাতি, অর্থাৎ যিহোয়াহসের ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশকে বলে পাঠালেন, “আসুন, আমরা যুদ্ধের জন্য মুখোমুখি হই।” কিন্তু ইসরাইলের বাদশাহ্‌ জবাবে এহুদার বাদশাহ্‌কে বলে পাঠালেন, “লেবাননের এক শিয়ালকাঁটা লেবাননেরই এরস গাছের কাছে বলে পাঠাল, ‘আমার ছেলের সংগে আপনার মেয়ের বিয়ে দিন।’ তারপর লেবাননের একটা বুনো জন্তু এসে সেই শিয়ালকাঁটাকে পায়ে মাড়িয়ে দিল। ইদোমকে হারিয়ে দিয়ে সত্যিই আপনার অহংকার হয়েছে। জয়ের বড়াই করুন, তবে নিজের ঘরে থাকুন। কেন বিপদ ডেকে আনবেন আর তার সংগে ডেকে আনবেন নিজের ও এহুদার ধ্বংস?” কিন্তু অমৎসিয় সেই কথায় কান দিলেন না। কাজেই ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশ তাঁকে হামলা করলেন। তিনি ও এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয় এহুদার বৈৎ-শেমশে একে অন্যের মুখোমুখি হলেন। ইসরাইলের হাতে এহুদা সম্পূর্ণভাবে হেরে গেল এবং প্রত্যেকে নিজের নিজের বাড়ীতে পালিয়ে গেল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশ বৈৎ-শেমশে অহসিয়ের নাতি, অর্থাৎ যোয়াশের ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয়কে বন্দী করলেন। তারপর যিহোয়াশ জেরুজালেমে গিয়ে সেখানকার দেয়ালের আফরাহীম-দরজা থেকে কোণের দরজা পর্যন্ত প্রায় চারশো হাত লম্বা একটা অংশ ভেংগে দিলেন। মাবুদের ঘরে এবং রাজবাড়ীর ধনভাণ্ডারে যত সোনা, রূপা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিল তিনি তা সবই নিয়ে গেলেন। এছাড়া তিনি জামিন হিসাবে কতগুলো লোককে নিয়ে সামেরিয়াতে ফিরে গেলেন। যিহোয়াশের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা, যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা এবং এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয়ের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে যিহোয়াশ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের সংগে দাফন করা হল। তাঁর ছেলে ইয়ারাবিম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াহসের ছেলে যিহোয়াশের মৃত্যুর পর এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশের ছেলে অমৎসিয় আরও পনেরো বছর বেঁচে ছিলেন। অমৎসিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। জেরুজালেমে অমৎসিয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে পর তিনি লাখীশে পালিয়ে গেলেন, কিন্তু লোকেরা লাখীশে লোক পাঠিয়ে তাঁকে সেখানে হত্যা করল। তাঁর লাশটা ঘোড়ার পিঠে করে জেরুজালেমে ফিরিয়ে আনা হল এবং দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হল। তারপর এহুদার সমস্ত লোক অসরিয়কে তাঁর পিতা অমৎসিয়ের জায়গায় বাদশাহ্‌ করল। তখন তাঁর বয়স ছিল ষোল বছর। অমৎসিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবার পরে অসরিয় এলৎ শহরটা আবার তৈরী করলেন এবং এহুদার অধীনে আনলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশের ছেলে অমৎসিয়ের রাজত্বের পনেরো বছরের সময় ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশের ছেলে ইয়ারাবিম সামেরিয়াতে বাদশাহ্‌ হলেন এবং তিনি একচল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনি সেই সব গুনাহ্‌ করতেই থাকলেন। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর গোলাম গাৎ-হেফরের মাত্তার ছেলে নবী ইউনুসের মধ্য দিয়ে যে কথা বলেছিলেন সেই কথা অনুসারে ইয়ারাবিম হামা এলাকা থেকে আরবার সমুদ্র পর্যন্ত আগে ইসরাইলের রাজ্যের যে সীমা ছিল তা আবার নিজের অধিকারে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এর কারণ হল, মাবুদ দেখেছিলেন ইসরাইলের স্বাধীন কিংবা গোলাম সবাই ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছে; কেউ তাদের সাহায্য করবার মত ছিল না। মাবুদের ইচ্ছা ছিল না যে, আসমানের নীচ থেকে ইসরাইলের নাম তিনি মুছে ফেলেন। সেইজন্য তিনি যিহোয়াশের ছেলে ইয়ারাবিমের মধ্য দিয়ে তাদের উদ্ধার করলেন। ইয়ারাবিমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা, যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা এবং এক সময় এহুদার অধিকারে থাকা দামেস্ক ও হামা কিভাবে তিনি ইসরাইলের জন্য আবার অধিকার করে নিয়েছিলেন সেই কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে, অর্থাৎ ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে জাকারিয়া বাদশাহ্‌ হলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিমের রাজত্বের সাতাশ বছরের সময় এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয়ের ছেলে অসরিয় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। তিনি ষোল বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে বাহান্ন বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিখলিয়া; তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের মেয়ে। অসরিয় তাঁর পিতা অমৎসিয়ের মতই মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। কিন্তু এবাদতের উঁচু স্থানগুলো তিনি ধ্বংস করেন নি; লোকেরা সেখানে পশু-কোরবানী করতে এবং ধূপ জ্বালাতে থাকল। পরে মাবুদ বাদশাহ্‌কে আঘাত করলে পর তিনি মৃত্যু পর্যন্ত একটা খারাপ চর্মরোগে ভুগেছিলেন। তিনি আলাদা ঘরে বাস করতেন। বাদশাহ্‌র ছেলে যোথম রাজবাড়ীর কর্তা হলেন এবং দেশের লোকদের শাসন করতে লাগলেন। অসরিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে অসরিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যোথম বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ অসরিয়ের রাজত্বের আটত্রিশ বছরের সময় ইয়ারাবিমের ছেলে জাকারিয়া সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হয়ে ছয় মাস রাজত্ব করেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন জাকারিয়া সেই সব গুনাহ্‌ করতে থাকলেন। জাকারিয়ার বিরুদ্ধে যাবেশের ছেলে শল্লুম ষড়যন্ত্র করলেন ও লোকদের সামনেই তাঁকে আক্রমণ করে হত্যা করলেন এবং তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। জাকারিয়ার অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। মাবুদ যেহূকে যা বলেছিলেন, “তোমার বংশের চার পুরুষ পর্যন্ত ইসরাইলের সিংহাসনে বসবে,” তা পূর্ণ হল। এহুদার বাদশাহ্‌ উষিয়ের, অর্থাৎ অসরিয়ের রাজত্বের ঊনচল্লিশ বছরের সময় যাবেশের ছেলে শল্লুম বাদশাহ্‌ হলেন এবং সামেরিয়াতে এক মাস রাজত্ব করেছিলেন। তারপর গাদির ছেলে মনহেম তির্সা থেকে সামেরিয়াতে গিয়ে যাবেশের ছেলে শল্লুমকে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করলেন এবং তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। শল্লুমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তাঁর ষড়যন্ত্রের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে মনহেম তির্সা থেকে বের হয়ে তিপ্‌সহ শহর এবং সেখানকার সব বাসিন্দা ও তার আশেপাশের এলাকার সবাইকে আক্রমণ করলেন, কারণ তারা তাদের শহর-দরজা খুলে দিতে রাজী হয় নি। সেইজন্য তিনি তিপ্‌সহ ধ্বংস করলেন এবং সমস্ত গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের পেট চিরে দিলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ অসরিয়ের রাজত্বের ঊনচল্লিশ বছরের সময় গাদির ছেলে মনহেম ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি সামেরিয়াতে দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তাঁর গোটা রাজত্বকালে তিনি সেই সব গুনাহ্‌ করতে থাকলেন যা নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে করিয়েছিলেন। এর পর আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ পূল ইসরাইল হামলা করলেন। তখন মনহেম পূলের সাহায্যে দেশে তাঁর রাজত্ব স্থির রাখবার জন্য তাঁকে ঊনচল্লিশ টন রূপা দিলেন। মনহেম এই টাকা ইসরাইলের লোকদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে দেবার জন্য প্রত্যেক ধনী লোককে সাড়ে ছ’শো গ্রাম করে রূপা দিতে হল। ফলে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। মনহেমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে মনহেম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে পকহিয় বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ অসরিয়ের রাজত্বের পঞ্চাশ বছরের সময় মনহেমের ছেলে পকহিয় সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হয়ে দু’বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ পকহিয় তা-ই করতেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন পকহিয় সেই সব গুনাহ্‌ করতে থাকলেন। রমলিয়ের ছেলে পেকহ নামে তাঁর একজন সেনাপতি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। পেকহ গিলিয়দের পঞ্চাশজন লোককে সংগে নিয়ে সামেরিয়ার রাজবাড়ীর কেল্লায় পকহিয়, অর্গোব ও অরিয়িকে হত্যা করলেন। পকহিয়কে হত্যা করে পেকহ তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। পকহিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। এহুদার বাদশাহ্‌ অসরিয়ের রাজত্বের বাহান্ন বছরের সময় রমলিয়ের ছেলে পেকহ সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি বিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন পেকহ সেই সব গুনাহ্‌ করতে থাকলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ পেকহের সময়ে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তিগ্লৎ-পিলেষর এসে ইয়োন, আবেল-বৈৎ-মাখা, যানোহ, কেদশ, হাৎসোর, গিলিয়দ, গালীল ও নপ্তালির সমস্ত এলাকা অধিকার করলেন আর লোকদের বন্দী করে আশেরিয়াতে নিয়ে গেলেন। পরে উষিয়ের ছেলে যোথমের রাজত্বের বিশ বছরের সময় এলার ছেলে হোশেয় রমলিয়ের ছেলে পেকহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন এবং তাঁকে হত্যা করে তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। পেকহের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। রমলিয়ের ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ পেকহের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে এহুদার বাদশাহ্‌ উষিয়ের ছেলে যোথম রাজত্ব করতে শুরু করলেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি বাদশাহ্‌ হলেন এবং ষোল বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিরূশা; তিনি ছিলেন সাদোকের মেয়ে। তাঁর পিতা উষিয়ের মতই যোথম মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। কিন্তু এবাদতের উচুঁ স্থানগুলো তিনি ধ্বংস করেন নি। লোকেরা সেখানে পশু-কোরবানী করতে ও ধূপ জ্বালাতে থাকল। যোথম মাবুদের ঘরের চারদিকের দেয়ালের উঁচু জায়গার দরজা মেরামত করেছিলেন। যোথমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। মাবুদ সেই সময় থেকেই সিরিয়ার বাদশাহ্‌ রৎসীন ও রমলিয়ের ছেলে পেকহকে এহুদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠাতে শুরু করলেন। পরে যোথম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের শহরে তাঁকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল। এর পরে তাঁর ছেলে আহস তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। রমলিয়ের ছেলে পেকহের রাজত্বের সতেরো বছরের সময় এহুদার বাদশাহ্‌ যোথমের ছেলে আহস রাজত্ব করতে শুরু করলেন। তিনি বিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হলেন এবং ষোল বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদ যেমন মাবুদের চোখে যা ভাল তা করতেন আহস তেমন করতেন না। তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের মতই চলতেন; এমন কি, মাবুদ যে সব জাতিকে বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে দূর করে দিয়েছিলেন তাদের জঘন্য কাজের মতই তিনিও তাঁর ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করলেন। তিনি পূজার উঁচু স্থানগুলোতে, পাহাড়ের উপরে ও প্রত্যেকটি ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে পশুবলি দিতেন ও ধূপ জ্বালাতেন। সিরিয়ার বাদশাহ্‌ রৎসীন ও রমলিয়ের ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ পেকহ জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে আহস সুদ্ধ শহরটা ঘেরাও করলেন, কিন্তু আহসকে হারিয়ে দিতে পারলেন না। এই সময় সিরিয়ার বাদশাহ্‌ রৎসীন এলৎ শহর থেকে এহুদার লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে সেটা আবার সিরিয়ার অধীনে নিয়ে আসলেন। তারপর ইদোমীয়রা এলতে গিয়ে বাস করতে শুরু করল। এখনও তারা সেখানেই বাস করছে। পরে আহস আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তিগ্লৎ-পিলেষরের কাছে এই কথা বলতে লোক পাঠিয়ে দিলেন, “আমি আপনার গোলাম ও আপনার পুত্র। আপনি এসে সিরিয়ার বাদশাহ্‌ ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌র হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন। তারা আমাকে আক্রমণ করেছে।” আহস মাবুদের ঘর ও রাজবাড়ীর ভাণ্ডার থেকে সোনা ও রূপা নিয়ে উপহার হিসাবে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ রাজী হয়ে দামেস্ক হামলা করে তা দখল করে নিলেন। তিনি সেখানকার লোকদের বন্দী করে কীরে নিয়ে গেলেন এবং রৎসীনকে হত্যা করলেন। তখন বাদশাহ্‌ আহস দামেস্কে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তিগ্লৎ-পিলেষরের সংগে দেখা করতে গেলেন। তিনি সেখানকার বেদীটি দেখে তাঁর নকশা ও সেটা তৈরী করবার পুরো পরিকল্পনা ইমাম উরিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দামেস্ক থেকে বাদশাহ্‌ আহসের পাঠানো সমস্ত পরিকল্পনা মতই ইমাম উরিয়া একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং বাদশাহ্‌ আহস ফিরে আসবার আগেই তা শেষ করলেন। দামেস্ক থেকে ফিরে এসে বাদশাহ্‌ সেই কোরবানগাহ্‌টি দেখলেন এবং সেই কোরবানগাহের কাছে গিয়ে তার উপর কোরবানী করলেন। তিনি সেখানে তাঁর পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী করলেন এবং তাঁর যোগাযোগ-কোরবানীর রক্তও ছিটিয়ে দিলেন। তিনি মাবুদের সামনে রাখা ব্রোঞ্জের কোরবানগাহ্‌টি মাবুদের ঘর ও নতুন কোরবানগাহের মাঝখান থেকে সরিয়ে এনে নতুন কোরবানগাহের উত্তর দিকে রাখলেন। বাদশাহ্‌ আহস তারপর ইমাম উরিয়াকে এই সব হুকুম দিলেন, “ঐ বড় কোরবানগাহ্‌টির উপর সকালবেলার পোড়ানো-কোরবানী ও বিকালবেলার শস্য-কোরবানী করবেন। এছাড়া তার উপর বাদশাহ্‌র পোড়ানো-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী এবং দেশের সব লোকদের পোড়ানো-কোরবানী ও তাদের শস্য-কোরবানী আর ঢালন-কোরবানী করবেন। সমস্ত পোড়ানো-কোরবানী ও অন্যান্য পশু-কোরবানীর রক্ত আপনি সেই কোরবানগাহের উপর ছিটিয়ে দেবেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র নির্দেশ পাওয়ার জন্য আমি ঐ ব্রোঞ্জের কোরবানগাহ্‌টি ব্যবহার করব।” ইমাম উরিয়া বাদশাহ্‌ আহসের হুকুম মতই সব কাজ করলেন। বাদশাহ্‌ আহস গামলা বসাবার ব্রোঞ্জের আসনগুলোর পাশের সব পাত খুলে ফেললেন এবং সেখান থেকে গামলাগুলো সরিয়ে ফেললেন। ব্রোঞ্জের গরুগুলোর উপর যে বিরাট পাত্রটা বসানো ছিল সেটা তিনি সরিয়ে নিয়ে একটা পাথরের ভিত্তির উপরে বসালেন। মাবুদের ঘরে বিশ্রামবারের উদ্দেশে যে চাঁদোয়া তৈরী করা হয়েছিল আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র ভয়ে আহস সেটা খুলে সরিয়ে রাখলেন এবং মাবুদের ঘরের বাইরের দিকে বাদশাহ্‌র ঢুকবার জন্য যে বিশেষ পথ তৈরী করা হয়েছিল তাও সরিয়ে রাখলেন। আহসের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে আহস তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে হিষ্কিয় বাদশাহ্‌ হলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ আহসের রাজত্বের বারো বছরের সময় এলার ছেলে হোশেয় সামেরিয়াতে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি নয় বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন, তবে ইসরাইলের আগের বাদশাহ্‌দের মত নয়। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ শালমানেসার হোশেয়কে আক্রমণ করতে আসলেন। তার ফলে হোশেয় শালমানেসারের অধীন্তবাদশাহ্‌ হলেন এবং তাঁকে খাজনা দিতে লাগলেন। কিন্তু আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ জানতে পারলেন যে, হোশেয় একজন বেঈমান, কারণ তিনি মিসরের বাদশাহ্‌ সোর কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন এবং আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে বছরের পর বছর যে খাজনা দিয়ে আসছিলেন তা আর দিচ্ছেন না। সেইজন্য শালমানেসার হোশেয়কে ধরে জেলে দিলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ গোটা দেশটা আক্রমণ করে সামেরিয়াতে গেলেন এবং তিন বছর ধরে সেটা ঘেরাও করে রাখলেন। হোশেয়ের রাজত্বের নয় বছরের সময় আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সামেরিয়া দখল করে বনি-ইসরাইলদের বন্দী করে আশেরিয়াতে নিয়ে গেলেন। তাদের তিনি হলহে, হাবোর নদীর ধারে গোষণ এলাকায় এবং মিডীয়দের শহরগুলোতে বাস করতে দিলেন। বনি-ইসরাইলরা গোপনে মাবুদের বিরুদ্ধে অনেক খারাপ কাজ করত। তারা যে সব জায়গায় বাস করত- তা ছোট হোক বা বড় হোক- সেই সব জায়গায় নিজেদের জন্য পূজার উঁচু স্থান তৈরী করে নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকটা উঁচু পাহাড়ের উপরে এবং ডালপালা ছড়ানো প্রত্যেকটা সবুজ গাছের নীচে পূজার পাথর ও আশেরা-খুঁটি স্থাপন করেছিল। যে সব জাতিকে মাবুদ তাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মত করে তারাও প্রত্যেকটা পূজার উঁচু স্থানে ধূপ জ্বালাত। এছাড়া তারা আরও খারাপ কাজ করে মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছিল। তারা মূর্তি পূজা করত, যদিও মাবুদ তাদের তা করতে নিষেধ করেছিলেন। মাবুদ তাঁর সমস্ত নবী ও দর্শকদের মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও এহুদাকে এই বলে সাবধান করেছিলেন, “তোমরা তোমাদের খারাপ পথ থেকে ফেরো এবং সমস্ত শরীয়ত যা আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনের জন্য দিয়েছিলাম আর আমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের মধ্য দিয়ে তোমাদের জানিয়েছিলাম তোমরা সেই অনুসারে আমার সমস্ত হুকুম ও নিয়ম পালন কর।” কিন্তু তারা সেই কথায় কান দেয় নি। তাদের পূর্বপুরুষেরা যারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করত না, তাদের মতই তারা একগুঁয়েমি করত। তারা তাঁর সব নিয়ম, তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য স্থাপন করা তাঁর ব্যবস্থা এবং তাদের কাছে তাঁর দেওয়া সাবধান বাণী মানতে অস্বীকার করেছিল। তারা অসার মূর্তির পূজা করে নিজেরাও অসার হয়ে পড়েছিল। মাবুদ যাদের মত চলতে বনি-ইসরাইলদের নিষেধ করেছিলেন তারা তাদের চারপাশের সেই জাতিগুলোর মতই চলত। তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সমস্ত হুকুম ত্যাগ করে নিজেদের জন্য ছাঁচে ফেলে দু’টা বাছুরের মূর্তি এবং একটা আশেরা-খুঁটি তৈরী করে নিয়েছিল। তারা আকাশের তারাগুলোর পূজা করত এবং বাল দেবতার সেবা করত। নিজের ছেলেমেয়েদের তারা আগুনে পুড়িয়ে বলি দিত। তারা গোণাপড়ার ও লক্ষণ দেখে ভবিষ্যতের কথা বলবার অভ্যাস করত এবং মাবুদের চোখে যা খারাপ সেই সব কাজ করবার জন্য নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছিল। কাজেই ইসরাইলের লোকদের উপর মাবুদ রাগ হয়ে তাঁর সামনে থেকে তাঁদের দূর করে দিলেন। বাকী ছিল কেবল এহুদা-গোষ্ঠী, কিন্তু এহুদা-গোষ্ঠীও তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম মত না চলে ইসরাইল যা করত তারাও তা-ই করতে লাগল। সেইজন্য মাবুদ সমস্ত বনি-ইসরাইলদেরই বাতিল করে দিলেন। তিনি তাদের কষ্টে ফেললেন এবং লুটেরাদের হাতে তুলে দিলেন, আর শেষে নিজের সামনে থেকে তাদের দূর করে দিলেন। মাবুদ দাউদের বংশ থেকে যখন ইসরাইলকে ছিঁড়ে নিয়ে আলাদা করে ফেলেছিলেন তখন তারা নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমকে তাদের বাদশাহ্‌ করেছিল। ইয়ারাবিম ইসরাইলকে মাবুদের পথে চলা থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে মহা গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন। ইসরাইলের লোকেরা ইয়ারাবিমের সমস্ত গুনাহের পথে চলেছিল, তা থেকে ফিরে আসে নি। শেষে মাবুদ তাঁর সমস্ত গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের মধ্য দিয়ে দেওয়া সাবধান বাণী অনুসারে তাঁর সামনে থেকে তাদের দূর করে দিলেন। এইজন্যই ইসরাইলের লোকদের তাদের নিজেদের দেশ থেকে বন্দী করে আশেরিয়া দেশে নিয়ে যাওয়া হল, আর আজও তারা সেখানে আছে। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ ইসরাইলের লোকদের জায়গা পূরণ করবার জন্য ব্যাবিলন, কূথা, অব্বা, হামা ও সফর্বয়িম থেকে লোক আনিয়ে সামেরিয়ার শহর ও গ্রামগুলোতে বসিয়ে দিলেন। তারা সেই সব জায়গায় বাস করতে লাগল। সেখানে বাস করবার প্রথম দিকে তারা মাবুদের এবাদত করত না, তাই তিনি তাদের মধ্যে সিংহ পাঠিয়ে দিলেন। সেগুলো তাদের কিছু লোককে মেরে ফেলল। তখন আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কাছে এই খবর পাঠানো হল, “যে সমস্ত লোকদের আপনি বন্দী করে সামেরিয়ায় বাস করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন তারা জানে না সেই দেশের আল্লাহ্‌কে কিভাবে সন্তুষ্ট করতে হয়। তাই আল্লাহ্‌ তাদের মধ্যে সিংহ পাঠিয়ে দিয়েছেন আর সেগুলো তাদের মেরে ফেলছে।” তখন আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তাঁর লোকদের এই হুকুম দিলেন, “যে সব ইমামদের আপনারা সামেরিয়া থেকে বন্দী করে এনেছিলেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে আপনারা সেখানে পাঠিয়ে দিন যাতে সে সেখানে গিয়ে বাস করে এবং সেই দেশের আল্লাহ্‌কে কিভাবে সন্তুষ্ট করতে হয় তা তাদের শিক্ষা দেয়।” তখন সামেরিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া ইমামদের মধ্য থেকে একজন গিয়ে বেথেলে বাস করতে লাগলেন এবং তিনিই তাদের শিক্ষা দিলেন কিভাবে মাবুদের এবাদত করতে হয়। তবুও প্রত্যেক জাতির লোকেরা যে যে গ্রামে ও শহরে বাস করত সেখানে নিজের নিজের দেবতা তৈরী করে নিল এবং সামেরিয়ার লোকদের তৈরী করা পূজার উঁচু স্থানগুলোর বিভিন্ন মন্দিরে সেগুলো রাখল। এইভাবে ব্যাবিলনের লোকেরা তৈরী করল সুক্কোৎ-বনোতের মূর্তি, কূথের লোকেরা করল নের্গলের মূর্তি, হামার লোকেরা করল অশীমার মূর্তি, অব্বীয়রা করল নিভস ও তর্তকের মূর্তি আর সফর্বীয়রা অদ্রম্মেলক ও অনম্মেলক নামে সফর্বয়িমের দেবতাদের উদ্দেশে তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে বলি দিল। তারা মাবুদের এবাদত করত এবং পূজার উঁচু স্থানের মন্দিরগুলোতে পুরোহিতের কাজ করবার জন্য নিজেদের মধ্য থেকে লোক নিযুক্ত করল। তারা মাবুদের এবাদত করত, কিন্তু সেই সংগে যে সব দেশ থেকে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল সেই সব দেশের নিয়ম অনুসারে তারা নিজের নিজের দেবতারও পূজা করত। আজ পর্যন্ত তারা ঐ নিয়ম মেনে চলছে। তারা আসলে মাবুদের এবাদত করে না, কারণ মাবুদ যে ইয়াকুবের নাম ইসরাইল রেখেছিলেন সেই ইয়াকুবের সন্তানদের কাছে মাবুদের দেওয়া নিয়ম, নির্দেশ, আইন এবং হুকুম তারা মেনে চলে না। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের জন্য ব্যবস্থা স্থাপন করবার সময় তাদের এই হুকুম দিয়েছিলেন, “তোমরা কোন দেব-দেবীর পূজা করবে না কিংবা তাদের কাছে মাথা নীচু করবে না এবং তাদের সেবা কিংবা তাদের উদ্দেশে বলি দেবে না। কিন্তু মাবুদ, যিনি হাত বাড়িয়ে মহাশক্তিতে মিসর থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন তোমরা তাঁরই এবাদত করবে, তাঁকে সেজদা করবে ও তাঁর উদ্দেশেই সব কোরবানী দেবে। তিনি যে সব নিয়ম, নির্দেশ, আইন ও হুকুম তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছিলেন তা যত্নের সংগে পালন করবে। তোমরা দেব-দেবীর পূজা করবে না। তোমাদের জন্য যে ব্যবস্থা আমি স্থাপন করেছি তা মনে রেখো; কোন দেব-দেবীর পূজা তোমরা করবে না, বরং তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌রই এবাদত করবে। তোমাদের সব শত্রুদের হাত থেকে তিনিই তোমাদের উদ্ধার করবেন।” কিন্তু ঐ সব জাতিরা সেই কথায় কান না দিয়ে তাদের আগের অভ্যাস মতই চলতে লাগল। তারা মাবুদের এবাদতও করত আবার তাদের দেব-দেবীর পূজাও করত। আজও তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিরা তাদের পূর্বপুরুষদের মতই চলছে। এলার ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হোশেয়ের রাজত্বের তৃতীয় বছরে এহুদার বাদশাহ্‌ আহসের ছেলে হিষ্কিয় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। তিনি পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং ঊনত্রিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল অবী। তিনি ছিলেন জাকারিয়ার মেয়ে। হিষ্কিয় তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের মতই মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। তিনি পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করলেন, পূজার পাথরগুলো চুরমার করলেন এবং আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেললেন। মূসার তৈরী ব্রোঞ্জের সাপটা তিনি ভেংগে টুকরা টুকরা করলেন, কারণ বনি-ইসরাইলরা সেই সময় পর্যন্ত সেই সাপের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাচ্ছিল। ব্রোঞ্জের সাপটার নাম ছিল নহুষ্টন। হিষ্কিয় ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করতেন। তাঁর আগে বা পরে এহুদার বাদশাহ্‌দের মধ্যে তাঁর মত আর কেউ ছিলেন না। মাবুদকে তিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন এবং সব সময় তাঁর পথেই চলতেন। মাবুদ মূসাকে যে সব হুকুম দিয়েছিলেন তা তিনি পালন করতেন। মাবুদ তাঁর সংগে সংগে থাকতেন। তিনি যে কোন কাজ করতেন তাতে সফল হতেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি তাঁর অধীনতা অস্বীকার করলেন। গাজা ও তার সব এলাকার মধ্যে যে সব জায়গায় ফিলিস্তিনীরা বাস করত তিনি তাদের আক্রমণ করে হারিয়ে দিলেন। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের রাজত্বের চতুর্থ বছরে, অর্থাৎ এলার ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হোশেয়ের রাজত্বের সপ্তম বছরে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ শালমানেসার সামেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে শহরটা ঘেরাও করে রাখলেন। তিন বছর ঘেরাও করে রাখবার পর হিষ্কিয়ের রাজত্বের ষষ্ঠ বছরে আর ইসরাইলের বাদশাহ্‌ হোশেয়ের রাজত্বের নবম বছরে আশেরিয়রা সামেরিয়া দখল করে নিল। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ ইসরাইলের লোকদের বন্দী করে আশেরিয়াতে নিয়ে গেলেন এবং হলহে, হাবোর নদীর ধারে গোষণ এলাকায় এবং মিডীয়দের শহরগুলোতে তাদের বাস করতে দিলেন। এই সব ঘটেছিল, কারণ তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কালাম তারা পালন করে নি, বরং তাঁর ব্যবস্থা, অর্থাৎ মাবুদের গোলাম মূসার সমস্ত হুকুম তারা অমান্য করেছিল। সেই সব হুকুমের কথায় তারা কান দেয় নি এবং তা পালনও করে নি। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের রাজত্বের চৌদ্দ বছরের সময় আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব এহুদার সমস্ত দেয়াল-ঘেরা শহরগুলো হামলা করে সেগুলো দখল করে নিলেন। তখন এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় লাখীশে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে এই কথা বলে পাঠালেন, “আমি অন্যায় করেছি। আপনি ফিরে যান। আপনি আমার কাছে যা দাবি করবেন আমি তা-ই দেব।” এতে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছ থেকে প্রায় বারো টন রূপা ও এক টনের কিছু বেশী সোনা দাবি করলেন। কাজেই হিষ্কিয় মাবুদের ঘরে ও রাজবাড়ীর ভাণ্ডারগুলোতে যত রূপা ছিল সবই তাঁকে দিলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় মাবুদের ঘরের দরজা ও দরজার চৌকাঠ যে সোনা দিয়ে মুড়িয়েছিলেন এই সময় তিনি তা খুলে নিয়ে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে দিলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ লাখীশ থেকে তর্তনকে, রব্‌সারীসকে ও রব্‌শাকিকে মস্ত বড় এক দল সৈন্য দিয়ে জেরুজালেমে বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা জেরুজালেমে এসে ধোপার মাঠের রাস্তার ধারে উঁচু জায়গার পুকুরের সংগে লাগানো পানির নালার কাছে থামলেন। তাঁরা বাদশাহ্‌কে ডাকলে পর রাজবাড়ীর পরিচালক হিল্কিয়ের ছেলে ইলিয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন এবং ইতিহাস লেখক আসফের ছেলে যোয়াহ বের হয়ে তাঁদের কাছে গেলেন। তখন রব্‌শাকি তাঁদের বললেন, “আপনারা হিষ্কিয়কে এই কথা বলুন যে, সেই মহান বাদশাহ্‌, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘তুমি কিসের উপর ভরসা করছ? তুমি বলছ তোমার যুদ্ধ করবার বুদ্ধি ও শক্তি আছে, কিন্তু ওগুলো তোমার ফাঁকা বুলি। বল দেখি, তুমি কার উপর ভরসা করে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছ? তুমি তো ভরসা করছ সেই থেঁৎলে যাওয়া নল, অর্থাৎ মিসরের উপর। যে সেই নলের উপর ভরসা করবে তা তার হাত ফুটা করে দেবে। মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের উপর যারা ভরসা করে তাদের প্রতি সে তা-ই করে।’ কিন্তু আপনারা যদি আমাকে বলেন যে, আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করছেন, তাহলে তিনি কি সেই আল্লাহ্‌ নন যাঁর এবাদতের উঁচু স্থান ও কোরবানগাহ্‌গুলো হিষ্কিয় ধ্বংস করেছে এবং এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের বলেছে জেরুজালেমের এই কোরবানগাহের সামনে তাদের এবাদত করতে হবে? “আপনারা আমার হয়ে আপনাদের বাদশাহ্‌কে আরও বলুন, ‘আপনি যদি পারেন তবে আমার মালিক আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র সংগে এই বাজি ধরুন যে, আমি আপনাকে দুই হাজার ঘোড়া দেব যদি আপনি তাতে চড়বার জন্য লোক দিতে পারেন। যদি তা-ই না পারেন তবে আমার মালিকের কর্মচারীদের মধ্যে সব চেয়ে যে ছোট তাকেই বা আপনি কেমন করে বাধা দেবেন, যদিও আপনি মিসরের রথ আর ঘোড়সওয়ারের উপর ভরসা করছেন? তা ছাড়া আমি কি মাবুদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই এই জায়গা হামলা ও ধ্বংস করতে এসেছি? এই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তা ধ্বংস করে ফেলতে মাবুদ নিজেই আমাকে বলেছেন।’ ” তখন হিল্কিয়ের ছেলে ইলীয়াকীম, শিব্‌ন ও যোয়াহ রব্‌শাকিকে বললেন, “আপনার গোলামদের কাছে আপনি দয়া করে আরামীয় ভাষায় কথা বলুন, কারণ আমরা তা বুঝতে পারি। দেয়ালের উপরকার লোকদের সামনে আপনি আমাদের সংগে হিব্রু ভাষায় কথা বলবেন না।” কিন্তু রব্‌শাকি জবাবে বললেন, “আমার মালিক কি কেবল আপনাদের মালিক ও আপনাদের কাছে এই সব কথা বলতে আমাকে পাঠিয়েছেন? দেয়ালের উপরে বসা ঐ সব লোকেরা, যাদের আপনাদেরই মত নিজের নিজের পায়খানা ও প্রস্রাব খেতে হবে তাদের কাছেও কি বলে পাঠান নি?” তারপর রব্‌শাকি দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হিব্রু ভাষায় বললেন, “তোমরা মহান বাদশাহ্‌র, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কথা শোন। বাদশাহ্‌ বলছেন যে, হিষ্কিয় যেন তোমাদের না ঠকায়। সে তাঁর হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। হিষ্কিয় যেন এই কথা বলে মাবুদের উপর তোমাদের বিশ্বাস না জন্মায় যে, ‘মাবুদ নিশ্চয়ই আমাদের উদ্ধার করবেন; এই শহর আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়া হবে না।’ “তোমরা হিষ্কিয়ের কথা শুনো না। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘তোমরা আমার সংগে সন্ধি কর এবং বের হয়ে আমার কাছে এস। তাহলে তোমরা প্রত্যেকে তার নিজের আংগুর ও ডুমুর গাছ থেকে ফল আর নিজের কূয়া থেকে পানি খেতে পারবে। তারপর আমি এসে তোমাদের নিজের দেশের মত আর এক দেশে তোমাদের নিয়ে যাব। সেই দেশ হল শস্য ও নতুন আংগুর-রসের দেশ, রুটি ও আংগুর ক্ষেতের দেশ, জলপাই ও মধুর দেশ। তোমরা যদি আমার কথামত কাজ কর তাহলে তোমরা মরবে না বরং বাঁচবে। “ ‘হিষ্কিয় যখন বলে যে, মাবুদ তোমাদের রক্ষা করবেন, তখন তাঁর কথা তোমরা শুনো না, কারণ সেই কথা বলে সে তোমাদের বিপথে চালাচ্ছে। অন্যান্য জাতির কোন দেবতা কি আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে তার দেশ রক্ষা করতে পেরেছে? হামা ও অর্পদের দেবতারা কোথায়? সফর্বয়িম, হেনা ও ইব্বার দেবতারা কোথায়? তারা কি আমার হাত থেকে সামেরিয়াকে রক্ষা করতে পেরেছে? এই সব দেশের সমস্ত দেব-দেবীদের মধ্যে কে আমার হাত থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করেছে? তাহলে মাবুদ কি করে আমার হাত থেকে জেরুজালেমকে রক্ষা করবেন?’ ” কিন্তু লোকেরা চুপ করে রইল, কোন জবাব দিল না, কারণ বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় কোন জবাব দিতে তাদের নিষেধ করেছিলেন। এর পর রাজবাড়ীর পরিচালক হিল্কিয়ের ছেলে ইলীয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন এবং ইতিহাস লেখক আসফের ছেলে যোয়াহ তাঁদের কাপড় ছিঁড়ে হিষ্কিয়ের কাছে গেলেন এবং রব্‌শাকির সমস্ত কথা তাঁকে জানালেন। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় এই কথা শুনে নিজের কাপড় ছিঁড়লেন এবং ছালার চট পরে মাবুদের ঘরে গেলেন। তিনি রাজবাড়ীর পরিচালক ইলিয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন ও ইমাম-নেতাদের চট পরা অবস্থায় আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ইশাইয়াকে বললেন, “হিষ্কিয় বলছেন যে, আজকের দিনটা হল কষ্টের, শাস্তি পাওয়ার ও অসম্মানের দিন। আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যেন সন্তানেরা জন্ম হবার মুখে এসেছে কিন্তু জন্ম দেবার শক্তি নেই। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ জীবন্ত আল্লাহ্‌কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে রব্‌শাকিকে পাঠিয়েছেন কিন্তু আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ হয়তো সেই সব কথা শুনে তাকে শাস্তি দেবেন। তাই যারা এখনও বেঁচে আছে তাদের জন্য আপনি মুনাজাত করুন।” শোন, আমি তার মধ্যে এমন একটা মনোভাবের সৃষ্টি করব যার ফলে সে একটা সংবাদ শুনে নিজের দেশে ফিরে যাবে এবং সেখানে আমি তাকে তলোয়ারের আঘাতে শেষ করে দেব।’ ” পরে রব্‌শাকি শুনলেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ লাখীশ ছেড়ে চলে গিয়ে লিব্‌নার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। সেইজন্য রব্‌শাকি সেখানে গেলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব খবর পেলেন যে, ইথিওপিয়া দেশের বাদশাহ্‌ তির্হকঃ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়েছেন। কাজেই তিনি দূতদের দিয়ে হিষ্কিয়ের কাছে বলে পাঠালেন, “তোমরা এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়কে বলবে, ‘তুমি যাঁর উপর ভরসা করে আছ সেই আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাতে জেরুজালেমকে তুলে দেওয়া হবে না। তাঁর সেই ছলনার কথায় তুমি ভুল কোরো না। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌রা কিভাবে অন্য সব দেশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই তুমি তা শুনেছ; তাহলে তুমি কেমন করে মনে করছ তুমি রক্ষা পাবে? আমার পূর্বপুরুষেরা যে সব জাতিকে ধ্বংস করেছেন তাদের দেবতারা, অর্থাৎ গোষণ, হারণ, রেৎসফ এবং তলঃসরে বাসকারী আদনের লোকদের দেবতারা কি তাদের রক্ষা করেছেন? হামার বাদশাহ্‌, অর্পদের বাদশাহ্‌, সফর্বয়িম শহরের বাদশাহ্‌ কিংবা হেনা ও ইব্বার বাদশাহ্‌ কোথায়?’ ” হিষ্কিয় দূতদের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়লেন। তারপর তিনি মাবুদের ঘরে গিয়ে মাবুদের সামনে চিঠিটা মেলে ধরলেন। হিষ্কিয় মাবুদের কাছে এই মুনাজাত করলেন, “দুই কারুবীর মাঝখানে থাকা হে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি, একমাত্র তুমিই দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যের আল্লাহ্‌। তুমি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছ। হে মাবুদ, কান দাও, শোন; হে মাবুদ, তোমার চোখ খোল, দেখ; জীবন্ত আল্লাহ্‌কে কুফরী করবার জন্য সন্‌হেরীব যে কথা বলে পাঠিয়েছে তা শোন। হে মাবুদ, এই কথা সত্যি যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌রা এই সব জাতি ও তাদের দেশ ধ্বংস করেছে। তাদের দেবতাদের তারা আগুনে ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে। সেগুলো তো মাবুদ নয়, মানুষের হাতে তৈরী কেবল কাঠ আর পাথর মাত্র; সেইজন্য তারা তাদের ধ্বংস করতে পেরেছে। এখন হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর যাতে দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য জানতে পারে যে, তুমিই, হে আল্লাহ্‌, কেবল তুমিই মাবুদ।” তখন আমোজের ছেলে ইশাইয়া হিষ্কিয়ের কাছে এই খবর পাঠালেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব সম্বন্ধে আপনার মুনাজাত তিনি শুনেছেন। তার বিরুদ্ধে মাবুদ বলছেন, ‘সিয়োন তোমাকে তুচ্ছ করবে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে। জেরুজালেমের লোকেরা তোমার পিছন থেকে মাথা নাড়বে। তুমি কাকে অসম্মান করেছ? কার বিরুদ্ধে কুফরী করেছ? তুমি কার বিরুদ্ধে চিৎকার করেছ এবং গর্বের সংগে চোখ তুলে তাকিয়েছ? ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের বিরুদ্ধেই তুমি এই সব করেছ। তোমার লোকদের দিয়ে তুমি দীন-দুনিয়ার মালিককে টিট্‌কারি দিয়ে বলেছ যে, তোমার সব রথ দিয়ে তুমি পাহাড়গুলোর চূড়ায়, লেবাননের সবচেয়ে উঁচু উঁচু চূড়ায় উঠেছ। তুমি তার সবচেয়ে লম্বা লম্বা এরস গাছ আর ভাল ভাল বেরস গাছ কেটে ফেলেছ। তুমি তার গভীর বনের সুন্দর জায়গায় ঢুকেছ। বিদেশের মাটিতে মাটিতে তুমি কূয়া খুঁড়েছ এবং সেখানকার পানি খেয়েছ। তোমার পা দিয়ে তুমি মিসরের সব নদীগুলো শুকিয়ে ফেলেছ। “ ‘তুমি কি শোন নি যে, অনেক আগেই আমি তা ঠিক করে রেখেছিলাম? অনেক কাল আগেই আমি তার পরিকল্পনা করেছিলাম? আর এখন আমি তা ঘটালাম। সেইজন্যই তো তুমি দেয়াল-ঘেরা শহরগুলো পাথরের ঢিবি করতে পেরেছ। সেখানকার লোকেরা শক্তিহীন হয়েছে এবং ভীষণ ভয় ও লজ্জা পেয়েছে। তারা ক্ষেতের ঘাসের মত, গজিয়ে ওঠা সবুজ চারার মত, ছাদের উপরে গজানো ঘাসের মত যা বেড়ে উঠবার আগেই শুকিয়ে যায়। কিন্তু তুমি কোথায় থাক আর কখন আস বা যাও আর কেমন করে আমার বিরুদ্ধে রেগে ওঠ, তা সবই আমি জানি। তুমি আমার বিরুদ্ধে রেগে উঠেছ বলে এবং তোমার গর্বের কথা আমার কানে এসেছে বলে আমি তোমার নাকে আমার কড়া লাগাব আর তোমার মুখে আমার লাগাম লাগাব; আর যে পথ দিয়ে তুমি এসেছ সেই পথেই ফিরে যেতে আমি তোমাকে বাধ্য করব।’ “হে হিষ্কিয়, তোমার জন্য চিহ্ন হবে এই: এই বছর নিজে নিজে যা জন্মাবে তোমরা তা-ই খাবে, আর দ্বিতীয় বছরে তা থেকে যা জন্মাবে তা খাবে। কিন্তু তৃতীয় বছরে তোমরা বীজ বুনবে ও ফসল কাটবে আর আংগুর ক্ষেত করে তার ফল খাবে। এহুদা-গোষ্ঠীর যে লোকেরা তখনও বেঁচে থাকবে তারা আর একবার সফল হবে। তারা গাছের মত নীচে শিকড় বসাবে আর উপরে ফল ফলাবে। বেঁচে থাকা লোকেরা জেরুজালেম থেকে আসবে, আর সিয়োন পাহাড় থেকে আসবে রক্ষা পাওয়া এক দল লোক। মাবুদের আগ্রহই এই সমস্ত করবে। “সেইজন্য আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র বিষয়ে মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘সে এই শহরে ঢুকবে না কিংবা এখানে একটা তীরও মারবে না। সে ঢাল নিয়ে এর সামনে আসবে না কিংবা ঘেরাও করে ওঠা-নামা করবার জন্য কিছু তৈরী করবে না। সে যে পথ দিয়ে এসেছে সেই পথেই ফিরে যাবে; এই শহরে সে ঢুকবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। আমি আমার ও আমার গোলাম দাউদের জন্য এই শহরটা ঘিরে রেখে তা রক্ষা করব।’ ” সেই রাতে মাবুদের ফেরেশতা বের হয়ে আশেরীয়দের ছাউনির এক লক্ষ পঁচাশি হাজার লোককে হত্যা করলেন। পরদিন সকালবেলায় লোকেরা যখন উঠল তখন দেখা গেল সব জায়গায় কেবল লাশ। কাজেই আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব তাঁর সৈন্যদল নিয়ে চলে গেলেন এবং নিনেভে শহরে ফিরে গিয়ে সেখানে থাকতে লাগলেন। একদিন যখন সন্‌হেরীব তাঁর দেবতা নিষ্রোকের মন্দিরে পূজা করছিলেন তখন অদ্রম্মেলক ও শরেৎসর নামে তাঁর দুই ছেলে তাঁকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে আরারাত দেশে পালিয়ে গেল। সন্‌হেরীবের জায়গায় তাঁর ছেলে এসর-হদ্দোন বাদশাহ্‌ হলেন। সেই সময়ে হিষ্কিয় অসুস্থ হয়ে মরবার মত হয়েছিলেন। তখন আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়া তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “মাবুদ বলছেন যে, আপনি যেন আপনার ঘরের ব্যবস্থা করে রাখেন, কারণ আপনি মারা যাবেন, ভাল হবেন না।” এই কথা শুনে হিষ্কিয় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “হে মাবুদ, তুমি মনে করে দেখ আমি তোমার সামনে কেমন বিশ্বস্তভাবে ও সমস্ত দিলের ভয় করে চলাফেরা করেছি এবং তোমার চোখে যা ঠিক তা করেছি।” এই বলে হিষ্কিয় খুব কাঁদতে লাগলেন। ইশাইয়া রাজবাড়ীর মাঝখানের উঠান পার হয়ে যেতে না যেতেই মাবুদের এই কালাম তাঁর উপর নাজেল হল, “তুমি ফিরে গিয়ে আমার বান্দাদের নেতা হিষ্কিয়কে বল যে, তার পূর্বপুরুষ দাউদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘আমি তোমার মুনাজাত শুনেছি ও তোমার চোখের পানি দেখেছি। আমি তোমাকে সুস্থ করব। এখন থেকে তিন দিনের দিন তুমি মাবুদের ঘরে যাবে। তোমার আয়ু আমি আরও পনেরো বছর বাড়িয়ে দিলাম। আর আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে আমি তোমাকে ও এই শহরকে উদ্ধার করব। আমার জন্য ও আমার গোলাম দাউদের জন্য আমি এই শহরকে রক্ষা করব।’ ” ইশাইয়া বললেন, “ডুমুরের একটা চাক নিয়ে এস।” লোকেরা তা এনে হিষ্কিয়ের ফোড়ার উপরে দিলে তিনি সুস্থ হলেন। এর আগে হিষ্কিয় ইশাইয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মাবুদ যে আমাকে সুস্থ করবেন এবং এখন থেকে তিন দিনের দিন আমি মাবুদের ঘরে যেতে পারব তার চিহ্ন কি?” জবাবে ইশাইয়া বলেছিলেন, “মাবুদ যে তাঁর ওয়াদা রক্ষা করবেন সেইজন্য তিনি একটি চিহ্ন দেবেন। আপনি বলুন, ছায়া কি দশ ধাপ এগিয়ে যাবে, না দশ ধাপ পিছিয়ে যাবে?” হিষ্কিয় বলেছিলেন, “ছায়া দশ ধাপ এগিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার, বরং তা দশ ধাপ পিছিয়ে যাক।” তখন নবী ইশাইয়া মাবুদকে ডেকেছিলেন। তাতে আহসের সিঁড়ি থেকে ছায়াটা যত ধাপ নেমে গিয়েছিল মাবুদ তা থেকে দশ ধাপ পিছিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় বলদনের ছেলে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বরোদক্‌বলদন্‌ হিষ্কিয়ের অসুখের খবর শুনে তাঁর কাছে চিঠি ও উপহার পাঠিয়ে দিলেন। হিষ্কিয় সেই দূতদের গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সব ভাণ্ডারগুলোতে যা কিছু ছিল, অর্থাৎ সোনা, রূপা, খোশবু মসলা, দামী তেল এবং তাঁর অস্ত্রশস্ত্র ও ধনভাণ্ডারের সব কিছু তাদের দেখালেন। হিষ্কিয়ের রাজবাড়ীতে কিংবা তাঁর সারা রাজ্যে এমন কিছু ছিল না যা তিনি তাদের দেখান নি। তখন নবী ইশাইয়া বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঐ লোকেরা কি বলল, আর কোথা থেকেই বা তারা এসেছিল?” হিষ্কিয় বললেন, “ওরা দূর দেশ থেকে, ব্যাবিলন দেশ থেকে এসেছিল।” নবী জিজ্ঞাসা করলেন, “ওরা আপনার রাজবাড়ীর মধ্যে কি কি দেখেছে?” হিষ্কিয় বললেন, “আমার রাজবাড়ীর সব কিছুই ওরা দেখেছে। আমার ধনভাণ্ডারের এমন কিছু নেই যা আমি তাদের দেখাই নি।” তখন ইশাইয়া হিষ্কিয়কে বললেন, “মাবুদ যা বলছেন তা আপনি শুনুন। মাবুদ বলছেন, এমন দিন আসবে যখন আপনার রাজবাড়ীর সব কিছু এবং আপনার পূর্বপুরুষদের জমানো যা কিছু আজ পর্যন্ত রয়েছে সবই ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হবে, কিছুই পড়ে থাকবে না। আপনার কয়েকজন বংশধর, আপনার নিজের সন্তান, যাদের আপনি জন্ম দিয়েছেন তারা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র বাড়ীতে খোজা হয়ে থাকবে।” জবাবে হিষ্কিয় বললেন, “মাবুদের যে কথা আপনি বললেন তা ভাল।” তিনি এই কথা বললেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন তাঁর জীবনকালে তিনি শান্তিতে ও নিরাপদে থাকতে পারবেন। হিষ্কিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা ও যুদ্ধে তাঁর জয়ের কথা এবং কেমন করে তিনি পুকুর ও সুড়ংগ কেটে শহরে পানি নিয়ে এসেছিলেন তা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে হিষ্কিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে মানশা বাদশাহ্‌ হলেন। মানশা বারো বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং পঞ্চান্ন বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল হিফ্‌সীবা। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে যে সব জাতিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মত জঘন্য কাজ করে মানশা মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। তাঁর পিতা হিষ্কিয় পূজার যে সব উঁচু স্থান ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো তিনি আবার তৈরী করলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাব যেমন করেছিলেন তেমনি তিনিও বাল দেবতার উদ্দেশে কতগুলো বেদী ও একটা আশেরা-খুঁটি তৈরী করলেন। তিনি আকাশের সব তারাগুলোর পূজা এবং সেবা করতেন। মাবুদ যে ঘরের বিষয় বলেছিলেন, “আমি জেরুজালেমে বাস করব,” মাবুদের সেই ঘরের মধ্যে তিনি কতগুলো বেদী তৈরী করলেন। মাবুদের ঘরের দু’টা উঠানেই তিনি আসমানের সমস্ত তারাগুলোর উদ্দেশে কতগুলো বেদী তৈরী করলেন। তিনি নিজের ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে বলি দিলেন। তিনি মায়াবিদ্যা ব্যবহার করতেন ও লক্ষণ দেখে ভবিষ্যতের কথা বলতেন এবং যারা ভূতের মাধ্যম হয় এবং খারাপ রূহ্‌দের সংগে সম্বন্ধ রাখে তিনি তাদের সংগে পরামর্শ করতেন। তিনি মাবুদের চোখে অনেক খারাপ কাজ করে তাঁকে রাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি যে আশেরা-খুঁটি খোদাই করে তৈরী করেছিলেন সেটা নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসে রাখলেন। বায়তুল-মোকাদ্দস সম্বন্ধে মাবুদ দাউদ ও তাঁর ছেলে সোলায়মানকে বলেছিলেন, “এই ঘর ও ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্য থেকে আমার বেছে নেওয়া এই জেরুজালেমকে আমি চিরকালের জন্য আমার বাসস্থান করব। বনি-ইসরাইলরা যদি কেবল আমার সব হুকুম যত্নের সংগে পালন করে এবং আমার গোলাম মূসা তাদের যে শরীয়ত দিয়েছে সেই মত চলে তবে আমি তাদের পূর্বপুরুষদের যে দেশ দিয়েছি সেই দেশ তাদের আর ছেড়ে যেতে হবে না।” কিন্তু লোকেরা সেই কথা শুনল না। মানশা তাদের বিপথে নিয়ে গেলেন; তার ফলে যে সব জাতিকে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তাদের চেয়েও তারা আরও খারাপ কাজ করতে লাগল। তখন মাবুদ তাঁর গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের মধ্য দিয়ে এই কথা বললেন, “এহুদার বাদশাহ্‌ মানশা এই সব জঘন্য গুনাহ্‌ করেছে। তার আগে যে আমোরীয়রা ছিল তাদের চেয়েও সে আরও খারাপ কাজ করেছে এবং নিজের প্রতিমাগুলো দিয়ে এহুদাকে গুনাহের পথে পরিচালিত করেছে। কাজেই আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি যে, আমি শীঘ্রই জেরুজালেম ও এহুদার উপর এমন বিপদ আনব যে, সেই কথা যারা শুনবে তারা সবাই শিউরে উঠবে। সামেরিয়ার বিরুদ্ধে যে মাপের দড়ি এবং আহাবের বংশের বিরুদ্ধে যে ওলন দড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল তা আমি জেরুজালেমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব। যেমন করে একজন থালা মুছে নিয়ে উল্টে উবুড় করে তেমনি করে আমি জেরুজালেমকে মুছে ফেলব। আমার লোকদের বাকী অংশকে আমি ত্যাগ করব এবং শত্রুদের হাতে তাদের তুলে দেব। তাদের সমস্ত শত্রুরা তাদের লুট করবে এবং সব কিছু জোর করে নিয়ে যাবে, কারণ আমার চোখে যা খারাপ তারা তা-ই করেছে এবং যেদিন তাদের পূর্বপুরুষেরা মিসর থেকে বের হয়ে এসেছিল সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত তারা আমাকে রাগিয়ে চলেছে।” এছাড়া মানশা এত নির্দোষ লোকদের রক্তপাত করেছিলেন যে, সেই রক্তে জেরুজালেমের এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি এহুদার লোকদের দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন যার ফলে তারা মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করেছিল। মানশার অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তাঁর গুনাহের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে মানশা তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে রাজবাড়ীর বাগানে, অর্থাৎ উষের বাগানে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে আমোন বাদশাহ্‌ হলেন। আমোন বাইশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং দুই বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মশুল্লেমৎ; তিনি ছিলেন যট্‌বা গ্রামের হারুষের মেয়ে। আমোন তাঁর বাবা মানশার মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। তাঁর পিতা যে সব পথে চলেছিলেন তিনিও সেই সব পথে চলতেন; তাঁর পিতা যে সব মূর্তির সেবা করেছিলেন তিনিও সেগুলোর সেবা ও পূজা করতেন। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর পথে চলতেন না। আমোনের কর্মচারীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁর রাজবাড়ীতেই তাঁকে খুন করল। কিন্তু যারা বাদশাহ্‌ আমোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল দেশের লোকেরা তাদের সবাইকে হত্যা করল এবং তারা তাঁর ছেলে ইউসিয়াকে তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ করল। আমোনের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। উষের বাগানে তাঁর জন্য ঠিক করা কবরে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে ইউসিয়া বাদশাহ্‌ হলেন। ইউসিয়া আট বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং একত্রিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিদীদা; তিনি ছিলেন বস্কৎ গ্রামের আদায়ার মেয়ে। মাবুদের চোখে যা ভাল ইউসিয়া তা-ই করতেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের পথে চলতেন, সেই পথ থেকে ডানে কি বাঁয়ে যেতেন না। বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার রাজত্বের আঠারো বছরের সময় তিনি মশুল্লমের নাতি, অর্থাৎ অৎসলিয়ের ছেলে বাদশাহ্‌র লেখক শাফনকে এই কথা বলে মাবুদের ঘরে পাঠালেন, “আপনি মহা-ইমাম হিল্কিয়ের কাছে যান এবং তাঁকে বলুন যেন তিনি মাবুদের ঘরে আনা সমস্ত টাকা-পয়সা যা দারোয়ানেরা লোকদের কাছ থেকে তুলেছে তার হিসাব ঠিক করে রাখেন। তাদের হাতে যে টাকা দেওয়া হবে তার হিসাব তাদের দিতে হবে না, কারণ তারা বিশ্বস্তভাবেই কাজ করে থাকে।” তখন বাদশাহ্‌র লেখক শাফনকে মহা-ইমাম হিল্কিয় বললেন, “মাবুদের ঘরে আমি তৌরাত কিতাবটি পেয়েছি।” হিল্কিয় সেই কিতাবটি শাফনকে দিলে পর তিনি তা তেলাওয়াত করলেন। তারপর শাফন সেই কিতাবটি বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “মাবুদের ঘরে যে টাকা ছিল তা আপনার গোলামেরা বের করে মাবুদের ঘরের কাজের তদারককারীদের হাতে দিয়েছে।” তখন লেখক শাফন এই কথা বাদশাহ্‌কে জানালেন, “ইমাম হিল্কিয় আমাকে একটি কিতাব দিয়েছেন।” এই বলে শাফন তা বাদশাহ্‌কে তেলাওয়াত করে শোনালেন। তৌরাত কিতাবে যা লেখা ছিল তা শুনে বাদশাহ্‌ নিজের পোশাক ছিঁড়লেন। তিনি ইমাম হিল্কিয়, শাফনের ছেলে অহীকাম, মিকায়ের ছেলে অক্‌বোর, শাফন ও বাদশাহ্‌র সাহায্যকারী অসায়কে এই হুকুম দিলেন, “এই যে কিতাবটি পাওয়া গেছে তার মধ্যে যে সমস্ত কথা লেখা আছে সেই সব কথা সম্বন্ধে আপনারা গিয়ে আমার জন্য এবং এখানকার ও সমস্ত এহুদার লোকদের জন্য মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। মাবুদ আমাদের বিরুদ্ধে রাগের আগুনে জ্বলে উঠেছেন, কারণ আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই কিতাবের কথামত চলেন নি এবং পালন করবার জন্য যে সব কথা সেখানে লেখা আছে সেই অনুসারে তাঁরা কাজ করেন নি।” এই কথা শুনে ইমাম হিল্কিয়, অহীকাম, অক্‌বোর, শাফন ও অসায় মহিলা-নবী হুল্‌দার কাছে গিয়ে তাঁর সংগে কথাবার্তা বললেন। হুল্‌দা ছিলেন কাপড়-চোপড় রক্ষাকারী শল্লুমের স্ত্রী। শল্লূম ছিলেন হর্হসের নাতি, অর্থাৎ তিক্‌বের ছেলে। হুল্‌দা জেরুজালেমের দ্বিতীয় অংশে বাস করতেন। তারা আমাকে ত্যাগ করে দেব-দেবীদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়েছে এবং তাদের হাতের তৈরী সমস্ত প্রতিমার দ্বারা আমাকে রাগিয়েছে; সেইজন্য এই জায়গার বিরুদ্ধে আমার রাগের আগুন জ্বলে উঠবে এবং তা নিভানো যাবে না।’ সেইজন্য আমি শীঘ্রই তোমাকে তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে নিয়ে যাব এবং তুমি শান্তিতে দাফন পাবে। এই জায়গার উপর আমি যে সব বিপদ নিয়ে আসব তোমার চোখ তা দেখবে না।’ ” তখন তাঁরা হুল্‌দার জবাব নিয়ে বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে গেলেন। পরে বাদশাহ্‌ ইউসিয়া লোক পাঠিয়ে এহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত বৃদ্ধ নেতাদের ডেকে একত্র করলেন। তিনি এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের, ইমামদের, নবীদের এবং সাধারণ ও গণ্যমান্য সমস্ত লোকদের নিয়ে মাবুদের ঘরে গেলেন। মাবুদের ঘরে ব্যবস্থার যে কিতাবটি পাওয়া গিয়েছিল তার সমস্ত কথা তিনি তাদের কাছে তেলাওয়াত করে শোনালেন। বাদশাহ্‌ থামের পাশে দাঁড়িয়ে মাবুদের পথে চলবার জন্য এবং সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ মেনে চলবার জন্য, অর্থাৎ এই কিতাবের মধ্যে লেখা ব্যবস্থার সমস্ত কথা পালন করবার জন্য মাবুদের সামনে ওয়াদা করলেন। তখন সমস্ত লোক বাদশাহ্‌র সংগে একই ওয়াদা করল। বাদশাহ্‌ তখন বাল দেবতা ও আশেরা এবং আসমানের সমস্ত তারাগুলোর পূজার জন্য তৈরী সব জিনিসপত্র মাবুদের ঘর থেকে বের করে ফেলবার জন্য মহা-ইমাম হিল্কিয়কে, দ্বিতীয় শ্রেণীর ইমামদের এবং দারোয়ানদের হুকুম দিলেন। তিনি সেগুলো জেরুজালেমের বাইরে কিদ্রোণ উপত্যকার মাঠে পুড়িয়ে দিলেন এবং ছাইগুলো বেথেলে নিয়ে গেলেন। এহুদার শহরগুলোর এবং জেরুজালেমের চারপাশের পূজার উঁচু স্থানগুলোতে ধূপ জ্বালাবার জন্য এহুদার বাদশাহ্‌রা যে সব মূর্তিপূজাকারী পুরোহিতদের নিযুক্ত করেছিলেন, অর্থাৎ যারা বাল দেবতা, চাঁদ, সূর্য, তারাপুঞ্জ এবং আসমানের অন্যান্য সমস্ত তারাগুলোর উদ্দেশে ধূপ জ্বালাত তাদের তিনি দূর করে দিলেন। তিনি মাবুদের ঘর থেকে আশেরা-খুঁটিটা নিয়ে জেরুজালেমের বাইরে কিদ্রোণ উপত্যকাতে সেটা পুড়িয়ে দিলেন। তারপর সেটা গুঁড়া করে তার ধুলা সাধারণ লোকদের কবরের উপরে ছিটিয়ে দিলেন। পুরুষ মন্দির-বেশ্যাদের যে কামরাগুলো মাবুদের ঘরে ছিল তিনি সেগুলো ভেংগে দিলেন। সেখানে স্ত্রীলোকেরা আশেরার জন্য কাপড় বুনত। ইউসিয়া এহুদার শহর ও গ্রামগুলো থেকে সমস্ত ইমামদের আনালেন এবং গেবা থেকে বের্‌-শেবা পর্যন্ত যে সব পূজার উঁচু স্থানগুলোতে সেই ইমামেরা ধূপ জ্বালাত সেগুলো নাপাক করে দিলেন। তিনি শাসনকর্তা ইউসার দরজায় ঢুকবার পথে যে সব পূজার উঁচু স্থান ছিল সেগুলো ভেংগে ফেললেন। এই দরজাটা ছিল শহরের প্রধান দরজার বাঁদিকে। পূজার উঁচু স্থানগুলোর ইমামেরা জেরুজালেমে মাবুদের কোরবানগাহের এবাদত-কাজ করতে পারত না, কিন্তু তারা অন্যান্য ইমামদের সংগে খামিহীন রুটি খেতে পারত। অন্য কেউ যাতে মোলক দেবতার উদ্দেশে নিজের ছেলে বা মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী দিতে না পারে সেইজন্য ইউসিয়া বেন্‌-হিন্নোম উপত্যকার তোফৎ নামে পূজার জায়গাটা নাপাক করে দিলেন। এহুদার বাদশাহ্‌রা যে সব রথ ও ঘোড়াগুলো সূর্যের পূজার উদ্দেশে দিয়েছিলেন ইউসিয়া সেই ঘোড়াগুলো দূর করে দিয়ে রথগুলো পুড়িয়ে ফেললেন। মাবুদের ঘরে ঢুকবার পথের পাশে, উঠানের মধ্যে, নথন্তমেলক নামে একজন কর্মচারীর কামরার কাছে ঘোড়াগুলো রাখা হত। রাজবাড়ীর ছাদের উপরে বাদশাহ্‌ আহসের উপরের কামরার কাছে এহুদার বাদশাহ্‌রা যে সব বেদী তৈরী করেছিলেন এবং মাবুদের ঘরের দু’টা উঠানে মানশা যে সব বেদী তৈরী করেছিলেন ইউসিয়া সেগুলো ভেংগে টুকরা টুকরা করে কিদ্রোণ উপত্যকায় ফেলে দিলেন। জেরুজালেমের পূর্ব দিকে ধ্বংসের পাহাড়ের দক্ষিণে যে সব পূজার উঁচু স্থান ছিল সেগুলো তিনি নাপাক করলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ সোলায়মান সিডনীয়দের জঘন্য দেবী অষ্টোরতের জন্য, মোয়াবের জঘন্য দেবতা কমোশের জন্য এবং অম্মোনের লোকদের জঘন্য দেবতা মোলকের জন্য এই সব উঁচু স্থান তৈরী করেছিলেন। ইউসিয়া পূজার পাথরগুলো ভেংগে ফেললেন এবং আশেরা-খুঁটিগুলোও কেটে ফেললেন আর সেই জায়গাগুলো মানুষের হাড়গোড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম যিনি ইসরাইলকে দিয়ে গুনাহ্‌ করিয়েছিলেন তিনি বেথেলে যে বেদী ও পূজার উঁচু স্থান তৈরী করেছিলেন তা ইউসিয়া ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ইউসিয়া সেই পূজার উঁচু স্থানটা পুড়িয়ে দিয়ে গুঁড়া করে ফেললেন এবং আশেরা-খুঁটিটাও পুড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন এবং পাহাড়ের কাছে যে সব কবর ছিল সেখান থেকে হাড়গোড় আনিয়ে সেগুলো বেদীর উপর পুড়িয়ে সেটা নাপাক করলেন। আল্লাহ্‌র বান্দা যে সব ঘটনার কথা আগে ঘোষণা করেছিলেন মাবুদের সেই কালাম অনুসারেই এই সব হয়েছিল। বাদশাহ্‌ বললেন, “আমি যে স-ম্ভটা দেখতে পাচ্ছি সেটা কি?” শহরের লোকেরা বলল, “ওটা আল্লাহ্‌র বান্দার কবরের চিহ্ন। তিনি এহুদা থেকে এসে বেথেলের বেদীর বিরুদ্ধে যা ঘোষণা করেছিলেন আপনি ঠিক তা-ই করেছেন।” তিনি বললেন, “ওটা থাকুক; কেউ যেন তাঁর হাড়গুলো নষ্ট না করে।” সেইজন্য লোকেরা তাঁর হাড়গোড় এবং যে নবী সামেরিয়া থেকে এসেছিলেন তাঁর হাড়গোড় যেমন ছিল তেমনই থাকতে দিল। সামেরিয়ার শহর ও গ্রামগুলোর পূজার উঁচু স্থানে ইসরাইলের বাদশাহ্‌রা যে সব মন্দির তৈরী করে মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছিলেন ইউসিয়া সেগুলো ধ্বংস করে দিলেন এবং সেগুলোর অবস্থা বেথেলের উঁচু স্থানের মত করলেন। ইউসিয়া ঐ সব বেদীর উপরে সেখানকার পুরোহিতদের জবাই করলেন এবং সেগুলোর উপর মানুষের হাড় পোড়ালেন। তারপর তিনি জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। এর পর বাদশাহ্‌ সব লোকদের এই হুকুম দিলেন, “ব্যবস্থার কিতাবে যেমন লেখা আছে তেমনি করে আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করুন।” বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তাদের আমলে কিংবা ইসরাইল ও এহুদার বাদশাহ্‌দের আমলে এই রকম উদ্ধার-ঈদ পালন করা হয় নি। কিন্তু বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার রাজত্বের আঠারো বছরের সময় জেরুজালেমে মাবুদের উদ্দেশে এই উদ্ধার-ঈদ পালন করা হল। এছাড়া যারা ভূতের মাধ্যম হয় এবং যারা খারাপ রূহের সংগে সম্বন্ধ রাখে ইউসিয়া তাদের দূর করে দিলেন। তিনি পারিবারিক দেবমূর্তি, প্রতিমা এবং এহুদা ও জেরুজালেমে যে সব জঘন্য জিনিস দেখতে পেলেন সেগুলোও সব দূর করে দিলেন। ইমাম হিল্কিয় মাবুদের ঘরে শরীয়ত লেখা যে কিতাব খুঁজে পেয়েছিলেন তার সব কথা যেন ঠিকভাবে পালন করা হয় সেইজন্য ইউসিয়া এই কাজ করেছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত মন, প্রাণ ও শক্তি দিয়ে মূসার সমস্ত শরীয়ত অনুসারে মাবুদের পথে চলতেন। তাঁর আগে বা পরে আর কোন বাদশাহ্‌ই তাঁর মত ছিলেন না। তবুও মানশা যে সব কাজ করে মাবুদকে রাগিয়ে তুলেছিলেন তার জন্য এহুদার বিরুদ্ধে যে ভয়ংকর রাগে মাবুদ জ্বলে উঠেছিলেন তা থেকে তিনি ফিরলেন না। সেইজন্য মাবুদ বললেন, “আমার সামনে থেকে যেমন করে আমি ইসরাইলকে দূর করেছি তেমনি করে এহুদাকেও দূর করব, আর যে শহরকে আমি বেছে নিয়েছিলাম সেই জেরুজালেমকে এবং যার সম্বন্ধে আমি বলেছিলাম, ‘এটা আমার বাসস্থান হবে’ সেই বায়তুল-মোকাদ্দসকে আমি অগ্রাহ্য করব।” ইউসিয়ার অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। ইউসিয়ার রাজত্বের সময়ে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন্তনেখো আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে সাহায্য করবার জন্য ফোরাত নদীর দিকে গেলেন। তখন বাদশাহ্‌ ইউসিয়া তাঁর সংগে যুদ্ধ করবার জন্য বের হলেন, কিন্তু ফেরাউন্তনেখো তাঁর সংগে যুদ্ধ করে তাঁকে মগিদ্দোতে হত্যা করলেন। ইউসিয়ার সৈন্যেরা তাঁর লাশটা রথে করে মগিদ্দো থেকে জেরুজালেমে নিয়ে এসে তাঁর নিজের জন্য ঠিক করা কবরে তাঁকে দাফন করল। পরে দেশের লোকেরা তাঁর ছেলে যিহোয়াহসকে অভিষেক করে তাঁর পিতার জায়গায় তাঁকে বাদশাহ্‌ করল। তেইশ বছর বয়সে যিহোয়াহস বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি তিন মাস জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল হমূটল; তিনি ছিলেন লিব্‌না শহরের ইয়ারমিয়ার মেয়ে। যিহোয়াহস তাঁর পূর্বপুরুষদের মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। ফেরাউন্তনেখো তাঁকে হামা দেশের রিব্‌লাতে আটক করে রাখলেন যাতে তিনি জেরুজালেমে রাজত্ব করতে না পারেন। ফেরাউন্তনেখো প্রায় চার টন রূপা ও ঊনচল্লিশ কেজি সোনা খাজনা হিসাবে এহুদা দেশের উপর চাপিয়ে দিলেন। তিনি ইউসিয়ার আর এক ছেলে ইলিয়াকীমকে তাঁর পিতা ইউসিয়ার জায়গায় বাদশাহ্‌ করলেন এবং ইলিয়াকীমের নাম বদলে যিহোয়াকীম রাখলেন। ফেরাউন্তনেখো যিহোয়াহসকে মিসরে নিয়ে গেলেন, আর সেখানে যিহোয়াহস ইন্তেকাল করলেন। ফেরাউন্তনেখোর দাবি অনুসারে যিহোয়াকীম তাঁকে সেই সোনা ও রূপা দিলেন। তা দেওয়ার জন্য তিনি দেশের লোকদের উপর খাজনা চাপালেন এবং দেশের প্রত্যেকের খাজনা ঠিক করে দিয়ে সেই সোনা ও রূপা তিনি দেশের লোকদের কাছ থেকে আদায় করলেন। পঁচিশ বছর বয়সে যিহোয়াকীম বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি এগারো বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল সবীদা; তিনি ছিলেন রূমা গ্রামের পদায়ের মেয়ে। যিহোয়াকীম তাঁর পূর্বপুরুষদের মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। যিহোয়াকীমের রাজত্বের সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার এহুদা দেশ হামলা করলেন। যিহোয়াকীম তিন বছর তাঁর অধীনে ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি বখতে-নাসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। মাবুদ যিহোয়াকীমের বিরুদ্ধে ব্যাবিলনীয়, সিরীয়, মোয়াবীয় ও অম্মোনীয় লুটেরাদের পাঠিয়ে দিলেন। মাবুদ তাঁর গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের মধ্য দিয়ে যে কথা ঘোষণা করেছিলেন সেই অনুসারে এহুদা দেশকে ধ্বংস করবার জন্য তিনি তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যিহোয়াকীমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা “এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোয়াখীন বাদশাহ্‌ হলেন। মিসরের বাদশাহ্‌ যুদ্ধ করবার জন্য তাঁর রাজ্য থেকে আর বের হন নি, কারণ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ মিসরের শুকনা নদী থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত সমস্ত রাজ্যটা দখল করে নিয়েছিলেন। আঠারো বছর বয়সের সময় যিহোয়াখীন বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং তিন মাস জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল নহুষ্টা; তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের ইল্‌নাথনের মেয়ে। যিহোয়াখীন তাঁর পিতার মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। সেই সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের সৈন্যেরা জেরুজালেমে এসে তা ঘেরাও করল। তাঁর সৈন্যেরা যখন শহর ঘেরাও করছিল তখন বখতে-নাসার নিজে শহরের কাছে গেলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীন, তাঁর মা, তাঁর সাহায্যকারীরা, তাঁর সেনাপতিরা ও তাঁর কর্মচারীরা সবাই বখতে-নাসারের হাতে নিজেদের তুলে দিলেন। বখতে-নাসারের রাজত্বের আট বছরের সময় তিনি যিহোয়াখীনকে বন্দী করে নিয়ে গেলেন। মাবুদ যেমন বলেছিলেন তেমনি করে বখতে-নাসার মাবুদের ঘর ও রাজবাড়ী থেকে সব ধন্তরত্ন নিয়ে গেলেন এবং ইসরাইলের বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের ঘরের জন্য সোনা দিয়ে যে সব জিনিস তৈরী করেছিলেন তা তিনি কেটে টুকরা টুকরা করলেন। এছাড়া জেরুজালেমের সবাইকে, অর্থাৎ সমস্ত কর্মচারী ও যোদ্ধাদের, সমস্ত কারিগর ও কর্মকারদের- মোট দশ হাজার লোককে তিনি বন্দী করে নিয়ে গেলেন। দেশে গরীব লোক ছাড়া আর কেউ রইল না। বখতে-নাসার যিহোয়াখীনকে বন্দী হিসাবে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জেরুজালেম থেকে বাদশাহ্‌র মাকে, তাঁর স্ত্রীদের, তাঁর কর্মচারীদের এবং দেশের গণ্যমান্য লোকদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত ও শক্তিশালী সাত হাজার যোদ্ধার গোটা সৈন্যদল এবং এক হাজার কারিগর ও কর্মকারদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যিহোয়াখীনের জায়গায় তাঁর চাচা মত্তনিয়কে বাদশাহ্‌ করলেন এবং তাঁর নাম বদলে সিদিকিয় রাখলেন। একুশ বছর বয়সে সিদিকিয় বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি জেরুজালেমে এগারো বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল হমূটল; তিনি ছিলেন লিব্‌না শহরের ইয়ারমিয়ার মেয়ে। যিহোয়াকীমের মত সিদিকিয় মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। জেরুজালেম ও এহুদার লোকদের দরুন মাবুদ রাগে জ্বলে উঠেছিলেন এবং শেষে তিনি তাঁর সামনে থেকে তাদের দূর করে দিয়েছিলেন। পরে সিদিকিয় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। সিদিকিয়ের রাজত্বের নবম বছরের দশম মাসের দশ দিনের দিন ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। তিনি শহরের বাইরে ছাউনি ফেললেন এবং শহরের চারপাশে ঢিবি তৈরী করলেন। বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের এগারো বছর পর্যন্ত শহরটা ঘেরাও করে রাখা হল। চতুর্থ মাসের নয় দিনের দিন শহরে দুর্ভিক্ষের অবস্থা এত ভীষণ হল যে, লোকদের খাওয়ার জন্য কিছুই ছিল না। পরে শহরের দেয়ালের একটা জায়গা ভেংগে গেল। যদিও ব্যাবিলনীয়রা তখনও শহরটা ঘেরাও করে ছিল তবুও রাতের বেলায় এহুদার সমস্ত সৈন্য বাদশাহ্‌র বাগানের কাছে দুই দেয়ালের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল আর বাদশাহ্‌ আরবার দিকে পালিয়ে গেলেন। তাঁর সমস্ত সৈন্য তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল এবং সেই সময় ব্যাবিলনীয় সৈন্যদলও বাদশাহ্‌র পিছনে তাড়া করে জেরিকোর সমভূমিতে তাঁকে ধরে ফেলল। তাঁরা তাঁকে বন্দী করে রিব্‌লাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেল। সেখানে তাঁর উপর শাস্তির হুকুম দেওয়া হল। সৈন্যেরা সিদিকিয়ের চোখের সামনেই তাঁর ছেলেদের হত্যা করল। তারপর তারা তাঁর চোখ দু’টা তুলে ফেলে তাঁকে ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বেঁধে ব্যাবিলনে নিয়ে গেল। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের রাজত্বের ঊনিশ বছরের পঞ্চম মাসের সপ্তম দিনে বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন জেরুজালেমে আসলেন। তিনি মাবুদের ঘরে, রাজবাড়ীতে এবং জেরুজালেমের সমস্ত বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। সমস্ত প্রধান প্রধান বাড়ী তিনি পুড়িয়ে ফেললেন। বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতির অধীনে সমস্ত ব্যাবিলনীয় সৈন্যদল জেরুজালেমের দেয়াল ভেংগে ফেলল। শহরের বাকী লোকদের এবং যারা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র পক্ষে গিয়েছিল তাদের সবাইকে রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন বন্দী করে নিয়ে গেলেন, কিন্তু আংগুর ক্ষেত দেখাশোনা ও জমি চাষ করবার জন্য কিছু গরীব লোককে তিনি দেশে রেখে গেলেন। ব্যাবিলনীয়রা মাবুদের ঘরের ব্রোঞ্জের দু’টা থাম, গামলা বসাবার ব্রোঞ্জের আসনগুলো এবং ব্রোঞ্জের বিরাট পাত্রটি ভেংগে টুকরা টুকরা করে ব্যাবিলনে নিয়ে গেল। এছাড়া তারা সব পাত্র, বেল্‌চা, সল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা, হাতা এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের এবাদত-কাজের জন্য অন্যান্য সমস্ত ব্রোঞ্জের জিনিস নিয়ে গেল। সব আগুন রাখবার পাত্র, বাটি এবং সোনা-রূপার অন্যান্য সমস্ত জিনিসও বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নিয়ে গেলেন। মাবুদের ঘরের জন্য সোলায়মান যে দু’টা থাম, বিরাট পাত্র এবং আসনগুলো তৈরী করিয়েছিলেন সেগুলোর ব্রোঞ্জ ওজন করা সম্ভব ছিল না। প্রত্যেকটা থাম ছিল আঠারো হাত উঁচু ও তার মাথাটা ছিল তিন হাত উঁচু। মাথাটার চারপাশ ব্রোঞ্জের শিকল ও ব্রোঞ্জের ডালিম দিয়ে সাজানো ছিল। ইহুদীদের প্রধান ইমাম সরায়, দ্বিতীয় ইমাম সফনিয় ও তিনজন দারোয়ানকে রক্ষীদলের সেনাপতি বন্দী করে নিয়ে গেলেন। যারা তখনও শহরে ছিল তাদের মধ্য থেকে তিনি যোদ্ধাদের উপরে নিযুক্ত একজন কর্মচারী ও বাদশাহ্‌র পাঁচজন পরামর্শদাতাকে ধরলেন। এছাড়া সেনাপতির লেখক, যিনি সৈন্যদলে লোক ভর্তি করতেন তাঁকে এবং শহরের মধ্যে পাওয়া আরও ষাটজন লোককেও ধরলেন। সেনাপতি নবূষরদন তাদের সবাইকে বন্দী করে রিব্‌লাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ হামা দেশের রিব্‌লাতে এই সব লোকদের হত্যা করলেন। এইভাবে এহুদার লোকদের বন্দী করে নিজের দেশ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হল। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার যে সব লোকদের এহুদা দেশে রেখে গিয়েছিলেন তাদের উপরে তিনি শাফনের নাতি, অর্থাৎ অহীকামের ছেলে গদলিয়কে নিযুক্ত করলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ গদলিয়কে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন শুনে এহুদার বাকী সেনাপতিরা ও তাঁদের লোকেরা, অর্থাৎ নথনিয়ের ছেলে ইসমাইল, কারেয়ের ছেলে যোহানন, নটোফাতীয় তন্‌হূমতের ছেলে সরায় ও মাখাথীয়ের ছেলে যাসনিয় এবং তাদের লোকেরা মিসপাতে গদলিয়ের কাছে আসলেন। গদলিয় তাদের ও তাদের লোকদের কাছে কসম খেয়ে বললেন, “আপনারা ব্যাবিলনীয় শাসনকর্তাদের ভয় করবেন না। আপনারা দেশে বাস করে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র অধীনতা স্বীকার করুন, তাতে আপনাদের ভাল হবে।” কিন্তু সপ্তম মাসে ইলীশামার নাতি, অর্থাৎ নথনিয়ের ছেলে ইসমাইল দশজন লোক সংগে করে নিয়ে গদলিয়কে এবং এহুদার যে সব লোকেরা ও ব্যাবিলনীয়রা মিসপাতে তাঁর সংগে ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করলেন। এই ইসমাইল ছিল রাজবংশের লোক। এতে ব্যাবিলনীয়দের ভয়ে এহুদার ছোট-বড় সব লোকেরা ও সেনাপতিরা মিসরে পালিয়ে গেল। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীনের বন্দীত্বের সাঁইত্রিশ বছরের সময় ইবিল-মারডক ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি সেই বছরের বারো মাসের সাতাশ দিনের দিন যিহোয়াখীনকে জেলখানা থেকে ছেড়ে দিলেন। তিনি যিহোয়াখীনের সংগে ভালভাবে কথা বললেন এবং ব্যাবিলনে তাঁর সংগে আর যে সব বাদশাহ্‌রা ছিলেন তাঁদের চেয়েও তাঁকে আরও সম্মানের আসন দিলেন। যিহোয়াখীন জেলখানার কাপড়-চোপড় খুলে ফেললেন এবং জীবনের বাকী দিনগুলো নিয়মিতভাবে বাদশাহ্‌র সংগে খাওয়া-দাওয়া করে কাটিয়ে দিলেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বাদশাহ্‌ নিয়মিতভাবে তাঁকে প্রতিদিনের জন্য একটা ভাতা দিতেন। আদমের ছেলে শিস, শিসের ছেলে আনুশ, আনুশের ছেলে কীনান, কীনানের ছেলে মাহলাইল, মাহলাইলের ছেলে ইয়ারুদ, ইয়ারুদের ছেলে ইনোক, ইনোকের ছেলে মুতাওশালেহ, মুতাওশালেহের ছেলে লামাক ও লামাকের ছেলে নূহ্‌। নূহের ছেলেরা হল সাম, হাম ও ইয়াফস। ইয়াফসের ছেলেরা হল গোমর, মাজুজ, মাদয়, যবন, তুবল, মেশক ও তীরস। গোমরের ছেলেরা হল অস্কিনস, দীফৎ ও তোগর্ম। যবনের ছেলেরা হল ইলীশা, তর্শীশ, কিত্তীম ও রোদানীম। হামের ছেলেরা হল কূশ, মিসর, পূট ও কেনান। কূশের ছেলেরা হল সবা, হবীলা, সপ্তা, রয়মা ও সপ্তকা। রয়মার ছেলেরা হল সাবা ও দদান। কূশের একটি ছেলে হয়েছিল যাঁর নাম ছিল নমরূদ। তিনি দুনিয়াতে একজন ক্ষমতাশালী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। সামের ছেলেরা হল ইলাম, আশুর, আরফাখশাদ, লূদ ও ইরাম। ইরামের ছেলেরা হল আওস, হূল, গেথর ও মেশেক। আরফাখশাদের ছেলে শালেখ এবং শালেখের ছেলে আবের। আবেরের দু’টি ছেলে হয়েছিল। তাদের একজনের নাম ছিল ফালেজ; তার সময়ে দুনিয়া ভাগ হয়েছিল বলেই তার এই নাম দেওয়া হয়েছিল। ফালেজের ভাইয়ের নাম ছিল ইয়াকতান। এই হল সামের বংশ-তালিকা: সামের ছেলে আরফাখশাদ, আরফাখশাদের ছেলে শালেখ, ইব্রাহিমের উপস্ত্রী কাতুরার ছেলেরা হল সিম্রণ, যক্‌ষণ, মদান, মাদিয়ান, যিশ্‌বক ও শূহ। যক্‌ষণের ছেলেরা হল সাবা ও দদান। মাদিয়ানের ছেলেরা হল ঐফা, এফর, হনোক, অবীদ ও ইল্‌দায়া। এরা সবাই ছিল কাতুরার ছেলে ও নাতি। ইব্রাহিমের ছেলে ইসহাকের ছেলেরা হল ইস্‌ আর ইসরাইল। ইসের ছেলেরা হল ইলীফস, রূয়েল, যিয়ূশ, যালম ও কারুন। ইলীফসের ছেলেরা হল তৈমন, ওমার, সফী, গয়িতম, কনস এবং তিম্নার গর্ভে আমালেক। রূয়েলের ছেলেরা হল নহৎ, সেরহ, শম্ম ও মিসা। সেয়ীরের ছেলেরা হল লোটন, শোবল, শিবিয়োন, অনা, দিশোন, এৎসর ও দীশন। লোটনের ছেলেরা হল হোরি ও হোমম। তিম্না ছিল লোটনের বোন। শোবলের ছেলেরা হল অলিয়ন, মানহৎ, এবল, শফী ও ওনম। সিবিয়োনের ছেলেরা হল অয়া ও অনা। অনার ছেলে হল দিশোন। দিশোনের ছেলেরা হল হম্রণ, ইশ্‌বন, যিত্রণ ও করাণ। এৎসরের ছেলেরা হল বিল্‌হন, সাবন ও যাকন। দীশনের ছেলেরা হল আওস ও অরাণ। বনি-ইসরাইলদের মধ্যে রাজশাসন শুরুহবার আগে ইদোম দেশে যে সব বাদশাহ্‌রা রাজত্ব করেছিলেন তাঁদের নাম এই: বাউরের ছেলে বেলা। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল দিন্‌হাবা। বেলার ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় বস্রা শহরের সেরহের ছেলে যোবব বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। যোববের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় তৈমনীয়দের দেশের হূশম বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। হূশমের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় বদদের ছেলে হদদ্‌ বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। তিনি মোয়াব দেশে মাদিয়ানীয়দের হারিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল অবীৎ। হদদের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় মস্রেকা শহরের সম্ল বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। সম্লের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় সেই এলাকার নদীর পারের রহোবোৎ শহরের শৌল বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। শৌলের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় অক্‌বোরের ছেলে বাল-হানন বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। বাল-হাননের ইন্তেকালের পরে তাঁর জায়গায় হদদ্‌ বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল পায় এবং তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল মহেটবেল। তিনি মট্রেদের মেয়ে এবং মেষাহবের নাত্‌নী। ইসরাইলের ছেলেরা হল রূবেণ, শিমিয়োন, লেবি, এহুদা, ইষাখর, সবূলূন, দান, ইউসুফ, বিন্‌ইয়ামীন, নপ্তালি, গাদ ও আশের। এহুদার বংশ-তালিকা এহুদার ছেলেরা হল এর, ওনন ও শেলা। এই তিনজন ছিল বৎ-শূয়ার গর্ভের সন্তান। বৎ-শূয়া ছিল একজন কেনানীয় স্ত্রীলোক। এর নামে এহুদার বড় ছেলে মাবুদের চোখে খারাপ হওয়াতে তিনি তাকে মেরে ফেললেন। এহুদার ছেলের স্ত্রী তামরের গর্ভে এহুদার ছেলে পেরস ও সেরহের জন্ম হয়েছিল। এহুদার মোট পাঁচটি ছেলে ছিল। পেরসের ছেলেরা হল হিষ্রোণ ও হামূল। সেরহের ছেলেরা হল শিম্রি, এথন, হেমন, কল্‌কোল ও দারা। এরা ছিল মোট পাঁচজন। শিম্রির নাতি, অর্থাৎ কর্মির ছেলে ছিল আখন, যার আর এক নাম ছিল আখর, সে ধ্বংসের জন্য ঠিক করে রাখা জিনিস নিয়ে ইসরাইলের উপর বিপদ ডেকে এনেছিল। এথনের একজন ছেলের নাম ছিল অসরিয়। হিষ্রোণের ছেলেরা হল যিরহমেল, রাম ও কালুবায়। রামের ছেলে হল অম্মীনাদব। অম্মীনাদবের ছেলে হল নহশোন; তিনি এহুদা-গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। নহশোনের ছেলে সল্‌মোন ও সল্‌মোনের ছেলে বোয়স; বোয়সের ছেলে ওবেদ আর ওবেদের ছেলে ইয়াসি। ইয়াসির বড় ছেলে হল ইলীয়াব, দ্বিতীয় অবীনাদব, তৃতীয় শম্ম, চতুর্থ নথনেল, পঞ্চম রদ্দয়, ষষ্ঠ ওৎসম ও সপ্তম দাউদ। তাদের বোনেরা হল সরূয়া ও অবীগল। অবীশয়, যোয়াব ও অসাহেল ছিলেন সরূয়ার তিনজন ছেলে। অবীগল ছিলেন অমাসার মা, আর ইসমাইলীয় যেথর ছিলেন অমাসার পিতা। হিষ্রোণের ছেলে কালুবায়ের স্ত্রী অসূবার গর্ভে ও যিরিয়োতের গর্ভে ছেলেমেয়ে হয়েছিল। অসূবার ছেলেরা হল যেশর, শোবব ও অর্দোন। অসূবা মারা গেলে কালুবায় ইফ্রাথাকে বিয়ে করলেন। ইফ্রাথার গর্ভে হূরের জন্ম হয়েছিল। হূরের ছেলে ঊরি ও ঊরির ছেলে বৎসলেল। পরে হিষ্রোণ ষাট বছর বয়সে মাখীরের মেয়েকে, অর্থাৎ গিলিয়দের বোনকে বিয়ে করে তার সংগে সহবাস করেছিল। সেই স্ত্রীর গর্ভে সগূবের জন্ম হল। হিষ্রোণ কালুত-ইফ্রাথায় মারা গেলে পর তাঁর স্ত্রী অবিয়ার গর্ভে তাঁর ছেলে অসহূরের জন্ম হয়েছিল। অসহূর তকোয় নামে একটা গ্রাম গড়ে তুলেছিল। হিষ্রোণের বড় ছেলে ছিল যিরহমেল আর যিরহমেলের বড় ছেলে ছিল রাম; তারপর বূনা, ওরণ, ওৎসম ও অহিয়ের জন্ম হয়েছিল। অটারা নামে যিরহমেলের আর একজন স্ত্রী ছিল। তার ছেলের নাম ওনম। যিরহমেলের বড় ছেলে রামের ছেলেরা হল মাষ, যামীন ও একর। ওনমের ছেলেরা হল শম্ময় ও যাদা। শম্ময়ের ছেলেরা হল নাদব ও অবীশূর। অবীশূরের স্ত্রীর নাম ছিল অবীহয়িল। তার গর্ভে অহবান ও মোলীদের জন্ম হয়েছিল। নাদবের ছেলেরা হল সেলদ ও অপ্পয়িম। সেলদ কোন ছেলেমেয়ে না রেখে মারা গেল। অপ্পয়িমের ছেলে যিশী, যিশীর ছেলে শেশন ও শেশনের ছেলে অহলয়। শম্ময়ের ভাই যাদার ছেলেরা হল যেথর ও যোনাথন। যেথর কোন ছেলেমেয়ে না রেখে মারা গেল। যোনাথনের ছেলেরা হল পেলৎ ও সাসা। এরা ছিল যিরহমেলের বংশ। শেশনের কেবল মেয়ে ছিল, কোন ছেলে ছিল না। যার্হা নামে শেশনের একজন মিসরীয় গোলাম ছিল। শেশন তার গোলাম যার্হার সংগে তার একজন মেয়ের বিয়ে দিল এবং সেই মেয়ের গর্ভে অত্তয়ের জন্ম হয়েছিল। অত্তয়ের ছেলে নাথন, নাথনের ছেলে সাবদ, সাবদের ছেলে ইফ্‌লল, ইফ্‌ললের ছেলে ওবেদ, ওবেদের ছেলে যেহূ, যেহূর ছেলে অসরিয়, অসরিয়ের ছেলে হেলস, হেলসের ছেলে ইলীয়াসা, ইলীয়াসার ছেলে সিস্‌ময়, সিস্‌ময়ের ছেলে শল্লুম, শল্লুমের ছেলে যিকমিয়া আর যিকমিয়ার ছেলে ইলীশামা। যিরহমেলের ভাই কালুবায়ের ছেলেদের মধ্যে মেশা ছিল বড়। মেশার ছেলে সীফ, সীফের ছেলে মারেশা আর মারেশার ছেলে হেবরন। হেবরনের ছেলেরা হল কারুন, তপূহ, রেকম ও শেমা। কালুবায়ের উপস্ত্রী ঐফার গর্ভে হারণ, মোৎসা ও গাসেসের জন্ম হয়েছিল। হারণের ছেলের নামও গাসেস রাখা হয়েছিল। যেহদয়ের ছেলেরা হল রেগম, যোথম, গেসন, পেলট, ঐফা ও শাফ। এই হল কালুতের বংশের কথা: ইফ্রাথার বড় ছেলে হূরের ছেলেরা হল শোবল, শল্‌ম আর হারেফ। শোবল কিরিয়ৎ-যিয়ারীম নামে একটা গ্রাম গড়ে তুলেছিল; শল্‌ম গড়ে তুলেছিল বেথেলহেম গ্রাম আর হারেফ গড়ে তুলেছিল বৈৎ-গাদের গ্রাম। দাউদের যে সব ছেলেদের হেবরনে জন্ম হয়েছিল তারা হল তাঁর বড় ছেলে অম্নোন, যার মা ছিলেন যিষ্রিয়েলের অহীনোয়ম; দ্বিতীয় ছেলে দানিয়াল, যার মা ছিলেন কর্মিলের অবীগল; তৃতীয় ছেলে অবশালোম, যার মা ছিলেন গশূরের বাদশাহ্‌ তল্‌ময়ের মেয়ে মাখা; চতুর্থ ছেলে আদোনিয়, যার মা ছিলেন হগীত; পঞ্চম ছেলে শফটিয়, যার মা ছিলেন অবীটল; ষষ্ঠ ছেলে যিত্রিয়ম, যার মা ছিলেন দাউদের আর একজন স্ত্রী ইগ্লা। দাউদ হেবরনে সাড়ে সাত বছর রাজত্ব করেছিলেন, আর সেই সময় হেবরনে তাঁর এই ছয় ছেলের জন্ম হয়েছিল। দাউদ তেত্রিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন, আর সেখানে অম্মীয়েলের মেয়ে বৎশেবার গর্ভে তাঁর চারজন ছেলের জন্ম হয়েছিল। তারা হল শিমিয়া, শোবব, নাথন ও সোলায়মান। এরা ছিল দাউদের ছেলে, আর তাদের বোনের নাম ছিল তামর। এছাড়াও দাউদের উপস্ত্রীদের গর্ভে আরও ছেলের জন্ম হয়েছিল। সোলায়মানের ছেলে রহবিয়াম, রহবিয়ামের ছেলে অবিয়, অবিয়ের ছেলে আসা, আসার ছেলে যিহোশাফট, যিহোশাফটের ছেলে যিহোরাম, যিহোরামের ছেলে অহসিয়, অহসিয়ের ছেলে যোয়াশ, যোয়াশের ছেলে অমৎসিয়, অমৎসিয়ের ছেলে অসরিয়, অসরিয়ের ছেলে যোথম, যোথমের ছেলে আহস, আহসের ছেলে হিষ্কিয়, হিষ্কিয়ের ছেলে মানশা, মানশার ছেলে আমোন ও আমোনের ছেলে ইউসিয়া। ইউসিয়ার প্রথম ছেলে যোহানন, দ্বিতীয় যিহোয়াকীম, তৃতীয় সিদিকিয়, চতুর্থ শল্লুম। যিহোয়াকীমের ছেলেরা হল যিকনিয় ও সিদিকিয়। বন্দী যিকনিয়ের ছেলেরা হল শল্টীয়েল, মল্‌কীরাম, পদায়, শিনৎসর, যিকমিয়া, হোশামা ও নদবিয়। পদায়ের ছেলেরা হল সরুব্বাবিল ও শিমিয়ি। সরুব্বাবিলের ছেলেরা হল মশল্লুম ও হনানিয়। তাদের বোনের নাম ছিল শলোমীৎ। এছাড়া সরুব্বাবিলের আরও পাঁচটি ছেলে ছিল; তারা হল হশুবা, ওহেল, বেরিখিয়, হসদিয় ও যুশব-হেষদ। হনানিয়ের বংশের লোকেরা হল পলটিয় ও যিশায়াহ; এছাড়া সেই বংশে ছিল রফায়ের, অর্ণনের, ওবদিয়ের ও শখনিয়ের ছেলেরা। শখনিয়ের বংশের লোকেরা হল শময়িয় ও তার ছেলেরা; সেই ছেলেদের নাম ছিল হটুশ, যিগাল, বারীহ, নিয়রিয় ও শাফট। এরা ছিল মোট ছয়জন। নিয়রিয়ের তিনজন ছেলে হল ইলীয়ৈনয়, হিষ্কিয় ও অস্রীকাম। ইলীয়ৈনয়ের সাতজন ছেলে হল হোদবিয়, ইলীয়াশীব, পলায়ঃ, অক্কুব, যোহানন, দলায় ও অনানি। এহুদার বংশের লোকেরা হল পেরস, হিষ্রোণ, কর্মী, হূর ও শোবল। শোবলের ছেলে রায়া, রায়ার ছেলে যহৎ এবং যহতের ছেলে অহূময় ও লহদ। এরা ছিল সরাথীয় বংশের লোক। যে লোক ঐটম গ্রাম গড়ে তুলেছিল তার ছেলেরা হল যিষ্রিয়েল, যিশ্মা ও যিদ্‌বশ। তাদের বোনের নাম ছিল হৎসলিল-পোনী। পনূয়েলের ছেলে গাদোর ও এশরের ছেলে হূশ। এরা সবাই ইফ্রাথার বড় ছেলে হূরের বংশের লোক। হূর বেথেলহেম গ্রাম গড়ে তুলেছিল। তকোয় গ্রামটা যে গড়ে তুলেছিল সেই অস্‌হূরের দু’জন স্ত্রীর নাম ছিল হিলা ও নারা। নারার গর্ভে অহুষম, হেফর, তৈমিনি ও অহষ্টরির জন্ম হয়েছিল। এরা ছিল নারার ছেলে। হিলার ছেলেরা হল সেরৎ, যিৎসোহর ও ইৎনন। কোষের ছেলেরা হল আনূব ও সোবেবা। কোষ ছিল হারুমের ছেলে অহর্হলের বংশের পূর্বপুরুষ। যাবেষ তাঁর ভাইদের চেয়ে আরও সম্মানিত লোক ছিলেন। তাঁর মা তাঁর এই নাম রেখে বলেছিলেন, “আমি খুব কষ্টে তাকে জন্ম দিয়েছি।” যাবেষ ইসরাইলের আল্লাহ্‌কে ডেকে বলেছিলেন, “তুমি আমাকে দোয়া কর আর আমার সম্পত্তি বাড়িয়ে দাও। তোমার শক্তি আমার সংগে সংগে থাকুক এবং সমস্ত বিপদ থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর যাতে আমি কষ্ট না পাই।” আর আল্লাহ্‌ তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলেন। কনসের ছেলেরা হল অৎনীয়েল ও সরায় এবং অৎনীয়েলের ছেলে হথৎ। মিয়োনোথয়ের ছেলে হল অফ্রা আর সরায়ের ছেলে যোয়াব। যোয়াব গী-হরসীম গ্রাম গড়ে তুলেছিল। সেই গ্রামটাকে গী-হরসীম বলা হত, কারণ তার সব লোকেরা ছিল কারিগর। যিফুন্নির ছেলে কালুতের ছেলেরা হল ঈরূ, এলা ও নয়ম। এলার ছেলের নাম ছিল কনস। যিহলিলেলের ছেলেরা হল সীফ, সীফা, তীরিয় ও অসারেল। নহমের বোনকে হোদিয় বিয়ে করেছিল। তার ছেলেরা হল গর্মীয় কিয়ীলার পিতা ও মাখাথীয় ইষ্টিমোয়ের বাবা শীমোনের ছেলেরা হল অম্নোন, রিন্ন, বিন্‌-হানন ও তীলোন। যিশীর ছেলেরা হল সোহেৎ ও বিন্‌-সোহেৎ। শেলার বংশের লোকদের মধ্যে যারা নতায়ীম ও গদেরাতে বাস করত তারা ছিল কুমার। বাদশাহ্‌র কাজকর্ম করবার জন্যই তারা সেখানে থাকত। শিমিয়োনের ছেলেরা হল নমূয়েল, যামীন, যারীব, সেরহ ও শৌল। শৌলের ছেলে হল শল্লুম, শল্লুমের ছেলে মিব্‌সম ও মিব্‌সমের ছেলে মিশ্‌ম। মিশ্‌মের একজন ছেলে হল হম্মুয়েল, হম্মুয়েলের ছেলে শক্কুর ও শক্কুরের ছেলে শিময়ি। শিময়ির ষোলজন ছেলে ও ছয়জন মেয়ে ছিল, কিন্তু তার ভাইদের বেশী ছেলেমেয়ে ছিল না। সেইজন্য তাদের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে এহুদা-গোষ্ঠীর মত এত লোক ছিল না। শিমিয়োন-গোষ্ঠীর এই সব লোকেরা এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের সময়ে সেখানে গিয়েছিল। তারা হামীয়দের বাসস্থানে গিয়ে তাদের আক্রমণ করল। এছাড়া তারা সেখানকার মিয়ূনীয়দেরও আক্রমণ করে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করল। তাদের আর কোন চিহ্নই রইল না। তারপর তারা ঐ লোকদের জায়গায় বাস করতে লাগল, কারণ তাদের পশুপালের জন্য সেখানে প্রচুর ঘাস ছিল। শিমিয়োনীয়দের মধ্যে পাঁচশো লোক যিশীর ছেলে পলটিয়, নিয়রিয়, রফায়িয় ও উষীয়েলকে তাদের নেতা করে নিয়ে সেয়ীর নামে পাহাড়ী এলাকাটা আক্রমণ করল। আগে আমালেকীয়দের কিছু লোক সেয়ীরে পালিয়ে এসে সেখানে বাস করছিল। শিমিয়োনীয়রা সেই সব লোকদের হত্যা করে সেখানে বাস করতে লাগল। আজও তারা সেখানে বাস করছে। ইসরাইলের বড় ছেলে রূবেণ তার বাবার বিছানা নাপাক করেছিল বলে বড় ছেলের অধিকার হারিয়েছিল। সেই অধিকার ইসরাইলের অন্য ছেলে ইউসুফের ছেলেদের দেওয়া হয়েছিল। তাই বংশ-তালিকায় তার স্থান বড় ছেলে হিসাবে লেখা হয় নি। আবার যদিও ভাইদের গোষ্ঠীর মধ্যে এহুদা-গোষ্ঠী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল এবং তাঁর গোষ্ঠী থেকেই নেতা বেছে নেওয়া হয়েছিল তবুও বড় ছেলের অধিকার ইউসুফই পেয়েছিলেন। ইসরাইলের বড় ছেলে রূবেণের ছেলেরা হল হনোক, পল্লু, হিষ্রোণ ও কর্মী। যোয়েলের বংশের লোকেরা হল যোয়েলের ছেলে শিময়িয়, শিময়িয়ের ছেলে গোগ, গোগের ছেলে শিমিয়ি, গিলিয়দে তাদের পশুপালের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল বলে পূর্ব দিকে মরুভূমি যেখান থেকে শুরুহয়েছে সেই পর্যন্ত তারা দখল করে নিল। এই মরুভূমি ফোরাত নদীর পশ্চিম দিকে ছিল। তালুতের রাজত্বের সময় রূবেণীয়রা হাগরীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের হত্যা করেছিল। তারা গিলিয়দের পূর্ব দিকে, অর্থাৎ হাগরীয়দের সমস্ত জায়গা দখল করে নিয়ে সেখানে বাস করতে লাগল। গাদ-গোষ্ঠীর লোকেরা রূবেণীয়দের পাশে বাশন দেশের সলখা পর্যন্ত জায়গাটায় বাস করত। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন যোয়েল, দ্বিতীয় শাফম, তারপর যানয় ও শাফট। এঁরা বাশনে থাকতেন। গাদ-গোষ্ঠীর বাকী লোকেরা ছিল এই সাতজনের, অর্থাৎ মিকাইল মশুল্লম, শেবা, যোরায়, যাকন, সীয় ও এবরের বংশের লোক। এরা ছিল হূরির ছেলে অবীহয়িলের বংশের লোক। হূরির পিতা ছিল যারোহ, যারোহের পিতা গিলিয়দ, গিলিয়দের পিতা মিকাইল, মিকাইলের পিতা যিশীশয়, যিশীশয়ের পিতা যহদো এবং যহদোর পিতা বূষ। অব্দিয়েলের ছেলে অহি ছিলেন তাদের বংশের নেতা আর অব্দিয়েল ছিল গূনির ছেলে। গাদ-গোষ্ঠীর লোকেরা বাশন দেশে, গিলিয়দে এবং সেখানকার গ্রামগুলোতে আর শারোণ এলাকার সমস্ত পশু চরাবার জায়গায় বাস করত। এহুদার বাদশাহ্‌ যোথম ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিমের রাজত্বের সময়ে এই সব লোকদের নাম বংশ-তালিকায় লেখা হয়েছিল। রূবেণ-গোষ্ঠীর, গাদ-গোষ্ঠীর, ও মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক থেকে চুয়াল্লিশ হাজার সাতশো ষাটজন শক্তিশালী লোক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা ঢাল, তলোয়ার ও ধনুকের ব্যবহার জানত এবং যুদ্ধে বেশ দক্ষ ছিল। তারা হাগরীয়দের, অর্থাৎ যিটূরের, নাফীশের ও নোদবের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল। এদের সংগে যুদ্ধ করবার সময় আল্লাহ্‌ তাদের সাহায্য করেছিলেন। তিনি হাগরীয় ও তাদের পক্ষের সমস্ত লোকদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কারণ যুদ্ধের সময় তারা আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করেছিল। তারা তাঁর উপর ভরসা করেছিল বলে তিনি তাদের মুনাজাতের জবাব দিয়েছিলেন। তারা হাগরীয়দের পঞ্চাশ হাজার উট, আড়াই লক্ষ ভেড়া ও দু’হাজার গাধা দখল করে নিল এবং এক লক্ষ লোককে বন্দী করে নিয়ে গেল। এছাড়া শত্রুদের অনেকে মারা পড়ল, কারণ আল্লাহ্‌র পরিচালনায় এই যুদ্ধ হয়েছিল। বনি-ইসরাইলরা বন্দী হবার আগ পর্যন্ত সেখানে বাস করত। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোক বাশন থেকে বাল-হর্মোণ, সনীর ও হর্মোণ পাহাড় পর্যন্ত যে জায়গাগুলো ছিল সেখানে বাস করতে লাগল। তারা সংখ্যায় অনেক ছিল। তাদের বংশের নেতাদের নাম ছিল এফর, যিশী, ইলীয়েল, অস্রীয়েল, ইয়ারমিয়া, হোদবিয় ও যহদীয়েল। এই সব শক্তিশালী যোদ্ধারা বিখ্যাত লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌র প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত রইলেন না। দেশের যে জাতিগুলোকে আল্লাহ্‌ তাঁদের সামনে থেকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তাদের দেব-দেবীদের কাছে তাঁরা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ইসরাইলের আল্লাহ্‌ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ পূলের, অর্থাৎ তিগ্লৎ-পিলেষরের মন উত্তেজিত করে তুললেন। তিনি রূবেণীয়, গাদীয় ও মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোককে বন্দী করে হেলহ, হাবোর ও হারা এলাকায় এবং গোষণ নদীর ধারে নিয়ে গেলেন; আর আজও তারা সেখানেই আছে। লেবির ছেলেরা হল গের্শোন, কহাৎ ও মরারি। কহাতের ছেলেরা হল ইমরান, যিষ্‌হর, হেবরন ও উষীয়েল। ইমরানের সন্তানেরা হল হারুন, মূসা ও মরিয়ম। হারুনের ছেলেরা হল নাদব, অবীহূ, ইলিয়াসর ও ঈথামর। ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস, পীনহসের ছেলে অবিশূয়, অবিশূয়ের ছেলে বুক্কি, বুক্কির ছেলে উষি, উষির ছেলে সরহিয়, সরহিয়ের ছেলে মরায়োৎ, মরায়োতের ছেলে অমরিয়, অমরিয়ের ছেলে অহীটূব, অহীটূবের ছেলে সাদোক, সাদোকের ছেলে অহীমাস, অহীমাসের ছেলে অসরিয়, অসরিয়ের ছেলে যোহানন, যোহাননের ছেলে অসরিয়। ইনি জেরুজালেমে সোলায়মানের তৈরী বায়তুল-মোকাদ্দসে ইমামের কাজ করতেন। অসরিয়ের ছেলে অমরিয়, অমরিয়ের ছেলে অহীটূব, অহীটূবের ছেলে সাদোক, সাদোকের ছেলে শল্লুম, শল্লুমের ছেলে হিল্কিয়, হিল্কিয়ের ছেলে অসরিয়, অসরিয়ের ছেলে সরায় এবং সরায়ের ছেলে যিহোষাদক। মাবুদ যে সময় বখতে-নাসারকে দিয়ে এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের বন্দীদশায় পাঠিয়েছিলেন সেই সময় যিহোষাদককেও সেখানে পাঠিয়েছিলেন। লেবির ছেলেরা হল গের্শোন, কহাৎ ও মরারি। গের্শোনের ছেলেদের নাম হল লিব্‌নি আর শিমিয়ি। কহাতের ছেলেরা হল ইমরান, যিষ্‌হর, হেবরন ও উষীয়েল। মরারির ছেলেরা হল মহলি ও মূশি। পূর্বপুরুষদের বংশ অনুসারে এদের নাম লেবীয়দের বংশ-তালিকায় লেখা হয়েছিল। গের্শোনের ছেলে লিব্‌নি, লিব্‌নির ছেলে যহৎ, যহতের ছেলে সিম্ম, সিম্মের ছেলে যোয়াহ, যোয়াহের ছেলে ইদ্দো, ইদ্দোর ছেলে সেরহ, সেরহের ছেলে যিয়ত্রয়। কহাতের একজন ছেলের নাম হল অম্মীনাদব, অম্মীনাদবের ছেলে কারুন, কারুনের ছেলে অসীর, অসীরের ছেলে ইল্‌কানা, ইল্‌কানার ছেলে ইবীয়াসফ, ইবীয়াসফের ছেলে অসীর, অসীরের ছেলে তহৎ, তহতের ছেলে ঊরীয়েল, ঊরীয়েলের ছেলে ঊষিয়, ঊষিয়ের ছেলে শৌল। ইল্‌কানার ছেলেরা হল অমাসয় ও অহীমোৎ, অহীমোতের ছেলে ইল্‌কানা, ইল্‌কানার ছেলে সোফী, সোফীর ছেলে নহৎ, নহতের ছেলে ইলীয়াব, ইলীয়াবের ছেলে যিরোহম, যিরোহমের ছেলে ইল্‌কানা এবং ইল্‌কানার ছেলে শামুয়েল। শামুয়েলের প্রথম ছেলের নাম যোয়েল ও দ্বিতীয় ছেলের নাম অবিয়। মরারির একজন ছেলের নাম হল মহলি, মহলির ছেলে লিব্‌নি, লিব্‌নির ছেলে শিমিয়ি, শিমিয়ির ছেলে উষঃ, উষের ছেলে শিমিয়া, শিমিয়ার ছেলে হগিয় এবং হগিয়ের ছেলে অসায়। সাক্ষ্য-সিন্দুকটি মাবুদের ঘরে এনে রাখবার পরে দাউদ কিছু লোকের উপর কাওয়ালী ও বাজনার ভার দিলেন। সোলায়মান জেরুজালেমে মাবুদের ঘর তৈরী না করা পর্যন্ত সেই লোকেরা আবাস-তাম্বুর সামনে, অর্থাৎ মিলন-তাম্বুর সামনে কাওয়ালী-বাজনা করে মাবুদের এবাদত-কাজ করত। তাদের জন্য যে নিয়ম ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল সেই অনুসারে তারা নিজেদের কাজ করত। এই এবাদত-কাজে যে সব লোকেরা এবং তাদের বংশধরেরা নিযুক্ত হয়েছিল তারা হল: কহাতীয়দের মধ্যে ছিলেন কাওয়াল হেমন। হেমন ছিলেন যোয়েলের ছেলে, যোয়েল শামুয়েলের ছেলে, শামুয়েল ইল্‌কানার ছেলে, ইল্‌কানা যিরোহমের ছেলে, যিরোহম ইলীয়েলের ছেলে, ইলীয়েল তোহের ছেলে, তোহ সূফের ছেলে, সূফ ইল্‌কানার ছেলে, ইল্‌কানা মাহতের ছেলে, মাহৎ অমাসয়ের ছেলে, অমাসয় ইল্‌কানার ছেলে, ইল্‌কানা যোয়েলের ছেলে, যোয়েল অসরিয়ের ছেলে, অসরিয় সফনিয়ের ছেলে, সফনিয় তহতের ছেলে, তহৎ অসীরের ছেলে, অসীর ইবীয়াসফের ছেলে, ইবীয়াসফ কারুনের ছেলে, কারুন যিষ্‌হরের ছেলে, যিষ্‌হর কহাতের ছেলে, কহাৎ লেবির ছেলে এবং লেবি ইসরাইলের ছেলে। হেমনের আত্মীয় আসফ ও তার কাওয়ালের দল হেমনের ডান দিকে দাঁড়াত। আসফ ছিলেন বেরিখিয়ের ছেলে, বেরিখিয় শিমিয়ার ছেলে, শিমিয়া মিকাইলের ছেলে, মিকাইল বাসেয়ের ছেলে, বাসেয় মল্কিয়ের ছেলে, মল্কিয় ইৎনির ছেলে, ইৎনি সেরহের ছেলে, সেরহ অদায়ার ছেলে, অদায়া এথনের ছেলে, এথন সিম্মের ছেলে, সিম্ম শিমিয়ির ছেলে, শিমিয়ি যহতের ছেলে, যহৎ গের্শোনের ছেলে এবং গের্শোন লেবির ছেলে। তাদের আত্মীয়রা, অর্থাৎ মরারীয় কাওয়াল দল হেমনের বাঁ দিকে দাঁড়াত। এথন ছিলেন কীশির ছেলে, কীশি অব্দির ছেলে, অব্দি মল্লুকের ছেলে, মল্লুক হশবিয়ের ছেলে, হশবিয় অমৎসিয়ের ছেলে, অমৎসিয় হিল্কিয়ের ছেলে, হিল্কিয় অম্‌সির ছেলে, অম্‌সি বানির ছেলে, বানি সামেরের ছেলে, সামের মহলির ছেলে, মহলি মূশির ছেলে, মূশি মরারির ছেলে এবং মরারি লেবির ছেলে। তাদের আত্মীয় অন্যান্য লেবীয়রা আবাস-তাম্বুর, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র ঘরের অন্যান্য সমস্ত কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। কিন্তু হারুন ও তাঁর বংশের লোকেরা আল্লাহ্‌র গোলাম মূসার সমস্ত হুকুম অনুসারে পোড়ানো-কোরবানীর কোরবানগাহ্‌ ও ধূপগাহের উপরে কোরবানী দিতেন এবং মহাপবিত্র স্থানে যা কিছু করবার দরকার তা করতেন আর ইসরাইল জাতির গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার ব্যবস্থা করতেন। হারুনের একজন ছেলের নাম ছিল ইলিয়াসর, ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস, পীনহসের ছেলে অবীশূয়, অবীশূয়ের ছেলে বুক্কি, বুক্কির ছেলে উষি, উষির ছেলে সরাহিয়, সরাহিয়ের ছেলে মরায়োৎ, মরায়োতের ছেলে অমরিয়, অমরিয়ের ছেলে অহীটূব, অহীটূবের ছেলে সাদোক এবং সাদোকের ছেলে অহীমাস। বিন্যামীন-গোষ্ঠীর জায়গা থেকে তাঁদের দেওয়া হল গেবা, আলেমৎ, অনাথোৎ ও এগুলোর চারপাশের পশু চরাবার মাঠ। মোট তেরোটা শহর ও গ্রাম কহাতীয় বংশগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের এলাকা থেকে দশটা শহর ও গ্রাম গুলিবাঁট অনুসারে কহাতের বাকী বংশের লোকদের দেওয়া হল। বংশ অনুসারে গের্শোনের বংশের লোকদের দেওয়া হল ইষাখর, আশের, নপ্তালি এবং বাশনের মানশা-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে তেরোটা শহর ও গ্রাম। রূবেণ, গাদ ও সবূলূন-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে গুলিবাঁট করে বারোটা শহর ও গ্রাম বংশ অনুসারে মরারির বংশের লোকদের দেওয়া হল। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা এই সব শহর ও গ্রাম এবং সেগুলোর পশু চরাবার মাঠ লেবীয়দের দিল। এহুদা, শিমিয়োন ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে যে সব শহর ও গ্রামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোও গুলিবাঁট অনুসারে দেওয়া হয়েছিল। কয়েকটি কহাতীয় বংশকে আফরাহীম-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে কতগুলো শহর ও গ্রাম দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের এলাকা থেকে আনের ও বিল্‌য়ম এবং সেগুলোর চারপাশের পশু চরাবার মাঠ কহাতের বাকী বংশগুলোকে দেওয়া হল। গের্শোনীয়রা মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের এলাকা থেকে পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ বাশনের গোলান ও অষ্টারোৎ পেল। নপ্তালি-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে পেল পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ গালীলের কেদশ, হম্মোন ও কিরিয়াথয়িম। বাকী লেবীয়রা, অর্থাৎ মরারীয়রা সবূলূন-গোষ্ঠীর এলাকা থেকে পশু চরাবার মাঠ সুদ্ধ রিম্মোণ ও তাবোর পেল। ইষাখরের চারজন ছেলে হল তোলয়, পূয়, যাশূব ও শিম্রোণ। তোলয়ের ছেলেরা হল উষি, রফায়, যিরীয়েল, যহময়, যিব্‌সম, ও শামুয়েল। এঁরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। দাউদের রাজত্বের সময়ে তোলয়ের বংশের যে সব লোকদের যোদ্ধা হিসাবে বংশ-তালিকায় নাম লেখা হয়েছিল তারা সংখ্যায় ছিল বাইশ হাজার ছ’শো। উষির একজন ছেলের নাম যিষ্রাহিয়। যিষ্রাহিয়ের ছেলেরা হল মিকাইল, ওবদিয়, যোয়েল ও যিশিয়। যিষ্রাহিয় সুদ্ধ এঁরা পাঁচজন ছিলেন বংশের নেতা। তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছিল অনেক; কাজেই তাঁদের বংশ-তালিকার হিসাব মত যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত লোকদের সংখ্যা ছিল ছত্রিশ হাজার। ইষাখর-গোষ্ঠীর সমস্ত বংশের মধ্যে মোট সাতাশি হাজার যোদ্ধার নাম বংশ-তালিকায় লেখা হয়েছিল। বিন্‌ইয়ামীনের তিনজন ছেলে হল বেলা, বেখর, ও যিদীয়েল। বেলার পাঁচজন ছেলে হল ইষ্‌বোণ, উষি, উষীয়েল, যিরেমোৎ ও ঈরী। এঁরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। তাঁদের বংশ-তালিকায় বাইশ হাজার চৌত্রিশ জন লোকের নাম যোদ্ধা হিসাবে লেখা হয়েছিল। বেখরের ছেলেরা হল সমীরাঃ, যোয়াশ, ইলীয়েষর, ইলিয়ো-ঐনয়, অম্রি, যিরেমোৎ, অবিয়, অনাথোৎ ও আলেমৎ। তাদের বংশ-তালিকায় নেতাদের নাম ও বিশ হাজার দু’শো জন যোদ্ধার নাম লেখা হয়েছিল। যিদীয়েলের একজন ছেলের নাম বিল্‌হন। বিল্‌হনের ছেলেরা হল যিয়ূশ, বিন্‌ইয়ামীন, এহূদ, কনানা, সেথন, তর্শীশ ও অহীশহর। যিদীয়েলের বংশের এই সব লোকেরা ছিলেন বংশের নেতা ও বীর যোদ্ধা। তাঁদের সতেরো হাজার দু’শো লোক যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল। শুপ্পীম ও হুপ্পীম ছিল ঈরের ছেলে এবং হূশীম ছিল অহেরের ছেলে। নপ্তালির ছেলেরা হল যহসিয়েল, গূনি, যেৎসর ও শল্লুম। এদের দাদীর নাম ছিল বিল্‌হা। মানশার ছেলেরা হল অস্রীয়েল ও গিলিয়দের পিতা মাখীর। মানশার সিরীয় উপস্ত্রীর গর্ভে এদের জন্ম হয়েছিল। মাখীর হুপ্পীম ও শুপ্পীমের জন্য স্ত্রী এনেছিল। মাখীরের বোনের নাম ছিল মাখা। মানশার বংশের আর একজন লোক ছিল সলফাদ। তার ছিল সব মেয়ে। মাখীরের স্ত্রী মাখার গর্ভে পেরশ নামে একটি ছেলের জন্ম হয়েছিল। তার ভাইয়ের নাম ছিল শেরশ এবং তার ছেলেদের নাম ছিল ঊলম ও রেকম। ঊলমের একজন ছেলের নাম বদান। এরা ছিল গিলিয়দের বংশের লোক। গিলিয়দ মাখীরের ছেলে আর মাখীর মানশার ছেলে। গিলিয়দের বোন হম্মোলেকতের ছেলেরা হল ঈশ্‌হোদ, অবীয়েষর ও মহলা। শমীদার ছেলেরা হল অহিয়ন, শেখম, লিক্‌হি ও অনীয়াম। আফরাহীমের একজন ছেলের নাম শূথেলহ, শূথেলহের ছেলে বেরদ, বেরদের ছেলে তহৎ, তহতের ছেলে ইলিয়াদা, ইলিয়াদার ছেলে তহৎ, তহতের ছেলে সাবদ এবং সাবদের ছেলে শূথেলহ। আফরাহীমের আরও দুই ছেলের নাম ছিল এৎসর ও ইলিয়দ। দেশে জন্মগ্রহণকারী গাতের লোকদের হাতে তারা মারা পড়েছিল, কারণ তারা গাতীয়দের পশু চুরি করবার জন্য গাতে গিয়েছিল। তাদের পিতা আফরাহীম অনেক দিন পর্যন্ত তাদের জন্য শোক করেছিলেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। এর পর তিনি স্ত্রীর সংগে সহবাস করলে পর তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হলেন এবং একটি ছেলের জন্ম হল। আফরাহীম তার নাম রাখলেন বরীয়, কারণ তাঁর পরিবারে তখন বিপদ নেমে এসেছিল। তাঁর মেয়ের নাম ছিল শীরা। শীরা উপরের ও নীচের বৈৎ-হোরোণ ও উষেণ-শীরা গ্রাম গড়ে তুলেছিল। বরীয়ের ছেলে রেফহ, রেফহের ছেলে রেশফ, রেশফের ছেলে তেলহ, তেলহের ছেলে তহন, তহনের ছেলে লাদন, লাদনের ছেলে অম্মীহূদ, অম্মীহূদের ছেলে ইলীশামা, ইলীশামার ছেলে নূন ও নূনের ছেলে ইউসা। বেথেল ও তার চারপাশের গ্রামগুলো, পূর্ব দিকে নারণ, পশ্চিম দিকে গেষর ও তার চারপাশের গ্রামগুলো ছিল আফরাহীমের জমিজমা ও বাসস্থান। এছাড়া শিখিম ও তার গ্রামগুলো থেকে অয়া ও তার গ্রামগুলো পর্যন্ত ছিল তাদের এলাকা। মানশার সীমানা বরাবর বৈৎশান, তানক, মগিদ্দো, দোর ও এগুলোর চারপাশের সব গ্রামও ছিল তাদের। ইসরাইলের ছেলে ইউসুফের বংশধরেরা এই সব শহরে ও গ্রামে বাস করত। আশেরের ছেলেরা হল যিম্ন, যিশ্‌বাঃ, যিশ্‌বী ও বরীয়। সেরহ ছিল তাদের বোন। বরীয়ের ছেলেরা হল হেবর ও মল্কীয়েল। মল্কীয়েল ছিল বির্ষোতের পিতা। হেবরের ছেলেরা হল যফ্‌লেট, শোমের ও হোথম। শূয়া ছিল তাদের বোন। যফ্‌লেটের ছেলেরা হল পাসক, বিম্‌হল ও অশ্বৎ। সামেরের ছেলেরা হল অহি, রোগহ, যিহুব্ব ও ইরাম। সামেরের ভাই হেলমের ছেলেরা হল শোফহ, যিম্ন, শেলশ ও আমল। শোফহের ছেলেরা হল সূহ, হর্ণেফর, শূয়াল, বেরী, যিম্র, বেৎসর, হোদ, শম্ম, শিল্‌শ, যিত্রণ ও বেরা। যেথরের ছেলেরা হল যিফুন্নি, পিসপ ও অরা। উল্লের ছেলেরা হল আরহ, হন্নীয়েল ও রিৎসিয়। আশের-গোষ্ঠীর এই সব লোকেরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন বাছাই-করা শক্তিশালী যোদ্ধা ও প্রধান নেতা। আশেরের বংশ-তালিকায় লেখা লোকদের মধ্যে যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত লোকের সংখ্যা ছিল ছাব্বিশ হাজার। বিন্‌ইয়ামীনের প্রথম ছেলে হল বেলা, দ্বিতীয় অস্‌বেল, তৃতীয় অহর্হ, চতুর্থ নোহা ও পঞ্চম রাফা। বেলার ছেলেরা হল অদ্দর, গেরা, অবীহূদ, অবীশূয়, নামান, আহোহ, গেরা, শফূফন ও হূরম। যিয়ূশ, শখিয় ও মির্ম। এঁরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। হূশীমের গর্ভে তার আরও দুই ছেলে অহীটূব ও ইল্পালের জন্ম হয়েছিল। এঁরা সবাই ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা এবং বংশ-তালিকা অনুসারে এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন প্রধান লোক। এঁরা জেরুজালেমে বাস করতেন। যে লোক গিবিয়োন গ্রাম গড়ে তুলেছিল সে সেখানে বাস করত। তার স্ত্রীর নাম ছিল মাখা; তার প্রথম ছেলে হল অব্দোন, তারপর সূর, কীশ, বাল, নাদব, নেরের ছেলে কীশ আর কীশের ছেলে তালুত। তালুতের ছেলেরা হল যোনাথন, মল্কীশূয়, অবীনাদব ও ইশ্‌বাল। যোনাথনের ছেলে মরীব্‌-বাল ও মরীব্‌-বালের ছেলে মিকাহ্‌। মিকাহ্‌র ছেলেরা হল পিথোন, মেলক, তরেয় ও আহস। আহসের ছেলে যিহোয়াদা, যিহোয়াদার ছেলেরা হল আলেমৎ, অস্‌মাবৎ ও সিম্রি। সিম্রির ছেলে মোৎসা, মোৎসার ছেলে বিনিয়া, বিনিয়ার ছেলে রফায়, রফায়ের ছেলে ইলীয়াসা ও ইলীয়াসার ছেলে আৎসেল। আৎসেলের ছয়জন ছেলের নাম হল অস্রীকাম, বোখরূ, ইসমাইল, শিয়রিয়, ওবদিয় ও হানান। আৎসেলের ভাই এশকের ছেলেদের মধ্যে প্রথম হল ঊলম, দ্বিতীয় যিয়ূশ ও তৃতীয় এলীফেলট। ঊলমের ছেলেরা শক্তিশালী যোদ্ধা ছিল। এরা ধনুকের ব্যবহার জানত। তাদের অনেক ছেলে ও নাতি ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল একশো পঞ্চাশ জন। “ইসরাইলীয় বাদশাহ্‌দের বই”-তে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বংশ-তালিকা লেখা রয়েছে। এহুদার লোকদের বেঈমানীর জন্য তাদের ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যারা প্রথমে ফিরে এসে নিজেদের শহর ও গ্রামে নিজেদের জায়গা-জমির উপর আবার বাস করতে শুরুকরল তারা ছিল ইমাম, লেবীয়, বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারী এবং অন্যান্য বনি-ইসরাইলরা। এহুদা, বিন্‌ইয়ামীন, আফরাহীম ও মানশা-গোষ্ঠীর যারা জেরুজালেমে বাস করতে লাগল তারা হল: এহুদা-গোষ্ঠী থেকে: এহুদার ছেলে পেরসের বংশের উথয়। উথয় ছিল অম্মীহূদের ছেলে, অম্মীহূদ অম্রির ছেলে, অম্রি ইম্রির ছেলে, ইম্রি বানির ছেলে ও বানি পেরসের ছেলে। এহুদার ছেলে শেলার বংশের অসায় ও তার ছেলেরা। অসায় ছিল তার পিতার বড় ছেলে। এহুদার ছেলে শেরহের বংশের যুয়েল। এহুদা-গোষ্ঠীর যে লোকেরা জেরুজালেমে বাস করল তাদের সংখ্যা হল ছ’শো নব্বই জন। বিন্যামীন-গোষ্ঠী থেকে: মশুল্লমের ছেলে সল্লু। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল হোদবিয় এবং হস্‌নূয়। যিরোহমের ছেলে যিব্‌নিয়। মিখ্রির নাতি, অর্থাৎ উষির ছেলে এলা। শফটিয়ের ছেলে মশুল্লম। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল রূয়েল ও যিব্‌নিয়। এঁরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। বিন্‌ইয়ামীনের বংশ-তালিকা অনুসারে যে সব লোক জেরুজালেমে বাস করল তাদের সংখ্যা ছিল ন’শো ছাপান্ন জন। যিরোহমের ছেলে অদায়া। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল পশ্‌হূর ও মল্কিয়। অদীয়েলের ছেলে মাসয়। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল যহসেরা, মশুল্লম, মশিল্লমীত ও ইম্মের। এঁরা ছিলেন নিজের নিজের বংশের নেতা। যে ইমামেরা জেরুজালেমে বাস করলেন তাঁদের সংখ্যা ছিল এক হাজার সাতশো ষাট জন। এঁরা আল্লাহ্‌র ঘরের এবাদত-কাজের ভার-পাওয়া যোগ্য লোক। লেবীয়দের থেকে: হশূবের ছেলে শময়িয়। তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল অস্রীকাম, হশবিয় ও মরারি। বকবকর, হেরশ, গালল ও মিকাহ্‌র ছেলে মত্তনিয়। মত্তনিয়ের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল সিখ্রি ও আসফ। শময়িয়ের ছেলে ওবদিয়। তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল গালল ও যিদূথূন। ইল্‌কানার নাতি, অর্থাৎ আসার ছেলে বেরিখিয়। সে নটোফাতীয়দের গ্রামে বাস করত। সেই সময় ইলীয়াসরের ছেলে পীনহসের উপর রক্ষীদের দেখাশোনার ভার ছিল এবং মাবুদ তাঁর সংগে ছিলেন। মশেলেমিয়ার ছেলে জাকারিয়া মিলন-তাম্বুর দরজার পাহারাদার ছিল। দরজাগুলো পাহারা দেবার জন্য যাদের বেছে নেওয়া হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল মোট দু’শো বারো। তাদের গ্রামগুলোতে যে সব বংশ-তালিকা ছিল সেখানে তাদের নাম লেখা হয়েছিল। দাউদ ও নবী শামুয়েল এই লোকদের দায়িত্বপূর্ণ দারোয়ানের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের ও তাদের বংশের লোকেরা মাবুদের ঘরের, অর্থাৎ আবাস-তাম্বুর দরজাগুলো পাহারা দিত। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ- এই চারদিকেই রক্ষীরা পাহারা দিত। গ্রাম থেকে তাদের ভাইদেরও পালা অনুসারে এসে সাত দিন করে তাদের কাজে সাহায্য করতে হত। যে চারজন লেবীয় প্রধান রক্ষী ছিল তাদের উপর ছিল আল্লাহ্‌র ঘরের ধনভাণ্ডারের কামরাগুলোর ভার। তারা আল্লাহ্‌র ঘরের কাছে বাস করত, কারণ সেই ঘর রক্ষা করবার ভার তাদের উপর ছিল, আর রোজ সকালে ঘরের দরজাও তাদের খুলে দিতে হত। লেবীয়দের মধ্যে কয়েকজনের উপর বায়তুল-মোকাদ্দসের এবাদত-কাজে ব্যবহার করা জিনিসপত্র রক্ষা করবার ভার ছিল। সেগুলো বের করবার ও ভিতরে আনবার সময় তারা গুণে দেখত। অন্যদের উপর ছিল বায়তুল-মোকাদ্দসের আসবাবপত্র এবং সমস্ত পাত্র, ময়দা ও আংগুর-রস, তেল, লোবান ও সব খোশবু মসলা রক্ষা করবার ভার। কিন্তু খোশবু মসলাগুলো মেশাবার ভার ছিল ইমামদের মধ্যে কয়েকজনের উপর। লেবীয়দের মধ্যে কারুনীয় শল্লুমের বড় ছেলে মত্তথিয়ের উপর শস্য-কোরবানীর জিনিস সেঁকে আনবার ভার দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক বিশ্রামবারে টেবিলের উপর যে পবিত্র-রুটি সাজিয়ে রাখা হত তা তৈরী করবার ভার ছিল লেবীয়দের মধ্যে কয়েকজন কহাতীয়ের উপর। লেবি-গোষ্ঠীর বংশ-নেতারা যাঁরা কাওয়ালী-বাজনা করতেন তাঁরা বায়তুল-মোকাদ্দসের কামরাগুলোতে থাকতেন। কাওয়ালী ও বাজনার কাজে তাঁরা দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন বলে তাঁদের উপর অন্য কোন কাজের ভার দেওয়া হয় নি। বংশ-তালিকা অনুসারে এঁরা সবাই ছিলেন লেবি-গোষ্ঠীর নিজের নিজের বংশের নেতা। এঁরা জেরুজালেমে বাস করতেন। যিয়ীয়েল গিবিয়োন গ্রামটা গড়ে তুলে সেখানে বাস করত। তার স্ত্রীর নাম ছিল মাখা। তার বড় ছেলের নাম অব্দোন, তার পরে সূর, কীশ, বাল, নের, নাদব, গাদোর, অহিয়ো, জাকারিয়া ও মিক্লোৎ। মিক্লোতের ছেলে শিমিয়াম। এরা জেরুজালেমে তাদের বংশের লোকদের কাছে বাস করত। নেরের ছেলে কীশ, কীশের ছেলে তালুত এবং তালুতের ছেলেরা হল যোনাথন, মল্কীশূয়, অবীনাদব ও ইশ্‌বাল। আহসের ছেলে যারঃ এবং যারের ছেলেরা হল আলেমৎ, অস্‌মাবৎ ও সিম্রি। সিম্রির ছেলে মোৎসা, মোৎসার ছেলে বিনিয়া, বিনিয়ার ছেলে রফায়, রফায়ের ছেলে ইলীয়াসা এবং ইলীয়াসার ছেলে আৎসেল। আৎসেলের ছয়জন ছেলের নাম হল অস্রীকাম, বোখরূ, ইসমাইল, শিয়রিয়, ওবদিয় ও হানান। একবার ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল আর বনি-ইসরাইলরা তাদের সামনে থেকে পালিয়ে গেল। তাদের মধ্যে অনেকে গিল্‌বোয় পাহাড়ে ফিলিস্তিনীদের হাতে মারা পড়ল। ফিলিস্তিনীরা তালুত ও তাঁর ছেলেদের পিছনে তাড়া করে গিয়ে তাঁর ছেলে যোনাথন, অবীনাদব ও মল্কী-শূয়কে হত্যা করল। তারপর তালুতের বিরুদ্ধে আরও ভীষণভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল। ধনুকধারী সৈন্যেরা তাঁকে দেখতে পেয়ে আঘাত করল। তালুত তখন তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটিকে বললেন, “তোমার তলোয়ার বের করে আমার শরীরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাও। তা না হলে ঐ খৎনা-না-করানো লোকেরা এসে আমাকে অপমান করবে।” কিন্তু তাঁর অস্ত্র বহনকারী লোকটি তা করতে রাজী হল না, কারণ সে খুব ভয় পেয়েছিল। তখন তালুত তাঁর নিজের তলোয়ার নিয়ে নিজেই তার উপরে পড়লেন। তালুত মারা গেছেন দেখে তাঁর অস্ত্র বহনকারীও নিজের তলোয়ারের উপর পড়ে মারা গেল। এইভাবে সেই দিন তালুত, তাঁর তিন ছেলে এবং তাঁর সংগের লোকেরা এক সংগে মারা গেলেন। যে সব ইসরাইলীয় সেই সময় উপত্যকায় ছিল তারা যখন দেখল যে, ইসরাইলীয় সৈন্যেরা পালিয়ে গেছে এবং তালুত ও তাঁর ছেলেরা মারা পড়েছেন তখন তারাও তাদের গ্রামগুলো ছেড়ে পালিয়ে গেল, আর ফিলিস্তিনীরা এসে সেই সব গ্রাম দখল করে নিল। পরের দিন ফিলিস্তিনীরা মৃত লোকদের সব কিছু লুট করতে এসে দেখল গিলবোয় পাহাড়ের উপরে তালুত ও তাঁর ছেলেদের লাশ পড়ে আছে। তারা তালুতের মাথা কেটে ফেলল এবং তাঁর সাজ-পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র খুলে নিল। এই খবর তাদের সমস্ত দেব-দেবী ও লোকদের কাছে ঘোষণা করবার জন্য তারা ফিলিস্তিনী দেশের সব জায়গায় সেগুলো পাঠিয়ে দিল। তারপর তারা তালুতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের দেবতাদের মন্দিরে রাখল আর তার মাথাটা দাগোন্তদেবতার মন্দিরে টাংগিয়ে দিল। ফিলিস্তিনীরা তালুতের প্রতি যা করেছে যাবেশ-গিলিয়দের সমস্ত লোক তা শুনতে পেল। তখন সেখানকার বীর সৈন্যেরা গিয়ে তালুত ও তাঁর ছেলেদের লাশগুলো যাবেশে নিয়ে আসল। যাবেশের এলোন গাছটার তলায় তারা তাঁদের হাড়গুলো দাফন করল এবং সাত দিন রোজা রাখল। বনি-ইসরাইলরা সবাই হেবরনে দাউদের কাছে এসে বলল, “আপনার ও আমাদের শরীরে একই রক্ত বইছে। এর আগে যখন তালুত বাদশাহ্‌ ছিলেন তখন যুদ্ধের সময় আপনিই বনি-ইসরাইলদের সৈন্য পরিচালনা করতেন; আর আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ আপনাকে বলেছেন যেন আপনিই তাঁর বান্দাদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের দেখাশোনা করেন ও তাদের নেতা হন।” ইসরাইল দেশের সমস্ত বৃদ্ধ নেতারা হেবরনে দাউদের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন দাউদ মাবুদকে সাক্ষী রেখে তাঁদের সংগে একটা চুক্তি করলেন, আর শামুয়েলের মধ্য দিয়ে বলা মাবুদের কথা অনুসারে তাঁরা দাউদকে ইসরাইল দেশের উপর বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করলেন। পরে দাউদ ও সমস্ত বনি-ইসরাইল জেরুজালেমে, অর্থাৎ যিবূষে গেলেন। যিবূষীয়রা সেখানে বাস করত। তারা দাউদকে বলল, “তুমি এখানে ঢুকতে পারবে না।” তবুও দাউদ সিয়োনের কেল্লাটা অধিকার করলেন। এখন ওটাকে দাউদ-শহর বলা হয়। দাউদ বলেছিলেন, “যে লোক প্রথমে যিবূষীয়দের আক্রমণ করবে সে-ই হবে প্রধান সেনাপতি।” এতে সরূয়ার ছেলে যোয়াব প্রথমে আক্রমণ করতে গেলেন, আর সেইজন্য তাঁকে প্রধান সেনাপতি করা হল। এর পর দাউদ সেই কেল্লায় বাস করতে লাগলেন; সেইজন্য সেটিকে দাউদ-শহর বলা হত। তিনি মিল্লোর কাছে শহর গড়ে তুললেন এবং যোয়াব শহরের বাদবাকী অংশ মেরামত করলেন। দাউদ দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, কারণ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর সংগে ছিলেন। তাঁর পরের জন ছিলেন ইলিয়াসর। ইনি ছিলেন অহোহীয়ের বংশের দোদোর ছেলে। নাম-করা তিনজন বীরের মধ্যে ইনি ছিলেন একজন। ফিলিস্তিনীরা যখন যুদ্ধের জন্য পস্‌-দম্মীমে জমায়েত হয়েছিল তখন ইলিয়াসর দাউদের সংগে ছিলেন। একটা জায়গায় যবে ভরা একটা ক্ষেতে ইসরাইলীয় সৈন্যেরা ফিলিস্তিনীদের সামনে থেকে পালিয়ে গেল। কিন্তু সেই তিনজন বীর ক্ষেতের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁরা সেই ক্ষেতটা রক্ষা করলেন এবং ফিলিস্তিনীদের শেষ করে দিলেন। সেই দিন মাবুদ তাঁদের রক্ষা করলেন ও মহাজয় দান করলেন। একবার ত্রিশজন বীরের মধ্যে তিনজন অদুল্লম গুহার কাছে যে বিরাট পাথরটা ছিল সেখানে দাউদের কাছে আসলেন। তখন একদল ফিলিস্তিনী সৈন্য রফায়ীম উপত্যকায় ছাউনি ফেলে ছিল। সেই সময় দাউদ মরুভূমির কেল্লার মত একটা জায়গায় ছিলেন আর ফিলিস্তিনী সৈন্যদল ছিল বেথেলহেমে। এমন সময় দাউদের খুব পিপাসা পেল, তাই তিনি বললেন, “আহা, যদি কেউ বেথেলহেমের দরজার কাছের কূয়াটা থেকে আমাকে একটু খাবার পানি এনে দিত!” এই কথা শুনে সেই তিনজন বীর ফিলিস্তিনী সৈন্যদলের ভিতর দিয়ে গিয়ে বেথেলহেমের দরজার কাছের কূয়াটা থেকে পানি তুলে দাউদের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু দাউদ তা খেলেন না; তার বদলে তিনি সেই পানি মাবুদের উদ্দেশে মাটিতে ঢেলে দিলেন। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্‌, আমি যে এই পানি খাব তা দূরে থাক্‌। এই লোকেরা, যারা তাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছিল তাদের রক্ত কি আমি খাব?” তাঁরা তাঁদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেই পানি এনেছিল বলে দাউদ তা খেতে রাজী হলেন না। সেই তিনজন নাম-করা বীরের কাজই ছিল এই রকম। যোয়াবের ভাই অবীশয় ছিলেন সেই তিনজনের উপরে প্রধান। তিনি বর্শা চালিয়ে তিনশো লোককে হত্যা করেছিলেন এবং তিনিও ঐ তিনজনের মত নাম-করা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সেই তিনজনের চেয়ে আরও বেশী সম্মান পেয়েছিলেন। সেইজন্য সেই তিনজনের মধ্যে তাঁকে ধরা না হলেও তিনি তাঁদের সেনাপতি হয়েছিলেন। কব্‌সেলীয় যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। তিনিও বড় বড় কাজ করেছিলেন। মোয়াবীয় অরিয়েলের দুই ছেলেকে তিনি হত্যা করেছিলেন। এক তুষার পড়া দিনে তিনি একটা গর্তের মধ্যে নেমে গিয়ে একটা সিংহকে মেরে ফেলেছিলেন। আবার একজন সাড়ে সাত ফুট লম্বা মিসরীয়কে তিনি হত্যা করেছিলেন। সেই মিসরীয়ের হাতে ছিল তাঁতীর বীমের মত একটা বর্শা, কিন্তু তবুও তিনি গদা হাতে তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মিসরীয়ের হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিয়ে তিনি সেই বর্শা দিয়ে তাকে হত্যা করেছিলেন। যিহোয়াদার ছেলে বনায়ের কাজই ছিল এই রকম। তিনিও সেই তিনজন বীরের মত নাম-করা হয়ে উঠেছিলেন। সেই তিনজনের মধ্যে তাঁকে ধরা না হলেও তিনি “ত্রিশ” নামে দলটার লোকদের চেয়ে বেশী সম্মান পেয়েছিলেন। দাউদ তাঁর দেহরক্ষীদের ভার বনায়ের উপরেই দিয়েছিলেন। সেই শক্তিশালী লোকেরা হলেন্ত যোয়াবের ভাই অসাহেল, বেথেলহেমের দোদোর ছেলে ইল্‌হানন, হরোরীয় শম্মোৎ, পলোনীয় হেলস, তকোয়ের ইক্কেশের ছেলে ঈরা, অনাথোতের অবীয়েষর, হূশাতীয় সিব্বখয়, অহোহীয় ঈলয়, নটোফাতীয় মহরয়, নটোফাতীয় বানার ছেলে হেলদ, বিন্যামীন-গোষ্ঠীর গিবিয়ার রীবয়ের ছেলে ইথয়, পিরিয়াথোনীয় বনায়, গাশের উপত্যকা থেকে হূরয়, অর্বতীয় অবীয়েল, বাহরূমীয় অস্‌মাবৎ, শাল্‌বোনীয় ইলীয়হবঃ, গিষোণীয় হাষেমের ছেলেরা, হরারীয় শাগির ছেলে যোনাথন, হরারীয় সাখরের ছেলে অহীয়াম, ঊরের ছেলে ইলীফাল, মখেরাতীয় হেফর, পলোনীয় অহিয়, কর্মিলীয় হিষ্রো, ইষ্‌বয়ের ছেলে নারয়, নাথনের ভাই যোয়েল, হগ্রির ছেলে মিভর, অম্মোনীয় সেলক, সরূয়ার ছেলে যোয়াবের অস্ত্র বহনকারী বেরোতীয় নহরয়, মাখার ছেলে হানান, মিত্নীয় যোশাফট, অষ্টরোতীয় উষিয়, অরোয়েরীয় হোথমের দুই ছেলে শাম ও যিয়ীয়েল, শিম্রির ছেলে যিদিয়েল ও তাঁর ভাই তীষীয় যোহা, মহবীয় ইলীয়েল, ইল্‌নামের দুই ছেলে যিরীবয় ও যোশবিয়, মোয়াবীয় যিৎমা, ইলীয়েল, ওবেদ ও মসোবায়ীয় যাসীয়েল। কীশের ছেলে তালুতের সামনে থেকে দাউদকে দূর করা হলে পর অনেক লোক সিক্লগে দাউদের কাছে এসেছিল। যুদ্ধের সময় যে যোদ্ধারা দাউদকে সাহায্য করেছিল এরা তাদের মধ্যে ছিল। এরা ধনুকধারী ছিল এবং বাঁ হাতে ও ডান হাতে তীর মারতে ও ফিংগা দিয়ে পাথর ছুঁড়তে পারত। এরা ছিল বিন্যামীন-গোষ্ঠীর তালুতের বংশের লোক। এদের মধ্যে ছিল: গিবিয়াতীয় শমায়ের ছেলে অহীয়েষর ও যোয়াশ- এঁরা নেতা ছিলেন; অস্‌মাবতের ছেলে যিষীয়েল ও পেলট, বরাখা, অনাথোতীয় যেহূ; গিবিয়োনীয় যিশ্ময়িয়- ইনি সেই “ত্রিশ” নামে বীরদের দলের মধ্যে একজন নেতা; ইয়ারমিয়া, যহসীয়েল, যোহানন, গদেরাথীয় যোষাবদ; ইলিয়ূষয়, যিরীমোৎ, বালিয়, শমরিয়, হরূফীয় শফটিয়; কারুনীয়দের মধ্যে ইল্‌কানা, যিশিয়, অসরেল, যোয়েষর, যাশবিয়াম; গদোরীয় যিরোহমের ছেলে যোয়েলা ও সবদিয়। গাদীয়দের কিছু লোক নিজেদের দল ছেড়ে মরুভূমির কেল্লার মত জায়গায় দাউদের কাছে এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন যুদ্ধের শিক্ষা-পাওয়া শক্তিশালী যোদ্ধা। তাঁরা ঢাল ও বর্শার ব্যবহার জানতেন। তাঁদের মুখ সিংহের মত ভয়ংকর ছিল এবং পাহাড়ী হরিণের মত তাঁরা জোরে দৌড়াতে পারতেন। পদ অনুসারে তাঁরা ছিলেন্ত প্রথম এষর, দ্বিতীয় ওবদিয়, তৃতীয় ইলীয়াব, চতুর্থ মিশ্মন্না, পঞ্চম ইয়ারমিয়া, এই গাদীয়রা ছিলেন সৈন্যদলের সেনাপতি। তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে ছোট তিনি ছিলেন একাই একশো জনের সমান এবং যিনি সবচেয়ে বড় তিনি ছিলেন একাই হাজার জনের সমান। সেই বছরের প্রথম মাসে যখন জর্ডান নদীর পানি কিনারা ছাপিয়ে গিয়েছিল তখন এঁরাই পার হয়ে গিয়ে নদীর পূর্ব ও পশ্চিম দিকের উপত্যকায় বাসকারী প্রত্যেককে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া বিন্যামীন-গোষ্ঠীর অন্য লোকেরা এবং এহুদার কিছু লোক দাউদের সেই কেল্লার মত জায়গায় তাঁর কাছে এসেছিল। দাউদ তাদের সংগে দেখা করতে বের হয়ে এসে বললেন, “আপনারা যদি শান্তির মনোভাব নিয়ে আমাকে সাহায্য করতে এসে থাকেন তবে আমি আপনাদের সংগে এক হতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমি কোন অন্যায় না করলেও যদি বেঈমানী করে শত্রুর হাতে আমাকে তুলে দেবার জন্য এসে থাকেন তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ যেন তা দেখেন এবং আপনাদের বিচার করেন।” যিনি পরে “ত্রিশ” নামে দলের নেতা হয়েছিলেন সেই অমাসয়ের উপর মাবুদের রূহ্‌ আসলেন। তখন তিনি বললেন, “হে দাউদ, আমরা আপনারই। হে ইয়াসির ছেলে, আমরা আপনারই পক্ষে। ভাল হোক, আপনার ভাল হোক, ভাল হোক তাদের, যারা আপনাকে সাহায্য করে, কারণ আপনার আল্লাহ্‌ আপনাকে সাহায্য করেন।” তখন দাউদ তাঁদের গ্রহণ করে তাঁর আক্রমণকারী দলের নেতা করলেন। দাউদ যখন ফিলিস্তিনীদের সংগে তালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখন মানশা-গোষ্ঠীর কিছু লোক নিজেদের দল ছেড়ে দাউদের কাছে গিয়েছিলেন। অবশ্য দাউদ ও তাঁর লোকেরা ফিলিস্তিনীদের সাহায্য করেন নি, কারণ ফিলিস্তিনী শাসনকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবার পর দাউদকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, “তিনি যদি আমাদের ত্যাগ করে তাঁর মালিক তালুতের সংগে গিয়ে যোগ দেন তবে আমাদের মাথা হারাতে হবে।” দাউদ সিক্লগে ফিরে যাবার সময় মানশা-গোষ্ঠীর যে লোকেরা দল ছেড়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন অদ্‌ন, যোষাবদ, যিদীয়েল, মিকাইল, যোষাবদ, ইলীহূ ও সিল্লথয়। এঁরা ছিলেন মানশা-গোষ্ঠীর এক এক হাজার সৈন্যের সেনাপতি। অন্যান্য আক্রমণকারী দলগুলোর বিরুদ্ধে এঁরা দাউদকে সাহায্য করেছিলেন। এঁরা সবাই ছিলেন শক্তিশালী যোদ্ধা এবং দাউদের সৈন্যদলের সেনাপতি। এইভাবে দিনের পর দিন লোকেরা দাউদকে সাহায্য করতে আসতে লাগল। শেষে আল্লাহ্‌র সৈন্যদলের মত তাঁর একটা মস্ত বড় সৈন্যদল গড়ে উঠল। মাবুদের কথা অনুসারে যুদ্ধ করে তালুতের রাজ্য দাউদের হাতে তুলে দেবার জন্য যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হেবরনে দাউদের কাছে এসেছিল তাদের সংখ্যা এই: যুদ্ধের সাজে সজ্জিত ঢাল ও বর্শাধারী এহুদা-গোষ্ঠীর ছয় হাজার আটশো জন। শিমিয়োন-গোষ্ঠীর সাত হাজার একশো শক্তিশালী যোদ্ধা। লেবি-গোষ্ঠীর চার হাজার ছ’শো জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হারুনের বংশের নেতা যিহোয়াদা, যাঁর সংগে ছিল তিন হাজার সাতশো জন লোক। এছাড়া ছিলেন সাদোক নামে একজন শক্তিশালী যুবক যোদ্ধা ও তাঁর বংশের বাইশজন সেনাপতি। তালুতের নিজের গোষ্ঠীর, অর্থাৎ বিন্যামীন-গোষ্ঠীর তিন হাজার জন। কিন্তু এই গোষ্ঠীর বেশীর ভাগ লোক তখনও তালুতের পরিবারের পক্ষে ছিল। আফরাহীম-গোষ্ঠীর বিশ হাজার আটশো শক্তিশালী যোদ্ধা। এরা নিজের নিজের বংশে বিখ্যাত ছিল। মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক বংশের আঠারো হাজার লোক। এই লোকদের নাম করে বলা হয়েছিল যেন তারা এসে দাউদকে বাদশাহ্‌ করে। ইষাখর-গোষ্ঠীর দু’শো জন নেতা। তাঁরা ছিলেন বুদ্ধিমান এবং বুঝতে পারতেন বনি-ইসরাইলদের কখন কি করা উচিত। তাঁদের সংগে ছিল তাঁদের অধীন নিজেদের গোষ্ঠীর লোকেরা। সবূলূন-গোষ্ঠীর পঞ্চাশ হাজার দক্ষ সৈন্য। তারা সব রকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে পারত। তারা সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে দাউদকে সাহায্য করেছিল। নপ্তালি-গোষ্ঠীর এক হাজার সেনাপতি। তাঁদের সংগে ছিল ঢাল ও বর্শাধারী সাঁইত্রিশ হাজার লোক। দান-গোষ্ঠীর আটাশ হাজার ছ’শো দক্ষ সৈন্য। আশের-গোষ্ঠীর চল্লিশ হাজার দক্ষ সৈন্য। সব রকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জর্ডানের পূর্ব দিক থেকে এসেছিল এক লক্ষ বিশ হাজার লোক। এরা এসেছিল রূবেণ, গাদ ও মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের মধ্য থেকে। এরা সকলেই ছিল দক্ষ যোদ্ধা। সমস্ত ইসরাইলের উপর দাউদকে বাদশাহ্‌ করবার জন্য তারা পুরোপুরি মন স্থির করে হেবরনে এসেছিল। দাউদকে বাদশাহ্‌ করবার ব্যাপারে বাদবাকী ইসরাইলীয়রাও একমত হয়েছিল। এই লোকেরা তিন দিন দাউদের সংগে থেকে খাওয়া-দাওয়া করল। সেখানকার লোকেরাই তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এছাড়া ইষাখর, সবূলূন ও নপ্তালি এলাকা থেকেও লোকেরা গাধা, উট, খ"চর ও বলদের পিঠে করে তাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল। ইসরাইল দেশের লোকদের মনে আনন্দ ছিল বলে তারা প্রচুর পরিমাণে ময়দা, ডুমুর ও কিশ্‌মিশের তাল, আংগুর-রস, তেল এবং গরু, ছাগল ও ভেড়া নিয়ে এসেছিল। দাউদ তাঁর প্রত্যেক নেতা, অর্থাৎ হাজার সৈন্যের সেনাপতি ও শত সৈন্যের সেনাপতিদের সংগে পরামর্শ করলেন। তারপর তিনি বনি-ইসরাইলদের গোটা দলটাকে বললেন, “আপনারা যদি ভাল মনে করেন আর এটাই যদি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হয় তবে আসুন, আমরা ইসরাইলের সমস্ত এলাকায় আমাদের বাদবাকী ভাইদের কাছে ও তাদের সংগে যে সব ইমাম ও লেবীয়রা তাদের গ্রামে আর পশু চরাবার মাঠে আছে তাদের কাছে খবর পাঠিয়ে দিই যেন তারা এসে আমাদের সংগে যোগ দেয়। আসুন, আমাদের আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকটা আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনি; তালুতের রাজত্বকালে আমরা তো সিন্দুকটির দিকে কোন মনোযোগ দিই নি।” তখন গোটা দলটাই তা করতে রাজী হল, কারণ সব লোকের কাছে সেটাই উচিত বলে মনে হল। কাজেই কিরিয়ৎ-যিয়ারীম থেকে আল্লাহ্‌র সিন্দুক নিয়ে আসবার জন্য দাউদ মিসরের সীহোর নদী থেকে হামার সীমা পর্যন্ত সমস্ত বনি-ইসরাইলদের একত্র করলেন। এহুদা দেশের বালা, অর্থাৎ কিরিয়ৎ-যিয়ারীম থেকে মাবুদ আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি নিয়ে আসবার জন্য দাউদ ও তাঁর সংগে সমস্ত বনি-ইসরাইল সেখানে গেলেন। এই সিন্দুকটি মাবুদের নামে পরিচিত, কারণ তিনি সেখানে কারুবীদের মাঝখানে থাকেন। লোকেরা অবীনাদবের বাড়ী থেকে আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি বের করে একটা নতুন গাড়ির উপরে বসিয়ে নিয়ে চলল। উষঃ ও অহিয়ো সেই গাড়িটা চালাচ্ছিল, আর দাউদ ও সমস্ত বনি-ইসরাইল মাবুদের সামনে তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়ে নেচে নেচে কাওয়ালী গাইছিলেন এবং সুরবাহার, বীণা, খঞ্জনী, করতাল ও শিংগা বাজাচ্ছিলেন। তাঁরা কীদোনের খামারের কাছে আসলে পর বলদ দু’টা উচোট খেল আর উষঃ সিন্দুকটা ধরবার জন্য হাত বাড়াল। এতে উষের উপর মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন। সিন্দুকে হাত দেওয়ার দরুন তিনি তাকে আঘাত করলেন। এতে সে আল্লাহ্‌র সামনেই সেখানে মারা গেল। উষের উপর মাবুদের এই রাগ দেখে দাউদ অসন্তুষ্ট হলেন। আজও সেই জায়গাটাকে বলা হয় পেরষ-উষঃ। দাউদ সেই দিন আল্লাহ্‌কে খুব ভয় করলেন। তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি তবে কি করে আমার কাছে আনা যাবে?” সিন্দুকটি তিনি দাউদ-শহরে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন না। তিনি সেটি নিয়ে গাতীয় ওবেদ-ইদোমের বাড়ীতে রাখলেন। আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি তিন মাস ওবেদ-ইদোমের বাড়ীতে তার পরিবারের কাছে রইল। এতে মাবুদ তার পরিবারকে ও তার সব কিছুকে দোয়া করলেন। পরে টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরম দাউদের কাছে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিলেন। তাদের সংগে পাঠালেন দাউদের জন্য রাজবাড়ী তৈরী করবার উদ্দেশ্যে এরস কাঠ, রাজমিস্ত্রি ও ছুতার মিস্ত্রি। তখন দাউদ বুঝতে পারলেন যে, মাবুদ ইসরাইলের উপর তাঁর রাজপদ স্থির করেছেন এবং তাঁর লোকদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের জন্য তাঁর রাজ্যের অনেক উন্নতি করেছেন। দাউদ জেরুজালেমে আরও বিয়ে করলেন এবং তাঁর আরও ছেলেমেয়ের জন্ম হল। জেরুজালেমে তাঁর যে সব সন্তানের জন্ম হয়েছিল তাদের নাম হল শম্মূয়, শোবব, নাথন, সোলায়মান, যিভর, ইলীশূয়, ইল্পেলট, নোগহ, নেফগ, যাফিয়, ইলীশামা, বীলিয়াদা ও ইলীফেলট। ফিলিস্তিনীরা যখন শুনতে পেল যে, গোটা ইসরাইলের উপরে দাউদকে রাজপদে অভিষেক করা হয়েছে তখন তারা সমস্ত সৈন্য নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে গেল। তা শুনে দাউদ তাদের বিরুদ্ধে বের হলেন। ফিলিস্তিনীরা এসে রফায়ীম উপত্যকায় হানা দিল। তখন দাউদ আল্লাহ্‌কে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি ফিলিস্তিনীদের আক্রমণ করব? তুমি কি আমার হাতে তাদের তুলে দেবে?” জবাবে মাবুদ বললেন, “যাও, তাদের আমি তোমার হাতে তুলে দেব।” তখন দাউদ ও তাঁর লোকেরা বাল-পরাসীমে গিয়ে তাদের হারিয়ে দিলেন। দাউদ বললেন, “আল্লাহ্‌ পানির বাঁধ ভাংগার মত করে আমার হাত দিয়ে আমার শত্রুদের ভেংগে ফেললেন।” এইজন্যই সেই জায়গার নাম হল বাল-পরাসীম। ফিলিস্তিনীরা তাদের দেবমূর্তিগুলো সেখানে ফেলে গিয়েছিল। দাউদের হুকুমে লোকেরা সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিল। ফিলিস্তিনীরা আবার সেই উপত্যকায় হানা দিল। তখন দাউদ আবার আল্লাহ্‌র কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, আর জবাবে আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, “তোমরা সোজাসুজি তাদের দিকে যেয়ো না, বরং তাদের পিছন দিক থেকে বাখা গাছগুলোর সামনে তাদের আক্রমণ কর। বাখা গাছগুলোর মাথায় যখন তুমি সৈন্যদলের চলবার মত শব্দ শুনবে তখনই তুমি যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়বে। এর মানে হল, ফিলিস্তিনী সৈন্যদের আঘাত করবার জন্য আল্লাহ্‌ তোমার আগে আগে গেছেন।” আল্লাহ্‌র হুকুম মতই দাউদ কাজ করলেন। তারা গিবিয়োন থেকে গেষর পর্যন্ত সারা পথ ফিলিস্তিনী সৈন্যদের মারতে মারতে গেল। এইভাবে দাউদের সুনাম সব দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর মাবুদ সব জাতির মধ্যে তাঁর সম্বন্ধে একটা ভয়ের ভাব জাগিয়ে দিলেন। দাউদ-শহরে নিজের জন্য ঘর-বাড়ী তৈরী করবার পর দাউদ আল্লাহ্‌র সিন্দুকের জন্য একটা জায়গা প্রস্তুত করে সেখানে একটা তাম্বু খাটালেন। তারপর তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র সিন্দুক লেবীয়রা ছাড়া আর কেউ বহন করবে না, কারণ মাবুদের সিন্দুক বহন করবার জন্য এবং চিরকাল তাঁর এবাদত-কাজ করবার জন্য মাবুদ তাদেরই বেছে নিয়েছেন।” মাবুদের সিন্দুকের জন্য দাউদ যে জায়গা প্রস্তুত করেছিলেন সেখানে সিন্দুকটি আনবার জন্য তিনি সমস্ত বনি-ইসরাইলদের এক জায়গায় জমায়েত করলেন। তিনি হারুনের বংশের যে লোকদের ও যে লেবীয়দের ডেকে জমায়েত করলেন তাঁরা হলেন: কহাতের বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা ঊরীয়েল এবং আরও একশো বিশজন লোক; মরারির বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা অসায় এবং আরও দু’শো বিশজন লোক; গের্শোনের বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা যোয়েল এবং আরও একশো ত্রিশজন লোক; ইলীষাফণের বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা শময়িয় এবং আরও দু’শো জন লোক; হেবরনের বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা ইলীয়েল এবং আরও আশিজন লোক; উষীয়েলের বংশের লোকদের মধ্য থেকে নেতা অম্মীনাদব এবং আরও একশো বারোজন লোক। তারপর দাউদ ইমাম সাদোক ও অবিয়াথরকে এবং লেবীয় ঊরীয়েল, অসায়, যোয়েল, শময়িয়, ইলীয়েল ও অম্মীনাদবকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁদের বললেন, “আপনারা হলেন লেবি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের নেতা; আপনারা ও আপনাদের সংগী লেবীয়রা নিজেদের পবিত্র করে নেবেন, যাতে যে জায়গা আমি প্রস্তুত করে রেখেছি সেই জায়গায় আপনারা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি এনে রাখতে পারেন। প্রথমবার আপনারা সেটি আনেন নি বলে আমাদের উপর আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাগে জ্বলে উঠেছিলেন। তাঁর হুকুম অনুসারে কিভাবে সেটি আনতে হবে আমরা তাঁর কাছে তা জানতে চাই নি।” এতে ইমামেরা ও লেবীয়রা নিজেদের পবিত্র করে নিলেন যাতে তাঁরা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি নিয়ে আসতে পারেন। মাবুদের নির্দেশ মত মূসার হুকুম অনুসারে লেবীয়রা আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি বহন করবার ডাণ্ডা কাঁধের উপর নিয়ে সেটি নিয়ে আসলেন। দাউদ লেবীয়দের নেতাদের বললেন যে, তারা যেন বাদ্যযন্ত্র, অর্থাৎ বীণা, সুরবাহার ও করতাল বাজিয়ে আনন্দের কাওয়ালী গাইবার জন্য তাঁদের কাওয়াল ভাইদের নিযুক্ত করেন। কাজেই লেবীয়রা যোয়েলের ছেলে হেমনকে ও তাঁর বংশের লোকদের মধ্য থেকে বেরিখিয়ের ছেলে আসফকে এবং তাঁদের গোষ্ঠী-ভাই মরারীয়দের মধ্য থেকে কূশায়ার ছেলে এথনকে নিযুক্ত করলেন। তাঁদের সংগে নিযুক্ত করা হল তাঁদের বংশের দ্বিতীয় শ্রেণীর ইমামদের। তারা হল জাকারিয়া, বেন, যাসীয়েল, শমীরামোৎ, যিহীয়েল, উন্নি, ইলীয়াব, বনায়, মাসেয়, মত্তিথিয়, ইলীফলেহূ, মিক্‌নেয় এবং ওবেদ-ইদোম ও যিয়ীয়েল নামে দরজার দু’জন পাহারাদার। ব্রোঞ্জের করতাল বাজাবার ভার পড়ল কাওয়াল হেমন, আসফ ও এথনের উপর। উঁচু সুরে বীণা বাজাবার ভার পড়ল জাকারিয়া, অসীয়েল, শমীরামোৎ, যিহীয়েল, উন্নি, ইলীয়াব, মাসেয় ও বনায়ের উপর। নীচু সুরে সুরবাহার বাজাবার ভার পড়ল মত্তিথিয়, ইলীফলেহূ, মিক্‌নেয়, ওবেদ-ইদোম, যিয়ীয়েল ও অসসিয়ের উপর। কাওয়ালী পরিচালনার ভার পড়ল লেবীয় নেতা কননিয়ের উপর। তিনি কাওয়ালীর ওস্তাদ ছিলেন বলে তাঁর উপর সেই দায়িত্ব পড়েছিল। এর পরে দাউদ, ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতারা আর সৈন্যদলের হাজার সৈন্যের সেনাপতিরা আনন্দ করতে করতে ওবেদ-ইদোমের বাড়ী থেকে মাবুদের সেই সাক্ষ্য-সিন্দুকটি আনবার জন্য গেলেন। যে লেবীয়রা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি বয়ে আনছিল আল্লাহ্‌ তাদের পরিচালনা করেছিলেন বলে সাতটা বলদ ও সাতটা ভেড়া কোরবানী দেওয়া হল। সিন্দুক বহনকারী লেবীয়রা, কাওয়ালেরা এবং কাওয়ালীর দলের পরিচালক কননিয় মসীনার পাতলা কাপড়ের পোশাক পরেছিল। দাউদও মসীনার পাতলা কাপড়ের পোশাক এবং মসীনার এফোদ পরেছিলেন। এইভাবে সমস্ত বনি-ইসরাইলরা চিৎকার করতে করতে এবং শিংগা, তূরী, করতাল, বীণা ও সুরবাহার বাজাতে বাজাতে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি জেরুজালেমে নিয়ে আসল। মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি দাউদ-শহরে ঢুকবার সময় তালুতের মেয়ে মীখল জানালা দিয়ে তা দেখলেন। বাদশাহ্‌ দাউদকে নাচতে ও আনন্দ করতে দেখে তিনি মনে মনে দাউদকে তুচ্ছ করলেন। আল্লাহ্‌র সিন্দুকের জন্য দাউদ যে তাম্বু খাটিয়েছিলেন লোকেরা সিন্দুকটি এনে তার ভিতরে রাখল। এর পর আল্লাহ্‌র সামনে পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দেওয়া হল। সেই সব কোরবানী দেওয়া শেষ হয়ে গেলে পর দাউদ মাবুদের নামে লোকদের দোয়া করলেন। তারপর তিনি ইসরাইলীয় প্রত্যেক স্ত্রীলোক ও পুরুষকে একটা করে রুটি, এক খণ্ড গোশ্‌ত ও এক তাল কিশমিশ দিলেন। মাবুদের সিন্দুকের সামনে এবাদত-কাজের জন্য দাউদ কয়েকজন লেবীয়কে নিযুক্ত করলেন যাতে তারা মুনাজাত করতে, শুকরিয়া জানাতে এবং ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে পারে। এই লোকদের নেতা ছিলেন আসফ, দ্বিতীয় ছিলেন জাকারিয়া, তারপরে ছিলেন যিয়ীয়েল, শমীরামোৎ, যিহীয়েল, মত্তিথিয়, ইলীয়াব, বনায়, ওবেদ-ইদোম ও যিয়ীয়েল। এঁরা বাজাতেন বীণা ও সুরবাহার আর আসফ বাজাতেন করতাল; ইমাম বনায় আর যহসীয়েল আল্লাহ্‌র সেই সাক্ষ্য-সিন্দুকের সামনে নিয়মিত ভাবে শিংগা বাজাতেন। সেই দিন দাউদ প্রথমে মাবুদের উদ্দেশে শুকরিয়ার এই কাওয়ালী গাইবার ভার আসফ ও তাঁর লোকদের উপর দিলেন: মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, তাঁর গুণের কথা ঘোষণা কর; তাঁর কাজের কথা অন্যান্য জাতিদের জানাও। তাঁর উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, তাঁর প্রশংসা-গজল কর; তাঁর সব অলৌকিক কাজের কথা বল। তাঁর পবিত্রতার গৌরব কর; যারা মাবুদকে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী তাদের দিল আনন্দিত হোক। মাবুদ ও তাঁর শক্তিকে বুঝতে চেষ্টা কর; সব সময় তাঁর সংগে যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী হও। তিনিই আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌; গোটা দুনিয়া তাঁরই শাসনে চলছে। যে কালামের নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন হাজার হাজার বংশের জন্য, তাঁর সেই ব্যবস্থার কথা চিরকাল মনে রেখো। সেই ব্যবস্থা তিনি ইব্রাহিমের জন্য স্থাপন করেছিলেন আর ইসহাকের কাছে কসম খেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ব্যবস্থা ইয়াকুবের কাছে নিয়ম হিসাবে আর ইসরাইলের কাছে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাকে কেনান দেশটা দেব, সেটাই হবে তোমার পাওনা সম্পত্তি।” তাদের সংখ্যা যখন কম ছিল, খুবই কম ছিল, আর তারা সেখানে বিদেশী ছিল, তারা যখন সেখানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে আর বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়াত, তখন তিনি কাউকে তাদের জুলুম করতে দিতেন না। তাদের জন্য তিনি বাদশাহ্‌দের ধম্‌কে দিতেন, বলতেন, “আমার অভিষিক্ত বান্দাদের ছোঁবে না; আমার নবীদের কোন ক্ষতি করবে না।” দুনিয়ার সব লোক, তোমরা মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও; তাঁর দেওয়া উদ্ধারের কথা দিনের পর দিন ঘোষণা কর। বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁর মহিমা ঘোষণা কর; সমস্ত লোকের মধ্যে তাঁর সব অলৌকিক কাজের কথা ঘোষণা কর। মাবুদই মহান এবং সবার উপরে প্রশংসার যোগ্য; সব দেব-দেবীর চেয়ে তিনি বেশী ভয় জাগান। বিভিন্ন জাতির দেব-দেবী অসার মাত্র, কিন্তু মাবুদ আসমানের সৃষ্টিকর্তা। তাঁকেই ঘিরে রয়েছে প্রশংসা ও মহিমা; তাঁর বাসস্থানে রয়েছে কুদরত ও আনন্দ। হে বিভিন্ন জাতির সমস্ত গোষ্ঠী, স্বীকার কর সমস্ত প্রশংসা ও কুদরত মাবুদেরই। তোমরা স্বীকার কর সমস্ত প্রশংসা মাবুদের; কোরবানীর জিনিস নিয়ে তাঁর সামনে এস। মাবুদের মহিমাপূর্ণ পবিত্রতার কথা ভেবে তাঁর এবাদত কর। দুনিয়ার সমস্ত লোক, তোমরা তাঁর সামনে কেঁপে ওঠো। দুনিয়া অটলভাবে স্থাপিত হল, তা কখনও নড়বে না। আসমান আনন্দ করুক, দুনিয়া খুশী হোক; বিভিন্ন জাতির মধ্যে তারা ঘোষণা করুক, “মাবুদই রাজত্ব করেন।” সাগর ও তার মধ্যেকার সব কিছু গর্জন করুক; মাঠ ও তার মধ্যেকার সব কিছু আনন্দিত হোক। তাহলে বনের গাছপালাও মাবুদের সামনে আনন্দে গজল গাইবে, কারণ তিনি দুনিয়ার বিচার করতে আসছেন। তোমরা মাবুদের শুকরিয়া আদায় কর, কারণ তিনি মেহেরবান; তাঁর অটল মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। তোমরা বল, “হে আমাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌, আমাদের উদ্ধার কর; অন্যান্য জাতিদের মধ্য থেকে তুমি আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এসে আমাদের রক্ষা কর, যাতে আমরা তোমার পবিত্রতার উদ্দেশে শুকরিয়া জানাতে পারি আর তোমার গুণগান করতে পারছি বলে গর্ববোধ করতে পারি। সৃষ্টির আগে থেকে আখেরাত পর্যন্ত ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক।” এর পর সব লোকেরা বলল, “আমিন, মাবুদের প্রশংসা হোক।” প্রতিদিনের প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত এবাদত-কাজের জন্য দাউদ মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকের কাছে আসফ ও তাঁর লোকদের রেখে গেলেন। তাদের সাহায্য করবার জন্য তিনি ওবেদ-ইদোম ও তাঁর আটষট্টিজন লোককেও রেখে গেলেন। যিদূথূনের ছেলে ওবেদ-ইদোম ও হোষা ছিলেন রক্ষী। দাউদ গিবিয়োনের এবাদতের উঁচু স্থানে মাবুদের আবাস-তাম্বুর সামনে ইমাম সাদোক ও তাঁর সংগের ইমামদের রেখে গেলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মাবুদ বনি-ইসরাইলদের যে শরীয়ত দিয়েছিলেন তাতে যা যা লেখা ছিল সেই অনুসারে যেন তাঁরা মাবুদের উদ্দেশে কোরবানগাহের উপর প্রতিদিন সকালে ও বিকালে নিয়মিতভাবে পোড়ানো-কোরবানী দিতে পারেন। তাঁদের সংগে ছিলেন হেমন ও যিদূথূন আর বাদবাকী লোক, যাদের নাম উল্লেখ করে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে তারা মাবুদের চিরকাল স্থায়ী অটল মহব্বতের জন্য তাঁকে শুকরিয়া জানাতে পারে। আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কাওয়ালী গাইবার সময়ে শিংগা, করতাল ও অন্যান্য বাজনা বাজাবার জন্য হেমন ও যিদূথূনের উপর ভার দেওয়া হল। যিদূথূনের বংশের লোকদের রক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করা হল। এর পর সব লোক যে যার বাড়ীর দিকে রওনা হল এবং দাউদ তাঁর পরিবারের লোকদের দোয়া করবার জন্য বাড়ীতে ফিরে গেলেন। রাজবাড়ীতে বাস করবার সময় একদিন দাউদ নবী নাথনকে বললেন, “আমি এখন এরস কাঠের ঘরে বাস করছি কিন্তু মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি রয়েছে একটা তাম্বুর মধ্যে।” জবাবে নাথন দাউদকে বললেন, “আপনার মনে যা আছে আপনি তা-ই করুন; আল্লাহ্‌ আপনার সংগে আছেন।” সেই রাতে আল্লাহ্‌র কালাম নাথনের উপর নাজেল হল; আল্লাহ্‌ বললেন, “তুমি গিয়ে আমার গোলাম দাউদকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমার থাকবার ঘর তুমি তৈরী করবে না। মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে আনবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোন ঘরে বাস করি নি। এক তাম্বু থেকে অন্য তাম্বুতে, এক বাসস্থান থেকে অন্য বাসস্থানে গিয়েছি। যে সব নেতাদের উপর আমি আমার বান্দাদের পালন করবার ভার দিয়েছিলাম, বিভিন্ন জায়গায় বনি-ইসরাইলদের সংগে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি সেই নেতাদের কি কোন সময় বলেছি যে, তারা কেন আমার জন্য এরস কাঠের ঘর তৈরী করে নি?’ “এখন তুমি আমার গোলাম দাউদকে বল যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছেন, ‘আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা হবার জন্য আমিই তোমাকে পশু চরাবার মাঠ থেকে, ভেড়ার পালের পিছন থেকে নিয়ে এসেছি। তুমি যে সব জায়গায় গিয়েছ আমিও সেখানে তোমার সংগে গিয়েছি এবং তোমার সামনে থেকে তোমার সমস্ত শত্রুদের শেষ করে দিয়েছি। আমি তোমার নাম দুনিয়ার মহান লোকদের নামের মত বিখ্যাত করব। তোমার আয়ু শেষ হলে পর যখন তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবে তখন আমি তোমার জায়গায় তোমার বংশের একজনকে, তোমার নিজের সন্তানকে বসাব এবং তার রাজ্য স্থির রাখব। তোমার সেই সন্তানই আমার জন্য একটা ঘর তৈরী করবে, আর তার সিংহাসন আমি চিরকাল স্থায়ী করব। আমি হব তার পিতা আর সে হবে আমার পুত্র। আমার মহব্বত আমি কখনও তার উপর থেকে তুলে নেব না, যেমন করে আমি তুলে নিয়েছিলাম তোমার আগে যে ছিল তার উপর থেকে। আমার ঘরে ও আমার রাজ্যে আমি তাকে চিরকাল স্থির রাখব এবং তার সিংহাসন চিরস্থায়ী হবে।’ ” এই দর্শনের সমস্ত কথাগুলো নাথন দাউদকে বললেন। এই সব কথা শুনে বাদশাহ্‌ দাউদ তাম্বুর ভিতরে গেলেন এবং মাবুদের সামনে বসে বললেন, “হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, আমিই বা কি, আর আমার বংশই বা কি যে, তুমি আমাকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছ? আর হে আল্লাহ্‌, এ-ও তোমার চোখে যথেষ্ট হয় নি; এর সংগে তোমার গোলামের বংশের ভবিষ্যতের কথাও তুমি বলেছ। হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, আমি যেন একজন মহান লোক সেই চোখেই তুমি আমাকে দেখেছ। “তোমার গোলাম আমাকে যে সম্মান দেখালে তাতে আমি তোমার কাছে আর বেশী কি বলতে পারি? তুমি তো তোমার গোলামকে জান। হে মাবুদ, তোমার গোলামের জন্য তোমার ইচ্ছা অনুসারে এই মহৎ কাজ তুমি করেছ আর তোমার গোলামকে তা জানিয়েছ। “হে আল্লাহ্‌, তোমার মত আর কেউ নেই এবং তুমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই; আমরা নিজের কানেই এই কথা শুনেছি। তোমার ইসরাইল জাতির মত দুনিয়াতে আর কোন জাতি নেই, যাকে তুমি তোমার নিজের বান্দা করবার জন্য মুক্ত করেছ। তুমি তাদের মিসর দেশ থেকে মুক্ত করে তাদের সামনে থেকে অন্যান্য জাতিদের দুর করে দিয়েছ। তোমার নিজের গৌরব প্রকাশের জন্য মহৎ ও ভয় জাগানো কাজের মধ্য দিয়ে তুমি তা করেছ। তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের তুমি নিজের উদ্দেশ্যে চিরকাল তোমার নিজের বান্দা করেছ, আর তুমি, হে আল্লাহ্‌, তুমি তাদের মাবুদ হয়েছ। “এখন হে মাবুদ, আমার ও আমার বংশের বিষয়ে তুমি যে ওয়াদা করেছ তা চিরকাল রক্ষা কর। তোমার ওয়াদা অনুসারেই তা কর। এতে আমার বংশ স্থায়ী হবে এবং চিরকাল তোমার গৌরব হবে। তখন লোকে বলবে, ‘আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই বনি-ইসরাইলদের মাবুদ, সত্যিই বনি-ইসরাইলদের মাবুদ’! আর তোমার গোলাম দাউদের বংশ তোমার সামনে স্থির থাকবে। হে আমার আল্লাহ্‌, তুমিই আমার কাছে এই বিষয় প্রকাশ করে বলেছ যে, তুমি আমার মধ্য দিয়ে একটা বংশ গড়ে তুলবে। তাই তোমার কাছে এই মুনাজাত করতে আমার মনে সাহস হয়েছে। হে আল্লাহ্‌, তুমিই মাবুদ। এই মেহেরবানীর ওয়াদা তুমিই আমার কাছে করেছ। আমার বংশকে তুমি খুশী হয়ে দোয়া করেছ যাতে এই বংশ চিরকাল তোমার সামনে থাকে। মাবুদ, তুমিই যখন এই বংশকে দোয়া করেছ তখন তা চিরকাল দোয়াযুক্ত থাকবে।” পরে দাউদ ফিলিস্তিনীদের হারিয়ে দিয়ে তাদের নিজের অধীনে আনলেন। তিনি ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে গাৎ ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো দখল করে নিলেন। দাউদ মোয়াবীয়দেরও হারিয়ে দিলেন। তারা দাউদের অধীন হয়ে তাঁকে খাজনা দিতে লাগল। পরে সোবার বাদশাহ্‌ হদদেষর যখন ফোরাত নদী বরাবর তাঁর জায়গাগুলোতে আবার তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে গেলেন তখন দাউদ তাঁর সংগে যুদ্ধ করতে হামা পর্যন্ত গেলেন। দাউদ তাঁর এক হাজার রথ, সাত হাজার ঘোড়সওয়ার এবং বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য আটক করলেন। তাদের একশোটা রথের ঘোড়া রেখে তিনি বাকী সব ঘোড়ার পায়ের শিরা কেটে দিলেন। দামেস্কের সিরীয়রা যখন সোবার বাদশাহ্‌ হদদেষরকে সাহায্য করতে আসল তখন দাউদ তাদের বাইশ হাজার লোককে হত্যা করলেন। দাউদ সিরিয়া রাজ্যের দামেস্কে সৈন্যদল রাখলেন। তাতে সিরীয়রা তাঁর অধীন হয়ে তাঁকে খাজনা দিতে লাগল। এইভাবে দাউদ যে কোন জায়গায় যেতেন মাবুদ সেখানে তাঁকে জয়ী করতেন। হদদেষরের লোকদের সোনার ঢালগুলো দাউদ জেরুজালেমে নিয়ে আসলেন। টিভৎ ও কূন নামে হদদেষরের দু’টা শহর থেকে দাউদ প্রচুর পরিমাণে ব্রোঞ্জও নিয়ে আসলেন। এই ব্রোঞ্জ দিয়ে সোলায়মান সেই বিরাট পাত্র, থাম ও ব্রোঞ্জের অন্যান্য জিনিস তৈরী করিয়েছিলেন। হামার বাদশাহ্‌ তয়ি শুনতে পেলেন যে, দাউদ সোবার বাদশাহ্‌ হদদেষরের গোটা সৈন্যদলকে হারিয়ে দিয়েছেন। দাউদ হদদেষরের সংগে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বলে তাঁকে সালাম ও অভিনন্দন জানাবার জন্য তয়ি তাঁর ছেলে হদোরামকে বাদশাহ্‌ দাউদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এই হদদেষরের সংগে তয়ির অনেকবার যুদ্ধ হয়েছিল। হদোরাম দাউদের জন্য সংগে করে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের নানা রকম জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। এর আগে বাদশাহ্‌ দাউদ ইদোমীয়, মোয়াবীয়, অম্মোনীয়, ফিলিস্তিনী এবং আমালেকীয়দের কাছ থেকে সোনা ও রূপা নিয়ে এসে যেমন মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করে রেখেছিলেন তেমনি এগুলো নিয়েও তিনি তা-ই করলেন। সরূয়ার ছেলে অবীশয় লবণ-উপত্যকায় আঠারো হাজার ইদোমীয়কে হত্যা করলেন। তিনি ইদোমের কয়েক জায়গায় সৈন্যদল রাখলেন আর তাতে সমস্ত ইদোমীয়রা দাউদের অধীন হল। দাউদ যে কোন জায়গায় যেতেন মাবুদ সেখানেই তাঁকে জয়ী করতেন। দাউদ সমস্ত ইসরাইল দেশের উপর রাজত্ব করতে লাগলেন। তাঁর লোকদের তিনি ন্যায়ভাবে বিচার ও শাসন করতেন। সরূয়ার ছেলে যোয়াব ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি আর অহীলূদের ছেলে যিহোশাফট তাঁর রাজত্বের সব ইতিহাস লিখে রাখতেন। অহীটূবের ছেলে সাদোক ও অবিয়াথরের ছেলে আবিমালেক ছিলেন ইমাম আর শব্‌শ ছিলেন বাদশাহ্‌র লেখক। যিহোয়াদার ছেলে বনায় ছিলেন দাউদের দেহরক্ষী করেথীয় ও পলেথীয়দের প্রধান, আর দাউদের ছেলেরা বাদশাহ্‌র প্রধান প্রধান পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরে অম্মোনীয় বাদশাহ্‌ নাহশ মারা গেলে পর তাঁর ছেলে হানূন তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। দাউদ বললেন, “হানূনের পিতা নাহশ আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন বলে আমিও হানূনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।” সেইজন্য তাঁর পিতার মৃত্যুতে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তিনি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিলেন। দাউদের লোকেরা হানূনকে সান্ত্বনা দেবার জন্য অম্মোনীয়দের দেশে গেল। কিন্তু অম্মোনীয় নেতারা হানূনকে বললেন, “আপনি কি মনে করেন যে, দাউদ আপনার পিতার প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য আপনাকে সান্ত্বনা দিতে লোক পাঠিয়েছে? সে তাদের আপনার কাছে পাঠিয়েছে যাতে তারা গোয়েন্দা হিসাবে দেশের খোঁজ-খবর নিয়ে পরে সেটা ধ্বংস করে দিতে পারে।” হানূন তখন দাউদের লোকদের ধরে তাদের দাড়ি কামিয়ে দিলেন এবং জুব্বার অর্ধেকটা, অর্থাৎ কোমর পর্যন্ত কেটে দিয়ে তাদের বিদায় করে দিলেন। কেউ এসে দাউদকে সেই লোকদের প্রতি কি করা হয়েছে তা জানালে পর তাঁর পাঠানো সেই লোকদের সংগে দেখা করবার জন্য তিনি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিলেন, কারণ সেই লোকেরা খুব লজ্জায় পড়েছিল। বাদশাহ্‌ তাদের বলে পাঠালেন, “তোমাদের দাড়ি বেড়ে না ওঠা পর্যন্ত তোমরা জেরিকোতেই থাক; তারপর তোমরা ফিরে এসো।” অম্মোনীয়রা যখন বুঝতে পারল যে, তারা দাউদের কাছে নিজেদের ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে, তখন হানূন ও অম্মোনীয়রা ইরাম-নহরয়িম, ইরাম-মাখা ও সোবা থেকে রথ ও রথ-চালকদের ভাড়া করে আনবার জন্য ঊনচল্লিশ হাজার কেজি রূপা পাঠিয়ে দিল। তারা বত্রিশ হাজার রথ এবং সৈন্যদল সুদ্ধ মাখার বাদশাহ্‌কে ভাড়া করল। তিনি ও তাঁর সৈন্যেরা এসে মেদবার কাছে ছাউনি ফেললেন আর ওদিকে অম্মোনীয়রা নিজের নিজের শহর থেকে একত্র হয়ে যুদ্ধের জন্য বের হল। এই সব শুনে দাউদ যোয়াবকে এবং তাঁর সমস্ত সৈন্যদলকে পাঠিয়ে দিলেন। তখন অম্মোনীয়রা বের হয়ে তাদের শহরের দরজায় ঢুকবার পথে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজাল। এদিকে যে বাদশাহ্‌রা এসেছিলেন তাঁরা খোলা মাঠে রইলেন। যোয়াব দেখলেন তাঁর সামনে এবং পিছনে সিরীয় সৈন্যদের সাজানো হয়েছে। সেইজন্য তিনি তাঁর সৈন্যদের মধ্য থেকে কতগুলো বাছাই করা সৈন্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাজালেন। বাকী সৈন্যদের তিনি তাঁর ভাই অবীশয়ের অধীনে রাখলেন; তাতে তারা অম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য নিজেদের সাজাল। যোয়াব তাঁর ভাইকে বললেন, “যদি সিরীয়রা আমার চেয়ে শক্তিশালী হয় তবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে আসবে, আর যদি অম্মোনীয়রা তোমার চেয়ে শক্তিশালী হয় তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে যাব। সাহস কর; আমাদের লোকদের জন্য এবং আমাদের আল্লাহ্‌র শহরগুলোর জন্য এস, আমরা সাহসের সংগে যুদ্ধ করি। মাবুদের চোখে যা ভাল তিনি তা-ই করুন।” এই বলে যোয়াব তাঁর সৈন্যদল নিয়ে সিরীয়দের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য এগিয়ে গেলে পর সিরীয়রা তাঁর সামনে থেকে পালিয়ে গেল। সিরীয়দের পালিয়ে যেতে দেখে অম্মোনীয়রাও যোয়াবের ভাই অবীশয়ের সামনে থেকে পালিয়ে গিয়ে শহরের ভিতরে ঢুকল। কাজেই যোয়াব জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। সিরীয়রা যখন দেখল যে, তারা বনি-ইসরাইলদের কাছে সম্পূর্ণভাবে হেরে গেছে তখন তারা লোক পাঠিয়ে ফোরাত নদীর ওপারে বাস করা সিরীয়দের নিয়ে আসল। হদদেষরের সৈন্যদলের সেনাপতি শোবক তাদের পরিচালনা করে নিয়ে আসলেন। দাউদকে সেই কথা জানালে পর তিনি সমস্ত ইসরাইলীয় সৈন্যদের জমায়েত করলেন এবং জর্ডান নদী পার হয়ে তাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গেলেন এবং তাদের সামনের দিকে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজালেন। তখন সিরীয়রা দাউদের সংগে যুদ্ধ করল। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে তারা পালিয়ে গেল। তখন দাউদ তাদের সাত হাজার রথচালক ও চল্লিশ হাজার পদাতিক সৈন্য হত্যা করলেন। তিনি তাদের সেনাপতি শোবককেও হত্যা করলেন। হদদেষরের অধীন বাদশাহ্‌রা যখন দেখলেন যে, তাঁরা বনি-ইসরাইলদের কাছে হেরে গেছেন তখন দাউদের সংগে শান্তি-চুক্তি করে তাঁরা তাঁর অধীন হলেন। কাজেই অম্মোনীয়দের সাহায্য করতে সিরীয়রা আর রাজী হল না। বসন্তকালে যখন বাদশাহ্‌রা সাধারণত: যুদ্ধ করতে বের হন তখন যোয়াব সৈন্যদল নিয়ে বের হলেন। তিনি অম্মোনীয়দের দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়ে রব্বাতে গিয়ে সেটা ঘেরাও করলেন। দাউদ কিন্তু জেরুজালেমেই রয়ে গেলেন। যোয়াব রব্বা আক্রমণ করে সেটা ধ্বংস করে দিলেন। দাউদ সেখানকার বাদশাহ্‌র মাথা থেকে তাজটা খুলে নিলেন। সেটা প্রায় চৌত্রিশ কেজি সোনা দিয়ে তৈরী ছিল, আর তাতে দামী পাথর বসানো ছিল। তাজটা দাউদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হল। দাউদ সেই শহর থেকে অনেক লুটের মাল নিয়ে গেলেন। তিনি শহরের লোকদের বের করে আনলেন এবং করাত, লোহার খন্তা ও কুড়াল দিয়ে তাদের কেটে ফেললেন। অম্মোনীয়দের সমস্ত শহরেও তিনি তা-ই করলেন। এর পর দাউদ তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। পরে গেষরে ফিলিস্তিনীদের সংগে যুদ্ধ শুরুহল। সেই সময় হূশাতীয় সিব্বখয় রফায়ীয়দের বংশের সিপ্পয় নামে একজনকে হত্যা করল, আর এতে ফিলিস্তিনীরা হেরে গেল। ফিলিস্তিনীদের সংগে আর একটা যুদ্ধে যায়ীরের ছেলে ইল্‌হানন গাতীয় জালুতের ভাই লহমিকে হত্যা করল। তার বর্শাটা ছিল তাঁতীদের বীমের মত। গাতে আর একটা যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে একজন লম্বা-চওড়া লোক ছিল যার দু’হাতে ও দু’পায়ে ছয়টা করে মোট চব্বিশটা আংগুল ছিল। সে-ও ছিল একজন রফায়ীয়। সে যখন ইসরাইল জাতিকে টিট্‌কারি দিল তখন দাউদের ভাই শিমিয়ার ছেলে যোনাথন তাকে হত্যা করল। গাতের এই লোকেরা ছিল রফার বংশের লোক। দাউদ ও তাঁর লোকদের হাতে এরা মারা পড়েছিল। শয়তান এবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগল। ইসরাইল জাতির লোক গণনা করবার জন্য সে দাউদের মনে ইচ্ছা জাগাল। দাউদ তখন যোয়াব ও সৈন্যদলের সেনাপতিদের বললেন, “বের্‌-শেবা থেকে দান পর্যন্ত বনি-ইসরাইলদের গণনা কর। তারপর ফিরে এসে আমাকে হিসাব দিয়ো যাতে এদের সংখ্যা কত তা আমি জানতে পারি।” কিন্তু যোয়াব জবাবে বললেন, “মাবুদ যেন তাঁর নিজের বান্দাদের সংখ্যা একশো গুণ বাড়িয়ে দেন। আমার প্রভু মহারাজ, এরা সবাই কি আপনার গোলাম নয়? তবে কেন আমার প্রভু এটা করতে চাইছেন? কেন আপনার জন্য গোটা ইসরাইল জাতি দোষী হবে?” কিন্তু যোয়াবের কাছে বাদশাহ্‌র হুকুম বহাল রইল; কাজেই যোয়াব গিয়ে গোটা ইসরাইল দেশটা ঘুরে জেরুজালেমে ফিরে আসলেন। যারা তলোয়ার চালাতে পারে তাদের সংখ্যা তিনি দাউদকে জানালেন্ত তা হল গোটা ইসরাইল দেশে এগারো লক্ষ এবং এহুদায় চার লক্ষ সত্তর হাজার। যোয়াব কিন্তু সেই গণনার মধ্যে লেবি ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকদের ধরেন নি, কারণ বাদশাহ্‌র এই হুকুম তাঁর কাছে খারাপ মনে হয়েছিল। এই হুকুম আল্লাহ্‌র চোখেও ছিল খারাপ; তাই তিনি ইসরাইল জাতিকে শাস্তি দিলেন। তখন দাউদ আল্লাহ্‌কে বললেন, “আমি এই কাজ করে ভীষণ গুনাহ্‌ করেছি। এখন আমি তোমার কাছে মিনতি করি, তুমি তোমার গোলামের এই অন্যায় মাফ কর। আমি খুবই বোকামির কাজ করেছি।” মাবুদ তখন দাউদের দর্শক নবী গাদকে বললেন, “তুমি গিয়ে দাউদকে এই কথা বল, ‘আমি মাবুদ তোমাকে তিনটা শাস্তির মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে বলছি। তুমি তার মধ্য থেকে যেটা বেছে নেবে আমি তোমার প্রতি তা-ই করব।’ ” তখন গাদ দাউদের কাছে গিয়ে বললেন, “মাবুদ আপনাকে এগুলোর মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে বলছেন্ত তিন বছর ধরে দুর্ভিক্ষ, কিংবা আপনার শত্রুদের কাছে হেরে গিয়ে তাদের সামনে থেকে তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়ানো, কিংবা তিন দিন পর্যন্ত মাবুদের তলোয়ার, অর্থাৎ দেশের মধ্যে মহামারী। সেই তিন দিন মাবুদের ফেরেশতা ইসরাইলের সব জায়গায় ধ্বংসের কাজ করে বেড়াবেন। এখন আপনি বলুন, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁকে আমি কি জবাব দেব?” দাউদ গাদকে বললেন, “আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমি যেন মানুষের হাতে না পড়ি, তার চেয়ে বরং মাবুদের হাতেই পড়ি, কারণ তাঁর মমতা অসীম।” তখন মাবুদ ইসরাইলের উপর একটা মহামারী পাঠিয়ে দিলেন আর তাতে ইসরাইলের সত্তর হাজার লোক মারা পড়ল। জেরুজালেম শহর ধ্বংস করবার জন্য আল্লাহ্‌ একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই ফেরেশতা যখন সেই কাজ করতে যাচ্ছিলেন তখন মাবুদ সেই ভীষণ শাস্তি দেওয়া থেকে মন ফিরালেন। সেই ধ্বংসকারী ফেরেশতাকে তিনি বললেন, “থাক্‌, যথেষ্ট হয়েছে, এবার তোমার হাত গুটাও।” মাবুদের ফেরেশতা তখন যিবূষীয় অরৌণার খামারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর মধ্যে দাউদ উপর দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, মাবুদের ফেরেশতা আকাশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর হাতে রয়েছে জেরুজালেমের উপর মেলে-ধরা খোলা তলোয়ার। এ দেখে দাউদ ও বৃদ্ধ নেতারা চট্‌ পরা অবস্থায় মাটির উপর উবুড় হয়ে পড়লেন। তখন দাউদ আল্লাহ্‌কে বললেন, “লোকদের গণনা করবার হুকুম কি আমিই দিই নি? গুনাহ্‌ আমিই করেছি, অন্যায়ও করেছি আমি। এরা তো ভেড়ার মত, এরা কি করেছে? হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, আমার ও আমার পরিবারের উপর তোমার হাত পড়ুক, কিন্তু এই মহামারী যেন আর তোমার লোকদের উপর না থাকে।” তখন মাবুদের ফেরেশতা নবী গাদকে হুকুম দিলেন যেন তিনি দাউদকে যিবূষীয় অরৌণার খামারে গিয়ে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করতে বলেন। মাবুদের নাম করে গাদ তাঁকে যে কথা বলেছিলেন সেই কথার বাধ্য হয়ে দাউদ সেখানে গেলেন। অরৌণা গম ঝাড়তে ঝাড়তে ঘুরে সেই ফেরেশতাকে দেখতে পেল, আর তার সংগে তার যে চারটি ছেলে ছিল তারা গিয়ে লুকাল। দাউদ এগিয়ে গেলেন আর তাঁকে দেখে অরৌণা খামার ছেড়ে তাঁর সামনে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সালাম জানাল। দাউদ তাকে বললেন, “তোমার ঐ খামার-বাড়ীর জায়গাটা আমাকে দাও। আমি সেখানে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করব যাতে লোকদের মধ্যে এই মহামারী থেমে যায়। পুরো দাম নিয়েই ওটা আমার কাছে বিক্রি কর।” অরৌণা দাউদকে বলল, “আপনি ওটা নিন। আমার প্রভু মহারাজের যা ভাল মনে হয় তা-ই করুন। দেখুন, পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আমি আমার ষাঁড়গুলো দিচ্ছি, জ্বালানি কাঠের জন্য দিচ্ছি শস্য মাড়াইয়ের কাঠের যন্ত্র আর শস্য-কোরবানীর জন্য গম। আমি এই সবই আপনাকে দিচ্ছি।” কিন্তু জবাবে বাদশাহ্‌ দাউদ অরৌণাকে বললেন, “না, তা হবে না। আমি এর পুরো দামই দেব। যা তোমার তা আমি মাবুদের জন্য নেব না, কিংবা বিনামূল্যে পাওয়া এমন কোন জিনিস দিয়ে পোড়ানো-কোরবানীও দেব না।” এই বলে সেই জমির জন্য দাউদ অরৌণাকে সাত কেজি আটশো গ্রাম সোনা দিলেন। দাউদ সেখানে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দিলেন। তিনি মাবুদের কাছে মিনতি করলেন আর মাবুদ কোরবানগাহের উপর বেহেশত থেকে আগুন পাঠিয়ে জবাব দিলেন। এর পর মাবুদ ঐ ফেরেশতাকে হুকুম দিলেন আর তিনি তাঁর তলোয়ার খাপে ঢুকিয়ে রাখলেন। সেই সময় দাউদ যখন দেখলেন যে, যিবূষীয় অরৌণার খামারে মাবুদ তাঁকে জবাব দিলেন তখন তিনি সেখানে আরও কোরবানী দিলেন। মরুভূমিতে মূসা মাবুদের জন্য যে আবাস-তাম্বু তৈরী করেছিলেন সেটা এবং কোরবানগাহ্‌টি সেই সময় গিবিয়োনের এবাদতের উঁচু স্থানে ছিল। কিন্তু মাবুদের ফেরেশতার তলোয়ারের ভয়ে দাউদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানবার জন্য সেই কোরবানগাহের সামনে যেতে পারলেন না। এর পর দাউদ বললেন, “মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘর এবং ইসরাইলের কোরবানগাহের স্থান এখানেই হবে।” বিভিন্ন জাতির যে সব লোকেরা ইসরাইল দেশে বাস করত দাউদ হুকুম দিলেন যেন তাদের একত্র করা হয়। তাদের মধ্য থেকে তিনি পাথর কাটবার লোকদের বেছে নিলেন যাতে আল্লাহ্‌র ঘর তৈরীর জন্য তারা পাথর কেটে-ছেঁটে প্রস্তুত করতে পারে। দরজাগুলোর দরজার পেরেক ও কব্‌জার জন্য তিনি প্রচুর পরিমাণে লোহা দিলেন, আর এত ব্রোঞ্জ দিলেন যে, তা ওজন করা গেল না। এছাড়া তিনি অসংখ্য এরস কাঠও দিলেন, কারণ সিডনীয় ও টায়ারীয়রা দাউদকে প্রচুর এরস কাঠ এনে দিয়েছিল। দাউদ বললেন, “আমার ছেলে সোলায়মানের বয়স কম এবং তার অভিজ্ঞতাও কম, কিন্তু মাবুদের জন্য যে ঘর তৈরী করতে হবে তা যেন সমস্ত জাতির চোখে খুব বিখ্যাত এবং জাঁকজমকে ও গৌরবে পূর্ণ হয়। কাজেই তার জন্য আমি সব কিছু প্রস্তুত করে রাখব।” এই বলে দাউদ তাঁর ইন্তেকালের আগে অনেক কিছুর আয়োজন করে রাখলেন। তারপর তিনি তাঁর ছেলে সোলায়মানকে ডেকে তাঁর উপর ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য একটা ঘর তৈরীর ভার দিলেন। দাউদ সোলায়মানকে বললেন, “বাবা, আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য একটা ঘর তৈরীর ইচ্ছা আমার দিলে ছিল। কিন্তু মাবুদের এই কথা আমাকে জানানো হল, ‘তুমি অনেক রক্তপাত করেছ এবং অনেক যুদ্ধও করেছ। তুমি আমার জন্য ঘর তৈরী করবে না, কারণ আমার চোখের সামনে তুমি দুনিয়াতে অনেক রক্তপাত করেছ। কিন্তু তোমার একটি ছেলে হবে যে শান্তি ভালবাসবে। তার চারপাশের শত্রুদের হাত থেকে আমি তাকে শান্তিতে রাখব। তার নাম হবে সোলায়মান (যার মানে শান্তি), কারণ আমি তার রাজত্বের সময়ে ইসরাইলকে শান্তিতে ও নিরাপদে রাখব। সে-ই আমার জন্য একটা ঘর তৈরী করবে। সে হবে আমার পুত্র আর আমি হব তার পিতা। ইসরাইলের উপরে তার রাজত্ব আমি চিরকাল স্থায়ী করব।’ “এখন বাবা আমার, মাবুদ তোমার সংগে থাকুন; তুমি সফলতা লাভ কর আর মাবুদের কথামত তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘর তৈরী কর। মাবুদ তোমার উপরে যখন ইসরাইলের শাসনভার দেবেন তখন যেন তিনি তোমাকে বুদ্ধি-বিবেচনা ও বুঝবার শক্তি দেন যাতে তুমি তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র শরীয়ত মেনে চলতে পার। মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ ইসরাইলকে যে নিয়ম ও নির্দেশ দিয়েছেন তা যদি তুমি যত্নের সংগে পালন কর তাহলেই তুমি সফলতা লাভ করতে পারবে। তুমি শক্তিশালী হও আর মনে সাহস রাখ। ভয় কোরো না কিংবা নিরাশ হোয়ো না। “আমি অনেক কষ্ট করে মাবুদের ঘরের জন্য তিন হাজার ন’শো টন সোনা ও ঊনচল্লিশ হাজার টন রূপা রেখেছি। এছাড়া এত বেশী ব্রোঞ্জ ও লোহা রেখেছি যা মাপা সম্ভব নয়, আর কাঠ এবং পাথরও ঠিক করে রেখেছি। অবশ্য এর সংগে তুমিও কিছু দিতে পারবে। দাউদ তারপর তাঁর ছেলে সোলায়মানকে সাহায্য করবার জন্য ইসরাইলের সমস্ত নেতাদের হুকুম দিয়ে বললেন, “আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ কি আপনাদের সংগে নেই? তিনি কি সব দিকেই আপনাদের শান্তি দেন নি? তিনি তো এই দেশের লোকদের আমার হাতে তুলে দিয়েছেন আর দেশটা মাবুদ ও তাঁর বান্দাদের অধীন হয়েছে। এখন আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানবার জন্য আপনাদের সমস্ত মনপ্রাণ স্থির করুন এবং মাবুদের উদ্দেশে তাঁর পবিত্র ঘরটি তৈরী করতে শুরুকরে দিন, যাতে তার মধ্যে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক ও আল্লাহ্‌র পবিত্র জিনিসগুলো এনে রাখা যায়।” দাউদ যখন খুব বেশী বুড়ো হয়ে গেলেন তখন তাঁর ছেলে সোলায়মানকে তিনি ইসরাইলের উপরে বাদশাহ্‌ করলেন। দাউদ ইসরাইলের সমস্ত নেতা, ইমাম এবং লেবীয়দের একত্র করলেন। যে সব লেবীয় পুরুষেরা ত্রিশ কিংবা তার বেশী বয়সের ছিল তাদের গণনা করলে দেখা গেল তাদের সংখ্যা আটত্রিশ হাজার। লেবির ছেলে গের্শোন, কহাৎ ও মরারির বংশ অনুসারে দাউদ লেবীয়দের তিনটি দলে ভাগ করলেন। গের্শোনের বংশের মধ্যে ছিলেন লাদন ও শিমিয়ি। লাদনের তিনজন ছেলের মধ্যে প্রধান ছিলেন যিহীয়েল, তারপর সেথম ও যোয়েল। শিমিয়ির তিনজন ছেলে হল শলোমৎ, হসীয়েল ও হারণ। এঁরা ছিলেন লাদনের বিভিন্ন বংশের নেতা। শিমিয়ির চারজন ছেলে হল যহৎ, সীন, যিয়ূশ ও বরীয়। এঁদের মধ্যে প্রথম ছিলেন যহৎ আর দ্বিতীয় ছিলেন সীন; কিন্তু যিয়ূশ ও বরীয়ের ছেলের সংখ্যা কম ছিল বলে তাঁদের সবাইকে একটা বংশের মধ্যে ধরা হল। কহাতের চারজন ছেলে হল ইমরান, যিষ্‌হর, হেবরন ও উষীয়েল। ইমরানের ছেলেরা হল হারুন ও মূসা। হারুন ও তাঁর বংশধরদের চিরকালের জন্য আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে পবিত্র করা হল যেন তাঁরা মহাপবিত্র জিনিসগুলোর ভার নিতে পারেন, মাবুদের সামনে সুগন্ধি ধূপ জ্বালাতে পারেন, তাঁর সামনে এবাদত-কাজ করতে পারেন এবং তাঁর নামে দোয়া উচ্চারণ করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র বান্দা মূসার ছেলেদের বাকী লেবীয়দের মধ্যে ধরা হত। মূসার ছেলেরা হল গের্শোম ও ইলীয়েষর। গের্শোমের বংশধরদের মধ্যে শবূয়েল ছিলেন নেতা। ইলীয়েষরের বংশধরদের মধ্যে রহবিয় ছিলেন নেতা। ইলীয়েষরের আর কোন ছেলে ছিল না, কিন্তু রহবিয়ের ছেলের সংখ্যা ছিল অনেক। যিষ্‌হরের বংশধরদের মধ্যে শলোমীৎ ছিলেন নেতা। হেবরনের ছেলেদের মধ্যে প্রথম ছিলেন যিরিয়, দ্বিতীয় অমরিয়, তৃতীয় যহসীয়েল ও চতুর্থ যিকমিয়াম। উষীয়েলের ছেলেদের মধ্যে মিকাহ্‌ ছিলেন প্রথম ও যিশিয় ছিলেন দ্বিতীয়। মরারির ছেলেরা হল মহলি ও মূশি। মহলির ছেলেরা হল ইলিয়াসর ও কীশ। ইলিয়াসর কোন ছেলে না রেখেই ইন্তেকাল করলেন, তাঁর কেবল মেয়েই ছিল। কীশের ছেলেরা, অর্থাৎ তাদের চাচার ছেলেরা সেই মেয়েদের বিয়ে করল। মূশির তিনজন ছেলে হল মহলি, এদর ও যিরেমোৎ। এঁরাই ছিলেন বংশ অনুসারে লেবি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন বংশের নেতা। এঁদের বংশের লোকদের মধ্যে যাদের বয়স ছিল বিশ কিংবা তার চেয়েও বেশী তাদের গণনা করে নাম লেখা হয়েছিল, আর তারাই ছিল মাবুদের ঘরের খেদমতকারী। দাউদ বলেছিলেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের শান্তি দিয়েছেন এবং তিনি চিরকালের জন্য জেরুজালেমে বাস করবেন। কাজেই এবাদত-কাজে ব্যবহার করবার জন্য আবাস-তাম্বু কিংবা অন্য কোন জিনিস লেবীয়দের আর বহন করে নিয়ে যেতে হবে না।” দাউদের শেষ নির্দেশ অনুসারে বিশ বছর থেকে শুরুকরে তার বেশী বয়সের লেবীয়দের গণনা করা হয়েছিল। এই লেবীয়দের কাজ ছিল মাবুদের ঘরের এবাদত-কাজে হারুনের বংশধরদের সাহায্য করা। এর মধ্যে ছিল বায়তুল-মোকাদ্দসের উঠান ও পাশের কামরাগুলোর দেখাশোনা করা, সমস্ত পবিত্র জিনিসগুলো পাক-সাফ করে নেওয়া এবং আল্লাহ্‌র ঘরের অন্যান্য কাজ করা। তাদের উপরে এই সব জিনিসের ভার ছিল- পবিত্র-রুটি, শস্য-কোরবানীর ময়দা, খামিহীন রুটি, সেঁকা রুটি এবং তেল মেশানো ময়দা। এছাড়া তাদের উপর ভার ছিল সব কিছুর ওজন ও পরিমাণ দেখা, এইভাবে লেবীয়রা মিলন-তাম্বুর ও পবিত্র স্থানের দেখাশোনা করত এবং মাবুদের ঘরের এবাদত-কাজের জন্য তাদের ভাই হারুনের বংশধরদের অধীনে কাজ করত। হারুনের বংশের লোকদের বিভিন্ন দলে ভাগ করা হয়েছিল। হারুনের ছেলেরা হল নাদব, অবীহূ, ইলিয়াসর ও ঈথামর। হারুন ইন্তেকাল করবার আগেই নাদব ও অবীহূ কোন ছেলে না রেখেই মারা গিয়েছিলেন; কাজেই ইলিয়াসর ও ঈথামর ইমামের কাজ করতেন। সাদোক নামে ইলিয়াসরের একজন বংশধর এবং অহীমেলক নামে ঈথামরের একজন বংশধরের সাহায্যে দাউদ ইমামদের কাজ অনুসারে তাঁদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে দিলেন। এতে ঈথামরের বংশের লোকদের চেয়ে ইলিয়াসরের বংশের লোকদের মধ্যে অনেক বেশী নেতা পাওয়া গেল। সেইজন্য ইলিয়াসরের বংশের ষোলজন নেতার জন্য তাঁদের ষোল দলে এবং ইথামরের বংশের আটজন নেতার জন্য তাঁদের আট দলে ভাগ করা হল। ইলিয়াসর ও ঈথামর, এই দুই বংশের নেতারা বায়তুল-মোকাদ্দসের ও আল্লাহ্‌র কর্মচারী ছিলেন বলে কারো পক্ষ না টেনে গুলিবাঁট করে ইমামদের কাজ ভাগ করা হল। বাদশাহ্‌ ও তাঁর উঁচু পদের কর্মচারীদের সামনে এবং ইমাম সাদোক, অবিয়াথরের ছেলে অহীমেলক, ইমাম বংশের নেতাদের ও লেবীয়দের সামনে নথনেলের ছেলে শময়িয় নামে একজন লেবীয় লেখক গুলিবাঁট অনুসারে সেই নেতাদের নাম তালিকায় লিখলেন। পালা পালা করে ইলিয়াসরের বিভিন্ন বংশের মধ্য থেকে একজন ও তারপর ঈথামরের বিভিন্ন বংশের মধ্য থেকে একজনের জন্য গুলিবাঁট করা হল। তখন প্রথম বারে গুলিবাঁটে উঠল যিহোয়ারীবের নামে, দ্বিতীয় বারে যিদয়িয়ের, তৃতীয় বারে হারীমের, চতুর্থ বারে সিয়োরীমের, পঞ্চম বারে মল্কিয়ের, ষষ্ঠ বারে মিয়ামীনের, সপ্তম বারে হক্কোষের, অষ্টম বারে অবিয়ের, নবম বারে ইউসার, দশম বারে শখনিয়ের, এগারো বারে ইলীয়াশীবের, বারো বারে যাকীমের, তেরো বারে হুপ্পের, চৌদ্দ বারে যেশবাবের, পনেরো বারে বিল্‌গার, ষোল বারে ইম্মেরের, সতেরো বারে হেষীরের, আঠারো বারে হপ্পিসেসের, ঊনিশ বারে পথাহিয়ের, বিশ বারে ইহিস্কেলের, একুশ বারে যাখীনের, বাইশ বারে গামূলের, তেইশ বারে দলায়ের ও চব্বিশ বারে মাসিয়ের নামে। তাঁদের পূর্বপুরুষ হারুনকে দেওয়া ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুসারে হারুন তাঁদের জন্য যে নিয়ম ঠিক করে দিয়েছিলেন সেইমত মাবুদের ঘরে গিয়ে এবাদত-কাজ করবার জন্য এইভাবে তাঁদের পালা ঠিক করা হল। যিষ্‌হরের বংশের পিতা শলোমীৎ ও শলোমীতের বংশ-নেতা যহৎ। হেবরনের বংশের মধ্যে প্রথম যিরিয়, দ্বিতীয় অমরিয়, তৃতীয় যহসীয়েল এবং চতুর্থ যিকমিয়াম ছিলেন বংশের পিতা। মরারির ছেলে মহলি, মূশি ও যাসিয়; যাসিয়ের বংশের বিনো শোহম, শক্কুর ও ইব্রি ছিলেন বংশের পিতা। মহলির বংশের ইলিয়াসর ও কীশ; ইলিয়াসরের কোন ছেলে ছিল না। কীশের বংশ-নেতা ছিলেন যিরহমেল। মূশির বংশের মহলি, এদর ও যিরেমোৎ ছিলেন বংশের পিতা। বিভিন্ন বংশ অনুসারে এঁরা ছিলেন লেবীয়। এঁরাও বাদশাহ্‌ দাউদ, সাদোক, অহীমেলক এবং ইমাম ও লেবীয়দের বংশ-নেতাদের সামনে এঁদের ভাইদের, অর্থাৎ হারুনের বংশের লোকদের মত করে গুলিবাঁট করেছিলেন। বড় ভাই হোক বা ছোট ভাই হোক তাদের সকলের জন্য একইভাবে গুলিবাঁট করা হয়েছিল। বায়তুল-মোকাদ্দসের এবাদত-কাজ করবার জন্য দাউদ এবং সৈন্যদলের সেনাপতিরা আসফ, হেমন ও যিদূথূনের ছেলেদের আলাদা করে নিলেন যাতে তাঁরা সুরবাহার, বীণা ও করতালের সংগে গজলের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র কালাম প্রকাশ করতে পারেন। যাঁরা এই কাজ করতেন তাঁদের তালিকা এই: আসফের ছেলে সক্কুর, ইউসুফ, নথনিয় ও অসারেল। তাঁরা বাদশাহ্‌র হুকুমে আসফের পরিচালনায় গজলের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র কালাম প্রকাশ করতেন। যিদূথূনের ছয়জন ছেলে গদলিয়, সরী, যিশায়াহ, শিমিয়ি, হশবিয় ও মত্তিথিয়। তাঁরা তাঁদের পিতা যিদূথূনের পরিচালনায় সুরবাহার বাজিয়ে মাবুদের প্রশংসা ও শুকরিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর কালাম প্রকাশ করতেন। হেমনের ছেলে বুক্কিয়, মত্তনিয়, উষীয়েল, শবূয়েল, যিরীমোৎ, হনানিয়, হনানি, ইলীয়াথা, গিদ্দল্‌তি, রোমাম্‌তী-এষর, যশ্‌বকাশা, মল্লোথি, হোথীর ও মহসীয়োৎ। এঁরা সবাই ছিলেন বাদশাহ্‌র দর্শক নবী হেমনের ছেলে। আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে হেমনকে শক্তিশালী করবার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁকে চৌদ্দটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র ঘরের এবাদত-কাজের জন্য এঁরা সবাই তাঁদের বাবা আসফ, যিদূথূন আর হেমনের পরিচালনার অধীন ছিলেন। তাঁরা বাদশাহ্‌র হুকুমে করতাল, বীণা ও সুরবাহার নিয়ে মাবুদের ঘরে গজল গাইতেন ও বাজনা করতেন। মাবুদের উদ্দেশে তাঁদের বংশের গজল ও বাজনায় শিক্ষিত ও দক্ষ লোকদের নিয়ে তাঁদের সংখ্যা ছিল দু’শো অষ্টাশি জন। ছেলে-বুড়ো, শিক্ষক-ছাত্র সকলের কাজের পালা গুলিবাঁট করে ঠিক করা হয়েছিল। আসফের পক্ষে প্রথম বারের গুলিবাঁটে ইউসুফের নাম উঠল। দ্বিতীয় বারের গুলিবাঁটে উঠল গদলিয়ের নাম; তিনি, তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও ছেলেরা ছিলেন বারোজন। তৃতীয় বারের গুলিবাঁটে উঠল সক্কুরের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। চতুর্থ বারের গুলিবাঁটে উঠল যিষ্রির নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। পঞ্চম বারে গুলিবাঁটে উঠল নথনিয়ের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। ষষ্ঠ বারের গুলিবাঁটে উঠল বুক্কিয়ের নাম; তিনি, তার ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। সপ্তম বারের গুলিবাঁটে উঠল যিমারেলার নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। অষ্টম বারের গুলিবাঁটে উঠল যিশয়াহের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। নবম বারের গুলিবাঁটে উঠল মত্তনিয়ের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। দশম বারের গুলিবাঁটে উঠল শিমিয়ির নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। এগারো বারের গুলিবাঁটে উঠল অসারেলের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। বারো বারের গুলিবাঁটে উঠল হশবিয়ের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারো জন। তেরো বারের গুলিবাঁটে উঠল শবূয়েলের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। চৌদ্দ বারের গুলিবাঁটে উঠল মত্তিথিয়ের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। পনেরো বারের গুলিবাঁটে উঠল যিরেমোতের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। ষোল বারের গুলিবাঁটে উঠল হনানিয়ের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। সতের বারের গুলিবাঁটে উঠল যশ্‌বকাশার নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। আঠারো বারের গুলিবাঁটে উঠল হনানির নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। ঊনিশ বারের গুলিবাঁটে উঠল মল্লোথির নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। কুড়ি বারের গুলিবাঁটে উঠল ইলীয়াথার নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। একুশ বারের গুলিবাঁটে উঠল হোথীর নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। বাইশ বারের গুলিবাঁটে উঠল গিদ্দল্‌তির নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। তেইশ বারের গুলিবাঁটে উঠল মহসীয়োতের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। চব্বিশ বারের গুলিবাঁটে উঠল রোমাম্‌তী-এষরের নাম; তিনি, তাঁর ছেলেরা ও আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন বারোজন। রক্ষীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করা হয়েছিল। কারুনীয়দের মধ্য থেকে আসফের বংশের কোরির ছেলে মশেলিমিয়া ছিলেন বংশ-পিতা। মশেলিমিয়ার ছেলেরা হল, প্রথম জাকারিয়া, দ্বিতীয় যিদীয়েল, তৃতীয় সবদিয়, চতুর্থ যৎনীয়েল, পঞ্চম ইলাম, ষষ্ঠ যিহোহানন, সপ্তম ইলিহৈনয়। ওবেদ-ইদোমের ছেলে শময়িয়েরও কয়েকজন ছেলে ছিল; তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের বংশের নেতা ছিলেন, কারণ তাঁরা ছিলেন বীর যোদ্ধা। শময়িয়ের ছেলেরা হল অৎনি, রফায়েল, ওবেদ, ইল্‌সাবদ। শময়িয়ের বংশের ইলীহূ আর সমথিয়ও ছিলেন শক্তিশালী লোক। এঁরা সবাই ছিলেন ওবেদ-ইদোমের বংশের লোক। তাঁরা, তাঁদের ছেলেরা ও বংশের লোকেরা ছিলেন উপযুক্ত ও শক্তিশালী। ওবেদ-ইদোমের বংশের লোকেরা ছিলেন মোট বাষট্টিজন। মশেলিমিয়ার ছেলেরা ও তাঁর বংশের লোকেরা ছিলেন শক্তিশালী লোক। তাঁরা ছিলেন মোট আঠারোজন। ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করা এই সব রক্ষীরা তাঁদের নেতাদের অধীনে থেকে তাঁদের গোষ্ঠী-ভাইদের মতই মাবুদের ঘরে এবাদত-কাজের ভার পেয়েছিলেন। বংশ অনুসারে ছেলে-বুড়ো সকলের জন্যই গুলিবাঁট করা হয়েছিল যাতে ঠিক করা যায় কোন্‌ দল কোন্‌ দরজায় পাহারা দেবে। পূর্ব দিকের দরজার জন্য গুলিবাঁটে উঠল শেলিমিয়ার নামে। তারপর তাঁর ছেলে জাকারিয়ার জন্য গুলিবাঁট করা হলে তাঁর নামে উত্তর দিকের দরজার জন্য গুলিবাঁটে উঠল। তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী পরামর্শদাতা। দক্ষিণ দিকের দরজার জন্য গুলিবাঁটে উঠল ওবেদ-ইদোমের নামে। ভাণ্ডার-ঘরের জন্য গুলিবাঁটে উঠল তাঁর ছেলেদের নামে। পশ্চিমের উঠানের জন্য রাস্তার দিকে চারজন এবং উঠানে দু’জন থাকতেন। এই ছিল কারুন আর মরারির বংশের রক্ষীদের দলভাগ। আল্লাহ্‌র ঘরের ধনভাণ্ডার এবং পবিত্র জিনিসের ভাণ্ডারের দেখাশোনার ভার ছিল বাকী লেবীয়দের মধ্য থেকে অহিয়ের উপর। ইমরানীয়, যিষ্‌হরীয়, হেবরনীয় ও উষীয়েলীয়দেরও কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল। শবূয়েল নামে মূসার ছেলে গের্শোমের একজন বংশধর প্রধান ধনরক্ষক ছিলেন। গের্শোমের ভাই ইলীয়ষেরের মধ্য দিয়ে শলোমোৎ ছিলেন শবূয়েলের বংশের লোক। ইলীয়ষেরের ছেলে রহবিয়, রহবিয়ের ছেলে যিশায়াহ, যিশায়াহের ছেলে যোরাম, যোরামের ছেলে সিখ্রি, সিখ্রির ছেলে শলোমোৎ। বাদশাহ্‌ দাউদ, ইসরাইলের বিভিন্ন বংশের নেতারা, হাজার ও শত সৈন্যের সেনাপতিরা এবং প্রধান সেনাপতিরা যে সব জিনিস পবিত্র করে রেখেছিলেন শলোমোৎ ও তাঁর বংশের লোকেরা সেই সব জিনিসের ভাণ্ডারের দেখাশোনাকারী ছিলেন। যুদ্ধে লুট করা কতগুলো জিনিস তাঁরা মাবুদের ঘর মেরামতের জন্য পবিত্র করে রেখেছিলেন। এছাড়া নবী শামুয়েল, কীশের ছেলে তালুত, নেরের ছেলে অবনের ও সরূয়ার ছেলে যোয়াব যে সব জিনিস পবিত্র করে রেখেছিলেন, মোট কথা, সমস্ত পবিত্র জিনিসের দেখাশোনার ভার ছিল শলোমোৎ ও তাঁর বংশের লোকদের উপর। যিষ্‌হরীয়দের মধ্য থেকে কননিয় ও তাঁর ছেলেরা বায়তুল-মোকাদ্দসের কাজে নয়, কিন্তু ইসরাইল দেশের উপরে কর্মকর্তা ও বিচারকের কাজে নিযুক্ত হলেন। হেবরনীয়দের মধ্য থেকে হশবিয় ও তাঁর বংশের এক হাজার সাতশো শক্তিশালী লোক মাবুদের ও বাদশাহ্‌র সমস্ত কাজ করবার জন্য জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের বনি-ইসরাইলদের উপরে নিযুক্ত হলেন। হেবরনীয়দের মধ্যে যিরিয় ছিলেন নেতা। দাউদের রাজত্বের চল্লিশ বছরের সময় তাদের বংশ-তালিকাগুলোর মধ্যে তালাশ করা হল এবং গিলিয়দের যাসেরে হেবরনীয়দের মধ্যে অনেক বীর যোদ্ধা পাওয়া গেল। যিরিয়ের বংশের দু’হাজার সাতশো জন লোক ছিলেন শক্তিশালী। তাঁরা ছিলেন নিজের নিজের পরিবারের কর্তা। বাদশাহ্‌ দাউদ আল্লাহ্‌র ও বাদশাহ্‌র সমস্ত কাজ করবার জন্য রূবেণীয়, গাদীয় ও মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের উপরে এই হেবরনীয়দের নিযুক্ত করলেন। এই হল বনি-ইসরাইলদের নেতা, হাজার ও শত সৈন্যের সেনাপতি ও তাঁদের অধীন কর্মচারীদের তালিকা। এঁরা বিভিন্ন সৈন্যদলের সমস্ত বিষয়ে বাদশাহ্‌কে সাহায্য করতেন। বারোটি দলের প্রত্যেকটিতে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। সারা বছর ধরে এক একটি দল এক এক মাস করে কাজ করত। প্রথম মাসের জন্য প্রথম সৈন্যদলের ভার ছিল সব্দীয়েলের ছেলে যাশবিয়ামের উপর। তিনি ছিলেন পেরসের বংশধর। তিনি প্রথম মাসের জন্য সমস্ত সেনাপতিদের নেতা ছিলেন। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। দ্বিতীয় মাসের জন্য সৈন্যদলের ভার ছিল অহোহীয় দোদাইয়ের উপর। তাঁর অধীনে দলনেতা ছিলেন মিক্লোৎ। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। তৃতীয় মাসের জন্য সেনাপতি ছিলেন ইমাম যিহোয়াদার ছেলে বনায়। তিনি ছিলেন তৃতীয় দলের নেতা। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। ইনি সেই বনায় যিনি “ত্রিশ” নামে বীর যোদ্ধাদের দলের একজন ছিলেন এবং সেই দলের নেতা ছিলেন। তাঁর ছেলে অম্মীষাবাদ তাঁর দলে ছিলেন। চতুর্থ মাসের জন্য চতুর্থ দলের সেনাপতি ছিলেন যোয়াবের ভাই অসাহেল। তাঁর মৃত্যুর পরে সেনাপতি হয়েছিলেন তাঁর ছেলে সবদিয়। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। পঞ্চম মাসের জন্য পঞ্চম দলের সেনাপতি ছিলেন যিষ্রাহীয় শমহূৎ। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। ষষ্ঠ মাসের জন্য ষষ্ঠ দলের সেনাপতি ছিলেন তকোয়ীয় ইক্কেশের ছেলে ঈরা। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। সপ্তম মাসের জন্য সপ্তম দলের সেনাপতি ছিলেন পলোনীয় হেলস; তিনি ছিলেন আফরাহীম-গোষ্ঠীর একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। অষ্টম মাসের জন্য অষ্টম দলের সেনাপতি ছিলেন হূশাতীয় সিব্বখয়; তিনি ছিলেন সেরহের বংশের একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। নবম মাসের জন্য নবম দলের সেনাপতি ছিলেন অনাথোতীয় অবীয়েষর; তিনি ছিলেন বিন্যামীন-গোষ্ঠীর একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। দশম মাসের জন্য দশম দলের সেনাপতি ছিলেন নটোফাতীয় মহরয়। তিনি ছিলেন সেরহের বংশের একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। একাদশ মাসের জন্য একাদশ দলের সেনাপতি ছিলেন পিরিয়াথোনীয় বনায়। তিনি ছিলেন আফরাহীম-গোষ্ঠীর একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। দ্বাদশ মাসের জন্য দ্বাদশ দলের সেনাপতি ছিলেন নটোফাতীয় হিল্‌দয়। তিনি ছিলেন অৎনীয়েলের বংশের একজন লোক। তাঁর দলে চব্বিশ হাজার সৈন্য ছিল। ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর প্রধান নেতাদের তালিকা এই: রূবেণীয়দের নেতা সিখ্রির ছেলে ইলীয়েষর, শিমিয়োনীয়দের নেতা মাখার ছেলে শফটিয়, লেবি-গোষ্ঠীর নেতা কমূয়েলের ছেলে হশবিয়, হারুনের বংশের নেতা সাদোক, এহুদা-গোষ্ঠীর নেতা দাউদের ভাই ইলীহূ, ইষাখর-গোষ্ঠীর নেতা মিকাইলের ছেলে অম্রি, সবূলূন-গোষ্ঠীর নেতা ওবদিয়ের ছেলে যিশ্মায়য়, নপ্তালি-গোষ্ঠীর নেতা অস্রীয়েলের ছেলে যিরেমোৎ, আফরাহীমের বংশের নেতা অসসিয়ের ছেলে হোশেয়, মানশা-গোষ্ঠীর অর্ধেক লোকদের নেতা পদায়ের ছেলে যোয়েল, গিলিয়দে বাসকারী মানশা-গোষ্ঠীর বাকী অর্ধেক লোকদের নেতা জাকারিয়ার ছেলে যিদ্দো, বিন্যামীন-গোষ্ঠীর নেতা অবনেরের ছেলে যাসীয়েল, দান-গোষ্ঠীর নেতা যিরোহমের ছেলে অসরেল। এঁরাই ছিলেন ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর প্রধান নেতা। দাউদ বিশ কিংবা তার চেয়ে কম বয়সী লোকদের সংখ্যা গণনা করলেন না, কারণ মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সংখ্যা আসমানের তারার মত অসংখ্য করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। সরূয়ার ছেলে যোয়াব লোকগণনা করতে শুরুকরেছিলেন, কিন্তু তা শেষ করেন নি। লোকগণনার জন্য ইসরাইলের উপর মাবুদের গজব নেমে এসেছিল। সেইজন্য বাদশাহ্‌ দাউদের ইতিহাস বইয়ে লোকদের কোন সংখ্যা লেখা হয় নি। বাদশাহ্‌র ভাণ্ডারের দেখাশোনার ভার ছিল অদীয়েলের ছেলে অস্‌মাবতের উপর। ক্ষেত-খামারে, শহরে, গ্রামে ও পাহারা দেওয়ার উঁচু ঘরগুলোতে যে সব গুদাম ছিল তার দেখাশোনা করবার ভার ছিল উষিয়ের ছেলে যোনাথনের উপর। চাষীদের দেখাশোনার ভার ছিল কলূবের ছেলে ইষ্রির উপর। আংগুর ক্ষেতের ভার ছিল রামাথীয় শিমিয়ির উপর। আংগুর ক্ষেত থেকে যে আংগুর-রস পাওয়া যেত তার ভাণ্ডারের ভার ছিল শিফমীয় সব্দির উপর। পশ্চিম দিকের নীচু পাহাড়ী এলাকার জলপাই ও ডুমুর গাছের ভার ছিল গদেরীয় বাল-হাননের উপর। জলপাইয়ের তেলের ভাণ্ডারের ভার ছিল যোয়াশের উপর। শারোণে যে সব গরুর পাল চরত তাদের ভার ছিল শারোণীয় সিট্রয়ের উপর। উপত্যকার গরুর পালের ভার ছিল অদ্‌লয়ের ছেলে শাফটের উপর। ইসমাইলীয় ওবীলের উপর ভার ছিল উটের পালের। মেরোণোথীয় যেহদিয়ের উপর ছিল গাধার পালের ভার। ছাগল ও ভেড়ার পালের ভার ছিল হাগরীয় যাসীষের উপর। বাদশাহ্‌ দাউদের সম্পত্তির দেখাশোনার ভার ছিল এই সব তদারককারীদের উপর। দাউদের চাচা যোনাথন ছিলেন পরামর্শদাতা, বুদ্ধিমান লোক ও বাদশাহ্‌র লেখক। বাদশাহ্‌র ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থার ভার ছিল হক্‌মোনির ছেলে যিহীয়েলের উপর। অহীথোফল ছিলেন বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা, অর্কীয় হূশয় ছিলেন বাদশাহ্‌র বন্ধু। অহীথোফলের মৃত্যুর পরে অবীয়াথর ও বনায়ের ছেলে যিহোয়াদা বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা হয়েছিলেন। বাদশাহ্‌র সৈন্যদলের সেনাপতি ছিলেন যোয়াব। দাউদ ইসরাইলের সমস্ত কর্মকর্তাদের জেরুজালেমে এসে একত্র হবার জন্য হুকুম দিলেন। এতে সমস্ত বীর যোদ্ধারা এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা, বাদশাহ্‌র বারোটি সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতিরা, হাজার ও শত সৈন্যের সেনাপতিরা, বাদশাহ্‌ ও বাদশাহ্‌র ছেলেদের সমস্ত সম্পত্তির তদারককারীরা, রাজবাড়ীর কর্মকর্তারা ও বীর যোদ্ধারা। পরে বাদশাহ্‌ দাউদ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের বললেন, “আমার ভাইয়েরা ও আমার লোকেরা, আমার কথায় মনোযোগ দিন। মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকের জন্য, অর্থাৎ আমাদের আল্লাহ্‌র পা রাখবার জায়গার জন্য একটা স্থায়ী ঘর তৈরী করবার ইচ্ছা আমার মনে ছিল, আর আমি তা তৈরী করবার আয়োজনও করেছিলোম। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে বললেন, ‘আমার জন্য তুমি ঘর তৈরী করবে না, কারণ তুমি একজন যোদ্ধা এবং তুমি রক্তপাত করেছ।’ “তবুও ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ চিরকাল ইসরাইলের উপর বাদশাহ্‌ হওয়ার জন্য আমার গোটা পরিবারের মধ্য থেকে আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি নেতা হিসাবে এহুদাকে বেছে নিয়েছিলেন, তারপর এহুদা-গোষ্ঠী থেকে আমার পিতার বংশকে বেছে নিয়েছিলেন এবং ইসরাইলের উপরে বাদশাহ্‌ হওয়ার জন্য তিনি খুশী হয়ে আমার ভাইদের মধ্য থেকে আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন। মাবুদ আমাকে অনেক ছেলে দিয়েছেন, আর সেই সব ছেলেদের মধ্যে মাবুদের রাজ্য ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য তিনি আমার ছেলে সোলায়মানকে বেছে নিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তোমার ছেলে সোলায়মানই সেই লোক, যে আমার ঘর ও উঠান তৈরী করবে, কারণ আমি তাকেই আমার পুত্র হবার জন্য বেছে নিয়েছি আর আমি তার পিতা হব। যেমন এখন করা হচ্ছে সেইভাবে যদি সে আমার হুকুম ও নির্দেশ পালন করবার ব্যাপারে স্থির থাকে তবে আমি তার রাজ্য চিরকাল স্থায়ী করব।’ “কাজেই সমস্ত বনি-ইসরাইলদের, অর্থাৎ মাবুদের সমাজের লোকদের এবং আমাদের আল্লাহ্‌র সামনে আমি আপনাদের এখন এই হুকুম দিচ্ছি যে, আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র সমস্ত হুকুম পালন করতে মনোযোগী হন যাতে আপনারা এই চমৎকার দেশে থাকতে পারেন এবং চিরকালের সম্পত্তি হিসাবে আপনাদের বংশধরদের হাতে তা দিয়ে যেতে পারেন। “আর তুমি, আমার ছেলে সোলায়মান, তুমি তোমার পিতার আল্লাহ্‌কে সামনে রেখে চলবে এবং তোমার দিল স্থির রেখে ও মনের ইচ্ছা দিয়ে তাঁর এবাদত করবে, কারণ মাবুদ প্রত্যেকটি দিল তালাশ করে দেখেন এবং চিন্তার প্রত্যেকটি উদ্দেশ্য বোঝেন। তাঁর ইচ্ছা জানতে চাইলে তুমি তা জানতে পারবে, কিন্তু যদি তুমি তাঁকে ত্যাগ কর তবে তিনিও তোমাকে চিরকালের জন্য অগ্রাহ্য করবেন। এখন মনোযোগী হও, কারণ এবাদত করবার জন্য একটা ঘর তৈরী করতে মাবুদ তোমাকেই বেছে নিয়েছেন। তুমি শক্তিশালী হও এবং কাজ কর।” তারপর দাউদ তাঁর ছেলে সোলায়মানকে বায়তুল-মোকাদ্দসের বারান্দা, তাঁর দালানগুলো, ভাণ্ডার-ঘরগুলো, উপরের ও ভিতরের কামরাগুলো এবং গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জায়গার নক্‌শা দিলেন। মাবুদের ঘরের উঠান, তার চারপাশের কামরা, আল্লাহ্‌র ঘরের ধনভাণ্ডার এবং কোরবানীর জিনিস রাখবার ভাণ্ডারের যে নমুনা পাক-রূহ্‌ দাউদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন তা সবই তিনি সোলায়মানকে জানালেন। ইমাম ও লেবীয়দের বিভিন্ন দলের কাজ, মাবুদের ঘরের সমস্ত এবাদত-কাজ এবং সেই কাজে ব্যবহারের সমস্ত জিনিসপত্র সম্বন্ধে তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন। বিভিন্ন এবাদত-কাজের জন্য যে সব সোনা ও রূপার জিনিস ব্যবহার করা হবে তিনি তার জন্য কতটা সোনা ও রূপা লাগবে তার নির্দেশ দিলেন। প্রত্যেকটি সোনার বাতিদান ও বাতির জন্য কতটা সোনা এবং ব্যবহার অনুসারে প্রত্যেকটা রূপার বাতিদান ও বাতির জন্য কতটা রূপা লাগবে তার নির্দেশ দিলেন। পবিত্র-রুটি রাখবার সোনার টেবিলের জন্য কতটা সোনা এবং রূপার টেবিলগুলোর জন্য কতটা রূপা লাগবে তার নির্দেশ দিলেন। দাউদ বললেন, “মাবুদ যে নমুনা আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর পরিচালনায় আমি তা এঁকেছিলাম, আর সেই নমুনার খুঁটিনাটি বুঝবার জ্ঞান তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।” দাউদ তাঁর ছেলে সোলায়মানকে এই কথাও বললেন, “তুমি শক্তিশালী হও, মনে সাহস আন এবং কাজ কর। তুমি ভয় কোরো না, নিরাশ হোয়ো না, কারণ মাবুদ আল্লাহ্‌, আমার আল্লাহ্‌ তোমার সংগে আছেন। মাবুদের এবাদত-কাজের জন্য বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরীর সব কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তোমাকে ছেড়ে যাবেন না বা ত্যাগ করবেন না। আল্লাহ্‌র ঘরের সমস্ত এবাদত-কাজের জন্য বিভিন্ন দলের ইমাম ও লেবীয়রা প্রস্তুত আছে। সমস্ত কাজে তোমাকে সাহায্য করবার জন্য দক্ষ ও ইচ্ছুক লোকেরাও আছে। নেতারা ও সমস্ত লোকেরা তোমার হুকুম মানবে।” বাদশাহ্‌ দাউদ তারপর সমস্ত লোকদের বললেন, “আমার ছেলে সোলায়মানকেই আল্লাহ্‌ বেছে নিয়েছেন; তার বয়সও বেশী নয় এবং অভিজ্ঞতাও কম। এই কাজ খুব মহৎ, কারণ এই বড় দালানটি মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য, কোন মানুষের জন্য নয়। আমার ক্ষমতা অনুসারে আমি আমার আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য এই সব যোগাড় করে রেখেছি- সোনার জিনিসের জন্য সোনা, রূপার জিনিসের জন্য রূপা, ব্রোঞ্জের জিনিসের জন্য ব্রোঞ্জ, লোহার জিনিসের জন্য লোহা এবং কাঠের জিনিসের জন্য কাঠ। এছাড়া বৈদুর্যমণি, বসাবার জন্য বিভিন্ন মণি, চক্‌চকে পাথর, নানা রংয়ের পাথর ও সমস্ত রকমের দামী পাথর রেখেছি আর অনেক মার্বেল পাথরও রেখেছি। পবিত্র বায়তুল-মোকাদ্দসের জন্য আমি যা যা যোগাড় করেছি তা ছাড়াও আমার আল্লাহ্‌র ঘরের প্রতি আমার ভালবাসার জন্য এখন আমি আমার নিজের সোনা ও রূপা দিচ্ছি। তখন বংশের নেতারা, বনি-ইসরাইলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা, হাজার সৈন্যের ও শত সৈন্যের সেনাপতিরা ও বাদশাহ্‌র কাজের তদারককারীরা খুশী হয়ে দান করলেন। আল্লাহ্‌র ঘরের কাজের জন্য তাঁরা একশো পঁচানব্বই টন সোনা, দশ হাজার সোনার অদর্কোন, তিনশো নব্বই টন রূপা, সাতশো দুই টন ব্রোঞ্জ ও তিন হাজার ন’শো টন লোহা দিলেন। যাঁদের কাছে দামী পাথর ছিল তাঁরা সেগুলো মাবুদের ঘরের ভাণ্ডারে রাখবার জন্য গের্শোনীয় যিহীয়েলের হাতে দিলেন। তাঁরা খুশী মনে এবং খোলা হাতে সমস্ত দিল দিয়ে মাবুদকে দিতে পেরে আনন্দিত হলেন। বাদশাহ্‌ দাউদও খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। দাউদ সমস্ত লোকের সামনে এই বলে মাবুদের প্রশংসা করলেন, “হে মাবুদ, আমাদের পূর্বপুরুষ ইসরাইলের আল্লাহ্‌, অনাদিকাল থেকে আখেরাত পর্যন্ত তোমার প্রশংসা হোক। হে মাবুদ, মহিমা, শক্তি, জাঁকজমক, জয় আর প্রশংসা তোমার, কারণ বেহেশতের ও দুনিয়ার সব কিছু তোমারই। হে মাবুদ, তুমিই সব কিছুর উপরে রাজত্ব করছ; তোমার স্থান সকলের উপরে। ধন ও সম্মান আসে তোমারই কাছ থেকে; তুমিই সব কিছু শাসন করে থাক। তোমার হাতেই রয়েছে শক্তি আর ক্ষমতা; মানুষকে উন্নত করবার ও শক্তি দেবার অধিকার তোমারই। এখন, হে আমাদের আল্লাহ্‌, আমরা তোমাকে শুকরিয়া জানাই, তোমার গৌরবময় নামের প্রশংসা করি। “কিন্তু হে মাবুদ, আমি কে আর আমার লোকেরাই বা কারা যে, আমরা এইভাবে খুশী হয়ে দান করতে পারি? সব কিছুই তো তোমার কাছ থেকে আসে। তোমার হাত থেকে যা পেয়েছি আমরা কেবল তোমাকে তা-ই দিয়েছি। আমরা তোমার চোখে আমাদের সমস্ত পূর্বপুরুষদের মতই পরদেশী বাসিন্দা। দুনিয়াতে আমাদের দিনগুলো ছায়ার মত, আমাদের কোন আশা নেই। হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার পবিত্র নামের উদ্দেশে একটা ঘর তৈরীর জন্য এই যে প্রচুর জিনিসের আয়োজন আমরা করেছি তা তোমার কাছ থেকেই এসেছে এবং এর সব কিছুই তোমার। হে আমার আল্লাহ্‌, আমি জানি যে, তুমি দিলের পরীক্ষা করে থাক এবং সততায় খুশী হও। এই সব জিনিস আমি খুশী হয়ে এবং দিলের সততায় দিয়েছি। আর এখন আমি দেখে আনন্দিত হলাম যে, তোমার বান্দারা যারা এখানে আছে তারাও কেমন খুশী হয়ে তোমাকে দিয়েছে। হে মাবুদ, আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইসরাইলের আল্লাহ্‌, তোমার বান্দাদের অন্তরে এই রকম ইচ্ছা তুমি চিরকাল রাখ এবং তোমার প্রতি তাদের অন্তর বিশ্বস্ত রাখ। আমার ছেলে সোলায়মানকে এমন স্থির দিল দান কর যাতে সে তোমার হুকুম, তোমার কালাম ও তোমার নিয়ম পালন করতে পারে এবং আমি যে দালান তৈরীর আয়োজন করেছি তা তৈরী করতে পারে।” পরে দাউদ সমস্ত লোকদের বললেন, “আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুন।” তখন তারা সবাই তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করল এবং মাবুদ ও বাদশাহ্‌র উদ্দেশে উবুড় হয়ে সম্মান জানাল। পরের দিন তারা মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী এবং পোড়ানো-কোরবানী দিল। সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জন্য তারা এক হাজার ষাঁড়, এক হাজার ভেড়া ও এক হাজার ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী দিল এবং প্রত্যেকটির সংগে নিয়মিত ঢালন-কোরবানী এবং প্রচুর পশু দিয়ে অন্যান্য কোরবানী দিল। সেই দিন তারা মাবুদের সামনে খুব আনন্দের সংগে খাওয়া-দাওয়া করল। তারা দাউদের ছেলে সোলায়মানকে এই দ্বিতীয় বার বাদশাহ্‌ বলে স্বীকার করল এবং তাঁকে বাদশাহ্‌ ও সাদোককে ইমাম হিসাবে মাবুদের উদ্দেশে অভিষেক করল। তখন সোলায়মান তাঁর পিতা দাউদের জায়গায় বাদশাহ্‌ হিসাবে মাবুদের সিংহাসনে বসলেন। তিনি সব বিষয়ে সফলতা লাভ করলেন এবং সমস্ত ইসরাইল তাঁর কথামত চলত। সমস্ত নেতারা ও সৈন্যেরা এবং বাদশাহ্‌ দাউদের অন্য সব ছেলেরা বাদশাহ্‌ সোলায়মানের অধীনতা স্বীকার করলেন। মাবুদ সমস্ত ইসরাইলের চোখে সোলায়মানকে খুব মহান করলেন এবং তাঁকে এমন রাজকীয় গৌরব দান করলেন যা এর আগে ইসরাইলের কোন বাদশাহ্‌ই পান নি। তিনি অনেক বছর বেঁচে থেকে ধন ও সম্মান লাভ করে খুব বুড়ো বয়সে ইন্তেকাল করলেন। তাঁর ছেলে সোলায়মান তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। নবী শামুয়েল, নবী নাথন ও নবী গাদের ইতিহাস বইয়ে বাদশাহ্‌ দাউদের রাজত্বের সমস্ত কথা শুরুথেকে শেষ পর্যন্ত লেখা রয়েছে। তাঁর রাজত্বের খুঁটিনাটি ও ক্ষমতার কথা এবং তাঁকে নিয়ে, ইসরাইলকে নিয়ে আর অন্যান্য দেশের সব রাজ্যগুলোকে নিয়ে যে সব ঘটনা ঘটেছিল সেই সব কথাও সেখানে লেখা রয়েছে। দাউদের ছেলে সোলায়মান তাঁর রাজ্যটি বেশ শক্তভাবে নিজের অধীনে রাখলেন, কারণ তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর সংগে ছিলেন এবং তাঁকে খুব মহান করেছিলেন। সোলায়মান সমস্ত বনি-ইসরাইলদের, অর্থাৎ হাজার সৈন্যের ও শত সৈন্যের সেনাপতিদের, বিচারকদের এবং ইসরাইলের সমস্ত বংশের নেতাদের একত্র হবার জন্য হুকুম দিলেন। তারপর তিনি ও সমস্ত লোকেরা গিবিয়োনের এবাদতের উঁচু স্থানে গেলেন, কারণ সেখানেই আল্লাহ্‌র মিলন-তাম্বু ছিল যেটি মাবুদের গোলাম মূসা মরুভূমিতে থাকতে তৈরী করেছিলেন। অবশ্য আল্লাহ্‌র সিন্দুকটি জেরুজালেমে ছিল, কারণ দাউদ কিরিয়ৎ-যিয়ারীম থেকে সেটি নিয়ে এসে এর জন্য জেরুজালেমে যে তাম্বু খাটিয়েছিলেন সেখানে রেখেছিলেন। কিন্তু হূরের নাতি ঊরির ছেলে বৎসলেল ব্রোঞ্জের যে কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছিলেন সেটি গিবিয়োনে মাবুদের আবাস-তাম্বুর সামনে ছিল। সেইজন্য সোলায়মান ও সব লোকেরা সেখানে গেলেন। তখন সোলায়মান সেই ব্রোঞ্জের কোরবানগাহের কাছে গিয়ে মাবুদের সামনে তার উপরে এক হাজার পশু দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। সেই রাতে আল্লাহ্‌ সোলায়মানের কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বললেন, “তুমি আমার কাছে যা চাইবে আমি তা-ই তোমাকে দেব।” জবাবে সোলায়মান আল্লাহ্‌কে বললেন, “তুমি আমার পিতা দাউদের প্রতি অটল মহব্বত দেখিয়েছ এবং তাঁর জায়গায় আমাকে বাদশাহ্‌ করেছ। হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, আমার পিতা দাউদের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছ এখন তা পূর্ণ কর, কারণ তুমি এমন এক জাতির উপরে আমাকে বাদশাহ্‌ করেছ যারা দুনিয়ার ধুলার মত অসংখ্য। আমাকে জ্ঞান ও বুদ্ধি দাও যাতে আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পারি, কারণ কার সাধ্য আছে তোমার এই মহাজাতিকে শাসন করে?” তখন আল্লাহ্‌ সোলায়মানকে বললেন, “তোমার মনের ইচ্ছা ভাল। তুমি ধন, সম্পদ, সম্মান কিংবা শত্রুদের মৃত্যু চাও নি, এমন কি, অনেক আয়ুও চাও নি। তার চেয়ে বরং আমার যে বান্দাদের উপরে আমি তোমাকে বাদশাহ্‌ করেছি তাদের শাসন করবার জন্য তুমি জ্ঞান ও বুদ্ধি চেয়েছ। সেইজন্য তোমাকে জ্ঞান ও বুদ্ধি দেওয়া হল। এছাড়া আমি তোমাকে এমন ধন, সম্পদ ও সম্মান দেব যা তোমার আগে কোন বাদশাহ্‌র ছিল না এবং তোমার পরেও থাকবে না।” এর পর সোলায়মান গিবিয়োনের এবাদতের উঁচু স্থান, যেখানে মিলন-তাম্বু ছিল, সেখান থেকে জেরুজালেমে চলে গেলেন আর ইসরাইলের উপরে রাজত্ব করতে লাগলেন। সোলায়মান অনেক রথ ও ঘোড়া যোগাড় করলেন। তাতে তাঁর এক হাজার চারশো রথ ও বারো হাজার ঘোড়া হল। এই সব তিনি রথ রাখবার শহরগুলোতে এবং জেরুজালেমে নিজের কাছে রাখলেন। বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে সোনা ও রূপাকে করলেন পাথরের মত প্রচুর এবং এরস কাঠকে করলেন নীচু পাহাড়ী এলাকায় গজানো ডুমুর গাছের মত অনেক। সোলায়মানের ঘোড়াগুলো মিসর ও কিলিকিয়া থেকে আনা হত। বাদশাহ্‌র বণিকেরা কিলিকিয়া থেকে সেগুলো কিনে আনত। মিসর থেকে আনা প্রত্যেকটা রথের দাম পড়ত সাত কেজি আটশো গ্রাম রূপা এবং প্রত্যেকটা ঘোড়ার দাম পড়ত প্রায় দুই কেজি রূপা। সেই বণিকেরা হিট্টীয় ও সিরীয় সব বাদশাহ্‌দের কাছে সেগুলো বিক্রি করত। সোলায়মান মাবুদের উদ্দেশে একটা এবাদত-খানা এবং নিজের জন্য একটা রাজবাড়ী তৈরী করবার হুকুম দিলেন। তিনি সত্তর হাজার লোককে বোঝা বইবার জন্য, আশি হাজার লোককে পাহাড়ে পাথর কাটবার জন্য এবং তিন হাজার ছ’শো লোককে তাদের তদারক করবার জন্য কাজে লাগালেন। সোলায়মান টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরমকে এই খবর পাঠালেন, “আমার পিতা দাউদের থাকবার জন্য একটা রাজবাড়ী তৈরী করতে আপনি যেমন তাঁকে এরস কাঠ পাঠিয়েছিলেন তেমনি আমার জন্যও এরস কাঠ পাঠিয়ে দিন। এখন আমি আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য একটা ঘর তৈরী করতে ও তাঁর নামে সেটি পবিত্র করতে প্রস্তুত হয়েছি, যাতে তাঁর সামনে খোশবু-ধূপ জ্বালানো যায়, নিয়মিত ভাবে পবিত্র-রুটি সাজিয়ে রাখা যায় এবং প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায়, বিশ্রামবারে, অমাবস্যায় ও আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র স্থির-করা বিভিন্ন ঈদের সময়ে পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া যায়। এই সব পালন করা বনি-ইসরাইলদের জন্য একটা চিরকালের নিয়ম। “যে ঘরটি আমি তৈরী করতে যাচ্ছি সেটি হবে মহৎ, কারণ আমাদের আল্লাহ্‌ সমস্ত দেবতার চেয়ে মহান। কিন্তু তাঁর জন্য ঘর তৈরী করতে কে পারে? কারণ আসমানে, এমন কি বেহেশতেও তাঁর স্থান অকুলান হয়। কেবল তাঁর সামনে বিভিন্ন কোরবানীর জিনিসগুলো পোড়াবার স্থান ছাড়া আমি আর কি করে তাঁর জন্য একটা ঘর তৈরী করতে পারি? “আমার পিতা দাউদ দক্ষ কারিগরদের ঠিক করে রেখেছেন যারা এখন এহুদা ও জেরুজালেমে আমার কাছে আছে। তাদের সংগে কাজ করবার জন্য আপনি আমাকে এমন একজন দক্ষ কারিগর পাঠিয়ে দিন যে সোনা-রূপা, ব্রোঞ্জ ও লোহার কাজ, বেগুনী, লাল ও নীল রংয়ের সুতার কাজ এবং খোদাই কাজ করতে জানে। আমি আপনার লোকদের, অর্থাৎ যে কাঠুরেরা গাছ কাটবে তাদের তিন হাজার ছ’শো টন পেষা গম, তিন হাজার ছ’শো টন যব, চার লক্ষ চারশো লিটার আংগুর-রস এবং চার লক্ষ চারশো লিটার জলপাইয়ের তেল দেব।” টায়ারের বাদশাহ্‌ হীরম জবাবে সোলায়মানকে এই চিঠি লিখে পাঠালেন, “মাবুদ তাঁর বান্দাদের মহব্বত করেন বলেই আপনাকে তাদের বাদশাহ্‌ করেছেন।” হীরম আরও লিখলেন, “সমস্ত প্রশংসা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র, যিনি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাদশাহ্‌ দাউদকে এমন একজন জ্ঞানী ছেলে দিয়েছেন যাঁর বুদ্ধি এবং বুঝবার ক্ষমতা আছে এবং যিনি মাবুদের জন্য একটা ঘর ও নিজের জন্য একটা রাজবাড়ী তৈরী করবেন। “আমি আপনার কাছে হীরাম নামে একজন খুব দক্ষ ও বুদ্ধিমান কারিগরকে পাঠালাম। তার মা দান-গোষ্ঠীর মেয়ে এবং তার বাবা টায়ারের লোক। সে সোনা-রূপা, ব্রোঞ্জ, লোহা, পাথর ও কাঠ এবং বেগুনী, নীল ও লাল সুতা আর মসীনা সুতার কাজ করতে জানে। সব রকম খোদাই করবার কাজে সে পাকা এবং যে কোন নক্‌শা দিলে সে তা করতে পারে। সে আপনাদের কারিগরদের সংগে ও আমার মালিক, আপনার পিতা দাউদের কারিগরদের সংগে কাজ করবে। “কাজেই আমার মালিক আপনি যেমন বলেছেন সেই মত গম, যব, জলপাইয়ের তেল ও আংগুর-রস আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমরা লেবানন থেকে আপনার প্রয়োজন মত সমস্ত কাঠ কেটে একসংগে বেঁধে সমুদ্রে ভাসিয়ে জাফা পর্যন্ত নিয়ে যাব। তারপর আপনি সেগুলো জেরুজালেমে তুলে নিয়ে যাবেন।” সোলায়মান তাঁর পিতা দাউদের লোকগণনার মতই ইসরাইল দেশে বাসকারী সমস্ত বিদেশীদের সংখ্যা গণনা করালেন। তাতে তাদের সংখ্যা হল এক লক্ষ তিপ্পান্ন হাজার ছ’শো। তাদের মধ্য থেকে তিনি সত্তর হাজার লোককে বোঝা বইবার জন্য, আশি হাজার লোককে পাহাড়ে পাথর কাটবার জন্য এবং সেই লোকদের কাজের তদারক করবার জন্য তিন হাজার ছ’শো লোককে নিযুক্ত করলেন। সোলায়মান জেরুজালেমে মোরিয়া পাহাড়ে মাবুদের ঘর তৈরী করতে শুরু করলেন। এই মোরিয়া পাহাড়েই যিবূষীয় অরৌণার খামারে মাবুদ তাঁর পিতা দাউদকে দেখা দিয়েছিলেন। দাউদ এই জায়গাটা বায়তুল-মোকাদ্দসের জন্য ঠিক করে রেখে গিয়েছিলেন। সোলায়মানের রাজত্বের চতুর্থ বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় দিনে সোলায়মান কাজ শুরু করলেন। আল্লাহ্‌র ঘর তৈরীর জন্য তিনি পুরানো মাপ অনুসারে ষাট হাত লম্বা ও বিশ হাত চওড়া ভিত্তি দিলেন। ঘরের সামনের বারান্দা ঘরের চওড়ার মাপ অনুসারে বিশ হাত চওড়া ও তার ছাদ একশো বিশ হাত উঁচু করে দেওয়া হল এবং তার ভিতরটা খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হল। প্রধান বড় কামরাটা সোলায়মান প্রথমে বেরস কাঠের তক্তা দিয়ে ঢেকে দিলেন এবং তারপর তা খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন, আর সেটা খেজুর ও শিকলের নক্‌শা দিয়ে সাজানো হল। এছাড়া দামী দামী পাথর দিয়ে তিনি ঘরটা সাজালেন। যে সোনা তিনি ব্যবহার করলেন তা ছিল পর্বয়িম দেশের। দেয়ালগুলোতে তিনি কারুবীদের আকার খোদাই করালেন এবং ছাদের কড়িকাঠ, দরজার ফ্রেম, দেয়াল ও দরজা সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি মহাপবিত্র স্থানটি তৈরী করলেন। সেটি ঘরের চওড়া অনুসারে বিশ হাত চওড়া ও বিশ হাত লম্বা করা হল। তেইশ টন চারশো কেজি খাঁটি সোনা দিয়ে তিনি ভিতরটা মুড়িয়ে দিলেন। সোনার পেরেকগুলোর ওজন ছিল ছ’শো পঞ্চাশ গ্রাম। তিনি উপরের কামরাগুলোও সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। মহাপবিত্র স্থানে তিনি এক জোড়া কারুবী খোদাই করে তৈরী করালেন এবং সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। সোলায়মান নীল, বেগুনী ও লাল সুতা এবং মসীনা সুতা দিয়ে পর্দা তৈরী করালেন আর তার মধ্যে কারুবীর আকার সেলাই করালেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে তিনি দু’টা থাম তৈরী করালেন। সেগুলো ছিল পঁয়ত্রিশ হাত উঁচু। প্রত্যেকটার মাথার মাপ ছিল পাঁচ হাত। তিনি পাকানো শিকল তৈরী করে থাম দু’টার মাথার উপরে দিলেন, আর একশোটা ডালিম তৈরী করে সেই শিকলে জুড়ে দিলেন। সেই থাম দু’টা বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে দক্ষিণে একটা ও উত্তরে অন্যটা দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। যেটা দক্ষিণে ছিল তার নাম তিনি দিলেন যাখীন (যার মানে “তিনি স্থাপন করেন”) এবং যেটা উত্তরে ছিল তার নাম দিলেন বোয়স (যার মানে “তাঁর মধ্যেই শক্তি”)। সোলায়মান বিশ হাত লম্বা, বিশ হাত চওড়া ও দশ হাত উঁচু একটা ব্রোঞ্জের কোরবানগাহ্‌ তৈরী করালেন। তারপর তিনি ব্রোঞ্জ ছাঁচে ঢেলে পানি রাখবার জন্য একটা গোল বিরাট পাত্র তৈরী করালেন। পাত্রটার এক দিক থেকে সোজাসুজি অন্য দিকের মাপ ছিল দশ হাত, গভীরতা পাঁচ হাত এবং বেড়ের চারপাশের মাপ ত্রিশ হাত। পাত্রটার বাইরের দিকের কিনারার নীচে প্রতি হাত জায়গায় দশটা করে দুই সারি গরুর আকার ছিল। যে ছাঁচের মধ্যে পাত্রটা তৈরী করা হয়েছিল সেই ছাঁচের মধ্যেই গরুগুলোর আকার ছিল বলে সবটা মিলে একটা জিনিসই হল। পাত্রটা বারোটা ব্রোঞ্জের গরুর পিঠের উপর বসানো ছিল। সেগুলোর তিনটা উত্তরমুখী, তিনটা পশ্চিমমুখী, তিনটা দক্ষিণমুখী ও তিনটা পূর্বমুখী ছিল এবং তাদের পিছনগুলো ছিল ভিতরের দিকে। পাত্রটা ছিল চার আংগুল পুরু। তার মুখটা একটা পেয়ালার মুখের মত ছিল এবং লিলি ফুলের পাপড়ির মত বাইরের দিকে উল্টানো ছিল। তাতে ছেষট্টি হাজার লিটার পানি ধরত। তিনি দশটা গামলা তৈরী করালেন এবং পাঁচটা রাখলেন দক্ষিণ দিকে আর পাঁচটা রাখলেন উত্তর দিকে। সেগুলোর মধ্যে পোড়ানো-কোরবানীর জিনিস ধোয়া হত, কিন্তু ইমামেরা নিজেদের হাত-পা ধোয়ার কাজে ব্যবহার করতেন বিরাট পাত্রটা। যেমন বলা হয়েছিল সেই মতই তিনি দশটা সোনার বাতিদান তৈরী করিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে দক্ষিণে পাঁচটা আর উত্তরে পাঁচটা রাখলেন। এছাড়া তিনি দশটা টেবিল তৈরী করিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে দক্ষিণে পাঁচটা আর উত্তরে পাঁচটা রাখলেন। তিনি একশোটা সোনার পেয়ালাও তৈরী করালেন। তিনি ইমামদের জন্য একটা উঠান প্রস্তুত করালেন; তারপর আর একটা বড় উঠান প্রস্তুত করিয়ে তার জন্য দরজা তৈরী করালেন এবং দরজাগুলো ব্রোঞ্জ দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। তিনি বিরাট পাত্রটা উঠানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় রাখলেন। এছাড়া হীরাম সব পাত্র, হাতা ও পেয়ালা তৈরী করলেন। এইভাবে তিনি আল্লাহ্‌র ঘরের যে যে কাজ বাদশাহ্‌ সোলায়মানের জন্য হাতে নিয়েছিলেন তা শেষ করলেন। সেগুলো হল: দু’টা থাম; থামের উপরকার গোলাকার দু’টা মাথা; সেই মাথার উপরটা সাজাবার জন্য দুই সারি কারুকাজ করা পাকানো শিকল; সেই শিকলগুলোর জন্য চারশো ডালিম- থামের উপরকার মাথার গোলাকার অংশটা সাজাবার জন্য প্রত্যেক সারি শিকলের জন্য দুই সারি ডালিম; গামলা এবং সেগুলো বসাবার বাক্স; বিরাট পাত্র ও তার নীচের বারোটা গরু; পাত্র, হাতা ও গোশ্‌ত তুলবার কাঁটা। মাবুদের ঘরের জন্য হীরাম যে সব জিনিস বাদশাহ্‌ সোলায়মানের নির্দেশে তৈরী করেছিলেন সেগুলো ছিল চক্‌চকে ব্রোঞ্জের। বাদশাহ্‌ সেগুলো জর্ডানের সমভূমিতে সুক্কোৎ ও সর্তনের মাঝামাঝি এক জায়গায় মাটির ছাঁচে ফেলে তৈরী করিয়েছিলেন। এই সব জিনিস সোলায়মান এত বেশী পরিমাণে তৈরী করিয়েছিলেন যে, ব্রোঞ্জের পরিমাণ জানা যায় নি। আল্লাহ্‌র ঘরের যে সব জিনিসপত্র সোলায়মান তৈরী করিয়েছিলেন সেগুলো হল: সোনার ধূপগাহ্‌; পবিত্র-রুটি রাখবার টেবিলগুলো; যেমন বলা হয়েছিল সেইমত মহাপবিত্র স্থানের সামনে জ্বালাবার জন্য খাঁটি সোনার বাতিদান ও সেগুলোর বাতি; খাঁটি সোনার ফুল, বাতি ও চিম্‌টা; শল্‌তে পরিষ্কার করবার খাঁটি সোনার চিম্‌টা, খাঁটি সোনার পেয়ালা, হাতা ও আগুন রাখবার পাত্র; আর ভিতরের কামরার, অর্থাৎ মহাপবিত্র স্থানের দরজার জন্য এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কামরার দরজার জন্য সোনার কব্‌জা। এই দরজাগুলো সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে সোলায়মান মাবুদের ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করলেন। তারপর তিনি তাঁর পিতা দাউদ যে সব জিনিস পবিত্র করে রেখেছিলেন সেগুলো নিয়ে আসলেন। সেগুলো ছিল সোনা, রূপা ও বিভিন্ন পাত্র। সেগুলো তিনি আল্লাহ্‌র ঘরের ধনভাণ্ডারে রেখে দিলেন। এর পর সোলায়মান দাউদ-শহর, অর্থাৎ সিয়োন থেকে মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি নিয়ে আসবার জন্য ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতাদের, গোষ্ঠী-সর্দারদের ও বনি-ইসরাইলদের প্রধান লোকদের জেরুজালেমে ডেকে পাঠালেন। তাতে সপ্তম মাসে ঈদের সময়ে ইসরাইলের ঐ সমস্ত লোক বাদশাহ্‌র কাছে উপস্থিত হলেন। ইসরাইলের সব বৃদ্ধ নেতারা উপস্থিত হলে পর লেবীয়রা সিন্দুকটি তুলে নিল। তারা এবং ইমামেরা সিন্দুকটি, মিলন-তাম্বু এবং সমস্ত পবিত্র পাত্র বয়ে নিলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান ও তাঁর কাছে জমায়েত হওয়া সমস্ত বনি-ইসরাইল সিন্দুকটির সামনে সামনে থেকে এত ভেড়া ও গরু কোরবানী দিলেন যে, সেগুলোর সংখ্যা গোণা গেল না। তারপর ইমামেরা মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুকটি নির্দিষ্ট জায়গায়, বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিতরের কামরায়, অর্থাৎ মহাপবিত্র স্থানে কারুবীদের ডানার নীচে নিয়ে রাখলেন। তাতে কারুবীদের মেলে দেওয়া ডানায় সিন্দুক ও তা বহন করবার ডাণ্ডাগুলো ঢাকা পড়ল। সিন্দুকের এই ডাণ্ডাগুলো এত লম্বা ছিল যে, সেগুলোর মাথা ভিতরের কামরার সামনের প্রধান কামরা, অর্থাৎ পবিত্র স্থান থেকে দেখা যেত, কিন্তু পবিত্র স্থানের বাইরে থেকে দেখা যেত না। সেগুলো আজও সেখানে রয়েছে। বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পরে মাবুদ তুর পাহাড়ে তাদের জন্য যখন ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন তখন মূসা যে পাথরের ফলক দু’টি সিন্দুকের মধ্যে রেখেছিলেন সেই দু’টি ছাড়া আর কিছুই তার মধ্যে ছিল না। তারপর সব ইমামেরা পবিত্র স্থান থেকে বাইরে আসলেন। সেই ইমামেরা যে কোন দলেরই হন না কেন, সবাই নিজেদের পাক-সাফ করেছিলেন। যে সব লেবীয়রা গজল গাইতেন ও বাজনা করতেন, অর্থাৎ আসফ, হেমন, যিদূথূন এবং তাঁদের ছেলেরা ও তাঁদের বংশের লোকেরা মসীনার কাপড় পরে কোরবানগাহের পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে করতাল, বীণা ও সুরবাহার বাজাচ্ছিলেন। তাঁদের সংগে ছিলেন একশো বিশ জন ইমাম যাঁরা শিংগা বাজাচ্ছিলেন। ইমামেরা যখন বাইরে আসলেন তখন শিংগা বাদকেরা ও কাওয়ালেরা একসংগে এক সুরে মাবুদের প্রশংসা করলেন ও তাঁর শুকরিয়া আদায় করলেন। শিংগা, করতাল ও অন্যান্য বাজনার সংগে তাঁরা জোরে জোরে মাবুদের উদ্দেশে এই কাওয়ালী গাইলেন, “তিনি মেহেরবান, তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” সেই সময় মাবুদের ঘর মেঘে ভরে গেল। সেই মেঘের জন্য ইমামেরা তাঁদের এবাদত-কাজ করতে পারলেন না, কারণ মাবুদের মহিমায় আল্লাহ্‌র ঘরটা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই বলে বাদশাহ্‌ একত্র হওয়া সমস্ত বনি-ইসরাইলদের দিকে ঘুরে তাদের দোয়া করলেন। তখন লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর তিনি বললেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। তিনি আমার পিতা দাউদের কাছে নিজের মুখে যা ওয়াদা করেছিলেন তা নিজেই পূর্ণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বান্দাদের মিসর থেকে বের করে আনবার পর নিজেকে প্রকাশ করবার স্থান হিসাবে একটি ঘর তৈরী করবার জন্য আমি বনি-ইসরাইলদের কোন গোষ্ঠীর শহর বেছে নিই নি, কিংবা আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের উপরে নেতা হবার জন্য কোন লোককেও আমি বেছে নিই নি, কিন্তু এখন আমার বাসস্থান হিসাবে আমি জেরুজালেমকে বেছে নিয়েছি এবং আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের শাসন করবার জন্য দাউদকে বেছে নিয়েছি।’ “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য একটা ঘর তৈরী করবার ইচ্ছা আমার পিতা দাউদের দিলে ছিল। কিন্তু মাবুদ আমার পিতা দাউদকে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য একটা ঘর তৈরী করবার ইচ্ছা যে তোমার দিলে আছে তা ভাল। তবে ঘরটি তুমি তৈরী করবে না, করবে তোমার ছেলে, যে তোমার নিজের সন্তান। সে-ই আমার জন্য সেই ঘর তৈরী করবে।’ “মাবুদ তাঁর ওয়াদা রক্ষা করেছেন। আমার পিতা দাউদ যে পদে ছিলেন আমি সেই পদ পেয়েছি। মাবুদের ওয়াদা অনুসারে আমি ইসরাইলের সিংহাসনে বসেছি এবং ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র জন্য এই ঘরটি তৈরী করেছি। সেখানে আমি সাক্ষ্য-সিন্দুকটি রেখেছি যার মধ্যে রয়েছে বনি-ইসরাইলদের জন্য মাবুদের স্থাপন করা ব্যবস্থা।” তারপর সোলায়মান সেখানে একত্র হওয়া বনি-ইসরাইলদের সামনে মাবুদের কোরবানগাহের কাছে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুললেন। তিনি পাঁচ হাত লম্বা, পাঁচ হাত চওড়া ও তিন হাত উঁচু একটা ব্রোঞ্জের মাচা তৈরী করিয়ে উঠানের মাঝখানে রেখেছিলেন। তিনি সেই মাচার উপর উঠে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সামনে হাঁটু পাতলেন এবং দু’হাত আসমানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্‌, ইসরাইলের মাবুদ, বেহেশতে কিংবা দুনিয়াতে তোমার মত মাবুদ আর কেউ নেই। তোমার যে গোলামেরা মনেপ্রাণে তোমার পথে চলে তুমি তাদের পক্ষে তোমার অটল মহব্বতের ব্যবস্থা রক্ষা করে থাক। তোমার গোলাম আমার পিতা দাউদের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছিলে তা তুমি রক্ষা করেছ। তুমি মুখে যা বলেছ কাজেও তা করেছ, আর আজকে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। “এখন হে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার গোলাম আমার পিতা দাউদের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছিলে তা রক্ষা কর। তুমি বলেছিলে, যদি তাঁর ছেলেরা তাঁর মত করে তোমার শরীয়ত অনুসারে চলবার দিকে মনোযোগ দেয় তবে ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য তাঁর বংশে লোকের অভাব হবে না। হে আল্লাহ্‌, ইসরাইলের মাবুদ, যে ওয়াদা তুমি তোমার গোলাম দাউদের কাছে করেছিলে তা সফল হোক। “কিন্তু সত্যিই কি আল্লাহ্‌ দুনিয়াতে মানুষের সংগে বাস করবেন? আসমান, এমন কি, আসমানের সমস্ত জায়গা জুড়েও যখন তোমার স্থান অকুলান হয় তখন আমার তৈরী এই ঘরে কি তোমার জায়গা হবে? তবুও হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার গোলামের মুনাজাত ও অনুরোধে তুমি কান দাও। তোমার কাছে তোমার গোলাম কাকুতি-মিনতি করে যে মুনাজাত করছে তা তুমি শোন। যে জায়গার কথা তুমি বলেছ যে, এখানে তোমার বাসস্থান হবে সেই জায়গার দিকে, অর্থাৎ এই বায়তুল-মোকাদ্দসের দিকে তোমার চোখ দিনরাত খোলা থাকুক। এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গোলাম যখন মুনাজাত করবে তখন তুমি তা শুনো। এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গোলাম ও তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলরা যখন অনুরোধ করবে তখন তাতে তুমি কান দিয়ো। তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো এবং তাদের মাফ কোরো। “কোন লোককে অন্যের বিরুদ্ধে অন্যায় করবার দোষে দোষী করা হলে তার নিজের উপর বদদোয়া ডেকে আনবার জন্য যদি তাকে কসম খেতে বাধ্য করা হয় এবং সে গিয়ে তোমার এই ঘরের কোরবানগাহের সামনে সেই কসম খায়, তবে তুমি বেহেশত থেকে সেই কথা শুনো এবং সেই মত কাজ কোরো। তখন তোমার গোলামদের তুমি বিচার করে দোষীর কাজের ফল তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে দোষী বলে প্রমাণ কোরো আর নির্দোষকে তার কাজ অনুসারে ফল দিয়ে তাকে নির্দোষ বলে প্রমাণ কোরো। “তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবার দরুন যখন তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলরা শত্রুর কাছে হেরে গিয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে এবং বায়তুল-মোকাদ্দসে তোমার গৌরব করে তোমার কাছে মুনাজাত ও অনুরোধ করবে, তখন বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো এবং তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ মাফ করে যে দেশ তুমি তাদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছ সেখানে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসো। “তোমার বিরুদ্ধে তোমার বান্দাদের গুনাহ্‌ করবার দরুন যখন আকাশ বন্ধ হয়ে বৃষ্টি পড়বে না তখন তারা যদি এই জায়গার দিকে ফিরে তোমার গৌরব করে ও তোমার কাছে মুনাজাত করে এবং তোমার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে গুনাহ্‌ থেকে ফেরে, তবে তুমি বেহেশত থেকে তা শুনো এবং তোমার গোলামদের, অর্থাৎ তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ মাফ করে দিয়ো। জীবনে ঠিকভাবে চলতে তাদের শিক্ষা দিয়ো এবং সম্পত্তি হিসাবে যে দেশ তুমি তাদের দিয়েছ সেই দেশের উপর বৃষ্টি দিয়ো। “যদি দেশে দুর্ভিক্ষ কিংবা মহামারী দেখা দেয়, যদি ফসল শুকিয়ে-যাওয়া রোগ কিংবা ছাৎলা-পড়া রোগ হয়, যদি ফসলে ফড়িং বা পংগপাল লাগে, যদি শত্রু তাদের কোন শহর ঘেরাও করে- যে কোন রকম বিপদ কিংবা রোগ দেখা দিক না কেন, তখন যদি তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের কেউ নিজের যন্ত্রণা ও কষ্ট বুঝে বায়তুল-মোকাদ্দসের দিকে হাত বাড়িয়ে মুনাজাত ও মিনতি করে, তবে তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো এবং তাকে মাফ কোরো। তার সব কাজ অনুসারে বিচার কোরো, কারণ তুমি তো তার দিলের অবস্থা জান্ত কেবল তুমিই সমস্ত মানুষের দিলের খবর জান। তুমি তা কোরো যাতে আমাদের পূর্বপুরুষদের তুমি যে দেশ দিয়েছ সেখানে বংশের পর বংশ ধরে তোমার বান্দারা সারা জীবন তোমাকে ভয় করে তোমার পথে চলে। “এছাড়া তোমার বান্দা বনি-ইসরাইল নয় এমন কোন বিদেশী তোমার মহান নাম এবং তোমার শক্তিশালী ও বাড়িয়ে দেওয়া হাতের কথা শুনে যখন দূর দেশ থেকে এসে বায়তুল-মোকাদ্দসের দিকে ফিরে মুনাজাত করবে, তখন তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তুমি তা শুনো। সে যা চায় তার জন্য তা কোরো যেন দুনিয়ার সমস্ত লোক তোমাকে জানতে পারে এবং তোমার নিজের বান্দা বনি-ইসরাইলদের মত তারাও তোমাকে ভয় করতে পারে আর জানতে পারে যে, আমার তৈরী এই ঘর তোমারই ঘর। “তুমি যখন তোমার বান্দাদের তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠাবে তখন তারা যেখানেই থাকুক না কেন সেখান থেকে যদি তোমার বেছে নেওয়া এই শহরের দিকে ও তোমার জন্য আমার তৈরী এই ঘরের দিকে ফিরে তোমার কাছে মুনাজাত করে, তবে বেহেশত থেকে তুমি তাদের মুনাজাত ও অনুরোধ শুনো এবং তাদের পক্ষ নিয়ো। “তারা যখন তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করবে- অবশ্য গুনাহ্‌ করে না এমন লোক নেই- আর তুমি তাদের উপর রাগ করে শত্রুর হাতে তাদের তুলে দেবে ও শত্রুরা তাদের বন্দী করে কাছের বা দূর দেশে নিয়ে যাবে, তখন বন্দী হয়ে থাকা সেই দেশে যদি তারা মন ফিরায় এবং অনুতপ্ত হয়ে তোমাকে অনুরোধ করে বলে, ‘আমরা গুনাহ্‌ করেছি, অন্যায় করেছি এবং খারাপভাবে চলেছি,’ তবে তুমি তাদের মুনাজাত শুনো। ঐ দেশে যদি তারা মনেপ্রাণে তোমার দিকে ফেরে এবং যে দেশ তুমি তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছ সেই দেশের দিকে, তোমার বেছে নেওয়া শহরের দিকে, তোমার জন্য আমার তৈরী এই ঘরের দিকে ফিরে মুনাজাত করে, তবে তুমি তোমার বাসস্থান বেহেশত থেকে তাদের মুনাজাত ও অনুরোধ শুনো এবং তাদের পক্ষ নিয়ো। তোমার যে বান্দারা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে সেই বান্দাদের তুমি মাফ কোরো। “হে আমার আল্লাহ্‌, এই জায়গায় যে সব মুনাজাত করা হবে তার দিকে যেন এখন তোমার চোখ ও কান খোলা থাকে। “হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, এখন তোমার বিশ্রাম-স্থানে এস; তুমি এস, আর তোমার কুদরতের সিন্দুক আসুক। হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, তোমার ইমামেরা উদ্ধারের পোশাক পরুক। তুমি যে সব মেহেরবানী করেছ তার জন্য তোমার ভক্তেরা আনন্দ করুক। হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, তোমার অভিষিক্ত বান্দার মুনাজাত তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না; তোমার গোলাম দাউদের প্রতি তুমি যে অটল মহব্বত দেখিয়েছ তা মনে করে দেখ।” সোলায়মানের মুনাজাত শেষ হলেই বেহেশত থেকে আগুন নেমে এসে পোড়ানো ও অন্যান্য কোরবানীর জিনিস পুড়িয়ে ফেলল এবং বায়তুল-মোকাদ্দস মাবুদের মহিমায় পরিপূর্ণ হল। সেইজন্য ইমামেরা সেখানে ঢুকতে পারলেন না। আগুন নেমে আসতে দেখে ও বায়তুল-মোকাদ্দসের উপরে মাবুদের মহিমা দেখতে পেয়ে সমস্ত বনি-ইসরাইল পাথরে বাঁধানো উঠানে উবুড় হয়ে পড়ে মাবুদকে সেজদা করল ও এই বলে তাঁর প্রশংসা করল, “তিনি মেহেরবান; তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” তারপর বাদশাহ্‌ ও সমস্ত লোক মাবুদের সামনে কোরবানী দিলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান বাইশ হাজার গরু এবং এক লক্ষ বিশ হাজার ভেড়া কোরবানী দিলেন। এইভাবে বাদশাহ্‌ ও সমস্ত লোক আল্লাহ্‌র ঘরটি উদ্বোধন করলেন। ইমামেরা তাঁদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন এবং লেবীয়রাও মাবুদের উদ্দেশে বাজাবার জন্য বাজনাগুলো নিয়ে তাঁদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। লেবীয়দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইমামেরা তাঁদের শিংগা বাজালেন এবং বনি-ইসরাইলরা সকলেই দাঁড়িয়ে রইল। লেবীয়দের এই বাজনাগুলো বাদশাহ্‌ দাউদ মাবুদের প্রশংসা করবার জন্য তৈরী করিয়েছিলেন এবং সেগুলো বাজানো হত যখন তিনি মাবুদের প্রশংসা করে বলতেন, “তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” সোলায়মান মাবুদের ঘরের সামনের উঠানের মাঝখানের অংশ পবিত্র করলেন এবং সেখানে তিনি পোড়ানো-কোরবানী দিলেন ও যোগাযোগ-কোরবানীর চর্বি কোরবানী দিলেন, কারণ ব্রোঞ্জের যে কোরবানগাহ্‌ তিনি তৈরী করিয়েছিলেন তা পোড়ানো-কোরবানীর ও শস্য-কোরবানীর জিনিস এবং চর্বির জন্য ছোট ছিল। সপ্তম মাসের তেইশ দিনের দিন বাদশাহ্‌ লোকদের নিজের নিজের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। দাউদ, সোলায়মান ও তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের প্রতি মাবুদ যে সব মেহেরবানী করেছেন তার জন্য তারা আনন্দিত ও খুশী হয়ে ফিরে গেল। মাবুদের ঘর ও রাজবাড়ী তৈরী করবার জন্য সোলায়মানের মনে যা যা করবার ইচ্ছা ছিল সেই সমস্ত তিনি সফলতার সংগে শেষ করলেন। পরে এক রাতে মাবুদ সোলায়মানকে দেখা দিয়ে বললেন, “আমি তোমার মুনাজাত শুনেছি এবং কোরবানী দেবার ঘর হিসাবে আমার জন্য আমি এই জায়গা বেছে নিয়েছি। “যখন আমি আকাশ বন্ধ করে দেব আর বৃষ্টি পড়বে না, কিংবা দেশ ধ্বংস করবার জন্য পংগপালকে হুকুম দেব, কিংবা আমার বান্দাদের মধ্যে মহামারী পাঠিয়ে দেব, তখন আমার লোকেরা, যাদের আমার বান্দা বলে ডাকা হয় তারা যদি নম্র হয়ে মুনাজাত করে ও আমার রহমত চায় এবং খারাপ পথ থেকে ফেরে, তবে বেহেশত থেকে তা শুনে আমি তাদের গুনাহ্‌ মাফ করব এবং তাদের দেশের অবস্থা ফিরিয়ে দেব। এই জায়গায় যে মুনাজাত করা হবে তার প্রতি আমার চোখ ও কান খোলা থাকবে। বায়তুল-মোকাদ্দস আমি বেছে নিয়ে চিরকাল আমার বাসস্থান হিসাবে পবিত্র করেছি। এর উপর সব সময় আমার চোখ ও মন থাকবে। “তোমার পিতা দাউদ যেভাবে চলত তুমি যদি সেইভাবে আমার সামনে চল এবং আমার সমস্ত হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ পালন কর, তাহলে আমি তোমার রাজসিংহাসন স্থায়ী করব, কারণ আমি তোমার পিতা দাউদের কাছে ওয়াদা করে বলেছিলাম, ‘ইসরাইলের উপর শাসন করবার জন্য তোমার বংশে লোকের অভাব হবে না।’ “কিন্তু তোমরা যদি আমার পথ থেকে সরে যাও এবং যে সব নিয়ম ও হুকুম আমি তোমাদের দিয়েছি তা ত্যাগ কর আর দেব-দেবীদের সেবা ও পূজা কর, তবে আমি আমার যে দেশ তোমাদের দিয়েছি তা থেকে তোমাদের শিকড়সুদ্ধ উপ্‌ড়ে ফেলব আর আমার উদ্দেশ্যে যে এবাদত-খানাটি পবিত্র করেছি তা আমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দেব। তখন সমস্ত জাতির কাছে আমি সেই ঘরটিকে টিট্‌কারির ও তামাশার পাত্র করে তুলব। বায়তুল-মোকাদ্দস এখন এত মহান হলেও তখন যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা আঁত্‌কে উঠে জিজ্ঞাসা করবে, ‘কেন মাবুদ এই দেশ ও বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রতি এই রকম করলেন?’ এর জবাবে লোকে বলবে, ‘এর কারণ হল, যিনি তাদের পূর্বপুরুষদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন সেই পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তারা ত্যাগ করেছে। তারা দেব-দেবীদের পিছনে গিয়ে তাদের পূজা ও সেবা করেছে; সেইজন্যই তিনি তাদের উপর এই সব বিপদ এনেছেন।’ ” মাবুদের ঘর ও তাঁর নিজের বাড়ী তৈরী করতে সোলায়মানের বিশ বছর লেগেছিল। হীরম যে সব গ্রাম তাঁকে দিয়েছিলেন সোলায়মান সেই বিশ বছরের শেষে সেগুলো আবার গড়ে তুললেন এবং বনি-ইসরাইলদের সেখানে বাস করতে দিলেন। তারপর সোলায়মান হামা-সোবাতে গিয়ে সেটা দখল করে নিলেন। তিনি মরুভূমিতে তদ্‌মোর শহর এবং হামা এলাকার সমস্ত ভাণ্ডার-শহর আবার তৈরী করালেন। তিনি উপরের বৈৎ-হোরোণ ও নীচের বৈৎ-হোরোণে দরজা ও আগল সুদ্ধ দেয়াল তৈরী করে তা শক্তিশালী করলেন। তিনি বালৎ শহর ও তাঁর সব ভাণ্ডার-শহর তৈরী করলেন এবং রথ ও ঘোড়সওয়ারদের জন্য কতগুলো শহর তৈরী করলেন। জেরুজালেমে, লেবাননে এবং তাঁর শাসনের অধীনে যে সব রাজ্য ছিল সেগুলোর মধ্যে তিনি যা যা তৈরী করতে চেয়েছিলেন তা সবই করলেন। যারা ইসরাইলীয় ছিল না, অর্থাৎ যে সব হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের বংশধরেরা তখনও দেশে বেঁচে ছিল, যাদের বনি-ইসরাইলরা ধ্বংস করে দেয় নি সোলায়মান তাদের গোলাম হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। তারা আজও সেই কাজ করছে। কিন্তু তাঁর কাজ করবার জন্য বনি-ইসরাইলদের তিনি গোলাম বানান নি; তারা ছিল তাঁর যোদ্ধা, তাঁর সেনাপতি এবং তাঁর রথচালক ও ঘোড়সওয়ারদের সেনাপতি। এছাড়া বাদশাহ্‌ সোলায়মানের দু’শো পঞ্চাশ জন প্রধান কর্মচারী ছিল যারা গোলামদের কাজের তদারক করত। সোলায়মান ফেরাউনের মেয়ের জন্য যে বাড়ী তৈরী করেছিলেন তিনি দাউদ-শহর থেকে তাঁকে সেখানে নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, “আমার স্ত্রী ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদের রাজবাড়ীতে থাকবেন না, কারণ যে সব জায়গায় মাবুদের সিন্দুক আনা হয়েছিল সেগুলো পবিত্র।” বায়তুল-মোকাদ্দসের বারান্দার সামনে সোলায়মান মাবুদের যে কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছিলেন তার উপর তিনি মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দিতেন। মূসার হুকুম মত তিনি বিশ্রামবারে, অমাবস্যায় ও বছরের তিনটি ঈদে, অর্থাৎ খামিহীন রুটির ঈদে, সাত-সপ্তাহের ঈদে ও কুঁড়ে-ঘরের ঈদে- সেই সব দিনগুলোর নিয়ম অনুসারে কোরবানী দিতেন। তাঁর পিতা দাউদের নির্দেশ অনুসারে তিনি ইমামদের কর্তব্য করবার জন্য তাঁদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে কাজে নিযুক্ত করলেন এবং প্রতিদিনের কাজ অনুসারে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবার ও ইমামদের সাহায্য করবার জন্য তিনি লেবীয়দের নিযুক্ত করলেন। প্রত্যেকটি দরজার জন্য তিনি রক্ষীদের দল অনুসারে কাজে বহাল করলেন, কারণ এইভাবেই আল্লাহ্‌র বান্দা দাউদ হুকুম দিয়ে গিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ দাউদ ভাণ্ডারের কোন ব্যাপারে ও অন্য যে কোন বিষয়ে ইমামদের ও লেবীয়দের যে হুকুম দিয়ে গিয়েছিলেন তা তাঁরা অমান্য করলেন না। মাবুদের ঘরের ভিত্তি গাঁথা থেকে শুরু করে তা শেষ করবার দিন পর্যন্ত সোলায়মানের সমস্ত কাজ ঠিকভাবেই করা হয়েছিল। এইভাবে মাবুদের ঘর তৈরীর কাজ শেষ হল। তারপর সোলায়মান ইদোম দেশের সমুদ্র-পারের ইৎসিয়োন-গেবরে ও এলতে গেলেন। হীরম তাঁর নিজের লোকদের দিয়ে সোলায়মানকে কয়েকটা জাহাজ ও কয়েকজন দক্ষ নাবিক পাঠিয়ে দিলেন। এরা সোলায়মানের লোকদের সংগে ওফীরে গিয়ে সাড়ে সতেরো টন সোনা নিয়ে এসে বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে দিল। সাবা দেশের রাণী সোলায়মানের সুনাম শুনে তাঁকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে পরীক্ষা করবার জন্য জেরুজালেমে আসলেন। তিনি অনেক লোক ও উট নিয়ে সোলায়মানের কাছে পৌঁছালেন। উটের পিঠে ছিল খোশবু মসলা, প্রচুর পরিমাণে সোনা ও মণি-মুক্তা। তিনি সোলায়মানের কাছে এসে তাঁর মনে যা যা ছিল তা সবই তাঁকে বললেন। সোলায়মান তাঁর সব প্রশ্নের জবাব দিলেন; সোলায়মানের কাছে কোন কিছুই এমন কঠিন ছিল না যা তিনি তাঁকে বুঝিয়ে বলতে পারেন নি। সাবা দেশের রাণী সোলায়মানের জ্ঞান ও তাঁর তৈরী রাজবাড়ী দেখলেন। তিনি আরও দেখলেন তাঁর টেবিলের খাবার, তাঁর কর্মচারীদের থাকবার জায়গা, সুন্দর পোশাক পরা তাঁর সেবাকারীদের, তাঁর পানীয় পরিবেশকদের এবং সেই সিঁড়ি, যে সিঁিড় দিয়ে তিনি মাবুদের ঘরে উঠে যেতেন। এই সব দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বাদশাহ্‌কে বললেন, “আমার নিজের দেশে থাকতে আপনার কাজ ও জ্ঞানের বিষয় যে খবর আমি শুনেছি তা সত্যি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত আমি সেই সব কথা বিশ্বাস করি নি। সত্যি আপনার জ্ঞানের অর্ধেকও আমাকে বলা হয় নি। যে খবর আমি পেয়েছি আপনার গুণ তার চেয়ে অনেক বেশী। আপনার লোকেরা কত সুখী! যারা সব সময় আপনার সামনে থাকে ও আপনার জ্ঞানের কথা শোনে আপনার সেই কর্মচারীরা কত ভাগ্যবান! আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, যিনি আপনার উপর খুশী হয়ে আপনাকে তাঁর সিংহাসনে বসিয়েছেন যেন আপনি আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র হয়ে রাজত্ব করতে পারেন। বনি-ইসরাইলদের তিনি মহব্বত করেন এবং তাদের চিরস্থায়ী করতে চান বলে তিনি সুবিচার ও ন্যায় রক্ষার জন্য আপনাকে বাদশাহ্‌ করেছেন।” তিনি বাদশাহ্‌কে সাড়ে চার টনেরও বেশী সোনা, অনেক খোশবু মসলা ও মণি-মুক্তা দিলেন। সাবা দেশের রাণী বাদশাহ্‌ সোলায়মানকে যে রকম মসলা দিয়েছিলেন সেই রকম মসলা আর কখনও দেশে দেখা যায় নি। এছাড়া হীরম ও সোলায়মানের যে লোকেরা ওফীর থেকে সোনা নিয়ে আসত তারা চন্দন কাঠ আর মণি-মুক্তাও নিয়ে আসত। বাদশাহ্‌ সেই সব চন্দন কাঠ দিয়ে মাবুদের ঘরের ও রাজবাড়ীর সিঁড়ি এবং কাওয়ালদের জন্য বীণা ও সুরবাহার তৈরী করালেন। এর আগে এত চন্দন কাঠ এহুদা দেশে কখনও দেখা যায় নি। সাবা দেশের রাণী যা ইচ্ছা করলেন ও চাইলেন বাদশাহ্‌ সোলায়মান তা সবই তাঁকে দিলেন। রাণী তাঁর জন্য যা এনেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশী তিনি তাঁকে দিলেন। এর পর রাণী তাঁর লোকজন নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন। প্রতি বছর সোলায়মানের কাছে যে সোনা আসত তার ওজন ছিল প্রায় ছাব্বিশ টন। এছাড়া বণিক ও ব্যবসায়ীরা সোনা নিয়ে আসত এবং আরবের সমস্ত বাদশাহ্‌রা ও দেশের শাসনকর্তারা সোলায়মানের কাছে সোনা ও রূপা নিয়ে আসত। বাদশাহ্‌ সোলায়মান পিটানো সোনা দিয়ে দু’শো বড় ঢাল তৈরী করালেন। প্রত্যেকটা ঢালে সাত কেজি আটশো গ্রাম সোনা লেগেছিল। পিটানো সোনা দিয়ে তিনি তিনশো ছোট ঢালও তৈরী করিয়েছিলেন। তার প্রত্যেকটাতে সোনা লেগেছিল তিন কেজি ন’শো গ্রাম করে। তিনি সেগুলো লেবানন্তবন্তকুটিরে রাখলেন। এর পরে বাদশাহ্‌ হাতির দাঁতের একটা বড় সিংহাসন তৈরী করিয়ে খাঁটি সোনা দিয়ে তা মুড়িয়ে নিলেন। সেই সিংহাসনের সিঁড়ির ছয়টা ধাপ ছিল এবং তার সংগে লাগানো ছিল পা রাখবার একটা সোনার আসন। বসবার জায়গার দু’দিকে হাতল ছিল এবং হাতলের পাশে ছিল দাঁড়ানো সিংহমূর্তি। সেই ছয়টা ধাপের প্রত্যেকটার দু’পাশে একটা করে মোট বারোটা সিংহমূর্তি ছিল। অন্য কোন রাজ্যে এই রকম সিংহাসন কখনও তৈরী হয় নি। সোলায়মানের পানীয়ের সমস্ত পাত্রগুলো ছিল সোনার আর লেবানন্তবন্তকুটিরের সমস্ত পাত্রগুলোও ছিল খাঁটি সোনার তৈরী। সোলায়মানের সময়ে রূপার তেমন কোন দাম ছিল না। বাদশাহ্‌র কতগুলো বড় বড় জাহাজ হীরমের লোকদের সংগে নিয়ে তর্শীশে যেত। প্রতি তিন বছর পর পর সেই তর্শীশ-জাহাজগুলো সোনা, রূপা, হাতির দাঁত, বানর ও বেবুন নিয়ে ফিরে আসত। বাদশাহ্‌ সোলায়মান দুনিয়ার অন্য সব বাদশাহ্‌দের চেয়ে ধনী ও জ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। আল্লাহ্‌ সোলায়মানের দিলে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন সেই জ্ঞানপূর্ণ কথাবার্তা শুনবার জন্য দুনিয়ার সব দেশের বাদশাহ্‌রা তাঁর সংগে দেখা করতে চেষ্টা করতেন। যাঁরা আসতেন তাঁরা প্রত্যেকে কিছু না কিছু উপহার আনতেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল সোনা-রূপার পাত্র, কাপড়-চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, খোশবু মসলা, ঘোড়া আর খ"চর। বছরের পর বছর এই রকম চলত। ঘোড়া ও রথের জন্য সোলায়মানের চার হাজার ঘর ছিল। তাঁর বারো হাজার ঘোড়সওয়ার ছিল; তাদের তিনি রথ রাখবার শহরগুলোতে এবং জেরুজালেমে নিজের কাছে রাখতেন। তিনি ফোরাত নদী থেকে ফিলিস্তিনীদের দেশ ও মিসরের সীমানা পর্যন্ত সমস্ত বাদশাহ্‌দের উপরে রাজত্ব করতেন। বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে রূপাকে করলেন পাথরের মত প্রচুর এবং এরস কাঠকে করলেন নীচু পাহাড়ী এলাকায় গজানো ডুমুর গাছের মত অনেক। সোলায়মানের ঘোড়াগুলো মিসর ও অন্যান্য সব দেশ থেকে আনা হত। সোলায়মানের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নবী নাথনের লেখায়, শীলোনীয় অহিয়ের ভবিষ্যদ্বাণীতে এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমের বিষয়ে “ইদ্দো নবীর দর্শন” নামে বইটিতে লেখা আছে। সোলায়মান জেরুজালেমে চল্লিশ বছর ধরে গোটা ইসরাইল জাতির উপরে রাজত্ব করেছিলেন। তারপর তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন; তাঁকে তাঁর পিতা দাউদের শহরে দাফন করা হল। তারপর তাঁর ছেলে রহবিয়াম তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। রহবিয়াম শিখিমে গেলেন, কারণ বনি-ইসরাইলরা সকলে তাঁকে বাদশাহ্‌ করবার জন্য সেখানে গিয়েছিল। তখন নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম মিসর থেকে ফিরে আসলেন। তিনি বাদশাহ্‌ সোলায়মানের কাছ থেকে পালিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকবার সময় তিনি রহবিয়ামের বাদশাহ্‌ হবার খবর শুনেছিলেন। লোকেরা ইয়ারাবিমকে ডেকে পাঠালে পর তিনি এবং বনি-ইসরাইলরা সবাই রহবিয়ামের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনার বাবা আমাদের উপর একটা ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এখন আপনি আমাদের উপর চাপানো সেই কঠিন পরিশ্রম কমিয়ে ভারী জোয়ালটা হালকা করে দিন; তাহলে আমরা আপনার সেবা করব।” জবাবে রহবিয়াম বললেন, “তোমরা তিন দিনের দিন আবার এসো।” তাতে লোকেরা চলে গেল। যে সব বৃদ্ধ নেতারা তাঁর পিতা সোলায়মানের জীবনকালে তাঁর সেবা করতেন রহবিয়াম তাঁদের সংগে পরামর্শ করবার জন্য বললেন, “এই লোকদের জবাব দেবার জন্য আপনারা আমাকে কি পরামর্শ দেন?” জবাবে তাঁরা বললেন, “আজকে যদি আপনি এই সব লোকদের সংগে ভাল ব্যবহার করে তাদের সন্তুষ্ট করেন এবং তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন তবে তারা সব সময় আপনার গোলাম হয়ে থাকবে।” কিন্তু রহবিয়াম বৃদ্ধ নেতাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে সেই সব যুবকদের সংগে পরামর্শ করলেন যারা তাঁর সংগে বড় হয়েছিল এবং তাঁর সেবা করত। তিনি তাদের বললেন, “লোকেরা বলছে, ‘আপনার বাবা যে ভারী জোয়াল আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন তা হালকা করুন।’ এই ব্যাপারে তোমাদের পরামর্শ কি? আমরা তাদের কি জবাব দেব?” জবাবে সেই যুবকেরা বলল, “যে লোকেরা আপনার বাবার চাপিয়ে দেওয়া ভারী জোয়াল হালকা করে দেবার কথা বলেছে তাদের আপনি বলুন যে, আপনার বাবার কোমরের চেয়েও আপনার কড়ে আংগুলটা মোটা। আপনার বাবা তাদের উপর যে ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছিলেন তা আপনি আরও ভারী করবেন। আপনার বাবা তাদের মেরেছিলেন চাবুক দিয়ে কিন্তু আপনি তাদের মারবেন কাঁকড়া-বিছা দিয়ে।” বাদশাহ্‌র কথামত তিন দিনের দিন ইয়ারাবিম ও সমস্ত লোকেরা রহবিয়ামের কাছে ফিরে আসল। বাদশাহ্‌ বৃদ্ধ নেতাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে তাদের খুব কড়া জবাব দিলেন। তিনি সেই যুবকদের পরামর্শ মত বললেন, “আমার বাবা তোমাদের জোয়াল ভারী করেছিলেন, আমি তা আরও ভারী করব। আমার বাবা চাবুক দিয়ে তোমাদের মেরেছিলেন, আমি তোমাদের মারব কাঁকড়া-বিছা দিয়ে।” এইভাবে বাদশাহ্‌ লোকদের কথায় কান দিলেন না। শীলোনীয় অহিয়ের মধ্য দিয়ে মাবুদ নবাটের ছেলে ইয়ারাবিমকে যে কথা বলেছিলেন তা পূর্ণ করবার জন্য আল্লাহ্‌ থেকেই ঘটনাটা এইভাবে ঘটল। বনি-ইসরাইলরা যখন বুঝল যে, বাদশাহ্‌ তাদের কথা শুনবেন না তখন তারা বাদশাহ্‌কে বলল, “দাউদের উপর আমাদের কোন দাবি নেই। ইয়াসির ছেলের উপর আমাদের কোন অধিকার নেই। হে ইসরাইল, তোমরা যে যার বাড়ীতে ফিরে যাও। হে দাউদ, এখন তোমার নিজের গোষ্ঠী তুমি নিজেই দেখ।” কাজেই বনি-ইসরাইলরা যে যার বাড়ীতে ফিরে গেল। তবে এহুদা-গোষ্ঠীর গ্রাম ও শহরগুলোতে যে সব ইসরাইলীয় বাস করত রহবিয়াম তাদের উপরে রাজত্ব করতে থাকলেন। যাদের কাজ করতে বাধ্য করা হত তাদের ভার যার উপরে ছিল সেই অদোরামকে বাদশাহ্‌ রহবিয়াম বনি-ইসরাইলদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু তারা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। তখন বাদশাহ্‌ রহবিয়াম তাড়াতাড়ি তাঁর রথে উঠে জেরুজালেমে পালিয়ে গেলেন। এইভাবে বনি-ইসরাইলরা দাউদের বংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল; অবস্থাটা আজও তা-ই আছে। জেরুজালেমে পৌঁছে রহবিয়াম এহুদা ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে যুদ্ধের জন্য জমায়েত করলেন। তাতে এক লক্ষ আশি হাজার সৈন্য হল। এটা করা হল যাতে বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করে রাজ্যটা আবার রহবিয়ামের হাতে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু আল্লাহ্‌র বান্দা শময়িয়ের উপর মাবুদের এই কালাম নাজেল হল, “তুমি এহুদার বাদশাহ্‌ সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামকে এবং এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীন এলাকার সমস্ত বনি-ইসরাইলদের বল যে, মাবুদ বলছেন তারা যেন তাদের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না যায়। তারা প্রত্যেকেই যেন বাড়ী ফিরে যায়, কারণ এটা মাবুদেরই কাজ।” কাজেই তারা মাবুদের কথা মেনে নিয়ে ইয়ারাবিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল না। বৈৎ-সূর, সোখো, অদুল্লম, গাৎ, মারেশা, সীফ, অদোরয়িম, লাখীশ, অসেকা, সরা, অয়ালোন ও হেবরন নামে এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীন এলাকার কয়েকটা গ্রাম ও শহর দেয়াল দিয়ে ঘিরে শক্তিশালী করলেন। তিনি সেগুলোর রক্ষার ব্যবস্থা মজবুত করলেন ও সেখানে সেনাপতিদের রাখলেন। তিনি সেখানে তাদের জন্য খাবার-দাবার, জলপাই-তেল ও আংগুর-রস মজুদ করলেন। তিনি সেই সমস্ত গ্রাম ও শহরের মধ্যে ঢাল ও বর্শা রেখে সেগুলো খুব শক্তিশালী করলেন। এইভাবে এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীন এলাকা তাঁর অধীনে রইল। ইসরাইলের সমস্ত এলাকার ইমাম ও লেবীয়রা তাঁর পক্ষে ছিলেন। লেবীয়রা তাদের পশু চরাবার মাঠ ও সম্পত্তি ত্যাগ করে এহুদা ও জেরুজালেমে চলে আসল, কারণ ইয়ারাবিম আর তাঁর ছেলেরা মাবুদের ইমামের পদ থেকে তাদের বাতিল করে দিয়েছিলেন। ইয়ারাবিম এবাদতের উঁচু স্থানগুলোর জন্য এবং ভূতদের জন্য ও তাঁর তৈরী বাছুরের মূর্তিগুলোর জন্য তাঁর নিজের পুরোহিতদের নিযুক্ত করেছিলেন। ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে যারা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানবার জন্য আগ্রহী হয়েছিল তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী দেবার জন্য লেবীয়দের সংগে জেরুজালেমে আসল। তারা তিন বছর পর্যন্ত এহুদা রাজ্য ও সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামের হাতকে শক্তিশালী করে তুলল, কারণ এই তিন বছর তারা দাউদ ও সোলায়মানের পথে চলেছিল। রহবিয়াম দাউদের ছেলে যিরীমোতের মেয়ে মহলৎকে বিয়ে করেছিলেন। মহলতের মা অবীহয়িল ছিলেন ইয়াসির ছেলে ইলীয়াবের মেয়ে। মহলতের গর্ভে যিয়ূশ, শমরিয় ও সহম নামে তিনটি ছেলের জন্ম হয়েছিল। তারপর রহবিয়াম অবশালোমের মেয়ে মাখাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর গর্ভে অবিয়, অত্তয়, সীষ ও শলোমীতের জন্ম হয়েছিল। রহবিয়াম তাঁর অন্যান্য স্ত্রী ও উপস্ত্রীদের চেয়ে অবশালোমের মেয়ে মাখাকে বেশী ভালবাসতেন। তাঁর মোট আঠারোজন স্ত্রী ও ষাটজন উপস্ত্রী, আটাশজন ছেলে ও ষাটজন মেয়ে ছিল। রহবিয়াম মাখার ছেলে অবিয়কে বাদশাহ্‌ করবার ইচ্ছা নিয়ে তাঁকে তাঁর ভাইদের মধ্যে প্রধান করলেন। তাঁর কয়েকজন ছেলেকে তিনি এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের সমস্ত এলাকার দেয়াল-ঘেরা শহরে পাঠিয়ে দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করলেন। তিনি তাঁদের প্রচুর খাবার-দাবার দিলেন এবং তাঁদের জন্য অনেক স্ত্রীর ব্যবস্থা করলেন। রহবিয়ামের রাজপদ যখন শক্ত হল এবং তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন তখন তিনি ও তাঁর সংগে সমস্ত বনি-ইসরাইল মাবুদের শরীয়ত পালন করা ত্যাগ করলেন। মাবুদের প্রতি বেঈমানী করাতে বাদশাহ্‌ রহবিয়ামের রাজত্বের পঞ্চম বছরে মিসরের বাদশাহ্‌ শীশক জেরুজালেম আক্রমণ করলেন। শীশকের সংগে বারোশো রথ, ষাট হাজার ঘোড়সওয়ার এবং অসংখ্য লিবীয়, সুক্কীয় ও ইথিওপীয় সৈন্য মিসর থেকে এসেছিল। তিনি এহুদার দেয়াল-ঘেরা শহরগুলো অধিকার করে নিয়ে জেরুজালেম পর্যন্ত চলে আসলেন। নবী শময়িয় তখন রহবিয়াম ও এহুদার নেতাদের কাছে আসলেন। সেই নেতারা শীশকের ভয়ে জেরুজালেমে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। শময়িয় তাঁদের বললেন, “মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘তোমরা আমাকে ত্যাগ করেছ, সেইজন্য আমিও এখন শীশকের হাতে তোমাদের তুলে দিয়েছি।’ ” এতে বাদশাহ্‌ ও ইসরাইলীয় নেতারা নিজেদের নত করলেন ও বললেন, “মাবুদ ন্যায় বিচারক।” মাবুদ যখন দেখলেন যে, তাঁরা নিজেদের নত করেছেন তখন তিনি শময়িয়কে বললেন, “তারা নিজেদের নত করেছে বলে আমি তাদের ধ্বংস না করে শাস্তির হাত থেকে কিছুটা রেহাই দেব। আমার গজব শীশকের মধ্য দিয়ে জেরুজালেমের উপর ঢেলে দেওয়া হবে না, কিন্তু তারা তার অধীন হবে। এতে তারা আমার সেবা করবার ও অন্যান্য দেশের বাদশাহ্‌দের সেবা করবার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা বুঝতে পারবে।” মিসরের বাদশাহ্‌ শীশক জেরুজালেম আক্রমণ করে মাবুদের ঘরের ও রাজবাড়ীর সমস্ত ধন-দৌলত নিয়ে চলে গেলেন। তিনি সব কিছুই নিয়ে গেলেন, এমন কি, সোলায়মানের তৈরী সোনার ঢালগুলোও নিয়ে গেলেন। কাজেই বাদশাহ্‌ রহবিয়াম সেগুলোর বদলে ব্রোঞ্জের ঢাল তৈরী করালেন। রাজবাড়ীর দরজায় যে সব সৈন্যেরা পাহারা দিত তাদের সেনাপতিদের কাছে তিনি সেগুলো রক্ষা করবার ভার দিলেন। বাদশাহ্‌ যখন মাবুদের ঘরে যেতেন তখন পাহারাদার সৈন্যেরা সেই ঢালগুলো নিয়ে তাঁর সংগে যেত এবং পরে তারা সেগুলো পাহারা-ঘরে জমা দিত। রহবিয়াম নিজেকে নত করেছিলেন বলে তাঁর উপর মাবুদের যে রাগ ছিল তা থেমে গেল এবং তাঁর সর্বনাশ হল না। তখনও এহুদার মধ্যে কিছু ভাল ছিল। বাদশাহ্‌ রহবিয়াম জেরুজালেমে নিজেকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করে রাজত্ব করেছিলেন। তিনি যখন বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল একচল্লিশ। ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর সমস্ত জায়গার মধ্য থেকে যে শহরটা মাবুদ নিজের বাসস্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সেই জেরুজালেম শহরে রহবিয়াম সতেরো বছর রাজত্ব করেছিলেন। রহবিয়ামের মায়ের নাম ছিল নয়মা; তিনি ছিলেন অম্মোনীয়া। মাবুদের ইচ্ছামত চলবার জন্য মন স্থির করেন নি বলে রহবিয়াম যা খারাপ তা-ই করতেন। রহবিয়ামের অন্যান্য কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নবী শময়িয়ের লেখা এবং নবী ইদ্দোর লেখা বংশ-তালিকায় লেখা আছে। রহবিয়াম ও ইয়ারাবিমের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ চলত। পরে রহবিয়াম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং দাউদ-শহরে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে অবিয় বাদশাহ্‌ হলেন। ইয়ারাবিমের রাজত্বের আঠারো বছরের সময় অবিয় এহুদার বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি জেরুজালেমে তিন বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মাখা; তিনি ছিলেন গিবিয়ার ঊরীয়েলের মেয়ে। অবিয় আর ইয়ারাবিমের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। অবিয় চার লক্ষ বাছাই-করা বীর যোদ্ধার একটা দল নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন আর ইয়ারাবিম আট লক্ষ বাছাই-করা বীর যোদ্ধা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সারি বাঁধলেন। অবিয় আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার মধ্যে সমারয়িম পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়ারাবিম ও ইসরাইলের সমস্ত লোকেরা, আমার কথা শুনুন। আপনারা কি জানেন না যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ চিরকালের অটল ব্যবস্থার দ্বারা দাউদ ও তাঁর বংশের লোকদের কাছে চিরদিনের জন্য ইসরাইলের রাজপদ দিয়েছেন? তবুও দাউদের ছেলে সোলায়মানের কর্মচারী নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম তাঁর মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। কয়েকজন অপদার্থ ও দুষ্ট লোক ইয়ারাবিমের চারপাশে জমায়েত হয়ে সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। সেই সময় রহবিয়াম ছিলেন যুবক এবং তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল কম; তাদের বাধা দেবার মত যথেষ্ট শক্তি তাঁর ছিল না। “এখন দাউদের বংশধরদের হাতে মাবুদের যে রাজ্য রয়েছে আপনারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছেন। সত্যিই আপনারা বিরাট একদল সৈন্য এবং আপনাদের মধ্যে রয়েছে সেই সোনার বাছুরের মূর্তিগুলো যা আপনাদের দেবতা হবার জন্য ইয়ারাবিম তৈরী করেছেন। আপনারা তো মাবুদের ইমামদের, অর্থাৎ হারুনের ছেলেদের এবং লেবীয়দের তাড়িয়ে দিয়েছেন এবং অন্যান্য দেশের জাতিদের মত নিজেদের জন্য পুরোহিতদের নিযুক্ত করেছেন। পুরোহিত হিসাবে নিজেকে আলাদা করবার জন্য যে কেউ একটা এঁেড় বাছুর ও সাতটা ভেড়া নিয়ে আসে সে-ই ঐ সব দেবতার পুরোহিত হতে পারে যারা মাবুদ নয়। “কিন্তু আমরা সেই রকম নই, আল্লাহ্‌ই আমাদের মাবুদ। আমরা তাঁকে ত্যাগ করি নি। যে ইমামেরা মাবুদের এবাদত-কাজ করেন তাঁরা হারুনের বংশের লোক, আর লেবীয়রাও তাদের নির্দিষ্ট কাজ করে। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় ইমামেরা মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দেন ও খোশবু ধূপ জ্বালান। তাঁরা পাক-সাফ করা টেবিলের উপর পবিত্র-রুটি সাজিয়ে রাখেন এবং প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় সোনার বাতিদানের উপর বাতিগুলো জ্বালিয়ে দেন। আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র হুকুম অনুসারে কাজ করি, কিন্তু আপনারা তাঁকে ত্যাগ করেছেন। আল্লাহ্‌ আমাদের সংগে আছেন; তিনিই আমাদের নেতা। তাঁর ইমামেরা তাঁদের শিংগা বাজিয়ে আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেবার জন্য আমাদের সংগে আছেন। হে ইসরাইলের লোকেরা, আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে আপনারা যুদ্ধ করবেন না, কারণ তাতে আপনারা সফল হবেন না।” ইয়ারাবিম গোপনে এহুদার সৈন্যদের পিছনের দিকে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন; তাতে তাঁর একদল সৈন্য এহুদার সামনের দিকে আর একদল সৈন্য এহুদার পিছন দিকে রইল। এহুদার সামনে থেকে বনি-ইসরাইলরা পালিয়ে যেতে লাগল আর আল্লাহ্‌ তাদের এহুদার লোকদের হাতে তুলে দিলেন। অবিয় ও তাঁর লোকেরা অনেক লোককে হত্যা করলেন। এতে বনি-ইসরাইলদের বাছাই-করা লোকদের মধ্য থেকে পাঁচ লক্ষ লোক মারা পড়ল। এইভাবে ইসরাইলের লোকেরা হেরে গেল, আর এহুদার লোকেরা জয়ী হল, কারণ তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করেছিল। অবিয় ইয়ারাবিমের পিছনে তাড়া করে গিয়ে তাঁর হাত থেকে বেথেল, যিশানা ও ইফ্রোণ এবং সেগুলোর আশেপাশের জায়গাগুলো দখল করে নিলেন। অবিয়ের সময়ে ইয়ারাবিম আর শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন নি। পরে মাবুদ তাঁকে আঘাত করলে পর তিনি মারা গেলেন। এদিকে অবিয় শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর চৌদ্দজন স্ত্রী এবং বাইশজন ছেলে ও ষোলজন মেয়ে ছিল। অবিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তিনি যা কিছু বলেছিলেন তা নবী ইদ্দোর ইতিহাসের বইয়ে লেখা আছে। পরে অবিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে আসা বাদশাহ্‌ হলেন। আসার সময়ে দশ বছর দেশে শান্তি ছিল। আসা তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা ভাল ও ঠিক তা-ই করতেন। তিনি দেব-দেবীদের বেদীগুলো ও পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করলেন আর পূজার পাথরগুলো চুরমার করলেন এবং আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেললেন। তিনি এহুদার লোকদের তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতে এবং তাঁর শরীয়ত ও হুকুম পালন করতে বললেন। তিনি এহুদা দেশের প্রত্যেকটি গ্রাম ও শহরের পূজার উঁচু স্থানগুলো ও ধূপ-বেদীগুলো ধ্বংস করলেন। তাঁর অধীনে রাজ্যে শান্তি ছিল। দেশে শান্তি ছিল বলে তিনি কয়েকটা গ্রাম দেয়াল দিয়ে ঘিরে শক্তিশালী করলেন। ঐ সব বছরে কেউ আসার সংগে যুদ্ধ করে নি, কারণ আল্লাহ্‌ তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিয়েছিলেন। তিনি এহুদার লোকদের বলেছিলেন, “আসুন, আমরা এই গ্রামগুলোর চারপাশে দেয়াল তৈরী করে তাতে উঁচু পাহারা-ঘর, দরজা ও আগল দিয়ে সেগুলো শক্তিশালী করি। দেশ এখনও আমাদের হাতে আছে, কারণ আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলেছি; সেইজন্য তিনি সব দিক থেকেই আমাদের শান্তি দিয়েছেন।” এইভাবে তারা সব কাজ সফলতার সংগে শেষ করল। এহুদা-গোষ্ঠীর এলাকায় বাদশাহ্‌ আসার বড় ঢাল ও বর্শাধারী তিন লক্ষ সৈন্য ছিল, আর বিন্যামীন-গোষ্ঠীর এলাকায় ছিল ঢাল ও ধনুকধারী দুই লক্ষ আশি হাজার সৈন্য। এরা সবাই ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা। পরে ইথিওপিয়া দেশের সেরহ দশ লক্ষ সৈন্য ও তিনশো রথ নিয়ে এহুদার লোকদের বিরুদ্ধে বের হয়ে মারেশা পর্যন্ত এগিয়ে আসলেন। তখন আসা তাঁর বিরুদ্ধে বের হলেন এবং দুই দলই মারেশার কাছে সফাথা উপত্যকায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। তখন আসা তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডেকে বললেন, “হে মাবুদ, তুমি যেমন শক্তিশালীকে সাহায্য করতে পার তেমনি তো শক্তিহীনকেও সাহায্য করতে পার। সেইজন্য হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি আমাদের সাহায্য কর, কারণ আমরা তোমার উপরেই ভরসা করি আর তোমার নামেই আমরা এই বিরাট সৈন্যদলের বিরুদ্ধে এসেছি। হে আল্লাহ্‌, তুমিই আমাদের মাবুদ; মানুষকে তোমার বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে দিয়ো না।” তখন আসা ও এহুদার লোকদের সামনে থেকে মাবুদ ইথিওপীয়দের হটিয়ে দিলেন। তাতে ইথিওপীয়রা পালিয়ে গেল। আসা ও তাঁর সৈন্যদল গরার পর্যন্ত তাদের তাড়া করে নিয়ে গেলেন। এত বেশী ইথিওপীয় মারা পড়ল যে, তারা আর শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারল না। তারা মাবুদ ও তাঁর সৈন্যদলের সামনে শেষ হয়ে গেল। এহুদার লোকেরা প্রচুর লুটের জিনিস নিয়ে আসল। তারা গরারের চারপাশের সমস্ত গ্রামগুলো ধ্বংস করে দিতে পেরেছিল, কারণ সেখানকার লোকেরা মাবুদকে ভীষণ ভয় করেছিল। সেখানে লুট করবার মত অনেক জিনিস ছিল বলে তারা এই সব গ্রাম লুট করেছিল। তারা পশুপালকদের তাম্বুগুলোও আক্রমণ করে পালে পালে ভেড়া, ছাগল ও উট নিয়ে এসেছিল। তারপর তারা জেরুজালেমে ফিরে গেল। আল্লাহ্‌র রূহ্‌ ওদেদের ছেলে অসরিয়ের উপরে আসলেন। তখন অসরিয় আসার সংগে দেখা করতে গিয়ে বললেন, “হে আসা, হে এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের সমস্ত লোকেরা, আমার কথা শুনুন। আপনারা যতদিন মাবুদের সংগে থাকবেন ততদিন তিনিও আপনাদের সংগে থাকবেন। তাঁর ইচ্ছা জানতে চাইলে আপনারা তা জানতে পারবেন, কিন্তু তাঁকে যদি ত্যাগ করেন তবে তিনিও আপনাদের ত্যাগ করবেন। বনি-ইসরাইলরা অনেক দিন ধরে সত্য আল্লাহ্‌ ছাড়া, শিক্ষা দেবার জন্য ইমাম ছাড়া এবং শরীয়ত ছাড়াই চলছিল। কিন্তু তাদের দুঃখের দিনে তারা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে তাঁর ইচ্ছা জানতে চেয়েছিল এবং তা জানতেও পেরেছিল। সেই দিনগুলোতে কোথাও যাওয়া-আসা করা নিরাপদ ছিল না, কারণ সমস্ত জায়গার লোকেরা তখন খুব অশান্ত অবস্থায় ছিল। এক জাতি অন্য জাতির, এক শহর অন্য শহরের সর্বনাশ করবার চেষ্টা করত, কারণ নানা রকম বিপদ দিয়ে আল্লাহ্‌ তাদের কষ্ট দিচ্ছিলেন। কিন্তু আপনারা শক্তিশালী হন, নিরাশ হবেন না, কারণ আপনাদের কাজের পুরস্কার আপনারা পাবেন।” আসা এই সব কথা শুনে, অর্থাৎ ওদেদের ছেলে নবী অসরিয়ের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে সাহস পেলেন। তিনি এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের সমস্ত এলাকা থেকে এবং তাঁর অধিকার করা আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকার গ্রাম ও শহরগুলো থেকে জঘন্য মূর্তিগুলো ধ্বংস করে দিলেন। তিনি মাবুদের ঘরের বারান্দার সামনে রাখা মাবুদের কোরবানগাহ্‌টি মেরামত করলেন। তারপর তিনি এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের সমস্ত লোকদের এবং আফরাহীম, মানশা ও শিমিয়োন এলাকার যে সব লোকেরা তাদের মধ্যে বাস করছিল তাদের এক সংগে জমায়েত করলেন। আসার মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর সংগে আছেন দেখে ইসরাইলের অনেক লোক তাঁর পক্ষ নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিল। আসার রাজত্বের পনেরো বছরের তৃতীয় মাসে এই লোকেরা জেরুজালেমে এসে জমায়েত হয়েছিল। তারা যা লুট করে এনেছিল তার মধ্য থেকে সেই সময় তারা সাতশো গরু ও সাত হাজার ভেড়া মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিল। তারা এই ওয়াদা করল যে, তারা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবে; ছোট-বড়, স্ত্রী-পুরুষ যে-ই হোক না কেন যারা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবে না তাদের হত্যা করা হবে। তারা আনন্দে চিৎকার করে এবং তূরী ও শিংগা বাজিয়ে মাবুদের কাছে জোরে জোরে কসম খেল। এই কসমে এহুদা দেশের সমস্ত লোক আনন্দ করল, কারণ সমস্ত দিল দিয়ে তারা সেই কসম খেয়েছিল। তারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানতে চেয়েছিল বলে তা জানতে পেরেছিল। তাই মাবুদ সব দিক থেকেই তাদের শান্তি দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ আসা তাঁর দাদী মা মাখাকে রাজমাতার পদ থেকে সরিয়ে দিলেন, কারণ তিনি একটা জঘন্য আশেরা-মূর্তি তৈরী করিয়েছিলেন। আসা সেটা কেটে ফেলে, ভেংগে কিদ্রোণ উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। যদিও পূজার উঁচু স্থানগুলো তিনি ইসরাইল থেকে ধ্বংস করেন নি তবুও সারা জীবন তাঁর দিল মাবুদের প্রতি ভয়ে পূর্ণ ছিল। তিনি ও তাঁর পিতা যে সব সোনা-রূপা ও অন্যান্য জিনিস পবিত্র করে রেখেছিলেন সেগুলো তিনি আল্লাহ্‌র ঘরে নিয়ে গেলেন। আসার রাজত্বের পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত আর কোন যুদ্ধ হয় নি। আসার রাজত্বের ছত্রিশ বছরের সময়ে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশা এহুদার লোকদের বিরুদ্ধে গিয়ে রামা শহরটা কেল্লার মত করে গড়ে তুলতে লাগলেন যাতে কেউ এহুদার বাদশাহ্‌ আসার কাছে যাওয়া-আসা করতে না পারে। তখন আসা মাবুদের ঘর ও তাঁর নিজের রাজবাড়ীর ভাণ্ডার থেকে সোনা ও রূপা বের করে নিয়ে সিরিয়া দেশের বাদশাহ্‌ বিন্‌হদদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বিন্‌হদদ দামেস্ক শহরে বাস করতেন। আসা তাঁকে বলে পাঠালেন, “আমার বাবা ও আপনার বাবার মত আসুন, আমরাও আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি করি। আমি আপনাকে এই সব সোনা ও রূপা উপহার পাঠালাম। আপনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশার সংগে এখন চুক্তি ভেংগে ফেলুন, তাতে সে আমার কাছ থেকে চলে যাবে।” বাদশাহ্‌ আসার কথায় রাজী হয়ে বিন্‌হদদ ইসরাইলের গ্রাম ও শহরগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর সেনাপতিদের পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ইয়োন, দান, আবেল-ময়িম ও নপ্তালির সমস্ত ভাণ্ডার-শহরগুলো দখল করে নিলেন। বাশা এই কথা শুনে রামা শহর শক্তিশালী করে গড়ে তুলবার কাজ বন্ধ করে দিলেন। তখন বাদশাহ্‌ আসা এহুদার সমস্ত লোকদের নিয়ে এসে বাশা যে সব পাথর ও কাঠ ব্যবহার করছিলেন সেগুলো রামা থেকে নিয়ে গেলেন। সেগুলো দিয়ে তিনি গেবা ও মিসপা গ্রাম কেল্লার মত করে গড়ে তুললেন। সেই সময় নবী হনানি এসে এহুদার বাদশাহ্‌ আসাকে বললেন, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা না করে আপনি সিরিয়ার বাদশাহ্‌র উপর ভরসা করেছিলেন বলে সিরিয়ার বাদশাহ্‌র সৈন্যদল আপনার হাতছাড়া হয়ে গেছে। ইথিওপীয় ও লিবীয়দের কি অনেক রথ ও ঘোড়সওয়ার সুদ্ধ একটা বিরাট সৈন্যদল ছিল না? কিন্তু আপনি মাবুদের উপর ভরসা করেছিলেন বলে তিনি আপনার হাতে তাদের তুলে দিয়েছিলেন। যাদের দিল মাবুদের প্রতি ভয়ে পূর্ণ থাকে তাদের রক্ষা করবার জন্য তাঁর চোখ দুনিয়ার সব জায়গায় থাকে। আপনি বোকামির কাজ করেছেন। এখন থেকে আপনি বারবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন।” এই কথা শুনে আসা সেই নবীর উপর ভীষণ রাগ করে তাঁকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিলেন। একই সময়ে আসা কতগুলো লোকের উপর জুলুম করলেন। আসার অন্যান্য কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত “এহুদা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। আসার রাজত্বের ঊনচল্লিশ বছরের সময় তাঁর পায়ে একটা রোগ হল। তাঁর এই রোগ ভীষণ হলেও তিনি মাবুদের সাহায্য না চেয়ে কেবল ডাক্তারদের সাহায্য নিলেন। পরে তাঁর রাজত্বের একচল্লিশ বছরের সময় তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। নানা রকম মসলা ও মিশানো খোশবু জিনিসে পরিপূর্ণ খাটে লোকেরা তাঁকে শোয়াল এবং দাউদ-শহরে তিনি নিজের জন্য যে কবর ঠিক করে রেখেছিলেন তারা সেখানে তাঁকে দাফন করল। লোকেরা তাঁর সম্মানে বিরাট একটা আগুন জ্বালাল। আসার জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোশাফট বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী করে তুললেন। এহুদার সমস্ত দেয়াল-ঘেরা শহর ও গ্রামগুলোতে তিনি সৈন্যদল রাখলেন এবং এহুদা দেশ ও তাঁর পিতার দখল করা আফরাহীম এলাকার গ্রাম ও শহরগুলোতেও সৈন্য রাখলেন। সেইজন্য মাবুদ তাঁর অধীনে রাজ্য স্থির রাখলেন। এহুদার সমস্ত লোক যিহোশাফটকে উপহার দিল; এতে তাঁর অনেক ধন-সম্পদ ও সম্মান বেড়ে গেল। মাবুদের পথে চলতে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। তা ছাড়া তিনি এহুদা দেশ থেকে পূজার উঁচু স্থানগুলো ও আশেরা-খুঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বের তৃতীয় বছরের সময় তিনি এহুদার সমস্ত গ্রাম ও শহরের লোকদের শিক্ষা দেবার জন্য তাঁর কর্মচারী বিন্‌-হয়িল, ওবদিয়, জাকারিয়া, নথনেল ও মিকায়কে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁদের সংগে ছিলেন শময়িয়, নথনিয়, সবদিয়, অসাহেল, শমীরামোৎ, যিহোনাথন, অদোনিয়, টোবিয় ও টোব্‌-অদোনীয় নামে কয়েকজন লেবীয় এবং ইলীশামা ও যিহোরাম নামে দু’জন ইমাম। মাবুদের দেওয়া তৌরাত কিতাব সংগে নিয়ে তাঁরা এহুদা দেশের সব জায়গায় তা থেকে শিক্ষা দিলেন। এহুদা দেশের আশেপাশের সব রাজ্যের উপর মাবুদের কাছ থেকে এমন ভয় নেমে আসল যে, তারা যিহোশাফটের সংগে যুদ্ধ করল না। কয়েকজন ফিলিস্তিনী খাজনা হিসাবে যিহোশাফটের কাছে উপহার ও রূপা নিয়ে আসল এবং আরবীয়রা নিয়ে আসল সাত হাজার সাতশো ভেড়া আর সাত হাজার সাতশো ছাগল। এইভাবে যিহোশাফট আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে লাগলেন। তিনি এহুদা দেশে কতগুলো কেল্লা ও ভাণ্ডার-শহর তৈরী করলেন। তিনি এহুদার শহরগুলোতে অনেক জিনিসপত্র মজুদ করলেন এবং জেরুজালেমে দক্ষ যোদ্ধাদের রাখলেন। বংশ অনুসারে তাদের সংখ্যা ও সেনাপতিদের নাম এই: এহুদা-গোষ্ঠী থেকে- প্রধান সেনাপতি অদ্‌ন ও তাঁর তিন লক্ষ যোদ্ধা; দ্বিতীয় সেনাপতি যিহোহানন ও তাঁর দুই লক্ষ আশি হাজার যোদ্ধা; তৃতীয় সেনাপতি সিখ্রির ছেলে অমসিয় ও তাঁর দুই লক্ষ যোদ্ধা। অমসিয় মাবুদের কাজে নিজেকে কোরবানী করেছিলেন। বিন্যামীন-গোষ্ঠী থেকে- নাম-করা বীর প্রধান সেনাপতি ইলিয়াদা ও তাঁর ধনুক ও ঢালধারী দুই লক্ষ যোদ্ধা; দ্বিতীয় সেনাপতি যিহোষাবদ ও তাঁর এক লক্ষ আশি হাজার দক্ষ যোদ্ধা। এই সব যোদ্ধারা বাদশাহ্‌র কাজে নিযুক্ত ছিল। এরা ছাড়াও এহুদার দেয়াল-ঘেরা গ্রাম ও শহরগুলোতে আরও সৈন্য রাখা হয়েছিল। যিহোশাফটের অনেক ধন-সম্পদ ও সম্মান ছিল। তিনি বিয়ের মধ্য দিয়ে আহাবের সংগে বন্ধুত্ব করলেন। তবে যিহোশাফট ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে এই কথাও বললেন, “আপনি প্রথমে মাবুদের পরামর্শ নিন।” কাজেই ইসরাইলের বাদশাহ্‌ নবীদের ডেকে একত্র করলেন। তাদের সংখ্যা ছিল চারশো। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “রামোৎ-গিলিয়দের বিরুদ্ধে কি আমরা যুদ্ধ করতে যাব, না যাব না?” তারা বলল, “যান, কারণ আল্লাহ্‌ ওটা বাদশাহ্‌র হাতেই তুলে দেবেন।” কিন্তু যিহোশাফট বললেন, “এখানে কি মাবুদের কোন নবী নেই যার কাছে আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি?” জবাবে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফটকে বললেন, “এখনও এমন একজন লোক আছে যার মধ্য দিয়ে আমরা মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারি, কিন্তু আমি তাকে ঘৃণা করি, কারণ সে আমার সম্বন্ধে কখনও উন্নতির কথা বলে না, সব সময় অবনতির কথাই বলে। সে হল য্নিের ছেলে মিকায়।” জবাবে যিহোশাফট বললেন, “বাদশাহ্‌ যেন ঐরকম কথা না বলেন।” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাঁর একজন কর্মচারীকে ডেকে বললেন, “তুমি এখনই য্নিের ছেলে মিকায়কে ডেকে নিয়ে এস।” ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ও এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট রাজপোশাক পরে সামেরিয়া শহরের দরজার কাছে গম ঝাড়বার জায়গায় তাঁদের সিংহাসনের উপরে বসে ছিলেন আর নবীরা সবাই তাঁদের সামনে ভবিষ্যতের কথা বলছিল। তখন কনানার ছেলে সিদিকিয় লোহার শিং তৈরী করে নিয়ে এই কথা ঘোষণা করল, “মাবুদ বলছেন যে, সিরীয়রা শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আপনি এগুলো দিয়েই তাদের আঘাত করতে থাকবেন।” অন্যান্য নবীরাও একই রকম কথা বলল। তারা বলল, “রামোৎ-গিলিয়দ আক্রমণ করে তা জয় করে নিন, কারণ মাবুদ সেটা মহারাজের হাতে তুলে দেবেন।” যে লোকটি মিকায়কে ডেকে আনতে গিয়েছিল সে তাঁকে বলল, “দেখুন, অন্যান্য নবীরা সবাই একবাক্যে বাদশাহ্‌র সফলতার কথা বলছেন। আপনার কথাও যেন তাঁদের কথার মতই হয়। আপনি উন্নতির কথাই বলবেন।” কিন্তু মিকায় বললেন, “আল্লাহ্‌র কসম যে, আমার মাবুদ যা বলবেন আমি কেবল সেই কথাই বলব।” মিকায় আসলে পর বাদশাহ্‌ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মিকায়, আমরা কি রামোৎ-গিলিয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাব, না যাব না?” জবাবে মিকায় বললেন, “জ্বী, যান যান, আক্রমণ করে জয়লাভ করুন, কারণ সেখানকার লোকদের আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।” বাদশাহ্‌ তাঁকে বললেন, “কতবার আমি তোমাকে এই কসম খেতে বলব যে, মাবুদের নামে তুমি সত্যি কথা ছাড়া আর কিছু বলবে না?” জবাবে মিকায় বললেন, “আমি দেখলাম, বনি-ইসরাইলরা সবাই রাখালহীন ভেড়ার মত পাহাড়ের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই মাবুদ বললেন, ‘এদের কোন মালিক নেই, কাজেই তারা শান্তিতে যে যার বাড়ীতে চলে যাক।’ ” তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোশাফটকে বললেন, “আমি কি আপনাকে আগেই বলি নি যে, সে আমার সম্বন্ধে অবনতি ছাড়া উন্নতির কথা বলবে না?” মিকায় বলতে লাগলেন, “তাহলে আপনারা মাবুদের কথা শুনুন। আমি দেখলাম, মাবুদ তাঁর সিংহাসনে বসে আছেন এবং তাঁর ডান ও বাঁ দিকে সমস্ত ফেরেশতারা রয়েছেন। তখন মাবুদ বললেন, ‘রামোৎ-গিলিয়দ আক্রমণ করবার জন্য কে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাবকে ভুলিয়ে সেখানে নিয়ে যাবে যাতে সে মারা যায়?’ তখন এক একজন এক এক কথা বললেন। শেষে একটি রূহ্‌ এগিয়ে এসে মাবুদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাব।’ মাবুদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন করে করবে?’ সে বলল, ‘আমি গিয়ে তার সব নবীদের মুখে মিথ্যা বলবার রূহ্‌ হব।’ মাবুদ বললেন, ‘তুমিই তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তুমি গিয়ে তা-ই কর।’ এইজন্যই মাবুদ এখন আপনার এই নবীদের মুখে মিথ্যা বলবার রূহ্‌ দিয়েছেন। আপনার সর্বনাশ হবার জন্য মাবুদ রায় দিয়েছেন।” তখন কনানার ছেলে সিদিকিয় গিয়ে মিকায়ের গালে চড় মেরে বলল, “মাবুদের রূহ্‌ তোর সংগে কথা বলবার জন্য আমার কাছ থেকে বেরিয়ে কোন্‌ পথে গিয়েছিলেন?” জবাবে মিকায় বললেন, “তুমি সেই দিন তা জানতে পারবে যেদিন তুমি নিজেকে লুকাবার জন্য ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকবে।” ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তখন এই হুকুম দিলেন, “মিকায়কে শহরের শাসনকর্তা আমোন ও রাজপুত্র যোয়াশের কাছে আবার পাঠিয়ে দাও। তাদের বল বাদশাহ্‌ বলেছেন এই লোকটিকে যেন জেলে রাখা হয় এবং বাদশাহ্‌ নিরাপদে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে অল্প পানি ও অল্প রুটি ছাড়া আর কিছু না দেওয়া হয়।” তখন মিকায় বললেন, “যদি আপনি সত্যিই নিরাপদে ফিরে আসেন তবে জানবেন মাবুদ আমার মধ্য দিয়ে কথা বলেন নি।” তারপর তিনি আবার বললেন, “আপনারা সবাই আমার কথাটা শুনে রাখুন।” এর পরে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ আহাব ও এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট রামোৎ-গিলিয়দ আক্রমণ করতে গেলেন। আহাব যিহোশাফটকে বললেন, “আমাকে যাতে লোকেরা চিনতে না পারে সেইজন্য আমি অন্য পোশাক পরে যুদ্ধে যোগ দেব, কিন্তু আপনি আপনার রাজপোশাকই পরুন।” এই বলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ অন্য পোশাক পরে যুদ্ধ করতে গেলেন। সিরিয়ার বাদশাহ্‌ তাঁর রথগুলোর সেনাপতিদের এই হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, “একমাত্র ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ছাড়া আপনারা ছোট কি বড় আর কারও সংগে যুদ্ধ করবেন না।” রথের সেনাপতিরা যিহোশাফটকে দেখে ভেবেছিলেন যে, তিনি নিশ্চয়ই ইসরাইলের বাদশাহ্‌। কাজেই তাঁরা ফিরে তাঁকে আক্রমণ করতে গেলেন কিন্তু যিহোশাফট চেঁচিয়ে উঠলেন, তখন মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁকে সাহায্য করলেন আর তাতে তাঁরা তাঁর কাছ থেকে চলে গেলেন। এতে সেনাপতিরা বুঝলেন যে, তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌ নন, সেইজন্য তাঁরা আর তাঁর পিছনে তাড়া করলেন না। কিন্তু একজন লোক লক্ষ্য স্থির না করেই তার ধনুকে টান দিয়ে ইসরাইলের বাদশাহ্‌র বুক ও পেটের বর্মের মাঝামাঝি ফাঁকে আঘাত করে বসল। তখন বাদশাহ্‌ তাঁর রথচালককে বললেন, “রথ ঘুরিয়ে তুমি যুদ্ধের জায়গা থেকে আমাকে বাইরে নিয়ে যাও। আমি আঘাত পেয়েছি।” সারা দিন ধরে ভীষণ যুদ্ধ চলল আর ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে রথের মধ্যে সিরীয়দের মুখোমুখি করে বসিয়ে রাখা হল, আর সূর্য ডুবে যাবার সময় তিনি মারা গেলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট জেরুজালেমে তাঁর রাজবাড়ীতে নিরাপদে ফিরে আসলেন। তখন হনানির ছেলে নবী যেহূ বের হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “দুষ্টদের সাহায্য করা এবং যারা মাবুদকে ঘৃণা করে তাদের ভালবাসা কি আপনার উচিত হয়েছে? এইজন্য মাবুদের গজব আপনার উপর নেমে এসেছে। তবে আপনার মধ্যে কিছু ভালও আছে, কারণ আপনি দেশের আশেরা-খুঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার জন্য আপনার মন স্থির করেছেন।” যিহোশাফট জেরুজালেমে বাস করতেন। তিনি বের্‌-শেবা থেকে শুরু করে আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকা পর্যন্ত লোকদের কাছে গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে আবার তাদের মন ফিরিয়ে আনলেন। তিনি দেশের মধ্যে, অর্থাৎ এহুদার প্রত্যেকটি দেয়াল-ঘেরা গ্রাম ও শহরে বিচারকদের নিযুক্ত করলেন। তিনি বিচারকদের বললেন, “আপনারা সাবধান হয়ে সব কাজ করবেন, কারণ আপনারা কোন মানুষের জন্য নয় বরং মাবুদের জন্যই বিচার করবেন। বিচারের রায় দেবার সময় তিনি আপনাদের সংগে থাকবেন। মাবুদের প্রতি ভয় আপনাদের মধ্যে থাকুক। সাবধানে বিচার করবেন, কারণ অবিচার, একচোখামী কিংবা ঘুষ খাওয়ার সংগে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোন সম্বন্ধ নেই।” বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে বাসকারী আপনাদের লোকদের কাছ থেকে যে কোন মামলা আসুক না কেন্ত সেটা রক্তপাত হোক বা শরীয়ত, হুকুম, নিয়ম কিংবা নির্দেশের ব্যাপারেই হোক- আপনারা তাদের সতর্ক করে দেবেন যেন তারা মাবুদের চোখে দোষী না হয়। তা না হলে আপনাদের ও আপনাদের লোকদের উপর মাবুদের গজব নেমে আসবে। আপনারা এইভাবে কাজ করুন, তাহলে আপনারা দোষী হবেন না। “মাবুদের সব ব্যাপারে প্রধান ইমাম অমরিয় এবং বাদশাহ্‌র সব ব্যাপারে এহুদা-গোষ্ঠীর নেতা ইসমাইলের ছেলে সবদিয় আপনাদের উপরে নিযুক্ত থাকবেন, আর লেবীয়রা আপনাদের সাহায্য করবেন। আপনারা সাহসের সংগে কাজ করুন। যাঁরা ন্যায়ভাবে কাজ করবেন মাবুদ তাঁদের সংগে থাকবেন।” এর পরে মোয়াবীয়রা, অম্মোনীয়রা ও মায়োনীয়দের কিছু লোক যিহোশাফটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসল। তখন কয়েকজন লোক এসে যিহোশাফটকে বলল, “সাগরের ওপারের সিরিয়া দেশ থেকে এক বিরাট সৈন্যদল আপনার বিরুদ্ধে আসছে। তারা হৎসসোন্ততামরে, অর্থাৎ ঐন্‌-গদীতে এসে গেছে।” এতে যিহোশাফট ভয় পেয়ে স্থির করলেন যে, তিনি মাবুদের কাছে সাহায্য চাইবেন। তিনি এহুদা দেশের সব জায়গায় রোজা রাখবার কথা ঘোষণা করলেন। এহুদার লোকেরা মাবুদের সাহায্য চাইবার জন্য এসে একত্র হল; এমন কি, এহুদার সমস্ত গ্রাম থেকেও লোকেরা এসেছিল। তখন যিহোশাফট মাবুদের ঘরের নতুন উঠানে এহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্‌, আমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ, তুমি তো বেহেশতের মাবুদ। তুমি সমস্ত জাতির রাজ্যগুলো শাসন করে থাক। ক্ষমতা ও শক্তি তোমারই হাতে এবং কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারে না। হে আমাদের আল্লাহ্‌, তোমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে এই দেশের বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিয়ে তুমি তা তোমার বন্ধু ইব্রাহিমের বংশের লোকদের চিরকালের জন্য দিয়েছ। তারা সেখানে বাস করেছে এবং তোমারই জন্য একটা পবিত্র ঘর তৈরী করে বলেছে, ‘যদি কোন বিপদ আমাদের উপরে আস্তে তা যুদ্ধ বা শাস্তি কিংবা মহামারী অথবা দুর্ভিক্ষ হোক- তবে আমরা তখন এই ঘরের সামনে, অর্থাৎ তোমার সামনে দাঁড়াব, কারণ তুমি এই ঘরে বাস কর। আমাদের কষ্টের সময় আমরা তোমার কাছে কাঁদব, আর তুমি আমাদের কথা শুনে আমাদের উদ্ধার করবে।’ “এখন অম্মোন ও মোয়াব এবং সেয়ীর পাহাড়ের লোকেরা এখানে এসেছে। যখন বনি-ইসরাইলরা মিসর থেকে বের হয়ে আসছিল তখন তুমি এদের দেশে তাদের ঢুকতে দাও নি। কাজেই তারা তাদের ধ্বংস না করে তাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিল। অধিকার হিসাবে যে সম্পত্তি তুমি আমাদের দিয়েছ এখন দেখ, তার বদলে তারা কেমন করে সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিতে আসছে। হে আমাদের আল্লাহ্‌, তুমি কি তাদের বিচার করবে না? এই যে বিরাট সৈন্যদল আমাদের আক্রমণ করতে আসছে তাদের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আমাদের নেই। কি করতে হবে তা আমরা জানি না, কিন্তু আমরা কেবল তোমার দিকে চেয়ে আছি।” সেই সময় এহুদার সমস্ত লোক তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও শিশুদের নিয়ে সেখানে মাবুদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন সেই দলের মধ্যে যহসীয়েল নামে আসফের বংশের একজন লেবীয়ের উপর মাবুদের রূহ্‌ আসলেন। যহসীয়েল ছিলেন জাকারিয়ার ছেলে, জাকারিয়া বনায়ের ছেলে, বনায় যিয়েলের ছেলে, যিয়েল মত্তনিয়ের ছেলে। যহসীয়েল বললেন, “হে বাদশাহ্‌ যিহোশাফট ও আপনারা যারা এহুদা আর জেরুজালেমে বাস করেন, সবাই শুনুন। মাবুদ আপনাদের কাছে এই কথা বলছেন, ‘এই বিরাট সৈন্যদল দেখে তোমরা ভয় পেয়ো না বা নিরাশ হোয়ো না। এই যুুদ্ধ আল্লাহ্‌র, তোমাদের নয়। আগামী কাল তোমরা তাদের বিরুদ্ধে বের হবে। তখন তারা সীস নামে পাহাড়ের পথ দিয়ে উঠে আসবে। তোমরা যিরূয়েল নামে মরুভূমির কাছে উপত্যকার শেষের দিকে তাদের পাবে। এই যুদ্ধ তোমাদের করতে হবে না। হে এহুদা ও জেরুজালেমের লোকেরা, তোমরা সারি বেঁধে দাঁড়ায়ো এবং মাবুদ তোমাদের কিভাবে উদ্ধার করেন তা দেখো। তোমরা ভয় কোরো না, নিরাশ হয়ো না। তোমরা কালকে গিয়ে তাদের মুখোমুখি হবে আর মাবুদ তোমাদের সংগে থাকবেন।’ ” তখন যিহোশাফট মাটিতে সেজদায় পড়লেন এবং এহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত লোক এবাদত করবার জন্য মাবুদের সামনে মাটিতে সেজদায় পড়ল। তারপর কহাতীয় ও কারুনীয় বংশের অনেক লেবীয় উঠে দাঁড়িয়ে খুব জোরে জোরে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। পরের দিন খুব সকালে তারা তকোয় মরুভূমির দিকে রওনা হল। তারা রওনা হবার আগে যিহোশাফট দাঁড়িয়ে বললেন, “হে এহুদা ও জেরুজালেমের লোকেরা, আমার কথা শুনুন। আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করুন, তাহলে আপনারা স্থির থাকতে পারবেন। তাঁর নবীদের উপর ঈমান রাখুন, তাতে আপনারা সফল হবেন।” যিহোশাফট লোকদের সংগে পরামর্শ করে মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী ও তাঁর মহিমাপূর্ণ পবিত্রতার প্রশংসা করবার জন্য লোকদের নিযুক্ত করলেন যেন তারা সৈন্যদলের আগে আগে এই কথা বলতে বলতে যায়, “মাবুদের শুকরিয়া আদায় কর, কারণ তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” এহুদার লোকেরা মরুভূমির উঁচু পাহারা-ঘরে এসে সেই বিরাট সৈন্যদলের দিকে তাকিয়ে দেখল যে, মাটিতে কেবল লাশ পড়ে রয়েছে; কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারে নি। তখন যিহোশাফট ও তাঁর লোকেরা লুটের জিনিস আনতে গিয়ে সেই লাশগুলোর সংগে এত বেশী পরিমাণে জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় ও ধন্তরত্ন দেখতে পেল যে, তারা সেগুলো বয়ে নিয়ে যেতে পারল না। লুটের জিনিস বেশী হওয়াতে তা নিয়ে যেতে তাদের তিন দিন লাগল। চতুর্থ দিনে তারা বরাখা উপত্যকায় জমায়েত হয়ে মাবুদের প্রশংসা করল। এইজন্য আজও সেই জায়গাকে বলা হয় বরাখা উপত্যকা (যার মানে “প্রশংসা”)। তারপর যিহোশাফটের পিছনে পিছনে এহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত লোক আনন্দ করতে করতে জেরুজালেমে ফিরে আসল, কারণ তাদের শত্রুদের উপরে মাবুদ তাদের জয় দান করেছিলেন। তারা বীণা, সুরবাহার ও শিংগা বাজাতে বাজাতে জেরুজালেমে ফিরে এসে মাবুদের ঘরে গেল। ইসরাইলের শত্রুদের বিরুদ্ধে মাবুদ কেমন করে যুদ্ধ করেছেন সেই কথা শুনে অন্যান্য দেশের সমস্ত লোকদের উপর মাবুদ সম্বন্ধে একটা ভয় নেমে আসল। এতে যিহোশাফটের রাজ্য শান্তিতে রইল, কারণ তাঁর আল্লাহ্‌ সব দিকেই তাঁকে শান্তি দিয়েছিলেন। যিহোশাফট পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এহুদার বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং পঁচিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল অসূবা; তিনি ছিলেন শিল্‌হির মেয়ে। যিহোশাফট তাঁর বাবা আসার পথে চলতেন এবং কখনও সেই পথ ছেড়ে যান নি। মাবুদের চোখে যা ঠিক তিনি তা-ই করতেন। কিন্তু পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করা হয় নি, কারণ তখনও লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌র প্রতি মন স্থির করে নি। যিহোশাফটের অন্যান্য কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হনানির ছেলে যেহূ লিখেছিলেন; তা “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে পাওয়া যায়। পরে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোশাফট ইসরাইলের বাদশাহ্‌ অহসিয়ের সংগে যোগ দিলেন। অহসিয় অন্যায় কাজ করতেন। যিহোশাফট তাঁর সংগে মিলে তর্শীশে যাবার জন্য কতগুলো বড় বড় জাহাজ তৈরী করতে রাজী হলেন। সেগুলো ইৎসিয়োন-গেবরে তৈরী করা হল। তখন মারেশার দোদাবাহূর ছেলে ইলীয়েষর যিহোশাফটের বিরুদ্ধে এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, “আপনি অহসিয়ের সংগে যোগ দিয়েছেন বলে আপনি যা তৈরী করেছেন তা মাবুদ ধ্বংস করবেন।” পরে সেই জাহাজগুলো ভেংগে গেল, তর্শীশে যেতে পারল না। পরে যিহোশাফট তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং দাউদ-শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যিহোরাম বাদশাহ্‌ হলেন। তাঁর ভাইদের, অর্থাৎ যিহোশাফটের ছেলেদের নাম ছিল অসরিয়, যিহীয়েল, জাকারিয়া, অসরিয়, মিকাইল ও শফটিয়। এরা সবাই ছিল বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ যিহোশাফটের ছেলে। তাদের পিতা তাদের সোনা, রূপা ও দামী দামী জিনিস এবং এহুদা দেশে দেয়াল-ঘেরা গ্রাম ও শহর দিয়েছিলেন, কিন্তু যিহোরাম বড় ছেলে বলে তাঁকে রাজ্য দিয়েছিলেন। যিহোরাম তাঁর পিতার রাজ্য নিজের অধীনে এনে নিজেকে শক্তিশালী করলেন। তিনি নিজের সমস্ত ভাইদের ও ইসরাইলের কয়েকজন উঁচু পদের কর্মচারীকে হত্যা করলেন। যিহোরাম বত্রিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে আট বছর রাজত্ব করেছিলেন। আহাবের বংশের লোকদের মতই তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের পথে চলতেন, কারণ তিনি আহাবের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তবুও মাবুদ দাউদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন সেইজন্য তাঁর বংশকে তিনি ধ্বংস করতে চাইলেন না। তিনি দাউদ ও তাঁর বংশধরদের চিরকাল একটা বাতি দেবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। যিহোরামের সময়ে ইদোম দেশের লোকেরা এহুদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের জন্য একজন বাদশাহ্‌ ঠিক করে নিয়েছিল। কাজেই যিহোরাম তাঁর সেনাপতিদের ও সব রথ নিয়ে সেখানে গেলেন। ইদোমীয়রা তাঁকে ও তাঁর রথের সেনাপতিদের ঘেরাও করল, কিন্তু তিনি রাতের বেলায় উঠে ঘেরাও ভেংগে বেরিয়ে গেলেন। ইদোম আজও এহুদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে আছে। যিহোরাম তাঁর পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করেছিলেন বলে একই সময়ে লিব্‌নাও বিদ্রোহ করল। তিনি এহুদার পাহাড়গুলোর উপরে পূজার উঁচু স্থান তৈরী করালেন এবং তাঁর জন্য জেরুজালেমের লোকেরা মূর্তি পূজায় নিজেদের বিকিয়ে দিল আর এহুদার লোকেরা বিপথে চলে গেল। কাজেই মাবুদ এখন তোমার লোকদের, তোমার ছেলেদের ও তোমার স্ত্রীদের উপর ভয়ংকর আঘাত করবেন এবং তোমার সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংস করবেন। তুমি নিজেও পেটের অসুখে ভুগতে থাকবে আর সেই অসুখে তোমার নাড়িভূঁড়ি বের হয়ে আসবে।’ ” মাবুদ যিহোরামের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের এবং ইথিওপীয়দের কাছে বাস করা আরবীয়দের মনে শত্রুতার ভাব জাগিয়ে তুললেন। তারা এহুদা আক্রমণ করে সেখানে ঢুকে রাজবাড়ীর সব জিনিসপত্র এবং যিহোরামের ছেলেদের ও স্ত্রীদের নিয়ে গেল। তাঁর ছোট ছেলে অহসিয় (যিহোয়াহস) ছাড়া আর কোন ছেলে তাঁর কাছে রইল না। এই সমস্ত ঘটনার পরে মাবুদ যিহোরামকে এমন পেটের অসুখ দিলেন যা ভাল করা যায় না। পরে দ্বিতীয় বছরের শেষে সেই রোগের দরুন তাঁর নাড়িভূঁড়ি বের হয়ে আসল এবং তিনি খুব যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেলেন। লোকেরা তাঁর পূর্বপুরুষদের সম্মান দেখাবার জন্য যেমন আগুন জ্বালাত তাঁর বেলায় তা করল না। যিহোরাম বত্রিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং আট বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে কেউ দুঃখ প্রকাশ করে নি। দাউদ-শহরে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল কিন্তু বাদশাহ্‌দের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয় নি। জেরুজালেমের লোকেরা যিহোরামের ছোট ছেলে অহসিয়কে যিহোরামের জায়গায় বাদশাহ্‌ করল, কারণ লুটকারীরা আরবীয়দের সংগে লুট করতে এসে যিহোরামের সব বড় ছেলেদের হত্যা করেছিল। কাজেই এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোরামের ছেলে অহসিয় রাজত্ব করতে শুরু করলেন। অহসিয় বাইশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং এক বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মা অথলিয়া ছিলেন অম্রির নাতনী। অহসিয়ও আহাবের বংশের লোকদের পথে চলতেন, কারণ তাঁর মা তাঁকে খারাপ কাজ করবার জন্য পরামর্শ দিতেন। অহসিয় আহাবের বংশের লোকদের মতই মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন, কারণ তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে সেই বংশের লোকেরাই তাঁকে পরামর্শ দিত। তার ফলে তাঁর পতন হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ অহসিয়ের পতন ঘটালেন। অহসিয় সেখানে পৌঁছে যোরামের সংগে নিম্‌শির ছেলে যেহূর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। এই যেহূকেই মাবুদ আহাবের বংশকে ধ্বংস করবার জন্য অভিষেক করেছিলেন। যেহূ যখন আহাবের বংশের লোকদের শাস্তি দিচ্ছিলেন সেই সময় তিনি অহসিয়ের সাহায্যকারী এহুদার নেতাদের ও তাঁর সব ভাইয়ের ছেলেদের দেখতে পেয়ে তাদের হত্যা করলেন। তারপর তিনি অহসিয়ের খোঁজে বের হলেন। অহসিয় সামেরিয়াতে লুকিয়ে ছিলেন আর যেহূর লোকেরা তাঁকে ধরে যেহূর কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করল। তারা তাঁকে দাফন করল, কারণ তারা বলেছিল, “ইনি সেই যিহোশাফটের নাতি যিনি সমস্ত দিল দিয়ে মাবুদের ইচ্ছামত চলতেন।” অহসিয়ের বংশে বাদশাহ্‌ হওয়ার মত ক্ষমতা কারও ছিল না। অহসিয়ের মা অথলিয়া যখন দেখলেন যে, তাঁর ছেলে মারা গেছে তখন তিনি এহুদার বাদশাহ্‌র সমস্ত ছেলেদের ধ্বংস করলেন। সপ্তম বছরে যিহোয়াদা নিজেকে শক্তিশালী করে যিহোরামের ছেলে অসরিয়, যিহোহাননের ছেলে ইসমাইল, ওবেদের ছেলে অসরিয়, অদায়ার ছেলে মাসেয় ও সিখ্রির ছেলে ইলীশাফটের সংগে একটা চুক্তি করলেন। এঁরা সবাই ছিলেন শত-সেনাপতি। এখন আপনাদের যে কাজ করতে হবে তা এই: যে সব ইমাম ও লেবীয় বিশ্রামবারে বায়তুল-মোকাদ্দসে কাজ করবেন তাঁদের তিন ভাগের এক ভাগ দরজায় পাহারা দেবেন, এক ভাগ পাহারা দেবেন রাজবাড়ীতে আর এক ভাগ পাহারা দেবেন ভিত্তি-দরজায় এবং বাকী সবাই থাকবেন মাবুদের ঘরের উঠানে। ইমামেরা এবং এবাদত-কাজে থাকা লেবীয়রা ছাড়া আর কেউ মাবুদের ঘরে ঢুকবে না। এঁরা ঢুকবেন, কারণ এঁরা পাক-পবিত্র করা, কিন্তু অন্য সব লোক মাবুদের হুকুম অনুসারে বাইরে থাকবে। লেবীয়রা প্রত্যেকে নিজের নিজের অস্ত্র হাতে নিয়ে বাদশাহ্‌র চারপাশ ঘিরে থাকবেন। কেউ বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকলেই তাকে হত্যা করবেন। বাদশাহ্‌ যেখানেই যান না কেন আপনারা তাঁর কাছে কাছে থাকবেন।” ইমাম যিহোয়াদা যে হুকুম দিলেন লেবীয়রা ও এহুদার শত-সেনাপতিরা সবাই তা-ই করলেন। সেনাপতিরা প্রত্যেকে নিজের নিজের লোকদের, অর্থাৎ বিশ্রামবারে যারা কাজে পালা বদল করতে আসছিল এবং যারা কাজ থেকে ফিরছিল তাদের নিয়ে আসলেন। এদের কোন দলকেই ইমাম যিহোয়াদা ছুটি দেন নি। বাদশাহ্‌ দাউদের যে সব বর্শা এবং ছোট ও বড় ঢাল আল্লাহ্‌র ঘরে ছিল সেগুলো নিয়ে তিনি সেই সেনাপতিদের হাতে দিলেন। বাদশাহ্‌কে রক্ষা করবার জন্য যিহোয়াদা এই সব লোকদের প্রত্যেককে অস্ত্র হাতে বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে কোরবানগাহের কাছে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত দাঁড় করালেন। তারপর যিহোয়াদা ও তাঁর ছেলেরা বাদশাহ্‌র ছেলেকে বের করে এনে তাঁর মাথায় তাজ পরিয়ে দিলেন। তাঁরা তাঁর হাতে ব্যবস্থার কিতাবখানা দিলেন এবং তাঁকে বাদশাহ্‌ হিসাবে অভিষেক করলেন। তখন লোকেরা চিৎকার করে বলল, “বাদশাহ্‌ চিরজীবী হোন।” লোকদের দৌড়াদৌড়ি ও বাদশাহ্‌র প্রশংসা করবার আওয়াজ শুনে অথলিয়া মাবুদের ঘরে তাদের কাছে গেলেন। তিনি দেখলেন, মাবুদের ঘরে ঢুকবার পথে বাদশাহ্‌ তাঁর থামের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এবং সেনাপতিরা ও শিংগা বাদকেরা বাদশাহ্‌র পাশে রয়েছে। দেশের সব লোক আনন্দ করছে ও শিংগা বাজাচ্ছে আর কাওয়ালেরা বাজনা বাজিয়ে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইছে। এ দেখে অথলিয়া তাঁর পোশাক ছিঁড়ে চিৎকার করে বললেন, “এ তো বেঈমানী! বেঈমানী!” তখন ইমাম যিহোয়াদা সৈন্যদলের উপরে নিযুক্ত শত-সেনাপতিদের বাইরে এনে বললেন, “ওঁকে সৈন্যদের সারির মাঝখানে রেখে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। যে তাঁর পিছনে পিছনে আসবে তাকে হত্যা করবেন।” এর আগে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন যে, মাবুদের ঘরের মধ্যে অথলিয়াকে হত্যা করা উচিত হবে না। কাজেই তাঁরা অথলিয়াকে ধরলেন এবং রাজবাড়ীর ঘোড়া-দরজায় ঢুকবার পথে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করলেন। তারপর যিহোয়াদা, বাদশাহ্‌ ও লোকেরা মিলে এই চুক্তি করলেন যে, তাঁরা মাবুদের বান্দা হিসাবে চলবেন। তারপর সব লোক বাল দেবতার মন্দিরে গিয়ে সেটা ভেংগে ফেলল। তারা বেদী ও মূর্তিগুলো চুরমার করে দিল এবং বেদীগুলোর সামনে বাল দেবতার পুরোহিত মত্তনকে হত্যা করল। তারপর যিহোয়াদা মাবুদের ঘরের দেখাশোনার ভার ইমামদের হাতে দিলেন। এঁরা ছিলেন লেবীয়। এঁদের উপরে দাউদ মাবুদের ঘরের ভার দিয়েছিলেন যেন তাঁরা দাউদের হুকুম মত আনন্দের সংগে কাওয়ালী গেয়ে মূসার শরীয়ত অনুসারে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দিতে পারেন। কোন রকম নাপাক লোক যাতে ঢুকতে না পারে সেইজন্য তিনি মাবুদের ঘরের দরজাগুলোতে রক্ষীদের রাখলেন। যিহোয়াদা শত-সেনাপতিদের, গণ্যমান্য লোকদের, লোকদের নেতাদের ও দেশের সব লোকদের নিয়ে মাবুদের ঘর থেকে বাদশাহ্‌কে বের করে আনলেন। তাঁরা উঁচু জায়গার দরজা দিয়ে রাজবাড়ীতে গেলেন এবং বাদশাহ্‌কে রাজ-সিংহাসনে বসালেন। অথলিয়াকে হত্যা করা হলে পর শহরটা শান্ত হল এবং দেশের সব লোক আনন্দ করল। সাত বছর বয়সে যোয়াশ বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল সিবিয়া; তিনি বের্‌-শেবা শহরের মেয়ে। ইমাম যিহোয়াদার সমস্ত জীবনকালে যোয়াশ মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। যিহোয়াদা তাঁকে দু’টি বিয়ে করিয়েছিলেন এবং তাঁর ছেলেমেয়ে হয়েছিল। পরে যোয়াশ মাবুদের ঘর মেরামত করবার জন্য স্থির করলেন। তিনি ইমাম ও লেবীয়দের ডেকে একত্র করে বললেন, “আপনারা প্রতি বছর আপনাদের আল্লাহ্‌র ঘর মেরামত করবার জন্য সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে এহুদার সমস্ত গ্রাম ও শহরে যান। এই কাজটা আপনারা তাড়াতাড়ি করুন।” কিন্তু লেবীয়রা সেই কাজ তাড়াতাড়ি করল না। কাজেই বাদশাহ্‌ প্রধান ইমাম যিহোয়াদাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “সাক্ষ্য-তাম্বুর জন্য মাবুদের গোলাম মূসা ইসরাইলের সব লোকদের উপর যে খাজনা বসিয়েছিলেন তা এহুদা ও জেরুজালেম থেকে আদায় করবার জন্য আপনি লেবীয়দের পাঠিয়ে দেন নি কেন?” সেই দুষ্টা স্ত্রীলোক অথলিয়ার ছেলেরা মাবুদের ঘর ভেংগে ঢুকেছিল এবং পাক-পবিত্র জিনিসগুলো পর্যন্ত বাল দেবতার পূজায় ব্যবহার করেছিল। বাদশাহ্‌র হুকুমে একটা বাক্স তৈরী করে মাবুদের ঘরের দরজার ঠিক বাইরে রাখা হল। তারপর এহুদা ও জেরুজালেমে একটা ঘোষণা দেওয়া হল যে, আল্লাহ্‌র গোলাম মূসা মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের উপর যে খাজনা বসিয়েছিলেন তা যেন লোকেরা মাবুদের কাছে নিয়ে আসে। এর ফলে নেতারা ও লোকেরা খুশী হয়ে তাদের খাজনা এনে সেই বাক্সে ফেলতে লাগল; এতে বাক্সটা ভরে উঠত। লেবীয়রা প্রত্যেক দিন সেই বাক্সটা বাদশাহ্‌র কর্মচারীদের কাছে নিয়ে আসত। যখন তার মধ্যে অনেক টাকা দেখা যেত তখন বাদশাহ্‌র লেখক ও প্রধান ইমামের কর্মচারী এসে বাক্সটা খালি করে আবার সেটা তার জায়গায় রেখে আসতেন। এইভাবে অনেক টাকা জমা হল। যাদের উপর মাবুদের ঘর মেরামতের দায়িত্ব ছিল বাদশাহ্‌ ও যিহোয়াদা সেই টাকা তাদের হাতে দিলেন। তারা মাবুদের ঘর আবার ঠিক করবার জন্য রাজমিস্ত্রি ও কাঠের মিস্ত্রি লাগিয়েছিল এবং লোহা ও ব্রোঞ্জের কারিগরও লাগিয়েছিল। যারা মেরামতের কাজ করছিল তারা খুব পরিশ্রম করত, আর তাদের কাজ এগিয়ে চলল। আল্লাহ্‌র ঘরটি তারা আগের অবস্থায় নিয়ে আসল এবং সেটি খুব মজবুত করল। কাজ শেষ করে তারা বাকী টাকা বাদশাহ্‌ ও যিহোয়াদার কাছে নিয়ে আসল এবং সেই টাকা দিয়ে মাবুদের ঘরের এই সব জিনিস তৈরী করা হল- এবাদত-কাজের ও পোড়ানো-কোরবানীর জন্য জিনিসপত্র, হাতা ও অন্যান্য সোনা-রূপার জিনিস। যতদিন যিহোয়াদা বেঁচে ছিলেন ততদিন মাবুদের ঘরে নিয়মিত ভাবে পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া হত। যিহোয়াদা বুড়ো হয়ে পুরো বয়স পেলেন এবং একশো ত্রিশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলেন। ইসরাইলের মধ্যে আল্লাহ্‌ ও তাঁর ঘরের জন্য তিনি যে সব ভাল কাজ করেছিলেন সেইজন্য তাঁকে দাউদ-শহরে বাদশাহ্‌দের সংগে দাফন করা হল। যিহোয়াদার ইন্তেকালের পরে এহুদার নেতারা এসে বাদশাহ্‌কে সালাম জানালেন আর বাদশাহ্‌ তাঁদের কথাই শুনলেন। তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘর ত্যাগ করে আশেরা-খুঁটির ও মূর্তি পূজা করতে লাগলেন। তাঁদের এই গুনাহের জন্য আল্লাহ্‌র গজব এহুদা ও জেরুজালেমের উপর নেমে আসল। যদিও মাবুদ লোকদের তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনবার জন্য নবীদের পাঠালেন এবং তাঁরা লোকদের সাবধান করলেন তবুও তারা শুনল না। তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ ইমাম যিহোয়াদার ছেলে জাকারিয়ার উপর আসলেন। তিনি লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘মাবুদের হুকুম তোমরা অমান্য করছ কেন? তোমরা এতে সফল হবে না। তোমরা মাবুদকে ত্যাগ করেছ বলে তিনিও তোমাদের ত্যাগ করেছেন।’ ” কিন্তু লোকেরা জাকারিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল এবং বাদশাহ্‌র হুকুমে মাবুদের ঘরের উঠানে তাঁকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করল। জাকারিয়ার পিতা যিহোয়াদা বাদশাহ্‌ যোয়াশের প্রতি যে বিশ্বস্ততা দেখিয়েছিলেন তা যোয়াশ মনে না রেখে তাঁর ছেলেকে হত্যা করলেন। জাকারিয়া মারা যাবার সময় বলেছিলেন, “মাবুদ এই কাজ দেখে আপনাকে শাস্তি দেবেন।” পরের বছর সিরিয়ার সৈন্যেরা যোয়াশের বিরুদ্ধে আসল। তারা এহুদা ও জেরুজালেম আক্রমণ করে সব নেতাদের হত্যা করল এবং দামেস্কে তাদের বাদশাহ্‌র কাছে সমস্ত লুটের জিনিস পাঠিয়ে দিল। এহুদার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করেছিল বলে সিরীয় সৈন্যদলে কম লোক থাকলেও মাবুদ অনেক বড় সৈন্যদলকে তাদের হাতে তুলে দিলেন। এইভাবে সিরীয়দের দ্বারা যোয়াশকে শাস্তি দেওয়া হল। আহত অবস্থায় যোয়াশকে ফেলে রেখে সিরীয়রা চলে গেল। ইমাম যিহোয়াদার ছেলেকে হত্যা করবার দরুন যোয়াশের কর্মচারীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বিছানার উপরেই তাঁকে হত্যা করল। তিনি মারা গেলে পর তাঁকে দাউদ-শহরে দাফন করা হল, কিন্তু বাদশাহ্‌দের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হল না। যে কর্মচারীরা বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তারা হল শিমিয়ৎ নামে একজন অম্মোনীয় স্ত্রীলোকের ছেলে সাবদ ও শিম্রীৎ নামে একজন মোয়াবীয় স্ত্রীলোকের ছেলে যিহোষাবদ। যোয়াশের ছেলেদের কথা, তাঁর বিষয়ে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী এবং আল্লাহ্‌র ঘরের মেরামতের কথা “বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে অমৎসিয় বাদশাহ্‌ হলেন। অমৎসিয় পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং ঊনত্রিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিহোয়দ্দন; তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের মেয়ে। মাবুদের চোখে যা ভাল অমৎসিয় তা-ই করতেন তবে সমস্ত মন দিয়ে করতেন না। রাজ্যটা শক্তভাবে তাঁর অধীনে আনবার পর যে কর্মচারীরা বাদশাহ্‌কে, অর্থাৎ তাঁর বাবাকে হত্যা করেছিল তাদের তিনি হত্যা করলেন। কিন্তু তিনি তাদের ছেলেদের হত্যা করলেন না বরং মূসার কিতাবে যে শরীয়ত লেখা ছিল সেইমতই কাজ করলেন। সেই কিতাবে মাবুদের এই হুকুম লেখা ছিল, “ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদের হত্যা করা চলবে না, কিন্তু প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে।” অমৎসিয় এহুদার সমস্ত লোককে ডেকে একত্র করে বংশ অনুসারে সমস্ত এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের লোকদের মধ্য থেকে হাজার সৈন্যের সেনাপতিদের ও শত সৈন্যের সেনাপতিদের অধীনে রাখলেন। তিনি বিশ বছর কিংবা তারও বেশী বয়সের লোকদের গণনা করে দেখলেন যে, যুদ্ধে যাবার জন্য তিন লক্ষ উপযুক্ত লোক রয়েছে যারা বর্শা ও ঢাল ব্যবহার করতে জানে। তিনি তিন হাজার ন’শো কেজি রূপা দিয়ে ইসরাইল থেকে এক লক্ষ যোদ্ধা ভাড়া করলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র একজন বান্দা এসে তাঁকে বললেন, “হে মহারাজ, ইসরাইলের এই সৈন্যদল আপনার সংগে যেন না যায়, কারণ মাবুদ ইসরাইলের সংগে, অর্থাৎ আফরাহীমের কারও সংগে নেই। যদি আপনি তাদের নিয়ে যান তবে সাহসের সংগে যুদ্ধ করলেও শত্রুর কাছে আল্লাহ্‌ আপনাকে পরাজিত করবেন, কারণ সাহায্য করবার অথবা পরাজিত করবার ক্ষমতা আল্লাহ্‌র আছে।” তখন অমৎসিয় আল্লাহ্‌র বান্দাকে বললেন, “এই ইসরাইলীয় সৈন্যদের জন্য আমি যে তিন হাজার ন’শো কেজি রূপা দিয়েছি তার কি হবে?” জবাবে আল্লাহ্‌র বান্দা বললেন, “আল্লাহ্‌ আপনাকে তাঁর চেয়েও বেশী দিতে পারেন।” তখন অমৎসিয় আফরাহীম থেকে তাঁর কাছে আসা সৈন্যদলকে বিদায় করে তাদের বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। সেই সৈন্যেরা এহুদার লোকদের উপর ভয়ংকর রেগে আগুন হয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল। অমৎসিয় মনে সাহস নিয়ে লবণ উপত্যকায় তাঁর সৈন্যদলকে পরিচালনা করলেন। সেখানে তিনি সেয়ীরের দশ হাজার লোককে হত্যা করলেন। এহুদার সৈন্যেরা আরও দশ হাজার লোককে জীবিত ধরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে নীচে ফেলে দিল। এতে তারা সবাই একেবারে থেঁৎলে গেল। এদিকে যে সৈন্যদের অমৎসিয় যুদ্ধ করতে না দিয়ে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন তারা সামেরিয়া থেকে বৈৎ-হোরণ পর্যন্ত এহুদার সব গ্রাম ও শহর আক্রমণ করল। তারা তিন হাজার লোককে হত্যা করল এবং অনেক জিনিস লুট করে নিয়ে গেল। অমৎসিয় ইদোমীয়দের হত্যা করে ফিরে আসবার সময় সেয়ীরের লোকদের মূর্তিগুলো সংগে করে নিয়ে আসলেন। সেগুলোকে তিনি নিজের দেব-দেবী হিসাবে স্থাপন করে তাদের পূজা করতে ও তাদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাতে লাগলেন। এতে অমৎসিয়ের উপর মাবুদের রাগ জ্বলে উঠল। তিনি একজন নবীকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেই নবী বললেন, “ঐ লোকদের যে দেবতারা আপনার হাত থেকে তাদের লোকদের উদ্ধার করতে পারে নি আপনি কেন তাদের সাহায্য চাইলেন?” নবীর কথা শেষ না হতেই বাদশাহ্‌ তাঁকে বললেন, “আমরা কি বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা হিসাবে তোমাকে নিযুক্ত করেছি? তুমি থাম, নইলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।” এতে সেই নবী থামলেন, তবুও বললেন, “আমি জানি, আপনি এই কাজ করেছেন এবং আমার পরামর্শে কান দেন নি বলে আল্লাহ্‌ আপনাকে ধ্বংস করাই ঠিক করেছেন।” পরে এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয় তাঁর মন্ত্রীদের সংগে পরামর্শ করে যেহূর নাতি, অর্থাৎ যিহোয়াহসের ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশের কাছে বলে পাঠালেন, “আসুন, আমরা যুদ্ধের জন্য মুখোমুখি হই।” কিন্তু ইসরাইলের বাদশাহ্‌ জবাবে এহুদার বাদশাহ্‌কে বলে পাঠালেন, “লেবাননের এক শিয়ালকাঁটা লেবাননেরই এরস গাছের কাছে বলে পাঠাল, ‘আমার ছেলের সংগে আপনার মেয়ের বিয়ে দিন।’ তারপর লেবাননের একটা বুনো জন্তু এসে সেই শিয়ালকাঁটাকে পায়ে মাড়িয়ে দিল। ‘ইদোমকে হারিয়ে দিয়েছি,’ মনে মনে এই কথা ভেবে আপনি অহংকারে ফুলে উঠেছেন। এখন আপনি নিজের ঘরে থাকুন। কেন বিপদ ডেকে আনবেন এবং তার সংগে ডেকে আনবেন নিজের ও এহুদার ধ্বংস?” কিন্তু অমৎসিয় সেই কথায় কান দিলেন না। এটা আল্লাহ্‌ থেকে হল, কারণ লোকেরা ইদোমের দেব-দেবীদের সাহায্য চেয়েছিল বলে আল্লাহ্‌ যিহোয়াশের হাতে তাদের তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সেইজন্য ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশ তাদের আক্রমণ করলেন। তিনি এবং এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয় এহুদার বৈৎ-শেমশে একে অন্যের মুখোমুখি হলেন। ইসরাইলের কাছে এহুদা সম্পূর্ণভাবে হেরে গেল এবং প্রত্যেকে নিজের নিজের বাড়ীতে পালিয়ে গেল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াশ বৈৎ-শেমসে অহসিয়ের নাতি, অর্থাৎ যোয়াশের ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ অমৎসিয়কে বন্দী করলেন। তারপর যিহোয়াশ জেরুজালেমে গিয়ে সেখানকার দেয়ালটার আফরাহীম-দরজা থেকে কোণার দরজা পর্যন্ত প্রায় চারশো হাত লম্বা একটা অংশ ভেংগে দিলেন। আল্লাহ্‌র ঘরের যত সোনা-রূপা ও জিনিসপত্রের ভার ওবেদ-ইদোমের উপর ছিল তা সমস্তই তিনি নিয়ে নিলেন। এছাড়া তিনি রাজবাড়ীর ধন-সম্পদ ও জামিন হিসাবে কতগুলো লোককে নিয়ে সামেরিয়াতে ফিরে গেলেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যিহোয়াহসের ছেলে যিহোয়াশের মৃত্যুর পরে এহুদার বাদশাহ্‌ যোয়াশের ছেলে অমৎসিয় আরও পনেরো বছর বেঁচে ছিলেন। অমৎসিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত “এহুদা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। অমৎসিয় মাবুদের পথে চলা থেকে সরে গেলে পর লোকেরা জেরুজালেমে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল। এতে তিনি লাখীশে পালিয়ে গেলেন, কিন্তু লোকেরা লাখীশে লোক পাঠিয়ে সেখানে তাঁকে হত্যা করল। তাঁর লাশ ঘোড়ার পিঠে করে এনে এহুদার শহরে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল। তারপর এহুদার সমস্ত লোক উষিয়কে তাঁর বাবা অমৎসিয়ের জায়গায় বাদশাহ্‌ করল। তখন তাঁর বয়স ছিল ষোল বছর। অমৎসিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে যাবার পর উষিয় এলৎ শহরটা আবার তৈরী করলেন এবং এহুদার অধীনে আনলেন। উষিয় ষোল বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে বাহান্ন বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিখলিয়া; তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের মেয়ে। উষিয় তাঁর পিতা অমৎসিয়ের মতই মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। জাকারিয়ার সময়কালে তিনি আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতেন। আল্লাহ্‌কে ভয় করতে জাকারিয়া তাঁকে উপদেশ দিতেন। যতদিন তিনি মাবুদের ইচ্ছামত চলেছিলেন ততদিন আল্লাহ্‌ও তাঁকে সফলতা দান করেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন এবং গাৎ, যব্‌নির ও অস্‌দোদের দেয়াল ভেংগে ফেললেন। তারপর তিনি অস্‌দোদ এলাকায় এবং ফিলিস্তিনীদের অন্যান্য জায়গায় কতগুলো দেয়াল-ঘেরা গ্রাম আবার গড়ে তুললেন। আল্লাহ্‌ ফিলিস্তিনীদের, গূরবালে বাসকারী আরবীয়দের এবং মিয়ূনীয়দের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করলেন। অম্মোনীয়রা উষিয়কে খাজনা দিত। তিনি খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন বলে মিসরের সীমানা পর্যন্ত তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। উষিয় জেরুজালেমের কোণার দরজায়, উপত্যকা-দরজায় এবং দেয়ালের কোণে উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করে সেগুলো শক্তিশালী করলেন। নীচু পাহাড়ী এলাকায় এবং সমভূমিতে তাঁর অনেক পশুপাল ছিল; সেইজন্য তিনি মরুভূমিতে উঁচু উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করলেন এবং অনেক কূয়া খুঁড়লেন। তাঁর লোকেরা উর্বর জমিতে চাষ করত এবং পাহাড়ে আংগুর ক্ষেত করত, কারণ তিনি কৃষিকাজ ভালবাসতেন। উষিয়ের একটা দক্ষ সৈন্যদল ছিল। তারা হনানীয় নামে একজন সেনাপতির পরিচালনার অধীনে ছিল এবং লেখক যিয়ূয়েল ও কর্মকর্তা মাসেয়ের ঠিক করা সংখ্যা অনুসারে তারা দলে দলে যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকত। উষিয় সমস্ত সৈন্যদলের জন্য ঢাল, বর্শা, মাথা রক্ষার টুপি, বর্ম, ধনুক ও ফিংগার পাথর যোগান দিতেন। তিনি জেরুজালেমে দক্ষ লোকদের তৈরী যন্ত্রপাতি উঁচু পাহারা-ঘরগুলোতে এবং দেয়ালের কোণায় কোণায় রাখলেন যাতে সেখান থেকে তীর ও বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারা যায়। তাঁর সুনাম দূর দেশে ছড়িয়ে গেল। তিনি আল্লাহ্‌র অনেক সাহায্য পেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। উষিয় শক্তিশালী হয়ে উঠলে পর তাঁর মনে অহংকার আসল এবং তাতে তাঁর পতন হল। তিনি ধূপগাহে ধূপ জ্বালাবার জন্য মাবুদের ঘরে ঢুকে তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করলেন। তাতে মহা-ইমাম অসরিয় এবং মাবুদের আশিজন সাহসী ইমাম বাদশাহ্‌র পিছনে পিছনে ভিতরে গেলেন। তাঁরা তাঁকে বাধা দেবার জন্য বললেন, “উষিয়, মাবুদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাবার অধিকার আপনার নেই। হারুনের বংশধরদের, যাদের ধূপ জ্বালাবার জন্য পবিত্র করা হয়েছে, সেই ইমামদেরই অধিকার আছে। এই পবিত্র জায়গা থেকে আপনি বের হয়ে যান, কারণ আপনি গুনাহ্‌ করেছেন। এর ফলে মাবুদ আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই আপনাকে শাস্তি দেবেন।” তখন উষিয় রেগে আগুন হয়ে গেলেন; তাঁর হাতে ধূপ জ্বালাবার জন্য একটা ধূপদানি ছিল। মাবুদের ঘরে ধূপগাহের সামনে ইমামদের উপর যখন তিনি রাগ করছিলেন তখন তাঁর কপালে একটা খারাপ চর্মরোগ দেখা দিল। প্রধান ইমাম অসরিয় ও অন্যান্য সব ইমামেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর কপালে সেই চর্মরোগ দেখতে পেলেন। কাজেই তাঁরা তাড়াতাড়ি তাঁকে বের করে দিলেন। তিনি নিজেও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে চাইলেন, কারণ মাবুদ তাঁকে আঘাত করেছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত বাদশাহ্‌ উষিয় চর্মরোগী ছিলেন। তিনি একটা আলাদা ঘরে বাস করতেন, কারণ মাবুদের ঘরে যাওয়া থেকে তিনি বাদ পড়েছিলেন। তাতে বাদশাহ্‌র দায়িত্ব তাঁর ছেলে যোথমের উপর পড়ল এবং তিনি দেশের লোকদের শাসন করতে লাগলেন। উষিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়া লিখে রেখেছেন। পরে উষিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। তাঁকে বাদশাহ্‌দের কবরস্থানের পাশে একটা মাঠে তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে দাফন করা হল, কারণ লোকেরা বলল, “তাঁর চর্মরোগ হয়েছিল।” তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে যোথম বাদশাহ্‌ হলেন। যোথম পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে ষোল বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যিরূশা; তিনি ছিলেন সাদোকের মেয়ে। যোথম তাঁর পিতার মত মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। এছাড়া তিনি তাঁর পিতার মত ভুল করেন নি; ধূপ জ্বালাবার জন্য তিনি মাবুদের ঘরে যান নি। তবুও লোকেরা খারাপ কাজ করত। যোথম মাবুদের ঘরের উঁচু জায়গার দরজাটা মেরামত করেছিলেন এবং ওফল পাহাড়ের দেয়ালের অনেক জায়গা মজবুত করলেন। তিনি এহুদার পাহাড়গুলোতে দেয়াল-ঘেরা গ্রাম তৈরী করলেন এবং বন এলাকায় কেল্লা এবং উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করলেন। অম্মোনীয়দের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি তাদের হারিয়ে দিলেন। তাতে সেই বছর অম্মোনীয়রা তাঁকে তিন হাজার ন’শো কেজি রূপা, এক হাজার আটশো টন গম ও এক হাজার আটশো টন যব দিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরেও তারা একই পরিমাণে দিল। এইভাবে যোথম শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি বিশ্বস্তভাবে তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র পথে চলতেন। যোথমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা, তাঁর সব যুদ্ধের কথা এবং তাঁর চালচলনের কথা সবই “ইসরাইল ও এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। তিনি পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে ষোল বছর রাজত্ব করেছিলেন। পরে যোথম তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে গেলেন এবং তাঁকে দাউদ-শহরে দাফন করা হল। এর পরে তাঁর ছেলে আহস তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। আহস বিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে ষোল বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদ যেমন মাবুদের চোখে যা ভাল তা করতেন তিনি তেমন করতেন না। তিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের মতই চলতেন এবং বাল দেবতার পূজা করবার জন্য তিনি ছাঁচে ঢেলে মূর্তি তৈরী করিয়েছিলেন। তিনি বিন্‌-হিন্নোম উপত্যকাতে ধূপ জ্বালাতেন এবং মাবুদ যে সব জাতিকে বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে দূর করে দিয়েছিলেন তাদের জঘন্য কাজের মতই তিনিও তাঁর ছেলেদের আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করলেন। তিনি পূজার উঁচু স্থানগুলোতে, পাহাড়ের উপরে ও প্রত্যেকটি ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে পশু-উৎসর্গ করতেন ও ধূপ জ্বালাতেন। সেইজন্যই তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁকে সিরিয়ার বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দিলেন। সিরীয়রা তাঁকে হারিয়ে দিল এবং তাঁর অনেক লোককে বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে গেল। তাঁকেও ইসরাইলের বাদশাহ্‌ পেকহের হাতে তুলে দেওয়া হল। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ তাঁর অনেক লোককে হত্যা করলেন। রমলিয়ের ছেলে পেকহ একদিনের মধ্যে এহুদায় এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যকে হত্যা করলেন, কারণ এহুদার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করেছিল। সিখ্রি নামে একজন আফরাহীমীয় যোদ্ধা বাদশাহ্‌র ছেলে মাসেয়কে ও রাজবাড়ীর ভার-পাওয়া কর্মচারী অস্রীকামকে এবং বাদশাহ্‌র পরে দ্বিতীয় স্থানে যিনি ছিলেন সেই ইল্‌কানাকে হত্যা করল। বনি-ইসরাইলরা তাদের জাতি-ভাইদের মধ্য থেকে স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের বন্দী করে নিয়ে গেল। তাদের সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ। তারা অনেক জিনিসও লুট করে সামেরিয়াতে নিয়ে গেল। ওদেদ নামে মাবুদের একজন নবী সামেরিয়াতে ছিলেন। সৈন্যদল যখন সামেরিয়াতে ফিরে আসছিল তখন তিনি তাদের সংগে দেখা করে বললেন, “আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এহুদার উপর রাগ করেছেন বলে তিনি তাদের আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু রাগের চোটে আপনারা তাদের যেভাবে মেরে ফেলেছেন সেই কথা বেহেশত পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর এখন আপনারা এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের আপনাদের গোলাম ও বাঁদী করতে চাইছেন। কিন্তু আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে কি আপনারাও দোষী নন? এখন আপনারা আমার কথা শুনুন। আপনাদের জাতি-ভাইদের মধ্য থেকে যাদের আপনারা বন্দী করে নিয়ে এসেছেন তাদের আপনারা ফেরত পাঠিয়ে দিন, কারণ মাবুদের ভয়ংকর রাগ আপনাদের উপরে রয়েছে।” তখন যুদ্ধ থেকে যারা ফিরে আসছিল আফরাহীমের কয়েকজন নেতা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। সেই নেতারা হলেন যিহোহাননের ছেলে অসরিয়, মশিল্লেমোতের ছেলে বেরিখিয়, শল্লুমের ছেলে যিহিষ্কিয় ও হদ্‌লয়ের ছেলে অমাসা। তাঁরা বললেন, “ঐ বন্দীদের তোমরা এখানে আনবে না; আনলে আমরা মাবুদের কাছে দোষী হব। আমাদের গুনাহ্‌ ও দোষের সংগে কি তোমরা আরও কিছু যোগ দিতে চাও? আমরা তো ভীষণভাবে দোষী হয়েই রয়েছি আর মাবুদের ভয়ংকর রাগ ইসরাইলের উপর রয়েছে।” তখন সৈন্যেরা সেই নেতাদের ও সমস্ত লোকদের সামনে সেই বন্দীদের ও লুটের জিনিসগুলো রাখল। সেই নেতারা তখন লুটের জিনিস থেকে কাপড়-চোপড় নিয়ে বন্দীদের মধ্যে যারা উলংগ ছিল তাদের সবাইকে কাপড় পরালেন। তাঁরা তাদের কাপড়-চোপড়, জুতা ও খাবার-দাবার দিলেন এবং তাদের আঘাতের উপর তেল ঢেলে দিলেন। দুর্বলদের তাঁরা গাধার উপর চড়িয়ে জেরিকোতে, অর্থাৎ খেজুর-শহরে তাদের নিজের লোকদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। পরে তাঁরা সামেরিয়াতে ফিরে আসলেন। সেই সময় বাদশাহ্‌ আহস সাহায্য চাইবার জন্য আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কাছে লোক পাঠালেন। এর কারণ হল, ইদোমীয়রা আবার এসে এহুদা আক্রমণ করে লোকদের বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। এদিকে আবার ফিলিস্তিনীরা তখন নীচু পাহাড়ী এলাকার গ্রামগুলোতে এবং এহুদার নেগেভে হানা দিয়েছিল। তারা বৈৎ-শেমশ, অয়ালোন, গদেরোৎ এবং আশেপাশের জায়গা সুদ্ধ সোখো, তিম্না ও গিম্‌সো অধিকার করে নিয়ে সেখানে বাস করছিল। বাদশাহ্‌ আহসের জন্য মাবুদ এহুদাকে নীচু করেছিলেন, কারণ আহস এহুদায় খারাপী বৃদ্ধি পেতে দিয়েছিলেন এবং নিজে মাবুদের প্রতি খুব বেশী বেঈমানী করেছিলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তিগ্লৎ-পিলেষর তাঁর কাছে এসেছিলেন কিন্তু তিনি সাহায্যের বদলে আহসকে কষ্টই দিলেন। তখন আহস মাবুদের ঘর ও রাজবাড়ী থেকে এবং নেতাদের কাছ থেকে কিছু দামী জিনিসপত্র নিয়ে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে উপহার দিলেন, কিন্তু তাতে কিছুই হল না। তাঁর এই কষ্টের সময়ে বাদশাহ্‌ আহস মাবুদের প্রতি আরও বেঈমানী করলেন। দামেস্কের দেবতারা তাঁকে হারিয়ে দিয়েছে ভেবে তিনি সেই দেবতাদের কাছে পশু-উৎসর্গ করলেন। তিনি ভাবলেন, “সিরিয়ার বাদশাহ্‌দের দেবতারা তাঁদের সাহায্য করে, কাজেই সাহায্য পাবার জন্য আমি সেই দেবতাদের কাছে পশু-উৎসর্গ করব।” কিন্তু সেই দেবতারাই হল তাঁর ও সমস্ত ইসরাইলের সর্বনাশের কারণ। আহস আল্লাহ্‌র ঘরের জিনিসপত্র একসংগে জড়ো করে কেটে টুকরা টুকরা করলেন। মাবুদের ঘরের দরজাগুলো তিনি বন্ধ করে দিলেন এবং জেরুজালেমের সমস্ত জায়গায় বেদী স্থাপন করলেন। দেব-দেবীদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাবার জন্য তিনি এহুদার প্রত্যেকটি শহর ও গ্রামে পূজার উঁচু স্থান তৈরী করে তাঁর পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে রাগিয়ে তুললেন। আহসের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তাঁর সমস্ত চালচলনের কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত “এহুদা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে আহস তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং জেরুজালেম শহরে তাঁকে দাফন করা হল, কিন্তু ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয় নি। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে হিষ্কিয় বাদশাহ্‌ হলেন। হিষ্কিয় পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়ে জেরুজালেমে ঊনত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল অবিয়া; তিনি ছিলেন জাকারিয়ার মেয়ে। হিষ্কিয় তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের মতই মাবুদের চোখে যা ভাল তা-ই করতেন। তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরের প্রথম মাসেই তিনি মাবুদের ঘরের দরজাগুলো খুলে দিলেন এবং মেরামত করলেন। তিনি পূর্ব দিকের উঠানে ইমাম ও লেবীয়দের একত্র করে বললেন, “লেবীয়রা, আমার কথা শুনুন; আপনারা নিজেদের এবং আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরটি পাক-সাফ করুন। এই পবিত্র জায়গা থেকে সমস্ত নাপাক জিনিস দূর করুন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বেঈমানী করেছেন; আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা খারাপ তাঁরা তা-ই করেছেন এবং তাঁকে ত্যাগ করেছেন। মাবুদের বাসস্থান থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর দিকে পিছন ফিরিয়েছেন। তাঁরা বারান্দার দরজাগুলোও বন্ধ করে দিয়েছেন এবং বাতিগুলো নিভিয়ে ফেলেছেন। এই পবিত্র জায়গায় তাঁরা ইসরাইলের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে ধূপ জ্বালান নি কিংবা কোন পোড়ানো-কোরবানী দেন নি। কাজেই এহুদা ও জেরুজালেমের উপর মাবুদের গজব নেমে এসেছে। আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন যে, তিনি তাদের ভীষণ ভয়ের ও ঘৃণার পাত্র করে তুলেছেন; তাদের দেখে লোকেরা হতভম্ব হচ্ছে। এইজন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধে মারা পড়েছেন এবং আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বন্দী হয়েছে। আমি এখন ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র সংগে একটা চুক্তি করতে চাই যাতে তাঁর ভয়ংকর গজব আমাদের উপর থেকে চলে যায়। হে আমার সন্তানেরা, আপনারা এখন আর বসে থাকবেন না, কারণ মাবুদের সামনে দাঁড়াতে এবং তাঁর খেদমতকারী হিসাবে তাঁর কাজ করতে ও ধূপ জ্বালাতে তিনি আপনাদেরই বেছে নিয়েছেন।” তখন এই সব লেবীয়রা কাজে লেগে গেলেন্ত কহাতীয়দের মধ্য থেকে অমাসয়ের ছেলে মাহৎ ও অসরিয়ের ছেলে যোয়েল; মরারীয়দের মধ্য থেকে অব্দির ছেলে কীশ ও যিহলিলেলের ছেলে অসরিয়; গের্শোনীয়দের মধ্য থেকে সিম্মের ছেলে যোয়াহ ও যোয়াহের ছেলে আদন; ইলীষাফণের বংশধরদের মধ্য থেকে শিম্রি ও যিয়ূয়েল; আসফের বংশধরদের মধ্য থেকে জাকারিয়া ও মত্তনিয়; হেমনের বংশধরদের মধ্য থেকে যিহূয়েল ও শিমিয়ি এবং যিদূথূনের বংশধরদের মধ্য থেকে শময়িয় ও উষীয়েল। তাঁরা তাঁদের লেবীয় ভাইদের একত্র করে নিজেদের পবিত্র করলেন। তারপর মাবুদের কথামত বাদশাহ্‌র হুকুম অনুসারে তাঁরা মাবুদের ঘর পাক-সাফ করবার জন্য ভিতরে গেলেন। ইমামেরা সেখানে যে সব নাপাক জিনিস পেলেন সেগুলো সবই মাবুদের ঘরের উঠানে বের করে আনলেন। লেবীয়রা সেগুলো বহন করে কিদ্রোণ উপত্যকায় নিয়ে গেল। তাঁরা সকলে প্রথম মাসের প্রথম দিনে মাবুদের ঘর পাক-সাফ করতে শুরু করে মাসের আট দিনের দিন ঘরের বারান্দা পর্যন্ত আসলেন। আরও আটদিন ধরে তাঁরা মাবুদের ঘরটি পাক-সাফ করলেন এবং প্রথম মাসের ষোল দিনের দিন তা শেষ করলেন। তারপর তাঁরা বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে গিয়ে বললেন, “আমরা কোরবানগাহ্‌ ও তার বাসন-কোসন এবং পবিত্র-রুটি রাখবার টেবিল ও তার সব জিনিসপত্র সুদ্ধ মাবুদের ঘরটি পাক-সাফ করেছি। মাবুদের প্রতি বেঈমানী করে বাদশাহ্‌ আহস তাঁর রাজত্বের সময় যে সব জিনিস বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন সেগুলো আমরা আবার ঠিক-ঠাক করে পাক-সাফ করে নিয়েছি। সেগুলো এখন মাবুদের কোরবানগাহের সামনে রয়েছে।” পরের দিন ভোরবেলায় বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় শহরের উঁচু পদের কর্মচারীদের একত্র করে মাবুদের ঘরে গেলেন। তাঁরা রাজ্যের জন্য, বায়তুল-মোকাদ্দসের জন্য ও এহুদার লোকদের জন্য গুনাহের জন্য কোরবানী হিসাবে সাতটা ষাঁড়, সাতটা ভেড়া, সাতটা ভেড়ার বাচ্চা ও সাতটা ছাগল নিয়ে আসলেন। তারপর বাদশাহ্‌ ইমামদের, অর্থাৎ হারুনের বংশধরদের সেগুলো মাবুদের কোরবানগাহের উপর কোরবানী দেবার জন্য হুকুম দিলেন। ইমামেরা প্রথমে সেই ষাঁড়গুলো জবাই করে প্রত্যেকটার রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন; তারপর ভেড়াগুলো ও শেষে ভেড়ার বাচ্চাগুলো কেটে সেগুলোর প্রত্যেকটার রক্তও ছিটিয়ে দিলেন। তারপর ইমামেরা গুনাহের কোরবানীর জন্য ছাগলগুলো বাদশাহ্‌ ও সব লোকদের সামনে আনলেন যাতে তাঁরা সেগুলোর মাথার উপর হাত রাখতে পারেন। এর পরে ইমাম সেই ছাগলগুলো জবাই করলেন এবং সমস্ত বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার উদ্দেশে কোরবানগাহের উপরে সেই রক্ত দিয়ে গুনাহের কোরবানী দিলেন। সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জন্য পোড়ানো-কোরবানী ও গুনাহের কোরবানী দেবার হুকুম বাদশাহ্‌ই দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ দাউদ, তাঁর নবী গাদ এবং নবী নাথনের হুকুম অনুসারে বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় লেবীয়দের বললেন যেন তারা করতাল, বীণা ও সুরবাহার নিয়ে মাবুদের ঘরে যায়। মাবুদ তাঁর নবীদের মধ্য দিয়ে এই হুকুমই দিয়েছিলেন। সেইজন্য লেবীয়রা দাউদের বাজনাগুলো নিয়ে আর ইমামেরা তাঁদের শিংগা নিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর হিষ্কিয় কোরবানগাহের উপরে পোড়ানো-কোরবানীর হুকুম দিলেন। এই কোরবানী শুরু হলে মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালীও শুরু হল আর তার সংগে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদের বাজনা ও শিংগা বাজানো হল। কাওয়ালেরা কাওয়ালী গাইতে ও শিংগা বাদকেরা শিংগা বাজাতে থাকলে সমস্ত লোক মাটিতে সেজদা করে মাবুদের এবাদত করল। পোড়ানো-কোরবানী শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সব চলতে থাকল। কোরবানী শেষ হলে পর বাদশাহ্‌ ও তাঁর সংগের সকলে সেজদা করে মাবুদের এবাদত করলেন। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় ও তাঁর কর্মচারীরা দাউদের এবং নবী আসফের রচনা-করা কাওয়ালী দিয়ে মাবুদের উদ্দেশে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবার জন্য লেবীয়দের হুকুম দিলেন। তখন তারা খুশী হয়ে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইল এবং মাটিতে সেজদা করে মাবুদের এবাদত করল। এর পর হিষ্কিয় বললেন, “আপনারা এখন মাবুদের কাছে নিজেদের দিয়ে দিয়েছেন। এবার আপনারা এসে মাবুদের ঘরে পশু-কোরবানী ও কৃতজ্ঞতা-কোরবানীর জিনিস আনুন।” তখন সবাই তা আনল এবং যাদের অন্তর চাইল তারা পোড়ানো-কোরবানীর জিনিসও আনল। তারা পোড়ানো-কোরবানীর জন্য সত্তরটা ষাঁড়, একশোটা ভেড়া ও দু’শোটা ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে আসল। এই সব ছিল মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য। কোরবানীর জন্য যে সব পশু পবিত্র করে রাখা হয়েছিল সেগুলোর সংখ্যা হল ছ’শো ষাঁড় ও তিন হাজার ছাগল-ভেড়া। ইমামদের সংখ্যা কম হওয়াতে তাঁরা সমস্ত পোড়ানো-কোরবানীর পশুর চামড়া ছাড়াতে পারলেন না; কাজেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং অন্য ইমামেরা পাক-সাফ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের লেবীয় ভাইয়েরা তাঁদের কাজে সাহায্য করল, কারণ নিজেদের পাক-সাফ করবার ব্যাপারে ইমামদের চেয়ে লেবীয়রা আরও বেশী মনোযোগী ছিল। যোগাযোগ-কোরবানীর চর্বি পোড়ানো ও পোড়ানো-কোরবানী এবং তার সংগেকার ঢালন-কোরবানী নিয়ে অনেকগুলো কোরবানী দেওয়া হল। এইভাবে মাবুদের ঘরের এবাদত-কাজ আবার শুরু করা হল। আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের জন্য এই সব কাজ খুব তাড়াতাড়ি করেছিলেন বলে হিষ্কিয় ও সমস্ত লোকেরা আনন্দ করল। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করবার জন্য লোকেরা যাতে জেরুজালেমে মাবুদের ঘরে আসে সেইজন্য হিষ্কিয় সমস্ত ইসরাইল দেশে ও এহুদায় খবর পাঠালেন এবং আফরাহীম ও মানশা-গোষ্ঠীর লোকদের কাছে চিঠি লিখলেন। বাদশাহ্‌ ও তাঁর কর্মচারীরা এবং জেরুজালেমের সমস্ত লোক ঠিক করল যে, দ্বিতীয় মাসে উদ্ধার-ঈদ পালন করা হবে। এর কারণ হল, অনেক ইমাম নিজেদের পাক-সাফ করেন নি আর লোকেরাও এসে জেরুজালেমে জমায়েত হয় নি বলে নিয়মিত সময়ে তারা এটা পালন করতে পারে নি। এই পরিকল্পনা বাদশাহ্‌ ও সমস্ত লোকের কাছে উপযুক্ত বলে মনে হল। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করবার জন্য যাতে সবাই জেরুজালেমে আসে সেইজন্য তারা বের্‌-শেবা থেকে দান পর্যন্ত ইসরাইলের সমস্ত জায়গায় লোক পাঠিয়ে ঘোষণা করাল। অনেক বছর ধরে তারা নিয়ম অনুসারে অনেক লোক একত্র হয়ে এই ঈদ পালন করে নি। বাদশাহ্‌র হুকুমে বাদশাহ্‌ ও তাঁর কর্মচারীদের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে লোকেরা ইসরাইল ও এহুদার সব জায়গায় গিয়ে এই কথা ঘোষণা করল, “হে বনি-ইসরাইলরা, আপনারা ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে আসুন, তাতে যাঁরা আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন তাঁদের কাছে, অর্থাৎ আপনাদের কাছে তিনিও ফিরে আসবেন। আপনারা আপনাদের পূর্বপুরুষ ও ইসরাইলীয় ভাইদের মত হবেন না। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রতি বেঈমানী করেছিল বলে তিনি তাদের ভীষণ শাস্তি দিয়েছিলেন। আপনারা তো তা দেখতেই পাচ্ছেন। “আপনারা আপনাদের পূর্বপুরুষদের মত ঘাড় শক্ত করবেন না বরং মাবুদের হাতে নিজেদের দিয়ে দিন। যে বায়তুল-মোকাদ্দসকে তিনি চিরকালের জন্য পবিত্র করেছেন আপনারা সেই ঘরে আসুন এবং আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করুন যাতে আপনাদের উপর থেকে তাঁর ভয়ংকর রাগ চলে যায়। যদি আপনারা মাবুদের কাছে ফিরে আসেন তবে আপনাদের ভাই ও ছেলেমেয়েদের যারা বন্দী করে রেখেছে তারা তাদের প্রতি দয়া দেখাবে। তখন তারা এই দেশে ফিরে আসতে পারবে, কারণ আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ। আপনারা তাঁর কাছে ফিরে আসলে তিনি তাঁর মুখ ফিরিয়ে রাখবেন না।” সংবাদ বহনকারীরা আফরাহীম ও মানশার সমস্ত গ্রাম ও শহরে এবং সবূলূন পর্যন্ত গেল, কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। তবুও আশের, মানশা ও সবূলূন-গোষ্ঠীর কিছু লোক নিজেদের নত করে জেরুজালেমে গেল। আল্লাহ্‌র হাত এহুদার লোকদের উপরেও ছিল, তাই মাবুদের কালাম অনুসারে বাদশাহ্‌ ও তাঁর কর্মচারীদের হুকুম পালন করবার জন্য তিনি তাদের মন এক করলেন। দ্বিতীয় মাসে খামিহীন রুটির ঈদ পালন করবার জন্য অনেক অনেক লোক জেরুজালেমে জমায়েত হল। পূজা করবার জন্য পশু-উৎসর্গের যে সব বেদী ও যে সব ধূপদানী জেরুজালেমে ছিল তারা সেগুলো সরিয়ে নিয়ে কিদ্রোণ উপত্যকায় ফেলে দিল। তারা দ্বিতীয় মাসের চৌদ্দ দিনের দিন উদ্ধার-ঈদের ভেড়ার বাচ্চা জবাই করল। এতে ইমাম ও লেবীয়রা লজ্জা পেয়ে নিজেদের পাক-সাফ করলেন এবং মাবুদের ঘরে পোড়ানো-কোরবানীর জিনিস নিয়ে আসলেন। তারপর আল্লাহ্‌র বান্দা মূসার শরীয়ত অনুসারে তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইমামেরা লেবীয়দের হাত থেকে রক্ত নিয়ে ছিটিয়ে দিলেন। লোকদের মধ্যে অনেকে নিজেদের পাক-সাফ করে নি। সেইজন্য এদের হয়ে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেবার জন্য উদ্ধার-ঈদের ভেড়ার বাচ্চা লেবীয়দেরই জবাই করতে হয়েছিল। মাবুদ হিষ্কিয়ের মুনাজাত শুনে লোকদের মাফ করলেন। যে সব ইসরাইলীয় জেরুজালেমে উপস্থিত হয়েছিল তারা খুব আনন্দের সংগে সাত দিন ধরে খামিহীন রুটির ঈদ পালন করল; আর এদিকে লেবীয় ও ইমামেরা প্রতিদিন মাবুদের উদ্দেশে বাজনা বাজিয়ে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইতে লাগলেন। মাবুদের এবাদত-কাজে যে সব লেবীয়রা দক্ষ ছিল হিষ্কিয় তাদের উৎসাহ দিয়ে কথা বললেন। তারা যোগাযোগ-কোরবানী দিয়ে সাত দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া করল এবং তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করল। তারপর সমস্ত লোক আরও সাত দিন সেই ঈদ পালন করবে বলে ঠিক করল; কাজেই আরও সাত দিন তারা আনন্দের সংগে সেই ঈদ পালন করল। এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় সমস্ত লোকের জন্য এক হাজার ষাঁড় ও সাত হাজার ভেড়া দিলেন আর উঁচু পদের কর্মচারীরা দিলেন এক হাজার ষাঁড় ও দশ হাজার ভেড়া। ইমামদের মধ্যে অনেকে নিজেদের পাক-সাফ করলেন। এহুদার সব লোকেরা, ইমামেরা, লেবীয়রা, ইসরাইল থেকে আসা লোকেরা এবং ইসরাইল ও এহুদায় বাসকারী যে বিদেশীরা এসেছিল তারা সবাই আনন্দ করল। জেরুজালেমে খুব আনন্দ হল; ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদের ছেলে সোলায়মানের পরে জেরুজালেমে আর এমনভাবে ঈদ পালন করা হয় নি। পরে যে লেবীয়রা ইমাম ছিলেন তাঁরা দাঁড়িয়ে লোকদের দোয়া করলেন, আর আল্লাহ্‌ তাঁদের মুনাজাত শুনলেন, কারণ তাঁদের মুনাজাত বেহেশতে তাঁর পবিত্র বাসস্থানে পৌঁছেছিল। ঈদের সব কিছু শেষ হবার পরে সেখানে উপস্থিত বনি-ইসরাইলরা বের হয়ে এহুদার শহরগুলোতে গিয়ে পূজার পাথরগুলো, আশেরা-খুঁটিগুলো, পূজার উঁচু স্থান ও বেদীগুলো একেবারে ধ্বংস করে দিল। তারা এহুদা, বিন্‌ইয়ামীন, আফরাহীম ও মানশা-গোষ্ঠীর সমস্ত এলাকায় একই কাজ করল। এই সব ধ্বংস করবার পর বনি-ইসরাইলরা গ্রামে ও শহরে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেল। পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবার জন্য, এবাদত-কাজের জন্য এবং আল্লাহ্‌র ঘরে শুকরিয়া-কাওয়ালী ও প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবার জন্য হিষ্কিয় ইমাম ও লেবীয়দের প্রত্যেকের কাজ অনুসারে তাদের বিভিন্ন দলকে নিযুক্ত করলেন। মাবুদের শরীয়তে যেমন লেখা আছে সেইমত সকাল ও সন্ধ্যার পোড়ানো-কোরবানীর জন্য এবং বিশ্রামবার, অমাবস্যা এবং নির্দিষ্ট ঈদের সময়কার পোড়ানো-কোরবানীর জন্য বাদশাহ্‌ তাঁর নিজের সম্পত্তি থেকে দান করলেন। ইমাম ও লেবীয়রা যাতে মাবুদের শরীয়ত পালন করবার ব্যাপারে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে ব্যস্ত রাখতে পারেন সেইজন্য তাঁদের পাওনা অংশ দিতে তিনি জেরুজালেমে বাসকারী লোকদের হুকুম দিলেন। এই হুকুম বের হবার সংগে সংগে বনি-ইসরাইলরা তাদের ফসল, নতুন আংগুর-রস, তেল ও মধুর প্রথম অংশ এবং ক্ষেতে আর যা কিছু জন্মায় তারও প্রথম অংশ প্রচুর পরিমাণে দান করল। এছাড়া তারা সব কিছুর দশ ভাগের একভাগ আনল এবং তা পরিমাণে অনেক হল। ইসরাইল ও এহুদার যে সব লোক এহুদার গ্রাম ও শহরগুলোতে বাস করত তারাও তাদের গরু, ভেড়া ও ছাগলের পালের দশ ভাগের এক ভাগ আনল এবং তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে পবিত্র করে রাখা জিনিসের দশ ভাগের একভাগ এনে কতগুলো স্তূপ করল। তৃতীয় মাসে এই কাজ শুরু করে তারা সপ্তম মাসে শেষ করল। হিষ্কিয় ও তাঁর কর্মচারীরা এসে সেই সতূপগুলো দেখে মাবুদের প্রশংসা করলেন এবং তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের প্রশংসা করলেন। হিষ্কিয় সেই স্তূপগুলোর কথা ইমাম ও লেবীয়দের জিজ্ঞাসা করলেন। এতে সাদোকের বংশের অসরিয় নামে প্রধান ইমাম জবাবে বললেন, “মাবুদের ঘরে লোকেরা যখন তাদের দান আনতে শুরু করল তখন থেকে আমাদের খাবারও যেমন যথেষ্ট হয়েছে তেমনি বাড়তিও রয়েছে প্রচুর, কারণ মাবুদ তাঁর বান্দাদের দোয়া করেছেন, আর এই সমস্ত জিনিস অনেক বেঁচে গেছে।” তখন হিষ্কিয় মাবুদের ঘরে কতগুলো ভাণ্ডার-ঘর তৈরী করবার হুকুম দিলেন আর সেগুলো তৈরী করা হল। তারপর লোকেরা উপহার, সব জিনিসের দশ ভাগের এক ভাগ ও পবিত্র করে রাখা জিনিস বিশ্বস্তভাবে ভাণ্ডার-ঘরে আনতে লাগল। কনানিয় নামে একজন লেবীয়ের উপর ছিল এই সব জিনিসের দেখাশোনার ভার আর তাঁর ভাই শিমিয়ি তাঁর সাহায্যকারী ছিল। এই দু’জনের অধীনে বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় ও মাবুদের ঘরের প্রধান কর্মচারী অসরিয়ের হুকুমে যিহীয়েল, অসসিয়, নহৎ, অসাহেল, যিরীমোৎ, যোষাবদ, ইলীয়েল, যিসমখিয়, মাহৎ ও বনায় তদারক করবার ভার পেল। লোকদের নিজেদের ইচ্ছায় করা কোরবানীর জিনিসের ভার ছিল পূর্ব দিকের দরজার রক্ষী-লেবীয় যিম্নার ছেলে কোরির উপরে। মাবুদকে দেওয়া সব উপহার ও মহাপবিত্র জিনিস ভাগ করে দেবার ভারও ছিল তাঁর উপর। ইমামদের শহর ও গ্রামগুলোতে তাঁদের বিভিন্ন দল অনুসারে বয়সে ছোট বা বড় তাঁদের সংগী ইমামদের ঠিকভাবে ভাগ করে দেবার জন্য কোরির অধীনে আদন, বিন্‌ইয়ামীন, ইউসা, শময়িয়, অমরিয় ও শখনিয় বিশ্বস্তভাবে কাজ করতেন। এছাড়া বিভিন্ন দল অনুসারে যে সব ইমামেরা প্রতিদিনের কর্তব্য পালন করবার জন্য মাবুদের ঘরে ঢুকতেন তাদেরও খাবারের ভাগ তাঁরা দিতেন। এঁরা ছিলেন তিন বছর ও তার বেশী বয়সের পুরুষ যাঁদের নাম ইমামদের বংশ-তালিকায় লেখা ছিল। বংশ-তালিকায় ইমামদের নাম পিতার বংশ অনুসারে লেখা হয়েছিল এবং বিশ বছর ও তার বেশী বয়সের লেবীয়দের নাম দায়িত্ব ও বিভিন্ন দল অনুসারে লেখা হয়েছিল। এছাড়া তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের, অর্থাৎ গোটা সমাজের নাম বংশ-তালিকায় লেখা হয়েছিল, কারণ ইমাম ও লেবীয়রা বিশ্বস্তভাবে নিজেদের পবিত্র করেছিলেন। যে ইমামেরা, অর্থাৎ হারুনের যে বংশধরেরা নিজের নিজের শহর ও গ্রামের চারপাশের ক্ষেতের জমিতে বাস করতেন তাঁদের খাবারের ভাগ দেবার জন্য প্রত্যেক শহর ও গ্রামে কয়েকজন লোকের নাম উল্লেখ করে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেক ইমামকে এবং বংশ তালিকায় লেখা প্রত্যেক লেবীয়কে খাবারের ভাগ দিতেন। হিষ্কিয় এহুদার সব জায়গায় এইভাবে কাজ করলেন। তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা ভাল, ন্যায্য এবং সত্য তিনি তা-ই করলেন। আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার জন্য আল্লাহ্‌র ঘরের কাজে এবং শরীয়ত পালন করবার ব্যাপারে তিনি যে কাজই করলেন না কেন তা সমস্ত দিল দিয়ে করলেন, আর সেইজন্য তিনি সফল হলেন। হিষ্কিয় বিশ্বস্তভাবে সব কিছু করবার পরে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব এসে এহুদা আক্রমণ করলেন। তিনি দেয়াল-ঘেরা শহর ও গ্রামগুলো ঘেরাও করলেন, ভাবলেন সেগুলো নিজের জন্য জয় করে নেবেন। হিষ্কিয় দেখলেন সন্‌হেরীব এসে গেছেন এবং জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য মন স্থির করেছেন। এ দেখে তিনি তাঁর সেনাপতিদের ও যোদ্ধাদের সংগে পরামর্শ করে শহরের বাইরের ঝর্ণাগুলোর পানি বন্ধ করে দেবেন বলে ঠিক করলেন। এই কাজে তাঁরা তাঁকে সাহায্য করলেন। অনেক লোক জমায়েত হয়ে সমস্ত ঝর্ণা ও দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত বন্ধ করে দিল। তারা বলেছিল, “আশেরিয়ার বাদশাহ্‌রা এসে কেন এত পানি পাবে?” হিষ্কিয় দেয়ালের সব ভাংগা অংশগুলো এবং উঁচু পাহারা-ঘরগুলো মেরামত করে নিজেকে শক্তিশালী করলেন। এছাড়া সেই দেয়ালের বাইরে তিনি আর একটা দেয়াল তৈরী করলেন এবং দাউদ-শহরের মিল্লো আরও মজবুত করলেন। তিনি অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও ঢাল তৈরী করালেন। তিনি লোকদের উপরে সেনাপতিদের নিযুক্ত করলেন এবং শহরের দরজার চকে তাদের একত্র করে এই কথা বলে উৎসাহ দিলেন, “আপনারা শক্তিশালী ও সাহসী হন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ ও তাঁর বিরাট সৈন্যদল দেখে আপনারা ভয় পাবেন না বা হতাশ হবেন না, কারণ তাঁর সংগে যারা আছে তাদের চেয়েও যিনি আমাদের সংগে আছেন তিনি আরও মহান। তাঁর সংগে রয়েছে কেবল মানুষের শক্তি, কিন্তু আমাদের সাহায্য করতে ও আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে আমাদের সংগে রয়েছেন আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌।” লোকেরা এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কথা শুনে তাঁর কথার উপর ভরসা করল। পরে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব ও তাঁর সমস্ত সৈন্যদল লাখীশ ঘেরাও করলেন এবং তাঁর কয়েকজন লোককে তিনি জেরুজালেমে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে এবং সেখানে উপস্থিত এহুদার সমস্ত লোকদের কাছে এই কথা বলে পাঠালেন, “আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব বলছেন, ‘তোমরা কিসের উপর ভরসা করে আছ যার দরুন তোমরা ঘেরাও হলেও জেরুজালেমেই থাকবে? খিদে ও পিপাসায় যাতে তোমরা মর তাই হিষ্কিয় এই কথা বলে তোমাদের ভুলাচ্ছে যে, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করবে। হিষ্কিয় নিজেই কি পূজার উঁচু স্থান আর বেদীগুলো ধ্বংস করে দেয় নি? এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের কি সে বলে নি যে, মাত্র একটি কোরবানগাহের সামনেই তাদের এবাদত করতে হবে এবং তার উপর ধূপ জ্বালাতে হবে? “ ‘অন্যান্য দেশের সব জাতিদের প্রতি আমি ও আমার পূর্বপুরুষেরা যা করেছি তা কি তোমরা জান না? সেই সব জাতির দেবতারা কি আমার হাত থেকে তাদের দেশ উদ্ধার করতে পেরেছে? এই যে জাতিগুলোকে আমার পূর্বপুরুষেরা ধ্বংস করে ফেলেছেন তাদের সব দেবতাগুলোর মধ্যে কে আমার হাত থেকে তার লোকদের উদ্ধার করতে পেরেছে? তাহলে কেমন করে তোমাদের আল্লাহ্‌ আমার হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করবে? এখন তোমরা হিষ্কিয়কে এইভাবে তোমাদের ছলনা করতে ও ভুলিয়ে রাখতে দিয়ো না। তোমরা তাকে বিশ্বাস কোরো না, কারণ কোন জাতির বা কোন রাজ্যের দেবতা আমার কিংবা আমার পূর্বপুরুষদের হাত থেকে তার লোকদের উদ্ধার করতে পারে নি। তাহলে এটা কত না নিশ্চয় যে, তোমাদের দেবতারা আমার হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করতে পারবে না।’ ” সন্‌হেরীবের লোকেরা মাবুদ আল্লাহ্‌ ও তাঁর গোলাম হিষ্কিয়ের বিরুদ্ধে আরও অনেক কথা বলল। এছাড়া সন্‌হেরীব ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌কে কুফরী করবার জন্য চিঠিতে তাঁর বিরুদ্ধে এই কথা লিখলেন, “অন্যান্য দেশের জাতিদের দেবতারা যেমন আমার হাত থেকে তাদের লোকদের উদ্ধার করে নি, ঠিক সেইভাবে হিষ্কিয়ের আল্লাহ্‌ও আমার হাত থেকে তার লোকদের উদ্ধার করবে না।” সন্‌হেরীবের লোকেরা হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে ঐ কথা বলতে লাগল, যাতে জেরুজালেমের যে লোকেরা দেয়ালের উপরে ছিল তারা ভীষণ ভয় পায় আর আশেরিয়ার লোকেরা শহরটা দখল করে নিতে পারে। তারা মানুষের হাতে তৈরী দুনিয়ার সব জাতির দেবতাদের সম্বন্ধে যা বলেছিল জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র বিষয়েও তা-ই বলল। সেইজন্য বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় ও আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়া মুনাজাতের মধ্য দিয়ে বেহেশতের আল্লাহ্‌র কাছে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন। এতে মাবুদ একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিলেন যিনি আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র ছাউনির মধ্য থেকে সমস্ত যোদ্ধা, নেতা ও সেনাপতিদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেললেন। এতে সন্‌হেরীব লজ্জা পেয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন। তিনি তাঁর দেবতার মন্দিরে গেলে পর তাঁর কয়েকজন ছেলে তাঁকে হত্যা করল। এইভাবে মাবুদ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীবের এবং অন্যান্য সকলের হাত থেকে হিষ্কিয়কে ও জেরুজালেমের লোকদের রক্ষা করলেন। তিনি সব দিক দিয়েই তাদের নিরাপদে রাখলেন। অনেকেই জেরুজালেমে মাবুদের উদ্দেশে উপহার নিয়ে আসল এবং এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের জন্য দামী উপহার আনল। তাতে সেই সময় থেকে সমস্ত জাতির লোক তাঁকে খুব সম্মান করতে লাগল। সেই সময় হিষ্কিয় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হলেন। হিষ্কিয় মাবুদের কাছে মুনাজাত করলে পর তিনি জবাব দিলেন এবং তাঁকে একটা অলৌকিক-চিহ্ন দিলেন। কিন্তু হিষ্কিয়ের অন্তরে অহংকার দেখা দিল। তাঁর প্রতি যে রকম দোয়া করা হয়েছিল সেই অনুসারে তিনি কাজ করলেন না; এতে তাঁর উপর এবং এহুদা ও জেরুজালেমের উপর মাবুদের রাগ হল। তখন হিষ্কিয় তাঁর দিলের অহংকারের কথা বুঝতে পেরে নিজেকে নত করলেন এবং জেরুজালেমের লোকেরাও তা-ই করল। সেইজন্য হিষ্কিয়ের সময়ে মাবুদের গজব তাদের উপর নেমে আসল না। হিষ্কিয়ের অনেক ধন-সম্পদ ও সম্মান ছিল। তাঁর সোনা-রূপা, মণি-মুক্তা, খোশবু মসলা, ঢাল ও সমস্ত রকম দামী জিনিসপত্র রাখবার জন্য তিনি ধনভাণ্ডার তৈরী করালেন। এছাড়া তিনি শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল রাখবার জন্য ভাণ্ডার-ঘর তৈরী করালেন এবং বিভিন্ন রকম পশুর ও ছাগল-ভেড়ার থাকবার ঘরও তৈরী করালেন। তিনি নিজের জন্য অনেক গ্রাম ও শহর গড়ে তুললেন। তাঁর গরু-ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা অনেক হল, কারণ আল্লাহ্‌ তাঁকে অনেক ধন দিয়েছিলেন। হিষ্কিয় জিহোন ঝর্ণার উপরের মুখ বন্ধ করে দাউদ-শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে পানি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সব কাজেই সফল হয়েছিলেন। দেশে যে অলৌকিক-চিহ্ন দেখানো হয়েছিল সেই বিষয় জিজ্ঞাসা করবার জন্য যখন ব্যাবিলনের নেতারা রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিলেন তখন আল্লাহ্‌ তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, যাতে তাঁর মনে কি আছে তা প্রকাশ পায়। হিষ্কিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তাঁর আল্লাহ্‌-ভয়ের কাজ সম্বন্ধে আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়ার দর্শনের বইয়ে এবং “এহুদা ও ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। পরে হিষ্কিয় তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং দাউদের বংশধরদের কবরস্থানের উপরের অংশে তাঁকে দাফন করা হল। তিনি ইন্তেকাল করবার সময় এহুদার সকলে এবং জেরুজালেমের লোকেরা তাঁকে সম্মান দেখাল। তাঁর ছেলে মানশা তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। মানশা বারো বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে পঞ্চান্ন বছর রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে যে সব জাতিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মত জঘন্য কাজ করে তিনি মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। তাঁর পিতা হিষ্কিয় পূজার যে সব উঁচু স্থান ধ্বংস করেছিলেন তিনি সেগুলো আবার তৈরী করালেন। এছাড়া তিনি বাল দেবতার উদ্দেশে কতগুলো বেদী ও আশেরা-খুঁটি তৈরী করলেন। তিনি আকাশের সব তারাগুলোর পূজা ও সেবা করতেন। যে ঘরের বিষয় মাবুদ বলেছিলেন, “আমি চিরকাল জেরুজালেমে বাস করব,” মাবুদের সেই ঘরের মধ্যে তিনি কতগুলো বেদী তৈরী করলেন। মাবুদের ঘরের দু’টা উঠানেই তিনি আকাশের সমস্ত তারাগুলোর উদ্দেশে কতগুলো বেদী তৈরী করলেন। বিন্‌-হিন্নোম উপত্যকায় তাঁর ছেলেদের তিনি আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করলেন। যারা কুলক্ষণ দেখে ভবিষ্যতের কথা বলে, মায়াবিদ্যা ও জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে এবং ভূতের মাধ্যম হয় আর ভূতদের সংগে সম্বন্ধ রাখে তিনি তাদের সংগে পরামর্শ করতেন। মাবুদের চোখে অনেক খারাপ কাজ করে তিনি তাঁকে রাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি যে মূর্তি খোদাই করে তৈরী করেছিলেন সেটা নিয়ে আল্লাহ্‌র ঘরে রাখলেন। আল্লাহ্‌ এই ঘর সম্বন্ধে দাউদ ও তাঁর ছেলে সোলায়মানকে বলেছিলেন, “এই ঘর ও ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্য থেকে আমার বেছে নেওয়া এই জেরুজালেমকে আমি চিরকালের জন্য আমার বাসস্থান করব। আমি বনি-ইসরাইলদের যে সব হুকুম দিয়েছি, অর্থাৎ মূসার মধ্য দিয়ে যে সব শরীয়ত, নিয়ম ও নির্দেশ দিয়েছি যদি কেবল তারা যত্নের সংগে তা পালন করে তবে যে দেশ আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছি সেখান থেকে তাদের আর দূর করে দেব না।” এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের মানশা বিপথে নিয়ে গেলেন; তার ফলে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের সামনে থেকে যে সব জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তাদের চেয়েও তারা আরও খারাপ কাজ করতে লাগল। মাবুদ মানশা ও তাঁর লোকদের কাছে কথা বলতেন কিন্তু তারা তাতে কান দিত না। কাজেই মাবুদ তাদের বিরুদ্ধে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র সেনাপতিদের নিয়ে আসলেন। তারা মানশাকে বন্দী করে তাঁর গায়ে আঁকড়া লাগিয়ে ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বেঁধে ব্যাবিলনে নিয়ে গেল। বিপদে পড়ে তিনি তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র রহমত ভিক্ষা করলেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌র সামনে নিজেকে খুবই নত করলেন। এইভাবে মুনাজাত করলে পর মাবুদের মন নরম হল এবং তাঁর মিনতি শুনে তিনি তাঁকে জেরুজালেমে ও তাঁর রাজ্যে ফিরিয়ে আনলেন। তখন মানশা বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহ্‌ই মাবুদ। পরে তিনি দাউদ-শহরের বাইরের দেয়ালটা উপত্যকার মধ্যেকার জিহোন ঝর্ণা থেকে ওফল পাহাড় ঘিরে পশ্চিম দিকে মাছ-দরজায় ঢুকবার পথ পর্যন্ত আরও উঁচু করে তৈরী করিয়ে শক্তিশালী করলেন। এহুদার দেয়াল-ঘেরা সমস্ত গ্রাম ও শহরগুলোতে তিনি সেনাপতিদের নিযুক্ত করলেন। তিনি মাবুদের ঘর থেকে দেব-দেবীদের মূর্তিগুলোকে দূর করে দিলেন। তিনি জেরুজালেমে এবং মাবুদের ঘরের পাহাড়ের উপরে যে সব বেদী তৈরী করেছিলেন সেগুলোও দূর করে দিলেন। সেগুলো নিয়ে তিনি শহরের বাইরে ফেলে দিলেন। তারপর তিনি মাবুদের কোরবানগাহ্‌ আবার ঠিক করলেন এবং তার উপরে যোগাযোগ ও কৃতজ্ঞতা-কোরবানী দিলেন। তিনি এহুদার লোকদের হুকুম দিলেন যেন তারা বনি-ইসরাইলদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করে। অবশ্য লোকেরা তখনও পূজার উঁচু স্থানগুলোতে পশু-কোরবানী দিত, তবে তারা তা করত কেবল তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌রই উদ্দেশে। মানশার অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা, তাঁর আল্লাহ্‌র কাছে তাঁর মুনাজাত এবং ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র নামে নবীরা তাঁকে যে কথা বলেছিলেন তা সবই “ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। তাঁর মুনাজাতের কথা, তাঁর মিনতিতে আল্লাহ্‌র মন নরম হওয়ার কথা, তাঁর সব গুনাহ্‌ ও বেঈমানীর কথা এবং তিনি নিজেকে আল্লাহ্‌র সামনে নত করবার আগে পূজার যে সব উঁচু স্থান তৈরী করেছিলেন আর আশেরা-খুঁটি ও খোদাই-করা মূর্তি স্থাপন করেছিলেন সেই সব কথা দর্শকদের বইয়ে লেখা রয়েছে। পরে মানশা তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন এবং রাজবাড়ীতেই তাঁকে দাফন করা হল। তাঁর জায়গায় তাঁর ছেলে আমোন বাদশাহ্‌ হলেন। আমোন বাইশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং জেরুজালেমে দু’বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পিতা মানশার মতই তিনি মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। মানশা যে সব মূর্তি খোদাই করে তৈরী করেছিলেন আমোন তাদের পূজা করতেন ও তাদের কাছে পশু-উৎসর্গ করতেন। কিন্তু তাঁর পিতা মানশার মত তিনি মাবুদের সামনে নিজেকে নত করেন নি; তিনি গুনাহ্‌ করতেই থাকলেন। আমোনের কর্মচারীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে রাজবাড়ীতেই তাঁকে খুন করল। কিন্তু যারা বাদশাহ্‌ আমোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল দেশের লোকেরা তাদের সবাইকে হত্যা করল এবং তারা তাঁর ছেলে ইউসিয়াকে তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ করল। ইউসিয়া আট বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং একত্রিশ বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা ভাল তিনি তা-ই করতেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের পথে চলতেন; সেই পথ থেকে ডানে কি বাঁয়ে যেতেন না। তাঁর রাজত্বের অষ্টম বছরে তাঁর বয়স কম থাকলেও তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার জন্য মন স্থির করলেন। রাজত্বের বারো বছরের সময় তিনি পূজার সব উঁচু স্থান, আশেরা-খুঁটি, খোদাই করা মূর্তি ও ছাঁচে ঢালা মূর্তি এহুদা ও জেরুজালেম থেকে দূর করে দিতে লাগলেন। তাঁর সামনে বাল দেবতার বেদীগুলো ভেংগে ফেলা হল; সেগুলোর উপরে যে সব ধূপদানী ছিল সেগুলো কেটে টুকরা টুকরা করা হল এবং আশেরা-খুঁটি, খোদাই করা মূর্তি ও ছাঁচে ঢালা মূর্তিগুলো ভেংগে ধুলার মত করা হল। যারা সেগুলোর কাছে পশু বলি দিত তাদের কবরের উপরে সেই ধুলা ছড়িয়ে দেওয়া হল। বেদীগুলোর উপরে পুরোহিতদের হাড় পোড়ানো হল। এইভাবে তিনি এহুদা ও জেরুজালেমকে পাক-সাফ করলেন। ইউসিয়ার রাজত্বের আঠারো বছরের সময় তিনি দেশ ও বায়তুল-মোকাদ্দস পাক-সাফ করবার পর তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরটি মেরামত করবার জন্য অৎসলিয়ের ছেলে শাফনকে, শহরের শাসনকর্তা মাসেয়কে ও যোয়াহসের ছেলে ইতিহাস লেখক যোয়াহকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা মহা-ইমাম হিল্কিয়ের কাছে গেলেন এবং আল্লাহ্‌র ঘরে যে সব টাকা-পয়সা আনা হয়েছিল, অর্থাৎ যে সব টাকা-পয়সা রক্ষী-লেবীয়রা মানশা ও আফরাহীম-গোষ্ঠীর লোকদের এবং ইসরাইলের বাকী সমস্ত লোকদের কাছ থেকে এবং এহুদা ও বিন্যামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোকদের ও জেরুজালেমের বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোগাড় করেছিল তা মহা-ইমামের কাছে রাখলেন। তারপর সেই টাকা-পয়সা মাবুদের ঘরের কাজের তদারক করবার জন্য যে লোকদের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের হাতে দেওয়া হল। তদারককারীরা বায়তুল-মোকাদ্দস মেরামত ও আবার ঠিকঠাক করবার জন্য মিস্ত্রিদের হাতে টাকা দিল, অর্থাৎ এহুদার বাদশাহ্‌রা যে ঘরগুলো ধ্বংস হতে দিয়েছিলেন সেগুলোর জন্য তারা ছুতার মিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রিদের টাকা দিল যাতে তারা সুন্দর করে কাটা পাথর এবং ঘরের জোড়ার জন্য ও কড়িকাঠের জন্য কাঠ কিনতে পারে। সেই মিস্ত্রিরা বিশ্বস্তভাবে কাজ করেছিল। তাদের তদারক করবার জন্য তাদের উপরে ছিল যহৎ ও ওবদিয় নামে মরারি-বংশের দু’জন লেবীয় এবং কহাৎ-বংশের জাকারিয়া ও মশুল্লম আর যে লেবীয়রা ভাল বাজনা বাজাতে পারত তারা। এরা বোঝা বহনকারী লোকদের উপর নিযুক্ত ছিল এবং বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত কাজের লোকদের সকলের তদারক করত। লেবীয়দের মধ্যে কেউ কেউ ছিল লেখক, কর্মকর্তা ও রক্ষী। তাঁরা যখন মাবুদের ঘরে আনা টাকা-পয়সা বের করে আনছিলেন তখন ইমাম হিল্কিয় মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া মাবুদের তৌরাত কিতাবটি পেলেন। হিল্কিয় তখন বাদশাহ্‌র লেখক শাফনকে বললেন, “মাবুদের ঘরে আমি তৌরাত কিতাবটি পেয়েছি।” এই বলে তিনি শাফনকে সেই কিতাব দিলেন। শাফন সেই কিতাবটি বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বললেন, “আপনার কর্মচারীদের উপর যে কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল তাঁরা তা সবই করছেন। মাবুদের ঘরে যে টাকা-পয়সা ছিল তাঁরা তা বের করে তদারককারী ও কাজের লোকদের দিয়েছেন।” তখন লেখক শাফন এই কথা বাদশাহ্‌কে জানালেন, “ইমাম হিল্কিয় আমাকে একটি কিতাব দিয়েছেন।” এই বলে শাফন তা বাদশাহ্‌কে তেলাওয়াত করে শোনালেন। বাদশাহ্‌ তৌরাত কিতাবের কথাগুলো শুনে নিজের পোশাক ছিঁড়লেন। তিনি হিল্কিয়, শাফনের ছেলে অহীকাম, মিকায়ের ছেলে অব্দোন, শাফন ও বাদশাহ্‌র সাহায্যকারী অসায়কে এই হুকুম দিলেন, “যে কিতাবটি পাওয়া গেছে তার মধ্যে কি লেখা রয়েছে তা আপনারা গিয়ে আমার এবং ইসরাইল ও এহুদার বাকী লোকদের জন্য মাবুদকে জিজ্ঞাসা করুন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাবুদের কালাম পালন করেন নি এবং এই কিতাবে যা লেখা আছে সেই অনুসারে কাজ করেন নি বলে তাঁর ভীষণ গজব আমাদের উপরে পড়েছে।” তখন হিল্কিয় এবং বাদশাহ্‌ যাদের হিল্কিয়ের সংগে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা এই বিষয়ে কথা বলবার জন্য মহিলা-নবী হুল্‌দার কাছে গেলেন। হুল্‌দা ছিলেন কাপড়-চোপড় রক্ষাকারী শল্লুমের স্ত্রী। শল্লুম ছিলেন হস্রহের নাতি, অর্থাৎ তোখতের ছেলে। তিনি জেরুজালেমের দ্বিতীয় অংশে বাস করতেন। তারা আমাকে ত্যাগ করে দেব-দেবীদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়েছে এবং তাদের হাতের তৈরী সমস্ত মূর্তির দ্বারা আমাকে রাগিয়েছে। সেইজন্য এই জায়গার উপর আমার গজব আমি ঢেলে দেব এবং সেই গজবের আগুন নিভানো যাবে না।’ মাবুদের কাছে জিজ্ঞাসা করবার জন্য যিনি আপনাদের পাঠিয়েছেন সেই এহুদার বাদশাহ্‌কে বলবেন যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘এই জায়গা ও তার লোকদের বিরুদ্ধে আমি যা বলেছি তা শুনে তোমার দিল তাতে সাড়া দিয়েছে এবং আমার সামনে তুমি নিজেকে নত করেছ ও তোমার পোশাক ছিঁড়ে আমার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছ। তুমি এই সব করেছ বলে আমি মাবুদ তোমার মুনাজাত শুনেছি। সেইজন্য আমি শীঘ্রই তোমাকে তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে নিয়ে যাব এবং তুমি শান্তিতে দাফন পাবে। এই জায়গার উপরে এবং যারা এখানে বাস করে তাদের উপরে আমি যে সব বিপদ নিয়ে আসব তোমার চোখ তা দেখবে না।’ ” তাঁরা হুল্‌দার জবাব নিয়ে বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে গেলেন। তখন বাদশাহ্‌ লোক পাঠিয়ে এহুদা ও জেরুজালেমের সমস্ত বৃদ্ধ নেতাদের ডেকে একত্র করলেন। তিনি এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের, ইমাম ও লেবীয়দের এবং সাধারণ ও গণ্যমান্য সমস্ত লোকদের নিয়ে মাবুদের ঘরে গেলেন। মাবুদের ঘরে ব্যবস্থার যে কিতাবটি পাওয়া গিয়েছিল তার সমস্ত কথা তিনি তাদের কাছে তেলাওয়াত করে শোনালেন। বাদশাহ্‌ তাঁর নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মাবুদের পথে চলবার জন্য এবং সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সব হুকুম, নিয়ম ও নির্দেশ মেনে চলবার জন্য, অর্থাৎ এই কিতাবের মধ্যে লেখা ব্যবস্থার সমস্ত কথা পালন করবার জন্য মাবুদের সামনে ওয়াদা করলেন। তারপর তিনি জেরুজালেম ও বিন্‌ইয়ামীনের উপস্থিত সমস্ত লোককে সেই একই ওয়াদা করালেন। জেরুজালেমের লোকেরা আল্লাহ্‌র, তাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌র ব্যবস্থা পালন করতে শুরু করল। ইউসিয়া বনি-ইসরাইলদের অধিকারে থাকা সমস্ত দেশ থেকে সব জঘন্য মূর্তি দূর করে দিলেন এবং ইসরাইল দেশে উপস্থিত সকলকে দিয়ে তিনি তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করালেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র পথে চলেছিল। ইউসিয়া জেরুজালেমে মাবুদের উদ্দেশে উদ্ধার-ঈদ পালন করলেন। প্রথম মাসের চৌদ্দ দিনের দিন লোকেরা উদ্ধার-ঈদের ভেড়া জবাই করল। তিনি ইমামদের তাঁদের কাজে নিযুক্ত করলেন এবং মাবুদের ঘরের এবাদত-কাজে তাঁদের উৎসাহ দিলেন। লেবীয়রা, যাঁরা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের শিক্ষা দিতেন এবং মাবুদের উদ্দেশ্যে যাঁদের পবিত্র করা হয়েছিল তাঁদের তিনি বললেন, “ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদের ছেলে সোলায়মান যে এবাদত-খানা তৈরী করিয়েছিলেন সেখানে আপনারা পবিত্র সিন্দুকটি রাখুন। এটা আর আপনাদের কাঁধে করে বহন করতে হবে না। এখন আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ও তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের খেদমত করুন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদ ও তাঁর ছেলে সোলায়মানের লেখা নির্দেশ মত, আপনাদের নিজের নিজের বংশ অনুসারে নির্দিষ্ট দলে এবাদত-কাজের জন্য আপনারা নিজেদের প্রস্তুত করুন। “আপনাদের জাতির লোকদের, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের বংশগুলোর প্রত্যেকটি ভাগের জন্য কয়েকজন লেবীয়কে তাঁদের বংশ অনুসারে সেই ভাগের লোকদের সংগে নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের উঠানে গিয়ে দাঁড়ান। আপনারা উদ্ধার-ঈদের ভেড়াগুলো জবাই করবেন বলে নিজেদের পাক-সাফ করুন এবং মূসার মধ্য দিয়ে দেওয়া মাবুদের হুকুম অনুসারে আপনাদের জাতির লোকেরা যাতে উদ্ধার-ঈদ পালন করতে পারে তার ব্যবস্থা করুন।” তারপর ইউসিয়া সেখানে উপস্থিত সমস্ত লোকদের জন্য উদ্ধার-ঈদের কোরবানীর উদ্দেশ্যে ত্রিশ হাজার ছাগল ও ভেড়ার বাচ্চা এবং তিন হাজার ষাঁড় দিলেন। এগুলো বাদশাহ্‌র নিজের সম্পত্তি থেকে দেওয়া হল। বাদশাহ্‌র কর্মচারীরাও নিজের ইচ্ছায় লোকদের, ইমামদের ও লেবীয়দের দান করলেন। হিল্কিয়, জাকারিয়া ও যিহীয়েল নামে আল্লাহ্‌র ঘরের নেতারা উদ্ধার-ঈদের কোরবানীর জন্য দু’হাজার ছ’শো ছাগল ও ভেড়া এবং তিনশো ষাঁড় ইমামদের দিলেন। কনানিয় এবং তার দুই ভাই শময়িয় ও নথনেল, হশবিয়, যীয়ীয়েল ও যোষাবদ- লেবীয়দের এই নেতারা উদ্ধার-ঈদের কোরবানীর জন্য পাঁচ হাজার ছাগল ও ভেড়া এবং পাঁচশো ষাঁড় লেবীয়দের দিলেন। এইভাবে এবাদত-কাজের ব্যবস্থা করা হল এবং বাদশাহ্‌র হুকুম মত ইমামেরা নিজের নিজের জায়গায় আর লেবীয়রা তাদের বিভিন্ন দল অনুসারে দাঁড়ালেন। লেবীয়রা উদ্ধার-ঈদের ছাগল ও ভেড়া জবাই করল এবং ইমামেরা তাদের হাত থেকে রক্ত নিয়ে তা ছিটিয়ে দিলেন, আর লেবীয়রা পশুগুলোর চামড়া ছাড়াল। মূসার কিতাবে লেখা হুকুম অনুসারে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী করবার জন্য তারা প্রত্যেক বংশের বিভিন্ন ভাগের লোকদের দেবার জন্য পোড়ানো-কোরবানীর জিনিস সরিয়ে রাখল। ষাঁড়ের বেলায়ও তারা তা-ই করল। নিয়ম অনুসারে তারা উদ্ধার-ঈদের পশু আগুনে ঝল্‌সে নিল এবং কোরবানীর গোশ্‌ত ডেক্‌চি, কড়াই ও হাঁড়িতে সিদ্ধ করল আর তাড়াতাড়ি করে লোকদের খেতে দিল। তারপর তারা নিজেদের ও ইমামদের জন্য ব্যবস্থা করল, কারণ ইমামেরা, অর্থাৎ হারুনের বংশধরেরা পোড়ানো-কোরবানীর জিনিস ও চর্বির অংশ রাত পর্যন্ত কোরবানী দিচ্ছিলেন। সেইজন্য লেবীয়রা নিজেদের ও হারুন্তবংশের ইমামদের জন্য ব্যবস্থা করল। দাউদ, আসফ, হেমন ও বাদশাহ্‌র নবী যিদূথূনের নির্দেশ অনুসারে আসফের বংশের কাওয়াল ও বাদকেরা নিজের নিজের জায়গায় ছিলেন। প্রত্যেকটি দরজায় রক্ষী ছিল। তাদের কাজ ছেড়ে আসবার দরকার হয় নি, কারণ তাদের লেবীয় ভাইয়েরা তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছিল। এইভাবে বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার হুকুম মত উদ্ধার-ঈদ পালনের জন্য এবং মাবুদের কোরবানগাহের উপরে পোড়ানো-কোরবানী দেবার জন্য সেই দিন মাবুদের সমস্ত এবাদত-কাজের ব্যবস্থা করা হল। যে সব ইসরাইলীয় উপস্থিত ছিল তারা সেই সময় উদ্ধার-ঈদ এবং সাত দিন ধরে খামিহীন রুটির ঈদ পালন করল। নবী শামুয়েলের পর থেকে আর কখনও ইসরাইল দেশে এইভাবে উদ্ধার-ঈদ পালন করা হয় নি। ইমাম, লেবীয় এবং জেরুজালেমের লোকদের সংগে উপস্থিত এহুদা ও ইসরাইলের সমস্ত লোকদের নিয়ে ইউসিয়া যেভাবে উদ্ধার-ঈদ পালন করেছিলেন ইসরাইলের বাদশাহ্‌দের মধ্যে আর কেউ তেমনভাবে পালন করেন নি। ইউসিয়ার রাজত্বের আঠারো বছরের সময় এই উদ্ধার-ঈদ পালন করা হয়েছিল। ইউসিয়া বায়তুল-মোকাদ্দসের সব কাজ শেষ করবার পরে মিসরের বাদশাহ্‌ নেখো ফোরাত নদীর কাছে কার্খেমিশে যুদ্ধ করতে গেলেন। তখন তাঁকে বাধা দেবার জন্য ইউসিয়া বের হয়ে আসলেন। কিন্তু নেখো লোক পাঠিয়ে তাঁকে বললেন, “হে এহুদার বাদশাহ্‌, আপনার ও আমার মধ্যে কিসের ঝগড়া? এইবার আমি যে আপনাকে আক্রমণ করতে আসছি তা নয়, কিন্তু আক্রমণ করছি সেই লোকদের যাদের সংগে আমার যুদ্ধ বেধেছে। আল্লাহ্‌ আমাকে তাড়াতাড়ি করতে বলেছেন, কাজেই আল্লাহ্‌ যিনি আমার সংগে আছেন আপনি তাঁকে বাধা দেবেন না, দিলে তিনি আপনাকে ধ্বংস করবেন।” ইউসিয়া কিন্তু ফিরলেন না, বরং তাঁর সংগে যুদ্ধ করবার জন্য ভিন্ন পোশাকে নিজেকে সাজালেন। আল্লাহ্‌র হুকুমে নেখো তাঁকে যা বললেন তাতে তিনি কান না দিয়ে মগিদ্দোর সমভূমিতে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন। তখন ধনুকধারীরা বাদশাহ্‌ ইউসিয়াকে তীর মারলে পর তিনি তাঁর লোকদের বললেন, “আমাকে নিয়ে যাও, আমি খুব বেশী আঘাত পেয়েছি।” কাজেই তারা তাঁর রথ থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে তাঁর অন্য রথটিতে রাখল এবং তাঁকে জেরুজালেমে নিয়ে আসল, আর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করলেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের কবরে তাঁকে দাফন করা হল, আর এহুদা ও জেরুজালেমের সব লোক তাঁর জন্য শোক করল। ইউসিয়ার জন্য নবী ইয়ারমিয়া বিলাপের গজল রচনা করলেন এবং আজও সমস্ত কাওয়ালেরা ইউসিয়ার বিষয়ে বিলাপ-গজল গায়। ইসরাইল দেশে এটা একটা চল্‌তি নিয়ম হয়ে গেল এবং বিলাপ-গজলের বইয়ে তা লেখা হল। পরে দেশের লোকেরা ইউসিয়ার ছেলে যিহোয়াহসকে নিয়ে জেরুজালেমে তাঁর বাবার জায়গায় বাদশাহ্‌ করল। যিহোয়াহস তেইশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং তিন মাস জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। মিসরের বাদশাহ্‌ নেখো জেরুজালেমে তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে এহুদার উপরে প্রায় চার টন রূপা ও ঊনচল্লিশ কেজি সোনা খাজনা বসালেন। মিসরের বাদশাহ্‌ যিহোয়াহসের এক ভাই ইলীয়াকীমকে এহুদা ও জেরুজালেমের উপরে বাদশাহ্‌ করলেন এবং ইলীয়াকীমের নাম বদলে যিহোয়াকীম রাখলেন। নেখো যিহোয়াহসকে ধরে মিসরে নিয়ে গেলেন। যিহোয়াকীম পঁচিশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং এগারো বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তাঁকে আক্রমণ করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাবার জন্য তাঁকে ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বাঁধলেন। বখতে-নাসার মাবুদের ঘর থেকে জিনিসপত্রও ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়ে তাঁর মন্দিরে রাখলেন। যিহোয়াকীমের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তিনি যে সব জঘন্য কাজ করেছিলেন ও তাঁর বিরুদ্ধে যা কিছু পাওয়া গিয়েছিল তা সবই “ইসরাইল ও এহুদার বাদশাহ্‌দের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে। তাঁর পরে তাঁর ছেলে যিহোয়াখীন তাঁর জায়গায় বাদশাহ্‌ হলেন। যিহোয়াখীন আঠারো বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং তিন মাস দশ দিন জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। বছরের শেষে বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার লোক পাঠিয়ে তাঁকে ও তাঁর সংগে মাবুদের ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাবিলনে নিয়ে গেলেন, আর যিহোয়াখীনের চাচা সিদিকিয়কে এহুদা ও জেরুজালেমের বাদশাহ্‌ করলেন। সিদিকিয় একুশ বছর বয়সে বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন এবং এগারো বছর জেরুজালেমে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন। তিনি নবী ইয়ারমিয়া, যিনি মাবুদের কালাম বলতেন, তাঁর সামনে নিজেকে নীচু করলেন না। এছাড়া বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার, যিনি আল্লাহ্‌র নামে তাঁকে কসম খাইয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করলেন। তিনি একগুঁয়েমি করে এবং নিজের অন্তর কঠিন করে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে ফিরলেন না। এছাড়া ইমামদের সব নেতারা ও লোকেরা অন্যান্য জাতির জঘন্য অভ্যাস মত চলে ভীষণ গুনাহ্‌ করল এবং মাবুদ জেরুজালেমে তাঁর যে ঘরকে পবিত্র করেছিলেন তা নাপাক করল। বনি-ইসরাইলদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বার বার লোক পাঠিয়ে তাদের সাবধান করতেন, কারণ তাঁর বান্দাদের ও তাঁর বাসস্থানের প্রতি তাঁর মমতা ছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌র পাঠানো লোকদের তারা টিট্‌কারি দিত, তাঁর কথা তুচ্ছ করত এবং তাঁর নবীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। শেষে মাবুদের রাগ তাঁর লোকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠল; তাদের রক্ষা পাওয়ার আর কোন পথ রইল না। তাদের বিরুদ্ধে মাবুদ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌কে নিয়ে আসলেন। সেই বাদশাহ্‌ বায়তুল-মোকাদ্দসে তাদের যুবকদের হত্যা করলেন এবং যুবক-যুবতী, বুড়ো বা বয়স্ক কাউকেই দয়া দেখালেন না। আল্লাহ্‌ তাদের সবাইকে সেই বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দিলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ আল্লাহ্‌র ঘরের ছোট-বড় সব জিনিস ও ধন-দৌলত এবং বাদশাহ্‌ ও তাঁর কর্মচারীদের ধন-দৌলত ব্যাবিলনে নিয়ে গেলেন। তাঁর লোকেরা আল্লাহ্‌র ঘর পুড়িয়ে দিল এবং জেরুজালেমের দেয়াল ভেংগে ফেলল। তারা সেখানকার সব বড় বড় বাড়ী পুড়িয়ে দিল ও সমস্ত দামী জিনিস নষ্ট করে ফেলল। যারা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল তাদের তিনি ব্যাবিলনে নিয়ে গেলেন, আর পারস্য-রাজ্য ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তারা বখতে-নাসার ও তাঁর বংশধরদের গোলাম হয়ে রইল। এই সময় ইসরাইল দেশ তার বিশ্রাম-বছরের বিশ্রাম ভোগ করল। নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে বলা মাবুদের কালামের সত্তর বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের দেশের সমস্ত জমি এমনি পড়ে থেকে বিশ্রাম ভোগ করল। নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে বলা মাবুদের কালাম পূর্ণ হবার জন্য পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছরে মাবুদ কাইরাসের দিলে এমন ইচ্ছা দিলেন যার জন্য তিনি তাঁর সমস্ত রাজ্যে মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে এই ঘোষণা দিলেন: “পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাস এই কথা বলছেন, ‘বেহেশতের মাবুদ আল্লাহ্‌ দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য আমাকে দিয়েছেন এবং এহুদা দেশের জেরুজালেমে তাঁর জন্য একটা ঘর তৈরী করবার জন্য আমাকে নিযুক্ত করেছেন। তাঁর লোকদের মধ্যে, অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে চায় সে সেখানে যাক এবং তার মাবুদ আল্লাহ্‌ তার সংগে থাকুন।’ ” নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে বলা মাবুদের কালাম পূর্ণ হবার জন্য পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছরে মাবুদ কাইরাসের দিলে এমন ইচ্ছা দিলেন যার জন্য তিনি তাঁর সমস্ত রাজ্যে মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে এই ঘোষণা দিলেন: “পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাস এই কথা বলছেন, ‘বেহেশতের মাবুদ আল্লাহ্‌ দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য আমাকে দিয়েছেন এবং এহুদা দেশের জেরুজালেমে তাঁর জন্য একটা ঘর তৈরী করবার জন্য আমাকে নিযুক্ত করেছেন। তাঁর লোকদের মধ্যে, অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে চায় সে এহুদা দেশের জেরুজালেমে গিয়ে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘর তৈরী করুক, কারণ তিনি জেরুজালেমে আছেন। যারা সেখানে যাবে তাদের আল্লাহ্‌ তাদের সংগে থাকুন। আল্লাহ্‌র যে সমস্ত লোকেরা এখনও বেঁচে আছে তারা যেখানেই বাস করুক না কেন তাদের মধ্যে যারা জেরুজালেমে যেতে চায় তাদের প্রতিবেশীরা যেন তাদের সোনা-রূপা, জিনিসপত্র ও পশুপাল দিয়ে সাহায্য করে ও জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য নিজের ইচ্ছায় উপহারও দেয়।’ ” এতে এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীনের বংশ-নেতাদের, ইমামদের ও লেবীয়দের মধ্যে যাঁদের দিলে আল্লাহ্‌ ইচ্ছা দিলেন তাঁরা প্রত্যেকে জেরুজালেমে মাবুদের ঘর তৈরী করতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁদের সব প্রতিবেশীরা রূপার পাত্র, সোনা, অন্যান্য জিনিস, পশুপাল ও দামী দামী জিনিস দিয়ে তাদের সাহায্য করল এবং আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য নিজের ইচ্ছায় উপহারও দিল। সেই সব জিনিসের তালিকা এই: ত্রিশটা সোনার গামলা, এক হাজার রূপার গামলা, ঊনত্রিশটা ছুরি, ত্রিশটা সোনার পেয়ালা, ভিন্ন আকারের চারশো দশটা রূপার পেয়ালা এবং এক হাজার অন্যান্য জিনিসপত্র। সেখানে মোট পাঁচ হাজার চারশোটা সোনা ও রূপার জিনিস ছিল। বন্দী অবস্থায় বিদেশে বাসকারী লোকেরা যখন ব্যাবিলন থেকে জেরুজালেমে আসল তখন শেশ্‌বসর এই সব জিনিস সংগে করে নিয়ে আসলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার যে সব লোকদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই বন্দী অবস্থা থেকে জেরুজালেম ও এহুদায় নিজের নিজের শহর ও গ্রামে ফিরে এসেছিল। এই লোকেরা সরুব্বাবিল, ইউসা, নহিমিয়া, সরায়, রিয়েলায়, মর্দখয়, বিল্‌শন, মিসপর, বিগ্‌বয়, রহূম ও বানার সংগে ফিরে এসেছিল। যে সমস্ত ইসরাইলীয় পুরুষ লোকেরা ফিরে এসেছিল তাদের সংখ্যা এই: পরোশের বংশের লোকেরা দু’হাজার একশো বাহাত্তর জন; শফটিয়ের তিনশো বাহাত্তর জন; আরহের সাতশো পঁচাত্তর জন; পহৎ-মোয়াবের বংশের ইউসা ও যোয়াবের বংশের লোকেরা দু’হাজার আটশো বারো জন; ইলামের এক হাজার দু’শো চুয়ান্ন জন; সত্তূর ন’শো পঁয়তাল্লিশ জন; সক্কয়ের সাতশো ষাট জন; অদোনীকামের ছ’শো ছেষট্টি জন; বিগ্‌বয়ের দু’হাজার ছাপান্ন জন; আদীনের চারশো চুয়ান্ন জন; যিহিষ্কিয়ের বংশধর আটেরের বংশের আটানব্বই জন; বেৎসয়ের তিনশো তেইশ জন; যোরাহের একশো বারো জন; নটোফার লোক ছাপান্ন জন; অনাথোতের লোক একশো আটাশ জন; অস্‌মাবতের লোক বিয়াল্লিশ জন; কিরিয়ৎ-আরীম, কফীরা ও বেরোতের লোক সাতশো তেতাল্লিশ জন; রামা ও গেবার লোক ছ’শো একুশ জন; মিক্‌মসের লোক একশো বাইশ জন; বেথেল এবং অয়ের লোক দ’ুশো তেইশ জন; হারীমের লোক তিনশো বিশ জন; লোদ, হাদীদ এবং ওনোর লোক সাতশো পঁচিশ জন; জেরিকোর লোক তিনশো পঁয়তাল্লিশ জন; সনায়ার লোক তিন হাজার ছ’শো ত্রিশ জন। ইমামদের সংখ্যা এই: যিদয়িয়ের বংশের ইউসার বংশের লোকেরা ন’শো তিয়াত্তর জন; ইম্মেরের এক হাজার বাহান্ন জন; পশ্‌হূরের এক হাজার দু’শো সাতচল্লিশ জন; হারীমের এক হাজার সতেরো জন। লেবীয়দের সংখ্যা এই: ইউসা ও কদ্‌মীয়েলের বংশের হোদবিয়ের বংশের লোকেরা চুয়াত্তর জন। কাওয়ালদের সংখ্যা এই: আসফের বংশের একশো আটাশ জন। বায়তুল-মোকাদ্দসের রক্ষীদের সংখ্যা মোট একশো ঊনচল্লিশ জন। এরা হল শল্লুম, আটের, টল্‌মোন, অক্কূব, হটীটা ও শোবয়ের বংশের লোক। বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা: এরা হল সীহ, হসূফা ও টব্বায়োতের বংশধরেরা; কেরোস, সীয় ও পাদোনের বংশধরেরা; লবানা, হগাব ও অক্কূবের বংশধরেরা; উষ, পাসেহ ও বেষয়ের বংশধরেরা; অস্না, মিয়ূনীম ও নফূষীমের বংশধরেরা; বক্‌বূক, হকূফা ও হর্হূরের বংশধরেরা; বসলূত, মহীদা ও হর্শার বংশধরেরা; বর্কোস, সীষরা ও তেমহের বংশধরেরা; নৎসীহ ও হটীফার বংশধরেরা। সোলায়মানের চাকরদের বংশধরেরা: এরা হল সোটয়, হস্‌সোফেরত, পরূদা, যালা, দর্কোন, গিদ্দেল, শফটিয়, হটীল, পোখেরৎ-হৎসবায়ীম ও আমীরের বংশধরেরা। বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা ও সোলায়মানের চাকরদের বংশধরেরা মোট তিনশো বিরানব্বই জন। তেল্‌-মেলহ, তেল্‌-হর্শা, কারুবী, অদ্দন ও ইম্মেরের এলাকা থেকে যারা এসেছিল তারা ইসরাইলীয় বলে নিজেদের প্রমাণ করতে পারল না। তারা হল দলায়, টোবিয় ও নকোদের বংশের ছ’শো বাহান্ন জন। শাসনকর্তা তাদের হুকুম দিলেন যতদিন ঊরীম ও তুম্মীম ব্যবহার করবার অধিকারী কোন ইমাম পাওয়া না যায় ততদিন পর্যন্ত তারা যেন মহাপবিত্র খাবারের কিছু না খায়। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা গোটা দলটার লোকসংখ্যা ছিল বিয়াল্লিশ হাজার তিনশো ষাট জন। এছাড়া সাত হাজার তিনশো সাঁইত্রিশ জন চাকর-চাকরাণী এবং দু’শো জন কাওয়াল ছিল। তাদের সাতশো ছত্রিশটা ঘোড়া, দু’শো পঁয়তাল্লিশটা খ"চর, চারশো পঁয়ত্রিশটা উট ও ছয় হাজার সাতশো বিশটা গাধা ছিল। তারা জেরুজালেমে মাবুদের ঘরে পৌঁছালে পর তাদের কয়েকজন বংশ-নেতা আল্লাহ্‌র ঘরটা আগের জায়গায় আবার তৈরী করবার জন্য নিজের ইচ্ছায় দান করলেন। তাঁদের ক্ষমতা অনুসারে এই কাজের জন্য তাঁরা চারশো পাঁচ কেজি সোনা, তিন হাজার দু’শো পঞ্চাশ কেজি রূপা ও ইমামদের জন্য একশোটা পোশাক ধনভাণ্ডারে দিলেন। ইমামেরা, লেবীয়রা, কাওয়ালেরা, বায়তুল-মোকাদ্দসের রক্ষীরা ও খেদমতকারীরা এবং অন্যান্য লোকেরা, অর্থাৎ সমস্ত বনি-ইসরাইল যে যার গ্রাম ও শহরে বাস করতে লাগল। বনি-ইসরাইলরা নিজের নিজের গ্রাম ও শহরে বাস করতে শুরু করবার পর সপ্তম মাসে সমস্ত লোকেরা একসংগে মিলে জেরুজালেমে জমায়েত হল। তারপর যোষাদকের ছেলে ইউসা ও তাঁর সংগী ইমামেরা এবং শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল ও তাঁর সংগীরা পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আল্লাহ্‌র বান্দা মূসার তৌরাত কিতাবের লেখা অনুসারে ইসরাইলের আল্লাহ্‌র কোরবানগাহ্‌টি তৈরী করলেন। তাঁদের চারপাশের লোকদের তাঁরা ভয় করলেও আগের ভিত্তির উপরেই তাঁরা কোরবানগাহ্‌ তৈরী করলেন এবং তার উপর সকাল ও বিকালের কোরবানীর সময়ে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দিতে লাগলেন। তারপর তাঁরা কিতাবের কথামত কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করলেন এবং প্রত্যেক দিনের নির্দিষ্ট সংখ্যা অনুসারে নিয়ম মত পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। তারপর থেকে তাঁরা প্রতি দিনকার পোড়ানো-কোরবানী, অমাবস্যার পোড়ানো-কোরবানী, মাবুদের উদ্দেশে নির্দিষ্ট করা ঈদের পোড়ানো-কোরবানী এবং নিজের ইচ্ছায় আনা পোড়ানো-কোরবানী দিতে লাগলেন। যদিও তখনও মাবুদের ঘরের ভিত্তি গাঁথা হয় নি তবুও তাঁরা সপ্তম মাসের প্রথম দিন থেকে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দিতে লাগলেন। তাঁরা রাজমিস্ত্রি ও ছুতার মিস্ত্রিকে টাকা দিলেন এবং সিডন ও টায়ারের লোকদের খাবার, আংগুর-রস ও তেল দিলেন যাতে তারা পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাসের অনুমতি অনুসারে লেবানন থেকে জাফা পর্যন্ত সমুদ্র পথে এরস কাঠ নিয়ে আসতে পারে। জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র ঘরে পৌঁছাবার পরে দ্বিতীয় বছরের দ্বিতীয় মাসে শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল, যোষাদকের ছেলে ইউসা এবং তাঁদের বাদবাকী ভাইয়েরা কাজ করতে শুরু করলেন। এই ভাইয়েরা হল ইমাম, লেবীয় ও অন্যান্য সমস্ত লোক যারা বন্দীদশা থেকে জেরুজালেমে ফিরে এসেছিল। বিশ বছর ও তার বেশী বয়সের লেবীয়দের মাবুদের ঘর তৈরীর কাজ দেখাশোনা করবার জন্য নিযুক্ত করা হল। ইউসা ও তাঁর ছেলেরা ও ভাইয়েরা, হোদবিয়ের বংশের কদ্‌মীয়েল ও তার ছেলেরা, হেনাদদের ছেলেরা এবং তাদের ছেলেরা ও ভাইয়েরা একত্র হয়ে যারা আল্লাহ্‌র ঘরে কাজ করছিল তাদের দেখাশোনা করতে লাগল। এরা সবাই লেবীয় ছিল। রাজমিস্ত্রিরা যখন মাবুদের ঘরের ভিত্তি স্থাপন করল তখন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ দাউদের নির্দেশ মত মাবুদের প্রশংসা করবার জন্য ইমামেরা তাঁদের নির্দিষ্ট পোশাক পরে শিংগা নিয়ে ও লেবীয়দের মধ্য থেকে আসফের ছেলেরা করতাল নিয়ে যে যার জায়গায় দাঁড়ালেন। মাবুদের প্রশংসা ও শুকরিয়ার কাওয়ালী গাইতে গাইতে তাঁরা গাইলেন, ॥য়1 “তিনি মেহেরবান, ॥য়1 ইসরাইলের প্রতি তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” মাবুদের ঘরের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে বলে সব লোকেরা খুব জোরে চিৎকার করে মাবুদের প্রশংসা করল। কিন্তু অনেকে যখন আনন্দে চিৎকার করে উঠল তখন যাঁরা আগের এবাদত-খানাটি দেখেছিলেন তেমন অনেক বুড়ো ইমাম, লেবীয় ও বংশের নেতা এই এবাদত-খানার ভিত্তি স্থাপন করতে দেখে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। লোকেরা এত চিৎকার করছিল যে, কোন্‌টা আনন্দের আর কোন্‌টা কান্নার শব্দ কেউ তা বুঝতে পারল না। অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শোনা গিয়েছিল। এহুদা আর বিন্‌ইয়ামীনের লোকদের শত্রুরা শুনতে পেল যে, বন্দীরা ফিরে এসে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে একটা এবাদত-খানা তৈরী করছে। সেই শত্রুরা তখন সরুব্বাবিল ও বংশের নেতাদের কাছে এসে বলল, “বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরীর কাজে আমরাও তোমাদের সংগে যোগ দেব, কারণ তোমাদের মত আমরাও তোমাদের আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতে চেষ্টা করছি। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ এসর-হদ্দোন আমাদের এখানে আনবার পর থেকে আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আমরা পশু-কোরবানী দিয়ে আসছি।” কিন্তু সরুব্বাবিল, ইউসা এবং ইসরাইলের অন্যান্য নেতারা বললেন, “আমাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে ঘর তৈরী করবার কাজে আমাদের সংগে তোমাদের কোন সম্বন্ধ নেই। পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাসের হুকুম অনুসারে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আমরা নিজেরাই তা করব।” তখন তাদের দেশে বাসকারী অন্যান্য জাতিরা এহুদার লোকদের উৎসাহ দমিয়ে দিতে এবং ভয় দেখাতে লাগল যেন তারা সেই ঘর তৈরী না করে। তাদের বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের উদ্দেশ্য বানচাল করে দেবার জন্য তারা পারস্যের বাদশাহ্‌র কর্মচারীদের টাকা দিল। তারা বাদশাহ্‌ কাইরাসের গোটা রাজত্বকালে ও তার পরের বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বকালে সেই একই কাজ করতে লাগল। জারেক্সেসের রাজত্বের শুরুতে সেই শত্রুরা এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের বিরুদ্ধে একটা নালিশ লিখে জানাল। পারস্যের বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের সময়েও বিশ্লম, মিত্রদাৎ, টাবেল ও তাঁর অন্যান্য সংগীরা আর্টা-জারেক্সেসের কাছে একটা চিঠি লিখলেন। সেই চিঠি আরামীয় ভাষায় অনুবাদ করে লেখা হল। জেরুজালেমের বিরুদ্ধে বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের কাছে শাসনকর্তা রহূম ও লেখক শিম্‌শয়ের চিঠি। তাঁরা বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন তা এই: “আপনার গোলামেরা, অর্থাৎ ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের লোকেরা বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের কাছে লিখছে। মহারাজের জানা দরকার যে, আপনার কাছ থেকে যে ইহুদীরা আমাদের কাছে এসেছে তারা জেরুজালেমে গেছে এবং বিদ্রোহী ও খারাপ শহরটা আবার গড়ে তুলছে; তারা এর দেয়াল ও ভিত্তি মেরামত করছে। মহারাজের আরও জানা দরকার যে, যদি ঐ শহর ও দেয়াল আবার গড়ে তোলা হয় তবে ঐ লোকেরা খাজনা, কর্‌ কিংবা শুল্ক দেবে না। তাতে বাদশাহ্‌র আয়ের ক্ষতি হবে। আমরা রাজবাড়ীর লবণ খাই তাই বাদশাহ্‌কে অসম্মানিত হতে দেখা আমাদের উচিত নয়। কাজেই আমরা এই সংবাদ বাদশাহ্‌র কাছে পাঠাচ্ছি। এতে বাদশাহ্‌ যেন তাঁর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস বইয়ে খুঁজে দেখেন। সেই বইয়ের মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন যে, জেরুজালেম একটা বিদ্রোহী শহর; এই শহর বাদশাহ্‌দের এবং প্রদেশগুলোর শাসনকর্তাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে আর অনেক কাল আগে থেকেই সেই শহরে বিদ্রোহ হয়ে আসছে। সেইজন্যই সেই শহরকে ধ্বংস করা হয়েছিল। আমরা বাদশাহ্‌কে জানাচ্ছি যে, এই শহরটা যদি আবার তৈরী করা হয় আর তার দেয়ালগুলো তোলা হয়, তাহলে ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের এলাকাগুলোতে আপনার অধীন বলে আর কিছুই থাকবে না।” বাদশাহ্‌ তখন সেই চিঠির এই জবাব পাঠিয়ে দিলেন: “শাসনকর্তা রহূম, লেখক শিম্‌শয় এবং সামেরিয়া ও ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের বিভিন্ন এলাকায় বাসকারী অন্যান্য উঁচু পদের কর্মচারীদের কাছে আমি লিখছি। আপনাদের শান্তি হোক। যে চিঠি আপনারা আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তা আমার কাছে অনুবাদ করে পড়া হয়েছে। আমি হুকুম দিলে পর খোঁজ করা হয়েছে এবং জানা গেছে যে, অনেক কাল আগে থেকে সেই শহর বাদশাহ্‌দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে; আসলে ওটা এমন একটা জায়গা যেখানকার লোকেরা শাসন মানে না। শক্তিশালী বাদশাহ্‌রা জেরুজালেমে থেকে ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের সমস্ত এলাকাগুলোতে রাজত্ব করেছেন এবং সেখানকার লোকেরা তাঁদের খাজনা, কর্‌ এবং শুল্ক দিয়েছে। এখন আপনারা ঐ সব লোকদের কাজ বন্ধ করবার হুকুম দিন যাতে আমার হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত ঐ শহরটা আবার গড়ে তোলা না হয়। সাবধান, এই কাজে যেন অবহেলা করা না হয়। রাজ-সরকারের ক্ষতি বাড়তে দেওয়া হবে কেন?” বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের চিঠিটা রহূম, লেখক শিম্‌শয় ও অন্যান্য উঁচু পদের কর্মচারীদের পড়ে শোনাবার সংগে সংগে তাঁরা জেরুজালেমের ইহুদীদের কাছে গেলেন এবং জোর করে কাজ বন্ধ করতে তাদের বাধ্য করলেন। এইভাবে জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র ঘরের কাজ বন্ধ হয়ে গেল; পারস্যের বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত তা বন্ধই রইল। বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে নবী হগয় এবং ইদ্দোর বংশধর নবী জাকারিয়া ইসরাইলের আল্লাহ্‌র নামে এহুদা ও জেরুজালেমের ইহুদীদের কাছে আল্লাহ্‌র দেওয়া কালাম বলতে লাগলেন। তখন শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল এবং যোষাদকের ছেলে ইউসা জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র ঘরটি আবার তৈরী করবার কাজে হাত দিলেন। আল্লাহ্‌র নবীরাও তাঁদের সংগে থেকে তাঁদের সাহায্য করতে লাগলেন। তখন ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের এলাকাগুলোর শাসনকর্তা তত্তনয়, শথরবোষণয় ও সেখানকার উঁচু পদের কর্মচারীরা ইহুদীদের কাছে গিয়ে তাদের বললেন, “বায়তুল-মোকাদ্দস আবার তৈরী করবার জন্য কে তোমাদের হুকুম দিয়েছে?” তাঁরা আরও বললেন, “যারা এই দালানটা তৈরী করছে তাদের নাম কি?” কিন্তু ইহুদীদের বৃদ্ধ নেতাদের দিকে আল্লাহ্‌ মনোযোগ দিয়েছিলেন। যতদিন না দারিয়ুসের কাছে খবর পাঠানো হল এবং তাঁর কাছ থেকে লিখিত জবাব পাওয়া গেল ততদিন পর্যন্ত নেতারা কাজ থামিয়ে দিলেন না। মহারাজ যেন জানতে পারেন যে, আমরা এহুদা প্রদেশে আল্লাহ্‌তা’লার ঘরে গিয়েছিলাম। লোকেরা বড় বড় পাথর দিয়ে ঘরটি তৈরী করছে এবং দেয়ালের উপরে বীম বসাচ্ছে। খুব যত্নের সংগে কাজটা করা হচ্ছে এবং তা সফলতার সংগে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ নেতাদের আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “এবাদত-খানাটি আবার তৈরী করবার জন্য কে তোমাদের হুকুম দিয়েছে?” আমরা তাদের নামও জিজ্ঞাসা করেছি যেন তাদের নেতাদের নাম আপনাকে জানাবার জন্য লিখে রাখতে পারি। জবাবে তারা আমাদের বলল, “আমরা আসমান ও জমীনের আল্লাহ্‌র গোলাম। আমরা সেই এবাদত-খানাটি আবার তৈরী করছি যেটি ইসরাইলের একজন মহান বাদশাহ্‌ অনেক দিন আগে তৈরী করে শেষ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা বেহেশতের আল্লাহ্‌কে রাগিয়েছিলেন বলে তিনি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ ক্যালডীয় বখতে-নাসারের হাতে তাঁদের তুলে দিয়েছিলেন। বখতে-নাসার এই এবাদত-খানাটি ধ্বংস করেছিলেন এবং লোকদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছরে তিনি আল্লাহ্‌র এই ঘরটি আবার তৈরী করবার হুকুম দিয়েছিলেন। এমন কি, তিনি ব্যাবিলনের মন্দির থেকে আল্লাহ্‌র ঘরের সেই সব সোনা ও রূপার পাত্রগুলো বের করে দিয়েছিলেন যা বখতে-নাসার জেরুজালেমের এবাদত-খানা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ কাইরাস সেগুলো তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তা শেশ্‌বসরের হাতে দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি যেন জেরুজালেমে আগের জায়গাতেই আল্লাহ্‌র ঘরটি আবার তৈরী করেন এবং সেই জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে সেখানে জমা রাখেন। কাজেই শেশ্‌বসর এসে জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত সেটি তৈরীর কাজ চলছে, এখনও শেষ হয় নি।” এখন মহারাজ যদি চান তবে ব্যাবিলনের রাজ-সরকারের নথিপত্র রাখবার জায়গায় খোঁজ করে দেখতে পারেন যে, জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র এই ঘরটি তৈরী করবার হুকুম বাদশাহ্‌ কাইরাস সত্যিই দিয়েছিলেন কি না। তারপর এই ব্যাপারে মহারাজ যা ঠিক করবেন তা যেন আমাদের জানিয়ে দেন। বাদশাহ্‌ দারিয়ুস হুকুম দিলে পর লোকেরা ব্যাবিলনের রাজ-সরকারের নথিপত্র রাখবার জায়গায় গিয়ে সেগুলো খুঁজে দেখলেন। এতে মিডিয়া প্রদেশের একবাটানা নামে রাজধানীতে একটা গুঁটিয়ে-রাখা বই পাওয়া গেল। তাতে এই কথা লেখা ছিল: স্মারক লিপি বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছরে জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র ঘর সম্বন্ধে তিনি এই হুকুম দিলেন: “পশু-কোরবানীর জায়গা হিসাবে বায়তুল-মোকাদ্দস আবার তৈরী করা হোক এবং তার ভিত্তি শক্তভাবে স্থাপন করা হোক। সেটি হবে ষাট হাত উঁচু এবং ষাট হাত চওড়া। তাতে থাকবে তিন সারি বড় বড় পাথরের উপর এক সারি কাঠ। বাদশাহ্‌র ধনভাণ্ডার থেকে সমস্ত খরচ দেওয়া হোক। এছাড়া বখতে-নাসার জেরুজালেমের বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে যে সব সোনা-রূপার পাত্র ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন সেগুলোও আবার আল্লাহ্‌র ঘরে ঠিক জায়গায় রাখা হোক।” তখন বাদশাহ্‌ দারিয়ুস এই জবাব দিলেন: “ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের এলাকাগুলোর শাসনকর্তা তত্তনয় এবং শথরবোষণয় ও সেখানকার উঁচু পদের কর্মচারীরা, আপনারা এখন সেই জায়গা থেকে দূরে থাকবেন। আল্লাহ্‌র এই ঘরের কাজে আপনারা বাধা দেবেন না। ইহুদীদের শাসনকর্তা ও তাদের বৃদ্ধ নেতারা আল্লাহ্‌র সেই ঘরটি আগের জায়গাতেই আবার তৈরী করুক। এছাড়া আল্লাহ্‌র সেই ঘরটি তৈরী করবার কাজে ইহুদীদের বৃদ্ধ নেতাদের জন্য আপনাদের যা করতে হবে সেই বিষয়ে আমি হুকুম দিচ্ছি। সেই কাজ যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সেইজন্য এই সব লোকদের পুরো খরচপত্র দিতে হবে রাজভাণ্ডার থেকে, অর্থাৎ ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের এলাকাগুলোর রাজকর্‌ থেকে। বেহেশতের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য জেরুজালেমের ইমামদের এঁড়ে বাছুর, ভেড়া ও ভেড়ার বাচ্চা এবং গম, লবণ, আংগুর-রস ও তেল, অর্থাৎ যা কিছু দরকার তা দিতে হবে। তাদের চাহিদামত প্রতিদিন এই সব অবশ্যই দিতে হবে, যাতে তারা বেহেশতের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কবুলযোগ্য কোরবানী দিতে পারে এবং বাদশাহ্‌ ও রাজপুত্রদের উন্নতির জন্য মুনাজাত করতে পারে। আমি আরও হুকুম দিচ্ছি, যদি কেউ এই হুকুম অমান্য করে তবে তার ঘর থেকে একটা কড়িকাঠ বের করে এনে তা চোখা করে তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করা হবে। তার এই অন্যায়ের জন্য তার ঘরটা একটা আবর্জনার স্তূপ করে ফেলা হবে। কোন বাদশাহ্‌ বা কোন জাতি যদি এই হুকুম অমান্য করে জেরুজালেমের সেই এবাদত-ঘরটি ধ্বংস করতে যায় তবে আল্লাহ্‌, যিনি সেখানে বাস করেন তিনি যেন তাকে ধ্বংস করেন। আমি দারিয়ুস এই হুকুম দিলাম। এটা যেন যত্নের সংগে পালন করা হয়।” বাদশাহ্‌ দারিয়ুস সেই হুকুম পাঠিয়েছিলেন বলে ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের এলাকাগুলোর শাসনকর্তা তত্তনয়, শথরবোষণয় এবং সেখানকার উঁচু পদের কর্মচারীরা তা যত্নের সংগে পালন করলেন। নবী হগয় ও ইদ্দোর বংশধর নবী জাকারিয়া আল্লাহ্‌র কালাম অনুসারে উৎসাহ দিচ্ছিলেন আর তার সংগে সংগে ইহুদীদের বৃদ্ধ নেতারা গাঁথনির কাজ সফলতার সংগে চালিয়ে যেতে থাকলেন। ইসরাইলের আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুসারে এবং পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাস, দারিয়ুস ও আর্টা-জারেক্সেসের হুকুমে তাঁরা বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরীর কাজ শেষ করলেন। বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের ছয় বছরের সময় অদর মাসের তৃতীয় দিনে বায়তুল-মোকাদ্দসের কাজ শেষ হল। তারপর বনি-ইসরাইলরা, অর্থাৎ ইমামেরা, লেবীয়রা আর বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা বাকী লোকেরা আনন্দের সংগে আল্লাহ্‌র ঘর উদ্বোধন করল। আল্লাহ্‌র ঘর উদ্বোধনের জন্য তারা একশোটা ষাঁড়, দু’শো ভেড়া ও চারশো ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী দিল। এছাড়া সমস্ত ইসরাইলের গুনাহের জন্য কোরবানীর জন্য ইসরাইলের গোষ্ঠীর সংখ্যা অনুসারে তারা বারোটা ছাগল কোরবানী দিল। মূসার কিতাবে যেমন লেখা ছিল সেই অনুসারে জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজের জন্য ইমামদের ও লেবীয়দের বিভিন্ন দলে নিযুক্ত করা হল। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা লোকেরা প্রথম মাসের চৌদ্দ দিনের দিন উদ্ধার-ঈদ পালন করল। ইমাম ও লেবীয়রা নিজেদের পাক-সাফ করল, তাতে তারা সবাই পাক-সাফ হল। লেবীয়রা নিজেদের জন্য, বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা সমস্ত লোকদের জন্য এবং তাদের ইমাম ভাইদের জন্য উদ্ধার-ঈদের ভেড়া জবাই করল। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা বনি-ইসরাইলরা এবং দেশে বাসকারী বনি-ইসরাইলরা যারা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার জন্য তাদের অ-ইহুদী প্রতিবেশীদের নাপাক অভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করেছিল তারা সবাই একসংগে সেই গোশ্‌ত খেল। সাত দিন পর্যন্ত তারা আনন্দের সংগে খামিহীন রুটির ঈদ পালন করল। তারা আনন্দে পূর্ণ হয়েছিল, কারণ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ যাতে ইসরাইলের আল্লাহ্‌র ঘরের কাজে তাদের সাহায্য করেন সেইজন্য মাবুদ তাঁর মন পরিবর্তন করেছিলেন। এই সব ঘটনার পরে পারস্যের বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের রাজত্বের সময়ে উযায়ের ব্যাবিলন থেকে আসলেন। উযায়ের সরায়ের ছেলে, সরায় অসরিয়ের ছেলে, অসরিয় হিল্কিয়ের ছেলে, হিল্কিয় শল্লুমের ছেলে, শল্লুম সাদোকের ছেলে, সাদোক অহীটূবের ছেলে, অহীটূব অমরিয়ের ছেলে, অমরিয় অসরিয়ের ছেলে, অসরিয় মরায়োতের ছেলে, মরায়োৎ সরহিয়ের ছেলে, সরহিয় উষির ছেলে, উষি বুক্কির ছেলে, বুক্কি অবীশূয়ের ছেলে, অবীশূয় পীনহসের ছেলে, পীনহস ইলিয়াসরের ছেলে এবং ইলিয়াসর ছিলেন প্রধান ইমাম হারুনের ছেলে। উযায়ের মাবুদের দেওয়া তৌরাত কিতাব তেলাওয়াত করবার, তা পালন করবার এবং তার নিয়ম ও নির্দেশ ইসরাইল দেশে শিক্ষা দেবার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। যিনি ইসরাইলকে দেওয়া মাবুদের সব হুকুম ও নিয়ম সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সেই ইমাম ও আলেম উযায়েরের কাছে বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেস এই চিঠি লিখেছিলেন: বেহেশতের আল্লাহ্‌র শরীয়তের ওস্তাদ ইমাম উযায়েরের কাছে আমি বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেস লিখছি। আপনার শান্তি হোক। আমি এখন এই হুকুম দিচ্ছি যে, আমার রাজ্যের যে সব ইসরাইলীয় এবং তাদের ইমামেরা ও লেবীয়রা আপনার সংগে জেরুজালেমে যেতে চায় তারা যেতে পারে। আপনার হাতে আপনাদের আল্লাহ্‌র যে শরীয়ত আছে সেই অনুসারে এহুদা ও জেরুজালেমের অবস্থা কেমন তার খোঁজ নেবার জন্য বাদশাহ্‌ ও তাঁর সাতজন পরামর্শদাতা আপনাকে সেখানে পাঠাচ্ছেন। ইসরাইলের আল্লাহ্‌, যিনি জেরুজালেমে বাস করেন তাঁকে বাদশাহ্‌ ও তাঁর পরামর্শদাতারা যে সব সোনা-রূপা নিজেদের ইচ্ছায় দিচ্ছেন তা আপনি নিয়ে যাবেন। এছাড়া যে সব সোনা-রূপা আপনি ব্যাবিলন প্রদেশ থেকে পাবেন এবং বনি-ইসরাইলরা ও তাদের ইমামেরা জেরুজালেমে তাদের আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য যা নিজের ইচ্ছায় দেবে আপনি তা সবই নিয়ে যাবেন। সেই সোনা-রূপা দিয়ে ষাঁড়, ভেড়া ও ভেড়ার বাচ্চা আর তার সংগেকার শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর জিনিস ভাল করে দেখে-শুনে কিনবেন এবং জেরুজালেমে আপনাদের আল্লাহ্‌র ঘরের কোরবানগাহের উপরে সেগুলো কোরবানী দেবেন। তারপর আপনি ও আপনার ইহুদী ভাইয়েরা বাকী সোনা-রূপা নিয়ে আপনাদের আল্লাহ্‌র ইচ্ছা অনুসারে যা ভাল মনে করেন তা-ই করবেন। আপনাদের আল্লাহ্‌র ঘরে এবাদতের জন্য যে সব পাত্র আপনার হাতে দেওয়া হল তা আপনি জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত করবেন। এছাড়া আপনাদের আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য আর যা কিছু দরকার তার খরচ আপনি রাজভাণ্ডার থেকে নিয়ে দেবেন। এখন আমি বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেস ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের সমস্ত ধনভাণ্ডারের রক্ষকদের এই হুকুম দিচ্ছি যে, বেহেশতের আল্লাহ্‌র শরীয়তের ওস্তাদ ইমাম উযায়ের আপনাদের কাছে যা কিছু চাইবেন তা আপনারা ঠিকভাবে তাঁকে দেবেন। আপনারা তাঁকে তিন হাজার ন’শো কেজি পর্যন্ত রূপা, আঠারো হাজার কেজি পর্যন্ত গম, দু’হাজার দু’শো লিটার পর্যন্ত আংগুর-রস, দু’হাজার দু’শো লিটার পর্যন্ত তেল এবং যত পরিমাণে লবণ দরকার তা দিতে পারবেন। বেহেশতের আল্লাহ্‌ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন সেইমতই বেহেশতের আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য যেন সব কিছু যত্নের সংগে করা হয়। বাদশাহ্‌ ও তাঁর ছেলেদের রাজ্যের বিরুদ্ধে যেন তাঁর রাগ প্রকাশিত না হয়। আমরা আপনাদের আরও বলছি যে, আল্লাহ্‌র সেই ঘরের কোন ইমাম, লেবীয়, কাওয়াল, রক্ষী, খেদমতকারী কিংবা অন্য কোন কর্মচারীর উপর কোন খাজনা, কর্‌ বা শুল্ক বসাবার ক্ষমতা আপনাদের নেই। হে উযায়ের, আল্লাহ্‌র বিষয়ে আপনার যে জ্ঞান আছে সেই অনুসারে আপনি ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের সমস্ত লোকদের বিচারের জন্য এমন সব কর্মচারী ও বিচারক নিযুক্ত করবেন যারা আপনার আল্লাহ্‌র দেওয়া শরীয়ত জানে। যারা তা জানে না আপনারা তাদের তা শিক্ষা দেবেন। যারা আপনার আল্লাহ্‌র শরীয়ত অথবা বাদশাহ্‌র আইন মানবে না তাদের ঠিকমত শাস্তি দিতে হবে। সেই শাস্তি হতে পারে মৃত্যু কিংবা দেশ থেকে দূর করে দেওয়া কিংবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা কিংবা জেলে বন্দী করা। আমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। জেরুজালেমে মাবুদের ঘরের প্রতি এইভাবে সম্মান দেখাবার মনোভাব তিনিই বাদশাহ্‌র দিলে জাগিয়েছেন। বাদশাহ্‌ ও তাঁর পরামর্শদাতাদের এবং তাঁর সব ক্ষমতাশালী কর্মচারীদের সামনে তিনিই আমাকে তাঁর অটল মহব্বত দেখিয়েছেন। আমার উপর আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র হাত ছিল বলেই আমি সাহস পেলাম এবং আমার সংগে জেরুজালেমে ফিরে যাবার জন্য বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে নেতাদের একত্র করলাম। বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের রাজত্বের সময়ে যে সব বংশ-নেতারা আমার সংগে ব্যাবিলন থেকে ফিরে এসেছিলেন তাঁদের তালিকা: পীনহসের বংশের মধ্যে গের্শোম; ঈথামরের বংশের মধ্যে দানিয়াল; দাউদের বংশের মধ্যে শখনিয়ের বংশধর হটূশ; পরোশের বংশের মধ্যে জাকারিয়া এবং তাঁর সংগে তালিকায় নাম লেখা একশো পঞ্চাশ জন; পহৎ-মোয়াবের বংশের মধ্যে সরহিয়ের ছেলে ইলীহৈনয় ও তাঁর সংগেকার দু’শো জন; সত্তূর বংশের মধ্যে যহসীয়েলের ছেলে শখনিয় ও তাঁর সংগেকার তিনশো জন; আদীনের বংশের মধ্যে যোনাথনের ছেলে এবদ ও তাঁর সংগেকার পঞ্চাশজন; ইলামের বংশের মধ্যে অথলিয়ের ছেলে যিশায়াহ ও তাঁর সংগেকার সত্তরজন; শফটিয়ের বংশের মধ্যে মিকাইলের ছেলে সবদিয় ও তাঁর সংগেকার আশিজন; যোয়াবের বংশের মধ্যে যিহিয়েলের ছেলে ওবদিয় ও তাঁর সংগেকার দু’শো আঠারো জন; বানির বংশের মধ্যে যোষিফিয়ের ছেলে শলোমীত ও তাঁর সংগেকার একশো ষাট জন; বেবয়ের বংশের মধ্যে বেবয়ের ছেলে জাকারিয়া ও তাঁর সংগেকার আটাশজন; অস্‌গদের বংশের মধ্যে হকাটনের ছেলে যোহানন ও তাঁর সংগেকার একশো দশ জন; অদোনীকামের বংশের মধ্যে যাঁরা শেষে ফিরে এসেছিলেন তাঁদের নাম হল ইলীফেলট, যিয়ূয়েল ও শময়িয় আর তাঁদের সংগেকার ষাটজন; বিগ্‌বয়ের বংশের মধ্যে ঊথয় ও সব্বূদ আর তাঁদের সংগেকার সত্তরজন। অহবার দিকে বয়ে যাওয়া খালের কাছে আমি এই সব লোকদের একত্র করলাম এবং সেই জায়গায় আমরা তাম্বু ফেলে তিন দিন রইলাম। লোকদের ও ইমামদের মধ্যে খোঁজ করে আমি কোন লেবীয়কে দেখতে পেলাম না। তখন আমি ইলীয়েষর, অরীয়েল, শময়িয়, ইল্‌নাথন, যারিব, ইল্‌নাথন, নাথন, জাকারিয়া ও মশুল্লম নামে নেতাদের ও যোয়ারীব ও ইল্‌নাথন নামে দু’জন ওস্তাদকে ডেকে পাঠালাম। এই সব লোকদের আমি কাসিফিয়ায় বাসকারী নেতা ইদ্দো ও তাঁর বংশের বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীদের কাছে এই কথা বলতে পাঠিয়ে দিলাম, “আপনারা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের এবাদত-কাজের জন্য আমাদের কাছে লোক নিয়ে আসুন।” আমাদের আল্লাহ্‌র মেহেরবানীর হাত আমাদের উপরে ছিল বলে তাঁরা ইসরাইলের ছেলে লেবি-গোষ্ঠীর মহলির বংশের মধ্য থেকে শেরেবিয় নামে একজন দক্ষ লোককে এবং তাঁর ছেলেদের ও ভাইদের মোট আঠারোজনকে আমাদের কাছে নিয়ে আসলেন। পরে আমি অহবার খালের কাছে আমাদের জন্য রোজা রাখবার কথা ঘোষণা করলাম যাতে আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র সামনে নিজেদের নত করতে পারি এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের ও সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে নিরাপদে যাত্রা করতে পারি। পথে আমাদের শত্রুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবার জন্য বাদশাহ্‌র কাছে সৈন্য ও ঘোড়সওয়ার চাইতে আমি লজ্জা পেলাম, কারণ আমরা বাদশাহ্‌কে বলেছিলাম, “যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলে তাদের প্রত্যেকের উপরে তাঁর মেহেরবানীর হাত আছে, কিন্তু যারা তাঁকে ত্যাগ করে তাঁর গজব ও শাস্তি তাদের সকলের উপর নেমে আসে।” কাজেই আমরা রোজা রাখলাম এবং এই বিষয় নিয়ে আমাদের আল্লাহ্‌র কাছে অনুরোধ জানালাম, আর তিনি আমাদের মুনাজাতের জবাব দিলেন। তারপর আমি বারোজন প্রধান ইমামকে এবং তাঁদের সংগে শেরেবিয়, হশবিয় ও তাঁদের দশজন লেবীয় ভাইকে আলাদা করলাম। আমি তাঁদের কাছে সেই সব সোনা, রূপা ও পাত্রগুলো ওজন করে বের করে দিলাম যা বাদশাহ্‌ ও তাঁর পরামর্শদাতারা, কর্মচারীরা এবং সেখানে উপস্থিত সব বনি-ইসরাইলরা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের জন্য দান করেছিলেন। আমি তাঁদের কাছে ঊনিশ হাজার পাঁচশো কেজি রূপা, তিন হাজার কেজি রূপার পাত্র ও তিন হাজার কেজি সোনা দিলাম। এছাড়া সাড়ে ছয় কেজি ওজনের বিশটা সোনার পাত্র এবং সোনার মত দামী খুব সুন্দর দু’টা পালিশ করা ব্রোঞ্জের পাত্র দিলাম। আমি তাঁদের বললাম, “আপনাদের এবং এই সব পাত্রগুলো মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করা হয়েছে। এছাড়া এই সব সোনা ও রূপা আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে নিজের ইচ্ছায় করা দান। আপনারা যে পর্যন্ত না এগুলো জেরুজালেমে মাবুদের ঘরের ভাণ্ডার-ঘরে প্রধান ইমামদের, লেবীয়দের এবং ইসরাইলের বংশ-নেতাদের সামনে ওজন করে দেন সেই পর্যন্ত তা সাবধানে রক্ষা করবেন।” এর পর ইমামেরা ও লেবীয়রা জেরুজালেমে আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরে নিয়ে যাবার জন্য ওজন করা সোনা, রূপা এবং পাত্র গ্রহণ করলেন। প্রথম মাসের বারো দিনের দিন আমরা জেরুজালেমে যাবার জন্য অহবা খালের কাছ থেকে যাত্রা করলাম। আমাদের আল্লাহ্‌র হাত আমাদের উপরে ছিল এবং তিনি পথের মধ্যে শত্রু ও ডাকাতের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করলেন। এইভাবে আমরা জেরুজালেমে পৌঁছে তিন দিন সেখানে বিশ্রাম নিলাম। তারপর চতুর্থ দিনের দিন আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের মধ্যে সেই সোনা, রূপা ও পাত্রগুলো ওজন করে ইমাম উরিয়ার ছেলে মরেমোতের হাতে দিলাম। মরেমোতের সংগে ছিলেন পীনহসের বংশধর ইলীয়াসর এবং তাঁদের সংগে ছিলেন ইউসার ছেলে যোষাবদ ও বিনুয়ির ছেলে নোয়দিয়। এঁরা দু’জনেই ছিলেন লেবীয়। সমস্ত জিনিসই গুণে আর ওজন করে দেওয়া হল এবং সেই সময় সেগুলোর সংখ্যা আর ওজন লিখে রাখা হল। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা লোকেরা ইসরাইলের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী দিল। তারা গোটা ইসরাইল জাতির জন্য বারোটা ষাঁড়, ছিয়ানব্বইটা ভেড়া, সাতাত্তরটা ভেড়ার বাচ্চা এবং গুনাহের জন্য কোরবানীর জন্য বারোটা ছাগল দিল। এই সবই মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে দেওয়া হল। তারা ফোরাত নদীর পশ্চিম পারের প্রদেশগুলোর ও জেলার শাসনকর্তাদের কাছে বাদশাহ্‌র হুকুম পৌঁছে দিল। সেই হুকুম পেয়ে তাঁরা লোকদের সহযোগিতা করলেন এবং আল্লাহ্‌র ঘরের কাজেও সহযোগিতা করলেন। এই সব কাজ শেষ হয়ে গেলে পর নেতারা আমার কাছে এসে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা এবং তাদের ইমামেরা ও লেবীয়রা তাদের দেশে বাসকারী অন্যান্য জাতিদের কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখে নি। তারা কেনানীয়, হিট্টীয়, পরিষীয়, যিবূষীয়, অম্মোনীয়, মোয়াবীয়, মিসরীয় ও আমোরীয়দের মত জঘন্য কাজ করছে। তারা নিজেদের ও তাদের ছেলেদের জন্য স্ত্রী হিসাবে ঐ সব জাতির মেয়েদের গ্রহণ করেছে, আর এইভাবে তাদের পবিত্র জাতিকে সেই জাতিদের সংগে মিশিয়ে ফেলেছে। এমন কি, নেতারা এবং উঁচু পদের কর্মচারীরাই প্রথমে এই বেঈমানীর পথ দেখিয়েছেন।” এই কথা শুনে আমি মনের কষ্টে আমার পরনের কাপড় ছিঁড়লাম এবং আমার মাথার চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা এই লোকদের বেঈমানীর ব্যাপারে যারা ইসরাইলের আল্লাহ্‌র কালাম মনে করে কেঁপে উঠল তারা প্রত্যেকে আমার কাছে এসে জমায়েত হল। সন্ধ্যাবেলার কোরবানীর সময় পর্যন্ত আমি সেখানে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। তারপর সন্ধ্যাবেলার কোরবানীর সময়ে আমি ভাংগা দিলের কষ্ট পাওয়া থেকে ফিরলাম এবং সেই ছেঁড়া কাপড় সুদ্ধই হাঁটু পেতে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র সামনে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে এই মুনাজাত করলাম, “হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার দিকে আমার মুখ তুলতে আমি খুব লজ্জা বোধ করছি, কারণ আমাদের গুনাহ্‌ আমাদের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে এবং আমাদের দোষ আসমান ছুঁয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা অনেক বেশী গুনাহ্‌ করেছি। আমাদের গুনাহের জন্যই আমাদের ও আমাদের বাদশাহ্‌দের এবং আমাদের ইমামদের অন্যান্য বাদশাহ্‌দের হাতে মৃত্যু, বন্দীদশা, লুটপাট এবং অসম্মান হয়েছে, আর আজও সেই অবস্থা রয়েছে। “কিন্তু এখন অল্প সময়ের জন্য আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ রহমত দান করে আমাদের কিছু লোককে জীবিত রেখেছেন এবং তাঁর পবিত্র দেশে আমাদের একটা স্থায়ী জায়গা দিয়েছেন। এইভাবে আমাদের আল্লাহ্‌ আমাদের আনন্দ ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের গোলামীর অবস্থায় আমাদের একটু প্রাণ জুড়িয়েছেন। আমরা গোলাম হলেও আমাদের গোলামীর সময় আমাদের আল্লাহ্‌ আমাদের ত্যাগ করেন নি। পারস্যের বাদশাহ্‌দের সামনে তিনি আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত ব্যবহার করেছেন। তিনি আমাদের জাগিয়ে তুলেছেন যাতে আবার আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘর তৈরী ও তার ভাংগা জায়গা মেরামত করতে পারি। তিনি এহুদা ও জেরুজালেমে আমাদের নিরাপদে থাকবার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই তোমাদের মেয়েদের তাদের ছেলেদের সংগে বিয়ে দিয়ো না কিংবা তোমাদের ছেলেদের জন্য তাদের মেয়েদের নিয়ো না এবং কখনও তাদের উপকার কিংবা উন্নতির চেষ্টা কোরো না। এতে তোমরা শক্তিশালী হবে এবং জমির ভাল ভাল জিনিস খেতে পারবে আর চিরস্থায়ী অধিকার হিসাবে দেশটা তোমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে যেতে পারবে।’ “আমাদের খারাপ কাজ ও আমাদের মহাগুনাহের ফলেই আমাদের উপর এই সব ঘটেছে, কিন্তু তবুও হে আমাদের আল্লাহ্‌, আমাদের গুনাহের পাওনা অনুসারে তুমি আমাদের কম শাস্তি দিয়েছ এবং আমাদের কিছু লোককে বেঁচে থাকতে দিয়েছ। আমরা কি আবার তোমার হুকুম অমান্য করে সেই সব জঘন্য কাজ করা লোকদের সংগে বিয়ের সম্বন্ধ করব? তা করলে তো তুমি আমাদের উপর এমন রাগ করবে যার জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করে ফেলবে এবং আমাদের কাউকে বেঁচে থাকতে দেবে না। হে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি ন্যায়বান। আমরা আজ পর্যন্ত কিছু লোক বেঁচে আছি। তোমার সামনে আমরা সকলে গুনাহ্‌গার, আর সেইজন্য আমাদের মধ্যে কেউই তোমার সামনে দাঁড়াবার উপযুক্ত নই।” উযায়ের যখন আল্লাহ্‌র ঘরের সামনে উবুড় হয়ে মুনাজাত ও গুনাহ্‌ স্বীকার করছিলেন ও কাঁদছিলেন তখন বনি-ইসরাইলদের পুরুষ, স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়ের একটা মস্ত বড় দল তাঁর কাছে জমায়েত হয়েছিল। তারাও খুব কাঁদছিল। তখন ইলামের এক বংশধর যিহীয়েলের ছেলে শখনিয় উযায়েরকে বললেন, “আমাদের দেশে বাসকারী অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করে আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র কাছে বেঈমানী করেছি; কিন্তু তা হলেও বনি-ইসরাইলদের এখনও আশা আছে। এখন আসুন, আমাদের আল্লাহ্‌র সামনে আমরা এই ওয়াদা করি যে, হুজুর আপনার পরামর্শ অনুসারে ও আমাদের আল্লাহ্‌র হুকুমকে যাঁরা ভয় করেন তাঁদের পরামর্শ অনুসারে আমরা এই সমস্ত স্ত্রীদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের ত্যাগ করব। শরীয়ত অনুসারেই তা করা হোক। আপনি উঠুন; এই বিষয় নিয়ে কাজ করা তো আপনারই দায়িত্ব। আমরা আপনাকে সাহায্য করব, কাজেই আপনি সাহসী হয়ে কাজ করুন।” তখন উযায়ের উঠলেন এবং সেই কথা অনুসারে কাজ করবার জন্য প্রধান ইমামদের, লেবীয়দের ও সেখানে একত্র হওয়া বনি-ইসরাইলদের কসম খাওয়ালেন। তারা সবাই কসম খেল। তারপর উযায়ের আল্লাহ্‌র ঘরের সামনে থেকে ইলীয়াশীবের ছেলে যিহোহাননের কামরায় গেলেন। তিনি সেখানে খাবার বা পানি কিছুই খেলেন না, কারণ বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা লোকদের বেঈমানীর জন্য তিনি শোক করছিলেন। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা সমস্ত লোকেরা যাতে জেরুজালেমে এসে জমায়েত হয় সেইজন্য এহুদা ও জেরুজালেমের সব জায়গায় একটা ঘোষণা দেওয়া হল। যে কেউ তিন দিনের মধ্যে উপস্থিত হবে না, উঁচু পদের কর্মচারী ও বৃদ্ধ নেতাদের পরামর্শ অনুসারে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা লোকদের সমাজ থেকে তাকে বের করে দেওয়া হবে। তিন দিনের মধ্যে এহুদা ও বিন্‌ইয়ামীন এলাকার সমস্ত লোক জেরুজালেমে জমায়েত হল। নবম মাসের বিশ দিনের দিন সমস্ত লোক আল্লাহ্‌র ঘরের সামনের চকে বসে সেই ব্যাপারের জন্য ও ভীষণ বৃষ্টির জন্য কাঁপছিল। তখন ইমাম উযায়ের উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের বললেন, “আপনারা বেঈমানী করেছেন, অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করে আপনারা বনি-ইসরাইলদের গুনাহের সংগে আরও গুনাহ্‌ যোগ করেছেন। এখন আপনারা আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে গুনাহ্‌ স্বীকার করে তাঁর ইচ্ছামত কাজ করুন। আপনাদের দেশে বাসকারী লোকদের ও অন্যান্য জাতির স্ত্রীদের থেকে নিজেদের আলাদা করুন।” তখন সমস্ত লোক খুব জোরে বলল, “আপনি ঠিক কথা বলেছেন; আপনি যেমন বলেছেন তেমনই আমাদের করতে হবে। কিন্তু লোক অনেক আর এখন খুব বৃষ্টি পড়ছে, কাজেই আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। তা ছাড়া এই বিষয়ের মীমাংসা এক বা দুই দিনের মধ্যে হতে পারে না, কারণ আমরা অনেকেই এই গুনাহ্‌ করেছি। আমাদের উঁচু পদের কর্মচারীরাই যেন গোটা সমাজের প্রতিনিধি হন। তারপর আমাদের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের মধ্যে যারা অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করেছে তারা প্রত্যেকে তাদের বৃদ্ধ নেতাদের ও বিচারকদের নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ে জেরুজালেমে আসুক। তাতে এই গুনাহের জন্য আমাদের আল্লাহ্‌র ভয়ংকর রাগ আমাদের কাছ থেকে চলে যাবে।” এই কথার বিরুদ্ধে দাঁড়াল কেবল অসাহেলের ছেলে যোনাথন ও তিক্‌বের ছেলে যহসিয়; তাদের পক্ষে ছিল মশুল্লম ও লেবীয় শব্বথয়। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা লোকেরা সেই কথামত কাজ করল। ইমাম উযায়ের প্রত্যেক বংশ থেকে নেতা বেছে নিলেন। দশম মাসের প্রথম দিনে তাঁরা সেই বিষয়ের তদন্ত করবার জন্য বসলেন। যারা অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করেছিল তাদের সকলের তদন্তের কাজ তাঁরা পরের বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে শেষ করলেন। যারা অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করেছিল তাদের তালিকা এই: ইমামদের মধ্যে যোষাদকের ছেলে ইউসার ও তার ভাইদের বংশধরদের মধ্যে মাসেয়, ইলীয়েষর, যারিব ও গদলিয়। এরা সবাই নিজের নিজের স্ত্রী তালাক দেবে বলে ওয়াদা করল এবং তাদের দোষের জন্য তারা প্রত্যেকে পাল থেকে একটা করে ভেড়া নিয়ে দোষ কোরবানী দিল। ইম্মেরের বংশধরদের মধ্যে হনানি ও সবদিয়। হারীমের বংশধরদের মধ্যে মাসেয়, ইলিয়াস, শময়িয়, যিহীয়েল ও উষিয়। পশহূরের বংশধরদের মধ্যে ইলীয়ৈনয়, মাসেয়, ইসমাইল, নথনেল, যোষাবদ ও ইলাসাহ্‌। লেবীয়দের মধ্যে যোষাবদ, শিমিয়ি, কলায়, অর্থাৎ কলীট, পথাহিয়, এহুদা ও ইলিয়েষর। কাওয়ালদের মধ্যে ইলীয়াশীব। রক্ষীদের মধ্যে শল্লুম, টেলম ও ঊরি। অন্যান্য বনি-ইসরাইলদের মধ্যে- পরিয়োশের বংশধরদের মধ্যে রমিয়া, যিষিয়, মল্কিয়, মিয়ামীন, ইলিয়াসর, মল্কিয় ও বনায়। ইলামের বংশধরদের মধ্যে মত্তনিয়, জাকারিয়া, যিহীয়েল, অব্দি, যিরেমোৎ ও ইলিয়াস। সত্তূর বংশধরদের মধ্যে ইলিয়ৈনয়, ইলিয়াশীব, মত্তনিয়, যিরেমোৎ, সাবদ ও অসীসা। বেবয়ের বংশধরদের মধ্যে যিহোহানন, হনানিয়, সব্বয় ও অৎলয়। বানির বংশধরদের মধ্যে মশুল্লম, মল্লূক, অদায়া, যাশূব, শাল ও যিরমোৎ। পহৎ-মোয়াবের বংশধরদের মধ্যে অদ্‌ন, কলাল, বনায়, মাসেয়, মত্তনিয়, বৎসলেল, বিনুয়ী ও মানশা। হারীমের বংশধরদের মধ্যে ইলিয়েষর, যিশিয়, মল্কিয়, শময়িয়, শিমিয়োন, বিন্‌ইয়ামীন, মল্লূক ও শমরিয়। হশূমের বংশধরদের মধ্যে মত্তনয়, মত্তত্ত, সাবদ, ইলীফেলট, যিরেময়, মানশা ও শিমিয়ি। বানির বংশধরদের মধ্যে মাদয়, ইমরান, ঊয়েল, এরা সবাই অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করেছিল এবং কোন কোন স্ত্রীর গর্ভের ছেলেমেয়েও ছিল। হখলিয়ের ছেলে নহিমিয়ার কথা। বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের রাজত্বের বিশ বছরের কিশ্‌লেব মাসে আমি সুসা রাজধানীতে ছিলাম। হনানি নামে আমার ভাইদের মধ্যে একজন এবং এহুদার অন্য কয়েকজন লোক সুসায় আসল। ব্যাবিলনে বন্দীদশা থেকে যারা ফিরে গিয়েছিল সেই লোকদের বিষয় ও জেরুজালেমের বিষয় আমি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা আমাকে বলল, “বন্দীদশা থেকে যারা দেশে ফিরে গিয়েছে তারা খুব দুরবস্থার ও অসম্মানের মধ্যে আছে। জেরুজালেমের দেয়াল ভেংগে গেছে এবং তার দরজাগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” এই সব কথা শুনে আমি বসে কাঁদতে লাগলাম। কিছুদিন ধরে আমি শোক ও রোজা রাখলাম এবং বেহেশতের আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করলাম। তারপর আমি বললাম, “হে বেহেশতের মাবুদ আল্লাহ্‌, ভয় জাগানো আল্লাহ্‌তা’লা, যারা তোমাকে মহব্বত করে ও তোমার হুকুম পালন করে তুমি তাদের জন্য অটল মহব্বতের ব্যবস্থা রক্ষা করে থাক। হে মাবুদ, মিনতি করি, তোমার গোলামদের জন্য, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলদের জন্য আমি তোমার গোলাম তোমার সামনে দিনরাত যে মুনাজাত করছি তা তুমি শোন ও তাতে মনোযোগ দাও। আমরা বনি-ইসরাইলরা তোমার বিরুদ্ধে যে সব গুনাহ্‌ করেছি তা আমি স্বীকার করছি। সত্যিই আমি ও আমার পিতার বংশের লোকেরা গুনাহ্‌ করেছি। আমরা তোমার বিরুদ্ধে খুবই অন্যায় কাজ করেছি। তোমার গোলাম মূসাকে তুমি যে সব হুকুম, নিয়ম ও শরীয়ত দিয়েছ তা আমরা পালন করি নি। “মিনতি করি, তোমার গোলাম মূসাকে তুমি যে নির্দেশ দিয়েছিলে তা মনে করে দেখ। তুমি বলেছিলে, ‘তোমরা যদি বেঈমানী কর তবে আমি অন্য জাতিদের মধ্যে তোমাদের ছড়িয়ে দেব; কিন্তু তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে এবং আমার হুকুম পালন করে সেইমত কাজ করলে, তোমাদের বন্দীদশায় থাকা লোকেরা যদি আসমানের শেষ সীমায়ও থাকে তবে আমি তাদের সেখান থেকে জোগাড় করে আমার বাসস্থান হিসাবে যে জায়গা বেছে নিয়েছি সেখানে তাদের নিয়ে আসব।’ “এরা তোমারই গোলাম এবং তোমারই বান্দা, যাদের তুমি তোমার মহাশক্তিতে ও শক্তিশালী হাতে মুক্ত করেছ। হে মালিক, মিনতি করি, তোমার এই গোলামের মুনাজাতে এবং যারা তোমার নাম ভয়ের সংগে স্মরণ করে তোমার সেই গোলামদের মুনাজাতে তুমি কান দাও। তোমার গোলামকে আজ সফলতা দান কর এবং এই বাদশাহ্‌র কাছে মমতার পাত্র কর।” আমি বাদশাহ্‌র আংগুর-রস পরিবেশনকারী ছিলাম। বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের রাজত্বের বিশ বছরের নীষন মাসের একদিন খাবার সময় বাদশাহ্‌র সামনে আংগুর-রস ছিল, আর আমি তা নিয়ে বাদশাহ্‌কে দিলাম। এর আগে আমি বাদশাহ্‌র সামনে কখনও মলিন মুখে থাকি নি। সেইজন্য বাদশাহ্‌ আমাকে বললেন, “তোমার তো অসুখ হয় নি, তবে তোমার মুখ এত মলিন দেখাচ্ছে কেন? এ তো দিলের কষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়।” এই কথা শুনে আমি খুব ভয় পেলাম, তবুও বাদশাহ্‌কে বললাম, “মহারাজ চিরজীবী হোন। আমার পূর্বপুরুষেরা যে শহরে কবর পেয়েছেন সেই শহর যখন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তার দরজাগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে তখন আমার মুখ কেন মলিন দেখাবে না?” বাদশাহ্‌ আমাকে বললেন,“তুমি কি চাও?” তখন আমি বেহেশতের আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করলাম। তারপর জবাবে বাদশাহ্‌কে বললাম, “মহারাজ যদি খুশী হয়ে থাকেন এবং আপনার গোলাম যদি আপনার চোখে দয়া পেয়ে থাকে তবে আমার পূর্বপুরুষদের কবর যেখানে আছে এহুদার সেই শহরে আপনি আমাকে যাবার অনুমতি দিন যাতে আমি তা আবার তৈরী করতে পারি।” বাদশাহ্‌র পাশে রাণীও বসে ছিলেন। বাদশাহ্‌ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার যেতে কতদিন লাগবে, আর কবেই বা তুমি ফিরে আসবে?” আমি একটা সময়ের কথা বললে পর বাদশাহ্‌ সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে যাবার অনুমতি দিলেন। আমি বাদশাহ্‌কে আরও বললাম, “যদি মহারাজ খুশী হয়ে থাকেন তবে ফোরাত নদীর ওপারের শাসনকর্তাদের কাছে তিনি যেন চিঠি দেন যাতে তাঁরা আমাকে তাঁদের দেশের মধ্য দিয়ে এহুদায় যেতে দেন। এছাড়া তিনি যেন তাঁর বন্তরক্ষক আসফের কাছে একটা চিঠি দেন যাতে তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের পাশের কেল্লার দরজার কড়িকাঠের জন্য এবং শহরের দেয়াল ও আমার থাকবার ঘরের জন্য আমাকে কাঠ দেন।” আমার আল্লাহ্‌র মেহেরবানীর হাত আমার উপরে ছিল বলে বাদশাহ্‌ আমার সব অনুরোধ রক্ষা করলেন। তিনি আমার সংগে কয়েকজন সেনাপতি ও একদল ঘোড়সওয়ার সৈন্যদের পাঠিয়ে দিলেন। পরে আমি ফোরাত নদীর ওপারের শাসনকর্তাদের কাছে গিয়ে বাদশাহ্‌র চিঠি দিলাম। বনি-ইসরাইলদের উপকার করবার জন্য একজন লোক এসেছে শুনে হোরোণীয় সন্‌বল্লট ও অম্মোনীয় কর্মকর্তা টোবিয় খুব অসন্তুষ্ট হল। সেই রাতে বের হয়ে আমি উপত্যকা-দরজার মধ্য দিয়ে সাপ-কূয়া ও তার পরে সার-দরজার দিকে গেলাম এবং জেরুজালেমের ভাংগা দেয়াল ও আগুন দিয়ে ধ্বংস করা দরজাগুলোর অবস্থা ভাল করে দেখলাম। তারপর আমি ঝর্ণা-দরজা ও বাদশাহ্‌র পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম; কিন্তু আমি যে পশুর উপর চড়ে ছিলাম তার সেই জায়গা দিয়ে যাবার জন্য কোন পথ ছিল না। এইজন্য আমি সেই রাতে দেয়ালের অবস্থা দেখতে দেখতে উপত্যকার মধ্য দিয়ে গেলাম এবং উপত্যকা-দরজা দিয়ে আবার শহরে ফিরে আসলাম। আমি কোথায় গেছি বা কি করেছি তা উঁচু পদের কর্মচারীরা জানতে পারেন নি, কারণ আমি তখনও সাধারণ ইহুদীদের বা ইমামদের বা গণ্যমান্য লোকদের বা উঁচু পদের কর্মচারীদের কিংবা যারা কাজ করবে তাদের কিছুই বলি নি। পরে আমি সেই উঁচু পদের কর্মচারীদের বললাম, “আমরা যে কি রকম দুরবস্থার মধ্যে আছি তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। জেরুজালেম ধ্বংস হয়ে রয়েছে এবং তার দরজাগুলো আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। আসুন, আমরা জেরুজালেমের দেয়াল আবার গেঁথে তুলি। এতে আর আমরা টিট্‌কারির পাত্র থাকব না।” আমার আল্লাহ্‌ কিভাবে আমার মেহেরবানী করেছেন ও বাদশাহ্‌ আমাকে কি বলেছেন তাও আমি তাঁদের জানালাম। জবাবে তাঁরা বললেন, “আসুন, আমরা গাঁথতে শুরু করি।” এই বলে তাঁরা সেই ভাল কাজ শুরু করতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু হোরণীয় সন্‌বল্লট, অম্মোনীয় কর্মকর্তা টোবিয় ও আরবীয় গেশম্‌ এই কথা শুনে আমাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। তারা বলল, “তোমরা এ কি করছ? তোমরা কি বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে?” আমি জবাবে তাদের বললাম, “বেহেশতের আল্লাহ্‌ আমাদের সফলতা দান করবেন। আমরা, তাঁর গোলামেরা, আবার দেয়াল গাঁথব, কিন্তু জেরুজালেমে আপনাদের কোন সম্পত্তি, কোন দাবি কিংবা কোন অধিকার নেই।” মহা-ইমাম ইলীয়াশীব ও তাঁর সংগের ইমামেরা কাজে লেগে গিয়ে মেষ-দরজাটা আবার গাঁথলেন। তাঁরা সেটা আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানী করে তার দরজা লাগালেন। তারপর তাঁরা হম্মেয়া-কেল্লা ও হননেল-কেল্লা পর্যন্ত গেঁথে দেয়ালের সেই দু’টা অংশ কোরবানী করলেন। এর পরের অংশটা জেরিকো শহরের লোকেরা গাঁথল এবং তার পরের অংশটা গাঁথল ইম্রির ছেলে সক্কুর। হস্‌সনায়ার ছেলেরা গাঁথল মাছ-দরজাটা। তারা তার কড়িকাঠগুলো এবং তার দরজা, খিল আর হুড়কাগুলো লাগাল। তার পরের অংশটা মেরামত করল উরিয়ার ছেলে মরেমোৎ। উরিয়া ছিল হক্কোসের ছেলে। তার পরের অংশটা বেরিখিয়ের ছেলে মশুল্লম মেরামত করল। বেরিখিয় ছিল মশেষবেলের ছেলে। তার পরের অংশটা বানার ছেলে সাদোক মেরামত করল। তার পরের অংশটা মেরামত করল তকোয়ার লোকেরা, কিন্তু তাদের ধনী লোকেরা তাদের তদারককারীদের অধীনে কাজ করতে রাজী হল না। পাসেহের ছেলে যিহোয়াদা আর বসোদিয়ার ছেলে মশুল্লম যিশানা-দরজাটা মেরামত করল। তারা তার কড়িকাঠগুলো এবং তার দরজা, খিল আর হুড়কাগুলো লাগাল। তার পরের অংশ মেরামত করল গিবিয়োনীয় মলাটিয় ও মেরোণোথীয় যাদোন। এরা ছিল গিবিয়োন ও মিসপার লোক। এই অংশটা ফোরাত নদীর পশ্চিম দিকের শাসনকর্তার বাড়ীর উল্টাদিকে ছিল। এর পরের অংশটা মেরামত করল হর্হয়ের ছেলে উষীয়েল। উষীয়েল ছিল একজন স্বর্ণকার। তার পরের অংশ মেরামত করল হনানিয়। সে খোশবু তৈরী করত। এইভাবে তারা চওড়া-দেয়াল পর্যন্ত জেরুজালেমের দেয়াল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনল। জেরুজালেম জেলার অর্ধেক অংশের শাসনকর্তা হূরের ছেলে রফায় তার পরের অংশটা মেরামত করলেন। তার পরের অংশটা মেরামত করল হরূমফের ছেলে যিদায়। এই অংশটা ছিল তার বাড়ীর কাছে। তার পরের অংশটা হশব্‌নিয়ের ছেলে হটুশ মেরামত করল। হারীমের ছেলে মল্কিয় ও পহৎ-মোয়াবের ছেলে হশূব তার পরের অংশ ও তন্দুর-কেল্লাটা মেরামত করল। জেরুজালেম জেলার অর্ধেক অংশের শাসনকর্তা হলোহেশের ছেলে শল্লুম ও তাঁর মেয়েরা তার পরের অংশটা মেরামত করলেন। উপত্যকা-দরজাটা মেরামত করল হানূন ও সানোহের বাসিন্দারা। তারা তার দরজা, খিল, ও হুড়কাগুলো লাগাল। তারা সার-দরজা পর্যন্ত দেয়ালের এক হাজার হাত জায়গাও মেরামত করল। বৈৎ-হক্কেরম জেলার শাসনকর্তা রেখবের ছেলে মল্কিয় সার-দরজাটা মেরামত করলেন। তিনি তার দরজা, খিল ও হুড়কাগুলো লাগালেন। মিসপা জেলার শাসনকর্তা কল্‌হোষির ছেলে শল্লুম ঝর্ণা-দরজাটা মেরামত করলেন। তিনি তার উপরে ছাদ দিলেন এবং তার দরজা, খিল ও হুড়কাগুলো লাগালেন। বাদশাহ্‌র বাগানের পাশে শীলোহের পুকুরের দেয়াল থেকে শুরু করে দাউদের শহর থেকে যে সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে সেই পর্যন্ত তিনি মেরামত করলেন। বৈৎসূর জেলার অর্ধেক অংশের শাসনকর্তা অস্‌বূকের ছেলে নহিমিয়া দেয়ালের পরের অংশটা দাউদ-বংশের কবরের কাছ থেকে কাটা পুকুর ও বীরদের বাড়ী পর্যন্ত মেরামত করলেন। তার পরের অংশটা বানির ছেলে রহূমের অধীনে লেবীয়রা মেরামত করল। তার পরের অংশটা কিয়ীলা জেলার অর্ধেক অংশের শাসনকর্তা হশবিয় তাঁর এলাকার হয়ে মেরামত করলেন। তার পরের অংশটা তাদের ভাইয়েরা, অর্থাৎ কিয়ীলা জেলার বাকী অর্ধেক অংশের লোকেরা মেরামত করল। তারা তাদের শাসনকর্তা হেনাদদের ছেলে ববয়ের অধীনে থেকে মেরামতের কাজ করল। তার পরের অংশটা, অর্থাৎ মিসপার শাসনকর্তা ইউসার ছেলে এসর অস্ত্রশস্ত্র রাখবার ঘরে উঠবার পথের সামনের জায়গা থেকে দেয়ালের বাঁক পর্যন্ত মেরামত করলেন। তার পরে সব্বয়ের ছেলে বারূক দেয়ালের বাঁক থেকে মহা-ইমাম ইলিয়াশীবের ঘরের দরজা পর্যন্ত আগ্রহের সংগে মেরামত করল। তার পরের অংশটা উরিয়ার ছেলে মরেমোৎ ইলিয়াশীবের ঘরের দরজা থেকে শুরু করে বাড়ীর শেষ পর্যন্ত মেরামত করল। উরিয়া ছিল হক্কোসের ছেলে। তার পরের অংশটা মেরামত করলেন জর্ডান নদীর সমভূমিতে বাসকারী ইমামেরা। তার পরের অংশ মেরামত করল বিন্‌ইয়ামীন ও হশূব। এটা ছিল তাদের ঘরের সামনের অংশ। তার পরের অংশটা মাসেয়ের ছেলে অসরিয় মেরামত করল। এই অংশটা ছিল তার ঘরের পাশের অংশ। মাসেয় ছিল অননিয়ের ছেলে। তার পাশে হেনাদদের ছেলে বিন্নূয়ী অসরিয়ের ঘর থেকে শুরু করে বাঁক ও কোণা পর্যন্ত আর একটা অংশ মেরামত করল। তাদের পাশে তকোয়ের লোকেরা সেই বেরিয়ে আসা বিরাট কেল্লা থেকে ওফলের দেয়াল পর্যন্ত আর একটা অংশ মেরামত করল। ঘোড়া-দরজার সামনের অংশটা ইমামেরা মেরামত করলেন। তাঁরা প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরের কাছে দেয়ালের অংশ মেরামত করলেন। তার পরের অংশটা ইম্মেরের ছেলে সাদোক মেরামত করল। এটা ছিল তার ঘরের সামনের দিকে। তার পরের অংশটা পূর্ব-দরজার পাহারাদার শখনিয়ের ছেলে শময়িয় মেরামত করল। তার পাশে শেলিমিয়ার ছেলে হনানিয় ও সালফের ষষ্ঠ ছেলে হানূন আর একটা অংশ মেরামত করল। তার পাশের অংশটা বেরিখিয়ের ছেলে মশুল্লম মেরামত করল। এটা ছিল তার ঘরের সামনের দিকে। তার পরের অংশটা মল্কিয় নামে একজন স্বর্ণকার মেরামত করল। এটা ছিল সমাবেশ-দরজার সামনে বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীদের এবং ব্যবসায়ীদের ঘর পর্যন্ত এবং দেয়ালের কোণের উপরকার কামরা পর্যন্ত। স্বর্ণকার ও ব্যবসায়ীরা দেয়ালের কোণের উপরকার ঘর আর মেষ-দরজার মাঝখানের জায়গাটা মেরামত করল। আমরা আবার দেয়াল গাঁথছি শুনে সন্‌বল্লট রেগে আগুন হয়ে গেল এবং ভীষণ অসন্তুষ্ট হল। সে ইহুদীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। তার সংগের লোকদের সামনে ও সামেরিয়ার সৈন্যদলের সামনে সে বলল, “এই দুর্বল ইহুদীরা করছে কি? তারা কি নিজেরাই এই কাজ করবে? আল্লাহ্‌র সাহায্য পাবার জন্য তারা কি পশু-কোরবানী দেবে? এক দিনেই কি দেয়াল গাঁথা শেষ করবে? টুকরা টুকরা হয়ে পড়ে থাকা পাথরের ঢিবি থেকে কি তারা পাথরগুলোকে শক্ত করে তুলতে পারবে? ওগুলো তো পুড়ে গেছে।” অম্মোনীয় টোবিয় তখন তার পাশে ছিল; সে বলল, “ওরা যা গাঁথছে তার উপরে যদি একটা শিয়াল ওঠে তবে তাদের ঐ পাথরের দেয়াল ভেংগে পড়বে।” তখন নহিমিয়া মুনাজাত করলেন, “হে আমাদের আল্লাহ্‌, তুমি শোন কিভাবে আমাদের তুচ্ছ করা হচ্ছে। তাদের করা অপমান তুমি তাদেরই মাথার উপরে ফেল। তুমি এমন কর যাতে তারা বন্দী হয়ে লুটের মাল হিসাবে অন্য দেশে থাকে। তাদের অন্যায় তুমি মাফ কোরো না কিংবা তোমার চোখের সামনে থেকে তাদের গুনাহ্‌ তুমি মুছে ফেলো না, কারণ যারা দেয়াল গাঁথছে তাদের সামনেই তারা তোমাকে কুফরী করেছে।” দেয়ালটা যত উঁচু হবে তার অর্ধেকটা পর্যন্ত এইভাবে আমরা গাঁথলাম, কারণ লোকেরা তাদের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করছিল। কিন্তু সন্‌বল্লট, টোবিয়, আরবীয়রা, অম্মোনীয়রা ও অস্‌দোদের লোকেরা যখন শুনল যে, জেরুজালেমের দেয়াল মেরামতের কাজ এগিয়ে গেছে এবং ফাঁকগুলো বন্ধ করা হচ্ছে তখন তারা খুব রেগে গেল। তারা সবাই মিলে এই ষড়যন্ত্র করল যে, তারা গিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং গোলমাল শুরু করে দেবে। কিন্তু আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করলাম এবং তাদের ভয়ে দিনরাত পাহারা দেবার জন্য ব্যবস্থা করলাম। এর মধ্যে এহুদার লোকেরা বলল, “মজুরেরা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং পড়ে থাকা পাথরের টুকরা এত বেশী যে, আমরা দেয়াল আর গাঁথতে পারব না।” এদিকে আমাদের শত্রুরা বলল, “তারা জানবার আগে কিংবা দেখবার আগেই আমরা সেখানে তাদের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হব এবং তাদের মেরে ফেলে কাজ বন্ধ করে দেব।” সেইজন্য যে ইহুদীরা তাদের কাছাকাছি বাস করত তারা এসে বারবার আমাদের বলতে লাগল, “তোমরা আমাদের কাছে ফিরে এস।” এই সব শুনে আমি দেয়ালের ভিতরের দিকের নীচু জায়গাগুলোতে দেয়ালের ফাঁকগুলোর কাছে বংশ অনুসারে লোকদের নিযুক্ত করলাম ও তাদের হাতে তলোয়ার, বর্শা ও ধনুক দিলাম। তারপর আমি সব কিছু দেখে-শুনে গণ্যমান্য লোকদের, উঁচু পদের কর্মচারীদের ও বাকী লোকদের বললাম, “ওদের আপনারা ভয় করবেন না। যিনি মহান এবং ভয় জাগানো মালিক, তাঁর কথা মনে করুন আর আপনাদের ভাই, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও বাড়ীর জন্য যুদ্ধ করুন।” আমাদের শত্রুরা যখন জানতে পারল যে, আমরা তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানি এবং আল্লাহ্‌ তা বিফল করে দিয়েছেন, তখন আমরা সবাই দেয়ালের কাছে ফিরে গিয়ে যে যার কাজে লেগে গেলাম। যারা গাঁথত তারা প্রত্যেকে কোমরে তলোয়ার বেঁধে নিয়ে কাজ করত, আর যে শিংগা বাজাত সে আমার কাছে থাকত। পরে আমি গণ্যমান্য লোকদের, উঁচু পদের কর্মচারীদের ও বাকী লোকদের বললাম, “কাজের এলাকাটা বড় এবং তা অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে; সেইজন্য আমরা দেয়াল বরাবর একজনের কাছ থেকে অন্যজন আলাদা হয়ে দূরে দূরে আছি। আপনারা যেখানে শিংগার শব্দ শুনবেন সেখানে আমাদের কাছে জমায়েত হবেন। আমাদের আল্লাহ্‌ আমাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।” ভোর থেকে শুরু করে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত অর্ধেক লোক বর্শা ধরে থাকত আর আমরা এইভাবেই কাজ করতাম। সেই সময় আমি লোকদের আরও বললাম, “প্রত্যেকে তার চাকরকে নিয়ে রাতের বেলায় যেন জেরুজালেমে থাকে যাতে রাতে পাহারা দিতে পারে এবং দিনের বেলায় কাজ করতে পারে।” আমি কিংবা আমার ভাইয়েরা বা আমার চাকরেরা বা আমার দেহরক্ষীরা কেউই আমরা কাপড়-চোপড় খুলতাম না; এমন কি, পানির কাছে গেলেও আমরা প্রত্যেকে নিজের অস্ত্রশস্ত্র সংগে নিতাম। পরে লোকেরা ও তাদের স্ত্রীরা তাদের ধনী ইহুদী ভাইদের বিরুদ্ধে খুব হৈ চৈ করতে লাগল। কেউ কেউ বলছিল, “আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংখ্যায় অনেক; খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্য আমাদের শস্যের প্রয়োজন খুব বেশী।” অন্যেরা বলছিল, “খাবারের অভাবের ফলে শস্য পাবার জন্য আমাদের জমাজমি, আংগুর ক্ষেত এবং বাড়ী-ঘর বন্ধক রাখতে হচ্ছে।” আবার অন্যেরা বলছিল, “বাদশাহ্‌র খাজনা দেবার জন্য জমাজমি এবং আংগুর ক্ষেত বন্ধক রেখে আমাদের টাকা নিতে হয়েছে। যদিও আমরা একই জাতির লোক এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের মতই তবুও আমাদের ছেলেমেয়েদের গোলাম বানাতে হয়েছে, আর আমাদের মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন আগেই বাঁদী হয়ে গেছে। এখন আমাদের কোন ক্ষমতাই নেই, কারণ আমাদের জমাজমি আর আংগুর ক্ষেতগুলো অন্যদের হয়ে গেছে।” তাদের হৈ চৈ ও এই সব নালিশ শুনে আমি ভীষণ রেগে গেলাম। আমি তাদের কথাগুলো ভেবে দেখলাম আর তারপরে গণ্যমান্য লোকদের ও নেতাদের দোষী করে বললাম, “আপনারা আপনাদের নিজের দেশের লোকদের কাছ থেকে সুদ আদায় করছেন।” কাজেই আমি তাঁদের বিচার করবার জন্য বড় একটা সভা ডাকলাম। আমি বললাম, “অ-ইহুদীদের কাছে আমাদের যে সব ভাইয়েরা বিক্রি হয়েছিল যতদূর সম্ভব তাদের আমরা ছাড়িয়ে এনেছি। আর এখন আপনারা আপনাদের ভাইদের বিক্রি হতে বাধ্য করছেন, যার ফলে আমাদের আবার তাদের কিনে নিতে হবে।” এই কথা শুনে তাঁরা চুপ করে রইলেন, কারণ জবাব দেবার মত তাঁরা কিছুই খুঁজে পেলেন না। আমি আরও বললাম, “আপনারা যা করছেন তা ঠিক নয়। অ-ইহুদী শত্রুরা যাতে আমাদের টিট্‌কারি দিতে না পারে সেইজন্য আমাদের আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় রেখে চলা কি আপনাদের উচিত নয়? লোকদের কাছে আমার, আমার ভাইদের ও আমার কর্মচারীদেরও টাকা ও শস্য পাওনা আছে। কিন্তু আসুন, আমরা এই সব মাফ করে দিই। এখনই আপনারা তাদের জমাজমি, আংগুর ক্ষেত, জলপাইয়ের বাগান ও ঘর-বাড়ী তাদের ফিরিয়ে দিন, আর টাকা, শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেলের দরুন শতকরা যে সুদ আপনারা নিয়েছেন তাও তাদের ফিরিয়ে দিন।” এই কথা শুনে তাঁরা বললেন, “আমরা সব ফিরিয়ে দেব। আমরা তাদের কাছ থেকে আর কিছুই দাবি করব না। আপনি যা বললেন আমরা তা-ই করব।” তারপর আমি ইমামদের ডেকে পাঠালাম এবং গণ্যমান্য লোকদের ও নেতাদের দিয়ে কসম খাওয়ালাম যাতে তাঁরা তাঁদের ওয়াদামত কাজ করেন। আমার পোশাকের সামনের দিকটা আমি ঝাড়া দিয়ে বললাম, “যাঁরা এই ওয়াদা রক্ষা করবেন না আল্লাহ্‌ তাঁদের প্রত্যেককে তাঁদের ঘর-বাড়ী ও সম্পত্তি থেকে এইভাবে ঝেড়ে ফেলবেন। এই রকম লোকদের এইভাবেই ঝেড়ে ফেলা হবে ও তাদের সব কিছু শেষ করা হবে।” এই কথা শুনে সমস্ত লোক বলল, “আমিন,” আর তারা মাবুদের প্রশংসা করল। গণ্যমান্য লোকেরা তাঁদের ওয়াদা অনুসারেই কাজ করলেন। আর্টা-জারেক্সেস বাদশাহ্‌র রাজত্বের বিশ বছরের সময় যখন আমি এহুদা দেশে লোকদের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলাম, তখন থেকে তাঁর রাজত্বের বত্রিশ বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ সেই বারো বছর ধরে আমি বা আমার ভাইয়েরা শাসনকর্তার পাওনা খাবার জিনিস গ্রহণ করি নি। কিন্তু আমার আগে যে সব শাসনকর্তা ছিলেন তাঁরা লোকদের উপর ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন এবং খাবার-দাবার ও আংগুর-রস ছাড়াও তাদের কাছ থেকে পাঁচশো বিশ গ্রাম রূপা নিতেন। তাদের চাকর-বাকরেরা পর্যন্ত লোকদের উপর কর্তৃত্ব করত। কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় থাকাতে আমি সেই রকম কাজ করি নি, বরং আমি এই দেয়ালের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম। আমার সব চাকরেরাও কাজ করবার জন্য সেখানে জমায়েত হত। আমরা কেউ কোন জমি কিনি নি। এছাড়াও ইহুদী ও উঁচু পদের কর্মচারীদের মধ্য থেকে দেড়শো জন এবং আশেপাশের জাতিদের মধ্য থেকে যারা আমাদের কাছে আসত তারা আমার সংগে খাওয়া-দাওয়া করত। প্রত্যেক দিন একটা ষাঁড়, ছয়টা বাছাই-করা ভেড়া ও কতগুলো পাখী আমার জন্য রান্না করা হত, আর প্রতি দশ দিন পর প্রচুর পরিমাণে সব রকমের আংগুর-রস আমাকে দেওয়া হত। কিন্তু আমি কখনও শাসনকর্তার পাওনা খাবার জিনিস দাবি করি নি, কারণ এই সব দাবি লোকদের উপরে ভারী বোঝার মত ছিল। হে আমার আল্লাহ্‌, এই লোকদের জন্য আমি যে সব কাজ করেছি তার জন্য তুমি আমার উপকার করতে ভুলে যেয়ো না। পরে সন্‌বল্লট, টোবিয়, আরবীয় গেশম ও আমাদের বাকী শত্রুরা শুনতে পেল যে, আমি দেয়াল আবার গেঁথে ফেলেছি এবং সেই দেয়ালের মধ্যে আর কোন ফাঁক নেই। অবশ্য তখনও আমি ফটকগুলোতে দরজা লাগাই নি। তখন সন্‌বল্লট আর গেশম আমাকে এই কথা বলে পাঠাল, “আসুন, আমরা ওনো সমভূমির একটা গ্রামে মিলিত হই।” আসলে তারা আমার ক্ষতি করবার ষড়যন্ত্র করছিল। সেইজন্য আমি লোক পাঠিয়ে তাদের এই জবাব দিলাম, “আমি একটা বিশেষ দরকারী কাজ করছি বলে যেতে পারছি না। আমি কাজ ছেড়ে আপনাদের কাছে যাবার ফলে কেন কাজ বন্ধ থাকবে?” তারা চার বার একই খবর আমার কাছে পাঠাল আর প্রত্যেকবার আমি তাদের একই জবাব দিলাম। তারপর পঞ্চম বারে সন্‌বল্লট একই খবর দিয়ে তার চাকরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিল। তার হাতে একটা খোলা চিঠি ছিল। সেখানে লেখা ছিল, “বিভিন্ন জাতিদের মধ্যে এই কথা শোনা যাচ্ছে আর গেশমও বলছে যে, আপনি ও ইহুদীরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছেন বলেই দেয়াল গাঁথছেন। এছাড়া এই সব খবর অনুসারে বুঝা যাচ্ছে যে, আপনি তাদের বাদশাহ্‌ হতে যাচ্ছেন। আপনার বিষয়ে এই কথা যাতে জেরুজালেমে ঘোষণা করা হয় যে, এহুদা দেশে একজন বাদশাহ্‌ আছেন, সেইজন্য আপনি নবীদের পর্যন্ত নিযুক্ত করেছেন। এখন এই খবর তো বাদশাহ্‌র কাছে পৌঁছাবে। কাজেই আসুন, আমরা একত্র হয়ে পরামর্শ করি।” আমি তাকে এই জবাব পাঠিয়ে দিলাম, “আপনি যা বলছেন সেই রকম কিছুই হচ্ছে না; এটা আপনার মনগড়া কথা।” তারা আমাদের কাজ থামিয়ে দেবার জন্য এই সব কথা বলে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করতে লাগল। হে আল্লাহ্‌, এখন তুমি আমার হাতে শক্তি দাও। এক দিন আমি দলায়ের ছেলে শময়িয়ের ঘরে গেলাম। দলায় মহেটবেলের ছেলে। শময়িয় তার ঘরে লুকিয়ে ছিল। সে বলল, “আসুন, আমরা আল্লাহ্‌র ঘরে, পবিত্র স্থানের মধ্যে মিলিত হই এবং ঘরের দরজাগুলো বন্ধ করে দিই, কারণ লোকেরা আপনাকে মারতে আসছে; তারা রাতের বেলায় আপনাকে মারতে আসবে।” কিন্তু আমি বললাম, “আমার মত লোকের কি পালিয়ে যাওয়া উচিত? কিংবা আমার মত কারও কি তার নিজের প্রাণ রক্ষা করবার জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে যাওয়া উচিত? আমি যাব না।” আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ্‌ তাকে পাঠান নি; টোবিয় আর সন্‌বল্লট তাকে টাকা দিয়েছিল বলে সে আমার বিরুদ্ধে এই সব কথা বলেছে। তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল যাতে আমি ভয় পাই এবং তারই কথামত কাজ করে গুনাহ্‌ করি, আর তাতে যেন তারা আমার দুর্নাম করে আমাকে লজ্জায় ফেলতে পারে। হে আমার আল্লাহ্‌, টোবিয় আর সন্‌বল্লট যা করেছে তা তুমি মনে রেখো। মহিলা-নবী নোয়দিয়া আর বাকী যে সব নবীরা আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল তাদের কথাও মনে রেখো। ইলূল মাসের পঁচিশ তারিখে, বাহান্ন দিনের দিন দেয়াল গাঁথা শেষ হল। আমাদের সব শত্রুরা যখন এই কথা শুনল আর আশেপাশের সব জাতি তা দেখল তখন আমাদের শত্রুরা সাহস হারাল, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এই কাজ আমাদের আল্লাহ্‌র সাহায্যেই করা হয়েছে। সেই সময়ে এহুদার গণ্যমান্য লোকেরা টোবিয়ের কাছে অনেক চিঠিপত্র পাঠাতেন এবং টোবিয়ের কাছ থেকে তাঁরা জবাবও পেতেন। এহুদার অনেকে টোবিয়ের কাছে কসমে বাঁধা ছিল, কারণ সে ছিল আরহের ছেলে শখনিয়ের জামাই। টোবিয়ের ছেলে যিহোহানন বেরিখিয়ের ছেলে মশুল্লমের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এছাড়া সেই গণ্যমান্য লোকেরা টোবিয়ের ভাল কাজের কথা আমাকে জানাত আর আমার কথাও তাকে জানাত। টোবিয় আমাকে ভয় দেখাবার জন্য আমার কাছে চিঠি লিখত। দেয়াল গাঁথা শেষ হলে পর আমি ফটকগুলোর দরজা লাগালাম। তার পরে দরজা-রক্ষী, কাওয়াল ও লেবীয়দের নিযুক্ত করা হল। আমার ভাই হনানি ও কেল্লার সেনাপতি হনানিয়কে আমি জেরুজালেমের ভার দিলাম, কারণ হনানিয় সৎ লোক ছিলেন এবং আল্লাহ্‌কে অনেকের চেয়ে বেশী ভয় করতেন। আমি তাঁদের বললাম, “রোদ বেশী না হওয়া পর্যন্ত জেরুজালেমের দরজাগুলো যেন খোলা না হয়। রক্ষীদের চলে যাওয়ার আগে যেন দরজাগুলো বন্ধ করা ও হুড়কা দেওয়া হয়। জেরুজালেমের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে যেন পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়। তাদের কেউ কেউ থাকুক পাহারা দেবার জায়গায় আর কেউ কেউ থাকুক তাদের নিজের নিজের বাড়ীর কাছে।” এই রকম ব্যবস্থা করা হল, কারণ জেরুজালেম শহরটা ছিল বড় এবং অনেক জায়গা জুড়ে, কিন্তু লোক ছিল খুব কম আর ঘর-বাড়ীও তখন তৈরী করা হয় নি। পরে আল্লাহ্‌ আমার মনে ইচ্ছা দিলেন যাতে আমি গণ্যমান্য লোকদের, নেতাদের ও সাধারণ লোকদের একত্র করে তাদের বংশ-তালিকা করতে পারি। যারা প্রথমে ফিরে এসেছিল সেই লোকদের বংশ-তালিকা পেলাম। সেখানে যা লেখা ছিল তা এই: ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার যে সব বনি-ইসরাইলদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই বন্দী অবস্থা থেকে জেরুজালেম ও এহুদায় নিজের নিজের শহর ও গ্রামে ফিরে এসেছিল। এই লোকেরা সরুব্বাবিল, ইউসা, নহিমিয়া, অসরিয়, রয়মিয়া, নহমানি, মর্দখয়, বিল্‌শন, মিসপরৎ, বিগ্‌বয়, নাহূম ও বানার সংগে ফিরে এসেছিল। যে সমস্ত ইসরাইলীয় পুরুষ লোকেরা ফিরে এসেছিল তাদের সংখ্যা: পরোশের বংশের লোকেরা দু’হাজার একশো বাহাত্তর জন; শফটিয়ের তিনশো বাহাত্তর জন; আরহের ছ’শো বাহান্ন জন; পহৎ-মোয়াবের বংশের ইউসা ও যোয়াবের বংশের লোকেরা দু’হাজার আটশো আঠারো জন; ইলামের এক হাজার দু’শো চুয়ান্ন জন; বেবয়ের ছ’শো আটাশ জন; আস্‌গদের দু’হাজার তিনশো বাইশ জন; অদোনীকামের ছ’শো সাতষট্টি জন; বিগ্‌বয়ের দু’হাজার সাতষট্টি জন; আদীনের ছ’শো পঞ্চান্ন জন; যিহিষ্কিয়ের বংশধর আটেরের বংশের আটানব্বইজন। হশুমের তিনশো আটাশ জন; বেৎসয়ের তিনশো চব্বিশ জন; হারীফের একশো বারো জন; গিবিয়োনের পঁচানব্বইজন। বেথেলহেম ও নটোফা গ্রামের লোক একশো অষ্টাশি জন; অনাথোতের লোক একশো আটাশ জন; বৈৎ-অস্মাবতের লোক বিয়াল্লিশ জন; কিরিয়ৎ-যিয়ারীম, কফীরা ও বেরোতের লোক সাতশো তেতাল্লিশ জন; রামা ও গেবার লোক ছ’শো একুশ জন; মিক্‌মসের লোক একশো বাইশ জন; বেথেল ও অয়ের লোক একশো তেইশ জন; অন্য নবোর লোক বাহান্ন জন; অন্য ইলামের লোক এক হাজার দু’শো চুয়ান্ন জন; হারীমের লোক তিনশো বিশ জন; জেরিকোর লোক তিনশো পয়ঁতাল্লিশ জন; লোদ, হাদীদ এবং ওনোর লোক সাতশো একুশ জন; সনায়ার লোক তিন হাজার ন’শো ত্রিশ জন। ইমামদের সংখ্যা এই: ইউসার বংশের মধ্যে যিদয়িয়ের বংশের ন’শো তেয়াত্তর জন; ইম্মেরের এক হাজার বাহান্ন জন; পশ্‌হূরের এক হাজার দু’শো সাতচল্লিশ জন; হারীমের এক হাজার সতেরো জন। লেবীয়দের সংখ্যা এই: ইউসার বংশের কদ্‌মীয়েল ও হোদবিয়ের বংশের লোকেরা চুয়াত্তর জন। কাওয়ালদের সংখ্যা এই: আসফের বংশের একশো আটচল্লিশ জন। বায়তুল-মোকাদ্দসের রক্ষীদের সংখ্যা একশো আটত্রিশ জন। এরা হল শল্লুম, আটের, টল্‌মোন, অক্কূব, হটীটা ও শোবয়ের বংশের লোক। বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা: এরা হল সীহ, হসূফা ও টব্বায়োতের বংশধরেরা; কেরোস, সীয় ও পাদোনের বংশধরেরা; লবানা, হগাব ও শল্‌ময়ের বংশধরেরা; হানন, গিদ্দেল ও গহরের বংশধরেরা; রায়া, রৎসীন ও নকোদের বংশধরেরা; গসম, আওস ও পাসেহের বংশধরেরা; বেষয়, মিয়ূনীম ও নফুষযীমের বংশধরেরা; বকবুক, হকূফা ও হর্হূরের বংশধরেরা; বসলীত, মহীদা ও হর্শার বংশধরেরা; বর্কোস, সীষরা ও তেমহের বংশধরেরা; নৎসীহ ও হটীফার বংশধরেরা। সোলায়মানের চাকরদের বংশধরেরা: এরা হল সোটয়, সোফেরত, পরীদা, যালা, দর্কোন, গিদ্দেল, শফটিয়, হটীল, পোখেরৎ-হৎসবায়ীম ও আমোনের বংশধরেরা। বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা ও সোলায়মানের চাকরদের বংশধরেরা মোট তিনশো বিরানব্বই জন। তেল্‌-মেলহ, তেল্‌হর্শা, কারুবী, অদ্দন ও ইম্মেরের এলাকা থেকে যারা এসেছিল তারা ইসরাইলীয় বলে নিজেদের প্রমাণ করতে পারল না। তারা হল: দলায়, টোবিয়, ও নকোদের বংশের ছ’শো বিয়াল্লিশ জন। শাসনকর্তা তাদের হুকুম দিলেন যতদিন ঊরীম ও তুম্মীম ব্যবহার করবার অধিকারী কোন ইমাম পাওয়া না যায় ততদিন পর্যন্ত তারা যেন মহাপবিত্র খাবারের কিছু না খায়। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা গোটা দলটার লোকসংখ্যা ছিল বিয়াল্লিশ হাজার তিনশো ষাট জন। এছাড়া সাত হাজার তিনশো সাঁইত্রিশ জন চাকর-চাকরানী এবং দু’শো পঁয়তাল্লিশ জন কাওয়ালও ছিল। বংশের প্রধান লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বায়তুল-মোকাদ্দসের কাজের জন্য দান করলেন। শাসনকর্তা ধনভাণ্ডারে দিলেন সাড়ে ছয় কেজি সোনা, পঞ্চাশটা পাত্র ও ইমামদের জন্য পাঁচশো ত্রিশটা পোশাক। বংশের প্রধান লোকদের মধ্যে কেউ কেউ এই কাজের জন্য একশো ত্রিশ কেজি সোনা ও এক হাজার চারশো ত্রিশ কেজি রূপা ধনভাণ্ডারে দিলেন। বাকী লোকেরা দিল মোট একশো ত্রিশ কেজি সোনা, এক হাজার তিনশো কেজি রূপা ও ইমামদের জন্য সাতষট্টিটা পোশাক। ইমামেরা, লেবীয়রা, রক্ষীরা, কাওয়ালেরা, বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা এবং অন্যান্য লোকেরা, অর্থাৎ সমস্ত বনি-ইসরাইল সপ্তম মাসের আগে যে যার গ্রাম ও শহরে বাস করতে লাগল। সপ্তম মাসের আগে সমস্ত লোক একসংগে মিলে পানি-দরজার সামনের চকে জমায়েত হল। তারা আলেম উযায়েরকে বনি-ইসরাইলদের জন্য মাবুদের দেওয়া শরীয়ত, অর্থাৎ তৌরাত কিতাব নিয়ে আসতে বলল। সপ্তম মাসের প্রথম দিনে ইমাম উযায়ের স্ত্রী-পুরুষ এবং যারা শুনে বুঝতে পারে এমন সব লোকদের দলের সামনে তৌরাত কিতাব নিয়ে আসলেন। পানি-দরজার সামনের চকের দিকে মুখ করে স্ত্রী-পুরুষ ও অন্যান্য যারা বুঝতে পারে তাদের কাছে তিনি ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত তা তেলাওয়াত করে শোনালেন, আর সমস্ত লোক মন দিয়ে তৌরাত কিতাবের কথা শুনল। কিতাবটি তেলাওয়াত করবার জন্য কাঠের যে মঞ্চ তৈরী করা হয়েছিল তার উপর আলেম উযায়ের গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মত্তিথিয়, শেমা, অনায়, উরিয়া, হিল্কিয় ও মাসেয়; আর তাঁর বাঁ পাশে ছিলেন পদায়, মীশায়েল, মল্কিয়, হশুম, হশবদ্দানা, জাকারিয়া ও মশুল্লম। তারপর উযায়ের কিতাবটি খুললেন। সব লোক তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল, কারণ তিনি তাদের থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কিতাবটি খুললে পর সব লোক উঠে দাঁড়াল। তখন উযায়ের মাবুদ আল্লাহ্‌তা’লার প্রশংসা করলেন, আর সমস্ত লোক তাদের হাত তুলে বলল, “আমিন, আমিন।” তারপর তারা সেজদা করে মাবুদের এবাদত করল। ইউসা, বানি, শেরেবিয়, যামীন, অক্কুব, শব্বথয়, হোদিয়, মাসেয়, কলীট, অসরীয়, যোষাবদ, হানন ও পলায়- এই সব লেবীয়রা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কাছে তৌরাতের বিষয় বুঝিয়ে দিলেন। যা তেলাওয়াত করা হচ্ছে তা যাতে লোকেরা বুঝতে পারে সেইজন্য তাঁরা আল্লাহ্‌র তৌরাত কিতাব থেকে পড়ে অনুবাদ করে মানে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর শাসনকর্তা নহিমিয়া, ইমাম ও আলেম উযায়ের এবং যে লেবীয়রা লোকদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন তাঁরা সমস্ত লোকদের বললেন, “আজকের এই দিনটা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে পবিত্র। আপনারা শোক বা কান্নাকাটি করবেন না।” তিনি এই কথা বললেন, কারণ লোকেরা সবাই তৌরাতের কথা শুনে কাঁদছিল। নহিমিয়া বললেন, “আপনারা গিয়ে ভাল ভাল খাবার ও মিষ্টি রস খান আর যাদের কোন খাবার নেই তাদের কিছু কিছু পাঠিয়ে দিন। আজকের দিনটা হল আমাদের মাবুদের উদ্দেশে পবিত্র। আপনারা দুঃখ করবেন না, কারণ মাবুদের দেওয়া আনন্দই হল আপনাদের শক্তি।” লেবীয়রা সমস্ত লোকদের শান্ত করে বললেন, “আপনারা নীরব হন, কারণ আজকের দিনটা পবিত্র। আপনারা দুঃখ করবেন না।” তখন সমস্ত লোক খুব আনন্দের সংগে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য ও খাবারের অংশ পাঠাবার জন্য চলে গেল, কারণ যে সব কথা তাদের জানানো হয়েছিল তা তারা বুঝতে পেরেছিল। সেই মাসের দ্বিতীয় দিনে সমস্ত বংশের প্রধান লোকেরা, ইমামেরা ও লেবীয়রা তৌরাত কিতাব ভাল করে বুঝবার জন্য আলেম উযায়েরের কাছে একত্র হলেন। তাঁরা তৌরাতের মধ্যে দেখতে পেলেন মূসার মধ্য দিয়ে মাবুদ এই হুকুম দিয়েছেন যে, সপ্তম মাসের ঈদের সময় বনি-ইসরাইলরা কুঁড়ে-ঘরে বাস করবে, আর তাদের গ্রামগুলোতে ও জেরুজালেমে তারা এই কথা ঘোষণা ও প্রচার করবে, “যেমন লেখা আছে সেইমত তোমরা পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে কুঁড়ে-ঘর বানাবার জন্য জলপাই ও বুনো জলপাই গাছের ডাল আর গুলমেঁদি, খেজুর ও পাতা-ভরা গাছের ডাল নিয়ে আসবে।” সেইজন্য লোকেরা গিয়ে ডাল নিয়ে এসে কেউ কেউ তাদের ঘরের ছাদের উপরে কিংবা উঠানে কিংবা আল্লাহ্‌র ঘরের উঠানে কিংবা পানি-দরজার কাছের চকে কিংবা আফরাহীম-দরজার কাছের চকে নিজেদের জন্য কুঁড়ে-ঘর তৈরী করল। বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা গোটা দলটাই কুঁড়ে-ঘর তৈরী করে সেগুলোর মধ্যে বাস করল। নূনের ছেলে ইউসার সময় থেকে সেই দিন পর্যন্ত বনি-ইসরাইলরা এই রকম আর করে নি। তারা খুব বেশী আনন্দ করল। প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত উযায়ের প্রতিদিনই আল্লাহ্‌র তৌরাত কিতাব থেকে তেলাওয়াত করতে থাকলেন। লোকেরা সাত দিন ধরে ঈদ পালন করল আর অষ্টম দিনে নিয়ম অনুসারে শেষ দিনের বিশেষ মাহ্‌ফিল হল। সেই একই মাসের চব্বিশ দিনের দিন বনি-ইসরাইলরা একত্র হয়ে রোজা রাখল, চট পরল এবং মাথায় ধুলা দিল। ইসরাইল জাতির লোকেরা অন্যান্য জাতির সমস্ত লোকদের কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করে নিল। তারা দাঁড়িয়ে নিজেদের গুনাহ্‌ ও তাদের পূর্বপুরুষদের অন্যায় স্বীকার করল। তারপর তারা দাঁড়িয়ে থেকেই দিনের চার ভাগের এক ভাগ সময় তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র তৌরাত কিতাব থেকে তেলাওয়াত করতে থাকল আর চার ভাগের এক ভাগ সময় গুনাহ্‌ স্বীকার করে ও তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করে কাটাল। ইউসা, বানি, কদ্‌মীয়েল, শবনিয়, বুন্নি, শেরেবিয়, বানি ও কেনানী নামে লেবীয়রা তাঁদের মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে জোরে জোরে তাঁদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডাকলেন। পরে লেবীয়দের মধ্য থেকে ইউসা, কদ্‌মীয়েল, বানি, হশব্‌নিয়, শেরেবিয়, হোদিয়, শবনিয় ও পথাহিয় বললেন, “আপনারা উঠে আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুন, যিনি অনাদিকাল থেকে আখেরাত পর্যন্ত আছেন।” তারপর তারা এই বলে মুনাজাত করলেন, “হে মাবুদ, তোমার মহিমাপূর্ণ নামের প্রশংসা হোক; আমাদের দেওয়া সমস্ত শুকরিয়া ও প্রশংসার চেয়েও তুমি মহান। কেবল তুমিই মাবুদ। তুমিই আকাশ, মহাকাশ ও তার মধ্যেকার সব কিছু, দুনিয়া ও তার উপরকার সব কিছু এবং সাগর ও তার মধ্যেকার সব কিছু তৈরী করেছ। তুমিই সকলের প্রাণ দিয়েছ এবং বেহেশতের সকলেই তোমার এবাদত করে। “তুমিই মাবুদ আল্লাহ্‌। তুমি ইব্রামকে বেছে নিয়ে ক্যালডীয়দের দেশ উর শহর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলে আর তাঁর নাম রেখেছিলে ইব্রাহিম। তুমি তাঁর দিল বিশ্বস্ত দেখে কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, যিবূষীয় ও গির্গাশীয়দের দেশ তাঁর বংশকে দেবার জন্য তাঁর জন্য একটা ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলে। তুমি ন্যায়বান বলে তোমার ওয়াদা তুমি রক্ষা করেছিলে। “মিসর দেশে আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্টভোগ তুমি দেখেছিলে; লোহিত সাগরের পারে তাদের কান্না তুমি শুনেছিলে। ফেরাউন, তাঁর সমস্ত কর্মচারী ও তাঁর দেশের সমস্ত লোকদের তুমি অনেক অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়েছিলে, কারণ তুমি জানতে আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগে মিসরীয়দের ব্যবহার ছিল অহংকারে পূর্ণ। এই সমস্ত কাজ করে তুমি তোমার সুনাম রক্ষা করেছিলে, যা এখনও রয়েছে। তুমি তাদের সামনে সাগরকে দু’ভাগ করেছিলে, তাই তারা শুকনা জমির উপর দিয়ে পার হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু যারা তাদের তাড়া করে আসছিল তুমি তাদের পানির স্রোতে পাথর ফেলবার মত করে গভীর পানিতে ফেলে দিয়েছিলে। তুমি দিনের বেলায় মেঘের থাম দিয়ে তাদের চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে আর রাতে আগুনের থাম দিয়ে তাদের যাওয়ার পথে আলো দিয়েছিলে। “তুমি তুর পাহাড়ের উপরে নেমে এসেছিলে এবং বেহেশত থেকে তাদের সংগে কথা বলেছিলে। সেই সময় তুমি ন্যায্য নির্দেশ, সঠিক শরীয়ত এবং ভাল নিয়ম ও হুকুম তাদের দিয়েছিলে। তোমার পবিত্র বিশ্রামবার সম্বন্ধে তুমি তাদের জানিয়েছিলে এবং তোমার গোলাম মূসার মধ্য দিয়ে তুমি তাদের হুকুম, নিয়ম ও আইন দিয়েছিলে। খিদে মিটাবার জন্য তুমি বেহেশত থেকে তাদের খাবার দিয়েছিলে আর পিপাসা মিটাবার জন্য পাথর থেকে পানি বের করে দিয়েছিলে। যে দেশ তাদের দেবার জন্য তুমি কসম খেয়েছিলে সেখানে গিয়ে তা অধিকার করবার জন্য তুমি তাদের হুকুম দিয়েছিলে। “তবুও আমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যবহার ছিল অহংকারে পূর্ণ; তারা একগুঁয়ে হয়েছিল আর তোমার হুকুম পালন করে নি। তারা বাধ্য থাকতে অস্বীকার করেছিল, আর যে সব অলৌকিক চিহ্ন তুমি তাদের মধ্যে করেছিলে তাও তারা মনে রাখে নি। তারা একগুঁয়েমি করে আবার গোলামী করতে মিসরে ফিরে যাবার জন্য একজন নেতাকে নিযুক্ত করেছিল। কিন্তু তুমি মাফদানকারী আল্লাহ্‌, দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ; তুমি সহজে অসন্তুষ্ট হও না এবং তোমার মহব্বতের সীমা নেই। তাই তুমি তাদের ত্যাগ কর নি। তুমি তাদের শিক্ষা দেবার জন্য তোমার মেহেরবান রূহ্‌কে দান করেছিলে। তাদের খাওয়ার জন্য তুমি যে মান্না দিয়েছিলে তা বন্ধ করে দাও নি; তুমি তাদের পিপাসা মিটাবার জন্য পানি দিয়েছিলে। মরুভূমিতে চল্লিশ বছর ধরে তুমি তাদের পালন করেছিলে। তাদের কিছুরই অভাব হয় নি; তাদের কাপড়-চোপড়ও পুরানো হয় নি এবং তাদের পা-ও ফোলে নি। “পরে তুমি অনেক রাজ্য ও জাতি তাদের হাতে দিয়েছিলে, এমন কি, তাদের সমস্ত জায়গাও তাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলে। তারা হিষ্‌বোণের বাদশাহ্‌ সীহোনের দেশ ও বাশনের বাদশাহ্‌ উজের দেশ অধিকার করেছিল। আসমানের তারার মত তুমি তাদের অসংখ্য সন্তান দিয়েছিলে এবং তুমি তাদের সেই দেশে নিয়ে গিয়েছিলে যে দেশে ঢুকে তা অধিকার করবার কথা তুমি তাদের পূর্বপুরুষদের বলেছিলে। তাদের সন্তানেরা সেই দেশে গিয়ে তা দখল করে নিয়েছিল। সেই দেশে বাসকারী কেনানীয়দের তুমি তাদের সামনে নত করেছিলে। কেনানীয়দের, তাদের বাদশাহ্‌দের ও দেশের অন্যান্য জাতিদের তুমি তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলে যাতে তারা তাদের উপর যা খুশী তা-ই করতে পারে। তারা দেয়াল-ঘেরা অনেক শহর ও উর্বর জমি অধিকার করেছিল; তারা সব রকম ভাল ভাল জিনিসে ভরা বাড়ী-ঘর ও আগেই খোঁড়া হয়েছে এমন অনেক কূয়া, আংগুর ক্ষেত, জলপাইয়ের বাগান এবং অনেক ফলের গাছ অধিকার করেছিল। তারা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে মোটা-সোটা হয়েছিল এবং তোমার দেওয়া প্রচুর মেহেরবানী ভোগ করেছিল। “কিন্তু তবুও তারা অবাধ্য হয়ে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল; তোমার শরীয়ত তারা ত্যাগ করেছিল। তোমার যে নবীরা তাদের সতর্ক করতেন যাতে তারা তোমার দিকে ফিরে আসে সেই নবীদের তারা মেরে ফেলেছিল; তারা তোমাকে ভীষণ কুফরী করেছিল। কাজেই তুমি শত্রুদের হাতে তাদের তুলে দিয়েছিলে আর শত্রুরা তাদের উপর জুলুম করত। তাদের কষ্টের সময় তারা তোমার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিল আর তুমি বেহেশত থেকে তা শুনেছিলে। তুমি প্রচুর মমতায় তাদের কাছে উদ্ধারকারীদের পাঠিয়ে দিয়েছিলে। তারা শত্রুদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করেছিল। “কিন্তু যেই তারা বিশ্রাম পেত অমনি আবার তারা তোমার চোখে যা খারাপ তা-ই করত। এর পর তুমি শত্রুদের হাতে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলে যাতে শত্রুরা তাদের কর্তা হতে পারে। কিন্তু আবার যখন তারা তোমার কাছে কাঁদত তখন বেহেশত থেকে তা শুনে তোমার মমতায় তুমি বারে বারে তাদের উদ্ধার করতে। “তোমার শরীয়তের দিকে ফিরে আসবার জন্য তুমি তাদের সতর্ক করেছিলে কিন্তু তাদের ব্যবহার ছিল অহংকারে পূর্ণ; তারা তোমার সব হুকুম অমান্য করেছিল। তোমার যে সব নির্দেশ পালন করলে মানুষ বাঁচে তার বিরুদ্ধে তারা গুনাহ্‌ করেছিল। তারা একগুঁয়েমি করে এবং ঘাড় শক্ত করে তোমার কথা শুনতে চায় নি। কিন্তু তবুও অনেক বছর ধরে তুমি তাদের উপর ধৈর্য ধরেছিলে। তোমার নবীদের মধ্য দিয়ে তোমার রূহের দ্বারা তুমি তাদের সতর্ক করেছিলে, কিন্তু তাতে তারা কান দেয় নি। কাজেই বিভিন্ন জাতির হাতে তুমি তাদের তুলে দিয়েছিলে। কিন্তু তোমার প্রচুর মমতার জন্য তুমি তাদের শেষ করে দাও নি কিংবা ত্যাগ কর নি, কারণ তুমি দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ আল্লাহ্‌। “হে আমাদের আল্লাহ্‌, তুমি শক্তিশালী ও ভয় জাগানো আল্লাহ্‌তা’লা। তোমার অটল মহব্বতের ব্যবস্থা তুমি রক্ষা করে থাক। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌দের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই যে সব কষ্ট আমাদের উপরে এবং আমাদের বাদশাহ্‌দের, নেতাদের, ইমামদের, নবীদের, আমাদের পূর্বপুরুষদের ও তোমার সমস্ত লোকদের উপরে চলছে তা তোমার চোখে যেন সামান্য মনে না হয়। তুমি আমাদের উপর যা কিছু ঘটতে দিয়েছ তাতে তুমি অন্যায় কর নি; তুমি বিশ্বস্ত ভাবে কাজ করেছ আর আমরা অন্যায় করেছি। আমাদের বাদশাহ্‌রা, নেতারা, ইমামেরা ও আমাদের পূর্বপুরুষেরা তোমার শরীয়ত মেনে চলেন নি; তোমার হুকুম কিংবা সতর্কবাণী তাঁরা শোনেন নি। তাঁদের রাজত্বকালে তাঁরা তোমার দেওয়া বড় ও উর্বর দেশে প্রচুর মেহেরবানী ভোগ করছিলেন, তবুও তাঁরা তোমার এবাদত করেন নি কিংবা তাঁদের খারাপ পথ থেকে ফেরেন নি। “দেখ, আজ আমরা গোলাম; যে দেশটা তুমি আমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলে যাতে তারা তার ফল আর সব রকমের ভাল জিনিস খেতে পারে আমরা সেখানেই গোলাম হয়ে রয়েছি। আমাদের গুনাহের দরুন যে বাদশাহ্‌দের তুমি আমাদের উপরে রাজত্ব করতে দিয়েছ দেশের প্রচুর ফসল তাঁদের কাছেই যায়। তাঁরা তাঁদের খুশী মতই আমাদের শরীরের উপরে ও আমাদের পশুপালের উপরে কর্তৃত্ব করেন। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছি।” তারপর লোকেরা লিখল: “এই সব কারণে আমরা এখন নিজেদের মধ্যে লিখিত ভাবে চুক্তি করছি, আর তার উপর আমাদের নেতারা, লেবীয়রা ও ইমামেরা তাঁদের সীলমোহর দিচ্ছেন।” যাঁরা তার উপর সীলমোহর দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন হখলিয়ের ছেলে শাসনকর্তা নহিমিয়া ও সিদিকিয়, সরায়, অসরিয়, ইয়ারমিয়া, পশহূর, অমরিয়, মল্কিয়, মশুল্লম, অবিয়, মিয়ামীন, মাসিয়, বিল্‌গয় ও শময়িয়। এঁরা সবাই ইমাম ছিলেন। মিকাহ্‌, রহোব, হশবিয়, সক্কূর, শেরেবিয়, শবনিয়, হোদীয়, বানি ও বনীনু। লোকদের নেতাদের মধ্য থেকে যাঁরা সীলমোহর দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন পরোশ, পহৎ-মোয়াব, ইলাম, সত্তূ, বানি, বুন্নি, অস্‌গদ, বেবয়, অদোনিয়, বিগ্‌বয়, আদীন, অহিয়, হানন, অনান, মল্লূক, হারীম ও বানা। আমরা আমাদের আশেপাশের জাতিদের সংগে আমাদের মেয়েদের বিয়ে দেব না কিংবা আমাদের ছেলেদের জন্য তাদের মেয়েদের নেব না। বিশ্রামবারে কিংবা অন্য কোন পবিত্র দিনে যদি আশেপাশের জাতির লোকেরা কোন জিনিসপত্র কিংবা শস্য বিক্রি করবার জন্য নিয়ে আসে তবে তাদের কাছ থেকে আমরা তা কিনব না। প্রত্যেক সপ্তম বছরে আমরা জমি চাষ করব না এবং সমস্ত ঋণ মাফ করে দেব। আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের এবাদত-কাজের জন্য প্রতি বছর এক শেখেলের তিন ভাগের এক ভাগ দেবার দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করলাম। এই সব শেখেল দিয়ে যেন টেবিলের উপরকার পবিত্র-রুটি দেওয়া যায় এবং নিয়মিত শস্য ও পোড়ানো-কোরবানী, বিশ্রামবারের কোরবানী, অমাবস্যা ও অন্যান্য নির্দিষ্ট ঈদ, পাক-পবিত্র জিনিস কোরবানী এবং বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য গুনাহের কোরবানী করা যায় আর আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের সমস্ত কাজ করা যায়। আমাদের শরীয়তে যেমন লেখা আছে সেইমত আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কোরবানগাহের উপরে পোড়াবার জন্য প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরে আমাদের প্রত্যেক বংশকে কখন কাঠ আনতে হবে তা স্থির করবার জন্য আমরা, অর্থাৎ ইমামেরা, লেবীয়রা ও লোকেরা গুলিবাঁট করলাম। আমরা প্রতি বছর প্রথমে কাটা ফসল ও প্রত্যেকটি গাছের প্রথম ফল মাবুদের ঘরে আনব। শরীয়তে যেমন লেখা আছে সেইমত আমরা আমাদের প্রথম পুরুষ সন্তান ও পশুর প্রথম বাচ্চা আর পালের গরু, ছাগল ও ভেড়ার প্রথম বাচ্চা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের খেদমতকারী ইমামদের কাছে নিয়ে যাব। এছাড়া আমাদের ময়দার ও শস্য-কোরবানীর প্রথম অংশ, সমস্ত গাছের প্রথম ফল ও নতুন আংগুর-রস ও তেলের প্রথম অংশ আমরা আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের ভাণ্ডার-ঘরে ইমামদের কাছে নিয়ে আসব। আর আমাদের ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ লেবীয়দের কাছে নিয়ে আসব, কারণ আমাদের সব গ্রামে লেবীয়রাই দশমাংশ গ্রহণ করে থাকেন। লেবীয়রা যখন দশমাংশ নেবেন তখন তাঁদের সংগে থাকবেন হারুনের বংশের একজন ইমাম। লেবীয়রা সেই সব দশমাংশের দশ ভাগের এক ভাগ আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের ধনভাণ্ডারের কামরাগুলোতে নিয়ে যাবেন। ধনভাণ্ডারের যে সব কামরায় পবিত্র স্থানের জিনিসপত্র রাখা হয় এবং খেদমতকারী ইমামেরা, রক্ষীরা ও কাওয়ালেরা থাকেন সেখানে বনি-ইসরাইলরা ও লেবীয়রা তাদের শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল নিয়ে আসবে। আমাদের আল্লাহ্‌র ঘরের কাজের জন্য যা কিছু দরকার আমরা তা দিতে থাকব। লোকদের নেতারা জেরুজালেমে বাস করতেন। বাকী লোকেরা গুলিবাঁট করল যাতে তাদের মধ্যে প্রতি দশজনের একজন পবিত্র শহর জেরুজালেমে বাস করতে পারে, আর বাকী নয়জন তাদের নিজের নিজের গ্রামেই থাকবে। যে সব লোক ইচ্ছা করে জেরুজালেমে বাস করতে চাইল লোকেরা তাদের প্রশংসা করল। পেরসের বংশের মোট চারশো আটষট্টিজন শক্তিশালী লোক জেরুজালেমে বাস করত। শিখ্রির ছেলে যোয়েল ছিলেন তাদের প্রধান কর্মচারী আর হস্‌সনূয়ার ছেলে এহুদা ছিলেন শহরের দ্বিতীয় কর্তা। লেবীয়দের মধ্য থেকে হশূবের ছেলে শিময়িয়; হশূবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন অস্রীকাম, হশবিয় ও বুন্নি। এছাড়া ছিলেন শব্বথয় আর যোষাবাদ নামে লেবীয়দের মধ্যে দু’জন প্রধান লোক, যাঁদের হাতে আল্লাহ্‌র ঘরের বাইরের কাজকর্ম দেখাশোনা করবার ভার ছিল। এঁরা ছাড়া ছিলেন মিকাহ্‌র ছেলে মত্তনিয়, যিনি শুকরিয়া ও মুনাজাত পরিচালনার কাজে প্রধান ছিলেন। মিকাহ্‌র পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সব্দি ও আসফ। এঁদের সংগে ছিলেন বক্‌বুকিয়, যিনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে দ্বিতীয়। আরও ছিলেন শম্মুয়ের ছেলে অব্দ; শম্মুয়ের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন গালল ও যিদূথূন। পবিত্র শহরের লেবীয়দের মোট সংখ্যা ছিল দু’শো চুরাশী। দরজা-রক্ষীরা হল অক্কুব, টল্‌মোন ও তাদের সংগীরা। এরা একশো বাহাত্তর জন লোক দরজাগুলো পাহারা দিত। বনি-ইসরাইলদের বাকী লোকেরা, ইমামেরা ও লেবীয়রা এহুদার সমস্ত শহর ও গ্রামের মধ্যে প্রত্যেকে যে যার পূর্বপুরুষের জায়গা-জমিতে বাস করত। বায়তুল-মোকাদ্দসের খেদমতকারীরা ওফল পাহাড়ে বাস করত। তাদের দেখাশোনার ভার ছিল সীহ ও গীষ্পের উপর। জেরুজালেমে লেবীয়দের প্রধান কর্মচারী ছিলেন বানির ছেলে উষি। বানির পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হশবিয়, মত্তনীয়, মিকাহ্‌ ও আসফ। আসফের বংশের লোকেরা কাওয়াল হিসাবে আল্লাহ্‌র ঘরে এবাদত-কাজ করতেন। বাদশাহ্‌র হুকুমের অধীনে ছিলেন এই কাওয়ালেরা। সেই হুকুম দ্বারাই তাঁদের প্রতিদিনকার কাজ ঠিক করা হত। লোকদের সমস্ত বিষয়ে বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতা ছিলেন মশেষবেলের ছেলে পথাহিয়। মশেষবেলের পূর্বপুরুষ ছিলেন সেরহ ও এহুদা। এহুদা-গোষ্ঠীর লোকেরা যে সব গ্রাম ও সেগুলোর ক্ষেত-খামারগুলোতে বাস করত তা হল কিরিয়ৎ-অর্ব ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, দীবোন ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, যিকব্‌-সেল ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, ইউসা, মোলাদা, বৈৎ-পেলট, হৎসর-শুয়াল, বের্‌-শেবা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, সিক্লগ, মকোনা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, ঐন্‌-রিম্মোন, সরা, যর্মূত, সানোহ, অদুল্লম ও সেগুলোর আশেপাশের গ্রামগুলো, লাখীশ ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো এবং অসেকা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো। তারা বের্‌-শেবা থেকে শুরু করে হিন্নোম উপত্যকা পর্যন্ত সমস্ত জায়গায় বাস করত। বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোকেরা যে সব গ্রামে বাস করত সেগুলো হল গেবা, মিক্‌মস, অয়া, বেথেল ও তার আশেপাশের গ্রামগুলো, অনাথোৎ, নোব, অননিয়া, এছাড়া কিছু লেবীয়, যারা আগে এহুদা-এলাকায় বাস করত, তারা বিন্‌ইয়ামীন্তএলাকায় গিয়ে বাস করতে লাগল। যে সব ইমাম ও লেবীয়রা শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল ও ইউসার সংগে বন্দীদশা থেকে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা হলেন: ইমামদের মধ্যে সরায়, ইয়ারমিয়া, উযায়ের, অমরিয়, মল্লুক, হটুশ, শখনিয়, রহূম, মরেমোৎ, সল্লূ, আমোক, হিল্কিয় ও যিদয়িয়। ইউসার সময়ে এঁরা ছিলেন ইমামদের ও তাঁদের বংশের লোকদের মধ্যে প্রধান। লেবীয়দের মধ্যে ইউসা, বিনুয়ী, কদ্‌মীয়েল, শেরেবিয়, এহুদা, ও মত্তনিয়। শুকরিয়া কাওয়ালীর তদারকির ভার ছিল এই মত্তনিয় ও তাঁর বংশের লোকদের উপর। এবাদত-কাজের সময় তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতেন তাদেরই বংশের বক্‌বুকিয় ও উন্নো। ইউসার ছেলের নাম যোয়াকীম, যোয়াকীমের ছেলের নাম ইলিয়াশীব, ইলিয়াশীবের ছেলের নাম যোয়াদা; যোয়াদার ছেলের নাম যোনাথন আর যোনাথনের ছেলের নাম যদ্দূয়। যোয়াকীমের সময়ে ইমাম-বংশগুলোর মধ্যে যাঁরা প্রধান ছিলেন তাঁরা হলেন সরায়ের বংশের মরায়, ইয়ারমিয়ার বংশের হনানিয়, উযায়েরের বংশের মশুল্লম, অমরিয়ের বংশের যিহোহানন, মল্লূকীর বংশের যোনাথন, শবনিয়ের বংশের ইউসুফ, হারীমের বংশের অদ্‌ন, মরায়োতের বংশের হিল্কয় ইদ্দোর বংশের জাকারিয়া, গিন্নথোনের বংশের মশুল্লম, অবিয়ের বংশের সিখ্রি, মিনিয়ামীনের বংশের একজন, মোয়দিয়ের বংশের পিল্টয়, বিল্‌গার বংশের সম্মুয়, শময়িয়ের বংশের যিহোনাথন, যোয়ারীবের বংশের মত্তনয়, যিদয়িয়ের বংশের উষি, সল্লয়ের বংশের কল্লয়, আমোকের বংশের আবের, হিল্কিয়ের বংশের হশবিয়, যিদয়িয়ের বংশের নথনেল। ইলিয়াশীব, যোয়াদা, যোহানন, ও যদ্দূয়ের জীবনকালে লেবীয়দের এবং ইমামদের বংশের প্রধানদের নাম তালিকায় লেখা হচ্ছিল, আর তা শেষ হয়েছিল পারস্যের বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বকালে। লেবির বংশের প্রধানদের নাম ইলিয়াশীবের ছেলে যোহাননের সময় পর্যন্ত খান্দাননামা নামে কিতাবের মধ্যে লেখা হয়েছিল। লেবীয়দের নেতা হশবিয়, শেরেবিয়, কদ্‌মীয়েলের ছেলে ইউসা ও তাঁদের বংশের লোকেরা আল্লাহ্‌র বান্দা দাউদের কথামতই অন্য দলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দলের পর দল আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতেন ও শুকরিয়া জানাতেন। মত্তনিয়, বক্‌বুকিয়, ওবদিয়, মশূল্লম, টল্‌মোন ও অক্কুব ছিল রক্ষী। এরা দরজার কাছের ভাণ্ডার-ঘরগুলো পাহারা দিত। ইউসার ছেলে, অর্থাৎ যোষাদকের নাতি যোয়াকীম ও শাসনকর্তা নহিমিয়া এবং ইমাম ও আলেম উযায়েরের সময়ে এরা পাহারা দিত। জেরুজালেমের দেয়াল আল্লাহ্‌র উদ্দেশে উৎসর্গের অনুষ্ঠানের সময়ে লেবীয়রা যেখানে বাস করত সেখান থেকে তাদের জেরুজালেমে আনা হল যাতে তারা করতাল, বীণা, ও সুরবাহার বাজিয়ে ও শুকরিয়া-কাওয়ালী গেয়ে আনন্দের সংগে সেই অনুষ্ঠান পালন করতে পারে। ইমাম ও লেবীয়রা নিজেদের পাক-সাফ করলেন এবং লোকদেরও পাক-সাফ করলেন; পরে দরজাগুলো ও দেয়াল পাক-সাফ করলেন। তারপর আমি এহুদার নেতাদের সেই দেয়ালের উপরে নিয়ে গেলাম এবং শুকরিয়া জানাবার জন্য দু’টা বড় কাওয়ালীর দল নিযুক্ত করলাম। একটা দল দেয়ালের উপর দিয়ে ডান দিকে সার-দরজার দিকে গেল। তাদের পিছনে গেল হোশয়িয় ও এহুদার নেতাদের অর্ধেক লোক। তাঁদের সংগে গেলেন অসরিয়, উযায়ের, মশুল্লম, ঝর্ণা-দরজার কাছে যেখানে দেয়াল উপরের দিকে উঠে গেছে সেখানে তাঁরা সোজা দাউদ-শহরে উঠবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে দাউদের বাড়ীর পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে পানি-দরজায় গেলেন। দ্বিতীয় কাওয়ালীর দলটা উল্টা দিকে এগিয়ে গেল। আমি বাকী অর্ধেক লোক নিয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে তাদের পিছনে পিছনে গেলাম। তারা তন্দুর-কেল্লা পার হয়ে চওড়া দেয়াল পর্যন্ত গেল। তারপর আফরাহীম-দরজা, যিশানা-দরজা, মাছ-দরজা, হননেলের কেল্লা ও হম্মেয়ার কেল্লার পাশ দিয়ে মেষ-দরজা পর্যন্ত গেল। তারপর পাহারাদার-দরজার কাছে গিয়ে তারা থামল। যে দু’টি কাওয়ালীর দল শুকরিয়া জানিয়েছিল তারা তারপর আল্লাহ্‌র ঘরের মধ্যে তাদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। আমিও তা-ই করলাম আর আমার সংগে রইলেন উঁচু পদের কর্মচারীদের মধ্য থেকে অর্ধেক লোক। ইলীয়াকীম, মাসেয়, মিনিয়ামীন, মিকায়, ইলিয়ৈনয়, জাকারিয়া ও হনানিয় নামে ইমামেরা তাঁদের শিংগা নিয়ে আমার সংগে রইলেন। এছাড়া রইলেন মাসেয়, শময়িয়, ইলিয়াসর, উষি, যিহোহানন, মল্কিয়, ইলাম ও এষর। কাওয়ালীর দলের লোকেরা যিষ্রহিয়ের নির্দেশ মত কাওয়ালী গাইল। আল্লাহ্‌ তাদের প্রচুর আনন্দ দান করেছেন বলে সেই দিন লোকেরা বড় একটা কোরবানী দিল ও খুব আনন্দ করল। তাদের স্ত্রীলোকেরা ও ছেলেমেয়েরাও আনন্দ করল। জেরুজালেমের লোকদের এই আনন্দের আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত শোনা গেল। ভাণ্ডার-ঘরে যে সব দান, প্রথমে তোলা ফসল ও দশমাংশ আনা হত তার তদারকির জন্য সেই সময় লোকদের নিযুক্ত করা হল। তারা গ্রামগুলোর আশেপাশের ক্ষেত থেকে শরীয়ত অনুসারে ইমাম ও লেবীয়দের জন্য লোকদের কাছ থেকে ফসলের অংশ নিয়ে আসত। এহুদার লোকেরা খুশী মনে দিত, কারণ খেদমতকারী ইমাম ও লেবীয়দের কাজে তারা সন্তুষ্ট ছিল। দাউদ ও তাঁর ছেলে সোলায়মানের হুকুম অনুসারে ইমাম ও লেবীয়রা তাঁদের আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ ও পাক-সাফ করবার কাজ করতেন আর কাওয়াল ও রক্ষীরাও তাদের নির্দিষ্ট কাজ করত। অনেক কাল আগে দাউদ ও আসফের সময়ে আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্র্রশংসা ও শুকরিয়ার কাওয়ালী গাইবার জন্য কাওয়ালদের ও পরিচালকদের নিযুক্ত করা হয়েছিল। সরুব্বাবিল ও নহিমিয়ার সময়েও বনি-ইসরাইলরা সকলেই কাওয়াল ও রক্ষীদের প্রতিদিনের পাওনা অংশ দিত। এছাড়া তারা অন্যান্য লেবীয়দের পাওনা অংশও আলাদা করে রাখত আর লেবীয়রা আলাদা করে রাখত হারুনের বংশধরদের পাওনা অংশ। পরে যখন লোকদের কাছে মূসার কিতাবটি তেলাওয়াত করা হল তখন সেখানে দেখা গেল লেখা আছে, কোন অম্মোনীয় বা মোয়াবীয় আল্লাহ্‌র বান্দাদের সমাজে কখনও যোগ দিতে পারবে না। এর কারণ হল, মূসার সময়ে তারা খাবার ও পানি নিয়ে বনি-ইসরাইলদের কাছে যায় নি, বরং তারা তাদের বদদোয়া দেবার জন্য বালামকে ভাড়া করেছিল। কিন্তু আমাদের আল্লাহ্‌ সেই বদদোয়ার বদলে দোয়া করেছিলেন। লোকেরা তৌরাত কিতাবের এই কথা শুনে বিদেশীদের বংশধরদের সবাইকে বনি-ইসরাইলদের সমাজ থেকে বাদ দিয়ে দিল। কিন্তু এই সব যখন হচ্ছিল তখন আমি জেরুজালেমে ছিলাম না, কারণ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ আর্টা-জারেক্সেসের বত্রিশ বছর রাজত্বের সময়ে আমি বাদশাহ্‌র কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। এর কিছুদিন পরে আমি বাদশাহ্‌র অনুমতি নিয়ে জেরুজালেমে ফিরে আসলাম। আল্লাহ্‌র ঘরে টোবিয়কে একটা কামরা দিয়ে ইলিয়াশীব যে খারাপ কাজ করেছেন আমি জেরুজালেমে ফিরে এসে সেই বিষয় শুনলাম। এতে আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে টোবিয়ের সব জিনিসপত্র সেই কামরা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। তারপর আমার হুকুমে সেই ঘরগুলো পাক-সাফ করা হল আর আমি আল্লাহ্‌র ঘরের জিনিসপত্র, শস্য-কোরবানীর জিনিস আর ধূপ আবার সেখানে এনে রাখলাম। আমি এও জানতে পারলাম যে, কাওয়ালদের ও অন্যান্য লেবীয়দের পাওনা অংশ দেওয়া হয় নি বলে তারা তাদের এবাদত-কাজ ছেড়ে নিজের নিজের ক্ষেত-খামারে ফিরে গেছে। এতে আমি উঁচু পদের কর্মচারীদের বকুনি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আল্লাহ্‌র ঘরের কাজের জন্য যা দরকার তা দিতে কেন অবহেলা করা হয়েছে?” তারপর আমি সেই সব লেবীয়দের ডেকে একত্র করে তাদের নিজের নিজের পদে বহাল করলাম। তারপর এহুদার সব লোক তাদের শস্যের, নতুন আংগুর-রসের ও তেলের দশমাংশ ভাণ্ডার-ঘরে নিয়ে আসল। ইমাম শেলিমিয়া, আলেম সাদোক ও পদায় নামে একজন লেবীয়কে আমি ভাণ্ডার-ঘরের ভার দিলাম এবং সক্কুরের ছেলে, অর্থাৎ মত্তনিয়ের নাতি হাননকে তাঁদের সাহায্যকারী হিসাবে নিযুক্ত করলাম। সবাই এই লোকদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করত। তাঁদের উপর তাঁদের গোষ্ঠী-ভাইদের অংশ ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হল। হে আমার আল্লাহ্‌, এই সব কাজের জন্য আমাকে মনে রেখো। আমার আল্লাহ্‌র ঘর ও সেই ঘরের এবাদত-কাজের জন্য আমি বিশ্বস্তভাবে যা করেছি তা মুছে ফেলে দিয়ো না। ঐ সময় আমি দেখলাম এহুদার লোকেরা বিশ্রামবারে আংগুর-মাড়াইয়ের কাজ করছে ও ফসল আনছে এবং সেই ফসল, আংগুর-রস, আংগুর, ডুমুর এবং অন্য সব রকমের বোঝা তারা গাধার উপর চাপাচ্ছে। এছাড়া তারা বিশ্রামবারে ঐ সব জেরুজালেমে নিয়ে আসছে। কাজেই বিশ্রামবারে খাবার জিনিস বিক্রি করবার বিষয়ে আমি তাদের সাবধান করলাম। জেরুজালেমে বাসকারী টায়ারের লোকেরা মাছ আর বিক্রি করবার অন্যান্য সব জিনিস এনে বিশ্রামবারে জেরুজালেমে এহুদার লোকদের কাছে বিক্রি করছিল। আমি তখন এহুদার গণ্যমান্য লোকদের বকুনি দিয়ে বললাম, “আপনারা এ কি করছেন? আপনারা তো এই অন্যায় কাজ করে বিশ্রামবারের পবিত্রতা নষ্ট করছেন। আপনাদের পূর্বপুরুষেরা কি সেই একই কাজ করেন নি, যার দরুন আমাদের আল্লাহ্‌ আমাদের উপর ও এই শহরের উপর এই সব সর্বনাশ ঘটিয়েছেন? আর এখন আপনারা বিশ্রামবারের পবিত্রতা নষ্ট করে বনি-ইসরাইলদের উপর আল্লাহ্‌র আরও রাগ বাড়িয়ে তুলছেন।” আমি এই হুকুম দিলাম যে, বিশ্রামবারের শুরুতে যখন জেরুজালেমের দরজাগুলোর উপর সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসবে তখন যেন দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং বিশ্রামবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ রাখা হয়। বিশ্রামবারে যাতে কোন বোঝা ভিতরে আনা না হয় তা দেখবার জন্য আমি আমার নিজের কয়েকজন কর্মচারীকে দরজাগুলোতে নিযুক্ত করলাম। এতে ব্যবসায়ীরা ও যারা সব রকম জিনিস বিক্রি করে তারা দু’-এক বার জেরুজালেমের বাইরে রাত কাটাল। কিন্তু আমি তাদের সাবধান করে দিয়ে বললাম, “তোমরা দেয়ালের কাছে কেন রাত কাটা"ছ? তোমরা যদি আবার এই কাজ কর তবে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।” সেই থেকে তারা আর বিশ্রামবারে আসত না। তারপর আমি লেবীয়দের হুকুম দিলাম যেন তারা নিজেদের পাক-সাফ করে এবং বিশ্রামবার পবিত্র রাখবার জন্য গিয়ে দরজাগুলো পাহারা দেয়। হে আমার আল্লাহ্‌, এর জন্যও তুমি আমাকে মনে রেখো এবং তোমার অটল মহব্বত অনুসারে আমাকে রহমত দান কর। সেই সময় আমি এও দেখলাম যে, এহুদার কোন কোন লোক অস্‌দোদ, অম্মোন ও মোয়াবের মেয়েদের বিয়ে করেছে। তাদের মধ্যে অনেক ছেলেমেয়ে অস্‌দোদের কিংবা অন্যান্য জাতির ভাষায় কথা বলে। তারা এহুদার ভাষায় কথা বলতে জানে না। আমি তাদের বকুনি দিলাম আর বললাম তাদের উপর যেন বদদোয়া নেমে আসে। তাদের কয়েকজন লোককে আমি মারলাম এবং চুল উপড়ে ফেললাম। আল্লাহ্‌র নামে আমি তাদের দিয়ে এই কসম খাওয়ালাম যে, তারা বিদেশী ছেলেদের সংগে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেবে না এবং নিজেরা বা তাদের ছেলেরা বিদেশী মেয়েদের বিয়ে করবে না। তারপর আমি তাদের বললাম, “ইসরাইলের বাদশাহ্‌ সোলায়মান এই রকম বিয়ে করবার দরুন গুনাহ্‌ করেছিলেন। অন্য কোন জাতির মধ্যে তাঁর মত বাদশাহ্‌ কেউ-ই ছিলেন না এবং আল্লাহ্‌ তাঁকে মহব্বত করতেন আর তাঁকে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের উপর বাদশাহ্‌ করেছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি বিদেশী স্ত্রীলোকদের দরুন গুনাহ্‌ করেছিলেন। এখন আমাদের কি এই কথাই শুনতে হবে যে, তোমরাও এই সব ভীষণ দুষ্টতার কাজ করেছ, অর্থাৎ বিদেশী স্ত্রীলোকদের বিয়ে করে আমাদের আল্লাহ্‌র প্রতি বেঈমানী করেছ?” প্রধান ইমাম ইলিয়াশীবের ছেলে যিহোয়াদার এক ছেলে হোরোণীয় সন্‌বল্লটের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সেইজন্য আমি সেই ছেলেকে আমার কাছ থেকে তাড়িয়ে দিলাম। হে আমার আল্লাহ্‌, এদের কথা মনে রেখো, কারণ এরা ইমামের পদ নাপাক করেছে এবং ইমাম ও লেবীয়দের কাজের চুক্তি ভেংগেছে। এইভাবে আমি সকলের মধ্য থেকে বিদেশীয় সব কিছু দূর করে দিলাম। পরে ইমাম ও লেবীয়দের কাজ অনুসারে তাদের প্রত্যেকের কাজ ভাগ করে দিলাম। এছাড়া সময় মত কাঠ ও প্রথমে তোলা ফসল আনবার জন্যও আমি ব্যবস্থা করলাম। হে আমার আল্লাহ্‌, আমার উপকার করবার জন্য আমাকে স্মরণ কোরো। তাঁর রাজত্বের তৃতীয় বছরে তিনি তাঁর সব উঁচু পদের লোকদের ও কর্মকর্তাদের জন্য একটা মেজবানী দিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পারস্য ও মিডিয়া দেশের সেনাপতিরা, গণ্যমান্য লোকেরা ও বিভাগগুলোর উঁচু পদের কর্মচারীরা। তিনি দীর্ঘ ছয় মাস ধরে তাঁর রাজ্যের প্রচুর ধন-সম্পদ ও বাদশাহ্‌ হিসাবে তাঁর জাঁকজমক তাঁদের দেখালেন। এই দিনগুলো শেষ হয়ে যাবার পর তিনি সুসার কেল্লায় উপস্থিত উঁচু-নীচু পদের সকলের জন্য সাত দিন ধরে রাজবাড়ীর বাগানের উঠানে একটা মেজবানী দিলেন। সেই বাগান সাজাবার জন্য সাদা ও নীল কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছিল। সেগুলো সাদা ও বেগুনে মসীনা সুতার দড়ি দিয়ে রূপার কড়াতে মার্বেল পাথরের থামে আটকানো ছিল। মার্বেল পাথর, ঝিনুক এবং নানা রংয়ের অন্যান্য দামী পাথরের কাজ করা মেঝের উপরে সোনা ও রূপার আসন ছিল। সমস্ত পানীয় নানা রকমের সোনার পাত্রে দেওয়া হচ্ছিল। বাদশাহ্‌র মন বড় ছিল বলে রাজবাড়ীতে আংগুর-রস ছিল পরিমাণে প্রচুর। বাদশাহ্‌র হুকুমে দাওয়াতী প্রত্যেকজনকে নিজের ইচ্ছামত তা খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কারণ প্রত্যেকে যেমন চায় বাদশাহ্‌ সেইভাবে পরিবেশন করবার জন্য রাজবাড়ীর সব চাকরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের রাজবাড়ীতে রাণী বষ্টীও মহিলাদের জন্য একটা মেজবানী দিলেন। বাদশাহ্‌র সেবাকারীরা বাদশাহ্‌র হুকুম রাণীকে জানালে পর রাণী বষ্টী আসতে রাজী হলেন না। এতে বাদশাহ্‌ ভীষণ রেগে আগুন হয়ে গেলেন। আইন ও বিচার সম্বন্ধে দক্ষ লোকদের সংগে বাদশাহ্‌র পরামর্শ করবার নিয়ম ছিল বলে তিনি সেই পরামর্শদাতাদের সংগে এই বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সেই সব পরামর্শদাতাদের মধ্যে কর্শনা, শেথর, অদ্‌মাথা, তর্শীশ, মেরস, মর্সনা ও মমূখনের উপরে বাদশাহ্‌ বেশী ভরসা করতেন। বাদশাহ্‌র সামনে পারস্য ও মিডিয়া দেশের এই সাতজন উঁচু পদের কর্মচারীদের উপস্থিত হবার অধিকার ছিল এবং রাজ্যের মধ্যে সব চেয়ে বড় স্থান ছিল তাঁদের। বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “আইন অনুসারে রাণী বষ্টীর প্রতি কি করা উচিত? তাঁর সেবাকারীদের দ্বারা বাদশাহ্‌ জারেক্সেস যে হুকুম রাণীকে পাঠিয়েছিলেন তা তিনি পালন করেন নি।” বাদশাহ্‌ ও উঁচু পদের কর্মচারীদের সামনে মমূখন জবাবে বললেন, “রাণী বষ্টী যে কেবল বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে অন্যায় করেছেন তা নয়, কিন্তু বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের সমস্ত উঁচু পদের কর্মচারী ও সমস্ত বিভাগের সমস্ত লোকদের বিরুদ্ধে অন্যায় করেছেন। রাণীর এই রকম ব্যবহারের কথা সমস্ত স্ত্রীলোকদের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে এবং তারা তাদের স্বামীদের তুচ্ছ করে বলবে, ‘বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের সামনে যাবার জন্য হুকুম পেয়েও রাণী বষ্টী তাঁর সামনে যান নি।’ পারস্য ও মিডিয়ার সম্মানিতা স্ত্রীলোকেরা রাণীর এই ব্যবহারের কথা শুনে আজই তাঁদের স্বামীদের সংগে একই রকম ব্যবহার করবেন। এতে অসম্মান ও ঝগড়া-বিবাদ বেড়ে যাবে। কাজেই যদি বাদশাহ্‌র অমত না থাকে তবে তিনি যেন একটা রাজ-হুকুম দেন যে, বষ্টী আর কখনও বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের সামনে আসতে পারবেন না। এই হুকুম পারস্য ও মিডিয়ার আইনে লেখা থাকুক যেন তা বাতিল করা না যায়। এছাড়া বাদশাহ্‌ যেন বষ্টীর চেয়েও উপযুক্ত অন্য আর একজনকে রাণীর পদ দেন। বাদশাহ্‌র এই হুকুম যখন তাঁর বিরাট রাজ্যের সব জায়গায় ঘোষণা করা হবে তখন সাধারণ থেকে সম্মানিতা সমস্ত স্ত্রীলোকেরা তাদের স্বামীদের সম্মান করবে।” এই পরামর্শ বাদশাহ্‌ ও তাঁর উঁচু পদের কর্মচারীদের ভাল লাগল। বাদশাহ্‌ সেইজন্য মমূখনের কথামত কাজ করলেন। তিনি তাঁর রাজ্যের সব জায়গায় প্রত্যেকটি বিভাগের অক্ষর ও প্রত্যেকটি জাতির ভাষা অনুসারে চিঠি পাঠিয়ে দিলেন যে, প্রত্যেকটি পুরুষ তার নিজের বাড়ীর কর্তা হোক এবং তার পরিবারে তার নিজের ভাষা ব্যবহার করুক। পরে বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের রাগ পড়ে গেলে পর তিনি বষ্টীর কথা, অর্থাৎ বষ্টী যা করেছিলেন এবং তাঁর বিষয়ে যে হুকুম দেওয়া হয়েছিল তা চিন্তা করলেন। তখন বাদশাহ্‌র নিজের কর্মচারীরা বলল, “মহারাজের জন্য সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়েদের তালাশ করা হোক। মহারাজ তাঁর রাজ্যের সমস্ত বিভাগে কর্মচারী নিযুক্ত করুন যাতে তারা সেই সব সুন্দরী মেয়েদের সুসার কেল্লায় রাজবাড়ীর হারেমে পাঠিয়ে দিতে পারে। মহারাজ হেগয় নামে যে খোজার হাতে স্ত্রীলোকদের ভার দিয়েছেন সে এই সব মেয়েদের তদারক করুক। তাদের সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য যা লাগে তা দেওয়া হোক। তারপর মহারাজের যাঁকে ভাল লাগবে তিনিই বষ্টীর জায়গায় রাণী হবেন।” এই পরামর্শ বাদশাহ্‌র কাছে ভাল লাগল। তিনি সেইমতই কাজ করলেন। সেই সময় মর্দখয় নামে বিন্যামীন-গোষ্ঠীর একজন ইহুদী সুসার কেল্লায় ছিলেন। তিনি ছিলেন যায়ীরের ছেলে, যায়ীর শিমিয়ির ছেলে এবং শিমিয়ি কীশের ছেলে। এহুদার বাদশাহ্‌ যিকনিয়ের, অর্থাৎ যিহোয়াখীনের সংগে যে সব লোককে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার জেরুজালেম থেকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিলেন মর্দখয়ের পূর্বপুরুষ তাঁদের মধ্যে ছিলেন। মর্দখয়ের চাচার হদসা নামে একজন মেয়ে ছিল। মেয়েটির মা-বাপ ছিল না বলে মর্দখয় তাকে লালন-পালন করেছিলেন। এই মেয়েটি, যাঁকে ইষ্টেরও বলা হত, তিনি শরীরের গড়নে ও চেহারায় সুন্দরী ছিলেন। মেয়েটির মা-বাবা মারা গেলে পর মর্দখয় তাঁকে নিজের মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। বাদশাহ্‌র হুকুম ও নির্দেশ ঘোষণা করা হলে পর অনেক মেয়েকে সুসার কেল্লায় নিয়ে এসে হেগয়ের তদারকির অধীনে রাখা হল। ইষ্টেরকেও রাজবাড়ীতে নিয়ে গিয়ে হেগয়ের কাছে রাখা হল। মেয়েটিকে হেগয়ের খুব ভাল লাগল এবং হেগয়ের কাছ থেকে মেয়েটি ভাল ব্যবহার পেলেন। হেগয় প্রথম থেকেই তাঁকে সৌন্দর্য বাড়াবার জিনিসপত্র দিল এবং বিশেষ খাবার দিল। সে রাজবাড়ী থেকে বেছে সাতজন বাঁদী তাঁর জন্য নিযুক্ত করল এবং হারেমের সবচেয়ে ভাল জায়গায় তাঁকে ও তাঁর বাঁদীদের রাখল। ইষ্টের তাঁর জাতি ও বংশের পরিচয় দিলেন না, কারণ মর্দখয় তাঁকে নিষেধ করেছিলেন। ইষ্টের কেমন আছেন ও তাঁর কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানবার জন্য মর্দখয় প্রতিদিন হারেমের উঠানের সামনে ঘোরাফেরা করতেন। বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের কাছে কোন মেয়ের যাবার পালা আসবার আগে এক বছর ধরে তাকে মেয়েদের জন্য সৌন্দর্য বাড়াবার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হত। তাকে ছয় মাস গন্ধরসের তেল ও ছয় মাস খোশবু ও সাজবার জিনিস ব্যবহার করতে হত। কোন মেয়ের বাদশাহ্‌র কাছে যাবার সময় হলে হারেম থেকে বাদশাহ্‌র সামনে নিয়ে যাবার জন্য সে যা চাইত তাকে তা-ই দেওয়া হত। সন্ধ্যাবেলায় সে সেখানে যেত এবং সকালবেলায় উপস্ত্রীদের ভার-পাওয়া বাদশাহ্‌র নিযুক্ত খোজা শাশ্‌গসের তদারকির অধীনে হারেমের অন্য অংশে ফিরে আসত। বাদশাহ্‌ তার উপর খুশী হয়ে নাম ধরে ডেকে না পাঠালে সে আর বাদশাহ্‌র কাছে যেতে পারত না। মর্দখয় তাঁর চাচা অবীহয়িলের যে মেয়েটিকে নিজের মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন সেই মেয়েটির, অর্থাৎ ইষ্টেরের যখন বাদশাহ্‌র কাছে যাবার পালা আসল তখন হারেমের তদারককারী বাদশাহ্‌র নিযুক্ত খোজা হেগয় তাঁকে যা নিতে বলল তা ছাড়া তিনি আর কিছুই চাইলেন না। যে কেউ ইষ্টেরকে দেখত তার চোখে তাঁকে ভাল লাগত। বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের রাজত্বের সাত বছরের দশম মাসে, অর্থাৎ টেবেৎ মাসে ইষ্টেরকে রাজবাড়ীতে বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে যাওয়া হল। অন্যান্য স্ত্রীলোকদের চেয়ে ইষ্টেরকে বাদশাহ্‌ বেশী ভালবাসলেন এবং তিনি অন্যান্য অবিবাহিতা মেয়েদের চেয়ে বাদশাহ্‌র কাছে বেশী দয়া ও ভালবাসা পেলেন। কাজেই বাদশাহ্‌ তাঁর মাথায় তাজ পরিয়ে দিলেন এবং বষ্টীর জায়গায় ইষ্টেরকে রাণী করলেন। তারপর বাদশাহ্‌ তাঁর উঁচু পদের লোকদের ও তাঁর কর্মকর্তাদের জন্য ইষ্টেরের মেজবানী নামে একটা বড় মেজবানী দিলেন। তিনি সব বিভাগের জন্য ছুটি ঘোষণা করে দিলেন এবং খোলা হাতে অনেক দান করলেন। দ্বিতীয়বার অবিবাহিতা মেয়েদের যোগাড় করবার সময় মর্দখয় রাজবাড়ীর দরজায় বসবার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইষ্টের মর্দখয়ের কথামত তাঁর বংশের পরিচয় এবং জাতির কথা গোপন রেখেছিলেন। ইষ্টের মর্দখয়ের কাছে লালিত-পালিত হবার সময় যেমন মর্দখয়ের কথামত চলতেন তখনও তিনি তেমনই চলছিলেন। মর্দখয় রাজবাড়ীর দরজায় নিযুক্ত থাকবার সময় একদিন রাজবাড়ীর দারোয়ানদের মধ্যে বিগ্‌থন ও তেরশ নামে বাদশাহ্‌র দু’জন কর্মচারী রাগ করে বাদশাহ্‌ জারেক্সেসকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করল। মর্দখয় ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে রাণী ইষ্টেরকে সেই কথা জানালেন। রাণী মর্দখয়ের নাম করে তা বাদশাহ্‌কে জানালেন। সেই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে যখন জানা গেল কথাটা সত্যি তখন সেই দু’জন কর্মচারীকে ফাঁসি দেওয়া হল। এই সব কথা বাদশাহ্‌র সামনেই ইতিহাস বইতে লেখা হল। এই সব ঘটনার পরে বাদশাহ্‌ জারেক্সেস অগাগীয় হম্মদাথার ছেলে হামানকে রাজ্যের অন্যান্য কর্মকর্তাদের চেয়ে উঁচু পদ দিয়ে সম্মানিত করলেন। রাজবাড়ীর দরজায় থাকা কর্মচারীরা হাঁটু পেতে হামানকে সম্মান দেখাত, কারণ বাদশাহ্‌ তার সম্বন্ধে সেই রকমই হুকুম দিয়েছিলেন। কিন্তু মর্দখয় হাঁটুও পাততেন না কিংবা তাকে সম্মানও দেখাতেন না। এতে রাজবাড়ীর দরজার কর্মচারীরা মর্দখয়কে বলল, “বাদশাহ্‌র হুকুম তুমি অমান্য কর কেন?” দিনের পর দিন তারা তাঁকে বললেও তিনি তা মানতে রাজী হলেন না। কাজেই তারা হামানকে সেই কথা জানাল। তারা দেখতে চাইল মর্দখয়ের এই ব্যবহার গ্রাহ্য করা হবে কি না, কারণ তিনি যে একজন ইহুদী সেই কথা তিনি তাদের বলেছিলেন। মর্দখয় হাঁটুও পাতেন না এবং তাকে সম্মানও দেখান না জানতে পেরে হামান খুব রেগে গেল। কিন্তু মর্দখয়ের জাতি সম্বন্ধে জানতে পেরে কেবল মর্দখয়কে হত্যা করা একটা সামান্য বিষয় বলে সে মনে করল। এর বদলে সে একটা উপায় খুঁজতে লাগল যাতে জারেক্সেসের গোটা রাজ্যের মধ্য থেকে মর্দখয়ের লোকদের, অর্থাৎ ইহুদীদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের রাজত্বের বারো বছরের প্রথম মাসে, অর্থাৎ নীষণ মাসে একটা দিন ও মাস বেছে নেবার জন্য লোকেরা হামানের সামনে পূর, অর্থাৎ গুলিবাঁট করতে লাগল। তাতে বারো মাসের, অর্থাৎ অদর মাসের বেলায় গুলিবাঁটে উঠল। হামান তখন বাদশাহ্‌ জারেক্সেসকে বলল, “আপনার রাজ্যের সমস্ত বিভাগের বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটা জাতি ছড়িয়ে রয়েছে। অন্য সব জাতি থেকে তাদের নিয়ম-কানুন আলাদা এবং তারা বাদশাহ্‌র আইন মানে না। কাজেই তাদের বাঁচতে দেওয়া বাদশাহ্‌র পক্ষে ভাল হবে না। বাদশাহ্‌র যদি ভাল মনে হয় তবে তাদের ধ্বংস করে ফেলবার জন্য একটা হুকুম জারি করা হোক। তাতে রাজ-ভাণ্ডারে রাখবার জন্য বাদশাহ্‌র কাজ পরিচালনাকারীদের হাতে আমি তিনশো নব্বই টন রূপা দেব।” বাদশাহ্‌ তখন নিজের আংগুল থেকে স্বাক্ষর দেবার আংটি খুলে নিয়ে ইহুদীদের শত্রু অগাগীয় হম্মদাথার ছেলে হামানকে দিলেন। বাদশাহ্‌ হামানকে বললেন, “টাকাও তোমার আর লোকেরাও তোমার; কাজেই সেই টাকা ও লোকদের নিয়ে তোমার যা ভাল মনে হয় তা-ই কর।” তারপর প্রথম মাসের তেরো দিনের দিন বাদশাহ্‌র লেখকদের ডাকা হল। তারা প্রত্যেকটি বিভাগের অক্ষর ও প্রত্যেকটি জাতির ভাষা অনুসারে হামানের সমস্ত হুকুম বিভিন্ন প্রদেশের ও বিভাগের শাসনকর্তাদের এবং বিভিন্ন জাতির নেতাদের কাছে লিখে জানাল। সেগুলো বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের নামে লেখা হল এবং বাদশাহ্‌র নিজের আংটি দিয়ে সীলমোহর করা হল। বাদশাহ্‌র সমস্ত বিভাগগুলোতে সংবাদ বাহকদের দিয়ে চিঠি পাঠানো হল। সেই চিঠিতে হুকুম দেওয়া হল যেন অদর নামে বারো মাসের তেরো দিনের দিন ইহুদীদের সমস্ত ছেলে-বুড়ো-শিশু-স্ত্রীলোককে, অর্থাৎ সবাইকে ধ্বংস করা হয়, অর্থাৎ হত্যা করা হয়, অর্থাৎ একেবারে শেষ করে দেওয়া হয়। এছাড়া তাদের জিনিসপত্র যেন লুট করা হয়। আইন হিসাবে সেই হুকুমের নকল প্রত্যেকটি বিভাগে পাঠিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের জানানো হল যাতে সেই দিনের জন্য তারা প্রস্তুত হয়। বাদশাহ্‌র হুকুম পেয়ে সংবাদ বাহকেরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল এবং সুসার কেল্লায়ও সেই হুকুম প্রচার করা হল। তারপর বাদশাহ্‌ ও হামান আংগুর-রস খেতে বসলেন আর এদিকে সুসা শহরের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। সমস্ত খবরাখবর জানতে পেরে মর্দখয় পরনের কাপড় ছিঁড়ে চট পরলেন ও ছাই মেখে শহরের মধ্যে গিয়ে জোরে জোরে খুব কাঁদতে লাগলেন। এইভাবে তিনি রাজবাড়ীর দরজা পর্যন্ত গেলেন কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারলেন না, কারণ চট পরে কারও ভিতরে ঢুকবার হুকুম ছিল না। প্রত্যেকটি বিভাগে যেখানে বাদশাহ্‌র ডিক্রি ও হুকুম পৌঁছাল সেখানে ইহুদীদের মধ্যে মহাশোক, রোজা রাখা, কান্নাকাটি ও বিলাপ হতে লাগল। অনেকে চট পরে ছাইয়ের মধ্যে শুয়ে পড়ল। ইষ্টেরের বাঁদীরা ও খোজারা এসে যখন তাঁকে মর্দখয়ের খবর দিল তখন তাঁর মনে খুব বেশী দুঃখ হল। চটের বদলে পরবার জন্য তিনি মর্দখয়কে কাপড় পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু তিনি তা নিলেন না। তখন ইষ্টের বাদশাহ্‌র নিযুক্ত তাঁর সেবাকারী খোজা হথককে ডেকে পাঠালেন ও মর্দখয়ের কি হয়েছে এবং কেন হয়েছে তা তাঁর কাছ থেকে জেনে আসবার জন্য হুকুম দিলেন। তখন হথক রাজবাড়ীর দরজার সামনে শহর-চকে মর্দখয়ের কাছে গেল। এতে মর্দখয় তাঁর প্রতি যা ঘটেছে এবং ইহুদীদের ধ্বংস করবার জন্য হামান যে পরিমাণ টাকা রাজ-ভাণ্ডারে দেবার ওয়াদা করেছে তা সব হথককে বললেন। সুসা শহরে দেওয়া ইহুদীদের ধ্বংস করবার যে রাজ-হুকুম বের হয়েছে মর্দখয় তার একটা নকল হথককে দিলেন, যাতে সে সেটা ইষ্টেরকে দেখাতে ও ব্যাপারটা বুঝাতে পারে। ইষ্টের যেন বাদশাহ্‌র সামনে গিয়ে তাঁর লোকদের জন্য মিনতি করেন সেই কথা ইষ্টেরকে বলবার জন্য মর্দখয় হথককে বললেন। হথক ফিরে গিয়ে মর্দখয় যা বলেছিলেন তা ইষ্টেরকে জানাল। তখন ইষ্টের মর্দখয়কে এই কথা বলবার জন্য হথককে নির্দেশ দিলেন, “বাদশাহ্‌র সব কর্মচারীরা এবং বাদশাহ্‌র অধীন সব বিভাগের লোকেরা জানে যে, কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক বাদশাহ্‌র ডাক না পেয়ে যদি ভিতরের দরবারে তাঁর কাছে যায় তবে তার জন্য মাত্র একটা আইনই আছে- সেটা হল তার মৃত্যু। তবে যে লোকের প্রতি বাদশাহ্‌ সোনার রাজদণ্ড বাড়িয়ে দেন কেবল তার প্রাণই বাঁচে। কিন্তু গত ত্রিশ দিনের মধ্যে বাদশাহ্‌র কাছে যাবার জন্য আমাকে ডাকা হয় নি।” ইষ্টেরের সব কথা মর্দখয়কে জানানো হল। মর্দখয় ইষ্টেরকে এই কথা বলে পাঠালেন, “এই কথা মনে কোরো না যে, বাদশাহ্‌র ঘরে আছ বলে সমস্ত ইহুদীদের মধ্যে কেবল একা তুমিই রক্ষা পাবে। কিন্তু এই সময় যদি তুমি চুপ করে থাক তবে অন্য দিক থেকে ইহুদীরা সাহায্য ও উদ্ধার পাবে, কিন্তু তুমি তো মরবেই আর তোমার বাবার বংশও শেষ হয়ে যাবে। কে জানে হয়তো এই রকম সময়ের জন্যই তুমি রাণীর পদ পেয়েছ।” তখন ইষ্টের মর্দখয়কে এই জবাব পাঠিয়ে দিলেন, “আপনি গিয়ে সুসা শহরে থাকা সমস্ত ইহুদীদের একত্র করুন এবং আমার জন্য সকলে রোজা রাখুন। আপনারা তিন দিন ধরে রাতে কি দিনে কোন কিছু খাওয়া-দাওয়া করবেন না। আপনারা যেমন রোজা রাখবেন তেমনি আমি ও আমার বাঁদীরা রোজা রাখব। তারপর যদিও তা আইনের বিরুদ্ধে হয় তবুও আমি বাদশাহ্‌র কাছে যাব। তাতে যদি আমাকে মরতে হয় আমি মরব।” এতে মর্দখয় গিয়ে ইষ্টেরের সব নির্দেশ মত কাজ করলেন। ইষ্টের তিন দিনের দিন রাণীর পোশাক পরে বাদশাহ্‌র ঘরের সামনে রাজবাড়ীর ভিতরের দরবারে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাদশাহ্‌ দরজার দিকে মুখ করে সেই ঘরের মধ্যে সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি রাণী ইষ্টেরকে দরবারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর উপর খুশী হয়ে তাঁর হাতের সোনার রাজদণ্ডটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তখন ইষ্টের এগিয়ে গিয়ে সেই রাজদণ্ডের আগাটা ছুঁলেন। বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “রাণী ইষ্টের, কি ব্যাপার? তুমি কি চাও? যদি রাজ্যের অর্ধেকটাও হয় তাও তোমাকে দেওয়া হবে।” জবাবে ইষ্টের বললেন, “মহারাজ যদি ভাল মনে করেন তবে আপনার জন্য আজ আমি যে মেজবানী প্রস্তুত করেছি তাতে মহারাজ ও হামান যেন উপস্থিত হন।” তখন বাদশাহ্‌ এই হুকুম দিলেন, “ইষ্টেরের কথামত যেন কাজ হয় সেইজন্য এখনই হামানকে নিয়ে এস।” কাজেই ইষ্টের যে মেজবানী প্রস্তুত করেছিলেন বাদশাহ্‌ ও হামান তাতে যোগ দিলেন। আংগুর-রস খেতে খেতে বাদশাহ্‌ ইষ্টেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি চাও? তোমাকে তা দেওয়া হবে। তোমার অনুরোধ কি? যদি রাজ্যের অর্দ্ধেকও হয় তাও তোমাকে দেওয়া হবে।” জবাবে ইষ্টের বললেন, “আমার অনুরোধ ও ইচ্ছা এই- মহারাজ যদি আমাকে দয়ার চোখে দেখেন ও আমার অনুরোধ রাখতে চান এবং আমার ইচ্ছা পূরণ করতে চান তবে আগামী কাল আমি যে মেজবানী প্রস্তুত করব তাতে যেন মহারাজ ও হামান আসেন। তখন আমি মহারাজের প্রশ্নের জবাব দেব।” সেই দিন হামান খুশী হয়ে আনন্দিত মনে বাইরে গেল। কিন্তু সে যখন রাজবাড়ীর দরজায় মর্দখয়কে দেখতে পেল, আর দেখল যে, মর্দখয় তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন না কিংবা আর কোন সম্মানও দেখালেন না তখন মর্দখয়ের উপর তার খুব রাগ হল। কিন্তু তবুও হামান নিজেকে দমন করে বাড়ী চলে গেল। বাড়ী গিয়ে সে তার বন্ধু-বান্ধব ও স্ত্রী সেরশকে ডেকে আনাল। তারপর সে তাদের কাছে তার ধন-সম্পদের কথা, তার ছেলেদের সংখ্যার কথা, যে সব উপায়ে বাদশাহ্‌ তাকে সম্মান দেখিয়েছেন তার কথা এবং কেমন করে তাকে অন্যান্য উঁচু পদের লোকদের ও কর্মকর্তাদের চেয়ে উপরে উঠিয়েছেন সেই সব কথা গর্ব করে বলতে লাগল। হামান বলল, “কেবল তা-ই নয় রাণী ইষ্টের যে মেজবানী দিয়েছিলেন তাতে আমি ছাড়া আর কাউকেই বাদশাহ্‌র সংগে দাওয়াত করা হয় নি। আবার তিনি কালকেও বাদশাহ্‌র সংগে আমাকে দাওয়াত করেছেন। কিন্তু যখনই ঐ ইহুদী মর্দখয়কে আমি রাজবাড়ীর দরজায় বসে থাকতে দেখি তখন এই সবেতেও আমার শান্তি লাগে না।” তখন তার স্ত্রী সেরশ ও তার সব বন্ধু-বান্ধব তাকে বলল, “তুমি পঞ্চাশ হাত উঁচু একটা ফাঁসিকাঠ তৈরী করাও এবং সকালে বাদশাহ্‌র অনুমতি নিয়ে মর্দখয়কে তার উপর ফাঁসি দেবার ব্যবস্থা কর। তারপর খুশী মনে বাদশাহ্‌র সংগে ভোজে যাও।” এই কথা হামানের ভাল লাগল এবং সে সেই ফাঁসিকাঠ তৈরী করাল। সেই রাতে বাদশাহ্‌ ঘুমাতে পারছিলেন না। তিনি হুকুম দিলেন যেন তাঁর রাজ্যের ইতিহাস বইখানা তাঁর কাছে আনা হয়। তারপর সেই বইটি তাঁকে পড়ে শোনানো হল। সেখানে দেখা গেল বিগ্‌থন ও তেরশ নামে বাদশাহ্‌র দু’জন দারোয়ান যখন বাদশাহ্‌ জারেক্সেসকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করেছিল তখন মর্দখয় সেই খবর বাদশাহ্‌কে দিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “এর জন্য মর্দখয়কে কি রকম সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে?” তাঁর কর্মচারীরা জবাবে বলল, “কিছুই করা হয় নি।” বাদশাহ্‌ বললেন, “দরবারে কে আছে?” মর্দখয়ের জন্য হামান যে ফাঁসিকাঠ তৈরী করেছিল তাতে মর্দখয়কে ফাঁসি দেবার কথা বাদশাহ্‌কে বলবার জন্য ঠিক সেই সময়েই সে রাজবাড়ীর বাইরের দরবারে এসেছিল। বাদশাহ্‌র কর্মচারীরা বলল, “হামান দরবারে দাঁড়িয়ে আছেন।” বাদশাহ্‌ বললেন, “হামান ভিতরে আসুক।” হামান ভিতরে আসলে পর বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাদশাহ্‌ যাকে সম্মান দেখাতে চান তার প্রতি কি করা উচিত?” তখন হামান মনে মনে ভাবল, তাকে ছাড়া আর কাকেই বা বাদশাহ্‌ সম্মান দেখাবেন? তারপর সেই পোশাক ও ঘোড়া বাদশাহ্‌র উঁচু পদের কর্মচারীদের মধ্যে একজনের হাতে দেওয়া হোক। বাদশাহ্‌ যাঁকে সম্মান দেখাতে চান তাঁকে সেই পোশাক পরানো হোক এবং তাঁকে সেই ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে শহর-চকে তাঁর আগে আগে এই কথা ঘোষণা করা হোক, ‘বাদশাহ্‌ যাঁকে সম্মান দেখাতে চান তাঁর প্রতি এই রকমই করা হবে।’ ” তখন বাদশাহ্‌ হামানকে হুকুম দিলেন, “তুমি এখনই গিয়ে রাজপোশাক এবং ঘোড়া নিয়ে যেমন বললে রাজবাড়ীর দরজায় বসা সেই ইহুদী মর্দখয়ের প্রতি তেমনই কর। তুমি যা যা বললে তার কোনটাই করতে যেন অবহেলা করা না হয়।” কাজেই হামান রাজপোশাক ও ঘোড়া নিল এবং মর্দখয়কে রাজপোশাক পরিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে শহর-চকে তাঁর আগে আগে এই কথা ঘোষণা করে বেড়াতে লাগল, “বাদশাহ্‌ যাঁকে সম্মান দেখাতে চান তাঁর প্রতি এই রকমই করা হবে।” এর পর মর্দখয় আবার রাজবাড়ীর দরজায় গেলেন। কিন্তু হামান দুঃখে মাথা ঢেকে তাড়াতাড়ি করে ঘরে গেল। তার প্রতি যা ঘটেছে তা সব তার স্ত্রী সেরশকে ও তার সব বন্ধুদের বলল। হামানের সেই পরামর্শদাতারা ও তার স্ত্রী সেরশ তাকে বলল, “যার সামনে তোমার এই পতন শুরু হয়েছে সেই মর্দখয় যদি ইহুদী বংশের লোক হয় তবে তার বিরুদ্ধে তুমি দাঁড়াতে পারবে না, নিশ্চয়ই তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।” তারা তখনও হামানের সংগে কথা বলছে এমন সময় বাদশাহ্‌র সেবাকারীরা এসে তাড়াতাড়ি করে হামানকে ইষ্টেরের তৈরী ভোজে যোগ দেবার জন্য নিয়ে গেল। তারপর বাদশাহ্‌ ও হামান এই দ্বিতীয় বার রাণী ইষ্টেরের সংগে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য গেলেন। তাঁরা যখন আংগুর-রস খাচ্ছিলেন তখন বাদশাহ্‌ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “রাণী ইষ্টের, তুমি কি চাও? তা-ই তোমাকে দেওয়া হবে। তোমার অনুরোধ কি? যদি রাজ্যের অর্ধেকও হয় তা-ও তোমাকে দেওয়া হবে।” জবাবে রাণী ইষ্টের বললেন, “মহারাজ, আমি যদি আপনার দয়া পেয়ে থাকি এবং মহারাজ যদি খুশী হয়ে থাকেন তবে আমার অনুরোধ হল আমার ও আমার জাতির লোকদের প্রাণ রক্ষা করুন, কারণ ধ্বংস করবার, অর্থাৎ হত্যা করবার, অর্থাৎ একেবারে শেষ করে দেবার জন্যই আমাকে ও আমার জাতির লোকদের বিক্রি করা হয়েছে। যদি আমাদের কেবল গোলাম ও বাঁদী হবার জন্য বিক্রি করা হত তবে আমি চুপ করেই থাকতাম, কারণ ঐ রকম কষ্টের কথা মহারাজকে জানানো উচিত হত না।” তখন বাদশাহ্‌ জারেক্সেস রাণী ইষ্টেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে সে? সেই লোকটি কোথায়? এমন কাজ করতে কার সাহস হয়েছে?” ইষ্টের বললেন, “সেই বিপক্ষ ও শত্রু হল এই দুষ্ট হামান।” তখন হামান বাদশাহ্‌ ও রাণীর সামনে ভীষণ ভয় পেল। বাদশাহ্‌ রেগে গিয়ে আংগুর-রস রেখে উঠলেন এবং বের হয়ে রাজবাড়ীর বাগানে গেলেন। বাদশাহ্‌ হামানের ভাগ্য ঠিক করে ফেলেছেন বুঝে সে রাণী ইষ্টেরের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবার জন্য সেখানে রইল। রাজবাড়ীর বাগান থেকে বাদশাহ্‌ মেজবানীর ঘরে ফিরে আসলেন আর তখন ইষ্টের যে আসনে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন তার উপর হামান পড়ে ছিল। তখন বাদশাহ্‌ চিৎকার করে বললেন, “এই লোকটা কি আমার সামনে রাণীর ইজ্জত নষ্ট করবে?” বাদশাহ্‌র মুখ থেকে এই কথা বের হওয়া মাত্র লোকেরা হামানের মুখ ঢেকে ফেলল। তখন হর্বোণা নামে বাদশাহ্‌র একজন সেবাকারী বলল, “হামানের বাড়ীতে পঞ্চাশ হাত উঁচু একটা ফাঁসিকাঠ ঠিক করা আছে। মর্দখয়, যিনি বাদশাহ্‌র প্রাণ রক্ষার জন্য খবর দিয়েছিলেন তাঁর জন্যই হামান ওটা তৈরী করেছিল।” বাদশাহ্‌ বললেন, “ওটার উপরে ওকেই ফাঁসি দাও।” কাজেই হামান যে ফাঁসিকাঠ মর্দখয়ের জন্য তৈরী করেছিল লোকেরা তার উপরে তাকেই ফাঁসি দিল। এর পর বাদশাহ্‌র রাগ পড়ল। সেই দিনই বাদশাহ্‌ জারেক্সেস ইহুদীদের শত্রু হামানের সম্পত্তি রাণী ইষ্টেরকে দিলেন। এর পর মর্দখয় বাদশাহ্‌র সামনে উপস্থিত হলেন, কারণ ইষ্টেরের সংগে তাঁর সম্বন্ধের কথা ইষ্টের বাদশাহ্‌কে জানিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ তাঁর স্বাক্ষর দেওয়ার যে আংটিটা হামানের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন সেটা নিজের হাত থেকে খুলে নিয়ে মর্দখয়কে দিলেন। ইষ্টের হামানের সম্পত্তির উপরে মর্দখয়কে নিযুক্ত করলেন। ইষ্টের বাদশাহ্‌র পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আবার তাঁর কাছে মিনতি জানালেন। ইহুদীদের বিরুদ্ধে অগাগীয় হামান যে দুষ্ট পরিকল্পনা করেছিল তা বন্ধ করে দেবার জন্য তিনি বাদশাহ্‌কে অনুরোধ করলেন। তখন বাদশাহ্‌ তাঁর সোনার রাজদণ্ডটা ইষ্টেরের দিকে বাড়িয়ে দিলেন আর ইষ্টের উঠে বাদশাহ্‌র সামনে দাঁড়ালেন। ইষ্টের বললেন, “মহারাজের যদি ভাল মনে হয়, তিনি যদি আমাকে দয়ার চোখে দেখেন এবং যদি ভাবেন যে, কাজটা করা ন্যায্য আর যদি তিনি আমার উপর খুশী হয়ে থাকেন, তবে মহারাজের সমস্ত বিভাগের ইহুদীদের ধ্বংস করবার জন্য ফন্দি এঁটে অগাগীয় হম্মাদাথার ছেলে হামান যে চিঠি লিখেছিল তা বাতিল করবার জন্য একটা হুকুম লেখা হোক। আমার জাতি ও আমার আপন লোকদের উপর সর্বনাশ নেমে আসবে তা দেখে আমি কেমন করে সহ্য করব?” এতে বাদশাহ্‌ জারেক্সেস রাণী ইষ্টের ও ইহুদী মর্দখয়কে বললেন, “হামান ইহুদীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল বলে আমি তার সম্পত্তি ইষ্টেরকে দিয়েছি আর লোকেরা তাকে ফাঁসি দিয়েছে। কিন্তু বাদশাহ্‌র নাম করে লেখা এবং বাদশাহ্‌র আংটি দিয়ে সীলমোহর করা কোন হুকুম বাতিল করা যায় না। কাজেই এখন যেভাবে তোমাদের ভাল মনে হয় সেই ইহুদীদের পক্ষে বাদশাহ্‌র নাম করে আর একটা হুকুম লিখে বাদশাহ্‌র স্বাক্ষরের আংটি দিয়ে সীলমোহর কর।” সেই সময় তৃতীয় মাসে, অর্থাৎ সীবন মাসের তেইশ দিনের দিন বাদশাহ্‌র লেখকদের ডাকা হল। মর্দখয়ের সমস্ত হুকুম অনুসারে ভারত থেকে ইথিওপিয়া পর্যন্ত একশো সাতাশটা বিভাগের ইহুদীদের, প্রদেশের ও বিভাগের শাসনকর্তাদের এবং উঁচু পদের কর্মচারীদের কাছে চিঠি লেখা হল। এই চিঠিগুলো প্রত্যেকটি বিভাগের অক্ষর ও প্রত্যেকটি জাতির ভাষা অনুসারে এবং ইহুদীদের অক্ষর ও ভাষা অনুসারে লেখা হল। মর্দখয় তখন বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের নামে চিঠিগুলো লিখে বাদশাহ্‌র স্বাক্ষরের আংটি দিয়ে সীলমোহর করলেন। তারপর তিনি বাদশাহ্‌র জোরে দৌড়ানো বিশেষ ঘোড়ায় করে সংবাদ বাহকদের দিয়ে চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিলেন। বাদশাহ্‌র হুকুম প্রত্যেকটি বিভাগে আইন হিসাবে প্রকাশ করা হল এবং প্রত্যেক জাতিকে তা জানানো হল যাতে ইহুদীরা সেই দিনে তাদের শত্রুদের উপর শোধ নেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। বাদশাহ্‌র বিশেষ ঘোড়ায় চড়ে সংবাদ বাহকেরা বাদশাহ্‌র হুকুমে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। সুসার কেল্লায়ও সেই হুকুম জানানো হল। মর্দখয় মসীনা সুতার বেগুনে পোশাকের উপরে নীল ও সাদা রংয়ের রাজপোশাক পরে এবং সোনার একটা বড় তাজ মাথায় দিয়ে বাদশাহ্‌র সামনে থেকে বের হয়ে গেলেন। সুসা শহরের লোকেরা চিৎকার করে আনন্দ করল। ইহুদীদের জন্য সময়টা হল খুব আনন্দের, আমোদের ও সম্মানের। প্রত্যেকটি বিভাগে ও শহরে যেখানে যেখানে বাদশাহ্‌র হুকুম গেল সেখানকার ইহুদীদের মধ্যে আনন্দপূর্ণ উৎসব হল। অন্যান্য জাতির অনেক লোক ইহুদী হয়ে গেল, কারণ তারা ইহুদীদের ভয় করেছিল। অদর মাসের, অর্থাৎ বারো মাসের তেরো দিনের দিন বাদশাহ্‌র হুকুম কাজে লাগাবার সময় আসল। এই দিনে ইহুদীদের শত্রুরা তাদের দমন করবার আশা করেছিল, কিন্তু ঘটনা হল উল্টা। ইহুদীদের যারা ঘৃণা করত ইহুদীরাই তাদের দমন করল। যারা তাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল তাদের আক্রমণ করবার জন্য ইহুদীরা বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের সমস্ত বিভাগে তাদের নিজের নিজের শহরগুলোতে জমায়েত হল। তাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারল না, কারণ অন্য সব জাতির লোকেরা তাদের ভয় করতে লাগল। বিভাগগুলোর সমস্ত উঁচু পদের কর্মচারীরা, প্রদেশের ও বিভাগের শাসনকর্তারা এবং বাদশাহ্‌র অন্যান্য কর্মচারীরা ইহুদীদের সাহায্য করতে লাগলেন, কারণ তাঁরা মর্দখয়কে ভয় করেছিলেন। মর্দখয় রাজবাড়ীর মধ্যে প্রধান হয়ে উঠলেন; তাঁর সুনাম বিভাগগুলোর সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল এবং তিনি দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। ইহুদীরা তাদের সব শত্রুদের ধ্বংস করতে, হত্যা করতে ও একেবারে শেষ করে দিতে লাগল এবং যারা তাদের ঘৃণা করত তাদের উপর যা খুশী তা-ই করতে লাগল। সুসার কেল্লায় যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের সংখ্যা সেই দিনই বাদশাহ্‌কে জানানো হল। বাদশাহ্‌ তখন রাণী ইষ্টেরকে বললেন, “সুসার কেল্লায় ইহুদীরা পাঁচশো লোক ও হামানের দশজন ছেলেকে হত্যা করেছে। বাদশাহ্‌র বাকী বিভাগগুলোতে তারা না জানি কি করেছে। এখন তোমার অনুরোধ কি? তা তোমাকে দেওয়া হবে। তুমি কি চাও? তাও করা হবে।” জবাবে ইষ্টের বললেন, “মহারাজের যদি ভাল মনে হয় তবে আজকের মত কালকেও একই কাজ করবার জন্য সুসা শহরের ইহুদীদের অনুমতি দেওয়া হোক; আর হামানের দশটি ছেলেকে ফাঁসিকাঠে ঝুলানো হোক।” বাদশাহ্‌ তা-ই করবার জন্য হুকুম দিলেন। সুসা শহরে বাদশাহ্‌র সেই হুকুম ঘোষণা করা হল আর লোকেরা হামানের দশটি ছেলেকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিল। সুসা শহরের ইহুদীরা অদর মাসের চৌদ্দ দিনের দিন একসংগে জমায়েত হয়ে সেখানে তিনশো লোককে হত্যা করল, কিন্তু তারা কোন লুটের জিনিসে হাত দিল না। এর মধ্যে বাদশাহ্‌র বিভাগগুলোর বাকী ইহুদীরাও নিজেদের জীবন রক্ষা করবার জন্য ও তাদের শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য একসংগে জমায়েত হল। তারা তাদের পঁচাত্তর হাজার শত্রুকে হত্যা করল কিন্তু কোন লুটের জিনিসে হাত দিল না। অদর মাসের তেরো দিনের দিন এই ঘটনা ঘটল এবং চৌদ্দ দিনের দিন তারা বিশ্রাম নিল। দিনটা তারা মেজবানীর ও আনন্দের দিন হিসাবে পালন করল। কিন্তু সুসা শহরের ইহুদীরা তেরো ও চৌদ্দ দিনের দিন একসংগে জমায়েত হয়েছিল। তারপর পনেরো দিনের দিন তারা বিশ্রাম নিল এবং দিনটা মেজবানীর ও আনন্দের দিন হিসাবে পালন করল। এইজন্যই গ্রামের ইহুদীরা, অর্থাৎ যারা দেয়াল-ছাড়া জায়গায় বাস করে তারা অদর মাসের চৌদ্দ দিনের দিনটাকে আনন্দ ও মেজবানীর দিন এবং একে অন্যকে খাবার পাঠাবার দিন হিসাবে পালন করে। মর্দখয় এই সব ঘটনা লিখে রাখলেন এবং বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের রাজ্যের দূরের কি কাছের সমস্ত বিভাগের ইহুদীদের কাছে চিঠি লিখে পাঠালেন। তিনি তাদের হুকুম দিলেন যেন তারা প্রতি বছর অদর মাসের চৌদ্দ ও পনেরো দিন দু’টি পালন করে। এর কারণ হল, এই দুই দিনে ইহুদীরা তাদের শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল এবং সেই মাসে তাদের দুঃখ ও শোক বদলে গিয়েছিল সুখে ও উৎসব পালনে। তিনি তাদের লিখলেন যেন তারা সেই দিনগুলো মেজবানী ও আনন্দের দিন এবং একে অন্যের কাছে খাবার পাঠাবার ও গরীবদের কাছে উপহার দেবার দিন বলে পালন করে। কাজেই ইহুদীরা যেমন শুরু করেছিল এবং মর্দখয় তাদের যেমন লিখেছিলেন সেইভাবে দিন দু’টি পালন করতে তারা রাজী হল। এর কারণ হল, সমস্ত ইহুদীদের শত্রু অগাগীয় হম্মাদাথার ছেলে হামান ইহুদীদের ধ্বংস ও চুরমার করবার এবং একেবারে শেষ করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল আর সেইজন্য সে পূর, অর্থাৎ গুলিবাঁট করেছিল। কিন্তু হামানের ষড়যন্ত্র যখন বাদশাহ্‌র কানে গিয়েছিল তখন তিনি লিখিত হুকুম দিয়েছিলেন যেন ইহুদীদের বিরুদ্ধে হামান যে খারাপ ফন্দি এঁটেছে তা তার নিজের মাথাতেই পড়ে এবং তাকে এবং তার ছেলেদের ফাঁসিকাঠে ঝুলানো হয়। প্রত্যেক বিভাগের প্রত্যেকটি শহরের প্রত্যেকটি পরিবার বংশের পর বংশ ধরে এই দু’টা দিন স্মরণ করবে এবং পালন করবে। এতে ইহুদীদের মধ্য থেকে পূরীমের সেই দু’টা দিন পালন করা কখনও বন্ধ হবে না এবং তাদের বংশধরদের মন থেকে সেই কথা মুছে যাবে না। সেইজন্য অবীহয়িলের মেয়ে রাণী ইষ্টের ও ইহুদী মর্দখয় পূরীমের এই নিয়ম স্থায়ী করবার জন্য এই দ্বিতীয় চিঠিটা সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে লিখলেন। জারেক্সেসের রাজ্যের একশো সাতাশটা বিভাগের সমস্ত ইহুদীদের কাছে মর্দখয় শান্তি ও নিরাপত্তার কথা লেখা চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। সেই চিঠি পাঠানো হয়েছিল যাতে তারা নির্দিষ্ট সময়ে ইহুদী মর্দখয় ও রাণী ইষ্টেরের নির্দেশমত পূরীমের এই দিন দু’টা পালন করবার জন্য স্থির করতে পারে, যেমন ভাবে তারা নিজেদের ও তাদের বংশধরদের জন্য অন্যান্য রোজা ও বিলাপের সময় স্থির করেছিল। ইষ্টেরের হুকুমে পূরীমের এই নিয়মগুলো স্থির করা হল এবং তা লিখে রাখা হল। বাদশাহ্‌ জারেক্সেস তাঁর গোটা রাজ্যে, এমন কি, দূরের দেশগুলোতেও খাজনা বসালেন। তাঁর ক্ষমতা ও শক্তির সব কথা এবং মর্দখয়কে বাদশাহ্‌ যেভাবে উঁচু পদ দিয়ে মহান করেছিলেন সেই সব কথা মিডিয়া ও পারস্যের বাদশাহ্‌দের ইতিহাস বইতে লেখা আছে। বাদশাহ্‌ জারেক্সেসের পরে ইহুদী মর্দখয়ের স্থান ছিল দ্বিতীয়। তাঁর সমস্ত জাতি-ভাইয়েরা তাঁকে সম্মান ও ভালবাসার চোখে দেখত, কারণ তিনি তাঁর লোকদের উপকারের জন্য কাজ করেছিলেন এবং সমস্ত ইহুদীদের নিরাপত্তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। আওস দেশে আইয়ুব নামে একজন লোক বাস করতেন। তিনি নির্দোষ ও সৎ লোক ছিলেন। তিনি আল্লাহ্‌কে ভয় করতেন এবং খারাপী থেকে দূরে থাকতেন। তাঁর সাত ছেলে ও তিন মেয়ে ছিল। তাঁর সাত হাজার ভেড়া, তিন হাজার উট, পাঁচশো জোড়া ষাঁড় ও পাঁচশো গাধী ছিল এবং তাঁর গোলামও ছিল অনেক। পূর্বদেশের সমস্ত লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধনী। তাঁর ছেলেরা পালা পালা করে তাদের নিজের নিজের বাড়ীতে ভোজ প্রস্তুত করত এবং তাদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য লোক পাঠিয়ে তাদের তিন বোনকে দাওয়াত করত। তাদের ভোজের দিনগুলো শেষ হয়ে গেলে পর আইয়ুব তাদের ডেকে এনে পাক-পবিত্র করতেন। ফজরে তিনি তাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে পোড়ানো-কোরবানী দিতেন। তিনি ভাবতেন, “আমার ছেলেমেয়েরা হয়তো গুনাহ্‌ করেছে এবং মনে মনে আল্লাহ্‌কে অসম্মান করেছে।” আইয়ুব সব সময় এই রকম করতেন। একদিন ফেরেশতারা মাবুদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন আর শয়তানও তাঁদের সংগে উপস্থিত হল। তখন মাবুদ শয়তানকে বললেন, “তুমি কোথা থেকে আসলে?” জবাবে শয়তান মাবুদকে বলল, “দুনিয়ার মধ্য দিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে আসলাম।” মাবুদ তখন শয়তানকে বললেন, “আমার গোলাম আইয়ুবের দিকে কি তুমি লক্ষ্য করেছ? দুনিয়াতে তার মত আর কেউ নেই। সে নির্দোষ ও সৎ। সে আমাকে ভয় করে এবং খারাপী থেকে দূরে থাকে।” তখন শয়তান বলল, “আইয়ুব কি এমনি এমনি আপনাকে ভয় করে? আপনি কি তার চারপাশে এবং তার বাড়ী ও তার যা কিছু আছে তার চারপাশে ঘেরা দিয়ে রাখেন নি? আপনি তো তার কাজে দোয়া করেছেন, সেইজন্য তার পশুপালে দেশ ছেয়ে গেছে। কিন্তু আপনি হাত বাড়িয়ে তার সব কিছুকে আঘাত করুন, সে নিশ্চয়ই আপনার সামনেই আপনার বিরুদ্ধে কুফরী করবে।” তখন মাবুদ শয়তানকে বললেন, “খুব ভাল; তার যা কিছু আছে তা তোমার হাতে দিলাম, কিন্তু তার শরীরের উপরে তুমি একটা আংগুলও ছোঁয়াবে না।” তখন শয়তান মাবুদের সামনে থেকে বের হয়ে চলে গেল। একদিন আইয়ুবের ছেলেমেয়েরা তাদের বড় ভাইয়ের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করছিল ও আংগুর-রস খাচ্ছিল। এমন সময় আইয়ুবকে খবর দেবার জন্য একজন লোক এসে বলল, “আপনার ষাঁড়গুলো জমি চাষ করছিল এবং গাধীগুলোও কাছাকাছি চরছিল। এর মধ্যে সাবায়ীয়রা লুট করতে এসে সেগুলো নিয়ে গেছে। তারা আপনার গোলামদের হত্যা করেছে। আপনাকে খবর দেবার জন্য কেবল আমিই রক্ষা পেয়েছি।” লোকটি তখনও কথা বলছিল এমন সময় আর একজন এসে খবর দিল, “আসমান থেকে আল্লাহ্‌র আগুন পড়ে আপনার ভেড়ার পাল আর গোলামদের পুড়িয়ে দিয়েছে। আপনাকে খবর দেবার জন্য কেবল আমিই রক্ষা পেয়েছি।” দ্বিতীয় লোকটি তখনও কথা বলছিল এমন সময় আর একজন এসে খবর দিল, “ক্যালডীয়রা তিনটা দলে ভাগ হয়ে হানা দিয়ে আপনার উটগুলো নিয়ে গেছে। তারা আপনার গোলামদের হত্যা করেছে। আপনাকে খবর দেবার জন্য কেবল আমিই রক্ষা পেয়েছি।” তৃতীয় লোকটি তখনও কথা বলছিল এমন সময় খবর দেবার জন্য আর একজন এসে বলল, “আপনার ছেলেমেয়েরা তাঁদের বড় ভাইয়ের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন ও আংগুর-রস খাচ্ছিলেন। তখন মরুভূমি থেকে হঠাৎ একটা জোর বাতাস এসে ঘরটাকে আঘাত করল। তাতে ঘরটা ভেংগে তাঁদের উপর পড়াতে তাঁরা মারা গেছেন। আপনাকে খবর দেবার জন্য কেবল আমিই রক্ষা পেয়েছি।” এই কথা শুনে আইয়ুব উঠে মনের দুঃখে তাঁর কাপড় ছিঁড়লেন এবং মাথা কামিয়ে ফেললেন। তারপর মাটিতে পড়ে আল্লাহ্‌কে সেজদা করে বললেন, “মায়ের পেট থেকে আমি উলংগ এসেছি আর উলংগই চলে যাব। মাবুদই দিয়েছিলেন আর মাবুদই নিয়ে গেছেন; মাবুদের প্রশংসা হোক।” এই সব হলেও আইয়ুব গুনাহ্‌ করলেন না কিংবা আল্লাহ্‌কে দোষী করলেন না। আর একদিন ফেরেশতারা মাবুদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন, আর শয়তানও তাঁর সামনে উপস্থিত হবার জন্য ফেরেশতাদের সংগে আসল। মাবুদ শয়তানকে বললেন, “তুমি কোথা থেকে আসলে?” জবাবে শয়তান মাবুদকে বলল, “দুনিয়ার মধ্যে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে আসলাম।” তখন মাবুদ শয়তানকে বললেন, “আমার গোলাম আইয়ুবের দিকে কি তুমি লক্ষ্য করেছ? দুনিয়াতে তাঁর মত আর কেউ নেই। সে নির্দোষ ও সৎ। সে আমাকে ভয় করে ও খারাপী থেকে দূরে থাকে। যদিও তুমি বিনা কারণে তার সর্বনাশ করবার জন্য আমাকে খুঁচিয়ে তুলেছ তবুও সে এখনও কোন দোষ করে নি।” শয়তান বলল, তার জীবনই তার কাছে প্রাণের প্রাণ; মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তার যা কিছু আছে সবই দেবে। আপনি হাত বাড়িয়ে তার শরীরে আঘাত করুন, সে নিশ্চয়ই আপনার সামনেই আপনার কুফরী করবে।” তখন মাবুদ শয়তানকে বললেন, “খুব ভাল; তাকে তোমার হাতে দিলাম, কিন্তু তুমি তাকে প্রাণে মারবে না।” এর পর শয়তান মাবুদের সামনে থেকে বের হয়ে গেল এবং আইয়ুবের মাথার তালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত যন্ত্রণাপূর্ণ ঘা দিয়ে তাঁকে কষ্ট দিতে লাগল। তখন আইয়ুব ছাইয়ের মধ্যে বসে মাটির পাত্রের একটা টুকরা দিয়ে নিজের শরীর ঘষতে লাগলেন। তখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, “তুমি এখনও দাবি করছ যে, তুমি নির্দোষ? আল্লাহ্‌কে দোষ দিয়ে মরে যাও।” কিন্তু আইয়ুব তাঁকে বললেন, “তুমি একজন বোকা স্ত্রীলোকের মত কথা বলছ। আমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কি কেবল উপকারই গ্রহণ করব, অপকার গ্রহণ করব না?” এই সব হলেও আইয়ুব তাঁর কথার মধ্য দিয়ে গুনাহ্‌ করলেন না। তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিল্‌দদ ও নামাথীয় সোফর নামে আইয়ুবের তিনজন বন্ধু যখন আইয়ুবের সব বিপদের কথা শুনলেন তখন তাঁরা তাঁদের বাড়ী থেকে রওনা হলেন। তাঁরা একত্র হয়ে পরামর্শ করলেন যে, তাঁরা গিয়ে তাঁর সংগে শোক করবেন ও তাঁকে সান্ত্বনা দেবেন। তাঁরা দূর থেকে তাঁকে দেখে চিনতেই পারলেন না। তাঁরা জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন এবং নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে মাথার উপরে আসমানের দিকে ধুলা ছড়ালেন। তারপর তাঁরা সাত দিন ও সাত রাত তাঁর সংগে মাটিতে বসে রইলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ তাঁকে কিছুই বললেন না, কারণ তাঁর কষ্ট যে কি ভীষণ তা তাঁরা দেখতেই পাচ্ছিলেন। “আমার জন্মের দিনটা ধ্বংস হয়ে যাক, সেই রাতটা ধ্বংস হয়ে যাক যখন বলা হয়েছিল, ‘ছেলে হয়েছে।’ সেই দিনটা অন্ধকার হয়ে যাক; উপর থেকে আল্লাহ্‌ যেন সেই দিনটার খবর না নেন; তার উপর কোন আলো না পড়ুক। অন্ধকার আর ঘন ছায়া সেই দিনটাকে অধিকার করে নিক; মেঘ তাকে ঢেকে ফেলুক, আর গাঢ় অন্ধকার তাকে ভীষণ ভয় দেখাক। ঘন অন্ধকার সেই রাতটাকে ধরে ফেলুক; বছরের দিনগুলোর মধ্যে ওটাকে গোণা না হোক, কিংবা কোন মাসের মধ্যেও ওটা না থাকুক। সেই রাতটা বন্ধ্যা হোক, কোন আনন্দের গান তার মধ্যে শোনা না যাক। যারা দিনগুলো খারাপ হওয়ার জন্য মন্ত্র পড়ে আর লিবিয়াথনকে জাগাতে পারে তারা ঐ দিনটাকে বদদোয়া দিক। তার ভোর রাতের সব তারা অন্ধকার হয়ে যাক; সে আলোর জন্য মিথ্যাই বসে থাকুক; সে যেন ভোরের প্রথম আলো দেখতে না পায়, কারণ সে আমার মায়ের গর্ভের দরজা বন্ধ করে নি, আমাকে কষ্ট থেকে দূরে রাখে নি। “আমি কেন গর্ভে থাকতে মরি নি? কেনই বা পেট থেকে পড়েই মরলাম না? মায়ের কোল কেন আমাকে গ্রহণ করেছিল? কেনই বা তাঁর বুকের দুধ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন? তা না হলে তো আমি এখন শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারতাম, আমি ঘুমাতাম আর বিশ্রাম পেতাম। আমি সেই বাদশাহ্‌দের আর সেই মন্ত্রীদের সংগে থাকতাম যাঁরা একদিন নিজেদের জন্য দালান গড়েছিলেন যেগুলো আজ ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে। আমি সেই শাসনকর্তাদের সংগে থাকতাম যাঁদের প্রচুর সোনা ছিল, যাঁরা রূপা দিয়ে ঘর-বাড়ী ভরে রাখতেন। যে শিশু দিনের আলো দেখতে পায় নি, কেন পেটে মরে-যাওয়া সেই শিশুর মত আমাকে মাটির মধ্যে লুকিয়ে রাখা হল না? সেখানে তো দুষ্ট লোকেরা হাংগামা করে না, আর ক্লান্ত লোকেরা বিশ্রাম পায়। বন্দীরা সবাই সেখানে আরাম ভোগ করে; জুলুমবাজদের চিৎকার আর সেখানে শোনা যায় না। ছোট ও বড় সবাই সেখানে আছে, আর গোলামেরা সেখানে মালিকের হাত থেকে মুক্ত। “যারা দুঃখে আছে, কেন তাদের আলো দেখতে দেওয়া হয় আর তেতো প্রাণকে দেওয়া হয় জীবন? তারা মৃত্যু চায় কিন্তু তা পায় না, যদিও তারা গুপ্তধনের চেয়েও বেশী করে তার খোঁজ করে। তারা কবরে পৌঁছাতে পারলে আনন্দিত হয়, আর তার জন্য তারা খুব আনন্দ করে। যে মানুষের পথ তার কাছে লুকানো, যাকে আল্লাহ্‌ আট্‌কে রেখেছেন, কেন সেই মানুষকে জীবন দেওয়া হয়? আমার দীর্ঘনিঃশ্বাসই আমার খাবার হয়েছে, আর আমার কাত্‌রানি পানির মত ঢেলে পড়ছে। আমি যা ভয় করেছিলাম তা-ই আমার উপর এসে পড়েছে; যা হবে বলে আমার ভীষণ ভয় হয়েছিল তা-ই আমার উপর ঘটেছে। আমার শান্তি নেই, স্থিরতা নেই, কোন বিশ্রাম নেই, আছে কেবল কষ্ট।” এই কথা শুনে তৈমনীয় ইলীফস জবাবে বললেন, “কেউ যদি তোমার সংগে কথা বলে তবে কি তুমি বিরক্ত হবে? কিন্তু কে কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারে? ভেবে দেখ, কত জনকে তুমি কত উপদেশ দিয়েছ এবং দুর্বল হাতকে সবল করেছ। যারা জীবন্তপথে উচোট খেয়েছে তোমার কথা তাদের সাহায্য করেছে; তাদের দুর্বল হাঁটু তুমি সবল করেছ। কিন্তু এখন তোমার নিজের উপর কষ্ট এসেছে আর তুমি হতাশ হয়েছ; কষ্ট তোমাকে আঘাত করেছে আর তুমি নিরাশ হয়েছ। তুমি যে আল্লাহ্‌কে ভয় কর তাতে কি তুমি আশ্বাস পাও না? তুমি যে নির্দোষ সেটা কি তোমার আশা নয়? “এখন ভেবে দেখ, নির্দোষ হয়ে কে কবে ধ্বংস হয়েছে? সৎ লোকেরা কে কোথায় শেষ হয়েছে? আমি দেখেছি যারা খারাপীর চাষ করে আর অশান্তির বীজ বোনে তারা তা-ই কাটে। আল্লাহ্‌র নিঃশ্বাসে তারা ধ্বংস হয়ে যায় আর শেষ হয়ে যায় তাঁর রাগের ঝাপ্‌টায়। সিংহেরা গর্জন ও গোঁ গোঁ শব্দ করে, তবুও সেই ভয়ংকর সিংহদের দাঁত ভেংগে যায়। শিকার না পেলে সিংহ মরে যায়, আর সিংহীর বাচ্চাগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। “একটা কালাম আমার কাছে চুপি চুপি আসল, তার ফিস্‌ ফিস্‌ শব্দ আমার কানে গেল। রাতে মানুষ যখন অঘোরে ঘুমায় তখন স্বপ্ন দেখে আমি অস্থির হলাম; ভয় আর কাঁপুনি আমাকে ধরল, আমার সব হাড়গুলো কেঁপে উঠল। একটা রূহ্‌ আমার সামনে দিয়ে চলে গেল, আর আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। সেই রূহ্‌ থামল, কিন্তু সেটা যে কেমন তা আমি বুঝতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে একটা কিছু দাঁড়াল, খুব আস্তে আমি এই স্বর শুনলাম, ‘কোন মানুষ কি আল্লাহ্‌র চোখে নির্দোষ হতে পারে? তার সৃষ্টিকর্তার চোখে কি সে খাঁটি হতে পারে? আল্লাহ্‌ যদি তাঁর গোলামদেরও বিশ্বাস না করেন আর ভুলের জন্য তাঁর ফেরেশতাদের দোষী করেন, তবে যারা মাটির ঘরে বাস করে, যাদের ভিত্তি হল ধুলা, যাদের পোকার মত সহজে পিষে ফেলা যায়, তারা আল্লাহ্‌র চোখে আরও কত না বেশী দোষী হবে! সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই তারা চুরমার হয়, চোখের আড়ালেই তারা চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের সব কিছু তাম্বুর মত তুলে ফেলা হয়, আর তারা জ্ঞানহীন অবস্থায় মারা যায়।’ “তুমি ডাক দেখি, কে তোমাকে জবাব দেবে? তুমি কোন্‌ ফেরেশতার কাছে সাহায্য চাইবে? বিরক্তিবোধ অসাড় বিবেক লোকদের শেষ করে দেয় আর হিংসা বোকাদের মেরে ফেলে। অসাড় বিবেক লোককে আমি উন্নতি করতে দেখলাম আর তখনই তার ঘরকে বদদোয়াপ্রাপ্ত বলে ঘোষণা করলাম। তার সন্তানেরা নিরাপদে থাকে না; বিচারের জায়গাতেই তারা সব কিছু হারায়, তাদের রক্ষাকারী কেউ থাকে না। ক্ষুধিত লোকেরা তার শস্য খেয়ে ফেলে, এমন কি, কাঁটার বেড়ার মধ্য থেকেও তারা তা তুলে নেয়; অভাবীরা তার ধন-সম্পদের জন্য খুব আগ্রহী হয়। মাটি থেকে কষ্ট উঠে আসে না, কিংবা জমি থেকে দুঃখ গজায় না। যেমন সত্যি যে আগুনের ফুল্‌কি উপরের দিকে ওঠে, তেমনি সত্যি যে, মানুষ কষ্ট পাবার জন্যই জন্মে। “কিন্তু আমি হলে আল্লাহ্‌র সাহায্য চাইতাম, তাঁর কাছে আমার মামলাটা তুলে ধরতাম। তিনি এমন সব মহৎ কাজ করেন যার গভীরতা মাপা যায় না; তিনি এমন সব কেরামতী দেখান যা গুণে শেষ করা যায় না। তিনি দুনিয়াতে বৃষ্টি দান করেন আর জমির উপর পানি পাঠিয়ে দেন। নীচু অবস্থার লোকদের তিনি উঁচুতে তোলেন; যারা শোক করে তাদের তিনি নিরাপদে রাখেন। ধূর্ত লোকদের পরিকল্পনা তিনি নিষ্ফল করে দেন, তাই তারা কোন সফলতা লাভ করতে পারে না। তিনি জ্ঞানীদের তাদের চালাকীর মধ্যে ধরেন, আর ছলনাকারীদের ফন্দি নিষ্ফল হয়ে যায়। দিনের বেলাতেই তাদের উপর অন্ধকার নেমে আসে; দুপুরে তারা রাতের বেলার মত হাত্‌ড়ে বেড়ায়। তিনি ধারালো জিভের হাত থেকে অভাবীদের বাঁচান; শক্তিশালীদের মুঠো থেকে তাদের রক্ষা করেন। সেইজন্য অসহায় লোকেরা আশায় বুক বাঁধে, আর অবিচার বন্ধ হয়ে যায়। “মোবারক সেই লোক, যাকে আল্লাহ্‌ সংশোধন করেন। কাজেই সর্বশক্তিমানের শাসনকে তুচ্ছ কোরো না, কারণ তিনি ক্ষত করেন, আবার তা বেঁধেও দেন; তিনি আঘাত করেন, আবার তাঁর হাতই তা সুস্থ করে। ছয়টা বিপদ থেকে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন, সাতটা বিপদের সময় তোমার কোন ক্ষতি হবে না। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি তোমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবেন, আর যুদ্ধের সময় রক্ষা করবেন তলোয়ারের আঘাত থেকে। জিভের আঘাত থেকে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন; বিপদ আসলে তুমি ভয় পাবে না। ধ্বংস ও দুর্ভিক্ষের সময় তুমি হাসবে; বুনো পশুদের তুমি ভয় করবে না। তোমার জমিতে কোন পাথর থাকবে না; বুনো পশুরা তোমাকে আক্রমণ করবে না। তুমি জানবে যে, তোমার তাম্বু নিরাপদ; তোমার সম্পত্তির হিসাব নিলে পর দেখবে তোমার কিছুই হারায় নি। তুমি জানবে যে, তোমার অনেক ছেলেমেয়ে হবে আর তোমার বংশধরেরা মাঠের ঘাসের মত প্রচুর হবে। যেমন করে সময় মত ফসল তোলা হয় তেমনি করে পূর্ণ আয়ু পেয়ে তুমি কবর পাবে। “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে, এ সব সত্যি; কাজেই তুমি শোন আর নিজের জীবনে তা কাজে লাগাও।” তখন জবাবে আইয়ুব বললেন, “আমার দারুণ যন্ত্রণা যদি ওজন করা যেত, আমার সমস্ত দুর্দশা যদি দাঁড়িপাল্লায় তোলা হত, তবে তা নিশ্চয়ই সাগর পারের বালুকণার চেয়েও ওজনে বেশী হত; সেজন্যই আমার কথাবার্তায় কোন লাগাম নেই। সর্বশক্তিমানের তীর আমাকে বিঁধেছে, আমার প্রাণ সেগুলোর বিষ খাচ্ছে; আল্লাহ্‌র ভয়ংকর কাজগুলো আমার বিরুদ্ধে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে। ঘাস পেলে কি বুনো গাধা চিৎকার করে, কিংবা খড় পেলে কি গরু ডাকে? স্বাদহীন খাবার কি লবণ ছাড়া খাওয়া যায়, কিংবা ডিমের লালায় কি কোন স্বাদ আছে? আমি তা খেতে চাই না; তা খেলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। “আহা, আমার অনুরোধ যেন রক্ষা হয়, আল্লাহ্‌ যেন আমার আশা পূর্ণ করেন, আমাকে যেন তিনি চুরমার করে ফেলেন এবং হাত বাড়িয়ে আমাকে মেরে ফেলেন! তাহলে আমার এই সান্ত্বনা থাকবে, ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যেও আমার এই আনন্দ থাকবে যে, আল্লাহ্‌ পাকের কথা আমি অস্বীকার করি নি। “অপেক্ষা করবার জন্য আমার কোন শক্তি নেই, আশা করবার মত আমার এমন কিছু নেই যে, আমি ধৈর্য ধরে থাকব। আমার শক্তি কি পাথরের মত? আমার শরীর কি ব্রোঞ্জের তৈরী? নিজেকে সাহায্য করবার শক্তি আমার নেই; আমার কাছ থেকে তো আমার সব কিছু দূর করা হয়েছে। “হতাশ লোক যদিও বা সর্বশক্তিমানকে ভয় করা ছেড়ে দেয়, তবুও তার বন্ধুদের উচিত তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। কিন্তু আমার বন্ধুদের উপর তো ভরসা করা যায় না; তারা এমন স্রোতের মত যা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে কিনারা ছাপিয়ে ওঠে। বরফ ও তুষার গলে সেই স্রোত ঘোলা হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আবার গরম কালে সেই স্রোত শুকিয়ে যায় আর তার পথ থেকে অদৃশ্য হয়। সেই পথে চলা মরুযাত্রীর দল পানি খুঁজতে খুঁজতে ফিরে যায়, আর তারা মরুভূমিতে শেষ হয়ে যায়। তাইমার মরুযাত্রীরা পানির খোঁজ করে, সাবার ব্যবসায়ীরা আশা নিয়ে তাকায়। তারা নিশ্চিত ছিল বলেই কষ্ট পায়; সেখানে এসে তারা নিরাশ হয়। তোমরাও তেমনি আমাকে কোন সাহায্য করতে পার না; আমার ভয়ংকর অবস্থা দেখে তোমরা ভয় পেয়েছ। আমি কি কখনও বলেছি, ‘আমাকে কিছু দাও, তোমাদের ধন থেকে আমাকে উপহার দাও, শত্রুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর, মূল্য দিয়ে নিষ্ঠুরদের থাবা থেকে আমাকে মুক্ত কর?’ “আমাকে শিক্ষা দাও, আমি চুপ করে থাকব; কোথায় আমার ভুল তা আমাকে দেখিয়ে দাও। ন্যায্য কথা কেমন শক্তিশালী, কিন্তু তোমাদের তর্কে কোন লাভ নেই। আমার কথায় কি তোমরা দোষ ধরতে চাইছ? তোমরা তো নিরাশ লোকের কথা বাতাসের মত মনে করছ। তোমরা এতিমদের জন্য ভাগ্য পরীক্ষা করে থাক আর বন্ধুকে বিক্রি করতে চাও। কিন্তু এখন দয়া করে তোমরা আমার দিকে তাকাও, আমি তোমাদের সামনে মিথ্যা কথা বলব না। তোমরা নরম হও, অন্যায় কোরো না; আবার ভেবে দেখ, কারণ আমি এখনও সৎ আছি। আমার মুখে কি কোন অন্যায় আছে? আমি কি সত্য-মিথ্যা বুঝি না? “এই দুনিয়াতে মানুষকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়, সে মজুরের মত দিন কাটায়। গোলাম যেমন সন্ধ্যাবেলার জন্য অপেক্ষা করে, মজুর যেমন তার মজুরির জন্য আশা করে থাকে, তেমনি করেই মাসের পর মাস নিষ্ফলতা আমার ভাগে পড়েছে; আমি রাতের পর রাত কেবল দুঃখ পেয়েছি। শোবার সময় আমি ভাবি, আমি কখন উঠব? কিন্তু রাত বড় হয়, আর আমি সকাল পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করি। পোকা আর ঘায়ের মাম্‌ড়িতে আমার শরীর ঢাকা পড়েছে; আমার চামড়া ফেটে গেছে এবং পূঁজ পড়ছে। আমার দিনগুলো তাঁতীর মাকুর চেয়েও তাড়াতাড়ি চলছে; কোন আশা ছাড়াই সেগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। “হে আল্লাহ্‌, মনে রেখ, আমার জীবন একটা নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়; আমি তো আর সুখের মুখ দেখব না। তোমার চোখ আর আমাকে দেখবে না; তুমি আমার খোঁজ করবে, কিন্তু আমি আর থাকব না। মেঘ যেমন অদৃশ্য হয়ে চলে যায়, তেমনি যে কবরে যায় সে আর ফিরে আসে না। সে তার বাড়ীতে আর ফিরে আসবে না; তার জায়গাও তাকে আর মনে রাখবে না। “কাজেই আমি আর চুপ করে থাকব না। আমার মনের দারুণ ব্যথায় আমি কথা বলব; আমার তেতো প্রাণে আমি তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করব। আমি কি সমুদ্র নাকি সাগরের জল-দানব যে, তুমি আমাকে পাহারা দিয়ে রেখেছ? যখন ভাবি আমার বিছানা আমাকে সান্ত্বনা দেবে আর আমার ঘুম আমার দুঃখ কমাবে, তখন তুমি নানা স্বপ্ন দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাও, নানা দর্শন দিয়ে আমাকে ভীষণ ভয় ধরিয়ে দাও। তাতে এই কংকাল শরীরে বেঁচে থাকার চেয়ে কেউ আমাকে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলুক তা-ই আমি চাই। আমার প্রাণকে আমি ঘৃণা করি; আমি তো চিরকাল বেঁচে থাকতে চাই না। আমাকে ছেড়ে দাও; আমার আয়ু তো ক্ষণস্থায়ী। “মানুষ কি যে, তাকে তুমি এত দাম দাও, আর তার প্রতি তুমি এত মনোযোগ দাও, প্রতিদিন সকালে তুমি তার খোঁজ নাও, আর প্রতি মুহূর্তে তাকে তুমি পরীক্ষা কর? আমার দিক থেকে কি তোমার চোখ ফিরাবে না, কিংবা ঢোক গিলতেও কি আমাকে সময় দেবে না? হে মানুষের পাহারাদার, আমি যদি গুনাহ্‌ করেই থাকি তবে তাতে তোমার কি? তুমি কেন আমাকে তোমার তীরের লক্ষ্যস্থান করেছ? আমি কি তোমার বোঝা হয়েছি? কেন তুমি আমার দোষ ও আমার গুনাহ্‌ মাফ কর না? কারণ আমাকে তো শীঘ্রই মাটিতে শুতে হবে; তুমি আমার খোঁজ করবে, কিন্তু আমি থাকব না।” তখন শূহীয় বিল্‌দদ জবাবে বললেন, “তুমি আর কতক্ষণ এই সব কথা বলতে থাকবে? তোমার কথাগুলো ঝোড়ো বাতাসের মত। আল্লাহ্‌ কি ন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করেন? সর্বশক্তিমান কি ঠিক্‌কে বেঠিক করেন? তোমার ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই তাঁর বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে, সেইজন্য তিনি গুনাহের শাস্তির হাতে তাদের তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি যদি আগ্রহী হয়ে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত কর আর সর্বশক্তিমানের কাছে অনুরোধ জানাও, যদি তুমি খাঁটি ও সৎ হয়ে থাক, তবে এখনও তিনি তোমার পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী হবেন আর তোমার সততাপূর্ণ জায়গায় আবার তোমাকে বসাবেন। তোমার ভবিষ্যৎ হবে এত সফলতায় পূর্ণ যে, মনে হবে তোমার প্রথম অবস্থা এর চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। “আগেকার দিনের লোকদের জিজ্ঞাসা কর; তাঁদের পূর্বপুরুষেরা যা শিখেছিলেন তার খোঁজ নাও। আমরা তো গতকাল জন্মেছি, কিছুই জানি না; দুনিয়ার উপর আমাদের দিনগুলো ছায়ার মত চলে যায়। তাঁদের কাছ থেকে তুমি শিক্ষা ও উপদেশ পাবে; তাঁরা যা জানেন তা তোমাকে বলবেন। “জলাভূমি না হলে নল বড় হতে পারে না; পানি না পেলে খাগ্‌ড়া বেড়ে উঠতে পারে না। বেড়ে উঠবার সময় যখন সেগুলো কাটা হয় না, তখন পানি না পেলে তা ঘাসের চেয়েও তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। যারা আল্লাহ্‌কে ভুলে যায় তাদের দশা তা-ই হয়; আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনদের আশা ঐভাবে ধ্বংস হয়। যার উপর সে ভরসা করে তা শক্ত নয়, তা মাকড়সার জাল মাত্র। সে যদি তার উপর ভর দেয় তবে তা ভেংগে পড়বে, যদি সে তা আঁকড়ে ধরে তবে তা তাকে ধরে রাখতে পারবে না। সে যেন সূর্যের আলোতে সতেজ একটা চারা, বাগানের সব জায়গায় তার ডালপালা ছড়িয়ে গেছে। জড়ো হওয়া পাথরের চারপাশে তার শিকড়গুলো জড়িয়ে গেছে; পাথরের মধ্যে সে একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু তার জায়গা থেকে যখন তাকে তুলে ফেলা হবে তখন সেই জায়গা তাকে অস্বীকার করে বলবে, ‘আমি তোমাকে কখনও দেখি নি।’ দেখ, এছাড়া তার আর কোন আনন্দ নেই; সেই মাটিতে অন্যান্য চারা গজাবে। “নির্দোষ মানুষকে আল্লাহ্‌ কখনও ত্যাগ করেন না কিংবা যারা খারাপ কাজ করে তাদের হাত শক্তিশালী করেন না। এখনও তোমার মুখ তিনি হাসিতে ভরে দেবেন আর তোমাকে আনন্দে পূর্ণ করবেন। যারা তোমাকে ঘৃণা করে তারা লজ্জিত হবে; দুষ্টদের বাসস্থান আর থাকবে না।” জবাবে আইয়ুব বললেন, “ঠিক কথা, আমি জানি এ সবই সত্যি। কিন্তু আল্লাহ্‌র চোখে কেমন করে মানুষ নির্দোষ হতে পারে? কেউ যদি তাঁর সংগে তর্কাতর্কি করতে চায়, তবে তিনি হাজারটা প্রশ্ন করলেও সে একটারও জবাব দিতে পারবে না। তাঁর জ্ঞান গভীর, তাঁর শক্তি অসীম; কে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রক্ষা পেয়েছে? তিনি হঠাৎ পাহাড়-পর্বতকে সরিয়ে দেন, রাগে সেগুলোকে ধ্বংস করেন; তিনি দুনিয়াকে তার জায়গা থেকে নাড়া দেন, তার থামগুলোকে কাঁপিয়ে তোলেন। তিনি নিষেধ করলে সূর্য আলো দেয় না আর তারাগুলো আলো দেওয়া বন্ধ করে। তিনিই আসমানকে বিছিয়ে দেন আর সাগরের ঢেউয়ের উপর দিয়ে হাঁটেন। তিনি সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, কৃত্তিকা আর দক্ষিণ দিকের তারাগুলোর সৃষ্টিকর্তা। তিনি এমন সব মহৎ কাজ করেন যা বোঝা যায় না আর এমন কেরামতী দেখান যার সংখ্যা গোণা যায় না। “তিনি আমার সামনে দিয়ে যান, আমি তাঁকে দেখতে পাই না; তিনি কাছ দিয়ে যান, আমি তাঁকে চিনতে পারি না। যদি তিনি কেড়ে নেন কে তাঁকে বাধা দিতে পারে? কে তাঁকে বলতে পারে, ‘তুমি কি করছ?’ আল্লাহ্‌ তাঁর রাগ দমন করেন না; এমন কি, জল-দানব রহবের সাহায্যকারীরাও তাঁর পায়ের কাছে ভয়ে জড়সড় হয়েছিল। “তাহলে কেমন করে আমি তাঁর কথার জবাব দেব? তাঁকে বলবার জন্য কোথায় কথা খুঁজে পাব? আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করলেও তাঁকে জবাব দিতে পারি না; আমার বিচারকের কাছে আমি কেবল দয়াই ভিক্ষা করব। আমি ডাকলে যদিও বা তিনি সাড়া দেন তবুও আমি বিশ্বাস করি না যে, তিনি আমার কথা শুনবেন। তিনি ঝড় দিয়ে আমাকে গুঁড়িয়ে ফেলেন এবং বিনা কারণেই বারে বারে আমাকে আঘাত করেন। তিনি আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দেন না বরং তিক্ততা দিয়েই আমার জীবন ভরে দেন। এটা যদি শক্তির ব্যাপার হয় তবে তিনি তো শক্তিশালী; যদি বিচারের ব্যাপার হয় তবে কে তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করবে? যদিও আমি নির্দোষ তবুও আমার মুখ আমাকে দোষী করবে; যদিও আমি সৎ তবুও আমার মুখ আমাকে অসৎ বলবে। আমি নির্দোষ, কিন্তু তাতে আমার কি আসে যায়? আমার নিজের জীবনকে আমি ঘৃণা করি। সবই সমান, সেজন্যই আমি বলছি, ‘নির্দোষ ও দুষ্ট- এই দু’জনকেই তিনি ধ্বংস করেন।’ দুর্দশার আঘাতে হঠাৎ নির্দোষীর মৃত্যু হলে তিনি হাসেন। দুষ্টদের হাতে দুনিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ্‌ বিচারকদের চোখ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনিই যদি তা না করে থাকেন তবে কে তা করেছে? “যে দৌড়ায় তার চেয়েও তাড়াতাড়ি চলে আমার দিনগুলো; তা উড়ে চলে যায়, ভাল দেখতে পায় না। হালকা নৌকার মতই তা তাড়াতাড়ি চলে যায়; তা ঈগল পাখীর ছোঁ মারার মত করে চলে যায়। যদি বলি, ‘আমার দুঃখ আমি ভুলে যাব, মুখের ভাব বদলে আমি হাসব,’ তবুও আমার সব যন্ত্রণাকে আমি ভয় করি, কারণ আমি জানি তুমি আমাকে নির্দোষ বলে ধরবে না। আমাকে যখন দোষী বলেই ধরা হবে, তখন কেন আমি মিথ্যাই কষ্ট করব? আমি যদি সাবান দিয়ে নিজেকে ধুয়ে ফেলি আর ক্ষার দিয়েও হাত পরিষ্কার করি, তবুও তুমি কাদার গর্তে আমাকে ডুবিয়ে দেবে; তাতে আমার কাপড়-চোপড়ও আমাকে ঘৃণা করবে। “তিনি তো আমার মত একজন মানুষ নন যে, তাঁর কথার জবাব দেব বা আদালতে তাঁর মুখোমুখি হব। আহা, যদি এমন কেউ থাকতেন যিনি আমাদের মধ্যে সালিশ করে দিতে পারেন এবং যাঁর কথা আমরা দু’জনেই মেনে নিতে পারি; যদি এমন কেউ থাকতেন যিনি আল্লাহ্‌র শাস্তি আমার উপর থেকে সরিয়ে দিতে পারেন, যাতে তার ভয়ংকরতা আমাকে আর ভয় দেখাতে না পারে। যদি তা হত তাহলে আমি আল্লাহ্‌কে ভয় না করে কথা বলতাম, কিন্তু এখন আমার যে অবস্থা হয়েছে তাতে আমি তা পারি না। “আমার বেঁচে থাকাকেই আমি ঘৃণা করি, তাই আমার দুঃখের কথা আমি খোলাখুলিভাবেই বলব আর আমার প্রাণের তেতো অবস্থা থেকে কথা বলব। হে আল্লাহ্‌, আমাকে দোষী কোরো না, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে তোমার যে নালিশ আছে তা আমাকে জানাও। আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ? তোমার হাতের কাজ কি তুমি পায়ে ঠেলছ আর দুষ্টদের মতলবে খুশী হচ্ছ? তোমার চোখ কি মানুষের চোখের মত? মানুষ যেমন দেখে তুমিও কি তেমনি দেখ? মানুষের মতই কি তোমার দিনগুলো কাটে? তাদের মতই কি তোমার বছরগুলো কাটে? তুমি কি সেজন্যই আমার দোষ খুঁজে বেড়া"ছ আর আমার গুনাহের তদন্ত করছ? তুমি তো জান আমি দোষী নই আর তোমার হাত থেকে উদ্ধারকারী কেউ নেই। “তোমারই হাত আমাকে গড়েছে, তৈরী করেছে; এখন তুমি কি ফিরে আমাকে ধ্বংস করবে? মনে করে দেখ, মাটির পাত্রের মত করে তুমি আমাকে গড়েছ; এখন তুমিই কি আবার আমাকে ধুলার মত করবে? দুধের মত করে তুমি আমাকে ঢেলেছ আর ছানার মত করে আমাকে জমাট করেছ। আমাকে চামড়া আর গোশ্‌ত দিয়ে ঢেকেছ, হাড় আর মাংসপেশী একসংগে করে আমাকে গড়েছ। তুমি আমাকে জীবন দিয়েছ, অটল মহব্বত দেখিয়েছ; তোমার যতে আমার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এটাই তোমার অন্তরে তুমি লুকিয়ে রেখেছ, আর আমি জানি এটাই তোমার মনে রয়েছে যে, যদি আমি গুনাহ্‌ করি, তুমি তা লক্ষ্য রাখবে আর আমার দোষের শাস্তি না দিয়ে তুমি ছাড়বে না। যদি আমি দোষী হই তবে আমার উপর বিপদ আসবে। যদি আমি নির্দোষও হই তবুও আমি মাথা তুলতে পারব না, কারণ আমি লজ্জায় পূর্ণ হয়েছি আর কষ্টের মধ্যে ডুবে গেছি। যদি আমি মাথা উঁচু করি তবে তুমি সিংহের মত আমার জন্য ওৎ পেতে থাকবে আর আমাকে আবার তোমার ভয়ংকর শক্তি দেখাবে। আমার বিরুদ্ধে তুমি নতুন নতুন সাক্ষী দাঁড় করা"ছ আর আমার প্রতি তোমার বিরক্তি বাড়িয়ে তুলছ; তোমার আক্রমণ একটার পর একটা আমার বিরুদ্ধে আসছে। “কেন তুমি মায়ের পেট থেকে আমাকে বের করে এনেছিলে? কোন চোখ আমাকে দেখবার আগে কেন আমি মরলাম না? হায়, আমাকে যদি কখনও গড়া না হত, কিংবা পেট থেকে সোজা কবরে নিয়ে যাওয়া হত! আমার অল্প দিনের আয়ু প্রায় শেষ; এবার তুমি আমাকে ছেড়ে দাও যাতে আমি একটুক্ষণ আনন্দ করতে পারি। আমি শীঘ্রই অন্ধকার ও ঘন ছায়ার দেশে যাব; আমি আর কখনও ফিরে আসব না। সেটা ঘোর অন্ধকারের দেশ, ঘন ছায়া ও বিশৃঙ্খলার দেশ; সেখানে আলোও অন্ধকারের মত।” তখন নামাথীয় সোফর জবাবে বললেন, “এই সব কথার কি জবাব দেওয়া হবে না? বাচালের কথা কি ঠিক বলে প্রমাণিত হবে? তোমার এই বাজে কথা শুনে কি লোকে চুপ করে থাকবে? তুমি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করলে কি কেউ তোমাকে লজ্জা দেবে না? তুমি আল্লাহ্‌কে বলছ, তোমার ঈমানে কোন খুঁত নেই এবং তাঁর চোখে তুমি খাঁটি। আহা, আল্লাহ্‌ যেন কথা বলেন, তোমার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন আর জ্ঞানের গোপন বিষয়গুলো তোমাকে জানান, কারণ জ্ঞানের অনেক দিক আছে। এটা জেনে রেখো, তোমার গুনাহ্‌ অনুসারে আল্লাহ্‌ তোমাকে শাস্তি দেন না। আল্লাহ্‌র গোপন বিষয়ের গভীরতা কতখানি তা কি তুমি বুঝতে পার? সর্বশক্তিমানের সীমা কতখানি তা কি তুমি তদন্ত করে দেখতে পার? সেগুলো যে আসমানের চেয়েও উঁচু তা কি তুমি বুঝতে পার? সেগুলো কবরের গভীরতার চেয়েও গভীর, তুমি কি তা জানতে পার? মাপলে দেখা যাবে তা দুনিয়ার এক দিক থেকে অন্য দিকের চেয়েও লম্বা আর সাগরের চেয়েও চওড়া। তিনি এসে যদি তোমাকে জেলে বন্দী করেন আর বিচার-সভা বসান, তবে কে তাঁকে বাধা দিতে পারে? তিনি ভণ্ড লোকদের নিশ্চয়ই চেনেন; খারাপ কিছু দেখলে তিনি কি তা লক্ষ্য করবেন না? বুনো গাধার বাচ্চা যেমন মানুষ হয়ে জন্মাতে পারে না, তেমনি বুদ্ধিহীন মানুষ জ্ঞানী হতে পারে না। “কিন্তু যদি তুমি তোমার দিলটা সম্পূর্ণভাবে তাঁকে দিয়ে দাও, তাঁর দিকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও, তোমার হাতে যে গুনাহ্‌ আছে তা দূর করে দাও, আর অন্যায়কে তোমার বাড়ীতে থাকতে না দাও, তাহলে তুমি নিষ্কলংক হয়ে মাথা তুলবে আর ভয় না করে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। তখন তোমার কষ্ট নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাবে, মনে হবে ওটা যেন কেবল বয়ে যাওয়া পানি। তোমার জীবন হবে দুপুরের চেয়েও উজ্জ্বল আর অন্ধকার হবে সকালবেলার মত। তোমার সাহস থাকবে, কারণ আশা আছে; চারদিকে তাকিয়ে তুমি নিরাপদে বিশ্রাম করবে; তুমি শুয়ে পড়লে কেউ তোমাকে ভয় দেখাবে না। অনেক লোক তোমার কাছে দয়া চাইবে। দুষ্টেরা কিন্তু উদ্ধারের আশায় মিথ্যাই তাকাবে, তারা কোন আশ্রয় পাবে না; শেষ নিঃশ্বাসই হবে তাদের আশা।” তখন আইয়ুব জবাবে বললেন, “তোমরা ভাব তোমরাই কেবল জ্ঞানী মানুষ আর তোমাদের মৃত্যুর সংগে সংগে জ্ঞানও মরে যাবে। কিন্তু তোমাদের মত আমারও বুদ্ধি আছে; আমি তোমাদের চেয়ে নীচু নই; তোমরা যা বলেছ তা কে না জানে? আমি আল্লাহ্‌কে ডাকতাম আর তিনি আমাকে জবাব দিতেন, তবুও আমার বন্ধুদের কাছে আমি একটা হাসির পাত্র হয়েছি; সৎ এবং নির্দোষ হলেও আমি এখন হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছু নই। সুখী লোকেরা দুঃখ-কষ্টকে তুচ্ছ করে; তারা মনে করে যাদের পা পিছ্‌লে যায় দুঃখ-কষ্ট তাদেরই জন্য। লুটেরাদের তাম্বুতে কোন গোলমাল নেই; যারা আল্লাহ্‌কে বিরক্ত করে তারা নিরাপদেই থাকে; আল্লাহ্‌ যেন তাদের সব কিছু দিচ্ছেন। “পশুদের জিজ্ঞাসা কর, তারা তোমাকে শিখাবে; আকাশের পাখীদের বল, তারাও তোমাকে বলে দেবে; দুনিয়াকে বল, সে-ও তোমাকে শিখাবে; সাগরের মাছেরাও তোমাকে বলে দেবে। এরা সবাই জানে মাবুদের কুদরতীই এ সব করেছে। তাঁরই হাতে সব প্রাণীদের জীবন রয়েছে; সব মানুষের নিঃশ্বাসও তাঁর হাতে আছে। জিভ্‌ যেমন খাবারের স্বাদ নেয় তেমনি কানও কথার পরীক্ষা করে। তোমরা বলে থাক, বুড়ো লোকদের কাছে জ্ঞান পাওয়া যায় আর দীর্ঘ জীবন বুদ্ধির যোগান দেয়। “কিন্তু জ্ঞান ও শক্তি আল্লাহ্‌র; পরামর্শ ও বুদ্ধি তাঁরই। তিনি ভাংলে আর তা গড়া যায় না; তিনি কাউকে জেলে আটক করলে খালাস করা যায় না। তিনি পানি বন্ধ করে রাখলে খরা হয়; তিনি তা খুলে দিলে দেশ ধ্বংস হয়। শক্তি ও জ্ঞান তাঁরই; যাকে ছলনা করা হয়েছে আর যে ছলনা করে তারা দু’জনেই তাঁর হাতের নীচে। তিনি মন্ত্রীদের পোশাক খুলে ফেলে তাদের বন্দী করেন আর বিচারকদের বোকা বানান। তিনি বাদশাহ্‌র পোশাক কেড়ে নেন আর তাঁকে বন্দী করেন। তিনি ইমামদের পোশাক খুলে ফেলে তাদের বন্দী করেন আর যারা শিকড় গেড়ে বসে আছে তাদের উপ্‌ড়ে ফেলেন। বিশ্বস্ত লোকদের মুখ তিনি বন্ধ করেন আর বুড়ো লোকদের বিবেচনা-শক্তি নষ্ট করেন। তিনি উঁচু পদের লোকদের উপর ঘৃণা ঢেলে দেন আর শক্তিমানদের অস্ত্রহীন করেন। অন্ধকারে লুকানো বিষয়গুলো তিনি প্রকাশ করেন আর ঘন ছায়াকে আলোতে আনেন। তিনি জাতিদের মহান করেন আবার ধ্বংসও করেন, তাদের বাড়িয়ে তোলেন আবার বন্দীদশায়ও নিয়ে যান। দুনিয়ার নেতাদের বিচারবুদ্ধি তিনি দূর করেন, পথহীন নির্জন জায়গায় তাদের ঘুরে বেড়াতে দেন। তারা আলো ছাড়াই অন্ধকারে হাঁত্‌ড়ে বেড়ায়; তিনি তাদের মাতালের মত হাঁটান। “আমি এই সব নিজের চোখে দেখেছি আর নিজের কানে শুনে তা বুঝেছি। তোমরা যা জান আমিও তা জানি; আমি তোমাদের চেয়ে নীচু নই। কিন্তু আমি সর্বশক্তিমানের সংগে কথা বলতে চাই, আল্লাহ্‌র সংগে আমার ব্যাপার নিয়ে তর্ক করতে চাই। তোমরা তো সব কিছু মিথ্যা দিয়ে লেপে দিচ্ছ; তোমরা সবাই অপদার্থ ডাক্তার। আহা, তোমরা সবাই যদি চুপ করে থাকতে! তোমাদের জন্য সেটাই হত বুদ্ধিমানের কাজ। “এখন তোমরা আমার যুক্তি শোন; আমার তর্কের কথায় কান দাও। আল্লাহ্‌র পক্ষ হয়ে কি তোমরা অন্যায় কথা বলবে? তাঁর হয়ে কি ছলনার কথা বলবে? তাঁর পক্ষ হয়ে কি একচোখামি করবে? আল্লাহ্‌র হয়ে কি তর্ক করবে? তিনি যদি তোমাদের পরীক্ষা করেন তবে কি তোমাদের ভাল হবে? মানুষকে যেমন ঠকানো যায় তেমনি করে কি তোমরা তাঁকেও ঠকাতে পারবে? তোমরা যদি গোপনে একচোখামি কর তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের বকুনি দেবেন। তাঁর মহিমা কি তোমাদের ভয় জাগায় না? তাঁর ভয়ংকরতা দেখে কি তোমরা ভয় পাও না? তোমাদের নীতি কথাগুলো যেন চলতি কথার ছাইয়ের গাদা; তোমাদের তর্কের কথাগুলো কাদার মত নরম। “তোমরা চুপ করে থাক, আমাকে কথা বলতে দাও; তারপর আমার যা হবার তা-ই হোক। কেন আমি নিজেকে বিপদে ফেলব আর আমার প্রাণকে হাতে রাখব? তিনি যদি আমাকে মেরেও ফেলেন তবুও তাঁর উপর আমি আশা রাখব; আমি নিশ্চয়ই তাঁর সামনে আমার পক্ষে কথা বলব। সেটাই হবে আমার রক্ষার উপায়, কারণ কোন দুষ্ট লোক তাঁর সামনে আসতে পারবে না। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন; আমি যা বলছি তা তোমাদের কানে যাক। আমার পক্ষে যা বলবার তা আমি এখন ঠিক করেছি, তাই আমি জানি যে, আমি নির্দোষ বলে প্রমাণিত হব। কেউ কি আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে পারে? পারলে আমি নীরবে মারা যাব। তারপর তুমি আমাকে ডেকো, আমি জবাব দেব, কিংবা আমাকে কথা বলতে দাও আর তুমি তার জবাব দিয়ো। বল, আমার অন্যায় আর গুনাহ্‌ কি? আমার দোষ ও গুনাহ্‌ আমাকে দেখিয়ে দাও। কেন তুমি মুখ লুকিয়ে রাখছ আর আমাকে শত্রু বলে ভাবছ? যে পাতা বাতাসে ওড়ে তাকে কি তুমি ভয় দেখাবে? শুকনা তুষের পিছনে কি তুমি তাড়া করবে? তুমি তো আমার বিরুদ্ধে তেতো কথা লিখছ, আমার যৌবনের গুনাহের ফল আমাকে ভোগ করা"ছ। তুমি আমার পায়ে বেড়ী দিয়েছ; আমার সমস্ত পথের উপর তুমি কড়া নজর রেখেছ আর আমার পায়ের ধাপের সীমা বেঁধে দিয়েছ। “মানুষ তো পচা জিনিসের মত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর পোকায় কাটা কাপড়ের মত হচ্ছে। স্ত্রীলোকের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী মানুষের জীবন অল্পদিনের, আর তা কষ্টে পরিপূর্ণ। সে ফুলের মত ফুটে ওঠে তারপর শুকিয়ে যায়; সে ছায়ার মত চলে যায়, আর থাকে না। এই রকম একজনের উপর কি তোমার চোখ পড়েছে? বিচারের জন্য কি তুমি আমাকে তোমার সামনে আনবে? নাপাক থেকে কেউ কি পাক-পবিত্র কিছু তৈরী করতে পারে? কেউ পারে না। মানুষের আয়ু স্থির করা আছে; তুমি তার মাসের সংখ্যা ঠিক করে রেখেছ; তার সীমা তুমি ঠিক করেছ, সে তা পার হতে পারে না। কাজেই তার দিক থেকে তুমি তোমার চোখ ফিরাও, তাকে বিশ্রাম দাও; দিন্তমজুরের মতই তাকে তার সময় কাটাতে দাও। “গাছেরও আশা আছে; সেটা কেটে ফেললেও আবার গজাবে, তা থেকে আবার নতুন ডাল বের হবে। মাটির মধ্যে তার শিকড় পুরানো হয়ে যায়, তার গোড়া মাটিতে মরে যায়। তবুও পানির গন্ধ পেলে তা আবার গজায়; নতুন চারার মতই আবার তার ডালপালা বের হয়। কিন্তু মানুষ মরলে সে শেষ হয়ে যায়; সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কোথায় যায়? হ্রদের জল যেমন শুকিয়ে যায় আর নদী যেমন মরে যায়, তেমনি মানুষ মরলে আর ওঠে না; আসমান শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে আর জাগবে না, সে মরণ-ঘুম থেকে জেগে উঠবে না। “আহা, তুমি যদি আমাকে কবরে লুকিয়ে রাখতে, তোমার রাগ চলে না যাওয়া পর্যন্ত গোপন রাখতে, তারপর আমার জন্য একটা সময় ঠিক করে আবার আমাকে মনে করতে! মানুষ মরে কি আবার জীবিত হবে? যদি হয়, তবে আমার কঠিন পরিশ্রমের সব দিনগুলোতে আমি নতুন হয়ে উঠবার জন্য অপেক্ষা করব। তখন তুমি ডাকবে আর আমি সাড়া দেব; তোমার হাতে গড়া প্রাণীর জন্য তোমার প্রাণ কাঁদবে। তখন তুমি আমার পায়ের ধাপ গুণবে কিন্তু আমার গুনাহের দিকে লক্ষ্য রাখবে না। তখন তুমি একটা থলির মধ্যে আমার দোষগুলো সীলমোহর করে রাখবে আর আমার গুনাহ্‌ সব ঢেকে দেবে। “কিন্তু পাহাড় যেমন আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গিয়ে ভেংগে পড়ে, পাথর যেমন তার নিজের জায়গা থেকে সরে যায়, পানি যেমন পাথরকে ক্ষয় করে আর পানির স্রোত মাটি ধুয়ে নিয়ে যায়, তেমনি করে তুমি মানুষের আশাকে ধ্বংস কর। তুমি চিরকালের জন্য তাকে দমন কর, আর সে চলে যায়; তার চেহারা বদলে দিয়ে তুমি তাকে দূর করে দাও। তার ছেলেরা সম্মানিত হলে সে জানতে পারে না; তারা অসম্মানিত হলেও সে তা দেখতে পায় না। সে কেবল তার শরীরের যন্ত্রণা বুঝতে পারে আর নিজের জন্যই শোক করে।” তখন তৈমনীয় ইলীফস জবাবে বললেন, “কোন জ্ঞানী লোক কি এইভাবে অনর্থক কথা বলবে কিংবা পূর্বের গরম বাতাস দিয়ে পেট ভরাবে? সে কি বাজে কথা দিয়ে তর্ক করবে না কি মূল্যহীন কথা বলবে? কিন্তু তুমি তো আল্লাহ্‌কে ভয় করা ছেড়ে দিয়েছ আর আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করাও কমিয়ে দিয়েছ। তোমার গুনাহের জন্যই তুমি এইভাবে কথা বলছ আর কথা বলছ চালাক লোকদের মত। আমি নই, কিন্তু তোমার নিজের মুখই তোমাকে দোষী করছে; তুমি তোমার নিজের বিরুদ্ধেই সাক্ষি দিচ্ছ। “মানুষের মধ্যে কি তুমিই প্রথমে জন্মেছ? পাহাড়ের জন্মের আগে কি তোমার জন্ম হয়েছিল? আল্লাহ্‌র পরিকল্পনার কথা কি তুমি শুনেছ? তুমি কি একাই সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী? তুমি এমন কি জান যা আমরা জানি না, আর এমন কি বোঝ যা আমরা বুঝি না? আমাদের মধ্যে এমন একজন আছেন যাঁর চুল পেকেছে, যিনি বৃদ্ধ; তাঁর বয়স তোমার আব্বার বয়সের চেয়েও বেশী। আল্লাহ্‌র দেওয়া সান্ত্বনা কি তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়? সেই কথা তো নরমভাবে তোমাকে বলা হয়েছে। তোমার দিল কেন তোমাকে দূরে সরায়? তোমার চোখ কেন রাগে জ্বলে ওঠে? এতে তো তুমি আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে রাগ করছ আর ঐ সব কথা তোমার মুখ থেকে বের করছ। মানুষ কি যে, সে খাঁটি হতে পারে? স্ত্রীলোকের গর্ভ থেকে যে জন্মেছে সে কি যে, নির্দোষ হতে পারে? আল্লাহ্‌ যদি তাঁর ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস রাখতে না পারেন, তাঁর চোখে যদি আসমানও খাঁটি না হয়, তাহলে মানুষ, যে জঘন্য ও খারাপ এবং পানির মত খারাপী খায়, সে মোটেই খাঁটি হতে পারে না। “আমার কথা শোন, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলি; আমি যা দেখেছি তা আমি তোমাকে বলব। জ্ঞানী লোকেরা তা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন আর তা সবই প্রকাশ করেছিলেন। কেবল তাঁদের হাতেই দেশটা দেওয়া হয়েছিল, কোন বিদেশী তাঁদের জ্ঞানে ভেজাল দেয় নি। দুষ্ট লোক সারা জীবন যন্ত্রণা ভোগ করে; নিষ্ঠুরেরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই যন্ত্রণা ভোগ করবে। তার কানে ভয় জাগানো শব্দ ঢুকবে; যখন সব কিছুই ভাল চলছে বলে মনে হবে তখন লুটেরারা তাকে আক্রমণ করবে। তার কোন আশা নেই যে, সে অন্ধকার থেকে পালিয়ে আসতে পারবে; তার জন্য ঠিক হয়ে আছে ভয়ংকর মৃত্যু। সে খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় আর জিজ্ঞাসা করে তা কোথায়। সে জানে যে, অন্ধকারের দিনটা কাছে এসে গেছে। দুর্দশা ও মনের কষ্ট তাকে ভয় দেখায় আর শক্তিশালী বাদশাহ্‌র মতই তাকে আক্রমণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়, কারণ সে আল্লাহ্‌কে ঘুষি দেখায় আর সর্বশক্তিমানের বিরুদ্ধে বড়াই করে। মোটা ও শক্ত ঢাল নিয়ে ঘাড় শক্ত করে সে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে এগিয়ে যায়। “তার মুখ চর্বিতে মোটা হয়ে গেছে আর কোমর মোটা হয়েছে গোশ্‌তে। সে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরে বাস করে; যে ঘরে কেউ থাকে না, যে ঘর ধ্বংসস্তূপ হবার জন্য তৈরী হয়ে আছে, সেখানে সে বাস করে। সে আর ধনী থাকবে না, তার ধন-সম্পত্তি স্থায়ী হবে না, আর তার হাজার হাজার পশুও থাকবে না। সে অন্ধকার এড়াতে পারবে না; সে এমন গাছের মত হবে যার ডালপালা আগুনের শিখায় পুড়ে যাবে; আল্লাহ্‌র মুখের শ্বাসে সে উড়ে যাবে। বাজে জিনিসের উপর বিশ্বাস করে সে যেন নিজেকে না ঠকায়, কারণ সে তার বদলে কিছুই পাবে না। সময়ের আগেই তার পাওনা শাস্তি সে পুরোপুরি পাবে; তার ডালপালা বেড়ে উঠবে না। সে এমন আংগুর লতার মত হবে যা থেকে সব কাঁচা আংগুর ঝরে পড়ে গেছে; সে এমন জলপাই গাছের মত হবে যার ফুল ঝরে গেছে। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনদের কোন ছেলেমেয়ে থাকবে না; তাদের ঘুষের বাড়ী-ঘর আগুনে গ্রাস করবে। তাদের গর্ভে থাকবে দুষ্টতা আর তারা জন্ম দেবে খারাপীকে; তাদের গর্ভে সৃষ্টি হবে ছলনা।” তখন জবাবে আইয়ুব বললেন, “আমি এই রকম কথা অনেক শুনেছি; কি রকম কষ্ট-দেওয়া সান্ত্বনাকারী তোমরা সবাই! তোমাদের এই একটানা বাতাসের মত কথাবার্তা কখনও কি শেষ হবে না? তোমাদের কিসে পেয়েছে যে, তোমরা তর্ক করেই চলেছ? তোমাদের অবস্থা যদি আমার মত হত তবে আমিও তোমাদের মত কথা বলতে পারতাম, তোমাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে পারতাম আর তোমাদের দেখে মাথাও নাড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করতাম না, বরং আমার মুখ তোমাদের উৎসাহ দিত; আমার মুখের সান্ত্বনার কথা তোমাদের আরাম দিত। “কথা বললেও আমার যন্ত্রণা কমে না; চুপ করে থাকলেও তা দূর হয় না। হে আল্লাহ্‌, তুমি তো আমাকে ক্ষয় হতে দিয়েছ; আমার গোটা সংসারটাকে তুমি ধ্বংস করে ফেলেছ। তুমি আমার শরীর শুকিয়ে ফেলেছ, আর সেটাই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে; আমার শুকনা চেহারাই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষি দিচ্ছে। আল্লাহ্‌ আমাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করেছেন এবং রাগে আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছেন; তিনি আমাকে দেখে দাঁতে দাঁত ঘষেছেন; আমার বিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে চোখ রাংগিয়েছেন। আমাকে ঠাট্টা করবার জন্যই লোকে মুখ খোলে; ধিক্কার দিয়ে তারা আমার গালে চড় মারে আর আমার বিরুদ্ধে একসংগে জমায়েত হয়। খারাপ লোকদের কাছে আল্লাহ্‌ আমাকে তুলে দিয়েছেন; দুষ্ট লোকদের হাতে তিনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছেন। আমি শান্তিতে ছিলাম কিন্তু তিনি আমাকে চুরমার করেছেন; আমার ঘাড় ধরে তিনি আমাকে আছাড় মেরেছেন। তিনি আমাকে করেছেন তাঁর তীরের লক্ষ্যস্থান। তাঁর ধনুকধারীরা আমাকে ঘিরে ফেলেছে; নিষ্ঠুরের মত তিনি আমার কিড্‌নি চিরে দিয়েছেন আর আমার পিত্ত মাটিতে ঢেলে ফেলেছেন। বারে বারে তিনি আমার রক্ষা-দেয়াল ভেংগে ফেলেছেন, যোদ্ধার মত করে তিনি আমার দিকে দৌড়ে এসেছেন। আমার চামড়ার উপরে আমি চট পরেছি; আমার অহংকার আমি ধুলায় লুটিয়েছি। কাঁদতে কাঁদতে আমার মুখ লাল হয়েছে, আমার চোখের নীচে কালি পড়েছে; তবুও আমি কাউকে জুলুম করি নি এবং আমার মুনাজাত খাঁটি রয়েছে। “হে দুনিয়া, আমার রক্ত ঢেকে দিয়ো না; আমার কান্না যেন সব সময় শোনা যায়। এখনও আমার সাক্ষী বেহেশতে রয়েছেন; আমার পক্ষে যিনি কথা বলবেন তিনি উপরে রয়েছেন। যিনি আমার পক্ষে আছেন তিনি আমার বন্ধু, আর আমি আল্লাহ্‌র কাছে চোখের পানি ফেলি। মানুষ যেমন বন্ধুর পক্ষ হয়ে কথা বলে তেমনি যদি কেবল একজন আমার পক্ষ হয়ে আল্লাহ্‌র কাছে কথা বলতে পারত! আমাকে তো আর কয়েকটা বছর পরে সেই পথে চলে যেতে হবে যে পথে গেলে আর আমি ফিরব না। “আমার মন ভেংগে গেছে, আমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে, আমার জন্য কবর অপেক্ষা করছে। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীরা সত্যিই আমার চারপাশে আছে; তাদের বিরুদ্ধভাব আমি দেখতে পাচ্ছি। “হে আল্লাহ্‌, যে জামিন তুমি চাও আমার পক্ষে সেই জামিন তুমিই হও; কে আর আমার হয়ে জামিন হবে? তুমি তাদের বুঝবার মন বন্ধ করে দিয়েছ, কাজেই তুমি তাদের জয়ী হতে দেবে না। লাভের আশায় যদি কেউ তার বন্ধুদের দোষী করে তবে তার সন্তানেরা কষ্ট ভোগ করবে। “আল্লাহ্‌ আমাকে সকলের টিট্‌কারির পাত্র করেছেন, যার মুখে সবাই থুথু দেয় তার মতই করেছেন। আমার চোখ দুঃখে নিসে-জ হয়ে এসেছে; আমার গোটা শরীরটা ছায়ার মত হয়েছে। এতে সৎ লোকেরা খুব অবাক হবে, আর নির্দোষ লোকেরা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনদের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে; কিন্তু খাঁটি লোকেরা তাদের পথে এগিয়ে যাবে, আর যাদের হাত পাক-সাফ তারা দিনে দিনে শক্তিশালী হবে। “ভাল, তোমরা সবাই এসে আবার চেষ্টা কর। আমি তোমাদের মধ্যে কাউকেই জ্ঞানী দেখি না। আমার আয়ু প্রায় শেষ হয়েছে, আমার সব পরিকল্পনা বিফল হয়েছে, আমার দিলের ইচ্ছাগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এই লোকেরা রাতকে দিন বানায় আর অন্ধকারের মধ্যে বলে, ‘আলো আসছে’। যদি আমার ঘর হিসাবে আমি কবরকে আশা করি, অন্ধকারের মধ্যে যদি আমার বিছানা পাতি, কবরকে যদি বলি, ‘তুমি আমার বাবা,’ আর পোকাকে বলি, ‘আমার মা’ কিংবা ‘আমার বোন,’ তাহলে আমার আশা কোথায়? আর আমার আশার পূর্ণতা কে দেখতে পাবে? সেই আশা কবরের দুয়ার পর্যন্ত নেমে যাবে না; আমার সংগে তা ধুলায় মিশে যাবে না।” তখন শূহীয় বিল্‌দদ জবাবে বললেন, “তোমার এই সব কথা বলা কখন শেষ হবে? তুমি ঠিকভাবে চিন্তা কর, তাহলে আমরা কথা বলতে পারব। আমাদের কেন পশুর মত মনে করছ? তোমার চোখে কেন আমরা বুদ্ধিহীন হয়েছি? তুমি তো রাগে নিজেকে টুকরা টুকরা করছ; তোমার জন্য কি দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে? নাকি পাহাড়কে তার জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে হবে? “দুষ্টের বাতি নিভিয়ে ফেলা হবে; তার আগুনের শিখা জ্বলবে না। তার তাম্বুর মধ্যে আলো অন্ধকার হবে; তার কাছে রাখা বাতি নিভে যাবে। তার চলবার শক্তি দুর্বল হবে; তার দেওয়া পরামর্শই তাকে নীচে ফেলে দেবে। তার পা-ই তাকে জালের মধ্যে ঠেলে ফেলবে; সে সেই জালের মধ্যে পা দেবে। তার পায়ের গোড়ালী ফাঁদে পড়বে, আর ফাঁদ তাকে আটকে রাখবে। তার জন্য মাটিতে ফাঁস লুকানো থাকবে; তার পথে ফাঁদ পাতা থাকবে। ভয় তার চারপাশে থাকবে; তার প্রতিটি ধাপে তা তার পিছু নেবে। বিপদ তার জন্য হা করে আছে; সে পড়ে গেলেই ধ্বংস তার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তা তার গায়ের চামড়া খেয়ে ফেলবে; মৃত্যুর প্রথম সন্তান তার গোটা শরীরটাই গিলে ফেলবে। তার তাম্বুর নিরাপদ অবস্থা থেকে তাকে উপ্‌ড়ে ফেলা হবে; তাকে নিয়ে যাওয়া হবে ভয়-বাদশাহ্‌র কাছে। তার তাম্বুতে তার নিজের কিছুই থাকবে না; তার বাসস্থানের উপরে জ্বলন্ত গন্ধক ছড়ানো হবে। নীচে তার শিকড় শুকিয়ে যাবে আর উপরে তার ডালপালা মরে যাবে। দুনিয়া থেকে তার স্মৃতি মুছে যাবে; দেশে তার নাম থাকবে না। তাকে আলো থেকে অন্ধকারে দূর করা হবে; দুনিয়া থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। নিজের জাতির মধ্যে তার কোন বংশধর থাকবে না; সে যেখানে থাকত সেখানে আর কেউ থাকবে না। পশ্চিম দেশের লোকেরা তার দুর্ভাগ্য দেখে অবাক হবে, আর পূর্বদেশের লোকদের ভীষণ ভয় ধরে যাবে। দুষ্ট লোকের বাসস্থান সত্যিই এই রকম হবে; যে আল্লাহ্‌কে জানে না তার দশা এই রকমই হবে।” তখন জবাবে আইয়ুব বললেন, “তোমরা আর কতক্ষণ আমার মনে কষ্ট দেবে আর কথার আঘাতে আমাকে চুরমার করবে? তোমরা অনেকবার আমাকে অপমান করেছ; লজ্জাহীনভাবে তোমরা আমার সংগে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছ। যদি সত্যিই আমি বিপথে গিয়ে থাকি, তবে তার ফল তো আমার একারই পাওনা। যদি সত্যিই তোমরা আমার উপরে নিজেদের উঁচু করতে চাও, আমার এই নীচু অবস্থা নিয়ে আমার দোষ প্রমাণ করতে চাও, তাহলে জেনো যে, আল্লাহ্‌ আমার প্রতি অন্যায় করেছেন; নিজের জালে তিনিই আমাকে ঘিরেছেন। “আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলে চিৎকার করলেও আমি কোন জবাব পাই না; কান্নাকাটি করলেও কোন বিচার পাই না। তিনি আমার পথে বেড়া দিয়েছেন বলে আমি পার হতে পারছি না; আমার সব পথ তিনি অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছেন। তিনি আমার সম্মান তুলে নিয়েছেন, মাথার উপর থেকে তাজ সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি সব দিক থেকে আমাকে আঘাত করেছেন যে পর্যন্ত না আমি শেষ হয়ে যাই; গাছের মত করে তিনি আমার আশা উপ্‌ড়ে ফেলেছেন। আমার বিরুদ্ধে তাঁর রাগ জ্বলছে; তাঁর শত্রুদের একজন বলে তিনি আমাকে মনে করেন। তাঁর সৈন্যেরা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে; আক্রমণের জন্য তারা আমার বিরুদ্ধে দেয়াল পার হবার রাস্তা তৈরী করেছে, আমার তাম্বুর চারপাশে ঘেরাও করেছে। “তিনি আমার কাছ থেকে আমার ভাইদের আলাদা করে দিয়েছেন; আমার চেনা লোকেরা অচেনার মত ব্যবহার করে। আমার আত্মীয়রা চলে গেছে; আমার বন্ধুরা আমাকে ভুলে গেছে। আমার মেহমান ও বান্দীরা আমাকে যেন চেনেই না; তারা আমাকে বিদেশী হিসাবে দেখে। আমার গোলামকে ডাকলে সে সাড়া দেয় না, নিজের মুখে মিনতি করলেও জবাব দেয় না। আমার স্ত্রী আমার নিঃশ্বাস ঘৃণা করে; আমার নিজের ভাইয়েরাও আমাকে জঘন্য মনে করে। এমন কি, ছোট ছেলেমেয়েরাও আমাকে ঘৃণা করে; আমি উঠে দাঁড়ালেই তারা আমাকে ঠাট্টা-তামাশা করে। আমার সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে ঘৃণা করে; আমি যাদের ভালবাসি তারা আমার বিরুদ্ধে উঠেছে। আমি এখন হাড়-চামড়া ছাড়া আর কিছু নই, কেবল প্রাণে বেঁচে আছি। হে আমার বন্ধুরা, আমার ব্যথার ব্যথী হও, কারণ আল্লাহ্‌র হাত আমাকে আঘাত করেছে। আল্লাহ্‌র মত করে কেন তোমরা আমার পিছনে তাড়া করছ? তোমরা কি আমাকে কষ্ট দেওয়া থামাবে না? “হায়, আমার সব কথা যদি লেখা হত! সেগুলো যদি কিতাবের পাতায় থাকত! যদি পাথরের ফলকে লোহার যন্ত্র ও সীসা দিয়ে চিরকালের জন্য তা খোদাই করা থাকত! আমি জানি আমার মুক্তিদাতা জীবিত আছেন; শেষে তিনি দুনিয়ার উপরে এসে দাঁড়াবেন। আমার চামড়া ধ্বংস হয়ে যাবার পরেও আমি জীবিত অবস্থায় আল্লাহ্‌কে দেখতে পাব। আমি নিজেই তাঁকে দেখব; অন্যে নয়, কিন্তু আমি আমার নিজের চোখেই তাঁকে দেখব। আমার অন্তর আকুলভাবে তা চাইছে। যদি তোমরা বল, ‘কষ্টের গোড়া তার মধ্যে রয়েছে বলে আমরা তাকে কষ্ট দিচ্ছি,’ তবে তলোয়ারের ভয় তোমাদের থাকা উচিত, কারণ আল্লাহ্‌র রাগ তলোয়ারের মধ্য দিয়ে শাস্তি নিয়ে আসে; আর এইভাবেই তোমরা জানতে পারবে যে, বিচার আছে।” তখন নামাথীয় সোফর জবাবে বললেন, “আমার চিন্তা আমাকে জবাব দিতে বাধ্য করছে, কারণ আমি খুবই উত্তেজিত হয়েছি। আমি এমন বকুনি শুনলাম যা আমাকে অসম্মানিত করছে; আমার বুদ্ধি জবাব দিতে আমাকে জোর করছে। তুমি নিশ্চয়ই জান সেই পুরানো দিন থেকে, দুনিয়ার উপরে মানুষকে স্থাপন করার পর থেকে, দুষ্টদের আমোদ-প্রমোদ অল্পক্ষণ স্থায়ী। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনের আনন্দ কেবল এক মুহূর্তের জন্য থাকে; তার সম্মান যদিও আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায় আর মাথা আসমান ছোঁয়, তবুও সে নিজের পায়খানার মত চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা তাকে দেখেছে তারা বলবে, ‘কোথায় গেল সে?’ স্বপ্নের মত সে মিলিয়ে যাবে, তাকে আর পাওয়া যাবে না; রাতের দর্শনের মত সে অদৃশ্য হয়ে যাবে। যারা তাকে দেখত তারা আর তাকে দেখবে না; তার বাসস্থানও আর তাকে দেখবে না। গরীবদের ক্ষতিপূরণ তার ছেলেমেয়েদেরই করতে হবে; তাকে নিজের হাতে তার ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। যৌবনের শক্তিতে পরিপূর্ণ তার হাড়গুলো তার সংগে ধুলায় শুয়ে থাকবে। “খারাপ যদিও তার মুখে মিষ্টি লাগে আর সে জিভের নীচে তা লুকিয়ে রাখে, যদিও সে তা ত্যাগ করতে না চেয়ে মুখের মধ্যে রেখে দেয়, তবুও সেই খাবার তার পেটে গিয়ে টক হয়ে যাবে; তার মধ্যে তা সাপের বিষের মত হবে। যে ধন-সম্পদ সে গিলেছিল তা সে বমি করে ফেলে দেবে; আল্লাহ্‌ তার পেট থেকে তা বের করে ফেলবেন। সে সাপের বিষ চুষবে; সাপ তাঁর বিষাক্ত কামড়ে তাকে মেরে ফেলবে। দই আর মধুর স্রোত সে আর দেখতে পাবে না। যার জন্য সে পরিশ্রম করেছে তা ভোগ না করেই ফিরিয়ে দিতে হবে; ব্যবসার লাভও সে আর ভোগ করবে না; কারণ সে গরীবদের জুলুম ও অবহেলা করেছে, আর যে বাড়ী-ঘর সে নিজে তৈরী করে নি তা দখল করে নিয়েছে। “সে সব সময় লোভ করে, সেইজন্য সে কিছুই রক্ষা করতে পারবে না। গ্রাস করবার মত তার আর কিছুই বাকী থাকবে না; তার সৌভাগ্য স্থায়ী হবে না। তার প্রচুর থাকার সময়েও সে কষ্টে পড়বে; দুঃখ তার পুরো শক্তি নিয়ে তার উপর আসবে। তার পেট ভরবার সময়ে আল্লাহ্‌ তাঁর জ্বলন্ত গজব তার উপরে ঢেলে দেবেন, তা ঢেলে দেবেন বৃষ্টির মত করে। যদি সে লোহার অস্ত্রের হাত থেকে পালায়, তবে ব্রোঞ্জের ধনুক থেকে তীর তাকে বিঁধবে। সেই চক্‌চকে তীরের ফলা তার পিত্ত থেকে বের হবে, সে তার শরীর থেকে তা টেনে বের করবে। নানা রকম ভয় তার উপর আসবে। তার ধনের জন্য পরিপূর্ণ অন্ধকার অপেক্ষা করে আছে। যে আগুন মানুষ লাগায় নি সেই আগুন তাকে পুড়িয়ে ফেলবে আর তার তাম্বুর বাকী সবাইকে গ্রাস করবে। আসমান তার অন্যায় প্রকাশ করে দেবে; দুনিয়া তার বিরুদ্ধে উঠবে। বন্যায় তার ঘরের সব কিছু নিয়ে যাবে, আল্লাহ্‌র রাগের দিনে তা সম্পূর্ণভাবে ধুয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ দুষ্টদের জন্য ঐ রকম অবস্থাই ঠিক করে রাখেন; ওটাই হল তাদের জন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া অধিকার।” তখন আইয়ুব জবাবে বললেন, “তোমরা আমার কথা মন দিয়ে শোন; সেটাই হবে আমাকে দেওয়া তোমাদের সান্ত্বনা। আমার কথা বলবার সময় তোমরা আমাকে সহ্য কোরো; বলা শেষ হলে তারপর বিদ্রূপ কোরো। “আমার নালিশ কি মানুষের কাছে? কেন আমি অধৈর্য হব না? আমার দিকে তাকিয়ে তোমরা অবাক হও; তোমাদের মুখে হাত চাপা দাও। এই সব কথা ভাবলে আমি ভয় পাই; আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। দুষ্টেরা কেন বেঁচে থাকে আর কেনই বা বুড়ো হয়? কেন তাদের শক্তি বেড়ে যায়? তাদের চারপাশে থাকে তাদের সন্তানেরা, আর তাদের চোখের সামনে থাকে তাদের নাতি-নাতনীরা। তাদের বাড়ী নিরাপদ ও ভয়শূন্য থাকে; আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের উপর থাকে না। তাদের ষাঁড়গুলো মিলিত হলে তা কখনও বিফল হয় না; তাদের গাভীগুলো বাচ্চা দেয়, তাদের গর্ভ নষ্ট হয় না। ভেড়ার পালের মত তাদের ছেলেমেয়েদের তারা বাইরে পাঠায়; তারা ভেড়ার বাচ্চার মত নেচে নেচে বেড়ায়। তারা খঞ্জনি ও সুরবাহার বাজিয়ে গান করে; বাঁশীর সুর শুনে আনন্দ করে। তারা সফলতার সংগে তাদের দিন কাটায় আর শান্তিতেই কবরে নেমে যায়। তবুও তারা আল্লাহ্‌কে বলে, ‘আমাদের কাছ থেকে তুমি দূর হও; তোমার পথ জানবার ইচ্ছা আমাদের মোটেই নেই। সেই সর্বশক্তিমান কে যে, আমরা তার এবাদত করব? তার কাছে মুনাজাত করলে আমাদের কি লাভ হবে?’ কিন্তু তাদের সফলতা তো তাদের নিজেদের হাতে নয়, তাই আমি দুষ্টদের পরামর্শ থেকে দূরে থাকি। “আসলে কি দুষ্টদের বাতি নিভে যায়? কতবারই বা তাদের উপর বিপদ আসে? কতবার আল্লাহ্‌ রাগে তাদের শাস্তি দেন? কতবার তারা বাতাসের মুখে খড়ের মত হয় আর ঝড়ের মুখে উড়ে যাওয়া তুষের মত হয়? লোকে বলে, ‘একজন লোকের শাস্তি আল্লাহ্‌ তার সন্তানদের জন্য জমা করে রাখেন।’ কিন্তু আল্লাহ্‌ যেন সেই লোককেই শাস্তি দেন যাতে সে তার দোষ বুঝতে পারে। সে নিজের চোখেই নিজের ধ্বংস দেখুক; সে সর্বশক্তিমানের গজব পান করুক। তার আয়ু যখন শেষ হয়ে যাবে তখন কি সে তার ফেলে যাওয়া পরিবারের জন্য ভাববে? “কেউ কি আল্লাহ্‌কে জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারে? তিনি তো ফেরেশতাদেরও বিচার করেন। কেউ পরিপূর্ণ শক্তি, শান্তি ও আরামে থেকে মারা যায়; তার শরীর পুষ্ট হয় ও হাড়ে যথেষ্ট মজ্জা থাকে। আবার কেউ কখনও ভাল কিছু ভোগ না করে তেতো প্রাণ নিয়ে মারা যায়। তারা একই ভাবে মাটিতে শুয়ে থাকে; পোকা তাদের দু’জনকেই ঢেকে ফেলে। “তোমরা যা ভাবছ তা আমি ভাল করেই জানি; আমার বিরুদ্ধে তোমাদের সব মতলব আমার জানা আছে। তোমরা বলছ, ‘এখন কোথায় গেল সেই বড় লোকের বাড়ী? কোথায় গেল সেই দুষ্ট লোকের তাম্বু?’ তোমরা কি কখনও যাত্রীদের এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছ? তোমরা কি তাদের এই কথার কোন দামই দেবে না যে, দুষ্ট লোক বিপদের দিনে রেহাই পায় আর রাগের দিনে রক্ষা পায়? তার স্বভাবের কথা কে তার মুখের উপর বলবে? সে যা করেছে তার ফল কে তাকে দেবে? কাজেই তোমাদের এই অর্থহীন কথা দিয়ে কেমন করে তোমরা আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে? তোমাদের জবাবে মিথ্যা ছাড়া তো আর কিছুই নেই।” তখন তৈমনীয় ইলীফস জবাবে বললেন, “মানুষ কি আল্লাহ্‌র উপকার করতে পারে? এমন কি, জ্ঞানী লোক তা করতে পারে? তুমি সৎ হলে কি সর্বশক্তিমান সুখী হবেন? তুমি নির্দোষ হলে কি তাঁর লাভ হবে? আল্লাহ্‌-ভয়ের জন্য কি তিনি তোমাকে বকুনি দিচ্ছেন? সেইজন্য কি তিনি তোমার বিরুদ্ধে বিচার বসিয়েছেন? তোমার খারাপী কি অনেক নয়? তোমার গুনাহেরও তো সীমা নেই। তুমি অকারণে তোমার ভাইদের কাছ থেকে বন্ধক নিতে; তুমি লোকদের কাপড় খুলে নিয়ে তাদের উলংগ রাখতে। তুমি ক্লান্তদের পানি খেতে দিতে না; ক্ষুধার্তদের খাবার দিতে না। কেবল শক্তিশালী লোকদেরই জমাজমি আছে, কেবল সম্মানিত লোকেরাই সেখানে বাস করে; তবুও তুমি বিধবাদের খালি হাতে বিদায় করতে আর এতিমদের অধিকার কেড়ে নিতে। সেজন্যই তোমার চারপাশে ফাঁদ পাতা রয়েছে, হঠাৎ বিপদ এসে তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে, এত অন্ধকার হয়েছে যে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আর বন্যার পানি তোমাকে ঢেকে ফেলেছে। “বেহেশতের উঁচু জায়গায় কি আল্লাহ্‌ থাকেন না? দেখ, তারাগুলো কত উঁচুতে আছে! তবুও তুমি বলছ, ‘আল্লাহ্‌ কি জানেন? এই অন্ধকারের মধ্যে আল্লাহ্‌ কি করে বিচার করবেন? ঘন মেঘ তাঁকে আড়াল করে রেখেছে, সেইজন্য তিনি দেখতে পান না; আসমানের উপরে তিনি ঘুরে বেড়ান।’ অন্যায়কারীরা যে পথে চলেছে তুমি কি সেই পুরানো পথেই চলবে? অসময়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে; বন্যায় তাদের ভিত্তি ধুয়ে নিয়ে গেছে। তাদের ধ্বংস দেখে সৎ লোকেরা আনন্দ করে; নির্দোষ লোকেরা তাদের ঠাট্টা করে বলে, ‘আমাদের শত্রুরা সত্যিই ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের ধন-সম্পদ আগুনে গ্রাস করেছে।’ “তুমি আল্লাহ্‌র কথায় রাজী হও, তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুভাব রেখো না; তাহলে তোমার ভাল হবে। তাঁর মুখ থেকে উপদেশ গ্রহণ কর, আর তাঁর কালাম তোমার দিলে রাখ। যদি তুমি সর্বশক্তিমানের কাছে ফিরে যাও, তবে তোমাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। যদি তোমার তাম্বু থেকে দুষ্টতা দূর কর, তোমার সোনার টুকরাগুলো ধুলায় ফেলে দাও, আর তোমার ওফীরের সোনা খাদের পাথরগুলোর মধ্যে ফেলে দাও, তাহলে সর্বশক্তিমানই তোমার সোনা হবেন, তিনিই হবেন তোমার সবচেয়ে ভাল রূপা। তখন সত্যিই তুমি সর্বশক্তিমানকে নিয়ে আনন্দ করবে আর তোমার মুখ আল্লাহ্‌র দিকে তুলবে। তুমি তাঁর কাছে মুনাজাত করলে তিনি তা শুনবেন, আর তুমি তোমার সব মানত পূরণ করবে। তুমি যা মনে স্থির করবে তা তোমার জন্য করা হবে, আর তোমার পথের উপর আলো পড়বে। যখন তোমাকে নত করা হবে তখন তুমি বলবে, ‘আমার অহংকারের জন্যই তা হয়েছে’ তোমার নম্রতার জন্যই আল্লাহ্‌ তোমাকে উদ্ধার করবেন। এছাড়া তিনি অন্যান্য দোষী লোককেও উদ্ধার করবেন; তোমার হাত পাক-সাফ বলে তারা উদ্ধার পাবে।” তখন আইয়ুব জবাবে বললেন, “আজও আমার কান্না তিক্ততায় ভরা; আমি কাতরাচ্ছি, তবুও আল্লাহ্‌র ভারী হাত আমার উপরে রয়েছে। যদি কেবল জানতাম কোথায় তাঁকে পাওয়া যায়, যদি তাঁর বাসস্থানে আমি যেতে পারতাম, তবে আমি তাঁর কাছে আমার নালিশ জানাতাম আর আমার নিজের পক্ষে অনেক কথা বলতাম। তখন তিনি আমাকে কি জবাব দিতেন তা জানতে পারতাম, আর যা বলতেন তা বুঝতে পারতাম। তিনি কি মহাশক্তিতে আমার সংগে তর্ক করতেন? না, তিনি আমার প্রতি মনোযোগ দিতেন। তখন একজন সৎ লোক তাঁর কাছে নালিশ জানাতে পারত; আমার বিচারকের হাত থেকে চিরকালের জন্য আমি উদ্ধার পেতে পারতাম। “কিন্তু আমি যদি পূর্ব দিকে যাই সেখানে তিনি নেই; যদি পশ্চিমে যাই সেখানেও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। উত্তর দিকে তিনি যখন কাজ করেন তখন তাঁকে দেখা যায় না; তিনি দক্ষিণে ফিরলে আমি তাঁকে দেখতে পাই না। কিন্তু আমি কোন্‌ পথে যাই তা তিনি জানেন; তিনি আমাকে যাচাই করলে আমি খাঁটি সোনার মতই হব। আমি বিশ্বস্তভাবে তাঁর পিছনে চলেছি; বিপথে না গিয়ে আমি তাঁর পথেই গিয়েছি। তাঁর হুকুম থেকে আমি সরে আসি নি; আমার প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়েও তাঁর মুখের কথার আমি বেশী মূল্য দিয়েছি। কিন্তু তিনি সব কিছুতে স্থির থাকেন, কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারে না; তাঁর যা খুশী তিনি তা-ই করেন। তিনি আমার জন্য যা ঠিক করে রেখেছেন তা-ই করেন; ঐ রকম অনেক পরিকল্পনা তাঁর এখনও জমা রয়েছে। কাজেই আমি তাঁর সামনে ভীষণ ভয় পাই; এই সব ভাবলে তাঁকে আমার ভয় লাগে। আল্লাহ্‌ আমার অন্তর দুর্বল করেছেন; সর্বশক্তিমান আমাকে ভীষণ ভয় দেখিয়েছেন। যদিও অন্ধকার আমার মুখ ঢেকে রেখেছে তবুও তা আমাকে চুপ রাখতে পারে নি, ঘন অন্ধকারও তা পারে নি। “সর্বশক্তিমান কেন বিচারের জন্য সময় ঠিক করেন না? যারা তাঁকে জানে তারা কেন সেই দিন দেখতে পায় না? লোকে সীমার পাথর সরিয়ে দেয়; তারা ভেড়ার পাল চুরি করে এবং তা চরায়। তারা এতিমদের গাধা নিয়ে যায় আর বিধবার গরু বন্ধক রাখে। তারা পথ থেকে অভাবীদের তাড়িয়ে দেয়; তাদের দরুন দেশের সব গরীবেরা লুকিয়ে থাকে। গরীবেরা মরুভূমির বুনো গাধার মত খাবারের খোঁজ করে; মরুভূমি তাদের ছেলেমেয়েদের খাবার যোগায়। তারা মাঠে গিয়ে পশুদের খাবার নিজেদের জন্য যোগাড় করে আর দুষ্টদের আংগুর ক্ষেত থেকে পড়ে থাকা আংগুর কুড়ায়। কাপড়ের অভাবে তারা উলংগ হয়ে রাত কাটায়; শীতকালে গায়ে দেবার জন্য তাদের কিছুই থাকে না। তারা পাহাড়ী বৃষ্টিতে ভেজে আর আশ্রয়ের অভাবে পাথরের কাছে জড়সড় হয়। এতিম শিশুকে সেই দুষ্টেরা মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেয় আর ঋণের জন্য গরীবের সন্তানকে বন্ধক রাখে। কাপড়ের অভাবে গরীবেরা উলংগ হয়ে ঘুরে বেড়ায়; তারা খিদে নিয়েই শস্যের আঁটি বহন করে। তারা বাগানে জাঁতা দিয়ে জলপাইয়ের তেল বের করে; তারা পিপাসা নিয়ে আংগুর মাড়াই করে। শহরের মধ্যে মানুষের কোঁকানি শোনা যায়, আহত লোকেরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করে; কিন্তু আল্লাহ্‌ তাদের কান্নায় মনোযোগ দেন না। “অনেকে আলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে; তারা আলো সম্বন্ধে জানে না কিংবা তার পথেও থাকে না। খুনী ফজরে উঠে গরীব আর অভাবীদের হত্যা করে, আর রাতের বেলায় সে চোর হয়ে চুরি করে। জেনাকারীর চোখ সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করে; সে তার মুখ ঢেকে রেখে ভাবে কারও চোখ তার উপর পড়বে না। অন্ধকার হলে লোকে ঘরে সিঁধ কাটে, কিন্তু দিনের বেলায় তারা লুকিয়ে থাকে; আলোর সংগে তাদের কোন সম্পর্ক থাকে না। তাদের জন্য সকালবেলা গাঢ় অন্ধকারের মত; অন্ধকারের ভয়ংকরতার সংগে তাদের বন্ধুত্ব আছে। “তারা পানির উপরকার ফেনার মত; তাদের ভাগের জমি বদদোয়াপ্রাপ্ত, কাজেই তারা কেউ আংগুর ক্ষেতে যায় না। গরম আর খরা যেমন বরফ-গলা পানি গ্রাস করে, কবরও তেমনি করে গুনাহ্‌গারদের গ্রাস করে। মা তাদের ভুলে যায়, পোকারা তাদের শরীর খেয়ে ফেলে; খারাপ লোকদের কেউ মনে রাখে না, তারা গাছের মত ভেংগে পড়ে। তারা বন্ধ্যা স্ত্রীলোককে গ্রাস করে আর বিধবাদের দয়া করে না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর কুদরতে সেই বলবানদের টেনে নামান; তারা প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। তিনি দুষ্টদের নিরাপদে বিশ্রাম দিতে পারেন, কিন্তু তাঁর চোখ থাকে তাদের পথের দিকে। কিছু সময়ের জন্য তাদের উন্নতি হয়, তারপর তারা আর থাকে না। তাদের নীচু করা হয়, ঘাসের মত তারা ্নান হয়ে যায়, আর শস্যের শীষের মতই তারা শুকিয়ে যায়। যদি তা না-ই হয় তবে কে আমার কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবে? আমার কথা যে সত্যি নয় তা কে বলতে পারবে?” তখন শূহীয় বিল্‌দদ জবাবে বললেন, “রাজ্য আল্লাহ্‌রই, ভয় তাঁরই পাওনা; বেহেশতের উঁচু জায়গায় তিনি শান্তি স্থাপন করেন। তাঁর সৈন্যদল কি গোণা যায়? তাঁর আলো কার উপরে না ওঠে? তাহলে আল্লাহ্‌র কাছে মানুষ কি নির্দোষ হতে পারে? স্ত্রীলোকের গর্ভ থেকে যে জন্মেছে সে কি খাঁটি হতে পারে? আল্লাহ্‌র চোখে যদি চাঁদ উজ্জ্বল না হয় আর তারাগুলো খাঁটি না হয়, তাহলে মানুষ কি করে খাঁটি হতে পারে? সে তো একটা পোকার মত; মানুষের সন্তান তো একটা কেঁচো ছাড়া আর কিছু নয়।” তখন জবাবে আইয়ুব বললেন, “তুমি শক্তিহীনকে এ কেমন সাহায্য করলে আর দুর্বলকে এ কেমন রক্ষা করলে? জ্ঞানহীনকে এ কেমন পরামর্শ দিলে আর মহাজ্ঞান প্রকাশ করলে? তুমি কার সাহায্যে এই সব কথা বলছ? কার কথা তোমার মুখ থেকে বের হয়ে এসেছে? “মৃত লোকেরা ভয়ে ভীষণ কাঁপছে; তারা কাঁপছে পানির নীচে আর পানিতে বাসকারীদের নীচে। আল্লাহ্‌র সামনে কবর ঢাকা নেই; ধ্বংসের স্থান খোলাই রয়েছে। তিনি শূন্যে উত্তরের আসমান বিছিয়ে দিয়েছেন; শূন্যের মধ্যে দুনিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাঁর মেঘের মধ্যে তিনি পানি আট্‌কে রাখেন, কিন্তু তার ভারে মেঘ ফেটে যায় না। তিনি পূর্ণিমার চাঁদের মুখ ঢেকে দেন, তার উপরে তাঁর মেঘ বিছিয়ে দেন। আলো ও অন্ধকার যেখানে গিয়ে মিলিত হয় সেখানে তিনি আকাশ ও সাগরের মধ্যে সীমানা টেনেছেন। আকাশের থামগুলো কেঁপে ওঠে, তাঁর বকুনিতে সেগুলো চম্‌কে ওঠে। তিনি নিজের কুদরতীতে সমুদ্রকে তোলপাড় করেন; তাঁর দক্ষতা দিয়ে তিনি রহবকে টুকরা টুকরা করেন। তাঁর নিঃশ্বাসে আসমান পরিষ্কার হয়; তাঁর হাত পালিয়ে যাওয়া সাপকে বিদ্ধ করে। এই সবই তাঁর কাজের মাত্র একটুখানি প্রকাশ, আমরা তাঁর বিষয়ে কেবল একটুখানি ফিস্‌ফিসানি শুনতে পাই; তাঁর কুদরতের গর্জন কে বুঝতে পারে?” আইয়ুব তাঁর কথা বলতেই থাকলেন। তিনি বললেন, “যিনি আমার বিচার করতে অস্বীকার করছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম, যিনি আমার প্রাণকে তেতো করে তুলেছেন সেই সর্বশক্তিমানের কসম যে, যতদিন আমার মধ্যে জীবন আছে, যতদিন আল্লাহ্‌র নিঃশ্বাস আমার নাকের মধ্যে আছে, ততদিন আমার মুখ অন্যায় কথা বলবে না, আমার জিভ্‌ ছলনার কথা বলবে না। তোমাদের কথা যে ঠিক তা কখনও আমি মেনে নেব না; আমার মরণ দিন পর্যন্ত আমি বলব যে, আমি সত্যি কথা বলেছি। আমি যে নির্দোষ সেই দাবি আমি ছাড়ব না, বলতেই থাকব। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন আমার বিবেক আমাকে দোষী করবে না। “আমার শত্রুরা দুষ্টদের মত হোক; আমার বিপক্ষেরা অন্যায়কারীর মত হোক। আল্লাহ্‌ যখন তাঁর প্রতি ভয়হীনদের শেষ করে দেন, তখন তাদের আর কোন আশাই থাকে না। তাদের উপর কষ্ট আসলে কি আল্লাহ্‌ তাদের কান্না শোনেন? তারা কি সর্বশক্তিমানকে নিয়ে আনন্দ পায়? তারা কি সব সময় আল্লাহ্‌কে ডাকে? আল্লাহ্‌র ক্ষমতার বিষয় আমি তোমাদের শিক্ষা দেব; সর্বশক্তিমানের বিষয় আমি গোপন করে রাখব না। তোমরা তো সবাই এই সব দেখেছ, তাহলে এই অসার কথাবার্তা বলছ কেন? “আল্লাহ্‌ দুষ্টদের ভাগ্যে যা রেখেছেন, সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে নিষ্ঠুর লোকেরা যে অধিকার পায় তা এই: তাদের ছেলেমেয়ে অনেক হলেও তাদের জন্য ঠিক হয়ে আছে ভয়ংকর মৃত্যু; তাদের সন্তানেরা কখনও যথেষ্ট খাবার পাবে না। তাদের পরে যারা বেঁচে থাকবে তাদের মৃত্যু হবে মহামারীতে; তাদের বিধবারা তাদের জন্য কাঁদবে না। ধুলার মত তারা রূপা জমা করলেও আর কাদার ঢিবির মত কাপড়-চোপড় জমা করলেও তাদের সেই কাপড়-চোপড় সৎ লোকেরা পরবে, আর নির্দোষ লোকেরা সেই রূপা ভাগ করে নেবে। তাদের তৈরী ঘর যেন পোকার বাসা, তা যেন পাহারাদারদের মাচা-ঘর। তারা শেষ বারের মতই ধনী অবস্থায় ঘুমাতে যায়, কিন্তু চোখ খুললে পর তারা দেখে সবই শেষ হয়ে গেছে। বন্যার মতই ভয় তাদের ধরে ফেলবে, রাতে ঝড় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পূবের বাতাস তাদের তুলে নিয়ে যাবে, তারা চলে যাবে; তাদের জায়গা থেকে সেই বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই জোর বাতাস থেকে যখন তারা তাড়াতাড়ি পালাতে চাইবে তখন নিষ্ঠুরভাবে তা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই বাতাস যেন বিদ্রূপে হাততালি দেয় আর তাদের জায়গা থেকে হিস্‌হিস্‌ শব্দ করে তাদের বের করে দেয়। “রূপার খনি আছে আর সোনা পরিষ্কার করবার জায়গাও আছে। মাটি থেকে লোহা তোলা হয়, আর ধাতু-পাথর গলিয়ে বের করা হয় তামা। দুনিয়ার গভীরে ঘন কালো অন্ধকারে যা রয়েছে মানুষ অন্ধকার দূর করে সেই দামী পাথরের খোঁজ করে। মানুষের বাসস্থান থেকে দূরে যেখানে মানুষ যায় না সেখানে সে গর্ত খোঁড়ে, আর সেই গর্তের মধ্যে সে ঝুলতে ও দুলতে থাকে। যে দুনিয়ার উপরে ফসল জন্মে, মানুষ সেই দুনিয়ার গভীরে আগুন দিয়ে ভেংগে চুরমার করে। দুনিয়ার পাথরের মধ্যে নীলকান্তমণি থাকে, আর মাটির মধ্যে থাকে সোনা। খনির গোপন পথ শকুন জানে না, কোন বাজপাখীর চোখ তা দেখে নি; কোন হিংস্র পশু সেখানে পা রাখে নি, কোন সিংহও সেখানে যায় নি। সেই কঠিন পাথরে মানুষই হাত দেয় আর পাহাড়ের গোড়ায় গভীরভাবে খোঁড়ে। সে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সুড়ংগ কাটে; সেখানকার সব মূল্যবান জিনিস তার চোখে পড়ে। সে ঝর্ণার পানি পড়া বন্ধ করে আর লুকানো জিনিসগুলো আলোতে আনে। “কিন্তু জ্ঞান কোথায় পাওয়া যায়? আর বুদ্ধিই বা কোথায় থাকে? লোকে তার মূল্য জানে না; জীবিতদের দেশে তা পাওয়া যায় না। গভীর পানি বলে, ‘তা আমার মধ্যে নেই,’ সাগর বলে, ‘তা আমার কাছে নেই।’ খাঁটি সোনা দিয়েও তা কেনা যায় না, অনেক রূপা দিয়েও তার দাম দেওয়া যায় না। ওফীরের সোনা দিয়ে তা কেনা যায় না, বৈদুর্যমণি বা নীলকান্তমণি দিয়েও তা কেনা যায় না। সোনা কিংবা দামী কাঁচের সংগেও তার তুলনা হয় না, সোনার পাত্রের বদলেও তা পাওয়া যায় না। তার কাছে প্রবাল ও স্ফটিকেরও দাম নেই; পদ্মরাগমণির চেয়েও জ্ঞানের মূল্য বেশী। তার সংগে ইথিওপিয়া দেশের পোখরাজমণিরও তুলনা হয় না; খাঁটি সোনা দিয়ে তা কেনা যায় না। “তাহলে জ্ঞান কোথা থেকে আসে? আর বুদ্ধিই বা কোথায় থাকে? সমস্ত প্রাণীর চোখের কাছ থেকে তা লুকানো আছে, এমন কি, আকাশের পাখীদের কাছ থেকেও তা গোপন আছে। দোজখ ও মৃত্যু বলে, ‘তার একটুখানি উড়ো খবর আমাদের কানে এসে পৌঁছেছে।’ “আল্লাহ্‌ তার পথ বুঝতে পারেন; তিনিই কেবল জানেন তা কোথায় থাকে, কারণ তিনি দুনিয়ার শেষ সীমাও দেখেন; আসমানের নীচের সব কিছুই তাঁর চোখে পড়ে। তিনি যখন বাতাসে শক্তি যোগালেন আর পানির পরিমাণ ঠিক করলেন, যখন তিনি বৃষ্টির জন্য নিয়মের ব্যবস্থা করলেন আর বাজ পড়া ও বিদ্যুৎ চম্‌কাবার পথ ঠিক করলেন, তখন তিনি জ্ঞানকে দেখলেন এবং তা মাপলেন; তিনি তা ভাল করে দেখলেন এবং তাঁর খোঁজ-খবর নিলেন। তারপর তিনি মানুষকে বললেন, ‘দীন-দুনিয়ার মালিকের প্রতি ভয়ই হল জ্ঞান, আর খারাপ থেকে সরে যাওয়াই হল বুদ্ধি।’॥ঃযং ” তারপর আইয়ুব আরও বললেন, “আহা, আল্লাহ্‌ যখন আমার দেখাশোনা করতেন তখনকার মাস ও দিনগুলো যদি আমি ফিরে পেতাম! আমার মাথার উপর তখন তাঁর বাতি জ্বলত, আর তাঁর আলোতে আমি অন্ধকারের মধ্যে চলাফেরা করতাম। আমার সেই সফলতার দিনগুলোতে আল্লাহ্‌ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুভাব দিয়ে আমার তাম্বুকে দোয়া করতেন। সর্বশক্তিমান তখন আমার সংগে ছিলেন আর আমার চারপাশে আমার ছেলেমেয়েরা ছিল; আমার জীবন্তপথ আরামে ভরা ছিল, আর আমার জন্য পাথর থেকে জলপাই-তেলের স্রোত বইত। “যখন আমি শহরের সদর দরজায় গিয়ে সেখানকার চকে আমার আসন গ্রহণ করতাম, তখন যুবকেরা আমাকে দেখে সরে দাঁড়াত আর বুড়ো লোকেরা উঠে দাঁড়াতেন; উঁচু পদের লোকেরা কথা বলা বন্ধ করতেন আর হাত দিয়ে মুখ ঢাকতেন; নেতাদের গলার আওয়াজ থেমে যেত, আর তাদের জিভ্‌ তালুতে আট্‌কে যেত। যারা আমার কথা শুনত তারা আমাকে মোবারক বলত, আর যারা আমাকে দেখত তারা আমার প্রশংসা করত, কারণ সাহায্যের জন্য যে গরীবেরা কাঁদত আর যে এতিমদের সাহায্যকারী কেউ ছিল না, তাদের আমি রক্ষা করতাম। মরে যাচ্ছে এমন লোকও আমার প্রশংসা করত; বিধবার অন্তরে আমি আনন্দের গান জাগাতাম। সততা আমি কাপড়ের মত পরতাম, আর সততা আমাকে তার বশে রাখত; আমি ছিলাম অন্ধদের চোখ আর খোঁড়াদের পা। আমি অভাবীদের আব্বার মত ছিলাম, আর অচেনাদের পক্ষে আমি তাদের বিচারের ভার নিতাম। আমি দুষ্টদের চোয়াল ভেংগে দিতাম আর তাদের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নিতাম। “আমি ভাবতাম আমার আপন লোকদের মধ্যে আমি মারা যাব, বালুকণার মতই আমার দিনগুলো অসংখ্য হবে; ভাবতাম আমার শিকড় পানিতে গিয়ে পৌঁছাবে, আমার ডালপালার উপরে সারা রাত ধরে শিশির পড়বে; ভাবতাম লোকদের কাছে আমার সম্মান ম্লান হবে না, আমার যৌবন্তশক্তি সব সময় নতুন থাকবে। “লোকে আমার কথা শুনবার জন্য অপেক্ষা করত, আমার পরামর্শের জন্য নীরব থাকত। আমার কথার পরে তারা আর কথা বলত না; আমি তাদের কাছে নরমভাবে কথা বলতাম। বৃষ্টির জন্য যেমন লোকে অপেক্ষা করে তেমনি তারা আমার কথার জন্য অপেক্ষা করত; বসন্তকালের বৃষ্টির মতই তারা আমার কথা গ্রহণ করত। আমি সাধারণ লোকদের দিকে তাকিয়ে হাসলে তারা আশ্চর্য হত; আমার হাসি তারা মনে গেঁথে রেখে আশায় বুক বাঁধত। আমি তাদের পথ ঠিক করে দিতাম আর তাদের নেতার মত বসতাম; সৈন্যদলের মধ্যে বাদশাহ্‌ যেমন, আমি তেমনই ছিলাম; যারা শোক করত তাদের আমি সান্ত্বনা দিতাম। “কিন্তু এখন যারা আমার চেয়ে বয়সে ছোট তারা আমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে; তাদের পিতাদের আমি আমার ভেড়ার পাল রক্ষাকারী কুকুরদের সংগে রাখতেও ঘৃণা বোধ করতাম। তাদের শক্তি আমার কি কাজে লাগত? তাদের কোন শক্তিই ছিল না। অভাব ও খিদের দরুন তাদের চেহারা শুকনা ছিল; তারা রাতের বেলায় নির্জন পোড়ো জায়গায় যা পেত তা-ই চিবাত। তারা ঝোপের মধ্য থেকে স্বাদহীন শাক তুলত; রেতম গাছের শিকড় তাদের খাবার ছিল। লোকসমাজ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল; তারা যেন চোর সেইভাবে লোকেরা তাদের পিছনে চিৎকার করত। শুকনা নদীর বুকে তাদের বাস করতে হত; তারা মাটির গর্তে ও পাহাড়ের ফাটলে থাকত। ঝোপের মধ্য থেকে তারা গাধার মত ডাকত, আগাছার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে বাস করত। তারা ছিল অপদার্থ ও দুর্নামের পাত্র; দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। “আর এখন তাদের ছেলেরা গান গেয়ে গেয়ে আমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে; তাদের কাছে আমি হয়েছি একটা টিট্‌কারির পাত্র। তারা আমাকে ঘৃণা করে আমার কাছ থেকে দূরে থাকে; আমার মুখে থুথু ফেলতেও তারা ভয় পায় না। আল্লাহ্‌ আমাকে শক্তিহীন করেছেন আর আমাকে কষ্টে ফেলেছেন; কাজেই তারা কোন বাধা না মেনেই আমার বিরুদ্ধে উঠেছে। উগ্র যুবকেরা যেন ডান দিক থেকে আমাকে আক্রমণ করে আর আমাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে; আমাকে আক্রমণ করতে তারা দেয়াল পার হবার জন্য ঢিবি তৈরী করে। তারা আমার পথ আট্‌কায়; কারও সাহায্য ছাড়াই তারা আমার সর্বনাশ করে। তারা যেন দেয়ালের বড় ফাঁকের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে; ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়েও তারা তাড়াতাড়ি এসে পড়ে। নানারকম ভয় আমাকে ঢেকে ফেলে; সেই ভয় আমার সম্মানকে বাতাসের মত উড়িয়ে দেয়; আমার সফলতা মেঘের মত মিলিয়ে যায়। “এখন আমার জীবনে ভাটা পড়েছে; কষ্টের দিনগুলো আমাকে আক্রমণ করেছে। রাতে আমার হাড়ের মধ্যে ভীষণ ব্যথা করে; সেই চিবানো ব্যথা কখনও থামে না। আল্লাহ্‌ কুস্তিগীরের মত তাঁর মহাশক্তিতে আমার কাপড় ধরেন, আমার কোর্তার গলার মত করে তিনি আমাকে জাপ্‌টে ধরেন; তারপর তিনি আমাকে কাদায় ছুঁড়ে ফেলে দেন। আমি তো ধুলা আর ছাইয়ের মত হয়ে গেছি। “হে আল্লাহ্‌, আমি তোমার কাছে ফরিয়াদ জানাই, কিন্তু তুমি জবাব দাও না; আমি দাঁড়িয়ে থাকি, কিন্তু তুমি কেবল আমার দিকে চেয়ে দেখ। তুমি আমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করছ; তোমার কুদরতীর হাতে তুমি আমাকে আক্রমণ করেছ। তুমি আমাকে তুলে নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিয়েছ; ঝড়ের মধ্যে ফেলে তুমি আমাকে নাচা"ছ। আমি জানি তুমি আমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছ, সমস্ত জীবিত লোকদের জন্য ঠিক করা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছ। “যে পড়ে গেছে আর কষ্টের মধ্যে সাহায্যের জন্য কান্নাকাটি করছে তাকে কি কেউ আঘাত করে? যারা কষ্টে পড়েছে তাদের জন্য কি আমি কাঁদি নি? গরীবদের জন্য কি আমি প্রাণে ব্যথা পাই নি? কিন্তু যখন আমি উপকারের আশা করলাম তখন অপকার ঘটল; যখন আলোর অপেক্ষা করলাম তখন অন্ধকার হল। আমার ভিতরটা তোলপাড় করছে, থামছে না; যন্ত্রণার দিন আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে। আমি রোদহীন দিনের মত কালো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি; আমি সভার মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে সাহায্য চাই। আমি শিয়ালের ভাই ও উটপাখীর বন্ধু হয়েছি। আমার চামড়া কালো হয়ে উঠে যাচ্ছে; জ্বরে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমার বীণা থেকে এখন দুঃখের সুর বের হয়, আর বাঁশী থেকে বের হয় বিলাপের সুর। “কামনা নিয়ে কোন যুবতী মেয়ের দিকে তাকাব না বলে আমার চোখের সংগে আমি একটা চুক্তি করেছি। বেহেশতবাসী আল্লাহ্‌র কাছ থেকে মানুষ কি পায়? বেহেশতের সর্বশক্তিমানের কাছে তার পাওনাই বা কি? তা কি দুষ্টদের জন্য ধ্বংস নয়? যারা খারাপ কাজ করে তাদের জন্য বিপদ নয়? তিনি কি আমার চলাফেরা দেখেন না? আমার প্রতিটি ধাপ কি তিনি গোণেন না? “আমি সত্যিই বলছি যে, আমি মিথ্যার মধ্যে চলাফেরা করি নি, আমার পা ছলনার পিছনে দৌড়ায় নি। সঠিক দাঁড়িপাল্লায় আল্লাহ্‌ যেন আমাকে ওজন করেন, তাহলে তিনি জানতে পারবেন যে, আমি নির্দোষ। যদি আমি বিপথে পা দিয়ে থাকি, আমার চোখ যদি আমার দিলকে গুনাহ্‌ করিয়ে থাকে, কিংবা আমার হাতে যদি কোন গুনাহের দাগ লেগে থাকে, তবে আমি যা বুনেছি তা যেন অন্যেরা খায়, আমার শস্য যেন উপ্‌ড়ে ফেলা হয়। “আমার দিল যদি কোন স্ত্রীলোকের দিকে গিয়ে থাকে, কিংবা যদি প্রতিবেশীর দরজার কাছে আমি ওৎ পেতে থাকি, তবে আমার স্ত্রী যেন অন্য লোকের জাঁতা ঘুরায়, আর অন্য লোক যেন তার সংগে শোয়। আমার পক্ষে তা হবে একটা জঘন্য কাজ, বিচারকদের দ্বারা শাস্তি পাওয়ার মত গুনাহ্‌। সেই গুনাহ্‌ এমন আগুনের মত যা কবর পর্যন্ত জ্বলছে, তা আমার সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে। “আমার গোলাম ও বান্দীরা আমার বিরুদ্ধে কোন নালিশ জানালে যদি আমি তার বিচার করতে রাজী না হয়ে থাকি, তবে আল্লাহ্‌ যখন আমার মুখোমুখি হবেন তখন আমি কি করব? আমি তাঁকে কি কৈফিয়ৎ দেব? যিনি আমাকে গর্ভের মধ্যে তৈরী করেছেন, তিনি কি তাদেরও তৈরী করেন নি? একই জন কি মায়ের গর্ভে আমাদের গড়েন নি? “আমি যদি গরীবদের অভাব না মিটিয়ে থাকি, কিংবা বিধবাদের নিরাশ করে থাকি, যদি আমার খাবার আমি এতিমদের না দিয়ে একা খেয়ে থাকি- অবশ্য আমার অল্প বয়স থেকেই তাদের আমি আব্বার মত পালন করেছি আর আমার জন্মের পর থেকেই বিধবাদের দেখাশোনা করেছি- যদি আমি কাউকে কাপড়-চোপড়ের অভাবে মরতে দেখে থাকি কিংবা অভাবী লোককে উলংগ দেখে থাকি, ভেড়ার লোমের কাপড় দিয়ে তাকে গরমে রেখেছি বলে যদি তার দিল আমার প্রশংসা না করে থাকে, বিচার-সভায় আমার ক্ষমতা আছে বলে আমি যদি এতিমদের গায়ে হাত তুলে থাকি, তাহলে কাঁধ থেকে আমার হাত যেন খসে পড়ে, হাড়ের জোড়া থেকে যেন তা ভেংগে পড়ে, কারণ আমি আল্লাহ্‌র দেওয়া শাস্তির ভয় করি; তাঁর মহিমা এত বেশী যে, তাঁর ভয়ে আমি ঐ সব করতে পারি না। “সোনার উপর যদি আমি ভরসা করে থাকি, কিংবা খাঁটি সোনাকে বলে থাকি, ‘তোমার উপরেই আমার নির্ভরতা,’ আমার নিজ হাত দিয়ে যে সম্পদ আমি লাভ করেছি সেই মহাধন নিয়ে যদি আমি আনন্দ করে থাকি, যদি উজ্জ্বল সূর্যের এবং জ্যোৎস্না-ভরা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর তাতে যদি আমার দিল গোপনে তাদের দিকে গিয়ে থাকে, তাদের চুম্বন করবার উদ্দেশ্যে যদি আমার হাতে চুম্বন করে থাকি, তাহলে এগুলোও হল শাস্তি পাবার মত গুনাহ্‌, কারণ তাতে আমি বেহেশতের আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করেছি। “আমার শত্রুর দুর্ভাগ্যে আমি আনন্দ করি নি কিংবা তার কষ্টের সময়ে খুশী হই নি। তার প্রাণের বিরুদ্ধে বদদোয়ার কথা বলে আমার মুখকে আমি গুনাহ্‌ করতে দিই নি। আমার ঘরের লোকেরা তো এই কথাই বলত, ‘হুজুরের দেওয়া গোশ্‌তে কে না পেট ভরেছে?’ কোন বিদেশীকে রাস্তায় রাত কাটাতে হয় নি, কারণ যাত্রীদের জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা থাকত। অন্যান্য মানুষের মত আমি গুনাহ্‌ গোপন করে রাখি নি আর আমার দিলে দোষ লুকিয়ে রাখি নি; কাজেই আমি লোকদের ভয় করতাম না, আর আমার বংশের লোকদের ঘৃণার ভয়ে আমি ঘরে চুপ করে বসে থাকতাম না। “হায়, আমার কথা যদি কেউ শুনত! আমি সই দিয়ে সাক্ষি দিচ্ছি যে, আমার কথা সত্যি; সর্বশক্তিমান যেন আমাকে জবাব দেন, আমার বিবাদী যেন আমার দোষ লিখে দেখান। আমি নিশ্চয়ই তা আমার কাঁধে লাগিয়ে রাখব আর তাজের মত করে মাথায় পরব। আমার প্রতিটি ধাপের হিসাব আমি তাঁকে দেব; রাজপুত্রের মত আমি তাঁর কাছে এগিয়ে যাব। “আমার জমি যদি আমার বিরুদ্ধে চিৎকার করে ওঠে আর চাষ করা জমি চোখের পানিতে ভিজে ওঠে, যদি আমি দাম না দিয়ে তার ফসল খেয়ে থাকি কিংবা সেখানকার মালিকদের নিষ্ঠুরভাবে যন্ত্রণা দিয়ে থাকি, তবে যেন সেখানে গমের বদলে কাঁটাগাছ গজায় আর যবের বদলে জন্মায় আগাছা।” এখানে আইয়ুবের কথা শেষ হয়েছে। আইয়ুব নিজের চোখে নিজেকে ন্যায়বান মনে করছিলেন বলে ঐ তিনজন আইয়ুবের কথার জবাব দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। এতে রামের বংশের বূষীয় বারখেলের ছেলে ইলীহূ আইয়ুবের উপর ভীষণ রেগে গেলেন, কারণ আইয়ুব আল্লাহ্‌র চেয়ে নিজেকে ন্যায়বান মনে করছিলেন। তিনি ঐ তিনজন বন্ধুর উপরেও খুব রেগে গেলেন, কারণ তাঁরা আইয়ুবের কথার জবাব দিতে না পেরেও তাঁকে দোষী করছিলেন। তাঁদের সকলের চেয়ে ইলীহূ বয়সে ছোট ছিলেন বলে আইয়ুবকে জবাব দেবার জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। পরে ঐ তিনজন লোকের জবাব দেবার আর কিছু নেই দেখে তিনি রাগে জ্বলে উঠলেন। সেইজন্য বারখেলের ছেলে ইলীহূ বললেন, “আমার বয়স কম, কিন্তু আপনারা বুড়ো হয়েছেন, কাজেই আমার মতামত প্রকাশ করতে আমি সাহস করি নি, ভয় করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, যাঁদের বয়স বেশী তাঁরাই কথা বলুন, তাঁরাই জ্ঞান শিক্ষা দিন যাঁদের অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সত্যিই মানুষের মধ্যে রূহ্‌ আছে, আর সর্বশক্তিমানের নিঃশ্বাস তাকে বুঝবার শক্তি দেয়। কেবল বুড়ো লোকেরাই যে জ্ঞানবান তা নয়, যাঁদের বয়স বেশী কেবল তাঁরাই যে সঠিক বিষয় বোঝেন তা নয়। “সেইজন্য আমি বলছি, আমার কথা শুনুন; আমিও আমার মতামত প্রকাশ করব। আপনাদের কথা বলবার সময় আমি অপেক্ষা করে ছিলাম। যখন আপনারা কি বলবেন তাঁর খোঁজ করছিলেন তখন আমি আপনাদের যুক্তি শুনছিলাম। আমি আপনাদের কথায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনাদের মধ্যে একজনও আইয়ুবের কথার ভুল প্রমাণ করেন নি; তাঁর কথার জবাবও আপনারা দেন নি। এই কথা বলবেন না, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মানুষ নয় কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁকে হারিয়ে দিতে পারেন।’ আইয়ুব আমার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি; আপনাদের যুক্তি দিয়ে আমি তাঁকে জবাব দেব না। “এঁরা হতভম্ব হয়েছেন, এঁদের আর কিছু বলবার নেই; এঁদের কথা হারিয়ে গেছে। এঁরা তো এখন চুপ করেছেন, জবাব না দিয়ে এঁরা থেমে গেছেন; আর কি আমার অপেক্ষা করা উচিত? এখন আমিও আমার কথা বলব, আমার মতামত আমি প্রকাশ করব; কারণ আমার বলবার মত অনেক কথা আছে, আমার রূহ্‌ আমাকে কথা বলতে বাধ্য করছে। আমার ভিতরটা থলিতে ভরা আংগুর-রসে ফেটে যাবার মত হয়েছে, নতুন চামড়ার থলির মতই ফেটে যাবার মত হয়েছে। শান্ত হবার জন্য আমাকে কথা বলতে হবে; মুখ খুলে আমাকে জবাব দিতে হবে। আমি কারও প্রতি একচোখামি করব না, কিংবা কোন মানুষকে তোষামোদ করব না; আমি তোষামোদ করতে জানি না; যদি তা করি তবে আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে শীঘ্রই তুলে নিয়ে যাবেন। “যাহোক, আইয়ুব, এবার আমার কথা শুনুন; আমি যা বলব তাতে মন দিন। আমি মুখ খুলতে যাচ্ছি; আমার কথা আমার জিভের আগায় এসেছে। আমার কথা খাঁটি দিল থেকে আসছে; আমি যা জানি তা আমার মুখ সরলভাবে বলবে। আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমাকে তৈরী করেছেন; সর্বশক্তিমানের নিঃশ্বাসে আমি জীবন পাচ্ছি। আপনি যদি পারেন তবে আমাকে জবাব দিন; নিজের কথা গুছিয়ে নিয়ে আমার মুখোমুখি হন। আল্লাহ্‌র সামনে আমি ও আপনি সমান; আমাকেও মাটি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। আমাকে যেন আপনি ভয় না পান, কিংবা আমার কথার চাপ যেন আপনার উপর ভারী না হয়। “তবে আপনি আমার সামনেই কথা বলেছেন; আপনি যা বলেছেন ঠিক তা-ই আমি শুনেছি; আপনি বলেছেন, ‘আমি পাক-পবিত্র, আমার কোন গুনাহ্‌ নেই; আমি খাঁটি, আমার কোন দোষ নেই। তবুও আল্লাহ্‌ আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন; তিনি আমাকে তাঁর শত্রু মনে করছেন। তিনি শিকল দিয়ে আমার পা বেঁধেছেন; আমার সমস্ত পথের উপর তিনি কড়া নজর রেখেছেন।’ “কিন্তু আমি আপনাকে বলি, এই বিষয়ে আপনার কথা ঠিক নয়, কারণ মানুষের চেয়ে আল্লাহ্‌ মহান। কেন আপনি তাঁকে এই নালিশ জানাচ্ছেন যে, মানুষের কোন কথার জবাব তিনি দেন না? আসলে আল্লাহ্‌ নানাভাবে কথা বলেন যদিও মানুষ তা বুঝতে পারে না। স্বপ্নের মধ্যে, রাতের দর্শনের মধ্যে, বিছানায় শুয়ে যখন মানুষের ঘুম গাঢ় হয়, তখন তিনি তাদের কানে কানে কথা বলেন আর সাবধানবাণী দিয়ে তাদের ভয় দেখান, যেন মানুষ তার অন্যায় কাজ থেকে ফেরে আর অহংকার থেকে দূরে থাকে। তিনি এইভাবে কবর থেকে তার প্রাণ, মৃত্যুর আঘাত থেকে তার জীবন রক্ষা করেন। মানুষ রোগের দরুন যন্ত্রণা পেয়ে শাস্তি পায়; তার হাড়ের মধ্যে সব সময় কষ্ট হয়। এতে খাবার-দাবারে তার বিরক্তি জাগে, সে সবচেয়ে ভাল খাবারও ঘৃণা করে। তার শরীরের গোশ্‌ত একেবারে ক্ষয় হয়ে যায়; তখন গোশ্‌তে ঢাকা হাড়গুলো বেরিয়ে পড়ে। তার প্রাণ কবরের কাছে উপস্থিত হয়, তার জীবন মৃত্যু-ফেরেশতাদের কাছাকাছি হয়। “যদি একজন ফেরেশতা তার পক্ষে থাকেন, হাজার ফেরেশতার মধ্যে একজন মধ্যস' থাকেন যিনি মানুষকে বলেন কোন্‌টা তার জন্য ঠিক, তবে তিনি তার প্রতি দয়ালু হয়ে বলুন, ‘কবরে নেমে যাওয়া থেকে তাকে রেহাই দাও; আমি তাঁর জন্য মুক্তির মূল্য পেয়েছি।’ তাহলে তার শরীর আবার যুবকের মত হবে; সে আবার যৌবন ফিরে পাবে। সে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করবে আর তিনি তাকে রহমত দান করবেন; সে আল্লাহ্‌র মুখ দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠবে; আল্লাহ্‌ তাকে তার নির্দোষ অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। সে তখন মানুষের কাছে এসে বলবে, ‘আমি গুনাহ্‌ করেছিলাম এবং যা ঠিক তার উল্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার পাওনা শাস্তি আমি পাই নি। কবরে নেমে যাওয়ার হাত থেকে তিনি আমার প্রাণ মুক্ত করেছেন; আমি আলো দেখতে পাচ্ছি।’ “আল্লাহ্‌ মানুষের জন্য বার বার ঐ সব করেন, যেন তার প্রাণ কবরে যাওয়া থেকে ফেরে আর তার উপরে জীবনের আলো পড়ে। “আইয়ুব, আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন; আপনি নীরব থাকুন, আমি কথা বলি। যদি আপনার কিছু বলবার থাকে তবে আমাকে বলুন; আপনি বলুন, কারণ আমি আপনাকে নির্দোষ দেখাতে চাই। যদি কিছু বলবার না থাকে, তবে আমার কথা শুনুন; আপনি নীরব থাকুন, আমি আপনাকে জ্ঞান শিক্ষা দেব।” তারপর ইলীহূ বললেন, “হে জ্ঞানী লোকেরা, আমার কথা শুনুন; হে বুদ্ধিমানেরা, আমার কথায় কান দিন। জিভ্‌ যেমন করে খাবারের স্বাদ নেয় তেমনি করে কান লোকের কথা পরীক্ষা করে দেখে। কোন্‌টা ঠিক, আসুন, আমরা তা বিচার করে দেখি; কোন্‌টা ভাল আমরা তা খুঁজে দেখি। “আইয়ুব বলছেন, ‘আমি নির্দোষ, কিন্তু আল্লাহ্‌ ন্যায়ভাবে আমার বিচার করেন নি। আমি ঠিক কথা বললেও আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করা হয়েছে; বিনা দোষে আমি এমন আঘাত পেয়েছি যা ভাল হয় না।’ আইয়ুবের মত কেউ আছে কি যিনি পানির মত করে ঠাট্টা-বিদ্রূপ খেয়েছেন? যারা খারাপ কাজ করে তিনি তাদের সংগে চলেন; তিনি দুষ্ট লোকদের সংগী হন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করে মানুষের কোন লাভই হয় না।’ “কাজেই হে বুদ্ধিমান লোকেরা, আমার কথা শুনুন। আল্লাহ্‌ যে খারাপ কাজ করেন, সর্বশক্তিমান যে অন্যায় করেন তা দূরে থাকুক। তিনি মানুষকে তার কাজের ফল দেন; তার আচার-ব্যবহার অনুসারে তিনি তার পাওনা দেন। আল্লাহ্‌ কখনও খারাপ কাজ করেন না, সর্বশক্তিমান কখনও উল্টা বিচার করেন না। দুনিয়ার ভার কি কেউ তাঁকে দিয়েছে? গোটা দুনিয়ার দেখাশোনার কাজে কেউ কি তাঁকে লাগিয়েছে? যদি তিনি তাঁর নিজের কথাই ভাবতেন আর তাঁর রূহ্‌ ও নিঃশ্বাস নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতেন, তবে সব মানুষ একসংগে ধ্বংস হয়ে যেত, তারা আবার ধুলা হয়ে যেত। “যদি আপনাদের বুদ্ধি থাকে তবে এই কথা শুনুন; আমার কথায় কান দিন। যিনি ন্যায়বিচার ঘৃণা করেন তিনি কি শাসন করতে পারেন? আপনারা কি ন্যায়বান ও ক্ষমতাশালীকে দোষ দেবেন? তিনি তো বাদশাহ্‌দের বলেন, ‘তোমরা অপদার্থ,’ আর প্রধান লোকদের বলেন, ‘তোমরা দুষ্ট।’ তিনি শাসনকর্তাদের পক্ষ নেন না, গরীবদের ফেলে ধনীদের বড় মনে করেন না, কারণ তারা সবাই তাঁরই হাতের কাজ। তারা হঠাৎ মারা যায়, মারা যায় মাঝরাতে; তাদের নাড়ানো হলে তারা ধ্বংস হয়; কেউ কিছু না করলেও শক্তিমানেরা মারা যায়। “মানুষের চলাফেরার উপর আল্লাহ্‌র চোখ আছে; তাদের প্রতিটি ধাপ তিনি দেখেন। এমন কোন অন্ধকার জায়গা বা ঘন ছায়া নেই যেখানে খারাপ কাজ করা লোকেরা লুকাতে পারে। মানুষের বিচারের জন্য আল্লাহ্‌র কোন খোঁজ নেবার দরকার নেই; তদন্ত না করেই তিনি শক্তিমানদের চুরমার করেন আর তাদের জায়গায় অন্যদের বসিয়ে দেন। তিনি তাদের কাজের হিসাব রাখেন বলে রাতের বেলায় তিনি তাদের ধ্বংস করে ফেলেন আর তারা চুরমার হয়ে যায়। তাদের দুষ্টতার জন্য তিনি সকলের সামনে তাদের শাস্তি দেন, কারণ তারা তাঁর পথে চলা বাদ দিয়েছে; তাঁর কোন হুকুমের প্রতি তাদের খেয়াল নেই। তাদের অত্যাচারের দরুন গরীবের কান্না তাঁর সামনে উপস্থিত হয়; তিনি অভাবীদের কান্না শোনেন। অবশ্য তিনি চুপ করে থাকলেও কেউ তাঁকে দোষী করতে পারে না; তিনি মুখ লুকালে কেউ তাঁকে দেখতে পায় না। তবুও তিনি মানুষ ও জাতির উপরে আছেন, যাতে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন লোক রাজত্ব করতে না পারে আর লোকদের ধরবার জন্য ফাঁদ পাততে না পারে। “কোন লোক তো আল্লাহ্‌কে বলে নি, ‘আমি শাস্তি পেয়েছি, আর অন্যায় করব না; আমি যা দেখতে পাই না তা আমাকে শিখাও; যদি আমি অন্যায় করে থাকি, তবে আর তা করব না।’ আপনি যখন আল্লাহ্‌কে অগ্রাহ্য করছেন তখন আল্লাহ্‌ কি করে আপনার ইচ্ছামত পুরস্কার দেবেন? মন স্থির করা আপনার কাজ, আমার নয়; কাজেই আপনার মতামত আপনি প্রকাশ করুন। “বুদ্ধিমান লোকেরা আমাকে বলেন, জ্ঞানী লোকেরা আমার কথা শুনে আমাকে বলেন, ‘আইয়ুব জ্ঞানশূন্য হয়ে কথা বলছেন, তাঁর কথায় কোন বুদ্ধির পরিচয় নেই।’ আইয়ুবের পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে হলেই ভাল, কারণ তিনি দুষ্ট লোকের মত কথা বলছেন। তাঁর গুনাহের সংগে তিনি বিদ্রোহ যোগ করছেন; তিনি আমাদের সামনে আল্লাহ্‌র কুফরী করছেন আর আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে অনেক কথা বলছেন।” তারপর ইলীহূ বললেন, “আপনি যে বলছেন আপনি আল্লাহ্‌র সামনে নির্দোষ, কথাটা কি আপনি ঠিক বলে মনে করেন? আপনি তাঁকে বলছেন, ‘এতে আমার কি লাভ? গুনাহ্‌ না করলে আমি কি পাব?’ “আমি আপনাকে ও আপনার সংগীদের এর জবাব দিতে চাই। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন; দেখুন, মেঘ আপনার কত উপরে আছে। আপনি যদি গুনাহ্‌ করেন তাতে আল্লাহ্‌র কি হয়? আপনার অন্যায় যদি অনেক হয় তাতেই বা তাঁর কি আসে যায়? আপনি যদি নির্দোষ হন তবে তাঁর কি উপকার হবে? আপনার হাত থেকে তিনি কিছুই চান না। আপনার দুষ্টতা কেবল মানুষেরই ক্ষতি করে, আর আপনার সততা কেবল তাদেরই সাহায্য করে। “অত্যাচারের ভারে লোকে চিৎকার করে; তারা শক্তিমানদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মিনতি করে। কিন্তু কেউ বলে না, ‘আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌ কোথায়, যিনি রাতের বেলায় আনন্দের কাওয়ালী দান করেন? তিনি তো দুনিয়ার পশুদের চেয়ে আমাদের বেশী শিক্ষা দেন আর আকাশের পাখীদের চেয়ে বেশী জ্ঞান দান করেন।’ লোকেরা যখন কাঁদে তখন তিনি জবাব দেন না, কারণ তারা অহংকারী ও দুষ্ট। তাদের মুনাজাতে কোন লাভ হয় না, কারণ আল্লাহ্‌ তা শোনেন না; সর্বশক্তিমান তাতে কোন মনোযোগই দেন না। আপনি বলছেন যে, আপনি তাঁকে দেখতে পান না, আপনার মামলা তাঁর সামনে রয়েছে, আর আপনি তাঁর বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি আরও বলছেন যে, তিনি রাগে শাস্তি দেন না আর দুষ্টতার দিকে বিশেষ খেয়াল করেন না। কাজেই আইয়ুব বাজে কথা বলছেন; তিনি না জেনে অনেক কথা বলছেন।” ইলীহূ আরও বললেন, “আল্লাহ্‌র পক্ষে আমার আরও কিছু বলবার আছে; আমার প্রতি আর একটু ধৈর্য ধরুন, আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমি অনেক দূর থেকে জ্ঞান লাভ করেছি; আমার সৃষ্টিকর্তা যে ন্যায়বান তা আমি প্রকাশ করব। আমি সত্যিই বলছি যে, আমার কথা মিথ্যা নয়; জ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন আপনার সংগে আছে। “আল্লাহ্‌ ক্ষমতাশালী, কিন্তু মানুষকে তুচ্ছ করেন না; তিনি শক্তিমান এবং তাঁর উদ্দেশ্য স্থির। তিনি দুষ্টদের বাঁচিয়ে রাখেন না কিন্তু যারা জুলুম ভোগ করে তাদের ন্যায়ভাবে বিচার করেন। তিনি ধার্মিক লোকদের থেকে তাঁর চোখ ফিরিয়ে নেন না; তিনি বাদশাহ্‌দের সংগে তাদের বসিয়ে দেন আর চিরদিনের জন্য তাদের সম্মানিত করেন। কিন্তু লোকেরা যদি গুনাহের জন্য শিকলে বাঁধা থাকে, বাঁধা থাকে যন্ত্রণার দড়িতে, তবে তারা যা করেছে তা তিনি তাদের দেখিয়ে দেন, দেখিয়ে দেন যে, তারা গর্বের সংগে গুনাহ্‌ করেছে। তিনি তাদের সংশোধনের জন্য উপদেশ দেন আর খারাপ থেকে মন ফিরাতে হুকুম দেন। যদি তারা তাঁর বাধ্য হয়ে তাঁর এবাদত করে, তবে তাদের বাকী জীবন তারা সফলতায় কাটায় আর বছরগুলো কাটায় সুখে। কিন্তু যদি তারা না শোনে, তবে মৃত্যুর আঘাতে তারা ধ্বংস হবে আর বুদ্ধিহীন অবস্থায় মারা যাবে। “আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন লোকেরা রাগ পুষে রাখে; তিনি বাঁধলেও তারা সাহায্যের জন্য ডাকে না। যৌবনেই তারা মারা যায়, মারা যায় মন্দিরের পুরুষ বেশ্যাদের মধ্যে। কিন্তু যারা কষ্ট ভোগ করে তাদের উদ্ধার করবার জন্য তিনি সেই কষ্ট ব্যবহার করেন, আর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষা দেন। “কষ্টের হাত থেকে তিনি আপনাকে বের করে নিয়ে আসতে চান; তিনি আপনাকে এমন বড় জায়গায় নিয়ে যেতে চান যেখানে কোন বাধা নেই। সেখানে আপনার টেবিল ভাল ভাল খাবারে পূর্ণ থাকবে। কিন্তু এখন আপনি দুষ্টদের পাওনা শাস্তি পাচ্ছেন; আপনি শাস্তি ও ন্যায়বিচার ভোগ করছেন। সতর্ক থাকুন যেন আপনার রাগের দরুন আপনার ধন-সম্পদ আপনাকে ভুল পথে নিয়ে না যায়; যে বড় মাসুল আপনি দিয়েছেন তা যেন আপনাকে বিপথে না নেয়। আপনার ধন-সম্পদ কিংবা আপনার সমস্ত ক্ষমতা কি আপনাকে দুঃখ-কষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারে? আপনি সেই রাতের আশা করবেন না যে সময় লোকে মারা যায়। সাবধান হন, খারাপীর দিকে ফিরবেন না, কারণ কষ্ট পাওয়ার চেয়ে খারাপীই আপনার কাছে প্রিয়। “আল্লাহ্‌ কুদরতে মহান। তাঁর মত শিক্ষক আর কে আছে? কে তাঁকে সংশোধন করতে পারে কিংবা তাঁকে বলতে পারে, ‘তুমি অন্যায় করেছ’? তাঁর কাজের প্রশংসা করতে ভুলবেন না; কাওয়ালীর মধ্য দিয়েই তো মানুষ তাঁর কাজের প্রশংসা করেছে। সমস্ত মানুষ তাঁর কাজ দেখেছে, কিন্তু তারা তা দূর থেকেই দেখেছে। আল্লাহ্‌ যে কত মহান তা আমরা বুঝতেও পারি না। তাঁর বয়স কত তা জানতে পারা সম্ভব নয়। “তিনি পানির ফোঁটা টেনে নেন, সেগুলো বাষž হয় এবং বৃষ্টি হয়ে পড়ে। মেঘ তা ঢেলে দেয়, আর মানুষের উপর প্রচুর বৃষ্টি পড়ে। কে বুঝতে পারে তিনি কেমন করে মেঘ বিছিয়ে দেন? কিংবা তাঁর বাসস্থান থেকে মেঘের গর্জন করেন? তিনি তাঁর চারপাশে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেন আর সমুদ্রের তলা ঢেকে দেন। এই সব দ্বারা তিনি সমস্ত জাতিকে শাসন করেন আর প্রচুর পরিমাণে খাবার যোগান। তিনি তাঁর হাত দিয়ে বিদ্যুৎ ধরেন আর তাঁর লক্ষ্যবস-ুকে আঘাত করতে হুকুম দেন। তাঁর মেঘের গর্জন ঝড় আসবার খবর ঘোষণা করে; পশুর পালগুলোও ঝড় আসবার খবর জানায়। “এতে আমি ভয়ে কাঁপছি আর আমার দিল ধুক্‌ ধুক্‌ করছে। শুনুন, শুনুন তাঁর গর্জনের শব্দ; তাঁর মুখ থেকে যে আওয়াজ বের হচ্ছে তা শুনুন। গোটা আকাশের নীচে আর দুনিয়ার শেষ সীমানায় তাঁর বিদ্যুৎকে তিনি পাঠিয়ে দেন। তারপর তাঁর গর্জনের শব্দ আসে; তাঁর মহান স্বরে তিনি গর্জন করেন। যখন তাঁর গলার আওয়াজ শোনা যায় তখন বিদ্যুৎকে তিনি থামিয়ে রাখেন না। আল্লাহ্‌ আশ্চর্যভাবে গর্জন করেন; তিনি এমন মহৎ মহৎ কাজ করেন যা আমরা বুঝতে পারি না। তিনি তুষারকে বলেন, ‘দুনিয়াতে পড়,’ আর বৃষ্টিকে বলেন, ‘মুষলধারে পড়।’ প্রত্যেক মানুষকে তাঁর কাজ থেকে তিনি থামিয়ে দেন, যেন সব মানুষ তাঁর কাজের বিষয় জানতে পারে। তখন পশুরা আশ্রয় নেয়; তারা তাদের গর্তে ঢোকে। ঝড় তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে, বাতাস ঠাণ্ডা বয়ে আনে। আল্লাহ্‌র নিঃশ্বাস থেকে বরফ জন্মায় আর পানি জমে যায়। তিনি ঘন মেঘে পানি ভরেন; তাঁর বিদ্যুৎকে তিনি মেঘের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দেন। তাঁর নির্দেশে মেঘগুলো ঘুরে বেড়ায়, তাঁর হুকুম পালনের জন্য তারা গোটা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। মানুষকে শাস্তি দেবার জন্য, কিংবা তাঁর দুনিয়াকে পানি দেবার জন্য, কিংবা তাঁর মহব্বত দেখাবার জন্য তিনি বৃষ্টি আনেন। “আইয়ুব, আপনি এই কথা শুনুন; স্থির হয়ে আল্লাহ্‌র কেরামতীর কথা ভাবুন। আপনি কি জানেন কেমন করে আল্লাহ্‌ মেঘকে দমনে রাখেন আর তাঁর বিদ্যুৎকে চম্‌কাতে দেন? আপনি কি জানেন কেমন করে মেঘ ঝুলে থাকে? যিনি জ্ঞানে পরিপূর্ণ তাঁর কেরামতী কি আপনি জানেন? দখিনা বাতাসে যখন দেশ নীরব হয়ে যায় তখন আপনি তো আপনার কাপড়-চোপড়ে গরম বোধ করেন। ছাঁচে ঢালা আয়নার মত শক্ত যে আকাশ তা কি আপনি আল্লাহ্‌র সংগে বিছিয়েছেন? “তাঁকে কি বলা উচিত তা আপনি আমাদের বলুন; আমরা জ্ঞানহীন বলে তাঁকে আমাদের কথা জানাতে পারি না। তাঁকে কি বলতে হবে যে, আমি কথা বলতে চাই? কোন মানুষ কি চাইবে যে, তাকে গিলে ফেলা হোক? বাতাসে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যখন সূর্য উজ্জ্বল হয় তখন তার দিকে কেউ তাকাতে পারে না। উত্তর দিক থেকে সোনালী উজ্জ্বলতা আসে; তাঁর চারদিকে ভয় জাগানো মহিমা দেখা যায়। সর্বশক্তিমান আমাদের নাগালের বাইরে এবং কুদরতে অনেক মহান; তাঁর ন্যায়বিচার ও সততার দরুন তিনি জুলুম করেন না। এইজন্যই মানুষ তাঁকে ভয় করে; যারা নিজেদের জ্ঞানী মনে করে তাদের দিকে তিনি কোন নজর দেন না।” তখন মাবুদ ঝড়ের মধ্য থেকে আইয়ুবকে জবাব দিলেন। তিনি বললেন, “এ কে, যে জ্ঞানহীন কথা দিয়ে আমার পরিকল্পনাকে সন্দেহ করে? তুমি বীরের মত কোমর বাঁধ; আমি তোমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব আর তুমি আমাকে জবাব দেবে। আমি দুনিয়ার ভিত্তি স্থাপন করবার সময় তুমি কোথায় ছিলে? যদি তোমার বুদ্ধি থাকে তবে বল। তুমি কি জান কে তার পরিমাণ ঠিক করেছে? কে তার উপর মাপের দড়ি ধরেছে? কিসের উপর দুনিয়ার থামগুলো স্থাপন করা হয়েছিল? আর তার কোণের পাথরটাই বা কে স্থাপন করেছিল? তখন তো ভোরের তারাগুলো একসাথে গান গেয়েছিল আর ফেরেশতারা সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিল। “যখন দুনিয়ার গর্ভ থেকে সমুদ্র বের হয়ে এসেছিল তখন কে তাকে দরজা দিয়ে বন্ধ করেছিল? তখন আমি মেঘকে তার পোশাক করেছিলাম, আর তাকে ঘন অন্ধকারে জড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি তার সীমা ঠিক করে দিয়েছিলাম; তার দরজা ও আগল আমি স্থাপন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘এই পর্যন্ত, আর নয়; এখানে তোমার গর্বিত ঢেউগুলোকে থামতে হবে।’ “তুমি কি কখনও সকালকে হুকুম দিয়েছ কিংবা ভোরকে তার পথ দেখিয়ে দিয়েছ, যাতে সে দুনিয়ার কিনারা ধরে দুষ্টদের সেখান থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে? মাটিতে সীলমোহর করলে যেমন তা আকার পেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তেমনি দিনের আলো পাহাড়-পর্বতকে পোশাকের ভাঁজের মত স্পষ্ট করে তোলে। দুষ্টদের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়, আর তাদের উঠানো হাত ভাংগা হয়। “সমুদ্রের জন্মস্থানে কি তুমি গিয়েছ কিংবা সাগরের তলায় হেঁটেছ? কবরের দরজা কি তোমাকে দেখানো হয়েছে? সেই অন্ধকার জায়গার দরজা কি তুমি দেখেছ? দুনিয়াটা কত বড় তা কি তুমি ধারণা করতে পেরেছ? যদি তুমি এই সব জান তবে বল। “আলোর বাসস্থানে যাওয়ার পথ কোথায়? আর অন্ধকারই বা কোথায় বাস করে? তুমি কি তাদের বাসস্থানে তাদের নিয়ে যেতে পার? তাদের বাড়ী যাবার পথ কি তুমি জান? নিশ্চয়ই জান, তখন তো তোমার জন্ম হয়েছিল। তোমার তো অনেক, অনেক বয়স হয়েছে। “তুমি কি তুষারের ভাণ্ডারে ঢুকেছ কিংবা শিলার ভাণ্ডার দেখেছ? সেগুলো আমি কষ্টের দিনের জন্য জমা করে রেখেছি, জমা করে রেখেছি যুদ্ধ আর লড়াইয়ের দিনের জন্য। যে জায়গা থেকে আলো ছড়িয়ে যায়, কিংবা যেখান থেকে দুনিয়াতে পূবের বাতাস ছড়িয়ে পড়ে সেই জায়গা কোথায়? ভারী বৃষ্টি আসবার জন্য এবং বাজ পড়া ও ঝড়-বৃষ্টির জন্য কে পথ করেছে, যাতে জনশূন্য জায়গা পানি পায়, পানি পায় মরুভূমি যেখানে কেউ বাস করে না; যাতে নির্জন পোড়ো জায়গা তৃপ্ত হয়, আর সেখানে ঘাস গজাতে পারে? বৃষ্টির কি পিতা আছে? কে শিশিরের ফোঁটার জন্ম দিয়েছে? কার গর্ভ থেকে বরফ আসে? আকাশ থেকে যে হিম পড়ে তার জন্মই বা কে দিয়েছে? পানি জমে পাথরের মত হয়ে যায়, আর সাগরের উপরটা জমে যায়। “তুমি কি কৃত্তিকা নামে তারাগুলো বাঁধতে পার? কালপুরুষ নামে তারাগুলোর বাঁধন খুলে দিতে পার? তুমি কি তারাপুঞ্জকে তাদের ঋতু অনুসারে বের করে আনতে পার, কিংবা সপ্তর্ষি ও তার ছেলেমেয়েদের পথ দেখাতে পার? আকাশের আইন্তকানুন কি তুমি জান? দুনিয়াতে কি সেই আইন্তকানুন স্থাপন করতে পার? “তুমি কি মেঘ পর্যন্ত তোমার গলার আওয়াজ তুলতে পার যাতে অনেক পানি তোমাকে ঢেকে দিতে পারে? তুমি কি বিদ্যুৎকে তার পথে পাঠাতে পার? সে কি তোমাকে বলবে, ‘এই যে আমি’? কে দিলকে জ্ঞান দিয়ে সাজিয়েছে, কিংবা মনকে বুঝবার শক্তি দিয়েছে? মেঘ গুণে দেখবার বুদ্ধি কার আছে? আকাশের পানির কলসী কে উল্টাতে পারে, যাতে ধূলিকণা গলে একসংগে মিশে যায় আর মাটির ঢেলাগুলো কাদা হয়ে যায়? দাঁড়কাকের বাচ্চারা যখন আল্লাহ্‌র কাছে কাঁদে আর খাবারের অভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, তখন কে তাদের খাবার যোগায়? “পাহাড়ী ছাগল কখন বাচ্চা দেয় তা কি তুমি জান? হরিণীর বাচ্চা দেওয়া কি কখনও তুমি দেখেছ? তাদের বাচ্চা গর্ভে কতদিন থাকে তা কি তুমি গুণেছ? তাদের জন্ম দেবার সময় কি তুমি জান? তারা নীচু হয়ে বাচ্চা দেয় আর তাদের প্রসবের যন্ত্রণা শেষ হয়ে যায়। তাদের বাচ্চারা বড় হয় আর মাঠে শক্তিশালী হয়ে ওঠে; তারা মায়ের কাছ থেকে চলে যায়, আর ফিরে আসে না। “বুনো গাধাকে কে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিয়েছে? কে তার দড়ির বাঁধন খুলে দিয়েছে? তার ঘরের জন্য আমি মরুভূমি দিয়েছি, তার বাসস্থানের জন্য দিয়েছি নোনা জায়গা। সে শহরের গোলমাল ঘৃণা করে, চালকের চিৎকার তার কানে আসে না। তার চরবার জায়গা হল পাহাড়ী এলাকা; সে সেখানে সব রকম সবুজ গাছপালার খোঁজ করে। “বুনো ষাঁড় কি তোমার কাজ করতে রাজী হবে? রাতে সে কি তোমার যাবপাত্রের কাছে থাকবে? চাষের জমিতে কি তুমি তাকে জোয়ালের দড়ি দিয়ে বাঁধতে পারবে? সে কি তোমার জন্য উপত্যকায় চাষ করবে? তার ভীষণ শক্তির জন্য কি তার উপর তুমি ভরসা করবে? তোমার ভারী কাজ কি তুমি তাকে করতে দেবে? সে যে তোমার ফসল ঘরে এনে খামারে জমা করবে সেই বিশ্বাস কি তুমি তার উপর করতে পারবে? “উটপাখী জোরে জোরে ডানা ঝাপ্‌টায়, কিন্তু সারস পাখীর ডানা ও পালখের সংগে তার তুলনা হয় না। উটপাখী মাটিতে ডিম পাড়ে আর বালিতে তা গরম হতে দেয়; তার মনেও থাকে না যে, তা পায়ে গুঁড়িয়ে যেতে পারে কিংবা কোন বুনো পশু তা পায়ে মাড়াতে পারে। তার বাচ্চাদের সংগে সে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে, যেন সেগুলো তার নয়; সে চিন্তাও করে না যে, তার সমস্ত পরিশ্রম বিফল হতে পারে, কারণ আল্লাহ্‌ তাকে জ্ঞান দেন নি কিংবা বুঝবার শক্তিও দেন নি। তবুও সে যখন পাখা ঝাপ্‌টায় তখন ঘোড়া ও তার সওয়ারকে সে হেসে উড়িয়ে দেয়। “ঘোড়াকে কি তুমি শক্তি দিয়েছ? তার ঘাড়ে কি সুন্দর কেশর দিয়েছ? পংগপালের মত করে তুমি কি তাকে লাফ দেওয়াতে পেরেছ? তার নাকের গর্ব-ভরা শব্দ ভীষণ ভয় জাগায়। সে জোরে জোরে পা ঘষে নিজের শক্তিতে আমোদ করে আর যুদ্ধের সময় আক্রমণ করতে যায়। সে ভয়কে দেখে হাসে, কিছুতেই ভয় পায় না; তলোয়ারের সামনে থেকে সে সরে যায় না। তার শরীরের পাশে তীর রাখবার তূণ শব্দ করে ওঠে, আর ঝক্‌মক্‌ করে ওঠে বর্শা ও বল্লম। সে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে যায়; শিংগা বাজলে সে আর স্থির থাকতে পারে না। শিংগার আওয়াজের সংগে সংগে সে নাক দিয়ে শব্দ করে; সে দূর থেকে যুদ্ধের গন্ধ পায় আর সেনাপতিদের চিৎকার ও যুদ্ধের হাঁক শোনে। “তোমার বুদ্ধিতেই কি বাজপাখী ওড়ে আর দক্ষিণ দিকে যাওয়ার জন্য ডানা মেলে দেয়? তোমার হুকুমেই কি ঈগল পাখী উঁচুতে ওড়ে আর উঁচু জায়গায় নিজের বাসা বাঁধে? সে খাড়া পাহাড়ের উপরে বাস করে, আর রাতে তার চূড়ায় থাকে; সেই চূড়াই তার কেল্লা। সেখানে থেকে সে খাবারের খোঁজ করে; তার চোখ দূর থেকে তার শিকার দেখতে পায়। তার বাচ্চারা পেট ভরে রক্ত খায়; যেখানে মরা থাকে সেখানে তাকে দেখা যায়।” মাবুদ আইয়ুবকে আরও বললেন, “সর্বশক্তিমানের সংগে যে ঝগড়া করছে সে কি তাঁকে সংশোধন করবে? আল্লাহ্‌র সংগে যে তর্ক করে সে তাঁকে জবাব দিক।” তখন আইয়ুব জবাবে মাবুদকে বললেন, “আমি তো অযোগ্য, আমি কেমন করে তোমাকে জবাব দেব? আমার মুখে আমি হাত চাপা দিয়েছি। আমি একবার কথা বলেছি, কিন্তু জবাব দেবার আমার কিছু নেই; দু’বার বলেছি, কিন্তু আর বলব না।” তখন মাবুদ ঝড়ের মধ্য থেকে আইয়ুবকে বললেন, “তুমি বীরের মত কোমর বাঁধ; আমি তোমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব আর তুমি আমাকে জবাব দেবে। তুমি আমার ন্যায়বিচারকে কি অগ্রাহ্য করবে? তুমি যে নির্দোষ তা প্রমাণের জন্য কি তুমি আমাকে দোষী করবে? তোমার কি আল্লাহ্‌র মত শক্তি আছে? তোমার গলার আওয়াজ কি তাঁর গর্জনের মত? তাহলে নিজেকে সাজাও দেখি গৌরব ও মহিমায়, আর পরাও নিজেকে সম্মান ও মর্যাদার পোশাক। তোমার ভয়ংকর গজব ঢেলে দাও; প্রত্যেক অহংকারী লোককে তোমার চাহনি দিয়ে নীচু কর। সব অহংকারী লোকদের তোমার চাহনি দিয়ে নীচুতে নামাও; দুষ্টেরা যেখানে আছে সেখানেই তাদের গুঁড়া কর। তাদের সবাইকে একসংগে ধুলায় ঢেকে ফেল; কবরে তাদের বেঁধে রাখ। তাহলে আমি নিজেই স্বীকার করে নেব যে, তোমার নিজের শক্তি তোমাকে রক্ষা করতে পারে। “বহেমোৎকে দেখ, তোমার সংগে আমি তাকেও তৈরী করেছি; সে গরুর মতই ঘাস খায়। তার কোমরে কি শক্তি! তার পেটের মাংসপেশীতে কত ক্ষমতা! তার লেজ এরস গাছের মত নড়ে; তার রানের মাংসপেশী শক্ত করে জোড়া লাগানো। তার হাড়গুলো যেন ব্রোঞ্জের নল, সেগুলো লোহার ডাণ্ডার মত। আল্লাহ্‌র সৃষ্টির মধ্যে তার স্থান প্রধান; কেবল তার সৃষ্টিকর্তাই তাকে মেরে ফেলতে পারেন। পাহাড়ে যা জন্মায় তা-ই সে খায়, সেখানকার সব বুনো পশুরা তার কাছেই খেলা করে। বাব্‌লা গাছের নীচে সে শুয়ে থাকে; জলাভূমির নলবনের মধ্যে সে লুকিয়ে থাকে। বাব্‌লা গাছ তার ছায়ায় তাকে ঢেকে রাখে; তাকে ঘিরে রাখে নদীর ধারের উইলো গাছ। নদীতে বেগে বান আসলেও সে ভয় পায় না; জর্ডানের পানি বেগে এসে তার মুখে পড়লেও সে স্থির থাকে। তার চোখ আক্রমণ করে কেউ কি তাকে ধরতে পারে? কেউ কি ফাঁদে ফেলে তার নাক ছেঁদা করতে পারে? “তুমি কি বড়শীতে গেঁথে লিবিয়াথনকে টেনে আনতে পার, কিংবা দড়ি দিয়ে তার জিভ্‌ বাঁধতে পার? তুমি কি তার নাকের মধ্য দিয়ে নলের দড়ি পরাতে পার, কিংবা বড়শী দিয়ে তার চোয়াল ছেঁদা করতে পার? সে কি তোমার দয়া চাইবে? সে কি তোমার সংগে নরম কথা বলবে? চিরজীবন তাকে তোমার গোলাম করে রাখার জন্য সে কি তোমার সংগে কোন চুক্তি করবে? পাখীর সংগে যেমন খেলা করে তেমনি কি তুমি তার সংগে খেলা করবে কিংবা তোমার মেয়েদের খেলার জন্য তাঁকে বেঁধে রাখতে পারবে? জেলেরা কি তার জন্য দর কষাকষি করবে? ব্যবসায়ীদের মধ্যে কি তাকে ভাগ করে দেবে? তুমি কি তার চামড়া কোঁচ দিয়ে কিংবা তার মাথা টেটা দিয়ে বিঁধতে পার? তুমি যদি তাকে ধরতে যাও তবে যে যুদ্ধ হবে তা তুমি কখনও ভুলবে না; তুমি আর কখনও তা করতে যাবে না। তাকে দমন করবার সব আশাই মিথ্যা; তাকে দেখামাত্রই লোকে সাহস হারায়। তাকে জাগাতে পারে এমন সাহসী কেউ নেই; তাহলে আমার সামনে কে দাঁড়াতে পারে? আমার বিরুদ্ধে কার দাবি আছে যে, তার দাবি আমাকে মানতে হবে? আকাশের নীচে যা কিছু আছে সবই তো আমার। “লিবিয়াথনের শরীরের অংশগুলোর কথা আমি বলব, তার শক্তি ও তার শরীরের গঠনের কথা বলব। তার গায়ের চামড়া কে খুলতে পারে? কে তার বর্ম বিঁধতে পারে? তার ভয় জাগানো দাঁতে ঘেরা মুখের দরজা কে খুলতে সাহস করবে? তার পিঠের আঁশগুলো ঢালের সারির মত; সেগুলো শক্তভাবে একসংগে আট্‌কানো আর এমনভাবে কাছাকাছি রয়েছে যে, তার মধ্য দিয়ে বাতাসও যেতে পারে না। সেগুলো একটার সংগে অন্যটা যুক্ত হয়ে আছে; সেগুলো একসংগে লেগে আছে, আলাদা করা যায় না। তার হাঁচিতে আলো ছুটে বের হয়; তার চোখ দু’টা ভোরের চক্‌চকে আলোর মত। তার মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হয়ে আসে; তা থেকে আগুনের ফুল্‌কি ছুটে বের হয়। নল-খাগড়ার আগুনে গরম পাত্র থেকে যেমন ধোঁয়া বের হয় তেমনি ধোঁয়া বের হয় তার নাক থেকে। তার নিঃশ্বাসে কয়লা জ্বলে ওঠে আর মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হয়। তার ঘাড়ে শক্তি থাকে; ভীষণ ভয় তার আগে আগে চলে। তার মাংসপেশীগুলো শক্তভাবে যুক্ত; সেগুলো শক্তভাবে থাকে, নড়ে না। তার বুক পাথরের মত শক্ত, তা জাঁতার নীচের অংশের মত শক্ত। সে উঠলে শক্তিশালীরা ভয় পায়; তারা ভয়ে পিছিয়ে যায়। তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করলেও তার কিছু হয় না; বর্শা, বল্লম বা ছোট তীর ছুঁড়লেও কিছু হয় না। সে লোহাকে খড় মনে করে আর ব্রোঞ্জকে মনে করে পচা কাঠের মত। কোন তীর তাকে তাড়িয়ে দিতে পারে না; ফিংগার পাথর তার কাছে যেন তুষ। গদা তার কাছে এক টুকরা খড়ের মত; বল্লমের শব্দে সে হাসে। তার নীচের দিকটা ভাংগা মাটির পাত্রের ধারালো টুকরার মত; সেইজন্য শস্য মাড়াবার যন্ত্রের মত তা কাদার উপর দাগ রেখে যায়। পাত্রের ফুটন্ত পানির মত সে সাগরকে তোলপাড় করে আর সমুদ্রকে ঘেঁটে মলমের মত করে। একটা চক্‌চকে দাগ সে তার পিছনে রেখে যায়; তা দেখতে পাকা চুলের মত মনে হয়। দুনিয়ার কোন কিছুই তার সমান নয়; তাকে ভয়শূন্য করে সৃষ্টি করা হয়েছে। গর্বিত সবাইকে সে নীচু চোখে দেখে; সে সমস্ত অহংকারীদের বাদশাহ্‌।” আইয়ুব তখন জবাবে মাবুদকে বললেন, “আমি জানি তুমি সব কিছুই করতে পার; তোমার কোন পরিকল্পনাই নিষ্ফল হয় না। তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, ‘এ কে, যে না বুঝে আমার উদ্দেশ্যকে গোপন করে রাখে?’ এই কথা ঠিক যে, আমি যা বুঝি নি সেই বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম; তা এত আশ্চর্য যে, আমার বুঝবার নাগালের বাইরে। তুমি বলেছ, ‘এখন শোন, আমি কথা বলি; আমি তোমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব আর তুমি আমাকে জবাব দেবে।’ আগে আমার কান তোমার বিষয় শুনেছে, কিন্তু এখন আমার চোখ তোমাকে দেখল। কাজেই আমি যা বলেছি তা এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি, আর ধুলা ও ছাইয়ের মধ্যে বসে তওবা করছি।” আইয়ুবকে এই সব কথা বলবার পরে মাবুদ তৈমনীয় ইলীফসকে বললেন, “আমার গোলাম আইয়ুব যেমন বলেছে তুমি ও তোমার বন্ধুরা সেইভাবে আমার বিষয় ঠিক কথা বল নি; সেইজন্য তোমাদের উপর আমার রাগের আগুন জ্বলে উঠেছে। কাজেই এখন সাতটা ষাঁড় ও সাতটা ভেড়া নিয়ে আমার গোলাম আইয়ুবের কাছে যাও এবং নিজেদের জন্য পোড়ানো-কোরবানী দাও। আমার গোলাম আইয়ুব তোমাদের জন্য মুনাজাত করবে আর আমি তা কবুল করব, তোমাদের বোকামি অনুসারে ফল দেব না। আমার গোলাম আইয়ুব যেমন আমার বিষয়ে ঠিক কথা বলেছে তোমরা তেমন বল নি।” তখন তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিল্‌দদ ও নামাথীয় সোফর মাবুদের কথামতই কাজ করলেন, আর মাবুদ আইয়ুবের মুনাজাত কবুল করলেন। আইয়ুব তাঁর বন্ধুদের জন্য মুনাজাত করবার পর মাবুদ আবার তাঁর অবস্থা ফিরালেন এবং তাঁকে সব কিছু আগের চেয়ে দুই গুণ দিলেন। তাঁর ভাই ও বোনেরা এবং যারা তাঁকে আগে চিনত তারা সকলে এসে তাঁর বাড়ীতে তাঁর সংগে খাওয়া-দাওয়া করল। মাবুদ তাঁর উপর যে সব কষ্ট এনেছিলেন তার জন্য তারা তাঁকে সান্ত্বনা দিল। তারা প্রত্যেকে তাঁকে এক টুকরা রূপা ও সোনার একটা কানের গহনা দিল। মাবুদ আইয়ুবের জীবনের প্রথম অবস্থা থেকে পরের অবস্থা আরও দোয়াযুক্ত করলেন। তাঁর চৌদ্দ হাজার ভেড়া, ছয় হাজার উট, এক হাজার জোড়া ষাঁড় ও এক হাজার গাধা হল। তাঁর ঘরে সাত ছেলে ও তিন মেয়ের জন্ম হল। তাঁর বড় মেয়ের নাম ছিল যিমীমা, মেজ মেয়ের নাম কৎসীয়া ও ছোট মেয়ের নাম কেরণ-হপ্পুক। আইয়ুবের মেয়েদের মত সুন্দরী দেশের মধ্যে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। তাদের পিতা তাদের ভাইদের সংগে তাদেরও সম্পত্তির ভাগ দিলেন। এর পর আইয়ুব আরও একশো চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের চার পুরুষ পর্যন্ত দেখেছিলেন। এইভাবে আইয়ুব বুড়ো হয়ে এবং পূর্ণ আয়ু পাবার পরে ইন্তেকাল করলেন। ধন্য সেই লোক, যে দুষ্টদের পরামর্শমত চলে না, গুনাহ্‌গারদের পথে থাকে না, ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের আড্ডায় বসে না; বরং মাবুদের শরীয়তেই তার আনন্দ, আর সেটিই তার দিনরাতের ধ্যান। সে যেন জলস্রোতের ধারে লাগানো গাছ, যা সময়মত ফল দেয়, আর যার পাতা শুকিয়ে ঝরে যায় না; সে সব কাজেই সফলতা লাভ করে। কিন্তু দুষ্টেরা সেরকম নয়; তারা যেন বাতাসে উড়ে যাওয়া তুষ। এইজন্য রোজ হাশরে দুষ্টেরা টিকবে না, গুনাহ্‌গার লোকেরা আল্লাহ্‌ভক্তদের দলে টিকে থাকতে পারবে না; কারণ আল্লাহ্‌ভক্তদের চলার পথের উপর মাবুদের খেয়াল আছে, কিন্তু দুষ্ট লোকদের চলার পথে রয়েছে ধ্বংস। কেন অস্থির হয়ে চেঁচামেচি করছে সমস্ত জাতির লোক? কেন লোকেরা মিছামিছি ষড়যন্ত্র করছে? মাবুদ ও তাঁর মসীহের বিরুদ্ধে দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা একসংগে দাঁড়াচ্ছে আর শাসনকর্তারা করছে গোপন বৈঠক। তারা বলছে, “এস, আমরা ভেংগে ফেলি ওদের শিকল, ছিঁড়ে ফেলি ওদের বাঁধন আমাদের উপর থেকে।” মাবুদ বেহেশতের সিংহাসন থেকে হাসছেন; তিনি তাদের বিদ্রূপ করছেন। তিনি রাগ করে তাদের ধমক দেবেন, তাঁর গজবের আগুন তাদের মনে ভয় জাগাবে। মাবুদ বলবেন, “আমি যাঁকে বাদশাহ্‌ করেছি তাঁকে আমার পবিত্র সিয়োন পাহাড়ে বসিয়েছি।” বাদশাহ্‌ বলবেন, “মাবুদ যা স্থির করেছেন আমি তা ঘোষণা করব; তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তুমি আমার পুত্র, আজই আমি তোমার পিতা হলাম। তুমি আমার কাছে চাও, তাতে সম্পত্তি হিসাবে আমি তোমার হাতে অ-ইহুদী জাতিদের দেব; গোটা দুনিয়াটা তোমার অধিকারে আসবে। লোহার দণ্ড দিয়ে তুমি তাদের ভেংগে ফেলবে, চুরমার করে ফেলবে মাটির পাত্রের মত।’ ” তাই হে বাদশাহ্‌রা, তোমরা এখন বুঝে-শুনে চল; দুনিয়ার শাসনকর্তারা, সাবধান হও। ভয়ের সংগে তোমরা মাবুদের এবাদত কর, ভয়-ভরা অন্তরে আনন্দ কর। তোমরা সেই পুত্রকে সম্মান দেখিয়ে চুম্বন কর, যাতে তিনি তোমাদের উপর গজব নাজেল না করেন আর চলার পথেই তোমরা ধ্বংস হয়ে না যাও; কারণ চোখের নিমেষেই তাঁর রাগ জ্বলে উঠতে পারে। ধন্য তারা, যারা তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয়। হে মাবুদ, দেখ, আমার শত্রুর সংখ্যা কত। দেখ, আমার বিরুদ্ধে কত লোক দাঁড়িয়েছে। অনেকে আমার সম্বন্ধে বলছে, “আল্লাহ্‌ তাকে উদ্ধার করবেন না।” [সেলা] কিন্তু হে মাবুদ, তুমি আমার চারপাশে ঢাল হয়ে আছ। তুমিই আমার গৌরব; আমার নীচু মাথা তুমিই উঁচু করেছ। আমি চিৎকার করে মাবুদকে ডাকি, আর তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র পাহাড় থেকে জবাব দেন। [সেলা] আমি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, আবার জেগে উঠলাম, কারণ মাবুদই আমাকে ধরে রাখেন। আমার বিরুদ্ধে আমার চারপাশে হাজার হাজার লোক উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু আমি তাদের ভয় করি না। হে মাবুদ, এস; হে আমার আল্লাহ্‌, আমাকে উদ্ধার কর। তুমি আমার শত্রুদের চোয়ালে আঘাত করে সেই দুষ্ট লোকদের দাঁত ভেংগে দিয়েছ। উদ্ধার করা মাবুদেরই কাজ। তোমার নিজের বান্দাদের উপর তোমার দোয়া নেমে আসুক। [সেলা] হে আমার আল্লাহ্‌, আমি যে তোমার ইচ্ছামত চলছি তা তুমি দেখিয়ে দিচ্ছ; আমি যখন তোমাকে ডাকব তখন তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়ো। বিপদ আমাকে চেপে ধরেছে, কিন্তু তুমি আমাকে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছ। আমার প্রতি রহমত কর, আমার মুনাজাত শোন। হে মানুষ, আর কতকাল তোমরা আমার সম্মানকে অসম্মান করবে? আর কতকাল তোমরা মিথ্যাকে ভালবাসবে আর অসত্যের পিছনে দৌড়াবে? [সেলা] তোমরা জেনে রেখো, মাবুদ তাঁর ভক্তদের তাঁর নিজের জন্য আলাদা করেছেন; আমি ডাকলে তিনি শুনবেন। তোমরা উত্তেজিত হয়ে গুনাহ্‌ কোরো না। বিছানায় শুয়ে তোমাদের অন্তর খুঁজে দেখো আর চুপ করে থেকো। [সেলা] যোগ্য মনোভাব নিয়ে তোমরা কোরবানী দিয়ো, আর মাবুদের উপর ভরসা কোরো। অনেকে বলে, “কে আমাদের ভাল করতে পারে?” হে মাবুদ, তোমার দয়ার দৃষ্টি আলোর মত করে আমাদের উপর পড়ুক। প্রচুর ফসল ও নতুন আংগুর-রস উঠলে লোকদের যেমন আনন্দ হয়, তার চেয়েও বেশী আনন্দ দিয়ে তুমি আমার অন্তর ভরে রেখেছ। হে মাবুদ, তুমিই আমাকে নির্ভয়ে রাখছ, তাই আমি শুয়ে শান্তিতে ঘুমাব। হে মাবুদ, আমার কথায় কান দাও, আমার দিলের আকুলতা দেখ। হে আমার বাদশাহ্‌, হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার সাহায্যের জন্য আমার ফরিয়াদ তুমি শোন, কারণ আমি তোমারই কাছে মুনাজাত করছি। হে মাবুদ, প্রতিদিন সকাল বেলায় তুমি আমার কথা শুনতে পাও। সকাল বেলায় আমি তোমার সামনে আমার মুনাজাতের ডালি সাজিয়ে রাখি আর আশা নিয়ে চেয়ে থাকি। হে আল্লাহ্‌, তুমি অন্যায়ে আনন্দিত হওয়ার আল্লাহ্‌ নও; খারাপ লোকেরা তোমার সামনে থাকতে পারে না। যারা গর্বিত তারা তোমার সামনে দাঁড়াতে পারে না; যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় তাদের তুমি অগ্রাহ্য কর। যারা মিথ্যা কথা বলে তাদের তুমি ধ্বংস কর; যাদের মধ্যে খুনীর এবং ছলনাকারীর মনোভাব রয়েছে মাবুদ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু আমি তোমার অসীম মমতার দরুন তোমার ঘরে ঢুকব, তোমার পবিত্র বাসস্থানের দিকে চেয়ে ভয়ের সংগে আমার মাথা নীচু করব। হে মাবুদ, আমার অনেক শত্রু রয়েছে বলে তোমার ন্যায়ের পথে তুমি আমাকে পরিচালনা কর; তোমার পথ আমার সামনে সোজা করে দাও। আমার শত্রুদের কোন কথা বিশ্বাস করা যায় না, ওদের অন্তরে আছে ধ্বংসের মনোভাব, ওদের মুখ যেন খোলা কবর, জিভ্‌ দিয়ে ওরা খোশামোদের কথা বলে। হে আল্লাহ্‌, তুমি ওদের দোষী বলে ঘোষণা কর; ওদের কুমতলবে ওদেরই সর্বনাশ হোক। ওদের অসংখ্য অপরাধের জন্য তুমি ওদের তাড়িয়ে দাও, কারণ ওরা তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কিন্তু যারা তোমার মধ্যে আশ্রয় নেয় তারা আনন্দিত হোক, তারা আনন্দে চিরকাল কাওয়ালী করুক; তাদের তুমি রক্ষা কর, যেন তোমাকে যারা মহব্বত করে তারা তোমাকে নিয়েই আনন্দ লাভ করে। হে মাবুদ, যারা তোমার ভক্ত তাদের উপর সত্যিই তোমার দোয়া রয়েছে; তোমার রহমত দিয়ে তুমি তাদের ঢালের মত করে ঘিরে রেখেছ। হে মাবুদ, রাগের বশে তুমি আমাকে বকুনি দিয়ো না; ক্রোধে আমাকে শাসন কোরো না। হে মাবুদ, তুমি আমার প্রতি রহমত কর, কারণ আমি দুর্বল। হে মাবুদ, আমাকে সুস্থ কর, কারণ ভয়ে আমার হাড়ে কাঁপুনি ধরেছে, আর প্রাণেও লেগেছে ভীষণ ভয়। হে মাবুদ, আর কতকাল তা চলবে? হে মাবুদ, আমার দিকে ফেরো, আমাকে উদ্ধার কর; তোমার অটল মহব্বতের দোহাই, আমাকে রক্ষা কর। মরে গেলে তোমাকে স্মরণ করা যায় না; কবরে কে তোমার প্রশংসা করবে? আমি কোঁকাতে কোঁকাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; সারা রাত কেঁদে কেঁদে আমি বিছানা ভিজাই, চোখের পানিতে আমার খাট ভাসাই। দুঃখে আমার দেখবার শক্তিও কমে গেছে; শত্রুদের কারণে আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে। হে খারাপ কাজ করে বেড়ানো লোকেরা, তোমরা সবাই আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও, কারণ মাবুদ আমার কান্না শুনেছেন। আমার দয়া-ভিক্ষায় মাবুদ সাড়া দিয়েছেন, আমার মুনাজাত তিনি কবুল করেছেন। আমার শত্রুরা সব লজ্জিত হবে এবং ভয় পাবে; তারা ফিরে যাবে, হঠাৎ লজ্জায় পড়বে। হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, আমি তোমারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। যারা আমার পিছনে তাড়া করে আসছে তাদের হাত থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর, আমাকে রক্ষা কর। তা না হলে সিংহের মত করে তারা আমাকে ছিঁড়ে ফেলবে; ওরা আমাকে টুকরা টুকরা করে ফেলবে, আমাকে বাঁচাবার কেউ থাকবে না। হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, যদি আমি এমন কিছু করে থাকি, যদি অন্যায়ের কোন কলংক আমার হাতে লেগে থাকে, যদি আমার বন্ধুর প্রতি অন্যায় করে থাকি, - যে বিনা কারণে আমার শত্রু হয়ে উঠেছিল আমি বরং তাকেও উদ্ধার করেছি- তবে শত্রুরা তাড়া করে আমাকে ধরে ফেলুক; তারা আমাকে মাটিতে ফেলুক আর পায়ে মাড়াক, আমার সম্মান ধুলাতে মিশিয়ে দিক। [সেলা] হে মাবুদ, রাগে তুমি উঠে দাঁড়াও, আমার শত্রুদের ক্রোধের বিরুদ্ধে হাত উঠাও। আমার জন্য তুমি ওঠো, কারণ তোমার ন্যায়বিচারের কথা তুমি ঘোষণা করেছ। সমস্ত জাতির লোক তোমার চারপাশে জমায়েত হোক; তুমি বেহেশতে ফিরে গিয়ে আবার তাদের উপর রাজত্ব কর। মাবুদই যেন তাদের বিচার করেন। হে মাবুদ, আমার ন্যায় কাজ ও সততা অনুসারে তুমি আমার বিচার কর। হে ন্যায়ের আল্লাহ্‌, তুমি অন্তর ও মনের যাচাই করে থাক; তুমি দুষ্টদের দুষ্টতা শেষ কর কিন্তু তোমার ভক্তকে ভাল অবস্থায় স্থির রাখ। আল্লাহ্‌ আমার ঢাল; যারা অন্তরে খাঁটি তাদের তিনি রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারক, দুষ্টদের বিচার তিনি সব সময়ই করে থাকেন। অন্যায়কারী যদি না ফেরে তবে তিনি তাঁর তলোয়ারে শান দেবেন আর তাঁর ধনুক বাঁকিয়ে ঠিক করে নেবেন। তিনি তাঁর মারণ-অস্ত্র ঠিক করে রেখেছেন, আর তাঁর জ্বলন্ত তীর তৈরী করছেন। অন্যায়কারী খারাপীকে গর্ভে ধরে, অন্যায়কে গর্ভে নিয়ে প্রসব বেদনায় ভোগে আর মিথ্যাকে প্রসব করে। গর্ত খুঁড়ে সে তার মধ্য থেকে মাটি তুলে ফেলে আর নিজের গর্তে নিজেই পড়ে। তার অন্যায়ের বোঝা তার নিজের মাথাতেই ফিরে আসে; সে যে জুলুম করে তা তারই মাথার উপরে নেমে আসে। মাবুদ ন্যায়বিচার করেন, সেজন্য আমি তাঁকে শুকরিয়া জানাব; আমি মহান মাবুদের প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। হে মাবুদ, আমাদের মালিক, সারা দুনিয়ায় রয়েছে তোমার মহিমার প্রকাশ; বেহেশতে তোমার মহিমা তুমি স্থাপন করেছ। ছোট ছেলেমেয়ে ও শিশুদের কথাকে তুমি শক্তির কেল্লা করেছ; তোমার শত্রুদের কথা ভেবেই তুমি তা করেছ, যাতে তোমার শত্রু ও প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের তুমি থামিয়ে দিতে পার। আমি যখন তোমার হাতে গড়া আসমানের দিকে তাকাই আর সেখানে তোমার স্থাপিত চাঁদ আর তারাগুলো দেখি, তখন ভাবি, মানুষ এমন কি যে, তুমি তার বিষয় চিন্তা কর? মানুষের সন্তানই বা কি যে, তুমি তার দিকে মনোযোগ দাও? তুমি মানুষকে ফেরেশতার চেয়ে সামান্য নীচু করেছ; রাজতাজ হিসাবে তুমি তাকে দান করেছ গৌরব ও সম্মান। তোমার হাতের সৃষ্টির শাসনভার তুমি তারই হাতে দিয়েছ আর তার পায়ের তলায় রেখেছ এই সব- গরু ও ভেড়ার পাল আর দুনিয়ার অন্য সব পশু, আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখী, সাগরের মাছ আর সাগর-পথে ঘুরে বেড়ানো অন্য সব প্রাণী। হে মাবুদ, আমাদের মালিক, সারা দুনিয়ায় রয়েছে তোমার মহিমার প্রকাশ। হে মাবুদ, আমার সমস্ত দিল দিয়ে আমি তোমার প্রশংসা করব আর তোমার সব অলৌকিক কাজের কথা বলব। তোমাকে নিয়েই আমি খুশী থাকব ও আনন্দ করব। হে আল্লাহ্‌তা’লা, আমি তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। আমার শত্রুরা ফিরে গেছে; তোমার সামনে তারা পড়ে গেছে আর ধ্বংস হয়ে গেছে; কারণ তুমি আমার বিচার করে আমার পক্ষে রায় দিয়েছ; তোমার সিংহাসনে বসে তুমি ন্যায়বিচার করেছ। তুমি অন্য জাতিদের ধম্‌কে দিয়েছ এবং দুষ্টদের ধ্বংস করেছ; তাদের নাম তুমি চিরকালের জন্য মুছে ফেলেছ। শত্রুরা চিরদিনের জন্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে; তাদের শহরগুলো তুমি উপ্‌ড়ে ফেলে দিয়েছ; তাদের নাম পর্যন্ত মুছে গেছে। মাবুদ চিরকাল রাজত্ব করেন; তিনি বিচারের সিংহাসন স্থাপন করেছেন। তিনি ন্যায়ভাবে দুনিয়ার বিচার করবেন, সৎ ভাবেই সব জাতিদের শাসন করবেন। যারা জুলুমের মধ্যে পড়ে আছে মাবুদই যেন তাদের আশ্রয় হন আর দুর্দিনের কেল্লা হন। যারা তোমাকে জানে তারা যেন তোমার উপর ভরসা করে, কারণ হে মাবুদ, যারা তোমাকে গভীরভাবে জানতে চায় তাদের তুমি কখনও ত্যাগ কর নি। মাবুদ সিয়োনে আছেন; তোমরা তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও। তিনি যা করেছেন তা অন্য জাতিদের কাছে ঘোষণা কর; কারণ যিনি রক্তের প্রতিশোধ নেন তিনি হত্যা করা লোকদের ভুলে যান না, দুঃখীর ফরিয়াদ তিনি অবহেলা করেন না। হে মাবুদ, আমার প্রতি রহমত কর; দেখ, আমার শত্রুরা কিভাবে আমাকে জুলুম করছে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে তুমি আমাকে তুলে আন, যাতে সিয়োন শহরের দরজাগুলোতে আমি তোমার প্রশংসা প্রচার করতে পারি, তোমার দেওয়া উদ্ধার পেয়ে আনন্দ করতে পারি। অন্য জাতিরা নিজেদের খোঁড়া গর্তে তলিয়ে যাচ্ছে; তাদের লুকানো জালে তাদেরই পা জড়িয়ে গেছে। ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে মাবুদ নিজেকে জানতে দেন; তিনি দুষ্টদের তাঁর কাজের ফাঁদে ফেলেন। [ধ্যান, সেলা] যে সব জাতি আল্লাহ্‌কে ভুলে যায় সেই দুষ্টেরা মরে কবরে যাবে। অভাবীদের চিরকাল ভুলে থাকা হবে না; অসহায়দের আশা কখনও অপূর্ণ থাকবে না। হে মাবুদ, তুমি ওঠো, মানুষকে তোমার উপর জয়ী হতে দিয়ো না; তোমার সামনে অন্য জাতিদের বিচার হোক। হে মাবুদ, তাদের অন্তরে ভয় জাগাও; অন্য জাতিরা জানুক যে, তারা কেবলমাত্র মানুষ। [সেলা] হে মাবুদ, কেন তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছ? দুর্দিনে কেন তুমি নিজেকে লুকিয়ে রাখ? দুষ্ট লোক অহংকারের দরুন দুঃখীদের তাড়া করে, কিন্তু নিজের কুমতলবে সে নিজেই ধরা পড়ে। দুষ্ট লোক তার দিলের খারাপ ইচ্ছার গর্ব করে; লোভী মাবুদকে বদদোয়া দেয় আর তাঁকে তুচ্ছ করে। দুষ্ট লোক অহংকারের দরুন মাবুদকে অগ্রাহ্য করে; তার কুমতলবের পিছনে এই চিন্তা রয়েছে- আল্লাহ্‌ বলে কেউ নেই। সব সময় সে সফলতার পথে এগিয়ে যায়; তার চোখ তোমার শাসন ব্যবস্থার নাগাল পায় না, কারণ তা অনেক উপরে; তার সব শত্রুদের সে তুচ্ছ করে। সে মনে মনে বলে, “এমন কিছু নেই যা আমাকে নাড়াতে পারে; আমার বিপদ কোন কালেই হবে না।” তার মুখ বদদোয়া, ঠকামি আর জুলুমের কথায় ভরা; তার জিভে রয়েছে অন্যায় আর খারাপীর কথা। গ্রামের কাছে গোপনে সে ওৎ পেতে বসে থাকে; গোপন জায়গাতে সে নির্দোষীকে খুন করে আর অসহায়ের উপর গোপনে লক্ষ্য রাখে। সে আড়ালে থেকে সিংহের মত করে ওৎ পাতে; দুঃখীকে ধরবার জন্যই সে তা করে, জালে ফেলে সে তাকে ধরে। তারপর সে তাদের পিষে ফেলে; সেই হতভাগারা পড়ে তার থাবার নীচে। সে মনে মনে বলে, “এদিকে আল্লাহ্‌র খেয়াল নেই; তিনি মুখ ফিরিয়ে আছেন, কখনও দেখবেন না।” হে মাবুদ, ওঠো; হে আল্লাহ্‌, তোমার হাত বাড়িয়ে দাও, দুঃখীদের ভুলে যেয়ো না। দুষ্ট লোক কেন আল্লাহ্‌কে তুচ্ছ বলে মনে করে? সে কেন মনে মনে বলে, “তিনি আমার কাছে কোন হিসাব চাইবেন না”? কিন্তু হে আল্লাহ্‌, দুঃখ-কষ্ট তোমার চোখ এড়িয়ে যায় না; তুমি নিজের হাতেই এর ব্যবস্থা কর। অসহায় তো তোমারই হাতে নিজেকে তুলে দেয়; এতিমকে তুমিই সাহায্য করে থাক। দুষ্ট এবং খারাপ লোকের ক্ষমতা তুমি শেষ করে দিয়ো; তার সমস্ত অন্যায়ের হিসাব তুমি চেয়ে নিয়ো। মাবুদই চিরকালের বাদশাহ্‌; তাঁর দেশ থেকে অন্য জাতিরা ধ্বংস হয়ে যাবে। হে মাবুদ, নম্রদের অন্তরের ইচ্ছার কথা তুমি শুনছ; তুমি তাদের সাহস দিচ্ছ, তাদের ফরিয়াদ তুমি শুনছ। তুমিই তা করছ, যাতে এতিম ও অত্যাচারিত লোকদের পক্ষে তুমি দাঁড়াতে পার, যেন এ দুনিয়ার মানুষ তাদের আর ভয় দেখাতে না পারে। আমি তো মাবুদের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছি। তোমরা কেন বলছ, “পাখীর মত উড়ে তোমাদের পাহাড়ে পালিয়ে যাও”? কেন বলছ, “অন্তরে যারা খাঁটি অন্ধকার থেকে তাদের তীর মারবার জন্য দুষ্ট লোকেরা তাদের ধনুক বাঁকিয়েছে আর তাতে তীর লাগিয়েছে”? কেন বলছ, “যদি দুনিয়া-সংসারের সব ভিত্তিই ভেংগে ফেলা হয় তবে আল্লাহ্‌ভক্তদের করবার আর কিছুই নেই”? কিন্তু মাবুদ বেহেশতে তাঁর পবিত্র বাসস্থানে আছেন; তাঁর সিংহাসন সেখানেই রয়েছে। তিনি মানুষকে লক্ষ্য করেন; তাঁর চোখ তাদের যাচাই করে। মাবুদ তাঁর ভক্তদের যাচাই করে দেখান, কিন্তু যারা দুষ্ট এবং জুলুম ভালবাসে তাদের তিনি অগ্রাহ্য করেন। তিনি দুষ্টদের উপরে বিপদ পাঠাবেন; তাদের ভাগ্যে রয়েছে আগুন, জ্বলন্ত গন্ধক আর আগুনের মত বাতাস। মাবুদ ন্যায়বান বলেই ন্যায়ের কাজ তিনি ভালবাসেন; যারা খাঁটি তারা তাঁর মুখ দেখতে পাবে। হে মাবুদ, রক্ষা কর, তোমার ভক্তেরা আর নেই; বিশ্বস্ত লোক মানুষের মধ্য থেকে উধাও হয়ে গেছে। মানুষ মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলে; তারা কথা বলে খোশামুদে ঠোঁটে আর ছলনা-ভরা অন্তরে। মাবুদ বলেন, “দুঃখীদের সর্বনাশ ও অভাবীদের কান্নার দরুন এবার আমি জেগে উঠব, আর নিরাপদে থাকাই যাদের অন্তরের কামনা তাদের নিরাপদে রাখব।” মাবুদের কথায় খাদ নেই; তা যেন আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া রূপা, সাতবার করে শুদ্ধ করা রূপা। হে মাবুদ, তুমিই তাদের নিরাপদে রাখবে; একালের লোকদের হাত থেকে চিরকাল তাদের প্রত্যেককে তুমি রক্ষা করবে। লোকেরা যখন খারাপীকে সম্মান করে দুষ্টেরা তখন বিনা বাধায় ঘোরাফেরা করে। হে মাবুদ, আর কতকাল? চিরকালই কি তুমি আমাকে ভুলে থাকবে? আমার কাছ থেকে আর কতকাল তুমি তোমার মুখ ফিরিয়ে রাখবে? আর কতকাল আমি মনের মধ্যে চিন্তার পর চিন্তা করে যাব, আর প্রতিদিন আমার অন্তর বেদনায় ভরে উঠবে? আর কতকাল শত্রু আমার উপর জয়ী থাকবে? হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, আমার দিকে চেয়ে দেখ, আমাকে জবাব দাও; আমার শক্তি ফিরিয়ে দাও, নইলে আমার উপর আসবে মরণের ঘুম। আমার শত্রু তখন বলবে, “আমি তাকে হারিয়ে দিয়েছি।” আমি স্থির না থাকলে আমার শত্রুরা আনন্দ করবে। কিন্তু আমি তোমার অটল মহব্বতের উপর ভরসা করেছি; তুমি আমাকে রক্ষা করবে বলে আমার অন্তর আনন্দিত। মাবুদ আমার উন্নতি করেছেন, তাই আমি তাঁর উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব। যাদের মন অসাড় তারা ভাবে আল্লাহ্‌ বলে কেউ নেই। তাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের কাজ জঘন্য; ভাল কাজ করে এমন কেউ নেই। মাবুদ বেহেশত থেকে নীচে মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, দেখতে চাইলেন কেউ সত্যিকারের জ্ঞান নিয়ে চলে কিনা, দেখতে চাইলেন কেউ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত কাজ করে কিনা। তিনি দেখলেন, সবাই ঠিক পথ থেকে সরে গেছে, সবাই একসংগে খারাপ হয়ে গেছে; ভাল কাজ করে এমন কেউ নেই, একজনও নেই। যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় তারা কি এতই অবুঝ? লোকে যেমন করে খাবার খায় তেমনি করেই তারা আমার লোকদের খেয়ে ফেলে; তারা মাবুদকে ডাকে না। আল্লাহ্‌ তাঁর ভক্তদের সংগে আছেন, তাই ঐ সব লোকেরা ভীষণ ভয়ের মধ্যে থাকবে। তোমরা যারা খারাপ কাজ করছ, তোমরা দুঃখীদের কাজ নষ্ট করে তাদের লজ্জায় ফেলছ, কিন্তু মাবুদই তাদের আশ্রয়। বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার সিয়োনের মধ্য থেকে আসুক; মাবুদ যখন তাঁর বান্দাদের অবস্থা ফিরাবেন তখন ইয়াকুবের বংশ আনন্দ করবে- বনি-ইসরাইলরা খুশী হবে। হে মাবুদ, তোমার আবাস-তাম্বুতে কে দাঁড়াবার যোগ্য? তোমার পবিত্র পাহাড়ে কে বাস করার যোগ্য? সে-ই যোগ্য, যে নিখুঁত জীবন কাটায়, ন্যায় কাজ করে, সত্যে ভরা অন্তর থেকে কথা বলে, পরের নিন্দা করে না, সংগীর ক্ষতি করে না, প্রতিবেশীর সম্মান নষ্ট করে না, ঘৃণার যোগ্য লোককে ত্যাগ করে চলে আর মাবুদের ভক্তদের সম্মান করে, ক্ষতি হলেও ওয়াদা রক্ষা করে, সুদ ছাড়াই টাকা ধার দেয়, আর ঘুষ খেয়ে নির্দোষীর ক্ষতি করে না। যে এইভাবে চলে সে সব সময় স্থির থাকবে। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে রক্ষা কর, কারণ আমি তোমারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। আমি মাবুদকে বলেছি, “তুমিই আমার মালিক; তুমি ছাড়া আর কিছুতে আমার ভাল নেই।” দুনিয়ার যে সব লোক আল্লাহ্‌র, তাঁরা মহান; তাঁদের নিয়েই আমার সব আনন্দ। যারা দেব-দেবীকে উপহার দিয়ে নিজের করে নেয় তাদের দুঃখ বেড়ে যাবে। তারা রক্তের যে ঢালন-কোরবানী করে আমি তা করব না; দেব-দেবীর নামও আমি মুখে আনব না। মাবুদ, তুমিই আমার সম্পত্তি; তুমিই আমার পিপাসার পানি। আমার ভাগ্য তোমার হাতেই আছে। আমার সীমার মধ্যে যে জায়গা পড়েছে তা চমৎকার; আমার সম্পত্তি দেখলে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। আমি মাবুদের শুকরিয়া আদায় করব যিনি আমাকে সুবুদ্ধি দেন; রাতে আমার অন্তর আমাকে নির্দেশ দেয়। আমার চোখ সব সময় মাবুদের দিকে আছে; তিনি আমার ডান পাশে আছেন বলে আমি স্থির থাকব। এইজন্য আমার মন খুশীতে ভরা, আমার অন্তর আনন্দ করছে আর আমার শরীর নিরাপদে থাকবে; কারণ তুমি আমাকে কবরে ফেলে রাখবে না, তোমার ভক্তের শরীরকে তুমি নষ্ট হতে দেবে না। জীবনের পথ তুমি আমাকে শিখিয়েছ; তোমার দরবারে থাকায় আছে পরিপূর্ণ আনন্দ আর তোমার ডান পাশে রয়েছে চিরকালের সুখ। হে মাবুদ, তুমি ন্যায় কথা শোন, আমার ফরিয়াদে কান দাও; আমার ছলনাহীন মুখের মুনাজাত শোন। আমার উপর তোমার বিচার যেন ন্যায্য হয়; যা সত্যি তা তোমার চোখে ধরা পড়ুক। তুমি তো আমার অন্তরে ঢুকে দেখেছ আর রাতে আমাকে পরীক্ষা করেছ; আমাকে যাচাই করেও দেখেছ কিন্তু কিছুই খুঁজে পাও নি। আমি ঠিক করেছি কোন গুনাহের কথায় আমার মুখ আমি ব্যবহার করব না। মানুষ যে সব কাজ করে তা না করে তোমার মুখের কালামের সাহায্যে জুলুমের পথ থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। তোমার পথেই আমি আমার পা স্থির রেখেছি; সেখান থেকে আমার পা একটুও নড়ে নি। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার ডাকে সাড়া দেবে, সেজন্য আমি তোমাকে ডাকছি; আমার কথায় কান দাও, আমার মুনাজাত শোন। তোমার অটল মহব্বত আশ্চর্যভাবে প্রকাশ কর; শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য যারা তোমার আশ্রয় নেয়, তুমি ডান হাত দিয়ে তাদের রক্ষা করে থাক। তাদের অসাড় দিলের দুয়ার তারা বন্ধ করে রেখেছে; তাদের মুখ দিয়ে অহংকারের কথাই বের হয়। তারা এখন আমাদের ঘিরে ফেলেছে, আমাদের কোথাও যাবার পথ নেই। তারা আমাদের উপর কড়া নজর রেখেছে যাতে মাটিতে আমাদের ফেলে দিতে পারে। তারা সিংহের মত শিকারের নেশায় পাগল, যেন আড়ালে ওৎ পেতে থাকা যুব সিংহ। হে মাবুদ, তুমি ওঠো, ওদের রুখে দাঁড়াও, ওদের মাটিতে ফেলে দাও। তোমার তলোয়ার দিয়ে দুষ্টের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। হে মাবুদ, ঐ লোকদের হাত থেকে, দুনিয়ার মানুষের হাত থেকে, তুমি নিজের হাতে আমার প্রাণ বাঁচাও। তাদের এই সব পুরস্কার এই দুনিয়াতেই রয়েছে- তোমার ধন-সম্পদে তাদের পেট ভরে, তাদের সন্তানের সংখ্যা অনেক হয়, সন্তানদের জন্য তারা তাদের ধন-সম্পদ রেখে যায়। কিন্তু আমি যেন নির্দোষ হয়ে তোমার সামনে থাকতে পারি, যাতে মৃত্যু থেকে জেগে উঠে তোমাকে দেখে আমি আনন্দ পাই। হে মাবুদ, তুমিই আমার শক্তি, আমি তোমাকে মহব্বত করি। মাবুদই আমার উঁচু পাহাড়, আমার কেল্লা ও আমার মুক্তিদাতা; আমার আল্লাহ্‌ আমার উঁচু পাহাড়, তাঁরই মধ্যে আমি আশ্রয় নিই। তিনিই আমার ঢাল, আমার রক্ষাকারী শিং, আমার উঁচু আশ্রয়-স্থান। মাবুদ প্রশংসার যোগ্য, আমি তাঁকে ডাকি; তাতে আমার শত্রুদের হাত থেকে আমি রক্ষা পাই। মৃত্যুর দড়িতে আমি বাঁধা পড়েছিলাম, ধ্বংসের স্রোতে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম। কবরের দড়িতে আমি বাঁধা পড়েছিলাম, আমার জন্য পাতা হয়েছিল মৃত্যুর ফাঁদ। আমি এই বিপদে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌কে ডাকলাম এবং সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে ফরিয়াদ জানালাম। তাঁর বাসস্থান থেকে তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনলেন; আমার ফরিয়াদ তাঁর কাছে পৌঁছাল আর তাঁর কানে গেল। তখন দুনিয়া কেঁপে উঠল আর টলতে লাগল, কেঁপে উঠল সব পাহাড়ের ভিত্তি; তাঁর রাগে সেগুলো কাঁপতে থাকল। তাঁর নাক থেকে ধোঁয়া উপরে উঠল, তাঁর মুখ থেকে ধ্বংসকারী আগুন বেরিয়ে আসল, তাঁর মুখের আগুনে কয়লা জ্বলে উঠল। তিনি আকাশে নুইয়ে নেমে আসলেন; তাঁর পায়ের নীচে ছিল ঘন কালো মেঘ। তিনি কারুবীতে চড়ে উড়ে আসলেন, উড়ে আসলেন বাতাসের ডানায় ভর করে। তিনি অন্ধকার দিয়ে নিজেকে ঘিরে ফেললেন; তাঁর চারপাশে রইল আকাশের ঘন কালো বৃষ্টির মেঘ। তাঁর আলোময় উপস্থিতির সামনে কালো মেঘ সরে গেল; শিলাবৃষ্টি আর বাজ বের হয়ে আসল। মাবুদ আকাশে গর্জন করলেন; বাজ ও শিলাবৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্‌তা’লার গলার আওয়াজ শোনা গেল। তিনি তীর ছুঁড়ে শত্রুদের ছড়িয়ে ফেললেন, আর বিদ্যুৎ চম্‌কিয়ে তাদের বিশৃঙ্খল করলেন। হে মাবুদ, তোমার ধমকে আর নিঃশ্বাসের ঝাপ্‌টায় মাটির তলার পানি দেখা দিল, দুনিয়ার ভিতরটা বেরিয়ে পড়ল। তিনি উপর থেকে হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরলেন, গভীর পানির মধ্য থেকে আমাকে টেনে তুললেন। আমার শক্তিমান শত্রুর হাত থেকে তিনি আমাকে বাঁচালেন; বাঁচালেন বিপক্ষদের হাত থেকে যাদের শক্তি আমার চেয়েও বেশী। বিপদের দিনে তারা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু মাবুদই আমাকে ধরে রাখলেন। তিনি আমাকে একটা খোলা জায়গায় বের করে আনলেন; আমার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই তিনি আমাকে উদ্ধার করলেন। আমার ন্যায় কাজ অনুসারেই মাবুদ আমাকে দান করলেন, আমার কাজের পবিত্রতা অনুসারে পুরস্কার দিলেন; কারণ মাবুদের পথেই আমি চলফেরা করেছি; খারাপ কাজ করে আমার আল্লাহ্‌র কাছ থেকে সরে যাই নি। তাঁর সমস্ত শরীয়ত আমার সামনে রয়েছে; তাঁর নিয়ম থেকে আমি সরে যাই নি। তাঁর সামনে আমি নির্দোষ ছিলাম; আমি গুনাহ্‌ থেকে দূরে থেকেছি। তাই মাবুদ আমাকে পুরস্কার দিয়েছেন তাঁর চোখে আমার ন্যায় কাজ অনুসারে, আমার কাজের পবিত্রতা অনুসারে। হে মাবুদ, তুমি বিশ্বস্তদের সংগে বিশ্বস্ত ব্যবহার কর, নির্দোষীদের সংগে কর নির্দোষ ব্যবহার, খাঁটিদের সংগে কর খাঁটি ব্যবহার, আর কুটিলদের দেখাও তোমার বুদ্ধির কৌশল। তুমি দুঃখীদের রক্ষা করে থাক আর অহংকারীদের নীচে নামাও। তুমিই আমার জীবন-বাতি জ্বালিয়ে রাখ; আমার মাবুদ আল্লাহ্‌ আমার অন্ধকারকে আলো করেন। তোমার সাহায্যেই আমি সৈন্যদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, আর আমার আল্লাহ্‌র সাহায্যে লাফ দিয়ে দেয়াল পার হতে পারি। আল্লাহ্‌র পথে কোন খুঁত নেই; মাবুদের কালাম খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনিই তাঁর মধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী সকলের ঢাল। একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া আর মাবুদ কে? আমাদের আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কি কেউ আশ্রয়-পাহাড় আছে? আল্লাহ্‌ আমার কোমরে শক্তি দিয়েছেন আর নিখুঁত করেছেন আমার চলার পথ। তিনি আমাকে হরিণীর মত করে লাফিয়ে চলার শক্তি দিয়েছেন; উঁচু উঁচু জায়গায় তিনিই আমাকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই আমার হাত যুদ্ধ করতে শিখেছে, তাই আমার হাত ব্রোঞ্জের ধনুক বাঁকাতে পারে। হে মাবুদ, তোমার রক্ষাকারী ঢাল তুমি আমাকে দিয়েছ, তোমার ডান হাত আমাকে ধরে আছে; তোমার যত্ন দিয়ে তুমি আমাকে মহান করেছ। তুমি আমার চলার পথ চওড়া করেছ, তাই আমার পায়ে উচোট লাগে নি। আমার শত্রুদের তাড়া করে আমি ধরে ফেলেছি; তারা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমি পিছন ফিরি নি। আমি তাদের চুরমার করে দিয়েছি, যাতে তারা আর উঠতে না পারে; তারা আমার পায়ের তলায় পড়েছে। তুমিই আমার কোমরে যুদ্ধ করার শক্তি দিয়েছ, আমার বিপক্ষদের আমার পায়ে নত করেছ। আমার শত্রুদের তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে বাধ্য করেছ; যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের আমি ধ্বংস করেছি। তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছে, কিন্তু কেউ তাদের রক্ষা করতে আসে নি। তারা মাবুদের কাছে চিৎকার করেছে, কিন্তু তিনিও তাদের জবাব দেন নি। বাতাসে বয়ে নিয়ে যাওয়া ধুলার মত আমি তাদের গুঁড়া করেছি, রাস্তার কাদা-মাটির মত করে তাদের ফেলে দিয়েছি। হে মাবুদ, লোকদের বিদ্রোহ থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার করেছ, অন্য জাতিদের উপরে আমাকে কর্তা করেছ; আমি যাদের চিনতাম না তারাও আমার অধীন হয়েছে। আমার কথা শুনলেই তারা আমার অধীনতা স্বীকার করে; বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে বিদেশীরা আমার বাধ্য হয়। তারা নিরাশ হয়ে পড়ে; তারা কাঁপতে কাঁপতে কেল্লা থেকে বের হয়। মাবুদ জীবন্ত। আমার আশ্রয়-পাহাড়ের প্রশংসা হোক। আমার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌র সম্মান বৃদ্ধি হোক। তিনিই অন্য জাতিদের আমার অধীনে আনেন আর আমার হয়ে তাদের পাওনা শাস্তি দেন। তিনি শত্রুদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে শত্রুদের উপরে তুলেছ, জুলুমবাজ লোকদের হাত থেকে তুমিই আমাকে রক্ষা করেছ। হে মাবুদ, এইজন্য অন্য জাতিদের মধ্যে আমি তোমার প্রশংসা করব আর তোমার সুনাম গাইব। মাবুদ তাঁর বাদশাহ্‌কে অনেকবার মহাজয় দান করেন; হ্যাঁ, তাঁর অভিষেক-করা বান্দার প্রতি, দাউদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতি, তিনি চিরকাল তাঁর অটল মহব্বত দেখান। আসমান আল্লাহ্‌র মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ। দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান। কিন্তু তাতে কোন শব্দ নেই, কোন ভাষা নেই, তাদের আওয়াজও কানে শোনা যায় না; তবুও তাদের ডাক সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ছে; তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত। আসমানে সূর্যের জন্য তিনি একটা তাম্বু খাটিয়েছেন; সে বরের মত করে বাসর-ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, নির্দিষ্ট পথে দৌড়াবে বলে খেলোয়াড়-বীরের মত খুশী হয়ে ওঠে; সে আসমানের এক দিক থেকে ওঠে আর ঘুরে অন্য দিকে যায়; তার তাপ থেকে কিছুই রেহাই পায় না। মাবুদের নির্দেশে কোন খুঁত নেই, তা মানুষকে জাগিয়ে তোলে। মাবুদের কালাম নির্ভরযোগ্য, তা সরলমনা লোককে জ্ঞান দেয়। মাবুদের সমস্ত নিয়ম সোজা পথে চালায় আর অন্তরে দেয় আনন্দ। মাবুদের হুকুম খাঁটি, তা দিলকে সতেজ করে। মাবুদের প্রতি যে ভয়, তা পবিত্রতায় ভরা আর চিরকাল স্থায়ী। মাবুদের শরীয়ত সত্য, তাতে অন্যায় কিছু নেই। তা সোনার চেয়ে, প্রচুর খাঁটি সোনার চেয়েও বেশী কামনা করার মত জিনিস। তা মধুর চেয়ে মিষ্টি, মৌচাকের ঝরা মধুর চেয়েও মিষ্টি। তা তোমার গোলামকে সাবধান করে, আর তা পালন করলে মহালাভ হয়। নিজের ভুল কে বোঝে? আমার অজানা দোষ তুমি মাফ কর। জেন্তেশুনে অহংকারের বশে করা গুনাহ্‌ থেকে তোমার গোলামকে তুমি দূরে রাখ; তা যেন আমার উপর রাজত্ব না করে। তাহলেই আমি নিখুঁত হতে পারব, মুক্ত থাকব আল্লাহ্‌র প্রতি ভীষণ বিদ্রোহের দায় থেকে। হে মাবুদ, আমার আশ্রয়-পাহাড়, আমার মুক্তিদাতা, আমার মুখের কথা ও আমার দিলের চিন্তা তোমাকে যেন খুশী করে। তোমার দুঃখের দিনে মাবুদ তোমার ডাকে সাড়া দিন; ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ তোমাকে নিরাপদে রাখুন। তাঁর পবিত্র জায়গা থেকে তিনি তোমাকে সাহায্য করুন আর সিয়োন পাহাড় থেকে তোমাকে শক্তি দিন। তোমার সমস্ত কোরবানীর কথা তাঁর মনে থাকুক, তোমার পোড়ানো-কোরবানীগুলো তিনি কবুল করুন। [সেলা] তোমার মনের ইচ্ছা তিনি পূরণ করুন, তোমার সমস্ত পরিকল্পনা সফল করুন। তোমার জয়ে আমরা যেন আনন্দ করি আর আমাদের আল্লাহ্‌র নামে নিশান উড়াই। মাবুদ তোমার সমস্ত মুনাজাত কবুল করুন। এখন আমি জানি, মাবুদ তাঁর অভিষেক-করা বান্দাকে রক্ষা করেন; তাঁর ডান হাতের রক্ষা করার শক্তিতে তিনি পবিত্র বেহেশত থেকে 3 তাঁর অভিষেক-করা বান্দার ডাকে সাড়া দেন। অনেকে তাদের রথের বড়াই করে, অনেকে করে তাদের ঘোড়ার, কিন্তু আমরা করি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র। তারা নীচু হয়েছে, তারা পড়ে গেছে, কিন্তু আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি। হে মাবুদ, রক্ষা কর; হে বাদশাহ্‌, আমাদের ডাকে সাড়া দাও। হে মাবুদ, তোমার শক্তি দেখে বাদশাহ্‌ আনন্দিত হন; তুমি তাঁকে জয় দান করলে তিনি কত খুশী হন। তুমি তাঁর মনের ইচ্ছা পূরণ করেছ, তাঁর মুখের কথা অগ্রাহ্য কর নি। [সেলা] উন্নতির অনেক দোয়া নিয়ে তুমি তাঁকে এগিয়ে আনতে গেছ, তাঁর মাথায় দিয়েছ খাঁটি সোনার তাজ। তিনি তোমার কাছে জীবন চেয়েছিলেন, আর তুমি তাঁকে তা দিয়েছ; তুমি তাঁকে দিয়েছ অশেষ আয়ু। তোমার দেওয়া জয় তাঁর সম্মান বাড়িয়েছে; তুমি তাঁকে দিয়েছ গৌরব ও মহিমা। তুমি তাঁকে চিরস্থায়ী দোয়া করেছ; তোমার উপস্থিতির আনন্দে তাঁকে আনন্দিত করেছ। মাবুদের উপরেই বাদশাহ্‌ ভরসা করেন; আল্লাহ্‌তা’লার অটল মহব্বত তাঁকে স্থির রাখবে। তোমার হাতই তোমার সব শত্রুদের ধরবে; যারা তোমাকে ঘৃণা করে তোমার ডান হাত তাদের ধরবে। তোমার প্রকাশকালে তুমি তাদের করে তুলবে চুলার জ্বলন্ত কয়লার মত। মাবুদ রাগে তাদের গিলে ফেলবেন, তাঁর আগুন তাদের পুড়িয়ে ফেলবে। দুনিয়ার বুক থেকে তাদের বংশধরদের তুমি ধ্বংস করে ফেলবে; ধ্বংস করে দেবে তাদের বংশ মানুষের মধ্য থেকে। যদিও তারা তোমার বিরুদ্ধে দুষ্ট ষড়যন্ত্র আর কুমতলব করেছে, তবুও তারা তাতে সফল হতে পারবে না; কারণ তুমি তাদের মুখ লক্ষ্য করে যখন তোমার ধনুকে টান দেবে, তখন তাদের পালিয়ে যেতে তুমি বাধ্য করবে। হে মাবুদ, তোমার শক্তিতে তুমি প্রকাশিত হও; আমরা তোমার শক্তির প্রশংসা করব ও কাওয়ালী গাইব। আল্লাহ্‌ আমার, আল্লাহ্‌ আমার, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ? আমাকে রক্ষা না করে, আমার কান্না-ভরা মুনাজাত না শুনে, কেন তুমি দূরে সরে রয়েছ? হে আমার আল্লাহ্‌, দিনের বেলায় আমি তোমাকে ডাকি, কিন্তু তুমি জবাব দাও না; রাতেও আমি চুপ করে থাকি না। কিন্তু তুমি পবিত্র; বনি-ইসরাইলদের প্রশংসার সিংহাসনে তুমি বসে আছ। তোমার উপরেই ভরসা করতেন আমার পূর্বপুরুষেরা; তাঁরা ভরসা করতেন, আর তুমি তাঁদের রক্ষা করতে। তাঁরা তোমার কাছে কাঁদতেন আর রক্ষা পেতেন; তোমার উপর ভরসা করে তাঁরা লজ্জায় পড়তেন না। কিন্তু আমি তো কেবল একটা পোকা, মানুষ নই; লোকে আমাকে টিট্‌কারি দেয় আর মানুষ আমাকে তুচ্ছ করে। যারা আমাকে দেখে তারা সবাই আমাকে ঠাট্টা করে। তারা আমাকে মুখ ভেংগায়, আর মাথা নেড়ে বলে, “ও তো মাবুদের উপর ভরসা করে, তাহলে তিনিই ওকে রক্ষা করুন; তিনিই ওকে উদ্ধার করুন, কারণ ওর উপর তিনি সন্তুষ্ট।” মায়ের গর্ভ থেকে তুমিই আমাকে বের করে এনেছ; যখন আমি মায়ের দুধ খেতাম তখন তোমার উপর আমার নির্ভরতা তুমিই জাগিয়েছ। জন্মের পরেই আমাকে তোমার হাতে দেওয়া হয়েছে; জন্ম থেকে তুমিই আমার আল্লাহ্‌ হয়েছ। তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না, কারণ আমার বিপদ কাছে এসে পড়েছে, আমার সাহায্যকারী কেউ নেই। আমার চারপাশে রয়েছে যেন ষাঁড়ের দল; যেন বাশন দেশের শক্তিশালী ষাঁড়গুলো আমাকে ঘিরে ধরেছে। শিকারের খোঁজে সিংহ যেমন গর্জন করে, তেমনি করে তারা আমার বিরুদ্ধে মুখ হাঁ করেছে। আমাকে পানির মত করে ঢেলে ফেলা হয়েছে, আমার সমস্ত হাড়ের জোড়া খুলে গেছে, আমার অন্তর মোমের মত হয়ে আমার ভিতরে গলে গলে পড়ছে। মাটির পাত্রের শুকনা টুকরার মত আমার শক্তি শুকিয়ে এসেছে, আর আমার জিভ্‌ তালুতে লেগে যাচ্ছে; তুমি আমাকে কবরে শুইয়ে রেখেছ। আমার চারপাশে একদল দুষ্ট লোক কুকুরের মত করে আমাকে ঘিরে ধরেছে; তারা আমার হাত ও পা বিঁধেছে। আমার হাড়গুলো আমি গুণতে পারি; সেই লোকেরা আমাকে হাঁ করে দেখছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে তারা আমার কাপড়-চোপড় ভাগ করছে আর আমার কোর্তার জন্য গুলিবাঁট করছে। কিন্তু তুমি, হে মাবুদ, দূরে থেকো না; হে আমার শক্তি, আমাকে সাহায্য করার জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে এস। তলোয়ারের মুখ থেকে আমার প্রাণ, ঐ সব কুকুরদের থাবা থেকে আমার বহুমূল্য জীবন তুমি রক্ষা কর। ঐ সব সিংহের মুখ থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। তুমি ঐ সব বুনো ষাঁড়ের শিংয়ের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করলে। ভাইদের কাছে আমি তোমার বিষয় প্রচার করব আর সমাজের মধ্যে তোমার গুণগান করব। তোমরা যারা মাবুদকে ভয় কর, তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। ইয়াকুবের সমস্ত বংশধরেরা, তোমরা তাঁকে সম্মান দেখাও। ইসরাইলের সমস্ত বংশধরেরা, তোমরা তাঁর এবাদত কর। দুঃখীর দুঃখ দেখে তাকে তিনি তুচ্ছ কিংবা অগ্রাহ্য করেন নি; তিনি তার কাছ থেকে নিজের মুখ ফিরান নি, বরং সাহায্যের জন্য তিনি তার অনুরোধ শুনেছেন। বড় সভার মধ্যে আমার যে প্রশংসা তা তোমার কাছ থেকেই আসে; তোমার উপর যাদের ভয় আছে তাদের সামনেই আমার সব মানত আমি পূরণ করব। নম্র লোকেরা খেয়ে তৃপ্ত হবে; যারা মাবুদের ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর প্রশংসা করবে। তারা চিরকাল জীবিত থাকুক। দুনিয়ার শেষ সীমার লোকেরাও তওবা করে মাবুদের কাছে আসবে; অন্য জাতিদের সমস্ত গোষ্ঠী তাঁকে সেজদা করবে। জ্বী, রাজ্য মাবুদেরই; সব জাতির উপরে তিনিই বাদশাহ্‌। দুনিয়ার ধনী লোকেরাও তখন তাঁর সামনে খাওয়া-দাওয়া করবে আর তাঁর এবাদত করবে; নিজের প্রাণ বাঁচাবার ক্ষমতা নেই বলে যাদের এক পা কবরে, তারাও তাঁকে সেজদা করবে। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তাঁর এবাদত করবে, আর সেই যুগের লোকদের কাছে দীন-দুনিয়ার মালিকের বিষয় বলা হবে। যাদের এখনও জন্ম হয় নি, তাদের কাছে গিয়ে লোকে তাঁর ন্যায্যতার কথা ঘোষণা করবে; বলবে, তিনিই এ কাজ করেছেন। মাবুদ আমার পালক, আমার অভাব নেই। তিনি আমাকে মাঠের সবুজ ঘাসের উপর শোয়ান, শান্ত পানির ধারেও আমাকে নিয়ে যান। তিনি আমাকে নতুন শক্তি দেন; তাঁর নিজের সুনাম রক্ষার জন্যই আমাকে ন্যায় পথে চালান। ঘন অন্ধকারে ঢাকা উপত্যকা পার হতে হলেও আমি বিপদের ভয় করব না, কারণ তুমিই আমার সংগে আছ; তোমার মুগুর আর লাঠি দূর করে দেয় বিপদের ভয়। শত্রুদের মধ্যে তুমি আমার সামনে খাবারে সাজানো টেবিল রেখে থাক; আমার মাথায় দাও তেল; আমার পেয়ালা উপ্‌চে পড়ে। আমি জানি সারা জীবন ধরে তোমার মেহেরবানী ও অটল মহব্বত আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসবে; আর আমি চিরকাল মাবুদের ঘরে বাস করব। দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব কিছু মাবুদের; বিশ্ব ও তার মধ্যে যারা বাস করে তারাও তাঁর; কারণ তিনিই গভীর পানির উপরে ভূমির ভিত্তি গাঁথলেন, আর সেই ভূমি মাটির নীচের পানির উপরে ধরে রাখলেন। কে মাবুদের পাহাড়ে ওঠার যোগ্য? তাঁর পবিত্র জায়গায় দাঁড়াবার যোগ্য কে? কেবল সে-ই যোগ্য, যার হাত নির্দোষ, অন্তর খাঁটি, মন মিথ্যার দিকে নয়, আর মুখে নেই মিথ্যা কসম। সে মাবুদের কাছ থেকে দোয়া পাবে; সে যে তাঁরই ইচ্ছামত চলছে তার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌ তা দেখিয়ে দেবেন। এই রকম লোকেরা মাবুদের এবাদত করে, তারা তাঁর মুখের দিকে তাকায়; এরাই ইয়াকুবের বংশ। [সেলা] হে শহরের দরজা, তোমাদের মাথা আরও উপরে তোল; হে পুরানো দিনের দরজা, তোমাদের পাল্লা সম্পূর্ণভাবে খুলে যাক; গৌরবের বাদশাহ্‌ ভিতরে ঢুকবেন। এই গৌরবের বাদশাহ্‌ কে? তিনি মাবুদ, যিনি শক্তিশালী ও মহান; সেই মাবুদ, যিনি যুদ্ধে মহান। হে শহরের দরজা, তোমাদের মাথা আরও উপরে তোল; হে পুরানো দিনের দরজা, তোমাদের পাল্লা সম্পূর্ণভাবে খুলে যাক; গৌরবের বাদশাহ্‌ ভিতরে ঢুকবেন। কে এই গৌরবের বাদশাহ্‌? আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই গৌরবের বাদশাহ্‌। [সেলা] হে মাবুদ, আমার অন্তর আমি তোমার দিকেই তুলে ধরছি। হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার উপরেই আমি ভরসা করি, তুমি আমাকে লজ্জায় পড়তে দিয়ো না; আমার শত্রুরা যেন আমার বিষয় নিয়ে আনন্দ করার সুযোগ না পায়। যে তোমার উপর আশা রাখে সে লজ্জায় পড়বে না, কিন্তু যারা অকারণে বেঈমানী করে তারাই লজ্জায় পড়বে। হে মাবুদ, তোমার পথ আমাকে জানাও, আমাকে তোমার পথে চলতে শিখাও। তোমার সত্যে আমাকে পরিচালনা কর আর আমাকে শিক্ষা দাও, কারণ তুমিই আমার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌; সব সময় তোমার উপরেই আমি আশা রাখি। হে মাবুদ, তোমার মমতা ও অটল মহব্বতের কথা তুমি ভুলে যেয়ো না; সে সব তো তোমার চিরকালের কাজ। আমার যৌবনকালের গুনাহ্‌ ও তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা তুমি মনে রেখো না; তোমার অটল মহব্বতের দরুন তুমি আমাকে মনে রেখো, কারণ হে মাবুদ, তুমি মেহেরবান। মাবুদ মেহেরবান ও সৎ, সেজন্যই তাঁর পথের বিষয় তিনি গুনাহ্‌গারদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি নম্রদের ন্যায়পথে চালিয়ে নিয়ে যান আর তাঁর পথের বিষয় শিক্ষা দেন। মাবুদের ব্যবস্থা ও শরীয়ত অনুসারে যারা চলে, তাদের কাছে তাঁর সমস্ত পথই অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততায় পরিপূর্ণ। আমার অন্যায়ের বোঝা খুব বেশী, তাই হে মাবুদ, তোমার সুনাম রক্ষার জন্যই আমার সেই অন্যায় তুমি মাফ কর। কে সেই লোক, যে মাবুদকে ভয় করে? কোন্‌ পথ তাকে বেছে নিতে হবে তা তিনি তাকে দেখিয়ে দেবেন। সে উন্নতির মধ্যে তার জীবন কাটাবে, আর তার বংশধরেরা দেশের অধিকার পাবে। মাবুদকে যারা ভয় করে তাদের কাছেই তিনি তাঁর গোপন উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন, আর তাঁর স্থাপন করা ব্যবস্থা তিনি তাদেরই জানান। আমার চোখ সব সময় মাবুদের দিকে আছে, কারণ শিকারীর জাল থেকে তিনিই আমার পা মুক্ত করবেন। আমার দিকে ফেরো আর আমার প্রতি রহমত কর, কারণ আমি একা আর দুঃখী। আমার দিলের যাতনা বেড়ে গেছে; আমার সব কষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা কর। চেয়ে দেখ আমার দুঃখ ও কষ্টের দিকে; আমার সমস্ত গুনাহ্‌ তুমি মাফ কর। দেখ, আমার শত্রুর সংখ্যা কত; তারা আমাকে কি ভীষণ ঘৃণা করে। আমার প্রাণ বাঁচাও ও আমাকে রক্ষা কর; আমাকে লজ্জায় পড়তে দিয়ো না, কারণ আমি তোমার মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছি। আমার সততা ও ন্যায় কাজ আমাকে রক্ষা করুক, কারণ আমি তোমার উপরেই আমার আশা রেখেছি। হে আল্লাহ্‌, ইসরাইলকে তার সমস্ত কষ্ট থেকে মুক্ত কর। হে মাবুদ, আমি যে ন্যায়পথে আছি তা তুমি দেখিয়ে দাও, কারণ আমি সৎ ভাবে চলি; আমি স্থিরভাবে মাবুদের উপর ভরসা করি। হে মাবুদ, তুমি আমাকে খাঁটি বলে প্রমাণ কর; আমাকে পরীক্ষা করে দেখ, আর আমার অন্তর ও মনের খাদ বের করে ফেল; কারণ সব সময় তোমার অটল মহব্বত আমার চোখের সামনে রয়েছে; তোমার বিশ্বস্ততার কথা মনে রেখে আমি চলাফেরা করি। আমি ঠগদের সংগে থাকি না, আর ভণ্ডদের সংগে ওঠা-বসা করি না। যারা খারাপ কাজ করে তাদের দলকে আমি ঘৃণা করি; আমি দুষ্টদের সংগে বসতে রাজী নই। হে মাবুদ, আমি নির্দোষ অবস্থায় হাত ধুয়ে ফেলব আর তোমার কোরবানগাহের চারপাশে ঘুরে আসব, যাতে চিৎকার করে আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাতে পারি, আর তোমার সমস্ত অলৌকিক কাজের কথা বলতে পারি। হে মাবুদ, যে ঘরে তুমি বাস কর, তোমার মহিমা যেখানে থাকে, সেই জায়গা আমি ভালবাসি। গুনাহ্‌গারদের দলে তুমি আমাকে ফেলো না; যারা রক্তপাত করতে ভালবাসে তাদের সংগে আমাকে মেরে ফেলো না। তাদের হাতে রয়েছে খারাপীর পরিকল্পনা, তাদের ডান হাত ঘুষে ভরা। কিন্তু আমি সৎ ভাবে চলাফেরা করি; আমাকে তাদের হাত থেকে মুক্ত কর, আর আমার প্রতি রহমত কর। আমি সমান জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি; আমি সকলের সামনেই মাবুদের প্রশংসা করব। মাবুদই আমার নূর ও আমার উদ্ধারকর্তা, আমি কাকে ভয় করব? মাবুদই আমার জীবনের কেল্লা, আমি কাকে দেখে ভয়ে কাঁপব? দুষ্ট লোকেরা আমাকে গিলে খাবার জন্য যখন এগিয়ে আসে তখন আমার সেই শত্রু ও বিপক্ষেরা উচোট খেয়ে পড়ে যায়। সৈন্যের দলও যদি আমাকে ঘিরে ধরে, তবুও আমার মনে ভয় হবে না; যদি আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধও শুরু হয় তবুও তখন আমি নিশ্চিন্ত থাকব। মাবুদের কাছে আমি একটা অনুরোধ জানাচ্ছি; আমি যা চাইছি তা এই- আমার সারা জীবন আমি যেন মাবুদের ঘরে বাস করতে পারি, যাতে আমি তাঁর সৌন্দর্য দেখতে পারি আর সেই বাসস্থানে তাঁর বিষয় নিয়ে ধ্যান করতে পারি; কারণ বিপদের দিনে তাঁর সেই আশ্রয়ে তিনি আমাকে নিরাপদে রাখবেন, তাঁর সেই তাম্বুতে আমাকে লুকিয়ে রাখবেন, আর পাহাড়ের উপরে আমাকে তুলে রাখবেন। যে সব শত্রুরা আমাকে ঘিরে ধরেছে তাদের চেয়ে তখন আমার সম্মান বাড়বে; আমি তাঁর ঘরে আনন্দে চিৎকার করতে করতে বিভিন্ন কোরবানী দেব; আমি মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব আর তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। হে মাবুদ, আমি ডাকলে তুমি শুনো, আমার প্রতি রহমত কোরো, আমার ডাকে সাড়া দিয়ো। আমার অন্তর তোমার এই কথাই বলছে, “তোমরা আমাকে ডাক।” হে মাবুদ, তাই আমি তোমাকে ডাকব। তোমার মুখ তুমি আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে রেখো না, রাগ করে তোমার গোলামকে তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না; তুমিই তো আমার সাহায্যকারী হয়ে আসছ। হে আল্লাহ্‌, আমার উদ্ধারকর্তা, আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, আমাকে ত্যাগ কোরো না। আমার মা-বাবা আমাকে ত্যাগ করলেও মাবুদ আমার ভার নেবেন। হে মাবুদ, তোমার পথ আমাকে দেখিয়ে দাও; আমার শত্রুদের দরুন সমান পথে আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাও। আমার শত্রুদের ইচ্ছার কাছে আমাকে ছেড়ে দিয়ো না, কারণ মিথ্যা সাক্ষীরা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে; তাদের নিঃশ্বাসের সংগে বের হচ্ছে জুলুম। মাবুদের দেওয়া মেহেরবানী আমি জীবিতদের মধ্যেই দেখতে পাব- এ কথা যদি আমি বিশ্বাস না করতাম তবে আমার কি হত? তোমরা মাবুদের উপর আশা রাখ; মনে শক্তি আন ও সাহসে বুক বাঁধ আর মাবুদের উপর আশা রাখ। হে মাবুদ, আমার আশ্রয়-পাহাড়, আমি তোমাকেই ডাকছি। তুমি আমার কথায় কান বন্ধ করে থেকো না, কারণ তুমি যদি চুপ করে থাক তবে যারা কবরে নেমে গেছে তাদের মতই আমার দশা হবে। সাহায্যের জন্য আমি যখন তোমাকে ডাকি আর তোমার মহাপবিত্র স্থানের দিকে হাত উঠাই, তখন তুমি আমার মিনতি শুনো। যারা দুষ্ট, যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায়, যারা সকলের সংগে ভাল মুখে কথা বলে অথচ অন্তরে পুষে রাখে খারাপ ইচ্ছা, তাদের সংগে শাস্তি দেবার জন্য তুমি আমাকে টেনে নিয়ো না। তাদের কাজের ফল, তাদের খারাপ কাজের ফল, তুমি তাদের দাও; তাদের হাত যে কাজ করেছে তার ফল তাদের দাও; তাদের যা পাওনা তা-ই তাদের দাও। মাবুদের হাত যে কাজ করেছে তার প্রতি তারা মনোযোগ দেয় নি, কাজেই তিনি তাদের ধ্বংস করবেন, আবার গড়বেন না। সমস্ত প্রশংসা মাবুদের, তিনি আমার মিনতি শুনেছেন। মাবুদই আমার শক্তি ও আমার ঢাল; আমার অন্তর তাঁর উপরে ভরসা করে, তাই আমি সাহায্য পেয়েছি; সেইজন্য আমার অন্তর আনন্দে ভরে উঠেছে, আর আমি কাওয়ালীর মধ্য দিয়ে তাঁর শুকরিয়া আদায় করব। মাবুদই তাঁর বান্দাদের শক্তি; তিনিই তাঁর অভিষেক-করা লোকের রক্ষাকারী কেল্লা। হে মাবুদ, তোমার বান্দাদের তুমি রক্ষা কর, তোমার সম্পত্তিকে তুমি দোয়া কর; তুমি তাদের পালক হও আর চিরকাল তাদের বয়ে নাও। হে ফেরেশতারা, তোমরা মাবুদের গৌরব ঘোষণা কর, ঘোষণা কর মাবুদের গৌরব ও কুদরত। তোমরা মাবুদের গৌরব ঘোষণা কর; তাঁর মহিমাপূর্ণ পবিত্রতার কথা ভেবে তাঁর এবাদত কর। পানির উপরে মাবুদের গলার আওয়াজ শোনা যায়; বাজ পড়ার শব্দে গৌরবময় আল্লাহ্‌ গর্জন করেন; সমস্ত পানির উপরে বাজের শব্দে রয়েছে মাবুদের গর্জন। মাবুদের গলার আওয়াজ কুদরতে পূর্ণ, মহিমায় পূর্ণ সেই আওয়াজ। সেই আওয়াজ এরস গাছও ভেংগে ফেলে; মাবুদ লেবাননের এরস গাছ টুকরা টুকরা করেন। তিনি লেবানন পাহাড়শ্রেণীকে বাছুরের মত নাচান, আর সিরিয়োণ পাহাড়কে নাচান বুনো ষাঁড়ের বাচ্চার মত। মাবুদের গলার আওয়াজে আকাশে বিদ্যুতের ঝলক সৃষ্টি হয়। সেই আওয়াজে মরুভূমি কেঁপে ওঠে; মাবুদ কাদেশের মরুভূমি কাঁপিয়ে তোলেন। তাঁর গলার আওয়াজে হরিণীরা বাচ্চা দেয় আর বনের ডাল ও পাতা পড়ে যায়; তাঁর বাসস্থানে সবার মুখে রয়েছে, “তিনি গৌরবময়।” মহাবন্যার পানি মাবুদের অধীনে ছিল; তিনি চিরকালের বাদশাহ্‌, তিনি সিংহাসনে আছেন। মাবুদ তাঁর বান্দাদের শক্তির যোগান দেবেন; শান্তি দান করে তিনি তাদের দোয়া করবেন। হে মাবুদ, আমি তোমার প্রশংসা করব, কারণ তুমিই আমাকে উঠিয়ে এনেছ; আমার শত্রুদের তুমি আমার বিরুদ্ধে আনন্দ করতে দাও নি। হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, সাহায্যের জন্য আমি তোমাকে ডেকেছিলাম আর তুমি আমাকে সুস্থ করে তুলেছ। হে মাবুদ, তুমি আমাকে কবর থেকে তুলে এনেছ; তুমিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ যেন সেই গর্তে আমাকে নেমে যেতে না হয়। হে মাবুদের ভক্তেরা, তোমরা তাঁর উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, তাঁর পবিত্রতার প্রশংসা কর; কারণ তাঁর রাগ বেশীক্ষণ থাকে না; তাঁর রহমতে জীবন পাওয়া যায়। কেবল রাতটুকু কাটে কান্নায়, কিন্তু ভোর বেলাতেই আসে আনন্দ। সুখের দিনে আমি বলেছিলাম, কেউ আমাকে নাড়াতে পারবে না। হে মাবুদ, তুমি রহমত করে আমার রাজ্য অটল রেখেছ, কিন্তু যখন তুমি মুখ ফিরালে তখন আমি ভীষণ ভয় পেলাম। হে মাবুদ, তোমাকেই আমি ডেকেছিলাম; আমার মালিকের কাছে আমি মিনতি করে বলেছিলাম, “আমার মরণে কিংবা কবরে যাওয়াতে কি লাভ? ধুলা কি তোমার প্রশংসা করবে কিংবা তোমার বিশ্বস্ততা প্রচার করবে? হে মাবুদ, শোন, আমার প্রতি রহমত কর; হে মাবুদ, তুমি আমাকে সাহায্য কর।” শোক প্রকাশের অনুষ্ঠান থেকে তুমি আমাকে নাচের উৎসবে এনেছ; শোকের চট খুলে নিয়ে তুমি আমাকে আনন্দের সাজ পরিয়েছ, যাতে আমার অন্তর নীরব না থাকে বরং তোমার উদ্দেশে কাওয়ালী গায়। হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, আমি চিরকাল তোমার শুকরিয়া আদায় করব। হে মাবুদ, আমি তোমারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি; আমাকে কখনো লজ্জায় পড়তে দিয়ো না; তোমার ন্যায়বিচারের জোরে আমাকে তুমি রক্ষা কর। আমার কথায় কান দাও; আমাকে উদ্ধার করতে তুমি তাড়াতাড়ি এস। আমাকে রক্ষা করার জন্য তুমি আমার আশ্রয়-পাহাড় হও আর আমার কেল্লা হও। তুমিই আমার আশ্রয়-পাহাড় ও আমার কেল্লা; তোমার সুনাম রক্ষার জন্য আমাকে তুমি পথ দেখাবে আর চালিয়ে নিয়ে যাবে। আমার জন্য গোপনে পেতে রাখা জাল থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার করবে, কারণ তুমিই তো আমার আশ্রয়। আমি তোমার হাতেই আমার রূহ্‌ তুলে দিলাম, কারণ হে আল্লাহ্‌, বিশ্বস্ত মাবুদ, তুমিই আমাকে মুক্ত করেছ। যারা অসার মূর্তিকে ভক্তি করে আমি তাদের ঘৃণা করি; কিন্তু আমি মাবুদের উপর ভরসা করি। তোমার অটল মহব্বত পেয়েছি বলে আমি আনন্দ করব, খুশী হব; কারণ তুমি তো আমার দুঃখ দেখেছ, আর আমার কষ্টের কথা জান। তুমি শত্রুদের হাতে আমাকে আট্‌কে রাখ নি, বরং একটা খোলা জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়েছ। হে মাবুদ, আমাকে রহমত দান কর, কারণ আমি কষ্টের মধ্যে আছি; দুঃখে আমার চোখ ও আমার দেহ-মন দুর্বল হয়ে পড়ছে। যন্ত্রণায় আমার জীবন গেল, আর কোঁকাতে কোঁকাতে বয়স গেল; অন্যায় করার দরুন আমার শক্তি কমে যাচ্ছে, আমার হাড়গুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। শত্রুরা আমাকে ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে, বিশেষ করে আমার সংগীদের কাছে তা করেছে। পরিচিত লোকদের কাছে আমি ভয়ের পাত্র; লোকে আমাকে রাস্তায় দেখে পালিয়ে যায়। মরা মানুষকে লোকে যেমন ভুলে যায় তেমনি করেই তারা আমাকে ভুলে গেছে; আমি যেন একটা ভাংগা পাত্র। আমার সম্বন্ধে অনেকের নিন্দার কথা আমার কানে এসেছে, আমার চারদিকে ভীষণ ভয়। ওরা আমার বিরুদ্ধে একসংগে পরামর্শ করছে, আমাকে হত্যা করবার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু হে মাবুদ, তোমার উপরে আমি ভরসা করে আছি; আমি বলি, “তুমিই আমার আল্লাহ্‌।” তোমার হাতেই তো আমার জীবনের সব কিছু; যারা আমাকে তাড়া করে আসছে সেই শত্রুদের হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও। তোমার গোলামের উপর তোমার রহমত আলোর মত করে পড়ুক; তোমার অটল মহব্বতে তুমি আমাকে রক্ষা কর। হে মাবুদ, আমি তো তোমাকে ডেকেছি, তুমি আমাকে লজ্জায় পড়তে দিয়ো না; দুষ্ট লোকেরা বরং লজ্জায় পড়ুক, তারা নীরব হয়ে কবরে পড়ে থাকুক। অহংকার ও ঘৃণার ভাব নিয়ে যারা আল্লাহ্‌ভক্তদের বিরুদ্ধে অসম্মানের কথা বলে, তাদের মিথ্যাবাদী মুখ বন্ধ হয়ে যাক। তুমি যে মেহেরবানী করেছ তা কত মহান! যারা তোমাকে ভয় করে তাদের জন্য তুমি তা তুলে রেখেছ; তোমার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারীদের তুমি সেই মেহেরবানী করে থাক, আর তা কর সকলের সামনে। তুমি তাদের তোমার আড়ালে রেখে মানুষের ষড়যন্ত্র থেকে লুকিয়ে রাখ; ঝগড়া-বিবাদের ঝাপ্‌টা থেকে তোমার আশ্রয়ে তাদের সরিয়ে রাখ। সমস্ত প্রশংসা মাবুদের। ঘেরাও করা শহরের মধ্যে তাঁর অটল মহব্বত আশ্চর্যভাবে তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। আমি ভয় পেয়ে বলেছিলাম, “তোমার কাছ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি”; কিন্তু সাহায্যের জন্য যখন আমি তোমাকে ডেকেছিলাম তখন তুমি আমার মিনতি শুনেছিলে। হে সমস্ত আল্লাহ্‌ভক্ত লোক, তোমরা মাবুদকে মহব্বত কোরো। মাবুদই বিশ্বস্তদের রক্ষা করেন কিন্তু অহংকারীদের তিনি পুরোপুরি শাস্তি দেন। তোমরা যারা মাবুদের উপর ভরসা করে আছ তোমরা মনে শক্তি আন ও সাহসে বুক বাঁধো। ধন্য সেই লোক, যার আল্লাহ্‌র প্রতি বিদ্রোহ মাফ করা হয়েছে, যার গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হয়েছে। ধন্য সেই লোক, যার অন্যায় মাবুদ মাফ করেছেন আর যার অন্তরে কোন ছলনা নেই। আমি যখন গুনাহ্‌ স্বীকার করি নি তখন সারা দিন কোঁকাতে কোঁকাতে আমার হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল; কারণ তখন দিনরাত আমার উপরে তোমার হাতের চাপ ভারী ছিল; গরমকালের গরমে যেমন হয় তেমনি করে আমার গায়ের শক্তি কমে যাচ্ছিল। [সেলা] তখন আমার গুনাহ্‌ আমি তোমার কাছে স্বীকার করলাম, আমার অন্যায় আমি আর ঢেকে রাখলাম না। আমি বলেছিলাম, “আমার বিদ্রোহের কথা আমি মাবুদের কাছে স্বীকার করব।” তাই গুনাহের দরুন আমার দোষ তুমি মাফ করে দিলে। [সেলা] কাজেই যতদিন সুযোগ আছে ততদিন তোমার ভক্তেরা তোমার কাছে মুনাজাত করুক; সত্যিই, বিপদ যখন বন্যার পানির মত হয়ে দেখা দেবে তখন তা তাদের কাছে আসবে না। তুমিই আমার লুকিয়ে থাকার জায়গা। তুমি আমাকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করছ। মুক্তির আনন্দ-কাওয়ালীতে তুমিই আমাকে ঘিরে রাখছ। [সেলা] আমি মাবুদ তোমাকে জ্ঞান দেব আর যে পথে যেতে হবে তা দেখিয়ে দেব; তোমাকে চোখে চোখে রেখে আমি শিক্ষা দেব। তোমরা ঘোড়া বা গাধার মত হোয়ো না যাদের বুঝবার শক্তি নেই; মুখে লাগাম ও দড়ি দিয়ে তাদের বশে রাখতে হয়, তা না দিলে তারা তোমাদের কাছে আসবে না। দুষ্টকে অনেক যন্ত্রণা পেতে হয়, কিন্তু যে মাবুদের উপর ভরসা করে মাবুদের অটল মহব্বত তাকে ঘিরে রাখে। হে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা, মাবুদই যেন তোমাদের আনন্দের বিষয় হন, তাঁকে নিয়েই তোমরা খুশী হও; তোমরা যারা অন্তরে খাঁটি, তোমরা সকলে আনন্দ-কাওয়ালী গাও। হে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা, মাবুদের বিষয় নিয়ে তোমরা আনন্দ-কাওয়ালী গাও; তাঁর গুণগান করা খাঁটি লোকদেরই কাজ। বীণা বাজিয়ে মাবুদের শুকরিয়া আদায় কর; তাঁর উদ্দেশে দশ তারের বীণা বাজাও। তাঁর উদ্দেশে নতুন কাওয়ালী গাও, পাকা হাতে বাজনা বাজাও আর আনন্দে চিৎকার কর। মাবুদের কালাম সত্য, তাঁর সব কাজে তিনি বিশ্বস্ত। মাবুদ ন্যায় কাজ ও ন্যায়বিচার ভালবাসেন; সারা দুনিয়া জুড়ে আছে তাঁর অটল মহব্বত। মাবুদের কালামে আসমান তৈরী হয়েছে; তার মধ্যেকার সব কিছু তৈরী হয়েছে তাঁর মুখের শ্বাসে। তিনি সমুদ্রের পানি জড়ো করে ঢিবি করেন, আর বিভিন্ন ভাণ্ডারে সেই গভীর পানি রাখেন। দুনিয়ার সব লোক মাবুদকে ভয় করুক, বিশ্বের সবাই তাঁর ভয়ে কাঁপুক; কারণ তিনি বললেন আর সব কিছুর সৃষ্টি হল; তিনি হুকুম দিলেন আর সব কিছু প্রতিষ্ঠিত হল। সব জাতির পরিকল্পনা মাবুদই অকেজো করেন; তাদের চিন্তাগুলো তিনিই বিফল করেন। কিন্তু মাবুদের পরিকল্পনা চিরকাল টিকে থাকে; তাঁর মন যুগ যুগ ধরেই স্থির থাকে। ধন্য সেই জাতি, যার মাবুদ আল্লাহ্‌; ধন্য সেই লোকেরা, যাদের তিনি নিজের সম্পত্তি হিসাবে বেছে নিয়েছেন। মাবুদ বেহেশত থেকে নীচে তাকিয়ে দেখেন আর সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করেন। যারা দুনিয়াতে বাস করে তাঁর বাসস্থান থেকে তিনি তাদের খেয়াল করেন। সকলের অন্তর তিনিই গড়েন; তারা যা কিছু করে তা তিনি বুঝতে পারেন। বড় সৈন্যদল থাকলেও কোন বাদশাহ্‌ তা দিয়ে রক্ষা পেতে পারে না; মহাশক্তি দ্বারাও কোন বীর যোদ্ধা রক্ষা পেতে পারে না। রক্ষা পাবার জন্য ঘোড়ার উপর নির্ভর করা মিথ্যা আশা; মহাশক্তি থাকলেও ঘোড়া রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু মাবুদের প্রতি যাদের ভয় আছে, যারা তাঁর অটল মহব্বতের উপর আশা রাখে, তাদের উপর তাঁর নজর রয়েছে; যাতে মৃত্যু থেকে তিনি তাদের রক্ষা করতে পারেন আর দুর্ভিক্ষের সময়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। আমরা মাবুদের জন্য অপেক্ষা করছি; তিনিই আমাদের সাহায্যকারী ও আমাদের ঢাল। হ্যাঁ, তাঁকেই ঘিরে রয়েছে আমাদের দিলের আনন্দ, কারণ আমরা তাঁর পবিত্রতার উপর ভরসা করি। হে মাবুদ, আমাদের উপরে তোমার মহব্বত থাকুক, কারণ আমরা তোমার উপরেই আমাদের আশা রেখেছি। আমি সব সময় মাবুদের প্রশংসা করব; আমার মুখে তাঁর গুণগান লেগেই থাকবে। আমি মাবুদকে নিয়ে গর্ব করব; তা শুনে দুঃখীরা আনন্দ পাবে। তোমরা আমার সংগে মাবুদের মহিমার কথা বল; এস, আমরা একসংগে তাঁর প্রশংসা করি। আমি মাবুদকে ডাকলাম, তিনি আমার ডাকে সাড়া দিলেন; আমার সমস্ত ভয় থেকে তিনি আমাকে উদ্ধার করলেন। লোকে তাঁর দিকে যখন ঈমানের চোখে চায় তখন তাদের মুখ নূরানী হয়ে ওঠে; তাদের মুখে লজ্জার ভাব দেখা দেয় না। এই হতভাগা মাবুদকে ডাকল; তিনি তার ডাকে সাড়া দিলেন আর সমস্ত কষ্ট থেকে তাকে উদ্ধার করলেন। যারা মাবুদকে ভয় করে মাবুদের ফেরেশতা তাদের চারপাশে ছাউনি ফেলেন আর তাদের রক্ষা করেন। স্বাদ নিয়ে দেখ মাবুদ মেহেরবান; ধন্য সেই লোক, যে তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয়। হে মাবুদের বান্দারা, তোমরা তাঁকে ভয় কর, কারণ যারা তাঁকে ভয় করে তাদের কোন কিছুরই অভাব হয় না। যুব সিংহদের খাবারের অভাব হয়, তারা ক্ষুধায় কষ্ট পায়; কিন্তু যারা মাবুদের ইচ্ছামত চলে তাদের ভাল জিনিসের অভাব হয় না। ছেলেমেয়েরা, এস, আমার কথা শোন; আমি তোমাদের শিখাব কি করে মাবুদকে ভয় করতে হয়। তোমাদের মধ্যে কে এই জীবন ভোগ করতে চায়? সুখভোগ করার জন্য কে অনেক দিন বেঁচে থাকতে চায়? তাহলে সে জিভ্‌ দিয়ে খারাপ কথা না বলুক, আর ঠোঁট দিয়ে ছলনার কথা বের না করুক। খারাপ কাজ থেকে দূরে থাক, ভাল কাজ কর; শান্তির জন্য আগ্রহী হও আর তার পিছু ছেড়ো না। যারা ন্যায়ের পথে চলে তাদের উপরে মাবুদের চোখ আছে; তাদের ডাক শোনার জন্য তাঁর কান খোলাই রয়েছে। যারা খারাপ কাজ করে মাবুদ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, যাতে দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম মুছে যায়। যারা ন্যায় কাজ করে মাবুদ তাদের ফরিয়াদ শোনেন; সমস্ত কষ্ট থেকে তিনি তাদের উদ্ধার করেন। যাদের মন ভেংগে গেছে মাবুদ তাদের কাছে থাকেন; যাদের অন্তর চুরমার হয়ে গেছে তিনি তাদের উদ্ধার করেন। যে ন্যায় পথে চলে তার বিপদ অনেক হলেও সেই সব থেকে মাবুদই তাকে উদ্ধার করেন। তার সব হাড় তিনিই রক্ষা করেন, সেগুলোর একটাও ভাংগা হবে না। অন্যায়কারীর মৃত্যু হবে খারাপীর হাতে; যারা ন্যায় কাজ করে তাদের ঘৃণাকারীদের শাস্তি হবে। মাবুদই তাঁর গোলামদের মুক্ত করেন; যারা তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয় তারা কেউই শাস্তি পাবে না। হে মাবুদ, যারা আমার বিপক্ষে তুমিও তাদের বিপক্ষে থাক; যারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তুমিও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। ছোট-বড় দু’খানা ঢালই তুমি তুলে নাও আর আমার সাহায্যের জন্য এসে দাঁড়াও। আমার পিছনে যারা তাড়া করে আসছে, বর্শা নিয়ে তাদের আসার পথ তুমি বন্ধ করে দাও। আমাকে বল, “আমিই তোমার উদ্ধার।” যারা আমাকে হত্যা করতে চাইছে তারা লজ্জা ও অসম্মানে পড়ুক; যারা আমার সর্বনাশের ষড়যন্ত্র করছে তারা অপমানিত হয়ে ফিরে যাক। তারা বাতাসের মুখে তুষের মত উড়ে যাক; হ্যাঁ, মাবুদের ফেরেশতা তাদের তাড়িয়ে দিন। তাদের পথ অন্ধকার ও পিছলা হোক; হ্যাঁ, মাবুদের ফেরেশতা তাদের তাড়া করুন। তারা অকারণে আমার জন্য গর্তের উপর গোপনে জাল পেতেছে, বিনা কারণে আমার জন্য গর্ত খুঁড়েছে। তাই হঠাৎ তাদের উপর সর্বনাশ নেমে আসুক; তাদের গোপন জালে তারাই ধরা পড়ুক, সেই সর্বনাশে তারাই পড়ুক। তখন মাবুদকে নিয়ে আমি আনন্দিত হব; তাঁর দেওয়া উদ্ধারে আমি আনন্দ করব। আমার সমস্ত শরীর তখন বলবে, “হে মাবুদ, আর কে আছে তোমার মত? তুমিই তো দুঃখীদের উদ্ধার করে থাক তাদের শত্রুদের হাত থেকে যারা তাদের চেয়ে শক্তিশালী; যারা লুটপাট করে তাদের হাত থেকে তুমি দুঃখী ও অভাবীদের উদ্ধার করে থাক।” জুলুমবাজেরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসছে, আর আমি যা জানি না সেই বিষয়ে আমাকে জেরা করছে। উপকারের বদলে তারা আমার ক্ষতি করছে; হায়, কি দুর্ভাগা আমি! তবুও তাদের অসুস্থতার সময় আমি চট পরেছি, রোজা রেখে নিজেকে ভেংগে চুরমার করেছি; কিন্তু আমার মুনাজাত আমার কাছেই ফিরে এসেছে। ভাই ও বন্ধু-হারার মত আমি তাদের জন্য শোক প্রকাশ করেছি; শোক প্রকাশের সময় মা-হারার মত মাথা নীচু করেছি। কিন্তু আমি যখন উচোট খেলাম তখন তারা খুশী হয়ে একজোট হল। সেই সব আক্রমণকারীরা আমার অজান্তে আমার বিরুদ্ধে একজোট হল। তারা আমাকে অনবরত গালাগালি করতে লাগল। উৎসবের সময়ে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন ঠাট্টাকারীদের মত আমার বিরুদ্ধে তারা দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগল। হে মালিক, আর কতকাল তুমি এ সব দেখবে? তাদের জুলুম থেকে আমাকে রক্ষা কর; এই সব সিংহদের হাত থেকে আমার বহুমূল্য জীবন বাঁচাও। বিরাট মাহ্‌ফিলের মধ্যে আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করব আর অসংখ্য লোকের মধ্যে তোমার গুণগান করব। মিথ্যা কারণে যারা আমার শত্রু হয়েছে তুমি আমাকে তাদের তামাশার পাত্র হতে দিয়ো না; অকারণে যারা আমাকে ঘৃণা করে আমার বিরুদ্ধে তাদের চোখ টেপাটিপি করতে দিয়ো না। তাদের কথাগুলো শান্তির দিকে নয়; দেশে যারা শান্তিতে বাস করছে তাদের বিরুদ্ধে তারা ছলনা-ভরা মতলব করে। আমার বিরুদ্ধে তারা মুখ ভেংগিয়ে বলেছে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা নিজের চোখেই দেখেছি।” হে মাবুদ, তুমি এ সব দেখেছ, তুমি চুপ করে থেকো না; হে মালিক, তুমি আমার কাছে কাছে থাক। আল্লাহ্‌ আমার, মালিক আমার, তুমি জেগে ওঠো, আমার পক্ষ নাও, আমার পক্ষ হয়ে কথা বল। হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, তোমার ন্যায়ে আমার বিচার কর; আমাকে তাদের তামাশার পাত্র হতে দিয়ো না। মনে মনে তাদের বলতে দিয়ো না, “শাবাশ! শাবাশ! যা আমরা চেয়েছিলাম তা-ই হয়েছে।” তাদের বলতে দিয়ো না, “আমরা ওকে শেষ করে দিয়েছি।” আমার বিপদ দেখে যারা আনন্দ করে তারা সবাই লজ্জিত ও অপমানিত হোক; যারা আমার উপরে নিজেদের তুলে ধরে তারা লজ্জা আর অপমানে ঢাকা পড়ুক। আমি ন্যায়পথে চলেছি, এ কথা যারা শুনতে ভালবাসে তারা খুশী হয়ে চিৎকার করুক আর আনন্দ করুক। তারা সব সময় বলুক, “আলহামদুলিল্লাহ্‌; তাঁর গোলামের উন্নতি হলে তিনি খুশী হন।” আমি জিভ্‌ দিয়ে তোমার ন্যায়বিচারের কথা বলব, আর সারা দিন তোমার গুণগান করতে থাকব। দুষ্টদের অপরাধ সম্বন্ধে আমার অন্তর আল্লাহ্‌র এই বাণী পেয়েছে, “দুষ্ট লোকেরা আল্লাহ্‌কে ভয় করে না।” তারা নিজেদের বিষয়ে বড়াই করে বলে যে, আল্লাহ্‌ তাদের গুনাহ্‌ ধরবেন না, ঘৃণার চোখেও দেখবেন না। তাদের মুখের কথা খারাপ ও ছলনায় পূর্ণ; বুদ্ধিমানের মত চলা তারা বাদ দিয়েছে, আর বাদ দিয়েছে ভাল কাজ করা। বিছানায় শুয়েও তারা খারাপ বুদ্ধি আঁটে; তারা অন্যায় পথে নিজেদের ছেড়ে দেয় আর খারাপকে ঘৃণা করে না। হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত মহাশূন্যে পৌঁছায়; তোমার বিশ্বস্ততা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। তোমার সততা অটল পাহাড়ের মত; তোমার ন্যায়বিচার যেন গভীর সাগর। হে মাবুদ, মানুষ ও পশু সবাইকে তুমিই বাঁচিয়ে রাখ। হে আল্লাহ্‌, তোমার অটল মহব্বতের দাম দেওয়া যায় না; তোমার পাখার ছায়ায় মানুষ আশ্রয় পায়। তোমার ঘরের প্রচুর খাবার খেয়ে তারা তৃপ্ত হয়; তোমার আনন্দ-নদীর পানি তুমি তাদের খেতে দাও। তোমার মধ্যে জীবনের ঝর্ণা রয়েছে; তোমার নূরেই আমরা নূর দেখি। যারা তোমাকে জানে তাদের প্রতি যেন তোমার অটল মহব্বত সব সময় থাকে; যাদের অন্তর খাঁটি তারা যেন সব সময় তোমার ন্যায়বিচার পায়। আমাকে অহংকারীদের পায়ের তলায় ফেলো না; দুষ্টেরা যেন আমাকে তাড়িয়ে দিতে না পারে। যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় দেখ তারা পড়ে গেছে; তাদের ফেলে দেওয়া হয়েছে, তারা আর উঠতে পারবে না। তুমি দুষ্ট লোকদের বিষয় নিয়ে উতলা হোয়ো না, কিংবা অন্যায়কারীদের দেখে হিংসা কোরো না; কারণ ঘাসের মতই তারা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে আর সবুজ লতা-গুল্মের মতই বেশী দিন টিকবে না। মাবুদের উপর বিশ্বাস রাখ আর ভাল কাজ কর; নিজের দেশে বাস কর, বিশ্বস্তভাবে চল। মাবুদকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাক; তোমার মনের ইচ্ছা তিনিই পূরণ করবেন। তোমার জীবন পথের ভার মাবুদের উপর ফেলে দাও; তাঁর উপর ভরসা কর, তিনিই সব করবেন। তিনিই তোমার সততাকে আলোর মত উজ্জ্বল করে তুলবেন; তোমার ন্যায় কাজকে দুপুরের রোদের মত স্পষ্ট করবেন। মাবুদের সামনে শান্ত হও; ধৈর্য্য ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা কর। নিজের কাজ সফল করতে যে লোক তার দুষ্ট পরিকল্পনা কাজে লাগায়, তার দরুন তুমি উতলা হোয়ো না। রাগ করা বন্ধ কর, মেজাজ দেখানো ত্যাগ কর; উতলা হোয়ো না, কারণ তা তোমাকে কেবলই খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। দুষ্ট লোকদের ধ্বংস করা হবে, কিন্তু মাবুদের উপর যারা আশা রাখে তারা দেশের দখল পাবে। আর কিছুকাল পরেই দুষ্টেরা শেষ হয়ে যাবে; খুঁজলেও তাদের জায়গায় তাদের পাওয়া যাবে না। কিন্তু নম্র লোকেরা দেশের দখল পাবে; প্রচুর দোয়া পেয়ে তারা আনন্দে মাতবে। আল্লাহ্‌ভক্তদের বিরুদ্ধে দুষ্টেরা মতলব আঁটে আর তাদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত ঘষে। দীন-দুনিয়ার মালিক জানেন দুষ্টদের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে, সেজন্যই তাদের দেখে তিনি হাসেন। দুঃখী ও অভাবীদের সর্বনাশ করার জন্য, সৎ পথে চলা লোকদের হত্যা করবার জন্য, দুষ্টেরা তলোয়ার বের করে আর ধনুকে টান দেয়। কিন্তু তাদের তলোয়ার তাদের বুকেই ঢুকবে আর তাদের ধনুক ভেংগে যাবে। অনেক দুষ্ট লোকের প্রচুর ধন আছে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তদের যেটুকু আছে সেটুকুই ভাল। দুষ্টদের হাত ভেংগে যাবে, কিন্তু মাবুদ আল্লাহ্‌ভক্তদের ধরে রাখবেন। নির্দোষ লোকের প্রতিদিনকার জীবন মাবুদ জানেন; তাদের পাওনা সম্পত্তি চিরকাল থাকবে। দুঃখের দিনে তারা লজ্জায় পড়বে না; দুর্ভিক্ষের দিনে তারা যথেষ্ট খাবার পাবে। কিন্তু দুষ্ট লোকেরা ধ্বংস হয়ে যাবে; মাবুদের শত্রুরা ক্ষেতের সৌন্দর্যের মত মিলিয়ে যাবে, মিলিয়ে যাবে ধোঁয়ার মত করে। দুষ্টেরা ধার করে শোধ দেয় না, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তেরা দয়ালু ও দানশীল। মাবুদ যাদের দোয়া করেন তারা দেশের দখল পাবে, কিন্তু যাদের তিনি বদদোয়া দেন তাদের ধ্বংস করা হবে। মাবুদই শক্তিশালী লোকদের চলার পথ ঠিক করে দেন; তাদের জীবন দেখে তিনি খুশী হন। পড়ে গেলেও তারা পড়ে থাকবে না, কারণ মাবুদের হাতই তাদের ধরে রাখছে। আমি যুবক ছিলাম, এখন বুড়ো হয়েছি, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তদের ত্যাগ করা হয়েছে কিংবা তাদের বংশধরদের ভিক্ষা করতে হচ্ছে এমন আমি দেখি নি। আল্লাহ্‌ভক্তেরা সব সময় দয়ালু হয় আর ধার দেয়; তাদের বংশধরেরা দোয়া পাবে। খারাপী ত্যাগ কর আর ভাল কাজ কর, তাতে চিরকাল বেঁচে থাকবে। মাবুদ ন্যায়বিচার ভালবাসেন; তাঁর ভক্তদের তিনি ত্যাগ করেন না। চিরকাল তাদের রক্ষা করা হবে, কিন্তু দুষ্টদের বংশধরদের ধ্বংস করা হবে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা দেশের দখল পাবে আর সেখানে চিরকাল বাস করবে। আল্লাহ্‌ভক্তদের মুখ জ্ঞানের কথা প্রচার করে; তাদের জিভ্‌ ন্যায়বিচারের কথা উচ্চারণ করে। তাদের আল্লাহ্‌র নির্দেশ তাদের অন্তরে রয়েছে; তাদের পা পিছ্‌লে যাবে না। দুষ্ট লোকেরা আল্লাহ্‌ভক্তদের জন্য ওৎ পেতে থাকে, তাদের হত্যা করবার চেষ্টা করে। কিন্তু মাবুদ দুষ্টদের হাতে তাদের ছেড়ে দেবেন না; বিচারে তাদের দোষী সাব্যস্ত হতে দেবেন না। মাবুদের উপর আশা রাখ, তাঁর পথে চল; তিনি তোমাকে মহান করবেন যাতে তুমি দেশের দখল পাও। দুষ্টেরা ধ্বংস হলে তুমি তা দেখতে পাবে। নিষ্ঠুর দুষ্ট লোককে আমি বেড়ে উঠতে দেখেছি, দেখেছি নিজের জায়গায় থাকা ডালপালা ছড়ানো পাতা-ভরা গাছের মত। তার পরে সে শেষ হয়ে গেল, আর রইল না; আমি তার খোঁজ করলাম, তাকে পাওয়া গেল না। নির্দোষ লোকদের জীবনের দিকে তাকাও; ঐ সৎ লোকদের দেখ। যারা শান্তি ভালবাসে তাদের বংশ থাকবে। কিন্তু গুনাহ্‌গার লোকেরা শেষ হয়ে যাবে; ঐ সব দুষ্ট লোকদের বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ভক্তদের উদ্ধার মাবুদের কাছ থেকেই আসে; বিপদের সময় তিনিই তাদের আশ্রয়। মাবুদই তাদের সাহায্য ও রক্ষা করেন; দুষ্টদের হাত থেকে তিনিই তাদের উদ্ধার করেন, আর তিনিই তাদের বাঁচান, কারণ তারা তাঁরই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। হে মাবুদ, রাগের বশে তুমি আমাকে বকুনি দিয়ো না, কিংবা ক্রোধে আমাকে শাসন কোরো না; কারণ তোমার তীরগুলো আমাকে বিঁধেছে, তোমার হাত আমাকে চেপে রেখেছে। তোমার রাগের ফলে আমার শরীর স্বাস্থ্যহীন, গুনাহের জন্য আমার হাড়ও সুস্থ নয়। আমার অন্যায়ের মধ্যে আমি ডুবে গেছি; তা এমন বোঝার মত হয়েছে যা আমি বইতে পারি না। আমার বোকামির দরুন আমার ঘা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, তাতে পচন ধরেছে। আমি কুঁজো হয়ে গেছি, একেবারে নূয়ে পড়েছি; সারা দিন আমি মনে দুঃখ নিয়ে বেড়াই। আমার কোমরে জ্বালাময় ব্যথা হয়েছে, আমার শরীর স্বাস্থ্যহীন। আমি দুর্বল হয়ে গেছি, একেবারে ভেংগে পড়েছি, দিলের যন্ত্রণায় আমি কাতরাচ্ছি। হে মালিক, আমার সমস্ত কামনা-বাসনা তোমার জানা আছে; আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস তোমার কাছ থেকে লুকানো নেই। আমার বুক ধুক্‌ধুক্‌ করছে, আমার শক্তি চলে গেছে, এমন কি, আমার চোখও আঁধার হয়ে গেছে। আমার এই অবস্থা দেখে বন্ধু-বান্ধব ও সংগীরা আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে, এমন কি, আমার আত্মীয়-স্বজনেরাও দূরে সরে থাকে। আমাকে যারা হত্যা করতে চায় তারা আমার জন্য ফাঁদ পেতেছে; যারা আমার ক্ষতি করতে চায় তারা আমাকে ধ্বংসের ভয় দেখায়; সারা দিন তারা কেবল আমাকে ঠকাবার ফন্দি আঁটে। আমি যেন বধির হয়ে গেছি, কিছুই শুনি না; যেন বোবা হয়ে গেছি, কিছুই বলি না। যে শোনে না আর যার মুখে কোন আপত্তি নেই, আমি তার মতই হয়েছি। হে মাবুদ, আমি তোমার দিকে চেয়ে আছি; হে আল্লাহ্‌, আমার মালিক, আমার জবাব তুমিই দেবে; কারণ আমি বলেছিলাম, “যখন আমার পা পিছ্‌লে যাবে তখন তা নিয়ে তুমি ওদের আনন্দ করতে দিয়ো না, আমার বিরুদ্ধে বড়াই করতে দিয়ো না।” আমি তো প্রায় পড়েই যাচ্ছি; আমার কষ্টের কথা সব সময় আমার মনে জাগছে। আমার দোষ আমি স্বীকার করছি; আমার গুনাহের জন্য আমার মন দুশ্চিন্তায় ভরা। আমার শত্রুরা সতেজ ও শক্তিশালী; যারা অকারণে আমাকে ঘৃণা করে তারা অনেক। আমি তাদের যে উপকার করি তার বদলে তারা আমার ক্ষতি করে; আমি যখন ভালোর খোঁজ করি তখন তারা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। হে মাবুদ, আমাকে ত্যাগ কোরো না; হে আমার আল্লাহ্‌, আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না। হে মালিক, আমার উদ্ধারকর্তা, আমাকে সাহায্য করতে তুমি শীঘ্র এস। আমি বললাম, “আমার চলার পথ সম্বন্ধে আমি সাবধান থাকব, যেন জিভ্‌ দিয়ে আমি গুনাহ্‌ না করি; যতক্ষণ দুষ্টেরা আমার সামনে থাকবে ততক্ষণ আমার মুখে আমি জাল্‌তি বেঁধে রাখব।” কিন্তু যেই আমি মুখ বন্ধ করে চুপ করে রইলাম, যা ভাল তা-ও বললাম না, অমনি আমার মনের কষ্ট বেড়ে গেল। আমার অন্তরে যেন জ্বালা ধরে গেল; আমি যখন মনে মনে কথা বলতে লাগলাম তখন যেন আগুন জ্বলতে লাগল। তারপর আমি বললাম, “হে মাবুদ, কখন আমার জীবন শেষ হবে? আমি আর কতকাল বেঁচে থাকব তা আমাকে জানাও; আমার জীবন যে কত অল্প দিনের তা আমাকে বুঝতে দাও। তুমি আমার আয়ু মাত্র চার আংগুলের সমান করেছ; তোমার চোখে আমার জীবনকাল কিছুই না। মানুষ তার পরিপূর্ণ অবস্থাতেও মাত্র একটা নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। [সেলা] মানুষ আসে ছায়ার মত, যায়ও ছায়ার মত; সে মিথ্যাই চেঁচামেচি করে; সে ধন-সম্পদ জমা করে কিন্তু কে তা ভোগ করবে জানে না। “হে মালিক, তবে আমি আর কিসের আশায় থাকব? আমার সব আশা তো তোমারই মধ্যে। আমার সমস্ত অন্যায় থেকে তুমি আমাকে সরিয়ে নাও; যাদের বিবেক অসাড় তাদের কাছে তুমি আমাকে হাসির পাত্র করে তুলো না। আমি চুপ করেই আছি, মুখ খুলব না, কারণ তুমিই এ সব কষ্ট হতে দিয়েছ। আমার উপর থেকে তোমার শাস্তি তুমি সরিয়ে নাও; তোমার হাতের আঘাত খেয়ে আমি প্রায় শেষ হয়ে গেছি। গুনাহের জন্য তুমি যখন মানুষকে কঠিন কথায় শাসন কর, তখন পোকা-মাকড়ের মত করে তাদের সৌন্দর্য তুমিই নষ্ট করে দাও; মানুষ তো একটা নিঃশ্বাস মাত্র। [সেলা] “হে মাবুদ, তুমি আমার মুনাজাত শোন; সাহায্যের জন্য আমার এই ফরিয়াদে তুমি কান দাও; আমার চোখের পানি দেখে তুমি চুপ করে থেকো না; কারণ আমার সমস্ত পূর্বপুরুষেরা যেমন ছিলেন তেমনি আমিও দুনিয়াতে তোমার সামনে পরদেশে বাসকারীর মত আছি। আমার উপর থেকে তোমার কড়া নজর সরিয়ে নাও, যেন চলে যাওয়ার আগে, শেষ হয়ে যাওয়ার আগে, আবার আমি খুশী হতে পারি।” আমি ধৈর্য ধরে মাবুদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমার কথায় কান দিলেন, আমার ফরিয়াদ শুনলেন। তিনি আমাকে তুলে আনলেন কাত্‌রানিতে ভরা গর্ত থেকে, সেই পাঁকে ভরা গর্ত থেকে। তিনি আমাকে পাথরের উপরে দাঁড় করালেন আর শক্ত মাটির উপর হাঁটতে দিলেন। তিনি আমার মুখে দিলেন নতুন কাওয়ালী, আমাদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা-কাওয়ালী। অনেকের চোখেই তা পড়বে আর তাদের মনে ভয় জাগবে; তারা মাবুদের উপর ভরসা করবে। ধন্য সেই লোক, যে মাবুদের উপর ভরসা করে, যে তাদের দিকে ফেরে না যারা অহংকারী আর মিথ্যার মধ্যে থাকে। হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, অসংখ্য তোমার অলৌকিক চিহ্ন! কেমন পরিকল্পনা করেছ আমাদের জন্য! আমি তা ঘোষণা করতে গেলে, বলতে গেলে, কখনও শেষ হবে না। কে আছে তোমার মত? পশু ও অন্যান্য কোরবানী তুমি চাও না, পোড়ানো ও গুনাহের কোরবানীও তোমার দরকার নেই; কিন্তু তোমার কথা শোনার কান তুমি আমাকে দিয়েছ। সেজন্য আমি বলেছিলাম, “এই যে আমি এসেছি; কিতাবে আমার আসার বিষয় লেখা আছে। হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার ইচ্ছামত চলাই আমার আনন্দ; তোমার সব নির্দেশ আমার অন্তরে আছে।” হে মাবুদ, বিরাট মাহ্‌ফিলের মধ্যে তোমার ন্যায় কাজের বিষয় আমি প্রচার করি; তুমি তো জান, আমি মুখ বন্ধ করে থাকি না। তোমার ন্যায় কাজের কথা আমার অন্তরে আমি লুকিয়ে রাখি না; আমি তোমার বিশ্বস্ততা ও উদ্ধার-কাজের কথা বলে থাকি; তোমার অটল মহব্বত ও তোমার বিশ্বস্ততার কথা বিরাট মাহ্‌ফিলের কাছে আমি গোপন করি না। হে মাবুদ, আমার প্রতি তোমার মমতা দেখাতে তুমি অস্বীকার কোরো না; তোমার অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততা যেন সব সময় আমাকে রক্ষা করে; কারণ অসংখ্য বিপদ আমাকে ঘিরে ধরেছে; গুনাহ্‌ আমার পিছনে তাড়া করে আমার উপরে এসে পড়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না; সংখ্যায় সেগুলো আমার মাথার চুলের চেয়েও বেশী; সাহস বলতে আমার আর কিছু নেই। হে মাবুদ, দয়া করে আমাকে বাঁচাও; হে মাবুদ, আমাকে সাহায্য করতে শীঘ্র এস। যারা আমাকে হত্যা করবার চেষ্টায় আছে তারা সবাই লজ্জিত ও অপমানিত হোক; যারা আমার সর্বনাশ দেখতে চায় তারা মাথা নীচু করে ফিরে যাক। যারা আমাকে দেখে বলে, “ভাল হয়েছে!” তারা লজ্জা পেয়ে ফিরে যাক। কিন্তু যারা তোমার ইচ্ছামত চলে তারা তোমাকে নিয়েই আনন্দিত ও খুশী হোক; যারা তোমার করা উদ্ধারের কাজ ভালবাসে তারা সব সময়েই বলুক, “আলহামদুলিল্লাহ্‌!” আমি দুঃখী ও অভাবী, কিন্তু আমার বিষয়ে আল্লাহ্‌ই চিন্তা করেন। আমার মালিক, তুমি দেরি কোরো না; তুমিই তো আমার সাহায্যকারী ও উদ্ধারকর্তা। ধন্য সেই লোক, যার মনে অসহায়দের জন্য চিন্তা রয়েছে; দুর্দিনে মাবুদ তাকে উদ্ধার করবেন। মাবুদ তাকে রক্ষা করবেন ও বাঁচিয়ে রাখবেন; দেশে সে সুখী হবে। তার শত্রুদের হাতে তিনি তাকে তুলে দেবেন না। সে অসুস্থ হয়ে যখন বিছানায় পড়বে তখন মাবুদ তাকে সান্ত্বনা দেবেন; রোগীর বিছানা থেকে তিনি তাকে তুলে আনবেন। আমি বললাম, “হে মাবুদ, আমি তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি; আমাকে রহমত দান কর, আমাকে সুস্থ কর।” আমার শত্রুরা আমার ক্ষতি চেয়ে বলে, “ও কখন মরবে? কখন ওর নাম মুছে যাবে?” তাদের কেউ আমাকে দেখতে আসলে আমার সংগে ভণ্ডামির কথা বলে; আমার বিরুদ্ধে তারা নিন্দার কথা জোগাড় করে আর বাইরে গিয়ে তা বলে বেড়ায়। যারা আমাকে ঘৃণা করে তারা আমার বিরুদ্ধে কানাকানি করে আর আমার অনিষ্টের চিন্তা করে। তারা বলে, “ওর উপর ভয়ানক খারাপ কিছু চেপে বসেছে, যেখানে ও শুয়ে আছে সেখান থেকে আর উঠবে না।” এমন কি, যে আমার প্রাণের বন্ধু, যার উপর আমার এত বিশ্বাস, যে আমার সংগেই খাওয়া-দাওয়া করে, সে-ও আমার বিরুদ্ধে পা উঠিয়েছে। কিন্তু তুমি, হে মাবুদ, আমাকে রহমত দান কর; আমাকে তোলো, যাতে আমি তাদের উপর শোধ নিতে পারি। আমি জানি তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট, কারণ শত্রু আমার বিরুদ্ধে জয়ের হাঁক আর দেয় না। আমার সততার জন্য তুমি আমাকে ধরে রেখেছ; তুমি চিরকালের জন্য আমাকে তোমার সামনে স্থাপন করেছ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। আমিন, আমিন। হরিণ যেমন আকুলভাবে পানির ধারা কামনা করে, তেমনি করে হে আল্লাহ্‌, আমার প্রাণ তোমার জন্য আকুল হয়ে আছে। আল্লাহ্‌র জন্য, জীবন্ত আল্লাহ্‌র জন্য আমার প্রাণে পিপাসা জেগেছে; কখন আমি গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারব? আমার চোখের পানিই আমার দিনরাতের খোরাক হয়েছে; আর এদিকে লোকে আমাকে কেবলই বলছে, “কোথায় গেল তোমার আল্লাহ্‌?” কান্নায় আমি যখন নিজেকে উজাড় করি, তখন আমার মনে পড়ে কেমন করে অসংখ্য ঈদ পালনকারীদের নিয়ে আমি আনন্দ ও শুকরিয়ার চিৎকার দিতে দিতে মিছিল করে আল্লাহ্‌র ঘরে যেতাম। হে আমার প্রাণ, কেন তুমি নিরাশ হয়ে পড়েছ? কেন এত চঞ্চল হয়ে উঠেছ? আল্লাহ্‌র উপরে আশা রাখ, কারণ তিনিই আমাকে উদ্ধার করেন; সেজন্য আমি আবার তাঁর প্রশংসা করব। হে আমার আল্লাহ্‌, আমার প্রাণ নিরাশ হয়ে পড়েছে; তাই তো আমি জর্ডান নদীর উৎসমুখে দাঁড়িয়ে, হর্মোণ পাহাড়ের চূড়ায় আর মিৎসিয়র পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে তোমার কথা ভাবছি। সেখানে তোমার ঝর্ণার আওয়াজ পানির গর্জনকে ডাক দিচ্ছে; আর তোমার ভেংগে-পড়া ধেয়ে-আসা ঢেউয়ের ধারা আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। দিনে মাবুদ তাঁর অটল মহব্বত আমার উপর ঢেলে দেন; আর রাতে আমার জীবনের আল্লাহ্‌র কাছে আমার মুনাজাত ও তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী আমার সাথী হয়। আমার আল্লাহ্‌র কাছে, আমার আশ্রয়-পাহাড়ের কাছে, আমি এই কথা বলব, “কেন তুমি আমাকে ভুলে গেছ? কেন আমাকে শত্রুর জুলুমে মনে দুঃখ নিয়ে বেড়াতে হবে?” আমার শত্রুরা যখন আমাকে ঠাট্টা করে কেবলই বলতে থাকে, “কোথায় গেল তোমার আল্লাহ্‌?” তখন আমার অবস্থা এমন হয় যেন হাড়গুলো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। হে আমার প্রাণ, কেন তুমি নিরাশ হয়ে পড়েছ? কেন এত চঞ্চল হয়ে উঠেছ? আল্লাহ্‌র উপরে আশা রাখ, কারণ আমি আবার তাঁর প্রশংসা করব; তিনি আমার উদ্ধারকর্তা ও আমার আল্লাহ্‌। হে আল্লাহ্‌, তুমি উচিত বিচার কর, আর এই ভয়হীন জাতির বিরুদ্ধে আমার পক্ষ হয়ে কথা বল; ঠগ ও দুষ্ট লোকের হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও। তুমিই আমার আশ্রয়-কেল্লা আল্লাহ্‌; কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ? কেন আমাকে শত্রুর জুলুমে মনে দুঃখ নিয়ে বেড়াতে হবে? তোমার নূর ও তোমার সত্য আমাকে দাও; তারাই আমাকে পথ দেখাক। তারাই আমাকে নিয়ে যাক তোমার সেই পবিত্র পাহাড়ে যেখানে তুমি বাস কর, যেন আমি আল্লাহ্‌র কোরবানগাহের কাছে যেতে পারি। তিনিই আমার সুখ ও আনন্দ। হে আল্লাহ্‌, আমার আল্লাহ্‌, আমি বীণা বাজিয়ে তোমার প্রশংসা করব। হে আমার প্রাণ, কেন তুমি নিরাশ হয়ে পড়ছ? কেন এত চঞ্চল হয়ে উঠেছ? আল্লাহ্‌র উপরে আশা রাখ, কারণ আমি আবার তাঁর প্রশংসা করব; তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা ও আমার আল্লাহ্‌। হে আল্লাহ্‌, অনেক অনেক দিন আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে তুমি যা করেছ সেই সম্বন্ধে তাঁদের কথা আমরা নিজের কানে শুনেছি। তুমি নিজের হাতে অন্যান্য জাতিদের তাড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় আমাদের পূর্বপুরুষদের বসিয়েছিলে; তুমি সেই সব লোকদের উপর সর্বনাশ এনেছিলে আর আমাদের পূর্বপুরুষদের বেড়ে উঠতে দিয়েছিলে। তাঁরা নিজেদের তলোয়ার দিয়ে এই দেশ দখল করেন নি, নিজেদের শক্তিতে জয়লাভও করেন নি; তোমার শক্তি, জ্বী, তোমার মহাশক্তি, আর তোমার উপস্থিতির মহিমাই তা করেছিল, কারণ তাঁদের উপর তোমার রহমত ছিল। হে আল্লাহ্‌, তুমিই আমার বাদশাহ্‌; ইয়াকুবের জয়ের ব্যবস্থা তুমিই কর। আমাদের শত্রুদের আমরা তোমারই শক্তিতে পিছু হটাব; যারা আমাদের বিরুদ্ধে উঠবে তোমার জোরেই তাদের পায়ে মাড়াব। আমার ধনুকের উপর আমি ভরসা করি না, আমার তলোয়ার আমাকে জয় দান করতে পারে না; কিন্তু তুমিই শত্রুদের উপর আমাদের জয়ী করেছ, আমাদের বিপক্ষদের লজ্জায় ফেলেছ। আল্লাহ্‌কে নিয়েই আমরা সব সময় গর্ব করে এসেছি; চিরকাল আমরা তোমার প্রশংসা করব। [সেলা] কিন্তু এখন তুমি আমাদের ত্যাগ করেছ আর লজ্জায় ফেলেছ; যুদ্ধের সময় আমাদের সৈন্যদলের সংগে তুমি আর থাক না। শত্রুদের সামনে থেকে তুমি আমাদের পিছিয়ে আসতে বাধ্য করেছ; আমাদের বিপক্ষেরা আমাদের লুট করেছে। জবাই করার ভেড়ার মত করে তাদের হাতে তুমি আমাদের তুলে দিয়েছ আর বিভিন্ন জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছ। প্রায় বিনামূল্যেই তোমার বান্দাদের তুমি বিক্রি করে দিয়েছ; এতে তোমার কি লাভ হয়েছে? প্রতিবেশী জাতিদের কাছে তুমি আমাদের নিন্দার পাত্র করে তুলেছ; চারপাশের লোকদের কাছে হাসি-তামাশার খোরাক করেছ। অন্যান্য জাতির কাছে তুমি আমাদের নামকে টিট্‌কারির ভাষা করেছ; লোকেরা আমাদের দেখে মাথা নাড়ে। এ সবই আমাদের উপর ঘটেছে, তবুও যে আমরা তোমাকে ভুলে গেছি তা নয়; তোমার ব্যবস্থার প্রতি যে একেবারে বেঈমানী করেছি তা-ও নয়। তোমার দিক থেকে আমাদের অন্তর ফিরে যায় নি; তোমার পথ থেকে আমাদের পা সরে যায় নি। কিন্তু তবুও তুমি এমন এক জায়গায় আমাদের চুরমার করেছ যেখানে শিয়ালের আনাগোনা; ঘন অন্ধকারে আমাদের ঢেকে রেখেছ। আমাদের আল্লাহ্‌কে যদি আমরা ভুলে গিয়ে থাকি, যদি হাত বাড়িয়ে থাকি কোন দেবতার কাছে, তবে আল্লাহ্‌ কি তা জানতেন না? তিনি তো আমাদের দিলের গোপন সব কিছুই জানেন। কিন্তু তবুও তোমার জন্যই সব সময় আমাদের কাউকে না কাউকে হত্যা করা হচ্ছে, জবাই করার ভেড়ার মতই লোকে আমাদের মনে করে। হে মালিক, জাগো, কেন তুমি ঘুমা"ছ? ওঠো, চিরকালের জন্য আমাদের ত্যাগ কোরো না। কেন তোমার মুখ তুমি ফিরিয়ে রেখেছ? আমাদের দুঃখ ও জুলুমের কথা কেন ভুলে গেছ? আমরা ধুলায় লুটিয়ে পড়েছি; আমাদের শরীর মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তুমি এস, আমাদের সাহায্য কর; তোমার অটল মহব্বত অনুসারে তুমি আমাদের মুক্ত কর। আমার অন্তর সুন্দর ভাবধারায় ভরে উঠছে; বাদশাহ্‌র উদ্দেশে আমার কবিতা বেরিয়ে আসছে; আমার জিভ্‌ পাকা লেখকের লেখনী হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্যে তুমি পরম সুন্দর; তোমার দু’টি ঠোঁট কথার মধুতে ভেজা; আল্লাহ্‌র চিরকালের দোয়া তোমার উপর ঝরে পড়ছে। হে বীর, তোমার কোমরে তলোয়ার বেঁধে নাও; গৌরব ও মহিমার সাজে তুমি সেজে নাও। সত্য, নম্রতা আর ন্যায়ের পক্ষে তুমি নিজের মহিমায় বিজয়ীর মত যাত্রা কর; তোমার ডান হাত ভয়-জাগানো মহান কাজ করুক। বাদশাহ্‌র শত্রুদের বুকে তোমার ধারালো তীর বিঁধে যায়; তোমার শত্রুজাতি তোমার পায়ের তলায় পড়ে। হে আল্লাহ্‌, তোমার সিংহাসন চিরস্থায়ী; তোমার শাসন ন্যায়ের শাসন। তুমি ন্যায় ভালবাস আর অন্যায়কে ঘৃণা কর; সেজন্য আল্লাহ্‌, তোমার আল্লাহ্‌, তোমার সংগীদের চেয়ে অনেক বেশী আনন্দ তেলের মত করে তোমার উপর ঢেলে দিয়েছেন। গন্ধরস, অগুরু আর দারচিনির গন্ধে তোমার রাজপোশাক খোশবুযুক্ত হয়েছে; হাতীর দাঁত বসানো রাজবাড়ীতে তারযন্ত্রের যে বাজনা বাজে তা তোমাকে আনন্দ দেয়। তোমার সম্মানিত মহিলাদের মধ্যে রাজকন্যারা আছেন, আর রাজ-কনে ওফীর দেশের সোনা দিয়ে সেজে তোমার ডান দিকে রয়েছেন। হে কন্যা, শোন, মন দাও, কান খাড়া কর। তোমার লোকদের তুমি ভুলে যাও, ভুলে যাও তোমার পিতার বাড়ীর কথা। তাহলে বাদশাহ্‌ তোমার সৌন্দর্যে ধরা দেবেন; তিনিই তোমার প্রভু, তাঁকে পায়ে ধরে সালাম কর। টায়ার শহরের লোকেরা উপহার নিয়ে আসবে; খুব ধনী লোকেরা তোমার রহমত চাইবে। রাজবাড়ীতে রাজ-কনেকে চমৎকার দেখাবে; তাঁর পোশাকে সোনার সুতা বোনা রয়েছে। নক্‌শা তোলা পোশাকে তাঁকে বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে যাওয়া হবে; তাঁর পিছে থাকা অবিবাহিতা সংগিনীদেরও তোমার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আনন্দ ও উৎসব করতে করতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে; তাঁরা রাজবাড়ীতে গিয়ে ঢুকবেন। তোমার পূর্বপুরুষদের জায়গা তোমার ছেলেরা নেবে; মানুষের মধ্যে তুমি তাদের শাসনকর্তা করবে। বংশের পর বংশে আমি তোমার নাম বাঁচিয়ে রাখব; সেইজন্য বিভিন্ন জাতি যুগের পর যুগ তোমার প্রশংসা করবে। আল্লাহ্‌ আমাদের আশ্রয়স্থান ও শক্তি; বিপদের সময় সাহায্য করতে তিনি প্রস্তুত থাকেন। একটা নদী আছে যার নানা স্রোতের ধারা আল্লাহ্‌র শহরকে আনন্দময় করে তোলে, আনন্দময় করে তোলে সেই পবিত্র জায়গা যেখানে আল্লাহ্‌তা’লা থাকেন। আল্লাহ্‌ সেই শহরের মধ্যে থাকেন, সেজন্য তা স্থির থাকবে; দিনের শুরুতেই আল্লাহ্‌ তাকে সাহায্য করবেন। জাতিরা সব হৈচৈ করে, রাজ্যগুলো ভেংগে পড়ে; তিনি গর্জন করে ওঠেন, দুনিয়া গলে যায়। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমাদের সংগে আছেন; ইয়াকুবের মাবুদ আমাদের কেল্লা। [সেলা] এস, মাবুদের বিভিন্ন কাজ দেখ- তিনি দুনিয়াতে ধ্বংস এনেছেন, তিনি দুনিয়ার সব যুদ্ধ বন্ধ করেন, তিনি ধনুক ভাংগেন, তিনি বর্শা টুকরা টুকরা করেন, তিনি রথ আগুনে পোড়ান। মাবুদ বলেন, “তোমরা থাম; তোমরা এ কথা জেনো যে, আমিই আল্লাহ্‌; সব জাতি আমাকেই গৌরব দান করবে, গৌরব দান করবে দুনিয়া।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমাদের সংগে আছেন; ইয়াকুবের মাবুদ আমাদের কেল্লা। [সেলা] হে সমস্ত জাতি, তোমরা হাততালি দাও; আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আনন্দধ্বনি কর। মহান মাবুদ ভয় জাগান; গোটা দুনিয়ার উপরে তিনিই মহান বাদশাহ্‌। অন্যান্য জাতিকে তিনি আমাদের অধীন করেন, আমাদের পায়ের তলায় তাদের রাখেন। তিনিই আমাদের সম্পত্তি বাছাই করে রেখেছেন; তা তাঁর মহব্বতের পাত্র ইয়াকুবের গর্বের বিষয়। [সেলা] আল্লাহ্‌ আনন্দধ্বনির মধ্যে উপরে উঠে গেছেন, মাবুদ শিংগার ধ্বনির মধ্যে উঠে গেছেন। আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাও, প্রশংসার কাওয়ালী গাও; আমাদের বাদশাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাও, প্রশংসার কাওয়ালী গাও। আল্লাহ্‌ সারা দুনিয়ার বাদশাহ্‌; তাঁর উদ্দেশে এক বিশেষ রকমের প্রশংসা-কাওয়ালী গাও। সব জাতির উপরে আল্লাহ্‌ রাজত্ব করেন; তাঁর পবিত্র সিংহাসনে তিনি বসে আছেন। জাতিগুলোর মধ্যে যারা উঁচু পদের লোক, তারা এক জায়গায় জমায়েত হয়, ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌র বান্দা হিসাবেই জমায়েত হয়। দুনিয়ার সব শাসনকর্তারা আল্লাহ্‌র অধীন, তিনিই সবচেয়ে মহান। আমাদের আল্লাহ্‌র শহরে, তাঁর পবিত্র পাহাড়ে, মাবুদ মহান ও সবচেয়ে বেশী প্রশংসার যোগ্য। আল্লাহ্‌র বাসস্থান ঐ সিয়োন পাহাড়, উঁচুতে স্থাপিত মহান বাদশাহ্‌র ঐ শহর দেখতে সুন্দর; সারা দুনিয়াকে তা আনন্দ দেয়। সেই শহরের রাজবাড়ীর দালান্তকোঠায় আল্লাহ্‌ নিজেকে কেল্লা হিসাবে প্রকাশ করেছেন। বাদশাহ্‌রা তাদের সৈন্যদল জমায়েত করে একসংগে এগিয়ে গেল; তারা সেই শহরটাকে দেখে আঁত্‌কে উঠল আর ভীষণ ভয়ে পালিয়ে গেল। ভয়ে সেখানে তাদের কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল আর প্রসবকারিণী স্ত্রীলোকের মত যন্ত্রণা হয়েছিল। যেমন করে জোরালো পূবের বাতাস দিয়ে তিনি বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ ভেংগে ফেললেন, তেমনি করেই তিনি তাদের ধ্বংস করলেন। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের শহরের মধ্যে থেকে, আমাদের মাবুদের শহরের মধ্যে থেকে আমরা যা শুনেছি চোখেও তা-ই দেখলাম; দেখলাম তিনি শহরটা চিরকালের জন্য স্থাপন করবেন। হে আল্লাহ্‌, তোমার ঘরের মধ্যে তোমার অটল মহব্বতের কথা আমরা ধ্যান করেছি। হে আল্লাহ্‌, তোমার বিষয় যেমন সব মানুষ জানে তেমনি তোমার প্রশংসা দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত আছে; তোমার ডান হাত ন্যায় কাজ করার কুদরতে পরিপূর্ণ। তোমার ন্যায়বিচার দেখে সিয়োন পাহাড় খুশী হোক আর এহুদার গ্রামগুলো আনন্দ করুক। হে এহুদার লোকেরা, তোমরা সিয়োনের চারপাশ দিয়ে ঘুরে এস, তার কেল্লাগুলো গুণে দেখ; তার চারপাশের দেয়ালগুলো লক্ষ্য কর, তার রাজবাড়ীর দালান্তকোঠা ঘুরে দেখ, যেন সেই সব কথা তোমাদের সন্তানদের কাছে বলে যেতে পার। এই আল্লাহ্‌ আমাদের চিরকালের আল্লাহ্‌; তিনি আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত পথ দেখিয়ে যাবেন। হে সমস্ত জাতি, তোমরা এই কথা শোন; যারা এই দুনিয়াতে বাস করছ তোমরা সবাই কান দাও; উঁচু-নীচু, ধনী-গরীব, তোমরা সবাই শোন। আমার মুখ থেকে জ্ঞানের কথা বেরিয়ে আসবে; আমার অন্তরের গভীর চিন্তা বুঝবার ক্ষমতা দেবে। আমি শিক্ষা-ভরা উদাহরণে মন দেব; বীণার সংগে কাওয়ালী গেয়ে তার গভীর বিষয় ব্যাখ্যা করব। জ্ঞানী লোকও যে মারা যায় তা কারও অজানা নেই; যাদের বিবেচনা নেই আর যাদের অন্তর অসাড় তারা একইভাবে ধ্বংস হয়; তাদের ধন তারা অন্যদের জন্য রেখে যায়। তারা ভাবে তাদের ঘর-বাড়ী চিরস্থায়ী, তাদের বাসস্থান বংশের পর বংশ ধরেই থাকবে, তাই নিজেদের নামেই তারা সম্পত্তির নাম দেয়। কিন্তু মানুষ ধনী-মানী হয়েও চিরস্থায়ী নয়; সে পশুদের মতই ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা নিজের উপর ভরসা করে, আর তাদের পরে যারা তাদের কথায় সায় দিয়ে চলে, তাদের দশাও তা-ই হবে। [সেলা] ভেড়ার পাল্‌কে যেমন নির্দিষ্ট করা খোঁয়াড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তেমনি নির্দিষ্ট করা কবরে সেই লোকদেরও নিয়ে যাওয়া হবে; সেখানে মৃত্যুই তাদের রাখাল হবে। নতুন দিনের শুরুতে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা তাদের উপর জয়ী হবে; কবর তাদের মৃতদেহ খেয়ে ফেলবে; তাদের বাসস্থান বলতে আর কিছু থাকবে না। কিন্তু কবরের হাত থেকে আল্লাহ্‌ মুক্তির মূল্য দিয়ে আমাকে মুক্ত করে নেবেন; তিনি আমাকে তাঁর নিজের কাছে নিশ্চয়ই নেবেন। [সেলা] অন্যে ধনী হয়েছে দেখে ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না তার পরিবারের ধন-সম্পদ বেড়ে গেলে; কারণ সে মরণকালে কিছুই সংগে নিয়ে যাবে না, তার ধন-সম্পদ তার সংগে কবরে যাবে না। যদিও জীবনকালে সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করত - অবশ্য কারও উন্নতি হলে লোকেও তাকে ভাগ্যবান বলে- তবুও তার পূর্বপুরুষদের কাছে তাকে যেতেই হবে যারা আর কখনও দিনের আলো দেখতে পাবে না। মানুষ ধনী-মানী হয়েও আল্লাহ্‌কে বুঝতে পারে না; সে পশুদের মতই ধ্বংস হয়ে যাবে। শক্তিশালী মাবুদ, আল্লাহ্‌ মাবুদ, কথা বলেছেন; পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দুনিয়ার সবাইকে তিনি ডাক দিয়েছেন। সিয়োন থেকে, পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের জায়গা থেকে, আল্লাহ্‌র নূর ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের আল্লাহ্‌ আসছেন, তিনি মুখ খুলবেন; আগুন তাঁর আগে আগে সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে চলবে; আর তাঁর চারপাশে ভীষণ ঝড় বইবে। তাঁর নিজের বান্দাদের বিচারে অংশ নেবার জন্য উপরের আসমানকে তিনি ডাক দিচ্ছেন, আর ডাক দিচ্ছেন দুনিয়াকে; তিনি বলছেন, “আমার সেই ভক্তদের আমার কাছে জমায়েত কর, যারা পশু-কোরবানীর মধ্য দিয়ে আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।” আসমান তাঁর ন্যায়বিচারের কথা ঘোষণা করছে, কারণ আল্লাহ্‌ নিজেই বিচারক। “হে আমার বান্দারা, শোন, আমি কথা বলছি; হে ইসরাইল, আমি তোমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছি; আমি আল্লাহ্‌, তোমারই আল্লাহ্‌। তোমার পশু-কোরবানী নিয়ে আমি তোমাকে দোষী করছি না; তোমার পোড়ানো-কোরবানী সব সময়ই তো আমার সামনে রয়েছে। তোমার গোয়ালের কোন ষাঁড়ের আমার দরকার নেই, তোমার খোঁয়াড়ের ছাগলও নয়; কারণ বনের সব প্রাণীই আমার, অসংখ্য পাহাড়ের উপরে ঘুরে বেড়ানো পশুও আমার। এমন কি, পাহাড়ের সব পাখীও আমার জানা আছে, মাঠের সব প্রাণীও আমার। আমার খিদে পেলেও আমি তোমাকে বলতাম না, কারণ দুনিয়া আমার আর তার মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমার। তুমি কি মনে কর ষাঁড়ের গোশ্‌ত আমার খাবার? ছাগলের রক্ত কি আমি খাই? আল্লাহ্‌র কাছে তোমার শুকরিয়াই তোমার কোরবানী হোক; সেই মহানের কাছেই তোমার সব মানত পূরণ করতে থাক। তোমার বিপদের দিনে তুমি আমাকে ডেকো; আমি তোমাকে উদ্ধার করব আর তুমি আমাকে সম্মান করবে।” কিন্তু আল্লাহ্‌ দুষ্ট লোকদের এই কথা বলেন, “আমার শরীয়তের কথা বলার কিংবা আমার ব্যবস্থার কথা মুখে আনার তোমার কি অধিকার আছে? তুমি তো আমার শাসন ঘৃণা কর আর আমার কথার ধার ধারো না। চোরকে দেখলে তুমি তাকে সায় দাও, জেনাকারীদের সংগে মেলামেশা কর। খারাপ কথায় তোমার মুখ খোলা, তোমার জিভ্‌ ছলনার বশে থেকে কথা বলে। তুমি বসে বসে তোমার নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে কথা বলে থাক আর তার নিন্দা কর। এ সবই তুমি করেছ, কিন্তু আমি মুখ খুলি নি; তুমি ভেবেছ আমি তোমারই মত একজন, কিন্তু আমি তোমার দোষ দেখিয়ে দেব আর তোমার সব কিছু তোমার চোখের সামনে পর পর তুলে ধরব। “তোমরা যারা আল্লাহ্‌কে ভুলে গেছ কথাটা একবার ভেবে দেখো; তা না হলে আমি তোমাদের ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলব, তোমাদের বাঁচাবার কেউ থাকবে না। যার জীবনে শুকরিয়াই হল তার কোরবানী সে-ই আমাকে সম্মান করে; যে আমার পথে চলে তাকে আমি উদ্ধার করব।” হে আল্লাহ্‌, তোমার অটল মহব্বতের জন্য আমার প্রতি দয়া কর; তোমার অসীম মমতার জন্য তোমার প্রতি আমার সব বিদ্রোহ মাফ কর। আমার সব অন্যায় তুমি ধুয়ে ফেল; আমার গুনাহ্‌ থেকে আমাকে পাক-সাফ কর। আমার সব বিদ্রোহের কথা আমার চেতনায় রয়েছে; আমার গুনাহ্‌ সব সময় আমার মনে রয়েছে। তোমার বিরুদ্ধে, কেবল তোমারই বিরুদ্ধে আমি গুনাহ্‌ করেছি আর তোমার চোখে যা খারাপ তা-ই করেছি। কাজেই তোমার রায় ঠিক, তোমার বিচার নিখুঁত। হ্যাঁ, জন্ম থেকেই আমি অন্যায়ের মধ্যে আছি; গুনাহের অবস্থাতেই আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম। তুমি দিলের মধ্যে সত্য দেখতে চাও; তুমিই আমার দিলের গভীরে জ্ঞান দাও। এসোব গাছের ডাল দিয়ে তুমি আমাকে পাক-সাফ কর, তাতে আমি পাক-সাফ হব; আমাকে ধূয়ে নাও, তাতে আমি ধব্‌ধবে সাদা হব। আমাকে খুশীর আওয়াজ ও আনন্দধ্বনি শুনতে দাও; তোমার চুরমার করা আমার এই হাড়গুলো আনন্দ করুক। তুমি আমার গুনাহের দিকে চেয়ে দেখো না; আমার সমস্ত অন্যায় তুমি মাফ কর। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার মধ্যে খাঁটি অন্তর সৃষ্টি কর; আমার মন আবার স্থির কর। তোমার সামনে থেকে আমাকে দূর করে দিয়ো না; আমার মধ্য থেকে তোমার পাক-রূহ্‌কে নিয়ে যেয়ো না। তোমার দেওয়া নাজাতের আনন্দ আমাকে আবার দাও; তোমার বাধ্য হওয়ার ইচ্ছুক মন দিয়ে তুমি আমাকে সবল কর। তাহলে আমি তোমার পথ সম্বন্ধে বিদ্রোহীদের শিক্ষা দিতে পারব, আর গুনাহ্‌গার লোকেরা ঘুরে তোমার দিকে ফিরবে। হে আল্লাহ্‌, আমার নাজাতদাতা আল্লাহ্‌, খুনের দায় থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও; তাতে আমার মুখ থেকে তোমার ন্যায্যতার কাওয়ালী বেরিয়ে আসবে। হে মালিক, আমার মুখ খুলে দাও, আমি তোমার প্রশংসা প্রচার করব। পশু-কোরবানীতে তো তুমি খুশী হও না, হলে আমি তা দিতাম; পোড়ানো-কোরবানীতেও তুমি সন্তুষ্ট হও না। ভাংগাচোরা অন্তরই আল্লাহ্‌র কবুলের যোগ্য কোরবানী; হে আল্লাহ্‌, নত এবং নম্র মনকে তুমি তুচ্ছ করবে না। তোমার মেহেরবানীর ইচ্ছায় তুমি সিয়োনের উন্নতি কর; তুমি জেরুজালেমের দেয়াল তোলার কাজ চালিয়ে যাও। তাহলে যোগ্য মনোভাব নিয়ে দেওয়া কোরবানীতে, পোড়ানো-কোরবানীতে আর নিঃশেষে পোড়ানো-কোরবানীতে তুমি আনন্দ পাবে, আর তোমার কোরবানগাহের উপরে লোকে ষাঁড় কোরবানী দেবে। ওহে শক্তিশালী যোদ্ধা, কেন তুমি খারাপ বিষয় নিয়ে গর্ব করছ? আল্লাহ্‌র অটল মহব্বতের তো শেষ নেই। তোমার জিভ্‌ দিয়ে ধ্বংসের পরিকল্পনার কথা বেরিয়ে আসছে; হে ছলনাকারী, তোমার জিভ্‌ যেন শান দেওয়া ক্ষুর। তুমি ভালোর চেয়ে খারাপী ভালবাস, আর ভালবাস সত্যের চেয়ে মিথ্যা কথা বলা। [সেলা] ওহে ছলনাকারী জিভ্‌, যে কথা ধ্বংস আনে তুমি তা-ই পছন্দ কর। কিন্তু আল্লাহ্‌ তোমাকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করবেন; তিনি তোমাকে টেনে আনবেন, তোমার তাম্বু থেকে ছিনিয়ে আনবেন, জীবিতদের দেশ থেকে তোমাকে উপ্‌ড়ে ফেলবেন। [সেলা] এ সব দেখে আল্লাহ্‌ভক্তদের প্রাণে ভয় জাগবে; তারা তোমাকে ঠাট্টা করে বলবে, “ঐ দেখ, ঐ লোকটি আল্লাহ্‌কে তার আশ্রয়-কেল্লা করে নি; তার প্রচুর ধন-সম্পদের উপর সে ভরসা করেছে আর খারাপ কামনা-বাসনার শক্তি দিয়ে নিজেকে শক্তিশালী করেছে।” কিন্তু আমি আল্লাহ্‌র ঘরে বাড়তে থাকা জলপাই গাছের মত; আমি সব সময় আল্লাহ্‌র অটল মহব্বতের উপর ভরসা করে থাকি। তুমি যা করেছ তার জন্য চিরকাল আমি তোমার প্রশংসা করব; তুমি মেহেরবান বলে তোমার ভক্তদের সামনে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। যাদের বিবেক অসাড় তারা ভাবে আল্লাহ্‌ বলে কেউ নেই। তাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের কাজ জঘন্য; ভাল কাজ করে এমন কেউ নেই। আল্লাহ্‌ বেহেশত থেকে নীচে মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলেন; দেখতে চাইলেন কেউ সত্যিকারের জ্ঞান নিয়ে চলে কিনা, কেউ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলে কিনা। তিনি দেখলেন সবাই ঠিক পথ থেকে সরে গেছে, সবাই একসংগে খারাপ হয়ে গেছে; ভাল কাজ করে এমন কেউ নেই, একজনও নেই। যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় তারা কি এতই অবুঝ? লোকে যেমন করে খাবার খায় তেমনি করেই তারা আমার লোকদের খেয়ে ফেলে; তারা আল্লাহ্‌কে ডাকে না। তোমার আক্রমণকারীদের হাড়গোড় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন; আগে তাদের ভয় ছিল না, তবুও তারা এখন ভীষণ ভয় পেল; আল্লাহ্‌ তাদের বাতিল করেছেন, তাই তুমি তাদের লজ্জায় ফেলেছ। বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার সিয়োনের মধ্য থেকে আসুক। আল্লাহ্‌ যখন তাঁর বান্দাদের অবস্থা ফিরাবেন তখন ইয়াকুবের বংশ আনন্দ করবে- বনি-ইসরাইলরা খুশী হবে। হে আল্লাহ্‌, তোমার ক্ষমতা দ্বারা তুমি আমাকে উদ্ধার কর; আমি যে ন্যায়পথে আছি তা তোমার শক্তির দ্বারা তুমি দেখিয়ে দাও। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার মুনাজাত শোন, আমার মুখের কথায় কান দাও। অন্য জাতির লোকেরা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে; জুলুমবাজেরা আমার প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে; আল্লাহ্‌র প্রতি এই লোকদের কোন ভয় নেই। [সেলা] আল্লাহ্‌ আমাকে সাহায্য করেন; দীন-দুনিয়ার মালিকই আমাকে ধরে রাখেন। শত্রুরা আমার যে ক্ষতি করেছে তা তিনি তাদের ঘাড়েই ফিরিয়ে দেবেন; হে মালিক, তোমার বিশ্বস্ততায় তুমি তাদের ধ্বংস করে দাও। আমি নিজের ইচ্ছায় তোমার উদ্দেশে পশু-কোরবানী দেব; হে মাবুদ, আমি তোমার প্রশংসা করব, কারণ তুমি মেহেরবান। আমার সমস্ত বিপদ থেকে তিনিই আমাকে উদ্ধার করেছেন; আমি নিজের চোখেই আমার শত্রুদের পরাজয় দেখেছি। হে আল্লাহ্‌, আমার মুনাজাতে কান দাও; আমার মিনতির সামনে তুমি নিজেকে লুকিয়ে রেখো না। এতে আমার অন্তর মোচড় দিয়ে উঠছে; মৃত্যুর ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে। আমাকে ভয় আর কাঁপুনিতে ধরেছে; ভীষণ ভয়ে আমি ডুবে আছি। আমি বলেছি, “হায়, যদি পাখীর মত আমার ডানা থাকত! তবে আমি উড়ে গিয়ে বিশ্রাম পেতাম। হ্যাঁ, তাহলে আমি অনেক দূরে চলে যেতাম, আর এক নিরালা জায়গায় গিয়ে থাকতাম। [সেলা] আমার আশ্রয়-স্থানে আমি ছুটে যেতাম, ঝোড়ো বাতাস থেকে দূরে চলে যেতাম।” হে মালিক, তুমি তাদের উপর ধ্বংস নিয়ে এস, তাদের ভাষায় গোলমাল লাগিয়ে দাও; আমি শহরে মারামারি আর ঝগড়া-বিবাদ দেখতে পাচ্ছি। তারা যেন কিসের খোঁজে দিনরাত শহরের দেয়ালের উপর ঘুরে বেড়ায়। দুষ্টতা আর অন্যায় কাজ শহরের মধ্যে চলছে। তার মধ্যে চলছে ধ্বংসের কাজ; জুলুম আর ছলনার কাজ শহরের চকে লেগেই আছে। যে আমাকে অপমান করছে সে যে আমার শত্রু তা নয়, তাহলে আমি সহ্য করতে পারতাম; যে আমার চেয়ে নিজেকে বড় করছে সে যে আমার বিপক্ষের লোক তা নয়, তাহলে আমি তার কাছ থেকে লুকাতাম। কিন্তু তা করেছ তুমি, আমারই সমান একজন মানুষ, আমার দিলের সাথী, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের মধ্যে গভীর যোগাযোগ-সম্বন্ধ ছিল; আল্লাহ্‌র ঘরে এবাদতকারী দলের মধ্যে আমরা একসংগে হাঁটা-চলা করতাম। আমার শত্রুদের উপর হঠাৎ মৃত্যু আসুক; তারা জীবিত অবস্থায় কবরে নেমে যাক, কারণ তাদের ঘর-বাড়ীতে ও তাদের অন্তরে খারাপী রয়েছে। কিন্তু আমি আল্লাহ্‌কে ডাকব, আর মাবুদ আমাকে উদ্ধার করবেন। সন্ধ্যায়, সকালে আর দুপুরে আমি কাতর স্বরে আমার নালিশ জানাতে থাকব, আর তিনি আমার স্বর শুনবেন। যে যুদ্ধ আমার বিরুদ্ধে চলছিল তাতে আমার বিপক্ষের দল বড় ছিল, তাই তিনি আমাকে ছাড়িয়ে এনে নিরাপদে রেখেছেন। আল্লাহ্‌, যিনি প্রথম থেকেই সিংহাসনে আছেন তিনি শুনবেন এবং তাদের শাস্তি দেবেন। [সেলা] তাদের মনে কোন পরিবর্তন নেই, আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ও নেই। আমার সেই বন্ধুর সংগে যারা শান্তিতে ছিল তাদের উপরেও সেই বন্ধু হাত উঠিয়েছে আর তার চুক্তি ভেংগেছে। তার মুখের কথা মাখনের চেয়ে মোলায়েম, কিন্তু তার অন্তরে রয়েছে যুদ্ধ; তার কথাগুলো গায়ে মাখানো তেলের চেয়েও আরামের, কিন্তু সেগুলো যেন খাপ থেকে টেনে বের করা তলোয়ার। তোমার সব ভার তুমি মাবুদের উপর ফেলে দাও, তিনিই তোমার ব্যবস্থা করবেন; তাঁর ভক্তদের তিনি কখনও টলতে দেবেন না। কিন্তু হে আল্লাহ্‌, তুমি খুনী ও ছলনাকারীদের কবরে ফেলে দেবে, আর তা করবে তাদের আয়ুর অর্ধেক শেষ হবার আগেই; কিন্তু আমি তোমার উপর ভরসা করব। হে আল্লাহ্‌, আমার প্রতি রহমত কর, কারণ লোকে আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে; সব সময় যুদ্ধ করে তারা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমার শত্রুরা সব সময় আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে; অনেকে অহংকারের বশে আমার সংগে যুদ্ধ করছে। অন্তরে ভয় জাগলে আমি তোমার উপর ভরসা করব। যাঁর কালামের গুণ আমি গাই, সেই আল্লাহ্‌র উপরে, হ্যাঁ, সেই আল্লাহ্‌র উপরেই আমি ভরসা করি; আমি ভয় করব না, মানুষ আমার কি করতে পারে? তারা সব সময় আমার কথার খারাপ অর্থ করে আর আমার ক্ষতি করার মতলবে থাকে। তারা একসংগে জমায়েত হয়, আমার জন্য ওৎ পেতে থাকে; আমাকে হত্যা করবার সুযোগের জন্য তারা আমার চলাফেরা লক্ষ্য করে। অন্যায়ের জন্য কি তারা শাস্তি পাবে না? হে আল্লাহ্‌, তুমি রাগে জাতিদের ধ্বংস কর। আমি যে কতবার পালিয়ে বেড়িয়েছি সেই কথা তো তুমি জান; আমার চোখের পানি দিয়ে তোমার পাত্র তুমি ভরে নাও। এ সবই তো তোমার কিতাবে লেখা আছে। যেদিন আমি তোমাকে ডাকব, সেদিন আমার শত্রুরা পালিয়ে যাবে; আমি জানি আল্লাহ্‌ আমার পক্ষে আছেন। আল্লাহ্‌, যাঁর কালামের গুণ আমি গাই, মাবুদ, যাঁর কালামের আমি গুণগান করি, আমি তাঁর উপরেই ভরসা করি; আমি ভয় করব না, মানুষ আমার কি করতে পারে? হে আল্লাহ্‌, তোমার কাছে যে মানত করেছি আমি তা পূরণ করতে বাধ্য; আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা-কোরবানী দেব; কারণ মৃত্যু থেকে তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ আর পড়ে যাওয়া থেকে আমাকে বাঁচিয়েছ, যাতে জীবনের আলোতে আমি আল্লাহ্‌র সামনে চলাফেরা করতে পারি। আমার প্রতি দয়া কর; হে আল্লাহ্‌, আমার প্রতি তুমি দয়া কর, কারণ তোমার মধ্যেই আমি আশ্রয় নিয়েছি। তোমার ডানার ছায়ার আশ্রয়ে আমি থাকব যতদিন না আমার উপর থেকে এই বিপদের ঝড় সরে যায়। আমি আল্লাহ্‌তা’লাকে ডাকব; যিনি আমাকে দেওয়া তাঁর সব কথাই রক্ষা করেন আমি তাঁকেই ডাকব। বেহেশত থেকে তাঁর সাহায্য নেমে আসবে; যারা আমাকে তাড়া করে বেড়ায় তাদের দোষের কথা বলতে তিনি ছাড়বেন না। [সেলা] আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তাঁর অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততা নেমে আসবে। ক্ষুধায় পাগল সিংহের মত লোকদের মাঝখানে আমি শুয়ে আছি; তাদের দাঁত যেন বর্শা আর তীর, আর জিভ্‌ ধারালো তলোয়ার। হে আল্লাহ্‌, তোমার মহিমা আসমান ছাপিয়ে উঠুক; তোমার গৌরব সমস্ত দুনিয়ার উপরে দেখা দিক। তারা আমার চলার পথে জাল পেতেছে; জুলুমে আমি ভেংগে পড়েছিলাম; তারা আমার পথে গর্ত খুঁড়েছে, কিন্তু তারা নিজেরাই তাতে পড়েছে। [সেলা] হে আল্লাহ্‌, আমার মন স্থির আছে, টলে নি; আমি কাওয়ালী গাইব, কাওয়ালীর সুর তুলব। হে আমার অন্তর, জেগে ওঠো; বীণা ও সুরবাহার, জেগে ওঠো; আমি ভোরকে জাগিয়ে তুলব। হে মালিক, বিভিন্ন জাতির সামনে আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাব, তাদের মধ্যে তোমার উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব; কারণ তোমার অটল মহব্বত যেন আসমান ছুঁয়েছে, তোমার বিশ্বস্ততা মেঘেরও উপরে পৌঁছায়। হে আল্লাহ্‌, তোমার মহিমা আসমান ছাপিয়ে উঠুক; তোমার গৌরব সমস্ত দুনিয়ার উপরে দেখা দিক। হে বিচারকেরা, আপনারা যে চুপ করে আছেন এটা কি ন্যায়বিচার হচ্ছে? ন্যায়ভাবে কি আপনারা লোকদের বিচার করছেন? না, আপনাদের মনে রয়েছে অন্যায় করার চিন্তা; বিচারের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে দুনিয়াতে আপনারা জুলুম মেপে দিচ্ছেন। জন্ম থেকেই দুষ্টেরা বিপথে যায়; যারা মিথ্যা কথা বলে, জন্ম থেকেই তারা কুপথে থাকে। সাপের বিষের মতই তাদের বিষ; তারা যেন বধির গোখরো সাপ যে নিজেই কান বন্ধ করে রেখেছে। সেই সাপ মন্ত্র-পড়া সাপুড়েদের স্বর শোনে না, তা সে যত ওস্তাদ সাপুড়েই হোক না কেন। হে আল্লাহ্‌, তুমি দুষ্টদের দাঁত তাদের মুখের মধ্যেই ভেংগে ফেল; হে মাবুদ, ঐ সব যুব সিংহদের ধারালো দাঁত তুমি ভেংগে ফেল। ব’য়ে যাওয়া পানির মতই তারা অদৃশ্য হয়ে যাক; তাদের ধনুকে টান দেওয়া তীরের ফলাগুলো ভেংগে পড়ুক। শামুক যেমন চলতে চলতে অদৃশ্য হয়ে যায় তেমনি তারাও অদৃশ্য হয়ে যাক; তারা যেন মায়ের গর্ভে মৃত শিশুদের মত হয় যারা আলো দেখতে পায় না। তোমাদের পাত্রে আগুনের আঁচ লাগবার আগেই শুকনা ও কাঁচা কাঁটার জ্বালানিগুলো তিনি ঝড়ে উড়িয়ে দেবেন। তাদের উপরে প্রতিশোধ নেওয়া হলে আল্লাহ্‌ভক্তেরা খুশী হবে; তারা দুষ্টদের রক্তে পা ধোবে। তা দেখে লোকে বলবে, “আল্লাহ্‌ভক্তের জীবনে সত্যিই পুরস্কার আছে; সত্যিই একজন আল্লাহ্‌ আছেন যিনি দুষ্টদের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার সময়েই বিচার করেন।” হে আল্লাহ্‌, আমার শত্রুদের হাত থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর; আমার বিপক্ষদের কাছ থেকে তুমি আমাকে উঁচুতে তাদের নাগালের বাইরে তুলে রাখ। যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় তাদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর; খুনীদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। তারা আমার জন্য ওৎ পেতে আছে, ভয়ংকর লোকেরা আমার উপর হামলা শুরু করেছে; হে মাবুদ, তা আমার কোন অন্যায় বা গুনাহের জন্য নয়। আমি কোন দোষ করি নি, তবুও তারা ছুটে এসে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আমার সাহায্যের জন্য তুমি উঠে এস, আমার বিপদ দেখ। হে মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, ইসরাইলের আল্লাহ্‌, তুমি সমস্ত জাতিকে শাস্তি দেবার জন্য ওঠো; দুষ্ট বেঈমানদের প্রতি তুমি কোন দয়া দেখিয়ো না। [সেলা] তারা সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসে, কুকুরের মত চিৎকার করে, আর শহরের সব জায়গায় ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। দেখ, তারা মুখ দিয়ে কি সব কথা বের করছে, তাদের ঠোঁট থেকে যেন তলোয়ার বের হচ্ছে; তারা বলছে, “আমাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না।” কিন্তু হে মাবুদ, তাদের দেখে তুমি হাসছ আর সেই সব জাতিকে বিদ্রূপ করছ। তারা শক্তিশালী বলে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব, কারণ হে আল্লাহ্‌, তুমিই আমার কেল্লা। আল্লাহ্‌ তাঁর অটল মহব্বতের জন্য আমার কাছে আসবেন, আমার শত্রুদের পরাজয় আমাকে দেখতে দেবেন। হে মালিক, আমাদের ঢাল, আমার শত্রুদের তুমি মেরে ফেলো না, তাহলে আমার লোকদের এ সব মনে থাকবে না। তুমি বরং তোমার শক্তিতে তাদের এমন কর যাতে তারা এখান্তেসেখানে ঘুরে বেড়ায়; তুমি তাদের পরাজিত কর। তাদের মুখের গুনাহে আর ঠোঁটের কথায় যে বদদোয়া ও মিথ্যা রয়েছে, তার দরুন তাদের অহংকারে তারা ধরা পড়ুক। তুমি রাগে তাদের ধ্বংস কর, ধ্বংস কর যাতে তারা আর না থাকে; এতে দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত সবাই জানবে, আল্লাহ্‌ ইয়াকুবের বংশের উপরে রাজত্ব করেন। [সেলা] তারা সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসে, কুকুরের মত চিৎকার করে, আর শহরের সব জায়গায় ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। তারা খাবারের খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়; পেট না ভরলে তারা সারা রাতই জেগে কাটায়। কিন্তু আমি তোমার শক্তির বিষয়ে কাওয়ালী গাইব, আর সকালে আনন্দে তোমার অটল মহব্বতের কাওয়ালী গাইব; কারণ তুমিই আমার কেল্লা, বিপদ কালের আশ্রয়-স্থান। হে আল্লাহ্‌, আমার শক্তি, আমি তোমার উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাইব। তুমিই আমার কেল্লা; তুমিই সেই আল্লাহ্‌, আমার জন্য যাঁর অটল মহব্বত আছে। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাদের অগ্রাহ্য করেছ, আমাদের চুরমার করেছ; তুমি রেগে গিয়েছ, কিন্তু এবার তুমি আমাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আন। তুমি দেশের উপর ভূমিকমপ এনেছ, ফাটল ধরিয়েছ; তুমি তার ফাটল বন্ধ কর, কারণ দেশ টলছে। তোমার বান্দাদের তুমি দুর্দিন দেখিয়েছ; তুমি আমাদের এমন আংগুর-রস খাইয়েছ যার দরুন আমরা মাতালের মত হাঁটছি। যারা তোমাকে ভয় করে তাদের তুমি একটা নিশান দিয়েছ, যাতে তা তুলে ধরা যায় সত্যের পক্ষে। [সেলা] তোমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে আমাদের তুমি উদ্ধার কর; আমার ডাকে সাড়া দাও যেন তুমি যাদের মহব্বত কর তারা উদ্ধার পায়। আল্লাহ্‌ তাঁর পবিত্রতার নাম করে বলেছেন, “আমি আনন্দের সংগে শিখিম ভাগ করে দেব, সুক্কোতের উপত্যকার জায়গা জরীপ করে ভাগ করে দেব। গিলিয়দ আমার, মানশাও আমার; আফরাহীম যেন আমার মাথার লোহার টুপী, আর এহুদা আমার রাজদণ্ড। মোয়াব আমার পা ধোয়ার পাত্র; আমি ইদোমের উপরে আমার পায়ের জুতা ফেলব; আর ফিলিস্তীন, আমার জন্য তুমি চিৎকার করে ওঠো।” কে আমাকে ঐ শহরে নিয়ে যাবে যেখানে ঢোকা শক্ত? কে আমাকে পথ দেখিয়ে ইদোমে নিয়ে যাবে? হে আল্লাহ্‌, তুমি কি আমাদের বাতিল কর নি? আমাদের সৈন্যদলের সংগে তুমি তো আর যাও না। হে আল্লাহ্‌, শত্রুর বিরুদ্ধে তুমি আমাদের সাহায্য কর, কারণ মানুষের সাহায্যের তো কোন দাম নেই। আল্লাহ্‌র সাহায্যে আমরা জয়লাভ করব; আমাদের শত্রুদের তিনিই পায়ে মাড়াবেন। হে আল্লাহ্‌, আমার ফরিয়াদ শোন; আমার মুনাজাতে কান দাও। আমি যখনই হতাশায় ভেংগে পড়ব তখন দুনিয়ার শেষ সীমায় থাকলেও সেখান থেকে আমি তোমাকে ডাকব। আমাকে তুমি এমন কোন উঁচু আশ্রয়-পাহাড়ে নিয়ে রাখ যা আমার নাগালের বাইরে। তুমিই তো আমার আশ্রয় হয়ে আছ; শত্রুর বিরুদ্ধে তুমিই আমার শক্তিশালী কেল্লা। তোমার তাম্বুতে যেন আমি চিরকাল বাস করতে পারি; তোমার ডানার তলায় যেন আশ্রয় পাই। [সেলা] হে আল্লাহ্‌, আমি যে সব মানত করেছি তা তো তুমি শুনেছ; তোমাকে যারা ভয় করে তাদের জন্য যে অধিকার তুমি স্থির করেছ তা তুমি আমাকেও দিয়েছ। তুমি বাদশাহ্‌র আয়ু বাড়িয়ে দেবে; তিনি কয়েক পুরুষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন। তিনি চিরকাল আল্লাহ্‌র সামনে বাস করবেন; তাঁকে রক্ষা করবার জন্য তোমার অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততাকে তুমি কাজে লাগাও। আমি চিরকাল তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব, আর দিনের পর দিন আমার মানত পূরণ করব। আমার অন্তর নীরবে কেবল আল্লাহ্‌র অপেক্ষা করছে, কারণ তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা। কেবল তিনিই আমার উঁচু পাহাড় আর আমার উদ্ধার; তিনিই আমার কেল্লা, আমি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হব না। আর কতদিন একজন মানুষের উপর তোমাদের এই সব হামলা চলবে, যাতে হেলে-পড়া দেয়াল আর পড়ে যাচ্ছে এমন বেড়ার মত করে তোমরা সবাই তাকে শেষ করে দিতে পার? তার উঁচু পদ থেকে তাকে নীচে নামিয়ে দেওয়াই তাদের একমাত্র মতলব; মিথ্যা কথাতেই তাদের আনন্দ। মুখেই তারা দোয়া করে কিন্তু অন্তরে বদদোয়া দেয়। [সেলা] হে আমার অন্তর, তুমি নীরবে কেবল আল্লাহ্‌র অপেক্ষা কর, কারণ তিনিই তোমাকে আশা দান করেন। কেবল তিনিই আমার উঁচু পাহাড় আর আমার উদ্ধার; তিনিই আমার কেল্লা, আমি স্থির থাকব। আমার উদ্ধার ও মান-সম্মান আল্লাহ্‌র উপরেই ভরসা করছে; আল্লাহ্‌ আমার শক্তি, আমার উঁচু পাহাড়, তিনিই আমার আশ্রয়স্থান। হে আমার লোকেরা, আল্লাহ্‌ আমাদের আশ্রয়; তোমরা সব সময় তাঁর উপরে ভরসা কর, তাঁরই কাছে তোমাদের অন্তর ঢেলে দাও। [সেলা] b সমাজের নীচের লোকেরা বাষ্পমাত্র, আর উপরের লোকেরা অসার; দাঁড়িপাল্লার ওজনে তারা সবাই মিলে বাতাসের চাইতেও হালকা। তোমরা অন্যায় সুবিধা নেওয়ার উপর ভরসা কোরো না; জুলুম করা আয়ের উপর মিথ্যা আশা রেখো না; বেড়ে ওঠা ধন-সম্পত্তি নিয়ে মেতে থেকো না। সব শক্তি আল্লাহ্‌রই হাতে- এ কথা তিনি অনেকবার বলেছেন, আর আমিও তা অনেকবার শুনেছি। হে মালিক, তোমারই মধ্যে অটল মহব্বত রয়েছে; তুমিই প্রত্যেককে তার কাজ অনুসারে ফল দিয়ে থাক। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমারই আল্লাহ্‌, আমি আগ্রহের সংগে তোমাকে ডাকছি; এই শুকনা পানিহীন দেশে, যার ফসল দেওয়ার শক্তি পর্যন্ত ফুরিয়ে গেছে, সেখানে তোমার জন্য আমার প্রাণ পিপাসিত, তোমার জন্য আমার শরীর ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এই ভাব নিয়েই সেই পবিত্রস্থানে আমি তোমাকে দেখেছি, দেখেছি তোমার কুদরত ও গৌরব। তোমার অটল মহব্বত পাওয়া বেঁচে থাকার চাইতেও ভাল; আমার মুখ তোমার প্রশংসা করবে। আমি সারা জীবন তোমার প্রশংসা করব; তোমার উদ্দেশে আমি হাত তুলে মুনাজাত করব। গোশ্‌ত ও মজ্জায় তৃপ্ত হওয়া লোকের মতই আমার প্রাণ তৃপ্ত; আমার মুখ মহা আনন্দে তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবে। বিছানায় শুয়ে আমি তোমার কথা ভাবি, রাতের প্রহরে প্রহরে তোমার বিষয় ধ্যান করি; কারণ তুমিই আমার সাহায্যকারী; তোমার ডানার ছায়ায় আমি কাওয়ালী গাই। আমার প্রাণ তোমাকে আঁকড়ে ধরেছে; তোমার ডান হাত আমাকে ধরে রেখেছে। যারা আমার জীবন শেষ করার খোঁজে থাকে তারা দুনিয়ার তলায় সবচেয়ে নীচু জায়গায় নেমে যাবে। তলোয়ারের মুখে তাদের তুলে দেওয়া হবে; তারা হবে শিয়ালের খাবার। বাদশাহ্‌ কিন্তু আল্লাহ্‌কে নিয়ে আনন্দ করবেন; যারা আল্লাহ্‌র নামে কসম খায় তারা সবাই তাঁকে নিয়েই গর্ব করবে; কিন্তু মিথ্যাবাদীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার নালিশের কথা শোন; তুমি শত্রুর ভয় থেকে আমার প্রাণ বাঁচাও। দুষ্টদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও; যারা খারাপ কাজ করে বেড়ায় সেই লোকদের চেঁচামেচি থেকে আমাকে বাঁচাও। তারা যেন তলোয়ারের মত করে জিভে শান দিয়ে রেখেছে, তাদের তেতো কথার তীর ধনুকে লাগিয়ে রেখেছে; যাতে গোপন জায়গা থেকে নির্দোষ লোকের দিকে সেই তীর তারা ছুঁড়তে পারে; তারা হঠাৎ তা ছোঁড়ে, ভয় করে না। তাদের খারাপ পরিকল্পনা তারা পাকাপোক্ত করে নেয়, আর গোপনে ফাঁদ পাতার পরামর্শ করে; তারা বলে, “কেউ ওদিকে নজর দেবে না।” তারা অন্যায় করার মতলব এঁটে বলে, “আমরা চারদিক ভেবে-চিন্তে একটা পরিকল্পনা করেছি।” সত্যিই মানুষের মন ও অন্তরের গভীরতার নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাদের উপর তীর ছুঁড়বেন; হঠাৎ তীর বিঁধে তারা পড়ে যাবে। তাদের জিভ্‌ দিয়ে তারা নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনবে; তাদের লক্ষ্য করে সবাই বিদ্রূপে মাথা নাড়বে। তখন সকলের মনে ভয় জাগবে; আল্লাহ্‌ যা করেছেন তারা তা ঘোষণা করবে আর সেই কথা ভাববে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা মাবুদকে নিয়ে আনন্দ করবে এবং তাঁরই মধ্যে আশ্রয় নেবে; অন্তরে যারা সৎ তারা তাঁর প্রশংসা করবে। হে আল্লাহ্‌, সিয়োনে নীরবে তোমার প্রশংসা করা হয়; আমাদের সব মানত তোমার উদ্দেশে পূরণ করা হবে। হে মুনাজাত কবুলকারী, তোমার কাছেই সব মানুষ আসে। আমার অন্যায় কাজে আমি তলিয়ে আছি, কিন্তু তুমিই আমাদের সব গুনাহ্‌ মাফ করে থাক। ধন্য সেই লোক, যাকে তুমি বেছে নাও আর নিয়ে আস নিজের কাছে, যেন সে তোমারই উঠানে বাস করতে পারে। তোমার ঘরের, তোমার পবিত্র বাসস্থানের দোয়ায় আমরা তৃপ্ত হব। হে আমাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌, তোমার ন্যায্যতায় ভয় জাগানো কাজ দিয়ে তুমি আমাদের ডাকে সাড়া দেবে। দুনিয়ার সব মানুষ, এমন কি, সবচেয়ে দূরের জায়গার আর দূরের সমুদ্র পারের মানুষও তোমার উপর ভরসা করে। তোমার শক্তিতেই সব পাহাড়-পর্বত দাঁড়িয়ে আছে; এতে প্রকাশ পায় তুমি শক্তিশালী। তুমিই সমুদ্রের গর্জন নীরব করে দাও, নীরব করে দাও তার ঢেউয়ের গর্জন আর জাতিদের গোলমাল। সব লোক, এমন কি, অনেক দূরের লোকেরাও তোমার কুদরতি ও চিহ্ন-কাজ দেখে ভয় পায়; সূর্য ওঠার দিক থেকে সূর্য ডোবার দিক পর্যন্ত তুমিই আনন্দ-গানে সব জায়গা পূর্ণ করে থাক। তুমিই দুনিয়ার মাটির উপর নজর রাখ আর তাতে পানি দিয়ে থাক; তুমিই তার উর্বরতা অনেক বাড়িয়ে দাও; তোমার কাছ থেকে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে; তুমি মানুষকে ফসল দিয়ে থাক। এইভাবে তুমি মাটি তৈরী করে থাক- চাষ-করা জমির খাঁজগুলো তুমি পানি ভরে দাও আর তার দু’ধার সমান কর; ভারী বৃষ্টি দিয়ে মাটি নরম কর আর তাতে নতুন গজানো চারাকে দোয়া কর। তুমি বছরকে অনেক দোয়া দিয়ে উন্নতি করেছ; তোমার চলার পথে প্রচুর দোয়া ঝরে পড়ে। তা ঝরে পড়ে পশু চরাবার মাঠে মাঠে; পাহাড়গুলোর গায়ে যেন আনন্দের পোশাক রয়েছে। প্রত্যেকটা মাঠ ভেড়ার পালে ভরে আছে, আর শস্যের পোশাকে যেন উপত্যকা ঢাকা পড়েছে; সেগুলো আনন্দধ্বনি তুলছে আর কাওয়ালী গাইছে। দুনিয়ার মানুষেরা, তোমরা সবাই আল্লাহ্‌র উদ্দেশে আনন্দধ্বনি কর। তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও; তাঁকে যোগ্য প্রশংসা দান কর। আল্লাহ্‌কে বল, “তোমার কাজ দেখে মনে কত ভয় জাগে। তোমার মহাশক্তির সামনে তোমার শত্রুরা নত হওয়ার ভান করবে। দুনিয়ার সব মানুষ তোমাকে তোমার এবাদত করবে; তোমার উদ্দেশে তারা প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবে; তারা তোমার প্রশংসার কাওয়ালী গাইবে।” [সেলা] তোমরা এসে আল্লাহ্‌র কাজ দেখে যাও; মানুষের জন্য তিনি যে কাজ করেছেন তা মনে ভয় জাগায়। তিনি সমুদ্রকে করেছিলেন শুকনা ভূমি; তারা পায়ে হেঁটে নদী পার হয়েছিল। এস, আমরা দেশের মধ্যে তাঁকে নিয়ে আনন্দ করি। তাঁর কুদরতেই তিনি চিরকাল রাজত্ব করেন; তাঁর চোখ সব জাতির উপর রয়েছে। যারা আল্লাহ্‌র প্রতি বিদ্রোহী তারা নিজেদের বড় মনে না করুক। [সেলা] সমস্ত জাতির লোকেরা, আমাদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর; তাঁর প্রশংসার ধ্বনি যেন শোনা যায়। তিনিই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন আর আমাদের পা স্থির রেখেছেন। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাদের যাচাই করেছ; রূপার খাদ বের করার মত করে তুমি আমাদের পরিষ্কার করেছ। তুমিই আমাদের জালে ফেলেছ আর আমাদের পিঠে ভীষণ বোঝা চাপিয়েছ। তুমি আমাদের মাথার উপর দিয়ে যেন লোকদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে দিয়েছ। আগুন আর পানির মধ্য দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, কিন্তু তুমি আমাদের পরিপূর্ণ দোয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছ। আমি তোমার ঘরে পোড়ানো-কোরবানী নিয়ে আসব আর তোমার কাছে আমার সব মানত পূরণ করব। সেই সব মানতের কথা আমি মুখে বলেছি, আর বিপদের দিনে আমার মুখ তা উচ্চারণ করেছে। আমি তোমার উদ্দেশে মোটা-তাজা পশু দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী দেব আর তার সংগে পোড়ানো ভেড়ার সুগন্ধ কোরবানী দেব; আমি ষাঁড় ও ছাগল কোরবানী দেব। [সেলা] তোমরা যারা আল্লাহ্‌কে ভয় কর তোমরা সবাই এসে শোন; তিনি আমার জন্য যা করেছেন তা আমি তোমাদের বলছি। আমি নিজের মুখে তাঁকে ডেকেছিলাম; আমার মুখে তাঁর প্রশংসা ছিল। আমার দিলে যদি আমি অন্যায় পুষে রাখতাম তাহলে আমার কথা দীন-দুনিয়ার মালিক শুনতেন না। কিন্তু আল্লাহ্‌ যে শুনেছেন তাতে কোন ভুল নেই; তিনি আমার মুনাজাতে কান দিয়েছেন। আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক! তিনি আমার মুনাজাত অগ্রাহ্য করেন নি কিংবা আমার প্রতি তাঁর অটল মহব্বত বন্ধ করেন নি। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাদের রহমত দান কর ও দোয়া কর; তোমার রহমত আলোর মত আমাদের উপর পড়ুক; [সেলা] যেন দুনিয়ার সবাই তোমার পথ জানতে পারে এবং সমস্ত জাতি তোমার দেওয়া নাজাত পেয়ে তা কাজে লাগাতে পারে। হে আল্লাহ্‌, জাতিরা তোমার প্রশংসা করুক; সমস্ত জাতিই তা করুক। জাতিরা খুশী হোক ও আনন্দ-কাওয়ালী করুক, কারণ তুমি ন্যায়ভাবে জাতিদের বিচার করবে আর এই দুনিয়াতে সব জাতিকে পরিচালনা করবে। [সেলা] হে আল্লাহ্‌, জাতিরা তোমার প্রশংসা করুক; সমস্ত জাতিই তা করুক। জমি তার ফসল দিয়েছে; আল্লাহ্‌, আমাদের আল্লাহ্‌, আমাদের দোয়া করেছেন। আল্লাহ্‌ আমাদের দোয়া করেছেন; তা দেখে দুনিয়ার সবচেয়ে দূরের দেশের লোকেরাও তাঁর ভক্ত হবে। আল্লাহ্‌ উঠুন, তাঁর শত্রুরা ছড়িয়ে পড়ুক আর তাঁর বিপক্ষেরা তাঁর সামনে থেকে পালিয়ে যাক। ধোঁয়ার মত করে তুমি তাদের উড়িয়ে দাও; আগুনের সামনে গলে যাওয়া মোমের মত দুষ্টেরা আল্লাহ্‌র সামনে ধ্বংস হয়ে যাক। কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তেরা খুশী হোক আর আল্লাহ্‌র সামনে আনন্দ করুক; তারা খুশীতে আনন্দ করুক। আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও; মরুভূমির মধ্য দিয়ে যিনি রথে চড়ে আসছেন তাঁর জন্য উঁচু পথ তৈরী কর; তাঁর নাম মাবুদ, তাঁর সামনে আনন্দ কর। আল্লাহ্‌ তাঁর পবিত্র বাসস্থানে এতিমদের পিতা আর বিধবাদের পক্ষ গ্রহণকারী। নিজের বলতে যার কেউ নেই তাকে তিনি নিজের পরিবারের লোক করে তোলেন; বন্দীদের তিনি মুক্ত করে উন্নতির মধ্যে নিয়ে যান, কিন্তু বিদ্রোহীরা রোদে পোড়া জমিতে বাস করে। হে আল্লাহ্‌, তুমি যখন মরুভূমির মধ্য দিয়ে তোমার বান্দাদের আগে আগে গিয়েছিলে, [সেলা] তখন দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল আর আকাশ বৃষ্টি ঢেলেছিল। এ সব হয়েছিল আল্লাহ্‌র সামনে, তুর পাহাড়ের সেই আল্লাহ্‌র সামনে, আল্লাহ্‌রই সামনে, ইসরাইলের আল্লাহ্‌র সামনে। হে আল্লাহ্‌, তুমি প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি দিয়েছিলে; শুকিয়ে ওঠা তোমার দেশকে তুমি সতেজ করে তুলেছিলে। তোমার নিজের লোকেরা তার মধ্যে বাসস্থান করেছিল; তোমার মেহেরবানীর ইচ্ছায়, হে আল্লাহ্‌, তুমি তাদের অভাব মিটিয়েছিলে। দীন-দুনিয়ার মালিক লোকদের হুকুম দেন; সুসংবাদ ঘোষণাকারী স্ত্রীলোকেরা সংখ্যায় অনেক। ঐ স্ত্রীলোকেরা বলে, “সৈন্যদলের বাদশাহ্‌রা পালিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে, আর ঘরে থাকা স্ত্রীলোকেরা লুটের মাল ভাগ করে নিচ্ছে। চারপাশে ভেড়ার খোয়াড়ের মাঝখানে তোমরা যখন শুয়ে থাক, তখন তোমাদের এমন ঘুঘুর মত দেখতে লাগে যার ডানা রূপায় ঢাকা আর পালক সোনায় মোড়ানো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ যখন দেশের মধ্যে বাদশাহ্‌দের ছড়িয়ে দিলেন তখন সল্‌মোন পাহাড়ের উপর বরফ পড়ছিল।” বাশনের পাহাড়ের সারি অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে; তার অনেকগুলো চূড়া। ওহে অনেক চূড়ার পাহাড়, আল্লাহ্‌ যে পাহাড়কে নিজে থাকার জন্য বেছে নিয়েছেন তুমি হিংসার চোখ নিয়ে কেন তার দিকে চেয়ে আছ? সেটাই তো মাবুদের চিরকালের বাসস্থান। আল্লাহ্‌র রথ হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ; দীন-দুনিয়ার মালিক সেগুলোর মধ্যে পবিত্র জায়গায় আছেন, যেমন তিনি তুর পাহাড়ে ছিলেন। যখন তুমি বেহেশতে উঠলে তখন পরাজিত বন্দীদের চালিয়ে নিয়ে গেলে। লোকদের মধ্যে, এমন কি, বিদ্রোহীদের মধ্যে থাকার সময় তোমার কাছে অনেক দান এসেছিল, যাতে তুমি, হে আল্লাহ্‌ মাবুদ, তাদের মধ্যে থাকতে পার। দীন-দুনিয়ার মালিকের সমস্ত প্রশংসা হোক। তিনি প্রতিদিনই আমাদের বোঝা বইছেন; তিনিই আমাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌। [সেলা] আমাদের আল্লাহ্‌ এমন আল্লাহ্‌ যিনি উদ্ধার করেন; আল্লাহ্‌ মালিক মৃত্যু থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ নিঃসন্দেহে তাঁর শত্রুদের মাথা চুরমার করে দেবেন; যারা গুনাহে পড়ে থাকে সেই সব লোকদের চুলে ভরা মাথা তিনি চুরমার করে দেবেন। দীন-দুনিয়ার মালিক বললেন, “আমি বাশন দেশ থেকে তাদের নিয়ে আসব; সমুদ্রের তলা থেকে তাদের তুলে আনব, যাতে তোমার পা তোমার শত্রুদের রক্ত দলে যায় আর তোমার কুকুরগুলো যেন তা ইচ্ছামত চেটে খেতে পারে।” হে আল্লাহ্‌, লোকে তোমার ঈদ-যাত্রা দেখেছে, দেখেছে পবিত্র জায়গার দিকে আমার আল্লাহ্‌র যাত্রা, যিনি আমার বাদশাহ্‌। প্রথমে যাচ্ছে কাওয়ালেরা, তাদের পিছনে যাচ্ছে বাজনা বাদকেরা; খঞ্জনি-বাজানো মেয়েদের মাঝখানে তারা চলেছে। তোমাদের সব মাহ্‌ফিলের মধ্যে আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর; তোমরা যারা ইসরাইল-বংশের লোক, তোমরা মাবুদের প্রশংসা কর। সবার ছোট যে বিন্‌ইয়ামীন, ঐ যাচ্ছে তার বংশ, যাদের হাতে আছে রাজদণ্ড; ঐ যে এহুদার নেতারা, যারা দলে ভারী; ঐ যে সবূলূনের নেতারা আর ঐ যায় নপ্তালির নেতারা। তোমার আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তোমার শক্তি এসেছে। হে আল্লাহ্‌, তোমার শক্তি দেখাও, আগে যেমন তুমি আমাদের পক্ষে কাজ করে দেখিয়েছিলে। জেরুজালেমে তোমার ঘর আছে; সেখানেই বাদশাহ্‌রা তোমার কাছে উপহার নিয়ে যাবে। তাদের এবং তাদের আনা রূপার টুকরাগুলো পায়ে দলে ফেলে নলবনের বুনো জন্তু ঐ মিসরকে তুমি ধম্‌কে দাও; ধম্‌কে দাও বাছুর ও বলদের দলের মত ঐ সব জাতিদের। যে সব জাতি যুদ্ধ ভালবাসে আল্লাহ্‌ তাদের দল ভেংগে দিয়েছেন। মিসর থেকে রাষ্ট্রদূতেরা আসবেন; ইথিওপিয়া তাড়াতাড়ি করে আল্লাহ্‌র কাছে হাত বাড়িয়ে দেবে। হে দুনিয়ার সব রাজ্য, আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, দীন-দুনিয়ার মালিকের প্রতি প্রশংসার কাওয়ালী গাও। [সেলা] তিনি সেই পুরানো দিনের আকাশের মধ্য দিয়ে রথে চড়ে চলাচল করেন। শোন, তিনি জোর গলায় কথা বলছেন। ঘোষণা কর, আল্লাহ্‌ শক্তিমান; তাঁর মহিমা ইসরাইলের উপর রয়েছে আর আসমান জুড়ে রয়েছে তাঁর কুদরত। হে আল্লাহ্‌, তোমার পবিত্র জায়গায় তোমার উপস্থিতি ভয় জাগিয়ে তোলে। ইসরাইলের আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে থাকেন। আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক! হে আল্লাহ্‌, আমাকে উদ্ধার কর, আমি যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছি। আমি গভীর পাঁকের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, সেখানে আমার দাঁড়াবার জায়গা নেই। আমি গভীর পানিতে এসে পড়েছি; বন্যা আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ডাকতে ডাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমার গলা শুকিয়ে গেছে; আমার আল্লাহ্‌র জন্য চেয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখও ঝাপ্‌সা হয়ে গেছে। যারা অকারণে আমাকে ঘৃণা করে, তাদের সংখ্যা আমার চুলের চাইতেও বেশী। যারা আমাকে ধ্বংস করে ফেলতে চায় তারা খুব শক্তিশালী; তারা মিথ্যা কারণে আমার শত্রু হয়েছে। আমি যা চুরি করি নি তা-ও আমাকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। হে আল্লাহ্‌, তুমি তো আমার বোকামির কথা জান; আমার দোষ তোমার কাছে লুকানো নেই। হে মালিক, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, যারা তোমার অপেক্ষায় থাকে আমার দরুন তারা যেন লজ্জা না পায়। হে ইসরাইলের মাবুদ, যারা তোমাকে জানবার জন্য আগ্রহী তারা যেন আমার দরুন অসম্মানিত না হয়। আমি তোমার জন্যই অপমান সহ্য করেছি, অসম্মানে আমার মুখ ঢেকে গেছে। আমার ভাইদের কাছে আমি যেন অচেনা হয়ে গেছি, মায়ের পেটের ভাইদের কাছে বিদেশী হয়েছি। তোমার ঘরের জন্য আমার যে গভীর ভালবাসা, সেই ভালবাসাই আমার দিলকে জ্বালিয়ে তুলেছে। যারা তোমাকে অপমান করে তাদের করা সব অপমান আমার উপরেই পড়েছে। আমার কান্না আর আমার রোজার কষ্ট আমার দুর্নামের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যখন চট পরেছি তখন লোকে আমাকে টিট্‌কারি দিয়েছে। যারা শহরের দরজায় বসে তাদের মধ্যে আমাকে নিয়ে কথা ওঠে; মাতালেরা আমাকে নিয়ে গান বাঁধে। কিন্তু হে মাবুদ, যে সময়ে তোমার রহমত পাওয়া যায় আমি সেই সময়ে তোমার কাছে মুনাজাত করছি; হে আল্লাহ্‌, তোমার অটল মহব্বতে তোমার উদ্ধার করার বিশ্বস্ততা দেখিয়ে আমাকে জবাব দাও। পাঁক থেকে আমাকে উদ্ধার কর, আমাকে ডুবে যেতে দিয়ো না; আমার শত্রুদের হাত থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর, উদ্ধার কর অথৈ পানির মধ্য থেকে। বন্যা যেন আমার উপর দিয়ে বয়ে না যায়, গভীর পানি যেন আমাকে তলিয়ে না ফেলে; কবরের মুখ যেন আমার উপর বন্ধ না হয়। হে মাবুদ, তোমার মেহেরবানীর অটল মহব্বতে আমাকে তুমি জবাব দাও; তোমার অসীম মমতায় তুমি আমার দিকে ফেরো। তোমার গোলামের দিক থেকে তোমার মুখ তুমি ফিরিয়ে রেখো না; আমি বিপদে পড়েছি, আমাকে শীঘ্র জবাব দাও। তুমি আমার কাছে এসে আমাকে ছাড়িয়ে নাও; তুমি আমাকে মুক্ত কর, কারণ আমার শত্রু রয়েছে। আমি যে কত ঘৃণা, লজ্জা ও অসম্মানের পাত্র হয়েছি তা তো তুমি জান; আমার শত্রুরা সবাই তোমার সামনে রয়েছে। ঘৃণা আমার মন ভেংগে দিয়েছে, তাতে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার দুঃখে যেন অন্যে দুঃখ বোধ করে সেটাই আমি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তা পাই নি। সান্ত্বনা দেবে এমন লোক আমি চেয়েছিলাম, কিন্তু তেমন কাউকে পেলাম না। আমার খাবারে তারা বিষ দিয়েছিল আর পিপাসার সময় দিয়েছিল সিরকা। তাদের মেজবানীর উৎসবগুলো ফাঁদ হোক, আর নিরাপদে থাকার ভাবটাই হোক তাদের জালের ফাঁদ। তাদের চোখ অন্ধ হোক যেন তারা দেখতে না পায়, আর সব সময় তাদের কোমরে খিঁচুনি ধরে যাক। তোমার রাগে তুমি তাদের বকুনি দাও; তোমার জ্বলন্ত গজব তাদের ধরে ফেলুক। তাদের থাকার জায়গা খালি হয়ে পড়ে থাকুক; তাদের তাম্বুতে বাস করার কেউ না থাকুক। তুমি যাকে শাস্তি দিয়েছ তারা তাকেই জুলুম করেছে; যাদের তুমি আঘাত করেছ তাদের যন্ত্রণাই হল তাদের আলোচনার বিষয়। অন্যায়ের উপর তাদের অন্যায় করে যেতে দাও; তারা যেন তোমার দেওয়া নাজাতের ভাগ না পায়। জীবিতদের তালিকা থেকে তাদের নাম যেন মুছে যায়, আল্লাহ্‌ভক্তদের তালিকায় যেন তাদের নাম না থাকে। আমি দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে আছি; হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে উদ্ধার করে তাদের নাগালের বাইরে রাখ। আমি কাওয়ালী গেয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করব; কৃতজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁর গৌরব করব। বলদ এবং শিং ও খুরযুক্ত ষাঁড় কোরবানীর চেয়ে তা মাবুদকে বেশী সন্তুষ্ট করবে। তা দেখে নম্র লোকেরা খুশী হবে; তোমরা যারা আল্লাহ্‌কে জানবার জন্য আগ্রহী, তোমরা বেঁচে থাক। মাবুদ অভাবীদের কথা শোনেন; তাঁর বান্দারা, যারা বন্দীদশায় আছে, তাদের তিনি নীচু চোখে দেখেন না। আসমান ও জমীন তাঁর প্রশংসা করুক; সমুদ্র ও তার মধ্যে ঘুরে বেড়ানো সব প্রাণী তাঁর প্রশংসা করুক; কারণ আল্লাহ্‌ সিয়োনকে উদ্ধার করবেন, এহুদার শহরগুলো আবার গড়বেন; তখন তাঁর বান্দারা সেখানে বাস করবে আর তার অধিকারী হবে। তাঁর গোলামদের বংশের লোকেরাই তা অধিকার হিসাবে পাবে, আর যারা তাঁকে মহব্বত করে তারাই সেখানে বাস করবে। হে আল্লাহ্‌, আমাকে বাঁচাও; হে মাবুদ, আমাকে সাহায্য করতে শীঘ্র এস। যারা আমাকে হত্যা করবার চেষ্টায় আছে তারা লজ্জিত ও অপমানিত হোক; যারা আমার সর্বনাশ দেখতে চায় তারা মাথা নীচু করে ফিরে যাক। যারা আমাকে দেখে বলে, “ভাল হয়েছে!” তারা লজ্জা পেয়ে ফিরে যাক। কিন্তু যারা তোমার ইচ্ছামত চলে তারা তোমাকে নিয়েই আনন্দিত ও খুশী হোক; যারা তোমার করা উদ্ধারের কাজ ভালবাসে তারা সব সময়েই বলুক, “আলহামদুলিল্লাহ্‌!” আমি দুঃখী ও অভাবী; হে আল্লাহ্‌, তুমি শীঘ্র আমার কাছে এস। তুমি তো আমার সাহায্যকারী ও উদ্ধারকর্তা; হে মাবুদ, দেরি কোরো না। হে মাবুদ, আমি তোমারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি, আমাকে কখনও লজ্জা পেতে দিয়ো না। তুমি ন্যায়বান বলে আমাকে বাঁচাও, উদ্ধার কর; আমার কথায় কান দাও এবং আমাকে রক্ষা কর। তুমিই আমার আশ্রয়-পাহাড় হও যাঁর কাছে আমি সব সময় যেতে পারি। তুমি আমার উঁচু পাহাড় ও কেল্লা, তাই আমাকে রক্ষা করার জন্য হুকুম দিয়েছ। হে আমার আল্লাহ্‌, দুষ্টদের হাত থেকে, খারাপ ও নিষ্ঠুর লোকদের হাতের মুঠো থেকে, তুমি আমাকে উদ্ধার কর। হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমিই আমার আশা, যুবা বয়স থেকে তুমিই আমার ভরসা। জন্ম থেকেই আমি তোমার উপর নির্ভরশীল; তুমিই আমাকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে এনেছ। তুমিই সব সময় আমার প্রশংসার বিষয়। আমাকে দেখে অনেকে হাঁ করে চেয়ে থাকে, কিন্তু তুমিই আমার অটল আশ্রয়। আমার মুখে তোমার গুণগান লেগেই আছে, তা সারা দিনই তোমার গৌরবের কথা বলে। আমার এই শেষ বয়সে আমাকে ফেলে দিয়ো না; আমার শক্তি ফুরিয়ে গেছে, আমাকে ত্যাগ কোরো না। আমার শত্রুরা আমার বিরুদ্ধে কথা বলছে; যারা আমাকে হত্যা করতে চায় তারা সবাই মিলে শলা-পরামর্শ করছে। তারা বলছে, “আল্লাহ্‌ ওকে ত্যাগ করেছেন; ওকে তাড়া করে ধরে ফেল, ওকে বাঁচাবার কেউ নেই।” হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না; হে আমার আল্লাহ্‌, আমাকে সাহায্য করতে তুমি শীঘ্র এস। আমার বিপক্ষেরা লজ্জিত ও ধ্বংস হোক; যারা আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টায় আছে তারা ঘৃণা আর অপমানে ঢাকা পড়ুক। কিন্তু আমি সব সময়েই তোমার উপর ভরসা করব, তোমার প্রশংসার উপর প্রশংসা করতে থাকব। তোমার ন্যায় কাজ আর তোমার করা উদ্ধার-কাজের কথা সারা দিন আমার মুখে থাকবে, কারণ সেগুলো বলে শেষ করা যায় না। হে আল্লাহ্‌ মালিক, তোমার মহৎ কাজের কথা বলার জন্য আমি তোমার ঘরে ঢুকব; আমি তোমার, কেবল তোমারই ন্যায় কাজের কথা বলব। হে আল্লাহ্‌, যৌবন কাল থেকে তুমিই আমাকে শিক্ষা দিয়েছ; আজও আমি তোমার অলৌকিক কাজের কথা প্রচার করছি। হে আল্লাহ্‌, আজ বুড়ো হয়ে চুল পেকে গেলেও তুমি আমাকে ত্যাগ কোরো না; পরের বংশধরদের কাছে তোমার ক্ষমতার কথা, ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তোমার শক্তির কথা আমাকে ঘোষণা করতে দাও। হে আল্লাহ্‌, তোমার ন্যায় কাজ যেন আসমান ছুঁয়েছে; সব মহান কাজ তুমিই করেছ; হে আল্লাহ্‌, তোমার সমান আর কে আছে? যদিও তুমি আমার উপর অনেক কষ্ট আর বিপদ এনেছ, তবুও তুমিই আবার আমার প্রাণ জীবিত করে তুলবে; মাটির তলা থেকে তুলে আনার মত করে আবার তুমি আমাকে তুলে আনবে। আমি চাই তুমি যেন আমার সম্মান বাড়িয়ে দাও, আবার আমাকে সান্ত্বনা দাও। হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার বিশ্বস্ততার বিষয় নিয়ে আমি বীণা বাজিয়ে তোমার প্রশংসা করব; হে ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক, আমি সুরবাহারে তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। আমি যখন তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব আমার মুখ তখন চিৎকার করে আনন্দধ্বনি করবে; আমার অন্তর তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইবে, কারণ তুমিই আমাকে মুক্ত করেছ। আমার মুখ সারা দিন তোমার ন্যায় কাজের কথাই বলবে, কারণ যারা আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টায় আছে তারা লজ্জিত ও অপমানিত হয়েছে। হে আল্লাহ্‌, বিচার করার যে অধিকার তোমার আছে তা তুমি এই বাদশাহ্‌কে দান কর; এই রাজপুত্রকে তোমার ন্যায়ের জ্ঞান দান কর; যাতে তিনি ন্যায়ভাবে তোমার বান্দাদের বিচার করতে পারেন আর অত্যাচারিতদের সুবিচার করতে পারেন। তাঁর ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে লোকদের জন্য পাহাড়-পর্বতে ভরা দেশটা উন্নতিতে ভরে উঠুক। তাঁর রাজ্যের অত্যাচারিত লোকদের উপর তিনি ন্যায়বিচার করুন; তাঁর গরীবদের বাঁচান আর জুলুমবাজদের চুরমার করুন। যতদিন চাঁদ-সূর্য থাকবে ততদিন বংশের পর বংশ ধরে লোকে তাঁকে ভয় করুক। ঘাস কেটে নেওয়া জমির উপর বৃষ্টি পড়লে যেমন হয় তিনি যেন তেমনি হন; তিনি যেন মাটি ভিজানো বৃষ্টিধারার মত হন। তাঁর আমলে আল্লাহ্‌ভক্তেরা যেন প্রচুর দোয়া পায়; যতদিন চাঁদ থাকবে ততদিন তাদের জীবন উন্নতিতে ভরে উঠুক। তাঁর রাজ্যের সীমা সাগর থেকে সাগর পর্যন্ত, ফোরাত নদী থেকে দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত হোক। মরুভূমির লোকেরা তাঁর কাছে নত হোক আর তাঁর শত্রুরা তাঁকে পায়ে ধরে সালাম করুক। তর্শীশ আর দ্বীপগুলোর বাদশাহ্‌রা তাঁকে খাজনা দিক; সাবা ও সবা দেশের বাদশাহ্‌রাও তাঁর পাওনা উপহার তাঁকে দিক। সমস্ত বাদশাহ্‌রা তাঁর কাছে মাথা নীচু করুক আর সমস্ত জাতি তাঁর সেবা করুক। যে সব অভাবী, অত্যাচারিত ও অসহায় লোকেরা সাহায্যের জন্য কাঁদছে তাদের তিনি উদ্ধার করবেন। অসহায় ও অভাবীদের তিনি দয়া করবেন আর অভাবীদের বাঁচাবেন। জুলুম ও হামলার হাত থেকে তিনি তাদের প্রাণ রক্ষা করবেন; তাঁর চোখে তাদের রক্তের দাম অনেক। তিনি অনেক দিন বেঁচে থাকুন; সাবা দেশের সোনা তাঁর কাছে আসুক। সব সময় তাঁর জন্য মুনাজাত হতে থাকুক; সারা দিন ধরে তাঁর উপর দোয়া ঝরে পড়ুক। দেশে প্রচুর শস্যের ফলন হোক, তা পাহাড়গুলোর চূড়ার উপরেও হোক। ক্ষেতের ফসলে লেবাননের বনের শন্‌শন্‌ শব্দ উঠুক; শহর থেকে বেরিয়ে আসা লোকেরা যেন মাঠের ঘাসের মত প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তাঁর সুনাম চিরকাল স্থায়ী হোক; সূর্য যতদিন আলো দেবে ততদিন তাঁর সুনাম বহাল থাকুক। তাঁর মধ্য দিয়ে সমস্ত জাতি যেন দোয়া পায়; তারা তাঁকে ধন্য বলুক। আল্লাহ্‌ মাবুদ, যিনি ইসরাইলের আল্লাহ্‌, তাঁর প্রশংসা হোক; কেবল তিনিই অলৌকিক চিহ্ন দেখান। চিরকাল তাঁর মহিমাপূর্ণ নামের প্রশংসা হোক; সারা দুনিয়া তাঁর মহিমায় পূর্ণ হোক। আমিন, আমিন। ইয়াসির ছেলে দাউদের সব মুনাজাতের শেষ এখানেই। যাদের অন্তর খাঁটি সেই বনি-ইসরাইলদের পক্ষে আল্লাহ্‌ সত্যিই মেহেরবান। কিন্তু আমি প্রায় পড়ে গিয়েছিলাম; আমার পা প্রায় পিছলে গিয়েছিল। আমি দেখলাম, দুষ্টেরা খুব সুখে আছে, সেজন্য ঐ সব অহংকারীদের দেখে আমার হিংসা হয়েছিল; কারণ মরণকালে তারা যন্ত্রণা পায় না আর তাদের শরীরও খুব মোটাসোটা থাকে। অন্য লোকেরা যেমন বিপদে পড়ে তেমনি তারা বিপদে পড়ে না; অন্যেরা যেমন কষ্ট ভোগ করে তেমনি তারা কষ্ট ভোগ করে না। সেজন্য অহংকার হয় তাদের গলার হার, আর জুলুম হয় তাদের গায়ের কাপড়। চর্বির ঠেলায় তাদের চোখ বেরিয়ে এসেছে; তাদের মনের কুমতলব উপ্‌চে পড়ছে। তাদের কথায় বিদ্রূপ আর হিংসা রয়েছে; অহংকারের বশে তারা জুলুমের ভয় দেখায়। তারা বেহেশতের বিরুদ্ধে কথা বলে আর সারা দুনিয়ায় তাদের বড় বড় কথা ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্য আল্লাহ্‌র বান্দারা খারাপ পথে ফিরে যায় আর সেই সব কথা প্রচুর পরিমাণে গিলতে থাকে। তারা বলে, “আল্লাহ্‌ কি করে জানবেন? আল্লাহ্‌তা’লার মধ্যে জ্ঞান বলতে কি কিছু আছে?” এরাই হল সেই দুষ্ট লোকেরা যারা আরামে থেকে ধন-সম্পত্তি বাড়িয়েছে। আমার দিলকে আমি মিছামিছি খাঁটি রেখেছি, আমার হাত মিথ্যাই আমি নির্দোষ রেখেছি। সারা দিন ধরে আমি কষ্ট ভোগ করেছি; প্রতিদিন সকাল বেলায় শাস্তি পেয়েছি। যদি এই সব কথা আমি লোকদের কাছে বলতাম, তবে এই কালের তোমার বান্দাদের কাছে আমি বেঈমান হতাম। আমি যখন এ সব ব্যাপারে বুঝবার চেষ্টা করলাম তখন আমার মনকে তা কষ্ট দিতে লাগল; কিন্তু যখন আমি আল্লাহ্‌র পবিত্র জায়গায় গেলাম তখন তাদের শেষ দশার কথা বুঝতে পারলাম। তুমি সত্যিই তাদের পিছলা জায়গায় রেখেছ আর ধ্বংসের মধ্যে ফেলেছ। কেমন হঠাৎ তারা ধ্বংস হয়ে যায় আর ভয় জাগানো বিপদের মধ্যে একেবারে শেষ হয়ে যায়। ঘুম ভাঙ্গলে মানুষের কাছে স্বপ্ন যেমন তুচ্ছ হয়ে যায়, তেমনি হে মালিক, তুমি জাগলে তারাও তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। যখন আমার মন তেতো হয়ে উঠেছিল আর অন্তরে আঘাত লেগেছিল, তখন আমি অসাড় ও অবুঝ হয়ে পড়েছিলাম আর তোমার কাছে বুদ্ধিহীন পশুর সমান হয়েছিলাম। তবুও আমি সব সময় তোমার সংগেই আছি; তুমিই আমার ডান হাত ধরে রেখেছ। তোমার নির্দেশের মধ্য দিয়ে তুমি আমাকে চালাবে, আর শেষে তোমার মহিমার মধ্যে আমাকে গ্রহণ করবে। বেহেশতে তুমিই আমার সব; তোমাকে পেয়ে দুনিয়াতেও আমার চাওয়ার আর কিছু নেই। আমার শরীর ও মন ক্ষয় হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্‌ আমার দিলের শক্তি আর আমার চিরকালের সম্পত্তির ভাগ। যারা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে, তারা শেষ হয়ে যাবে; যারা তোমার প্রতি বেঈমান তুমি তাদের ধ্বংস করে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র সংগে থাকা আমার জন্য ভাল; আল্লাহ্‌ মালিককে আমি আমার আশ্রয়স্থান করেছি, যেন তাঁর সব কাজের কথা আমি প্রচার করতে পারি। হে আল্লাহ্‌, তুমি চিরদিনের জন্য কেন আমাদের ত্যাগ করেছ? তোমার চারণভূমির ভেড়াদের বিরুদ্ধে কেন তোমার রাগের আগুন ধূমিয়ে উঠছে? মনে করে দেখ তোমার সেই লোকদের কথা যাদের তুমি অনেক কাল আগেই তোমার করে নিয়েছিলে, যে বংশকে তুমি তোমার অধিকার হিসাবে মুক্ত করে এনেছিলে। মনে করে দেখ সেই সিয়োন পাহাড়ের কথা যাকে তুমি তোমার বাসস্থান করেছ। চিরকালের এই ধ্বংসস্তূপের দিকে তুমি পা চালিয়ে এগিয়ে এস; পবিত্র স্থানে সব কিছুই শত্রুরা ছারখার করে দিয়েছে। যেখানে তোমার সংগে আমাদের মিলন হত সেই জায়গায় শত্রুরা গর্জন করে বেড়িয়েছে, সেখানে তারা নিজেদের নিশান তুলেছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন কেউ বনের গাছ কাটার জন্য কুড়াল চালিয়েছিল। কুড়াল ও হাতুড়ি দিয়ে সমস্ত খোদাই করা কাজগুলো তারা চুরমার করে দিয়েছে। তোমার পবিত্র স্থানে তারা আগুন লাগিয়েছে, তোমার থাকবার জায়গা মাটির সংগে মিশিয়ে দিয়ে নাপাক করেছে। তারা মনে মনে বলেছে, “আমরা ওদের সম্পূর্ণভাবে দাবিয়ে রাখব।” আল্লাহ্‌র সংগে মিলিত হওয়ার সব জায়গাগুলো তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের জন্য কোন অলৌকিক চিহ্ন দেখানো হচ্ছে এমন তো আর আমরা দেখি না; কোন নবীও আর নেই; এরকম যে আর কতদিন চলবে তা আমাদের কেউ জানে না। হে আল্লাহ্‌, শত্রুরা আর কতদিন ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে? চিরদিনই কি শত্রুরা তোমার নামের অপমান করবে? কেন তুমি তোমার হাতখানা, ঐ ডান হাতখানা লুকিয়ে রেখেছ? তা বুকের মধ্য থেকে বের করে এনে তাদের শেষ করে দাও। তবুও হে আল্লাহ্‌, অনেক কাল আগে থেকে তুমিই আমার বাদশাহ্‌; তুমিই এই দুনিয়ার বুকে উদ্ধারের কাজ করছ। নিজের শক্তিতে তুমিই সাগরকে ভাগ করেছিলে; তুমিই সাগরের মধ্যে ভেংগে দিয়েছিলে জল-দানবদের মাথা। লিবিয়াথনের মাথাগুলো তুমিই চুরমার করে দিয়েছিলে আর তার শরীরটা মরুভূমির প্রাণীদের খেতে দিয়েছিলে। তুমি ঝর্ণা ও ছোট নদীর পথ খুলে দিয়েছ; অনেক কালের বয়ে যাওয়া নদী তুমিই শুকিয়ে ফেলেছ। দিন তোমার, রাতও তোমার; চাঁদ-তারা ও সূর্য তুমিই স্থাপন করেছ। দুনিয়ার সব কিছুর সীমা তুমিই ঠিক করে দিয়েছ; তুমিই শীত ও গ্রীসমকাল তৈরী করেছ। হে মাবুদ, ভুলে যেয়ো না শত্রুরা তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে, অসাড়-বিবেক লোকেরা তোমার নামের অপমান করেছে। তোমার এই প্রিয় ঘুঘুকে তুমি বুনো পশুর হাতে তুলে দিয়ো না; তোমার অত্যাচারিত লোকদের জীবনের কথা তুমি চিরদিন ভুলে থেকো না। তোমার ব্যবস্থার কথা তুমি ভেবে দেখ; দেশের সব লুকাবার স্থানের অনেক বাসস্থান জুলুমে ভরে উঠেছে। তুমি অত্যাচারিত লোকদের অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে দিয়ো না; দুঃখী এবং অভাবী লোকেরা তোমার নামের প্রশংসা করুক। হে আল্লাহ্‌, তুমি উঠে বিচার করবার জন্য তোমার মামলা উপস্থিত কর; ভুলে যেয়ো না অসাড়-বিবেক লোকেরা সারা দিন তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তোমার শত্রুদের চেঁচামেচি, তোমার বিরুদ্ধে তাদের যে হৈচৈ সব সময় চলছে, তা ভুলে যেয়ো না। হে আল্লাহ্‌, আমরা তোমাকে শুকরিয়া জানাই, আমরা তোমার শুকরিয়া আদায় করি, কারণ তুমি কাছেই আছ; লোকে তোমার অলৌকিক কাজের কথা ঘোষণা করে। তুমি বলে থাক, “ঠিক সময় আমিই বেছে নিই, আমিই ন্যায়বিচার করি। দুনিয়া ও তার মানব-সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা যখন ভেংগে যায়, তখন আমিই তার থামগুলো টিকিয়ে রাখি। [সেলা] “আমি অহংকারীদের বলি, ‘গর্ব কোরো না,’ আর দুষ্টদের বলি, ‘শিং উঁচু কোরো না। তোমাদের শিং উঁচুতে তুলো না আর ঘাড় বাঁকিয়ে কথা বোলো না।’ ” পূর্ব কি পশ্চিম কিংবা মরুভূমি থেকে কেউ রক্ষা করতে আসে না; কিন্তু আল্লাহ্‌ বিচার করেন; তিনি একজনকে নীচে নামান ও আর একজনকে উপরে তোলেন। মাবুদের হাতে একটা পেয়ালা আছে, তাতে ফেনিয়ে ওঠা মসলা মিশানো আংগুর-রস রয়েছে। তিনি সেই পেয়ালা থেকে ঢেলে দেন; দুনিয়ার সব দুষ্ট লোককে তার তলানি পর্যন্ত খেতেই হবে। কিন্তু আমি চিরদিন মাবুদ সম্বন্ধে প্রচার করব আর ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। আমি দুষ্টদের সমস্ত শিং কেটে ফেলে দেব, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তদের শিং উঁচুতে তোলা হবে। এহুদা-রাজ্যে সকলেই আল্লাহ্‌র কথা জানে; ইসরাইল-রাজ্যে তাঁর নাম মহান। জেরুজালেমে তাঁর আবাস-তাম্বু আর সিয়োনে তাঁর বাসস্থান আছে। তিনি সেখানে সব জ্বলন্ত তীর ভেংগে ফেলেছেন, ভেংগে ফেলেছেন ঢাল, তলোয়ার আর যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র। [সেলা] তুমি নূরে কেমন নূরানী! শিকারে ভরা পাহাড় থেকে তোমার ফিরে আসা কেমন মহিমাপূর্ণ! সাহসী যোদ্ধাদের লুটপাট করা হয়েছে, তারা শেষ ঘুমে ঢলে পড়েছে; কোন যোদ্ধার হাতে আর শক্তি ছিল না। হে ইয়াকুবের আল্লাহ্‌, ঘোড়া আর রথচালকেরা তোমার ধমক খেয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে। তুমি, তুমিই খুব ভয়ানক; তোমার রাগ জেগে উঠলে কে তোমার সামনে দাঁড়াতে পারে? অবশ্যই মানুষের রাগের ফলে তোমার প্রশংসা হয়; সেই রাগের বাকী অংশ দিয়ে তুমি নিজেকে সাজাও। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মানত কর আর তা পূরণ কর। যিনি ভয়ের পাত্র তাঁর উদ্দেশে চারদিকের দেশ থেকে লোকে উপহার আনুক। শাসনকর্তাদের সাহস তিনিই দমিয়ে দেন; দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা তাঁকে ভয় করে। আমি চিৎকার করে আল্লাহ্‌র কাছে কাঁদছি; আমি আল্লাহ্‌র কাছে চিৎকার করছি যেন তিনি তা শুনে জবাব দেন। বিপদের দিনে আমি মালিককে ডাকলাম; রাতের বেলা আমার হাত দু’টা আল্লাহ্‌র দিকে বাড়ানোই থাকত, আমি ক্লান্ত হতাম না; আমার অন্তর সান্ত্বনা পেত না। আমি যখন আল্লাহ্‌র কথা ভাবতাম তখন দুঃখে কোঁকাতাম; ভাবতে ভাবতে আমি নিরাশ হয়ে পড়তাম। [সেলা] তুমিই আমার চোখের পাতা খোলা রাখতে; আমি খুব অস্থির হয়ে পড়তাম, তাই কথাও বলতে পারতাম না। অনেক পুরানো দিনের কথা আমি ভাবতাম, ভাবতাম অনেক অনেক বছর আগেকার কথা। রাতের বেলায় আমার সব কাওয়ালীর কথা আমার মনে পড়ত; আমি অন্তরে গভীরভাবে চিন্তা করতাম আর মনে মনে প্রশ্ন করতাম- মালিক কি চিরদিনের জন্য আমাদের ত্যাগ করেছেন? তিনি কি আমাদের আর কখনও রহমত করবেন না? তাঁর অটল মহব্বত কি চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল? তাঁর ওয়াদাও কি চিরকালের জন্য বিফল হয়ে গেল? আল্লাহ্‌ কি রহমত করতে ভুলে গেলেন? তিনি কি রাগে তাঁর মমতা বন্ধ করে দিলেন? [সেলা] আমি বললাম, “এটাই আমার দুঃখ যে, আল্লাহ্‌তা’লার ডান হাতখানা বদলে গেছে।” মাবুদের সব কাজের কথা আমি মনে করব; হ্যাঁ, মনে করব পুরানো দিনে তোমার করা কুদরতি কাজের কথা। তোমার সমস্ত কাজের বিষয়ে আমি ধ্যান করব; তোমার সব কাজের কথা ভেবে দেখব। হে আল্লাহ্‌, তোমার চলার পথ পবিত্র; আমাদের আল্লাহ্‌র মত মহান কি কোন দেবতা আছে? তুমিই সেই আল্লাহ্‌ যিনি কুদরতি দেখিয়ে থাকেন; সব জাতির মধ্যে তোমার শক্তির পরিচয় তুমি দিয়েছ। তুমি তোমার বান্দা ইয়াকুব ও ইউসুফের বংশধরদের তোমার শক্ত হাতে মুক্ত করেছ। [সেলা] হে আল্লাহ্‌, সাগরের পানি তোমাকে দেখেছিল; তোমাকে দেখে পানি অস্থির হয়ে উঠল, তার গভীর তলা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মেঘ পানি ঢেলে দিল, আকাশে বাজের গর্জন হল; তোমার বিদ্যুতের তীর এখানে ওখানে চম্‌কাতে লাগল। ঘূর্ণিঝড়ে তোমার বাজের শব্দ শোনা গেল, তোমার বিদ্যুতের ঝলক্‌ দুনিয়া আলোময় করল; দুনিয়া কাঁপল ও টলমল করে উঠল। সাগরের মধ্য দিয়ে তুমি পথ করে দিলে, গভীর পানির মধ্য দিয়ে তুমি পথ করে দিলে, কিন্তু তোমার পায়ের চিহ্ন সেখানে দেখা যায় নি। মূসা ও হারুনকে দিয়ে ভেড়ার পালের মত করে তুমি তোমার বান্দাদের চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। হে আমার জাতির লোকেরা, আমার উপদেশ শোন; আমার মুখের কথায় কান দাও। শিক্ষা-ভরা উদাহরণের মধ্য দিয়ে আমি মুখ খুলব; আমি পুরানো দিনের গভীর বিষয় নিয়ে কথা বলব। এই সব কথা আমরা শুনেছি আর জেনেছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের কাছে বলে গেছেন। তাঁদের বংশধরদের কাছে আমরা তা গোপন রাখব না; আমরা পরের বংশধরদের কাছে মাবুদের গৌরবপূর্ণ কাজের কথা বলব; তাঁর শক্তির কথা আর তিনি যে সব কুদরতি দেখিয়েছেন সেই সব কথা বলব। তিনি ইয়াকুবের বংশের উপর তাঁর হুকুম জারি করেছেন, ইসরাইল জাতির জন্য তাঁর শরীয়ত স্থাপন করেছেন; সেই শরীয়ত তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে তিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের হুকুম দিয়েছেন, যাতে পরের বংশধরেরা, যারা এখনও জন্মগ্রহণ করে নি তারা সেগুলো জানতে পারে আর তাদের সন্তানদের কাছে তা বলতে পারে। তাহলে তারা আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করবে; তাঁর কাজগুলো তারা ভুলে যাবে না বরং তাঁর হুকুমগুলো পালন করবে। এতে তাদের পূর্বপুরুষদের মত তারা একগুঁয়ে ও বিদ্রোহী হবে না; সেই পূর্বপুরুষদের অন্তর আল্লাহ্‌র প্রতি অটল ছিল না আর মনও বিশ্বস্ত ছিল না। আফরাহীমের লোকেরা ধনুকধারী হলেও যুদ্ধের দিনে পিছু হটে গিয়েছিল। তারা আল্লাহ্‌র ব্যবস্থা পালন করে নি, তাঁর শরীয়ত মতে চলতে তারা অস্বীকার করেছিল। তিনি যে কি করেছিলেন তা তারা ভুলে গিয়েছিল, ভুলে গিয়েছিল তাঁর অলৌকিক কাজের কথা যা তিনি তাদের দেখিয়েছিলেন। বনি-ইসরাইলদের পূর্বপুরুষদের চোখের সামনে তিনি অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছিলেন; মিসরে ও সোয়ন এলাকায় তিনি তা দেখিয়েছিলেন। তিনি সাগর দু’ভাগ করে তার মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন; তিনি পানিকে ঢিবির মত করে দাঁড় করিয়েছিলেন। দিনে মেঘ দিয়ে আর সারা রাত আগুনের আলো দিয়ে তিনি তাদের পথ দেখিয়েছিলেন। মরুভূমিতে পাথর ফাটিয়ে মাটির নীচের পানি থেকে তিনি তাদের অনেক খাবার পানি দিলেন। পাহাড়ের মত পাথর থেকে তিনি পানির স্রোত বের করে আনলেন; সেই পানি তিনি নদীর মত করে বইয়ে দিলেন। কিন্তু তারা তাঁর বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করতেই থাকল; আল্লাহ্‌তা’লার বিরুদ্ধে মরুভূমিতে বিদ্রোহ করল। তাদের ইচ্ছামত খাবার দাবি করে মনে মনে তারা আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করল। তারা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে এই কথা বলল, “আল্লাহ্‌ কি মরুভূমিতে খাবার দিয়ে টেবিল সাজাতে পারেন? তিনি পাথরে আঘাত করলেন আর তা থেকে উপ্‌চে পড়া পানির স্রোত বেরিয়ে আসল; তাই বলে কি তিনি আমাদের রুটিও দিতে পারেন? তিনি কি তাঁর বান্দাদের জন্য গোশ্‌ত যোগাতে পারেন?” এ কথা শুনে মাবুদ রাগে জ্বলে উঠলেন। ইয়াকুবের বিরুদ্ধে তাঁর অন্তরে আগুন জ্বলে উঠল, ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাঁর গজব জেগে উঠল; কারণ আল্লাহ্‌র উপরে তারা ঈমান আনে নি; তিনি যে তাদের উদ্ধার করবেন সেই কথায় তারা ভরসা করে নি। তবুও তিনি উপরে আকাশকে হুকুম দিলেন আর আসমানের দরজা খুলে দিলেন। লোকদের খাবার জন্য তিনি বৃষ্টির মত করে মান্না দিলেন, বেহেশতের শস্য তাদের দিলেন। ফেরেশতার খাবার মানুষ খেল; তারা যত খেতে পারে তত খাবার জিনিসই তিনি তাদের পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আকাশ থেকে পূবের বাতাস বহালেন; তিনি নিজের শক্তিতে দক্ষিণের বাতাসকে চালালেন। তিনি ধূলিকণার মত গোশ্‌তের বৃষ্টি দিলেন, সাগর পারের বালুকণার মত পাখীর বৃষ্টি দিলেন। তাদের ছাউনি-এলাকায়, তাদের তাম্বুর চারপাশে তিনি সেগুলোকে পড়তে দিলেন। তারা পেট ভরে তা খেল; তারা যা চেয়েছিল তাদের তিনি তা-ই দিলেন। যে খাবার তারা খেতে চেয়েছিল তা খাওয়া শেষ না হতেই, এমন কি, তা তাদের মুখে থাকতেই আল্লাহ্‌র রাগ তাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠল। তাদের কিছু শক্তিশালী যুবকদের তিনি মেরে ফেললেন; ইসরাইলের সেরা লোকদের তিনি তাঁর অধীনে আনলেন। তবুও তারা গুনাহ্‌ করতেই থাকল, তাঁর কুদরতি দেখেও তাঁর উপর ঈমান আনল না। তাই তিনি তাদের দিনগুলো বিফলতায় শেষ করে দিলেন আর বছরগুলো শেষ করে দিলেন ভয়ের মধ্য দিয়ে। তিনি তাদের মেরে ফেলার পর বাকী লোকেরা তাঁর কথা মনে করল; তারা আবার তাঁর দিকে ফিরে আগ্রহের সংগে তাঁকে ডাকল। তাদের মনে পড়ল আল্লাহ্‌ তাদের আশ্রয়-পাহাড়, আল্লাহ্‌তা’লা তাদের মুক্তিদাতা। কিন্তু তারা তখন মুখ দিয়ে ছলনা করল, জিভ্‌ দিয়ে তাঁর কাছে মিথ্যা কথা বলল। তাদের অন্তর তাঁর প্রতি স্থির ছিল না; তাঁর ব্যবস্থার প্রতি তারা বিশ্বস্ত ছিল না। তবুও তিনি মমতায় পূর্ণ বলে তাদের অন্যায় মাফ করলেন, তাদের ধ্বংস করলেন না; তাঁর রাগ তিনি বার বার দমন করলেন, তাঁর সম্পূর্ণ ক্রোধ জ্বলে উঠল না। তিনি ভেবে দেখলেন তারা মানুষ মাত্র, তারা বয়ে যাওয়া বাতাসের মত যা ফিরে আসে না। মরুভূমিতে কতবার তাঁর বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছে, সেই মরুভূমিতে কতবার তাঁকে দুঃখ দিয়েছে। বার বার তারা আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করেছে, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাককে কষ্ট দিয়েছে। তারা তাঁর শক্তির কথা মনে রাখে নি; মনে রাখে নি সেই দিনের কথা- যেদিন তিনি শত্রুর হাত থেকে তাদের মুক্ত করেছিলেন, যেদিন মিসরে তিনি চিহ্ন দেখিয়েছিলেন আর অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছিলেন সোয়ন এলাকায়। সেদিন তাদের সমস্ত নদীর পানি তিনি রক্ত করে দিয়েছিলেন আর সেই পানি তারা খেতে পারে নি। তাদের মধ্যে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা পাঠালেন, সেগুলো তাদের যেন খেয়ে শেষ করে দিল। তিনি ব্যাঙের দল পাঠিয়ে দিলেন, সেগুলো তাদের সর্বনাশ করল। তাদের শস্য তিনি ফড়িংকে দিলেন আর তাদের ফসল দিলেন পংগপালকে। শিলাবৃষ্টি দিয়ে তাদের আংগুর লতা তিনি নষ্ট করে দিলেন; জমে যাওয়া শিশির দিয়ে ডুমুর গাছ নষ্ট করে দিলেন। তিনি শিলাবৃষ্টির হাতে তাদের গরুর পাল তুলে দিলেন আর বাজ পড়ার হাতে তুলে দিলেন তাদের পশুর পাল। তিনি তাদের বিরুদ্ধে তাঁর জ্বলন্ত উপ্‌চে পড়া ভীষণ রাগ আর দুঃখ-কষ্ট পাঠিয়ে দিলেন; সেগুলো হল ধ্বংসের কাজে নিযুক্ত একদল ফেরেশতা। তাঁর গজব-নাজেল পথের বাধা তিনি দূর করে দিলেন; তিনি মৃত্যু থেকে তাদের রেহাই দেন নি বরং মহামারীর হাতে তাদের তুলে দিলেন। তিনি মিসর দেশের প্রত্যেকটি প্রথম পুরুষ সন্তানকে আঘাত করলেন, আঘাত করলেন হাম-বংশের তাম্বুতে যৌবন শক্তির প্রত্যেকটি প্রথম ফলকে। এর পর তাঁর বান্দাদের তিনি ভেড়ার মত করে বের করে আনলেন, আর মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভেড়ার পালের মত করে তাদের পরিচালনা করলেন। তিনি তাদের নিরাপদে নিয়ে আসলেন, তাদের কোন ভয় হল না; কিন্তু সাগর তাদের শত্রুদের গিলে ফেলল। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর পবিত্র দেশে তাদের নিয়ে আসলেন, নিয়ে আসলেন সেই পাহাড়ী দেশে যে দেশ তাঁর ডান হাতে তিনি দখল করেছিলেন। তাদের সামনে থেকে অন্যান্য জাতিদের তিনি তাড়িয়ে দিলেন, আর সেই জাতিদের জায়গা-জমি তিনি জরীপ করে সম্পত্তি হিসাবে তাদের ভাগ করে দিলেন; তাদের ঘর-দুয়ারে ইসরাইলের গোষ্ঠীদের বাস করালেন। কিন্তু তবুও তারা আল্লাহ্‌তা’লাকে পরীক্ষা করল আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল; তাঁর হুকুম তারা পালন করল না। তাদের পূর্বপুরুষদের মতই তারা ঠিক পথ থেকে সরে গিয়ে বেঈমানী করল; বেয়াড়া ধনুকের মতই তারা বেঁকে রইল। তারা পাহাড়ের উপরকার বেদীগুলো ব্যবহার করে তাঁর রাগ জাগিয়ে তুলল; খোদাই-করা মূর্তি পূজা করে তাঁর পাওনা এবাদতের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলল। এ সব দেখে-শুনে আল্লাহ্‌ রাগ করলেন; তিনি ইসরাইলকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করলেন। শীলোতে তাঁর যে আবাস-তাম্বু ছিল তা তিনি ছেড়ে গেলেন; এটা সেই তাম্বু যা তিনি মানুষের মধ্যে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর কুদরতের চিহ্ন তিনি বন্দীদশায় পাঠালেন; তাঁর মহিমার চিহ্নটি তাঁর শত্রুদের হাতে দিলেন। তাঁর বান্দাদের তিনি শত্রুর তলোয়ারের হাতে তুলে দিলেন; তাঁর নিজের লোকদের উপর তাঁর গজব নাজেল হল। আগুন তাদের যুবকদের পুড়িয়ে ফেলল; তাদের অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য বিয়ের গান হল না। তলোয়ারের আঘাতে তাদের ইমামেরা মারা পড়ল; তাদের বিধবারা শোক প্রকাশ করতে পারল না। b তারপর দীন-দুনিয়ার মালিক যেন ঘুম থেকে জাগলেন; তিনি আংগুর-রসের নেশা কাটিয়ে ওঠা বীরের মত করে জাগলেন। তাঁর শত্রুদের তিনি পিছু হটিয়ে দিলেন; তাদের তিনি স্থায়ী অপমানের মধ্যে ফেললেন। পরে তিনি ইউসুফ-বংশের এলাকা অগ্রাহ্য করলেন, আফরাহীম-গোষ্ঠীর এলাকা বেছে নিলেন না; কিন্তু বেছে নিলেন এহুদা-গোষ্ঠীর এলাকা- সেই সিয়োন পাহাড় যাকে তিনি ভালবাসতেন। সেখানে তাঁর পবিত্র ঘরটি তিনি উঁচু করে তৈরী করলেন, তা ছিল যেন আসমান ছোঁয়া; তিনি তা দুনিয়ার মত স্থায়ীভাবে স্থাপন করলেন। তিনি তাঁর গোলাম দাউদকে বেছে নিলেন, নিলেন তাঁকে ভেড়ার খোঁয়াড় থেকে; তাঁকে দুধ দেওয়া ভেড়ীদের দেখাশোনা করার কাজ থেকে নিয়ে আসলেন, যেন তিনি মালিকের বান্দাদের, অর্থাৎ ইয়াকুবের বংশকে, যারা তাঁর সম্পত্তি সেই ইসরাইল জাতিকে চরাতে পারেন। দাউদ তাঁর দিলের সততা অনুসারে তাদের পালন করলেন; তিনি তাদের বুদ্ধি-বিবেচনার সংগে চালিয়ে নিলেন। হে আল্লাহ্‌, অন্য জাতিরা তোমার সম্পত্তি আক্রমণ করেছে, তারা সেখানে ঢুকে পড়েছে; তোমার পবিত্র ঘরটা তারা নাপাক করেছে; জেরুজালেমকে তারা ধ্বংসের স্তূপ করেছে। তোমার গোলামদের লাশগুলো তারা আকাশের পাখীদের খেতে দিয়েছে; তোমার ভক্তদের লাশের গোশ্‌ত দুনিয়ার পশুদের দিয়েছে। জেরুজালেমের চারদিকে তারা পানির মত করে তাদের রক্ত ঢেলে দিয়েছে; তাদের দাফন করবার কেউ নেই। প্রতিবেশী জাতিদের কাছে আমরা নিন্দার পাত্র হয়েছি, আমাদের চারপাশের লোকদের কাছে হাসি-তামাশার খোরাক হয়েছি। হে মাবুদ, আর কতকাল? তুমি কি চিরকালই রেগে থাকবে? আর কতদিন তোমার পাওনা এবাদত না পাওয়ার জ্বালা আগুনের মত জ্বলতে থাকবে? যারা তোমাকে মেনে নেয় না সেই সব জাতির উপর তোমার গজব নাজেল কর, নাজেল কর সেই সব রাজ্যগুলোর উপর যারা তোমার এবাদত করে না; কারণ তারাই ইয়াকুবের বংশকে যেন শেষ করে ফেলেছে, তার বাসস্থান ধ্বংস করেছে। পূর্বপুরুষদের অন্যায় তুমি আমাদের বিরুদ্ধে ধোরো না; তুমি শীঘ্র তোমার মমতা আমাদের দেখাও, কারণ আমরা সব দিক থেকে কাতর হয়ে পড়েছি। হে আমাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌, তোমার গৌরবের জন্য তুমি আমাদের সাহায্য কর; তোমার সুনাম রক্ষার জন্য আমাদের উদ্ধার কর আর আমাদের গুনাহ্‌ মাফ কর। অন্য জাতিরা কেন বলবে, “কোথায় গেল ওদের আল্লাহ্‌?” তুমি আমাদের সামনেই তাদের জানিয়ে দাও যে, তোমার গোলামদের রক্তপাতের শোধ তুমি নেবেই। বন্দীদের কাত্‌রানি তোমার কানে পৌঁছাক; যাদের উপর মৃত্যুর রায় দেওয়া হয়েছে তোমার মহাশক্তিতে তুমি তাদের বাঁচাও। হে মালিক, আমাদের প্রতিবেশী জাতিরা যেভাবে তোমাকে গাল-মন্দ করেছে, তার সাতগুণ শাস্তি তুমি তাদের ফিরিয়ে দাও। তাহলে আমরা, তোমার বান্দারা, যারা তোমার চারণ ভূমির ভেড়া, চিরকাল তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাব আর বংশের পর বংশ ধরে তোমার প্রশংসা করব। হে ইসরাইলের পালক, তুমি আমাদের কথায় কান দাও; তুমি ইউসুফের বংশকে ভেড়ার পালের মত করে চালিয়ে নি"ছ। তুমি কারুবীদের উপরে আছ, তোমার নূর তুমি ছড়িয়ে দাও। তুমি আফরাহীম, বিন্‌ইয়ামীন ও মানশা-গোষ্ঠীর সামনে তোমার শক্তিকে জাগিয়ে তোল আর আমাদের উদ্ধার করতে এস। হে আল্লাহ্‌, তুমি আগের অবস্থায় আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাও; তোমার রহমত আলোর মত করে আমাদের উপর পড়ুক, আমরা তাতে উদ্ধার পাব। হে মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তোমার বান্দাদের মুনাজাতে আর কতকাল তুমি রেগে থাকবে? খাবার জিনিস হিসাবে তুমি চোখের পানি তাদের খেতে দিয়েছ আর প্রচুর চোখের পানি পান করিয়েছ। তুমি এমন করেছ যাতে প্রতিবেশী জাতিরা আমাদের নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করে। আমাদের শত্রুরা আমাদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি-তামাশার করে। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, আমাদের তুমি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাও; তোমার রহমত আলোর মত করে আমাদের উপর পড়ুক, আমরা তাতে উদ্ধার পাব। তুমি একটা আংগুর লতার মত মিসর দেশ থেকে আমাদের আনলে; অন্যান্য জাতিদের তাড়িয়ে দিয়ে তুমি সেটা লাগালে। তুমি তার জন্য জমি পরিষ্কার করলে; তার শিকড় মাটিতে বসে সারা দেশ ছেয়ে গেল। তার ছায়ায় পাহাড়-পর্বত ঢেকে গেল; তার ডালপালা বড় বড় এরস গাছগুলো ঢেকে ফেলল। সাগর পর্যন্ত সে তার ডালপালা আর ফোরাত নদী পর্যন্ত তার নতুন নতুন ডাল ছড়িয়ে দিল। কেন তার রক্ষা-দেয়াল তুমি ভেংগে দিলে, যার জন্য যারা তার পাশ দিয়ে যায় তারাই তার ফল ছেঁড়ে? বনের শুয়োর এসে তা খেয়ে ফেলে; মাঠের প্রাণীরাও তা খায়। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি ফিরে এস; বেহেশত থেকে তুমি চেয়ে দেখ আর এই আংগুর লতার দেখাশোনা কর, যে চারাগাছকে তুমি নিজের হাতে লাগিয়েছ, যার ডাল তোমার নিজের জন্য তুমি শক্তিশালী করেছ; সেই গাছ আগুনে পুড়ে গেছে, তা কেটে ফেলা হয়েছে; তোমার বান্দারা তোমার বকুনি খেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার বেছে নেওয়া লোকের উপর তুমি হাত রাখ; হাত রাখ সেই মানুষের উপর যাকে তুমি নিজের জন্য শক্তিশালী করেছ। তাহলে আমরা আর তোমার কাছ থেকে ফিরে যাব না; তুমি আবার আমাদের জীবিত করে তোল, আমরা তোমার এবাদত করব। হে মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি আগের অবস্থায় আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাও; তোমার রহমত আলোর মত করে আমাদের উপর পড়ুক, আমরা তাতে উদ্ধার পাব। আল্লাহ্‌, যিনি আমাদের শক্তি, তোমরা তাঁর উদ্দেশে আনন্দের ধ্বনি কর; ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে জয়ের ধ্বনি কর। কাওয়ালী শুরু কর, খঞ্জনি বাজাও; বাজাও মধুর বীণা আর সুরবাহার। আমাদের ঈদের দিন অমাবস্যায় আর পূর্ণিমায় শিংগা বাজাও; ওটাই ইসরাইলের নিয়ম, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র আইন। যখন তিনি শাস্তি দেবার জন্য মিসর দেশের বিরুদ্ধে বের হলেন তখন ইউসুফ-বংশের জন্য তিনি এই ঈদ সাক্ষ্য হিসাবে স্থাপন করলেন। আমি এমন একটা বাণী শুনলাম যা আগে বুঝি নি। মাবুদ বললেন, “আমি তার কাঁধ থেকে বোঝা সরিয়ে দিলাম; ঝুড়ি বওয়া থেকে সে রেহাই পেল। বিপদে পড়ে তুমি আমাকে ডাকলে আর আমি তোমাকে উদ্ধার করলাম; বাজ পড়ার শব্দের আড়াল থেকে আমি তোমাকে জবাব দিলাম; মরীবার পানির কাছে আমি তোমাকে পরীক্ষায় ফেললাম। [সেলা] হে আমার বান্দারা, তোমরা আমার সাবধান বাণী শোন; হে বনি-ইসরাইলরা, আমার একান্ত ইচ্ছা যে, তোমরা আমার কথায় কান দাও। কোন দেব-দেবী তোমাদের না থাকুক; অন্য কোন জাতির দেবতারও যেন তোমরা পূজা না কর। আমিই আল্লাহ্‌, তোমাদের মাবুদ; আমিই মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। তোমরা বড় করে মুখ খোল, আমি তা ভরে দেব। কিন্তু আমার বান্দারা আমার কথায় কান দিল না; ইসরাইল আমার বাধ্য হতে রাজী হল না। সেইজন্য আমি তাদের একগুঁয়ে দিলের হাতেই ফেলে রাখলাম, যাতে তারা নিজেদের ইচ্ছামত চলে। হায়, যদি আমার বান্দারা কেবল আমার বাধ্য থাকত, যদি ইসরাইল আমার পথে চলত, তবে শীঘ্রই আমি তাদের শত্রুদের দমন করতাম, তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমার হাত তুলতাম। “শত্রুরা আমার সামনে নত হতে বাধ্য হবে, তাদের শাস্তি হবে চিরকাল স্থায়ী। কিন্তু ইসরাইলকে আমি সবচেয়ে ভাল গম খেতে দেব; সত্যিই আমি তাদের তৃপ্ত করব সেই মধু দিয়ে যা পাহাড়ের ফাটলে পাওয়া যায়।” আল্লাহ্‌ তাঁর বিচার-সভার মধ্যে দাঁড়িয়েছেন; তিনি শাসনকর্তাদের মাঝখানে থেকে তাদের বিচার করে হুকুম দিচ্ছেন: “আর কতকাল তোমরা অন্যায়ের শাসন চালাবে? কতকাল দুষ্টদের পক্ষে থাকবে? [সেলা] তোমরা গরীব ও এতিমদের প্রতি ন্যায়বিচার কর, দুঃখী ও অভাবীদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা কর, গরীব ও কাংগালদের বাঁচাও; দুষ্টদের হাত থেকে তাদের রক্ষা কর।” শাসনকর্তাদের জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি বলে কিছু নেই, তারা অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে; দুনিয়া-সংসারের সব ভিত্তি টলমল করছে। আমি বলেছিলাম, “তোমরা যেন আল্লাহ্‌, তোমরা সবাই আল্লাহ্‌তা’লার সন্তান। কিন্তু তবুও তোমরা মানুষের মতই মরবে; অন্যান্য শাসনকর্তাদের মতই তোমাদের পতন হবে।” হে আল্লাহ্‌, তুমি ওঠো, দুনিয়ার বিচার কর, কারণ সমস্ত জাতিই তোমার অধিকারে আছে। হে আল্লাহ্‌, তুমি চুপ করে বসে থেকো না; হে আল্লাহ্‌, তুমি মুখ বন্ধ করে রেখো না, সাড়া দাও। দেখ, কেমন করে তোমার শত্রুরা গর্জন করছে আর যারা তোমাকে ঘৃণা করে তারা গর্বের সংগে মাথা উঁচু করেছে। তোমার বান্দাদের বিরুদ্ধে তারা পরামর্শ করছে, তুমি যাদের রক্ষা করছ তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলছে, “চল, আমরা জাতি হিসাবে ওদের শেষ করে দিই, যেন ইসরাইলের নাম আর কারও মনে না থাকে।” তারা এক হয়ে ষড়যন্ত্র করছে; যারা তোমার বিরুদ্ধে চুক্তি করেছে তারা হল- তাম্বুবাসী ইদোমীয়রা, ইসমাইলীয়রা, মোয়াবীয়রা ও হাজেরীয়রা, গবালীয়রা, অম্মোনীয়রা, আমালেকীয়রা আর টায়ার-বাসীদের সংগে ফিলিস্তিনীরা; এমন কি, আশেরিয়রাও তাদের সংগে যোগ দিয়েছে আর লুতের বংশধরদের ডান হাত হয়েছে। [সেলা] তুমি মাদিয়ানীয়দের প্রতি যা করেছিলে, কীশোন নদীর ধারে সীষরা আর যাবীনের প্রতি যা করেছিলে, এদের প্রতি তা-ই কর। সীষরা আর যাবীন ঐন্‌দোরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; তারা জমির উপরে গোবরের মত পড়ে ছিল। তাদের উঁচু পদের লোকদের দশা তুমি ওরেব ও সেবের মত কর; তাদের সব শাসনকর্তাদের দশা সেবহ ও সল্‌মুন্নের মত কর। ঐ সব শত্রুরা বলেছিল, “এস, আমরা আল্লাহ্‌র দেওয়া দেশটা দখল করে নিই।” হে আমার আল্লাহ্‌, তুমি তাদের বাতাসে উড়ে যাওয়া শুকনা গাছের মত কর, বাতাসের মুখে তুষের মত কর। বনে আগুন লাগলে যেমন গাছের পর গাছ পুড়িয়ে দেয় আর আগুনের শিখা পাহাড়ের পর পাহাড় জ্বালিয়ে দেয়, তেমনি করে তোমার ঝড় দিয়ে তুমি তাদের তাড়া কর; তোমার ভয়ংকর ঝড় দিয়ে ভীষণ ভয় ধরিয়ে দাও। তুমি লজ্জা দিয়ে তাদের মুখ ঢেকে দাও, যাতে হে মাবুদ, তারা তোমাকে ডাকে। তারা চিরকালের জন্য লজ্জিত হোক ও ভীষণ ভয় পাক; তারা অসম্মানের সংগে ধ্বংস হয়ে যাক। তারা যেন জানতে পারে যে, তোমার নাম মাবুদ, হ্যাঁ, কেবল তুমিই সারা দুনিয়ার আল্লাহ্‌তা’লা। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, কি সুন্দর তোমার বাসস্থান! আমার প্রাণ মাবুদের ঘরের উঠানগুলো দেখবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে, আর সেজন্য আমার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাচ্ছে; জীবন্ত আল্লাহ্‌র জন্য আমার দেহ ও মন আনন্দে চিৎকার করছে। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, আমার বাদশাহ্‌, আমার মাবুদ, তোমার কোরবানগাহের কাছে চড়াই পাখী ঘর পেয়েছে, খঞ্জন পাখীও বাচ্চা রাখবার বাসা পেয়েছে। ধন্য তারা, যারা তোমার ঘরে থাকে; তারা সব সময় তোমার প্রশংসা করে। [সেলা] ধন্য তারা, যারা তোমার কাছ থেকে শক্তি পায়। ধন্য তারা, যাদের অন্তরে সিয়োনে যাবার পথের চিন্তা রয়েছে। বাকা-উপত্যকার মধ্য দিয়ে যাবার সময় তারা জায়গাটাকে ঝর্ণার স্থান করে তোলে; প্রথম বর্ষার বৃষ্টি সেই জায়গাটাকে দোয়ায় ভরে দেয়। যাওয়ার পথে তারা শক্তির উপরে শক্তি পায়; তারা প্রত্যেকে সিয়োনে আল্লাহ্‌র সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। হে মাবুদ, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, আমার মুনাজাত শোন; হে ইয়াকুবের আল্লাহ্‌, আমার কথায় কান দাও। [সেলা] হে আল্লাহ্‌, আমাদের ঢালকে দেখ; তোমার এই অভিষিক্ত বান্দার উপর তোমার দয়ার চোখ রাখ। অন্য জায়গায় হাজার দিন কাটানোর চেয়ে তোমার ঘরের উঠানগুলোতে একটা দিন কাটানো অনেক ভাল; দুষ্ট লোকদের তাম্বুর মধ্যে বাস করার চেয়ে বরং আমার আল্লাহ্‌র ঘরের দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভাল। সত্যি মাবুদ আল্লাহ্‌ই সূর্য ও ঢালের মত; তিনি রহমত ও গৌরব দান করেন। যারা সৎ ভাবে চলে তাদের কোন ভাল জিনিস দিতে তিনি অস্বীকার করেন না। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, ধন্য সে, যে তোমার উপর ভরসা করে। হে মাবুদ, তোমার দেশের প্রতি তুমি রহমত দেখিয়েছ; তুমি ইয়াকুবকে তার বন্দীদশা থেকে ফিরিয়ে এনেছ। তোমার বান্দাদের অন্যায় তুমি মাফ করেছ; তুমি তাদের সব গুনাহ্‌ ঢেকে দিয়েছ। [সেলা] তোমার সমস্ত উপ্‌চে পড়া রাগ তুমি দূর করে দিয়েছ আর তোমার জ্বলন্ত গজব থেকে ফিরেছ। হে আমাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌, তুমি আমাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আন; আমাদের প্রতি তোমার রাগ তুমি থামাও। চিরকাল কি তুমি আমাদের উপর তোমার রাগ বজায় রাখবে? বংশের পর বংশ ধরে কি তুমি রাগ করেই থাকবে? তোমার বান্দারা যাতে তোমাকে নিয়েই আনন্দিত হতে পারে সেজন্য কি তুমি তাদের আবার জীবিত করে তুলবে না? হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত তুমি আমাদের দেখাও আর আমাদের উদ্ধার কর। মাবুদ আল্লাহ্‌ যা বলবেন আমি তা শুনব; তাঁর বান্দাদের কাছে, তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি শান্তির কথা বলবেন; কিন্তু তারা যেন আর বোকামির দিকে না ফেরে। যারা তাঁকে ভয় করে সত্যিই তাঁর উদ্ধার করার সময় তাদের কাছে এসে গেছে; এতে তাঁর মহিমা আমাদের দেশে বাস করবে। অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার মিলন ঘটবে; ন্যায় এবং শান্তি একে অন্যকে চুম্বন করবে। দেশের মাটি থেকে বিশ্বস্ততা গজিয়ে উঠবে; বেহেশত থেকে ন্যায় নীচে তাকিয়ে দেখবে। যা ভাল মাবুদ সত্যিই তা দেবেন, আর আমাদের দেশ ফসল দান করবে। ন্যায় তাঁর আগে আগে চলবে; সে তাঁরই পায়ের চিহ্নে চলার পথ গড়ে দেবে। হে মাবুদ, আমার কথায় কান দাও আর আমাকে জবাব দাও, কারণ আমি দুঃখী আর অভাবী। আমার প্রাণ বাঁচাও, কারণ আমি তোমার ভক্ত; হে আমার আল্লাহ্‌, যে গোলাম তোমার উপর ভরসা করছে তাকে তুমি রক্ষা কর। হে মালিক, আমার প্রতি রহমত কর, কারণ আমি সারা দিন তোমাকেই ডাকি। তোমার গোলামের মনে আনন্দ দাও, কারণ হে মালিক, আমার অন্তর আমি তোমার দিকেই তুলে ধরছি। হে মালিক, তুমি মেহেরবান ও মাফদানকারী; যারা তোমাকে ডাকে তাদের প্রতি তুমি মহব্বতে ভরপুর। হে মাবুদ, আমার মুনাজাতে কান দাও; আমার মিনতির কান্না তুমি শোন। বিপদের দিনে আমি তোমাকে ডাকব, কারণ তুমি আমাকে জবাব দেবে। হে মালিক, দেবতাদের মধ্যে তোমার মত কেউ নেই; তোমার কাজের সংগে অন্য কোন কাজের তুলনা হয় না। হে মালিক, তোমার সৃষ্ট সমস্ত জাতি এসে তোমার সামনে সেজদা করবে; তারা তোমার গুণগান করবে। তুমি মহান আর অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়ে থাক; একমাত্র তুমিই আল্লাহ্‌। হে মাবুদ, তোমার পথ সম্বন্ধে আমাকে শিক্ষা দাও, যাতে আমি তোমার সত্যে চলতে পারি; তোমাকে ভয় করার জন্য আমার দোটানা অন্তরকে তুমি এক কর। হে আল্লাহ্‌, আমার মালিক, আমি সমস্ত দিল দিয়ে তোমার প্রশংসা করব; চিরকাল তোমার গুণগান করব। আমার প্রতি তোমার অটল মহব্বতের সীমা নেই; কবরের সবচেয়ে নীচু জায়গা থেকে তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। হে আল্লাহ্‌, অহংকারীরা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে; জুলুমবাজের দল আমার প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে। তোমার প্রতি সেই লোকদের কোন ভয় নেই। কিন্তু হে মালিক, তুমি মমতায় পূর্ণ দয়াময় আল্লাহ্‌; তুমি সহজে রেগে উঠ না, তোমার অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার সীমা নেই। তুমি আমার দিকে ফেরো এবং আমাকে দয়া কর; তোমার গোলামকে তোমার শক্তি দান কর; তোমার বাঁদীর ছেলেকে রক্ষা কর। তোমার মেহেরবানীর ইচ্ছার প্রমাণ আমাকে দেখাও, যাতে আমাকে যারা ঘৃণা করে তারা তা দেখে লজ্জা পায়; কারণ হে মাবুদ, তুমিই আমাকে সাহায্য করেছ আর সান্ত্বনা দিয়েছ। মাবুদ পবিত্র পাহাড়শ্রেণীর উপরে তাঁর শহর স্থাপন করেছেন। ইয়াকুব-বংশের অন্য সব বাসস্থানের চেয়ে তিনি সিয়োনের দরজাগুলো ভালবাসেন। হে আল্লাহ্‌র শহর, তোমার সম্বন্ধে অনেক গৌরবের কথা বলা হয়েছে। [সেলা] মাবুদ বলছেন, “যারা আমাকে সত্যিই জানে তাদের বিষয় বলার সময় আমি রহব ও ব্যাবিলনের কথা বলব, আর ঐ যে ফিলিস্তীন, টায়ার ও ইথিওপিয়া, তাদের কথাও বলব, ‘এরা প্রত্যেকেই যেন সিয়োনে জন্মেছে।’ ” আর সিয়োনের ব্যাপারে বলা হবে, “বিভিন্ন জাতির লোক তার মধ্যে জন্মেছে; আল্লাহ্‌তা’লা নিজেই সিয়োনকে তুলে ধরবেন।” মাবুদ জাতির তালিকা করার সময় এই কথা বলবেন, “এ সিয়োনে জন্মেছে।” [সেলা] যারা গাইবে ও যারা নাচবে তারা বলবে, “আমার সব আনন্দের ঝর্ণা তোমারই মধ্যে রয়েছে।” হে আল্লাহ্‌, আমার উদ্ধারকর্তা মাবুদ, আমি দিনরাত তোমার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি। তোমার সামনে আমার মুনাজাত উপস্থিত হোক; তুমি আমার ফরিয়াদ শোন; কারণ আমার অন্তর দুঃখে ভরা; আমার প্রাণ প্রায় কবরের কাছে চলে গেছে। যারা কবরে যাবে তাদের মধ্যেই আমাকে ধরা হয়েছে; শক্তিশালী হয়েও যে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে আমি তারই মত হয়েছি। আমাকে যেন মৃতদের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে; আমি মেরে ফেলা, কবরে শুয়ে থাকা লোকদের মতই হয়েছি, যাদের কথা তুমি আর মনেও কর না, যারা তোমার সাহায্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তুমি আমাকে কবরের সবচেয়ে নীচু জায়গায় রেখেছ, রেখেছ অন্ধকারময় গভীর জায়গায়। তোমার রাগ আমার উপরে চেপে বসে আছে; তোমার সমস্ত গজবের ঢেউ দিয়ে তুমি আমাকে তলিয়ে দিচ্ছ। [সেলা] আমার নিজের লোকদের আমার কাছ থেকে তুমি সরিয়ে নিয়েছ; তাদের কাছে তুমি আমাকে ঘৃণার জিনিস করে তুলেছ। আমি আট্‌কা পড়ে গেছি, বেরিয়ে আসতে পারছি না; দুঃখ-কষ্টে চোখ আমার ঝাপ্‌সা হয়ে গেছে। হে মাবুদ, প্রতিদিন আমি তোমাকে ডাকি; আমি তোমার দিকে আমার হাত বাড়িয়ে রেখেছি। যারা মারা গেছে, তাদের জন্য কি তুমি কুদরতি দেখাও? মৃতেরা উঠে কি তোমার প্রশংসা করবে? [সেলা] কবরের মধ্যে কি তোমার অটল মহব্বত আর দোজখে কি তোমার বিশ্বস্ততার কথা প্রচার করা হবে? অন্ধকার স্থানে কি তোমার কুদরতি বুঝা যাবে? যে দেশের লোকদের লোকে ভুলে যায় সেখানে কি তোমার ন্যায় কাজ বুঝা যাবে? হে মাবুদ, আমি, আমি তোমার কাছে সাহায্যের জন্য কাঁদি; সকাল বেলায় তোমার কাছে আমার মুনাজাত পৌঁছায়। হে মাবুদ, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করছ? তোমার মুখ আমার কাছ থেকে কেন লুকিয়ে রাখছ? ছেলেবেলা থেকেই আমি দুঃখের মধ্যে পড়ে আছি আর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আছি। তোমার ভয়ানক শাস্তি আমার উপর নেমে আসছে; আমি বড়ই অসহায়। তোমার ভয়ংকর রাগ আমার উপর দিয়ে বয়ে গেছে; তোমার ভয়-জাগানো আঘাত আমাকে শেষ করে দিয়েছে। সেগুলো পানির মত করে সারা দিন আমাকে ঘিরে রেখেছে, আমাকে সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিয়েছে। আমার সংগী যারা, প্রিয় যারা, তাদের তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছ; এখন অন্ধকারই আমার বন্ধু। আমি চিরকাল মাবুদের অটল মহব্বতের কাওয়ালী গাইব; বংশের পর বংশ ধরে সকলের সামনে তোমার বিশ্বস্ততার কথা জানাব। আমি ঘোষণা করব যে, তোমার মহব্বতের কাজ চিরকাল ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে; তোমার বিশ্বস্ততা বেহেশতেই তুমি স্থাপন করছ। তুমি বলেছ, “আমার বাছাই করা বান্দার জন্য আমি একটা ব্যবস্থা স্থাপন করেছি; আমার গোলাম দাউদের কাছে আমি এই কসম খেয়েছি, ‘তোমার বংশকে আমি চিরকালের জন্য স্থাপন করব; বংশের পর বংশ ধরে তোমার সিংহাসন স্থির রাখব।’ ” [সেলা] হে মাবুদ, বেহেশতের সব কিছু তোমার সুন্দর মহান কাজের গুণগান করে, পবিত্র ফেরেশতাদের মধ্যে তোমার বিশ্বস্ততার প্রশংসা করে। বেহেশতের মধ্যে এমন কে আছে যাকে মাবুদের সংগে তুলনা করা যায়? ফেরেশতাদের মধ্যে কে মাবুদের সমান? পবিত্র ফেরেশতাদের সভায় সকলে আল্লাহ্‌কে ভয় করে; তাঁর চারপাশের সকলের চেয়ে তিনিই বেশী ভয় জাগান। হে মাবুদ, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, কে আছে তোমার মত শক্তিমান, হে মাবুদ? তোমার বিশ্বস্ততা তোমাকে ঘিরে রয়েছে। ফুলে ওঠা সাগরের ঢেউ তোমার শাসনে থাকে; তার ঢেউ উঠলে তাকে তুমিই শান্ত কর। তুমি রহবকে চুরমার করে মেরে ফেলা লোকের মত করেছ; তোমার শক্তিশালী হাতে তোমার শত্রুদের তুমি ছড়িয়ে দিয়েছ। আসমান তোমার, জমীনও তোমার; এই দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব কিছু তুমিই স্থাপন করেছ। উত্তর ও দক্ষিণ তোমারই সৃষ্টি; তাবোর ও হর্মোণ পাহাড় তোমাকে নিয়ে আনন্দের কাওয়ালী গায়। তোমার হাত ক্ষমতায় ভরা; তোমার হাতে রয়েছে শক্তি, তোমার ডান হাতের শক্তির তুলনা নেই। সততা ও ন্যায়বিচারের উপর তোমার সিংহাসন দাঁড়িয়ে আছে; মহব্বত ও বিশ্বস্ততা তোমার আগে আগে চলে। ধন্য সেই লোকেরা, যারা সেই আনন্দের ধ্বনি চেনে; হে মাবুদ, তারা তোমার দয়ার দৃষ্টির নূরে চলাফেরা করে। সারা দিন ধরে তোমাকে ঘিরেই তাদের আনন্দ; তোমার সততা তাদের উঁচুতে তোলে। তুমিই তো তাদের শক্তির সৌন্দর্য; তোমার রহমতই আমাদের শক্তির শিং উঁচুতে তোলে। আমাদের বাদশাহ্‌কে ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক নিযুক্ত করেছেন; আমাদের সেই ঢাল মাবুদেরই নিযুক্ত। একবার তুমি দর্শনে তোমার ভক্তদের বলেছিলে, “আমি এক বীরকে সাহায্য করেছি; লোকদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিয়ে উঁচুতে তুলেছি। আমার গোলাম দাউদকে আমি খুঁজে পেয়েছি; আমার পবিত্র তেল দিয়ে তাকে অভিষেক করেছি। আমার শক্তিশালী হাত তার সংগে থাকবে; আমার হাতই তাকে শক্তি দান করবে। কোন শত্রু তার উপরে উঠতে পারবে না; কোন দুষ্ট লোক তাকে জুলুম করতে পারবে না। তার সামনেই আমি তার বিপক্ষদের চুরমার করে ফেলব আর যারা তাকে ঘৃণা করে তাদের আঘাত করব। আমার বিশ্বস্ততা ও অটল মহব্বত তার সংগে থাকবে; আমার নামেই তার শক্তির শিং উঁচুতে উঠবে। আমি সাগরের উপরে আর নদীর উপরে তাকে ক্ষমতা দেব। সে আমাকে ডেকে বলবে, ‘তুমিই আমার পিতা, আমার আল্লাহ্‌, আমার রক্ষাকারী পাহাড়।’ আমিও তাকে আমার প্রথম সন্তান করব; দুনিয়ার বাদশাহ্‌দের মধ্যে তাকে প্রধান করব। চিরকাল তার প্রতি আমার মহব্বত থাকবে; তারই জন্য আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা অটল থাকবে। আমি তার বংশকে চিরকাল স্থায়ী করব; যতদিন আসমান থাকবে তার সিংহাসনও ততদিন থাকবে। তার ছেলেরা যদি আমার নির্দেশ থেকে দূরে সরে যায় আর আমার শরীয়ত মেনে না চলে, যদি তারা আমার নিয়ম অমান্য করে আর আমার হুকুম পালন না করে, তবে বেত মেরে আমি তাদের গুনাহের শাস্তি দেব, তাদের অন্যায়ের শাস্তি দেব। কিন্তু আমার অটল মহব্বত আমি তার উপর থেকে তুলে নেব না; আমার বিশ্বস্ততা মিথ্যা হতে দেব না। আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা আমি বাতিল করব না; আমার মুখ যা বলেছে তা বদলাব না। আমার পবিত্রতার কসম খেয়ে আমি একবারই বলে রেখেছি- আমি দাউদের কাছে কখনও মিথ্যা বলব না; তার বংশ চিরকাল থাকবে; তার সিংহাসন আমার সামনে সূর্যের মত টিকে থাকবে। আসমানের বিশ্বস্ত সাক্ষী চাঁদের মত তা চিরকালের জন্য স্থাপন করা হবে।” [সেলা] কিন্তু তুমিই ত্যাগ করেছ, পায়ে ঠেলেছ; তোমার অভিষিক্ত বান্দার প্রতি তুমি রেগে গিয়েছ। তোমার গোলামের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছ তা তুমি পায়ে মাড়িয়েছ; তাঁর তাজ তুমি মাটিতে ফেলে নাপাক করেছ। তাঁর রক্ষা-দেয়াল তুমি ভেংগে দিয়েছ; তাঁর সব কেল্লা ধ্বংস করেছ। যারা তাঁর দেশের পাশ দিয়ে যায় তারা তাঁর সব কিছু লুট করে; তাঁর প্রতিবেশী জাতিদের কাছে তিনি নিন্দার পাত্র হয়েছেন। তুমি তাঁর বিপক্ষদের শক্তিশালী করেছ; তাঁর শত্রুদের আনন্দিত করেছ। তুমি তাঁর তলোয়ার অকেজো করে দিয়েছ; তুমি যুদ্ধে তাঁকে টিকতে দাও নি। তাঁর জাঁকজমক তুমি শেষ করে দিয়েছ; তাঁর সিংহাসন মাটিতে ফেলেছ। তাঁর যৌবনের দিনগুলো তুমি কমিয়ে দিয়েছ, লজ্জা দিয়ে তাঁকে ঢেকে দিয়েছ। [সেলা] হে মাবুদ, আর কতকাল? চিরকালই কি তুমি নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? আর কতকাল তোমার রাগ আগুনের মত জ্বলবে? ভেবে দেখ আমার জীবনকাল কত ছোট; কি অসারতার জন্যই না তুমি মানুষকে সৃষ্টি করেছ! কে সেই শক্তিশালী মানুষ, যে বেঁচেই থাকবে, মরবে না? এমন কে আছে, যে কবরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? [সেলা] হে মালিক, কোথায় তোমার সেই আগেকার অটল মহব্বত? তোমার বিশ্বস্ততার দরুন সেই মহব্বতের কসম তুমি দাউদের কাছে খেয়েছিলে। হে মালিক, তোমার গোলামদের যে অপমান করা হয়েছে তা তুমি মনে করে দেখ; মনে করে দেখ, অন্যান্য জাতির করা সেই অপমান কেমন করে আমি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি। হে মাবুদ, তোমার শত্রুরা সেই অপমান করেছে; অপমান করেছে তোমার অভিষিক্ত বান্দাকে তাঁর প্রতিটি ব্যাপারে। চিরকাল আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমিন, আমিন। হে মালিক, বংশের পর বংশ ধরে তুমিই আমাদের বাসস্থান। যখন পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি হয় নি, জগৎ ও দুনিয়ার সৃষ্টি হয় নি, তার আগে থেকেই আখেরাত পর্যন্ত তুমিই আল্লাহ্‌। মানুষকে তুমি ধূলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাও; তুমি বলে থাক, “হে মানুষের সন্তানেরা, তোমরা আবার ধূলিতে ফিরে যাও।” তোমার চোখে হাজার বছর যেন চলে যাওয়া গতকাল, যেন রাতের একটা প্রহর মাত্র। তুমি মানুষকে যেন বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছ, তারা স্বপ্নের মত; তারা যেন সকাল বেলার ঘাস, নতুন করে বেড়ে ওঠা ঘাস। সকালে তা গজিয়ে উঠে বেড়ে উঠতে থাকে; সন্ধ্যায় তা শুকিয়ে শেষ হয়ে যায়। তোমার গজবে আমরা শেষ হয়ে যাই; তোমার জ্বলন্ত রাগে ভীষণ ভয় পাই। আমাদের অন্যায় তুমি তোমার সামনে রেখে থাক; তোমার উপস্থিতির নূরে আমাদের গোপন গুনাহ্‌ প্রকাশ পায়। তোমার ভীষণ রাগের নীচে আমাদের দিন কেটে যায়; নিঃশ্বাসের মতই আমাদের বছরগুলো শেষ হয়ে যায়। আমাদের আয়ু মাত্র সত্তর বছর, শক্তি থাকলে আশি বছরও হয়; আমাদের আয়ু যতই হোক না কেন তাতে থাকে কেবল দুঃখ আর কষ্ট; বছর চলে যায় চোখের পলকে আর আমরাও শেষ হয়ে যাই। তোমার রাগের শক্তি কে বুঝতে পারে? কতজনের অন্তরে তোমার পাওনা ভয় আছে, যাতে তারা তোমার ক্রোধ বুঝতে পারে? তাহলে তুমি আমাদের বুঝতে দাও যে, আমাদের আয়ু কত অল্প, যাতে আমাদের অন্তর জ্ঞানে ভরে ওঠে। হে মাবুদ, আর কতকাল? এবার তুমি ফেরো, তোমার গোলামদের প্রতি মমতা দেখাও। নতুন করে তোমার অটল মহব্বত দিয়ে আমাদের তৃপ্ত কর, যেন আমরা আনন্দে কাওয়ালী গাইতে পারি আর খুশীতে জীবন কাটাতে পারি। যতকাল ধরে তুমি আমাদের অহংকার ভেংগে দেবার কাজ করেছ, যত বছর আমরা কষ্টের মধ্যে ছিলাম, ততকাল তুমি আমাদের সুখে রাখ। তোমার গোলামদের কাছে তোমার কাজ আর তাদের সন্তানদের কাছে তোমার গৌরব তুমি প্রকাশ কর। আমাদের আল্লাহ্‌ মালিকের রহমত আমাদের উপরে থাকুক; আমাদের সব কাজ তুমি সফল কর, হ্যাঁ, আমাদের সব কাজে তুমি সফলতা দান কর। আল্লাহ্‌তা’লার আশ্রয়ে যে বাস করে সে সর্বশক্তিমানের ছায়ায় থাকে। মাবুদের সম্বন্ধে আমি এই কথা বলব, “তিনিই আমার আশ্রয় ও আমার কেল্লা; তিনিই আমার আল্লাহ্‌ যাঁর উপরে আমি ভরসা করি।” তিনি তোমাকে শিকারীদের ফাঁদ থেকে আর সর্বনাশা মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করবেন। তাঁর পালখে তিনি তোমাকে ঢেকে রাখবেন, তাঁর ডানার নীচে তুমি আশ্রয় পাবে; তাঁর বিশ্বস্ততা তোমার ঢাল ও দেহ-রক্ষাকারী বর্ম হবে। রাতের বিপদ আর দিনের হামলাকে তুমি ভয় করবে না; ভয় করবে না অন্ধকারের চলমান মহামারীকে কিংবা দুপুরের ধ্বংসকারী আঘাতকে। হয়তো তোমার একদিকে পড়বে হাজার খানেক, আর হাজার দশেক পড়বে অন্য দিকে, কিন্তু এ সব তোমার কাছেই আসবে না। দুষ্ট লোকেরা কেমন পাওনা পায় তুমি কেবল তা চোখে দেখবে। “হে মাবুদ, তুমিই আমার আশ্রয়স্থান।” তুমি স্থির করেছ আল্লাহ্‌তা’লা তোমার বাসস্থান; সেজন্য তোমার কোন সর্বনাশ হবে না, তোমার বাড়ীর উপর কোন আঘাত পড়বে না; কারণ তিনি তাঁর দূতদের তোমার বিষয়ে হুকুম দেবেন যেন সব অবস্থায় তাঁরা তোমাকে রক্ষা করেন। তাঁরা হাত দিয়ে তোমাকে ধরে ফেলবেন যাতে তোমার পায়ে পাথরের আঘাত না লাগে। তুমি সিংহ আর কেউটে সাপের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে, যুব সিংহ ও সাপকে পায়ে দলে যাবে। মাবুদ বলছেন, “মহব্বত দিয়ে যে আমাকে আঁকড়ে ধরেছে, তাকে আমি রক্ষা করব; আমি তাকে বিপদের নাগালের বাইরে রাখব, কারণ সে আমাকে সত্যিই চিনেছে। সে আমাকে ডাকলে আমি তাকে সাড়া দেব; বিপদের সময় আমি তার সংগে থাকব; তাকে আমি রক্ষা করব আর সম্মানের স্থান দেব। অনেক আয়ু দিয়ে আমি তাকে খুশী করব; আমার উদ্ধারের কাজ আমি তাকে দেখাব।” হে মাবুদ, তোমার কাজ আমাকে আনন্দিত করেছে; তোমার সব কাজের জন্য আমি আনন্দে কাওয়ালী গাইব। হে মাবুদ, তোমার সব কাজ কেমন মহৎ আর তোমার চিন্তা কত গভীর! যার অন্তর অসাড় সে তা জানে না; যার মধ্যে বিবেচনা নেই সে তা বুঝতে পারে না। দুষ্ট লোকেরা যদিও ঘাসের মত বেড়ে ওঠে আর অন্যায়কারীরা ফেঁপে ওঠে তাড়াতাড়ি, তবুও তারা চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু হে মাবুদ, তুমি চিরকাল সবার উপরে থাকবে। হে মাবুদ, তোমার শত্রুরা ধ্বংস হয়ে যাবে, হ্যাঁ, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে; অন্যায়কারীরা সবাই ছড়িয়ে পড়বে। বুনো ষাঁড়ের উঁচু শিংয়ের মত তুমি আমার মাথা উঁচুতে তুলে ধরেছ; আনন্দে আমার উপর নতুন তেল ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আমার শত্রুদের পরাজয় আমি নিজের চোখেই দেখেছি; যারা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেই দুষ্ট লোকদের কান্না আমি নিজের কানে শুনেছি। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক খেজুর গাছের মত ফুলে-ফলে ভরে উঠবে; সে লেবাননের এরস গাছের মত বেড়ে উঠবে। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাড়ীতে যাদের লাগানো হয়েছে তারা তাঁরই উঠানে বেড়ে উঠবে। শেষ বয়সেও তারা ফল দেবে; তারা সরস ও তাজা হবে। তাতে প্রচারিত হবে, মাবুদ ন্যায়বান; তিনিই আমার শক্তি, তাঁর মধ্যে কোন অন্যায় নেই। মাবুদই বাদশাহ্‌; তিনি মহিমার রাজপোশাক পরেছেন, তিনি শক্তিতে কোমর বেঁধেছেন; দুনিয়া অটলভাবে স্থাপিত হয়েছে, তা কখনও নড়বে না। প্রথম থেকেই তোমার সিংহাসন অটল; তুমি চিরকাল আছ। হে মাবুদ, বন্যার পানিতে গর্জন উঠেছে, সেই পানি গর্জন করছে; ফুলে ওঠা ঢেউগুলো ভেংগে পড়ছে। বন্যার পানির গর্জনের চেয়ে, সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের চেয়ে মাবুদ শক্তিমান, যিনি উপরে আছেন। তোমার সব কালাম নির্ভরযোগ্য; হে মাবুদ, তোমার ঘর পবিত্রতার সাজে চিরকাল সাজানো। হে মাবুদ, অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকারী আল্লাহ্‌, হে অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকারী আল্লাহ্‌, তোমার নূর প্রকাশিত হোক। হে দুনিয়ার বিচারকর্তা, তুমি ওঠো; অহংকারীদের যা পাওনা তা তুমি তাদের দাও। আর কতকাল, হে মাবুদ, আর কতকাল দুষ্ট লোকেরা আনন্দে মেতে থাকার সুযোগ পাবে? তাদের মুখ থেকে কেবল দেমাক-ভরা কথার স্রোত বের হয়ে আসে; সেই অন্যায়কারীর দল বড়াই করে বেড়ায়। হে মাবুদ, তারা তোমার বান্দাদের দলে-পিষে মারছে; যারা তোমার নিজের সম্পত্তি তাদের উপর তারা জুলুম করছে। বিধবা আর বিদেশীদের তারা হত্যা করছে আর এতিমদের খুন করছে। তারা বলছে, “এদিকে মাবুদের চোখ নেই; ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ খেয়াল করেন না।” অসাড় দিলের লোকেরা, তোমরা কান দাও; ওহে বিবেচনাহীন লোকেরা, কবে তোমাদের সুবুদ্ধি হবে? যিনি কান সৃষ্টি করেছেন তিনি কি শুনতে পান না? যিনি চোখ গড়েছেন তাঁর কি দেখার শক্তি নেই? যিনি সব জাতিকে শাসন করেন ও মানুষকে শিক্ষা দেন তিনি কি শাস্তি না দিয়ে থাকবেন? মাবুদ মানুষের সব চিন্তা জানেন; তিনি জানেন যে, সে সবই নিষ্ফল। হে মাবুদ, ধন্য সেই লোক যাকে তুমি শাসনে রাখ আর তোমার শরীয়ত শিক্ষা দাও, যাতে বিপদের দিনে সে সাহস পায়, যে পর্যন্ত না দুষ্ট লোকদের জন্য গর্ত তৈরী শেষ হয়। মাবুদ কখনও তাঁর বান্দাদের ত্যাগ করবেন না; যারা তাঁর নিজের সম্পত্তি তাদের তিনি ফেলে দেবেন না। বিচারের রায় আবার ন্যায়পূর্ণ হয়ে উঠবে; যাদের অন্তর খাঁটি তারা সবাই তা মেনে চলবে। কে আমার পক্ষ হয়ে দুষ্টদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আমার পক্ষ হয়ে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? যদি মাবুদ আমাকে সাহায্য না করতেন, তবে মৃত্যুর নীরবতায় চলে যেতে আমার দেরি হত না। যখনই আমি ভাবি আমার পা পিছ্‌লে যাচ্ছে, তখনই হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত আমাকে ধরে রাখে। আমার মনে যখন দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, তখন তোমার দেওয়া সান্ত্বনা আমার অন্তরকে আনন্দিত করে। খারাপ শাসনকর্তারা খারাপ কাজের জন্য আইন তৈরী করে; তোমার সংগে তাদের কি কোন সম্বন্ধ থাকতে পারে? তারা সৎ লোকের বিরুদ্ধে দল পাকায় আর নির্দোষীকে মৃত্যুর শাস্তি দেবার জন্য দোষী বানায়। কিন্তু মাবুদই আমার কেল্লা; আমার আল্লাহ্‌ আমার আশ্রয়-পাহাড়। তাদের অন্যায় তিনি তাদেরই মাথার উপর নিয়ে আসবেন, তাদের দুষ্টতাতেই তিনি তাদের শেষ করে দেবেন; আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তা করবেন। এস, আমরা মাবুদের উদ্দেশে আনন্দের কাওয়ালী গাই; আমাদের রক্ষাকারী পাহাড়ের উদ্দেশে আনন্দধ্বনি করি। চল, আমরা শুকরিয়া জানাতে জানাতে তাঁর সামনে যাই, কাওয়ালীর মধ্য দিয়ে তাঁর উদ্দেশে আনন্দধ্বনি করি। মাবুদই আল্লাহ্‌তা’লা; সমস্ত দেব-দেবীর উপরে তিনিই মহান বাদশাহ্‌। দুনিয়ার সব গভীর স্থান তাঁরই হাতে রয়েছে; পাহাড়ের চূড়াগুলোও তাঁর। সমুদ্র তাঁর, কারণ তিনিই তা তৈরী করেছেন; ভূমিও তাঁর হাতে গড়া। এস, আমরা সেজদা করে তাঁর এবাদত করি; আমাদের সৃষ্টিকর্তা মাবুদের সামনে হাঁটু পাতি। তিনিই আমাদের আল্লাহ্‌, আমরা তাঁরই বান্দা; তাঁর চারণ ভূমির ভেড়ার মত তিনি আমাদের দেখাশোনা করেন। আহা, আজ যদি তোমরা তাঁর কথায় কান দাও! চল্লিশ বছর ধরে সেই সময়কার লোকদের উপর আমি বিরক্ত ছিলাম; আমি বলেছিলাম, ‘এই লোকদের দিল বিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তারা আমার পথ জানল না।’ সেইজন্য আমি রাগে কসম খেয়ে বলেছিলাম, ‘আমার দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় তারা যেতে পারবে না।’ ” তোমরা মাবুদের উদ্দেশে নতুন কাওয়ালী গাও; দুনিয়ার সব লোক, তোমরা মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও। মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, তাঁর প্রশংসা কর; তাঁর দেওয়া উদ্ধারের কথা দিনের পর দিন প্রচার কর। বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁর মহিমার কথা ঘোষণা কর; সমস্ত লোকের মধ্যে তাঁর সব অলৌকিক কাজের কথা ঘোষণা কর। মাবুদই মহান এবং সবার উপরে প্রশংসার যোগ্য; সব দেব-দেবীর চেয়ে তিনি বেশী ভয় জাগান। বিভিন্ন জাতির দেব-দেবী অসার মাত্র, কিন্তু মাবুদ আসমানের সৃষ্টিকর্তা। তাঁকেই ঘিরে রয়েছে গৌরব ও মহিমা; তাঁর পবিত্র ঘরে রয়েছে শক্তি ও সৌন্দর্য। হে বিভিন্ন জাতির সমস্ত গোষ্ঠী, স্বীকার কর সমস্ত গৌরব ও শক্তি মাবুদেরই। তোমরা স্বীকার কর সমস্ত গৌরব মাবুদের; কোরবানীর জিনিস নিয়ে তাঁর উঠানে এস। মাবুদের মহিমাপূর্ণ পবিত্রতার কথা ভেবে তাঁর এবাদত কর; দুনিয়ার সমস্ত লোক, তোমরা তাঁর সামনে কেঁপে ওঠো। বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঘোষণা কর, “মাবুদই বাদশাহ্‌। দুনিয়া অটলভাবে স্থাপিত হল, তা কখনও নড়বে না; তিনি ন্যায়ভাবে সব জাতিকে শাসন করবেন।” আসমান আনন্দ করুক, দুনিয়া খুশী হোক; সাগর ও তার মধ্যেকার সব কিছু গর্জন করুক; মাঠ ও তার মধ্যেকার সব কিছু আনন্দিত হোক। তাহলে বনের সব গাছপালাও আনন্দে গান করবে; তারা মাবুদের সামনে গান করবে, কারণ তিনি আসছেন। তিনি দুনিয়ার বিচার করতে আসছেন। তিনি ন্যায়ভাবে দুনিয়ার বিচার করবেন, আর জাতিদের বিচার করবেন বিশ্বস্তভাবে। মাবুদই বাদশাহ্‌; দুনিয়া আনন্দ করুক, দূর-দূরান্তের অসংখ্য দ্বীপ খুশী হোক। তাঁর চারপাশে মেঘ ও অন্ধকার দিয়ে ঘেরা; সততা ও ন্যায়বিচারের উপর তাঁর সিংহাসন দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর আগে আগে চলছে আগুন; সেই আগুন তাঁর চারদিকের সব শত্রুদের পুড়িয়ে ফেলছে। তাঁর বিদ্যুতের ঝলকে জগৎ আলোময় হয়েছিল; তা দেখে দুনিয়া কেঁপেছিল। মাবুদের সামনে, সমস্ত দুনিয়ার মালিকের সামনে পাহাড়-পর্বত মোমের মত গলে গিয়েছিল। আসমান তাঁর ন্যায়ের কথা ঘোষণা করছে, আর সমস্ত জাতি তাঁর গৌরব দেখছে। যারা মূর্তিপূজা করে আর দেব-দেবী নিয়ে বড়াই করে তারা সবাই লজ্জায় পড়ুক; মাবুদের সামনে দেব-দেবী সেজদা করুক। হে মাবুদ, তোমার ন্যায়বিচারের কথা শুনে সিয়োন আনন্দিত হয়েছে, এহুদার গ্রামগুলো খুশী হয়েছে। হে মাবুদ, তুমি সমস্ত দুনিয়ার আল্লাহ্‌তা’লা; সমস্ত দেবতার অনেক উপরে তোমার স্থান। যারা মাবুদকে মহব্বত করে তারা অন্যায়কে ঘৃণা করুক; তিনিই তো তাঁর ভক্তদের প্রাণ রক্ষা করেন আর দুষ্টদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করেন। আল্লাহ্‌ভক্তদের জীবনে নূর দেওয়া হয়, আর যাদের অন্তর খাঁটি তাদের জীবনে আনন্দ দেওয়া হয়। হে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা, মাবুদই যেন তোমাদের আনন্দের বিষয় হন। তোমরা তাঁর পবিত্রতার প্রশংসা কর। তোমরা মাবুদের উদ্দেশে নতুন কাওয়ালী গাও, কারণ তিনি অনেক অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছেন; তাঁর শক্তি, হ্যাঁ, তাঁর পবিত্র মহাশক্তি দিয়ে তিনি উদ্ধার করেছেন। মাবুদ তাঁর উদ্ধারের কাজ দেখিয়ে দিয়েছেন; সমস্ত জাতির সামনে তাঁর ন্যায়ের কাজ প্রকাশ করেছেন। ইসরাইল জাতির জন্য তাঁর অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার কথা তিনি মনে রেখেছেন; আমাদের আল্লাহ্‌র উদ্ধারের কাজ সমস্ত দুনিয়ার লোকেরা দেখেছে। দুনিয়ার সব লোক, তোমরা মাবুদের উদ্দেশে আনন্দধ্বনি কর; আনন্দ-গানে ফেটে পড় ও প্রশংসার কাওয়ালী গাও। বীণা বাজিয়ে আর সুন্দর সুরে মাবুদের উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাও। তূরী বাজিয়ে আর শিংগার আওয়াজে বাদশাহ্‌ মাবুদের সামনে আনন্দধ্বনি কর। সাগর ও তার মধ্যেকার সব কিছু আনন্দে চিৎকার করুক; দুনিয়া ও দুনিয়াতে বাসকারীরা আনন্দে চিৎকার করুক। সমস্ত নদী হাততালি দিয়ে আনন্দ করুক; পাহাড়-পর্বত একসংগে মিলে আনন্দে কাওয়ালী করুক। মাবুদের সামনেই তারা তা করুক, কারণ তিনি দুনিয়ার বিচার করতে আসছেন। তিনি ন্যায়ভাবে দুনিয়ার বিচার করবেন, আর জাতিদের বিচার করবেন সৎ ভাবে। মাবুদই বাদশাহ্‌; সমস্ত জাতি কেঁপে উঠুক। তিনি কারুবীদের উপরে সিংহাসনে বসে আছেন; দুনিয়া টলমল করুক। সিয়োনে বাসকারী মাবুদ মহান; সমস্ত জাতি তাঁর অধীন। সেই জাতিরা তাঁর প্রশংসা করুক; তিনি ভয়-জাগানো আল্লাহ্‌তা’লা; তিনি পবিত্র। যে বাদশাহ্‌ ন্যায়বিচার ভালবাসেন তাঁর শক্তিকে তুমিই অটল করেছ, যাতে তিনি সৎ ভাবে বিচার করতে পারেন। তুমিই ইয়াকুবের বংশের মধ্যে ন্যায়বিচার ও সততা বহাল করেছ। আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর; তাঁর পা-দানির সামনে সেজদা কর; তিনি পবিত্র। তাঁর ইমামদের মধ্যে ছিলেন মূসা ও হারুন; যাঁরা তাঁর কাছে মুনাজাত করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন শামুয়েল। মূসা, হারুন ও শামুয়েল মাবুদকে ডাকতেন আর তিনি তাঁদের জবাব দিতেন। তিনি মেঘের থামের মধ্য থেকে তাঁদের কাছে কথা বলতেন; তাঁরা তাঁর কালাম ও তাঁর দেওয়া হুকুম পালন করতেন। হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে; তুমি তাঁদের মাফদানকারী আল্লাহ্‌ ছিলে, যদিও তাঁদের অন্যায়ের শাস্তি দিতে তুমি ছাড় নি। সেইজন্য আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর; তাঁর পবিত্র পাহাড়ের সামনে তাঁর এবাদত কর, কারণ আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ পবিত্র। হে দুনিয়ার সমস্ত লোক, তোমরা মাবুদের উদ্দেশে আনন্দধ্বনি কর। খুশী মনে মাবুদের এবাদত কর; আনন্দের কাওয়ালী গাইতে গাইতে তাঁর সামনে উপস্থিত হও। তোমরা জেনো আল্লাহ্‌ই মাবুদ। তিনিই আমাদের তৈরী করেছেন, আমরা তাঁরই; আমরা তাঁরই বান্দা, তাঁরই চারণ ভূমির ভেড়া। তাঁকে শুকরিয়া জানাতে জানাতে তাঁর দরজা দিয়ে ঢোকো, তাঁর প্রশংসা করতে করতে তাঁর উঠানে ঢোকো; তাঁকে শুকরিয়া জানাও, তাঁর প্রশংসা কর। মাবুদ মেহেরবান, তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী; তাঁর বিশ্বস্ততা বংশের পর বংশ ধরে চলে। আমি তোমার অটল মহব্বত ও ন্যায়বিচারের কাওয়ালী গাইব; হে মাবুদ, আমি তোমার উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাইব। নিখুঁত জীবন কাটাবার দিকে আমি মনোযোগ দেব; কবে তুমি আমার কাছে আসবে? আমার নিজের ঘরে আমি খাঁটি অন্তরে থাকব। আমি খারাপ কোন কিছু আমার চোখের সামনে রাখব না। বিপথে যাওয়া লোকদের কাজ আমি ঘৃণার চোখে দেখি; সেগুলো আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারবে না। আমার অন্তরে আমি কুটিলতাকে স্থান দেব না; খারাপীর সংগে আমার কোন যোগ থাকবে না। যারা গোপনে অন্যদের নিন্দা করে তাদের আমি শেষ করব; যাদের চোখে গর্ব আর বুকে অহংকার রয়েছে তাদের আমি সহ্য করব না। দেশের বিশ্বস্ত লোকদের দিকে আমার নজর থাকবে যাতে তারা আমার সংগে বাস করতে পারে; যাদের জীবন নিখুঁত তারাই আমার কাজ করবে। ছলনাকারীরা আমার বাড়ীতে বাস করতে পারবে না; মিথ্যাবাদীরা আমার কাজে বহাল থাকতে পারবে না। রোজ সকালে দেশের দুষ্ট লোকদের আমি শেষ করব, যাতে মাবুদের শহর থেকে প্রত্যেকটি অন্যায়কারীকে উপ্‌ড়ে ফেলা যায়। হে মাবুদ, তুমি আমার মুনাজাত শোন; সাহায্য চেয়ে আমার এই ফরিয়াদ তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছাক। আমার বিপদের সময় তুমি মুখ ফিরিয়ে রেখো না। আমার কথায় কান দাও; আমার ডাকে সাড়া দিতে তুমি দেরি কোরো না। আমার দিনগুলো ধোঁয়ার মত মিলিয়ে গেছে; আমার হাড়গুলো যেন চুলার আগুনে পুড়ছে। রোদের তেজে শুকিয়ে যাওয়া ঘাসের মত আমার অন্তর শুকিয়ে গেছে; আমি খেতেও ভুলে যাই। জোরে কোঁকাতে কোঁকাতে আমার শরীরে হাড়-চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই। আমি মরু-পেঁচার মত হয়েছি, হয়েছি পোড়ো বাড়ীর পেঁচা। আমি ঘুমাতে পারি না; আমি যেন ছাদের উপরে সংগীহীন পাখী। শত্রুরা দিনরাত আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে; আমার উপর যারা ক্ষেপে আছে তারা আমার নাম বদদোয়া হিসাবে ব্যবহার করে। আমার দিনগুলো বিকালের ছায়ার মত হয়ে গেছে; ঘাসের মতই আমি শুকিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু হে মাবুদ, তুমি চিরকাল তোমার সিংহাসনে আছ; তোমার নাম বংশের পর বংশ ধরে থাকবে। তুমি সিয়োনের প্রতি মমতা করবে, কারণ তাকে রহমত দেখাবার সময় হয়েছে, নির্দিষ্ট সময় এসে গেছে। তার পাথরগুলো পর্যন্ত তোমার গোলামদের কাছে প্রিয়; তার ধূলিকণার প্রতিও তাদের মমতা রয়েছে। তখন মাবুদের নাম শুনে অন্য সব জাতি ভয় পাবে; তোমার গৌরব দেখে দুনিয়ার সব বাদশাহ্‌দের মনে ভয় জাগবে। মাবুদ আবার সিয়োনকে গড়বেন, আর তিনি নিজের মহিমায় দেখা দেবেন। তিনি সর্বহারাদের মুনাজাতের জবাব দেবেন; তাদের মিনতি তিনি তুচ্ছ করবেন না। আগামী বংশধরদের জন্য এ সব কথা লেখা থাকবে, যাতে এখনও যারা জন্ম গ্রহণ করে নি তারাও মাবুদের প্রশংসা করতে পারে। আমার জীবনকালের মাঝখানে তিনি আমার শক্তি কমিয়ে দিয়েছেন, আমার আয়ু খাটো করে দিয়েছেন। তাই আমি বলেছি, “হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার দেওয়া আয়ুর মাঝখানে আমাকে তুমি নিয়ে যেয়ো না; চিরকাল ধরেই তো তুমি আছ। অনেক কাল আগে তুমি দুনিয়ার ভিত্তি গেঁথেছিলে; আসমানও তোমার হাতে গড়া। সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু তুমি চিরকাল থাকবে। কাপড়ের মতই সেগুলো পুরানো হয়ে যাবে; সেগুলো তুমি কাপড়ের মতই বদলে দেবে, আর তা বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি একই রকম থাকবে; তোমার জীবনকাল কখনও শেষ হবে না। তোমার গোলামদের সন্তানেরা বেঁচে থাকবে; তাদের বংশধরেরা তোমার সামনে স্থির থাকবে।” হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর; হে আমার অন্তর, তাঁর পবিত্রতার প্রশংসা কর। হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর; তাঁর কোন উপকারের কথা ভুলে যেয়ো না। তোমার সমস্ত গুনাহ্‌ তিনি মাফ করেন; তিনি তোমার সমস্ত রোগ ভাল করেন। তিনি কবর থেকে তোমার জীবন মুক্ত করেন; তিনি তোমাকে অটল মহব্বত ও মমতায় ঘিরে রাখেন। যা উপকার আনে তেমন সব জিনিস দিয়ে তিনি তোমাকে তৃপ্ত করেন; তিনি ঈগল পাখীর মত তোমাকে নতুন যৌবন দেন। মাবুদ উচিত কাজ করেন; তিনি ন্যায়ভাবে অত্যাচারিতদের বিচার করেন। কি উদ্দেশ্যে কি করেন তা তিনি মূসাকে জানিয়েছেন; তাঁর কাজ তিনি বনি-ইসরাইলদের দেখতে দিয়েছেন। মাবুদ মমতায় পূর্ণ ও দয়াময়; তিনি সহজে রেগে উঠেন না, তাঁর অটল মহব্বতের সীমা নেই। তিনি দোষীর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন অভিযোগ করেন না, চিরকাল রাগ পুষে রাখেন না। আমাদের গুনাহের শাস্তি যতটা আমাদের পাওনা ততটা তিনি আমাদের দেন না; আমাদের অন্যায় অনুসারেও শাস্তি দেন না। দুনিয়া থেকে আসমানের দূরত্বের যেমন সীমা নেই, তেমনি তাঁর ভক্তদের উপরে তাঁর অটল মহব্বতেরও সীমা নেই। পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিক যত দূরে, আমাদের সব গুনাহ্‌ তিনি তত দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। সন্তানদের প্রতি পিতার যেমন মমতা আছে তেমনি তাঁর ভক্তদের উপর তাঁর মমতা আছে। কিভাবে আমরা গড়া তা তো তাঁর অজানা নেই; আমরা যে ধূলি ছাড়া আর কিছু নই তা তাঁর মনে আছে। ঘাসের আয়ুর মতই মানুষের আয়ু, মাঠের ফুলের মতই সে ফুটে ওঠে। ফুলের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে গেলে ফুল আর থাকে না; যে জায়গায় সেই ফুল ফুটেছিল সেই জায়গায়ও আর তাকে মনে রাখে না। মাবুদ বেহেশতে তাঁর সিংহাসন স্থাপন করেছেন; সব কিছুর উপরেই তাঁর রাজত্ব। হে মাবুদের শক্তিশালী ফেরেশতারা, যারা তাঁর কথার বাধ্য থেকে তাঁর হুকুম পালন করছ, তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। হে মাবুদের খেদমতকারী শক্তিদলগুলো যারা তাঁর ইচ্ছা পালন করছ, তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। হে মাবুদের রাজ্যের সব স্থানে তাঁর সৃষ্ট সব কিছু, তোমরা তাঁর প্রশংসা কর; হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর। হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর; হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, তুমি কত মহান! তুমি গৌরব ও মহিমার সাজে সেজে আছ। কাপড়ের মত করে তুমি নিজেকে আলো দিয়ে ঢেকেছ; আসমানকে তুমি ছাউনির মত করে বিছিয়ে দিয়েছ। তোমার বেহেশতের বাসস্থানের ভিত্তি তুমি আসমানের পানির উপরে স্থাপন করেছ; তুমি মেঘকে করেছ তোমার রথ; তুমি বাতাসের পাখায় ভর করে চলাচল কর। তুমি বাতাসকে তোমার দূত করেছ; জ্বলন্ত আগুনকে করেছ তোমার গোলাম। তুমি দুনিয়াকে তার নিজের ভিত্তির উপর স্থাপন করেছ; তা কখনও নড়বে না। তুমি দুনিয়াকে কাপড় দিয়ে ঢাকার মত করে সাগরের পানি দিয়ে ঢেকেছিলে; পাহাড়-পর্বতও সেই পানিতে ঢাকা ছিল। কিন্তু সেই পানি তোমার হুকুমে চলে গেল; তা ছুটে চলে গেল তোমার গর্জনে। পাহাড়-পর্বত আরও উঁচু হয়ে উঠল, সব উপত্যকা আরও নীচু হয়ে গেল; তুমি যে জায়গা ঠিক করে রেখেছিলে সেগুলো সেই পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাল। এইভাবে তুমি পানির সীমানা ঠিক করে দিয়েছ, যাতে পানি আর কখনও সীমানা ডিংগিয়ে দুনিয়াকে ঢেকে না ফেলে। উপত্যকার মধ্যে তুমিই পানির ঝর্ণা পাঠাও; সেই পানি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায়। তা জীবজন্তুদের পানির যোগান দেয়; তাতে বুনো গাধার পিপাসা মেটে। পানির কাছেই আকাশের পাখীরা বাসা বাঁধে, আর গাছের ডালে ডালে গান গায়। তোমার বেহেশতের বাসস্থান থেকে তুমি পাহাড়-পর্বতের উপরে পানি ফেল; তোমার সেই কাজের ফলে দুনিয়া তৃপ্ত হয়। তুমি পশুপালের জন্য ঘাস আর মানুষের চাষের জন্য ফসলের গাছ জন্মাতে দাও, যেন জমি থেকেই সে তার খোরাক পেতে পারে- আংগুর-রস যা মানুষের মনকে খুশী করে, তেল যা তার মুখকে উজ্জ্বল করে, আর রুটি যা তার অন্তরে আনে বল। মাবুদের তৈরী সব গাছপালা প্রচুর বৃষ্টি পায়; তাঁর লাগানো লেবাননের এরস গাছও বৃষ্টি পায়। সেই সব গাছে পাখীরা বাসা বাঁধে; সারসও বেরস গাছে ঘর বানায়। উুঁচ উঁচু পাহাড়গুলোতে বুনো ছাগল বাস করে; পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে শাফনের দল আশ্রয় নেয়। ঋতু ভাগ করার জন্য তুমি চাঁদ তৈরী করেছ; তোমার সময়মত সূর্য অস্ত যায়। তুমি অন্ধকার আনলে রাত হয়, বনের সব পশুরা তখন ঘুরে বেড়ায়। যুবসিংহেরা শিকার খুঁজতে গিয়ে চিৎকার করে, আল্লাহ্‌র কাছে তাদের খাবার চায়। সূর্য উঠলে তারা চলে যায় আর তাদের গর্তে শুয়ে পড়ে। তখন মানুষ তার কাজে বের হয়, সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে। হে মাবুদ, তুমি অনেক কিছু সৃষ্টি করেছ; তোমার জ্ঞান দিয়ে সেই সব তৈরী করেছ; তোমার সৃষ্ট জিনিসে দুনিয়া ভরা। ঐ যে বিরাট, বিশাল সমুদ্র- তা চলে বেড়ানো ছোট-বড় অসংখ্য প্রাণীতে ভরা আছে। তার মধ্যে ঐ চলছে জাহাজ, সেখানে লিবিয়াথনও আছে; তাকে তুমি সাগরে খেলা করার জন্য সৃষ্টি করেছ। তারা সব তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছে, যাতে ঠিক সময়ে তুমি তাদের খাবার দাও। তুমি তাদের দিলে তারা তুলে নেয়; তুমি হাত খুললে তারা ভাল ভাল জিনিস পেয়ে তৃপ্ত হয়। তুমি মুখ লুকালে তারা ভয় পায়; তুমি তাদের জীবন্তবায়ু নিয়ে গেলে তারা মরে যায়, আবার তারা ধুলা হয়ে যায়। তোমার রূহ্‌ পাঠালে তাদের সৃষ্টি হয়; তুমি নতুন নতুন প্রাণ দিয়ে দুনিয়াকে সাজাও। মাবুদের গৌরব অনন্তকাল থাকুক; তিনি যেন নিজের কাজে আনন্দিত হন। তিনি দুনিয়ার দিকে তাকালে তা কাঁপে; তাঁর ছোঁয়াতে পাহাড়-পর্বত থেকে ধোঁয়া বের হয়। আমার সারা জীবন ধরে আমি মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব; আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাইব। আমার সব ধ্যান তাঁর কাছে মধুর হোক; আমি মাবুদের সংগে যুক্ত হয়ে আনন্দ করব। দুনিয়ার বুক থেকে গুনাহ্‌গার লোকেরা মুছে যাক; দুষ্ট লোকেরা সব শেষ হয়ে যাক। হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর; আলহামদুলিল্লাহ্‌! মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, তাঁর গুণের কথা ঘোষণা কর; তাঁর কাজের কথা অন্যান্য জাতিদের জানাও। তাঁর উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও; তাঁর সব অলৌকিক কাজের কথা বল। তাঁর পবিত্রতার প্রশংসা কর; যারা মাবুদকে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী তাদের অন্তর আনন্দিত হোক। মাবুদ ও তাঁর কুদরতকে বুঝতে চেষ্টা কর; সব সময় তাঁর সংগে যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী হও। তিনিই আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌; গোটা দুনিয়া তাঁরই শাসনে চলছে। যে কালামের নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন হাজার হাজার বংশের জন্য, তাঁর সেই ব্যবস্থার কথা তিনি চিরকাল মনে রাখবেন। সেই ব্যবস্থা তিনি ইব্রাহিমের জন্য স্থাপন করেছিলেন আর ইসহাকের কাছে কসম খেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ব্যবস্থা ইয়াকুবের কাছে নিয়ম হিসাবে আর ইসরাইলের কাছে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাকে কেনান দেশটা দেব, সেটাই হবে তোমার পাওনা সম্পত্তি।” তাদের সংখ্যা যখন কম ছিল, খুবই কম ছিল, আর তারা সেখানে বিদেশী ছিল, তারা যখন সেখানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে আর বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়াত, তখন তিনি কাউকে তাদের জুলুম করতে দিতেন না। তাদের জন্য তিনি বাদশাহ্‌দের ধম্‌কে দিতেন, বলতেন, “আমার অভিষিক্ত বান্দাদের ছোঁবে না; আমার নবীদের কোন ক্ষতি করবে না।” তারপর তিনি তাদের দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনলেন আর তাদের খাবারের অভাব ঘটালেন; তখন তিনি একজন লোককে তাদের আগে পাঠিয়ে দিলেন- ইউসুফকে পাঠিয়ে দিলেন; গোলাম হিসাবে তাঁকে বিক্রি করা হল। বেড়ীর শিকলে তাঁর পা কষ্ট পেল, লোহার শিকলে তিনি বাঁধা পড়লেন। তিনি যা বলেছিলেন যতদিন না তা সত্যি হয়ে দেখা দিল, ততদিন তাঁর সম্বন্ধে মাবুদের ওয়াদা পুরণের ব্যাপারে তাঁর পরীক্ষা চলছিল। বাদশাহ্‌র হুকুমে তাঁর শিকল খুলে দেওয়া হল; সেই শাসনকর্তা তাঁকে ছেড়ে দিলেন। তিনি তাঁকে তাঁর রাজবাড়ীর ও তাঁর সমস্ত সম্পত্তির কর্তা করলেন, যাতে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তিনি রাজকর্মচারীদের শাসনে রাখেন আর বৃদ্ধ নেতাদের পরামর্শ দেন। তারপর ইসরাইল মিসরে গেলেন; হাম-বংশীয়দের দেশে ইয়াকুব কিছুকাল বাস করলেন। মাবুদ তাঁর নিজের বান্দাদের বংশ অনেক বাড়িয়ে দিলেন; শত্রুদের চেয়ে তিনি তাদের শক্তিশালী করলেন। তাঁর বান্দাদের বিরুদ্ধে তিনি শত্রুদের অন্তরে ঘৃণা জাগিয়ে দিলেন, তাতে তারা তাঁর গোলামদের সংগে চালাকি খাটিয়ে চলতে লাগল। তিনি তাঁর গোলাম মূসাকে আর তাঁর বেছে নেওয়া হারুনকে পাঠিয়ে দিলেন; তাঁদের দিয়ে মাবুদ হাম-বংশীয়দের দেশে সকলের সামনে নানা রকম অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি কাজ দেখালেন। তিনি অন্ধকার পাঠালেন, তাতে অন্ধকার হল; তাঁর কালামের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করল না। তাদের পানি তিনি রক্ত করে দিলেন, তাতে সব মাছ মরে গেল। দেশ ব্যাঙে কিল্‌বিল্‌ করতে লাগল; এমন কি, তাদের বাদশাহ্‌র ঘরে গিয়েও সেগুলো ঢুকল। তাঁর কথায় ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা আসল, তাদের দেশ মশাতে ছেয়ে গেল। তিনি বৃষ্টির মত করে তাদের উপর শিলা ফেললেন, সারা দেশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। তাদের আংগুর লতা আর ডুমুর গাছে তিনি আঘাত করলেন আর দেশের সব গাছপালা ভেংগে দিলেন। তাঁর কথায় পংগপাল আর অসংখ্য ফড়িং আসল; সেগুলো দেশের গাছ-গাছড়া আর জমির ফসল খেয়ে ফেলল। তারপর তিনি মিসরীয়দের যৌবনের শক্তির প্রথম ফল, অর্থাৎ দেশের সব প্রথম সন্তানকে আঘাত করলেন। তিনি সোনা-রূপা সহ বনি-ইসরাইলদের বের করে আনলেন; তাদের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ে নি। তাদের চলে যাওয়া দেখে মিসরীয়রা খুশী হয়েছিল, কারণ তারা বনি-ইসরাইলদের ভীষণ ভয় করত। তাদের আড়াল করার জন্য তিনি তাঁর সেই মেঘটি মেলে দিলেন, আর রাতে আলো দেবার জন্য দিলেন আগুন। তারা খাবার চেয়েছিল বলে তিনি তাদের ভারুই পাখী এনে দিলেন; বেহেশত থেকে রুটি দিয়ে তাদের তৃপ্ত করলেন। তিনি পাথর খুলে দিলেন, তাতে পানি বেরিয়ে আসল; শুকনা জায়গার মধ্য দিয়ে তা নদীর মত বয়ে গেল। তাঁর গোলাম ইব্রাহিমের কাছে তিনি যে পবিত্র ওয়াদা করেছিলেন তা তিনি মনে করলেন। আনন্দ ও আনন্দ-গানের সংগে তাঁর বাছাই করা বান্দাদের তিনি বের করে আনলেন। তিনি অন্যান্য জাতির দেশ বনি-ইসরাইলদের দিলেন আর সেই সব জাতির পরিশ্রমের ফল তাঁর বান্দাদের নিতে দিলেন, যাতে তারা তাঁর নিয়ম পালন করে আর তাঁর শরীয়ত মেনে চলে। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আলহামদুলিল্লাহ্‌! তোমরা মাবুদের শুকরিয়া আদায় কর, কারণ তিনি মেহেরবান; তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। মাবুদের মহৎ কাজের বর্ণনা কে করতে পারে? তাঁর প্রশংসার পূর্ণ প্রকাশ করে এমন সাধ্য কার? ধন্য তারা, যারা চালচলনে ন্যায়ের মান রাখে আর সব সময় ন্যায় কাজ করে। হে মাবুদ, তোমার বান্দাদের প্রতি রহমত দেখাবার সময় আমাকে ভুলে যেয়ো না; তাদের উদ্ধার করার সময় আমার দিকেও হাত বাড়িয়ে দিয়ো। এতে যেন আমি তোমার বাছাই করা বান্দাদের উন্নতি দেখতে পাই, তোমার জাতির আনন্দে আনন্দিত হতে পারি, আর যারা তোমার সম্পত্তি তার অংশ হিসাবে গর্ব করতে পারি। আমাদের পূর্বপুরুষদের মত আমরাও গুনাহ্‌ করেছি; আমরা অন্যায় করেছি, খারাপভাবে চলেছি। মিসরে থাকার সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তোমার অলৌকিক চিহ্ন দেখে কিছুই বোঝে নি; তারা তোমার সীমাহীন অটল মহব্বতের কথাও মনে রাখে নি; তারা সাগরের ধারে, লোহিত সাগরের ধারে বিদ্রোহ করেছিল। তবুও তিনি তাঁর সুনাম রক্ষার জন্য, তাঁর মহাশক্তি প্রকাশের জন্য তাদের উদ্ধার করেছিলেন। তাঁর হুকুমে লোহিত সাগর শুকিয়ে গেল; তিনি মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়ার মত করে গভীর সাগরের মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে গেলেন। তিনি ঘৃণাকারীদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করলেন; শত্রুদের হাত থেকে তাদের মুক্ত করলেন। তাদের শত্রুরা পানিতে ঢাকা পড়ল, একজনও বেঁচে রইল না। তখন মাবুদের কথায় তারা বিশ্বাস করল আর তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাইল। কিন্তু তাঁর কাজের কথা ভুলে যেতে তাদের দেরি হল না; তারা তাঁর পরামর্শের অপেক্ষায় রইল না। মরুভূমিতে তারা লোভ করে আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করল। তারা যা চেয়েছিল তিনি তা-ই তাদের দিলেন, কিন্তু তাদের উপর পাঠিয়ে দিলেন এক ক্ষয় করা রোগ। তাম্বুতে জীবন কাটাবার সময় মূসাকে দেখে, আর মাবুদের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র করা সেই হারুনকে দেখে তাদের হিংসা হল। দুনিয়া মুখ খুলে দাথনকে গিলে ফেলল আর অবীরামের দলকে ঢেকে ফেলল। তাদের দলের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল; আগুনের শিখা দুষ্ট লোকদের পুড়িয়ে ফেলল। তুর পাহাড়ের সামনে তারা একটা বাছুর তৈরী করল আর ছাঁচে ঢালা মূর্তির পূজা করল। তাদের গৌরবময় আল্লাহ্‌কে ফেলে তারা ঘাস খাওয়া গরুর মূর্তিকে গ্রহণ করল। তাদের উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌কে তারা ভুলে গেল যিনি মিসরে অনেক বড় বড় কাজ করেছিলেন। হাম-বংশীয়দের দেশে করা কুদরতি কাজের বিষয় তারা ভুলে গেল, লোহিত সাগরের কাছে করা ভয় জাগানো সব কাজ ভুলে গেল। তাই তিনি বললেন তাদের ধ্বংস করবেন; তিনি তা-ই করতেন কিন্তু তাঁর বাছাই করা বান্দা মূসা তাঁর আসবার পথে গিয়ে দাঁড়ালেন, যেন তিনি তাদের ধ্বংস করে ফেলার রাগ ফিরাতে পারেন। পরে তারা সেই সুন্দর দেশটাকে তুচ্ছ করল; তারা মাবুদের কথায় বিশ্বাস করল না। তাদের তাম্বুর মধ্যে তারা বকবক করতে লাগল; মাবুদের কথায় তারা কান দিল না। তাই তিনি তাদের সম্বন্ধে এই কসম খেলেন- তিনি মরুভূমিতেই তাদের শেষ করে দেবেন, তাদের বংশধরদের বিভিন্ন জাতির মধ্যে মৃত্যু ঘটাবেন, আর বিভিন্ন দেশে তাদের ছড়িয়ে দেবেন। তারা পিয়োর পাহাড়ের বাল দেবতার পূজায় যোগ দিল আর মৃত লোকদের উদ্দেশে কোরবানীর গোশ্‌ত খেল। এই সব খারাপ কাজ দিয়ে তারা মাবুদের রাগ জাগিয়ে তুলল, তাই তাদের মধ্যে মহামারী লাগল। তখন ইমাম পীনহস্‌ উঠে এর উপযুক্ত শাস্তি দিলেন, আর মহামারী থেমে গেল। পীনহসের এই কাজের ফলে তাঁকে চিরকালের জন্য ধার্মিক বলে ধরা হল। মরীবার পানির ধারে তারা মাবুদের রাগ জাগিয়ে তুলল; তাদের জন্যই মূসা বিপদে পড়লেন। তারা আল্লাহ্‌র রূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাতে মূসার মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে এসেছিল যা বলা তাঁর উচিত ছিল না। আল্লাহ্‌র হুকুমের অবাধ্য হয়ে তারা অন্যান্য জাতিদের ধ্বংস করল না, বরং সেই সব জাতির সংগে তারা নিজেদের মিশিয়ে দিল আর তাদের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করল। তাদের মূর্তিগুলোকে তারা পূজা করল আর সেগুলোই তাদের ফাঁদ হল। এমন কি, ভূতদের উদ্দেশে তাদের ছেলে ও মেয়েদের তারা বলি দিল। তারা নির্দোষীদের, অর্থাৎ তাদের ছেলেমেয়েদের রক্তপাত করল। তারা কেনানের মূর্তিগুলোর উদ্দেশে তাদের বলি দিল, তাতে গোটা দেশটা সেই রক্তে নাপাক হল। এ সব করে তারা নিজেদের নাপাক করল; তাদের কাজ দিয়ে তারা মাবুদের প্রতি বেঈমানী করল। সেজন্যই মাবুদের রাগ তাঁর বান্দাদের উপর জ্বলে উঠল; যারা তাঁরই সম্পত্তি তাদের প্রতি তাঁর ঘৃণা জাগল। তিনি অন্যান্য জাতিদের হাতে তাদের তুলে দিলেন; তাদের ঘৃণাকারীরা তাদের শাসন করতে লাগল। তাদের শত্রুরা তাদের উপর জুলুম চালাল; তারা তাদের অধীনে রইল। অনেকবারই তিনি তাদের উদ্ধার করলেন, কিন্তু তারা নিজেদের ইচ্ছায় বিদ্রোহী হল; গুনাহের দরুন তাদের পতন হল। তবুও তিনি তাদের ফরিয়াদ শুনে তাদের কষ্টের দিকে তাকালেন। তাদের জন্য তাঁর স্থাপন করা ব্যবস্থার কথা তিনি মনে করলেন; তাঁর অসীম, অটল মহব্বত অনুসারে তাদের প্রতি মমতা করলেন। যারা তাদের বন্দী করেছিল তাদের কাছে তিনি তাদের দয়ার পাত্র করে তুললেন। হে আল্লাহ্‌, আমাদের মাবুদ, আমাদের উদ্ধার কর; অন্যান্য জাতিদের মধ্য থেকে তুমি আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এস, যাতে আমরা তোমার পবিত্রতার উদ্দেশে শুকরিয়া জানাতে পারি আর তোমার গুণগান করতে পারছি বলে গর্ববোধ করতে পারি। সৃষ্টির আগে থেকে আখেরাত পর্যন্ত ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। সমস্ত লোক বলুক, “আমিন।” আলহামদুলিল্লাহ্‌! তিনি অন্যান্য দেশ থেকে তাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন, নিয়ে এসেছেন পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ থেকে। তারা মরুভূমির নির্জন জায়গায় ঘুরে বেড়ালো; বাস করার মত কোন শহর তারা খুঁজে পেল না। তারা খিদে ও পিপাসায় কষ্ট পেল, তাদের প্রাণ শ্রান্ত-ক্লান্ত হল। বিপদে পড়ে তারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাল, এতে কষ্ট থেকে তিনি তাদের উদ্ধার করলেন। তিনি সোজা পথ দিয়ে তাদের নিয়ে গেলেন যেন তারা কোন শহরে গিয়ে বাস করতে পারে। মানুষের প্রতি মাবুদের কুদরতি কাজের জন্য আর তাঁর অটল মহব্বতের জন্য তারা তাঁর শুকরিয়া আদায় করুক। যাদের অন্তরে পিপাসা আছে তিনি তাদের পিপাসা মেটান, আর যাদের অন্তরে খিদে আছে ভাল ভাল জিনিস দিয়ে তিনি তাদের তৃপ্ত করেন। তারা অন্ধকারে, ঘন অন্ধকারের মধ্যে বসে ছিল, সেই বন্দীরা দুঃখে ও লোহার শিকলে কষ্ট পাচ্ছিল; কারণ তারা আল্লাহ্‌র কালামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত, আল্লাহ্‌তা’লার পরামর্শ তারা তুচ্ছ করত। তাই তিনি কঠিন পরিশ্রম দিয়ে তাদের অহংকার ভেংগে দিলেন; তারা উচোট খেল, সাহায্যকারী কেউ ছিল না। বিপদে পড়ে তারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাল, এতে কষ্ট থেকে তিনি তাদের রক্ষা করলেন। অন্ধকার, ঘন অন্ধকার থেকে তিনি তাদের বের করে আনলেন; তিনি তাদের শিকল ভেংগে দিলেন। মানুষের প্রতি মাবুদের কুদরতি কাজের জন্য আর তাঁর অটল মহব্বতের জন্য তারা তাঁর শুকরিয়া আদায় করুক। তিনি ব্রোঞ্জের দরজা ভেংগে ফেলেছেন আর লোহার আগল কেটে ফেলেছেন। যাদের মন অসাড় তারা তাদের বিদ্রোহের জন্য আর অন্যায়ের জন্য কষ্ট পেল। তারা সমস্ত খাবার ঘৃণা করল আর মৃত্যুর দুয়ারের কাছে উপস্থিত হল। বিপদে পড়ে তারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাল, এতে কষ্ট থেকে তিনি তাদের রক্ষা করলেন। তাঁর কালাম পাঠিয়ে তিনি তাদের সুস্থ করলেন; তিনি কবর থেকে তাদের উদ্ধার করলেন। মানুষের প্রতি মাবুদের কুদরতি কাজের জন্য আর তাঁর অটল মহব্বতের জন্য তারা তাঁর শুকরিয়া আদায় করুক। তারা কৃতজ্ঞতা-কোরবানী দিক, আনন্দ-কাওয়ালীর মধ্য দিয়ে তাঁর সব কাজের কথা বলুক। যারা জাহাজে করে সাগরে যায় আর মহাসমুদ্রের মধ্যে ব্যবসা করে, তারাই মাবুদের কাজ দেখেছে, গভীর পানিতে দেখেছে তাঁর অলৌকিক চিহ্ন। একবার তাঁর কথায় ভীষণ ঝড় হল, তাতে বড় বড় ঢেউ উঠল। ফলে নাবিকেরা উঠল আসমান পর্যন্ত আর নামল পানির তলায়; বিপদে পড়ে ভয়ে তাদের প্রাণ উড়ে গেল। মাতালের মত তারা হেলেদুলে ঢলে পড়ল; তারা বুদ্ধিহারা হয়ে গেল। বিপদে পড়ে তারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাল, এতে কষ্ট থেকে তিনি তাদের বের করে আনলেন। তিনি ঝড় থামিয়ে দিলেন, তাতে সমুদ্রের ঢেউ শান্ত হয়ে গেল। সমুদ্র শান্ত হয়ে গেলে তারা খুশী হল; যে বন্দরে তারা যেতে চেয়েছিল সেখানেই তিনি তাদের নিয়ে গেলেন। মানুষের প্রতি মাবুদের কুদরতি কাজের জন্য আর তাঁর অটল মহব্বতের জন্য তারা তাঁর শুকরিয়া আদায় করুক। সমাজের মধ্যে তারা তাঁর প্রশংসা করুক, বৃদ্ধ নেতাদের সভায় তাঁর গুণগান করুক। তিনি নদীগুলোকে মরুভূমি করে ফেলেন, ঝর্ণাকে করে ফেলেন শুকনা জমি, আর ফসল জন্মানো জমিকে করে ফেলেন লবণের মাঠ। যারা সেখানে বাস করে তাদের দুষ্টতার জন্যই তিনি এই সব করেন। তিনি মরুভূমিকে পুকুর করে ফেলেন আর শুকনা জায়গাকে করে ফেলেন ঝর্ণা। ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া লোকদের তিনি সেখানে বাস করান; তারা সেখানে শহর গড়ে তোলে। তারা ক্ষেতে বীজ বোনে, আংগুর গাছ লাগায়, আর প্রচুর ফসল ফলায়। তিনি তাদের দোয়া করেন আর তাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়; তিনি তাদের পশুপাল কমে যেতে দেন না। জুলুম, বিপদ ও দুঃখে আবার তাদের সংখ্যা কমে যায় আর তাদের অবস্থা খারাপ হয়। তিনি উঁচু পদের লোকদের উপরে অপমান ঢেলে দেন, পথহীন নির্জন জায়গায় তাদের ঘুরে বেড়াতে দেন; কিন্তু তিনি দুর্দশার নাগালের বাইরে অভাবীদের রাখেন, ভেড়ার পালের মত তাদের সন্তানের সংখ্যা বাড়ান। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা তা দেখে আনন্দিত হয়, কিন্তু অন্যায়কারীরা মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যে জ্ঞানী সে এই সব বিষয়ে মনোযোগ দিক আর মাবুদের অটল মহব্বতের বিষয় ভাল করে লক্ষ্য করুক। হে আল্লাহ্‌, আমার মন স্থির আছে; আমি কাওয়ালী গাইব আর আমার সমস্ত দিল দিয়ে গানের সুর তুলব। ওহে বীণা ও সুরবাহার, জেগে ওঠো; আমি ভোরকে জাগিয়ে তুলব। হে মাবুদ, বিভিন্ন জাতির সামনে আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করব, তাদের মধ্যে তোমার উদ্দেশে কাওয়ালী গাইব; কারণ তোমার অটল মহব্বত আসমান থেকেও উঁচু, তোমার বিশ্বস্ততা মেঘেরও উপরে পৌঁছায়। হে আল্লাহ্‌, তোমার মহিমা আসমান ছাপিয়ে উঠুক; তোমার গৌরব সমস্ত দুনিয়ার উপরে দেখা দিক। তোমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে আমাদের তুমি উদ্ধার কর; আমার ডাকে সাড়া দাও, যেন তুমি যাদের ভালবাস তারা উদ্ধার পায়। আল্লাহ্‌ তাঁর পবিত্রতার নাম করে বলেছেন, “আমি আনন্দের সংগে শিখিম ভাগ করে দেব, সুক্কোতের উপত্যকার জায়গা জরীপ করে ভাগ করে দেব। গিলিয়দ আমার, মানশাও আমার; আফরাহীম যেন আমার মাথার লোহার টুপী, আর এহুদা আমার রাজদণ্ড। মোয়াব আমার পা ধোয়ার পাত্র; আমি ইদোমের উপরে আমার পায়ের জুতা ফেলব, আর ফিলিস্তীনের উপরে জয়ের হাঁক দেব।” কে আমাকে ঐ শহরে নিয়ে যাবে যেখানে ঢোকা শক্ত? কে আমাকে পথ দেখিয়ে ইদোমে নিয়ে যাবে? হে আল্লাহ্‌, তুমি কি আমাদের বাতিল কর নি? আমাদের সৈন্যদলের সংগে তুমি তো আর যাও না। হে আল্লাহ্‌, শত্রুর বিরুদ্ধে তুমি আমাদের সাহায্য কর, কারণ মানুষের সাহায্যের তো কোন দাম নেই। আল্লাহ্‌র সাহায্যে আমরা জয়লাভ করব; আমাদের শত্রুদের তিনিই পায়ে মাড়াবেন। হে আল্লাহ্‌ আমি তোমার প্রশংসা করি; তুমি চুপ করে থেকো না। দুষ্ট ছলনাকারী লোকেরা আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে; তাদের মিথ্যাবাদী জিভ্‌ দিয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। তারা আমাকে ঘৃণার কথা দিয়ে ঘিরে ফেলেছে, বিনা কারণে আমার উপর হামলা করেছে। আমার ভালবাসার বদলে তারা আমার বিরুদ্ধে শত্রুতা করে, কিন্তু আমি মুনাজাতে ব্যস্ত থাকি। তারা উপকারের বদলে আমার ক্ষতি করে, ভালবাসার বদলে আমাকে ঘৃণা করে। তুমি তাদের উপরে দুষ্ট বিচারক নিযুক্ত কর; যারা তাদের দোষী করবে তারা তাদের ডান পাশে দাঁড়াক। বিচারে তাদের দোষী বলে রায় দেওয়া হোক; তাদের মুনাজাত গুনাহ্‌ বলে ধরা হোক। তাদের আয়ু অল্প হোক; তাদের উঁচু পদ অন্য লোকেরা নিয়ে যাক। তাদের ছেলেমেয়েরা বাবাকে হারাক; তাদের স্ত্রীরা বিধবা হোক। তাদের ছেলেমেয়েরা পথে পথে ভিক্ষা করুক আর তাদের ভাংগাচোরা ঘর থেকে দূরে গিয়ে খাবার খুঁজে বেড়াক। মহাজন তাদের সব কিছু নিয়ে যাক; অন্য লোকে তাদের পরিশ্রমের ফল লুটে নিক। তাদের প্রতি দয়া করতে পারে এমন কেউ না থাকুক; তাদের এতিম ছেলেমেয়েদের প্রতি কেউ মমতা না করুক। তাদের বংশধরদের মেরে ফেলা হোক; তাদের সন্তানদের নাম মুছে ফেলা হোক। তাদের পূর্বপুরুষদের অন্যায়ের কথা মাবুদের মনে থাকুক; তাদের মায়েদের গুনাহ্‌ মুছে ফেলা না হোক। সব সময় সেগুলো মাবুদের সামনে থাকুক, যাতে তিনি দুনিয়া থেকে তাদের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেন। তারা দয়া করার কথা কখনও মনে করত না, বরং দুঃখী, গরীব ও হতাশ লোকদের হত্যা করবার জন্য জুলুম করত। তারা বদদোয়া দিতে ভালবাসত, তাই সেই বদদোয়া তাদেরই উপরে পড়ল; দোয়া করতে তাদের ভাল লাগত না, তাই দোয়া তাদের কাছ থেকে দূরে গেল। কাপড় পরার মত করে বদদোয়া দেওয়া তাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল; তা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল তাদের পানি খাওয়ার মত আর গায়ে তেল মাখাবার মত। সেই বদদোয়া চাদরের মত তাদের জড়িয়ে রাখুক আর কোমর-বাঁধনির মত সব সময় বেঁধে রাখুক। আমার বিপক্ষেরা, যারা আমার বিষয়ে খারাপ কথা বলে, তারা মাবুদের কাছ থেকে যেন এই ফলই পায়। কিন্তু তুমি, হে আল্লাহ্‌ মালিক, তোমার সুনাম রক্ষার জন্য তুমি আমার প্রতি দয়া কর; তোমার মহব্বতের মেহেরবানীতে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। আমি দুঃখী ও অভাবী; আমি অন্তরে আঘাত পেয়েছি। বিকালের ছায়ার মতই আমি মিলিয়ে যাচ্ছি; পংগপালের মত আমাকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। না খেয়ে খেয়ে আমার হাঁটু দুর্বল হয়েছে; আমার শরীর রোগা হয়ে গেছে, একেবারে শুকিয়ে গেছে। আমার বিপক্ষদের কাছে আমি ঠাট্টার পাত্র হয়েছি; তারা আমাকে দেখে মাথা নাড়ে। হে আল্লাহ্‌ আমার মাবুদ, আমাকে সাহায্য কর; তোমার অটল মহব্বতের দরুন আমাকে রক্ষা কর। তারা জানুক এ তোমারই কাজ; তুমিই, হে মাবুদ, এই কাজ করেছ। তারা বদদোয়া দিক, কিন্তু তুমি দোয়া কোরো; তারা আমার বিরুদ্ধে উঠলে লজ্জায় পড়বে, কিন্তু তোমার গোলাম আনন্দিত হবে। আমার বিপক্ষেরা অপমানে ঢাকা পড়ুক, আর লজ্জা চাদরের মত তাদের গায়ে জড়িয়ে থাকুক। আমি সকলের সামনে মাবুদের অনেক শুকরিয়া আদায় করব, আর অনেক লোকের মধ্যে তাঁর প্রশংসা করব; কারণ তিনি অভাবীর পাশে থাকেন, যেন অন্যায় বিচারের রায় থেকে তার প্রাণ রক্ষা করতে পারেন। মাবুদ আমার প্রভুকে বললেন, “যতক্ষণ না আমি তোমার শত্রুদের তোমার পায়ের তলায় রাখি, ততক্ষণ তুমি আমার ডান দিকে বস।” তোমার রাজপদের অধিকার মাবুদ সিয়োন থেকে প্রকাশ করবেন; তিনি বলবেন, “তোমার শত্রুদের মাঝখানে থেকে তুমি রাজত্ব কোরো।” যুদ্ধের দিনে তোমার লোকেরা নিজেরাই যুদ্ধ করতে আসবে; পবিত্রতার সাজে সেজে ভোরের গর্ভ থেকে যেমন শিশির, তেমনি তোমার কাছে তোমার যুবকেরা। মাবুদ কসম খেয়েছেন, “তুমি চিরকালের জন্য মাল্‌কীসিদ্দিকের মত ইমাম।” এই বিষয়ে তিনি তাঁর মন বদলাবেন না। দীন-দুনিয়ার মালিক তোমার ডান পাশে আছেন; তাঁর গজবের দিনে তিনি বাদশাহ্‌দের শেষ করে দেবেন। তিনি বিভিন্ন জাতির বিচার করে রায় দেবেন; তিনি দুনিয়া লাশে পরিপূর্ণ করবেন; তিনি দুনিয়ার সব জায়গায় শত্রুদের মাথা চুরমার করবেন। তাদের তাড়া করে যেতে যেতে তিনি স্রোতের পানি খাবেন, তাতে সতেজ হয়ে শেষে তিনি জয়ী হবেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমি সমস্ত দিল দিয়ে মাবুদের প্রশংসা করব, প্রশংসা করব আল্লাহ্‌ভক্তদের দলের মধ্যে, প্রশংসা করব মাহ্‌ফিলের লোকদের মধ্যে। মাবুদের সব কাজ মহৎ; যারা তাতে আনন্দিত হয় তারা সেই সব নিয়ে ধ্যান করে। তাঁর কাজ গৌরব ও মহিমায় পূর্ণ, তাঁর সততা চিরকাল স্থায়ী। তিনি তাঁর অলৌকিক চিহ্ন স্মরণীয় করে রাখলেন; তিনি দয়াময় এবং মমতায় পূর্ণ। তাঁর ভক্তদের তিনি খাবার যুগিয়ে দেন; তাঁর স্থাপন করা ব্যবস্থা তিনি কখনও ভুলবেন না। অন্যান্য জাতির দেশ অধিকার হিসাবে তাঁর বান্দাদের দিয়ে তিনি তাঁর কাজের শক্তি তাদের দেখিয়েছেন। তাঁর সব কাজে তিনি বিশ্বস্ত ও ন্যায়ে পূর্ণ; তাঁর সমস্ত নিয়ম বিশ্বাসযোগ্য। সেই নিয়মগুলো চিরকাল স্থায়ী; তা বিশ্বস্ততা ও সততার সংগে স্থাপন করা হয়েছে। তাঁর বান্দাদের জন্য তিনি মুক্তির বন্দোবস্ত করেছেন; তিনি হুকুম দিয়ে চিরকালের জন্য তাঁর ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন। তিনি পবিত্র; তিনি ভয় জাগান। মাবুদের প্রতি ভয় হল জ্ঞানের ভিত্তি; যারা সেই অনুসারে কাজ করে তারা সুবুদ্ধি পায়। মাবুদের প্রশংসা চিরকাল স্থায়ী। আলহামদুলিল্লাহ্‌! ধন্য সে, যে মাবুদকে ভয় করে এবং তাঁর হুকুমে খুব আনন্দিত হয়। তার বংশধরেরা দুনিয়াতে শক্তিশালী হবে; অন্তরে যে খাঁটি তার বংশ দোয়া পাবে। তার ঘরে ধন ও সম্পদ থাকবে; তার সততা চিরকাল স্থায়ী। যে অন্তরে খাঁটি তার জন্য অন্ধকারেও আলো দেখা দেয়, কারণ সে দয়ালু, মমতায় পূর্ণ ও সৎ। যে দয়া করে ও ধার দেয় আর ন্যায়ভাবে সব কাজ করে তার উন্নতি হয়। সে সব সময় স্থির থাকবে; আল্লাহ্‌ভক্ত লোককে মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। দুঃসংবাদেও সে ভয় পাবে না; তার অন্তর স্থির আর সে মাবুদের উপর ভরসা করে। তার অন্তর সুস্থির বলে সে ভয় করে না; শেষে সে তার শত্রুদের পরাজয় দেখবে। সে খোলা হাতে গরীবদের দান করেছে; তার সততা চিরকাল স্থায়ী, তার শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। দুষ্ট লোক তা দেখে বিরক্ত হবে; সে দাঁতে দাঁত ঘষবে ও শেষ হয়ে যাবে। দুষ্টদের আশা-ভরসা নিষ্ফল হবে। আলহামদুলিল্লাহ্‌! হে মাবুদের গোলামেরা, প্রশংসা কর; মাবুদের প্রশংসা কর। মাবুদের নামের প্রশংসা হোক, এখন ও চিরকাল হোক। সূর্য ওঠার স্থান থেকে শুরু করে তার অস্ত যাবার স্থান পর্যন্ত মাবুদের প্রশংসা হোক। সমস্ত জাতি মাবুদের অধীন; আসমানেরও উপরে রয়েছে তাঁর মহিমা। আর কে আছে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র মত? তিনি আকাশেরও অনেক উপরে বাস করেন আর নীচু হয়ে আসমান ও জমীনের দিকে তাকান। তিনি ধুলা থেকে দুঃখীকে উঠান, আর অভাবীকে উঠান ময়লার স্তূপ থেকে; যাতে তিনি উঁচু পদের লোকদের সংগে তাদের বসিয়ে দিতে পারেন, এমন কি, যারা তাঁর বান্দাদের মধ্যে উঁচু পদে আছে তাদের সংগে বসিয়ে দিতে পারেন। তিনি বন্ধ্যাকে ছেলেমেয়েদের আনন্দময়ী মা করে সংসারের পূর্ণ অধিকার দেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌! ইসরাইল জাতি যখন মিসর থেকে বের হয়ে আসল, ভিন্ন ভাষায় কথা বলা লোকদের মধ্য থেকে ইয়াকুবের বংশ যখন বের হয়ে আসল, তখন এহুদা হল আল্লাহ্‌র পবিত্র স্থান, ইসরাইল হল তাঁর রাজ্য। তা দেখে লোহিত সাগর পালিয়ে গেল, জর্ডান নদী উজানে বইল, আর বড় বড় পাহাড় ভেড়ার মত, ছোট ছোট পাহাড় ভেড়ার বাচ্চার মত লাফাতে লাগল। ওহে সাগর, কি হল তোমার? কেন তুমি পালিয়ে গেলে? ওহে জর্ডান, কেন তুমি উজানে বইলে? ওহে বড় বড় পাহাড়, কেন তোমরা ভেড়ার মত লাফাতে লাগলে? ওহে ছোট ছোট পাহাড়, কেন লাফাতে লাগলে ভেড়ার বাচ্চার মত? হে দুনিয়া, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ মালিকের সামনে কেঁপে ওঠো। তিনি পাথুরে পাহাড়কে করলেন পুকুর আর শক্ত পাথরকে করলেন পানির ঝর্ণা। আমাদের নয়, হে মাবুদ, আমাদের নয়, কিন্তু তোমার প্রশংসা হোক; তোমার অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার জন্যই হোক। অন্য জাতিরা কেন বলবে, “কোথায় ওদের আল্লাহ্‌?” আমাদের আল্লাহ্‌ বেহেশতে আছেন; তাঁর ইচ্ছামত তিনি কাজ করেন। ওদের মূর্তিগুলো সোনা আর রূপা দিয়ে মানুষের হাতে গড়া। তাদের মুখ আছে কিন্তু কথা বলতে পারে না, চোখ আছে কিন্তু দেখতে পায় না; তাদের কান আছে কিন্তু শুনতে পায় না, নাক আছে কিন্তু গন্ধ নিতে পারে না। তাদের হাত আছে কিন্তু ছুঁতে পারে না, পা আছে কিন্তু হাঁটতে পারে না, গলা দিয়ে কোন শব্দও বের করতে পারে না। যারা এগুলোকে তৈরী করে আর তাদের উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করে তারাও ঐ সব মূর্তির মত হবে। হে বনি-ইসরাইলরা, মাবুদের উপর ভরসা কর - তিনিই তাদের সাহায্যকারী ও ঢাল। হে হারুনের বংশ, মাবুদের উপর ভরসা কর - তিনিই তাদের সাহায্যকারী ও ঢাল। হে মাবুদের ভক্তেরা, মাবুদের উপর ভরসা কর - তিনিই তাদের সাহায্যকারী ও ঢাল। মাবুদ আমাদের কথা মনে করেছেন, সেজন্য তিনি আমাদের দোয়া করবেন; হ্যাঁ, তিনি ইসরাইলের বংশকে দোয়া করবেন, তিনি হারুনের বংশকে দোয়া করবেন, তিনি তাঁর ছোট-বড় সব ভক্তকে দোয়া করবেন। মাবুদ তোমাদের ও তোমাদের সন্তানদের বংশ বাড়িয়ে তুলুন। মাবুদ, যিনি আসমান ও জমীনের সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের দোয়া করুন। বেহেশত হল মাবুদেরই বেহেশত, কিন্তু দুনিয়াটা তিনি মানুষকে দিয়েছেন। মৃতেরা তো মাবুদের প্রশংসা করে না; যারা মৃত্যুর নীরবতার মধ্যে নেমে যায় তারা প্রশংসা করে না; কিন্তু আমরা মাবুদের প্রশংসা করব, প্রশংসা করব এখন থেকে চিরকাল। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমি মাবুদকে মহব্বত করি, কারণ তিনি আমার মিনতি শুনেছেন। তিনি আমার কথায় কান দিয়েছেন, তাই যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন তাঁকে ডাকব। মৃত্যুর দড়িতে আমি বাঁধা পড়েছিলাম, কবরের আজাব আমাকে পেয়ে বসেছিল; আমি দুঃখ ও কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন আমি মাবুদকে ডেকে বললাম, “হে মাবুদ, আমি তোমার কাছে মিনতি করি, তুমি আমার প্রাণ বাঁচাও।” মাবুদ দয়াময় ও ন্যায়বান; আমাদের আল্লাহ্‌ মমতায় পূর্ণ। মাবুদ সরলমনা লোকদের রক্ষা করেন; আমি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু তিনিই আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। হে আমার প্রাণ, আবার শান্ত হও, কারণ মাবুদ তোমার অনেক উন্নতি করেছেন। হে মাবুদ, তুমিই মৃত্যু থেকে আমার প্রাণ, চোখের পানি থেকে আমার চোখ, আর পড়ে যাওয়ার হাত থেকে আমার পা রক্ষা করেছ। আমি জীবিতদের মধ্যে মাবুদের সামনে চলাফেরা করব। যখন আমি বলেছিলাম, “আমি খুব দুর্দশায় পড়েছি,” তখনও আমার ঈমান ছিল। আমি ভয় পেয়ে বলেছিলাম, “সব মানুষই মিথ্যাবাদী।” মাবুদ আমার যে সব উন্নতি করেছেন তার বদলে আমি তাঁকে কি দেব? তিনি বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন, সেজন্য ঢালন-কোরবানীর পেয়ালা আমি তুলে ধরব আর তাঁর গৌরব ঘোষণা করব। মাবুদের কাছে আমি যে সব মানত করেছি তাঁর সব বান্দাদের সামনেই আমি তা পূর্ণ করব। মাবুদের কাছে তাঁর ভক্তদের মৃত্যুর মূল্য অনেক বেশী। হে মাবুদ, সত্যিই আমি তোমার গোলাম, তোমারই গোলাম, তোমার বাঁদীর ছেলে; তুমিই আমার বাঁধন খুলে দিয়েছ। আমি তোমার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা-কোরবানী দেব আর তোমার গৌরব ঘোষণা করব। মাবুদের কাছে আমি যে সব মানত করেছি তাঁর সব বান্দাদের সামনেই আমি তা পূর্ণ করব; হে জেরুজালেম, তোমারই মধ্যে, মাবুদের ঘরের উঠানে আমি তা পূর্ণ করব। আলহামদুলিল্লাহ্‌! হে সমস্ত জাতি, মাবুদের গৌরব কর; হে সমস্ত লোক, তাঁর প্রশংসা কর; কারণ আমাদের প্রতি মাবুদের মহব্বত প্রচুর আর তাঁর বিশ্বস্ততা চিরকাল স্থায়ী। আলহামদুলিল্লাহ্‌! মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, কারণ তিনি মেহেরবান; তাঁর অটল মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। বনি-ইসরাইলরা বলুক, “তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” হারুনের বংশ বলুক, “তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” মাবুদের ভক্তেরা বলুক, “তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী।” আমি বিপদে পড়ে মাবুদকে ডাকলাম; তিনি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে একটা খোলা জায়গায় আমাকে বের করে আনলেন। মাবুদ আমার পক্ষে আছেন, আমি ভয় করব না; মানুষ আমার কি করতে পারে? আমার সাহায্যকারী হিসাবে মাবুদ আমার পক্ষে আছেন, তাই আমার শত্রুদের পরাজয় আমি দেখতে পাব। মানুষের উপরে নির্ভর করার চেয়ে মাবুদের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া ভাল। উঁচু পদের লোকদের উপরে ভরসা করার চেয়ে মাবুদের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া ভাল। সমস্ত জাতি আমাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু মাবুদের নামে আমি তাদের শেষ করে দেব। তারা আমাকে ঘিরে ধরেছে, সত্যিই তারা আমাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু মাবুদের নামে আমি তাদের শেষ করে দেব। মৌমাছির মত তারা আমাকে ঘিরে ধরেছে; কাঁটা-ঝোপের আগুনের মতই তাড়াতাড়ি তারা নিভে গেছে। মাবুদের নামে আমি তাদের নিশ্চয়ই শেষ করে দেব। আমি যাতে পড়ে যাই সেজন্য তারা আমাকে ধাক্কা মেরেছিল, কিন্তু মাবুদ আমাকে সাহায্য করলেন। মাবুদই আমার শক্তি, তিনিই আমার কাওয়ালী; তাঁরই মধ্যে রয়েছে আমার উদ্ধার। সৎ লোকদের বাড়ীতে উদ্ধারের আনন্দধ্বনি শোনা যায়; মাবুদের শক্তিশালী হাত মহৎ কাজ করেছে। মাবুদের শক্তিশালী হাত জয় দান করেছে; মাবুদের শক্তিশালী হাত মহৎ কাজ করেছে। আমি মরব না, বেঁচে থাকব, আর মাবুদ যা করেছেন তা ঘোষণা করব। মাবুদ আমাকে কড়া শাসন করেছেন, কিন্তু মৃত্যুর হাতে তিনি আমাকে তুলে দেন নি। আমাকে ন্যায়বান মাবুদের ঘরের দরজা খুলে দাও, যেন আমি সেখানে ঢুকে তাঁকে শুকরিয়া জানাতে পারি। এই তো মাবুদের ঘরের দরজা; এর মধ্য দিয়েই সৎ লোকেরা ঢোকে। আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করব, কারণ তুমি আমার কথা শুনেছ; আমার উদ্ধার তোমারই মধ্যে রয়েছে। রাজমিস্ত্রিরা যে পাথরটা বাতিল করে দিয়েছিল সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল; মাবুদই এটা করলেন, আর তা আমাদের চোখে খুব আশ্চর্য লাগে। এই সেই দিন যা মাবুদ ঠিক করেছেন; এস, আমরা এই দিনে আনন্দ করি ও খুশী হই। হে মাবুদ, মিনতি করি তুমি আমাদের উদ্ধার কর; হে মাবুদ, মিনতি করি সফলতা দান কর। যিনি মাবুদের নামে আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক। মাবুদের ঘর থেকে আমরা তোমাদের দোয়া করছি। আল্লাহ্‌ই মাবুদ, তিনিই আমাদের নূর দিয়েছেন। ঈদের কোরবানীর পশু তোমরা দড়ি দিয়ে কোরবানগাহের শিংয়ে বেঁধে দাও। তুমিই আমার আল্লাহ্‌, আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাব; তুমিই আমার আল্লাহ্‌, আমি তোমার প্রশংসা করব। মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, কারণ তিনি মেহেরবান; তাঁর অটল মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। ধন্য তারা, যারা নিখুঁত জীবন কাটায় আর মাবুদের নির্দেশ অনুসারে চলে। ধন্য তারা, যারা তাঁর কথা মেনে চলে আর সমস্ত দিল দিয়ে তাঁর ইচ্ছামত চলে। তারা কোন অন্যায় করে না; তারা মাবুদের পথেই চলে। তুমি নিয়ম-কানুন ঠিক করে দিয়েছ যেন আমরা তা যত্নের সংগে পালন করি। আহা! তোমার নিয়ম মত চলার জন্য যেন আমার মনের স্থিরতা থাকে। তাহলে তোমার সব হুকুম পালন করবার দরুন আমি লজ্জিত হব না। তোমার ন্যায়পূর্ণ শরীয়ত শিক্ষা করতে করতে আমি খাঁটি অন্তরে তোমাকে শুকরিয়া জানাব। আমি তোমার নিয়ম মত চলব; আমাকে একেবারে ত্যাগ কোরো না। যুবক কেমন করে তার জীবন খাঁটি রাখতে পারবে? তোমার কালাম পালন করেই সে তা পারবে। আমার সারা অন্তর দিয়ে আমি তোমাকে জানতে আগ্রহী হয়েছি; তোমার হুকুম-পথের বাইরে আমাকে ঘুরে বেড়াতে দিয়ো না। তোমার কালাম আমার অন্তরে আমি জমা করে রেখেছি, যাতে তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ না করি। হে মাবুদ, সমস্ত প্রশংসা তোমার। তোমার নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও। তোমার মুখ থেকে যে সব শরীয়ত বের হয়েছে আমার মুখ তা প্রকাশ করবে। মহাধন লাভ করলে মানুষ যেমন আনন্দ পায়, তোমার কথা মেনে চলে আমি তেমনই আনন্দ পাই। আমি তোমার নিয়ম-কানুনের বিষয় ধ্যান করি, আর তোমার পথের দিকে মনোযোগ দিই। তোমার নিয়মের মধ্যে আমি আনন্দ পাই; তোমার কালাম আমি ভুলে যাব না। তোমার এই গোলামের উন্নতি কর যেন আমি বেঁচে থাকি আর তোমার কালাম পালন করতে পারি। আমার চোখ খুলে দাও যাতে তোমার শিক্ষার মধ্যে আমি আশ্চর্য আশ্চর্য বিষয় দেখতে পাই। আমি তো দুনিয়াতে বাসকারী একজন বিদেশী; তোমার হুকুম আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখো না। তোমার শরীয়ত জানার জন্য সব সময় আমার প্রাণের আকুলতা খুব বেশী। তুমি অহংকারীদের ধমক দিয়ে থাক; তারা তো বদদোয়াপ্রাপ্ত, তারা তোমার হুকুমের পথ ছেড়ে ঘুরে বেড়ায়। অপমান ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ তুমি আমার কাছ থেকে দূর কর, কারণ আমি তোমার কথা মেনে চলি। যদিও শাসনকর্তারা বসে আমার বিপক্ষে কথা বলেন তবুও তোমার এই গোলাম তোমার নিয়ম ধ্যান করে। তোমার কথাই আমার আনন্দ; সেগুলো আমাকে পরামর্শ দেয়। আমি ধুলায় লুটিয়ে পড়েছি; তোমার কালাম অনুসারে আমাকে নতুন শক্তি দান কর। আমার জীবনের সব কথা আমি তোমাকে জানিয়েছি, আর তুমি আমাকে জবাব দিয়েছ; তোমার নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও; তোমার নিয়ম-কানুনের নির্দেশ আমাকে বুঝবার শক্তি দাও; তাহলে আমি তোমার কুদরতি কাজের বিষয় ধ্যান করতে পারব। দুঃখে আমার প্রাণ কাতর হয়ে পড়েছে; তোমার কালাম অনুসারে আমাকে শক্তি দান কর। আমার মধ্য থেকে ছলনা দূর কর; তুমি রহমত করে তোমার শিক্ষা আমাকে দান কর। আমি বিশ্বস্ততার পথ বেছে নিয়েছি; তোমার শরীয়ত আমার সামনে রেখেছি। হে মাবুদ, আমি তোমার কথা আঁকড়ে ধরে রেখেছি; তুমি আমাকে লজ্জা পেতে দিয়ো না। তোমার হুকুমের পথে আমি দৌড়ে যাব, কারণ তুমি আমার অন্তর খুলে দিয়েছ। হে মাবুদ, তোমার নিয়ম সম্বন্ধে আমাকে শিক্ষা দাও; জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি তা পালন করব। আমাকে বুঝবার শক্তি দাও, যাতে আমি তোমার নির্দেশ অনুসারে চলতে পারি আর আমার সমস্ত দিল দিয়ে তা পালন করতে পারি। তোমার হুকুমের পথে আমাকে চালাও, কারণ তাতেই আমি আনন্দ পাই। অন্যায় লাভের দিকে আমার অন্তর যেন না ফেরে, বরং তোমার কথার দিকে তুমি আমার অন্তর ফিরাও। অসার জিনিসের দিক থেকে তুমি আমার চোখ ফিরাও; তোমার পথে চলতে আমাকে নতুন শক্তি দাও। তোমার এই গোলামের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছ তা তুমি পূর্ণ কর, যাতে আমি তোমাকে ভয় করতে পারি। আমার অপমান তুমি দূর কর যার বিষয়ে আমি ভয় পাই; সত্যিই তোমার শরীয়ত ভাল বয়ে আনে। তোমার নিয়ম-কানুনের প্রতি আমার আগ্রহ রয়েছে; তুমি ন্যায়বান বলে আমাকে নতুন শক্তি দাও। হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত আমাকে দেখাও; তোমার ওয়াদা অনুসারে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। তাহলে যারা আমাকে ঠাট্টা করে তাদের আমি জবাব দিতে পারব, কারণ আমি তোমার কালামের উপর ভরসা করি। তোমার সত্যের কালাম তুমি আমার মুখ থেকে একেবারে কেড়ে নিয়ো না, কারণ তোমার শরীয়তের উপরেই আমি আশা করে রয়েছি। আমি সব সময় তোমার নির্দেশ পালন করব, চিরকাল তা করব। আমি বিনা বাধায় জীবন কাটাব, কারণ তোমার নিয়ম-কানুনের দিকে আমি মনোযোগ দিয়েছি। তুমি যে সব কথা বলেছ তা আমি বাদশাহ্‌দের সামনে বলব; আমি লজ্জিত হব না। তোমার সব হুকুম পালন করার মধ্যে আমি আনন্দ পাই, কারণ আমি সেগুলো ভালবাসি। তোমার সব হুকুমের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ আছে, কারণ আমি সেগুলো ভালবাসি; তোমার নিয়ম আমি ধ্যান করি। তোমার এই গোলামের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছ তা মনে করে দেখ; তার দ্বারাই তো তুমি আমাকে আশা দিয়েছিলে। তোমার কালাম যে আমাকে নতুন শক্তি দেয়, কষ্টভোগের সময় এটাই আমার সান্ত্বনা। অহংকারীরা আমাকে খুব ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, কিন্তু আমি তোমার নির্দেশ থেকে একটুও সরে যাই নি। হে মাবুদ, অনেক কাল আগে দেওয়া তোমার শরীয়তের কথা আমি মনে করি আর নিজেকে সান্ত্বনা দিই। দুষ্ট লোকদের দুষ্টতা দেখে ভীষণ রাগ আমাকে পেয়ে বসেছে; তারা তো তোমার নির্দেশ ত্যাগ করেছে। আমি যতদিন এই দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে আছি ততদিন তোমার নিয়মগুলোই হবে আমার কাওয়ালীর বিষয়। হে মাবুদ, আমি তোমার নির্দেশ মেনে চলি, আর রাতে তোমার কথা মনে করি। এটাই আমার অভ্যাস যে, আমি তোমার নিয়ম-কানুন মেনে চলি। হে মাবুদ, তুমি আমার সম্পত্তি; আমি তোমার কথা মেনে চলার জন্য ওয়াদা করেছি। আমি মনেপ্রাণে তোমার রহমত চেয়েছি; তোমার কালাম অনুসারে তুমি আমার প্রতি রহমত কর। আমার চলাফেরার বিষয় আমি চিন্তা করে দেখেছি, সেজন্য তোমার কালামের দিকে আমার পা ফিরিয়েছি। তুমি যে সব হুকুম দিয়েছ তা আমি তাড়াতাড়ি পালন করেছি, দেরি করি নি। দুষ্ট লোকদের দড়িতে আমি বাঁধা পড়েছি, কিন্তু আমি তোমার নির্দেশ ভুলে যাই নি। তোমার ন্যায়পূর্ণ শরীয়তের জন্য শুকরিয়া জানাতে আমি দুপুর রাতে উঠি। যারা তোমাকে ভয় করে ও তোমার নিয়ম-কানুন পালন করে আমি তাদের সকলের সংগী। হে মাবুদ, দুনিয়া তোমার অটল মহব্বতে পূর্ণ; তোমার নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও। হে মাবুদ, তোমার কালাম অনুসারে তোমার এই গোলামের তুমি মেহেরবানী করেছ। আমার যাতে ভাল বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান হয় সেজন্য তুমি আমাকে শিক্ষা দাও; তোমার সব হুকুমের উপর আমি ভরসা করি। কষ্ট পাবার আগে আমি বিপথে ছিলাম, কিন্তু এখন আমি তোমার কালামের বাধ্য হয়েছি। তুমি মেহেরবান আর মেহেরবানীই করে থাক; তোমার নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও। অহংকারীরা মিথ্যা দিয়ে আমাকে ঢেকে দিয়েছে কিন্তু আমি মনপ্রাণ দিয়ে তোমার নিয়ম-কানুন পালন করি। তাদের অন্তর চর্বির মত অসাড়, কিন্তু আমি তোমার সমস্ত নির্দেশে আনন্দ পাই। আমি যে কষ্ট পেয়েছি তা আমার পক্ষে ভালই হয়েছে; তাতে আমি তোমার নিয়ম শিখতে পারছি। তোমার মুখের নির্দেশ আমার কাছে হাজার হাজার সোনা-রূপার টুকরার চেয়েও দামী। তোমার হাতই আমাকে তৈরী করেছে, আমাকে গড়েছে; আমাকে বুঝবার শক্তি দাও যাতে তোমার সব হুকুম আমি জানতে পারি। যারা তোমাকে ভয় করে তারা আমাকে দেখে আনন্দ পাবে, কারণ আমি তোমার ওয়াদার উপর ভরসা করে আছি। হে মাবুদ, আমি জানি তোমার শরীয়ত ন্যায়ে পূর্ণ; তুমি বিশ্বস্ত বলে আমাকে কষ্ট দিয়েছ। তোমার এই গোলামের কাছে তুমি যে ওয়াদা করেছ সেই অনুসারে তোমার অটল মহব্বতই হোক আমার সান্ত্বনা। আমার প্রতি তোমার মমতা নেমে আসুক যেন আমি বেঁচে থাকি, কারণ তোমার নির্দেশ আমাকে আনন্দ দেয়। মিথ্যা কথা বলে আমার সর্বনাশ করার জন্য অহংকারীরা লজ্জিত হোক; কিন্তু আমি তোমার নিয়ম-কানুনের বিষয় ধ্যান করব। যারা তোমাকে ভয় করে ও তোমার কালাম বুঝতে পারে তারা আমার কাছে ফিরে আসুক। তোমার নিয়ম পালন করার সময় আমার অন্তর যেন নিখুঁত থাকে, যাতে আমি লজ্জায় না পড়ি। তুমি আমাকে রক্ষা করবে সেই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার শক্তি কমে যাচ্ছে; আমি তোমার কালামে আশা রেখেছি। তোমার ওয়াদা পূর্ণ হবার অপেক্ষায় আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে; আমি বলি, “কখন তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেবে?” আংগুর-রস রাখা চামড়ার থলি ধোঁয়ায় যেমন নষ্ট হয়ে যায় আমি তেমনই হয়েছি; তবুও তোমার নিয়ম আমি ভুলে যাই না। তোমার এই গোলামের আয়ু আর কতকাল? আমাকে যারা জুলুম করে কবে তুমি তাদের বিচার করবে? অহংকারীরা আমার জন্য গর্ত খুঁড়েছে; তারা তোমার নির্দেশ মানে না। তোমার সমস্ত হুকুমই বিশ্বাসযোগ্য। লোকে মিথ্যা কথা বলে আমাকে জুলুম করে; তুমি আমাকে সাহায্য কর। দুনিয়া থেকে তারা আমাকে প্রায় মুছে ফেলেছিল, কিন্তু তোমার নিয়ম-কানুন আমি ত্যাগ করি নি। তোমার অটল মহব্বতে তুমি আমাকে নতুন শক্তি দাও, যাতে তোমার মুখের কালাম আমি পালন করতে পারি। হে মাবুদ, তোমার কালাম বেহেশতে চিরকাল স্থির আছে। বংশের পর বংশ ধরে তোমার বিশ্বস্ততা বয়ে চলেছে; তুমি দুনিয়া স্থাপন করেছ, আর তা স্থির রয়েছে। তোমার শরীয়ত অনুসারে আজও সব কিছু স্থির আছে, কারণ সেগুলো তোমার অধীনে রয়েছে। তোমার সব নির্দেশে যদি আমি আনন্দ না পেতাম, তবে আমার কষ্টে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। তোমার নিয়ম-কানুন আমি কখনও ভুলে যাব না, কারণ তার দ্বারাই তো তুমি আমাকে নতুন শক্তি দান করেছ। আমাকে রক্ষা কর, কারণ আমি তোমারই; তোমার নিয়ম-কানুনের দিকে আমি মনোযোগ দিয়েছি। দুষ্টেরা আমাকে ধ্বংস করার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তোমার কালাম নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করব। আমি দেখেছি কোন কিছুরই পরিপূর্ণতা নেই, কিন্তু তোমার হুকুমগুলো সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ। আমি তোমার নির্দেশ কত ভালবাসি! সারা দিন আমি তা ধ্যান করি। তোমার সব হুকুম আমার শত্রুদের চেয়ে আমাকে বুদ্ধিমান করে তোলে, কারণ সেগুলো সব সময়েই আমার সংগে সংগে থাকে। আমার সব শিক্ষকদের চেয়ে আমি জ্ঞানবান, কারণ তোমার সমস্ত কথা আমি ধ্যান করি। বৃদ্ধ লোকদের চেয়েও আমি বেশী বুঝি, কারণ আমি তোমার নিয়ম-কানুন পালন করি। সমস্ত কুপথ থেকে আমার পা আমি সরিয়ে রেখেছি, যাতে আমি তোমার কালাম পালন করতে পারি। তোমার শরীয়তের পথ থেকে আমি সরে যাই নি, কারণ তুমি নিজেই আমাকে শিক্ষা দিয়েছ। তোমার সব ওয়াদা আমার জিভে কেমন মিষ্টি লাগে! তা আমার মুখে মধুর চেয়েও মিষ্টি মনে হয়। তোমার নিয়ম-কানুন থেকে আমি বিচারবুদ্ধি লাভ করি, তাই আমি সমস্ত মিথ্যা পথ ঘৃণা করি। তোমার কালাম আমার পথ দেখাবার বাতি, আমার চলার পথের আলো। আমি তোমার ন্যায়পূর্ণ শরীয়ত মেনে চলার কসম খেয়েছি, আর সেই কসম পাকাপোক্ত করেছি। আমি অনেক কষ্ট সহ্য করছি; হে মাবুদ, তোমার কালাম অনুসারে আমাকে নতুন শক্তি দাও। হে মাবুদ, আমি নিজের ইচ্ছায় যে প্রশংসা কোরবানী করি তা তুমি কবুল কর, আর তোমার শরীয়ত আমাকে শিক্ষা দাও। যদিও সব সময় আমি জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চলি, তবুও তোমার নির্দেশ আমি ভুলে যাই না। দুষ্টেরা আমার জন্য ফাঁদ পেতেছে, কিন্তু আমি তোমার নিয়ম-কানুন থেকে সরে যাই নি। তোমার কালাম আমার চিরকালের সম্পত্তি; তা আমার অন্তরের আনন্দ। সব সময়, এমন কি, শেষ পর্যন্ত তোমার নিয়ম পালন করার জন্য আমার অন্তরকে আমি স্থির করেছি। দু’মনা লোকদের আমি পছন্দ করি না, কিন্তু তোমার নির্দেশ আমি ভালবাসি। তুমিই আমার আশ্রয় ও আমার ঢাল; তোমার কালামের উপরেই আমি আশা রেখেছি। তোমরা যারা খারাপ কাজ কর, তোমরা আমার কাছ থেকে দূর হও, যাতে আমার আল্লাহ্‌র হুকুম আমি পালন করতে পারি। তোমার ওয়াদা অনুসারে তুমি আমাকে ধরে রাখ, তাতে আমি বেঁচে থাকব; তোমার উপর আমার যে আশা আছে সেই বিষয়ে তুমি আমাকে লজ্জিত হতে দিয়ো না। আমাকে ধর, তাহলে আমি রক্ষা পাব, আর তোমার নিয়ম আমি সব সময় মেনে চলব। তোমার নিয়ম থেকে যারা দূরে চলে যায় তাদের তুমি অগ্রাহ্য করেছ, কারণ তাদের ভান করা নিষ্ফল। দুনিয়ার সব দুষ্টদের তুমি ময়লার মত দূর করে দিয়ে থাক, সেইজন্যই তো তোমার সব কথা আমি ভালবাসি। তোমার ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দেয়; তোমার শরীয়তের দরুন আমি ভয়ে পূর্ণ হই। আমি ন্যায়বিচার ও ন্যায় কাজ করেছি; যারা আমাকে জুলুম করে তাদের হাতে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ো না। তোমার এই গোলামের উপকারের ভার তুমি নাও; অহংকারীদের আমাকে জুলুম করতে দিয়ো না। তোমার সততা অনুসারে তুমি যে ওয়াদা করেছ তা পূর্ণ হবার এবং তোমার দেওয়া উদ্ধার পাবার অপেক্ষায় থেকে আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তোমার এই গোলামের সংগে তোমার অটল মহব্বত অনুসারে ব্যবহার কর, আর তোমার নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও। আমি তোমার গোলাম; আমাকে বুঝবার শক্তি দাও যাতে আমি তোমার কথা বুঝতে পারি। হে মাবুদ, এখন তোমার কাজে নামার সময় হয়েছে; লোকে তো তোমার নির্দেশ অমান্য করেছে। সেইজন্য আমি তোমার সমস্ত হুকুম সোনার চেয়ে, খাঁটি সোনার চেয়েও ভালবাসি। তোমার সমস্ত নিয়ম-কানুন আমি ঠিক বলে মনে করি, আর সমস্ত মিথ্যা পথ ঘৃণা করি। তোমার সমস্ত কথা চমৎকার, সেইজন্যই আমি তা পালন করে থাকি। তোমার কালাম প্রকাশিত হলে তা আলো দান করে; তা সরলমনা লোকদের বুঝবার শক্তি দেয়। তোমার হুকুম পাবার জন্য আমি আকুল হয়ে ছিলাম, যেন আমি মুখ খুলে হাঁপাচ্ছিলাম। যারা তোমাকে মহব্বত করে তাদের প্রতি তুমি যেমন করে থাক, তেমনি করে তুমি আমার দিকে ফেরো ও আমার প্রতি রহমত কর। তোমার কালাম অনুসারে ঠিক পথে চলবার জন্য তুমি আমার পা স্থির কর; কোন অন্যায় যেন আমার উপরে কর্তৃত্ব না করে। লোকদের জুলুমের হাত থেকে তুমি আমাকে মুক্ত কর যেন আমি তোমার নিয়ম-কানুন পালন করতে পারি। তোমার রহমত আলোর মত করে তোমার এই গোলামের উপর পড়ুক; তোমার সব নিয়ম আমাকে শিক্ষা দাও। আমার চোখের পানি স্রোতের মত বইছে, কারণ লোকে তোমার নির্দেশ মানে না। হে মাবুদ, তুমি ন্যায়বান; তোমার বিচার ন্যায্য। তোমার ন্যায্যতায় ও মহা বিশ্বস্ততায় তুমি তোমার শরীয়ত দিয়েছ। আমার শত্রুরা তোমার কালাম ভুলে গেছে বলে তোমার সম্মান রক্ষার জন্য গভীর আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসেছে। তোমার কালাম একেবারে খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই তোমার এই গোলাম তা ভালবাসে। যদিও আমি সামান্য ও তুচ্ছ, তবুও আমি তোমার নিয়ম-কানুন ভুলে যাই না। তোমার ন্যায্যতা চিরকাল স্থায়ী, আর তোমার সমস্ত নির্দেশ সত্য। কষ্ট ও যন্ত্রণা আমার উপর এসে পড়েছে, কিন্তু তোমার সব হুকুমেই আমি আনন্দ পাই। তোমার সব কথা চিরকাল ন্যায়ে পূর্ণ; আমাকে তা বুঝবার শক্তি দাও যেন আমি বেঁচে থাকতে পারি। আমার সমস্ত দিল দিয়ে আমি তোমাকে ডাকছি; হে মাবুদ, আমাকে জবাব দাও। আমি তোমার সব নিয়ম পালন করব। আমি তোমাকেই ডাকছি, আমাকে উদ্ধার কর; আমি তোমার সব কথা পালন করব। ভোর হওয়ার আগেই আমি উঠে সাহায্যের জন্য কাঁদি; তোমার ওয়াদার উপর আমি ভরসা করে আছি। রাত শেষ হবার আগেই আমার চোখ খুলে যায়, যেন তোমার সব ওয়াদা নিয়ে আমি ধ্যান করতে পারি। তোমার অটল মহব্বত অনুসারে তুমি আমার কথা শোন; হে মাবুদ, তোমার শরীয়ত অনুসারে তুমি আমাকে নতুন শক্তি দাও। যারা খারাপ কাজ করে তারা কাছে এসে পড়েছে; তারা তোমার নির্দেশ থেকে অনেক দূরে থাকে। কিন্তু হে মাবুদ, তুমি তো কাছেই আছ, আর তোমার সমস্ত হুকুম সত্য। তোমার কালাম থেকে অনেক আগেই আমি জেনেছি যে, তুমি চিরকালের জন্য তা স্থির করেছ। আমার দুর্দশার দিকে তাকাও, আমাকে রক্ষা কর, কারণ আমি তোমার নির্দেশ ভুলে যাই নি। আমার পক্ষ হয়ে কথা বল, আর আমি যে নির্দোষ তা প্রমাণ কর; তোমার ওয়াদা অনুসারে আমাকে নতুন শক্তি দাও। দুষ্ট লোকদের কাছ থেকে উদ্ধার অনেক দূরে রয়েছে, কারণ তারা তোমার নিয়মের দিকে মনোযোগ দেয় না। হে মাবুদ, তোমার মমতা অনেক বেশী; তোমার শরীয়ত অনুসারে আমাকে নতুন শক্তি দাও। আমার শত্রুরা ও জুলুমবাজ লোকেরা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু আমি তোমার কালাম থেকে সরে যাই নি। বেঈমানদের দেখে আমার ঘৃণা লাগে, কারণ তারা তোমার কালাম অনুসারে চলে না। দেখ, আমি তোমার নিয়ম-কানুন কেমন ভালবাসি! হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত অনুসারে আমাকে নতুন শক্তি দাও। তোমার সমস্ত কালাম সত্য; তোমার প্রত্যেকটি ন্যায়পূর্ণ আইন চিরকাল স্থায়ী। শাসনকর্তারা বিনা কারণেই আমার উপর জুলুম করেন, কিন্তু আমার অন্তরে তোমার কালামের প্রতি ভয় রয়েছে। যুদ্ধে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে লোকে যেমন আনন্দ পায়, ঠিক তেমনি তোমার ওয়াদার জন্য আমি আনন্দ পাই। মিথ্যাকে আমি ঘৃণা করি, জঘন্য মনে করি, কিন্তু তোমার নির্দেশ আমি ভালবাসি। তোমার ন্যায়পূর্ণ শরীয়তের জন্য দিনে সাত বার আমি তোমার প্রশংসা করি। যারা তোমার নির্দেশ ভালবাসে তারা খুব শান্তি পায়; কোন কিছুতেই তারা উচোট খায় না। হে মাবুদ, তুমি আমাকে উদ্ধার করবে আমি সেই আশায় আছি, আর তোমার হুকুম পালন করছি। আমি তোমার সব কথা মেনে চলি আর তা খুব ভালবাসি। আমি তোমার নিয়ম-কানুন ও সব কথা মেনে চলি, কারণ আমার জীবনের আগাগোড়াই তোমার জানা আছে। হে মাবুদ, আমার ফরিয়াদ তোমার সামনে উপস্থিত হোক; তোমার কালাম অনুসারে আমাকে বুঝবার শক্তি দাও। আমার মিনতি তোমার সামনে উপস্থিত হোক; তোমার ওয়াদা অনুসারে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। আমার ঠোঁট থেকে তোমার প্রশংসা উপ্‌চে পড়ুক, কারণ তুমিই আমাকে তোমার নিয়ম শিক্ষা দিচ্ছ। আমার জিভ্‌ তোমার কালাম নিয়ে কাওয়ালী করুক, কারণ তোমার সমস্ত হুকুম ন্যায়পূর্ণ। তোমার হাত আমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকুক, কারণ তোমার নিয়ম-কানুন আমি পালন করব বলে ঠিক করেছি। হে মাবুদ, তুমি আমাকে উদ্ধার করবে সেজন্য আমি আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করে আছি; তোমার সব নির্দেশই আমার আনন্দের বিষয়। আমাকে বাঁচতে দাও যেন আমি তোমার প্রশংসা করতে পারি; তোমার শরীয়ত আমাকে সাহায্য করুক। হারানো ভেড়ার মত আমি বিপথে গিয়েছি; তোমার গোলামকে তুমি খুঁজে নাও, কারণ তোমার হুকুম আমি ভুলে যাই নি। আমার বিপদের সময় আমি মাবুদকে ডাকলাম, তিনি আমাকে জবাব দিলেন। হে মাবুদ, মিথ্যাবাদী মুখ আর ছলনাকারী জিভ্‌ থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। ওহে ছলনাকারী জিভ্‌, তিনি তোমাকে কি দেবেন? তিনি কি তোমাকে আরও শাস্তি দেবেন না? তিনি তোমাকে দেবেন যোদ্ধার ধারালো তীর আর রোতম কাঠের জ্বলন্ত কয়লা। হায়, কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি মেশকীয়দের মত লোকদের কাছে বাস করছি, কায়দারীয়দের মত লোকদের তাম্বুর মধ্যে রয়েছি। যারা শান্তি ঘৃণা করে তেমন লোকদের সংগে আমি আর বাস করতে চাই না। আমি শান্তি ভালবাসি, কিন্তু যখন আমি শান্তির কথা বলি তখন ওরা যুদ্ধ করতে চায়। আমি সেই পাহাড়ের সারির দিকে চোখ তুলে তাকাব; কোথা থেকে আমার সাহায্য আসবে? আসমান ও জমীনের সৃষ্টিকর্তা মাবুদের কাছ থেকেই আমার সাহায্য আসবে। তিনি তোমার পা পিছ্‌লে যেতে দেবেন না; যিনি তোমাকে পাহারা দেন তিনি ঘুমে ঢুলে পড়বেন না। যিনি বনি-ইসরাইলদের পাহারা দেন তিনি তো ঘুমে ঢুলে পড়েন না, ঘুমানও না। মাবুদই তোমার রক্ষাকারী; মাবুদই তোমার ছায়া, তিনি তোমার ডান পাশে রয়েছেন। দিনের বেলা সূর্য আর রাতের বেলায় চাঁদ তোমার ক্ষতি করবে না। সমস্ত বিপদ থেকে মাবুদই তোমাকে রক্ষা করবেন; তিনি তোমার প্রাণ রক্ষা করবেন। তোমার প্রতিদিনের জীবনে মাবুদই তোমাকে পাহারা দেবেন, এখন থেকে চিরকাল দেবেন। আমি আনন্দিত হলাম যখন লোকে আমাকে বলল, “চল, আমরা মাবুদের ঘরে যাই।” হে জেরুজালেম, আমরা তোমার দরজার ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই জেরুজালেমকে একটা সুন্দর শহর হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যার মধ্যে কোন ধ্বংসস্থান নেই। সেখানেই উঠে যায় সমস্ত গোষ্ঠী, মাবুদের বান্দাদের সমস্ত গোষ্ঠী; ইসরাইলকে দেওয়া হুকুম অনুসারে তারা উঠে যায় মাবুদকে শুকরিয়া জানাবার জন্য। সেখানেই আছে বিচারের সব সিংহাসন, দাউদের বংশের লোকদের বিচারের সিংহাসন। তোমরা জেরুজালেমের শান্তির জন্য এই মুনাজাত কর, “যারা জেরুজালেমকে ভালবাসে তাদের উন্নতি হোক। তার চারপাশের দেয়ালের ভিতরে শান্তি থাকুক, আর তার রাজবাড়ীর দালান্তকোঠার মধ্যে থাকুক নিরাপত্তা।” আমার ভাই-বন্ধুদের ভালোর জন্যই আমি বলব, “জেরুজালেমের মধ্যে শান্তি থাকুক।” আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘর সেখানে আছে বলে আমি জেরুজালেমের উন্নতি চেষ্টা করব। তুমি বেহেশতের সিংহাসনে আছ; আমি তোমার দিকেই চোখ তুলে তাকিয়ে থাকি। মালিকের হাতের দিকে যেমন গোলামদের চোখ থাকে আর বাঁদীদের চোখ থাকে বেগম সাহেবার হাতের দিকে, তেমনি আমাদের চোখ থাকবে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দিকে, যতদিন না তিনি আমাদের দয়া করেন। আমাদের উপর দয়া কর, হে মাবুদ, আমাদের উপর দয়া কর, কারণ লোকদের ঘৃণা আমাদের মাথার তালু পর্যন্ত গিয়ে উঠেছে। আরামে থাকা লোকদের বিদ্রূপ আর অহংকারীদের ঘৃণা আমাদের তালু পর্যন্ত গিয়ে উঠেছে। ইসরাইল বলুক, “যদি মাবুদ আমাদের পক্ষে না থাকতেন, লোকে যখন আমাদের হামলা করেছিল, তখন যদি মাবুদ আমাদের পক্ষে না থাকতেন, তাহলে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে রাগে জ্বলে উঠে আমাদের জীবিতই গিলে ফেলত, বন্যা আমাদের ডুবিয়ে দিত, ভীষণ স্রোত আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যেত, ফুলে-ফেঁপে ওঠা পানি বয়ে যেত আমাদের উপর দিয়ে।” সমস্ত প্রশংসা মাবুদের! শত্রুদের দাঁত দিয়ে তিনি আমাদের ছিঁড়ে ফেলতে দেন নি। শিকারীর ফাঁদ থেকে পাখী যেমন করে রক্ষা পায় তেমনি করে আমরা রক্ষা পেয়েছি; ফাঁদ ছিঁড়ে গেছে আর আমরা রক্ষা পেয়েছি। মাবুদ, যিনি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছেন, তাঁর কাছ থেকেই আমাদের সাহায্য আসে। যারা মাবুদের উপর ভরসা করে তারা সিয়োন পাহাড়ের মত অটল ও চিরকাল স্থায়ী। জেরুজালেমের চারপাশ যেমন পাহাড়ে ঘেরা তেমনি করে মাবুদ তাঁর বান্দাদের ঘিরে রাখেন, এখন রাখছেন এবং চিরকাল রাখবেন। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা যাতে অন্যায় কাজে হাত না দেয় সেজন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া তাদের দেশের উপর দুষ্টদের রাজত্ব করতে দেওয়া হবে না। হে মাবুদ, যারা ভাল এবং অন্তরে খাঁটি তাদের তুমি সহিসালামতে রাখ; কিন্তু যারা নিজের তৈরী বাঁকা পথে উচোট খেতে খেতে চলে মাবুদ অন্যায়কারীদের সংগে তাদের দূর করে দেবেন। বনি-ইসরাইলদের উপর শান্তি আসুক! মাবুদ যখন সিয়োনকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন, তখন মনে হল আমরা যেন স্বপ্ন দেখছি। তখন আমাদের মুখ ছিল হাসিতে ভরা, আর জিভ্‌ ছিল আনন্দের গানে পূর্ণ। অন্যান্য জাতির লোকেরা তখন বলাবলি করেছিল, “মাবুদ ওদের জন্য অনেক মহৎ কাজ করেছেন।” মাবুদ আমাদের জন্য অনেক মহৎ কাজ করেছেন, তাই আমরা আনন্দ করতে লাগলাম। হে মাবুদ, নেগেভ মরুভূমির জলস্রোতের মত করে তুমি আগের অবস্থায় আমাদের ফিরিয়ে আন। যারা চোখের পানির সংগে বীজ বোনে তারা আনন্দে চিৎকার করতে করতে ফসল কাটবে। যে লোক কাঁদতে কাঁদতে বীজ বুনতে যায় সে শস্যের বোঝা নিয়ে আনন্দে চিৎকার করতে করতে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। মাবুদ যদি ঘর তৈরী না করেন তবে মিস্ত্রীরা মিথ্যাই পরিশ্রম করে; যদি মাবুদ শহর রক্ষা না করেন তবে পাহারাদার মিথ্যাই পাহারা দেয়। তোমরা মিথ্যাই খাবার জোগাড়ের জন্য পরিশ্রম করতে ভোরে ওঠ আর দেরি করে ঘুমাতে যাও; কিন্তু মাবুদ যাদের মহব্বত করেন তারা যখন ঘুমায় তখনও তিনি তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন। ছেলেরা মাবুদের দেওয়া সম্পত্তি, গর্ভের সন্তানেরা তাঁরই দেওয়া পুরস্কার। যৌবনের ছেলেরা যোদ্ধার হাতের তীরের মত। ধন্য সেই লোক, যার তীর রাখার খাপ এই রকম তীরে পূর্ণ; শহরের সদর দরজার কাছে বিপক্ষদের সংগে কথা বলার সময় তারা লজ্জা পাবে না। ধন্য তারা, যারা মাবুদকে ভয় করে আর তাঁর পথে চলে। তোমার নিজের হাতের পরিশ্রমের ফল তুমি ভোগ করবে; তুমি সুখী হবে আর তোমার উন্নতি হবে। তোমার বাড়ীর ভিতরের ঘরে তোমার স্ত্রী ফলে ভরা আংগুর গাছের মত হবে; তোমার খাবার টেবিলের চারপাশে তোমার সন্তানেরা হবে জলপাই গাছের চারার মত। সত্যিই, মাবুদকে যে ভয় করে সে এইভাবে দোয়া পাবে। সিয়োন থেকে মাবুদ তোমাকে দোয়া করুন; তোমার সারা জীবন ধরে তুমি যেন জেরুজালেমের উন্নতি দেখতে পাও। তুমি যেন তোমার নাতিপুতি দেখতে পাও। বনি-ইসরাইলদের উপর শান্তি আসুক। ইসরাইল বলুক, “আমার ছেলেবেলা থেকে লোকে আমাকে অনেক জুলুম করেছে। যদিও আমার ছেলেবেলা থেকে তারা আমাকে অনেক জুলুম করেছে, তবুও তারা আমার উপর জয়ী হতে পারে নি। চাষীদের মত করে তারা আমার পিঠ চষে ফেলেছে, তারা লম্বা করে খাঁজ কেটেছে; কিন্তু মাবুদ ন্যায়বিচারক, তিনি দুষ্টদের বাঁধন কেটে ফেলেছেন।” যারা সিয়োনকে ঘৃণা করে তারা লজ্জা পেয়ে পিছু হটে যাক। তারা ঘরের ছাদে গজানো ঘাসের মত হোক যা বেড়ে উঠবার আগেই শুকিয়ে যায়; যে তা কাটে তাতে তার মুঠি ভরে না, আর যে তা দিয়ে আঁটি বাঁধে তাতে কোঁচড়ও ভরে না। যারা সেই লোকদের পাশ দিয়ে যায় তারা বলে না, “তোমাদের উপর মাবুদের দোয়া নেমে আসুক; মাবুদ তোমাদের উন্নতি দান করুন।” হে মাবুদ, ভীষণ কষ্টে তলিয়ে গিয়ে আমি তোমাকে ডাকছি; হে মালিক, তুমি আমার ডাক শোন; আমার এই ফরিয়াদে তুমি কান দাও। হে মাবুদ, তুমি যদি অন্যায়ের হিসাব রাখ, তবে হে মালিক, কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে? কিন্তু তোমার কাছে মাফ আছে, যেন লোকে তোমাকে ভয় করে। আমি মাবুদের অপেক্ষায় আছি, আমার অন্তর তাঁর অপেক্ষায় আছে। আমি তাঁর কালামে আশা রেখেছি। পাহারাদারেরা যেমন ভোর হওয়ার অপেক্ষা করে, হ্যাঁ, তারা যেমন ভোর হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, আল্লাহ্‌ মালিকের জন্য আমার অন্তর তার চেয়েও বেশী অপেক্ষা করে আছে। হে ইসরাইল, মাবুদের উপর আশা রাখ, কারণ মাবুদের কাছে অটল মহব্বত আছে, আর তাঁর মুক্ত করার প্রচুর ক্ষমতাও আছে। তিনিই ইসরাইলকে তার সব অন্যায় থেকে মুক্ত করবেন। হে মাবুদ, আমার অন্তর গর্বিত নয়, আমার চোখে অহংকারের ভাব নেই; যে সমস্ত বড় ও কঠিন কাজ করা আমার পক্ষে অসম্ভব তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি আমার অন্তরকে শান্ত ও নীরব করে রেখেছি; দুধ ছাড়ানো শিশু যেমন মায়ের কাছে শান্ত হয়ে থাকে, তেমনিভাবে আমার মধ্যে আমার অন্তরও শান্ত হয়ে রয়েছে। হে ইসরাইল, মাবুদের উপর তোমার আশা রাখ, এখন থেকে চিরকাল। হে মাবুদ, তুমি দাউদের সমস্ত কষ্টের কথা মনে করে দেখ। তিনি তো মাবুদের কাছে কসম খেয়েছিলেন, ইয়াকুবের সেই শক্তিশালী আল্লাহ্‌র কাছে এই ওয়াদা করেছিলেন, “আমার ঘরে আমি ঢুকব না, কিংবা বিছানাতেও শোব না; আমার চোখে ঘুম আসতে দেব না, চোখের পাতায় তন্দ্রা নামতে দেব না; যতক্ষণ না মাবুদের জন্য একটা জায়গা খুঁজে পাই, ইয়াকুবের সেই শক্তিশালী আল্লাহ্‌র জন্য একটা বাসস্থান খুঁজে পাই।” আমরা ইফ্রাথা থেকে সাক্ষ্য-সিন্দুকের খবর শুনেছিলাম, যায়ারের মাঠে সেটা পেয়েছিলাম; চল, আমরা তাঁর বাসস্থানে যাই, তাঁর পা-দানিতে সেজদা করি। হে মাবুদ, ওঠো, তোমার বিশ্রামের জায়গায় এস; তুমি এস, আর তোমার কুদরতের সিন্দুক আসুক। তোমার ইমামেরা ন্যায়ের পোশাক পরুক, আর তোমার ভক্তেরা আনন্দে কাওয়ালী করুক। তোমার গোলাম দাউদের দরুন তোমার অভিষিক্ত বান্দার মুনাজাত তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না। মাবুদ দাউদের কাছে এই নিশ্চিত কসম খেয়েছেন যা তিনি কখনও ভাঙ্গবেন না, “তোমার একজন সন্তানকে আমি তোমার সিংহাসনে বসাব। তোমার ছেলেরা যদি আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা পালন করে আর আমার কালাম মেনে চলে যা আমি তাদের শিখাব, তাহলে তাদের ছেলেদের চিরকাল ধরে তোমার সিংহাসনে বসতে দেওয়া হবে।” মাবুদ সিয়োনকে বেছে নিয়েছেন; তাঁর বাসস্থানের জন্য এটাই তিনি চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এটাই আমার চিরকালের বিশ্রামের স্থান; আমি এখানেই বাস করব, কারণ আমি তা-ই চেয়েছি। আমি সিয়োনকে প্রচুর খাবার দিয়ে দোয়া করব; খাবার দিয়ে সেখানকার গরীব লোকদের তৃপ্ত করব। আমি সিয়োনের ইমামদের উদ্ধারের পোশাক পরাব; সেখানকার ভক্তেরা আনন্দে জোরে জোরে কাওয়ালী গাইবে। আমি সেখানে দাউদের জন্য একটা শক্তিশালী বংশ গড়ে তুলব; আমার অভিষিক্ত বান্দার জন্য আমি একটা বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা করেছি। আমি তার শত্রুদের লজ্জার পোশাক পরাব, কিন্তু তার মাথায় থাকবে উজ্জ্বল তাজ।” আমার জাতি ভাইয়েরা যখন এক মন নিয়ে একসংগে বাস করে তখন তা কত ভাল ও কত সুন্দর লাগে! তা যেন মাথায় ঢেলে দেওয়া দামী তেল যা ঝরে পড়ে হারুনের দাড়ি বেয়ে, বেয়ে পড়ে তার পোশাকের গলার উপর। মনে হয় তা যেন হর্মোণ পাহাড়ে পড়া শিশির যা ঝরে পড়ে সিয়োন পাহাড়ে; কারণ মাবুদ সেখানে দোয়া করেছেন, আর সেই দোয়া হল চিরকালের জীবন। হে মাবুদের খেদমতকারীরা, যারা মাবুদের ঘরে রাতের বেলায় এবাদত-কাজ করে থাক, তোমরা সবাই মাবুদের প্রশংসা কর। পবিত্র স্থানের দিকে হাত তুলে তোমরা মাবুদের প্রশংসা কর। আসমান ও জমীনের সৃষ্টিকর্তা মাবুদ সিয়োন থেকে তোমাদের দোয়া করুন। মাবুদের প্রশংসা কর, কারণ তিনি মেহেরবান; তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও, কারণ তা করা খুব ভাল। মাবুদ ইয়াকুবকে তাঁর নিজের জন্য, ইসরাইলকে তাঁর নিজের সম্পত্তি হবার জন্য বেছে নিয়েছেন। আমি জানি মাবুদ মহান; আমাদের মালিক সব দেব-দেবীর চেয়েও মহান। আসমানে, দুনিয়াতে, সাগরে ও দুনিয়ার গভীর স্থানে মাবুদ তাঁর ইচ্ছামত কাজ করেন। তিনিই দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে মেঘ উঠিয়ে আনেন; তিনিই বৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ তৈরী করেন, আর তাঁর ভাণ্ডার থেকে বাতাস বের করে আনেন। মিসরের প্রথম সন্তানগুলোকে তিনিই আঘাত করেছিলেন, আঘাত করেছিলেন মানুষ ও পশুর প্রথম সন্তানদের। হে মিসর, তিনি তোমার মধ্যে ফেরাউন ও তাঁর সব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়েছিলেন। তিনি অনেক জাতিকে আঘাত করেছিলেন আর শক্তিশালী বাদশাহ্‌দের মেরে ফেলেছিলেন। তিনি আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনকে, বাশনের বাদশাহ্‌ উজকে, আর কেনানের সব বাদশাহ্‌দের মেরে ফেলেছিলেন। তিনি তাদের দেশ তাঁর বান্দা বনি-ইসরাইলদের অধিকার হিসাবে দান করলেন। হে মাবুদ, তোমার সুনাম চিরকাল স্থায়ী। হে মাবুদ, বংশের পর বংশ ধরে তোমার নাম স্মরণে থাকবে; কারণ মাবুদ তাঁর বান্দাদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন, আর তাঁর গোলামদের প্রতি মমতা করবেন। অন্যান্য জাতিদের মূর্তিগুলো সোনা আর রূপা দিয়ে তৈরী; সেগুলো মানুষের হাতে গড়া। তাদের মুখ আছে কিন্তু কথা বলতে পারে না, চোখ আছে, দেখতে পায় না; তাদের কান আছে কিন্তু শুনতে পায় না, তাদের মুখের মধ্যে শ্বাস বলতে কিছু নেই। যারা এগুলোকে তৈরী করে আর তাদের উপর বিশ্বাস ও ভরসা করে তারাও ঐ সব মূর্তির মত হবে। হে ইসরাইলের বংশ, মাবুদের প্রশংসা কর; হে হারুনের বংশ, মাবুদের প্রশংসা কর; হে লেবির বংশ, মাবুদের প্রশংসা কর; হে মাবুদের ভক্ত লোকেরা, তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। মাবুদ, যিনি জেরুজালেমে বাস করেন, তাঁর প্রশংসা সিয়োন থেকে হোক। আলহামদুলিল্লাহ্‌! মাবুদের শুকরিয়া আদায় কর, কারণ তিনি মেহেরবান; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- আল্লাহ্‌, যিনি সব দেবতার চেয়েও মহান তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- মালিক, যিনি সব মালিকদের চেয়েও মহান তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। যিনি একাই সব বড় বড় কুদরতি দেখান তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি তাঁর বুদ্ধি দিয়ে আসমান তৈরী করেছেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি পানির উপরে ভূমি স্থাপন করেছেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি বড় বড় আলোর সৃষ্টি করেছেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি দিনের উপর রাজত্ব করার জন্য সূর্য সৃষ্টি করেছেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি রাতের উপর রাজত্ব করার জন্য চাঁদ ও তারা সৃষ্টি করেছেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। যিনি মিসরীয়দের প্রথম সন্তানদের আঘাত করেছিলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি তাদের মধ্য থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে এনেছিলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি কঠোর ও শক্তিশালী হাত দিয়ে তাদের বের করে এনেছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। যিনি লোহিত সাগরকে দু’ভাগ করেছিলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি বনি-ইসরাইলদের সাগরের মধ্য দিয়ে পার করে এনেছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- কিন্তু ফেরাউন ও তাঁর সৈন্যদলকে তিনি লোহিত সাগরে ফেলে দিয়েছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। যিনি তাঁর বান্দাদের মরুভূমির মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি বড় বড় বাদশাহ্‌দের আঘাত করেছিলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি শক্তিশালী বাদশাহ্‌দের মেরে ফেলেছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি আমোরীয়দের বাদশাহ্‌ সীহোনকে মেরে ফেলেছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি বাশনের বাদশাহ্‌ উজকে মেরে ফেলেছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি তাদের দেশ অধিকার হিসাবে দিয়ে দিয়েছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- তিনি তাদের দেশ অধিকার হিসাবে তাঁর সেবাকারী বনি-ইসরাইলদের দিয়েছিলেন; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। যিনি আমাদের নীচু অবস্থায় আমাদের কথা মনে করলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি শত্রুদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করলেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী- যিনি সমস্ত প্রাণীকে খাবার দেন তাঁর শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। তোমরা বেহেশতের আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় কর; - তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। ব্যাবিলনের নদীগুলোর ধারে বসে আমরা যখন সিয়োনের কথা মনে করতাম তখন আমাদের চোখ দিয়ে পানি পড়ত। সেখানকার উইলো গাছে আমাদের বীণাগুলো আমরা টাংগিয়ে রাখতাম। যারা আমাদের বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে তারা আমাদের কাওয়ালী গাইতে বলত; সেই অত্যাচারীরা আমাদের কাছ থেকে আনন্দের কাওয়ালী শুনতে চাইত; তারা বলত, “তোমরা সিয়োনের একটা কাওয়ালী আমাদের শোনাও।” কিন্তু বিদেশের মাটিতে আমরা কেমন করে মাবুদের কাওয়ালী গাইতে পারতাম? হে জেরুজালেম, যদি আমি তোমাকে ভুলে যাই তবে আমার ডান হাত যেন অকেজো হয়ে যায়। যদি আমি তোমাকে মনে না রাখি, যদি জেরুজালেমকে আমার সবচেয়ে বেশী আনন্দের জিনিস বলে মনে না করি, তবে আমার জিভ্‌ যেন আমার তালুতে লেগে যায়। হে মাবুদ, জেরুজালেমের ধ্বংসের দিনে ইদোমীয়রা যা করেছিল তা মনে করে দেখ; তারা বলেছিল, “ধ্বংস কর, একেবারে এর ভিত্তি পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেল।” ওহে ব্যাবিলন কন্যা, তোমাকে ধ্বংস করা হবে; তুমি যেমন আমাদের প্রতি করেছ, ধন্য সেই লোক যে তোমার প্রতি তা করবে! ধন্য সেই লোক যে তোমার শিশুদের ধরে পাথরের উপরে আছড়াবে! হে মাবুদ, আমার সমস্ত দিল দিয়ে আমি তোমার প্রশংসা করব; এমন কি, দেব-দেবীদের সামনেও আমি তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। তোমার পবিত্র ঘরের দিকে আমি সেজদা করব, আর তোমার অটল মহব্বত ও বিশ্বস্ততার জন্য তোমার প্রশংসা করব; কারণ তোমার ওয়াদার পূর্ণতার মধ্য দিয়ে তুমি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছ তা তোমার সুনামের চেয়েও মহান। আমি যখন তোমাকে ডাকলাম তুমি আমাকে জবাব দিলে; আমার অন্তরে শক্তি দিয়ে তুমি আমাকে সাহসী করলে। হে মাবুদ, তোমার মুখের কথা শুনে দুনিয়ার সমস্ত বাদশাহ্‌ তোমার প্রশংসা করবে। তারা মাবুদের কাজ নিয়ে কাওয়ালী গাইবে, কারণ মাবুদের মহিমা মহৎ। যদিও মাবুদ সব কিছুর উপরে আছেন তবুও তিনি নীচু অবস্থার লোকদের দিকে নজর রাখেন, কিন্তু অহংকারীদের তিনি দূর থেকেই জানেন। যখন আমি বিপদের মধ্য দিয়ে চলি তখন তুমি আমার প্রাণ রক্ষা কর; তোমার হাত বাড়িয়ে তুমি আমার শত্রুদের রাগ বিফল কর, আর তোমার ডান হাত আমাকে উদ্ধার করে। মাবুদ আমার জন্য যা ঠিক করে রেখেছেন তা পূর্ণ করবেন। হে মাবুদ, তোমার অটল মহব্বত চিরকাল স্থায়ী; তুমি নিজের হাতে যে সব কাজ করছ তা শেষ কোরো। হে মাবুদ, তুমি আমাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছ আর আমাকে জেনেছ। আমি যা কিছু করি তার সবই তো তুমি জান; তুমি দূর থেকেই আমার মনের চিন্তা বুঝতে পার। তুমি আমার কাজকর্ম ও বিশ্রামের বিষয় খুব ভাল করে খোঁজ নিয়ে থাক; তুমি আমার জীবন্তপথ ভাল করেই জান। হে মাবুদ, কোন কথা আমার মুখে আনার আগেই তুমি তার সবই জান। তুমি সব দিক থেকেই আমাকে ঘিরে ধরেছ, আর আমাকে তোমার অধীনে রেখেছ। তোমার এই জ্ঞান আমার পক্ষে বুঝতে পারা অসম্ভব; তা খুব উঁচু, আমার নাগালের বাইরে। তোমার পাক-রূহের কাছ থেকে আমি কোথায় যেতে পারি? তোমার সামনে থেকে আমি কোথায় পালাতে পারি? যদি আসমানে গিয়ে উঠি, সেখানে তুমি; যদি কবরে আমার বিছানা পাতি, সেখানেও তুমি; যদি ভোরের পাখায় ভর করে উঠে আসি, যদি ভূমধ্যসাগরের ওপারে গিয়ে বাস করি, সেখানেও তোমার হাত আমাকে পরিচালনা করবে, তোমার ডান হাত আমাকে শক্ত করে ধরে রাখবে। যদি আমি বলি, “অন্ধকার আমাকে ঢেকে ফেলবে, আর আমার চারপাশে যে আলো আছে তা অন্ধকার হয়ে যাবে,” তবুও তাতে কোন লাভ হবে না; কারণ সেই অন্ধকার তো তোমার কাছে অন্ধকার নয়। রাত দিনের মতই আলোময়; তোমার কাছে অন্ধকার আর আলো দুই-ই সমান। তুমিই আমার অন্তর সৃষ্টি করেছ; মায়ের গর্ভে তুমিই আমার শরীরের অংশগুলো একসংগে বুনেছ। আমি তোমার প্রশংসা করি, কারণ আমি ভীষণ আশ্চর্যভাবে গড়া; আশ্চর্য তোমার সব কাজ, আমি তা ভাল করেই জানি। যখন আমাকে গোপন স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছিল, মায়ের গর্ভে যখন আমার শরীর নিপুণ ভাবে গেঁথে তোলা হচ্ছিল, তখন আমার গড়ন তোমার কাছে লুকানো ছিল না। তোমার চোখ আমার গড়ে-না-ওঠা শরীর দেখেছে। আমার জন্য ঠিক করে রাখা দিনগুলো যখন শুরু হয় নি, তখন তোমার বইয়ে সেগুলোর বিষয় সবই লেখা ছিল। হে আল্লাহ্‌, তোমার এই সব পরিকল্পনা আমার কাছে কত দামী! সেগুলো অসংখ্য। যদি সেগুলো আমি গুণি তবে তার সংখ্যা বালুকণার চেয়েও বেশী। আমি যখন জেগে উঠি তখনও আমি তোমার কাছেই থাকি। হে আল্লাহ্‌, আমি চাই তুমি দুষ্টদের মেরে ফেল। ওহে রক্ত-পিপাসু লোকেরা, আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও। খারাপ চিন্তা নিয়ে তারা তোমার বিষয়ে নানা কথা বলে; তোমার শত্রুরা বাজে উদ্দেশ্যে তোমার নাম নেয়। হে মাবুদ, যারা তোমাকে অগ্রাহ্য করে আমি কি তাদের অগ্রাহ্য করি না? যারা তোমার বিরুদ্ধে ওঠে আমি কি তাদের ঘৃণার চোখে দেখি না? তাদের আমি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করি; আমার শত্রু বলেই আমি তাদের মনে করি। হে আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখ, আর আমার অন্তরের অবস্থা জেনে নাও; আমাকে যাচাই করে দেখ, আর আমার দুশ্চিন্তার কথা জেনে নাও। তুমি দেখ আমার মধ্যে এমন কিছু আছে কি না যা দুঃখ দেয়; তুমি আমাকে অনন্ত জীবনের পথে চালাও। হে মাবুদ, দুষ্ট লোকদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর; জুলুমবাজদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। তারা মনে মনে দুষ্ট ফন্দি আঁটে আর প্রতিদিন যুদ্ধ বাধায়। তারা সাপের মত তাদের জিভ্‌ ধারালো করেছে; তাদের ঠোঁটের নীচে যেন সাপের বিষ আছে। [সেলা] হে মাবুদ, দুষ্টদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। জুলুমবাজ লোকদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর; আমার পা যেন পিছ্‌লে যায় সেজন্য তারা ফন্দি এঁটেছে। অহংকারী লোকেরা আমার জন্য ফাঁদ ও দড়ি ঠিক করে রেখেছে; তারা পথের পাশে তাদের জাল বিছিয়ে রেখেছে আর আমার জন্য ফাঁদ পেতেছে। [সেলা] হে মাবুদ, আমি তোমাকে বলেছি, “তুমিই আমার আল্লাহ্‌।” হে মাবুদ, আমার ফরিয়াদে তুমি কান দাও। হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমার শক্তিশালী উদ্ধারকর্তা, যুদ্ধের দিনে তুমিই আমার মাথা ঢেকে রাখ। হে মাবুদ, দুষ্টদের মনের ইচ্ছা তুমি পূর্ণ হতে দিয়ো না; তাদের ষড়যন্ত্র সফল হতে দিয়ো না, যেন তারা অহংকারী হয়ে না ওঠে। [সেলা] যারা আমাকে ঘিরে ধরেছে তাদের মুখ যে সব অন্যায় করেছে তা তাদেরই মাথার উপর এসে পড়ুক। তাদের উপর জ্বলন্ত কয়লা পড়ুক; আগুনের মধ্যে, গভীর গর্তের মধ্যে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হোক; যেন তারা আর কখনও উঠে আসতে না পারে। নিন্দুকেরা যেন দেশের মধ্যে অধিকার না পায়; জুলুমবাজদের পিছনে বিপদ অনবরত তাড়া করুক। আমি জানি মাবুদ দুঃখীদের পক্ষে রায় দেবেন আর অভাবীদের জন্য ন্যায়বিচার করবেন। সৎ লোকেরা অবশ্যই তোমার প্রশংসা করবে, আর যারা অন্তরে খাঁটি তারা তোমার সামনে বাস করবে। হে মাবুদ, আমি তোমাকে ডাকছি, তুমি তাড়াতাড়ি আমার কাছে এস; আমি ডাকলে তুমি আমার ডাকে কান দিয়ো। আমার মুনাজাত যেন খোশবু ধূপের মত, আমার হাত উঠানো যেন সন্ধ্যাবেলার কোরবানীর মত তোমার সামনে উপস্থিত হয়। হে মাবুদ, আমার মুখের উপর তুমি পাহারা বসাও, আমার ঠোঁটের দরজা তুমি চৌকি দাও। আমার মনকে কোন খারাপ জিনিসের দিকে ঝুঁকতে দিয়ো না, যাতে অন্যায়কারীদের সংগে খারাপ কাজে আমি অংশ না নিই; তাদের ভাল ভাল খাবার যেন আমি না খাই। একজন আল্লাহ্‌ভক্ত লোক আমাকে আঘাত করুন, সেটা হবে বিশ্বস্ততা। তিনি আমাকে বকুনি দিন, সেটা হবে আমার মাথায় তেল দেওয়ার মত; আমার মাথা তা অগ্রাহ্য না করুক। কিন্তু আমার মুনাজাত সব সময় অন্যায়কারীদের কাজের বিরুদ্ধে থাকবে। তাদের শাসনকর্তাদের খাড়া পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হবে; তখন তারা আমার কথায় কান দেবে, কারণ তা মধুর। মানুষ চাষ করে যেমন মাটি ভেংগে ফেলে তেমনি করেই আমাদের হাড়গুলো কবরের মুখে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমার চোখ তোমার দিকে রয়েছে; আমি তোমার মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছি, আমাকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়ো না। তারা আমার জন্য যে জাল পেতেছে তা থেকে আমাকে রক্ষা কর; অন্যায়কারীদের পাতা ফাঁদ থেকে আমাকে রক্ষা কর। দুষ্টেরা তাদের নিজেদের জালে নিজেরাই ধরা পড়ুক, আর আমি সেই সময় নিরাপদেই তা পার হয়ে যাব। আমি চিৎকার করে মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি; আমি জোরে জোরে মাবুদের কাছে মিনতি করছি। আমার দুঃখের কথা আমি তাঁর সামনে ঢেলে দিচ্ছি, আমার কষ্টের কথা তাঁর সামনে বলছি। যখন আমি নিরাশ হয়ে পড়ি তখন তুমিই আমার জীবনের পথ সম্বন্ধে জান; আমার চলার পথে লোকে আমার জন্য গোপনে ফাঁদ পেতে রেখেছে। আমার ডান পাশে তাকিয়ে দেখ, আমাকে চেনে এমন কেউ নেই। আমার পালাবার স্থান নেই; কেউ আমার প্রাণের জন্য চিন্তা করে না। হে মাবুদ, আমি তোমার কাছেই ফরিয়াদ জানিয়েছি; আমি বলেছি, “তুমিই আমার আশ্রয়, এই দুনিয়াতে তুমিই আমার সম্পত্তি।” আমার ফরিয়াদে তুমি কান দাও, কারণ আমি খুব অসহায় হয়ে পড়েছি; আমাকে যারা তাড়া করছে তাদের হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও, কারণ তারা আমার চেয়ে শক্তিশালী। জেলখানায় থাকবার মত এই অবস্থা থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর, যাতে আমি তোমার প্রশংসা করতে পারি। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা আনন্দে আমাকে ঘিরে থাকবে, কারণ তুমি আমাকে সহিসালামতে রাখবে। হে মাবুদ, আমার মুনাজাত শোন, আমার ফরিয়াদে তুমি কান দাও; তোমার বিশ্বস্ততা ও তোমার ন্যায়ে আমাকে জবাব দাও। তোমার এই সেবাকারীর বিচার কোরো না, কারণ তোমার চোখে কোন প্রাণীই নির্দোষ নয়। শত্রু আমার পিছনে তাড়া করেছে, সে আমাকে চুরমার করে মাটিতে ফেলেছে; অনেক দিন আগেকার মৃত লোকদের মতই সে আমাকে অন্ধকারে বাস করাচ্ছে। সেজন্য আমি নিরাশ হয়ে পড়েছি; আমার ভিতরে আমার অন্তর অসাড় হয়ে পড়েছে। আমি পুরানো দিনের কথা মনে করি, তোমার সমস্ত কাজের বিষয় ধ্যান করি; তোমার হাত যা করেছে তা চিন্তা করি। আমি তোমার দিকে আমার হাত বাড়িয়ে দিই; শুকনা জমির মত আমার প্রাণ তোমার জন্য পিপাসিত। হে মাবুদ, তুমি আমাকে শীঘ্র জবাব দাও, কারণ আমার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাচ্ছে; আমার কাছ থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে রেখো না, যেন কবরে যারা নেমে যাচ্ছে আমি তাদের মত হয়ে না পড়ি। সকালে তুমি আমাকে তোমার অটল মহব্বতের কথা শোনাও, কারণ আমি তোমার উপরেই ভরসা করে আছি; কোন্‌ পথে যেতে হবে তা আমাকে দেখাও, কারণ আমার অন্তর আমি তোমার দিকেই তুলে ধরছি। হে মাবুদ, আমার শত্রুদের হাত থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর, কারণ আমি তোমার মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছি। তোমার ইচ্ছামত কাজ করতে তুমি আমাকে শিখাও, কারণ তুমিই আমার আল্লাহ্‌; তোমার মেহেরবান রূহ্‌ দ্বারা আমাকে সমান পথে চালাও। হে মাবুদ, তোমার সুনাম রক্ষার জন্য আমাকে নতুন শক্তি দাও; তোমার ন্যায়ে বিপদ থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। তোমার অটল মহব্বতের জন্য তুমি আমার শত্রুদের ছেঁটে ফেলে দাও; আমার সমস্ত বিপক্ষদের তুমি ধ্বংস কর, কারণ আমি তোমার গোলাম। মাবুদের প্রশংসা হোক, তিনি আমার আশ্রয়-পাহাড়; তিনি আমার হাতকে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছেন, আমার আংগুলগুলোকে শিখিয়েছেন লড়াই করতে। তিনিই আমার বিশ্বস্ত সাহায্যকারী, আমার কেল্লা, আমার উঁচু আশ্রয়স্থান ও উদ্ধারকর্তা; তিনিই আমার ঢাল, আমি তাঁর মধ্যে আশ্রয় নিই; তিনিই আমার লোকদের আমার অধীনে আনেন। হে মাবুদ, মানুষ এমন কি যে, তার দিকে তুমি খেয়াল কর? মানুষের সন্তানই বা কি যে, তার দিকে তুমি মনোযোগ দাও? মানুষ তো নিঃশ্বাস মাত্র; তার দিনগুলো সরে যাওয়া ছায়ার মত। হে মাবুদ, তোমার আসমান নুইয়ে তুমি নেমে এস; তুমি পাহাড়-পর্বত ছোঁও যাতে সেগুলো থেকে ধোঁয়া বের হয়। তুমি বিদ্যুৎ পাঠিয়ে শত্রুদের ছড়িয়ে দাও; তোমার তীর ছুঁড়ে তাদের বিশৃঙ্খল করে দাও। তুমি উপর থেকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও; তুমি আমাকে রক্ষা কর, বন্যার হাত থেকে, হ্যাঁ, অন্য জাতিদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। তাদের মুখ ছলনার কথায় ভরা; তারা ডান হাত তুলে মিথ্যা কসম খায়। হে আল্লাহ্‌, আমি তোমার উদ্দেশে নতুন কাওয়ালী গাইব; দশতারা বাজিয়ে আমি তোমার উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাইব। তুমি তো বাদশাহ্‌দের জয় দান করে থাক; তোমার গোলাম দাউদকে সর্বনাশা তলোয়ারের হাত থেকে রক্ষা করে থাক। আমাকে রক্ষা কর, অন্য জাতিদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও; তাদের মুখ ছলনার কথায় ভরা; তারা ডান হাত তুলে মিথ্যা কসম খায়। আমাদের ছেলেরা কিশোর বয়সে যেন গাছের চারার মত বেড়ে ওঠে, আর আমাদের মেয়েরা যেন রাজবাড়ীর খোদাই করা থামের মত হয়। আমাদের গোলাঘরগুলো যেন সব রকম খাবারে ভরা থাকে; আমাদের ভেড়াগুলো যেন মাঠের মধ্যে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে বাচ্চা দেয়। আমাদের বলদগুলো যেন ভারী ভারী বোঝা টানতে পারে; আমাদের দেয়ালে যেন ফাটল না ধরে, কেউ যেন বন্দী না হয়, রাস্তায় রাস্তায় যেন দুঃখের কান্নার শব্দ না ওঠে। ধন্য সেই জাতি, যার অবস্থা এরকম হয়। ধন্য সেই জাতি, আল্লাহ্‌ যার মাবুদ। হে আমার আল্লাহ্‌, হে বাদশাহ্‌, আমি তোমার গুণগান করব; আমি চিরকাল তোমার প্রশংসা করব। প্রতিদিন আমি তোমার প্রশংসা করব; চিরকাল তোমার গৌরব করব। মাবুদ মহান আর সব চেয়ে বেশী প্রশংসার যোগ্য; কেউ তাঁর মহত্ব বুঝে উঠতে পারে না। এক বংশের লোকেরা তার পরের বংশের লোকদের কাছে তোমার কাজের গুণগান করবে; তারা তোমার শক্তিশালী কাজের কথা ঘোষণা করবে। আমি তোমার মহিমার গৌরবময় জাঁকজমক আর তোমার অলৌকিক চিহ্ন সম্বন্ধে ধ্যান করব। লোকে তোমার ভয়-জাগানো কুদরতি কাজের কথা বলবে, আর আমি তোমার মহত্বের কথা ঘোষণা করব। তুমি যে তাদের প্রচুর মেহেরবানী করেছ তা তারা বলে বেড়াবে, তোমার ন্যায্যতার কথা নিয়ে আনন্দে কাওয়ালী গাইবে। মাবুদ দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ; তিনি সহজে রেগে উঠেন না এবং তাঁর অটল মহব্বতের সীমা নেই। মাবুদ সকলের জন্যই মেহেরবান; তাঁর সৃষ্ট সব কিছুর উপরে তাঁর মমতা রয়েছে। হে মাবুদ, তুমি যা কিছু সৃষ্টি করেছ সে সবই তোমাকে শুকরিয়া জানাবে; তোমার ভক্তেরা তোমার প্রশংসা করবে। তারা তোমার রাজ্যের গৌরবের কথা আর তোমার কুদরতীর কথা বলবে; যাতে সব মানুষ তোমার কুদরতী-কাজের কথা জানতে পারে, আর জানতে পারে তোমার রাজ্যের গৌরবপূর্ণ জাঁকজমকের কথা। তোমার রাজ্য চিরস্থায়ী রাজ্য; তোমার শাসন বংশের পর বংশ ধরে চলে। যারা পড়ে যাচ্ছে মাবুদ তাদের ধরে রাখেন; যারা নুয়ে পড়েছে তাদের তিনি তুলে ধরেন। আশা নিয়ে সকলেই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে; ঠিক সময়ে তুমি তাদের খাবার দিয়ে থাক। সমস্ত প্রাণীর মনের ইচ্ছা তুমি হাত খুলে পূরণ করে থাক। মাবুদ তাঁর সমস্ত পথে ন্যায়বান আর সমস্ত কাজে বিশ্বস্ত। যারা মাবুদকে ডাকে, অন্তর দিয়ে ডাকে, তিনি তাদের কাছেই থাকেন। যারা তাঁকে ভয় করে তাদের মনের ইচ্ছা তিনি পূরণ করেন; সাহায্যের জন্য তাদের ফরিয়াদ শুনে তিনি তাদের রক্ষা করেন। যারা মাবুদকে মহব্বত করে তাদের সকলকে তিনি রক্ষা করেন, কিন্তু সব দুষ্টদের তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন। আমার মুখ মাবুদের গুণগান করবে; সমস্ত প্রাণী যুগ যুগ ধরে তাঁর পবিত্রতার প্রশংসা করবে। আলহামদুলিল্লাহ্‌! হে আমার প্রাণ, মাবুদের প্রশংসা কর। আমি সারা জীবন মাবুদের প্রশংসা করব; যতদিন আমি বেঁচে থাকব আমার আল্লাহ্‌র প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। কোন উঁচু পদের লোক, কোন মানুষের উপর তোমরা ভরসা কোরো না; তারা উদ্ধার করতে পারে না। তাদের প্রাণ বের হয়ে গেলে তারা মাটিতে ফিরে যায়, আর সেদিনই তাদের সব পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায়। ধন্য সেই লোক, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ যার সাহায্যকারী, যার আশা তার মাবুদ আল্লাহ্‌র উপর। মাবুদ আসমান ও জমীন, সাগর ও তার মধ্যেকার সব কিছু তৈরী করেছেন; তিনি চিরকাল বিশ্বস্ত থাকেন। তিনি অত্যাচারিতদের পক্ষে ন্যায়বিচার করেন আর যাদের খিদে আছে তাদের খাবার দেন; মাবুদই বন্দীদের মুক্ত করেন। মাবুদ অন্ধদের দেখবার শক্তি দেন; যারা নুয়ে পড়েছে মাবুদ তাদের তুলে ধরেন; মাবুদ সৎ লোকদের মহব্বত করেন। মাবুদ বিদেশীদের উপর চোখ রাখেন আর এতিম ও বিধবাদের দেখাশোনা করেন, কিন্তু দুষ্টদের পথ তিনি বাঁকা করেন। মাবুদ চিরকাল রাজত্ব করবেন; হে সিয়োন, বংশের পর বংশ ধরে তোমার আল্লাহ্‌ রাজত্ব করবেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমাদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা-কাওয়ালী গাওয়া কত ভাল! তা কি সুন্দর! তাঁর প্রশংসা করা কত উপযুক্ত! মাবুদই জেরুজালেমকে গড়ে তোলেন; দূর করে দেওয়া বনি-ইসরাইলদের তিনিই জমায়েত করেন। যাদের মন ভেংগে গেছে তিনি তাদের সুস্থ করেন; তাদের সব আঘাত তিনিই বেঁধে দেন। তিনি তারাগুলোর সংখ্যা গণনা করেন, তাদের প্রত্যেকটির নাম ধরে ডাকেন। আমাদের মালিক মহান, তাঁর কুদরত প্রচুর; তাঁর জ্ঞান বুদ্ধির সীমা নেই। মাবুদ নম্র লোকদের ধরে রাখেন, কিন্তু দুষ্ট লোকদের মাটিতে ফেলে দেন। তোমরা মাবুদের উদ্দেশে শুকরিয়ার কাওয়ালী গাও; বীণা বাজিয়ে আমাদের আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী গাও। তিনি আকাশ মেঘে ঢাকেন; তিনি দুনিয়ার জন্য বৃষ্টির ব্যবস্থা করেন আর পাহাড়ের উপরে ঘাস জন্মাতে দেন। পশুদের খাবার তিনিই যুগিয়ে দেন; দাঁড়কাকের বাচ্চারা যখন ডাকে তখন তিনিই তাদের খাবার দেন। ঘোড়ার শক্তিতে তিনি সন্তুষ্ট হন না, যোদ্ধার পায়ের শক্তিতেও তাঁর আনন্দ নেই; কিন্তু যারা তাঁকে ভয় করে আর তাঁর অটল মহব্বতের উপর আশা রাখে, তাদের নিয়েই মাবুদের যত আনন্দ। হে জেরুজালেম, মাবুদের গুণগান কর; হে সিয়োন, তোমার আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর। তিনিই তো তোমার দরজাগুলোর আগল শক্ত করেছেন, তোমার মধ্যে বাসকারী লোকদের দোয়া করেছেন। তোমার সীমানাগুলোতে তিনিই শান্তি রাখেন, আর সবচেয়ে ভাল গম দিয়ে তোমাকে তৃপ্ত করেন। তিনি দুনিয়াতে তাঁর হুকুম পাঠান; খুব তাড়াতাড়ি তা পালন করা হয়। তিনি ভেড়ার লোমের মত তুষার পাঠান আর ছাইয়ের মত শিশির ছড়ান। তিনি রুটির টুকরার মত করে শিলা ফেলেন; তাঁর দেওয়া শীত কে সহ্য করতে পারে? তাঁর কালাম পাঠিয়ে তিনি শিলা গলিয়ে ফেলেন; তাঁর বাতাস বহালে পানি বয়ে যায়। ইয়াকুবের উপরে তিনি তাঁর কালাম নাজেল করেছেন, ইসরাইলের কাছে প্রকাশ করেছেন তাঁর নিয়ম ও শরীয়ত। অন্য কোন জাতির জন্য তিনি তা করেন নি; তাঁর শরীয়ত তারা জানে না। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আলহামদুলিল্লাহ্‌! বেহেশত থেকে তোমরা মাবুদের প্রশংসা কর; আকাশে ও মহাকাশে তাঁর প্রশংসা কর। হে তাঁর সমস্ত ফেরেশতা, তাঁর প্রশংসা কর; হে তাঁর সমস্ত শক্তিদল, তাঁর প্রশংসা কর। হে সূর্য ও চাঁদ, তাঁর প্রশংসা কর; হে উজ্জ্বল সব তারা, তাঁর প্রশংসা কর। হে বেহেশত, তাঁর প্রশংসা কর; হে আসমানের উপরের পানি, তাঁর প্রশংসা কর। এরা সব মাবুদের প্রশংসা করুক, কারণ তিনি হুকুম দিলেন আর এদের সৃষ্টি হল। এদের তিনি চিরকালের জন্য ঠিক জায়গায় স্থাপন করেছেন; তিনি একটা নিয়ম দিয়েছেন, কেউ তা ভাঙ্গতে পারবে না। দুনিয়া থেকে তোমরা মাবুদের প্রশংসা কর। হে সাগরের বড় বড় প্রাণী ও সাগরের গভীর তলদেশ, তাঁর প্রশংসা কর। হে বিদ্যুৎ ও শিলা, তুষার ও কুয়াশা আর তাঁর হুকুম পালন্তকরা ঝোড়ো বাতাস, তাঁর প্রশংসা কর। হে সমস্ত পাহাড়-পর্বত আর ফলের গাছ ও সমস্ত এরস গাছ, তাঁর প্রশংসা কর। হে বুনো জানোয়ার ও সমস্ত পোষ-মানা পশু আর বুকে-হাঁটা প্রাণী ও ডানাযুক্ত প্রাণী, তাঁর প্রশংসা কর। হে দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা এবং সমস্ত জাতি আর রাজপুরুষেরা ও দুনিয়ার শাসনকর্তারা, তাঁর প্রশংসা কর। হে যুবক ও যুবতীরা আর বৃদ্ধ ও ছেলেমেয়েরা, তাঁর প্রসংশা কর। এরা সবাই মাবুদের প্রশংসা করুক, কারণ একমাত্র তিনিই মহান; আসমান ও জমীনের উপরেও তাঁর গৌরব রয়েছে। তাঁর বান্দাদের তিনি শক্তিশালী করেছেন; তা তাঁর সমস্ত ভক্তদের গৌরব, তাঁর প্রিয় জাতি ইসরাইলের গৌরব। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আলহামদুলিল্লাহ্‌! তোমরা মাবুদের উদ্দেশে নতুন কাওয়ালী গাও, আল্লাহ্‌ভক্তদের মাহ্‌ফিলে তাঁর প্রশংসা-কাওয়ালী গাও। ইসরাইল তার সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে আনন্দ করুক, সিয়োনের লোকেরা তাদের বাদশাহ্‌কে নিয়ে খুশী হোক। তারা নাচতে নাচতে তাঁর প্রশংসা করুক, খঞ্জনি আর বীণা বাজিয়ে তাঁর উদ্দেশে প্রশংসার কাওয়ালী করুক; কারণ মাবুদ তাঁর বান্দাদের নিয়ে আনন্দ পান; তিনি নম্র লোকদের উদ্ধার করে সম্মানিত করেন। এই সম্মান লাভ করে আল্লাহ্‌ভক্তেরা আনন্দ করুক; তারা নিজের নিজের বিছানায় আনন্দে কাওয়ালী করুক। তাদের মুখে আল্লাহ্‌র প্রশংসা থাকুক আর হাতে থাকুক দু’দিকে ধার দেওয়া তলোয়ার, যাতে তারা জাতিদের উপরে প্রতিশোধ নিতে পারে আর সেই সব লোকদের শাস্তি দিতে পারে, যাতে শিকল দিয়ে তাদের বাদশাহ্‌দের বাঁধতে পারে, তাদের উঁচু পদের লোকদের লোহার বেড়ী দিয়ে বাঁধতে পারে, আর তাদের বিরুদ্ধে যে রায় লেখা হয়েছে তা কাজে লাগাতে পারে। এ সমস্তই তাঁর সব ভক্তদের গৌরব। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আলহামদুলিল্লাহ্‌! তোমরা আল্লাহ্‌র পবিত্র স্থানে তাঁর প্রশংসা কর, তাঁর শক্তিতে গড়া আসমানে তাঁর প্রশংসা কর। তাঁর শক্তিপূর্ণ কাজের জন্য তাঁর প্রশংসা কর, তাঁর সীমাহীন মহত্বের জন্য তাঁর প্রশংসা কর। শিংগা বাজিয়ে তাঁর প্রশংসা কর, বীণা আর সুরবাহার বাজিয়ে তাঁর প্রশংসা কর। খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে নেচে তাঁর প্রশংসা কর, তারের বাজনা আর বাঁশী বাজিয়ে তাঁর প্রশংসা কর। জোর আওয়াজের করতাল বাজিয়ে তাঁর প্রশংসা কর, ঝন্‌ঝন্‌ করা করতাল বাজিয়ে তাঁর প্রশংসা কর। শ্বাসযুক্ত সমস্ত প্রাণী মাবুদের প্রশংসা করুক। মাবুদের প্রশংসা কর। দাউদের ছেলে ইসরাইলের বাদশাহ্‌ সোলায়মানের সৎ উপদেশ। এগুলো লেখা হয়েছে যেন লোকে সুবুদ্ধি এবং শিক্ষা পায়, যেন তাদের বিচারবুদ্ধি বাড়ে, যেন লোকে অন্যের সংগে বিবেচনা করে চলে, যেন সকলের সংগে তারা উপযুক্ত, ন্যায় ও সৎ ব্যবহার করে, যেন বোকা লোকেরা চালাক হয় আর যুবকেরা জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি পায়, - জ্ঞানীরা এই সব উপদেশ শুনুক ও আরও শিক্ষা লাভ করুক, আর বুদ্ধিমানেরা শুনে পথ চলায় পাকা হোক- যেন লোকে চলতি কথা ও গভীর অর্থপূর্ণ কথা এবং জ্ঞানীদের বলা কথা ও ধাঁধা বুঝতে পারে। মাবুদের প্রতি ভয় হল জ্ঞানের ভিত্তি, কিন্তু যাদের বিবেক অসাড় তারা সুবুদ্ধি ও শিক্ষা তুচ্ছ করে। ছেলে আমার, তুমি তোমার পিতার উপদেশে কান দাও; তোমার মায়ের দেওয়া শিক্ষা ত্যাগ কোরো না। সেগুলো হবে তোমার মাথায় জড়াবার সুন্দর মালা আর গলার হারের মত। ছেলে আমার, গুনাহ্‌গার লোকেরা যদি তোমাকে বিপথে নিয়ে যেতে চায় তুমি রাজী হোয়ো না। ধর, কেউ বলল, “আমাদের সংগে এস, খুন করবার জন্য চল আমরা ওৎ পেতে থাকি, কোন নির্দোষ লোককে ধরবার জন্য লুকিয়ে থাকি। তারা যেমন সম্পূর্ণ শরীর নিয়ে জীবিত অবস্থায় কবরে, অর্থাৎ সেই গর্তে নেমে যায়, তেমনি করেই এস, আমরা ওদের জীবিত অবস্থায় গোটাই গিলে ফেলি; তাহলে আমরা নানা রকমের দামী জিনিস পাব, আর লুটের জিনিস দিয়ে আমাদের বাড়ী-ঘর ভরব। আমাদের সংগেই তোমার ভাগ্য তুমি জুড়ে নাও, আমাদের টাকার থলি একটাই হবে।” ছেলে আমার, তুমি ওদের সংগে যেয়ো না, ওদের পথে তোমার পা ফেলো না; কারণ ওদের পা গুনাহের দিকে দৌড়ায়, খুন করবার জন্য ওরা ছুটে চলে। লোকে বলে, “পাখীর চোখের সামনে জাল পাতলে কোন লাভ হয় না।” এই লোকেরা নিজেরাই খুন হবার জন্য ওৎ পেতে থাকে, নিজেরাই শেষ হওয়ার জন্য লুকিয়ে থাকে। খারাপ উপায়ে কোন কিছু লাভ করবার জন্য যারা ছোটে তাদের সকলের দশাই এই রকম হয়; তারা যা লাভ করে তা তাদের জীবন শেষ করে দেয়। সুবুদ্ধি রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করে ডাকে, বাজারে বাজারে আওয়াজ তোলে। গোলমাল-ভরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে সে চিৎকার করে, শহরের দরজায় ঢুকবার পথে সে এই কথা বলে, “বোকা লোকেরা, আর কতদিন তোমরা তোমাদের বোকামি ভালবাসবে? যারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তারা আর কতকাল তার মধ্যে আনন্দ পাবে? যারা বিবেচনাহীন তারা আর কতকাল জ্ঞানকে ঘৃণা করবে? আমার শাসনের কথায় যদি তোমরা কান দিতে, তাহলে আমার রূহ্‌ আমি তোমাদের উপরে ঢেলে দিতাম, আমার মনের কথা তোমাদের জানাতাম। আমি যখন ডাকলাম তখন তোমরা আমাকে অগ্রাহ্য করলে, হাত বাড়িয়ে দিলেও কেউ তাতে সাড়া দিলে না। তোমরা যখন আমার সব উপদেশই অগ্রাহ্য করলে, দোষ দেখিয়ে দিলেও তা গ্রহণ করতে চাইলে না, তখন তোমাদের ধ্বংস দেখে আমি হাসব, তোমাদের উপর বিপদ নেমে আসলে তামাশা করব। বিপদ ঝড়ের মত তোমাদের উপর নেমে আসলে, ধ্বংস ঘূর্ণিবাতাসের মত তোমাদের ঝেঁটিয়ে নিয়ে গেলে, দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে তোমরা ডুবে গেলে, আমি তামাশা করব। “বুদ্ধিহীনেরা তখন আমাকে ডাকবে কিন্তু আমি সাড়া দেব না; তারা আমার তালাশ করবে কিন্তু আমাকে খুঁজে পাবে না। তারা জ্ঞানকে ঘৃণা করেছে আর মাবুদকে ভয় করতে চায় নি। সেইজন্য আমার উপদেশ তারা গ্রহণ করে নি, আর সংশোধনের জন্য আমি যা বলেছি তা পায়ে দলেছে; কাজেই তাদের নিজেদের কাজের ফল তাদেরই ভোগ করতে হবে, নিজেদের পরামর্শের ফল দিয়েই পেট ভরাতে হবে। বোকা লোকদের বিপথে যাওয়াই তাদের মৃত্যুর কারণ হবে, বিবেচনাহীনদের নিশ্চিন্ত মনোভাব তাদের ধ্বংস করবে; কিন্তু যারা আমার কথা শোনে তারা নিরাপদে বাস করবে; তারা শান্তিতে থাকবে, বিপদের ভয় করবে না।” ছেলে আমার, তুমি যদি আমার কথা শোন আর তোমার অন্তরের মধ্যে আমার সব হুকুম জমা করে রাখ, যদি সুবুদ্ধির কথায় কান দাও আর বিচারবুদ্ধির দিকে মনোযোগ দাও, যদি বিবেচনা-শক্তিকে ডাক আর চিৎকার করে ডাক বিচারবুদ্ধিকে, যদি রূপা খুঁজবার মত করে সুবুদ্ধির তালাশ কর আর গুপ্তধনের মত তা তালাশ করে দেখ, তাহলে মাবুদের প্রতি ভয় কি, তা তুমি বুঝতে পারবে আর আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে জ্ঞান পাবে; কারণ মাবুদই সুবুদ্ধি দান করেন, তাঁর মুখ থেকেই জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি বের হয়ে আসে। খাঁটি অন্তরের লোকদের জন্য তিনি উপস্থিত বুদ্ধি জমা করে রাখেন; যারা সততায় চলাফেরা করে তিনি তাদের ঢাল হন, যেন তিনি ন্যায়বিচার বজায় রাখতে পারেন, আর তাঁর ভক্তদের পথ রক্ষা করতে পারেন। যদি তুমি আমার কথা শোন, তাহলে বুঝতে পারবে কোনটা উপযুক্ত, ন্যায্য ও সৎ আর বুঝতে পারবে উন্নতির সমস্ত পথ; কারণ সুবুদ্ধি তোমার অন্তরে ঢুকবে, আর জ্ঞান তোমার প্রাণে আনন্দ দেবে। তোমার নেকী-বদী বুঝবার শক্তি তোমাকে রক্ষা করবে, আর বিচারবুদ্ধি তোমাকে পাহারা দেবে। এতে দুষ্ট লোকদের পথ থেকে জ্ঞানই তোমাকে রক্ষা করবে; রক্ষা করবে তাদের থেকে- যারা মিথ্যা কথা বলে, যারা অন্ধকার পথে চলবার জন্য সোজা পথ ত্যাগ করে, যারা খারাপ কাজে আনন্দ পায়, খারাপীর কুটিল পথেই যাদের আনন্দ, আর যারা বাঁকা পথে ও বিপথে চলে। জ্ঞানই তোমাকে রক্ষা করবে জেনাকারিণীর হাত থেকে, মিষ্টি কথায় ভরা বিপথে যাওয়া স্ত্রীলোকের হাত থেকে। সে তার যৌবনকালের স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছে আর তার আল্লাহ্‌র স্থাপন করা ব্যবস্থা অমান্য করেছে। তুমি তার ঘরে ঢুকলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে, তার সংগে যোগ দিলে মৃতদের কাছে পৌঁছাবে। যারা তার কাছে যায় তাদের কেউ আর ফিরে আসে না, তারা বাঁচবার পথ পায় না। জ্ঞানই তোমাকে ঐ সব থেকে রক্ষা করবে যাতে তুমি ভাল লোকদের পথে, আল্লাহ্‌ভক্তদের পথে চলতে পার। সৎ লোকেরাই দেশে বাস করতে পারবে, নির্দোষ লোকেরাই তার মধ্যে টিকে থাকবে; কিন্তু দেশ থেকে দুষ্টদের ছেঁটে ফেলা হবে আর বেঈমানদের উপ্‌ড়ে ফেলা হবে। ছেলে আমার, তুমি আমার শিক্ষা ভুলে যেয়ো না, সমস্ত দিল দিয়ে তুমি আমার হুকুম পালন কর; কারণ তাতে তুমি অনেক আয়ু পাবে আর তোমার অনেক উন্নতি হবে। বিশ্বস্ততা আর সততা যেন কখনও তোমাকে ছেড়ে না যায়; তোমার গলায় সেগুলো বেঁধে রাখ, তোমার অন্তরের পাতায় সেগুলো লিখে রাখ। তা করলে আল্লাহ্‌ ও মানুষের সামনে তুমি দয়া ও সুনাম লাভ করবে। তোমার সমস্ত দিল দিয়ে মাবুদের উপর ভরসা কর; তোমার নিজের বিচারবুুদ্ধির উপর ভরসা কোরো না। তোমার সমস্ত চলবার পথে তাঁকে সামনে রাখ; তিনিই তোমার সব পথ সোজা করে দেবেন। তোমার নিজের চোখে জ্ঞানী হোয়ো না; মাবুদকে ভয় কর, খারাপী থেকে দূরে যাও। তাতে তুমি স্বাস্থ্যবান হবে আর তোমার হাড় পুষ্ট হবে। তোমার ধন-সম্পদ দিয়ে আর তোমার প্রথমে কাটা ফসলের অংশ কোরবানী করে তুমি মাবুদকে সম্মান দেখাও; তাতে তোমার গোলাঘরগুলো প্রচুর শস্যে ভরে যাবে আর তোমার জালাগুলো থেকে নতুন আংগুর-রস উপ্‌চে পড়বে। ছেলে আমার, মাবুদের শাসন অগ্রাহ্য কোরো না, তিনি বকুনি দিলে তা তুচ্ছ কোরো না; কারণ বাবা যেমন তাঁর প্রিয় ছেলেকে ভীষণ বকুনি দেন, ঠিক তেমনি মাবুদ যাকে মহব্বত করেন তাকেই বকুনি দেন। ধন্য সেই লোক যে সুবুদ্ধির খোঁজ পায় আর বিচারবুদ্ধি লাভ করে, কারণ তাতে রূপার ব্যবসার চেয়েও বেশী লাভ পাওয়া যায়, সোনার চেয়েও তাতে বেশী লাভ হয়; প্রবাল পাথরের চেয়েও সুবুদ্ধি বেশী দামী, তোমার চাওয়ার মত কোন জিনিসের সংগে তার তুলনা হয় না। তার ডান হাতে আছে অনেক আয়ু, বাঁ হাতে আছে ধন আর সম্মান। তার পথে পাওয়া যায় আনন্দ, আর তার সমস্ত পথেই আছে উন্নতি। যারা তাকে ধরে তাদের কাছে তা জীবন্তগাছের মত; যারা তাকে আঁকড়ে ধরে তারা দোয়া পায়। মাবুদ সুবুদ্ধি দিয়ে দুনিয়ার ভিত্তি গেঁথেছেন, বিচারবুদ্ধি দিয়ে আসমানকে তার জায়গায় রেখেছেন। তিনি জ্ঞান দিয়ে মাটির নীচের পানি বের করে এনেছেন, আর আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা শিশির পড়ে। ছেলে আমার, তুমি উপস্থিত বুদ্ধি ও বিচারবুদ্ধি রক্ষা কোরো, তাতে মনোযোগ দিয়ো। তোমার জন্য তা হবে জীবন, তোমার গলার জন্য তা হবে সুন্দর হারের মত। তখন তুমি নিরাপদে তোমার পথে চলতে পারবে, তোমার পায়ে উচোট লাগবে না। শোবার সময় তুমি ভয় পাবে না, আর তোমার ঘুম হবে সুখের। হঠাৎ বিপদ আসলে তুমি ভয় কোরো না, দুষ্ট লোকের ধ্বংস দেখে ভয় পেয়ো না; কারণ তুমি মাবুদের উপরে ভরসা করবে, আর তিনি ফাঁদে পড়া থেকে তোমার পা রক্ষা করবেন। যারা উপকার পাবার উপযুক্ত তাদের উপকার করবার ক্ষমতা যখন তোমার হাতে থাকবে তখন তা করতে তুমি অস্বীকার কোরো না। সাহায্য করবার ক্ষমতা তোমার হাতে থাকলে কাউকে বোলো না, “যাও, পরে এসো, কালকে করব।” তোমার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে কোন কুমতলব কোরো না, সে তো তোমার পাশে নিশ্চিন্তে বাস করে। যে লোক তোমার কোন ক্ষতি করে নি, বিনা কারণে তাকে দোষী কোরো না। কোন জুলুমবাজ লোককে দেখে হিংসায় জ্বলতে থেকো না, কিংবা তার কোন পথও তুমি বেছে নিয়ো না; কারণ বাঁকা পথে যাওয়া মানুষকে মাবুদ ঘৃণা করেন, কিন্তু খাঁটি অন্তরের লোকের সংগে তিনি যোগাযোগ রাখেন। দুষ্ট লোকের ঘরের উপর মাবুদের বদদোয়া থাকে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তদের বাড়ীকে তিনি দোয়া করেন। যারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তাদেরও তিনি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন, কিন্তু নম্রদের রহমত দান করেন। জ্ঞানীরা সম্মান পাবে, কিন্তু বিবেচনাহীনদের পাওনা হল লজ্জা। সন্তানেরা, বাবার উপদেশে কান দাও, বিচারবুদ্ধি লাভ করবার দিকে মনোযোগ দাও। আমি তোমাদের ভাল শিক্ষা দিচ্ছি, সেইজন্য আমার নির্দেশের অবাধ্য হোয়ো না। আমিও তো আমার বাবার ছেলে ছিলাম, মায়ের চোখে কচি ও একমাত্র সন্তানের মত ছিলাম। তখন পিতা আমাকে শিক্ষা দিয়ে বলতেন, “তোমার সমস্ত দিল দিয়ে আমার কথা ধরে রেখো; আমার হুকুম মেনে চোলো, তাতে বাঁচবে। জ্ঞান লাভ কর, বিচারবুদ্ধি লাভ কর; আমার কথা ভুলে যেয়ো না, তা থেকে সরে যেয়ো না। জ্ঞানকে ত্যাগ কোরো না, সে-ই তোমাকে রক্ষা করবে; তাকে ভালবেসো, সে-ই তোমার উপর নজর রাখবে। জ্ঞানী হওয়ার প্রথম ধাপ হল জ্ঞান লাভ করা; তোমার যা কিছু আছে সব দিয়ে বিচারবুদ্ধি লাভ কর। জ্ঞানকে প্রধান স্থান দাও, সে-ই তোমাকে উঁচুতে তুলবে; তাকে জড়িয়ে ধর, সে তোমাকে সম্মান দেবে। সে তোমার মাথার উপর দেবে সুন্দর মালা আর উপহার দেবে সৌন্দর্যের তাজ।” ছেলে আমার, শোন, আমার কথা তোমার অন্তরে রাখ, তাতে তুমি অনেক বছর বেঁচে থাকবে। আমি তোমাকে জ্ঞানের পথ দেখিয়ে দিয়েছি, সোজা পথে তোমাকে চালিয়ে নিয়েছি। তাই হাঁটবার সময় পা ফেলতে তুমি বাধা পাবে না, দৌড়াবার সময় উচোট খাবে না। উপদেশ ধরে রাখ, ছেড়ে দিয়ো না; তা রক্ষা কর, কারণ ওটাই তোমার জীবন। দুষ্টদের পথে তুমি পা দিয়ো না, খারাপ লোকদের পথে হেঁটো না। সেই পথ তুমি এড়িয়ে যাও, তার উপর দিয়ে তুমি হেঁটো না; সেই পথে না গিয়ে বরং এগিয়ে যাও; কারণ খারাপ কাজ না করলে দুষ্টদের ঘুম হয় না; কাউকে উচোট খাওয়াতে না পারলে তাদের ঘুম আসে না। দুষ্টতা হল তাদের খাবার আর জুলুম হল তাদের মদ। আল্লাহ্‌ভক্তদের পথ খুব ভোরের প্রথম আলোর মত, যা দুপুর না হওয়া পর্যন্ত উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। কিন্তু দুষ্টদের পথ গভীর অন্ধকারের মত; তারা জানে না কিসে তারা উচোট খায়। ছেলে আমার, আমি যা বলছি তাতে মন দাও, আমার কথায় কান দাও। কথাগুলো তোমার চোখের আড়াল হতে দিয়ো না, তোমার অন্তরের মধ্যে তা রেখে দিয়ো। যারা এই রকম করে তাদের জন্য তা হয় জীবন, তা তাদের স্বাস্থ্যবান করে। সব কিছুর চেয়ে তোমার অন্তরকে বেশী করে পাহারা দিয়ে রাখ, কারণ অন্তর থেকেই তোমার জীবনের সব কিছু বের হয়ে আসে। তোমার মুখ থেকে বাঁকা কথা দূর করে দাও, ঠোঁট থেকে খারাপ কথা দূরে সরিয়ে দাও। তোমার চোখ যেন সোজা সামনে তাকায়, তোমার চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রাখ। তোমার চলবার পথ সমান কর, তাতে তোমার পথ তুমি স্থির করতে পারবে। ডানে কিংবা বাঁয়ে ফিরো না; খারাপ পথ থেকে তোমার পা দূরে রেখো। ছেলে আমার, আমি যে জ্ঞানের কথা বলছি তা ভাল করে শোন; আমার বিচারবুদ্ধির কথায় কান দাও। তাতে তুমি নেকী-বদী বুঝবার শক্তি রক্ষা করতে পারবে, আর তোমার মুখ থেকে জ্ঞানের কথা বের হবে। জেনাকারিণীর ঠোঁট থেকে যেন মধু ঝরে পড়ে, তার কথাবার্তা তেলের চেয়েও মোলায়েম; কিন্তু তার শেষ ফল হয় বিষের মত তেতো, দু’দিকে ধার দেওয়া ছোরার মত ধারালো। তার পথ মৃত্যুর কাছে নেমে গেছে, তা সোজা চলে গেছে কবরের দিকে। জীবনের দিকে যাবার পথের কথা সে চিন্তাও করে না; তার চলবার পথ বাঁকা, কিন্তু সে তা জানে না। ছেলেরা আমার, এবার আমার কথা শোন, আমি যা বলি তা থেকে সরে যেয়ো না। সেই স্ত্রীলোকের কাছ থেকে তোমার পা দূরে রাখ, তার ঘরের দরজার কাছেও যেয়ো না; যদি যাও তাহলে তোমার যৌবনের শক্তি অন্যদের দিয়ে দেবে আর তোমার আয়ু দিয়ে দেবে নিষ্ঠুরদের। তাতে অজানা লোকেরা তোমার ধন-সম্পদ ভোগ করবে, আর তোমার পরিশ্রমের ফল চলে যাবে অন্য লোকের বাড়ীতে। জীবনের শেষ সময়ে যখন তোমার শরীর ও গায়ের গোশ্‌ত ধ্বংস হবে তখন তুমি কাত্‌রাতে থাকবে। তুমি বলবে, “হায়! আমি শাসন ঘৃণা করেছি, আমার অন্তর সংশোধনের কথা তুচ্ছ করেছে। আমার শিক্ষকদের কথা আমি শুনি নি, যাঁরা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তাঁদের কথায় কান দিই নি। সমাজের লোকদের হাতে পড়ে আমি প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম।” তোমার নিজের জমা করা পানি থেকেই তুমি পানি খাও; তোমার নিজের কূয়ার টাটকা পানি খাও। তোমার নিজের ঝর্ণার পানি কেন বাইরে উপ্‌চে পড়বে? তোমার স্রোতের পানি কেন গিয়ে পড়বে রাস্তায় রাস্তায়? তোমার সন্তানেরা তোমার একারই থাকুক, জেনাকারিণীদের তাতে ভাগ না থাকুক, তোমার ঝর্ণায় দোয়া থাকুক, তোমার যৌবনের স্ত্রীকে নিয়েই তুমি আনন্দ কর। সে ভালবাসাপূর্ণ হরিণী, সৌন্দর্য-ভরা হরিণী; তারই বুক তোমাকে সব সময় সন্তুষ্ট রাখুক, তুমি সব সময় তার মহব্বতে মেতে থেকো। ছেলে আমার, কেন তুমি জেনাকারিণীকে নিয়ে মজে থাকবে? তার বুক কেন তুমি জড়িয়ে ধরবে? মানুষের চলাফেরার উপর মাবুদই চোখ রেখেছেন; তাদের সমস্ত পথ তিনিই যাচাই করে দেখেন। দুষ্ট লোক তার খারাপ কাজের ফাঁদে পড়ে, সে নিজের গুনাহের দড়িতে কষে বাঁধা পড়ে। শাসনের অভাবে সে মারা পড়ে; নিজের ভীষণ বোকামির দরুন সে তার পথে স্থির থাকে না। ছেলে আমার, তুমি যদি কারও জামিন হয়ে থাক, অন্যের জামিন হবার জন্য হাতে হাত রেখে থাক, যা বলেছ যদি তার ফাঁদে পড়ে থাক, যদি তোমার মুখের কথায় বাঁধা পড়ে থাক, তবে ছেলে আমার, তুমি যখন অন্যের হাতে ধরা পড়ে গেছ, তখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য এই সব কাজ কর- তার কাছে গিয়ে নিজেকে নীচু কর, তাকে সাধাসাধি কর, তোমার চোখকে ঘুমাতে দিয়ো না, চোখের পাতাকে বন্ধ হতে দিয়ো না। শিকারীর হাত থেকে হরিণের মত করে, পাখী শিকারীর হাত থেকে পাখীর মত করে তুমি নিজেকে ছাড়িয়ে নাও। হে অলস, তুমি পিঁপড়ার কাছে যাও, তার চলাফেরা দেখে জ্ঞান লাভ কর। তাকে হুকুম দেবার কেউ নেই, তার উপরে কোন পরিচালক বা শাসনকর্তা নেই; তবুও সে গরমকালে তার খাবার জমা করে রাখে আর ফসল কাটবার সময় খাবার যোগাড় করে। হে অলস, আর কতকাল তুমি শুয়ে থাকবে? কখন ঘুম থেকে উঠবে? তুমি বলে থাক, “আর একটু ঘুম, আর একটু ঘুমের ভাব, বিশ্রামের জন্য আর একটুক্ষণ হাত গুটিয়ে রাখি।” কিন্তু বারে বারে মেহমান আসলে কিংবা অস্ত্রশস্ত্রে সাজা দস্যুর হাতে পড়লে যেমন অভাব আসে, ঠিক তেমনি করে তোমারও অভাব আসবে। যে লোক জঘন্য ও দুষ্ট সে খারাপ কথা মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; সে চোখ টিপে ইশারা করে, পা দিয়ে ইংগিত দেয়, আংগুল দিয়ে সংকেত করে, মনে কুটিল চিন্তা নিয়ে সব সময় কুমতলব করে আর গোলমাল বাধায়। সেইজন্য হঠাৎ তার উপরে বিপদ আসবে; মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বংস হয়ে যাবে, সে আর উঠতে পারবে না। মাবুদ কমপক্ষে সাতটা জিনিস ঘৃণা করেন যেগুলো তাঁর কাছে জঘন্য: গর্বে ভরা চোখের চাহনি, মিথ্যাবাদী জিভ্‌, নির্দোষ লোকের রক্তপাত করে যে হাত, কুমতলব আঁটা অন্তর, অন্যায় কাজ করবার জন্য দৌড়ে যাওয়া পা, মিথ্যা কথা বলা মিথ্যা সাক্ষী, আর ভাইদের মধ্যে গোলমাল বাধানো লোক। ছেলে আমার, তুমি তোমার বাবার হুকুম পালন কর, আর মায়ের দেওয়া শিক্ষা ত্যাগ কোরো না। চিরদিনের জন্য তোমার অন্তরে তা গেঁথে রাখ, তোমার গলায় তা বেঁধে রাখ। চলবার সময় তা তোমাকে পথ দেখাবে, ঘুমাবার সময় তোমাকে পাহারা দেবে আর জেগে উঠলে তোমার সংগে কথা বলবে; কারণ এই সব হুকুম বাতির মত, এই শিক্ষা আলোর মত, আর কঠোর বকুনি দিয়ে শাসন করাই হল জীবনের পথ। এই সব তোমাকে খারাপ স্ত্রীলোকের হাত থেকে রক্ষা করবে, রক্ষা করবে বিপথে যাওয়া স্ত্রীলোকের মিষ্টি কথার হাত থেকে। তার সৌন্দর্য দেখে তুমি অন্তরে লোভ কোরো না, তার চোখের পাতায় তুমি নিজেকে বন্দী হতে দিয়ো না; কারণ বেশ্যা শেষ পর্যন্ত তোমাকে খাবার অভাবের মধ্যে নিয়ে যাবে, আর জেনাকারিণী তোমার মূল্যবান প্রাণ শিকার করবে। যদি কেউ আগুন তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখে তবে কি তার কাপড় পুড়ে যাবে না? যদি কেউ জ্বলন্ত কয়লার উপরে হাঁটে তবে তার পা কি পুড়ে যাবে না? যে লোক অন্যের স্ত্রীর কাছে যায় তার দশা এই রকমই হয়; যে সেই স্ত্রীলোককে ছোঁয় তাকে শাস্তি পেতেই হবে। খেতে না পেয়ে খিদে মিটাবার জন্য যে চুরি করে, সেই চোরকে লোকে ঘৃণার চোখে দেখে না। তবুও যখন সে ধরা পড়বে তখন হয়তো তাকে সাত গুণ ফিরিয়ে দিতে হবে, হয়তো তার ঘরের সমস্ত ধনও তাকে দিয়ে দিতে হবে। যে জেনা করে তার বুদ্ধির অভাব আছে; সে তা করে নিজেকেই ধ্বংস করে। তার ভাগ্যে আছে আঘাত আর অপমান, তার দুর্নাম কখনও মুছে যাবে না; কারণ দিলের জ্বালা স্বামীর ভয়ংকর রাগকে জাগিয়ে তোলে; প্রতিশোধ নেবার সময় সে কোন দয়াই দেখাবে না। কোন ক্ষতিপূরণই সে গ্রহণ করবে না, অনেক বেশী ঘুষ দিলেও সে সন্তুষ্ট হবে না। ছেলে আমার, আমার কথা শোন আর আমার সব হুকুম তোমার অন্তরের মধ্যে জমা করে রাখ। আমার হুকুম পালন কর, তাতে তুমি বাঁচবে। আমার দেওয়া শিক্ষা তোমার চোখের মণির মত করে পাহারা দিয়ে রাখ; তোমার আংগুলগুলোতে তা বেঁধে রাখ, তোমার অন্তরের পাতায় তা লিখে রাখ। জ্ঞানকে বল, “তুমি আমার বোন,” আর বুদ্ধিকে সাথী বল; যাতে তারা তোমাকে জেনাকারিণীর হাত থেকে রক্ষা করে, রক্ষা করে সেই মিষ্টি কথায় ভরা বিপথে যাওয়া স্ত্রীলোকের হাত থেকে। আমার ঘরের জানালার জালির মধ্য দিয়ে আমি বাইরে তাকালাম। বোকা লোকদের মধ্যে আমি চেয়ে দেখলাম, যুবকদের মধ্যে আমি এমন একজন যুবককে লক্ষ্য করলাম যার বুদ্ধির অভাব ছিল। সে সেই স্ত্রীলোকের বাড়ীর কাছের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তারপর সে তার বাড়ীর দিকের গলিতে গিয়ে ঢুকল; তখন দিনের আলো মিলিয়ে যাবার পর সন্ধ্যা হয়ে রাতের গভীর অন্ধকার নেমে এসেছিল। সেই সময় একজন স্ত্রীলোক তার সংগে দেখা করতে বের হয়ে আসল; তার পরনে বেশ্যার পোশাক, আর তার অন্তর ছিল ছলনায় ভরা। সে বিপথে যাওয়া স্ত্রীলোক, জোরে জোরে কথা বলে, তার পা কখনও ঘরে থাকে না; কখনও রাস্তায়, কখনও বাজারে, প্রত্যেকটি মোড়ে সে ওৎ পেতে থাকে। সে সেই যুবককে ধরে চুমু দিল আর বেহায়া মুখে বলল, “আমার ঘরে যোগাযোগ-কোরবানীর গোশ্‌ত আছে, আজকেই আমি মানত পূরণ করেছি। তাই আমি তোমার সংগে দেখা করবার জন্য বের হয়ে এসেছি; আমি তোমার তালাশ করে তোমাকে পেয়েছি। মিসর দেশের বিভিন্ন রংয়ের কাপড়ের তৈরী চাদর দিয়ে আমি বিছানা ঢেকেছি; গন্ধরস, অগুরু আর দারচিনি দিয়ে আমার বিছানা সুগন্ধযুক্ত করেছি। এস, আমরা সকাল পর্যন্ত দেহ-ভোগে মেতে থাকি, গভীর ভালবাসার মধ্যে আনন্দ ভোগ করি। আমার স্বামী বাড়ীতে নেই, তিনি দূরে যাত্রা করেছেন; তিনি থলি ভরে টাকা নিয়েছেন, পূর্ণিমার আগে ঘরে ফিরবেন না।” মন ভুলানো কথাবার্তার দ্বারা সে তাকে বিপথে নিয়ে গেল, মিষ্টি কথায় তাকে ভুলিয়ে নিল, আর সে তখনই সেই স্ত্রীলোকের পিছনে গেল। গরু যেমন করে জবাই হতে যায়, শিকলে বাঁধা অসাড়-বিবেক লোক যেমন তার শাস্তি পেতে যায়, পাখী যেমন তাড়াতাড়ি ফাঁদে পড়তে যায় আর শেষে তার কলিজায় তীর বিঁধে যায়, তেমনি করে সেই লোক জানেও না যে, এতে তার প্রাণ যাবে। ছেলেরা আমার, এখন তোমরা আমার কথা শোন, আমি যা বলি তাতে কান দাও। তোমাদের মনকে সেই স্ত্রীলোকের পথে যেতে দিয়ো না, তোমরা তার পথে ঘুরে বেড়ায়ো না; কারণ সে অনেকের সর্বনাশ করেছে, আর যাদের সে শেষ করে দিয়েছে তারা সংখ্যায় অনেক। তার ঘরটা হল কবরে যাবার পথ, যে পথ মৃত্যুর ঘরে নেমে গেছে। সুবুদ্ধি কি ডাক দেয় না? বিচারবুদ্ধি কি চিৎকার করে কথা বলে না? পথের পাশে উঁচু জায়গায় যেখানে পথ গিয়ে পথের সংগে মিলেছে সেখানে সুবুদ্ধি দাঁড়িয়ে থাকে। শহরে যাবার পথে সদর দরজার কাছে সে জোরে চেঁচিয়ে বলে, “ওহে লোকেরা, আমি তোমাদের ডাকছি, সমস্ত মানুষের কাছে জোর গলায় বলছি। বোকা লোকেরা, চালাক হবার বুদ্ধি লাভ কর; বিবেচনাহীন লোকেরা, বিচারবুদ্ধি লাভ কর। শোন, আমি উপযুক্ত কথা বলব, সঠিক কথা বলবার জন্য আমার মুখ খুলব। আমি সত্যি কথা বলব; খারাপ কথা আমার কাছে জঘন্য লাগে, তাই আমি তা বলব না। আমার মুখের সমস্ত কথাই ঠিক, তার মধ্যে বাঁকা কথা বা কুটিলতা নেই। যাদের বিচারবুদ্ধি আছে তাদের কাছে আমার কথা ভণ্ডামিশূন্য; যাদের জ্ঞান আছে তাদের কাছে সেগুলো খাঁটি। রূপার চেয়ে আমার উপদেশ লাভ করতে আগ্রহী হও, বাছাই করা সোনার চেয়ে জ্ঞান লাভ করতে আগ্রহী হও; কারণ প্র্রবাল পাথরের চেয়েও সুবুদ্ধি বেশী দামী; তোমার চাওয়ার মত কোন জিনিসের সংগে তার তুলনা হয় না। “আমি সুবুদ্ধি, আমি চালাক হবার বুদ্ধির সংগে বাস করি; জ্ঞান ও নেকী-বদী বুঝবার শক্তি আমার আছে। মাবুদকে ভয় করা মানেই দুষ্টতাকে ঘৃণা করা; অহংকার, বড়াই করা, খারাপ ব্যবহার আর বাঁকা কথাকে আমি ঘৃণা করি। পরামর্শ ও উপস্থিত বুদ্ধি আমার কাছ থেকে আসে; আমি বিচারবুদ্ধি, আমি ক্ষমতা দিই। বাদশাহ্‌রা রাজত্ব করে আমার দ্বারা, আর শাসনকর্তারা তৈরী করে ন্যায়পূর্ণ শরীয়ত; আমার দ্বারা রাজপুরুষেরা আর উঁচু পদের লোকেরা শাসন্তকাজ চালায়; তারা সবাই বিচারকের কাজ করে। যারা আমাকে ভালবাসে আমিও তাদের ভালবাসি; যারা মনেপ্রাণে আমার তালাশ করে তারা আমাকে পায়। ধন ও সম্মান আমার কাছ থেকে আসে, আসে স্থায়ী সম্পদ ও উন্নতি। সোনার চেয়েও, এমন কি, খাঁটি সোনার চেয়েও আমার দেওয়া ফল ভাল; আমি যা দিই তা বাছাই করা রূপার চেয়েও খাঁটি। আমি ন্যায়ের পথে হাঁটি, ন্যায়বিচারের পথ ধরে চলি। যারা আমাকে ভালবাসে তারা ধন-সম্পদ পায়; আমিই তাদের ধনভাণ্ডার পরিপূর্ণ করে তুলি। “মাবুদের কাজের শুরুতে, তাঁর সৃষ্টির কাজের আগে আমি তাঁরই ছিলাম; সেই প্রথম থেকে, দুনিয়া সৃষ্টির আগে থেকে, সমস্ত যুগের আগে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। যখন কোন সাগর ছিল না, ছিল না কোন ঝর্ণা যেখান থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে আসে, তখন আমি জন্মেছিলাম। পাহাড়-পর্বত স্থাপন করবার আগে আমি ছিলাম। যখন জমীন ও মাঠ-ময়দান কিংবা দুনিয়ার একটা ধূলিকণা পর্যন্ত তিনি তৈরী করেন নি, তখন আমি ছিলাম। তিনি যখন আসমান স্থাপন করছিলেন তখন আমি সেখানে ছিলাম; তিনি যখন সাগরের উপরে চারদিকের সীমানা ঠিক করছিলেন, তখন আমি সেখানে ছিলাম। তিনি যখন উপর দিকে আকাশ স্থাপন করছিলেন আর মাটির নীচের বড় বড় ঝর্ণা শক্তভাবে স্থাপন করছিলেন, তিনি যখন সাগরের সীমানা স্থির করছিলেন যেন পানি তাঁর নিয়মের বাইরে পার হয়ে না আসে, যখন তিনি দুনিয়ার ভিত্তি ঠিক করছিলেন, তখন আমিই কারিগর হিসাবে তাঁর পাশে ছিলাম। দিনের পর দিন আমি খুশীতে পূর্ণ হয়ে তাঁর সামনে সব সময় আনন্দ করতাম; তাঁর দুনিয়া নিয়ে আনন্দ করতাম, আর মানুষকে নিয়ে খুশীতে পূর্ণ ছিলাম। “ছেলেরা আমার, এখন আমার কথা শোন; যারা আমার পথে চলে তারা সুখী। আমার নির্দেশে কান দাও, জ্ঞানবান হও, অবহেলা কোরো না। যে লোক আমার কথা শোনে আর প্রতিদিন আমার দরজার কাছে জেগে থাকে ও আমার দরজার চৌকাঠে অপেক্ষা করে সে সুখী; কারণ যে আমাকে পায় সে জীবন পায় আর মাবুদের কাছ থেকে রহমত পায়। কিন্তু যে আমাকে পায় না সে নিজের ক্ষতি করে; যারা আমাকে ঘৃণা করে তারা সবাই মৃত্যুকে ভালবাসে।” সুবুদ্ধি তার ঘর তৈরী করেছে; পাথর কেটে সে সাতটা থাম তৈরী করেছে। সে পশু কেটে গোশ্‌ত রান্না করেছে এবং আংগুর-রসের সংগে মসলা মিশিয়েছে; সে খাবার দিয়ে টেবিল সাজিয়েছে। সে তার চাকরাণীদের সব জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে, আর শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা থেকে সে ডাক দিয়ে বলছে, “বোকা লোকেরা এখানে আসুক।” যাদের বুদ্ধি নেই তাদের সে বলে, “এস, আমার খাবার খাও, আমার মসলা মেশানো আংগুর-রস খাও; তুমি বোকা লোকদের সংগ ছেড়ে দাও, তাতে তুমি বাঁচবে; তুমি বিচারবুদ্ধির পথে চলাফেরা কর।” ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীকে যে সংশোধন করতে যায় সে অপমানিত হয়; দুষ্ট লোকের দোষ যে দেখিয়ে দেয় তাকেই সেই দুষ্ট লোক দোষী করে। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীর দোষ দেখিয়ে দিয়ো না, দিলে সে তোমাকে ঘৃণা করবে; বরং জ্ঞানী লোককে তার দোষ দেখিয়ে দাও, সে তোমাকে ভালবাসবে। জ্ঞানী লোককে উপদেশ দাও, তাতে সে আরও জ্ঞানী হবে; আল্লাহ্‌ভক্ত লোককে শিক্ষা দাও, সে আরও শিক্ষা লাভ করবে। মাবুদের প্রতি ভয় হল সুবুদ্ধির ভিত্তি; আল্লাহ্‌ পাককে জানতে পারলে বিচারবুদ্ধি লাভ হয়। সুবুদ্ধি বলে, “আমার মধ্য দিয়ে তুমি অনেক দিন বেঁচে থাকবে, তোমার আয়ু আরও অনেক বছর বেড়ে যাবে। তুমি যদি জ্ঞানী হও তবে তোমার নিজের লাভ হবে, কিন্তু যদি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী হও তবে তুমি একাই কষ্ট পাবে।” নির্বুদ্ধি স্ত্রীলোকের মত যে গলাবাজি করে সে কোন বাধা মানে না, তার জ্ঞান নেই। সে তার ঘরের দরজার পাশে শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গার আসনে বসে। যারা সেই পথ দিয়ে সোজা নিজের নিজের পথে যায় তাদের সে ডেকে বলে, “বোকা লোকেরা এখানে আসুক।” যাদের বুদ্ধি নেই তাদের সে বলে, “চুরি করা পানি মিষ্টি; যে খাবার লুকিয়ে খাওয়া হয় তা খুব স্বাদ লাগে।” কিন্তু তারা জানেই না যে, মৃত লোকেরা সেখানে থাকে; সেই স্ত্রীলোকের দাওয়াত করা লোকেরা কবরের গভীরে থাকে। সোলায়মানের সৎ উপদেশ। জ্ঞানী ছেলে বাবার জীবনে আনন্দ আনে, কিন্তু বিবেচনাহীন ছেলে মায়ের জীবনে দুঃখ আনে। অন্যায়ভাবে পাওয়া ধনে কোন লাভ হয় না, কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় মৃত্যু থেকে উদ্ধার করে। মাবুদ তাঁর ভক্তদের ক্ষুধায় কষ্ট পেতে দেন না, কিন্তু তিনি দুষ্টদের কামনা-বাসনা পূর্ণ হতে দেন না। অলসতা মানুষকে গরীব করে, কিন্তু পরিশ্রম ধন নিয়ে আসে। জ্ঞানী ছেলে গরমকালে ফসল জমা করে, কিন্তু লজ্জাদায়ী ছেলে ফসল কাটবার সময় ঘুমিয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ভক্তদের মাথায় অনেক দোয়া নেমে আসে, কিন্তু দুষ্টদের জুলুমবাজ মনোভাব তাদের মুখের কথায় ঢাকা পড়ে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের স্মৃতি দোয়া আনে, কিন্তু দুষ্টদের নাম পচে যায়। যার অন্তরে জ্ঞান আছে সে হুকুম মানে, কিন্তু বকবক করা অসাড়-বিবেক লোক ধ্বংস হয়ে যাবে। যে সততায় চলে সে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করে, কিন্তু যে বাঁকা পথে চলে সে ধরা পড়বে। যে লোক চোখ টিপে ইশারা করে সে দুঃখ দেয়; বকবক করা অসাড়-বিবেক লোক ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ভক্তের মুখ জীবনের ঝর্ণার মত, কিন্তু দুষ্টদের জুলুমবাজ মনোভাব তাদের মুখের কথায় ঢাকা পড়ে। ঘৃণা ঝগড়া-বিবাদ জাগিয়ে তোলে, কিন্তু ভালবাসা সমস্ত অন্যায় ঢেকে রাখে। যাদের বিচারবুদ্ধি আছে তাদের মুখে জ্ঞান পাওয়া যায়, কিন্তু যাদের বুদ্ধি নেই তাদের পিঠের জন্য আছে লাঠি। জ্ঞানী লোক জ্ঞান জমা করে, কিন্তু অসাড়-বিবেকের মুখ সর্বনাশ ডেকে আনে। ধনীর ধনই তাদের দেয়াল-ঘেরা শহর; গরীবদের অভাবই হল তাদের সর্বনাশ। আল্লাহ্‌ভক্তদের মজুরি হল পরিপূর্ণ জীবন, কিন্তু দুষ্টদের আয়ে গুনাহের বৃদ্ধি হয়। যে শাসন মানে সে জীবনের পথে চলে, কিন্তু যে সংশোধনের কথা অগ্রাহ্য করে সে বিপথে যায়। যে লোক তার মনের মধ্যে ঘৃণা গোপন করে রাখে সে মিথ্যা কথা বলে; যে লোক নিন্দা রটায় সে বিবেচনাহীন। বেশী কথার মধ্যে অন্যায় উপস্থিত থাকে, কিন্তু যে তার মুখ দমনে রাখে সে বুদ্ধিমান। আল্লাহ্‌ভক্তদের জিভ্‌ খাঁটি রূপার মত, কিন্তু দুষ্টদের অন্তরের দাম কম। আল্লাহ্‌ভক্তদের মুখ অনেককে লালন-পালন করে, কিন্তু বুদ্ধির অভাবে অসাড়-বিবেক লোকেরা মারা পড়ে। মাবুদ যাকে দোয়া করেন সে-ই ধনী; সেই দোয়ায় কোন দুঃখ-কষ্ট থাকে না। খারাপ কাজ করা বিবেচনাহীনের আনন্দ, কিন্তু বুদ্ধিমানের আনন্দের বিষয় হল জ্ঞান। দুষ্ট লোকেরা যা ভয় করে তা-ই তাদের উপর ঘটবে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তদের ইচ্ছা পূরণ করা হবে। ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেলে দুষ্ট আর থাকে না, কিন্তু যে আল্লাহ্‌ভক্ত সে চিরকাল অটল থাকে। দাঁতে সির্‌কা আর চোখে ধোঁয়া লাগলে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি যারা অলসকে কোথাও পাঠায় তারা কষ্ট পায়। মাবুদের প্রতি ভয় আয়ু বাড়ায়, কিন্তু দুষ্টদের আয়ু কমিয়ে দেওয়া হবে। আল্লাহ্‌ভক্তদের আশায় আনন্দ আছে, কিন্তু দুষ্টদের আশায় ছাই পড়বে। মাবুদের পথ সৎ লোকদের জন্য কেল্লার মত, কিন্তু যারা খারাপ কাজ করে তাদের জন্য তা সর্বনাশ। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা সব সময় অটল থাকবে, কিন্তু দুষ্ট লোকেরা দেশে বাস করতে পারবে না। আল্লাহ্‌ভক্তদের মুখ থেকে জ্ঞানের কথা বের হয়, কিন্তু যে জিভ্‌ বাঁকা কথা বলে তা কেটে ফেলা হবে। আল্লাহ্‌ভক্তদের মুখ উপযুক্ত কথা বলতে জানে, কিন্তু দুষ্টদের মুখ কেবল বাঁকা কথাই বলে। ঠকামির দাঁড়িপাল্লা মাবুদ ঘৃণা করেন, কিন্তু ন্যায্য বাট্‌খারাতে তিনি খুশী হন। অহংকারের সংগে সংগে অপমানও আসে, কিন্তু নম্রতার সংগে আসে জ্ঞান। সৎ লোকেরা পরিচালিত হয় তাদের সততার দ্বারা, কিন্তু বেঈমান লোকেরা ধ্বংস হয় নিজেদের ছলনার দ্বারা। যেদিন আল্লাহ্‌র গজব নেমে আসবে সেই দিন ধন কোন উপকারে আসবে না, কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে। সৎ লোকদের আল্লাহ্‌-ভয় তাদের জন্য সোজা পথ তৈরী করে, কিন্তু দুষ্টদের পতন হয় তাদের দুষ্টতার দ্বারা। সৎ লোকদের আল্লাহ্‌-ভয় তাদের রক্ষা করে, কিন্তু বেঈমান লোকেরা নিজেদের লোভের ফাঁদে পড়ে। দুষ্ট লোক মরলে তার আশাও নষ্ট হয়ে যায়; তার শক্তির দরুন সে যে সব আশা করেছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক কষ্ট থেকে উদ্ধার পায়, কিন্তু সেই কষ্ট দুষ্ট লোকের উপরে এসে পড়ে। আল্লাহ্‌র প্রতি যার ভয় নেই সে মুখ দিয়ে প্রতিবেশীর সর্বনাশ করে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক জ্ঞান দ্বারা রক্ষা পায়। আল্লাহ্‌ভক্তদের উন্নতি হলে শহরে আনন্দ হয়, আর দুষ্টেরা ধ্বংস হলে লোকে আনন্দে চিৎকার করে। সৎ লোকেরা আল্লাহ্‌র দোয়া পেলে শহরের উন্নতি হয়, কিন্তু দুষ্টদের মুখের দ্বারা শহরের সর্বনাশ হয়। যে তার প্রতিবেশীকে তুচ্ছ করে তার বুদ্ধির অভাব আছে, কিন্তু যার বিচারবুদ্ধি আছে সে তার জিভ্‌ সামলায়। যে পরের বিষয় নিয়ে অলোচনা করে সে গোপন কথা বলে দেয়, কিন্তু বিশ্বস্ত লোক কথা গোপন রাখে। উপযুক্ত পরিচালনার অভাবে জাতি হেরে যায়, কিন্তু অনেক পরামর্শদাতা হলে জাতি উদ্ধার পায়। যে অন্যের জামিন হয় সে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে, কিন্তু যে জামিন হতে অস্বীকার করে সে নিরাপদে থাকে। সুন্দর স্বভাবের স্ত্রীলোক সম্মান লাভ করে, আর জুলুমবাজ লোকেরা ধন লাভ করে। দয়ালু লোক নিজের উপকার করে, কিন্তু নিষ্ঠুর লোক নিজের ক্ষতি করে। দুষ্ট লোক যা আয় করে তা মিথ্যা, কিন্তু যে আল্লাহ্‌-ভয়ের বীজ বোনে সে সত্যিই তার ফসল কাটবে। যে আল্লাহ্‌-ভয়ে অটল সে পরিপূর্ণ জীবন পায়, কিন্তু যে খারাপীর পিছনে দৌড়ায় সে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে। যাদের অন্তর কুটিল মাবুদ তাদের ঘৃণা করেন, কিন্তু যারা নিখুঁত জীবন কাটায় তাদের উপর তিনি সন্তুষ্ট হন। তোমরা নিশ্চয় জেনো দুষ্টেরা শাস্তি পাবেই পাবে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্তেরা কোন শাস্তি পাবে না। শূকরের নাকে সোনার নথ দিলে যেমন হয়, তেমনি হয় সেই সুন্দরী স্ত্রীলোক যার নেকী-বদীর বোধ নেই। আল্লাহ্‌ভক্তের মনের ইচ্ছা উন্নতি বয়ে আনে, কিন্তু দুষ্ট লোকের আশার বদলে কেবল আল্লাহ্‌র গজব নেমে আসে। যে কেউ খোলা হাতে দান করে সে আরও বেশী লাভ করে; আবার যে কেউ ন্যায্য খরচ করতে অস্বীকার করে সে অভাবে পড়ে। যে খোলা হাতে দান করে তার উন্নতি হয়; যে অন্যকে তৃপ্ত করে সে নিজেও তৃপ্ত হয়। যে লোক শস্য আটক করে রাখে লোকে তাকে বদদোয়া দেয়, কিন্তু যে তা বিক্রি করে সে দোয়ার পাত্র হয়। যে ভালোর তালাশ করে সে দয়া পায়, কিন্তু যে খারাপীর তালাশ করে তার উপর তা-ই ঘটবে। যে তার ধনের উপর ভরসা করে তার পতন হবে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক সবুজ পাতার মত সতেজ থাকবে। যে তার পরিবারে কষ্ট নিয়ে আসে তার ভাগে বাতাস ছাড়া আর কিছুই থাকবে না; আর যাদের বিবেক অসাড় তারা জ্ঞানীদের গোলাম হবে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক অন্যদের কাছে জীবন্তগাছের মত; যে অন্যদের মন জয় করে সে জ্ঞানী। এই দুনিয়াতেই যদি আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের পাওনা পেতে হয়, তবে দুষ্ট এবং গুনাহ্‌গার লোকেরা নিশ্চয়ই তাদের পাওনা পাবে। যে লোক শাসন ভালবাসে সে জ্ঞান ভালবাসে, কিন্তু যে লোক সংশোধনের কথা ঘৃণা করে সে পশুর সমান। ভাল লোক মাবুদের কাছ থেকে রহমত পায়, কিন্তু যে কুমতলব করে মাবুদ তাকে দোষী বলে স্থির করেন। খারাপী দিয়ে কোন লোকের জীবনে স্থিরতা আসে না, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোকের জীবনের ভিত্তি অটল থাকে। ভাল ও গুণবতী স্ত্রী স্বামীর মাথার তাজের মত, কিন্তু যে স্ত্রী লজ্জার কাজ করে সে তার স্বামীর পচা হাড়ের মত। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের চিন্তা ন্যায়ে পূর্ণ, কিন্তু দুষ্টদের পরামর্শে আছে ছলনা। দুষ্ট লোকেরা রক্তপাত করবার জন্য ওৎ পেতে থাকবার কথা বলে, কিন্তু ন্যায়বান লোকেরা রক্ষা করবার কথা বলে। দুষ্ট লোকেরা ধ্বংস হয়ে যায়, তাদের বংশ থাকে না, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের বংশ অটল থাকে। মানুষ যেভাবে বুদ্ধি খাটায় সেই অনুসারে প্রশংসা পায়, কিন্তু কুটিলমনা লোকদের তুচ্ছ করা হয়। যে লোক বড়লোকের ভান করে কিন্তু ঘরে খাবার নেই, তার চেয়ে যে বড়লোক নয় অথচ চাকর রাখে সে বরং ভাল। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক তার পশুদের যত্ন করে, কিন্তু দুষ্টদের মমতাও নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। যে লোক নিজের জমিতে পরিশ্রম করে তার প্রচুর খাবার থাকে, কিন্তু যে অসারতার পিছনে দৌড়ায় তার বুদ্ধির অভাব আছে। দুষ্টেরা খারাপ লোকদের লুট করা জিনিস পেতে চায়, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের জীবন ফল দান করে। খারাপ লোক তার গুনাহে পূর্ণ কথাবার্তার দ্বারা ফাঁদে পড়ে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক কষ্ট থেকে রেহাই পায়। মানুষ তার কথার দ্বারা উন্নতিতে পরিপূর্ণ হতে পারে, আর তার কাজ অনুসারে সে ফল পায়। অসাড়-বিবেক লোকের পথ তার নিজের কাছে ঠিক মনে হয়, কিন্তু জ্ঞানী লোক পরামর্শ শোনে। যার বিবেক অসাড় সে তার বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলে, কিন্তু সতর্ক লোক নিজের অপমান ঢাকা দেয়। সত্যবাদীর সাক্ষ্যের ফলে উচিত বিচার হয়, কিন্তু মিথ্যবাদীর সাক্ষ্যের ফলে ভুল বিচার হয়। বেপরোয়া কথা তলোয়ারের মত আঘাত করে, কিন্তু জ্ঞানীর কথা সুস্থ করে। সত্যবাদীর কথা চিরকাল স্থায়ী, কিন্তু মিথ্যাবাদীর কথা অল্পকাল স্থায়ী। যারা কুমতলব করে তাদের অন্তরে ছলনা থাকে, কিন্তু যারা ভালোর পরামর্শ দেয় তাদের অন্তরে থাকে আনন্দ। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের জীবনে অবনতি হয় না, কিন্তু দুষ্টদের জীবন অবনতিতে পূর্ণ থাকে। মিথ্যাবাদী মুখকে মাবুদ ঘৃণা করেন, কিন্তু যে লোকেরা বিশ্বস্ততায় চলে তাদের উপর তিনি সন্তুষ্ট হন। সতর্ক লোক যা জানে তা বলে বেড়ায় না, কিন্তু বিবেচনাহীন লোকেরা তাদের কথায় নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করে। পরিশ্রমী লোকেরা কর্তৃত্ব করে, কিন্তু অলস লোকেরা পরের অধীন হয়। দুশ্চিন্তার ভারে মানুষের অন্তর ভেংগে পড়ে, কিন্তু একটুখানি উৎসাহের কথা তাকে আনন্দ দান করে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক তার প্রতিবেশীকে পথ দেখায়, কিন্তু দুষ্টেরা এমন পথে চলে যা তাদেরই বিপথে নিয়ে যায়। অলস লোক নিজের খাবারের জন্য শিকার করতেও যায় না, কিন্তু মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল পরিশ্রমী হওয়া। ন্যায়ের পথে জীবন থাকে, সেই পথে মৃত্যু নেই। জ্ঞানী ছেলে পিতার শাসন মানে, কিন্তু ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী সংশোধনে কান দেয় না। মানুষ নিজের কথার দ্বারা উন্নতি লাভ করতে পারে; বেঈমান লোক জুলুম করতে চায়। যে তার মুখ সাবধানে রাখে সে তার প্রাণ রক্ষা করে, কিন্তু যে অসাবধানে কথা বলে তার সর্বনাশ হয়। অলস পেতে চায় কিন্তু কিছুই পায় না, কিন্তু পরিশ্রমী লোকেরা তাদের চাওয়ার অতিরিক্ত পায়। আল্লাহ্‌ভক্ত লোক মিথ্যাকে ঘৃণা করে, কিন্তু দুষ্ট লোক লজ্জা ও দুর্নামের কারণ হয়। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় সৎ লোককে রক্ষা করে, কিন্তু দুষ্টতা গুনাহ্‌গারদের সর্বনাশ ঘটায়। কেউ নিজেকে ধনী দেখায় কিন্তু তার কিছুই নেই; আবার কেউ নিজেকে গরীব দেখায় কিন্তু তার অনেক ধন আছে। ধনীকে তার ধন দিয়েই নিজের প্রাণ রক্ষা করতে হয়, কিন্তু গরীব লোককে কেউ ভয় দেখায় না। আল্লাহ্‌ভক্তদের নূর উজ্জ্বলভাবে জ্বলে, কিন্তু দুষ্টদের বাতি নিভে যায়। অহংকার কেবল ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি করে, কিন্তু যারা উপদেশ শোনে তাদের কাছে জ্ঞান পাওয়া যায়। পরিশ্রম না করে যে টাকা পাওয়া যায় তা কমে যায়, কিন্তু যে লোক পরিশ্রম করে টাকা জমায় তার টাকা বেড়ে যায়। আশা পূর্ণ হতে দেরি হলে অন্তর ভেংগে পড়ে, কিন্তু ইচ্ছার পরিপূর্ণতা জীবন্তগাছের মত। যে লোক আল্লাহ্‌র কালাম তুচ্ছ করে সে নিজের সর্বনাশ করে, কিন্তু যে লোক ভয়ে আল্লাহ্‌র হুকুম মানে সে তার পাওনা পায়। জ্ঞানী লোকের দেওয়া শিক্ষা জীবনের ঝর্ণার মত; তা মানুষকে মৃত্যুর ফাঁদ থেকে দূরে রাখে। যার বুদ্ধি ভাল সে সম্মান পায়, কিন্তু বেঈমান লোকেরা শেষ হয়ে যাবে। সতর্ক লোক জ্ঞানের সংগে কাজ করে, কিন্তু বিবেচনাহীন লোক তার নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করে। দুষ্ট সংবাদদাতা বিপদে পড়ে, কিন্তু বিশ্বস্ত সংবাদদাতা উপকার আনে। যে লোক শাসন অগ্রাহ্য করে সে অভাবে পড়ে ও লজ্জা পায়, কিন্তু যে লোক সংশোধনের কথায় কান দেয় সে সম্মানিত হয়। মনের ইচ্ছা পূরণ হলে অন্তর তৃপ্ত হয়, কিন্তু বিবেচনাহীনেরা খারাপী থেকে দূরে সরে যেতে ঘৃণা বোধ করে। জ্ঞানীদের সংগে যে চলাফেরা করে সে জ্ঞানী হয়, কিন্তু যে লোক বিবেচনাহীনদের সংগী তার ক্ষতি হয়। অবনতি গুনাহ্‌গারদের পিছনে পিছনে ছুটে আসে, কিন্তু উন্নতি হল আল্লাহ্‌ভক্তদের পাওনা। ভাল লোক তার নাতি-নাতনীদের জন্য অধিকার রেখে যায়, কিন্তু গুনাহ্‌গারের ধন আল্লাহ্‌ভক্তদের জন্যই জমা করা হয়। গরীবের জমিতে প্রচুর শস্য জন্মায়, কিন্তু অবিচারের ফলে তা কেড়ে নেওয়া হয়। যে তার ছেলেকে শাস্তি দেয় না সে তাকে ভালবাসে না, কিন্তু যে তাকে ভালবাসে সে তার শাসনের দিকে মনোযোগ দেয়। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা পেট ভরে খায়, কিন্তু দুষ্টেরা পেট ভরে খেতে পায় না। বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোক তার সংসারের উন্নতি করে, কিন্তু যে স্ত্রীলোকের বিবেক অসাড় সে নিজেই তার সংসারের ভাংগন ধরায়। যে সততায় চলে সে মাবুদকে ভয় করে, কিন্তু যে বাঁকা পথে চলে সে তাঁকে তুচ্ছ করে। যার বিবেক অসাড় তার কথাবার্তায় অহংকার প্রকাশ পায়, কিন্তু জ্ঞানীরা তাদের কথার দ্বারা রক্ষা পায়। গরু না থাকলে যাবপাত্র খালি থাকে, কিন্তু বলদের শক্তি দ্বারা প্রচুর ফসল পাওয়া যায়। বিশ্বস্ত সাক্ষী মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তু অবিশ্বস্ত সাক্ষী মিথ্যা কথা বলে। যে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে সে জ্ঞানের খোঁজ করেও পায় না, কিন্তু যার বিচারবুদ্ধি আছে সে সহজেই জ্ঞান লাভ করে। বিবেচনাহীন লোকের কাছ থেকে তুমি চলে যাও, কারণ তার মুখে তুমি জ্ঞানের কথা পাবে না। বিচারবুদ্ধি অনুসারে চলা হল সতর্ক লোকের জ্ঞান, কিন্তু ছলনা হল বিবেচনাহীন লোকের নির্বুদ্ধিতা। অসাড়-বিবেক লোকেরা তাদের দোষ দিয়ে একে অন্যের সংগে বাঁধা থাকে, কিন্তু সৎ লোকেরা বাঁধা থাকে উপকার করবার ইচ্ছা দিয়ে। যার অন্তর তেতো সে তা নিজেই বোঝে; একজনের অন্তরের আনন্দের ভাগী অন্যে হতে পারে না। দুষ্টদের বাড়ী ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু সৎ লোকদের তাম্বু বড় থেকে আরও বড় হবে। একটা পথ আছে যেটা মানুষের চোখে ঠিক মনে হয়, কিন্তু সেই পথের শেষে থাকে মৃত্যু। হাসবার সময়েও মনে ব্যথা থাকতে পারে, আর আনন্দের শেষে দুঃখ থাকতে পারে। বেঈমান লোকেরা নিজেদের আচার-ব্যবহারে তৃপ্ত হয়, কিন্তু ভাল লোকেরা নিজেদের আচার-ব্যবহারে আরও বেশী তৃপ্ত হয়। বোকা লোক সব কথাই বিশ্বাস করে, কিন্তু সতর্ক লোক বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে চলে। জ্ঞানী লোক খারাপীকে ভয় করে তা থেকে সরে যায়, কিন্তু বিবেচনাহীন লোক নিজের উপর বেশী বিশ্বাস করে দুঃসাহসী হয়। বদমেজাজী লোক বোকার মত কাজ করে, আর কুমতলবকারীকে সবাই ঘৃণা করে। বোকা লোকেরা পাওনা হিসাবে পায় নির্বুদ্ধিতা, আর সতর্ক লোকেরা পুরস্কার হিসাবে পায় জ্ঞান। খারাপ লোকেরা ভাল লোকদের সামনে নত হয়, আর দুষ্টেরা আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের দরজার কাছে নত হয়। গরীবকে তার প্রতিবেশীরা পর্যন্ত অপছন্দ করে, কিন্তু ধনীর অনেক বন্ধু থাকে। যে তার প্রতিবেশীকে তুচ্ছ করে সে গুনাহ্‌ করে, কিন্তু ধন্য সে যে অভাবীদের প্রতি দয়া করে। যারা খারাপ কাজ করবার ফন্দি আঁটে তারা কি বিপথে যায় না? কিন্তু যারা উপকার করবার পরিকল্পনা করে তাদের জন্য আছে বিশ্বস্ততা ও সততা। সমস্ত পরিশ্রম লাভ নিয়ে আসে, কিন্তু শুধু কথাবার্তা কেবল অভাবের দিকে নিয়ে যায়। জ্ঞানীদের পুরস্কার হল তাদের ধন, কিন্তু বিবেচনাহীনদের বোকামি আরও বোকামির জন্ম দেয়। যে সাক্ষী সত্যি কথা বলে সে অন্যের জীবন রক্ষা করে, কিন্তু মিথ্যা সাক্ষী ছলনা করে। মাবুদের প্রতি ভয় থেকে দৃঢ় নিশ্চয়তা আসে আর তার ছেলেমেয়েদের জন্য আশ্রয়স্থান থাকে। মাবুদের প্রতি ভয় জীবনের ঝর্ণার মত; তা লোককে মৃত্যুর ফাঁদ থেকে দূরে রাখে। লোকসংখ্যা বেশী হলে বাদশাহ্‌র গৌরব হয়, কিন্তু প্রজা কম থাকলে বাদশাহ্‌র সর্বনাশ হয়। যে লোক সহজে রাগ করে না সে খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু যে লোক হঠাৎ রেগে যায় সে বোকামি তুলে ধরে। শান্ত মন শরীরকে সুস্থ রাখে, কিন্তু হিংসা শরীরকে অসুস্থ করে তোলে। যে লোক গরীবের উপর জুলুম করে সে তার সৃষ্টিকর্তাকে অপমান করে, কিন্তু যে লোক অভাবীকে দয়া করে সে তার সৃষ্টিকর্তাকে সম্মান করে। দুষ্টদের অন্যায় কাজ তাদের পতন ঘটায়, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের মৃত্যুর সময়েও আশা থাকে। যাদের বিচারবুদ্ধি আছে তাদের অন্তরে জ্ঞান শান্তভাবে থাকে, কিন্তু বিবেচনাহীনেরা তাদের জ্ঞান প্রকাশ করবার জন্য ব্যস্ত হয়। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় জাতিকে সম্মানিত করে কিন্তু গুনাহ্‌ জাতিকে অসম্মানে ফেলে। যে কর্মচারী বুদ্ধি করে কাজ করে বাদশাহ্‌ তাকে সুনজরে দেখেন, কিন্তু যে কর্মচারী লজ্জাপূর্ণ কাজ করে সে তাঁর রাগের পাত্র হয়। নরম জবাব রাগ দূর করে, কিন্তু কড়া কথা রাগ জাগিয়ে তোলে। জ্ঞানী লোকদের মুখ জ্ঞান ভালভাবে ব্যবহার করে, কিন্তু বিবেচনাহীনদের মুখ থেকে বোকামি স্রোতের মত বের হয়ে আসে। মাবুদের চোখ সবখানেই আছে; তা ভাল ও খারাপ লোকদের উপর নজর রাখে। যে কথা মানুষের জীবনে সুস্থতা আনে তা জীবন্তগাছের মত, কিন্তু ছলনার কথা মানুষের মন ভেংগে দেয়। অসাড়-বিবেক লোক তার পিতার শাসনকে তুচ্ছ করে, কিন্তু সতর্ক লোক সংশোধনের কথায় কান দেয়। আল্লাহ্‌ভক্তদের ঘর হল মহাধনের ভাণ্ডার, কিন্তু দুষ্টদের আয় বিপদ ডেকে আনে। জ্ঞানীদের মুখ জ্ঞান ছড়ায়, কিন্তু বিবেচনাহীনদের অন্তর তা করে না। দুষ্টদের কোরবানী মাবুদ ঘৃণা করেন, কিন্তু খাঁটি লোকদের মুনাজাতে তিনি খুশী হন। মাবুদ দুষ্টদের পথ ঘৃণা করেন, কিন্তু যারা ন্যায় কাজ করবার জন্য এগিয়ে যায় তাদের তিনি মহব্বত করেন। যারা ঠিক পথ ত্যাগ করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে; যে লোক সংশোধনের কথা ঘৃণা করে সে মরবে। মাবুদ তো ধ্বংসস্থান, অর্থাৎ কবর দেখতে পান; তাহলে মানুষের অন্তর তিনি আরও কত বেশী করেই না দেখতে পাচ্ছেন! ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী সংশোধনের কথা পছন্দ করে না; সে জ্ঞানীদের কাছে যায় না। অন্তরে আনন্দ থাকলে মুখও খুশী দেখায়, কিন্তু অন্তরের ব্যথায় মন ভেংগে যায়। যার মনে বিচারবুদ্ধি আছে সে জ্ঞানের তালাশ করে, কিন্তু বিবেচনাহীনের খাবার হল বোকামি। দুঃখীর সব দিনগুলোই কষ্টে ভরা, কিন্তু যার মন খুশী থাকে তার সব দিনই যেন মেজবানীর দিন। অশান্তির সংগে প্রচুর ধন লাভের চেয়ে মাবুদের প্রতি ভয়ের সংগে অল্পও ভাল। ধনীর ভালবাসাহীন বাড়ীতে মোটাসোটা বাছুর থাকবার চেয়ে গরীবের ভালবাসাপূর্ণ বাড়ীতে শাক-ভাতও ভাল। রাগী লোক ঝগড়া খুঁচিয়ে তোলে, কিন্তু যে লোক সহজে রাগ করে না সে ঝগড়া থামিয়ে দেয়। অলসের পথ দু’পাশে কাঁটার বেড়া দেওয়া পথের মত, কিন্তু সৎ লোকের পথ যেন রাজপথ। জ্ঞানী ছেলে পিতার জীবনে আনন্দ আনে, কিন্তু বিবেচনাহীন লোক মাকে তুচ্ছ করে। যার বুদ্ধির অভাব আছে সে বোকামিতে আনন্দ পায়, কিন্তু যার বিচারবুদ্ধি আছে সে সোজা পথে হাঁটে। পরামর্শের অভাবে পরিকল্পনা মিথ্যা হয়ে যায়, কিন্তু পরামর্শদাতা অনেক হলে পরিকল্পনা সফল হয়। যে লোক উপযুক্ত জবাব দিতে পারে সে খুশী হয়; ঠিক সময়ে বলা কথা কেমন ভাল! বুদ্ধিমান লোকের জীবনের পথ তাকে উপরের দিকে নিয়ে যায়, আর তাতে সে নীচে কবরে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। মাবুদ অহংকারীদের বাড়ী ভেংগে ফেলেন, কিন্তু তিনি বিধবার সীমানা ঠিক রাখেন। মাবুদ সব কুমতলব ঘৃণা করেন, কিন্তু উপকারের কথাবার্তা তাঁর চোখে খাঁটি। লোভী লোক তার পরিবারে কষ্ট নিয়ে আসে, কিন্তু যে লোক ঘুষ ঘৃণা করে সে পরিপূর্ণ জীবন পাবে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকের অন্তর চিন্তা করে জবাব দেয়, কিন্তু দুষ্টদের মুখ থেকে খারাপ কথার স্রোত বের হয়ে আসে। মাবুদ দুষ্টদের থেকে দূরে থাকেন, কিন্তু তিনি আল্লাহ্‌ভক্তদের মুনাজাত শোনেন। আনন্দে ভরা চোখ অন্যকে আনন্দ দেয়, আর ভাল খবর হাড়-মাংসকে পুষ্ট করে। যে লোক জীবনদানকারী সংশোধনের কথায় কান দেয় সে জ্ঞানীদের মধ্যে বাস করবে। যে লোক শাসন অগ্রাহ্য করে সে নিজেকেই তুচ্ছ করে, কিন্তু যে লোক সংশোধনের কথায় কান দেয় সে বুদ্ধি লাভ করে। মাবুদের প্রতি ভয় মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়, আর নম্রতা সম্মান আনে। মানুষ মনে মনে পরিকল্পনা করে, কিন্তু মুখ দিয়ে তা প্রকাশ করবার ক্ষমতা মাবুদের কাছ থেকে আসে। মানুষের সব পথই তার নিজের কাছে নির্দোষ, কিন্তু মাবুদ তার উদ্দেশ্যগুলো ওজন করে দেখেন। তুমি যা-ই কর না কেন তার ভার মাবুদের উপর ফেলে দাও; তাতে তোমার পরিকল্পনা সফল হবে। মাবুদ সব কিছু তৈরী করেছেন তাদের নিজের নিজের উদ্দেশ্য অনুসারে; দুষ্টকেও তিনি দুর্দশা-দিনের জন্যই ঠিক করে রেখেছেন। যাদের অন্তর গর্বিত তাদের সবাইকে মাবুদ ঘৃণার চোখে দেখেন; তোমরা নিশ্চয়ই জেনো তারা শাস্তি পাবেই পাবে। বিশ্বস্ততা ও সততার মধ্য দিয়ে অন্যায় দূর করা যায়; মাবুদের প্রতি ভয়ে মানুষ খারাপী থেকে সরে যায়। মানুষের জীবন দেখে যখন মাবুদ সন্তুষ্ট হন তখন তিনি তার শত্রুদেরও তার সংগে শান্তিতে বাস করান। অন্যায় বিচারের সংগে প্রচুর লাভের চেয়ে ন্যায়বিচারের সংগে অল্পও ভাল। মানুষ মনে মনে তার পথ সম্বন্ধে পরিকল্পনা করে, কিন্তু তার পায়ের ধাপ মাবুদই পরিচালনা করেন। বাদশাহ্‌র মুখে বিচারের ন্যায্য রায় থাকে; তাঁর কথা ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে যায় না। সঠিক দাঁড়িপাল্লা ও নিক্তি মাবুদের; থলির সঠিক বাটখারাগুলো তাঁর চোখে ভাল। বাদশাহ্‌র পক্ষে অন্যায় কাজ করা একটা জঘন্য ব্যাপার, কারণ ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে সিংহাসন স্থির থাকে। সত্যবাদী মুখ বাদশাহ্‌দের আনন্দ দেয়; যে লোক সত্যি কথা বলে বাদশাহ্‌রা তাকে মহব্বত করেন। বাদশাহ্‌র রাগ মৃত্যুর ফেরেশতার মত, কিন্তু জ্ঞানী লোক সেই রাগ শান্ত করে। বাদশাহ্‌ সন্তুষ্ট হলে জীবন বাঁচে; তাঁর দয়া বসন্তকালের বৃষ্টির মেঘের মত। সোনার চেয়ে জ্ঞান লাভ করা কত ভাল! আর রূপার চেয়ে বিচারবুদ্ধি লাভ করা কত পছন্দনীয়! খারাপী থেকে সরে যাওয়াই হল সৎ লোকদের জীবনের পথ; যে লোক তার জীবন পথের দিকে খেয়াল রাখে সে তার প্রাণ রক্ষা করে। অহংকার ধ্বংস আনে আর গর্বে ভরা মন পতন আনে। অহংকারীদের সংগে লুটের জিনিস ভাগ করে নেওয়ার চেয়ে নম্র মনোভাব নিয়ে অত্যাচারিতদের সংগে থাকা অনেক ভাল। যে লোক আল্লাহ্‌র কালামে কান দেয় তার উন্নতি হয়, আর ধন্য সে যে মাবুদের উপর ভরসা করে। যার অন্তরে জ্ঞান আছে তাকে বুদ্ধিমান বলা হয়, আর মিষ্টি কথায় কাউকে শিক্ষা দিলে তার জ্ঞান বাড়ে। যার বুদ্ধি আছে সেই বুদ্ধি তার কাছে জীবনের ঝর্ণার মত; অসাড়-বিবেক লোকদের বোকামিই তাদের শাস্তি। জ্ঞানী লোকের অন্তর তার মুখকে পরিচালনা করে, তাতে তার শিক্ষায় অন্যদের জ্ঞান বাড়ে। মিষ্টি কথা মৌচাকের মত; অন্তরের জন্য তা মধুর আর তা শরীরকে সুস্থ রাখে। একটা পথ আছে যেটা মানুষের চোখে ঠিক মনে হয়, কিন্তু সেই পথের শেষে থাকে মৃত্যু। খিদে মানুষকে পরিশ্রম করায়; তার পেটের খিদে তাকে কাজ করতে বাধ্য করে। নীচমনা লোক খারাপ কাজ করবার জন্য ষড়যন্ত্র করে; তার কথাবার্তা ঝল্‌সে দেওয়া আগুনের মত। যে লোক কুটিল সে ঝগড়া খুঁচিয়ে তোলে, আর যে লোক নিন্দা রটায় সে বন্ধুত্বে ভাংগন ধরায়। জুলুমবাজ লোকের জীবন দেখে অন্যেরা লোভে পড়ে আর কুপথে যায়। যে লোক চোখ টেপে সে কুমতলব করে; যে লোক ঠোঁট বাঁকায় সে খারাপ কাজ করবে বলে ঠিক করেছে। পাকা চুল হল সৌন্দর্যের তাজ; আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়পূর্ণ জীবন কাটিয়ে তা পাওয়া যায়। যে সহজে রাগ করে না সে যোদ্ধার চেয়ে ভাল; যে শহর জয় করে তার চেয়ে যে নিজেকে দমনে রাখে সে ভাল। লোকে গুলিবাঁট করে, কিন্তু তার ফলাফল মাবুদই ঠিক করেন। ঝগড়া-বিবাদে ভরা মেজবানীর ঘরের চেয়ে শান্তির সংগে এক টুকরা শুকনা রুটিও ভাল। পরিবারে অসম্মান আনা ছেলের উপরে বুদ্ধিমান চাকর কর্তা হয়, আর ভাইদের মধ্যে সে-ও সম্পত্তির অধিকার পায়। রূপা যাচাই করবার জন্য আছে গলাবার পাত্র আর সোনার জন্য আছে চুলা, কিন্তু মাবুদই অন্তর যাচাই করেন। দুষ্ট লোক খারাপ কথা শোনে; মিথ্যাবাদী সর্বনাশের কথায় কান দেয়। যে লোক গরীবকে ঠাট্টা করে সে তাদের সৃষ্টিকর্তাকে অপমান করে; যে অন্যদের বিপদে আনন্দ করে সে শাস্তি পাবেই পাবে। নাতি-নাতনী বুড়ো লোকের তাজের মত, আর পিতা তার ছেলেমেয়েদের গর্বের বিষয়। নীচমনা লোকের পক্ষে বড় বড় কথা বলা মানায় না, আবার উঁচু পদের লোকের পক্ষেও মিথ্যা কথা বলা মানায় না। যে লোক ঘুষ দেয় তার কাছে ওটা সৌভাগ্যের পাথরের মত; সে যে দিকে ফেরে সেই দিকেই সফল হয়। যে লোক অন্যায় ঢাকা দেয় সে ভালবাসা বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু যে তা বলে বেড়ায় সে বন্ধুত্বে ভাংগন ধরায়। বিবেচনাহীনের কাছে চাবুকের একশোটা আঘাত যত না লাগে, একবার বকুনি খেলে বুদ্ধিমানের তার চেয়ে বেশী লাগে। বিদ্রোহী কেবলই খারাপীর দিকে ঝোঁকে; তার বিরুদ্ধে একজন নিষ্ঠুর দূতকে পাঠানো হবে। যে বিবেচনাহীন লোক বোকামির মধ্যে পড়ে আছে তার সংগে দেখা হওয়ার চেয়ে বাচ্চা চুরি হওয়া ভল্লুকের সংগে দেখা হওয়া বরং ভাল। যে লোক উপকারের বদলে অপকার করে, অপকার কখনও তার বাড়ী ছাড়বে না। ঝগড়া শুরু করা বাঁধ-ভাংগা পানির মত, তাই তর্কাতর্কির শুরুতেই তা বাদ দিয়ো। যারা দোষীকে নির্দোষ বলে ধরে আর যারা নির্দোষীকে দোষী করে, তাদের উভয়কেই মাবুদ ঘৃণা করেন। জ্ঞান লাভের জন্য বিবেচনাহীন বোকা লোকের হাতে টাকা থাকলে কি লাভ? তার তো বুদ্ধি নেই। বন্ধু সব সময়েই ভালবাসে, আর ভাই থাকে দুর্দশার সময়ে সাহায্য করবার জন্য। যে লোকের বিচারবুদ্ধির অভাব আছে সে হাতে হাত মিলিয়ে চুক্তি করে আর বন্ধুর জামিন হয়। যে লোক বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে থাকতে ভালবাসে সে ঝগড়া করতে ভালবাসে; যে লোক বড়াই করে সে ধ্বংস ডেকে আনে। যে লোকের অন্তর কুটিল তার উন্নতি হয় না; যে লোক ছলনার কথা বলে সে বিপদে পড়ে। বিবেচনাহীন সন্তান মা-বাবার জন্য দুঃখ নিয়ে আসে; ভয়হীন সন্তানের পিতার আনন্দ বলতে কিছু নেই। আনন্দিত অন্তর স্বাস্থ্য ভাল রাখে, কিন্তু ভাংগা মন স্বাস্থ্য নষ্ট করে। বিচারের রায় ঘুরিয়ে দেবার জন্য দুষ্ট লোক লুকিয়ে রাখা ঘুষ নেয়। যার বিচারবুদ্ধি আছে সে জ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেয়, কিন্তু বিবেচনাহীন লোকের মন দুনিয়ার সব দিকেই ঘুরে বেড়ায়। বিবেচনাহীন ছেলে পিতাকে বিরক্ত করে তোলে, আর যে তাকে গর্ভে ধরেছে তার মন সে তেতো করে দেয়। নির্দোষ লোককে জরিমানা করা কিংবা উঁচু পদের লোকের সততার জন্য তাকে মারধর করা ঠিক নয়। বুদ্ধিমান লোক নিজেকে দমনে রেখে কথা বলে; যে লোকের বিচারবুদ্ধি আছে তার মেজাজ ঠাণ্ডা। চুপ করে থাকলে অসাড়-বিবেক লোককেও জ্ঞানী মনে হয়, আর মুখ বন্ধ রাখলে মনে হয় তার বিচারবুদ্ধি আছে। যে লোক নিজেকে সমাজ থেকে আলাদা করে রাখে সে নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে চেষ্টা করে, আর সে সমস্ত বুদ্ধিপূর্ণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বিবেচনাহীন লোক নেকী-বদী বুঝবার ব্যাপারে কোন আনন্দ পায় না, কিন্তু নিজের মতামত প্রকাশেই আনন্দ পায়। দুষ্টতা ডেকে আনে ঘৃণা আর অসম্মান ডেকে আনে নিন্দা। মানুষের মুখের কথা যেন মাটির গভীরে থাকা পানি, কিন্তু জ্ঞানী লোকের মুখের কথা যেন ঝর্ণা থেকে বেরিয়ে আসা স্রোতের পানি। দোষী লোকের পক্ষ নেওয়া ঠিক নয়, তাতে নির্দোষীর প্রতি অবিচার করা হয়। বিবেচনাহীনের কথার দরুন মকদ্দমা হয়, আর তার কথার জন্য তাকে মার খেতে হয়। বিবেচনাহীনের মুখই তার সর্বনাশের কারণ; তার কথার দরুন তার জীবন ফাঁদে পড়ে। নিন্দার কথা স্বাদযুক্ত খাবারের মত, মানুষের অন্তরের গভীরে তা নেমে যায়। যে নিজের কাজে অলসতা করে সে ধ্বংসকারীর ভাই। মাবুদই শক্ত কেল্লার মত; আল্লাহ্‌ভক্ত লোক সেখানে দৌড়ে গিয়ে রক্ষা পায়। ধনীদের ধনই তাদের দেয়াল-ঘেরা শহর; তাদের ধনকেই তারা মনে করে রক্ষাকারী দেয়াল। মানুষের অন্তরের গর্ব ধ্বংস আনে, কিন্তু নম্রতা সম্মান আনে। শুনবার আগেই যে লোক জবাব দেয় তার পক্ষে তা বোকামি ও লজ্জার বিষয়। দুর্বলতার সময় মনের বলই মানুষকে ধরে রাখে, কিন্তু ভাংগা মন কে সহ্য করতে পারে? যার মনে বিচারবুদ্ধি আছে সে জ্ঞান লাভ করে, আর জ্ঞানীদের কান জ্ঞানের তালাশ করে। উপহার মানুষের জন্য পথ করে দেয় আর বড়লোকদের সামনে তাকে উপস্থিত করে। মকদ্দমার সময়ে যে প্রথমে নিজের পক্ষে কথা বলে তার কথা সত্যি মনে হয়, যতক্ষণ না আর একজন এসে তাকে জেরা করে। গুলিবাঁট করে ঝগড়া বন্ধ করা হয় আর দুই বলবান পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করা হয়। ভাইয়ের দ্বারা অপমানিত হওয়া ভাই শক্তিশালী শহরের চেয়েও শক্ত; আর ঝগড়া-বিবাদ রাজবাড়ীর দরজার শক্ত হুড়কার মত। মানুষ তার কথার দ্বারা যে ফল লাভ করে তাতে তার অন্তর ভরে যায়; তার কথার ফলে সে যা পায় তা তাকে তৃপ্ত রাখে। মুখের কথার উপর ভরসা করে জীবন ও মৃত্যু; যারা উপযুক্ত কথা বলতে ভালবাসে তারা তার ফল লাভ করবে। যে লোক স্ত্রী পায় সে দোয়া পায় আর মাবুদের কাছ থেকে রহমত পায়। গরীব লোক দয়া পাবার জন্য কাকুতি-মিনতি করে, কিন্তু ধনী অপমানে ভরা কড়া জবাব দেয়। যার অনেক বন্ধু তার বেশী সর্বনাশ হতে পারে, কিন্তু এমন বন্ধু আছে যে ভাইয়ের চেয়েও বেশী বিশ্বস্ত। যে বিবেচনাহীন লোক বাঁকা কথা বলে তার চেয়ে সেই গরীব লোকটি ভাল যে সততায় চলাফেরা করে। আবার জ্ঞানহীন হওয়াও ভাল নয়; যে লোক তাড়াহুড়া করে সব কাজ করতে যায় সে ভুল করে। মানুষের নিজের বোকামিই তাকে বিপথে নিয়ে যায়, কিন্তু তবুও তার অন্তর মাবুদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। ধন অনেক বন্ধু নিয়ে আসে, কিন্তু তবুও গরীব লোক তার বন্ধু হারায়। মিথ্যা সাক্ষী শাস্তি পাবেই পাবে; যে সাক্ষী মিথ্যা কথা বলে সে রেহাই পাবে না। উঁচু পদের লোকের দয়া পাবার জন্য অনেকেই তার খোশামোদ করে, আর যে দান করে সবাই তার বন্ধু হয়। গরীবকে তার আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই যখন এড়িয়ে চলে তখন এটা নিশ্চিত যে, তার বন্ধু-বান্ধবেরা তার কাছ থেকে দূরে থাকবে; তার কাকুতি-মিনতিতে তারা কান দেবে না। যে নিজেকে ভালবাসে সে বুদ্ধি লাভ করে; যে বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে চলে সে দোয়া পায়। মিথ্যা সাক্ষী শাস্তি পাবেই পাবে; যে সাক্ষী মিথ্যা কথা বলে সে ধ্বংস হবে। বিবেচনাহীনের পক্ষে সুখভোগ করা যখন উপযুক্ত নয়, তখন গোলামের পক্ষে রাজপুরুষদের উপর কর্তা হওয়া আরও অনুপযুক্ত। যে মানুষের বুদ্ধি আছে সেই বুদ্ধি তাকে সহজে রাগ করতে দেয় না; তার বিরুদ্ধে কেউ দোষ করলে তা না ধরা তার পক্ষে গৌরব। বাদশাহ্‌র রাগ সিংহের গর্জনের মত, কিন্তু তার দয়া যেন ঘাসের উপরে পড়া শিশির। বিবেচনাহীন ছেলে তার পিতার সর্বনাশের কারণ হয়, আর ঝগড়াটে স্ত্রী টপ্‌ টপ্‌ করে ফোঁটা পড়বার মত। ঘর-বাড়ী ও ধন পিতার কাছ থেকে পাওয়া যায়, কিন্তু বুদ্ধিমতী স্ত্রী পাওয়া যায় মাবুদের কাছ থেকে। অলসতা গাঢ় ঘুম নিয়ে আসে; অলস লোক ক্ষুধায় কষ্ট পায়। যে লোক আল্লাহ্‌র শরীয়ত পালন করে সে তার জীবন রক্ষা করে; কিন্তু যে তার জীবন পথের দিকে মনোযোগ দেয় না সে মরবে। যে লোক গরীবকে দয়া করে সে মাবুদকে ধার দেয়; মাবুদই তার সেই উপকারের প্রতিদান দেবেন। তোমার ছেলেকে শাসন কর, কারণ তাতে আশা আছে; তার মৃত্যু ঘটাতে চেয়ো না। অতিরিক্ত রাগী লোককে শাস্তি পেতে হবে; তাকে একবার রক্ষা করলে বার বার তা করতে হবে। উপদেশে কান দাও, শাসন মেনে চল; পরে তুমি জ্ঞানী হতে পারবে। মানুষের মনে অনেক পরিকল্পনা থাকে, কিন্তু মাবুদ যা ঠিক করেছেন তা-ই হবে। মানুষ মানুষের কাছ থেকে অটল মহব্বত পেতে চায়; মিথ্যাবাদীর চেয়ে গরীব লোক ভাল। মাবুদের প্রতি ভয় পরিপূর্ণ জীবনের দিকে নিয়ে যায়; যার সেই জীবন আছে সে পরিতৃপ্ত থাকে, কোন বিপদ তার কাছে আসতে পারে না। অলস লোক থালায় হাত ডুবায়; সে হাতটা মুখে তুলতেও চায় না। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীকে মার দিলে বোকা লোক সতর্ক হবে; বুদ্ধিমানকে সংশোধন করলে সে জ্ঞান লাভ করবে। যে ছেলে পিতার উপর জুলুম করে আর মাকে তাড়িয়ে দেয়, সে তাদের উপর লজ্জা ও অপমান ডেকে নিয়ে আসে। ছেলে আমার, যদি তুমি শাসন না মান তবে তুমি জ্ঞানের শিক্ষা থেকে অন্যদিকে সরে যাবে। দুষ্ট সাক্ষী ন্যায়বিচার নিয়ে ঠাট্টা করে; দুষ্টেরা অন্যায়ের মধ্যে ডুবে থাকে। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে শাস্তি, আর বিবেচনাহীনদের পিঠের জন্য রয়েছে চাবুক। যে লোক মদানো আংগুর-রস খেয়ে মাতাল হয় সে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, আর যে মদ খায় সে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ করে; এগুলো খেয়ে যে মাতাল হয় সে জ্ঞানী নয়। বাদশাহ্‌র রাগ সিংহের গর্জনের মত; তাঁকে যে রাগায় সে নিজের প্রাণকে বিপদে ফেলে। ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ সম্মান পায়; যাদের বিবেক অসাড় তারা প্রত্যেকেই ঝগড়া করতে প্রস্তুত থাকে। অলস লোক শীতকালে চাষ করে না, সেইজন্য ফসল কাটবার সময় সে চাইলেও কিছু পাবে না। মানুষের অন্তরের উদ্দেশ্য যেন মাটির নীচে থাকা পানি, কিন্তু বুদ্ধিমান লোক তা তুলে আনে। অনেক লোক নিজেদের বিশ্বস্ত বলে দাবি করে, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য লোক কে খুঁজে পায়? আল্লাহ্‌ভক্ত লোক সততায় চলাফেরা করেন; ধন্য তাঁর বংশধরেরা! বাদশাহ্‌ যখন বিচার করতে সিংহাসনে বসেন তখন চোখের চাহনি দিয়ে তিনি সমস্ত দুষ্টতাকে দূর করে দেন। কে বলতে পারে, “আমার অন্তর আমি খাঁটি করেছি, আমার গুনাহ্‌ থেকে আমি পরিষ্কার হয়েছি”? বেঠিক বাটখারা ও মাপ- এ দু’টাই মাবুদ ঘৃণা করেন। কিশোর-কিশোরীদের কাজকর্ম খাঁটি ও ঠিক হোক বা না হোক, সেই কাজের দ্বারাই তারা নিজেদের পরিচয় দেয়। শুনবার জন্য কান ও দেখবার জন্য চোখ- মাবুদ এ দু’টাই সৃষ্টি করেছেন। ঘুম ভালবেসো না, তাতে তুমি গরীব হবে; জেগে থাক, তাতে তোমার যথেষ্ট খাবার থাকবে। খদ্দের বলে, “ওটা ভাল নয়, ভাল নয়।” তারপর সে কিনে নিয়ে চলে যায় আর তার কেনা জিনিস নিয়ে গর্ব করে। সোনা আছে, প্রবাল পাথরও প্রচুর আছে, কিন্তু যে মুখ জ্ঞানের কথা বলে তার মূল্য অনেক বেশী। যে লোক বিদেশী লোকের জামিন হয় তার পোশাক নিয়ে যাও; যে লোক অন্য কোন দেশের লোকের জামিন হয় তাকেই জামানতের জিনিস হিসাবে রেখো। ঠকিয়ে পাওয়া খাবার মানুষের কাছে মিষ্টি লাগে, কিন্তু শেষে তার মুখ কাঁকরে ভরে যায়। পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পনা কোরো; উপযুক্ত পরামর্শ না নিয়ে তুমি যুদ্ধ ঘোষণা কোরো না। যে নিন্দা করে বেড়ায় সে গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়; কাজেই যে বেশী কথা বলে তার সংগে মেলামেশা কোরো না। যার কথায় পিতা কিংবা মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা থাকে, ভীষণ অন্ধকারে তার জীবন-বাতি নিভে যাবে। পিতার সম্পত্তির অধিকার যদি তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় তবে শেষে তাতে দোয়া পাওয়া যাবে না। তুমি বোলো না, “এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেব।” মাবুদের জন্য অপেক্ষা কর, তিনি সেই বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করবেন। মাবুদ বেঠিক বাটখারা ঘৃণা করেন; ঠকামির দাঁড়িপাল্লা ভাল নয়। বীরপুরুষের চলবার পথ যদি মাবুদই ঠিক করে দেন, তাহলে সাধারণ মানুষ তার নিজের পথ কেমন করে বুঝতে পারবে? ভেবে না দেখে তাড়াতাড়ি করে মাবুদের উদ্দেশে কোন কিছু মানত করা মানুষের জন্য ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। চাপ দিয়ে যেমন শস্য মাড়াই করা হয়, তেমনি জ্ঞানী বাদশাহ্‌ তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে দুষ্টদের দূর করে দেন। মানুষের রূহ্‌ হল মাবুদের বাতি; তা মানুষের অন্তরের গভীর জায়গাগুলো খুঁজে দেখে। বিশ্বস্ততা আর সততা বাদশাহ্‌কে নিরাপদে রাখে; বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে তাঁর সিংহাসন স্থির থাকে। যুবকদের শক্তিই হল তাদের সৌন্দর্য, আর বুড়োদের গৌরব হল পাকা চুল। ভীষণভাবে মার খেলে খারাপী পরিষ্কার হয়ে যায়, আর মনে আঘাত পেলে অন্তরের গভীর জায়গাগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। মাবুদের হাতে বাদশাহ্‌র অন্তর পানির স্রোতের মত; মাবুদ যেখানে চান সেখানে তাকে চালান। মানুষের সব পথই তার নিজের কাছে ঠিক মনে হয়, কিন্তু মাবুদ তার অন্তর ওজন করে দেখেন। মাবুদের কাছে পশু-কোরবানীর চেয়ে ঠিক ও ন্যায় কাজ করা আরও গ্রহণযোগ্য। দুষ্টদের চোখের চাহনি গর্বে ভরা এবং অন্তর অহংকারে পূর্ণ; তাদের জীবন-বাতি গুনাহে ভরা। পরিশ্রমীর পরিকল্পনার ফলে নিশ্চয়ই প্রচুর ধনলাভ হয়, কিন্তু যে লোক পরিকল্পনা না করে তাড়াহুড়া করে কাজ করতে যায় তার নিশ্চয়ই অভাব হয়। মিথ্যাবাদী মুখ দিয়ে যারা ধন লাভ করে তারা মৃত্যুর তালাশ করে; তাদের জন্য সেই ধনলাভ যেন মৃত্যুর আগে একটুখানি সুখের নিঃশ্বাস। দুষ্টদের ভীষণ জুলুম তাদেরই ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়, কারণ তারা ন্যায়ভাবে চলতে অস্বীকার করে। দোষী লোকের জীবন্তপথ আঁকাবাকা, কিন্তু খাঁটি লোক সৎভাবে কাজ করে। ঝগড়াটে স্ত্রীর সংগে বাস করবার চেয়ে বরং ছাদের এক কোণায় একা বাস করা ভাল। দুষ্ট লোক ক্ষতি করতে চায়; তার প্রতিবেশী তার কাছ থেকে কোন দয়া পায় না। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীকে শাস্তি দিলে বোকা লোক জ্ঞান লাভ করে; জ্ঞানীকে উপদেশ দিলে সে বুদ্ধি লাভ করে। ন্যায়বান আল্লাহ্‌ দুষ্টদের পরিবারের লোকদের চোখে চোখে রাখেন আর সেই দুষ্টদের ধ্বংস করেন। যে লোক গরীবদের কান্নায় কান বন্ধ করে রাখে, সে যখন নিজে কাঁদবে তখন কেউ তাতে কান দেবে না। গোপনে দেওয়া দান রাগ শান্ত করে, আর লুকিয়ে রাখা ঘুষ বের করে দিলে ভয়ংকর রাগ শান্ত হয়। ন্যায়বিচার আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের কাছে আনন্দ, কিন্তু অন্যায়কারীদের কাছে তা সর্বনাশ। যে লোক বুদ্ধির পথ ছেড়ে অন্য দিকে যায় সে মৃতদের সংগে থাকবে। যে লোক আমোদ-প্রমোদ ভালবাসে সে গরীব হবে; যে লোক আংগুর-রস ও খোশবু তেল ভালবাসে সে কখনও ধনী হতে পারবে না। শেষে নির্দোষ লোকদের বদলে দুষ্টেরা আর সৎ লোকদের বদলে বেঈমানেরা কষ্ট পাবে। ঝগড়াটে আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের স্ত্রীর সংগে বাস করবার চেয়ে মরুভূমিতে গিয়ে বাস করা ভাল। বুদ্ধিমানের ঘরে মূল্যবান ধন ও খোশবু তেল জমা থাকে, কিন্তু তা যদি বিবেচনাহীন লোকের ঘরে থাকে তবে সে সবই শেষ করে ফেলে। যে লোক আগ্রহের সংগে সততা ও বিশ্বস্ততার পথে চলে সে জীবন, দোয়া ও সম্মান লাভ করে। জ্ঞানী লোক শক্তিশালীদের শহর হামলা করে আর যে কেল্লার উপর তারা ভরসা করত তা ধ্বংস করে ফেলে। যে তার মুখ ও জিভ্‌ সাবধানে রাখে সে বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করে। গর্বিত ও অহংকারী লোকের নাম হল “ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী”; সে অতিরিক্ত গর্বের সংগে কাজ করে। অলসের কামনা তার মৃত্যু ঘটায়, কারণ তার হাত কাজ করতে অস্বীকার করে। এমন লোক আছে যে সব সময় লোভ করে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক খোলা হাতে দান করে। দুষ্টদের কোরবানী মাবুদ ঘৃণা করেন, আর তা যদি খারাপ উদ্দেশ্যে আনা হয় তবে তা আরও ঘৃণার যোগ্য হয়। মিথ্যা সাক্ষী ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু যে লোক মনোযোগ দিয়ে শোনে তার কথা চিরকাল স্থায়ী। দুষ্ট লোকের মুখে কোন লজ্জার ভাব দেখা যায় না, কিন্তু সৎ লোক তার জীবন্তপথে চলা সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকে। কোন জ্ঞান, কোন বুদ্ধি বা কোন পরিকল্পনাই মাবুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। যুদ্ধের দিনের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখা হয়, কিন্তু জয় মাবুদের উপর ভরসা করে। প্রচুর ধনের চেয়ে সুনাম বেছে নেওয়া ভাল; রূপা ও সোনার চেয়ে অন্যের ভালবাসা পাওয়া ভাল। ধনী-গরীব একটা ব্যাপারে সমান্ত মাবুদ তাদের সকলকেই তৈরী করেছেন। সতর্ক লোক বিপদ দেখে আশ্রয় নেয়, কিন্তু বোকা লোকেরা বিপদ দেখেও চলতে থাকে আর তার দরুন শাস্তি পায়। নম্রতা ও মাবুদের প্রতি ভয় ধন, সম্মান ও জীবন আনে। কুটিল লোকের পথে থাকে কাঁটা ও ফাঁদ, কিন্তু যে নিজেকে সাবধানে রাখে সে সেগুলো থেকে দূরে থাকে। ছেলে বা মেয়ের প্রয়োজন অনুসারে তাকে শিক্ষা দাও, সে বুড়ো হয়ে গেলেও তা থেকে সরে যাবে না। গরীবের উপর ধনী কর্তা হয়, আর ঋণী ঋণদাতার চাকর হয়। যে লোক দুষ্টতার বীজ বোনে সে বিপদের ফসল কাটবে; সে রাগের বশে যে জুলুম করে তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে দানশীল লোক তার খাবারের ভাগ থেকে গরীবদের দেয় সে দোয়া পাবে। বিদ্রূপকারীকে তাড়িয়ে দাও, গোলমালও দূর হবে; ঝগড়া-বিবাদ ও অপমান শেষ হয়ে যাবে। যে লোক খাঁটি অন্তর ভালবাসে আর দয়াপূর্ণ কথাবার্তা বলে সে বাদশাহ্‌র বন্ধুত্ব লাভ করে। মাবুদ জ্ঞান রক্ষা করেন, কিন্তু তিনি বেঈমানদের কথাবার্তা বিফল করে দেন। অলস বলে, “বাইরে সিংহ আছে, রাস্তায় গেলে আমি মারা পড়ব।” জেনাকারিণীর কথাবার্তা যেন গভীর গর্ত; যে লোক মাবুদের রাগের পাত্র সে তার মধ্যে পড়বে। ছেলে বা মেয়ের অন্তরে বোকামি যেন বাঁধা থাকে, কিন্তু শাসনের লাঠি তা তার কাছে থেকে দূর করে দেয়। ধন লাভের জন্য যে লোক গরীবের উপর জুলুম করে কিংবা যে লোক ধনীদের দান করে তাদের দু’জনেরই অভাব হয়। জ্ঞানীদের কথায় কান দাও, তাঁরা যা বলেছেন তা শোন; আমি তোমাকে যে শিক্ষা দিই তাতে তুমি মনোযোগ দাও। সেই শিক্ষা তোমার অন্তরে রাখলে তুমি সুখী হবে; তা সব সময় তোমার ঠোঁটের আগায় থাকুক। তুমি যাতে মাবুদের উপর ভরসা করতে পার সেইজন্য আমি আজ তোমাকে, তোমাকেই এই সব জানালাম। পরামর্শ ও জ্ঞান সম্বন্ধে আমি কি তোমার জন্য ত্রিশটা উপদেশের কথা লিখি নি? আমি কি তোমাকে সত্য ও নির্ভরযোগ্য কালাম শিক্ষা দিই নি, যাতে তুমি তা দিতে পার তাদের কাছে যারা তোমাকে পাঠিয়েছে? একজন লোক অসহায় বলে জোর করে তার জিনিস নিয়ো না, আর বিচার-স্থানে অভাবীর সর্বনাশ কোরো না; কারণ মাবুদ মামলায় তাদের পক্ষ নেবেন, আর যারা তাদের জিনিস কেড়ে নেয় তিনি তাদের প্রাণ কেড়ে নেবেন। বদমেজাজী লোকের সংগে বন্ধুত্ব কোরো না; যে সহজে রেগে যায় তার সংগে মেলামেশা কোরো না। তা করলে তুমি তার মত চলাফেরা করতে শিখবে আর নিজেকে ফাঁদে ফেলবে। হাতে হাত রেখে কারও ঋণের জামিন হোয়ো না; তুমি যদি তা শোধ দিতে না পার তবে তোমার গায়ের নীচ থেকে তোমার বিছানাটা পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হবে। তোমার পূর্বপুরুষেরা সীমানার যে চিহ্ন্তপাথর স্থাপন করে গেছেন, সেই চিহ্ন তুমি সরিয়ে দিয়ো না। তুমি কি এমন কোন লোককে দেখেছ যে পাকা হাতে কাজ করে? সে বাদশাহ্‌দের জন্য কাজ করবে, সাধারণ লোকদের অধীনে কাজ করবে না। তুমি যখন শাসনকর্তার সংগে খেতে বসবে, তখন তোমার সামনে কি আছে তা ভাল করে খেয়াল করবে। যদি তুমি পেটুক হও তবে সাবধান! তুমি নিজেকে দমনে রেখে খেয়ো। তাঁর দামী দামী খাবারে লোভ কোরো না, কারণ সেই খাবার দেবার পিছনে থাকে শাসনকর্তার কোন উদ্দেশ্য। ধন লাভের জন্য ব্যস্ত হোয়ো না; এই ব্যাপারে তোমার বুদ্ধির উপর ভরসা কোরো না। ধনের দিকে একটি বার তাকালে দেখবে সেগুলো আর নেই, কারণ সেগুলোতে পাখা গজাবেই আর ঈগলের মত আকাশে উড়ে যাবে। লোভী লোকের খাবার খেয়ো না; তার দামী দামী খাবার খেতে চেয়ো না; কারণ সে এমন লোক যে সব সময় তার খাবারের দামের কথা ভাবে। সে তোমাকে বলে, “খাওয়া-দাওয়া কর,” কিন্তু সে মন্তেমুখে এক নয়। যেটুকু তুমি খেয়েছ তা তুমি বমি করে ফেলবে, আর তোমার করা প্রশংসা মিথ্যা হয়ে যাবে। বিবেচনাহীন লোকের কাছে কথা বোলো না; তোমার কথার মধ্যে যে জ্ঞান রয়েছে তা সে তুচ্ছ করবে। সীমানার পুরানো চিহ্ন্তপাথর তুমি সরিয়ে দিয়ো না কিংবা এতিমদের জমি দখল কোরো না, কারণ তাদের মুক্তিদাতা শক্তিশালী; তিনি তোমার বিরুদ্ধে মামলায় আত্মীয় হিসাবে তাদের পক্ষ নেবেন। তুমি শিক্ষার দিকে মন দাও, আর জ্ঞানের কথায় কান দাও। ছেলে বা মেয়েকে শাসন করতে অবহেলা কোরো না; তাকে লাঠি দিয়ে মারলে সে মরবে না। তাকে অবশ্যই তুমি লাঠি দিয়ে মেরে শাস্তি দেবে, তাতে কবর থেকে তাকে রক্ষা করবে। ছেলে আমার, তোমার অন্তর যদি জ্ঞানপূর্ণ হয় তবে আমার অন্তর সুখী হবে, হ্যাঁ, আমি সুখী হব। যখন তোমার মুখ ঠিক কথা বলবে তখন আমার অন্তর আনন্দিত হবে। তোমার অন্তর গুনাহ্‌গারদের হিংসা না করুক, বরং সব সময় মাবুদের প্রতি ভয়ে তুমি চলাফেরা কর। তাহলে তোমার ভবিষ্যতের আশা আছে, আর তোমার আশা ছেঁটে ফেলা হবে না। ছেলে আমার, কথা শোন, জ্ঞানী হও, তোমার অন্তর ঠিক পথে চালাও। যারা বেশী পরিমাণে আংগুর-রস খায় কিংবা যারা পেটুক ও বেশী গোশ্‌ত খায়, তুমি তাদের সংগে যোগ দিয়ো না; কারণ মাতাল ও পেটুকেরা গরীব হয়ে যায়, আর ঘুম ঘুম ভাব মানুষকে ছেঁড়া কাপড় পরায়। তোমার বাবার কথা শোন যিনি তোমাকে জন্ম দিয়েছেন; তোমার মা বুড়ী হয়ে গেলে তাকে তুচ্ছ কোরো না। যে কোন মূল্যেই হোক না কেন সত্য, জ্ঞান, শিক্ষা এবং বিচারবুদ্ধি লাভ কর; কোন কিছুর বদলে তা অন্যকে দিয়ো না। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকের পিতা মহা আনন্দ লাভ করেন; জ্ঞানী ছেলের বাবা তাঁর ছেলের দ্বারা সুখী হন। তোমার মা-বাবা যেন সুখী হন; যিনি তোমাকে প্রসব করেছেন তিনি যেন আনন্দিতা হন। ছেলে আমার, আমার শিক্ষায় মনোযোগ দাও; আমার জীবন দেখে যেন তুমি খুশী হও। দেখ, বেশ্যা গভীর গর্তের মত, আর বিপথে যাওয়া স্ত্রীলোক যেন সরু গর্ত। ঐ রকম স্ত্রীলোক ডাকাতের মত ওৎ পেতে থাকে, আর মানুষের মধ্যে বেঈমান লোকদের সংখ্যা বাড়ায়। কে হায় হায় করে? কে বিলাপ করে? কে ঝগড়া করে? কে বকবক করে? কে অকারণে আঘাত পায়? কার চোখ লাল হয়? যারা অনেকক্ষণ ধরে মদ খায় তাদেরই এই রকম হয়; তারা মিশানো মদ খেয়ে দেখবার জন্য তার খোঁজে যায়। মদের দিকে তাকায়ো না যদিও তা লাল রংয়ের, যদিও তা পেয়ালায় চক্‌মক্‌ করে, যদিও তা সহজে গলায় নেমে যায়; শেষে তা সাপের মত কামড়ায়, আর বিষাক্ত সাপের মত কামড় দেয়। তোমার চোখ তখন অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য দেখবে আর মন এলোমেলো কথা চিন্তা করবে। তুমি হবে মহাসমুদ্রে ঘুমিয়ে থাকা লোকের মত, কিংবা মাস-ুলের উপরে শুয়ে থাকা লোকের মত। তুমি বলবে, “ওরা আমাকে আঘাত করেছে কিন্তু আমি ব্যথা পাই নি, আমাকে ওরা মেরেছে কিন্তু আমি টের পাই নি। কখন আমি জেগে উঠে আবার মদের খোঁজে যাব?” তুমি দুষ্ট লোকদের উপর হিংসা কোরো না, তাদের সংগে থাকতে ইচ্ছাও কোরো না; কারণ তাদের অন্তর জুলুম করবার ষড়যন্ত্র করে, আর তাদের মুখ অন্যায় করবার কথা বলে। জ্ঞানের সাহায্যে ঘর তৈরী করা হয়, আর বুদ্ধি দ্বারা তা স্থির রাখা হয়; জ্ঞানের সাহায্যে কামরাগুলো পূর্ণ করা হয় মূল্যবান এবং সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়ে। জ্ঞানী লোকের মহা ক্ষমতা আছে, আর বুদ্ধিমান লোক নিজের শক্তি বাড়ায়। যুদ্ধ করতে গেলে তুমি উপযুক্ত পরামর্শ নেবেই, আর অনেক পরামর্শদাতা থাকলে জয়লাভ করা যায়। জ্ঞান অসাড়-বিবেক লোকের নাগালের বাইরে; শহরের সদর দরজার সভাতে তার কিছু বলবার যোগ্যতা থাকে না। যে কেউ খারাপীর পরিকল্পনা করে লোকে তাকে ষড়যন্ত্রকারী বলে জানে। অসাড়-বিবেক লোকের ষড়যন্ত্র হল গুনাহ্‌; লোকে ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীকে ঘৃণা করে। বিপদের দিনে যদি তুমি হতাশ হয়ে পড়, তবে তো তোমার শক্তি বেশী নয়। যাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের উদ্ধার কর; যারা টল্‌তে টল্‌তে জবাই হতে যাচ্ছে তাদের রক্ষা করতে অস্বীকার কোরো না। তুমি যদি বল, “কিন্তু আমরা কিছুই জানতাম না,” তবে যিনি অন্তরের উদ্দেশ্য ওজন করেন তিনি কি তোমার কথা বিচার করে দেখবেন না? যিনি তোমার জীবন রক্ষা করেন তিনি কি তা জানবেন না? তিনি কি প্রত্যেক মানুষকে তার কাজ অনুসারে ফল দেবেন না? ছেলে আমার, মধু খাও, কারণ তা ভাল; মৌচাক থেকে মধু খাও, তা তোমার মুখে মিষ্টি লাগবে। এটাও জেনো যে, জ্ঞান তোমার অন্তরের জন্য মধুর মত মিষ্টি; যদি তুমি জ্ঞান পাও তবে তোমার ভবিষ্যতের আশা আছে, আর তোমার আশা ছেঁটে ফেলা হবে না। ওহে দুষ্ট লোক, আল্লাহ্‌ভক্ত লোকের বাড়ীর বিরুদ্ধে তুমি ওৎ পেতে থেকো না, তার বাসস্থানে হানা দিয়ো না; কারণ আল্লাহ্‌ভক্ত লোক সাত বার পড়ে গেলেও আবার ওঠে, কিন্তু দুষ্টদের দুর্দশা আসলে তারা একেবারে ভেংগে পড়ে। তোমার শত্রু পড়ে গেলে আনন্দ বোধ কোরো না; সে উচোট খেলে তোমার অন্তরকে আনন্দিত হতে দিয়ো না। যদি তা কর তাহলে মাবুদ তা দেখে রাগ করবেন, আর শত্রুর উপর থেকে তাঁর রাগ সরিয়ে নেবেন। তুমি দুষ্ট লোকদের বিষয় নিয়ে উতলা হোয়ো না, কিংবা খারাপ লোকদের দেখে হিংসা কোরো না; কারণ দুষ্ট লোকের ভবিষ্যতের কোন আশা নেই, আর খারাপ লোকদের জীবন-বাতি নিভে যাবে। ছেলে আমার, মাবুদ ও বাদশাহ্‌কে ভয় কর, আর বিদ্রোহীদের সংগে যোগ দিয়ো না; কারণ তাদের উপর হঠাৎ ধ্বংস আসবে, আর মাবুদ ও বাদশাহ্‌র কাছ থেকে কেমন বিপদ আসবে তা কে জানে? এগুলোও জ্ঞানীদের বলা কথা। বিচারে কারও পক্ষ নেওয়া ভাল নয়। যে লোক দোষীকে বলে, “তুমি নির্দোষ,” বিভিন্ন দেশের লোকেরা তার নিন্দা করে, আর বিভিন্ন জাতি তাকে বদদোয়া দেয়। কিন্তু দোষীকে যারা দোষী বলে রায় দেয় তাদের উপর প্রচুর দোয়া পড়ে, আর তারা সুখী হয়। ভণ্ডামিশূন্য জবাব পাওয়া চুম্বন পাওয়ার মত। তোমার ক্ষেত-খামার প্রস্তুত করে তুমি বাইরের কাজ শেষ কর, তার পরে তোমার ঘর বাঁধ। কিছু না জেনে তোমার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ো না, কিংবা মুখ দিয়ে ছলনা কোরো না। এই কথা বোলো না, “সে আমার প্রতি যেমন করেছে আমিও তার প্রতি তেমন করব; সে যা করেছে তার ফল তাকে দেব।” আমি অলসের ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলাম, বুদ্ধিহীন লোকের আংগুর ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলাম; দেখলাম সব জায়গায় কাঁটা গাছ জন্মেছে, আগাছায় মাটি ঢেকে গেছে, আর পাথরের দেয়ালও ভেংগে পড়েছে। আমি যা দেখলাম তাতে মন দিলাম, তা দেখে আমি এই শিক্ষা পেলাম, “‘আর একটু ঘুম, আর একটু ঘুমের ভাব, বিশ্রামের জন্য আর একটুক্ষণ হাত গুটিয়ে রাখি।’ কিন্তু বারে বারে মেহমান আসলে কিংবা অস্ত্রশস্ত্রে সাজা দস্যুর হাতে পড়লে যেমন অভাব আসে, ঠিক তেমনি করে তোমারও অভাব আসবে।” এগুলো সোলায়মানের বলা আরও সৎ উপদেশ। এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের লোকেরা এগুলো সংগ্রহ করে আবার লিখে নিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌ কোন বিষয় গোপন রাখলে তাতে তাঁর গৌরব হয়; বাদশাহ্‌রা কোন বিষয় তদন্ত করে প্রকাশ করলে তাতে তাঁদের গৌরব হয়। আসমান যেমন উঁচু আর দুনিয়া গভীর, তেমনি বাদশাহ্‌দের অন্তরের তালাশ করা যায় না। রূপা থেকে খাদ বের করে ফেল, তাহলে স্বর্ণকার তা দিয়ে সুন্দর জিনিস তৈরী করতে পারবে। দুষ্ট কর্মচারীকে বাদশাহ্‌র সামনে থেকে সরিয়ে দাও, তাহলে ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর সিংহাসন স্থির থাকবে। বাদশাহ্‌র সামনে নিজেকে জাহির কোরো না; মহৎ লোকদের মধ্যে নিজের জন্য স্থান দাবি কোরো না; কারণ তুমি যেমন আগে হতে দেখেছ সেইভাবে উঁচু পদের লোকের সামনে নীচু হওয়ার চেয়ে বরং তোমাকে বলা ভাল, “এখানে উঠে আসুন।” তাড়াতাড়ি আদালতে যেয়ো না, কারণ শেষে তোমার প্রতিবেশী যদি তোমাকে লজ্জায় ফেলে তখন তুমি কি করবে? প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যদি মামলা কর তবে অন্যের গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়ো না; যদি তা কর তাহলে যে শুনবে সে তোমার নিন্দা করবে, আর তোমার বদনাম কখনও ঘুচবে না। সময়মত বলা কথা যেন কারুকাজ করা রূপার উপরে বসানো সোনার ফল। সোনার দুল কিংবা ভাল সোনার গহনা যেমন, তেমনি বাধ্য লোকের কানে জ্ঞানী লোকের সংশোধনের কথা। বিশ্বস্ত সংবাদদাতা তার মালিকদের কাছে যেন ফসল কাটবার সময়ে ঠাণ্ডা তুষার; কারণ যারা তাকে পাঠিয়েছিল সে সেই মালিকদের প্রাণ জুড়ায়। যে লোক দান করবার বিষয়ে বড় বড় কথা বলে অথচ তা করে না, সে এমন কুয়াশা ও বাতাসের মত যার সাথে কোন বৃষ্টি আসে না। রাগ দমনে রাখলে নেতাকে নিজের পক্ষে আনা যায়; নম্র কথাবার্তা হাড় ভেংগে ফেলতে পারে। তুমি মধু পেলে পরিমাণ মত খেয়ো, বেশী খেলে বমি করবে। প্রতিবেশীর ঘরে কম যেয়ো, বেশী গেলে সে তোমাকে অপছন্দ করবে। যে লোক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় সে গদা, তলোয়ার ও ধারালো তীরের মত। বিপদের সময় অবিশ্বস্ত লোকের উপর ভরসা করা খারাপ দাঁত ও খোঁড়া পায়ের মত। যার মন খারাপ তার কাছে যে গজল করে সে এমন লোকের মত যে শীতের দিনে কাপড় খুলে ফেলে কিংবা সোডার উপরে সিরকা দেয়। তোমার শত্রুর যদি খিদে পায় তাকে খেতে দাও, যদি তার পিপাসা পায় তাকে পানি দাও; তা করলে তুমি তার মাথায় জ্বলন্ত কয়লা গাদা করে রাখবে, আর মাবুদ তোমাকে পুরস্কার দেবেন। উত্তর দিকের বাতাস যেমন বৃষ্টি আনে, তেমনি নিন্দাকারীর কথায় অন্যের মুখে রাগের ভাব দেখা যায়। ঝগড়াটে স্ত্রীর সংগে ঘরের মধ্যে বাস করবার চেয়ে বরং ছাদের এক কোণায় একা বাস করা ভাল। পিপাসিত লোকের জন্য যেমন ঠাণ্ডা পানি, তেমনি দূর দেশ থেকে আসা ভাল সংবাদ। ঘোলা করে ফেলা আর দূষিত করা ঝর্ণার পানি যেমন, দুষ্ট লোকের দরুন গুনাহে পড়া আল্লাহ্‌ভক্ত লোক তেমনি। বেশী মধু খাওয়া ভাল নয়; প্রশংসা পাবার জন্য চেষ্টা করাও ভাল নয়। যে লোক নিজেকে দমন করতে পারে না সে এমন শহরের মত যার দেয়াল ভেংগে ফেলা হয়েছে। গ্রীসমকালে তুষার কিংবা ফসল কাটবার সময় বৃষ্টি যেমন উপযুক্ত নয়, তেমনি বিবেচনাহীন লোকের পক্ষে সম্মানও উপযুক্ত নয়। চড়াই কিংবা খঞ্জন পাখী যেমন এদিক ওদিক উড়ে বেড়ায়, তেমনি অকারণে দেওয়া বদদোয়াও নেমে আসে না। ঘোড়ার জন্য চাবুক, গাধার গলার জন্য লাগাম, আর বিবেচনাহীনদের পিঠের জন্য লাঠি। প্রয়োজন বোধে বিবেচনাহীনকে তার বোকামি অনুসারে জবাব দিয়ো না, জবাব দিলে তুমিও তার মত হয়ে যাবে। প্রয়োজন বোধে বিবেচনাহীনের বোকামি অনুসারে জবাব দিয়ো, তা না হলে সে তার নিজের চোখে নিজেকে জ্ঞানী মনে করবে। যে লোক বিবেচনাহীনের হাতে খবর পাঠায় সে যেন নিজের পা কেটে ফেলে এবং বিপদ ডেকে আনে। খোঁড়া লোকের ঝুলতে থাকা পা যেমন অকেজো, বিবেচনাহীনের মুখে সৎ উপদেশও তেমনি। যে লোক গুল্‌তিতে পাথর বেঁধে রাখে সে এমন লোকের মত যে বিবেচনাহীনকে সম্মান করে। মাতালের হাতে ফুটে যাওয়া কাঁটা যেমন, তেমনি বিবেচনাহীনের মুখে সৎ উপদেশ। একজন ধনুকধারী যেমন এলোপাতাড়ি তীর ছুঁড়ে সকলকে ক্ষতবিক্ষত করে, তেমনি সেই লোক, যে বিবেচনাহীনকে কিংবা পথের লোককে কাজে লাগায়। কুকুর যেমন নিজের বমির দিকে ফেরে, তেমনি বিবেচনাহীন লোকও আবার বোকামি করে। তুমি কি এমন লোককে দেখেছ যে তার নিজের চোখে জ্ঞানী? তার চেয়ে বরং বিবেচনাহীনের বিষয়ে আশা আছে। অলস বলে, “পথে সিংহ আছে; ভয়ংকর একটা সিংহ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।” কব্‌জায় যেমন দরজা ঘোরে তেমনি অলস তার বিছানাতে ঘোরে। অলস থালায় হাত ডুবায়, হাতটা মুখে তুলতেও তার আলসেমি লাগে। যারা চিন্তা-ভাবনা করে জবাব দেয় তেমন সাতজন লোকের চেয়ে অলস নিজেকে জ্ঞানী বলে মনে করে। পথে যেতে যেতে যে লোক অন্যের ঝগড়ার মধ্যে নিজের নাক গলায়, সে এমন লোকের মত যে কুকুরের কান ধরে। যে পাগল জ্বলন্ত কাঠ বা তীর ছোঁড়ে যার ফলে মৃত্যু হতে পারে সেই পাগল যেমন, তেমনি সেই লোক যে প্রতিবেশীর সংগে ছলনা করে আর বলে, “আমি কেবল তামাশা করছিলাম।” আগুনে কাঠ না দিলে আগুন নিভে যায়; নিন্দাকারী না থাকলে ঝগড়াও মিটে যায়। জ্বলন্ত কয়লার মধ্যে আরও কয়লা দিলে আর আগুনের মধ্যে আরও কাঠ দিলে যেমন হয়, তেমনি হয় ঝগড়ার আগুন জ্বালিয়ে তুলবার জন্য ঝগড়াটে লোক। নিন্দার কথা স্বাদযুক্ত খাবারের মত; মানুষের অন্তরের গভীরে তা নেমে যায়। মাটির পাত্রের উপরে যেমন খাদ মিশানো রূপার প্রলেপ, যার অন্তর খারাপ তার ভালবাসার কথাও তেমনি। ঘৃণাকারী মুখ দিয়ে ভান করে, কিন্তু অন্তরে পোষে ছলনা। তার কথা মিষ্টি হলেও বিশ্বাস কোরো না, কারণ তার অন্তরের মধ্যে আছে সাতটা ঘৃণার জিনিস। তার ঘৃণা যদিও ছলনা দিয়ে লুকানো থাকে তবুও তার দুষ্টতা সমাজের মধ্যে প্রকাশ পাবে। যে লোক গর্ত খোঁড়ে সে তার মধ্যে পড়ে; যে লোক পাথর গড়িয়ে দেয় তার উপরেই সেটা ফিরে আসে। মিথ্যাবাদী তার জিভ্‌ দিয়ে যাদের আঘাত করেছে তাদের সে ঘৃণা করে, আর খোশামুদে মুখ অন্যের সর্বনাশ ডেকে আনে। আগামী কালের বিষয় নিয়ে বড়াই কোরো না, কারণ কোন্‌ দিন কি হবে তা তুমি জান না। অন্য লোকে তোমার প্রশংসা করুক, তোমার নিজের মুখ না করুক; জ্বী, অন্য লোকে তা করুক। পাথর ভারী আর বালিও ভারী, কিন্তু অসাড়-বিবেক লোককে রাগিয়ে তুললে সে ঐ দু’টার চেয়েও ভারী হয়। রাগ নিষ্ঠুর আর ক্রোধ বন্যার মত, কিন্তু হিংসার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কেউ যদি তোমাকে ভালবাসে অথচ তা প্রকাশ না করে, তার চেয়ে বরং কেউ যদি তোমাকে খোলাখুলিভাবে দোষ দেখিয়ে দেয় সে ভাল। শত্রু অনেক চুম্বন করতে পারে, কিন্তু বন্ধুর দেওয়া আঘাতে বিশ্বস্ততা আছে। যার পেট ভরা সে মধুও অগ্রাহ্য করে, কিন্তু যার খিদে আছে তার কাছে তেতোও মিষ্টি লাগে। বাসা ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো পাখী যেমন, ঘর ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষও তেমন। খোশবু তেল আর ধূপ মনকে আনন্দ দেয়; ঠিক সেইভাবে বন্ধুর দেওয়া উপদেশ বন্ধুর কাছে মিষ্টি লাগে। নিজের কিংবা পিতার বন্ধুকে ত্যাগ কোরো না; বিপদের সময়ে ভাইয়ের ঘরে যেয়ো না; দূরে থাকা ভাইয়ের চেয়ে কাছে থাকা প্রতিবেশী ভাল। ছেলে আমার, তুমি জ্ঞানবান হও আর আমার মনকে আনন্দিত কর; তাতে যারা আমাকে টিট্‌কারি দেয় তাদের আমি জবাব দিতে পারব। সতর্ক লোক বিপদ দেখে আশ্রয় নেয়, কিন্তু বোকা লোকেরা বিপদ দেখেও চলতে থাকে আর তার দরুন শাস্তি পায়। যে লোক বিদেশী লোকের জামিন হয় তার পোশাক নিয়ে নাও; যে লোক অন্য কোন দেশের লোকের জামিন হয় তাকেই জামানতের জিনিস হিসাবে রেখো। যে লোক খুব ভোরে উঠে চেঁচিয়ে তার প্রতিবেশীকে দোয়া করে তা বদদোয়া বলেই ধরে নিতে হবে। ঝগড়াটে স্ত্রী আর বৃষ্টির দিনে অনবরত টপ্‌ টপ্‌ করে বৃষ্টি পড়া- দু’টাই সমান। বাতাস যেমন লুকানো যায় না, আর ডান হাত দিয়ে লাগানো খোশবু তেলের গন্ধ যেমন লুকানো যায় না, তেমনি ঝগড়াটে স্ত্রীকেও লুকানো যায় না। লোহা যেমন লোহাকে ধারালো করে, তেমনি একজন আর একজনের জীবনকে কাজের উপযুক্ত করে তোলে। যে লোক ডুমুর গাছের যত্ন নেয় সে তার ফল খাবে; যে তার মালিকের সেবা করে সে সম্মানিত হবে। পানির মধ্যে যেমন মুখের চেহারা দেখা যায়, তেমনি অন্য একজনের স্বভাব দেখে নিজের স্বভাব বুঝা যায়। কবর ও দোজখের যেমন কখনও তৃপ্তি হয় না, তেমনি মানুষের চোখেরও তৃপ্তি হয় না। রূপা যাচাই করবার জন্য আছে গলাবার পাত্র, আর সোনার জন্য আছে চুলা, কিন্তু মানুষ যে প্রশংসা পায় তা দিয়েই তাকে যাচাই করা হয়। অসাড়-বিবেক লোককে যদিও শস্যের সংগে হামানদিস্তা দিয়ে গুঁড়া করা হয়, তবুও তার বোকামি তাকে ছেড়ে যাবে না। তোমার ছাগল-ভেড়ার পালের অবস্থা তুমি ভাল করে জেনে রেখো, আর তোমার পশুপালের দিকে মনোযোগ দিয়ো; কারণ ধন চিরস্থায়ী নয়, আর তাজও বংশের পর বংশের জন্য টিকে থাকে না। ক্ষেত থেকে যখন খড় কেটে ফেলা হবে এবং নতুন ঘাস গজাবে আর পাহাড় থেকে ঘাস কেটে আনা হবে, তখন ভেড়ার বাচ্চারা তোমার কাপড় যোগাবে, আর ছাগল দেবে নতুন জমির দাম; এছাড়া তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য তুমি যথেষ্ট দুধ পাবে; তোমার যুবতী চাকরাণীরাও তা খেয়ে পুষ্ট হবে। কেউ তাড়া না করলেও দুষ্ট লোক পালায়, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক সিংহের মত নির্ভয়ে বাস করে। দেশের লোকদের অন্যায়ের ফলে অনেক শাসনকর্তা হয়, কিন্তু জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান শাসনকর্তা শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। যে গরীব নেতা অসহায়দের উপর জুলুম করে সে এমন বৃষ্টির ঢলের মত যার পরে আর কোন ফসল থাকে না। যারা মাবুদের শরীয়ত ত্যাগ করে তারা দুষ্টদের প্রশংসা করে, কিন্তু যারা তা মানে তারা দুষ্টদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। খারাপ লোকেরা ন্যায়বিচার সম্বন্ধে বোঝে না, কিন্তু যারা মাবুদের ইচ্ছামত চলে তাদের নেকী-বদী বুঝবার শক্তি আছে। যে ধনী লোক বাঁকা পথে চলে তার চেয়ে বরং সেই গরীব লোকটি ভাল যে সততায় চলাফেরা করে। যে ছেলে শরীয়ত মানে সে বুদ্ধিমান, কিন্তু যে ছেলে পেটুকদের সংগী সে তার পিতার জন্য অসম্মান নিয়ে আসে। যে কোন রকম সুদ নিয়ে যে লোক তার ধন বাড়ায়, সে তা এমন একজনের জন্য জমায় যে গরীবদের প্রতি দয়ালু। মাবুদের শরীয়তের কথা যদি কেউ শুনেও না শোনে, তবে তার মুনাজাত পর্যন্ত ঘৃণার যোগ্য হয়। সৎ লোককে যে কুপথে নিয়ে যায় সে তার নিজের গর্তেই পড়বে, কিন্তু যারা নির্দোষ তাদের উন্নতি হবে। ধনী লোক তার নিজের চোখে জ্ঞানী, কিন্তু যে গরীব লোকের বিচারবুদ্ধি আছে সে সেই ধনী লোকের আসল অবস্থা বুঝতে পারে। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের হাতে ক্ষমতা গেলে সকলের উপকার হয়, কিন্তু দুষ্টদের হাতে ক্ষমতা গেলে লোকদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যে লোক নিজের গুনাহ্‌ গোপন করে তার উন্নতি হয় না, কিন্তু যে তা স্বীকার করে ত্যাগ করে সে মমতা পায়। ধন্য সে লোক যে অন্যায় করতে সব সময় ভয় করে, কিন্তু যে তার অন্তরকে কঠিন করে এবং অন্যায় করতে ভয় করে না সে বিপদে পড়ে। গর্জনকারী সিংহ আর আক্রমণকারী ভল্লুক যেমন, তেমনি সেই দুষ্ট লোক যে অসহায় লোকদের শাসনকর্তা হয়। যে শাসনকর্তার বিচারবুদ্ধি নেই সে ভীষণ জুলুম করে; যে শাসনকর্তা লোভ ঘৃণা করে সে অনেক দিন বেঁচে থাকে। যে লোক খুন করে দুশ্চিন্তায় কষ্ট পাচ্ছে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে পালিয়ে বেড়ায়; কেউ তাকে সাহায্য না করুক। যার চলাফেরা নির্দোষ সে নিরাপদে থাকে, কিন্তু যে লোক বাঁকা পথে চলে সে হঠাৎ পড়ে যাবে। যে লোক নিজের জমিতে পরিশ্রম করে তার প্রচুর খাবার থাকে, কিন্তু যে অসারতার পিছনে দৌড়ায় তার খুব অভাব হয়। বিশ্বস্ত লোক অনেক দোয়া পায়, কিন্তু যে ধনী হবার জন্য আকুল হয় সে শাস্তি পাবেই পাবে। বিচারে কারও পক্ষ নেওয়া ভাল নয়; যে তা করে সে এক টুকরা রুটির জন্যও অন্যায় করতে পারে। যে লোক লোভী সে ধনী হবার জন্য ব্যস্ত হয়, কিন্তু সে জানে না অভাব তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যে লোক খোশামুদে কথা বলে তার চেয়ে যে সংশোধনের কথা বলে সে শেষে বেশী সম্মান পায়। যে কেউ মা-বাবার জিনিস চুরি করে বলে, “এটা অন্যায় নয়,” সে ধ্বংসকারীর সংগী। যে লোক লোভী সে ঝগড়া খুঁচিয়ে তোলে, কিন্তু যে মাবুদের উপর ভরসা করে তার উন্নতি হয়। যে নিজের জ্ঞানের উপর ভরসা করে সে বিবেচনাহীন, কিন্তু যে আল্লাহ্‌র দেওয়া বুদ্ধির পথে চলে সে নিরাপদে থাকে। যে লোক গরীবকে দান করে তার অভাব হয় না, কিন্তু যে তাদের দেখে চোখ বুঁজে থাকে সে অনেক বদদোয়া কুড়ায়। দুষ্ট লোকদের হাতে ক্ষমতা গেলে লোকেরা লুকায়, কিন্তু সেই দুষ্টেরা ধ্বংস হলে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের সংখ্যা বাড়ে। অনেক বার সংশোধনের কথা শুনেও যে লোক ঘাড় শক্ত করে রাখে সে মুহূর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে যাবে; সে আর উঠতে পারবে না। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের সংখ্যা বাড়লে লোকে আনন্দ করে, কিন্তু দুষ্ট লোক শাসনকর্তা হলে লোকে কাত্‌রায়। যে লোক জ্ঞান ভালবাসে সে তার পিতাকে আনন্দ দেয়, কিন্তু যে বেশ্যাদের সংগে থাকে সে তার ধন নষ্ট করে। ন্যায়বিচারের দ্বারা বাদশাহ্‌ দেশকে স্থির রাখেন, কিন্তু যে ঘুষ খেতে ভালবাসে সে দেশকে ধ্বংস করে ফেলে। যে লোক প্রতিবেশীকে খোশামোদ করে সে নিজের পায়ের নীচে জাল পাতে। দুষ্ট লোক নিজের গুনাহের দ্বারা ফাঁদে পড়ে, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক আনন্দিত হয় ও গজল করে। গরীবদের প্রতি যেন ন্যায়বিচার করা হয় সেদিকে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের চোখ আছে, কিন্তু দুষ্টেরা এই সব কিছুই বোঝে না। ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীরা শহরের মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দেয়, কিন্তু জ্ঞানী লোকেরা মানুষের রাগ শান্ত করে। বুদ্ধিমান লোক যদি অসাড়-বিবেক লোকের বিরুদ্ধে মামলা করে তবে সেই লোক হয় রেগে যাবে না হয় হাসবে, আর তাতে কোন মীমাংসা হবে না। যারা রক্তপাত করে তারা নির্দোষ লোককে ঘৃণা করে এবং সৎ লোককে হত্যা করবার চেষ্টা করে। বিবেচনাহীন লোক তার রাগ পুরোপুরি প্রকাশ করে, কিন্তু জ্ঞানী লোক নিজেকে দমন করে রাখে। যে শাসনকর্তা মিথ্যা কথায় কান দেয় তার সব কর্মচারী দুষ্ট। গরীব ও জুলুমবাজ একটা ব্যাপারে সমান্ত মাবুদ তাদের দু’জনকেই জীবন দিয়েছেন। যে বাদশাহ্‌ সততার সংগে গরীবদের বিচার করেন তাঁর সিংহাসন সব সময় স্থির থাকে। সংশোধনের কথা ও শাসনের লাঠি জ্ঞান দান করে, কিন্তু যে ছেলেকে শাসন করা হয় না সে তার মাকে লজ্জা দেয়। দুষ্ট লোকদের সংখ্যা বাড়লে গুনাহের বৃদ্ধি হয়, কিন্তু আল্লাহ্‌ভক্ত লোক তাদের ধ্বংস দেখতে পায়। তোমার ছেলেকে শাসন কর, তাতে সে তোমাকে শান্তিতে রাখবে আর তোমার প্রাণে আনন্দ দেবে। যেখানে নবীদের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ তাঁর সত্য প্রকাশ করেন না সেখানকার লোকেরা উ"ছৃঙ্খল হয়; কিন্তু ধন্য সেই লোক যে মাবুদের শরীয়ত মেনে চলে। কেবল কথার দ্বারা গোলামকে সংশোধন করা যায় না; সে বুঝলেও তা মানবে না। তুমি কি এমন লোককে দেখেছ যে তাড়াতাড়ি করে কথা বলতে যায়? তার চেয়ে বরং বিবেচনাহীনের বিষয়ে আশা আছে। ছেলেবেলা থেকে যদি কোন গোলামকে আশ্‌কারা দেওয়া হয়, শেষে তাকে দমন করা যায় না। রাগী লোক ঝগড়া খুঁচিয়ে তোলে, আর বদমেজাজী লোক অনেক গুনাহ্‌ করে। অহংকার মানুষকে নীচে নামায়, কিন্তু নম্র স্বভাবের লোক সম্মান পায়। যে চোরের ভাগীদার সে নিজেই নিজের শত্রু; তাকে কসমনামা শুনানো হলেও সে কোন কিছু স্বীকার করে না। মানুষকে যে ভয় করে সেই ভয় তার পক্ষে ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু যে মাবুদের উপর ভরসা করে সে নিরাপদে থাকে। বিচারে অনেকে শাসনকর্তাকে নিজের পক্ষে আনতে চায়, কিন্তু মাবুদের কাছ থেকে মানুষ ন্যায়বিচার পায়। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা অন্যায়কারীকে ঘৃণার চোখে দেখে, আর যে লোক সোজা পথে চলে দুষ্টেরা তাকে ঘৃণা করে। আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা যাকির ছেলে আগূর ইথীয়েলের কাছে, জ্বী, ইথীয়েল ও উকলের কাছে বলেছিলেন। সত্যিই আমি মানুষ হলেও আমার বুদ্ধি পশুর মত; মানুষের যে বিচারবুদ্ধি আছে তা-ও আমার নেই। আমি জ্ঞান লাভ করি নি; আল্লাহ্‌ পাক সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান নেই। কে বেহেশতে উঠেছেন এবং নেমে এসেছেন? হাতের মুঠোয় কে বাতাস ধরেছেন? কে নিজের কাপড়ের মধ্যে সমস্ত পানি জমা করে রেখেছেন? দুনিয়ার সব দিকের শেষ সীমা কে স্থাপন করেছেন? তাঁর নাম ও তাঁর পুত্রের নাম কি? যদি তুমি জান তবে তা আমাকে বল। আল্লাহ্‌র সমস্ত কালাম খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়েছে; যারা তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয় তিনি তাদের ঢাল হন। তাঁর কালামের সংগে অন্য কোন কথা যোগ কোরো না; যোগ করলে তিনি তোমার দোষ দেখিয়ে দেবেন, আর তুমি মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হবে। হে মাবুদ, দু’টি জিনিস আমি তোমার কাছ থেকে চাই; আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তুমি তা আমাকে দিতে অস্বীকার কোরো না- ছলনা এবং মিথ্যা কথা আমার কাছ থেকে দূরে রাখ, আমাকে গরীব বা ধনী কোরো না। যে খাবার আমার দরকার কেবল তা-ই আমাকে দিয়ো, তা না হলে হয়তো আমার অতিরিক্ত থাকবে আর আমি তোমাকে অস্বীকার করে বলব, “মাবুদ কে?” কিংবা আমি গরীব হয়ে চুরি করব আর আমার আল্লাহ্‌র নামের অসম্মান করব। মালিকের কাছে গোলামের দুর্নাম কোরো না, তা করলে সেই গোলাম তোমাকে বদদোয়া দেবে আর তুমি দোষী হবে। এমন অনেক লোক আছে যারা এই রকম- তারা বাবাকে বদদোয়া দেয় আর মায়ের ভাল চায় না, তারা নিজেদের চোখে খাঁটি অথচ নোংরামি থেকে পাক-সাফ হয় নি, তাদের চোখ অহংকারে ভরা, তাদের দৃষ্টি ঘৃণায় পূর্ণ, তাদের দাঁত যেন তলোয়ার আর চোয়াল যেন ছুরি, যাতে তারা দুনিয়া থেকে দুঃখী লোকদের আর মানুষের মধ্য থেকে অভাবীদের গ্রাস করতে পারে। জোঁকের দু’টি মেয়ে আছে, তারা “দাও, দাও” বলে চিৎকার করে। তিনটা জিনিস আছে যা কখনও তৃপ্ত হয় না, আসলে চারটা জিনিস কখনও বলে না, “যথেষ্ট হয়েছে”- কবর, বন্ধ্যা স্ত্রীলোক, জমি, যা কখনও পানিতে তৃপ্ত হয় না, আর আগুন, যা কখনও বলে না, “যথেষ্ট হয়েছে।” যে চোখ বাবাকে ঠাট্টা করে আর মায়ের কথার বাধ্য হতে ঘৃণার সংগে অস্বীকার করে, সেই চোখ উপত্যকার কাকেরা ঠুক্‌রে বের করে নেবে, আর শকুনের বাচ্চারা তা খেয়ে ফেলবে। তিনটা জিনিস আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে, আসলে চারটা জিনিস আমি বুঝতেই পারি না- কেমন করে ঈগল পাখি আকাশে ওড়ে, কেমন করে সাপ পাথরের উপরে চলে, কেমন করে জাহাজ মহাসমুদ্রে চলে, কেমন করে পুরুষ ও যুবতী মেয়ের মিলনের ফলে জীবনের শুরু হয়। জেনাকারিণী স্ত্রীলোকের ব্যবহার আমি বুঝতে পারি না; সে জেনা করবার পরে গোসল করে বলে, “আমি তো কোন অন্যায় করি নি।” দুনিয়া তিনটার ভারে কাঁপে, আসলে চারটার ভার সে সহ্য করতে পারে না- গোলামের ভার যখন সে বাদশাহ্‌ হয়, নীচমনা লোকের ভার যখন সে পেট ভরে খায়, ঘৃণিতা স্ত্রীলোকের ভার যখন সে স্ত্রীর অধিকার পায়, আর বাঁদীর ভার যখন সে কর্ত্রীর স্থান পায়। দুনিয়াতে চারটা জিনিস ছোট, তবুও সেগুলো খুব জ্ঞানে পূর্ণ- পিঁপড়া এমন এক জাতের প্রাণী যাদের শক্তি খুবই কম, তবুও গরমকালে তারা খাবার জমা করে; শাফন এমন এক জাতের প্রাণী যাদের ক্ষমতা খুবই কম, তবুও খাড়া পাথরের গায়ে তারা ঘর বাঁধে; পংগপালদের বাদশাহ্‌ নেই, তবুও তারা সারি বেঁধে এগিয়ে যায়; টিক্‌টিকি হাত দিয়ে ধরা যায়, তবুও সে বাদশাহ্‌র বাড়ীতে থাকে। তিনটা জিনিস আছে যারা গৌরবের সংগে পা ফেলে, আসলে চারটা জিনিস গৌরবের সংগে চলে- সিংহ, যে জন্তুদের মধ্যে শক্তিশালী এবং কোন জন্তুর সামনে থেকে পালায় না; বুক ফুলিয়ে হাঁটা মোরগ, পুরুষ ছাগল, আর সৈন্যদলে ঘেরা বাদশাহ্‌। যদি তুমি নিজেকে বড় করে তুলে বোকামি কর কিংবা অন্যদের বিরুদ্ধে কুমতলব কর, তবে হাত মুখের উপরে চাপা দাও। দুধ ফেটালে যেমন মাখন বের হয়, নাক মোচড়ালে যেমন রক্ত বের হয়, তেমনি রাগকে খুঁচিয়ে তুললে ঝগড়া-বিবাদ বের হয়। বাদশাহ্‌ লমূয়েলের বলা কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র দেওয়া যে কালাম তাঁর মা তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ছেলে আমার, হে আমার গর্ভের সন্তান, হে আমার মানতের সন্তান, তোমাকে কি বলব? স্ত্রীলোকের উপরে তোমার শক্তি ক্ষয় কোরো না; বাদশাহ্‌দের যা ধ্বংস করে তার কাছে নিজেকে দিয়ে দিয়ো না। হে লমূয়েল, বাদশাহ্‌দের পক্ষে, জ্বী, বাদশাহ্‌দের পক্ষে মদানো আংগুর-রস খাওয়া উপযুক্ত নয়; মদ খেতে চাওয়া শাসনকর্তাদের পক্ষে উপযুক্ত নয়। মদ খেয়ে তারা শরীয়ত ভুলে যেতে পারে, আর অত্যাচারিতদের প্রতি অন্যায় বিচার করতে পারে। যারা মরে যাচ্ছে তাদের মদ দাও। যাদের মনে খুব কষ্ট আছে তাদের আংগুর-রস দাও; তারা তা খেয়ে তাদের অভাবের কথা ভুলে যাক, তাদের দুঃখ-কষ্ট আর তাদের মনে না থাকুক। হে লমূয়েল, যারা নিজেদের পক্ষে কথা বলতে পারে না তুমি তাদের হয়ে কথা বোলো; অসহায়দের অধিকার রক্ষার জন্য তুমি কথা বোলো। চুপ করে থেকো না, ন্যায়বিচার কোরো; দুঃখী আর অভাবীদের অধিকার রক্ষা কোরো। ভাল ও গুণবতী স্ত্রী কে পেতে পারে? প্রবাল পাথরের চেয়েও তার মূল্য অনেক বেশী। তাঁর উপর তাঁর স্বামী পরিপূর্ণভাবে ভরসা করেন; তাঁর স্বামীর সব দিক থেকে লাভ হয়। তাঁর জীবনের সমস্ত সময়েই তিনি স্বামীর ভাল করেন, ক্ষতি করেন না। তিনি ভেড়ার লোম ও মসীনা বেছে নিয়ে খুশী মনে নিজের হাতে কাজ করেন। তিনি বাণিজ্যের জাহাজের মত দূর থেকে তাঁর খাবার জিনিস আনিয়ে নেন। অন্ধকার থাকতেই তিনি ওঠেন; তিনি পরিবারের লোকদের খাবারের ব্যবস্থা করেন আর চাকরাণীদের খাবার ভাগ করে দেন। কোন জমি কিনবার আগে তিনি সেটা দেখে চিন্তা করেন আর তারপর তা কিনেন; তাঁর নিজের আয় থেকে তিনি আংগুর ক্ষেত করেন। তিনি শক্তির সংগে কোমর বেঁধে কাজে হাত দেন এবং খুব পরিশ্রম করেন। তিনি দেখতে পান যে, তাঁর পরিশ্রম থেকে লাভ ভালই আসছে; রাতেও তাঁর বাতি জ্বলতে থাকে। হাত দিয়ে তিনি সুতা কাটবার টাকু ঘুরান আর আংগুল দিয়ে সুতা কাটেন। দুঃখীদের জন্য তাঁর হাত খোলা; তিনি অভাবীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। বরফ পড়লেও পরিবারের জন্য তাঁর কোন ভয় নেই, কারণ তারা সকলেই দামী লাল কাপড় পরে। বিছানার জন্য তিনি চাদর তৈরী করেন; তিনি নিজেও মসীনার কাপড় ও দামী বেগুনে কাপড় পরেন। তাঁর স্বামী শহরের সদর দরজায় সম্মান লাভ করেন; তিনি সেখানে দেশের বৃদ্ধ নেতাদের সংগে বসেন। সেই স্ত্রী মসীনার পোশাক তৈরী করে বিক্রি করেন; কোমর বাঁধবার কাপড় তিনি ব্যবসায়ীদের যোগান দেন। ক্ষমতা ও মর্যাদাই হল তাঁর পোশাক; ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা ভেবে তাঁর কোন চিন্তা-ভাবনা হয় না। তিনি বুদ্ধি করে কথা বলেন; ভালবাসার মনোভাব নিয়ে তিনি নির্দেশ দেন। তাঁর পরিবারের সমস্ত ব্যাপারের দিকে তিনি লক্ষ্য রাখেন; তিনি পরিশ্রম করে খান। তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁকে সকলের সামনে ধন্য বলে; তাঁর স্বামীও তাঁর প্রশংসা করে বলেন, “অনেক স্ত্রীলোক তাদের যোগ্যতা দেখিয়েছে, কিন্তু তুমি তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছ।” সুন্দর ব্যবহার ছলনা করতে পারে, সৌন্দর্য স্থায়ী নয়, কিন্তু যে স্ত্রীলোক মাবুদকে ভয় করে সে প্রশংসা পায়। তার কাজের পাওনা সম্মান তাকে দাও; শহরের সদর দরজায় তার কাজই তার প্রশংসা করুক। হেদায়েতকারীর কথা; তিনি জেরুজালেমের বাদশাহ্‌ এবং দাউদের ছেলে। তিনি বলছেন, “অসার, অসার! কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সব কিছুই অসার!” সূর্যের নীচে মানুষ যে পরিশ্রম করে সেই সব পরিশ্রমে তার কি লাভ? এক পুরুষ চলে যায়, আর এক পুরুষ আসে, কিন্তু দুনিয়া চিরকাল থাকে। সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়, আর তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে আবার সেখান থেকে ওঠে। বাতাস দক্ষিণ দিকে বয়, তারপর ঘুরে যায় উত্তরে; এইভাবে তা ঘুরতে থাকে আর নিজের পথে ফিরে আসে। সমস্ত নদী সাগরে গিয়ে পড়ে, তবুও সাগর কখনও পূর্ণ হয় না; যেখান থেকে সব নদী বের হয়ে আসে আবার সেখানেই তার পানি ফিরে যায়। সব কিছুই ঘুরে ঘুরে আসে আর ক্লানি- জন্মায়; সেই সব বিষয়ে বলবার ভাষা কারও নেই। চোখ যতই দেখুক না কেন সে আরও দেখতে চায়, কান যতই শুনুক না কেন সে আরও শুনতে চায়। যা হয়ে গেছে তা আবার হবে, যা করা হয়েছে তা আবার করা হবে; সূর্যের নীচে নতুন বলতে কিছু নেই। এমন কিছু থাকতে পারে যার বিষয় লোকে বলে, “দেখ, এটা নতুন।” কিন্তু ওটা তো অনেক আগে থেকেই ছিল, আমাদের কালের আগেই ছিল। আগেকার কালের লোকদের কথা কারও মনে নেই; যারা ভবিষ্যতে জন্মাবে তাদের কথাও তারা মনে রাখবে না যারা তাদের পরে জন্মাবে। আমি হেদায়েতকারী; আমি জেরুজালেমে ইসরাইলের উপরে বাদশাহ্‌ ছিলাম। আসমানের নীচে যা কিছু করা হয় তা জ্ঞান দ্বারা পরীক্ষা ও খোঁজ করবার জন্য আমি মন স্থির করলাম। দেখলাম, কি ভারী কষ্টই না আল্লাহ্‌ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন! সূর্যের নীচে যা কিছু করা হয় তা সবই আমি দেখলাম; দেখলাম সমস্তই অসার, কেবল বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। যা বাঁকা তা সোজা করা যায় না; যা অসম্পূর্ণ তা সম্পূর্ণ করা যায় না। আমি মনে মনে বললাম, “আমার আগে যাঁরা জেরুজালেমে রাজত্ব করে গেছেন তাঁদের সকলের চেয়ে আমি জ্ঞানে অনেক বেড়ে উঠেছি; আমার অনেক জ্ঞান ও বুদ্ধি লাভ হয়েছে।” তারপর আমি জ্ঞান ও বুদ্ধি এবং নীতিহীনতা ও নির্বুদ্ধিতা সম্বন্ধে বুঝবার চেষ্টা করলাম। তাতে বুঝতে পারলাম যে, তা-ও বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়; কারণ জ্ঞান বাড়লে তার সংগে অনেক বিরক্তি বাড়ে, আর যত বুদ্ধি বাড়ে তত যন্ত্রণা বাড়ে। আমি নিজেকে বললাম, “সুখ কি, তা বুঝবার জন্য আমি নিজে আমোদ-প্রমোদ করে তা পরীক্ষা করে দেখি।” কিন্তু দেখলাম, তা-ও অসার। আমি বললাম, “হাসিতেও বোকামি আছে, আর আমোদ-প্রমোদেই বা কি লাভ।” আমি স্বজ্ঞানে আংগুর-রস খেয়ে শরীরকে উত্তেজিত করলাম এবং নির্বোধের মত কাজ করে নিজেকে খুশী করবার চেষ্টা করলাম। আমি দেখতে চাইলাম, আসমানের নীচে মানুষের মাত্র কয়েক দিনের জীবনকালে তার জন্য কোনটা ভাল- জ্ঞানের পথে চলা না নির্বুদ্ধিতার পথে চলা। আমি কতগুলো বড় বড় কাজ করলাম। আমি নিজের জন্য অনেক ঘর-বাড়ী তৈরী করলাম আর অনেক আংগুর ক্ষেত করলাম। আমি ছোট ও বড় অনেক বাগান তৈরী করে তাতে সব রকমের ফলের গাছ লাগালাম। আমি নিজের জন্য কতগুলো পুকুর কাটলাম যাতে বনের গাছগুলোতে পানি দেওয়া যায়। আমি অনেক গোলাম ও বাঁদী কিনলাম, আর অনেক গোলাম ও বাঁদী আমার ঘরেও জন্মেছিল। আমার আগে যারা জেরুজালেমে ছিলেন তাঁদের চেয়েও আমার অনেক বেশী গরু-ভেড়া ছিল। আমি অনেক সোনা-রূপা এবং অন্যান্য বাদশাহ্‌দের ও বিভিন্ন প্রদেশের ধন-সম্পদ এনে নিজের জন্য জমা করলাম। আমি অনেক গায়ক-গায়িকা ও পুরুষের আনন্দ দানকারিণী অনেক উপস্ত্রী পেলাম। আমার আগে যাঁরা জেরুজালেমে ছিলেন তাঁদের চেয়েও আমি অনেক বেশী ধন লাভ করলাম। তখনও জ্ঞান আমাকে পরিচালনা করছিল। আমার চোখে যা ভাল লাগত আমি তা-ই গ্রহণ করতাম; আমি নিজেকে সব আনন্দই ভোগ করতে দিতাম। আমার সব কাজেই আমার মন খুশী হত, আর এটাই ছিল আমার সব পরিশ্রমের পুরস্কার। তবুও আমি যা কিছু করেছি আর যা পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছি তার দিকে যখন আমি তাকালাম তখন দেখলাম সবই অসার। এই সব কেবল বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। সূর্যের নীচে কোন কিছুতেই লাভ নেই। তারপর আমি জ্ঞান, নীতিহীনতা আর নির্বুদ্ধিতার কথা চিন্তা করলাম। আগের বাদশাহ্‌ যেভাবে কাজ করে গেছেন আমরা কি জানতে পারি যে, তাঁর পরের বাদশাহ্‌ সেইভাবে কাজ করবেন? আমি দেখলাম, অন্ধকারের চেয়ে যেমন আলো ভাল, তেমনি নির্বুদ্ধিতার চেয়ে জ্ঞান ভাল। জ্ঞানী লোকের চোখ আছে, কিন্তু বোকা অন্ধকারে চলাফেরা করে; তবে আমি এটাই বুঝতে পারলাম যে, ঐ দু’জনের শেষ দশা একই। তারপর আমি নিজের মনে বললাম, “বোকার যে দশা হয় আমারও তো সেই দশাই হবে। তাহলে এত জ্ঞানী হয়ে আমার কি লাভ হল? এটাও তো অসার।” লোকে বোকাকে যেমন মনে রাখে না তেমনি জ্ঞানীকেও বেশী দিন মনে রাখে না; ভবিষ্যতে এই দু’জনকেই লোকে ভুলে যাবে। বোকা যেমন মরে যায় জ্ঞানী লোকও তেমনি মরে যায়। কাজেই আমি আমার জীবনকে ঘৃণা করতে লাগলাম, কারণ সূর্যের নীচে যে কাজ করা হয় তা আমার কাছে কষ্টের ব্যাপার বলে মনে হল- এ সবই অসার, বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। সূর্যের নীচে যে সব জিনিসের জন্য আমি পরিশ্রম করেছি সেগুলোকে এখন আমি ঘৃণা করতে লাগলাম, কারণ আমার পরে যে আসবে তার জন্যই তো সেই সব রেখে যেতে হবে। সেই লোক জ্ঞানী না বুদ্ধিহীন হবে তা কে জানে? তবুও সে-ই আমার সব কাজের ফল ভোগ করবে, যার জন্য আমি সূর্যের নীচে পরিশ্রম করেছি ও যোগ্যতা দেখিয়েছি। এটাও অসার। কাজেই সূর্যের নীচে আমি যে সব পরিশ্রমের কাজ করেছি তার জন্য আমার দিল নিরাশ হতে লাগল। এর কারণ হল, জ্ঞান, বুদ্ধি ও যোগ্যতা দিয়ে একজন পরিশ্রম করতে পারে, কিন্তু তার পরে তার সব কিছু অধিকার হিসাবে এমন একজনের জন্য রেখে যেতে হয় যে লোক তার জন্য কোন পরিশ্রমই করে নি। এটাও অসার ও বড় কষ্টের ব্যাপার। সূর্যের নীচে মানুষ যে সব পরিশ্রম ও চিন্তা-ভাবনা করে তার ফলে তার কি লাভ হয়? প্রত্যেক দিন তার কাজে থাকে ব্যথা আর বিরক্তি; রাতেও তার মন বিশ্রাম পায় না। এটাও অসার। তাহলে মানুষের পক্ষে খাওয়া-দাওয়া করা এবং নিজের কাজে সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া ভাল আর কিছুই নেই। আমি দেখতে পেলাম এই সব আল্লাহ্‌র হাত থেকে আসে, কারণ তিনি না দিলে কে খেতে পারে বা আনন্দ ভোগ করতে পারে? আল্লাহ্‌কে যে সন্তুষ্ট করে তাকে তিনি জ্ঞান, বুদ্ধি ও আনন্দ দান করেন, কিন্তু গুনাহ্‌গারকে তিনি ধন-সম্পদ যোগাড় করবার ও তা জমাবার কাজ দেন, যাতে সে তা সেই লোককে দিয়ে যায় যে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করে। এটাও অসার, বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। সব কিছুর জন্য একটা সময় আছে; আসমানের নীচে প্রত্যেকটি কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে- জন্মের সময় ও মরণের সময়, বুনবার সময় ও উপ্‌ড়ে ফেলবার সময়, মেরে ফেলবার সময় ও সুস্থ করবার সময়, ভেংগে ফেলবার সময় ও গড়বার সময়, কাঁদবার সময় ও হাসবার সময়, শোক করবার সময় ও নাচবার সময়, পাথর ছুঁড়বার সময় ও সেগুলো জড়ো করবার সময়, ভালবেসে জড়িয়ে ধরবার সময় ও জড়িয়ে না ধরবার সময়, খুঁজে পাওয়ার সময় ও হারাবার সময়, রাখবার সময় ও ফেলে দেবার সময়, ছিঁড়ে ফেলবার সময় ও সেলাই করবার সময়, চুপ করে থাকবার সময় ও কথা বলবার সময়, ভালবাসবার সময় ও ভাল না বাসবার সময়, যুদ্ধের সময় ও শান্তির সময়। যে কাজ করে সে তার পরিশ্রমের কি ফল পায়? আল্লাহ্‌ মানুষের উপর যে বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন তা আমি দেখেছি। তিনি সব কিছুর জন্য উপযুক্ত সময় ঠিক করে রেখেছেন। তিনি মানুষের দিলে অনন্তকাল সম্বন্ধে বুঝবার ইচ্ছা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কি করেন তা মানুষ বুঝতে পারে না। আমি জানি, মানুষের জীবনকালে আনন্দ ও ভাল কাজ করা ছাড়া তার জন্য আর ভাল কিছু নেই। এটা আল্লাহ্‌র দান যে, সব মানুষ খাওয়া-দাওয়া করবে ও তার সব কাজে সন্তুষ্ট হবে। আমি জানি আল্লাহ্‌ যা কিছু করেন তা চিরকাল থাকে; কিছুই তার সংগে যোগ করা যায় না এবং কিছুই তা থেকে বাদ দেওয়াও যায় না। আল্লাহ্‌ তা করেন যেন মানুষ তাঁকে ভয় করে। যা কিছু আছে তা আগে থেকেই ছিল, যা হবে তাও আগে ছিল; যা হয়ে গেছে আল্লাহ্‌ তা আবার ঘটান। আমি সূর্যের নীচে আর একটা ব্যাপার দেখলাম যে, ন্যায়বিচার ও সততার জায়গায় দুষ্টতা রয়েছে। আমি মনে মনে বললাম, “আল্লাহ্‌ সৎ ও দুষ্ট এই দু’জনেরই বিচার করবেন, কারণ আল্লাহ্‌র কাছে সমস্ত ব্যাপার ও সমস্ত কাজের একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে।” আমি এ-ও ভাবলাম যে, মানুষকে আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করেন যাতে তারা দেখতে পায় তারা পশুদেরই মত, কারণ মানুষের প্রতি যা ঘটে পশুর প্রতিও তা-ই ঘটে। এ যেমন মরে সেও তেমনি মরে। তাদের সবার প্রাণবায়ু একই রকমের। এই ব্যাপারে পশু আর মানুষের মধ্যে আলাদা কিছু নেই; কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সকলেই এক জায়গায় যায়; সবাই মাটি থেকে তৈরী আর মাটিতেই ফিরে যায়। মানুষের প্রাণবায়ু যে উপর দিকে ওঠে আর পশুর প্রাণবায়ু নীচে মাটির তলায় যায় তা কে জানে? কাজেই আমি দেখলাম, নিজের কাজে আনন্দ করা ছাড়া আর ভাল কিছু মানুষের জন্য নেই। ওটাই তার পাওনা, কারণ তার মৃত্যুর পরে কি ঘটবে তা কে তাকে দেখাতে পারে? সূর্যের নীচে যে সব জুলুম হয় তার দিকে আমি একবার চেয়ে দেখলাম যে, অত্যাচারিতেরা কাঁদছে, কিন্তু তাদের সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। যারা জুলুম করে তাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু অত্যাচারিতদের সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। আমি বুঝতে পারলাম, যারা এখনও বেঁচে আছে তাদের চেয়ে যারা আগেই মরে গেছে তারা আরও ভাল অবস্থায় আছে। কিন্তু এই দু’জনের চেয়ে তার অবস্থা আরও ভাল যার এখনও জন্ম হয় নি আর সূর্যের নীচে যে অন্যায় করা হয় তা দেখে নি। আমি দেখলাম, প্রতিবেশীর প্রতি হিংসার দরুনই মানুষ সব পরিশ্রম করে আর সফলতা লাভ করে। এটাও অসার, কেবল বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। বোকা লোক হাত গুটিয়ে রেখে নিজেকে ধ্বংস করে। বাতাসের পিছনে দৌড়াবার জন্য পরিশ্রম করে দু’মুঠো পাওয়ার চেয়ে শান্তির সংগে এক মুঠো পাওয়া অনেক ভাল। সূর্যের নীচে আমি আরও কিছু নিষ্ফলতা দেখতে পেলাম। কোন একজন লোক একেবারে একা- তার ছেলেও নেই, ভাইও নেই; তবুও তার পরিশ্রমের শেষ নেই আর ধন-সম্পদে তার চোখ ভরে না। সে জিজ্ঞাসা করল, “কার জন্য আমি পরিশ্রম করছি? কেন আমোদ-প্রমোদ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখছি?” এটা অসার, ভারী কষ্টের ব্যাপার। একজনের চেয়ে দ’ুজন ভাল, কারণ তাদের কাজে অনেক ফল হয়। একজন যদি পড়ে যায় তবে তার সংগী তাকে উঠাতে পারে; কিন্তু হায় সেই লোক, যে পড়ে গেলে তাকে উঠাবার কেউ থাকে না। এছাড়া দু’জন একসংগে শুয়ে থাকলে শরীর গরম হয়, কিন্তু একজন কেমন করে গরম হবে? মানুষ একা হলে সহজে হেরে যেতে পারে, কিন্তু দু’জন হলে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তিনটা দড়ি একসংগে পাকানো হলে তাড়াতাড়ি ছেঁড়ে না। একজন বুড়ো বোকা বাদশাহ্‌, যিনি আর পরামর্শ গ্রহণ করতে চান না তাঁর চেয়ে বরং একজন গরীব অথচ বুদ্ধিমান যুবক ভাল। সেই যুবক যদিও সেই রাজ্যের একটা গরীব পরিবারে জন্মেছিল তবুও সে জেলখানা থেকে বের হয়ে পরে বাদশাহ্‌ হয়েছিল। আমি দেখলাম, যারা বেঁচে ছিল, অর্থাৎ সূর্যের নীচে চলাফেরা করছিল তারা সেই বুড়ো বাদশাহ্‌র পরে যে যুবক বাদশাহ্‌ হয়েছিল তার পিছনেই চলল। আগে এই যুবক বাদশাহ্‌র অসংখ্য লোক ছিল যাদের উপর সে রাজত্ব করছিল, কিন্তু তার পরের লোকেরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট ছিল না। এটাও অসার, কেবল বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ্‌র ঘরে যাবার সময় তোমার পা সাবধানে ফেলো। যারা নিজেদের অন্যায় বোঝে না সেই বোকা লোকদের মত কোরবানী দেবার চেয়ে বরং আল্লাহ্‌র বাধ্য হওয়া ভাল। তোমার মুখ তাড়াতাড়ি করে কথা না বলুক; আল্লাহ্‌র কাছে তাড়াতাড়ি করে কোন কথা বোলো না। আল্লাহ্‌ বেহেশতে আছেন আর তুমি আছ দুনিয়াতে, তাই তোমার কথা যেন অল্প হয়। অনেক ভাবনা-চিন্তা থাকলে লোকে যেমন স্বপ্ন দেখে তেমনি অনেক কথা বললে বোকামি বের হয়ে আসে। আল্লাহ্‌র কাছে কোন মানত করলে তা পূর্ণ করতে দেরি কোরো না। বোকা লোকদের নিয়ে তিনি কোন আনন্দ পান না। তোমার মানত পূর্ণ কোরো। মানত করে তা পূরণ না করবার চেয়ে বরং মানত না করাই ভাল। তোমার মুখ যেন তোমাকে গুনাহের পথে নিয়ে না যায়। “আমার মানত করা ভুল হয়েছে,” এই কথা এবাদত-খানার খেদমতকারীকে বোলো না। তোমার কথার জন্য কেন আল্লাহ্‌ রেগে গিয়ে তোমার হাতের কাজ নষ্ট করে ফেলবেন? অনেক স্বপ্ন দেখা এবং অনেক কথা বলা অসার, কিন্তু তুমি আল্লাহ্‌কে ভয় কর। তোমার এলাকায় যদি কোন গরীবকে অত্যাচারিত হতে দেখ কিংবা কাউকে ন্যায়বিচার ও তার ন্যায্য অধিকার না পেতে দেখ তবে ভয় পেয়ো না, কারণ এক কর্মচারীর উপরে বড় আর এক কর্মচারী আছেন এবং তাদের দ’ুজনের উপরে আরও বড় বড় কর্মকর্তা আছেন। তবুও চাষের জমি রক্ষা করবার জন্য একজন বাদশাহ্‌ থাকলে দেশের সুবিধা হয়। যে লোক টাকা-পয়সা ভালবাসে তার কখনও যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। যে লোক ধন-সম্পদ ভালবাসে সে তার আয়ে কখনও সন্তুষ্ট হয় না। এটাও অসার। সম্পত্তি বাড়লে তা ভোগ করবার লোকও বাড়ে। কেবল দেখবার সুখ ছাড়া সেই সম্পত্তিতে মালিকের কি লাভ? যে পরিশ্রম করে সে কম খাক বা বেশী খাক তার ঘুম ভাল হয়। কিন্তু ধনী লোকের প্রচুর ধন-সম্পদ তাকে ঘুমাতে দেয় না। সূর্যের নীচে আমি একটা ভীষণ দুঃখের ব্যাপার দেখেছি- ধনী অনেক ধন জমা করে কিন্তু শেষে তার ক্ষতি হয়। কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তা ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই তার ছেলের জন্য কিছুই থাকে না। মায়ের গর্ভ থেকে মানুষ উলংগ আসে; সে যেমন আসে তেমনই চলে যায়। তার পরিশ্রমের কোন কিছুই সে হাতে করে নিয়ে যেতে পারে না। এটাও একটা ভীষণ দুঃখের ব্যাপার যে, মানুষ যেমন আসে তেমনই চলে যায়; তার লাভ কি? সে তো বাতাসের জন্যই পরিশ্রম করে। বিরক্তি, যন্ত্রণা আর রাগ নিয়ে সারা জীবনই সে অন্ধকারে কাটায়। তারপর আমি বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ্‌ সূর্যের নীচে মানুষকে যে কয়টা দিন বাঁচতে দিয়েছেন তাতে খাওয়া-দাওয়া করা এবং তার কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে তৃপ্ত হওয়াই তার পক্ষে ভাল ও উপযুক্ত, কারণ ওটাই তার পাওনা। এছাড়া আল্লাহ্‌ যখন কোন মানুষকে ধন ও সম্পত্তি দেন তখন তাকে তা ভোগ করতে দেন, তার নিজের জন্য একটা অংশ গ্রহণ করতে দেন ও নিজের কাজে আনন্দ করতে দেন। এ সবই আল্লাহ্‌র দান। তার আয়ুর দিনগুলোর দিকে সে ফিরে তাকায় না, কারণ আল্লাহ্‌ তার মনে আনন্দ দিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখেন। সূর্যের নীচে আমি আর একটা দুঃখের ব্যাপার দেখেছি, আর তা মানুষের জন্য বড় কষ্টের। আল্লাহ্‌ কোন মানুষকে এত ধন, সম্পত্তি ও সম্মান দান করেন যে, তার চাইবার মত আর কিছু থাকে না, কিন্তু আল্লাহ্‌ তাকে তা ভোগ করবার ক্ষমতা দেন না, অন্য একজন তা ভোগ করে। এটা অসার, এটা ভীষণ দুঃখের ব্যাপার। কোন লোকের একশোজন ছেলেমেয়ে থাকতে পারে এবং সে অনেক দিন বেঁচেও থাকতে পারে, কিন্তু সে যদি জীবনে সুখ না পায় এবং উপযুক্তভাবে দাফন না পায় তবে যত বছরই সে বেঁচে থাকুক না কেন আমি বলি তার চেয়ে বরং মৃত-সন্তানের জন্ম হওয়া অনেক ভাল। সেই মৃত-সন্তান অনর্থক এসে অন্ধকারেই বিদায় নেয় আর অন্ধকারেই তার নাম ঢাকা পড়ে যায়। যদিও সে কখনও সূর্য দেখে নি কিংবা কিছুই জানে নি তবুও সেই লোকের চেয়ে সে অনেক বিশ্রাম পায়। সেই লোক যদিও বা দু’হাজার বছর বেঁচে থাকে কিন্তু জীবনে সুখ না পায় তবে তার কি লাভ? সবাই কি একই জায়গায় যায় না? মানুষের সমস্ত পরিশ্রমই তার পেটের জন্য, তবুও তার খিদে কখনও মেটে না। বোকার চেয়ে জ্ঞানী লোকের সুবিধা কি? অন্যদের সামনে কিভাবে চলতে হবে তা জানলে একজন গরীবের কি লাভ হয়? আরও পাবার ইচ্ছার চেয়ে বরং চোখ যা দেখতে পায় তাতে সন্তুষ্ট থাকা ভাল। এও অসার, কেবল বাতাসের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। যা রয়েছে তা আগেই ঠিক করা হয়েছে, আর মানুষ যে কি, তা-ও জানা গেছে; নিজের চেয়ে যিনি শক্তিশালী তাঁর সংগে কেউ তর্কাতর্কি করতে পারে না। যত বেশী কথা বলা হয় ততই অসারতা বাড়ে, আর তাতে মানুষের কি লাভ হয়? মানুষের জীবনকালে তার জন্য কি ভাল তা কে জানে? সে তো তার অল্প ও অস্থায়ী দিনগুলো ছায়ার মত কাটায়। সে চলে গেলে পর সূর্যের নীচে কি ঘটবে তা কে তাকে বলতে পারবে? ভাল খোশবুর চেয়ে সুনাম ভাল, জন্মের দিনের চেয়ে মৃত্যুর দিন ভাল। মেজবানীর ঘরে যাওয়ার চেয়ে শোকের ঘরে যাওয়া ভাল, কারণ সকলেই একদিন মারা যাবে; জীবিতদের এই কথা মনে রাখা উচিত। আনন্দ করার চেয়ে কষ্ট ভোগ করা ভাল, কারণ মুখে দুঃখের ভাব থাকলেও দিলে সুখ থাকতে পারে। জ্ঞানীর দিল শোকের ঘরে থাকে, কিন্তু বোকা লোকদের দিল থাকে আমোদের ঘরে। বোকাদের গান শোনার চেয়ে জ্ঞানী লোকের বকুনি শোনা ভাল। পাত্রের তলায় আগুনে কাঁটা পোড়ালে কেবল শব্দই হয়; বোকাদের হাসিও ঠিক তেমনি। এও অসার। জ্ঞানী লোক যদি জুলুম করে তবে সে বোকা হয়ে যায়, আর ঘুষ দিল নষ্ট করে। কোন কাজের শুরুর চেয়ে শেষ ভাল, আর অহংকারের চেয়ে ধৈর্য ভাল। তোমার দিলকে তাড়াতাড়ি রেগে উঠতে দিয়ো না, কারণ রাগ বোকাদেরই দিলে বাস করে। “এখনকার চেয়ে আগেকার কাল কেন ভাল ছিল?” এই কথা জিজ্ঞাসা কোরো না, কারণ এই প্রশ্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জ্ঞান সম্পত্তি পাওয়ার মত ভাল জিনিস; তা জীবিত লোকদের উপকার করে। টাকা-পয়সার মতই জ্ঞান নিরাপত্তা দান করে, তবে জ্ঞানের সুবিধা হল এই যে, জ্ঞানীর জ্ঞানই তার জীবন রক্ষা করে। আল্লাহ্‌র কাজ ভেবে দেখ। তিনি যা বাঁকা করেছেন কে তা সোজা করতে পারে? সুখের দিনে সুখী হও; কিন্তু দুঃখের দিনে এই কথা ভেবে দেখো যে, আল্লাহ্‌ যেমন সুখ রেখেছেন তেমনি দুঃখও রেখেছেন, যেন মানুষ তার ভবিষ্যতের কোন কিছুই জানতে না পারে। আমার এই অসার জীবনকালে আমি দেখেছি যে, একজন সৎ লোক তার সততার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়, আর একজন দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার মধ্যে অনেক দিন বেঁচে থাকে। নিজের চোখে অতিরিক্ত সৎ কিংবা অতিরিক্ত জ্ঞানী হোয়ো না। কেন তুমি নিজেকে ধ্বংস করবে? দুষ্টতার বশে থেকো না, বোকামিও কোরো না। কেন তুমি অসময়ে মারা যাবে? এই দু’টা উপদেশ ধরে রেখো, কোনটাকেই ছেড়ে দিয়ো না; যে লোক আল্লাহ্‌কে ভয় করে সে কোন কিছুই অতিরিক্ত করে না। দশজন শাসনকর্তা শহরকে যত না শক্তিশালী করে জ্ঞান একজন জ্ঞানী লোককে তার চেয়েও শক্তিশালী করে। দুনিয়াতে এমন কোন সৎ লোক নেই যে সব সময় ভাল কাজ করে, কখনও গুনাহ্‌ করে না। লোকে যা বলে তার সব কথায় কান দিয়ো না, হয়তো শুনবে যে, তোমার চাকর তোমাকে বদদোয়া দিচ্ছে; কারণ তুমি তো তোমার দিলে জান যে, অনেকবার তুমি নিজেই অন্যদের বদদোয়া দিয়েছ। এই সব আমার জ্ঞান দিয়ে আমি পরীক্ষা করে দেখে বললাম, “আমি জ্ঞানী হবই হব।” কিন্তু তা আমার নাগালের বাইরে। জীবনের প্রকৃত অর্থ খুবই গভীর, তা নাগালের বাইরে; কে তা খুঁজে পেতে পারে? সেইজন্য আমি মন স্থির করলাম যাতে জ্ঞান ও সব কিছুর পিছনে যে পরিকল্পনা আছে তা জানতে পারি এবং পরীক্ষা ও খোঁজ করে দেখতে পারি, আর বুঝতে পারি যে, দুষ্টতা হল বোকামি আর নির্বুদ্ধিতা হল বিচারবুদ্ধিহীনতা। আমি দেখলাম, মৃত্যুর চেয়েও তেতো হল সেই স্ত্রীলোক, যার দিল একটা ফাঁদ ও জাল আর হাত দু’টা শিকল। যে লোক আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করে সে তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, কিন্তু গুনাহ্‌গারকে সে ফাঁদে ফেলবে। হেদায়েতকারী বলছেন, “দেখ, সব কিছুর পিছনে যে পরিকল্পনা আছে তা খুঁজে দেখবার জন্য আমি ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে কতগুলো বিষয় জানতে পারলাম। আমি যখন জ্ঞানের খোঁজ করছিলাম কিন্তু পাচ্ছিলাম না তখন আমি হাজার জনের মধ্যে একজন খাঁটি পুরুষ লোককে পেলাম, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন স্ত্রীলোককেও খাঁটি দেখতে পাই নি। কেবল এটাই আমি জানতে পারলাম যে, আল্লাহ্‌ মানুষকে খাঁটিই তৈরী করেছিলেন, কিন্তু মানুষ নানা চালাকির পিছনে চলে গেছে।” কে জ্ঞানী লোকের মত? যা ঘটে কে তার অর্থ বুঝতে পারে? জ্ঞান মানুষের মুখ উজ্জ্বল করে এবং তার মুখের কঠিনতা পরিবর্তন করতে পারে। আমার উপদেশ এই যে, তুমি বাদশাহ্‌র হুকুম পালন কর, কারণ আল্লাহ্‌র সামনে তুমি সেই কসমই খেয়েছ। তাড়াতাড়ি বাদশাহ্‌কে ত্যাগ করে চলে যেয়ো না। খারাপ কিছুর সংগে যুক্ত হোয়ো না, কারণ বাদশাহ্‌ তাঁর ইচ্ছামত কাজ করেন। বাদশাহ্‌র কথাই যখন সবচেয়ে বড় তখন কে তাঁকে বলতে পারে, “আপনি কি করছেন?” যে তাঁর হুকুম পালন করে তার কোন ক্ষতি হবে না। জ্ঞানী লোকদের দিল উপযুক্ত সময় ও কাজের নিয়ম জানে। প্রত্যেকটি ব্যাপারের জন্য উপযুক্ত সময় আছে আর কাজেরও নিয়ম আছে, কিন্তু মানুষের জ্ঞান সীমিত বলে সে খুব কষ্ট পায়; কারণ কোন মানুষই যখন জানে না কি ঘটবে তখন কেউ তাকে বলতে পারে না কখন তা ঘটবে। বাতাসকে যেমন ধরে রাখবার ক্ষমতা কারও নেই এবং যুদ্ধের সময় যেমন কেউ ছুটি পায় না, তেমনি মৃত্যুর দিনের উপরেও কারও হাত নেই। দুষ্টদের দুষ্টতাও তা থেকে তাদের রক্ষা করতে পারে না। সূর্যের নীচে যা কিছু করা হয় তার দিকে মনোযোগ দিয়ে আমি দেখতে পেলাম যে, একজন লোক অন্যদের উপর কর্তৃত্ব করে এবং তার ফলে তাদের ক্ষতি হয়। তারপর আমি এও দেখলাম যে, দুষ্ট লোকদের দাফন করা হচ্ছিল। এরা এবাদত-খানায় যাওয়া-আসা করত; পরে তাদের শহরের লোকেরা তাদের দুষ্টতার কথা ভুলে গেল। এও অসার। অন্যায় কাজের শাস্তি যদি তাড়াতাড়ি দেওয়া না হয় তাহলে লোকদের দিল অন্যায় করবার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়। গুনাহ্‌গার লোক যদিও একশোটা অন্যায় কাজ করে অনেক দিন বেঁচে থাকে তবুও আমি জানি আল্লাহ্‌কে যারা ভয় করে তাদের ভাল হবে। কিন্তু দুষ্টেরা আল্লাহ্‌কে ভয় করে না বলে তাদের ভাল হবে না এবং তাদের আয়ু হবে ছায়ার মত। দুনিয়াতে আর একটা অসার ব্যাপার হল, দুষ্টদের যা পাওনা তা পায় সৎ লোক, আর সৎ লোকদের যা পাওনা তা পায় দুষ্ট লোকেরা। আমি বলি এটাও অসার। কাজেই আমি জীবনে আমোদ-প্রমোদের প্রশংসাই করছি, কারণ সূর্যের নীচে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ করা ছাড়া মানুষের জন্য ভাল আর কিছু নেই। তাহলে সূর্যের নীচে আল্লাহ্‌র দেওয়া মানুষের জীবনের সমস্ত দিনগুলোতে তার কাজে আনন্দই হবে তার সংগী। সেইজন্য আমি এই সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করলাম এবং দেখলাম যে, সৎ ও জ্ঞানী লোকেরা এবং তাদের কাজ সবই আল্লাহ্‌র হাতে। কেউ জানে না তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে- ভালবাসা না ঘৃণা। সকলের শেষ অবস্থা একই- তা সে সৎ হোক বা দুষ্ট হোক, ভাল ও পাক-পবিত্র হোক বা নাপাক হোক, কোরবানী দিক বা না দিক। ভাল লোকের জন্যও যা, গুনাহ্‌গারের জন্যও তা; যারা কসম খায় তাদের জন্যও যা, যারা তা করতে ভয় পায় তাদের জন্যও তা। সূর্যের নীচে যা কিছু ঘটে তার মধ্যে দুঃখের বিষয় হল এই যে, সকলের একই দশা ঘটে। এছাড়া মানুষের দিল দুঃখে পরিপূর্ণ এবং যতদিন সে বেঁচে থাকে ততদিন তার দিলে থাকে বিচারবুদ্ধিহীনতা, আর তার পরে সে মারা যায়। জীবিত লোকদের আশা আছে; এমন কি, মরা সিংহের চেয়ে জীবিত কুকুরও ভাল। জীবিত লোকেরা জানে যে, তাদের মরতে হবে, কিন্তু মৃতেরা কিছুই জানে না। তাদের আর কোন পুরস্কার নেই, কারণ তাদের কথাও লোকে ভুলে যায়। তাদের ভালবাসা, ঘৃণা ও হিংসা আগেই শেষ হয়ে গেছে; সূর্যের নীচে যা কিছু ঘটবে তাতে তাদের আর কোন অংশ থাকবে না। তাই তুমি গিয়ে আনন্দের সংগে তোমার খাবার খাও আর আনন্দপূর্ণ দিলে আংগুর-রস খাও, কারণ তোমার এই সব কাজ আল্লাহ্‌ আগেই কবুল করেছেন। সব সময় সাদা কাপড় পরে আর মাথায় তেল দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে। সূর্যের নীচে আল্লাহ্‌ তোমাকে এই যে সব অস্থায়ী দিনগুলো দিয়েছেন, তোমার জীবনের সেই সব দিনগুলো তোমার স্ত্রী, যাকে তুমি ভালবাস, তার সংগে আনন্দে কাটাও, কারণ সূর্যের নীচে তোমার জীবন ও তোমার কষ্টপূর্ণ পরিশ্রমের মধ্যে এ-ই তোমার পাওনা। তোমার হাতে যে কোন কাজ আসুক না কেন তা তোমার সমস্ত শক্তি দিয়েই কোরো, কারণ তুমি যে জায়গায় যাচ্ছ সেই কবরে কোন কাজ বা পরিকল্পনা বা বুদ্ধি কিংবা জ্ঞান বলে কিছু নেই। সূর্যের নীচে আমি আরও কিছু দেখেছি, তা হল: যারা তাড়াতাড়ি দৌড়ায় তারাই যে সব সময় জয়ী হয়, তা নয়; শক্তিশালীরা যে সব সময় যুদ্ধে জয়ী হয়, তা নয়; জ্ঞানীরা যে সব সময় পেট ভরে খাবার পায়, তা নয়; বুদ্ধিমানেরা যে সব সময় ধনী হয়, তা নয়; দক্ষ লোকেরা যে সব সময় সুযোগ পায়, তা নয়; কারণ তারা সকলেই সময় ও সুযোগের হাতে বাঁধা। কেউ জানে না তার মৃত্যুর সময় কখন আসবে। যেমন করে মাছ নিষ্ঠুর জালে ধরা পড়ে আর পাখীরা ফাঁদে পড়ে তেমনি করে বিপদ হঠাৎ মানুষের উপর এসে পড়ে এবং তাকে ফাঁদে ফেলে। আমি সূর্র্যের নীচে জ্ঞান সম্বন্ধে আর একটা ব্যাপার দেখলাম যা আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটল। একটা ছোট শহরে অল্প লোক ছিল। একজন শক্তিশালী বাদশাহ্‌ তার বিরুদ্ধে এসে সেটা ঘেরাও করে আক্রমণ করবার জন্য প্রস্তুত হল। সেই শহরে একজন জ্ঞানী গরীব লোক ছিল। সে তার জ্ঞান দিয়ে শহরটা রক্ষা করল, কিন্তু কেউই সেই গরীব লোকটিকে মনে রাখল না। তাই আমি বললাম, “শক্তির চেয়ে জ্ঞান ভাল,” কিন্তু গরীব লোকের জ্ঞানকে তুচ্ছ করা হয় এবং তার কথা কেউ শোনে না। বোকাদের শাসনকর্তার চিৎকারের চেয়ে বরং জ্ঞানীদের শান্তিপূর্ণ কথা শোনা ভাল। যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের চেয়ে জ্ঞান ভাল, কিন্তু একজন গুনাহ্‌গার অনেক ভাল কাজ নষ্ট করে। মরা মাছি যেমন খোশবু তেল দুর্গন্ধ করে তোলে, তেমনি একটুখানি নির্বুদ্ধিতা জ্ঞান ও সম্মানকে মুছে ফেলে। জ্ঞানীদের দিল ভাল পথের দিকে ফেরে, কিন্তু বোকাদের দিল যায় ভুল পথের দিকে। এমন কি, রাস্তায় চলবার সময়েও দেখা যায় বোকার বুদ্ধির অভাব আছে; সে যে বোকা তা সবাই বুঝতে পারে। শাসনকর্তা যদি তোমার উপর রেগে ওঠেন তবুও তুমি তোমার পদ ত্যাগ কোরো না; শান্তভাব থাকলে বড় বড় অন্যায়ও মাফ করা যায়। সূর্যের নীচে আমি একটা ব্যাপার দেখেছি যা ঠিক নয়: শাসনকর্তারা এই রকমের ভুল করে থাকে- বুদ্ধিহীনেরা নিযুক্ত হয় বড় বড় পদে, আর ধনীরা নিযুক্ত হয় নীচু পদে। আমি গোলামদের ঘোড়ার পিঠে আর উঁচু পদের কর্মচারীদের গোলামের মত পায়ে হেঁটে চলতে দেখেছি। যে গর্ত খোঁড়ে সে তার মধ্যে পড়তে পারে; যে দেয়াল ভাংগে তাকে সাপে কামড়াতে পারে। যে পাথর কাটে সে তার দ্বারাই আঘাত পেতে পারে; যে কাঠ কাটে সে তার দ্বারাই বিপদে পড়তে পারে। কুড়াল যদি ভোঁতা হয় আর তাতে ধার দেওয়া না হয়, তবে তা ব্যবহার করতে বেশী শক্তি লাগে, কিন্তু জ্ঞান ব্যবহার করে মানুষ সফল হয়। সাপকে মুগ্ধ করার আগেই যদি সে কামড় দেয় তবে সাপুড়ের কোন লাভ হয় না। জ্ঞানী লোকের মুখের কথায় থাকে দয়া, কিন্তু বোকা তার মুখের কথা দিয়ে নিজেকে ধ্বংস করে। তার কথার শুরুতে থাকে নির্বুদ্ধিতা, শেষে থাকে পুরোপুরি বিচারবুদ্ধিহীনতা। বুদ্ধিহীনেরা অনেক কথা বলে, কিন্তু কি হবে তা কেউ জানে না, আর ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা মানুষকে কে বলে দিতে পারে? বোকার পরিশ্রম তাকে ক্লান্ত করে; সে এত বোকা যে, শহরে যাবার রাস্তাও সে জানে না। ঘৃণ্য সেই দেশ, যেখানে বালক রাজপদ পায় আর সেখানকার মন্ত্রীরা সকাল বেলাতেই মেজবানী খায়। ধন্য সেই দেশ, যার বাদশাহ্‌ উঁচু বংশের লোক, আর সেখানকার মন্ত্রীরা মাত্‌লামির জন্য নয় কিন্তু শক্তির জন্য উপযুক্ত সময়ে খাওয়া-দাওয়া করে। অলস লোকের ঘরের ছাদ ধ্বসে যায়; অলসতার জন্য ঘরে পানি পড়ে। হাসিখুশীর জন্যই মেজবানীর ব্যবস্থা করা হয়; আংগুর-রস জীবনে আনন্দ আনে; টাকা-পয়সা সব কিছু যোগায়। বাদশাহ্‌কে মনে মনে বদদোয়া দিয়ো না কিংবা নিজের শোবার ঘরে ধনীকে বদদোয়া দিয়ো না, কারণ আকাশের পাখীও তোমার কথা বয়ে নিয়ে যেতে পারে; সে উড়ে গিয়ে তোমার কথাগুলো বলে দিতে পারে। তুমি তোমার টাকা খাটাও, কারণ অনেক দিন পরে তা আবার ফিরে পাবে। তোমার ধন নানাভাবে খাটাও, কারণ দুনিয়াতে কি বিপদ আসবে তা তো তুমি জান না। মেঘ যদি পানিতে ভরা থাকে তবে তা থেকে দুনিয়াতে বৃষ্টি পড়ে। গাছ দক্ষিণে কি উত্তরে পড়ুক, যেখানে পড়বে সেখানেই পড়ে থাকবে। যে লোক উপযুক্ত বাতাসের জন্য অপেক্ষা করে তার বীজ বোনা হয় না; যে লোক উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে তার ফসল কাটা হয় না। কেমন করে মায়ের গর্ভের শিশুর মধ্যে রূহ্‌ প্রবেশ করে তা যেমন তুমি জান না, তেমনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র কাজও তুমি বুঝতে পার না। তোমার বীজ সকালে বোনো, বিকালেও তোমার হাতকে সেই কাজ করতে দিয়ো, কারণ কোন্‌ সময়ের কাজ সফল হবে নাকি দু’টাই সমানভাবে ভাল হবে, তা তো তুমি জান না। আলো সুন্দর, আর সূর্য দেখতে পাওয়া ভাল। একজন লোক যদি অনেক বছর বেঁচে থাকে তবে সে যেন সেই দিনগুলোতে আনন্দ ভোগ করে। কিন্তু অন্ধকারের দিনগুলোর কথাও যেন সে মনে রাখে, কারণ সেগুলো হবে অনেক। যা কিছু ঘটবে তা সবই অস্থায়ী। হে যুবক, তোমার যৌবনকালে তুমি সুখী হও, যুবা বয়সের দিনগুলোতে তোমার দিল তোমাকে আনন্দিত করুক। তোমার দিলের ইচ্ছামত পথে চল আর তোমার চোখে যা ভাল লাগে তা-ই কর, কিন্তু জেনে রেখো, এই সব কাজের জন্য আল্লাহ্‌ তোমার বিচার করবেন। কাজেই তোমার দিল থেকে বিরক্তি দূর করে দাও, আর তোমার শরীরকে কষ্ট পেতে দিয়ো না, কারণ যৌবন ও শক্তি স্থায়ী নয়। তোমার যৌবনকালেই তোমার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ কর, কারণ বৃদ্ধ বয়সের দিনগুলো আসছে, অর্থাৎ দুঃখের দিনগুলো আসছে যখন তুমি বলবে, “আমার এই বৃদ্ধকালে আমার কোন আনন্দ নেই।” সেই সময় সূর্য, আলো, চাঁদ আর তারাগুলো অন্ধকার হয়ে যাবে, আর বৃষ্টির পরে মেঘ আবার ফিরে আসবে। সেই সময় ঘরের রক্ষাকারীরা কাঁপবে, আর শক্তিশালী লোকেরা কুঁজা হয়ে যাবে; যারা গম পেষে তারা লোক অল্প বলে কাজ ছেড়ে দেবে, আর জানালা দিয়ে যারা দেখত তারা আর ভালভাবে দেখতে পাবে না। সেই সময় রাস্তার দিকের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে; এতে গম পেষার আওয়াজ মিলিয়ে যাবে, পাখীর শব্দে বুড়ো লোক জেগে উঠবে, আর গান-বাজনার আওয়াজ কমে যাবে। সেই সময় উঁচু জায়গায় আর রাস্তায় যেতে সে ভয় পাবে। তখন বাদাম গাছে ফুল ধরবে, ফড়িং টেনে টেনে হাঁটবে এবং কামনা-বাসনা আর উত্তেজিত হবে না। তারপর সে চলে যাবে তার অনন্তকালের বাড়ীতে, আর বিলাপকারীরা পথে পথে ঘুরবে। রূপার তার ছিঁড়ে যাওয়ার আগে, কিংবা সোনার পাত্র ভেংগে যাওয়ার আগে, ঝর্ণার কাছে কলসী চুরমার করার আগে, কিংবা কূয়ার পানি তোলার চাকা ভেংগে যাওয়ার আগে তোমার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ কর। মাটি মাটিতেই ফিরে যাবে, আর যে রূহ্‌ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন সেই রূহ্‌ তাঁর কাছেই ফিরে যাবে। হেদায়েতকারী বলছেন, “অসার, অসার, সব কিছুই অসার!” হেদায়েতকারী নিজে জ্ঞানী ছিলেন এবং তিনি লোকদেরও জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি চিন্তা করে ও পরীক্ষা করে অনেক চলতি কথা সাজিয়েছেন। তিনি উপযুক্ত শব্দের খোঁজ করেছেন, আর তিনি যা লিখেছেন তা খাঁটি ও সত্যি কথা। জ্ঞানী লোকদের কথা রাখালের খোঁচানো লাঠির মত। তাঁদের কথাগুলো একত্র করলে মনে হয় যেন সেগুলো সব শক্ত করে গাঁথা পেরেক। সেই সব একজন রাখালের দেওয়া কথা। ছেলে আমার, এই কথার সংগে কিছু যোগ দেওয়া হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে সতর্ক থেকো। বই লেখার শেষ নেই আর অনেক পড়াশোনায় শরীর ক্লান্ত হয়। এখন সব কিছু তো শোনা হল; তবে শেষ কথা এই যে, আল্লাহ্‌কে ভয় করবার ও তাঁর সব হুকুম পালন করবার মধ্য দিয়ে মানুষের সমস্ত কর্তব্য পালন করা হয়। আল্লাহ্‌ প্রত্যেকটি কাজের, এমন কি, প্রত্যেকটি গোপন ব্যাপারের বিচার করবেন্ত তা ভাল হোক বা খারাপ হোক। এটা সবচেয়ে সুন্দর গজল। এই গজল সোলায়মানের। তুমি চুম্বনে চুম্বনে আমাকে ভরে দাও, কারণ তোমার ভালবাসা আংগুর-রসের চেয়েও ভাল। তোমার তেলের সুগন্ধ আনন্দ দান করে; ঢেলে দেওয়া খোশবুর মতই তোমার নাম। তাই তো মেয়েরা তোমাকে ভালবাসে। আমি বাদশাহ্‌কে বললাম, “তুমি আমাকে তোমার সংগে নাও; চল, আমরা তাড়াতাড়ি যাই।” তিনি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। আমরা আপনাকে নিয়ে আনন্দ করব ও খুশী হব; আংগুর-রসের চেয়েও আপনার ভালবাসার বেশী প্রশংসা করব। তারা যে তোমাকে ভালবাসে তা ঠিকই করে। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি কায়দারের তাম্বুর মত কালো কিন্তু সোলায়মানের তাম্বুর পর্দার মত সুন্দরী। আমি কালো বলে আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থেকো না, কারণ সূর্য আমার রং কালো করেছে। আমার ভাইয়েরা আমার উপর রাগ করে আংগুর ক্ষেতের দেখাশোনার ভার আমাকে দিয়েছে, সেইজন্য আমার নিজের আংগুর ক্ষেতের দেখাশোনা আমি করি নি। হে আমার প্রিয়তম, তুমি আমাকে বল, কোথায় তোমার ভেড়ার পাল তুমি চরাও? তোমার ভেড়াগুলোকে দুপুরে কোথায় বিশ্রাম করাও? তোমার সংগী রাখালদের ভেড়ার পালের কাছে কেন আমি ঘোমটা দেওয়া বেশ্যার মত যাব? হে সেরা সুন্দরী, তুমি যদি তা না জান তবে ভেড়ার পালের পায়ের চিহ্ন ধরে এসে রাখালদের তাম্বুগুলোর কাছে তোমার সব ছাগলের বাচ্চা চরাও। হে আমার প্রিয়তমা, ফেরাউনের রথের এক স্ত্রী-ঘোড়ার সংগে আমি তোমার তুলনা করেছি। তোমার গালের দু’পাশ দিয়ে কানের দুল ঝুলছে, তাতে তোমার গাল সুন্দর দেখাচ্ছে আর গলার হার তোমার গলায় সুন্দর মানাচ্ছে। আমরা তোমার জন্য সোনার কারুকাজ করা রূপার কানের দুল তৈরী করব। বাদশাহ্‌ যখন তাঁর বিছানায় ছিলেন তখন আমার সুগন্ধি সুগন্ধ ছড়াতে লাগল। আমার প্রিয় আমার কাছে যেন গন্ধরস রাখার ছোট থলি যা আমার বুকের মাঝখানে থাকে। আমার প্রিয় আমার কাছে যেন এক গোছা মেহেদী ফুল যা ঐন্‌-গদীর আংগুর ক্ষেতে জন্মায়। প্রিয়া আমার, কি সুন্দরী তুমি! হ্যাঁ, তুমি সুন্দরী। তোমার চোখ দু’টা ঘুঘুর মত। প্রিয় আমার, কি সুন্দর তুমি! হ্যাঁ, তুমি খুবই সুন্দর। আমাদের বিছানা পাতা-ভরা ডাল দিয়ে তৈরী। এরস গাছ আমাদের ঘরের কড়িকাঠ, আর বেরস গাছ আমাদের ঘরের ছাদের বীম। আমি যেন শারোণের একটা গোলাপ, উপত্যকার লিলি ফুল। কাঁটাবনের মধ্যে যেমন লিলি ফুল, মেয়েদের মধ্যে তেমনি আমার প্রিয়া। বনের গাছপালার মধ্যে যেমন আপেল গাছ, তেমনি যুবকদের মধ্যে আমার প্রিয়। আমি তাঁর ছায়াতে বসে আনন্দ পাই, আমার মুখে তাঁর ফল মিষ্টি লাগে। তিনি আমাকে মেজবানীর ঘরে নিয়ে গেলেন, আর নিশান টাংগাবার মত করে আমার প্রতি তাঁর ভালবাসা ঘোষণা করলেন। কিশ্‌মিশ খাইয়ে আমাকে শক্তিশালী কর আর আপেল খাইয়ে আমাকে তাজা করে তোলো, কারণ ভালবাসায় আমি দুর্বল হয়ে গেছি। আমার মাথার নীচে আছে তাঁর বাঁ হাত, আর ডান হাত আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি কৃষ্ণসার ও মাঠের হরিণীদের নামে অনুরোধ করে বলছি, তোমরা ভালবাসাকে জাগায়ো না বা উত্তেজিত কোরো না যতক্ষণ না তার উপযুক্ত সময় হয়। ঐ শোন, আমার প্রিয়ের শব্দ, ঐ দেখ, তিনি আসছেন; তিনি পাহাড়-পর্বতের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছেন। আমার প্রিয় যেন কৃষ্ণসার কিংবা হরিণের বাচ্চা। ঐ দেখ, তিনি আমাদের দেয়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, জাফ্‌রির মধ্য দিয়ে উঁকি মারছেন। আমার প্রিয় আমাকে বললেন, “প্রিয়া আমার, ওঠো; সুন্দরী আমার, আমার সংগে এস। দেখ, শীতকাল চলে গেছে; বর্ষা শেষ হয়েছে, চলেও গেছে। মাঠে মাঠে ফুল ফুটেছে, এসেছে গানের মৌসুম; আমাদের দেশে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। ডুমুর গাছে ফল ধরতে শুরু হয়েছে; আংগুর লতায় ফুল ধরে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রিয়া আমার, ওঠো, এস; সুন্দরী আমার, এস আমার সংগে।” ঘুঘু আমার, তুমি পাহাড়ের ফাটলে, পাহাড়ের গায়ের লুকানো জায়গায় রয়েছ; আমাকে তোমার মুখ দেখাও, তোমার গলার আওয়াজ শুনতে দাও, কারণ তোমার স্বর মিষ্টি আর মুখের চেহারা সুন্দর। তোমরা সেই শিয়ালগুলোকে, সেই ছোট ছোট শিয়ালগুলোকে ধর, কারণ তারা আমাদের আংগুর ক্ষেতগুলো নষ্ট করে; আমাদের আংগুর ক্ষেতে ফুলের কুঁড়ি ধরেছে। আমার প্রিয় আমারই আর আমি তাঁরই; তিনি লিলি ফুলের বনে চরেন। হে আমার প্রিয়, তুমি ফিরে এসো; যতক্ষণ না ভোর হয় আর অন্ধকার চলে যায় ততক্ষণ তুমি থাক। খাড়া পাহাড়ের উপরে তুমি কৃষ্ণসার কিংবা বাচ্চা হরিণের মত হও। রাতের বেলায় আমার বিছানায় আমার প্রাণের প্রিয়তমকে আমি খুঁজছিলাম; আমি তাঁকে খুঁজছিলাম, কিন্তু পেলাম না। আমি ভাবলাম, আমি এখন উঠে শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াব, ঘুরে বেড়াব রাস্তায় রাস্তায়, চকে চকে; সেখানে আমি আমার প্রাণের প্রিয়তমকে খুঁজব; আমি তাঁর খোঁজ করছিলাম কিন্তু তাঁকে পেলাম না। পাহারাদারেরা শহরে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবার সময় আমাকে দেখতে পেল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কি আমার প্রাণের প্রিয়তমকে দেখেছ?” তাদের পার হয়ে এগিয়ে যেতেই আমি আমার প্রাণের প্রিয়তমের দেখা পেলাম। তাঁকে ধরে আমার মায়ের ঘরে না আনা পর্যন্ত আমি তাঁকে ছাড়লাম না; যিনি আমাকে গর্ভে ধরেছিলেন আমি তাঁরই ঘরে তাঁকে আনলাম। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি কৃষ্ণসার ও মাঠের হরিণীদের নামে অনুরোধ করে বলছি, তোমরা ভালবাসাকে জাগায়ো না বা উত্তেজিত কোরো না যতক্ষণ না তার উপযুক্ত সময় হয়। মরুভূমি থেকে ধোঁয়ার থামের মত যে আসছে সে কে? সেই ধোঁয়ার থামে রয়েছে বণিকের সব রকম মসলার, গন্ধরসের ও খোশবু ধূপের সুগন্ধ। দেখ, ওটা সোলায়মানের পালকী! ষাটজন বীর যোদ্ধা রয়েছেন সেই পালকীর চারপাশে; তাঁরা ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী বীর। তাঁদের সবার সংগে আছে তলোয়ার, যুদ্ধে তাঁরা সবাই পাকা; তলোয়ার কোমরে বেঁধে নিয়ে তাঁরা প্রত্যেকে প্রস্তুত রয়েছেন রাতের বিপদের জন্য। বাদশাহ্‌ সোলায়মান এই পালকী তৈরী করেছেন নিজের জন্য, তৈরী করেছেন লেবাননের কাঠ দিয়ে। সেই পালকীর খুঁটি রূপা দিয়ে তৈরী, তলাটা তৈরী সোনার, আসনটা তার বেগুনে রংয়ের; জেরুজালেমের মেয়েরা ভালবেসে তার ভিতরের অংশে কারুকাজ করে দিয়েছে। হে সিয়োনের মেয়েরা, তোমরা বের হয়ে এস, দেখ, বাদশাহ্‌ সোলায়মান তাজ পরে আছেন; তাঁর বিয়ের দিনে, তাঁর মনের আনন্দের দিনে, তাঁর মা তাঁকে তাজ পরিয়ে দিয়েছেন। প্রিয়া আমার, কি সুন্দরী তুমি! হ্যাঁ, তুমি সুন্দরী। ঘোমটার মধ্যে তোমার চোখ দু’টা ঘুঘুর মত। তোমার চুল যেন গিলিয়দ পাহাড় থেকে নেমে আসা ছাগলের পাল। তোমার দাঁতগুলো এমন ভেড়ীর পালের মত যারা এইমাত্র লোম ছাটাই হয়ে গোসল করে এসেছে। তাদের প্রত্যেকটারই জোড়া আছে, কোনটাই হারিয়ে যায় নি! তোমার ঠোঁট দু’টা লাল রংয়ের সুতার মত লাল; কি সুন্দর তোমার মুখ! ঘোমটার মধ্যে তোমার কপালের দু’পাশ যেন আধখানা করা ডালিম। তোমার গলা যেন দাউদের উঁচু পাহারা-ঘরের মত লম্বা; তাতে ঝুলানো রয়েছে এক হাজার ঢাল, তার সবগুলোই যোদ্ধাদের। তোমার বুক দু’টা যেন লিলি ফুলের বনে চরে বেড়ানো কৃষ্ণসারের যমজ বাচ্চা। যতক্ষণ না ভোর হয় আর অন্ধকার চলে যায় ততক্ষণ আমি গন্ধরসের পাহাড়ে, হ্যাঁ, ধূপের পাহাড়ে থাকব। প্রিয়া আমার, তোমার শরীরের সব কিছুই সুন্দর, তোমার মধ্যে কোন খুঁত নেই। বিয়ের কনে আমার, লেবানন থেকে আমার সংগে এস, আমারই সংগে লেবানন থেকে এস। অমানার চূড়া থেকে, শনীর ও হর্মোণ পাহাড়ের উপর থেকে, সিংহের গর্ত থেকে, চিতাবাঘের পাহাড়ী বাসস্থান থেকে তুমি নেমে এস। প্রিয়া আমার, কনে আমার, তুমি আমার মন চুরি করেছ; তোমার এক পলকের চাহনি দিয়ে, তোমার গলার হারের একটা মণি দিয়ে তুমি আমার মন চুরি করে নিয়েছ। প্রিয়া আমার, কনে আমার, তোমার ভালবাসা কত আনন্দ দেয়! আংগুর-রসের চেয়ে তোমার ভালবাসা, আর সমস্ত মসলার চেয়ে তোমার খোশবুর সুন্দর গন্ধ আরও কত না বেশী ভাল! কনে আমার, তোমার ঠোঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু ঝরে। তোমার জিভের তলায় আছে দুধ আর মধু; তোমার কাপড়ের গন্ধ লেবাননের বনের গন্ধের মত। প্রিয়া আমার, কনে আমার, তুমি যেন দেয়াল-ঘেরা একটা বাগান; তুমি যেন আট্‌কে রাখা ঝর্ণা, বন্ধ করে রাখা ঝর্ণা। তুমি যেন সুন্দর একটা ডালিমের বাগান; সেখানে আছে ভাল ভাল ফল, মেহেদী আর খোশবু লতা। আছে জটামাংসী, জাফরান, বচ, দারচিনি আর সব রকম ধূপের গাছ; সেখানে আছে গন্ধরস, অগুরু আর সব চেয়ে ভাল নানা রকম খোশবু মসলা। তুমি যেন বাগানের ঝর্ণা, যেন উপ্‌চে পড়া পানির কূয়া, যেন লেবানন থেকে নেমে আসা স্রোত। উত্তুরে হাওয়া জাগো, এসো দখিনা বাতাস। আমার বাগানের উপর দিয়ে বয়ে যাও যাতে তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আমার প্রিয় যেন তাঁর বাগানে এসে তার ভাল ভাল ফল খান। প্রিয়া আমার, কনে আমার, আমি আমারই বাগানে এসেছি; আমার গন্ধরস ও খোশবু মসলা আমি জোগাড় করেছি। আমার মৌচাক ও মধু আমি খেয়েছি, খেয়েছি আংগুর-রস ও দুধ। ভোগ কর, হে বন্ধুরা, ভোগ কর, ভালবাসা পরিপূর্ণভাবে ভোগ কর। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, কিন্তু আমার দিল জেগে ছিল। ঐ শোন, আমার প্রিয় দরজায় আঘাত দিয়ে বলছেন, “কনে আমার, প্রিয়া আমার, আমার ঘুঘু, আমার নিখুঁত সেই জন, আমাকে দরজা খুলে দাও। শিশিরে আমার মাথা ভিজে গেছে, রাতের কুয়াশায় ভিজেছে আমার চুল।” আমি মনে মনে বললাম, “আমার পোশাক আমি খুলে ফেলেছি, কেমন করে আবার তা পরব? আমি আমার পা ধুয়েছি, কেমন করে তা আবার নোংরা করব?” দরজার ফুটো দিয়ে আমার প্রিয় তাঁর হাত ঢুকালেন, আমার মন তাঁর জন্য ব্যাকুল হল। আমার প্রিয়কে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য আমি উঠলাম, আমার হাত গন্ধরসে ভেজা ছিল, আমার আংগুল থেকে গন্ধরসের স্রোতে দরজার হাতল ভিজে গেল। আমার প্রিয়ের জন্য আমি দরজা খুললাম, কিন্তু আমার প্রিয় ছিলেন না, চলে গিয়েছিলেন। তিনি যখন কথা বলেছিলেন তখন দুঃখে আমার মন গলে গিয়েছিল। আমি তাঁর খোঁজ করলাম, কিন্তু পেলাম না; আমি তাঁকে ডাকলাম, কিন্তু তিনি সাড়া দিলেন না। পাহারাদারেরা শহরে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবার সময় আমাকে দেখতে পেল; তারা আমাকে মারল, তাতে কালশিরা পড়ে গেল; শহর-দেয়ালের পাহারাদারেরা আমার গায়ের চাদর কেড়ে নিল। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, যদি তোমরা আমার প্রিয়ের দেখা পাও তবে তাঁকে বোলো যে, আমি ভালবাসায় দুর্বল হয়েছি। ওহে সেরা সুন্দরী, অন্যদের চেয়ে তোমার প্রিয় কিসে ভাল? তোমার প্রিয় অন্যদের চেয়ে কিসে ভাল যে, তুমি এইভাবে আমাদের অনুরোধ করছ? আমার প্রিয়ের চেহারা উজ্জ্বল, লাল্‌চে তাঁর গায়ের রং; দশ হাজার জনের মধ্যে তিনি বিশেষ একজন। তাঁর মাথা খাঁটি সোনার মত, তাঁর চুল ঢেউ খেলানো আর দাঁড়কাকের মত কালো; তাঁর চোখ স্রোতের ধারে থাকা এক জোড়া ঘুঘুর মত, যা দুধে ধোয়া, রত্নের মত বসানো। তাঁর গাল দু’টা যেন খোশবু মসলার বীজতলা, যেখান থেকে সুগন্ধ বের হচ্ছে। তাঁর ঠোঁট দু’টা যেন গন্ধরস ঝরা লিলি ফুল। তাঁর হাত দু’টা যেন বৈদূর্যমণি বসানো সোনার লাঠি, আর শরীরটা নীলকান্তমণিতে সাজানো, পালিশ করা হাতির দাঁতের মত। তাঁর রান দু’টা যেন খাঁটি সোনার ভিত্তির উপর বসানো মার্বেল পাথরের থাম। তাঁর ধরন লেবাননের উঁচু পাহাড়ের মত, লেবাননের বাছাই করা এরস গাছের মত জাঁকালো। তাঁর মুখখানা খুব মিষ্টি, তাঁর সবই সুন্দর। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, উনিই আমার প্রিয়, আমার বন্ধু। হে সেরা সুন্দরী, তোমার প্রিয় কোথায় গেছেন? তিনি কোন্‌ দিকের পথ ধরেছেন? বল, যাতে আমরা তোমার সংগে তাঁর খোঁজ করতে পারি। আমার প্রিয় গেছেন তাঁর বাগানে খোশবু মসলার বীজতলায়; গেছেন খেয়ে বেড়াবার জন্য আর লিলি ফুল তুলবার জন্য। আমি আমার প্রিয়েরই এবং তিনি আমারই, তিনি লিলি ফুলের বনে চরেন। প্রিয়া আমার, তুমি তির্সা শহরের মত সুন্দরী, জেরুজালেমের মত চমৎকার; নিশান উড়ানো সৈন্যদলের মত তোমার জাঁকজমক। আমার দিক থেকে তোমার চোখ ফিরিয়ে নাও; ও দু’টা আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। তোমার চুল যেন গিলিয়দ পাহাড় থেকে নেমে আসা ছাগলের পাল। তোমার দাঁতগুলো যেন গোসল করে আসা ভেড়ীর পাল; তাদের প্রত্যেকটারই জোড়া আছে, কোনটাই হারিয়ে যায় নি। ঘোমটার মধ্যে তোমার কপালের দু’পাশ যেন আধখানা করা ডালিম। ষাটজন রাণী, আশিজন উপস্ত্রী আর অসংখ্য মেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আমার ঘুঘু, আমার নিখুঁত জনের মত আর কেউ নেই। সে তার মায়ের একমাত্র মেয়ে, যিনি তাকে গর্ভে ধরেছিলেন তাঁর আদরের মেয়ে। মেয়েরা তাকে দেখে বলল, ধন্যা আর রাণীরা ও উপস্ত্রীরা তার প্রশংসা করলেন। তাঁরা বললেন, “কে সে, যে ভোরের মত দেখা দেয়, চাঁদের মত সুন্দরী, সূর্যের মত উজ্জ্বল, আর নিশান উড়ানো সৈন্যদলের মত যার জাঁকজমক?” উপত্যকার নতুন চারাগুলো দেখতে, আংগুর লতায় কুঁড়ি ধরেছে কি না দেখতে, আর ডালিম গাছে ফুল ফুটেছে কি না দেখতে আমি নেমে বাদাম গাছের বনে গেলাম। আমি কিছু বুঝবার আগেই আমার বাসনা আমাকে আমার জাতির বাদশাহ্‌র রথগুলোর একটার মধ্যে বসিয়ে দিল। হে শূলম্মীয়া, ফিরে এস, ফিরে এস; আমরা যেন তোমাকে দেখতে পাই সেইজন্য ফিরে এস, ফিরে এস। তোমরা মহনয়িমের নাচ দেখার মত করে কেন শূলম্মীয়াকে দেখতে চাইছ? হে রাজকন্যা, জুতার মধ্যে তোমার পা দু’খানা দেখতে কেমন সুন্দর! তোমার দুু’টি উরুর গড়ন মণি-মাণিকের মত, তা যেন পাকা কারিগরের হাতের কাজ। তোমার নাভি দেখতে গোল পাত্রের মত যার মধ্যে মেশানো আংগুর-রসের অভাব হয় না। তোমার পেট দেখতে উড়ানো গমের স্তূপের মত যার চারপাশ লিলি ফুল দিয়ে ঘেরা। তোমার বুক দু’টা যেন হরিণের দু’টা বাচ্চা, কৃষ্ণসারের যমজ বাচ্চা। হাতির দাঁতের উঁচু পাহারা-ঘরের মত তোমার গলা, তোমার চোখ দু’টি বৎ-রব্বীমের দরজার কাছে হিষ্‌বোনের পুকুরগুলোর মত। তোমার নাক যেন দামেস্কের দিকে মুখ করা লেবাননের উঁচু পাহারা-ঘর। তোমার শরীরের উপর তোমার মাথা কর্মিল পাহাড়ের মত; চক্‌চকে মোলায়েম কাপড়ের মতই তোমার চুল; সেই চুলের গোছায় বাদশাহ্‌ বন্দী হয়ে আছেন। হে আমার প্রিয়া, আমার আনন্দ দানকারিনী, তুমি কি সুন্দর, কি চমৎকার! তোমার গড়ন খেজুর গাছের মত, আর বুক দু’টা যেন আংগুরের দু’টা থোকা। আমি বললাম, “আমি খেজুর গাছে উঠব, আমি তার ফল ধরব।” তোমার বুক দু’টা হোক আংগুরের থোকা, তোমার নিঃশ্বাসের গন্ধ হোক আপেলের মত, আর তোমার মুখ হোক সবচেয়ে ভাল আংগুর-রস। সেই আংগুর-রস সোজা আমার প্রিয়ের গলায় নেমে যাক, যেমন ঘুমিয়ে থাকা লোকদের ঠোঁটের মধ্য দিয়ে আংগুর-রস সহজে চলে যায়। আমি আমার প্রিয়ের, তাঁর কামনা-বাসনা আমারই জন্য। প্রিয় আমার, চল, আমরা মাঠে যাই, মেহেদী ঝোপের মধ্যে গিয়ে রাত কাটাই। চল, আমরা ভোর বেলাতেই আংগুর ক্ষেতে যাই, দেখি, আংগুর লতায় কুঁড়ি ধরেছে কি না, তাতে ফুল ধরেছে কি না আর ডালিমের ফুল ফুটেছে কি না; আমি সেখানেই তোমাকে আমার ভালবাসা দান করব। দূদাফল তার সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে; তাজা ও পাকা সব রকম ভাল ভাল ফল আমাদের দরজার কাছেই আছে। প্রিয় আমার, আমি তোমার জন্যই এই সব রেখেছি। আহা, যদি তুমি আমার ভাইয়ের মত হতে যে আমার মায়ের দুধ খেয়েছে! তাহলে আমি তোমাকে বাইরে পেলেও চুম্বন করতে পারতাম, কেউ আমাকে কিছু বলতে পারত না; তাহলে আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে আমার মায়ের ঘরে নিয়ে আসতাম, আর তুমি আমাকে শিক্ষা দিতে। আমি তোমাকে খোশবু মসলা-দেওয়া আংগুর-রস খেতে দিতাম, খেতে দিতাম আমার ডালিমের মিষ্টি রস। আমার মাথার নীচে আছে তাঁর বাঁ হাত, আর ডান হাত আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। হে জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি তোমাদের অনুরোধ করে বলছি, তোমরা ভালবাসাকে জাগায়ো না বা উত্তেজিত কোরো না যতক্ষণ না তার উপযুক্ত সময় হয়। তার প্রিয়ের উপর ভর দিয়ে মরুভূমি থেকে যে আসছে সে কে? আপেল গাছের নীচে আমি তোমাকে জাগালাম; তোমার মা ওখানেই প্রসব-যন্ত্রণা ভোগ করে তোমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। সীলমোহরের মত করে তুমি আমাকে তোমার দিলে আর তোমার হাতে রাখ; কারণ ভালবাসা মৃত্যুর মত শক্তিশালী, পাওনা ভালবাসার আগ্রহ কবরের মতই হার মানে না। তা জ্বলন্ত আগুনের মতই জ্বলতে থাকে, জ্বলতে থাকে জোরালো শিখার মত। বন্যার পানিও ভালবাসাকে নিভাতে পারে না; সব নদীও পারে না তা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। ভালবাসার জন্য যদি কেউ তার সব কিছু দিয়েও দেয় তবে তা হবে খুবই তুচ্ছ। আমাদের একটা ছোট বোন আছে, তার বুক দু’টা এখনও বড় হয় নি। সেদিন আমরা কি করব যেদিন তার বিয়ের কথাবার্তা হবে? সে যদি দেয়াল হত তবে আমরা তার উপরে রূপা দিয়ে উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করতাম। যদি সে দরজা হত তবে এরস কাঠের পাল্লা দিয়ে আমরা তাকে বন্ধ করে রাখতাম। আমি তো একটা দেয়াল, আর আমার বুক দু’টা উঁচু পাহারা-ঘরের মত। আমি তাঁর চোখে তেমনই হলাম যা তৃপ্তি আনতে পারে। বাল-হামোনে সোলায়মানের একটা আংগুর ক্ষেত আছে; তিনি সেটা দেখাশোনাকারীদের হাতে দিয়েছেন। তার ফলের দাম হিসাবে প্রত্যেককে বারো কেজি রূপা দিতে হয়। আমার নিজের আংগুর ক্ষেত আছে, যা কেবল আমিই দিতে পারি। হে সোলায়মান, সেই বারো কেজি রূপা তোমারই থাকুক, কিন্তু আড়াই কেজি থাকুক তাদের জন্য যারা ফলের দেখাশোনা করেছে। তুমি তো বাগানে বাগানে থাক; তোমার বন্ধুরা তোমার গলার আওয়াজ শোনে, আমাকেও তা শুনতে দাও। প্রিয় আমার, চলে এস; খোশবু মসলা-ভরা পাহাড়ের উপরে তুমি হও কৃষ্ণসারের মত কিংবা হরিণের বাচ্চার মত। এহুদা দেশের বাদশাহ্‌ উষিয়, যোথম, আহস ও হিষ্কিয়ের রাজত্বের সময়ে আমোজের ছেলে ইশাইয়া এহুদা ও জেরুজালেমের বিষয়ে যে দর্শন পেয়েছিলেন সেই সম্বন্ধে এখানে লেখা আছে। হে আসমান শোন, হে দুনিয়া শোন, মাবুদ বলছেন, “আমি ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছি ও তাদের বড় করে তুলেছি, কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। গরু তার মালিককে চেনে, গাধাও তার মালিকের যাবপাত্র চেনে; কিন্তু ইসরাইল তার মালিককে চেনে না, আমার বান্দারা আমাকে বোঝে না।” হায়! তারা একটা গুনাহে পূর্ণ জাতি, দোষের ভারে বোঝাই লোক, অন্যায়কারীদের বংশ, কুকাজ করা সন্তান। তারা মাবুদকে ত্যাগ করেছে এবং ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাককে অগ্রাহ্য করেছে আর তাঁর দিকে পিছন ফিরিয়েছে। তোমরা আর কেন মার খাবে? কেন বিদ্রোহ করতেই থাকবে? তোমাদের গোটা মাথাতেই আঘাত লেগেছে, গোটা দিলটাই অসুস্থ হয়েছে। পায়ের তলা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত কোথাও ভাল অবস্থা নেই, আছে কেবল আঘাত, মারের দাগ আর কাঁচা ঘা। তা পরিষ্কার করা বা বেঁধে দেওয়া হয় নি, তেল দিয়ে যন্ত্রণা কমানোও হয় নি। তোমাদের দেশটা ধ্বংস হয়ে পড়ে রয়েছে, শহরগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমাদের সব ক্ষেতের ফসল তোমাদের চোখের সামনেই বিদেশীরা লুট করেছে; বিদেশীরা দেশটা ধ্বংসস্থান করে রেখেছে। সিয়োন্তকন্যাকে এমনভাবে ফেলে রাখা হয়েছে যেন সে আংগুর ক্ষেতের পাহারা-ঘর, যেন শসা ক্ষেতের কুঁড়ে-ঘর, যেন শত্রু দ্বারা ঘেরাও করা একটা শহর। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমাদের জন্য যদি কয়েকজনকে জীবিত না রাখতেন তবে আমাদের অবস্থা সাদুম ও আমুরা শহরের মত হত। হে সাদুমের শাসনকর্তারা, মাবুদের কালাম শোন। হে আমুরার লোকেরা, আমাদের আল্লাহ্‌র নির্দেশে কান দাও। মাবুদ বলছেন, “তোমাদের কোন পশু-কোরবানী আমার দরকার নেই। ভেড়া ও মোটাসোটা পশুর চর্বি দিয়ে পোড়ানো-কোরবানী যেন আমার গলা পর্যন্ত উঠেছে; গরু, ভেড়ার বাচ্চা ও ছাগলের রক্তে আমি কোন আনন্দ পাই না। তোমরা যে আমার কাছে উপস্থিত হয়ে আমার সব উঠান পায়ে মাড়াও, এ তোমাদের কাছে কে চেয়েছে? অসার কোরবানীর জিনিস তোমরা আর এনো না। তোমাদের ধূপ জ্বালানো আমার ঘৃণা লাগে। অমাবস্যা, বিশ্রামবার এবং ধর্মীয় মাহ্‌ফিল- তোমাদের গুনাহের দরুন আমি এই সব সভা সহ্য করতে পারি না। আমি তোমাদের সব অমাবস্যার উৎসব ও নির্দিষ্ট মেজবানী-সভা ঘৃণা করি। এগুলো আমার কাছে বোঝার মত হয়েছে; এগুলোর ভার বয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মুনাজাতের জন্য যখন তোমরা হাত তুলবে তখন আমি তোমাদের দিক থেকে আমার চোখ ফিরিয়ে নেব। যদিও বা অনেক মুনাজাত কর আমি তা শুনব না, কারণ তোমাদের হাত রক্তে পূর্ণ। তোমরা নিজেদের খাঁটি কর, পাক-সাফ হও। আমার চোখের সামনে থেকে তোমাদের সব খারাপ কাজ দূর করে দাও; তা আর কোরো না। তোমরা ভাল কাজ করতে শেখো, ন্যায়বিচার কর, জুলুমবাজদের সংশোধন কর, এতিমদের পক্ষে থাক, বিধবাদের মামলার তদারকি কর।” মাবুদ আরও বলছেন, “এখন এস, আমরা বোঝাপড়া করি। যদিও তোমাদের সব গুনাহ্‌ টক্‌টকে লাল হয়েছে তবুও তা বরফের মত সাদা হবে; যদিও সেগুলো গাঢ় লাল রংয়ের হয়েছে তবুও তা ভেড়ার লোমের মত সাদা হবে। যদি তোমরা বাধ্য হতে রাজী হও তবে দেশের সবচেয়ে ভাল ফসল তোমরা খেতে পাবে, কিন্তু যদি তোমরা বাধ্য হতে রাজী না হয়ে বিদ্রোহ কর তবে তলোয়ার তোমাদের ধ্বংস করবে।” মাবুদ নিজেই এই কথা বলেছেন। হায়, সতী শহরটা কেমন বেশ্যার মত হয়ে গেছে! সে এক সময় ন্যায়বিচারে পূর্ণ ছিল; সততা তার মধ্যে বাস করত, কিন্তু এখন বাস করছে খুনীরা। তোমার রূপা খাদ হয়ে গেছে; তোমার ভাল আংগুর-রসে পানি মেশানো হয়েছে। তোমার শাসনকর্তারা বিদ্রোহী ও চোরদের সংগী; তারা সবাই ঘুষ খেতে ভালবাসে আর উপহার পেতে চায়। তারা এতিমদের পক্ষে থাকে না আর বিধবাদের মামলা তাদের কাছে স্থান পায় না। সেইজন্য দীন-দুনিয়ার মালিক, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, ইসরাইলের সেই শক্তিশালী মাবুদ বলছেন, “আহা, আমার বিপক্ষদের হাত থেকে আমি রেহাই পাব এবং আমার শত্রুদের উপর শোধ নেব। আমি তোমার বিরুদ্ধে আমার হাত তুলব। ধাতুর মত করে আমি ক্ষার দিয়ে তোমার খাদ বের করে ফেলব ও তোমার সব ভেজাল দূর করে দেব। আমি আগের দিনের মত তোমাকে শাসনকর্তা ও পরামর্শদাতাদের দেব; তারপর তোমাকে বলা হবে ন্যায়ের শহর, সতী শহর।” আল্লাহ্‌ তাঁর ন্যায়বিচার দিয়ে সিয়োনকে মুক্ত করবেন, আর যারা তওবা করবে তাদের মুক্ত করবেন তাঁর সততা দিয়ে। কিন্তু বিদ্রোহী ও গুনাহ্‌গার লোকেরা সবাই একসংগে ধ্বংস হবে, আর যারা মাবুদকে ত্যাগ করেছে তারা শেষ হয়ে যাবে। “জ্বী, তোমরা যে সব এলোন গাছ পূজা করতে তার জন্য তোমরা লজ্জা পাবে, আর যে সব বাগানে তোমরা পূজা করতে তার জন্য অসম্মানিত হবে। তোমরা হবে সেই এলোন গাছের মত যার পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে; তোমরা হবে সেই বাগানের মত যার মধ্যে পানি নেই। শক্তিশালী লোক শুকনা খড়কুটার মত হবে, আর তার কাজ হবে আগুনের ফুল্‌কির মত। সেই সব একসংগে পুড়ে যাবে; কেউ সেই আগুন নিভাতে পারবে না।” এহুদা ও জেরুজালেম সম্বন্ধে আমোজের ছেলে ইশাইয়া যা দেখেছিলেন তা এই: কেয়ামতের সময়ে সমস্ত পাহাড়ের মধ্যে সেই পাহাড়টাকেই সবচেয়ে উঁচুতে তোলা হবে যেখানে মাবুদের ঘর আছে। ছোট ছোট পাহাড়গুলোর চেয়ে তাকে উঁচুতে তোলা হবে, আর সব জাতি স্রোতের মত তার দিকে যাবে। অনেক জাতির লোক এসে বলবে, “চল, আমরা মাবুদের পাহাড়ে উঠে যাই, চল, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র ঘরে যাই। তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব।” তারা এই কথা বলবে, কারণ সিয়োন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে আর জেরুজালেম থেকে বের হবে মাবুদের কালাম। তিনি জাতিদের মধ্যে বিচার করে দেবেন; অনেক দেশের লোকদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করবেন। তারা তাদের তলোয়ার ভেংগে লাংগলের ফাল গড়বে আর বর্শা ভেংগে গড়বে ডাল ছাঁটবার ছুরি। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে আর তলোয়ার উঠাবে না; তারা আর যুদ্ধ করতে শিখবে না। হে ইয়াকুবের বংশধরেরা, এস; চল, আমরা মাবুদের নূরে চলাফেরা করি। হে আল্লাহ্‌, তুমি তো তোমার বান্দাদের, অর্থাৎ ইয়াকুবের বংশধরদের ত্যাগ করেছ। তারা পূর্ব দিকের দেশগুলোর কুসংস্কার দিয়ে পূর্ণ হয়েছে; তারা ফিলিস্তিনীদের মত মায়াবিদ্যার অভ্যাস করেছে এবং ভিন্ন জাতিদের সংগে হাতে হাত মিলিয়েছে। তাদের দেশ সোনা ও রূপায় ভরা, তাদের ধন-সম্পদের শেষ নেই। তাদের দেশ ঘোড়ায় পরিপূর্ণ আর তাদের রথও অসংখ্য। এছাড়া তাদের দেশ প্রতিমায় পূর্ণ হয়েছে। তাদের হাতে তৈরী জিনিসের কাছে তারা সেজদা করে, তারা যা আংগুল দিয়ে তৈরী করেছে তার কাছেই মাথা নোয়ায়। কাজেই লোকদের নত করা হবে এবং তাদের সবাইকে নীচু করা হবে। তাদের তুমি মাফ কোরো না। মাবুদের ভয়ংকরতা এবং তাঁর মহিমার উজ্জ্বলতার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তোমরা বড় বড় পাথরের ফাঁকে ঢুকে যাও, মাটির মধ্যে লুকাও। গর্বিত লোকের চাহনি নত করা হবে আর লোকদের অহংকার নীচে নামানো হবে। সেই দিন কেবল মাবুদকেই সম্মানিত করা হবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন অহংকারী আর গর্বিত লোকদের এবং যারা উঁচুতে আছে তাদের সকলের জন্য একটা দিন ঠিক করেছেন; সেই দিন তাদের সবাইকে নত করা হবে। লেবাননের সব লম্বা ও উঁচু এরস গাছ আর বাশনের সব এলোন গাছ নীচু করা হবে; এছাড়া সব বড় বড় পাহাড়-পর্বত, প্রত্যেকটা উঁচু পাহারা-ঘর, প্রত্যেকটা শক্ত দেয়াল, সমস্ত তর্শীশ-জাহাজ আর প্রত্যেকটা জাঁকজমকপূর্ণ জাহাজ নীচু করা হবে। মানুষের গর্বকে নীচে নামানো হবে আর লোকের অহংকারকে নীচু করা হবে। সেই দিন কেবল মাবুদকেই সম্মানিত করা হবে, আর প্রতিমাগুলো একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ যখন দুনিয়ার লোকদের ভয় দেখাবার জন্য আসবেন তখন তাঁর ভয়ংকরতার ও তাঁর মহিমার উজ্জ্বলতার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য লোকে সেই দিন পাহাড়ের গুহায় আর মাটির গর্তে পালাবে। সেই দিন লোকে তাদের পূজার জন্য তৈরী সোনা ও রূপার মূর্তিগুলো ছুঁচো ও বাদুড়ের কাছে ফেলে দেবে। মাবুদ যখন দুনিয়ার লোকদের ভয় দেখাবার জন্য আসবেন তখন তাঁর ভয়ংকরতার ও তাঁর মহিমার উজ্জ্বলতার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য লোকে বড় বড় পাথরের ফাঁকে ও পাহাড়ের ফাটলে পালিয়ে যাবে। তোমরা মানুষের উপর ভরসা করা ছেড়ে দাও। তার প্রাণ তো তার নাকের একটা নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়; তার কোনই দাম নেই। এখন দেখ, যে সব জিনিস ও লোকদের উপর লোকে ভরসা করে সেই সব জেরুজালেম ও এহুদা থেকে দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন দূর করে দিতে যাচ্ছেন। তিনি তাদের সব খাবার ও পানি দূর করে দেবেন। এছাড়া তিনি বীর ও যোদ্ধাদের, শাসনকর্তা ও নবীদের, গণক ও বৃদ্ধ নেতাদের, পঞ্চাশ সৈন্যের সেনাপতি ও সম্মানিত লোকদের, পরামর্শদাতা, চালাক জাদুকরদের ও মন্ত্র-পড়া সাপুড়েদের দূর করে দিতে যাচ্ছেন। তাদের উপরে তিনি অল্প বয়সী ছেলেদের কর্তা বানাবেন; অল্প বুদ্ধির যুবকেরা তাদের শাসনকর্তা হবে। মানুষ মানুষের উপর, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর উপর জুলুম করবে; ছোটরা বুড়োদের বিরুদ্ধে উঠবে, আর নীচু স্তরের লোকেরা সম্মানিত লোকদের বিরুদ্ধে উঠবে। লোকে নিজের বংশের একজনকে ধরে বলবে, “তোমার চাদর আছে, তুমি আমাদের শাসনকর্তা হও, এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশের ভার নাও।” কিন্তু সেই দিন সে আপত্তি করে বলবে, “দেশের ভাল করবার মত আমার কিছু নেই। আমার বাড়ীতে কোন খাবার বা কাপড় নেই; তোমরা আমাকে লোকদের শাসনকর্তা বানায়ো না।” জেরুজালেম উচোট খেয়েছে আর এহুদা পড়ে গেছে, কারণ তাদের কথা ও কাজ মাবুদের বিরুদ্ধে; তারা তাঁর সামনেই তাঁর মহিমাকে অগ্রাহ্য করে। তাদের মুখের চেহারাই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়; তারা সাদুমের মত তাদের গুনাহ্‌ প্রকাশ করে, ঢাকে না। হায়, সেই লোকেরা! তারা নিজেদের উপর ধ্বংস ডেকে এনেছে। তোমরা সৎ লোকদের বল যে, তাদের উন্নতি হবে, কারণ তারা তাদের কাজের সুফল ভোগ করবে। হায়, দুষ্টেরা! তাদের উপর বিপদ আসবে। তারা যা করেছে তার পাওনা তারা পাবে। যারা আমার বান্দাদের জুলুম করে তারা ছোট ছেলেদের মত, আর যারা তাদের শাসন করে তারা স্ত্রীলোকের মত। হে আমার বান্দারা, তোমাদের পথ দেখাবার লোকেরাই তোমাদের বিপথে নিয়ে যায়; তারা ঠিক পথ থেকে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যায়। মাবুদ আদালতে তাঁর স্থান নিয়েছেন; তিনি বিভিন্ন জাতির বিচার করবার জন্য দাঁড়িয়েছেন। মাবুদ তাঁর বান্দাদের মধ্যেকার বুড়ো লোকদের ও নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার করে বলছেন, “তোমরা আমার আংগুর ক্ষেত নষ্ট করেছ; গরীবদের মাল লুট করে নিজেদের ঘরে রেখেছ। তোমরা কিসের জন্য আমার বান্দাদের চুরমার করছ আর গরীবদের পিষে ফেলছ?” এই কথা দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন। মাবুদ আরও বলছেন, “সিয়োনের স্ত্রীলোকেরা অহংকারী। তারা মাথা উঁচু করে হেঁটে বেড়ায় আর চোখ দিয়ে ইশারা করে; পায়ের নূপুরের রুম্‌ঝুম শব্দ তুলে তারা হালকা পায়ে কায়দা করে হাঁটে। সেইজন্য মাবুদ সিয়োনের স্ত্রীলোকদের মাথায় ঘা হতে দেবেন আর তাতে টাক পড়াবেন।” সেই দিনে দীন-দুনিয়ার মালিক তাদের সুন্দর সুন্দর গয়নাগাঁটি কেড়ে নেবেন। তিনি তাদের নূপুর, মাথার টায়রা, চন্দ্রহার, কানের দুল, বালা, জালি পর্দা, মাথার ঘোমটা, পায়ের মল, কোমরের রেশমী ফিতা, খোশবুর শিশি, তাবিজ, আংটি ও নাকের নোলক, সুন্দর সুন্দর লম্বা কোর্তা, উপরের কোর্তা, শাল, টাকার থলি, আয়না, মসীনার ভিতরের কাপড়, পাগড়ী আর ওড়না কেড়ে নেবেন। সুগন্ধের বদলে পচা গন্ধ, কোমর-বাঁধনির বদলে দড়ি, সুন্দর করে আঁচড়ানো চুলের বদলে টাক, দামী কাপড়ের বদলে ছালার চট, আর সৌন্দর্যের বদলে পোড়ার দাগ থাকবে। তোমাদের লোকেরা তলোয়ারের আঘাতে আর যোদ্ধারা যুদ্ধে মারা পড়বে। সিয়োনের দরজাগুলো বিলাপ ও শোক করবে; সিয়োন সব হারিয়ে মাটিতে বসবে। সেই দিন সাতজন স্ত্রীলোক একজন পুরুষকে ধরে বলবে, “আমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করব; কেবল তোমার স্ত্রী বলে যেন আমাদের ডাকা হয় সেই অধিকার দাও। আমাদের অসম্মান দূর কর।” সেই দিন মাবুদের চারাগাছ সুন্দর ও গৌরবময় হবে এবং দেশের ফল ইসরাইল দেশে বেঁচে থাকা বান্দাদের গর্ব ও গৌরবের জিনিস হবে। সেই দিন সিয়োনে যারা বাকী থাকবে, অর্থাৎ জেরুজালেমে যারা বেঁচে থাকবে তাদের পবিত্র বলে ডাকা হবে। জেরুজালেমে বেঁচে থাকবার জন্য সেই সব লোকদের নাম তালিকায় লেখা রয়েছে। দীন-দুনিয়ার মালিক তাঁর রূহের দ্বারা আগুন দিয়ে ন্যায়বিচার করে সিয়োনের স্ত্রীলোকদের ময়লা পরিষ্কার করবেন এবং জেরুজালেম থেকে রক্তপাতের দাগ দূর করে দেবেন। মাবুদ সেই দিন সিয়োন পাহাড়ের সব জায়গার উপরে এবং যারা সেখানে জমায়েত হবে তাদের উপরে দিনে ধোঁয়ার মেঘ ও রাতে জ্বলন্ত আগুনের আলো সৃষ্টি করবেন; তা হবে সমস্ত ইসরাইলের মহিমার উপরে যেন একটা চাঁদোয়া। এটা দিনের রোদ থেকে ছায়া পাবার জন্য একটা ছাউনি এবং ঝড় ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটা আশ্রয়ের জায়গা হবে। আমি যাঁকে মহব্বত করি তাঁর উদ্দেশে আমি একটা কাওয়ালী গাইব, কাওয়ালী গাইব তাঁর আংগুর ক্ষেতের বিষয়ে। পাহাড়ের গায়ে একটা উর্বর জায়গায় ছিল আমার প্রিয়ের একটা আংগুর ক্ষেত। তিনি জায়গাটা খুঁড়ে সব পাথর তুলে ফেললেন আর তাতে লাগালেন সব চেয়ে ভাল আংগুরের লতা। তার মধ্যে তিনি তৈরী করলেন একটা উঁচু পাহারা-ঘর আর আংগুর মাড়াইয়ের জন্য পাথর কেটে ঠিক করে নিলেন। তারপর তিনি সেখানে ভাল আংগুর ফলের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু তাতে ধরল কেবল বুনো আংগুর। “হে জেরুজালেমের বাসিন্দারা ও এহুদার লোকেরা, এখন তোমরাই বল, এ কি আমার, না আমার আংগুর ক্ষেতের দোষ? আমার আংগুর ক্ষেতের জন্য আমি যা করেছি তার চেয়ে বেশী আর কি করা যেত? যখন আমি ভাল আংগুরের জন্য অপেক্ষা করলাম তখন কেন তাতে ধরল কেবল বুনো আংগুর? আমার আংগুর ক্ষেতের প্রতি যা করব তা এখন আমি তোমাদের বলব: আমি তার বেড়া তুলে ফেলব আর তাতে জমিটা ধ্বংস হয়ে যাবে; আমি তার দেয়াল ভেংগে ফেলব আর তাতে তা পায়ে মাড়ানো হবে। আমি ওটা একটা ধ্বংসস্থান করব; তার লতা ছাঁটাও হবে না এবং তার জমিও চাষ করা হবে না, আর সেখানে জন্মাবে কেবল কাঁটাঝোপ আর কাঁটাগাছ। আমি মেঘকে হুকুম দেব যেন সে বৃষ্টি না দেয়।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের আংগুর ক্ষেত হল ইসরাইল-বংশের লোকেরা; আর এহুদার লোকেরা হল তাঁর আনন্দের আংগুর-চারা। তিনি ন্যায়বিচারের খোঁজ করলেন কিন্তু দেখলেন রক্তপাত; তিনি সততার তালাশ করলেন কিন্তু শুনলেন দুঃখের কান্না। ঘৃণ্য তোমরা, যারা ঘরের সংগে ঘর আর ক্ষেতের সংগে ক্ষেত যোগ করছ; শেষে অন্যদের জন্য কোন জায়গা থাকবে না, আর তোমরা একাই দেশে বাস করবে। আমি নিজের কানে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের এই কথা শুনেছি, “সত্যিই বড় বড় বাড়ীগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, সুন্দর সুন্দর দালানে কোন বাসিন্দা থাকবে না। ত্রিশ বিঘা আংগুর ক্ষেত থেকে মাত্র বাইশ লিটার আংগুর-রস পাওয়া যাবে, আর একশো আশি কেজি বীজে মাত্র আঠারো কেজি শস্য জন্মাবে।” ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা মদ খাবার জন্য খুব সকালে ওঠে আর অনেক রাত পর্যন্ত বসে আংগুর-রস খেতে থাকে, যতক্ষণ না তাতে তারা গরম হয়ে ওঠে। তাদের মেজবানীর সময় থাকে সুরবাহার ও বীণা, আর থাকে খঞ্জনি, বাঁশী আর আংগুর-রস; কিন্তু মাবুদের কাজের প্রতি তাদের কোন মনোযোগ নেই, তাঁর হাতের কাজের প্রতি কোন খেয়াল নেই। কাজেই বুদ্ধির অভাবে আমার বান্দারা অন্য দেশে বন্দী হয়ে থাকবে। তাদের গণ্যমান্য লোকেরা ক্ষুধায় মারা পড়বে, আর তাদের অন্যান্য লোকদের বুক পিপাসায় শুকাবে। সেইজন্য কবর তার গলার নালী চওড়া করছে, তার মুখ খুব বড় করে হা করছে। সম্মানিত ও সাধারণ লোক, ঝগড়াটে আর হৈ-হুল্লোড়কারীরা সবাই সেখানে নেমে যাবে। উঁচু-নীচু সকলকে নত করা হবে, আর গর্বিতদের চোখ নীচু করা হবে। কিন্তু আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন ন্যায়বিচার করে মহান থাকবেন; আল্লাহ্‌ পাক তাঁর সততার জন্য পবিত্র বলে প্রকাশিত হবেন। তখন ভেড়াগুলো নিজেদের ক্ষেতে যেমন চরে তেমনি করেই ধনীদের সব ধ্বংসস্থানগুলোতে চরে বেড়াবে, আর বিদেশীরা সেই সব ধ্বংসস্থানগুলো ভোগ করবে। ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা ছলনার দড়ি দিয়ে অন্যায়কে টেনে আনে, আর গুনাহ্‌কে টেনে আনে যেন গরুর গাড়ির দড়ি দিয়ে। তারা বলে, “আল্লাহ্‌ শীঘ্র করুন; তিনি তাড়াতাড়ি করে তাঁর কাজ করুন যেন আমরা তা দেখতে পাই। ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের পরিকল্পনা পূর্ণ হোক যেন আমরা তা জানতে পারি।” ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা খারাপকে বলে ভাল আর ভালকে বলে খারাপ, যারা আলোকে অন্ধকার আর অন্ধকারকে আলো বলে ধরে, যারা মিষ্টকে তেতো আর তেতোকে মিষ্ট বলে ধরে। ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা নিজেদের চোখে জ্ঞানবান আর নিজেদের বুদ্ধিমান বলে মনে করে। ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা আংগুর-রস খাওয়ার বেলায় ওস্তাদ আর মদ মিশাবার কাজে পাকা, যারা ঘুষ খেয়ে দোষীকে ছেড়ে দেয় আর নির্দোষীদের জন্য ন্যায়বিচার করতে অস্বীকার করে। কাজেই আগুনের জিভ্‌ যেমন খড় পুড়িয়ে ফেলে আর আগুনের শিখার মধ্যে শুকনা ঘাস পুড়ে যায়, তেমনি করেই তাদের গোড়া পচে যাবে আর ধুলার মতই তাদের ফুল উড়ে যাবে; কারণ তারা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছে আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের কালামকে পায়ে ঠেলেছে। সেইজন্য মাবুদের রাগ তাঁর বান্দাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছে; তিনি হাত তুলে তাদের আঘাত করেছেন। পাহাড়-পর্বত কাঁপছে আর লাশগুলো রাস্তায় ময়লার মত পড়ে আছে। এই সবের পরেও তাঁর রাগ থামে নি, তিনি হাত উঠিয়েই রেখেছেন। তিনি দূরের জাতির জন্য একটা নিশান তুলবেন আর দুনিয়ার শেষ সীমার সেই লোকদের ডাক দেবেন। দেখ, তারা তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে দৌড়ে আসবে। তারা কেউই ক্লান্ত হবে না, উচোটও খাবে না; কেউই ঝিমাবে না বা ঘুমাবে না; তাদের কোমর-বাঁধনি খুলে যাবে না, জুতার ফিতাও ছিঁড়বে না; তাদের তীরগুলো ধারালো, তাদের সব ধনুকে চাড়া দেওয়া আছে; তাদের ঘোড়ার খুরগুলো চক্‌মকি পাথরের মত শক্ত, আর তাদের রথের চাকাগুলো ঘূর্ণিবাতাসের মত। সিংহীর মতই তাদের গর্জন; তারা যুব সিংহের মত গর্জন করবে আর শিকার ধরবার সময় গোঁ গোঁ শব্দ করবে। সেই শিকার তারা বয়ে নিয়ে যাবে; তাদের হাত থেকে কেউ তা রক্ষা করতে পারবে না। সেই দিন তারা সমুদ্রের গর্জনের মত করে মাবুদের বান্দাদের উপর গর্জন করবে। কেউ যদি তখন দেশের দিকে তাকায় তবে সে দেখতে পাবে অন্ধকার আর কষ্ট; এমন কি, আলোও মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে যাবে। যে বছরে বাদশাহ্‌ উষিয় ইন্তেকাল করলেন সেই বছরে আমি দেখলাম দীন-দুনিয়ার মালিক খুব উঁচু একটা সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর রাজ-পোশাকের নীচের অংশ দিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দস পূর্ণ ছিল। তাঁর উপরে ছিলেন কয়েকজন সরাফ; তাঁদের প্রত্যেকের ছয়টা করে ডানা ছিল- দু’টি ডানা দিয়ে তাঁরা মুখ আর দু’টি ডানা দিয়ে পা ঢেকে ছিলেন এবং আর দু’টি ডানা দিয়ে তাঁরা উড়ছিলেন। তাঁরা একে অন্যকে ডেকে বলছিলেন, “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র; তাঁর মহিমায় গোটা দুনিয়া পরিপূর্ণ।” ॥স তাদের গলার স্বরের আওয়াজে বায়তুল-মোকাদ্দসের দরজার কব্‌জাগুলো কেঁপে উঠল এবং ঘরটা ধোঁয়ায় পূর্ণ হয়ে গেল। তখন আমি বললাম, “হায়, আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম, কারণ আমার মুখ নাপাক এবং আমি এমন লোকদের মধ্যে বাস করি যাদের মুখ নাপাক। আমি নিজের চোখে বাদশাহ্‌কে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনকে দেখেছি।” তখন একজন সরাফ হাতে একটা জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে আমার কাছে উড়ে আসলেন; কয়লাটা তিনি ধূপগাহের উপর থেকে চিম্‌টা দিয়ে নিয়েছিলেন। সেই কয়লাটা তিনি আমার মুখে ছুঁইয়ে বললেন, “দেখ, এটা তোমার মুখ ছুঁয়েছে; তোমার অন্যায় দূর করা হয়েছে এবং তোমার গুনাহ্‌ মুছে ফেলা হয়েছে।” তারপর আমি দীন-দুনিয়ার মালিকের কথা শুনতে পেলাম। তিনি বললেন, “আমি কাকে পাঠাব? আমাদের পক্ষ হয়ে কে যাবে?” আমি বললাম, “এই যে আমি, আপনি আমাকে পাঠান।” তিনি বললেন, “তুমি গিয়ে এই লোকদের বল, ‘তোমরা শুনতে থেকো কিন্তু বুঝো না, দেখতে থেকো কিন্তু জেনো না।’ ” তারপর তিনি আমাকে আরও বললেন, “তুমি এই লোকদের দিল অসাড় কর, তাদের কান বন্ধ কর, আর তাদের চোখও বন্ধ করে দাও। তা না হলে তারা চোখে দেখবে, কানে শুনবে, দিলে বুঝবে আর তওবা করে সুস্থ হবে।” তখন আমি বললাম, “হে মালিক, আর কত দিন?” জবাবে তিনি বললেন, “যতদিন না শহরগুলো ধ্বংস হয়ে বাসিন্দাশূন্য হয়, বাড়ী-ঘর খালি হয়ে যায় আর ক্ষেত-খামার ধ্বংস ও ছারখার হয়; যতদিন না মাবুদ সকলকে দূর করে দেন এবং দেশের অনেক জায়গা জনশূন্য হয়। যদি দেশের মধ্যে দশভাগের একভাগ লোকও থাকে, তবুও তাদের পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিন্তু এলোন গাছ কেটে ফেললেও যেমন তার গুঁড়ি থেকে যায়, তেমনি গুঁড়ি হিসাবে দেশে পবিত্র বীজের মত কয়েকজন লোক থাকবে।” উষিয়ের নাতি, অর্থাৎ যোথমের ছেলে আহস যখন এহুদা দেশের বাদশাহ্‌ হলেন তখন সিরিয়ার বাদশাহ্‌ রৎসীন ইসরাইলের বাদশাহ্‌ রমলিয়ের ছেলে পেকহকে সংগে নিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন, কিন্তু তাঁরা তা জয় করতে পারলেন না। তখন দাউদের বংশের লোকদের বলা হল, “সিরিয়ার সৈন্যদল বন্ধু হিসাবে আফরাহীমে ছাউনি ফেলে আছে।” এই কথা শুনে আহস ও তাঁর লোকদের দিল ভয়ে বাতাসে দুলে-ওঠা বনের গাছের মতই দুলে উঠল। তখন মাবুদ ইশাইয়াকে বললেন, “তুমি ও তোমার ছেলে শার-যাশূব বের হয়ে ধোপার মাঠের রাস্তার ধারে উঁচু পুকুরের সংগে লাগানো পানির সুড়ংগের মুখের কাছে গিয়ে আহসের সংগে দেখা কর। তাকে এই কথা বল, ‘সতর্ক হও, স্থির থাক ও ভয় কোরো না। ধোঁয়া ওঠা ঐ দু’টা কাঠের শেষ অংশ দেখে, অর্থাৎ রৎসীন, সিরিয়া ও রমলিয়ের ছেলের ভয়ংকর রাগ দেখে নিরাশ হোয়ো না। সিরিয়া, আফরাহীম ও রমলিয়ের ছেলে এই বলে তোমার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে যে, তারা এহুদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাবে এবং তাদের হারিয়ে দিয়ে টাবেলের ছেলেকে সেখানকার বাদশাহ্‌ করবে। কিন্তু আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, এই যুদ্ধ হবেও না, ঘটবেও না, কারণ সিরিয়ার মাথা দামেস্কই বা কি আর দামেস্কের মাথা বাদশাহ্‌ রৎসীনই বা কে? পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে আফরাহীম এমনভাবে ধ্বংস হবে যে, জাতি হিসাবে সে আর থাকবে না। আফরাহীমের মাথা সামেরিয়াই বা কি, আর সামেরিয়ার মাথা রমলিয়ের ছেলেই বা কে? তোমাদের ঈমানে যদি তোমরা স্থির হয়ে না থাক তবে তোমরা কোনমতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।’ ” মাবুদ আবার আহসকে বললেন, “তুমি তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে বল যেন তিনি তোমাকে একটা চিহ্ন দেখান্ত সেই চিহ্ন কবর থেকে বেহেশত পর্যন্ত যে কোন জায়গায় দেখানো যেতে পারে।” কিন্তু আহস বললেন, “আমি তা বলব না, আর মাবুদকে পরীক্ষাও করব না।” তখন ইশাইয়া বললেন, “দাউদের বংশের লোকেরা, তোমরা শোন। মানুষের ধৈর্য পরীক্ষা করা কি যথেষ্ট নয়? তোমরা কি আমার আল্লাহ্‌র ধৈর্য পরীক্ষা করবে? কাজেই দীন-দুনিয়ার মালিক নিজেই তোমাদের কাছে একটা চিহ্ন দেখাবেন। তা হল, একজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে গর্ভবতী হবে, আর তাঁর একটি ছেলে হবে; তাঁর নাম রাখা হবে ইম্মানূয়েল। এহুদা ও আফরাহীমের আলাদা হবার দিনের পর থেকে যা কখনও হয় নি, মাবুদ আপনার ও আপনার লোকদের এবং আপনার পিতার বংশের লোকদের উপর সেই রকম একটা সময় আনবেন। সেই সময় তিনি আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে নিয়ে আসবেন।” সেই দিন মাবুদ মিসর দেশের দূরের নদীগুলো থেকে মাছি ও আশেরিয়া দেশ থেকে মৌমাছিদের আসবার জন্য ডাক দেবেন। সেগুলো এসে খাড়া উপত্যকার মধ্যে, পাহাড়ের ফাটলে, সমস্ত কাঁটাঝোপের মধ্যে ও মাঠে মাঠে বসবে। সেই দিন দীন-দুনিয়ার মালিক তোমাদের মাথার চুল, পায়ের লোম ও দাড়ি কামিয়ে দেবার জন্য ফোরাত নদীর ওপার থেকে একটা ক্ষুর, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে ভাড়া করে আনবেন। সেই দিন যে সব জায়গায় বারো কেজি রূপার দামের এক হাজারটা আংগুর লতা ছিল সেখানে থাকবে কেবল কাঁটাঝোপ আর কাঁটাগাছ। লোকে সেখানে যাবে তীর-ধনুক নিয়ে, কারণ দেশটা কাঁটাঝোপে আর কাঁটাগাছে ভরে যাবে। যে সব পাহাড়ী জায়গা কোদাল দিয়ে খুঁড়ে চাষ করা হত সেখানে লোকে কাঁটার ভয়ে আর যাবে না; সেগুলো হবে গরু আর ভেড়ার পাল চরে বেড়াবার জায়গা। মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি একটা বড় ফলক নিয়ে তার উপরে সাধারণ লোকের হাতের লেখা অনুসারে এই কথা লেখ, মহের-শালল-হাশ-বস (যার মানে ‘শীঘ্র লুট করা, তাড়াতাড়ি কেড়ে নেওয়া’)। আমি ইমাম উরিয়া ও যিবেরিখিয়ের ছেলে জাকারিয়াকে আমার বিশ্বস্ত সাক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করব।” পরে আমি আমার স্ত্রী, যিনি মহিলা-নবী ছিলেন, তাঁর সংগে মিলিত হলাম আর তিনি গর্ভবতী হয়ে একটি ছেলের জন্ম দিলেন। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “ওর নাম রাখ মহের-শালল-হাস-বস। ছেলেটি ‘মা’ কিংবা ‘বাবা’ বলবার আগেই দামেস্কের ধন-সম্পদ ও সামেরিয়ার লুটের মাল আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ নিয়ে যাবে।” মাবুদ আবার আমাকে বললেন, “এই লোকেরা শীলোহের আস্তে আস্তে বয়ে যাওয়া পানি ত্যাগ করে রৎসীন আর রমলিয়ের ছেলেকে নিয়ে আনন্দ করছে। সেইজন্য দীন-দুনিয়ার মালিক ফোরাত নদীর ভীষণ বন্যার পানির মত করে সমস্ত জাঁকজমক সুদ্ধ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই নিয়ে আসবেন। সেই পানি নদীর সব খাল ও কিনারা ছাপিয়ে বয়ে যাবে, আর তা এহুদা দেশের মধ্যে বেগে এসে পড়বে এবং উথলে উঠে গলা পর্যন্ত বেড়ে যাবে। হে ইম্মানূয়েল, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তার মেলে দেওয়া ডানা দিয়ে তোমার গোটা দেশটা ঢেকে ফেলবে। “হে জাতিরা, তোমরা একত্র হও, কিন্তু তোমরা ধ্বংস হবে; হে দূরের দেশগুলো, শোন, তোমরা যুদ্ধের জন্য তৈরী হও, কিন্তু তোমরা ধ্বংস হবে; জ্বী, যুদ্ধের জন্য তৈরী হও, কিন্তু তোমরা ধ্বংস হবে। তোমরা পরিকল্পনা কর, কিন্তু তা সফল হবে না; সেই পরিকল্পনার কথা তোমরা বলবে, কিন্তু তা টিকবে না, কারণ ‘আল্লাহ্‌ আমাদের সংগে আছেন।’ ” মাবুদ তাঁর শক্তিশালী হাত আমার উপর রেখে আমার সংগে কথা বললেন। তিনি আমাকে সতর্ক করে দিলেন যেন আমি এই লোকদের পথে না চলি। তিনি বললেন, “এই লোকেরা যেগুলোকে ষড়যন্ত্র বলে তোমরা সেগুলোর কোনটাকেই ষড়যন্ত্র বোলো না। তারা যাতে ভয় পায় তোমরা তাতে ভয় পেয়ো না; তা ভয়ানক কিছু বলে মনেও কোরো না। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনকেই পবিত্র বলে মান; তাকেই ভয় কর; তাঁকেই ভয়ানক বলে মনে কর। তাহলে তিনি হবেন একটা পবিত্র আশ্রয়স্থান, কিন্তু বনি-ইসরাইলদের দু’টি দেশের জন্য তিনি এমন একটা পাথর হবেন যাতে লোকে উচোট খাবে এবং যা লোকের উচোট খাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জেরুজালেমের লোকদের জন্য তিনি হবেন একটা ফাঁদ ও একটা জাল। তাদের মধ্যে অনেকে উচোট খাবে। তারা পড়ে গিয়ে ধ্বংস হবে; ফাঁদে আট্‌কে গিয়ে তারা ধরা পড়বে।” তুমি এই সাক্ষ্য রক্ষা কর আর আমার সাহাবীদের মধ্যে তা সীলমোহর করে রাখ। আমি মাবুদের জন্য অপেক্ষা করব, যিনি ইয়াকুব-বংশের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন; আমি তাঁর উপরেই ভরসা করব। এই দেখ, আমি এবং সেই সন্তানেরা যাদের মাবুদ আমাকে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, যিনি সিয়োন পাহাড়ে বাস করেন আমরা তাঁরই ইচ্ছা অনুসারে চিহ্ন ও আশ্চর্য লক্ষণ হয়েছি। লোকে যখন তোমাদের সেই লোকদের কাছে যেতে বলে যারা মৃত লোকদের ও ভূতদের সংগে যোগাযোগ স্থাপন করে আর ফিস্‌ফিস্‌ ও বিড়বিড় করে, তখন তোমাদের কি আল্লাহ্‌র কাছে যাওয়া উচিত নয়? যারা জীবিত আছে তাদের হয়ে কেন মৃতদের সংগে পরামর্শ করতে যাবে? তোমাদের যেতে হবে আল্লাহ্‌র নির্দেশ ও সাক্ষ্যের কাছে। যদি তারা আল্লাহ্‌র কালাম অনুসারে কথা না বলে তবে বুঝতে হবে তাদের মধ্যে কোন নূর নেই। কষ্ট ও খিদে নিয়ে তারা দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে। খিদের কষ্টে তারা রাগ করে উপরের দিকে তাকিয়ে তাদের বাদশাহ্‌ ও তাদের আল্লাহ্‌কে বদদোয়া দেবে। তারপর তারা দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাবে কেবল কষ্ট, অন্ধকার আর ভয়ানক যন্ত্রণা। ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে তাদের দূর করে দেওয়া হবে। কিন্তু যারা আগে কষ্টের মধ্যে ছিল তাদের জন্য অন্ধকার আর থাকবে না। আগেকার দিনে আল্লাহ্‌ সবূলূন ও নপ্তালি এলাকাকে নীচু করেছিলেন, কিন্তু ভবিষ্যতে সমুদ্রের কিনারার রাস্তা থেকে ধরে জর্ডান নদীর পূর্ব পারের এলাকা পর্যন্ত অ-ইহুদীদের গালীলকে তিনি সম্মানিত করবেন। যে লোকেরা অন্ধকারে চলে তারা মহা নূর দেখতে পাবে; যারা ঘন অন্ধকারের দেশে বাস করে তাদের উপর সেই নূর জ্বলবে। তুমি সেই জাতিকে বড় করবে আর বাড়িয়ে দেবে তাদের আনন্দ; ফসল কাটার সময় লোকে যেমন আমোদ করে, লুটের মাল ভাগের সময় যেমন আনন্দ করে, তেমনি করেই তারা তোমার সামনে আনন্দ করবে। মাদিয়ানের হেরে যাওয়ার দিনে যেমন তুমি করেছিলে, তেমনি করেই তুমি চুরমার করে দেবে সেই জোয়াল, যা তাদের উপর ভার হয়ে আছে, সেই লাঠি, যা তাদের আঘাত করে, সেই জাতি, যে তাদের উপর জুলুম করে। যুদ্ধ করতে আসা প্রত্যেকজন যোদ্ধার জুতা, রক্তে ভেজা প্রত্যেকটি পোশাক আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। এই সমস্ত হবে, কারণ একটি ছেলে আমাদের জন্য জন্মগ্রহণ করবেন, একটি পুত্র আমাদের দেওয়া হবে। শাসন করবার ভার তাঁর কাঁধের উপর থাকবে, আর তাঁর নাম হবে আশ্চর্য পরামর্শদাতা, শক্তিশালী আল্লাহ্‌, চিরস্থায়ী পিতা, শান্তির বাদশাহ্‌। তাঁর শাসনক্ষমতা বৃদ্ধির ও শান্তির শেষ হবে না। তিনি দাউদের সিংহাসন ও তাঁর রাজ্যের উপরে রাজত্ব করবেন; তিনি সেই সময় থেকে চিরকালের জন্য ন্যায়বিচার ও সততা দিয়ে তা স্থাপন করবেন ও স্থির করবেন। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই গভীর আগ্রহে এই সমস্ত করবেন। ইয়াকুবের বিরুদ্ধে দীন-দুনিয়ার মালিক একটা সংবাদ পাঠিয়েছেন; তা ইসরাইলের উপর ঘটবে। আফরাহীম ও সামেরিয়ার সব বাসিন্দারা তা জানতে পারবে। তারা অহংকার ও দিলের গর্বের সংগে বলে, “ইটগুলো পড়ে গেছে, কিন্তু আমরা তা আবার সুন্দর করে কাটা পাথর দিয়ে গড়ব; সব ডুমুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আমরা তার বদলে লাগাব এরস গাছ।” কিন্তু মাবুদ তো রৎসীনের বিরুদ্ধে তার শত্রুদের শক্তিশালী করেছেন আর তার বিরুদ্ধে তাদের উত্তেজিত করেছেন। পূর্ব দিক থেকে সিরীয়রা আর পশ্চিম দিক থেকে ফিলিস্তিনীরা মুখ হা করে ইসরাইলকে গিলে ফেলবে। এই সব হলেও তাঁর রাগ থামবে না। এখনও তাঁর হাত উঠানোই রয়েছে। কিন্তু যিনি তাদের আঘাত করেছেন তাঁর কাছে লোকেরা ফিরে আসে নি, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছামত চলে নি। কাজেই মাবুদ ইসরাইলের খেজুরের ডাল ও নল-খাগড়া, অর্থাৎ মাথা ও লেজ একই দিনে কেটে ফেলবেন। সেই মাথা হল বৃদ্ধ নেতারা ও সম্মানিত লোকেরা, আর লেজ হল মিথ্যা শিক্ষাদানকারী নবীরা। যারা এই জাতির লোকদের পথ দেখায় তারা তাদের ভুল পথে নিয়ে যায়; যারা তাদের পিছনে চলে তারা বুঝতে পারছে না তারা কোথায় যাচ্ছে। কাজেই দীন-দুনিয়ার মালিক যুবকদের নিয়ে কোন আনন্দ পাবেন না, আর এতিম ও বিধবাদের প্রতি তিনি কোন মমতা করবেন না; কারণ সবাই আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন ও দুষ্ট, সবাই খারাপ কথা বলে। এই সব হলেও তাঁর রাগ থামবে না; এখনও তাঁর হাত উঠানোই রয়েছে। সত্যিই দুষ্টতা আগুনের মত জ্বলে, তা কাঁটাঝোপ আর কাঁটাগাছ পুড়িয়ে ফেলে। তা বনের সব ঘন ঝোপ জ্বালিয়ে দেয় আর তাতে ধোঁয়ার থাম পাক খেয়ে খেয়ে উপরে ওঠে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ভীষণ রাগে দেশ ঝল্‌সে যাবে, আর লোকেরা হবে আগুনের জন্য জ্বালানী কাঠের মত। কেউ তার ভাইকে পর্যন্ত মমতা করবে না। এপাশে যা আছে তা তারা গিলতে থাকবে, কিন্তু তবুও খিদে মিটবে না; ওপাশে যা আছে তা খেতে থাকবে, কিন্তু তৃপ্ত হবে না। শেষে প্রত্যেকে নিজের লোকদের গোশ্‌ত খাবে- মানশা আফরাহীমের আর আফরাহীম মানশার গোশ্‌ত খাবে, আর তারা একসংগে এহুদার বিরুদ্ধে উঠবে। এই সব হলেও তাঁর রাগ থামবে না; এখনও তাঁর হাত উঠানোই রয়েছে। শাস্তি পাবার দিনে যখন দূর থেকে বিপদ আসবে তখন তোমরা কি করবে? সাহায্য পাবার জন্য কার কাছে দৌড়ে যাবে? তোমাদের ধন-সম্পদ কোথায় রেখে যাবে? তোমরা তো বন্দীদের মধ্যে থাকবে কিংবা মৃতদের সংগী হবে; তোমাদের করবার আর কিছুই থাকবে না। এই সব হলেও তাঁর রাগ থামবে না; এখনও তাঁর হাত উঠানোই রয়েছে। ঘৃণ্য আশেরিয়া, আমার গজবের লাঠি! তার হাতে রয়েছে আমার ভীষণ রাগের গদা। আমি তাকে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন এক জাতির বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছি এবং যারা আমার রাগ জাগিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছি যেন সে লুট করতে ও কেড়ে নিতে পারে আর রাস্তার কাদার মত করে তাদের পায়ে মাড়াতে পারে। কিন্তু আশেরিয়ার উদ্দেশ্য তা নয়, তার পরিকল্পনা অন্য রকম; তার উদ্দেশ্য ধ্বংস করা আর অনেক জাতিকে শেষ করে দেওয়া। সে বলে, “আমার সেনাপতিরা কি সবাই বাদশাহ্‌র মত নয়? কল্‌নোর অবস্থা কি কার্খেমিশের মত নয়? হামা কি অর্পদের মত নয়? আর সামেরিয়া কি দামেস্কের মত নয়? সেই সব মূর্তিতে ভরা রাজ্যগুলো আমার হাতে পড়েছে; তাদের মূর্তিগুলো জেরুজালেম আর সামেরিয়ার মূর্তিগুলোর চেয়ে অনেক ভাল। আমি সামেরিয়া ও তার প্রতিমাগুলোর প্রতি যা করেছি জেরুজালেম ও তার মূর্তিগুলোর প্রতি তা-ই করব।” দীন-দুনিয়ার মালিক সিয়োন পাহাড় ও জেরুজালেমের বিরুদ্ধে তাঁর সব কাজ শেষ করে বলবেন, “আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র অহংকারী দিলের কাজ ও তার গর্বভরা চাহনির জন্য আমি তাকে শাস্তি দেব, কারণ সে বলে, ‘আমার হাতের শক্তিতে আর জ্ঞানের দ্বারা আমি এটা করেছি, কারণ আমার বুদ্ধি আছে। জাতিদের সীমা আমি দূর করে দিয়েছি, তাদের ধন-সম্পদ লুট করেছি; শক্তিশালী বীরের মত আমি তাদের বাদশাহ্‌দের দমন করেছি। যেমন করে কেউ পাখীর বাসায় হাত দেয় তেমনি করে আমি জাতিদের ধন-সম্পদে হাত দিয়েছি। লোকে যেমন করে পড়ে থাকা ডিম জড়ো করে তেমনি করে দুনিয়ার সমস্ত দেশকে আমি জড়ো করেছি। কেউ ডানা নাড়ে নি কিংবা কেউ কিচির মিচির করবার জন্য মুখ খোলে নি।’ ” কুড়াল কি কাঠুরের উপরে নিজেকে উঠায় কিংবা করাত কি কাঠ-মিস্ত্রির সামনে বড়াই করে? না, তা হতে পারে না। লাঠি লাঠিয়ালকে চালাতে পারে না ও গদা গদাধারীকে ঘুরাতে পারে না, কারণ গদাধারী তো কাঠের জিনিস নয়। সেইজন্য দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আশেরিয়ার শক্তিশালী যোদ্ধাদের উপর একটা ক্ষয়-করা রোগ পাঠিয়ে দেবেন; তার জাঁকজমকের নীচে জ্বলন্ত শিখার মত করে আগুন জ্বালানো হবে। ইসরাইলের আলো হবেন আগুনের মত; তাদের আল্লাহ্‌ পাক হবেন একটা শিখার মত। সেই আগুন একদিনে তার সব কাঁটাঝোপ আর কাঁটাগাছ পুড়িয়ে ফেলবে। যেমন করে একজন রোগী ক্ষয় হয়ে যায়, তেমনি করে সেই আগুন আশেরিয়ার সব গভীর বন ও উর্বর ক্ষেত-খামার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলবে। তার বনের বাকী গাছগুলো সংখ্যায় এত কম হবে যে, একজন ছোট ছেলেও তা গুণে লিখতে পারবে। সেই দিন ইসরাইলের বেঁচে থাকা বান্দারা, অর্থাৎ ইয়াকুবের বংশের বাকী লোকেরা তাদের আঘাতকারীদের উপর আর ভরসা করবে না, কিন্তু মাবুদের উপর, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের উপর সত্যিই ভরসা করবে। বেঁচে থাকা বান্দারা ফিরে আসবে; ইয়াকুবের বাকী লোকেরা শক্তিশালী আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে আসবে। হে ইসরাইল, যদিও তোমার লোকসংখ্যা সমুদ্র-পারের বালুকণার মত তবুও মাত্র অল্প লোকই ফিরে আসবে। ইসরাইলের জন্য ধ্বংস ঠিক করা আছে এবং সেই ন্যায্য শাস্তি তাদের উপর আসবেই আসবে। গোটা দেশের উপর যে ধ্বংস ঠিক করা আছে সেইমত দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কাজ করবেন। সেইজন্য দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হে আমার বান্দারা, তোমরা যারা সিয়োনে থাক, যদিও আশেরীয়রা মিসর দেশের মত করে তোমাদের লাঠি দিয়ে মারে আর তোমাদের বিরুদ্ধে গদা তোলে তবুও তোমরা তাদের ভয় কোরো না। তোমাদের উপরে আমার রাগ খুব শীঘ্রই শেষ হবে, আর তা আশেরীয়দের ধ্বংস করবে।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন ওরেব পাহাড়ে মাদিয়ানকে আঘাত করবার সময় যেমন করেছিলেন তেমনি করে তিনি চাবুক দিয়ে আশেরীয়দের মারবেন। মিসরে যেমন করেছিলেন তেমনি করেই তিনি পানির উপরে তাঁর লাঠি উঠাবেন। সেই দিন তোমাদের কাঁধ থেকে তাদের বোঝা, তোমাদের ঘাড় থেকে তাদের জোয়াল তুলে নেওয়া হবে; তোমরা মোটা হয়েছ বলে সেই জোয়াল ভেংগে পড়বে। তারা অয়াতে ঢুকেছে, মিগ্রোণ পার হয়ে গেছে; তারা মিক্‌মসে তাদের জিনিসপত্র রেখে গেছে। তারা গিরিপথ পার হয়ে এসে বলছে, “আমরা গেবাতে ছাউনি ফেলে রাত কাটাব।” এতে রামা কাঁপছে, তালুতের গিবিয়ার লোকেরা পালিয়ে যাচ্ছে। হে গল্লীমের লোকেরা, তোমরা চিৎকার কর। হে লয়িশার লোকেরা, তোমরা কান দাও। হায়, অনাথোৎ! মদ্‌মেনার লোকেরা পালিয়ে যাচ্ছে; গেবীমের লোকেরা লুকাচ্ছে। আজকে আশেরীয়রা নোবে গিয়ে থামবে; তারা সিয়োন্তকন্যার পাহাড়ের দিকে, অর্থাৎ জেরুজালেমের পাহাড়ের দিকে ঘুষি বাগাচ্ছে। দেখ, দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন মহাশক্তিতে ডালগুলো ভেংগে ফেলবেন। উঁচু উঁচু গাছগুলো কেটে ফেলা হবে; সেগুলো মাটিতে পড়ে যাবে। তিনি লোহার অস্ত্র দিয়ে বনের ঘন ঝোপ কেটে ফেলবেন, আর শক্তিশালী একজনের দ্বারা লেবাননের গাছগুলো ধ্বংস করা হবে। ইয়াসিরের গোড়া থেকে একটা নতুন চারা বের হবেন; তাঁর মূলের সেই চারায় ফল ধরবে। তাঁর উপর থাকবেন মাবুদের রূহ্‌, জ্ঞান ও বুঝবার রূহ্‌, পরামর্শ ও শক্তির রূহ্‌, বুদ্ধি ও মাবুদের প্রতি ভয়ের রূহ্‌। তিনি মাবুদের প্রতি ভয়ে আনন্দিত হবেন। তিনি চোখে যা দেখবেন তা দিয়ে বিচার করবেন না, কিংবা কানে যা শুনবেন তা দিয়ে মীমাংসা করবেন না; কিন্তু অভাবীদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন, আর দুনিয়ার গরীবদের ব্যাপার সততার সংগে মীমাংসা করবেন। লাঠির মত করে তিনি মুখের কথায় দুনিয়াকে আঘাত করবেন, আর দুষ্টদের হত্যা করবেন তাঁর মুখের শ্বাসে। সততা হবে তাঁর কোমর-বাঁধনি আর বিশ্বস্ততা হবে তাঁর কোমরে জড়াবার পটি। নেকড়েবাঘ ভেড়ার বাচ্চার সংগে বাস করবে, চিতাবাঘ শুয়ে থাকবে ছাগলের বাচ্চার সংগে; গরুর বাচ্চা, যুব সিংহ ও মোটাসোটা বাছুর একসংগে থাকবে, আর ছোট ছেলে তাদের চরাবে। গরু ও ভল্লুক একসংগে চরবে, আর তাদের বাচ্চারা একসংগে শুয়ে থাকবে; সিংহ গরুর মত খড় খাবে। কেউটে সাপের গর্তের কাছে ছোট শিশু খেলা করবে, আর ছোট ছেলেমেয়ে বিষাক্ত সাপের গর্তে হাত দেবে। আমার পবিত্র পাহাড়ের কোন জায়গায় কেউ ক্ষতিও করবে না, ধ্বংসও করবে না, কারণ সমুদ্র যেমন পানিতে পরিপূর্ণ থাকে তেমনি মাবুদের বিষয়ে জ্ঞানে দুনিয়া পরিপূর্ণ হবে। সেই দিন ইয়াসিরের মূল সব জাতির জন্য নিশানের মত হয়ে দাঁড়াবেন; সব জাতি তাঁর কাছে জমায়েত হবে এবং তাঁর বিশ্রামের স্থান গৌরবময় হবে। সেই দিন দীন-দুনিয়ার মালিক তাঁর বেঁচে থাকা বান্দাদের আশেরিয়া থেকে, মিসর ও পথ্রোষ থেকে, ইথিওপিয়া, ইলাম, ব্যাবিলন, হামা ও দ্বীপগুলো থেকে উদ্ধার করে আনবার জন্য দ্বিতীয়বার তাঁর হাত বাড়িয়ে দেবেন। তিনি জাতিদের জন্য একটা নিশান তুলবেন আর বিদেশে বন্দী থাকা বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করবেন; এহুদার ছড়িয়ে থাকা লোকদের তিনি দুনিয়ার চারদিক থেকে একত্র করবেন। আফরাহীমের হিংসা দূর হয়ে যাবে এবং এহুদার শত্রুভাব আর থাকবে না। আফরাহীম এহুদার উপর হিংসা করবে না, এহুদাও আফরাহীমের সংগে শত্রুতা করবে না। তারা পশ্চিম দিকে ফিলিস্তিনীদের দেশের ঢালু জায়গায় ছোঁ মারবে, তাঁরা একসংগে পূর্ব দিকের দেশ লুট করবে। তারা ইদোম ও মোয়াব দখল করে নেবে আর অম্মোনীয়রা তাদের অধীন হবে। মাবুদ সুয়েজ উপসাগর শুকিয়ে ফেলবেন; তিনি গরম শুকনা বাতাস দিয়ে ফোরাত নদীর উপরে তাঁর শক্তি দেখাবেন। তিনি সেটা ভাগ করে সাতটা নালা বানাবেন, যাতে লোকে জুতা পায়ে পার হতে পারে। মিসর থেকে বের হয়ে আসবার সময় যেমন বনি-ইসরাইলদের জন্য একটা পথ হয়েছিল তেমনি তাঁর বেঁচে থাকা বান্দাদের জন্য আশেরিয়া থেকে একটা রাজপথ হবে। সেই দিন তুমি বলবে, “হে মাবুদ, আমি তোমার প্রশংসা করব, কারণ তুমি আমার উপর রাগ প্রকাশ করেছিলে; কিন্তু এখন তোমার রাগ থেমে গেছে আর তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ। সত্যি, আল্লাহ্‌ আমার উদ্ধারকর্তা; আমি তাঁর উপর ভরসা করব, ভয় করব না। মাবুদ, মাবুদই আমার শক্তি ও আমার কাওয়ালী; তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা হয়েছেন।” এজন্য তোমরা আনন্দের সংগে উদ্ধারের সব ঝর্ণা থেকে পানি তুলবে। সেই দিন তোমরা বলবে, “মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, তাঁর গুণের কথা ঘোষণা কর; তিনি যা করেছেন তা সব জাতিকে জানাও আর ঘোষণা কর যে, তিনি মহান। মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও, কারণ তিনি গৌরবময় কাজ করেছেন; সারা দুনিয়াতে যেন এই কথা জানানো হয়। হে সিয়োনের লোকেরা, তোমরা জোরে চিৎকার কর আর আনন্দে কাওয়ালী গাও, কারণ ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক তোমাদের মধ্যে মহান।” আমোজের ছেলে ইশাইয়া ব্যাবিলন সম্বন্ধে দর্শন পেয়েছিলেন। মাবুদ বলছেন, “তোমরা গাছপালাহীন পাহাড়ের মাথার উপরে একটা নিশান তোল; চিৎকার করে যোদ্ধাদের ডাক আর প্রধান লোকদের দরজা দিয়ে ঢুকবার জন্য হাত দিয়ে যোদ্ধাদের ইশারা কর। আমার পবিত্র বান্দাদের আমি হুকুম দিয়েছি; আমার রাগ ঢেলে দেবার জন্য আমি আমার যোদ্ধাদের ডেকেছি। আমার গৌরব প্রকাশিত হয়েছে বলে তারা আনন্দে গর্ব করছে।” শোন, পাহাড়-পর্বতের উপরে অনেক লোকের ভিড়ের শব্দ হচ্ছে। শোন, সমস্ত জাতির ও রাজ্যের লোকেরা একসংগে জমায়েত হয়ে গোলমাল করছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যুদ্ধের জন্য একটা সৈন্যদল সাজাচ্ছেন। তারা দূর দেশ থেকে আসছে, তারা দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে আসছে; মাবুদ তাঁর রাগের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গোটা দুনিয়াটাকে ধ্বংস করবার জন্য আসছেন। তোমরা জোরে জোরে কাঁদ, কারণ মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে; সেই দিন সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে ধ্বংস আসবে। সেইজন্য সকলের হাত নিসে-জ হয়ে পড়বে আর সমস্ত লোক সাহস হারাবে। তারা ভীষণ ভয় পাবে, তাদের ব্যথা ও দারুণ যন্ত্রণা হবে, প্রসবকারিণীর মত তারা ব্যথায় মোচড়াবে, তারা বুদ্ধিহারা হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাবে এবং তাদের মুখ আগুনের শিখার মত হবে। দেখ, মাবুদের দিন আসছে। তা নিষ্ঠুরতা, উপ্‌চে পড়া গজব ও জ্বলন্ত রাগ নিয়ে আসছে; দুনিয়াকে ধ্বংসস্থান করবার জন্য আর তার মধ্যেকার গুনাহ্‌গারদের বিনষ্ট করবার জন্য আসছে। তখন আসমানের তারা ও নক্ষত্রপুঞ্জ নূর দেবে না; সূর্য উঠবার সময়েও অন্ধকার থাকবে আর চাঁদও আলো দেবে না। মাবুদ বলছেন, “আমি খারাপীর জন্য দুনিয়াকে শাস্তি দেব; দুষ্টদের অন্যায়ের জন্য তাদের শাস্তি দেব। আমি গর্বিতদের বড়াই করা শেষ করে দেব আর নিষ্ঠুরদের অহংকার ভেংগে দেব। তখন আমি মানুষকে পাওয়া খাঁটি সোনা পাওয়ার চেয়েও কঠিন করব, ওফীরের সোনা পাওয়ার চেয়ে আরও বেশী কঠিন করব। সেইজন্য আমি আসমানকে কাঁপাব; আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের উপ্‌চে পড়া গজবে তাঁর জ্বলন্ত রাগের দিনে দুনিয়া তার জায়গা থেকে নড়ে যাবে। “শিকারের জন্য তাড়ানো হরিণের মত, রাখাল ছাড়া ভেড়ার মত প্রত্যেকে তার নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাবে, প্রত্যেকে তার নিজের দেশে পালিয়ে যাবে। যাদের পাওয়া যাবে তাদের অস্ত্র দিয়ে বিদ্ধ করা হবে; যাদের ধরা হবে তারা তলোয়ারের আঘাতে মারা পড়বে। তাদের চোখের সামনে শিশুদের আছাড় দিয়ে মারা হবে; তাদের ঘর-বাড়ী লুট করা হবে ও স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হবে। “দেখ, আমি তাদের বিরুদ্ধে মিডীয়দের খুঁচিয়ে তুলব। তারা রূপার দিকেও খেয়াল করবে না আর সোনা নিয়েও আনন্দ করবে না। তারা ধনুক দিয়ে যুবকদের হত্যা করবে; তারা শিশুদের প্রতি কোন দয়া করবে না কিংবা ছেলেমেয়েদের দিকে মমতার চোখে তাকাবে না। সমস্ত রাজ্যের মণি ব্যাবিলনকে, ক্যালডীয়দের গৌরবের ব্যাবিলনকে আল্লাহ্‌ সাদুম ও আমুরার মত ধ্বংস করবেন। তার মধ্যে আর কখনও বাসস্থান হবে না কিংবা বংশের পর বংশ ধরে কেউ সেখানে বাস করবে না। কোন আরবীয় সেখানে তাম্বু খাটাবে না, কোন রাখাল সেখানে তার পশুপালকে বিশ্রাম করাবে না। কিন্তু মরুভূমির প্রাণীরা সেখানে শুয়ে থাকবে, সেখানকার ঘর-বাড়ীগুলো হায়েনায় পরিপূর্ণ হবে, উটপাখীরা সেখানে বাস করবে আর বুনো ছাগলেরা লাফিয়ে বেড়াবে। সেখানকার কেল্লার মধ্যে শিয়াল ডাকবে আর খেঁকশিয়াল সৌখিন ঘর-বাড়ীর মধ্যে থাকবে। ব্যাবিলনের সময় এসে গেছে, তার দিনগুলো আর বাড়ানো হবে না।” মাবুদ ইয়াকুবের প্রতি মমতা করবেন; তিনি আবার বনি-ইসরাইলদের বেছে নেবেন এবং তাদের নিজেদের দেশে বসিয়ে দেবেন। বিদেশীরা তাদের সংগে যোগ দেবে আর তারা ইয়াকুবের বংশের সংগে যুক্ত হবে। অন্যান্য জাতিরা তাদের নিয়ে তাদের নিজেদের দেশে পৌঁছে দেবে। মাবুদের দেশে অন্যান্য জাতিরা বনি-ইসরাইলদের গোলাম ও বাঁদী হবে। যারা তাদের বন্দী করেছিল এখন তাদেরই তারা বন্দী করবে আর তাদের অত্যাচারকারীদের উপরে তারা কর্তা হবে। দুষ্টদের লাঠি আর শাসনকর্তাদের শাসনদণ্ড মাবুদই ভেংগে দিয়েছেন। জুলুমবাজ ভীষণ রাগ করে জাতিদের অনবরত আঘাত করত, রাগে সে বারবার তাদের জুলুম করে দমন করত। এখন সমস্ত দুনিয়া রেহাই ও শান্তি পেয়েছে; সেইজন্য তারা আনন্দে গান গাইছে। এমন কি, বেরস আর লেবাননের এরস গাছও আনন্দের সংগে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌কে বলছে, ‘এখন তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে কোন কাঠুরেই আর আমাদের কাটতে আসে না।’ “তুমি মৃতস্থানে আসছ বলে মৃতস্থানের লোকেরা তোমার সংগে দেখা করবার জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে। তাই মৃতদের রূহ্‌ উঠছে যেন তারা তোমার সংগে দেখা করতে পারে। যারা এই দুনিয়ার নেতা ছিল তারা সবাই উঠছে; যারা জাতিদের উপরে বাদশাহ্‌ ছিল তারা সবাই তাদের সিংহাসন থেকে উঠছে। তারা সবাই তোমাকে ডেকে বলবে, ‘তুমিও আমাদের মত দুর্বল হয়ে পড়েছ; তুমি আমাদের মতই হয়েছ।’ “তোমার সব জাঁকজমক মৃতস্থানে নামিয়ে আনা হয়েছে; তার সংগে তোমার সব বীণার শব্দ নামানো হয়েছে। তোমার নীচে ছড়িয়ে রয়েছে পোকা আর সেগুলো তোমাকে ঢেকে ফেলেছে। হে শুকতারা, ভোরের সন্তান, তুমি তো আসমান থেকে পড়ে গেছ। তুমি একদিন জাতিদের পরাজিত করেছ আর তোমাকেই এখন দুনিয়াতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তুমি মনে মনে বলেছ, ‘আমি বেহেশতে উঠব, আল্লাহ্‌র তারাগুলোর উপরে আমার সিংহাসন উঠাব; যেখানে দেবতারা জমায়েত হয় উত্তর দিকের সেই পাহাড়ের উপরে আমি সিংহাসনে বসব। আমি মেঘের মাথার উপরে উঠব; আমি আল্লাহ্‌তা’লার সমান হব।’ কিন্তু তোমাকে মৃতস্থানে নামানো হয়েছে, জ্বী, সেই গর্তের সব চেয়ে নীচু জায়গায় নামানো হয়েছে। যারা তোমাকে দেখে তারা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা তোমার অবস্থা দেখে বলে, ‘যে দুনিয়াকে নাড়াত আর রাজ্যগুলোকে কাঁপাত এ কি সেই লোক? এ কি সে, যে দুনিয়াকে মরুভূমির মত করত, শহরগুলোকে উল্টে ফেলত, আর বন্দীদের বাড়ী ফিরে যেতে দিত না?’ “জাতিদের সব বাদশাহ্‌ সম্মানের সংগে নিজের নিজের কবরে শুয়ে আছেন। কিন্তু তোমার লাশকে গাছের বাদ দেওয়া ডালের মত কবরের বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে। তলোয়ার দিয়ে যাদের হত্যা করে মৃতস্থানের সবচেয়ে নীচু জায়গায় পাঠানো হয়েছে তাদের লাশ দিয়ে তুমি ঢাকা পড়েছ। তুমি পায়ে মাড়ানো লাশের মত হয়েছ। তুমি অন্যান্য বাদশাহ্‌দের মত দাফন পাবে না, কারণ তোমার দেশকে তুমি ধ্বংস করেছ আর তোমার লোকদের হত্যা করেছ। দুষ্টদের বংশধরদের কথা আর কখনও উল্লেখ করা হবে না। তাদের পূর্বপুরুষদের গুনাহের দরুন তাদের ছেলেদের হত্যা করবার জন্য একটা জায়গা ঠিক কর। দেশ অধিকার করবার জন্য তারা আর উঠবে না; তারা দুনিয়াকে আর তাদের শহর দিয়ে পরিপূর্ণ করবে না।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “আমি তাদের বিরুদ্ধে উঠব; ব্যাবিলনের নাম ও তার বেঁচে থাকা লোকদের আর তার বংশধরদের আমি একেবারে শেষ করে দেব। আমি তাকে শজারুদের জায়গা ও জলা জায়গা করব। ধ্বংসের ঝাঁটা দিয়ে আমি তাকে ঝাড়ু দেব। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কসম খেয়ে বলেছেন, “সত্যিই, আমি যেমন ঠিক করেছি তেমনই ঘটবে, আর তা স্থির থাকবে। আমার দেশের মধ্যে আমি আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে চুরমার করব আর আমার পাহাড়-পর্বতের উপরে তাকে পায়ের নীচে মাড়াব। তখন আমার বান্দাদের কাছ থেকে তার জোয়াল দূর হয়ে যাবে ও তাদের কাঁধ থেকে তার বোঝা সরে যাবে।” সারা দুনিয়ার জন্য এই ব্যবস্থাই ঠিক করা হয়েছে আর সমস্ত জাতির উপরে এই হাতই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই এই সব ঠিক করেছেন, তাই কে তা বিফল করতে পারে? তাঁর হাত বাড়ানো রয়েছে, কে তা গুটাতে পারে? যে বছরে বাদশাহ্‌ আহস ইন্তেকাল করেছিলেন সেই বছরে ইশাইয়া এই ভবিষ্যদ্বাণী পেয়েছিলেন। হে ফিলিস্তীন, যে লাঠি তোমাকে আঘাত করত তা ভেংগে গেছে বলে তোমরা কেউ আনন্দ কোরো না। সাপের গোড়া থেকে বের হয়ে আসবে কেউটে সাপ, আর সেই সাপ থেকে বেরিয়ে আসবে উড়ন্ত বিষাক্ত সাপ। সবচেয়ে গরীব লোকেরা খাবার পাবে আর অভাবীরা নিরাপদে শুয়ে থাকবে। কিন্তু তোমার শিকড়কে আমি দুর্ভিক্ষ দিয়ে ধ্বংস করব, তাতে তোমার বেঁচে থাকা লোকেরা মরে যাবে। হে দরজা, বিলাপ কর। হে শহর, কাঁদ। হে ফিলিস্তীন, তোমার সব কিছু মিলিয়ে যাক। উত্তর দিক থেকে ধোঁয়ার মেঘ আসছে, সেই সৈন্যদল থেকে একজন সৈন্যও পিছিয়ে পড়ছে না। এই জাতির দূতদের কি জবাব দেওয়া যাবে? তাদের বলা হবে, “মাবুদ সিয়োনকে স্থাপন করেছেন এবং তার মধ্যে অত্যাচারিত হওয়া তাঁর বান্দারা আশ্রয় পাবে।” মোয়াব সম্বন্ধে মাবুদের কথা এই: মোয়াবের মধ্যেকার আর্‌ নামে শহরটা এবং মোয়াবের মধ্যেকার কীর শহরটা এক রাতের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। মোয়াবের লোকেরা কাঁদবার জন্য দীবোনের মন্দিরে ও পূজার উঁচু স্থানে উঠে গেছে। তারা নবো ও মেদবার জন্য শোক করছে। তাদের সকলের মাথা কামানো হয়েছে এবং দাড়িও কাটা হয়েছে। তারা রাস্তায় রাস্তায় ছালার চট পরে বেড়াচ্ছে। তারা সবাই ছাদের উপরে ও শহর-চকের মধ্যে শোক করছে। তারা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। হিষ্‌বোন ও ইলিয়ালী কাঁদছে; তাদের গলার আওয়াজ যহস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। সেইজন্য মোয়াবের সৈন্যেরাও কাঁদছে এবং তাদের দিল ভয়ে কাঁপছে। মোয়াবের জন্য আমার দিল কাঁদছে; তার লোকেরা সোয়রের দিকে ইগ্লৎ-শলিশীয়া পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে। তারা কাঁদতে কাঁদতে লূহীতের পাহাড়ী পথে উঠে যাচ্ছে; তাদের জায়গা ধ্বংস হয়েছে বলে তারা বিলাপ করতে করতে হোরণয়িমের রাস্তায় চলছে। নিম্রীমের সব পানি নষ্ট করা হয়েছে ও ঘাস শুকিয়ে গেছে; গাছ-গাছড়া নেই, সবুজ বলতে আর কিছুই বাকী নেই। সেইজন্য তাদের জমানো ধন-সম্পদ তারা উইলো গাছের খাদের ওপাশে নিয়ে যাচ্ছে। মোয়াবের সীমার চারপাশে তাদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে; ইগ্লয়িম ও বের-এলীম পর্যন্ত তাদের বিলাপ শোনা যাচ্ছে। দীমোনের পানি রক্তে ভরা, তবুও আমি তার উপরে আরও দুঃখ আনব; মোয়াবের পালিয়ে যাওয়া লোকদের উপরে, আর যারা দেশে বেঁচে থাকবে তাদের উপরে আমি সিংহ নিয়ে আসব। হে মোয়াবীয়রা, তোমরা মরুভূমির মধ্যেকার সেলা থেকে সিয়োন্তপাহাড়ে দেশের শাসনকর্তার কাছে উপহার হিসাবে কতগুলো ভেড়ার বাচ্চা পাঠিয়ে দাও। বাসা থেকে ঠেলে বের করে দিলে পাখী যেমন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় তেমনি করে মোয়াবের লোকেরা অর্ণোন নদীর হেঁটে পার হওয়ার জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। তারা বলবে, “আমাদের পরামর্শ দাও; কি করা উচিত বল। তোমার দুপুর বেলার ছায়াকে রাতের অন্ধকারের মত কর- যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের লুকিয়ে রাখ, আর যারা রক্ষা পাবার জন্য আশ্রয় চায় তাদের ধরিয়ে দিয়ো না। মোয়াবের পালিয়ে যাওয়া লোকদের তোমাদের সংগে থাকতে দাও; ধ্বংসকারীদের সামনে থেকে তাদের আড়াল করে রাখ।” এহুদায় অত্যাচারীরা শেষ হয়ে যাবে; ধ্বংসের কাজ থেমে যাবে। দেশে আক্রমণকারীদের আর দেখা যাবে না। অটল মহব্বত দিয়ে দাউদের রাজবাড়ীতে একটা সিংহাসন স্থাপন করা হবে; একজন বিশ্বস্ত বান্দা তার উপরে বসবেন। তিনি সততার সংগে বিচার করবেন এবং তাড়াতাড়ি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। আমরা মোয়াবের অহংকারের কথা শুনেছি, সে খুব অহংকারী। তার গর্বের কথা, নিজেকে বড় করবার কথা ও সব অহংকারের কথা শুনেছি, কিন্তু তার সব বড়াই মিথ্যা। কাজেই মোয়াবীয়রা তাদের দেশের জন্য একসংগে জোরে জোরে কাঁদবে, কীর্‌-হরসতের কিশমিশের পিঠার জন্য তোমরা জোরে জোরে কাঁদবে ও দুঃখ করবে। হিষ্‌বোনের ক্ষেতগুলো আর সিব্‌মার আংগুর লতা শুকিয়ে গেছে। জাতিদের শাসনকর্তারা ভাল ভাল আংগুর গাছ মাড়িয়ে গেছে; সেগুলো একদিন যাসের পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাত আর মরুভূমির দিকে ছড়িয়ে যেত। সেগুলোর লতা আরও ছড়িয়ে সমুদ্র পার হয়ে গিয়েছিল। সেইজন্য আমি যাসেরের মতই সিব্‌মার আংগুর লতার জন্য কাঁদছি। হে হিষ্‌বোন, হে ইলিয়ালী, আমি চোখের পানিতে তোমাদের ভিজাব। পাকা ফল ও ফসল কাটবার জন্য তোমাদের আনন্দের চিৎকার থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলের বাগানগুলো থেকে আনন্দ ও খুশীর ভাব দূর করা হয়েছে। আংগুর ক্ষেতে আর কেউ গান বা চিৎকার করে না, আর আংগুর মাড়াইয়ের জায়গায় কেউ মাড়াই করে রস বের করে না, কারণ সেই চিৎকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার দিল মোয়াবের জন্য, আমার ভিতরটা কীর্‌-হরসতের জন্য বীণার মত করে কাঁদছে। মোয়াব যখন বুঝতে পারবে যে, তার পূজার উঁচু স্থানে গিয়ে লাভ হচ্ছে না তখন প্রার্থনার জন্য সে তার মন্দিরে যাবে, কিন্তু তাতেও কোন লাভ হবে না। মাবুদ মোয়াব সম্বন্ধে এই কথা আগেই বলেছেন। কিন্তু এখন মাবুদ বলছেন, “চুক্তিতে বাঁধা চাকর যেমন বছর গোণে তেমনি করে ঠিক তিন বছরের মধ্যে মোয়াবের জাঁকজমক ও তার বহু সংখ্যক লোকের সবাইকে তুচ্ছ করা হবে এবং বেঁচে থাকা লোকেরা হবে সংখ্যায় অল্প ও দুর্বল।” দামেস্ক সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী এই: মাবুদ বলছেন, “দেখ, দামেস্ক আর শহর থাকবে না, তা হবে একটা ধ্বংসের স্তূপ। অরোয়েরের গ্রামগুলো ত্যাগ করে লোকেরা চলে যাবে; পশুর পাল সেগুলো অধিকার করবে। তারা সেখানে শুয়ে থাকবে; কেউ তাদের ভয় দেখাবে না। আফরাহীমে আর কোন কেল্লা থাকবে না এবং দামেস্কে রাজশক্তি থাকবে না; সিরিয়ার বেঁচে থাকা লোকেরা বনি-ইসরাইলদের মত গৌরবহীন হবে।” এই হল আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কথা। “সেই দিন ইয়াকুবের গৌরব ্নান হবে; তার শরীরের চর্বি গলে যাবে। লোকে যেমন করে ক্ষেতের শস্য কেটে জড়ো করে, বনি-ইসরাইলদের অবস্থা তেমনই হবে। রফায়ীমের উপত্যকায় লোকে যেমন করে পড়ে থাকা শস্য কুড়ায় তাদের অবস্থা তেমনই হবে। তবুও কিছু শস্য পড়ে থাকবে। যেমন করে জলপাই গাছ ঝাড়া হলে পর উপরের ডালগুলোতে দু’তিনটা জলপাই থেকে যায় আর যে ডালে বেশী ফল ধরে সেখানে চার-পাঁচটা ফল থেকে যায়, তাদের অবস্থা তেমনই হবে।” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন। সেই দিন লোকে তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে তাকাবে, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের দিকে চোখ ফিরাবে। তারা নিজেদের হাতের তৈরী বেদীর দিকে চেয়ে দেখবে না, আর তাদের হাতের তৈরী আশেরা-খুঁটি ও ধূপ-বেদীর প্রতি কোন মনোযোগও দেবে না। সেই দিন তাদের শক্তিশালী শহরগুলো বন্তজংগলের মত হবে। যেমন করে বনি-ইসরাইলদের দরুন লোকে তাদের শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল তাদের অবস্থা তেমনই হবে। তাদের দেশ ধ্বংসস্থান হবে। তোমার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌কে তুমি ভুলে গেছ; সেই আশ্রয়-পাহাড়কে তুমি মনে রাখ নি। সেইজন্য যদিও তুমি সুন্দর সুন্দর চারা আর বিদেশ থেকে আনা আংগুর লতা লাগা"ছ, আর সেই দিনই তুমি সেগুলো বাড়িয়ে তুলছ আর সকাল বেলায় তাতে কুঁড়ি ধরা"ছ, তবুও রোগ এবং ভীষণ ব্যথার দিনে কাটবার জন্য তেমন কোন ফসল থাকবে না। হায় হায়, অনেক লোকের গর্জন শোনা যাচ্ছে! গর্জনকারী সাগরের মতই জাতিরা গর্জন করছে। জাতিদের ভীষণ চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ভয়ংকর বন্যার পানির গর্জনের মতই তারা চিৎকার করছে। ভয়ংকর বন্যার পানির শব্দের মত যদিও লোকেরা গর্জন করছে, তবুও তিনি ধমক দিলে তারা দূরে পালিয়ে যাবে। বাতাসের মুখে পাহাড়ের উপরকার তুষের মত, ঝড়ের মুখে গড়াগড়ি খাওয়া ধুলার মত তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। সন্ধ্যা বেলায় তারা ভীষণ ভয় পাবে আর সকাল হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমাদের লুটকারীদের জন্য এ-ই আছে; এটাই আমাদের লুটকারীদের ভাগ্য। হায়! ইথিওপিয়া দেশের নদীগুলোর ওপারে এমন একটা দেশ আছে যেখানে পাখার ঝিঁঝিঁ শব্দ শোনা যায়। সেই দেশ পানির উপর দিয়ে নলের তৈরী নৌকায় দূত পাঠায়। হে দ্রুতগামী দূতেরা, যে জাতি লম্বা ও মোলায়েম চামড়ার, যে জাতিকে কাছের ও দূরের লোকেরা ভয় করে, যে শক্তিশালী জাতি অন্যদের পায়ে মাড়ায় এবং যার দেশ নদ-নদী দিয়ে ভাগ করা, তোমরা তার কাছে ফিরে যাও। হে দুনিয়ার লোকেরা, হে পৃথিবীতে বাসকারী সব লোক, তোমরা দেখো, কখন পাহাড়-পর্বতের উপরে নিশান তোলা হবে, আর শুনো, কখন শিংগা বাজানো হবে। মাবুদ আমাকে বলছেন, “পরিষ্কার আকাশে রোদের তেজের মত, গরমকালে ফসল কাটবার সময়ে কুয়াশার মেঘের মত আমি চুপ করে আমার বাসস্থান থেকে দেখতে থাকব।” ফসল কাটবার আগে যখন ফুল আর থাকবে না আর সেই ফুল আংগুর হয়ে পেকে যাবে সেই সময় ছুরি দিয়ে তিনি কচি ডালগুলো কেটে ফেলবেন আর ছড়িয়ে পড়া ডালগুলো দূর করে দেবেন। পাহাড়ের শকুন ও বুনো পশুদের কাছে তাদের সবাইকে ফেলে রাখা হবে; সারা গরমকাল ধরে শকুনেরা তাদের খাবে আর বুনো পশুরা খাবে সারা শীতকাল ধরে। সেই সময় আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছে সেই লম্বা ও মোলায়েম চামড়ার জাতির কাছ থেকে উপহার আসবে। এ সেই জাতি যাকে কাছের ও দূরের লোকেরা ভয় করে। এ সেই শক্তিশালী জাতি যে অন্যদের পায়ে মাড়ায় এবং যার দেশ নদ-নদী দিয়ে ভাগ করা। সেই জাতির উপহারগুলো সিয়োন পাহাড়ে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের থাকবার জায়গায় আনা হবে। মিসর দেশ সম্বন্ধে মাবুদের কথা এই: দেখ, মাবুদ একটা দ্রুতগামী মেঘে করে মিসর দেশে আসছেন। তাঁর সামনে মিসরের মূর্তিগুলো কাঁপবে, আর মিসরীয়দের দিলে সাহস থাকবে না। মাবুদ বলছেন, “আমি এক মিসরীয়কে অন্য মিসরীয়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলব; তাতে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে, শহর শহরের বিরুদ্ধে, আর রাজ্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। মিসরীয়রা মনের বল হারিয়ে ফেলবে, আর আমি তাদের পরিকল্পনা নিষ্ফল করে দেব। তারা মূর্তি ও মৃতদের রূহের কাছে, ভূতের মাধ্যমের কাছে, আর খারাপ রূহ্‌দের সংগে সম্বন্ধ রক্ষাকারীদের কাছে পরামর্শ চাইবে। একজন কড়া মালিকের হাতে আমি মিসরীয়দের তুলে দেব; একজন ভয়ংকর বাদশাহ্‌ তাদের শাসন করবে।” এই হল দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কথা। নীল নদের পানি শুকিয়ে যাবে, আর নদীর বুকে চর পড়ে তা ফেটে যাবে। খালগুলোতে দুর্গন্ধ হবে; মিসরের নদীগুলো ছোট হয়ে শুকিয়ে যাবে; নল ও খাগড়া শুকিয়ে যাবে; নীল নদের পারের সব গাছ-গাছড়াও শুকিয়ে যাবে। নদীর ধারের বীজ লাগানো ক্ষেত শুকিয়ে ফেটে যাবে; চারাগুলো শুকিয়ে উড়ে যাবে, কিছুই থাকবে না। জেলেরা হায় হায় করবে আর নীল নদে যারা বড়শী ফেলে তারা বিলাপ করবে। যারা পানিতে জাল ফেলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। যারা মসীনার সুতা প্রস্তুত করে আর যারা পাতলা কাপড় বোনে তারা নিরাশ হবে। জগৎ-সংসারের সব ভিত্তি ভেংগে পড়বে আর দিন্তমজুরেরা সবাই প্রাণে দুঃখ পাবে। সোয়নের উঁচু পদের কর্মচারীরা একেবারে বোকা; ফেরাউনের জ্ঞানী পরামর্শদাতারা অর্থহীন উপদেশ দেয়। তোমরা ফেরাউনকে কেমন করে বলতে পার, “আমি জ্ঞানী লোকদের একজন এবং খুব পুরানো দিনের বাদশাহ্‌দের বংশধর”? তোমার জ্ঞানী লোকেরা এখন কোথায়? মিসরের বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যা ঠিক করেছেন তা তারা নিজেরা জানুক ও তোমাকে বলুক। সোয়নের উঁচু পদের কর্মচারীরা বোকা হয়েছে, আর মেম্ফিসের নেতারা ঠকেছে; মিসরের প্রধান লোকেরা মিসরকে বিপথে নিয়ে গেছে। মাবুদ তাদের ভিতরে বিশৃঙ্খলার ভাব সৃষ্টি করেছেন, তাতে মাতাল যেমন তার বমির মধ্যে টলমল করে তেমনি সব কাজে তারা মিসরকে টলমল করায়। মিসরের মধ্যে মাথা বা লেজ, খেজুরের ডাল বা নল-খাগড়া, কেউই কিছু করতে পারবে না। সেই দিন মিসরীয়রা স্ত্রীলোকদের মত হবে। তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন হাত উঠাবেন এবং তা দেখে তারা ভয়ে কাঁপবে। মিসরীয়দের কাছে কেউ এহুদা দেশের নাম করলেই তা তাদের পক্ষে ভীষণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের বিরুদ্ধে যা করবেন বলে ঠিক করেছেন তার জন্য তারা ভয় পাবে। সেই দিন মিসরের পাঁচটি শহর কেনানের ভাষা বলবে এবং আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে বলে কসম খাবে। সেই শহরগুলোর মধ্যে একটাকে বলা হবে ধ্বংসের শহর। সেই দিন মিসর দেশের মধ্যে মাবুদের উদ্দেশে একটা কোরবানগাহ্‌ আর তার সীমানায় একটা স-ম্ভ থাকবে। এই সব হবে মিসর দেশে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশে একটা চিহ্ন ও সাক্ষ্য। তাদের জুলুমবাজদের দরুন তারা যখন মাবুদের কাছে কাঁদবে তখন তিনি তাদের কাছে একজন উদ্ধারকর্তা ও রক্ষাকারীকে পাঠিয়ে দেবেন এবং তিনি তাদের উদ্ধার করবেন। এইভাবে মাবুদ মিসরীয়দের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন এবং সেই দিন তারা মাবুদকে স্বীকার করে নেবে। তারা পশু-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী করে তাঁর এবাদত করবে এবং মাবুদের কাছে মানত করে তা পূরণ করবে। মাবুদ মিসরকে আঘাত করবেন; তিনি তাদের আঘাত করবেন এবং সুস্থও করবেন। তারা মাবুদের দিকে ফিরবে, আর তিনি তাদের মিনতিতে সাড়া দেবেন ও তাদের সুস্থ করবেন। সেই দিন মিসর থেকে আশেরিয়া পর্যন্ত একটা রাজপথ হবে। আশেরীয়রা মিসরে এবং মিসরীয়রা আশেরিয়াতে যাওয়া-আসা করবে। মিসরীয় ও আশেরীয়রা এক সংগে এবাদত করবে। সেই দিন মিসর, আশেরিয়া ও ইসরাইল মিলে একটা দল হবে এবং তারা হবে দুনিয়ার মধ্যে একটা দোয়া। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের এই বলে দোয়া করবেন, “আমার বান্দা মিসর, আমার হাতে গড়া আশেরিয়া ও আমার অধিকার ইসরাইল দোয়াযুক্ত হোক।” আশেরিয়া দেশের বাদশাহ্‌ সর্গোনের পাঠানো সেনাপতি অস্‌দোদে এসে তা আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। যে বছর তিনি আক্রমণ করেছিলেন সেই বছরে মাবুদ আমোজের ছেলে ইশাইয়াকে বলেছিলেন, “তোমার শরীর থেকে ছালার চট ও পা থেকে জুতা খুলে ফেল।” এতে ইশাইয়া উলংগ হয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তারপর মাবুদ বললেন, “আমার গোলাম ইশাইয়া যেমন মিসর ও ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে একটা চিহ্ন ও ভবিষ্যতের লক্ষণ হিসাবে তিন বছর ধরে উলংগ হয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, ঠিক তেমনি করে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ মিসরকে লজ্জা দেবার জন্য মিসরীয় ও ইথিওপীয় বন্দীদের ছেলে-বুড়ো সবাইকে উলংগ অবস্থায়, খালি পায়ে ও পেছন্তখোলা অবস্থায় নিয়ে যাবে। যারা ইথিওপিয়া দেশের উপর ভরসা করেছিল এবং মিসরকে নিয়ে বড়াই করেছিল তারা ভয় পাবে ও লজ্জিত হবে। সেই দিন সাগর পারের বাসিন্দারা বলবে, ‘দেখ, যাদের উপর আমরা ভরসা করেছিলাম এবং সাহায্য পাবার জন্য ও আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য যাদের কাছে গিয়েছিলাম তাদের অবস্থা কি হয়েছে। তাহলে আমরাই বা কি করে বাঁচব?’ ” মরু-সমুদ্র সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী এই: নেগেভে যেমন করে ঘূর্ণিবাতাস বয়ে যায় তেমনি করে মরুভূমি থেকে, সেই ভয়ংকর দেশ থেকে একটা বিপদ আসছে। একটা ভীষণ দর্শন আমাকে দেখানো হয়েছে- বেঈমান বেঈমানী করছে, আর লুটকারী লুট করছে। হে ইলাম, আক্রমণ কর; মিডিয়া, ঘেরাও কর। ব্যাবিলন যে সব দুঃখ-কষ্ট ঘটিয়েছে তা আমি বন্ধ করে দেব। আমি পেটের ব্যথায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি, স্ত্রীলোকের প্রসব-যন্ত্রণার মত যন্ত্রণা আমাকে ধরেছে। আমি এমন যন্ত্রণা পাচ্ছি যে, শুনতে পাচ্ছি না, এমন ভয় পাচ্ছি যে, দেখতে পাচ্ছি না। আমার বুক ধুক্‌ ধুক্‌ করছে; ভীষণ ভয় আমাকে কাঁপিয়ে তুলছে। যে সন্ধ্যাবেলার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম তা এখন আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা খাবার সাজাচ্ছে, মাদুর বিছাচ্ছে আর খাওয়া-দাওয়া করছে। হে সেনাপতিরা, ওঠো, ঢালে তেল লাগাও। দীন-দুনিয়ার মালিক আমাকে বলছেন, “তুমি গিয়ে একজন পাহারাদার নিযুক্ত কর। সে যা কিছু দেখবে তার খবর যেন সে দেয়। সে যখন জোড়ায় জোড়ায় ঘোড়সওয়ার দেখবে আর গাধা কিংবা উটের পিঠে চড়া লোকদের দেখবে, তখন যেন সে সতর্ক হয়, পুরোপুরি সতর্ক হয়।” তখন সেই পাহারাদার চেঁচিয়ে বলবে, “হে হুজুর, দিনের পর দিন উঁচু পাহারা-ঘরে আমি দাঁড়িয়ে থাকি; আমি প্রত্যেক রাতে আমার পাহারা-স্থানেই থাকি। দেখুন, জোড়ায় জোড়ায় ঘোড়সওয়ার আসছে।” তারপর সে বলবে, “ব্যাবিলনের পতন হয়েছে, পতন হয়েছে। তার সব দেবতাদের মূর্তিগুলো চুরমার হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।” হে আমার লোকেরা, ফসলের মত তোমাদের তো মাড়াই করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে, ইসরাইলের মাবুদের কাছ থেকে আমি যা শুনেছি তা তোমাদের জানালাম। দূমা, অর্থাৎ ইদোম সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী এই: সেয়ীর থেকে কেউ আমাকে ডেকে বলল, “পাহারাদার, রাত আর কতক্ষণ আছে? পাহারাদার, রাত আর কতক্ষণ আছে?” পাহারাদার জবাব দিল, “সকাল হয়ে আসছে, কিন্তু তারপর রাতও আসছে। যদি আবার জিজ্ঞাসা করতে চাও তবে ফিরে এসে আবার জিজ্ঞাসা কোরো।” আরব সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী এই: হে দদানীয় যাত্রীর দল, তোমরা যারা আরবের মরুভূমিতে তাম্বু খাটাও, তোমরা পিপাসিত লোকদের জন্য পানি আন। হে তাইমা দেশের বাসিন্দারা, তোমরা পালিয়ে যাওয়া লোকদের জন্য খাবার আন। তারা তলোয়ারের সামনে থেকে, খোলা তলোয়ারের সামনে থেকে, বাঁকানো ধনুকের সামনে থেকে আর ভয়ংকর যুদ্ধের সামনে থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। দীন-দুনিয়ার মালিক আমাকে বললেন, “চুক্তিতে বাঁধা চাকর যেমন বছর গোণে তেমনি ঠিক এক বছরের মধ্যে কায়দারের সমস্ত জাঁকজমক শেষ হয়ে যাবে। কায়দারের ধনুকধারী যোদ্ধাদের মধ্যে অল্প লোকই বেঁচে থাকবে। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন।” দর্শন্তউপত্যকা সম্বন্ধে মাবুদের কথা এই: তোমার এখন কি হয়েছে যে, তোমার সব লোকেরা ছাদের উপরে উঠেছে? হে গোলমালে ভরা শহর, হে সোরগোল ও হৈ-হল্লার শহর, তোমার মৃত লোকেরা তো তলোয়ারের আঘাতে মরে নি কিংবা যুদ্ধেও মরে নি। তোমার নেতারা সব একসংগে পালিয়ে গেছে; ধনুক ব্যবহার না করেই তাদের ধরা হয়েছে। তোমার মধ্যে যাদের ধরা হয়েছিল, যদিও তারা দূরে পালিয়ে গিয়েছিল তবুও তাদের সবাইকে একসংগে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেইজন্য আমি বললাম, “আমার কাছ থেকে চলে যাও; আমাকে খুব করে কাঁদতে দাও। আমার লোকেরা ধ্বংস হয়েছে বলে আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা কোরো না।” দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে দর্শন্তউপত্যকায় ভীষণ ভয়ের, পায়ে মাড়াবার এবং বিশৃঙ্খলার একটা দিন এসেছে। সেটা দেয়াল ভেংগে ফেলবার এবং পাহাড়-পর্বতের কাছে কাঁদবার একটা দিন। ইলামের লোকেরা তীর রাখবার তূণ তুলে নিয়েছে; তাদের সংগে রথ ও ঘোড়সওয়ারদের দল রয়েছে। কীরের লোকেরা ঢাল নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। তোমার বাছাই করা উপত্যকাগুলো রথে ভরে গেছে, আর শহর-দরজাগুলোতে ঘোড়সওয়ারদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এহুদার রক্ষার ব্যবস্থা দূর করা হয়েছে। সেই দিন তোমরা বন্তকুটিরের অস্ত্রশস্ত্রের উপর ভরসা করেছিলে। তোমরা দাউদ-শহরের দেয়ালগুলোর মধ্যে অনেক ফাটল দেখেছিলে এবং নীচের পুকুরের পানি জমা করেছিলে। তোমরা জেরুজালেমের ঘর-বাড়ী গুণেছিলে আর দেয়াল শক্ত করবার জন্য সেগুলো ভেংগেছিলে। পুরানো পুকুরের পানি রাখবার জন্য তোমরা দুই দেয়ালের মাঝখানে একটা জায়গা তৈরী করেছিলে। কিন্তু যিনি এই অবস্থা ঘটিয়েছিলেন তোমরা তাঁর দিকে তাকালে না, কিংবা অনেক দিন আগে যিনি এই সবের পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁর প্রতি তোমাদের ভয় ছিল না। সেই সময় দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কাঁদবার ও শোক করবার জন্য, মাথার চুল কামাবার জন্য ও ছালার চট পরবার জন্য তোমাদের ডেকেছিলেন। কিন্তু দেখ, সেখানে আনন্দ ও হৈ-হল্লা চলছে, আর গরু ও ভেড়া জবাই করা এবং গোশ্‌ত ও আংগুর-রস খাওয়া চলছে। তোমরা বলছ, “এস, আমরা খাওয়া-দাওয়া করি, কারণ কালকে আমরা মরে যাব।” দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমার কাছে এই কথা প্রকাশ করেছেন, “তোমাদের মরণকালেও এই গুনাহ্‌ মাফ করা হবে না। আমি দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তুমি বাদশাহ্‌র ঐ ভাণ্ডারীর কাছে, রাজবাড়ীর ভার-পাওয়া শিব্‌নের কাছে গিয়ে বল, ‘তুমি এখানে কি করছ? আর এখানে নিজের কবর খুঁড়বার জন্য, উঁচু জায়গায় তোমার কবর ঠিক করবার জন্য, পাহাড় কেটে বিশ্রাম-স্থান বানাবার জন্য কে তোমাকে অধিকার দিয়েছে? “ ‘সাবধান, ওহে শক্তিশালী লোক, মাবুদ তোমাকে শক্ত করে ধরে ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছেন। তিনি তোমাকে শক্ত করে গুটিয়ে বলের মত করে একটা বিরাট দেশে ফেলে দেবেন। সেখানে তুমি মারা যাবে, আর তোমার চমৎকার রথগুলো সেখানে পড়ে থাকবে। তুমি তোমার মালিকের রাজবাড়ীর অসম্মান করেছ। তোমার পদ থেকে আমি তোমাকে সরিয়ে দেব; তোমার স্থান থেকে তোমাকে নীচে নামিয়ে দেওয়া হবে। “ ‘সেই দিন আমার গোলাম হিল্কিয়ের ছেলে ইলীয়াকীমকে আমি ডাকব। তাকে আমি তোমার পোশাক পরাব ও তার কোমরে তোমার কোমর-বাঁধনি বেঁধে দেব এবং তোমার কাজের ভার তার হাতে তুলে দেব। সে জেরুজালেমের বাসিন্দাদের ও এহুদার বংশের পিতার মত হবে। তার কাঁধে আমি দাউদের বংশের চাবি রাখব; সে যা খুলবে তা কেউ বন্ধ করতে পারবে না, আর যা বন্ধ করবে তা কেউ খুলতে পারবে না। একটা শক্ত জায়গায় আমি তাকে গোঁজের মত করে লাগিয়ে দেব, তার পিতার বংশের জন্য সে হবে একটা সম্মানের আসন। তার বংশের সব বোঝা তার কাঁধেই ঝুলবে। সব রকম ছোটখাট পাত্র যেমন গোঁজে ঝোলে তেমনি তার ছেলেমেয়ে ও বংশধরেরা তাঁর কাঁধেই ঝুলতে থাকবে। যে গোঁজটা শক্ত জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই দিন সেটা খুলে আসবে; সেটা পড়ে যাবে এবং তার উপরে যে ভার ঝুলছিল সেটা কেটে ফেলা হবে।’ ” এই হল আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কথা। এই সব ঘটবে, কারণ মাবুদ নিজেই তা বলেছেন। টায়ার সম্বন্ধে মাবুদের কথা এই: হে বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ, হাহাকার কর, কারণ টায়ার ধ্বংস হয়ে গেছে; সেখানে ঘরও নেই, বন্দরও নেই। সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে তোমরা এই খবর পেয়েছ। হে সাগর পারের লোকেরা, হে সিডনের বণিকেরা, তোমরা নীরব হও। তোমাদের নাবিকেরা সাগর পার হয়ে যেত। শীহোর নদীর, অর্থাৎ নীল নদের পারের শস্য বড় সাগরের উপর দিয়ে আসত; টায়ারের আয় ছিল সেই নদীর পারের ফসল, আর টায়ার হয়ে উঠেছিল সব জাতির বাজার। হে সিডন, লজ্জিত হও, কারণ সাগর, সাগরের কেল্লা এই কথা বলছে, “আমার প্রসব-যন্ত্রণাও হয় নি, আমি জন্মও দিই নি। আমি ছেলেদের মানুষ করি নি আর মেয়েদের বড় করি নি।” মিসরে এই খবর গেলে পর মিসরীয়রা টায়ারের খবরে দারুণ মনোকষ্ট পাবে। হে সাগর পারের লোকেরা, হাহাকার কর; তোমরা পার হয়ে তর্শীশে যাও। এই কি তোমাদের সেই আনন্দ করবার শহর, সেই পুরানো, খুব পুরানো শহর, যার লোকেরা দূর দেশে বাস করবার জন্য যেত? যে টায়ার অন্যদের তাজ পরাত, যার বণিকেরা রাজপুরুষ আর ব্যবসায়ীরা দুনিয়াতে নাম-করা, তার বিরুদ্ধে কে এই পরিকল্পনা করেছে? তার সমস্ত অহংকারকে ধ্বংস করবার জন্য আর দুনিয়ার নাম-করা লোকদের নীচু করবার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই এই পরিকল্পনা করেছেন। হে তর্শীশের লোকেরা, নীল নদের পানি যেমন কিনারা ছাপিয়ে যায় তেমনি করে তোমরাও দেশে ছড়িয়ে পড়; তোমাদের আট্‌্‌কে রাখবার মত আর কেউ নেই। মাবুদ সমুদ্রের উপরে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আর রাজ্যগুলো কাঁপিয়ে তুলেছেন। তিনি কেনান দেশ সম্বন্ধে এক হুকুম জারি করেছেন যেন তার কেল্লাগুলো ধ্বংস করা হয়। তিনি বলেছেন, “হে সিডনের লোকেরা, তোমাদের আনন্দ শেষ হয়েছে, কারণ তোমরা তো অত্যাচারিত হয়েছ। ওঠো, পার হয়ে সাইপ্রাস দ্বীপে যাও; সেখানেও তোমরা বিশ্রাম পাবে না।” ব্যাবিলন দেশের দিকে তাকাও; এক সময় তার লোকদের বিশেষ কেউ জানত না। আশেরীয়রা ব্যাবিলনকে মরুভূমির প্রাণীদের জায়গা করেছে, কিন্তু ব্যাবিলনীয়রা টায়ারকে আক্রমণ করবার জন্য পাহারা-ঘরের মত উঁচু উঁচু রথ তৈরী করেছে, তার বড় বড় বাড়ী লুট করেছে আর তাকে একটা ধ্বংসের স্তূপ বানিয়েছে। হে বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ, তোমরা হাহাকার কর, কারণ তোমাদের আশ্রয়-বন্দর ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সময় একজন বাদশাহ্‌র জীবনকাল, অর্থাৎ সত্তর বছরের জন্য টায়ারকে ভুলে থাকা হবে। কিন্তু সেই সত্তর বছরের শেষে বেশ্যার গানের মত টায়ারের অবস্থা এই রকম হবে: হে ভুলে যাওয়া বেশ্যা, বীণা নিয়ে শহরে হেঁটে বেড়াও। সুন্দর করে বীণা বাজাও; অনেক গান কর যাতে তোমাকে আবার মনে করা যায়। সত্তর বছর পার হয়ে গেলে পর মাবুদ টায়ারের দিকে মনোযোগ দেবেন। তখন সে তার ব্যবসার কাজে ফিরে গিয়ে দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যের সংগে ব্যবসা চালাবে। কিন্তু তার লাভ ও আয় মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করা হবে; সেগুলো জমিয়ে রাখা বা মজুদ করা হবে না। যারা মাবুদের সামনে চলাফেরা করে তাদের প্রচুর খাবার ও সুন্দর কাপড়-চোপড়ের জন্য তার সেই লাভ খরচ করা হবে। দেখ, মাবুদ দুনিয়াকে একেবারে খালি করতে ও ধ্বংস করতে যাচ্ছেন। তিনি তার উপরের অংশ উল্টে ফেলে তার বাসিন্দাদের ছড়িয়ে ফেলবেন। সেই দিন ইমাম ও সাধারণ লোকদের, মালিক ও চাকরের, কর্ত্রী ও বাঁদীর, দোকানদার ও খদ্দেরের, যে ধার করে ও যে ধার দেয় তাদের এবং ঋণী ও ঋণদাতার সকলের অবস্থা একই রকম হবে। দুনিয়া একেবারে খালি হয়ে পড়ে থাকবে, তা সম্পূর্ণভাবে লুট করা হবে। মাবুদ এই কথা বলেছেন। দুনিয়া শোকে নিসে-জ হয়ে যাবে; পৃথিবী ্নান ও নিসে-জ হবে এবং দুনিয়ার সম্মানিত লোকেরা ্নান হবে। দুনিয়াকে তার লোকেরা নোংরা করে ফেলেছে। তারা শরীয়ত অমান্য করেছে; তারা নিয়ম ভেংগেছে আর মাবুদের চিরস্থায়ী ব্যবস্থামত চলে নি। সেইজন্য একটা বদদোয়া দুনিয়াকে গ্রাস করবে; তার লোকেরা দোষী হবে। সেইজন্য দুনিয়ার বাসিন্দাদের পুড়িয়ে ফেলা হবে আর খুব কম লোকই বেঁচে থাকবে। নতুন আংগুর-রস থাকবে না ও আংগুর লতা নিসে-জ হবে; যারা আমোদ-আহ্লাদ করে তারা সবাই দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবে। খঞ্জনির ফুর্তি, হৈ-হুল্লোড়কারীদের শব্দ আর বীণার আনন্দ-গান সব থেমে যাবে। তারা আর গান করে করে আংগুর-রস খাবে না; মদখোরদের মুখে মদ তেতো লাগবে। শহর ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকবে। সমস্ত বাড়ী-ঘর বন্ধ হয়ে যাবে; ভিতরে যাওয়া যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় আংগুর-রসের জন্য চিৎকার উঠবে। সমস্ত আনন্দের বদলে দুঃখ হবে, আর দুনিয়া থেকে সব আমোদ-আহ্লাদ দূর হয়ে যাবে। শহর ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে থাকবে এবং তার দরজা টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে যাবে। জলপাই গাছ ঝাড়া হলে পর আর আংগুর তুলে নেবার পর যেমন অল্পই ফল গাছে থাকে, দুনিয়ার জাতিগুলোর অবস্থা তেমনই হবে। তারা চিৎকার করবে ও আনন্দে কাওয়ালী গাইবে। তারা পশ্চিম দিক থেকে জোরে জোরে মাবুদের মহিমার প্রশংসা করবে। সেইজন্য পূর্ব দিকের লোকেরা মাবুদের গৌরব করুক এবং দূর দেশের লোকেরা ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুক। দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে আমরা এই কাওয়ালী শুনতে পাচ্ছি, “ন্যায়পরায়ণ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক!” কিন্তু আমি বললাম, “হায়! আমি সর্বনাশের মধ্যে পড়ে আছি, কারণ বেঈমানেরা বেঈমানী করছে; জ্বী, তারা খুব বেঈমানী করছে।” হে দুনিয়ার লোকেরা, তোমাদের জন্য ভয়, গর্ত ও ফাঁদ অপেক্ষা করে আছে। যে লোক ভয়ের শব্দে পালাবে সে গর্তে পড়বে, আর যে গর্ত থেকে উঠে আসবে সে ফাঁদে ধরা পড়বে। আসমানে ফাটল ধরবে আর দুনিয়ার ভিত্তিগুলো কাঁপবে। দুনিয়া টুকরা টুকরা হবে, দুনিয়া ভেংগে পড়বে, দুনিয়া ভীষণভাবে কাঁপবে। দুনিয়া মাতালের মত টলবে, বাতাসে দুলতে থাকা কুঁড়ে-ঘরের মত দুলবে। তার গুনাহের ভার তার উপর এত বেশী হবে যে, সে পড়ে যাবে; সে আর কখনও উঠতে পারবে না। সেই দিন মাবুদ উপরে আসমানের সব ক্ষমতার অধিকারীদের শাস্তি দেবেন, আর দুনিয়াতে শাস্তি দেবেন বাদশাহ্‌দের। জেলখানার গর্তে যেমন বন্দীদের একসংগে রাখা হয় তেমনি করে তাদের একসংগে রাখা হবে। তাদের বন্ধ করা হবে জেলখানায় আর অনেক দিন পরে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। চাঁদ হতভম্ব হবে আর সূর্য লজ্জিত হবে, কারণ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন সিয়োন পাহাড় ও জেরুজালেমে রাজত্ব করবেন, আর তাঁর বৃদ্ধ নেতারা তাঁর মহিমা দেখতে পাবে। হে আল্লাহ্‌, তুমিই আমার মাবুদ; আমি তোমার গৌরব করব আর তোমার প্রশংসা করব। যে সব অলৌকিক চিহ্ন অনেক দিন আগেই তুমি পরিকল্পনা করেছিলে তা তুমি সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে করেছ। তুমি শহরকে পাথরের ঢিবি করেছ আর দেয়াল-ঘেরা শহরকে করেছ ধ্বংসের স্তূপ। বিদেশী শত্রুদের কেল্লা আর থাকবে না; তা কখনও আর তৈরী করা হবে না। সেইজন্য শক্তিশালী জাতিরা তোমার প্রশংসা করবে এবং নিষ্ঠুর জাতিদের শহরগুলো তোমাকে ভয় করবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই পাহাড়ের উপরে সব জাতির লোকদের জন্য ভাল ভাল খাবার জিনিসের আর পুরানো আংগুর-রসের এক মহাভোজ দেবেন; তাতে থাকবে সবচেয়ে ভাল গোশ্‌ত আর সবচেয়ে ভাল আংগুর-রস। যে পর্দায় সব জাতির লোকেরা ঢাকা পড়েছে, যে চাদর সব জাতিকে ঢেকে ফেলেছে, এই পাহাড়েই তিনি তা নষ্ট করে দেবেন। মৃত্যুকে তিনি চিরকালের জন্য ধ্বংস করবেন। আল্লাহ্‌ মালিক সকলের চোখের পানি মুছিয়ে দেবেন আর সমস্ত দুনিয়া থেকে তাঁর বান্দাদের অসম্মান দূর করবেন। মাবুদ এই কথা বলেছেন। সেই দিন লোকে বলবে, “দেখ, ইনিই আমাদের আল্লাহ্‌; আমরা তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম যেন তিনি আমাদের উদ্ধার করেন। ইনিই মাবুদ; আমরা তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। এস, আমরা তাঁর উদ্ধার-কাজের জন্য আনন্দ করি ও খুশী হই।” মাবুদের হাত এই পাহাড়ের উপরে থাকবে। গোবরের সংগে খড় যেমন পায়ে মাড়ানো হয় ঠিক তেমনি করে মোয়াবকেও তিনি পায়ে মাড়াবেন। সাঁতারু যেমন হাত বাড়িয়ে সাঁতার কাটে তেমনি করে তারা গোবরের মধ্যে হাত বাড়াবে। তাদের হাতের চেষ্টা মিথ্যা হবে; আল্লাহ্‌ তাদের অহংকার ভেংগে দেবেন। তিনি মোয়াবের দেয়ালের উঁচু কেল্লাগুলো ধ্বংস করবেন; তিনি সেগুলো মাটিতে, এমন কি, ধুলায় মিশিয়ে দেবেন। সেই দিন এহুদা দেশে এই কাওয়ালীটি গাওয়া হবে: আমাদের একটা শক্ত শহর আছে; আল্লাহ্‌র দেওয়া উদ্ধার হবে তার দেয়াল ও রক্ষার ব্যবস্থা। তোমরা দরজা খুলে দাও যাতে সৎ ও বিশ্বস্ত সেই জাতি ঢুকতে পারে। যার মন তোমার উপর স্থির আছে তাকে তুমি পূর্ণ শান্তিতে রাখবে, কারণ সে তোমার উপর ভরসা করে। তোমরা চিরদিনের জন্য মাবুদের উপর ভরসা কর, কারণ মাবুদ, সেই মাবুদই চিরস্থায়ী আশ্রয়-পাহাড়। যারা উঁচুতে বাস করে তাদের তিনি নীচুতে নামান; সেই উঁচু শহরকে তিনি ধ্বংস করে নীচু করেন। তিনি তা মাটিতে, এমন কি, ধুলায় মিশিয়ে দেন। অত্যাচারিত ও গরীবেরা তা পায়ে মাড়ায়। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের পথ সমান থাকে; হে ন্যায়বান, তুমি আল্লাহ্‌ভক্তদের পথ সমান করে থাক। জ্বী, মাবুদ, আমরা তোমার ন্যায় পথে চলে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি; আমরা চাই যেন তুমি তোমার কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হও। রাতে আমার প্রাণ তোমার জন্য কাঁদে; আমার রূহ্‌ তোমার জন্য আকুল হয়। দুনিয়াতে তোমার ন্যায়বিচার আসলে পর দুনিয়ার লোক সততা শিক্ষা পাবে। দুষ্টদের দয়া দেখানো হলেও তারা সততা শিক্ষা করে না; এমন কি, ন্যায়ের দেশেও তারা অন্যায় করতে থাকে আর মাবুদের গৌরব স্বীকার করে না। হে মাবুদ, তোমার হাত তুমি উঁচুতে উঠিয়েছ, কিন্তু তারা তা দেখে না। তোমার বান্দাদের জন্য তোমার আগ্রহ তারা দেখুক এবং লজ্জিত হোক; আগুন তোমার শত্রুদের পুড়িয়ে ফেলুক। হে মাবুদ, আমাদের জন্য তুমি শান্তি স্থাপন করবে; কারণ আমরা যা করতে পেরেছি তা সবই তুমি আমাদের জন্য করেছ। হে আল্লাহ্‌, আমাদের মাবুদ, তুমি ছাড়া অন্য মালিকেরাও আমাদের উপর কর্তা হয়েছিল, কিন্তু কেবল তোমাকেই আমরা স্বীকার করি। তারা এখন মরে গেছে, আর বেঁচে নেই; তাদের রূহ্‌গুলো আর বেঁচে উঠবে না। তুমি তাদের শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছ; তাদের বিষয় তুমি একেবারে মুছে ফেলেছ। হে মাবুদ, তুমি এই জাতিকে বড় করেছ; এই জাতিকে বড় করে তুমি গৌরব লাভ করেছ; তুমি দেশের সমস্ত সীমা বাড়িয়ে দিয়েছ। হে মাবুদ, কষ্টের সময় তারা তোমাকে দেখেছিল; তোমার কাছ থেকে শাস্তি পাবার সময় তারা আকুল হয়ে ফিস্‌ ফিস্‌ করে মুনাজাত জানিয়েছিল। গর্ভবতী স্ত্রীলোক প্রসবের সময় যেমন ব্যথায় মোচড়ায় ও চিৎকার করে, হে মাবুদ, আমরাও তোমার সামনে তেমনই হয়েছি। আমরা গর্ভবতী হয়েছি, ব্যথায় মোচড় দিয়েছি, কিন্তু আমরা জন্ম দিয়েছি বাতাসের। আমাদের দ্বারা দেশ রক্ষা পায় নি, দুনিয়ার লোকও আমাদের দ্বারা জীবন পায় নি। কিন্তু তোমার মৃত বান্দারা বাঁচবে; তাদের মৃতদেহ বেঁচে উঠবে। তোমরা যারা ধুলায় বাস কর, তোমরা জাগো এবং আনন্দে চিৎকার কর। সকালের শিশির যেমন দুনিয়াকে সতেজ করে তেমনি তুমি মৃতদের জীবন দেবে। হে আমার লোকেরা, তোমরা যাও, তোমাদের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ কর; তোমরা নিজেদের লুকিয়ে রাখ, কারণ অল্পক্ষণ পরে তাঁর রাগ থেমে যাবে। দেখ, দুনিয়ার লোকদের গুনাহের শাস্তি দেবার জন্য মাবুদ তাঁর বাসস্থান থেকে বেরিয়ে আসছেন। দুনিয়ার উপরে যে রক্তপাত হয়েছে তা প্রকাশ করা হবে; হত্যা করা তার লোকদের আর সে লুকিয়ে রাখবে না। সেই দিন মাবুদ তাঁর ভয়ংকর, মহান ও ক্ষমতাপূর্ণ তলোয়ার দিয়ে সেই এঁকে-বেঁকে পালিয়ে যাওয়া সাপ লিবিয়াথনকে শাস্তি দেবেন। তিনি সমুদ্রের সেই দানবকে কেটে ফেলবেন। সেই দিন এই কাওয়ালী গাওয়া হবে: “তোমরা কাওয়ালী গাও সেই আংগুর ক্ষেতের বিষয় নিয়ে যেখান থেকে রস পাওয়া যায়। আমি মাবুদ তার দেখাশোনা করি; আমি সব সময় তাতে পানি দিই। যাতে কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য দিনরাত আমি তা পাহারা দিই। তার উপর আমার রাগ নেই। আহা, কাঁটাঝোপ ও কাঁটাবন যেন আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়! তাহলে আমি তাদের পায়ে মাড়াব আর সেগুলো সবই পুুড়িয়ে দেব। সেগুলো বরং আশ্রয়ের জন্য আমার কাছে আসুক; আমার সংগে শান্তি স্থাপন করুক। জ্বী, তারা আমার সংগে শান্তি স্থাপন করুক। আগামী দিনগুলোতে ইয়াকুব শিকড় বসাবে, ইসরাইল কুঁড়ি ধরিয়ে ফুল ফোটাবে আর ফল দিয়ে সারা দুনিয়া ভরিয়ে দেবে।” ইসরাইলের আঘাতকারীদের যেমন মাবুদ আঘাত করেছেন তেমনি করে তিনি ইসরাইলকে আঘাত করেন নি; যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের মত করে তিনি তাকে হত্যা করেন নি। তিনি বিচার করে তাকে বের করে দিয়েছেন, কিন্তু তাতে পাওনার অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হয় নি; পূর্বের বাতাসের মত করে তাঁর ভীষণ ঝাপটায় তিনি তাকে তাড়িয়ে বের করে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ইয়াকুবের গুনাহের দেনা পরিশোধ করা হবে, কিন্তু তার সব গুনাহ্‌ দূর করবার আগে চুনা পাথরের মত করে সে তার বেদীর সব পাথর চুরমার করবে; কোন আশেরা-খুঁটি বা ধূপ-বেদী থাকবে না। দেয়াল-ঘেরা শহরটা নির্জন হয়েছে; তা ছেড়ে যাওয়া বাসস্থান ও মরুভূমির মত ত্যাগ করা হয়েছে। সেখানে বাছুর চরে বেড়াবে ও শুয়ে থাকবে; তারা গাছের সব পাতা খেয়ে ফেলবে। তার ডালপালা শুকালে পর ভেংগে ফেলা হবে আর স্ত্রীলোকেরা এসে সেগুলো দিয়ে আগুন জ্বালাবে। এটা একটা বুদ্ধিহীন জাতি, কাজেই যিনি তাদের তৈরী করেছেন তাদের উপর তাঁর কোন মমতা নেই; তাদের প্রতি তাদের সৃষ্টিকর্তার কোন রহমত নেই। হে বনি-ইসরাইলরা, সেই দিন বয়ে যাওয়া ফোরাত থেকে মিসরের শুকনা নদী পর্যন্ত শস্য ঝাড়ার মত করে মাবুদ তোমাদের ঝাড়বেন, আর এক এক করে তোমাদের জমায়েত করবেন। সেই দিন একটা বিরাট শিংগা বাজবে। এতে যারা আশেরিয়া দেশে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল এবং যাদের মিসর দেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তারা আসবে আর জেরুজালেমের পবিত্র পাহাড়ে মাবুদের এবাদত করবে। হায়, আফরাহীমের মাতালদের তাজের মত শহর, যা নিয়ে তারা অহংকার করে! হায়, আফরাহীমের গৌরবময় সৌন্দর্যের সেই ্নান হওয়া মালা, যা একটা উর্বর উপত্যকার মাথার উপর রয়েছে! আংগুর-রস সেই উপত্যকার লোকদের খেয়ে ফেলেছে। দেখ, দীন-দুনিয়ার মালিকের একজন ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী লোক আছে। শিলাবৃষ্টি ও ধ্বংসকারী একটা বাতাসের মত, মুষলধারে পড়া একটা বন্যার বৃষ্টির মত সে সজোরে সেই শহরকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আফরাহীমের মাতালদের সেই অহংকারের তাজ পায়ের তলায় মাড়ানো হবে। আফরাহীমের গৌরবময় সৌন্দর্যের সেই ্নান হওয়া মালা যা একটা উর্বর উপত্যকার মাথার উপর রয়েছে, তা প্রথমে পাকা ডুমুরের মত শেষ হয়ে যাবে; কেউ তা দেখলে হাতে নিয়ে গিলে ফেলবে। সেই দিন আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর বেঁচে থাকা বান্দাদের জন্য একটা গৌরবময় তাজ এবং একটা সুন্দর মালা হবেন। তিনি বিচারকের দিলে ন্যায়বিচারের মনোভাব দেবেন। যারা দরজার কাছ থেকে যুদ্ধ সরিয়ে দেয় তাদের তিনি শক্তি দেবেন। কিন্তু আফরাহীমের ইমাম ও নবীরা এখন আংগুর-রস খেয়ে টলে ও মাতলামি করে আর মদ খেয়ে গড়াগড়ি দেয়; তারা টলতে টলতে দর্শন পায় আর সেই অবস্থায় রায় দেয়। সব টেবিলগুলো বমিতে ভরা; বমি ছাড়া একটু জায়গাও পরিষ্কার নেই। তারা বলে, “সে কাকে শিক্ষা দিচ্ছে? তার বাণী কার কাছে ব্যাখ্যা করছে? যারা দুধ খাওয়া ছেড়েছে, বুকের দুধ থেকে যাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের কাছে কি? তা হল, ‘এটা কর, ওটা কর, এই নিয়ম মান, ঐ নিয়ম মান, এখানে আছে, ওখানে আছে।’ ” ভাল, তাহলে মাবুদ বিদেশীদের মুখের অদ্ভুত ভাষা দিয়ে এই লোকদের কাছে কথা বলবেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, “এটাই সেই বিশ্রামের জায়গা, ক্লান্ত লোকেরা এখানে বিশ্রাম করুক। দেখ, এই সেই আরামের জায়গা।” কিন্তু তারা তা শুনল না। কাজেই তাদের কাছে মাবুদের কথা হবে, “এটা কর, ওটা কর, এই নিয়ম মান, ঐ নিয়ম মান, এখানে আছে, ওখানে আছে,” যাতে তারা গিয়ে পিছন দিকে পড়ে যায় আর আঘাত পেয়ে ফাঁদে ধরা পড়ে। সেইজন্য হে ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীরা, তোমরা যারা জেরুজালেমে এই লোকদের শাসন করে থাক, তোমরা মাবুদের কালাম শোন। তোমরা বড়াই করে বল, “আমরা মৃত্যুর সংগে, কবরের সংগে একটা চুক্তি করেছি। ধ্বংসের চাবুক যখন জোরে নেমে আসবে তখন তা আমাদের কাছে আসবে না, কারণ আমরা মিথ্যাকে আমাদের আশ্রয়স্থান আর ছলনাকে আমাদের লুকাবার জায়গা করেছি।” কাজেই আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছেন, “দেখ, আমি যাচাই করে নেওয়া খুব দামী একটা পাথর বেছে নিয়েছি; সেটা সিয়োনের ভিত্তির কোণের পাথর হিসাবে স্থাপন করেছি। যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে সব সময় স্থির থাকবে। আমি ন্যায়বিচারকে মাপের দড়ি আর সততাকে ওলনদড়ি করব; শিলাবৃষ্টি তোমাদের আশ্রয়স্থানরূপ মিথ্যাকে ধ্বংস করে দেবে, আর বন্যা তোমাদের লুকাবার জায়গা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মৃত্যুর সংগে তোমরা যে চুক্তি করেছ তা বাতিল করা হবে; কবরের সংগে তোমাদের যে চুক্তি হয়েছে তা স্থির থাকবে না। ধ্বংসের চাবুক যখন জোরে নেমে আসবে, তখন তা দিয়ে তোমাদের মারা হবে। তা যতবার নেমে আসবে ততবার তোমাদের মারা হবে; সকালের পর সকাল, দিনে ও রাতে তা জোরে নেমে আসবে। এই কথা বুঝতে পারলে তোমরা ভীষণ ভয় পাবে।” লম্বা হয়ে শোবার জন্য তোমাদের বিছানা খাটো, আর গায়ে জড়াবার জন্য কম্বলও ছোট। মাবুদ যুদ্ধ করবেন, যেমন করে তিনি পরাসীম পাহাড়ে করেছিলেন। তিনি উত্তেজিত হবেন, যেমন গিবিয়োন উপত্যকায় হয়েছিলেন। এইভাবে তিনি তাঁর কাজ, তাঁর অদ্ভুত ও অসাধারণ কাজ শেষ করবেন। কাজেই এখন তোমাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ থামাও, তা না হলে তোমাদের বাঁধন আরও শক্ত হবে; কারণ দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের মুখে আমি গোটা দেশের জন্য ঠিক করা ধ্বংসের কথা শুনেছি। শোন, আমার কথায় কান দাও; আমি যা বলি তা মন দিয়ে শোন। চাষী বীজ বুনবার জন্য কি অনবরত চাষ করে? সে কি সব সময় ঢেলা ভাংগে আর জমিতে মই দেয়? মাটির উপরটা সমান করলে পর সে কি কালোজিরা এবং জিরা বোনে না? সে কি সারি সারি করে গম, জায়গামত যব আর ক্ষেতের সীমানায় জনার লাগায় না? তার আল্লাহ্‌ তাকে নির্দেশ দেন এবং তাকে ঠিক পথ শিক্ষা দেন। কালোজিরা ভারী যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করা হয় না, কিংবা জিরার উপর দিয়ে গাড়ির চাকা গড়ানো হয় না, বরং লাঠি দিয়ে কালোজিরা ও জিরা মাড়াই করা হয়। অনেক দিন ধরে কেউ গম মাড়াই করতে থাকে না, তাতে তা নষ্ট হয়ে যায়; মাড়াই করবার সময় সে তার উপর দিয়ে এমনভাবে গাড়ির চাকা ও ঘোড়া চালায় যাতে তা নষ্ট না হয়। এই সব জ্ঞান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে আসে। তাঁর পরামর্শ আশ্চর্য ও তাঁর জ্ঞান চমৎকার। হায়, অরীয়েল, অরীয়েল, দাউদের বাসস্থানের শহর! তুমি বছরের পর বছর পার করে যাচ্ছ আর তোমার ঈদগুলো ঘুরে ঘুরে আসছে। কিন্তু আমি অরীয়েলের উপর বিপদ আনব। সে শোক ও বিলাপ করবে; সে আমার কাছে একটা অরীয়েলের মত, অর্থাৎ একটা কোরবানগাহের মত হবে। আমি তোমার চারপাশে তোমার বিরুদ্ধে ছাউনি ফেলব, কেল্লা গড়ে তোমাকে ঘেরাও করব, আর তোমার বিরুদ্ধে উঁচু করে ঢিবি তৈরী করব। তোমাকে নীচে নামানো হবে এবং তুমি মাটি থেকে কথা বলবে; ধুলার মধ্য থেকে অস্পষ্টভাবে তোমার কথা বের হবে। ভূতের স্বরের মত মাটি থেকে তোমার স্বর আসবে; ধুলার মধ্য থেকে তোমার কথা ফিস্‌ ফিস্‌ করে বের হবে। তখন সমস্ত জাতির যে দলগুলো অরীয়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, অর্থাৎ যারা তাকে ও তার কেল্লাকে আক্রমণ করছে আর তাকে বিপদে ফেলছে তারা হবে স্বপ্নের মত আর রাতের বেলার দর্শনের মত। যারা সিয়োন পাহাড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে সেই সব জাতির দলগুলোর অবস্থা এই রকম হবে- খিদে পাওয়া লোক যেমন খাওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু জাগলে পর তার খিদে থেকে যায়; আবার পিপাসা পাওয়া লোক যেমন পানি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু তার পিপাসা মেটে না আর সে দুর্বল অবস্থায় জেগে ওঠে। তোমরা অবাক ও আশ্চর্য হও; চোখ বন্ধ করে অন্ধ হও; মাতাল হও, কিন্তু আংগুর-রস খেয়ে নয়; টলতে থাক, কিন্তু মদের দরুন নয়; কারণ মাবুদ তোমাদের উপর একটা গভীর ঘুম এনেছেন; তোমাদের চোখ যে নবীরা, তোমাদের সেই চোখ তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন আর তোমাদের মাথা যে দর্শকেরা, তোমাদের সেই মাথা তিনি ঢেকে দিয়েছেন। এই গোটা দর্শনটাই তোমাদের কাছে কেবল সীলমোহর করা গুটানো-কিতাবের মত হয়েছে। যে তেলাওয়াত করতে জানে তাকে যদি সেই কিতাবটা দিয়ে বলা হয়, “দয়া করে এটা তেলাওয়াত করুন,” তবে জবাবে সে বলবে, “আমি পারব না, কারণ এটা সীলমোহর করা হয়েছে।” কিংবা যে তেলাওয়াত করতে জানে না তাকে কিতাবটা দিয়ে যদি বলা হয়, “দয়া করে এটা তেলাওয়াত করুন,” তবে জবাবে সে বলবে, “আমি তেলাওয়াত করতে জানি না।” দীন-দুনিয়ার মালিক বলছেন, “এই লোকেরা মুখেই আমার এবাদত করে আর মুখেই আমাকে সম্মান করে, কিন্তু তাদের দিল আমার কাছ থেকে দূরে থাকে। তারা কেবল মানুষের শিখানো নিয়ম দিয়ে আমার এবাদত করে। কাজেই আমি আবার চমৎকার অলৌকিক চিহ্ন দিয়ে এই লোকদের হতভম্ব করে দেব; তাতে জ্ঞানীদের জ্ঞান নষ্ট হয়ে যাবে আর বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি অদৃশ্য হবে।” ঘৃণ্য সেই লোকেরা, যারা মাবুদের কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনা লুকাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। তারা অন্ধকারে তাদের কাজ করে আর ভাবে, “কে আমাদের দেখছে? কে জানতে পারবে?” তোমাদের কেমন উল্টা বুদ্ধি! তোমরা তো কুমার আর মাটিকে একই সমান ধরছ! যে তৈরী করছে তার তৈরী জিনিস কি তার বিষয় বলতে পারে, “সে আমাকে তৈরী করে নি”? পাত্র কি কুমারের বিষয়ে বলবে, “সে কিছুই জানে না”? অল্পকালের মধ্যে তো লেবাননের বন একটা উর্বর জমি হয়ে উঠবে আর উর্বর জমি বনের মত মনে হবে। সেই দিন বধিররা সেই গুটানো-কিতাবের কথা শুনতে পাবে, আর গভীর অন্ধকারে থাকা অন্ধেরা দেখতে পাবে। নম্র লোকেরা আবার মাবুদকে নিয়ে আনন্দিত হবে, আর যারা খুব গরীব তারা ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাককে নিয়ে আনন্দ করবে। নিষ্ঠুরেরা আর থাকবে না; ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীরাও শেষ হয়ে যাবে, আর যারা খারাপ কাজ করতে চায় তাদের ধ্বংস করে ফেলা হবে। তারা মিথ্যা কথা দিয়ে মানুষকে দোষী করে, শহর-দরজায় নির্দোষীর পক্ষে থাকা লোককে ফাঁদে ফেলে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে নির্দোষীকে ন্যায়বিচার পেতে দেয় না। সেইজন্য ইব্রাহিমের মুক্তিদাতা মাবুদ ইয়াকুবের বংশ সম্বন্ধে বলছেন, “ইয়াকুব আর লজ্জা পাবে না; তাদের মুখ আর ফ্যাকাশে হবে না। যখন তারা তাদের মধ্যে আমার হাতের কাজ, অর্থাৎ তাদের ছেলেমেয়েদের দেখবে তখন তারা আমাকে পবিত্র বলে মানবে। ইয়াকুবের আল্লাহ্‌ পাককে তারা পবিত্র বলে স্বীকার করবে আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌কে ভয় করবে। যারা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না তারা ভালভাবে বুঝতে পারবে, আর যারা অসন্তোষ প্রকাশ করে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে।” মাবুদ বলছেন, “ঘৃণ্য সেই একগুঁয়ে সন্তানেরা, যারা পরিকল্পনামত কাজ করে কিন্তু আমার পরিকল্পনামত নয়। তারা বন্ধুত্ব স্থাপন করে কিন্তু আমার রূহের ইচ্ছামত নয়। এইভাবে তারা গুনাহের উপরে গুনাহ্‌ বোঝাই করে। তারা আমার সংগে পরামর্শ না করে মিসরে যায়; তারা সাহায্যের জন্য ফেরাউনের আশ্রয় তালাশ করে আর মিসরের ছায়ায় খোঁজে রক্ষার স্থান। কিন্তু ফেরাউনের আশ্রয়ে তারা লজ্জা পাবে এবং মিসরের ছায়া তাদের অসম্মান আনবে। যদিও সোয়নে তাদের উঁচু পদের কর্মচারী আছে আর তাদের দূতেরা হানেষে পৌঁছেছে, তবুও তাদের প্রত্যেককে লজ্জায় ফেলা হবে, কারণ সেই জাতি তাদের কোন উপকারে আসবে না। তারা সাহায্য বা সুবিধা কিছুই দিতে পারবে না; দেবে কেবল লজ্জা ও অসম্মান।” নেগেভের পশুদের সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী এই: সেই দূতেরা কষ্ট ও দুর্দশাপূর্ণ দেশের মধ্য দিয়ে এবং সিংহ ও সিংহী, বিষাক্ত সাপ ও উড়ন্ত বিষাক্ত সাপের দেশের মধ্য দিয়ে যায়। তারা তাদের ধন-সম্পদ গাধার পিঠে করে আর তাদের দামী জিনিস উটের পিঠে করে সেই জাতির কাছে বয়ে নিয়ে যায় যাদের দ্বারা তাদের কোন লাভ হবে না। মিসরের সাহায্য অসার, কোন কাজের নয়; সেইজন্য আমি সেই জাতির নাম রেখেছি রহব-হেম-শবৎ, অর্থাৎ যে গর্বিত জাতি চুপ করে বসে থাকে। তুমি এখন এই কথা একটা ফলকে ও একটা কিতাবে লিখে রাখ, যেন আগামী দিনগুলোতে সেটা বনি-ইসরাইলদের জন্য একটা চিরস্থায়ী সাক্ষ্য হয়ে থাকে। এই লোকেরা বিদ্রোহী ও মিথ্যাবাদী; তারা মাবুদের শিক্ষা শুনতে রাজী নয়। তারা দর্শকদের বলে, “তোমরা আর দর্শন দেখো না,” আর নবীদের বলে, “যা সত্যি তা আমাদের আর বোলো না। আমাদের কাছে সুখের কথা বল; যা সত্যি নয় এমন সব বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী বল। পথ ছাড়, রাস্তা থেকে সরে যাও। আমরা আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের কথা শুনতে চাই না।” সেইজন্য ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক এই কথা বলছেন, “তোমরা আমার কালাম অগ্রাহ্য করেছ, আর মিথ্যা ও জুলুম করবার উপর ভরসা করছ। সেইজন্য এই গুনাহ্‌ তোমাদের জন্য একটা উঁচু, ফাটল ধরা ও পড়ো পড়ো দেয়ালের মত হয়ে দাঁড়াবে, যা হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে ভেংগে পড়বে। তা মাটির পাত্রের মত টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে যাবে; তা এমনভাবে ভেংগে যাবে যে, সেগুলোর মধ্যে একটা টুকরাও পাওয়া যাবে না যা দিয়ে চুলা থেকে কয়লা বা কূয়া থেকে পানি তোলা যায়।” আল্লাহ্‌ মালিক, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক এই কথা বলছেন, “তওবা করে শান্ত হলে তোমরা উদ্ধার পাবে, আর স্থির হয়ে ঈমান আনলে শক্তি পাবে।” কিন্তু তোমরা তাতে রাজী হলে না। তোমরা বললে, “না, আমরা ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে যাব।” কাজেই তোমাদের পালাতে হবে। তোমরা বললে, “যে ঘোড়া খুব বেগে যায় তাতে চড়ে আমরা চলে যাব।” কাজেই যারা তোমাদের তাড়া করবে তারা বেগেই আসবে। একজনের ভয়ে তোমাদের হাজার জন পালাবে আর পাঁচজনের ভয়ে তোমরা সবাই পালিয়ে যাবে; তাতে তোমাদের সৈন্যদলে পাহাড়ের উপরকার নিশানের খুঁটি ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তবুও মাবুদ তোমাদের রহমত দান করবার জন্য অপেক্ষা করছেন; তোমাদের মমতা করবার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়ে আছেন। মাবুদ ন্যায়বিচারের আল্লাহ্‌; ধন্য তারা, যারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করে। হে সিয়োনের লোকেরা, তোমরা যারা জেরুজালেমে বাস কর, তোমাদের আর কাঁদতে হবে না। সাহায্যের জন্য কাঁদলে তিনি নিশ্চয়ই তোমাদের রহমত করবেন। তিনি শোনামাত্রই জবাব দেবেন। যদিও দীন-দুনিয়ার মালিক তোমাদের অল্প রুটি আর অল্প পানি দিয়েছেন, তবুও তোমাদের ওস্তাদ মাবুদ আর লুকিয়ে থাকবেন না; তোমরা নিজেদের চোখেই তাঁকে দেখতে পাবে। ডানে বা বাঁয়ে কোথাও যাবার সময় তোমরা পিছন থেকে তাঁর এই কথা শুনতে পাবে, “এটাই পথ; তোমরা এই পথেই চল।” তখন তোমরা তোমাদের রূপা ও সোনা দিয়ে মুড়ানো মূর্তিগুলো নাপাক করবে; তোমরা সেগুলো নোংরা কাপড়ের মত ফেলে দিয়ে বলবে, “দূর হ, দূর হ!” তিনি তোমাদের বৃষ্টি দেবেন যাতে তোমরা মাটিতে বীজ বুনতে পার এবং জমি থেকে যে ফসল আসবে তা ভাল ও পুষ্ট হয়। সেই দিন তোমাদের পশুপালগুলো অনেক বড় মাঠে চরবে। তোমাদের চাষের গরু ও গাধা জাব্‌নার সংগে কুলা ও চালুনিতে ঝাড়া কলাই খাবে। সেই ভীষণ দিনে যখন অনেককে হত্যা করা হবে ও কেল্লাগুলো পড়ে যাবে তখন সমস্ত পাহাড়-পর্বতের গা বেয়ে পানির স্রোত বয়ে যাবে। যেদিন মাবুদ তাঁর বান্দাদের আঘাত-পাওয়া জায়গা বেঁধে দেবেন ও তাঁর করা ক্ষত ভাল করবেন সেই দিন চাঁদ আলো দেবে সূর্যের মত, আর সূর্যের আলো হবে পুরো সাত দিনের আলোর মত সাতগুণ বেশী। দেখ, মাবুদ জ্বলন্ত রাগ ও গাঢ় ধোঁয়ার মেঘের সংগে দূর থেকে আসছেন; তাঁর মুখ ভীষণ রাগে পূর্ণ আর তাঁর জিভ্‌ পুড়িয়ে ফেলা আগুনের মত। তাঁর নিঃশ্বাস যেন বেগে আসা ভীষণ পানির স্রোত যা মানুষের গলা পর্যন্ত ওঠে। তিনি সব জাতিকে ধ্বংসের চালুনিতে চালবেন এবং সব জাতির লোকদের মুখে এমন বল্‌গা দেবেন যা তাদের ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। পবিত্র ঈদ পালনের রাতের মত তোমরা কাওয়ালী করবে। লোকে যখন বাঁশী নিয়ে মাবুদের পাহাড়ের উপরে উঠে ইসরাইলের আশ্রয়-পাহাড়ের কাছে আসে তখন যেমন আনন্দ হয় তেমনি তোমাদের দিল আনন্দিত হবে। মাবুদ ভীষণ রাগ, পুড়িয়ে ফেলা আগুন, ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি আর শিল পড়বার মধ্য দিয়ে তাঁর ক্ষমতাপূর্ণ স্বর লোকদের শোনাবেন আর তাঁর শাস্তির হাত দেখাবেন। মাবুদের স্বরে আশেরিয়া ভেংগে পড়বে; তাঁর লাঠি দিয়ে তিনি আশেরীয়দের আঘাত করবেন। মাবুদ তাদের সংগে যুদ্ধ করবার সময় যখন তাঁর নিযুক্ত লাঠি তাদের উপর আঘাত করবে তখন খঞ্জনি আর বীণা বাজবে। তোফতের মত পোড়াবার জায়গা অনেক আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে; তা বাদশাহ্‌র জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই জায়গা গভীর ও চওড়া করা হয়েছে, আর তাতে আছে আগুনের জন্য প্রচুর কাঠ। মাবুদের নিঃশ্বাস জ্বলন্ত গন্ধকের স্রোতের মত হয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবে। ঘৃণ্য যারা সাহায্যের জন্য মিসরে যায়! তারা তো ঘোড়ার উপরে ভরসা করে আর তাদের অসংখ্য রথের উপর এবং ঘোড়সওয়ারদের মহাশক্তির উপর বিশ্বাস রাখে, কিন্তু তারা ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের দিকে তাকায় না কিংবা মাবুদের কাছ থেকে সাহায্য চায় না। কিন্তু তাঁর কি কোন জ্ঞান নেই? তিনি তো বিপদ ঘটাবেন; তাঁর কথা তিনি ফিরিয়ে নেবেন না। তিনি দুষ্টদের বিরুদ্ধে আর তাদের সাহায্যকারীদের বিরুদ্ধে উঠবেন। মিসরীয়রা তো মানুষ, তারা আল্লাহ্‌ নয়; তাদের ঘোড়াগুলো গোশ্‌তের, সেগুলো রূহ্‌ নয়। মাবুদ যখন তাঁর হাত তুলবেন তখন সাহায্যকারীরা উচোট খাবে আর যারা সাহায্য পায় তারা পড়ে যাবে; তারা সবাই একসংগে ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ আমাকে এই কথা বলছেন, “সিংহ তার শিকারের পশু নিয়ে গর্জন করবার সময় রাখালদের দল তার বিরুদ্ধে চিৎকার ও গোলমাল করলেও সে ভয় কিংবা বাধা পায় না। ঠিক তেমনি করে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যুদ্ধ করবার জন্য সিয়োন পাহাড় ও তার উঁচু জায়গাগুলোতে নেমে আসবেন। পাখীরা যেমন বাসার উপর উড়তে থাকে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তেমনি করে জেরুজালেমকে ঢেকে রাখবেন। তিনি তাকে ঢেকে রাখবেন ও উদ্ধার করবেন, আর তার উপর দিয়ে গিয়ে তাকে রক্ষা করবেন।” হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা যাঁর বিরুদ্ধে এত বিদ্রোহ করেছ তাঁর কাছে ফিরে এস, কারণ সেই দিন তোমরা সবাই যে সব সোনা ও রূপার মূর্তি তৈরী করে গুনাহ্‌ করেছ সেগুলো দূর করে দেবে। মাবুদ বলছেন, “মানুষের নয় এমন একটা তলোয়ারের আঘাতে আশেরিয়া পড়ে যাবে; সেই তলোয়ার তাকে গ্রাস করবে। তার লোকেরা তলোয়ারের সামনে থেকে পালিয়ে যাবে আর তাদের যুবকদের জোর করে খাটানো হবে। তাদের বাদশাহ্‌ ভয়ে পালিয়ে যাবে; তার সেনাপতিরা নিশান দেখে দারুণ ভয় পাবে।” সিয়োনে যাঁর আগুন আছে, আর জেরুজালেমে আছে চুলা, সেই মাবুদই এই কথা বলছেন। দেখ, একজন বাদশাহ্‌ ন্যায়ভাবে রাজত্ব করবেন আর শাসনকর্তারা ন্যায়বিচার করবেন। তাদের প্রত্যেকজন হবে যেন বাতাস থেকে আড়ালের জায়গা আর ঝড় থেকে আশ্রয়স্থান, যেন মরুভূমিতে পানির স্রোত আর রোদে পোড়া জমিতে বড় পাথরের ছায়া। তখন যাদের চোখ দেখতে পায় তাদের চোখ বন্ধ করা হবে না, আর যাদের কান শুনতে পায় তারা শুনতে থাকবে। যারা চিন্তা-ভাবনা না করে কাজ করে তারা জ্ঞান লাভ করবে, আর তোতলারা স্পষ্ট করে কথা বলবে। নীচমনা লোকদের আর বলা হবে না ভাল লোক, কিংবা বদমাইশদেরও আর বলা হবে না সম্মানিত লোক, কারণ নীচমনা লোক খারাপ কথাই বলে আর তার মন খারাপ বিষয়ে ব্যস্ত থাকে। সে জঘন্য জঘন্য কাজ করে আর মাবুদ সম্বন্ধে কুফরী ছড়ায়। সে এমন ব্যবস্থা করে যাতে খিদে পাওয়া লোকেরা খাবার না পায় এবং পিপাসিতেরা পানি না পায়। বদমাইশদের কাজের ধারা খারাপ; এমন কি, অভাবীদের অনুরোধ উপযুক্ত হলেও সে মিথ্যা কথা দিয়ে তাদের ধ্বংস করবার জন্য খারাপ ফন্দি আঁটে। কিন্তু ভাল লোক ভাল পরিকল্পনা করে আর তার ভাল কাজের দ্বারা সে স্থির থাকে। হে আরামে-থাকা স্ত্রীলোকেরা, তোমরা আমার কথার বাধ্য হও। হে নিশ্চিন্তমনা মেয়েরা, তোমরা আমার কথায় কান দাও। হে নিশ্চিন্তমনা মেয়েরা, এক বছরের কিছু বেশী সময় হলে পর তোমরা ভয়ে কাঁপবে, কারণ আংগুর নষ্ট হয়ে যাবে, ফল পাড়বার সময় আসবে না। হে আরামে-থাকা স্ত্রীলোকেরা আর নিশ্চিন্তমনা মেয়েরা, তোমরা ভয়ে কাঁপতে থাক; তোমাদের কাপড়-চোপড় খুলে কোমরে চট জড়াও। চোখ জুড়ানো ক্ষেত ও ফলে ভরা আংগুর লতার জন্য তোমাদের বুক চাপড়াও। কাঁটাগাছে আর কাঁটাঝোপে ভরা আমার বান্দাদের দেশের জন্য বুক চাপড়াও। জ্বী, আমোদ-ফুর্তিতে ভরা বাড়ী-ঘর আর হৈ-হুল্লোড়ে ভরা শহরের জন্য বুক চাপড়াও। তার পরে মরুভূমিতে বাস করবে ন্যায়বিচার আর উর্বর জমিতে বাস করবে সততা। সততার ফল হবে শান্তি, আর তার ফলে চিরকালের জন্য স্থিরতা ও নিশ্চয়তা আসবে। আমার বান্দারা শান্তিপূর্ণ বাসস্থানে, নিরাপদ বাড়ী-ঘরে ও গোলমালহীন বিশ্রামের জায়গায় বাস করবে। শিলাবৃষ্টি বনের গাছপালা মাটিতে ফেলে দেবে আর শহর সম্পূর্ণভাবে মাটির সংগে সমান হয়ে যাবে। কিন্তু প্রত্যেকটা স্রোতের ধারে বীজ লাগিয়ে আর তোমাদের গরু ও গাধাগুলো নিরাপদে চরতে দিয়ে তোমরা সুখী হবে। হে ধ্বংসকারী, ঘৃণ্য তুমি! তুমি ধ্বংস না হয়েও ধ্বংস করছ; তোমার প্রতি বেঈমানী করা হয় নি তবুও তুমি বেঈমানী করছ। ধ্বংসের কাজ শেষ করলেই তোমাকে ধ্বংস করা হবে; বেঈমানী করা শেষ করলেই তোমার প্রতি বেঈমানী করা হবে। হে মাবুদ, আমাদের প্রতি রহমত কর; আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। প্রতিদিন সকাল বেলায় তুমি আমার লোকদের শক্তি হও, আর কষ্টের সময় আমাদের উদ্ধারকারী হও। তোমার গলার স্বরে লোকেরা পালায়; তুমি উঠলে জাতিরা ছড়িয়ে পড়ে। পংগপাল যেমন করে শস্য নষ্ট করে, তেমনি করে হে ধ্বংসকারী, তোমাদের জিনিসও লুট করা হবে। লোকে এক ঝাঁক পংগপালের মত সেগুলোর উপর এসে পড়বে। মাবুদ কত মহান! তিনি বেহেশতে বাস করেন; তিনি সিয়োনকে ন্যায়বিচার ও সততায় পূর্ণ করেছেন। যুগের পর যুগ ধরে তিনিই তাদের নিরাপত্তা, উদ্ধার, জ্ঞান ও বুঝবার শক্তির ভাণ্ডার হয়ে আসছেন। মাবুদের প্রতি ভয় হল তাদের ধন। দেখ, তাদের সাহসী লোকেরা রাস্তায় রাস্তায় কাঁদছে; শান্তির জন্য পাঠানো দূতেরা খুব বেশী কান্নাকাটি করছে। রাজপথগুলো খালি, কোন লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে না। চুক্তি ভেংগে গেছে; শহরগুলোকে কোন দাম দেওয়া হচ্ছে না এবং কাউকেই সম্মান করা হচ্ছে না। দেশ শোক করছে আর ্নান হয়ে যাচ্ছে, লেবানন লজ্জা পেয়েছে ও শুকিয়ে যাচ্ছে, শারোণ মরুভূমির মত হয়েছে আর বাশন ও কর্মিলের সব গাছের পাতা ঝরে পড়েছে। মাবুদ বলছেন, “এবার আমি উঠব, এবার আমি সম্মানিত হব, এবার আমার গৌরব প্রকাশিত হবে। তোমরা গর্ভে ধরবে তুষ আর জন্ম দেবে খড়ের। তোমাদের নিঃশ্বাস আগুনের মত করে তোমাদের পুড়িয়ে ফেলবে। লোকেরা হবে পুড়িয়ে ফেলা চুনা পাথরের মত এবং কেটে ফেলে আগুনে দেওয়া কাঁটাঝোপের মত।” তোমরা যারা দূরে আছ, আমি যা করেছি তা শোন; তোমরা যারা কাছে আছ আমার শক্তিকে স্বীকার করে নাও। সিয়োনের গুনাহ্‌গার বান্দারা ভীষণ ভয় পেয়েছে; আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন লোকদের কাঁপুনি ধরেছে। তারা বলছে, “আমাদের মধ্যে কে পুড়িয়ে ফেলা আগুনের সংগে থাকতে পারে? কে চিরকাল জ্বলতে থাকা আগুনের সংগে বাস করতে পারে?” সে-ই বাস করতে পারে, যে লোক সৎভাবে চলাফেরা করে ও যা ঠিক তা বলে, যে লোক জুলুম করে লাভ করা ঘৃণা করে ও ঘুষ নেওয়া থেকে হাত সরিয়ে রাখে, যে লোক খুনের ষড়যন্ত্রের কথা শোনা থেকে কান বন্ধ করে রাখে আর খারাপ কাজ করতে দেখা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখে। সেই লোক নিরাপদে বাস করবে এবং তার আশ্রয় হবে পাহাড়ী কেল্লা। তাকে খাবারের যোগান দেওয়া হবে আর সে নিশ্চয়ই পানি পাবে। তোমার চোখ বাদশাহ্‌কে তাঁর জাঁকজমকের মধ্যে দেখতে পাবে, আর দেখতে পাবে এমন একটা দেশ যার সীমানা অনেক বড়। তোমার চিন্তার মধ্যে থাকবে আগের সেই ভীষণ ভয়ের কথা। তুমি ভাববে, “কোথায় সেই হিসাব-রক্ষক? কোথায় সেই লোক, যে খাজনা আদায় করত? কোথায় কেল্লার ভার-পাওয়া সেই কর্মচারী?” সেই দেমাক-ভরা লোকদের তুমি আর দেখবে না; দেখবে না সেই অজানা ভাষা বলা লোকদের, যাদের কথা অদ্ভুত আর বুঝা যায় না। আমাদের সব ঈদ পালনের শহর সিয়োনের দিকে চেয়ে দেখ। তোমার চোখ দেখবে জেরুজালেমকে, একটা শান্তিপূর্ণ বাসস্থানকে, একটা তাম্বুকে যা সরানো হবে না। তার গোঁজগুলো কখনও তোলা হবে না আর তার কোন দড়িও ছিঁড়বে না। সেখানে শক্তিশালী মাবুদ আমাদের ভালোর জন্য থাকবেন। সেখানে বড় বড় নদী ও খাল থাকবে। কোন দাঁড়ের নৌকা সেখানে চলবে না; কোন শক্তিশালী জাহাজও তার উপর দিয়ে যাবে না। মাবুদই আমাদের ন্যায়বিচারক ও আমাদের আইনদাতা; মাবুদই আমাদের বাদশাহ্‌, তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন। এখন তোমার পালের দড়াদড়ি ঢিলে হয়ে গেছে; তাতে মাস্তুলটা শক্ত করে আট্‌কানো নেই, পালও খাটানো যায় নি। পরে লুটের প্রচুর জিনিস ভাগ করা হবে; এমন কি, খোঁড়ারাও লুটের মাল নিয়ে যাবে। সিয়োনে বাসকারী কেউ বলবে না, “আমি অসুস্থ।” যারা সেখানে বাস করে তাদের গুনাহ্‌ মাফ করা হবে। ওহে জাতিরা, তোমরা কাছে এস, শোন; হে লোকেরা, তোমরা কান দাও। দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব লোকেরা শুনুক; পৃথিবী ও তার মাটি থেকে তৈরী মানুষেরা শুনুক। সব জাতির উপরেই মাবুদ ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন; তাদের সব সৈন্যদলের উপরে তাঁর রাগ রয়েছে। তিনি তাদের একেবারে শেষ করে ফেলবেন, ধ্বংসের হাতে তাদের তুলে দেবেন। তাদের নিহত লোকদের বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। তাদের লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হবে এবং তাদের রক্তে পাহাড়-পর্বত ধুয়ে যাবে। আসমানের সূর্য-চাঁদ-তারাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে আর আকাশ গুটিয়ে রাখা কাগজের মত গুটিয়ে যাবে। যেমন করে আংগুর লতা আর ডুমুর গাছ থেকে শুকনা পাতা পড়ে যায় তেমনি করে সমস্ত তারাগুলো পড়ে যাবে। আমার তলোয়ার আসমানে সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত; দেখ, বিচারের জন্য সেটা ইদোমের উপর, অর্থাৎ যে লোকদের আমি ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন করে রেখেছি তাদের উপর নেমে আসছে। মাবুদের তলোয়ার রক্তে গোসল করেছে; তা চর্বিতে ঢাকা পড়ে গেছে। সেই রক্ত ভেড়ার বাচ্চা ও ছাগলের রক্তের মত আর চর্বি ভেড়ার কিড্‌নির চর্বির মত, কারণ মাবুদ বস্রাতে একটা কোরবানী দেবেন আর ইদোমে অনেককে জবাই করা হবে। সেগুলোর সংগে বুনো ষাঁড়, এঁড়ে বাছুর ও বড় বড় ষাঁড় জবাই করা হবে। তাদের দেশ রক্তে ভিজে যাবে, আর চর্বিতে ধুলা ঢেকে যাবে। এই সব হবে, কারণ প্রতিশোধ নেবার মাবুদের একটা দিন আছে, সিয়োনের পক্ষ হয়ে শাস্তি দেবার একটা সময় আছে। ইদোমের পানির স্রোতগুলো আলকাত্‌রায় ভরে যাবে, তার ধুলা হবে গন্ধকে ভরা, তাই দেশের মাটি হবে জ্বলন্ত আলকাত্‌রা। দিনে রাতে কখনও তা নিভবে না; চিরকাল তার ধোঁয়া উঠতে থাকবে। বংশের পর বংশ ধরে সেটা খালি হয়ে পড়ে থাকবে; কেউ তার মধ্য দিয়ে আর কখনও যাবে না। মরু-পেঁচা, শজারু, হুতুম পেঁচা আর দাঁড়কাক সেই দেশ অধিকার করবে ও সেখানে বাসা করবে। মাবুদ বিশৃঙ্খলার মাপের দড়ি আর শূন্যতার ওলনদড়ি ইদোমের উপর বিছিয়ে দেবেন। রাজ্য চালাবার জন্য কোন উঁচু পদের লোক কিংবা কোন শাসনকর্তা থাকবে না। কাটাগাছে তার বড় বড় বাড়ীগুলো ঢেকে যাবে, আর কেল্লাগুলো ঢেকে যাবে বিছুটি আর কাঁটাঝোপে। সেই দেশ হবে শিয়াল ও উটপাখীর বাসস্থান। মরু-প্রাণীরা শিয়ালদের সংগে থাকবে আর বুনো ছাগলেরা একে অন্যকে ডাকবে। রাতে ঘুরে বেড়ানো পেত্নী সেখানে বাস করবে; সেখানে তার বিশ্রামের স্থান সে খুঁজে পাবে। পেঁচা বাসা বানিয়ে সেখানে ডিম পাড়বে, তারপর ডিম ফুটিয়ে তার ডানার ছায়ায় তার বাচ্চাগুলো এক জায়গায় করবে। সেখানে চিলগুলো নিজের নিজের সংগিনীর সংগে একত্র হবে। তোমরা মাবুদের কিতাবে তালাশ করে দেখ ও তেলাওয়াত কর। সেখানে লেখা আছে- এদের একটাও হারিয়ে যাবে না, একটারও সংগিনীর অভাব হবে না; কারণ আমার মুখ দিয়ে মাবুদ সেই হুকুম দিয়েছেন, আর তাঁর রূহ্‌ তাদের একসংগে জড়ো করবেন। তিনি গুলিবাঁট করে ও মাপের দড়ি দিয়ে মেপে সেই জায়গা তাদের ভাগ করে দেবেন। তা চিরকাল তাদেরই থাকবে; বংশের পর বংশ ধরে তারা সেখানে বাস করবে। যারা দুর্বল তাদের হাত শক্তিশালী কর; কাঁপতে থাকা হাঁটু স্থির কর। যাদের দিল ভয়ে ভরা তাদের বল, “বলবান হও, ভয় কোরো না। তোমাদের আল্লাহ্‌ আসবেন, প্রতিশোধ নেবার ও শাস্তি দেবার জন্য আসবেন; তিনি এসে তোমাদের উদ্ধার করবেন।” তখন অন্ধদের চোখ খুলে যাবে, বধিরদের কান বন্ধ থাকবে না। তখন খোঁড়ারা হরিণের মত লাফাবে, বোবাদের জিভ্‌ আনন্দে চিৎকার করবে। মরুভূমির নীচ থেকে জোরে পানি বেরিয়ে আসবে, আর মরুভূমির নানা জায়গায় স্রোত বইবে। শুকনা জমি পুকুর হবে, আর পিপাসিত মাটিতে পানির ঝর্ণা উঠবে; যেখানে শিয়ালেরা শুয়ে থাকত সেই জায়গায় জন্মাবে নল-খাগড়ার জংগল। সেখানে হবে একটা রাজপথ, জ্বী, একটা পথ হবে; সেটাকে বলা হবে পবিত্রতার পথ। নাপাক লোকেরা তার উপর দিয়ে যাবে না; সেটা হবে তাদের জন্য যারা পবিত্রতার পথে চলে। অসাড়-বিবেক লোকেরা সেই পথ দিয়ে যাবে না। সেখানে কোন সিংহ থাকবে না, কোন হিংস্র জন্তু সেই পথে যাবে না; সেখানে তাদের দেখা যাবে না, কিন্তু কেবল মুক্তি পাওয়া লোকেরাই সেই পথে হাঁটবে, আর মাবুদের মুক্ত করা লোকেরাই ফিরে আসবে। তারা আনন্দে কাওয়ালী গাইতে গাইতে সিয়োনে ঢুকবে; তাদের মাথার তাজ হবে চিরস্থায়ী আনন্দ। তারা খুশী ও আনন্দে পূর্ণ হবে, আর দুঃখ ও দীর্ঘনিঃশ্বাস দূরে পালিয়ে যাবে। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের রাজত্বের চৌদ্দ বছরের সময় আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব এহুদার সমস্ত দেয়াল-ঘেরা শহরগুলো আক্রমণ করে সেগুলো দখল করে নিলেন। তারপর আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ রব্‌শাকিকে বড় একদল সৈন্য দিয়ে লাখীশ থেকে জেরুজালেমে বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে পাঠালেন। রব্‌শাকি গিয়ে ধোপার মাঠের রাস্তার ধারে উঁচু পুকুরের সংগে লাগানো পানির সুড়ংগের কাছে থামলেন। তখন রাজবাড়ীর পরিচালক হিল্কিয়ের ছেলে ইলিয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন ও ইতিহাস লেখক আসফের ছেলে যোয়াহ বের হয়ে তাঁর কাছে গেলেন। রব্‌শাকি তাঁদের বললেন, “আপনারা হিষ্কিয়কে এই কথা বলুন যে, সেই মহান বাদশাহ্‌, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘তুমি কিসের উপর ভরসা করছ? আমি বলছি তোমার যুদ্ধ করবার বুদ্ধি ও শক্তির কথা কেবল ফাঁকা বুলি। বল দেখি, তুমি কার উপর ভরসা করে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছ? তুমি তো ভরসা করছ সেই থেঁৎলে যাওয়া নল, অর্থাৎ মিসরের উপর। যে সেই নলের উপর ভরসা করবে তা তার হাত ফুটা করে দেবে। মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের উপর যারা ভরসা করে তাদের প্রতি সে তা-ই করে।’ কিন্তু আপনারা যদি আমাকে বলেন যে, আপনারা আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করছেন, তাহলে তিনি কি সেই আল্লাহ্‌ নন যাঁর এবাদতের উঁচু স্থান ও কোরবানগাহ্‌গুলো হিষ্কিয় ধ্বংস করেছে এবং এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের বলেছে জেরুজালেমের এই কোরবানগাহের সামনে তাদের এবাদত করতে হবে? “আপনারা আমার হয়ে আপনাদের বাদশাহ্‌কে আরও বলুন, ‘আপনি যদি পারেন তবে আমার মালিক আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র সংগে এই বাজি ধরুন যে, আমি আপনাকে দুই হাজার ঘোড়া দেব যদি আপনি তাতে চড়বার জন্য লোক দিতে পারেন। যদি তা-ই না পারেন তবে আমার মালিকের কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট তাকেই বা আপনি কেমন করে বাধা দেবেন, যদিও আপনি মিসরের রথ ও ঘোড়সওয়ারের উপর ভরসা করছেন? তা ছাড়া আমি কি মাবুদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই এই দেশ আক্রমণ ও ধ্বংস করতে এসেছি? এই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তা ধ্বংস করে ফেলতে মাবুদ নিজেই আমাকে বলেছেন।’ ” তখন ইলিয়াকীম, শিব্‌ন ও যোয়াহ রব্‌শাকিকে বললেন, “আপনার গোলামদের কাছে আপনি দয়া করে আরামীয় ভাষায় কথা বলুন, কারণ আমরা তা বুঝতে পারি। দেয়ালের উপরকার লোকদের সামনে আপনি আমাদের কাছে হিব্রু ভাষায় কথা বলবেন না।” কিন্তু জবাবে রব্‌শাকি বললেন, “আমার মালিক কি কেবল আপনাদের মালিক ও আপনাদের কাছে এই সব কথা বলতে আমাকে পাঠিয়েছেন? দেয়ালের উপরে বসা ঐ সব লোকেরা, যাদের আপনাদেরই মত নিজের নিজের পায়খানা ও প্রস্রাব খেতে হবে তাদের কাছেও কি বলে পাঠান নি?” তারপর রব্‌শাকি দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হিব্রু ভাষায় বললেন, “তোমরা মহান বাদশাহ্‌র, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কথা শোন। বাদশাহ্‌ বলছেন যে, হিষ্কিয় যেন তোমাদের না ঠকায়। সে তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। হিষ্কিয় যেন এই কথা বলে মাবুদের উপর তোমাদের বিশ্বাস না জন্মায় যে, ‘মাবুদ নিশ্চয়ই আমাদের উদ্ধার করবেন; এই শহর আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়া হবে না।’ “তোমরা হিষ্কিয়ের কথা শুনো না। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ বলছেন, ‘তোমরা আমার সংগে সন্ধি কর এবং বের হয়ে আমার কাছে এস। তাহলে তোমরা প্রত্যেকে তার নিজের আংগুর ও ডুমুর গাছ থেকে ফল আর নিজের কূয়া থেকে পানি খেতে পারবে। তারপর আমি এসে তোমাদের নিজের দেশের মত আর এক দেশে তোমাদের নিয়ে যাব। সেই দেশ হল শস্য ও নতুন আংগুর-রসের দেশ, রুটি ও আংগুর ক্ষেতের দেশ। “ ‘হিষ্কিয় তোমাদের বিপথে চালাবার জন্য যেন না বলে যে, মাবুদ তোমাদের রক্ষা করবেন। অন্যান্য জাতির কোন দেবতা কি আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে তার দেশ রক্ষা করতে পেরেছে? হামা ও অর্পদের দেবতারা কোথায়? কোথায় সফর্বয়িমের দেবতারা? তারা কি আমার হাত থেকে সামেরিয়াকে রক্ষা করতে পেরেছে? এই সব দেশের সমস্ত দেব-দেবীদের মধ্যে কে আমার হাত থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করেছে? তাহলে মাবুদ কি করে আমার হাত থেকে জেরুজালেমকে রক্ষা করবেন?’ ” লোকেরা কিন্তু চুপ করে রইল, কোন জবাব দিল না, কারণ বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় কোন জবাব দিতে তাদের নিষেধ করেছিলেন। এর পর রাজবাড়ীর পরিচালক হিল্কিয়ের ছেলে ইলিয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন ও ইতিহাস লেখক আসফের ছেলে যোয়াহ তাঁদের কাপড় ছিঁড়ে হিষ্কিয়ের কাছে গেলেন এবং রব্‌শাকির সমস্ত কথা তাঁকে জানালেন। বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় এই কথা শুনে নিজের কাপড় ছিঁড়লেন এবং ছালার চট পরে মাবুদের ঘরে গেলেন। তিনি রাজবাড়ীর পরিচালক ইলিয়াকীম, বাদশাহ্‌র লেখক শিব্‌ন ও ইমাম-নেতাদের চট পরা অবস্থায় আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ইশাইয়াকে বললেন, “হিষ্কিয় বলছেন যে, আজকের দিনটা হল কষ্টের, শাস্তি পাওয়ার ও অসম্মানের দিন। আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যেন সন্তানেরা জন্ম হবার মুখে এসেছে কিন্তু জন্ম দেবার শক্তি নেই। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ জীবন্ত আল্লাহ্‌কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে রব্‌শাকিকে পাঠিয়েছেন, কিন্তু আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ হয়তো সেই সব কথা শুনে তাকে শাস্তি দেবেন। তাই যারা এখনও বেঁচে আছে তাদের জন্য আপনি মুনাজাত করুন।” বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কর্মচারীরা যখন ইশাইয়ার কাছে আসলেন, তখন ইশাইয়া তাঁদের বললেন, “আপনাদের মালিককে বলবেন যে, মাবুদ বলছেন, ‘তুমি যা শুনেছ, অর্থাৎ আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র কর্মচারীরা আমার বিরুদ্ধে যে সব কুফরী করেছে তাতে ভয় পেয়ো না। শোন, আমি তার মধ্যে এমন একটা মনোভাবের সৃষ্টি করব যার ফলে সে একটা সংবাদ শুনে নিজের দেশে ফিরে যাবে, আর সেখানে আমি তাকে তলোয়ারের আঘাতে শেষ করে দেব।’ ” পরে রব্‌শাকি শুনলেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ লাখীশ ছেড়ে চলে গিয়ে লিব্‌নার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। সেইজন্য রব্‌শাকি সেখানে গেলেন। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব খবর পেলেন যে, ইথিওপিয়া দেশের বাদশাহ্‌ তির্হকঃ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য বের হয়েছেন। এই কথা শুনে তিনি হিষ্কিয়ের কাছে দূতদের পাঠালেন। তিনি তাদের বললেন, “তোমরা এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়কে বলবে, ‘তুমি যাঁর উপর ভরসা করে আছ সেই আল্লাহ্‌ বলেছেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাতে জেরুজালেমকে তুলে দেওয়া হবে না। তাঁর সেই ছলনার কথায় তুমি ভুল কোরো না। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌রা কিভাবে অন্য সব দেশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই তুমি তা শুনেছ; তাহলে তুমি কেমন করে মনে করছ তুমি রক্ষা পাবে? আমার পূর্বপুরুষেরা যে সব জাতিকে ধ্বংস করেছেন তাদের দেবতারা, অর্থাৎ গোষণ, হারণ, রেৎসফ ও তলঃসরে বাসকারী আদনের লোকদের দেবতারা কি তাদের রক্ষা করেছেন? হামার বাদশাহ্‌, অর্পদের বাদশাহ্‌, সফর্বয়িম শহরের বাদশাহ্‌ আর হেনা ও ইব্বার বাদশাহ্‌ কোথায়?’ ” হিষ্কিয় দূতদের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়লেন। তারপর তিনি মাবুদের ঘরে গিয়ে মাবুদের সামনে চিঠিটা মেলে ধরলেন। হিষ্কিয় মাবুদের কাছে এই মুনাজাত করলেন, “হে দুই কারুবীর মাঝখানে থাকা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, ইসরাইলের মাবুদ, তুমি, একমাত্র তুমিই দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যের আল্লাহ্‌। তুমি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছ। হে মাবুদ, কান দাও, শোন; হে মাবুদ, তোমার চোখ খোল, দেখ; জীবন্ত আল্লাহ্‌কে অপমান করবার জন্য সন্‌হেরীব যে সব কথা বলে পাঠিয়েছে তা শোন। এখন হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর, যাতে দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য জানতে পারে যে, তুমি, কেবল তুমিই মাবুদ।” তখন আমোজের ছেলে ইশাইয়া হিষ্কিয়ের কাছে এই খবর পাঠালেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন যে, আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব সম্বন্ধে আপনি মুনাজাত করেছেন; এইজন্য তার বিরুদ্ধে মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘সিয়োন তোমাকে তুচ্ছ করবে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে। জেরুজালেমের লোকেরা তোমার পিছন থেকে মাথা নাড়বে। তুমি কাকে অসম্মান করেছ? কার বিরুদ্ধে তুমি অপমানের কথা বলেছ? তুমি কার বিরুদ্ধে চিৎকার করেছ আর গর্বের সংগে চোখ তুলে তাকিয়েছ? ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের বিরুদ্ধেই তুমি এই সব করেছ। তুমি দীন-দুনিয়ার মালিককে টিট্‌কারি দিয়ে ও গর্ব করে তোমার গোলামদের দিয়ে বলে পাঠিয়েছ যে, তোমার সব রথ দিয়ে তুমি পাহাড়গুলোর চূড়ায়, লেবাননের সবচেয়ে উঁচু উঁচু চূড়ায় উঠেছ, তার সবচেয়ে লম্বা লম্বা এরস গাছ আর ভাল ভাল বেরস গাছ কেটে ফেলেছ, তার গভীর বনের সুন্দর জায়গায় ঢুকেছ, বিদেশের মাটিতে মাটিতে কূয়া খুঁড়েছ এবং সেখানকার পানি খেয়েছ, আর তোমার পা দিয়ে মিসরের সব নদীগুলো শুকিয়ে ফেলেছ। “ ‘তুমি কি শোন নি যে, অনেক আগেই আমি তা ঠিক করে রেখেছিলাম, অনেক কাল আগেই আমি তার পরিকল্পনা করেছিলাম? আর এখন আমি তা ঘটালাম। সেইজন্যই তো তুমি দেয়াল-ঘেরা শহরগুলো পাথরের ঢিবি করতে পেরেছ। সেখানকার লোকেরা শক্তিহীন হয়েছে এবং ভীষণ ভয় ও লজ্জা পেয়েছে। তারা ক্ষেতের ঘাসের মত, গজিয়ে ওঠা সবুজ চারার মত, ছাদের উপরে গজানো ঘাসের মত যা বেড়ে উঠবার আগেই শুকিয়ে যায়। কিন্তু তুমি কোথায় থাক আর কখন আস বা যাও আর কেমন করে আমার বিরুদ্ধে রেগে ওঠ তা সবই আমি জানি। তুমি আমার বিরুদ্ধে রেগে উঠেছ বলে এবং তোমার দেমাকের কথা আমার কানে এসেছে বলে আমি তোমার নাকে আমার কড়া লাগাব আর তোমার মুখে আমার বল্‌গা লাগাব, আর যে পথ দিয়ে তুমি এসেছ সেই পথেই ফিরে যেতে আমি তোমাকে বাধ্য করব।’ “হে হিষ্কিয়, তোমার জন্য চিহ্ন হবে এই: এই বছর নিজে নিজে যা জন্মাবে তোমরা তা-ই খাবে, আর দ্বিতীয় বছরে তা থেকে যা জন্মাবে তা খাবে। কিন্তু তৃতীয় বছরে তোমরা বীজ বুনবে ও ফসল কাটবে আর আংগুর ক্ষেত করে তার ফল খাবে। এহুদা-গোষ্ঠীর যে লোকেরা তখনও বেঁচে থাকবে তারা আর একবার সফল হবে। তারা গাছের মত নীচে শিকড় বসাবে আর উপরে ফল ফলাবে। বেঁচে থাকা লোকেরা জেরুজালেম থেকে আসবে আর সিয়োন পাহাড় থেকে আসবে রক্ষা পাওয়া একদল লোক। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের আগ্রহই এই সমস্ত করবে। “সেইজন্য আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র বিষয়ে মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘সে এই শহরে ঢুকবে না কিংবা এখানে একটা তীরও মারবে না। সে ঢাল নিয়ে এর সামনে আসবে না কিংবা ঘেরাও করে ওঠা-নামা করবার জন্য কিছু তৈরী করবে না। সে যে পথ দিয়ে এসেছে সেই পথেই ফিরে যাবে; এই শহরে সে ঢুকবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। আমি আমার ও আমার গোলাম দাউদের জন্য এই শহরটা ঘিরে রেখে তা রক্ষা করব।’ ” তারপর মাবুদের ফেরেশতা বের হয়ে আশেরীয়দের ছাউনির এক লক্ষ পঁচাশি হাজার লোককে মেরে ফেললেন। পরদিন সকালবেলায় লোকেরা যখন উঠল তখন দেখা গেল সব জায়গায় কেবল লাশ। কাজেই আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ সন্‌হেরীব তাঁর সৈন্যদল নিয়ে চলে গেলেন এবং নিনেভে শহরে ফিরে গিয়ে সেখানে থাকতে লাগলেন। একদিন সন্‌হেরীব যখন তাঁর দেবতা নিষ্রোকের মন্দিরে পূজা করছিলেন তখন অদ্রম্মেলক ও শরেৎসর নামে তাঁর দুই ছেলে তাঁকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে আরারাত দেশে পালিয়ে গেল। সন্‌হেরীবের জায়গায় তাঁর ছেলে এসর-হদ্দোন বাদশাহ্‌ হলেন। সেই সময় হিষ্কিয় অসুস্থ হয়ে মরবার মত হয়েছিলেন। তখন আমোজের ছেলে নবী ইশাইয়া তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “মাবুদ বলছেন যে, আপনি যেন আপনার ঘরের ব্যবস্থা করে রাখেন, কারণ আপনি মারা যাবেন, ভাল হবেন না।” এই কথা শুনে হিষ্কিয় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “হে মাবুদ, তুমি মনে করে দেখ, আমি তোমার সামনে কেমন বিশ্বস্তভাবে ও সমস্ত দিলের এবাদত দিয়ে চলাফেরা করেছি এবং তোমার চোখে যা ঠিক তা করেছি।” এই বলে হিষ্কিয় খুব কাঁদতে লাগলেন। তখন মাবুদের এই কালাম ইশাইয়ার উপর নাজেল হল, “তুমি গিয়ে হিষ্কিয়কে বল যে, তার পূর্বপুরুষ দাউদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আমি তোমার মুনাজাত শুনেছি ও তোমার চোখের পানি দেখেছি; আমি তোমার আয়ু আরও পনেরো বছর বাড়িয়ে দিলাম। আশেরিয়ার বাদশাহ্‌র হাত থেকে আমি তোমাকে ও এই শহরকে উদ্ধার করব এবং শহরটার রক্ষার ব্যবস্থা করব। “ ‘আমি যে আমার কথামত কাজ করব তার চিহ্ন হল এই: আহসের সিঁড়িতে ছায়া সূর্যের সংগে যত ধাপ এগিয়ে গেছে আমি সেই ছায়া দশ ধাপ পিছনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’ ” কাজেই সূর্যের সংগে ছায়া আবার দশ ধাপ পিছনে ফিরে গেল। এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় তাঁর অসুস্থতা থেকে সুস্থ হবার পরে যা লিখেছিলেন তা এই: আমি বলেছিলাম, “আমার জীবনের মাঝখানেই কি আমাকে কবরের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে? আর আমার বাকী বছরগুলো থেকে কি আমাকে বঞ্চিত করা হবে?” আমি বলেছিলাম, “আমি মাবুদকে জীবিতদের দেশে আর দেখতে পাব না; এই অস্থায়ী দুনিয়াতে বাসকারী মানুষকেও আর আমি দেখতে পাব না। ভেড়ার রাখালের তাম্বুর মত করে আমার বাসস্থান তুলে ফেলে আমার কাছ থেকে তা নিয়ে নেওয়া হবে। আমার আয়ু আমি তাঁতীদের মত করে তাঁতে জড়িয়েছিলাম আর এখন তা থেকে তুমি আমাকে ছেঁটে ফেলবে। এক দিনের মধ্যেই তুমি আমাকে শেষ করে দেবে। সকাল না হওয়া পর্যন্ত আমি নিজেকে শান্ত রাখলাম। সিংহের মত করে আমার হাড়গুলো তুমি ভেংগে দিলে; এক দিনের মধ্যেই তুমি আমাকে শেষ করে দেবে। চাতক, শালিক ও ঘুঘুর মত আমি কাতর স্বরে ডাকতে লাগলাম। উপর দিকে তাকাতে তাকাতে আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়ল। হে মালিক, আমি কষ্ট পাচ্ছি, তুমি আমার ভার নাও। “কিন্তু আমি কি বলব? তিনি আমার সংগে কথা বলেছেন আর নিজেই এটা করেছেন। আমার প্রাণের এই যন্ত্রণার জন্য আমি জীবনের বাকী সব বছরগুলো নম্র হয়ে চলব। হে মালিক, তোমার কালাম ও কাজ দিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে; এই সবের মধ্যেই আমার রূহ্‌ জীবিত থাকবে। তুমি আমার স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে বাঁচতে দেবে। “অবশ্য আমার ভালোর জন্যই আমি এই ভীষণ যন্ত্রণা ভোগ করেছি, কিন্তু ধ্বংসের গর্ত থেকে তোমার মহব্বতে তুমি আমাকে উদ্ধার করেছ। আমার সব গুনাহ্‌ তুমি পিছনে ফেলে দিয়েছ। কবর তো তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারে না, আর মৃত্যুও তোমার প্রশংসা-কাওয়ালী গাইতে পারে না। যারা সেই গর্তে নামে তারা তোমার ওয়াদার পূর্ণতার আশা করতে পারে না। কেবল জীবিতেরা, জীবিতেরাই তোমার প্রশংসা করে যেমন আজ আমি করছি; পিতা তার ছেলেদের তোমার ওয়াদার কথা বলে থাকেন। মাবুদ আমাকে রক্ষা করেছেন, সেইজন্য আমাদের জীবনের সমস্ত দিনগুলোতে মাবুদের ঘরে তারের বাজনার সংগে আমরা কাওয়ালী গাইব।” এর আগে ইশাইয়া বলেছিলেন, “ডুমুর দিয়ে একটা প্রলেপ তৈরী করে তাঁর ফোড়ার উপর লাগিয়ে দিলে তিনি সুস্থ হবেন।” তখন হিষ্কিয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমি যে মাবুদের ঘরে উঠতে পারব তার চিহ্ন কি?” এই সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বলদনের ছেলে মারডক-বলদন হিষ্কিয়ের অসুখ ও সুস্থ হবার খবর শুনে তাঁর কাছে চিঠি ও উপহার পাঠিয়ে দিলেন। হিষ্কিয় খুশী হয়ে সেই দূতদের গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সব ভাণ্ডারগুলোতে যা কিছু ছিল, অর্থাৎ সোনা, রূপা, খোশবু-মসলা, দামী তেল এবং তাঁর অস্ত্রশস্ত্র ও ধনভাণ্ডারের সব কিছু তাদের দেখালেন। হিষ্কিয়ের রাজবাড়ীতে কিংবা তাঁর সারা রাজ্যে এমন কিছু ছিল না যা তিনি তাদের দেখান নি। পরে নবী ইশাইয়া বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঐ লোকেরা কি বলল, আর কোথা থেকেই বা তারা এসেছিল?” হিষ্কিয় বললেন, “ওরা দূর দেশ থেকে, ব্যাবিলন দেশ থেকে এসেছিল।” নবী জিজ্ঞাসা করলেন, “ওরা আপনার রাজবাড়ীর মধ্যে কি কি দেখেছে?” হিষ্কিয় বললেন, “আমার রাজবাড়ীর সব কিছুই ওরা দেখেছে। আমার ধনভাণ্ডারের এমন কিছু নেই যা আমি তাদের দেখাই নি।” তখন ইশাইয়া হিষ্কিয়কে বললেন, “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যা বলছেন তা আপনি শুনুন। মাবুদ বলছেন, এমন দিন আসবে যখন আপনার রাজবাড়ীর সব কিছু এবং আপনার পূর্বপুরুষদের জমানো যা কিছু আজ পর্যন্ত রয়েছে সবই ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হবে, কিছুই পড়ে থাকবে না। আপনার কয়েকজন বংশধর, আপনার নিজের সন্তান, যাদের আপনি জন্ম দিয়েছেন, তারা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র বাড়ীতে খোজা হয়ে সেবা-কাজ করবে।” জবাবে হিষ্কিয় বললেন, “মাবুদের যে কথা আপনি বললেন তা ভাল।” তিনি এই কথা বললেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন তাঁর জীবনকালে তিনি শান্তিতে ও নিরাপদে থাকতে পারবেন। তোমাদের আল্লাহ্‌ বলছেন, “আমার বান্দাদের সান্ত্বনা দাও, সান্ত্বনা দাও। জেরুজালেমের লোকদের সংগে নরমভাবে কথা বল, আর তাদের কাছে এই কথা ঘোষণা কর যে, তাদের দুঃখ-কষ্ট শেষ হয়েছে, তাদের গুনাহের মাফ হয়েছে, তাদের সব গুনাহের ফল তারা মাবুদের হাত থেকে পুরোপুরিই পেয়েছে।” একজনের কণ্ঠস্বর চিৎকার করে জানাচ্ছে, “তোমরা মরুভূমিতে মাবুদের পথ ঠিক কর; মরুভূমিতে আমাদের আল্লাহ্‌র জন্য একটা রাস্তা সোজা কর। প্রত্যেক উপত্যকা ভরা হবে, পাহাড়-পর্বত সমান করা হবে, পাহাড়ী জায়গা সমতল করা হবে, আর অসমান জমি সমান করা হবে। তখন মাবুদের গৌরব প্রকাশিত হবে, আর সমস্ত মানুষ তা একসংগে দেখবে; মাবুদই এই সব কথা বলেছেন।” একজনের কণ্ঠস্বর বলছে, “ঘোষণা কর।” আমি বললাম, “আমি কি ঘোষণা করব?” “সব মানুষই ঘাসের মত, ঘাসের ফুলের মতই তাদের সব সৌন্দর্য। ঘাস শুকিয়ে যায় আর ফুলও ঝরে যায়, কারণ মাবুদের নিঃশ্বাস সেগুলোর উপর দিয়ে বয়ে যায়। সত্যিই মানুষ ঘাসের মত। ঘাস শুকিয়ে যায় আর ফুলও ঝরে যায়, কিন্তু আমাদের আল্লাহ্‌র কালাম চিরকাল থাকে।” হে সিয়োন, সুসংবাদ আনছ যে তুমি, তুমি উঁচু পাহাড়ে গিয়ে ওঠো। হে জেরুজালেম, সুসংবাদ আনছ যে তুমি, তুমি জোরে চিৎকার কর, চিৎকার কর, ভয় কোরো না; এহুদার শহরগুলোকে বল, “এই তো তোমাদের আল্লাহ্‌!” দেখ, আল্লাহ্‌ মালিক শক্তির সংগে আসছেন, তাঁর শক্তিশালী হাত তাঁর হয়ে রাজত্ব করছে। দেখ, পুরস্কার তাঁর সংগে আছে, তাঁর পাওনা তাঁর কাছেই আছে। তিনি রাখালের মত করে তাঁর ভেড়ার পাল চরাবেন, ভেড়ার বাচ্চাগুলো তিনি হাতে তুলে নেবেন আর কোলে করে তাদের বয়ে নিয়ে যাবেন; বাচ্চা আছে এমন ভেড়ীদের তিনি আস্তে আস্তে চালিয়ে নিয়ে যাবেন। কে তার হাতের তালুতে দুনিয়ার সব পানি মেপেছে কিংবা তার বিঘত দিয়ে আসমানের সীমানা মেপেছে? কে দুনিয়ার ধুলা মাপের ঝুড়িতে ভরেছে কিংবা দাঁড়িপাল্লায় পাহাড়-পর্বত ওজন করেছে? কে মাবুদের রূহ্‌কে মাপতে পেরেছে কিংবা তাঁর পরামর্শদাতা হিসাবে তাঁকে উপদেশ দিয়েছে? বুদ্ধি পাবার জন্য মাবুদ কার পরামর্শ নিয়েছেন, আর ঠিক পথ কে তাঁকে দেখিয়ে দিয়েছে? কে তাঁকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে কিংবা বিচারবুদ্ধির পথ দেখিয়েছে? দেখ, জাতিগুলো যেন কলসীর মধ্যে পানির একটা ফোঁটা; দাঁড়িপাল্লায় ধূলিকণার মতই তাদের মনে করা হয়। দূর দেশের লোকেরা তাঁর কাছে মিহি ধুলার মত ওজনহীন। আগুন জ্বালাবার জন্য লেবাননের কাঠ আর পোড়ানো-কোরবানীর জন্য লেবাননের পশু যথেষ্ট নয়। সমস্ত জাতি তাঁর সামনে কিছুই নয়; সেগুলোকে তিনি কিছু বলে মনে করেন না; সেগুলো তাঁর কাছে অসার। তবে কার সংগে তোমরা আল্লাহ্‌র তুলনা করবে? তুলনা করবে কিসের সংগে? কারিগরেরা ছাঁচে ঢেলে মূর্তি বানায়; স্বর্ণকার তা সোনা দিয়ে মোড়ে আর তার জন্য রূপার শিকল তৈরী করে। গরীব লোক মূর্তি তৈরী করবার জন্য যে কাঠ পচবে না সেই কাঠই বেছে নেয়। যা টলবে না এমন মূর্তি তৈরীর জন্য সে একজন পাকা কারিগরের খোঁজ করে। তোমরা কি জান না? তোমরা কি শোন নি? প্রথম থেকেই কি তোমাদের সে কথা বলা হয় নি? দুনিয়া স্থাপনের সময় থেকে কি তোমরা বোঝ নি? দুনিয়ার গোল আসমানের উপরে তিনিই সিংহাসনে বসে আছেন, দুনিয়ার লোকেরা ফড়িংয়ের মত। চাঁদোয়ার মত করে তিনি আসমানকে বিছিয়ে দিয়েছেন, বাস করবার তাম্বুর মত করে তা খাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বাদশাহ্‌দের ক্ষমতাশূন্য করেন আর এই দুনিয়ার শাসনকর্তাদের অসার জিনিসের মত করেন। যেই তাদের লাগানো হয়, যেই তাদের বোনা হয়, যেই তারা মাটিতে শিকড় বসায়, অমনি তিনি তাদের উপর ফুঁ দেন আর তারা শুকিয়ে যায়; একটা ঘূর্ণিবাতাস নাড়ার মত করে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ্‌ পাক বলছেন, “তোমরা কার সংগে আমার তুলনা করবে? কে আমার সমান?” তোমরা চোখ তুলে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখ; কে ঐ সব সৃষ্টি করেছেন? তিনিই তারাগুলোকে এক এক করে বের করে এনেছেন; তিনিই তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে ডাকেন। তাঁর মহাক্ষমতা ও মহাশক্তির জন্য তাদের একটাও হারিয়ে যায় না। হে ইয়াকুব, কেন তুমি বলছ, হে ইসরাইল, কেন তুমি এই নালিশ করছ, “আমার পথ মাবুদের কাছ থেকে লুকানো রয়েছে, আমার ন্যায়বিচার পাবার অধিকার আমার আল্লাহ্‌ অগ্রাহ্য করেছেন”? তোমরা কি জান না? তোমরা কি শোন নি? মাবুদ, যিনি চিরকাল স্থায়ী আল্লাহ্‌, যিনি দুনিয়ার শেষ সীমার সৃষ্টিকর্তা, তিনি দুর্বল হন না, ক্লান্তও হন না; তাঁর বুদ্ধির গভীরতা কেউ মাপতে পারে না। তিনি দুর্বলদের শক্তি দেন আর শক্তিহীনদের বল বাড়িয়ে দেন। অল্পবয়সীরা পর্যন্ত দুর্বল হয় ও ক্লান্ত হয় আর যুবকেরা উচোট খেয়ে পড়ে যায়, কিন্তু যারা মাবুদের উপর আশা রাখে তারা নতুন শক্তি পাবে। তারা ঈগল পাখীর মত ডানা মেলে উঁচুতে উড়বে; তারা দৌড়ালে ক্লান্ত হবে না, তারা হাঁটলে দুর্বল হবে না। মাবুদ বলছেন, “হে দূর দেশের লোকেরা, তোমরা আমার সামনে চুপ করে থাক। হে জাতিগুলো, তোমরা নতুন করে শক্তি পাও; তোমরা এগিয়ে এসে কথা বল। চল, আমরা বিচারের জন্য একসংগে জমায়েত হই। “কে পূর্ব দিক থেকে আসবার জন্য একজনকে উত্তেজিত করেছেন? ন্যায়বান আল্লাহ্‌ তাঁর কাজের জন্য তাকে ডাক দিয়েছেন। তিনি সেই লোকের হাতে জাতিদের তুলে দেবেন আর তার সামনে বাদশাহ্‌দের নত করবেন। তার তলোয়ার দিয়ে সে তাদের ধুলার মত করবে আর তার ধনুকের সামনে বাতাসে নাড়ার মত তাদের উড়িয়ে দেবে। সে তাদের তাড়া করবে; যে পথে সে আগে কখনও চলে নি সেই পথে সে নিরাপদে চলবে। কে এই কাজ করেছেন? কার দ্বারা এই কাজ হয়েছে? বংশের পর বংশে কি ঘটবে তা কে প্রথম থেকে ঠিক করে রেখেছেন? আমি মাবুদই প্রথম থেকে আছি আর শেষ সময়ের লোকদের সংগেও থাকব।” মাবুদের এই কাজ দেখে দূর দেশের লোকেরা ভয় পাবে আর দুনিয়ার শেষ সীমার লোকেরা কাঁপবে। তারা এগিয়ে এসে একত্র হবে; তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে আর নিজের নিজের ভাইকে বলবে, “সাহস কর।” কারিগর স্বর্ণকারকে উৎসাহ দেবে; হাতুড়ী দিয়ে যে সমান করে সে নেহাইয়ের উপর আঘাতকারীকে উৎসাহ দেবে। সে জোড়ার কাজ দেখে বলবে, “ভাল হয়েছে।” সে পেরেক দিয়ে মূর্তিটা শক্ত করবে যেন সেটা পড়ে না যায়। মাবুদ বলছেন, “কিন্তু হে আমার গোলাম ইসরাইল, আমার বেছে নেওয়া ইয়াকুব, আমার বন্ধু ইব্রাহিমের বংশ, আমি তোমাকে দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে এনেছি, তোমাকে সবচেয়ে দূরের জায়গা থেকে ডেকে এনেছি। আমি বলেছি, ‘তুমি আমার গোলাম’; আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, অগ্রাহ্য করি নি। কাজেই তুমি ভয় কোরো না, আমি তো তোমার সংগে সংগে আছি; ব্যাকুল হোয়ো না, কারণ আমি তোমার আল্লাহ্‌। আমি তোমাকে শক্তি দেব ও নিশ্চয়ই সাহায্য করব আর আমার ন্যায়ের ডান হাত দিয়ে তোমাকে নিশ্চয়ই ধরে রাখব। “যারা তোমার উপর রাগ করে তারা সকলে নিশ্চয়ই লজ্জিত ও অসম্মানিত হবে। যারা তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের কোন চিহ্ন থাকবে না; তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার শত্রুদের খুঁজলেও তুমি তাদের পাবে না। যারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাদের আর কোন চিহ্ন থাকবে না, কারণ আমি আল্লাহ্‌, তোমার মাবুদ; আমি তোমার ডান হাত ধরে আছি আর তোমাকে বলছি, ভয় কোরো না; আমি তোমাকে সাহায্য করব। হে ইয়াকুব, হে ইসরাইল, তুমি যদিও পোকার মত সামান্য তবুও ভয় কোরো না; আমি নিজেই তোমাকে সাহায্য করব। আমি মাবুদ তোমার মুক্তিদাতা ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক এই কথা বলছি। দেখ, আমি তোমাকে নতুন, ধারালো দাঁতযুক্ত শস্য মাড়াই করবার যন্ত্র বানাব। তুমি পাহাড়-পর্বত মাড়াই করে সেগুলো চুরমার করবে, আর ছোট পাহাড়গুলোকে তুষের মত করবে। তুমি সেগুলো ঝাড়লে বাতাস তাদের তুলে নিয়ে যাবে আর ঘূর্ণিবাতাস তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেবে। কিন্তু তুমি মাবুদকে নিয়ে আনন্দ করবে আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক তোমার গৌরবের জিনিস হবেন। “দুঃখী ও অভাবীরা পানির খোঁজ করে, কিন্তু পানি নেই; পিপাসায় তাদের জিভ্‌ শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আমি মাবুদই তাদের জবাব দেব; আমি ইসরাইলের আল্লাহ্‌ তাদের ত্যাগ করব না। আমি গাছপালাহীন পাহাড়গুলোর উপরে নদী বইয়ে দেব আর উপত্যকার নানা জায়গায় ঝর্ণা বইয়ে দেব। আমি মরুভূমিতে পুকুর তৈরী করব, আর শুকনা মাটিতে ঝর্ণা খুলে দেব। আমি মরুভূমিতে এরস, বাব্‌লা, গুলমেঁদি ও বুনো জলপাই গাছ লাগাব আর মরুভূমিতে লাগাব বেরস, ঝাউ ও তাশূর গাছ, যাতে লোকেরা দেখে, জেনে ও বিবেচনা করে বুঝতে পারে যে, মাবুদের হাতই এই কাজ করেছে, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকই এই সব করেছেন।” মাবুদ, অর্থাৎ ইয়াকুবের বাদশাহ্‌ বলছেন, “দেবতারা, তোমরা এবার তোমাদের পক্ষে কথা বল। তোমাদের সব যুক্তি দেখাও। তোমরা সেই সব যুক্তি নিয়ে এসে যা ঘটবে তা আমাদের বল। আগেকার ঘটনাগুলো সম্বন্ধে আমাদের জানাও, যাতে আমরা সেগুলোর বিষয় ভেবে দেখে তাদের শেষ ফল কি তা জানতে পারি; কিংবা কি কি ঘটবে সেই বিষয় আমাদের কাছে ঘোষণা কর। ভবিষ্যতে কি হবে তা আমাদের বল, তা হলে আমরা জানতে পারব যে, তোমরা দেবতা। ভাল হোক বা খারাপ হোক একটা কিছু কর যা দেখে আমরা হতভম্ব হব। কিন্তু আসলে তোমরা কিছুই না, আর তোমাদের কাজগুলোও কিছু না; যে তোমাদের বেছে নেয় সে ঘৃণার পাত্র। “পূর্ব দিকের একজন লোক আমার নাম ঘোষণা করবে; তাকে আমি উত্তর দিক থেকে আসবার জন্য উত্তেজিত করেছি, আর সে আসছে। যেমন করে চুন্তসুরকি ও পানি মিশানো হয় আর কুমার মাটি দলাই-মলাই করে তেমনি করে সে শাসনকর্তাদের পায়ে দলবে। এই বিষয় কে শুরু থেকে আমাদের বলেছিল যাতে আমরা জানতে পারি? কিংবা কে আগে জানিয়েছিল যাতে আমরা বলতে পারি, ‘সে ঠিক কথা বলেছে’? কেউ বলে নি, কেউ জানায় নি, কেউ তোমাদের কথা বলতে শোনে নি। আমিই প্রথমে সিয়োনকে বলেছি, আর দেখ, তারা এসে গেছে। আমি জেরুজালেমকে একজন সুসংবাদদাতা দিয়েছি। আমি চেয়ে দেখলাম কেউ নেই; পরামর্শ দেবার জন্য তাদের মধ্যে কেউ নেই যে, তাদের জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিতে পারে। দেখ, তারা সবাই অসার, তাদের কাজ কিছুই নয়। তাদের ছাঁচে-ঢালা মূর্তিগুলো বাতাস ছাড়া আর কিছু নয়; তারা কিছুই করতে পারে না।” মাবুদ বলছেন, “দেখ, আমার গোলাম, যাঁকে আমি সাহায্য করি; আমার বাছাই করা বান্দা, যাঁর উপর আমি সন্তুষ্ট। আমি তাঁর উপরে আমার রূহ্‌ দেব আর তিনি জাতিদের কাছে ন্যায়বিচার নিয়ে আসবেন। তিনি চিৎকার করবেন না বা জোরে কথা বলবেন না; তিনি রাস্তায় রাস্তায় তাঁর গলার স্বর শোনাবেন না। তিনি থেঁৎলে যাওয়া নল ভাংবেন না আর মিটমিট করে জ্বলতে থাকা সল্‌তে নিভাবেন না। তিনি সততার সংগে ন্যায়বিচার করবেন। দুনিয়াতে ন্যায়বিচার স্থাপন না করা পর্যন্ত তিনি দুর্বল হবেন না বা ভেংগে পড়বেন না। দূরের লোকেরা তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে।” মাবুদ আল্লাহ্‌ আসমান সৃষ্টি করে মেলে দিয়েছেন; তিনি দুনিয়া ও তাতে যা জন্মায় তা সব বিছিয়ে দিয়েছেন; তিনি সেখানকার লোকদের নিঃশ্বাস দেন আর যারা সেখানে চলাফেরা করে তাদের জীবন দেন। তিনি বলছেন, “আমি মাবুদ তোমাকে ন্যায়ভাবে ডেকেছি; আমি তোমার হাত ধরে রাখব। আমি তোমাকে রক্ষা করব এবং আমার বান্দাদের জন্য তোমাকে একটা ব্যবস্থার মত করব আর অন্যান্য জাতিদের জন্য করব আলোর মত। তুমি অন্ধদের চোখ খুলে দেবে, জেলখানা থেকে বন্দীদের মুক্ত করবে আর সেখানকার অন্ধকার গর্তে রাখা লোকদের বের করে আনবে। “আমি মাবুদ, এ-ই আমার নাম। আমি অন্যকে আমার গৌরব কিংবা মূর্তিকে আমার পাওনা প্রশংসা পেতে দেব না। দেখ, আগেকার ঘটনাগুলো ঘটে গেছে আর এখন আমি নতুন ঘটনার কথা ঘোষণা করব; সেগুলো ঘটবার আগেই তোমাদের কাছে তা জানাচ্ছি।” হে সাগরে চলাচলকারীরা, সাগরের মধ্যেকার সব প্রাণী, হে দূরের দেশগুলো আর তার মধ্যেকার বাসিন্দারা, তোমরা সবাই মাবুদের উদ্দেশে একটা নতুন কাওয়ালী গাও, দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে তাঁর প্রশংসার কাওয়ালী গাও। মরুভূমি ও তার শহরগুলো জোরে জোরে প্রশংসা করুক; কায়দারীয়দের গ্রামগুলোও তা করুক, শেলার লোকেরা আনন্দে কাওয়ালী করুক, পাহাড়ের চূড়াগুলো থেকে আনন্দে চিৎকার করুক। তারা মাবুদের গৌরব করুক; দূরের দেশগুলোর মধ্যে তাঁর প্রশংসা ঘোষণা করুক। একজন শক্তিশালী লোকের মত করে মাবুদ বের হয়ে আসবেন; তিনি যোদ্ধার মত তাঁর আগ্রহকে উত্তেজিত করবেন; তিনি চিৎকার করে যুদ্ধের হাঁক দেবেন আর শত্রুদের উপর জয়ী হবেন। “আমি মাবুদ অনেক দিন চুপ করে ছিলাম; আমি শান্ত থেকে নিজেকে দমন করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন প্রসবকারিণী স্ত্রীলোকের মত আমি চিৎকার করছি, শ্বাস টানছি ও হাঁপাচ্ছি। আমি পাহাড়-পর্বতগুলো গাছপালাহীন করব আর সেখানকার সমস্ত গাছপালা শুকিয়ে ফেলব; আমি নদীগুলোকে দ্বীপ বানাব আর পুকুরগুলো শুকিয়ে ফেলব। আমি অন্ধদের তাদের অজানা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাব, যে পথ তারা জানে না সেই পথে তাদের চালাব। তাদের আগে আগে আমি অন্ধকারকে আলো করব আর অসমান জায়গাকে সমান করে দেব। এ সবই আমি করব, নিশ্চয়ই করব। কিন্তু যারা খোদাই করা মূর্তির উপর ভরসা করে, যারা ছাঁচে ঢালা মূর্তিগুলোকে বলে, ‘তোমরা আমাদের দেবতা,’ আমি তাদের ভীষণ লজ্জায় ফেলে ফিরিয়ে দেব। “ওহে বধির লোকেরা, শোন, আর অন্ধেরা, তোমরা তাকিয়ে দেখ। আমার গোলাম ছাড়া অন্ধ আর কে? আমার পাঠানো দূতের মত বধির আর কে? আমার উপর ভরসাকারীর মত অন্ধ আর কে? মাবুদের গোলামের মত অন্ধ কে? তুমি অনেক কিছু দেখেও মনোযোগ দিচ্ছ না; তোমার কান খোলা থাকলেও কিছু শুনছ না।” উদ্ধারের পরিকল্পনার জন্য মাবুদ খুশী হয়ে তাঁর নির্দেশকে মহৎ ও গৌরবযুক্ত করলেন। কিন্তু এই লোকদের সব কিছু নিয়ে যাওয়া ও লুট করা হয়েছে, তাদের সবাইকে গর্তে ফেলা হয়েছে আর জেলখানায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তারা কেড়ে নেওয়া জিনিসের মত হয়েছে, তাদের উদ্ধার করবার কেউ নেই। তারা লুটের মাল হয়েছে; কেউ বলে না, “তাদের ফিরিয়ে দাও।” তোমাদের মধ্যে কে আমার কথা শুনবে? আর যে সময় আসছে সেই সময়ের জন্য কে আমার কথায় গভীর মনোযোগ দেবে? ইয়াকুবকে কে লুট হতে দিয়েছেন? আর ইসরাইলকে কে লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছেন? তিনি কি মাবুদ নন, যাঁর বিরুদ্ধে আমরা গুনাহ্‌ করেছি? তারা তাঁর পথে চলতে চায় নি, তাঁর নির্দেশ পালন করে নি। তাই তিনি তাঁর জ্বলন্ত রাগ ও যুদ্ধের ভয়ংকরতা ইসরাইলের উপর ঢেলে দিয়েছেন। তাতে সেই আগুন তার চারদিকে জ্বলে উঠল, তবুও সে বুঝতে পারল না; আগুন তার গায়ে লাগল, কিন্তু তাতে সে মনোযোগ দিল না। হে ইয়াকুব, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, হে ইসরাইল, যিনি তোমাকে তৈরী করেছেন, সেই মাবুদ এখন এই কথা বলছেন, “তুমি ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমাকে মুক্ত করেছি। আমি তোমার নাম ধরে ডেকেছি, তুমি আমার। তুমি যখন পানির মধ্য দিয়ে যাবে তখন আমি তোমার সংগে সংগে থাকব। যখন তুমি নদীর মধ্য দিয়ে যাবে, তখন সেগুলো তোমাকে ডুবিয়ে দেবে না; তুমি যখন আগুনের মধ্য দিয়ে যাবে, তখন তুমি পুড়বে না; আগুনের শিখা তোমার গায়ে লাগবে না; কারণ আমিই তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার উদ্ধারকর্তা, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক। আমি তোমার মুক্তির মূল্য হিসাবে মিসর দেশ দেব, আর তোমার বদলে ইথিওপিয়া ও সবা দেশ দেব। আমি তোমার বদলে অন্য লোকদের দেব আর তোমার প্রাণের বদলে অন্য জাতিদের দেব, কারণ তুমি আমার চোখে মূল্যবান ও সম্মানিত, আর আমি তোমাকে মহব্বত করি। তুমি ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমার সংগে সংগে আছি। পূর্ব দিক থেকে আমি তোমার বংশকে নিয়ে আসব আর পশ্চিম দিক থেকে তোমাকে জমায়েত করব। আমি উত্তরের দেশগুলোকে বলব, ‘ওদের ছেড়ে দাও,’ আর দক্ষিণের দেশগুলোকে বলব, ‘ওদের আট্‌কে রেখো না।’ আমি তাদের বলব, ‘তোমরা দূর থেকে আমার ছেলেদের আর দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে আমার মেয়েদের নিয়ে এস। আমার নামে যাদের ডাকা হয়, আমি যাদের আমার গৌরবের জন্য সৃষ্টি করেছি, যাদের আমি গড়েছি ও তৈরী করেছি, তোমরা তাদের প্রত্যেককে নিয়ে এস।’ ” যারা চোখ থাকতেও অন্ধ আর কান থাকতেও বধির তারা বের হয়ে আসুক। সব জাতি একসংগে জমায়েত হোক আর লোকেরা এক জায়গায় মিলিত হোক। তাদের মধ্যে কে আমাদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে ও আগেকার বিষয় বলতে পারে? তাদের কথা যে ঠিক তা প্রমাণ করবার জন্য তারা তাদের সাক্ষী আনুক যাতে সেই সাক্ষীরা তা শুনে বলতে পারে, “ঠিক কথা।” আল্লাহ্‌ বনি-ইসরাইলদের বলছেন, “তোমরাই আমার সাক্ষী ও আমার বেছে নেওয়া গোলাম, যাতে তোমরা জানতে পার ও আমার উপর ঈমান আনতে পার আর বুঝতে পার যে, আমিই তিনি। আমার আগে কোন মাবুদ তৈরী হয় নি আর আমার পরেও অন্য কোন মাবুদ থাকবেন না। আমি, আমিই আল্লাহ্‌, আমি ছাড়া আর কোন উদ্ধারকর্তা নেই। আমিই প্রকাশ করেছি, উদ্ধার করেছি ও ঘোষণা করেছি; তখন তোমাদের মধ্যে কোন দেবতা ছিল না। এই বিষয়ে তোমরাই আমার সাক্ষী। আমি আল্লাহ্‌ এই কথা বলেছি; আমিই মাবুদ। জ্বী, প্রথম থেকে আমিই তিনি। কেউ আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। আমি কাজ করলে কেউ তা বাতিল করতে পারে না।” মাবুদ, তোমাদের মুক্তিদাতা, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক এই কথা বলছেন, “আমি তোমাদের জন্য ব্যাবিলনে লোক পাঠাব এবং যে জাহাজ নিয়ে ব্যাবিলনীয়রা গর্ব করত তাতে করে পালিয়ে যাওয়া লোকদের মত করে সেই ব্যাবিলনীয়দের নিয়ে আসব। আমিই মাবুদ, তোমাদের আল্লাহ্‌ পাক; আমিই ইসরাইলের সৃষ্টিকর্তা ও তোমাদের বাদশাহ্‌।” মাবুদ সাগরের মধ্য দিয়ে রাস্তা করেছিলেন, সেই ভীষণ পানির মধ্য দিয়ে পথ করেছিলেন। তিনি রথ, ঘোড়া ও শক্তিশালী সৈন্যদলকে বের করে এনেছিলেন। তারা একসংগে সেখানে পড়ে ছিল, আর উঠতে পারে নি। তারা শল্‌তের মত নিভে গিয়েছিল। তিনি বলছেন, “তোমরা আগেকার সব কিছু মনে এনো না; পুরানো কিছুর মধ্যে পড়ে থেকো না। দেখ, আমি একটা নতুন কাজ করতে যাচ্ছি। তা এখনই শুরু হবে আর তোমরা তা জানতে পারবে। আমি মরুভূমির মধ্যে পথ করব আর মরুভুমিতে নদী বইয়ে দেব। বুনো পশু, শিয়াল ও উটপাখীরা আমার গৌরব করবে, কারণ আমার বান্দাদের, আমার বাছাই করা বান্দাদের খাবার জন্য আমি মরুভূমিতে পানি যুগিয়ে দেব আর মরুভূমিতে নদী বইয়ে দেব। সেই বান্দাদের আমি নিজের জন্য তৈরী করেছি যাতে তারা আমার প্রশংসা ঘোষণা করতে পারে। “কিন্তু হে ইয়াকুব, তুমি আমাকে ডাক নি; হে ইসরাইল, তুমি আমাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছ। পোড়ানো-কোরবানীর জন্য তুমি আমার কাছে ভেড়া আন নি আর তোমার কোন কোরবানীর দ্বারা আমাকে সম্মান দেখাও নি। আমি তোমার উপর শস্য-কোরবানীর ভার দিই নি; লোবান দেবার জন্য তোমাকে ক্লান্ত করি নি। তুমি কোন খোশবু বচ আমার জন্য কিনে আন নি; তোমার পশু-কোরবানীর চর্বি দিয়ে তুমি আমাকে খুশী কর নি। তার বদলে তুমি তোমার গুনাহের বোঝা আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছ আর তোমার সমস্ত অন্যায় দিয়ে আমাকে ক্লান্ত করেছ। “আমি, আমিই আমার নিজের জন্য তোমার অন্যায় মুছে ফেলি; আমি তোমার গুনাহ্‌ আর মনে আনব না। তোমার বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দাও; এস, আমরা তা নিয়ে তর্কাতর্কি করি। তুমি নিজের পক্ষে কথা বল যাতে তোমাকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করা যায়। তোমার আদিপিতা গুনাহ্‌ করেছিল; তোমার মধ্যস' হিসাবে যারা কথা বলেছিল তারা আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছিল। তাই আমি তোমাদের এবাদত-খানার ইমামদের অপমান করব আর ইয়াকুবকে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন করব এবং ইসরাইলকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র করব।” মাবুদ বলছেন, “হে আমার গোলাম ইয়াকুব, আমার বেছে নেওয়া ইসরাইল, তুমি এখন শোন। মাবুদ, যিনি তোমাকে তৈরী করেছেন, মায়ের গর্ভে গড়ে তুলেছেন ও তোমাকে সাহায্য করবেন, তিনি এই কথা বলেছেন, ‘হে আমার গোলাম ইয়াকুব, আমার বেছে নেওয়া ইসরাইল, তুমি ভয় কোরো না; কারণ আমি পিপাসিত জমির উপরে পানি ঢালব আর শুকনা জায়গার উপর দিয়ে স্রোত বইয়ে দেব। আমি তোমার সন্তানদের উপর আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব আর তোমার বংশের লোকদের দোয়া করব। তারা ঘাসের মধ্যে বয়ে যাওয়া স্রোতের ধারের উইলো গাছের মত ঘাসের মধ্যে গজিয়ে উঠবে। একজন বলবে যে, সে মাবুদের; আর একজন ইয়াকুবের নামে নিজের পরিচয় দেবে; অন্য আর একজন নিজের হাতের উপরে লিখবে যে, সে মাবুদের, আর সে ইসরাইল নাম গ্রহণ করবে।’ ” মাবুদ, যিনি ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ও মুক্তিদাতা, যিনি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তিনি এই কথা বলছেন, “আমিই প্রথম ও আমিই শেষ; আমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। তাহলে আমার মত আর কে আছে? সে তা ঘোষণা করুক। সে ঘোষণা করুক ও আমাকে বলুক যে, আমি পুরানো দিনের লোকদের স্থাপন করবার পর কি ঘটেছিল আর কি এখনও ঘটে নি; জ্বী, যা ঘটবে সে তা আগেই বলুক। তোমরা কেঁপো না বা ভয় কোরো না। আমি কি অনেক দিন আগে এই সব ঘোষণা করি নি ও জানাই নি? তোমরাই আমার সাক্ষী; আমি ছাড়া আর কি কোন মাবুদ আছে? না, আর কোন আশ্রয়-পাহাড় নেই; আমি আর কাউকে জানি না।” যারা খোদাই করে মূর্তি তৈরী করে তারা অপদার্থ; তাদের এই মূল্যবান জিনিসগুলো উপকারী নয়। সেই মূর্তিগুলোর পক্ষ হয়ে যারা কথা বলে তারা অন্ধ, কিছু জানে না; সেইজন্য তারা লজ্জা পাবে। কে দেবতা তৈরী করেছে আর অপদার্থ মূর্তি ছাঁচে ঢেলেছে? যারা মূর্তির সংগে যুক্ত তাদের লজ্জায় ফেলা হবে; তাদের কারিগরেরা মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা সবাই এসে একসংগে দাঁড়াক; তারা ভয়ে কাঁপবে ও একসংগে অসম্মানিত হবে। কামার একটা যন্ত্র নেয় আর তা দিয়ে জ্বলন্ত কয়লার মধ্যে কাজ করে। সে হাতুড়ি দিয়ে মূর্তির আকার গড়ে, আর হাতের শক্তি দিয়ে তা তৈরী করে। তাতে তার খিদে পায় ও শক্তি কমে যায়; পানি না খেয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছুতার মিস্ত্রি সুতা দিয়ে মাপে আর কলম দিয়ে নকশা আঁকে; সে যন্ত্র দিয়ে খোদাই করে আর কমপাস দিয়ে তার আকার ঠিক করে। সে তাতে একটা সুন্দর মানুষের আকার দেয় যেন তা ঘরের মধ্যে থাকতে পারে। কেউ এরস গাছ কাটে, কিংবা হয়তো তর্সা বা এলোন গাছ বেছে নেয়। সে বনের গাছপালার মধ্যে সেটাকে বাড়তে দেয়, কিংবা সে ঝাউ গাছ লাগায় আর বৃষ্টি সেটা বাড়িয়ে তোলে। পরে সেটা মানুষের জ্বালানি কাঠ হয়। সে তার কিছু নিয়ে আগুন পোহায়, আবার আগুন জ্বেলে রুটি সেঁকে, আবার একটা দেবতা তৈরী করে তার পূজাও করে, আবার মূর্তি তৈরী করে মাটিতে পড়ে তাকে প্রণাম করে। সে কাঠের এক ভাগ দিয়ে আগুন জ্বালায়, তারপর সে তার উপর তার খাবার তৈরী করে আর গোশ্‌ত ঝল্‌সে নিয়ে পেট ভরে খায়; আবার আগুন পোহায়ে সে বলে, “আহা! আমি আগুন পোহালাম, আগুনের তাপ নিলাম।” বাকী অংশ দিয়ে সে একটা দেবতা, অর্থাৎ একটা মূর্তি তৈরী করে আর মাটিতে পড়ে তাকে প্রণাম করে ও পূজা করে। সে তার কাছে প্রার্থনা করে বলে, “আমাকে উদ্ধার কর; তুমিই আমার দেবতা।” সেই লোকেরা কিছু জানেও না, বোঝেও না। তাদের চোখ বন্ধ বলে তারা দেখতে পায় না আর মন বন্ধ বলে তারা বুঝতেও পারে না। কেউ একটু চিন্তা করে না; কারও জ্ঞান বা বুদ্ধি নেই যে বলে, “আমি এর এক ভাগ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছি, তার কয়লার উপর রুটি সেঁকেছি আর গোশ্‌ত ঝল্‌সে নিয়ে খেয়েছি। তাহলে কি এর বাকী অংশ দিয়ে আমি ঘৃণার জিনিস তৈরী করব? কাঠের খণ্ডকে কি আমি মাটিতে পড়ে প্রণাম করব?” সে ছাই খাওয়ার মত কাজ করে এবং তার ঠগ দিল তাকে বিপথে নেয়। সে নিজেকে উদ্ধার করতে পারে না বা বলেও না, “আমার ডান হাতের এই জিনিসটা কি মিথ্যা নয়?” “হে ইয়াকুব, হে ইসরাইল, তুমি এই সব মনে রেখ, কারণ তুমি আমার গোলাম। আমি তোমাকে তৈরী করেছি, তুমি আমারই গোলাম; হে ইসরাইল, আমি তোমাকে ভুলে যাব না। মেঘের মত করে তোমার সব অন্যায় আর সকাল বেলার কুয়াশার মত করে তোমার সব গুনাহ্‌ আমি দূর করে দিয়েছি। তুমি আমার কাছে ফিরে এস, কারণ আমিই তোমাকে মুক্ত করেছি।” হে আসমান, আনন্দে কাওয়ালী গাও, কারণ মাবুদই এটা করেছেন। হে দুনিয়ার গভীর স্থানগুলো, জয়ধ্বনি কর। হে পাহাড়-পর্বত, হে বন আর সেখানকার গাছপালা, তোমরা আনন্দ-গানে ফেটে পড়, কারণ মাবুদ ইয়াকুবকে মুক্ত করেছেন আর ইসরাইলের মধ্য দিয়ে তাঁর গৌরব প্রকাশ করবেন। মাবুদ, যিনি তোমার মুক্তিদাতা, যিনি তোমাকে গর্ভে গড়েছেন তিনি বলছেন, “আমি মাবুদ; আমিই সব কিছু তৈরী করেছি। আমি একাই আসমানকে বিছিয়েছি আর নিজেই দুনিয়াকে মেলে দিয়েছি। ভণ্ড নবীদের চিহ্ন আমি বিফল করে দিই আর গণকদের বোকা বানাই। আমি জ্ঞানীদের শিক্ষা বিফল করে তা বোকাদের শিক্ষা বানাই। কিন্তু আমি আমার গোলামের কথা সফল হতে দিই আর আমার দূতদের বলা কথা পূর্ণ করি। আমি জেরুজালেমের বিষয়ে বলি, ‘ওখানে লোকেরা বাস করবে,’ আর এহুদার শহরগুলো সম্বন্ধে বলি, ‘সেগুলো আবার তৈরী করা হবে।’ আমি দেশের ধ্বংসস্থানগুলো আবার তৈরী করব। আমি অগাধ পানিকে বলি, ‘তুমি শুকিয়ে যাও; আমি তোমার স্রোতগুলো শুকিয়ে ফেলব।’ আমি কাইরাসের সম্বন্ধে বলি যে, সে আমার রাখাল; আমি যাতে খুশী হই সে তা সবই করবে। সে জেরুজালেম সম্বন্ধে বলবে, ‘ওটা আবার তৈরী হোক,’ আর বায়তুল-মোকাদ্দস সম্বন্ধে বলবে, ‘ওর ভিত্তি স্থাপন করা হোক।’ ” মাবুদ তাঁর অভিষেক-করা বান্দা কাইরাসের সম্বন্ধে বলছেন, “তার সামনে জাতিদের দমন করবার জন্য আর বাদশাহ্‌দের শক্তিহীন করবার জন্য আমি তার ডান হাত ধরেছি। আমি তার সামনে দরজাগুলো খুলে দেব যাতে দরজাগুলো বন্ধ না থাকে।” তিনি কাইরাসকে বলছেন, “আমি তোমার আগে আগে গিয়ে উঁচু-নীচু জায়গাগুলো সমান করে দেব; আমি ব্রোঞ্জের সব দরজা ভেংগে দেব আর লোহার আগলগুলো কেটে ফেলব। আমি তোমাকে অন্ধকার জায়গায় রাখা ধন-সম্পদ আর লুকানো জায়গায় জমিয়ে রাখা ধন দেব, যাতে তুমি জানতে পার যে, আমিই আল্লাহ্‌, ইসরাইলের মাবুদ, যিনি তোমার নাম ধরে ডাকেন। আমার গোলাম ইয়াকুবের জন্য, আমার বেছে রাখা ইসরাইলের জন্য আমি তোমার নাম ধরে ডেকেছি। আমাকে তুমি না জানলেও আমি তোমাকে সম্মানের উপাধি দিয়েছি। আমিই আল্লাহ্‌, অন্য আর কেউ নেই; আমি ছাড়া অন্য মাবুদ নেই। তুমি আমাকে না জানলেও আমি তোমাকে শক্তি দিয়েছি, যেন পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত লোকে জানতে পারে যে, আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমিই মাবুদ, অন্য আর কেউ নেই। আমিই আলো এবং অন্ধকার সৃষ্টি করি; আমিই উন্নতি নিয়ে আসি ও সর্বনাশের সৃষ্টি করি। আমি মাবুদই এই সব করে থাকি। “হে আসমান, তুমি সততার বৃষ্টি ফেল; মেঘ সততা ঢেলে দিক। দুনিয়ার বুক খুলে গিয়ে উদ্ধার গজিয়ে উঠুক আর তার সংগে বেড়ে উঠুক সততা। আমি মাবুদই এর ব্যবস্থা করেছি। “ঘৃণ্য সেই লোক, যে তার সৃষ্টিকর্তার সংগে ঝগড়া করে। সে তো মাটির পাত্রগুলোর মধ্যে একটা পাত্র ছাড়া আর কিছু নয়। মাটি কি কুমারকে বলবে, ‘তুমি কি তৈরী করছ?’ তোমার তৈরী জিনিস কি বলবে, ‘তোমার হাত পাকা নয়’? ঘৃণ্য সেই লোক, যে তার বাবাকে বলে, ‘তুমি কি জন্ম দিয়েছ?’ কিংবা তার মাকে বলে ‘তুমি কি প্রসব করেছ?’ “মাবুদ, যিনি ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক, যিনি তার সৃষ্টিকর্তা, তিনি এই কথা বলছেন, ‘তোমরা কি ভবিষ্যতের ঘটনা সম্বন্ধে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ? আমার সন্তানদের সম্বন্ধে কিংবা আমার হাতের কাজের বিষয়ে কি আমাকে হুকুম দিচ্ছ? আমিই দুনিয়া তৈরী করে তার উপর মানুষকে সৃষ্টি করেছি; আমি নিজের হাতে আকাশকে বিছিয়ে দিয়েছি আর আসমানের সূর্য, চাঁদ ও তারাগুলোকে স্থাপন করেছি। আমার ন্যায্যতায় আমি কাইরাসকে উত্তেজিত করব; আমি তার সমস্ত পথ সোজা করব। সে আমার শহর আবার তৈরী করবে, আমার যে বান্দারা বন্দী ছিল সে তাদের ছেড়ে দেবে কিন্তু সে কোন দাম বা পুরস্কারের জন্য তা করবে না।’ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছেন।” মাবুদ ইসরাইল জাতিকে বলছেন, “মিসরের উপার্জন করা সম্পদ ও ইথিওপিয়ার ব্যবসার জিনিস তোমার কাছে আসবে। লম্বা লম্বা সবায়ীয়রা নিজেরাই তোমার কাছে আসবে; তারা তোমার হবে আর তোমার পিছনে পিছনে চলবে। তারা শিকলে বাঁধা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে। তারা তোমার সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে মিনতি জানাবে ও বলবে, ‘আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই তোমার সংগে আছেন। একমাত্র তিনিই আল্লাহ্‌, আর কোন মাবুদ নেই।’ ” হে ইসরাইলের আল্লাহ্‌ ও উদ্ধারকর্তা, সত্যিই তুমি এমন আল্লাহ্‌ যিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। যারা মূর্তি তৈরী করে তারা সবাই লজ্জিত ও অসম্মানিত হবে; তারা একসংগে অপমানিত হয়ে চলে যাবে। কিন্তু আল্লাহ্‌ ইসরাইলকে চিরকালের জন্য উদ্ধার করবেন; তোমরা কোন কালেই লজ্জিত বা অপমানিত হবে না। আল্লাহ্‌, যিনি আসমান সৃষ্টি করেছেন, তিনিই মাবুদ; যিনি দুনিয়ার আকার দিয়েছেন ও তৈরী করেছেন, তিনিই তা স্থাপন করেছেন। তিনি বাস করবার অযোগ্য করে দুনিয়া সৃষ্টি করেন নি, বরং লোকেরা যাতে বাস করতে পারে সেইভাবেই তা সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলছেন, “আমিই আল্লাহ্‌, আর কেউ নয়। কোন অন্ধকার দেশের কোন জায়গা থেকে আমি গোপনে কথা বলি নি। ইয়াকুবের বংশকে আমি বলি নি, ‘তোমরা মিথ্যাই আমাকে ডাক।’ আমি মাবুদ ন্যায্য কথা বলি; যা ঠিক তা-ই ঘোষণা করি। “ওহে অন্যান্য জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা, তোমরা এক সংগে জমায়েত হয়ে এস। যারা কাঠের মূর্তি বয়ে নিয়ে বেড়ায় আর এমন দেবতার কাছে মুনাজাত করে যে উদ্ধার করতে পারে না তারা কিছুই জানে না। এস, তোমাদের পক্ষে যা বলবার আছে তা উপস্থিত কর; তোমরা একসংগে পরামর্শ কর। এই ঘটনা যে ঘটবে তা কে আগে বলেছেন? সেই দূর অতীতে কে তা আগে ঘোষণা করেছেন? আমি আল্লাহ্‌ই কি তা করি নি? আমি ছাড়া আর মাবুদ নেই; আমি ন্যায়বান আল্লাহ্‌, আমি উদ্ধারকর্তা। আমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। “হে দুনিয়ার সব শেষ সীমাগুলো, আমার দিকে ফেরো এবং উদ্ধার পাও, কারণ আমিই আল্লাহ্‌, আর কেউ মাবুদ নয়। আমি নিজের নামেই কসম খেয়েছি, আমার ন্যায্যতায় আমি এই কথা বলেছি, আর তা বাতিল হবে না। সেই কথা হল, আমার সামনে প্রত্যেকে হাঁটু পাতবে এবং আমার অধীনতা স্বীকার করবে। তারা আমার বিষয় বলবে, ‘কেবল মাবুদের মধ্যেই সততা ও কুদরত আছে।’ লোকেরা আমার কাছে আসবে এবং যারা আমার উপর রেগে আছে তারা লজ্জিত হবে। আমার মধ্যেই ইসরাইলের সমস্ত বংশ নির্দোষ বলে প্রমাণিত হবে এবং তারা আমার প্রশংসা করবে।” মাবুদ বলছেন, “বেল দেবতা নীচু হবে আর নবো দেবতা উবুড় হয়ে পড়বে; তাদের মূর্তিগুলো ভার বহনকারী পশুরা বয়ে নেবে। যে মূর্তিগুলো ব্যাবিলনীয়রা পূজা করত সেগুলো বোঝার মত হবে, ক্লান্ত পশুদের জন্য ভার হবে। সেই দেবতারা একসংগে উবুড় হবে আর নীচু হবে। তারা নিজেদের মূর্তিগুলো রক্ষা করতে পারবে না বরং নিজেরাই বন্দী হয়ে চলে যাবে। “হে ইয়াকুবের বংশ, ইসরাইলের বংশের বেঁচে থাকা লোকেরা, তোমরা আমার কথা শোন। গর্ভে আসবার সময় থেকে এবং জন্মের পর থেকে আমি তোমাদের ভার বহন করছি। তোমাদের বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমি একই থাকব; তোমাদের চুল পাকবার বয়স পর্যন্ত তোমাদের ভার বহন করব। আমিই তোমাদের তৈরী করেছি, আমিই তোমাদের ভার বইব; আমিই তোমাদের বহন করব এবং রক্ষা করব। “তোমরা কার সংগে আমার তুলনা করবে কিংবা কার সমান বলে আমাকে ধরবে? কার সংগে তুলনা করলে আমাদের সমান বলা যাবে? কেউ কেউ তাদের থলি থেকে সোনা ঢালে আর দাঁড়িপাল্লায় রূপা ওজন করে। সেগুলো দিয়ে তারা দেবতা তৈরী করবার জন্য স্বর্ণকারকে দেয়; পরে তারা সেই দেবতাকে প্রণাম করে ও পূজা করে। তারা তাকে কাঁধে তুলে বয়ে নেয়; তার জায়গায় তারা তাকে স্থাপন করে আর সে সেখানেই থাকে। সেই জায়গা থেকে সে আর নড়তে পারে না। কেউ তার কাছে কাঁদলেও সে জবাব দিতে পারে না, তার দুঃখ-কষ্ট থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে না। “হে গুনাহ্‌গার বান্দারা, তোমরা এই কথা মনে রেখে স্থির থেকো আর মনোযোগ দিয়ো। তোমরা অনেক অনেক দিন আগেকার বিষয় স্মরণ কর। আমিই আল্লাহ্‌, অন্য আর কেউ নয়; আমিই আল্লাহ্‌, আমার মত আর কেউ নেই। আমি শেষ কালের বিষয় আগেই বলি আর যা এখনও হয় নি তা আগেই জানাই। আমি বলেছি যে, আমার উদ্দেশ্য স্থির থাকবে; আমার সমস্ত ইচ্ছা আমি পূরণ করব। আমার উদ্দেশ্য পূরণ করবার জন্য আমি একজন লোককে দূর দেশ থেকে ডেকে আনব; সে পূর্বদেশ থেকে শিকারী পাখীর মত আসবে। আমি যা বলেছি তা আমি সফল করব এবং যা পরিকল্পনা করেছি তা করব। হে একগুঁয়ে অন্তরের লোকেরা, তোমরা যারা আমার গ্রহণযোগ্য হওয়া থেকে দূরে আছ, আমার কথা শোন। আমার নির্দোষিতা আমি তোমাদের কাছে নিয়ে আসছি; তা বেশী দূরে নয় এবং আমার উদ্ধার কাজেরও আর বেশী দেরি নেই। আমি সিয়োনকে উদ্ধার করে ইসরাইলকে গৌরব দান করব।” মাবুদ বলছেন, “হে ব্যাবিলন, তুমি নীচে নেমে ধুলায় বস; হে ক্যালডিয়া, তুমি সিংহাসন ছেড়ে মাটিতে বস। তোমাকে আর কোমল ও আহ্লাদী বলা হবে না। তুমি জাঁতা নিয়ে গম পেষো আর তোমার ঘোমটা খুলে ফেল। তোমার কাপড় তুলে রান খোলা রাখ আর নদীর মধ্য দিয়ে হেঁটে যাও। তোমার উলংগতা প্রকাশ পাবে আর তোমার লজ্জা ঢাকা থাকবে না। আমি প্রতিশোধ নেব, কারও অনুরোধ মানব না।” আমাদের মুক্তিদাতা হলেন ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক; তাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। মাবুদ বলছেন, “হে ব্যাবিলন, তুমি চুপ করে বস; তুমি অন্ধকারের মধ্যে যাও। তোমাকে আর রাজ্যগুলোর রাণী বলে ডাকা হবে না। আমার বান্দাদের উপর আমার রাগ জ্বলে উঠেছিল এবং আমার সম্পত্তিকে আমি নাপাক হতে দিয়েছিলাম। তাদের আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম আর তুমি তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাও নি। এমন কি, বুড়ো লোকদের উপরেও তুমি ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলে। তুমি বলেছিলে, ‘আমি চিরকাল রাণীই থাকব।’ কিন্তু তুমি এই সব বিষয় চিন্তাও কর নি, কিংবা এর শেষ ফল কি তা-ও ভেবে দেখ নি। “এখন, হে ভোগবিলাসিনী, শোন; তুমি নিশ্চিন্তে আরামে বসে মনে মনে বলছ, ‘কেবল আমিই আছি, আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি কখনও বিধবা হব না কিংবা সন্তান হারাবার ব্যথা পাব না।’ কিন্তু সন্তান হারানো বা বিধবা হওয়া এ দু’টাই একই দিনে মুহূর্তের মধ্যে তোমার প্রতি ঘটবে। তোমার অনেক জাদুবিদ্যা ও অনেক মন্ত্রতন্ত্র থাকলেও তা তোমার উপর পুরোপুরিভাবেই ঘটবে। তোমার সেই দুষ্টতার উপর তুমি ভরসা করেছ আর বলেছ, ‘কেউ আমাকে দেখছে না।’ তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি তোমাকে বিপথে নিয়ে গেছে; তুমি মনে মনে বলেছ, ‘কেবল আমিই আছি, আমি ছাড়া আর কেউ নেই।’ কিন্তু তোমার উপর দুর্দশা নেমে আসবে, আর তুমি জানবে না কিভাবে জাদুর বলে তা দূর করা যাবে। তোমার উপর বিপদ এসে পড়বে, আর তুমি তা ঠেকাতে পারবে না। যে সর্বনাশের বিষয় তুমি আগে জানতে পার নি তা হঠাৎ তোমার উপর এসে পড়বে। “যে সব জাদুবিদ্যা ও মন্ত্রতন্ত্রের জন্য তুমি ছোটকাল থেকে পরিশ্রম করছ সেই সব তুমি চালিয়ে যাও। হয়তো তুমি সফল হবে, হয়তো তুমি ভয় দেখাতে পারবে। তুমি যে সব পরামর্শ পেয়েছ তা কেবল তোমাকে ক্লান্তই করেছে। তোমার জ্যোতিষীরা সামনে আসুক; তারাগুলো দেখে মাসের পর মাস যারা ভবিষ্যদ্বাণী করে তারা তোমার উপর যা আসছে তা থেকে তোমাকে রক্ষা করুক। তারা নাড়ার মত; আগুন সেগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। তারা আগুনের শক্তির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। এই আগুন এমন কয়লার আগুন নয় যার সামনে বসে কেউ আগুন পোহাতে পারে বা যা থেকে আলো পেতে পারে। যাদের সংগে তুমি পরিশ্রম করেছ আর ছেলেবেলা থেকে ব্যবসা করেছ তারা ঐ রকমই হবে। তারা প্রত্যেকে নিজের নিজের পথে চলছে; একজনও নেই যে তোমাকে রক্ষা করতে পারে।” হে ইয়াকুবের বংশ, তোমরা শোন। তোমাদের তো ইসরাইল নামে ডাকা হয়, তোমরা এহুদার বংশ থেকে এসেছ, তোমরা মাবুদের নাম নিয়ে কসম খেয়ে থাক আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করে থাক, কিন্তু সত্যে বা ন্যায়ে তা কর না। তোমরা তো নিজেদের পবিত্র শহরের বাসিন্দা বলে থাক আর ইসরাইলের মাবুদের উপরে ভরসা কর, যাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। মাবুদ বলছেন, “যা হয়ে গেছে তা আমি অনেক কাল আগেই বলেছিলাম; আমি তা জানিয়েছিলাম আর আমার মুখ তা ঘোষণা করেছিল। তারপর আমি হঠাৎ তা করলাম আর তা হল, কারণ তোমরা যে কেমন একগুঁয়ে তা আমি জানতাম; তোমাদের ঘাড়ের গোশ্‌ত লোহার মত আর কপাল ব্রোঞ্জের মত। সেইজন্য অনেক আগেই আমি তোমাদের এই সব বলেছিলাম আর তা ঘটবার আগেই তোমাদের কাছে ঘোষণা করেছিলাম, যাতে তোমরা বলতে না পার, ‘আমাদের মূর্তিগুলো এই সব করেছে, আমাদের খোদাই করা মূর্তি আর ছাঁচে ঢালা মূর্তি এই সব হুকুম দিয়েছে।’ তোমরা এই সব শুনেছ; সেই সমসে-র দিকে তোমরা তাকিয়ে দেখ। তোমরা কি তা মেনে নেবে না? “এখন থেকে আমি তোমাদের নতুন নতুন বিষয়ের কথা বলব যা তোমাদের অজানা ও গোপন বিষয়। সেগুলো অনেক দিন আগে নয়, এখনই সৃষ্ট হয়েছে; আজকের আগে তোমরা সেই সব শোন নি। কাজেই তোমরা বলতে পারবে না, ‘জ্বী, আমরা তা জানতাম।’ তোমরা তা শোন নি এবং বুঝতেও পার নি; আগে থেকে তোমাদের কান খোলা হয় নি। তোমরা যে কেমন বেঈমান তা আমি জানি, জন্ম থেকেই তোমাদের বিদ্রোহী বলা হয়। আমার নিজের সুনামের জন্যই আমার রাগকে আমি দমন করে রেখেছি; আমার প্রশংসার জন্য আমি তা বাধা দিয়ে রেখেছি যাতে তোমাদের শেষ করে ফেলা না হয়। দেখ, আমি তোমাদের আগুনে ফেলেছি, কিন্তু তোমরা রূপার মত খাঁটি হয়ে বের হও নি; দুঃখের চুলাতে আমি তোমাদের যাচাই করেছি। আমি যা কিছু করি তা আমার নিজের জন্য, কেবল আমার নিজের জন্যই করি। আমার নিজের অগৌরব আমি কি করে হতে দিতে পারি? আমার গৌরব আমি অন্যকে পেতে দিতে পারি না। “হে ইয়াকুব, হে আমার বেছে নেওয়া ইসরাইল, তোমরা আমার কথা শোন। আমিই তিনি; আমিই প্রথম এবং আমিই শেষ। আমি নিজের হাতে দুনিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছি আর ডান হাতে আসমানকে বিছিয়ে দিয়েছি; আমি ডাকলে এদের সবাই একসংগে দাঁড়ায়। “তোমরা সকলে একত্র হয়ে শোন। মূর্তিগুলোর মধ্যে কোন্‌টা এই সব বিষয় আগেই বলেছে? ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে মাবুদের বেছে নেওয়া বান্দা তার নিজের ইচ্ছা পূর্ণ করবে; মাবুদের হাত ব্যাবিলনীয়দের বিরুদ্ধে উঠবে। আমি, আমি মাবুদই কথা বলেছি; জ্বী, আমিই তাকে ডেকেছি। আমি তাকে নিয়ে আসব আর সে তার কাজে সফল হবে। “তোমরা আমার কাছে এসে এই কথা শোন। আমি প্রথম থেকে কোন কথা গোপন রাখবার জন্য বলি নি; সেই সব কথা পূর্ণ হবার সময় আমি সেখানে থাকি।” এখন আল্লাহ্‌ মালিক তাঁর রূহ্‌ দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন। মাবুদ, তোমাদের মুক্তিদাতা, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক এই কথা বলছেন, “আমি তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌; তোমাদের উপকারের জন্য আমি তোমাদের শিক্ষা দিই। যে পথে তোমাদের চলতে হবে আমি সেই পথে তোমাদের চালাই। তোমরা যদি কেবল আমার হুকুমের প্রতি মনোযোগ দিতে তাহলে তোমাদের শান্তি হত নদীর মত আর তোমাদের সততা হত সাগরের ঢেউয়ের মত। এছাড়া তোমাদের বংশধরেরা বালির মত হত আর তোমাদের ছেলেমেয়েরা হত বালুকণার মত অসংখ্য। তাদের নাম আমার সামনে থেকে কখনও মুছে ফেলা হত না কিংবা তাদের ধ্বংস করা হত না।” তোমরা ব্যাবিলন ছেড়ে চলে যাও, ব্যাবিলনীয়দের কাছ থেকে পালাও। তোমরা আনন্দে চিৎকার করে জানাও, ঘোষণা কর। দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত এই কথা বল, “মাবুদ তাঁর গোলাম ইয়াকুবকে মুক্ত করেছেন।” যখন তিনি মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তারা পিপাসায় কষ্ট পায় নি, কারণ তিনি পাথর থেকে তাদের জন্য পানি বইয়ে দিয়েছিলেন; তিনি পাথর ফাটিয়েছিলেন আর তাতে পানি বের হয়ে এসেছিল। মাবুদ বলছেন, “দুষ্টদের কোন শান্তি নেই।” ওহে দূর দেশের লোকেরা, আমার কথা শোন; দূরের জাতিরা, কান দাও। আমার জন্মের আগে মাবুদ আমাকে ডেকেছিলেন; তিনি মায়ের গর্ভ থেকে আমার নাম উল্লেখ করে আসছেন। তিনি আমার মুখকে ধারালো তলোয়ারের মত করেছেন। তিনি আমাকে তাঁর হাতের ছায়ায় লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি আমাকে একটা বাছাই করা তীর করেছেন আর তাঁর তীর রাখবার খাপের মধ্যে রেখেছেন। তিনি আমাকে বললেন, “হে ইসরাইল, তুমি আমার গোলাম; আমি তোমার মধ্য দিয়েই আমার গৌরব প্রকাশ করব।” কিন্তু আমি বললাম, “আমার পরিশ্রম নিষ্ফল হয়েছে; আমি অসার উদ্দেশ্যে লাভ ছাড়াই আমার শক্তি ক্ষয় করেছি। তবুও আমার যা পাওনা তা মাবুদেরই হাতে রয়েছে, আর আমার পুরস্কার রয়েছে আল্লাহ্‌র কাছে।” মাবুদ তাঁর গোলাম হবার জন্য আমাকে গর্ভের মধ্যে গড়েছেন যেন আমি ইয়াকুবকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি আর ইসরাইলকে তাঁর কাছে আনতে পারি। আমি মাবুদের চোখে সম্মানিত আর আমার আল্লাহ্‌ আমার শক্তি। তিনি বলছেন, “কেবল ইয়াকুবের বংশকে উদ্ধার করবার জন্য আর ইসরাইলের বেঁচে থাকা বান্দাদের ফিরিয়ে আনবার জন্য যে তুমি আমার গোলাম হবে তা নয়; সেটা খুবই সামান্য ব্যাপার। এছাড়াও আমি অন্য জাতিদের কাছে তোমাকে আলোর মত করব যেন তোমার মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়ার লোক নাজাত পায়।” লোকে যাঁকে তুচ্ছ করছে ও ঘৃণার চোখে দেখছে, যিনি শাসনকর্তাদের গোলাম, তাঁকে ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক ও মুক্তিদাতা মাবুদ এই কথা বলছেন, “বাদশাহ্‌রা তোমাকে দেখে উঠে দাঁড়াবে, আর রাজপুরুষেরা মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সম্মান দেখাবে, কারণ মাবুদ তোমাকে বেছে নিয়েছেন; ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাক বিশ্বস্ত।” মাবুদ বলছেন, “রহমত দেখাবার সময়ে আমি তোমার মুনাজাতের জবাব দেব এবং উদ্ধার পাবার দিনে তোমাকে সাহায্য করব। আমি তোমাকে রক্ষা করব আর তোমার মধ্য দিয়ে লোকদের জন্য একটা ব্যবস্থা স্থাপন করব, যাতে তুমি দেশের অবস্থা ফিরাতে পার আর খালি পড়ে থাকা জায়গাগুলো আবার লোকদের অধিকারে আনতে পার। তুমি বন্দীদের বলবে, ‘তোমরা মুক্ত হও,’ আর যারা অন্ধকারে আছে তাদের বলবে, ‘তোমরা বের হয়ে এস।’ তারা রাস্তার ধারে আর গাছপালাহীন পাহাড়ের উপরে খাবার পাবে। তাদের খিদে পাবে না, পিপাসাও পাবে না কিংবা মরুভুমির গরম বা সূর্যের তাপ তাদের আঘাত করবে না। তাদের উপর যাঁর মমতা আছে তিনিই তাদের পথ দেখাবেন আর পানির ঝর্ণার কাছে নিয়ে যাবেন। আমার সব পাহাড়গুলোকে আমি রাস্তা বানাব; আমার রাজপথগুলো তৈরী করা হবে। দেখ, তারা দূর থেকে আসবে; কেউ উত্তর থেকে, কেউ পশ্চিম থেকে আর কেউ সীনীম দেশ থেকে আসবে।” হে আসমান, আনন্দে চিৎকার কর; হে দুনিয়া, আনন্দ কর; হে পাহাড়-পর্বত, জোরে জোরে আনন্দ-কাওয়ালী গাও; কারণ মাবুদ তাঁর বান্দাদের সান্ত্বনা দেবেন আর তাঁর অত্যাচারিত লোকদের উপর মমতা করবেন। কিন্তু সিয়োন বলল, “মাবুদ আমাকে ত্যাগ করেছেন, তিনি আমাকে ভুলে গেছেন।” সেইজন্য মাবুদ বলছেন, “মা কি তার দুধের শিশুকে ভুলে যেতে পারে? যে শিশুকে সে জন্ম দিয়েছে তার উপর সে কি মমতা করবে না? এমন কি, মা-ও ভুলে যেতে পারে কিন্তু আমি কখনও তোমাকে ভুলে যাব না। দেখ, আমার হাতের তালুতে আমি তোমার নাম খোদাই করে রেখেছি; তোমার চারদিকের দেয়াল সব সময় আমার সামনে আছে। তোমার ছেলেরা ফিরে আসবার জন্য তাড়াতাড়ি করছে, আর যারা তোমাকে ধ্বংস করে ফেলে রেখেছে তারা তোমার কাছ থেকে চলে যাবে। তুমি চোখ তুলে চারপাশে তাকাও; দেখ, তোমার সব ছেলেরা একত্র হয়ে তোমার কাছে আসছে। আমার জীবনের কসম যে, তারা সবাই তোমার গহনার মত হবে, বিয়ের কনের গহনার মত হবে। “যদিও তুমি ধ্বংস হয়েছ এবং খালি পড়ে আছ আর তোমার দেশ পোড়ো জমি হয়ে রয়েছে তবুও সময় আসছে যখন তুমি তোমার লোকদের তোমার মধ্যে জায়গা দিতে পারবে না, আর যারা তোমাকে গিলে ফেলেছিল তারা দূর হয়ে যাবে। তোমার যে সন্তানদের তুমি হারিয়েছিলে তারা তোমার কাছে এসে বলবে, ‘এই জায়গা আমাদের জন্য খুব ছোট; বাস করবার জন্য আমাদের আরও জায়গা দাও।’ তখন তুমি মনে মনে বলবে, ‘এগুলোকে কে আমার জন্য জন্ম দিয়েছে? আমি সন্তানদের হারিয়ে বন্ধ্যার মত হয়ে গিয়েছিলাম; আমাকে যেন দূর করে দেওয়া হয়েছিল, আমি যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তাহলে কে এদের লালন-পালন করেছে? আমাকে তো একাই ফেলে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এরা? এরা কোথা থেকে এসেছে?’ ” আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “দেখ, আমি হাতের ইশারায় অন্যান্য জাতিদের ডাকব আর আমার নিশান তাদের দেখাব। কাজেই তারা কোলে করে তোমার ছেলেদের নিয়ে আসবে আর কাঁধে করে তোমার মেয়েদের বহন করবে। বাদশাহ্‌রা তোমার লালন-পালনকারী হবে আর তাদের রাণীরা তোমার ধাই-মা হবে। তারা মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সম্মান দেখাবে আর তোমার পায়ের ধুলা চাটবে। তখন তুমি জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ; যারা আমার উপর আশা রাখে তারা লজ্জিত হবে না।” যোদ্ধার কাছ থেকে কি লুটের জিনিস নিয়ে নেওয়া যায়? কিংবা বিজয়ী লোকের হাত থেকে কি বন্দীকে উদ্ধার করা যায়? কিন্তু মাবুদ বলছেন, “জ্বী, যোদ্ধাদের হাত থেকে বন্দীদের নিয়ে নেওয়া হবে আর ভয়ংকর লোকের হাত থেকে লুটের জিনিস উদ্ধার করা হবে। যারা তোমার সংগে ঝগড়া করবে তাদের সংগে আমিই ঝগড়া করব আর তোমার সন্তানদের আমিই রক্ষা করব। তোমার উপর যারা জুলুম করে আমি তাদের গোশ্‌ত তাদেরই খাওয়াব; তারা মদের মত করে নিজেদের রক্ত খেয়ে মাতাল হবে। তখন সমস্ত মানুষ জানবে যে, আমি মাবুদই তোমার উদ্ধারকর্তা, তোমার মুক্তিদাতা, ইয়াকুবের শক্তিশালী আল্লাহ্‌।” মাবুদ বলছেন, “আমি যে তালাক-নামা দিয়ে তোমাদের মাকে দূর করে দিয়েছিলাম সেটা কোথায়? আমার ঋণদাতাদের মধ্যে কার কাছে আমি তোমাদের বিক্রি করেছি? তোমাদের গুনাহের জন্যই তোমরা বিক্রি হয়েছ; তোমাদের অন্যায়ের জন্যই তোমাদের মাকে দূর করা হয়েছে। আমি আসলে পর কেউ সেখানে ছিল না কেন? আমি ডাকলে পর জবাব দেবার জন্য কেউ ছিল না কেন? তোমাদের মুক্ত করবার জন্য আমার হাত কি বেশী খাটো? তোমাদের উদ্ধার করবার জন্য আমার কি শক্তির অভাব হয়েছে? মাত্র ধমক দিয়েই আমি সাগর শুকিয়ে ফেলি আর নদীগুলো মরুভূমি করে দিই; সেগুলোর মাছ পানির অভাবে পচে যায় আর পিপাসায় মরে যায়। আমি কাপড়ের মত করে আসমানকে অন্ধকার পরাই আর চট দিয়ে ঢেকে দেবার মতই তাকে ঢেকে দিই।” আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে শিক্ষিতদের জিভ্‌ দিয়েছেন যাতে আমি কথার দ্বারা ক্লান্ত লোকদের সাহায্য করতে পারি। তিনি আমাকে প্রত্যেক দিন সকালে জাগিয়ে দেন আর আমার কানকে সজাগ করেন যাতে আমি একজন শাগরেদের মত শুনি। আল্লাহ্‌ মালিক আমার কান খুলে দিয়েছেন এবং আমি অবাধ্য হই নি, পিছিয়েও যাই নি। যারা আমাকে মেরেছে আমি তাদের কাছে আমার পিঠ পেতে দিয়েছি আর যারা আমার দাড়ি উপ্‌ড়িয়েছে তাদের কাছে আমার গাল পেতে দিয়েছি। যখন আমাকে অপমান করা ও আমার উপর থুথু ফেলা হয়েছে তখন আমি আমার মুখ ঢেকে রাখি নি। আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে সাহায্য করেন বলে আমি অপমানিত হব না। কাজেই আমি চক্‌মকি পাথরের মতই আমার মুখ শক্ত করেছি, আর আমি জানি যে, আমি লজ্জিত হব না। যিনি আমাকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করেছেন তিনি কাছেই আছেন; তাহলে কে আমার বিরুদ্ধে নালিশ আনবে? এস, আমরা মুখোমুখি হই। কে আমাকে দোষী করছে? সে আমার সামনে আসুক। আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে সাহায্য করছেন, কাজেই কে আমাকে দোষী করবে? তারা সবাই কাপড়ের মত পুরানো হয়ে যাবে; পোকা তাদের খেয়ে ফেলবে। তোমাদের মধ্যে যে মাবুদকে ভয় করে, যে তাঁর গোলামের কথার বাধ্য হয়, কোন আলো নেই বলে যে অন্ধকারে চলে, সে মাবুদের উপর ঈমান আনুক আর তার আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করুক। কিন্তু তোমরা যারা আগুন জ্বেলেছ আর মশাল নিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা করেছ, তোমরা সবাই গিয়ে তোমাদের আগুনের আলোতে আর মশালের আলোতে চল। আমার হাত থেকে তোমরা যা পাবে তা হল, যন্ত্রণার মধ্যে তোমরা শুয়ে থাকবে। মাবুদ বলছেন, “তোমরা যারা সৎভাবে চলতে চাও আর আমার ইচ্ছামত চলবার চেষ্টা করছ, তোমরা শোন। যে পাথর থেকে তোমাদের কেটে নেওয়া হয়েছে আর যে খাদ থেকে তোমাদের খুঁড়ে তোলা হয়েছে তার দিকে তাকিয়ে দেখ। তোমাদের পিতা ইব্রাহিম এবং তোমাদের যে জন্ম দিয়েছে সেই সারার দিকে তাকিয়ে দেখ। আমি যখন তাকে ডেকেছিলাম তখন সে ছিল একজন, আর আমি তাকে দোয়া করে সংখ্যায় অনেক করলাম। আমি নিশ্চয়ই সিয়োনকে সান্ত্বনা দেব আর তার সব ধ্বংসস্থানগুলোর প্রতি মমতা করব; তার মরুভূমিকে আমি আদন বাগানের মত করব আর মরুভূমিকে মাবুদের বাগানের মত করব। তার মধ্যে আমোদ, আনন্দ, শুকরিয়া ও কাওয়ালীর আওয়াজ পাওয়া যাবে। “হে আমার বান্দারা, আমার কথা শোন, আমার কথায় কান দাও। আমার মধ্য থেকেই নির্দেশ বের হবে; আমি আমার ন্যায়বিচার স্থাপন করব যাতে অন্য জাতিরা নূর পায়। আমার সততা কাছে এসে গেছে আর আমার উদ্ধার করবার কাজ শুরু হয়েছে। আমি নিজেই জাতিদের উপর ন্যায়বিচার করব। দূর দেশের লোকেরা আমার দিকে তাকাবে আর আমার শক্তিশালী হাতের অপেক্ষায় থাকবে। তোমরা আসমানের দিকে চোখ তোল আর নীচে দুনিয়ার দিকে তাকাও। আসমান ধোঁয়ার মত অদৃশ্য হয়ে যাবে, দুনিয়া কাপড়ের মত পুরানো হয়ে যাবে আর তার বাসিন্দারাও মারা যাবে। কিন্তু আমার দেওয়া উদ্ধার অনন্তকাল স্থায়ী হবে আর আমার সততা চিরকাল থাকবে। “যা ঠিক তোমরা যারা তা জান আর যাদের দিলে আমার শিক্ষা আছে, তোমরা শোন। তোমরা মানুষের টিট্‌কারিকে কিংবা তাদের করা অপমানকে ভয় কোরো না, কারণ কাপড়ের মত করে আর পশমের মত করে পোকা তাদের খেয়ে ফেলবে। কিন্তু আমার সততা চিরকাল থাকবে; আমার দেওয়া উদ্ধার বংশের পর বংশ ধরে স্থায়ী হবে।” হে মাবুদের শক্তিশালী হাত, ওঠো, ওঠো, তোমার শক্তি প্রকাশ কর। যেমন তুমি আগেকার দিনে উঠেছিলে, যেমন বংশের পর বংশ ধরে উঠেছিলে তেমনি করে ওঠো। তুমি কি রহবকে টুকরা টুকরা করে কাট নি? সেই বিরাট দানবকে কি তুমি বিদ্ধ কর নি? তুমি কি সাগরের গভীর পানি শুকিয়ে ফেল নি? তুমি কি সাগরের ভিতরে রাস্তা তৈরী কর নি যাতে তোমার মুক্ত করা বান্দারা পার হয়ে যেতে পারে? মাবুদের রক্ষা করা বান্দারা ফিরে আসবে আর কাওয়ালী গাইতে গাইতে সিয়োনে ঢুকবে। চিরকাল স্থায়ী আনন্দই হবে তাদের মাথার তাজ। তারা খুব আনন্দিত হবে আর দুঃখ ও দীর্ঘনিঃশ্বাস পালিয়ে যাবে। মাবুদ বলছেন, “আমি, আমিই তোমাদের সান্ত্বনা দিই। তোমরা কেন মানুষকে ভয় করছ? তারা তো মরে যাবে। মানুষের সন্তানেরা ঘাসের মতই অল্পক্ষণ স্থায়ী। তোমাদের যিনি তৈরী করেছেন তাঁকে কেন তোমরা ভুলে গেছ? তিনি তো আসমানকে বিছিয়ে দিয়েছেন আর দুনিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। যে জুলুমবাজ ধ্বংস করবার জন্য ঝুঁকে আছে তার ভয়ংকর রাগের দরুন কেন তোমরা প্রতিদিন সব সময় ভয়ে ভয়ে বাস করছ? সেই জুলুমবাজের ভয়ংকর রাগ কিছুই নয়। বন্দীদের শীঘ্রই ছেড়ে দেওয়া হবে। তারা তাদের জেলের গর্তে মারা যাবে না, তাদের খাবারের অভাবও হবে না। আমিই আল্লাহ্‌, তোমাদের মাবুদ। আমি সমুদ্রকে তোলপাড় করলে তার ঢেউ গর্জন করে। আমার নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। আমি তোমাদের মুখে আমার কালাম দিয়েছি আর আমার হাতের ছায়ায় তোমাদের ঢেকে রেখেছি। আমিই আসমানকে তার জায়গায় রেখেছি আর দুনিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছি। আমি সিয়োনকে বলেছি, ‘তুমি আমার বান্দা।’ ” হে জেরুজালেম, জাগো, জাগো; উঠে দাঁড়াও। তুমি তো মাবুদের হাত থেকে তাঁর রাগের পেয়ালায় খেয়েছ; মানুষ যে পেয়ালা থেকে খেয়ে টলতে থাকে সেই পেয়ালার তলা পর্যন্ত তুমি চেটে খেয়েছ। তুমি যে সব ছেলেদের জন্ম দিয়েছ তাদের মধ্যে পথ দেখাবার মত কেউ নেই; যে সব ছেলেদের তুমি পালন করেছ তাদের মধ্যে তোমার হাত ধরবার মত কেউ নেই। ধ্বংস ও সর্বনাশ এবং দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ- এই দুই রকম বিপদ তোমার উপর এসে পড়েছে। কে তোমাকে সান্ত্বনা দিতে পারে? আমি কেমন করে তোমাকে সান্ত্বনা দেব? তোমার ছেলেরা অজ্ঞান হয়ে গেছে; তারা জালে পড়া হরিণের মত প্রতিটি রাস্তার মাথায় শুয়ে আছে। তাদের উপর মাবুদের রাগ, তোমার আল্লাহ্‌র গজব পরিপূর্ণভাবে নেমে এসেছে। কাজেই হে দুঃখিনী, তুমি এই কথা শোন। তোমাকে মাতাল করা হয়েছে, কিন্তু আংগুর-রসে নয়। তোমার মালিক, তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি তাঁর বান্দাদের পক্ষে থাকেন তিনি এই কথা বলছেন, “দেখ, যে পেয়ালা থেকে খেয়ে তুমি টলতে তা আমি তোমার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছি; আমার রাগের সেই পেয়ালা থেকে তুমি আর কখনও খাবে না। আমি সেই পেয়ালা তোমার জুলুমবাজদের হাতে তুলে দেব, যারা তোমাকে বলত, ‘উবুড় হয়ে পড়, যাতে আমরা তোমার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারি।’ তোমার উপর দিয়ে হেঁটে যাবার জন্য তুমি তোমার পিঠকে জমি আর রাস্তার মত করেছ।” হে সিয়োন, ওঠো, ওঠো, তোমার শক্তি প্রকাশ কর। হে পবিত্র শহর জেরুজালেম, তোমার জাঁকজমকের পোশাক পর। খৎনা-না-করানো ও নাপাক লোক তোমার মধ্যে আর ঢুকবে না। হে জেরুজালেম, ওঠো, তুমি গায়ের ধুলা ঝেড়ে ফেলে সিংহাসনে বস। হে বন্দী সিয়োন্তকন্যা, তোমার গলার শিকল সব খুলে ফেল। আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “তোমাকে বিনামূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল আবার বিনামূল্যেই মুক্ত করা হবে। আমার বান্দারা আগে মিসরে বাস করতে গিয়েছিল; পরে আশেরিয়া অকারণে তাদের উপর জুলুম করেছিল। আর এখন এখানে আমার কি আছে? আমার বান্দাদের তো অকারণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর তাদের শাসনকর্তারা তাদের গালাগালি করে; অনবরত আমার নামের কুফরী করা হয়। কাজেই আমার বান্দারা জানতে পারবে আমি কে; সেই দিন তারা জানবে যে, আমিই কথা বলেছিলাম; জ্বী, আমিই বলেছিলাম।” যে লোক সুখবর দিতে আসে, শান্তি ঘোষণা করে, উপকারের সংবাদ নিয়ে আসে, উদ্ধার ঘোষণা করে আর সিয়োনকে বলে, ‘তোমার আল্লাহ্‌ রাজত্ব করছেন,’ পাহাড়ের উপর দিয়ে আসবার সময় সেই লোকের পা কেমন সুন্দর দেখায়। শোন, তোমার পাহারাদারেরা চিৎকার করছে, তারা আনন্দে একসংগে চেঁচাচ্ছে, কারণ মাবুদ যখন সিয়োনে ফিরে আসবেন তখন তারা নিজেদের চোখেই তা দেখবে। হে জেরুজালেমের ধ্বংসস্থানগুলো, তোমরা একসংগে জোরে জোরে আনন্দ-কাওয়ালী গাও, কারণ মাবুদ তাঁর বান্দাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন আর জেরুজালেমকে মুক্ত করেছেন। মাবুদ সমস্ত জাতির চোখের সামনে তাঁর পবিত্র শক্তিশালী হাত প্রকাশ করবেন, আর দুনিয়ার সব জায়গার লোকেরা আমাদের আল্লাহ্‌র উদ্ধারের কাজ দেখতে পাবে। তোমরা বের হও, ঐ জায়গা থেকে বের হয়ে এস। তোমরা কোন হারাম জিনিস ছুঁয়ো না। তোমরা যারা মাবুদের পাত্র বয়ে নিয়ে যাও তোমরা সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এস এবং পাক-সাফ হও। কিন্তু তোমরা তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে আসবে না কিংবা পালিয়েও আসবে না, কারণ মাবুদ তোমাদের আগে আগে যাবেন; ইসরাইলের আল্লাহ্‌ তোমাদের পিছন দিকের রক্ষক হবেন। মাবুদ বলছেন, “দেখ, আমার গোলাম সফল হবেন। তাঁকে উঁচুতে তোলা হবে এবং তিনি গৌরব ও সম্মান পাবেন। তাঁর চেহারা ও আকার এত বিশ্রী করে দেওয়া হবে যে, তা আর কোন মানুষের মত থাকবে না; সেইজন্য অনেকে তাঁকে দেখে হতভম্ব হবে। কিন্তু পরে তিনি অনেক জাতির লোককে পাক-সাফ করবেন, আর তাঁরই দরুন বাদশাহ্‌রা মুখ বন্ধ করবে, কারণ যা তাদের বলা হয় নি তা তারা দেখতে পাবে, আর যা তারা শোনে নি তা বুঝতে পারবে।” আমাদের দেওয়া খবরে কে বিশ্বাস করেছে? কার কাছেই বা মাবুদের শক্তিশালী হাত প্রকাশিত হয়েছেন? তিনি তাঁর সামনে নরম চারার মত, শুকনা মাটিতে লাগানো গাছের মত বড় হলেন। তাঁর এমন সৌন্দর্য বা জাঁকজমক নেই যে, তাঁর দিকে আমরা ফিরে তাকাই; তাঁর চেহারাও এমন নয় যে, আমাদের আকর্ষণ করতে পারে। লোকে তাঁকে ঘৃণা করেছে ও অগ্রাহ্য করেছে; তিনি যন্ত্রণা ভোগ করেছেন এবং রোগের সংগে তাঁর পরিচয় ছিল। লোকে যাকে দেখলে মুখ ফিরায় তিনি তার মত হয়েছেন; লোকে তাঁকে ঘৃণা করেছে এবং আমরা তাঁকে সম্মান করি নি। সত্যি, তিনিই আমাদের সব রোগ তুলে নিয়েছেন আর আমাদের যন্ত্রণা বহন করেছেন; কিন্তু আমরা ভেবেছি আল্লাহ্‌ তাঁকে আঘাত করেছেন, তাঁকে মেরেছেন ও কষ্ট দিয়েছেন। আমাদের গুনাহের জন্যই তাঁকে বিদ্ধ করা হয়েছে; আমাদের অন্যায়ের জন্য তাঁকে চুরমার করা হয়েছে। যে শাস্তির ফলে আমাদের শান্তি এসেছে সেই শাস্তি তাঁকেই দেওয়া হয়েছে; তিনি যে আঘাত পেয়েছেন তার দ্বারাই আমরা সুস্থ হয়েছি। আমরা সবাই ভেড়ার মত করে বিপথে গিয়েছি; আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের পথের দিকে ফিরেছি। মাবুদ আমাদের সকলের অন্যায় তাঁর উপর চাপিয়েছেন। তিনি অত্যাচারিত হলেন ও কষ্ট ভোগ করলেন, কিন্তু তবুও তিনি মুখ খুললেন না; জবাই করতে নেওয়া ভেড়ার বাচ্চার মত, লোম ছাঁটাইকারীদের সামনে চুপ করে থাকা ভেড়ীর মত তিনি মুখ খুললেন না। জুলুম ও অন্যায় বিচার করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময়কার লোকদের মধ্যে কে খেয়াল করেছিল যে, আমার লোকদের গুনাহের জন্য তাঁকে জীবিতদের দেশ থেকে শেষ করে ফেলা হয়েছে? সেই শাস্তি তো তাদেরই পাওনা ছিল। যদিও তিনি কোন অনিষ্ট করেন নি কিংবা তাঁর মুখে কোন ছলনার কথা ছিল না, তবুও দুষ্টদের সংগে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল আর মৃত্যুর দ্বারা তিনি ধনীর সংগী হয়েছিলেন। আসলে মাবুদ তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁকে চুরমার করেছিলেন আর তাঁকে কষ্ট ভোগ করিয়েছিলেন। মাবুদের গোলাম যখন তাঁর প্রাণকে দোষের কোরবানী হিসাবে দেবেন তখন তিনি তাঁর সন্তানদের দেখতে পাবেন আর তাঁর আয়ু বাড়ানো হবে; তাঁর দ্বারাই মাবুদের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তিনি তাঁর কষ্টভোগের ফল দেখে তৃপ্ত হবেন; মাবুদ বলছেন, আমার ন্যায়বান গোলামকে গভীরভাবে জানবার মধ্য দিয়ে অনেককে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে, কারণ তিনি তাদের সব অন্যায় বহন করবেন। সেইজন্য মহৎ লোকদের মধ্যে আমি তাঁকে একটা অংশ দেব আর তিনি বলবানদের সংগে বিজয়ের ফল ভাগ করবেন, কারণ তিনি নিজের ইচ্ছায় প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁকে গুনাহ্‌গারদের সংগে গোণা হয়েছিল; তিনি অনেকের গুনাহ্‌ বহন করেছিলেন আর গুনাহ্‌গারদের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। মাবুদ বলছেন, “হে বন্ধ্যা স্ত্রীলোক, যার কখনও সন্তান হয় নি, তুমি আনন্দে গান কর; তুমি, যার কখনও প্রসব-বেদনা হয় নি, তুমি গানে ফেটে পড়, আনন্দে চিৎকার কর; কারণ যার স্বামী আছে তার চেয়ে যার কেউ নেই তার সন্তান অনেক বেশী হবে। তোমার তাম্বুর জায়গা আরও বাড়াও; তোমার তাম্বুর পর্দা আরও চওড়া কর, কৃপণতা কোরো না। তোমার তাম্বুর দড়িগুলো লম্বা কর আর গোঁজগুলো শক্ত কর, কারণ তুমি ডানে ও বাঁয়ে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার বংশধরেরা অন্যান্য জাতিদের দেশ দখল করবে আর তাদের লোকজনহীন শহরগুলোতে বাস করবে। তুমি ভয় কোরো না, কারণ তোমাকে লজ্জা দেওয়া হবে না। তুমি লজ্জাবোধ কোরো না, কারণ তোমাকে অসম্মানিত করা হবে না। তোমার যৌবনের লজ্জা তুমি ভুলে যাবে আর তোমার বিধবা থাকবার দুর্নাম তুমি মনে রাখবে না। তোমার সৃষ্টিকর্তাই তোমার স্বামী, তাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন; ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকই তোমার মুক্তিদাতা। তাঁকেই সমস্ত দুনিয়ার আল্লাহ্‌ বলা হয়। তুমি ত্যাগ করা আর দিলে কষ্ট পাওয়া স্ত্রীর মত হয়েছ, যৌবনকালে দূর করে দেওয়া স্ত্রীর মত হয়েছ; কিন্তু মাবুদ আবার তোমাকে ডেকেছেন। আমি তোমার আল্লাহ্‌ এই কথা বলছি। “এক মুহূর্তের জন্য আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম, কিন্তু গভীর মমতায় আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনব। রাগে মুহূর্তের জন্য তোমার কাছ থেকে আমি মুখ ফিরিয়েছিলাম, কিন্তু চিরকালের অটল মহব্বত দিয়ে আমি তোমার উপর মমতা করব। আমি তোমার মুক্তিদাতা মাবুদ এই কথা বলছি। “আমার কাছে এটা নূহের দিনের মত লাগছে। আমি যেমন কসম খেয়েছিলাম যে, নূহের সময়কার পানির মত পানি আর কখনও দুনিয়া ঢেকে ফেলবে না, তেমনি এই কসমও খেয়েছি যে, তোমার উপর রাগ করব না, তোমাকে আর কখনও বকুনি দেব না। যদিও বা পর্বত সরে যায় আর পাহাড় টলতে থাকে, তবুও তোমার জন্য আমার অটল মহব্বত সরে যাবে না কিংবা আমার শান্তির ব্যবস্থা টলবে না।” তোমার উপর যাঁর মমতা রয়েছে সেই মাবুদ এই কথা বলছেন। মাবুদ বলছেন, “হে ঝড়ে আঘাত পাওয়া, সান্ত্বনা না পাওয়া অত্যাচারিত শহর, আমি তোমাকে চক্‌চকে পাথর দিয়ে তৈরী করতে যাচ্ছি আর তোমার ভিত্তি নীলকান্তমণি দিয়ে গাঁথব। পদ্মরাগমণি দিয়ে তোমার দেয়াল গাঁথব, ঝক্‌মকে মণি দিয়ে তোমার দরজা তৈরী করব আর তোমার সব দেয়াল দামী দামী পাথর দিয়ে গাঁথব। তোমার সব ছেলেরা মাবুদের উম্মত হবে আর তোমার সন্তানদের প্রচুর উন্নতি হবে। তুমি ন্যায্যতায় স্থাপিত হবে। তোমার কাছ থেকে জুলুম দূরে থাকবে; তোমার ভয়ের কিছু থাকবে না। ভীষণ ভয় দূরে সরে যাবে, তা তোমার কাছে আসবে না। যদি কেউ তোমাকে আক্রমণ করে তবে বুঝতে হবে আমি তাকে পাঠাই নি। যে তোমাকে আক্রমণ করবে তোমার দরুন তার পতন হবে। “দেখ, যে কামার কয়লার আগুনে বাতাস দেয় আর কাজের উপযুক্ত অস্ত্র তৈরী করে সেই কামারকে আমিই সৃষ্টি করেছি। ধ্বংস করে দেবার জন্য আমিই ধ্বংসকারীকে সৃষ্টি করেছি। তোমার বিরুদ্ধে তৈরী করা কোন অস্ত্রই টিকবে না; তোমাকে দোষী করা প্রত্যেকটি লোকের যুক্তি খণ্ডন করে তুমি তাদেরই দোষী করবে। এ-ই হল মাবুদের গোলামদের অধিকার আর তাদের উপযুক্ত পাওনা।” মাবুদ বলছেন, “হে পিপাসিত লোকেরা, তোমরা সবাই পানির কাছে এস; যার পয়সা নেই সেও এসে কিনে খেয়ে যাক। এস, বিনা পয়সায়, বিনামূল্যে আংগুর-রস আর দুধ কেনো। যা কোন খাবার নয় তার জন্য কেন পয়সা খরচ করবে? যা তৃপ্তি দেয় না তার জন্য কেন পরিশ্রম করবে? শোন, আমার কথা শোন, যা ভাল তা-ই খাও; তাতে সবচেয়ে ভাল খাবার পেয়ে তোমাদের প্রাণ আনন্দিত হবে। আমার কথায় কান দাও, আমার কাছে এস; আমার কথা শোন যেন তোমরা জীবিত থাক। আমার বিশ্বস্ততায় ভরা মহব্বতের দরুন আমি দাউদের কাছে যে ওয়াদা করেছি সেই অনুসারে আমি তোমাদের জন্য একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা স্থাপন করব। দেখ, আমি তাকে জাতিদের কাছে একজন সাক্ষী, একজন নেতা ও তাদের সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করেছি। সত্যিই, যে জাতিদের তোমরা চিনতে না তাদের ডাকবে আর সেই জাতিরা, যারা তোমাদের চেনে না তারা দৌড়ে তোমাদের কাছে আসবে। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের জন্যই তারা তা করবে, কারণ তিনি তোমাদের গৌরবে পূর্ণ করেছেন।” মাবুদ কাছে থাকতেই তাঁর দিকে ফেরো; তিনি কাছে থাকতে থাকতে তাঁকে ডাক। দুষ্ট লোক তার পথ ত্যাগ করুক আর খারাপ লোক তার সব চিন্তা ত্যাগ করুক। সে মাবুদের দিকে ফিরুক, তাতে তিনি তার উপর মমতা করবেন; আমাদের আল্লাহ্‌র দিকে ফিরুক, কারণ তিনি সম্পূর্ণভাবেই মাফ করবেন। মাবুদ বলছেন, “আমার চিন্তা তোমাদের চিন্তার মত নয়, আমার পথও তোমাদের পথের মত নয়। আসমান যেমন দুনিয়ার চেয়ে অনেক উঁচু, তেমনি আমার পথ তোমাদের পথের চেয়ে, আমার চিন্তা তোমাদের চিন্তার চেয়ে অনেক উঁচু। বৃষ্টি ও তুষার আকাশ থেকে নেমে আসে আর দুনিয়াকে পানি দান না করে সেখানে ফিরে যায় না, বরং তাতে ফুল ও ফল ধরায় এবং যে বীজ বোনে তার জন্য শস্য আর যে খায় তার জন্য খাবার দান করে। ঠিক তেমনি আমার মুখ থেকে বের হওয়া কালাম নিষ্ফল হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে না, বরং তা আমার ইচ্ছামত কাজ করবে আর যে উদ্দেশ্যে আমি পাঠিয়েছি তা সফল করবে। তোমরা আনন্দের সংগে বাইরে যাবে আর শান্তিতে তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে। পাহাড়-পর্বতগুলো তোমার সামনে জোরে জোরে কাওয়ালী গাইবে আর মাঠের সমস্ত গাছপালা হাততালি দেবে। কাঁটাঝোপের বদলে বেরস আর কাঁটাগাছের বদলে গুলমেঁদি জন্মাবে। মাবুদের সুনামের জন্য একটা চিরস্থায়ী চিহ্ন হিসাবে এই সব হবে। সেই চিহ্ন কখনও ধ্বংস হবে না।” মাবুদ বলছেন, “তোমরা ন্যায়বিচার রক্ষা কর এবং ন্যায় কাজ কর, কারণ আমার দেওয়া উদ্ধার কাছে এসে গেছে আর কিভাবে তোমরা আমার গ্রহণযোগ্য হতে পার তার উপায় শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ধন্য সেই লোক, যে এই সব কাজ করে; ধন্য সেই মানুষ, যে তা করতে মনোযোগী হয়। বিশ্রামবার অপবিত্র না করে যে লোক তা পালন করে আর খারাপ কাজ করা থেকে তার হাত সরিয়ে রাখে, সে ধন্য।” মাবুদের এবাদত করে এমন কোন বিদেশী না বলুক, “মাবুদ নিশ্চয়ই আমাকে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে বাদ দেবেন।” কোন খোজা লোক না বলুক, “আমি কেবল একটা শুকনা গাছ,” কারণ মাবুদ এই কথা বলছেন, “খোজারা যদি আমার বিশ্রামবার পালন করে, আমি যা পছন্দ করি তা-ই বেছে নেয় আর আমার ব্যবস্থা শক্ত করে ধরে রাখে, তবে তাদের ছেলেমেয়ে থাকলে যে নাম থাকত তার চেয়ে আমার ঘর ও দেয়ালের ভিতরে তাদের নাম স্থাপন করে তা আমি আরও স্মরণীয় করে রাখব। আমি তাদের এমন চিরস্থায়ী নাম দেব যা মুছে ফেলা হবে না। এছাড়া যে বিদেশীরা আমার এবাদতের জন্য আর আমাকে মহব্বত করবার ও আমার গোলাম হবার জন্য আমার কাছে নিজেদের দিয়ে দেয় এবং যারা বিশ্রামবার অপবিত্র না করে তা পালন করে আর আমার ব্যবস্থা শক্ত করে ধরে রাখে, তাদের আমি আমার পবিত্র পাহাড়ে নিয়ে আসব আর আমার ঘরে, অর্থাৎ মুনাজাতের ঘরে তাদের আনন্দ দান করব। আমার কোরবানগাহের উপরে তাদের পোড়ানো ও অন্যান্য কোরবানী গ্রহণ করা হবে। এইজন্য আমার ঘরকে সমস্ত জাতির মুনাজাতের ঘর বলা হবে।” আল্লাহ্‌ মালিক, যিনি বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করেন তিনি এই কথা ঘোষণা করছেন, “যাদের আগেই জমায়েত করা হয়েছে তাদের সংগে অন্য জাতির লোকদেরও আমি জমায়েত করব।” মাঠের ও বনের সব পশু, তোমরা এসে খেয়ে ফেল। ইসরাইলের পাহারাদারেরা অন্ধ, তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা সবাই যেন বোবা কুকুর, তারা ঘেউ ঘেউ করতে পারে না। তারা শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে ও ঘুমাতে ভালবাসে। তারা এমন কুকুরের মত যাদের খিদে বেশী; তাদের কখনও তৃপ্তি হয় না। তারা বুদ্ধিহীন রাখাল; তারা সবাই নিজের নিজের পথের দিকে ফিরেছে আর নিজের লাভের চেষ্টা করছে। প্রত্যেকে বলে, “চল, আংগুর-রস আনি; চল, আমরা পেট ভরে মদ খাই। আজকের চেয়ে কাল আরও ভাল হবে।” সৎ লোকেরা যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার দিকে কেউ মনোযোগ দেয় না। আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না যে, খারাপের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যারা ঠিক পথে চলে তারা শান্তি পাবে; তারা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিশ্রাম পাবে। মাবুদ বলছেন, “হে জাদুকারিণীর ছেলেরা, জেনাকারী ও বেশ্যার সন্তানেরা, তোমরা এখানে এস। তোমরা কাকে ঠাট্টা করছ? কাকে তোমরা মুখ ভেংগা"ছ ও জিভ্‌ দেখা"ছ? তোমরা কি অন্যায়কারীদের বংশ ও মিথ্যাবাদীদের সন্তান নও? তোমরা তো এলোন গাছগুলোর মধ্যে, ডালপালা ছড়ানো প্রত্যেকটা সবুজ গাছের নীচে কামনায় জ্বলে ওঠো; তোমরা উপত্যকায় উপত্যকায় আর পাহাড়ের ফাটলে ফাটলে তোমাদের ছেলেমেয়েদের বলি দিয়ে থাক। “হে ইসরাইল, তুমি উপত্যকার সমান পাথরগুলোই পূজা করে থাক; ওরা, ওরাই তোমার সম্পত্তি। জ্বী, ওদের কাছেই তুমি ঢালন-কোরবানী ঢেলে দিয়েছ আর শস্য-কোরবানী করেছ। এই সব ব্যাপার দেখে কি আমি চুপ করে থাকব? তুমি উঁচু পাহাড়ের উপরে তোমার বিছানা পেতেছ, আর তোমার কোরবানীর জন্য তুমি সেখানে উঠে গিয়েছ। তোমার ঘরের ভিতরে তুমি তোমার পূজার জিনিস রেখেছ। আমাকে ত্যাগ করে অন্যদের পেয়ে তুমি কাপড় খুলে খাটে উঠেছ, আর নিজের বিছানা বড় করে তাদের সংগেই থাকবার চুক্তি করেছ; তুমি তাদের সংগে থাকতে ভালবেসেছ ও তাদের উলংগতা দেখেছ। তুমি জলপাইয়ের তেল মেখে বাদশাহ্‌র কাছে গিয়েছ আর প্রচুর পরিমাণে খোশবু ব্যবহার করেছ। তোমার দূতদের তুমি দূর দেশে পাঠিয়েছ, এমন কি, কবর পর্যন্তও পাঠিয়েছ। তোমার এই সব যাওয়া-আসার ফলে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, তবুও ‘আশা নেই,’ এই কথা বল নি। কিন্তু তুমি পূজা করে নতুন শক্তি পেয়েছ, কাজেই তুমি দুর্বল হয়ে পড় নি। “কাকে তুমি এত ভয় করেছ যার জন্য তুমি আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছ, আমাকে ভুলে গেছ আর আমার প্রতি অমনোযোগী হয়েছ? আমি অনেক দিন ধরে চুপ করে আছি, সেইজন্যই কি তুমি আমাকে ভয় কর না? তোমার সততা ও তোমার কাজ যে কি তা আমি প্রকাশ করব; সেগুলো তো তোমার কোন উপকারে আসবে না। সাহায্যের জন্য যখন তুমি কাঁদবে তখন তোমার জড়ো করা মূর্তিগুলোই তোমাকে রক্ষা করুক। বাতাস তাদের সকলকে বয়ে নিয়ে যাবে; সামান্য একটা নিঃশ্বাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু যে লোক আমার আশ্রয় নেয় সে দেশের এবং আমার পবিত্র পাহাড়ের অধিকার পাবে।” মাবুদ বলবেন, “রাস্তা তৈরী কর, তৈরী কর, তা প্রস্তুত কর। আমার বান্দাদের সামনে থেকে সমস্ত বাধা সরিয়ে ফেল।” যিনি মহান ও গৌরবে পূর্ণ, যিনি চিরকাল জীবিত, যাঁর নাম পবিত্র, তিনি বলছেন, “আমি উঁচু ও পবিত্র জায়গায় বাস করি, কিন্তু যার মন নম্র, যার মন ভেংগে চুরমার হয়েছে আমি তার সংগেও বাস করি যাতে নম্রদের ও মন ভেংগে চুরমার হওয়া লোকদের দিলকে আমি নতুন করে তুলতে পারি। আমি চিরকালের জন্য মানুষকে দোষী করব না কিংবা আমার রাগ সব সময় তাদের উপর থাকবে না। যদি থাকে তাহলে মানুষ, যে মানুষকে আমি তৈরী করেছি তারা তো আমার সামনে শেষ হয়ে যাবে। তাদের লোভের জন্য আমি রাগে জ্বলে উঠেছিলাম, আর তাদের শাস্তি দিয়ে রাগে আমার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম; তবুও তারা তাদের ইচ্ছামত পথে চলতে লাগল। আমি মানুষের সব ব্যবহার দেখেছি, তবুও আমি তাদের সুস্থ করব। আমি তাদের পরিচালনা করব এবং যারা শোক করে তাদের সান্ত্বনা দান করব। তাতে তারা বলবে, ‘কাছের ও দূরের সকলের ভাল হোক।’ আমি মাবুদ বলছি যে, আমি তাদের সুস্থ করব।” কিন্তু দুষ্টেরা দুলতে থাকা সমুদ্রের মত যার ঢেউ পাঁক ও কাদা উপরে উঠায়। আমার আল্লাহ্‌ বলছেন, “দুষ্টদের কোন শান্তি নেই।” মাবুদ বলছেন, “জোরে চিৎকার কর, সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার কর; শিংগার আওয়াজের মত জোরে আওয়াজ কর। আমার বান্দাদের কাছে তাদের অন্যায়ের কথা আর ইয়াকুবের বংশের কাছে তাদের গুনাহের কথা জানাও। তাদের দেখলে মনে হয় দিনের পর দিন যেন তারা আমার ইচ্ছামত চলছে আর আমার পথ জানবার জন্য তাদের আগ্রহ আছে; তারা যেন এমন একটা জাতি যারা ঠিক কাজ করে আর তাদের আল্লাহ্‌র হুকুম ত্যাগ করে না; তারা যেন আমার কাছে ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানতে চায় আর যেন আল্লাহ্‌র কাছে আসতে আগ্রহী। তারা বলে, ‘আমরা রোজা রেখেছি আর তুমি তা চেয়ে দেখলে না কেন? আমরা কষ্ট স্বীকার করেছি আর তুমি তা লক্ষ্য করলে না কেন?’ কিন্তু দেখ, তোমাদের রোজার দিনে তোমরা তো নিজেদের সন্তুষ্ট করে থাক, আর তোমাদের সব কর্মচারীদের উপর জুলুম করে থাক। রোজা রাখবার ফলে তোমরা ঝগড়া আর বিবাদ করে থাক এবং ঘুষি মেরে একে অন্যকে আঘাত করে থাক। তোমরা এইভাবে রোজা রাখলে আশা করতে পারবে না যে, আমি তোমাদের কথা শুনব। আমি কি এই রকম রোজা চেয়েছি? তোমাদের রোজা তো কেবল নিজেদের কষ্ট দেওয়া; তা কেবল নল-খাগড়ার মত মাথা নোয়ানো আর ছালার চটের ও ছাইয়ের উপর শুয়ে থাকা। এটাকেই কি তোমরা রোজা আর মাবুদের রহমত দেখাবার দিন বল? “আসলে আমি এই রকম রোজা চাই: তোমরা অবিচারের শিকল আর জোয়ালের দড়ি খুলে দাও, অত্যাচারিতদের মুক্তি দাও আর প্রত্যেকটি জোয়াল ভেংগে ফেল, খিদে পাওয়া লোকদের তোমাদের খাবার ভাগ করে দাও, ঘুরে বেড়ানো গরীব লোককে নিজের ঘরে আশ্রয় দাও, উলংগকে দেখলে তাকে কাপড় পরাও, আর নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। এই সব কাজ করাই হল আসল রোজা। তাহলে তোমাদের নূর ভোরের মত প্রকাশ পাবে আর শীঘ্রই তোমরা সুস্থতা লাভ করবে; তোমাদের সততা তোমাদের আগে আগে যাবে আর আমার গৌরব তোমাদের পিছন দিকের রক্ষক হবে। তখন তোমরা মুনাজাত করলে আমি জবাব দেব; তোমরা সাহায্যের জন্য ডাকলে আমি বলব, ‘এই যে আমি।’ “যদি তোমরা তোমাদের কাছ থেকে অত্যাচারীর জোয়াল, বিদ্রূপের ইংগিত এবং হিংসাপূর্ণ কথাবার্তা ত্যাগ কর, যদি খিদে পাওয়া লোকদের প্রতি মমতা দেখিয়ে তাদের খাবার দাও, তাহলে অন্ধকারেও তোমাদের নূর জ্বলে উঠবে আর তোমাদের রাত হবে দুপুর বেলার মত। আমি মাবুদই তোমাদের সব সময় পরিচালনা করব; শুকিয়ে যাওয়া দেশে আমি তোমাদের প্রয়োজন মিটাব আর তোমাদের শরীরকে শক্তি দান করব। তোমরা ভালভাবে পানি পাওয়া বাগানের মত হবে আর এমন ঝর্ণার মত হবে যার পানি কখনও শুকাবে না। তোমাদের লোকেরা আগেকার ধ্বংস হওয়া জায়গাগুলো আবার তৈরী করবে আর অনেক কাল আগেকার ভিত্তিগুলোর উপরে আবার গাঁথবে; তোমাদের বলা হবে ভাংগা দেয়ালের এবং বসতিস্থানের রাস্তাগুলোর মেরামতকারী। “যদি তোমরা বিশ্রামবার পালন কর ও আমার পবিত্র দিনে নিজেদের সন্তুষ্ট না কর, যদি বিশ্রামবারকে আনন্দদায়ক আর মাবুদের দিনকে সম্মানের যোগ্য মনে কর, যদি নিজেদের খুশীমত না চলে সেই দিনের সম্মান রাখ আর যা খুশী তা না কর বা বাজে কথা না বল, তাহলে আমাকে নিয়েই তোমরা আনন্দে মেতে থাকবে আর আমি দুনিয়ার সব উঁচু জায়গার অধিকার তোমাদের দেব। এছাড়া আমি তোমাদের পিতা ইয়াকুবের অধিকার তোমাদের ভোগ করতে দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” দেখ, মাবুদের হাত এত খাটো নয় যে, তিনি উদ্ধার করতে পারেন না; তাঁর কানও এত ভারী নয় যে, তিনি শুনতে পান না। কিন্তু তোমাদের অন্যায় মাবুদের কাছ থেকে তোমাদের আলাদা করে দিয়েছে। তোমাদের গুনাহের দরুন তিনি তাঁর মুখ তোমাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছেন; সেইজন্য তিনি শোনেন না। তোমাদের হাত রক্তে আর আংগুল গুনাহে নাপাক হয়েছে। তোমাদের মুখ মিথ্যা কথা বলেছে আর তোমাদের জিভ্‌ দুষ্টতার কথা বলে। কেউ ন্যায়ভাবে মামলা করে না, কেউ সততার সংগে মামলার ওকালতি করে না। তারা বাজে যুক্তির উপর ভরসা করে আর মিথ্যা কথা বলে; তারা দুষ্টতা গর্ভে ধরে আর খারাপীর জন্ম দেয়। তারা বিষাক্ত সাপের ডিমে তা দেয় আর মাকড়সার জাল বোনে। যে কেউ সেই ডিম খায় সে মরে; সেগুলোর একটা ভাঙ্গলে বিষাক্ত সাপ বের হয়। তাদের মাকড়সার জালে কাপড় হয় না; তারা যা পরে তা দিয়ে নিজেদের ঢাকতে পারে না। তাদের সব কাজ খারাপ, তাদের হাতে আছে অনিষ্টের কাজ। তাদের পা গুনাহের দিকে দৌড়ে যায়; তারা নির্দোষীর রক্তপাত করবার জন্য তাড়াতাড়ি যায়। তাদের চিন্তা সবই খারাপ এবং তাদের পথে ধ্বংস ও সর্বনাশ থাকে। তারা শান্তির পথ জানে না; তাদের পথে কোন ন্যায়বিচার নেই। তারা নিজেদের পথ আঁকাবাঁকা করেছে; যারা সেই পথে চলে তারা শান্তি কি তা জানে না। সেইজন্য ন্যায়বিচার আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকে আর সততা আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমরা আলো পেতে চাই, কিন্তু সবই অন্ধকার; উজ্জ্বলতা পেতে চাই, কিন্তু ঘন ছায়ায় চলি। আমরা অন্ধের মত দেয়াল হাতড়ে বেড়াই; যাদের চোখ নেই তাদের মতই পথ হাতড়াই। যেন সন্ধ্যা হয়েছে সেইভাবে আমরা দুপুরেই উচোট খাই; আমরা জীবিতদের মধ্যে মরার মত। আমরা সবাই ভল্লুকের মত গর্জন করি, ঘুঘুর মত কাতর স্বরে ডাকি। আমরা ন্যায়বিচার পেতে চাই, কিন্তু পাই না; আমরা উদ্ধার পেতে চাই, কিন্তু তা অনেক দূরে থাকে। হে মাবুদ, তোমার চোখে আমাদের অন্যায় অনেক বেশী; আমাদের গুনাহ্‌ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। আমাদের অন্যায় আমাদের সংগে সংগেই রয়েছে আর আমাদের দোষের বিষয় আমরা জানি। সেগুলো হল, বিদ্রোহ আর তোমাকে অস্বীকার করা, আমাদের আল্লাহ্‌র কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া, জুলুম ও বিদ্রোহের জন্য উস্‌কে দেওয়া আর দিল থেকে মিথ্যা কথা বের করে এনে তা বলা। সেইজন্য ন্যায়বিচারকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে আর ন্যায্যতা দূরে দাঁড়িয়ে আছে; সত্য রাস্তায় রাস্তায় উচোট খেয়েছে, সততা ঢুকতে পারছে না। সত্যকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, আর যে খারাপীকে ত্যাগ করে সে অত্যাচারের শিকার হয়। মাবুদ এই সব দেখলেন আর ন্যায়বিচার নেই বলে অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি দেখে অবাক হলেন যে, ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য কেউ নেই; কাজেই তিনি তাঁর শক্তিশালী হাত দিয়েই উদ্ধারের কাজ করলেন আর এই কাজে তাঁর ন্যায্যতা তাঁকে সাহায্য করল। তিনি বুক রক্ষার জন্য ন্যায্যতা পরলেন আর মাথা রক্ষার জন্য উদ্ধার মাথায় দিলেন। তিনি প্রতিশোধের পোশাক পরলেন আর চাদরের মত করে আগ্রহ গায়ে জড়ালেন। লোকেরা যা করেছে তা-ই তিনি তাদের ফিরিয়ে দেবেন; তাঁর বিপক্ষদের উপর রাগ ঢেলে দেবেন আর শত্রুদের কুকাজের শাস্তি দেবেন। দূর দেশের লোকদের যা পাওনা তা-ই তিনি তাদের দেবেন। পশ্চিম দিকের লোকেরা মাবুদকে ভয় করবে আর পূর্ব দিকের লোকেরা তাঁর মহিমা দেখে ভয় পাবে, কারণ মাবুদ তাঁর নিঃশ্বাসের ঝাপ্‌টায় তাড়ানো বাঁধ-ভাংগা বন্যার মত আসবেন। মাবুদ বলছেন, “ইয়াকুবের যারা তওবা করেছে তাদের জন্য মুক্তিদাতা সিয়োনে আসবেন। তাদের জন্য আমার ব্যবস্থা এই: আমার যে রূহ্‌ তোমাদের উপরে আছে আর আমার যে কথা আমি তোমাদের মুখে দিয়েছি তা তোমাদের, তোমাদের ছেলেমেয়েদের ও তাদের বংশধরদের মুখ থেকে চলে যাবে না; তা এখন থেকে চিরকাল থাকবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “হে জেরুজালেম, ওঠো, আলো দাও, কারণ তোমার আলো এসে গেছে; মাবুদের মহিমা তোমাকে আলো দিচ্ছে। দেখ, দুনিয়া আঁধারে ঢেকে গেছে আর জাতিদের উপরে এসেছে ঘন অন্ধকার, কিন্তু মাবুদ তোমার উপরে আলো দেবেন আর তাঁর মহিমা তোমার উপরে প্রকাশিত হবে। জাতিরা তোমার আলোর কাছে আসবে; বাদশাহ্‌রা তোমার ভোরের উজ্জ্বলতার কাছে আসবে। “তুমি চোখ তুলে চারপাশে তাকিয়ে দেখ, তারা সকলে একত্র হয়ে তোমার কাছে আসছে; তোমার ছেলেরা দূর থেকে আসছে আর তোমার মেয়েদের কোলে করে আনা হচ্ছে। তা দেখে তুমি আনন্দে উজ্জ্বল হবে, মহা আনন্দে তোমার বুক ফুলে উঠবে; সাগরের ধন তোমার কাছে আনা হবে, জাতিদের ধন-সম্পদ তোমার কাছে আসবে। মরুযাত্রীদের উটের বহরে তোমার দেশ ছেয়ে যাবে, ছেয়ে যাবে মাদিয়ান ও ঐফার শক্তিশালী উটে। তারা সোনা আর খোশবু ধূপ নিয়ে সাবা দেশ থেকে আসবে আর মাবুদের গৌরব ঘোষণা করবে। কায়দারের ভেড়ার পালগুলো তোমার কাছে জড়ো হবে, নাবায়ুতের ভেড়া তোমার কাজে লাগবে; আমার কোরবানগাহের উপরে কোরবানী হিসাবে আমি সেগুলো গ্রহণ করব, আর আমার গৌরবময় ঘর আমি আরও গৌরবময় করব। “নিজের নিজের বাসার দিকে ঘুঘু যেমন উড়ে আসে তেমনি এরা কারা মেঘের মত উড়ে আসছে? সত্যিই দূর দেশের লোকেরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে; তোমার ছেলেদের ও তাদের সোনা-রূপা নিয়ে দূর থেকে বড় বড় তর্শীশ-জাহাজ সবার আগে আগে আসছে। ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের, তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র গৌরব করবার জন্য তোমার ছেলেরা আসছে, কারণ তোমাকে তিনি জাঁকজমকে সাজিয়েছেন। “বিদেশীরা তোমার দেয়াল আবার গাঁথবে আর তাদের বাদশাহ্‌রা তোমার সেবা করবে। যদিও রাগে আমি তোমাকে আঘাত করেছি তবুও রহমত করে আমি তোমাকে মমতা করব। তোমার দরজাগুলো সব সময় খোলা থাকবে, দিনে ও রাতে কখনও সেগুলো বন্ধ থাকবে না যাতে জাতিদের ধন-সম্পদ লোকে তোমার কাছে আনতে পারে; তাদের বাদশাহ্‌দেরও নিয়ে আসা হবে। যে জাতি বা রাজ্য তোমার সেবা করবে না তা ধ্বংস হবে, তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। “লেবাননের গৌরব তোমার কাছে আসবে; আমার পবিত্র জায়গা সাজাবার জন্য আসবে বেরস, ঝাউ ও তাশূর গাছ; আমার পা রাখবার জায়গাকে আমি গৌরব দান করব। তোমাকে যারা জুলুম করত তাদের ছেলেরা মাথা নীচু করে তোমার সামনে আসবে; যারা তোমাকে তুচ্ছ করত তারা সবাই মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সালাম জানাবে আর তোমাকে মাবুদের শহর, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের সিয়োন বলে ডাকবে। “যদিও তোমাকে ত্যাগ ও ঘৃণা করা হয়েছিল, কেউ তোমার মধ্য দিয়ে যেত না, তবুও আমি তোমাকে করব চিরস্থায়ী গর্বের পাত্র আর বংশের পর বংশের সকলের আনন্দের বিষয়। মা যেমন তার সন্তানকে দুধ খাওয়ায় তেমনি জাতিরা ও বাদশাহ্‌রা তাদের ভাল ভাল জিনিস তোমাকে দেবে। তখন তুমি জানবে যে, আমি মাবুদই তোমার উদ্ধারকর্তা, তোমার মুক্তিদাতা, ইয়াকুবের শক্তিশালী আল্লাহ্‌। আমি তোমার জন্য আনব ব্রোঞ্জের বদলে সোনা আর লোহার বদলে রূপা। কাঠের বদলে আমি তোমার জন্য আনব ব্রোঞ্জ আর পাথরের বদলে লোহা। আমি উন্নতিকে করব তোমার শাসনকর্তা আর সততাকে করব তোমার নেতা। কোন অনিষ্টের কথা আর তোমার দেশে শোনা যাবে না, তোমার সীমানার মধ্যে শোনা যাবে না কোন ধ্বংস বা বিনাশের কথা। তোমার দেয়ালগুলোর নাম হবে উদ্ধার আর তোমার দরজাগুলোর নাম হবে প্রশংসা। দিনের বেলায় সূর্যের আলো তোমার আর দরকার হবে না, চাঁদের উজ্জ্বলতাও তোমার লাগবে না, কারণ মাবুদই হবেন তোমার চিরস্থায়ী আলো, আর তোমার আল্লাহ্‌ হবেন তোমার জাঁকজমক। তোমার সূর্য আর কখনও অস্ত যাবে না, তোমার চাঁদও আর ক্ষীণ হয়ে যাবে না। মাবুদই হবেন তোমার চিরস্থায়ী আলো; তোমার শোকের দিন শেষ হবে। তখন তোমার সব লোকেরা সৎ হবে; তারা চিরদিনের জন্য দেশ অধিকার করবে। তারা আমার লাগানো চারা, আমার হাতের কাজ; তাদের মধ্য দিয়ে আমার জাঁকজমক প্রকাশিত হবে। তোমাদের মধ্যে যে ছোট সে হাজার জন হবে, আর যে সবচেয়ে ছোট সে একটা শক্তিশালী জাতি হবে। আমি মাবুদ; সময়মত আমি তা তাড়াতাড়িই করব।” আল্লাহ্‌ মালিকের রূহ্‌ আমার উপর আছেন, কারণ তিনিই আমাকে নিযুক্ত করেছেন যেন আমি গরীবদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করি। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন যাতে আমি লোকদের ভাংগা মন জোড়া দিতে পারি এবং বন্দীদের কাছে স্বাধীনতা আর কয়েদীদের কাছে মুক্তি ঘোষণা করতে পারি; যাতে আমি মাবুদের রহমত দেখাবার সময়ের কথা আর আমাদের আল্লাহ্‌র প্রতিশোধের দিনের কথা ঘোষণা করতে পারি এবং যারা শোক করছে তাদের সান্ত্বনা দিতে পারি; যাতে সিয়োনে যারা শোক করছে তাদের মাথার উপর আমি ছাইয়ের বদলে সৌন্দর্যের তাজ দিতে পারি; যাতে আমি শোকের বদলে আনন্দের তেল আর হতাশার বদলে প্রশংসার পোশাক দিতে পারি। তাদের বলা হবে সততার এলোন গাছ; মাবুদ তা লাগিয়েছেন যেন তাদের মধ্য দিয়ে তাঁর গৌরব প্রকাশ পায়। তারা পুরানো দিনের ধ্বংস হওয়া স্থানগুলো আবার গাঁথবে ও মেরামত করবে। যে সব শহরগুলো বংশের পর বংশ ধরে ধ্বংস হয়ে ছিল সেগুলো তারা আবার নতুন করে গড়বে। অন্য জাতির লোকেরা এসে তোমাদের ভেড়ার পাল চরাবে; বিদেশীরা তোমাদের শস্য ক্ষেত ও আংগুর ক্ষেতে কাজ করবে। তোমাদের বলা হবে মাবুদের ইমাম; তোমাদের নাম হবে আমাদের আল্লাহ্‌র খেদমতকারী। তোমরা জাতিদের ধন-সম্পদ ভোগ করবে আর তাদের ধন দিয়ে গর্ব করবে। আমার বান্দারা লজ্জার বদলে সম্পত্তির দুই গুণ ভাগ পাবে, আর অসম্মানের বদলে তারা তাদের সম্পত্তিতে আনন্দ করবে। তাদের দেশে তারা দুই গুণ ভাগ পাবে আর তাদের চিরস্থায়ী আনন্দ হবে। মাবুদ বলছেন, “আমি ন্যায়বিচার ভালবাসি আর ডাকাতি ও অন্যায় ঘৃণা করি। আমার বিশ্বস্ততায় আমি তাদের পুরস্কার দেব আর তাদের জন্য একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা স্থাপন করব। জাতিদের মধ্যে তাদের বংশধরেরা আর লোকদের মধ্যে তাদের সন্তানেরা নাম-করা হবে। যারা তাদের দেখবে তারা সবাই বুঝতে পারবে যে, এরা সেই জাতি যাদের মাবুদ দোয়া করেছেন।” আমি মাবুদকে নিয়ে খুব খুশী হব; আমার প্রাণ আমার আল্লাহ্‌কে নিয়ে আনন্দ করবে, কারণ বর যেমন নিজের মাথায় পাগড়ী পরে আর কনে নিজেকে অলংকার দিয়ে সাজায় তেমনি করে তিনি আমাকে উদ্ধারের কাপড় পরিয়েছেন আর সততার পোশাকে সাজিয়েছেন। মাটিতে যেমন চারা গজায় আর বাগানে বীজ থেকে গাছ গজায় তেমনি করে আল্লাহ্‌ মালিক সমস্ত জাতির সামনে সততা ও প্রশংসার চারা গজাবেন। আমি সিয়োনের পক্ষে আছি তাই চুপ করে থাকব না, জেরুজালেমের পক্ষে আছি তাই বসে থাকব না, যে পর্যন্ত না তার সততা ভোরের উজ্জ্বলতার মত আর তার উদ্ধার জ্বলন্ত মশালের মত হয়ে দেখা দেয়। হে জেরুজালেম, জাতিরা তোমার সততা আর সমস্ত বাদশাহ্‌রা তোমার মহিমা দেখবে। তোমাকে একটা নতুন নামে ডাকা হবে; মাবুদই সেই নাম দেবেন। তুমি মাবুদের হাতে একটা জাঁকজমকপূর্ণ তাজ হবে আর তোমার আল্লাহ্‌র হাতে হবে একটা রাজমুকুট। তারা আর তোমাকে “ত্যাগ করা” বলবে না কিংবা তোমার দেশের নাম “জনশূন্য” দেবে না, বরং তোমাকে “আমার প্রীতির পাত্রী” বলা হবে, আর তোমার দেশকে “বিবাহিতা” বলা হবে, কারণ মাবুদ তোমাকে নিয়ে খুশী হবেন আর তোমার দেশের বিয়ে হবে। একজন যুবক যেমন একজন অবিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করে তেমনি তোমার লোকেরা তোমাকে বিয়ে করবে; বর যেমন কনেকে নিয়ে আনন্দ করে তেমনি তোমার আল্লাহ্‌ও তোমাকে নিয়ে আনন্দ করবেন। মাবুদ তাঁর ডান হাত, তাঁর শক্তিশালী হাত দিয়ে কসম খেয়ে বলেছেন, “আমি আর কখনও তোমার শস্য খাবার হিসাবে শত্রুদের দেব না এবং যে আংগুর-রসের জন্য তোমরা পরিশ্রম করেছ তা বিদেশীরা আর কখনও খাবে না। যারা ফসল কেটে জড়ো করবে তারাই সেই ফসল খাবে আর মাবুদের প্রশংসা করবে। যারা আংগুর জড়ো করবে তারা আমার পবিত্র জায়গার উঠানে তার রস খাবে।” তোমরা এগিয়ে যাও, দরজার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাও, লোকদের জন্য পথ প্রস্তুত কর। তোমরা রাজপথ তৈরী কর, তৈরী কর। সব পাথর সরিয়ে দাও; জাতিদের জন্য একটা নিশান তোল। মাবুদ দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত ঘোষণা করছেন, “সিয়োন্তকন্যাকে বল, ‘দেখ, তোমার উদ্ধারকর্তা আসছেন। দেখ, তিনি যে পুরস্কার পেয়েছেন তা তাঁর সংগেই আছে; তাঁর পাওনা তাঁর কাছেই আছে।’ ” তার লোকদের বলা হবে, “পবিত্র বান্দা, অর্থাৎ মাবুদের মুক্ত করা লোক।” হে জেরুজালেম, তোমাকে বলা হবে, “খুঁজে পাওয়া শহর, অর্র্থাৎ ফিরিয়ে আনা শহর।” যিনি ইদোমের বস্রা থেকে লাল রংয়ে রাংগানো পোশাকে আসছেন, উনি কে? যিনি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে মহাশক্তিতে এগিয়ে আসছেন, উনি কে? “এ আমি, আমি ন্যায়ভাবে কথা বলি, আমি মহাশক্তিতে উদ্ধার করি।” আংগুর মাড়াই করবার গর্তে যে লোক আংগুর মাড়াই করে তার মত তোমার পোশাক লাল কেন? “আমি একাই আংগুর মাড়াই করেছি; জাতিদের মধ্যে কেউ আমার সংগে ছিল না। আমি রাগ হয়ে তাদের পায়ে দলেছি এবং ক্রোধে তাদের পায়ে মাড়িয়েছি; তাদের রক্তের ছিটা আমার পোশাকে লেগেছে আর সমস্ত কাপড়ে দাগ লেগেছে। এখন মুক্ত করবার সময় এসে গেছে; সেইজন্য আমি প্রতিশোধের যে সময় ঠিক করেছিলাম তা-ও এসে গেছে। আমি চেয়ে দেখলাম, কিন্তু সাহায্যকারী কাউকে পেলাম না; আমি আশ্চর্য হলাম যে, কেউ আমাকে সাহায্য করল না। সেইজন্য আমি নিজের শক্তিতেই উদ্ধারের কাজ করলাম, আর আমার রাগ আমাকে উৎসাহ দিল। আমি রাগ হয়ে জাতিদের পায়ে মাড়ালাম; আমার ক্রোধে তাদের মাতালের মত করলাম আর মাটিতে তাদের রক্ত ঢেলে দিলাম।” আমি মাবুদের অটল মহব্বতের কথা বলব আর তাঁর সব কাজের জন্য তাঁর প্রশংসা করব। তাঁর মমতা ও তাঁর প্রচুর মহব্বতের দরুন তিনি ইসরাইল জাতির জন্য প্রচুর পরিমাণে ভাল কাজ করেছেন বলে আমি তাঁর প্রশংসা করব। তিনি বলেছেন, “অবশ্যই তারা আমার বান্দা, তারা এমন সন্তান যারা অবিশ্বস্ত হবে না,” আর সেইজন্যই তিনি তাদের উদ্ধারকর্তা হলেন। তাদের সব দুঃখে তিনিও দুঃখিত হলেন আর তাঁর ফেরেশতা তাদের উদ্ধার করলেন। তাঁর মহব্বত ও দয়ায় তিনি তাদের মুক্ত করলেন; আগেকার কালের সমস্ত দিনে তিনি তাদের তুলে বহন করেছিলেন। তবুও তারা বিদ্রোহ করে তাঁর পাক-রূহ্‌কে দুঃখ দিত। সেইজন্য তিনি ফিরে তাদের শত্রু হলেন আর তিনি নিজে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তখন তাঁর বান্দারা পুরানো দিনের কথা, অর্থাৎ মূসা ও তাঁর লোকদের দিনের কথা মনে করল। তারা বলল, “যিনি তাঁর বান্দাদের ও তাদের নেতাদের সমুদ্রের মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, যিনি তাদের মধ্যে থাকবার জন্য তাঁর পাক-রূহ্‌কে দিয়েছিলেন তিনি কোথায়? যিনি মূসাকে সাহায্য করবার জন্য তাঁর গৌরবময় শক্তিশালী জনকে দিয়েছিলেন, যিনি নিজের সুনাম চিরস্থায়ী করবার জন্য তাদের সামনে পানিকে দু’ভাগ করেছিলেন, যিনি সমুদ্রের মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি কোথায়? সেইজন্য মরুভূমিতে চলা ঘোড়ার মত তারা উচোট খায় নি। মাবুদের রূহ্‌ উপত্যকায় নেমে যাওয়া পশুপালের মত তাদের বিশ্রাম দিয়েছিলেন। তাঁর গৌরবময় নাম স্থাপন করবার জন্য তিনি এমনি করেই তাঁর বান্দাদের পরিচালনা করেছিলেন।” হে মাবুদ, বেহেশত থেকে, তোমার পবিত্র ও গৌরবময় বাসস্থান থেকে তুমি তাকিয়ে দেখ। তোমার আগ্রহ ও তোমার শক্তিপূর্ণ কাজ কোথায়? তোমার নরমভাব ও মমতা আমাদের কাছ থেকে তুমি সরিয়ে রেখেছ। হে মাবুদ, তুমি তো আমাদের পিতা। যদিও ইব্রাহিম আমাদের জানেন না কিংবা ইয়াকুব আমাদের স্বীকার করেন না, তবুও তুমিই আমাদের পিতা; তুমি অনন্তকালের মুক্তিদাতা- এ-ই তোমার নাম। হে মাবুদ, তোমার পথ ছেড়ে কেন আমাদের ঘুরে বেড়াতে দিচ্ছ? আমরা যেন তোমাকে ভয় না করি সেইজন্য কেন তুমি আমাদের দিল কঠিন করছ? তোমার গোলামদের জন্য, অর্থাৎ যে গোষ্ঠীগুলো তোমার অধিকার, তাদের জন্য তুমি ফিরে এস। তোমার পবিত্র জায়গা অল্প দিনের জন্য তোমার পবিত্র বান্দাদের হাতে ছিল, কিন্তু এখন আমাদের শত্রুরা সেটা পায়ে মাড়িয়েছে। তুমি যাদের উপর কখনও কর্তৃত্ব কর নি, যাদের কখনও তোমার নামে ডাকাও হয় নি, এখন আমরা তাদের সমান হয়েছি। আহা, তুমি যদি আসমান চিরে নেমে আসতে! যদি পাহাড়-পর্বত তোমার সামনে কাঁপত! আগুন যেমন ডালপালা জ্বালায় আর পানি ফুটায় তেমনি তুমি নেমে এসে তোমার শত্রুদের কাছে নিজেকে প্রকাশ কর, যেন জাতিগুলো তোমার সামনে ভয়ে কাঁপে। আমরা যা আশা করি নি তেমন ভয় জাগানো অলৌকিক চিহ্ন যখন তুমি দেখিয়েছিলে তখন তুমি নেমে এসেছিলে আর পাহাড়-পর্বত তোমার সামনে কেঁপেছিল। সেই আগেকার কাল থেকে তুমি ছাড়া আর কোন মাবুদের কথা কেউ কানেও শোনে নি চোখেও দেখে নি, যিনি তাঁর অপেক্ষাকারীর জন্য কাজ করে থাকেন। যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত কাজ করতে আনন্দ পায় আর তোমাকে স্মরণ করে তোমার পথে চলে তাদের সাহায্য করবার জন্য তুমি এসে থাক; কিন্তু আমরা গুনাহ্‌ করেছি ও অনেক দিন ধরে সেই অবস্থায় আছি বলে তুমি আমাদের উপর ভীষণ রাগ করে আছ। তাহলে আমরা কেমন করে উদ্ধার পাব? আমরা প্রত্যেকে নাপাক লোকের মত হয়েছি আর আমাদের সব সৎ কাজ নোংরা কাপড়ের মত। আমরা সবাই পাতার মত শুকিয়ে গেছি, আমাদের গুনাহ্‌ বাতাসের মত করে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কেউ তোমাকে ডাকে না কিংবা মিনতি করতে কেউ তোমার কাছে আসে না, কারণ আমাদের দিক থেকে তুমি তোমার মুখ ফিরিয়ে রেখেছ আর আমাদের গুনাহের জন্য আমাদের ধ্বংস হয়ে যেতে দিচ্ছ। তবুও, হে মাবুদ, তুমিই আমাদের পিতা। আমরা মাটি, তুমি কুমার; আমরা সবাই তোমার হাতের কাজ। হে মাবুদ, তুমি এত বেশী রাগ কোরো না; আমাদের গুনাহ্‌ চিরকাল মনে রেখো না। আমরা মিনতি করছি, তুমি আমাদের দিকে তাকাও, কারণ আমরা সবাই তোমারই বান্দা। তোমার পবিত্র শহরগুলো মরুভূমি হয়ে গেছে; এমন কি, সিয়োনেরও সেই অবস্থা হয়েছে, জ্বী, জেরুজালেম জনশূন্য হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেখানে তোমার প্রশংসা করতেন আমাদের সেই পবিত্র ও গৌরবময় বায়তুল-মোকাদ্দস আগুনে পুড়ে গেছে আর আমাদের পছন্দনীয় যা কিছু ছিল সব ধ্বংস হয়ে গেছে। হে মাবুদ, এই সবের পরেও কি তুমি বসে থাকবে? তুমি কি চুপ করে থেকে আমাদের ভীষণ শাস্তি দেবে? মাবুদ বলছেন, “আমি এই লোকদের আমার কাছে অনুরোধ জানাবার সুযোগ দিয়েছি, কিন্তু তারা আমার কাছে কোন অনুরোধ জানায় নি; আমি তাদের কাছেই ছিলাম, কিন্তু তারা কোন সাহায্যের জন্য আমার কাছে আসে নি। আমি এই জাতির লোকদের বলেছি, ‘এই যে আমি, এই যে আমি,’ কিন্তু তারা আমার কাছে মুনাজাত করে নি। একগুঁয়ে লোকদের দিকে আমি সারা দিন আমার হাত বাড়িয়েই রয়েছি। তারা নিজের নিজের কল্পনার পিছনে গিয়ে খারাপ পথে চলে। সেই লোকেরা আমার মুখোমুখি হয়েই আমাকে অনবরত বিরক্ত করছে; তারা বাগানে বাগানে কোরবানী করছে আর ইটের উপরে ধূপ জ্বালাচ্ছে। তারা কবরস্থানে বসে আর গোপন জায়গায় রাত কাটায়; তারা শূকরের গোশ্‌ত খায় আর তাদের পাত্রে নাপাক গোশ্‌তের ঝোল থাকে। তারা বলে, ‘দূরে থাক; আমার কাছে এসো না, কারণ আমি তোমার চেয়ে বেশী পবিত্র।’ ঐ লোকেরা আমার নাকের ধোঁয়া আর সারা দিন জ্বলতে থাকা আগুন। মাবুদ বলছেন, “আংগুরের থোকায় রস আছে দেখে লোকে যেমন বলে, ‘নষ্ট কোরো না, এখনও ওর মধ্যে ভাল কিছু আছে,’ তেমনি আমি আমার গোলামদের সবাইকে ধ্বংস করব না। আমি ইয়াকুব থেকে এবং এহুদা থেকে একটা বংশ তুলব; তারা আমার পাহাড়-পর্বতের অধিকারী হবে। আমার বাছাই করা লোকেরা সেগুলো অধিকার করবে আর আমার গোলামেরা সেখানে বাস করবে। আমার যে বান্দারা আমার ইচ্ছামত চলেছে তাদের জন্য শারোণ হবে ভেড়ার পাল চরাবার জায়গা আর আখোর উপত্যকা হবে পশুপালের বিশ্রাম-স্থান। কিন্তু তোমরা যারা মাবুদকে ত্যাগ করেছ এবং আমার পবিত্র পাহাড়কে ভুলে গেছ, যারা ভাগ্যদেবের উদ্দেশে টেবিল সাজিয়েছ আর ভাগ্যদেবীর উদ্দেশে মেশানো মদে পাত্র ভরেছ, আমি তোমাদের ভাগ্য নির্দিষ্ট করব তলোয়ার দিয়ে, আর তোমরা সকলে জবাই হবার জন্য নীচু হবে। এর কারণ হল, আমি তোমাদের ডেকেছিলাম কিন্তু তোমরা জবাব দাও নি, আমি কথা বলেছিলাম কিন্তু তোমরা শোন নি। আমার চোখে তোমরা খারাপ কাজ করেছ এবং যাতে আমি অসন্তুষ্ট হই তা-ই বেছে নিয়েছ।” কাজেই আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “আমার গোলামেরা খাবে, কিন্তু তোমরা ক্ষুধায় মরবে; আমার গোলামেরা পানি খাবে, কিন্তু তোমরা পিপাসিত থাকবে; আমার গোলামেরা আনন্দ করবে, কিন্তু তোমাদের লজ্জা দেওয়া হবে। দিলে আনন্দ আছে বলে আমার গোলামেরা কাওয়ালী গাইবে, কিন্তু তোমরা মনের দারুণ কষ্টে কাঁদবে এবং ভাংগা দিল নিয়ে হাহাকার করবে। আমার বাছাই করা বান্দারা কাউকে নিন্দা করবার জন্য তোমাদের নাম ব্যবহার করবে। আল্লাহ্‌ মালিক তোমাদের মেরে ফেলবেন, কিন্তু তাঁর গোলামদের তিনি আর একটা নাম দেবেন। দেশের মধ্যে যে কোন লোক দোয়া চাইবে সে সত্যময় আল্লাহ্‌র কাছেই তা চাইবে; দেশের মধ্যে যে কেউ কসম খাবে সে সত্যময় আল্লাহ্‌র নামেই তা করবে; কারণ লোকে আগেকার কষ্ট ভুলে যাবে আর আমার চোখের সামনে থেকে তা লুকানো হবে। “দেখ, আমি নতুন আসমান ও একটা নতুন জমীন সৃষ্টি করব। আগের বিষয়গুলো মনে থাকবে না, সেগুলো মনেও পড়বে না। আমি যা সৃষ্টি করব তোমরা তাতে চিরকাল খুশী থেকো আর আনন্দ কোরো, কারণ আমি জেরুজালেমকে একটা আনন্দের জিনিস আর তার লোকদের একটা খুশীর জিনিস হিসাবে সৃষ্টি করব। আমি জেরুজালেমকে নিয়ে আনন্দ করব আর আমার বান্দাদের নিয়ে খুশী হব; তার মধ্যে আর কোন কান্নাকাটির শব্দ শোনা যাবে না। সেখানে কোন শিশু মারা যাবে না, কিংবা কোন বুড়ো লোক আয়ু শেষ না হলে মরবে না। কেউ একশো বছর বয়সে মারা গেলেও তাকে যুবক বলা হবে; যে একশো বছর বাঁচবে না তাকে বদদোয়াপ্রাপ্ত বলা হবে। তারা ঘর-বাড়ী তৈরী করে সেখানে বাস করবে আর আংগুর ক্ষেত করে তার ফল খাবে। তারা ঘর তৈরী করলে অন্যেরা আর সেখানে বাস করবে না, কিংবা গাছ লাগালে অন্যেরা ফল খাবে না। আমার বান্দাদের আয়ু একটা গাছের আয়ুর সমান হবে; আমার বাছাই করা লোকেরা অনেক দিন ধরে তাদের হাতের কাজের ফল ভোগ করবে। তাদের পরিশ্রম মিথ্যা হবে না আর তাদের সন্তানেরা বিপদে পড়বে না, কারণ তারা এবং তাদের সন্তানেরা মাবুদের দোয়া পাওয়া বান্দা হবে। তারা ডাকবার আগেই আমি সাড়া দেব, তারা কথা বলতে না বলতেই আমি শুনব। নেকড়ে বাঘ ও ভেড়ার বাচ্চা এক সংগে খাবে, সিংহ গরুর মত বিচালি খাবে আর সাপের খাবার হবে ধুলা। সেগুলো আমার পবিত্র পাহাড়ের কোন জায়গায় কোন ক্ষতি করবে না কিংবা ধ্বংস করবে না।” মাবুদ বলছেন, “বেহেশত আমার সিংহাসন আর দুনিয়া আমার পা রাখবার জায়গা। তোমরা আমার জন্য কোথায় ঘর তৈরী করবে? আমার বিশ্রামের স্থান কোথায় হবে? এই সব জিনিস আমি নিজের হাতে তৈরী করেছি আর তাই এই সব হয়েছে। যে লোক নম্র, যার মন ভেংগে চুরমার হয়েছে এবং যে আমার কথায় কাঁপতে থাকে তাকে আমি ভাল চোখে দেখব। কিন্তু যে একটা গরু কোরবানী করছে সে যেন মানুষ খুন করছে, যে একটা ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী করছে সে যেন কুকুরের ঘাড় ভেংগে দিচ্ছে, যে শস্য কোরবানী করছে সে যেন শূকরের রক্ত দিচ্ছে, আর যে আমার উদ্দেশে ধূপ জ্বালাচ্ছে সে যেন মূর্তি পূজা করছে। তারা তাদের নিজের নিজের পথ বেছে নিয়েছে; তাদের ঘৃণার জিনিসগুলোতে তারা তৃপ্ত হয়। তাই আমিও তাদের উপর শাস্তির ব্যবস্থা বেছে নেব আর তারা যা ভয় করে তা-ই তাদের উপর আনব, কারণ আমি ডাকলে কেউ জবাব দেয় নি, আমি কথা বললে কেউ শোনে নি। আমার চোখে যা খারাপ তা-ই তারা করেছে, আর আমাকে যা অসন্তুষ্ট করে তা-ই তারা বেছে নিয়েছে।” তোমরা যারা মাবুদের কথায় কাঁপ তোমরা তাঁর কথা শোন। তিনি বলছেন, “তোমাদের ভাইয়েরা তোমাদের ঘৃণা করে আর আমার জন্য তোমাদের বাতিল করে। তারা ঠাট্টা করে বলে, ‘মাবুদের গৌরব হোক, আমরা যেন তোমাদের আনন্দ দেখতে পাই।’ কিন্তু তারা নিজেরাই লজ্জায় পড়বে। শোন, শহরে গণ্ডগোল হচ্ছে; শোন, বায়তুল-মোকাদ্দসে হৈ চৈ হচ্ছে; এ তো মাবুদের আওয়াজ- তাঁর শত্রুদের যা পাওনা তিনি তা-ই দিচ্ছেন। “প্রসব-বেদনা উঠবার আগেই সিয়োন সন্তানের জন্ম দিয়েছে; তার ব্যথা উঠবার আগেই সে এক ছেলের জন্ম দিয়েছে। কে এই রকম কথা শুনেছে? কে এই রকম ঘটনা দেখেছে? একটা দেশ কি এক দিনে জন্ম নিতে পারে? কিংবা একটা জাতির কি এক মুহূর্তে জন্ম হয়? কিন্তু সিয়োনের ব্যথা উঠতে না উঠতেই সে তার সন্তানদের জন্ম দিয়েছে। আমি তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি, ‘জন্মের মুহূর্ত পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আমি কি জন্ম দিতে দেব না? আমি যখন জন্ম দেবার ব্যবস্থা করেছি তখন কি আমি জন্ম দিতে দেব না?’ ” তোমরা যারা জেরুজালেমকে ভালবাস তোমরা তার সংগে আনন্দ কর, তার জন্য খুশী হও; তোমরা যারা তার জন্য দুঃখ করেছ তোমরা তার সংগে আনন্দিত হও। তোমরা বুকের দুধ খেয়ে সান্ত্বনা পাওয়া শিশুর মত জেরুজালেমের উপ্‌চে পড়া উন্নতি ভোগ করে তৃপ্ত হবে। মাবুদ বলছেন, “আমি তার দিকে নদীর মত করে উন্নতি বইয়ে দেব, আর জাতিদের ধন-সম্পদ তার কাছে বন্যার মত আসবে। তোমরা এমন শিশুর মত হবে যাকে দুধ খাইয়ে কোলে করে নেওয়া হয় আর হাঁটুর উপরে নাচানো হয়। মা যেমন তার সন্তানকে সান্ত্বনা দেয় তেমনি আমি তোমাদের সান্ত্বনা দেব; আর তোমরা জেরুজালেমে সান্ত্বনা পাবে।” এই সব দেখে তোমাদের দিল আনন্দিত হবে আর তোমরা ঘাসের মতই বেড়ে উঠবে। মাবুদের গোলামেরা তাঁর শক্তি দেখতে পাবে, আর তাঁর শত্রুরা দেখতে পাবে তাঁর রাগ। দেখ, মাবুদ আগুনের মধ্যে আসবেন আর তাঁর রথগুলো ঘূর্ণিবাতাসের মত আসবে। তাঁর রাগ তিনি ভয়ংকরভাবে প্রকাশ করবেন, আর তাঁর বকুনি আগুনের শিখায় প্রকাশিত হবে। মাবুদ আগুন ও তলোয়ার সংগে নিয়ে সমস্ত মানুষের উপর তাঁর বিচারের কাজ চালাবেন; তিনি যাদের মেরে ফেলবেন তাদের সংখ্যা হবে অনেক। মাবুদ বলছেন, “যারা শূকর ও ইঁদুরের গোশ্‌ত আর অন্যান্য জঘন্য জিনিস খায় এবং অনুষ্ঠান্তপরিচালকের পিছনে পিছনে পূজার বাগানে যাবার জন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিজেদের আলাদা করে রাখে ও পাক-সাফ করে, তারা একসংগে শেষ হয়ে যাবে। আমি তাদের সব কাজ ও কল্পনার কথা জানি। সমস্ত জাতি ও ভাষার লোকদের একত্র করবার সময় এসে গেছে। তারা এসে আমার মহিমা দেখতে পাবে।” মাবুদ আরও বলছেন, “আমি তাদের মধ্যে একটা চিহ্ন স্থাপন করব এবং যারা বেঁচে থাকবে তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আমি জাতিদের কাছে পাঠাব- সেপন, পূল ও নাম-করা ধনুকধারী লিডিয়া, তূবল ও গ্রীসের কাছে এবং যে সব দূরের দেশগুলো আমার সুনাম শোনে নি ও আমার মহিমাও দেখে নি তাদের কাছে পাঠাব। তারা জাতিদের মধ্যে আমার মহিমার কথা ঘোষণা করবে। মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী হিসাবে তারা সমস্ত জাতির মধ্য থেকে তোমাদের ভাইদের রথ ও গাড়িতে করে এবং ঘোড়া, গাধা ও উটে করে নিয়ে আমার পবিত্র পাহাড় জেরুজালেমে আসবে। বনি-ইসরাইলরা যেমন পাক-সাফ পাত্রের মধ্যে শস্য-কোরবানীর জিনিস আনে তেমনি করে তারা মাবুদের ঘরে তাদের নিয়ে আসবে। আমি তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন লেবীয়কে ইমাম ও খেদমতকারী হবার জন্য বেছে নেব।” মাবুদ বলছেন, “যে নতুন আসমান ও নতুন জমীন আমি তৈরী করব তা যেমন আমার সামনে টিকে থাকবে তেমনি তোমাদের নাম ও তোমাদের বংশধরেরাও টিকে থাকবে। প্রত্যেক অমাবস্যায় ও প্রত্যেক বিশ্রামবারে সমস্ত লোক আমার সামনে এসে আমার এবাদত করবে। তারা বের হয়ে সেই সব লোকদের লাশ দেখবে যারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। যে সব পোকা তাদের লাশ খায় সেগুলো মরবে না ও যে আগুন তাদের পোড়ায় তা নিভবে না, আর তারা সমস্ত মানুষের ঘৃণার পাত্র হবে।” এই সব কথা হিল্কিয়ের ছেলে ইয়ারমিয়া বলেছিলেন। তিনি ছিলেন বিন্‌ইয়ামীন এলাকার অনাথোৎ গ্রামের ইমামদের মধ্যে একজন। এহুদার বাদশাহ্‌ আমোনের ছেলে ইউসিয়ার রাজত্বের তেরো বছরের সময় মাবুদের কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হয়েছিল। ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের সময় থেকে এহুদার বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার ছেলে সিদিকিয়ের রাজত্বের এগারো বছরের পঞ্চম মাস পর্যন্তও মাবুদের কালাম আবার নাজেল হয়েছিল। সেই মাসেই জেরুজালেমের লোকদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মাবুদ আমাকে বললেন, “তোমাকে মায়ের গর্ভে গঠন করবার আগেই আমি তোমাকে বেছে রেখেছি। তোমার জন্মের আগেই আমি তোমাকে আলাদা করে রেখে জাতিদের কাছে নবী হিসাবে নিযুক্ত করেছি।” তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমি কথা বলতে জানি না; আমি তো ছেলেমানুষ।” কিন্তু মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি ছেলেমানুষ এই কথা বোলো না। আমি যাদের কাছে তোমাকে পাঠাব তাদের প্রত্যেকের কাছে তুমি যাবে এবং আমি যা বলতে হুকুম করব তা-ই বলবে। তুমি তাদের ভয় কোরো না, কারণ আমি মাবুদ তোমাকে রক্ষা করবার জন্য তোমার সংগে সংগে আছি।” তারপর মাবুদ হাত বাড়িয়ে আমার মুখ ছুঁলেন এবং আমাকে বললেন, “এখন আমি তোমার মুখে আমার কালাম দিলাম। দেখ, উপ্‌ড়ে ও ভেংগে ফেলবার জন্য, ধ্বংস ও সর্বনাশ করবার জন্য এবং তৈরী করবার ও স্থাপন করবার জন্য আজ আমি তোমাকে জাতি ও রাজ্যগুলোর উপরে নিযুক্ত করলাম।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “ইয়ারমিয়া, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “আমি বাদাম গাছের একটা ডাল দেখতে পাচ্ছি।” মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই দেখেছ, কারণ আমার কালাম যাতে সফল হয় তার দিকে আমি খেয়াল রাখছি।” আবার মাবুদ বললেন, “তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” আমি বললাম, “আমি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে কাৎ হয়ে থাকা একটা পাত্র দেখতে পাচ্ছি যার মধ্যে কিছু ফুটছে।” মাবুদ আমাকে বললেন, “এই দেশে যারা বাস করে তাদের সকলের উপরে উত্তর দিক থেকে বিপদ বন্যার মত বেগে আসবে। আমি উত্তর দিকের রাজ্যগুলোর সমস্ত জাতিদের ডাক দিচ্ছি।” জেরুজালেমের দরজাগুলোতে ঢুকবার পথে বাদশাহ্‌রা এসে তাদের সিংহাসন স্থাপন করবে। তারা তার চারপাশের দেয়াল আর এহুদার সমস্ত শহরগুলো ঘেরাও করবে। আমার বান্দারা আমাকে ত্যাগ করেছে, তারা দেব-দেবীদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়েছে আর নিজেদের হাতের তৈরী জিনিসের পূজা করেছে। তাদের এই সব দুষ্টতার জন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে আমার বিচারের রায় দেব। “তুমি কোমর বেঁধে দাঁড়াও এবং আমি তোমাকে যা বলতে হুকুম করি তা-ই তুমি তাদের বল। তাদের দেখে তুমি ভেংগে পোড়ো না, যদি পড় তাহলে আমি এমন করব যাতে তাদের সামনে তুমি একেবারে ভেংগে পড়। আজ আমি তোমাকে একটা শক্তিশালী শহরের মত, একটা লোহার থামের মত ও একটা ব্রোঞ্জের দেয়ালের মত করলাম যাতে তুমি গোটা দেশের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ এহুদার বাদশাহ্‌দের, উঁচু পদের কর্মচারীদের, ইমামদের ও দেশের লোকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পার। তারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবে না, কারণ তোমাকে রক্ষা করবার জন্য আমি তোমার সংগে সংগে আছি। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” ইসরাইল মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করা জাতি; তারা তাঁর ফসল তুলবার সময়কার প্রথমে কাটা ফসল। যারা ইসরাইলকে গ্রাস করেছে তারা সবাই দোষী হয়েছে, তাদের উপর বিপদ ঘটেছে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” হে ইয়াকুবের বংশ, ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠী, তোমরা সবাই মাবুদের কথা শোন। মাবুদ বলছেন, “তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আমার কি দোষ খুঁজে পেয়েছিল যে, তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল? তারা অপদার্থ মূর্তির পিছনে গিয়ে নিজেরা অপদার্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা জিজ্ঞাসাও করে নি, ‘সেই মাবুদ কোথায় যিনি মিসর থেকে আমাদের বের করে এমন মরুভূমির মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন যা ছিল পানিশূন্য ও ফাটল ধরা এবং শুকনা ও অন্ধকারময়? সেখানে তো কেউ যাওয়া-আসা ও বাস করত না।’ “আমি তোমাদের একটা উর্বর দেশে নিয়ে এসেছিলাম যেন তোমরা সেখানকার ফল ও ভাল ভাল জিনিস খেতে পার; কিন্তু তোমরা এসে আমার দেশটাকে নাপাক করেছ, আমার অধিকারকে ঘৃণার জিনিস করে তুলেছ। ইমামেরা জিজ্ঞাসা করে নি, ‘মাবুদ কোথায়?’ যাদের হাতে শরীয়ত ছিল তারা আমাকে চেনে নি; নেতারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। নবীরা অপদার্থ মূর্তিগুলোর পিছনে গিয়ে বাল দেবতার নামে কথা বলেছে। “সেইজন্য আমি তোমাদের ও তোমাদের বংশধরদের আরও দোষী করব। তোমরা পার হয়ে সাইপ্রাস দ্বীপের সমুদ্র পারের দেশগুলোতে গিয়ে দেখ, কায়দারে লোক পাঠিয়ে খুব ভাল করে লক্ষ্য কর। তোমরা দেখবে সেখানে এই রকম কোন কিছু কখনও হয় নি। যদিও জাতিদের দেব-দেবী মাবুদ নয় তবুও কোন জাতি নিজের দেব-দেবীর পরিবর্তন করে নি; কিন্তু আমার বান্দারা তাদের গৌরবময় আল্লাহ্‌র বদলে অপদার্থ দেবতাদের গ্রহণ করেছে। হে আসমান, এ দেখে হতভম্ব হও এবং ভীষণ ভয়ে কাঁপতে থাক, কারণ আমার বান্দারা দু’টা গুনাহ্‌ করেছে। জীবনদায়ী পানির ঝর্ণা যে আমি, সেই আমাকেই তারা ত্যাগ করেছে, আর নিজেদের জন্য এমন পানি রাখবার জায়গা তৈরী করেছে যা ভাংগা, যাতে পানি ধরে রাখা যায় না। ইসরাইল কি গোলাম? সে কি জন্ম থেকেই গোলাম? কেন সে শিকারের বস-ু হয়েছে? সিংহেরা গর্জন করেছে; তাকে দেখে গোঁ গোঁ করেছে। তার দেশ তারা পোড়ো জমি করে রেখেছে; তার শহরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তাতে লোকজন নেই। এছাড়াও মেম্ফিস ও তফন্‌হেষ শহরের লোকেরা তোমার মাথা কামিয়ে দিয়েছে। তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌ যখন তোমাকে ঠিক পথে চালাচ্ছিলেন তখন কি তুমি তাঁকে ত্যাগ করে এই সব নিজের উপর নিয়ে আস নি? এখন নীল নদের পানি খাবার জন্য কেন তুমি মিসরে যাচ্ছ? ফোরাত নদীর পানি খাবার জন্য কেন তুমি আশেরিয়া দেশে যাচ্ছ? তোমার দুষ্টতাই তোমাকে শাস্তি দেবে; তোমার বিপথে যাওয়া তোমাকে দোষী করবে। তাহলে এবার চিন্তা কর এবং বুঝে দেখ, তুমি যখন তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌কে ত্যাগ কর এবং তাঁকে ভয় কর না তখন তা তোমার জন্য কত খারাপ ও তেতো হয়। এই কথা আমি দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি। “অনেক দিন আগেই তুমি তোমার জোয়াল ভেংগে বাঁধন ছিঁড়ে ফেলেছ; তুমি বলেছ, ‘আমি তোমার এবাদত করব না।’ তুমি প্রত্যেকটি উঁচু পাহাড়ে ও ডালপালা ছড়ানো প্রত্যেকটি সবুজ গাছের নীচে বেশ্যার মত শুয়েছ। আমি তো তোমাকে বাছাই করা বীজ থেকে জন্মানো ভাল আংগুরের চারা হিসাবে লাগিয়েছিলাম; তাহলে কেমন করে তুমি একটা খারাপ বুনো আংগুর গাছ হয়েছ? যদিও তুমি সোডা দিয়ে নিজেকে ধোও আর প্রচুর সাবান ব্যবহার কর তবুও তোমার অন্যায়ের দাগ আমার সামনে রয়েছে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। তুমি কেমন করে বলতে পার যে, তুমি নাপাক নও, তুমি বাল দেবতাদের পিছনে দৌড়াও নি? ভেবে দেখ, তুমি উপত্যকাতে কেমন ব্যবহার করেছিলে; তুমি যা করেছ তা চিন্তা কর। তুমি যেন পুরুষ উটের সংগে মিলিত হওয়ার জন্য এখান্তেসেখানে দৌড়ানো স্ত্রী-উট। তুমি যেন মরুভূমিতে থাকা একটা বুনো গাধী, যে খুব বেশী কামনার জন্য বাতাস শুঁকে বেড়ায়। দেহে মিলিত হবার উত্তেজনার সময়ে কে তাকে থামিয়ে রাখতে পারে? যে গাধাগুলো তার খোঁজ করে তারা ক্লান্ত হবে না; মিলনের সময় হলে তারা সহজে তাকে খুঁজে পাবে। তুমি সাবধান হও, না হলে তোমার পায়ের জুতা নষ্ট হয়ে যাবে আর তোমার গলাও শুকিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি বলছ, ‘কোন লাভ নেই। আমি দেব-দেবীদের ভালবাসি, তাদের পিছনেই আমি যাব।’ “চোর ধরা পড়লে যেমন অসম্মানিত হয় তেমনি বনি-ইসরাইলরা অসম্মানিত হয়েছে। তারা নিজেরা, তাদের বাদশাহ্‌রা ও কর্মচারীরা, তাদের ইমামেরা ও নবীরা সবাই অসম্মানিত হয়েছে। তারা কাঠকে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা,’ আর পাথরকে বলে, ‘তুমি আমার আম্মা।’ তারা আমার দিকে তাদের মুখ ফিরায় নি, ফিরিয়েছে তাদের পিছন দিক; তবুও বিপদের সময় তারা বলে, ‘তুমি এস, আমাদের উদ্ধার কর।’ হে এহুদা, তুমি নিজের জন্য যে দেব-দেবী বানিয়েছ তারা তখন কোথায় থাকে? যখন তুমি বিপদে পড় তখন যদি তারা তোমাকে উদ্ধার করতে পারে তবে তারা আসুক, কারণ তোমার যতগুলো শহর আছে ততগুলো দেব-দেবীও আছে।” মাবুদ বলছেন, “কেন তোমরা আমাকে দোষ দিচ্ছ? তোমরা তো সবাই আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছ। আমি তোমাদের বৃথাই শাস্তি দিয়েছি; তোমরা শাসন অগ্রাহ্য করেছ। খিদে-পাওয়া সিংহের মত তোমাদের তলোয়ার তোমাদের নবীদের গ্রাস করেছে। “এই কালের লোকেরা, তোমরা আমার কালাম শোন। ইসরাইলের কাছে কি আমি মরুভূমি হয়েছি? আমি কি ভীষণ অন্ধকারের দেশ হয়েছি? আমার বান্দারা কেন বলে, ‘আমরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারি; আমরা তোমার কাছে আর আসব না’? কোন মেয়ে কি তার অলংকার সম্বন্ধে ভুলে যেতে পারে? কোন বিয়ের কনে কি তার বিয়ের গহনা-গাঁটি সম্বন্ধে ভুলে যেতে পারে? কিন্তু আমার বান্দারা অনেক অনেক দিন ধরে আমাকে ভুলে রয়েছে। “হে এহুদা, তুমি প্রেমের পিছনে ধাওয়া করতে কেমন পাকা! সবচেয়ে খারাপ স্ত্রীলোকও তোমার পথ দেখে শিখতে পারে। বারবার পথ বদলে কেন তুমি এত ঘুরে বেড়াও? আশেরিয়ার বিষয় তুমি যেমন লজ্জিত হয়েছিলে তেমনি মিসরের বিষয়েও লজ্জিত হবে। তোমার হাত মাথার উপর দিয়ে তুমি সেই জায়গাও ছেড়ে আসবে, কারণ যাদের উপর তুমি ভরসা কর আমি মাবুদ তাদের অগ্রাহ্য করেছি; তাদের সাহায্যে তুমি সফলতা লাভ করতে পারবে না।” মাবুদ বলছেন, “যদি কোন লোক তার স্ত্রীকে তালাক দেয় আর সেই স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য লোককে বিয়ে করে, তাহলে সেই পুরুষের কি আবার সেই স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবার নিয়ম আছে? যদি যায় তবে সেই দেশ সম্পূর্ণভাবে নাপাক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি তো অনেকের সংগে থেকে বেশ্যার মত জীবন কাটিয়েছ; এখন তুমি কি করে আমার কাছে ফিরে আসবে? “তুমি চোখ তুলে গাছপালাহীন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখ। এমন কোন জায়গা আছে কি যেখানে তুমি জেনা কর নি? যাদের সংগে তুমি জেনা করেছ তাদের অপেক্ষায় তুমি রাস্তার ধারে বসে থাকতে, মরুভূমির আরবীয়দের মত ওৎ পেতে থাকতে। তোমার বেশ্যাগিরি আর দুষ্টতা দিয়ে তুমি দেশকে নাপাক করেছ। এইজন্য বৃষ্টি বন্ধ করে রাখা হয়েছে এবং বসন্তের বৃষ্টিও পড়ে নি। তবুও তোমার চোখে আছে বেশ্যার বেহায়া চাহনি; তোমার কোন লজ্জা নেই। তুমি কি এইমাত্র আমাকে ডেকে বল নি, ‘হে আমার পিতা, আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তুমি কি সব সময় রাগ করে থাকবে? তোমার রাগ কি চিরকাল পুষে রাখবে?’ তুমি তো এইভাবে কথা বল, কিন্তু তোমার পক্ষে যতখানি খারাপ কাজ করা সম্ভব তুমি ততখানিই করেছ।” বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার রাজত্বের সময়ে মাবুদ আমাকে বললেন, “বিপথে যাওয়া ইসরাইল যা করেছে তা কি তুমি দেখেছ? সে সমস্ত উঁচু পাহাড়ের উপরে ও ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে গিয়ে জেনা করেছে। আমি ভেবেছিলাম এই সব করবার পরে সে আমার কাছে ফিরে আসবে, কিন্তু সে আসে নি আর তার বেঈমান বোন এহুদা তা দেখেছিল। বিপথে যাওয়া ইসরাইলকে আমি তালাক-নামা দিয়েছিলাম এবং তার সমস্ত জেনার জন্য তাকে দূর করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম তার বেঈমান বোন এহুদার কোন ভয় নেই; সে-ও গিয়ে জেনা করল। তার জেনার কাজ তার কাছে কিছুই মনে হয় নি বলে সে পাথর ও কাঠের দেব-দেবীর সংগে জেনা করে দেশকে নাপাক করল। এই সব হলেও ইসরাইলের বেঈমান বোন এহুদা সমস্ত মন দিয়ে নয় কিন্তু কেবল ভান করে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ আমাকে বললেন, “বিপথে যাওয়া ইসরাইল বরং বেঈমান এহুদার চেয়ে নিজেকে সৎ দেখিয়েছে। তুমি গিয়ে এই সব সংবাদ উত্তর দিকে মুখ করে ঘোষণা কর: ‘আমি মাবুদ বলছি, হে বিপথে যাওয়া ইসরাইল, ফিরে এস। আমি আর তোমার দিকে ভুরু কুঁচকে থাকব না; আমি দয়াবান, তাই চিরকাল রাগ পুষে রাখব না। তুমি কেবল তোমার দোষ মেনে নাও যে, তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে তুমি বিদ্রোহ করেছ, ডালপালা ছড়ানো সমস্ত সবুজ গাছের নীচে দেব-দেবীকে তোমার ভালবাসা দান করেছ এবং আমার কথার বাধ্য হও নি।’ “আমি মাবুদ আরও বলছি, ‘হে বিপথে যাওয়া লোকেরা, ফিরে এস, কারণ আমিই তোমাদের স্বামী। আমি তোমাদের মধ্যেকার প্রত্যেক শহর থেকে একজন ও প্রত্যেক বংশ থেকে দু’জনকে বেছে নিয়ে সিয়োনে আনব। তারপর আমি তোমাদের আমার মনের মত পালক দেব; তারা জ্ঞান ও বুদ্ধির সংগে তোমাদের চালাবে। সেই সময় আমি যখন দেশে তোমাদের লোকসংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেব তখন লোকে আর মাবুদের সাক্ষ্য-সিন্দুক সম্বন্ধে বলবে না। তার কথা কখনও তাদের মনে পড়বে না বা মনেও থাকবে না; তার আর দরকার হবে না কিংবা অন্য আর একটা তৈরীও করা হবে না। সেই সময় লোকে জেরুজালেমকে বলবে মাবুদের সিংহাসন, আর মাবুদের এবাদত করবার জন্য সমস্ত জাতি জেরুজালেমে জমায়েত হবে। তাদের খারাপ দিলের একগুঁয়েমিতে আর তারা চলবে না। সেই সময় এহুদার লোকেরা ইসরাইলের লোকদের সংগে যুক্ত হবে আর আমি যে দেশ অধিকার হিসাবে তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছি সেই দেশে তারা একসংগে উত্তর দিকের দেশ থেকে ফিরে আসবে।’ “আমি নিজেই বলেছিলাম, ‘আমি ছেলে হিসাবে তোমাদের কবুল করব এবং চাওয়ার মত একটা দেশ, জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর একটা অধিকার তোমাদের দেব।’ আমি ভেবেছিলাম তোমরা আমাকে পিতা বলে ডাকবে এবং আমার পিছনে চলা থেকে ফিরে যাবে না। কিন্তু হে বনি-ইসরাইলরা, স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত স্ত্রীর মত তোমরা আমার প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছ। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” গাছপালাহীন পাহাড়গুলোর উপরে বনি-ইসরাইলদের ফরিয়াদ ও মিনতির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কারণ তাদের পথ তারা বাঁকা করেছে এবং তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে তারা ভুলে গেছে। মাবুদ বলছেন, “হে বিপথে যাওয়া সন্তানেরা, ফিরে এস; তোমাদের বিপথে যাওয়া রোগ আমি ভাল করে দেব।” তখন বনি-ইসরাইলরা বলবে, “জ্বী, আমরা তোমার কাছে আসব, কারণ তুমিই আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। সত্যিই পাহাড়-পর্বতগুলোর উপরকার পূজার হৈ চৈ ছলনা ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যিই আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র মধ্যেই আছে ইসরাইলের উদ্ধার। আমাদের ছেলেবেলা থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিশ্রমের ফল, অর্থাৎ তাঁদের গরু-ভেড়ার পাল ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের এই লজ্জাজনক দেব-দেবী গ্রাস করেছে। এস, আমরা আমাদের লজ্জার মধ্যে শুয়ে থাকি, আমাদের অপমান আমাদের ঢেকে ফেলুক। ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করে চলেছি, আর আমাদের পূর্বপুরুষেরাও তা-ই করেছিলেন। আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য থাকি নি।” মাবুদ বলছেন, “হে ইসরাইল, তুমি যদি ফিরে আসতে চাও তবে আমার কাছেই ফিরে এস। যদি তুমি আমার চোখের সামনে থেকে তোমার জঘন্য মূর্তিগুলো সরিয়ে দাও এবং আর বিপথে না যাও, যদি তুমি সত্যে, ন্যায়ে ও সততায় ‘আল্লাহ্‌র কসম’ বলে কসম খাও, তাহলে আমি অন্যান্য জাতিদের দোয়া করব আর তারা আমাকে নিয়েই গৌরব বোধ করবে।” মাবুদ এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের বলছেন, “তোমরা পতিত জমি চাষ কর এবং কাঁটাবনের মধ্যে বীজ বুনো না। হে এহুদা ও জেরুজালেমের লোকেরা, মাবুদের বাধ্য হবার জন্য তোমাদের নিজেদের খৎনা কর, অর্থাৎ তোমাদের দিলের ময়লা দূর কর; তা না হলে তোমাদের খারাপ কাজের জন্য আমার রাগ বের হয়ে আগুনের মত জ্বলে উঠবে, কেউ তা নিভাতে পারবে না। “তোমরা এহুদা দেশে ও জেরুজালেমে ঘোষণা করে বল, ‘সারা দেশে শিংগা বাজাও।’ জোরে চিৎকার করে বল, ‘তোমরা একসংগে জমায়েত হও। চল, আমরা দেয়াল-ঘেরা শহরগুলোতে যাই।’ সিয়োনে যাবার পথ দেখাবার জন্য চিহ্ন স্থাপন কর। দেরি না করে নিরাপদ হবার জন্য পালাও, কারণ আমি উত্তর দিক থেকে বিপদ এবং ভয়ংকর ধ্বংস আনতে যাচ্ছি। একটা সিংহ তার ঝোপ ছেড়ে উঠে এসেছে; জাতিদের ধ্বংসকারী একজন রওনা হয়েছে। তোমার দেশ ধ্বংস করবার জন্য সে তার জায়গা ছেড়ে আসছে। তোমার শহরগুলো জনশূন্য ও ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকবে। কাজেই চট পরে বিলাপ ও হাহাকার কর, কারণ মাবুদের জ্বলন্ত রাগ আমাদের দিক থেকে ফিরে যায় নি।” মাবুদ বলছেন, “সেই দিন বাদশাহ্‌ ও উঁচু পদের কর্মচারীরা সাহস হারাবে, আর ইমামেরা ও নবীরা হতভম্ব হবে।” তখন আমি বললাম, “হায়, হায়! হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি এই লোকদের ও জেরুজালেমকে পুরোপুরি ছলনা করে বলেছ, ‘তোমাদের শান্তি হবে,’ অথচ আমাদের গলার কাছে তলোয়ার ধরা রয়েছে।” সেই সময় মাবুদ এই লোকদের ও জেরুজালেমকে বলবেন, “মরুভূমির গাছপালাহীন পাহাড়গুলো থেকে গরম বাতাস আমার বান্দাদের দিকে আসছে, কিন্তু তা শস্য ঝাড়বার বা পরিষ্কার করবার বাতাস নয়; আমার হুকুমে আসা সেই বাতাসের জোর খুব বেশী। এইভাবে আমি এখন তাদের বিরুদ্ধে আমার বিচারের রায় দেব।” দেখ, তিনি মেঘের মত করে এগিয়ে আসছেন। তাঁর রথগুলো ঘূর্ণিবাতাসের মত আসছে আর তাঁর ঘোড়াগুলো ঈগল পাখীর চেয়েও জোরে দৌড়ায়। হায়, হায়, আমরা ধ্বংস হয়ে গেলাম! হে জেরুজালেম, তোমার দিল থেকে খারাপী ধুয়ে ফেল যাতে তুমি উদ্ধার পাও। আর কত দিন তুমি খারাপ চিন্তা মনে পুষে রাখবে? দান শহর থেকে ও আফরাহীমের পাহাড়গুলো থেকে বিপদের কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। জাতিগুলোর কাছে এবং জেরুজালেমের কাছে এই কথা ঘোষণা কর, “ঘেরাও করবার জন্য সৈন্যেরা দূর দেশ থেকে আসছে; তারা এহুদার শহরগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের হাঁক দিচ্ছে। ক্ষেতের পাহারাদারদের মত তারা জেরুজালেমকে ঘেরাও করবে, কারণ সে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। তোমার আচার-ব্যবহার ও তোমার সমস্ত কাজের জন্য এই সব তোমার উপর এসেছে। এ তোমার দুষ্টতার শাস্তি। এ ভীষণ তেতো; এ তোমার দিলকে বিঁধেছে।” হায়, আমার দিল, আমার দিল! আমি যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছি। হায়, আমার দিল! আমার বুক ধুক্‌ ধুক্‌ করছে। আমি চুপ করে থাকতে পারছি না, কারণ আমি শিংগার আওয়াজ শুনেছি, আমি যুদ্ধের হাঁক শুনেছি। বিপদের পর বিপদ আসছে; সমস্ত দেশ যেন ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে। অল্পক্ষণের মধ্যে আমার তাম্বুগুলো, এক মুহূর্তের মধ্যে আমার তাম্বুর পর্দাগুলো যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কত দিন আমাকে যুদ্ধের নিশান দেখতে হবে আর শুনতে হবে শিংগার আওয়াজ? মাবুদ বলছেন, “আমার বান্দারা বোকা; তারা আমাকে জানে না। তারা বুদ্ধিহীন ছেলেমেয়ে; তাদের বুঝবার শক্তি নেই। খারাপ কাজ করতে তারা ওস্তাদ, কিন্তু কেমন করে ভাল কাজ করতে হয় তা তারা জানে না।” আমি দুনিয়ার দিকে তাকালাম; সেটা আকারহীন ও খালি; আসমানের দিকে তাকালাম, সেখানে আলো নেই। বড় বড় পাহাড়ের দিকে তাকালাম, সেগুলো কাঁপছে; সমস্ত ছোট ছোট পাহাড়গুলো দুলছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কোন লোক নেই; আসমানের সব পাখী উড়ে চলে গেছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম মাবুদের সামনে, তাঁর ভয়ংকর রাগের সামনে উর্বর দেশটা মরুভূমি হয়ে গেছে; তার সমস্ত শহরগুলো ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে। মাবুদ বলছেন, “গোটা দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে, যদিও আমি তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হতে দেব না। দুনিয়া শোক করবে আর আসমান অন্ধকার হয়ে যাবে, কারণ আমি এই কথা বলেছি। আমিই এটা স্থির করেছি; তা থেকে ফিরব না, তা করবই করব।” ঘোড়সওয়ার আর ধনুকধারীদের আওয়াজেই সমস্ত শহরের লোকেরা পালিয়ে যাবে। কিছু লোক যাবে ঘন ঝোপের মধ্যে আর কিছু লোক উঠবে বড় বড় পাথরের উপরে। প্রত্যেকটি শহর খালি হয়ে পড়ে থাকবে; সেখানে কোন লোক বাস করবে না। হে ধ্বংস হওয়া সেই শহর, তুমি কি করবে? কেন লাল রংয়ের কাপড় আর সোনার গহনা পরছ? কেন চোখে কাজলের রেখা টানছ? তুমি অনর্থক নিজেকে সাজা"ছ। তোমার প্রেমিকেরা তোমাকে ঘৃণা করে, তারা তোমার প্রাণ নেবার চেষ্টা করে। একজন স্ত্রীলোকের প্রসব-বেদনার কান্নার মত, প্রথম সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার কান্নার মত সিয়োন্তকন্যার কান্না আমি শুনেছি। সে নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁপাচ্ছে আর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, “হায়! আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি, খুনীরা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।” মাবুদ বলছেন, “তোমরা জেরুজালেমের রাস্তাগুলোর এ মাথা থেকে ও মাথায় যাও আর চারপাশে তাকিয়ে দেখ। সেখানকার শহর-চকগুলোতে গিয়ে তালাশ কর। দেখ, যদি এমন কাউকে পাও যে ন্যায়ভাবে এবং সৎভাবে চলে তাহলে আমি এই শহরকে মাফ করে দেব। যদিও তারা বলে, ‘আল্লাহ্‌র কসম,’ তবুও তারা মিথ্যাভাবে কসম খায়।” হে মাবুদ, তুমি কি সত্য দেখতে চাও না? তুমি তাদের আঘাত করলেও তারা ব্যথা বোধ করে নি; তুমি তাদের চুরমার করলেও তারা সংশোধন অগ্রাহ্য করেছে। তাদের মুখ তারা পাথরের চেয়েও শক্ত করে তওবা করতে অস্বীকার করেছে। আমি ভেবেছিলাম, “তারা গরীব ও বোকা, কারণ তারা মাবুদের পথ এবং তাদের আল্লাহ্‌র শরীয়ত জানে না। কাজেই আমি নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের সংগে কথা বলব; নিশ্চয়ই তারা মাবুদের পথ ও তাদের আল্লাহ্‌র শরীয়ত জানে।” কিন্তু তারাও একসংগে জোয়াল ভেংগে বাঁধন ছিড়ে ফেলেছে। সেইজন্য বন থেকে একটা সিংহ এসে তাদের মেরে ফেলবে। মরুভূমির একটা নেকড়ে বাঘ তাদের ধ্বংস করবে এবং তাদের শহরগুলোর কাছে একটা চিতাবাঘ ওৎ পেতে থাকবে। যদি কেউ সেখান থেকে বের হয়ে আসে তবে সে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে, কারণ তাদের গুনাহ্‌ ভীষণ ও তাদের বিপথে যাওয়ার ঘটনা অনেক। মাবুদ বলছেন, “হে জেরুজালেম, কেন আমি তোমাকে মাফ করব? তোমার ছেলেমেয়েরা আমাকে ত্যাগ করেছে এবং যারা আল্লাহ্‌ নয় তাদের নামে কসম খেয়েছে। আমি তাদের সব প্রয়োজন মিটিয়েছি, তবুও তারা জেনা করেছে এবং দলে দলে বেশ্যাদের বাড়ীতে গিয়েছে। তারা পেট ভরে খাওয়া তেজী কামুক ঘোড়ার মত একে অন্যের স্ত্রীর সংগে সহবাস করবার জন্য ডেকে উঠেছে। আমি মাবুদ জিজ্ঞাসা করছি, এর জন্য কি আমি তাদের শাস্তি দেব না? আমি কি এই রকম জাতির উপর শোধ নেব না? “হে জাতিরা, তোমরা জেরুজালেমের আংগুর ক্ষেতগুলোতে গিয়ে সেগুলো ধ্বংস কর কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নষ্ট কোরো না। তার ডালপালাগুলো কেটে ফেল, কারণ এই লোকেরা মাবুদের নয়। ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা আমার প্রতি ভীষণ বেঈমানী করেছে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” তারা মাবুদের বিষয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। তারা বলেছে, “তিনি কিছুই করবেন না। আমাদের কোন ক্ষতি হবে না; আমরা কখনও যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষ দেখব না। নবীরা বাতাসের মত; তাদের মধ্যে আল্লাহ্‌র কালাম নেই। কাজেই তারা যা বলে তা তাদের প্রতিই করা হবে।” কাজেই মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছেন, “লোকেরা এই কথা বলেছে বলে তোমার মুখে আমার কথাগুলো আগুনের মত করব আর এই লোকদের করব কাঠের মত; সেই আগুন তা পুড়িয়ে দেবে।” মাবুদ বলছেন, “হে বনি-ইসরাইলরা, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দূর থেকে এক জাতিকে নিয়ে আসব। সে একটা পুরানো ও টিকে থাকা জাতি; সেই লোকদের ভাষা তোমরা জানবে না ও তাদের কথা তোমরা বুঝবে না। তারা সাংঘাতিকভাবে তীর ছোঁড়ে; তারা সবাই শক্তিশালী যোদ্ধা। তারা তোমাদের ফসল ও খাবার গ্রাস করবে, গ্রাস করবে তোমাদের ছেলেমেয়েদের; তারা তোমাদের গরু-ভেড়ার পাল গ্রাস করবে, গ্রাস করবে তোমাদের সব আংগুর ও ডুমুর গাছ। যে দেয়াল-ঘেরা শহরের উপর তোমরা ভরসা করছ তা তারা যুদ্ধ করে ধ্বংস করে দেবে।” মাবুদ বলছেন, “তবুও সেই দিনগুলোতে আমি সম্পূর্ণভাবে তোমাকে ধ্বংস করব না। যখন লোকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতি এই সব কেন করলেন?’ তখন তুমি তাদের বলবে, ‘যেমন তোমরা আমাকে ত্যাগ করে তোমাদের দেশে দেব-দেবীর এবাদত করেছ তেমনি যে দেশ তোমাদের নিজেদের নয় সেই দেশে গিয়ে এখন তোমরা বিদেশীদের সেবা করবে।’ ” মাবুদ ইয়াকুবের বংশকে এই কথা বলতে এবং এহুদার কাছে এই কথা ঘোষণা করতে বললেন, “হে বোকা ও বুদ্ধিহীন লোকেরা, তোমরা যারা চোখ থাকতেও দেখতে পাও না, কান থাকতেও শুনতে পাও না, তোমরা শোন। তোমরা কি আমাকে ভয় করবে না? আমার সামনে কি তোমরা কাঁপবে না? আমিই একটা চিরস্থায়ী বাধা হিসাবে বালু দিয়ে সমুদ্রের সীমা ঠিক করেছি, যাতে সমুদ্র তা পার হতে না পারে। তার ঢেউগুলো গড়িয়ে আসলেও তা সফল হতে পারে না; তা গর্জন করলেও পার হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু এই লোকদের দিল একগুঁয়ে ও বিদ্রোহী। তারা বিপথে চলে গেছে। তারা মনে মনেও বলে না, ‘এস, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে আমরা ভয় করে চলি, যিনি সময়মত শরৎ ও বসন্তকালে বৃষ্টি দেন, যিনি আমাদের জন্য ফসল কাটবার নিয়মিত সময় রক্ষা করেন।’ তোমাদের অন্যায় কাজের দরুন এই সব দূরে রাখা হয়েছে; তোমাদের গুনাহের দরুন তোমাদের উন্নতি হয় না। “আমার বান্দাদের মধ্যে এমন দুষ্ট লোক আছে যারা পাখী শিকারীদের মত ওৎ পেতে থাকে; তারা ফাঁদ পেতে মানুষ ধরে। খাঁচা যেমন পাখীতে ভরা তাদের বাড়ীও তেমনি ছলনায় ভরা। তারা ধনী ও শক্তিশালী হয়েছে, তারা মোটা ও তেল্‌তেলে হয়েছে। তাদের খারাপ কাজের সীমা নেই; এতিমেরা যাতে ন্যায়বিচার পায় সেইজন্য তারা তাদের পক্ষে দাঁড়ায় না এবং তারা গরীবদের অধিকারও রক্ষা করে না। এইজন্য আমি কি তাদের শাস্তি দেব না? আমি কি এই রকম জাতির উপর প্রতিশোধ নেব না? আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “দেশের মধ্যে খুব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। নবীরা মিথ্যা কথা ঘোষণা করে, ইমামেরা নিজের হাতেই ক্ষমতা নিয়ে শাসন করে, আর আমার বান্দারা এই রকমই ভালবাসে। কিন্তু হে আমার বান্দারা, শেষে তোমরা কি করবে?” মাবুদ বলছেন, “হে বিন্‌ইয়ামীনের লোকেরা, রক্ষা পাবার জন্য পালাও। জেরুজালেম থেকে পালাও। তকোয় শহরে শিংগা বাজাও। বৈৎ-হক্কেরমে সংকেত দেখাও, কারণ উত্তর দিক থেকে বিপদ ও ভয়ংকর ধ্বংস উঁকি মারছে। সুন্দরী ও আরামে থাকা সিয়োন্তকন্যাকে আমি ধ্বংস করব। রাখালেরা যেমন ভেড়ার পাল নিয়ে আসে তেমনি করে বাদশাহ্‌রা তাদের সৈন্যদল নিয়ে তার বিরুদ্ধে আসবে; তার চারপাশে তারা তাম্বু খাটাবে এবং যে যার জায়গায় থাকবে। তারা বলবে, ‘তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। ওঠো, চল, আমরা দুপুর বেলায় আক্রমণ করি। কিন্তু হায়, দিনের আলো কমে যাচ্ছে, আর সন্ধ্যার ছায়া লম্বা হচ্ছে। কাজেই ওঠো, চল, আমরা রাতেই আক্রমণ করি এবং তার কেল্লাগুলো ধ্বংস করে দিই।’ ” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের এই কথা বলছেন, “তোমরা গাছপালা কেটে তা দিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে তার দেয়ালের সংগে ঢিবি তৈরী কর। এই শহরকে শাস্তি দিতে হবে; এটা অত্যাচারে ভরে গেছে। কূয়ার পানি যেমন সব সময় তাজা থাকে তেমনি করে সে তার দুষ্টতা সব সময় চালু রাখে। তার মধ্যে জুলুম ও ধ্বংসের শব্দ শোনা যায়; তার অসুস্থতা ও আঘাত সব সময় আমার সামনে রয়েছে। হে জেরুজালেম, সাবধানবাণী শোন, তা না হলে আমি তোমার কাছ থেকে ফিরে গিয়ে তোমার দেশ ধ্বংস ও জনশূন্য করব।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “আংগুর ক্ষেত থেকে যেমন ভাল করে আংগুর ঝেড়ে ফেলা হয় তেমনি শত্রুরা দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের ঝেড়ে ফেলবে। যে লোক আংগুর তোলে সে যেমন আবার ডালে হাত দেয় তারাও বাকী লোকদের প্রতি তেমনি করবে।” আমি কার সংগে কথা বলব ও কাকে সাবধান করব যাতে তারা আমার কথা শোনে? তাদের কান বন্ধ তাই তারা শুনতে পায় না। মাবুদের কালাম তাদের টিট্‌কারির বিষয় হয়েছে; তারা তাতে কোন আনন্দ পায় না। কিন্তু আমি মাবুদের রাগে পূর্ণ হয়েছি; আমি আর তা আমার ভিতরে ধরে রাখতে পারছি না। মাবুদ জবাবে বলছেন, “তুমি তা রাস্তায় ছেলেমেয়েদের উপরে ও একসংগে জমায়েত হওয়া যুবকদের উপরে ঢেলে দাও। স্বামী ও স্ত্রী তার মধ্যে ধরা পড়বে, আর বুড়োরা ও খুব বুড়োরা রেহাই পাবে না। যারা দেশে বাস করে তাদের বিরুদ্ধে যখন আমি শাস্তির হাত বাড়িয়ে দেব তখন অন্যদের হাতে তাদের বাড়ী-ঘর, জমাজমি ও স্ত্রীদের তুলে দেওয়া হবে। “ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই লাভের জন্য লোভ করে; এমন কি, নবী ও ইমাম সবাই ছলনা করে। তারা আমার বান্দাদের ঘা এমনভাবে বেঁধে দেয় যেন তা বিশেষ কিছু নয়। তারা বলে, ‘শান্তি, শান্তি,’ কিন্তু আসলে শান্তি নেই। তারা কি তাদের সেই জঘন্য কাজের জন্য লজ্জিত? না, তাদের কোন লজ্জা নেই; তারা লজ্জায় লাল হতে জানেই না। সেইজন্য তারা তাদের মধ্যে পড়বে যারা শাস্তি ভোগ করবে। আমি যখন তাদের শাস্তি দেব তখন তাদের নত করা হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ তাঁর বান্দাদের বলছেন, “তোমরা রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখে পুরানো পথের কথা জিজ্ঞাসা কর; ভাল পথ কোথায় তা জিজ্ঞাসা করে সেই পথে চল। তাতে তোমরা নিজের নিজের দিলে বিশ্রাম পাবে। কিন্তু তোমরা বলেছ, ‘আমরা সেই পথে চলব না।’ আমি তোমাদের উপরে পাহারাদার নিযুক্ত করে বলেছি, ‘তোমরা শিংগার আওয়াজ শোন,’ কিন্তু তোমরা বলেছ, ‘আমরা শুনব না।’ কাজেই হে অন্যান্য জাতিরা, শোন; আমার বান্দাদের যা হবে তা লক্ষ্য কর। হে দুনিয়া শোন, আমি লোকদের উপর বিপদ ডেকে আনব; তা হবে তাদের পরিকল্পনার ফল, কারণ তারা আমার কথা শোনে নি আর আমার শরীয়তকে অগ্রাহ্য করেছে। হে আমার বান্দারা, সাবা দেশ থেকে যে ধূপ আসে কিংবা দূর দেশ থেকে যে মিষ্টি বচ আসে তাতে আমার কি দরকার? তোমাদের পোড়ানো-কোরবানী আমার গ্রহণযোগ্য নয়; তোমাদের পশু-কোরবানী আমাকে সন্তুষ্ট করে না।” কাজেই মাবুদ বলছেন, “এই লোকদের সামনে আমি নানা বাধা রাখব। পিতা ও ছেলেরা একসংগে তাতে উচোট খাবে; প্রতিবেশীরা ও বন্ধুরা ধ্বংস হয়ে যাবে।” মাবুদ এই কথা বলছেন, “দেখ, উত্তর দিকের দেশ থেকে একদল সৈন্য আসছে; দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে একটা বড় জাতি উত্তেজিত হয়ে আসছে। তাদের কাছে ধনুক ও বর্শা আছে; তারা নিষ্ঠুর এবং কোন দয়া দেখায় না। ঘোড়ায় চড়ে আসবার সময় তাদের আওয়াজ উঠছে সমুদ্রের গর্জনের মত; হে সিয়োন্তকন্যা, তোমাকে আক্রমণ করবার জন্য তারা যোদ্ধার মত প্রস্তুত হয়ে আসছে।” আমরা তাদের সম্বন্ধে খবর পেয়েছি আর তাই আমাদের হাত যেন অবশ হয়ে ঝুলে পড়েছে। যন্ত্রণা আমাদের আঁকড়ে ধরেছে; প্রসবকারিণী স্ত্রীলোকদের মত ব্যথা আমাদের ধরেছে। তোমরা মাঠে যেয়ো না কিংবা রাস্তায় হেঁটো না, কারণ শত্রুর হাতে তলোয়ার আছে আর সব দিকেই রয়েছে ভীষণ ভয়। হে আমার লোকেরা, ছালার চট পর আর ছাইয়ের মধ্যে গড়াগড়ি দাও। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে যেমন লোকে শোক করে তেমনি ভীষণ বিলাপ করে তোমরা শোক কর, কারণ ধ্বংসকারী হঠাৎ আমাদের উপরে এসে পড়বে। মাবুদ বলছেন, “আমি তোমাকে আমার বান্দাদের যাচাইকারী করেছি যাতে তুমি তাদের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের পথগুলো যাচাই করতে পার। তারা সবাই দারুণ বিদ্র্রোহী; তারা বদনাম করে বেড়ায়। তারা ব্রোঞ্জ আর লোহার মত; তারা সবাই খারাপ হয়ে গেছে। আগুন দিয়ে সীসা পুড়িয়ে ফেলবার জন্য হাপর ভীষণভাবে বাতাস দিচ্ছে; কিন্তু অনর্থক খাদ বের করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, কারণ দুষ্টদের বের করা যাচ্ছে না। তাদের বলা হয় অগ্রাহ্য করা রূপা, কারণ আমি মাবুদ তাদের অগ্রাহ্য করেছি।” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তোমরা যদি তোমাদের আচার-ব্যবহার ও কাজকর্ম সংশোধন কর তাহলে আমি তোমাদের এই জায়গায় বাস করতে দেব। মাবুদের ঘরের নাম নিয়ে বার বার যে মিথ্যা কথা বলা হয় তোমরা তা বিশ্বাস কোরো না। যদি সত্যিসত্যিই তোমরা তোমাদের আচার-ব্যবহার ও কাজকর্মের পরিবর্তন কর এবং ন্যায়ভাবে একে অন্যের সংগে ব্যবহার কর, যদি বিদেশী, এতিম কিংবা বিধবাদের জুলুম না কর এবং এই দেশে নির্দোষের রক্তপাত না কর আর দেব-দেবীদের পিছনে গিয়ে নিজেদের ক্ষতি না কর, তবে এই যে দেশ আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের যুগ যুগ ধরে বাস করবার জন্য দিয়েছি এখানে আমি তোমাদের বাস করতে দেব। “দেখ, তোমরা মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করছ, কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই। তোমরা তো চুরি, খুন, জেনা ও মিথ্যা কসম খাও আর বাল দেবতাদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাও। এছাড়া যে দেব-দেবীদের তোমরা চেন না তোমরা তাদের পিছনে গিয়ে থাক। তারপর এসে তোমরা আমার ঘরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বল যে, তোমরা নিরাপদ। তোমরা তা কর যাতে তোমরা ঐ সব জঘন্য কাজ করে যেতে পার। আমার ঘর কি তোমাদের কাছে ডাকাতদের আড্ডাখানা হয়েছে? আমি মাবুদ বলছি যে, আমি এই সব দেখছি। “এখন তোমরা শীলোতে যেখানে আমি প্রথমে আমার বাসস্থান করেছিলাম সেখানে যাও আর আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের দুষ্টতার জন্য আমি তার অবস্থা কি করেছি তা দেখ। তোমরা এই সব গুনাহ্‌ করেছ, অর্থাৎ আমি তোমাদের বার বার বললেও তোমরা শোন নি আর তোমাদের ডাকলেও জবাব দাও নি। এই যে ঘরের উপর তোমরা ভরসা করছ সেই ঘর আমি আমার বাসস্থান করেছিলাম, আর এই জায়গা আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের গুনাহের জন্য এই ঘর ও এই জায়গার অবস্থা আমি সেই রকম করব যা আমি শীলোর প্রতি করেছিলাম। আমি তোমাদের ভাইদের প্রতি, অর্থাৎ আফরাহীমের লোকদের প্রতি যেমন করেছিলাম সেইভাবে আমার সামনে থেকে তোমাদের ঠেলে ফেলে দেব।” মাবুদ বলছেন, “এই লোকদের জন্য তুমি কোন মুনাজাত কোরো না, কিংবা তাদের জন্য ফরিয়াদ বা কোন বিশেষ অনুরোধ কোরো না; আমার কাছে কোন মিনতিও জানাবে না, কারণ আমি তোমার কথা শুনব না। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না তারা এহুদার শহরগুলোতে ও জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় কি করছে? ছেলেমেয়েরা কাঠ কুড়ায়, বাবারা আগুন জ্বালে আর স্ত্রীলোকেরা ময়দা মাখে ও আকাশ-রাণীর উদ্দেশে পিঠা বানায়। আমাকে দুঃখ দেবার জন্য তারা দেব-দেবীদের উদ্দেশে ঢালন-কোরবানী করে। কিন্তু এই সব করে কি তারা আমাকে দুঃখ দিচ্ছে? আসলে তারা তো নিজেদের উপর লজ্জা ডেকে আনছে আর নিজেদের দুঃখ দিচ্ছে।” সেইজন্য আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “আমার রাগ ও গজব এই জায়গার উপরে, মানুষ ও পশুর উপরে, মাঠের গাছপালা ও ভূমির ফলের উপরে ঢালা হবে, আর সেই রাগ জ্বলতেই থাকবে, নিভে যাবে না।” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তোমাদের অন্যান্য কোরবানীর সংগে তোমরা পোড়ানো-কোরবানী দিয়ে তার গোশ্‌তও খেয়ে ফেল না কেন? আমি এই কথা বলছি, কারণ যখন আমি মিসর থেকে তোমাদের পূর্বপুরুষদের বের করে এনেছিলাম তখন আমি পোড়ানো ও অন্যান্য কোরবানীর কথা বলি নি কিংবা হুকুম দিই নি, কিন্তু আমি তাদের এই হুকুম দিয়েছিলাম, ‘তোমরা আমার কথামত চল, তাতে আমি তোমাদের আল্লাহ্‌ হব আর তোমরা আমার বান্দা হবে। আমি যে সব পথে চলবার হুকুম দিয়েছি সেই সব পথে চল যাতে তোমাদের উপকার হয়।’ কিন্তু তা তারা শোনে নি এবং তাতে মনোযোগও দেয় নি; তার বদলে তারা তাদের ইচ্ছামত, তাদের খারাপ দিলের একগুঁয়েমিতে চলেছে। তারা পিছু হটেছে, এগিয়ে যায় নি। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন মিসর ছেড়ে এসেছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত দিনের পর দিন আমি তোমাদের কাছে আমার সমস্ত গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের পাঠিয়ে আসছি। কিন্তু তোমরা আমার কথা শোন নি কিংবা মনোযোগও দাও নি। তোমরা ঘাড় শক্ত করে তোমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়েও আরও বেশী খারাপ কাজ করেছ। “তুমি যখন এই সব কথা তাদের বলবে তারা তোমার কথা শুনবে না; তুমি যখন তাদের ডাকবে তারা জবাব দেবে না। কাজেই তুমি তাদের বলবে, ‘তোমরা সেই জাতি, যে তার মাবুদ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলে নি কিংবা তাঁর সংশোধনে সাড়া দেয় নি। সত্য ধ্বংস হয়ে গেছে; কেউ সেই বিষয় মুখেও আনে না।’ ” হে জেরুজালেম, তোমার চুল কেটে তুমি দূরে ফেলে দাও; গাছপালাহীন পাহাড়ে পাহাড়ে বিলাপ কর, কারণ মাবুদ তাঁর গজবের নীচে থাকা এই লোকদের তিনি অগ্রাহ্য ও ত্যাগ করেছেন। মাবুদ বলছেন, “আমার চোখে এহুদার লোকেরা খারাপ কাজ করেছে। আমার ঘরে তারা তাদের জঘন্য মূর্তিগুলো স্থাপন করে তা নাপাক করেছে। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের আগুনে পোড়াবার জন্য বিন্তহিন্নোম উপত্যকায় তোফৎ নামে পূজার উঁচু স্থান তৈরী করেছে। কিন্তু এই হুকুম আমি দিই নি, আমার মনেও তা ঢোকে নি। কাজেই দেখ, এমন দিন আসছে যখন লোকেরা ঐ জায়গাকে আর বলবে না তোফৎ কিংবা বিন্তহিন্নোমের উপত্যকা, বরং বলবে জবাইয়ের উপত্যকা, কারণ যতদিন তোফতে জায়গা থাকবে ততদিন সেখানেই তারা মৃতদের দাফন করবে। তারপর এই লোকদের লাশ আকাশের পাখী ও দুনিয়ার পশুদের খাবার হবে আর সেগুলোকে তাড়িয়ে দেবার জন্য কেউ থাকবে না। আমি এহুদার শহরগুলোতে ও এহুদার সমস্ত পথে আনন্দ ও আমোদের শব্দ আর বর ও কনের গলার আওয়াজ বন্ধ করে দেব, কারণ দেশটা ধ্বংসস্থান হয়ে যাবে।” মাবুদ বলছেন, “সেই সময়ে এহুদার বাদশাহ্‌ ও উঁচু পদের কর্মচারীদের হাড়, ইমাম ও নবীদের হাড় এবং জেরুজালেমের লোকদের হাড় তাদের কবর থেকে তুলে ফেলা হবে। সেই হাড়গুলো সূর্য, চাঁদ ও আসমানের সব তারার সামনে পড়ে থাকবে, কারণ তারা আসমানের সেই সবগুলোকে ভালবাসত ও এবাদত করত এবং সেগুলোর পিছনে যেত আর তাদের সংগে পরামর্শ করত ও তাদের পূজা করত। সেই হাড়গুলোকে জড়ো করে দাফন করা হবে না, বরং সেগুলো গোবরের মত মাটিতে পড়ে থাকবে। যেখানে আমি তাদের দূর করে দেব সেখানে এই দুষ্ট জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা জীবনের চেয়ে মরণকেই পছন্দ করবে। এই কথা আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি।” মাবুদ আমাকে এই কথা বলতে বললেন, “লোকে পড়ে গেলে কি আর ওঠে না? বিপথে গেলে কি ফিরে আসে না? তবে কেন জেরুজালেমের এই লোকেরা বিপথে গিয়ে আর ফিরে আসে না? তারা ছলনাকে আঁকড়ে ধরে রাখে; তারা ফিরে আসতে অস্বীকার করে। আমি মন দিয়ে শুনেছি যে, তারা ঠিক কথা বলে না। দুষ্টতার জন্য তওবা করে কেউ বলে না, ‘হায়, আমি কি করলাম!’ ঘোড়া যেমন দৌড়ে যুদ্ধে যায় সেই রকম ভাবে প্রত্যেকে নিজের নিজের পথে চলে। সারস পাখীও নিজের সময় জানে, আর ঘুঘু, চাতক ও শালিক পাখীও তাদের চলে যাবার সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখে, কিন্তু আমার লোকেরা আমার শরীয়তের দিকে মনোযোগ দেয় না। “তোমরা কেমন করে বল, ‘আমরা জ্ঞানী এবং মাবুদের শরীয়ত আমাদের কাছে আছে।’ আসলে আলেমেরা শরীয়ত ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে মিথ্যা কথা লিখেছে। জ্ঞানী লোকেরা লজ্জিত ও হতভম্ব হয় আর ফাঁদে ধরা পড়ে। তারা যখন মাবুদের কালাম অগ্রাহ্য করেছে তখন তাদের কি রকমের জ্ঞান আছে? সেইজন্য তাদের স্ত্রীদের আমি অন্য লোকদের এবং তাদের ক্ষেত নতুন মালিকদের দিয়ে দেব। ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই লাভের জন্য লোভ করে; এমন কি, নবী ও ইমাম সবাই ছলনা করে। তারা আমার বান্দাদের আঘাত এমনভাবে বেঁধে দেয় যেন তা বিশেষ কিছু নয়। তারা বলে ‘শান্তি, শান্তি,’ কিন্তু আসলে শান্তি নেই। তারা কি তাদের সেই জঘন্য কাজের জন্য লজ্জিত? না, তাদের কোন লজ্জা নেই; তারা লজ্জায় লাল হতে জানেই না। সেইজন্য তারা তাদের মধ্যে পড়বে যারা শাস্তি ভোগ করবে। আমি যখন তাদের শাস্তি দেব তখন তাদের নত করা হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “তাদের আমি শেষ করে দেব। আংগুর লতায় কোন আংগুর থাকবে না, ডুমুর গাছে ডুমুর থাকবে না এবং সেগুলোর পাতা শুকিয়ে যাবে। আমি তাদের যা দিয়েছি তা আর থাকবে না।” আমরা এখানে বসে আছি কেন? চল, আমরা একসংগে দেয়াল-ঘেরা শহরগুলোতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে ধ্বংস হই, কারণ আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য ধ্বংসই ঠিক করে রেখেছেন এবং বিষাক্ত পানি খেতে দিয়েছেন, কারণ আমরা তাঁর বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। আমরা শান্তির আশা করেছিলাম কিন্তু কোন উপকার হল না; আমরা সুস্থ হবার আশা করেছিলাম কিন্তু ভীষণ ভয় উপস্থিত হল। দান শহর থেকে শত্রুদের ঘোড়ার নাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে; তাদের ঘোড়াগুলোর ডাকে গোটা দেশটা কাঁপছে। দেশ ও তার মধ্যেকার সব কিছু এবং শহর ও শহরবাসীদের তারা গ্রাস করতে আসছে। মাবুদ বলছেন, “দেখ, আমি তোমাদের মধ্যে বিষাক্ত সাপ পাঠিয়ে দেব; সেই কালসাপ কোন মন্ত্রতন্ত্র মানবে না, সেগুলো তোমাদের কামড়াবেই।” আমার দুঃখ এত বেশী যে, তার সান্ত্বনা নেই; আমার মধ্যে আমার দিল ভীষণ দুঃখ পাচ্ছে। দূর দেশ থেকে আমার লোকদের এই ফরিয়াদ শোনা যাচ্ছে, “মাবুদ কি সিয়োনে নেই? তার বাদশাহ্‌ কি আর সেখানে নেই?” জবাবে মাবুদ বলছেন, “তারা তাদের সব মূর্তি ও তাদের অপদার্থ প্রতিমাগুলো দিয়ে কেন আমাকে বিরক্ত করে তুলেছে?” আমার লোকেরা বলছে, “ফসল কাটবার সময় চলে গেল, গরম কালও শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমরা তো উদ্ধার পেলাম না।” আমার লোকেরা ভেংগে পড়েছে বলে আমিও ভেংগে পড়েছি; আমি শোক করছি আর ভীষণ ভয় আমাকে ধরেছে। গিলিয়দে কি কোন মলম নেই? সেখানে কি কোন ডাক্তার নেই? তাহলে আমার লোকদের স্বাস্থ্য কেন ভাল হয় নি? হায়, আমার মাথাটা যদি পানির ঝর্ণা হত, আর আমার চোখ হত পানির ফোয়ারা! তাহলে আমার জাতির যে লোকদের হত্যা করা হয়েছে তাদের জন্য আমি দিনরাত কাঁদতাম। হায়, মরুভূমিতে যাত্রীদের থাকবার জায়গার মত আমার যদি একটা জায়গা থাকত! তাহলে আমার লোকদের ছেড়ে আমি সেখানে চলে যেতে পারতাম, কারণ তারা সবাই জেনাকারী এবং বেঈমানদের দল। মাবুদ বলছেন, “তারা মিথ্যার তীর ছুঁড়বার জন্য তাদের ধনুকের মত জিভ্‌কে প্রস্তুত রেখেছে; দেশে সত্যের উপরে মিথ্যা জয়লাভ করে। তারা গুনাহের উপরে গুনাহ্‌ করতে থাকে। তারা আমাকে তাদের আল্লাহ্‌ বলে স্বীকার করে না। তারা প্রত্যেকে বন্ধুদের থেকে সাবধান হোক আর নিজের ভাইদের বিশ্বাস না করুক, কারণ প্রত্যেক ভাই ঠকায় আর প্রত্যেক বন্ধু নিন্দা করে। বন্ধু বন্ধুকে ঠকায় আর কেউ সত্যি কথা বলে না। তারা তাদের জিভ্‌কে মিথ্যা কথা বলতে শিখিয়েছে; গুনাহ্‌ করে করে তারা নিজেদের ক্লান্ত করেছে। তুমি ছলনার মাঝখানে বাস করছ। তোমার লোকেরা ছলনায় পূর্ণ; তারা আমার কাছে নিজেদের সঁপে দেয় না।” কাজেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “দেখ, আমি তাদের খাদ বের করে যাচাই করব, কারণ আমার বান্দাদের নিয়ে আমি আর কি করতে পারি? তাদের জিভ্‌ ভয়ংকর তীরের মত; তা ছলনার কথা বলে। প্র্রত্যেকে মুখ দিয়ে প্রতিবেশীর সংগে মিষ্টি কথা বলে কিন্তু দিলের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতে। আমি কি এর জন্য তাদের শাস্তি দেব না? এই রকম জাতির উপর কি আমি নিজেই প্রতিশোধ নেব না?” পাহাড়গুলোর জন্য আমি কাঁদব ও বিলাপ করব আর বিলাপ করব মরুভূমির পশু চরাবার জায়গাগুলোর জন্য। সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে কেউ আসা-যাওয়া করে না। পশুপালের ডাক আর শোনা যায় না। আকাশের পাখীরা পালিয়ে গেছে আর জীবজন্তুরা চলে গেছে। মাবুদ বলছেন, “আমি জেরুজালেমকে একটা ধ্বংসের ঢিবি ও শিয়ালদের বাসস্থান করব। আমি এহুদার শহরগুলোকে এমন ধ্বংসস্থান করব যে, তাতে আর কেউ বাস করতে পারবে না।” কোন্‌ লোক এমন জ্ঞানী যে, এই কথা বুঝতে পারে? কে মাবুদের কাছে শুনে তা অন্যদের জানাতে পারে? কেন দেশটা ধ্বংস হয়ে মরুভূমির মত এমন পোড়ো জমি হয়ে রয়েছে যে, কেউ তা পার হয়ে যায় না? মাবুদ বলছেন, “তার কারণ হল, আমি যে শরীয়ত তাদের দিয়েছিলাম তা তারা ত্যাগ করেছে; তারা আমার বাধ্য হয় নি কিংবা আমার কথাও মেনে চলে নি। তার বদলে তারা তাদের দিলের একগুঁয়েমি অনুসারে চলেছে; তাদের পিতাদের শিক্ষামত তারা বাল দেবতার পিছনে চলেছে। সেইজন্য আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি, ‘দেখ, আমি এই লোকদের তেতো খাবার ও বিষাক্ত পানি খেতে বাধ্য করব। আমি তাদের এমন সব জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেব যাদের তারা জানে না কিংবা তাদের পূর্বপুরুষেরাও জানত না। তাদের ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমি যুদ্ধ পাঠিয়ে তাদের পিছনে তাড়া করব।’ ” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তোমরা এখন ভেবে দেখ। বিলাপকারী স্ত্রীলোকদের ডেকে আন; যারা এই কাজে পাকা তাদের ডাকতে লোক পাঠাও।” তারা তাড়াতাড়ি এসে আমাদের জন্য বিলাপ করুক যে পর্যন্ত না আমাদের চোখ পানিতে ভেসে যায় আর চোখের পাতার কাছ থেকে পানির ধারা বয়ে যায়। সিয়োন থেকে এই বিলাপের কথা শোনা যাচ্ছে, “আমরা কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেলাম! কিভাবে এতখানি লজ্জিত হলাম! আমাদের বাড়ীগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, কাজেই আমাদের দেশ ছেড়ে যেতে হবে।” এখন হে স্ত্রীলোকেরা, মাবুদের কালাম শোন; তাঁর মুখের কথা শুনবার জন্য তোমাদের কান খোলা রাখ। কেমন করে বিলাপ করতে হয় তা নিজের নিজের মেয়েদের শিক্ষা দাও, আর বিলাপের গজল গাইতে অন্যদের শিক্ষা দাও। মৃত্যু আমাদের জানালা দিয়ে উঠে আমাদের কেল্লাগুলোর মধ্যে ঢুকেছে; তা রাস্তায় রাস্তায় ছেলেমেয়েদের শেষ করে দিয়েছে আর শহর-চক থেকে শেষ করে দিয়েছে যুবকদের। মাবুদ আমাকে এই কথা বলতে বললেন, “লোকদের লাশ গোবরের মত খোলা মাঠে পড়ে থাকবে; যারা ফসল কাটে তাদের পিছনে কেটে ফেলে রাখা শস্যের মত সেগুলো পড়ে থাকবে, কেউ তাদের জড়ো করবে না।” মাবুদ বলছেন, “জ্ঞানী লোকেরা তাদের জ্ঞানের গর্ব না করুক, কিংবা শক্তিশালীরা তাদের শক্তির গর্ব না করুক কিংবা ধনীরা তাদের ধনের গর্ব না করুক, কিন্তু যে গর্ব করতে চায় সে এই নিয়ে গর্ব করুক যে, সে আমাকে বোঝে ও জানে, অর্থাৎ সে জানে যে, আমিই মাবুদ; আমার মহব্বত অটল আর দুনিয়াতে আমার কাজ ন্যায়ে ও সততায় পূর্ণ। এই সমস্ত বিষয়েই আমি আনন্দ পাই। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” হে ইসরাইল জাতি, মাবুদ তোমাদের যে কথা বলছেন তা শোন। মাবুদ বলছেন, “তোমরা ভিন্ন জাতিদের আচার-ব্যবহার শিখো না, কিংবা আসমানের নানা চিহ্ন দেখে ভেংগে পোড়ো না, যদিও ভিন্ন জাতিরাই সেগুলো দেখে ভেংগে পড়ে। এর কারণ সেই লোকদের ধর্মীয় আচার-ব্যবহার অসার। তারা বন থেকে একটা গাছ কাটে এবং কারিগর বাটালি দিয়ে তার আকার দেয়। তারা সোনা ও রূপা দিয়ে সেটা সাজায় এবং যাতে সেটা পড়ে না যায় সেইজন্য সেটাকে হাতুড়ি ও পেরেক দিয়ে শক্ত করে। শসার ক্ষেতের কাকতাড়ুয়ার মত তাদের মূর্তিগুলো কথা বলতে পারে না; তাদের বহন করে নিয়ে যেতে হয়, কারণ তারা হাঁটতে পারে না। তোমরা তাদের ভয় কোরো না; তারা ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না।” হে মাবুদ, তোমার মত আর কেউ নেই; তুমি মহান, তুমি ক্ষমতায় শক্তিশালী। হে জাতিদের বাদশাহ্‌, তোমাকে কে না ভয় করবে? এ তো তোমার পাওনা। জাতিদের সব জ্ঞানী লোকদের মধ্যে এবং তাদের সব রাজ্যের মধ্যে কেউ তোমার মত নয়। তারা সবাই জ্ঞানহীন ও বোকা। তাদের মূর্তিগুলো তো কাঠের তৈরী, সেগুলো কি করে শিক্ষা দেবে? সেপন থেকে পিটানো রূপা ও ঊফস থেকে সোনা আনা হয়। কারিগর ও স্বর্ণকার তা দিয়ে মূর্তি মোড়ায়। সেগুলোকে নীল ও বেগুনে কাপড় পরানো হয়; তা পাকা কারিগরের হাতে তৈরী। কিন্তু মাবুদই সত্যিকারের আল্লাহ্‌; তিনি জীবন্ত আল্লাহ্‌ ও চিরস্থায়ী বাদশাহ্‌। তাঁর রাগে দুনিয়া কাঁপে; জাতিরা তাঁর রাগ সহ্য করতে পারে না। তোমরা লোকদের বল যে, এই দেব-দেবী আসমান ও জমীন তৈরী করে নি; তারা আসমান ও জমীনের সব জায়গা থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ নিজের শক্তিতে দুনিয়া তৈরী করেছেন, তাঁর জ্ঞান দ্বারা জমীন স্থাপন করেছেন ও বুদ্ধি দ্বারা আসমান বিছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর হুকুমে আসমানের পানি গর্জন করে; তিনি দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে মেঘ উঠিয়ে আনেন। তিনি বৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ তৈরী করেন এবং তাঁর ভাণ্ডার থেকে বাতাস বের করে আনেন। সব মানুষই জ্ঞানহীন ও বোকা; প্রত্যেক স্বর্ণকার তার মূর্তিগুলোর জন্য লজ্জা পায়। তার ছাঁচে ঢালা মূর্তিগুলো মিথ্যা, সেগুলোর মধ্যে নিঃশ্বাস নেই। সেগুলো অপদার্থ, ঠাট্টা-বিদ্রূপের জিনিস; বিচারের সময় আসলে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যিনি ইয়াকুবের পাওনা অংশ তিনি এগুলোর মত নন, কারণ তিনিই সমস্ত জিনিসের সৃষ্টিকর্তা আর ইসরাইল তাঁর বিশেষ সম্পত্তি। তাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। তোমরা যারা ঘেরাও হয়ে আছ, তোমরা দেশ ছেড়ে যাবার জন্য নিজের নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, কারণ মাবুদ বলছেন, “এই সময় যারা দেশে থাকবে আমি তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেব; আমি তাদের উপর এমন কষ্ট আনব যাতে তারা ধরা পড়ে।” হায়, আমার আঘাত! আমার আঘাত ভাল হবার নয়! তবু আমি নিজেকে বলেছি, “এটা আমার রোগ, আমাকে তা সহ্য করতেই হবে।” আমার তাম্বু ধ্বংস হয়েছে; তার সমস্ত দড়াদড়ি ছিঁড়ে গেছে। আমার ছেলেরা আমার কাছ থেকে চলে গেছে, তারা আর নেই; আমার তাম্বু আবার খাটাবার কিংবা তার পর্দা টাংগাবার জন্য এখন আর কেউ নেই। রাখালেরা জ্ঞানহীন, তারা মাবুদের ইচ্ছা জানতে চায় না; তাই তারা সফল হয় নি এবং তাদের সমস্ত পশুপাল ছড়িয়ে এদিক-সেদিক চলে গেছে। শোন, খবর আসছে! এহুদার শহরগুলো জনশূন্য ও শিয়ালদের বাসস্থান করবার জন্য উত্তরের দেশ থেকে ভীষণ গোলমালের আওয়াজ আসছে। হে মাবুদ, আমি জানি মানুষের জীবন্তপথ তার নিজের নয়; তার পায়ের ধাপ নির্দেশ করাও তার কাজ নয়। হে মাবুদ, কেবল ন্যায়বিচার দিয়ে তুমি আমাকে সংশোধন কর, কিন্তু তোমার রাগে তা কোরো না, করলে তুমি আমাকে একেবারে শূন্য করে দেবে। যে সব জাতি তোমাকে স্বীকার করে না, যারা তোমাকে ডাকে না, তাদের উপর তোমার গজব ঢেলে দাও। তারা ইয়াকুবকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছে, তার দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যখন আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের মিসর থেকে, লোহা গলানো চুলা থেকে বের করে এনেছিলাম তখন আমি এই বলে তাদের হুকুম দিয়েছিলাম, ‘তোমরা আমার কথা শোন এবং আমি যা করতে হুকুম দিয়েছি তা কর, তাহলে তোমরা আমার বান্দা হবে ও আমি তোমাদের আল্লাহ্‌ হব। আমি তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে এমন দেশ দেবার কসম খেয়েছিলাম যেখানে দুধ, মধু ও কোন কিছুর অভাব নেই, আর সেই কসম আমি পূরণ করব।’ সেই দেশই আজ তোমরা অধিকার করে আছ।” জবাবে আমি বললাম, “আমিন, মাবুদ।” মাবুদ আমাকে এহুদার শহরগুলোতে ও জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় এই কথা ঘোষণা করতে বললেন, “এই ব্যবস্থার কথাগুলো শুনে তা পালন কর। তোমাদের পূর্বপুরুষদের যখন আমি মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলাম তখন থেকে আজ পর্যন্ত বার বার তাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছিলাম, ‘তোমরা আমার কথামত চল।’ কিন্তু তারা তা শোনে নি বা তাতে মনোযোগও দেয় নি; তার বদলে তারা তাদের একগুঁয়ে খারাপ দিলের ইচ্ছামত চলেছে। কাজেই যে ব্যবস্থা আমি তাদের পালন করতে বলেছিলাম তারা তা পালন করে নি বলে সেই ব্যবস্থার কথা অনুসারে আমি তাদের শাস্তি দিয়েছি।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “এহুদার ও জেরুজালেমের লোকদের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। তারা তাদের সেই পূর্বপুরুষদের গুনাহের দিকে ফিরে গেছে যারা আমার কথা শুনতে অস্বীকার করেছিল। তারা দেব-দেবীদের এবাদত করবার জন্য তাদের পিছনে গেছে। তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম তা ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা পালন করে নি। কাজেই আমি মাবুদ বলছি যে, আমি তাদের উপর এমন বিপদ আনব যা থেকে তারা পালাতে পারবে না। যদিও তারা আমার কাছে কাঁদবে তবুও আমি তাদের কথা শুনব না। যখন বিপদ আসবে তখন এহুদার শহরগুলোর ও জেরুজালেমের লোকেরা গিয়ে সেই দেব-দেবীর কাছে কান্নাকাটি করবে যাদের সামনে তারা ধূপ জ্বালিয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের রক্ষা করবে না। এহুদার যতগুলো শহর ও গ্রাম আছে ততগুলো দেব-দেবীও আছে, আর জেরুজালেমের যতগুলো রাস্তা আছে সেই লজ্জাজনক বাল দেবতার উদ্দেশে ধূপ জ্বালাবার জন্য ততগুলো বেদীও তৈরী করা হয়েছে। “এই লোকদের জন্য তুমি কোন মুনাজাত কোরো না কিংবা তাদের জন্য কোন মিনতি বা অনুরোধ কোরো না, কারণ তাদের কষ্টের সময় তারা আমাকে ডাকলে আমি শুনব না। “আমার ঘরে আমার প্রিয় বান্দাদের কি অধিকার আছে? তারা তো অনেক খারাপ কাজ করেছে, এমন কি, তারা আমার উদ্দেশে কোরবানী দেওয়া গোশ্‌ত তাদের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলে। হে অন্যায়কারীরা, যখন বিপদ তোমাদের উপর আসবে তখনও কি তোমরা আনন্দ করতে থাকবে?” মাবুদ এই জাতিকে ফলে ভরা সুন্দর একটা জলপাই গাছ বলে ডেকেছিলেন। কিন্তু ভীষণ ঝড়ের গর্জনে তিনি তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন আর তাতে তার ডালগুলো ভেংগে পড়বে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, যিনি তাকে লাগিয়েছিলেন তিনিই তার সর্বনাশের রায় দিয়েছেন, কারণ এহুদা ও ইসরাইলের লোকেরা খারাপ কাজ করেছে এবং বাল দেবতার উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়ে তাঁর রাগকে খুঁচিয়ে তুলেছে। অনাথোতের লোকদের ষড়যন্ত্রের কথা মাবুদ আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন বলে আমি তা জানতে পেরেছিলাম। আমি ছিলাম জবাই করতে নিয়ে যাওয়া শান্ত ভেড়ার বাচ্চার মত; আমি বুঝতে পারি নি যে, তারা এই বলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, “এস, আমরা গাছ ও তার ফল নষ্ট করে ফেলি; এস, আমরা তাকে জীবিতদের দেশ থেকে কেটে ফেলে দিই যাতে তার নাম আর মনে করা না হয়।” হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি ন্যায়ভাবে বিচার করে থাক আর দিল ও মনের পরীক্ষা করে থাক, তাই তাদের উপর তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমাকে দেখতে দাও, কারণ আমি আমার নালিশ তোমাকেই জানিয়েছি। সেইজন্য অনাথোতের লোকদের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “যারা তোমার প্রাণ নিতে চাইছে আর বলছে, ‘মাবুদের নামে নবী হিসাবে কথা বোলো না, বললে তুমি আমাদের হাতে মারা পড়বে,’ আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমি তাদের শাস্তি দেব। তাদের যুবকেরা যুদ্ধে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা দুর্ভিক্ষে মারা যাবে। তাদের বাকী বলতে কেউ থাকবে না, কারণ অনাথোতের লোকদের শাস্তি দেবার সময়ে আমি তাদের উপর সর্বনাশ নিয়ে আসব।” হে মাবুদ, আমি যখন তোমার বিরুদ্ধে কোন নালিশ করি তখন তুমি যে নির্দোষ তা সব সময়ই প্রমাণিত হয়। তবুও আমি তোমার বিচার সম্বন্ধে তোমার সংগে কিছু কথা বলব। দুষ্টদের পথ কেন ভাল হয়? যারা বেঈমানী করে তারা কেন আরামে বাস করে? তুমিই তাদের লাগিয়েছ আর তারা শিকড় বসিয়েছে; তারা বেড়ে ওঠে ও তাদের ফল ধরে। মুখে তারা সব সময় তোমার কথা বলে কিন্তু তাদের দিল তোমার কাছ থেকে দূরে থাকে। হে মাবুদ, তুমি আমাকে জান; তুমি আমাকে দেখে থাক এবং তোমার প্রতি আমার ভয় কতখানি তা পরীক্ষা করে থাক। ভেড়ার মত জবাই করবার জন্য তুমি তাদের টেনে নিয়ে যাও; জবাইয়ের দিনের জন্য তাদের আলাদা করে রাখ। আর কত দিন দেশ শোক করবে এবং মাঠের ঘাস শুকনা হয়ে থাকবে? যারা সেখানে বাস করে তারা মন্দ বলে জীব-জানোয়ার আর পাখীরা সব ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই লোকেরা বলছে, “আমাদের যা হবে তা সে দেখতে পাবে না।” “মানুষের সংগে দৌড় প্রতিযোগিতায় যদি তুমি ক্লান্ত হয়ে পড় তবে ঘোড়াদের সংগে দৌড়ে তুমি কি করে পারবে? কেবল শান্তিপূর্ণ দেশে যদি তুমি নিজেকে নিরাপদ মনে কর তাহলে জর্ডানের ধারের জংগলে তুমি কি করে থাকবে? তোমার ভাইয়েরা, অর্থাৎ তোমার বংশের নিজের লোকেরা তোমার প্রতি বেঈমানী করেছে; তারাও তোমার পিছনে লেগেছে। তোমার বিষয় ভাল কথা বললেও তাদের বিশ্বাস কোরো না। “আমি আমার বান্দাদের ছেড়ে দিয়েছি এবং আমার সম্পত্তি ইসরাইলকে ত্যাগ করেছি; আমি যাকে মহব্বত করি তাকে তার শত্রুদের হাতে তুলে দিয়েছি। আমার সম্পত্তি আমার কাছে বনের সিংহের মত হয়েছে। সে আমাকে দেখে গর্জন করেছে, তাই আমি তাকে ঘৃণা করি। আমার সম্পত্তি আমার কাছে অদ্ভূত রংয়ের শিকারী পাখীর মত হয়েছে, যাকে অন্যান্য শিকারী পাখীরা ঘেরাও করে আক্রমণ করছে। তুমি গিয়ে সমস্ত বুনো পশুদের জড়ো করে নিয়ে এস যেন তারা খেতে পারে। অনেক রাখাল আমার আংগুর ক্ষেত নষ্ট করেছে এবং তা পায়ে মাড়িয়েছে; আমার সুন্দর ক্ষেতকে তারা জনশূন্য পোড়ো জমি করে ফেলেছে। তা আমার সামনে জনশূন্য হয়ে শোক করছে। গোটা দেশটাই পোড়ো জমি হয়ে রয়েছে বলে কেউ তার দিকে মনোযোগ দেয় না। মরুভূমির গাছপালাহীন পাহাড়ের উপরে ধ্বংসকারীরা এসেছে, কারণ মাবুদের তলোয়ার দেশের এক কিনারা থেকে অন্য কিনারা পর্যন্ত গ্রাস করছে; কেউ শান্তিতে নেই। তারা বুনেছে গম কিন্তু কেটেছে কাঁটা; তারা কঠিন পরিশ্রম করেছে কিন্তু কিছুই পায় নি। মাবুদের জ্বলন্ত রাগের দরুন তোমরা তোমাদের ফসল কাটবার লজ্জা বহন করেছ।” মাবুদ বলছেন, “আমি অধিকার হিসাবে যে জায়গা আমার বান্দাদের দিয়েছি আমার সমস্ত দুষ্ট প্রতিবেশীরা তাতে হানা দিয়েছে। সেইজন্য আমি তাদের দেশ থেকে তাদের উপ্‌ড়ে ফেলব এবং তাদের মধ্য থেকে এহুদার লোকদের তুলে আনব। কিন্তু তাদের উপ্‌ড়ে ফেলবার পর আমি আবার মমতা করে তাদের প্রত্যেককে তার নিজের অধিকারে ও নিজের দেশে ফিরিয়ে আনব। যদিও তারা একদিন আমার বান্দাদের বাল দেবতার নামে কসম খেতে শিখিয়েছিল তবুও যদি তারা আমার বান্দাদের পথে চলে এবং ‘আল্লাহ্‌র কসম’ বলে আমার নামে কসম খায়, তবে তারা আমার বান্দাদের মধ্যে থেকে দোয়া পাবে। কিন্তু যদি কোন জাতি তা না করে তবে তাকে আমি সম্পূর্ণভাবে উপ্‌ড়ে ফেলে ধ্বংস করে দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি গিয়ে মসীনা সুতার একটা জাংগিয়া কিনে পর, কিন্তু সেটা পানিতে ডুবাবে না।” কাজেই মাবুদের নির্দেশমত আমি একটা জাংগিয়া কিনে পরলাম। তখন মাবুদ দ্বিতীয়বার আমাকে বললেন, “যে জাংগিয়া তুমি কিনে পরেছ সেটা নিয়ে এখনই তুমি ফোরাত নদীর কাছে গিয়ে পাথরের কোন ফাটলে লুকিয়ে রাখ।” সেইজন্য মাবুদের কথামত আমি গিয়ে ফোরাত নদীর কাছে সেটা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর অনেক দিন পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি এখনই ফোরাত নদীর কাছে যাও এবং সেখানে যে জাংগিয়াটা আমি তোমাকে লুকিয়ে রাখতে বলেছিলাম সেটা নিয়ে এস।” সেইজন্য আমি ফোরাত নদীর কাছে গিয়ে জাংগিয়াটা যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম সেখান থেকে সেটা খুঁড়ে বের করলাম, কিন্তু তখন সেটা নষ্ট ও সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “আমি মাবুদ এই কথা বলছি যে, এই রকম করে আমি এহুদার অহংকার এবং জেরুজালেমের ভীষণ অহংকার ধ্বংস করব। এই দুষ্ট জাতির লোকেরা, যারা আমার কথা শুনতে অস্বীকার করেছে এবং তাদের দিলের একগুঁয়েমিতে চলেছে আর সেবা ও এবাদত করবার জন্য দেব-দেবীর পিছনে গেছে তারা এই জাংগিয়ার মত সম্পূর্ণভাবে অকেজো হবে। লোকে কোমরে যেমন করে জাংগিয়া পরে তেমনি করে আমি গোটা ইসরাইল ও এহুদার সমস্ত লোকদের আমার সংগে জড়িয়েছিলাম, যাতে তারা আমার সুনাম, প্রশংসা ও সম্মানের জন্য আমার বান্দা হয়, কিন্তু তারা আমার কথা শোনে নি। “তুমি তাদের বল যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘আংগুর-রস রাখা প্রত্যেকটি মাটির পাত্র রসে পূর্ণ করতে হবে।’ আর যদি তারা তোমাকে বলে, ‘আমরা কি জানি না যে, আংগুর-রস রাখা প্রত্যেকটি পাত্র রসে পূর্ণ করতে হবে?’ তবে তুমি তাদের বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘যারা এই দেশে বাস করে, অর্থাৎ দাউদের সিংহাসনে বসা সমস্ত বাদশাহ্‌দের, ইমামদের, নবীদের এবং জেরুজালেমে বাসকারী সকলকে আমি মাতলামি দিয়ে পূর্ণ করব। আংগুর-রসের পাত্রের মত করে আমি একজনের উপর আর একজনকে আছাড় মেরে চুরমার করব; বাবা হোক বা ছেলে হোক সবাইকে চুরমার করব। আমি কোন করুণা বা দয়া কিংবা মমতা করব না; তাদের ধ্বংস করবই করব।’ ” তোমরা শোন, মনোযোগ দাও, গর্বিত হোয়ো না, কারণ মাবুদ কথা বলেছেন। তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র গৌরব কর, তা না হলে তিনি অন্ধকার নিয়ে আসবেন আর অন্ধকার হয়ে আসা সব পাহাড়ের উপরে তোমাদের পায়ে উচোট লাগবে। তোমরা আলোর আশা করলে তিনি তা অন্ধকার করে দেবেন, গভীর অন্ধকার করে দেবেন। তোমরা যদি কথা না শোন তবে তোমাদের অহংকারের জন্য আমি গোপনে কাঁদব, ভীষণভাবে কাঁদব ও আমার চোখ পানিতে ভেসে যাবে, কারণ মাবুদের বান্দাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে। মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি বাদশাহ্‌ ও তার মাকে বল, ‘আপনারা সিংহাসন থেকে নেমে আসুন, কারণ আপনাদের সুন্দর তাজ আপনাদের মাথা থেকে পড়ে যাবে। নেগেভের শহরগুলোর ঢুকবার পথ বন্ধ করা হবে এবং কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না। এহুদার সমস্ত লোককে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে, একেবারে সকলকে নিয়ে যাওয়া হবে।’ ” মাবুদ বলছেন, “হে জেরুজালেম, তুমি চোখ তোল, দেখ, উত্তর দিক থেকে শত্রুরা আসছে। যে পাল তোমার হাতে দেওয়া হয়েছিল, যে ভেড়াদের নিয়ে তুমি গর্ব করতে তারা কোথায়? যে সব রাজ্যের সংগে তুমি বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলে মাবুদ যখন তোমার উপরে তাদের বসাবেন তখন তুমি কি বলবে? প্রসবের সময়ে স্ত্রীলোক যেমন যন্ত্রণা পায় তেমনি কি তুমি যন্ত্রণা পাবে না? যদি তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা কর, ‘আমার উপর এটা কেন ঘটল?’ তবে এর জবাব হল, তোমার অনেক গুনাহের জন্য তোমার কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ও শরীরের উপর জুলুম করা হয়েছে। ইথিওপিয়া দেশের লোক কি তার শরীরের রং কিংবা চিতাবাঘ কি তার গায়ের ফোঁটা ফোঁটা দাগ বদলে ফেলতে পারে? তুমিও তেমনি ভাল কাজ করতে পার না, কারণ তুমি খারাপ কাজ করা অভ্যাস করে ফেলেছ। “মরুভূমির বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া তুষের মত আমি তোমার লোকদের ছড়িয়ে দেব। এটাই তোমার পাওনা; এটাই আমি তোমার জন্য মেপে দিয়েছি, কারণ তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে মিথ্যা দেব-দেবীর উপর বিশ্বাস করেছ। আমি তোমার কাপড় তোমার মুখের উপর তুলে দেব যাতে তোমার লজ্জা দেখা যায়। আমি তোমার জেনা ও কামনাপূর্ণ ডাক এবং লজ্জাহীন বেশ্যার কাজ দেখেছি; দেখেছি পাহাড়ে পাহাড়ে ও মাঠে মাঠে এই সব জঘন্য কাজ। জেরুজালেম, ঘৃণ্য তুমি! আর কত দিন তুমি নাপাক থাকবে?” খরা সম্বন্ধে মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “এহুদা শোক করছে, কারণ তার শহরগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে; সেখানকার লোকেরা মাটিতে পড়ে শোক করছে, আর জেরুজালেম থেকে একটা কান্নার শব্দ উপরে উঠছে। গণ্যমান্য লোকেরা পানির জন্য তাদের চাকরদের পাঠায়; তারা পানির জায়গায় এসে পানি না পেয়ে খালি কলসী নিয়ে ফিরে যায়; তারা লজ্জিত ও হতাশ হয়ে মাথা ঢাকে। মাটি ফেটে গেছে, কারণ দেশে কোন বৃষ্টি হয় নি; চাষীরা হতাশ হয়ে মাথায় হাত দেয়। এমন কি, মাঠে ঘাস নেই বলে হরিণী প্রসব করে তার বাচ্চাকে ফেলে যায়। বুনো গাধারা গাছপালাশূন্য পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে শিয়ালের মত হাঁপায়; ঘাসের অভাবে তাদের চোখের তেজ কমে যায়।” হে মাবুদ, আমাদের গুনাহ্‌ যদিও আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তবুও তোমার সুনামের জন্য কিছু কর। আমরা অনেকবার বিপথে গিয়েছি; আমরা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। হে ইসরাইলের আশা, কষ্টের সময়কার উদ্ধারকর্তা, কেন তুমি দেশের মধ্যে অচেনার মত, এক রাত থাকা পথিকের মত হয়েছ? কেন তুমি হতভম্ব হয়ে যাওয়া লোকের মত, রক্ষা করতে পারে না এমন যোদ্ধার মত হয়েছ? হে মাবুদ, তুমি আমাদের মধ্যেই আছ আর আমরা তো তোমারই; তুমি আমাদের ত্যাগ কোরো না। এই লোকদের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “তারা ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে; তারা তাদের পা থামায় না। তাই আমি তাদের কবুল করি না; আমি এবার তাদের দুষ্টতার বিষয় মনে আনব আর গুনাহের জন্য শাস্তি দেব।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি এই লোকদের উপকারের জন্য মুনাজাত কোরো না। তারা যদিও বা রোজা রাখে তবুও তাদের কান্না আমি শুনব না; পোড়ানো-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী দিলেও আমি তা কবুল করব না। তার বদলে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দিয়ে আমি তাদের ধ্বংস করব।” এতে আমি বললাম, “হায়, আল্লাহ্‌ মালিক! নবীরা তাদের বলছে, ‘তোমরা যুদ্ধ দেখবে না কিংবা দুর্ভিক্ষেও কষ্ট পাবে না। মাবুদ সত্যিই এই জায়গায় তোমাদের স্থায়ী শান্তি দান করবেন।’ ” তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “নবীরা আমার নাম করে মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী বলছে। আমি তাদের পাঠাই নি, তাদের হুকুম দিই নি কিংবা তাদের কাছে কোন কথাও বলি নি। তারা তোমাদের কাছে মিথ্যা দর্শন, মিথ্যা গোণাপড়া ও নিজেদের মনগড়া মিথ্যা কথা বলে। কাজেই যে সব নবীরা আমার নাম করে কথা বলছে তাদের সম্বন্ধে আমি মাবুদ এই কথা বলছি যে, আমি তাদের পাঠাই নি, তবুও তারা বলছে, ‘কোন যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষ এই দেশে আসবে না।’ ঐ সব নবীরাই যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষে ধ্বংস হয়ে যাবে। যে সব লোকদের কাছে তারা নবী হিসাবে কথা বলছে তাদের লাশ দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের ফলে জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। তাদের কিংবা তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের দাফন করবার জন্য কেউ থাকবে না। তাদের পাওনা দুর্দশা আমি তাদের উপরেই ঢেলে দেব। “তুমি লোকদের কাছে এই কথা বল, ‘আমার চোখের পানি না থেমে দিনরাত আমার চোখ থেকে উপ্‌চে পড়ুক, কারণ আমার জাতির লোকেরা ভীষণ আঘাত, চুরমার-করা আঘাত পেয়েছে। আমি বের হয়ে মাঠে গেলে নিহত লোকদের দেখতে পাই; আর শহরে গেলে দেখি দুর্ভিক্ষের দরুন ধ্বংস। নবী ও ইমামেরা এমন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না।’ ” হে মাবুদ, তুমি কি এহুদাকে একেবারে অগ্রাহ্য করেছ? তুমি কি সিয়োনকে ঘৃণা করেছ? তুমি আমাদের কেন এমন কষ্ট দিয়েছ যে, আমরা সুস্থ হতে পারছি না? আমরা শান্তির আশা করেছিলাম কিন্তু কোন উপকার হল না, আমরা সুস্থ হবার আশা করেছিলাম কিন্তু ভীষণ ভয় উপস্থিত হল। হে মাবুদ, আমরা আমাদের দুষ্টতা ও আমাদের পূর্বপুরুষদের দোষের কথা স্বীকার করছি; আমরা সত্যিই তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। তোমার সুনাম রক্ষার জন্য তুমি আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না; তোমার গৌরবময় সিংহাসনের জায়গাকে অসম্মানিত হতে দিয়ো না। আমাদের জন্য তোমার স্থাপন করা ব্যবস্থার কথা মনে কর; তুমি তা বাতিল কোরো না। জাতিদের অসার মূর্তিগুলো কি বৃষ্টি আনতে পারে? আকাশ নিজে নিজে কি এক পশলা বৃষ্টি দিতে পারে? হে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, কেবল তুমিই তা পার। কাজেই তোমার উপরেই আমরা আশা রাখি, কারণ তুমিই এই সব করে থাক। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “মূসা ও শামুয়েলও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তবুও আমার দিল এই লোকদের জন্য নরম হবে না। আমার সামনে থেকে তুমি এদের বিদায় কর; তারা চলে যাক। আর যদি তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমাদের কি হবে?’ তবে তাদের বলবে, ‘মাবুদ এই কথা বলছেন যে, মৃত্যুর জন্য যারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে তাদের মৃত্যু হবে; তলোয়ারের জন্য যারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে তারা যুদ্ধে মারা যাবে; দুর্ভিক্ষের জন্য যারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে তারা দুর্ভিক্ষে মারা যাবে; আর বন্দী হবার জন্য যারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে তারা বন্দী হবে।’ ” মাবুদ বলছেন, “আমি তাদের বিরুদ্ধে চার রকম ধ্বংসকারীকে পাঠিয়ে দেব। সেগুলো হল, হত্যা করবার জন্য তলোয়ার, টেনে নিয়ে যাবার জন্য কুকুর, খেয়ে ফেলবার ও ধ্বংস করবার জন্য আকাশের পাখী ও বনের পশু। এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের ছেলে মানশা জেরুজালেমে যা করেছে তার জন্য আমি যে শাস্তি দেব তা দেখে দুনিয়ার সব রাজ্যের লোকেরা ভয় পাবে। “হে জেরুজালেম, কে তোমার উপর দয়া করবে? কে তোমার জন্য শোক করবে? তুমি কেমন আছ তা জিজ্ঞাসা করবার জন্য কে আসবে? আমি মাবুদ বলছি যে, তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ, তুমি উল্টা পথে গিয়েছ। সেইজন্য আমি তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে তোমাকে ধ্বংস করব; আমি আর মমতা করতে পারি না। দেশের শহর-দরজার কাছে আমি কুলায় করে তোমার লোকদের ঝাড়ব। আমার বান্দাদের উপর আমি সন্তানের মৃত্যুর শোক আনব ও তাদের ধ্বংস করব, কারণ নিজেদের পথ থেকে তারা ফেরে নি। তাদের বিধবাদের সংখ্যা আমি সমুদ্রের বালির চেয়েও বেশী করব। তুমি তো যোদ্ধাদের মা, তোমার লোকদের বিরুদ্ধে দুপুরবেলায় আমি একজন ধ্বংসকারীকে আনব; আমি তাদের উপর হঠাৎ যন্ত্রণা ও ভয় আনব। সাত সন্তানের মা দুর্বল হয়ে লজ্জিত ও অপমানিত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে। সময় থাকতেই তার জীবনের সূর্য ডুবে যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তাদেরও আমি শত্রুদের তলোয়ারের সামনে দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” হায়! হায়! মা আমার, তুমি কেন আমাকে জন্ম দিয়েছ, যার সংগে গোটা দেশটা ঝগড়া ও লড়াই করে? আমি ধার দিই নি কিংবা কেউ আমাকে ধারও দেয় নি, তবুও প্রত্যেকে আমাকে বদদোয়া দেয়। মাবুদ বললেন, “একটা উপকারের উদ্দেশ্যে আমি নিশ্চয় তোমাকে রেহাই দেব। আমি এমন অবস্থা সৃষ্টি করব যার ফলে বিপদ ও দুর্দশার সময়ে তোমার শত্রুরা অবশ্য তোমার কাছে এসে মিনতি করবে। “কোন লোক কি উত্তর দেশের লোহা বা ব্রোঞ্জ ভেংগে ফেলতে পারে? হে এহুদা, সারা দেশের মধ্যে তোমার সমস্ত গুনাহের দরুন আমি তোমার ধন ও ধনভাণ্ডারের জিনিসপত্র বিনামূল্যে লুটের মাল হিসাবে দেব। যে দেশের কথা তুমি জান না সেই দেশে আমি তোমাকে তোমার শত্রুদের গোলাম করব, কারণ আমার গজবের আগুন জ্বলে উঠে তোমার উপর জ্বলতে থাকবে।” হে মাবুদ, তুমি তো সবই বুঝতে পার; কাজেই আমার কথা স্মরণ কর ও আমার প্রতি মনোযোগ দাও। আমার জুলুমবাজদের উপর তুমিই প্রতিশোধ নাও। তুমি তো তাদের উপর অনেক ধৈর্য ধরে থাক, কিন্তু তাই বলে তাদের হাতে তুমি আমাকে ধ্বংস হতে দিয়ো না; মনে করে দেখ, আমি তোমার জন্য কেমন টিট্‌কারি সহ্য করছি। তোমার কালাম প্রকাশিত হলে পর আমি তা অন্তরে গ্রহণ করলাম; সেই কালাম ছিল আমার আনন্দ ও আমার দিলের সুখ, কারণ হে মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, আমি তো তোমারই। যারা হৈ হুল্লোড় করে মদ খায় আমি কখনও তাদের দলে বসি নি, তাদের সংগে কখনও আনন্দ করি নি; তোমার হাত আমার উপরে ছিল বলে আমি একাই বসে থাকতাম আর তুমি আমাকে রাগে পরিপূর্ণ করেছ। কেন আমার ব্যথার শেষ নেই, কেন আমার ঘা ভাল হয় না, কেন তা সারানো যায় না? তুমি কি আমার কাছে মিথ্যা স্রোত ও অস্থায়ী ঝর্ণার পানির মত হবে? তখন মাবুদ বললেন, “তুমি যদি মন ফিরাও তবে আমি তোমাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনব যাতে তুমি আমার এবাদত করতে পার; যদি তুমি বাজে কথা না বলে মূল্যবান কথা বল তবে তুমি আমার মুখ হয়ে কথা বলবে। এই লোকেরা তোমার দিকে ফিরুক, কিন্তু তুমি তাদের দিকে ফিরবে না। এই লোকদের কাছে আমি তোমাকে ব্রোঞ্জের একটা শক্তিশালী দেয়ালের মত করব; তারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিন্তু তোমাকে হারিয়ে দিতে পারবে না, কারণ আমি মাবুদ বলছি যে, তোমাকে উদ্ধার করতে ও বাঁচাতে আমি তোমার সংগে সংগে থাকব। আমি তোমাকে দুষ্টদের হাত থেকে রক্ষা করব এবং নিষ্ঠুরদের মুঠি থেকে মুক্ত করব।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি এই জায়গায় বিয়ে কোরো না এবং ছেলেমেয়েরও জন্ম দিয়ো না, “যে বাড়ীতে লোকে শোক করে সেই বাড়ীতে ঢুকো না; বিলাপ করতে বা তাদের দুঃখে দুঃখিত হতে সেখানে যেয়ো না, কারণ এই লোকদের থেকে আমি আমার শান্তি, অটল মহব্বত ও মমতা তুলে নিয়েছি। এই দেশে ছোট-বড় সবাই মারা যাবে। কেউ তাদের দাফনও করবে না, তাদের জন্য বিলাপও করবে না এবং কেউ তাদের জন্য নিজের শরীরে কাটাকাটিও করবে না, নিজের মাথাও কামাবে না। যারা সেই মৃতদের জন্য বিলাপ করে, এমন কি, বাবা বা মায়ের জন্য বিলাপ করে তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্য কেউ খাবারও দেবে না বা পানীয়ও দেবে না। “মেজবানীর বাড়ীতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে বোসো না, কারণ আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমি এই জায়গার লোকদের চোখের সামনে ও তাদের জীবনকালেই আমোদ ও আনন্দের শব্দ এবং বর ও কনের গলার আওয়াজ বন্ধ করে দেব। “এই লোকদের কাছে এই সব কথা বললে পর তারা যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘মাবুদ আমাদের বিরুদ্ধে এমন বিপদের কথা বলেছেন কেন? আমরা কি করেছি? আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে আমরা কি গুনাহ্‌ করেছি?’ তখন তুমি তাদের বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘এর কারণ হল তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাকে ত্যাগ করেছে এবং দেব-দেবীদের পিছনে গিয়ে তাদের এবাদত ও পূজা করেছে। তারা আমাকে ত্যাগ করেছে এবং আমার শরীয়ত অমান্য করেছে। কিন্তু তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়েও খারাপভাবে চলেছ। দেখ, তোমরা প্রত্যেকে আমার কথামত না চলে কিভাবে তোমাদের খারাপ দিলের একগুঁয়েমিতে চলেছ। কাজেই আমি এই দেশ থেকে তোমাদের এমন একটা দেশে ছুঁড়ে ফেলে দেব যে দেশের কথা তোমরাও জান না, তোমাদের পূর্বপুরুষেরাও জানত না। সেখানে তোমরা দিনরাত দেব-দেবীর এবাদত করবে, কারণ আমি তোমাদের কোন দয়া দেখাব না।’ ” মাবুদ বলছেন, “এমন দিন আসছে যখন লোকে আর বলবে না, ‘যিনি বনি-ইসরাইলদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন সেই আল্লাহ্‌র কসম,’ বরং তারা বলবে, ‘যিনি উত্তর দেশে ও অন্যান্য দেশে বনি-ইসরাইলদের দূর করে দিয়েছিলেন ও সেখান থেকে বের করে এনেছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম।’ তারা এই কথা বলবে, কারণ যে দেশ আমি তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলাম সেই দেশেই তাদের ফিরিয়ে আনব। “কিন্তু এখন আমি অনেক জেলেকে ডেকে পাঠাব আর তারা তাদের মাছের মত ধরবে। তারপর আমি অনেক শিকারীকে ডেকে পাঠাব আর তারা প্রত্যেক বড় ও ছোট পাহাড় ও পাথরের ফাটল থেকে তাদের শিকার করে আনবে। তাদের সব চলাফেরার উপর আমার চোখ রয়েছে; তারা আমার চোখ থেকে লুকানো নেই এবং তাদের গুনাহ্‌ও আমার কাছ থেকে গোপন নয়। তাদের দুষ্টতা ও গুনাহের জন্য আমি তাদের দুই গুণ ফল দেব, কারণ তারা আমার দেশকে নাপাক করেছে এবং তাদের জঘন্য মূর্তি ও প্রতিমা দিয়ে আমার সেই অধিকারকে পূর্ণ করেছে।” হে মাবুদ, আমার শক্তি, আমার কেল্লা, আমার কষ্টের সময়কার আশ্রয়, দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে অন্য জাতিরা তোমার কাছে এসে বলবে, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন সব মিথ্যা দেব-দেবী ও অপদার্থ মূর্তির অধিকারী ছিল যা দিয়ে তাদের কোন লাভ হয় নি। লোকে কি নিজেদের জন্য দেব-দেবী তৈরী করতে পারে? যদিও বা তা করে সেগুলো তো আল্লাহ্‌ নয়।” মাবুদ বলছেন, “সেইজন্য এইবার আমি বনি-ইসরাইলদের আমার ক্ষমতা ও শক্তি দেখিয়ে শিক্ষা দেব। তখন তারা জানতে পারবে যে, আমার নাম মাবুদ।” মাবুদ বলছেন, “এহুদার গুনাহ্‌ লোহার যন্ত্র দিয়ে লেখা হয়েছে, হীরার কাঁটা দিয়ে তাদের দিলের ফলকে, তাদের বেদীর শিংয়ের উপরে খোদাই করা হয়েছে। ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপরে তাদের বেদী ও আশেরা-খুঁটি তাদের ছেলেমেয়েদের কাছেও প্রিয়। হে এহুদা, তোমার গুনাহের জন্য দেশের মধ্যেকার আমার পাহাড় এবং তোমার ধন ও তোমার ধনভাণ্ডারের জিনিসপত্র আর সারা দেশে তোমার পূজার উঁচু স্থানগুলো আমি লুট হিসাবে দিয়ে দেব। যে অধিকার আমি তোমাকে দিয়েছিলাম, তোমার নিজের দোষেই তুমি তা হারাবে। যে দেশের কথা তুমি জান না সেই দেশে আমি তোমাকে তোমার শত্রুদের গোলাম করব, কারণ তুমি আমার রাগের আগুন জ্বালিয়েছ আর তা চিরকাল জ্বলতে থাকবে।” মাবুদ বলছেন, “যে লোক মানুষের উপর ভরসা করে ও শক্তির জন্য নিজের শরীরের উপর বিশ্বাস করে এবং যার দিল আমার কাছ থেকে সরে গেছে সে বদদোয়াপ্রাপ্ত। সে হবে পতিত জমিতে একটা ঝোপের মত; ভাল সময় আসলে সে তা দেখতে পাবে না। মরুভূমির গরম শুকনা জায়গায়, অর্থাৎ যেখানে কেউ বাস করে না এমন নোনা জায়গায় সে বাস করবে। “কিন্তু ধন্য সেই লোক, যে মাবুদের উপর ভরসা করে ও মাবুদ যার ঈমানের ভিত্তি। সে পানির ধারে লাগানো গাছের মত হবে যা স্রোতের ধারে তার শিকড় মেলে দেয়। গরম আসলে সে ভয় পায় না; তার পাতা সব সময় সবুজ থাকে। খরার বছরে তার কোন ভাবনা হয় না আর সে কখনও ফলহীন থাকে না। “অন্তর সব কিছুর চেয়ে ঠগ, তাকে কোন রকমে ভাল করা যায় না। কেউ মানুষের দিল বুঝতে পারে না। আমি মাবুদ দিল খুঁজে দেখি ও মনের পরীক্ষা করি; আমি মানুষের চলাফেরা ও তার কাজের পাওনা অনুসারে ফল দিই। “অন্যের ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা পাওয়া তিতির পাখীর মতই সেই লোক, যে অসৎ উপায়ে ধন লাভ করে। তার বয়সের মাঝামাঝি সময়ে সেই ধন তাকে ছেড়ে চলে যাবে, আর শেষে সে বোকা বলে প্রমাণিত হবে।” সেই প্রথম থেকে স্থাপন করা গৌরবময় সিংহাসনটা হল আমাদের পবিত্র এবাদত-খানার জায়গা। হে মাবুদ, ইসরাইলের আশা, যারা তোমাকে ত্যাগ করেছে তাদের সবাইকে লজ্জায় ফেলা হবে। তোমার কাছ থেকে যারা ফিরে গেছে তাদের নাম ধূলায় লেখা হবে, কারণ তারা জীবন্ত পানির ঝর্ণা মাবুদকে ত্যাগ করেছে। হে মাবুদ, আমাকে সুস্থ কর, তাতে আমি সুস্থ হব; আমাকে উদ্ধার কর, তাতে আমি উদ্ধার পাব, কারণ তুমিই আমার প্রশংসার পাত্র। দেখ, তারা আমাকে বলতে থাকে, “মাবুদের কালাম কোথায়? এখন তা পূর্ণ হোক।” তোমার বান্দাদের পালক হওয়া থেকে আমি তো পালিয়ে যাই নি; তুমি জান আমি বিপদের দিন চাই নি। আমার মুখ থেকে যা বের হয় তা তোমার কাছ থেকে লুকানো নেই। তুমি আমার ভেংগে পড়বার কারণ হোয়ো না; বিপদের দিনে তুমিই আমার আশ্রয়। আমার জুলুমবাজদের লজ্জায় ফেলা হোক, কিন্তু তুমি আমাকে লজ্জা থেকে রক্ষা কর। তারা ভেংগে পড়ুক, কিন্তু তুমি আমাকে ভেংগে পড়া থেকে রক্ষা কর। তুমি তাদের উপর বিপদের দিন নিয়ে এস; দুই গুণ ধ্বংস দিয়ে তাদের ধ্বংস কর। জনসাধারণের যে দরজা দিয়ে এহুদার বাদশাহ্‌রা আসা-যাওয়া করে মাবুদ আমাকে সেই দরজায় এবং জেরুজালেমের অন্যান্য সব দরজায়ও গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তিনি আমাকে এই কথা বলতে বললেন, “হে এহুদার বাদশাহ্‌রা ও সমস্ত লোকেরা এবং জেরুজালেমে বাসকারী সকলে, তোমরা যারা এই সব দরজা দিয়ে ভিতরে যাওয়া-আসা করে থাক, তোমরা মাবুদের কালাম শোন। মাবুদ বলছেন, ‘তোমরা সাবধান হও; বিশ্রামবারে কোন বোঝা বইবে না কিংবা জেরুজালেমের দরজা দিয়ে তা ভিতরে আনবে না। আমি যেমন তোমাদের পূর্বপুরুষদের হুকুম দিয়েছিলাম সেই মত বিশ্রামবারে তোমরা তোমাদের বাড়ী থেকে কোন বোঝা বের করে আনবে না বা কোন কাজ করবে না, বরং বিশ্রামবার পবিত্র করে রাখবে। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই কথা শোনেও নি, তাতে মনোযোগও দেয় নি। তারা তাদের ঘাড় শক্ত করেছিল; তারা আমার কথা শুনতে ও আমার শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু যদি তোমরা সতর্ক হয়ে আমার কথামত চল এবং বিশ্রামবারে শহরের দরজা দিয়ে কোন বোঝা না আন বরং বিশ্রামবারে কোন কাজ না করে দিনটা পবিত্র করে রাখ, তাহলে তোমাদের বাদশাহ্‌রা দাউদের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করবে। তারা, তাদের রাজকর্মচারীরা এবং এহুদার লোকেরা ও জেরুজালেমের বাসিন্দারা রথে ও ঘোড়ায় চড়ে শহরের দরজা দিয়ে যাওয়া-আসা করবে; এই শহর কখনও জনশূন্য হবে না। এহুদার শহরগুলো ও জেরুজালেমের আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে বিন্‌ইয়ামীন এলাকা এবং উঁচু ও নীচু পাহাড়ী এলাকা থেকে আর নেগেভ থেকে লোকেরা আসবে এবং মাবুদের ঘরে পোড়ানো-কোরবানী, পশু-কোরবানী, শস্য-কোরবানী, ধূপ ও শুকরিয়া-কোরবানীর জিনিস আনবে। কিন্তু যদি তোমরা আমার কথা না শোন এবং বিশ্রামবার পবিত্র করে না রাখ আর সেই দিনে বোঝা নিয়ে জেরুজালেমের দরজার মধ্য দিয়ে ঢোক, তবে জেরুজালেমের সমস্ত দরজায় আমি আগুন জ্বালাব আর তা তার কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। সেই আগুন কেউ নিভাতে পারবে না।’ ” মাবুদ ইয়ারমিয়ার কাছে এই কথা প্রকাশ করলেন, “তুমি কুমারের বাড়ীতে যাও, সেখানে আমি তোমার সংগে কথা বলব।” সেইজন্য আমি কুমারের বাড়ীতে গেলাম এবং দেখলাম সে তার চাকে কাজ করছে। আমি আরও দেখলাম সে মাটি দিয়ে যে পাত্রটা তৈরী করছিল তা তার হাতে নষ্ট হয়ে গেল; তখন সে তা নিয়ে তার ইচ্ছামত আর একটা পাত্র তৈরী করল। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “আমি বলছি, ‘হে ইসরাইলের লোকেরা, আমি কি এই কুমারের মত তোমাদের সংগে ব্যবহার করতে পারি না? হে ইসরাইলের লোকেরা, কুমারের হাতের কাদার মতই তোমরা আমার হাতে আছ। “সেইজন্য এখন তুমি এহুদার লোকদের ও জেরুজালেমের বাসিন্দাদের বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘দেখ, আমি তোমাদের জন্য বিপদের ব্যবস্থা করছি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পনা করছি। কাজেই তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের খারাপ পথ থেকে ফেরো ও তোমাদের চলাফেরা ও কাজ ভাল কর।’ কিন্তু তারা জবাব দেবে, ‘কোন লাভ নেই। আমাদের পরিকল্পনা মতই আমরা চলব; আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের খারাপ দিলের একগুঁয়েমি অনুসারেই চলব।’ ” সেইজন্য মাবুদ বলছেন, “জাতিদের মধ্যে তালাশ করে দেখ, এর আগে এই রকম কথা কে শুনেছে? ইসরাইল জাতি একটা জঘন্য কাজ করেছে। লেবাননের তুষার কি কখনও তার পাহাড়ের ঢালু জায়গা থেকে সম্পূর্ণ গলে যায়? দূর থেকে আসা তার ঠাণ্ডা পানি বয়ে যাওয়া কি কখনও বন্ধ হয়ে যায়? কিন্তু আমার বান্দারা আমাকে ভুলে গিয়ে অসার মূর্তির কাছে ধূপ জ্বালাচ্ছে। তারা ঠিক পথে উচোট খেয়ে সেই পুরানো পথে আর চলাফেরা করছে না। তারা ভাল রাস্তা ছেড়ে বিপথে চলেছে। সেইজন্য তাদের দেশ পতিত জমি এবং একটা স্থায়ী ঘৃণার জিনিস হয়ে থাকবে; যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা অবাক হয়ে মাথা নাড়বে। তাদের শত্রুদের সামনে আমি পূবের বাতাসের মত তাদের ছড়িয়ে দেব; বিপদের দিনে আমি তাদের আমার মুখ নয় কিন্তু পিঠ দেখাব।” লোকেরা বলল, “চল, আমরা ইয়ারমিয়ার বিরুদ্ধে ফন্দি আঁটি; কারণ ইমামের কাছে শরীয়তের শিক্ষা, জ্ঞানীদের কাছে পরামর্শ ও নবীদের কাছে আল্লাহ্‌র কালাম তো আছেই। কাজেই এস, আমরা আমাদের মুখের কথা দিয়ে তাকে দোষী করি আর তার কথায় মনোযোগ না দিই।” হে মাবুদ, আমার কথা শোন; আমার বিপক্ষেরা আমার বিরুদ্ধে যা বলেছে তাতে মনোযোগ দাও। ভালোর শোধ কি খারাপ দিয়ে করা হবে? কিন্তু তারা তো আমার জন্য গর্র্ত খুঁড়েছে। মনে করে দেখ, তোমার গজব যাতে তাদের উপর থেকে ফিরে যায় সেইজন্য আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলেছি। কাজেই তুমি তাদের সন্তানদের দুর্ভিক্ষের হাতে ছেড়ে দাও; তলোয়ারের হাতে তাদের তুলে দাও। তাদের স্ত্রীরা সন্তানহীনা ও বিধবা হোক; তাদের পুরুষ লোকেরা মহামারীতে মারা যাক, আর যুদ্ধে তলোয়ারের আঘাতে তাদের যুবকেরা কাটা পড়ুক। তুমি তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ আক্রমণকারী নিয়ে আসলে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে কান্না শোনা যাক, কারণ আমাকে ধরবার জন্য তারা গর্ত খুঁড়েছে এবং আমার পায়ের জন্য ফাঁদ লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু হে মাবুদ, আমাকে হত্যা করবার জন্য এই সব ষড়যন্ত্রের কথা তো তুমি জান। তাদের এই অন্যায় তুমি মাফ কোরো না কিংবা তোমার চোখের সামনে থেকে তাদের গুনাহ্‌ মুছে ফেলো না। তোমার সামনে তারা পড়ে যাক; তোমার রাগের সময়ে তুমি তাদের শাস্তি দাও। মাবুদ বললেন, “তুমি গিয়ে কুমারের কাছ থেকে একটা মাটির পাত্র কিনে আন। তোমার সংগে লোকদের কয়েকজন বৃদ্ধ নেতা ও বয়স্ক ইমামদের নাও। তারপর খাপ্‌রা-দরজায় ঢুকবার পথের কাছে বিন্‌-হিন্নোম উপত্যকায় যাও। আমি তোমাকে যে কথা বলব তা সেখানে ঘোষণা কর। সেই কথা হল, ‘হে এহুদার বাদশাহ্‌রা ও জেরুজালেমের লোকেরা, আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যে কথা বলছি তা শোন। আমি এই জায়গার উপরে এমন বিপদ আনব যে, যারা তা শুনবে তাদের প্রত্যেকের কান শিউরে উঠবে। এর কারণ হল, তারা আমাকে ত্যাগ করেছে এবং এই জায়গা দেব-দেবীদের জায়গা বানিয়েছে; তারা এমন সব দেবতাদের কাছে ধূপ জ্বালিয়েছে যাদের কথা তাদের পূর্বপুরুষেরা কিংবা এহুদার বাদশাহ্‌রা কখনও জানত না। এছাড়া এই জায়গা তারা নির্দোষীদের রক্ত দিয়ে পূর্ণ করেছে। তারা বাল দেবতার কাছে কোরবানী হিসাবে তাদের সন্তানদের আগুনে পোড়াবার জন্য বাল দেবতার পূজার উঁচু স্থান তৈরী করেছে, কিন্তু আমি তা করতে হুকুম দিই নি কিংবা বলি নি এবং তা আমার মনেও আসে নি। কাজেই এমন দিন আসছে যখন লোকে এই জায়গাকে আর তোফৎ কিংবা বিন্‌-হিন্নোম উপত্যকা বলবে না, বলবে জবাই করবার উপত্যকা। “ ‘এই জায়গায় আমি এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের পরিকল্পনা নষ্ট করব। যারা তাদের প্রাণ নিতে চায় তাদের সেই শত্রুদের দিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আমি তাদের মেরে ফেলব এবং তাদের লাশ আকাশের পাখী ও বুনো পশুদের খাবার হিসাবে দেব। আমি এই শহরটাকে ধ্বংস করব এবং ঠাট্টার পাত্র করব; যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা সবাই তার সব আঘাত দেখে ভয় পাবে ও ঠাট্টা করবে। তাদের শত্রুরা, অর্থাৎ যারা তাদের হত্যা করতে চায় তারা যখন তাদের ঘেরাও করবে তখনকার সেই কষ্টের সময়ে আমি তাদের ছেলেমেয়েদের গোশ্‌ত তাদেরই খেতে বাধ্য করব এবং তারা একে অন্যের গোশ্‌ত খাবে।’ আমি এই জায়গা ও এখানকার বাসিন্দাদের প্রতি যা করব তা এই: আমি এই শহরকে তোফতের মত করব; জেরুজালেমের সব ঘর-বাড়ী ও এহুদার বাদশাহ্‌দের ঘর-বাড়ী, অর্থাৎ যে সব ঘর-বাড়ীর ছাদের উপরে সূর্য, চাঁদ ও তারাগুলোর উদ্দেশে তারা ধূপ জ্বালাত এবং দেব-দেবীর উদ্দেশে ঢালন-কোরবানীর জিনিস ঢেলে দিত সেই সব ঘর-বাড়ী তোফতের মত নাপাক হবে।’ ” ইয়ারমিয়া তারপর তোফৎ থেকে ফিরে আসলেন। মাবুদ তাঁকে তাঁর কালাম বলবার জন্য সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মাবুদের ঘরের উঠানে দাঁড়িয়ে সমস্ত লোকদের বললেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘শোন, আমি এই শহর ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোর উপর যে সব বিপদ ঘটাবার কথা বলেছি আমি সেই সবই তাদের উপর ঘটাব, কারণ তারা ঘাড় শক্ত করেছে এবং আমার কথা শোনে নি।’ ” ইয়ারমিয়া যখন নবী হিসাবে এই সব কথা বলছিলেন তখন মাবুদের ঘরের প্রধান কর্মচারী ইম্মেরের ছেলে ইমাম পশ্‌হূর সেই কথা শুনলেন। তিনি নবী ইয়ারমিয়াকে মারধর করে মাবুদের ঘরের কাছে উঁচু জায়গায় বিন্‌ইয়ামীন্তদরজার ধারে হাড়িকাঠে বন্ধ করে রাখলেন। তার পরের দিন পশ্‌হূর সেই হাড়িকাঠ থেকে ইয়ারমিয়াকে খুলে আনলেন। তখন ইয়ারমিয়া তাঁকে বললেন, “মাবুদের দেওয়া আপনার নাম পশ্‌হূর নয় বরং মাগোর-মিষাবীব (যার মানে ‘চারদিকে ভীষণ ভয়’), কারণ মাবুদ বলছেন, ‘আমি তোমাকে তোমার নিজের ও তোমার বন্ধুবান্ধবদের কাছে ভীষণ ভয়ের পাত্র করব। তুমি নিজের চোখে যুদ্ধে শত্রুদের হাতে তাদের মরে যেতে দেখবে। সমস্ত এহুদাকে আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেব। সে তাদের অনেককে ব্যাবিলনে নিয়ে যাবে আর বাকী লোকদের হত্যা করবে। আমি এই শহরের সমস্ত ধন-সম্পদ, অর্থাৎ তাদের ক্ষেতের শস্য ও সব দামী জিনিস এবং এহুদার বাদশাহ্‌দের সমস্ত ধনভাণ্ডার তাদের শত্রুদের হাতে তুলে দেব। তারা সেগুলো লুট করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাবে। আর হে পশ্‌হূর, তোমাকে ও তোমার বাড়ীর সকলকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তুমি মরবে ও তোমাকে দাফন করা হবে; তোমার যে সব বন্ধুদের কাছে তুমি নবী হিসাবে কথা বলবার সময় মিথ্যা কথা বলেছ তাদের সকলেরই একই দশা হবে।’ ” হে মাবুদ, তুমি আমাকে ভুলিয়েছ বলে আমার এই অবস্থা হয়েছে; তুমি আমার চেয়ে শক্তিশালী বলে তুমি জয়ী হয়েছ। আমি সারা দিন ঠাট্টার পাত্র হয়েছি; প্রত্যেকে আমাকে ঠাট্টা করে। যতবার আমি কথা বলি ততবারই ভীষণ অনিষ্ট ও ধ্বংসের কথা চিৎকার করে তবলিগ করি। কাজেই মাবুদের কালামের জন্য সারা দিন আমাকে অপমান ও ভীষণ নিন্দা করা হয়। কিন্তু যদি আমি বলি, “আমি তাঁর কথা উল্লেখ করব না কিংবা তাঁর নাম করে আর কিছু বলব না,” তবে তাঁর কথা আমার দিলে যেন জ্বলন্ত আগুন হয়ে হাড়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে। আমি তা ভিতরে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি; সত্যিই আমি আর তা ভিতরে রাখতে পারি না। আমার চারদিকে ভীষণ ভয়, কারণ আমি এই সব কথা অনেক লোকদের ফিস্‌ ফিস্‌ করে বলতে শুনি, “তার নামে নালিশ কর; চল, আমরা তার নামে নালিশ করি।” আমার সমস্ত বন্ধুরা এই বলে আমার পিছ্‌লে পড়বার অপেক্ষায় আছে, “হয়তো আমরা তাকে ঠকাতে পারব, আর তখন আমরা তার উপর জয়ী হব আর প্রতিশোধ নেব।” কিন্তু মাবুদ শক্তিশালী যোদ্ধার মত আমার সংগে সংগে আছেন, তাই আমার অত্যাচারীরা উচোট খাবে এবং জয়ী হবে না। তারা বিফল হবে এবং খুব লজ্জিত হবে; তাদের অসম্মান কেউ কখনও ভুলে যাবে না। হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি তো সৎ লোকদের পরীক্ষা করে থাক এবং প্রত্যেকের দিল ও মনের কথা জান। আমার শত্রুদের উপর তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমাকে দেখতে দাও, কারণ আমি আমার নালিশ তোমাকেই জানিয়েছি। তোমরা মাবুদের উদ্দেশে কাওয়ালী গাও। মাবুদের প্রশংসা কর। তিনি দুষ্টদের হাত থেকে অভাবীদের প্রাণ উদ্ধার করেন। আমি যেদিন জন্মেছিলাম সেই দিনটা বদদোয়াপ্রাপ্ত হোক। যেদিন আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন সেই দিনটা দোয়া বিহীন হোক। “আপনার একটি ছেলে হয়েছে,” এই সংবাদ দিয়ে যে আমার বাবাকে আনন্দিত করেছিল সে বদদোয়াপ্রাপ্ত হোক। মাবুদ মমতা না করে যে সব শহরের সর্বনাশ করেছিলেন ঐ লোকটি সেগুলোর মত হোক। সে সকালে শুনুক কান্নাকাটির শব্দ আর দুপুরে শুনুক বিপদের চিৎকার; কারণ মায়ের গর্ভে থাকতে সে আমাকে হত্যা করে নি। তাতে আমার মা-ই আমার কবর হতেন, আর তাঁর পেট চিরকাল বড় হয়েই থাকত। কষ্ট আর দুঃখ দেখবার জন্য এবং লজ্জায় আমার জীবন কাটাবার জন্য কেন আমি গর্ভ থেকে বের হয়ে আসলাম? পরে মাবুদের কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল। সেই সময় বাদশাহ্‌ সিদিকিয় মল্কিয়ের ছেলে পশ্‌হূরকে ও মাসেয়ের ছেলে ইমাম সফনিয়কে ইয়ারমিয়ার কাছে এই কথা বলতে পাঠালেন, “ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার আমাদের সংগে যুদ্ধ করছে; কাজেই আপনি আমাদের জন্য মাবুদের কাছে অনুরোধ করুন যেন সে আমাদের কাছ থেকে ফিরে যায়। হয়তো মাবুদ আমাদের জন্য আগের মত অলৌকিক চিহ্ন দেখাবেন।” ইয়ারমিয়া তাদের বললেন, “আপনারা বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে বলুন যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এই কথা বলছেন, ‘ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ ও যে ব্যাবিলনীয়রা দেয়ালের বাইরে থেকে তোমাকে আক্রমণ করছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তোমার হাতে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে সেগুলোর মুখ আমি ঘুরিয়ে দেব এবং শহরের মধ্যে সেগুলো জড়ো করব। আমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমি রেগে গিয়ে, গজবে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে নিজেই তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এই শহরে যারা বাস করে, তা সে মানুষ হোক বা পশু হোক, আমি তাদের মহামারী দিয়ে আঘাত করব, তাতে তারা মারা যাবে। তারপর আমি মহামারী, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বেঁচে থাকা এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে, তার রাজকর্মচারীদের এবং এই শহরের সমস্ত লোকদের ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাতে ও যারা তাদের হত্যা করতে চায় সেই শত্রুদের হাতে তুলে দেব। বখতে-নাসার তাদের হত্যা করবে; সে তাদের কোন মায়া, মমতা বা দয়া দেখাবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “তুমি লোকদের বল যে, মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘দেখ, আমি তোমাদের সামনে জীবনের পথ ও মৃত্যুর পথ রাখছি। যে কেউ এই শহরে থাকবে সে যুদ্ধে কিংবা দুর্ভিক্ষে কিংবা মহামারীতে মারা যাবে; কিন্তু যে কেউ বাইরে বের হয়ে গিয়ে তোমাদের আক্রমণকারী ব্যাবিলনীয়দের হাতে নিজেকে তুলে দেবে সে বাঁচবে; সে তার প্রাণ বাঁচাতে পারবে। আমি এই শহরের উন্নতি নয় কিন্তু ক্ষতি করবার জন্য মন স্থির করেছি। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে এটা দেওয়া হবে, আর সে আগুন দিয়ে এটা পুড়িয়ে দেবে।’ “এছাড়াও এহুদার রাজবংশকে আমার এই কালাম শুনতে বল, ‘হে দাউদের বংশ, আমি মাবুদ বলছি, তোমরা প্রত্যেক দিন সকালবেলায় ন্যায়বিচার করবে। যাকে লুট করা হয়েছে তাকে তার অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধার করবে; তা না হলে তোমাদের খারাপ কাজের জন্য আমার রাগ বের হয়ে আগুনের মত জ্বলবে, কেউ তা নিভাতে পারবে না। হে জেরুজালেম, যদিও তুমি উপত্যকার উপরে পাথুরে মালভূমিতে আছ তবুও আমি তোমার বিরুদ্ধে। তুমি বলে থাক যে, তোমাদের বিরুদ্ধে কেউ আসতে পারবে না, কেউ তোমাদের আশ্রয়ে ঢুকতে পারবে না; কিন্তু আমি তোমার কাজের পাওনা অনুসারে তোমাকে শাস্তি দেব। আমি তোমার বনগুলোতে আগুন জ্বালাব; সেই আগুন তোমার চারপাশের সব কিছু পুড়িয়ে ফেলবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” মাবুদ আমাকে এহুদার রাজবাড়ীতে গিয়ে এই সংবাদ ঘোষণা করতে বললেন, “দাউদের সিংহাসনে বসা হে এহুদার বাদশাহ্‌, আপনি, আপনার রাজকর্মচারীরা এবং আপনার যে সব লোকেরা এই দরজার মধ্য দিয়ে আসেন, আপনারা সকলে মাবুদের কালাম শুনুন। মাবুদ বলছেন, ‘যা ন্যায্য ও ঠিক তোমরা তা-ই কর। যাকে লুট করা হয়েছে তাকে তার অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধার কর। বিদেশী, এতিম ও বিধবাদের প্রতি কোন অন্যায় বা জুলুম কোরো না এবং এই জায়গায় নির্দোষের রক্তপাত কোরো না। তোমরা যদি এই হুকুম পালন কর তবে তোমাদের বাদশাহ্‌রা দাউদের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করবে এবং তাদের রাজকর্মচারী ও লোকজন নিয়ে রথে ও ঘোড়ায় চড়ে এই রাজবাড়ীর দরজা দিয়ে ভিতরে আসবে। কিন্তু যদি তোমরা এই সব হুকুম পালন না কর তবে আমি মাবুদ আমার নিজের নামেই কসম খেয়ে বলছি যে, এই রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যাবে।’ ” এহুদার রাজবাড়ীর সমস্ত জায়গা সম্বন্ধে মাবুদ বলছেন, “যদিও তুমি আমার কাছে গিলিয়দের মত এবং লেবাননের চূড়ার মত তবুও আমি তোমাকে নিশ্চয়ই মরুভূমির মত কিংবা লোকশূন্য শহরগুলোর মত করব। আমি তোমার বিরুদ্ধে ধ্বংসকারীদের পাঠাব; তাদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র থাকবে। তারা তোমার ভাল ভাল এরস গাছগুলো কেটে আগুনে ফেলবে। “বিভিন্ন জাতির লোকেরা এই শহরের পাশ দিয়ে যাবার সময় একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘এই মহা শহরের প্রতি কেন মাবুদ এমন করলেন?’ তার জবাব হবে, ‘কারণ তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র স্থাপন করা ব্যবস্থা ত্যাগ করে দেব-দেবীর পূজা ও এবাদত করছিল।’ ” তোমরা মৃত বাদশাহ্‌র জন্য কেঁদো না কিংবা বিলাপ কোরো না; তার চেয়ে বরং যিনি বন্দী হয়ে দূরে গেছেন তাঁর জন্য খুব বেশী করে কাঁদ, কারণ তিনি আর কখনও ফিরে আসবেন না কিংবা তাঁর জন্মদেশও আর দেখতে পাবেন না। তিনি হলেন ইউসিয়ার ছেলে শল্লুম, যিনি তাঁর পিতার পরে এহুদার বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর সম্বন্ধে মাবুদ বলছেন, “সে কখনও ফিরে আসবে না। যেখানে সে বন্দী হয়ে আছে সেই জায়গাতেই সে মারা যাবে; সে এই দেশ আর দেখতে পাবে না।” মাবুদ বলছেন, “ঘৃণ্য সে, যে লোক তার বাড়ী অন্যায় দিয়ে তৈরী করে আর অবিচার দিয়ে তার উপরের তলার কামরাগুলো তৈরী করে। ঘৃণ্য সে, যে লোক কোন কিছু না দিয়ে তার দেশের লোকদের খাটায় এবং তাদের পরিশ্রমের মজুরী দেয় না। ঘৃণ্য সে, যে লোক বলে, ‘আমি নিজের জন্য একটা বড় বাড়ী তৈরী করব যার উপরের তলায় থাকবে বড় বড় কামরা। আমি তার মধ্যে বড় বড় জানালা বসাব এবং তার তক্তাগুলো এরস কাঠ দিয়ে তৈরী করব আর তা লাল রং দিয়ে সাজাব।’ অনেক অনেক এরস গাছ থাকলেই কি তা তোমাকে বাদশাহ্‌ বানাবে? তোমার পিতা যদিও ভালভাবেই খাওয়া-দাওয়া করত তবুও যা ঠিক ও ন্যায্য সে তা করত বলে তার সময়ে সব কিছু ভাল চলেছিল। সে দুঃখী ও অভাবীদের পক্ষ নিত বলে সব কিছু ভাল চলেছিল। মাবুদকে জানা মানেই ঐ সব কাজ করা। কিন্তু তোমার চোখ ও মন রয়েছে কেবল অন্যায় লাভ, নির্দোষের রক্তপাত এবং অত্যাচার ও জুলুম করবার উপর।” কাজেই এহুদার বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার ছেলে যিহোয়াকীমের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “লোকে তার জন্য একে অন্যের কাছে ‘হায় হায়’ বলে বিলাপ করবে না। তারা তার জন্য ‘হায় হুজুর! হায় তাঁর জাঁকজমক!’ বলেও বিলাপ করবে না। গাধাকে যেমন করে কবর দেওয়া হয় তেমনি করে তাকে দাফন করা হবে; তাকে টেনে জেরুজালেমের দরজার বাইরে ফেলে দেওয়া হবে।” মাবুদ বলছেন, “হে জেরুজালেম, তুমি লেবাননে গিয়ে চিৎকার কর, তোমার গলার আওয়াজ বাশনে শোনা যাক। তুমি অবারীম থেকে চিৎকার কর, কারণ তোমার সব প্রেমিকেরা চুরমার হয়ে গেছে। তুমি যখন ভাল অবস্থায় ছিলে তখন আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম, কিন্তু তুমি বলেছিলে, ‘আমি শুনব না।’ প্রথম থেকেই তোমার ব্যবহার এই রকম; তুমি আমার বাধ্য হও নি। বাতাস তোমার সব রাখালদের তাড়িয়ে নিয়ে যাবে আর তোমার প্রেমিকেরা বন্দী হয়ে দূরে যাবে। তখন তুমি তোমার সব দুষ্টতার জন্য লজ্জিত ও অপমানিত হবে। হে লেবাননের এরস কাঠের তৈরী বাড়ীতে বাসকারিণী, স্ত্রীলোকের প্রসব ব্যথার মত যন্ত্রণা যখন তোমার উপর আসবে তখন তুমি ভীষণ কাত্‌রাবে!” মাবুদ বলছেন, “হে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের ছেলে যিহোয়াখীন, আমার জীবনের কসম, তুমি যদি আমার ডান হাতের সীলমোহরের আংটি হতে তবুও আমি তোমাকে খুলে ফেলে দিতাম। যারা তোমার প্রাণ নিতে চায়, যাদের তুমি ভয় পাও সেই ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ও ব্যাবিলনীয়দের হাতে আমি তোমাকে তুলে দেব। আমি তোমাকে ও তোমাকে যে জন্ম দিয়েছে তোমার সেই মাকে অন্য দেশে, যেখানে তোমাদের কারও জন্ম হয় নি সেই দেশে ছুঁড়ে ফেলে দেব, আর তোমরা দু’জনে সেখানে মারা যাবে। তোমরা যে দেশে ফিরে আসতে চাইবে সেখানে কখনও ফিরে আসতে পারবে না।” এই যিহোয়াখীন কি এমন একটা তুচ্ছ ভাংগা পাত্র যাঁকে কেউ চায় না? কেন তাঁকে ও তাঁর সন্তানদের তাঁদের অজানা একটা দেশে ছুঁড়ে ফেলা হবে? হে দেশ, দেশ, দেশ, মাবুদের কালাম শোন। মাবুদ বলছেন, “তুমি লেখ, এই লোকটির যেন কোন ছেলেমেয়ে নেই। সে তার জীবনকালে সফল হতে পারবে না আর তার কোন সন্তানও সফল হবে না। তাদের কেউ দাউদের সিংহাসনে বসবে না কিংবা এহুদা দেশের উপর রাজত্ব করবে না।” মাবুদ বলছেন, “ঘৃণ্য সেই পালকদের, যারা আমার চারণ ভূমির ভেড়াগুলোকে ধ্বংস করছে ও ছড়িয়ে দিচ্ছে।” সেইজন্য যে পালকেরা আমার লোকদের চরায় সেই রাখালদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, “তোমরা আমার পালের ভেড়াগুলোকে ছড়িয়ে ফেলেছ এবং তাদের তাড়িয়ে দিয়েছ, তাদের কোন যত্ন কর নি; কাজেই তোমাদের অন্যায়ের জন্য আমি তোমাদের শাস্তি দেব। যে সব দেশে আমি আমার পালের ভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম সেখান থেকে আমি নিজেই তাদের বাদবাকীগুলোকে তাদের চারণ ভূমিতে ফিরিয়ে আনব; সেখানে তাদের বংশ বৃদ্ধি পাবে ও তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠবে। আমি তাদের উপর এমন পালকদের নিযুক্ত করব যারা তাদের দেখাশোনা করবে; আমার ভেড়ার পাল আর ভয় পাবে না বা ব্যাকুল হবে না কিংবা কোনটা হারিয়ে যাবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “সেই দিনগুলো আসছে যখন আমি দাউদের বংশে একটা ন্যায়বান চারাকে তুলব; তিনি বাদশাহ্‌ হয়ে জ্ঞানের সংগে রাজত্ব করবেন এবং দেশে সৎ ও ন্যায় কাজ করবেন। তাঁর সময়ে এহুদা রক্ষা পাবে এবং ইসরাইল নিরাপদে বাস করতে পারবে। তাঁকে ‘মাবুদ আমাদের ধার্মিকতা’ বলে ডাকা হবে। “কাজেই এমন দিন আসছে যখন লোকে আর বলবে না, ‘যিনি বনি-ইসরাইলদের মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন সেই আল্লাহ্‌র কসম,’ বরং তারা বলবে, ‘যিনি বনি-ইসরাইলদের উত্তর দেশে ও অন্যান্য দেশে দূর করে দিয়েছিলেন ও সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম।’ তারপর তারা নিজেদের দেশে বাস করবে।” পরে নবীদের সম্বন্ধে মাবুদের কথা শুনে আমার দিল যেন আমার মধ্যে ভেংগে পড়ছে আর আমার সমস্ত হাড় কাঁপছে। মাবুদ ও তাঁর পাক কালামের জন্য আমি মাতালের মত, আংগুর-রস খেয়ে ভীষণ মাতাল হওয়া লোকের মত হয়েছি। দেশ জেনাকারীদের দিয়ে ভরে গেছে; বদদোয়ার দরুন দেশ শোক করছে এবং মরুভূমির চারণ ভূমি শুকিয়ে গেছে। লোকেরা খারাপ পথ ধরে চলছে আর তাদের ক্ষমতা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে। মাবুদ বলছেন, “নবী ও ইমামেরা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন হয়েছে; আমার ঘরে পর্যন্ত আমি তাদের দুষ্টতা দেখেছি। সেইজন্য তাদের পথ পিছলা হবে; অন্ধকারে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে আর সেখানে তারা পড়ে যাবে। তাদের শাস্তি পাবার সময়ে আমি তাদের উপর বিপদ আনব। “সামেরিয়ার নবীদের মধ্যে আমি এই জঘন্য ব্যাপার দেখেছি যে, তারা বাল দেবতার নামে নবী হিসাবে কথা বলে আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের বিপথে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া জেরুজালেমের নবীদের মধ্যে এই ভয়ংকর ব্যাপার দেখেছি যে, তারা জেনা করে এবং মিথ্যার মধ্যে জীবন কাটায়। তারা অন্যায়কারীদের হাত এমন শক্ত করে যার জন্য কেউ তার দুষ্টতা থেকে ফেরে না। তারা সবাই আমার কাছে সাদুম ও আমুরার লোকদের মত। “সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন নবীদের সম্বন্ধে বলছি, আমি তাদের তেতো খাবার ও বিষাক্ত পানি খাওয়াব, কারণ জেরুজালেমের নবীদের কাছ থেকে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনতা সমস্ত দেশময় ছড়িয়ে গেছে।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “নবীরা যে কথা বলছে তা তোমরা শুনো না; তারা তোমাদের মনে মিথ্যা আশা জাগিয়েছে। তারা মাবুদের মুখ থেকে শুনে কথা বলে না বরং নিজেদের মনগড়া দর্শনের কথা বলে। যারা আমাকে তুচ্ছ করে তাদের কাছে সেই নবীরা এই কথা বলতে থাকে, ‘মাবুদ বলছেন, তোমাদের শান্তি হবে’; আর যারা নিজেদের দিলের একগুঁয়েমিতে চলে তারা তাদের বলে, ‘তোমাদের কোন বিপদ হবে না।’ কিন্তু তাদের মধ্যে কে আমার কালাম শুনবার ও বুঝবার জন্য আমার সামনে দাঁড়িয়েছে? কে আমার কালামে কান দিয়েছে বা তাতে মনোযোগ দিয়েছে? দেখ, আমার রাগ ঝড়ের মত ফেটে পড়বে আর দুষ্টদের মাথার উপরে ঘুরে ঘুরে পড়বে ঘূর্ণিবাতাসের মত। আমার রাগ আমার দিলের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে পূর্ণ না করা পর্যন্ত ফিরে যাবে না। তোমরা ভবিষ্যতে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে। এই নবীদের আমি পাঠাই নি, তবুও তারা আগ্রহের সংগে তাদের সংবাদ লোকদের জানিয়েছে; আমি তাদের কোন কথা বলি নি, তবুও তারা কথা বলেছে। কিন্তু তারা যদি আমার সামনে দাঁড়াত, তাহলে আমার বান্দাদের কাছে তারা আমার কালামই ঘোষণা করত আর খারাপ পথ ও খারাপ কাজ থেকে তাদের ফিরাত।” মাবুদ বলছেন, “আমি কি কেবল কাছেরই আল্লাহ্‌, দূরের আল্লাহ্‌ নই? কেউ কি এমন গোপন জায়গায় লুকাতে পারে যেখানে আমি তাকে দেখতে পাব না? আমি কি আসমান ও জমীনের সব জায়গায় থাকি না?” “যে সব নবীরা আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলে তাদের কথা আমি শুনেছি। তারা বলে, ‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, একটা স্বপ্ন দেখেছি।’ আর কত দিন এই নবীরা তাদের দিলের মিথ্যা থেকে মিথ্যা কথা বলবে? তারা মনে করে যেমন করে তাদের পূর্বপুরুষেরা বাল দেবতার পূজা করে আমার নাম ভুলে গিয়েছিল তেমনি করে তাদের যে সব স্বপ্নের কথা তারা সকলের কাছে বলে সেগুলো দিয়ে তারা আমার বান্দাদের আমার নাম ভুলিয়ে দেবে। যে নবী স্বপ্ন দেখেছে সে তার স্বপ্নের কথা স্বপ্ন হিসাবেই বলুক, কিন্তু যে আমার কালাম পেয়েছে সে তা বিশ্বস্তভাবে বলুক; কারণ শস্যের কাছে খড়ের কোন দাম নেই। আমার কালাম কি আগুনের মত নয়? যে হাতুড়ী পাথর টুকরা টুকরা করে আমার কালাম কি সেই হাতুড়ীর মত নয়? “সেইজন্য যে নবীরা অন্যদের কাছ থেকে আমার কালাম চুরি করে আমি তাদের বিরুদ্ধে। জ্বী, আমি সেই নবীদেরই বিরুদ্ধে যারা নিজেদের জিভ্‌ নাড়ায় আর ঘোষণা করে, ‘মাবুদ বলছেন।’ সত্যিই আমি সেই নবীদের বিরুদ্ধে যারা মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলে। তারা সেগুলো বলে আর তাদের গর্বভরা মিথ্যা কথা দিয়ে আমার বান্দাদের বিপথে নিয়ে যায়। আমি কিন্তু তাদের পাঠাই নি কিংবা হুকুমও দিই নি। তারা এই লোকদের এক তিলও উপকার করতে পারে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ আমাকে বললেন, “এই লোকেরা কিংবা কোন নবী বা ইমাম যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘মাবুদের কালাম কি?’ তখন তুমি তাদের বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘তোমরা আমার বোঝা এবং আমি তোমাদের ফেলে দেব।’ যদি কোন নবী বা ইমাম কিংবা অন্য কেউ দাবি করে, ‘মাবুদের কালাম এই,’ তবে আমি সেই লোক ও তার পরিবারকে শাস্তি দেব। “হে আমার বান্দারা, তোমরা প্রত্যেকে যেন তোমাদের বন্ধু বা আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা কর, ‘মাবুদ কি জবাব দিয়েছেন?’ কিংবা ‘মাবুদ কি বলেছেন?’ কিন্তু তোমরা যেন আর কখনও না বল, ‘মাবুদের কালাম এই,’ কারণ প্রত্যেক লোক নিজের কথাকে আল্লাহ্‌র কালাম বানায়। এইভাবে তোমরা জীবন্ত আল্লাহ্‌র, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কালাম বাঁকা কর।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “যখন তাদের মধ্যে কেউ নবী হিসাবে কথা বলে তখন তাকে জিজ্ঞাসা কর, ‘আপনার কাছে মাবুদ কি জবাব দিয়েছেন?’ কিংবা ‘মাবুদ কি বলেছেন?’ “হে আমার বান্দারা, যদি তোমরা আমার কথা অমান্য করে দাবি কর, ‘মাবুদের কালাম এই,’ তাহলে আমি নিশ্চয়ই আমার সামনে থেকে তোমাদের তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেব এবং যে শহর আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলাম সেই শহরও আমার সামনে থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব। আমি তোমাদের উপরে চিরস্থায়ী অপমান ও লজ্জা আনব যা লোকে ভুলে যাবে না।” ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার যিহোয়াকীমের ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীন ও এহুদার রাজকর্মচারী, কারিগর ও কর্মকারদের জেরুজালেম থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার পরে মাবুদ আমাকে তাঁর ঘরের সামনে রাখা দুই টুকরি ডুমুর ফল দেখালেন। একটা টুকরিতে ছিল প্রথমে পাকা ডুমুরের মত খুব ভাল ডুমুর, আর অন্যটাতে ছিল খুব খারাপ ডুমুর, এত খারাপ যে, খাওয়া যায় না। মাবুদ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়ারমিয়া, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “ডুমুর; ভালগুলো খুবই ভাল, কিন্তু খারাপগুলো এত খারাপ যে, সেগুলো খাওয়া যায় না।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি, এহুদা থেকে যে বন্দীদের আমি এখান থেকে ব্যাবিলনীয়দের দেশে পাঠিয়েছি তাদের আমি এই ভাল ডুমুরের মতই মনে করব। আমি তাদের উন্নতির জন্য তাদের উপর নজর রাখব এবং এই দেশে তাদের ফিরিয়ে আনব। আমি তাদের গড়ে তুলব, ভেংগে ফেলব না; আমি তাদের লাগিয়ে দেব, তুলে ফেলব না। আমিই যে মাবুদ তা জানবার দিল আমি তাদের দেব। তারা আমার বান্দা হবে আর আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব, কারণ সমস্ত দিল দিয়েই তারা আমার কাছে ফিরে আসবে। “কিন্তু এই খারাপ ডুমুর, যা এত খারাপ যে, খাওয়া যায় না, সেগুলোর মত করে আমি এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়, তার রাজকর্মচারী ও জেরুজালেমের যে লোকেরা দেশে রয়ে গেছে কিংবা মিসরে বাস করছে তাদের সংগে খারাপ ব্যবহার করব। আমি তাদের যেখানেই দূর করে দিই না কেন সেখানে আমি তাদের করে তুলব ভয়ের পাত্র, দুনিয়ার সমস্ত জাতির বিরক্তির কারণ, একটা টিট্‌কারির পাত্র, একটা চল্‌তি কথা ও একটা ঠাট্টার পাত্র। লোকে তাদের নাম নিয়ে বদদোয়া দেবে। আমি তাদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের যে দেশ দিয়েছি সেই দেশে যে পর্যন্ত না তারা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় সেই পর্যন্ত আমি তাদের মধ্যে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী পাঠাব।” ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের চতুর্থ বছরে, অর্থাৎ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের রাজত্বের প্রথম বছরে এহুদার সমস্ত লোকদের সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল। সেইজন্য নবী ইয়ারমিয়া সমস্ত এহুদার লোক ও জেরুজালেমের সমস্ত বাসিন্দাদের বললেন, “ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ আমোনের রাজত্বের তেরো বছর থেকে এই পর্যন্ত, অর্থাৎ এই তেইশ বছর ধরে মাবুদের কালাম আমার উপর নাজেল হয়েছে আর আমি বার বার তোমাদের তা বলেছি, কিন্তু তোমরা তাতে কান দাও নি। “মাবুদ যদিও তাঁর সব গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের বার বার তোমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন তবুও তোমরা শোন নি কিংবা মনোযোগও দাও নি। তাঁরা মাবুদের এই কথা বলেছিলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে এখন তোমাদের খারাপ পথ ও খারাপ কাজ থেকে ফেরো, তাহলে যে দেশ আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলাম সেই দেশে তোমরা চিরকাল থাকতে পারবে। দেব-দেবীদের এবাদত ও পূজা করবার জন্য তাদের পিছনে যেয়ো না; তোমাদের হাতের তৈরী জিনিস দিয়ে আমাকে রাগিয়ে তুলো না। তাহলে আমি তোমাদের ক্ষতি করব না।’ “এখন মাবুদ বলছেন, ‘কিন্তু তোমরা আমার কথা শোন নি। তার বদলে তোমাদের হাতের তৈরী জিনিস দিয়ে আমাকে রাগিয়ে নিজেদের উপর ক্ষতি ডেকে এনেছ।’ “সেইজন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তোমরা আমার কথা শোন নি। কাজেই আমি উত্তরের সব জাতিগুলোকে ও আমার গোলাম ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে ডেকে আনব। এই দেশ ও তার বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে এবং চারপাশের সব জাতিদের বিরুদ্ধে আমি তাদের আনব। আমি সেই লোকদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেব এবং ভীষণ ভয়ের ও ঠাট্টার পাত্র করব; তাদের দেশ আমি চিরস্থায়ী ধ্বংসের স্থান করব। আমি তাদের মধ্য থেকে আমোদ ও আনন্দের শব্দ, বর ও কনের গলার আওয়াজ, জাঁতার শব্দ ও বাতির আলো দূর করে দেব। এই দেশটা ধ্বংসস্থান ও পতিত জমি হয়ে যাবে আর এই সব জাতিরা সত্তর বছর ধরে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র গোলাম হয়ে থাকবে। কিন্তু সত্তর বছর পূর্ণ হলে পর আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ ও তার জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য শাস্তি দেব এবং ব্যাবিলনীয়দের দেশকে চিরদিনের জন্য ধ্বংসস্থান করব। আমি সেই সব দেশের বিরুদ্ধে যে সব কথা বলেছি যা এই কিতাবে লেখা আছে, অর্থাৎ সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে ইয়ারমিয়া নবী হিসাবে যে কথা বলেছে তা আমি ঐ দেশের উপরে আনব। ব্যাবিলনীয়রা অনেক জাতি ও বড় বড় বাদশাহ্‌দের গোলাম হবে; তাদের সমস্ত কাজ অনুসারেই আমি তাদের ফল দেব।’ ” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাকে বললেন, “তুমি আমার হাত থেকে আংগুর রসে, অর্থাৎ আমার রাগে পূর্ণ এই পেয়ালাটা নাও এবং যে সব জাতির কাছে আমি তোমাকে পাঠাব তাদের তা খেতে দাও। তারা তা খেয়ে টলতে থাকবে এবং আমি যে যুদ্ধ তাদের মধ্যে পাঠিয়ে দেব তার দরুন পাগল হয়ে যাবে।” তখন আমি মাবুদের হাত থেকে পেয়ালাটা নিলাম এবং তিনি যে সব জাতির কাছে আমাকে পাঠালেন তাদের খাওয়ালাম। আমি জেরুজালেম ও এহুদার শহরগুলোকে এবং তার বাদশাহ্‌দের ও রাজকর্মচারীদের খাওয়ালাম, যেন তারা আজ যেমন আছে সেই রকম ধ্বংসের, ভীষণ ভয়ের, ঠাট্টার ও বদদোয়ার পাত্র থাকে। এছাড়া আমি তা খাওয়ালাম মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন ও তার রাজকর্মচারীদের, তার দেশের নেতাদের ও তার সব লোকদের; সেখানকার সব বিদেশীদের; আওস দেশের সব বাদশাহ্‌দের; ফিলিস্তিনীদের সব বাদশাহ্‌দের, অর্থাৎ অস্কিলোন, গাজা, ইক্রোণ ও অস্‌দোদের বাকী অংশের বাদশাহ্‌দের; ইদোম, মোয়াব ও অম্মোনের লোকদের; টায়ার ও সিডনের সব বাদশাহ্‌দের; সমুদ্রের ওপারের দেশের বাদশাহ্‌দের; দদান, তাইমা, বূষ দেশের লোকদের; মাথার দু’পাশের চুল কাটা লোকদের; আরবের সব বাদশাহ্‌দের; মরুভূমিতে বাসকারী বিদেশী সব বাদশাহ্‌দের; সিম্রী, ইলাম ও মিডীয়দের সব বাদশাহ্‌দের; কাছের ও দূরের একের পর এক উত্তরের সব বাদশাহ্‌দের। মোট কথা, আমি দুনিয়ার সমস্ত জাতিদের তা খাওয়ালাম। এদের সকলের পরে শেশকের, অর্থাৎ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ও তা খাবে। তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “তাদের বল যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে যুদ্ধ পাঠাচ্ছি; তোমরা আমার রাগের পেয়ালা থেকে খাও, মাতাল হও, বমি কর, পড়ে যাও এবং আর উঠো না।’ কিন্তু তারা যদি তোমার হাত থেকে পেয়ালা নিয়ে খেতে অস্বীকার করে তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তোমাদের খেতেই হবে। দেখ, আমার নিজের শহরকেই আমি প্রথমে ধ্বংস করতে যাচ্ছি, তাহলে তোমরা কি শাস্তি না পেয়েই থাকবে? তোমরা শাস্তি পাবেই পাবে, কারণ দুনিয়ার সব লোকদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ডেকে আনছি। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।’ “এখন তুমি তাদের বিরুদ্ধে নবী হিসাবে এই সব কথা বল, ‘মাবুদ উপর থেকে গর্জন করবেন; তাঁর পবিত্র বাসস্থান থেকে তিনি তাঁর গলার আওয়াজ শোনাবেন এবং তাঁর দেশের বিরুদ্ধে খুব জোরে গর্জন করবেন। যারা আংগুর মাড়াই করে তাদের মতই তিনি দুনিয়াতে বাসকারী সকলের বিরুদ্ধে চিৎকার করবেন। দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত সেই শব্দ শোনা যাবে, কারণ মাবুদ জাতিদের বিরুদ্ধে নালিশ আনবেন। তিনি সমস্ত মানুষের বিচার করবেন এবং তলোয়ারের হাতে দুষ্টদের তুলে দেবেন।’ ” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “দেখ, এক জাতি থেকে আর এক জাতিতে বিপদ ছড়িয়ে পড়ছে; দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে একটা ভীষণ ঝড় উঠছে।” তখন মাবুদ যাদের মেরে ফেলবেন তারা দুনিয়ার এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত সব জায়গায় পড়ে থাকবে। তাদের জন্য কেউ শোক করবে না কিংবা তাদের কেউ জড়োও করবে না বা দাফনও করবে না, কিন্তু তারা হবে মাটিতে পড়ে থাকা গোবরের মত। হে রাখালেরা, তোমরা কাঁদ, বিলাপ কর; হে পালের নেতারা, তোমরা ধূলায় গড়াগড়ি দাও, কারণ তোমাদের জবাই করে ফেলবার সময় এসেছে; তোমরা সুন্দর একটা মাটির পাত্রের মত চুরমার হয়ে যাবে। পালকদের পালাবার উপায় থাকবে না; পালের নেতারা কোথাও চলে যেতে পারবে না। পালকদের কান্না আর পালের নেতাদের বিলাপ শোন, কারণ মাবুদ তাদের চারণ ভূমি নষ্ট করে ফেলছেন। মাবুদের জ্বলন্ত রাগের দরুন শান্তিপূর্ণ মাঠগুলো পতিত জমি হয়ে থাকবে। তিনি সিংহের মত করেই তাঁর জায়গা ছেড়ে আসবেন; তাতে জুলুমবাজদের রাগের জন্য ও মাবুদের জ্বলন্ত রাগের জন্য তাদের দেশ ধ্বংসস্থান হয়ে যাবে। ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের প্রথম দিকে মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “আমি মাবুদ বলছি, তুমি আমার ঘরের উঠানে গিয়ে দাঁড়াও এবং এহুদার শহরগুলো থেকে যে সব লোক এবাদতের জন্য আমার ঘরে আসে তাদের সবাইকে আমি তোমাকে যে সব কথা বলতে হুকুম দিয়েছি তার প্রত্যেকটি কথা বল, একটা কথাও বাদ দিয়ো না। হয়তো তারা শুনবে এবং প্রত্যেকে তার খারাপ পথ থেকে ফিরে আসবে। তাহলে তাদের অন্যায় কাজের জন্য আমি তাদের উপর যে বিপদ আনবার পরিকল্পনা করেছি তা আর আনব না। তুমি তাদের এই কথা বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘তোমরা এতদিন আমার কথা শোন নি এবং তোমাদের সামনে আমি যে শরীয়ত রেখেছি তা পালন কর নি; এছাড়া আমি বারে বারে আমার যে গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি তাদের কথাও শোন নি। তোমরা যদি এই রকম করতেই থাক তবে আমি এই ঘরটাকে শীলোর মত করব এবং এমন করব যাতে দুনিয়ার সমস্ত জাতি এই শহরের নাম নিয়ে বদদোয়া দেয়।’ ” মাবুদের ঘরে ইয়ারমিয়া যখন এই সব কথা বললেন তখন ইমাম, নবী ও সব লোকেরা তা শুনল। কিন্তু মাবুদের হুকুম মত ইয়ারমিয়া সব কথা বলা যেই শেষ করলেন তখনই ইমাম, নবী ও সমস্ত লোকেরা তাঁকে ধরে বলল, “তোমাকে মরতে হবে। কেন তুমি মাবুদের নাম নিয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী করছ যে, এই ঘর শীলোর মত হবে এবং এই শহরটা ধ্বংস ও জনশূন্য হবে?” এই বলে সব লোক মাবুদের ঘরে ইয়ারমিয়াকে ঘিরে ধরল। এহুদার রাজকর্মচারীরা এই সব কথা শুনে রাজবাড়ী থেকে মাবুদের ঘরে আসলেন এবং মাবুদের ঘরের নতুন দরজায় ঢুকবার পথে বসলেন। তখন ইমাম ও নবীরা সেই রাজকর্মচারীদের ও সব লোকদের বললেন, “এই লোকটি মৃত্যুর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, কারণ সে এই শহরের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বলেছে; আর তোমরা নিজের কানেই তা শুনেছ।” তখন ইয়ারমিয়া সব রাজকর্মচারী ও সব লোকদের বললেন, “আপনারা এই ঘর ও শহরের বিরুদ্ধে যা শুনলেন সেই সব কথা বলতে মাবুদই আমাকে পাঠিয়েছেন। এখন আপনারা আপনাদের চলাফেরা ও কাজ সংশোধন করুন এবং আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা শুনুন। তাহলে মাবুদ আপনাদের বিরুদ্ধে যে বিপদ পাঠাবার কথা বলেছেন তা আর পাঠাবেন না। দেখুন, আমি তো আপনাদের হাতেই রয়েছি; আপনারা যা ভাল ও ন্যায্য মনে করেন তা-ই আমার প্রতি করুন। তবে এটা নিশ্চয়ই জানবেন যে, আপনারা যদি আমাকে মেরে ফেলেন তবে নির্দোষের রক্তপাতের অন্যায় আপনারা নিজেদের উপরে এবং এই শহরের উপরে ও যারা এখানে বাস করে তাদের উপরে নিয়ে আসবেন; কারণ এই সব কথা আপনাদের শোনাবার জন্য সত্যিই মাবুদ আমাকে পাঠিয়েছেন।” তখন রাজকর্মচারীরা ও সব লোকেরা ইমাম ও নবীদের বললেন, “এই লোকটি মৃত্যুর শাস্তির উপযুক্ত নয়। তিনি আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র নাম করে আমাদের কাছে কথা বলেছেন।” এর পর দেশের বৃদ্ধ নেতাদের মধ্যে কয়েকজন এগিয়ে এসে জমায়েত হওয়া সমস্ত লোকদের বললেন, “এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের সময়ে মোরেষ্টীয় মিকাহ্‌ নবী হিসাবে কথা বলতেন। তিনি এহুদার লোকদের বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন যে, সিয়োনকে ক্ষেতের মত করে চাষ করা হবে, জেরুজালেম হবে ধ্বংসের স্তূপ আর বায়তুল-মোকাদ্দসের পাহাড়টা ঘন ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়বে।’ এহুদার বাদশাহ্‌ হিষ্কিয় কিংবা এহুদার অন্য কেউ কি মিকাহ্‌কে হত্যা করেছিলেন? হিষ্কিয় কি মাবুদকে ভয় করেন নি এবং তাঁর রহমত ভিক্ষা করেন নি? এতে মাবুদ লোকদের উপর যে বিপদ পাঠাবার কথা বলেছিলেন তা আর পাঠান নি। কিন্তু আমরা তো নিজেদের উপর একটা ভীষণ বিপদ ডেকে আনছি।” কিরিয়ৎ-যিয়ারীমের শময়িয়ের ছেলে উরিয়া ছিলেন আর একজন যিনি মাবুদের নামে নবী হিসাবে কথা বলতেন। তিনিও ইয়ারমিয়ার মত এই শহর ও এই দেশের বিরুদ্ধে একই রকম কথা বললেন। বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীম ও তাঁর সব সেনাপতি ও রাজকর্মচারীরা যখন উরিয়ার কথা শুনলেন তখন বাদশাহ্‌ তাঁকে হত্যা করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু উরিয়া সেই কথা শুনে ভয়ে মিসর দেশে পালিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীম তখন অক্‌বোরের ছেলে ইল্‌নাথনকে এবং তাঁর সংগে আরও কয়েকজনকে মিসরে পাঠিয়ে দিলেন। তারা মিসর থেকে উরিয়াকে নিয়ে এসে বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের কাছে নিয়ে গেল; বাদশাহ্‌ তাঁকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করে তাঁর লাশ সাধারণ লোকদের কবরস্থানে ফেলে দিলেন। কিন্তু শাফনের ছেলে অহীকাম ইয়ারমিয়ার পক্ষে ছিলেন, তাই ইয়ারমিয়াকে হত্যা করবার জন্য লোকদের হাতে দেওয়া হয় নি। ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের প্রথম দিকে মাবুদের কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হয়েছিল। মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি কতগুলো চামড়ার ফিতা আর কাঠ দিয়ে একটা জোয়াল তৈরী করে তোমার ঘাড়ের উপর রাখবে। তারপর যে সব রাষ্ট্রদূত ইদোম, মোয়াব, অম্মোন, টায়ার ও সিডনের বাদশাহ্‌দের কাছ থেকে জেরুজালেমে এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের কাছে এসেছে তাদের দিয়ে ঐ সব বাদশাহ্‌দের কাছে খবর পাঠাবে। তাদের মালিকদের একটা খবর দেবার জন্য বলবে যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের মালিকদের এই কথা বলতে বলছেন, ‘আমার মহাশক্তিতে এবং ক্ষমতাপূর্ণ হাতে আমি এই দুনিয়া ও তার উপরকার যে সব মানুষ ও পশু তৈরী করেছি, আর আমি যাকে উপযুক্ত মনে করি তার হাতে ক্ষমতা দিয়ে থাকি। এখন আমি তোমাদের সব দেশগুলো আমার গোলাম ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাতে তুলে দেব; এমন কি, বুনো পশুদেরও আমি তার অধীন করব। যতদিন না তার দেশের সময় আসে ততদিন পর্যন্ত সমস্ত জাতি তার, তার ছেলের ও তার নাতির গোলাম হবে; তারপর অনেক জাতি ও বড় বড় বাদশাহ্‌রা তাকে তাদের অধীনে আনবে। “ ‘কিন্তু কোন জাতি বা রাজ্য যদি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের গোলাম না হয় কিংবা তার জোয়ালের নীচে কাঁধ না দেয় তবে আমি সেই জাতিকে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দিয়ে শাস্তি দেব যে পর্যন্ত না আমি তার হাত দিয়ে সেই জাতিকে ধ্বংস করি। কাজেই তোমরা তোমাদের নবী, গণক, স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের কথা বলা লোক, মায়াবিদ্যাকারী কিংবা তোমাদের জাদুকরদের কথা শুনো না; তারা তোমাদের বলে যে, তোমরা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র গোলাম হবে না। তারা মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী বলে, আর এর ফলে তোমরা তোমাদের দেশ থেকে দূর হয়ে যাবে; আমি তোমাদের তাড়িয়ে দেব এবং তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কোন জাতি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র জোয়ালের নীচে ঘাড় নীচু করে এবং তার গোলাম হয় তবে আমি সেই জাতিকে তার নিজের দেশে থাকতে দেব যাতে তারা সেখানে চাষ ও বাস করতে পারে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে আমি সেই একই সংবাদ দিয়ে বললাম, “ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র জোয়ালের নীচে আপনারা আপনাদের ঘাড় নীচু করুন; তাঁর ও তাঁর লোকদের গোলাম হন, তাতে আপনি বাঁচবেন। যে জাতি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র গোলাম হবে না তার বিরুদ্ধে মাবুদ যা বলেছেন সেইমত কেন আপনি ও আপনার লোকেরা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মারা যাবেন? সেই নবীদের কথা শুনবেন না যারা আপনাদের বলে, ‘আপনারা কখনও ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র গোলাম হবেন না’; তারা আপনাদের কাছে মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী বলে। মাবুদ বলছেন, ‘আমি তাদের পাঠাই নি। তারা আমার নাম করে মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী বলে। সেইজন্য আমি তোমাদের ও তোমাদের কাছে যারা ভবিষ্যদ্বাণী বলে সেই নবীদের দূর করে দেব আর তোমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।’ ” তখন আমি ইমামদের ও সমস্ত লোকদের বললাম যে, মাবুদ বলছেন, “যে নবীরা তোমাদের বলে, ‘খুব শীঘ্রই মাবুদের ঘরের জিনিসগুলো ব্যাবিলন থেকে ফিরিয়ে আনা হবে,’ তাদের কথা তোমরা শুনো না। তারা তোমাদের কাছে মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী বলছে। তাদের কথা শুনো না। তোমরা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সেবা কর, তাতে বাঁচবে। এই শহরটা ধ্বংস হবে কেন? যদি তারা নবীই হয়ে থাকে আর মাবুদের কালাম তাদের কাছে থাকে তবে মাবুদের ঘরের, এহুদার বাদশাহ্‌র বাড়ীর ও জেরুজালেমের যে সব জিনিসপত্র এখনও বাকী রয়ে গেছে তা যাতে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া না হয় সেইজন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছে তারা মিনতি করুক। সেই একই বছরে, এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের প্রথম দিকে, অর্থাৎ চতুর্থ বছরের পঞ্চম মাসে গিবিয়োন শহরের অসূরের ছেলে নবী হনানিয় মাবুদের ঘরে ইমামদের ও সমস্ত লোকদের সামনে ইয়ারমিয়াকে এই কথা বলল, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র জোয়াল ভেংগে ফেলতে যাচ্ছি। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার মাবুদের ঘরের যে জিনিসপত্র এখান থেকে ব্যাবিলনে সরিয়ে নিয়ে গেছে তা আমি দু’বছরের মধ্যে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। এছাড়া আমি যিহোয়াকীমের ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীনকে এবং এহুদার অন্যান্য যে সব বন্দী ব্যাবিলনে গেছে তাদেরও এই জায়গায় ফিরিয়ে আনব, কারণ আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র জোয়াল ভেংগে ফেলব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” তখন নবী ইয়ারমিয়া ইমামদের ও যে সব লোক মাবুদের ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সামনে নবী হনানিয়ের কথার জবাব দিলেন। তিনি বললেন, “আমিন, মাবুদ যেন তা-ই করেন। মাবুদের ঘরের জিনিসপত্র এবং ব্যাবিলন থেকে সমস্ত বন্দীদের এখানে ফিরিয়ে এনে মাবুদ আপনার বলা ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করুন। কিন্তু আমি আপনার ও সমস্ত লোকদের কাছে যে কথা বলতে চাই তা শুনুন। আপনার ও আমার আগে পুরানো দিনের যে নবীরা ছিলেন, তাঁরা অনেক দেশ ও বড় বড় রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বিপদ ও মহামারীর বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু যে নবী শান্তির ভবিষ্যদ্বাণী বলেন তাঁর কথা যখন পূর্ণ হবে কেবল তখনই জানা যাবে যে, তাঁকে সত্যিই মাবুদ পাঠিয়েছিলেন।” এর পর নবী হনানিয় নবী ইয়ারমিয়ার ঘাড় থেকে জোয়ালটা নিয়ে ভেংগে ফেললেন। তারপর তিনি সমস্ত লোকদের সামনে বললেন, “মাবুদ বলছেন, ‘এইভাবে আমি দুই বছরের মধ্যে সমস্ত জাতির ঘাড় থেকে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের জোয়াল ভেংগে ফেলব।’ ” তখন নবী ইয়ারমিয়া সেখান থেকে চলে গেলেন। হনানিয় জোয়ালটা ভেংগে ফেলবার কিছুদিন পর মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “তুমি গিয়ে হনানিয়কে বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘তুমি কাঠের জোয়াল ভেংগে ফেলেছ কিন্তু তার জায়গায় দেওয়া হবে লোহার জোয়াল। আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, এই সব জাতি যাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের গোলাম হয় সেইজন্য আমি তাদের ঘাড়ে লোহার জোয়াল চাপিয়ে দেব, আর তারা তার সেবা করবেই করবে। এমন কি, আমি তাকে বুনো পশুদের উপরেও কর্তা করব।’ ” তখন নবী ইয়ারমিয়া নবী হনানিয়কে বললেন, “হনানিয়, শুনুন। মাবুদ আপনাকে পাঠান নি, কিন্তু আপনি এই জাতিকে মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করাচ্ছেন। কাজেই মাবুদ বলছেন, ‘আমি তোমাকে দুনিয়ার উপর থেকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছি। এই বছরেই তুমি মারা যাবে, কারণ তুমি মাবুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা তবলিগ করেছ।’ ” সেই বছরের সপ্তম মাসে নবী হনানিয় মারা গেলেন। বন্দীদের মধ্যে বেঁচে থাকা বৃদ্ধ নেতাদের, ইমামদের ও নবীদের এবং অন্য যে সব লোকদের বখতে-নাসার জেরুজালেম থেকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কাছে নবী ইয়ারমিয়া জেরুজালেম থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীন, তাঁর মা, রাজকর্মচারীরা, এহুদা ও জেরুজালেমের নেতারা, কারিগর ও কর্মকারেরা বন্দী হয়ে জেরুজালেম থেকে যাবার পরে এই চিঠি লেখা হয়েছিল। শাফনের ছেলে ইলাসাহ্‌ ও হিল্কিয়ের ছেলে গমরিয়কে এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয় বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, আর তাদেরই হাতে ইয়ারমিয়া চিঠিখানা দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল: ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যাদের বন্দী হিসাবে জেরুজালেম থেকে ব্যাবিলনে পাঠিয়েছেন তাদের সকলের কাছে বলছেন, “তোমরা ঘর-বাড়ী তৈরী করে বাস কর; বাগান করে তার ফল খাও। বিয়ে করে ছেলে ও মেয়ের জন্ম দাও; তোমাদের ছেলে ও মেয়েদের বিয়ে দাও যাতে তাদেরও ছেলেমেয়ে হয়। সেখানে তোমাদের সংখ্যা বাড়াবে, কমাবে না। এছাড়া যে শহরে আমি তোমাদের বন্দী হিসাবে নিয়ে গেছি সেখানকার উন্নতির চেষ্টা কর। এর জন্য আমার কাছে মুনাজাত কর, কারণ যদি সেই শহরের উন্নতি হয় তবে তোমাদেরও উন্নতি হবে। তোমাদের মধ্যেকার নবী ও গণকেরা যেন তোমাদের না ঠকায়। তারা যে সব স্বপ্ন দেখে তাতে তোমরা মনোযোগ দিয়ো না। তারা আমার নাম করে মিথ্যা কথা বলে। আমি মাবুদ তাদের পাঠাই নি। “ব্যাবিলন সম্বন্ধে যে সত্তর বছরের কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হলে পর আমি তোমাদের দিকে মনোযোগ দেব; আমি যে উপকার করবার ওয়াদা করেছিলাম তা পূর্ণ করব, অর্থাৎ তোমাদের এই জায়গায় ফিরিয়ে আনব। তোমাদের জন্য আমার পরিকল্পনার কথা আমিই জানি; তা তোমাদের উপকারের জন্য, অপকারের জন্য নয়। সেই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তোমাদের ভবিষ্যতের আশা পূর্ণ হবে। তখন তোমরা আমাকে ডাকবে ও আমার কাছে এসে মুনাজাত করবে, আর আমি তোমাদের কথা শুনব। যখন তোমরা আমাকে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী হবে তখন আমাকে জানতে পারবে। তোমরা আমাকে জানতে পারবে, আর আমি তোমাদের বন্দীদশা থেকে ফিরিয়ে আনব। যে সব জাতি ও জায়গার মধ্যে আমি তোমাদের দূর করে দিয়েছি সেখান থেকে আমি তোমাদের জমায়েত করব। যে জায়গা থেকে আমি তোমাদের বন্দী করে নিয়ে গেছি আমি সেখানেই তোমাদের ফিরিয়ে আনব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” আপনারা হয়তো বলবেন, “মাবুদ ব্যাবিলনে আমাদের জন্য আমাদের মধ্য থেকে নবীদের তুলেছেন,” কিন্তু দাউদের সিংহাসনে বসা বাদশাহ্‌র বিষয়ে এবং এই শহরের বাদবাকী সমস্ত লোকদের বিষয়ে, অর্থাৎ আপনাদের দেশের লোক যারা আপনাদের সংগে বন্দী হয়ে যায় নি তাদের সকলের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী পাঠিয়ে দেব এবং আমি তাদের এমন খারাপ ডুমুরের মত করব যা পচা বলে খাওয়া যায় না। আমি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী নিয়ে তাদের পিছনে তাড়া করব এবং দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যের কাছে তাদের ভয়ের পাত্র করে তুলব। যে সব জাতির মধ্যে আমি তাদের তাড়িয়ে দেব তাদের কাছে তাদের করে তুলব ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও ঘৃণার পাত্র। তাদের অবস্থা দেখে লোকেরা হতভম্ব হবে ও তাদের নাম বদদোয়া হিসাবে ব্যবহার করবে। এর কারণ হল, যে কথা আমি বারে বারে আমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের দিয়ে তাদের কাছে বলে পাঠিয়েছি তা তারা শোনে নি। “সেইজন্য তোমরা বন্দীরা, যাদের আমি জেরুজালেম থেকে ব্যাবিলনে পাঠিয়ে দিয়েছি, তোমরা সবাই আমার কথা শোন। কোলায়ের ছেলে আহাব ও মাসেয়ের ছেলে সিদিকিয়, যারা আমার নাম করে তোমাদের কাছে মিথ্যা কথা বলছে তাদের সম্বন্ধে আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাতে তাদের তুলে দেব, আর সে তোমাদের চোখের সামনেই তাদের হত্যা করবে। ব্যাবিলনে থাকা এহুদার সমস্ত বন্দীরা তাদের কথা মনে করে এই বদদোয়া ব্যবহার করবে, ‘মাবুদ তোমাকে সিদিকিয় ও আহাবের মত করুন, যাদের ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ আগুনে পুড়িয়েছিলেন,’ কারণ তারা বনি-ইসরাইলদের মধ্যে জঘন্য কাজ করেছে; তারা প্রতিবেশীদের স্ত্রীদের সংগে জেনা করেছে এবং আমি তাদের যা বলতে বলি নি তারা আমার নাম করে সেই সব মিথ্যা কথা বলেছে। আমি তা জানি এবং আমি তার সাক্ষী। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ ইয়ারমিয়াকে নিহিলামীয় শময়িয়কে বলতে বললেন যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তুমি নিজের নামে জেরুজালেমের সব লোকদের কাছে, মাসেয়ের ছেলে ইমাম সফনিয়ের কাছে এবং অন্য সব ইমামদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছ। তুমি সফনিয়কে লিখেছ, ‘মাবুদ তোমাকে যিহোয়াদার জায়গায় ইমাম নিযুক্ত করেছেন যাতে মাবুদের ঘরের ভার তোমার উপর থাকে। কোন পাগল যদি নবীর মত কাজ করে তবে হাড়িকাঠ ও গলায় লোহার বেড়ী দিয়ে তাকে তোমার বন্ধ করা উচিত। কাজেই অনাথোতের ইয়ারমিয়া যখন তোমাদের কাছে নবীর মত কথা বলছে তখন তাকে তুমি শাস্তি দাও নি কেন? সে তো ব্যাবিলনে আমাদের কাছে এই খবর পাঠিয়েছে যে, অনেক দিন আমাদের এখানে থাকতে হবে। সেইজন্য আমরা যেন ঘর-বাড়ী তৈরী করে এখানে বাস করি এবং বাগান করে তার ফল ভোগ করি।’ ” ইমাম সফনিয় কিন্তু সেই চিঠিটা নবী ইয়ারমিয়ার কাছে পড়লেন। তখন মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “তুমি সমস্ত বন্দীদের কাছে এই খবর পাঠিয়ে দাও যে, নিহিলামীয় শময়িয়ের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, ‘আমি শময়িয়কে পাঠাই নি, তবুও সে তোমাদের কাছে নিজেকে নবী হিসাবে দেখিয়ে মিথ্যা কথায় তোমাদের বিশ্বাস করিয়েছে। আমি নিশ্চয়ই নিহিলামীয় শময়িয় ও তার বংশধরদের শাস্তি দেব। এই জাতির মধ্যে তার কেউ থাকবে না এবং আমি আমার বান্দাদের জন্য যে সব উপকার করব তা-ও সে দেখতে পাবে না, কারণ সে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রচার করেছে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” মাবুদের কাছ থেকে এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি, আমি তোমাকে যে সমস্ত কথা বলেছি তা সব তুমি একটা কিতাবে লিখে রাখ, কারণ এমন দিন আসছে যখন আমি আমার বান্দা ইসরাইল ও এহুদার অবস্থা ফিরাব এবং যে দেশ আমি তাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছিলাম সেই দেশে তাদের ফিরিয়ে আনব, আর তা তাদের দখলে থাকবে।” ইসরাইল ও এহুদা সম্বন্ধে মাবুদ এই কথা বললেন, “আমি মাবুদ বলছি, শান্তির চিৎকার নয় বরং ভীষণ ভয়ের চিৎকার শোনা গেছে। তোমরা জিজ্ঞাসা করে দেখ, পুরুষ কি গর্ভে সন্তান ধরতে পারে? তাহলে কেন আমি প্রত্যেকটি শক্তিশালী পুরুষকে প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করা স্ত্রীলোকের মত পেটের উপর হাত রাখতে ও সকলের মুখ মৃত্যুর মত ফ্যাকাশে দেখতে পাচ্ছি? হায়, সেই দিনটা কি ভয়ংকর হবে! সেই রকম আর কোন দিন হবে না। তখন হবে ইয়াকুবের কষ্টের সময়, কিন্তু তা থেকে তাকে উদ্ধার করা হবে। “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, সেই দিন আমি তাদের ঘাড় থেকে জোয়াল ভেংগে ফেলব এবং তাদের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলব; বিদেশীরা আর তাদের গোলাম করে রাখবে না। তার বদলে তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ও তাদের বাদশাহ্‌ দাউদের একজন বংশধরের সেবা করবে যাঁকে আমি তাদের বাদশাহ্‌ করব। “কাজেই হে আমার গোলাম ইয়াকুব, ভয় কোরো না; হে ইসরাইল, উৎসাহহীন হোয়ো না। আমি দূরের জায়গা থেকে তোমাকে ও বন্দী থাকা দেশ থেকে তোমার সন্তানদের নিশ্চয়ই উদ্ধার করব। ইয়াকুব আবার শান্তি ও নিরাপদ বোধ করবে এবং কেউ তাকে ভয় দেখাবে না। আমি তোমার সংগে সংগে আছি এবং আমি তোমাকে উদ্ধার করব। যে সব জাতির মধ্যে আমি তোমাদের ছড়িয়ে রেখেছিলাম আমি তাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করব, কিন্তু তোমাদের আমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করব না। তবে একেবারে শাস্তি না দিয়েও আমি তোমাদের ছাড়ব না, কিন্তু ন্যায়বিচার দিয়ে আমি তোমাদের শাসন করব।” মাবুদ বলছেন, “তোমার ঘা ভাল করা যায় না, তোমার আঘাত চিকিৎসার বাইরে। তোমার পক্ষে কথা বলবার কেউ নেই, তোমার আঘাতের ওষুধ নেই, তোমার ভাল হওয়ার কোন আশাও নেই। তোমার সব প্রেমিকেরা তোমাকে ভুলে গেছে; তারা তোমার বিষয় ভাবে না। আমি তোমাকে শত্রুর আঘাতের মত আঘাত করেছি এবং নিষ্ঠুরের মত শাস্তি দিয়েছি, কারণ তোমার অন্যায় খুব বেশী আর তোমার গুনাহ্‌ অনেক। তোমার আঘাত যখন ভাল করা যাবে না তখন তোমার ব্যথার জন্য কেন তুমি চিৎকার করছ? তোমার অনেক অন্যায় ও গুনাহের জন্যই আমি তোমার প্রতি এই সব করেছি। “কিন্তু যারা তোমাকে শেষ করে দিচ্ছে তাদের সবাইকে শেষ করে ফেলা হবে; তোমার সব শত্রুরা বন্দীদশায় যাবে। যারা তোমাকে লুট করছে তাদেরও লুট করা হবে; যারা তোমার জিনিস কেড়ে নিচ্ছে আমি তাদের জিনিসও কেড়ে নিতে দেব। লোকে তোমাকে বলে, ‘এই সেই দূর করে দেওয়া সিয়োন যার খোঁজ কেউ করে না, কিন্তু তবুও আমি তোমার স্বাস্থ্য ফিরাব এবং তোমার আঘাত ভাল করে দেব।’ ” মাবুদ বলছেন, “আমি ইয়াকুবের বংশের লোকদের অবস্থা ফিরাব এবং তাদের উপরে মমতা করব। শহরটাকে তার ধ্বংসস্থানের উপরে আবার গড়ে তোলা হবে আর রাজবাড়ীটা দাঁড়িয়ে থাকবে তার আগের জায়গায়। সেগুলো থেকে বের হবে শুকরিয়ার কাওয়ালী আর আনন্দের শব্দ। আমি তাদের লোকসংখ্যা বাড়াব, তারা কমে যাবে না। আমি তাদের সম্মানিত করে তুলব, তাদের কেউ তুচ্ছ করবে না। তাদের ছেলেমেয়েরা আগের দিনের মতই হবে, আর আমার সামনেই তাদের সমাজ স্থাপিত হবে। যারা তাদের জুলুম করবে আমি তাদের শাস্তি দেব। তাদের নেতা হবে তাদেরই একজন; তাদের মধ্য থেকেই তাদের শাসনকর্তা উঠবে। আমি তাকে ডাকব আর সে আমার কাছে আসবে, কারণ আমি না ডাকলে কে সাহস করে আমার কাছে আসতে পারে? কাজেই তোমরা আমার বান্দা হবে আর আমি তোমাদের আল্লাহ্‌ হব।” দেখ, মাবুদের রাগ ঝড়ের মত ফেটে পড়বে, তাড়িয়ে নেওয়া একটা বাতাস ঘুরে ঘুরে দুষ্টদের মাথার উপরে নেমে আসবে। মাবুদ যে পর্যন্ত না তাঁর দিলের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে কাজে লাগান সেই পর্যন্ত তাঁর ভয়ংকর রাগ ফিরে যাবে না। ভবিষ্যতে তোমরা এটা বুঝতে পারবে। মাবুদ বলছেন, “সেই সময় আমি ইসরাইলের সব গোষ্ঠীরই আল্লাহ্‌ হব, আর তারা আমার বান্দা হবে।” মাবুদ আরও বলছেন, “বনি-ইসরাইলরা যখন বিশ্রাম পাবার জন্য যাচ্ছিল তখন যারা যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচেছিল তারা মরুভূমিতে আমার রহমত পেয়েছিল।” সেই সময় বনি-ইসরাইলরা বলেছিল যে, মাবুদ দূর থেকে তাদের দেখা দিয়েছিলেন। তখন মাবুদ তাদের বলেছিলেন, “অশেষ মহব্বত দিয়ে আমি তোমাদের মহব্বত করেছি; অটল মহব্বত দিয়ে আমি তোমাদের কাছে টেনেছি।” এখন তিনি বলছেন, “হে ইসরাইল, আমি তোমাকে আবার গড়ে তুলব, তাতে তুমি আবার গড়ে উঠবে। তুমি আবার তোমার খঞ্জনি নেবে এবং আনন্দকারীদের সংগে নাচতে যাবে। সামেরিয়ার পাহাড়ে আবার তুমি আংগুর ক্ষেত করবে; যারা ক্ষেত করবে তারা তার ফল খাবে। এমন একদিন আসবে যখন আফরাহীমের পাহাড়ের উপরে পাহারাদারেরা চেঁচিয়ে বলবে, ‘চল, আমরা সিয়োনে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে যাই।’ ” মাবুদ বলছেন, “তোমরা ইয়াকুবের জন্য খুশী মনে গজল গাও; সবচেয়ে সেরা জাতির জন্য আনন্দধ্বনি কর। তোমরা প্রশংসা করে বল, ‘হে মাবুদ, তোমার বান্দাদের, ইসরাইলের বেঁচে থাকা লোকদের উদ্ধার কর।’ দেখ, আমি উত্তরের দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের নিয়ে আসব আর দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে তাদের জমায়েত করব। তাদের মধ্যে থাকবে অন্ধ, খোঁড়া, গর্ভবতী মা এবং প্রসব ব্যথা ওঠা স্ত্রীলোক; মস্ত বড় একটা দল ফিরে আসবে। তারা কাঁদতে কাঁদতে আসবে; আমি যখন তাদের ফিরিয়ে আনব তখন তারা মুনাজাত করতে করতে আসবে। সমান পথ দিয়ে আমি পানির স্রোতের কাছে তাদের চালিয়ে নিয়ে আসব; সেখানে তারা উচোট খাবে না, কারণ আমি ইসরাইলের, অর্থাৎ আফরাহীমের পিতা আর সে আমার প্র্রথম সন্তান। “হে জাতিরা, আমার কালাম শোন; তোমরা দূরের দেশগুলোতে এই কথা ঘোষণা কর, ‘যিনি ইসরাইলকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি তাদের জমায়েত করবেন এবং রাখালের মত করে তাঁর পাল রক্ষা করবেন।’ আমি মাবুদই ইয়াকুবকে ছাড়িয়ে আনব এবং তাদের চেয়েও শক্তিশালীদের হাত থেকে তাদের মুক্ত করব। তারা এসে সিয়োনের উঁচু জায়গায় আনন্দধ্বনি করবে; আমার দেওয়া প্রচুর শস্য, নতুন আংগুর-রস, তেল, ভেড়া ও গরুর পালের বাচ্চা পেয়ে তারা আনন্দ করবে। তারা হবে ভাল করে পানি দেওয়া বাগানের মত; তারা আর দুর্বল হবে না। যুবতী মেয়েরা নাচবে ও আনন্দ করবে, যুবক এবং বুড়ো লোকেরাও বাদ যাবে না। আমি তাদের শোক খুশীতে বদলে দেব; দুঃখের বদলে আমি তাদের দেব সান্ত্বনা ও আনন্দ। সব কিছু প্রচুর পরিমাণে দিয়ে আমি ইমামদের পূর্ণ করব, আর আমার বান্দারা আমার দোয়ায় তৃপ্ত হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “রামায় বিলাপ ও ভীষণ কান্নাকাটির শব্দ শোনা যাচ্ছে; রাহেলা তার সন্তানদের জন্য কাঁদছে, কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না, কারণ তারা আর নেই। তোমার কান্নাকাটি থামাও ও চোখের পানি মুছ, কারণ তোমার কাজের পুরস্কার তুমি পাবে। তারা শত্রুদের দেশ থেকে ফিরে আসবে। কাজেই তোমার ভবিষ্যতের জন্য আশা আছে। তোমার ছেলেমেয়েরা নিজেদের দেশে ফিরে আসবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “আমি অবশ্যই আফরাহীমের এই কাতর স্বর শুনেছি, ‘তুমি আমাকে অবাধ্য বাছুরের মত করে শাসন করেছ, আর তার ফলে আমি শাস্তি পেয়েছি। আমাকে ফিরাও, তাতে আমি ফিরব, কারণ তুমিই আমার মাবুদ আল্লাহ্‌। আমি বিপথে যাওয়ার পর দুঃখিত হয়ে ফিরলাম, বুঝতে পেরে বুক চাপড়ালাম। আমি লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করলাম, কারণ আমার যুবা বয়সের গুনাহের জন্য আমাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে।’ আফরাহীম কি আমার প্রিয় পুত্র নয়? সে কি সেই সন্তান নয় যাকে দেখে আমি খুশী হই? যদিও আমি প্রায়ই তার বিরুদ্ধে কথা বলেছি কিন্তু তবুও আমি তাকে সব সময় মনে রাখি। সেইজন্যই আমার প্রাণ তার জন্য কাঁদে; তার জন্য আমার খুব মমতা আছে। “তোমরা রাস্তায় রাস্তায় পথ নির্দেশ-করা চিহ্ন দাও ও খুঁটি স্থাপন কর। যে পথে তুমি গিয়েছিলে সেই রাজপথের কথা মনে রাখ। হে ইসরাইল, ফিরে এস, তোমার সব শহরে তুমি ফিরে এস। হে বিপথে যাওয়া কন্যা, আর কতকাল তুমি ঘুরে বেড়াবে? আমি মাবুদ দুনিয়াতে একটা নতুন ব্যাপার ঘটিয়েছি, তা হল, স্ত্রীলোক পুরুষকে ঘেরাও করবে।” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “আমি যখন বন্দীদশা থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনব তখন এহুদা দেশ ও তার শহরগুলোর লোকেরা আবার বলবে, ‘হে সততাপূর্ণ বাসস্থান, হে পবিত্র পাহাড়, মাবুদ তোমাকে দোয়া করুন।’ সেই লোকেরা এহুদা ও তার সব শহরগুলোতে বাস করবে এবং চাষীরা ও যারা তাদের পশুপাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারাও সেখানে থাকবে। আমি ক্লান্তদের সতেজ করে তুলব এবং দুর্বলদের দিল শক্তিশালী করব।” তখন আমি জেগে উঠে চারপাশে তাকালাম। আমার ঘুম আমার কাছে আরামের ছিল। মাবুদ বলছেন, “সময় আসছে যখন আমি ইসরাইল ও এহুদা দেশে লোকদের ও পশুদের চারার মত লাগিয়ে দেব। আমি যেমন করে তাদের উপ্‌ড়ে, ভেংগে ও ছুঁড়ে ফেলবার দিকে এবং তাদের উপর ধ্বংস ও বিপদ আনবার দিকে খেয়াল রেখেছিলাম তেমনি করে তাদের গড়ে তুলবার ও চারার মত লাগিয়ে দেবার দিকেও খেয়াল রাখব। সেই সময় লোকেরা আর বলবে না, ‘বাবারা টক আংগুর খেয়েছে, কিন্তু সন্তানদের দাঁত টকে গেছে।’ তার বদলে প্রত্যেকে নিজের গুনাহের জন্যই মরবে; যে টক আংগুর খাবে তার নিজের দাঁতই টকে যাবে।” মাবুদ বলছেন, “সময় আসছে যখন আমি ইসরাইল ও এহুদার লোকদের জন্য একটা নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করব। মিসর দেশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের আমি হাত ধরে বের করে আনবার সময় তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম এই নতুন ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থার মত হবে না। আমি যদিও তাদের স্বামীর মত ছিলাম তবুও তারা আমার ব্যবস্থা ভেংগেছিল। পরে আমি বনি-ইসরাইলদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করব তা হল, আমার শরীয়ত আমি তাদের মনের মধ্যে রাখব এবং তাদের দিলেও তা লিখে রাখব। আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব আর তারা আমারই বান্দা হবে। নিজের প্রতিবেশীকে এবং নিজের ভাইকে কেউ এই বলে আর কখনও শিক্ষা দেবে না, ‘মাবুদকে চিনতে শেখ,’ কারণ সবাই আমাকে চিনবে। সেইজন্য আমি তাদের অন্যায় মাফ করব, তাদের গুনাহ্‌ আর কখনও মনে রাখব না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” যিনি দিনের বেলায় সূর্যকে আর রাতের বেলায় চাঁদ ও তারাকে আলো দেবার জন্য হুকুম দেন, যিনি সমুদ্রকে তোলপাড় করেন যাতে তার ঢেউগুলো গর্জন করে, যাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তিনি বলছেন, “যদি এই নিয়মগুলো আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় তবে বনি-ইসরাইলরাও জাতি হিসাবে আমার সামনে থেকে শেষ হয়ে যাবে। যদি উপরের আসমানকে মাপা যায় এবং নীচে দুনিয়ার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় তবে বনি-ইসরাইলরা যা করেছে তার জন্য আমি তাদের অগ্রাহ্য করতে পারি। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “সেই সময় আসছে যখন আমার জন্য হননেল-কেল্লা থেকে কোণার দরজা পর্যন্ত এই শহরটা আবার গড়ে তোলা হবে। মাপের দড়ি সেখান থেকে সোজা গারেব পাহাড় পর্যন্ত টানা হবে এবং তারপর ঘুরে গোয়াতে যাবে। গোটা উপত্যকাটা যেখানে লাশ ও ছাই ফেলা হয় এবং পূর্ব দিকে ঘোড়া-দরজার কোণা পর্যন্ত কিদ্রোণ উপত্যকার সমস্ত মাঠ মাবুদের উদ্দেশ্যে পবিত্র করে রাখা হবে। শহরটাকে আর কখনও উপ্‌ড়ে ফেলা বা ধ্বংস করা হবে না।” এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের দশম বছরে, অর্থাৎ বখতে-নাসারের রাজত্বের আঠারো বছরের সময় মাবুদের কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হয়েছিল। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সৈন্যদল তখন জেরুজালেম ঘেরাও করছিল এবং ইয়ারমিয়া এহুদার রাজবাড়ীর পাহারাদারদের উঠানে বন্দী ছিলেন। তিনি সেখানে ছিলেন, কারণ এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয় এই কথা বলে তাঁকে বন্দী করেছিলেন, “তুমি এই কথা বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছ যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমি এই শহরকে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি এবং সে এটা দখল করবে। এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাত থেকে রেহাই পাবে না বরং তাদের বাদশাহ্‌র হাতে তাকে অবশ্যই তুলে দেওয়া হবে। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র মুখোমুখি হয়ে সে কথা বলবে এবং নিজের চোখে তাকে দেখবে। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে ব্যাবিলনে নিয়ে যাবে এবং যে পর্যন্ত না আমি তার দিকে মনোযোগ দেব সেই পর্যন্ত সে সেখানেই থাকবে। সেইজন্য ব্যাবিলনীয়দের সংগে যুদ্ধ করলেও তোমরা সফল হবে না।’ ” সেই সময় ইয়ারমিয়া বলেছিলেন, “মাবুদ আমাকে বললেন যে, আমার চাচা শল্লুমের ছেলে হনমেল আমার কাছে এসে বলবে, ‘অনাথোতে আমার যে জমিটা আছে তুমি সেটা কেনো, কারণ নিকট আত্মীয় হিসাবে সেটা কেনার অধিকার তোমার।’ তখন মাবুদের কথামতই আমার চাচার ছেলে হনমেল পাহারাদারদের উঠানে আমার কাছে এসে বলল, ‘বিন্‌ইয়ামীন এলাকার অনাথোতে আমার যে জমি আছে সেটা তুমি কেনো। এটা মুক্ত করবার ও দখল করবার অধিকার যখন তোমার তখন তুমিই সেটা নিজের জন্য কেনো।’ “আমি জানতাম এটা মাবুদেরই কালাম; কাজেই আমার চাচার ছেলে হনমেলের কাছ থেকে আমি অনাথোতের সেই জমিটা কিনলাম এবং একশো সাতাশি গ্রাম রূপা আমি তাকে ওজন করে দিলাম। আমি দলিলে স্বাক্ষর করলাম, সীলমোহর করলাম ও সাক্ষী রাখলাম এবং দাঁড়িপাল্লায় সেই রূপা ওজন করে দিলাম। আমি দু’টা দলিলই নিলাম-নিয়ম ও শর্ত লেখা সীলমোহর করা একটা ও সীলমোহর না করা আর একটা। তারপর আমি আমার চাচার ছেলে হনমেলের সামনে ও যে সাক্ষীরা দলিলে স্বাক্ষর করেছিল তাদের ও পাহারাদারদের উঠানে বসা সমস্ত ইহুদীদের সামনে সেই দলিলটা নেরিয়ের ছেলে বারূককে দিলাম। এই নেরিয় মহসেয়ের ছেলে। কারণ এই দেশে ঘর-বাড়ী, জায়গা-জমি ও আংগুর ক্ষেত আবার কেনা-বেচা চলবে। আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।’ “জমি কেনার দলিলটা নেরিয়ের ছেলে বারূককে দেবার পর আমি মাবুদের কাছে এই মুনাজাত করলাম, ‘হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি তোমার মহাশক্তি ও ক্ষমতাপূর্ণ হাত দিয়ে আসমান ও জমীন তৈরী করেছ। তোমার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তুমি হাজার হাজার জনকে তোমার অটল মহব্বত দেখিয়ে থাক এবং পিতাদের গুনাহের শাস্তি তুমি তাদের পরে তাদের সন্তানদের দিয়ে থাক। হে মহান ও শক্তিশালী মাবুদ, তোমার নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন; তোমার উদ্দেশ্য মহান ও তোমার সব কাজ শক্তিপূর্ণ। মানুষের সব চালচলনের দিকে তোমার চোখ খোলা রয়েছে; তুমি প্রত্যেকজনকে তার চালচলনের ও কাজের ফল দিয়ে থাক। তুমি মিসর দেশে অনেক অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়েছিলে এবং আজও পর্যন্ত ইসরাইল ও সমস্ত মানুষের মধ্যে সেই সব করে চলেছ, আর তাতে তুমি সুনাম লাভ করেছ। তুমি অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়ে এবং শক্তিশালী ও ক্ষমতাপূর্ণ হাত বাড়িয়ে ভীষণ ভয়ের সংগে তোমার বান্দা ইসরাইলকে সেখান থেকে বের করে এনেছিলে। যে দেশে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই সেই দেশ দেবার কথা তুমি তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কসম খেয়েছিলে এবং তা তাদের দিয়েছিলে। তারা এসে তা অধিকার করেছিল, কিন্তু তারা তোমার কথা শোনে নি আর তোমার শরীয়ত মত চলে নি; তুমি যা করতে তাদের হুকুম দিয়েছিলে তার কিছুই তারা করে নি। কাজেই এই সমস্ত বিপদ তুমি তাদের উপর এনেছ। শহরটা নিয়ে নেবার জন্য কেমন করে দেয়ালের সংগে লাগিয়ে ঢিবি তৈরী করা হচ্ছে তা তুমি দেখ। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর মধ্য দিয়ে শহরটা আক্রমণকারী ব্যাবিলনীয়দের হাতে যাবে। তুমি তো দেখতে পাচ্ছ যে, তুমি যা বলেছিলে তা-ই হয়েছে, কিন্তু হে আল্লাহ্‌ মালিক, যদিও শহরটা ব্যাবিলনীয়দের হাতে যাবে তবুও তুমি আমাকে বলেছিলে যে, আমি যেন রূপা দিয়ে জমিটা কিনি এবং সেই কাজের সাক্ষী রাখি।’ ” পরে মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “আমি মাবুদ, সমস্ত মানুষের আল্লাহ্‌। কোন কিছু করা কি আমার পক্ষে অসম্ভব? কাজেই আমি এই শহরটা ব্যাবিলনীয়দের ও তাদের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি। সে এটা দখল করবে। যে ব্যাবিলনীয়রা শহরটা আক্রমণ করছে তারা শহরে ঢুকে তাতে আগুন লাগিয়ে দেবে। যে সব বাড়ী-ঘরের ছাদের উপরে লোকেরা বাল দেবতার উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়ে এবং অন্যান্য দেব-দেবীর উদ্দেশে ঢালন-কোরবানী করে আমাকে অসন্তুষ্ট করেছে তারা সেই সব বাড়ী-ঘর সুদ্ধ শহরটা পুড়িয়ে দেবে। “ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা ছোটকাল থেকে আমার চোখে কেবল খারাপ ছাড়া আর কিছু করে নি; সত্যিই ইসরাইলের লোকেরা তাদের হাতের তৈরী জিনিস দিয়ে আমাকে কেবল অসন্তুষ্টই করেছে। যেদিন এই শহরটা তৈরী হয়েছিল সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত সেটা আমার রাগ ও ক্রোধ এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছে যে, আমার চোখের সামনে থেকে আমি ওটা সরিয়ে দেবই, কারণ ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা, তাদের সব বাদশাহ্‌ ও রাজকর্মচারীরা, ইমাম ও নবীরা এবং এহুদা ও জেরুজালেমের লোকেরা তাদের সমস্ত খারাপ কাজের দ্বারা আমাকে অসন্তুষ্ট করেছে। তারা আমার দিকে পিঠ ফিরিয়েছে, মুখ নয়; যদিও আমি বারে বারে তাদের শিক্ষা দিয়েছি তবুও তারা আমার শাসন মানে নি, গ্রহণও করে নি। আমার ঘরে তারা তাদের জঘন্য মূর্তিগুলো বসিয়ে তা নাপাক করেছে। তারা মোলক দেবতার উদ্দেশে তাদের ছেলেমেয়েদের কোরবানী দেবার জন্য বিন্‌-হিন্নোম উপত্যকায় বাল দেবতার উদ্দেশে পূজার উঁচু স্থান তৈরী করেছে। আমি কখনও সেই হুকুম দিই নি কিংবা আমার মনেও তা ঢোকে নি যে, তারা এই রকম জঘন্য কাজ করে এহুদাকে গুনাহ্‌ করাবে। “তোমরা এই শহরের বিষয়ে বলছ, ‘যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মধ্য দিয়ে এটা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে’; কিন্তু আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি যে, আমার ভীষণ রাগ এবং জ্বলন্ত ও ভয়ংকর ক্রোধে আমি তাদের যে সব দেশে দূর করে দিয়েছিলাম সেখান থেকে আমি নিশ্চয়ই তাদের জমায়েত করব। আমি এই জায়গায় তাদের ফিরিয়ে আনব এবং নিরাপদে বাস করতে দেব। তারা আমার বান্দা হবে ও আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব। আমি তাদের এমন মন ও স্বভাব দেব যা কেবল আমারই দিকে আসক্ত থাকবে; তাতে তারা তাদের নিজেদের ও তাদের পরে তাদের ছেলেমেয়েদের উপকারের জন্য সব সময় আমাকে ভয় করবে। আমি তাদের জন্য এই চিরস্থায়ী ব্যবস্থা স্থাপন করব যে, আমি তাদের উপকার করা কখনও বন্ধ করব না। আমি তাদের মনে ভয় জাগাব যাতে তারা কখনও আমার কাছ থেকে ফিরে না যায়। আমি খুশী মনে তাদের উপকার করব এবং আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে এই দেশে নিশ্চয়ই তাদের চারার মত লাগিয়ে দেব। “আমি এই লোকদের উপর যেমন এই সব মহা বিপদ এনেছি তেমনি তাদের কাছে আমার ওয়াদা করা সমস্ত উপকার আমি তাদের দান করব। যে দেশের বিষয়ে তোমরা বলতে, ‘এটা একটা পতিত জমি, এতে মানুষ কিংবা পশু কিছুই নেই, কারণ এটা ব্যাবিলনীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে,’ সেই দেশে আবার জমি কেনা-বেচা হবে। বিন্‌ইয়ামীন এলাকায়, জেরুজালেমের চারপাশের এলাকায়, এহুদার ও নেগেভের সব গ্রাম ও শহরে এবং উঁচু ও নীচু পাহাড়ী এলাকার সব গ্রাম ও শহরে টাকা দিয়ে ক্ষেত কেনা হবে ও দলিলে স্বাক্ষর ও সীলমোহর দেওয়া হবে এবং সাক্ষী রাখা হবে, কারণ আমি তাদের অবস্থা ফিরাব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” ইয়ারমিয়া তখনও পাহারাদারদের উঠানে বন্দী ছিলেন, এমন সময় দ্বিতীয়বার মাবুদের কালাম তাঁর উপর নাজেল হল। মাবুদ বললেন, “আমার নাম মাবুদ, আমি কাজ করি; যে কাজ আমি করি তার পরিকল্পনা করি এবং তা শেষ করি। আমি বলছি, আমাকে ডাক, আমি তোমাকে জবাব দেব এবং এমন মহৎ ও এমন গোপন বিষয়ের কথা বলব যা তুমি জান না। “তবুও আমি এতে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা আনব; আমার বান্দাদের আমি সুস্থ করব এবং সত্যিকারের শান্তি প্রচুর পরিমাণে ভোগ করতে দেব। আমি এহুদা ও ইসরাইলের লোকদের বন্দীদশা থেকে ফিরিয়ে আনব এবং তাদের দেশটা আবার আগের মতই গড়ে তুলব। আমার বিরুদ্ধে তারা যে সব গুনাহ্‌ করেছে তা থেকে আমি তাদের পাক-সাফ করব এবং আমার বিরুদ্ধে করা তাদের সব অন্যায় ও বিদ্রোহ মাফ করব। তখন এই শহর দুনিয়ার সমস্ত জাতির সামনে আমাকে আনন্দিত ও সম্মানিত করবে এবং গৌরব দান করবে। আমি তার যে সব উপকার করব সেই জাতিরা তা শুনতে পাবে, আর তাকে দেওয়া প্রচুর উন্নতি ও শান্তি দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকবে। এই পতিত জমি, যেখানে মানুষ ও পশু কিছুই নেই, সেখানে এবং সেখানকার সমস্ত শহর ও গ্রামে আবার রাখালদের ভেড়াগুলোর জন্য চারণ ভূমি হবে। উঁচু ও নীচু পাহাড়ী এলাকার সব গ্রাম ও শহরে, বিন্‌ইয়ামীন এলাকায়, জেরুজালেমের চারপাশের এলাকায় এবং এহুদার ও নেগেভের সব গ্রাম ও শহরে যারা ভেড়ার সংখ্যা গোণে তাদের হাতের নীচ দিয়ে আবার ভেড়ার পাল যাওয়া-আসা করবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “ইসরাইল ও এহুদার লোকদের কাছে আমি যে উন্নতির ওয়াদা করেছিলাম সময় আসছে যখন আমি তা পূর্ণ করব। সেই দিনগুলোতে ও সেই সময়ে আমি দাউদের বংশ থেকে একটা সততার চারা গজাতে দেব; যা ন্যায় ও সৎ তিনি দেশের মধ্যে তা-ই করবেন। সেই সময়ে এহুদার লোকেরা উদ্ধার পাবে আর জেরুজালেমের লোকেরা নিরাপদে বাস করবে। তাঁকে এই নামে ডাকা হবে-‘মাবুদ আমাদের ধার্মিকতা।’ ইসরাইলের সিংহাসনে বসবার জন্য দাউদের বংশে কোন লোকের অভাব হবে না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সব সময় পোড়ানো-কোরবানীর, শস্য-কোরবানীর ও পশু-কোরবানী দিতে লেবীয় ইমামদের মধ্যেও লোকের অভাব হবে না।” এর পর মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “আমি মাবুদ বলছি যে, দিন ও রাত সম্বন্ধে আমার যে নিয়ম আছে তা যদি ভাংগা যায় যাতে ঠিক সময়ে রাত বা দিন না হয়, তাহলে আমার গোলাম দাউদের জন্য ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে যারা এবাদত-কাজ করে সেই লেবীয় ইমামদের জন্য আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছি তা-ও ভাংগা যাবে আর দাউদের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করবার জন্য তার কোন বংশধর থাকবে না। আমার গোলাম দাউদের বংশধরদের এবং যে লেবীয়রা আমার সামনে দাঁড়িয়ে এবাদত-কাজ করে তাদের আমি আসমানের তারার মত অসংখ্য করব এবং সমুদ্র-পারের বালির মত করব, যা গোণা যায় না।” তারপর মাবুদ ইয়ারমিয়াকে আরও বললেন, “লোকেরা যে বলছে, ‘মাবুদ ইসরাইল ও এহুদার লোকদের বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু এখন তাদের অগ্রাহ্য করেছেন,’ তা কি তুমি খেয়াল কর নি? তারা আমার বান্দাদের তুচ্ছ করে ও জাতি হিসাবে তাদের আর দেখে না। কিন্তু আমি মাবুদ বলছি, দিন ও রাত সম্বন্ধে আমার ব্যবস্থা যেমন ভাংগা যায় না, আসমান ও জমীন সম্বন্ধে আমার নিয়ম যেমন সব সময় ঠিক থাকে, তেমনি ইয়াকুব ও আমার গোলাম দাউদের বংশধরদের জন্য আমার ব্যবস্থা ঠিক থাকবে এবং ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের বংশধরদের উপর রাজত্ব করবার জন্য আমি দাউদের বংশধরদের অগ্রাহ্য করব না। আমি নিশ্চয়ই তাদের অবস্থা ফিরাব ও তাদের উপর মমতা করব।” তুমি তার হাত থেকে রেহাই পাবে না; তোমাকে নিশ্চয়ই ধরে তার হাতে দেওয়া হবে। তুমি নিজের চোখে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌কে দেখতে পাবে; সে তোমার মুখোমুখি হয়ে তোমার সংগে কথা বলবে, আর তুমি ব্যাবিলনে যাবে। “হে এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়, তবুও তুমি আমার কথা শোন। তোমার সম্বন্ধে আমি বলছি, তুমি তলোয়ারের আঘাতে মারা পড়বে না; তুমি শান্তিতে মারা যাবে। তোমার পূর্বপুরুষ, অর্থাৎ তোমার আগে যে সব বাদশাহ্‌রা ছিল তাদের সম্মান দেখাবার জন্য যেমন আগুন জ্বালানো হয়েছিল লোকে তোমার সম্মানের জন্যও তেমনি আগুন জ্বালাবে এবং ‘হায় মালিক!’ বলে দুঃখ প্রকাশ করবে। আমি মাবুদ নিজেই এই কথা বলছি।” তখন নবী ইয়ারমিয়া জেরুজালেমে এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে সেই সব কথা বললেন। সেই সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সৈন্যেরা জেরুজালেম, লাখীশ ও অসেকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, কারণ এহুদা দেশের মধ্যে কেবল এই দেয়াল-ঘেরা শহরগুলোই অধিকার করে নিতে তাদের বাকী ছিল। পরে মাবুদ আবার ইয়ারমিয়ার সংগে কথা বললেন। এর আগে বাদশাহ্‌ সিদিকিয় জেরুজালেমের সমস্ত লোকদের সংগে গোলামদের মুক্তি ঘোষণার বিষয় নিয়ে নিয়ম স্থির করেছিলেন। সেই নিয়ম হল, প্রত্যেকে তার ইবরানী গোলাম ও বাঁদীকে মুক্ত করে দেবে; কোন ইহুদী ভাইকে কেউ গোলাম করে রাখতে পারবে না। কাজেই সব রাজকর্মচারী ও লোকেরা এই নিয়ম মেনে তাদের গোলাম ও বাঁদীদের মুক্ত করে দিতে রাজী হল এবং তাদের আর গোলাম করে রাখবে না বলে ঠিক করল। তখন তারা তাদের গোলামদের মুক্ত করে দিল। কিন্তু পরে তারা মন বদলে ফেলল এবং যে সব গোলাম ও বাঁদীদের তারা মুক্ত করেছিল তাদের ফিরিয়ে এনে আবার গোলাম বানাল। এইজন্য মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বলেছিলেন, “আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছি যে, আমি যখন তোমাদের পূর্বপুরুষদের মিসর থেকে, গোলামীর দেশ থেকে বের করে এনেছিলাম তখন তাদের জন্য এই নিয়ম স্থির করে বলেছিলাম, ‘যদি কোন ইবরানী ভাই নিজেকে তোমাদের কাছে বিক্রি করে থাকে তবে সপ্তম বছরে তোমরা তাকে মুক্ত করে দেবে। ছয় বছর সে তোমাদের গোলামী করলে পর তোমাদের তাকে ছেড়ে দিতে হবে।’ কিন্তু তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আমার কথা শোনে নি, আমার কথায় মনোযোগও দেয় নি। অল্প কিছুদিন হল তোমরা তওবা করে আমার চোখে যা ঠিক তা-ই করেছিলে, অর্থাৎ তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের ইবরানী ভাইদের মুক্তি ঘোষণা করেছিলে। এমন কি, আমার ঘরে আমার সামনে তোমরা আমার নিয়ম মানবে বলে রাজী হয়েছিলে। কিন্তু এখন তোমরা ঘুরে গেছ এবং আমাকে অসম্মানিত করেছ; তোমরা যে সব গোলাম ও বাঁদীদের তাদের ইচ্ছামত চলে যাবার জন্য মুক্ত করে দিয়েছিলে তোমরা প্রত্যেকে তাদের আবার ফিরিয়ে এনে গোলাম ও বাঁদী বানিয়েছ। “কাজেই আমি বলছি, তোমরা আমার বাধ্য হও নি, কারণ তোমাদের জাতি ভাইদের জন্য তোমরা মুক্তি ঘোষণা কর নি। সেইজন্য আমি এখন তোমাদের জন্য মুক্তি ঘোষণা করছি; সেই মুক্তি হল যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের হাতে পড়বার মুক্তি। আমি তোমাদের অবস্থা এমন করব যা দেখে দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যের লোকেরা ভয়ে আঁত্‌কে উঠবে। সেইজন্য যারা তাদের হত্যা করতে চায় সেই শত্রুদের হাতে আমি তাদের তুলে দেব। তাদের লাশ হবে আকাশের পাখী ও বনের পশুদের খাবার। “যে শত্রুরা এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয় ও তার কর্মচারীদের হত্যা করতে চায় আমি সেই শত্রুদের হাতেই তাদের তুলে দেব। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র যে সৈন্যদল তোমাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিল আমি তাদেরই হাতে তোমাদের তুলে দেব। আমি তাদের হুকুম দিয়ে এই শহরে ফিরিয়ে আনব। তারা এই শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং তা দখল করে পুড়িয়ে দেবে। আমি এহুদার শহরগুলোকে ধ্বংস করে জনশূন্য করব।” ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের সময়ে মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “তুমি রেখবীয় বংশের লোকদের কাছে গিয়ে তাদের আমার ঘরের একটা কামরায় আসতে বল ও তাদের আংগুর-রস খেতে দাও।” তখন আমি হবৎসিনিয়ের নাতি, অর্থাৎ ইয়ারমিয়ার ছেলে যাসিনিয় ও তার সব ভাই ও ছেলেদের, অর্থাৎ রেখবীয়দের গোটা বংশকে নিয়ে আসলাম। আমি তাদের মাবুদের ঘরে আল্লাহ্‌র বান্দা যিগ্‌দলিয়ের ছেলে হাননের ছেলেদের কামরায় নিয়ে গেলাম। সেটা ছিল শল্লুমের ছেলে দারোয়ান মাসেয়ের কামরার উপরে কর্মচারীদের কামরার পাশে। আমি তারপর সেই রেখবীয়দের সামনে আংগুর-রসে পূর্ণ কতগুলো বাটি আর কতগুলো পেয়ালা রেখে তাদের বললাম, “তোমরা আংগুর-রস খাও।” কিন্তু তারা বলল, “আমরা আংগুর-রস খাই না, কারণ আমাদের পূর্বপুরুষ রেখবের ছেলে যিহোনাদব আমাদের এই হুকুম দিয়েছেন, ‘তোমরা কিংবা তোমাদের বংশধরেরা কখনও আংগুর-রস খাবে না। এছাড়া তোমরা কখনও ঘর-বাড়ী তৈরী করবে না, বীজ বুনবে না কিংবা আংগুর ক্ষেত কিনবে না বা চাষ করবে না; কিন্তু সব সময় তাম্বুতে বাস করবে। তাহলে তোমরা যে দেশে বিদেশীর মত থাকবে সেখানে অনেক দিন থাকতে পারবে।’ আমাদের পূর্বপুরুষ রেখবের ছেলে যিহোনাদব আমাদের যা হুকুম দিয়েছিলেন আমরা তা সবই পালন করে আসছি। আমরা, আমাদের স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়েরা কেউ কখনও আংগুর-রস খাই নি, বাস করবার জন্য ঘর বাঁধি নি কিংবা আংগুর ক্ষেত, শস্য কিংবা ফসলের ক্ষেতও করি নি। আমরা তাম্বুতে তাম্বুতে বাস করে আসছি এবং আমাদের পূর্বপুরুষ যিহোনাদব আমাদের যা হুকুম দিয়েছেন তা সবই আমরা পুরোপুরি পালন করে আসছি। কিন্তু যখন ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার এই দেশ আক্রমণ করলেন তখন আমরা বললাম, ‘ব্যাবিলনীয় ও সিরীয় সৈন্যদের কাছ থেকে পালিয়ে চল, আমরা জেরুজালেমে যাই।’ তাই আমরা জেরুজালেমে রয়ে গেছি।” রেখবের ছেলে যিহোনাদব তার ছেলেদের আংগুর-রস খেতে নিষেধ করেছিল আর সেই হুকুম তারা পালন করছে। আজও তারা আংগুর-রস খায় না, কারণ তারা তাদের পূর্বপুরুষের হুকুম মেনে চলে। কিন্তু আমি তোমাদের বারে বারে বলেছি, তবুও তোমরা আমার কথা শোন নি। আমি আমার সমস্ত গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের বারে বারে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি। তারা বলেছে, ‘তোমরা প্রত্যেকে কুপথ থেকে ফেরো এবং তোমাদের চালচলন ভাল কর; দেব-দেবীদের এবাদত করবার জন্য তাদের পিছনে যেয়ো না। তাহলে যে দেশ আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের দিয়েছি সেখানে তোমরা বাস করতে পারবে।’ কিন্তু তোমরা আমার কথায় মনোযোগও দাও নি এবং শোনও নি। রেখবের ছেলে যিহোনাদবের বংশধরেরা তাদের পূর্বপুরুষের দেওয়া হুকুম পালন করে আসছে, কিন্তু তোমরা আমার কথার বাধ্য হও নি। “সেইজন্য আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, ‘শোন, আমি এহুদা ও জেরুজালেমে বাসকারী প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যে সব বিপদের কথা বলেছি তার প্রত্যেকটাই আমি তাদের উপর ঘটাব। আমি তাদের বলেছিলাম, কিন্তু তারা শোনে নি; আমি তাদের ডেকেছিলাম, কিন্তু তারা সাড়া দেয় নি।’ ” এর পরে ইয়ারমিয়া রেখবীয়দের বললেন যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষ যিহোনাদবের হুকুম পালন করেছ এবং তার সব নির্দেশ মত চলেছ ও তার হুকুম মত সব কাজ করেছ। সেইজন্য আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমার এবাদত-কাজ করবার জন্য রেখবের ছেলে যিহোনাদবের বংশে কখনও লোকের অভাব হবে না।” ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের চতুর্থ বছরে মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “তুমি গুটিয়ে রাখা একটা কিতাব নাও এবং ইউসিয়ার রাজত্বের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইসরাইল, এহুদা ও অন্যান্য জাতির বিষয় আমি তোমাকে যে যে কথা বলেছি তা তাতে লেখ। এহুদার লোকদের উপর যে সব বিপদ ঘটাবার বিষয় আমি ঠিক করেছি হয়তো তারা সেই সব কথা শুনে প্রত্যেকে তাদের কুপথ থেকে ফিরবে; তাহলে আমি তাদের অন্যায় ও গুনাহ্‌ মাফ করব।” তখন ইয়ারমিয়া নেরিয়ের ছেলে বারূককে ডাকলেন এবং মাবুদ ইয়ারমিয়াকে যে সব কথা বলেছিলেন তা তাঁর মুখ থেকে শুনে বারূক গুটিয়ে রাখা সেই কিতাবটাতে লিখলেন। তারপর ইয়ারমিয়া বারূককে বললেন, “আমাকে মাবুদের ঘরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল বলে আমি সেখানে যেতে পারি না। কাজেই তুমি একটা রোজা রাখবার দিনে মাবুদের ঘরে গিয়ে এই কিতাবে লেখা মাবুদের কালাম লোকদের কাছে তেলাওয়াত করে শোনাও যা তুমি আমার মুখ থেকে শুনে লিখেছিলে। এহুদার যে লোকেরা তাদের শহর থেকে আসবে তাদের সকলের কাছে তা তেলাওয়াত করবে। হয়তো তারা মাবুদের কাছে মুনাজাত করবে এবং প্রত্যেকে তাদের কুপথ থেকে ফিরবে, কারণ এই লোকদের বিরুদ্ধে মাবুদ খুবই রাগ ও ক্রোধের কথা বলেছেন।” নবী ইয়ারমিয়া নেরিয়ের ছেলে বারূককে যা যা করতে বলেছিলেন তা তিনি সবই করলেন; তিনি মাবুদের ঘরে সেই কিতাব থেকে মাবুদের কালাম তেলাওয়াত করলেন। ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের পঞ্চম বছরের নবম মাসে জেরুজালেমের সমস্ত লোকদের ও এহুদার শহরগুলো থেকে আসা লোকদের জন্য মাবুদের সামনে রোজা রাখবার কথা ঘোষণা করা হল। তখন মাবুদের ঘরের নতুন দরজার কাছে উপরের উঠানে শাফনের ছেলে গমরিয় লেখকের কামরায় দাঁড়িয়ে বারূক সেই কিতাব থেকে ইয়ারমিয়ার কথাগুলো সমস্ত লোকদের কাছে তেলাওয়াত করলেন। শাফনের নাতি, অর্থাৎ গমরিয়ের ছেলে মিকায় যখন সেই কিতাব থেকে মাবুদের সমস্ত কথা শুনলেন, তখন তিনি রাজবাড়ীর মধ্যেকার লেখকের কামরায় গেলেন; সেখানে সব রাজকর্মচারীরা, অর্থাৎ লেখক ইলীশামা, শময়িয়ের ছেলে দলায়, অক্‌বোরের ছেলে ইল্‌নাথন, শাফনের ছেলে গমরিয়, হনানিয়ের ছেলে সিদিকিয় এবং অন্যান্য সব রাজকর্মচারীরা বসে ছিলেন। বারূক সেই কিতাব থেকে লোকদের কাছে যা যা তেলাওয়াত করেছিলেন তা মিকায় সেই রাজকর্মচারীদের কাছে সব বললেন; তখন রাজকর্মচারীরা সকলে নথনিয়ের ছেলে যেহুদীকে দিয়ে বারূককে বলে পাঠালেন, “আপনি যে কিতাব থেকে লোকদের তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন তা নিয়ে আসুন।” নথনিয় ছিল শেলিমিয়ার ছেলে, শেলিমিয়া ছিল কূশির ছেলে। তখন নেরিয়ের ছেলে বারূক সেই কিতাব হাতে করে তাঁদের কাছে গেলেন। তাঁরা বারূককে বললেন, “আপনি দয়া করে বসে আমাদের কাছে ওটা তেলাওয়াত করে শোনান।” তখন বারূক তাঁদের কাছে তা তেলাওয়াত করে শোনালেন। তাঁরা সমস্ত কথা শুনে ভয়ে একে অন্যের দিকে তাকালেন এবং বারূককে বললেন, “এই সব কথা বাদশাহ্‌কে গিয়ে আমাদের জানাতেই হবে।” তারপর তাঁরা বারূককে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের বলুন আপনি কেমন করে এই সব কথা লিখলেন? ইয়ারমিয়ার মুখ থেকে শুনে কি আপনি লিখেছেন?” জবাবে বারূক বললেন, “জ্বী, তিনি আমাকে এই সব কথা বলেছেন আর আমি তা এই কিতাবে কালি দিয়ে লিখেছি।” তখন রাজকর্মচারীরা বারূককে বললেন, “আপনি ও ইয়ারমিয়া গিয়ে লুকিয়ে থাকুন। আপনারা কোথায় আছেন তা যেন কেউ জানতে না পারে।” পরে রাজকর্মচারীরা সেই কিতাবটা লেখক ইলীশামার কামরায় রেখে রাজদরবারে বাদশাহ্‌র কাছে গেলেন এবং তাঁকে সব কথা জানালেন। তখন বাদশাহ্‌ সেই কিতাবটা আনবার জন্য যেহুদীকে পাঠালেন। লেখক ইলীশামার কামরা থেকে যেহুদী কিতাবটা এনে বাদশাহ্‌ ও তাঁর পাশে দাঁড়ানো সব রাজকর্মচারীদের সামনে পড়ে শোনালেন। তখন ছিল বছরের নবম মাস। বাদশাহ্‌ তাঁর শীতকাল কাটাবার ঘরে বসে ছিলেন এবং তাঁর সামনে আগুনের পাত্রে আগুন জ্বলছিল। যেহুদী সেই কিতাবের কিছুটা তেলাওয়াত করলে পর বাদশাহ্‌ লেখকের ছুরি দিয়ে সেই অংশটা কেটে নিয়ে আগুনের পাত্রে ফেলে দিলেন; এইভাবে গোটা কিতাবটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হল। বাদশাহ্‌ ও তাঁর যে সব লোকেরা সেই কথা শুনলেন তাঁরা ভয়ও পেলেন না কিংবা তাঁদের কাপড়ও ছিঁড়লেন না। ইল্‌নাথন, দলায় ও গমরিয় বাদশাহ্‌কে সেই কিতাব না পোড়াতে মিনতি করলেও বাদশাহ্‌ তাঁদের কথা শুনলেন না। তার বদলে তিনি লেখক বারূক ও নবী ইয়ারমিয়াকে ধরে আনবার জন্য রাজপুত্র যিরহমেল, অস্রীয়েলের ছেলে সরায় ও অব্দিয়েলের ছেলে শেলিমিয়াকে হুকুম দিলেন। কিন্তু মাবুদ তাঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন। ইয়ারমিয়ার বলা কথাগুলো বারূক যে কিতাবে লিখেছিলেন তা বাদশাহ্‌ পুড়িয়ে দিলে পর মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীম যে কিতাবটা পুড়িয়ে দিয়েছে সেই প্রথম কিতাবে যা যা লেখা ছিল তা সবই তুমি আর একটা গুটিয়ে রাখা কিতাব নিয়ে তাতে লেখ। এছাড়া তুমি এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘তুমি কিতাবটা পুুড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছ কেন ইয়ারমিয়া ঐ কিতাবের মধ্যে লিখেছে যে, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ নিশ্চয় এসে এই দেশ ধ্বংস করবেন এবং মানুষ ও পশু দুই-ই শেষ করে দেবেন? সেইজন্য তোমার বিষয়ে আমি মাবুদ বলছি যে, দাউদের সিংহাসনে বসবার জন্য তোমার কেউ বেঁচে থাকবে না; তোমার লাশ বাইরে ফেলে দেওয়া হবে এবং তা দিনের বেলায় গরমে ও রাতের বেলায় ঠাণ্ডায় পড়ে থাকবে। আমি তোমার ও তোমার ছেলেদের এবং তোমার কর্মচারীদের অন্যায়ের জন্য তোমাদের শাস্তি দেব; আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যে সব বিপদের কথা বলেছি তা সবই তোমাদের উপর ও জেরুজালেম ও এহুদার লোকদের উপর আনব, কারণ তোমরা কথা শোন নি।’ ” তখন ইয়ারমিয়া আর একটা গুটিয়ে রাখা কিতাব নিয়ে নেরিয়ের ছেলে লেখক বারূককে দিলেন; এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীম যে কিতাবটা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তাতে যে সব কথা লেখা ছিল সেই সব কথা ইয়ারমিয়ার মুখ থেকে শুনে বারূক আবার লিখলেন। ঐ রকম আরও অনেক কথাও তার সংগে যোগ করা হল। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ইউসিয়ার ছেলে সিদিকিয়কে এহুদার বাদশাহ্‌ করলেন, তাই সিদিকিয় যিহোয়াকীমের ছেলে কনিয়ের, অর্থাৎ যিহোয়াখীনের জায়গায় রাজত্ব করতে লাগলেন। মাবুদ নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে যে সব কথা বলেছিলেন তাতে সিদিকিয় কিংবা তাঁর কর্মচারীরা কিংবা দেশের লোকেরা কেউই কান দিত না। তবুও একদিন বাদশাহ্‌ সিদিকিয় শেলিমিয়ার ছেলে যিহূখল ও মাসেয়ের ছেলে ইমাম সফনিয়কে এই সংবাদ দিয়ে ইয়ারমিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, “আপনি দয়া করে আমাদের জন্য আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করুন।” ইয়ারমিয়া সেই সময় লোকদের মধ্যে স্বাধীনভাবে যাওয়া-আসা করছিলেন, কারণ তখনও তাঁকে জেলখানায় দেওয়া হয় নি। তখন ব্যাবিলনীয়রা জেরুজালেম ঘেরাও করে রেখেছিল, কিন্তু তারা যখন শুনল ফেরাউনের সৈন্যদল মিসর থেকে বের হয়েছে তখন তারা জেরুজালেম ছেড়ে চলে গেল। তারপর ব্যাবিলনীয়রা ফিরে এসে এই শহর আক্রমণ করবে; তারা এটা দখল করে পুড়িয়ে দেবে। “ ‘তোমরা এই কথা ভেবে নিজেদের ঠকিয়ো না যে, ব্যাবিলনীয়রা অবশ্যই তোমাদের ছেড়ে চলে যাবে। না, তারা যাবে না। যে ব্যাবিলনীয় সৈন্যেরা তোমাদের আক্রমণ করছে তোমরা যদি তাদের সবাইকে হারিয়ে দাও আর কেবল তাদের আহত লোকেরা তাম্বুতে পড়ে থাকে, তবে তারাই বের হয়ে এসে এই শহর পুড়িয়ে দেবে।’ ” কিন্তু যখন তিনি বিন্‌ইয়ামীন্তদরজায় পৌঁছালেন তখন যিরিয় নামে পাহারাদারদের সেনাপতি তাঁকে ধরে বলল, “তুমি ব্যাবিলনীয়দের পক্ষে যাচ্ছ।” এই যিরিয় ছিল শেলিমিয়ার ছেলে, শেলিমিয়া হনানিয়ের ছেলে। ইয়ারমিয়া বললেন, “এটা মিথ্যা কথা, আমি ব্যাবিলনীয়দের পক্ষে যাচ্ছি না।” কিন্তু যিরিয় তাঁর কথা না শুনে তাঁকে ধরে রাজকর্মচারীদের সামনে নিয়ে গেল। সেই রাজকর্মচারীরা ইয়ারমিয়ার উপর রাগ করে তাঁকে মারধর করলেন এবং লেখক যোনাথনের বাড়ীতে তাঁকে বন্দী করে রাখলেন; সেটাকেই তাঁরা জেলখানা বানিয়েছিলেন। সেই জেলখানার মাটির নীচের একটা কামরায় ইয়ারমিয়াকে রাখা হল। সেখানে তিনি অনেক দিন রইলেন। তারপর বাদশাহ্‌ সিদিকিয় লোক পাঠিয়ে তাঁকে রাজবাড়ীতে ডেকে আনিয়ে গোপনে জিজ্ঞাসা করলেন, “মাবুদের কোন কালাম আছে কি?” জবাবে ইয়ারমিয়া বললেন, “জ্বী, আছে। আপনাকে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়া হবে।” তারপর ইয়ারমিয়া বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে বললেন, “আমি আপনার কিংবা আপনার কর্মচারীদের কিংবা এই লোকদের বিরুদ্ধে কি দোষ করেছি যে, আপনারা আমাকে জেলখানায় রেখেছেন? যারা আপনাদের কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ আপনাকে বা এই দেশকে আক্রমণ করবে না, আপনাদের সেই নবীরা কোথায়? কিন্তু এখন হে আমার প্রভু মহারাজ, দয়া করে শুনুন। আপনার সামনে আমি আমার এই অনুরোধ রাখছি, আপনি আমাকে লেখক যোনাথনের বাড়ীতে আর পাঠাবেন না, পাঠালে আমি সেখানে মরে যাব।” তখন বাদশাহ্‌ সিদিকিয় ইয়ারমিয়াকে পাহারাদারদের উঠানে রাখবার জন্য হুকুম দিলেন এবং শহরের সমস্ত রুটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রুটিওয়ালাদের রাস্তা থেকে তাঁকে একখানা করে রুটি দেবার হুকুম দিলেন। কাজেই ইয়ারমিয়া পাহারাদারদের উঠানে রইলেন। ইয়ারমিয়া যখন সমস্ত লোকদের কাছে কথা বলছিলেন তখন মত্তনের ছেলে শফটিয়, পশ্‌হূরের ছেলে গদলিয়, শেলিমিয়ার ছেলে যিহূখল ও মল্কিয়ের ছেলে পশ্‌হূর তা শুনল। ইয়ারমিয়া বলছিলেন, “মাবুদ এই কথা বলছেন, ‘যে কেউ এই শহরে থাকবে সে হয় যুদ্ধে না হয় দুর্ভিক্ষে কিংবা মহামারীতে মারা যাবে, কিন্তু যে কেউ ব্যাবিলনীয়দের কাছে যাবে সে মরবে না। সে তার প্রাণ কোনমতে বাঁচাতে পারবে। এই শহর নিশ্চয়ই ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সৈন্যদলের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে; তারা এটা অধিকার করবে।’ ” তখন রাজকর্মচারীরা বাদশাহ্‌কে বললেন, “এই লোকটিকে হত্যা করা উচিত। যে সব সৈন্যেরা ও লোকেরা এই শহরে রয়ে গেছে সে এই সব কথা বলে তাদের হতাশ করে দিচ্ছে। সে এই লোকদের উপকার না চেয়ে ক্ষতি চাইছে।” জবাবে বাদশাহ্‌ সিদিকিয় বললেন, “সে তো আপনাদের হাতেই রয়েছে; বাদশাহ্‌ আপনাদের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না।” তখন তাঁরা ইয়ারমিয়াকে ধরে বাদশাহ্‌র ছেলে মল্কিয়ের কূয়াতে ফেলে দিলেন। এই কূয়াটা ছিল পাহারাদারদের উঠানের মধ্যে। তাঁরা ইয়ারমিয়াকে দড়ি দিয়ে সেই কূয়াতে নামিয়ে দিলেন। সেখানে পানি ছিল না, কেবল কাদা ছিল; আর ইয়ারমিয়া সেই কাদার মধ্যে ডুবে যেতে লাগলেন। কিন্তু রাজবাড়ীর একজন কর্মচারী ইথিওপীয় এবদ-মেলক শুনতে পেলেন যে, ইয়ারমিয়াকে কূয়াতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাদশাহ্‌ তখন বিন্‌ইয়ামীন দরজায় বসে ছিলেন। এবদ-মেলক রাজবাড়ী থেকে বের হয়ে বাদশাহ্‌কে গিয়ে বললেন, “হে আমার প্রভু মহারাজ, এই লোকেরা নবী ইয়ারমিয়ার প্রতি যা করেছে তা অন্যায়। তারা তাঁকে কূয়াতে ফেলে দিয়েছে; তিনি সেখানে ক্ষুধায় মারা যাবেন, কারণ শহরে আর রুটি নেই।” তখন বাদশাহ্‌ ইথিওপীয় এবদ-মেলককে এই হুকুম দিলেন, “তুমি এখান থেকে ত্রিশজন লোক সংগে নাও এবং নবী ইয়ারমিয়াকে তুলে আন যেন তিনি মারা না যান।” তখন এবদ-মেলক সেই লোকদের সংগে নিয়ে রাজবাড়ীর ধনভাণ্ডারের নীচের একটা ঘরে গেলেন। তিনি সেখান থেকে কতগুলো পুরানো ও ছেঁড়া কাপড় নিয়ে সেগুলো দড়ি দিয়ে সেই কূয়ার মধ্যে ইয়ারমিয়ার কাছে নামিয়ে দিলেন। ইথিওপীয় এবদ-মেলক ইয়ারমিয়াকে বললেন, “এই পুরানো ও ছেঁড়া কাপড়গুলো আপনি আপনার বগলে দিন যাতে আপনি দড়িতে ব্যথা না পান।” ইয়ারমিয়া তা-ই করলেন। তখন তারা দড়ি দিয়ে তাঁকে টেনে সেই কূয়া থেকে তুলে আনল। এর পর ইয়ারমিয়া পাহারাদারদের উঠানেই রইলেন। তারপর বাদশাহ্‌ সিদিকিয় লোক পাঠিয়ে নবী ইয়ারমিয়াকে মাবুদের ঘরে ঢুকবার তৃতীয় স্থানে ডেকে আনলেন। বাদশাহ্‌ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, আমার কাছ থেকে কিছুই লুকাবেন না।” তখন ইয়ারমিয়া সিদিকিয়কে বললেন, “আমি যদি আপনাকে বলি তবে তো আপনি আমাকে হত্যা করবেন। আর আমি যদি আপনাকে পরামর্শ দিই তবে আপনি আমার কথা শুনবেন না।” এতে বাদশাহ্‌ সিদিকিয় গোপনে ইয়ারমিয়ার কাছে কসম খেয়ে বললেন, “যিনি আমাদের শ্বাসবায়ু দিয়েছেন সেই আল্লাহ্‌র কসম যে, আমি আপনাকে হত্যা করব না বা যারা আপনাকে হত্যা করতে চাইছে তাদের হাতেও আপনাকে তুলে দেব না।” তখন ইয়ারমিয়া সিদিকিয়কে বললেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তুমি যদি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সেনাপতিদের কাছে হার স্বীকার কর তবে তোমার প্রাণ বাঁচবে এবং এই শহরও পুড়িয়ে দেওয়া হবে না; তুমি ও তোমার পরিবার বাঁচবে। কিন্তু যদি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সেনাপতিদের কাছে হার স্বীকার না কর তবে এই শহর ব্যাবিলনীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং তারা এটা পুড়িয়ে দেবে; আর তুমি নিজেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।’ ” বাদশাহ্‌ সিদিকিয় তখন ইয়ারমিয়াকে বললেন, “যে সব ইহুদী ব্যাবিলনীয়দের কাছে গেছে আমি তাদের ভয় করি, কারণ ব্যাবিলনীয়রা হয়তো আমাকে তাদের হাতে তুলে দেবে আর তারা আমার সংগে খারাপ ব্যবহার করবে।” জবাবে ইয়ারমিয়া বললেন, “তারা আপনাকে তুলে দেবে না। আমি আপনাকে যা বলি তা করে মাবুদের বাধ্য হন। তাহলে আপনার ভাল হবে, আপনার প্রাণ বাঁচবে। কিন্তু যদি হার মানতে অস্বীকার করেন তবে মাবুদ আমার কাছে যা প্রকাশ করেছেন তা এই- এহুদার বাদশাহ্‌র রাজবাড়ীর বাকী স্ত্রীলোকদের ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সেনাপতিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই স্ত্রীলোকেরা আপনাকে বলবে, ‘তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তোমাকে বিপথে নিয়ে গেছে, তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে। কাদায় তোমার পা ডুবে গেছে; তোমার বন্ধুরা তোমাকে ত্যাগ করেছে।’ আপনার সব স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ব্যাবিলনীয়দের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি নিজেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাবেন না বরং ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে ধরা পড়বেন, আর এই শহর পুড়িয়ে দেওয়া হবে।” তখন সিদিকিয় ইয়ারমিয়াকে বললেন, “এই কথাবার্তার বিষয় কেউ যেন না জানে, জানলে আপনি মারা পড়বেন। যদি রাজকর্মচারীরা শোনে যে, আমি আপনার সংগে কথা বলেছি, আর তারা এসে আপনাকে বলে, ‘তুমি বাদশাহ্‌কে যা বলেছ এবং বাদশাহ্‌ তোমাকে যা বলেছেন তা আমাদের বল; আমাদের কাছ থেকে লুকায়ো না, লুকালে আমরা তোমাকে হত্যা করব,’ তবে আপনি তাদের বলবেন, ‘আমি বাদশাহ্‌কে মিনতি করছিলাম আমাকে যেন যোনাথনের বাড়ীতে ফিরে না পাঠান, কারণ সেখানে পাঠালে আমি মারা যাব।’ ” রাজকর্মচারীরা সকলে ইয়ারমিয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে পর বাদশাহ্‌ তাঁকে যে কথা বলতে হুকুম দিয়েছিলেন ইয়ারমিয়া তাদের সেই সব কথাই বললেন। তখন তাঁরা তাঁকে আর কিছু বললেন না, কারণ বাদশাহ্‌র সংগে তাঁর কথাবার্তা কেউই শোনে নি। যতদিন না ব্যাবিলনীয়রা জেরুজালেম দখল করল ততদিন ইয়ারমিয়া পাহারাদারদের সেই উঠানেই রইলেন। জেরুজালেম এইভাবে দখল করা হয়েছিল। এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের নবম বছরের দশম মাসে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে এসে শহরটা ঘেরাও করে রাখলেন। সিদিকিয়ের রাজত্বের এগারো বছরের চতুর্থ মাসের নবম দিনে শহরের দেয়ালের এক জায়গা ভেংগে ফেলা হল। তখন ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সব রাজকর্মচারীরা, অর্থাৎ নের্গল-শরেৎসর, সমগরনবো, শর্সখীম নামে একজন প্রধান কর্মচারী, নের্গল-শরেৎসর নামে উঁচু পদের একজন রাজকর্মচারী এবং ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র অন্যান্য সব কর্মচারীরা এসে মাঝ-দরজায় বসলেন। এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয় ও তাঁর সমস্ত সৈন্য তাঁদের দেখে পালিয়ে গেলেন; তাঁরা রাতের বেলায় বাদশাহ্‌র বাগানের পথ ধরে দুই দেয়ালের দরজা দিয়ে শহর ত্যাগ করে আরবার দিকে গেলেন। কিন্তু ব্যাবিলনীয় সৈন্যেরা তাঁদের পিছনে তাড়া করে জেরিকোর সমভূমিতে সিদিকিয়কে ধরে ফেলল। তারা তাঁকে ধরে হামা দেশের রিব্‌লাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের কাছে নিয়ে গেল। বখতে-নাসার তাঁর শাস্তির হুকুম দিলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ রিব্‌লাতে সিদিকিয়ের চোখের সামনেই তাঁর ছেলেদের হত্যা করলেন এবং এহুদার সমস্ত রাজকর্মচারীদেরও হত্যা করলেন। তারপর তিনি সিদিকিয়ের চোখ তুলে ফেলে তাঁকে ব্যাবিলনে নিয়ে যাবার জন্য ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বাঁধলেন। ব্যাবিলনীয়রা রাজবাড়ীতে ও লোকদের বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল এবং জেরুজালেমের দেয়াল ভেংগে ফেলল। সেই সময় যারা শহরে থেকে গিয়েছিল, যারা ব্যাবিলনের পক্ষে গিয়েছিল এবং দেশের বাকী লোকদের ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে গেলেন। কিন্তু রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন সম্পত্তিহীন কিছু গরীব লোককে এহুদা দেশে রেখে গেলেন; সেই সময়ে তিনি তাদের আংগুর ক্ষেত ও জমি দিয়ে গেলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ইয়ারমিয়ার বিষয়ে বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদনকে এই হুকুম দিলেন, “তাঁকে নিয়ে তাঁর দেখাশোনা করবে; তাঁর কোন ক্ষতি করবে না বরং তিনি যা বলবেন তা করবে।” ইয়ারমিয়া যখন পাহারাদারদের উঠানে বন্দী ছিলেন তখন মাবুদের এই কালাম তাঁর উপর নাজেল হয়েছিল, “ইথিওপীয় এবদ-মেলকের কাছে গিয়ে বল যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘উপকার দিয়ে নয় বরং অপকারের মধ্য দিয়ে আমি এই শহরের বিরুদ্ধে আমার কালাম সফল করতে যাচ্ছি। সেই সময় তোমার চোখের সামনেই তা পূর্ণ হবে, কিন্তু আমি তোমাকে উদ্ধার করব। যাদের তুমি ভয় কর তাদের হাতে তোমাকে দেওয়া হবে না। আমি নিশ্চয়ই তোমাকে রক্ষা করব; তোমাকে হত্যা করা হবে না, বরং তুমি কোনমতে তোমার প্রাণ রক্ষা করবে, কারণ তুমি আমার উপর ভরসা করেছ। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” জেরুজালেম ও এহুদার সব বন্দীদের ব্যাবিলনে নিয়ে যাবার সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন তাদের সংগে ইয়ারমিয়াকেও শিকলে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি রামা থেকে ইয়ারমিয়াকে ছেড়ে দিলেন। এর পর মাবুদ ইয়ারমিয়ার কাছে কথা বলেছিলেন। ইয়ারমিয়াকে ছেড়ে দেবার সময় নবূষরদন তাঁকে বলেছিলেন, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ এহুদার বিরুদ্ধে এই ধ্বংসের কথাই বলেছিলেন। এখন মাবুদ যা করবেন বলেছিলেন ঠিক তা-ই তিনি করেছেন। এই সব ঘটেছে, কারণ আপনারা মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছেন এবং তাঁর কথার অবাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আজ আমি আপনার হাতের শিকল থেকে আপনাকে মুক্ত করলাম। আপনি যদি চান তবে আমার সংগে আপনি ব্যাবিলনে যেতে পারেন, আমি আপনার দেখাশোনা করব; কিন্তু যদি যেতে না চান তবে যাবেন না। দেখুন, গোটা দেশটা আপনার সামনে পড়ে আছে; আপনি যেখানে খুশী যেতে পারেন।” কিন্তু ইয়ারমিয়া সেখান থেকে যাবার আগেই নবূষরদন বললেন, “আপনি শাফনের নাতি, অর্থাৎ অহীকামের ছেলে গদলিয়ের কাছে ফিরে যান। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ এহুদার সব শহরের উপরে গদলিয়কে নিযুক্ত করেছেন। আপনি তাঁর সংগে লোকদের মধ্যেই থাকতে পারেন কিংবা আপনার খুশীমত অন্য কোথাও যেতে পারেন।” তারপর সেনাপতি তাঁকে খাবার-দাবার ও উপহার দিয়ে বিদায় দিলেন। তখন ইয়ারমিয়া মিসপাতে অহীকামের ছেলে গদলিয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সংগে দেশে রেখে যাওয়া লোকদের মধ্যেই রইলেন। সেই সময় এহুদার সৈন্যদলের যে সব সেনাপতি ও তাদের লোকেরা খোলা মাঠে ছিল তারা শুনল যে, অহীকামের ছেলে গদলিয়কে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ দেশের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন এবং যাদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয় নি দেশের সেই সব গরীব পুরুষ, স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের ভার তাঁর হাতে দেওয়া হয়েছে। তখন সেই সৈন্যেরা, অর্থাৎ নথনিয়ের ছেলে ইসমাইল, কারেহের দুই ছেলে যোহানন ও যোনাথন, তন্‌হূমতের ছেলে সরায়, নটোফাতীয় এফয়ের ছেলেরা এবং মাখাথীয়ের ছেলে যাসনিয় ও তাদের লোকেরা মিসপাতে গদলিয়ের কাছে আসল। শাফনের নাতি, অর্থাৎ অহীকামের ছেলে গদলিয় তাদের ও তাদের লোকদের কাছে কসম খেয়ে এই কথা বললেন, “ব্যাবিলনীয়দের অধীন হতে তোমরা ভয় কোরো না; দেশে বাস কর ও ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র অধীন হও, এতে তোমাদের ভাল হবে। আমি নিজে মিসপাতে থাকব এবং যে সব ব্যাবিলনীয়রা আমাদের কাছে আসবে তাদের কাছে আমি তোমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলব; কিন্তু তোমরা আংগুর-রস, গরম কালের ফল ও তেল যোগাড় করে তোমাদের পাত্রে জমা করবে এবং তোমরা যে সব গ্রাম ও শহরের দখল নেবে সেখানে বাস করবে।” মোয়াব, অম্মোন, ইদোম ও অন্যান্য দেশের সব ইহুদীরা শুনল যে, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ এহুদা দেশে কিছু লোককে ফেলে রেখে গেছেন এবং গদলিয়কে তাদের উপর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন। তখন তারা যে সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সেখান থেকে সবাই এহুদা দেশের মিসপাতে গদলিয়ের কাছে ফিরে আসল। তারা প্রচুর পরিমাণে আংগুর-রস ও গরম কালের ফল জমা করল। পরে কারেহের ছেলে যোহানন ও খোলা মাঠে থাকা সৈন্যদের সব সেনাপতিরা মিসপাতে গদলিয়ের কাছে এসে তাঁকে বলল, “আপনি কি জানেন যে, অম্মোনীয়দের বাদশাহ্‌ বালীস আপনাকে হত্যা করবার জন্য নথনিয়ের ছেলে ইসমাইলকে পাঠিয়েছেন?” অহীকামের ছেলে গদলিয় কিন্তু তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। তখন কারেহের ছেলে যোহানন মিসপাতে গদলিয়কে গোপনে বলল, “আপনি অনুমতি দিলে আমি গিয়ে নথনিয়ের ছেলে ইসমাইলকে হত্যা করব, কেউ জানতে পারবে না। সে কেন আপনাকে হত্যা করবে? তাতে তো যে সব ইহুদীরা আপনার চারপাশে জমায়েত হয়েছে তারা ছড়িয়ে পড়বে এবং এহুদার বাকী লোকেরা ধ্বংস হবে।” কিন্তু অহীকামের ছেলে গদলিয় কারেহের ছেলে যোহাননকে বললেন, “ঐ রকম কাজ কোরো না। তুমি ইসমাইলের বিষয়ে যা বলছ তা মিথ্যা।” এছাড়া মিসপাতে গদলিয়ের সংগে যে সব ইহুদীরা ছিল এবং সেখানে যে সব ব্যাবিলনীয় সৈন্য ছিল ইসমাইল তাদের সবাইকে হত্যা করল। ইসমাইল তাদের সংগে দেখা করবার জন্য কাঁদতে কাঁদতে মিসপা থেকে বের হল। সেই লোকদের সংগে দেখা হলে পর সে বলল, “অহীকামের ছেলে গদলিয়ের কাছে চল।” তারা শহরে ঢোকামাত্র ইসমাইল ও তার সংগের লোকেরা সেই লোকদের হত্যা করে একটা কূয়ার মধ্যে ফেলে দিল। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে দশজন ইসমাইলকে বলল, “আমাদের মারবেন না। মাঠের মধ্যে আমাদের গম, যব, তেল ও মধু লুকানো রয়েছে।” সেইজন্য ইসমাইল তাদের ছেড়ে দিল, অন্যদের সংগে হত্যা করল না। গদলিয় ও অন্যদের হত্যা করে যে কূয়ার মধ্যে সে তাদের সকলের লাশ ফেলে দিয়েছিল সেটা ইসরাইলের বাদশাহ্‌ বাশার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাদশাহ্‌ আসা তৈরী করিয়েছিলেন। ইসমাইল সেটা লাশ দিয়ে ভরে ফেলল। ইসমাইল মিসপার বাকী সব লোকদের বন্দী করল। তাদের মধ্যে ছিল বাদশাহ্‌র মেয়েরা ও সেখানে রেখে যাওয়া অন্য সব লোকেরা। বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন এই সব লোকদের উপরে গদলিয়কে নিযুক্ত করেছিলেন। ইসমাইল তাদের বন্দী করে নিয়ে অম্মোনীয়দের কাছে পার হয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হল। কারেহের ছেলে যোহানন ও তার সংগের সৈন্যদলের সব সেনাপতিরা যখন ইসমাইলের সব অন্যায় কাজের কথা শুনতে পেল, তখন তারা তাদের সব লোকদের নিয়ে তার সংগে যুদ্ধ করতে গেল। গিবিয়োনের বড় পুকুরের কাছে তারা তার নাগাল পেল। কিন্তু ইসমাইল ও তার আটজন লোক যোহাননের কাছ থেকে পালিয়ে অম্মোনীয়দের কাছে গেল। তারপর যোহানন ও তার সংগের সৈন্যদলের সব সেনাপতিরা গিবিয়োন থেকে মিসপার বাদবাকী সব লোকদের ফিরিয়ে আনল। ইসমাইল গদলিয়কে খুন করবার পর যোহানন তার হাত থেকে এই সব সৈন্যদের, স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের এবং রাজকর্মচারীদের উদ্ধার করেছিল। তারা মিসরে যাবার পথে বেথেলহেমের কাছে গেরুৎ কিম্‌হমে কিছু দিনের জন্য রইল। তারা ব্যাবিলনীয়দের ভয়ে এহুদা থেকে পালাচ্ছিল, কারণ ইসমাইল ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র নিযুক্ত শাসনকর্তা গদলিয়কে হত্যা করেছিল। আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করুন যাতে তিনি আমাদের বলে দেন আমরা কোথায় যাব আর কি করব।” জবাবে নবী ইয়ারমিয়া বললেন, “আমি আপনাদের কথা শুনেছি। আমি আপনাদের অনুরোধ অনুসারে আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে নিশ্চয়ই মুনাজাত করব। মাবুদ যা বলবেন তা সবই আপনাদের বলব, কিছুই আপনাদের কাছ থেকে গোপন করব না।” তখন তারা ইয়ারমিয়াকে বলল, “আপনার মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাদের যা বলবার জন্য আপনাকে পাঠাবেন সেইমত যদি আমরা সব কিছু না করি তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে মাবুদই যেন একজন সত্যিকার বিশ্বস্ত সাক্ষী হন। আমরা যাঁর কাছে আপনাকে পাঠাচ্ছি আমরা আমাদের সেই মাবুদ আল্লাহ্‌র কথার বাধ্য হব-তা আমাদের পছন্দমত হোক বা না হোক। যদি আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র বাধ্য হই তবে আমাদের ভাল হবে।” এর দশ দিন পরে ইয়ারমিয়ার উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। তখন তিনি যোহাননকে ও তার সংগের সৈন্যদলের সব সেনাপতিদের এবং সমস্ত লোকদের ডেকে একত্র করলেন। তিনি তাদের বললেন, “আপনারা আপনাদের মিনতি জানাবার জন্য যাঁর কাছে আমাকে পাঠিয়েছিলেন সেই ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘তোমরা যদি দেশে থাক তবে আমি তোমাদের গড়ে তুলব, ভেংগে ফেলব না; আমি তোমাদের লাগিয়ে দেব, উপ্‌ড়ে ফেলব না, কারণ তোমাদের উপরে যে বিপদ এনেছি তার জন্য আমি মনে ব্যথা পেয়েছি। যাকে তোমরা ভয় করছ সেই ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌কে তোমরা ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি। আমি তোমাদের রক্ষা করব এবং তার হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করব। আমি তোমাদের প্রতি মমতা করব, তাতে সে-ও তোমাদের প্রতি মমতা করবে এবং তোমাদের নিজেদের জায়গায় আবার তোমাদের ফিরিয়ে আনবে।’ “কিন্তু যদি আপনারা বলেন, ‘আমরা দেশে থাকব না’ এবং এইভাবে আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা অমান্য করেন, আর যদি আপনারা বলেন, ‘আমরা গিয়ে মিসরে বাস করব; সেখানে আমরা যুদ্ধও দেখব না, শিংগার আওয়াজও শুনব না, খাবারের অভাবে খিদেও বোধ করব না,’ তাহলে এহুদার বাদবাকী লোকেরা মাবুদের কালাম শুনুন। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তোমরা যদি মিসরে যাওয়াই ঠিক করে থাক আর সেখানে গিয়ে বাস কর, তবে যে যুদ্ধকে তোমরা ভয় করছ তা সেখানেই তোমাদের ধরে ফেলবে এবং যে দুর্ভিক্ষের ভয় করছ তা তোমাদের পিছন পিছন মিসরে যাবে এবং সেখানেই তোমরা মারা পড়বে। এই কথা সত্যি যে, যারা মিসরে গিয়ে বাস করবে বলে ঠিক করেছে তারা সবাই সেখানে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মারা পড়বে; যে বিপদ আমি তাদের উপর আনব তা থেকে তাদের একজনও বেঁচে থাকতে পারবে না কিংবা তা এড়াতেও পারবে না।’ ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘যারা জেরুজালেমে বাস করত তাদের উপরে যেমন করে আমার ভীষণ রাগ ও গজব ঢেলে পড়েছে তোমরা মিসরে গেলে তেমনি করে আমার গজব তোমাদের উপরেও ঢেলে পড়বে। তোমরা হবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও ঘৃণার পাত্র; তোমাদের অবস্থা দেখে লোকে হতভম্ব হবে আর তোমাদের নাম নিয়ে লোকে বদদোয়া দেবে। তোমরা আর কখনও এই জায়গা দেখতে পাবে না।’ “হে এহুদার বাদবাকী লোকেরা, মাবুদ তো আপনাদের বলেছেন, ‘তোমরা মিসরে যেয়ো না।’ আপনারা জেনে রাখুন আমি আজ আপনাদের সাবধান করছি যে, আপনারা মারাত্মক ভুল করতে যাচ্ছেন। আপনারা আমাকে আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে এই বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘আপনি আমাদের জন্য আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করুন; তিনি যা বলবেন তা সবই আপনি আমাদের বলবেন আর আমরা তা করব।’ আমি আজ তা আপনাদের বললাম কিন্তু যে সব বিষয় বলবার জন্য আপনাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন তা আপনারা এখনও পালন করেন নি। কাজেই এখন আপনারা জেনে রাখুন যে, আপনারা যে জায়গায় গিয়ে বাস করতে চান সেখানে আপনারা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মারা পড়বেন।” কিন্তু নেরিয়ের ছেলে বারূক আমাদের বিরুদ্ধে আপনাকে উত্তেজিত করে তুলছে যাতে ব্যাবিলনীয়দের হাতে আমাদের তুলে দেওয়া যায় আর তারা আমাদের হত্যা করে কিংবা বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়।” এইভাবে যোহানন, সৈন্যদলের সমস্ত সেনাপতিরা ও সমস্ত লোকেরা এহুদা দেশে রয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মাবুদের হুকুম অমান্য করল। এহুদার বাদবাকী যে সব লোক সমস্ত জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেখান থেকে এহুদা দেশে বাস করবার জন্য ফিরে এসেছিল তাদের নিয়ে যোহানন এবং সমস্ত সেনাপতিরা মিসরে চলল। এরা ছিল সেই সব পুরুষ, স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে এবং বাদশাহ্‌র মেয়েরা, যাদের বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন গদলিয়ের হাতে রেখে গিয়েছিলেন। এদের সংগে নবী ইয়ারমিয়া ও বারূককেও নিয়ে যাওয়া হল। এইভাবে তারা মাবুদের অবাধ্য হয়ে মিসরে ঢুকল এবং তফন্‌হেষ পর্যন্ত গেল। তফন্‌হেষে মাবুদ ইয়ারমিয়াকে বললেন, “তুমি কতগুলো বড় বড় পাথর নিয়ে তফন্‌হেষে ফেরাউনের রাজবাড়ীতে ঢুকবার পথে ইটের বাঁধানো উঠানের মাটির নীচে ইহুদীদের চোখের সামনে সেগুলো লুকিয়ে রাখ। তারপর তাদের বল যে, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘আমি আমার গোলাম ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে ডেকে আনাব এবং যে পাথরগুলো আমি এখানে লুকিয়ে রেখেছি তার উপর তার সিংহাসন বসাব; সে তার উপরে তার রাজ-চাঁদোয়া খাটাবে। সে এসে মিসর আক্রমণ করবে এবং যারা মৃত্যুর জন্য ঠিক হয়ে আছে তাদের মৃত্যু হবে, যারা বন্দী হবার জন্য ঠিক হয়ে আছে তারা বন্দী হবে আর যারা তলোয়ারের জন্য ঠিক হয়ে আছে তারা যুদ্ধে মারা যাবে। মিসরের দেব-দেবীর মন্দিরগুলোতে সে আগুন ধরিয়ে দেবে; সে তাদের মন্দিরগুলো পুড়িয়ে দিয়ে তাদের দেবতাগুলোকে বন্দী করে নিয়ে যাবে। রাখাল যেমন করে তার গায়ে কাপড় জড়ায় তেমনি করে সে মিসরকে দিয়ে নিজেকে জড়াবে এবং সেখান থেকে সে নিরাপদেই চলে যাবে। মিসরের সূর্যদেবতার পূজার থামগুলো সে ভেংগে ফেলবে এবং মিসরের দেব-দেবীর মন্দিরগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।’ ” মিসর দেশে যে সব ইহুদীরা মিগ্‌দোল, তফন্‌হেষ, মেম্ফিস ও পথ্রোষ এলাকায় বাস করত তাদের বিষয়ে মাবুদের এই কালাম ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমি জেরুজালেম ও এহুদার সমস্ত গ্রাম ও শহরের উপর যে ভীষণ বিপদ এনেছি তা তোমরা দেখেছ। সেগুলো আজ ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে; সেখানে কেউ বাস করে না। তা হয়েছে তাদের দুষ্টতার জন্য, কারণ তারা দেব-দেবীদের সামনে ধূপ জ্বালিয়ে ও তাদের পূজা করে আমার রাগ জাগিয়ে তুলেছে। সেই দেব-দেবীর কথা তারাও জানত না, তোমরাও জানতে না বা তোমাদের পূর্বপুরুষেরাও জানত না। আমি বারে বারে আমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের পাঠিয়েছি; তারা বলেছে যে, তারা যেন সেই জঘন্য কাজ না করে যা আমি ঘৃণা করি। কিন্তু তারা তাতে কানও দেয় নি, মনোযোগও দেয় নি; তারা তাদের দুষ্টতা থেকে ফেরে নি কিংবা দেব-দেবীদের কাছে ধূপ জ্বালানোও বন্ধ করে নি। কাজেই আমার জ্বলন্ত গজব ঢেলে দেওয়া হয়েছিল; তা এহুদার শহরে শহরে ও জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠেছিল আর তাই আজকে সেগুলো জনশূন্য ও ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে। “এখন আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, কেন তোমরা নিজেদের এত বড় সর্বনাশ করছ? তোমরা তো পুরুষ, স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে ও শিশুদের এহুদা থেকে বের করে এনে নিজেদের ও তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিচ্ছ। তোমরা যেখানে বাস করতে এসেছ সেই মিসর দেশের দেব-দেবীদের মূর্তির সামনে ধূপ জ্বালিয়ে কেন তোমরা আমার রাগকে খুঁচিয়ে তুলছ? তোমরা তো নিজেদের ধ্বংস করবে এবং দুনিয়ার সমস্ত জাতির লোকেরা তোমাদের ঘৃণা করবে ও তোমাদের নাম নিয়ে বদদোয়া দেবে। এহুদা দেশে ও জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় তোমাদের পূর্বপুরুষদের, এহুদার বাদশাহ্‌ ও রাণীদের এবং তোমাদের ও তোমাদের স্ত্রীদের দুষ্টতার কথা কি তোমরা ভুলে গেছ? আজও পর্যন্ত তোমরা নিজেদের অন্তর ভেংগে চুরমার কর নি কিংবা আমাকে ভয়ও কর নি; তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আমি যে শরীয়ত ও নিয়ম-কানুন দিয়েছিলাম তা-ও তোমরা পালন কর নি। “সেইজন্য আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন ঠিক করেছি যে, তোমাদের উপর বিপদ এনে সমস্ত এহুদাকে আমি ধ্বংস করব। এহুদার বাকী যে সব লোক মিসরে গিয়ে বাস করবে বলে ঠিক করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে তারা সবাই মিসরে ধ্বংস হয়। তারা সবাই যুদ্ধে না হয় দুর্ভিক্ষে মারা পড়বে। তারা হবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও ঘৃণার পাত্র; তাদের অবস্থা দেখে লোকেরা হতভম্ব হবে, আর তাদের নাম নিয়ে লোকেরা বদদোয়া দেবে। আমি যেভাবে জেরুজালেমকে শাস্তি দিয়েছিলাম, যারা মিসরে বাস করছে তাদের আমি সেইভাবে যুুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দিয়ে শাস্তি দেব। এহুদার বাকী যে সব লোকেরা মিসরে বাস করতে গেছে তারা এহুদা দেশে ফিরে আসবার জন্য পালাতে বা বেঁচে থাকতে পারবে না, যদিও তারা সেখানে ফিরে এসে বাস করতে চাইবে; তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউই পালিয়ে ফিরে আসতে পারবে না।” তখন যে সব লোকেরা জানত যে, তাদের স্ত্রীরা দেব-দেবীদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালায় তারা এবং সেখানে উপস্থিত সমস্ত স্ত্রীলোকেরা, অর্থাৎ মিসরের পথ্রোষ এলাকায় বাসকারী সবাই একটা বড় দল হয়ে ইয়ারমিয়াকে বলল, “আপনি মাবুদের নাম করে যে সব কথা আমাদের কাছে বলেছেন তা আমরা শুনব না। আমরা যা বলেছি তা সবই আমরা নিশ্চয় করব। যেভাবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষেরা, বাদশাহ্‌রা ও রাজকর্মচারীরা এহুদার শহরে শহরে ও জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় আকাশ-রাণীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালাতাম এবং ঢালন-কোরবানী করতাম সেইভাবে আমরা করবই করব। সেই সময় আমাদের প্রচুর খাবার ছিল আর আমাদের অবস্থাও ভাল ছিল এবং আমরা কোন কষ্ট ভোগও করি নি। কিন্তু যখন থেকে আমরা আকাশ-রাণীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালানো ও ঢালন-কোরবানী করা বন্ধ করলাম, তখন থেকে আমাদের অভাব হচ্ছে এবং আমরা যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি।” স্ত্রীলোকেরা আরও বলল, “আমরা যখন আকাশ-রাণীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালাতাম ও ঢালন-কোরবানী করতাম এবং তাঁর আকারেই পিঠা তৈরী করতাম তখন কি আমাদের স্বামীরা সেই কথা জানতেন না?” যে পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা ইয়ারমিয়ার কথার জবাব দিয়েছিল তাদের সকলের কাছে ইয়ারমিয়া বললেন, “এহুদার গ্রাম ও শহরগুলোতে আর জেরুজালেমের রাস্তায় রাস্তায় আপনারা ও আপনাদের পূর্বপুরুষেরা, আপনাদের বাদশাহ্‌রা ও রাজকর্মচারীরা এবং দেশের অন্যান্য লোকেরা যে ধূপ জ্বালাতেন তা কি মাবুদের মনে পড়ে নি এবং সেই বিষয় কি তিনি চিন্তা করেন নি? আপনাদের খারাপ ও জঘন্য কাজ মাবুদ যখন আর সহ্য করতে পারলেন না তখন আপনাদের দেশ জনশূন্য, ধ্বংসস্থান ও ঘৃণার পাত্র হয়ে গেল এবং সেই দেশের নাম লোকেরা বদদোয়া হিসাবে ব্যবহার করে। আজও তা-ই রয়েছে। আপনারা ধূপ জ্বালিয়েছেন এবং মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছেন; আপনারা তাঁর কথা অমান্য করেছেন এবং তাঁর শরীয়ত, নিয়ম ও কালাম পালন করেন নি; সেইজন্য এই বিপদ আপনাদের উপর এসেছে। আপনারা তো তা দেখতে পাচ্ছেন।” তারপর ইয়ারমিয়া সমস্ত পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের বললেন, “মিসরে বাসকারী এহুদার সমস্ত লোকেরা, আপনারা মাবুদের কালাম শুনুন। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছেন, ‘তোমরা বলেছিলে যে, আকাশ-রাণীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালাবার ও ঢালন-কোরবানী করবার যে কসম তোমরা খেয়েছ তা তোমরা নিশ্চয়ই পালন করবে। তোমাদের সেই ওয়াদা অনুসারে তোমরা ও তোমাদের স্ত্রীরা কাজের দ্বারা তা দেখিয়েছ।’ “কাজেই আপনারা যা ওয়াদা করেছেন তা-ই করুন। আপনাদের কসম রক্ষা করুন। কিন্তু মিসরে বাসকারী সমস্ত ইহুদীরা, আপনারা মাবুদের কালাম শুনুন। মাবুদ বলছেন, ‘আমি আমার মহান নামের কসম খেয়ে বলছি, মিসরের যে কোন জায়গায় বাসকারী এহুদার কোন লোক আমার নাম নিয়ে কসম খেয়ে বলবে না যে, আল্লাহ্‌র কসম। তাদের উপকারের জন্য নয় কিন্তু অপকারের জন্যই আমি তাদের উপর খেয়াল রাখছি; মিসরে বাসকারী ইহুদীরা যুদ্ধে ও দুর্ভিক্ষে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা যুদ্ধের হাত থেকে রেহাই পেয়ে মিসর থেকে এহুদা দেশে ফিরে আসবে তাদের সংখ্যা হবে খুবই কম। তারপর এহুদার বাদবাকী যে সব লোক মিসরে বাস করতে এসেছে তারা জানতে পারবে কার কথা ঠিক থাকবে-আমার না তাদের। “ ‘আমি মাবুদ তোমাদের জন্য একটা চিহ্ন দেব যে, এই জায়গায় তোমাদের শাস্তি দেব যাতে তোমরা জানতে পার তোমাদের বিরুদ্ধে আমি যে ক্ষতির ভয় দেখিয়েছি তা ঠিক থাকবে। সেই চিহ্ন হল এই- এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়কে যে শত্রু হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল সেই ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাতে যেমন আমি তাকে তুলে দিয়েছি, ঠিক সেইভাবে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন হফ্রাকেও আমি তার সেই শত্রুদের হাতে তুলে দেব যারা তার প্রাণ নেবার চেষ্টা করছে।’ ” ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের চতুর্থ বছরে ইয়ারমিয়ার কাছে শুনে তা নেরিয়ের ছেলে বারূক গুটিয়ে রাখা কিতাবে লিখেছিলেন। সেই সময় নবী ইয়ারমিয়া তাঁকে বললেন, “বারূক, ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাকে বলছেন যে, তুমি বলেছ, ‘হায়! মাবুদ আমার ব্যথার উপরে আমাকে দুঃখ দিয়েছেন; আমি কাত্‌রাতে কাত্‌রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, বিশ্রাম পাচ্ছি না।’ “মাবুদ আমাকে এই কথা তোমাকে বলতে বললেন, ‘আমি মাবুদ সারা দেশের মধ্যে যা তৈরী করেছি তা ভেংগে ফেলব এবং যা লাগিয়েছি তা উপ্‌ড়ে ফেলব। তাহলে তুমি কি করে নিজের জন্য মহৎ মহৎ বিষয়ের আশা করছ? তা কোরো না। মনে রেখো, সমস্ত লোকের উপরে আমি বিপদ আনব, কিন্তু তুমি যেখানেই যাও না কেন আমি তোমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।’ ” নবী ইয়ারমিয়ার কাছে বিভিন্ন জাতির বিষয়ে মাবুদের কালাম। ইউসিয়ার ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের চতুর্থ বছরে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ফোরাত নদীর কাছে কার্খেমিশে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন নেখোর যে সৈন্যদলকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মাবুদ তাদের সম্বন্ধে বলছেন, “তোমাদের ছোট ও বড় ঢাল ঠিকঠাক করে নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য বের হও। ঘোড়াগুলোকে সাজিয়ে তার উপর চড়। মাথা রক্ষার টুপি মাথায় দিয়ে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও। তোমাদের বর্শাগুলো ঝক্‌ঝকে করে নাও। যুদ্ধের সাজ পর। “আমি কিসের জন্য এই সব দেখতে পাচ্ছি? তারা ভয় পেয়েছে, তারা পিছু হটছে, তাদের যোদ্ধারা হেরে গেছে। তারা পিছনে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাচ্ছে, আর চারদিকে ভীষণ ভয়। যারা তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে তারাও পালাতে পারছে না; শক্তিশালীরাও পালাতে পারছে না। উত্তর দিকে ফোরাত নদীর কাছে তারা উচোট খেয়ে পড়ে গেছে। “ও কে যে, নীল নদের মত করে, নদীর ফুলে ওঠা পানির মত করে উঠে আসছে? নীল নদের মত করে, নদীর ফুলে ওঠা পানির মত করে মিসর উঠে আসছে। সে বলছে, ‘আমি ফুলে উঠে দুনিয়া ঢেকে ফেলব; আমি শহরগুলো ও তাদের লোকদের ধ্বংস করব।’ ওহে সমস্ত ঘোড়া, তোমরা আক্রমণ কর। ওহে রথচালকেরা, তোমরা পাগলের মত রথ চালাও। হে যোদ্ধারা, ঢাল-বহনকারী ইথিওপিয়া ও পুটের লোকেরা, ধনুকধারী লিডীয়রা, তোমরা এগিয়ে যাও। কিন্তু সেই দিনটা হল দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের দিন। সেই দিন হল তাঁর শত্রুদের উপর প্রতিশোধ নেবার দিন। তলোয়ার তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, তার রক্তের পিপাসা না মেটা পর্যন্ত গ্রাস করতে থাকবে; কারণ উত্তর দিকের দেশে, ফোরাত নদীর ধারে দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কোরবানী দেবেন। “হে মিসর, তুমি গিলিয়দে উঠে গিয়ে ব্যথার মলম আন। কিন্তু মিথ্যাই তুমি ওষুধের সংখ্যা বাড়া"ছ; তোমার ভাল হবার কোন আশা নেই। জাতিরা তোমার লজ্জার বিষয় শুনবে; তোমার কান্নায় দুনিয়া পূর্ণ হবে। এক যোদ্ধা অন্য আর একজনের উপর উচোট খেয়ে দু’জনেই একসংগে পড়ে যাবে।” ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার যে মিসর আক্রমণ করতে আসবেন সেই খবর মাবুদ নবী ইয়ারমিয়াকে বলেছিলেন। সেই খবর হল, “তোমরা মিসরে প্রচার কর, মিগ্‌দোলে ঘোষণা কর, মেম্ফিস ও তফন্‌হেষে ঘোষণা করে বল, ‘তোমরা জায়গা নিয়ে দাঁড়াও ও প্রস্তুত হও, কারণ তলোয়ার তোমাদের চারপাশে গ্রাস করবে।’ তোমাদের যোদ্ধারা কেন হেরে যাবে? তারা দাঁড়াতে পারবে না, কারণ মাবুদই তাদের ঠেলে নীচে ফেলবেন। তারা বার বার উচোট খাবে; তারা একে অন্যের উপর পড়বে। তারা বলবে, ‘ওঠো, চল আমরা অত্যাচারীর তলোয়ার থেকে দূরে গিয়ে আমাদের নিজেদের লোকদের কাছে ও নিজেদের দেশে ফিরে যাই।’ সেখানকার লোকেরা বলে, ‘মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন একটা জোরে বাজানো ঘণ্টা মাত্র; সে তার সুযোগ হারিয়েছে।’ ” যাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন সেই বাদশাহ্‌ ঘোষণা করছেন, “আমার জীবনের কসম যে, এমন একজন আসবেন যিনি পাহাড়গুলোর মধ্যে তাবোরের মত, সমুদ্রের কাছের কর্মিলের মত। হে মিসরের লোকেরা, তোমরা বন্দী হয়ে দূরে যাবার জন্য তোমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, কারণ মেম্ফিস জনশূন্য, পতিত জমি ও ধ্বংসস্থান হয়ে পড়ে থাকবে। “মিসর যেন একটা সুন্দর বক্‌না বাছুর, কিন্তু উত্তর দিক থেকে তার বিরুদ্ধে একটা ডাঁশ-মাছি আসছে। মিসরের বেতনভোগী সৈন্যেরা মোটা তাজা বাছুরের মত। তারাও ফিরে একসংগে পালাবে; তারা স্থির থেকে যুদ্ধ করবে না, কারণ তাদের উপর ধ্বংসের দিন আসছে, তাদের শাস্তি পাবার সময় এসে পড়েছে। শত্রু সৈন্যেরা যখন এগিয়ে আসবে তখন মিসরীয়রা সাপের মত খস্‌ খস্‌ শব্দ করে পালিয়ে যাবে; কাঠুরিয়াদের মত করে শত্রুরা কুড়াল নিয়ে মিসরের বিরুদ্ধে আসবে। মিসরের বন গভীর হলেও তারা তা কেটে ফেলবে। তারা পংগপালের চেয়েও সংখ্যায় বেশী; তাদের গোণা যায় না। মিসরের লোকদের লজ্জা দেওয়া হবে এবং উত্তর দিকের লোকদের হাতে তাদের তুলে দেওয়া হবে।” ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “আমি থিব্‌স্‌ শহরের দেবতা আমোনকে, ফেরাউন ও মিসরকে, তার দেব-দেবী ও বাদশাহ্‌দের আর যারা ফেরাউনের উপর ভরসা করে তাদের সবাইকে শাস্তি দেব। যারা তাদের হত্যা করতে চায় সেই ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ও তার সৈন্যদলের হাতে আমি তাদের তুলে দেব। কিন্তু পরে মিসরে আবার আগের মত লোকজন বাস করবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” “হে আমার গোলাম ইয়াকুব, ভয় কোরো না; হে ইসরাইল, উৎসাহহীন হোয়ো না। আমি দূর দেশ থেকে, বন্দী থাকা দেশ থেকে তোমাকে ও তোমার বংশধরদের নিশ্চয় উদ্ধার করব। ইয়াকুব আবার শান্তিতে ও নিরাপদে থাকবে, কেউ তাকে ভয় দেখাবে না। হে আমার গোলাম ইয়াকুব, ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমার সংগে সংগে আছি। যে সব জাতির মধ্যে আমি তোমাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই সব জাতিকে যদিও আমি একেবারে ধ্বংস করে দেব তবুও তোমাকে আমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করব না। তবে একেবারে শাস্তি না দিয়েও আমি তোমাকে ছাড়ব না, কিন্তু ন্যায়বিচার দিয়ে আমি তোমাকে শাসন করব।” ফেরাউন গাজা আক্রমণ করবার আগে ফিলিস্তিনীদের সম্বন্ধে মাবুদের এই কালাম নবী ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “দেখ, উত্তর দিকে কেমন করে পানি উথ্‌লে উঠছে; তা হয়ে উঠবে উপ্‌চে পড়া পানির স্রোত। তা দেশ ও তার মধ্যেকার সব কিছু, সব গ্রাম ও শহর এবং তার মধ্যে বাসকারী সবাইকে ডুবিয়ে দেবে। তাতে লোকে চিৎকার করবে; দেশে বাসকারী সবাই বিলাপ করবে। তারা জোরে দৌড়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ, শত্রুদের রথের শব্দ এবং রথের চাকার ঘড় ঘড় শব্দ শুনবে। বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করবার জন্য ফিরবে না; তাদের হাত অবশ হয়ে ঝুলে থাকবে। ফিলিস্তিনীদের সবাইকে ধ্বংস করবার দিন এবং টায়ার ও সিডনের সাহায্যকারী বাকী সব লোককে হত্যা করবার দিন এসে গেছে। আমি মাবুদ ফিলিস্তিনীদের, অর্থাৎ ক্রীট দ্বীপ থেকে আসা লোকদের ধ্বংস করব। গাজা শোক প্রকাশ করে তার মাথা কামিয়ে ফেলবে; অস্কিলোনকে ধ্বংস করা হবে। হে সমভূমির বাকী লোকেরা, আর কতকাল তোমরা নিজেদের দেহ কাটাকুটি করবে? তোমরা এই বলে কেঁদে ওঠো, ‘হে মাবুদের তলোয়ার, আর কত দিন পরে তুমি বিশ্রাম করবে? তোমার খাপে তুমি ফিরে যাও; থাম, শান্ত হও।’ কিন্তু আমি তাকে হুকুম দিয়েছি তাই কেমন করে সে বিশ্রাম করবে? আমিই তো তাকে অস্কিলোন ও সমুদ্রের কিনারা আক্রমণ করতে হুকুম দিয়েছি।” মোয়াব সম্বন্ধে ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হায় নবো! ওটা তো ধ্বংস হয়ে যাবে। কিরিয়াথয়িম অসম্মানিত হয়ে অন্যদের হাতে চলে যাবে; তার কেল্লা অপমানিত হয়ে চুরমার হয়ে যাবে। মোয়াবকে আর প্রশংসা করা হবে না; তার পতনের জন্য লোকে হিশ্‌বোনে ষড়যন্ত্র করে বলবে, ‘এস, আমরা ঐ জাতিকে শেষ করে দিই।’ হে মদ্‌মেনা, তোমাকেও ধ্বংস করা হবে; তলোয়ার তোমার পিছনে তাড়া করবে। হোরোণয়িম থেকে কান্নার শব্দ শোন, ধ্বংস ও বিনাশের কান্না। মোয়াবকে ভেংগে ফেলা হবে; তার ছোট ছেলেমেয়েরা কেঁদে উঠবে। লূহীতের পথে উঠে যাবার সময় লোকে খুব কাঁদতে কাঁদতে যাবে; যে রাস্তা হোরোণয়িমের দিকে নেমে গেছে সেখানে ধ্বংসের জন্য দারুণ মনোকষ্টের কান্না শোনা যাবে। পালাও, নিজের নিজের প্রাণ নিয়ে দৌড়াও; মরুভূমির ঝোপের মত হও। তুমি যখন তোমার কাজ ও ধনের উপর ভরসা করছ তখন তোমাকেও বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে, আর কমোশ তার ইমাম ও রাজকর্মচারীদের সংগে বন্দী হয়ে দূরে যাবে। প্রত্যেকটি শহরের বিরুদ্ধে ধ্বংসকারী আসবে এবং কোন শহরই এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমার কথামত উপত্যকা ধ্বংস হবে এবং সমভূমির বিনাশ হবে। মোয়াবকে ডানা দাও যেন সে উড়ে পালিয়ে যেতে পারে; তার শহরগুলো জনশূন্য হবে, সেখানে কেউ বাস করবে না।” মাবুদ বলছেন, “আমার কাজে যে লোক ঢিলেমি করে তার উপর বদদোয়া পড়ুক। যে তার তলোয়ারকে রক্তপাত করতে দেয় না তার উপরে বদদোয়া পড়ুক। “এক কলসী থেকে অন্য কলসীতে ঢালা না হলে মদানো রস যেমন তার গাদের উপর পড়ে থাকে তেমনি করে মোয়াব তার ছোটবেলা থেকে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে; সে বন্দীদশায় যায় নি। তাই তার স্বাদ আগের মতই রয়েছে, তার সুগন্ধের পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু দিন আসছে যখন আমি কলসী থেকে ঢালবার লোকদের পাঠিয়ে দেব, আর তারা তাকে ঢেলে বের করবে; তারা তার কলসীগুলো খালি করবে এবং তার পাত্রগুলো চুরমার করে দেবে। ইসরাইলের লোকেরা যেমন বেথেলের উপর বিশ্বাস করে লজ্জিত হয়েছিল তেমনি মোয়াবও কমোশের বিষয়ে লজ্জিত হবে। “তোমরা কেমন করে বলতে পার, ‘আমরা যোদ্ধা, যুদ্ধে সাহসী লোক’? মোয়াব ধ্বংস হবে এবং তার শহরগুলো আক্রমণ করা হবে; তার সেরা সেরা যুবকেরা জবাই করবার জায়গায় নেমে যাবে।” যাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন সেই বাদশাহ্‌ এই কথা বলছেন, “মোয়াবের পতন এসে গেছে; তার বিপদ তাড়াতাড়ি আসবে। তোমরা যারা তার চারপাশে বাস কর, যারা তার সুনামের কথা জান, তোমরা সবাই তার জন্য বিলাপ কর। তাকে বল, ‘শক্তিশালী রাজদণ্ড, গৌরবময় লাঠি কেমন ভেংগে গেছে!’ ” মাবুদ বলছেন, “হে দীবোনের বাসিন্দারা, তোমাদের গৌরবের জায়গা থেকে নেমে এসে শুকনা মাটির উপরে বস, কারণ মোয়াবের ধ্বংসকারী তোমাদের বিরুদ্ধে এসে তোমাদের কেল্লাগুলো ধ্বংস করে দেবে। হে অরোয়েরের বাসিন্দারা, তোমরা পথের পাশে দাড়িয়ে দেখ। পালিয়ে যাওয়া পুরুষ ও স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা কর, ‘কি হয়েছে?’ মোয়াব অপমানিত হয়েছে, কারণ সে চুরমার হয়েছে। তোমরা বিলাপ কর ও কাঁদ। অর্ণোন নদীর ধারে এই কথা প্রচার কর যে, মোয়াব ধ্বংস হয়ে গেছে। সমভূমির এই সব জায়গায় বিচারের সময় উপস্থিত হয়েছে-হোলন, যহস, মেফাৎ, দীবোন, নবো, বৈৎ-দিব্লাথয়িম, কিরিয়াথয়িম, বৈৎ-গামূল, বৈৎ-মিয়োন, করিয়োৎ ও বস্রা, অর্থাৎ মোয়াব দেশের দূরের ও কাছের সমস্ত গ্রাম ও শহরগুলোর উপরে বিচারের সময় উপস্থিত হয়েছে। মোয়াবের শক্তির শিং কেটে ফেলা হয়েছে; তার হাত ভেংগে গেছে। “মোয়াবকে মাতাল কর, কারণ সে আমার বিরুদ্ধে নিজেকে বড় করে দেখিয়েছে। সে তার বমির মধ্যে গড়াগড়ি দেবে; সে হাস্তিঠাট্টার পাত্র হবে। হে মোয়াব, ইসরাইল কি তোমার হাস্তিঠাট্টার পাত্র ছিল না? সে কি চোরদের মধ্যে ধরা পড়েছে যে, তুমি যতবার তার কথা বল ততবার ঘৃণায় মাথা নাড়? ওহে মোয়াবের বাসিন্দারা, তোমরা শহর ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে বাস কর। তোমরা এমন কবুতরের মত হও, যে পাহাড়ের খাদের মুখে তার বাসা বাঁধে। “মোয়াব খুব অহংকারী। আমরা তার অহংকারের কথা, তার মিথ্যা গর্ব, তার বড়াই ও বদরাগ এবং তার দিলের গর্বের কথা জানি। আমি তার গর্বে ভরা অহংকারের কথা জানি, কিন্তু তা মিথ্যা এবং তার বড়াই কোন কাজের নয়। তাই আমি মোয়াবের জন্য বিলাপ করব, সমস্ত মোয়াবের জন্য কাঁদব, কীর-হেরেসের লোকদের জন্য কাত্‌রাব। হে সিব্‌মার আংগুর লতা, আমি যাসেরের জন্য যেভাবে কাঁদব তার চেয়েও বেশী কাঁদব তোমার জন্য। তোমার ডালপালাগুলো সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে; সেগুলো যাসেরের সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু তোমার গরম কালের ফল ও আংগুরের উপর ধ্বংসকারীরা এসে পড়েছে। মোয়াবের ফলের বাগান, অর্থাৎ মোয়াব দেশ থেকে আনন্দ ও খুশীর ভাব চলে গেছে। আমি আংগুর মাড়াইয়ের জায়গা থেকে আংগুর-রসের স্রোত বন্ধ করেছি; আনন্দের চিৎকারের সংগে আর সেগুলো কেউ মাড়াই করে না। যদিও চেঁচামেচি আছে কিন্তু সেগুলো আনন্দের চিৎকার নয়। “তাদের কান্নার শব্দ হিশ্‌বোন থেকে ইলিয়ালী ও যহস পর্যন্ত, সোয়র থেকে হোরোণয়িম ও ইগ্লৎ-শলিশীয়া পর্যন্ত উঠেছে, কারণ নিম্রীমের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি মাবুদ বলছি, মোয়াবে যারা পূজার উঁচু স্থানে কোরবানী করে ও তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালায় আমি তাদের শেষ করে দেব। তাই মোয়াবের ও কীর-হেরেসের লোকদের জন্য আমার দিল বাঁশীর সুরের মত করে বিলাপ করছে। তারা যে ধন জমা করেছিল তা শেষ হয়ে গেছে। দুঃখ প্রকাশের জন্য সকলের মাথা কামানো ও দাড়ি কেটে ফেলা হয়েছে; প্রত্যেকের হাতে কাটাকুটি করা ও কোমরে ছালার চট পরানো হয়েছে। মোয়াবের সমস্ত বাড়ীর ছাদের উপরে ও শহর-চকে বিলাপ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, কারণ যে পাত্র কেউ চায় না তেমন পাত্রের মতই আমি মোয়াবকে ভেংগে ফেলেছি। সে কেমন চুরমার হয়েছে! লোকে কেমন করে তার জন্য বিলাপ করছে! মোয়াব লজ্জায় কেমন করে তার পিঠ ফিরিয়েছে! মোয়াব তার চারপাশের সমস্ত লোকদের কাছে হাস্তিঠাট্টার পাত্র হয়েছে, আর তার অবস্থা দেখে সেই লোকেরা হতভম্ব হয়েছে।” মাবুদ বলছেন, “দেখ, একজন লোক ঈগলের মত শোঁ করে নেমে আসছে এবং মোয়াবের বিরুদ্ধে তার ডানা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার সব শহর অধিকার করে কেল্লাগুলো দখল করা হবে। সেই দিন মোয়াবের যোদ্ধাদের অন্তর প্রসব-যন্ত্রণা ভোগকারিণী স্ত্রীলোকের অন্তরের মত হবে। জাতি হিসাবে মোয়াবকে ধ্বংস করা হবে, কারণ সে আমার বিরুদ্ধে নিজেকে বড় করে দেখিয়েছে। হে মোয়াবের লোকেরা, তোমাদের জন্য ভয়, গর্ত ও ফাঁদ অপেক্ষা করে আছে। যে লোক ভয়ে পালাবে সে গর্তে পড়বে, যে লোক গর্ত থেকে উঠে আসবে সে ফাঁদে ধরা পড়বে; কারণ আমি মোয়াবের শাস্তির সময় ঠিক করে রেখেছি। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “হিশ্‌বোনের ছায়াতে পালিয়ে যাওয়া লোকেরা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ হিশ্‌বোন থেকে আগুন ও সীহোনের মধ্য থেকে আগুনের শিখা বের হয়েছে; তা মোয়াবের কপাল ও গোলমাল করা গর্বকারীদের মাথার খুলি পুড়িয়ে দিয়েছে। হে মোয়াব, ঘৃণ্য তুমি! কমোশের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে; তোমার ছেলেদের দূর দেশে বন্দী হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর তোমার মেয়েদের বন্দী করা হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমি মোয়াবের অবস্থা ফিরাব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মোয়াবের বিচারের কথা এখানে শেষ হয়েছে। অম্মোনীয়দের বিষয়ে মাবুদ এই কথা বলছেন, “ইসরাইলের কি কোন ছেলে নেই? তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির অধিকারী কি কেউ নেই? তাহলে মিল্‌কম কেন গাদ-গোষ্ঠীর জায়গা অধিকার করেছে? কেন মিল্‌কমের পূজাকারীরা সেখানকার শহরগুলোতে বাস করছে? দেখ, সময় আসছে যখন আমি অম্মোনীয়দের রব্বা শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হাঁক দেব; তখন সেটা ধ্বংসের ঢিবি হবে, আর তার চারপাশের গ্রামগুলোতে আগুন লাগানো হবে। তখন যারা ইসরাইলকে তাড়িয়ে বের করে দিয়েছে ইসরাইল তাদেরই তাড়িয়ে বের করে দেবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “হে হিশ্‌বোন, বিলাপ কর, কারণ অয় শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। হে রব্বা শহরের বাসিন্দারা, কাঁদ; ছালার চট পরে শোক প্রকাশ কর। দেয়ালগুলোর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি কর, কারণ তোমার দেবতা মিল্‌কম বন্দী হয়ে দূর দেশে যাবে, আর তার সংগে যাবে তার ইমাম ও উঁচু পদের কর্মচারীরা। কেন তুমি তোমার উর্বর উপত্যকাগুলো নিয়ে গর্ব করছ? হে অবিশ্বস্ত কন্যা, তোমার ধন-সম্পদের উপর ভরসা করে তুমি বলছ, ‘কে আমাকে আক্রমণ করবে?’ আমি দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, তোমার চারদিকের সকলের কাছ থেকে আমি তোমার উপর ভীষণ ভয় নিয়ে আসব। তোমাদের প্রত্যেককে তাড়িয়ে দেওয়া হবে; পালিয়ে যাওয়া লোকদের একত্র করবার জন্য কেউ থাকবে না। কিন্তু পরে আমি অম্মোনীয়দের অবস্থা ফিরাব।” ইদোমের বিষয়ে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তৈমনে কি জ্ঞান নেই? বুদ্ধিমানদের কাছ থেকে কি উপদেশ শেষ হয়ে গেছে? তাদের জ্ঞান কি ক্ষয় হয়ে গেছে? হে দদানের বাসিন্দারা, তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে যাও, গোপন জায়গায় গিয়ে লুকাও, কারণ ইস্‌কে শাস্তি দেবার সময় আমি তার উপর বিপদ আনব। যারা আংগুর তোলে তারা যদি তোমার কাছে আসে তবে কি তারা কিছু আংগুর বাকী রাখবে না? চোরেরা যদি রাতে আসে তবে তাদের যতটা দরকার ততটাই কেবল চুরি করবে। কিন্তু আমি ইসের জায়গাটা জনশূন্য করে ফেলব। সে যাতে লুকাতে না পারে সেইজন্য আমি তার লুকাবার জায়গাগুলো প্রকাশ করে দেব। তার বংশের লোকেরা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা ধ্বংস হয়ে যাবে আর সে-ও থাকবে না। তোমার এতিম ছেলেমেয়েদের রেখে যাও; আমি তাদের জীবন রক্ষা করব। তোমার বিধবারাও আমার উপর ভরসা করুক।” মাবুদ বলছেন, “যারা শাস্তি পাবার উপযুক্ত নয়, তাদের যদি শাস্তির পেয়ালায় খেতেই হয় তবে তুমি কেন শাস্তি না পেয়ে থাকবে? তোমাকে সেই পেয়ালায় খেয়ে শাস্তি পেতেই হবে। আমি আমার নিজের নামেই কসম খাচ্ছি যে, বস্রা ধ্বংস হয়ে ঘৃণার পাত্র হবে। লোকেরা তার অবস্থা দেখে হতভম্ব হবে এবং তার নাম নিয়ে বদদোয়া দেবে। তার সব গ্রাম ও শহরগুলো চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে থাকবে।” আমি মাবুদের কাছ থেকে এই খবর শুনেছি যে, একজন দূতকে জাতিদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সে বলছে, “তোমরা ইদোমকে আক্রমণ করবার জন্য একত্র হও। যুদ্ধ করবার জন্য ওঠো।” মাবুদ বলছেন, “এখন আমি জাতিদের মধ্যে তোমাকে সবচেয়ে ছোট করব এবং লোকদের মধ্যে ঘৃণার পাত্র করব। হে পাথরের ফাটলে বাসকারী পাহাড়ের উঁচু উঁচু জায়গার অধিকারী, তুমি ভয়ংকর বলে তোমার দিলের যে গর্ব তা তোমাকে ছলনা করেছে। যদিও তুমি ঈগলের মত উঁচু জায়গায় তোমার বাসা তৈরী কর তবুও সেখান থেকে আমি তোমাকে নীচে নামিয়ে আনব। “ইদোমের অবস্থা দেখে লোকেরা হতভম্ব হবে; যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা সবাই ভীষণ ভয় পাবে এবং তার সব আঘাতের জন্য তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে। আমি মাবুদ বলছি, আশেপাশের গ্রাম সুদ্ধ যেমন সাদুম ও আমুরাকে ধ্বংস করা হয়েছিল তেমনি ইদোমে কেউ বাস করবে না; তার মধ্যে কোন মানুষ থাকবে না। “জর্ডানের জংগল থেকে সিংহ যেমন উঠে এসে ভাল চারণ ভূমিতে শিকার করতে যায় তেমনি করে আমি মুহূর্তের মধ্যে ইদোমকে তার দেশ থেকে তাড়া করব। আমি তার উপর আমার বাছাই করা বান্দাকে নিযুক্ত করব। কে আমার সমান? কে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? কোন্‌ পালক আমার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে?” কাজেই ইদোমের বিরুদ্ধে মাবুদ কি পরিকল্পনা করেছেন, তৈমনের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে তিনি কি ঠিক করেছেন তা শোন্তপালের বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে; তাদের কাজের দরুনই তাদের চারণ ভূমি তিনি একেবারে ধ্বংস করে দেবেন। তাদের পতনের শব্দে দুনিয়া কাঁপবে; তাদের কান্না লোহিত সাগর পর্যন্ত শোনা যাবে। দেখ, তাদের শত্রু ঈগলের মত করে উঁচুতে উড়বে আর বস্রার উপরে ডানা মেলে দিয়ে শোঁ করে নীচে নেমে আসবে। সেই দিন ইদোমের যোদ্ধাদের অন্তর প্রসব-যন্ত্রণা ভোগকারিণী স্ত্রীলোকের অন্তরের মত হবে। দামেস্কের বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “হামা আর অর্পদ ভয়ে ব্যাকুল হয়েছে, কারণ তারা খারাপ খবর শুনেছে। তারা হতাশ হয়েছে, অস্থির সাগরের মত অশান্ত হয়েছে। দামেস্ক দুর্বল হয়েছে, সে পালাবার জন্য ফিরেছে এবং ভয় তাকে আঁকড়ে ধরেছে; প্রসব-যন্ত্রণা ভোগকারিণী স্ত্রীলোকের মত যন্ত্রণা ও ব্যথা তাকে ধরেছে। সেই বিখ্যাত শহর, যে শহরকে নিয়ে আমি খুশী হতাম, কেন লোকেরা তা ত্যাগ করে চলে যায় নি? আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, তার যুবকেরা নিশ্চয়ই শহরের খোলা জায়গায় মরে পড়ে থাকবে; সেই দিন তার সব সৈন্যদের শেষ করে দেওয়া হবে। দামেস্কের দেয়ালগুলোতে আমি আগুন লাগিয়ে দেব; তা বিন্‌হদদের কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।” ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার কায়দার ও হাৎসোরের যে রাজ্যগুলোকে হারিয়ে দিয়েছিলেন সেগুলোর বিষয়ে মাবুদ বলছেন, “ওঠো, কায়দার আক্রমণ কর এবং পূর্বদেশের লোকদের ধ্বংস কর। লোকে তাদের সব তাম্বু ও পশুপাল নিয়ে যাবে আর তাদের সমস্ত জিনিস, তাম্বুর পর্দা ও উট নিয়ে যাবে। তারা চিৎকার করে তাদের বলবে, ‘চারদিকেই ভীষণ ভয়!’ ” মাবুদ বলছেন, “হে হাৎসোরের বাসিন্দারা, তোমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও। তোমরা গোপন স্থানে গিয়ে থাক। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তোমাদের বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পনা করেছে। হে ব্যাবিলনীয়রা, তোমরা ওঠো, সেই আরামে থাকা জাতি যে নিরাপদে বাস করে তাকে আক্রমণ কর। সেই জাতির দরজাও নেই, আগলও নেই; তারা একা বাস করে। তাদের উটগুলো লুটের মাল হবে এবং তাদের মস্ত বড় পশুপাল লুটের জিনিস হবে। যারা মাথার দু’পাশের চুল কাটে তাদের আমি চারদিকে ছড়িয়ে দেব এবং সব দিক থেকেই তাদের উপর বিপদ আনব। হাৎসোর হবে শিয়ালদের বাসস্থান ও চিরস্থায়ী জনশূন্য জায়গা। কেউ সেখানে বাস করবে না, তার মধ্যে কোন মানুষ থাকবে না।” এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের প্রথম দিকে ইলাম সম্বন্ধে মাবুদের এই কালাম নবী ইয়ারমিয়ার উপর নাজেল হল, “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমি ইলামের ধনুক, তাদের শক্তির প্রধান খুঁটি ভেংগে ফেলব। আমি আসমানের চারদিক থেকে চারটা বাতাস ইলামের বিরুদ্ধে আনব। সেই বাতাসে আমি তাদের চারদিকে ছড়িয়ে দেব; ইলামের দূর করে দেওয়া বন্দীরা সমস্ত জাতির কাছে যাবে। যারা তাদের হত্যা করতে চায় সেই শত্রুদের সামনেই আমি ইলামীয়দের চুরমার করে দেব; আমার জ্বলন্ত রাগে আমি তাদের উপর বিপদ নিয়ে আসব। তাদের শেষ করে না ফেলা পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার পাঠাব। আমি ইলামে আমার সিংহাসন স্থাপন করব এবং তার বাদশাহ্‌ ও রাজকর্মচারীদের ধ্বংস করব, কিন্তু ভবিষ্যতে আমি ইলামের অবস্থা ফিরাব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” ব্যাবিলন, অর্থাৎ ব্যাবিলনীয়দের দেশ সম্বন্ধে নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে মাবুদ এই কথা বলেছিলেন, “তোমরা জাতিদের মধ্যে প্রচার ও ঘোষণা কর, নিশান তুলে ধর এবং ঘোষণা কর। কিছু গোপন রেখো না, বরং বল, ‘অন্যেরা ব্যাবিলনকে অধিকার করবে; বেল দেবতাকে লজ্জা দেওয়া হবে, মারডক দেবতাকে চুরমার করা হবে। ব্যাবিলনের মূর্তিগুলোকে লজ্জা দেওয়া হবে এবং তার প্রতিমাগুলোকে চুরমার করা হবে।’ উত্তর থেকে একটা জাতি তাকে আক্রমণ করবে এবং তার দেশকে পতিত জমি করে রাখবে। কেউ তার মধ্যে বাস করবে না; মানুষ ও পশু দুই-ই পালিয়ে যাবে। “সেই সময়ে ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা একত্রে চোখের পানির সংগে তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী হবে। তারা সিয়োনে যাবার পথের কথা জিজ্ঞাসা করবে এবং সেই দিকে তাদের মুখ ফিরাবে। তারা এসে এমন একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় মাবুদের সংগে নিজেদের বাঁধবে যা লোকে ভুলে যাবে না। “আমার বান্দারা হারানো ভেড়ার মত হয়েছে; তাদের রাখালেরা তাদের বিপথে নিয়ে গেছে। সেই রাখালদের দরুন তারা পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং নিজেদের বিশ্রামের জায়গার কথা ভুলে গেছে। যারা তাদের পেয়েছে তারা তাদের গ্রাস করেছে; তাদের শত্রুরা বলেছে, ‘আমরা দোষী নই, কারণ মাবুদের বিরুদ্ধে, তাদের সত্যিকারের চারণ ভূমির বিরুদ্ধে, তাদের পূর্বপুরুষদের আশা সেই মাবুদের বিরুদ্ধে তারা গুনাহ্‌ করেছে।’ “হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা ব্যাবিলন থেকে পালিয়ে যাও; ব্যাবিলনীয়দের দেশ ত্যাগ কর এবং পালের আগে আগে চলা ছাগলগুলোর মত হও। আমি উত্তর দিকের দেশ থেকে বড় বড় জাতিদের একত্র করব আর তাদের উত্তেজিত করে ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে নিয়ে আসব। তারা ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে সৈন্যদের সাজাবে এবং সেটা অধিকার করবে। দক্ষ যোদ্ধাদের মত তাদের তীরগুলো বিফল হবে না। ব্যাবিলনকে লুট করা হবে; যারা তাকে লুট করবে তারা সবাই তৃপ্ত হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “হে ব্যাবিলনীয়রা, তোমরা আমার অধিকারকে লুট করছ এবং তাতে আনন্দ করছ, খুশী হচ্ছ। তোমরা শস্য মাড়াই-করা বক্‌না বাছুরের মত নাচানাচি করছ এবং তেজী ঘোড়ার মত ডাকছ; সেইজন্য তোমাদের মা খুব লজ্জা পাবে; যে তোমাদের জন্ম দান করেছে সে অসম্মানিতা হবে। জাতিদের মধ্যে সে হবে সবচেয়ে ছোট; সে হবে একটা মরুভূমি, একটা শুকনা জায়গা, একটা মরুভূমি। মাবুদের রাগের দরুন তার মধ্যে কেউ বাস করবে না, তা একেবারে ধ্বংসস্থান হবে। যারা ব্যাবিলনের পাশ দিয়ে যাবে তারা সবাই হতভম্ব হবে এবং তার সব আঘাত দেখে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে। “হে ধনুকধারীরা, তোমরা সবাই যুদ্ধের জন্য জায়গা নিয়ে ব্যাবিলনের চারপাশে দাঁড়াও। তার দিকে তীর ছোঁড়ো। কোন তীর রেখে দিয়ো না, কারণ সে মাবুদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে। তার বিরুদ্ধে চারদিক থেকে যুদ্ধের হাঁক দাও। সে হার স্বীকার করেছে, তার রক্ষার ব্যবস্থা ভেংগে গেছে এবং তার দেয়াল ধ্বংস হয়েছে। মাবুদ তার উপরে প্রতিশোধ নিচ্ছেন, তোমরাও প্রতিশোধ নাও। সে অন্যদের প্রতি যা করেছে তোমরাও তার প্রতি তা-ই কর। ব্যাবিলনে যারা বীজ বোনে আর সময়মত ফসল কাটে তাদের প্রত্যেককে শেষ করে দাও। অত্যাচারীর তলোয়ারের ভয়ে প্রত্যেকে তার নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাবে, প্রত্যেকে তার নিজের দেশে পালিয়ে যাবে। “ইসরাইল যেন একটা ছড়িয়ে পড়া ভেড়ার পাল যাকে সিংহেরা তাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌ তাকে গ্রাস করেছিল; শেষে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তার হাড়গুলো গুঁড়া করে দিয়েছে। সেইজন্য আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আশেরিয়ার বাদশাহ্‌কে যেমন শাস্তি দিয়েছি তেমনি করে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ ও তার দেশকে আমি শাস্তি দেব। কিন্তু ইসরাইলকে আমি তার নিজের চারণ ভূমিতে ফিরিয়ে আনব এবং সে কর্মিল ও বাশনের উপরে চরে বেড়াবে; আফরাহীম ও গিলিয়দের পাহাড়গুলোতে তার খিদে মিটবে। সেই সময়ে ইসরাইলের অন্যায়ের খোঁজ নেওয়া হবে কিন্তু একটাও থাকবে না, এহুদার গুনাহের খোঁজ করা হবে কিন্তু একটাও পাওয়া যাবে না, কারণ আমি যাদের বাঁচিয়ে রাখব তাদের আমি মাফ করব। “হে ব্যাবিলনের শত্রুরা, আমি মাবুদ বলছি, তোমরা মরাথয়িম দেশকে ও যারা পকোদে বাস করে তাদের আক্রমণ কর। তাদের তাড়া কর, হত্যা কর ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দাও; আমি তোমাদের যে যে হুকুম দিয়েছি তার প্রত্যেকটা তোমরা পালন করবে। দেশে যুদ্ধের ও মহা ধ্বংসের শব্দ হচ্ছে। গোটা দুনিয়ার হাতুড়ী কেমন ভেংগে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। ব্যাবিলনের অবস্থা দেখে সব জাতির লোকেরা কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে। হে ব্যাবিলন, আমি তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছি আর তুমি না জেনে তাতে ধরা পড়েছ; তোমাকে পাওয়া গেছে এবং ধরাও হয়েছে, কারণ তুমি আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলে। আমি আমার অস্ত্রশস্ত্রের ঘর খুলে আমার রাগের অস্ত্রগুলো বের করে আনলাম, কারণ ব্যাবিলনীয়দের দেশে দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাজ আছে। হে ব্যাবিলনের শত্রুরা, তোমরা দূর থেকে তার বিরুদ্ধে এস। তার গোলাঘরগুলো খুলে ফেল; জড়ো করা শস্যের মত তাকে ঢিবি কর। তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস কর, তার কিছু বাকী রেখো না। তার সব ষাঁড়গুলো মেরে ফেল; সেগুলো জবাই করবার জায়গায় নেমে যাক। হায়! তাদের শাস্তি পাবার সময় এসে পড়েছে।” শোন, ব্যাবিলন থেকে পালিয়ে যাওয়া ও রক্ষা পাওয়া লোকেরা সিয়োনে এসে ঘোষণা করছে যে, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ কেমন করে তাঁর ঘরের জন্য প্রতিশোধ নিয়েছেন। মাবুদ বলছেন, “ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে সব ধনুকধারীদের ডাক। তার চারপাশে সৈন্য-ছাউনি ফেল; কাউকে পালাতে দিয়ো না। তার কাজের ফল তাকে দাও। সে যা করেছে তার প্রতি তা-ই কর, কারণ সে মাবুদের বিরুদ্ধে, ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের বিরুদ্ধে নিজেকে বড় করে দেখিয়েছে। সেইজন্য তার যুবকেরা শহরের খোলা জায়গায় মরে পড়ে থাকবে; সেই দিন তার সব সৈন্যদের শেষ করে দেওয়া হবে। আমি দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, হে অহংকারী, দেখ, আমি তোমার বিরুদ্ধে, কারণ তোমার শাস্তি পাবার সময় এসে গেছে। সেই অহংকারী উচোট খেয়ে পড়ে যাবে এবং কেউ তাকে উঠতে সাহায্য করবে না; তার শহরগুলোতে আমি আগুন ধরিয়ে দেব, তা তার চারপাশের সব কিছু পুড়িয়ে ফেলবে।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “ইসরাইল ও এহুদার লোকেরা অত্যাচারিত হচ্ছে। যারা তাদের ধরেছে তারা সবাই তাদের শক্ত করে ধরে রেখেছে, তাদের যেতে দিচ্ছে না। কিন্তু তাদের মুক্তিদাতা শক্তিশালী; তাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। তিনি জোরালোভাবেই তাদের পক্ষে ওকালতি করবেন যাতে তাদের দেশে শান্তি ও ব্যাবিলনের বাসিন্দাদের জন্য অশান্তি আনতে পারেন।” মাবুদ বলছেন, “ব্যাবিলনীয়দের বিরুদ্ধে, ব্যাবিলনের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ও তার উঁচু পদের কর্মচারী ও জ্ঞানী লোকদের বিরুদ্ধে তলোয়ার রয়েছে। তার ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে রয়েছে তলোয়ার; তারা বোকা হয়ে যাবে। তার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে রয়েছে তলোয়ার; তারা ভয়ে পূর্ণ হবে। তার সব ঘোড়া, রথ ও বিদেশী সৈন্যদের বিরুদ্ধে রয়েছে তলোয়ার; তারা স্ত্রীলোকদের মত দুর্বল হয়ে যাবে। তার ধন-সম্পদের বিরুদ্ধে রয়েছে তলোয়ার; সেই সব লুট হয়ে যাবে। খরায় তার সমস্ত পানি শুকিয়ে যাবে, কারণ সেটা হল মূর্তির দেশ, আর সেই ভয়ংকর মূর্তিগুলো সেখানকার লোকদের পাগল করে তুলবে। “সেইজন্য মরুভূমির প্রাণী ও শিয়ালেরা সেখানে বাস করবে, আর সেখানে উটপাখী থাকবে। সেখানে আর কখনও লোক থাকবে না, পুরুষের পর পুরুষ কেউ সেখানে বাস করবে না। আমি যেমন আশেপাশের গ্রাম সুদ্ধ সাদুম ও আমুরা ধ্বংস করেছিলাম, তেমনি কেউ সেখানে বাস করবে না; কোন মানুষ তার মধ্যে থাকবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “দেখ, একদল সৈন্য উত্তর থেকে আসছে; দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে একটা বড় জাতি ও অনেক বাদশাহ্‌রা উত্তেজিত হয়ে আসছে। তারা ধনুক ও তলোয়ারধারী; তারা নিষ্ঠুর ও দয়াহীন। তারা ঘোড়ায় করে আসবার সময় সমুদ্রের গর্জনের মত শব্দ হচ্ছে; হে ব্যাবিলন্তকন্যা, তোমাকে আক্রমণ করবার জন্য তারা যুদ্ধের সাজে আসছে। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ তাদের সম্বন্ধে খবর শুনেছে আর তার হাত অবশ হয়ে ঝুলে পড়েছে। প্রসব-যন্ত্রণা ভোগকারিণী স্ত্রীলোকের ব্যথার মত দারুণ কষ্ট তাকে ধরেছে। জর্ডানের জংগল থেকে সিংহ যেমন উঠে এসে ভাল চারণ ভূমিতে শিকার করতে যায় তেমনি করে আমি মুহূর্তের মধ্যে ব্যাবিলনীয়দের তাদের দেশ থেকে তাড়া করব। আমি তার উপর আমার বাছাই করা বান্দাকে নিযুক্ত করব। কে আমার সমান? কে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? কোন্‌ পালক আমার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে?” কাজেই ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে মাবুদ কি পরিকল্পনা করেছেন, ব্যাবিলনীয়দের বিরুদ্ধে তিনি কি ঠিক করেছেন তা শোন্তপালের বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে; তাদের কাজের দরুনই তাদের চারণ ভুমি তিনি একেবারে ধ্বংস করে দেবেন। “ব্যাবিলন দখল করা হয়েছে,” এই চিৎকারের শব্দে দুনিয়া কাঁপবে; জাতিদের মধ্যে তার কান্নার শব্দ শোনা যাবে। মাবুদ বলছেন, “দেখ, লেব্‌-কামাই, অর্থাৎ ব্যাবিলন ও তার লোকদের বিরুদ্ধে ধ্বংসকারী বাতাসকে আমি উত্তেজিত করব। ব্যাবিলনকে ঝাড়বার জন্য ও তার দেশকে ধ্বংস করবার জন্য আমি তার কাছে বিদেশীদের পাঠাব; তার বিপদের দিনে তারা সব দিক থেকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যাবিলনের ধনুকধারী তার ধনুকে টান না দিক কিংবা সে তার বর্ম না পরুক। তার যুবকদের ছেড়ে দিয়ো না; তার সৈন্যদলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দাও। তারা ব্যাবিলনের রাস্তায় রাস্তায় ভীষণ আঘাত পেয়ে মরে পড়ে থাকবে।” ইসরাইল ও এহুদাকে তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন ত্যাগ করেন নি, যদিও ইসরাইলের আল্লাহ্‌ পাকের সামনে তাদের দেশ দোষে পূর্ণ হয়েছে। তোমরা ব্যাবিলন থেকে পালাও। তোমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের জীবন রক্ষা কর। তার গুনাহের জন্য তোমরা ধ্বংস হয়ে যেয়ো না। মাবুদের প্রতিশোধ নেবার সময় হয়েছে; তার যা পাওনা তাকে তিনি তা দেবেন। ব্যাবিলন মাবুদের হাতে একটা সোনার পেয়ালার মত ছিল; সে গোটা দুনিয়াকে মাতাল করেছিল। জাতিরা তার আংগুর-রস খেয়েছিল, তাই এখন তারা পাগল হয়ে গেছে। ব্যাবিলন হঠাৎ পড়ে গিয়ে ভেংগে গেছে। তার জন্য বিলাপ কর। তার ব্যথার জন্য মলম আন; হয়তো সে সুস্থ হবে। লোকে বলে, “আমরা ব্যাবিলনকে সুস্থ করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে সুস্থ হয় নি। চল, আমরা তাকে ছেড়ে যে যার দেশে চলে যাই, কারণ তার শাস্তি আসমান পর্যন্ত পৌঁছেছে, তা মেঘ পর্যন্ত উঁচুতে উঠেছে।” আমরা যে মাবুদের নিজের বান্দা তিনি তা দেখিয়ে দিয়েছেন; আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ যা করেছেন এস, আমরা তা সিয়োনে বলি। তোমরা তীরগুলো ধারালো কর, ঢাল নাও। মাবুদ মিডীয় বাদশাহ্‌দের উত্তেজিত করেছেন, কারণ তাঁর উদ্দেশ্যই হল ব্যাবিলনকে ধ্বংস করা। মাবুদ অবশ্যই তাঁর ঘরের জন্য প্রতিশোধ নেবেন। ব্যাবিলনকে আক্রমণ করবার জন্য একটা নিশান তোল। রক্ষীদলকে আরও শক্তিশালী কর, পাহারা বসাও, গোপন স্থানে সৈন্যদের প্রস্তুত রাখ। মাবুদ ব্যাবিলনের লোকদের বিরুদ্ধে তাঁর উদ্দেশ্য ও হুকুম অনুসারে কাজ করবেন। হে ব্যাবিলন, তুমি তো অনেক পানির ধারে বাস কর এবং অনেক ধন-সম্পদের অধিকারী; তোমার শেষ এসেছে, তোমাকে ছেঁটে ফেলবার সময় উপস্থিত হয়েছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর নিজের নামেই কসম খেয়ে বলেছেন, “আমি নিশ্চয়ই এক ঝাঁক পংগপালের মত লোকজন দিয়ে তোমাকে পূর্ণ করব, আর তারা তোমার উপরে জয়ের হাঁক দেবে।” মাবুদ নিজের শক্তিতে দুনিয়া তৈরী করেছেন, তাঁর জ্ঞান দ্বারা জমীন স্থাপন করেছেন ও বুদ্ধি দ্বারা আসমান বিছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর হুকুমে আসমানের পানি গর্জন করে; তিনি দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে মেঘ উঠিয়ে আনেন। তিনি বৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ তৈরী করেন এবং তাঁর ভাণ্ডার থেকে বাতাস বের করে আনেন। সব মানুষই জ্ঞানহীন ও বোকা; প্রত্যেক স্বর্ণকার তার মূর্তিগুলোর জন্য লজ্জা পায়। তার ছাঁচে ঢালা মূর্তিগুলো মিথ্যা, সেগুলোর মধ্যে নিঃশ্বাস নেই। সেগুলো অপদার্থ, ঠাট্টা-বিদ্রূপের জিনিস; বিচারের সময় আসলে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যিনি ইয়াকুবের পাওনা অংশ তিনি এগুলোর মত নন, কারণ তিনিই সমস্ত জিনিসের সৃষ্টিকর্তা আর ইসরাইল তাঁর বিশেষ সম্পত্তি। তাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। মাবুদ বলছেন, “হে ব্যাবিলন, তুমি আমার যুদ্ধের গদা, আমার যুদ্ধের অস্ত্র; তোমাকে দিয়ে আমি জাতিদের চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে রাজ্যগুলোকে ধ্বংস করেছি; তোমাকে দিয়ে আমি ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারকে চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে রথ ও রথচালকদের চুরমার করেছি; তোমাকে দিয়ে আমি পুরুষ ও স্ত্রীলোককে চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে বুড়ো ও শিশুকে চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে যুবক ও যুবতীকে চুরমার করেছি; তোমাকে দিয়ে আমি রাখাল ও ভেড়ার পাল চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে চাষী ও বলদদের চুরমার করেছি, তোমাকে দিয়ে শাসনকর্তাদের ও রাজকর্মচারীদের চুরমার করেছি।” মাবুদ বলছেন, “ব্যাবিলন ও ব্যাবিলনে বাসকারী সকলে সিয়োনে যে সব অন্যায় কাজ করেছে তোমাদের চোখের সামনে আমি তার ফল দেব।” মাবুদ বলছেন, “হে ধ্বংসকারী পাহাড়, তুমি সমস্ত দুনিয়ার ধ্বংসকারী; আমি তোমার বিরুদ্ধে। আমার হাত আমি তোমার বিরুদ্ধে বাড়িয়ে খাড়া পাহাড় থেকে তোমাকে গড়িয়ে ফেলে দেব ও তোমাকে করব একটা পুড়ে যাওয়া পাহাড়। লোকে কোণার পাথরের জন্য তোমার মধ্য থেকে কোন পাথর নেবে না, ভিত্তির জন্যও নেবে না; তুমি চিরকাল জনশূন্য হয়ে থাকবে। “তোমরা দেশের মধ্যে নিশান তোল। জাতিদের মধ্যে শিংগা বাজাও। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য জাতিদের প্রস্তুত কর; তার বিরুদ্ধে আরারাত, মিন্নি ও অস্কিনস রাজ্যকে ডাক দাও। তার বিরুদ্ধে একজন সেনাপতিকে নিযুক্ত কর; পংগপালের মত অনেক ঘোড়া পাঠিয়ে দাও। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য জাতিদের, মিডীয় বাদশাহ্‌দের, তাদের শাসনকর্তাদের ও সব রাজকর্মচারীদের এবং তাদের শাসনের অধীন সমস্ত রাজ্যগুলোকে প্রস্তুত কর। দেশ কাঁপছে ও মোচড় খাচ্ছে, কারণ ব্যাবিলনকে জনশূন্য ও পতিত জমি করে রাখবার মাবুদের যে উদ্দেশ্য তা ঠিক রয়েছে। ব্যাবিলনের যোদ্ধারা যুদ্ধ করা থামিয়েছে; তারা তাদের কেল্লার মধ্যে রয়েছে। তাদের শক্তি ফুরিয়ে গেছে; তারা স্ত্রীলোকদের মত দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের বাসস্থানগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে; ব্যাবিলনের সব দরজার আগলগুলো ভেংগে ফেলা হয়েছে। সংবাদদাতার পর সংবাদদাতা এবং দূতের পর দূত চলেছে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে ঘোষণা করতে যে, তার গোটা শহরটাই অধিকার করা হয়েছে, তার নদীর হেঁটে পার হওয়ার জায়গাগুলো দখল করা হয়েছে, নলবনে আগুন লাগানো হয়েছে ও সৈন্যেরা ভীষণ ভয় পেয়েছে।” আমি ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, “ব্যাবিলন্তকন্যা শস্য মাড়াই করবার সময়কার খামারের মত হয়েছে; ফসল কাটবার মত তাকে কেটে ফেলবার সময় শীঘ্রই আসবে।” জেরুজালেমের লোকেরা বলছে, “ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার আমাদের গ্রাস করেছেন, আমাদের চুরমার করেছেন, আমাদের খালি কলসীর মত করেছেন। দানবের মত তিনি আমাদের গিলে ফেলেছেন এবং আমাদের ভাল ভাল খাবার দিয়ে তাঁর পেট ভরেছেন, আর তার পরে আমাদের এঁটোকাঁটার মত দূর করে দিয়েছেন।” সিয়োনের বাসিন্দারা বলছে, “আমাদের শরীরের উপর যে জুলুম করা হয়েছে তা ব্যাবিলনের উপর করা হোক। যারা ব্যাবিলনে বাস করে আমাদের রক্তের জন্য তারা দায়ী থাকুক।” সেইজন্য মাবুদ বলছেন, “হে জেরুজালেম, আমি তোমার পক্ষ হব এবং তোমার হয়ে প্রতিশোধ নেব; আমি তার সাগর শুকিয়ে ফেলব এবং সব ঝর্ণা শুকনা করব। ব্যাবিলন হবে একটা ধ্বংসের ঢিবি, শিয়ালদের বাসস্থান এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র। সেখানে কেউ বাস করবে না; তার অবস্থা দেখে লোকেরা হতভম্ব হবে। তার লোকেরা সবাই সিংহের মত গর্জন করবে, সিংহের বাচ্চাদের মত গোঁ গোঁ করবে। তারা উত্তেজিত হলে পর আমি তাদের জন্য একটা মেজবানীর ব্যবস্থা করব। আমি তাদের মাতাল করব যেন তারা আনন্দে মেতে ওঠে, তারপর চিরকালের জন্য ঘুমায়, কখনও না জাগে। বাচ্চা-ভেড়াগুলোর মত করে, ভেড়া ও ছাগলের মত করে আমি তাদের জবাই করবার জায়গায় নিয়ে যাব। “শেশককে, অর্থাৎ ব্যাবিলনকে কেমন বেদখল করা হবে! গোটা দুনিয়ার প্রশংসার পাত্রকে কেমন অধিকার করা হবে! ব্যাবিলনকে দেখে জাতিরা হতভম্ব হবে। ব্যাবিলনের উপরে সমুদ্র উঠে আসবে, তার গর্জন্তকরা ঢেউ তাকে ঢেকে ফেলবে। তার শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। সেগুলো হবে শুকনা ও মরুভূমির দেশ; সেই দেশে কেউ বাস করবে না, তার মধ্য দিয়ে কেউ যাওয়া-আসা করবে না। আমি ব্যাবিলনের বেল দেবতাকে শাস্তি দেব এবং সে যা গিলেছে তা তাকে দিয়ে বমি করাব। জাতিরা আর তার কাছে স্রোতের মত যাবে না। ব্যাবিলনের দেয়ালও পড়ে যাবে। “হে আমার বান্দারা, ব্যাবিলনের মধ্য থেকে বের হয়ে এস। তোমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের জীবন রক্ষা কর। মাবুদের জ্বলন্ত রাগ থেকে দৌড়ে পালাও। যখন নানা গুজব শোনা যাবে তখন হতাশ হোয়ো না বা ভয় পেয়ো না; এক বছরে একটা গুজব উঠবে আর অন্য বছরে আর একটা গুজব উঠবে। সেই গুজব হল, ব্যাবিলনে জুলুম হচ্ছে এবং এক শাসনকর্তা আর এক শাসনকর্তার বিরুদ্ধে উঠছে। এমন সময় নিশ্চয়ই আসছে যখন আমি ব্যাবিলনের মূর্তিগুলোকে শাস্তি দেব; তার গোটা দেশটাই অসম্মানিত হবে আর তার নিহত লোকেরা সবাই তার মধ্যে পড়ে থাকবে। আসমান, জমীন ও সেগুলোর মধ্যেকার সব কিছু ব্যাবিলনের বিষয় নিয়ে আনন্দে চিৎকার করবে, কারণ উত্তর দিক থেকে ধ্বংসকারীরা এসে তাকে আক্রমণ করবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। ব্যাবিলনের দরুন যেমন সমস্ত দুনিয়াতে লোকেরা মরে পড়ে ছিল তেমনি বনি-ইসরাইলদের হত্যা করবার দরুন ব্যাবিলনীয়দেরও মরে পড়ে থাকতে হবে। তোমরা যারা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছ তোমরা চলে এস, দেরি কোরো না। দূর দেশে থাকবার সময় মাবুদকে মনে কর এবং জেরুজালেমের বিষয়ে চিন্তা কর। “তোমরা বলেছ, ‘আমাদের বিষয়ে টিট্‌কারির কথা শুনেছি বলে আমরা অসম্মানিত হয়েছি। লজ্জা আমাদের মুখ ঢেকে ফেলেছে, কারণ মাবুদের ঘরের পবিত্র জায়গাগুলোতে বিদেশীরা ঢুকেছিল।’ কিন্তু আমি বলছি, দিন আসছে যখন আমি ব্যাবিলনের মূর্তিগুলোকে শাস্তি দেব এবং ব্যাবিলনের সব জায়গায় ভীষণভাবে আহত লোকেরা কাত্‌রাতে থাকবে। ব্যাবিলন যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছায় আর সেখানে শক্ত কেল্লা গড়ে তোলে, তবুও আমি তার বিরুদ্ধে ধ্বংসকারীদের পাঠিয়ে দেব।” ব্যাবিলন থেকে কান্নার শব্দ উঠছে, ব্যাবিলনীয়দের দেশ থেকে উঠছে মহা ধ্বংসের শব্দ, কারণ মাবুদ ব্যাবিলনকে ধ্বংস করবেন; তিনি তার ভীষণ শব্দকে থামিয়ে দেবেন। শত্রুরা বড় বড় ঢেউয়ের মত গর্জন করতে করতে আসবে; তারা জোরে জোরে চিৎকার করবে। ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে আসবে ধ্বংসকারী; তার যোদ্ধারা ধরা পড়বে এবং তাদের ধনুকগুলো ভেংগে যাবে; কারণ আল্লাহ্‌ প্রতিশোধ দাতা মাবুদ; ব্যাবিলনের পাওনা তিনি পুরোপুরিই দেবেন। যাঁর নাম আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন সেই বাদশাহ্‌ বলছেন, “আমি তার রাজকর্মচারী, জ্ঞানী লোক, শাসনকর্তা, উঁচু পদের কর্মচারী ও যোদ্ধাদের মাতাল করব। তারা চিরকালের জন্য ঘুমাবে; তারা আর জাগবে না। ব্যাবিলনের মোটা দেয়াল ভেংগে সমান করে ফেলা হবে এবং তার উঁচু দরজাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। লোকেরা মিথ্যাই নিজেদের ক্লান্ত করবে, জাতিদের পরিশ্রমের ফল আগুনে পুড়ে যাবে।” এহুদার বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের চতুর্থ বছরে মহসেয়ের নাতি, অর্থাৎ নেরিয়ের ছেলে সরায় যিনি বাদশাহ্‌র একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী ছিলেন, তিনি যখন বাদশাহ্‌র সংগে ব্যাবিলনে গিয়েছিলেন তখন ইয়ারমিয়া তাঁকে কিছু হুকুম দিয়েছিলেন। ব্যাবিলনের উপর যে সব বিপদ আসবে, অর্থাৎ ব্যাবিলন সম্বন্ধে যে সব কথা লেখা হয়েছিল তা ইয়ারমিয়া একটা গুটিয়ে রাখা কিতাবে লিখেছিলেন। ইয়ারমিয়া সরায়কে বললেন, “আপনি যখন ব্যাবিলনে পৌঁছাবেন তখন খেয়াল রাখবেন যেন এই সব কথা আপনি লোকদের পড়ে শোনান। তারপর বলবেন, ‘হে মাবুদ, তুমি এই জায়গা ধ্বংস করবার কথা বলেছ, তাতে মানুষ বা পশু কেউই তার মধ্যে বাস করবে না; এটা চিরদিনের জন্য জনশূন্য হয়ে থাকবে।’ এই কিতাবটা তেলাওয়াত করা শেষ করে তাতে একটা পাথর বেঁধে ফোরাত নদীতে ফেলে দেবেন। তারপর বলবেন, ‘এইভাবে ব্যাবিলন ডুবে যাবে, আর উঠবে না, কারণ মাবুদ তার উপর বিপদ আনবেন। সে একেবারেই শেষ হয়ে যাবে।’ ” ইয়ারমিয়ার কথা এখানেই শেষ। একুশ বছর বয়সে সিদিকিয় বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি জেরুজালেমে এগারো বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল হমুটল; তিনি ছিলেন লিব্‌না শহরের ইয়ারমিয়ার মেয়ে। যিহোয়াকীমের মত সিদিকিয় মাবুদের চোখে যা খারাপ তা-ই করতেন। জেরুজালেম ও এহুদার লোকদের দরুন মাবুদ রাগে জ্বলে উঠেছিলেন এবং শেষে তিনি তাঁর সামনে থেকে তাদের দূর করে দিয়েছিলেন। পরে সিদিকিয় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। সেইজন্য তাঁর রাজত্বের নবম বছরের দশম মাসের দশ দিনের দিন ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তাঁর সমস্ত সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। তারা শহরের বাইরে ছাউনি ফেলল এবং শহরের চারপাশে ঢিবি তৈরী করল। বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের রাজত্বের এগারো বছর পর্যন্ত শহরটা ঘেরাও করে রাখা হল। চতুর্থ মাসের নয় দিনের দিন শহরে দুর্ভিক্ষের অবস্থা এত ভীষণ হল যে, লোকদের খাওয়ার জন্য কিছুই ছিল না। পরে শহরের দেয়ালের একটা জায়গা ভেংগে গেল। যদিও ব্যাবিলনীয়রা তখনও শহরটা ঘেরাও করে ছিল তবুও রাতের বেলায় এহুদার সমস্ত সৈন্য বাদশাহ্‌র বাগানের কাছে দুই দেয়ালের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে আরবার দিকে গেল। বাদশাহ্‌র সমস্ত সৈন্য তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল এবং সেই সময় ব্যাবিলনীয় সৈন্যদলও বাদশাহ্‌ সিদিকিয়ের পিছনে তাড়া করে জেরিকোর সমভূমিতে তাঁকে ধরে ফেলল। তারা সিদিকিয়কে বন্দী করে হামা দেশের রিব্‌লাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেল এবং সেখানে তাঁকে শাস্তির হুকুম দেওয়া হল। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ রিব্‌লাতে সিদিকিয়ের চোখের সামনেই তাঁর ছেলেদের হত্যা করলেন এবং এহুদার সমস্ত রাজকর্মচারীদেরও হত্যা করলেন। তারপর তিনি সিদিকিয়ের চোখ দু’টা তুলে ফেলে, তাঁকে ব্রোঞ্জের শিকল দিয়ে বেঁধে ব্যাবিলনে নিয়ে গেলেন এবং তিনি না মরা পর্যন্ত তাঁকে জেলখানায় রাখলেন। ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের রাজত্বের ঊনিশ বছরের পঞ্চম মাসের দশম দিনে বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি হিসাবে যিনি বাদশাহ্‌র সেবা করতেন সেই নবূষরদন জেরুজালেমে আসলেন। তিনি মাবুদের ঘরে, রাজবাড়ীতে এবং জেরুজালেমের সমস্ত বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। সমস্ত প্রধান প্র্রধান বাড়ী তিনি পুড়িয়ে ফেললেন। বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতির অধীনে ব্যাবিলনীয় সমস্ত সৈন্যদল জেরুজালেমের দেয়াল ভেংগে ফেলল। যে সব গরীব লোক শহরে পড়ে ছিল তাদের কয়েকজনকে ও বাদবাকী কারিগরদের এবং যারা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র পক্ষে গিয়েছিল রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন তাদের বন্দী করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু আংগুর ক্ষেত দেখাশোনা ও জমি চাষ করবার জন্য কিছু গরীব লোককে তিনি দেশে রেখে গেলেন। ব্যাবিলনীয়রা মাবুদের ঘরের ব্রোঞ্জের দু’টা থাম, গামলা বসাবার ব্রোঞ্জের আসনগুলো এবং ব্রোঞ্জের বিরাট পাত্রটি ভেংগে টুকরা টুকরা করে ব্যাবিলনে নিয়ে গেল। এছাড়া তারা সব পাত্র, বেল্‌চা, শল্‌তে পরিষ্কার করবার চিম্‌টা, পেয়ালা, হাতা এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের এবাদত-কাজের জন্য অন্যান্য সমস্ত ব্রোঞ্জের জিনিস নিয়ে গেল। বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি সোনা বা রূপার তৈরী যে সব পেয়ালা, আগুন রাখবার পাত্র, পেয়ালা, বাতিদান, বেল্‌চা, ঢালন-কোরবানীর পাত্র ও অন্যান্য যে সব পাত্র ছিল তা নিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ সোলায়মান মাবুদের ঘরের জন্য যে দু’টা থাম, বিরাট পাত্র ও তার নীচেকার বারোটা ব্রোঞ্জের গরু ও যে সব আসন তৈরী করিয়েছিলেন তার সব ব্রোঞ্জ ওজন করা সম্ভব ছিল না। প্রত্যেকটা থাম ছিল আঠারো হাত উঁচু ও তার বেড় ছিল বারো হাত; প্রত্যেকটা থামের ব্রোঞ্জ চার আংগুল পুরু ছিল এবং ভিতরটা ছিল ফাঁপা। একটা থামের মাথা ছিল পাঁচ হাত উঁচু এবং সেই মাথার চারপাশ ব্রোঞ্জের শিকল ও ব্রোঞ্জের ডালিম দিয়ে সাজানো ছিল। অন্য থামটিও একই রকম ছিল। ব্রোঞ্জের শিকলের চারপাশের ডালিমের সংখ্যা ছিল একশো, কিন্তু সামনে থেকে মাত্র ছিয়ানব্বইটা ডালিম দেখা যেত। ইহুদীদের প্রধান ইমাম সরায়, দ্বিতীয় ইমাম সফনিয় ও তিনজন দারোয়ানকে রক্ষীদলের সেনাপতি বন্দী করে নিয়ে গেলেন। যারা তখনও শহরে ছিল তাদের মধ্য থেকে তিনি যোদ্ধাদের উপরে নিযুক্ত একজন কর্মচারী ও বাদশাহ্‌র সাতজন পরামর্শদাতাকে ধরলেন। এছাড়া সেনাপতির লেখক, যিনি সৈন্যদলে লোক ভর্তি করতেন তাঁকে এবং শহরের মধ্যে পাওয়া আরও ষাটজন লোককেও ধরলেন। সেনাপতি নবূষরদন তাদের সবাইকে বন্দী করে রিব্‌লাতে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ হামা দেশের রিব্‌লাতে এই সব লোকদের হত্যা করলেন। এইভাবে এহুদার লোকদের বন্দী করে নিজের দেশ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হল। বখতে-নাসার যে লোকদের বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের সংখ্যা হল এই: সপ্তম বছরে তিন হাজার তেইশজন ইহুদী, বখতে-নাসারের রাজত্বের আঠারো বছরের সময় জেরুজালেম থেকে আটশো বত্রিশজন ইহুদী; আর তাঁর রাজত্বের তেইশ বছরের সময় বাদশাহ্‌র রক্ষীদলের সেনাপতি নবূষরদন সাতশো পঁয়তাল্লিশজন ইহুদীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এদের সংখ্যা ছিল মোট চার হাজার ছ’শো। এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীনের বন্দীত্বের সাঁইত্রিশ বছরের সময় ইবিল-মারডক ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি সেই বছরের বারো মাসের পঁচিশ দিনের দিন যিহোয়াখীনকে জেলখানা থেকে ছেড়ে দিলেন। তিনি যিহোয়াখীনের সংগে ভালভাবে কথা বললেন এবং ব্যাবিলনে তাঁর সংগে আর যে সব বাদশাহ্‌রা ছিলেন তাঁদের চেয়েও তাঁকে আরও সম্মানের আসন দিলেন। যিহোয়াখীন জেলখানার কাপড়-চোপড় খুলে ফেললেন এবং জীবনের বাকী দিনগুলো নিয়মিতভাবে বাদশাহ্‌র সংগে খাওয়া-দাওয়া করে কাটিয়ে দিলেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বাদশাহ্‌ নিয়মিতভাবে তাঁকে প্রতিদিনের জন্য একটা ভাতা দিতেন। হায়! যে শহর একদিন লোকজনে পরিপূর্ণ ছিল সে কেমন একা পড়ে রয়েছে। যে শহর একদিন জাতিদের মধ্যে প্রধান ছিল, সে এখন বিধবার মত হয়েছে। যে ছিল প্রদেশগুলোর রাণী সে এখন হয়েছে বাঁদী। সে রাতের বেলায় খুব কাঁদতে থাকে, চোখের পানিতে তার গাল ভেসে যায়। তার প্রেমিকদের মধ্যে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য একজনও নেই। তার বন্ধুরা সবাই তার প্রতি বেঈমানী করেছে; তারা সকলেই তার শত্রু হয়েছে। কষ্ট ও কঠিন পরিশ্রমের পর এহুদা দূরে বন্দীদশায় গেছে। সে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বাস করছে; কোথাও সে বিশ্রামস্থান পায় নি। যারা তাকে তাড়া করছিল তারা তার কষ্টের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলেছে। সিয়োনের রাস্তাগুলো শোক করছে, কারণ নির্দিষ্ট পর্বে কেউ আর আসে না। তার সব দরজায় ঢুকবার পথ খালি। তার ইমামেরা কাত্‌রাচ্ছে, যুবতী মেয়েরা দুঃখ করছে, তাতে সে মনে খুব ব্যথা পাচ্ছে। তার বিপক্ষেরা তার মালিক হয়েছে; তার শত্রুরা আরামে আছে। তার অনেক গুনাহের জন্য মাবুদই তাকে দুঃখ দিয়েছেন। তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বন্দী হয়ে শত্রুর আগে আগে গেছে। সিয়োন্তকন্যার সব জাঁকজমক চলে গেছে। তার নেতারা এমন সব হরিণের মত যারা চরবার জায়গা পায় না; তারা দুর্বল হয়ে তাদেরই আগে আগে পালিয়ে গেছে যারা তাদের তাড়া করছে। জেরুজালেম তার কষ্টের আর ঘুরে বেড়াবার দিনগুলোতে তার পুরানো দিনের ধন-সম্পদের কথা মনে করছে। তার লোকেরা যখন শত্রুর হাতে পড়েছিল তখন তাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। তার শত্রুরা তার দিকে তাকিয়ে তার ধ্বংসের জন্য ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল। জেরুজালেম খুব গুনাহ্‌ করেছে, তাই সে নাপাক হয়ে গেছে। যারা তাকে সম্মান করত তারা সবাই তাকে তুচ্ছ করছে, কারণ তারা তার উলংগ অবস্থা দেখেছে; সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে ও মুখ লুকাচ্ছে। তার নোংরামি তার কাপড়ে লেগে আছে; তার ভবিষ্যতের কথা সে চিন্তা করে নি। সে ভীষণভাবে পড়ে গেছে; তাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। সে বলছে, “হে মাবুদ, আমার কষ্ট দেখ, কারণ শত্রু জয়লাভ করেছে।” শত্রু তার সব মূল্যবান জিনিসের উপর হাত দিয়েছে; দেবতা-পূজাকারী জাতিদের সে তার পবিত্র জায়গায় ঢুকতে দেখেছে। এরা সেই লোক যাদের তুমি তোমার সমাজে ঢুকতে নিষেধ করেছিলে। তার সব লোকেরা কাত্‌রাতে কাত্‌রাতে খাবারের তালাশ করছে; নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তারা খাবারের বদলে তাদের মূল্যবান জিনিস দিয়ে দিয়েছে। জেরুজালেম বলছে, “হে মাবুদ, তাকাও, ভেবে দেখ, আমাকে তুচ্ছ করা হয়েছে। তোমরা যারা আমার পাশ দিয়ে যাও তোমাদের কি কিছুই যায়-আসে না? একটু ঘুরে তাকিয়ে দেখ। আমাকে যে যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে সেই রকম যন্ত্রণা কি আর কাউকে দেওয়া হয়েছে, যা মাবুদ তাঁর জ্বলন্ত রাগের দিনে আমাকে দিয়েছেন? তিনি উপর থেকে আমার হাড়গোড়ের মধ্যে আগুন পাঠিয়েছেন। আমার পায়ের জন্য তিনি জাল বিছিয়েছেন এবং আমাকে পিছন ফিরতে বাধ্য করেছেন। তিনি আমাকে জনশূন্য করে দিয়েছেন, সারাদিন দুর্বল করে রেখেছেন। আমার সব গুনাহ্‌ তিনি জোয়ালের মত বেঁধেছেন; তিনি হাত দিয়ে সেগুলো একসংগে বুনেছেন। সেগুলো আমার ঘাড়ের উপর দেওয়া হয়েছে; মাবুদই আমার শক্তিকে দুর্বল করেছেন। যাদের আমি বাধা দিতে পারি না তাদের হাতেই তিনি আমাকে তুলে দিয়েছেন। মাবুদই আমার মধ্যেকার সব যোদ্ধাদের বাতিল করেছেন; আমার যুবকদের গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আমার বিরুদ্ধে একটা সময় ঠিক করেছেন। আংগুর মাড়াইয়ের গর্তে এহুদাকে তিনি পায়ে মাড়িয়েছেন। সেইজন্যই আমি কাঁদছি, আমার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমার কাছে কেউ নেই, কেউ নেই যে আমার প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আমার ছেলেমেয়েরা একা হয়ে গেছে, কারণ শত্রু জয়ী হয়েছে।” সিয়োন তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। মাবুদ ইয়াকুবের জন্য এই হুকুম দিয়েছেন যে, তার প্রতিবেশীরা তার শত্রু হবে। তাদের মধ্যে জেরুজালেম হয়েছে একটা নাপাক জিনিস। সে বলছে, “মাবুদ ন্যায়বান, আমি তো তার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। সমস্ত জাতিরা শোন, আমার কষ্ট দেখ; আমার যুবক-যুবতীরা বন্দী হয়ে দূরে চলে গেছে। আমার প্রেমিকদের আমি ডাকলাম কিন্তু তারা আমার প্রতি বেঈমানী করল। আমার ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্য খাবার খুঁজতে খুঁজতে শহরের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। হে মাবুদ, দেখ, আমি কেমন কষ্ট পাচ্ছি! আমার ভিতরেও যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার দিল ব্যাকুল হয়েছে, কারণ আমি ভীষণ বিদ্রোহী হয়েছি। শহরের বাইরে তলোয়ার নিচ্ছে প্রাণ, আর ভিতরে আছে কেবল মৃত্যু। লোকে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনেছে, কিন্তু আমাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। আমার সব শত্রুরা আমার কষ্টের কথা শুনেছে; তুমি যা করেছ তা দেখে তারা আনন্দ করছে। যে দিনের কথা তুমি ঘোষণা করেছ সেই দিন তুমি আন যাতে তারা আমার মত হতে পারে। তাদের সব দুষ্টতা তোমার চোখে পড়ুক। আমার সব গুনাহের জন্য তুমি আমার প্রতি যেমন করেছ তাদের প্রতিও তা-ই কর। আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস বেশী, আমি মনমরা হয়ে পড়েছি।” হায়, মাবুদ কিভাবে তাঁর রাগে সিয়োন্তকন্যাকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছেন! ইসরাইলের জাঁকজমক তিনি আসমান থেকে দুনিয়াতে ফেলে দিয়েছেন। তাঁর রাগের দিনে তাঁর পা রাখবার জায়গাকে তিনি মনে রাখেন নি। ইয়াকুবের সব বাসস্থান মাবুদ গ্রাস করেছেন, কোন মমতা করেন নি। এহুদা-কন্যার কেল্লাগুলো তাঁর উপ্‌চে পড়া রাগে তিনি ভেংগে ফেলেছেন, সেগুলো তিনি মাটিতে ফেলে ধ্বংস করেছেন। তাঁর রাজ্য ও নেতাদের তিনি অসম্মানের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। জ্বলন্ত রাগে তিনি ইসরাইলের সমস্ত শক্তি নষ্ট করে দিয়েছেন। শত্রু এগিয়ে আসতে থাকলে তাঁর শক্তিশালী হাত তিনি গুটিয়ে নিয়েছেন। চারপাশের সব কিছু পুড়িয়ে ফেলা আগুনের শিখার মত তিনি ইয়াকুবের মধ্যে জ্বলে উঠেছেন। শত্রুর মত করে তিনি তাঁর ধনুকে টান দিয়েছেন, তাঁর শক্তিশালী হাত ঠিক করেছেন। যাদের দেখে তারা আনন্দ পেত তাদের তিনি মেরে ফেলেছেন। সিয়োন্তকন্যার তাম্বুর মধ্যে তিনি আগুনের মত করে তাঁর গজব ঢেলে দিয়েছেন। মাবুদ শত্রুর মত হয়েছেন; তিনি ইসরাইলকে গ্রাস করেছেন। তিনি গ্রাস করেছেন তার সব বড় বড় বাড়ীগুলো আর ধ্বংস করে দিয়েছেন তার সব কেল্লা। তিনি এহুদা-কন্যার শোক ও বিলাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বাগানের গাছের মত করে তাঁর বাসস্থানকে উপ্‌ড়ে ফেলেছেন; ধ্বংস করে দিয়েছেন তাঁর নির্দিষ্ট মিলন স্থানকে। মাবুদ সিয়োনকে তার সব ঈদ ও বিশ্রামবারের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন; ভয়ংকর রাগে বাদশাহ্‌ ও ইমামকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। মাবুদ তাঁর কোরবানগাহ্‌কে অগ্রাহ্য করেছেন, ত্যাগ করেছেন তাঁর পবিত্র জায়গা। তাঁর কেল্লাগুলোর সমস্ত দেয়াল তিনি শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছেন। ঈদের দিনের মত করে শত্রুরা মাবুদের ঘরে চিৎকার করছে। সিয়োন্তকন্যার চারপাশের দেয়াল ভেংগে ফেলাই মাবুদ স্থির করেছেন। তিনি মাপের দড়ি দিয়ে মেপেছেন আর ধ্বংস করবার কাজে নিজের হাতকে থামিয়ে রাখেন নি। তিনি সিয়োনের কেল্লা ও দেয়ালকে বিলাপ করিয়েছেন; সেগুলো একসংগে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার দরজাগুলো মাটিতে ঢেকে গেছে; আগলগুলো তিনি ভেংগে নষ্ট করে দিয়েছেন। তার বাদশাহ্‌ ও নেতারা জাতিদের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে; শরীয়ত বলতে কিছু নেই; তার নবীরা মাবুদের কাছ থেকে আর দর্শন পায় না। সিয়োন্তকন্যার বৃদ্ধ নেতারা চুপ করে মাটিতে বসে আছেন। তাঁরা নিজেদের মাথায় ধুলা ছড়িয়েছেন আর ছালার চট পরেছেন। জেরুজালেমের যুবতী মেয়েরা দুঃখে মাটিতে মাথা ঠেকিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে, আমার ভিতরেও যন্ত্রণা হচ্ছে; আমার লোকেরা ধ্বংস হয়েছে, আর ছেলেমেয়েরা ও শিশুরা শহরের খোলা জায়গাগুলোতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সেইজন্য আমার দিল যেন মাটিতে ঢেলে পড়ছে। তারা তাদের মায়েদের বলে, “রুটি আর আংগুর-রস কোথায়?” এই বলে তারা শহরের খোলা জায়গাগুলোতে আহত লোকের মত অজ্ঞান হয়ে পড়ছে; মায়ের কোলের মধ্যে তাদের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হে জেরুজালেম-কন্যা, আমি কি কথা বলে তোমার পক্ষ নেব? কিসের সংগে আমি তোমার তুলনা করব? হে সিয়োন্তকন্যা, তোমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি কিসের সংগে তোমাকে সমান করে দেখব? তোমার আঘাত সাগরের মত বড়; কে তোমাকে সুস্থ করতে পারে? তোমার নবীদের দর্শন মিথ্যা ও বাজে; তোমার বন্দীদশা যাতে দূর হয়ে যায় সেজন্য তারা তোমার গুনাহ্‌ দেখিয়ে দেয় নি। ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে তারা যা তোমাদের বলেছে তা মিথ্যা; তা তোমাদের ভুল পথে চালিয়েছে। যারা তোমার পাশ দিয়ে যায় তারা তোমাকে দেখে হাততালি দেয়; তারা জেরুজালেম-কন্যাকে দেখে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে আর মাথা নেড়ে বলে, “এ কি সেই শহর যাকে বলা হত সেরা সুন্দরী, যাকে নিয়ে সারা দুনিয়া আনন্দ করত?” তোমার সব শত্রুরা তোমার বিরুদ্ধে মুখ বড় করে হা করেছে; তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “ওকে আমরা গিলে ফেলেছি। এই দিনের জন্যই আমরা অপেক্ষা করে ছিলাম আর তা দেখতে পেলাম।” মাবুদ তাঁর পরিকল্পনামতই কাজ করেছেন; যে কথা তিনি অনেক আগেই বলেছিলেন সেই কথা পূর্ণ করেছেন। তিনি মমতা না করেই তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন; শত্রুকে তোমার বিরুদ্ধে তিনি আনন্দ করতে দিয়েছেন, তোমার বিপক্ষদের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তোমার লোকদের অন্তর মাবুদের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছে, “হে সিয়োন্তকন্যার দেয়াল, তোমার চোখের পানি দিনরাত নদীর মত বয়ে যাক; তোমার নিজেকে শান্তি পেতে দিয়ো না, চোখকেও বিশ্রাম দিয়ো না। ওঠো, রাতের প্রত্যেক প্রহরের শুরুতে কেঁদে ওঠো; মাবুদের সামনে পানির মত ঢেলে দাও তোমার দিল। তোমার ছেলেমেয়েরা যারা খিদের জ্বালায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে, তাদের জীবন বাঁচাবার জন্য তাঁর উদ্দেশে তোমার হাত তোল।” হে মাবুদ, তাকাও, ভেবে দেখ, তুমি তো আর কারও প্রতি এই রকম ব্যবহার কর নি? স্ত্রীলোকেরা কি তাদের নিজেদের সন্তানদের খাবে যাদের তারা লালন-পালন করেছে? দীন-দুনিয়ার মালিকের পবিত্র জায়গায় কি ইমাম ও নবীদের হত্যা করা হবে? ছেলে ও বুড়োরা ধুলার মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে; আমার যুবক ও যুবতীরা তলোয়ারের ঘায়ে পড়ে গেছে। তোমার রাগের দিনে তুমি তাদের মেরে ফেলেছ; তুমি তাদের কেটে ফেলেছ, মমতা কর নি। ঈদের দিনে যেমন তুমি লোকদের জমায়েত কর তেমনি আমার চারপাশে তুমি নানা রকম ভীষণ ভয় জড়ো করেছ। মাবুদের রাগের দিনে কেউ রেহাই পায় নি কিংবা বেঁচে থাকে নি; যাদের আমি লালন-পালন ও যত্ন করতাম আমার শত্রু তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি সেই লোক, যে মাবুদের রাগের শাস্তি পেয়েছে। তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি আমাকে আলোতে নয়, কিন্তু অন্ধকারে হাঁটিয়েছেন; সত্যিই সারাদিন ধরে তিনি আমার বিরুদ্ধে বারে বারে তাঁর হাত তুলেছেন। আমার চামড়া ও গোশ্‌তকে তিনি শুকিয়ে ফেলেছেন আর হাড়গুলো ভেংগে দিয়েছেন। তিনি মনোদুঃখ ও কষ্ট দিয়ে আমাকে আটক করে ঘিরে রেখেছেন। যারা অনেক দিন আগে মারা গেছে তাদের মত করে তিনি আমাকে অন্ধকারে বাস করিয়েছেন। আমি যাতে পালাতে না পারি সেজন্য তিনি আমার চারদিক ঘিরে রেখেছেন; আমাকে ভারী শিকল দিয়ে বেঁধেছেন। যখন আমি ডাকি বা সাহায্যের জন্য কাঁদি, তখন আমার মুনাজাত তিনি শোনেন না। ভারী ভারী পাথর দিয়ে তিনি আমার পথ বন্ধ করেছেন; আমার পথ তিনি বাঁকা করে দিয়েছেন। আমার কাছে তিনি ওৎ পেতে থাকা ভল্লুক আর লুকিয়ে থাকা সিংহের মত; পথ থেকে তিনি আমাকে টেনে এনে টুকরা টুকরা করেছেন এবং আমাকে একা ফেলে রেখে গেছেন। তাঁর ধনুকে টান দিয়ে তিনি আমাকে তাঁর তীরের লক্ষ্যস্থান করেছেন। তাঁর তূণ থেকে তীর নিয়ে তিনি আমার দিল ছিদ্র করেছেন। আমার সমস্ত লোকের কাছে আমি হাসির পাত্র হয়েছি; তারা সারাদিন গান গেয়ে গেয়ে আমাকে ঠাট্টা করে। তেতো দিয়ে তিনি আমাকে পূর্ণ করেছেন, বিষ দিয়ে আমার পেট ভরিয়েছেন। তিনি পাথর দিয়ে আমার দাঁত ভেংগেছেন আর ধুলার মধ্যে আমাকে মাড়িয়েছেন। শান্তি আমার কাছ থেকে দূর করা হয়েছে; সুখ কি, তা আমি ভুলে গেছি। তাই আমি বলি, “আমার শক্তি চলে গেছে। মাবুদের কাছ থেকে আমি যা কিছু আশা করেছিলাম তা-ও আর নেই।” আমার কষ্ট ও ঘুরে বেড়াবার কথা মনে কর; মনে কর আমার তেতো ও বিষে পূর্ণ জীবনের কথা। তা সব সময়ই আমার মনে আছে, আর আমার প্রাণ আমার ভিতরে দুঃখিত হয়ে আছে। তবুও আমার আশা আছে, কারণ আমি এই কথা মনে করি: মাবুদের অটল মহব্বতের জন্য আমরা ধ্বংস হচ্ছি না, কারণ তাঁর মমতা কখনও শেষ হয় না; প্রতিদিন সকালে তা নতুন হয়ে দেখা দেয়; তাঁর বিশ্বস্ততা মহৎ। আমি মনে মনে বলি, “মাবুদই আমার সম্পত্তি, তাই আমি তাঁর উপর আশা রাখব।” মাবুদের উপর যারা আশা রাখে ও তাঁর উপর ভরসা করে তাদের তিনি উপকার করেন। মাবুদ উদ্ধার না করা পর্যন্ত নীরবে অপেক্ষা করা ভাল। যৌবন কালে জোয়াল বহন করা মানুষের জন্য ভাল। মাবুদই সেই জোয়াল তার উপর দিয়েছেন, তাই সে একা চুপ করে বসে থাকুক। সে ধুলাতে মুখ ঢাকুক, হয়তো আশা থাকতেও পারে। যে তাকে মারছে তার কাছে সে গাল পেতে দিক, নিজেকে অপমানে পূর্ণ হতে দিক। দীন-দুনিয়ার মালিক তো চিরদিনের জন্য মানুষকে দূর করে দেন না। যদি বা তিনি দুঃখ দেন, তবুও তাঁর অটল মহব্বত অনুসারে তিনি মমতা করবেন, কারণ তিনি ইচ্ছা করে মানুষকে কষ্ট কিংবা মনোদুঃখ দেন না। দেশের সব বন্দীদের পায়ে দলানো, আল্লাহ্‌তা’লার সামনে মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করা, ন্যায়বিচার হতে না দেওয়া- এ সব কি দীন-দুনিয়ার মালিক দেখবেন না? যদি মাবুদ হুকুম না দেন তবে কে মুখে বলে কিছু ঘটাতে পারে? আল্লাহ্‌তা’লার মুখ থেকেই কি ক্ষতি ও উন্নতি বের হয় না? গুনাহের জন্য শাস্তি পেলে পর মানুষ কেন তা নিয়ে নালিশ করবে? এস, আমরা আমাদের জীবন পথের পরীক্ষা করি ও যাচাই করি এবং মাবুদের কাছে ফিরে যাই। এস, আমরা আমাদের দিল ও হাত বেহেশতে আল্লাহ্‌র দিকে উঠাই আর বলি, “আমরা গুনাহ্‌ করেছি, বিদ্রোহ করেছি; তুমি মাফ কর নি। তুমি রাগ দিয়ে নিজেকে ঢেকে আমাদের তাড়া করেছ; মমতা না করে তুমি মেরে ফেলেছ। তুমি মেঘ দিয়ে নিজেকে ঢেকেছ যাতে কোন মুনাজাত তার মধ্য দিয়ে যেতে না পারে। জাতিদের মধ্যে তুমি আমাদের করেছ ময়লা ও আবর্জনার মত। আমাদের সব শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে মুখ বড় করে হা করেছে। আমরা ভয়, ফাঁদ, সর্বনাশ ও ধ্বংসের মুখে পড়েছি।” আমার লোকেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেজন্য আমার চোখ থেকে পানির স্রোত বইছে। আমার চোখ থেকে স্রোত বইতেই থাকবে, থামবে না, যে পর্যন্ত না মাবুদ বেহেশত থেকে নীচে তাকিয়ে দেখেন। আমার শহরের সব স্ত্রীলোকদের বিষয়ে আমি যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে আমার প্রাণ কাঁদছে। বিনা কারণে যারা আমার শত্রু হয়েছিল তারা পাখীর মত করে আমাকে শিকার করেছে। তারা গর্তের মধ্যে আমার প্রাণ শেষ করে দেবার চেষ্টা করেছে এবং আমার উপর পাথর ছুঁড়েছে। আমার মাথার উপর দিয়ে পানি বয়ে গেছে, আমি ভেবেছিলাম আমি মরে যাচ্ছি। হে মাবুদ, সেই গভীর গর্তের মধ্য থেকে আমি তোমাকে ডাকলাম। তুমি আমার এই মিনতি শুনেছিলে, “সাহায্যের জন্য আমার কান্নার প্রতি তুমি কান বন্ধ করে রেখো না।” আমি যখন তোমাকে ডেকেছি তখন তুমি কাছে এসে বলেছ, “ভয় কোরো না।” হে মালিক, তুমি আমার পক্ষ নিয়েছ, তুমি আমার প্রাণ মুক্ত করেছ। হে মাবুদ, আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তা তো তুমি দেখেছ। আমার প্রতি ন্যায়বিচার কর। তারা কিভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে তা তুমি দেখেছ, দেখেছ আমার বিরুদ্ধে তাদের সব ষড়যন্ত্র। হে মাবুদ, তাদের টিট্‌কারির কথা তুমি শুনেছ, শুনেছ আমার বিরুদ্ধে তাদের সব ষড়যন্ত্রের কথা। আমার শত্রুরা সারাদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে কত ফিস্‌ ফিস্‌ করে ও নানা কথা বলে। দেখ, তাদের সমস্ত কাজের মধ্যে তারা গান গেয়ে গেয়ে আমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। হে মাবুদ, তাদের কাজ অনুসারে তুমি তাদের ফল দাও। তাদের দিল কঠিন কর, আর তোমার বদদোয়া তাদের উপরে পড়ুক। তুমি রাগে তাদের তাড়া কর, তোমার আসমানের নীচ থেকে তাদের ধ্বংস করে ফেল। হায়! সোনা কেমন করে তার উজ্জ্বলতা হারিয়েছে, খাঁটি সোনা ্নান হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দামী দামী পাথরগুলো। সিয়োনের ছেলেরা একদিন সোনার মত মূল্যবান ছিল; তাদের এখন মনে করা হয় কুমারের তৈরী মাটির পাত্রের মত। শিয়ালেরা পর্যন্ত নিজের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ায়, কিন্তু আমার লোকেরা মরুভূমির উট পাখীদের মত নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। পিপাসায় শিশুদের জিভ্‌ তালুতে লেগে যাচ্ছে; ছেলেমেয়েরা রুটি চাইছে, কিন্তু কেউ তা দিচ্ছে না। যারা একদিন ভাল ভাল খাবার খেত তারা এখন অভাবের মধ্যে পথে পথে রয়েছে। যারা দামী বেগুনে কাপড় পরে মানুষ হয়েছে তারা এখন ছাইয়ের গাদায় শুয়ে আছে। যে সাদুমকে মুহূর্তের মধ্যে উল্টে ফেলা হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে কোন মানুষের হাত ওঠে নি, সেই সাদুমের গুনাহের চেয়েও আমার লোকদের অন্যায় বেশী। তাদের বাছাই করা নেতারা ছিল তুষারের চেয়েও উজ্জ্বল, ছিল দুধের চেয়েও সাদা; তাদের শরীর প্রবাল পাথরের চেয়ে লাল ছিল আর চেহারা ছিল নীলকান্তমণির মত। কিন্তু তারা এখন কালির চেয়েও কালো হয়েছে; রাস্তায় তাদের চেনা যায় না। তাদের চামড়া হাড়ের উপর কুঁচকে গেছে; তা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষে মরার চেয়ে বরং যুদ্ধে মরা ভাল; আমার লোকেরা ক্ষেতের শস্যের অভাবে খিদের যন্ত্রণায় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। স্নেহময়ী স্ত্রীলোকেরা নিজের হাতে তাদের সন্তানদের রান্না করেছে। আমার লোকদের ধ্বংসের সময় তাদের সন্তানেরাই তাদের খাবার হয়েছিল। মাবুদ তাঁর রাগকে পুরোপুরিই বের করেছেন; তাঁর জ্বলন্ত গজব তিনি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি সিয়োনে আগুন জ্বেলেছেন; তা তার ভিত্তিগুলো পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাদশাহ্‌রা কিংবা দুনিয়ার কোন লোকই বিশ্বাস করত না যে, জেরুজালেমের দরজা দিয়ে কোন শত্রু বা বিপক্ষ ঢুকতে পারে। এই ঘটনা ঘটেছিল তার নবীদের গুনাহের জন্য, তার ইমামদের অন্যায়ের জন্য, কারণ সেখানেই তারা সৎ লোকদের রক্তপাত করত। তাই তারা অন্ধদের মত রাস্তায় রাস্তায় হাঁত্‌ড়ে বেড়িয়েছে; তারা এমনভাবে রক্তে নাপাক হয়েছে যে, কেউ তাদের কাপড় ছুঁতে চাইত না। লোকে চিৎকার করে তাদের বলেছে, “সরে যাও, তোমরা নাপাক। সরে যাও, সরে যাও, আমাদের ছুঁয়ো না।” তারা পালিয়ে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে; অন্যান্য জাতির লোকেরা বলেছে, “তারা এখানে আর থাকতে পারবে না।” মাবুদ নিজেই তাদের ছড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি তাদের প্রতি আর মনোযোগ দেন না। লোকে ইমামদের সম্মান দেখায় না, দয়া করে না বৃদ্ধ নেতাদের। তবুও সাহায্যের জন্য মিথ্যাই তাকিয়ে থেকে থেকে আমাদের চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে; আমরা অনবরত এমন এক জাতির দিকে তাকিয়ে ছিলাম যে জাতি আমাদের রক্ষা করতে পারত না। লোকে আমাদের জন্য ওৎ পেতে থাকত, তাই আমরা আমাদের খোলা জায়গাগুলোতে হাঁটতে পারতাম না। আমাদের শেষ কাল কাছে এসেছিল, আমাদের দিনগুলো ফুরিয়ে গিয়েছিল, কারণ আমাদের শেষ সময় উপস্থিত হয়েছিল। আমাদের যারা তাড়া করত তারা আকাশের ঈগল পাখীর চেয়েও বেগে যেত; তারা পাহাড়ে পাহাড়ে আমাদের তাড়া করত আর মরুভূমিতে ওৎ পেতে থাকত আমাদের জন্য। যিনি মাবুদের অভিষিক্ত, যিনি আমাদের জীবন্তবায়ু, তিনি তাদের ফাঁদে ধরা পড়েছিলেন; কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম তাঁর ছায়াতে জাতিদের মধ্যে আমরা বাস করব। আওস দেশে বাসকারিণী হে ইদোম-কন্যা, তুমি আনন্দ কর, খুশী হও; কিন্তু তোমাকেও সেই পেয়ালা দেওয়া হবে; তুমি মাতাল ও উলংগ হবে। হে সিয়োন্তকন্যা, তোমার শাস্তি শেষ হবে; তিনি তোমাকে আর বন্দীদশায় ফেলে রাখবেন না; কিন্তু হে ইদোম-কন্যা, তিনি তোমার অন্যায়ের শাস্তি দেবেন এবং তোমার গুনাহ্‌ প্রকাশ করবেন। হে মাবুদ, আমাদের উপর যা ঘটেছে তা মনে করে দেখ; তুমি তাকাও, আমাদের অপমান দেখ। আমাদের ভাগের সম্পত্তি বিদেশীদের হাতে দেওয়া হয়েছে, আর বাড়ী-ঘর দেওয়া হয়েছে ভিন্ন জাতির লোকদের। আমরা এতিম হয়েছি, আমাদের পিতা নেই, আমাদের মায়েরা বিধবা হয়েছে। আমাদের খাবার পানি কিনে খেতে হয়; কেবল দাম দিয়েই আমরা কাঠ পেতে পারি। যারা আমাদের তাড়া করছে তারা আমাদের কাছে এসে পড়েছে; আমরা ক্লান্ত হয়েছি, বিশ্রাম পাচ্ছি না। যথেষ্ট খাবার পাবার জন্য আমরা মিসর ও আশেরিয়ার অধীন হয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গুনাহ্‌ করেছিলেন; তাঁরা এখন আর নেই, কিন্তু আমরা তাঁদের শাস্তি বহন করছি। গোলামেরা আমাদের শাসন করছে; তাদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করবার কেউ নেই। মরুভূমিতে ডাকাতদের ভয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমরা খাবার জোগাড় করি। আমাদের চামড়া তুন্দুরের মত গরম; খিদের জ্বালায় জ্বর জ্বর বোধ করি। সিয়োনে স্ত্রীলোকদের নষ্ট করা হয়েছে; এহুদার গ্রাম ও শহরে নষ্ট করা হয়েছে অবিবাহিতা মেয়েদের। উঁচু পদের কর্মচারীদের হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; বৃদ্ধ নেতাদের সম্মান দেখানো হয় নি। যুবকদের জাঁতা ঘুরিয়ে পরিশ্রম করতে হচ্ছে; ছোট ছেলেরা কাঠের বোঝার ভারে টলমল করছে। শহর-দরজার কাছে বৃদ্ধ নেতারা আর বসেন না; যুবকেরা বাজনা বাজানো থামিয়েছে। আমাদের দিল থেকে আনন্দ চলে গেছে আমরা নাচের বদলে শোক করছি। আমাদের মাথা থেকে তাজ পড়ে গেছে। ঘৃণ্য আমরা, কারণ আমরা গুনাহ্‌ করেছি! এইজন্য আমাদের দিল দুর্বল হয়ে গেছে, এই সব কারণে আমাদের চোখের তেজ কমে গেছে। সিয়োন পাহাড় জনশূন্য হয়ে পড়ে আছে; শিয়ালেরা তার উপর ঘুরে বেড়ায়। হে মাবুদ, তুমি চিরকাল রাজত্ব কর; তোমার সিংহাসন বংশের পর বংশ ধরে স্থায়ী। তুমি কি চিরকালের জন্য আমাদের ভুলে যাবে? এতদিন ধরে কেন তুমি আমাদের ত্যাগ করে আছ? ত্রিশ বছরের চতুর্থ মাসের পঞ্চম দিনে আমি যখন কবার নদীর ধারে বন্দীদের মধ্যে ছিলাম তখন আসমান খুলে গেল আর আমি আল্লাহ্‌র দর্শন পেলাম। সেই সময়টা ছিল বাদশাহ্‌ যিহোয়াখীনের বন্দী হবার পঞ্চম বছর। ব্যাবিলনীয়দের দেশে কবার নদীর ধারে বুষির ছেলে ইমাম ইহিস্কেলের উপর, অর্থাৎ আমার উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। সেখানে মাবুদের হাত আমার উপরে ছিল। আমি তাকিয়ে দেখতে পেলাম উত্তর দিক থেকে একটা ঝোড়ো বাতাস আসছে, একটা বিরাট মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এবং তার চারপাশটা উজ্জ্বল আলোয় ঘেরা। সেই বিদ্যুতের মাঝখানে উজ্জ্বল ধাতুর মত কিছু ঝক্‌মক করছিল। সেখানে চারটি প্রাণীর মত কিছু দেখা গেল। তাঁদের চেহারা দেখতে ছিল মানুষের মত, কিন্তু প্রত্যেকের চারটি করে মুখ ও চারটি করে ডানা ছিল। তাঁদের পা সোজা ও পায়ের পাতা বাছুরের খুরের মত; সেগুলো পালিশ করা ব্রোঞ্জের মত চক্‌চকে। তাঁদের চারপাশে ডানার নীচে মানুষের মত হাত ছিল। তাঁদের প্রত্যেকের মুখ এবং ডানা ছিল, আর তাঁদের ডানাগুলো একটার সংগে অন্যটা ছুঁয়ে ছিল। তাঁরা প্রত্যেকে সোজা এগিয়ে যেতেন, যাবার সময় ফিরতেন না। তাঁদের মুখগুলো দেখতে ছিল এই রকম-তাঁদের চারজনের প্রত্যেকের একটা করে মানুষের মুখ ছিল এবং প্রত্যেকের ডান দিকের মুখ সিংহের, বাঁদিকের ষাঁড়ের এবং প্রত্যেকের একটা করে ঈগলের মুখও ছিল। তাদের মুখগুলো এই রকম ছিল। তাঁদের ডানাগুলো উপর দিকে মেলে দেওয়া ছিল; প্রত্যেকের দু’টি ডানা তাঁর দু’পাশের প্রাণীর ডানা ছুঁয়ে ছিল, আর দু’টি ডানা দিয়ে শরীর ঢাকা ছিল। তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের মুখ অনুসারে চারদিকে এগিয়ে যেতে পারতেন। সেই প্রাণীদের রূহ্‌ যেদিকে যেতেন তাঁরা সেই দিকেই যেতেন, যাবার সময় ফিরতেন না। এই প্রাণীদের মধ্যে জ্বলন্ত কয়লা কিংবা মশালের মত আগুন জ্বলছিল এবং তা সেই প্রাণীদের মধ্যে আসা-যাওয়া করছিল; সেই আগুন উজ্জ্বল এবং তার মধ্য থেকে বিদ্যুৎ বেরিয়ে আসছিল। প্রাণীগুলো বিদ্যুৎ চমকাবার মত করে আসা-যাওয়া করছিলেন। সেই প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলাম চারটি প্রাণীর প্রত্যেকটির পাশে মাটিতে একটা করে চাকা আছে। সেই চাকাগুলোর আকার ও গঠন এই রকম ছিল- সেগুলো বৈদূর্যমণির মত ঝক্‌মক করছিল এবং সেই চারটা চাকা দেখতে একই রকম ছিল। একটা চাকার ভিতরে যেন আর একটা চাকা এইভাবে প্রত্যেকটা চাকা তৈরী ছিল। চাকাগুলো যখন চলত তখন সেই প্রাণীগুলোর চারদিকের যে কোন দিকে সোজা চলত; চলবার সময় চাকাগুলো ফিরত না। সেই চাকাগুলো ছিল খুব বড় ও ভয় জাগানো এবং চারটা চাকার বেড়ের সবদিকই চোখে ভরা ছিল। প্রাণীগুলো চলবার সময় তাঁদের পাশের চাকাগুলোও চলত; প্রাণীগুলো মাটি থেকে উঠলে পর চাকাগুলোও উঠত। প্রাণীগুলোর রূহ্‌ যখন যেদিকে যেতেন চাকাগুলোও তাঁর সংগে সংগে যেত, কারণ সেই প্রাণীদের রূহ্‌ সেই চাকার মধ্যে ছিল। প্রাণীরা চললে চাকাগুলোও চলত; প্রাণীগুলো স্থির হয়ে দাঁড়ালে চাকাগুলোও স্থির হয়ে দাঁড়াত; আবার প্রাণীগুলো মাটি থেকে উঠলে চাকাগুলোও তাঁদের সংগে সংগে উঠত, কারণ সেই প্রাণীদের রূহ্‌ চাকাগুলোর মধ্যে ছিল। সেই প্রাণীদের মাথার উপরে কিছু একটা বিছানো ছিল; সেটা বরফের মত চক্‌মক করছিল এবং ভয়ংকর ছিল। সেটার নীচে তাঁদের ডানাগুলো মেলে দেওয়া ছিল এবং একজনের ডানা অন্যজনের ডানাকে ছুঁয়ে ছিল। অন্য দু’টি ডানা দিয়ে প্রত্যেকের শরীর ঢাকা ছিল। প্রাণীগুলো চললে পর আমি তাঁদের ডানার শব্দ শুনতে পেলাম; তা ছিল বন্যার পানির স্রোতের শব্দের মত, সর্বশক্তিমানের গলার আওয়াজের মত, একটা সৈন্যদলের গোলমালের মত। প্রাণীগুলো স্থির হয়ে দাঁড়ালে পর তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো গুটিয়ে নিতেন। যখন তাঁরা ডানা গুটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন তাঁদের মাথার উপরকার সেই জায়গার উপর থেকে একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল। সেখানে নীলকান্তমণির সিংহাসনের মত কিছু একটা দেখা গেল। সেই উঁচুতে থাকা সিংহাসনের উপরে মানুষের আকারের মত একজনকে দেখা গেল। আমি দেখলাম কোমর থেকে উপর পর্যন্ত তিনি দেখতে ছিলেন উজ্জ্বল ধাতুর মত, যেন সেটি আগুনে পূর্ণ, আর কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত তাঁকে আগুনের মত দেখতে লাগছিল; তাঁর চারপাশে ছিল উজ্জ্বল আলো। বৃষ্টির দিনে মেঘের মধ্যে মেঘধনুকের মতই তাঁর চারপাশের সেই আলো দেখা যাচ্ছিল। যা দেখা গেল তা ছিল মাবুদের মহিমার মত। আমি তা দেখে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লাম আর একজনকে কথা বলতে শুনলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াও; আমি তোমার সংগে কথা বলব।” তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমার মধ্যে এসে আমাকে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করালেন আর আমি শুনলাম তিনি আমার সংগে কথা বলছেন। তিনি বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আমি তোমাকে বনি-ইসরাইলদের কাছে, অর্থাৎ যারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে সেই বিদ্রোহী জাতির কাছে পাঠাচ্ছি; তারা এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা আজ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে। যে লোকদের কাছে আমি তোমাকে পাঠাচ্ছি তারা একগুঁয়ে ও জেদী। তুমি তাদের কাছে আল্লাহ্‌ মালিকের কালাম বলবে। তারা সেই কথা না-ও শুনতে পারে, কারণ তারা বিদ্রোহী জাতি; তবুও তারা জানতে পারবে যে, একজন নবী তাদের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু হে মানুষের সন্তান, তুমি তাদের ও তাদের কথায় ভয় কোরো না। যদিও তারা শিয়ালকাঁটা ও কাঁটাগাছের মত তোমার চারপাশে থাকবে ও বিছার মধ্যে তুমি বাস করবে তবুও ভয় কোরো না। তাদের দেখে বা তাদের কথা শুনে তুমি ভয় পেয়ো না; তারা তো বিদ্রোহী জাতি। তারা বিদ্রোহী বলে আমার কথা না-ও শুনতে পারে, কিন্তু তারা শুনুক বা না শুনুক তুমি তাদের কাছে আমার কথাগুলো বলবে। হে মানুষের সন্তান, আমি তোমাকে যা বলি তা শোন। ঐ বিদ্রোহী জাতির মত তুমি বিদ্রোহী হোয়ো না। তুমি হা কর, আমি তোমাকে যা দিচ্ছি তা খাও।” তখন আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে একটা হাত বাড়ানো রয়েছে। তাতে রয়েছে একটা গুটিয়ে রাখা কিতাব। আমার সামনে তিনি তা খুলে ধরলেন। তার দু’দিকেই লেখা রয়েছে বিলাপ, শোক ও দুঃখের কথা। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তোমার সামনে যা আছে তা তুমি খাও; এই গুটিয়ে রাখা কিতাবটা খেয়ে ফেল, তারপর বনি-ইসরাইলদের কাছে গিয়ে কথা বল।” তখন আমি মুখ খুললাম, আর তিনি আমাকে সেই কিতাবটা খাইয়ে দিলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আমার দেওয়া এই কিতাবটা খেয়ে তোমার পেট ভর।” কাজেই আমি তা খেয়ে ফেললাম, আর তা আমার মুখে মধুর মত মিষ্টি লাগল। তিনি তারপর আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এখন বনি-ইসরাইলদের কাছে গিয়ে আমার কথাগুলো বল। তোমাকে তো এমন লোকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে না যাদের ভাষা তোমার অজানা এবং কঠিন, কিন্তু পাঠানো হচ্ছে বনি-ইসরাইলদের কাছে। যাদের কথা তুমি বোঝ না সেই রকম অজানা ও কঠিন ভাষা বলা অনেক জাতির কাছে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে না। যদি তাদের কাছে আমি তোমাকে পাঠাতাম তাহলে নিশ্চয়ই তারা তোমার কথা শুনত। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা তোমার কথা শুনতে চাইবে না, কারণ তারা আমার কথা শুনতে চায় না; এর কারণ হল, গোটা ইসরাইল জাতি কঠিন্তমনা ও একগুঁয়ে। কিন্তু আমি তোমাকে তাদেরই মত একরোখা ও কঠিন্তমনা করে দেব। আমি তোমার কপাল হীরার মত শক্ত, চক্‌মকি পাথরের চেয়েও শক্ত করে দিলাম। যদিও তারা একটা বিদ্রোহী জাতি তবুও তুমি তাদের ভয় কোরো না বা তাদের দেখে ভয় পেয়ো না।” তিনি আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আমি তোমাকে যে সব কথা বলব তা তুমি মন দিয়ে শোনো ও অন্তরে জমা রাখ। তুমি এখন বন্দীদশায় থাকা তোমার দেশের লোকদের কাছে গিয়ে কথা বল। তারা শুনুক বা না শুনুক, তুমি তাদের কাছে আল্লাহ্‌ মালিকের কালাম বলবে।” তারপর আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমাকে তুলে নিলেন, আর আমি আমার পিছনে জোরে বলা এই কথা শুনলাম, “মাবুদের বাসস্থানে তাঁর মহিমার প্রশংসা হোক।” আমি সেই প্রাণীদের একে অন্যের সংগে ডানা ঘষার শব্দ ও তাঁদের পাশের চাকার শব্দ খুব জোরে শুনতে পেলাম। আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমাকে তুলে নিয়ে যাবার সময় আমি মনে বিরক্তি ও রাগ নিয়ে গেলাম, আর মাবুদের কঠিন হাত আমার উপরে ছিল। যে বন্দীরা কবার নদীর কাছে তেল-আবীবে ছিল আমি তাদের কাছে গেলাম। তারা যেখানে বাস করছিল আমি সেখানে তাদের মধ্যে সাত দিন হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। সাত দিন কেটে গেলে পর মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, বনি-ইসরাইলদের জন্য আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়েছি; কাজেই আমি যা বলি তা তুমি শোন এবং আমার হয়ে তাদের সতর্ক কর। আমি যখন একজন দুষ্ট লোককে বলি, ‘তুমি নিশ্চয়ই মরবে,’ তখন তুমি যদি তাকে সাবধান না কর, কিংবা তার প্রাণ বাঁচাতে খারাপ পথ থেকে ফিরাবার জন্য কিছু না বল, তবে সেই দুষ্ট লোক তার গুনাহের জন্য মরবে, কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমি তোমাকে দায়ী করব। কিন্তু সেই দুষ্ট লোককে তুমি সাবধান করবার পরেও যদি সে তার দুষ্টতা থেকে কিংবা তার খারাপ পথ থেকে না ফেরে, তবে তার গুনাহের জন্য সে মরবে; কিন্তু তুমি নিজে রক্ষা পাবে। “আবার, যদি কোন সৎ লোক তার ঠিক পথ থেকে ফিরে খারাপ কাজ করে আর আমি তার সামনে একটা বিপদ রাখি, তবে সে মরবে। তুমি তাকে সাবধান কর নি বলে সে তার গুনাহের জন্য মরবে। যে সব সৎ কাজ সে করেছে তা আর মনে করা হবে না; আমি তোমাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করব। কিন্তু গুনাহ্‌ না করবার জন্য যদি তুমি সেই সৎ লোককে সাবধান কর আর সে গুনাহ্‌ না করে তবে সাবধান হবার কথা শুনবার ফলে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে এবং তুমিও নিজেকে রক্ষা করবে।” সেখানে মাবুদের শক্তিশালী হাত আমার উপরে ছিল এবং তিনি আমাকে বললেন, “তুমি উঠে সমভূমিতে যাও, সেখানে আমি তোমার সংগে কথা বলব।” কাজেই আমি উঠে সমভূমিতে গেলাম। কবার নদীর ধারে মাবুদের যে মহিমা দেখেছিলাম সেই রকম মহিমাই সেখানে দেখলাম; আর আমি উবুড় হয়ে পড়লাম। তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমার মধ্যে এসে আমাকে তুলে পায়ের উপর দাঁড় করালেন। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি তোমার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ভিতরে থাক। হে মানুষের সন্তান, তোমাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে; তাতে তুমি বাইরে লোকজনের মধ্যে যেতে পারবে না। তুমি যাতে চুপ করে থাক ও তাদের বকাবকি করতে না পার সেইজন্য আমি তোমার জিভ্‌ তোমার মুখের তালুতে আট্‌কে দেব। বনি-ইসরাইলরা তো একটা বিদ্রোহী জাতি। কিন্তু আমি তোমার সংগে কথা বলবার সময় তোমার মুখ খুলে দেব এবং তুমি তাদের কাছে আল্লাহ্‌ মালিকের কালাম বলবে। তাদের মধ্যে যে শুনতে চায় সে শুনুক ও যে শুনতে না চায় সে না শুনুক; তারা তো একটা বিদ্রোহী জাতি।” তিনি আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এখন একটা মাটির ফলক নিয়ে তোমার সামনে রাখ এবং তার উপর জেরুজালেম শহরের ছবি আঁক। তার চারপাশে এইভাবে ঘেরাও দেখাও: তার বিরুদ্ধে একটা উঁচু ঢিবি তৈরী কর, শহরের দেয়ালের সংগে একটা ঢালু ঢিবি বানাও, শহরের বিরুদ্ধে সৈন্যদের ছাউনি খাটাও এবং দেয়ালের চারপাশে দেয়াল ভাংগার যন্ত্র বসাও। তারপর লোহার একটা পাত নিয়ে সেটা তোমার ও শহরের মাঝখানে দেয়ালের মত করে রাখ এবং তোমার মুখ সেই দিকে ফিরিয়ে রাখ। তাতে শহরটা ঘেরাও করা হয়েছে বুঝা যাবে; এইভাবে তুমি দেখাবে যে, শহরটা ঘেরাও করা হয়েছে। এটা হবে ইসরাইল জাতির জন্য একটা চিহ্ন। “তারপর তুমি বাঁ পাশ ফিরে শোবে এবং ইসরাইলের গুনাহের শাস্তি তোমার নিজের উপরে নেবে। যে কয়দিন তুমি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে সেই কয় দিন তাদের শাস্তি তুমি বহন করবে। তাদের শাস্তি পাবার বছরের সংখ্যা হিসাব করে ততদিন আমি তোমাকে তা বহন করতে দিলাম। কাজেই তিনশো নব্বই দিন ইসরাইলের শাস্তি তুমি বহন করবে। “এটা শেষ হলে পর তুমি আবার শোবে; এবার ডান পাশ ফিরে শোবে এবং এহুদার গুনাহের শাস্তি বহন করবে। শুয়ে থাকবার জন্য আমি তোমাকে চল্লিশ দিন দিলাম, এক এক বছরের জন্য এক এক দিন। তুমি জেরুজালেমের ঘেরাওয়ের দিকে মুখ ফিরাবে এবং হাতের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে সেই শহরের বিরুদ্ধে নবী হিসাবে কথা বলবে। তোমার ঘেরাওয়ের দিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাতে তুমি এপাশ-ওপাশ ফিরতে না পার সেইজন্য আমি তোমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখব। “তুমি গম, যব, শিম, মসুর ডাল, বাজ্‌রা ও জনার নিয়ে একটা পাত্রে রাখবে এবং সেগুলো দিয়ে তোমার জন্য রুটি তৈরী করবে। যে তিনশো নব্বই দিন তুমি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে তখন তা খাবে। প্রতিদিন ওজন করে দু’শো চল্লিশ গ্রাম খাবার সেই দিনের মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে খাবে। এছাড়া আধা লিটারের একটু বেশী পানিও বিভিন্ন সময়ে খাবে। যবের পিঠার মত করে সেই খাবার তুমি খাবে; লোকদের চোখের সামনে মানুষের পায়খানা পুড়িয়ে তা সেঁকে নেবে। যে সব জাতির মধ্যে আমি বনি-ইসরাইলদের তাড়িয়ে দেব তাদের মধ্যে থাকবার সময় তারা এইভাবে নাপাক খাবার খাবে।” এই কথা মাবুদ বললেন। তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, এই রকম না হোক। আমি কখনও নাপাক হই নি। ছেলেবেলা থেকে এই পর্যন্ত আমি মরা বা বুনো পশুর মেরে ফেলা কোন কিছু খাই নি। কোন নাপাক গোশ্‌ত আমার মুখে কখনও ঢোকে নি।” তিনি বললেন, “আচ্ছা, মানুষের পায়খানার বদলে আমি তোমাকে গোবরের ঘুঁটে পুড়িয়ে তোমার রুটি সেঁকবার অনুমতি দিলাম।” তারপর তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আমি জেরুজালেমে খাবারের যোগান বন্ধ করে দেব। লোকেরা দুশ্চিন্তা নিয়ে মেপে খাবার খাবে ও হতাশা নিয়ে মেপে পানি খাবে, কারণ খাবার ও পানির অভাব হবে। তারা একে অন্যকে দেখে হতভম্ব হবে এবং তাদের গুনাহের জন্য তারা ক্ষয় হয়ে যেতে থাকবে। “হে মানুষের সন্তান, এখন তোমার মাথার চুল ও দাড়ি কামাবার জন্য তুমি একটা ধারালো ছোরা নিয়ে তা নাপিতের ক্ষুরের মত ব্যবহার করবে। তারপর দাঁড়িপাল্লা নিয়ে চুলগুলো তিন ভাগ করবে। যখন শহরের ঘেরাওয়ের দিন শেষ হয়ে যাবে তখন সেই চুলের তিন ভাগের এক ভাগ চুল নিয়ে শহরের মধ্যে পুড়িয়ে দেবে। তিন ভাগের এক ভাগ চুল নিয়ে ছোরা দিয়ে শহরের চারপাশে তা কুচি কুচি করে কাটবে, আর তিন ভাগের এক ভাগ চুল নিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেবে। পরে খোলা তলোয়ার নিয়ে আমি লোকদের তাড়া করব। তবে কিছু চুল রেখে দিয়ে তা তোমার পোশাকের ভাঁজে গুঁজে রাখবে। তারপর আরও কিছু চুল নিয়ে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে দেবে। সেখান থেকে আগুন গোটা ইসরাইল জাতির মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। “আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, এই হল জেরুজালেম। তাকে আমি জাতিদের মাঝখানে স্থাপন করেছি; তার চারপাশে রয়েছে নানা দেশ। কিন্তু সে তার খারাপীর জন্য আমার শরীয়ত ও নিয়মের বিরুদ্ধে তার চারপাশের নানা জাতি ও দেশের চেয়েও বেশী বিদ্রোহ করেছে। সে আমার শরীয়ত অগ্রাহ্য করেছে এবং আমার নিয়ম মেনে চলে নি। “কাজেই আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, হে জেরুজালেম, তোমার চারপাশের দেশগুলোর চেয়ে তুমি আরও বেশী খারাপ হয়েছ। তুমি আমার নিয়ম মেনে চল নি এবং আমার শরীয়তও পালন কর নি। এমন কি, তোমার চারপাশের জাতিদের নিয়ম অনুসারেও চল নি। সেইজন্য আমি নিজেই তোমার বিরুদ্ধে, আর জাতিদের চোখের সামনেই আমি তোমাকে শাস্তি দেব। তোমার সব জঘন্য মূর্তিগুলোর জন্য আমি তোমার প্রতি যা করব তা আমি আগে কখনও করি নি এবং কখনও করব না। তার ফলে তোমার মধ্যে বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের গোশ্‌ত খাবে আর ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাদের গোশ্‌ত খাবে। আমি তোমাকে শাস্তি দেব এবং তোমার বেঁচে থাকা লোকদের চারদিকে ছড়িয়ে দেব। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি, তোমার সব বাজে মূর্তি ও জঘন্য কাজকর্মের দ্বারা তুমি আমার ঘর নাপাক করেছ বলে আমি নিজেই আমার দয়া সরিয়ে নেব; আমি তোমার উপর মমতা করে তাকাব না কিংবা তোমাকে রেহাই দেব না। তোমার তিন ভাগের এক ভাগ লোক তোমার মধ্যে হয় মহামারীতে না হয় দুর্ভিক্ষে মারা যাবে; তিন ভাগের এক ভাগ দেয়ালের বাইরে যুদ্ধে মারা পড়বে এবং তিন ভাগের এক ভাগকে আমি চারদিকে ছড়িয়ে দেব আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তাড়া করব। “এই সব করবার পরে আমার রাগ শেষ হবে; তাদের উপর আমার গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেবার পর আমি শান্ত হব। তখন তারা জানতে পারবে যে, আমার দিলের জ্বালায় আমি মাবুদ এই কথা বলেছি। “হে জেরুজালেম, তোমার চারপাশের জাতিদের মধ্যে যারা তোমার পাশ দিয়ে যায় আমি তাদের চোখের সামনে তোমাকে একটা ধ্বংসস্থান ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র করব। আমি যখন রাগ, গজব ও ভীষণ বকুনি দ্বারা তোমাকে শাস্তি দেব তখন তোমার চারপাশের জাতিরা তোমাকে দেখে হতভম্ব হবে; তুমি তাদের কাছে হবে নিন্দা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র এবং একটা সাবধানবাণীর মত। তোমাকে ধ্বংস করবার জন্যই আমি তোমার প্রতি আমার দুর্ভিক্ষের ভয়ংকর তীর ছুঁড়ব। আমি তোমার উপর সেই দুর্ভিক্ষ আরও বাড়িয়ে তুলব এবং তোমার খাবারের যোগান বন্ধ করে দেব। তোমার বিরুদ্ধে আমি দুর্ভিক্ষ ও হিংস্র জন্তু পাঠিয়ে দেব; তারা তোমাকে সন্তানহারা করবে। মহামারী ও রক্তপাত তোমার মধ্য দিয়ে যাবে এবং আমি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে আসব। আমি মাবুদই এই কথা বললাম।” তোমাদের বেদী সব ধ্বংস করা হবে এবং তোমাদের ধূপবেদীগুলো ভেংগে ফেলা হবে। তোমাদের মূর্তিগুলোর সামনে তোমাদের লোকদের আমি মেরে ফেলব। আমি বনি-ইসরাইলদের লাশগুলো তাদের মূর্তিগুলোর সামনে রাখব এবং তোমাদের বেদীর চারপাশে তোমাদের হাড়গুলো ছড়িয়ে দেব। তোমরা যেখানেই বাস কর না কেন সেখানকার শহরগুলো খালি পড়ে থাকবে এবং পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস হবে; তার ফলে তোমাদের বেদীগুলো পড়ে থাকবে ও নষ্ট হয়ে যাবে, তোমাদের মূর্তিগুলো চুরমার ও ধ্বংস হবে, তোমাদের ধূপবেদীগুলো ভেংগে পড়ে যাবে এবং তোমাদের তৈরী সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তোমাদের মধ্যেই তোমাদের লোকেরা মরে পড়ে থাকবে। এই সব হলে পর তোমরা জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘তবে আমি কিছু লোককে বাঁচিয়ে রাখব; তোমরা যখন নানা দেশ ও জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে তখন সেই লোকেরা মৃত্যুর হাত এড়াতে পারবে। সেই সব জাতির মধ্যে থেকে তারা আমার বিষয় এই কথা মনে করবে যে, তাদের অবিশ্বস্ত দিল ও চোখ দিয়ে তারা আমাকে কিভাবে দুঃখ দিয়েছে; সেই দিল আমার কাছ থেকে সরে গেছে এবং সেই চোখ তাদের মূর্তিগুলোকে আকুলভাবে কামনা করেছে। তাদের সব খারাপ ও জঘন্য কাজের জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের ঘৃণা করবে। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ; তাদের উপর এই বিপদ আনবার কথা আমি অনর্থক বলি নি।’ ” তারপর আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে বললেন, “তুমি হাতে হাত দিয়ে ও মাটিতে পা দিয়ে জোরে আঘাত কর এবং ইসরাইল জাতির সমস্ত খারাপ ও জঘন্য কাজের জন্য জোরে জোরে হাহাকার কর, কারণ তারা যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে ও মহামারীতে মারা পড়বে। যে দূরে আছে সে মহামারীতে মরবে এবং যে কাছে আছে সে যুদ্ধে মারা পড়বে, আর যে বেঁচে যাবে সে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে দুর্ভিক্ষে মরবে। এইভাবে আমার গজব আমি তাদের উপর সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেব। বনি-ইসরাইলরা তাদের বেদীর চারপাশের মূর্তিগুলোর মধ্যে, সমস্ত বড় বড় পাহাড়ের উপরে, ডালপালা ছড়ানো প্রত্যেকটা গাছের নীচে এবং পাতা-ভরা প্রত্যেকটা এলোন গাছের তলায়, অর্থাৎ যে সব জায়গায় তাদের মূর্তিগুলোর উদ্দেশে তারা খোশবু ধূপ উৎসর্গ করত সেই সব জায়গায় মরে পড়ে থাকবে। তখন বেঁচে থাকা লোকেরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। বনি-ইসরাইলরা যেখানেই বাস করুক না কেন আমি তাদের বিরুদ্ধে আমার হাত বাড়াব এবং মরুভূমি থেকে দিব্‌লা পর্যন্ত সারা দেশটা জনশূন্য ও ধ্বংসস্থান করব। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” পরে মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইল দেশের কাছে আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি, ‘দেখ, শেষ সময়! দেশের চারদিকে শেষ সময় উপস্থিত হয়েছে! এখন সেই সময় তোমার উপর এসে পড়েছে এবং তোমার বিরুদ্ধে আমি আমার গজব ঢেলে দেব। তোমার চালচলন অনুসারে আমি তোমার বিচার করব এবং তোমার সমস্ত জঘন্য কাজের জন্য তোমাকে শাস্তি দেব। আমি তোমার দিকে মমতার চোখে দেখব না বা তোমাকে রেহাইও দেব না; তোমার চালচলন ও তোমার মধ্যেকার জঘন্য কাজের জন্য আমি নিশ্চয়ই তোমাকে শাস্তি দেব। তখন তুমি জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আল্লাহ্‌ মালিক বললেন, “বিপদ! একটা ভীষণ বিপদ আসছে! শেষ সময় এসে পড়েছে! তোমাদের বিরুদ্ধে তা জেগে উঠেছে, তা এসে পড়েছে! তোমরা যারা দেশে বাস করছ তোমাদের উপর সর্বনাশ আসছে। সময় হয়েছে, দিন কাছিয়েছে; তখন পাহাড়-পর্বতের উপরে আনন্দের বদলে ভয়ের চেঁচামেচি হবে। আমি শীঘ্রই তোমাদের উপর আমার গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেব। তোমাদের চালচলন অনুসারে আমি তোমাদের বিচার করব ও তোমাদের সব জঘন্য কাজের জন্য শাস্তি দেব। আমি মমতার চোখে তোমাদের দিকে তাকাব না বা তোমাদের রেহাইও দেব না; তোমাদের চালচলন ও তোমাদের মধ্যেকার জঘন্য কাজের পাওনা আমি তোমাদের দেব। তখন তোমরা জানবে যে, আমি মাবুদই আঘাত করি। “দেখ, দিন এসেছে! তা এসে পড়েছে! সর্বনাশ ফেটে বেরিয়েছে, লাঠিতে কুঁড়ি ধরেছে, অহংকারের ফুল ফুটেছে। জুলুমের লাঠি দিয়েই অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের সংখ্যা অনেক হলেও কেউ থাকবে না, তাদের ধন-সম্পদ বা গৌরব কিছুই থাকবে না। সময় হয়েছে, দিন এসে গেছে। যারা জমি কেনে তারা আনন্দ না করুক আর যারা তা বিক্রি করে তারাও দুঃখ না করুক, কারণ তাদের সকলের উপরে গজব উপস্থিত হয়েছে। যে কিনেছে আর যে বিক্রি করেছে তারা দু’জনে বেঁচে থাকলেও যে বিক্রি করেছে সে সেই জমি আর ফিরে পাবে না, কারণ এই দর্শন সমস্ত লোকের জন্য, আর তা হবেই হবে। দুষ্ট লোকদের মধ্যে একজনও তার জীবন রক্ষা করতে পারবে না। লোকেরা শিংগা বাজিয়ে সব কিছু প্রস্তুত রেখেছে, কিন্তু কেউ যুদ্ধে যাচ্ছে না, কারণ দেশের সমস্ত লোকের উপরেই আমার রাগ রয়েছে। “শহরের বাইরে রয়েছে যুদ্ধ আর ভিতরে রয়েছে মহামারী আর দুর্ভিক্ষ; যারা বাইরে থাকবে তারা যুদ্ধে মারা যাবে, আর যারা শহরে থাকবে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী তাদের গ্রাস করবে। যারা বেঁচে থাকবে ও পালিয়ে যাবে তারা সবাই পাহাড়ে পাহাড়ে থাকবে এবং প্রত্যেকে তার গুনাহের জন্য উপত্যকার ঘুঘুর মত বিলাপ করবে। প্রত্যেকের হাত অবশ হয়ে যাবে এবং প্রত্যেকের হাঁটু দুর্বল হয়ে পড়বে। তারা ছালার চট পরবে ও ভীষণ ভয়ে কাঁপবে। তারা লজ্জায় পূর্ণ হবে এবং তাদের মাথার চুল কামানো হবে। তাদের রূপা তারা রাস্তায় রাস্তায় ফেলে দেবে এবং তাদের সোনা হবে একটা নাপাক জিনিস। মাবুদের রাগের দিনে তাদের সোনা-রূপা তাদের রক্ষা করতে পারবে না। তা দিয়ে তাদের খিদে মিটবে না বা পেট ভরবে না। আসলে সেগুলোই তাদের গুনাহের মধ্যে ফেলেছে। তাদের সুন্দর গহনার জন্য তারা গর্ববোধ করত এবং তা দিয়ে তাদের জঘন্য প্রতিমা ও মূর্তিগুলো তৈরী করত। কাজেই আমি তাদের জন্য সেগুলো নাপাক করে দেব। আমি সেই সব জোর করে নিয়ে যাবার জন্য বিদেশীদের হাতে এবং লুটের মাল হিসাবে দুনিয়ার দুষ্টদের হাতে তুলে দেব; তারা সেগুলো অপবিত্র করবে। ডাকাতেরা আমার পবিত্র জায়গায় ঢুকে তা অপবিত্র করবে, আর আমি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব। “শিকল ঠিক করা আছে, কারণ দেশ রক্তপাতে ও শহর জুলুমে ভরে গেছে। তাদের ঘর-বাড়ী দখল করবার জন্য আমি জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্ট জাতিকে নিয়ে আসব। আমি শক্তিশালীদের অহংকার ভেংগে দেব, আর তাদের পবিত্র জায়গাগুলো অপবিত্র হবে। ভীষণ ভয় আসলে পর তারা শান্তির তালাশ করবে কিন্তু তা পাবে না। বিপদের উপর বিপদ আসবে, আর গুজবের উপর গুজব শোনা যাবে। তারা নবীর কাছ থেকে দর্শনের কথা শুনবার চেষ্টা করবে; ইমামের দেওয়া শরীয়তের শিক্ষা ও বৃদ্ধ নেতাদের পরামর্শ আর থাকবে না। বাদশাহ্‌ বিলাপ করবে, রাজপুরুষ হতভম্ব হবে, আর দেশের লোকদের হাত কাঁপতে থাকবে। আমি তাদের চালচলন অনুসারে তাদের সংগে ব্যবহার করব এবং তাদের পাওনা অনুসারেই শাস্তি দেব। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” বন্দীদশায় থাকবার ষষ্ঠ বছরের ষষ্ঠ মাসের পঞ্চম দিনে আমি যখন আমার ঘরে বসে ছিলাম আর এহুদার বৃদ্ধ নেতারা আমার সামনে বসে ছিলেন তখন আল্লাহ্‌ মালিকের হাত সেই জায়গায় আমার উপরে আসল। আমি তাকিয়ে মানুষের মত একজনকে দেখতে পেলাম। তাঁর কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত আগুনের মত লাগছিল, আর কোমর থেকে উপর পর্যন্ত চক্‌চকে ধাতুর মত উজ্জ্বল ছিল। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার মাথার চুল ধরলেন। তখন আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমাকে আকাশে তুলে নিলেন এবং আল্লাহ্‌র দেওয়া দর্শনের মধ্যে তিনি আমাকে জেরুজালেমের বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিতরের উঠানের উত্তর দিকের দরজায় ঢুকবার পথে নিয়ে গেলেন। সেখানে এমন একটা মূর্তি ছিল যেটা আল্লাহ্‌র রাগ খুঁচিয়ে তুলেছিল, আর সেখানে আমার সামনে ছিল ইসরাইলের আল্লাহ্‌র মহিমা, যা আমি সমভূমিতে দর্শনের মধ্যে দেখেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি উত্তর দিকে তাকাও।” কাজেই আমি সেই দিকে তাকালাম এবং কোরবানগাহের দরজায়, অর্থাৎ উত্তর দিকের দরজায় ঢুকবার পথে আমি সেই মূর্তিকে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তারা যা করছে তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ? বনি-ইসরাইলরা এখানে কি ভীষণ জঘন্য কাজ করছে যার ফলে আমাকে আমার পবিত্র জায়গা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কিন্তু এর পরেও তুমি আরও জঘন্য কাজ দেখতে পাবে।” তারপর তিনি আমাকে উঠানে ঢুকবার পথে নিয়ে গেলেন। আমি তাকিয়ে দেয়ালে একটা গর্ত দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, দেয়ালের ঐ গর্তটা আরও বড় কর।” সেইজন্য আমি সেই গর্তটা বড় করলাম ও সেখানে একটা দরজা দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি ভিতরে গিয়ে তারা সেখানে যে সব খারাপ ও জঘন্য কাজ করছে তা দেখ।” তাই আমি ভিতরে গিয়ে তাকালাম আর দেয়ালের সমস্ত জায়গায় সব রকম বুকে-হাঁটা প্রাণী ও নাপাক জীবজন্তুর চেহারা এবং বনি-ইসরাইলদের সমস্ত মূর্তির চেহারা খোদাই করা রয়েছে দেখতে পেলাম। সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বনি-ইসরাইলদের সত্তরজন বৃদ্ধ নেতা এবং তাঁদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন শাফনের ছেলে যাসনিয়। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ধূপদানি ছিল এবং তা থেকে ধূপের ধোঁয়ার মেঘ উপর দিকে উঠছিল। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, বনি-ইসরাইলদের বৃদ্ধ নেতারা অন্ধকারে প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরে মূর্তির কাছে কি করছে তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ? তারা বলছে, ‘মাবুদ আমাদের দেখেন না, কারণ তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।’ ” তিনি আবার বললেন, “এর চেয়েও বেশী জঘন্য কাজ তুমি তাদের করতে দেখবে।” তারপর তিনি আমাকে মাবুদের ঘরের উত্তর দিকের দরজায় ঢুকবার পথে আনলেন, আর আমি দেখলাম স্ত্রীলোকেরা সেখানে বসে তাম্মাজ দেবতার জন্য কাঁদছে। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি কি এটা দেখলে? এর চেয়েও বেশী জঘন্য জিনিস তুমি দেখতে পাবে।” তারপর তিনি আমাকে মাবুদের ঘরের ভিতরের উঠানে নিয়ে গেলেন আর সেখানে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকবার মুখে বারান্দা ও কোরবানগাহের মাঝখানে প্রায় পঁচিশজন লোক ছিল। মাবুদের ঘরের দিকে পিছন ফিরে পূর্ব দিকে মুখ করে তারা সূর্যকে সেজদা করছিল। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এটা দেখলে? এহুদার লোকেরা যে জঘন্য কাজ এখানে করছে তা করা তাদের পক্ষে কি একটা সামান্য ব্যাপার? তারা জুলুমে দেশটা ভরে তুলেছে এবং অনবরত আমার রাগ খুঁচিয়ে তুলছে। দেখ, তারা আমাকে কি ভীষণ কুফরী করছে। কাজেই আমি রাগে জ্বলে উঠে তাদের সংগে ব্যবহার করব; আমি তাদের মমতার চোখে দেখব না বা তাদের রেহাই দেব না। তারা আমার কানের কাছে চিৎকার করলেও আমি তাদের কথা শুনব না।” তারপর আমি আল্লাহ্‌কে জোর গলায় ডেকে বলতে শুনলাম, “হে শহর-ধ্বংসের কাজে নিযুক্ত লোকেরা, তোমরা প্রত্যেকে ধ্বংসের অস্ত্র হাতে নিয়ে এখানে এস।” উত্তর দিকের উঁচু জায়গার দরজার দিক থেকে আমি ছয়জন লোককে আসতে দেখলাম; প্রত্যেকের হাতে ধ্বংসকারী অস্ত্র ছিল। তাঁদের সংগে ছিলেন মসীনার কাপড় পরা একজন লোক আর তাঁর কোমরের পাশে ছিল লেখার সরঞ্জাম। তাঁরা ভিতরে ঢুকে ব্রোঞ্জের কোরবানগাহের পাশে দাঁড়ালেন। তখন ইসরাইলের আল্লাহ্‌র যে মহিমা কারুবীদের উপরে ছিল তা সেখান থেকে উঠে বায়তুল-মোকাদ্দসের চৌকাঠের কাছে গেল। মাবুদ মসীনার কাপড় পরা সেই লোকটিকে ডাকলেন। তিনি তাঁকে বললেন, “তুমি জেরুজালেম শহরের মধ্য দিয়ে যাও এবং তার মধ্যে যে সব জঘন্য কাজ করা হয়েছে সেইজন্য যারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কোঁকাচ্ছে তাদের কপালে একটা করে চিহ্ন দাও।” তারপর আমি শুনতে পেলাম তিনি সেই ছয়জনকে বলছেন, “তোমরা শহরের মধ্যে ওর পিছনে পিছনে যাও এবং কোন মায়া-মমতা না দেখিয়ে লোকদের মেরে ফেলতে থাক, কাউকে রেহাই দিয়ো না। বুড়ো, যুবক, যুবতী মেয়ে, স্ত্রীলোক ও ছোট ছেলেমেয়েদের মেরে ফেল, কিন্তু যাদের কপালে চিহ্ন আছে তাদের ছুঁয়ো না। বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে তা করতে শুরু কর।” এতে তাঁরা বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে যে বৃদ্ধ নেতারা ছিলেন তাঁদের দিয়ে শুরু করলেন। তারপর আল্লাহ্‌ তাঁদের বললেন, “তোমরা নিহত লোকদের দিয়ে উঠানটা ভরে ফেলে বায়তুল-মোকাদ্দস নাপাক কর। যাও, কাজ কর।” কাজেই তাঁরা বের হয়ে শহরে গিয়ে লোকদের মেরে ফেলতে লাগলেন। আমি তখন বায়তুল-মোকাদ্দসে একা ছিলাম। সেই সময় আমি উবুড় হয়ে পড়ে আবেগের সংগে বললাম, “হায়, আল্লাহ্‌ মালিক! জেরুজালেমের উপরে তোমার গজব ঢেলে দিয়ে তুমি কি ইসরাইলের বাকী সবাইকে ধ্বংস করে ফেলবে?” তিনি জবাবে আমাকে বললেন, “ইসরাইল ও এহুদার লোকদের গুনাহ্‌ খুবই বেশী; দেশ রক্তপাতে ভরা আর শহরটা অন্যায় কাজে ডুবে গেছে। তারা বলে, ‘মাবুদ এই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন; তাই তিনি এই সব দেখেন না।’ সেইজন্য আমি তাদের মমতার চোখেও দেখব না, রেহাইও দেব না; তারা যা করেছে তার ফল আমি তাদের উপর ঢেলে দেব।” পরে মসীনার কাপড় পরা সেই লোকটি ফিরে এসে এই খবর দিলেন, “আমি আপনার হুকুম অনুসারে কাজ করেছি।” তারপর আমি চেয়ে দেখলাম, আর কারুবীদের মাথার উপর দিকে যা বিছানো ছিল তার উপরে নীলকান্তমণির সিংহাসনের মত কিছু একটা দেখতে পেলাম। মাবুদ মসীনার কাপড় পরা লোকটিকে বললেন, “কারুবীদের নীচে যে চাকাগুলো আছে তুমি সেগুলোর মধ্যে যাও। সেই কারুবীদের মাঝখান থেকে তুমি দু’হাত ভরে জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে শহরের উপর ছড়িয়ে দাও।” আমার চোখের সামনেই লোকটি সেখানে ঢুকলেন। তখন কারুবীরা বায়তুল-মোকাদ্দসের দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর ভিতরের উঠানটা মেঘে ভরে গেল। সেই সময় মাবুদের মহিমা কারুবীদের উপর থেকে উঠে বায়তুল-মোকাদ্দসের চৌকাঠের দিকে চলে গেল। বায়তুল-মোকাদ্দস মেঘে ভরে গেল, আর তখন মাবুদের মহিমার আলোয় উঠানটা ভরা ছিল। কারুবীদের ডানার আওয়াজ বাইরের উঠান পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল; সেই আওয়াজটা ছিল সর্বশক্তিমান মাবুদের কথা বলবার আওয়াজের মত। মাবুদ যখন মসীনার কাপড় পরা লোকটিকে এই হুকুম দিয়েছিলেন, “তুমি কারুবীদের মাঝখানে চাকার মধ্য থেকে আগুন নাও,” তখন লোকটি ভিতরে গিয়ে একটা চাকার পাশে দাঁড়ালেন। পরে আমি তাকিয়ে কারুবীদের প্রত্যেকের পাশে একটা করে মোট চারটা চাকা দেখতে পেলাম; চাকাগুলো বৈদুর্যমণির মত ঝক্‌মক করছিল। সেই চারটা চাকা দেখতে একই রকম ছিল; একটা চাকার ভিতরে যেন আর একটা চাকা। চলবার সময় সেই চাকাগুলো চারদিকের যে কোন দিকে সোজা চলত; অন্য কোন দিকে ফিরত না। কারুবীদের মাথা যে দিকে থাকত তাঁরা সেদিকেই চলতেন; চলবার সময় ফিরতেন না। তাঁদের চারটা চাকাতে, গোটা শরীরে, পিঠে, হাতে এবং ডানার চারপাশ চোখে ভরা ছিল। আমি শুনলাম চাকাগুলোকে “ঘুরন্ত চাকা” বলে ডাকা হচ্ছে। প্রত্যেকটি কারুবীর চারটা করে মুখ ছিল- প্রথমটা কারুবীর, দ্বিতীয়টা মানুষের, তৃতীয়টা সিংহের এবং চতুর্থটা ঈগল পাখীর। তারপর সেই কারুবীরা উপরের দিকে উঠলেন। এঁরাই সেই প্রাণী যাঁদের আমি কবার নদীর ধারে দেখতে পেয়েছিলাম। কারুবীরা চললে তাঁদের পাশে চাকাগুলোও চলত; কারুবীরা মাটি ছেড়ে উপরে উঠবার জন্য ডানা মেললে চাকাগুলো তাঁদের পাশ ছাড়ত না। কারুবীরা থামলে সেগুলোও থামত আর কারুবীরা উঠলে তাঁদের সংগে চাকাগুলোও উঠত, কারণ সেই প্রাণীদের রূহ্‌ সেগুলোর মধ্যেই ছিল। তারপর মাবুদের মহিমা বায়তুল-মোকাদ্দসের চৌকাঠের উপর থেকে চলে গিয়ে কারুবীদের উপরে থামল। আমার চোখের সামনেই কারুবীরা ডানা মেলে দিয়ে মাটি ছেড়ে উপরে উঠতে লাগলেন, আর চাকাগুলোও তাঁদের সংগে চলল। তাঁরা মাবুদের ঘরের পূর্ব দিকের দরজার ঢুকবার পথে গিয়ে থামলেন; ইসরাইলের আল্লাহ্‌র মহিমা তাঁদের উপরে রইল। এই প্রাণীদেরই আমি কবার নদীর ধারে ইসরাইলের আল্লাহ্‌র সিংহাসনের নীচে দেখেছিলাম, আর তাঁরা যে কারুবী তা আমি বুঝতে পারলাম। প্রত্যেকের চারটা করে মুখ ও চারটা করে ডানা ছিল এবং তাঁদের ডানার নীচে মানুষের হাতের মত কিছু ছিল। কবার নদীর ধারে আমি যেমন দেখেছিলাম তাঁদের মুখের চেহারা তেমনই ছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেন। তারপর মাবুদের রূহ্‌ আমাকে তুলে নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের পূর্ব দিকের দরজার কাছে আনলেন। সেখানে দরজায় ঢুকবার পথে পঁচিশজন পুরুষলোক ছিল, আর আমি তাদের মধ্যে অসূরের ছেলে যাসনিয় ও বনায়ের ছেলে প্লটিয়কে দেখলাম; তারা ছিল লোকদের নেতা। মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, এরাই সেই লোক যারা শহরের মধ্যে কুমতলব করছে আর খারাপ পরামর্শ দিচ্ছে। তারা বলছে, ‘ঘর-বাড়ী তৈরী করবার সময় কি হয় নি? এই শহরটা যেন রান্নার পাত্র আর আমরা হচ্ছি গোশ্‌ত।’ কাজেই হে মানুষের সন্তান, তুমি এদের বিরুদ্ধে নবী হিসাবে কথা বল, জ্বী, নবী হিসাবে কথা বল।” তারপর মাবুদের রূহ্‌ আমার উপরে আসলেন, আর তিনি আমাকে এই কথা বলতে বললেন, “মাবুদ বলছেন, ‘হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা ঐ কথা বলছ, কিন্তু তোমাদের মনে কি আছে তা আমি জানি। তোমরা এই শহরের অনেক লোককে হত্যা করেছ এবং মরা লোক দিয়ে রাস্তাগুলো ভরে ফেলেছ।’ “সেইজন্য আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘সত্যি এই শহরটা রান্নার পাত্র, কিন্তু যে লোকগুলোকে তোমরা শহরে হত্যা করেছ সেগুলোই গোশ্‌ত; আর আমি সেখান থেকে তোমাদের তাড়িয়ে বের করে দেব। যে যুদ্ধকে তোমরা ভয় কর সেই যুদ্ধই আমি তোমাদের বিরুদ্ধে আনব। আমি শহর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে বের করে বিদেশীদের হাতে তুলে দেব এবং তোমাদের শাস্তি দেব। তোমরা যুদ্ধে মারা পড়বে; ইসরাইলের সীমানায় আমি তোমাদের সবাইকে শাস্তি দেব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। এই শহর তোমাদের জন্য পাত্রও হবে না আর তোমরাও তার মধ্যেকার গোশ্‌ত হবে না; ইসরাইলের সীমানায় আমি তোমাদের সবাইকে শাস্তি দেব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। তোমরা আমার নিয়ম মত চল নি কিংবা আমার শরীয়তও পালন কর নি বরং তোমাদের চারপাশের জাতিগুলোর নিয়ম অনুসারে চলেছ।’ ” আমি যখন নবী হিসাবে কথা বলছিলাম তখন বনায়ের ছেলে প্লটিয় মারা গেল। তখন আমি উবুড় হয়ে পড়ে আবেগের সংগে জোরে জোরে বললাম, “হায়, আল্লাহ্‌ মালিক! তুমি কি ইসরাইলের বাকী লোকদের সবাইকে শেষ করে দেবে?” তখন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, তোমার ভাইদের, তোমার নিজের লোকদের, অর্থাৎ বন্দীদশায় থাকা সমস্ত বনি-ইসরাইলদের সম্বন্ধে জেরুজালেমের লোকেরা বলছে, ‘তারা মাবুদের দেশ থেকে দূরে চলে গেছে; এই দেশ তো অধিকার হিসাবে আমাদেরই দেওয়া হয়েছে।’ “সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক যা বলছি তা তুমি তোমার লোকদের বল যে, আমি যদিও অন্যান্য জাতিদের মধ্যে তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি এবং দেশে দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি তবুও যে সব দেশে তারা গেছে সেখানেও এই অল্পকালের জন্য আমিই তাদের পবিত্র স্থান হয়েছি। “কাজেই তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, জাতিদের মধ্য থেকে আমি তাদের জমায়েত করব; যে সব দেশে তারা ছড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনব আর ইসরাইল দেশটা আবার আমি তাদের ফিরিয়ে দেব। “তারা সেখানে ফিরে গিয়ে সব বাজে মূর্তি ও জঘন্য প্রতিমাগুলো দূর করে দেবে। আমি তাদের এমন দিল দেব যা কেবল আমারই দিকে আসক্ত থাকবে, আর আমি তাদের মধ্যে নতুন রূহ্‌ দেব; আমি তাদের কঠিন দিল সরিয়ে দিয়ে নরম দিল দেব। তাহলে তারা আমার নিয়ম মত চলবে এবং আমার শরীয়ত যত্নের সংগে পালন করবে। তারা আমার বান্দা হবে এবং আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব। কিন্তু যাদের অন্তর বাজে মূর্তি ও জঘন্য প্রতিমাগুলোর দিকে, তাদের কাজের ফল আমি তাদের উপর ঢেলে দেব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” এর পর কারুবীরা তাঁদের ডানা মেলে দিলেন; তাঁদের পাশে ছিল সেই চাকাগুলো, আর ইসরাইলের আল্লাহ্‌র মহিমা তাঁদের উপরে ছিল। মাবুদের মহিমা শহরের মধ্য থেকে উঠে শহরের পূর্ব দিকের পাহাড়ের উপরে গিয়ে থামল। তারপর আল্লাহ্‌র রূহ্‌ আমাকে তুলে নিলেন এবং তাঁর দেওয়া দর্শনের মধ্য দিয়ে আবার ব্যাবিলনে বন্দীদের কাছে নিয়ে গেলেন। যে দর্শন আমি দেখছিলাম এর পর তা শেষ হয়ে গেল। মাবুদ আমাকে যা যা দেখিয়েছিলেন তা সবই আমি বন্দীদের কাছে বললাম। পরে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, তুমি একটা বিদ্রোহী জাতির মধ্যে বাস করছ। তাদের চোখ আছে কিন্তু তারা দেখে না, কান আছে শোনে না, কারণ তারা একটা বিদ্রোহী জাতি। “কাজেই হে মানুষের সন্তান, তুমি যেন দূরে বন্দী হয়ে যাচ্ছ সেইভাবে তোমার জিনিসপত্র বেঁধে নাও এবং তাদের চোখের সামনে দিনের বেলাতেই রওনা হও; তুমি যেখানে আছ সেখান থেকে অন্য জায়গায় যাও। তারা যে বিদ্রোহী জাতি হয়তো তারা তা বুঝতে পারবে। দূরে বন্দী হয়ে যাবার জন্য তোমার গুছিয়ে নেওয়া জিনিসপত্র দিনের বেলাতেই তাদের চোখের সামনে বাইরে বের করবে। তারপর সন্ধ্যা বেলায় দূরে বন্দী হয়ে যাবার মত করে তাদের চোখের সামনে রওনা হবে। তাদের চোখের সামনেই দেয়ালে গর্ত খুঁড়ে তোমার জিনিসপত্র তার মধ্য দিয়ে বের করে নেবে। জিনিসপত্রগুলো তাদের চোখের সামনে কাঁধে তুলে নেবে এবং অন্ধকারের মধ্যে সেগুলো বের করে নিয়ে যাবে। তোমার চোখ ঢেকে রাখবে যাতে তুমি তোমার দেশের মাটি দেখতে না পাও, কারণ ইসরাইল জাতির জন্য আমি তোমাকে একটা নিশানার মত করেছি।” আমাকে যা হুকুম করা হল সেইমতই আমি কাজ করলাম। দূরে বন্দী হয়ে যাবার মত করে আমি আমার জিনিসপত্র দিনের বেলাতেই বের করে আনলাম। তারপর সন্ধ্যা বেলায় হাত দিয়ে দেয়ালে গর্ত খুঁড়লাম। তাদের চোখের সামনেই অন্ধকারে আমার জিনিসপত্র আমি কাঁধের উপরে নিয়ে রওনা হলাম। সকাল বেলায় মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, বিদ্রোহী ইসরাইল জাতি কি তোমাকে জিজ্ঞাসা করে নি, ‘তুমি কি করছ?’ তুমি তাদের বল, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘এই চিহ্ন জেরুজালেমের শাসনকর্তা এবং সেখানকার বনি-ইসরাইলদের জন্য।’ তুমি তাদের বল যে, তুমি তাদের কাছে একটা চিহ্ন। তুমি যেমন করলে, তাদের প্রতি তেমনই করা হবে। তারা বন্দী হয়ে দূর দেশে যাবে। “তাদের মধ্যেকার শাসনকর্তা অন্ধকারে তার জিনিসপত্র কাঁধে নিয়ে বের হবে এবং দেয়ালে গর্ত খোঁড়া হবে যাতে সে তার মধ্য দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। সে তার চোখ ঢাকবে যাতে সে তার দেশের মাটি দেখতে না পায়। আমি তার জন্য জাল পাতব আর সে আমার ফাঁদে ধরা পড়বে। আমি তাকে ব্যাবিলনীয়দের দেশ ব্যাবিলনে নিয়ে যাব, কিন্তু সে তা দেখবে না; সেখানেই সে মারা যাবে। আমি তার চারপাশের সবাইকে, অর্থাৎ তার কর্মচারী ও তার সমস্ত সৈন্যদলকে চারদিকে ছড়িয়ে দেব এবং খোলা তলোয়ার নিয়ে আমি তাদের তাড়া করব। “আমি যখন তাদের নানা জাতি ও দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু লোককে আমি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর হাত থেকে বাঁচাব, যাতে তারা যেখানেই যাক না কেন সেখানকার সমস্ত জাতির মধ্যে তাদের সব জঘন্য অভ্যাসের কথা স্বীকার করে। তাতে তারা জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।” তারপর মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তোমার খাবার ও পানি খাও। তুমি দেশের লোকদের বল যে, ইসরাইল দেশের জেরুজালেমের বাসিন্দাদের বিষয়ে আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তারা ভয়ে ভয়ে তাদের খাবার খাবে আর হতভম্ব হয়ে পানি খাবে, কারণ সেখানকার বাসিন্দাদের অত্যাচারের দরুন তাদের দেশটা খালি হয়ে পড়ে থাকবে। লোকজন ভরা শহরগুলো ধ্বংসস্থান হয়ে থাকবে এবং দেশ জনশূন্য হবে। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইল দেশে এ কেমন চলতি কথা রয়েছে, ‘দিন চলে যায় আর প্রত্যেক দর্শনই বিফল হয়’? তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আমি সেই চলতি কথাটা বাতিল করে দেব; ইসরাইল দেশে সেই কথা আর কেউ বলবে না।’ তার বদলে তাদের বল, ‘দিন এসে গেছে, এখন প্রত্যেকটা দর্শন ফলবে। ইসরাইলের লোকদের মধ্যে মিথ্যা দর্শন আর খুশী করবার গোণা-পড়া আর থাকবে না। তখন আমি মাবুদ যা বলব তা সফল হবে, দেরি হবে না। হে বিদ্রোহী জাতি, আমি যা বলছি তা তোমাদের সময়েই সফল করব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, বনি-ইসরাইলরা বলছে যে, তুমি যে দর্শন দেখছ তা এখন থেকে অনেক বছর পরের কথা, আর যে ভবিষ্যদ্বাণী বলছ তা দূর ভবিষ্যতের বিষয়ে। কাজেই তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আমার কোন কথা সফল হতে আর দেরি নেই; আমি যা বলব তা সফল হবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইলের যে নবীরা এখন কথা বলছে তুমি তাদের বিরুদ্ধে নবী হিসাবে কথা বল। যারা নিজেদের মনগড়া কথা বলছে তুমি তাদের বল যে, তারা যেন মাবুদের কালাম শোনে। আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘ঘৃণ্য, সেই ভয়হীন নবীরা, যারা কোন দর্শন না পেয়ে তাদের মনগড়া কথা বলে। হে ইসরাইল, তোমার নবীরা ধ্বংসস্থানের মধ্যে শিয়ালদের মত। তারা ইসরাইল জাতির দেয়ালের ফাটল মেরামত করতে সেখানে ওঠে নি যাতে মাবুদের দিনে যুদ্ধের সময়ে সেটা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তাদের দর্শন মিথ্যা এবং তাদের গোণা-পড়া সত্যি নয়। তারা বলে যে, আমি এই কথা বলছি, অথচ আমি তাদের পাঠাই নি; তবুও তারা আশা করে তাদের কথা সফল হবে। তারা কি মিথ্যা দর্শন দেখছে না এবং মিথ্যা গোণা-পড়া করছে না? তারা তো বলছে যে, আমি এই কথা বলছি, অথচ আমি বলি নি। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, তাদের মিথ্যা কথা ও মিথ্যা দর্শনের জন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে। আমার হাত সেই সব নবীদের বিরুদ্ধে উঠবে যারা মিথ্যা দর্শন দেখে ও মিথ্যা গোণা-পড়া করে। আমার বান্দাদের সমাজে তারা থাকবে না এবং ইসরাইলের বংশ-তালিকার মধ্যে তাদের নাম থাকবে না, আর ইসরাইল দেশেও তারা ফিরে আসতে পারবে না। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই আল্লাহ্‌ মালিক। “ ‘যখন কোন শান্তি নেই তখন নবীরা বলে যে, শান্তি আছে, আর এইভাবে তারা আমার বান্দাদের বিপথে নিয়ে গেছে। তারা যেন লোকদের গাঁথা এমন দেয়ালের উপর চুনকাম করেছে যা শক্ত নয়। সেইজন্য যারা এই কাজ করেছে তুমি তাদের বল যে, সেই দেয়াল পড়ে যাবে। মুষলধারে বৃষ্টি ও বড় বড় শিলা পড়বে এবং ঝোড়ো বাতাস সজোরে বইবে। সেই দেয়াল যখন ভেংগে পড়বে তখন লোকে কি তাদের জিজ্ঞাসা করবে না যে, তারা যে চুনকাম করে দেয়ালটা ঢেকেছিল সেই চুন গেল কোথায়? “ ‘আমার রাগে আমি ঝোড়ো বাতাস খুলে দেব। আমার গজবে আমি বড় বড় শিলা ও মুষলধারে বৃষ্টি দিয়ে তা ধ্বংস করে দেব। যে দেয়াল নবীরা চুনকাম করে ঢেকে দিয়েছিল তা আমি ভেংগে মাটির সংগে সমান করে দেব যাতে তার ভিত্তি খোলা পড়ে থাকে। সেটা ভেংগে পড়বার সময় তার তলায় তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। সেই দেয়াল ও সেটাকে যারা চুনকাম করে ঢেকে দিয়েছে তাদের উপরে আমি আমার গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেব। আমি লোকদের বলব যে, সেই দেয়ালটাও নেই এবং যারা সেটা চুনকাম করেছিল, অর্থাৎ ইসরাইলের সেই নবীরা যারা জেরুজালেমের লোকদের কাছে কথা বলেছিল এবং শান্তি না থাকলেও শান্তির দর্শন দেখেছিল তারাও নেই। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তোমার জাতির যে মেয়েরা নবী হিসাবে নিজেদের মনগড়া কথা বলে এখন তুমি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াও। তুমি তাদের বিরুদ্ধে এই কথা বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘ঘৃণ্য স্ত্রীলোকেরা! তোমরা তো লোকদের হাতের জন্য তাবিজ এবং মাথা ঢাকবার জন্য বিভিন্ন মাপের কাপড় তৈরী কর যাতে তোমরা সেই লোকদের বশ করতে পার। তোমরা কি আমার বান্দাদের প্রাণ শিকার করছ আর নিজেদের প্রাণ রক্ষা করছ? কয়েক মুঠা যব আর কয়েক টুকরা রুটির জন্য তোমরা আমার বান্দাদের সামনে আমাকে অসম্মানিত করেছ। আমার বান্দারা, যারা মিথ্যা কথা শোনে, তোমরা তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলে যারা মরবার উপযুক্ত নয় তাদের হত্যা করেছ এবং যারা বাঁচবার উপযুক্ত নয় তাদের বাঁচিয়ে রেখেছ। “ ‘সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, তোমরা যে তাবিজ দিয়ে পাখীর মত করে লোকদের ধর আমি তার বিপক্ষে। তোমাদের হাত থেকে আমি সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেব। পাখীর মত করে যে লোকদের তোমরা ধর তাদের আমি ছেড়ে দেব। তোমাদের মাথা ঢাকবার কাপড়গুলো আমি ছিঁড়ে ফেলে তোমাদের হাত থেকে আমার বান্দাদের উদ্ধার করব; তারা আর তোমাদের হাতে শিকারের মত ধরা পড়বে না। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। যে সৎ লোকদের আমি দুঃখ দিই নি, মিথ্যা কথা বলে তোমরা তাদের হতাশ করেছ এবং দুষ্ট লোকদের তোমরা উৎসাহ দিয়েছ যাতে তারা প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুপথ থেকে না ফেরে। সেইজন্য তোমরা আর মিথ্যা দর্শন দেখবে না এবং গোণা-পড়াও করবে না। তোমাদের হাত থেকে আমি আমার বান্দাদের উদ্ধার করব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” পরে ইসরাইলের কয়েকজন বৃদ্ধ নেতা আমার কাছে এসে আমার সামনে বসলেন। তখন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, এই লোকেরা তাদের দিলের মধ্যে মূর্তি স্থাপন করে গুনাহে পড়বার মত জিনিস তাদের সামনে রেখেছে। সেইজন্য আমার কাছে যদি তারা কোন কিছু জিজ্ঞাসা করে তবে আমি তাদের জবাব দেব না। কাজেই তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘কোন ইসরাইলীয় যদি তার দিলের মধ্যে মূর্তি স্থাপন করে গুনাহে পড়বার মত জিনিস নিজের সামনে রাখে আর তারপর নবীর কাছে আসে, তবে আমি মাবুদ নিজেই তার অনেক মূর্তি অনুসারে তাকে জবাব দেব। বনি-ইসরাইলদের অন্তর আবার জয় করবার জন্যই আমি এটা করব, কারণ তারা সবাই তাদের মূর্তিগুলোর জন্য আমাকে ত্যাগ করেছে।’ “সেইজন্য তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমরা তওবা কর। তোমাদের মূর্তিগুলো থেকে ফেরো এবং সব জঘন্য কাজ ত্যাগ কর। কোন ইসরাইলীয় কিংবা ইসরাইল দেশে বাসকারী কোন বিদেশী যদি আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং তার দিলে মূর্তি স্থাপন করে গুনাহে পড়বার মত জিনিস তার সামনে রাখে আর তার পরে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করবার জন্য কোন নবীর কাছে আসে, তবে আমি মাবুদ নিজেই তাকে জবাব দেব। আমি সেই লোকের বিপক্ষে দাঁড়াব এবং তাকে একটা দৃষ্টান্ত ও একটা চলতি কথার মত করব। আমার বান্দাদের মধ্য থেকে আমি তাকে ছেঁটে ফেলব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘যদি সেই নবী তাকে কোন জবাব দেয় তবে জানবে যে, আমি মাবুদই জবাব দেবার জন্য তাকে ভুলিয়েছি। তারপর সেই নবীর বিরুদ্ধে আমি হাত বাড়াব এবং আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে তাকে ধ্বংস করব। তারা দু’জনেই তাদের অন্যায়ের শাস্তি পাবে; সেই নবীর ও সেই পরামর্শ করতে আসা লোকটির সমান শাস্তি হবে। তখন বনি-ইসরাইলরা আর আমার কাছ থেকে বিপথে যাবে না এবং তাদের সব গুনাহ্‌ দিয়ে নিজেদের আর নাপাক করবে না। তারা আমার বান্দা হবে এবং আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ধর, অবিশ্বস্ত হয়ে কোন দেশ আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করল আর আমি তার বিরুদ্ধে হাত বাড়িয়ে তার খাবারের যোগান বন্ধ করলাম এবং দুর্ভিক্ষ পাঠিয়ে তার মানুষ ও পশু মেরে ফেললাম। এই অবস্থায় সেখানে যদি নূহ্‌, দানিয়াল ও আইয়ুব- এই তিনজন লোক থাকত তবে তাদের সততার জন্য তারা কেবল নিজেদেরই রক্ষা করতে পারত। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ধর, আমি সেই দেশে বুনো জন্তু পাঠিয়ে দিলাম এবং তারা দেশটাকে জনশূন্য করল। তাতে সেটা এমন ভয়ংকর হয়ে পড়ল যে, জানোয়ারের ভয়ে তার মধ্য দিয়ে কেউ যাওয়া-আসা করতে পারল না। আমার জীবনের কসম যে, সেই তিনজন লোক সেখানে থাকলেও তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত রক্ষা করতে পারত না। তারা নিজেরা রক্ষা পেত কিন্তু দেশটা জনশূন্য হয়ে যেত। “ধর, আমি সেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে এসে বললাম, ‘দেশের সব জায়গায় যুদ্ধ হোক,’ আর আমি তার লোকজন ও জীবজন্তু মেরে ফেললাম। আমার জীবনের কসম যে, তার মধ্যে সেই তিনজন লোক থাকলেও তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত রক্ষা করতে পারত না। তারা নিজেরাই কেবল রক্ষা পেত। “আবার ধর, আমি সেই দেশের মধ্যে মহামারী পাঠালাম এবং তার মানুষ ও পশুদের মেরে ফেলবার মধ্য দিয়ে আমার গজব তার উপর ঢেলে দিলাম। আমার জীবনের কসম যে, তার মধ্যে নূহ্‌, দানিয়াল ও আইয়ুব থাকলেও তারা তাদের কোন ছেলে বা মেয়েকে রক্ষা করতে পারত না। তাদের সততার জন্য তারা কেবল নিজেদেরই রক্ষা করতে পারত। “এখন আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আমি যখন জেরুজালেমের মানুষ ও পশু মেরে ফেলবার জন্য তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বুনো জন্তু ও মহামারী- এই চারটি ভয়ংকর শাস্তি পাঠাব তখন কতই না খারাপ হবে! তবুও সেখানকার কয়েকজন বেঁচে যাবে ও তাদের বের করে আনা হবে। তারা তোমাদের কাছে আসবে, আর যখন তোমরা তাদের খারাপ স্বভাব-চরিত্র ও কাজকর্ম দেখবে তখন জেরুজালেমের উপর আমার আনা বিপদের বিষয়ে তোমরা সান্ত্বনা পাবে। তাদের স্বভাব-চরিত্র ও কাজকর্ম দেখে তোমরা সান্ত্বনা পাবে এবং বুঝতে পারবে যে, অকারণে আমি কিছুই করি নি। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আংগুর গাছের ডাল কি বনের অন্য যে কোন গাছের ডালের চেয়ে ভাল? দরকারী কোন কিছু তৈরী করবার জন্য কি তা থেকে কাঠ নেওয়া হয়? জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখবার জন্য লোকে কি তা দিয়ে গোঁজ তৈরী করে? জ্বালানী কাঠ হিসাবে তা আগুনে ফেলবার পরে যখন কাঠের দু’দিক পুড়ে যায় এবং মাঝখানটা কালো হয়ে যায় তখন কি সেটা কোন কাজে লাগে? আগুনে ফেলবার আগে যদি সেটা কোন কিছুর জন্য কাজে না লেগে থাকে তবে আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেলে কি তা দিয়ে কোন দরকারী কিছু তৈরী করা যেতে পারে? “সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, বনের গাছপালার মধ্যে আংগুর গাছের কাঠকে আমি যেমন জ্বালানী কাঠ হিসাবে আগুনে দিয়েছি, তেমনি জেরুজালেমে বাসকারী লোকদেরও আগুনে দেব। আমি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। আগুন থেকে তারা বের হয়ে আসলেও আগুনই তাদের পুড়িয়ে ফেলবে। আমি যখন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। দেশটা আমি জনশূন্য করব, কারণ তারা অবিশ্বস্ত হয়েছে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি জেরুজালেমের জঘন্য কাজকর্মের বিষয় তাকে জানাও। তুমি বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক জেরুজালেমকে বলছেন, ‘তোমার বাড়ী ও তোমার জন্মের স্থান কেনানীয়দের দেশে; তোমার পিতা হল আমোরীয় ও মা হিট্টীয়। যেদিন তুমি জন্মেছিলে সেদিন তোমার নাড়ী কাটা হয় নি, তোমাকে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয় নি, তোমার গায়ে লবণ মাখানো হয় নি কিংবা তোমাকে কাপড় দিয়ে জড়ানো হয় নি। কেউ তোমাকে মমতার চোখে দেখে নি কিংবা তোমার প্রতি এই সব করবার জন্য কারও মনে দয়াও জাগে নি। তোমাকে বরং খোলা মাঠে ফেলে রাখা হয়েছিল, কারণ যেদিন তুমি জন্মেছিলে সেই দিন তোমাকে ঘৃণা করা হয়েছিল। “ ‘আমি তোমার কাছ দিয়ে যাবার সময় তোমাকে তোমার রক্তের মধ্যে শুয়ে ছট্‌ফট করতে দেখলাম। তখন আমি তোমাকে হুকুম দিলাম যেন তুমি তোমার রক্তের মধ্যেই বেঁচে থাক। আমি তোমাকে ক্ষেতের চারার মত বড় করে তুললাম। তুমি বেড়ে উঠে কিশোরী হলে, তোমার বুক গড়ে উঠল, লোম গজাল, কিন্তু তুমি উলংগিনী ও কাপড় ছাড়াই ছিলে। “ ‘পরে আমি তোমার পাশ দিয়ে যাবার সময় তোমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তোমার এখন প্রেম করবার সময় হয়েছে; সেইজন্য আমার পোশাকের অংশ আমি তোমার উপরে বিছিয়ে তোমার উলংগতা ঢেকে দিলাম। আমি তোমার কাছে কসম খেয়ে তোমার সংগে বিয়ের চুক্তি করলাম, আর তাতে তুমি আমার হলে। আমি তোমাকে পানিতে গোসল করিয়ে তোমার রক্ত ধুয়ে দিলাম এবং গায়ে তেল লাগিয়ে দিলাম। আমি তোমার গায়ে নক্‌শা তোলা কাপড় দিলাম ও পায়ে শুশুকের চামড়ার সুন্দর চটি পরালাম। আমি তোমার মাথায় পাতলা মসীনার কাপড় জড়ালাম এবং রেশমের কাপড় দিয়ে তোমাকে ঢেকে দিলাম। আমি গহনা দিয়ে তোমাকে সাজালাম; তোমার হাতে চুড়ি, গলায় হার, নাকে নোলক, কানে দুল ও মাথায় সুন্দর একটা তাজ দিলাম। এইভাবে সোনা ও রূপা দিয়ে তোমাকে সাজানো হল; তোমার কাপড়-চোপড় ছিল পাতলা মসীনার, রেশমের ও নক্‌শা তোলা কাপড়ের। তোমার খাবার ছিল মিহি ময়দা, মধু ও জলপাইয়ের তেল। তুমি খুব সুন্দরী হয়ে উঠে রাণীর মত হলে। তোমার সৌন্দর্যের জন্য তোমার সুনাম জাতিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, কারণ আমার দেওয়া জাঁকজমকে তোমার সৌন্দর্য পরিপূর্ণ হয়েছিল। “ ‘কিন্তু তুমি তোমার সৌন্দর্যের সুনাম বেশ্যা হবার জন্য ব্যবহার করেছ। যে কেউ তোমার পাশ দিয়ে যেত তার সংগে তুমি জেনা করতে এবং সে তোমাকে ভোগ করত। তোমার কোন কোন কাপড় নিয়ে তুমি পূজার উঁচু স্থান সাজিয়ে সেখানে তোমার বেশ্যার কাজ চালাতে লাগলে। ঐ রকম কাজ করা তোমার কখনও উচিত ছিল না। আমার সোনা-রূপা দিয়ে তৈরী গহনা, যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম, সেই সুন্দর গহনা নিয়ে তুমি নিজের জন্য পুরুষ-মূর্তি তৈরী করে সেগুলোর সংগে জেনা করতে। তোমার নক্‌শা তোলা কাপড়-চোপড় নিয়ে তুমি সেগুলোকে পরাতে এবং তাদের সামনে তুমি আমার তেল ও ধূপ কোরবানী করতে। আমি তোমার খাবার জন্য তোমাকে যে মিহি ময়দা, জলপাই তেল ও মধু দিয়েছিলাম তা তুমি তাদের সামনে খোশবু হিসাবে রাখতে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, এই সবই ঘটেছে। “ ‘তোমার যে সব ছেলেমেয়েদের তুমি আমার জন্য গর্ভে ধরেছিলে তাদের নিয়ে তুমি খাবার হিসাবে মূর্তিগুলোর উদ্দেশে কোরবানী দিয়েছ। তোমার জেনার কাজ কি যথেষ্ট ছিল না? আবার আমার ছেলেমেয়েদের কেটে তুমি মূর্তিগুলোর উদ্দেশে তাদের আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী দিয়েছ। তোমার সব জঘন্য কাজকর্ম ও তোমার জেনার মধ্যে তুমি তোমার ছোটবেলার কথা মনে কর নি যখন তুমি ছিলে উলংগিনী এবং খালি গায়ে নিজের রক্তের মধ্যে ছট্‌ফট করছিলে। রাস্তার মোড়ে মোড়েও মূর্তির আসন তৈরী করে তোমার সৌন্দর্যকে তুমি অপমান করেছ। যে কেউ তোমার পাশ দিয়ে গেছে তাকে তোমার শরীর দান করে তুমি তোমার জেনার কাজ বাড়িয়েছ। তোমার কামুক প্রতিবেশী মিসরীয়দের সংগে তুমি জেনা করেছ এবং তোমার জেনার কাজ বাড়িয়ে আমার রাগ খুঁচিয়ে তুলেছ। সেইজন্য আমি তোমার বিরুদ্ধে আমার হাত বাড়িয়ে তোমার সম্পত্তি কমিয়ে দিয়েছি। তোমার শত্রুদের, অর্থাৎ ফিলিস্তিনীদের মেয়েরা, যারা তোমার জঘন্য স্বভাবের জন্য লজ্জা পেয়েছে আমি তাদের হাতে তোমাকে তুলে দিয়েছি। আশেরীয়দের সংগেও তুমি জেনা করেছ, কারণ তুমি অতৃপ্ত ছিলে; কিন্তু তার পরেও তোমার তৃপ্তি হয় নি। তার পরে তুমি তোমার জেনার কাজ বাড়িয়ে বণিকদের দেশ ব্যাবিলনের সংগেও জেনা করলে, কিন্তু এতেও তোমার তৃপ্তি হল না। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, তুমি কত দুর্বল-মনা, কারণ তুমি বেহায়া বেশ্যার মত এই সব কাজ করছ। তুমি যখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তির আসন তৈরী করেছ তখন বেশ্যার কাজ করেও তোমার পাওনা টাকা অগ্রাহ্য করেছ। তুমি জেনাকারিণী স্ত্রীর মত, তুমি তোমার স্বামীর চেয়ে অচেনাদের পছন্দ করেছ। সব বেশ্যারাই উপহার পায়, কিন্তু তুমি তোমার সব প্রেমিকদের উপহার দিয়ে থাক। তোমার সংগে জেনা করবার জন্য যাতে তারা সব জায়গা থেকে তোমার কাছে আসে সেইজন্য তুমি তাদের ঘুষ দিয়ে থাক। কাজেই তোমার বেশ্যাগিরিতে তুমি অন্য বেশ্যাদের চেয়ে আলাদা; তোমার সংগে জেনা করবার জন্য কেউ তোমার পিছনে দৌড়ায় না। তুমি একেবারে আলাদা, কারণ তুমি টাকা নাও না বরং টাকা দিয়ে থাক।’ ” ওহে বেশ্যা, মাবুদের কালাম শোন। আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “জেনার কাজে তুমি তোমার লজ্জা-স্থান খুলে দিয়ে তোমার প্রেমিকদের কাছে তোমার উলংগতা প্রকাশ করেছ। তোমার সমস্ত জঘন্য মূর্তির জন্য ও তাদের উদ্দেশে তোমার ছেলেমেয়েদের যে রক্ত দিয়েছ, তার জন্য আমি তোমার সেই সব প্রেমিকদের জমায়েত করব যাদের সংগে তুমি আনন্দ ভোগ করেছ। যাদের তুমি ভালবেসেছ এবং যাদের ঘৃণা করেছ তাদের সবাইকে আমি জমায়েত করব। আমি চারদিক থেকে তোমার বিরুদ্ধে তাদের জমায়েত করব ও তাদের সামনেই তোমার সব কাপড় খুলে ফেলব যাতে তারা তোমার উলংগতা দেখতে পায়। যে স্ত্রীলোকেরা জেনা করে এবং যারা রক্তপাত করে তাদের যে শাস্তি দেওয়া হয় সেই শাস্তিই আমি তোমাকে দেব। আমার রাগ ও দিলের জ্বালার জন্য আমি তোমাকে মৃত্যুর শাস্তি দেব। তারপর আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকদের হাতে তুলে দেব; তারা তোমার মূর্তির আসনগুলো ধ্বংস করে দেবে। তারা তোমার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলবে ও তোমার সুন্দর গহনাগুলো নিয়ে নেবে আর তোমাকে একেবারে উলংগ করে রেখে যাবে। তারা তোমার বিরুদ্ধে একদল লোককে উত্তেজিত করবে; তারা তোমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে এবং তাদের তলোয়ার দিয়ে তোমাকে টুকরা টুকরা করে কাটবে। তারা তোমার ঘর-বাড়ী পুড়িয়ে ফেলবে এবং অনেক স্ত্রীলোকের চোখের সামনে তোমাকে শাস্তি দেবে। এইভাবে আমি তোমার বেশ্যাগিরি বন্ধ করে দেব; তোমার প্রেমিকদের তুমি আর টাকা-পয়সা দেবে না। তারপর তোমার উপর আমার রাগ ও দিলের জ্বালা থেমে যাবে। আমি শান্ত হব, আর রাগ করব না। “তুমি তোমার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে রাখ নি, বরং এই সব কাজ দিয়ে আমাকে বিরক্ত করে তুলেছ; সেইজন্য আমিও তোমার কাজের ফল তোমাকে দেব। তোমার অন্য সমস্ত কুকর্মের সংগে কি তুমি এই জঘন্য কাজও যোগ কর নি? “লোকে তোমার বিষয় নিয়ে এই চলতি কথা বলবে, ‘যেমন মা তেমনি মেয়ে।’ তুমি তোমার মায়ের উপযুক্ত মেয়ে, তোমার মা তার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের ঘৃণা করত; তুমি তোমার বোনদের উপযুক্ত বোন, সেই বোনেরা তাদের স্বামী ও ছেলেমেয়েদের ঘৃণা করত। তোমাদের মা হল হিট্টীয়া আর পিতা আমোরীয়। তোমার বড় বোন সামেরিয়া; তার মেয়েদের নিয়ে সে তোমার উত্তর দিকে বাস করে। তোমার ছোট বোন হল সাদুম; সে তার মেয়েদের নিয়ে তোমার দক্ষিণে বাস করে। তুমি যে তাদের চালচলন এবং জঘন্য অভ্যাস মত চলেছ কেবল তা-ই নয় বরং তোমার সমস্ত আচার-ব্যবহারে তুমি অল্প সময়ের মধ্যে তাদের চেয়ে আরও জঘন্য হয়েছ। আমার কথা সত্যি যে, তোমার মেয়েরা ও তুমি যা করেছ তোমার বোন সাদুম ও তার মেয়েরা কখনও তা করে নি। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “তোমার বোন সাদুমের গুনাহ্‌ ছিল এই- সে ও তার মেয়েরা ছিল অহংকারী, কারণ তাদের প্রচুর খাবার ছিল ও তারা নিশ্চিন্তে বাস করত, কিন্তু তারা গরীব ও অভাবীদের সাহায্য করত না। তারা ছিল গর্বিত এবং আমার সামনে জঘন্য কাজকর্ম করত। কাজেই তুমি যেমন দেখেছ সেইভাবেই আমি তাদের দূর করে দিয়েছি। তুমি যে সব গুনাহ্‌ করেছ তার অর্ধেকও সামেরিয়া করে নি। তুমি তাদের চেয়ে আরও জঘন্য জঘন্য কাজ করেছ। তুমি এই যে সব কাজ করেছ তা দেখে তোমার বোনদের বরং ধার্মিক মনে হয়েছে। তোমার অসম্মান তোমাকেই বহন করতে হবে, কারণ তোমার কাজগুলো তোমার বোনদের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তোমার গুনাহ্‌ তাদের চেয়েও জঘন্য বলে তোমার চেয়ে তাদের ধার্মিক বলে মনে হয়। কাজেই তুমি লজ্জিত হও ও তোমার অসম্মান বহন কর, কারণ তুমি তোমার বোনদের ধার্মিক প্রমাণ করেছ। “যাহোক, আমি সাদুম ও তার মেয়েদের, সামেরিয়া ও তার মেয়েদের এবং তাদের সংগে সংগে তোমারও অবস্থা ফিরাব। তাতে তুমি অসম্মান বোধ করবে এবং তোমার যে সব খারাপ কাজের জন্য তারা নিজেদের ভাল বলে মনে করেছে তার জন্য তুমি লজ্জিত হবে। তোমার বোনেরা তাদের মেয়েদের নিয়ে আগে যেমন ছিল তেমনই হবে; আর তুমি ও তোমার মেয়েরা আগে যেমন ছিলে তেমনই হবে। তোমার অহংকারের দিনে তুমি তোমার বোন সাদুমকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে; তখন তোমার দুষ্টতা প্রকাশ পায় নি। এখন সিরিয়ার মেয়েরা ও তার প্রতিবেশীরা, ফিলিস্তিনীদের মেয়েরা, অর্থাৎ তোমার চারপাশের যারা তোমাকে ঘৃণা করে তারা সবাই তোমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে। তুমি তোমার কুকর্ম ও জঘন্য কাজকর্মের ফল বহন করবে। “তোমার কাজ অনুসারেই আমি তোমার সংগে ব্যবহার করব, কারণ তুমি আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা ভেংগে আমার কসম তুচ্ছ করেছ। তবুও তোমার অল্প বয়সে তোমার জন্য আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম তা আমি মনে করব এবং তোমার জন্য একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা স্থাপন করব। আমি তোমার মেয়ে হিসাবে তোমার বড় ও ছোট বোনদের তোমাকে দেব আর তুমি তাদের গ্রহণ করবে, যদিও তারা আমার ব্যবস্থার মধ্যে নেই। তখন তুমি তোমার চালচলনের কথা মনে করে লজ্জিত হবে। আমি তোমার জন্য আমার ব্যবস্থা স্থাপন করব, আর তুমি জানবে যে, আমিই মাবুদ। আমি যখন তোমার সব অন্যায় মাফ করব তখন তুমি সেই সব অন্যায় কাজের কথা মনে করে লজ্জিত হবে এবং তোমার অসম্মানের জন্য আর কখনও মুখ খুলবে না। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের বল যে, তারপর সে কিছু বীজ উর্বর মাটিতে লাগিয়ে দিল। প্রচুর পানির ধারে উইলো গাছের মত করে সে তা লাগিয়ে দিল। সেটা গজিয়ে উঠে মাটিতে ছড়িয়ে পড়া একটা লতা হল। সেই লতার ডগাগুলো ঐ ঈগলের দিকে ফিরল, আর তার শিকড়গুলো রইল মাটির গভীরে। এইভাবে সেই লতা বড় হল এবং তাতে পাতা সুদ্ধ অনেক ডগা বের হল। “ ‘কিন্তু সেখানে পালখে ঢাকা বড় ডানাযুক্ত আর একটা বড় ঈগল ছিল। সেই লতা পানি পাবার জন্য তার শিকড় ও ডগাগুলো সেখান থেকে সেই ঈগলের দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রচুর পানির পাশে ভাল মাটিতে তাকে লাগানো হয়েছিল যাতে সে অনেক ডগা বের করতে পারে, ফল ধরাতে পারে ও সুন্দর লতা হয়ে উঠতে পারে।’ “তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘সে কি বেড়ে উঠবে? সে যাতে শুকিয়ে যায় সেইজন্য কি তাকে উপ্‌ড়ে ফেলে তার ফলগুলো ফেলে দেওয়া হবে না? তার নতুন গজানো ডগা সব শুকিয়ে যাবে। তার শিকড় ধরে তুলে ফেলবার জন্য কোন শক্তিশালী হাত বা অনেক লোক লাগবে না। যদিও তাকে ভালভাবে লাগানো হয়েছিল তবুও সে বেঁচে থাকবে না। যে জমিতে সে বেড়ে উঠেছিল সেখানে পূবের বাতাসের আঘাতে সে একেবারে শুকিয়ে যাবে।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি এই বিদ্রোহী জাতিকে বল, ‘এই সব বিষয়ের মানে কি তা কি তোমরা জান না? ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ জেরুজালেমে এসে তার বাদশাহ্‌ ও রাজপুরুষদের ধরে ব্যাবিলনে নিয়ে গেল। কিন্তু সেই শাসনকর্তা ঘোড়া ও একটা বড় সৈন্যদল পাবার জন্য মিসরে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়ে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। সে কি সফল হবে? যে এই সব কাজ করে সে কি রেহাই পাবে? কসম ভেংগে ফেললে কি সে রক্ষা পাবে? “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি, তাকে যে বাদশাহ্‌ সিংহাসনে বসাল, যার কসমকে সে তুচ্ছ করল, আর যার চুক্তি সে ভেংগে ফেলল সে সেই বাদশাহ্‌র দেশ ব্যাবিলনে মারা যাবে। যুদ্ধের সময় যখন অনেক জীবন ধ্বংস করবার জন্য উঁচু ঢিবি ও ঢালু ঢিবি তৈরী করা হবে তখন ফেরাউনের শক্তিশালী মস্ত বড় সৈন্যদল তাকে সাহায্য করবে না। সে তো চুক্তি ভেংগে ফেলে কসম তুচ্ছ করেছে। সে অধীনতার চুক্তি করেও এই সব কাজ করেছে বলে রেহাই পাবে না। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, সে আমার নামে কসম খেয়ে তা তুচ্ছ করেছে এবং অধীনতার চুক্তি ভেংগেছে বলে তার ফল আমি তাকে দেব। আমি তার জন্য আমার জাল পাতব এবং সে আমার ফাঁদে ধরা পড়বে। সে আমার প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছে বলে আমি তাকে ব্যাবিলনে নিয়ে যাব এবং সেখানে তাকে শাস্তি দেব। তার সেরা সৈন্যেরা যুদ্ধে মারা যাবে আর বাদবাকী সৈন্যেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তখন তোমরা জানবে যে, আমি মাবুদই এই কথা বলেছি।’ ” আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “আমি নিজেই এরস গাছের মাথা থেকে একটা কচি আগা নিয়ে পাহাড়ের উঁচু চূড়ার উপর লাগিয়ে দেব। ইসরাইলের উঁচু পাহাড়ের উপরে তা থেকে ডালপালা বের হয়ে ফল ধরবে; সেটা একটা চমৎকার এরস গাছ হয়ে উঠবে। সব রকমের পাখী তার ডালপালার মধ্যে বাসা করবে এবং তার ছায়ায় বাস করবে। এতে মাঠের সব গাছপালা জানবে যে, আমি মাবুদই উঁচু গাছকে নীচু করি এবং নীচু গাছকে উঁচু করি। আমিই সবুজ গাছকে শুকনা করি এবং শুকনা গাছকে জীবিত করি। “আমি মাবুদই এই কথা বলেছি এবং আমি তা করব।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “ইসরাইল দেশে তোমরা এই যে চলতি কথাটা বল তার মানে কি, ‘বাবারা টক আংগুর খেয়েছে কিন্তু সন্তানদের দাঁত টকে গেছে’? “আমার জীবনের কসম যে, ইসরাইল দেশে আর এই চলতি কথাটা বলা হবে না। জীবিত সব লোকই আমার, বাবা ও ছেলে দুই-ই আমার। যে গুনাহ্‌ করবে সে-ই মরবে। “ধর, একজন সৎ লোক ন্যায় ও ঠিক কাজ করে। সে পাহাড়ের উপরের কোন পূজার স্থানে খাওয়া-দাওয়া করে না, কিংবা বনি-ইসরাইলদের কোন মূর্তির পূজা করে না। সে প্রতিবেশীর স্ত্রীকে নষ্ট করে না, কিংবা মাসিক হচ্ছে এমন স্ত্রীলোকের সংগে সহবাস করে না। সে কাউকে জুলুম করে না বরং ঋণীকে বন্ধকী জিনিস ফিরিয়ে দেয়। সে চুরি করে না, কিন্তু যাদের খিদে পেয়েছে তাদের খেতে দেয় এবং উলংগদের কাপড় দেয়। সে সুদে টাকা ধার দেয় না কিংবা বাড়তি সুদ নেয় না। সে অন্যায় করা থেকে হাত সরিয়ে রাখে ও লোকদের মধ্যে ন্যায়ভাবে বিচার করে। সে আমার নিয়ম-কানুন মত চলে এবং বিশ্বস্তভাবে আমার শরীয়ত পালন করে। এই লোক সত্যিই সৎ; সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। সে গরীব ও অভাবীদের জুলুম করে। সে চুরি করে এবং বন্ধকী জিনিস ফিরিয়ে দেয় না। সে মূর্তিপূজা করে এবং জঘন্য কাজকর্ম করে। সে সুদে টাকা ধার দেয় এবং বাড়তি সুদ নেয়। সেই ছেলে কি বাঁচবে? সে বাঁচবে না। এই সব জঘন্য কাজ করেছে বলে সে মরবেই মরবে। সে তার মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী হবে। “আবার ধর, সেই ছেলের একটা ছেলে আছে। সে তার বাবাকে এই সব গুনাহ্‌ করতে দেখেও তা করে না। সে গরীবদের জুলুম করে না এবং কোন রকম সুদ নেয় না। সে আমার শরীয়ত রক্ষা করে এবং আমার নিয়ম-কানুন পালন করে। সে তার বাবার গুনাহের জন্য মরবে না; সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। কিন্তু তার বাবা তার নিজের গুনাহের জন্য মরবে, কারণ সে জোর করে টাকা আদায় করত, ভাইয়ের জিনিস চুরি করত এবং তার লোকদের মধ্যে অন্যায় কাজ করত। “তবুও তোমরা বলছ, ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’ সেই ছেলে তো ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে এবং আমার সমস্ত নিয়ম-কানুন যত্নের সংগে পালন করেছে, তাই সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। যে গুনাহ্‌ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। “কিন্তু যদি একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ্‌ থেকে ফিরে আমার সব নিয়ম-কানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। সে যে সব অন্যায় করেছে তা আমি আর মনে রাখব না। সে যে সব সৎ কাজ করেছে তার জন্যই সে বাঁচবে। দুষ্ট লোকের মরণে কি আমি খুশী হই? বরং সে যখন তার কুপথ থেকে ফিরে এসে বাঁচে তখনই আমি খুশী হই। “কিন্তু যদি একজন সৎ লোক তার সততা থেকে ফিরে গুনাহ্‌ করে এবং দুষ্ট লোকের মত জঘন্য কাজ করে তবে সে কি বাঁচবে? তার কোন সৎ কাজই তখন আমি মনে করব না। তার বেঈমানী ও গুনাহের জন্যই সে মরবে। “তবুও তোমরা বলছ, ‘মাবুদের পথ ঠিক নয়।’ হে বনি-ইসরাইলরা, শোন। আমার পথ কি অন্যায়ের পথ? না, বরং তোমাদের পথই অন্যায়ের পথ। যদি একজন সৎ লোক তার সততা থেকে ফিরে গুনাহ্‌ করে আর মরে, তবে সে তার গুনাহের দরুনই মরবে। কিন্তু যদি একজন দুষ্ট লোক তার দুষ্টতা থেকে ফিরে ন্যায় ও সৎ কাজ করে, তবে সে তার প্রাণ বাঁচাবে। তার অন্যায়ের কথা চিন্তা করে তা থেকে ফিরেছে বলে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। তবুও তোমরা বলছ, ‘মাবুদের পথ ঠিক নয়।’ হে বনি-ইসরাইলরা, আমার পথ কি অন্যায়ের? অন্যায়ের পথ তো তোমাদেরই। “সেইজন্য হে বনি-ইসরাইলরা, আমি তোমাদের প্রত্যেকের আচার-ব্যবহার অনুসারে বিচার করব। তোমরা ফেরো, তোমাদের সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে তওবা কর; তাহলে গুনাহের জন্য তোমরা ধ্বংস হবে না। তোমাদের সমস্ত অন্যায় তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে দূর কর এবং তোমাদের দিল ও মন নতুন করে গড়ে তোল। কেন তোমরা মরবে? আমি কারও মৃত্যুতে খুশী হই না। তোমরা তওবা করে বাঁচ। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি ইসরাইলের শাসনকর্তাদের জন্য বিলাপ করে বল, ‘সিংহদের মধ্যে তোমার মা ছিল সেরা সিংহী। সে যুব সিংহদের মধ্যে শুয়ে থাকত; তার বাচ্চাদের সে লালন-পালন করত। তার একটা বাচ্চা বড় হয়ে শক্তিশালী সিংহ হয়ে উঠল। সে পশু শিকার করতে শিখল আর মানুষ খেতে লাগল। জাতিরা তার বিষয় শুনতে পেল; সে তাদের গর্তে ধরা পড়ল। তারা তার নাকে কড়া লাগিয়ে মিসর দেশে নিয়ে গেল। “ ‘সেই সিংহী দেখল তার আশা পূর্ণ হল না; সে যা চাইছিল তা হল না; তখন সে তার আর একটা বাচ্চা নিয়ে তাকে শক্তিশালী করে তুলল। সেই বাচ্চা সিংহদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে একটা শক্তিশালী সিংহ হয়ে উঠল। সে পশু শিকার করতে শিখল আর মানুষ খেতে লাগল। সে তাদের কেল্লাগুলো ভাঙ্গল আর শহর সব ধ্বংস করে ফেলল। তার গর্জনে দেশের সকলেই ভয় পেল। তখন তার চারপাশের জাতিরা তার বিরুদ্ধে আসল। তারা তার জন্য তাদের জাল পাতল, আর সে তাদের গর্তে ধরা পড়ল। নাকে কড়া লাগিয়ে তারা তাকে খাঁচায় রাখল আর ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গেল। তারা তাকে কেল্লায় বন্ধ করে রাখল; ইসরাইলের পাহাড়ে পাহাড়ে তার গর্জন আর শোনা গেল না। “ ‘তোমার মা পানির ধারে লাগানো একটা আংগুর গাছের মত; প্রচুর পানি পাবার দরুন তা ছিল ফল ও ডালপালায় ভরা। তার ডালগুলো ছিল শক্ত, শাসনকর্তার রাজদণ্ড হওয়ার উপযুক্ত। সেই গাছটা উঁচু হয়ে যেন মেঘ ছুঁলো; সেইজন্য তার পাতা-ভরা ডালপালা সহজে নজরে পড়ল। কিন্তু মাবুদ তাঁর রাগে সেটা উপ্‌ড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। পূবের বাতাসে সেটা কুঁকড়ে গেল, তার ফল ঝরে পড়ল; তার শক্ত ডালগুলো ভেংগে শুকিয়ে গেল, আর আগুন তা পুড়িয়ে ফেলল। এখন সেটাকে মরুভূমিতে, শুকনা, পানিহীন দেশে লাগানো হয়েছে। তার গুঁড়ি থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল; তার ডাল ও ফল পুড়ে গেল। শাসনকর্তার রাজদণ্ড হবার উপযুক্ত কোন শক্ত ডালই তাতে রইল না।’ “এটা একটা বিলাপ; দুঃখের কাওয়ালী হিসাবে এটা ব্যবহার করা হবে।” সপ্তম বছরের পঞ্চম মাসের দশ দিনের দিন ইসরাইলের কয়েকজন বৃদ্ধ নেতা মাবুদের ইচ্ছা জানবার জন্য এসে আমার সামনে বসলেন। তখন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, তুমি ইসরাইলের বৃদ্ধ নেতাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমরা কি আমার ইচ্ছা জানতে এসেছ? আমার জীবনের কসম, আমি তোমাদের আমার ইচ্ছা জানতে দেব না।’ “হে মানুষের সন্তান, তুমি কি তাদের বিচার করবে? তাহলে তাদের পূর্বপুরুষদের জঘন্য আচার-ব্যবহারের কথা তাদের জানাও। তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘যেদিন আমি ইসরাইলকে বেছে নিয়েছিলাম সেই দিন ইয়াকুবের বংশের লোকদের কাছে কসম খেয়েছিলাম ও মিসরে তাদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছিলাম। আমি কসম খেয়ে তাদের বলেছিলাম যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। সেই দিন আমি তাদের কাছে আরও কসম খেয়েছিলাম যে, মিসর দেশ থেকে তাদের বের করে তাদের জন্য যে দেশ আমি ঠিক করেছি সেই দেশে তাদের নিয়ে যাব। সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই; সেটা সব দেশের মধ্যে সেরা। আমি তাদের বলেছিলাম, যে সব জঘন্য মূর্তি তাদের কাছে ভাল লেগেছে তা যেন তারা প্রত্যেকে দূর করে দেয় এবং মিসরের মূর্তিগুলো দিয়ে নিজেদের নাপাক না করে, কারণ আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। “ ‘কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, আমার কথা শুনতে রাজী হল না। যে সব জঘন্য মূর্তি তাদের কাছে ভাল লাগত তা তারা দূর করল না এবং মিসরের মূর্তিগুলো ত্যাগ করল না। কাজেই আমি বললাম মিসরে আমি তাদের উপর আমার রাগ ও গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেব। কিন্তু আমার সুনাম রক্ষার জন্য আমি তা করি নি, যাতে তারা যে জাতিদের মধ্যে বাস করছিল তাদের কাছে আমার নাম অপবিত্র না হয়। মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে এনে সেই সব জাতির চোখের সামনে আমি বনি-ইসরাইলদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করলাম। আমি মিসর থেকে তাদের বের করে মরুভূমিতে আনলাম। আমি তাদের আমার নিয়ম দিলাম এবং আমার শরীয়ত তাদের জানালাম; যে তা পালন করবে সে তার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে। আমার ও তাদের মধ্যে চিহ্ন হিসাবে বিশ্রাম দিনগুলোও তাদের দিলাম যাতে তারা জানতে পারে যে, আমি মাবুদই তাদের পবিত্র করলাম। “ ‘কিন্তু ইসরাইলের লোকেরা মরুভূমিতে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। তারা আমার নিয়মগুলো পালন করল না এবং আমার যে শরীয়ত পালন করলে মানুষ জীবন পায় তা তারা অগ্রাহ্য করল; তারা আমার দেওয়া বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করল না। কাজেই আমি বললাম, আমি তাদের উপর আমার গজব ঢেলে দিয়ে মরুভূমিতেই তাদের ধ্বংস করে ফেলব। কিন্তু আমার সুনাম রক্ষার জন্য আমি তা করি নি, যাতে যে জাতিদের সামনে আমি তাদের বের করে এনেছিলাম তাদের কাছে আমার নাম অপবিত্র না হয়। এছাড়া সেই মরুভূমিতেই তাদের কাছে আমি কসম খেলাম যে, আমার দেওয়া দেশ- যে দেশে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই, যে দেশ সব দেশের মধ্যে সেরা- সেই দেশে আমি তাদের নিয়ে যাব না। তারা আমার শরীয়ত অগ্রাহ্য করেছে ও আমার নিয়মগুলো অমান্য করেছে এবং আমার দেওয়া বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করে নি, কারণ তাদের অন্তরের টান ছিল মূর্তিপূজার দিকে। তবুও আমি তাদের মমতার চোখে দেখে মরুভূমিতে তাদের একেবারে ধ্বংস করি নি। সেখানে তাদের ছেলেমেয়েদের আমি বললাম যে, তারা যেন তাদের পূর্বপুরুষদের মত কাজ না করে, তাদের আচার-ব্যবহার অনুসারে না চলে এবং তাদের মূর্তিগুলো দিয়ে নিজেদের নাপাক না করে। আমি তাদের আরও বললাম যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, তাই আমার নিয়মগুলো যেন তারা পালন করে এবং আমার শরীয়ত মেনে চলে। তারা যেন আমার দেওয়া বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করে; তাতে আমার ও তাদের মধ্যে তা একটা চিহ্ন হয়ে থাকবে, আর তারা জানতে পারবে যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। “ ‘কিন্তু সেই ছেলেমেয়েরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। তারা আমার নিয়মগুলো পালন করল না এবং যে শরীয়ত পালন করলে মানুষ জীবন পায় তারা আমার সেই শরীয়ত মেনে চলবার দিকে মনোযোগ দিল না; তারা আমার দেওয়া বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করল না। তাই আমি বললাম মরুভূমিতে আমি তাদের উপর আমার রাগ ও গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেব। কিন্তু আমার হাত আমি সরিয়ে রাখলাম এবং আমার সুনাম রক্ষার জন্য আমি তা করি নি যাতে যে সব জাতিদের সামনে আমি তাদের বের করে এনেছিলাম তাদের কাছে আমার নাম অপবিত্র না হয়। তা ছাড়া মরুভূমিতে আমি তাদের কাছে কসম খেয়েছিলাম যে, নানা জাতি ও দেশের মধ্যে আমি তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেব, কারণ তারা আমার শরীয়ত পালন করে নি, আমার নিয়মগুলো অগ্রাহ্য করেছে, আমার দেওয়া বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করে নি, আর তাদের পূর্বপুরুষদের মূর্তিগুলো তাদের কাছে ভাল লেগেছে। সেইজন্য যে সব নিয়ম ভাল নয় এবং যে শরীয়তের মধ্য দিয়ে তারা জীবন পাবে না সেই সবের হাতে আমি তাদের ছেড়ে দিলাম। প্রথমে জন্মেছে এমন প্রত্যেকটি সন্তানকে তারা আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী দিয়েছে, আর তার মধ্য দিয়েই আমি তাদের নাপাক হতে দিলাম যেন আমি তাদের ধ্বংস করতে পারি। তখন তারা জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।’ “কাজেই হে মানুষের সন্তান, তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমাদের পূর্বপুরুষেরা বেঈমানীর কাজ করে আমাকে কুফরী করেছে। যে দেশ দেবার কসম আমি তাদের কাছে খেয়েছিলাম সেখানে নিয়ে যাবার পর যখন তারা কোন উঁচু পাহাড় বা ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছ দেখল সেখানে তারা তাদের পশু-কোরবানী দিতে লাগল। সেই কোরবানী দিয়ে তারা আমার রাগ জাগিয়ে তুলল। এছাড়া তারা সেখানে তাদের খোশবু-ধূপ জ্বালাল এবং ঢালন-কোরবানী করল। তখন আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম সেই সব উঁচু স্থানে তারা কেন যায়।’ ” আজও সেই সব জায়গার নাম রয়েছে “পূজার উঁচু স্থান।” কাজেই মাবুদ আমাকে বললেন, “তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমরা কি তোমাদের পূর্বপুরুষদের মত করে নিজেদের নাপাক করবে এবং তাদের জঘন্য মূর্তিগুলোর পূজা করবে? আজও পর্যন্ত যখন তোমরা মূর্তির সামনে তোমাদের ছেলেমেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী দাও তখন সেই সব মূর্তি দিয়ে তোমরা নিজেদের নাপাক করে থাক। হে বনি-ইসরাইলরা, আমি কি তোমাদের আমার ইচ্ছা জানতে দেব? আমার জীবনের কসম যে, আমি কিছুতেই আমার ইচ্ছা তোমাদের জানতে দেব না। “ ‘তোমরা বলে থাক যে, তোমরা দুনিয়ার অন্যান্য জাতির লোকদের মত হতে চাও যারা কাঠ ও পাথরের পূজা করে। কিন্তু তোমাদের মনে যা আছে তা কখনও হবে না। আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, আমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে গজব ঢেলে দিয়ে আমি তোমাদের উপরে রাজত্ব করব। আমার শক্তিশালী হাত বাড়িয়ে গজব ঢেলে দিয়ে নানা জাতির মধ্য থেকে আমি তোমাদের নিয়ে আসব এবং যে সব দেশে তোমাদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে তোমাদের একত্র করব। জাতিদের মরুভূমিতে তোমাদের মুখোমুখি হয়ে আমি তোমাদের বিচার করব। মিসর দেশের মরুভূমিতে আমি যেমন তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিচার করেছিলাম তেমনি তোমাদেরও বিচার করব। আমার লাঠির নীচ দিয়ে তোমাদের যেতে হবে; আমার ব্যবস্থার বাঁধন দিয়ে আমি তোমাদের বাঁধব। তোমাদের মধ্যে যারা আমার বিরুদ্ধে থাকে ও বিদ্রোহ করে আমি তাদের দূর করে দেব। তারা যে দেশে বাস করছে যদিও সেখান থেকে আমি তাদের বের করে আনব তবুও তারা ইসরাইল দেশে ঢুকতে পারবে না। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘হে বনি-ইসরাইলরা, আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, যাও, তোমরা প্রত্যেকে গিয়ে তোমাদের মূর্তিগুলোর সেবা কর। কিন্তু পরে আমার কথা তোমরা অবশ্যই শুনবে এবং তখন তোমরা তোমাদের উপহার ও মূর্তি দিয়ে আর আমার পবিত্র নাম অপবিত্র করবে না। তখন দেশের মধ্যে আমার পবিত্র পাহাড়ের উপরে, ইসরাইলের উঁচু পাহাড়ের উপরে ইসরাইলের সমস্ত লোক আমার এবাদত করবে এবং সেখানে আমি তাদের কবুল করব। সেখানে আমি তোমাদের সব পবিত্র কোরবানী, দান ও ভাল ভাল উপহার দাবি করব। আমি যখন জাতিদের মধ্য থেকে তোমাদের বের করে আনব এবং যে সব দেশে তোমরা ছড়িয়ে পড়েছ সেখান থেকে একত্র করব তখন খোশবু ধূপের মত আমি তোমাদের কবুল করব। তখন তোমাদের মধ্য দিয়ে জাতিরা বুঝতে পারবে যে, আমি পবিত্র। তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যে দেশ দেবার কসম আমি খেয়েছিলাম সেই ইসরাইল দেশে তোমাদের নিয়ে যাবার পর তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। সেখানে তোমাদের আগের আচার-ব্যবহারের কথা ও যে সব কাজের দ্বারা তোমরা নিজেদের নাপাক করেছিলে তা মনে করবে এবং তোমাদের সমস্ত খারাপ কাজের জন্য নিজেরা নিজেদের ঘৃণা করবে। হে বনি-ইসরাইলরা, আমি তোমাদের খারাপ আচার-ব্যবহার এবং খারাপ কাজ অনুসারে তোমাদের সংগে ব্যবহার করব না, কিন্তু নিজের সুনাম রক্ষার জন্য তোমাদের সংগে ভাল ব্যবহার করব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তোমার মুখ তুমি দক্ষিণ দিকে রেখে সেই দেশের বিরুদ্ধে কথা বল এবং সেখানকার বনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল। তুমি দক্ষিণের বনকে আমার কালাম শুনতে বল। তাকে বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আমি তোমার মধ্যে আগুন জ্বালাতে যাচ্ছি এবং তা তোমার সব কাঁচা ও শুকনা গাছপালা পুড়িয়ে ফেলবে। সেই জ্বলন্ত আগুন নিভবে না এবং দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত সমস্ত লোক তাতে ঝল্‌সে যাবে। প্রত্যেকে দেখবে যে, আমি মাবুদই তা জ্বালিয়েছি; তা নিভবে না।’ ” তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, লোকেরা আমার বিষয়ে বলছে যে, আমি কেবল গল্প কথাই বলছি।” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তোমার মুখ তুমি জেরুজালেমের দিকে রেখে বায়তুল-মোকাদ্দসের বিরুদ্ধে কথা বল ও ইসরাইল দেশের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল। তাকে বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘আমি তোমার বিরুদ্ধে। আমি খাপ থেকে আমার তলোয়ার বের করে তোমার মধ্য থেকে সৎ ও দুষ্ট সবাইকে মেরে ফেলব। সৎ ও দুষ্ট সবাইকে মেরে ফেলবার জন্য আমার তলোয়ার খাপ থেকে বের হয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত সমস্ত লোককে মেরে ফেলবে। তখন সব লোক জানবে যে, আমি মাবুদই খাপ থেকে তলোয়ার বের করেছি; তা আর ফিরবে না।’ “সেইজন্য হে মানুষের সন্তান, তুমি কাত্‌রাও, ভাংগা দিল ও গভীর দুঃখে তাদের সামনে কাত্‌রাও। তারা যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘কেন কাত্‌রা"ছ?’ তুমি বলবে, ‘যে সংবাদ আসছে তার জন্য কাত্‌রাচ্ছি। সেই সময় সকলের দিল গলে যাবে এবং সকলের হাত নিসে-জ হবে; সকলের মন মুষ্‌ড়ে পড়বে ও সকলের হাঁটু দুর্বল হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন যে, তা আসছে; তা হবেই হবে।’ ” মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘একটা তলোয়ার! ধার দেওয়া ও পালিশ করা একটা তলোয়ার! কেটে ফেলবার জন্য তা ধার দেওয়া হয়েছে, তা পালিশ করা হয়েছে এবং তা বিদ্যুতের মত ঝক্‌মক করছে।’ ” বনি-ইসরাইলরা বলছে, “এহুদার রাজদণ্ড নিয়ে আমরা আনন্দ করব; সেই রাজদণ্ড সমস্ত লাঠিকে তুচ্ছ করছে।” মাবুদ বলছেন, “তলোয়ারটা পালিশ করা হয়েছে যেন তা ব্যবহার করা যায়; যে মেরে ফেলবে তার হাতে দেবার জন্য ওটা ধার দেওয়া ও পালিশ করা হয়েছে। হে মানুষের সন্তান, কাঁদ ও বিলাপ কর, কারণ সেই তলোয়ার আমার বান্দাদের বিরুদ্ধে এবং ইসরাইলের সমস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। আমার বান্দাদের সংগে তাদেরও তলোয়ারের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে। কাজেই তুমি বুক চাপড়াও। এই পরীক্ষা আসবেই আসবে। এহুদার বাদশাহ্‌ যদি আমার শাস্তিকে তুচ্ছ করে তবে কি সে টিকে থাকতে পারবে? “কাজেই হে মানুষের সন্তান, তুমি ভবিষ্যদ্বাণী বল আর হাতে হাত দিয়ে আঘাত কর। সেই তলোয়ার দু’বার, এমন কি, তিনবার আঘাত করুক। এই তলোয়ার কাটবার জন্য, অনেককে কাটবার জন্যই একটা তলোয়ার; তা চারপাশ থেকে তাদের উপর চেপে আসবে। কেটে ফেলবার জন্য তাদের সব দরজায় দরজায় আমি তলোয়ার বসিয়েছি যাতে তাদের দিল সব গলে যায় এবং অনেকে মারা পড়ে। জ্বী, সেই তলোয়ার বিদ্যুতের মত চম্‌কায়; তা কেটে ফেলবার জন্য ধার দেওয়া হয়েছে। ওহে ধারালো তলোয়ার, ডান দিকে আঘাত কর, তারপর বাঁদিকে কর, যেদিকে তোমার ফলা ঘুরানো যায় সেই দিকেই আঘাত কর। আমিও হাতে হাত দিয়ে আঘাত করব আর আমার রাগ শান্ত হবে। আমি মাবুদই এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র তলোয়ার যাবার জন্য দু’টা রাস্তায় চিহ্ন দাও, সেই দু’টা রাস্তাই এক দেশ থেকে বের হবে। যেখানে রাস্তা ভাগ হয়ে শহরের দিকে গেছে সেখানে পথ নির্দেশ-করা খুঁটি দাও। তলোয়ারের জন্য অম্মোনীয়দের রব্বা শহরের বিরুদ্ধে যাবার একটা রাস্তায় এবং এহুদা ও দেয়াল-ঘেরা জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যাবার অন্য একটা রাস্তায় চিহ্ন দাও, কারণ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ গোণা-পড়া করবার জন্য সেখানে থামবে যেখানে রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে, অর্থাৎ দুই রাস্তা যেখানে মিলেছে। সে তীর ছুঁড়বে, তার দেবতাদের সংগে পরামর্শ করবে এবং কোন পশুর কলিজা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে। তার ডান হাতে থাকা গোণা-পড়া করবার জিনিস জেরুজালেমের দিকের পথ দেখিয়ে দেবে; সেখানে সে দেয়াল ও দরজা ভাংবার যন্ত্র বসাবে, হত্যা করবার হুকুম দেবে, যুদ্ধের হাঁক দেবে, ঢালু ঢিবি ও উঁচু ঢিবি তৈরী করবে। জেরুজালেমের যে লোকেরা ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র অধীনে থাকবার কসম খেয়েছিল তাদের কাছে এই গোণা-পড়া মিথ্যা মনে হবে, কিন্তু তাদের দোষের কথা সে তাদের মনে করিয়ে দেবে এবং তাদের বন্দী করে নিয়ে যাবে। “আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, তোমরা খোলাখুলিভাবে গুনাহ্‌ করে তোমাদের দোষ দেখিয়ে দিয়েছ; তোমাদের সব কাজে তোমাদের অন্যায় প্রকাশ পাচ্ছে। তার ফলে তোমাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে। “ওহে অপবিত্র ও দুষ্ট ইসরাইলের বাদশাহ্‌, তোমার দিন উপস্থিত হয়েছে, তোমার শাস্তির সময় এসে গেছে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, তোমার পাগড়ী খোল, তাজ নামিয়ে ফেল। যেমন ছিল তেমন আর হবে না। ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট করা হবে। ধ্বংস! ধ্বংস! আমি এই সব ধ্বংস করে দেব! যাঁর সত্যিকারের অধিকার আছে তিনি না আসা পর্যন্ত এগুলো আর থাকবে না। আমি তাঁকেই এই সব দেব। “হে মানুষের সন্তান, তুমি ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, অম্মোনীয়দের বিষয়ে ও তাদের করা অপমানের বিষয়ে আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘একটা তলোয়ার, একটা তলোয়ার খোলা হয়েছে; তা মেরে ফেলবার জন্য পালিশ করা হয়েছে যেন তা গ্রাস করে ও বিদ্যুতের মত চম্‌কায়। হে তলোয়ার, তোমার বিষয়ে মিথ্যা দর্শন পেলেও এবং মিথ্যা গোণা-পড়া করলেও যাদের মেরে ফেলা হবে সেই দুষ্টদের গলার উপর তোমাকে রাখা হবে; তাদের দিন এসে পড়েছে, তাদের শাস্তির সময় এসে গেছে। হে অম্মোনীয়রা, তোমাদের তলোয়ার খাপে রাখ। যে জায়গায় তোমাদের সৃষ্টি, তোমাদের সেই পূর্বপুরুষদের দেশে আমি তোমাদের বিচার করব। আমার গজব আমি তোমাদের উপর ঢেলে দেব এবং তোমাদের বিরুদ্ধে আমার রাগের আগুনে ফুঁ দেব। আমি তোমাদের এমন নিষ্ঠুর লোকদের হাতে তুলে দেব যারা ধ্বংস করবার কাজে পাকা। তোমরা আগুনের জন্য কাঠের মত হবে। তোমাদের রক্ত তোমাদের দেশের মধ্যেই পড়বে এবং তোমাদের ভুলে যাওয়া হবে। আমি মাবুদই এই কথা বলেছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি কি বিচার করতে প্রস্তুত? তাহলে তুমি রক্তপাতের এই শহরের বিচার কর। তুমি তার সব জঘন্য কাজকর্মের কথা তাকে জানাও। তুমি বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘এ সেই শহর, যে নিজের মধ্যে রক্তপাত করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে এবং মূর্তি তৈরী করে নিজেকে নাপাক করে। রক্তপাত করে তুমি দোষী হয়েছ এবং মূর্তি তৈরী করে নাপাক হয়েছ। তুমি তোমার দিন কাছিয়ে এনেছ এবং তোমার শেষ কাল উপস্থিত হয়েছে। সেইজন্য জাতিদের কাছে আমি তোমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র করে তুলব এবং সমস্ত দেশের কাছে করব হাসির পাত্র। হে অশান্তিপূর্ণ জঘন্য শহর, যারা কাছে আছে আর যারা দূরে আছে তারা তোমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে। “ ‘দেখ, তোমার মধ্যেকার ইসরাইলের প্রত্যেক শাসনকর্তা রক্তপাত করবার জন্য কেমন করে তার ক্ষমতা ব্যবহার করছে। তোমার মধ্যেই লোকে মা-বাবাকে তুচ্ছ করছে, বিদেশীদের জুলুম করছে আর এতিম ও বিধবাদের সংগে অন্যায় ব্যবহার করছে। তুমি আমার পাক-পবিত্র জিনিসগুলো ঘৃণা করেছ ও আমার বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা কর নি। তোমার মধ্যে এমন এমন লোক আছে যারা অন্যের বদনাম রটিয়ে তাদের রক্তপাত করায়, পাহাড়ের উপরকার পূজার জায়গায় খাওয়া-দাওয়া করে ও খারাপ খারাপ কাজ করে। তোমার মধ্যে এমন এমন লোক আছে যারা সৎমায়ের সংগে জেনা করে, স্ত্রীলোকের মাসিকের সময়ে নাপাক থাকা কালে জোর করে তার সংগে সহবাস করে, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সংগে, ছেলের বউয়ের সংগে আর নিজের সৎবোনের সংগে জেনা করে। তোমার মধ্যে রক্তপাত করবার জন্য লোকে ঘুষ খায়; এছাড়া তারা বাড়তি সুদ নিয়ে থাকে এবং জুলুম করে প্রতিবেশীর কাছ থেকে অন্যায় লাভ করে। তুমি আমাকে ভুলে গেছ। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ ‘তুমি যে অন্যায় লাভ করেছ এবং তোমার মধ্যে যে রক্তপাত করেছ তার জন্য আমি নিশ্চয়ই আমার হাতে হাত দিয়ে আঘাত করব। আমি যেদিন তোমার কাছ থেকে হিসাব নেব সেই দিন কি তোমার সাহস থাকবে? তোমার হাতে কি জোর থাকবে? আমি মাবুদই এই কথা বললাম এবং আমি তা করবই। আমি তোমার লোকদের বিভিন্ন জাতি ও দেশের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেব এবং তোমার নাপাকী দূর করব। জাতিদের সামনে তুমি যখন অসম্মানিত হবে তখন তুমি জানবে যে, আমি মাবুদ।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, বনি-ইসরাইলরা আমার কাছে খাদের মত হয়েছে; তারা সবাই যেন রূপা খাঁটি করবার সময় চুলার ভিতরে খাদ হিসাবে পড়ে থাকা পিতল, দস্তা, লোহা ও সীসা। কাজেই আমি আল্লাহ্‌ মালিক তাদের বলছি, ‘তোমরা সবাই খাদ হয়ে গেছ বলে আমি জেরুজালেমে তোমাদের জমায়েত করব। লোকে যেমন করে রূপা, পিতল, লোহা, সীসা ও দস্তা জড়ো করে চুলায় দিয়ে গলাবার জন্য আগুনে ফুঁ দেয় তেমনি করে আমার রাগ ও গজবে আমি তোমাদের জড়ো করে শহরের মধ্যে রেখে গলাব। আমি তোমাদের জমায়েত করে আমার জ্বলন্ত রাগে ফুঁ দেব আর তোমরা শহরের মধ্যে গলে যাবে। চুলার মধ্যে যেমন রূপা গলে যায় তোমরাও তেমনি তার মধ্যে গলে যাবে। তখন তোমরা জানবে যে, আমি মাবুদই তোমাদের উপর আমার গজব ঢেলে দিয়েছি।’ ” আবার মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি দেশকে বল, ‘তুমি একটা নাপাক দেশ, তাই আমার রাগের দিনে তোমার উপর বৃষ্টি পড়বে না।’ সেই দেশের নবীরা ষড়যন্ত্র করে; তারা গর্জনকারী সিংহের মত শিকার ছেঁড়ে। তারা লোকদের গ্রাস করে, ধন-সম্পদ ও দামী দামী জিনিস নিয়ে নেয় এবং দেশের মধ্যে অনেক স্ত্রীলোককে বিধবা করে। তার ইমামেরা আমার শরীয়তের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং আমার পবিত্র জিনিসগুলো অপবিত্র করে। যা পবিত্র ও যা পবিত্র নয় তারা তা এক করে ফেলে; তারা পাক-পবিত্র ও নাপাকর মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেই বিষয়ে শিক্ষা দেয় না এবং আমার বিশ্রাম দিনগুলো পালন করবার ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখে। এতে তাদের মধ্যে আমার নামের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। নেকড়ে বাঘ যেমন করে শিকার ছেঁড়ে তেমনি করে সেখানকার রাজকর্মচারীরা রক্তপাত করে এবং অন্যায় লাভের জন্য মানুষ খুন করে। মিথ্যা দর্শন ও মিথ্যা গোণা-পড়া দিয়ে তাদের নবীরা তাদের ঐ সব কাজের উপর চুনকাম করে। মাবুদ না বললেও তারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছেন।’ দেশের লোকেরা জুলুম এবং ডাকাতি করে; তারা গরীব ও অভাবীদের উপর অন্যায় করে এবং ন্যায়বিচার না করে বিদেশীদের উপর জুলুম করে। “আমি তাদের মধ্যে এমন একজন লোকের তালাশ করলাম, যে দেয়ালটা গাঁথবে এবং দেশের পক্ষ হয়ে দেয়ালের ফাঁকের মধ্যে আমার সামনে দাঁড়াবে যাতে আমাকে দেশটা ধ্বংস করতে না হয়, কিন্তু কাউকে পেলাম না। কাজেই আমার গজব আমি তাদের উপর ঢেলে দেব এবং তাদের আচার-ব্যবহারের ফল তাদের মাথার উপর নামিয়ে দিয়ে আমার জ্বলন্ত রাগে আমি তাদের পুড়িয়ে ফেলব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, দু’টি স্ত্রীলোক ছিল যারা একই মায়ের মেয়ে। অল্প বয়স থেকে মিসর দেশে তারা বেশ্যাগিরি করত। সেই দেশেই লোকে তাদের বুক ধরে সোহাগ করে তাদের সতীত্ব নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে বড়টির নাম ছিল অহলা ও তার বোনের নাম ছিল অহলীবা। পরে তারা আমার হল এবং ছেলেমেয়েদের জন্ম দিল। অহলা হল সামেরিয়া আর অহলীবা হল জেরুজালেম। সব সেরা সেরা আশেরীয়দের কাছে সে নিজেকে বেশ্যা হিসাবে দান করেছিল; যাদের সে কামনা করত তাদের সমস্ত মূর্তি দিয়ে সে নিজেকে নাপাক করেছিল। মিসরে যে বেশ্যাগিরি সে শুরু করেছিল তা সে ছেড়ে দেয় নি; সেখানে তার অল্প বয়সেই লোকে তার সংগে শুয়ে তার সতীত্ব নষ্ট করেছে ও তাদের কামনা তার উপর ঢেলে দিয়েছে। “সেইজন্য আমি তাকে তার প্রেমিকদের হাতে, অর্থাৎ যাদের সে কামনা করত সেই আশেরীয়দের হাতে ছেড়ে দিলাম। তারা তাকে উলংগ করে তার ছেলেমেয়েদের কেড়ে নিয়ে তলোয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করল। তার শাস্তির বিষয় নিয়ে স্ত্রীলোকেরা বলাবলি করতে লাগল। “তার বোন অহলীবা এই সব দেখল, তবুও সে তার কামনা ও বেশ্যাগিরিতে তার বোনের চেয়ে আরও বেশী খারাপ হল। তারও আশেরীয়দের প্রতি কামনা হল; তারা ছিল শাসনকর্তা ও সেনাপতি; তারা সুন্দর পোশাক পরা যোদ্ধা ও ঘোড়সওয়ার; তারা সবাই সুন্দর যুবক। আমি দেখলাম সে-ও নিজেকে নাপাক করল; দু’জনে একই পথে গেল। “কিন্তু অহলীবা তার বেশ্যাগিরিতে আরও এগিয়ে গেল। সে দেয়ালের উপর লাল রংয়ে আঁকা ব্যাবিলনীয় পুরুষদের ছবি দেখল। কোমরে তাদের কোমর-বাঁধনি, মাথার উপর উড়ন্ত পাগড়ী; তারা সবাই দেখতে ব্যাবিলন দেশের সেনাপতিদের মত। তাদের দেখামাত্রই তাদের প্রতি তার কামনা জাগল এবং সে ব্যাবিলনে তাদের কাছে লোক পাঠাল। তাতে ব্যাবিলনীয়রা তার কাছে এসে তার সংগে বিছানায় গেল এবং জেনা করে তাকে নাপাক করল। তাদের দ্বারা নাপাক হবার পর সে তাদের ঘৃণা করতে লাগল। সে খোলাখুলিভাবেই যখন তার বেশ্যাগিরি চালাতে লাগল এবং তার উলংগতা প্রকাশ করল তখন আমি তাকে ঘৃণা করলাম, যেমন আমি তার বোনকে ঘৃণা করেছিলাম। যৌবনে যখন সে মিসরে বেশ্যা ছিল তখনকার দিনগুলো মনে করে সে আরও বেশী জেনা করতে লাগল। সেখানে সে এমন অস্বাভাবিক যৌনাচারী লোকদের কামনা করত যারা ছিল গাধা ও ঘোড়ার মতই কামুক। “হে অহলীবা, তোমার যৌবন কালে মিসরের লোকেরা তোমার বুক ধরে আদর করে তোমার সতীত্ব নষ্ট করেছিল; এখন তুমি আবার সেই লোকদের সংগে জেনা করতে চাও। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, তোমার যে সব প্রেমিকদের তুমি ঘৃণা করেছ আমি তাদেরই তোমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করব এবং চারদিক থেকে আমি তাদের তোমার বিরুদ্ধে নিয়ে আসব। তারা হল ব্যাবিলনীয়রা, সমস্ত ক্যালডীয়রা, পকোদ, শোয়া ও কোয়ার লোকেরা ও তাদের সংগে সমস্ত আশেরীয়রা। তারা সবাই সুন্দর যুবক; তারা সকলেই শাসনকর্তা, সেনাপতি, রথের কর্মচারী, উঁচু পদের লোক এবং ঘোড়সওয়ার। তারা অস্ত্রশস্ত্র, রথ, গাড়ি এবং লোকজনের মস্ত বড় একটা দল নিয়ে তোমার বিরুদ্ধে আসবে। তারা ছোট ও বড় ঢাল নিয়ে মাথা রক্ষার টুপি পরে তোমাকে ঘেরাও করবে। শাস্তি পাবার জন্য আমি তোমাকে তাদের হাতে তুলে দেব এবং তারা তাদের বিচারের নিয়ম অনুসারে তোমাকে শাস্তি দেবে। আমার দিলের জ্বালা আমি তোমার বিরুদ্ধেই কাজে লাগাব বলে তারা জ্বলন্ত রাগে তোমার সংগে ব্যবহার করবে। তারা তোমার নাক-কান কেটে দেবে এবং তোমার বাকী লোকদের হত্যা করবে। তারা তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবে, আর তোমার বাকী লোকেরা আগুনে পুড়ে মরবে। তারা তোমার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলবে ও তোমার সুন্দর গহনা নিয়ে নেবে। যে জেনা ও বেশ্যাগিরি তুমি মিসরে শুরু করেছিলে তা আমি এইভাবে বন্ধ করে দেব। তাতে তুমি ঐ লোকদের দিকে তাকাবে না এবং মিসরকে আর মনেও করবে না। “তুমি যাদের ঘৃণা কর, যাদের দিক থেকে তুমি ফিরেছ তাদের হাতেই আমি তোমাকে তুলে দেব। তুমি তোমার বোনের পথেই গেছ; কাজেই তার পেয়ালা আমি তোমার হাতে তুলে দেব। “আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, তোমার বোনের পেয়ালাতেই তুমি খাবে; পেয়ালাটা বড় ও গভীর। তাতে অনেকটা ধরে বলে তা থেকে খেয়ে তুমি ঘৃণা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র হবে। তুমি ভয় ও ধ্বংসের পেয়ালা থেকে খেয়ে, তোমার বোন সামেরিয়ার পেয়ালা থেকে খেয়ে মাতলামিতে ও দুঃখে পূর্ণ হবে। তুমি তাতে খাবে, চেটেপুটে খাবে; তুমি তা ভেংগে চুরমার করবে এবং নিজের বুক ছিঁড়ে ফেলবে। এই হল আমার বিচারের রায়। তুমি আমাকে ভুলে গেছ এবং তোমার পিছনে আমাকে ঠেলে দিয়েছ বলে তোমাকে তোমার জেনা ও বেশ্যাগিরির ফল ভোগ করতে হবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” এর পর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি কি অহলা আর অহলীবার বিচার করতে প্রস্তুত? তাহলে তুমি তাদের জঘন্য কাজকর্মের কথা তাদের জানাও। তারা জেনা করেছে আর তাদের হাতে রয়েছে রক্ত। তাদের মূর্তিগুলোর পূজা করে তারা জেনা করেছে; এমন কি, আমার জন্য জন্ম-দেওয়া ছেলেমেয়েদের তারা মূর্তিগুলোর খাবার হিসাবে আগুনে পুড়িয়ে কোরবানী দিয়েছে। এছাড়া সেই একই সময়ে তারা আমার ঘর নাপাক করেছে। তারা আমার বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করে নি। সেই একই দিনে তারা তাদের মূর্তিগুলোর কাছে তাদের ছেলেমেয়েদের জবাই করেছে ও আমার ঘরে ঢুকে তা অপবিত্র করেছে। তারা আমার ঘরের মধ্যেই এই কাজ করেছে। “এছাড়া অহলা ও অহলীবা দূর দেশ থেকে লোকদের আনবার জন্য লোক পাঠাল। সেই লোকেরা আসলে পর তারা তাদের জন্য গোসল করল, চোখে কাজল দিল এবং গহনা পরে নিজেদের সাজাল। তারপর তারা সুন্দর বিছানায় বসে তার সামনে একটা টেবিল পেতে তার উপর আমারই ধূপ ও তেল রাখল। “তাদের চারপাশে ছিল চিন্তাহীন, হৈ চৈ করা লোকদের গোলমাল। তাদের মধ্যে ছিল নীচমনা লোক আর মরুভূমির মদখোরেরা। তারা সেই দুই বোনের হাতে বালা পরাল আর তাদের মাথায় দিল সুন্দর তাজ। তখন জেনা করে দুর্বল হয়ে যাওয়া স্ত্রীলোকের বিষয়ে আমি বললাম, ‘এখন সেই লোকেরা বেশ্যা হিসাবেই তাকে ব্যবহার করুক এবং সে-ও তাদের সংগে জেনা করুক।’ লোকে যেমন বেশ্যার সংগে শোয় তেমনি করে তারা অহলা ও অহলীবার সংগে, সেই কামুক স্ত্রীলোকদের সংগে শুলো। কিন্তু সৎ লোকেরা জেনা ও রক্তপাতের পাওনা শাস্তি সেই স্ত্রীলোকদের দেবে, কারণ তারা জেনাকারিণী আর তাদের হাতে রয়েছে রক্ত। “তুমি তাদের বিরুদ্ধে একদল লোক নিয়ে যাও এবং ভয় ও লুটের হাতে তাদের তুলে দাও। সেই লোকেরা তাদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে এবং তলোয়ার দিয়ে তাদের টুকরা টুকরা করে কাটবে। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের হত্যা করবে এবং তাদের ঘর-বাড়ী পুড়িয়ে দেবে। “হে অহলা ও অহলীবা, এইভাবে আমি দেশের মধ্যে কুকাজ শেষ করে দেব যাতে সব স্ত্রীলোক সাবধান হতে পারে এবং তোমাদের মত কুকাজ না করে। তোমাদের কুকাজের ফল তোমাদেরই ভোগ করতে হবে এবং মূর্তিপূজার গুনাহের ফল বহন করতে হবে। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই আল্লাহ্‌ মালিক।” আমাদের বন্দীদশার নবম বছরের দশম মাসের দশম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, তুমি আজকের, আজকের তারিখের কথাই লিখে রাখ, কারণ আজকে ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ জেরুজালেম ঘেরাও করছে। এই বিদ্রোহী জাতির কাছে এই দৃষ্টান্তের কথা বল। তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হাঁড়ি চড়াও, হাঁড়ি চড়াও এবং তার মধ্যে পানি দাও। তার মধ্যে গোশ্‌তের টুকরা দাও, রান ও কাঁধের ভাল ভাল গোশ্‌তের টুকরা দাও। ভাল ভাল হাড় দিয়ে তা ভরতি কর। পাল থেকে সেরা ভেড়াটা নাও; হাঁড়ির নীচে কাঠ সাজাও; তা ভালভাবে ফুটিয়ে নিয়ে হাড়গুলো রান্না কর।’ “আল্লাহ্‌ মালিক আরও বলছেন, ‘ঘৃণ্য, সেই রক্তপাতকারী শহর! সে যেন একটা হাঁড়ি যাতে ময়লার স-র পড়ে গেছে, যা পরিষ্কার করা যায় না। গোশ্‌তগুলো বেছে বেছে না নিয়ে টুকরার পর টুকরা বের কর। সেই শহরের মধ্যে রক্তপাত করা হয়েছে। সেই রক্ত পাথরের উপর ঢালা হয়েছে; তা মাটিতে ঢালা হয় নি যেখানে ধুলায় তা ঢাকা পড়ত। রাগ খুঁচিয়ে তুলে যাতে প্রতিশোধ নেওয়া হয় সেইজন্য আমি সেই রক্ত পাথরের উপরে রেখেছি যেন সেটা ঢাকা না পড়ে।’ “আল্লাহ্‌ মালিক আবার বলছেন, ‘ঘৃণ্য, সেই রক্তপাতকারী শহর! আমিও কাঠ জড়ো করে উঁচু করব। তাই অনেক কাঠ সাজাও, আগুন জ্বালাও, মসলা মিশিয়ে গোশ্‌ত ভাল করে রান্না কর, হাড়গুলো পুড়ে যেতে দাও। তারপর খালি হাঁড়িটা কয়লার উপরে রাখ যেন তা গরম হয়, তার তামা পুড়ে লাল হয়, তার নাপাকী সব গলে যায় এবং তার ময়লার স-র পুড়ে যায়। কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই মিথ্যা হয়ে গেছে; তার ময়লার পুরু স-র পরিষ্কার করা যায় নি, সেইজন্য তা আগুনে ফেলে দাও। “ ‘হে জেরুজালেম, তোমার কুকাজই হল তোমার সেই নাপাকী। আমি তোমাকে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তোমার নাপাকী থেকে তুমি পরিষ্কার হলে না। তোমার বিরুদ্ধে আমার গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে না দেওয়া পর্যন্ত তুমি আর পরিষ্কার হবে না। আমার কাজ করবার সময় এসে গেছে। আমি তা করবই করব, মমতা করব না কিংবা নরমও হব না। তোমার আচার-ব্যবহার ও তোমার কাজ অনুসারে তোমার বিচার করা হবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আমি এক আঘাতেই তোমার কাছ থেকে তোমার চোখের মণিকে নিয়ে নিতে যাচ্ছি। তবুও তুমি বিলাপ কোরো না, কেঁদো না কিংবা চোখের পানি ফেলো না। তুমি নীরবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়বে। তুমি মৃতের জন্য শোক প্রকাশ কোরো না। তুমি পাগড়ী বেঁধো ও পায়ে চটি দিয়ো; তোমার মুখের নীচের অংশ ঢেকো না কিংবা লোকদের পাঠানো খাবার খেয়ো না।” আমি সকালবেলায় লোকদের সংগে কথা বললাম আর সন্ধ্যাবেলায় আমার স্ত্রী মারা গেলেন। পরদিন সকালে আমি মাবুদের হুকুম মত কাজ করলাম। তখন লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি যা করছেন আমাদের জন্য তার অর্থ কি? তা কি আমাদের বলবেন না?” তখন ইহিস্কেল যা করেছে তোমরাও তা-ই করবে। মুখের নীচের অংশটা তোমরা ঢাকবে না কিংবা লোকদের পাঠানো খাবার খাবে না। তোমাদের মাথায় তোমরা পাগড়ী বাঁধবে এবং পায়ে চটি দেবে। তোমরা বিলাপ করবে না বা কাঁদবে না, কিন্তু নিজের নিজের গুনাহের জন্য দুর্বল হয়ে যাবে এবং একে অন্যের কাছে কোঁকাবে। ইহিস্কেল তোমাদের কাছে একটা চিহ্নের মত হবে; সে যা করেছে তোমরা ঠিক তা-ই করবে। যখন এটা ঘটবে তখন তোমরা জানবে যে, আমিই আল্লাহ্‌ মালিক।” মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, যেদিন আমি তাদের সেই শক্তির অহংকার, তাদের আনন্দ ও গৌরব, তাদের চোখের সুখ, তাদের দিলের চাওয়া এবং তাদের ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে নেব, সেই দিন একজন পালিয়ে আসা লোক তোমাকে খবর দিতে আসবে। সেই সময় তোমার মুখ খুলে যাবে; তুমি তার সংগে কথা বলবে, তোমার জিভ্‌ আর আট্‌কানো থাকবে না। এইভাবে তুমি তাদের কাছে একটা চিহ্ন হবে আর তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, অম্মোনীয়দের দিকে তোমার মুখ রেখে তাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল। আল্লাহ্‌ মালিকের এই কালাম তাদের শুনতে বল, ‘আমার ঘর নাপাক হতে দেখে ও ইসরাইল দেশকে পতিত জমি হতে দেখে এবং এহুদার লোকদের বন্দী হিসাবে নিয়ে যেতে দেখে তোমরা বেশ খুশী হয়েছিলে। সেইজন্য আমি পূর্বদেশের লোকদের হাতে তোমাদের তুলে দেব। তারা তোমাদের দেশে তাদের তাম্বু খাটিয়ে তোমাদের মধ্যে বাস করবে; তারা তোমাদের ফল ও দুধ খাবে। আমি রব্বা শহরকে করব উটের চারণ ভূমি ও অম্মোন দেশকে করব ভেড়ার বিশ্রামস্থান। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। তোমরা ইসরাইল দেশের অবস্থা দেখে হাততালি দিয়েছ, নেচেছ এবং দিলের সংগে তাকে হিংসা করে আনন্দ করেছ। সেইজন্য তোমাদের বিরুদ্ধে আমি আমার হাত বাড়াব এবং লুটের মাল হিসাবে অন্য জাতিদের হাতে তোমাদের তুলে দেব। অন্যান্য জাতি ও দেশের মধ্য থেকে আমি তোমাদের ছেঁটে ফেলে ধ্বংস করে দেব। তাতে তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” পরে আল্লাহ্‌ মালিক বললেন, “মোয়াব ও সেয়ীর বলেছে, ‘দেখ, এহুদার লোকেরা অন্যান্য সব জাতিদের মত হয়ে গেছে।’ সেইজন্য আমি মোয়াবের এক দিকের সীমানা খুলে দেব। তাতে মোয়াবের গৌরবের শহর বৈৎ-যিশীমোৎ, বাল-মিয়োন ও কিরিয়াথয়িম আক্রমণ করা হবে। পরে আল্লাহ্‌ মালিক বললেন, “ইদোম এহুদার লোকদের উপর বারবার প্রতিশোধ নিয়ে খুব অন্যায় করেছে। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, ইদোমের বিরুদ্ধে আমি আমার হাত বাড়াব এবং সেখানকার সমস্ত লোকজন ও পশু মেরে ফেলব। আমি সেটা ধ্বংসস্থান করে রাখব এবং তৈমন থেকে দদান পর্যন্ত লোকে যুদ্ধে মারা পড়বে। আমি আমার বান্দা ইসরাইলের হাত দিয়ে ইদোমের উপর প্রতিশোধ নেব আর তারা আমার রাগ ও গজব অনুসারে ইদোমের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তখন তারা জানতে পারবে যে, আমি প্রতিশোধ নিয়েছি।” পরে আল্লাহ্‌ মালিক বললেন, “ফিলিস্তিনীরা হিংসার মনোভাব নিয়ে এহুদার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে; তারা পুরানো শত্রুতার মনোভাব নিয়ে এহুদাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, ‘ফিলিস্তীনের বিরুদ্ধে আমি আমার হাত বাড়াব; আমি করেথীয়দের কেটে ফেলব এবং সাগরের কিনারা বরাবর বাকী লোকদের ধ্বংস করব। আমি তাদের উপর ভীষণ প্রতিশোধ নেবার জন্য আমার রাগে তাদের শাস্তি দেব। আমি যখন তাদের উপর প্রতিশোধ নেব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আমাদের বন্দী থাকবার এগারো বছরের সময় মাসের প্রথম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, জেরুজালেম সম্বন্ধে টায়ার খুশী হয়ে বলেছে, ‘ভাল হয়েছে, জাতিগুলোর সদর দরজা ভেংগে গেছে আর তার দরজাগুলো আমার কাছে পুরোপুরি খুলে গেছে; শহরটা এখন ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে বলে আমার উন্নতি হবে।’ সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, ‘হে টায়ার, আমি তোমার বিপক্ষে। সমুদ্র যেমন তার ঢেউ উঠায় তেমনি করে আমি তোমার বিরুদ্ধে অনেক জাতিকে নিয়ে আসব।’ তারা টায়ারের দেয়াল ধ্বংস করবে এবং উঁচু পাহারা-ঘরগুলো ভেংগে ফেলবে। আমি তার ধুলা-ময়লা চেঁছে ফেলে তাকে পাথরের মত করে রেখে দেব। সে সমুদ্রের বুকে জাল শুকাবার জায়গা হবে, কারণ আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলেছি। সে জাতিদের লুটের জিনিস হবে। তার অধীনের উপকূলের গ্রামগুলো যুদ্ধের দরুন ধ্বংস হবে। তখন সেখানকার লোকেরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “হে টায়ার, আমি তোমার বিরুদ্ধে উত্তর দিক থেকে ঘোড়া, রথ, ঘোড়সওয়ার ও মস্ত বড় এক সৈন্যদলের সংগে বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌, অর্থাৎ ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে নিয়ে আসব। সে যুদ্ধ করে তোমার গ্রামগুলো ধ্বংস করবে। সে তোমার বিরুদ্ধে একটা উঁচু ঢিবি তৈরী করবে এবং তোমার দেয়ালের সংগে লাগানো একটা ঢালু ঢিবি বানাবে; তারা নিজেদের রক্ষা করবার জন্য তাদের সব ঢাল উঁচু করে ধরবে। সে দেয়াল ভাংগার যন্ত্র দিয়ে তোমার দেয়ালে আঘাত করবে এবং তার যন্ত্রপাতি দিয়ে তোমার উঁচু পাহারা ঘরগুলো ধ্বংস করে ফেলবে। তার এত বেশী ঘোড়া থাকবে যে, সেগুলো তোমাকে ধুলায় ঢেকে দেবে। ভাংগা দেয়ালের মধ্য দিয়ে লোকে যেমন করে শহরে ঢোকে তেমনি করেই সে যখন যুদ্ধের ঘোড়া, গাড়ি ও রথ নিয়ে তোমার সব দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকবে তখন তার শব্দে তোমার দেয়ালগুলো কাঁপবে। তার ঘোড়াগুলোর খুর তোমার সব রাস্তা মাড়াবে; তোমার লোকদের সে মেরে ফেলবে ও তোমার শক্ত শক্ত থামগুলো মাটিতে পড়ে যাবে। তারা তোমার ধন-সম্পদ ও তোমার বাণিজ্যের জিনিসপত্র লুট করবে; তারা তোমার দেয়াল ভেংগে ফেলবে, সুন্দর সুন্দর বাড়ী-ঘর ধ্বংস করবে এবং তোমার পাথর, কাঠ ও ধুলা সমুদ্রে ফেলে দেবে। আমি তোমার গানের শব্দ থামিয়ে দেব; বীণার বাজনাও আর শোনা যাবে না। আমি তোমাকে পাথরের মত করে রাখব আর তুমি হবে জাল শুকাবার জায়গা। তোমাকে আর তৈরী করা হবে না, কারণ আমি আল্লাহ্‌ মালিকই এই কথা বলছি। “হে টায়ার, তোমার পতনের শব্দে, আহতদের কোঁকানিতে ও তোমার মধ্যে যে লোকদের হত্যা করা হবে তাতে কি দূরের দেশগুলো কেঁপে উঠবে না? তখন সমুদ্রের কিনারার দেশগুলোর বাদশাহ্‌রা তাদের সিংহাসন থেকে নেমে তাদের রাজপোশাক ও কারুকাজ করা পোশাকগুলো খুলে ফেলবে। ভীষণ ভয়ে তারা মাটিতে বসবে, সব সময় কাঁপতে থাকবে ও তোমাকে দেখে হতভম্ব হবে। তখন তারা তোমার বিষয়ে বিলাপ করে বলবে, ‘হে নাম-করা শহর, তুমি কেমন ধ্বংস হয়ে গেলে! তোমার লোকেরা তো সাগরে চলাচল করত। সমুদ্রে তুমি ও তোমার বাসিন্দারা শক্তিশালী ছিলে; সমুদ্রের কিনারায় যারা বাস করত তারা সকলে তোমাকে ভয় করত। এখন তোমার পতনের দিনে সমুদ্রের কিনারার দেশগুলো কাঁপছে; তোমার ধ্বংস দেখে সমুদ্রের মধ্যেকার দ্বীপগুলো ভীষণ ভয় পেয়েছে।’ “হে টায়ার, আমি আল্লাহ্‌ মালিক যখন তোমাকে জনশূন্য শহরগুলোর মত করব যেখানে কেউ বাস করে না, যখন সাগরের পানি তোমার উপরে আনব ও তার পানির রাশি তোমাকে ঢেকে দেবে, তখন আমি তোমাকে কবরে যাওয়া লোকদের সংগে পুরানো দিনের লোকদের কাছে নীচে নামিয়ে দেব। আমি তোমাকে দুনিয়ার গভীরে পুরানো দিনের ধ্বংসস্থানের মধ্যে কবরে যাওয়া লোকদের সংগে বাস করাব। তোমার মধ্যে আর কেউ বাস করবে না এবং জীবিতদের দেশে তোমার স্থান হবে না। আমি তোমাকে ভয়ংকরভাবে শেষ করে দেব; তুমি আর থাকবে না। লোকেরা তোমার তালাশ করবে কিন্তু তোমাকে আর কখনও পাওয়া যাবে না। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, টায়ারের বিষয়ে তুমি বিলাপ কর। সমুদ্রে ঢুকবার মুখে যে রয়েছে, সমুদ্র পারের অনেক জাতির যে বণিক সেই টায়ারকে তুমি বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে টায়ার, তুমি বলছ তুমি সৌন্দর্যে পরিপূর্ণা। সমুদ্রের মধ্যে তোমার রাজ্য; একটা সুন্দর জাহাজের মত করে মিস্ত্রিরা তোমার সৌন্দর্যে সম্পূর্ণতা এনেছে। সনীর এলাকার বেরস গাছ থেকে তারা তোমার সব তক্তা বানিয়েছে; তোমার মাস-ুল তৈরী করবার জন্য তারা লেবানন দেশ থেকে এরস গাছ এনেছে। তারা বাশন দেশের এলোন গাছ থেকে বানিয়েছে তোমার দাঁড়গুলো; সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে তাশূর কাঠ এনে তারা তোমার পাটাতন বানিয়ে হাতীর দাঁত দিয়ে সাজিয়েছে। মিসরের সুন্দর নক্‌শা তোলা মসীনার কাপড় দিয়ে তোমার পাল তৈরী করা হয়েছিল এবং সেটা দিয়েই লোকে তোমাকে চিনতে পারত। ইলীশা থেকে আনা নীল আর বেগুনে কাপড় ছিল তোমার চাঁদোয়া। সিডন ও অর্বদের লোকেরা তোমার দাঁড় বাইত। হে টায়ার, দক্ষ লোকেরা তোমার নাবিক ছিল। গবালের বৃদ্ধ নেতারা দক্ষ লোক হিসাবে তোমার মধ্যে মেরামতের কাজ করত। সাগরের সব জাহাজ ও তাদের নাবিকেরা তোমার জিনিসপত্র দেওয়া-নেওয়া করবার জন্য তোমার পাশে ভিড়ত। “ ‘পারস্য, লিডিয়া ও লিবিয়া দেশের লোকেরা তোমার সৈন্যদলে যোদ্ধার কাজ করত। তারা তাদের ঢাল ও মাথা-রক্ষার টুপী তোমার মধ্যে টাংগিয়ে তোমার জাঁকজমক বাড়িয়ে তুলত। অর্বদ ও হেলেকের লোকেরা তোমার চারপাশের দেয়ালের উপরে পাহারা দিত, আর গাম্মাদের লোকেরা তোমার উঁচু পাহারা-ঘরে চৌকি দিত। তোমার চারপাশের দেয়ালে তারা তাদের ঢাল টাংগিয়ে রাখত; তোমার সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা তারাই এনেছিল। “ ‘তোমার প্রচুর ধন-সম্পদের জন্য সেপন তোমার সংগে ব্যবসা করত; রূপা, লোহা, দস্তা ও সীসার বদলে তারা তোমার জিনিস নিত। গ্রীস, তূবল ও মেশক তোমার সংগে ব্যবসা করত; তারা তোমার জিনিসপত্রের বদলে দিত গোলাম ও ব্রোঞ্জের পাত্র। তোমার জিনিসপত্রের বদলে বৈৎ-তোগর্মের লোকেরা দিত ঘোড়া, যুদ্ধের ঘোড়া ও খ"চর। দদানের লোকেরা তোমার সংগে ব্যবসা করত এবং সমুদ্র পারের অনেক দেশই তোমার জিনিসপত্র কিনত; দাম হিসাবে তারা দিত হাতীর দাঁত ও আবলুস কাঠ। তোমার তৈরী অনেক জিনিসের জন্য সিরিয়া তোমার সংগে ব্যবসা করত; তোমার জিনিসপত্রের বদলে তারা দিত চুনী পাথর, বেগুনে কাপড়, নক্‌শা তোলা কাপড়, পাতলা মসীনার কাপড়, প্রবাল ও পদ্মরাগমণি। এহুদা ও ইসরাইল তোমার সংগে ব্যবসা করত; তারা তোমার জিনিসের বদলে মিন্নীতের গম, খাবার জিনিস, মধু, তেল ও খোশবু মলম দিত। তোমার তৈরী অনেক জিনিস ও প্রচুর ধন-সম্পদের জন্য দামেস্ক হিল্‌বোনের আংগুর-রস ও সাদা পশম দিয়ে তোমার সংগে ব্যবসা করত। বদান ও গ্রীসের লোকেরা তোমার জিনিসের বদলে দিত উষল থেকে আনা পিটানো লোহা, দারচিনি ও বচ। দদান তোমার সংগে ঘোড়ার পিঠের গদির কাপড়ের ব্যবসা করত। আরব ও কায়দারের সব সর্দারেরা ছিল তোমার খদ্দের; তারা তোমার জিনিসের বদলে ভেড়ার বাচ্চা, ভেড়া ও ছাগল দিত। সাবা ও রয়মার ব্যবসায়ীরাও তোমার সংগে ব্যবসা করত; তোমার জিনিসপত্রের বদলে তারা দিত সব রকমের ভাল ভাল মসলা, দামী পাথর ও সোনা। হারণ, কন্নী, আদন ও সাবার ব্যবসায়ীরা এবং আশেরিয়া ও কিল্‌মদ তোমার সংগে ব্যবসা করত। তারা তোমার বাজারে সুন্দর সুন্দর পোশাক, নীল কাপড়, নক্‌শা তোলা কাপড় এবং রং বেরংয়ের গালিচা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে আনত। “ ‘তর্শীশের জাহাজগুলো তোমার জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে আসত। সাগরের মাঝখানে অনেক জিনিসপত্র দিয়ে তুমি পূর্ণ ছিলে। যারা দাঁড় বাইত তারা তোমাকে মাঝ দরিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সাগরের মাঝখানে পূর্বের বাতাসে তুমি টুকরা টুকরা হয়ে গেলে। তোমার ধ্বংসের দিনে তোমার ধন-সম্পদ, ব্যবসার জিনিস ও অন্যান্য জিনিস, তোমার সব নাবিকেরা, মেরামতকারীরা, তোমার ব্যবসায়ীরা ও তোমার সব সৈন্যেরা এবং তোমার মধ্যে থাকা আর অন্য সকলে সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যাবে। তোমার নাবিকদের চিৎকারের শব্দে সমুদ্রের পারের জায়গাগুলো কেঁপে উঠবে। যারা দাঁড় টানে তারা সবাই তাদের জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে; নাবিকেরা সকলে সমুদ্রের পারে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা তোমার জন্য চিৎকার করে খুব কান্নাকাটি করবে এবং নিজেদের মাথায় ধুলা দেবে ও ছাইয়ের মধ্যে গড়াগড়ি দেবে। তারা তোমার জন্য মাথা কামিয়ে ফেলবে এবং ছালার চট পরবে। তারা মনের দুঃখে তোমার জন্য বিলাপ করে করে খুব কাঁদবে। তারা তোমার জন্য জোরে জোরে কাঁদবে ও শোক করবে; তোমাকে নিয়ে তারা এই বিলাপ করবে: “ ‘সাগর-ঘেরা টায়ারের মত করে আর কাউকে কি চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে? তোমার ব্যবসার জিনিসপত্র যখন সাগরে বের হত তখন তুমি অনেক জাতিকে তৃপ্ত করতে; তোমার প্রচুর ধন-সম্পদ ও জিনিসপত্র দিয়ে তুমি দুনিয়ার বাদশাহ্‌দের ধনী করতে। তুমি এখন সাগরের আঘাতে গভীর পানির মধ্যে চুরমার হয়েছ; তোমার জিনিসপত্র ও তোমার সব লোক তোমার সংগে ডুবে গেছে। সাগর পারে বাসকারী লোকেরা সবাই তোমার অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়েছে; তাদের বাদশাহ্‌রা ভয়ে কেঁপে উঠেছে এবং তাদের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে। জাতিদের মধ্যেকার ব্যবসায়ীরা তোমাকে দেখে টিট্‌কারি দেয়। তুমি ভয়ংকরভাবে শেষ হয়ে গেছ; তুমি আর থাকবে না।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি টায়ারের শাসনকর্তাকে বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমার দিলের অহংকারে তুমি বলেছ যে, তুমি দেবতা; তুমি সাগরের মধ্যে দেবতার সিংহাসনে বসে আছ। কিন্তু তুমি তো একজন মানুষ, দেবতা নও, যদিও তুমি নিজেকে দেবতার মত জ্ঞানী মনে করছ। তুমি তো দানিয়ালের চেয়েও জ্ঞানী; সব গোপন বিষয় তোমার জানা আছে। তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে তুমি নিজের জন্য ধন-সম্পদ লাভ করেছ এবং তোমার ধনভাণ্ডারে সোনা ও রূপা জমা করেছ। পাকা ব্যবসায়ী বুদ্ধি দিয়ে তুমি তোমার ধন বাড়িয়েছ এবং তোমার ধন-সম্পদের জন্য তোমার দিল অহংকারে ভরে উঠেছে। তারা তোমাকে কবরে নামাবে; তুমি সাগরের গভীরে ভীষণভাবে শেষ হয়ে যাবে। যারা তোমাকে শেষ করে দেবে তাদের সামনে তখন কি তুমি বলবে যে, তুমি দেবতা? যারা তোমাকে মেরে ফেলবে তাদের কাছে তুমি হবে একজন মানুষ মাত্র, দেবতা নও। তুমি বিদেশীদের হাতে খৎনা-না-করানো লোকদের মত মারা যাবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, টায়ারের বাদশাহ্‌র বিষয়ে তুমি বিলাপ করে করে তাকে বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তুমি ছিলে সম্পূর্ণ নিখুঁত, জ্ঞানে পূর্ণ এবং সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। তুমি আল্লাহ্‌র বাগান আদনে ছিলে। সব রকম দামী দামী পাথর, সার্দীয়মণি, পীতমণি, হীরা, পোখরাজ, বৈদুর্যমণি, সূর্যকান্তমণি, নীলকান্তমণি, চুনী, পান্না ও সোনা দিয়ে তুমি সাজানো ছিলে; তোমার সৃষ্টির দিনে এগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। রক্ষাকারী কারুবী হিসাবে তোমাকে অভিষেক করা হয়েছিল, কারণ সেইভাবেই আমি তোমাকে নিযুক্ত করেছিলাম। তুমি আল্লাহ্‌র পবিত্র পাহাড়ে ছিলে; তুমি আগুনের মত ঝক্‌মক করা পাথরের মধ্য দিয়ে হাঁটা-চলা করতে। তোমার সৃষ্টির দিন থেকে তোমার চালচলনে তুমি নির্দোষ ছিলে, কিন্তু শেষে তোমার মধ্যে দুষ্টতা পাওয়া গেল। তোমার অনেক ব্যবসার দরুন তুমি জুলুমবাজ হয়ে গুনাহ্‌ করলে। কাজেই আল্লাহ্‌র পাহাড় থেকে আমি তোমাকে নাপাক অবস্থায় তাড়িয়ে দিলাম। হে রক্ষাকারী কারুবী, আমি তোমাকে আগুনের মত ঝক্‌মক করা পাথরের মধ্য থেকে সরিয়ে দিলাম। তোমার সৌন্দর্যের জন্য তোমার দিল অহংকারে ভরে উঠেছে আর তোমার জাঁকজমকের জন্য তুমি তোমার জ্ঞানকে নষ্ট করেছ। তাই আমি তোমাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম; বাদশাহ্‌দের সামনে আমি তোমাকে রাখলাম যাতে তোমাকে দেখে তারা খুশী হয়। তোমার অনেক গুনাহ্‌ ও অসৎ ব্যবসা দিয়ে তুমি নিজের এবাদতের জায়গাগুলো নাপাক করেছ। এইজন্য আমি তোমার মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিলাম আর তা তোমাকে পুড়িয়ে ফেলল; যারা দেখছিল তাদের সকলের চোখের সামনে আমি তোমাকে মাটির উপরে ছাই করে দিলাম। যে সমস্ত জাতি তোমাকে জানত তারা তোমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তুমি ভয়ংকরভাবে শেষ হয়ে গেছ; তুমি আর থাকবে না।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি সিডন শহরের দিকে তোমার মুখ রেখে তার বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘ওহে সিডন, আমি তোমার বিপক্ষে; আমি তোমার মধ্যে যা করব তাতে আমার মহিমা প্রকাশ পাবে। আমি যখন তোমাকে শাস্তি দেব এবং তোমার মধ্যে আমার পবিত্রতা প্রকাশ করব তখন তোমার লোকেরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। তোমার উপর আমি মহামারী পাঠাব এবং তোমার রাস্তায় রাস্তায় রক্তপাত হবে। তোমাকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হবে এবং তাতে লোকে খুন হয়ে তোমার মধ্যে পড়ে থাকবে। তখন তোমার লোকেরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আল্লাহ্‌ মালিক আরও বললেন, “ইসরাইল জাতির জন্য ব্যথা দেওয়া কোন কাঁটাগাছ কিংবা সূচালো কাঁটার মত ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী প্রতিবেশী জাতি আর থাকবে না। তখন তারা জানবে যে, আমিই আল্লাহ্‌ মালিক। “নানা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়া বনি-ইসরাইলদের আমি যখন জমায়েত করব তখন জাতিদের চোখের সামনে তাদের মধ্যে আমি নিজের পবিত্রতা প্রকাশ করব। তখন তারা নিজেদের সেই দেশে বাস করবে যে দেশ আমি আমার গোলাম ইয়াকুবকে দিয়েছিলাম। সেখানে তারা ঘর-বাড়ী বানিয়ে নিরাপদে বাস করবে এবং আংগুর ক্ষেত করবে। তাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী প্রতিবেশী জাতিদের সবাইকে যখন আমি শাস্তি দেব তখন তারা নিরাপদে বাস করবে। তাতে তারা জানবে যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌।” আমাদের বন্দীদশার দশম বছরের দশম মাসের বারো দিনের দিন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, তুমি তোমার মুখ মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের দিকে রেখে তার ও সারা মিসর দেশের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন, আমি তোমার বিপক্ষে। তুমি নিজের নদীর মধ্যে শুয়ে থাকা সেই বিরাট কুমীর। তুমি বলে থাক যে, নীল নদ তোমার আর তুমি নিজের জন্যই সেটা তৈরী করেছ। কিন্তু আমি তোমার চোয়ালে কড়া লাগাব ও তোমার নদীর মাছগুলোকে তোমার আঁশের সংগে লাগিয়ে দেব। তোমার আঁশে লেগে থাকা সব মাছ সুদ্ধই আমি তোমাকে তোমার নদী থেকে টেনে তুলে আনব। আমি তোমাকে ও তোমার নদীর সব মাছগুলোকে মরুভূমিতে ফেলে রাখব। তুমি খোলা মাঠে পড়ে থাকবে এবং তোমাকে তুলে কবর দেওয়া হবে না। আমি খাবার হিসাবে তোমাকে বুনো পশু ও আকাশের পাখীদের দেব। তাতে যারা মিসরে বাস করে তারা সবাই জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘তুমি বনি-ইসরাইলদের জন্য নলের লাঠি হয়েছিলে। তারা তোমাকে হাত দিয়ে ধরলে পর তুমি ফেটে গিয়ে তাদের কাঁধে আঘাত করতে। তারা যখন তোমার উপর ভর দিত তখন তুমি ভেংগে যেতে এবং তাদের পিঠ তাতে মোচড় খেত। “ ‘সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আমি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে এসে তোমার লোকদের ও পশুদের মেরে ফেলব। মিসর হবে একটা জনশূন্য ধ্বংসস্থান। তখন তোমার লোকেরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘তুমি বলেছ যে, নীল নদ তোমার আর তুমিই সেটা তৈরী করেছ। সেইজন্য আমি তোমার ও তোমার নদীর সমস্ত পানির বিরুদ্ধে। আমি মিগ্‌দোল থেকে আসওয়ান, অর্থাৎ ইথিওপিয়ার সীমানা পর্যন্ত মিসর দেশকে জনশূন্য ও ধ্বংসস্থান করে দেব। তার মধ্য দিয়ে কোন মানুষ বা পশু চলাফেরা করবে না; চল্লিশ বছর ধরে সেখানে কেউ বাস করবে না। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সমস্ত দেশগুলোর মধ্যে আমি মিসর দেশের অবস্থা আরও বেশী খারাপ করে দেব; ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলোর মধ্যে তার শহরগুলোর অবস্থা চল্লিশ বছর ধরে আরও খারাপ হয়ে থাকবে। আমি নানা জাতি ও দেশের মধ্যে মিসরীয়দের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেব। “ ‘চল্লিশ বছরের শেষে আমি নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা মিসরীয়দের জমায়েত করব। আমি তাদের অবস্থা ফিরিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ পথ্রোষে নিয়ে যাব। সেখানে তাদের রাজ্য হবে দুর্বল। পথ্রোষ হবে সবচেয়ে দুর্বল রাজ্য; অন্যান্য জাতিদের উপরে সে কখনও নিজেকে উঁচু করবে না। আমি তাকে এত দুর্বল করব যে, সে আর কখনও অন্যান্য জাতিদের উপরে রাজত্ব করবে না। বনি-ইসরাইলরা আর কখনও মিসরের উপর ভরসা করবে না। মিসরের অবস্থা দেখে তারা বুঝতে পারবে যে, সাহায্যের জন্য মিসরের দিকে ফিরে তারা গুনাহ্‌ করেছিল। তাতে তারা জানবে যে, আমিই আল্লাহ্‌ মালিক।’ ” আমাদের বন্দীদশার সাতাশ বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার টায়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তার সৈন্যদলকে এত বেশী খাটিয়েছে যে, তাদের সকলের মাথার চুল উঠে গেছে ও কাঁধের ছাল-চামড়া উঠে গেছে। তবুও টায়ারের বিরুদ্ধে সে যে যুদ্ধ চালিয়েছে তাতে তার বা তার সৈন্যদলের কোন লাভ হয় নি। সেইজন্য আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে মিসর দেশটা দেব আর সে তার ধন-সম্পদ নিয়ে যাবে। তার সৈন্যদলের বেতনের জন্য সে সেই দেশটা লুটপাট করবে। তার কাজের পাওনা হিসাবে আমি তাকে মিসর দেশটা দিয়েছি, কারণ সে আমার জন্য কাজ করেছে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “সেই দিন আমি ইসরাইল জাতিকে শক্তিশালী করব এবং তাদের মধ্যে কথা বলবার জন্য তোমার মুখ খুলে দেব। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” পরে মাবুদ আমাকে আরও বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘সেই দিনের জন্য দুঃখ প্রকাশ কর। একটা ভয়ংকর দিন আসছে, কারণ মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে; সেটা মেঘে ঢাকা দিন এবং জাতিদের শেষ সময়। মিসরের উপর আসবে যুদ্ধ আর ইথিওপিয়ার উপর আসবে দারুণ যন্ত্রণা। মিসরে লোকেরা মরে পড়ে থাকবে, তার ধন-সম্পদ নিয়ে যাওয়া হবে এবং তার সব জায়গা ধ্বংস হবে। ইথিওপিয়া, লিবিয়া, লিডিয়া ও সমস্ত আরব দেশ, কূব ও বন্ধু দেশের লোকেরা যুদ্ধে মিসরের সংগে মারা পড়বে। মিসরের বন্ধু দেশের লোকেরা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার শক্তির গর্বও শেষ হবে। মিগ্‌দোল থেকে আসওয়ান পর্যন্ত লোকেরা যুদ্ধে মারা পড়বে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে মিসরের অবস্থা আরও খারাপ হবে এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলোর মধ্যে তার শহরগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হবে। যখন আমি মিসরে আগুন ধরিয়ে দেব এবং তার সব সাহায্যকারীরা চুরমার হয়ে যাবে তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘সেই দিন আরামে থাকা ইথিওপিয়াকে ভয় দেখাবার জন্য সংবাদ বহনকারীরা আমার হুকুমে জাহাজে করে বের হয়ে যাবে। মিসরের শেষ দিনে ইথিওপিয়ারও যন্ত্রণা হবে, কারণ সেই দিন তার উপরেও আসবে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের হাত দিয়ে মিসরের মস্ত বড় দলকে আমি শেষ করে দেব। তাকে ও তার সৈন্যদলকে, অর্থাৎ সমস্ত জাতির মধ্যে যারা সবচেয়ে নিষ্ঠুর তাদেরই আনা হবে দেশটাকে ধ্বংস করবার জন্য। তারা মিসরকে আক্রমণ করে তার নিহত লোকদের দিয়ে দেশটাকে ভরে দেবে। আমি নীল নদের পানি শুকিয়ে ফেলব এবং দুষ্ট লোকদের কাছে দেশটা বিক্রি করে দেব; বিদেশীদের হাত দিয়ে দেশ ও তার মধ্যেকার সব কিছুকে আমি ধ্বংস করে দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “ ‘আমি মেম্ফিস শহরের মূর্তিগুলো ধ্বংস করে ফেলব, তার মূর্তিগুলো শেষ করে দেব। মিসরে আর কোন শাসনকর্তা থাকবে না এবং দেশের সবখানেই আমি ভয় ছড়িয়ে দেব। আমি পথ্রোষকে পতিত জমি করে ফেলে রাখব, সোয়নে আগুন লাগাব এবং থিব্‌স্‌ শহরকে শাস্তি দেব। আমি মিসরের কেল্লা সীন শহরের উপরে আমার গজব ঢেলে দেব এবং থিব্‌স্‌ শহরের সমস্ত লোকদের ছেঁটে ফেলে দেব। আমি মিসর দেশে আগুন লাগাব; সীন শহর যন্ত্রণায় মোচড় খাবে। থিব্‌স্‌ শহরের উপর হঠাৎ বিপদ আসবে; মেম্ফিস দিনের বেলায় কষ্টের মধ্যে পড়বে। আবেন ও পী-বেশতের যুবকেরা যুদ্ধে মারা পড়বে এবং অন্যান্য লোকেরা বন্দীদশায় যাবে। আমি যখন মিসরের জোয়াল ভেংগে ফেলব তখন তফন্‌হেষে দিনের বেলা অন্ধকার নেমে আসবে; সেখানে তার শক্তির গর্বও শেষ হয়ে যাবে। সে মেঘে ঢেকে যাবে আর তার গ্রামগুলোর লোকেরা বন্দীদশায় যাবে। এইভাবে আমি মিসরকে শাস্তি দেব, আর তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আমাদের বন্দীদশার এগারো বছরের প্রথম মাসের সাত দিনের দিন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, আমি মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের হাত ভেংগে দিয়েছি। ভাল হবার জন্য সেই হাত কাপড় দিয়ে বাঁধা হয় নি যাতে সেটা তলোয়ার ধরবার জন্য উপযুক্ত শক্তি পায়। আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আমি মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের বিপক্ষে। আমি তার ভাল ও ভাংগা দু’টা হাতই ভেংগে দেব এবং তার হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দেব। আমি নানা জাতির ও দেশের মধ্যে মিসরীয়দের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেব। আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে শক্তি দেব এবং আমার তলোয়ার তার হাতে দেব, কিন্তু ফেরাউনের হাত আমি ভেংগে ফেলব। তাতে ফেরাউন ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র সামনে আহত লোকের মত কাত্‌রাবে। আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে শক্তি দেব কিন্তু ফেরাউনের হাত ঝুলে পড়বে। আমি যখন আমার তলোয়ার ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র হাতে দেব আর সে মিসরের বিরুদ্ধে তা চালাবে তখন সবাই জানবে যে, আমিই মাবুদ। আমি যখন মিসরীয়দের নানা জাতির ও দেশের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” আমাদের বন্দীদশার এগারো বছরের তৃতীয় মাসের প্রথম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউন ও তার সমস্ত লোকদের বল, ‘জাঁকজমকের দিক থেকে তুমি কার সমান? আশেরিয়ার কথা চিন্তা করে দেখ, সে একদিন লেবাননের এরস গাছ ছিল। তার সুন্দর সুন্দর ডালপালা বনে ঘন ছায়া ফেলত; সে খুব উঁচু ছিল, তার মাথা যেন আকাশ ছুঁতো। প্রচুর পানি তাকে পুষ্ট করে তুলেছিল, গভীর ঝর্ণা তাকে লম্বা করেছিল; ঝর্ণার স্রোত তার জায়গার চারপাশ দিয়ে বয়ে যেত এবং তার নালাগুলো বনের সব গাছগুলোকে পানি দিত। এইভাবে বনের সব গাছের চেয়ে সে উঁচু হয়ে উঠল; প্রচুর পানি পাওয়ার দরুন তার অনেক বড় বড় ডাল হল এবং ডালপালাগুলো লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। আকাশের সব পাখীরা তার ডালপালায় বাসা বাঁধল আর বনের সব পশুরা তার ডালপালার নীচে বাচ্চা দিত; তার ছায়ায় বাস করত সমস্ত বড় বড় জাতি। তার ছড়িয়ে পড়া ডালপালার সৌন্দর্যে সে মহান ছিল, কারণ তার শিকড়গুলো নীচে প্রচুর পানির কাছে গিয়েছিল। আল্লাহ্‌র বাগানের এরস গাছগুলোও তার সংগে পাল্লা দিতে পারত না। বেরস গাছের ডালপালাও তার বড় বড় ডালের সমান ছিল না; তার ডালপালার সংগে আর্মোণ গাছের তুলনা হত না। মোট কথা, আল্লাহ্‌র বাগানের কোন গাছই সৌন্দর্যে তার সমান ছিল না। প্রচুর ডালপালা দিয়ে আমি তাকে সুন্দর করেছিলাম; সে ছিল আদনে আল্লাহ্‌র বাগানের সব গাছের হিংসার পাত্র। “ ‘এখন আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, সে উঁচু হয়েছে, তার মাথা যেন আকাশ ছুঁয়েছে, আর সে লম্বা বলে তার অহংকার হয়েছে। সেইজন্য আমি তাকে জাতিদের শাসনকর্তার হাতে তুলে দিয়েছি; তার খারাপী অনুসারে সে তার সংগে ব্যবহার করবে। আমি তাকে অগ্রাহ্য করেছি। জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর জাতির লোকেরা তাকে কেটে ফেলে রেখে গেছে। তার বড় বড় ডালগুলো পাহাড়ে পাহাড়ে ও সব উপত্যকাগুলোতে পড়েছে; তার ডালপালাগুলো ভেংগে দেশের সব পানির স্রোতের মধ্যে পড়ে আছে। দুনিয়ার সব জাতিরা তার ছায়া থেকে বের হয়ে তাকে ফেলে চলে গেছে। সেই পড়ে যাওয়া গাছে আকাশের সব পাখীরা এসে রইল এবং বনের সব পশুরাও তার ডালপালার কাছে থাকল। তার ফলে পানির ধারের অন্য কোন গাছ অহংকারে উঁচু হবে না, তার মাথা আকাশ ছোঁবে না এবং সে এত উঁচুতেও পৌঁছাবে না। তারা সবাই মানুষের মত মৃত্যুর অধীন; তারা দুনিয়ার গভীরে, অর্থাৎ কবরে নেমে যাবার জন্য ঠিক হয়ে আছে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক আরও বলছি, যেদিন সে কবরে নেমে গেল সেই দিন তার জন্য শোকের চিহ্ন হিসাবে সেই গভীর ঝর্ণা আমি ঢেকে দিলাম; আমি তার সব স্রোত থামিয়ে দিলাম, তাতে তার সব পানি বন্ধ হয়ে গেল। এর জন্য আমি লেবাননকে শোক করালাম আর তার বনের প্রত্যেকটি গাছ শুকিয়ে গেল। মৃত লোকদের সংগে আমি যখন তাকে কবরে নামিয়ে দিলাম তখন তার পড়ে যাবার শব্দে জাতিরা কেঁপে উঠল। তখন আদনের সব গাছ, লেবাননের বাছাই করা ও সেরা গাছ এবং ভালভাবে পানি পাওয়া সব গাছ দুনিয়ার গভীরে সান্ত্বনা পেল। যারা তার ছায়ায় বাস করত, অর্থাৎ জাতিদের মধ্যে তার বন্ধুরা তার সংগে কবরে যুদ্ধে নিহত লোকদের কাছে নেমে গেল। “ ‘হে ফেরাউন, জাঁকজমক ও গৌরবের দিক দিয়ে আদনের গাছপালার মধ্যে একটাও তোমার সমান নয়। তবুও আদনের গাছপালার সংগে তোমাকেও দুনিয়ার গভীরে নামিয়ে দেওয়া হবে; যারা যুদ্ধে মারা গেছে সেই খৎনা-না-করানো লোকদের সংগে তুমি শুয়ে থাকবে।’ “আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, সেই গাছ হল ফেরাউন ও তার সমস্ত দলবল।” আমাদের বন্দীদশার বারো বছরের বারো মাসের প্রথম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, মিসরের বাদশাহ্‌ ফেরাউনের বিষয়ে তুমি বিলাপ করে করে তাকে বল, ‘তুমি মনে করতে তুমি জাতিদের মধ্যে একটা সিংহের মত, কিন্তু আসলে তুমি নদীর মধ্যেকার কুমীরের মত। তুমি নিজের নদীর মধ্যে দাপাদাপি করতে, পা দিয়ে পানি তোলপাড় করতে এবং নদীর পানি ঘোলা করতে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, লোকদের একটা বড় দল নিয়ে আমি তোমার উপর আমার জাল ফেলব; তারা আমার জালে তোমাকে টেনে তুলবে। ডাংগার উপরে খোলা মাঠে আমি তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেব। আমার হুকুমে আকাশের সব পাখীরা তোমার উপর বসবে এবং দুনিয়ার সব পশুরা তোমাকে খেয়ে তৃপ্ত হবে। আমি তোমার লাশ টুকরা টুকরা করে পাহাড়ে পাহাড়ে, উপত্যকায় উপত্যকায় ছড়িয়ে দেব। পাহাড়-পর্বত পর্যন্ত আমি তোমার রক্ত দিয়ে দেশটা ভিজাব; তাতে তোমার রক্তে স্রোতের পানি লাল হয়ে যাবে। তোমাকে শেষ করে দেবার সময় আমি আসমান ঢেকে দেব এবং তারাগুলোকে কালো করে দেব; মেঘ দিয়ে আমি সূর্য ঢেকে দেব এবং চাঁদ আলো দেবে না। তোমার উপরকার আসমানের সব আলো আমি কালো করে দেব; তোমার দেশের উপর আমি অন্ধকার আনব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ ‘নানা জাতির মধ্যে, এমন কি, তোমার অজানা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যখন আমি তোমার ধ্বংসের খবর দেব তখন তারা অন্তরে কষ্ট পাবে। আমি তোমার উপর যা করব তা দেখে অনেক জাতি হতভম্ব হবে। আমি যখন তাদের সামনে আমার তলোয়ার ঘুরাব তখন তাদের বাদশাহ্‌রা ভয়ে কাঁপবে। তোমার পতনের দিনে তাদের প্রত্যেকজন তার নিজের প্রাণের ভয়ে প্রতি মুহূর্তে কাঁপতে থাকবে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌র তলোয়ার তোমার উপরে আসবে। শক্তিশালী লোকদের তলোয়ার দিয়ে, অর্থাৎ সমস্ত জাতির মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর জাতির তলোয়ার দিয়ে আমি তোমার সব লোকদের পতন ঘটাব। তারা মিসরের অহংকার চুরমার করবে এবং তার সব লোকদের ধ্বংস করবে। পানির পাশে থাকা তার সব পশুদের আমি ধ্বংস করে দেব; সেই পানি মানুষের পায়ে কিংবা পশুর খুরে আর ঘোলা হবে না। এইভাবে আমি তার পানি পরিষ্কার রাখব এবং তার সব নদীকে তেলের মত বয়ে যেতে দেব। আমি যখন মিসরকে ধ্বংসস্থান করব এবং দেশের মধ্যেকার সব কিছু খালি করে ফেলব আর সেখানকার সব বাসিন্দাদের আঘাত করব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘এই সব কথা তারা মিসরের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে গাইবে। বিভিন্ন জাতির মেয়েরাও তা গাইবে; তারা মিসর ও তার সব লোকদের জন্য তা গাইবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” আমাদের বন্দীদশার বারো বছরের সময় সেই মাসের পনেরো দিনের দিন মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, মিসরের লোকদের জন্য বিলাপ কর এবং যারা কবরে নেমে যাচ্ছে তাদের সংগে তাকে ও অন্যান্য শক্তিশালী জাতিগুলোর লোকদের দুনিয়ার গভীরে পাঠিয়ে দাও। তুমি মিসরকে বল, ‘অন্যদের চেয়ে কি তুমি বেশী সুন্দর? তুমি কবরে নেমে গিয়ে খৎনা-না-করানো লোকদের মধ্যে শুয়ে থাক।’ যুদ্ধে যারা মারা পড়েছে তাদের মধ্যেই তার লোকেরা পড়ে থাকবে। তলোয়ারের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হবে; তার সব লোকদের সংগে তাকেও টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। কবরের মধ্য থেকে শক্তিশালী যোদ্ধারা মিসর ও তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বলবে, ‘যুদ্ধে নিহত সেই খৎনা-না-করানো লোকেরা নীচে নেমে এসে শুয়ে আছে।’ “আশেরিয়া তার সমস্ত সৈন্যদলের সংগে সেখানে আছে। তাকে ঘিরে রয়েছে তার সব নিহত লোকদের কবর; এরা সবাই যুদ্ধে মারা পড়েছিল। তাদের কবর মৃতস্থানের গভীরে রয়েছে এবং তার সৈন্যদল তার কবরের চারপাশে শুয়ে আছে। জীবিতদের দেশে যারা ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল তাদের সবাইকে যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। “ইলাম সেখানে আছে; তার কবরের চারপাশে রয়েছে তার সমস্ত লোক। তাদের সবাইকে যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। তারা জীবিতদের দেশে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু শেষে তারা সবাই খৎনা-না-করানো অবস্থায় দুনিয়ার গভীরে নেমে গেছে। যারা কবরে নেমে গেছে তাদের সংগেই এই লোকেরা অসম্মান বহন করছে। নিহত লোকদের মধ্যে ইলামের বিছানা পাতা হয়েছে; তার কবরের চারপাশে তার সংগে রয়েছে তার সমস্ত লোক। এই সব খৎনা-না-করানো লোকদের যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। জীবিতদের দেশে তারা ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু যারা কবরে নেমে গেছে তাদের সংগেই এই লোকেরা অসম্মান বহন করছে; নিহত লোকদের মধ্যে তাদের শোয়ানো হয়েছে। “মেশক ও তূবল সেখানে রয়েছে; তাদের চারপাশে রয়েছে তাদের সব লোকদের কবর। এই সব খৎনা-না-করানো লোকদের যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। জীবিতদের দেশে তারা ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারা খৎনা-না-করানো অন্যান্য যোদ্ধাদের সংগে শুয়ে থাকবে না। সেই যোদ্ধারা তাদের যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কবরে নেমে গেছে, তাদের তলোয়ার তাদের মাথার নীচে রাখা হয়েছে আর তাদের গুনাহের শাস্তি তাদের হাড়গোড়ের উপরে রয়েছে। তারাও জীবিতদের দেশে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল। “হে মিসর, তোমাকেও ভেংগে ফেলা হবে এবং তুমি সেই খৎনা-না-করানো লোকদের মধ্যে শুয়ে থাকবে যাদের যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। “ইদোম, তার বাদশাহ্‌রা ও তার সব শাসনকর্তারা সেখানে আছে; তাদের শক্তি থাকলেও যুদ্ধে নিহত লোকদের সংগে তাদের শোয়ানো হয়েছে। যারা কবরে নেমে গেছে সেই খৎনা-না-করানো লোকদের সংগে তারা শুয়ে আছে। “উত্তর দেশের সব শাসনকর্তারা ও সিডনীয়রা সকলেই সেখানে আছে। যদিও তাদের শক্তির দ্বারা তারা ভয় জন্মিয়েছিল তবুও অসম্মানের সংগে তারা যুদ্ধে নিহত লোকদের সাথে নীচে নেমে গেছে এবং তাদের সংগে খৎনা-না-করানো অবস্থায় শুয়ে আছে। যারা কবরে নেমে গেছে তাদের সংগে এই লোকেরা তাদের অসম্মান বহন করছে। “যখন ফেরাউন ও তার সব সৈন্যেরা যুদ্ধে নিহত হবে তখন সে ঐসব লোকদের দেখতে পাবে এবং তার সব লোকদের বিষয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া হবে। যদিও আমি ফেরাউনকে দিয়ে জীবিতদের দেশে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তবুও তাকে ও তার সব লোকদের সেই খৎনা-না-করানো, যুদ্ধে নিহত লোকদের সংগে শোয়ানো হবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তোমার জাতির লোকদের বল যে, মাবুদ বলছেন, ‘ধর, আমি কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে আসলাম। তখন দেশের লোকেরা তাদের লোকদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিয়ে তাকে তাদের পাহারাদার নিযুক্ত করল। সে দেশের বিরুদ্ধে সৈন্যদল আসতে দেখে লোকদের সতর্ক করবার জন্য শিংগা বাজাল। তখন যদি কেউ শিংগার আওয়াজ শুনেও সতর্ক না হয় আর সৈন্যেরা এসে তাকে হত্যা করে তবে তার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী থাকবে। শিংগার আওয়াজ শুনেও সে সতর্ক হয় নি বলে তাঁর মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী থাকবে। সে যদি সতর্ক হত তবে নিজেকে রক্ষা করতে পারত। কিন্তু ধর, সেই পাহারাদার সৈন্যদলকে আসতে দেখেও লোকদের সতর্ক করবার জন্য শিংগা বাজাল না। তারপর সৈন্যেরা এসে কোন একজনকে হত্যা করল। তাহলে বুঝতে হবে সেই মানুষ তার নিজের গুনাহের জন্যই মারা গেল, কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমি সেই পাহারাদারকে দায়ী করব।’ “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইল জাতির জন্য আমি তোমাকে পাহারাদার নিযুক্ত করেছি; কাজেই আমি যা বলছি তা শোন এবং আমার হয়ে তাদের সতর্ক কর। আমি যখন কোন দুষ্ট লোককে বলি, ‘ওহে দুষ্ট লোক, তুমি নিশ্চয়ই মরবে,’ আর তুমি তাকে তার খারাপ পথ থেকে ফিরবার জন্য সতর্ক না কর, তবে সেই দুষ্ট লোক তার গুনাহের জন্য মারা যাবে কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমি তোমাকে দায়ী করব। কিন্তু তুমি যদি সেই দুষ্ট লোককে তার কুপথ থেকে ফিরবার জন্য সতর্ক কর আর যদি সে না ফেরে তবে সে তার গুনাহের জন্য মরবে, কিন্তু তুমি নিজের প্রাণ রক্ষা করবে। “হে মানুষের সন্তান, তুমি ইসরাইল জাতিকে বল, ‘তোমরা বলছ তোমাদের অন্যায় ও গুনাহের ভার তোমাদের উপর চেপে আছে; তাতেই তোমরা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছ, বাঁচবার আশা নেই।’ তুমি তাদের বল যে, আমি আল্লাহ্‌ মালিক, আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি, দুষ্ট লোকের মৃত্যুতে আমি কোন আনন্দ পাই না, বরং তারা যেন কুপথ থেকে ফিরে বাঁচে তাতেই আমি আনন্দ পাই। হে ইসরাইল জাতি, তোমরা ফেরো, তোমাদের খারাপ পথ থেকে তোমরা ফেরো। কেন তোমরা মারা যাবে? “সেইজন্য, হে মানুষের সন্তান, তুমি তোমার জাতির লোকদের বল, ‘সৎ লোক যদি মাবুদের অবাধ্য হয় তবে তার সততা তাকে রক্ষা করতে পারবে না, আর দুষ্ট লোক যদি তার দুষ্টতা থেকে ফেরে তবে সে তার দুষ্টতার শাস্তি পাবে না। সৎ লোক যদি গুনাহ্‌ করে তবে তার আগের সততা তাকে বঁাঁচাতে পারবে না।’ যদি আমি একজন সৎ লোককে বলি যে, সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, কিন্তু সে পরে তার সততার উপর ভরসা করে খারাপ কাজ করে তবে সে আগে যে সব সৎ কাজ করেছে তার কোনটাই মনে করা হবে না; সে যে খারাপ কাজ করেছে তার জন্যই সে মরবে। যদি আমি একজন দুষ্ট লোককে বলি, ‘তুমি নিশ্চয়ই মরবে,’ কিন্তু সে পরে তার গুনাহ্‌ থেকে ফিরে ন্যায় ও ঠিক কাজ করে, অর্থাৎ যদি সে বন্ধক রাখা জিনিস ও চুরির জিনিস ফিরিয়ে দেয় এবং জীবনদায়ী নিয়ম-কানুন পালন করে আর খারাপ কাজ না করে তবে সে মরবে না, নিশ্চয়ই বাঁচবে। সে যে সব গুনাহ্‌ করেছে তার কোনটাই তার বিরুদ্ধে মনে রাখা হবে না। সে ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে বলে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। “তবুও তোমার জাতির লোকেরা বলে থাকে, ‘মাবুদের পথ ঠিক নয়।’ আসলে তাদেরই পথ ঠিক নয়। একজন সৎ লোক যদি তার সততা থেকে ফিরে খারাপ কাজ করে তবে তার জন্য সে মরবে। একজন দুষ্ট লোক যদি তার দুষ্টতা থেকে ফিরে ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে তার জন্য সে বাঁচবে। তবুও হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা বলে থাক, ‘মাবুদের পথ ঠিক নয়।’ তোমরা যেভাবে চলছ সেই অনুসারে আমি তোমাদের প্রত্যেকের বিচার করব।” আমাদের বন্দীদশার বারো বছরের দশ মাসের পাঁচ দিনের দিন একজন লোক জেরুজালেম থেকে পালিয়ে আমার কাছে এসে বলল, “শত্রুরা শহর দখল করেছে।” লোকটি পৌঁছাবার আগে সন্ধ্যাবেলায় মাবুদের হাত আমার উপরে ছিল এবং সকালবেলায় লোকটি আমার কাছে আসবার আগে তিনি আমার মুখ খুলে দিলেন। কাজেই আমি কথা বলতে লাগলাম, আর চুপ করে রইলাম না। পরে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইল দেশের ধ্বংসস্থানে যারা বাস করছে তারা বলছে, ‘ইব্রাহিম মাত্র একজন মানুষ হয়েও দেশের অধিকার পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তো অনেকজন; কাজেই দেশটা নিশ্চয়ই আমাদের অধিকারের জন্য দেওয়া হয়েছে।’ সেইজন্য তুমি তাদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘তোমরা তো রক্তসুদ্ধ গোশ্‌ত খা"ছ, মূর্তিপূজা করছ আর রক্তপাত করছ; তাহলে কি তোমরা দেশের অধিকারী হবে? তোমরা তো তোমাদের তলোয়ারের উপর ভরসা করছ, জঘন্য কাজকর্ম করছ এবং প্রত্যেকে প্রতিবেশীর স্ত্রীকে নাপাক করছ; তাহলে কি তোমরা দেশের অধিকারী হবে?’ “তুমি তাদের বল যে, আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি, যারা সেই ধ্বংসস্থানে আছে তারা যুদ্ধে মারা পড়বে, যারা মাঠে আছে তাদের খেয়ে ফেলবার জন্য আমি বুনো জন্তুদের কাছে তাদের দেব এবং যারা কেল্লায় ও গুহায় আছে তারা মহামারীতে মারা যাবে। আমি ইসরাইল দেশটাকে একটা জনশূন্য পতিত জায়গা করব; তার শক্তির গর্ব শেষ হয়ে যাবে এবং তার পাহাড়-পর্বত এমনভাবে খালি হয়ে পড়ে থাকবে যে, সেখান দিয়ে কেউ যাওয়া-আসা করবে না। তাদের সব জঘন্য কাজের দরুন আমি যখন দেশটা জনশূন্য পতিত জায়গা করব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “হে মানুষের সন্তান, তোমার জাতির লোকেরা দেয়ালের পাশে ও ঘরের দরজায় একত্র হয়ে তোমার বিষয়ে বলাবলি করছে এবং একে অন্যকে বলছে, ‘মাবুদের কাছ থেকে যে সংবাদ এসেছে চল, আমরা গিয়ে তা শুনি।’ আমার লোকেরা অভ্যাস মতই তোমার কাছে আসে এবং তোমার কথা শুনবার জন্য তোমার সামনে বসে, কিন্তু তারা তা কাজে লাগায় না। মুখে তারা মহব্বতের কথা বলে কিন্তু তাদের অন্তরে থাকে লোভ। এই কথা সত্যি যে, তুমি তাদের কাছে কেবল মিষ্টি সুরে সুন্দরভাবে বাজনা বাজিয়ে ভালবাসার গান গাওয়া একজন লোক ছাড়া আর কিছু নও, কারণ তারা তোমার কথা শোনে বটে, কিন্তু তা কাজে লাগায় না। “যখন এই সব সত্যিই ঘটবে, আর তা নিশ্চয়ই ঘটবে, তখন তারা জানবে যে, তাদের মধ্যে একজন নবী ছিল।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, ইসরাইলের পালকদের বিরুদ্ধে তুমি নবী হিসাবে এই কথা বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘ঘৃণ্য, ইসরাইলের সেই পালকদের, যারা কেবল নিজেদেরই দেখাশোনা করে! মেষপালের দেখাশোনা করা কি পালকদের উচিত নয়? তোমরা তো চর্বি খাও, পশম দিয়ে কাপড় বানিয়ে পর এবং বাছাই করা ভেড়া জবাই কর, কিন্তু তোমরা ভেড়াগুলোর যত্ন কর না। তোমরা দুর্বলদের সবল কর নি, অসুস্থদের সুস্থ কর নি, আহতদের ঘা বেঁধে দাও নি। যারা বিপথে গেছে তাদের তোমরা ফিরিয়ে আন নি কিংবা হারিয়ে যাওয়া লোকদের তালাশ কর নি, বরং কড়া ও নিষ্ঠুরভাবে তাদের শাসন করেছ। পালক নেই বলে তারা ছড়িয়ে পড়েছে এবং বুনো জন্তুর খাবার হয়েছে। আমার ভেড়াগুলো সমস্ত পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা গোটা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে; কেউ তাদের তালাশ করে নি। “ ‘কাজেই, ওহে রাখালেরা, তোমরা আমার কথা শোন। আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, রাখালের অভাবে আমার পাল লুটের জিনিস হয়েছে এবং বুনো জন্তুর খাবার হয়েছে। আমার রাখালেরা আমার পালের খোঁজ করে নি এবং দেখাশোনাও করে নি; তার বদলে তারা নিজেদের দেখাশোনা করেছে। সেইজন্য, ওহে রাখালেরা, আমার কথা শোন। আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আমি পালকদের বিপক্ষে; আমি তাদের হাত থেকে আমার মেষগুলোকে আদায় করে নেব। আমার পাল চরানোর কাজ থেকে আমি তাদের সরিয়ে দেব যাতে তারা আর নিজেরা লাভবান হতে না পারে। তাদের মুখ থেকে আমি আমার পাল রক্ষা করব এবং মেষগুলো আর তাদের খাবার হবে না। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আমি নিজেই আমার ভেড়াগুলোর খোঁজ নেব ও তাদের দেখাশোনা করব। রাখাল যেমন করে তার ছড়িয়ে পড়া পালের খোঁজ করে তেমনি করে আমি আমার ভেড়াগুলোর খোঁজ করব। মেঘ ও অন্ধকারের দিনে তারা যে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে আমি সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করব। আমি নানা জাতি ও দেশের মধ্য থেকে তাদের বের করে আনব এবং তাদের নিজের দেশে তাদের জমায়েত করব। ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের উপরে, নদীগুলোর ধারে এবং দেশের সব বসতি স্থানগুলোতে আমি তাদের চরাব। চরে বেড়াবার ভাল জায়গায় আমি তাদের চরাব এবং ইসরাইলের উঁচু উঁচু পাহাড়ে তাদের চরবার জায়গা হবে। ভাল চরবার জায়গায় তারা থাকবে এবং সেখানে ইসরাইলের পাহাড়গুলোর উপরকার ভাল চারণ ভূমিতে খেয়ে বেড়াবে। আমি নিজেই আমার ভেড়াগুলো চরাব এবং বিশ্রামস্থানে নিয়ে যাব। যারা হারিয়ে গেছে আমিই তাদের খুঁজব এবং যারা বিপথে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনব। আমি আহতদের ঘা বেঁধে দেব এবং দুর্বলদের সবল করব, কিন্তু মোটাসোটা ও বলবানদের আমি ধ্বংস করব, কারণ আমি ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে আমার পালের দেখাশোনা করব। “ ‘হে আমার ছাগল ও ভেড়ার পাল, শোন। আমি ভাল ও খারাপ ছাগল-ভেড়াদের মধ্যে বিচার করব। সমস্ত পুরুষ ভেড়া ও ছাগল খারাপ বলে আমি তাদের শাস্তি দেব।। “ওহে সমস্ত পুরুষ ভেড়া ও পাঠা, তোমাদের পক্ষে ভাল চারণ ভূমিতে খাওয়া কি যথেষ্ট নয়? আবার বাকী ঘাসগুলোও কি পা দিয়ে মাড়াতে হবে? তোমাদের পক্ষে পরিষ্কার পানি খাওয়া কি যথেষ্ট নয়? আবার বাকী পানিও কি পা দিয়ে ঘোলা করতে হবে? তোমরা পা দিয়ে যা মাড়িয়েছ এবং যে পানি ঘোলা করেছ তা-ই কি আমার ভেড়াগুলোকে খেতে হবে? “ ‘দেখ, আমি আল্লাহ্‌ মালিক নিজেই মোটা আর রোগা মেষের মধ্যে বিচার করব। সব দুর্বল মেষগুলোকে তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা শরীর ও কাঁধ দিয়ে তাদের ঠেলছ এবং শিং দিয়ে গুঁতা"ছ। কাজেই আমি আমার মেষগুলোকে রক্ষা করব এবং তারা আর লুটের জিনিস হবে না। আমি ভাল ও খারাপ মেষদের মধ্যে বিচার করব। আমি তাদের উপরে একজন পালককে, অর্থাৎ আমার গোলাম দাউদকে নিযুক্ত করব; সে নিজেই তাদের দেখাশোনা করবে এবং তাদের পালক হবে। আমি আল্লাহ্‌ তাদের মাবুদ হব এবং আমার গোলাম দাউদ তাদের নেতা হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “ ‘আমি তাদের জন্য শান্তির একটা ব্যবস্থা স্থাপন করব এবং দেশ থেকে হিংস্র জন্তুদের শেষ করব যাতে তারা নিরাপদে মরুভূমিতে বাস করতে ও বন্তেজংগলে ঘুমাতে পারে। আমি তাদের দোয়া করব এবং আমার পাহাড়ের চারপাশের জায়গাগুলোকে দোয়া করব। আমি ঠিক সময়ে বৃষ্টি পাঠাব; তা হবে দোয়ার বৃষ্টি। মাঠের গাছে গাছে ফল ধরবে এবং মাটি তার ফসল দেবে; তারা নিরাপদে নিজের নিজের জমিতে বাস করবে। আমি যখন তাদের জোয়াল ভেংগে ফেলব এবং যারা তাদের গোলাম বানিয়েছিল তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনব তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। তারা আর জাতিদের লুটের জিনিস হবে না কিংবা বুনো পশুরাও তাদের খেয়ে ফেলবে না। তারা নিরাপদে বাস করবে এবং কেউ তাদের ভয় দেখাবে না। আমি তাদের উর্বর জমি দেব; দেশের মধ্যে তারা আর দুর্ভিক্ষের হাতে পড়বে না কিংবা অন্যান্য জাতিদের অসম্মানের পাত্র হবে না। তখন তারা জানবে যে, আমি তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের সংগে সংগে আছি এবং তারা, অর্থাৎ বনি-ইসরাইলরা আমারই বান্দা। হে আমার ভেড়ার পাল, আমার চারণ ভূমির পাল, তোমরা আমারই বান্দা এবং আমিই তোমাদের আল্লাহ্‌। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, সেয়ীর পাহাড়ের দিকে তোমার মুখ রেখে তার বিরুদ্ধে এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে সেয়ীর পাহাড়, আমি তোমার বিপক্ষে; আমি তোমার বিরুদ্ধে আমার হাত বাড়িয়ে তোমাকে একটা জনশূন্য পতিত জমি করে রাখব। তোমার শহরগুলো আমি ধ্বংসস্থান করব এবং তুমি জনশূন্য হবে। তখন তুমি জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘তুমি অনেক দিন ধরে ইসরাইলের শত্রু হয়ে আছ এবং তাদের বিপদের সময় যখন তাদের শাস্তি সম্পূর্ণভাবে দেওয়া হয়েছে তখন তুমি তলোয়ারের হাতে তাদের তুলে দিয়েছ। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, আমি তোমাকে রক্তপাতের হাতে তুলে দেব এবং তা তোমার পিছনে তাড়া করবে। তুমি যখন রক্তপাতকে ঘৃণা কর নি তখন রক্তপাতই তোমার পিছনে তাড়া করবে। আমি সেয়ীর পাহাড়কে জনশূন্য ও ধ্বংসস্থান করব এবং যারা সেখানে যাওয়া-আসা করে তাদের সবাইকে শেষ করে দেব। তোমার পাহাড়-পর্বতগুলো আমি নিহত লোকদের দিয়ে ঢেকে দেব; যুদ্ধে যারা মারা গেছে তারা তোমার পাহাড়ে পাহাড়ে, উপত্যকায় উপত্যকায় ও তোমার সব পানির স্রোতে পড়ে থাকবে। চিরকালের জন্য আমি তোমাকে জনশূন্য করে রাখব; তোমার শহরগুলোতে কেউ বাস করবে না। তখন তুমি জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘আমি মাবুদ যদিও ইসরাইল ও এহুদায় উপস্থিত ছিলাম তবুও তুমি বলেছ যে, এই দুই দেশের লোকেরা ও তাদের দেশ তোমাদের হবে এবং তোমরা তা অধিকার করবে। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি যে, তাদের প্রতি ঘৃণায় তুমি যেমন রাগ ও হিংসা দেখিয়েছ সেই হিসাবেই আমি তোমার সংগে ব্যবহার করব; আমি যখন তোমার বিচার করব তখন তাদের মধ্যে আমি নিজেকে প্রকাশ করব। সেই সময় তুমি জানবে যে, তুমি ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের বিরুদ্ধে যে সব কুফরী করেছ তা আমি মাবুদ শুনেছি। তুমি বলেছ যে, সেগুলো ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে এবং তা গ্রাস করবার জন্য তোমাকে দেওয়া হয়েছে। তুমি আমার বিরুদ্ধে গর্ব করে অনেক কথা বলেছ। আমি সেই সব শুনেছি। যখন সমস্ত দুনিয়া আনন্দ করবে তখন আমি তোমাকে জনশূন্য করব। ইসরাইল জাতি অধিকার হিসাবে যে দেশ পেয়েছে তা জনশূন্য দেখে তুমি যেমন আনন্দ করেছ তেমনি করে আমি তোমার সংগে ব্যবহার করব। হে সেয়ীর পাহাড়, তুমি ও ইদোমের বাকী সমস্ত জায়গা জনশূন্য হবে। তখন লোকে জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” কাজেই আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, তোমরা যাতে অন্যান্য জাতিগুলোর দখলে আস এবং লোকদের হিংসার ও নিন্দার পাত্র হও সেইজন্য তারা চারদিক থেকে তোমাদের ধ্বংস ও গ্রাস করেছে। তাই হে ইসরাইলের পাহাড়-পর্বত, তোমরা আমার কালাম শোন। হে বড় বড় ও ছোট ছোট পাহাড়, খাদ ও উপত্যকাগুলো, জনশূন্য সব ধ্বংসস্থান এবং তোমাদের চারপাশের অন্যান্য জাতিরা যেগুলোকে লুট ও হাসির পাত্র করেছে সেই সব ছেড়ে যাওয়া শহরগুলো, আমি আল্লাহ্‌ মালিক তোমাদের বলছি, আমার দিলের জ্বালায় আমি অন্যান্য জাতিদের ও সমস্ত ইদোমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, কারণ তাদের মনের আনন্দ ও হিংসার সংগে তারা আমার দেশকে নিজেদের দখলে এনেছে যাতে তা লুট করতে পারে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “তুমি ইসরাইল দেশ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী বল। তার বড় বড় ও ছোট ছোট পাহাড়, খাদ ও উপত্যকাগুলোকে বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আমার দিলের জ্বালাপূর্ণ রাগে আমি কথা বলছি, কারণ তোমরা অন্যান্য জাতির কাছ থেকে অপমান ভোগ করেছ। সেইজন্য আমি কসম খেয়ে বলছি যে, তোমাদের চারপাশের জাতিরাও অপমান ভোগ করবে। “ ‘কিন্তু হে ইসরাইলের পাহাড়-পর্বত, তোমরা তোমাদের গাছের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের অনেক ফল দেবে, কারণ তারা শীঘ্রই ফিরে আসবে। আমি তোমাদের পক্ষে আছি এবং তোমাদের দিকে মনোযোগ দেব; তাতে তোমাদের উপর চাষ করা ও বীজ বোনা হবে। আমি তোমাদের উপরে গোটা ইসরাইল জাতির লোকসংখ্যা বাড়িয়ে দেব। শহরগুলোতে লোকজন বাস করবে এবং ধ্বংসস্থানগুলো আবার গড়া হবে। আমি তোমাদের উপরে মানুষ ও পশুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেব এবং তারা ফলবান ও সংখ্যায় অনেক হবে। আমি তোমাদের উপরে আগের মতই লোকজন বাস করাব এবং আগের চেয়েও তোমাদের বেশী সফলতা দান করব। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। আমি তোমাদের উপর দিয়ে লোকজনকে, অর্থাৎ আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের হাঁটা-চলা করাব। তারা তোমাদের অধিকার করবে এবং তোমরা তাদের অধিকারের জায়গা হবে; তোমরা আর কখনও তাদের সন্তানহারা করবে না। “ ‘হে ইসরাইল দেশ, লোকে তোমাকে বলে যে, তুমি মানুষকে গ্রাস কর এবং নিজের জাতিকে সন্তানহারা কর। কিন্তু আমি বলছি, তুমি মানুষকে আর গ্রাস করবে না কিংবা তোমার জাতিকে সন্তানহারা করবে না। জাতিদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ আর আমি তোমাকে শুনতে দেব না এবং তাদের করা অপমান আর তোমাকে সহ্য করতে হবে না। তোমার দরুন তোমার জাতির লোকেরা আর উচোট খাবে না। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।’ ” তারপর মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, বনি-ইসরাইলরা নিজেদের দেশে বাস করবার সময়ে তাদের আচার-ব্যবহার ও কাজকর্ম দিয়ে দেশটা নাপাক করেছিল। আমার চোখে তাদের আচার-ব্যবহার ছিল স্ত্রীলোকের মাসিকের নাপাকীর মত। সেইজন্য আমি তাদের উপর আমার গজব ঢেলে দিয়েছিলাম, কারণ তারা দেশের মধ্যে রক্তপাত করেছিল আর তাদের মূর্তিগুলো দিয়ে দেশটা নাপাক করেছিল। আমি নানা জাতি ও দেশের মধ্যে তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছি; তাদের আচার-ব্যবহার ও কাজকর্ম অনুসারে আমি তাদের শাস্তি দিয়েছি। তারা জাতিদের মধ্যে যেখানেই গেছে সেখানেই আমার পবিত্র নাম অপবিত্র করেছে, কারণ লোকে তাদের সম্বন্ধে বলেছে, ‘এরা মাবুদের বান্দা, অথচ তাঁর দেশ তাদের ছাড়তে হয়েছে।’ আমার নামের পবিত্রতা রক্ষার দিকে আমার মনোযোগ ছিল, কারণ ইসরাইল জাতি যে সব জাতির মধ্যে গেছে সেখানেই আমার নাম অপবিত্র করেছে। “কাজেই তুমি বনি-ইসরাইলদের বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে বনি-ইসরাইলরা, আমি যে তোমাদের দরুন এই সব কাজ করতে যাচ্ছি তা নয়, কিন্তু আমার সেই পবিত্র নামের দরুনই করব। তোমরা যে সব জাতির মধ্যে গিয়েছ সেখানেই এই নাম অপবিত্র করেছ। যে নাম জাতিদের মধ্যে অসম্মানিত করা হয়েছে আমার সেই মহৎ নামের পবিত্রতা আমি দেখাব; তোমরা তাদের মধ্যে সেই নাম অপবিত্র করেছ। যখন আমি তাদের চোখের সামনে তোমাদের মধ্য দিয়ে নিজের পবিত্রতা দেখাব তখন জাতিরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘আমি জাতিদের মধ্য থেকে তোমাদের বের করে আনব; সমস্ত দেশ থেকে আমি তোমাদের জড়ো করে তোমাদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনব। আমি তোমাদের উপরে পরিষ্কার পানি ছিটিয়ে দেব, আর তাতে তোমরা পাক-সাফ হবে; তোমাদের সমস্ত নোংরামি ও মূর্তি থেকে আমি তোমাদের পাক-সাফ করব। আমি তোমাদের ভিতরে নতুন দিল ও নতুন মন দেব; আমি তোমাদের কঠিন দিল দূর করে নরম দিল দেব। তোমাদের ভিতরে আমি আমার রূহ্‌ স্থাপন করব এবং এমন করব যাতে তোমরা আমার সব নিয়ম পালন কর। তাতে তোমরা আমার শরীয়ত মেনে চলতে মনোযোগী হবে। তোমাদের পূর্বপুরুষদের যে দেশ আমি দিয়েছিলাম সেখানে তোমরা বাস করবে; তোমরা আমারই বান্দা হবে আর আমি তোমাদের আল্লাহ্‌ হব। তোমাদের সব নাপাকী থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করব। আমি তোমাদের প্রচুর ফসল দেব এবং তোমাদের দেশে আমি আর দুর্ভিক্ষ পাঠাব না। আমি গাছের ফল ও ক্ষেতের ফসল বাড়িয়ে দেব যাতে দুর্ভিক্ষের দরুন তোমরা জাতিদের মধ্যে আর অসম্মান ভোগ না কর। তখন তোমাদের খারাপ আচার-ব্যবহার ও অসৎ কাজকর্মের কথা তোমাদের মনে পড়বে এবং নিজেদের গুনাহ্‌ ও জঘন্য কাজকর্মের জন্য নিজেরাই নিজেদের ঘৃণা করবে। তোমরা জেনে রাখ যে, আমি তোমাদের দরুন এই কাজ করতে যাচ্ছি না। হে ইসরাইল জাতি, তোমাদের আচার-ব্যবহারের জন্য তোমরা লজ্জিত ও দুঃখিত হও। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, যেদিন আমি সব গুনাহ্‌ থেকে তোমাদের পরিষ্কার করব সেই দিনই আমি শহরগুলোতে লোকদের বাস করাব এবং ধ্বংসস্থানগুলো আবার তৈরী করা হবে। লোকে যাওয়া-আসা করবার সময় যে দেশটাকে ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকতে দেখত সেই দেশে চাষের কাজ চলবে। তারা বলবে যে, এই দেশটা আগে ধ্বংস হয়ে পড়ে ছিল, কিন্তু এখন সেটা আদন বাগানের মত হয়েছে; তার শহরগুলো ধ্বংস, জনশূন্য ও ভাংগাচোরা হয়ে পড়ে ছিল, কিন্তু এখন সেগুলো দেয়াল-ঘেরা ও বাস করবার জায়গা হয়েছে। তখন তোমাদের চারপাশের বেঁচে থাকা জাতিরা জানবে যে, আমি মাবুদই ভাংগা জায়গা আবার গড়েছি এবং পতিত জায়গায় আবার গাছ লাগিয়েছি। আমি মাবুদই এই কথা বলেছি এবং আমি তা-ই করব।’ ” তারপর আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে বললেন, “আমি আর একবার ইসরাইল জাতিকে আমার কাছে অনুরোধ জানাতে দেব এবং তাদের অনুরোধ অনুসারে আমি ভেড়ার পালের মত তাদের লোকদের অসংখ্য করব। জেরুজালেমে নির্দিষ্ট ঈদের সময়ে যেমন কোরবানীর ভেড়ায় ভরে যায় তেমনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলো অসংখ্য মানুষে ভরে যাবে। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।” মাবুদের হাত আমার উপরে ছিল এবং তিনি তাঁর রূহের দ্বারা আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা উপত্যকার মাঝখানে রাখলেন; জায়গাটা হাড়গোড়ে ভরা ছিল। তিনি সেগুলোর চারপাশ দিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। আমি সেই উপত্যকার মধ্যে অনেক হাড়গোড় দেখলাম; সেগুলো ছিল খুব শুকনা। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মানুষের সন্তান, এই হাড়গুলো কি বেঁচে উঠতে পারে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, তুমিই কেবল তা জান।” তখন তিনি আমাকে সেই হাড়গুলোর কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বলতে বললেন, “ওহে শুকনা সব হাড়, তোমরা মাবুদের কালাম শোন। আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে নিঃশ্বাস ঢুকিয়ে দেব আর তোমরা জীবিত হবে। আমি তোমাদের হাড়ের সংগে হাড় বেঁধে দেব, তোমাদের উপরে গোশ্‌ত জন্মাব এবং চামড়া দিয়ে তা ঢেকে দেব। আমি তোমাদের মধ্যে নিঃশ্বাস দেব আর তোমরা জীবিত হবে। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আমাকে যেমন হুকুম দেওয়া হয়েছিল আমি তখন সেইমতই ভবিষ্যদ্বাণী বললাম। ভবিষ্যদ্বাণী বলবার সময় খট্‌খট্‌ শব্দ হতে লাগল এবং হাড়গুলোর প্রত্যেকটা নিজের নিজের হাড়ের সংগে যুক্ত হল। আমি দেখলাম হাড়ের সংগে হাড়ের বাঁধন হল, তার উপরে গোশ্‌ত হল এবং চামড়া দিয়ে তা ঢাকা পড়ল, কিন্তু তাদের মধ্যে শ্বাস ছিল না। তখন তিনি আমাকে বললেন, “তুমি বাতাসের উদ্দেশে ভবিষ্যদ্বাণী বল; হে মানুষের সন্তান, তুমি এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে বাতাস, তুমি চারদিক থেকে এস এবং এই সব নিহত লোকদের মধ্যে শ্বাস দাও যাতে তারা জীবিত হয়।’ ” সেইজন্য তাঁর হুকুমমতই আমি ভবিষ্যদ্বাণী বললাম আর তখন তাদের মধ্যে শ্বাস ঢুকল; তারা জীবিত হয়ে পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারা ছিল এক বিরাট সৈন্যদল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, এই হাড়গুলো হল গোটা ইসরাইল জাতি। তারা বলছে, ‘আমাদের হাড়গুলো শুকিয়ে গেছে আর আমাদের আশাও চলে গেছে; আমরা মরে গেছি।’ কাজেই তুমি তাদের কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে আমার বান্দারা, আমি তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের তুলে আনব। ইসরাইল দেশে আমি তোমাদের ফিরিয়ে আনব। আমি যখন তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের বের করে আনব তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। আমার রূহ্‌ আমি তোমাদের মধ্যে দেব এবং তোমরা জীবিত হবে। তোমাদের নিজেদের দেশে আমি তোমাদের বাস করাব। তখন তোমরা জানবে যে, আমি মাবুদই এই কথা বলেছি এবং তা করেছি।’ ” পরে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, একটা লাঠি নিয়ে তুমি তার উপর এই কথা লেখ, ‘এহুদা ও তার সংগের বনি-ইসরাইলদের জন্য।’ তারপর আর একটা লাঠি নিয়ে তার উপরে লেখ, ‘আফরাহীমের লাঠি, অর্থাৎ ইউসুফ ও তার সংগের সমস্ত বনি-ইসরাইলদের জন্য।’ পরে সেই দু’টা লাঠি জোড়া দিয়ে একটা লাঠি বানাও যাতে তোমার হাতে সেই দু’টা একটা লাঠিই হয়। “তোমার জাতির লোকেরা যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তুমি কি এর মানে আমাদের বলবে না?’ তখন তুমি তাদের বলবে যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘আফরাহীমের হাতে ইউসুফ ও তার সংগের ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর যে লাঠিটা আছে আমি সেটা নিয়ে এহুদার লাঠির সংগে জোড়া দিয়ে একটা লাঠিই বানাব আর সেই দু’টা আমার হাতে একটাই হবে।’ সেখানে ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের উপরে আমি তাদের নিয়ে একটাই রাজ্য করব। তাদের সকলের উপরে একজনই বাদশাহ্‌ হবে এবং তারা আর কখনও দুই হবে না কিংবা দু’টা রাজ্যে ভাগ হবে না। তাদের সব প্রতিমা, মূর্তি কিংবা তাদের কোন অন্যায় দিয়ে তারা আর নিজেদের নাপাক করবে না। তাদের সব গুনাহ্‌ ও বিপথে যাওয়া থেকে আমি তাদের রক্ষা করব এবং পাক-সাফ করব। তারা আমার বান্দা হবে এবং আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব। “ ‘আমার গোলাম দাউদ তাদের বাদশাহ্‌ হবে এবং তাদের সকলের পালক একজনই হবে। তারা আমার শরীয়ত মতে চলবে এবং আমার সব নিয়ম সতর্ক হয়ে পালন করবে। যে দেশ আমি আমার গোলাম ইয়াকুবকে দিয়েছি, যে দেশে তাদের পূর্বপুরুষেরা বাস করে গেছে সেখানেই তারা বাস করবে। তারা, তাদের ছেলেমেয়েরা ও নাতী-নাতনীরা সেখানে চিরকাল বাস করবে এবং আমার গোলাম দাউদ চিরকাল তাদের বাদশাহ্‌ হবে। আমি তাদের জন্য একটা শান্তির ব্যবস্থা স্থাপন করব; সেটা হবে একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা। আমি তাদের শক্তিশালী করব ও তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেব এবং আমার ঘর আমি চিরকালের জন্য তাদের মধ্যে স্থাপন করব। আমার বাসস্থান হবে তাদের মধ্যে; আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব এবং তারা আমার বান্দা হবে। আমার ঘর যখন চিরকালের জন্য তাদের মধ্যে হবে তখন জাতিরা সব জানবে যে, আমি মাবুদই ইসরাইলকে পবিত্র করেছি।’ ” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি মাজুজ দেশের মেশক ও তূবলের প্রধান শাসনকর্তা ইয়াজুজের দিকে মুখ করে এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে মেশক ও তূবলের প্রধান শাসনকর্তা ইয়াজুজ, আমি তোমার বিপক্ষে। আমি তোমাকে পিছন ঘুরিয়ে তোমার চোয়ালে কড়া লাগাব এবং তোমার গোটা সৈন্যদলের সংগে, অর্থাৎ সব ঘোড়া, সুন্দর পোশাক পরা সব ঘোড়সওয়ার এবং ছোট-বড় ঢাল ও তলোয়ার সুদ্ধ এক বিরাট দলের সংগে তোমাকে বের করে আনব। তাদের সংগে থাকবে পারস্য, ইথিওপিয়া ও লিবিয়া দেশের সৈন্যেরা; তারা সবাই ঢালধারী ও মাথা রক্ষার টুপি পরা। গোমর দেশের সব সৈন্যেরা এবং উত্তর দিকের শেষ সীমার বৈৎ-তোগর্ম দেশের সব সৈন্যেরা তোমার সংগে থাকবে। অনেক জাতিই তোমার সংগী হবে। “ ‘তুমি প্রস্তুত হও; তুমি ও তোমার চারপাশে জমায়েত হওয়া সমস্ত দলবল, তোমরা নিজেদের প্রস্তুত কর এবং তুমি তাদের সেনাপতি হও। অনেক বছর পরে তোমাকে যুদ্ধের জন্য ডাকা হবে। তখন তুমি এমন একটা দেশ আক্রমণ করবে যে দেশ যুদ্ধ থেকে রেহাই পেয়েছে, যার লোকেরা অনেক জাতির মধ্য থেকে ইসরাইলের পাহাড়-পর্র্বতে জড়ো হয়েছে। সেই দেশ অনেক দিন ধরে জনশূন্য হয়ে ছিল, কিন্তু তোমার আক্রমণের আগে নানা জাতির মধ্য থেকে তার লোকদের বের করে আনা হবে, আর তখন তারা সবাই নিরাপদে বাস করবে। তুমি ও তোমার সব সৈন্যেরা এবং তোমার সংগের অনেক জাতি সেই দেশ আক্রমণ করতে ঝড়ের মত এগিয়ে যাবে; তোমরা মেঘের মত করে দেশটাকে ঢেকে ফেলবে। “ ‘সেই দিন তোমার মনে নানা চিন্তা আসবে এবং তুমি একটা খারাপ মতলব আঁটবে। তুমি বলবে যে, তুমি এমন একটা দেশ আক্রমণ করবে যেখানকার গ্রামগুলোতে দেয়াল নেই। তুমি শান্তিতে ও নিশ্চিন্তে থাকা লোকদের আক্রমণ করবে যারা দেয়াল, দরজা ও আগল ছাড়াই বাস করে। তুমি তাদের জিনিসপত্র কেড়ে নেবে ও লুট করবে এবং ধ্বংসস্থান ঠিক করে নেওয়া জায়গাগুলোর বিরুদ্ধে আর জাতিদের মধ্য থেকে জড়ো হওয়া লোকদের বিরুদ্ধে তোমার হাত উঠাবে। সেই সময় সেই লোকেরা পশুপাল ও জিনিসপত্রে ধনী থাকবে এবং দেশটা হবে দুনিয়ার কেন্দ্র। “ ‘তখন সাবা, দদান এবং সেপন ও তার সব গ্রামগুলোর ব্যবসায়ীরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, তুমি লুটপাট করতে এসেছ কিনা এবং সোনা-রূপা, পশুপাল ও জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য আর অনেক জিনিস কেড়ে নেবার জন্য তোমার দলবল জড়ো করেছ কি না।’ “কাজেই, হে মানুষের সন্তান, তুমি ইয়াজুজকে এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘সেই দিন যখন আমার বান্দা ইসরাইল নিরাপদে বাস করবে তখন তুমি কি তা খেয়াল করবে না? উত্তর দিকের শেষ সীমায় তোমার জায়গা থেকে তুমি ও তোমার সংগের অনেক জাতির লোকেরা ঘোড়ায় চড়ে একটা বিরাট দল, একটা শক্তিশালী সৈন্যদল হয়ে চলে আসবে। দেশটা মেঘের মত করে ঢেকে ফেলবার জন্য তুমি আমার বান্দা ইসরাইলের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসবে। হে ইয়াজুজ, কেয়ামতের দিনে আমি আমার দেশের বিরুদ্ধে তোমাকে আনব। তখন আমি জাতিদের চোখের সামনে তোমার মধ্য দিয়ে নিজেকে পবিত্র বলে দেখাব যাতে তারা আমাকে জানতে পারে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি যে, আগেকার কালে আমার গোলামদের, অর্থাৎ ইসরাইলের নবীদের মধ্য দিয়ে আমি যার কথা বলেছি সে কি তুমি নও? সেই সময় বছরের পর বছর নবীরা বলেছিল যে, আমি তোমাকে তাদের বিরুদ্ধে আনব। সেই দিন যখন ইয়াজুজ ইসরাইল দেশ আক্রমণ করবে তখন আমার ভীষণ রাগ জ্বলে উঠবে। আমার আগ্রহে ও জ্বলন্ত রাগে আমি ঘোষণা করছি যে, সেই সময়ে ইসরাইল দেশে ভীষণ ভূমিকমপ হবে। তখন সাগরের মাছ, আকাশের পাখী, বনের পশু, মাটির উপরকার প্রত্যেকটি বুকে-হাঁটা প্রাণী আর দুনিয়ার সমস্ত লোক আমার সামনে কাঁপতে থাকবে। বড় বড় পাহাড় উল্টে যাবে, খাড়া উঁচু পাহাড় টুকরা টুকরা হয়ে পড়বে এবং সব দেয়াল মাটিতে পড়ে যাবে। আমার দেশের সব পাহাড়-পর্বতের উপরে ইয়াজুজের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ডেকে আনব। প্রত্যেক মানুষের তলোয়ার থাকবে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। আমি মহামারী ও রক্তপাত দিয়ে ইয়াজুজকে শাস্তি দেব; আমি ভীষণ বৃষ্টি, শিলা ও জ্বলন্ত গন্ধক তার উপর, তার সৈন্যদের উপর ও তার সংগের সমস্ত জাতির উপর ঢেলে দেব। এইভাবে অনেক জাতির চোখের সামনে আমি নিজেকে প্রকাশ করব; আমি যে মহৎ ও পবিত্র তা দেখাব। তখন তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ “হে মানুষের সন্তান, ইয়াজুজের বিরুদ্ধে তুমি এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে মেশক ও তূবলের প্রধান শাসনকর্তা ইয়াজুজ, আমি তোমার বিপক্ষে। আমি তোমাকে পিছন ঘুরিয়ে টেনে নিয়ে যাব। আমি তোমাকে উত্তর দিকের শেষ সীমা থেকে নিয়ে এসে ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের বিরুদ্ধে পাঠাব। তারপর আমি আঘাত করে তোমার বাঁ হাত থেকে তোমার ধনুক ও ডান হাত থেকে তোমার তীরগুলো ফেলে দেব। ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের উপরে তুমি, তোমার সব সৈন্যেরা ও তোমার সংগের জাতিরা পড়ে থাকবে। আমি তোমাকে শকুন ও বুনো পশুদের খাবার হিসাবে দেব। তুমি খোলা মাঠে পড়ে থাকবে, কারণ আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলেছি। আমি মাজুজের উপরে এবং যারা দূরের দেশগুলোতে নিরাপদে বাস করছে তাদের উপরে আগুন পাঠাব; তাতে তারা জানবে যে, আমিই মাবুদ। “ ‘আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আমি আমার পবিত্রতা প্রকাশ করব। আমার নাম আমি আর অপবিত্র হতে দেব না; তাতে জাতিরা জানবে যে, আমিই মাবুদ, ইসরাইলের মধ্যে আল্লাহ্‌ পাক। এটা আসছে, এটা হবেই হবে। এই দিনের কথাই আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলেছি। “ ‘তখন যারা ইসরাইলের শহরে বাস করছে তারা বাইরে গিয়ে জ্বালানি কাঠ হিসাবে অস্ত্রশস্ত্র পোড়াবে। তারা ছোট ও বড় ঢাল, তীর ও ধনুক এবং যুদ্ধের গদা ও বর্শা সাত বছর ধরে কাঠের বদলে পোড়াবে। মাঠ থেকে কিংবা বন্তজংগল থেকে তাদের আর জ্বালানি কাঠ জোগাড় করতে হবে না, কারণ কাঠের বদলে তারা অস্ত্রশস্ত্রগুলোই পোড়াবে। তারা তাদের লুটকারীদের জিনিসপত্র লুট করবে; তাদের জিনিসপত্র যারা কেড়ে নিয়েছে তাদের জিনিসপত্র তারা কেড়ে নেবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ ‘সেই দিন আমি ইয়াজুজকে ইসরাইলের মধ্যে একটা কবরস্থান দেব। সেটা হবে সাগরের পূর্ব দিকে যাত্রীদের উপত্যকার মধ্যে। যারা যাওয়া-আসা করে তাদের পথ এটা বন্ধ করে দেবে, কারণ ইয়াজুজ ও তার সব দলবলকে সেখানে দাফন করা হবে। সেইজন্য এটাকে বলা হবে ইয়াজুজের দলবলের উপত্যকা। বনি-ইসরাইলরা সাত মাস ধরে তাদের কবর দিয়ে দেশটা পাক-সাফ করবে। দেশের সব লোক তাদের কবর দেবে। এইভাবে আমার মহিমা প্রকাশ করবার দিনে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। সেই সাত মাসের শেষে দেশটা পাক-সাফ করবার জন্য লোকদের নিযুক্ত করা হবে। তারা দেশময় ঘুরে বেড়িয়ে মাটিতে পড়ে থাকা হাড়গোড়ের খোঁজ করবে এবং সেগুলো কবর দেবে। দেশের মধ্যে ঘোরাফেরার সময় তাদের কেউ যদি মানুষের একটা হাড় দেখে তবে যে পর্যন্ত না কবর খুঁড়বার লোকেরা সেটাকে ইয়াজুজের দলবলের উপত্যকায় কবর দেয় সেই পর্যন্ত তারা সেই হাড় দেখাবার জন্য একটা চিহ্ন খাড়া করে রাখবে। এইভাবে তারা দেশটা পাক-সাফ করবে। সেই উপত্যকায় একটা শহরের নাম হবে হামোনা (যার মানে দলবল)।’ “হে মানুষের সন্তান, আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, তুমি সব রকম পাখী ও সব বুনো পশুদের ডাক দিয়ে বল, ‘তোমরা জড়ো হও এবং আমি তোমাদের জন্য ইসরাইলের পাহাড়-পর্বতের উপরে যে বিরাট কোরবানীর ব্যবস্থা করছি তার জন্য চারদিক থেকে একত্র হও। সেখানে তোমরা গোশ্‌ত ও রক্ত খাবে। তোমরা শক্তিশালী লোকদের গোশ্‌ত খাবে এবং দুনিয়ার শাসনকর্তাদের রক্ত খাবে; এই লোকেরা যেন বাশন দেশের মোটাসোটা পুরুষ ভেড়া, বাচ্চা-ভেড়া, ছাগল ও ষাঁড়। যে কোরবানীর ব্যবস্থা আমি তোমাদের জন্য করব তাতে তোমরা পেট না ভরা পর্যন্ত চর্বি খাবে এবং মাতাল না হওয়া পর্যন্ত রক্ত খাবে। আমার টেবিলে তোমরা পেট ভরে ঘোড়া, রথচালক, শক্তিশালী লোক ও সব রকমের সৈন্যদের গোশ্‌ত খাবে।’ “আমি জাতিদের মধ্যে আমার মহিমা প্রকাশ করব এবং আমার শক্তিশালী হাত দিয়ে তাদের যে শাস্তি দেব তা সমস্ত জাতিই দেখবে। সেই দিন থেকে বনি-ইসরাইলরা জানবে যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌। আর জাতিরা জানবে যে, বনি-ইসরাইলরা তাদের গুনাহের জন্য বন্দীদশায় গিয়েছিল, কারণ তারা আমার প্র্রতি বেঈমানী করেছিল। সেইজন্য আমার মুখ আমি তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে রেখেছিলাম এবং শত্রুদের হাতে তাদের তুলে দিয়েছিলাম; তারা সবাই যুদ্ধে মারা পড়েছিল। তাদের নাপাকী ও গুনাহ্‌ অনুসারে আমি তাদের সংগে ব্যবহার করেছিলাম এবং তাদের কাছ থেকে আমার মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলাম।” আল্লাহ্‌ মালিক আরও বললেন, “আমি এখন ইয়াকুবকে বন্দীদশা থেকে ফিরিয়ে আনব ও ইসরাইলের সব লোকদের মমতা করব এবং আমার নামের পবিত্রতার জন্য আগ্রহী হব। যখন তারা তাদের দেশে নিরাপদে বাস করবে এবং কেউ তাদের ভয় দেখাবে না তখন আমার প্রতি বেঈমানীর দরুন তাদের লজ্জার কথা তারা ভুলে যাবে। জাতিদের মধ্য থেকে আমি যখন তাদের ফিরিয়ে আনব এবং শত্রুদের দেশ থেকে তাদের জড়ো করব তখন অনেক জাতির চোখের সামনে আমি তাদের মধ্য দিয়ে আমার পবিত্রতা প্রকাশ করব। তখন তারা জানবে যে, আমিই তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, কারণ নানা জাতির মধ্যে তাদের বন্দীদশায় পাঠালেও আমি তাদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনব, কাউকে ফেলে রাখব না। তাদের কাছ থেকে আমি আমার মুখ আর ফিরিয়ে রাখব না, কারণ বনি-ইসরাইলদের উপরে আমি আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” আমাদের বন্দীদশার পঁচিশ বছরের শুরুতে, মাসের দশ দিনের দিন, জেরুজালেম শহরের পতনের চৌদ্দ বছর পরে মাবুদের হাত আমার উপরে ছিল। আল্লাহ্‌র দেওয়া দর্শনের মধ্যে তিনি আমাকে ইসরাইল দেশে নিয়ে গিয়ে একটা খুব উঁচু পাহাড়ের উপরে রাখলেন। সেই পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে কতগুলো দালান ছিল যেগুলো দেখতে শহরের মত। তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন আর আমি একটা মানুষকে দেখলাম যার শরীর ব্রোঞ্জের মত ঝক্‌মক করছিল। হাতে মসীনার দড়ি ও মাপের কাঠি নিয়ে তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। লোকটি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি চোখ দিয়ে দেখ ও কান দিয়ে শোন এবং আমি তোমাকে যা দেখাব তার সব কিছুতে মনোযোগ দাও, কারণ সেইজন্যই তোমাকে এখানে আনা হয়েছে। তুমি যা কিছু দেখবে সবই বনি-ইসরাইলদের বলবে।” আমি দেখলাম একটা দেয়াল দিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের চারপাশটা ঘেরা রয়েছে। লোকটির হাতের মাপকাঠিটা লম্বায় ছয় হাত; প্রত্যেক হাত এক হাত চার আংগুল করে লম্বা। তিনি দেয়ালটা মাপলেন; সেটা এক মাপকাঠি মোটা আর এক মাপকাঠি উঁচু। তারপর তিনি পূর্বমুখী দরজার কাছে গেলেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ঢুকবার মুখটা মাপলেন; সেটা লম্বায় ছিল এক মাপকাঠি। দরজায় পাহারাদারদের কামরাগুলো এক মাপকাঠি লম্বা ও এক মাপকাঠি চওড়া এবং এক কামরা থেকে আর এক কামরার মধ্যেকার দেয়াল পাঁচ হাত মোটা ছিল। দরজার শেষ অংশে বায়তুল-মোকাদ্দস মুখী কামরায় ঢুকবার মুখটা ছিল এক মাপকাঠি লম্বা। তারপর তিনি সেই কামরাটা মাপলেন; সেটা চওড়ায় ছিল সেই কামরায় ঢুকবার মুখের চওড়ার চেয়ে দু’পাশে এক মাপকাঠি করে বেশী। সেই কামরাটা লম্বায় ছিল আট হাত এবং তা থেকে বের হবার পথের দু’পাশের থাম দু’টা ছিল দুই হাত করে চওড়া। দরজার শেষে সেই কামরাটার মুখ ছিল বায়তুল-মোকাদ্দসের দিকে। পূর্ব দিকের দরজার ভিতরের দু’পাশে তিনটা করে মোট ছয়টা কামরা ছিল; সেগুলোর প্রত্যেকটির মাপ সমান এবং সেগুলোর মধ্যেকার দেয়ালগুলোর প্রত্যেকটির মাপ একই ছিল। তারপর তিনি দরজার মাপ নিলেন; তার ঢুকবার পথ লম্বায় ছিল তেরো হাত এবং ঢুকবার মুখটা চওড়ায় ছিল দশ হাত। পাহারাদারদের প্রত্যেকটি কামরার সামনে ছিল এক হাত উঁচু ও এক হাত চওড়া দেয়াল এবং কামরাগুলো লম্বা ও চওড়ায় ছিল ছয় হাত। তারপর তিনি দরজার ছাদের চওড়ার মাপ নিলেন; তিনি একটা কামরার বাইরের দিক থেকে তার সামনের কামরার বাইরের দিক পর্যন্ত মাপলেন্ত একটা কামরার দেয়ালের খোলা জায়গা থেকে তার সামনের কামরার দেয়ালের খোলা জায়গার দূরত্ব ছিল পঁচিশ হাত। তিনি দরজার থাম দু’টার উচ্চতা ষাট হাত করে ধরলেন। থাম দু’টা থেকে দরজার উঠান শুরু হয়েছে। দরজায় ঢুকবার মুখ থেকে দরজার শেষ সীমার কামরা পর্যন্ত দূরত্ব ছিল পঞ্চাশ হাত। কামরাগুলোর বাইরের দেয়ালে এবং থাম দু’টার পাশের দেয়ালে জালি দেওয়া জানালা ছিল, আর দরজার শেষে যে কামরা ছিল তার দেয়ালেও তা-ই ছিল; এইভাবে দরজার দেয়ালগুলোতে ঐ রকম জানালা ছিল। এছাড়া থাম দু’টার গায়ে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। তারপর তিনি আমাকে বাইরের উঠানে নিয়ে গেলেন। উঠানের সব দিকে আমি মোট ত্রিশটা এক দিক খোলা কামরা দেখলাম; সেগুলোর সামনে বাঁধানো জায়গা ছিল। সেই বাঁধানো জায়গা প্রত্যেকটি দরজার দু’পাশেও ছিল এবং দরজার লম্বার সমান ছিল; এটা ছিল নীচের বাঁধানো জায়গা। তারপর তিনি পূর্ব দিকের বাইরের উঠানের দরজার শেষ সীমা থেকে ভিতরের উঠানের দরজায় ঢুকবার মুখ পর্যন্ত মাপলেন; তার দূরত্ব ছিল একশো হাত। সেইভাবে উত্তর দিকের দূরত্বও ছিল একশো হাত। তারপর তিনি বাইরের উঠানের উত্তরমুখী দরজার লম্বা ও চওড়া মাপলেন। তার দু’পাশের তিনটা করে কামরার মাপ ও তার থামগুলো এবং তার শেষের কামরার মাপ প্রথম দরজার সব কিছুর মাপের মতই ছিল। সেটা ছিল পঞ্চাশ হাত লম্বা ও পঁচিশ হাত চওড়া। তার জানালাগুলো, শেষের কামরা ও থামগুলোর খোদাই করা খেজুর গাছ পূর্বমুখী দরজার মতই ছিল। সেখানে উঠবার সিঁড়ির সাতটা ধাপ ছিল এবং দরজার শেষ সীমায় তার কামরা ছিল। ভিতরের উঠানের পূর্বমুখী দরজার মতই তার উত্তরমুখী একটা দরজা ছিল। তিনি বাইরের উঠানের দরজা থেকে ভিতরের উঠানের দরজা পর্যন্ত মাপলেন; তা একশো হাত হল। তারপর তিনি আমাকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে গেলেন। আমি বাইরের উঠানের দক্ষিণমুখী একটা দরজা দেখলাম। তিনি সেই দরজার থামগুলো ও শেষের কামরা মাপলেন। অন্য দরজাগুলোর মত তার একই মাপ হল। অন্যান্য দরজার মতই এই দরজায়ও জানালা ছিল। দরজাটা ছিল পঞ্চাশ হাত লম্বা ও পঁচিশ হাত চওড়া। সেখানে উঠবার সিঁড়ির সাতটা ধাপ ছিল এবং দরজার শেষ সীমায় তার কামরা ছিল। দরজার ভিতরের দু’পাশের থামগুলোতে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। ভিতরের উঠানেরও একটা দক্ষিণমুখী দরজা ছিল। তিনি সেই দরজা থেকে বাইরের উঠানের দক্ষিণমুখী দরজা পর্যন্ত মাপলেন; তা একশো হাত হল। তারপর তিনি ভিতরের উঠানের দক্ষিণমুখী দরজার মধ্য দিয়ে আমাকে ভিতরের উঠানে নিয়ে গেলেন এবং দরজাটা মাপলেন; সেটা অন্যগুলোর মত একই মাপের হল। সেই দরজার পাহারাদারদের কামরাগুলো, থাম দু’টা ও শেষের কামরাটা অন্যগুলোর মত একই মাপের ছিল। অন্যান্য দরজার মতই এই দরজায়ও জানালা ছিল। দরজাটা ছিল পঞ্চাশ হাত লম্বা ও পঁচিশ হাত চওড়া। ভিতরের উঠানের বিভিন্ন স্থানে থামের উপরে ছাদ দেওয়া জায়গা ছিল। সেগুলো ছিল পঁচিশ হাত লম্বা ও পাঁচ হাত চওড়া। ভিতরের উঠানের দক্ষিণমুখী দরজায় ঢুকবার কামরার মুখ ছিল বাইরের উঠানের দিকে। দরজায় ঢুকবার পথের দু’পাশের থামগুলোতে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। সেখানে উঠবার সিঁড়ির আটটা ধাপ ছিল। তারপর তিনি আমাকে ভিতরের উঠানের পূর্ব দিকে নিয়ে আসলেন এবং সেখানকার দরজাটা মাপলেন; সেটার মাপ অন্যগুলোর মতই ছিল। তার পাহারাদারদের কামরাগুলো, থাম দু’টা ও ঢুকবার কামরাটা অন্যগুলোর মত একই মাপের ছিল। অন্যান্য দরজার মত এই দরজায়ও জানালা ছিল। দরজাটা পঞ্চাশ হাত লম্বা ও পঁচিশ হাত চওড়া ছিল। তার ঢুকবার কামরার মুখ ছিল বাইরের উঠানের দিকে। দরজায় ঢুকবার পথের দু’পাশের থামগুলোতে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। সেখানে উঠবার সিঁড়ির আটটা ধাপ ছিল। তারপর তিনি আমাকে উত্তর-দরজার কাছে এনে সেটা মাপলেন। সেটা অন্যগুলোর মত একই মাপের ছিল। তার পাহারাদারদের কামরাগুলো, থাম দু’টা ও ঢুকবার কামরাটা অন্যগুলোর মত একই মাপের ছিল। অন্যান্য দরজার মত এই দরজায়ও জানালা ছিল। দরজাটা পঞ্চাশ হাত লম্বা ও পঁচিশ হাত চওড়া ছিল। তার থাম দু’টা ছিল বাইরের উঠানের দিকে; সেগুলোতে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। সেখানে উঠবার সিঁড়ির আটটা ধাপ ছিল। বাইরের উঠানের মধ্যে ভিতরের দরজার থামের পাশে এক দিক খোলা একটা কামরা ছিল; সেটা ছিল পোড়ানো-কোরবানীর পশুর গোশ্‌ত ধোবার জায়গা। দরজায় ঢুকবার কামরার দু’পাশে দু’টা করে টেবিল ছিল। সেগুলোর উপরে পোড়ানো-কোরবানী, গুনাহের কোরবানী ও দোষের কোরবানীর পশুর গোশ্‌ত টুকরা করা হয়। উত্তরমুখী দরজায় ঢুকবার পথের এক পাশে সিঁড়ির কাছে দু’টা টেবিল এবং সিঁড়ির অন্য পাশে দু’টা টেবিল ছিল। এইভাবে দরজার একপাশে চারটা ও অন্য পাশে চারটা মোট আটটা টেবিল ছিল যার উপর কোরবানীর পশুর গোশ্‌ত টুকরা করা হয়। পোড়ানো-কোরবানীর জন্য যে চারটা টেবিল ছিল সেগুলো পাথর কেটে তৈরী করা; প্রত্যেকটা টেবিল ছিল দেড় হাত লম্বা, দেড় হাত চওড়া ও এক হাত উঁচু। সেখানে কোরবানীর যন্ত্রপাতি রাখা হয়। চার আংগুল লম্বা দু’কাঁটার আঁকড়া দেয়ালের গায়ে লাগানো ছিল। টেবিলগুলোর উপরে কোরবানীর গোশ্‌ত রাখা হয়। ভিতরের উঠানের মধ্যে দরজার পাশে কাওয়ালদের জন্য তিনটা এক দিক খোলা কামরা ছিল; দু’টা উত্তর-দরজার পাশে দক্ষিণমুখী আর একটা পূর্ব-দরজার পাশে উত্তরমুখী। তারপর তিনি উঠানটা মাপলেন। সেটা ছিল একশো হাত লম্বা ও একশো হাত চওড়া একটা চারকোণা জায়গা। আর কোরবানগাহ্‌টি বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে ছিল। তারপর তিনি আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসের বারান্দায় আনলেন এবং বারান্দার সামনের থাম দু’টা ও ঢুকবার পথের দু’পাশের বাজু মাপলেন। প্রত্যেকটা বাজু পাঁচ হাত চওড়া ও তিন হাত মোটা ছিল। বারান্দাটা ছিল বিশ হাত লম্বা এবং এগারো হাত চওড়া। সেখানে উঠবার একটা সিঁড়ি ছিল এবং সেই দু’টা বাজুর সামনে ছিল একটা করে থাম। তারপর তিনি আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কামরায় এনে দরজার বাজু দু’টা মাপলেন; দু’দিকের বাজু চওড়ায় ছিল ছয় হাত করে; বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালও ছিল ছয় হাত মোটা। দুই বাজুর মাঝখানের জায়গাটা ছিল দশ হাত এবং প্রত্যেকটা বাজু পাঁচ হাত মোটা ছিল। তিনি প্রধান কামরাটাও মাপলেন; সেটা চল্লিশ হাত লম্বা ও বিশ হাত চওড়া ছিল। তারপর তিনি ভিতরের কামরায় গিয়ে সেখানে ঢুকবার দরজার বাজু দু’টা মাপলেন; প্রত্যেকটা বাজু ছিল দু’হাত করে চওড়া। দুই বাজুর মাঝখানের জায়গাটা ছিল ছয় হাত এবং বাজুর সংগে লাগানো দু’পাশের দেয়াল লম্বায় ছিল সাত হাত করে। তারপর তিনি ভিতরের কামরার মাপ নিলেন; সেটা লম্বায় ছিল বিশ হাত আর চওড়ায় ছিল বিশ হাত। তিনি আমাকে বললেন, “এটাই মহাপবিত্র স্থান।” তারপর তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়াল মাপলেন; সেটা ছিল ছয় হাত মোটা এবং সেই দেয়ালের বাইরের দিকের তিন পাশের গা ঘেঁষে যে কামরাগুলো ছিল তার প্রত্যেকটা চার হাত চওড়া ছিল। সেই কামরাগুলো একটার উপরে আর একটা করে তিন তলা ছিল; প্রত্যেক তলায় ত্রিশটা করে কামরা ছিল। কামরাগুলোর ভার বইবার জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের তিন পাশে থাক্‌ ছিল। কামরাগুলোর বীম সেই থাকের উপর বসানো ছিল, বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের মধ্যে ঢুকানো ছিল না। সেইজন্য বায়তুল-মোকাদ্দসের তিন পাশের কামরাগুলো চওড়ায় নীচের তলা থেকে উপরের তলা পর্যন্ত পর পর বেড়ে গেছে। নীচের তলা থেকে দু’তলার মধ্য দিয়ে উপর তলা পর্যন্ত একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। আমি দেখলাম, বায়তুল-মোকাদ্দস একটা উঁচু সমান জায়গার উপর রয়েছে এবং সেটাই ছিল বায়তুল-মোকাদ্দস ও কামরাগুলোর ভিত্তি। সেই ভিত্তি এক মাপকাঠি, অর্থাৎ ছয় হাত উঁচু ছিল এবং কামরাগুলো থেকে পাঁচ হাত বাড়ানো ছিল। বায়তুল-মোকাদ্দসের পাশের কামরাগুলোতে ঢুকবার জন্য উত্তর দিকে একটা ও দক্ষিণ দিকে আর একটা দরজা ছিল এবং সেই দু’টা দরজা খোলা জায়গার দিকে মুখ করা ছিল। ভিত্তির সেই পাঁচ হাত বাড়ানো অংশটা ছিল দরজা দু’টার কাছে যাবার পথ। বায়তুল-মোকাদ্দসের পশ্চিম দিকে খোলা জায়গার শেষ সীমায় একটা দালান ছিল। সেটা সত্তর হাত চওড়া এবং নব্বই হাত লম্বা ছিল। তার চারপাশের দেয়ালগুলো ছিল পাঁচ হাত মোটা। তারপর তিনি বায়তুল-মোকাদ্দস মাপলেন; সেটা ছিল লম্বায় একশো হাত এবং বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে খোলা জায়গা ও পিছনের দেয়াল সুদ্ধ দালানটা লম্বায় ছিল একশো হাত। পূর্ব দিকে বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে যে খোলা জায়গা ছিল তা লম্বায় ছিল একশো হাত। একটা মানুষের মুখ ও অন্যটা সিংহের মুখ; মানুষের মুখ একটা খেজুর গাছের দিকে ও সিংহের মুখ অন্য খেজুর গাছের দিকে। গোটা বায়তুল-মোকাদ্দসের দেয়ালের চারদিকে এগুলো খোদাই করা ছিল। প্রত্যেকটি কামরার দেয়ালে মেঝে থেকে শুরু করে ঢুকবার মুখের উপরের জায়গা পর্যন্ত সব জায়গায় কারুবী ও খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। প্রধান কামরার দরজার ফ্রেমটা চারকোণা ছিল এবং মহাপবিত্র স্থানের দরজাটাও একই রকম ছিল। প্রধান কামরায় তিন হাত উঁচু, দু’হাত লম্বা ও দু’হাত চওড়া কাঠের একটা কোরবানগাহ্‌ ছিল; এর চার কোণা, ভিত্তি ও চারপাশ ছিল কাঠের তৈরী। তিনি আমাকে বললেন, “এটা হচ্ছে সেই টেবিল যেটা মাবুদের সামনে রয়েছে।” প্রধান কামরা ও মহাপবিত্র স্থানে একটা করে দুই পাল্লার দরজা ছিল। প্রত্যেকটা পাল্লা দু’টা তক্তা দিয়ে তৈরী; তক্তা দু’টা কব্‌জার উপরে ঘোরে। প্রধান কামরার দরজার পাল্লা দু’টার উপরে দেয়ালের মতই কারুবী ও খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। বারান্দায় ঢুকবার মুখের ছাদের নীচে একটা বীম ছিল। বারান্দার জালি দেওয়া জানালাগুলোর দু’পাশে ও বাজুগুলোতে খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। এছাড়া বায়তুল-মোকাদ্দসের বীমগুলোতে ও পাশের কামরাগুলোতেও খেজুর গাছ খোদাই করা ছিল। পরে তিনি আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসের উত্তর দিকের বাইরের উঠানে এনে একটা দালানে নিয়ে গেলেন। সেই দালানটা বায়তুল-মোকাদ্দসের উত্তর দিকের খোলা জায়গার পাশে এবং পশ্চিম দিকের দালানটার কাছে ছিল। সেটা ছিল একশো হাত লম্বা ও পঞ্চাশ হাত চওড়া এবং তাতে ঢুকবার পথ ছিল উত্তরমুখী। এই দালানটা ছিল ভিতরের উঠানের বিশ হাতের সেই খোলা জায়গা এবং বাইরের উঠানের বাঁধানো জায়গার মধ্যে। দালানটা তিন তলা ছিল এবং প্রত্যেক তলায় কামরাগুলোর সামনে হাঁটবার পথ ছিল। সেই পথ ছিল দশ হাত চওড়া; সেখান থেকে দালানের ভিতরের খোলা জায়গায় যাবার জন্য এক হাত চওড়া একটা পথ ছিল। দালানের কামরাগুলো উত্তর দিকে খোলা ছিল। বায়তুল-মোকাদ্দসের দক্ষিণ দিকে ঠিক একই রকম একটা দালান ছিল। সেটা ছিল ভিতরের উঠানের খোলা জায়গার পাশে এবং পশ্চিম দিকের দালানটার কাছে। উত্তর দিকের মতই এই দালানটা বরাবর একটা পথ ছিল। এই দালানটা সব দিক থেকে, অর্থাৎ লম্বা, চওড়া, ঢুকবার পথ এবং ভিতরের পরিকল্পনা উত্তর দিকের দালানের মত ছিল। সেই দালানের ঢুকবার পথ ছিল দক্ষিণ দিকে। দালানটার পূর্ব দিকে আর একটা ঢুকবার পথ ছিল এবং তার সামনেও একটা দেয়াল ছিল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, “বায়তুল-মোকাদ্দসের খোলা জায়গার উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দালান দু’টা ইমামদের। যে ইমামেরা মাবুদের কাছে যায় তারা এই দালান দু’টাতে কোরবানীর মহাপবিত্র জিনিসগুলো খাবে। সেখানে তারা শস্য-কোরবানী, গুনাহের কোরবানী ও দোষের কোরবানীর মহাপবিত্র জিনিসগুলো রাখবে, কারণ দালান দু’টা পবিত্র। ইমামেরা এবাদত-কাজের জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসে যে পোশাকগুলো পরে ঢুকবে সেগুলো এই দালান দু’টাতে খুলে রাখবে এবং তার পরে বাইরের উঠানে যেতে পারবে, কারণ সেগুলো পবিত্র পোশাক। সাধারণ লোকদের জায়গায় যাবার আগে তাদের অন্য কাপড় পরতে হবে।” বায়তুল-মোকাদ্দসের চারপাশের দেয়ালের ভিতরের সব কিছু মাপা শেষ করলে পর তিনি আমাকে পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে বাইরে আনলেন এবং বাইরের চারপাশের এলাকাটা মাপলেন। পবিত্র জায়গা থেকে সাধারণ লোকদের জায়গা আলাদা করবার জন্য চারপাশের প্রত্যেক দিকে পাঁচশো মাপকাঠি লম্বা একটা দেয়াল ছিল। তারপর তিনি আমাকে পূর্বমুখী দরজার কাছে আনলেন, আর আমি পূর্ব দিক থেকে ইসরাইলের আল্লাহ্‌র মহিমা আসতে দেখলাম। তাঁর গলার আওয়াজ ছিল জোরে বয়ে যাওয়া পানির গর্জনের মত এবং তাঁর মহিমায় দুনিয়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই দর্শন দেখে আমি উবুড় হয়ে পড়লাম; আমি শহর-ধ্বংসের যে দর্শন কবার নদীর ধারে দেখেছিলাম এই দর্শনটা ছিল তারই মত। মাবুদের মহিমা পূর্বমুখী দরজার মধ্য দিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকল। তখন মাবুদের রূহ্‌ আমাকে তুলে ভিতরের উঠানে নিয়ে গেলেন, আর মাবুদের মহিমায় বায়তুল-মোকাদ্দস ভরে গেল। সেই মানুষটি তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর আমি বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্য থেকে কাউকে আমার সংগে কথা বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, “হে মানুষের সন্তান, এটাই আমার সিংহাসনের স্থান ও আমার পা রাখবার জায়গা। আমি এখানেই বনি-ইসরাইলদের মধ্যে চিরকাল বাস করব। বনি-ইসরাইলরা আর কখনও আমার পবিত্র নাম কলংকিত করবে না। তাদের কিংবা তাদের বাদশাহ্‌দের মূর্তিপূজা দ্বারা এবং পূজার উঁচু স্থানে তাদের বাদশাহ্‌দের লাশ নিয়ে যাবার দ্বারা আমার নাম কলংকিত করবে না। তারা আমার ঘরের পাশেই তাদের ঘর তৈরী করেছিল; তাদের ঘর ও আমার ঘরের মধ্যে কেবল একটা দেয়াল ছিল। তাদের জঘন্য কাজ দ্বারা তারা আমার পবিত্র নাম কলংকিত করেছিল। কাজেই আমি রাগে তাদের ধ্বংস করেছিলাম। এখন তারা আমার কাছ থেকে তাদের মূর্তিপূজা ও তাদের বাদশাহ্‌দের লাশ দূর করুক; তাতে আমি চিরকাল তাদের মধ্যে বাস করব। “হে মানুষের সন্তান, তুমি বনি-ইসরাইলদের কাছে বায়তুল-মোকাদ্দসের বিষয় বল এবং এর নক্‌শাটার বিষয় চিন্তা করে দেখতে বল, যাতে তারা তাদের গুনাহের জন্য লজ্জিত হয়। তারা যদি তাদের সব কাজের জন্য লজ্জিত হয় তবে বায়তুল-মোকাদ্দসের নক্‌শাটার খুঁটিনাটি তাদের জানাও; তার কাঠামো, তার বাইরে যাবার ও ভিতরে ঢুকবার পথ, অর্থাৎ তার পুরো নক্‌শা ও তার সব নিয়ম ও শরীয়ত তাদের কাছে প্রকাশ কর। তার সব কিছু তাদের সামনে লেখ যাতে তারা তার নক্‌শা অনুুসারে কাজ করতে পারে এবং তার সব নিয়ম মেনে চলতে পারে। “এই হল বায়তুল-মোকাদ্দসের আইন্ত পাহাড়ের উপরকার চারদিকের সব এলাকা হবে মহা পবিত্র। বায়তুল-মোকাদ্দসের আইন এই রকমই। “বায়তুল-মোকাদ্দসের কোরবানগাহের মাপ হাতের মাপ অনুসারে করা হয়েছিল; প্রত্যেক হাত ছিল এক হাত চার আংগুল করে। এই হল কোরবানগাহের মাপ: কোরবানগাহের ভিত্তিটা এক হাত উঁচু ও তার চারদিক কোরবানগাহ্‌ থেকে এক হাত করে বাড়ানো এবং ভিত্তির চারদিকের কিনারা আধ হাত উঁচু। কোরবানগাহ্‌টি এই রকম উঁচু হবে- মাঝখানের অংশটাও চারকোনা বিশিষ্ট, চৌদ্দ হাত লম্বা ও চৌদ্দ হাত চওড়া। কাজেই সেই অংশটা তার উপরের অংশ থেকে চারদিকে এক হাত বাড়ানো থাকবে; তার কিনারা আধা হাত উঁচু থাকবে। কোরবানগাহের সিঁড়িগুলো পূর্বমুখী।” তারপর তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন যে, কোরবানগাহ্‌টি তৈরী হলে পর যেদিন সেটি মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী করা হবে যাতে তার উপর পোড়ানো-কোরবানী দেওয়া ও রক্ত ছিটানো যায় সেই দিন এই নিয়ম পালন করতে হবে: সাদোকের বংশের যে ইমামেরা আমার এবাদত-কাজ করবার জন্য আমার কাছে আসে তুমি গুনাহের কোরবানীর জন্য তাদের একটা যুবা ষাঁড় দেবে। তুমি তার কিছু রক্ত নিয়ে কোরবানগাহের চারটা শিংয়ে, মাঝখানের অংশের চার কোণায় ও কিনারার সব দিকে লাগাবে; এইভাবে গুনাহ্‌ ঢেকে কোরবানগাহ্‌টি পাক-সাফ করবে। তুমি গুনাহের কোরবানীর জন্য জবাই করা ষাঁড়টা নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের এলাকার বাইরে পবিত্র জায়গার নির্দিষ্ট স্থানে সেটা পোড়াবে। “দ্বিতীয় দিনে তুমি একটা নিখুঁত ছাগল নিয়ে আসবে, আর ইমামেরা গুনাহের কোরবানী দেবে এবং কোরবানগাহ্‌টি ষাঁড়ের রক্ত দিয়ে যেমন পাক-সাফ করা হয়েছিল তেমনিভাবে পাক-সাফ করবে। “সাত দিন ধরে তোমাকে প্রতিদিন গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা করে ছাগল দিতে হবে। এছাড়াও একটা যুবা ষাঁড় ও পাল থেকে একটা ভেড়া দিতে হবে; সবগুলোই যেন নিখুঁত হয়। ইমামেরা সাত দিন ধরে কোরবানগাহের গুনাহ্‌ ঢাকবার কাজ করে সেটা পাক-সাফ করবে; এইভাবে তারা কোরবানগাহ্‌টি পবিত্র করবে। এই দিনগুলো শেষ হলে পর আট দিনের দিন থেকে ইমামেরা সেই কোরবানগাহের উপর তোমাদের পোড়ানো ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবে। তখন আমি তোমাদের কবুল করব। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” তারপর সেই মানুষটি আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসের পূর্বমুখী বাইরের দরজার কাছে ফিরিয়ে আনলেন; দরজাটা বন্ধ ছিল। মাবুদ আমাকে বললেন, “এই দরজাটা বন্ধই থাকবে, খোলা হবে না যাতে কেউ এর ভিতর দিয়ে ঢুকতে না পারে। এটা বন্ধ থাকবে, কারণ ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ এর মধ্য দিয়ে ঢুকেছেন। কেবলমাত্র শাসনকর্তাই দরজার মধ্যে বসে মাবুদের সামনে খেতে পারবে। সে শেষের কামরা দিয়ে দরজায় ঢুকবে আর একই পথ দিয়ে বের হবে।” তারপর সেই মানুষটি আমাকে উত্তর দরজার পথ দিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের সামনে নিয়ে আসলেন। আমি দেখলাম মাবুদের ঘরটা তাঁর মহিমায় ভরে গেছে; তখন আমি উবুড় হয়ে পড়লাম। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি ভাল করে দেখ ও কান দিয়ে শোন এবং আমার ঘর সম্বন্ধে আমি তোমাকে যে সব নিয়ম ও শরীয়তের বিষয় বলব তার প্রত্যেকটিতে মনোযোগ দাও। বায়তুল-মোকাদ্দসে কারা ঢুকতে পারবে এবং কারা ঢুকতে পারবে না সেই বিষয়ে মনোযোগ দাও। তুমি বিদ্রোহী জাতি ইসরাইলকে বল যে, আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, ‘হে বনি-ইসরাইলরা, তোমাদের জঘন্য আচার-ব্যবহার যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের অন্যান্য জঘন্য আচার-ব্যবহারের সংগে তোমরা আমার কাছে খাবার, চর্বি ও রক্ত কোরবানী দেবার সময় অন্তর ও শরীরে খৎনা-না-করানো বিদেশীদের আমার ঘরে এনে আমার ঘর অপবিত্র করেছ এবং তাদের কাজের মধ্য দিয়ে তোমরা আমার ব্যবস্থা বাতিল করেছ। আমার পাক-পবিত্র জিনিসগুলোর প্রতি তোমাদের যে কর্তব্য করবার কথা তা না করে আমার ঘরের ভার তোমরা অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছ। যে বিদেশীদের অন্তর ও শরীরের খৎনা করানো হয় নি তারা আমার ঘরে ঢুকতে পারবে না; এমন কি, বনি-ইসরাইলদের মধ্যে বাস করা বিদেশীরাও পারবে না। “ ‘বনি-ইসরাইলরা যখন বিপথে গিয়েছিল তখন তাদের সংগে যে লেবীয়রা আমাকে ছেড়ে তাদের মূর্তিগুলোর পিছনে ঘুরে বেড়িয়ে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তাদের গুনাহের ফল তাদের বহন করতেই হবে। তবুও বায়তুল-মোকাদ্দসের দরজাগুলো রক্ষার ভার পেয়ে ও সেখানে কাজ করে তারা আমার ঘরের এবাদত-কাজ করতে পারবে। তারা পোড়ানো-কোরবানীর পশু জবাই করতে ও লোকদের জন্য কোরবানী দিতে পারবে এবং লোকদের সেবা করবার জন্য তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু তারা মূর্তিগুলোর সামনে লোকদের সেবা করেছে এবং ইসরাইল জাতিকে গুনাহে ফেলেছে, সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ মালিক কসম খেয়েছি যে, তাদের গুনাহের ফল তাদের বহন করতেই হবে। তারা ইমাম হিসাবে আমার এবাদত-কাজ করবার জন্য আমার কাছে আসবে না কিংবা আমার কোন পবিত্র কিংবা মহাপবিত্র জিনিসের কাছে আসতে পারবে না; তাদের জঘন্য আচার-ব্যবহারের লজ্জা তাদের বহন করতেই হবে। তবুও বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রতি কর্তব্য ও সেখানকার সমস্ত কাজের ভার আমি তাদের উপর দেব। “ ‘কিন্তু বনি-ইসরাইলরা যখন আমার কাছ থেকে বিপথে গিয়েছিল তখন সাদোকের বংশের যে লেবীয়রা ইমাম হিসাবে আমার ঘরে বিশ্বস্তভাবে তাদের কর্তব্য করেছে তারাই আমার এবাদত-কাজ করতে আমার কাছে আসতে পারবে; তারা চর্বি ও রক্ত কোরবানী দেবার জন্য আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। তারাই কেবল আমার ঘরে ঢুকতে পারবে; কেবল তারাই আমার এবাদত-কাজের জন্য আমার টেবিলের কাছে আসতে পারবে এবং তারাই আমার ঘরের সমস্ত কাজ করবে। “ ‘মসীনার পোশাক পরে তারা ভিতরের উঠানের দরজাগুলো দিয়ে ঢুকবে; ভিতরের উঠানের দরজাগুলোর কাছে কিংবা বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে এবাদত-কাজের সময় তারা কোন পশমের পোশাক পরতে পারবে না। তাদের মাথায় মসীনার পাগড়ী থাকবে এবং তারা মসীনার জাংগিয়া পরবে; যাতে ঘাম হয় এমন কাপড় তারা পরবে না। তারা যখন বাইরের উঠানে থাকা লোকদের কাছে যাবে তখন এবাদত-কাজের জন্য তারা যে পোশাক পরেছিল তা খুলে পবিত্র কামরায় রেখে অন্য কাপড়-চোপড় পরবে, যাতে তাদের পোশাকের ছোঁয়ায় লোকেরা পবিত্র হয়ে না যায়। “ ‘তাদের মাথার চুল তারা কামিয়ে ফেলবে না কিংবা চুল লম্বা রাখবে না কিন্তু চুল ছোট করে কাটবে। কোন ইমাম আংগুর-রস খেয়ে ভিতরের উঠানে ঢুকবে না। বিধবা কিংবা স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে এমন কোন স্ত্রীলোককে তারা বিয়ে করবে না; তারা কেবল ইসরাইল জাতির অবিবাহিতা মেয়েদের কিংবা ইমামের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে। যা পবিত্র করা হয়েছে ও যা পবিত্র করা হয় নি তার মধ্যে পার্থক্য কি তা তারা আমার বান্দাদের শিক্ষা দেবে এবং কোন্‌টা পাক ও কোন্‌টা নাপাক তা তাদের দেখিয়ে দেবে। “ ‘কোন মামলা-মকদ্দমা হলে ইমামেরা বিচারকের কাজ করবে এবং আমার নির্দেশ অনুসারে তার রায় দেবে। আমার নির্দিষ্ট করা সব ঈদগুলোর জন্য তারা আমার শরীয়ত ও নিয়মগুলো পালন করবে এবং বিশ্রাম দিনগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করবে। “ ‘ইমাম কোন মৃত লোকের কাছে গিয়ে নিজেকে নাপাক করবে না; কিন্তু মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই কিংবা অবিবাহিতা বোনের জন্য নিজেকে নাপাক করতে পারবে। পাক-সাফ হলে পর তাকে সাত দিন অপেক্ষা করতে হবে। তারপর যেদিন সে এবাদত-কাজের জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিতরের উঠানে যাবে সেই দিন তাকে নিজের জন্য গুনাহের কোরবানী দিতে হবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “ ‘ইমামদের সম্পত্তি বলতে কেবল আমিই থাকব। তোমরা বনি-ইসরাইলরা তোমাদের দেশে তাদের কোন সম্পত্তি দেবে না; আমিই হব তাদের সম্পত্তি। তারা শস্য-কোরবানী, গুনাহের কোরবানী ও দোষের কোরবানীর জিনিস খাবে; ইসরাইল দেশে মাবুদের উদ্দেশে দেওয়া প্রত্যেকটি জিনিসই তাদের হবে; সেগুলো ছাড়িয়ে আনা যাবে না। প্রথমে কাটা সব রকম ফসলের সবচেয়ে ভাল অংশটা এবং তোমাদের সমস্ত উপহারগুলো ইমামদের হবে। তোমাদের নতুন ময়দার প্রথম অংশ তোমরা তাদের দেবে যাতে তোমাদের পরিবারের উপর দোয়া থাকে। মরে গেছে কিংবা বুনো জানোয়ারে ছিঁড়ে ফেলেছে এমন কোন পাখী বা পশু ইমামেরা খাবে না। “ ‘তোমরা যখন সম্পত্তি হিসাবে দেশের জমি ভাগ করে দেবে তখন পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা ও বিশ হাজার মাপকাঠি চওড়া দেশের এক খণ্ড জমি মাবুদকে দেবে; সেই পুরো এলাকাটাই হবে পবিত্র। তার মধ্য থেকে পাঁচশো মাপকাঠি লম্বা ও পাঁচশো মাপকাঠি চওড়া একটা অংশ বায়তুল-মোকাদ্দসের জন্য থাকবে; তার চারপাশে পঞ্চাশ হাত খোলা জায়গা থাকবে। সেই পুরো পবিত্র এলাকার মধ্য থেকে পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা এবং দশ হাজার মাপকাঠি চওড়া একটা অংশ মেপে রাখবে। এই অংশের মধ্যেই বায়তুল-মোকাদ্দস, অর্থাৎ মহাপবিত্র জায়গা থাকবে। এই অংশটা ইমামদের জন্য; তা পবিত্র। ইমামেরা বায়তুল-মোকাদ্দসে সেবা করে এবং মাবুদের এবাদত করবার জন্য তাঁর সামনে এগিয়ে যায়। সেই জায়গাতেই হবে তাদের ঘর-বাড়ী এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের জন্য পবিত্র জায়গা। বাকী পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা ও দশ হাজার মাপকাঠি চওড়া জায়গা সেই লেবীয়দের অধিকারে থাকবে যারা বায়তুল-মোকাদ্দসের কাজ করে। সেখানেই তারা বাস করবে। “ ‘পবিত্র এলাকার পাশে পাঁচ হাজার মাপকাঠি চওড়া ও পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা একটা অংশ শহরের জন্য রাখতে হবে। সেই শহর গোটা ইসরাইল জাতির জন্য থাকবে। “ ‘পবিত্র এলাকা ও শহরের সীমানার পূর্ব ও পশ্চিম পাশের জমি শাসনকর্তার হবে। শাসনকর্তার এই দুই জায়গা দেশের পশ্চিম ও পূর্ব সীমানা পর্যন্ত যাবে। এই জায়গার উত্তর-দক্ষিণের মাপ পবিত্র এলাকা ও শহরের উত্তর-দক্ষিণের মাপের সমান হবে। এই জায়গা ইসরাইল দেশের শাসনকর্তার অধিকারে থাকবে। আমার শাসনকর্তারা আমার বান্দাদের উপর আর জুলুম করবে না, বরং ইসরাইল জাতিকে তার গোষ্ঠীগুলো অনুসারে জমি ভোগ করতে দেবে। “ ‘হে ইসরাইলের শাসনকর্তারা, আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, যথেষ্ট হয়েছে। এখন জোর-জবরদস্তি ও জুলুম করা ছেড়ে দিয়ে তোমরা ন্যায় ও সৎ কাজ কর। আমার বান্দাদের জায়গা তোমাদের দখলে নেওয়া বন্ধ কর। তোমরা ঠিক দাঁড়িপাল্লা ও অন্যান্য মাপের জিনিস ব্যবহার কর। ঐফা ও বাৎ-এর মাপ সমান হবে; এক বাৎ হোমরের দশ ভাগের একভাগ এবং এক ঐফাও হোমরের দশ ভাগের এক ভাগ; এই দু’টাই মাপা হবে হোমর অনুসারে। এক শেখেলে থাকবে বিশ গেরা। এক মানিতে থাকবে ষাট শেখেল। “ ‘তোমরা উপহার হিসাবে যা দেবে তা হল: তোমাদের সমস্ত গমের ষাট ভাগের এক ভাগ, সমস্ত যবের ষাট ভাগের এক ভাগ, সমস্ত জলপাই তেলের একশো ভাগের এক ভাগ। তেলের পরিমাণ মাপবার জন্য বাৎ-এর মাপ ব্যবহার করতে হবে। দশ বাৎ-এর সমান এক হোমর আর এক হোমরের সমান এক কোর। ইসরাইল দেশের মধ্যে ভাল জমিতে চরে এমন প্রতি দু’শো ছাগল-ভেড়া থেকে একটা বাচ্চা দেবে। লোকদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য এগুলো শস্য-কোরবানী, পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানীর জন্য ব্যবহার করা হবে। দেশের সব লোক ইসরাইলের শাসনকর্তাকে এই উপহার দেবে। শাসনকর্তার কর্তব্য হবে সব ঈদ, অমাবস্যা ও বিশ্রাম দিনের জন্য, অর্থাৎ ইসরাইল জাতির নির্দিষ্ট সমস্ত ঈদের জন্য পোড়ানো-কোরবানী, শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানীর জিনিস যোগান দেওয়া। সে ইসরাইল জাতির গুনাহ্‌ ঢাকা দেবার জন্য গুনাহের কোরবানী, শস্য-কোরবানী, পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানীর জিনিস যোগান দেবে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক আরও বলছি, তোমরা প্রথম মাসের প্রথম দিনে একটা নিখুঁত যুবা ষাঁড় নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দস পাক-সাফ করবে। ইমাম গুনাহের কোরবানীর কিছু রক্ত নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের দুই বাজুতে, কোরবানগাহের উপরের অংশের চার কোণায় ও ভিতরের উঠানের দরজার দুই বাজুতে লাগাবে। যারা ভুল করে কিংবা না জেনে বায়তুল-মোকাদ্দসের বিরুদ্ধে কোন গুনাহ্‌ করে ফেলে তোমরা তাদের জন্য মাসের সাত দিনের দিন ঐ একই কাজ করবে। এইভাবে তোমরা গুনাহ্‌ ঢাকা দিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দস পাক-সাফ করবে। “ ‘প্রথম মাসের চৌদ্দ দিনের দিন তোমরা উদ্ধার-ঈদ পালন করবে। এই ঈদটি সাত দিনের; সেই সময়ে তোমাদের খামিহীন রুটি খেতে হবে। সেই দিন শাসনকর্তা তার নিজের ও দেশের সব লোকদের জন্য গুনাহের কোরবানী হিসাবে একটা ষাঁড় দেবে। ঈদের সাত দিনের প্রত্যেক দিন সে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য নিখুঁত সাতটা ষাঁড় ও সাতটা ভেড়া দেবে এবং গুনাহের কোরবানীর জন্য একটা ছাগল দেবে। শস্য-কোরবানী হিসাবে তাকে প্রত্যেক ষাঁড় ও ভেড়ার জন্য আঠারো কেজি ময়দা এবং পৌনে চার লিটার তেল দিতে হবে। “ ‘সাত মাসের পনেরো দিনের দিন যে সাত দিনের ঈদ শুরু হয় সেই সময় কোরবানীর জন্য শাসনকর্তা গুনাহের কোরবানীর, পোড়ানো-কোরবানীর ও শস্য-কোরবানীর জিনিস এবং তেল দেবে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক বলছি, ভিতরের উঠানের পূর্বমুখী দরজাটা কাজের ছয় দিন বন্ধ থাকবে, কিন্তু বিশ্রাম দিনে ও অমাবস্যার দিনে সেটা খোলা হবে। তখন শাসনকর্তাকে বাইরে থেকে দরজায় ঢুকবার কামরা দিয়ে ঢুকে দরজার বাজুর পাশে দাঁড়াতে হবে। ইমামেরা তার পোড়ানো-কোরবানী ও যোগাযোগ-কোরবানী দেবে। দরজায় ঢুকবার মুখে সে এবাদত করবার পরে বের হয়ে যাবে, কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত দরজা খোলা থাকবে। লোকেরাও বিশ্রামবার ও অমাবস্যাতে সেই দরজার বাইরে মাবুদের এবাদত করবে। বিশ্রাম দিনে শাসনকর্তাকে মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য ছয়টা বাচ্চা-ভেড়া ও একটা পুরুষ ভেড়া আনতে হবে; সবগুলোই যেন নিখুঁত হয়। পুরুষ ভেড়ার সংগে শস্য-কোরবানীর জন্য আঠারো কেজি ময়দা দিতে হবে আর বাচ্চা-ভেড়াগুলোর সংগে যতটা খুশী ততটা ময়দা দিতে হবে; প্রত্যেক আঠারো কেজি ময়দার জন্য পৌনে চার লিটার করে তেল দিতে হবে। অমাবস্যার দিনে তাকে একটা যুবা ষাঁড় ও ছয়টা বাচ্চা-ভেড়া ও একটা পুরুষ ভেড়া কোরবানী দিতে হবে; সবগুলোই যেন নিখুঁত হয়। ষাঁড়ের সংগে তাকে আঠারো কেজি ময়দা, পুরুষ ভেড়ার সংগে আঠারো কেজি ময়দা আর বাচ্চা-ভেড়ার সংগে যতটা খুশী ততটা ময়দা শস্য-কোরবানী হিসাবে দিতে হবে; প্রত্যেক আঠারো কেজি ময়দার জন্য পৌনে চার লিটার করে তেল দিতে হবে। শাসনকর্তাকে দরজায় ঢুকবার কামরা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে এবং একই পথে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। “ ‘নির্দিষ্ট সব ঈদের সময়ে দেশের লোকেরা যখন এবাদতের জন্য মাবুদের সামনে আসবে তখন যে কেউ উত্তর দরজা দিয়ে ঢুকবে সে দক্ষিণ দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে আর যে দক্ষিণ দরজা দিয়ে ঢুকবে সে উত্তর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে। লোকে যে দরজা দিয়ে ঢুকবে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, কিন্তু প্রত্যেককে ঢুকবার দরজার উল্টা দিকের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে। ভিতরে যাবার সময় শাসনকর্তাকে লোকদের সংগে ভিতরে যেতে হবে এবং বাইরে যাবার সময় লোকদের সংগেই বের হয়ে যেতে হবে। “ ‘ঈদ ও নির্দিষ্ট মেজবানীর সময়ে একটা ষাঁড়ের জন্য আঠারো কেজি ময়দা, ভেড়ার জন্য আঠারো কেজি ময়দা এবং বাচ্চা-ভেড়াগুলোর জন্য যতটা খুশী ততটা ময়দা দিতে হবে; প্রত্যেক আঠারো কেজি ময়দার সংগে পৌনে চার লিটার করে তেল দিতে হবে। শাসনকর্তা যখন মাবুদের উদ্দেশে নিজের ইচ্ছায় কোন কোরবানী দিতে চায়- তা সেটা পোড়ানো-কোরবানীই হোক বা যোগাযোগ-কোরবানীই হোক- তখন তার জন্য পূর্বমুখী দরজাটা খুলে দিতে হবে। বিশ্রাম দিনের মত করেই সে তার পোড়ানো-কোরবানী কিংবা যোগাযোগ-কোরবানী দেবে। তারপর সে বাইরে গেলে দরজাটা বন্ধ করা হবে। “ ‘মাবুদের উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানীর জন্য তোমাদের প্রতিদিন একটা করে এক বছরের নিখুঁত বাচ্চা-ভেড়া কোরবানী দিতে হবে; প্রতিদিন সকালে তোমাদের তা করতে হবে। এছাড়া এর সংগে রোজ সকালে তোমাদের শস্য-কোরবানীর জিনিসও দিতে হবে; এতে থাকবে তিন কেজি ময়দা ও তাতে ময়ান দেবার জন্য সোয়া এক লিটার তেল। মাবুদের উদ্দেশে এই শস্য-কোরবানী একটা স্থায়ী নির্দেশ। এইভাবে নিয়মিত পোড়ানো-কোরবানীর জন্য রোজ সকালে সেই বাচ্চা-ভেড়া এবং শস্য-কোরবানীর জন্য ময়দা ও তেল যোগান দিতে হবে। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ মালিক আরও বলছি, যদি শাসনকর্তা তার সম্পত্তি থেকে তার কোন ছেলেকে কোন জায়গা দান করে তবে তা তার বংশধরদেরও অধিকারে থাকবে। তারা সেই সম্পত্তির অধিকারী হবে। কিন্তু যদি সে তার সম্পত্তি থেকে তার কোন গোলামকে কোন জায়গা দান করে তবে সেই গোলাম তা ফিরে পাওয়ার বছর পর্যন্ত রাখতে পারবে; তারপর সেটা আবার শাসনকর্তার দখলে আসবে। শাসনকর্তার সম্পত্তি কেবল তার ছেলেরাই পাবে; সেটা তাদেরই হবে। লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে শাসনকর্তা তাদের কোন সম্পত্তিই দখল করতে পারবে না। সে কেবল তার নিজের সম্পত্তি থেকেই তার ছেলেদের দিতে পারবে যাতে আমার বান্দাদের মধ্য থেকে কেউই তার সম্পত্তির মালিকানা না হারায়।’ ” তারপর সেই মানুষটি আমাকে দরজার পাশের ঢুকবার পথ দিয়ে ইমামদের উত্তরমুখী পবিত্র দালানের সামনে নিয়ে আসলেন। তিনি আমাকে দালানের পশ্চিম দিকের শেষ সীমায় একটা জায়গা দেখালেন। তিনি আমাকে বললেন, “এটা সেই জায়গা যেখানে ইমামেরা দোষের কোরবানী ও গুনাহের কোরবানীর গোশ্‌ত সিদ্ধ করবে এবং শস্য-কোরবানীর জিনিস সেঁকে নেবে যাতে সেই পাক-পবিত্র জিনিসগুলো বাইরের উঠানে আনতে না হয়, কারণ সাধারণ কোন লোক সেগুলো ছুঁলে সে পবিত্র হয়ে যাবে।” তারপর তিনি আমাকে বাইরের উঠানে এনে তার চারটা কোণায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন, আর আমি প্রত্যেকটি কোণায় আর একটা করে ছোট উঠান দেখতে পেলাম। দেয়াল-ঘেরা সেই ছোট উঠানগুলোর মাপ ছিল চল্লিশ হাত লম্বা ও ত্রিশ হাত চওড়া। প্র্রত্যেকটা উঠান একই মাপের ছিল। সেই চারটা উঠানের প্রত্যেকটির ভিতরের চারপাশে দেয়ালের সংগে লাগানো পাথরের তাক ছিল এবং সেই তাকের নীচে চারপাশে চুলা ছিল। তিনি আমাকে বললেন, “এগুলো হল চুলা; যারা বায়তুল-মোকাদ্দসের এবাদত-কাজ করে তারা সেখানে লোকদের কোরবানীর জিনিস সিদ্ধ করবে।” তারপর তিনি আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকবার মুখের কাছে ফিরিয়ে আনলেন, আর আমি দেখলাম বায়তুল-মোকাদ্দসের ঢুকবার মুখের তলা থেকে পানি বের হয়ে পূর্ব দিকে বয়ে যাচ্ছে। বায়তুল-মোকাদ্দস পূর্বমুখী ছিল। সেই পানি বায়তুল-মোকাদ্দসের দক্ষিণ পাশের তলা থেকে কোরবানগাহের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। পরে তিনি উত্তর-দরজার মধ্য দিয়ে আমাকে বের করে আনলেন এবং বাইরের পথ দিয়ে ঘুরিয়ে পূর্বমুখী বাইরের দরজার কাছে নিয়ে গেলেন; সেই দরজার দক্ষিণ পাশ দিয়ে অল্প পানি বয়ে যাচ্ছিল। মাপের দড়ি হাতে নিয়ে তিনি মাপতে মাপতে এক হাজার হাত পূর্ব দিকে গেলেন। সেখানে তিনি আমাকে গোড়ালি-ডোবা পানির মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি আর এক হাজার হাত মেপে আমাকে হাঁটু পানির মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি আর এক হাজার হাত মেপে কোমর পর্যন্ত পানির মধ্য দিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি আর এক হাজার হাত মাপলেন, কিন্তু পানি তখন নদী হয়ে যাওয়াতে আমি পার হতে পারলাম না, কারণ পানি বেড়ে গিয়েছিল এবং সাঁতার দেবার মত গভীর হয়েছিল। সেটা এমন নদী হয়েছিল যা কেউ হেঁটে পার হতে পারে না। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি কি এটা দেখলে?” তারপর তিনি আমাকে নদীর কিনারায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে আমি নদীর দু’ধারেই অনেক গাছপালা দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “এই পানি পূর্ব দিকে বয়ে যাচ্ছে এবং আরবার মধ্য দিয়ে মরু-সাগরে গিয়ে পড়ছে। যখন সেটা গিয়ে সাগরে পড়ে তখন সেখানকার পানি মিষ্টি হয়ে যায়। যেখান দিয়ে এই নদীটা বয়ে যাবে সেখানে সব রকমের ঝাঁক-বাঁধা প্রাণী ও প্রচুর মাছ বাস করবে। এই পানি যেখান দিয়ে বয়ে যাবে সেখানকার পানি মিষ্টি করে তুলবে; কাজেই যেখান দিয়ে নদীটা বয়ে যাবে সেখানকার সব কিছুই বাঁচবে। জেলেরা নদীর কিনারায় দাঁড়াবে; ঐন্‌-গদী থেকে ঐন্‌-ইগ্লয়িম পর্যন্ত জাল মেলে দেবার জায়গা হবে। ভূমধ্যসাগরের মাছের মত সেখানেও নানা রকমের অনেক মাছ পাওয়া যাবে। কিন্তু জলাভূমি ও বিলের পানি মিষ্টি হবে না; সেগুলো লবণের জন্য থাকবে। নদীর দুই ধারেই সব রকমের ফলের গাছ জন্মাবে। সেগুলোর পাতা শুকিয়ে যাবে না, ফলও শেষ হবে না। প্রতি মাসেই তাতে ফল ধরবে, কারণ বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে সেখানে পানি বয়ে আসবে। সেগুলোর ফল খাবার জন্য আর পাতা সুস্থ হবার জন্য ব্যবহার করা হবে।” “দেশের সীমানা হবে এই: উত্তর দিকের সীমানা হবে ভূমধ্যসাগর থেকে লেবো-হামা ছাড়িয়ে হিৎলোনের রাস্তা বরাবর সদাদ পর্যন্ত; সেখান থেকে দামেস্ক ও হামার সীমানার মধ্যে থাকা বরোথা ও সিব্রয়িম পর্যন্ত; সেখান থেকে হৌরণের সীমানার পাশের হৎসর-হত্তীকোন পর্যন্ত। এই সীমানা চলে যাবে ভূমধ্যসাগর থেকে দামেস্কের উত্তর সীমার পাশে হৎসোর-ঐনন পর্যন্ত, অর্থাৎ হামার সীমানা পর্যন্ত। এটাই হবে উত্তর দিকের সীমানা। পূর্ব দিকের সীমানা হৌরণ ও দামেস্কের মধ্য দিয়ে গিলিয়দ ও ইসরাইল দেশের মধ্যেকার জর্ডান নদী বরাবর গিয়ে মরু-সাগর পর্যন্ত চলে যাবে। এটাই হবে পূর্ব দিকের সীমানা। দক্ষিণ দিকের সীমানা মরু-সাগরের তামর থেকে কাদেশের মরীবৎ পানি পর্যন্ত গিয়ে মিসরের শুকনা নদী বরাবর ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চলে যাবে। এটাই হবে দক্ষিণের সীমানা। পশ্চিম দিকের সীমানা হবে ভূমধ্যসাগর বরাবর লেবো-হামার উল্টা দিক পর্যন্ত। এটাই হবে পশ্চিম দিকের সীমানা। “ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলো অনুসারে তোমরা নিজেদের মধ্যে দেশটা ভাগ করে নেবে। তোমাদের মধ্যে যে সব বিদেশী তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করছে তাদের জন্য ও তোমাদের জন্য দেশটা সম্পত্তি হিসাবে ভাগ করে দেবে। তাদের তোমরা দেশে জন্মানো ইসরাইলীয় হিসাবে ধরবে। তোমাদের সংগে তারাও ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পত্তি হিসাবে জমির ভাগ পাবে। যে গোষ্ঠীর মধ্যে সেই বিদেশী বাস করবে সেখানেই তোমরা তাকে জমির অধিকার দেবে। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি।” তারপর মাবুদ বললেন, “গোষ্ঠী অনুসারে দেশের জমিজমার ভাগ এইভাবে হবে। দেশের উত্তর সীমায় দান-গোষ্ঠী একটা অংশ পাবে; সেটা ভূমধ্যসাগর থেকে হিৎলোনের রাস্তা বরাবর লেবো-হামা পর্যন্ত যাবে; সেখান থেকে যাবে পূর্ব দিকে দামেস্কের উত্তর সীমার পাশে হৎসোর-ঐনন পর্যন্ত, অর্থাৎ হামার সীমানা পর্যন্ত। আশের একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দানের সীমানার দক্ষিণে। নপ্তালি একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আশেরের সীমানার দক্ষিণে। মানশা একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নপ্তালির সীমানার দক্ষিণে। আফরাহীম একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে মানশার সীমানার দক্ষিণে। রূবেণ একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আফরাহীমের সীমানার দক্ষিণে। এহুদা একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে রূবেণের সীমানার দক্ষিণে। “এহুদার সীমানার দক্ষিণে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত থাকবে সেই জায়গাটা যা তোমরা বিশেষ কাজের জন্য আলাদা করে রাখবে। সেটা চওড়ায় হবে পঁচিশ হাজার মাপকাঠি এবং লম্বায় হবে অন্যান্য গোষ্ঠীর অংশের মত দেশের পূর্ব সীমানা থেকে পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত; সেই জায়গার মাঝখানে থাকবে বায়তুল-মোকাদ্দস। সেই আলাদা করা জায়গা থেকে তোমরা একটা বিশেষ অংশ মাবুদকে দেবে; সেটা লম্বায় হবে পঁচিশ হাজার মাপকাঠি আর চওড়ায় দশ হাজার মাপকাঠি। এটা হবে ইমামদের জন্য পবিত্র অংশ। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে এটা হবে পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা এবং পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দশ হাজার মাপকাঠি চওড়া। তার মাঝখানে থাকবে মাবুদের ঘর। এই বিশেষ অংশটা হবে পবিত্র করা সাদোকের বংশের ইমামদের জন্য। তারা আমার এবাদতে বিশ্বস্ত ছিল এবং বনি-ইসরাইলদের সংগে বিপথে যাওয়া লেবীয়দের মত তারা বিপথে যায় নি। এটা হবে দেশের পবিত্র অংশ থেকে তাদের জন্য একটা বিশেষ অংশ; এই অংশ থাকবে লেবীয়দের অংশের সীমানার পাশে, আর এটা হবে মহাপবিত্র জায়গা। “ইমামদের সীমানার পাশে লেবীয়রা পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা ও দশ হাজার মাপকাঠি চওড়া একটা জায়গা পাবে। লেবীয়রা সেই জমি বিক্রি করতে কিংবা তার অংশ বদল করতে পারবে না। সেটা সবচেয়ে ভাল জমি এবং তা অন্যদের হাতে দিয়ে দেওয়া চলবে না, কারণ সেটা মাবুদের উদ্দেশে পবিত্র। “বাকী পাঁচ হাজার মাপকাঠি চওড়া ও পঁচিশ হাজার মাপকাঠি লম্বা এলাকাটা শহরের সাধারণ কাজের জন্য, অর্থাৎ বাড়ী-ঘর ও পশু চরাবার জন্য ব্যবহার করা হবে। শহরটা তার মাঝখানে থাকবে; আর সেই শহরের চারদিকের মাপ হবে চার হাজার পাঁচশো মাপকাঠি করে। শহরের চারদিকে পশু চরাবার জায়গা থাকবে দু’শো পঞ্চাশ মাপকাঠি করে। এই শহরের পূর্ব পাশের দশ হাজার মাপকাঠি এবং পশ্চিম পাশের দশ হাজার মাপকাঠি জায়গায় যে ফসল জন্মাবে তা শহরের কর্মচারীদের খাবার হবে। ইসরাইলের সমস্ত গোষ্ঠী থেকে যারা এই শহরে কাজ করবে তারা এই জমি চাষ করবে। সেই আলাদা করা পুরো জায়গাটা হবে পঁচিশ হাজার মাপকাঠি করে একটা চারকোনা বিশিষ্ট জায়গা। এই জায়গার মধ্যে থাকবে সেই পবিত্র অংশ এবং শহর ও তার আশেপাশের জায়গা। “বাকী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিন্‌ইয়ামীন একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আলাদা করা জায়গার দক্ষিণে। শিমিয়োন একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিন্‌ইয়ামীনের সীমানার দক্ষিণে। ইষাখর একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে শিমিয়োনের সীমানার দক্ষিণে। সবূলূন একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ইষাখরের সীমানার দক্ষিণে। গাদ একটা অংশ পাবে; সেটা হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সবূলূনের সীমানার দক্ষিণে। গাদের অংশের দক্ষিণের সীমানা হল দেশের দক্ষিণের সীমানা। তা তামর থেকে কাদেশের মরীবৎ পানি পর্যন্ত গিয়ে মিসরের শুকনা নদী বরাবর ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চলে যাবে। এই দেশ ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোকে সম্পত্তি হিসাবে তোমরা ভাগ করে দেবে, আর এগুলোই হবে তাদের অংশ। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। সাড়ে চার হাজার মাপকাঠির পূর্ব দিকের দেয়ালের তিনটা দরজার নাম হবে ইউসুফ-দরজা, বিন্‌ইয়ামীন্তদরজা ও দান্তদরজা। সাড়ে চার হাজার মাপকাঠির দক্ষিণ দিকের দেয়ালের তিনটা দরজার নাম হবে শিমিয়োন্তদরজা, ইষাখর-দরজা ও সবূলূন্তদরজা। সাড়ে চার হাজার মাপকাঠির পশ্চিম দিকের দেয়ালের তিনটা দরজার নাম হবে গাদ-দরজা, আশের-দরজা ও নপ্তালি-দরজা। শহরের চারপাশের দেয়ালের মাপ হবে আঠারো হাজার মাপকাঠি। সেই সময় থেকে শহরের নাম হবে, ‘মাবুদ এখানে আছেন।’ ” এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমের রাজত্বের তৃতীয় বছরের সময় ব্যাবিলনের বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার জেরুজালেমে এসে শহরটা ঘেরাও করলেন। দীন-দুনিয়ার মালিক তাঁর হাতে এহুদার বাদশাহ্‌ যিহোয়াকীমকে তুলে দিলেন এবং তাঁর সংগে আল্লাহ্‌র ঘরের কতগুলো পাত্রও তুলে দিলেন। তিনি সেই পাত্রগুলো ব্যাবিলনে তাঁর দেবতার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সেখানকার ধনভাণ্ডারে রেখে দিলেন। পরে বাদশাহ্‌ তাঁর প্রধান রাজকর্মচারী অসপনস্‌কে হুকুম দিলেন যেন তিনি ইসরাইলীয় রাজপরিবার ও সম্মানিত পরিবারগুলোর মধ্য থেকে কয়েকজন যুবককে নিয়ে আসেন। সেই যুবকদের হতে হবে নিখুঁত, সুন্দর, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান, সমস্ত শিক্ষা গ্রহণে চট্‌পটে এবং রাজ-দরবারের কাজ করবার যোগ্য। অসপনস্‌কে হুকুম দেওয়া হল যেন তিনি এই যুবকদের ব্যাবিলনীয়দের ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে শিক্ষা দেন। বাদশাহ্‌ তাঁর খাবার থেকে তাদের প্রতিদিনের পরিমাণ মত খাবার ও আংগুর-রস দেবার নির্দেশ দিলেন। এইভাবে তাদের তিন বছর শিক্ষা দেবার পরে তারা বাদশাহ্‌র কাজে নিযুক্ত হবে। এদের মধ্যে ছিলেন এহুদা-গোষ্ঠীর দানিয়াল, হনানিয়, মীশায়েল ও অসরিয়। সেই প্রধান রাজকর্মচারী তাঁদের নতুন নাম রাখলেন; তিনি দানিয়ালকে বেল্টশৎসর, হনানিয়কে শদ্রক, মীশায়েলকে মৈশক ও অসরিয়কে অবেদ্‌-নগো নাম দিলেন। দানিয়াল কিন্তু মনে মনে ঠিক করলেন যে, তিনি বাদশাহ্‌র খাবার ও আংগুর-রস দিয়ে নিজেকে নাপাক করবেন না। এইভাবে যাতে নিজেকে নাপাক করতে না হয় সেইজন্য তিনি প্রধান রাজকর্মচারীর কাছে অনুমতি চাইলেন। আল্লাহ্‌ সেই রাজকর্মচারীর মনে দানিয়ালের জন্য দয়া ও মমতা দিলেন। তবে সেই রাজকর্মচারী দানিয়ালকে বললেন, “যিনি তোমাদের খাবার ও আংগুর-রসের ব্যবস্থা করেছেন আমি আমার সেই প্রভু মহারাজকে ভয় করি। তিনি তোমাদের বয়সী অন্য যুবকদের চেয়ে কেন তোমাদের রোগা দেখবেন? এতে বাদশাহ্‌ তোমাদের দরুন আমার মাথা কেটে ফেলতে পারেন।” সেই রাজকর্মচারী দানিয়াল, হনানিয়, মীশায়েল ও অসরিয়ের যত্ন নেবার জন্য যে লোককে নিযুক্ত করেছিলেন দানিয়াল তাঁকে বললেন, “আপনি দয়া করে দশ দিন আপনার এই গোলামদের পরীক্ষা করে দেখুন; আপনি আমাদের কেবল শাক-সব্‌জি ও পানি খেতে দেবেন। তারপর বাদশাহ্‌র খাবার খাওয়া সেই যুবকদের সংগে আমাদের চেহারার তুলনা করে দেখবেন এবং আপনি যেমন দেখবেন সেই অনুসারেই আপনার এই গোলামদের সংগে ব্যবহার করবেন।” তিনি এতে রাজী হলেন এবং দশ দিন তাঁদের পরীক্ষা করলেন। দশ দিনের শেষে দেখা গেল বাদশাহ্‌র খাবার খাওয়া যুবকদের সকলের চেয়ে তাঁরা আরও সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হয়েছেন। তখন সেই লোকটি বাদশাহ্‌র খাবার ও আংগুর-রস সরিয়ে দিয়ে তার বদলে তাঁদের শাক-সব্‌জিই দিতে থাকলেন। এই চারজন যুবককে আল্লাহ্‌ সব রকম সাহিত্য ও বিদ্যায় জ্ঞানলাভ করবার ও বুঝবার ক্ষমতা দিলেন; আর দানিয়াল সব রকম দর্শন ও স্বপ্নের বিষয় বুঝতে পারতেন। বাদশাহ্‌র সামনে সেই যুবকদের নিয়ে যাবার জন্য বাদশাহ্‌ যে সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন সেই সময়ের শেষে সেই প্রধান রাজকর্মচারী তাঁদের বখতে-নাসারের সামনে নিয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ তাঁদের সংগে কথা বলে বুঝলেন যে, আর কেউ দানিয়াল, হনানিয়, মীশায়েল ও অসরিয়ের সমান নয়; তাই এই চারজন বাদশাহ্‌র কাজে নিযুক্ত হলেন। জ্ঞান ও বুদ্ধির বিষয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপারে বাদশাহ্‌ তাঁদের জিজ্ঞাসা করে বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা তাঁর সারা রাজ্যের মধ্যেকার সমস্ত জাদুকর ও ভূতের ওঝাদের চেয়ে দশগুণ ভাল। বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছর পর্যন্ত দানিয়াল বাদশাহ্‌র কাজে বহাল রইলেন। বখতে-নাসারের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে তিনি স্বপ্ন দেখলেন; তাতে তাঁর মন অস্থির হল, তিনি ঘুমাতে পারলেন না। তাঁর স্বপ্ন বুঝিয়ে দেবার জন্য তিনি জাদুকর, ভূতের ওঝা, গণক ও জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এসে বাদশাহ্‌র সামনে দাঁড়াল। বাদশাহ্‌ তাদের বললেন, “আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি; তার অর্থ বুঝবার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে।” তখন জ্যোতিষীরা জবাবে আরামীয় ভাষায় বাদশাহ্‌কে বলল, “হে মহারাজ, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকুন। আপনি স্বপ্নটা আপনার গোলামদের বলুন, আমরা তার অর্থ বলে দেব।” জবাবে বাদশাহ্‌ তাদের বললেন, “আমি স্থির করেছি যে, আমার স্বপ্নটা কি এবং তার অর্থ কি তা যদি তোমরা বলতে না পার তবে তোমাদের টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হবে আর তোমাদের বাড়ী-ঘর আবর্জনার স্তূপ করা হবে। কিন্তু যদি তোমরা আমার স্বপ্ন ও তার অর্থ বলতে পার তবে আমার কাছ থেকে তোমরা উপহার, পুরস্কার ও মহা সম্মান লাভ করবে। কাজেই তোমরা সেই স্বপ্নটা ও তার অর্থ আমাকে বল।” জবাবে তারা আবার বলল, “মহারাজ যেন তাঁর গোলামদের কাছে স্বপ্নটা বলেন, আমরা তার অর্থ বলব।” তখন বাদশাহ্‌ বললেন, “আমি নিশ্চয় করে জানি যে, তোমরা দেরি করবার চেষ্টা করছ, কারণ তোমরা বুঝতে পেরেছ যে, এই বিষয়ে আমার মন স্থির আছে। তোমরা যদি স্বপ্নটা আমাকে বলতে না পার তবে মাত্র একটা শাস্তিই তোমাদের জন্য আছে। তোমরা আশা করছ অবস্থার বদল হবে, আর তাই আমাকে মিথ্যা কথা বলে ঠকাবার পরামর্শ করেছ। তোমরা এখন আমাকে স্বপ্নটা বল; তাহলে আমি জানব যে, তোমরা তার অর্থও আমাকে বলতে পারবে।” জ্যোতিষীরা জবাবে বাদশাহ্‌কে বললেন, “মহারাজ আমাদের কাছে যা জানতে চাইছেন তা জানাতে পারে এমন কোন লোক এই দুনিয়াতে নেই। কোন মহান বাদশাহ্‌ কখনও এমন বিষয় কোন জাদুকর বা ভূতের ওঝা বা জ্যোতিষীর কাছে জানতে চান নি। মহারাজ যা চাইছেন তা করা খুবই কঠিন। দেবতারা ছাড়া আর কেউই এটা মহারাজের কাছে প্রকাশ করতে পারবে না, আর তাঁরা তো মানুষের মধ্যে বাস করেন না।” এতে বাদশাহ্‌ এত রেগে গেলেন যে, তিনি ব্যাবিলনে তাঁর সমস্ত পরামর্শদাতাদের হত্যা করবার হুকুম দিলেন। কাজেই বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতাদের হত্যা করবার হুকুম জারি করা হল। তখন দানিয়াল ও তাঁর বন্ধুদের হত্যা করবার জন্য তাঁদের খোঁজে লোক পাঠানো হল। বাদশাহ্‌র দেহরক্ষীদের সেনাপতি অরিয়োক যখন সেই পরামর্শদাতাদের হত্যা করবার জন্য বের হলেন তখন দানিয়াল বুদ্ধি করে সাবধানে তাঁর সংগে কথা বললেন। তিনি সেই সেনাপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহারাজ এই ভীষণ হুকুম কেন দিয়েছেন?” তখন অরিয়োক ব্যাপারটা দানিয়ালের কাছে বুঝিয়ে বললেন। তা শুনে দানিয়াল বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে সময় চাইলেন যাতে তিনি বাদশাহ্‌কে স্বপ্নটার অর্থ বলে দিতে পারেন। তারপর দানিয়াল ঘরে ফিরে গিয়ে তাঁর বন্ধু হনানিয়, মীশায়েল ও অসরিয়কে ব্যাপারটা বললেন। তিনি তাঁদের অনুরোধ করলেন যেন তাঁরা সেই অজানা বিষয় জানবার জন্য বেহেশতের আল্লাহ্‌র কাছে দয়া ভিক্ষা করেন, যাতে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা ব্যাবিলনের অন্যান্য পরামর্শদাতাদের সংগে মারা না পড়েন। রাতের বেলায় একটা দর্শনের মধ্যে সেই অজানা বিষয় দানিয়ালের কাছে প্রকাশিত হল। তখন দানিয়াল বেহেশতের আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন। তিনি বললেন, “চিরকাল আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক; জ্ঞান ও কুদরত তাঁরই। তিনিই সময় ও ঋতু তাঁর অধীনে রাখেন; তিনি বাদশাহ্‌দের সিংহাসনে বসান ও নামিয়ে দেন। তিনি জ্ঞানীদের জ্ঞান দান করেন আর বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি দান করেন। তিনি গভীর ও লুকানো বিষয় প্রকাশ করেন; তিনি জানেন অন্ধকারের মধ্যে কি আছে; তাঁর সংগে আলো বাস করে। হে আমার পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌, আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাই, তোমার প্রশংসা করি, কারণ তুমি আমাকে জ্ঞান ও ক্ষমতা দিয়েছ; আমরা তোমার কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম তা তুমি আমাকে জানিয়েছ; বাদশাহ্‌র স্বপ্নের বিষয় তুমি আমাদের জানিয়েছ।” পরে দানিয়াল অরিয়োকের কাছে গেলেন। বাদশাহ্‌ অরিয়োককেই তাঁর পরামর্শদাতাদের হত্যা করবার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। দানিয়াল অরিয়োককে বললেন, “বাদশাহ্‌র পরামর্শদাতাদের হত্যা করবেন না। আমাকে বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে চলুন; আমি বাদশাহ্‌র স্বপ্নের অর্থ বলব।” অরিয়োক তখনই দানিয়ালকে বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “এহুদার বন্দীদের মধ্যে আমি এমন একজন লোককে পেয়েছি যে মহারাজের স্বপ্নের অর্থ বলে দিতে পারবে।” দানিয়াল, যাঁকে বেল্টশৎসর নামে ডাকা হত তাঁকে বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি আমার স্বপ্ন ও তার অর্থ আমাকে বলতে পারবে?” জবাবে দানিয়াল বললেন, “মহারাজ যে অজানা বিষয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন তা কোন গুণিন, ভূতের ওঝা, জাদুকর কিংবা গণক বলতে পারবেন না; কিন্তু বেহেশতে একজন আল্লাহ্‌ আছেন যিনি গোপন বিষয় প্রকাশ করেন। ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা তিনি বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে জানিয়েছেন। আপনার স্বপ্ন, অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে যে দর্শন আপনি দেখেছেন তা আমি এখন বলব। “হে মহারাজ, আপনি যখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন তখন ভবিষ্যতে কি হবে সেই কথা চিন্তা করছিলেন। যিনি গোপন বিষয় প্রকাশ করেন তিনি আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন কি ঘটবে। অন্যান্য লোকদের চেয়ে আমার বেশী জ্ঞান আছে বলে যে আমার কাছে এই অজানা বিষয় প্রকাশিত হয়েছে তা নয়, কিন্তু হে মহারাজ, আমাকে এটা বলা হয়েছে যাতে আপনি এর অর্থ জানতে পারেন এবং আপনার মনের চিন্তা বুঝতে পারেন। “হে মহারাজ, আপনি তাকিয়ে ছিলেন, আর আপনার সামনে একটা বিরাট মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল; মূর্তিটা বিরাট, খুব উজ্জ্বল এবং তার চেহারাটা ভয়ংকর। সেই মূর্তির মাথাটা খাঁটি সোনার, বুক ও হাত রূপার এবং পেট ও রান ব্রোঞ্জের তৈরী; তার পা লোহার এবং পায়ের পাতা কিছুটা লোহা ও কিছুটা মাটি দিয়ে তৈরী ছিল। আপনি যখন তাকিয়ে দেখছিলেন তখন একটা পাথর কেটে নেওয়া হল, কিন্তু সেটা মানুষের হাতে কাটা হয় নি। সেই পাথরটা লোহা ও মাটি মেশানো পায়ে আঘাত করে তা চুরমার করে ফেলল। তখন লোহা, মাটি, ব্রোঞ্জ, রূপা ও সোনা টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে পড়ল এবং গরমকালে খামারের মেঝেতে পড়ে থাকা তূষের মত হয়ে গেল। বাতাস তা এমন করে উড়িয়ে নিয়ে গেল যে, তার আর কোন চিহ্নই রইল না। কিন্তু যে পাথরটা মূর্তিটাকে আঘাত করেছিল সেটা একটা বিরাট পাহাড় হয়ে গিয়ে সমস্ত দুনিয়া দখল করে ফেলল। “এটাই ছিল সেই স্বপ্ন। এখন আমরা তার অর্থ মহারাজের কাছে বলব। হে মহারাজ, আপনি বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌। বেহেশতের আল্লাহ্‌ আপনাকে রাজ্য, ক্ষমতা, শক্তি ও সম্মান দান করেছেন। আপনার হাতে তিনি মানুষ, পশু আর পাখীদের দিয়েছেন। তারা যেখানেই বাস করুক না কেন তিনি তাদের সকলকে আপনার অধীন করেছেন। আপনিই সেই সোনার মাথা। “আপনার রাজ্যের পরে যে রাজ্য উঠবে সেটা আপনার রাজ্যের মত মহান হবে না। তার পরে তৃতীয় আর একটা রাজ্য উঠবে, সেটা সেই ব্রোঞ্জের পেট ও রান; আর গোটা দুনিয়া সেই রাজ্যের অধীন হবে। শেষে লোহার মত শক্ত চতুর্থ একটা রাজ্য উঠবে। লোহা যেমন সব কিছু ভেংগে চুরমার করে তেমনি সেই রাজ্য অন্য সব রাজ্যকে ভেংগে চুরমার করবে। আপনি স্বপ্নে যে পায়ের পাতা ও পায়ের আংগুলগুলোর কিছু অংশ মাটি ও কিছু অংশ লোহা দিয়ে তৈরী দেখেছিলেন তা হল একটা ভাগ করা রাজ্য। তবে আপনি যেমন মাটির সংগে লোহা মিশানো দেখেছেন তেমনি সেই রাজ্যে লোহার মত কিছু শক্তি থাকবে। পায়ের পাতা ও আংগুলগুলো যেমন এইভাবে মিশানো ছিল তেমনি সেই রাজ্যের কিছু অংশ হবে শক্তিশালী ও কিছু অংশ দুর্বল। লোহার সংগে মাটি মিশানোর অর্থ রাজ্যের লোকেরা হবে মিশানো এবং লোহা যেমন মাটির সংগে মেশে না তেমনি তারাও এক হয়ে থাকবে না। “ঐ সব বাদশাহ্‌দের সময়ে বেহেশতের আল্লাহ্‌ এমন একটা রাজ্য স্থাপন করবেন যেটা কখনও ধ্বংস হবে না কিংবা অন্য লোকদের হাতে যাবে না। সেই রাজ্য ঐ সব রাজ্যগুলোকে চুরমার করে শেষ করে দেবে কিন্তু সেই রাজ্যটা নিজে চিরকাল থাকবে। এটা হল সেই পাহাড় থেকে কেটে নেওয়া পাথর যেটা মানুষের হাতে কাটা হয় নি। সেই পাথরটা লোহা, ব্রোঞ্জ, মাটি, রূপা ও সোনাকে টুকরা টুকরা করে ভেংগে ফেলেছিল। ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা এইভাবে আল্লাহ্‌তা’লা মহারাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন। স্বপ্নটা সত্যি এবং তার ব্যাখ্যাও বিশ্বাসযোগ্য।” তখন বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার দানিয়ালের সামনে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন এবং তাঁর সামনে শস্য কোরবানী করতে ও ধূপ জ্বালাতে হুকুম দিলেন। বাদশাহ্‌ দানিয়ালকে বললেন, “আপনাদের আল্লাহ্‌ সত্যিই দেবতাদের আল্লাহ্‌ ও বাদশাহ্‌দের মালিক। আমি বুঝতে পারলাম তিনি গোপন বিষয় প্রকাশ করেন, কারণ আপনি এই গোপন বিষয়টা প্রকাশ করতে পেরেছেন।” তারপর দানিয়ালকে বাদশাহ্‌ একটা উঁচু পদ দিলেন এবং অনেক ভাল ভাল উপহার দিলেন। তিনি তাঁকে গোটা ব্যাবিলন প্রদেশের প্রধান পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর সমস্ত পরামর্শদাতাদের ভার তাঁর উপরে দিলেন। এছাড়া দানিয়ালের অনুরোধে শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোকে বাদশাহ্‌ ব্যাবিলন প্রদেশের রাজকর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। দানিয়াল নিজে রাজ-দরবারে রইলেন। বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার ষাট হাত উঁচু ও ছয় হাত মোটা একটা সোনার মূর্তি তৈরী করে ব্যাবিলন প্রদেশের দূরা সমভূমিতে রাখলেন। তারপর তিনি সেই মূর্তিটার প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে আসবার জন্য প্রদেশগুলোর শাসনকর্তাদের ও প্রধান পরিচালকদের, বিভাগের শাসনকর্তাদের, মন্ত্রীদের, কোষাধ্যক্ষদের, মহা বিচারকদের, অন্যান্য বিচারকদের ও অন্যান্য সব উঁচু পদের কর্মচারীদের ডাকলেন। তখন তাঁরা সবাই বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের স্থাপন করা মূর্তিটার প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের জন্য এসে জমায়েত হলেন এবং সেই মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন। তখন ঘোষণাকারী জোরে এই কথা ঘোষণা করল, “হে নানা জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা, আপনাদের এই হুকুম দেওয়া হচ্ছে যে, আপনারা যখনই শিংগা, বাঁশী, সুরবাহার, ছোট ও বড় বীণা, বড় বাঁশী ও অন্যান্য সব রকম বাজনার শব্দ শুনবেন তখনই মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারের স্থাপন করা সোনার মূর্তিকে সেজদা করবেন। যে কেউ উবুড় হয়ে পড়ে সেজদা করবে না তাকে তখনই জ্বলন্ত চুল্লীতে ফেলে দেওয়া হবে।” কাজেই যখনই তারা সেই সব বাজনার শব্দ শুনল তখনই সব জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে বখতে-নাসারের স্থাপন করা সোনার মূর্তিকে সেজদা করল। এই সময় কয়েকজন জ্যোতিষী এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দোষী করল। তারা বাদশাহ্‌ বখতে-নাসারকে বলল, “হে মহারাজ, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকুন। আপনি একটা হুকুম দিয়েছেন যে, লোকেরা যখন শিংগা, বাঁশী, সুরবাহার, ছোট ও বড় বীণা, বড় বাঁশী ও অন্যান্য সব রকম বাজনার শব্দ শুনবে তখন তাদের উবুড় হয়ে পড়ে সোনার মূর্তিকে সেজদা করতে হবে; কিন্তু যে উবুড় হয়ে পড়ে সেজদা করবে না তাকে জ্বলন্ত চুল্লীতে ফেলে দেওয়া হবে। হে মহারাজ, এমন কয়েকজন ইহুদী আছে যাদের আপনি ব্যাবিলন প্রদেশের রাজ-কাজে নিযুক্ত করেছেন; তারা হল শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগো। তারা আপনার হুকুমে কান দেয় নি। তারা আপনার দেবতাদের সেবা করে না এবং আপনি যে সোনার মূর্তি স্থাপন করেছেন তাঁকেও সেজদা করে না।” এই কথা শুনে বখতে-নাসার রাগে আগুন হয়ে শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোকে ডেকে পাঠালেন। তখন বাদশাহ্‌র সামনে সেই লোকদের নিয়ে আসা হল। বখতে-নাসার তাঁদের বললেন, “হে শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগো, এ কি সত্যি যে, তোমরা আমার দেবতাদের সেবা কর না এবং আমি যে সোনার মূর্তি স্থাপন করেছি তাঁকেও সেজদা কর না? এখন তোমরা যদি শিংগা, বাঁশী, সুরবাহার, ছোট ও বড় বীণা, বড় বাঁশী ও অন্যান্য সব রকম বাজনার শব্দ শুনে উবুড় হয়ে পড়ে আমার তৈরী মূর্তিকে সেজদা করতে প্রস্তুত থাক তাহলে তো ভাল। কিন্তু যদি সেজদা না কর তবে জ্বলন্ত চুল্লীতে তখনই তোমাদের ফেলে দেওয়া হবে। তখন কোন্‌ দেবতা আমার হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করতে পারবে?” তখন শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগো জবাবে বাদশাহ্‌কে বললেন, “হে মহারাজ বখতে-নাসার, এই ব্যাপারে আপনাকে জবাব দেবার কোন দরকার আমরা মনে করি না। আমরা যে আল্লাহ্‌র এবাদত করি তিনি যদি চান তবে সেই জ্বলন্ত চুল্লী থেকে ও আপনার হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন। কিন্তু হে মহারাজ, তিনি যদি তা না-ও করেন তবুও আমরা আপনার দেবতাদের সেবা করব না কিংবা আপনার স্থাপন করা সোনার মূর্তিকে সেজদা করব না।” তখন শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোর উপর বখতে-নাসার ভীষণ রেগে গেলেন এবং তাঁর মুখে রাগের ভাব ফুটে উঠল। চুল্লীটা যেমন গরম থাকে তিনি সেটা তার চেয়েও সাতগুণ বেশী গরম করতে বললেন। তিনি তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকজন সৈন্যকে হুকুম দিলেন যেন তারা শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোকে বেঁধে জ্বলন্ত চুল্লীতে ফেলে দেয়। তখন ঐ তিনজনকে কোর্তা, পাজামা, পাগড়ী ও অন্যান্য কাপড়-চোপড় পরা অবস্থায় বেঁধে জ্বলন্ত চুল্লীতে ফেলে দেওয়া হল। বাদশাহ্‌র কড়া হুকুম জরুরীভাবে পালন করবার দরুন এবং চুল্লীটা বেশী গরম হওয়ার দরুন যে লোকেরা শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোকে চুল্লীতে ফেলবার জন্য নিয়ে গিয়েছিল তারাই আগুনের শিখায় পুড়ে মরল। আর সেই তিনজন বাঁধা অবস্থায় জ্বলন্ত চুল্লীতে পড়লেন। তখন বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার আশ্চর্য হয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পরামর্শদাতাদের বললেন, “আমরা কি তিনজন লোককে বেঁধে আগুনে ফেলে দিই নি?” তারা জবাব দিল, “জ্বী, মহারাজ।” তিনি বললেন, “কিন্তু আমি চারজন লোককে আগুনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখছি। তারা বাঁধা অবস্থায় নেই এবং তাদের কোন ক্ষতিও হয় নি, আর চতুর্থ জনকে দেখতে দেবতার মত লাগছে।” তখন বখতে-নাসার জ্বলন্ত চুল্লীর মুখের কাছে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, “হে আল্লাহ্‌তা’লার গোলাম শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগো, তোমরা বের হয়ে এখানে এস।” এতে শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগো আগুন থেকে বের হয়ে আসলেন। তখন প্রদেশগুলোর শাসনকর্তারা ও প্রধান পরিচালকেরা, বিভাগের শাসনকর্তারা এবং অন্যান্য সব উঁচু পদের কর্মচারীরা তাঁদের কাছে এসে ভিড় করলেন। তাঁরা দেখলেন আগুন তাঁদের শরীরের কোন ক্ষতি করে নি, তাঁদের মাথার একটা চুলও পোড়ে নি, পোশাকও নষ্ট হয় নি এবং তাঁদের গায়ে আগুনের গন্ধও নেই। তখন বখতে-নাসার বললেন, “শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোর আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, যিনি তাঁর ফেরেশতাকে পাঠিয়ে তাঁর গোলামদের উদ্ধার করলেন। এরা তাঁর উপরেই ঈমান রেখে বাদশাহ্‌র হুকুম অগ্রাহ্য করেছিল এবং তাদের নিজের আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোন দেবতার সেবা ও এবাদত করবার বদলে মরতেও রাজী ছিল। সেইজন্য আমি এই হুকুম দিচ্ছি যে, কোন জাতির, দেশের বা ভাষার লোক যদি শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোর আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কিছু বলে তবে তাকে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হবে এবং তার বাড়ী-ঘর আবর্জনার স্তূপ করা হবে, কারণ আর কোন দেবতা এইভাবে উদ্ধার করতে পারেন না।” বাদশাহ্‌ এর পর শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্‌-নগোকে ব্যাবিলন প্রদেশের মধ্যে আরও উঁচু পদ দান করলেন। পরে বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার দুনিয়ার সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকদের কাছে এই সংবাদ পাঠালেন: তোমাদের প্রচুর উন্নতি হোক। আল্লাহ্‌তা’লা আমার জন্য যে সব অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখিয়েছেন তা আমি খুশী হয়েই তোমাদের জানাচ্ছি। তাঁর চিহ্ন-কাজগুলো কত মহান, তাঁর কুদরতি কাজগুলো কত শক্তিশালী! তাঁর রাজ্য অনন্তকালের রাজ্য, আর তাঁর রাজত্ব যুগের পর যুগ স্থায়ী। আমি বখতে-নাসার আরাম ও সফলতায় পূর্ণ হয়ে আমার রাজবাড়ীতে ছিলাম। আমি যখন বিছানায় শুয়ে ছিলাম তখন একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেলাম; সেই স্বপ্নে আমি যা যা দেখলাম তা আমার মনে ভয় ধরিয়ে দিল। সেইজন্য আমার স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করবার জন্য আমি ব্যাবিলনের সমস্ত রাজ-পরামর্শদাতাদের আমার সামনে আনবার হুকুম দিলাম। জাদুকর, ভূতের ওঝা, জ্যোতিষী ও গণকেরা আমার কাছে আসলে পর আমি তাদের কাছে স্বপ্নটা বললাম, কিন্তু তারা তার অর্থ বলতে পারল না। শেষে দানিয়াল আমার সামনে আসলে পর আমি তাকে স্বপ্নটা বললাম। আমার দেবতার নাম অনুসারে তাকে বেল্টশৎসর নাম দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে পবিত্র এমন কিছু রয়েছে যা এই দুনিয়ার নয়। আমি বললাম, “হে জাদুকরদের প্রধান বেল্টশৎসর, আমি জানি তোমার মধ্যে পবিত্র এমন কিছু রয়েছে যা এই দুনিয়ার নয় এবং কোন গোপন বিষয় জানা তোমার কাছে খুব কঠিন নয়। আমার এই স্বপ্নটার অর্থ তুমি বলে দাও। বিছানায় শুয়ে আমি এই দর্শন দেখেছিলাম। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা গাছ দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে; সেটা খুবই উঁচু। গাছটা বেড়ে উঠে বিরাট ও শক্তিশালী হল এবং তার মাথাটা গিয়ে আকাশ ছুঁলো; দুনিয়ার শেষ সীমা থেকেও গাছটা দেখা যাচ্ছিল। তার পাতাগুলো ছিল সুন্দর ও ফল ছিল প্রচুর এবং তা থেকে সকলেই খাবার পেত। তার নীচে মাঠের পশুরা আশ্রয় পেত এবং আকাশের পাখীরা তার ডালে বাস করত; সমস্ত প্রাণীই তা থেকে খাবার পেত। “বিছানায় শুয়ে সেই দর্শনের মধ্যে আমি তাকিয়ে দেখলাম যে, একজন পবিত্র পাহারাদার বেহেশত থেকে নেমে আসলেন। তিনি জোর গলায় বললেন, ‘গাছটা কেটে ফেল ও তার ডালগুলো ছেঁটে ফেলে দাও; তার পাতাগুলো ঝেড়ে ফেল এবং ফলগুলো ছড়িয়ে দাও। তার তলা থেকে পশুরা ও ডালপালা থেকে পাখীরা পালিয়ে যাক, কিন্তু তার গোড়া ও শিকড়গুলো লোহা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মাটিতে মাঠের ঘাসের মধ্যে থাকুক। আকাশের শিশিরে সে ভিজুক এবং দুনিয়ার গাছপালার মধ্যে পশুদের সংগে সে বাস করুক। তার আর মানুষের স্বভাব না থাকুক এবং সাত বছর পর্যন্ত তাকে পশুর স্বভাব দেওয়া হোক। “ ‘যে রায় দেওয়া হল তা পাহারাদারেরা, অর্থাৎ পবিত্র ফেরেশতারা ঘোষণা করছেন, যাতে জীবিত লোকেরা জানতে পারে যে, মানুষের রাজ্যগুলোর উপরে আল্লাহ্‌তা’লা কর্তৃত্ব করেন এবং তিনি যাকে খুশী তাকে রাজ্য দান করেন ও মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যে নীচু তাকেই তার উপরে বসান।’ “এটা সেই স্বপ্ন যা আমি বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার দেখেছি। এখন হে বেল্টশৎসর, তুমি বল এর অর্থ কি? আমার রাজ্যের কোন পরামর্শদাতাই এর অর্থ আমাকে বলে দিতে পারে নি; কিন্তু তুমি পারবে, কারণ তোমার মধ্যে পবিত্র এমন কিছু রয়েছে যা এই দুনিয়ার নয়।” তখন দানিয়াল, অর্থাৎ বেল্টশৎসর স্বপ্নের কথা চিন্তা করে ভয় পেল এবং কিছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে রইল। এতে বাদশাহ্‌ বললেন, “হে বেল্টশৎসর, স্বপ্ন কিংবা তার অর্থ তোমাকে চিনি-ত না করুক।” বেল্টশৎসর জবাব দিলেন, “হে হুজুর, এই স্বপ্ন এবং তার অর্থ আপনার শত্রুদের উপর ঘটুক। আপনি যে গাছটা দেখেছিলেন, যেটা বিরাট ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, যার মাথা আকাশ ছুঁয়েছিল ও যেটা দুনিয়ার সবাই দেখতে পেয়েছিল, যাতে সুন্দর পাতা ও প্রচুর ফল ছিল, যা সকলকে খাবার যোগাত, যা মাঠের পশুদের আশ্রয় দিত এবং যার ডালে আকাশের পাখীরা থাকবার জায়গা পেত- আপনি, হে মহারাজ, আপনিই সেই গাছ। আপনি মহান ও বলবান হয়েছেন; আপনার শক্তি বেড়ে গিয়ে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং আপনার রাজ্য দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। “আপনি, হে মহারাজ, একজন পবিত্র পাহারাদারকে বেহেশত থেকে নেমে আসতে দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গাছটা কেটে ধ্বংস করে ফেল, কিন্তু তার গোড়া ও শিকড়গুলো লোহা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে বেঁধে মাটিতে মাঠের ঘাসের মধ্যে ফেলে রেখে দাও। সে আকাশের শিশিরে ভিজুক; সাত বছর পর্যন্ত সে পশুদের সংগে বাস করুক।’ “হে মহারাজ, আমি এখন যা বলছি তা হল আমার প্রভু মহারাজের স্বপ্নের অর্থ এবং তাঁর বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌তা’লার রায়। আপনাকে লোকদের কাছ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং আপনি পশুদের সংগে বাস করবেন; আপনি ষাঁড়ের মত ঘাস খাবেন এবং আকাশের শিশিরে ভিজবেন। এইভাবে সাত বছর চলে যাবে, যে পর্যন্ত না আপনি মেনে নেবেন যে, মানুষের রাজ্যগুলোর উপরে আল্লাহ্‌তা’লা কর্তৃত্ব করেন এবং তিনিই সেই সব রাজ্য যাকে ইচ্ছা তাকে দেন। শিকড়সুদ্ধ গাছটার গোড়া রেখে দেওয়ার হুকুমের মানে হল, আপনি যখন মেনে নেবেন যে, বেহেশতের আল্লাহ্‌ কর্তৃত্ব করেন তখন আপনার রাজ্য আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাজেই হে মহারাজ, আপনি আমার পরামর্শ গ্রহণ করুন। আপনি ন্যায় কাজ করে এবং গরীবদের প্রতি দয়ালু হয়ে আপনার গুনাহ্‌ ও অন্যায় ত্যাগ করুন। তাহলে হয়তো আপনার ভাল অবস্থা স্থির থাকবে।” কথাগুলো তাঁর মুখে থাকতে থাকতেই বেহেশত থেকে কেউ বললেন, “হে বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার, তোমাকে বলা হচ্ছে যে, তোমার রাজ্য তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তোমাকে লোকদের কাছ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং তুমি পশুদের সংগে বাস করবে; ষাঁড়ের মত তুমি ঘাস খাবে। যে পর্যন্ত না তুমি মেনে নেবে যে, আল্লাহ্‌তা’লা মানুষের রাজ্যগুলোর উপরে কর্তৃত্ব করেন এবং সেই সব রাজ্য যাকে ইচ্ছা তাকে দেন সেই পর্যন্ত সাত বছর চলে যাবে।” বখতে-নাসারের সম্বন্ধে যা বলা হয়েছিল তখনই তা পূর্ণ হল। মানুষের কাছ থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হল এবং তিনি ষাঁড়ের মত ঘাস খেতে লাগলেন। তাঁর শরীর আকাশের শিশিরে ভিজতে লাগল; তাঁর চুলগুলো ঈগল পাখীর পালখের মত হয়ে উঠল আর তাঁর নখগুলো পাখীর পায়ের নখের মত হয়ে গেল। সেই সময় শেষ হয়ে গেলে পর আমি বখতে-নাসার বেহেশতের দিকে চোখ তুললাম এবং আমার মনের সুস্থতা ফিরে আসল। তখন আমি আল্লাহ্‌তা’লার গৌরব করলাম; যিনি চিরকাল জীবিত আছেন আমি তাঁকে সম্মান দেখালাম ও তাঁর প্রশংসা করলাম। আমি বললাম, “আল্লাহ্‌র রাজ্য অনন্তকালের রাজ্য; তাঁর রাজত্ব যুগের পর যুগ স্থায়ী। দুনিয়ার সমস্ত লোক তাঁর কাছে যেন কিছুই নয়। তিনি ফেরেশতাদের ও দুনিয়ার লোকদের নিয়ে তাঁর ইচ্ছামত কাজ করেন। এমন কেউ নেই যে, তাঁর হাত থামিয়ে দিতে পারে কিংবা তাঁকে বলতে পারে, ‘তুমি কি করছ?’ ” যখন আমার মনের সুস্থতা ফিরে আসল তখন আমার রাজ্যের সম্মানের জন্য আমার জাঁকজমক ও গৌরব আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। আমার মন্ত্রীরা ও প্রধান লোকেরা আমাকে খুঁজে বের করল এবং আমাকে আবার সিংহাসনে বসানো হল আর আমি আগের চেয়েও বেশী মহান হলাম। এখন আমি বখতে-নাসার সেই বেহেশতের বাদশাহ্‌র প্রশংসা, সম্মান ও গৌরব করি, কারণ তিনি যা কিছু করেন তা ঠিক, আর তাঁর সব পথই ন্যায়ে পূর্ণ। যারা অহংকারের বশে চলে তাদের তিনি নীচু করতে পারেন। এক সময় বাদশাহ্‌ বেল্‌শৎসর তাঁর এক হাজার প্রধান লোকদের জন্য একটা বড় মেজবানী দিলেন এবং তিনি তাঁদের সংগে আংগুর-রস খাচ্ছিলেন। আংগুর-রস খেতে খেতে বেল্‌শৎসর হুকুম দিলেন, তাঁর নানা বখতে-নাসার জেরুজালেমের বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে যে সব সোনা ও রূপার পাত্র এনেছিলেন সেগুলো যেন আনা হয় যাতে বাদশাহ্‌, তাঁর প্রধান লোকেরা, তাঁর স্ত্রীরা ও তাঁর উপস্ত্রীরা সেই সব পাত্রে করে আংগুর-রস খেতে পারেন। তখন আল্লাহ্‌র ঘর থেকে যে সব সোনার পাত্র নিয়ে আসা হয়েছিল সেগুলো আনা হলে পর বাদশাহ্‌, তাঁর প্রধান লোকেরা, তাঁর স্ত্রীরা ও তাঁর উপস্ত্রীরা তাতে করে আংগুর-রস খেলেন। তাঁরা আংগুর-রস খেতে খেতে সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, লোহা, কাঠ ও পাথরের তৈরী দেব-দেবীদের প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন হঠাৎ মানুষের একটা হাত এসে রাজবাড়ীর মধ্যে বাতিদানের কাছে দেয়ালের উপর লিখতে লাগল। লিখবার সময় বাদশাহ্‌ সেই হাতখানা দেখতে পেলেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল এবং তিনি এত ভয় পেলেন যে, তাঁর কোমর দুর্বল হয়ে গেল এবং হাঁটু কাঁপতে লাগল। তখন বাদশাহ্‌ জোরে ডাক দিয়ে ভূতের ওঝা, জ্যোতিষী ও গণকদের নিয়ে আসতে বললেন। তিনি ব্যাবিলনের সেই পরামর্শদাতাদের বললেন, “যে কেউ এই লেখা পড়ে তার মানে আমাকে বলে দিতে পারবে তাকে বেগুনে কাপড় পরানো হবে ও গলায় সোনার হার দেওয়া হবে আর তাকে রাজ্যের তিনজন বাদশাহ্‌র মধ্যে একজনের পদ দেওয়া হবে।” বাদশাহ্‌র সেই সব পরামর্শদাতারা ভিতরে আসল, কিন্তু তারা সেই লেখা পড়তে কিংবা বাদশাহ্‌কে তার অর্থ বলতে পারল না। তখন বাদশাহ্‌ বেল্‌শৎসর আরও ভয় পেলেন এবং তাঁর মুখ আরও ফ্যাকাশে হল। তাঁর প্রধান লোকেরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। বাদশাহ্‌ ও তাঁর প্রধান লোকদের কথা শুনে রাণীমা সেই মেজবানীর ঘরে এসে বললেন, “হে মহারাজ, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকুন। আপনি ভয় পাবেন না, আপনার মুখ এত ফ্যাকাশে হতে দেবেন না। আপনার রাজ্যের মধ্যে একজন লোক আছেন যাঁর ভিতরে পবিত্র এমন কিছু আছে যা এই দুনিয়ার নয়। আপনার নানা বখতে-নাসারের সময়ে সেই লোকের মধ্যে বুঝবার শক্তি, বুদ্ধি ও দেবতাদের মত জ্ঞান দেখা গিয়েছিল। আপনার নানা বাদশাহ্‌ বখতে-নাসার তাঁকে জাদুকর, ভূতের ওঝা, জ্যোতিষী ও গণকদের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি দানিয়াল নামে এই লোককে বেল্টশৎসর বলে ডাকতেন। তাঁর মধ্যে অসাধারণ গুণ, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্বপ্নের অর্থ বলবার শক্তি, গোপন বিষয় ব্যাখ্যার ও কঠিন সমস্যার জবাব দেবার ক্ষমতা দেখা গিয়েছিল। আপনি দানিয়ালকে ডেকে পাঠান; এই লেখার অর্থ তিনিই আপনাকে বলে দেবেন।” তখন দানিয়ালকে বাদশাহ্‌র সামনে আনা হল, আর বাদশাহ্‌ তাঁকে বললেন, “তুমি কি সেই দানিয়াল যাকে আমার নানা এহুদা দেশ থেকে বন্দী করে এনেছিলেন? আমি শুনেছি তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা এই দুনিয়ার নয়, আর তোমার ভিতরে বুঝবার শক্তি, বুদ্ধি ও বিশেষ জ্ঞান রয়েছে। এই লেখা পড়ে আমাকে অর্থ বলে দেবার জন্য গুণিন ও অন্যান্য পরামর্শদাতাদের আমার কাছে আনা হয়েছিল, কিন্তু তারা এর অর্থ বলতে পারে নি। এখন আমি শুনলাম যে, তুমি গোপন বিষয়ের অর্থ বলে দিতে ও কঠিন সমস্যার সমাধান দিতে পার। তুমি যদি এই লেখা পড়ে আমাকে তার অর্থ বলে দিতে পার তবে তোমাকে বেগুনে কাপড় পরানো হবে ও গলায় সোনার হার দেওয়া হবে এবং তুমি এই রাজ্যের তিনজন বাদশাহ্‌র মধ্যে একজনের পদ পাবে।” তখন দানিয়াল জবাবে বাদশাহ্‌কে বললেন, “আপনার পুরস্কার আপনারই থাকুক অথবা সেগুলো আপনি অন্য কাউকে দিন। কিন্তু আমি মহারাজের কাছে লেখাটা পড়ব ও তার অর্থ তাঁকে বলব। হে মহারাজ, আল্লাহ্‌তা’লা আপনার নানা বখতে-নাসারকে রাজ্য, শক্তি, গৌরব ও জাঁকজমক দিয়েছিলেন। তাঁকে সেই শক্তি দেওয়াতে সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সামনে ভয়ে কাঁপত। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে হত্যা করতেন, যাকে ইচ্ছা তাকে জীবিত রাখতেন, যাকে ইচ্ছা তাকে উঁচু পদে তুলতেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে নীচে নামিয়ে দিতেন। কিন্তু যখন তাঁর অন্তর গর্বিত ও অহংকারে কঠিন হয়ে উঠল তখন তাঁকে তাঁর রাজসিংহাসন থেকে নামিয়ে দেওয়া হল এবং তাঁর সম্মান নিয়ে নেওয়া হল। তাঁকে মানুষের কাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে একটা পশুর স্বভাব দেওয়া হল। যতদিন না তিনি মেনে নিলেন যে, আল্লাহ্‌তা’লা মানুষের রাজ্যগুলোর উপরে কর্তৃত্ব করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সেই সব রাজ্যের উপরে বসান ততদিন পর্যন্ত তিনি বুনো গাধাদের সংগে বাস করতেন ও ষাঁড়ের মত ঘাস খেতেন এবং আকাশের শিশিরে ভিজতেন। “কিন্তু হে বেল্‌শৎসর, আপনি তাঁরই নাতি; আপনি সব কিছু জেনেও নিজেকে নত করেন নি। তার বদলে আপনি নিজেকে বেহেশতের মালিকের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ঘর থেকে নিয়ে আসা পাত্রগুলো আপনি আনিয়েছেন এবং আপনি, আপনার প্রধান লোকেরা, আপনার স্ত্রীরা ও উপস্ত্রীরা তাতে করে আংগুর-রস খেয়েছেন। আপনি রূপা, সোনা, ব্রোঞ্জ, লোহা, কাঠ ও পাথরের তৈরী যে দেবতারা দেখতে, শুনতে ও বুঝতে পারে না তাদের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু আপনি আল্লাহ্‌র প্রশংসা করেন নি, যাঁর হাতে রয়েছে আপনার জীবন ও আপনার সমস্ত পথ। সেইজন্য তিনি সেই হাত পাঠিয়ে এই কথা লিখিয়েছেন। “সেই লেখাটা হল এই: ‘মিনে মিনে তকেল উপারসীন।’ ঐ কথাগুলোর অর্থ হল: মিনে, অর্থাৎ গোণা- আল্লাহ্‌ আপনার রাজত্বের দিনগুলো গুণেছেন এবং তা শেষ করেছেন। তকেল, অর্থাৎ ওজন করা- দাঁড়িপাল্লায় আপনাকে ওজন করা হয়েছে এবং আপনি কম পড়েছেন। উপারসীন, অর্থাৎ ভাগ করা- আপনার রাজ্যটা ভাগ করে মিডীয় ও পারসীকদের দেওয়া হয়েছে।” তখন বেল্‌শৎসরের হুকুমে দানিয়ালকে বেগুনে কাপড় পরানো হল এবং তাঁর গলায় সোনার হার দেওয়া হল। তাঁকে রাজ্যের তিনজন বাদশাহ্‌র মধ্যে একজনের পদ দেবার কথা ঘোষণা করা হল। সেই রাতেই ব্যাবিলনীয়দের বাদশাহ্‌ বেল্‌শৎসরকে হত্যা করা হল, আর মিডীয় দারিয়ুস বাষট্টি বছর বয়সে রাজ্যের ভার গ্রহণ করলেন। দারিয়ুস তাঁর রাজ্যের সমস্ত প্রদেশগুলোর উপরে একশো বিশ জন শাসনকর্তা নিযুক্ত করা উপযুক্ত মনে করলেন। তাঁদের উপরে থাকবেন তিনজন রাজ-পরিচালক। সেই তিনজনের মধ্যে দানিয়াল ছিলেন একজন। এই তিনজনের কাছে সেই শাসনকর্তারা দায়ী থাকবেন যাতে মহারাজের কোন ক্ষতি না হয়। দানিয়াল নিজের অসাধারণ গুণের জন্য অন্যান্য রাজ-পরিচালক ও প্রদেশের শাসনকর্তাদের চেয়ে নিজেকে আরও ভাল বলে প্রমাণ করলেন। তার ফলে মহারাজ তাঁকে গোটা রাজ্যের উপরে নিযুক্ত করবেন বলে ঠিক করলেন। এতে সেই রাজ-পরিচালকেরা ও সেই শাসনকর্তারা সরকারী কাজের ব্যাপারে দানিয়ালের দোষ ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু পারলেন না। তাঁর মধ্যে তাঁরা কোন দোষ খুঁজে পেলেন না, কারণ তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন, কোন দোষ বা অবহেলা তাঁর মধ্যে ছিল না। শেষে সেই লোকেরা বললেন, “ঐ দানিয়ালকে দোষী করবার জন্য তার বিরুদ্ধে আমরা কখনও কোন দোষ খুঁজে পাব না, কেবল তার আল্লাহ্‌র শরীয়ত নিয়ে যদি কিছু পাই।” তখন রাজ-পরিচালকেরা ও প্রদেশের শাসনকর্তারা দল বেঁধে বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বললেন, “মহারাজ দারিয়ুস, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকুন। সমস্ত রাজ-পরিচালক, প্রদেশগুলোর পরিচালক ও শাসনকর্তা, পরামর্শদাতা ও বিভাগের শাসনকর্তারা সবাই এই কথায় রাজী হয়েছেন যে, মহারাজ যেন একটা কড়া হুকুম জারি করেন। সেই হুকুম হল, এর পরের ত্রিশ দিন যদি কেউ, হে মহারাজ, আপনি ছাড়া কোন দেবতা বা মানুষের কাছে মুনাজাত করে তবে তাকে সিংহের গর্তে ফেলে দেওয়া হবে। এখন হে মহারাজ, আপনি সেই হুকুম লিখিতভাবে দেবেন যাতে এটাও মিডীয় ও পারসীকদের আরও একটা আইন হয় যা বাতিল করা বা বদলানো যায় না।” তখন বাদশাহ্‌ দারিয়ুস সেই লিখিত হুকুমে স্বাক্ষর করলেন। হুকুমে স্বাক্ষর দেওয়া হয়ে গেছে শুনে দানিয়াল তাঁর বাড়ীর উপর তলার ঘরে গেলেন; সেই ঘরের জানালা জেরুজালেমের দিকে খোলা ছিল। তিনি নিজের অভ্যাস মতই দিনে তিনবার হাঁটু পেতে মুনাজাত করে তাঁর আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন। তখন সেই লোকেরা দল বেঁধে সেখানে গিয়ে দানিয়ালকে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করতে ও মিনতি জানাতে দেখলেন। এতে তাঁরা বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে তাঁকে তাঁর দেওয়া হুকুমের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, “হে মহারাজ, আপনি কি এই হুকুম জারি করেন নি যে, এর পরের ত্রিশ দিনের মধ্যে যদি কেউ আপনি ছাড়া কোন দেবতা বা মানুষের কাছে মুনাজাত করে তবে তাকে সিংহের গর্তে ফেলে দেওয়া হবে?” বাদশাহ্‌ জবাব দিলেন, “মিডীয় ও পারসীকদের আইন অনুসারে এই হুকুম স্থির আছে, কারণ সেই আইন বাতিল করা যায় না।” তখন তাঁরা বাদশাহ্‌কে বললেন, “হে মহারাজ, দানিয়াল নামে এহুদা দেশের বন্দীদের একজন আপনার কথায় কিংবা যে হুকুমে আপনি স্বাক্ষর করেছেন তাতে কান দেয় না। সে এখনও দিনে তিনবার মুনাজাত করে।” বাদশাহ্‌ এই কথা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন; দানিয়ালকে তিনি রক্ষা করবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন এবং তাঁকে উদ্ধার করবার জন্য সূর্য না ডোবা পর্যন্ত সব রকম চেষ্টা করলেন। তখন সেই লোকেরা আবার দল বেঁধে বাদশাহ্‌র কাছে গিয়ে বললেন, “হে মহারাজ, আপনি মনে রাখবেন যে, মিডীয় ও পারসীকদের আইন অনুসারে বাদশাহ্‌ যে হুকুম জারি করেন তা আর বদলানো যায় না।” শেষে বাদশাহ্‌ হুকুম দিলেন আর লোকেরা দানিয়ালকে নিয়ে এসে সিংহের গর্তে ফেলে দিল। তখন বাদশাহ্‌ দানিয়ালকে বললেন, “তুমি সব সময় যাঁর এবাদত কর সেই আল্লাহ্‌ যেন তোমাকে রক্ষা করেন।” পরে একটা পাথর এনে সেই গর্তের মুখে চাপা দেওয়া হল। বাদশাহ্‌ তাঁর নিজের ও প্রধান লোকদের সীলমোহরের আংটি দিয়ে সেটা সীলমোহর করে দিলেন যাতে দানিয়ালের জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা করা না যায়। পরে বাদশাহ্‌ রাজবাড়ীতে ফিরে গিয়ে কিছু না খেয়ে রাত কাটালেন এবং তাঁর জন্য কোন আনন্দের ব্যবস্থা করতে দিলেন না। তিনি সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না। ভোরের প্রথম আলো দেখা দিতেই বাদশাহ্‌ উঠে তাড়াতাড়ি করে সেই সিংহের গর্তের দিকে গেলেন। গর্র্তের কাছে গিয়ে তিনি কাতর স্বরে দানিয়ালকে ডেকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র গোলাম দানিয়াল, তুমি সব সময় যাঁর এবাদত কর তোমার সেই আল্লাহ্‌ কি তোমাকে সিংহের মুখ থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন?” দানিয়াল জবাব দিলেন, “হে মহারাজ, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকুন। আমার আল্লাহ্‌ তাঁর ফেরেশতা পাঠিয়ে সিংহদের মুখ বন্ধ করেছিলেন। তারা আমাকে আঘাত করে নি, কারণ আল্লাহ্‌র চোখে আমি নির্দোষ ছিলাম। হে মহারাজ, আপনার কাছেও আমি কোন দোষ করি নি।” তখন বাদশাহ্‌ খুব খুশী হলেন এবং সেই গর্ত থেকে দানিয়ালকে তুলে আনবার হুকুম দিলেন। দানিয়ালকে তোলা হলে পর তাঁর গায়ে কোন আঘাত দেখা গেল না, কারণ তিনি তাঁর আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করেছিলেন। যে লোকেরা হিংসা করে দানিয়ালকে দোষ দিয়েছিল বাদশাহ্‌র হুকুমে তাদের নিয়ে আসা হল এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সুদ্ধ তাদের সেই সিংহের গর্তে ফেলে দেওয়া হল। তারা সেই গর্তের মেঝেতে পড়তে না পড়তেই সিংহেরা তাদের আক্রমণ করে তাদের হাড়গোড় পর্যন্ত চুরমার করে দিল। এর পর বাদশাহ্‌ দারিয়ুস সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকদের কাছে এই কথা লিখলেন: “তোমাদের প্রচুর উন্নতি হোক! আমি হুকুম দিচ্ছি যে, আমার রাজ্যের সমস্ত লোক যেন দানিয়ালের আল্লাহ্‌কে ভয় করে, কারণ তিনিই জীবন্ত আল্লাহ্‌ ও চিরকাল স্থায়ী। তাঁর রাজ্য ধ্বংস হবে না, তাঁর কর্তৃত্ব কখনও শেষ হবে না। তিনি রক্ষা ও উদ্ধার করেন; তিনি আসমানে ও জমীনে নানা অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখান। তিনি সিংহদের হাত থেকে দানিয়ালকে রক্ষা করেছেন।” এইভাবে দারিয়ুস ও পারসীক বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের সময়ে দানিয়াল ভাল অবস্থায় ছিলেন। সেই সমুদ্র থেকে চারটা বিরাট জন্তু উঠে আসল; তারা এক একটা এক এক রকমের ছিল। প্রথমটা ছিল সিংহের মত এবং তার ঈগল পাখীর মত ডানা ছিল। দেখতে দেখতে তার ডানা দু’টা ছিঁড়ে ফেলা হল এবং তাকে মাটি থেকে উপরে উঠানো হল। তখন সেটা মানুষের মত দুই পায়ে দাঁড়াল এবং তাকে মানুষের দিল দেওয়া হল। “তারপর আমি দ্বিতীয় জন্তুটা দেখতে পেলাম। সেটা দেখতে ছিল ভল্লুকের মত। তার এক পাশ অন্য পাশের চেয়ে উঁচু ছিল এবং তার মুখের মধ্যে পাঁজরের তিনটা হাড় ছিল। তাকে বলা হল, ‘তুমি গিয়ে পেট ভরে গোশ্‌ত খাও।’ “তারপর আমি তাকিয়ে আর একটা জন্তু দেখতে পেলাম। সেটা দেখতে চিতাবাঘের মত ছিল। তার পিঠে পাখীর ডানার মত চারটা ডানা ছিল। এই জন্তুটার চারটা মাথা ছিল এবং তাকে কর্তৃত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল। “রাতের বেলায় আমার সেই স্বপ্নের মধ্যে তাকিয়ে আমি চতুর্থ জন্তুটা দেখতে পেলাম। সে ছিল ভয়ংকর, ভয় জাগানো এবং খুব শক্তিশালী। তার বড় বড় লোহার দাঁত ছিল। তার শিকারকে সে চুরমার করে গিলে ফেলল এবং যা বাকী রইল তা পা দিয়ে মাড়ালো। এটা আগের জন্তুদের চেয়ে আলাদা ছিল এবং তার দশটা শিং ছিল। আমি যখন সেই শিংগুলোকে লক্ষ্য করছিলাম তখন আর একটা ছোট শিং সেগুলোর মাঝখানে উঠল; তার সামনে আগের শিংগুলোর মধ্য থেকে তিনটা শিং উপ্‌ড়ে ফেলা হল। এই শিংটার মানুষের চোখের মত চোখ ছিল আর একটা মুখ ছিল যেটা বড়াই করে কথা বলছিল। “পরে আমি দেখলাম কয়েকটা সিংহাসন রাখা হল এবং খুব বৃদ্ধ একজন তাঁর সিংহাসনে বসলেন। তাঁর কাপড়-চোপড় তুষারের মত সাদা এবং তাঁর মাথার চুল সাদা পশমের মত। তাঁর সিংহাসন ও সিংহাসনের চাকাগুলো যেন আগুনে জ্বলছিল। তাঁর সামনে থেকে একটা আগুনের নদী বের হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। হাজার হাজার লোক তাঁর সেবা করছিল; লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বিচার শুরু হল এবং বইগুলো খোলা হল। “আমি দেখলাম ঐ শিংটা তখনও বড়াই করে কথা বলছে। সেই জন্তুটাকে যে পর্যন্ত না কেটে ফেলা হল সেই পর্যন্ত আমি তাকিয়েই রইলাম। তার দেহটা ধ্বংস করে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া হল। অন্য জন্তুদের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হল কিন্তু নির্দিষ্ট কালের জন্য তাদের বাঁচতে দেওয়া হল। “রাতের বেলায় আমার সেই স্বপ্নের মধ্যে আমি তাকিয়ে ইব্‌ন্তেআদমের মত একজনকে আকাশের মেঘের মধ্যে আসতে দেখলাম। তিনি সেই বৃদ্ধ জনের কাছে এগিয়ে গেলে পর তাঁকে তাঁর সামনে নিয়ে যাওয়া হল। সেই ইবনে আদমকে কর্তৃত্ব, সম্মান ও রাজত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল যেন সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে। তাঁর রাজত্ব চিরস্থায়ী; তা শেষ হবে না আর তাঁর রাজ্য কখনও ধ্বংস হবে না। “তখন আমি দানিয়াল স্বপ্নের মধ্যে মনে কষ্ট পেতে লাগলাম এবং আমি যা যা দেখছিলাম তা আমাকে অশান্ত করে তুলছিল। যাঁরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমি তাঁদের একজনের কাছে এগিয়ে গিয়ে এই সবের অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি আমাকে এই কথা বলে ঐ সবের অর্থ বুঝিয়ে দিলেন, ‘ঐ চারটা বিরাট জন্তু হল দুনিয়ার চারটা রাজ্য। কিন্তু শেষে আল্লাহ্‌তা’লার বান্দারা কর্তৃত্ব পেয়ে চিরকাল, জ্বী, চিরকাল রাজত্ব করবে।’ “তখন আমি সেই চতুর্থ জন্তুটার অর্থ জানতে চাইলাম। এটা সেই জন্তু যে অন্য সবগুলোর চেয়ে ভিন্ন এবং ভয়ংকর ছিল, যার লোহার দাঁত ও ব্রোঞ্জের নখ ছিল, যে জন্তুটা তার শিকার চুরমার করে গিলে ফেলেছিল এবং বাকীটা পায়ে মাড়িয়েছিল। তার মাথার দশটা শিং সম্বন্ধে এবং অন্য যে শিংটা উঠেছিল, যার সামনে তিনটা শিং পড়ে গিয়েছিল, যার চোখ ও বড়াই-করা মুখ ছিল এবং যেটা অন্যগুলোর চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল, সেই শিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলাম। তারপর আমি দেখলাম সেই শিংটা আল্লাহ্‌র বান্দাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁদের হারিয়ে দিচ্ছিল, যে পর্যন্ত না সেই বৃদ্ধ এসে আল্লাহ্‌তা’লার বান্দাদের পক্ষে রায় দিলেন। এর পর থেকে আল্লাহ্‌র বান্দারা রাজত্ব করতে লাগলেন। “তারপর তিনি আমাকে এই রকম ব্যাখ্যা দিলেন, ‘চতুর্থ জন্তুটা হল দুনিয়ার চতুর্থ রাজ্য। সেটা অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে আলাদা হবে এবং গোটা দুনিয়াকে মাড়িয়ে চুরমার করে গ্রাস করবে। সেই দশটা শিং হল দশজন বাদশাহ্‌ যারা এই রাজ্যে রাজত্ব করবে। তাদের পরে আর একজন বাদশাহ্‌ উঠবে, সে আগের বাদশাহ্‌দের চেয়ে অন্য রকম হবে; সে তিনজন বাদশাহ্‌কে হারিয়ে দেবে। আল্লাহ্‌তা’লার বিরুদ্ধে সে কথা বলবে এবং তাঁর বান্দাদের উপর জুলুম করবে। সে নির্দিষ্ট করা দিনগুলো ও শরীয়ত বদলাতে চেষ্টা করবে। আল্লাহ্‌র সেই বান্দাদের সাড়ে তিন বছরের জন্য তার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু পরে তার বিচার করা হবে এবং তার ক্ষমতা তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, আর তা চিরকালের জন্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হবে। তারপর রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও দুনিয়ার সমস্ত রাজ্যগুলোর শক্তি আল্লাহ্‌তা’লার বান্দাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তাঁদের রাজ্য হবে চিরস্থায়ী এবং সব বাদশাহ্‌রা তাঁদের সেবা করবে ও তাঁদের বাধ্য হবে।’ “এখানেই সেই স্বপ্নের ব্যাপারটার শেষ। আমি দানিয়াল আমার এই সব চিন্তার জন্য এত ভয় পেলাম যে, আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কিন্তু স্বপ্নের ব্যাপারটা আমি মনে গেঁথে রাখলাম, কাউকে বললাম না।” বাদশাহ্‌ বেল্‌শৎসরের রাজত্বের তৃতীয় বছরে আমি দানিয়াল আর একটা দর্শন পেলাম। সেই দর্শনে আমি নিজেকে ইলাম প্রদেশের সুসার কেল্লায় দেখতে পেলাম। সেই দর্শনের মধ্যে আমি ঊলয় খালের পারে ছিলাম। আমি তাকিয়ে একটা পুরুষ ভেড়াকে খালের পারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তার দু’টা লম্বা শিং ছিল। একটা শিং অন্যটার চেয়ে লম্বা এবং সেটা পরে উঠেছিল। আমি দেখলাম ভেড়াটা পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে গুঁতা মারল। তার সামনে কোন পশুই টিকতে পারল না এবং তার হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে এমন কেউ ছিল না। সে যা খুশী তা-ই করত এবং সে শক্তিশালী হয়ে উঠল। আমি যখন এই বিষয় ভাবছিলাম তখন হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে একটা ছাগল মাটি না ছুঁয়ে সেখানে ছুটে আসল; তার দুই চোখের মাঝখানে চোখে পড়বার মত একটা শিং ছিল। দুই শিংয়ের যে ভেড়াকে আমি খালের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম ছাগলটা ভয়ংকর বেগে তার দিকে দৌড়ে গেল। আমি দেখলাম ছাগলটা সেই ভেড়াটাকে ভীষণভাবে আঘাত করে তার শিং দু’টা ভেংগে ফেলল। তার সামনে ভেড়াটার দাঁড়াবার কোন ক্ষমতা রইল না; ছাগলটা তাকে মাটিতে ফেলে পায়ে মাড়াতে লাগল। তার হাত থেকে ভেড়াটাকে উদ্ধার করতে পারে এমন কেউ ছিল না। ছাগলটা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল, কিন্তু সে যখন তার শক্তির চূড়ায় উঠল তখন তার বড় শিংটা ভেংগে গেল এবং তার জায়গায় চার দিকে চারটা চোখে পড়বার মত শিং উঠল। সেই শিংগুলোর একটা থেকে আর একটা শিং উঠল; সেটা প্রথমে ছোট ছিল কিন্তু পরে দক্ষিণ, পূর্ব ও সুন্দর দেশের দিকে বড় হতে লাগল। সেটা বড় হতে হতে আসমানের তারাগুলো পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাল এবং কতগুলো তারা মাটিতে ফেলে সেগুলোকে পায়ে মাড়াল। সে নিজেকে সেই তারাগুলোর কর্তার সমান বলে দাবি করল। তাঁর উদ্দেশ্যে করা প্রতিদিনের কোরবানী সে বন্ধ করে দিল এবং বায়তুল-মোকাদ্দসও নাপাক করা হল। তার গুনাহের ফলে সেই তারাগুলো ও প্রতিদিনের কোরবানী তার হাতে গিয়ে পড়ল। সে সত্যকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল এবং যা কিছু করল তাতেই সফল হল। তারপর আমি একজন পবিত্র ফেরেশতাকে কথা বলতে শুনলাম এবং আর একজন পবিত্র ফেরেশতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই দর্শনে যা দেখানো হল তা কত দিন ধরে চলবে? কত দিন ধরে প্রতিদিনের কোরবানীর বদলে সর্বনাশা গুনাহের জিনিস থাকবে? কত দিন ধরে বায়তুল-মোকাদ্দস ও তারাগুলোকে পায়ে মাড়ানো হবে?” তিনি বললেন, “দুই হাজার তিনশো সন্ধ্যা ও সকাল ধরে এই সব চলবে। তারপর বায়তুল-মোকাদ্দস আবার পাক-সাফ করা হবে।” আমি দানিয়াল যখন দর্শনটা দেখে বুঝবার চেষ্টা করছিলাম তখন মানুষের মত দেখতে একজন আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি একজন মানুষের স্বর শুনলাম; সেই স্বর ঊলয় খালের মধ্য থেকে ডেকে বলল, “জিবরাইল, এই দর্শনের অর্থ এই লোকটিকে বুঝিয়ে দাও।” আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তিনি সেই জায়গার কাছে আসলে পর আমি ভয় পেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, এই দর্শনটা যে কেয়ামতের বিষয়ে তা তুমি বুঝে নাও।” তিনি যখন আমার সংগে কথা বলছিলেন তখন আমি উবুড় অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। তিনি আমাকে ছুঁয়ে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “গজবের সময়ের শেষের দিকে যা ঘটবে তা আমি তোমাকে বলছি, কারণ দর্শনটা হল কেয়ামতের নির্দিষ্ট করা সময়ের বিষয়ে। তুমি দুই শিংয়ের যে ভেড়া দেখেছ তা হল মিডীয় ও পারসীক বাদশাহ্‌রা। সেই লোমশ ছাগল হল গ্রীস রাজ্য এবং তার দু’চোখের মাঝখানের বড় শিং হল সেই রাজ্যের প্রথম বাদশাহ্‌। ভেংগে ফেলা শিংয়ের জায়গায় সেই চারটা শিং হল চারটি রাজ্য যা সেই জাতির মধ্য থেকে বের হবে কিন্তু সেই রাজ্যগুলোর বাদশাহ্‌দের প্রথম বাদশাহ্‌র মত ক্ষমতা থাকবে না। “তাদের রাজত্বের শেষের দিকে যখন গুনাহের মাত্রা পূর্ণ হবে তখন একজন ভীষণ নিষ্ঠুর ও চালাক বাদশাহ্‌ উঠবে। সে খুব বলবান হবে, কিন্তু নিজের শক্তিতে নয়। সে ভীষণভাবে ধ্বংস করবে এবং সে যা করবে তাতেই সফল হবে। সে শক্তিশালী লোকদের ও আল্লাহ্‌র বান্দাদের ধ্বংস করবে। তার চালাকির জন্য সে ছলনা করে সফলতা লাভ করবে এবং নিজেকে সবচেয়ে বড় মনে করবে। লোকে যখন নিজেদের নিরাপদ মনে করবে তখন সে অনেককে ধ্বংস করবে এবং শাসনকর্তাদের কর্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। শেষে সে ধ্বংস হবে, কিন্তু মানুষের শক্তিতে নয়। “তোমাকে সন্ধ্যা ও সকালের কোরবানীর বিষয়ে যে দর্শন দেখানো হয়েছে তা সত্যি, কিন্তু এই দর্শনটা সীলমোহর করে রাখ, কারণ সেটা ভবিষ্যতে অনেক পরে হবে।” আমি দানিয়াল ক্লান্ত হয়ে পড়লাম এবং অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন শুয়ে রইলাম। তারপর আমি উঠে বাদশাহ্‌র কাজ করতে গেলাম। আমি সেই দর্শন দেখে খুব চিনি-ত হয়েছিলাম, কারণ সেই দর্শনের অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না। সেইজন্য আমি রোজা রেখে, চট পরে এবং ছাই মেখে অনুরোধ ও মিনতির সংগে আল্লাহ্‌ মালিকের কাছে মুনাজাত করলাম। আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে আমি মুনাজাত করলাম ও গুনাহ্‌ স্বীকার করে বললাম, “হে মালিক, তুমিই ভয় জাগানো আল্লাহ্‌তা’লা। যারা তোমাকে মহব্বত করে ও তোমার হুকুম পালন করে তাদের জন্য তুমি তোমার অটল মহব্বতের ব্যবস্থা রক্ষা করে থাক। আমরা গুনাহ্‌ করেছি, অন্যায় করেছি। আমরা খারাপ কাজ করেছি, বিদ্রোহ করেছি। আমরা তোমার হুকুম ও শরীয়তের পথ থেকে সরে গেছি। আমাদের বাদশাহ্‌দের, নেতাদের, পূর্বপুরুষদের ও দেশের সব লোকদের কাছে তোমার গোলাম নবীরা তোমার দেওয়া যে কথা বলেছেন তা আমরা শুনি নি। “হে মালিক, তুমি ন্যায়বান, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা অপমানে ঢাকা রয়েছি। এহুদার লোকেরা, জেরুজালেমের বাসিন্দারা এবং যে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের তোমার প্রতি বেঈমানীর জন্য তুমি নানা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলে তারা সবাই অপমানে ঢেকে আছে। হে মাবুদ, আমাদের বাদশাহ্‌রা, নেতারা, পূর্বপুরুষেরা ও আমরা অপমানে ঢাকা আছি, কারণ আমরা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। আমাদের আল্লাহ্‌ মালিক দয়ালু ও মাফদানকারী, যদিও আমরা তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথার বাধ্য হই নি; তোমার গোলাম নবীদের মধ্য দিয়ে তোমার দেওয়া নির্দেশ আমরা পালন করি নি। বনি-ইসরাইলরা সবাই তোমার নির্দেশ অমান্য করে তোমার পথ থেকে সরে গেছে; তারা তোমার কথা শোনে নি। সেইজন্য তোমার গোলাম মূসার শরীয়তে লেখা যে বদদোয়ার কথা তুমি কসম খেয়ে বলেছিলে তা আমাদের উপরেই ঢেলে দেওয়া হয়েছে, কারণ আমরা তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। আমাদের ও আমাদের শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে তুমি যে কথা বলেছ তা পূর্ণ করবার জন্য তুমি আমাদের উপর মহা বিপদ এনেছ। জেরুজালেমের প্রতি যা করা হয়েছে গোটা দুনিয়ার আর কোথাও তেমন করা হয় নি। মূসার শরীয়তে যেমন লেখা আছে সেইমতই এই সব বিপদ আমাদের উপরে এসেছে, তবুও আমরা আমাদের গুনাহ্‌ থেকে ফিরে আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র দয়া পাবার চেষ্টা করি নি; তোমার সত্যের প্রতি আমরা মনোযোগী হই নি। কাজেই হে মাবুদ, তুমি বিপদ প্রস্তুত করে রেখেছ যেন তা এখন আমাদের উপর পাঠিয়ে দিতে পার, কারণ আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ সব কাজেই ন্যায়বান; তবুও আমরা তোমার কথা শুনি নি। “এখন হে আমাদের আল্লাহ্‌ মালিক, তুমি শক্তিশালী হাত দিয়ে তোমার বান্দাদের মিসর থেকে বের করে এনে সুনাম লাভ করেছিলে, আর তা আজ পর্যন্তও রয়েছে। আমরা গুনাহ্‌ করেছি, খারাপ কাজ করেছি। হে মালিক, তোমার ন্যায্যতা অনুসারে তোমার শহর, অর্থাৎ তোমার পবিত্র পাহাড় জেরুজালেম থেকে তোমার রাগ ও গজব দূর করে দাও। আমাদের গুনাহ্‌ ও আমাদের পূর্বপুরুষদের অন্যায়ের জন্য আমাদের চারপাশের লোকদের কাছে জেরুজালেম ও তোমার বান্দারা টিট্‌কারির পাত্র হয়েছে। “এখন, হে আমাদের আল্লাহ্‌, তোমার গোলামের মুনাজাত ও মিনতি শোন। হে মালিক, তোমার সুনাম রক্ষার জন্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া তোমার ঘরের প্রতি তুমি দয়ার চোখে তাকাও। হে আমার আল্লাহ্‌, তুমি কান দাও, শোন; তোমার চোখ খোল এবং যে শহর তোমার নামে পরিচিত তার ধ্বংস একবার দেখ। আমাদের নিজেদের গুণে নয় বরং তোমার মহা দয়ার জন্যই আমরা তোমার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। হে মালিক, শোন। হে মালিক, মাফ কর। হে মালিক, মনোযোগ দাও, কিছু কর। হে আমার আল্লাহ্‌, তোমার সুনাম রক্ষার জন্য আর দেরি কোরো না, কারণ তোমার শহর ও তোমার বান্দারা তোমার নামেই পরিচিত।” এইভাবে আমি মুনাজাত করছিলাম, আমার ও আমার জাতি বনি-ইসরাইলদের গুনাহ্‌ স্বীকার করছিলাম এবং আমার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে তাঁর পবিত্র পাহাড়ের জন্য অনুরোধ করছিলাম। আমি তখনও মুনাজাত করছিলাম এমন সময় আগের দর্শনে আমি যাঁকে দেখেছিলাম সেই জিবরাইল ফেরেশতা সন্ধ্যার কোরবানীর সময়ে বেগে উড়ে আমার কাছে আসলেন। তিনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, “দানিয়াল, আমি এখন তোমাকে বুঝবার ক্ষমতা ও বুদ্ধি দিতে এসেছি। তুমি মুনাজাত করতে শুরু করতেই আল্লাহ্‌ তার জবাব দিয়েছেন, আর তা আমি তোমাকে জানাতে এসেছি, কারণ তিনি তোমাকে খুবই মহব্বত করেন। কাজেই এই সংবাদের বিষয় তুমি চিন্তা করে দেখ ও দর্শনটা বুঝে নাও। “তোমার লোকদের ও তোমার পবিত্র শহরের জন্য সত্তর গুণ সাত বছর ঠিক করা হয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে খারাপী বন্ধ করা হবে, অন্যায়ের শেষ হবে, গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হবে, চিরস্থায়ী ন্যায্যতা স্থাপন করা হবে, দর্শন ও ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করা হবে এবং মহাপবিত্র স্থানকে অভিষেক করা হবে। “তুমি জেনে ও বুঝে নাও যে, জেরুজালেমকে আবার মেরামত ও তৈরী করবার হুকুম বের হওয়া থেকে শুরু করে সেই মসীহের, অর্থাৎ শাসনকর্তার আসা পর্যন্ত সাত গুণ সাত বছর এবং বাষট্টি গুণ সাত বছর হবে। শহর-চক ও শহর রক্ষার ব্যবস্থা আবার নতুন করে তৈরী করা হবে এবং তা করা হবে কষ্টের সময়ে। বাষট্টি গুণ সাত বছর পরে মসীহ্‌কে হত্যা করা হবে এবং তাঁর কিছুই থাকবে না। অন্য একজন শাসনকর্তা আসবে এবং তার লোকেরা এসে শহর ও বায়তুল-মোকাদ্দস ধ্বংস করবে। শেষ সময় বন্যার মত আসবে, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে এবং ধ্বংসের পর ধ্বংস ঠিক করে রাখা আছে। সাত বছরের জন্য অনেকের সংগে সেই শাসনকর্তা সন্ধি করবে, কিন্তু সাত বছরের মাঝখানেই সে পশু ও শস্য কোরবানী দেওয়া বন্ধ করে দেবে। সেই ধ্বংসকারীর উপরে ঠিক করা শাস্তি সম্পূর্ণভাবে ঢেলে না দেওয়া পর্যন্ত বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে সে সর্বনাশা ঘৃণার জিনিস রাখবে।” পারস্যের বাদশাহ্‌ কাইরাসের রাজত্বের তৃতীয় বছরে যাঁকে বেল্টশৎসর নাম দেওয়া হয়েছিল সেই দানিয়ালের কাছে একটা বিষয় প্রকাশিত হল। বিষয়টা সত্যি এবং সেটা এক মহাকষ্ট সম্বন্ধে। একটা দর্শনের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টা তাঁকে বুঝানো হল। সেই সময় আমি দানিয়াল তিন সপ্তা ধরে শোক করছিলাম। সেই তিন সপ্তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন ভাল খাবার আমি খাই নি, গোশ্‌ত বা আংগুর-রস মুখে দিই নি এবং তেলও মাখি নি। প্রথম মাসের চব্বিশ দিনের দিন আমি মহানদী তাইগ্রীসের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় আমি তাকিয়ে মসীনার কাপড় পরা ও কোমরে খাঁটি সোনার কোমর-বাঁধনি দেওয়া একজন লোককে দেখতে পেলাম। তাঁর শরীর বৈদূর্যমণির মত, মুখ বিদ্যুতের মত, চোখ জ্বলন্ত মশালের মত, হাত-পা পালিশ করা ব্রোঞ্জের উজ্জ্বলতার মত এবং তাঁর স্বর জমায়েত হওয়া অনেক লোকের আওয়াজের মত। আমি দানিয়াল একাই সেই দর্শন দেখতে পেলাম; আমার সংগের লোকেরা তা দেখতে পেল না, কিন্তু তারা এত ভয় পেল যে, তারা পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রইল। কাজেই আমি একাই সেই মহৎ দর্শন দেখতে লাগলাম। আমার মধ্যে কোন শক্তি রইল না, আমার মুখ মরার মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল এবং আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। তারপর আমি সেই লোকের কথা শুনতে পেলাম এবং তাঁর কথা শোনামাত্রই আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লাম। তখন একটা হাত আমাকে ছুঁয়ে আমাকে দুই হাত ও হাঁটুর উপরে ভর করিয়ে দিল। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্‌র প্রিয় দানিয়াল, আমি তোমাকে যে কথা বলতে যাচ্ছি তাতে ভাল করে মনোযোগ দাও। তুমি উঠে দাঁড়াও, কারণ আমাকে এখন তোমার কাছে পাঠানো হয়েছে।” তিনি আমাকে এই কথা বললে পর আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বলতে লাগলেন, “দানিয়াল, ভয় কোরো না। প্রথম যেদিন তুমি দর্শনের বিষয় বুঝবার জন্য এবং তোমার আল্লাহ্‌র সামনে অন্তর ভেংগেচুরে কষ্ট স্বীকার করবার জন্য মন স্থির করেছিলে সেই দিনই তোমার কথা শোনা হয়েছিল আর সেইজন্যই আমি এসেছি। কিন্তু পারস্য রাজ্যের প্রধান একুশ দিন পর্যন্ত আমাকে বাধা দিয়েছিল। তখন মিকাইল নামে প্রধান ফেরেশতাদের একজন আমাকে সাহায্য করতে আসলেন, কারণ আমি পারস্যের বাদশাহ্‌দের মধ্যে একা ছিলাম। ভবিষ্যতে তোমার লোকদের উপর যা ঘটবে তা তোমাকে বুঝাবার জন্য আমি এখন তোমার কাছে এসেছি, কারণ দর্শনের মধ্যে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে তা এখনও আসে নি।” তিনি যখন আমাকে এই কথা বলছিলেন তখন আমি মাথা নীচু করে ছিলাম, আমার মুখে কোন কথা ছিল না। তখন মানুষের মত দেখতে সেই ফেরেশতা, যিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আমার ঠোঁট ছুঁলেন, আর আমি মুখ খুলে তাঁকে বললাম, “হে হুজুর, এই দর্শনের জন্য আমি মনে খুব কষ্ট পাচ্ছি এবং আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হে হুজুর, আমি আপনার গোলাম, আমি কেমন করে আপনার সংগে কথা বলব? আমার শক্তি নেই এবং আমার মধ্যে শ্বাসও নেই।” তখন মানুষের মত দেখতে সেই ফেরেশতা আবার আমাকে ছুঁলেন এবং আমাকে শক্তি দিলেন। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্‌র প্রিয়, তুমি ভয় কোরো না। তোমার শান্তি হোক। তুমি সাহস কর ও শক্তিশালী হও।” তিনি আমার সংগে কথা বলামাত্রই আমি শক্তি পেয়ে বললাম, “হে আমার প্রভু, বলুন, কারণ আপনি আমাকে শক্তি দিয়েছেন।” আমি নিজেও মিডীয় দারিয়ুসের রাজত্বের প্রথম বছরে মিকাইলকে সাহায্য করবার ও শক্তি দেবার জন্য গিয়েছিলাম। “এখন আমি তোমাকে যা বলব তা সত্যিই ঘটবে। পারস্যে আরও তিনজন বাদশাহ্‌ রাজত্ব করবে। তাদের পরে আর একজন বাদশাহ্‌ অন্য বাদশাহ্‌দের চেয়ে অনেক বেশী ধনী হবে। তার ধন দিয়ে শক্তিশালী হওয়ার পর সে গ্রীস রাজ্যের বিরুদ্ধে সকলকে ক্ষেপিয়ে তুলবে। তখন একজন শক্তিশালী বাদশাহ্‌ উঠবে এবং মহাশক্তিতে রাজত্ব করবে; সে যা খুশী তা-ই করবে। সে উঠবার পরে তার রাজ্য ভেংগে চার দিকে চার ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। তার রাজ্য তার বংশধরদের হাতে যাবে না; সেই রাজ্যটা যাদের হাতে যাবে আগের বাদশাহ্‌র মত তাদের শক্তি থাকবে না, কারণ তাদের রাজ্য ধ্বংস হয়ে অন্যদের হাতে যাবে। “দক্ষিণ দিকের বাদশাহ্‌ শক্তিশালী হবে, কিন্তু তার একজন সেনাপতি তার চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে আরও বড় রাজ্য শাসন করবে। কয়েক বছর পরে সে উত্তর দিকের বাদশাহ্‌র সংগে বন্ধুত্ব করবে। বন্ধুত্বের জন্য দক্ষিণ দিকের বাদশাহ্‌র মেয়েকে উত্তর দিকের বাদশাহ্‌র সংগে বিয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু সেই মেয়ে সেই বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারবে না এবং সেই বাদশাহ্‌ ও তার ক্ষমতাও স্থায়ী হবে না। সেই মেয়েকে, তার রক্ষীদের, তার বাবাকে এবং তার সাহায্যকারীকে হত্যা করা হবে। “সেই মেয়ের পরিবারের মধ্য থেকে একজন তার বাবার রাজপদ নেবার জন্য উঠবে। সে উত্তরের বাদশাহ্‌র সৈন্যদলকে আক্রমণ করে তার কেল্লায় ঢুকবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবে। সে তাদের দেব-দেবী, ধাতুর তৈরী সব মূর্তি এবং রূপা ও সোনার দামী দামী জিনিস দখল করে মিসরে নিয়ে যাবে। কয়েক বছর সে উত্তরের বাদশাহ্‌র প্রতি কিছুই করবে না। তারপর উত্তরের বাদশাহ্‌ দক্ষিণের বাদশাহ্‌র রাজ্য আক্রমণ করবে, কিন্তু পরে নিজের দেশে ফিরে যাবে। তার ছেলেরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে এক বিরাট সৈন্যদল জমায়েত করবে এবং ভীষণ বন্যার মত এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে দক্ষিণের বাদশাহ্‌র কেল্লা পর্যন্ত যাবে। “তখন দক্ষিণের বাদশাহ্‌ ভীষণ রাগ করে বের হয়ে এসে উত্তরের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। উত্তরের বাদশাহ্‌ এক বিরাট সৈন্যদল জোগাড় করলেও তারা হেরে যাবে। দক্ষিণের বাদশাহ্‌ সৈন্যদের বন্দী করে নিয়ে যাবার পর অহংকারে পূর্ণ হবে এবং হাজার হাজার লোককে হত্যা করবে, তবুও সে শেষ পর্যন্ত জয়ী থাকবে না। পরে উত্তরের বাদশাহ্‌ প্রথম সৈন্যদলের চেয়ে আরও বড় একদল সৈন্য জমায়েত করবে; কয়েক বছর পরে সে এক বিরাট সৈন্যদল ও প্রচুর মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যাবে। “সেই সময়ে অনেকে দক্ষিণের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে উঠবে। এই দর্শন যাতে পূর্ণ হয় সেইজন্য তোমার নিজের জাতির মধ্য থেকে দুর্দান্ত লোকেরা বিদ্রোহ করবে, কিন্তু সফল হবে না। তারপর উত্তরের বাদশাহ্‌ এসে একটা দেয়াল-ঘেরা শহর ঘেরাও করে তা অধিকার করবে। দক্ষিণের সৈন্যদলের বাধা দেবার ক্ষমতা থাকবে না; এমন কি, তাদের সবচেয়ে ভাল সৈন্যদলেরও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকবে না। আক্রমণকারী যা খুশী তা-ই করবে; তার বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে পারবে না। সুন্দর দেশের মধ্যে সে নিজেকে স্থাপন করবে এবং সেটা ধ্বংস করবার ক্ষমতা তার থাকবে। সে তার গোটা রাজ্যের শক্তি সংগে নিয়ে সেখানে আসবে বলে স্থির করবে এবং দক্ষিণের বাদশাহ্‌র সংগে বন্ধুত্ব করবে। সেই রাজ্য ধ্বংস করবার জন্য সে তার এক মেয়েকে দক্ষিণের বাদশাহ্‌র সংগে বিয়ে দেবে, কিন্তু তার পরিকল্পনা সফল হবে না কিংবা তার কোন লাভও হবে না। তারপর উত্তরের বাদশাহ্‌ দূরের দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দেবে এবং অনেকগুলো দেশ দখল করে নেবে, কিন্তু একজন সেনাপতি তার সেই জয়ের গর্ব শেষ করে দেবে এবং তার টিট্‌কারি তার উপরেই ফিরিয়ে দেবে। এর পর সে তার নিজের দেশের কেল্লাগুলোতে ফিরে আসবে, কিন্তু তার পতন হবে; তাকে আর দেখা যাবে না। “তার জায়গায় যে বাদশাহ্‌ হবে সে রাজ্যের জাঁকজমক ফিরিয়ে আনবার জন্য খাজনা আদায়কারীদের পাঠাবে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সে ধ্বংস হয়ে যাবে; এই ধ্বংস কোন রাগ বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসবে না। “যাকে বাদশাহ্‌ হওয়ার অধিকার দেওয়া হয় নি এমন একজন ঘৃণার যোগ্য লোক তার জায়গায় বাদশাহ্‌ হবে। লোকে যখন নিশ্চিন্তে থাকবে তখনই সে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজ্যটা দখল করবে। যে শক্তিশালী সৈন্যদল তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তারা পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সন্ধির কর্তাও ধ্বংস হয়ে যাবে। সন্ধি করবার পরে সেই বাদশাহ্‌ ছলনা করবে আর অল্প কয়েকজন লোকের সাহায্যে ক্ষমতা লাভ করবে। ধনী প্রদেশগুলো যখন নিজেদের নিরাপদ মনে করবে তখনই সে তাদের আক্রমণ করবে এবং তার পূর্বপুরুষেরা ও সেই পূর্বপুরুষদের পূর্বপুরুষেরা যা করতে পারে নি সে তা করবে। কেড়ে নেওয়া ও লুট করা জিনিসপত্র এবং ধন সে তার লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। সে কেল্লাগুলোর সর্বনাশ করবার জন্য ষড়যন্ত্র করবে, কিন্তু তা অল্প দিনের জন্য। “একটা বিরাট সৈন্যদল নিয়ে সে দক্ষিণের বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে তার নিজের শক্তি ও সাহসকে উত্তেজিত করে তুলবে। দক্ষিণের বাদশাহ্‌ এক বিরাট শক্তিশালী সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধ করবে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হবে তার জন্য সে দাঁড়াতে পারবে না। যারা বাদশাহ্‌র খাবারের ভাগ পায় তারা তাকে ধ্বংস করবে। তার সৈন্যদল বিরাট হলেও অনেকে মারা পড়বে। এই দুই বাদশাহ্‌র দিল খারাপীর দিকে ঝুঁকে থাকাতে তারা একই টেবিলে বসে একে অন্যের কাছে মিথ্যা কথা বলবে, কিন্তু তাতে কোন ফল হবে না, কারণ তাদের সব কিছুর শেষ নির্দিষ্ট সময়েই আসবে। উত্তরের বাদশাহ্‌ অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে তার নিজের দেশের দিকে যাবে, কিন্তু তার দিল পবিত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে থাকবে। সে তার নিজের ইচ্ছামত কাজ করবে এবং তারপর নিজের দেশে ফিরে যাবে। “নির্দিষ্ট সময়ে সে আবার দক্ষিণ দেশ আক্রমণ করবে, কিন্তু এইবার আগের মত না হয়ে অন্য রকম হবে। সাইপ্রাস দ্বীপের জাহাজগুলো তাকে বাধা দেবে এবং তার মন ভেংগে যাবে। তখন সে ফিরে রাগ করে পবিত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের ইচ্ছামত কাজ করবে। সে ফিরে এসে যারা সেই পবিত্র ব্যবস্থা ত্যাগ করবে তাদের প্রতি মনোযোগ দেবে। তার সৈন্যেরা বায়তুল-মোকাদ্দস, অর্থাৎ কেল্লা নাপাক করবে এবং প্রতিদিনের কোরবানী বন্ধ করে দেবে। তারপর তারা সর্বনাশা ঘৃণার জিনিস স্থাপন করবে। যারা পবিত্র ব্যবস্থা অমান্য করবে খোশামুদে কথা বলে সে তাদের কুপথে নিয়ে যাবে, কিন্তু যে লোকেরা তাদের আল্লাহ্‌কে জানে তারা খুব শক্তভাবে তাকে বাধা দেবে। “সেই লোকদের মধ্যে যাদের বুঝবার ক্ষমতা আছে তারা অনেককে শিক্ষা দেবে, তবুও কিছুকাল ধরে তাদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধে মারা পড়বে, কিংবা তাদের পুড়িয়ে মারা হবে, কিংবা তাদের বন্দী করা বা লুট করা হবে। এই সময়ে তারা অল্পই সাহায্য পাবে এবং অনেকে খোশামুদে কথা বলে তাদের সংগে যোগ দেবে। যাদের বুঝবার ক্ষমতা আছে তাদের মধ্যে কারও কারও পতন হবে। এর ফলে শেষ সময় না আসা পর্যন্ত আল্লাহ্‌র বান্দাদের খাঁটি, শুদ্ধ ও নিখুঁত করা হবে; আর সেই শেষ সময় নির্দিষ্ট করা আছে। “উত্তরের বাদশাহ্‌ নিজের ইচ্ছামত কাজ করবে। সমস্ত দেবতাদের চেয়ে সে নিজেকে বড় করে দেখাবে এবং যিনি দেবতাদের আল্লাহ্‌ তাঁর বিরুদ্ধেও বড় বড় কথা বলবে। আল্লাহ্‌র গজব সম্পূর্ণভাবে ঢেলে না দেওয়া পর্যন্ত সে সফল হবে, কারণ যা স্থির করা হয়েছে তা ঘটবেই। তার পূর্বপুরুষদের দেবতাদের কিংবা স্ত্রীলোকেরা যা চায় তার প্রতি সে কোন সম্মান দেখাবে না; আসলে কোন দেবতাকেই সে সম্মান করবে না, কিন্তু সকলের উপরে নিজেকে উঁচু করে দেখাবে। তাদের বদলে সে যুদ্ধের দেবতাকে সম্মান করবে; যে দেবতা পূর্বপুরুষদের অজানা তাকেই সে সোনা, রূপা, দামী দামী পাথর ও উপহার দিয়ে সম্মান দেখাবে। সেই অজানা দেবতার সাহায্যে সে সবচেয়ে শক্তিশালী কেল্লাগুলো আক্রমণ করবে এবং যারা তাকে মেনে নেবে তাদের সে খুব সম্মানিত করবে। তাদের সে অনেক লোকের উপরে শাসনকর্তা করবে এবং পুরস্কার হিসাবে জমি ভাগ করে দেবে। “শেষ সময় আসলে পর দক্ষিণ দেশের বাদশাহ্‌ তাকে আক্রমণ করবে এবং সেই উত্তরের বাদশাহ্‌ রথ, ঘোড়সওয়ার সৈন্য এবং অনেক জাহাজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ঝড়ের মত আসবে। সে অনেক দেশ আক্রমণ করবে এবং বন্যার মত করে তাদের ধুয়ে-মুছে ফেলবে। সে সুন্দর দেশটাও আক্রমণ করবে। অনেক দেশেরই পতন হবে, কিন্তু গোটা ইদোম ও মোয়াব এবং অম্মোনের সবচেয়ে ভাল লোকেরা তার হাত থেকে উদ্ধার পাবে। অনেক দেশের উপর সে তার ক্ষমতা বাড়াবে; মিসরও রেহাই পাবে না। সমস্ত সোনা-রূপা ও মিসরের সমস্ত ধন তার অধিকারে আসবে এবং লিবীয়রা ও ইথিওপীয়রা তার অধীনে আসবে। কিন্তু পূর্ব ও উত্তরের খবর পেয়ে সে ভয় পাবে এবং ভীষণ রাগে ধ্বংস করবার ও অনেককে হত্যা করবার জন্য সে বের হবে। সাগর ও সুন্দর পবিত্র পাহাড়ের মাঝখানে সে তার রাজ-তাম্বু খাটাবে। তবুও তার শেষ উপস্থিত হবে, কেউ তাকে সাহায্য করবে না। “সেই সময় তোমার লোকদের রক্ষাকারী মহান ফেরেশতা মিকাইল তোমাদের পক্ষে দাঁড়াবেন। এমন একটা কষ্টের সময় উপস্থিত হবে যা তোমার জাতির শুরু থেকে সেই সময় পর্যন্ত কখনও হয় নি। কিন্তু সেই সময় তোমার লোকদের মধ্যে যাদের নাম কিতাবের মধ্যে লেখা থাকবে তারা উদ্ধার পাবে। দুনিয়ার মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা অসংখ্য লোক তখন জেগে উঠবে; কেউ কেউ উঠবে অনন্তকাল বেঁচে থাকবার জন্য, আবার অন্যেরা উঠবে লজ্জার ও চিরস্থায়ী ঘৃণার পাত্র হবার জন্য। যাদের বুঝবার ক্ষমতা আছে, অর্থাৎ যারা অনেককে ন্যায়পথে এনেছে তারা আসমানের আলো ও উজ্জ্বল তারার মত চিরকাল জ্বল্‌ জ্বল্‌ করবে। কিন্তু তুমি, দানিয়াল, শেষ সময় না আসা পর্যন্ত এই ভবিষ্যদ্বাণীর কিতাবটা বন্ধ করে তার কথাগুলো সীলমোহর করে রাখ। সেই সময়ের মধ্যে অনেকে যেখান্তেসেখানে যাবে এবং জ্ঞানের বৃদ্ধি হবে।” তখন আমি দানিয়াল তাকিয়ে অন্য দু’জনকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাঁদের একজন নদীর এপারে এবং অন্যজন নদীর ওপারে ছিলেন। মসীনার কাপড়-পরা যিনি নদীর পানির উপরে ছিলেন তাঁকে সেই দু’জনের মধ্যে একজন বললেন, “এই সব আশ্চর্য আশ্চর্য ব্যাপার শেষ হতে কত কাল লাগবে?” তখন আমি শুনলাম, নদীর পানির উপরে থাকা মসীনার কাপড়-পরা সেই লোক তাঁর দু’হাত বেহেশতের দিকে তুলে যিনি চিরকাল জীবিত তাঁর নামে কসম খেয়ে বললেন, “সাড়ে তিন বছর লাগবে। শেষে আল্লাহ্‌র বান্দাদের শক্তি যখন একেবারে ভেংগে পড়বে তখন এই সব কথা পূর্ণ হবে।” আমি শুনলাম বটে কিন্তু কিছু বুঝলাম না। সেইজন্য আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হে হুজুর, এই সবের শেষ ফল কি হবে?” জবাবে তিনি বললেন, “দানিয়াল, তুমি এই বিষয় নিয়ে আর চিন্তা কোরো না, কারণ শেষ সময় না আসা পর্যন্ত এই সব কথা বন্ধ করে সীলমোহর করে রাখা হয়েছে। অনেককে শুদ্ধ, নিখুঁত ও খাঁটি করা হবে, কিন্তু দুষ্টেরা অন্যায় করতেই থাকবে। দুষ্টদের কেউই বুঝতে পারবে না, কিন্তু জ্ঞানীরা বুঝবে। যেদিন থেকে নিয়মিত কোরবানী বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সর্বনাশা ঘৃণার জিনিস স্থাপন করা হবে সেই দিন থেকে এক হাজার দু’শো নব্বই দিন হবে। ধন্য সেই লোক যে অপেক্ষা করে এবং এক হাজার তিনশো পঁয়ত্রিশ দিনের শেষ পর্যন্ত স্থির থাকে। “কিন্তু তুমি এখন যেমন আছ মৃত্যু পর্যন্ত তেমনই থাক। তারপর তুমি বিশ্রাম পাবে এবং কেয়ামতের সময়ে তুমি তোমার পুরস্কার পাবার জন্য বেঁচে উঠবে।” এহুদার বাদশাহ্‌ উষিয়, যোথম, আহস ও হিষ্কিয়ের রাজত্বের সময়ে এবং ইসরাইলের বাদশাহ্‌ যোয়াশের ছেলে ইয়ারাবিমের সময়ে বেরির ছেলে হোসিয়ার উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। হোসিয়ার মধ্য দিয়ে প্রথমবার কথা বলবার সময়ে মাবুদ তাঁকে বললেন, “তুমি গিয়ে একজন জেনাকারিণী স্ত্রীলোককে বিয়ে কর। তার জেনার সন্তানদেরও গ্রহণ করবে, কারণ এই দেশ মাবুদের কাছ থেকে সরে গিয়ে সবচেয়ে জঘন্য জেনার দোষে দোষী হয়েছে।” কাজেই হোসিয়া দিব্‌লায়িমের মেয়ে গোমরকে বিয়ে করলেন আর গোমর গর্ভবতী হয়ে হোসিয়ার জন্য একটি ছেলের জন্ম দিল। তখন মাবুদ হোসিয়াকে বললেন, “তুমি ওর নাম রাখ যিষ্রিয়েল, কারণ যিষ্রিয়েল শহরে অনেক লোককে যেহূ মেরে ফেলেছে বলে আমি তার বংশকে শীঘ্রই শাস্তি দেব এবং ইসরাইল রাজ্যকে শেষ করে দেব। সেই দিন আমি যিষ্রিয়েলের উপত্যকায় ইসরাইলের ধনুক ভেংগে ফেলব।” পরে গোমর আবার গর্ভবতী হল এবং তার একটি মেয়ে হল। তখন মাবুদ হোসিয়াকে বললেন, “তুমি মেয়েটির নাম রাখ লো-রুহামা (যার মানে ‘দয়ার পাত্র নয়’), কারণ ইসরাইলের লোকদের আর আমি দয়া করব না, কোনমতেই তাদের মাফ করব না। কিন্তু এহুদার লোকদের রহমত করব এবং তাদের উদ্ধার করব। সেই উদ্ধার ধনুক, তলোয়ার কিংবা যুদ্ধ অথবা ঘোড়া বা ঘোড়সওয়ার দিয়ে হবে না, বরং আমি তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ই তাদের উদ্ধার করব।” লো-রুহামাকে দুধ খাওয়ানো ছাড়িয়ে দেবার পরে গোমরের আর একটি ছেলে হল। তখন মাবুদ বললেন, “তুমি তার নাম রাখ লো-অম্মি (যার মানে ‘আমার লোক নয়’), কারণ তোমরা আমার লোক নও এবং আমিও তোমাদের আল্লাহ্‌ নই। তবুও বনি-ইসরাইলরা সাগর-পারের বালুকণার মত হবে, যা মাপা যায় না, গোণাও যায় না। যে জায়গায় তাদের বলা হয়েছিল, ‘তোমরা আমার লোক নও,’ সেখানে তাদের বলা হবে, ‘জীবন্ত আল্লাহ্‌র সন্তান।’ এহুদা ও ইসরাইলের লোকেরা আবার মিলিত হবে এবং তাদের উপরে একজন নেতাকে নিযুক্ত করবে। তার আগে যে দেশে তারা বন্দী ছিল সেখান থেকে তারা চলে আসবে, কারণ যিষ্রিয়েলের সেই দিনটা হবে মহৎ। “তোমাদের ভাইদের তোমরা বলবে অম্মি (যার মানে ‘আমার লোক’) আর বোনদের বলবে রুহামা (যার মানে ‘দয়ার পাত্র’)। “তোমাদের মাকে বকুনি দাও, বকুনি দাও তাকে, কারণ সে আমার স্ত্রী নয় এবং আমিও তার স্বামী নই। সে তার চোখের চাহনি থেকে বেশ্যাগিরি ও তার বুক থেকে জেনা দূর করুক। তা না হলে আমি তাকে উলংগ করে দেব এবং সে তার জন্মের দিনে যেমন উলংগ ছিল তেমনি করব। আমি তাকে করব মরুভূমির মত, করে দেব শুকনা জমির মত এবং পিপাসা দিয়ে তাকে মেরে ফেলব। আমি তার ছেলেমেয়েদের দয়া করব না, কারণ তারা জেনার সন্তান। তাদের মা জেনা করেছে; যে তাদের গর্ভে ধরেছে সে লজ্জার কাজ করেছে। সে বলত, ‘আমি আমার প্রেমিকদের পিছনে যাব; তারাই আমাকে খাবার, পানি, পশম, মসীনা, তেল ও পানীয় দিয়ে থাকে।’ সেইজন্য আমি কাঁটাঝোপ দিয়ে তার পথ বন্ধ করব; আমি তার চারদিকে দেয়াল গাঁথব যাতে সে তার পথ খুঁজে না পায়। সে তার প্রেমিকদের পিছনে দৌড়াবে কিন্তু তাদের ধরতে পারবে না; সে তাদের খুঁজবে কিন্তু পাবে না। তখন সে বলবে, ‘আমি আমার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাব, কারণ তখন আমি এখনকার চেয়ে ভাল ছিলাম।’ সে স্বীকার করত না যে, আমিই তাকে সেই শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল দিতাম, তাকে প্রচুর পরিমাণে সোনা ও রূপা দিতাম, যা সে বাল দেবতার জন্য ব্যবহার করেছে। “কাজেই আমার শস্য পাকলে এবং আমার নতুন আংগুর-রস তৈরী হলে আমি তা নিয়ে যাব। তার উলংগতা ঢাকবার জন্য আমার সেই পশম ও মসীনা আমি ফিরিয়ে নেব। আমি এখন তার প্রেমিকদের চোখের সামনে তার লজ্জার কাজ প্রকাশ করব; আমার হাত থেকে কেউ তাকে উদ্ধার করবে না। আমি তার সব আনন্দের অনুষ্ঠান, ঈদ, অমাবস্যা, বিশ্রাম দিন্ত এক কথায় তার সব নির্দিষ্ট ঈদ বন্ধ করে দেব। যে সব আংগুর লতা ও ডুমুর গাছের বিষয় সে বলেছে যে, তার পাওনা হিসাবে তার প্রেমিকেরা দিয়েছে, সেগুলো আমি নষ্ট করব; সেগুলো আমি জংগলে ভরে দেব আর বুনো পশুরা সেগুলো খেয়ে ফেলবে। যতদিন সে বাল দেবতাদের উদ্দেশে ধূপ জ্বালিয়েছে এবং আংটি ও গহনা-গাঁটি দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তার প্রেমিকদের পিছনে গিয়ে আমাকে ভুলে থেকেছে ততদিনের জন্য আমি তাকে শাস্তি দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “পরে আমি তাকে মিষ্টি কথা বলে মরুভূমিতে নিয়ে যাব এবং তার সংগে মহব্বতের কথা বলব। আমি সেখানে তার আংগুর ক্ষেত তাকে ফিরিয়ে দেব এবং আখোর উপত্যকাকে করব আশার দরজা। তার যৌবনকালের মত করে সে সেখানে কাওয়ালী গেয়ে সাড়া দেবে যেমন সে দিয়েছিল মিসর থেকে বের হয়ে আসবার দিনে। “আমি মাবুদ বলছি যে, সেই দিনে সে আমাকে ‘আমার স্বামী’ বলে ডাকবে; ‘আমার মালিক’ বলে আর ডাকবে না। তার মুখ থেকে আমি বাল দেবতাদের নাম দূর করে দেব; সে আর বাল দেবতাদের ডাকবে না। সেই দিন আমি তার জন্য পশু, পাখী ও বুকে-হাঁটা প্রাণীদের সংগে সন্ধি করব। আমি দেশ থেকে ধনুক, তলোয়ার ও যুদ্ধ দূর করে দেব যাতে সবাই নিরাপদে ঘুমাতে পারে। “হে ইসরাইল, আমি তোমার সংগে বিয়ের সম্বন্ধ চিরকালের জন্য পাকা করব; সততা, ন্যায়বিচার, অটল মহব্বত ও দয়ায় আমি সেই সম্বন্ধ পাকা করব। আমি বিশ্বস্ততায় সেই সম্বন্ধ পাকা করব আর তখন তুমি মাবুদকে গভীরভাবে জানতে পারবে। “আমি মাবুদ বলছি, সেই দিনে আমি তোমাদের সাড়া দেব। আমি আকাশকে হুকুম দেব; আকাশ দুনিয়াকে বৃষ্টি দেবে; দুনিয়া শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল দেবে, আর সেগুলোর মধ্য দিয়ে যিষ্রিয়েল, অর্থাৎ ইসরাইল আমার সাড়া পাবে। আমার জন্যই আমি তাকে দেশে বীজের মত করে বুনে দেব; আমি যাকে বলেছিলাম, ‘আমার দয়ার পাত্র নয়,’ তাকেই আমি দয়া করব। আমি যাদের বলেছিলাম, ‘আমার বান্দা নয়,’ তাদের আমি বলব, ‘তোমরা আমারই বান্দা’; আর তারা বলবে, ‘তুমিই আমাদের আল্লাহ্‌।’ ” মাবুদ আমাকে বললেন, “যদিও তোমার স্ত্রী অন্য লোকের সংগে জেনা করছে তবুও তুমি গিয়ে তাকে আবার ভালবাস। বনি-ইসরাইলরা যদিও দেব-দেবীর দিকে ফিরেছে এবং পূজার কিশমিশের পিঠা ভালবাসে তবুও মাবুদ যেমন তাদের ভালবাসেন, ঠিক তেমনি করে তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালবাস।” কাজেই আমি তাকে একশো আশি গ্রাম রূপা ও নব্বই কেজি যব দিয়ে কিনে আনলাম। তারপর আমি তাকে বললাম, “আমার সংগে সহবাস করবার জন্য তোমাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তুমি জেনা করবে না কিংবা কোন লোকের সংগে ভালবাসার সম্পর্ক করবে না। আমিও তোমার জন্য অপেক্ষা করব।” ঠিক এইভাবে বনি-ইসরাইলরা অনেক দিন পর্যন্ত বাদশাহ্‌, নেতা, কোরবানী, পূজার পাথর, এফোদ এবং মূর্তি ছাড়াই থাকবে। তার পরে তারা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ও তাদের বাদশাহ্‌ দাউদের দিকে ফিরবে। কেয়ামতের সময়ে তারা মাবুদের দোয়া পাবার জন্য ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে আসবে। হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা মাবুদের কালাম শোন, কারণ যারা দেশে বাস করে তাদের বিরুদ্ধে মাবুদের একটা নালিশ আছে। তা হল, দেশে বিশ্বস্ততা ও অটল মহব্বত নেই এবং আল্লাহ্‌কে কেউ সত্যিকারভাবে জানে না; আছে কেবল কসম ভাংগা, মিথ্যা কথা বলা, খুন করা, চুরি করা ও জেনা করা। তারা আইন অমান্য করে এবং রক্তপাতের উপরে রক্তপাত করে। এইজন্য দেশ শোক করছে এবং যারা তার মধ্যে বাস করে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং পশু, পাখী ও মাছ মরে যাচ্ছে। মাবুদ বলছেন, “কেউ কারও বিরুদ্ধে নালিশ না করুক, কেউ কাউকে দোষী না করুক, কারণ তোমরা সেই লোকদের মত হয়েছ যারা ইমামদের বিরুদ্ধে নালিশ করে। ইমামেরা, তোমরা দিনে ও রাতে উচোট খা"ছ এবং তোমাদের সংগে উচোট খাচ্ছে নবীরা। কাজেই আমি তোমাদের মা ইসরাইলকে ধ্বংস করে দেব। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাবে আমার বান্দারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তোমরা সেই জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করেছ বলে আমিও আমার ইমাম হিসাবে তোমাদের অগ্রাহ্য করলাম। তোমরা তোমাদের আল্লাহ্‌র শরীয়ত ভুলে গেছ, তাই আমিও তোমাদের ছেলেমেয়েদের ভুলে যাব। “ইমামেরা সংখ্যায় যত বাড়ছে ততই তারা আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করছে, সেইজন্য আমি সম্মানের বদলে তাদের অসম্মানিত করব। আমার বান্দাদের গুনাহের দরুন তারা লাভবান হয় বলে তারা আমার বান্দাদের গুনাহ্‌ করতে উৎসাহ দেয়। যেমন লোকদের তেমনি ইমামদেরও শাস্তি দেওয়া হবে; তাদের আচার-ব্যবহারের জন্য তাদের সকলকেই আমি শাস্তি দেব এবং তাদের কাজ অনুসারে ফল দেব। তারা খাবে কিন্তু তৃপ্ত হবে না; তারা জেনা করবে কিন্তু সংখ্যায় বাড়বে না, কারণ তারা মূর্তিপূজার জন্য মাবুদকে ত্যাগ করেছে। “জেনা এবং নতুন ও পুরানো আংগুর-রস আমার বান্দাদের বুদ্ধি নষ্ট করছে। তারা কাঠের মূর্তির কাছে পরামর্শ চায় আর কাঠের লাঠি তাদের নির্দেশ দেয়, কারণ জেনার মন তাদের বিপথে নিয়ে গেছে; তারা তাদের আল্লাহ্‌র কাছে অবিশ্বস্ত হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় তারা পশু উৎসর্গ করে এবং পাহাড়ের উপরে অলোন, লিব্‌নী ও এলা গাছের নীচে যেখানে ছায়া আরাম দেয় সেখানে তারা ধূপ জ্বালায়। সেইজন্য তোমাদের মেয়েরা বেশ্যা হয় এবং ছেলের স্ত্রীরা জেনা করে। তোমাদের মেয়েরা বেশ্যা হলে আর ছেলের স্ত্রীরা জেনা করলে আমি শাস্তি দেব না, কারণ পুরুষেরা নিজেরাই বেশ্যাদের কাছে যায় এবং মন্দির-বেশ্যাদের সংগে পশু উৎসর্গ করে। এই বুদ্ধিহীন জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। “হে ইসরাইল, তুমি যদিও জেনা করছ তবুও এহুদা যেন একই দোষে দোষী না হয়। তোমরা গিল্‌গলে যেয়ো না; বৈৎ-আবনে যেয়ো না; ‘আল্লাহ্‌র কসম’ বলে কসম খেয়ো না। বনি-ইসরাইলরা একগুঁয়ে গাভীর মত। কাজেই মাঠে ভেড়ার বাচ্চাদের মত মাবুদ কি করে তাদের চরাবেন? আফরাহীম প্রতিমাদের সংগে যোগ দিয়েছে; তাকে তা-ই করতে দাও। যখন তাদের মদ খাওয়া শেষ হয়ে যায় তখন তারা জেনা চালাতে থাকে; তাদের শাসনকর্তারা লজ্জাপূর্ণ আচার-ব্যবহার খুব ভালবাসে। শাস্তি বাতাসের মত করে যেন তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে; তাদের উৎসর্গ অনুষ্ঠানগুলোর জন্য তারা লজ্জা পাবে।” মাবুদ বলছেন, “হে ইমামেরা, তোমরা এই কথা শোন। হে ইসরাইলের লোকেরা, মনোযোগ দাও। হে রাজবংশ, কান দাও। এই রায় তোমাদেরই বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে, কারণ তোমরা মিসপাতে ফাঁদের মত আর তাবোরে মেলে দেওয়া জালের মত হয়েছিলে। বিদ্রোহীরা ভীষণভাবে জুলুম করছে, কিন্তু আমি তাদের সবাইকে শাস্তি দেব। আমি আফরাহীম সম্বন্ধে সব জানি; ইসরাইল আমার কাছ থেকে লুকানো নেই। আফরাহীম এখন জেনা করছে; ইসরাইল নাপাক হয়ে গেছে। “তাদের কাজ তাদের আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে যেতে দেয় না। তাদের মধ্যে আছে জেনার মন। তারা মাবুদকে সত্যিকারভাবে জানে না। ইসরাইলের অহংকারই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়; আফরাহীম, এমন কি, গোটা ইসরাইল তাদের গুনাহের জন্য উচোট খাচ্ছে আর এহুদাও তাদের সংগে উচোট খাচ্ছে। তাদের ভেড়া ও গরুর পাল নিয়ে মাবুদের কাছে গেলে তারা তাঁকে পায় না; তাদের কাছ থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তারা মাবুদের কাছে অবিশ্বস্ত হয়েছে; তারা জারজ সন্তানদের জন্ম দেয়। কাজেই এখন তাদের অমাবস্যার ঈদগুলো তাদের গ্রাস করবে এবং তাদের ক্ষেতগুলোও তাদের গ্রাস করবে। “তোমরা গিবিয়াতে তূরী বাজাও আর রামাতে বাজাও শিংগা। বৈৎ-আবনে চিৎকার করে বল, ‘হে বিন্‌ইয়ামীন, যুদ্ধে আমাদের পরিচালনা কর।’ শাস্তি দেবার দিনে আফরাহীম জনশূন্য হয়ে পড়ে থাকবে। যা হবেই হবে তা আমি ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঘোষণা করছি। যারা সীমানার পাথর সরায় এহুদার নেতারা তাদেরই মত। আমার গজব আমি বন্যার পানির মতই তাদের উপর ঢেলে দেব। আফরাহীম নিজের ইচ্ছায় অসারতার পিছনে গেছে বলে সে অত্যাচারিত হয়েছে এবং বিচারে তাকে পায়ের তলায় মাড়ানো হয়েছে। আফরাহীমের কাছে আমি হয়েছি পোকার মত আর এহুদার লোকদের কাছে হয়েছি ক্ষয় করা জিনিসের মত। “আফরাহীম যখন তার রোগ দেখতে পেল আর এহুদা দেখতে পেল তার আঘাত তখন আফরাহীম আশেরিয়ার দিকে ফিরে সাহায্যের জন্য সেই মহা বাদশাহ্‌র কাছে লোক পাঠাল। কিন্তু সে তো তাকে সুস্থ করতে পারবে না এবং তার আঘাতও সারাতে পারবে না। আমি আফরাহীমের কাছে ও এহুদার কাছে সিংহের মত হব। আমি তাদের টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলে চলে যাব; আমি তাদের নিয়ে যাব, তাদের উদ্ধার করবার জন্য কেউ থাকবে না। যে পর্যন্ত না তারা তাদের দোষ স্বীকার করে ও আমার দিকে মনোযোগ দেয় সেই পর্যন্ত আমি আমার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে সেখানে থাকব। তাদের দুঃখ-কষ্টের সময় তারা আগ্রহের সংগে আমার কাছে ফিরে আসবে।” চল, আমরা মাবুদের কাছে ফিরে যাই। তিনিই আমাদের টুকরা টুকরা করেছেন, তিনি আমাদের সুস্থও করবেন; তিনিই আমাদের আঘাত করেছেন, তিনি আমাদের আঘাত বেঁধেও দেবেন। অল্পদিন পরে তিনিই আবার আমাদের বাঁচিয়ে তুলবেন, এবং আমাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন যাতে আমরা তাঁর সামনে বাস করতে পারি। চল, আমরা মাবুদকে স্বীকার করে নিই; তাঁকে জানবার জন্য তাঁর পিছনে দৌড়াই। সূর্য ওঠার মত তিনি নিশ্চয়ই প্রকাশিত হবেন; বৃষ্টির মত করে, বসন্তকালের মাটি ভেজানো বৃষ্টির মত করে তিনি আসবেন। মাবুদ বলছেন, “হে আফরাহীম, আমি তোমাকে নিয়ে কি করব? হে এহুদা, তোমাকে নিয়েই বা আমি কি করব? তোমার বিশ্বস্ততা সকালের কুয়াশার মত, তা ভোরের শিশিরের মত যা তাড়াতাড়ি অদৃশ্য হয়ে যায়। সেইজন্য আমার নবীদের দিয়ে আমি তোমাদের টুকরা টুকরা করে কেটেছি, আমার মুখের কালাম দিয়ে তোমাদের মেরে ফেলেছি; আমার বিচারের রায় তোমাদের উপর বিদ্যুতের মত চম্‌কে উঠেছে। আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়; পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্‌কে চেনে। তোমরা আদমের মত আমার স্থাপন করা ব্যবস্থা অমান্য করেছ; তোমরা আমার প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছ। গিলিয়দ হল সেই দুষ্ট লোকদের শহর যেখানে রয়েছে তাদের রক্তমাখা পায়ের ছাপ। ডাকাতেরা যেমন মানুষের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে, তেমনি করে ওৎ পেতে থাকে ইমামের দল; তারা শিখিমে যাওয়ার রাস্তায় মানুষ খুন করে এবং ভীষণ অন্যায় কাজ করে। ইসরাইলের মধ্যে আমি একটা জঘন্য ব্যাপার দেখেছি। সেখানে আফরাহীম জেনা করেছে এবং ইসরাইল নাপাক হয়ে গেছে। “হে এহুদা, তোমার জন্যও ফসল কাটবার সময় স্থির করা হয়েছে। যখনই আমি আমার বান্দাদের অবস্থা ফিরাতে চাই, যখনই ইসরাইলকে সুস্থ করতে চাই, তখনই আফরাহীমের গুনাহ্‌ দেখা যায় আর সামেরিয়ার অন্যায় প্রকাশিত হয়। তারা ছলনা করে, ঘরে চোর ঢোকে আর বাইরে ডাকাতেরা লুটপাট করে; কিন্তু তারা বোঝে না যে, তাদের সব অন্যায় কাজ আমি মনে রাখি। তাদের গুনাহ্‌ সম্পূর্ণভাবে তাদের ঘিরে রেখেছে; সেগুলো সব সময়ই আমার সামনে রয়েছে। “তাদের দুষ্টতা দিয়ে তারা বাদশাহ্‌কে এবং মিথ্যা কথা দিয়ে রাজকর্মচারীদের আনন্দিত করে। তারা সবাই জেনাকারী, তারা রুটিকারের জ্বালানো তুন্দুরের মত; ময়দা ঠাসা থেকে শুরু করে তা ফেঁপে ওঠা পর্যন্ত সেই তুন্দুরের আগুন খোঁচাবার দরকার হয় না। বাদশাহ্‌র উৎসবের দিনে রাজকর্মচারীরা আংগুর-রস খেয়ে উত্তেজিত হয়েছিল আর বাদশাহ্‌ সেই ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের সংগে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন ষড়যন্ত্র করেছিল তখন তাদের অন্তর তুন্দুরের মত জ্বলছিল। তাদের রুটিকার সারারাত ঘুমিয়ে ছিল এবং সকালে সেই ষড়যন্ত্র জ্বলন্ত আগুনের মত জ্বলে উঠেছিল। তারা সবাই তুন্দুরের মত গরম হয়েছিল এবং তাদের শাসনকর্তাদের তারা আগুনের মত গ্রাস করেছিল। তাদের বাদশাহ্‌রা সবাই মারা পড়ে; তারা কেউই আমাকে ডাকে না। “আফরাহীম অন্যান্য জাতিদের সংগে মিশে গেছে; আফরাহীম এক দিক পুড়ে যাওয়া পিঠার মত হয়েছে যা উল্টানো হয় নি। বিদেশীরা তার শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে, কিন্তু সে তা বুঝতে পারছে না। তার মাথার চুল এখান্তেসেখানে পেকেছে, কিন্তু সে তা লক্ষ্য করছে না। ইসরাইলের অহংকার তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিন্তু এই সব হলেও সে তার মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরছে না, তাঁর দিকে মনোযোগও দিচ্ছে না। “আফরাহীম যেন একটা অবুঝ কবুতর; সে একেবারে বুদ্ধিহীন। একবার সে মিসরকে ডাকে আর একবার যায় আশেরিয়ার কাছে। তারা যখন যাবে তখন আমি তাদের উপর আমার জাল ফেলব; আকাশের পাখীদের মত করে আমি তাদের টেনে নামাব। বনি-ইসরাইলদের কাছে যেমন বলা হয়েছে সেইভাবেই আমি তাদের শাস্তি দেব। ঘৃণ্য তারা, কারণ তারা আমার কাছ থেকে বিপথে চলে গেছে। তাদের সর্বনাশ হোক, কারণ তারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আমি তাদের মুক্ত করতে চাই কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে। তাদের বিছানার উপর তারা বিলাপ করে, কিন্তু তারা দিল থেকে আমার কাছে কাঁদে না। শস্য ও নতুন আংগুর-রস পাবার জন্য তারা একত্র হয় এবং আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আমি তাদের যুদ্ধের শিক্ষা দিয়েছি ও শক্তিশালী করেছি, কিন্তু তারা আমারই বিরুদ্ধে খারাপীর ষড়যন্ত্র করে। তারা বেহেশতের দিকে ফেরে না; তারা খুঁতযুক্ত একটা ধনুকের মত। তাদের নেতারা তাদের অহংকারপূর্ণ কথাবার্তার জন্য মারা পড়বে, আর সেইজন্য বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশে হাসি-তামাশার পাত্র হবে। “তুমি শিংগা বাজাও। মাবুদের বান্দাদের বিরুদ্ধে শত্রু ঈগল পাখীর মত আসছে, কারণ লোকেরা আমার দেওয়া ব্যবস্থা অমান্য করেছে এবং আমার শরীয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ইসরাইল আমার কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছে, ‘হে আমার আল্লাহ্‌, আমরা তোমাকে স্বীকার করছি।’ কিন্তু যা ভাল ইসরাইল তা অগ্রাহ্য করেছে, তাই শত্রু তার পিছনে তাড়া করবে। আমার নির্দেশ ছাড়াই তারা বাদশাহ্‌দের নিযুক্ত করেছে; আমার অনুমতি ছাড়াই তারা নেতাদের বেছে নিয়েছে। তাদের সোনা ও রূপা দিয়ে তারা মূর্তি তৈরী করে নিজেদের সর্বনাশ করেছে। হে সামেরিয়া, আমি তোমার বাছুর-মূর্তি অগ্রাহ্য করেছি। সেগুলোর বিরুদ্ধে আমার রাগের আগুন জ্বলছে। ভাল হতে তোমার লোকদের আর কত দিন লাগবে? সেই বাছুর ইসরাইলের লোকেরাই তৈরী করেছে। একজন কারিগর সেটা গড়েছে; ওটা তো আল্লাহ্‌ নয়। সামেরিয়ার ঐ বাছুরটাকে ভেংগে টুকরা টুকরা করা হবে। “তারা তো বাতাস বোনে আর শেষে ঘূর্ণিঝড় কাটে। শস্যের শীষে কোন দানা নেই; তা থেকে ময়দা হবে না। যদি তাতে কিছু হয়ও তবে তা বিদেশীরা গ্রাস করবে। বনি-ইসরাইলদের গ্রাস করা হয়েছে; বাজে জিনিসের মতই তারা এখন বিভিন্ন জাতির মধ্যে রয়েছে। একা একা ঘুরে বেড়ানো বুনো গাধার মতই তারা আশেরিয়া পর্যন্ত গেছে। আফরাহীম টাকা দিয়ে প্রেমিকদের এনেছে। যদিও তারা বিভিন্ন জাতির সংগে টাকা দিয়ে বন্ধুত্ব করেছে তবুও এখন আমি তাদের একসংগে জমায়েত করে শাস্তি দেব। তারা শাসনকর্তাদের বাদশাহ্‌র অত্যাচারের তলায় ক্ষয় হয়ে যাবে। “গুনাহ্‌ দূর করবার জন্য আফরাহীম অনেক কোরবানগাহ্‌ তৈরী করেছে, কিন্তু সেগুলো হয়েছে গুনাহ্‌ করবার কোরবানগাহ্‌। আমার শরীয়তের অনেক কথাই আমি তাদের জন্য লিখেছিলাম, কিন্তু তারা সেগুলো বিদেশী কোন কিছু বলে মনে করেছে। তারা আমার উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিয়ে তার গোশ্‌ত খায় কিন্তু আমি মাবুদ তাদের উপর সন্তুষ্ট নই। এখন আমি তাদের দুষ্টতার কথা স্মরণ করে তাদের গুনাহের শাস্তি দেব; তারা মিসরে ফিরে যাবে। ইসরাইলের লোকেরা নিজেদের সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে বড় বড় বাড়ী তৈরী করেছে; এহুদার লোকেরা অনেক শহর দেয়াল দিয়ে ঘিরেছে। কিন্তু আমি তাদের শহরগুলোর উপরে আগুন পাঠাব যা তাদের সব কেল্লা পুড়িয়ে ফেলবে।” হে ইসরাইল, অন্যান্য জাতিদের মত তুমি আনন্দের উৎসব কোরো না। তুমি তো তোমার আল্লাহ্‌কে ত্যাগ করে তাঁর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছ; প্রত্যেকটি খামারে তুমি বেশ্যার পাওনা পেয়ে খুশী হয়েছ। এর পরে খামার ও আংগুর মাড়াইয়ের জায়গা লোকদের খাবার দেবে না; তারা নতুন আংগুর-রস পাবে না। তারা মাবুদের দেশে থাকবে না; আফরাহীম মিসরে ফিরে যাবে এবং আশেরিয়ার নাপাক খাবার খাবে। তারা মাবুদের উদ্দেশে আংগুর-রস দিয়ে ঢালন-কোরবানী করবে না এবং তাদের পশু-কোরবানীগুলোও তাঁকে সন্তুষ্ট করবে না। ঐ রকম কোরবানী তাদের কাছে শোক প্রকাশকারীদের খাবারের মতই হবে; যারা তা খাবে তারা সবাই নাপাক হবে। সেই খাবার তাদের নিজেদের খিদে মিটাবার জন্যই হবে, তা মাবুদের ঘরে আসবে না। তাদের ঈদের দিনে ও মাবুদের উৎসব-দিনে তারা কি করবে? যখন তারা ধ্বংসের হাত থেকে পালিয়ে যাবে তখন মিসর তাদের জড়ো করবে এবং মেম্ফিস শহরে তাদের দাফন করবে। তাদের জমা করা রূপা আর তাদের বাসস্থান আগাছা ও কাঁটাগাছে ঢেকে ফেলবে। ইসরাইল যেন জেনে রাখে যে, শাস্তির দিন এসে গেছে, হিসাব-নিকাশের দিন উপস্থিত হয়েছে। তাদের গুনাহ্‌ সংখ্যায় অনেক এবং তারা আল্লাহ্‌কে এত ঘৃণা করে যে, তারা নবীকে বোকা আর আল্লাহ্‌র রূহে পাওয়া লোককে পাগল ভাবে। নবী আমার আল্লাহ্‌র সংগে আফরাহীমের পাহারাদার হলেও তার সমস্ত পথেই রয়েছে ফাঁদ আর তার আল্লাহ্‌র ঘরে রয়েছে তার বিরুদ্ধে শত্রুতা। গিবিয়ার সময়ে যেমন ছিল সেইভাবে বনি-ইসরাইলরা অন্যায়ের মধ্যে ডুবে গেছে। আল্লাহ্‌ তাদের দুষ্টতার কথা মনে করবেন এবং তাদের গুনাহের জন্য শাস্তি দেবেন। মাবুদ বলছেন, “মরুভূমিতে আংগুর ফল পাবার মত করেই ইসরাইলকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম; প্রথমবার ফল দেওয়া ডুমুর গাছের আগাম ফলের মতই তোমাদের পূর্বপুরুষদের দেখেছিলাম। কিন্তু তারা বাল-পিয়োরের কাছে গিয়ে সেই লজ্জাপূর্ণ মূর্তির কাছে নিজেদের দিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের প্রিয় মূর্তির মতই তারা জঘন্য হয়ে পড়েছিল। আফরাহীমের গৌরব পাখীর মত উড়ে যাবে; তখন সন্তানের জন্ম হবে না, কেউ গর্ভবতী হবে না এবং কেউ সন্তান গর্ভে ধরবে না। যদি বা কেউ সন্তান লালন-পালন করে তবুও সেই সন্তানদের আমি মেরে ফেলব; তাদের একজনও থাকবে না। ঘৃণ্য তারা, যখন আমি তাদের কাছ থেকে চলে যাব। আফরাহীমকে আমি টায়ারের মত সুন্দর জায়গায় লাগানো দেখেছি। কিন্তু আফরাহীম তার সন্তানদের বের করে নিয়ে যাবে তার কাছে যে তাদের মেরে ফেলবে।” হে মাবুদ, আমি এই লোকদের জন্য কি চাইব? তুমি তাদের কি দেবে? তুমি তাদের সন্তান নষ্ট হয়ে যাবার গর্ভ ও শুকনা বুক দাও। মাবুদ বলছেন, “গিল্‌গলে তারা তাদের সব দুষ্টতা শুরু করেছিল, আর সেখানে আমি তাদের ঘৃণা করতে লাগলাম। তাদের গুনাহের জন্য আমার বান্দাদের মধ্য থেকে আমি তাদের তাড়িয়ে বের করে দেব। আমি তাদের আর মহব্বত করব না; তাদের নেতারা সবাই বিদ্রোহী। আফরাহীম ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তার শিকড় শুকিয়ে গেছে, তাতে ফল ধরে না। যদি বা তার লোকেরা সন্তানের জন্ম দেয় তবুও আমি তাদের প্রিয় সন্তানদের মেরে ফেলব।” আমার আল্লাহ্‌ তাদের অগ্রাহ্য করবেন, কারণ তারা তাঁর বাধ্য হয় নি; তারা বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঘুরে বেড়াবে। ইসরাইল ছিল একটা ছড়িয়ে যাওয়া লতা; তাতে প্রচুর ফল ধরেছিল। তার ফল যত বেড়েছে তত বেশী সংখ্যায় সে বেদী তৈরী করেছে; তার দেশের যত উন্নতি হয়েছে ততই সে তার পূজার পাথরগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। তার লোকদের অন্তর অবিশ্বস্ত; সেইজন্য এখন তাদের দোষের বোঝা বইতে হবে। মাবুদ তাদের বেদীগুলো ভেংগে ফেলবেন এবং তাদের পূজার পাথরগুলো নষ্ট করে দেবেন। তারা তখন নিশ্চয় বলবে, “আমরা মাবুদকে ভয় করি নি বলে আমাদের কোন বাদশাহ্‌ নেই। কিন্তু বাদশাহ্‌ থাকলেও তিনি আমাদের জন্য কি করতে পারতেন?” লোকেরা অনেক বাজে কথা বলে এবং চুক্তি করবার সময় মিথ্যা কসম খায়। কাজেই চাষ করা জমিতে বিষাক্ত আগাছার মত মামলা-মোকদ্দমা গজিয়ে ওঠে। সামেরিয়ায় বাসকারী লোকেরা বৈৎ-আবনের বাছুর-মূর্তির জন্য ভয় পেয়েছে। তার লোকেরা শোক করছে ও তার মূর্তিপূজাকারী পুরোহিতেরা বিলাপ করছে, কারণ সেই মূর্তির জাঁকজমক তাদের কাছ থেকে দূর করা হয়েছে। সেটা আশেরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মহারাজার খাজনা হিসাবে দেওয়া হয়েছে। সেইজন্য আফরাহীম অসম্মানিত হবে, ইসরাইল তার নিজের পরিকল্পনার জন্য লজ্জা পাবে। পানি যেমন ছোট ডালকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তেমনি সামেরিয়া ও তার বাদশাহ্‌কে নিয়ে যাওয়া হবে। বৈৎ-আবনের পূজার উঁচু স্থানগুলো, অর্থাৎ ইসরাইলের গুনাহের জায়গাগুলো ধ্বংস হবে। কাঁটাগাছ গজিয়ে উঠে তাদের বেদীগুলো ঢেকে ফেলবে। তখন তারা বড় বড় পাহাড়কে বলবে, “আমাদের ঢেকে ফেল” আর ছোট ছোট পাহাড়কে বলবে, “আমাদের উপরে পড়।” মাবুদ বলছেন, “হে ইসরাইল, গিবিয়ায় যখন তুমি গুনাহ্‌ করেছিলে তখন থেকেই তুমি গুনাহ্‌ করে আসছ, আর গুনাহের মধ্যেই তুমি রয়ে গেছ। যুদ্ধ কি গিবিয়ায় অন্যায়কারীদের নাগাল পাবে না? আমার যখন খুশী তখন আমি তাদের শাস্তি দেব; তাদের দু’টা গুনাহের দরুন তাদের বাঁধবার জন্য বিভিন্ন জাতি তাদের বিরুদ্ধে একত্র হবে। আফরাহীম একটা শিক্ষা পাওয়া গাভী যে শস্য মাড়াই করতে ভালবাসে, কিন্তু আমি তার সুন্দর গলার উপরে জোয়াল তুলে দেব। আফরাহীম হবে আমার চাষ করবার গরু এবং এহুদা আমার লাংগল টানবে, আর ইয়াকুব মাটি ভাংগার কাজ করবে।” তোমরা নিজেদের জন্য ন্যায়ের বীজ বোন, বিশ্বস্ততার ফসল কাট এবং তোমাদের চাষ-না-করা অন্তর ভাংগ, কারণ মাবুদের দিকে ফিরবার সময় হয়েছে। যখন তোমরা তা করবে তখন তিনি এসে তোমাদের উপরে সততার বৃষ্টি দেবেন। কিন্তু তোমরা তো দুষ্টতা লাগিয়েছ, খারাপীর ফসল কেটেছ আর ছলনার ফল খেয়েছ। তোমরা নিজেদের শক্তি ও অনেক যোদ্ধার উপর ভরসা করেছ; সেইজন্য তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হৈ চৈ উঠবে এবং তোমাদের সব কেল্লাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন করে শল্‌মন যুদ্ধের দিনে বৈৎ-অর্বেল ধ্বংস করেছিল। সেই দিন ছেলেমেয়েদের সংগে মায়েদের মাটিতে আছাড় মারা হয়েছিল। হে বেথেল, তোমার প্রতি তেমনই ঘটবে, কারণ তোমার দুষ্টতা খুব বেশী। ভোর হলে পর ইসরাইলের বাদশাহ্‌কে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হবে। মাবুদ বলছেন, “ইসরাইলের ছেলেবেলায় আমি তাকে মহব্বত করতাম এবং মিসর থেকে আমার ছেলেকে ডেকে এনেছিলাম। কিন্তু আমি ইসরাইলকে যত ডাকলাম ততই সে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। তার লোকেরা বাল দেবতার কাছে পশু-উৎসর্গ করতে থাকল এবং মূর্তিগুলোর কাছে ধূপ জ্বালাতে লাগল। আমিই আফরাহীমকে হাঁটতে শিখিয়েছিলাম, আমিই তাকে কোলে নিতাম; কিন্তু তার লোকেরা বুঝল না যে, আমিই তাদের সুস্থ করেছিলাম। আমি স্নেহের দড়ি ও মহব্বতের বাঁধন দিয়ে তাদের চালাতাম; তাদের কাঁধের উপর থেকে জোয়াল তুলে নিতাম ও নীচু হয়ে তাদের খাওয়াতাম। “বনি-ইসরাইলরা মন ফিরাতে রাজী হয় নি বলে তারা মিসরে ফিরে যাবে না, বরং আশেরিয়া তাদের উপর রাজত্ব করবে। তাদের শহরে শহরে ভীষণ যুদ্ধ হবে; তাতে তাদের দরজাগুলোর আগল ধ্বংস হবে এবং তাদের পরিকল্পনার দরুন তারা শেষ হয়ে যাবে। আমার বান্দারা আমার কাছ থেকে ফিরে যাওয়া স্থির করেছে। সেইজন্য তারা আল্লাহ্‌তা’লাকে, অর্থাৎ আমাকে ডাকলেও আমি তাদের মোটেই সাহায্য করব না। “আফরাহীম, আমি কি করে তোমাকে ত্যাগ করব? ইসরাইল, আমি কেমন করে তোমাকে অন্যের হাতে তুলে দেব? কি করে আমি তোমাকে অদ্‌মার ও সবোয়িমের মত ধ্বংস করব? তোমার জন্য আমার অন্তর ব্যাকুল হচ্ছে; আমার সব মমতা জেগে উঠেছে। আমার ভয়ংকর রাগ আমি প্রকাশ করব না, আফরাহীমকে আর ধ্বংস করব না, কারণ আমি আল্লাহ্‌, মানুষ নই; আমি তোমার মধ্যে থাকা আল্লাহ্‌ পাক। আমি রাগ নিয়ে আসব না। তোমার লোকেরা আমার পিছনে পিছনে যাবে, কারণ আমি সিংহের মত ডাকব। আমি ডাকলে পর আমার সন্তানেরা পশ্চিম দিক থেকে কাঁপতে কাঁপতে আসবে। মিসর থেকে পাখীর মত, আশেরিয়া থেকে ঘুঘুর মত তারা কাঁপতে কাঁপতে আসবে। আমি তাদের বাড়ী-ঘরে তাদের বসিয়ে দেব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” মাবুদ বলছেন, “আফরাহীমের মিথ্যা কথা, ইসরাইলের ছলনা আমার চারদিকে রয়েছে। এহুদা আল্লাহ্‌র, অর্থাৎ সেই বিশ্বস্ত আল্লাহ্‌ পাকের অবাধ্য হয়েছে। আফরাহীম বাতাস খায়; সে সারাদিন পূর্বের বাতাসের পিছনে তাড়া করে এবং মিথ্যা কথা ও জুলুম বাড়িয়ে তোলে। সে আশেরিয়ার সংগে সন্ধি করেছে এবং মিসরকে জলপাইয়ের তেল পাঠিয়েছে।” এহুদার বিরুদ্ধে মাবুদের একটা নালিশ আছে; ইয়াকুবের আচার-ব্যবহার অনুসারে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন এবং তার কাজ অনুসারে ফল দেবেন। পেটে থাকতে ইয়াকুব তার ভাইয়ের গোড়ালী ধরেছিল; বয়সকালে সে আল্লাহ্‌র সংগে যুদ্ধ করেছিল। সে ফেরেশতার সংগে যুদ্ধ করে তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিল; সে দয়া পাবার জন্য কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করেছিল। সে বেথেলে মাবুদকে পেয়েছিল এবং সেখানে মাবুদ আমাদের সংগে কথা বলেছিলেন। তিনিই মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন; মাবুদ নামেই লোকে তাঁকে স্মরণ করে। এখন হে ইয়াকুব-বংশের লোকেরা, তোমাদের আল্লাহ্‌র কাছে তোমরা ফিরে এস; তোমরা বিশ্বস্ততা ও ন্যায়বিচার রক্ষা কর এবং সর্বদা তোমাদের আল্লাহ্‌র অপেক্ষায় থাক। মাবুদ বলছেন, “ব্যবসায়ী আফরাহীম ঠকামির দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে; সে জোরজুলুম করতে ভালবাসে। সে বলে, ‘আমি খুব ধনী হয়েছি, অনেক ধন-সম্পদ জমা করেছি। আমার সব কাজের মধ্যে লোকে আমার কোন দোষ বা গুনাহ্‌ খুঁজে পাবে না।’ কিন্তু হে আফরাহীম, আমিই তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌; আমি মিসর দেশ থেকে তোমাকে বের করে এনেছি। তোমার নির্দিষ্ট ঈদের সময়ের মত করে আমি আবার তোমাকে তাম্বুতে বাস করাব। আমি নবীদের কাছে কথা বলেছি, তাদের অনেক দর্শন দিয়েছি এবং তাদের মধ্য দিয়ে রূপক অর্থে অনেক কথা বলেছি।” গিলিয়দ অন্যায়ে পূর্ণ; তার লোকেরা অপদার্থ। তারা গিল্‌গলে অনেক বলদ উৎসর্গ করে। তাদের বেদীগুলো চাষ করা জমিতে পাথরের ঢিবির মত অনেক। ইয়াকুব সিরিয়া দেশে পালিয়ে গিয়েছিল; স্ত্রী পাবার জন্য ইসরাইল মজুরের কাজ ও ভেড়া চরাবার কাজ করেছিল। মিসর থেকে ইসরাইলকে নিয়ে আসবার জন্য মাবুদ একজন নবীকে ব্যবহার করেছিলেন; তাঁকে দিয়ে তিনি তার দেখাশোনা করেছিলেন। কিন্তু আফরাহীম মাবুদকে ভীষণ রাগিয়ে তুলেছিল; সেইজন্য তার মালিক তার খারাপ কাজের জন্য তাকেই দায়ী করবেন এবং সে যে অপমান করেছে সেই অপমান তাকেই ফিরিয়ে দেবেন। আফরাহীম কথা বললে লোকে কাঁপত; ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সে মহান হয়েছিল। কিন্তু বাল দেবতার পূজা করবার দোষে দোষী হয়ে সে মরেছিল। এখন তার লোকেরা আরও বেশী করে গুনাহ্‌ করছে; তাদের রূপা দিয়ে তারা নিজেদের জন্য ছাঁচে ঢালা প্রতিমা, অর্থাৎ পাকা হাতে গড়া মূর্তি তৈরী করেছে; সেগুলো সবই কারিগরদের কাজ। এই মূর্তিগুলোর সম্বন্ধে তারা বলে, “যারা উৎসর্গ করে তারা বাছুর-মূর্তিগুলোকে চুম্বন করুক।” সেইজন্য তারা হবে সকালের কুয়াশার মত, হবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ভোরের শিশিরের মত, হবে খামার থেকে বাতাসে উড়ে যাওয়া তুষের মত, হবে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ধোঁয়ার মত। মাবুদ বলছেন, “মিসর থেকে তোমাকে বের করে আনবার সময় থেকে আমিই তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌। আমি ছাড়া তোমার আর কোন মাবুদ নেই; আমি ছাড়া তোমার আর কোন উদ্ধারকর্তা নেই। মরুভূমিতে, ভীষণ শুকনা দেশে আমিই তোমাকে দেখাশোনা করেছিলাম। আমি তোমার লোকদের খাওয়ালে পর তারা তৃপ্ত হল; তৃপ্ত হয়ে তারা অহংকারী হল, আর তারপর তারা আমাকে ভুলে গেল। কাজেই আমি সিংহের মত তাদের উপরে আসব, চিতাবাঘের মত পথের ধারে ওৎ পেতে থাকব। বাচ্চা চুরি হয়ে যাওয়া ভল্লুকের মত আমি তাদের আক্রমণ করে তাদের বুক চিরে ফেলব। সিংহীর মত আমি তাদের গ্রাস করব; বুনো জানোয়ারের মত আমি তাদের টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলব। “হে ইসরাইল, তুমি আমার বিপক্ষে, অর্থাৎ তোমার সাহায্যকারীর বিপক্ষে আছ বলে আমি তোমাকে ধ্বংস করব। তোমার বাদশাহ্‌ কোথায় যে তোমার সব শহরে তোমাকে রক্ষা করতে পারবে? তোমার শাসনকর্তারা কোথায় যাদের বিষয় তুমি বলতে, ‘আমাকে বাদশাহ্‌ ও শাসনকর্তাদের দাও’? তাই আমি রাগ করে তোমাকে একজন বাদশাহ্‌ দিয়েছিলাম এবং আমার ক্রোধে তাকে নিয়েও গিয়েছি। আফরাহীমের দোষ, অর্থাৎ তার সমস্ত গুনাহ্‌ লিখে বেঁধে রাখা হয়েছে। স্ত্রীলোকের প্রসব-বেদনার মত ব্যথা তাকে ধরেছে, কিন্তু সে তো বুদ্ধিহীন শিশু; সময় উপস্থিত হলে সে গর্ভের খোলা মুখে আসে না। “কবরের শক্তি থেকে আমি মূল্য দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনব। মৃত্যু থেকে আমি তাকে মুক্ত করব। হে মৃত্যু, তোমার মহামারী সব কোথায়? হে কবর, কোথায় তোমার ধ্বংস? আমি কোন মমতা করব না। যদিও বা আফরাহীম তার ভাইদের মধ্যে সফলতা লাভ করে তবুও মাবুদের কাছ থেকে একটা পূবালী বাতাস মরুভূমি থেকে বয়ে আসবে; তার ঝর্ণাতে পানি থাকবে না ও তার কূয়া শুকিয়ে যাবে। তার ভাণ্ডারের সব দামী জিনিস লুট করা হবে। সামেরিয়ার লোকেরা তাদের আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে বলে দায়ী হবে। তারা যুদ্ধে মারা পড়বে; তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের মাটিতে আছাড় মেরে চুরমার করা হবে এবং তাদের গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের পেট চিরে ফেলা হবে।” হে ইসরাইলের লোকেরা, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে তোমরা ফিরে এস। তোমাদের গুনাহের জন্যই তোমাদের পতন হয়েছিল। তোমরা মাবুদের কাছে ফিরে এসে তাঁকে বল, “আমাদের সব গুনাহ্‌ মাফ কর এবং আমাদের যা ভাল তা কবুল কর যাতে আমরা ষাঁড় কোরবানীর মত করে আমাদের মুখ দিয়ে তোমার প্রশংসা করতে পারি। আশেরিয়া আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না; আমরা যুদ্ধের ঘোড়ার উপর ভরসা করব না। আমাদের নিজের হাতে তৈরী মূর্তিগুলোকে আমরা আর কখনও বলব না, ‘আমাদের দেব-দেবী,’ কারণ তোমার কাছেই এতিমেরা মমতা পায়।” মাবুদ বলছেন, “আমি তাদের বিপথে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে আনব এবং কোন শর্ত ছাড়াই তাদের মহব্বত করব, কারণ আমার রাগ তাদের উপর থেকে সরে গেছে। আমি ইসরাইলের কাছে শিশিরের মত হব; সে লিলি ফুলের মত ফুটবে। লেবাননের এরস গাছের মত সে তার শিকড়গুলো নীচে নামিয়ে দেবে। তার ডালপালা ছড়িয়ে যাবে। সে জলপাই গাছের মত সুন্দর হবে আর তার সুগন্ধ হবে লেবাননের এরস গাছের মত। যারা তার ছায়ায় বাস করবে তারা প্রচুর ফসল জন্মাবে। তারা আংগুর লতার মত ফুলে-ফলে ভরে যাবে আর লেবাননের আংগুর-রসের মত তাদের সুনাম হবে। হে আফরাহীম, মূর্তিগুলোর সংগে তোমার আর কোন সম্পর্ক নেই। আমিই তোমার মুনাজাতের জবাব দেব ও তোমার যত্ন নেব। আমিই সতেজ বেরস গাছের মত; তোমার ফল আমার কাছ থেকেই আসে।” জ্ঞানী কে? সে এই সব বিষয় বুঝুক। বুদ্ধিমান কে? সে এই সব বিষয় জানুক। মাবুদের পথ সততার পথ; সৎ লোক সেই পথে হাঁটে, কিন্তু অন্যায়কারীরা উচোট খায়। পথূয়েলের ছেলে যোয়েলের উপর মাবুদের কালাম নাজেল হয়েছিল। হে বৃদ্ধ লোকেরা, তোমরা এই কথা শোন; হে দেশে বাসকারী লোকেরা, তোমরা সবাই শোন। তোমাদের কিংবা তোমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে কি এই রকম ঘটনা কখনও ঘটেছে? এই ঘটনার কথা তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে বল আর তারা তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে বলুক এবং সেই ছেলেমেয়েরা তাদের বংশধরদের কাছে বলুক। কামড়ানো পংগপালে যা রেখে গেছে তা ঝাঁক বাঁধা পংগপালে খেয়েছে; ঝাঁক বাঁধা পংগপালে যা রেখে গেছে তা ধ্বংসকারী পংগপালে খেয়েছে; ধ্বংসকারী পংগপালে যা রেখে গেছে তা লাফিয়ে চলা পংগপালে খেয়েছে। ওহে মাতালেরা, জেগে ওঠো ও কান্নাকাটি কর। ওহে সমস্ত মদখোর, তোমরা টাটকা আংগুর-রসের মদের জন্য বিলাপ কর, কারণ তা তোমাদের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক জাতি আমার দেশ আক্রমণ করেছে; সে শক্তিশালী ও তার সৈন্যেরা অসংখ্য। তার দাঁত সিংহের দাঁতের মত ও তার ছেদন্তদাঁত সিংহীর ছেদন্তদাঁতের মত। সে আমার সব আংগুর লতা নষ্ট করেছে আর ডুমুর গাছগুলো ভেংগে ফেলেছে। সেগুলোর ছাল ছাড়িয়ে সে তা ফেলে দিয়েছে; তাতে ডালগুলো সব সাদা হয়ে গেছে। হে আমার বান্দারা, যে যুবতী মেয়ে তার যৌবন কালের ভাবী স্বামীর মৃত্যুর জন্য চট পরে বিলাপ করছে তোমরা তার মতই বিলাপ কর। মাবুদের ঘর থেকে শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা মাবুদের এবাদত-কাজ করে সেই ইমামেরা শোক করছে। সমস্ত ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে, মাটি শোক করছে, কারণ শস্য নষ্ট হয়েছে, নতুন আংগুর-রস শুকিয়ে গেছে ও তেল শেষ হয়ে আসছে। ওহে চাষীরা, তোমরা লজ্জিত হও; তোমরা যারা আংগুর গাছের যত্ন কর, তোমরা গম ও যবের জন্য বিলাপ কর; কারণ ক্ষেতের ফসল ধ্বংস হয়েছে। আংগুর লতা শুকিয়ে গেছে ও ডুমুর গাছ মরে যাচ্ছে; ডালিম, খেজুর ও আপেল গাছ, এমন কি, ক্ষেতের সব গাছ শুকিয়ে গেছে। সত্যিই লোকদের মধ্য থেকে আনন্দ ফুরিয়ে গেছে। হে ইমামেরা, তোমরা চট পরে শোক প্রকাশ কর; কোরবানগাহে যারা এবাদত-কাজ কর তোমরা বিলাপ কর। যারা আমার আল্লাহ্‌র এবাদত কর তোমরা এসে চট পরে রাত কাটাও, কারণ তোমাদের আল্লাহ্‌র ঘরে শস্য-কোরবানী ও ঢালন-কোরবানী বন্ধ করা হয়েছে। তোমরা পবিত্র রোজার ব্যবস্থা কর; একটা বিশেষ মাহ্‌ফিল ডাক। বৃদ্ধ নেতাদের ও দেশে বাসকারী সবাইকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ঘরে ডেকে আন এবং মাবুদের কাছে কান্নাকাটি কর। হায়, কি ভয়ংকর দিন! কারণ মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে; ধ্বংসকারী দিন হিসাবে সেই দিনটা সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে আসছে। আমাদের চোখের সামনেই খাবার ও আমাদের আল্লাহ্‌র ঘর থেকে আনন্দ-উল্লাস কি বন্ধ হয়ে যায় নি? মাটির ঢেলার নীচে বীজগুলো পচে গেছে। শস্যের ভাণ্ডার ধ্বংস হয়েছে, গোলাঘর সব ভেংগে ফেলা হয়েছে, কারণ শস্য ফুরিয়ে গেছে। কিভাবে গরু-ভেড়াগুলো কোঁকাচ্ছে! গরুর পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারণ তাদের চরে খাবার জায়গা নেই; ভেড়ার পালগুলো পর্যন্ত কষ্ট পাচ্ছে। হে মাবুদ, আমি তোমাকেই ডাকছি, কারণ চরে খাবার জায়গাগুলো আগুনে গ্রাস করেছে আর আগুনের শিখা পুড়িয়ে ফেলেছে মাঠের সব গাছপালা। এমন কি, বুনো পশুরাও তোমার কাছে কাঁদছে, কারণ পানির স্রোত শুকিয়ে গেছে আর চরে খাবার জায়গাগুলো আগুনে গ্রাস করেছে। তোমরা সিয়োনে শিংগা বাজাও, বাজাও বিপদ-সংকেত আমার পবিত্র পাহাড়ে। দেশে বাসকারী সবাই কাঁপুক, কারণ মাবুদের দিন আসছে; সেই দিন কাছে এসে গেছে। তা অন্ধকার ও গাঢ় অন্ধকারের দিন, মেঘের ও ঘোর অন্ধকারের দিন। পাহাড়-পর্বতের উপরে যেমন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ে তেমনি করে একটা বিরাট ও শক্তিশালী পংগপালের সৈন্যদল আসছে। এই রকম সৈন্যদল আগেকার কালে কখনও ছিল না, আর যে সব যুগ আসছে তখনও থাকবে না। তাদের আগে আগে গ্রাস করছে আগুন এবং তাদের পিছনে জ্বলছে আগুনের শিখা। তাদের সামনে দেশটা যেন আদন বাগান, আর তাদের পিছনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মরুভূমি; কিছুই তা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। তাদের আকার ঘোড়ার মত; ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের মত তারা ছুটে চলে। রথের শব্দের মত, নাড়া পোড়ানো আগুনের শব্দের মত তারা পাহাড়ের উপর দিয়ে লাফিয়ে আসে। তারা যুদ্ধের জন্য সারি বাঁধা একদল শক্তিশালী সৈন্যের মত। তাদের দেখে জাতিদের মনে দারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে; সকলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সেই সৈন্যেরা বীর যোদ্ধাদের মত দৌড়ায়, সৈন্যদের মত দেয়ালে ওঠে। তারা সবাই সারি বেঁধে এগিয়ে যায়, তাদের পথ থেকে তারা সরে যায় না। তারা একে অন্যের উপর চাপাচাপি করে না; প্রত্যেকে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। যে কোন বাধাই আসুক না কেন তারা সারি না ভেংগে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা শহরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দেয়ালের উপরে দৌড়ায়; তারা বাড়ী-ঘরে ওঠে, তারা চোরের মত জানালা দিয়ে ঢোকে। তাদের সামনে দুনিয়া কাঁপে, আসমান কাঁপতে থাকে, চাঁদ ও সূর্য অন্ধকার হয়ে যায় এবং তারাগুলো আলো দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মাবুদ তাঁর সৈন্যদলের আগে আগে থেকে জোরে তাঁর গলার আওয়াজ শোনান; তাঁর সৈন্যদলের সংখ্যা গোণা যায় না এবং যারা তাঁর হুকুম পালন করে তারা শক্তিশালী। মাবুদের দিন মহৎ ও ভয়ংকর; কে তা সহ্য করতে পারে? মাবুদ ঘোষণা করছেন, “কিন্তু এখন তোমরা রোজা, কান্নাকাটি ও দুঃখ প্রকাশ করে সমস্ত দিলের সংগে আমার কাছে ফিরে এস।” তোমাদের পোশাক না ছিঁড়ে অন্তর ছিঁড়ে ফেল। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে এস, কারণ তিনি দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ; তিনি সহজে রেগে উঠেন না, তাঁর অটল মহব্বতের সীমা নেই এবং তিনি মন পরিবর্তন করে আর শাস্তি দেন না। কে জানে, হয়তো তিনি আবার মন পরিবর্তন করবেন এবং দোয়া রেখে যাবেন, যাতে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র উদ্দেশে শস্য ও ঢালন-কোরবানী করতে পার। তোমরা সিয়োনে শিংগা বাজাও, পবিত্র রোজার ব্যবস্থা কর, একটা বিশেষ মাহ্‌ফিল ডাক; লোকদের জমায়েত করে তাদের পাক-পবিত্র কর; বৃদ্ধ নেতাদের এক জায়গায় ডাক, যারা বুকের দুধ খায় তাদের এবং ছেলেমেয়েদের জমায়েত কর। বর ও কনে তাদের বাসর ঘর ছেড়ে আসুক। যারা মাবুদের সামনে এবাদত-কাজ করে সেই ইমামেরা বায়তুল-মোকাদ্দসের বারান্দা ও কোরবানগাহের মাঝখানে কাঁদুক। তারা বলুক, “হে মাবুদ, তোমার বান্দাদের উপর তুমি দয়া কর। তোমার সম্পত্তিকে টিট্‌কারির পাত্র কোরো না, জাতিদের মধ্যে তাদের নামকে টিট্‌কারির কথা হতে দিয়ো না। অন্যান্য জাতির লোকেরা কেন বলবে, ‘তাদের আল্লাহ্‌ কোথায়?’ ” তখন মাবুদ তাঁর দেশের জন্য আগ্রহী হবেন এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি মমতা করবেন। মাবুদ তাদের কথার জবাব দিয়ে বলবেন, “আমি তোমাদের কাছে শস্য, নতুন আংগুর-রস ও তেল পাঠাচ্ছি, তাতে তোমরা পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হবে; অন্যান্য জাতির কাছে আর কখনও আমি তোমাদের টিট্‌কারির পাত্র করব না। “আমি উত্তর দিক থেকে আসা সৈন্যদলকে তোমাদের কাছ থেকে দূর করে দেব; শুকনা ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া মরুভূমিতে তাদের তাড়িয়ে দেব। তাদের সামনের অংশ পূর্ব সমুদ্রে আর পিছনের অংশ পশ্চিম সমুদ্রে তাড়িয়ে দেব। তাদের দুর্গন্ধ উপরে উঠবে এবং তা থেকে পচা গন্ধ বের হবে, কারণ তাদের কাজ ছিল গর্বে ভরা।” হে দেশ, ভয় কোরো না; তুমি খুশী হও, আনন্দ কর, কারণ মাবুদ মহৎ মহৎ কাজ করেছেন। ওহে মাঠের পশুরা, তোমরা ভয় কোরো না, কারণ চরে বেড়াবার মাঠ সবুজ হয়ে উঠেছে। গাছে গাছে ফল ধরেছে; ডুমুর গাছ ও আংগুর লতা প্রচুর ফল দিচ্ছে। হে সিয়োনের লোকেরা, খুশী হও, তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে নিয়ে আনন্দ কর, কারণ তাঁর সততার দরুন তিনি তোমাদের শরৎ কালের বৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি তোমাদের প্রচুর বৃষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আগের মতই শরৎ ও বসন্তকালের বৃষ্টি দিচ্ছেন। খামারগুলো শস্যে ভরে যাবে; পাত্র থেকে আংগুর-রস আর তেল উপ্‌চে পড়বে। মাবুদ বলছেন, “আমার বিরাট সৈন্যদল যা আমি তোমাদের মধ্যে পাঠিয়েছিলাম তারা, অর্থাৎ ঝাঁক-বাঁধা পংগপাল, ধ্বংসকারী পংগপাল, লাফিয়ে-চলা পংগপাল ও কামড়ানো পংগপাল যত বছর ধরে তোমাদের ফসল খেয়েছে তা আমি শোধ করে দেব। তোমরা পেট ভরে খেয়ে তৃপ্ত হবে এবং তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করবে যিনি তোমাদের জন্য অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছেন; আমার বান্দারা আর কখনও লজ্জিত হবে না। তখন তোমরা জানতে পারবে যে, আমি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে আছি এবং আমিই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌, অন্য কেউ নয়; আমার বান্দারা আর কখনও লজ্জিত হবে না। “তার পরে আমি সমস্ত লোকের উপরে আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব। তাতে তোমাদের ছেলেরা ও মেয়েরা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলবে, তোমাদের বুড়ো লোকেরা স্বপ্ন দেখবে ও তোমাদের যুবকেরা দর্শন পাবে। এমন কি, সেই সময়ে আমার গোলাম ও বাঁদীদের উপরে আমি আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব। আমি আসমানে ও জমীনে আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা দেখাব, অর্থাৎ রক্ত, আগুন ও প্রচুর ধোঁয়া দেখাব। মাবুদের সেই মহৎ ও ভয়ংকর দিন আসবার আগে সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে ও চাঁদ রক্তের মত হবে। রক্ষা পাবার জন্য যে কেউ মাবুদকে ডাকবে সে রক্ষা পাবে, কারণ মাবুদের কথামত সিয়োন পাহাড়ে ও জেরুজালেমে কতগুলো লোক রক্ষা পাবে। আল্লাহ্‌ যাদের বেছে নিয়েছেন তারা সেই রক্ষা পাওয়া লোকদের মধ্যে থাকবে। “শোন, সেই দিনে ও সেই সময়ে যখন আমি এহুদা ও জেরুজালেমের অবস্থা ফিরাব, তখন আমি সব জাতিদের জমায়েত করব এবং যিহোশাফটের উপত্যকায় তাদের নামিয়ে আনব। সেখানে আমার সম্পত্তি, অর্থাৎ আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের বিষয় নিয়ে আমি তাদের বিরুদ্ধে বিচার করব, কারণ তারা জাতিদের মধ্যে আমার বান্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং আমার দেশ ভাগ করেছিল। তারা আমার বান্দাদের ভাগ করে নেবার জন্য গুলিবাঁট করেছিল এবং বেশ্যা পাবার জন্য তারা ইসরাইলীয় ছেলেদের বিক্রি করেছিল; আংগুর-রসের জন্য তারা ইসরাইলীয় মেয়েদের বিক্রি করেছিল যাতে তারা আংগুর-রস খেতে পারে। “এখন হে টায়ার, সিডন ও ফিলিস্তীনের সমস্ত এলাকা, আমার সংগে তোমাদের সম্বন্ধ কি? তোমরা কি আমার উপর প্রতিশোধ নি"ছ? যদি তোমরা আমার উপর প্রতিশোধ নাও তবে তোমরা যা করবে তা-ই আমি সংগে সংগে খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের নিজেদের মাথার উপর ফিরিয়ে দেব। এর কারণ হল, তোমরা আমার সোনা ও রূপা নিয়ে নিয়েছ এবং আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র তোমাদের মন্দিরগুলোতে নিয়ে গেছ। তোমরা এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের তাদের দেশ থেকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য গ্রীকদের কাছে বিক্রি করেছ। “শোন, যে সব জায়গায় তোমরা তাদের বিক্রি করেছ সেখান থেকে আমি তাদের ডেকে আনব এবং তোমরা যা করেছ তা-ই তোমাদের নিজেদের মাথার উপর ফিরিয়ে দেব। তোমাদের ছেলেমেয়েদের আমি এহুদার লোকদের কাছে বিক্রি করে দেব এবং তারা দূরের সাবায়ীয় জাতির কাছে তাদের বিক্রি করবে।” এই কথা মাবুদ বলেছেন। তোমরা জাতিদের মধ্যে এই কথা ঘোষণা কর: “তোমরা পবিত্র যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত কর, বলবান লোকদের ডেকে আন। সব যোদ্ধারা কাছে গিয়ে আক্রমণ করুক। তোমাদের লাংগলের ফলা পিটিয়ে তলোয়ার আর কাসে- দিয়ে বড়শা তৈরী কর। দুর্বল লোক বলুক, ‘আমি বলবান।’ হে চারদিকের সমস্ত জাতি, তোমরা তাড়াতাড়ি এসে জড়ো হও।” হে মাবুদ, তোমার বলবান লোকদের তুমি পাঠিয়ে দাও। মাবুদ বলছেন, “জাতিদের ডেকে আনা হোক; তারা যিহোশাফটের উপত্যকায় এগিয়ে যাক, কারণ সেখানে আমি চারদিকের সব জাতিদের বিচার করতে বসব। তাদের দুষ্টতা অনেক, সেইজন্য তোমরা কাসে- লাগাও, কারণ ফসল পেকেছে। তোমরা এসে আংগুর মাড়াও, কারণ আংগুর মাড়াইয়ের গর্ত পূর্ণ হয়েছে। আংগুর-রসের পাত্র থেকে রস উপ্‌চে পড়ছে।” শাস্তির উপত্যকায় অনেক লোকের ভিড়, অনেক লোকের ভিড়, কারণ শাস্তির উপত্যকায় মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে। সূর্য ও চাঁদ অন্ধকার হবে এবং তারাগুলো আলো দেওয়া বন্ধ করে দেবে। মাবুদ সিয়োন থেকে গর্জন করবেন, জেরুজালেম থেকে জোরে কথা বলবেন; আসমান ও জমীন কাঁপতে থাকবে। কিন্তু মাবুদই হবেন তাঁর বান্দাদের জন্য আশ্রয়স্থান, ইসরাইলের লোকদের জন্য একটা কেল্লা। মাবুদ বলছেন, “তখন তোমরা জানবে যে, আমিই তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌; আমি সিয়োনে, আমার পবিত্র পাহাড়ে বাস করি। জেরুজালেম পবিত্র হবে; বিদেশীরা আর কখনও সেখানে যাবে না। “সেই দিন বড় বড় পাহাড়গুলো থেকে প্রচুর নতুন আংগুর-রস পাওয়া যাবে আর ছোট ছোট পাহাড়গুলো থেকে প্রচুর দুধ পাওয়া যাবে। এহুদার সব পানির খাদগুলো দিয়ে পানি বয়ে যাবে। মাবুদের ঘর থেকে একটা ঝর্ণা উঠে শিটীমের উপত্যকাকে পানি দান করবে। কিন্তু মিসর ধ্বংসস্থান হবে আর ইদোম ধ্বংস হয়ে যাওয়া মরুভূমি হবে, কারণ এহুদার লোকদের উপর জুলুম করা হয়েছে আর তাদের দেশে নির্দোষের রক্তপাতও করা হয়েছে। তকোয়ের রাখালদের মধ্যে আমোস ছিলেন একজন। তখন এহুদার বাদশাহ্‌ ছিলেন উষিয় এবং ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ছিলেন যিহোয়াশের ছেলে ইয়ারাবিম। ভূমিকমেপর দুই বছর আগে ইসরাইল সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ আমোসকে যা দেখিয়েছিলেন তা তিনি বলেছিলেন। আমোস বললেন, “মাবুদ সিয়োন থেকে গর্জন করছেন এবং জেরুজালেম থেকে জোরে কথা বলছেন। তাতে রাখালদের চারণ ভূমি সব শুকিয়ে যাচ্ছে ও কর্মিল পাহাড়ের চূড়ার গাছপালা মরে যাচ্ছে।” মাবুদ বলছেন, “দামেস্কের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ লোহার কাঁটাযুক্ত মাড়াই-যন্ত্র দিয়ে সে গিলিয়দকে মাড়াই করেছে। সেইজন্য আমি হসায়েলের রাজবাড়ীর উপরে আগুন পাঠাব; তা বিন্‌হদদের কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। আমি দামেস্কের দরজার আগল ভেংগে ফেলব; আমি আবনের উপত্যকার লোকদের এবং বৈৎ-আদনে যে লোক রাজদণ্ড ধরে আছে তাকে ধ্বংস করব। সিরিয়ার লোকেরা বন্দী হয়ে কীরে যাবে।” মাবুদ বলছেন, “গাজার তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ সে কতগুলো গ্রামের সমস্ত লোককে বন্দী করে ইদোমের হাতে তুলে দিয়েছে। সেইজন্য আমি গাজার দেয়ালের উপরে আগুন পাঠাব; তা তার কেল্লাগুলোকে পুড়িয়ে ফেলবে। আমি অস্‌দোদের লোকদের এবং অস্কিলোনে যে লোক রাজদণ্ড ধরে আছে তাকে ধ্বংস করব। আমি ইক্রোণের বিরুদ্ধে আমার হাত উঠাব, তাতে ফিলিস্তিনীদের বেঁচে থাকা লোকেরা মারা পড়বে।” মাবুদ বলছেন, “টায়ারের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ ভাইয়ের সংগে ভাইয়ের চুক্তি অগ্রাহ্য করে সে কতগুলো গ্রামের সমস্ত লোককে বন্দী করে ইদোমের হাতে তুলে দিয়েছে। সেইজন্য আমি টায়ারের দেয়ালের উপরে আগুন পাঠিয়ে দেব; তা তার কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।” মাবুদ বলছেন, “ইদোমের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ সমস্ত মায়া-মমতা ত্যাগ করে সে তলোয়ার নিয়ে তার ভাইকে তাড়া করেছে। এছাড়া তার ভয়ংকর রাগ অনবরতই দেখা দিয়েছে আর সে তা পুষে রেখেছে। কাজেই আমি তৈমনের উপরে আগুন পাঠাব; তা বস্রার কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।” মাবুদ বলছেন, “অম্মোনের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ তার সীমানা বাড়াবার জন্য সে গিলিয়দের গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের পেট চিরে দিয়েছে। সেইজন্য যুদ্ধের দিনে যুদ্ধের হাঁকের মধ্যে, ভয়ংকর ঝড়ের মত যুদ্ধের মধ্যে আমি রব্বার দেয়ালে আগুন ধরিয়ে দেব; তা তার কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। তার বাদশাহ্‌ ও তার শাসনকর্তাদের একসংগে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে।” মাবুদ বলছেন, “মোয়াবের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ সে ইদোমের বাদশাহ্‌র হাড়গুলো পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কাজেই আমি মোয়াবের উপরে আগুন পাঠিয়ে দেব; তা করিয়োতের কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। যুদ্ধের হাঁক ও শিংগার আওয়াজের সংগে ভীষণ গোলমালের মধ্যে মোয়াবের পতন হবে। তার বাদশাহ্‌কে আমি ধ্বংস করব এবং তার সংগে তার সব শাসনকর্তাদের মেরে ফেলব।” মাবুদ বলছেন, “এহুদার তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব, কারণ তার লোকেরা মাবুদের শরীয়ত অগ্রাহ্য করেছে, আর তাঁর নিয়মগুলো পালন করে নি। তাদের পূর্বপুরুষেরা যে মিথ্যা দেব-দেবীর পিছনে গিয়েছিল তারাও সেইভাবে বিপথে গিয়েছে। কাজেই এহুদার উপরে আমি আগুন পাঠিয়ে দেব; তা জেরুজালেমের কেল্লাগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।” মাবুদ বলছেন, “ইসরাইলের তিনটা গুনাহ্‌, এমন কি, চারটা গুনাহের দরুন আমি নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেব। তার লোকেরা টাকা-পয়সার জন্য সৎ লোকদের এবং পায়ের এক জোড়া জুতার জন্য অভাবীদের বিক্রি করে। ধুলা মাড়াবার মত করে তারা গরীবদের মাড়ায় এবং পথ থেকে অভাবীদের ঠেলে সরিয়ে দেয়। পিতা ও ছেলে একই মেয়ের সংগে জেনা করে এবং এইভাবে আমার পবিত্র নামের অসম্মান করে। তারা প্রত্যেকটি বেদীর কাছে বন্ধক নেওয়া পোশাকের উপরে ঘুমায়। তাদের উপাসনা-ঘরে তারা জরিমানার টাকা দিয়ে কেনা আংগুর-রস খায়। “হে ইসরাইলের লোকেরা, আমোরীয়রা যদিও এরস গাছের মত লম্বা ও এলোন গাছের মত শক্তিশালী ছিল তবুও তোমাদের সামনে সেই আমোরীয়দের আমিই ধ্বংস করেছিলাম। আমি তাদের ফল ও তার শিকড় ধ্বংস করেছিলাম। আমোরীয়দের দেশ তোমাদের দেবার জন্য আমিই মিসর থেকে তোমাদের বের করে এনে মরুভূমিতে চল্লিশ বছর পরিচালনা করেছিলাম। হে ইসরাইলের লোকেরা, এই কথা কি সত্যি নয় যে, আমি তোমাদের ছেলেদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে নবী ও কয়েকজনকে নাসরীয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম? কিন্তু তোমরা সেই নাসরীয়দের আংগুর-রস খাইয়েছিলে এবং নবী হিসাবে কথা না বলবার জন্য নবীদের হুকুম দিয়েছিলে। “শস্য বোঝাই গাড়ির নীচে কিছু পড়লে যেমন চুরমার হয়ে যায় তেমনি করে এখন আমি তোমাদের চুরমার করব। যারা তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না, বলবানেরা তাদের শক্তি দেখাতে পারবে না এবং যোদ্ধারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারবে না। ধনুকধারীরা স্থিরভাবে দাঁড়াতে পারবে না, তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাওয়া লোকেরা পালাতে পারবে না; এমন কি, ঘোড়সওয়ারও নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারবে না। যোদ্ধাদের মধ্যে যে সবচেয়ে সাহসী সেও সেই দিন উলংগ হয়ে পালিয়ে যাবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” হে ইসরাইলের লোকেরা, তোমাদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ মাবুদ যাদের মিসর থেকে বের করে এনেছেন সেই গোটা জাতির বিরুদ্ধে তিনি যা বলছেন তা শোন: “দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্য থেকে আমি কেবল তোমাদেরই বেছে নিয়েছি; কাজেই তোমাদের সব গুনাহের জন্য আমি তোমাদের শাস্তি দেব।” আগে থেকে ঠিক না করলে কি দু’জন একসংগে কোথাও যায়? শিকার করা পশু না থাকলে কি সিংহ ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে গর্জন করে? কিছু ধরতে না পারলে কি যুব সিংহ তার গর্তের মধ্যে গোঁ গোঁ করে? ফাঁদের মধ্যে টোপ না থাকলে কি পাখী ফাঁদের কাছে আসে? ধরবার কিছু না পেলে কি ফাঁদ লাফিয়ে ওঠে? শহরে শিংগার আওয়াজ শুনলে কি লোকেরা কাঁপে না? মাবুদ না ঘটালে কি শহরে বিপদ ঘটে? আসলে আল্লাহ্‌ মালিক তাঁর গোলাম নবীদের কাছে তাঁর পরিকল্পনা প্রকাশ না করে কিছুই করেন না। সিংহ গর্জন করলে কে না ভয় করবে? আল্লাহ্‌ মালিক বলতে বললে কে নবী হিসাবে কথা না বলে পারবে? তোমরা অস্‌দোদ ও মিসরের সব কেল্লার লোকদের কাছে বল, “তোমরা সামেরিয়ার পাহাড়গুলোর উপরে জড়ো হও; দেখ, তার মধ্যে কত গোলমাল! তার লোকদের মধ্যে কত জুলুম!” মাবুদ বলছেন, “রাখাল সিংহের মুখ থেকে যেমন কেবল পায়ের দু’টা হাড় কিংবা কানের একটা টুকরা উদ্ধার করতে পারে তেমনি ইসরাইলের যে লোকেরা সামেরিয়ায় বাস করে তারা কেবল তাদের খাটের পায়া এবং চাদরের টুকরা নিয়ে উদ্ধার পাবে।” দীন-দুনিয়ার মালিক মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তোমরা শোন এবং ইয়াকুবের বংশকে সাবধান কর। আমি গুনাহের জন্য ইসরাইলকে যেদিন শাস্তি দেব সেই দিন বেথেলের বেদীগুলো ভেংগে ফেলব; তখন বেদীর শিংগুলো ভেংগে মাটিতে পড়বে। আমি শীতকাল কাটাবার ঘর ও গরমকাল কাটাবার ঘর ভেংগে ফেলব; হাতীর দাঁতের কাজ করা ঘরগুলো নষ্ট করা হবে এবং বড় বড় বাড়ীগুলো ধ্বংস করা হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” হে সামেরিয়ার পাহাড়ের উপরকার বাশনের গাভীগুলোর মত স্ত্রীলোকেরা, তোমরা শোন। তোমরা গরীবদের জুলুম কর এবং অভাবীদের চুরমার কর আর তোমাদের স্বামীদের বল, “আমাদের জন্য মদানো রস এনে দাও।” আল্লাহ্‌ মালিক নিজের পবিত্রতায় কসম খেয়ে বলেছেন, “সেই সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন কড়া লাগিয়ে তোমাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে; তোমাদের সবাইকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে বড়শী দিয়ে। তোমরা প্রত্যেকে দেয়ালের ভাংগা জায়গা দিয়ে সোজা বের হয়ে যাবে এবং হার্মোনের দিকে তোমাদের ফেলে দেওয়া হবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “তোমরা যখন বেথেলে গিয়ে গুনাহ্‌ করতে চাইছ তখন যাও, গুনাহ্‌ কর; গিল্‌গলে গিয়ে আরও বেশী করে কর। প্রতিদিন সকালে তোমাদের উৎসর্গের জিনিস এবং প্রতি তিন দিনের দিন তোমাদের দশ ভাগের এক ভাগ জিনিস নিয়ে যাও। তোমরা ধন্যবাদের উৎসর্গ হিসাবে খামি দেওয়া রুটি দাও ও তোমাদের নিজের ইচ্ছায় দেওয়া উৎসর্গের জিনিস নিয়ে বড়াই কর, কারণ হে বনি-ইসরাইলরা, তোমরা তো তা করতে ভালবাস। আমি আল্লাহ্‌ মালিক এই কথা বলছি। “আমি আরও বলছি, প্রত্যেকটি শহরে আমি তোমাদের খালি পেটে রাখলাম এবং প্রত্যেকটি গ্রামে দিলাম রুটির অভাব; তবুও তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে না। ফসল কাটবার তিন মাস বাকী থাকতে আমি তোমাদের উপর বৃষ্টি পড়া বন্ধ করে দিলাম। এক গ্রামে বৃষ্টি পাঠিয়ে আমি অন্য গ্রামে তা বন্ধ করলাম। একটা ক্ষেত বৃষ্টি পেল, অন্যটা বৃষ্টি না পেয়ে শুকিয়ে গেল। পানির জন্য লোকেরা টলতে টলতে গ্রাম থেকে গ্রামে গেল কিন্তু যথেষ্ট পানি খেতে পেল না; তবুও তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে না। আমি অনেকবার তোমাদের বাগান ও আংগুর ক্ষেত শুকিয়ে যাওয়া রোগ ও ছাৎলা-পড়া রোগ দিয়ে আঘাত করলাম। পংগপালে তোমাদের ডুমুর ও জলপাই গাছ শেষ করে দিল; তবুও তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে না। মিসরে যেমন পাঠিয়েছিলাম তেমনি করে আমি তোমাদের মধ্যে মহামারী পাঠালাম। আমি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তোমাদের যুবকদের মেরে ফেললাম এবং তোমাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে গেলাম। তোমাদের সেনা-ছাউনির দুর্গন্ধ তোমাদের নাকে ভরে দিলাম; তবুও তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে না। আমি তোমাদের আল্লাহ্‌ যেমন করে সাদুম ও আমুরা ধ্বংস করেছিলাম তেমনি করে তোমাদের অনেককে ধ্বংস করলাম। তোমরা হয়েছিলে আগুন থেকে তুলে নেওয়া জ্বলন্ত কাঠের মত, তবুও তোমরা আমার কাছে ফিরে আসলে না। কাজেই হে ইসরাইল, আমি অবশ্যই তোমার সংগে এই রকম ব্যবহার করব। সেইজন্য হে ইসরাইল, তোমার আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়াবার জন্য তুমি প্রস্তুত হও।” মনে রেখ, যিনি পাহাড়-পর্বত গড়েন, বাতাস সৃষ্টি করেন এবং মানুষের কাছে নিজের চিন্তা প্রকাশ করেন, যিনি আলোকে অন্ধকার করেন এবং দুনিয়ার পাহাড়-পর্বতের উপর দিয়ে চলেন তাঁর নাম মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন। হে ইসরাইলের লোকেরা, তোমাদের বিষয় নিয়ে আমি এই যে বিলাপ করছি তা শোন। “ইসরাইল পড়ে গেছে, সে আর কখনও উঠবে না; তাকে তার নিজের মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে, তাকে তুলবার কেউ নেই।” আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “ইসরাইলের যে শহর থেকে এক হাজার বলবান লোক বের হয়ে যায় তার মাত্র একশো জন বেঁচে থাকবে, আবার যে শহর থেকে একশো জন বলবান লোক বের হয়ে যায় তার মাত্র দশজন বেঁচে থাকবে।” ইসরাইলের লোকদের মাবুদ বলছেন, “তোমরা আমার কাছে এস, তাতে বাঁচবে। তোমরা বেথেলে কিংবা গিল্‌গলে কিংবা বের্‌-শেবায় যেয়ো না, কারণ গিল্‌গলের লোকেরা নিশ্চয়ই বন্দী হয়ে অন্য দেশে যাবে এবং বেথেলের সর্বনাশ হবে।” তোমরা মাবুদের কাছে যাও তাতে বাঁচবে; তা না হলে তিনি আগুনের মত করে ইউসুফের, অর্থাৎ ইসরাইলের লোকদের মধ্যে জ্বলে উঠবেন। সেই আগুন গ্রাস করবে এবং বেথেলের কেউ তা নিভাতে পারবে না। তোমরা তো ন্যায়বিচারকে তেতো করে তুলছ এবং সততাকে মাটিতে ফেলছ। যিনি কৃত্তিকা ও মৃগশীর্ষ নামে তারাগুলো তৈরী করেছেন, যিনি অন্ধকারকে আলো করেন এবং দিনকে রাতের আঁধার করেন, যিনি সাগরের পানিকে ডাক দিয়ে ভূমির উপর ঢেলে দেন, তাঁর নাম মাবুদ। তিনি শক্তিশালীদের উপর এবং তাদের কেল্লার উপর হঠাৎ সর্বনাশ এনে ধ্বংস করে দেন। যে লোক শহরের সদর দরজায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তোমরা তো তাকে ঘৃণা কর এবং যে সত্যি কথা বলে তাকে তুচ্ছ কর। তোমরা গরীবকে জুলুম কর এবং জোর করে তার কাছ থেকে শস্য আদায় কর। কাজেই তোমরা যদিও পাথরের বড় বড় ঘর তৈরী করে থাক তবুও তোমরা তাতে বাস করতে পারবে না। যদিও তোমরা সুন্দর আংগুর ক্ষেত করে থাক তবুও তোমরা তার আংগুর-রস খেতে পারবে না। আমি জানি তোমাদের অন্যায় কত বেশী এবং তোমাদের গুনাহ্‌ কি ভীষণ! তোমরা তো সৎ লোকদের উপর জুলুম কর ও ঘুষ খাও; শহরের সদর দরজায় তোমরা গরীবদের ন্যায়বিচার পেতে দাও না। সেইজন্য এই রকম সময়ে বুদ্ধিমান লোক চুপ করে থাকে, কারণ সময়টা খারাপ। তোমরা যাতে বাঁচতে পার সেইজন্য ভালোর পিছনে যাও, খারাপীর পিছনে নয়; তাহলে যেমন তোমরা বলে থাক তেমনি মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন সত্যিসত্যিই তোমাদের সংগে থাকবেন। খারাপীকে ঘৃণা কর, ভালোকে ভালবাস; শহরের সদর দরজায় ন্যায়বিচার রক্ষা কর। হয়তো ইসরাইলের বেঁচে থাকা লোকদের উপর মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন রহমত করবেন। দীন-দুনিয়ার মালিক মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “শহরের প্রত্যেকটি খোলা জায়গায় লোকে বিলাপ করবে এবং প্রত্যেকটি রাস্তায় হায় হায় করবে। এমন কি, শোক প্রকাশকারীদের সংগে বিলাপ করবার জন্য চাষীদেরও ডাকা হবে। সমস্ত আংগুর ক্ষেতগুলোতে বিলাপ হবে, কারণ আমি তোমাদের মধ্য দিয়ে যাব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” ঘৃণ্য তোমরা! তোমরা তো আকুল হয়ে মাবুদের দিন দেখতে চাইছ! কেন তোমরা সেই দিনের আকাংক্ষা করছ? তোমাদের কাছে সেই দিন আলো নয় কিন্তু অন্ধকার হবে। সেটা হবে যেন কোন মানুষ সিংহের হাত থেকে পালিয়ে ভল্লুকের সামনে পড়ল, যেন নিজের বাড়ীতে ঢুকে দেয়ালে হাত রেখে সাপের কামড় খেল। মাবুদের দিন আলো না হয়ে কি অন্ধকার হবে না? উজ্জ্বলতার কণামাত্র না থেকে তা কি গাঢ় অন্ধকার হবে না? মাবুদ বলছেন, “আমি তোমাদের ঈদগুলো ঘৃণা করি, অগ্রাহ্য করি; তোমাদের মাহ্‌ফিলগুলো আমি সহ্য করতে পারি না। তোমরা আমার উদ্দেশে পোড়ানো-কোরবানী ও শস্য-কোরবানী দিলেও আমি সেগুলো কবুল করব না। যদিও তোমরা মোটাসোটা পশু দিয়ে যোগাযোগ-কোরবানী দাও তবুও সেই দিকে আমি চেয়েও দেখব না। তোমাদের কাওয়ালীর আওয়াজ দূর কর। তোমাদের বীণার বাজনা আমি শুনব না। তার চেয়ে বরং ন্যায়বিচার নদীর মত আর সততা চিরকাল বয়ে যাওয়া স্রোতের মত বয়ে যাক। “হে ইসরাইলের লোকেরা, মরুভূমিতে সেই চল্লিশ বছর তোমরা কি আমার উদ্দেশে কোন পশু বা অন্য জিনিস কোরবানী দিয়েছিলে? না, বরং তোমরা তোমাদের নিজেদের তৈরী বাদশাহ্‌-দেবতা সিক্কুতের মূর্তি ও তারা-দেবতা কীয়ূনের মূর্তি বয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। কাজেই আমি দামেস্কের ওপাশে বন্দী হিসাবে তোমাদের পাঠিয়ে দেব। আমি মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” ঘৃণ্য তোমরা! তোমরা তো সিয়োনে আরামে বাস করছ আর সামেরিয়ার পাহাড়ে নিজেদের নিরাপদ মনে করছ। তোমরা সবচেয়ে প্রধান জাতি ইসরাইলের নাম-করা লোক আর তোমাদের কাছেই ইসরাইলের লোকেরা আসে। তোমরা কল্‌নীতে গিয়ে দেখ; সেখান থেকে বড় হামায় যাও, তার পরে ফিলিস্তিনীদের গাৎ শহরে যাও। ঐ রাজ্যগুলোর চেয়ে কি তোমাদের রাজ্য দু’টা ভাল? তাদের দেশের চেয়ে কি তোমাদের দেশ বড়? তোমরা মনে করছ যে, তোমরা বিপদের দিনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ, কিন্তু আসলে তোমরা সন্ত্রাসের রাজত্ব চালা"ছ। তোমরা হাতীর দাঁতের কাজ করা খাটে শোও আর তোমাদের বিছানায় অলসভাবে শরীর টান কর। তোমাদের পাল থেকে তোমরা বাছাই করা ভেড়ার বাচ্চা ও বাছুরের গোশ্‌ত খাও। তোমরা বীণা বাজিয়ে কাওয়ালী গাও এবং দাউদের মত নানা রকম বাজনা তৈরী করে থাক। তোমরা পেয়ালা ভরে আংগুর-রস খাও আর সবচেয়ে ভাল খোশবু তেল গায়ে মাখ, কিন্তু তোমরা ইউসুফের, অর্থাৎ ইসরাইলের ধ্বংসের জন্য দুঃখিত হও না। কাজেই যারা বন্দী হয়ে অন্য দেশে যাবে তাদের মধ্যে তোমরাই হবে প্রথম; তখন তোমাদের মেজবানী খাওয়া ও শরীর টান করা শেষ হবে। দীন-দুনিয়ার মালিক মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন নিজের নামেই কসম খেয়ে বলেছেন, “আমি ইয়াকুবের অহংকার এবং তার কেল্লাগুলো ভীষণ ঘৃণা করি; সেইজন্য আমি তোমাদের শহর ও তার মধ্যেকার সব কিছু অন্যের হাতে দিয়ে দেব।” একটা ঘরে দশজন লোক বেঁচে থাকলেও তারা মারা পড়বে। তারপর কোন আত্মীয় লাশগুলো পোড়াবার জন্য সেগুলো ঘর থেকে বের করে নিতে আসবে। ঘরের ভিতরে আর কেউ আছে কি না তা জানবার জন্য সে জিজ্ঞাসা করবে, “তুমি ছাড়া আর কেউ আছে কি?” তখন সেই ঘরের লোক বলবে, “জ্বী না, নেই।” এতে সেই আত্মীয় বলবে, “চুপ কর। এমন কি, মাবুদের নামও নিয়ো না।” যখন মাবুদ হুকুম দেবেন তখন বড় বড় বাড়ী খণ্ড খণ্ড আর ছোট ছোট বাড়ী টুকরা টুকরা করা হবে। খাড়া পাহাড়ে কি ঘোড়ারা দৌড়ায়? কেউ কি সেখানে বলদ দিয়ে চাষ করে? কিন্তু তোমরা ন্যায়বিচারকে করেছ বিষের মত আর তেতোর মত করেছ সততার ফল। তোমরা লো-দবার (যার মানে “কিছুই না”) জয় করেছ বলে আনন্দ করে থাক, আবার বলে থাক, “আমরা কি নিজের শক্তিতে কর্ণয়িম (যার মানে ‘শক্তিশালী শিং’) অধিকার করি নি?” মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হে ইসরাইলের লোকেরা, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে একটা জাতিকে পাঠাব। সেই জাতি উত্তর দিকের হামা এলাকা থেকে দক্ষিণ দিকের আরবা উপত্যকা পর্যন্ত সমস্ত জায়গায় তোমাদের উপর জুলুম করবে।” আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে এই দর্শন দেখালেন: দ্বিতীয় ফসলের সময় বাদশাহ্‌র ভাগের ঘাস কাটবার পরে যখন আবার ঘাস গজিয়ে উঠছিল তখন মাবুদ ঝাঁকে ঝাঁকে পংগপাল ঠিক করলেন। সেগুলো যখন দেশের সবুজ গাছ-গাছড়া খেয়ে পরিষ্কার করে দিল তখন আমি মিনতি করে বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, মাফ কর। ইয়াকুব কি করে বেঁচে থাকবে? সে তো খুবই ছোট।” তখন মাবুদ মন ফিরিয়ে বললেন, “ঐ রকম ঘটবে না।” তারপর আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে আর একটা দর্শন দেখালেন। আল্লাহ্‌ মালিক শাস্তি দেবার জন্য আগুনকে ডাকলেন। সেই আগুন মহাসমুদ্রকে শুকিয়ে ফেলল এবং ভূমিকে গ্রাস করতে লাগল। তখন আমি মিনতি করে বললাম, “হে আল্লাহ্‌ মালিক, আমি অনুরোধ করছি তুমি থাম। ইয়াকুব কি করে বাঁচবে? সে তো খুবই ছোট।” তখন আল্লাহ্‌ মালিক মন ফিরিয়ে বললেন, “ঐ রকমও ঘটবে না।” তারপর মাবুদ আমাকে আর একটা দর্শন দেখালেন। তিনি ওলনদড়ি হাতে নিয়ে ওলনের মাপে তৈরী একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, “আমোস, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “একটা ওলনদড়ি।” তখন মাবুদ বললেন, “আমার বান্দা ইসরাইলের মধ্যে আমি একটা ওলনদড়ি রাখছি; আমি আর তাদের রেহাই দেব না। ইসহাকের বংশের লোকদের পূজার উঁচু স্থানগুলো আর ইসরাইলের উপাসনার অন্যান্য জায়গাগুলো ধ্বংস করা হবে। আমি তলোয়ার নিয়ে ইয়ারাবিমের বংশের বিরুদ্ধে উঠব।” পরে বেথেলের পুরোহিত অমৎসিয় ইসরাইলের বাদশাহ্‌ ইয়ারাবিমের কাছে এই খবর পাঠালেন, “আমোস ইসরাইলের মধ্যেই আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করছে। দেশের লোকেরা তার কোন কথা সহ্য করতে পারছে না। আমোস বলছে, ‘ইয়ারাবিমকে তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলা হবে আর ইসরাইলকে অবশ্যই তার দেশ থেকে বন্দী হয়ে অন্য দেশে যেতে হবে।’ ” তখন অমৎসিয় আমোসকে বললেন, “ওহে নবী, দূর হয়ে যাও। তুমি এহুদা দেশেই চলে যাও। সেখানে নবী হিসাবে কথা বলে তোমার খাবার যোগাড় কর। বেথেলে আর নবী হিসাবে কথা বোলো না, কারণ এটা বাদশাহ্‌র উপাসনার জায়গা ও রাজবাড়ী।” জবাবে আমোস অমৎসিয়কে বললেন, “আমি নবীও ছিলাম না, নবীর শাগরেদও ছিলাম না; আসলে আমি ছিলাম একজন রাখাল, আর আমি ডুমুর গাছের দেখাশোনাও করতাম। কিন্তু মাবুদ আমাকে ভেড়ার পালের দেখাশোনার কাজ থেকে নিয়ে এসে বললেন, ‘তুমি গিয়ে আমার বান্দা ইসরাইলের কাছে নবী হিসাবে কথা বল।’ তাহলে এখন আপনি মাবুদের কালাম শুনুুন। আপনি বলছেন, ‘ইসরাইলের বিরুদ্ধে নবী হিসাবে কথা বোলো না এবং ইসহাকের বংশের বিরুদ্ধে প্রচার কোরো না।’ কাজেই মাবুদ বলছেন, ‘তোমার স্ত্রী শহরের মধ্যে বেশ্যা হবে, আর তোমার ছেলেমেয়েরা যুদ্ধে মারা যাবে। তোমার জমি মেপে মেপে অন্যদের ভাগ করে দেওয়া হবে আর তুমি নিজে একটা নাপাক দেশে মারা যাবে। ইসরাইলের লোকদের অবশ্যই তাদের দেশ থেকে বন্দী হয়ে অন্য দেশে যেতে হবে।’ ” আল্লাহ্‌ মালিক আমাকে আর একটা দর্শন দেখালেন। আমি দেখলাম, এক টুকরি পাকা ফল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমোস, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “এক টুকরি পাকা ফল।” তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “আমার বান্দা ইসরাইলের সময় শেষ হয়ে গেছে; আমি আর তাদের রেহাই দেব না। সেই দিন রাজবাড়ীতে গানের বদলে এই বিলাপ হবে, ‘অনেক, অনেক লাশ; সেগুলো সব জায়গায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। চুপ কর।’ ” তোমরা যারা অভাবীদের পায়ে মাড়া"ছ আর গরীবদের শেষ করে দিচ্ছ, তোমরা শোন। তোমরা বলছ, “কখন অমাবস্যা চলে যাবে যাতে আমরা শস্য বিক্রি করতে পারি? কখন বিশ্রাম দিন শেষ হবে যাতে আমরা বাজারে গম বেচতে পারি? আমরা মাপের টুকরি ছোট করব, দাম বাড়াব, ঠকামির দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করব, রূপা দিয়ে গরীবকে এবং এক জোড়া জুতা দিয়ে অভাবীকে কিনে নেব আর ঝাড়ু দিয়ে ফেলে দেওয়া গম তাদের কাছে বিক্রি করব।” মাবুদ, যিনি ইয়াকুবের গৌরব, তিনি কসম খেয়ে বলেছেন, “তারা যা করেছে তা কখনই আমি ভুলে যাব না। এর জন্য কি দেশ কাঁপবে না? তার মধ্যে বাসকারী সবাই কি বিলাপ করবে না? গোটা দেশটাই মিসরের নীল নদের মত ফুলে উঠে অশান্ত হবে আর তারপর নেমে যাবে।” আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “সেই দিন দুপুর বেলাতেই আমি সূর্যকে অস্ত যাওয়াব এবং দিনের বেলায় দুনিয়াকে অন্ধকার করে দেব। আমি তোমাদের ঈদগুলো শোকে ও সমস্ত কাওয়ালী বিলাপে বদলে দেব। আমি তোমাদের সকলকে ছালার চট পরাব ও মাথায় টাক পড়াব। আমি সেই সময়টাকে করব একমাত্র ছেলের মৃত্যুর শোকের সময়ের মত এবং তা শেষ পর্যন্ত চলবে ভীষণ দুঃখে।” আল্লাহ্‌ মালিক বলছেন, “এমন সব দিন আসছে যখন আমি দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষ পাঠাব। তা খাবারের দুর্ভিক্ষ কিংবা পানির পিপাসা নয় কিন্তু মাবুদের কালাম শুনবার দুর্ভিক্ষ। লোকে মাবুদের কালামের খোঁজে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে টলতে টলতে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু তা পাবে না। সেই দিন সুন্দরী যুবতীরা এবং শক্তিশালী যুবকেরা সেই কালামের পিপাসায় জ্ঞান হারাবে। যারা সামেরিয়ার মূর্তির নাম নিয়ে কসম খেয়ে বলে, ‘হে দান, তোমার জীবন্ত দেবতার কসম,’ কিংবা বলে, ‘বের্‌-শেবার জীবন্ত দেবতার কসম,’ তারা পড়ে যাবে, আর কখনও উঠবে না।” আমি মাবুদকে বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তিনি বললেন, “থামগুলোর মাথায় আঘাত কর যাতে সেগুলো কেঁপে উঠে সেখানকার সমস্ত লোকদের মাথার উপর ভেংগে পড়ে। যারা বেঁচে থাকবে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমি তাদের মেরে ফেলব। কেউ চলে যেতে কিংবা পালাতে পারবে না। তারা কবরের গভীর পর্যন্ত খুঁড়ে সেখানে গেলেও আমার হাত সেখান থেকে তাদের নিয়ে আসবে। তারা আসমান পর্যন্ত উঠলেও সেখান থেকে আমি তাদের নামিয়ে আনব। তারা কর্মিল পাহাড়ের চূড়ায় নিজেদের লুকালেও সেখান থেকে আমি তাদের খুঁজে বের করে ধরব। তারা আমার কাছ থেকে সমুদ্রের তলায় লুকালেও সেখানে তাদের কামড়াবার জন্য আমি সাপকে হুকুম দেব। শত্রুদের দ্বারা বন্দী হয়ে তারা অন্য দেশে গেলেও সেখানে তাদের মেরে ফেলবার জন্য আমি তলোয়ারকে হুকুম দেব। নিরাপত্তার জন্য নয় কিন্তু বিপদের জন্যই আমি তাদের উপর আমার চোখ স্থির রাখব।” দীন-দুনিয়ার মালিক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন দেশটাকে ছুঁলে তা গলে যায় আর তার মধ্যে বাসকারী সবাই শোক করে। তাঁর ছোঁয়ায় গোটা দেশটা মিসরের নীল নদের মত ফুলে ওঠে, তারপর নেমে যায়। তিনি আসমানে তাঁর উঁচু ঘর তৈরী করেছেন এবং দুনিয়ার উপরে চাঁদোয়ার মত আকাশকে স্থাপন করেছেন; তিনি সাগরের পানিকে ডেকে ভূমির উপরে ঢেলে দেন। যিনি এই সব করেন তাঁর নাম মাবুদ। মাবুদ বলছেন, “হে ইসরাইলের লোকেরা, তোমরা কি আমার কাছে ইথিওপীয়দের মত নও? আমি কি মিসর থেকে বনি-ইসরাইলদের, ক্রীট থেকে ফিলিস্তিনীদের এবং কীর থেকে সিরীয়দের নিয়ে আসি নি? আমার চোখ অবশ্যই এই গুনাহে পূর্ণ রাজ্যের উপর রয়েছে। দুনিয়ার বুক থেকে আমি তা ধ্বংস করে দেব; তবুও আমি ইয়াকুবের বংশকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করব না। আমি হুকুম দেব, আর চালুনিতে যেমন শস্য চালে তেমনি করে সমস্ত জাতির মধ্যে আমি ইসরাইলের বংশকে চালব, কিন্তু একটা দানাও মাটিতে পড়বে না। আমার সব গুনাহ্‌গার বান্দাদের মধ্যে যারা বলে, ‘বিপদ আমাদের নাগাল পাবে না কিংবা আমাদের কাছে আসবে না,’ তারা সবাই যুদ্ধে মারা পড়বে।” মাবুদ বলছেন, “সেই দিন আমি দাউদের পড়ে যাওয়া ঘর আবার উঠাব। আমি তার ভাংগা জায়গাগুলো মেরামত করব, ধ্বংসস্থানগুলো ঠিক করব এবং আগে যেমন ছিল তেমনি করে তা তৈরী করব, যাতে বনি-ইসরাইলরা ইদোমের বাকী অংশ এবং আমার অন্য সব জাতিদের দেশ অধিকার করতে পারে।” মাবুদ, যিনি এই সব কাজ করেন, তিনি এই কথা বলছেন। মাবুদ আরও বলছেন, “সেই দিনগুলো আসছে যখন এত শস্য জন্মাবে যে, তা সব কাটবার আগে আবার চাষ করবার সময় আসবে এবং এত আংগুর হবে যে, তা সব মাড়াই করবার আগে আবার ফসল লাগাবার সময় আসবে। বড় বড় পাহাড়গুলো থেকে প্রচুর নতুন আংগুর-রস পাওয়া যাবে এবং তা সমস্ত ছোট ছোট পাহাড়গুলোকে যেন ধুয়ে নিয়ে যাবে। বন্দীদশায় থাকা আমার বান্দা বনি-ইসরাইলদের আমি ফিরিয়ে আনব; তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলো আবার তৈরী করবে এবং সেগুলোতে বাস করবে। তারা আংগুর ক্ষেত করে আংগুর-রস খাবে; তারা বাগান করে তার ফল খাবে। আমি বনি-ইসরাইলদের তাদের নিজের দেশে গাছের মত লাগিয়ে দেব; যে দেশ আমি তাদের দিয়েছি সেখান থেকে আর তাদের কখনও উপ্‌ড়ে ফেলা হবে না।” এই কথা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন। ওবদিয়ের দর্শন। ইদোম দেশের বিষয়ে আল্লাহ্‌ মালিক এই সব কথা বলেছেন। আমরা মাবুদের কাছ থেকে একটা সংবাদ পেয়েছি। তিনি জাতিদের কাছে একজন সংবাদদাতাকে পাঠিয়ে এই কথা বলতে বলেছিলেন, “ওঠো, চল আমরা ইদোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাই।” মাবুদ ইদোমকে বলছেন, “দেখ, জাতিদের মধ্যে আমি তোমাকে ছোট করব; তোমাকে একেবারে তুচ্ছ করা হবে। তুমি পাথরের পাহাড়ের ফাটলে বাস কর এবং উঁচু উঁচু জায়গায় থাক আর মনে মনে বল, ‘কে আমাকে মাটিতে নামাতে পারবে?’ কিন্তু তোমার দিলের অহংকারই তোমাকে ঠকিয়েছে। যদিও তুমি ঈগল পাখীর মত উঁচুতে বাসা বাঁধ এবং তারাগুলোর মধ্যে ঘর বানাও তবুও আমি সেখান থেকে তোমাকে নামিয়ে আনব। আমি মাবুদ এই কথা বলছি। “কি বিপদই না তোমার জন্য অপেক্ষা করছে! যদি চোরেরা তোমার কাছে আসে, ডাকাতেরা আসে রাতের বেলায়, তবে তাদের যতটা ইচ্ছা কেবল ততটাই তারা চুরি করবে। আংগুর তুলবার লোকেরা যদি তোমার কাছে আসে তবে তারা তোমার জন্য কিছু আংগুর রেখে যাবে। কিন্তু ইস্‌কে একেবারে লুট করা হবে, তার গুপ্তধন সম্পূর্ণভাবে লুটপাট করা হবে। তোমার সব বন্ধু-রাজ্যগুলো তোমার পালিয়ে যাওয়া লোকদের তাদের সীমায় ঢুকতে দেবে না। তোমার বন্ধুরা তোমাকে ঠকাবে এবং বশে আনবে; যারা তোমার খাবার খায় তারা তোমার জন্য ফাঁদ পাতবে, কিন্তু তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না।” মাবুদ বলছেন, “সেই দিন আমি কি ইদোমের জ্ঞানী লোকদের এবং ইসের পাহাড়গুলো থেকে বুদ্ধিমান লোকদের ধ্বংস করব না? হে তৈমন, তোমার যোদ্ধারা ভীষণ ভয় পাবে আর ইসের পাহাড়গুলোর সবাইকে মেরে ফেলা হবে। তোমার ভাই ইয়াকুবের বিরুদ্ধে অত্যাচারের জন্য তুমি লজ্জায় ঢাকা পড়বে; তুমি চিরকালের জন্য ধ্বংস হবে। অন্য দেশের লোকেরা যখন ইয়াকুবের ধন-সম্পদ নিয়ে যাচ্ছিল আর তার দরজাগুলো দিয়ে ঢুকে জেরুজালেমের জন্য গুলিবাঁট করছিল তখন তুমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলে; তুমি তাদের একজনের মত হয়েছিলে। তোমার ভাইয়ের দুর্দশার দিনে তুমি খুশী হয়েছ, এহুদার লোকদের ধ্বংসের দিনে তাদের বিষয় নিয়ে আনন্দ করেছ এবং তাদের কষ্টের দিনে গর্ব করেছ। আমার বান্দাদের বিপদের দিনে তুমি তাদের দরজাগুলো দিয়ে ঢুকেছ, তাদের ধ্বংসের দিনে তাদের বিপদ দেখে তুমি খুশী হয়েছ এবং তাদের ধন-সম্পদ দখল করেছ, তাদের পালিয়ে যাওয়া লোকদের মেরে ফেলবার জন্য তুমি তাদের পালাবার রাস্তায় রাস্তায় অপেক্ষা করেছ, আর তাদের কষ্টের দিনে তাদের রক্ষা পাওয়া লোকদের শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছ। এই সব করা তোমার উচিত ছিল না। “সমস্ত জাতির জন্য মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে। তুমি যেমন করেছ তোমার প্রতি তেমনই করা হবে; তোমার কাজের ফল তোমারই মাথার উপর ফিরে আসবে। আমার পবিত্র পাহাড়ে তুমি যেমন মদ খেয়েছ তেমনি সমস্ত জাতি অনবরত আমার রাগের মদ খাবে; তারা তা খেতেই থাকবে এবং সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সিয়োন পাহাড়ে কতগুলো লোক রক্ষা পাবে; তারা হবে পবিত্র লোক। ইয়াকুবের বংশ তাদের পাওনা সম্পত্তি পাবে। ইয়াকুবের বংশ হবে আগুন আর ইউসুফের বংশ হবে আগুনের শিখা; ইসের বংশ হবে নাড়া আর সেই আগুন তা পুড়িয়ে ফেলবে। ইসের বংশের কেউই বেঁচে থাকবে না। আমি মাবুদ এই কথা বলেছি।” নেগেভে থাকা বনি-ইসরাইলরা ইসের পাহাড়গুলো দখল করে নেবে এবং নীচু পাহাড়ী এলাকার লোকেরা ফিলিস্তিনীদের দেশ অধিকার করবে। তারা আফরাহীম ও সামেরিয়ার জায়গাগুলো দখল করবে এবং বিন্‌ইয়ামীন গিলিয়দ এলাকা অধিকার করবে। বন্দীদশায় থাকা বনি-ইসরাইলদের দল এসে সারিফৎ পর্যন্ত কেনানীয়দের দেশটা অধিকার করে নেবে; বন্দীদশায় থাকা জেরুজালেমের যে লোকেরা সফারদে আছে তারা এসে নেগেভের গ্রামগুলো অধিকার করবে। শাসনকর্তারা সিয়োন পাহাড় থেকে ইসের পাহাড়গুলোর লোকদের শাসন করবে, আর মাবুদই রাজত্ব করবেন। মাবুদের এই কালাম মাত্তার ছেলে ইউনুসের উপর নাজেল হল, “তুমি সেই বড় শহর নিনেভেতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে তবলিগ কর, কারণ তার লোকদের খারাপী আমি দেখতে পেয়েছি।” কিন্তু ইউনুস মাবুদের কাছ থেকে সেপন দেশে পালিয়ে যাবার জন্য রওনা হলেন। তিনি জাফা বন্দরে গিয়ে সেপনে যাবার একটা জাহাজ পেলেন। ভাড়া দেবার পর তিনি সেই জাহাজে উঠলেন এবং মাবুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার জন্য সেপনের দিকে যাত্রা করলেন। তখন মাবুদ সমুদ্রে একটা জোর বাতাস পাঠিয়ে দিলেন। তাতে এমন ভয়ংকর একটা ঝড় উঠল যে, জাহাজখানা ভেংগে যাবার মত হল। এতে নাবিকেরা সবাই ভয় পেয়ে প্রত্যেকে নিজের নিজের দেবতার কাছে কান্নাকাটি করতে লাগল। জাহাজের ভার কমাবার জন্য তারা মালপত্র সমুদ্রে ফেলে দিল। কিন্তু এর আগেই ইউনুস জাহাজের খোলে নেমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর ঘুম গভীর হয়েছিল। তখন জাহাজের ক্যাপ্টেন ইউনুসের কাছে গিয়ে বললেন, “তুমি কেমন করে ঘুমা"ছ? উঠে তোমার দেবতাকে ডাক। তিনি হয়তো আমাদের দিকে মনোযোগ দেবেন আর তাতে আমরা ধ্বংস হব না।” পরে নাবিকেরা একে অন্যকে বলল, “কে এই বিপদের জন্য দায়ী তা দেখবার জন্য এস, আমরা গুলিবাঁট করে দেখি।” তারা গুলিবাঁট করলে পর ইউনুসের নাম উঠল। তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আমাদের বল, এই যে বিপদ আমাদের উপর এসেছে তার জন্য কে দায়ী? তুমি কি কাজ কর? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তুমি কোন্‌ দেশের লোক? তুমি কোন্‌ জাতির লোক?” জবাবে ইউনুস বললেন, “আমি একজন ইবরানী। আমি বেহেশতের মাবুদ আল্লাহ্‌র এবাদত করি। তিনিই সাগর ও ভূমি তৈরী করেছেন।” তিনি যে মাবুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন তা তারা জানতে পারল, কারণ তিনি সেই কথা তাদের বললেন। এতে তারা ভীষণ ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এ কি করেছ?” সাগর অশান্ত থেকে আরও অশান্ত হয়ে উঠছিল বলে তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “সমুদ্র যাতে আমাদের জন্য শান্ত হয় সেইজন্য আমরা তোমাকে নিয়ে কি করব?” জবাবে ইউনুস বললেন, “আমাকে তুলে সমুদ্রে ফেলে দিন, তাতে সমুদ্র শান্ত হবে। আমি জানি, আমার দোষেই এই ভীষণ ঝড় আপনাদের উপরে এসেছে।” তবুও সেই নাবিকেরা তা না করে ডাংগার দিকে ফিরে যাবার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁড় বাইতে লাগল; কিন্তু তারা পারল না, কারণ সমুদ্র আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। তখন তারা মাবুদকে ডেকে বলল, “হে মাবুদ, এই লোকের মৃত্যুর জন্য আমাদের যেন মরতে না হয়। একজন নির্দোষ লোকের মৃত্যুর জন্য তুমি আমাদের দায়ী কোরো না, কারণ হে মাবুদ, তুমি তো তোমার ইচ্ছামত কাজ করেছ।” এর পর তারা ইউনুসকে ধরে সমুদ্রে ফেলে দিল, তাতে তোলপাড় করা সেই সাগর শান্ত হয়ে গেল। এতে সেই লোকেরা মাবুদকে ভীষণ ভয় করতে লাগল। তারা মাবুদের উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিল এবং তাঁর কাছে কতগুলো মানত করল। এদিকে ইউনুসকে গিলে ফেলবার জন্য মাবুদ একটা বড় মাছ ঠিক করে রেখেছিলেন। ইউনুস সেই মাছের পেটে তিন দিন তিন রাত রইলেন। ইউনুস সেই মাছের পেটে থেকে তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করলেন। তিনি বললেন, “হে মাবুদ, আমার কষ্টের সময়ে আমি তোমাকে ডাকলাম আর তুমি আমাকে জবাব দিলে। কবরের গভীরতা থেকে আমি সাহায্যের জন্য ডাক দিলাম আর তুমি আমার ফরিয়াদ শুনলে। তুমি আমাকে গভীর পানিতে, সাগরের তলায় ফেলে দিলে আর আমি স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেলাম; তোমার সমস্ত ঢেউ আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল। আমি বললাম, ‘আমাকে তোমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দেওয়া হয়েছে; তবুও আমি আবার তোমার সেই পবিত্র ঘরের দিকে চোখ তুলব।’ সাগরের পানি আমাকে গ্রাস করে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে গেল; সাগর আমাকে ঘিরে ধরল এবং তার আগাছা আমার মাথায় জড়িয়ে গেল। আমি ডুবে গিয়ে পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত গেলাম; কবর চিরকালের জন্য আমাকে আট্‌কে রাখল। কিন্তু হে আমার মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি সেখান থেকে আমাকে উঠিয়ে আনলে। “হে মাবুদ, আমার প্রাণ যখন যায়-যায় হয়ে উঠেছিল তখন আমি তোমাকে মনে করলাম, আর আমার মুনাজাত তোমার কাছে, তোমার পবিত্র ঘরে উঠে গিয়েছিল। যারা অপদার্থ মূর্তিগুলোর পূজা করে তারা তোমার যে রহমত পেতে পারত তা অবহেলা করে, কিন্তু আমি শুকরিয়া-কাওয়ালী গেয়ে তোমার উদ্দেশে পশু-কোরবানী দেব। আমি যে মানত করেছি তা পূর্ণ করব। উদ্ধার করা মাবুদেরই কাজ।” পরে মাবুদ মাছটাকে হুকুম দিলেন আর মাছটা ইউনুসকে শুকনা জমির উপর বমি করে বের করে দিল। পরে মাবুদের কালাম দ্বিতীয়বার ইউনুসের উপর নাজেল হল। তিনি বললেন, “তুমি এখন সেই বড় শহর নিনেভেতে যাও এবং আমি যে খবর তোমাকে দেব তা সেখানে ঘোষণা কর।” মাবুদের কথামত ইউনুস নিনেভেতে গেলেন। নিনেভে ছিল খুব বড় একটা শহর; তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে হেঁটে সমস্ত জায়গায় যেতে তিন দিন লাগত। ইউনুস সেই শহরে ঢুকে এক দিনের পথ গেলেন এবং এই কথা ঘোষণা করলেন, “আর চল্লিশ দিন পরে নিনেভে ধ্বংস হয়ে যাবে।” তখন নিনেভের লোকেরা আল্লাহ্‌র কথায় ঈমান আনল। তাই তারা রোজা ঘোষণা করল এবং বড় থেকে ছোট পর্যন্ত সকলেই ছালার চট পরল। বাদশাহ্‌র কাছে সেই খবর পৌঁছালে পর তিনি তাঁর সিংহাসন ছেড়ে উঠে তাঁর রাজপোশাক খুলে ফেললেন এবং ছালার চট পরে ছাইয়ের মধ্যে বসলেন। তারপর তিনি নিনেভেতে তাঁর ও তাঁর রাজকর্মচারীদের এই হুকুম ঘোষণা করালেন: “মানুষ বা পশু, গরু বা ভেড়ার পাল কেউ কোন কিছু না খাক; তারা খাবার কিংবা পানি না খাক। মানুষ ও পশু ছালার চট পরুক। প্রত্যেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আল্লাহ্‌কে ডাকুক আর খারাপ পথ ও সন্ত্রাসের কাজ ছেড়ে দিক। কে জানে হয়তো বা আল্লাহ্‌ মন ফিরিয়ে তাঁর জ্বলন্ত রাগ থেকে ফিরবেন যাতে আমরা ধ্বংস হয়ে না যাই।” তারা যা করেছিল এবং কেমন করে তাদের খারাপ পথ থেকে ফিরেছিল তা যখন আল্লাহ্‌ দেখলেন তখন তিনি তাঁর মন ফিরালেন। তিনি যে ক্ষতি করবেন বলেছিলেন তা করলেন না। কিন্তু ইউনুস এতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে রেগে গেলেন। তিনি মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বললেন, “হে মাবুদ, আমি দেশে থাকতেই জানতাম যে, এই রকম হবে। সেইজন্যই তো আমি প্রথমে সেপনে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম যে, তুমি দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ আল্লাহ্‌, তুমি সহজে রেগে উঠ না, তোমার অটল মহব্বতের সীমা নেই এবং গজব নাজেল করবার ব্যাপারে মন পরিবর্তন করে থাক। এখন হে মাবুদ, তুমি আমার প্রাণ নাও, কারণ আমার বেঁচে থাকবার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।” জবাবে মাবুদ বললেন, “তোমার রাগ করা কি উচিত হচ্ছে?” তখন ইউনুস শহরের বাইরে গিয়ে পূর্ব দিকে একটা জায়গায় চালা তৈরী করে তার ছায়ায় বসে রইলেন। শহরের কি দশা হয় তা দেখবার জন্য তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। তখন মাবুদ আল্লাহ্‌ সেখানে একটা গাছ জন্মালেন। সেই গাছটা বড় হয়ে ইউনুসের কষ্ট কমাবার জন্য তাঁর মাথায় ছায়া দিতে লাগল। এতে ইউনুস সেই গাছটার জন্য খুব খুশী হলেন। কিন্তু পরের দিন ভোরবেলায় আল্লাহ্‌ একটা পোকা পাঠালেন; গাছটা সেই পোকায় কাটলে পর সেটা শুকিয়ে গেল। যখন সূর্য উঠল তখন আল্লাহ্‌ গরম পূবের বাতাস বহালেন; তাতে ইউনুসের মাথায় এমন রোদ লাগল যে, তিনি প্রায় অজ্ঞান হবার মত হলেন। তখন তিনি মরতে চেয়ে বললেন, “আমার বেঁচে থাকবার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।” কিন্তু আল্লাহ্‌ ইউনুসকে বললেন, “ঐ গাছের বিষয়ে রাগ করা কি তোমার উচিত হচ্ছে?” ইউনুস বললেন, “তার কারণ আছে। আমি মরণ পর্যন্ত রাগ করে থাকব।” কিন্তু মাবুদ বললেন, “তুমি যদিও এই গাছটার জন্য কোন পরিশ্রম কর নি বা এটাকে বাড়িয়ে তোল নি তবুও গাছটার জন্য তোমার মমতা হয়েছে। ওটা তো এক রাতের মধ্যে গজিয়েছিল এবং এক রাতেই মরে গেল। কিন্তু নিনেভেতে এক লক্ষ বিশ হাজারেরও বেশী শিশু আছে যারা জানে না কোনটা ডান হাত আর কোনটা বাঁ হাত; এছাড়া অনেক গরু-ভেড়াও আছে। তাহলে আমি কি করব? আমি কি ঐ বড় শহরের জন্য মমতা করব না?” এহুদার বাদশাহ্‌ যোথম, আহস ও হিষ্কিয়ের রাজত্বের সময়ে মোরেষৎ গ্রামের মিকাহ্‌র কাছে সামেরিয়া ও জেরুজালেম সম্বন্ধে মাবুদের কালাম দর্শনের মধ্য দিয়ে নাজেল হয়েছিল। ওহে জাতিরা, তোমরা সবাই কান দাও; হে দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব কিছু, শোন। আল্লাহ্‌ মালিক তাঁর পবিত্র ঘর থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন। দেখ, মাবুদ তাঁর বাসস্থান থেকে আসছেন; তিনি নেমে এসে দুনিয়ার উঁচু জায়গাগুলোর উপর দিয়ে যাবেন। মোম যেমন আগুনে গলে যায়, ঢালু জায়গা দিয়ে যেমন পানি গড়িয়ে যায় তেমনি করে তাঁর পায়ের তলায় পাহাড়-পর্বত গলে যাবে, উপত্যকাগুলো ফেটে যাবে। ইয়াকুবের গুনাহের জন্য, অর্থাৎ ইসরাইলের বংশের অন্যায়ের জন্যই এই সব হবে। ইয়াকুবের গুনাহের জন্য দায়ী কে? সামেরিয়া কি নয়? এহুদার পূজার উঁচু স্থানের জন্য দায়ী কে? জেরুজালেম কি নয়? সেইজন্য মাবুদ বলছেন, “সামেরিয়াকে আমি খোলা মাঠের ধ্বংসের স্তূপ করব, আর সেটা হবে আংগুর গাছ লাগাবার জায়গা। আমি তার পাথরগুলো উপত্যকায় ফেলে দেব এবং তার ভিত্তি খোলা রাখব। তার সব প্রতিমা টুকরা টুকরা করে ভেংগে ফেলা হবে; তার মন্দির-বেশ্যাদের সমস্ত আয় আগুন দিয়ে পোড়ানো হবে; তার সব মূর্তিগুলো আমি ধ্বংস করে ফেলব। সে তো বেশ্যাগিরির পাওনা হিসাবে এই সব পেয়েছে তাই সেইগুলো আবার বেশ্যাগিরির জন্যই ব্যবহার করা হবে।” এইজন্য আমি কান্নাকাটি ও বিলাপ করব; আমি খালি পায়ে উলংগ হয়ে ঘুরে বেড়াব। আমি শিয়ালের ও পেঁচার ডাকের মত করে বিলাপ করব। এর কারণ সামেরিয়ার ক্ষত আর ভাল হবে না; তা এহুদার কাছে এসে গেছে। তা আমার লোকদের দরজা পর্যন্ত, এমন কি, জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছেছে। তোমরা গাৎ শহরে এই কথা জানায়ো না, একটুও কান্নাকাটি কোরো না। তোমরা বৈৎ-লি-অফ্রাতে ধুলায় গড়াগড়ি দাও। হে শাফীরে বাসকারী লোকেরা, তোমরা উলংগ ও লজ্জিত হয়ে চলে যাও। যারা সাননে বাস করে তারা বের হয়ে আসতে পারবে না। বৈৎ-এৎসল বিলাপ করছে; সে আর তোমাদের পক্ষে দাঁড়াবে না। যারা মারোতে বাস করে তারা ব্যাকুল হয়ে রেহাই পাবার জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ মাবুদের কাছ থেকে বিপদ এসে গেছে; এমন কি, তা জেরুজালেমের দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে। হে লাখীশে বাসকারী লোকেরা, তোমরা রথের সংগে ঘোড়াগুলো জুড়ে দাও। ইসরাইলের অন্যায় প্রথমে তোমাদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল বলে সিয়োন্তকন্যাকে তোমরাই গুনাহের পথে নিয়ে গিয়েছিলে। সেইজন্য তোমরা মোরেষৎ-গাত্‌কে বিদায়-উপহার দেবে। ইসরাইলের বাদশাহ্‌রা অক্‌ষীব শহরের উপর ভরসা করতে পারবে না। হে মারেশায় বাসকারী লোকেরা, মাবুদ তোমাদের বিরুদ্ধে একজন দখলকারীকে পাঠাবেন। ইসরাইলের সমস্ত গৌরব অদুল্লমে চলে যাবে। যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তোমরা আনন্দিত হতে তাদের জন্য শোক করতে গিয়ে তোমাদের মাথা কামিয়ে ফেল; শকুনের মাথার মত তোমরা মাথা টাক করে ফেল, কারণ তারা বন্দী হয়ে তোমাদের কাছ থেকে দূরে যাবে। ঘৃণ্য তারা, যারা অন্যায়ের পরিকল্পনা করে, যারা নিজেদের বিছানায় খারাপীর ফন্দি আঁটে। সকাল হলেই তারা সেইমত কাজ করে, কারণ তা করবার ক্ষমতা তাদের হাতে আছে। তারা ক্ষেত-খামার আর ঘর-বাড়ীর প্রতি লোভ করে তা কেড়ে নেয়। তারা মানুষকে ঠকিয়ে তার ঘর-বাড়ী ও তার জায়গা-জমি নিয়ে নেয়। সেইজন্য মাবুদ বলছেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে আমি বিপদের পরিকল্পনা করছি যা থেকে তোমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। তোমরা আর গর্ব করে চলবে না, কারণ সময়টা হবে বিপদের। সেই দিন ভীষণ বিলাপ হবে এবং এই দুঃখের গান গাওয়া হবে: আমরা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছি; আমাদের জাতির সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাবুদ তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। আমাদের ক্ষেত-খামার তিনি বেঈমানদের দিয়ে দিয়েছেন।” কাজেই তোমাদের মধ্যে কেউই মাবুদের বান্দাদের সংগে জমির ভাগ পাবে না। তোমাদের নবীরা আমাদের বলে, “এই সব কথা বোলো না, এই সব বিষয়ে কোন কথা বোলো না, কারণ আমাদের উপরে অসম্মান আসবে না।” হে ইয়াকুবের বংশ, তোমাদের এই কথা বলা উচিত নয়, “মাবুদের রূহ্‌ অধৈর্য হন নি; তিনি এই সব কাজ করেন না।” মাবুদ বলছেন, “যারা ন্যায় পথে চলে কেবল তাদেরই উপর আমার কালাম উন্নতি আনে। আজকাল আমার বান্দারা শত্রুর মত হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা লোকদের মত যারা নিশ্চিন্তে পথ চলছে তাদের গা থেকে তোমরা কাপড় খুলে নি"ছ। আমার বান্দাদের স্ত্রীদের তোমরা তাদের প্রিয় বাড়ী-ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ। আমার দোয়া থেকে তাদের ছেলেমেয়েদের তোমরা চিরকালের জন্য বঞ্চিত করছ। তোমরা ওঠো, চলে যাও, এটা তো তোমাদের বিশ্রামের স্থান নয়; কারণ তোমরা দেশটাকে নাপাক করেছ, সেইজন্যই তা ভীষণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি কোন মিথ্যাবাদী ও ঠগ এসে বলে, ‘আমি বলছি যে, তোমাদের প্রচুর মদ ও আংগুর-রস হবে,’ তবে সে-ই হবে এই জাতির জন্য উপযুক্ত নবী!” মাবুদ বলছেন, “হে ইয়াকুব, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের সবাইকে জমায়েত করব; আমি অবশ্যই ইসরাইলের বেঁচে থাকা লোকদের একত্র করব। বস্রার ভেড়াগুলোর মত করে, খোঁয়াড়ে থাকা ভেড়ার পালের মত করে আমি তাদের একত্র করব; দেশটা আবার লোকে ভরে যাবে।” বন্দীদশা থেকে ফিরে আসবার জন্য যিনি পথ খুলে দেবেন তিনি তাদের আগে আগে যাবেন; তারা দরজা ভেংগে বের হয়ে আসবে। মাবুদ, যিনি তাদের বাদশাহ্‌, তিনি তাদের আগে আগে যাবেন। আমি মিকাহ্‌ বলছি, হে ইয়াকুবের নেতারা, অর্থাৎ ইসরাইলের বংশের শাসনকর্তারা, আপনারা শুনুন। আপনাদের কি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানা উচিত নয়? আপনারা তো ভাল কাজকে ঘৃণা করে খারাপ কাজকে ভালবাসেন; আপনারা আমার লোকদের গা থেকে চামড়া আর হাড় থেকে গোশ্‌ত ছাড়িয়ে নিচ্ছেন; আপনারা আমার লোকদের গোশ্‌ত খাচ্ছেন, তাদের চামড়া তুলে ফেলে হাড়গুলো টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গছেন; আপনারা হাঁড়ির মধ্যেকার গোশ্‌তের মত করে তাদের টুকরা টুকরা করে কাটছেন। সময় আসছে যখন আপনারা মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাবেন, কিন্তু তিনি আপনাদের জবাব দেবেন না। সেই সময় তিনি আপনাদের দিক থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে রাখবেন, কারণ আপনারা খারাপ কাজ করেছেন। যে সব নবীরা আমার লোকদের বিপথে নিয়ে গেছে তাদের যদি কেউ খেতে দেয় তবে তারা “শান্তি” বলে ঘোষণা করে; কিন্তু যদি খেতে না দেয় তবে তারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হয়। সেইজন্য মাবুদ সেই নবীদের বলছেন, “তোমাদের জন্য রাত আসছে, তোমরা কোন দর্শন পাবে না; তোমাদের জন্য অন্ধকার আসছে, তোমরা গণনা করে কিছু বলতে পারবে না। তোমাদের জন্য সূর্য ডুবে যাবে এবং দিন অন্ধকার হয়ে যাবে।” তাতে সেই দর্শনকারীরা লজ্জিত হবে এবং গণকেরা অসম্মানিত হবে। তারা সবাই মুখ ঢাকবে, কারণ আল্লাহ্‌ কোন জবাব দেবেন না। কিন্তু আমি ইয়াকুবকে তার অন্যায়, ইসরাইলকে তার গুনাহ্‌ সম্বন্ধে জানাবার জন্য মাবুদের রূহের দেওয়া শক্তিতে, ন্যায়বিচারে ও সাহসে পূর্ণ হয়েছি। হে ইয়াকুবের বংশের নেতারা, ইসরাইলের বংশের শাসনকর্তারা, শুনুন। আপনারা তো ন্যায়বিচার তুচ্ছ করছেন এবং যা সোজা তা সবই বাঁকা করে তুলছেন। আপনারা রক্ত দিয়ে সিয়োনকে, অন্যায় দিয়ে জেরুজালেমকে গড়ে তুলছেন। সেখানকার নেতারা ঘুষ খেয়ে বিচার করে, ইমামেরা বেতন নিয়ে শিক্ষা দেয় এবং নবীরা টাকা নিয়ে ভাগ্য গণনা করে। আর তবুও তারা মাবুদের সাহায্যের আশা করে বলে, “মাবুদ কি আমাদের মধ্যে নেই? আমাদের উপর কোন বিপদ আসবে না।” কাজেই আপনাদের জন্য সিয়োনকে ক্ষেতের মত করে চাষ করা হবে, জেরুজালেম হবে ধ্বংসের স্তূপ, আর বায়তুল-মোকাদ্দসের পাহাড়টা ঘন ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়বে। কেয়ামতের সময়ে সমস্ত পাহাড়ের মধ্যে সেই পাহাড়টাকেই সবচেয়ে উঁচুতে তোলা হবে যেখানে মাবুদের ঘর আছে। ছোট ছোট পাহাড়গুলোর চেয়ে তাকে উঁচুতে তোলা হবে, আর সব জাতি স্রোতের মত তার দিকে যাবে। অনেক জাতির লোক এসে বলবে, “চল, আমরা মাবুদের পাহাড়ে উঠে যাই, চল, ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র ঘরে যাই। তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব।” তারা এই কথা বলবে, কারণ সিয়োন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে আর জেরুজালেম থেকে বের হবে মাবুদের কালাম। তিনি জাতিদের মধ্যে বিচার করে দেবেন এবং দূরের শক্তিশালী লোকদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করবেন। তারা তাদের তলোয়ার ভেংগে লাংগলের ফাল গড়বে আর বর্শা ভেংগে গড়বে ডাল ছাঁটবার ছুরি। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে আর তলোয়ার উঠাবে না; তারা আর যুদ্ধ করতে শিখবে না। ॥স প্রত্যেকে নিজের নিজের আংগুর লতার ও ডুমুর গাছের নীচে বসবে এবং কেউ তাদের ভয় দেখাবে না, কারণ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই সেই কথা বলেছেন। সব জাতিরা তাদের দেব-দেবীর শক্তিতে কাজ করলেও আমরা চিরকাল আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র শক্তিতে কাজ করব। মাবুদ বলছেন, “সেই দিন আমি খোঁড়াদের একত্র করব; যারা বন্দী হয়ে অন্য দেশে আছে, যাদের আমি দুঃখ দিয়েছি তাদের আমি এক জায়গায় জমায়েত করব। আমি খোঁড়াদের বাঁচিয়ে রাখব এবং তাড়িয়ে দেওয়া লোকদের করব একটা শক্তিশালী জাতি। আমি মাবুদ সেই দিন থেকে চিরকাল সিয়োন পাহাড়ে তাদের উপরে রাজত্ব করব। হে ভেড়ার রাখালের পাহারা-ঘর, হে সিয়োন্তকন্যার কেল্লা, আগের রাজ্য তোমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে; বাদশাহ্‌ আবার জেরুজালেমে রাজত্ব করবে।” কেন তুমি এখন জোরে জোরে কাঁদছ? তোমার কি বাদশাহ্‌ নেই? তোমার পরামর্শদাতা কি মরে গেছে? সেইজন্য কি প্রসব-ব্যথায় কষ্ট পাওয়া স্ত্রীলোকের মত ব্যথা তোমাকে ধরেছে? হে সিয়োন্তকন্যা, প্রসব-ব্যথায় কষ্ট পাওয়া স্ত্রীলোকের মত তুমি ব্যথায় মোচড়াও, কারণ এখন তোমাকে শহর ছেড়ে খোলা মাঠে গিয়ে থাকতে হবে। তুমি ব্যাবিলনে যাবে; সেখানে তুমি উদ্ধার পাবে। মাবুদ সেখানেই তোমার শত্রুদের হাত থেকে তোমাকে মুক্ত করবেন। কিন্তু এখন অনেক জাতি তোমার বিরুদ্ধে জমায়েত হয়েছে। তারা বলছে, “তাকে নাপাক করা হোক; এস, আমরা সিয়োনের দুর্দশা দেখে আনন্দ করি।” কিন্তু তারা মাবুদের পরিকল্পনার কথা জানে না; তারা বুঝতে পারে না যে, তিনি শস্যের আঁটির মত খামারে মাড়াই করবার জন্য তাদের জড়ো করেছেন। মাবুদ বলছেন, “হে সিয়োন্তকন্যা, তুমি উঠে শস্য মাড়াই কর; আমি তোমাকে লোহার শিং আর ব্রোঞ্জের খুর দেব যাতে তুমি অনেক জাতিকে চুরমার করতে পার। তুমি তাদের অন্যায়ভাবে লাভ করা জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ আমার উদ্দেশে, সমস্ত দুনিয়ার মালিকের উদ্দেশে ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন হিসাবে দিয়ে দেবে।” ওহে সৈন্যদলে ঘেরাও হওয়া শহর, তোমার সৈন্যদল সাজাও, কারণ আমাদের বিরুদ্ধে একটা ঘেরাও হচ্ছে। শত্রুরা ইসরাইলের শাসনকর্তার গালে লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। মাবুদ বলছেন, “কিন্তু, হে বেথেলহেম-ইফ্রাথা, যদিও তুমি এহুদার হাজার হাজার গ্রামগুলোর মধ্যে ছোট, তবুও তোমার মধ্য থেকে আমার পক্ষে এমন একজন আসবেন যিনি হবেন ইসরাইলের শাসনকর্তা, যাঁর শুরু পুরানো দিন থেকে, অনন্তকাল থেকে।” সেই সময় না আসা পর্যন্ত মাবুদ ইসরাইলকে ত্যাগ করবেন। প্রসব-যন্ত্রণা ভোগকারিনী তার সন্তানের জন্ম দেবার পরে সেই শাসনকর্তার যে ভাইয়েরা বন্দীদশায় আছে তারা বনি-ইসরাইলদের সংগে যোগ দেবার জন্য ফিরে আসবে। সেই শাসনকর্তা এসে মাবুদের কুদরতে, তাঁর মাবুদ আল্লাহ্‌র মহিমায় রাখালের মত তাঁর লোকদের চালাবেন। তারা নিরাপদে বাস করবে, কারণ তিনি যে মহান সেই কথা তখন দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত সবাই স্বীকার করবে; আর তিনিই শান্তি আনবেন। আশেরীয়রা যখন আমাদের দেশ আক্রমণ করবে এবং আমাদের কেল্লাগুলো পায়ে মাড়াবে তখন আমরা তার বিরুদ্ধে সাতজন পালককে, এমন কি, আটজন নেতাকে দাঁড় করাব। তারা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আশেরিয়া দেশ অর্থাৎ, নমরূদের দেশ শাসন করবে। আশেরীয়রা আমাদের দেশ আক্রমণ করলে এবং আমাদের সীমানা পায়ে মাড়ালে তাদের হাত থেকে আমাদের শাসনকর্তাই আমাদের উদ্ধার করবেন। অনেক জাতির মধ্যে ইয়াকুবের বেঁচে থাকা লোকেরা হবে মাবুদের কাছ থেকে আসা শিশিরের মত, ঘাসের উপরে পড়া বৃষ্টির মত যা মানুষের হুকুমে পড়ে না বা তার উপর ভরসা করে না। অনেক জাতির মধ্যে ইয়াকুবের বেঁচে থাকা লোকেরা হবে বুনো জন্তুদের মধ্যে সিংহের মত, ভেড়ার পালের মধ্যে যুব সিংহের মত; সেই সিংহ যখন ভেড়াগুলোর মধ্য দিয়ে যায় তখন তাদের ধরে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলে; কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারে না। বনি-ইসরাইলরা শত্রুদের উপরে জয়লাভ করবে এবং তাদের সব শত্রু ধ্বংস হয়ে যাবে। মাবুদ বলছেন, “হে ইসরাইল, সেই সময় আমি তোমার মধ্য থেকে তোমার ঘোড়াগুলো শেষ করে ফেলব এবং তোমার রথগুলো ধ্বংস করে দেব। তোমার দেশের শহরগুলো আমি ধ্বংস করে দেব আর তোমার সব কেল্লাগুলো ভেংগে ফেলব। আমি তোমার জাদুবিদ্যা নষ্ট করব; মায়াবিদ্যা ব্যবহারকারীরা আর তোমার মধ্যে থাকবে না। তোমার মধ্য থেকে আমি খোদাই করা মূর্তিগুলো এবং তোমার পূজার সব খুঁটি নষ্ট করে ফেলব; তোমার হাতে গড়া জিনিসকে তুমি আর পূজা করবে না। আমি তোমার মধ্য থেকে সব আশেরা-খুঁটি উপ্‌ড়ে ফেলব এবং তোমার শহরগুলো ভেংগে ফেলব। যে জাতিরা আমার বাধ্য হয় নি আমি ভীষণ রাগে তাদের উপর প্রতিশোধ নেব।” হে ইসরাইল, মাবুদের কথা শোন। তিনি বলছেন, “হে মিকাহ্‌, তুমি উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়-পর্বতের সামনে তোমার মামলা উপস্থিত কর; তোমার যা বলবার আছে তা পাহাড়গুলো শুনুক।” হে পাহাড়-পর্বত, তোমরা মাবুদের অভিযোগ শোন; হে দুনিয়ার চিরস্থায়ী ভিত্তিগুলো, তোমরাও শোন। এর কারণ তাঁর বান্দাদের বিরুদ্ধে মাবুদের কিছু বলবার আছে; তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটা মামলা রুজু করেছেন। মাবুদ বলছেন, “হে আমার বান্দারা, আমি তোমাদের কি করেছি? কিভাবে আমি তোমাদের কষ্ট দিয়েছি? আমাকে জবাব দাও। আমি মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি, গোলামের অবস্থা থেকে তোমাদের মুক্ত করেছি। তোমাদের সাহায্যের জন্য মূসা, হারুন ও মরিয়মকে পাঠিয়েছি। হে আমার বান্দারা, মোয়াবের বাদশাহ্‌ বালাক যে পরিকল্পনা করেছিল এবং বাউরের ছেলে বালাম কি জবাব দিয়েছিল তা মনে করে দেখ। শিটীম থেকে গিল্‌গল পর্যন্ত তোমাদের যাত্রার কথা মনে কর যাতে তোমরা আমার করা উদ্ধারের কাজগুলো জানতে পার।” আমি কি নিয়ে মাবুদের সামনে যাব এবং বেহেশতের আল্লাহ্‌র এবাদত করব? আমি কি পোড়ানো-কোরবানীর জন্য এক বছর বয়সের কতগুলো বাছুর নিয়ে তাঁর সামনে যাব? মাবুদ কি হাজার হাজার ভেড়া কিংবা দশ হাজার নদী-ভরা জলপাই তেলে খুশী হবেন? আমার অন্যায়ের জন্য কি আমি আমার প্রথম সন্তান, আমার গুনাহের জন্য আমার শরীরের ফল কোরবানী দেব? ওহে মানুষ, যা ভাল তা তো তিনি তোমাকে দেখিয়েছেন। ন্যায় কাজ করা, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে ভালবাসা আর তোমার আল্লাহ্‌র সংগে নম্রভাবে যোগাযোগ-সম্বন্ধ রক্ষা করা ছাড়া মাবুদ তোমার কাছে আর কিছু চান না। জ্ঞানী লোকেরা মাবুদকে ভয় করে। ঐ শোন, মাবুদ শহরের লোকদের ডাকছেন। তিনি বলছেন, “তোমরা শাস্তির লাঠির দিকে ও যিনি সেটাকে নিযুক্ত করেছেন তাঁর দিকে মনোযোগ দাও। দুষ্ট লোকদের ঘরে অসৎ উপায়ে পাওয়া ধন-সম্পদ ও ঠকাবার মাপের টুকরি আছে যা আমি ঘৃণা করি। যে লোকের কাছে ঠকাবার দাঁড়িপাল্লা ও ওজনে কম বাট্‌খারা আছে তাকে কি আমি নির্দোষ বলে মনে করব? তোমাদের ধনী লোকেরা জুলুমবাজ, তোমরা মিথ্যাবাদী এবং তোমাদের মুখ ছলনার কথা বলে। কাজেই আমি তোমাদের গুনাহের জন্য ভীষণভাবে শাস্তি দেব ও তোমাদের ধ্বংস করব। তোমরা খেয়ে তৃপ্ত হবে না; তোমাদের পেটে খিদে থেকে যাবে। তোমরা জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে কিন্তু কিছুই রক্ষা করতে পারবে না, কারণ তোমরা যদি বা কিছু রক্ষা কর তবে তা আমি যুদ্ধ এনে ধ্বংস করব। তোমরা বীজ বুনবে কিন্তু ফসল কাটতে পারবে না; তোমরা জলপাই মাড়াই করবে কিন্তু নিজে তার তেল ব্যবহার করতে পারবে না; তোমরা আংগুর মাড়াই করেও তার রস খেতে পারবে না। তোমরা অম্রির নিয়ম-কানুন পালন করেছ ও আহাব-বংশের সব অভ্যাসমত চলেছ। তোমরা তাদের পরামর্শ অনুসারে চলেছ। সেইজন্য আমি ধ্বংসের হাতে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের হাতে তোমাদের তুলে দেব; আমার বান্দা হিসাবে তোমাদের অসম্মান ভোগ করতে হবে।” কি বিপদ আমার! আমি হয়েছি তারই মত যে সমস্ত ফল পেড়ে নেবার পরে আংগুর তুলতে ও অন্যান্য ফল পাড়তে যায়, কিন্তু সেখানে খাবার জন্য কোন আংগুরের থোকা নেই, কোন প্রথমে পাকা ডুমুরও নেই যা আমার প্রাণে চায়। দেশ থেকে আল্লাহ্‌ভক্তদের মুছে ফেলা হয়েছে; সৎ লোক একজনও নেই। রক্তপাত করবার জন্য সবাই ওৎ পেতে আছে; প্রত্যেকে তার নিজের জালে অন্যকে আট্‌কাতে চায়। অন্যায় কাজ করতে তাদের দু’হাতই পাকা। নেতারা উপহার দাবি করে, বিচারকেরা ঘুষ খায়, বড় লোকেরা যা চায় তা জানিয়ে দেয়; তারা সবাই একসংগে ষড়যন্ত্র করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল লোকেরা কাঁটাঝোপের মত, সবচেয়ে সৎ লোকেরা কাঁটা গাছের বেড়ার চেয়েও খারাপ। তোমাদের পাহারাদারদের ঘোষণা করা দিন, তোমাদের শাস্তির দিন এসে পড়েছে। এখনই তোমাদের বুদ্ধিহারা হওয়ার সময়। কোন প্রতিবেশীর উপর ভরসা কোরো না, কোন বন্ধুর উপর বিশ্বাস স্থাপন কোরো না; এমন কি, যে স্ত্রী তোমার বুকের মধ্যে শুয়ে থাকে তার কাছে কথা বলতে সাবধান হোয়ো, কারণ ছেলে বাবাকে তুচ্ছ করবে, মেয়ে মায়ের বিরুদ্ধে ও ছেলের স্ত্রী শ্বাশুড়ীর বিরুদ্ধে উঠবে। একজন মানুষের নিজের পরিবারের লোকেরাই তার শত্রু হবে। কিন্তু আমি মাবুদের উপর আশা রাখব, আমার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌র জন্য অপেক্ষা করব। আমার আল্লাহ্‌ আমার কথা শুনবেন। হে আমাদের শত্রু, আমাদের দুর্দশা দেখে আনন্দ কোরো না। আমরা পড়ে গেলেও আবার উঠব। অন্ধকারে বসে থাকলেও মাবুদ হবেন আমাদের আলো। এখন আমরা মাবুদের রাগ বহন করছি, কারণ আমরা তাঁর বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি, কিন্তু শেষে তিনি আমাদের পক্ষে কথা বলে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি আমাদের আলোতে বের করে আনবেন আর আমরা তাঁর ন্যায়বিচার দেখতে পাব। তখন আমাদের শত্রুরা তা দেখে ভীষণ লজ্জিত হবে। তারা তো আমাদের বলত, “তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ কোথায়?” কিন্তু আমাদের চোখ তাদের পতন দেখবে; এমন কি, রাস্তার কাদার মত তাদের পায়ে মাড়ানো হবে। হে জেরুজালেম, সেই সময় তোমার দেয়াল গেঁথে তোলা হবে, তোমার সীমানা বাড়ানো হবে। সেই সময় আশেরিয়া ও মিসরের শহরগুলো থেকে লোকেরা তোমার কাছে আসবে; এমন কি, মিসর থেকে ফোরাত নদী, এক সাগর থেকে আর এক সাগর ও এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড় পর্যন্ত লোকেরা আসবে। দুনিয়াতে বাসকারীদের দুষ্টতার ফলে দুনিয়া জনশূন্য হবে। হে মাবুদ, তুমি মুগুর হাতে তোমার বান্দাদের রাখালের মত চরাও। তারা তো তোমার নিজের পাল। তাদের চারদিকে উর্বর চারণ ভূমি থাকলেও তারা একা মরুভূমিতে বাস করছে। অনেক দিন আগে যেমন চরত তেমনি করে তারা যেন বাশন ও গিলিয়দে চরে বেড়াতে পারে। মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার দিনগুলোর মত করে তুমি আমাদের অলৌকিক চিহ্ন দেখাও। জাতিরা শক্তিশালী হলেও তোমার কাজ দেখে লজ্জিত হোক। তারা মুখে হাত দিক আর কান বন্ধ করে রাখুক। তারা সাপ ও অন্যান্য বুকে-হাঁটা প্রাণীদের মত ধুলা চাটুক। তাদের কেল্লা থেকে তারা কাঁপতে কাঁপতে তোমার কাছে, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে বের হয়ে আসুক এবং তোমাকে ভয় করুক। তোমার মত আল্লাহ্‌ আর কেউ নেই যিনি তাঁর বেঁচে থাকা লোকদের গুনাহ্‌ ও অন্যায় মাফ করে দেন। তুমি চিরকাল রাগ পুষে রাখ না বরং তোমার অটল মহব্বত দেখাতে আনন্দ পাও। তুমি আবার আমাদের উপর মমতা করবে; তুমি আমাদের সব গুনাহ্‌ পায়ের তলায় মাড়াবে এবং আমাদের সব অন্যায় সাগরের গভীর পানিতে ফেলে দেবে। অনেক অনেক দিন আগে তুমি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যেমন কসম খেয়েছিলে তেমনিভাবেই তুমি ইব্রাহিম ও ইয়াকুবের বংশের কাছে বিশ্বস্ত থাকবে এবং তোমার অটল মহব্বত দেখাবে। নিনেভে সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র কালাম। ইল্‌কোশ গ্রামের নাহূম যে দর্শন পেয়েছিলেন তা এখানে লেখা আছে। মাবুদ এমন আল্লাহ্‌ যিনি তাঁর পাওনা এবাদত চান ও প্রতিফল দেন; মাবুদ প্রতিশোধ নেন ও তিনি রাগে পরিপূর্ণ। মাবুদ তাঁর বিপক্ষদের উপরে প্রতিশোধ নেন এবং তাঁর শত্রুদের জন্য তাঁর রাগ জমা করে রাখেন। মাবুদ সহজে রাগ করেন না এবং তিনি কুদরতে মহান; দোষীকে তিনি শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেন না। তাঁর পথ ঘূর্ণিবাতাস ও ঝড়ের মধ্যে থাকে, আর মেঘ হল তাঁর পায়ের ধুলা। তিনি সমুদ্রকে ধমক দিয়ে শুকিয়ে ফেলেন; সমস্ত নদীগুলোকে তিনি পানিশূন্য করে দেন। বাশন আর কর্মিল শুকিয়ে যায় আর লেবাননের সব ফুল ্নান হয়ে যায়। বড় বড় পাহাড় তাঁর সামনে কাঁপে আর ছোট ছোট পাহাড়গুলো গলে যায়। তাঁর উপস্থিতিতে দুনিয়া ও তার মধ্যে বাসকারী সকলে কাঁপে। তাঁর রাগের সামনে কে টিকে থাকতে পারে? কে সহ্য করতে পারে তাঁর ভয়ংকর গজব? তাঁর রাগ আগুনের মত জ্বলে; তাঁর সামনে বড় বড় পাথর টুকরা টুকরা হয়ে যায়। মাবুদ মেহেরবান, কষ্টের সময়ের আশ্রয়স্থান। যারা তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয় তিনি তাদের দেখাশোনা করেন। কিন্তু তিনি ডুবিয়ে দেওয়া বন্যা দিয়ে নিনেভে শহর একেবারে মুছে ফেলবেন; তাঁর বিপক্ষদের তিনি অন্ধকারে তাড়া করবেন। হে নিনেভের লোকেরা, মাবুদের বিরুদ্ধে তোমরা যে কোন ষড়যন্ত্র কর না কেন তা তিনি বিফল করে দেবেন; তোমরা কাউকে আর কষ্ট দিতে পারবে না। তোমরা কাঁটার মধ্যে জড়িয়ে যাবে এবং মদানো রস খেয়ে মাতাল হবে; তোমরা নাড়ার মত পুড়ে যাবে। তোমাদের মধ্য থেকে এমন একজন বের হয়ে এসেছে যে মাবুদের বিরুদ্ধে কুমতলব করছে ও খারাপীর পরামর্শ দিচ্ছে। মাবুদ বলছেন, “হে এহুদা, যদিও আশেরীয়রা শক্তিতে পূর্ণ এবং অসংখ্য তবুও তাদের মেরে ফেলা হবে। আমি তোমাকে দুঃখ দিয়েছি সত্যি, কিন্তু আর দুঃখ দেব না। এখন আমি তোমার কাঁধ থেকে তাদের জোয়াল ভেংগে দেব এবং তোমার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলব।” হে নিনেভে, মাবুদ তোমার বিষয়ে বলছেন, “তোমার নাম রক্ষা করবার জন্য তোমার মধ্যে কোন লোক থাকবে না। তোমার দেব-দেবীর মন্দিরে যে সব প্রতিমা ও মূর্তি রয়েছে সেগুলো আমি ধ্বংস করে ফেলব। তুমি অপদার্থ বলে আমি তোমার কবর প্রস্তুত করব।” যে লোক সুখবর নিয়ে আসে ও শান্তি ঘোষণা করে, ঐ দেখ, পাহাড়-পর্বতের উপরে তার পা। হে এহুদা, তোমার ঈদগুলো পালন কর এবং মানত সব পূর্ণ কর। দুষ্টেরা আর তোমাকে আক্রমণ করবে না; তাদের একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হবে। হে নিনেভে, যে লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় সে তোমার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসছে। কেল্লার উপরে তোমার সৈন্য সাজাও, রাস্তা পাহারা দাও, কোমর বেঁধে নাও, তোমার সৈন্যদল প্রস্তুত রাখ। যদিও ধ্বংসকারীরা ইসরাইলকে জনশূন্য করেছে এবং তার আংগুর ক্ষেতগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে তবুও মাবুদ এখন ইয়াকুবের, অর্থাৎ ইসরাইলের আগের জাঁকজমক ফিরিয়ে দেবেন। শত্রু-সৈন্যদের ঢাল লাল রংয়ের আর যোদ্ধাদের পরনে টক্‌টকে লাল রংয়ের পোশাক। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে; তাদের রথগুলোর লোহা ঝক্‌মক করছে; তারা বর্শা ঘুরাচ্ছে; তাদের সব রথ রাস্তায় রাস্তায় ঝড়ের মত চলছে আর শহরের খোলা জায়গাগুলোর মধ্য দিয়ে বেপরোয়া ভাবে এদিক ওদিক যাচ্ছে। সেগুলো দেখতে জ্বলন্ত মশালের মত; সেগুলো বিদ্যুতের মত ছুটে যাচ্ছে। বাদশাহ্‌ তাঁর সেনাপতিদের ডাকছেন; তারা পথে উচোট খেয়েও এগিয়ে যাচ্ছে। তারা শহরের দেয়ালের কাছে ছুটে যাচ্ছে; তারা দেয়াল ভাংগার যন্ত্র বসাচ্ছে। নদীর বাঁধের দরজাগুলো ভেংগে পড়ছে আর রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাণীর কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর বাঁদীরা ঘুঘুর ডাকের মত বিলাপ করছে এবং বুক চাপড়াচ্ছে। নিনেভে একটা বাঁধ-ভাংগা পুকুরের মত যার পানি বের হয়ে যাচ্ছে। সে “থাম, থাম,” বলে চিৎকার করছে কিন্তু তার লোকেরা কেউ পিছন ফিরছে না। তার রূপা লুট কর, সোনা লুট কর। এই সব জিনিস অফুরন্ত; এগুলো তার সব ধনভাণ্ডারের ধন-সম্পদ। তাকে লুট করা হচ্ছে, খালি করা হচ্ছে ও ধ্বংস করা হচ্ছে। তার লোকদের দিল গলে গেছে, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লাগছে; তাদের কোমরে আর জোর নেই, তাদের প্রত্যেকজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সেই সিংহদের গর্ত এখন কোথায়, যেখানে তারা তাদের বাচ্চাদের খাওয়াত, যেখানে সিংহ, সিংহী ও তাদের বাচ্চারা নির্ভয়ে থাকত? সিংহ তার বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট পশু মারত আর তার সিংহীদের জন্য গলা টিপে মারত অনেক পশু; সে তার মেরে ফেলা পশু দিয়ে তার বাসস্থান আর ছিঁড়ে ফেলা পশু দিয়ে তার গর্ত ভরত। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হে নিনেভে, আমি তোমার বিরুদ্ধে; আমি তোমার রথগুলো পুড়িয়ে ফেলব, আর তলোয়ার তোমার যুব সিংহদের গ্রাস করবে। আমি তোমার শিকারের জন্য কোন কিছুই এই দুনিয়াতে ফেলে রাখব না। তোমার সংবাদদাতাদের গলার আওয়াজ আর শোনা যাবে না।” ঘৃণ্য, সেই রক্তপাতের শহর, যেটা মিথ্যা ও লুটের জিনিসে ভরা, যেখানে সব সময় মানুষ-শিকার চলছে। শোন, চাবুকের শব্দ, চাকার ঘড়ঘড় শব্দ; সেখানে ঘোড়া লাফ দিয়ে দিয়ে চলছে; রথ বেপরোয়া ভাবে চলছে; ঘোড়সওয়ারেরা আক্রমণ করছে, তলোয়ার চম্‌কাচ্ছে, বর্শা চক্‌ চক্‌ করছে। দেখ, অনেক আহত লোক আর লাশের ঢিবি, অসংখ্য লাশ, লোকে লাশের উপরে উচোট খাচ্ছে। এই সবই হচ্ছে সেই বেশ্যার অনেক বেশ্যাগিরির জন্য; সে আকর্ষনীয়া এবং নানারকম জাদুর কর্ত্রী। তার বেশ্যার কাজ দিয়ে সে জাতিদের এবং জাদুবিদ্যা দিয়ে লোকদের বন্দী করে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হে নিনেভে, আমি তোমার বিরুদ্ধে; আমি মুখ পর্যন্ত তোমার কাপড় উঠাব। তোমার উলংগতা আমি জাতিদের দেখাব আর রাজ্যগুলোকে দেখাব তোমার লজ্জা। আমি তোমার উপর আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলব, তোমাকে ঘৃণার চোখে দেখব এবং তোমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র করব। লোকে তোমাকে দেখে মুখ ফিরাবে এবং বলবে, ‘নিনেভে ধ্বংস হয়ে গেছে, কে তার জন্য বিলাপ করবে?’ আমি তোমার জন্য কোথায় সান্ত্বনাকারী খুঁজে পাব?” হে নিনেভে, তুমি কি থিব্‌সের চেয়ে ভাল? সে তো নীল নদের ধারে ছিল আর তার চারপাশ ঘিরে ছিল পানি। নদী ছিল তার রক্ষার দেয়াল। ইথিওপিয়া আর মিসর তাকে সীমাহীন শক্তি যোগাত; তার বন্ধুদের মধ্যে ছিল পূট ও লিবিয়া। তবুও তার লোকদের বন্দী করে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকটি রাস্তার মোড়ে তার শিশুদের আছাড় মারা হয়েছিল। তার গণ্যমান্য লোকদের জন্য গুলিবাঁট করে তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হে নিনেভে, তুমিও মাতাল হয়ে ঢলে পড়বে; তুমি শত্রুদের কাছ থেকে লুকাবার জন্য আশ্রয় খুঁজবে। তোমার সমস্ত কেল্লাগুলো পাকা ফলে ভরা ডুমুর গাছের মত; যে কেউ সেগুলো নাড়াবে ডুমুরগুলো তারই মুখে পড়বে। তোমার সৈন্যেরা তো সবাই স্ত্রীলোকের মত। তোমার দেশের দরজাগুলো তোমার শত্রুদের সামনে একেবারে খোলা রয়েছে; আগুন সেগুলোর আগল পুড়িয়ে ফেলেছে। ঘেরাওয়ের সময়ের জন্য তুমি পানি তুলে রাখ, তোমার কেল্লাগুলো শক্তিশালী কর। কাদা দলাই-মলাই কর; চুন ও বালি মিশাও ও ইটের ছাঁচ তৈরী কর। সেখানে আগুন তোমাকে গ্রাস করবে; তলোয়ার তোমাকে কেটে ফেলবে এবং ধ্বংসকারী পংগপালের মত ধ্বংস করে ফেলবে। তুমি ধ্বংসকারী ও ঝাঁকবাঁধা পংগপালের মত সংখ্যায় বেড়ে ওঠো। তোমার ব্যবসায়ীদের সংখ্যা তুমি আসমানের তারার চেয়েও বেশী বাড়িয়েছ, কিন্তু তারা ধ্বংসকারী পংগপালের মত খোলস ছেড়ে উড়ে গেছে। তোমার পাহারাদারেরা ও কর্মচারীরা ঝাঁকবাঁধা পংগপালের ঝাঁকের মত, যারা শীতের দিনে দেয়ালের উপরে বসে থাকে কিন্তু সূর্য উঠলে পর উড়ে যায়, কোথায় যায় কেউ জানে না। হে আশেরিয়ার বাদশাহ্‌, তোমার নেতারা ঘুমাচ্ছে; তোমার রাজকর্মচারীরা শুয়ে আছে। তোমার লোকেরা পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের জমায়েত করবার কেউ নেই। কোন কিছুই তোমার ঘা ভাল করতে পারছে না; তোমার আঘাত সাংঘাতিক। যারা তোমার খবর শুনছে তারা প্রত্যেকেই তোমার পতনে হাততালি দিচ্ছে, কারণ তোমার অশেষ নিষ্ঠুরতা কে না ভোগ করেছে? নবী হাবাক্কুকের উপর দর্শনের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র কালাম নাজেল হয়েছিল। হে মাবুদ, আর কতকাল সাহায্যের জন্য আমি তোমাকে ডাকব আর তুমি শুনবে না? কতকাল “জুলুম চলছে” বলে তোমার কাছে ফরিয়াদ জানাব আর তুমি উদ্ধার করবে না? কেন তুমি আমাকে দুষ্টতা দেখতে বাধ্য করছ? কেন তুমি অন্যায় সহ্য করছ? আমার সামনে ধ্বংস ও জুলুম হচ্ছে আর অনবরত ঝগড়া ও মারামারি চলছে। শরীয়ত শক্তিহীন হয়ে পড়েছে এবং কখনও ন্যায়বিচার হচ্ছে না। সৎ লোকদের চেয়ে দুষ্টদের ক্ষমতা বেশী বলে বিচার উল্টা হচ্ছে। জবাবে মাবুদ বললেন, “তোমরা জাতিদের দিকে চেয়ে দেখ, তাতে তোমরা একেবারে অবাক হবে, কারণ তোমাদের সময়কালেই আমি এমন একটা কিছু করতে যাচ্ছি যার কথা তোমাদের বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না। আমি ব্যাবিলনীয়দের প্রস্তুত করছি; তারা সেই নিষ্ঠুর হঠকারী জাতি, যারা অন্যদের দেশ অধিকার করবার জন্য গোটা দুনিয়ার সব জায়গায় যায়। তাদের দেখে লোকে ভীষণ ভয় পায়। তারা নিজেরাই নিজেদের শরীয়ত তৈরী করে এবং কারও অধীনতা স্বীকার করে না। তাদের ঘোড়াগুলো চিতাবাঘের চেয়েও তাড়াতাড়ি চলে, সেগুলো সন্ধ্যাবেলার নেকড়ে বাঘের চেয়েও ভয়ংকর। তাদের ঘোড়সওয়ারেরা দূর থেকে খুব বেগে আসে; গ্রাস করবার জন্য তারা শকুনের মত তাড়াতাড়ি আসে। তারা সবাই জুলুম করবার জন্যই আসে। তাদের বিরাট দল এগিয়ে আসতে থাকে এবং বালির মত অসংখ্য লোকদের বন্দী করে। তারা বাদশাহ্‌দের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে আর শাসনকর্তাদের টিট্‌কারি দেয়। কেল্লাগুলো দেখে তারা হাসে; তারা দেয়াল পার হবার জন্য পাথরের ঢিবি তৈরী করে সেই কেল্লাগুলো দখল করে নেয়। তারপর তারা বাতাসের মত চলে যায়। সেই লোকেরা দোষী, কারণ তাদের কাছে তাদের শক্তিই হল তাদের দেবতা।” হে আল্লাহ্‌, আমার মাবুদ, আমার আল্লাহ্‌ পাক, তুমি কি চিরস্থায়ী নও? আমরা একেবারে ধ্বংস হব না। হে মাবুদ, আমাদের শাস্তি দেবার জন্যই তুমি ব্যাবিলনীয়দের নিযুক্ত করেছ; হে আশ্রয়-পাহাড়, তুমি আমাদের শায়েস্তা করবার জন্যই তাদের নিযুক্ত করেছ। তুমি এত খাঁটি যে, তুমি খারাপীর দিকে তাকাতে পার না এবং অন্যায় সহ্য করতে পার না। তাহলে তুমি কেমন করে সেই বেঈমানদের ভাল চোখে দেখছ? দুষ্টেরা যখন তাদের চেয়ে ভাল লোকদের গ্রাস করে তখন কেন তুমি চুপ করে থাক? কেন তুমি লোকদের সমুদ্রের মাছ ও বুকে-হাঁটা প্রাণীদের মত শাসনকর্তাহীন অবস্থায় রেখেছ? ব্যাবিলনীয়রা বড়শী দিয়ে তাদের সবাইকে টেনে তোলে কিংবা জাল দিয়ে তাদের ধরে বা টানা-জালে তাদের একত্র করে; আর তাই তারা আনন্দ করে, খুশী হয়। সেইজন্য তারা তাদের জালের উদ্দেশে পশু-উৎসর্গ করে এবং টানা-জালের উদ্দেশে ধূপ জ্বালায়, কারণ তাদের জাল দিয়েই তারা অনেক লাভ করে এবং ভাল ভাল খাবার খায়। তারা কি বারে বারে তাদের জাল খালি করে দয়া না দেখিয়ে জাতিদের ধ্বংস করতেই থাকবে? আমি আমার পাহারা-স্থানে দাঁড়াব, দেয়ালের উপরে জায়গা নেব; তিনি আমাকে কি বলবেন আর আমার নালিশের কি জবাব দেবেন তার জন্য অপেক্ষা করব। তখন জবাবে মাবুদ বললেন, “এই দর্শনের কথা লেখ এবং পাথরের ফলকের উপরে স্পষ্টভাবে খোদাই কর যাতে তা সহজে পড়া যায়, কারণ এই দর্শনের কথা পূর্ণ হবার সময় এখনও বাকী আছে, কিন্তু তা তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছে এবং সেই দর্শন মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। দেরি হলেও তার জন্য অপেক্ষা কর; তা ঠিক সময়ে নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে। তুমি এই কথা লেখ: “অহংকারী ব্যাবিলন সৎ নয়, কিন্তু যাকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় সে তার বিশ্বস্ততার দরুন বেঁচে থাকবে। গর্বে ভরা ব্যাবিলনের সংগে আংগুর-রস বেঈমানী করছে, তাকে অস্থির করে তুলছে। সে কবরের মত লোভী এবং মৃত্যুর মত কখনও তৃপ্ত হয় না; সে সমস্ত জাতিকে নিজের কাছে জমায়েত করে এবং তাদের বন্দী করে নিয়ে যায়। “তারা সবাই তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে আর বলবে, ‘ঘৃণ্য সে, যে অন্যদের জিনিস নিজের জন্য জমা করে এবং জামিনের জিনিস দিয়ে ধনী হয়। আর কত দিন এই রকম চলবে?’ তোমার পাওনাদারেরা কি একদিন হঠাৎ উঠবে না? তারা জেগে উঠে কি তোমাকে কাঁপিয়ে তুলবে না? তখন তুমি হবে তাদের কাছে লুটের মালের মত। তুমি অনেক জাতির ধন-সম্পদ লুট করেছ বলে সেই সব জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা তোমার ধন-সম্পত্তি লুট করবে। এর কারণ হল, তুমি মানুষের রক্তপাত করেছ; তুমি নানা দেশ, শহর ও সেগুলোর মধ্যেকার সমস্ত লোকদের জুলুম করেছ। “জাতিরা বলবে, ‘ঘৃণ্য সে, যে অন্যায় লাভের দ্বারা তার বাসস্থান গড়ে তোলে যাতে সে নিরাপদে থাকতে পারে এবং বিপদের হাত থেকে রক্ষা পায়।’ তুমি অনেক জাতিকে ধ্বংস করে নিজের পরিবারের উপর লজ্জা নিয়ে এসেছ এবং বাঁচবার অধিকার হারিয়ে ফেলেছ। তোমার ঘরের দেয়ালের পাথরগুলো তোমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাবে এবং ঘরের বীমগুলো সেই কথায় সায় দেবে। “জাতিরা বলবে, ‘ঘৃণ্য সে, যে রক্তপাতের দ্বারা শহর গড়ে এবং অন্যায় কাজের দ্বারা গ্রাম স্থাপন করে।’ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন স্থির করেছেন যে, জাতিদের পরিশ্রমের ফল আগুনে পুড়ে যাবে আর তারা মিথ্যাই নিজেদের ক্লান্ত করবে। সমুদ্র যেমন পানিতে ভরা থাকে তেমনি দুনিয়া মাবুদের মহিমার জ্ঞানে পরিপূর্ণ হবে। “জাতিরা বলবে, ‘ঘৃণ্য সে, যে রাগ করে তার প্রতিবেশীদের কড়া মদানো রস খাওয়ায় এবং মাতাল করে তোলে যাতে সে তাদের উলংগতা দেখতে পায়।’ তুমি সম্মানের বদলে লজ্জায় পরিপূর্ণ হবে। এবার তোমার পালা। তুমি মদানো রস খেয়ে উলংগ হও। মাবুদের ডান হাতের গজবের পেয়ালা তোমার দিকে আসছে; অসম্মানে তোমার সম্মান ঢাকা পড়বে। লেবাননের উপর তুমি যে জুলুম করেছ সেই জুলুম সম্পূর্ণভাবে তোমার উপর আসবে এবং সেখানকার পশুদের মেরে ফেলেছ বলে এখন পশুরাই তোমাকে ভয় দেখাবে। তুমি তো মানুষের রক্তপাত করেছ এবং দেশ, শহর ও সেখানকার সমস্ত লোকদের জুলুম করেছ। “প্রতিমার কোন মূল্য নেই, কারণ মানুষই তো তাকে খোদাই করে তৈরী করেছে। ছাঁচে ঢালা মূর্তিরও মূল্য নেই, কারণ তা থেকে মানুষ মিথ্যা শিক্ষা পায়। যে তা তৈরী করে সে কেন তার হাতে গড়া জিনিসের উপর ভরসা করে? সেই মূর্তি তো কথা বলতে পারে না। জাতিরা বলবে, ‘ঘৃণ্য সে, যে কাঠকে জীবিত হতে বলে কিংবা প্রাণহীন পাথরকে জেগে উঠতে বলে।’ সেগুলো কি তাকে শিক্ষা দিতে পারে? সেগুলো তো সোনা আর রূপা দিয়ে মোড়ানো; সেগুলোর মধ্যে শ্বাসবায়ু নেই। কিন্তু মাবুদ তাঁর পবিত্র ঘরে আছেন; সমস্ত দুনিয়া তাঁর সামনে নীরব থাকুক।” নবী হাবাক্কুকের ছন্দে বাঁধা মুনাজাত। হে মাবুদ, আমি তোমার কাজের কথা শুনে ভয় পেলাম। হে মাবুদ, আমাদের কালে সেগুলো তুমি আবার কর; আমাদের সময়ে তুমি সেগুলো দেখাও। রাগের সময় তুমি মমতা করবার কথা ভুলে যেয়ো না। আল্লাহ্‌ তৈমন থেকে আসছেন, আল্লাহ্‌ পাক পারণ পাহাড় থেকে আসছেন। [সেলা] তাঁর মহিমা আসমান ছেয়ে যায়; দুনিয়া তাঁর প্রশংসায় পরিপূর্ণ। সূর্যের মতই তাঁর উজ্জ্বলতা; তাঁর হাত থেকে আলো ঠিক্‌রে পড়ে, সেখানে তাঁর শক্তি লুকানো আছে। তাঁর আগে আগে যাচ্ছে মহামারী; তাঁর পিছনে পিছনে চলছে রোগ। তিনি দাঁড়িয়ে দুনিয়াকে নাড়া দিচ্ছেন; তিনি তাকিয়ে জাতিদের কাঁপিয়ে তুলছেন। পুরানো দিনের পাহাড়-পর্বত টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে আর পুরানো যুগের পাহাড়গুলো ভেংগে পড়ছে। অনন্তকাল থেকে তার পথের কোন পরিবর্তন নেই। আমি কূশনের লোকগুলোকে দুর্দশার মধ্যে দেখলাম, আর দেখলাম মাদিয়ানের বাসিন্দারা কাঁপছে। হে মাবুদ, নদীগুলোর উপর কি তুমি রাগ করেছ? তোমার গজব কি নদীগুলোর উপর পড়েছে? তুমি কি সাগরের উপর ভীষণ বিরক্ত হয়েছ? সেজন্যই কি তুমি তোমার ঘোড়াগুলোতে আর তোমার বিজয়ী রথগুলোতে চড়ে বেড়া"ছ? তোমার ধনুক তুমি তুলে নিলে আর তোমার কালাম অনুসারে শাস্তি দেবার জন্য লাঠিগুলো কসম খেয়েছে। সেলা তুমি দুনিয়াকে ভাগ করে দিলে নদনদী দিয়ে। পাহাড়-পর্বত তোমাকে দেখে কেঁপে উঠল। ভীষণ পানির স্রোত বয়ে গেল; গভীর পানি গর্জন করে উঠল আর তার ঢেউগুলো উপরে তুলল। তোমার উড়ন্ত তীরের ঝল্‌কানিতে আর বিদ্যুতের মত তোমার বর্শার চম্‌কানিতে আসমানে সূর্য ও চাঁদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ক্রোধে তুমি দুনিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলে আর রাগে জাতিদের পায়ে মাড়ালে। তোমার বান্দাদের উদ্ধার করতে, তোমার অভিষিক্ত লোককে রক্ষা করতে তুমি বের হয়ে আসলে। তুমি দুষ্টদের দেশের নেতাকে আঘাত করলে, তার দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিলে। [সেলা] যখন তার যোদ্ধারা আমাদের ছড়িয়ে দেবার জন্য ভীষণভাবে আক্রমণ করল, তখন তারা তাদের মতই আনন্দ করছিল যারা গোপনে দুঃখীদের গ্রাস করে আনন্দ পায়। কিন্তু তুমি তাদের নেতাকে তারই বর্শা দিয়ে বিঁধলে। তোমার পরিচালনায় ঘোড়াগুলো সাগর মাড়িয়ে গেল আর মহাজলের রাশিকে তোলপাড় করল। সেই শব্দ শুনে আমি কাঁপতে লাগলাম, আমার ঠোঁটও কেঁপে উঠল; আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম আর আমার পা কাঁপতে লাগল। তবুও আমি সেদিনের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব যেদিন আমাদের আক্রমণকারীদের উপর বিপদ আসবে। যদিও ডুমুর গাছে কুঁড়ি ধরবে না আর আংগুর লতায় থাকবে না কোন আংগুর, যদিও জলপাই গাছে ফল ধরবে না আর ক্ষেতে জন্মাবে না খাবারের জন্য কোন শস্য, যদিও ভেড়ার খোঁয়াড়ে থাকবে না ভেড়া আর গোয়াল ঘরে থাকবে না গরু, তবুও আমি মাবুদকে নিয়ে আনন্দ করব, আমার উদ্ধারকর্তা আল্লাহ্‌কে নিয়ে খুশী হব। আল্লাহ্‌ মালিকই আমার শক্তি; তিনি আমার পা হরিণীর পায়ের মত করেন আর আমাকে উঁচু উঁচু জায়গায় যাবার ক্ষমতা দেন। কাওয়ালী পরিচালকের জন্য। আমার নির্দেশ অনুসারে তারের বাজনাগুলোর সংগে গাইতে হবে। আমোনের ছেলে এহুদার বাদশাহ্‌ ইউসিয়ার রাজত্বের সময়ে কূশির ছেলে সফনিয়ের উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। কূশি ছিলেন গদলিয়ের ছেলে, গদলিয় অমরিয়ের ছেলে, অমরিয় বাদশাহ্‌ হিষ্কিয়ের ছেলে। মাবুদ বলছেন, “আমি দুনিয়ার বুক থেকে সব কিছুই শেষ করে দেব। মানুষ ও পশু, আকাশের পাখী ও সাগরের মাছ আমি শেষ করে দেব। আমি দুষ্টদের পতন ঘটাব। দুনিয়ার উপর থেকে আমি মানুষকে ধ্বংস করে দেব। “এহুদার বিরুদ্ধে এবং জেরুজালেমে বাসকারী সকলের বিরুদ্ধে আমি আমার হাত উঠাব। আমি এই দেশ থেকে বাল দেবতার পূজার সমস্ত কিছু এবং মূর্তিপূজাকারী নানান পদের পুরোহিতদের শেষ করে ফেলব। যারা আসমানের সব তারাগুলোর পূজা করবার জন্য ছাদের উপরে উঠে প্রণাম করে এবং যারা মাবুদের উদ্দেশে সেজদা করে কসম খাওয়ার পরে মিল্‌কম দেবতার নামেও কসম খায় তাদের আমি ধ্বংস করে ফেলব। যারা মাবুদের পিছনে চলা থেকে ফিরে গেছে এবং তাঁর ইচ্ছামত চলে না ও তাঁর ইচ্ছা জানতেও চায় না তাদের আমি শেষ করে দেব।” তোমরা আল্লাহ্‌ মালিকের সামনে নীরব হও, কারণ মাবুদের দিন কাছে এসে গেছে। মাবুদ একটা কোরবানীর আয়োজন করেছেন; তিনি যাদের দাওয়াত করেছেন তাদের পাক-পবিত্র করেছেন। মাবুদ বলছেন, “আমার সেই কোরবানীর দিনে আমি রাজকর্মচারীদের, বাদশাহ্‌র ছেলেদের এবং বিদেশী কাপড় পরা সমস্ত লোকদের শাস্তি দেব। যারা লাফ দিয়ে চৌকাঠ পার হয় এবং জুলুম ও ছলনা দ্বারা তাদের দেব-দেবীর ঘর পূর্ণ করে সেই দিনে আমি তাদের শাস্তি দেব।” মাবুদ আরও বলছেন, “সেই দিন মাছ-দরজার কাছ থেকে কান্নার শব্দ, শহরের দ্বিতীয় অংশ থেকে বিলাপের শব্দ এবং পাহাড়গুলোর দিক থেকে ভেংগে পড়বার জোর শব্দ শোনা যাবে। হে মক্তেশের বাসিন্দারা, তোমরা বিলাপ কর, কারণ তোমাদের সব ব্যবসায়ীদের ও টাকা-পয়সা লেনদেনকারীদের মুছে ফেলা হবে। সেই সময়ে আমি বাতি নিয়ে জেরুজালেমের সব জায়গায় খোঁজ করব এবং যারা নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে আর বলে, ‘মাবুদ ভাল-মন্দ কিছুই করবেন না,’ তাদের আমি শাস্তি দেব। তাদের ধন-সম্পদ লুট করা হবে এবং তাদের বাড়ী-ঘর ধ্বংস হবে। তারা ঘর-বাড়ী তৈরী করবে কিন্তু তাতে বাস করতে পারবে না; তারা আংগুর ক্ষেত করবে কিন্তু আংগুর-রস খেতে পারবে না।” মাবুদের সেই মহা দিন কাছে এসে গেছে এবং তাড়াতাড়ি আসছে। ঐ শোন, মাবুদের দিনের শব্দ! তখন যোদ্ধারা যন্ত্রণায় চিৎকার করবে। সেই দিনটা হবে রাগের দিন, দারুণ দুর্দশা ও মনের কষ্টের দিন, বিপদ ও ধ্বংসের দিন, গাঢ় অন্ধকারের দিন, মেঘ ও ঘন কালোর দিন। সেটা হবে দেয়াল-ঘেরা সব শহরের বিরুদ্ধে ও কোণের সব উঁচু পাহারা-ঘরের বিরুদ্ধে শিংগার আওয়াজ ও যুদ্ধের হাঁকের দিন। লোকদের উপরে মাবুদ দারুণ কষ্ট আনবেন যার জন্য তারা অন্ধ লোকদের মত হাঁটবে, কারণ মাবুদের বিরুদ্ধে তারা গুনাহ্‌ করেছে। তাদের রক্ত ধুলার মত ফেলে দেওয়া হবে ও তাদের লাশ গোবরের মত পড়ে থাকবে। মাবুদের রাগের দিনে তাদের সোনা-রূপাও তাদের রক্ষা করতে পারবে না। তাঁর অন্তরের জ্বালার আগুনে সমস্ত দুনিয়া পুড়ে যাবে, কারণ দুনিয়াতে বাসকারী সকলকে তিনি হঠাৎ শেষ করে দেবেন, জ্বী, ভীষণভাবে শেষ করে দেবেন। হে লজ্জাহীন জাতি, তোমরা একত্র হও, একসংগে জমায়েত হও। সেই দিন তুষের মত উড়ে আসছে; সেইজন্য নির্দিষ্ট সময় আসবার আগে, মাবুদের জ্বলন্ত রাগ তোমাদের উপরে আসবার আগে, তাঁর গজব তোমাদের উপরে পড়বার আগে তোমরা একসংগে জমায়েত হও। হে দেশের সব নম্র লোকেরা, তোমরা যারা মাবুদের হুকুমমত কাজ কর, তোমরা তাঁর ইচ্ছামত ন্যায়ভাবে ও নম্রভাবে চল; তাহলে মাবুদের রাগের দিনে হয়তো তোমরা আশ্রয় পাবে। গাজা জনশূন্য হবে আর অস্কিলোন ধ্বংসস্থান হয়ে পড়ে থাকবে। দিনের বেলাতেই অস্‌দোদের লোকদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে আর ইক্রোণকে উপ্‌ড়ে ফেলা হবে। হে করেথীয় লোকেরা, তোমরা যারা সমুদ্রের ধারে বাস কর, ঘৃণ্য তোমরা! হে ফিলিস্তিনীদের দেশ কেনান, তোমার বিরুদ্ধে রয়েছে মাবুদের এই কালাম, “আমি তোমাকে এমনভাবে ধ্বংস করব যে, তোমার মধ্যে কেউ থাকবে না।” সাগরের কিনারার এলাকা হবে চারণ ভূমি; সেখানে থাকবে রাখালের গুহা ও ভেড়ার খোঁয়াড়। সেই এলাকা এহুদার বংশের বেঁচে থাকা লোকদের অধিকারে থাকবে; সেখানে তারা পাল চরাবার জায়গা পাবে। সন্ধ্যাবেলায় তারা অস্কিলোনের বাড়ী-ঘরে শুয়ে থাকবে। তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাদের দেখাশোনা করবেন; তিনি তাদের অবস্থা ফিরাবেন। তাদের অহংকারের জন্য তারা এই ফল পাবে, কারণ তারা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের বান্দাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে ও তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের বড় করে তুলেছে। মাবুদ তাদের কাছে ভীষণ ভয়ের কারণ হবেন; তিনি দুনিয়ার সমস্ত দেব-দেবীকে শক্তিহীন করবেন। তখন দূর দেশের সব জাতির লোকেরা নিজের নিজের দেশে থেকে তাঁর এবাদত করবে। মাবুদ বলছেন, “হে ইথিওপীয়রা, তোমরাও আমার তলোয়ারের আঘাতে মারা পড়বে।” মাবুদ উত্তর দিকের বিরুদ্ধে হাত বাড়িয়ে আশেরিয়া দেশ ধ্বংস করবেন এবং নিনেভে শহরকে একেবারে জনশূন্য ও মরুভূমির মত শুকনা করে দেবেন। সেখানে গরু ও ভেড়ার পাল এবং সব জাতের প্রাণী শুয়ে থাকবে। মরু-পেঁচা ও ভূতুম পেঁচা তার থামগুলোর উপরে ঘুমাবে, আর জানালার মধ্য দিয়ে তাদের ডাক শোনা যাবে। ঘর-বাড়ীগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাবে আর সেগুলোর এরস গাছের তক্তা লুট হয়ে যাবে। এটাই সেই নিশ্চিন্তে থাকা শহর যে নিরাপদে আছে। সে মনে মনে বলে, “আমিই আছি, আমি ছাড়া আর কেউ নেই।” সে কেমন ধ্বংস হয়ে গেল, বুনো পশুদের আশ্রয়স্থান হল! যারা তার পাশ দিয়ে যাবে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে এবং তাদের বুড়ো আংগুল দেখাবে। ঘৃণ্য সেই জুলুমবাজ, বিদ্রোহী ও নাপাক শহর! সে কাউকে মানে না, শাসনও গ্রাহ্য করে না। মাবুদের উপর সে ভরসা করে না, তার আল্লাহ্‌র কাছে যায় না। তার রাজকর্মচারীরা যেন গর্জনকারী সিংহ আর শাসনকর্তারা সন্ধ্যাবেলার নেকড়ে বাঘ; তারা সকালের জন্য কিছুই ফেলে রাখে না। তার নবীরা হঠকারী ও বেঈমান। তার ইমামেরা পবিত্রকে অপবিত্র করে এবং শরীয়তের বিরুদ্ধে কাজ করে। তার মধ্যে বাসকারী মাবুদ ন্যায়বান; তিনি কোন অন্যায় করেন না। প্রতিদিন সকালে তিনি ন্যায়বিচার করেন; তা করতে তিনি ভুল করেন না। কিন্তু অন্যায়কারীদের লজ্জা নেই। মাবুদ বলছেন, “আমি জাতিদের শেষ করে দিয়েছি; তাদের উঁচু পাহারা-ঘরগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি তাদের রাস্তাগুলো জনশূন্য করেছি; কেউ সেগুলো দিয়ে আর যায় না। তাদের সব শহর ধ্বংস হয়ে গেছে; সেখানে কেউ নেই, কেউ বাস করে না। আমি জেরুজালেমকে বললাম, ‘এখন তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভয় করবে এবং আমার শাসন মানবে।’ তাহলে তার বাসস্থান নষ্ট করা হবে না, আমার সব শাস্তিও তার উপরে আসবে না। কিন্তু তার লোকেরা আগ্রহের সংগে খারাপ কাজ করতে থাকল। “হে জেরুজালেম, তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর; যেদিন আমি জাতিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্য উঠে দাঁড়াব তুমি সেই দিনের জন্য অপেক্ষা কর। আমি ঠিক করেছি যে, জাতিদের আমি জমায়েত করব, রাজ্যগুলো একত্র করব এবং তাদের উপর আমার গজব, আমার জ্বলন্ত রাগ ঢেলে দেব। আমার দিলের জ্বালার আগুনে গোটা দুনিয়া পুড়ে যাবে। তারপর আমি জাতিদের মুখ পাক-সাফ করব যাতে তারা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমার এবাদত করতে পারে। ইথিওপিয়া দেশের নদীগুলোর ওপার থেকে আমার এবাদতকারীরা, আমার ছড়িয়ে পড়া বান্দারা আমার উদ্দেশে কোরবানীর জিনিস নিয়ে আসবে। তুমি আমার প্রতি যে সব অন্যায় করেছ তার জন্য তুমি সেই দিন লজ্জিত হবে না, কারণ এই শহর থেকে আমি সব অহংকারী ও গর্বিত লোকদের বের করে দেব। আমার পবিত্র পাহাড়ের উপরে তুমি আর কখনও গর্ব করবে না। যারা মাবুদের উপর ভরসা করে সেই রকম নত ও নম্র লোকদের আমি তোমার মধ্যে বাকী রাখব। ইসরাইলের সেই বাকী লোকেরা অন্যায় করবে না; তারা মিথ্যা কথা বলবে না এবং তাদের মুখে ছলনা থাকবে না। তারা খেয়ে নিরাপদে ঘুমাবে, কেউ তাদের ভয় দেখাবে না।” হে সিয়োন্তকন্যা, কাওয়ালী গাও; হে ইসরাইল, জয়ধ্বনি কর; হে জেরুজালেম-কন্যা, তুমি খুশী হও ও তোমার সমস্ত দিল দিয়ে আনন্দ কর। মাবুদ তোমার শাস্তি দূর করে দিয়েছেন, তিনি তোমার শত্রুকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ইসরাইলের বাদশাহ্‌ মাবুদ তোমার মধ্যে রয়েছেন; তুমি আর কখনও বিপদের ভয় করবে না। সেই দিন তোমাকে বলা হবে, “হে সিয়োন, তুমি ভয় কোরো না, তুমি নিরাশ হোয়ো না। তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমার মধ্যে আছেন, তাঁর রক্ষা করবার শক্তি আছে। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে খুব আনন্দিত হবেন, আর তাঁর গভীর মহব্বতের তৃপ্তিতে তিনি নীরব হবেন। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে আনন্দ-কাওয়ালী গাইবেন।” মাবুদ বলছেন, “নির্দিষ্ট ঈদ পালন করতে না পেরে তোমার যে লোকেরা দুঃখ করছে তাদের আমি একত্র করব। তারা তো অসম্মানের বোঝা বহন করছে। যারা তোমার উপর জুলুম করে তাদের সবাইকে আমি সেই সময় শাস্তি দেব; আমি খোঁড়াদের উদ্ধার করব এবং যারা ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের জমায়েত করব। তাদের লজ্জার বদলে আমি তাদের সারা দুনিয়াতে প্রশংসা ও গৌরব দান করব। হে জেরুজালেমের লোকেরা, সেই সময়ে আমি তোমাদের নিয়ে এসে জমায়েত করব। আমি যখন তোমাদের অবস্থা ফিরাব তখন দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্যে আমি তোমাদের সম্মান ও গৌরবের পাত্র করব, আর তোমরা তা দেখতে পাবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল ছিলেন এহুদার শাসনকর্তা এবং যিহোষাদকের ছেলে ইউসা ছিলেন মহা-ইমাম। সেই বছরের ষষ্ঠ মাসের প্রথম দিনে মাবুদ নবী হগয়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের বললেন, “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, এই লোকেরা বলে, ‘মাবুদের ঘর তৈরীর সময় এখনও আসে নি।’ ” তখন নবী হগয়ের মধ্য দিয়ে মাবুদ আরও বললেন, “এটা কি ঠিক হচ্ছে যে, তোমরা নিজেরা কারুকাজ করা বাড়ীতে থাকছ আর আমার ঘরটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে? আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, তোমরা কিভাবে চলছ তা ভাল করে চিন্তা করে দেখ। তোমরা অনেক বুনেছ, কিন্তু কাটছ অল্প। তোমরা খেয়ে থাক, কিন্তু কখনও তৃপ্ত হও না। তোমরা আংগুর-রস খেয়ে থাক, কিন্তু যথেষ্ট পাও না। তোমরা কাপড়-চোপড় গায়ে দাও, কিন্তু তাতে শরীর গরম হয় না। তোমরা বেতন পেয়ে ফুটা থলিতে রাখ। কাজেই তোমরা কিভাবে চলছ তা ভাল করে চিন্তা করে দেখ। এবার তোমরা পাহাড়ে উঠে কাঠ নিয়ে এসে বায়তুল-মোকাদ্দস তৈরী কর, যাতে আমি খুশী ও সম্মানিত হই। “তোমরা অনেক ফসল পাবার আশা করেছিলে, কিন্তু অল্পই পেয়েছ। তোমরা যা ঘরে নিয়ে এসেছিলে তা আমি উড়িয়ে দিয়েছি। কেন দিয়েছি? আমার ঘরের জন্যই তা করেছি, কারণ সেই ঘর ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে আর এদিকে তোমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছ। কাজেই তোমাদের জন্য আকাশ তার শিশির পড়া আর জমি ফসল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ক্ষেত-খামার, পাহাড়-পর্বত, শস্য, নতুন আংগুর-রস, তেল ও মাটিতে যা কিছু জন্মায় তার উপরে এবং মানুষ, পশু ও তোমাদের হাতের সব পরিশ্রমের উপরে বৃষ্টি না পড়বার জন্য আমি হুকুম দিয়েছিলাম।” তখন শল্টীয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল, যিহোষাদকের ছেলে মহা-ইমাম ইউসা এবং অন্য সব লোকেরা তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথামত এবং তাঁর পাঠানো নবী হগয়ের কথামত কাজ করল, কারণ তারা মাবুদকে ভয় করতে লাগল। তখন মাবুদ তাঁর সংবাদদাতা হগয়ের মধ্য দিয়ে লোকদের বললেন, “আমি মাবুদ তোমাদের সংগে সংগে আছি।” এর পর মাবুদ এহুদার শাসনকর্তা সরুব্বাবিলের, মহা-ইমাম ইউসার এবং বাকী সব লোকদের অন্তর জাগিয়ে তুললেন। তাতে তারা সবাই এসে তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ঘরের কাজ করতে শুরু করে দিল। সেই কাজ বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরের ষষ্ঠ মাসের চব্বিশ দিনের দিন শুরু হয়েছিল। পরে সপ্তম মাসের একুশ দিনের দিন মাবুদ নবী হগয়কে বললেন, “তুমি শল্টীয়েলের ছেলে এহুদার শাসনকর্তা সরুব্বাবিলকে, যিহোষাদকের ছেলে মহা-ইমাম ইউসাকে এবং বাকী সব লোকদের জিজ্ঞাসা কর, ‘আপনাদের মধ্যে এমন কে আছেন যিনি এই ঘরকে তার আগেকার জাঁকজমকের অবস্থায় দেখেছেন? আর এখন সেটি কেমন দেখছেন? আপনাদের কাছে কি মনে হচ্ছে না যে, আগেকার তুলনায় এটি কিছুই নয়?’ তারপর তুমি তাদের বলবে যে, মাবুদ বলছেন, ‘হে সরুব্বাবিল, তুমি সাহস কর; হে মহা-ইমাম ইউসা, সাহস কর; হে দেশের সমস্ত লোক, তোমরা সাহস কর ও কাজ কর; কারণ আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তোমাদের সংগে সংগে আছি। তোমরা যখন মিসর দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিলে তখন তোমাদের কাছে আমি এই ওয়াদাই করেছিলাম, আর আমার রূহ্‌ এখনও তোমাদের মধ্যে আছেন। তোমরা ভয় কোরো না। “ ‘আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আর অল্পকাল পরে আমি আর একবার আসমান, দুনিয়া, সাগর ও ভূমিকে নাড়া দেব। আমি সমস্ত জাতিদের নাড়া দেব আর তাতে তারা তাদের ধন-সম্পদ এখানে নিয়ে আসবে। তখন আমি এই ঘর জাঁকজমকে পূর্ণ করব। রূপাও আমার, সোনাও আমার। আগেকার ঘরের জাঁকজমকের চেয়ে এখনকার ঘরের জাঁকজমক আরও বেশী হবে। এই জায়গায় আমি উন্নতি নিয়ে আসব। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।’ ” দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরের নবম মাসের চব্বিশ দিনের দিন মাবুদ নবী হগয়কে বললেন, “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, শরীয়ত সম্বন্ধে তুমি ইমামদের এই কথা জিজ্ঞাসা কর, ‘কোন লোক যদি তার পোশাকের ভাঁজে পবিত্র গোশ্‌ত বহন করে আর সেই কাপড়ের ছোঁয়া কোন রুটি, সিদ্ধ করা খাবার, আংগুর-রস, তেল কিংবা অন্য কোন খাবারে লাগে তবে তা কি পবিত্র হয়ে যায়?’ ” হগয়ের প্রশ্নের জবাবে ইমামেরা বললেন, “জ্বী না, হয় না।” তখন হগয় বললেন, “লাশের ছোঁয়া লেগে নাপাক হয়েছে এমন কোন লোক যদি এর কোন একটা ছোঁয়, তবে সেই জিনিস কি নাপাক হয়ে যাবে?” ইমামেরা জবাব দিলেন, “জ্বী, সেটা নাপাক হয়ে যাবে।” তখন হগয় বললেন, “মাবুদ বলছেন, ‘ঠিক সেইভাবে আমার চোখে এই লোকেরা ও এই জাতি নাপাক। সেইজন্য তারা যা কিছু করে এবং যা কিছু কোরবানী দেয় তা-ও নাপাক। এখন থেকে তোমরা এই বিষয় নিয়ে ভাল করে চিন্তা কর যে, আমার ঘরে যখন একটা পাথরের উপরে আর একটা পাথর ছিল না তখন কি অবস্থা ছিল। কেউ যখন বিশ মণ শস্যের স্তূপের কাছে আসত তখন সেখানে পেত মাত্র দশ মণ। যখন কেউ পঞ্চাশ লিটার আংগুর-রস নেবার জন্য আংগুর-রস রাখা জালার কাছে যেত তখন সেখানে থাকত মাত্র বিশ লিটার। আমি শস্যের শুকিয়ে যাওয়া ও ছাৎলা পড়া রোগ আর শিলাবৃষ্টি দিয়ে তোমাদের হাতের সমস্ত কাজকে আঘাত করেছিলাম, কিন্তু তবুও তোমরা আমার দিকে ফেরো নি। আজ নবম মাসের চব্বিশ দিনের দিন আমার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করা হল। এবার আমি তোমাদের জন্য কি করতে যাচ্ছি তা দেখ। এখন অবশ্য তোমাদের গোলাঘরে কোন বীজ নেই এবং এতদিন আংগুর, ডুমুর, ডালিম ও জলপাই গাছে কম ফল ধরেছে, কিন্তু আজ থেকে আমি তোমাদের দোয়া করব।’ ” সেই একই দিনে মাবুদ হগয়কে আবার বললেন, “তুমি এহুদার শাসনকর্তা সরুব্বাবিলকে বল, ‘আমি আসমান ও জমীনকে নাড়া দেব। আমি বিভিন্ন জাতির বাদশাহ্‌দের সিংহাসন উল্টে ফেলব এবং তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করে দেব। আমি রথ ও তার চালকদের উল্টে ফেলে দেব; ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারেরা প্রত্যেকে তার ভাইয়ের তলোয়ারের আঘাতে মারা পড়বে। হে শল্টীয়েলের ছেলে আমার গোলাম সরুব্বাবিল, আমি মাবুদ সেই দিন তোমাকে নিয়ে আমার সীলমোহরের আংটির মত করব, কারণ আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি।’ আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরের অষ্টম মাসে মাবুদের কালাম নবী জাকারিয়ার উপর নাজেল হল। জাকারিয়া ছিলেন বেরিখিয়ের ছেলে আর বেরিখিয় ইদ্দোর ছেলে। মাবুদ জাকারিয়াকে বললেন, “তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর আমি খুবই রাগ করেছিলাম। সেইজন্য তুমি লোকদের বল যে, আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, ‘তোমরা আমার দিকে ফেরো, তাতে আমিও তোমাদের দিকে ফিরব। তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের মত হোয়ো না। তাদের কাছে আগেকার নবীরা আমার এই কথা ঘোষণা করেছিল যে, তারা যেন তাদের খারাপ পথ ও খারাপ অভ্যাস থেকে ফেরে। কিন্তু তারা তা শোনে নি এবং আমার কথায় মনোযোগও দেয় নি। তোমাদের সেই পূর্বপুরুষেরা এখন কোথায়? আর নবীরা কি চিরকাল বেঁচে থাকে? কিন্তু আমি আমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের যে সব হুকুম দিয়েছিলাম, আমার সেই সব কালাম ও নিয়ম অনুসারে কি তোমাদের পূর্বপুরুষেরা শাস্তি পায় নি? তখন তারা মন ফিরিয়ে বলেছিল যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের আচার-ব্যবহার ও অভ্যাস অনুসারে তাদের প্রতি যা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তিনি তা-ই করেছেন।’ ” দারিয়ুসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরের এগারো মাসের, অর্থাৎ শবাট মাসের চব্বিশ দিনের দিন বেরিখিয়ের ছেলে নবী জাকারিয়ার উপর মাবুদের কালাম নাজেল হল। রাতের বেলায় আমি জাকারিয়া একটা দর্শন পেলাম। আমি দেখলাম, মানুষের মত দেখতে একজন ফেরেশতা লাল ঘোড়ার উপরে চড়ে আছেন। ঘোড়াটা একটা খাদের ভিতরে গুলমেঁদি গাছগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির পিছনে আছে লাল, মেটে ও সাদা রংয়ের কতগুলো ঘোড়া। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হে হুজুর, এগুলো কি?” আর একজন ফেরেশতা যিনি আমার সংগে কথা বলছিলেন জবাবে তিনি বললেন, “ওগুলো কি তা আমি তোমাকে দেখাব।” যিনি গুলমেঁদি গাছগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি আমাকে বললেন, “সারা দুনিয়াতে ঘুরে দেখবার জন্য মাবুদ এগুলোকে পাঠিয়েছেন।” মাবুদের যে ফেরেশতা গুলমেঁদি গাছগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে ঘোড়সওয়ারেরা বলল, “আমরা সারা দুনিয়াতে ঘুরে দেখলাম যে, গোটা দুনিয়াটা নির্ভয়ে ও শান্তিতে রয়েছে।” তখন মাবুদের ফেরেশতা বললেন, “হে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, তুমি জেরুজালেম ও এহুদার অন্যান্য শহরগুলোর উপর এই যে সত্তর বছর রাগ করে রয়েছ তাদের উপর আর কতকাল তুমি মমতা না করে থাকবে?” তখন যে ফেরেশতা আমার সংগে কথা বলছিলেন মাবুদ তাঁকে অনেক মমতার ও সান্ত্বনার কথা বললেন। সেইজন্য সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “তুমি এই কথা ঘোষণা কর যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘জেরুজালেমের জন্য, অর্থাৎ সিয়োনের জন্য আমি অন্তরে খুব জ্বালা বোধ করছি। আমি নিশ্চিন্তে থাকা সেই সব জাতির উপরে ভীষণ রাগ করেছি, কারণ আমি যখন আমার বান্দাদের উপর কেবল একটুখানি রাগ করেছিলাম তখন সেই সব জাতি আমার বান্দাদের দুর্দশার সংগে আরও দুর্দশা যোগ করেছিল। সেইজন্য আমি জেরুজালেমকে মমতা করবার জন্য ফিরে আসব। সেখানে আমার ঘর আবার তৈরী হবে এবং জেরুজালেম শহরকে মেপে আবার গড়ে তোলা হবে। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই ওয়াদা করছি যে, আমার শহরগুলোতে আবার উন্নতি উপ্‌চে পড়বে আর আমি আবার সিয়োনকে সান্ত্বনা দেব এবং আবার জেরুজালেমকে বেছে নেব।’ ” তারপর আমি চোখ তুলে চারটা শিং দেখতে পেলাম। যে ফেরেশতা আমার সংগে কথা বলছিলেন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এগুলো কি?” জবাবে তিনি আমাকে বললেন, “এগুলো সেই শিং যা এহুদা, ইসরাইল ও জেরুজালেমের লোকদের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে।” মাবুদ তারপর আমাকে চারজন মিস্ত্রীকে দেখালেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এরা কি করতে এসেছে?” জবাবে তিনি বললেন, “সেই শিংগুলো হল সেই সব জাতির শক্তি যারা এহুদার লোকদের এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, তারা কেউই মাথা তুলতে পারে নি। সেই সব জাতিকে ভয় দেখাবার জন্য ও তাদের শক্তি ধ্বংস করবার জন্য এই মিস্ত্রীরা এসেছে।” তারপর আমি চোখ তুলে মাপের দড়ি হাতে একজন লোককে দেখতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” জবাবে তিনি আমাকে বললেন, “জেরুজালেম কতটা চওড়া ও কতটা লম্বা তা মেপে দেখতে যাচ্ছি।” যে ফেরেশতা আগে আমার সংগে কথা বলেছিলেন তিনি চলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আর একজন ফেরেশতা তাঁর সংগে দেখা করতে আসলেন। তিনি তাঁকে বললেন, “আপনি দৌড়ে গিয়ে ঐ যুবককে বলুন, ‘জেরুজালেমের মধ্যে মানুষ ও পশু সংখ্যায় বেশী হওয়ার দরুন তাতে কোন দেয়াল থাকবে না। মাবুদ বলছেন যে, তিনি নিজেই তার চারপাশে আগুনের দেয়াল হবেন এবং তিনিই তাঁর মহিমায় সেখানে থাকবেন।’ ” মাবুদ বলছেন, “শোন, শোন। আমি তো চারদিকে তোমাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন তোমরা উত্তর দেশ থেকে পালিয়ে এস। ওহে সিয়োনের লোকেরা, তোমরা যারা ব্যাবিলনে বাস করছ, তোমরা পালিয়ে এস।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর গৌরব প্রকাশ করবার জন্য আমাকে সেই সব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন যারা তোমাদের লুট করেছে। তিনি বলছেন, “যে কেউ তোমাদের ছোঁয় সে আমার চোখের মণি ছোঁয়। আমি তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমার হাত উঠাব, তাতে তাদের গোলামেরা তাদের লুট করবে।” এটা যখন ঘটবে তখন তোমরা বুঝতে পারবে যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই আমাকে পাঠিয়েছেন। মাবুদ বলছেন, “হে সিয়োন্তকন্যা, আনন্দে কাওয়ালী গাও এবং খুশী হও, কারণ আমি আসছি, আর আমি তোমাদের মধ্যে বাস করব। সেই দিন অনেক জাতি আমার সংগে যুক্ত হয়ে আমার বান্দা হবে। আমি তোমাদের মধ্যে বাস করব।” যখন তা ঘটবে তখন তোমরা জানবে যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। পবিত্র দেশে তাঁর সম্পত্তি হিসাবে মাবুদ এহুদা দেশ অধিকার করবেন এবং জেরুজালেমকে আবার বেছে নেবেন। হে সমস্ত মানুষ, তোমরা মাবুদের সামনে নীরব হও, কারণ তিনি বিচার করবার জন্য তাঁর পবিত্র বাসস্থান থেকে বের হয়ে আসছেন। তারপর সেই ফেরেশতা আমাকে দেখালেন মহা-ইমাম ইউসা মাবুদের ফেরেশতার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাঁকে দোষ দেবার জন্য শয়তান তাঁর ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে। মাবুদ শয়তানকে বললেন, “শয়তান, মাবুদ তোমাকে বাধা দিন। জেরুজালেমকে যিনি বেছে নিয়েছেন তিনি তোমাকে বাধা দিন। এই লোকটি কি আগুন থেকে বের করে নেওয়া কাঠ নয়?” তখন ইউসা নোংরা কাপড় পরা অবস্থায় মাবুদের ফেরেশতার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই ফেরেশতা নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য ফেরেশতাদের বললেন, “তার নোংরা কাপড়-চোপড় খুলে ফেল।” তারপর তিনি ইউসাকে বললেন, “দেখ, আমি তোমার গুনাহ্‌ দূর করে দিয়েছি এবং আমি তোমাকে সুন্দর পোশাক পরাব।” তখন আমি বললাম, “তাঁর মাথায় একটা পরিষ্কার পাগড়ী দেওয়া হোক।” সেইজন্য সেই ফেরেশতারা তাঁর মাথায় একটা পরিষ্কার পাগড়ী দিলেন এবং তাঁকে পোশাক পরালেন। তখনও মাবুদের ফেরেশতা তাঁদের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর মাবুদের ফেরেশতা ইউসাকে বললেন, “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তোমাকে বলছেন, ‘তুমি যদি আমার পথে চল ও আমার এবাদত-কাজ কর তাহলে তুমি আমার ঘরের সব কিছু পরিচালনা করবে এবং আমার উঠানের দেখাশোনার ভার পাবে, আর যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছে আমি তাদের মতই আমার সামনে আসবার অধিকার তোমাকে দেব। হে মহা-ইমাম ইউসা, তুমি শোন এবং তোমার সামনে বসে থাকা তোমার সংগী-ইমামেরা শুনুক। আমি যে সেই চারাকে, অর্থাৎ আমার গোলামকে নিয়ে আসব এই ইমামেরা হল তার চিহ্ন। হে ইউসা, আমি তোমার সামনে একটা পাথর রেখেছি। সেই পাথরের উপরে সাতটা চোখ রয়েছে, আর তার উপরে আমি একটা কথা খোদাই করব এবং আমি এক দিনেই এই দেশের গুনাহ্‌ দূর করে দেব। সেই দিন তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের আংগুর লতা ও ডুমুর গাছের তলায় বসবার জন্য তোমাদের প্রতিবেশীকে দাওয়াত করবে। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।’ ” তারপর যে ফেরেশতা আমার সংগে কথা বলছিলেন তিনি ফিরে আসলেন এবং ঘুম থেকে জাগাবার মত করে আমাকে জাগালেন। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “আমি একটা সোনার বাতিদান দেখতে পাচ্ছি যার মাথায় রয়েছে একটা তেলের পাত্র। সেই বাতিদানের উপরে সাতটা বাতি ও প্রত্যেকটি বাতিতে সাতটা সল্‌তে রাখবার জায়গা আছে। সেই বাতিদানের কাছে রয়েছে দু’টা জলপাই গাছ, ডানদিকে একটা ও বাঁদিকে আর একটা।” আমি সেই ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হে হুজুর, এগুলো কি?” জবাবে তিনি আমাকে বললেন, “এগুলো কি তা কি তুমি জান না?” আমি বললাম, “হে হুজুর, আমি জানি না।” তখন তিনি আমাকে বললেন, “মাবুদ সরুব্বাবিলকে এই সংবাদ দিচ্ছেন, ‘শক্তি বা ক্ষমতার দ্বারা নয়, কিন্তু আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি যে, আমার রূহ্‌ দ্বারা তুমি সফল হবে। হে বিরাট পাহাড়, কে তুমি? সরুব্বাবিলের সামনে তুমি হবে সমভূমি। বায়তুল-মোকাদ্দসের শেষ পাথরটা লাগাবার সময় লোকেরা চিৎকার করে বলবে যে, ওটা খুব সুন্দর হয়েছে।’ ” তারপর মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “সরুব্বাবিলের হাত বায়তুল-মোকাদ্দসের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং তারই হাত সেটা শেষ করবে। তখন লোকেরা জানতে পারবে যে, আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই তোমাকে তাদের কাছে পাঠিয়েছি। এতদিন যে সামান্য কাজ হয়েছে তা লোকে তুচ্ছ মনে করেছে। কিন্তু সরুব্বাবিলের হাতে ওলনদড়িটা দেখে লোকেরা আনন্দ করবে।” তারপর আমি শুনলাম, “এই সাতটা বাতি হল মাবুদের চোখ যা সারা দুনিয়া দেখতে পায়।” তখন আমি সেই ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ঐ বাতিদানের ডানে ও বাঁয়ে যে দু’টা জলপাই গাছ আছে সেগুলো কি?” আবার আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ঐ দু’টা জলপাই গাছের ডাল থেকে সোনালী তেল বের হয়ে এসে সোনার বাতিদানের দু’টি সল্‌তে রাখবার জায়গায় পড়েছে। ঐ ডালগুলোর অর্থ কি?” জবাবে তিনি বললেন, “তুমি কি জান না ঐ দু’টার অর্থ কি?” আমি বললাম, “হে হুজুর, আমি জানি না।” তখন তিনি বললেন, “ঐ দু’টা হল সেই দু’জন যারা সমস্ত দুনিয়ার মালিকের এবাদত-কাজ করবার জন্য অভিষিক্ত হয়েছে।” পরে আমি আবার তাকিয়ে দেখতে পেলাম খোলা অবস্থায় একটা গুটানো কিতাব উড়ছে। সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?” জবাবে আমি বললাম, “আমি বিশ হাত লম্বা ও দশ হাত চওড়া একটা উড়ন্ত কিতাব দেখতে পাচ্ছি।” তিনি আমাকে বললেন, “এটা হল সেই বদদোয়া যা সমস্ত দেশে প্রকাশিত হবে। তার একদিকে লেখা কথা অনুসারে সব চোরদের দূর করে দেওয়া হবে আর অন্য দিকের কথা অনুসারে মিথ্যা কসমকারীদেরও দূর করে দেওয়া হবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘আমি সেই বদদোয়া পাঠাব আর তা চোরদের ঘরে ও আমার নামে মিথ্যা কসমকারীদের ঘরে গিয়ে ঢুকবে এবং তা তাদের বাড়ীতে থেকে কাঠ ও পাথর সুদ্ধ বাড়ী ধ্বংস করে ফেলবে।’ ” পরে সেই ফেরেশতা এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, “তুমি উপরে তাকিয়ে দেখ কি আসছে।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা কি?” জবাবে তিনি বললেন, “ওটা একটা মাপের পাত্র।” তিনি আরও বললেন, “ওটা গোটা দেশের অন্যায়কারীদের ছবি।” তারপর সেই পাত্রের সীসার ঢাকনি তোলা হলে পর দেখা গেল একজন স্ত্রীলোক তার মধ্যে বসে আছে। সেই ফেরেশতা বললেন, “এ হল দুষ্টতা।” এই বলে তিনি সেই স্ত্রীলোকটিকে সেই পাত্রের মধ্যে ঠেলে দিয়ে পাত্রের মুখে সীসার ঢাকনিটা চেপে দিলেন। তারপর আমি চোখ তুলে দু’জন স্ত্রীলোককে বাতাসের সংগে উড়ে আসতে দেখলাম। তাদের ডানা ছিল সারস পাখীর ডানার মত আর তারা সেই পাত্রটাকে আকাশে তুলে নিয়ে উড়ে চলে গেল। তখন আমি সেই ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওরা পাত্রটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?” জবাবে তিনি বললেন, “তারা ওটা ব্যাবিলন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে সেই স্ত্রীলোকটার জন্য একটা ঘর তৈরী করা হবে। ঘর তৈরী হলে পর তাকে তার জায়গায় বসানো হবে।” আমি আবার তাকিয়ে চারটা রথ দেখতে পেলাম। সেগুলো দু’টা পাহাড়ের মাঝখান থেকে বের হয়ে আসছিল। সেই পাহাড় দু’টা ছিল ব্রোঞ্জের। প্রথম রথে ছিল সব লাল রংয়ের ঘোড়া, দ্বিতীয়টাতে ছিল সব কালো রংয়ের ঘোড়া, তৃতীয়টাতে ছিল সব সাদা রংয়ের ঘোড়া এবং চতুর্থটাতে ছিল সব নানা রংয়ের ছাপের ঘোড়া; সব ঘোড়াই ছিল শক্তিশালী। আমি সেই ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হে হুজুর, এগুলো কি?” জবাবে তিনি আমাকে বললেন, “এগুলো আসমানের চারটি বায়ু; সমস্ত দুনিয়ার মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবার পরে এগুলো বের হয়ে আসছে। কালো ঘোড়ার রথটা উত্তর দেশের দিকে যাচ্ছে, সাদা ঘোড়ার রথটা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে এবং নানা রংয়ের ছাপের ঘোড়ার রথটা যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে।” শক্তিশালী ঘোড়াগুলো বের হয়ে সারা দুনিয়া ঘুরে দেখবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। তখন সেই ফেরেশতা বললেন, “দুনিয়ার সমস্ত জায়গা ঘুরে দেখ।” কাজেই তারা দুনিয়ার সমস্ত জায়গা ঘুরে দেখতে গেল। তারপর তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “দেখ, যারা উত্তর দেশের দিকে যাচ্ছে তারা আমার রাগ শান্ত করেছে।” পরে মাবুদ আমাকে বললেন, “ব্যাবিলনের বন্দীদশা থেকে ফিরে আসা হিল্‌দয়, টোবিয় ও যিদায়ের কাছ থেকে তুমি সোনা ও রূপা নাও। একই দিনে তুমি সফনিয়ের ছেলে ইউসিয়ার বাড়ীতে যাও। তারপর তুমি সেই সোনা ও রূপা দিয়ে একটা তাজ তৈরী কর এবং সেটা যিহোষাদকের ছেলে মহা-ইমাম ইউসার মাথায় পরিয়ে দাও। তাকে বল যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘এই সেই লোক, যার নাম চারাগাছ; সে নিজের জায়গায় থেকে বেড়ে উঠবে এবং মাবুদের ঘর তৈরী করবে। জ্বী, সে-ই মাবুদের ঘর তৈরী করবে। তাকে বাদশাহ্‌র সম্মান দেওয়া হবে আর সে তার সিংহাসনে বসে শাসন করবে। সে একজন ইমাম হিসাবে সিংহাসনে বসবে এবং তাতে এই দুই পদের মধ্যে কোন অমিল থাকবে না।’ হেলেম, অর্থাৎ হিল্‌দয়, টোবিয়, যিদায় ও সফনিয়ের ছেলে হেনকে, অর্থাৎ ইউসিয়াকে স্মরণ রাখবার চিহ্ন হিসাবে সেই তাজ মাবুদের ঘরের মধ্যে থাকবে। “যারা দূরে আছে তারা এসে মাবুদের ঘর তৈরীর কাজে সাহায্য করবে। তখন তোমরা জানতে পারবে যে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। যদি তোমরা যত্নের সংগে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কালাম পালন কর তবেই এই সব হবে।” বাদশাহ্‌ দারিয়ুসের রাজত্বের চতুর্থ বছরের কিষ্‌লেব নামে নবম মাসের চার দিনের দিন মাবুদের কালাম জাকারিয়ার উপর নাজেল হল। সেই সময় মাবুদের দোয়া চাইবার জন্য বেথেলের লোকেরা শরেৎসরকে, রেগম্মেলককে ও তাদের লোকদের পাঠিয়ে দিল। তারা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ঘরের ইমামদের ও নবীদের এই কথা জিজ্ঞাসা করতে পাঠাল, “আমরা এত বছর যেমন করে এসেছি সেইভাবে কি পঞ্চম মাসে শোক প্রকাশ ও রোজা রাখব?” তখন আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমাকে বললেন, “তুমি দেশের সব লোক ও ইমামদের বল, ‘তোমরা গত সত্তর বছর ধরে পঞ্চম ও সপ্তম মাসে যে শোক প্রকাশ করেছ ও রোজা রেখেছ তা মাবুদের উদ্দেশ্যে কর নি। আর যখন তোমরা খাওয়া-দাওয়া করেছ তখন তা নিজেদের জন্যই করেছ। যখন জেরুজালেম ও তার আশেপাশের শহরগুলোতে লোকজন বাস করছিল ও সেগুলোর অবস্থার উন্নতি হয়েছিল আর নেগেভ ও পশ্চিমের নীচু পাহাড়ী এলাকায় লোকদের বসতি ছিল তখনও মাবুদ এই সব কথা আগেকার নবীদের মধ্য দিয়ে বলেছিলেন।’ ” তোমরা বিধবা, এতিম, বিদেশী ও গরীবদের উপর জুলুম কোরো না; মনে মনে একে অন্যের বিরুদ্ধে কুমতলব কোরো না।’ “কিন্তু তারা তা শুনতে চায় নি; একগুঁয়েমী করে তারা পিছন ফিরে তাদের কান বন্ধ করে রেখেছিল। তারা তাদের অন্তর পাথরের মত শক্ত করেছিল এবং শরীয়ত মানে নি। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আমার রূহ্‌ দ্বারা আগেকার নবীদের মধ্য দিয়ে যে কালাম পাঠিয়েছিলাম তা-ও তারা শোনে নি। কাজেই আমার ভীষণ রাগ জ্বলে উঠেছিল। আমি ডাকলে পর তারা শোনে নি, তাই তারা ডাকলে আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন শুনি নি। আমি অচেনা জাতিদের মধ্যে তাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এর পরে তাদের দেশ এমন জনশূন্য হয়ে পড়েছিল যে, সেখানে কেউ যাওয়া-আসা করত না। এইভাবে তারা সেই সুন্দর দেশটাকে জনশূন্য করেছিল।” পরে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কালাম নাজেল হল। তিনি বললেন, “সিয়োনের জন্য আমার দিলে খুব জ্বালা আছে; আমি তার জন্য আবেগে ভীষণভাবে জ্বলছি। আমি সিয়োনে ফিরে গিয়ে জেরুজালেমে বাস করব। তখন জেরুজালেমকে ‘সত্যের শহর’ এবং আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের পাহাড়কে ‘পবিত্র পাহাড়’ বলা হবে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা আবার জেরুজালেমের খোলা জায়গায় বসে সময় কাটাবে আর বেশী বয়সের দরুন তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকবে। শহরের বিভিন্ন খোলা জায়গায় অনেক ছেলেমেয়ে খেলা করবে। এই সব যে ঘটবে তা এই জাতির বেঁচে থাকা লোকদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা অসম্ভব নয়। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি। আমি আরও বলছি যে, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আমি আমার বান্দাদের উদ্ধার করব। জেরুজালেমে বাস করবার জন্য আমি তাদের ফিরিয়ে আনব। তারা আমারই বান্দা হবে এবং আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব; আমি তাদের প্রতি বিশ্বস্ত ও ন্যায়বান থাকব। “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, আমার ঘর তৈরীর জন্য ভিত্তি স্থাপন করবার সময় নবীরা সেই সব কথা বলেছিল, আর এখন তোমরা সেই একই কথা শুনতে পাচ্ছ; কাজেই তোমরা শক্তিশালী হও। সেই কাজ শুরু করবার আগে কেউ মানুষের বেতন কিংবা পশুর ভাড়া দিতে পারত না। শত্রুর দরুন কেউ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারত না, কারণ আমিই প্রত্যেক জনকে তার প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে উস্‌কে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি এই জাতির বেঁচে থাকা লোকদের সংগে আগেকার মত ব্যবহার করব না। এখন বীজ থেকে গাছ ভালভাবে বেড়ে উঠবে, আংগুর লতায় ফল ধরবে, মাটিতে ফসল জন্মাবে এবং আকাশ থেকে শিশির পড়বে। এই জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা আমার দেওয়া অধিকার হিসাবে এই সব পাবে। হে এহুদা ও ইসরাইল, সমস্ত জাতির লোকেরা আগে তোমাদের নাম বদদোয়া হিসাবে ব্যবহার করত, কিন্তু এখন আমি তোমাদের উদ্ধার করব আর তারা তোমাদের নাম দোয়া হিসাবে ব্যবহার করবে। তোমরা ভয় কোরো না, বরং শক্তিশালী হও। “আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি, তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন আমাকে রাগিয়ে তুলেছিল তখন আমি তাদের উপর বিপদ আনব বলে ঠিক করেছিলাম এবং তা ঘটিয়েও ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আবার জেরুজালেম ও এহুদার উপকার করব বলে ঠিক করেছি। তোমরা ভয় কোরো না। এই সব হুকুম তোমাদের মানতে হবে- তোমরা একে অন্যের কাছে সত্যি কথা বলবে এবং তোমাদের আদালতে ন্যায়বিচার করবে যাতে লোকদের মধ্যে শান্তি হয়; তোমরা কারও বিরুদ্ধে কুমতলব করবে না এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না। আমি মাবুদ এই সব ঘৃণা করি।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আবার আমাকে বললেন, “চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম ও দশম মাসের রোজা এহুদার জন্য আনন্দের, খুশীর ও সুখের ঈদ হয়ে উঠবে। কাজেই তোমরা সত্য ও শান্তি ভালবেসো। “এমন সময় আসবে যখন অনেক জাতি ও অনেক শহরের বাসিন্দারা জেরুজালেমে আসবে; এক শহরের বাসিন্দারা অন্য শহরে গিয়ে বলবে, ‘আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের দোয়া চাইবার জন্য ও তাঁর এবাদত করবার জন্য চল, আমরা এখনই যাই।’ তখন অনেকেই বলবে, ‘আমিও যাব।’ আমার এবাদত করবার জন্য ও আমার দোয়া চাইবার জন্য অনেক লোক ও শক্তিশালী জাতি জেরুজালেমে আসবে। সেই সময়ে নানা ভাষা ও জাতির দশজন লোক একজন ইহুদীর পোশাকের কিনারা ধরে বলবে, ‘চল, আমরা তোমাদের সংগে যাই, কারণ আমরা শুনেছি যে, আল্লাহ্‌ তোমাদেরই সংগে আছেন।’ আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” হদ্রক ও দামেস্কের বিরুদ্ধে মাবুদ যে কালাম নাজেল করেছিলেন তা পূর্ণ হবে। ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর ও অন্য সব মানুষের চোখ মাবুদের উপর রয়েছে। হামা, যেটা হদ্রকের সীমানার কাছে আছে তারও বিরুদ্ধে মাবুদের কালাম পূর্ণ হবে। যদিও টায়ার ও সিডনের লোকেরা খুবই জ্ঞানী, তবুও তাদের বিরুদ্ধে তা পূর্ণ হবে। টায়ার নিজের জন্য একটা কেল্লা তৈরী করেছে এবং ধুলার মত রূপা ও রাস্তার কাদার মত সোনা জড়ো করেছে। কিন্তু দীন-দুনিয়ার মালিক তার সব কিছু দূর করে দেবেন; তার ধন-সম্পদ তিনি সমুদ্রে ফেলে দেবেন আর আগুন সেই শহরকে পুড়িয়ে ফেলবে। অস্কিলোন তা দেখে ভয় পাবে, গাজা যন্ত্রণায় মোচড় খাবে আর ইক্রোণের দশাও তা-ই হবে, কারণ তার আশা পূর্ণ হবে না। গাজা তার বাদশাহ্‌কে হারাবে আর অস্কিলোনে কেউ বাস করবে না। মিশ্র জাতের বংশধরেরা অস্‌দোদে বাস করবে। মাবুদ বলছেন, “ফিলিস্তিনীদের অহংকার আমি শেষ করে দেব। আমি তাদের মুখ থেকে রক্তসুদ্ধ গোশ্‌ত ও অন্যান্য হারাম খাবার বের করব। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা হবে আমার বান্দা; তারা হবে এহুদার একটা বংশের মত এবং ইক্রোণ হবে যিবূষীয়দের মত। আক্রমণকারী সৈন্যদলের হাত থেকে আমি আমার বান্দাদের রক্ষা করব। কোন জুলুমবাজ আর কখনও আমার বান্দাদের কাছে আসবে না, কারণ এখন আমি পাহারা দিচ্ছি। “হে সিয়োন্তকন্যা, খুব আনন্দ কর। হে জেরুজালেম, তুমি জয়ধ্বনি কর। দেখ, তোমার বাদশাহ্‌ তোমার কাছে আসছেন; তিনি ন্যায়বান ও তাঁর কাছে উদ্ধার আছে; তিনি নম্র, তিনি গাধার উপরে, গাধীর বাচ্চার উপরে চড়ে আসছেন। আমি আফরাহীমের রথ ও জেরুজালেমের যুদ্ধের ঘোড়া সব ধ্বংস করব আর যুদ্ধের ধনুক ভেংগে ফেলা হবে। তিনি জাতিদের কাছে শান্তি ঘোষণা করবেন। তাঁর শাসন সাগর থেকে সাগর পর্যন্ত, ফোরাত নদী থেকে দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত চলবে। হে জেরুজালেম, তোমার জন্য আমার ব্যবস্থা স্থাপনের রক্তের দরুন আমি তোমার বন্দীদের সেই পানিশূন্য গর্ত থেকে মুক্ত করে দেব। হে আশায় পূর্ণ বন্দীরা, তোমরা তোমাদের কেল্লায় ফিরে যাও; আজ আমি ওয়াদা করছি যে, আমি তোমাদের দুই গুণ দোয়া করব। আমি এহুদাকে ধনুকের মত আর আফরাহীমকে তীরের মত ব্যবহার করব। হে সিয়োন, আমি তোমার ছেলেদের গ্রীস দেশের ছেলেদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলব এবং তোমাকে যোদ্ধার তলোয়ারের মত করব।” তারপর মাবুদ তাঁর বান্দাদের উপরে প্রকাশিত হবেন; তাঁর তীর বিদ্যুতের মত চম্‌কাবে। আল্লাহ্‌ মালিক শিংগা বাজাবেন আর দক্ষিণের ঝোড়ো বাতাসের মত এগিয়ে যাবেন; আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের রক্ষা করবেন। এতে তারা শত্রুদের ধ্বংস করবে ও তাদের ফিংগার পাথর পায়ে মাড়াবে। তারা আংগুর-রস খাবে এবং মাতালদের মত চিৎকার করবে; কোরবানগাহের কোণাগুলোতে পাত্র থেকে রক্ত ঢালবার মত করে তারা প্রচুর রক্তপাত করবে। সেই দিন তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ ভেড়ার পালের মত করে তাঁর বান্দাদের উদ্ধার করবেন। তারা তাঁর দেশে তাজের মধ্যে মণি-মাণিকের মত ঝক্‌মক্‌ করবে। তাদের চেহারা কত ভাল হবে, কত সুন্দর হবে! শস্য খেয়ে যুবকেরা এবং নতুন আংগুর-রস খেয়ে যুবতীরা সতেজ হয়ে উঠবে। বসন্তকালে বৃষ্টি দেবার জন্য তোমরা মাবুদকে বল; তিনিই বৃষ্টির মেঘ তৈরী করেন। তিনি লোকদের বৃষ্টি দান করেন আর সকলের ক্ষেতে ফসল জন্মান। মূর্তিগুলো ছলনার কথা বলে, গণকেরা মিথ্যা দর্শন দেখে; তারা যে স্বপ্নের কথা বলে তা মিথ্যা, আর তারা মিথ্যাই সান্ত্বনা দেয়। সেইজন্য লোকেরা অত্যাচারিত হয়ে ভেড়ার মত ঘুরে বেড়ায়, কারণ তাদের পালক নেই। মাবুদ বলছেন, “পালকদের বিরুদ্ধে আমার রাগ জ্বলে উঠছে, সেইজন্য আমি নেতাদের শাস্তি দেব। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন নিজের পালের, অর্থাৎ এহুদার লোকদের দেখাশোনা করব এবং যুদ্ধের শক্তিশালী ঘোড়ার মত করে তুলব। এহুদা থেকে কোণার পাথর, তাম্বুর গোঁজ, যুদ্ধের ধনুক ও সমস্ত শাসনকর্তা আসবে। তখন এহুদার লোকেরা এমন শক্তিশালী লোকদের মত হবে যারা যুদ্ধে কাদা-ভরা রাস্তায় শত্রুদের পায়ে মাড়ায়। আমি তাদের সংগে থাকব বলে তারা যুদ্ধ করে ঘোড়সওয়ারদের হারিয়ে দেবে। “আমি এহুদার লোকদের শক্তিশালী করব এবং ইউসুফের, অর্থাৎ ইসরাইলের লোকদের উদ্ধার করব। আমি তাদের ফিরিয়ে আনব, কারণ তাদের উপর আমার মমতা আছে। তখন তারা এমন হবে যেন আমি তাদের অগ্রাহ্য করি নি, কারণ আমি তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌; আমি তাদের ডাকে সাড়া দেব। আফরাহীমীয়রা শক্তিশালী লোকদের মত হবে, আংগুর-রস খাওয়ার মত তাদের অন্তর খুশী হবে। তা দেখে তাদের সন্তানেরা আনন্দিত হবে; তাদের অন্তর আমাকে নিয়ে আনন্দ করবে। আমি তাদের শিস্‌ দিয়ে ডাকব এবং একসংগে জমায়েত করব। আমি তাদের মুক্ত করব বলে তারা আগের মতই সংখ্যায় অনেক হবে। যদিও নানা জাতির মধ্যে আমি তাদের ছড়িয়ে দিয়েছি তবুও দূর দেশে তারা আমাকে মনে করবে। তারা ও তাদের ছেলেমেয়েরা বেঁচে থাকবে এবং তারা ফিরে আসবে। মিসর দেশ থেকে আমি তাদের ফিরিয়ে আনব, আশেরিয়া থেকে তাদের একত্র করব। গিলিয়দ ও লেবাননে আমি তাদের নিয়ে আসব আর এত লোক হবে যে, সেখানে তাদের জায়গা কুলাবে না। আমি কষ্ট-সাগরের মধ্য দিয়ে যাব আর সাগরের ঢেউকে দমন করব এবং তাতে নীল নদের সব গভীর জায়গাগুলো শুকিয়ে যাবে। আশেরিয়ার অহংকার ভেংগে দেওয়া হবে এবং মিসরের রাজদণ্ড দূর হয়ে যাবে। আমার শক্তি দিয়ে আমি তাদের শক্তিশালী করব এবং আমার ইচ্ছামত তারা চলাফেরা করবে। আমি মাবুদ এই কথা বলছি।” ওহে লেবানন, তোমার দরজাগুলো খুলে দাও, যাতে আগুন তোমার এরস গাছগুলো গ্রাস করতে পারে। ওহে বেরস গাছ, বিলাপ কর, কারণ এরস গাছ পড়ে গেছে। সেরা গাছগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ওহে বাশনের এলোন গাছ, তোমরা বিলাপ কর, কারণ গভীর বনের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ভেড়ার রাখালদের বিলাপ শোন; তাদের ভাল ভাল চারণ ভূমি নষ্ট হয়ে গেছে। সিংহদের গর্জন শোন; জর্ডানের জংগল ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, “জবাই করবার জন্য যে ভেড়ার পাল ঠিক হয়ে আছে তুমি সেই পাল চরাও। যারা তাদের কিনে নেয় তারা তাদের জবাই করে কিন্তু নিজেদের দোষী মনে করে না। যারা তাদের বিক্রি করে তারা বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমি ধনী হয়েছি।’ তাদের রাখালেরা তাদের উপর দয়া করে না। দেশের লোকদের উপর আমি আর দয়া করব না; আমি প্রত্যেকজনকে তার প্রতিবেশী ও বাদশাহ্‌র হাতে তুলে দেব। তারা দেশটাকে ধ্বংস করবে এবং তাদের হাত থেকে আমি কাউকে উদ্ধার করব না।” জবাই করবার জন্য যে ভেড়ার পাল ঠিক হয়ে আছে, বিশেষ করে সেই পালের দুঃখীদের আমি চরাতে লাগলাম। তারপর আমি দু’টা লাঠি নিলাম এবং তার একটার নাম দিলাম রহমত ও অন্যটার নাম দিলাম মিলন; আর আমি সেই ভেড়ার পাল চরাতে থাকলাম। এক মাসের মধ্যে আমি তিনজন পালককে দূর করে দিলাম। পরে সেই পাল আমাকে ঘৃণা করতে লাগল আর আমিও তাদের নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমি বললাম, “আমি তোমাদের পালক হব না। যার মরবার কথা আছে সে মরুক এবং যার দূর হয়ে যাবার কথা আছে সে দূর হয়ে যাক। বাকীরা একে অন্যের গোশ্‌ত খাক।” তারপর আমি রহমত নামে সেই লাঠিটা নিয়ে ভেংগে ফেলে সমস্ত জাতির সংগে আমার যে চুক্তি ছিল তা বাতিল করলাম। সেই দিনেই তা বাতিল হল, কাজেই পালের দুঃখীরা যারা আমাকে লক্ষ্য করছিল তারা জানতে পারল যে, এই সবের মধ্য দিয়ে মাবুদই কথা বলছেন। আমি তাদের বললাম, “আপনারা যদি ভাল মনে করেন তবে আমার বেতন দিন; কিন্তু যদি ভাল মনে না করেন তবে তা রেখে দিন।” তখন তারা আমাকে ত্রিশটা রূপার টুকরা দিল। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “আহা, কি সেই দাম যা তারা আমার মূল্য হিসাবে ঠিক করেছিল! ওটা কুমারের কাছে ফেলে দাও।” তারপর আমি সেই ত্রিশটা রূপার টুকরা নিয়ে মাবুদের ঘরে কুমারের কাছে ফেলে দিলাম। পরে আমি মিলন নামে সেই দ্বিতীয় লাঠিটা ভেংগে এহুদা ও ইসরাইলের মধ্যে ভাইয়ের যে সম্বন্ধ ছিল তা নষ্ট করলাম। তখন মাবুদ আমাকে বললেন, “এবার তুমি আবার একজন বাজে রাখালের জিনিসপত্র নাও। দেশের উপরে আমি এমন একজন পালককে তুলব যে বিপদে পড়া লোকদের দেখাশোনা করবে না, যারা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের খোঁজ করবে না, যারা আঘাত পেয়েছে তাদের সুস্থ করবে না, স্বাস্থ্যবানদের খাওয়াবে না; কিন্তু সে বাছাই করা ভেড়াগুলোর গোশ্‌ত খাবে এবং তাদের খুর থেকেও গোশ্‌ত ছিড়ে খাবে। “ঘৃণ্য, সেই অপদার্থ পালককে, যে সেই পাল ছেড়ে চলে যায়! তলোয়ার যেন তার হাত ও ডান চোখকে আঘাত করে। তাতে তার হাত একেবারে শুকিয়ে যাবে এবং তার ডান চোখ একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে।” এই হল ইসরাইল সম্বন্ধে মাবুদের কালাম। মাবুদ, যিনি আসমানকে মেলে দিয়েছেন, যিনি দুনিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছেন, যিনি মানুষের ভিতরে রূহ্‌ সৃষ্টি করেছেন, তিনি বলছেন, “আমি জেরুজালেমকে এমন একটা মদের পাত্র বানাব যা থেকে খেয়ে আশেপাশের সব জাতিরা টলবে। জেরুজালেমের সংগে এহুদার অন্যান্য শহরগুলোকেও ঘেরাও করা হবে। সেই দিন যখন সমস্ত জাতি জেরুজালেমের বিরুদ্ধে জমায়েত হবে তখন আমি তাকে সব জাতির জন্য একটা ভারী পাথরের মত করব। যারা সেই পাথরকে উঠাতে চেষ্টা করবে তারা নিজেরাই আঘাত পাবে। সেই দিন আমি প্রত্যেকটা ঘোড়াকে ভয় ধরিয়ে দেব এবং ঘোড়সওয়ারকে করব পাগল। এহুদার লোকদের প্রতি আমি সতর্ক নজর রাখব, কিন্তু অন্যান্য জাতিদের সব ঘোড়াগুলোকে অন্ধ করে দেব। তখন এহুদার নেতারা মনে মনে বলবে, ‘জেরুজালেমের লোকেরা আমাদের শক্তি, কারণ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তাদের মাবুদ।’ “সেই দিন এহুদার নেতাদের আমি কাঠের বোঝার মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার মত ও শস্যের আঁটির মধ্যে জ্বলন্ত মশালের মত করব। তারা ডানে-বাঁয়ে আশেপাশের সমস্ত জাতিকে গ্রাস করবে, কিন্তু জেরুজালেমের লোকেরা আবার তাদের নিজেদের জায়গায় বাস করবে। “আমি মাবুদ প্রথমে এহুদার বাসস্থানগুলো উদ্ধার করব যাতে দাউদের বংশের ও জেরুজালেমের বাসিন্দাদের সম্মান এহুদার অন্যান্য লোকদের চেয়ে বেশী না হয়। সেই দিন আমি জেরুজালেমের বাসিন্দাদের রক্ষা করব। তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে দুর্বল লোকও দাউদের মত হবে এবং দাউদের বংশধরেরা আল্লাহ্‌র মত, অর্থাৎ মাবুদের ফেরেশতার মত তাদের আগে আগে চলবে। সেই দিন যে সমস্ত জাতি জেরুজালেমকে আক্রমণ করতে আসবে আমি তাদের ধ্বংস করব। “আমি দাউদের বংশ ও জেরুজালেমের বাসিন্দাদের উপরে আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব; তিনি রহমত দান করেন ও মুনাজাতের মনোভাব দেন। তাতে তারা আমার দিকে, অর্থাৎ যাঁকে তারা বিঁধেছে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখবে। একমাত্র সন্তানের জন্য বিলাপ করবার মত করে তারা তাঁর জন্য বিলাপ করবে এবং প্রথম সন্তানের জন্য যেমন শোক করে তেমনি ভীষণভাবে শোক করবে। সেই দিন জেরুজালেমে ভীষণ বিলাপ হবে, যেমন মগিদ্দো সমভূমির হদদ্‌-রিম্মোণে হয়েছিল। তবুও যদি কেউ নবী হিসাবে কথা বলে তবে তার নিজের মা-বাবা তাকে বলবে, ‘তোমাকে মরতে হবে, কারণ তুমি মাবুদের নাম করে মিথ্যা কথা বলেছ।’ সে নবী হিসাবে কথা বললে পর তার নিজের মা-বাবা তাকে তীক্ষ্ন অস্ত্র দিয়ে হত্যা করবে। “প্রত্যেক নবী সেই দিন তার দর্শনের বিষয়ে লজ্জিত হবে। ছলনা করবার জন্য সে নবীদের মত লোমের পোশাক পরবে না। সে বলবে, ‘আমি নবী নই, আমি একজন চাষী; ছোটবেলায় আমাকে গোলাম হিসাবে বিক্রি করা হয়েছিল।’ যদি কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার শরীরে ওগুলো কিসের দাগ?’ সে জবাব দেবে, ‘আমার বন্ধুদের বাড়ীতে যে সব আঘাত পেয়েছি এ তারই দাগ।’ ” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “হে তলোয়ার, তুমি আমার পালকের বিরুদ্ধে, আমার সংগের লোকের বিরুদ্ধে, জেগে ওঠো। পালককে আঘাত কর, তাতে মেষগুলো ছড়িয়ে পড়বে; আমি মেষের বাচ্চাগুলোর বিরুদ্ধেও আমার হাত উঠাব। গোটা দেশের তিন ভাগের দু’ভাগ লোককে হত্যা করা হবে, কিন্তু আমি মাবুদ বলছি, তৃতীয় ভাগ তার মধ্যে বেঁচে থাকবে। এই তৃতীয় ভাগকে আমি আগুনের মধ্যে নিয়ে যাব; রূপা খাঁটি করবার মত করে আমি তাদের খাঁটি করব এবং সোনা যাচাই করবার মত তাদের যাচাই করব। তারা আমাকে ডাকবে আর আমি তাদের জবাব দেব; আমি বলব, ‘এরা আমার বান্দা,’ আর তারা বলবে, ‘আল্লাহই আমাদের মাবুদ।’ ” মাবুদের এমন একটা দিন আসছে যেদিন জেরুজালেমের লোকদের জিনিস লুট হয়ে তাদের সামনে ভাগ করে নেওয়া হবে। জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য মাবুদ সমস্ত জাতিকে জমায়েত করবেন। শহর দখল করা হবে, ঘর-বাড়ী লুটপাট করা হবে ও স্ত্রীলোকদের সতীত্ব নষ্ট করা হবে। শহরের অর্ধেক লোক বন্দী হয়ে অন্য দেশে যাবে কিন্তু বাকী লোকেরা শহরে থাকবে। তারপর মাবুদ বের হবেন এবং যুদ্ধের সময় যেমন করেন সেইভাবে তিনি জাতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। সেই দিন তিনি এসে জেরুজালেমের পূর্ব দিকে জৈতুন পাহাড়ের উপরে দাঁড়াবেন; তাতে জৈতুন পাহাড় পূর্ব থেকে পশ্চিমে চিরে যাবে এবং অর্ধেক উত্তরে ও অর্ধেক দক্ষিণে সরে গিয়ে একটা বড় উপত্যকার সৃষ্টি করবে। তোমরা পাহাড়ের সেই উপত্যকা দিয়ে পালিয়ে যাবে, কারণ সেই উপত্যকা আৎসল পর্যন্ত চলে যাবে। এহুদার বাদশাহ্‌ উষিয়ের রাজত্বকালে ভূমিকমেপর সময়ে যেভাবে তোমরা পালিয়ে গিয়েছিলে সেইভাবেই পালিয়ে যাবে। তারপর আমার মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর সব পবিত্রজনদের সংগে নিয়ে আসবেন। সেই দিন কোন আলো থাকবে না, চাঁদ ও সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে। সেই দিনটা অন্য কোন দিনের মত হবে না- দিনও হবে না, রাতও হবে না; দিনটার কথা কেবল মাবুদই জানেন। সেই দিনের শেষে আলো হবে। সেই সময় গরমকালে ও শীতকালে জেরুজালেম থেকে মিষ্টি পানি বের হয়ে অর্ধেকটা পূর্ব সাগরের দিকে আর অর্ধেকটা পশ্চিম সাগরের দিকে বয়ে যাবে। মাবুদই হবেন গোটা দুনিয়ার বাদশাহ্‌। সেই দিন লোকে আল্লাহ্‌কে একমাত্র মাবুদ বলে স্বীকার করবে, কেবল তাঁরই নামে এবাদত করবে। জেরুজালেমের দক্ষিণে গেবা থেকে রিম্মোণ পর্যন্ত আরবা সমভূমির মত হবে, কিন্তু জেরুজালেম উঁচুই থাকবে। বিন্‌ইয়ামীন্তদরজা থেকে প্রথম দরজা ও কোণার দরজা পর্যন্ত এবং হননেলের উঁচু পাহারা-ঘর থেকে বাদশাহ্‌র আংগুর মাড়াইয়ের স্থান পর্যন্ত গোটা শহরটা ঠিক থাকবে। সেখানে লোকজন বাস করবে; জেরুজালেম আর কখনও ধ্বংসের বদদোয়ার অধীন হবে না। সে নিরাপদে থাকবে। যে সব জাতি জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে মাবুদ মহামারী দিয়ে তাদের আঘাত করবেন। তারা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই তাদের গায়ের গোশ্‌ত পচে যাবে এবং তাদের চোখের গর্তের মধ্যে চোখ পচে যাবে ও মুখের মধ্যে জিভ্‌ পচে যাবে। সেই দিন মাবুদ ভীষণ ভয় দিয়ে সেই লোকদের আঘাত করবেন। তারা সবাই একে অন্যকে ধরে আক্রমণ করবে। এহুদাও জেরুজালেমের পক্ষে যুদ্ধ করবে। আশেপাশের জাতিদের ধন-সম্পদ, অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে সোনা, রূপা ও কাপড়-চোপড় জড়ো করা হবে। একই রকম মহামারী ঐ সব সৈন্য-ছাউনির ঘোড়া, খ"চর, উট, গাধা এবং অন্যান্য সব পশুকে আঘাত করবে। পরে সেই সব জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা সেই বাদশাহ্‌র, অর্থাৎ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের এবাদত করবার জন্য এবং কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করবার জন্য প্রতি বছর জেরুজালেমে আসবে। যদি দুনিয়ার কোন জাতি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের এবাদত করবার জন্য জেরুজালেমে না যায় তবে তাদের দেশে বৃষ্টি হবে না। যদি মিসরীয়রা না যায় এবং এবাদতে অংশ না নেয় তবে তাদের দেশেও বৃষ্টি হবে না। যে সব জাতি কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করবার জন্য যাবে না মাবুদ তাদের উপর যে মহামারী আনবেন মিসরীয়দের উপর তিনি সেই একই মহামারী আনবেন। মিসর এবং অন্যান্য যে সব জাতি কুঁড়ে-ঘরের ঈদ পালন করবার জন্য যাবে না তাদের এই শাস্তিই দেওয়া হবে। সেই দিন “মাবুদের উদ্দেশে পবিত্র” এই কথা ঘোড়ার গলার ঘণ্টার উপরে খোদাই করা থাকবে এবং মাবুদের ঘরের রান্নার পাত্রগুলো কোরবানগাহের সামনের পবিত্র পেয়ালাগুলোর মত পবিত্র হবে। জেরুজালেম ও এহুদার প্রত্যেকটি রান্নার পাত্র আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশে পবিত্র হবে এবং যারা পশু-কোরবানী দিতে আসবে তারা সেই সব পাত্রের কয়েকটা নিয়ে সেগুলোতে রান্না করবে। সেই দিন আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ঘরে কেউ ব্যবসা করবে না। মালাখির মধ্য দিয়ে ইসরাইলের কাছে মাবুদের কালাম। ইদোম হয়তো বলবে, “আমাদের চুরমার করা হলেও আমরা ধ্বংসস্থানগুলো আবার গড়ে তুলব।” কিন্তু আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তারা গড়তে পারে কিন্তু আমি ভেংগে ফেলব। তাদের বলা হবে, ‘দুষ্ট দেশ’ এবং ‘যে জাতি সব সময় মাবুদের রাগের তলায় রয়েছে।’ তোমরা তা নিজের চোখে দেখবে ও বলবে, ‘ইসরাইলের সীমানার বাইরেও মাবুদ মহান।’ ” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “ছেলে তার পিতাকে ও চাকর তার মালিককে সম্মান করে। যদি আমি পিতা হয়ে থাকি তবে আমার পাওনা সম্মান কোথায়? যদি মালিক হয়ে থাকি তবে আমার পাওনা ভয় কোথায়? ওহে ইমামেরা, তোমরাই আমাকে তুচ্ছ করছ। কিন্তু তোমরা বলছ, ‘আমরা কেমন করে তোমাকে তুচ্ছ করেছি?’ আমার কোরবানগাহের উপরে তোমরা নাপাক খাবার রেখে আমাকে তুচ্ছ করেছ। কিন্তু তোমরা বলছ, ‘তাতে কি তুমি নাপাক হয়েছ?’ তোমরা যখন বল, ‘মাবুদের টেবিল ঘৃণার যোগ্য,’ তখন তো তোমরা আমাকেই নাপাক বলছ। কোরবানী দেবার জন্য যখন তোমরা অন্ধ পশু নিয়ে আস তখন তা কি অন্যায় নয়? যখন তোমরা খোঁড়া ও অসুস্থ পশু দিয়ে কোরবানী দাও, তখন কি তা অন্যায় নয়? তোমাদের শাসনকর্তার কাছে সেগুলো কোরবানী দিলে সে কি তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবে? সে কি তোমাদের কবুল করবে? আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জিজ্ঞাসা করছি।” এখন আল্লাহ্‌র কাছে রহমত চাইলে কি লাভ? তোমাদের হাত দিয়ে যখন এই রকম কোরবানী দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি কি আমাদের কবুল করবেন? শোন, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কি বলছেন, “হায়! যদি তোমাদের মধ্যে একজনও বায়তুল-মোকাদ্দসের দরজাগুলো বন্ধ করত আর তোমরা আমার কোরবানগাহের উপরে অনর্থক আগুন না জ্বালাতে তবে আমি খুশী হতাম। আমি তোমাদের উপর সন্তুষ্ট নই এবং কোন কোরবানীর জিনিস আমি তোমাদের হাত থেকে কবুল করব না। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমস্ত জাতির মধ্যে আমার নাম হবে মহৎ। সব জায়গাতেই আমার উদ্দেশে ধূপ জ্বালানো হবে এবং কোরবানী দেবার জন্য পাক-পবিত্র জিনিস আনা হবে, কারণ সব জাতির মধ্যে আমার নাম মহৎ হবে। কিন্তু তোমরা আমার নাম অসম্মানিত করছ, কারণ তোমরা বলছ, ‘মাবুদের টেবিল নাপাক এবং তার উপরকার খাবার জঘন্য।’ তোমরা তুচ্ছ করবার মনোভাব নিয়ে এ-ও বলে থাক, ‘এ কি জ্বালা!’ তোমরা তো লুট করা, খোঁড়া কিংবা অসুস্থ পশু নিয়ে এসে কোরবানীর জন্য দাও, কিন্তু তা কি আমি তোমাদের হাত থেকে নিতে পারি? আমি মাবুদ এই কথা বলছি। যার পশুপালের মধ্যে রয়েছে উপযুক্ত পুরুষ পশু এবং সে সেটা দেবার জন্য মানতও করেছে কিন্তু তারপর একটা খুঁতযুক্ত পশু মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিয়েছে, সে তো ঠগ। তার উপর বদদোয়া পড়ুক। আমিই মহান বাদশাহ্‌ এবং সমস্ত জাতি আমাকেই ভয় করে। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” তোমাদের দরুনই আমি তোমাদের বংশধরদের শাস্তি দেব; তোমাদের ঈদের কোরবানীর পশুর ময়লা আমি তোমাদের মুখে মাখিয়ে দেব এবং সেই ময়লা সুদ্ধই তোমাদের দূর করে দেওয়া হবে।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আরও বলছেন, “তোমরা জেনো যে, আমি তোমাদের কাছে এই সতর্কবাণী পাঠিয়েছি যাতে লেবির বংশের জন্য স্থাপন করা আমার ব্যবস্থা চালু থাকে। তাদের জন্য আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম তা হল জীবন ও শান্তির ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা আমি তাদের দিয়েছিলাম। এছাড়া এটা ভয়ের ব্যবস্থাও বটে, যেন তারা আমাকে ভয় করে; সত্যিই তারা আমাকে ভয় করত। তাদের মুখে সত্যিকারের শিক্ষা ছিল এবং তাতে কোন মিথ্যা থাকত না। শান্তিতে ও সততায় তারা আমার সংগে চলাফেরা করত এবং অনেককে গুনাহ্‌ থেকে ফিরাত। আসলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া ইমামদের উচিত যাতে সেই শিক্ষা হারিয়ে না যায়। এছাড়া আল্লাহ্‌র কালাম জানবার জন্য ইমামদের কাছেই লোকদের যাওয়া উচিত, কারণ তারাই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের সংবাদদাতা। কিন্তু তোমরা ঠিক পথ থেকে সরে গেছ এবং তোমাদের শিক্ষার দ্বারা অনেককে উচোট খাইয়েছ। এইভাবে লেবির বংশের জন্য স্থাপন করা ব্যবস্থা তোমরা বাদ দিয়েছ। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছি। তোমরা আমার পথে চল নি বরং শরীয়তের ব্যাপারে লোকদের সংগে তোমরা একচোখামি করেছ। সেইজন্য সমস্ত লোকদের সামনে আমি তোমাদের তুচ্ছের ও অসম্মানের পাত্র করেছি।” আমাদের সকলের পিতা কি একজন নন? একজন আল্লাহ্‌ কি আমাদের সৃষ্টি করেন নি? তাহলে আমরা কেন একে অন্যের সংগে বেঈমানী করে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য স্থাপন করা ব্যবস্থা অসম্মানিত করি? এহুদা বেঈমানী করেছে। ইসরাইল দেশে ও জেরুজালেমে জঘন্য কাজ করা হয়েছে। এহুদার লোকেরা দেবতা পূজাকারী মেয়েদের বিয়ে করে মাবুদ যাদের মহব্বত করেন তাদের নাপাক করেছে। যারা এই রকম কাজ করে তারা যদিও বা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশে কোরবানীর জিনিস নিয়ে আসে তবুও মাবুদ ইয়াকুবের বংশের মধ্য থেকে তাদের সবাইকে শেষ করে দেবেন। আর একটা খারাপ কাজ তোমরা করে থাক; সেটা হল, চোখের পানিতে তোমরা মাবুদের কোরবানগাহ্‌ ভাসাও। তোমরা কান্নাকাটি ও বিলাপ কর, কারণ তোমরা যা দাও তার প্রতি তিনি আর মনোযোগ দেন না কিংবা খুশী মনে তোমাদের হাত থেকে তা কবুলও করেন না। তোমরা বলছ, “কেন করেন না?” এর কারণ হল, মাবুদ তোমাদের প্রত্যেক লোকের ও তার যৌবনকালের স্ত্রীর বিয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন; কিন্তু যদিও সেই স্ত্রী তার সংগী, তার বিয়ের চুক্তি করা স্ত্রী, তবুও সে তার সংগে বেঈমানী করেছে। মাবুদ কি স্বামী ও স্ত্রীকে এক করেন নি? শরীরে ও রূহে তারা তাঁরই। তারা কেন এক? কারণ তিনি তাদের মধ্য দিয়ে একটা আল্লাহ্‌ভক্ত বংশ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কাজেই তোমরা তোমাদের দিলের বিষয়ে সাবধান হও; যৌবনকালের স্ত্রীর সংগে তোমরা বেঈমানী কোরো না। ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, “আমি তালাক ঘৃণা করি।” এছাড়া আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “যে লোক কাপড় পরবার মত করে নিজেকে জুলুম দিয়ে সাজায় তার সেই কাজ আমি ঘৃণা করি। কাজেই তোমরা তোমাদের দিলের বিষয়ে সাবধান হও, বেঈমানী কোরো না।” তোমরা নিজেদের কথার দ্বারা মাবুদকে ক্লান্ত করে তুলেছ। তবুও তোমরা বলছ, “কেমন করে আমরা তাঁকে ক্লান্ত করেছি?” তোমরা এইভাবে করেছ- তোমরা বলেছ, “যারা অন্যায় করে তারা সবাই মাবুদের চোখে ভাল এবং তিনি তাদের উপর সন্তুষ্ট,” কিংবা বলেছ, “কোথায় সেই আল্লাহ্‌ যিনি ন্যায়বিচার করেন?” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “দেখ, আমি আমার সংবাদদাতাকে পাঠাচ্ছি; সে আমার আগে গিয়ে পথ প্রস্তুত করবে। তারপর যে মালিকের জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ তিনি হঠাৎ তাঁর ঘরে আসবেন; ব্যবস্থা কাজে পরিণতকারী সেই সংবাদদাতা, যাঁকে তোমরা চাইছ, তিনি আসছেন।” কিন্তু তাঁর আসবার দিন কেউ সহ্য করতে পারবে না; তিনি উপস্থিত হলে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না; কারণ তিনি হবেন রূপা যাচাই করবার আগুন অথবা ধোপার সাবানের মত। যে লোক রূপা গলিয়ে খাঁটি করে তিনি তার মত হয়ে বসবেন। তিনি লেবীয়দের পাক-সাফ করবেন এবং সোনা ও রূপার মত করে তাদের খাঁটি করবেন। তারপর তারা সততার মনোভাব নিয়ে মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দেবে। তখন আগেকার দিনের মত করে, পুরানো দিনের মত করে এহুদা ও জেরুজালেমের লোকদের কোরবানীর জিনিস মাবুদকে সন্তুষ্ট করবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “তখন আমি বিচার করবার জন্য তোমাদের কাছে আসব; সেই সময় জাদুকর, জেনাকারী, মিথ্যা সাক্ষী এবং যারা মজুরদের মজুরীতে ঠকায়, যারা বিধবা ও এতিমদের জুলুম করে আর বিদেশীদের ন্যায়বিচার পেতে দেয় না, অর্থাৎ যারা আমাকে ভয় করে না তাদের সকলের বিরুদ্ধে আমি সাক্ষ্য দিতে দেরি করব না। “আমি মাবুদ, আমার কোন পরিবর্তন নেই। সেইজন্য হে ইয়াকুবের বংশধরেরা, তোমরা ধ্বংস হচ্ছ না। তোমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই তোমরা আমার সব নিয়ম-কানুন থেকে সরে গেছ এবং তা পালন কর নি। আমার কাছে ফিরে এস, আর আমিও তোমাদের কাছে ফিরে আসব। কিন্তু তোমরা বলছ, ‘আমরা কেমন করে ফিরে আসব?’ মানুষ কি আল্লাহ্‌কে ঠকাবে? কিন্তু তোমরা তো আমাকে ঠকা"ছ। তবুও তোমরা বলছ, ‘আমরা তোমাকে কি করে ঠকাচ্ছি?’ আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ ও দানের ব্যাপারে তোমরা আমাকে ঠকা"ছ। তোমরা বদদোয়ার তলায় রয়েছ, তবুও তোমাদের গোটা জাতি আমাকে ঠকাচ্ছে। তোমরা তোমাদের সমস্ত আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ ভাণ্ডার-ঘরে আনবে যাতে আমার ঘরে খাবার থাকে। এই বিষয়ে তোমরা আমাকে পরীক্ষা করে দেখ, আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন আসমানের সব দরজা খুলে তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত দোয়া ঢেলে দিই কি না। আমি গ্রাসকারী পোকাকে বাধা দেব যাতে তারা তোমাদের ফসল খেয়ে না ফেলে; এছাড়া তোমাদের ক্ষেতে আংগুর লতার ফল ঝরে পড়বে না। তখন সমস্ত জাতি তোমাদের ধন্য বলবে, কারণ তোমাদের দেশটা হবে আনন্দদায়ক। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি।” মাবুদ আবার বলছেন, “তোমরা আমার বিরুদ্ধে শক্ত শক্ত কথা বলেছ, কিন্তু তোমরা বলছ, ‘তোমার বিরুদ্ধে আমরা কি বলেছি?’ তোমরা বলেছ, ‘আল্লাহ্‌র এবাদত করা অনর্থক। তাঁর শরীয়ত অনুসারে কাজ করাতে এবং শোক প্রকাশ করে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের সামনে চলাফেরা করাতে আমাদের কি লাভ হল? এখন আমরা গর্বিত লোকদের ধন্য বলছি; জ্বী, অন্যায়কারীরা উন্নতি করছে; তারা আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করেও রেহাই পাচ্ছে।’ ” তখন যারা মাবুদকে ভয় করত তারা একে অন্যের সংগে কথাবার্তা বলল এবং মাবুদ তা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। যারা মাবুদকে ভয় করত ও তাঁর বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করত তাদের স্মরণ করবার জন্য তাঁর সামনে একটা কিতাব লেখা হল। তাদের বিষয়ে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “আমার নির্দিষ্ট করা দিনে তারা আমার নিজের বিশেষ সম্পত্তি হবে; তারা আমারই হবে। একজন লোক যেমন তার সেবাকারী ছেলেকে মমতা করে শাস্তি থেকে রেহাই দেয় তেমনি করে আমি তাদের রেহাই দেব। তখন তোমরা সৎ ও দুষ্টের মধ্যে, অর্থাৎ যে আমার এবাদত করে আর যে করে না তাদের মধ্যে আমি কিভাবে পার্থক্য করি তা দেখতে পাবে।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলছেন, “দেখ, সেই দিনটা আসছে, তা চুলার আগুনের মত জ্বলবে। সেই দিন সমস্ত গর্বিত লোক ও অন্যায়কারীরা নাড়ার মত হবে এবং পুড়ে যাবে। একটা শিকড় বা একটা ডালও বাকী থাকবে না। কিন্তু তোমরা যারা আমাকে ভয় কর তোমাদের উপরে ন্যায়ের সূর্য উঠবে যার আলোর রশ্মিতে থাকবে সুস্থতা। তোমরা বের হয়ে গোয়াল থেকে ছাড়া পাওয়া বাছুরের মত লাফাবে। তারপর তোমরা দুষ্টদের পায়ে মাড়াবে, কারণ যেদিন আমি এই সব কাজ করব সেই দিন তারা হবে তোমাদের পায়ের তলায় পড়া ছাইয়ের মত। আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এই কথা বলছি। “তোমরা আমার গোলাম মূসার শরীয়তের কথা, অর্থাৎ আমি তাকে তুর পাহাড়ে সমস্ত ইসরাইলের জন্য যে সব নিয়ম ও হুকুম দিয়েছিলাম তা মনে কর। “দেখ, মাবুদের সেই মহৎ ও ভয়ংকর দিন আসবার আগে আমি মাবুদ তোমাদের কাছে নবী ইলিয়াসকে পাঠিয়ে দেব। সে পিতাদের অন্তর তাদের ছেলেমেয়েদের দিকে এবং ছেলেমেয়েদের অন্তর তাদের পিতাদের দিকে ফিরাবে, যেন আমি এসে বদদোয়া দিয়ে দেশকে ধ্বংস না করি।” ঈসা মসীহ্‌ দাউদের বংশের এবং দাউদ ইব্রাহিমের বংশের লোক। ঈসা মসীহের বংশের তালিকা এই: ইব্রাহিমের ছেলে ইসহাক; ইসহাকের ছেলে ইয়াকুব; ইয়াকুবের ছেলে এহুদা ও তাঁর ভাইয়েরা; এহুদার ছেলে পেরস ও সেরহ- তাঁদের মা ছিলেন তামর; পেরসের ছেলে হিষ্রোণ; হিষ্রোণের ছেলে রাম; রামের ছেলে অম্মীনাদব; অম্মীনাদবের ছেলে নহশোন; নহশোনের ছেলে সল্‌মোন; সল্‌মোনের ছেলে বোয়স- তাঁর মা ছিলেন রাহব; বোয়সের ছেলে ওবেদ- তাঁর মা ছিলেন রূত; ওবেদের ছেলে ইয়াসি; ইয়াসির ছেলে বাদশাহ্‌ দাউদ। দাউদের ছেলে সোলায়মান্ত তাঁর মা ছিলেন উরিয়ার বিধবা স্ত্রী; সোলায়মানের ছেলে রহবিয়াম; রহবিয়ামের ছেলে অবিয়; অবিয়ের ছেলে আসা; আসার ছেলে যিহোশাফট; যিহোশাফটের ছেলে যোরাম; যোরামের ছেলে ঊষিয়; ঊষিয়ের ছেলে যোথম; যোথমের ছেলে আহস; আহসের ছেলে হিষ্কিয়; হিষ্কিয়ের ছেলে মানশা; মানশার ছেলে আমোন; আমোনের ছেলে যোশিয়; যোশিয়ের ছেলে যিকনিয় ও তাঁর ভাইয়েরা- ইসরাইল জাতিকে ব্যাবিলন দেশে বন্দী হিসাবে নিয়ে যাবার সময় এঁরা ছিলেন। যিকনিয়ের ছেলে শল্‌টিয়েল- ইসরাইল জাতিকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার পরে এঁর জন্ম হয়েছিল; শল্‌টিয়েলের ছেলে সরুব্বাবিল; সরুব্বাবিলের ছেলে অবীহূদ; অবীহূদের ছেলে ইলীয়াকীম; ইলীয়াকীমের ছেলে আসোর; আসোরের ছেলে সাদোক; সাদোকের ছেলে আখীম; আখীমের ছেলে ইলীহূদ; ইলীহূদের ছেলে ইলিয়াসর; ইলিয়াসরের ছেলে মত্তন; মত্তনের ছেলে ইয়াকুব; ইয়াকুবের ছেলে ইউসুফ- ইনি মরিয়মের স্বামী। এই মরিয়মের গর্ভে ঈসা, যাঁকে মসীহ্‌ বলা হয়, তাঁর জন্ম হয়েছিল। এইভাবে ইব্রাহিম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; ব্যাবিলনে বন্দী হবার পর থেকে মসীহ্‌ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ। ঈসা মসীহের জন্ম এইভাবে হয়েছিল। ইউসুফের সংগে ঈসার মা মরিয়মের বিয়ের ঠিক হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা একসংগে বাস করবার আগেই পাক-রূহের শক্তিতে মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন। মরিয়মের স্বামী ইউসুফ সৎ লোক ছিলেন, কিন্তু তিনি লোকের সামনে মরিয়মকে লজ্জায় ফেলতে চাইলেন না; এইজন্য তিনি গোপনে তাঁকে তালাক দেবেন বলে ঠিক করলেন। ইউসুফ যখন এই সব ভাবছিলেন তখন মাবুদের এক ফেরেশতা স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে বললেন, “দাউদের বংশধর ইউসুফ, মরিয়মকে বিয়ে করতে ভয় কোরো না, কারণ তাঁর গর্ভে যিনি জন্মেছে তিনি পাক-রূহের শক্তিতেই জন্মেছেন। তাঁর একটি ছেলে হবে। তুমি তাঁর নাম ঈসা রাখবে, কারণ তিনি তাঁর লোকদের তাদের গুনাহ্‌ থেকে নাজাত করবেন।” এই সব হয়েছিল যেন নবীর মধ্য দিয়ে মাবুদ এই যে কথা বলেছিলেন তা পূর্ণ হয়: “একজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে গর্ভবতী হবে, আর তাঁর একটি ছেলে হবে; তাঁর নাম রাখা হবে ইম্মানূয়েল।” এই নামের মানে হল, আমাদের সংগে আল্লাহ্‌। মাবুদের ফেরেশতা ইউসুফকে যেমন হুকুম দিয়েছিলেন, ঘুম থেকে উঠে তিনি তেমনই করলেন। তিনি মরিয়মকে বিয়ে করলেন, কিন্তু ছেলের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সংগে মিলিত হলেন না। পরে ইউসুফ ছেলেটির নাম ঈসা রাখলেন। এহুদিয়া প্রদেশের বেথেলহেম গ্রামে ঈসার জন্ম হয়েছিল। তখন বাদশাহ্‌ ছিলেন হেরোদ। পূর্বদেশ থেকে কয়েকজন পণ্ডিত জেরুজালেমে এসে বললেন, “ইহুদীদের যে বাদশাহ্‌ জন্মেছেন তিনি কোথায়? পূর্ব দিকের আসমানে আমরা তাঁর তারা দেখে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সম্মান দেখাতে এসেছি।” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ হেরোদ এবং তাঁর সংগে জেরুজালেমের অন্য সকলে অস্থির হয়ে উঠলেন। হেরোদ সমস্ত প্রধান ইমাম ও আলেমদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন মসীহ্‌ কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, “এহুদিয়ার বেথেলহেম গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করবেন, কারণ নবী এই কথা লিখেছেন: এহুদিয়া দেশের বেথেলহেম, এহুদিয়ার মধ্যে তুমি কোনমতেই ছোট নও, কারণ তোমার মধ্য থেকেই এমন একজন শাসনকর্তা আসবেন যিনি আমার ইসরাইল জাতিকে পরিচালনা করবেন।” তখন হেরোদ সেই পণ্ডিতদের গোপনে ডাকলেন এবং জেনে নিলেন ঠিক কোন্‌ সময়ে তারাটা দেখা গিয়েছিল। তিনি পণ্ডিতদের এই কথা বলে বেথেলহেমে পাঠিয়ে দিলেন, “আপনারা গিয়ে ভাল করে সেই শিশুটির খোঁজ করুন। তাঁকে খুঁজে পেলে পর আমাকে জানাবেন যেন আমিও গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সম্মান দেখাতে পারি।” বাদশাহ্‌র কথা শুনে পণ্ডিতেরা চলে গেলেন। তাঁরা পূর্ব দিকে যে তারাটা দেখেছিলেন সেই তারাটা তাঁদের আগে আগে চলল। শিশুটি যেখানে ছিলেন সেই ঘরের উপরে এসে না থামা পর্যন্ত তারাটা চলতেই থাকল। পরে আল্লাহ্‌ স্বপ্নে তাঁদের সাবধান করে দিলেন যেন তাঁরা হেরোদের কাছে ফিরে না যান। তখন তাঁরা অন্য পথে নিজেদের দেশে ফিরে গেলেন। পণ্ডিতেরা চলে যাবার পর মাবুদের এক ফেরেশতা স্বপ্নে ইউসুফকে দেখা দিয়ে বললেন, “ওঠো, ছেলেটি ও তাঁর মাকে নিয়ে মিসর দেশে পালিয়ে যাও আর আমি যতদিন না বলি ততদিন পর্যন্ত সেখানেই থাক, কারণ ছেলেটিকে মেরে ফেলবার জন্য হেরোদ তাঁর খোঁজ করবে।” পণ্ডিতেরা তাঁকে ঠকিয়েছেন দেখে হেরোদ ভীষণ রেগে গেলেন। সেই পণ্ডিতদের কাছ থেকে যে সময়ের কথা তিনি জেনে নিয়েছিলেন সেই সময়ের হিসাব মত দুই বছর ও তার কম বয়সের যত ছেলে বেথেলহেম ও তাঁর আশেপাশের জায়গাগুলোতে ছিল সকলকে হত্যা করবার হুকুম দিলেন। তাতে নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হল: রামায় ভীষণ কান্নাকাটির শব্দ শোনা যাচ্ছে; রাহেলা তার সন্তানদের জন্য কাঁদছে, কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না, কারণ তারা আর নেই। হেরোদ মারা যাবার পর মাবুদের এক ফেরেশতা মিসর দেশে ইউসুফকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, “ওঠো, ছেলেটি এবং তাঁর মাকে নিয়ে ইসরাইল দেশে ফিরে যাও। ছেলেটিকে যারা মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারা মারা গেছে।” তখন ইউসুফ উঠে সেই ছেলেটি ও তাঁর মাকে নিয়ে ইসরাইল দেশে গেলেন। এহুদিয়া প্রদেশে সেই সময় হেরোদের পরে তাঁর ছেলে আর্খিলায় বাদশাহ্‌ হয়েছিলেন। এই কথা শুনে ইউসুফ সেখানে যেতে ভয় পেলেন। পরে স্বপ্নে হুকুম পেয়ে তিনি গালীল প্রদেশে চলে গেলেন, আর নাসরত নামে একটা গ্রামে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এটা ঘটল যাতে নবীদের মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: “তাঁকে নাসরতীয় বলে ডাকা হবে।” পরে তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া এহুদিয়ার মরুভূমিতে এসে এই বলে তবলিগ করতে লাগলেন, “তওবা কর, কারণ বেহেশতী রাজ্য কাছে এসে গেছে।” এই ইয়াহিয়ার বিষয়েই নবী ইশাইয়া বলেছিলেন, মরুভূমিতে একজনের কণ্ঠস্বর চিৎকার করে জানাচ্ছে, “তোমরা মাবুদের পথ ঠিক কর; তাঁর রাস্তা সোজা কর।” ইয়াহিয়া উটের লোমের কাপড় পরতেন এবং তাঁর কোমরে চামড়ার কোমর-বাঁধনি ছিল। তিনি পংগপাল ও বনমধু খেতেন। জেরুজালেম, সমস্ত এহুদিয়া এবং জর্ডান নদীর চারপাশের লোকেরা সেই সময় তাঁর কাছে আসতে লাগল। এই লোকেরা যখন নিজেদের গুনাহ্‌ স্বীকার করল তখন ইয়াহিয়া জর্ডান নদীতে তাদের তরিকাবন্দী দিলেন। পরে ইয়াহিয়া দেখলেন অনেক ফরীশী ও সদ্দূকী তরিকাবন্দী নেবার জন্য তাঁর কাছে আসছেন। তিনি তাঁদের বললেন, “সাপের বংশধরেরা! আল্লাহ্‌র যে গজব নেমে আসছে তা থেকে পালিয়ে যাবার এই বুদ্ধি তোমাদের কে দিল? ভাল, তোমরা যে তওবা করেছ তার উপযুক্ত ফল তোমাদের জীবনে দেখাও। তোমরা ইব্রাহিমের বংশের লোক, এটা নিজেদের মনে বলতে পারবার কথা চিন্তাও কোরো না। আমি তোমাদের বলছি, আল্লাহ্‌ এই পাথরগুলো থেকে ইব্রাহিমের বংশধর তৈরী করতে পারেন। গাছের গোড়াতে কুড়াল লাগানোই আছে। যে গাছে ভাল ফল ধরে না তা কেটে আগুনে ফেলে দেওয়া হবে। তওবা করেছ বলে আমি তোমাদের পানিতে তরিকাবন্দী দিচ্ছি, কিন্তু আমার পরে যিনি আসছেন তিনি আমার চেয়ে শক্তিশালী। আমি তাঁর জুতা বইবারও যোগ্য নই। তিনি পাক-রূহ্‌ ও আগুনে তোমাদের তরিকাবন্দী দেবেন। কুলা তাঁর হাতেই আছে এবং তাঁর ফসল মাড়াবার জায়গা তিনি ভাল করেই পরিষ্কার করবেন। তিনি তাঁর ফসল গোলাতে জমা করবেন, কিন্তু যে আগুন কখনও নেভে না সেই আগুনে তুষ পুড়িয়ে ফেলবেন।” সেই সময় ঈসা তরিকাবন্দী নেবার জন্য গালীল থেকে জর্ডান নদীর ধারে ইয়াহিয়ার কাছে আসলেন। ইয়াহিয়া কিন্তু তাঁকে এই কথা বলে বাধা দিতে চেষ্টা করলেন, “আমারই বরং আপনার কাছে তরিকাবন্দী নেওয়া দরকার; আর আপনি কিনা আসছেন আমার কাছে!” তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “কিন্তু এবার এই রকমই হোক, কারণ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এইভাবেই আমাদের পূর্ণ করা উচিত।” তখন ইয়াহিয়া রাজী হলেন। তরিকাবন্দী নেবার পর ঈসা পানি থেকে উঠে আসবার সংগে সংগেই তাঁর সামনে আসমান খুলে গেল। তিনি আল্লাহ্‌র রূহ্‌কে কবুতরের মত হয়ে তাঁর উপরে নেমে আসতে দেখলেন। তখন বেহেশত থেকে বলা হল, “ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট।” এর পরে পাক-রূহ্‌ ঈসাকে মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন যেন ইবলিস ঈসাকে লোভ দেখিয়ে গুনাহে ফেলবার চেষ্টা করতে পারে। সেখানে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত রোজা রাখবার পর ঈসার খিদে পেল। তখন শয়তান এসে তাঁকে বলল, “তুমি যদি ইব্‌নুল্লাহ্‌ হও তবে এই পাথরগুলোকে রুটি হয়ে যেতে বল।” ঈসা জবাবে বললেন, “পাক-কিতাবে লেখা আছে, মানুষ কেবল রুটিতেই বাঁচে না, কিন্তু আল্লাহ্‌র মুখের প্রত্যেকটি কালামেই বাঁচে।” তখন ইবলিস ঈসাকে পবিত্র শহর জেরুজালেমে নিয়ে গেল এবং বায়তুল-মোকাদ্দসের চূড়ার উপর তাঁকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তুমি যদি ইব্‌নুল্লাহ্‌ হও তবে লাফ দিয়ে নীচে পড়, কারণ পাক-কিতাবে লেখা আছে, আল্লাহ্‌ তাঁর ফেরেশতাদের তোমার বিষয়ে হুকুম দেবেন; তাঁরা তোমাকে হাত দিয়ে ধরে ফেলবেন যাতে তোমার পায়ে পাথরের আঘাত না লাগে।” ঈসা ইবলিসকে বললেন, “আবার এই কথাও লেখা আছে, তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌কে তুমি পরীক্ষা করতে যেয়ো না।” তখন ইবলিস আবার তাঁকে খুব উঁচু একটা পাহাড়ে নিয়ে গেল এবং দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য ও তাঁদের জাঁকজমক দেখিয়ে বলল, “তুমি যদি মাটিতে পড়ে আমাকে সেজদা কর তবে এই সবই আমি তোমাকে দেব।” তখন ঈসা তাকে বললেন, “দূর হও, শয়তান। পাক-কিতাবে লেখা আছে, তুমি তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌কেই ভয় করবে, কেবল তাঁরই এবাদত করবে।” তখন ইবলিস তাঁকে ছেড়ে চলে গেল, আর ফেরেশতারা এসে তাঁর সেবা করতে লাগলেন। এটা হল যাতে নবী ইশাইয়ার মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: সবূলূন ও নপ্তালি এলাকার, সমুদ্রের দিকের, জর্ডানের অন্য পারের এবং অ-ইহুদীদের গালীলের যে লোকেরা অন্ধকারে বাস করে, তারা মহানূর দেখতে পাবে। যারা ঘন অন্ধকারের দেশে বাস করে, তাদের কাছে আলো প্রকাশিত হবে। সেই সময় থেকে ঈসা এই বলে তবলিগ করতে লাগলেন, “তওবা কর, কারণ বেহেশতী রাজ্য কাছে এসে গেছে।” ঈসা গালীল সাগরের পার দিয়ে যাবার সময় শিমোন, যাঁকে পিতর বলা হয় আর তাঁর ভাই আন্দ্রিয়কে দেখতে পেলেন। তাঁরা সাগরে জাল ফেলছিলেন, কারণ তাঁরা ছিলেন জেলে। ঈসা তাঁদের বললেন, “আমার সংগে চল, আমি তোমাদের মানুষ-ধরা জেলে করব।” তখনই তাঁরা জাল ফেলে রেখে ঈসার সংগে গেলেন। সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে তিনি ইয়াকুব ও ইউহোন্না নামে অন্য দুই ভাইকে দেখতে পেলেন। তাঁরা ছিলেন সিবদিয়ের ছেলে। তাঁদের বাবা সিবদিয়ের সংগে নৌকায় বসে তাঁরা জাল ঠিক করছিলেন। ঈসা সেই দুই ভাইকেও ডাকলেন। তাঁরা তখনই তাঁদের নৌকা ও বাবাকে ছেড়ে ঈসার সংগে গেলেন। গালীল প্রদেশের সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে ইহুদীদের ভিন্ন ভিন্ন মজলিস-খানায় ঈসা শিক্ষা দিতে লাগলেন। এছাড়া তিনি বেহেশতী রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করতে এবং লোকদের সব রকম রোগ ভাল করতে লাগলেন। সমস্ত সিরিয়া দেশে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়ল। যে সব লোকেরা নানা রকম রোগে ও ভীষণ যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিল, যাদের ভূতে ধরেছিল এবং যারা মৃগী ও অবশ-রোগে ভুগছিল, লোকেরা তাদের ঈসার কাছে আনল। তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করলেন। গালীল, দেকাপলি, জেরুজালেম, এহুদিয়া এবং জর্ডানের অন্য পার থেকে অনেক লোক ঈসার পিছনে পিছনে চলল। ঈসা অনেক লোক দেখে পাহাড়ের উপর উঠলেন। তিনি বসলে পর তাঁর সাহাবীরা তাঁর কাছে আসলেন। তখন তিনি সাহাবীদের এই বলে শিক্ষা দিতে লাগলেন: “ধন্য তারা, যারা দিলে নিজেদের গরীব মনে করে, কারণ বেহেশতী রাজ্য তাদেরই। ধন্য তারা, যারা দুঃখ করে, কারণ তারা সান্ত্বনা পাবে। ধন্য তারা, যাদের স্বভাব নম্র, কারণ দুনিয়া তাদেরই হবে। ধন্য তারা, যারা মনেপ্রাণে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতে চায়, কারণ তাদের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হবে। ধন্য তারা, যারা দয়ালু, কারণ তারা দয়া পাবে। ধন্য তারা, যাদের দিল খাঁটি, কারণ তারা আল্লাহ্‌কে দেখতে পাবে। ধন্য তারা, যারা লোকদের জীবনে শান্তি আনবার জন্য পরিশ্রম করে, কারণ আল্লাহ্‌ তাদের নিজের সন্তান বলে ডাকবেন। ধন্য তারা, যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতে গিয়ে জুলুম সহ্য করে, কারণ বেহেশতী রাজ্য তাদেরই। “ধন্য তোমরা, যখন লোকে আমার জন্য তোমাদের অপমান করে ও জুলুম করে এবং মিথ্যা করে তোমাদের নামে সব রকম খারাপ কথা বলে। তোমরা আনন্দ কোরো ও খুশী হোয়ো, কারণ বেহেশতে তোমাদের জন্য মহা পুরস্কার আছে। তোমাদের আগে যে নবীরা ছিলেন লোকে তাঁদেরও এইভাবে জুলুম করত। “তোমরা দুনিয়ার লবণ, কিন্তু যদি লবণের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় তবে কেমন করে তা আবার নোন্‌তা করা যাবে? সেই লবণ আর কোন কাজে লাগে না। তা কেবল বাইরে ফেলে দেবার ও লোকের পায়ে মাড়াবার উপযুক্ত হয়। “তোমরা দুনিয়ার আলো। পাহাড়ের উপরের শহর লুকানো থাকতে পারে না। কেউ বাতি জ্বেলে ঝুড়ির নীচে রাখে না কিন্তু বাতিদানের উপরেই রাখে। এতে ঘরের সমস্ত লোকই আলো পায়। সেইভাবে তোমাদের আলো লোকদের সামনে জ্বলুক, যেন তারা তোমাদের ভাল কাজ দেখে তোমাদের বেহেশতী পিতার প্রশংসা করে। “এই কথা মনে কোরো না, আমি তৌরাত কিতাব আর নবীদের কিতাব বাতিল করতে এসেছি। আমি সেগুলো বাতিল করতে আসি নি বরং পূর্ণ করতে এসেছি। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আসমান ও জমীন শেষ না হওয়া পর্যন্ত, যতদিন না তৌরাত কিতাবের সমস্ত কথা সফল হয় ততদিন সেই তৌরাতের এক বিন্দু কি এক মাত্রা মুছে যাবে না। তাই মূসার শরীয়তের মধ্যে ছোট একটা হুকুমও যে কেউ অমান্য করে এবং লোককে তা অমান্য করতে শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে সবচেয়ে ছোট বলা হবে। কিন্তু যে কেউ শরীয়তের হুকুমগুলো পালন করে ও শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে বড় বলা হবে। আমি তোমাদের বলছি, আলেম ও ফরীশীদের ধার্মিকতার চেয়ে তোমাদের যদি বেশী কিছু না থাকে তবে তোমরা কোনমতেই বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে না। “তোমরা শুনেছ, আগেকার লোকদের কাছে এই কথা বলা হয়েছে, ‘খুন কোরো না; যে খুন করে সে বিচারের দায়ে পড়বে।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ তার ভাইয়ের উপর রাগ করে সে বিচারের দায়ে পড়বে। যে কেউ তার ভাইকে বলে, ‘তুমি অপদার্থ,’ সে মহাসভার বিচারের দায়ে পড়বে। আর যে তার ভাইকে বলে, ‘তুমি বিবেকহীন,’ সে জাহান্নামের আগুনের দায়ে পড়বে। “সেইজন্য আল্লাহ্‌র উদ্দেশে কোরবানগাহের উপরে তোমার দান কোরবানী দেবার সময় যদি মনে পড়ে যে, তোমার বিরুদ্ধে তোমার ভাইয়ের কিছু বলবার আছে, তবে তোমার দান সেই কোরবানগাহের সামনে রেখে চলে যাও। আগে তোমার ভাইয়ের সংগে আবার মিলিত হও এবং পরে এসে তোমার দান কোরবানী দাও। “কেউ তোমার বিরুদ্ধে মকদ্দমা করলে আদালতে যাবার আগেই তার সংগে তাড়াতাড়ি মীমাংসা করে ফেল। তা না হলে সে তোমাকে বিচারকের হাতে দেবে, আর বিচারক তোমাকে পুলিশের হাতে দেবে, আর পুলিশ তোমাকে জেলে দেবে। আমি তোমাকে সত্যি বলছি, শেষ পয়সাটা না দেওয়া পর্যন্ত তুমি সেখান থেকে কিছুতেই ছাড়া পাবে না। “তোমরা শুনেছ, এই কথা বলা হয়েছে, ‘জেনা কোরো না।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ কোন স্ত্রীলোকের দিকে কামনার চোখে তাকায় সে তখনই মনে মনে তার সংগে জেনা করল।” “তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপ্‌ড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর জাহান্নামে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। যদি তোমার ডান হাত তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর জাহান্নামে যাওয়ার চেয়ে বরং একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। “আবার বলা হয়েছে, ‘যে কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দেয় সে তাকে তালাক-নামা দিক।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ জেনার দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে তালাক দেয় সে তাকে জেনাকারিনী করে তোলে। আর যাকে তালাক দেওয়া হয়েছে সেই স্ত্রীকে যে বিয়ে করে সেও জেনা করে। “আবার তোমরা শুনেছ, আগেকার লোকদের কাছে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যা কসম খেয়ো না, বরং মাবুদের উদ্দেশে তোমার সমস্ত কসম পালন কোরো।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, একেবারেই কসম খেয়ো না। বেহেশতের নামে খেয়ো না, কারণ তা আল্লাহ্‌র সিংহাসন। দুনিয়ার নামে খেয়ো না, কারণ তা তাঁর পা রাখবার জায়গা। জেরুজালেমের নামে খেয়ো না, কারণ তা মহান বাদশাহ্‌র শহর। তোমার মাথার নামে খেয়ো না, কারণ তার একটা চুল সাদা কি কালো করবার ক্ষমতা তোমার নেই। তোমাদের কথার ‘হ্যাঁ’ যেন ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ যেন ‘না’ হয়; এর বেশী যা, তা ইবলিসের কাছ থেকে আসে। “তোমরা শুনেছ, বলা হয়েছে, ‘চোখের বদলে চোখ এবং দাঁতের বদলে দাঁত।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের সংগে যে কেউ খারাপ ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে কিছুই কোরো না; বরং যে কেউ তোমার ডান গালে চড় মারে তাকে অন্য গালেও চড় মারতে দিয়ো। যে কেউ তোমার কোর্তা নেবার জন্য মামলা করতে চায় তাকে তোমার চাদরও নিতে দিয়ো। যে কেউ তোমাকে তার বোঝা নিয়ে এক মাইল যেতে বাধ্য করে তার সংগে দুই মাইল যেয়ো। যে তোমার কাছে কিছু চায় তাকে দিয়ো, আর যে তোমার কাছে ধার চায় তাকে দিতে অস্বীকার কোরো না। “তোমরা শুনেছ, বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিবেশীকে মহব্বত কোরো এবং শত্রুকে ঘৃণা কোরো।’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের শত্রুদেরও মহব্বত কোরো। যারা তোমাদের জুলুম করে তাদের জন্য মুনাজাত কোরো, যেন লোকে দেখতে পায় তোমরা সত্যিই তোমাদের বেহেশতী পিতার সন্তান। তিনি তো ভাল-মন্দ সকলের উপরে তাঁর সূর্য উঠান এবং সৎ ও অসৎ লোকদের উপরে বৃষ্টি দেন। যারা তোমাদের মহব্বত করে কেবল তাদেরই যদি তোমরা মহব্বত কর তবে তোমরা কি পুরস্কার পাবে? খাজনা-আদায়কারীরাও কি তা-ই করে না? আর যদি তোমরা কেবল তোমাদের নিজেদের লোকদেরই সালাম জানাও তবে অন্যদের চেয়ে বেশী আর কি করছ? অ-ইহুদীরাও কি তা-ই করে না? এইজন্য বলি, তোমাদের বেহেশতী পিতা যেমন খাঁটি তোমরাও তেমনি খাঁটি হও। “সাবধান, লোককে দেখাবার জন্য ধর্মকর্ম কোরো না; যদি কর তবে তোমাদের বেহেশতী পিতার কাছ থেকে কোন পুরস্কার পাবে না। “এইজন্য যখন তুমি গরীবদের কিছু দাও তখন ভণ্ডদের মত কোরো না। তারা তো লোকদের প্রশংসা পাবার জন্য মজলিস-খানায় এবং পথে পথে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ভিক্ষা দেয়। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তারা তাদের পুরস্কার পেয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যখন গরীবদের কিছু দাও তখন তোমার ডান হাত কি করছে তা তোমার বাঁ হাতকে জানতে দিয়ো না, যেন তোমার দান করা গোপনে হয়। তাহলে তোমার পিতা, যিনি গোপনে সব কিছু দেখেন, তিনিই তোমাকে পুরস্কার দেবেন। “তোমরা যখন মুনাজাত কর তখন ভণ্ডদের মত কোরো না, কারণ তারা লোকদের কাছে নিজেদের দেখাবার জন্য মজলিস-খানায় ও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মুনাজাত করতে ভালবাসে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তারা তাদের পুরস্কার পেয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যখন মুনাজাত কর তখন ভিতরের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ কোরো এবং তোমার পিতা, যাঁকে দেখা না গেলেও উপস্থিত আছেন, তাঁর কাছে মুনাজাত কোরো। তোমার পিতা, যিনি গোপন সব কিছু দেখেন, তিনিই তোমাকে পুরস্কার দেবেন। “যখন তোমরা মুনাজাত কর তখন অ-ইহুদীদের মত অর্থহীন কথা বার বার বোলো না। অ-ইহুদীরা মনে করে, বেশী কথা বললেই আল্লাহ্‌ তাদের মুনাজাত শুনবেন। তাদের মত কোরো না, কারণ তোমাদের পিতার কাছে চাইবার আগেই তিনি জানেন তোমাদের কি দরকার। এইজন্য তোমরা এইভাবে মুনাজাত কোরো: হে আমাদের বেহেশতী পিতা, তোমার নাম পবিত্র বলে মান্য হোক। তোমার রাজ্য আসুক। তোমার ইচ্ছা যেমন বেহেশতে তেমনি দুনিয়াতেও পূর্ণ হোক। যে খাবার আমাদের দরকার তা আজ আমাদের দাও। যারা আমাদের উপর অন্যায় করে, আমরা যেমন তাদের মাফ করেছি তেমনি তুমিও আমাদের সমস্ত অন্যায় মাফ কর। আমাদের তুমি পরীক্ষায় পড়তে দিয়ো না, বরং শয়তানের হাত থেকে রক্ষা কর। তোমরা যদি অন্যদের দোষ মাফ কর তবে তোমাদের বেহেশতী পিতা তোমাদেরও মাফ করবেন। কিন্তু তোমরা যদি অন্যদের দোষ মাফ না কর তবে তোমাদের পিতা তোমাদেরও মাফ করবেন না। “তোমরা যখন রোজা রাখ তখন ভণ্ডদের মত মুখ কালো করে রেখো না। তারা যে রোজা রাখছে তা লোকদের দেখাবার জন্য তারা মাথায় ও মুখে ছাই মেখে বেড়ায়। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তারা তাদের পুরস্কার পেয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যখন রোজা রাখ তখন মাথায় তেল দিয়ো ও মুখ ধুয়ো, যেন অন্যেরা জানতে না পারে যে, তুমি রোজা রাখছ। তাহলে তোমার পিতা, যিনি দেখা না গেলেও উপস্থিত আছেন, কেবল তিনিই তা দেখতে পাবেন। তোমার পিতা, যিনি গোপন সব কিছু দেখেন, তিনিই তোমাকে পুরস্কার দেবেন। “এই দুনিয়াতে তোমরা নিজেদের জন্য ধন-সম্পদ জমা কোরো না। এখানে মরচে ধরে ও পোকায় নষ্ট করে এবং চোর সিঁদ কেটে চুরি করে। কিন্তু বেহেশতে মরচেও ধরে না, পোকায় নষ্টও করে না এবং চোর সিঁদ কেটে চুরিও করে না। তাই বেহেশতে নিজেদের জন্য ধন জমা কর, কারণ তোমার ধন যেখানে থাকবে তোমার মনও সেখানে থাকবে। “চোখ শরীরের বাতি। সেইজন্য তোমার চোখ যদি ভাল হয় তবে তোমার সমস্ত শরীরই আলোতে পূর্ণ হবে। কিন্তু তোমার চোখ যদি খারাপ হয় তবে তোমার সমস্ত শরীর অন্ধকারে পূর্ণ হবে। তোমার মধ্যে যে আলো আছে তা যদি আসলে অন্ধকারই হয় তবে সেই অন্ধকার কি ভীষণ! “কেউই দুই কর্তার সেবা করতে পারে না, কারণ সে একজনকে ঘৃণা করবে ও অন্যজনকে ভালবাসবে। সে একজনের উপরে মনোযোগ দেবে ও অন্যজনকে তুচ্ছ করবে। আল্লাহ্‌ এবং ধন-সম্পত্তি এই দু’য়ের সেবা তোমরা একসংগে করতে পার না। “এইজন্য আমি তোমাদের বলছি, কি খাবে বলে বেঁচে থাকবার বিষয়ে কিংবা কি পরবে বলে শরীরের বিষয়ে চিন্তা কোরো না। প্রাণটা কেবল খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার নয়, আর শরীরটা কেবল কাপড়-চোপড়ের ব্যাপার নয়। “আকাশের পাখীদের দিকে তাকিয়ে দেখ; তারা বীজ বোনে না, কাটেও না, গোলাঘরে জমাও করে না, আর তবুও তোমাদের বেহেশতী পিতা তাদের খাইয়ে থাকেন। তোমরা কি তাদের থেকে আরও মূল্যবান নও? তোমাদের মধ্যে কে চিন্তা-ভাবনা করে নিজের আয়ু এক ঘণ্টা বাড়াতে পারে? “কাপড়-চোপড়ের জন্য কেন চিন্তা কর? মাঠের ফুলগুলোর কথা ভেবে দেখ সেগুলো কেমন করে বেড়ে ওঠে। তারা পরিশ্রম করে না, সুতাও কাটে না। কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, বাদশাহ্‌ সোলায়মান এত জাঁকজমকের মধ্যে থেকেও এগুলোর একটারও মত তিনি নিজেকে সাজাতে পারেন নি। মাঠের যে ঘাস আজ আছে আর কাল চুলায় ফেলে দেওয়া হবে, তা যখন আল্লাহ্‌ এইভাবে সাজান তখন ওহে অল্প বিশ্বাসীরা, তিনি যে তোমাদের নিশ্চয়ই সাজাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এইজন্য ‘কি খাব’ বা ‘কি পরব’ বলে চিন্তা কোরো না। অ-ইহুদীরাই এই সব বিষয়ের জন্য ব্যস্ত হয়; তা ছাড়া তোমাদের বেহেশতী পিতা তো জানেন যে, এই সব জিনিস তোমাদের দরকার আছে। কিন্তু তোমরা প্রথমে আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে ও তাঁর ইচ্ছামত চলবার জন্য ব্যস্ত হও। তাহলে ঐ সব জিনিসও তোমরা পাবে। কালকের বিষয় চিন্তা কোরো না; কালকের চিন্তা কালকের উপর ছেড়ে দাও। দিনের কষ্ট দিনের জন্য যথেষ্ট। “তোমরা অন্যের দোষ ধরে বেড়িয়ো না যেন তোমাদেরও দোষ ধরা না হয়, কারণ যেভাবে তোমরা অন্যের দোষ ধর সেইভাবে তোমাদেরও দোষ ধরা হবে, আর যেভাবে তোমরা মেপে দাও সেইভাবে তোমাদের জন্যও মাপা হবে। “তোমার ভাইয়ের চোখে যে কুটা আছে কেবল তা-ই দেখছ, অথচ তোমার নিজের চোখের মধ্যে যে কড়িকাঠ আছে তা লক্ষ্য করছ না কেন? যখন তোমার নিজের চোখেই কড়িকাঠ রয়েছে তখন কি করে তোমার ভাইকে এই কথা বলছ, ‘এস, তোমার চোখ থেকে কুটাটা বের করে দিই’? ভণ্ড! প্রথমে তোমার নিজের চোখ থেকে কড়িকাঠটা বের করে ফেল, তাতে তোমার ভাইয়ের চোখ থেকে কুটাটা বের করবার জন্য স্পষ্ট দেখতে পাবে। “যা পবিত্র তা কুকুরকে দিয়ো না। শূকরের সামনে তোমাদের মুক্তা ছড়ায়ো না। হয়তো তারা সেগুলো তাদের পায়ের তলায় মাড়াবে এবং ফিরে তোমাদের টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলবে। “চাও, তোমাদের দেওয়া হবে; খোঁজ কর, পাবে; দরজায় আঘাত দাও, তোমাদের জন্য খোলা হবে। যারা চায় তারা প্রত্যেকে পায়; যে খোঁজ করে সে পায়; আর যে দরজায় আঘাত দেয় তার জন্য দরজা খোলা হয়। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে, তার ছেলে রুটি চাইলে তাকে পাথর দেবে? কিংবা মাছ চাইলে সাপ দেবে? তোমরা খারাপ হয়েও যদি নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভাল ভাল জিনিস দিতে জান, তবে যারা তোমাদের বেহেশতী পিতার কাছে চায় তিনি যে তাদের ভাল ভাল জিনিস দেবেন এটা কত না নিশ্চয়! তোমরা অন্য লোকদের কাছ থেকে যে রকম ব্যবহার পেতে চাও তোমরাও তাদের সংগে সেই রকম ব্যবহার কোরো। এটাই হল তৌরাত কিতাব ও নবীদের কিতাবের শিক্ষার মূল কথা। “সরু দরজা দিয়ে ঢোকো, কারণ যে পথ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় তার দরজাও বড় এবং রাস্তাও চওড়া। অনেকেই তার মধ্য দিয়ে ঢোকে। কিন্তু যে পথ জীবনের দিকে নিয়ে যায় তার দরজাও সরু, পথও সরু। খুব কম লোকই তা খুঁজে পায়। “ভণ্ড নবীদের বিষয়ে সাবধান হও। তারা তোমাদের কাছে ভেড়ার চেহারায় আসে, অথচ ভিতরে তারা রাক্ষুসে নেকড়ে বাঘের মত। তাদের জীবনে যে ফল দেখা যায় তা দিয়েই তোমরা তাদের চিনতে পারবে। কাঁটাঝোপে কি আংগুর ফল কিংবা শিয়ালকাঁটায় কি ডুমুর ফল ধরে? ঠিক সেইভাবে প্রত্যেক ভাল গাছে ভাল ফলই ধরে আর খারাপ গাছে খারাপ ফলই ধরে। ভাল গাছে খারাপ ফল এবং খারাপ গাছে ভাল ফল ধরতে পারে না। যে গাছে ভাল ফল ধরে না তা কেটে আগুনে ফেলে দেওয়া হয়। এইজন্য বলি, ভণ্ড নবীদের জীবনে যে ফল দেখা যায় তা দিয়েই তোমরা তাদের চিনতে পারবে। “যারা আমাকে ‘প্রভু, প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়, কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু, প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করি নি?’ তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব, ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ “সেইজন্য বলি, যে কেউ আমার এই সমস্ত কথা শুনে তা পালন করে সে এমন একজন বুদ্ধিমান লোকের মত, যে পাথরের উপরে তার ঘর তৈরী করল। পরে বৃষ্টি নামল, বন্যা আসল, ঝড় বইল এবং সেই ঘরের উপরে আঘাত করল; কিন্তু সেই ঘরটা পড়ল না কারণ তা পাথরের উপরে তৈরী করা হয়েছিল। যে কেউ আমার এই সমস্ত কথা শুনে তা পালন না করে সে এমন একজন মূর্খ লোকের মত, যে বালির উপরে তার ঘর তৈরী করল। পরে বৃষ্টি নামল, বন্যা আসল, ঝড় বইল এবং সেই ঘরের উপরে আঘাত করল; তাতে ঘরটা পড়ে গেল। কি ভীষণ ভাবেই না সেই ঘরটা পড়ে গেল!” ঈসা যখন কথা বলা শেষ করলেন তখন লোকেরা তাঁর শিক্ষায় আশ্চর্য হয়ে গেল, কারণ তিনি আলেমদের মত শিক্ষা দিচ্ছিলেন না, বরং যাঁর অধিকার আছে সেই রকম লোকের মতই শিক্ষা দিচ্ছিলেন। ঈসা যখন পাহাড় থেকে নেমে আসলেন তখন অনেক লোক তাঁর পিছনে পিছনে চলল। সেই সময় একজন চর্মরোগী এসে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে বলল, “হুজুর, আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ভাল করতে পারেন।” ঈসা হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে বললেন, “আমি তা-ই চাই, তুমি পাক-সাফ হও।” তখনই লোকটির চর্মরোগ ভাল হয়ে গেল। ঈসা তাকে বললেন, “দেখ, কাউকে এই কথা বোলো না, বরং ইমামের কাছে গিয়ে নিজেকে দেখাও, আর নবী মূসা যা হুকুম দিয়েছেন সেই মত দান কোরবানী দাও। এতে লোকদের কাছে প্রমাণ হবে তুমি ভাল হয়েছ।” পরে ঈসা কফরনাহূম শহরে ঢুকলেন। তখন একজন রোমীয় শত-সেনাপতি তাঁর কাছে এসে অনুরোধ করে বললেন, “হুজুর, আমার গোলাম ঘরে বিছানায় পড়ে আছে। সে অবশ-রোগে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমি গিয়ে তাকে ভাল করব।” সেই সেনাপতি তাঁকে বললেন, “হুজুর, আপনি যে আমার বাড়ীতে ঢোকেন এমন যোগ্য আমি নই। কেবল মুুখে বলুন, তাতেই আমার গোলাম ভাল হয়ে যাবে। আমি এই কথা জানি কারণ আমাকেও অন্যের কথামত চলতে হয় এবং সৈন্যেরা আমার কথামত চলে। আমি একজনকে ‘যাও’ বললে সে যায়, অন্যজনকে ‘এস’ বললে সে আসে। আমার গোলামকে ‘এটা কর’ বললে সে তা করে।” ঈসা এই কথা শুনে আশ্চর্য হলেন এবং যারা তাঁর পিছনে পিছনে যাচ্ছিল তাদের বললেন, “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, বনি-ইসরাইলদের মধ্যেও এত বড় ঈমান কারও মধ্যে আমি দেখি নি। আমি আপনাদের বলছি যে, পূর্ব ও পশ্চিম থেকে অনেকে আসবে এবং ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের সংগে বেহেশতী রাজ্যে খেতে বসবে। কিন্তু যাদের বেহেশতী রাজ্যে থাকবার কথা তাদের বাইরের অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হবে। সেখানে লোকেরা কান্নাকাটি করবে ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে।” পরে ঈসা সেই সেনাপতিকে বললেন, “আপনি যান। আপনি যেমন বিশ্বাস করেছেন তেমনই হোক।” ঠিক তখনই তাঁর গোলাম ভাল হয়ে গেল। এর পরে ঈসা পিতরের বাড়ীতে গিয়ে দেখলেন, পিতরের শাশুড়ীর জ্বর হয়েছে এবং তিনি শুয়ে আছেন। ঈসা তাঁর হাত ছুঁলেন আর তাতে তাঁর জ্বর ছেড়ে গেল। তখন তিনি উঠে ঈসার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। সন্ধ্যা হলে পর লোকেরা ভূতে পাওয়া অনেককে ঈসার কাছে নিয়ে আসল। তিনি মুখের কথাতেই সেই ভূতদের ছাড়ালেন আর যারা অসুস্থ ছিল তাদের সবাইকে সুস্থ করলেন। এই সব ঘটল যাতে নবী ইশাইয়ার মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: তিনি আমাদের সমস্ত দুর্বলতা তুলে নিলেন, আর আমাদের রোগ দূর করলেন। ঈসা নিজের চারদিকে অনেক লোকের ভিড় দেখে সাহাবীদের সাগরের অন্য পারে যাবার হুকুম দিলেন। একজন আলেম তখন ঈসার কাছে এসে বললেন, “হুজুর, আপনি যেখানে যাবেন আমিও আপনার সংগে সেখানে যাব।” ঈসা তাঁকে বললেন, “শিয়ালের গর্ত আছে এবং পাখীর বাসা আছে, কিন্তু ইব্‌ন্তেআদমের মাথা রাখবার জায়গা কোথাও নেই।” সাহাবীদের মধ্যে আর একজন এসে তাঁকে বললেন, “হুজুর, আগে আমার বাবাকে দাফন করে আসতে দিন।” ঈসা তাঁকে বললেন, “মৃতেরাই তাদের মৃতদের দাফন করুক, কিন্তু তুমি আমার সংগে এস।” পরে ঈসা একটা নৌকাতে উঠলেন এবং তাঁর সাহাবীরা তাঁর সংগে গেলেন। হঠাৎ সাগরে ভীষণ ঝড় উঠল, আর তাতে নৌকার উপর ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। ঈসা কিন্তু ঘুমাচ্ছিলেন। তখন সাহাবীরা তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে জাগিয়ে বললেন, “হুজুর, বাঁচান; আমরা যে মরলাম!” তখন তিনি তাঁদের বললেন, “অল্প বিশ্বাসীরা, কেন তোমরা ভয় পাচ্ছ?” এর পরে তিনি উঠে বাতাস ও সাগরকে ধমক দিলেন। তখন সব কিছু খুব শান্ত হয়ে গেল। এতে সাহাবীরা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “ইনি কি রকম লোক যে, বাতাস এবং সাগরও তাঁর কথা শোনে!” পরে ঈসা সাগরের অন্য পারে গাদারীয়দের এলাকায় গেলেন। তখন ভূতে পাওয়া দু’জন লোক কবরস্থান থেকে বের হয়ে তাঁর কাছে আসল। তারা এমন ভয়ঙ্কর ছিল যে, কেউই সেই পথ দিয়ে যেতে পারত না। তারা চিৎকার করে বলল, “হে ইব্‌নুল্লাহ্‌, আমাদের সংগে আপনার কি দরকার? সময় না হতেই কি আপনি আমাদের যন্ত্রণা দিতে এখানে এসেছেন?” তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু দূরে খুব বড় এক পাল শূকর চরে বেড়াচ্ছিল। ভূতেরা ঈসাকে অনুরোধ করে বলল, “আপনি যদি আমাদের দূর করেই দিতে চান তবে ঐ শূকরের পালের মধ্যেই পাঠিয়ে দিন।” ঈসা তাদের বললেন, “তা-ই যাও।” তখন তারা বের হয়ে শূকরগুলোর মধ্যে গেল। তাতে সেই শূকরের পাল ঢালু পার দিয়ে জোরে দৌড়ে গেল এবং সাগরের পানিতে ডুবে মরল। যারা সেই পাল চরাচ্ছিল তারা তখন দৌড়ে গ্রামে গিয়ে সব খবর জানাল। বিশেষ করে সেই ভূতে পাওয়া লোকদের বিষয়ে তারা সবাইকে বলল। তখন গ্রামের সব লোক বের হয়ে ঈসার সংগে দেখা করতে গেল। তাঁর সংগে দেখা হলে পর তারা তাঁকে অনুরোধ করল যেন তিনি তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যান। পরে ঈসা নৌকায় উঠে সাগর পার হয়ে নিজের শহরে আসলেন। লোকেরা তখন বিছানায় পড়ে থাকা একজন অবশ-রোগীকে তাঁর কাছে আনল। সেই লোকদের বিশ্বাস দেখে ঈসা সেই রোগীকে বললেন, “সাহস কর। তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল।” এতে কয়েকজন আলেম মনে মনে বলতে লাগলেন, “এই লোকটা কুফরী করছে।” ঈসা তাঁদের মনের চিন্তা জেনে বললেন, “আপনারা মনে মনে খারাপ চিন্তা করছেন কেন? কোন্‌টা বলা সহজ, ‘তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল,’ না ‘তুমি উঠে হেঁটে বেড়াও’? আপনারা যেন জানতে পারেন এই দুনিয়াতে গুনাহ্‌ মাফ করবার ক্ষমতা ইব্‌ন্তেআদমের আছে”- এই পর্যন্ত বলে তিনি সেই অবশ-রোগীকে বললেন, “ওঠো, তোমার বিছানা তুলে নিয়ে বাড়ী যাও।” তখন সে উঠে তার বাড়ীতে চলে গেল। লোকে এই ঘটনা দেখে ভয় পেল, আর আল্লাহ্‌ মানুষকে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন বলে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। ঈসা যখন সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন তখন পথে মথি নামে একজন লোককে খাজনা আদায় করবার ঘরে বসে থাকতে দেখলেন। ঈসা তাঁকে বললেন, “এস, আমার উম্মত হও।” মথি তখনই উঠে তাঁর সংগে গেলেন। এর পরে ঈসা মথির বাড়ীতে খেতে বসলেন। তখন অনেক খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোক এসে ঈসা ও তাঁর সাহাবীদের সংগে খেতে বসল। তা দেখে ফরীশীরা ঈসার সাহাবীদের বললেন, “তোমাদের ওস্তাদ খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করেন কেন?” এই কথা শুনে ঈসা বললেন, “যারা সুস্থ আছে তাদের জন্য ডাক্তারের দরকার নেই, বরং অসুস্থদের জন্যই দরকার আছে। ‘আমি দয়া দেখতে চাই, পশু-কোরবানী নয়’- পাক-কিতাবের এই কথার মানে কি, তা গিয়ে খুঁজে বের করুন। যারা ধার্মিক তাদের আমি ডাকতে আসি নি, বরং গুনাহ্‌গারদেরই ডাকতে এসেছি।” পরে ইয়াহিয়ার সাহাবীরা ঈসার কাছে এসে বললেন, “আমরা ও ফরীশীরা এত রোজা রাখি, কিন্তু আপনার সাহাবীরা রোজা রাখেন না কেন?” ঈসা তাঁদের বললেন, “বর সংগে থাকতে কি বরের সংগের লোকেরা দুঃখ প্রকাশ করতে পারে? কিন্তু সময় আসছে যখন বরকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই সময় তারা রোজা রাখবে। “কেউ পুরানো কোর্তাতে নতুন কাপড়ের তালি দেয় না, কারণ পরে সেই পুরানো কাপড় থেকে নতুন তালিটা ছিঁড়ে আসে আর তাতে সেই ছেঁড়াটা আরও বড় হয়। পুরানো চামড়ার থলিতে কেউ টাটকা আংগুর-রস রাখে না। রাখলে থলিগুলো ফেটে গিয়ে সেই রস পড়ে যায় আর থলিগুলোও নষ্ট হয়। লোকে নতুন চামড়ার থলিতেই টাটকা আংগুর-রস রাখে; তাতে দু’টাই রক্ষা পায়।” ঈসা লোকদের যখন এই সব কথা বলছিলেন তখন একজন ইহুদী নেতা তাঁর কাছে আসলেন এবং তাঁর সামনে উবুড় হয়ে বললেন, “আমার মেয়েটা এইমাত্র মারা গেছে। কিন্তু আপনি এসে তার উপর হাত রাখুন, তাতে সে বেঁচে উঠবে।” তখন ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা উঠে তাঁর সংগে গেলেন। সেই সময় একজন স্ত্রীলোক পিছন থেকে ঈসার কাছে এসে তাঁর চাদরের কিনারা ছুঁলো। স্ত্রীলোকটি বারো বছর ধরে রক্তস্রাব রোগে ভুগছিল। সে মনে মনে ভাবছিল, যদি সে কেবল তাঁর কাপড়টা ছুঁতে পারে তাহলেই ভাল হয়ে যাবে। ঈসা ফিরে তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, “সাহস কর। তুমি বিশ্বাস করেছ বলে ভাল হয়েছ।” সেই সময় থেকেই স্ত্রীলোকটি সুস্থ হল। এর পরে ঈসা সেই ইহুদী নেতার বাড়ীতে গেলেন। সেখানে তিনি দেখলেন, যারা বাঁশী বাজায় তারা রয়েছে এবং লোকেরা হৈচৈ করছে। এতে ঈসা বললেন, “তোমরা বাইরে যাও। মেয়েটি মারা যায় নি, ঘুমাচ্ছে।” এই কথা শুনে তারা হাসাহাসি করতে লাগল। লোকদের বের করে দেওয়া হলে পর তিনি ভিতরে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরলেন। তাতে সে উঠে বসল। এই ঘটনার কথা সেই এলাকার সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাবার সময় দু’জন অন্ধ লোক তাঁর পিছনে পিছনে চলল। তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, “দাউদের বংশধর, আমাদের দয়া করুন।” ঈসা ঘরে ঢুকলে পর সেই অন্ধ লোকেরা তাঁর কাছে আসল। তখন তিনি তাদের বললেন, “তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, আমি এই কাজ করতে পারি?” তারা বলল, “জ্বী হুজুর, করি।” তিনি তাদের চোখ ছুঁয়ে বললেন, “তোমরা যেমন বিশ্বাস করেছ তোমাদের প্রতি তেমনই হোক।” আর তখনই তাদের চোখ খুলে গেল। ঈসা খুব কঠোরভাবে তাদের বললেন, “দেখো, কেউ যেন জানতে না পারে।” কিন্তু তারা বাইরে গিয়ে সেই এলাকার সমস্ত জায়গায় ঈসার খবর ছড়িয়ে দিল। সেই দু’জন লোক যখন চলে যাচ্ছিল তখন লোকেরা ভূতে পাওয়া একজন বোবা লোককে ঈসার কাছে আনল। ঈসা সেই ভূতকে ছাড়াবার পর লোকটা কথা বলতে লাগল। তাতে সবাই আশ্চর্য হয়ে বলল, “ইসরাইল দেশে আর কখনও এই রকম দেখা যায় নি।” তখন ফরীশীরা বললেন, “সে ভূতদের বাদশাহ্‌র সাহায্যে ভূত ছাড়ায়।” ঈসা শহরে শহরে ও গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইহুদীদের মজলিস-খানায় শিক্ষা দিতে ও বেহেশতী রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করতে লাগলেন। এছাড়া তিনি লোকদের সব রকম রোগও ভাল করলেন। লোকদের ভিড় দেখে তাদের জন্য ঈসার মমতা হল, কারণ তারা রাখালহীন ভেড়ার মত ক্লান্ত ও অসহায় ছিল। তখন ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “ফসল সত্যিই অনেক কিন্তু কাজ করবার লোক কম। সেইজন্য ফসলের মালিকের কাছে অনুরোধ কর যেন তিনি তাঁর ফসল কাটবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেন।” ঈসা তাঁর বারোজন সাহাবীকে ডাকলেন এবং ভূত ছাড়াবার ও সব রকম রোগ ভাল করবার ক্ষমতা দিয়ে তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন। সেই বারোজন প্রেরিতের নাম এই: প্রথম, শিমোন যাঁকে পিতর বলা হয়, তারপর তাঁর ভাই আন্দ্রিয়; সিবদিয়ের ছেলে ইয়াকুব ও তাঁর ভাই ইউহোন্না; ফিলিপ ও বর্‌থলময়; থোমা ও খাজনা-আদায়কারী মথি; আল্‌ফেয়ের ছেলে ইয়াকুব ও থদ্দেয়; মৌলবাদী শিমোন এবং ঈসাকে যে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই এহুদা ইষ্কারিয়োৎ। ঈসা সেই বারোজনকে এই সব হুকুম দিয়ে পাঠালেন, “তোমরা অ-ইহুদীদের কাছে বা সামেরীয়দের কোন গ্রামে যেয়ো না, বরং ইসরাইল জাতির হারানো ভেড়াদের কাছে যেয়ো। তোমরা যেতে যেতে এই কথা তবলিগ কোরো যে, বেহেশতী রাজ্য কাছে এসে গেছে। এছাড়া তোমরা অসুস্থদের সুস্থ কোরো, মৃতদের জীবন দিয়ো, চর্মরোগীদের ভালো কোরো ও ভূতদের ছাড়ায়ো। তোমরা বিনামূল্যে পেয়েছ, বিনামূল্যেই দিয়ো। তোমাদের কোমর-বাঁধনিতে তোমরা সোনা, রূপা কিংবা তামার পয়সাও নিয়ো না। পথের জন্য কোন রকম থলি, দু’টা কোর্তা, জুতা বা লাঠিও নিয়ো না, কারণ যে কাজ করে সে খাওয়া-পরা পাবার যোগ্য। “তোমরা যে কোন শহরে বা গ্রামে যাবে সেখানে একজন উপযুক্ত লোক খুঁজে নিয়ো এবং অন্য কোথাও চলে না যাওয়া পর্যন্ত তার বাড়ীতে থেকো। সেই বাড়ীর ভিতরে ঢুকবার সময় তাদের সালাম জানায়ো। যদি সেই বাড়ী উপযুক্ত হয় তবে তোমাদের শান্তি সেই বাড়ীর উপরে নেমে আসুক। কিন্তু যদি সেই বাড়ী উপযুক্ত না হয় তবে তোমাদের শান্তি তোমাদের কাছেই ফিরে আসুক। যদি কেউ তোমাদের গ্রহণ না করে বা তোমাদের কথা না শোনে তবে সেই বাড়ী বা গ্রাম থেকে চলে যাবার সময়ে তোমাদের পায়ের ধুলা ঝেড়ে ফেলো। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, রোজ হাশরে সেই গ্রামের চেয়ে বরং সাদুম ও আমুরা শহরের অবস্থা অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে। “দেখ, আমি নেকড়ে বাঘের মধ্যে ভেড়ার মত তোমাদের পাঠাচ্ছি। এইজন্য সাপের মত সতর্ক এবং কবুতরের মত সরল হও। সাবধান থেকো, কারণ মানুষ বিচার-সভার লোকদের হাতে তোমাদের ধরিয়ে দেবে এবং তাদের মজলিস-খানায় তোমাদের বেত মারবে। আমার জন্যই শাসনকর্তা ও বাদশাহ্‌দের সামনে তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে যেন তাদের কাছে ও অ-ইহুদীদের কাছে তোমরা সাক্ষ্য দিতে পার। লোকেরা যখন তোমাদের ধরিয়ে দেবে তখন কিভাবে এবং কি বলতে হবে তা ভেবো না। কি বলতে হবে তা তোমাদের সেই সময়েই বলে দেওয়া হবে। তোমরাই যে বলবে তা নয়, বরং তোমাদের পিতার রূহ্‌ তোমাদের মধ্য দিয়ে কথা বলবেন। “ভাই ভাইকে এবং বাবা ছেলেকে হত্যা করবার জন্য ধরিয়ে দেবে। ছেলেমেয়েরা মা-বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের খুন করাবে। আমার জন্য সবাই তোমাদের ঘৃণা করবে, কিন্তু যে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকবে সে উদ্ধার পাবে। কোন গ্রামের লোকেরা যখন তোমাদের উপর জুলুম করবে তখন অন্য গ্রামে পালিয়ে যেয়ো। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, ইসরাইল দেশের সমস্ত শহর ও গ্রামে তোমাদের কাজ শেষ হবার আগেই ইব্‌ন্তেআদম আসবেন। “শিক্ষক থেকে ছাত্র বড় নয় এবং মালিক থেকে গোলাম বড় নয়। ছাত্রের পক্ষে শিক্ষকের মত হওয়া আর গোলামের পক্ষে মালিকের মত হওয়াই যথেষ্ট। ঘরের কর্তাকেই যখন তারা বেল্‌সবূল বলেছে তখন ঘরের অন্য সবাইকে আরও কত বেশী করেই না বেল্‌সবূল বলবে। “তবে তোমরা তাদের ভয় কোরো না, কারণ লুকানো সব কিছুই প্রকাশ পাবে এবং গোপন সব কিছুই জানানো হবে। আমি তোমাদের কাছে যা অন্ধকারে বলছি তা তোমরা আলোতে বোলো। তোমরা যা কান্তেকানে শুনছ তা ছাদের উপর থেকে প্রচার কোরো। যারা কেবল শরীরটা মেরে ফেলতে পারে কিন্তু রূহ্‌কে মারতে পারে না তাদের ভয় কোরো না। যিনি শরীর ও রূহ্‌ দু’টাই জাহান্নামে ধ্বংস করতে পারেন বরং তাঁকেই ভয় কর। দু’টা চড়াই পাখী কি সামান্য দামে বিক্রি হয় না? তবুও তোমাদের পিতার অনুমতি ছাড়া তাদের একটাও মাটিতে পড়ে না; এমন কি, তোমাদের মাথার চুলগুলোও গোণা আছে। কাজেই তোমরা ভয় পেয়ো না। অনেক অনেক চড়াই পাখীর চেয়েও তোমাদের মূল্য অনেক বেশী। “যে কেউ মানুষের সামনে আমাকে স্বীকার করে আমিও আমার বেহেশতী পিতার সামনে তাকে স্বীকার করব। কিন্তু যে কেউ মানুষের সামনে আমাকে অস্বীকার করে আমিও আমার বেহেশতী পিতার সামনে তাকে অস্বীকার করব। “আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে কোরো না। আমি শান্তি দিতে আসি নি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে শাশুড়ীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। একজন মানুষের নিজের পরিবারের লোকেরাই তার শত্রু হবে। “যে কেউ আমার চেয়ে পিতা-মাতাকে বেশী ভালবাসে সে আমার উপযুক্ত নয়। আর যে কেউ ছেলে বা মেয়েকে আমার চেয়ে বেশী ভালবাসে সে আমার উপযুক্ত নয়। যে নিজের ক্রুশ নিয়ে আমার পথে না চলে সে-ও আমার উপযুক্ত নয়। যে কেউ নিজের জীবন রক্ষা করতে চায় সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে; কিন্তু যে কেউ আমার জন্য তার প্রাণ হারায় সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে। “যে তোমাদের গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে; আর যে আমাকে গ্রহণ করে আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন সে তাঁকেই গ্রহণ করে। কোন নবীকে যদি কেউ নবী বলে গ্রহণ করে তবে নবী যে পুরস্কার পাবে সে-ও সেই পুরস্কার পাবে। একজন আল্লাহ্‌ভক্ত লোককে যদি কেউ আল্লাহ্‌ভক্ত লোক বলে গ্রহণ করে তবে আল্লাহ্‌ভক্ত লোক যে পুরস্কার পাবে সে-ও সেই পুরস্কার পাবে। যে কেউ এই সামান্য লোকদের মধ্যে একজনকে আমার উম্মত বলে এক পেয়ালা ঠাণ্ডা পানি দেয়, আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, সে কোনমতে তার পুরস্কার হারাবে না।” ঈসা তাঁর বারোজন সাহাবীকে হুকুম দেওয়া শেষ করলেন। তারপর তিনি গ্রামে গ্রামে শিক্ষা দেবার ও তবলিগ করবার জন্য সেখান থেকে চলে গেলেন। ইয়াহিয়া জেলখানায় থেকে যখন মসীহের কাজের কথা শুনলেন তখন তাঁর সাহাবীদের দিয়ে ঈসাকে জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন, “যাঁর আসবার কথা আছে আপনি কি তিনি, না আমরা আর কারও জন্য অপেক্ষা করব?” জবাবে ঈসা তাদের বললেন, “তোমরা যা শুনছ এবং দেখছ তা গিয়ে ইয়াহিয়াকে বল। তাঁকে জানাও যে, অন্ধেরা দেখছে, খোঁড়ারা হাঁটছে, চর্মরোগীরা পাক-সাফ হচ্ছে, বধির লোকেরা শুনছে, মৃতেরা বেঁচে উঠছে আর গরীব লোকদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করা হচ্ছে। আর ধন্য সে-ই যে আমাকে নিয়ে মনে কোন বাধা না পায়।” ইয়াহিয়ার সাহাবীরা চলে যাচ্ছে, এমন সময় ঈসা লোকদের কাছে ইয়াহিয়ার বিষয়ে বলতে শুরু করলেন, “আপনারা মরুভূমিতে কি দেখতে গিয়েছিলেন? বাতাসে দোলা নল-খাগড়া? তা না হলে কি দেখতে গিয়েছিলেন? সুন্দর কাপড় পরা কোন লোককে দেখতে কি? আসলে যারা সুন্দর কাপড় পরে তারা বাদশাহ্‌র বাড়ীতে থাকে। তা না হলে কি দেখতে গিয়েছিলেন? কোন নবীকে কি? জ্বী, আমি আপনাদের বলছি, তিনি নবীর চেয়েও বড়। ইয়াহিয়াই সেই লোক যাঁর বিষয়ে কিতাবে লেখা আছে: দেখ, আমি তোমার আগে আমার সংবাদদাতাকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার আগে গিয়ে তোমার পথ প্রস্তুত করবে। আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, মানুষের মধ্যে তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়ার চেয়ে বড় আর কেউ নেই। কিন্তু বেহেশতী রাজ্যের মধ্যে যে সকলের চেয়ে ছোট সে-ও ইয়াহিয়ার চেয়ে মহান। ইয়াহিয়ার সময় থেকে এখন পর্যন্ত বেহেশতী রাজ্য খুব জোরের সংগে এগিয়ে আসছে, আর যারা শক্তিশালী তারা তা আঁকড়ে ধরছে। ইয়াহিয়ার সময় পর্যন্ত নবীদের সমস্ত কিতাব, এমন কি, তৌরাত কিতাবও ভবিষ্যতের কথা বলেছে। যদি আপনারা এই কথা বিশ্বাস করতে রাজী থাকেন তবে শুনুন্ত যাঁর আসবার কথা ছিল এই ইয়াহিয়াই সেই নবী ইলিয়াস। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক।” “এই কালের লোকদের আমি কাদের সংগে তুলনা করব? এরা এমন ছেলেমেয়েদের মত যারা বাজারে বসে অন্য ছেলেমেয়েদের ডেকে বলে, ‘আমরা তোমাদের জন্য বাঁশী বাজালাম, তোমরা নাচলে না; বিলাপের গান গাইলাম, তোমরা বুক চাপড়ালে না।’ ইয়াহিয়া এসে খাওয়া-দাওয়া করলেন না বলে লোকে বলছে, ‘তাকে ভূতে পেয়েছে।’ আর ইব্‌ন্তেআদম এসে খাওয়া-দাওয়া করলেন বলে লোকে বলছে, ‘ঐ দেখ, একজন পেটুক ও মদখোর, খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের বন্ধু।’ কিন্তু জ্ঞান যে খাঁটি তার প্রমাণ তার কাজের মধ্যেই রয়েছে।” ঈসা যে সব গ্রামে ও শহরে বেশীর ভাগ অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করেছিলেন সেই সব জায়গার লোকেরা তওবা করে নি। এইজন্য সেই জায়গাগুলোকে তিনি ধিক্কার দিয়ে বলতে লাগলেন, “ঘৃণ্য কোরাসীন, ঘৃণ্য বৈৎসৈদা! তোমাদের মধ্যে যে সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করা হয়েছে সেগুলো যদি টায়ার ও সিডন শহরে করা হত তবে অনেক দিন আগেই তারা চট পরে ছাই মেখে তওবা করত। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, রোজ হাশরে টায়ার ও সিডনের অবস্থা বরং তোমাদের চেয়ে অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে। আর তুমি কফরনাহূম! তুমি নাকি বেহেশত পর্যন্ত উঁচুতে উঠবে? কখনও না, তোমাকে নীচে কবরে ফেলে দেওয়া হবে। যে সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ তোমার মধ্যে করা হয়েছে তা যদি সাদুম শহরে করা হত তবে সাদুম আজও টিকে থাকত। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, রোজ হাশরে সাদুমের অবস্থা বরং তোমাদের চেয়ে অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে।” তারপর ঈসা বললেন, “হে পিতা, তুমি বেহেশত ও দুনিয়ার মালিক। আমি তোমার প্রশংসা করি, কারণ তুমি এই সব বিষয় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছ, কিন্তু শিশুর মত লোকদের কাছে প্রকাশ করেছ। জ্বী পিতা, তোমার ইচ্ছামতই এটা হয়েছে। “আমার পিতা সব কিছুই আমার হাতে দিয়েছেন। পিতা ছাড়া পুত্রকে কেউ জানে না এবং পুত্র ছাড়া পিতাকে কেউ জানে না, আর পুত্র যার কাছে পিতাকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করেন সে-ই তাঁকে জানে। “তোমরা যারা ক্লান্ত ও বোঝা বয়ে বেড়া"ছ, তোমরা সবাই আমার কাছে এস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব। আমার জোয়াল তোমাদের উপর তুলে নাও ও আমার কাছ থেকে শেখো, কারণ আমার স্বভাব নরম ও নম্র। এতে তোমরা দিলে বিশ্রাম পাবে, কারণ আমার জোয়াল বয়ে নেওয়া সহজ ও আমার বোঝা হালকা।” একদিন ঈসা একটা শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই দিনটা বিশ্রামবার ছিল। তাঁর সাহাবীদের খিদে পেয়েছিল বলে তাঁরা শীষ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগলেন। তা দেখে ফরীশীরা তাঁকে বললেন, “শরীয়ত মতে বিশ্রামবারে যা করা উচিত নয়, দেখুন, আপনার সাহাবীরা তা-ই করছে।” ঈসা তাঁদের বললেন, “দাউদ ও তাঁর সংগীদের যখন খিদে পেয়েছিল তখন তিনি কি করেছিলেন তা কি আপনারা পড়েন নি? তিনি তো আল্লাহ্‌র ঘরে ঢুকে পবিত্র-রুটি খেয়েছিলেন। নবী দাউদ ও তাঁর সংগীদের অবশ্য তা খাওয়া উচিত ছিল না, কেবল ইমামেরাই তা খেতে পারতেন। এছাড়া আপনারা কি তৌরাত শরীফে পড়েন নি যে, বিশ্রামবারে বায়তুল-মোকাদ্দসের ইমামেরা বিশ্রামবারের নিয়ম ভাংলেও তাঁদের দোষ হয় না? আমি আপনাদের বলছি, বায়তুল-মোকাদ্দস থেকেও বড় একজন এখানে আছেন। ‘আমি দয়া দেখতে চাই, পশু-কোরবানী নয়’- কিতাবের এই কথার অর্থ যদি আপনারা জানতেন তবে নির্দোষীদের দোষী করতেন না। জেনে রাখুন, ইব্‌ন্তেআদমই বিশ্রামবারের মালিক।” পরে সেই জায়গা ছেড়ে ঈসা সেই ফরীশীদের মজলিস-খানায় গেলেন। সেখানে একজন লোক ছিল যার একটা হাত শুকিয়ে গিয়েছিল। ঈসাকে দোষী করবার উদ্দেশ্যে ফরীশীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শরীয়ত মতে বিশ্রামবারে কি কাউকে সুস্থ করা উচিত?” ঈসা তাঁদের বললেন, “ধরুন, আপনাদের মধ্যে কারও একটা ভেড়া আছে। সেই ভেড়াটা যদি বিশ্রামবারে গর্তে পড়ে যায় তবে কি তিনি তাকে ধরে তুলবেন না? আর ভেড়ার চেয়ে মানুষের দাম তো অনেক বেশী। তাহলে দেখা যায়, বিশ্রামবারে ভাল কাজ করা উচিত।” তারপর তিনি লোকটিকে বললেন, “তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।” সে তার হাতটা বাড়িয়ে দিলে পর সেটা ভাল হয়ে অন্য হাতটার মত হয়ে গেল। তখন ফরীশীরা বাইরে গেলেন এবং ঈসাকে হত্যা করবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পরামর্শ করতে লাগলেন। সেই পরামর্শের বিষয় জানতে পেরে ঈসা সেখান থেকে চলে গেলেন। তখন অনেক লোক তাঁর পিছনে পিছনে গেল। তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ ছিল তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করলেন এবং সাবধান করে দিলেন যেন তাঁর বিষয়ে তারা বলাবলি না করে। এটা হল যাতে নবী ইশাইয়ার মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: দেখ, আমার গোলাম যাঁকে আমি বেছে নিয়েছি। ইনিই আমার প্রিয়জন যাঁর উপর আমি সন্তুষ্ট। আমি তাঁর উপরে আমার রূহ্‌ দেব, আর তিনি অ-ইহুদীদের কাছে ন্যায়বিচার প্রচার করবেন। তিনি ঝগড়া বা চিৎকার করবেন না; তিনি রাস্তায় রাস্তায় তাঁর গলার আওয়াজ শোনাবেন না। ন্যায়বিচারকে জয়ী না করা পর্যন্ত তিনি থেঁৎলে যাওয়া নল ভাংবেন না আর মিট মিট করে জ্বলতে থাকা সল্‌তে নিভাবেন না। তাঁরই উপর অ-ইহুদীরা আশা রাখবে। পরে লোকেরা ভূতে পাওয়া একজন লোককে ঈসার কাছে আনল। লোকটি অন্ধ এবং বোবা ছিল। ঈসা তাকে ভাল করলেন। তাতে লোকটি কথা বলতে লাগল ও দেখতে পেল। তখন সব লোকেরা আশ্চর্য হয়ে বলল, “ইনি কি দাউদের সেই বংশধর?” ফরীশীরা এই কথা শুনে বললেন, “ও তো কেবল ভূতদের বাদশাহ্‌ বেল্‌সবূলের সাহায্যে ভূত ছাড়ায়।” ফরীশীদের মনের চিন্তা বুঝতে পেরে ঈসা তাঁদের বললেন, “যে রাজ্য নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সেই রাজ্য ধ্বংস হয়। আর যে শহর বা পরিবার নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সেই শহর বা পরিবার টেকে না। শয়তান যদি শয়তানকেই বের করে দেয় তবে সে তো নিজের মধ্যেই ভাগ হয়ে গেল। তাহলে তার রাজ্য কি করে টিকবে? আমি যদি বেল্‌সবূলের সাহায্যেই ভূত ছাড়াই তবে আপনাদের লোকেরা কার সাহায্যে তাদের ছাড়ায়? আপনারা ঠিক কথা বলছেন কি না, আপনাদের লোকেরাই তা বিচার করবে। কিন্তু আমি যদি আল্লাহ্‌র রূহের সাহায্যে ভূত ছাড়াই তবে আল্লাহ্‌র রাজ্য তো আপনাদের কাছে এসে গেছে। “যে লোকের গায়ে বল আছে তাঁকে প্রথমে বেঁধে না রাখলে কেউ কি তার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র লুট করতে পারে? বাঁধলে পরেই সে তা পারবে। “যদি কেউ আমার পক্ষে না থাকে তবে সে আমার বিপক্ষে আছে। যে আমার সংগে কুড়ায় না সে ছড়ায়। এইজন্য আমি আপনাদের বলছি, মানুষের সমস্ত গুনাহ্‌ এবং কুফরী মাফ করা হবে, কিন্তু পাক-রূহের বিরুদ্ধে কুফরী মাফ করা হবে না। ইব্‌ন্তেআদমের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে তাকে মাফ করা হবে, কিন্তু পাক-রূহের বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁকে মাফ করা হবে না- এই যুগেও না, আগামী যুগেও না। “এই কথা স্বীকার করুন যে, গাছ ভাল হলে তার ফলও ভাল হবে, আবার গাছ খারাপ হলে তার ফলও খারাপ হবে; কারণ ফল দিয়েই গাছ চেনা যায়। সাপের বংশধরেরা! নিজেরা খারাপ হয়ে কেমন করে আপনারা ভাল কথা বলতে পারেন? মানুষের দিল যা দিয়ে পূর্ণ থাকে মুখ তো সেই কথাই বলে। ভাল লোক তার দিল-ভরা ভাল থেকে ভাল কথা বের করে, আর খারাপ লোক তার দিল-ভরা খারাপী থেকে খারাপ কথা বের করে। কিন্তু আমি আপনাদের বলছি, লোকে যে সব বাজে কথা বলে, রোজ হাশরে তার প্রত্যেকটি কথার হিসাব তাদের দিতে হবে। আপনার কথার দ্বারাই আপনাকে নির্দোষ বলা হবে এবং আপনার কথার দ্বারাই আপনাকে দোষী বলা হবে।” এর পরে কয়েকজন আলেম ও ফরীশী ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা চিহ্ন দেখতে চাই।” ঈসা তাঁদের বললেন, “এই কালের দুষ্ট ও বেঈমান লোকেরা চিহ্নের খোঁজ করে, কিন্তু ইউনুস নবীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্নই তাদের দেখানো হবে না। ইউনুস যেমন সেই মাছের পেটে তিন দিন ও তিন রাত ছিলেন ইব্‌ন্তেআদমও তেমনি তিন দিন ও তিন রাত মাটির নীচে থাকবেন। রোজ হাশরে নিনেভে শহরের লোকেরা উঠে এই কালের লোকদের দোষ দেখিয়ে দেবে, কারণ নিনেভের লোকেরা ইউনুসের তবলিগের ফলে তওবা করেছিল। আর দেখুন, এখানে ইউনুসের চেয়ে আরও মহান একজন আছেন। রোজ হাশরে সাবা দেশের রাণী উঠে এই কালের লোকদের দোষ দেখিয়ে দেবেন, কারণ বাদশাহ্‌ সোলায়মানের জ্ঞানের কথাবার্তা শুনবার জন্য তিনি দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে এসেছিলেন। আর দেখুন, এখানে সোলায়মানের চেয়ে আরও মহান একজন আছেন। “যখন কোন ভূত কোন মানুষের মধ্য থেকে বের হয়ে যায় তখন সে বিশ্রামের খোঁজে শুকনা জায়গার মধ্য দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কিন্তু তা না পেয়ে সে বলে, ‘যেখান থেকে বের হয়ে এসেছি আমার সেই ঘরেই আমি ফিরে যাব।’ সে ফিরে এসে সেই ঘর খালি, পরিষ্কার ও সাজানো দেখতে পায়। পরে সেই ভূত গিয়ে নিজের চেয়েও খারাপ আরও সাতটা ভূত সংগে নিয়ে আসে এবং সেখানে ঢুকে বাস করতে থাকে। তাতে সেই লোকটার প্রথম দশা থেকে শেষ দশা আরও খারাপ হয়ে ওঠে। এই কালের দুষ্ট লোকদের অবস্থাও তেমনি হবে।” ঈসা যখন লোকদের সংগে কথা বলছিলেন তখন তাঁর মা ও ভাইয়েরা তাঁর সংগে কথা বলবার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোন একজন লোক তাঁকে বলল, “দেখুন, আপনার মা ও ভাইয়েরা আপনার সংগে কথা বলবার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।” তখন ঈসা তাকে বললেন, “কে আমার মা, আর আমার ভাইয়েরাই বা কারা?” পরে তিনি তাঁর সাহাবীদের দেখিয়ে বললেন, “এই দেখ, আমার মা ও আমার ভাইয়েরা; কারণ যারা আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা পালন করে তারা-ই আমার ভাই, বোন আর মা।” সেই দিনই ঈসা ঘর থেকে বের হয়ে সাগরের ধারে গিয়ে বসলেন। তাঁর কাছে এত লোক এসে জমায়েত হল যে, তিনি একটা নৌকায় উঠে বসলেন, আর সমস্ত লোক সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। তখন তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয় তাদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, “একজন চাষী বীজ বুনতে গেল। বুনবার সময় কতগুলো বীজ পথের পাশে পড়ল আর পাখীরা এসে তা খেয়ে ফেলল। কতগুলো বীজ পাথুরে জমিতে পড়ল। সেখানে বেশী মাটি ছিল না। মাটি গভীর ছিল না বলে তাড়াতাড়ি চারা গজিয়ে উঠল, কিন্তু সূর্য উঠলে পর তা পুড়ে গেল এবং শিকড় ভাল করে বসে নি বলে শুকিয়ে গেল। আবার কতগুলো বীজ কাঁটাবনের মধ্যে পড়ল। তাতে কাঁটাগাছ বেড়ে উঠে চারাগুলো চেপে রাখল। আর কতগুলো বীজ ভাল জমিতে পড়ে কোনটাতে একশো গুণ, কোনটাতে ষাট গুণ আর কোনটাতে ত্রিশ গুণ ফসল জন্মাল।” গল্পের শেষে ঈসা বললেন, “যার শুনবার কান আছে সে শুনুক।” পরে সাহাবীরা ঈসার কাছে এসে তাঁকে বললেন, “আপনি গল্পের মধ্য দিয়ে লোকদের শিক্ষা দিচ্ছেন কেন?” জবাবে তিনি সাহাবীদের বললেন, “বেহেশতী রাজ্যের গোপন সত্যগুলো তোমাদের জানতে দেওয়া হয়েছে কিন্তু ওদের জানতে দেওয়া হয় নি, কারণ যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে, আর তাতে তার অনেক হবে। কিন্তু যার নেই তার যা আছে তা-ও তার কাছে থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। সেইজন্য আমি গল্পের মধ্য দিয়ে ওদের শিক্ষা দিই, কারণ ওরা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না এবং বোঝে না। এদের মধ্য দিয়ে ইশাইয়া নবীর এই কথা পূর্ণ হচ্ছে: তোমরা শুনতে থাকবে কিন্তু কোনমতেই বুঝবে না; দেখতে থাকবে কিন্তু কোনমতেই জানবে না। এই সব লোকদের দিল অসাড় এবং কান বন্ধ হয়ে গেছে, আর তারা তাদের চোখও বন্ধ করে রেখেছে, যেন তারা চোখ দিয়ে না দেখে, কান দিয়ে না শোনে এবং দিল নিয়ে না বোঝে, আর ভাল হবার জন্য আমার কাছে ফিরে না আসে। “কিন্তু ধন্য তোমরা, কারণ তোমাদের চোখ দেখতে পায় এবং তোমাদের কান শুনতে পায়। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তোমরা যা যা দেখছ তা অনেক নবী ও আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা দেখতে চেয়েও দেখতে পান নি, আর তোমরা যা যা শুনছ তা তাঁরা শুনতে চেয়েও শুনতে পান নি। আর পাথুরে জমিতে বোনা বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যারা বেহেশতী রাজ্যের কথা শুনে তখনই আনন্দের সংগে তা গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে শিকড় ভাল করে বসে না বলে তারা অল্প সময়ের জন্য স্থির থাকে। যখন সেই কথার জন্য কষ্ট এবং জুলুম আসে তখনই তারা পিছিয়ে যায়। কাঁটার মধ্যে বোনা বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যারা সেই কথা শোনে, কিন্তু সংসারের চিন্তা-ভাবনা এবং ধন-সম্পত্তির মায়া সেই কথাকে চেপে রাখে। সেইজন্য তাতে কোন ফল হয় না। ভাল জমিতে বোনা বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যারা সেই কথা শুনে বোঝে এবং ফল দেয়। কেউ দেয় একশো গুণ, কেউ দেয় ষাট গুণ আর কেউ দেয় ত্রিশ গুণ।” পরে ঈসা লোকদের শিক্ষা দেবার জন্য আর একটা গল্প বললেন। গল্পটা এই: “বেহেশতী রাজ্য এমন একজন লোকের মত যিনি নিজের জমিতে ভাল বীজ বুনলেন। পরে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল তখন সেই লোকের শত্রু এসে গমের মধ্যে শ্যামাঘাসের বীজ বুনে চলে গেল। শেষে গমের চারা যখন বেড়ে উঠে ফল ধরল তখন তার মধ্যে শ্যামাঘাসও দেখা গেল। তা দেখে বাড়ীর গোলামেরা এসে মালিককে বলল, ‘আপনি কি জমিতে ভাল বীজ বোনেন নি? তবে শ্যামাঘাস কোথা থেকে আসল?’ “তিনি তাদের বললেন, ‘কোন শত্রু এটা করেছে।’ “গোলামেরা তাঁকে বলল, ‘তবে আমরা গিয়ে সেগুলো তুলে ফেলব কি?’ “তিনি বললেন, ‘না, শ্যামাঘাস তুলতে গিয়ে তোমরা হয়তো ঘাসের সংগে গমও তুলে ফেলবে। ফসল কাটবার সময় পর্যন্ত ওগুলো একসংগে বাড়তে দাও। যারা ফসল কাটে, আমি তখন তাদের বলব যেন তারা প্রথমে শ্যামাঘাসগুলো জড়ো করে পোড়াবার জন্য আঁটি আঁটি করে বাঁধে, আর তার পরে গম আমার গোলায় জমা করে।’ ” ঈসা তাদের আর একটা গল্প বললেন। গল্পটা এই: “বেহেশতী রাজ্য এমন একটা সরিষা-দানার মত যা একজন লোক নিয়ে নিজের জমিতে লাগাল। সমস্ত বীজের মধ্যে ওটা সত্যিই সবচেয়ে ছোট, কিন্তু গাছ হয়ে বেড়ে উঠলে পর তা সমস্ত শাক-সবজীর মধ্যে সবচেয়ে বড় হয়। ওটা এমন একটা বড় গাছ হয়ে ওঠে যে, পাখীরা এসে তার ডালপালায় বাসা বাঁধে।” তিনি তাদের আর একটা গল্প বললেন। গল্পটা এই: “বেহেশতী রাজ্য খামির মত। একজন স্ত্রীলোক তা নিয়ে আঠারো কেজি ময়দার মধ্যে মিশাল। ফলে সমস্ত ময়দাই ফেঁপে উঠল।” ঈসা গল্পের মধ্য দিয়ে লোকদের এই সব শিক্ষা দিলেন। তিনি গল্প ছাড়া কোন শিক্ষাই তাদের দিতেন না। এটা হল যাতে নবীর মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: শিক্ষা-ভরা উদাহরণের মধ্য দিয়ে আমি মুখ খুলব; দুনিয়ার শুরু থেকে যা যা লুকানো ছিল, তা বলব। পরে ঈসা লোকদের ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। তখন তাঁর সাহাবীরা এসে তাঁকে বললেন, “জমির ঐ শ্যামাঘাসের গল্পটা আমাদের বুঝিয়ে দিন।” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “যিনি ভাল বীজ বোনেন তিনি ইব্‌ন্তেআদম। জমি এই দুনিয়া, আর বেহেশতী রাজ্যের লোকেরা ভাল বীজ। শয়তানের লোকেরা হল সেই শ্যামাঘাস। যে শত্রু তা বুনেছিল সে হল ইবলিস, আর ফসল কাটবার সময় হল এই যুগের শেষ সময়। যাঁরা শস্য কাটবেন তাঁরা হলেন ফেরেশতা। শ্যামাঘাস জড়ো করে যেমন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যুগের শেষের সময়ও ঠিক তেমনি হবে। ইব্‌ন্তেআদম তাঁর ফেরেশতাদের পাঠিয়ে দেবেন। যারা অন্যদের গুনাহ্‌ করায় এবং যারা নিজেরা গুনাহ্‌ করে তাদের সবাইকে সেই ফেরেশতারা ইব্‌ন্তেআদমের রাজ্যের মধ্য থেকে একসংগে জমায়েত করবেন ও জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ফেলে দেবেন। সেখানে লোকে কান্নাকাটি করবে ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে। সেই সময়ে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা তাদের বেহেশতী পিতার রাজ্যে সূর্যের মত উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেবে। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক। “বেহেশতী রাজ্য জমির মধ্যে লুকিয়ে রাখা ধনের মত। একজন লোক তা খুঁজে পেয়ে আবার লুকিয়ে রাখল। তারপর সে খুশী মনে চলে গেল এবং তার যা কিছু ছিল সব বিক্রি করে সেই জমিটা কিনল। “আবার, বেহেশতী রাজ্য এমন একজন সওদাগরের মত যে ভাল মুক্তা খুঁজছিল। একটা দামী মুক্তার খোঁজ পেয়ে সে গিয়ে তার যা কিছু ছিল সব বিক্রি করে সেই মুক্তাটা কিনল। “আবার, বেহেশতী রাজ্য এমন একটা বড় জালের মত যা সাগরে ফেলা হল আর তাতে সব রকম মাছ ধরা পড়ল। জাল পূর্ণ হলে পর লোকেরা সেটা পারে টেনে তুলল। পরে তারা বসে ভাল মাছগুলো বেছে ঝুড়িতে রাখল এবং খারাপগুলো ফেলে দিল। যুগের শেষের সময়ে এই রকমই হবে। ফেরেশতারা এসে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের মধ্য থেকে দুষ্টদের আলাদা করবেন এবং জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে তাদের ফেলে দেবেন। সেখানে লোকে কান্নাকাটি করবে ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে।” এর পর ঈসা তাঁর সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি এই সব বুঝতে পেরেছ?” তাঁরা তাঁকে বললেন, “জ্বী, পেরেছি।” তখন ঈসা তাদের বললেন, “বেহেশতী রাজ্যের বিষয়ে যে সব আলেম শিক্ষা পেয়েছেন তারা সবাই এমন একজন গৃহসে'র মত যিনি তাঁর ভাণ্ডার থেকে নতুন ও পুরানো জিনিস বের করেন।” শিক্ষা দেবার জন্য এই সব গল্প বলা শেষ করে ঈসা সেখান থেকে চলে গেলেন। তারপর নিজের গ্রামে গিয়ে তিনি মজলিস-খানায় লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। তাঁর কথা শুনে লোকে আশ্চর্য হয়ে বলল, “এই জ্ঞান ও এই সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করবার ক্ষমতা এ কোথা থেকে পেল? এ কি সেই ছুতার মিস্ত্রীর ছেলে নয়? তার মায়ের নাম কি মরিয়ম নয়? আর তার ভাইয়েরা কি ইয়াকুব, ইউসুফ, শিমোন ও এহুদা নয়? তার সব বোনেরা কি আমাদের মধ্যে নেই? তাহলে কোথা থেকে সে এই সব পেল?” এইভাবে ঈসাকে নিয়ে লোকদের মনে বাধা আসতে লাগল। তখন ঈসা তাদের বললেন, “নিজের গ্রাম ও নিজের বাড়ী ছাড়া আর সব জায়গাতেই নবীরা সম্মান পান।” লোকদের অবিশ্বাসের জন্য তিনি সেখানে বেশী অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করলেন না। সেই সময়ে ঈসার বিষয় শুনে গালীল প্রদেশের শাসনকর্তা হেরোদ তাঁর কর্মচারীদের বললেন, “ইনি তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া; মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছেন। সেইজন্যই উনি এই সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করছেন।” হেরোদ নিজের ভাই ফিলিপের স্ত্রী হেরোদিয়ার দরুন ইয়াহিয়াকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে জেলখানায় রেখেছিলেন, কারণ ইয়াহিয়া তাঁকে বলতেন, “হেরোদিয়াকে স্ত্রী হিসাবে রাখা আপনার উচিত নয়।” হেরোদ ইয়াহিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি লোকদের ভয় করতেন কারণ লোকে ইয়াহিয়াকে নবী বলে মানত। হেরোদের জন্মদিনের উৎসবে হেরোদিয়ার মেয়ে উপস্থিত লোকদের সামনে নেচে হেরোদকে সন্তুষ্ট করল। সেইজন্য হেরোদ কসম খেয়ে বললেন সে যা চাইবে তা-ই তিনি তাকে দেবেন। মেয়েটি তার মায়ের কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে বলল, “থালায় করে তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়ার মাথাটা এখানে আমার কাছে এনে দিন।” এতে বাদশাহ্‌ হেরোদ দুঃখিত হলেন, কিন্তু যাঁরা তাঁর সংগে খেতে বসেছিলেন তাঁদের সামনে কসম খেয়েছিলেন বলে তিনি তা দিতে হুকুম করলেন। তিনি লোক পাঠিয়ে জেলখানার মধ্যেই ইয়াহিয়ার মাথা কাটালেন। পরে মাথাটি থালায় করে এনে মেয়েটিকে দেওয়া হলে পর সে তার মায়ের কাছে তা নিয়ে গেল। এর পর ইয়াহিয়ার সাহাবীরা এসে তাঁর লাশটা নিয়ে গিয়ে দাফন করলেন এবং সেই খবর ঈসাকে গিয়ে দিলেন। ইয়াহিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে ঈসা একাই সেখান থেকে নৌকায় করে একটা নির্জন জায়গায় চলে গেলেন। লোকেরা সেই কথা শুনে ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম থেকে হাঁটা-পথে তাঁর পিছন ধরল। তিনি নৌকা থেকে নেমে লোকদের ভিড় দেখতে পেলেন আর মমতায় পূর্ণ হয়ে তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ ছিল তাদের সুস্থ করলেন। দিনের শেষে সাহাবীরা তাঁর কাছে এসে বললেন, “জায়গাটা নির্জন, বেলাও গেছে। লোকদের বিদায় করে দিন যেন তারা গ্রামে গিয়ে নিজেদের জন্য খাবার কিনতে পারে।” ঈসা তাঁদের বললেন, “ওদের যাবার দরকার নেই, তোমরাই ওদের খেতে দাও।” সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “আমাদের এখানে পাঁচখানা রুটি আর দু’টা মাছ ছাড়া আর কিছুই নেই।” খাওয়ার পরে যে টুকরাগুলো পড়ে রইল সাহাবীরা তা তুলে নিলেন, আর তাতে বারোটা টুকরি পূর্ণ হল। যারা খেয়েছিল তাদের মধ্যে স্ত্রীলোক ও ছোট ছেলেমেয়ে ছাড়া কমবেশী পাঁচ হাজার পুরুষ ছিল। এর পরে ঈসা সাহাবীদের তাগাদা দিলেন যেন তাঁরা নৌকায় উঠে তাঁর আগে অন্য পারে যান, আর এদিকে তিনি লোকদের বিদায় করলেন। লোকদের বিদায় করে মুনাজাত করবার জন্য তিনি একা পাহাড়ে উঠে গেলেন। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল তখনও তিনি সেখানে একাই রইলেন। ততক্ষণে সাহাবীদের নৌকাখানা ডাংগা থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়েছিল এবং বাতাস উল্টাদিকে থাকাতে ঢেউয়ে ভীষণভাবে দুলছিল। শেষ রাতে ঈসা সাগরের উপর দিয়ে হেঁটে সাহাবীদের কাছে আসছিলেন। সাহাবীরা একজনকে সাগরের উপর হাঁটতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে বললেন, “ভূত, ভূত,” আর তার পরেই চিৎকার করে উঠলেন। ঈসা তখনই তাঁদের বললেন, “এ তো আমি; ভয় কোরো না, সাহস কর।” পিতর তাঁকে বললেন, “হুজুর, যদি আপনিই হন তবে পানির উপর দিয়ে আপনার কাছে যেতে আমাকে হুকুম দিন।” ঈসা বললেন, “এস।” তখন পিতর নৌকা থেকে নেমে পানির উপর দিয়ে হেঁটে ঈসার কাছে চললেন। কিন্তু জোর বাতাস দেখে তিনি ভয় পেয়ে ডুবে যেতে লাগলেন এবং চিৎকার করে বললেন, “হুজুর, আমাকে বাঁচান।” ঈসা তখনই হাত বাড়িয়ে তাঁকে ধরলেন এবং বললেন, “অল্প ঈমানদার, কেন সন্দেহ করলে?” পরে তাঁরা সাগর পার হয়ে গিনেষরৎ এলাকায় এসে নামলেন। সেখানকার লোকেরা ঈসাকে চিনতে পেরে এলাকার সব জায়গায় খবর পাঠাল। তাতে লোকেরা অসুস্থদের ঈসার কাছে আনল এবং তাঁকে অনুরোধ করল যেন সেই অসুস্থরা তাঁর চাদরের কিনারাটা কেবল ছুঁতে পারে; আর যত লোক তা ছুঁলো তারা সবাই সুস্থ হল। জেরুজালেম থেকে কয়েকজন ফরীশী ও আলেম ঈসার কাছে এসে বললেন, “পুরানো দিনের আলেমদের দেওয়া যে নিয়ম চলে আসছে আপনার সাহাবীরা তা মেনে চলে না কেন? খাওয়ার আগে তারা হাত ধোয় না।” জবাবে ঈসা বললেন, “যে নিয়ম চলে আসছে তার জন্য আপনারাই বা কেন আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করেন? আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘মা-বাবাকে সম্মান কোরো’ এবং ‘যার কথায় মা-বাবার প্রতি অসম্মান থাকে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে।’ কিন্তু আপনারা বলে থাকেন, যদি কেউ তার মা কিংবা বাবাকে বলে, ‘আমার যে জিনিসের দ্বারা তোমার সাহায্য হতে পারত, তা আল্লাহ্‌র কাছে দেওয়া হয়েছে,’ তবে পিতা-মাতাকে তার আর সম্মান করবার দরকার নেই। আপনাদের এই সব চলতি নিয়মের জন্য আপনারা আল্লাহ্‌র কালাম বাতিল করেছেন। ভণ্ডেরা! আপনাদের সম্বন্ধে ইশাইয়া নবী ঠিক কথাই বলেছিলেন যে, এই লোকেরা মুখেই আমাকে সম্মান করে, কিন্তু তাদের দিল আমার কাছ থেকে দূরে থাকে। তারা মিথ্যাই আমার এবাদত করে; তাদের দেওয়া শিক্ষা মানুষের তৈরী কতগুলো নিয়ম মাত্র। পরে ঈসা লোকদের ডেকে বললেন, “আমার কথা শুনুন এবং বুঝুন। মুখের ভিতরে যা যায় তা মানুষকে নাপাক করে না, কিন্তু মুখের ভিতর থেকে যা বের হয়ে আসে তা-ই মানুষকে নাপাক করে।” তখন তাঁর সাহাবীরা এসে তাঁকে বললেন, “ফরীশীরা আপনার এই কথা শুনে যে অপমান বোধ করেছেন, তা কি আপনি জানেন?” জবাবে তিনি বললেন, “যে চারা আমার বেহেশতী পিতা লাগান নি তার প্রত্যেকটাকে উপ্‌ড়ে ফেলা হবে। তাদের কথা ছেড়ে দাও। অন্ধদের পথ দেখাবার কথা তাঁদেরই, কিন্তু তাঁরা নিজেরাই অন্ধ। অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাতে গেলে দু’জনই গর্তে পড়ে।” তখন পিতর ঈসাকে বললেন, “আপনি যে দৃষ্টান্ত দিলেন তা আমাদের বুঝিয়ে দিন।” কিন্তু যা মুখের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে তা অন্তর থেকে আসে, আর সেগুলোই মানুষকে নাপাক করে। অন্তর থেকেই খারাপ চিন্তা, খুন, সব রকম জেনা, চুরি, মিথ্যা সাক্ষ্য ও নিন্দা বের হয়ে আসে। এই সবই মানুষকে নাপাক করে, কিন্তু হাত না ধুয়ে খেলে মানুষ নাপাক হয় না।” পরে ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে টায়ার ও সিডন এলাকায় চলে গেলেন। সেখানকার একজন কেনানীয় স্ত্রীলোক এসে চিৎকার করে বলতে লাগল, “হে হুজুর, দাউদের বংশধর, আমাকে দয়া করুন। ভূতে ধরবার দরুন আমার মেয়েটি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।” ঈসা কিন্তু তাকে একটা কথাও বললেন না। তখন তাঁর সাহাবীরা এসে তাঁকে অনুরোধ করে বললেন, “ওকে বিদায় করে দিন, কারণ ও আমাদের পিছনে পিছনে চিৎকার করছে।” জবাবে ঈসা বললেন, “আমাকে কেবল বনি-ইসরাইলদের হারানো ভেড়াদের কাছেই পাঠানো হয়েছে।” সেই স্ত্রীলোকটি কিন্তু ঈসার কাছে এসে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে পড়ে বলল, “হুজুর, আমার এই উপকারটা করুন।” ঈসা বললেন, “ছেলেমেয়েদের খাবার নিয়ে কুকুরের সামনে ফেলা ভাল নয়।” সে বলল, “ঠিক কথা, হুজুর; তবুও মালিকের টেবিল থেকে খাবারের যে সব টুকরা পড়ে তা কুকুরেই খায়।” তখন ঈসা তাকে বললেন, “সত্যিই তোমার বিশ্বাস খুব বেশী। তুমি যেমন চাও তেমনই হোক।” আর তখনই তার মেয়েটি সুস্থ হয়ে গেল। পরে ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে গালীল সাগরের পার দিয়ে চললেন এবং একটা পাহাড়ে উঠে সেখানে বসলেন। তখন লোকেরা খোঁড়া, অন্ধ, নুলা, বোবা এবং আরও অনেককে সংগে নিয়ে তাঁর কাছে আসল। তারা ঐ সব লোকদের তাঁর পায়ের কাছে রাখল আর তিনি তাদের সুস্থ করলেন। লোকেরা যখন দেখল বোবা কথা বলছে, নুলা সুস্থ হচ্ছে, খোঁড়া চলাফেরা করছে এবং অন্ধ দেখতে পাচ্ছে, তখন তারা আশ্চর্য হল এবং বনি-ইসরাইলদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। এর পর ঈসা তাঁর সাহাবীদের ডেকে বললেন, “এই লোকদের জন্য আমার মমতা হচ্ছে, কারণ আজ তিন দিন হল এরা আমার সংগে সংগে আছে, আর এদের কাছে কোন খাবার নেই। এই অবস্থায় আমি এদের বিদায় দিতে চাই না; হয়তো বা তারা পথে অজ্ঞান হয়ে পড়বে।” সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “এই নির্জন জায়গায় এত লোককে খাওয়াবার মত রুটি আমরা কোথায় পাব?” ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমাদের কাছে কয়টা রুটি আছে?” সাহাবীরা বললেন, “সাতটা রুটি আর কয়েকটা ছোট মাছ আছে।” লোকেরা সবাই পেট ভরে খেল, আর যে টুকরাগুলো পড়ে রইল সাহাবীরা তা তুলে নিয়ে সাতটা টুকরি পূর্ণ করলেন। যারা খেয়েছিল তাদের মধ্যে স্ত্রীলোক ও ছোট ছেলেমেয়ে ছাড়া চার হাজার পুরুষ ছিল। এর পর ঈসা লোকদের বিদায় দিয়ে নৌকায় উঠে মগদন এলাকায় গেলেন। পরে কয়েকজন ফরীশী ও সদ্দূকী ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর কাছে আসলেন এবং বেহেশত থেকে কোন চিহ্ন দেখাতে বললেন। ঈসা জবাবে তাঁদের বললেন, “সন্ধ্যা হলে আপনারা বলে থাকেন, ‘দিনটা পরিষ্কার হবে কারণ আকাশ লাল হয়েছে।’ আর সকালবেলায় বলেন, ‘আজ ঝড় হবে কারণ আকাশ লাল ও অন্ধকার হয়েছে।’ আকাশের অবস্থা আপনারা ঠিক ভাবেই বিচার করতে জানেন, অথচ সময়ের চিহ্ন বুঝতে পারেন না। এই কালের দুষ্ট ও বেঈমান লোকেরা চিহ্নের খোঁজ করে, কিন্তু ইউনুস নবীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্নই তাদের দেখানো হবে না।” এর পরে ঈসা তাঁদের ছেড়ে চলে গেলেন। সাগরের অন্য পারে যাবার সময় সাহাবীরা রুটি নিতে ভুলে গেলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা সতর্ক থাক, ফরীশী ও সদ্দূকীদের খামি থেকে সাবধান হও।” এতে সাহাবীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “আমরা রুটি আনি নি বলে উনি এই কথা বলছেন।” এই কথা বুঝতে পেরে ঈসা বললেন, “অল্প বিশ্বাসীরা, তোমরা নিজেদের মধ্যে কেন বলাবলি করছ যে, তোমাদের রুটি নেই? তোমরা কি এখনও বোঝ না বা মনেও কি পড়ে না, সেই পাঁচ হাজার লোকের জন্য পাঁচখানা রুটির কথা, আর তার পরে কত টুকরি তোমরা তুলে নিয়েছিলে? কিংবা সেই চার হাজার লোকের জন্য সাতখানা রুটির কথা, আর কত টুকরি তোমরা তুলে নিয়েছিলে? আমি যে তোমাদের কাছে রুটির কথা বলি নি তা তোমরা কেন বোঝ না? ফরীশী ও সদ্দূকীদের খামি থেকে তোমরা সাবধান হও।” তখন সাহাবীরা বুঝতে পারলেন যে, তিনি রুটির খামি থেকে তাঁদের সাবধান হতে বলেন নি, কিন্তু ফরীশী ও সদ্দূকীদের শিক্ষা থেকে সাবধান হতে বলেছেন। পরে ঈসা যখন সিজারিয়া-ফিলিপি এলাকায় গেলেন তখন সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “ইব্‌ন্তেআদম কে, এই বিষয়ে লোকে কি বলে?” তাঁরা বললেন, “কেউ কেউ বলে আপনি তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া; কেউ কেউ বলে ইলিয়াস নবী; আবার কেউ কেউ বলে ইয়ারমিয়া নবী বা নবীদের মধ্যে একজন।” তখন তিনি তাঁদের বললেন, “কিন্তু তোমরা কি বল, আমি কে?” শিমোন্তপিতর বললেন, “আপনি সেই মসীহ্‌, জীবন্ত আল্লাহ্‌র পুত্র।” জবাবে ঈসা তাঁকে বললেন, “শিমোন ইব্‌নে ইউনুস, ধন্য তুমি, কারণ কোন মানুষ তোমার কাছে এটা প্রকাশ করে নি; আমার বেহেশতী পিতাই প্রকাশ করেছেন। আমি তোমাকে বলছি, তুমি পিতর, আর এই পাথরের উপরেই আমি আমার জামাত গড়ে তুলব। দোজখের কোন শক্তিই তার উপর জয়লাভ করতে পারবে না। আমি তোমাকে বেহেশতী রাজ্যের চাবিগুলো দেব, আর তুমি এই দুনিয়াতে যা বাঁধবে তা বেহেশতেও বেঁধে রাখা হবে এবং যা খুলবে তা বেহেশতেও খুলে দেওয়া হবে।” এর পরে তিনি তাঁর সাহাবীদের সাবধান করে দিলেন যেন তাঁরা কাউকে না বলেন যে, তিনিই মসীহ্‌। সেই সময় থেকে ঈসা তাঁর সাহাবীদের জানাতে লাগলেন যে, তাঁকে জেরুজালেমে যেতে হবে এবং বৃদ্ধ নেতাদের, প্রধান ইমামদের ও আলেমদের হাতে অনেক দুঃখভোগ করতে হবে। পরে তাঁকে হত্যা করা হবে এবং তৃতীয় দিনে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠতে হবে। তখন পিতর তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে অনুযোগ করে বললেন, “হুজুর, এ দূর হোক। আপনার উপর কখনও এমন হবে না।” ঈসা ফিরে পিতরকে বললেন, “আমার কাছ থেকে দূর হও, শয়তান। তুমি আমার পথের বাধা। যা আল্লাহ্‌র তা তুমি ভাবছ না কিন্তু যা মানুষের তা-ই ভাবছ।” এর পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “যদি কেউ আমার পথে আসতে চায় তবে সে নিজের ইচ্ছামত না চলুক; নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে সে আমার পিছনে আসুক। যে কেউ তাঁর নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চায় সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে; কিন্তু যে কেউ আমার জন্য তার প্রাণ হারায় সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে। যদি কেউ সমস্ত দুনিয়া লাভ করে তার বিনিময়ে তার সত্যিকারের জীবন হারায় তবে তার কি লাভ হল? সত্যিকারের জীবন ফিরে পাবার জন্য তার দেবার মত কি আছে? ইব্‌ন্তেআদম তাঁর ফেরেশতাদের সংগে নিয়ে তাঁর পিতার মহিমায় আসছেন। তখন তিনি প্রত্যেক লোককে তার কাজ অনুসারে ফল দেবেন। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এখানে এমন কয়েকজন আছে যাদের কাছে ইব্‌ন্তেআদম বাদশাহ্‌ হিসাবে দেখা না দেওয়া পর্যন্ত তারা কোনমতেই মারা যাবে না।” এর ছয় দিন পরে ঈসা কেবল পিতর, ইয়াকুব এবং ইয়াকুবের ভাই ইউহোন্নাকে সংগে নিয়ে একটা উঁচু পাহাড়ে গেলেন। তাঁদের সামনে ঈসার চেহারা বদলে গেল। তাঁর মুখ সূর্যের মত উজ্জ্বল এবং তাঁর কাপড় আলোর মত সাদা হয়ে গেল। তাঁরা নবী মূসা এবং নবী ইলিয়াসকে ঈসার সংগে কথা বলতে দেখলেন। তখন পিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, ভালই হয়েছে যে, আমরা এখানে আছি। আপনি যদি চান তবে আমি এখানে তিনটা কুঁড়ে-ঘর তৈরী করব- একটা আপনার, একটা মূসার ও একটা ইলিয়াসের জন্য।” পিতর যখন কথা বলছিলেন তখন একটা উজ্জ্বল মেঘ তাঁদের ঢেকে ফেলল। সেই মেঘ থেকে এই কথা শোনা গেল, “ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট। তোমরা এঁর কথা শোন।” এই কথা শুনে সাহাবীরা খুব ভয় পেয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন। তখন ঈসা এসে তাঁদের ছুঁয়ে বললেন, “ওঠো, ভয় কোরো না।” তখন তাঁরা উপরের দিকে তাকিয়ে কেবল ঈসা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলেন না। যখন তাঁরা সেই পাহাড় থেকে নেমে আসছিলেন তখন ঈসা তাঁদের এই হুকুম দিলেন, “তোমরা যা দেখলে, ইব্‌ন্তেআদম মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে না ওঠা পর্যন্ত তা কাউকে বোলো না।” সাহাবীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে আলেমেরা কেন বলেন যে, প্রথমে ইলিয়াস নবীর আসা দরকার?” ঈসা তাঁদের জবাব দিলেন, “সত্যিই ইলিয়াস আসবেন এবং সব কিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, ইলিয়াস এসেছিলেন আর লোকে তাঁকে চিনতে পারে নি। লোকেরা তাঁর উপর যা ইচ্ছা তা-ই করেছে। এইভাবে ইব্‌ন্তেআদমকেও লোকদের হাতে কষ্টভোগ করতে হবে।” তখন সাহাবীরা বুঝতে পারলেন যে, তিনি তাঁদের কাছে তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়ার বিষয় বলছেন। ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা যখন লোকদের কাছে ফিরে আসলেন তখন একজন লোক এসে ঈসার সামনে হাঁটু পেতে বসে বলল, “হুজুর, আপনি আমার ছেলেটির উপর দয়া করুন। সে মৃগী রোগে খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রায়ই সে আগুনে এবং পানিতে পড়ে যায়। আমি তাকে আপনার সাহাবীদের কাছে এনেছিলাম কিন্তু তাঁরা তাকে ভাল করতে পারলেন না।” জবাবে ঈসা বললেন, “বেঈমান ও দুষ্ট লোকেরা! আর কতকাল আমি তোমাদের সংগে সংগে থাকব? কতদিন তোমাদের সহ্য করব? ছেলেটিকে এখানে আমার কাছে আন।” ঈসা সেই ভূতকে ধমক দিলে পর সে ছেলেটির মধ্য থেকে বের হয়ে গেল, আর ছেলেটি তখনই সুস্থ হল। এর পর সাহাবীরা গোপনে ঈসার কাছে এসে বললেন, “আমরা কেন সেই ভূতকে ছাড়াতে পারলাম না?” ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমাদের অল্প বিশ্বাসের জন্যই পারলে না। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি একটা সরিষা দানার মত বিশ্বাসও তোমাদের থাকে তবে তোমরা এই পাহাড়কে বলবে, ‘এখান থেকে সরে ওখানে যাও,’ আর তাতে ওটা সরে যাবে। তোমাদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব হবে না। মুনাজাত ও রোজা ছাড়া এই রকম ভূত আর কিছুতে বের হয় না। পরে গালীল দেশের মধ্য দিয়ে যাবার সময় ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “ইব্‌ন্তেআদমকে লোকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। লোকেরা তাঁকে হত্যা করবে, আর তৃতীয় দিনে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবেন।” এতে সাহাবীরা খুব দুঃখিত হলেন। পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা যখন কফরনাহূমে গেলেন তখন বায়তুল-মোকাদ্দসের খাজনা-আদায়কারীরা পিতরের কাছে এসে বললেন, “আপনাদের ওস্তাদ কি বায়তুল-মোকাদ্দসের খাজনা দেন না?” পিতর বললেন “জ্বী, দেন।” এর পর পিতর ঘরে এসে কিছু বলবার আগেই ঈসা তাঁকে বললেন, “শিমোন, তোমার কি মনে হয়? এই দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা কাদের কাছ থেকে কর্‌ বা খাজনা আদায় করে থাকেন? নিজের দেশের লোকদের কাছ থেকে, না বিদেশীদের কাছ থেকে?” পিতর বললেন, “বিদেশীদের কাছ থেকে।” তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “তাহলে তো নিজের দেশের লোকেরা রেহাই পেয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ব্যবহারে খাজনা-আদায়কারীরা যেন অপমান বোধ না করে এইজন্য তুমি সাগরে গিয়ে বড়শী ফেল, আর প্রথমে যে মাছটা উঠবে তার মুখ খুললে একটা রূপার টাকা পাবে। ওটা নিয়ে গিয়ে তোমার আর আমার খাজনা দিয়ে এস।” সেই সময়ে সাহাবীরা ঈসার কাছে এসে বললেন, “বেহেশতী রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় কে?” তখন ঈসা একটা শিশুকে ডেকে তাঁদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি তোমরা মন ফিরিয়ে শিশুদের মত না হও তবে কোনমতেই বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে না। যে কেউ এই শিশুর মত নিজেকে নম্র করে সে-ই বেহেশতী রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আর যে কেউ এর মত কোন শিশুকে আমার নামে গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে। “আমার উপর ঈমানদার এই ছোটদের মধ্যে কাউকে যদি কেউ গুনাহের পথে নিয়ে যায় তবে তার গলায় একটা বড় পাথর বেঁধে তাকে সাগরের গভীর পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া বরং তার পক্ষে ভাল। ঘৃণ্য দুনিয়া! গুনাহের পথে নিয়ে যাবার জন্য কত উসকানিই না তোমার মধ্যে আছে! অবশ্য সেই সব উসকানি আসবেই; তবুও ঘৃণ্য সেই লোক, যার মধ্য দিয়ে সেই উসকানি আসে! “তোমার হাত কিংবা পা যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। দুই হাত ও দুই পা নিয়ে চিরকালের আগুনে পড়বার চেয়ে বরং নুলা বা খোঁড়া হয়ে জীবনে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল। তোমার চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপ্‌ড়ে ফেলে দাও। দুই চোখ নিয়ে জাহান্নামের আগুনে পড়বার চেয়ে বরং কানা হয়ে জীবনে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল। “দেখো, তোমরা যেন এই ছোটদের মধ্যে একজনকেও তুচ্ছ না কর। আমি তোমাদের বলছি, বেহেশতে তাদের ফেরেশতারা সব সময় আমার বেহেশতী পিতার মুখ দেখছেন। “যা হারিয়ে গেছে তা উদ্ধার করবার জন্য ইব্‌ন্তেআদম এসেছেন। তোমরা কি মনে কর? ধর, একজন লোকের একশোটা ভেড়া আছে। সেগুলোর মধ্যে যদি একটা ভুল পথে চলে যায় তবে সে কি নিরানব্বইটা পাহাড়ের ধারে রেখে সেই ভেড়াটা খুঁজতে যায় না? আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি সে সেটা পায় তবে যে নিরানব্বইটা ভুল পথে যায় নি, তাদের চেয়ে যেটা ভুল পথে চলে গিয়েছিল তার জন্য সে আরও বেশী আনন্দ করে। ঠিক সেইভাবে, তোমাদের বেহেশতী পিতার ইচ্ছা নয় যে, এই ছোটদের মধ্যে একজনও নষ্ট হয়। “তোমার ভাই যদি তোমার বিরুদ্ধে অন্যায় করে তবে তার কাছে গিয়ে যখন আর কেউ থাকবে না তখন তার দোষ দেখিয়ে দিয়ো। যদি সে তোমার কথা শোনে তবে তুমি তো তোমার ভাইকে ফিরে পেলে। কিন্তু যদি সে না শোনে তবে অন্য দু’একজনকে তোমার সংগে নিয়ে যেয়ো, যেন দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথায় এই সব বিষয় সত্য বলে প্রমাণিত হয়। যদি সে তাদের কথা না শোনে তবে জামাতকে বোলো। সে যদি জামাতের কথাও না শোনে তবে সে তোমার কাছে অ-ইহুদী বা খাজনা-আদায়কারীর মত হোক। “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা দুনিয়াতে যা বাঁধবে তা বেহেশতেও বেঁধে রাখা হবে, আর যা খুলবে তা বেহেশতেও খুলে দেওয়া হবে। “আমি তোমাদের আরও বলছি, তোমাদের মধ্যে দু’জন যদি একমত হয়ে কোন বিষয়ে মুনাজাত করে তবে আমার বেহেশতী পিতা তোমাদের জন্য তা করবেন, কারণ যেখানে দুই বা তিনজন আমার নামে জমায়েত হয় সেখানে আমি তাদের মধ্যে উপস্থিত থাকি।” তখন পিতর এসে ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমার ভাই আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করলে আমি কতবার তাকে মাফ করব? সাত বার কি?” ঈসা তাঁকে বললেন, “কেবল সাত বার নয়, কিন্তু আমি তোমাকে সত্তর গুণ সাত বার পর্যন্ত মাফ করতে বলি। “দেখ, বেহেশতী রাজ্য এমন একজন বাদশাহ্‌র মত যিনি তাঁর কর্মচারীদের কাছে হিসাব চাইলেন। তিনি যখন হিসাব নিতে শুরু করলেন তখন তাদের মধ্য থেকে এমন একজন কর্মচারীকে আনা হল, বাদশাহ্‌র কাছে যার লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ ছিল। তার ঋণ শোধ করবার ক্ষমতা ছিল না। তখন সেই মালিক হুকুম করলেন যেন সেই লোককে এবং তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে আর তার যা কিছু আছে সমস্ত বিক্রি করে পাওনা আদায় করা হয়। তাতে সেই কর্মচারী মাটিতে পড়ে মালিকের পা ধরে বলল, ‘হুজুর, আমার উপর ধৈর্য ধরুন, আপনাকে আমি সমস্তই শোধ করে দেব।’ তখন মালিক মমতা করে সেই কর্মচারীকে ছেড়ে দিলেন এবং তার ঋণ মাফ করে দিলেন। “পরে সেই কর্মচারী বাইরে গিয়ে তার একজন সংগী-কর্মচারীকে দেখতে পেল। তার কাছে সেই সংগী-কর্মচারীটির প্রায় একশো টাকা ঋণ ছিল। সেই কর্মচারী তার সংগীর গলা টিপে ধরে বলল, ‘তুই যে টাকা ধার করেছিস্‌ তা শোধ কর্‌।’ “সংগী-কর্মচারীটি তখন তার পায়ে পড়ে তাকে অনুরোধ করে বলল, ‘আমার উপর ধৈর্য ধর, আমি সব শোধ করে দেব।’ কিন্তু সে রাজী হল না বরং ঋণ শোধ না করা পর্যন্ত তাকে জেলখানায় আটক রাখল। “এই সব ঘটনা দেখে তার অন্য সংগী-কর্মচারীরা খুব দুঃখিত হল। তারা গিয়ে তাদের মালিকের কাছে সব কথা জানাল। তখন মালিক সেই কর্মচারীকে ডেকে বললেন, ‘দুষ্ট কর্মচারী! তুমি আমাকে অনুরোধ করেছিলে বলে আমি তোমার সব ঋণ মাফ করেছিলাম। আমি যেমন তোমাকে দয়া করেছিলাম তেমনি তোমার সংগী-কর্মচারীকে দয়া করা কি তোমার উচিত ছিল না?’ পরে তার মালিক রাগ করে তার সমস্ত ঋণ শোধ না করা পর্যন্ত তাকে কষ্ট দেবার জন্য জেলখানার লোকদের হাতে তুলে দিলেন। “ঠিক সেইভাবে, তোমরা প্রত্যেকে যদি তোমাদের ভাইকে অন্তর দিয়ে মাফ না কর তবে আমার বেহেশতী পিতাও তোমাদের উপর এই রকম করবেন।” এই সব কথা বলা শেষ করে ঈসা গালীল প্রদেশ ছেড়ে জর্ডান নদীর অন্য পারে এহুদিয়া প্রদেশে গেলেন। অনেক লোক তাঁর পিছনে পিছনে গেল আর তিনি সেখানে তাদের সুস্থ করলেন। তখন কয়েকজন ফরীশী ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর কাছে এসে বললেন, “মূসার শরীয়ত মতে যে কোন কারণে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া কি কারও পক্ষে উচিত?” জবাবে ঈসা বললেন, “আপনারা কি পড়েন নি, সৃষ্টিকর্তা প্রথমে তাঁদের পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে সৃষ্টি করেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘এইজন্যই মানুষ পিতা-মাতাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন একশরীর হবে’? এইজন্য তারা আর দুই নয়, কিন্তু একশরীর। তাই আল্লাহ্‌ যা একসংগে যোগ করেছেন মানুষ তা আলাদা না করুক।” তখন ফরীশীরা তাঁকে বললেন, “তাহলে নবী মূসা কেন তালাক-নামা দিয়ে স্ত্রীকে তালাক দিতে হুকুম দিয়েছেন?” ঈসা তাদের বললেন, “আপনাদের মন কঠিন বলেই স্ত্রীকে তালাক দিতে মূসা আপনাদের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম থেকে এই রকম ছিল না। আমি আপনাদের বলছি, যে কেউ জেনার দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্যকে বিয়ে করে সে জেনা করে।” তখন তাঁর সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ যদি এই রকমেরই হয় তাহলে তো বিয়ে না করাই ভাল।” ঈসা তাঁদের বললেন, “সবাই এই কথা মেনে নিতে পারে না; কেবল যাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তারাই তা মেনে নিতে পারে। কেউ কেউ খোজা হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আর কাউকে কাউকে মানুষেই খোজা করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আবার এমন কেউ কেউ আছে যারা বেহেশতী রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না বলে মন স্থির করে। যে এই কথা মেনে নিতে পারে সে মেনে নিক।” পরে লোকেরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঈসার কাছে নিয়ে আসল যেন তিনি তাদের মাথার উপর হাত রেখে মুনাজাত করেন। কিন্তু সাহাবীরা তাদের বকুনি দিতে লাগলেন। তখন ঈসা বললেন, “ছেলেমেয়েদের আমার কাছে আসতে দাও, বাধা দিয়ো না; কারণ বেহেশতী রাজ্য এদের মত লোকদেরই।” ছেলেমেয়েদের মাথার উপর হাত রেখে মুনাজাত করবার পর ঈসা সেখান থেকে চলে গেলেন। পরে একজন যুবক এসে ঈসাকে বলল, “হুজুর, অনন্ত জীবন পাবার জন্য আমাকে ভাল কি করতে হবে?” ঈসা তাকে বললেন, “ভালোর বিষয়ে কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছ? ভাল মাত্র একজনই আছেন। যদি তুমি অনন্ত জীবন পেতে চাও তবে তাঁর সব হুকুম পালন কর।” সেই যুবকটি বলল, “কোন্‌ কোন্‌ হুকুম?” ঈসা বললেন, “খুন কোরো না, জেনা কোরো না, চুরি কোরো না, মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না, পিতা-মাতাকে সম্মান কোরো আর তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত কোরো।” সেই যুবকটি ঈসাকে বলল, “আমি এগুলো সবই পালন করে আসছি, তবে আমাকে আর কি করতে হবে?” ঈসা তাকে বললেন, “যদি তুমি পুরোপুরি খাঁটি হতে চাও তবে গিয়ে তোমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে গরীবদের দান কর। তাতে তুমি বেহেশতে ধন পাবে। তারপর এসে আমার উম্মত হও।” এই কথা শুনে যুবকটি খুব দুঃখিত হয়ে চলে গেল, কারণ তার অনেক ধন-সম্পত্তি ছিল। তখন ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, ধনী লোকের পক্ষে বেহেশতী রাজ্যে ঢোকা কঠিন হবে। আমি আবার তোমাদের বলছি, ধনী লোকের পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকবার চেয়ে বরং সূচের ফুটা দিয়ে উটের ঢোকা সহজ।” এই কথা শুনে সাহাবীরা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “তাহলে কে নাজাত পেতে পারে?” ঈসা সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌র পক্ষে সবই সম্ভব।” তখন পিতর তাঁকে বললেন, “দেখুন, আমরা সব কিছু ছেড়ে আপনার সাহাবী হয়েছি; আমরা কি পাব?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা যারা আমার সাহাবী হয়েছ, নতুন সৃষ্টিতে যখন ইব্‌ন্তেআদম তাঁর সম্মানের সিংহাসনে বসবেন তখন তোমরাও বারোটা সিংহাসনে বসবে এবং ইসরাইলের বারো বংশের বিচার করবে। আর যে কেউ আমার জন্য বাড়ী-ঘর, ভাই-বোন, মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে কিংবা জায়গা-জমি ছেড়ে দিয়েছে, সে তার একশো গুণ বেশী পাবে আর অনন্ত জীবনও পাবে। যারা প্রথম সারিতে আছে তাদের মধ্যে অনেকে শেষে পড়বে, আর যারা শেষের সারিতে আছে তাদের মধ্যে অনেকে প্রথম হবে। “বেহেশতী রাজ্য একজন গৃহসে'র মত। তিনি একদিন সকালবেলায় ক্ষেতের কাজে মজুর লাগাবার জন্য বাইরে গেলেন। তিনি মজুরদের সংগে ঠিক করলেন যে, দিনে এক দীনার করে দেবেন। এর পর তিনি তাদের তাঁর আংগুর ক্ষেতে পাঠিয়ে দিলেন। প্রায় ন’টার সময় আবার তিনি বাইরে গেলেন এবং বাজারে আরও কয়েকজন বিনা কাজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরাও আমার আংগুর ক্ষেতে কাজ করতে যাও। আমি তোমাদের উপযুক্ত মজুরি দেব।’ তাতে সেই লোকেরাও কাজ করতে গেল। “সেই গৃহস' আবার প্রায় বারোটায় এবং তিনটায় বাইরে গিয়ে ঐ একই রকম করলেন। প্রায় পাঁচটার সময় বাইরে গিয়ে অন্য কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা কাজ না করে সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ “তারা তাঁকে বলল, ‘কেউ আমাদের কাজে লাগায় নি।’ “তিনি সেই লোকদের বললেন, ‘তোমরাও আমার আংগুর ক্ষেতের কাজে যাও।’ “পরে সন্ধ্যা হলে আংগুর ক্ষেতের মালিক তাঁর কর্মচারীকে বললেন, ‘মজুরদের ডেকে শেষ জন থেকে শুরু করে প্রথম জন পর্যন্ত প্রত্যেককে মজুরি দাও।’ “বিকাল পাঁচটার সময় যে মজুরদের কাজে লাগানো হয়েছিল তারা এসে প্রত্যেকে এক এক দীনার করে নিয়ে গেল। এতে যাদের প্রথমে কাজে লাগানো হয়েছিল তারা বেশী পাবে বলে মনে করল, কিন্তু তারাও প্রত্যেকে এক এক দীনার করেই পেল। তাতে তারা সেই মালিকের বিরুদ্ধে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতে লাগল, ‘আমরা সারা দিন রোদে পুড়ে কাজ করেছি। কিন্তু যাদের শেষে কাজে লাগানো হয়েছিল তারা মাত্র এক ঘণ্টা কাজ করেছে, অথচ তাদের আপনি আমাদের সমান মজুরি দিলেন।’ “তখন মালিক তাদের মধ্যে একজনকে বললেন, ‘বন্ধু, আমি তোমার উপর তো অন্যায় করি নি। তুমি কি এক দীনারে কাজ করতে রাজী হও নি? তোমার পাওনা নিয়ে চলে যাও। তোমাকে যেমন দিয়েছি, এই শেষের জনকেও তেমনই দিতে আমার ইচ্ছা। যা আমার নিজের, তা আমার খুশীমত ব্যবহার করবার অধিকার কি আমার নেই? নাকি আমি দয়ালু বলে তোমার চোখ টাটাচ্ছে?’ ” গল্পের শেষে ঈসা বললেন, “এইভাবেই শেষে যারা তারা প্রথম হবে, আর প্রথম যারা তারা শেষে পড়বে।” পরে ঈসা জেরুজালেমে যাবার পথে তাঁর বারোজন সাহাবীকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, “দেখ, আমরা জেরুজালেমে যাচ্ছি। সেখানে ইব্‌ন্তেআদমকে প্রধান ইমামদের ও আলেমদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরা তাঁর বিচার করে তাঁকে মৃত্যুর উপযুক্ত বলে স্থির করবেন। তাঁরা তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবার জন্য এবং চাবুক মারবার ও ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য অ-ইহুদীদের হাতে দেবেন; পরে তৃতীয় দিনে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবেন।” পরে সিবদিয়ের দুই ছেলেকে তাঁদের মা সংগে করে নিয়ে ঈসার কাছে আসলেন এবং তাঁর কাছে কিছু চাইবার উদ্দেশ্যে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে পড়লেন। ঈসা তাঁকে বললেন, “আপনি কি চান?” তিনি বললেন, “আপনি এই হুকুম দিন যেন আপনার রাজ্যে আমার এই দুই ছেলের একজন আপনার ডান পাশে আর একজন বাঁ পাশে বসতে পায়।” জবাবে ঈসা বললেন, “তোমরা কি চাইছ তা জান না। যে দুঃখের পেয়ালায় আমি খেতে যাচ্ছি তাতে কি তোমরা খেতে পার?” তাঁরা তাঁকে বললেন, “পারি।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “সত্যিই তোমরা আমার পেয়ালায় খাবে, কিন্তু আমার ডানে বা বাঁয়ে বসতে দেবার অধিকার আমার নেই। আমার পিতা যাদের জন্য তা ঠিক করে রেখেছেন তারাই তা পাবে।” এই সব কথা শুনে বাকী দশজন সাহাবী সেই দুই ভাইয়ের উপর বিরক্ত হলেন। তখন ঈসা সাহাবীদের ডেকে বললেন, “তোমরা এই কথা জান যে, অ-ইহুদীদের মধ্যে শাসনকর্তারা তাদের প্রভু হয় এবং নেতারা তাদের উপর হুকুম চালায়। কিন্তু তোমাদের মধ্যে তা হওয়া উচিত নয়। তোমাদের মধ্যে যে বড় হতে চায় তাকে তোমাদের সেবাকারী হতে হবে, আর যে প্রথম হতে চায় তাকে তোমাদের গোলাম হতে হবে। “মনে রেখো, ইব্‌নে-আদম সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন।” ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা জেরিকো শহর ছেড়ে যাবার সময় অনেক লোক তাঁর পিছনে পিছনে চলল। পথের ধারে দু’জন অন্ধ লোক বসে ছিল। ঈসা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছেন শুনে তারা চিৎকার করে বলল, “হুজুর, দাউদের বংশধর, আমাদের দয়া করুন।” তারা যেন চুপ করে সেইজন্য লোকেরা তাদের ধমক দিল। কিন্তু তারা আরও চিৎকার করে বলল, “হুজুর, দাউদের বংশধর, আমাদের দয়া করুন।” তখন ঈসা দাঁড়ালেন এবং তাদের ডেকে বললেন, “তোমরা কি চাও? আমি তোমাদের জন্য কি করব?” তারা তাঁকে বলল, “হুজুর, আমাদের চোখ খুলে দিন।” তখন ঈসা মমতায় পূর্ণ হয়ে তাদের চোখ ছুঁলেন, আর তখনই তারা দেখতে পেল এবং তাঁর পিছনে পিছনে চলল। ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা জেরুজালেমের কাছাকাছি পৌঁছে জৈতুন পাহাড়ের উপরে বৈৎফগী গ্রামের কাছে আসলেন। তখন ঈসা দু’জন সাহাবীকে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা ঐ সামনের গ্রামে যাও। সেখানে গেলেই দেখতে পাবে একটা গাধা বাঁধা আছে এবং একটা বাচ্চাও তার সংগে আছে। সেই দু’টা খুলে আমার কাছে নিয়ে এস। কেউ যদি কিছু বলে তবে বোলো, ‘হুজুরের দরকার আছে।’ তাতে তখনই সে তাদের ছেড়ে দেবে।” এটা হল যেন নবীর মধ্য দিয়ে এই যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়: “তোমরা সিয়োন্তকন্যাকে বল, তোমার বাদশাহ্‌ তোমার কাছে আসছেন। তিনি নম্র। তিনি গাধার উপরে, গাধীর বাচ্চার উপরে চড়ে আসছেন।” ঈসা সেই সাহাবীদের যেমন হুকুম দিয়েছিলেন তাঁরা গিয়ে তেমনি করলেন। তাঁরা সেই গাধা ও গাধীর বাচ্চাটা এনে তাদের উপর নিজেদের গায়ের চাদর পেতে দিলে পর ঈসা বসলেন। অনেক লোক পথের উপরে তাদের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিল। অন্যেরা গাছের ডাল কেটে নিয়ে পথের উপরে ছড়াল। যারা ঈসার সামনে ও পিছনে যাচ্ছিল তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, “মারহাবা, দাউদের বংশধর! মাবুদের নামে যিনি আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক। বেহেশতেও মারহাবা!” ঈসা জেরুজালেমে ঢুকলে পর শহরের সমস্ত জায়গায় হুলস'ূল পড়ে গেল। সবাই জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “ইনি কে?” লোকেরা বলল, “উনি গালীলের নাসরত গ্রামের ঈসা নবী।” পরে ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকলেন এবং সেখানে যারা কেনা-বেচা করছিল তাদের সবাইকে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি টাকা বদল করে দেবার লোকদের টেবিল এবং যারা কবুতর বিক্রি করছিল তাদের বসবার জায়গা উল্টে দিয়ে বললেন, “পাক-কিতাবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘আমার ঘরকে এবাদত-ঘর বলা হবে,’ কিন্তু তোমরা এটাকে ডাকাতের আড্ডাখানা করে তুলছ।” এর পরে অন্ধ ও খোঁড়া লোকেরা বায়তুল-মোকাদ্দসে ঈসার কাছে আসল, আর তিনি তাদের সুস্থ করলেন। তিনি যে সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করছিলেন প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা তা দেখলেন। তাঁরা বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে ছেলেমেয়েদের চিৎকার করে বলতে শুনলেন, “মারহাবা, দাউদের বংশধর!” এই সব দেখে-শুনে তারা বিরক্ত হয়ে ঈসাকে বললেন, “ওরা যা বলছে তা তুমি শুনতে পাচ্ছ?” তিনি তাঁদের বললেন, “জ্বী, পাচ্ছি। পাক-কিতাবে আপনারা কি কখনও পড়েন নি: ছোট ছেলেমেয়ে এবং শিশুদের কথার মধ্যে তুমি নিজের জন্য প্রশংসার ব্যবস্থা করেছ?” এর পরে ঈসা তাঁদের ছেড়ে শহরের বাইরে বেথানিয়া গ্রামে চলে গেলেন এবং সেখানেই রাতটা কাটালেন। পরদিন সকালে শহরে ফিরে আসবার সময় ঈসার খিদে পেল। পথের পাশে একটা ডুমুর গাছ দেখে তিনি গাছটার কাছে গেলেন, কিন্তু তাতে পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। তখন তিনি গাছটাকে বললেন, “আর কখনও তোমার মধ্যে ফল না ধরুক।” আর তখনই ডুমুর গাছটা শুকিয়ে গেল। সাহাবীরা তা দেখে আশ্চর্য হয়ে বললেন, “ডুমুর গাছটা এত তাড়াতাড়ি কেমন করে শুকিয়ে গেল?” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা সন্দেহ না করে যদি বিশ্বাস কর তবে ডুমুর গাছের উপরে আমি যা করেছি তোমরাও তা করতে পারবে। কেবল তা নয়, কিন্তু যদি এই পাহাড়কে বল, ‘উঠে সাগরে গিয়ে পড়,’ তবে তাও হবে। তোমরা যদি বিশ্বাস করে মুনাজাত কর তবে তোমরা যা চাইবে তা-ই পাবে।” পরে ঈসা আবার বায়তুল-মোকাদ্দসে গেলেন। যখন তিনি সেখানে শিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন প্রধান ইমামেরা ও ইহুদীদের বৃদ্ধ নেতারা তাঁর কাছে এসে বললেন, “তুমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছ? এই অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমিও আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনারা যদি আমাকে তার জবাব দিতে পারেন তবে আমিও আপনাদের বলব আমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছি। বলুন দেখি, তরিকাবন্দী দেবার অধিকার ইয়াহিয়া কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আল্লাহ্‌র কাছ থেকে, না মানুষের কাছ থেকে?” তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই আলোচনা করলেন, “আমরা যদি বলি, ‘আল্লাহ্‌র কাছ থেকে,’ তাহলে সে আমাদের বলবে, ‘তবে কেন আপনারা ইয়াহিয়াকে বিশ্বাস করেন নি?’ আবার যদি বলি, ‘মানুষের কাছ থেকে,’ তবে লোকদের কাছ থেকে আমাদের ভয় আছে, কারণ ইয়াহিয়াকে সবাই নবী বলে মনে করে।” এইজন্য জবাবে তাঁরা ঈসাকে বললেন, “আমরা জানি না।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “তবে আমিও আপনাদের বলব না আমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছি।” তারপর ঈসা বললেন, “আচ্ছা, আপনারা কি মনে করেন? ধরুন, একজন লোকের দু’টি ছেলে ছিল। লোকটি তাঁর বড় ছেলের কাছে গিয়ে বলল, ‘আজ তুমি আংগুর ক্ষেতে গিয়ে কাজ কর।’ জবাবে ছেলেটি বলল, ‘আমি যাব না।’ কিন্তু পরে সে মন ফিরিয়ে কাজে গেল। লোকটি পরে অন্য ছেলেটির কাছে গিয়ে সেই একই কথা বলল। অন্য ছেলেটি জবাবে বলল, ‘আমি যাচ্ছি,’ কিন্তু গেল না। এই দু’জনের মধ্যে কে পিতার ইচ্ছা পালন করল?” তখন ধর্ম-নেতারা জবাব দিলেন, “প্রথম জন।” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, খাজনা-আদায়কারীরা এবং বেশ্যারা আপনাদের আগে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকছে, কারণ ইয়াহিয়া আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার পথ দেখাবার জন্য আপনাদের কাছে এসেছিলেন, আর আপনারা তাঁর কথায় ঈমান আনেন নি। কিন্তু খাজনা-আদায়কারীরা এবং বেশ্যারা তাঁর কথায় ঈমান এনেছিল। এ দেখেও আপনারা তওবা করে তাঁর কথায় ঈমান আনেন নি। “আর একটা দৃষ্টান্ত দিই, শুনুন। একজন গৃহস' একটা আংগুর ক্ষেত করে তার চারদিকে বেড়া দিলেন। পরে সেই ক্ষেতের মধ্যে আংগুর-রস করবার জন্য গর্ত খুঁড়লেন এবং একটা উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করলেন। এর পরে তিনি কয়েকজন চাষীর কাছে সেই আংগুর ক্ষেতটা ইজারা দিয়ে বিদেশে চলে গেলেন। যখন ফল পাকবার সময় হয়ে আসল তখন তিনি সেই ফলের ভাগ নিয়ে আসবার জন্য তাঁর গোলামদের সেই চাষীদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। চাষীরা তাঁর গোলামদের একজনকে ধরে মারল, একজনকে খুন করল এবং অন্য আর একজনকে পাথর মারল। এর পর তিনি প্রথম বারের চেয়ে আরও বেশী গোলাম পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু চাষীরা সেই গোলামদের সংগে একই রকমের ব্যবহার করল। আংগুর ক্ষেতের মালিক শেষে নিজের ছেলেকেই তাদের কাছে পাঠালেন। তিনি ভাবলেন, তারা অন্ততঃ তাঁর ছেলেকে সম্মান করবে। কিন্তু সেই চাষীরা ছেলেকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, ‘এ-ই পরে সম্পত্তির মালিক হবে। চল, আমরা ওকে মেরে ফেলি, তাতে আমরাই সম্পত্তির মালিক হব।’ এই বলে তারা সেই ছেলেকে ধরে আংগুর ক্ষেত থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলল। তাহলে বলুন দেখি, আংগুর ক্ষেতের মালিক যখন নিজে আসবেন তখন তিনি সেই চাষীদের নিয়ে কি করবেন?” সেই ধর্ম-নেতারা ঈসাকে বললেন, “তিনি সেই দুষ্ট লোকদের একেবারে ধ্বংস করবেন এবং যে চাষীরা তাঁকে সময়মত ফলের ভাগ দেবে তাদের কাছেই সেই আংগুর ক্ষেতটা ইজারা দেবেন।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা কি পাক-কিতাবের মধ্যে কখনও পড়েন নি, ‘রাজমিস্ত্রিরা যে পাথরটা বাতিল করে দিয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল; মাবুদই এটা করলেন, আর তা আমাদের চোখে খুব আশ্চর্য লাগে’? এইজন্য আপনাদের বলছি, আল্লাহ্‌র রাজ্য আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে এবং এমন লোকদের দেওয়া হবে যাদের জীবনে সেই রাজ্যের উপযুক্ত ফল দেখা যাবে। যে সেই পাথরের উপরে পড়বে সে ভেংগে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে এবং সেই পাথর যার উপরে পড়বে সে চুরমার হয়ে যাবে।” প্রধান ইমামেরা এবং ফরীশীরা ঈসার শিক্ষা-ভরা গল্পগুলো শুনে বুঝতে পারলেন তিনি তাঁদের কথাই বলছেন। তখন তাঁরা তাঁকে ধরতে চাইলেন, কিন্তু লোকদের ভয়ে তা করলেন না, কারণ লোকে ঈসাকে নবী বলে মনে করত। শিক্ষা দেবার জন্য ঈসা আবার সেই ধর্ম-নেতাদের কাছে এই গল্পটা বললেন, “বেহেশতী রাজ্য এমন একজন বাদশাহ্‌র মত যিনি তাঁর ছেলের বিয়ের মেজবানী প্রস্তুত করলেন। যে লোকেরা সেই ভোজে দাওয়াত পেয়েছিল, তাদের ডাকবার জন্য তিনি তাঁর গোলামদের পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু তারা আসতে চাইল না। তখন তিনি আবার অন্য গোলামদের দিয়ে যে লোকদের দাওয়াত করা হয়েছিল, তাদের বলে পাঠালেন, ‘দেখুন, আমি আমার বলদ ও মোটাসোটা বাছুরগুলো জবাই করে মেজবানী প্রস্তুত করেছি। এখন সবই প্রস্তুত, আপনারা ভোজে আসুন।’ “যে লোকেরা দাওয়াত পেয়েছিল, তারা কিন্তু সেই গোলামদের কথা না শুনে একজন তার নিজের ক্ষেতে ও আর একজন তার নিজের কাজে চলে গেল। বাকী সবাই বাদশাহ্‌র গোলামদের ধরে অপমান করল ও হত্যা করল। তখন বাদশাহ্‌ খুব রেগে গেলেন এবং সৈন্য পাঠিয়ে তিনি সেই খুনীদের ধ্বংস করলেন আর তাদের শহর পুড়িয়ে দিলেন। পরে তিনি তাঁর গোলামদের বললেন, ‘মেজবানী প্রস্তুত, কিন্তু যাদের দাওয়াত করা হয়েছিল তারা এর যোগ্য নয়। তোমরা বরং রাস্তার মোড়ে মোড়ে যাও, আর যত জনের দেখা পাও সবাইকে বিয়ের ভোজে ডেকে আন।’ তখন সেই গোলামেরা বাইরে রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে ভাল-মন্দ যাদের পেল সবাইকে ডেকে আনল। তাতে বিয়ে-বাড়ী সেই মেহমানে ভরে গেল। “এর পর বাদশাহ্‌ মেহমানদের দেখবার জন্য ভিতরে এসে দেখলেন, একজন লোক বিয়ের কাপড় না পরেই সেখানে এসেছে। বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বন্ধু, বিয়ের কাপড় ছাড়া কেমন করে এখানে ঢুকলে?’ সে এর কোন জবাব দিতে পারল না। তখন বাদশাহ্‌ চাকরদের বললেন, ‘এর হাত-পা বেঁধে বাইরের অন্ধকারে ফেলে দাও। সেই জায়গায় লোকে কান্নাকাটি করবে ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে।’ ” গল্পের শেষে ঈসা বললেন, “এইজন্য বলি, অনেক লোককে ডাকা হয়েছে কিন্তু অল্প লোককে বেছে নেওয়া হয়েছে।” তখন ফরীশীরা চলে গেলেন এবং কেমন করে ঈসাকে তাঁর কথার ফাঁদে ফেলা যায় সেই পরামর্শ করতে লাগলেন। তারা হেরোদের দলের কয়েকজন লোকের সংগে নিজেদের কয়েকজন শাগরেদকে ঈসার কাছে পাঠালেন। তারা তাঁকে বলল, “হুজুর, আমরা জানি আপনি একজন সৎ লোক। আল্লাহ্‌র পথের বিষয়ে আপনি সত্যভাবে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। লোকে কি মনে করবে না করবে তাতে আপনার কিছু যায় আসে না, কারণ আপনি কারও মুখ চেয়ে কিছু করেন না। তাহলে আপনি বলুন, মূসার শরীয়ত অনুসারে রোম-সম্রাটকে কি খাজনা দেওয়া উচিত? আপনার কি মনে হয়?” তাদের খারাপ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঈসা বললেন, “ভণ্ডেরা, কেন আমাকে পরীক্ষা করছ? যে টাকায় খাজনা দেবে তার একটা আমাকে দেখাও।” তারা একটা দীনার ঈসার কাছে আনল। তখন ঈসা তাদের বললেন, “এর উপরে এই ছবি ও নাম কার?” তারা বলল, “রোম-সম্রাটের।” ঈসা তাদের বললেন, “তবে যা সম্রাটের তা সম্রাটকে দাও, আর যা আল্লাহ্‌র তা আল্লাহ্‌কে দাও।” এই কথা শুনে তারা আশ্চর্য হল এবং তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। সেই একই দিনে কয়েকজন সদ্দূকী ঈসার কাছে আসলেন। সদ্দূকীদের মতে মৃতদের জীবিত হয়ে ওঠা বলে কিছু নেই। এইজন্য তাঁরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, মূসা বলেছেন, যদি কোন লোক সন্তানহীন অবস্থায় মারা যায় তবে তার ভাই তার স্ত্রীকে বিয়ে করে ভাইয়ের হয়ে তার বংশ রক্ষা করবে। আমাদের এখানে সাত ভাই ছিল। প্রথম জন বিয়ে করে মারা গেল এবং সন্তান না থাকাতে সে তার ভাইয়ের জন্য নিজের স্ত্রীকে রেখে গেল। এইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও সপ্তম ভাই পর্যন্ত সেই স্ত্রীকে বিয়ে করল। শেষে সেই স্ত্রীলোকটিও মারা গেল। তাহলে মৃতেরা যখন জীবিত হয়ে উঠবে তখন ঐ সাত ভাইয়ের মধ্যে এই স্ত্রীলোকটি কার স্ত্রী হবে? তারা সবাই তো তাকে বিয়ে করেছিল।” ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা ভুল করছেন, কারণ আপনারা পাক-কিতাবও জানেন না, আল্লাহ্‌র শক্তির বিষয়েও জানেন না। মৃতেরা জীবিত হয়ে উঠবার পরে বিয়ে করবে না এবং তাদের বিয়ে দেওয়াও হবে না; তারা ফেরেশতাদের মত হবে। মৃতদের জীবিত হয়ে উঠবার বিষয়ে আল্লাহ্‌ যে কথা আপনাদের বলেছেন সেই কথা কি আপনারা পাক-কিতাবে পড়েন নি? তাতে লেখা আছে, ‘আমি ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, ইসহাকের আল্লাহ্‌ এবং ইয়াকুবের আল্লাহ্‌।’ কিন্তু আল্লাহ্‌ তো মৃতদের আল্লাহ্‌ নন, তিনি জীবিতদেরই আল্লাহ্‌।” এই কথা শুনে লোকেরা তাঁর শিক্ষায় আশ্চর্য হল। ঈসা সদ্দূকীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন শুনে ফরীশীরা একত্র হলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আলেম ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে বড় হুকুম কোন্‌টা?” তার পরের দরকারী হুকুমটা প্রথমটারই মত- ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।’ সম্পূর্ণ তৌরাত শরীফ এবং নবীদের সমস্ত কিতাব এই দু’টি হুকুমের উপরেই ভরসা করে আছে।” ফরীশীরা তখনও একসংগে ছিলেন, এমন সময় ঈসা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা মসীহের বিষয়ে কি মনে করেন? তিনি কার বংশধর?” তাঁরা ঈসাকে বললেন, “দাউদের বংশধর।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “তবে দাউদ কেমন করে মসীহ্‌কে পাক-রূহের পরিচালনায় প্রভু বলে ডেকেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘মাবুদ আমার প্রভুকে বললেন, যতক্ষণ না আমি তোমার শত্রুদের তোমার পায়ের তলায় রাখি, ততক্ষণ তুমি আমার ডানদিকে বস।’ তাহলে দাউদ যখন মসীহ্‌কে প্রভু বলে ডেকেছেন তখন মসীহ্‌ কেমন করে দাউদের বংশধর হতে পারেন?” এর জবাবে কেউ এক কথাও তাঁকে বলতে পারল না এবং সেই দিন থেকে কেউ তাঁকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতেও সাহস করল না। পরে ঈসা লোকদের কাছে ও তাঁর সাহাবীদের কাছে বললেন, “শরীয়ত শিক্ষা দেবার ব্যাপারে আলেমেরা ও ফরীশীরা মূসা নবীর জায়গায় আছেন। এইজন্য তাঁরা যা কিছু করতে বলেন তা কোরো এবং যা পালন করবার হুকুম দেন তা পালন কোরো। কিন্তু তাঁরা যা করেন তোমরা তা কোরো না, কারণ তাঁরা মুখে যা বলেন কাজে তা করেন না। তাঁরা ভারী ভারী বোঝা বেঁধে মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেন, কিন্তু সেগুলো সরাবার জন্য নিজেরা একটা আংগুলও নাড়াতে চান না। লোকদের দেখাবার জন্যই তাঁরা সব কাজ করেন। পাক-কিতাবের আয়াত-লেখা তাবিজ তাঁরা বড় করে তৈরী করেন আর নিজেদের ধার্মিক দেখাবার জন্য চাদরের কোণায় কোণায় লম্বা থোপ্‌না লাগান। মেজবানীর সময় সম্মানের জায়গায় এবং মজলিস-খানায় প্রধান প্রধান আসনে তাঁরা বসতে ভালবাসেন। তাঁরা হাটে-বাজারে সম্মান খুঁজে বেড়ান আর চান যেন লোকেরা তাঁদের ওস্তাদ বলে ডাকে। “কেউ তোমাদের ওস্তাদ বলে ডাকুক তা চেয়ো না, কারণ তোমাদের ওস্তাদ বলতে কেবল একজনই আছেন, আর তোমরা সবাই ভাই ভাই। এই দুনিয়াতে কাউকেই পিতা বলে ডেকো না, কারণ তোমাদের একজনই পিতা আর তিনি বেহেশতে আছেন। কেউ তোমাদের নেতা বলে ডাকুক তা চেয়ো না, কারণ তোমাদের নেতা বলতে কেবল একজনই আছেন, তিনি মসীহ্‌। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে তোমাদের সেবাকারী হোক। যে কেউ নিজেকে উঁচু করে তাকে নীচু করা হবে এবং যে কেউ নিজেকে নীচু করে তাকে উঁচু করা হবে। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা লোকদের সামনে বেহেশতী রাজ্যের দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাতে নিজেরাও ঢোকেন না আর যারা ঢুকতে চেষ্টা করছে তাদেরও ঢুকতে দেন না। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! এক দিকে আপনারা লোকদের দেখাবার জন্য লম্বা লম্বা মুনাজাত করেন, অন্য দিকে বিধবাদের সম্পত্তি দখল করেন। এইজন্য আপনাদের অনেক বেশী শাস্তি হবে। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! একটি মাত্র লোককে আপনাদের ধর্ম-মতে আনবার জন্য আপনারা দুনিয়ার কোথায় না যান। আর সে যখন আপনাদের ধর্ম-মতে আসে তখন আপনারা নিজেদের চেয়ে তাকে অনেক বেশী করে জাহান্নামী করে তোলেন। “ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা নিজেরা অন্ধ অথচ অন্যদের পথ দেখান। আপনারা বলে থাকেন, বায়তুল-মোকাদ্দসের নামে কেউ কসম খেলে তাতে কিছু হয় না, কিন্তু যদি কেউ বায়তুল-মোকাদ্দসের সোনার নামে কসম খায় তবে সে সেই কসমে বাঁধা পড়ে। মূর্খ ও অন্ধের দল, কোন্‌টা বড়? সোনা, না সেই বায়তুল-মোকাদ্দস যা সেই সোনাকে পবিত্র করে? আপনারা আবার এই কথাও বলে থাকেন, কোরবানগাহের নামে কেউ কসম খেলে কিছুই হয় না, কিন্তু যদি কেউ সেই কোরবানগাহের উপরে যে দান আছে তার নামে কসম খায় তবে সে সেই কসমে বাঁধা পড়ে। অন্ধের দল, কোন্‌টা বড়? সেই দান, না সেই কোরবানগাহ্‌ যা সেই দানকে পবিত্র করে? এইজন্য কোরবানগাহের নামে যে কসম খায় সে সেই কোরবানগাহ্‌ এবং তার উপরের সব কিছুর নামেই কসম খায়। আর বায়তুল-মোকাদ্দসের নামে যে কসম খায় সে বায়তুল-মোকাদ্দস এবং তার ভিতরে যিনি থাকেন তাঁরই নামে কসম খায়। যে বেহেশতের নামে কসম খায় সে আল্লাহ্‌র সিংহাসন এবং যিনি তার উপর বসে আছেন তাঁরই নামে কসম খায়। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা পুদিনা, মৌরি আর জিরার দশ ভাগের এক ভাগ আল্লাহ্‌কে ঠিকমতই দিয়ে থাকেন; কিন্তু ন্যায়, দয়া এবং বিশ্বস্ততা, যা মূসার শরীয়তের আরও দরকারী বিষয় তা আপনারা বাদ দিয়েছেন। আগেরগুলো পালন করবার সংগে সংগে পরেরগুলোও পালন করা আপনাদের উচিত। আপনারা নিজেরা অন্ধ অথচ অন্যদের পথ দেখান। একটা ছোট মাছিও আপনারা ছাঁকেন অথচ উট গিলে ফেলেন। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা থালা-পেয়ালার বাইরের দিকটা পরিষ্কার করে থাকেন, কিন্তু সেগুলো জুলুমের জিনিস আর লোভের ফল দিয়ে পূর্ণ। অন্ধ ফরীশীরা, আগে সেগুলোর ভিতরের দিকটা পরিষ্কার করুন, তাতে তার বাইরের দিকটাও পরিষ্কার হবে। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা চুনকাম করা কবরের মত, যার বাইরের দিকটা সুন্দর কিন্তু ভিতরটা মরা মানুষের হাড়-গোড় ও সব রকম ময়লায় ভরা। ঠিক সেইভাবে, বাইরে আপনারা লোকদের চোখে ধার্মিক কিন্তু ভিতরে ভণ্ডামী ও গুনাহে পূর্ণ। “ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা নবীদের কবর নতুন করে গাঁথেন এবং আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের কবর সাজান। আপনারা বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় বেঁচে থাকতাম তবে নবীদের খুন করবার জন্য তাঁদের সংগে যোগ দিতাম না।’ এতে আপনারা নিজেদের বিরুদ্ধে এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নবীদের যারা খুন করেছে আপনারা তাদেরই বংশধর। তাহলে আপনাদের পূর্বপুরুষেরা যা শুরু করে গেছেন তার বাকী অংশ আপনারা শেষ করুন। “সাপের দল আর সাপের বংশধরেরা! কেমন করে আপনারা জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা পাবেন? এইজন্যই আমি আপনাদের কাছে নবী, জ্ঞানী লোক এবং আলেমদের পাঠাচ্ছি। আপনারা তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে খুন করবেন ও কয়েকজনকে ক্রুশের উপরে হত্যা করবেন। কয়েকজনকে আপনাদের মজলিস-খানায় চাবুক মারবেন এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তাড়া করে বেড়াবেন। এইজন্য নির্দোষ হাবিলের খুন থেকে শুরু করে আপনারা যে বরখিয়ের ছেলে জাকারিয়াকে পবিত্র স্থান আর কোরবানগাহের মাঝখানে খুন করেছিলেন, সেই জাকারিয়ার খুন পর্যন্ত দুনিয়াতে যত নির্দোষ লোক খুন হয়েছে আপনারা সেই সমস্ত রক্তের দায়ী হবেন। আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, এই কালের লোকেরাই সেই সমস্ত রক্তের দায়ী হবে। “জেরুজালেম! হায় জেরুজালেম! তুমি নবীদের খুন করে থাক এবং তোমার কাছে যাদের পাঠানো হয় তাদের পাথর মেরে থাক। মুরগী যেমন বাচ্চাদের তার ডানার নীচে জড়ো করে তেমনি আমি তোমার লোকদের কতবার আমার কাছে জড়ো করতে চেয়েছি, কিন্তু তারা রাজী হয় নি। হে জেরুজালেমের লোকেরা, তোমাদের বাড়ী তোমাদের সামনে খালি হয়ে পড়ে থাকবে। আমি তোমাদের বলছি, যে পর্যন্ত না তোমরা বলবে, ‘যিনি মাবুদের নামে আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক,’ সেই পর্যন্ত আর তোমরা আমাকে দেখতে পাবে না।” ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর সাহাবীরা তাঁকে বায়তুল-মোকাদ্দসের দালানগুলো দেখাবার জন্য তাঁর কাছে আসলেন। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা তো এই সব দেখছ, কিন্তু আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এখানে একটা পাথরের উপরে আর একটা পাথর থাকবে না; সমস্তই ভেংগে ফেলা হবে।” পরে ঈসা যখন জৈতুন পাহাড়ে বসে ছিলেন তখন সাহাবীরা গোপনে তাঁর কাছে এসে বললেন, “আমাদের বলুন, কখন এই সব হবে এবং কি রকম চিহ্নের দ্বারা বুঝা যাবে আপনার আসবার সময় ও কেয়ামতের সময় হয়েছে?” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “দেখো, কেউ যেন তোমাদের না ঠকায়, কারণ অনেকেই আমার নাম নিয়ে এসে বলবে, ‘আমিই মসীহ্‌,’ এবং অনেক লোককে ঠকাবে। তোমাদের কানে যুদ্ধের আওয়াজ আসবে আর যুদ্ধের খবরাখবরও তোমরা শুনতে পাবে। কিন্তু সাবধান! এতে ভয় পেয়ো না, কারণ এই সব হবেই; কিন্তু তখনও শেষ নয়। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে এবং এক রাজ্য অন্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষ ও ভূমিকমপ হবে। কিন্তু এই সব কেবল যন্ত্রণার শুরু। “সেই সময়ে লোকে তোমাদের কষ্ট দেবার জন্য ধরিয়ে দেবে এবং তোমাদের খুন করবে। আমার জন্য সব লোকেরা তোমাদের ঘৃণা করবে। সেই সময়ে অনেকেই পিছিয়ে যাবে এবং একে অন্যকে ধরিয়ে দেবে ও ঘৃণা করবে। অনেক ভণ্ড নবী এসে অনেককে ঠকাবে। দুষ্টতা বেড়ে যাবে বলে অনেকের মহব্বত খুব কমে যাবে। কিন্তু যে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকবে সে উদ্ধার পাবে। সমস্ত জাতির কাছে সাক্ষ্য দেবার জন্য বেহেশতী রাজ্যের সুসংবাদ সারা দুনিয়াতে তবলিগ করা হবে এবং তার পরেই শেষ সময় উপস্থিত হবে। “দানিয়াল নবীর মধ্য দিয়ে যে সর্বনাশা ঘৃণার জিনিসের কথা বলা হয়েছিল তা তোমরা পবিত্র জায়গায় রাখা হয়েছে দেখতে পাবে। (যে পড়ে সে বুঝুক।) সেই সময় যারা এহুদিয়াতে থাকবে তারা পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যাক। যে ছাদের উপরে থাকবে সে ঘর থেকে জিনিসপত্র নেবার জন্য নীচে না নামুক। ক্ষেতের মধ্যে যে থাকবে সে তার গায়ের চাদর নেবার জন্য না ফিরুক। তখন যারা গর্ভবতী আর যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ায় তাদের অবস্থা কি ভীষণই না হবে! মুনাজাত কর যেন শীতকালে বা বিশ্রামবারে তোমাদের পালাতে না হয়। তখন এমন মহাকষ্ট হবে যা দুনিয়ার শুরু থেকে এই সময় পর্যন্ত কখনও হয় নি এবং হবেও না। সেই কষ্টের দিনগুলো যদি আল্লাহ্‌ কমিয়ে না দিতেন তবে কেউই বাঁচত না। কিন্তু তাঁর বাছাই করা বান্দাদের জন্য আল্লাহ্‌ সেই দিনগুলো কমিয়ে দেবেন। “সেই সময়ে যদি কেউ তোমাদের বলে, ‘দেখ, মসীহ্‌ এখানে’ কিংবা ‘দেখ,মসীহ্‌ ওখানে,’ তবে তা বিশ্বাস কোরো না; কারণ তখন অনেক ভণ্ড মসীহ্‌ ও ভণ্ড নবী আসবে এবং বড় বড় চিহ্ন-কাজ ও কুদরতি দেখাবে যাতে সম্ভব হলে আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদেরও তারা ঠকাতে পারে। দেখ, আমি আগেই তোমাদের এই সব বলে রাখলাম। “সেইজন্য লোকে যদি তোমাদের বলে, ‘তিনি মরুভূমিতে আছেন,’ তোমরা বাইরে যেয়ো না। যদি বলে, ‘তিনি ভিতরের ঘরে আছেন,’ বিশ্বাস কোরো না। বিদ্যুৎ যেমন পূর্ব দিকে দেখা দিয়ে পশ্চিম দিক পর্যন্ত চম্‌কে যায় ইব্‌ন্তেআদমের আসা সেইভাবেই হবে। যেখানে লাশ থাকবে সেখানেই শকুন এসে একসংগে জড়ো হবে। “সেই সময়কার কষ্টের ঠিক পরেই সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে, চাঁদ আর আলো দেবে না, তারাগুলো আসমান থেকে খসে পড়ে যাবে এবং চাঁদ-সূর্য-তারা আর স্থির থাকবে না। এমন সময় আসমানে ইব্‌ন্তেআদমের চিহ্ন দেখা দেবে। তখন দুনিয়ার সমস্ত লোক দুঃখে বুক চাপড়াবে। তারা ইব্‌ন্তেআদমকে শক্তি ও মহিমার সংগে মেঘে করে আসতে দেখবে। জোরে জোরে শিংগা বেজে উঠবে আর সংগে সংগে ইব্‌ন্তেআদম তাঁর ফেরেশতাদের পাঠিয়ে দেবেন। সেই ফেরেশতারা দুনিয়ার এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত চার দিক থেকে তাঁর বাছাই করা বান্দাদের একসংগে জমায়েত করবেন। “ডুমুর গাছ দেখে শিক্ষা লাভ কর। যখন তার ডালপালা নরম হয়ে তাতে পাতা বের হয় তখন তোমরা জানতে পার যে, গরমকাল কাছে এসেছে। সেইভাবে তোমরা এই সব ঘটনা দেখলে পর বুঝতে পারবে যে, ইব্‌ন্তেআদম কাছে এসে গেছেন, এমন কি, দরজায় উপস্থিত। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, যখন এই সব হবে তখনও এই কালের কিছু লোক বেঁচে থাকবে। আসমান ও জমীন শেষ হবে, কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকবে। “সেই দিন ও সেই সময়ের কথা কেউই জানে না, বেহেশতের ফেরেশতারাও না, পুত্রও না; কেবল পিতাই জানেন। “নবী নূহের সময়ে যে অবস্থা হয়েছিল ইব্‌ন্তেআদমের আসবার সময়ে ঠিক সেই অবস্থাই হবে। বন্যার আগের দিনগুলোতে নূহ্‌ জাহাজে না ঢোকা পর্যন্ত লোকে খাওয়া-দাওয়া করেছে, বিয়ে করেছে এবং বিয়ে দিয়েছে। যে পর্যন্ত না বন্যা এসে তাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই পর্যন্ত তারা কিছুই বুঝতে পারল না। ইব্‌ন্তেআদমের আসাও ঠিক সেই রকমই হবে। তখন দু’জন লোক মাঠে থাকবে; একজনকে নেওয়া হবে এবং অন্যজনকে ফেলে যাওয়া হবে। দু’জন স্ত্রীলোক জাঁতা ঘুরাবে; একজনকে নেওয়া হবে, অন্যজনকে ফেলে যাওয়া হবে। “তাই বলি, তোমরা সতর্ক থাক, কারণ তোমাদের প্রভু কোন্‌ দিন আসবেন তা তোমরা জান না। তবে তোমরা এই কথা জেনো, ঘরের কর্তা যদি জানতেন কোন্‌ সময় চোর আসবে তাহলে তিনি জেগেই থাকতেন, নিজের ঘরে তিনি চোরকে ঢুকতে দিতেন না। সেইজন্য তোমরাও প্রস্তুত থাক, কারণ যে সময়ের কথা তোমরা চিন্তাও করবে না সেই সময়েই ইব্‌ন্তেআদম আসবেন। “সেই বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান গোলাম কে, যাকে তার মালিক তাঁর অন্যান্য গোলামদের ঠিক সময়ে খাবার দেবার ভার দিয়েছেন? ধন্য সেই গোলাম, যাকে তার মালিক এসে বিশ্বস্তভাবে কাজ করতে দেখবেন। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তিনি সেই গোলামকেই তাঁর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার দেবেন। কিন্তু ধর, সেই গোলাম দুষ্ট, আর সে মনে মনে বলল, ‘আমার মালিক আসতে দেরি করছেন।’ সেই সুযোগে সে তার সংগী-গোলামদের মারধর করতে লাগল এবং মাতালদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করে মদ খেতে লাগল। কিন্তু যেদিন ও যে সময়ের কথা সেই গোলাম চিন্তাও করবে না, জানবেও না, সেই দিন ও সেই সময়েই তার মালিক এসে হাজির হবেন। তখন তিনি তাকে কেটে দু’টুকরা করে ভণ্ডদের মধ্যে তার স্থান ঠিক করবেন। সেখানে লোকে কান্নাকাটি করবে ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে। “সেই সময়ে বেহেশতী রাজ্য এমন দশজন মেয়ের মত হবে যারা বান্ধবীর বরকে এগিয়ে আনবার জন্য বাতি নিয়ে বাইরে গেল। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিল বুদ্ধিমতি। বুদ্ধিহীন মেয়েরা তাদের বাতি নিল বটে কিন্তু সংগে করে তেল নিল না। বুদ্ধিমতি মেয়েরা তাদের বাতির সংগে পাত্রে করে তেলও নিল। বর আসতে দেরি হওয়াতে তারা ঢুলতে ঢুলতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। “পরে মাঝ রাতে চিৎকার শোনা গেল, ‘ঐ দেখ, বর আসছেন! বরকে এগিয়ে আনতে বের হও।’ তখন সেই মেয়েরা উঠে তাদের বাতি ঠিক করল। বুদ্ধিহীন মেয়েরা বুদ্ধিমতিদের বলল, ‘তোমাদের তেল থেকে আমাদের কিছু দাও, কারণ আমাদের বাতি নিভে যাচ্ছে।’ তখন সেই বুদ্ধিমতি মেয়েরা জবাবে বলল, ‘না, তেল যা আছে তাতে হয়তো আমাদের ও তোমাদের কুলাবে না। তোমরা বরং দোকানদারদের কাছে গিয়ে নিজেদের জন্য তেল কিনে নাও।’ সেই বুদ্ধিহীন মেয়েরা যখন তেল কিনতে গেল তখনই বর এসে পড়লেন। তখন যে মেয়েরা প্রস্তুত ছিল তারা বরের সংগে বিয়ে বাড়ীতে গেল। তারা সবাই ভিতরে গেলে পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। “পরে সেই বুদ্ধিহীন মেয়েরা এসে বলল, ‘দেখুন, দরজাটা খুলে দিন।’ জবাবে বর বললেন, ‘সত্যি বলছি, আমি তোমাদের চিনি না।’ ” গল্পের শেষে ঈসা বললেন, “এইজন্য সতর্ক থাক, কারণ সেই দিন বা সেই সময়ের কথা তোমরা জান না। “বেহেশতী রাজ্য এমন একজন লোকের মত যিনি বিদেশে যাবার আগে তাঁর গোলামদের ডেকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির ভার তাদের হাতে দিয়ে গেলেন। সেই গোলামদের ক্ষমতা অনুসারে তিনি একজনকে পাঁচ হাজার, একজনকে দু’হাজার ও একজনকে এক হাজার টাকা দিলেন। যে পাঁচ হাজার টাকা পেল সে তা দিয়ে ব্যবসা করে আরও পাঁচ হাজার টাকা লাভ করল। যে দু’হাজার টাকা পেল সে-ও একইভাবে আরও দু’হাজার টাকা লাভ করল। কিন্তু যে এক হাজার টাকা পেল সে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তার মালিকের টাকাগুলো লুকিয়ে রাখল। “অনেক দিন পরে সেই মালিক এসে গোলামদের কাছ থেকে হিসাব চাইলেন। যে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিল সে আরও পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসে বলল, ‘আপনি আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। দেখুন, আমি আরও পাঁচ হাজার টাকা লাভ করেছি।’ তখন তার মালিক তাকে বললেন, ‘শাবাশ! তুমি ভাল ও বিশ্বস্ত গোলাম। তুমি অল্প বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে আমি তোমাকে অনেক বিষয়ের ভার দেব। এস, আমার আনন্দের ভাগী হও।’ “যে দু’হাজার টাকা পেয়েছিল সে এসে বলল, ‘আপনি আমাকে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন। দেখুন, আমি আরও দু’হাজার টাকা লাভ করেছি।’ তখন তার মালিক তাকে বললেন, ‘শাবাশ! তুমি ভাল ও বিশ্বস্ত গোলাম। তুমি অল্প বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে আমি তোমাকে অনেক বিষয়ের ভার দেব। এস, আমার আনন্দের ভাগী হও।’ “কিন্তু যে এক হাজার টাকা পেয়েছিল সে এসে বলল, ‘দেখুন, আমি জানতাম আপনি ভয়ানক কঠিন লোক। আপনি যেখানে বীজ বোনেন নি সেখান থেকে কাটেন এবং যেখানে ছড়ান নি সেখান থেকে কুড়ান। এইজন্য আমি ভয়ে ভয়ে বাইরে গিয়ে মাটিতে আপনার টাকা লুকিয়ে রেখেছিলাম। এই দেখুন, আপনার জিনিস আপনারই আছে।’ জবাবে তার মালিক তাকে বললেন, ‘দুষ্ট ও অলস গোলাম! তুমি তো জানতে যেখানে আমি বুনি নি সেখানে কাটি আর যেখানে ছড়াই নি সেখানে কুড়াই। তাহলে মহাজনদের কাছে আমার টাকা জমা রাখ নি কেন? তা করলে তো আমি এসে টাকাটাও পেতাম এবং সংগে কিছু সুদও পেতাম।’ তারপর তিনি অন্যদের বললেন, ‘তোমরা ওর কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে যার দশ হাজার টাকা আছে তাকে দাও। যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে আর তাতে তার অনেক হবে। কিন্তু যার নেই তার যা আছে তা-ও তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। ঐ অপদার্থ গোলামকে তোমরা বাইরের অন্ধকারে ফেলে দাও; সেখানে লোকে কান্নাকাটি করবে আর যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবে।’ “ইব্‌ন্তেআদম সমস্ত ফেরেশতাদের সংগে নিয়ে যখন নিজের মহিমায় আসবেন তখন তিনি বাদশাহ্‌ হিসাবে তাঁর সিংহাসনে মহিমার সংগে বসবেন। সেই সময় সমস্ত জাতির লোকদের তাঁর সামনে একসংগে জমায়েত করা হবে। রাখাল যেমন ভেড়া আর ছাগল আলাদা করে তেমনি তিনি সব লোকদের দু’ভাগে আলাদা করবেন। তিনি নিজের ডান দিকে ভেড়াদের আর বাঁ দিকে ছাগলদের রাখবেন। “এর পরে বাদশাহ্‌ তাঁর ডান দিকের লোকদের বলবেন, ‘তোমরা যারা আমার পিতার দোয়া পেয়েছ, এস। দুনিয়ার শুরুতে যে রাজ্য তোমাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তার অধিকারী হও। যখন আমার খিদে পেয়েছিল তখন তোমরা আমাকে খেতে দিয়েছিলে; যখন পিপাসা পেয়েছিল তখন পানি দিয়েছিলে; যখন মেহমান হয়েছিলাম তখন আশ্রয় দিয়েছিলে; যখন খালি গায়ে ছিলাম তখন কাপড় পরিয়েছিলে; যখন অসুস্থ হয়েছিলাম তখন আমার দেখাশোনা করেছিলে; আর যখন আমি জেলখানায় বন্দী অবস্থায় ছিলাম তখন আমাকে দেখতে গিয়েছিলে।’ “তখন সেই আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা জবাবে তাঁকে বলবে, ‘প্রভু, আপনার খিদে পেয়েছে দেখে কখন আপনাকে খেতে দিয়েছিলাম বা পিপাসা পেয়েছে দেখে পানি দিয়েছিলাম? কখনই বা আপনাকে মেহমান হিসাবে আশ্রয় দিয়েছিলাম, কিংবা খালি গায়ে দেখে কাপড় পরিয়েছিলাম? আর কখনই বা আপনাকে অসুস্থ বা জেলখানায় আছেন জেনে আপনার কাছে গিয়েছিলাম?’ “এর জবাবে বাদশাহ্‌ তখন তাদের বলবেন, ‘আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আমার এই ভাইদের মধ্যে সামান্য কোন একজনের জন্য যখন তা করেছিলে তখন আমারই জন্য তা করেছিলে।’ “পরে তিনি তাঁর বাঁ দিকের লোকদের বলবেন, ‘ওহে বদদোয়াপ্রাপ্ত লোকেরা, আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও। ইবলিস এবং তার ফেরেশতাদের জন্য যে চিরকালের আগুন প্রস্তুত করা হয়েছে তার মধ্যে যাও। যখন আমার খিদে পেয়েছিল তখন তোমরা আমাকে খেতে দাও নি; যখন পিপাসা পেয়েছিল তখন পানি দাও নি; যখন মেহমান হয়েছিলাম তখন আশ্রয় দাও নি; যখন খালি গায়ে ছিলাম তখন আমাকে কাপড় পরাও নি; যখন অসুস্থ হয়েছিলাম এবং জেলখানায় বন্দী অবস্থায় ছিলাম তখন আমাকে দেখতে যাও নি।’ “তখন তারা তাঁকে বলবে, ‘প্রভু, কখন আপনার খিদে বা পিপাসা পেয়েছে দেখে, কিংবা মেহমান হয়েছেন দেখে, কিংবা খালি গায়ে দেখে, কিংবা অসুস্থ বা জেলখানায় আছেন জেনে সাহায্য করি নি?’ “জবাবে তিনি তাদের বলবেন, ‘আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা যখন এই সামান্য লোকদের মধ্যে কোন একজনের জন্য তা কর নি তখন তা আমার জন্যই কর নি।’ ” তারপর ঈসা বললেন, “এই লোকেরা অনন্ত শাস্তি পেতে যাবে, কিন্তু ঐ আল্লাহ্‌ভক্ত লোকেরা অনন্ত জীবন ভোগ করতে যাবে।” এই সব কথার শেষে ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “তোমরা তো জান আর দুই দিন পরেই উদ্ধার-ঈদ, আর ইব্‌ন্তেআদমকে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য ধরিয়ে দেওয়া হবে।” তবে তাঁরা বললেন, “ঈদের সময়ে নয়; তাতে লোকদের মধ্যে হয়তো গোলমাল শুরু হবে।” ঈসা যখন বেথানিয়াতে চর্মরোগী শিমোনের বাড়ীতে ছিলেন তখন একজন স্ত্রীলোক তাঁর কাছে আসল। সেই স্ত্রীলোকটি একটা সাদা পাথরের পাত্রে করে খুব দামী আতর এনেছিল। ঈসা যখন খেতে বসলেন তখন সে তাঁর মাথায় সেই আতর ঢেলে দিল। সাহাবীরা তা দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই দামী জিনিসটা কেন নষ্ট করা হচ্ছে? এটা তো অনেক দামে বিক্রি করে টাকাটা গরীবদের দেওয়া যেত।” ঈসা এই কথা বুঝতে পেরে সাহাবীদের বললেন, “তোমরা এই স্ত্রীলোকটিকে দুঃখ দিচ্ছ কেন? সে তো আমার প্রতি ভাল কাজই করেছে। গরীবেরা তো সব সময় তোমাদের মধ্যে আছে, কিন্তু আমাকে তোমরা সব সময় পাবে না। সে আমার গায়ের উপর এই আতর ঢেলে দিয়ে আমাকে কবরের জন্য প্রস্তুত করেছে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, দুনিয়ার যে কোন জায়গায় সুসংবাদ তবলিগ করা হবে সেখানে এই স্ত্রীলোকটির কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য তার এই কাজের কথাও বলা হবে।” তখন সেই বারোজন সাহাবীদের মধ্যে এহুদা ইষ্কারিয়োৎ নামে সাহাবীটি প্রধান ইমামদের কাছে গিয়ে বলল, “ঈসাকে আপনাদের হাতে ধরিয়ে দিলে আপনারা আমাকে কি দেবেন?” প্রধান ইমামেরা ত্রিশটা রূপার টাকা গুণে তাকে দিলেন। তার পর থেকেই এহুদা ঈসাকে ধরিয়ে দেবার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল। খামিহীন রুটির ঈদের প্রথম দিনে সাহাবীরা ঈসার কাছে এসে বললেন, “আপনার জন্য উদ্ধার-ঈদের মেজবানী আমাদের কোথায় প্রস্তুত করতে বলেন?” ঈসা বললেন, “শহরের মধ্যে গিয়ে ঐ লোককে বল যে, হুজুর বলছেন, ‘আমার সময় কাছে এসে গেছে। আমার সাহাবীদের সংগে আমি তোমার বাড়ীতেই উদ্ধার-ঈদ পালন করব।’ ” ঈসা সাহাবীদের যে হুকুম দিয়েছিলেন সাহাবীরা সেইভাবেই উদ্ধার-ঈদের মেজবানী প্রস্তুত করলেন। পরে সন্ধ্যা হলে ঈসা সেই বারোজন সাহাবীকে নিয়ে খেতে বসলেন। খাবার সময়ে তিনি বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমাদের মধ্যে একজন আমাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে।” এতে সাহাবীরা খুব দুঃখিত হয়ে একজনের পর একজন ঈসাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “সে কি আমি, হুজুর?” জবাবে তিনি তাঁদের বললেন, “যে আমার সংগে পাত্রের মধ্যে হাত দিচ্ছে সে-ই আমাকে ধরিয়ে দেবে। ইব্‌ন্তেআদমের বিষয়ে পাক-কিতাবে যেভাবে লেখা আছে ঠিক সেইভাবে তিনি মারা যাবেন বটে, কিন্তু হায় সেই লোক, যে ইব্‌ন্তেআদমকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেয়! সেই মানুষের জন্ম না হলেই বরং তার পক্ষে ভাল হত।” যে ঈসাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিতে যাচ্ছিল সেই এহুদা বলল, “হুজুর, সে কি আমি?” ঈসা তাকে বললেন, “তুমি ঠিক কথাই বললে।” খাওয়া-দাওয়া চলছে, এমন সময় ঈসা রুটি নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন। পরে তিনি সেই রুটি টুকরা টুকরা করলেন এবং সাহাবীদের দিয়ে বললেন, “এই নাও, খাও; এ আমার শরীর।” এর পরে তিনি পেয়ালা নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন ও সেটা সাহাবীদের দিয়ে বললেন, “পেয়ালার এই আংগুর-রস তোমরা সবাই খাও, কারণ এ আমার রক্ত যা অনেকের গুনাহের ক্ষমার জন্য দেওয়া হবে। মানুষের জন্য আল্লাহ্‌র নতুন ব্যবস্থা আমার এই রক্তের দ্বারাই বহাল করা হবে। আমি তোমাদের বলছি, এখন থেকে যতদিন আমি আমার পিতার রাজ্যে তোমাদের সংগে আংগুর ফলের রস নতুন ভাবে না খাই ততদিন পর্যন্ত আমি আর তা খাব না।” পরে তাঁরা একটা কাওয়ালী গেয়ে বের হয়ে জৈতুন পাহাড়ে গেলেন। পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আজ রাতে আমাকে নিয়ে তোমাদের সকলের মনে বাধা আসবে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘আমি রাখালকে মেরে ফেলব, তাতে পালের মেষগুলো ছড়িয়ে পড়বে।’ কিন্তু আমাকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হলে পর আমি তোমাদের আগেই গালীলে যাব।” তখন পিতর তাঁকে বললেন, “আপনাকে নিয়ে সবার মনে বাধা আসলেও আমার মনে কখনও বাধা আসবে না।” ঈসা তাঁকে বললেন, “কিন্তু আমি তোমাকে সত্যিই বলছি, আজ শেষ রাতে মোরগ ডাকবার আগেই তুমি তিন বার বলবে যে, তুমি আমাকে চেনো না।” পিতর ঈসাকে বললেন, “আমাকে যদি আপনার সংগে মরতেও হয় তবুও আমি কখনও বলব না, আমি আপনাকে চিনি না।” অন্য সাহাবীরা সবাই সেই একই কথা বললেন। পরে ঈসা সাহাবীদের সংগে গেৎশিমানী নামে একটা জায়গায় গেলেন এবং সাহাবীদের বললেন, “আমি ওখানে গিয়ে যতক্ষণ মুনাজাত করি ততক্ষণ তোমরা এখানে বসে থাক।” এই বলে তিনি পিতর আর সিবদিয়ের দুই ছেলেকে সংগে নিয়ে গেলেন। তাঁর মন দুঃখে ও কষ্টে ভরে উঠতে লাগল। তিনি তাঁদের বললেন, “দুঃখে যেন আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমরা এখানেই থাক আর আমার সংগে জেগে থাক।” পরে তিনি কিছু দূরে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন এবং মুনাজাত করে বললেন, “আমার পিতা, যদি সম্ভব হয় তবে এই দুঃখের পেয়ালা আমার কাছ থেকে দূরে যাক। তবুও আমার ইচ্ছামত না হোক, তোমার ইচ্ছামতই হোক।” এর পরে তিনি সাহাবীদের কাছে এসে দেখলেন তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি পিতরকে বললেন, “এ কি! আমার সংগে এক ঘণ্টাও কি তোমরা জেগে থাকতে পারলে না? জেগে থাক ও মুনাজাত কর যেন পরীক্ষায় না পড়। দিলে ইচ্ছা আছে বটে, কিন্তু শরীর দুর্বল।” তিনি ফিরে গিয়ে দ্বিতীয় বার মুনাজাত করে বললেন, “পিতা আমার, আমি গ্রহণ না করলে যদি এই দুঃখের পেয়ালা দূর না হয় তবে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।” তিনি ফিরে এসে দেখলেন তাঁরা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন, কারণ তাঁদের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার তাঁদের ছেড়ে গিয়ে তৃতীয় বার সেই একই কথা বলে মুনাজাত করলেন। পরে তিনি সাহাবীদের কাছে এসে বললেন, “এখনও তোমরা ঘুমা"ছ আর বিশ্রাম করছ? দেখ, সময় এসে পড়েছে, ইব্‌ন্তেআদমকে গুনাহ্‌গারদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। ওঠো, চল, আমরা যাই। দেখ, যে আমাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে সে এসে পড়েছে।” ঈসা তখনও কথা বলছেন, এমন সময় এহুদা সেখানে আসল। সে সেই বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন ছিল। তার সংগে অনেক লোক ছোরা ও লাঠি নিয়ে আসল। প্রধান ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা এদের পাঠিয়েছিলেন। ঈসাকে শত্রুদের হাতে যে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই এহুদা ঐ লোকদের সংগে একটা চিহ্ন ঠিক করেছিল; সে বলেছিল, “যাকে আমি চুমু দেব সে-ই সেই লোক; তোমরা তাকে ধরবে।” তাই এহুদা সোজা ঈসার কাছে গিয়ে বলল, “আস্‌সালামু আলাইকুম, হুজুর।” এই কথা বলেই সে ঈসাকে চুমু দিল। ঈসা তাকে বললেন, “বন্ধু, যা করতে এসেছ, কর।” সংগে সংগেই লোকেরা এসে ঈসাকে ধরল। যাঁরা ঈসার সংগে ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর ছোরা বের করলেন এবং তার আঘাতে মহা-ইমামের গোলামের একটা কান কেটে ফেললেন। তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “তোমার ছোরা খাপে রাখ। ছোরা যারা ধরে তারা ছোরার আঘাতেই মরে। তুমি কি মনে কর যে, আমি আমার পিতাকে ডাকলে তিনি এখনই আমাকে হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে দেবেন না? কিন্তু তাহলে পাক-কিতাবের কথা কিভাবে পূর্ণ হবে? কিতাবে তো লেখা আছে এই সব এভাবেই ঘটবে।” পরে ঈসা লোকদের বললেন, “আমি কি ডাকাত যে, আপনারা ছোরা ও লাঠি নিয়ে আমাকে ধরতে এসেছেন? আমি প্রত্যেক দিনই বায়তুল-মোকাদ্দসে বসে শিক্ষা দিতাম, আর তখন তো আপনারা আমাকে ধরেন নি। কিন্তু এই সব ঘটল যাতে পাক-কিতাবে নবীরা যা লিখেছেন তা পূর্ণ হয়।” সাহাবীরা সবাই তখন ঈসাকে ফেলে পালিয়ে গেলেন। যারা ঈসাকে ধরেছিল তারা তাকে মহা-ইমাম কাইয়াফার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে আলেমেরা ও বৃদ্ধ নেতারা একসংগে জমায়েত হয়েছিলেন। পিতর দূরে থেকে ঈসার পিছনে পিছনে মহা-ইমামের উঠান পর্যন্ত গেলেন এবং শেষে কি হয় তা দেখবার জন্য ভিতরে ঢুকে রক্ষীদের সংগে বসলেন। ঈসাকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে প্রধান ইমামেরা এবং মহাসভার সমস্ত লোকেরা মিথ্যা সাক্ষ্যের খোঁজ করছিলেন। অনেক মিথ্যা সাক্ষী উপস্থিতও হয়েছিল, তবুও তাঁরা ঠিকমত কোন সাক্ষ্যই পেলেন না। শেষে দু’জন লোক এগিয়ে এসে বলল, “এই লোকটা বলেছিল, সে আল্লাহ্‌র ঘরটা ভেংগে ফেলে তিন দিনের মধ্যে আবার তা তৈরী করে দিতে পারে।” তখন মহা-ইমাম উঠে দাঁড়িয়ে ঈসাকে বললেন, “তুমি কি কোন জবাব দেবে না? এরা তোমার বিরুদ্ধে এই সব কি সাক্ষ্য দিচ্ছে?” ঈসা কিন্তু চুপ করেই রইলেন। মহা-ইমাম আবার তাঁকে বললেন, “তুমি আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে আমাদের বল যে, তুমি সেই মসীহ্‌ ইব্‌নুল্লাহ্‌ কি না।” তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “জ্বী, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। তবে আমি আপনাদের এটাও বলছি, এর পরে আপনারা ইব্‌ন্তেআদমকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র ডান পাশে বসে থাকতে এবং মেঘে করে আসতে দেখবেন।” তখন মহা-ইমাম তাঁর কাপড় ছিঁড়ে ফেলে বললেন, “এ কুফরী করল। আমাদের আর সাক্ষীর কি দরকার? এখনই তো আপনারা শুনলেন, সে কুফরী করল। আপনারা কি মনে করেন?” তাঁরা জবাব দিলেন, “এ মৃত্যুর উপযুক্ত।” তখন লোকেরা ঈসার মুখে থুথু দিল এবং ঘুষি ও চড় মারল। তারা বলল, “এই মসীহ্‌, বল্‌ তো দেখি, কে তোকে মারল?” সেই সময় পিতর বাইরের উঠানে বসে ছিলেন। একজন চাকরাণী তাঁর কাছে এসে বলল, “গালীলের ঈসার সংগে তো আপনিও ছিলেন।” কিন্তু পিতর সকলের সামনে অস্বীকার করে বললেন, “তুমি কি বলছ তা আমি জানি না।” এর পরে পিতর বাইরে দরজার কাছে গেলেন। তাঁকে দেখে আর একজন চাকরাণী সেখানকার লোকদের বলল, “এই লোকটা নাসরতের ঈসার সংগে ছিল।” তখন পিতর কসম খেয়ে আবার অস্বীকার করে বললেন, “আমি ঐ লোকটাকে চিনি না।” যে লোকেরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তারা কিছুক্ষণ পরে পিতরকে এসে বলল, “নিশ্চয়ই তুমি ওদের একজন; তোমার ভাষাই তোমাকে ধরিয়ে দিচ্ছে।” তখন পিতর নিজেকে বদদোয়া দিলেন এবং কসম খেয়ে বলতে লাগলেন, “আমি ঐ লোকটাকে মোটেই চিনি না।” আর তখনই একটা মোরগ ডেকে উঠল। তখন পিতরের মনে পড়ল ঈসা বলেছিলেন, “মোরগ ডাকবার আগে তুমি তিন বার বলবে যে, তুমি আমাকে চেনো না।” আর পিতর বাইরে গিয়ে খুব কাঁদতে লাগলেন। খুব ভোরে প্রধান ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা সবাই ঈসাকে হত্যা করবার কথাই ঠিক করলেন। তাঁরা ঈসাকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে রোমীয় প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের হাতে দিলেন। ঈসাকে শত্রুদের হাতে যে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই এহুদা যখন দেখল ঈসাকে বিচারে দোষী বলে ঠিক করা হয়েছে তখন তার মনে খুব দুঃখ হল। সে প্রধান ইমামদের ও বৃদ্ধ নেতাদের কাছে সেই ত্রিশটা রূপার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি নির্দোষীকে মেরে ফেলবার জন্য ধরিয়ে দিয়ে গুনাহ্‌ করেছি।” তাঁরা বললেন, “তাতে আমাদের কি? তুমিই তা বুঝবে।” তখন এহুদা সেই রূপার টাকাগুলো নিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল এবং গলায় দড়ি দিয়ে মরল। প্রধান ইমামেরা সেই রূপার টাকাগুলো নিয়ে বললেন, “এই টাকা বায়তুল-মোকাদ্দসের তহবিলে রাখা ঠিক নয়, কারণ এটা রক্তের দাম।” পরে তাঁরা পরামর্শ করে সেই টাকা দিয়ে বিদেশীদের একটা কবরস্থানের জন্য কুমারের জমি কিনলেন। সেইজন্য সেই জমিকে আজও ‘রক্তের জমি’ বলা হয়। এতে নবী ইয়ারমিয়ার মধ্য দিয়ে যে কথা বলা হয়েছিল তা পূর্ণ হল: “তারা ত্রিশটা রূপার টাকা নিল। এই টাকা তাঁর দাম। বনি-ইসরাইলরা তাঁর জন্য এই দাম ঠিক করেছিল। মাবুদ যেমন আমাকে হুকুম দিয়েছিলেন সেইমতই তারা কুমারের জমির জন্য এই টাকাগুলো দিল।” এদিকে ঈসা তখন প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাসনকর্তা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ইহুদীদের বাদশাহ্‌?” ঈসা জবাব দিলেন, “আপনি ঠিকই বলছেন।” প্রধান ইমামেরা এবং বৃদ্ধ নেতারা ঈসাকে অনেক দোষ দিলেন কিন্তু তিনি কোন জবাব দিলেন না। তখন পীলাত ঈসাকে বললেন, “ওরা তোমাকে কত দোষ দিচ্ছে তা কি তুমি শুনতে পাচ্ছ না?” ঈসা কিন্তু একটা কথারও জবাব দিলেন না। এতে সেই শাসনকর্তা খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। প্রত্যেক উদ্ধার-ঈদের সময় প্রধান শাসনকর্তা লোকদের পছন্দ করা একজন কয়েদীকে ছেড়ে দিতেন। এটাই ছিল তাঁর নিয়ম। সেই সময় বারাব্বা নামে একজন কুখ্যাত কয়েদী ছিল। লোকেরা একসংগে জমায়েত হলে পর পীলাত তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি চাও? তোমাদের কাছে আমি কাকে ছেড়ে দেব, বারাব্বাকে, না যাকে মসীহ্‌ বলে সেই ঈসাকে?” পীলাত জানতেন, লোকেরা হিংসা করেই ঈসাকে ধরিয়ে দিয়েছে। পীলাত যখন বিচারের আসনে বসে ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলে পাঠালেন, “ঐ নির্দোষ লোকটিকে তুমি কিছু কোরো না, কারণ আজ স্বপ্নে আমি তাঁর দরুন অনেক কষ্ট পেয়েছি।” কিন্তু প্রধান ইমামেরা এবং বৃদ্ধ নেতারা লোকদের উস্‌কিয়ে দিলেন যেন তারা বারাব্বাকে চেয়ে নেয় এবং ঈসাকে হত্যা করবার কথা বলে। পরে প্রধান শাসনকর্তা লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, “এই দু’জনের মধ্যে আমি তোমাদের কাছে কাকে ছেড়ে দেব?” তারা বলল, “বারাব্বাকে।” তখন পীলাত তাদের বললেন, “তাহলে যাকে মসীহ্‌ বলে সেই ঈসাকে নিয়ে আমি কি করব?” তারা সবাই বলল, “ওকে ক্রুশে দেওয়া হোক।” পীলাত বললেন, “কেন, সে কি দোষ করেছে?” এতে তারা আরও বেশী চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “ওকে ক্রুশে দেওয়া হোক।” পীলাত যখন দেখলেন তিনি কিছুই করতে পারছেন না বরং আরও গোলমাল হচ্ছে, তখন তিনি পানি নিয়ে লোকদের সামনে হাত ধুয়ে বললেন, “এই লোকের রক্তের জন্য আমি দায়ী নই; তোমরাই তা বুঝবে।” জবাবে লোকেরা সবাই বলল, “আমরা এবং আমাদের সন্তানেরা ওর রক্তের দায়ী হব।” তখন পীলাত বারাব্বাকে লোকদের কাছে ছেড়ে দিলেন, কিন্তু ঈসাকে ভীষণভাবে চাবুক মারবার হুকুম দিয়ে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য দিলেন। তখন প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের সৈন্যেরা ঈসাকে নিয়ে তাঁর বাড়ীর ভিতরে গেল এবং সমস্ত সৈন্যদলকে ঈসার চারদিকে জড়ো করল। তারা ঈসার কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে তাঁকে লাল রংয়ের পোশাক পরাল। পরে তারা কাঁটা-লতা দিয়ে একটা তাজ গেঁথে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিল, আর তাঁর ডান হাতে একটা লাঠি দিল। তার পরে তাঁর সামনে হাঁটু পেতে তাঁকে তামাশা করে বলল, “মারহাবা, ইহুদীদের বাদশাহ্‌!” তখন তাঁর গায়ে তারা থুথু দিল এবং সেই লাঠি দিয়ে তাঁর মাথায় বারবার আঘাত করল। তাঁকে তামাশা করবার পর তারা সেই পোশাক খুলে নিল এবং তাঁর নিজের কাপড়-চোপড় পরিয়ে তাঁকে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য নিয়ে চলল। সেখান থেকে বের হয়ে যাবার সময় সৈন্যেরা কুরীণী শহরের শিমোন নামে একজন লোকের দেখা পেল। সৈন্যেরা তাকে ঈসার ক্রুশ বয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করল। ঈসাকে ক্রুশে দেবার পর সৈন্যেরা গুলিবাঁট করে তাঁর কাপড়-চোপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। পরে তারা সেখানে বসে তাঁকে পাহারা দিতে লাগল। তারা ক্রুশে ঈসার মাথার উপরের দিকে এই দোষ-নামা লাগিয়ে দিল, “এ ঈসা, ইহুদীদের বাদশাহ্‌।” তারা দু’জন ডাকাতকেও ঈসার সংগে ক্রুশে দিল, একজনকে ডান দিকে আর অন্যজনকে বাঁ দিকে। যে সব লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা মাথা নেড়ে ঈসাকে ঠাট্টা করে বলল, “তুমি না বায়তুল-মোকাদ্দস ভেংগে আবার তিন দিনের মধ্যে তৈরী করতে পার! তাহলে এখন নিজেকে রক্ষা কর। যদি তুমি ইব্‌নুল্লাহ্‌ হও তবে ক্রুশ থেকে নেমে এস।” প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা এবং বৃদ্ধ নেতারাও তাঁকে ঠাট্টা করে বললেন, “ও অন্যদের রক্ষা করত, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ও তো ইসরাইলের বাদশাহ্‌! এখন ক্রুশ থেকে ও নেমে আসুক। তাহলে আমরা ওর উপর ঈমান আনব। ও আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে; এখন আল্লাহ্‌ যদি ওর উপর খুশী থাকেন তবে ওকে তিনি উদ্ধার করুন। ও তো নিজেকে ইব্‌নুল্লাহ্‌ বলত।” যে ডাকাতদের তাঁর সংগে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তারাও সেই একই কথা বলে তাঁকে টিট্‌কারি দিল। সেই দিন দুপুর বারোটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত সমস্ত দেশ অন্ধকার হয়ে রইল। প্রায় তিনটার সময় ঈসা জোরে চিৎকার করে বললেন, “ইলী, ইলী, লামা শবক্তানী,” অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ আমার, আল্লাহ্‌ আমার, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ?” যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন এই কথা শুনে বলল, “ও নবী ইলিয়াসকে ডাকছে।” তাদের মধ্যে একজন তখনই দৌড়ে গিয়ে সিরকায় পূর্ণ একটা সপঞ্জ নিল এবং একটা লাঠির মাথায় সেটা লাগিয়ে ঈসাকে খেতে দিল। অন্যেরা বলল, “থাক্‌, দেখি নবী ইলিয়াস ওকে রক্ষা করতে আসেন কি না।” ঈসা আবার জোরে চিৎকার করবার পরে প্রাণত্যাগ করলেন। তখন বায়তুল-মোকাদ্দসের পর্দাটা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত চিরে দু’ভাগ হয়ে গেল; আর ভূমিকমপ হল ও বড় বড় পাথর ফেটে গেল। কতগুলো কবর খুলে গেল এবং আল্লাহ্‌র যে বান্দারা ইন্তেকাল করেছিলেন তাঁদের অনেকের দেহ জীবিত হয়ে উঠল। তাঁরা কবর থেকে বের হয়ে আসলেন এবং ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলে পর পবিত্র শহরের মধ্যে গেলেন। তাঁরা সেখানে অনেককে দেখা দিলেন। সেনাপতি ও তাঁর সংগে যারা ঈসাকে পাহারা দিচ্ছিল তারা ভূমিকমপ ও অন্য সব ঘটনা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে বলল, “সত্যিই উনি ইব্‌নুল্লাহ্‌ ছিলেন।” অনেক স্ত্রীলোকও সেখানে দূরে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলেন। ঈসার সেবা করবার জন্য তাঁরা গালীল থেকে তাঁর সংগে সংগে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মগ্‌দলীনী মরিয়ম, ইয়াকুব ও ইউসুফের মা মরিয়ম এবং সিবদিয়ের ছেলে ইয়াকুব ও ইউহোন্নার মা। সন্ধ্যা হলে পর অরিমাথিয়া গ্রামের ইউসুফ নামে একজন ধনী লোক সেখানে আসলেন। ইনি ঈসার উম্মত হয়েছিলেন। পীলাতের কাছে গিয়ে তিনি ঈসার লাশটা চাইলেন। তখন পীলাত তাঁকে সেই লাশটা দিতে হুকুম দিলেন। ইউসুফ ঈসার লাশটা নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার কাপড়ে জড়ালেন, আর যে নতুন কবর তিনি নিজের জন্য পাহাড়ের মধ্যে কেটে রেখেছিলেন সেখানে সেই লাশটা দাফন করলেন। পরে সেই কবরের মুখে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু মগ্‌দলীনী মরিয়ম ও সেই অন্য মরিয়ম সেখানে সেই কবরের সামনে বসে রইলেন। পরের দিন, অর্থাৎ আয়োজন্তদিনের পরের দিন প্রধান ইমামেরা এবং ফরীশীরা পীলাতের কাছে জমায়েত হয়ে বললেন, “হুজুর, আমাদের মনে পড়েছে, সেই ঠগটা বেঁচে থাকতে বলেছিল, ‘আমি তিন দিন পরে বেঁচে উঠব।’ সেইজন্য হুকুম দিন যেন তিন দিন পর্যন্ত কবরটা পাহারা দেওয়া হয়। না হলে তাঁর সাহাবীরা হয়তো এসে তাঁর লাশটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে লোকদের বলবে, ‘তিনি মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছেন।’ তাহলে প্রথম ছলনার চেয়ে শেষ ছলনাটা আরও খারাপ হবে।” তখন পীলাত তাঁদের বললেন, “পাহারাদারদের নিয়ে গিয়ে আপনারা যেভাবে পারেন সেইভাবে পাহারা দেবার ব্যবস্থা করুন।” তখন তাঁরা গিয়ে পাথরের উপরে সীলমোহর করলেন এবং পাহারাদারদের সেখানে রেখে কবরটা কড়াকড়িভাবে পাহারা দেবার ব্যবস্থা করলেন। বিশ্রামবারের পরে সপ্তার প্রথম দিনের খুব ভোরে মগ্‌দলীনী মরিয়ম ও সেই অন্য মরিয়ম কবরটা দেখতে গেলেন। তখন হঠাৎ ভীষণ ভূমিকমপ হল, কারণ মাবুদের একজন ফেরেশতা বেহেশত থেকে নেমে আসলেন এবং কবরের মুখ থেকে পাথরখানা সরিয়ে দিয়ে তার উপর বসলেন। তাঁর চেহারা বিদ্যুতের মত ছিল আর তাঁর কাপড়-চোপড় ছিল ধব্‌ধবে সাদা। তাঁর ভয়ে পাহারাদারেরা কাঁপতে লাগল এবং মরার মত হয়ে পড়ল। ফেরেশতা স্ত্রীলোকদের বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না, কারণ আমি জানি, যাঁকে ক্রুশের উপর হত্যা করা হয়েছিল তোমরা সেই ঈসাকে খুঁজছ। তিনি এখানে নেই। তিনি যেমন বলেছিলেন তেমন ভাবেই জীবিত হয়ে উঠেছেন। এস, তিনি যেখানে শুয়ে ছিলেন সেই জায়গাটা দেখ। তোমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর সাহাবীদের বল তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন এবং তাদের আগে গালীলে যাচ্ছেন। তারা তাঁকে সেখানেই দেখতে পাবে। দেখ, কথাটা আমি তোমাদের জানিয়ে দিলাম।” সেই স্ত্রীলোকেরা অবশ্য ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তবুও খুব আনন্দের সংগে তাড়াতাড়ি কবরের কাছ থেকে চলে গেলেন এবং ঈসার সাহাবীদের এই খবর দেবার জন্য দৌড়াতে লাগলেন। এমন সময় ঈসা হঠাৎ সেই স্ত্রীলোকদের সামনে এসে বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম।” তখন সেই স্ত্রীলোকেরা তাঁর কাছে গিয়ে পা ধরে তাঁকে সেজদা করলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “ভয় কোরো না; তোমরা গিয়ে ভাইদের গালীলে যেতে বল। তারা সেখানেই আমাকে দেখতে পাবে।” সেই স্ত্রীলোকেরা যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন সেই পাহারাদারদের কয়েকজন শহরে গেল এবং যা যা ঘটেছিল তা প্রধান ইমামদের জানাল। তখন ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা একত্র হয়ে পরামর্শ করলেন এবং সেই সৈন্যদের অনেক টাকা দিয়ে বললেন, “তোমরা বোলো, ‘আমরা রাতে যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন তাঁর সাহাবীরা এসে তাঁকে চুরি করে নিয়ে গেছে।’ এই কথা যদি প্রধান শাসনকর্তা শুনতে পান তবে আমরা তাঁকে শান্ত করব এবং শাস্তির হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করব।” তখন পাহারাদারেরা সেই টাকা নিল এবং তাদের যেমন বলা হয়েছিল তেমনই বলল। আজও পর্যন্ত সেই কথা ইহুদীদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। ঈসা গালীলের যে পাহাড়ে সাহাবীদের যেতে বলেছিলেন সেই এগারোজন সাহাবী তখন সেই পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ঈসাকে দেখে তাঁরা তাঁকে সেজদা করলেন, কিন্তু কয়েকজন সন্দেহ করলেন। তখন ঈসা কাছে এসে তাঁদের এই কথা বললেন, “বেহেশতের ও দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়েছে। এইজন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক-রূহের নামে তাদের তরিকাবন্দী দাও। আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি তা পালন করতে তাদের শিক্ষা দাও। দেখ, যুগের শেষ পর্যন্ত সব সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি।” ॥ভব ইব্‌নুল্লাহ্‌ ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদের শুরু। নবী ইশাইয়ার কিতাবে আল্লাহ্‌র বলা এই কথা লেখা আছে: দেখ, তোমার আগে আমি আমার সংবাদদাতাকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার পথ প্রস্তুত করবে। মরুভূমিতে একজনের কণ্ঠস্বর চিৎকার করে জানাচ্ছে, তোমরা মাবুদের পথ ঠিক কর, তাঁর রাস্তা সোজা কর। সেই কথামতই হযরত ইয়াহিয়া মরুভূমিতে গিয়ে লোকদের তরিকাবন্দী দিচ্ছিলেন এবং তবলিগ করছিলেন যেন লোকে গুনাহের মাফ পাবার জন্য তওবা করে ও তরিকাবন্দী নেয়। তাতে এহুদিয়া প্রদেশ ও জেরুজালেম শহরের সবাই বের হয়ে ইয়াহিয়ার কাছে আসতে লাগল। তারা যখন গুনাহ্‌ স্বীকার করল তখন ইয়াহিয়া জর্ডান নদীতে তাদের তরিকাবন্দী দিলেন। ইয়াহিয়া উটের লোমের কাপড় পরতেন এবং তাঁর কোমরে চামড়ার কোমর-বাঁধনি ছিল। তিনি পংগপাল আর বনমধু খেতেন। তিনি যা তবলিগ করতেন তা এই, “আমার পরে একজন আসছেন। তিনি আমার চেয়ে শক্তিশালী। উবুড় হয়ে তাঁর জুতার ফিতা খুলবার যোগ্যও আমি নই। আমি তোমাদের পানিতে তরিকাবন্দী দিচ্ছি কিন্তু তিনি পাক-রূহে তোমাদের তরিকাবন্দী দেবেন।” সেই সময়ে ঈসা গালীল প্রদেশের নাসরত গ্রাম থেকে আসলেন, আর ইয়াহিয়া তাঁকে জর্ডান নদীতে তরিকাবন্দী দিলেন। পানি থেকে উঠে আসবার সংগে সংগেই ঈসা দেখলেন, আসমান চিরে গেছে এবং পাক-রূহ্‌ কবুতরের মত হয়ে তাঁর উপর নেমে আসছেন। সেই সময় আসমান থেকে এই কথা শোনা গেল, “তুমিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমার উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট।” এর পরেই ঈসাকে পাক-রূহের পরিচালনায় মরুভূমিতে যেতে হল। সেই মরুভূমিতে চল্লিশ দিন ধরে শয়তান ঈসাকে লোভ দেখিয়ে গুনাহে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল। সেখানে অনেক বুনো জন্তু ছিল, আর ফেরেশতারা ঈসার সেবা করতেন। ইয়াহিয়া জেলখানায় বন্দী হবার পরে ঈসা গালীল প্রদেশে গেলেন। সেখানে তিনি এই কথা বলে আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করতে লাগলেন, “সময় হয়েছে, আল্লাহ্‌র রাজ্য কাছে এসে গেছে। আপনারা তওবা করুন এবং এই সুসংবাদের উপর ঈমান আনুন।” একদিন ঈসা গালীল সাগরের পার দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি শিমোন ও তাঁর ভাই আন্দ্রিয়কে সাগরে জাল ফেলতে দেখলেন। সেই দু’জন ছিলেন জেলে। ঈসা তাঁদের বললেন, “আমার সংগে চল। আমি তোমাদের মানুষ-ধরা জেলে করব।” তখনই তাঁরা জাল ফেলে রেখে ঈসার সংগে গেলেন। সেখান থেকে কিছু দূরে গেলে পর তিনি সিবদিয়ের দুই ছেলে ইয়াকুব ও ইউহোন্নাকে দেখতে পেলেন। তাঁরা তাঁদের নৌকায় বসে জাল ঠিক করছিলেন। ঈসা তাঁদের দেখামাত্র ডাক দিলেন, আর তাঁরা তাঁদের বাবা সিবদিয়কে মজুরদের সংগে নৌকায় রেখে ঈসার সংগে গেলেন। ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা কফরনাহূম শহরে গেলেন। পরে বিশ্রামবারে ঈসা মজলিস-খানায় গিয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। লোকেরা তাঁর শিক্ষায় আশ্চর্য হয়ে গেল, কারণ তিনি আলেমদের মত শিক্ষা দিচ্ছিলেন না বরং যাঁর অধিকার আছে সেই রকম লোকের মতই শিক্ষা দিচ্ছিলেন। সেই সময় ভূতে পাওয়া একজন লোক সেই মজলিস-খানার মধ্যে ছিল। সে চিৎকার করে বলল, “ওহে নাসরতের ঈসা, আমাদের সংগে আপনার কি দরকার? আপনি কি আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছেন? আমি জানি আপনি কে; আপনিই তো আল্লাহ্‌র সেই পবিত্রজন।” ঈসা তখন সেই ভূতকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর, ওর মধ্য থেকে বের হয়ে যাও।” সেই ভূত তখন লোকটাকে মুচ্‌ড়ে ধরল এবং জোরে চিৎকার করে তার মধ্য থেকে বের হয়ে গেল। এই ঘটনা দেখে লোকেরা এমন আশ্চর্য হল যে, তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগল, “এই সব কি ব্যাপার? এই অধিকার-ভরা নতুন শিক্ষাই বা কি? এমন কি, ভূতদেরও তিনি হুকুম দেন আর তারা তাঁর কথা শুনতে বাধ্য হয়।” এতে গালীল প্রদেশের সব জায়গায় ঈসার কথা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ল। পরে তাঁরা মজলিস-খানা থেকে বের হয়ে শিমোন ও আন্দ্রিয়ের বাড়ীতে গেলেন। ইয়াকুব এবং ইউহোন্নাও তাঁদের সংগে ছিলেন। শিমোনের শাশুড়ীর জ্বর হয়েছিল বলে তিনি শুয়ে ছিলেন। ঈসা আসামাত্রই তাঁর কথা তাঁকে বলা হল। তখন ঈসা তাঁর কাছে গিয়ে হাত ধরে তাঁকে তুললেন। তাতে তাঁর জ্বর ছেড়ে গেল এবং তিনি তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। সেই দিন সূর্য ডুবে গেলে পর সন্ধ্যাবেলা লোকেরা সব রোগীদের ও ভূতে পাওয়া লোকদের ঈসার কাছে আনল। শহরের সব লোক তখন সেই বাড়ীর দরজার কাছে এসে জমায়েত হল। ঈসা অনেক রকমের রোগীকে সুস্থ করলেন এবং অনেক ভূত ছাড়ালেন। তিনি ভূতদের কথা বলতে দিলেন না, কারণ সেই ভূতেরা জানত তিনি কে। পরদিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই ঈসা উঠলেন এবং ঘর ছেড়ে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে মুনাজাত করতে লাগলেন। শিমোন ও তাঁর সংগীরা ঈসাকে তালাশ করছিলেন। পরে তাঁকে তালাশ করে পেয়ে বললেন, “সবাই আপনাকে তালাশ করছে।” ঈসা তাঁদের বললেন, “চল, আমরা কাছের গ্রামগুলোতে যাই যেন আমি সেখানেও তবলিগ করতে পারি, কারণ সেইজন্যই তো আমি এসেছি।” এইভাবে ঈসা গালীলের সব জায়গায় গিয়ে ইহুদীদের মজলিস-খানাগুলোতে তবলিগ করলেন এবং ভূত দূর করলেন। পরে একজন চর্মরোগী ঈসার কাছে এসে তাঁর সামনে হাঁটু পেতে বলল, “আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ভাল করতে পারেন।” লোকটির উপর ঈসার খুব মমতা হল। তিনি হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে বললেন, “আমি তা-ই চাই, তুমি পাক-সাফ হও।” আর তখনই তার চর্মরোগ ভাল হয়ে গেল। ঈসা তখনই তাকে বিদায় করলেন, কিন্তু তার আগে তাকে কড়াকড়িভাবে বললেন, “দেখ, এই কথা কাউকে বোলো না। তুমি বরং ইমামের কাছে গিয়ে নিজেকে দেখাও আর পাক-সাফ হবার জন্য মূসা যে কোরবানীর হুকুম দিয়েছেন তা কোরবানী দাও। এতে ইমামদের কাছে প্রমাণ হবে যে, তুমি ভাল হয়েছ।” সেই লোকটি কিন্তু বাইরে গিয়ে সব জায়গায় এই খবর ছড়াতে লাগল। তার ফলে ঈসা কোন গ্রামে আর খোলাখুলিভাবে যেতে পারলেন না। তাঁকে নির্জন জায়গায় থাকতে হল; তবুও লোকেরা সব জায়গা থেকে তাঁর কাছে আসতে লাগল। কয়েকদিন পরে ঈসা আবার কফরনাহূমে গেলেন। লোকেরা শুনল তিনি ঘরে আছেন। তখন এত লোক সেখানে জমায়েত হল যে, ঘর তো দূরের কথা, দরজার বাইরেও আর জায়গা রইল না। ঈসা লোকদের কাছে আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করছিলেন। এমন সময় কয়েকজন লোক একজন অবশ-রোগীকে তাঁর কাছে নিয়ে আসল। চারজন লোক তাকে বয়ে আনছিল, কিন্তু ভিড়ের জন্য তারা তাকে ঈসার কাছে নিয়ে যেতে পারল না। এইজন্য ঈসা যেখানে ছিলেন ঠিক তার উপরের ছাদের কিছু অংশ তারা সরিয়ে ফেলল। তারপর সেই খোলা জায়গা দিয়ে মাদুর সুদ্ধই সেই অবশ-রোগীকে নীচে নামিয়ে দিল। তারা ঈমান এনেছে দেখে ঈসা সেই অবশ-রোগীকে বললেন, “বাছা, তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল।” সেখানে কয়েকজন আলেম বসে ছিলেন। তাঁরা মনে মনে ভাবছিলেন, “লোকটা এই রকম কথা বলছে কেন? সে তো কুফরী করছে। একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কে গুনাহ্‌ মাফ করতে পারে?” তাঁরা যে ঐ সব কথা ভাবছেন তা ঈসা নিজের অন্তরে তখনই বুঝতে পারলেন। এইজন্য তিনি তাঁদের বললেন, “আপনারা কেন মনে মনে ঐ সব কথা ভাবছেন? এই অবশ-রোগীকে কোন্‌টা বলা সহজ- ‘তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল,’ না, ‘ওঠো, তোমার মাদুর তুলে নিয়ে হেঁটে বেড়াও’? কিন্তু আপনারা যেন জানতে পারেন দুনিয়াতে গুনাহ্‌ মাফ করবার ক্ষমতা ইব্‌ন্তেআদমের আছে”- এই পর্যন্ত বলে তিনি সেই অবশ-রোগীকে বললেন, “আমি তোমাকে বলছি, ওঠো, তোমার মাদুর তুলে নিয়ে বাড়ী চলে যাও।” তখনই সেই লোকটি উঠে তার মাদুর তুলে নিল এবং সকলের সামনেই বাইরে চলে গেল। এতে সবাই আশ্চর্য হয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলল, “আমরা কখনও এই রকম দেখি নি।” পরে ঈসা আবার গালীল সাগরের ধারে গেলেন। তখন অনেক লোক তাঁর কাছে আসল, আর তিনি তাদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। এর পরে তিনি পথে যেতে যেতে দেখলেন আল্‌ফেয়ের ছেলে লেবি খাজনা আদায় করবার ঘরে বসে আছেন। ঈসা তাঁকে বললেন, “এস, আমার উম্মত হও।” তখন লেবি উঠে ঈসার সংগে গেলেন। পরে ঈসা লেবির বাড়ীতে খেতে বসলেন। তখন অনেক খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকেরাও ঈসা ও তাঁর সাহাবীদের সংগে খেতে বসল, কারণ অনেক লোক ঈসার সংগে সংগে যাচ্ছিল। ফরীশী দলের আলেমেরা যখন দেখলেন ঈসা খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের সংগে খাচ্ছেন তখন তাঁরা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “উনি খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করেন কেন?” এই কথা শুনে ঈসা সেই আলেমদের বললেন, “সুস্থদের জন্য ডাক্তারের দরকার নেই বরং অসুস্থদের জন্যই দরকার আছে। আমি ধার্মিকদের ডাকতে আসি নি বরং গুনাহ্‌গারদেরই ডাকতে এসেছি।” একবার ইয়াহিয়ার সাহাবীরা ও ফরীশীরা রোজা রাখছিলেন। তা দেখে কয়েকজন লোক ঈসার কাছে এসে বলল, “ইয়াহিয়ার সাহাবীরা ও ফরীশীদের শাগরেদেরা রোজা রাখেন, কিন্তু আপনার সাহাবীরা রাখেন না কেন?” ঈসা তাদের বললেন, “বর সংগে থাকতে কি বরের সংগের লোকেরা রোজা রাখতে পারে? যতদিন বর সংগে থাকে ততদিন তারা রোজা রাখতে পারে না। কিন্তু সময় আসছে যখন তাদের কাছ থেকে বরকে নিয়ে যাওয়া হবে, আর সেই সময় তারা রোজা রাখবে। “কেউ পুরানো কোর্তায় নতুন কাপড়ের তালি দেয় না। যদি দেয় তবে সেই পুরানো কাপড় থেকে নতুন তালিটা ছিঁড়ে আসে। তাতে সেই ছেঁড়া আরও বড় হয়। পুরানো চামড়ার থলিতে কেউ টাটকা আংগুর-রস রাখে না। যদি রাখে তবে টাটকা রসের দরুন থলি ফেটে গিয়ে রস ও থলি দু’টাই নষ্ট হয়। টাটকা রস নতুন থলিতেই রাখা হয়।” এক বিশ্রামবারে ঈসা শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সাহাবীরা যেতে যেতে শীষ ছিঁড়তে লাগলেন। তাতে ফরীশীরা ঈসাকে বললেন, “শরীয়ত মতে বিশ্রামবারে যা করা উচিত নয় তা ওরা করছে কেন?” ঈসা তাঁদের আরও বললেন, “মানুষের জন্যই বিশ্রামবারের সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বিশ্রামবারের জন্য মানুষের সৃষ্টি হয় নি। তাই ইব্‌ন্তেআদম বিশ্রামবারেরও মালিক।” এর পরে ঈসা আবার মজলিস-খানায় গেলেন। সেখানে একজন লোক ছিল যার একটা হাত শুকিয়ে গিয়েছিল। ফরীশীদের মধ্যে কয়েকজন ঈসাকে দোষ দেবার অজুহাত খুঁজছিলেন। বিশ্রামবারে ঈসা লোকটাকে সুস্থ করেন কি না তা দেখবার জন্য তাঁরা তাঁর উপর ভাল করে নজর রাখতে লাগলেন। ঈসা সেই শুকনা-হাত লোকটিকে বললেন, “সকলের সামনে এসে দাঁড়াও।” তারপর ঈসা ফরীশীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “বিশ্রামবারে ভাল কাজ করা উচিত, না খারাপ কাজ করা উচিত? প্রাণ রক্ষা করা উচিত, না নষ্ট করা উচিত?” ফরীশীরা কিন্তু কোনই জবাব দিলেন না। তখন ঈসা বিরক্ত হয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন এবং তাঁদের অন্তরের কঠিনতার জন্য গভীর দুঃখের সংগে সেই লোকটিকে বললেন, “তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।” লোকটি হাত বাড়িয়ে দিলে পর তার হাত একেবারে ভাল হয়ে গেল। তখন ফরীশীরা বাইরে গেলেন এবং কিভাবে ঈসাকে হত্যা করা যায় সেই বিষয়ে বাদশাহ্‌ হেরোদের দলের লোকদের সংগে পরামর্শ করতে লাগলেন। ঈসা নিজের জন্য একটা ছোট নৌকা তাঁর সাহাবীদের ঠিক করে রাখতে বললেন যেন ভিড়ের দরুন লোকে চাপাচাপি করে তাঁর উপর না পড়ে। তিনি অনেক লোককে সুস্থ করেছিলেন বলে রোগীরা তাঁকে ছোঁবার জন্য ঠেলাঠেলি করছিল। ভূতেরা যখনই তাঁকে দেখত তখনই তাঁর সামনে মাটিতে পড়ে চিৎকার করে বলত, “আপনিই ইব্‌নুল্লাহ্‌।” কিন্তু তিনি খুব কড়াভাবে তাদের হুকুম দিতেন যেন তারা কাউকে না বলে তিনি কে। যে বারোজনকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন তাঁরা হলেন শিমোন, যাঁর নাম তিনি দিলেন পিতর; সিবদিয়ের দুই ছেলে ইয়াকুব ও ইউহোন্না (এঁদের নাম তিনি দিলেন বোয়ানের্গিস, অর্থাৎ বজ্রধ্বনির পুত্রেরা); আন্দ্রিয়, ফিলিপ, বর্‌থলময়, মথি, থোমা, আলফেয়ের ছেলে ইয়াকুব, থদ্দেয়, মৌলবাদী শিমোন, আর এহুদা ইষ্কারিয়োৎ, যে ঈসাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ঈসা ঘরে আসলে পর আবার এত লোক তাঁর কাছে জমায়েত হল যে, তিনি ও তাঁর সাহাবীরা কিছু খেতেও পারলেন না। ঈসার নিজের লোকেরা এই খবর শুনে তাঁকে বের করে নিতে আসলেন। তাঁরা বললেন, “ও পাগল হয়ে গেছে।” জেরুজালেম থেকে যে আলেমেরা এসেছিলেন তাঁরা বললেন, “ওকে বেল্‌সবূলে পেয়েছে। ভূতদের বাদশাহ্‌র সাহায্যেই ও ভূত ছাড়ায়।” ঈসা সেই আলেমদের ডাকলেন এবং শিক্ষা দেবার জন্য বললেন, “শয়তান কেমন করে শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে পারে? কোন রাজ্য নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে সেই রাজ্য টিকতে পারে না। আবার কোন পরিবার যদি ভাগ হয়ে যায় তবে সেই পরিবারও টিকতে পারে না। সেইভাবে শয়তানও যদি নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর শক্তিতে ভাংগন ধরায় তবে সেও টিকতে পারে না এবং সেখানেই তার শেষ হয়। এই কথা ঠিক যে, একজন বলবান লোককে প্রথমে বেঁধে না রেখে তার ঘরে ঢুকে তার জিনিসপত্র কেউই নিয়ে যেতে পারে না। তাকে বাঁধলে পরে তবেই সে তার ঘর লুট করতে পারবে। আমি আপনাদের সত্যি বলছি, মানুষের সমস্ত গুনাহ্‌ এবং কুফরী মাফ করা হবে, কিন্তু পাক-রূহের বিরুদ্ধে কুফরী কখনও মাফ করা হবে না। সেই লোকের গুনাহ্‌ চিরকাল থাকবে।” আলেমেরা যে বলেছিলেন, “ওকে ভূতে পেয়েছে,” তাঁদের সেই কথার জন্যই ঈসা এই সব বললেন। এর পরে ঈসার মা ও ভাইয়েরা সেখানে আসলেন এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ঈসার চারদিকে তখন অনেক লোক বসে ছিল। তারা তাঁকে বলল, “আপনার মা ও ভাইয়েরা বাইরে আপনার খোঁজ করছেন।” ঈসা বললেন, “কে আমার মা, আর কারা আমার ভাই?” যারা তাঁকে ঘিরে বসে ছিল তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই তো আমার মা ও ভাইয়েরা! আল্লাহ্‌র ইচ্ছা যারা পালন করে তারাই আমার ভাই, বোন ও মা।” ঈসা আবার গালীল সাগরের ধারে লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। তাঁর চারদিকে অনেক লোকের ভিড় হল; সেইজন্য তিনি সাগরের মধ্যে একটা নৌকায় উঠে বসলেন আর লোকেরা সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয় তাদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। তার মধ্যে তিনি বললেন, “শুনুন, একজন চাষী বীজ বুনতে গেল। বীজ বুনবার সময় কতগুলো বীজ পথের পাশে পড়ল, আর পাখীরা এসে তা খেয়ে ফেলল। আবার কতগুলো বীজ পাথুরে জমিতে পড়ল। সেখানে বেশী মাটি ছিল না। মাটি গভীর ছিল না বলে তাড়াতাড়ি চারা গজিয়ে উঠল। সূর্য উঠলে পর সেগুলো পুড়ে গেল এবং শিকড় ভাল করে বসে নি বলে শুকিয়ে গেল। আর কতগুলো বীজ কাঁটাবনের মধ্যে পড়ল। কাঁটাগাছ বেড়ে উঠে চারাগুলো চেপে রাখল, তাই ফল ধরল না। কিন্তু আর কতগুলো বীজ ভাল জমিতে পড়ল এবং গাছ বের হয়ে বেড়ে উঠল ও ফল দিল; কোনটাতে ত্রিশ গুণ, কোনটাতে ষাট গুণ, আবার কোনটাতে একশোগুণ ফসল জন্মাল।” শেষে ঈসা বললেন, “যার শুনবার কান আছে, সে শুনুক।” ভিড় কমে গেলে পর ঈসার চারপাশের লোকেরা আর তাঁর বারোজন সাহাবী সেই গল্পের বিষয় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্যের গোপন সত্য তোমাদেরই জানতে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যদের কাছে গল্পের মধ্য দিয়ে সব কথা বলা হয়, যেন পাক-কিতাবের কথামত, ‘তারা তাকিয়েও দেখতে না পায় এবং শুনেও বুঝতে না পারে। তা না হলে তারা হয়তো আল্লাহ্‌র দিকে ফিরবে এবং মাফ পাবে।’ ” তারপর ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা কি এই গল্পটার মানে বুঝলে না? তাহলে কেমন করে অন্য গল্পগুলোর মানে বুঝবে? চাষী যে বীজ বুনেছিল তা হল আল্লাহ্‌র কালাম। পথের পাশে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শোনে, কিন্তু শয়তান তখনই এসে তাদের অন্তরে যে কালাম বোনা হয়েছিল তা নিয়ে যায়। পাথুরে জমিতে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শুনে তখনই আনন্দের সংগে তা গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে শিকড় ভাল করে বসে না বলে কেবল অল্প দিনের জন্য তারা স্থির থাকে। পরে কালামের জন্য যখন কষ্ট এবং জুলুম আসে তখনই তারা পিছিয়ে যায়। আবার কাঁটাবনের মধ্যে বোনা বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শোনে, কিন্তু সংসারের চিন্তা-ভাবনা, ধন-সম্পত্তির মায়া এবং অন্যান্য জিনিসের লোভ এসে সেই কালামকে চেপে রাখে; সেইজন্য তাতে কোন ফল হয় না। আর ভাল জমিতে বোনা বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শুনে তা গ্রহণ করে এবং ফল দেয়। কেউ দেয় ত্রিশগুণ, কেউ দেয় ষাট গুণ আবার কেউ দেয় একশো গুণ।” ঈসা আরও বললেন, “কেউ কি বাতি নিয়ে ঝুড়ি বা খাটের নীচে রাখে? সে কি তা বাতিদানের উপর রাখে না? কোন জিনিস যদি লুকানো থাকে তবে তা প্রকাশিত হবার জন্যই লুকানো থাকে; আবার কোন জিনিস যদি ঢাকা থাকে তবে তা খুলবার জন্যই ঢাকা থাকে। যদি কারও শুনবার কান থাকে সে শুনুক।” এর পরে ঈসা বললেন, “তোমরা যা শুনছ সেই বিষয়ে মনোযোগ দাও। তোমরা যেভাবে মেপে দাও তোমাদের জন্য সেইভাবে মাপা হবে; এমন কি, বেশী করেই মাপা হবে। যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে, কিন্তু যার নেই তার যা আছে তা-ও তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে।” ঈসা আরও বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্য এই রকম: একজন লোক জমিতে বীজ ছড়াল। পরে সে রাতে ঘুমিয়ে ও দিনে জেগে থেকে সময় কাটাল। এর মধ্যে সেই বীজ থেকে চারা গজিয়ে বড় হল, কিন্তু কিভাবে হল তা সে জানল না। জমি নিজে নিজেই ফল জন্মাল- প্রথমে চারা, পরে শীষ এবং শীষের মাথায় পরিপূর্ণ শস্যের দানা। দানা পাকলে পর সে কাসে- লাগাল, কারণ ফসল কাটবার সময় হয়েছে।” তারপর ঈসা বললেন, “কিসের সংগে আমরা আল্লাহ্‌র রাজ্যের তুলনা করব? কোন্‌ দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে তা বুঝাব? সেই রাজ্য একটা সরিষা দানার মত। জমিতে বুনবার সময় দেখা যায় যে, ওটা সব বীজের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। কিন্তু লাগাবার পর যখন গাছ বেড়ে ওঠে তখন সমস্ত শাক-সব্‌জির মধ্যে ওটা সবচেয়ে বড় হয়, আর এমন বড় বড় ডাল বের হয় যে, পাখীরাও তার আড়ালে বাসা বাঁধে।” এই রকম আরও অনেক গল্পের মধ্য দিয়ে ঈসা আল্লাহ্‌র কালাম লোকদের কাছে বলতেন। তারা যতটুকু বুঝতে পারত ততটুকুই তিনি তাদের কাছে বলতেন। গল্প ছাড়া তিনি তাদের শিক্ষা দিতেন না, কিন্তু সাহাবীরা যখন তাঁর সংগে একা থাকতেন তখন তিনি সব কিছু তাঁদের বুঝিয়ে দিতেন। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “চল, আমরা সাগরের ওপারে যাই।” তখন সাহাবীরা লোকদের ছেড়ে ঈসা যে নৌকায় ছিলেন সেই নৌকাতে করে তাঁকে নিয়ে চললেন। অবশ্য সেখানে আরও অন্য নৌকাও ছিল। নৌকা যখন চলছিল তখন একটা ভীষণ ঝড় উঠল এবং ঢেউগুলো নৌকার উপর এমনভাবে আছড়ে পড়ল যে, নৌকা পানিতে ভরে উঠতে লাগল। ঈসা কিন্তু নৌকার পিছন দিকে একটা বালিশের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। সাহাবীরা তাঁকে জাগিয়ে বললেন, “হুজুর, আমরা যে মারা পড়ছি সেদিকে কি আপনার খেয়াল নেই?” ঈসা উঠে বাতাসকে ধমক দিলেন এবং সাগরকে বললেন, “থাম, শান্ত হও।” তাতে বাতাস থেমে গেল ও সব কিছু খুব শান্ত হয়ে গেল। তিনি সাহাবীদের বললেন, “তোমরা ভয় পাও কেন? এখনও কি তোমাদের বিশ্বাস হয় নি?” এতে সাহাবীরা ভীষণ ভয় পেলেন এবং নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “ইনি কে যে, বাতাস এবং সাগরও তাঁর কথা শোনে?” তারপর ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা গালীল সাগর পার হয়ে গেরাসেনীদের এলাকায় গেলেন। ঈসা নৌকা থেকে নামতেই ভূতে পাওয়া একজন লোক কবরস্থান থেকে বের হয়ে তাঁর সামনে আসল। লোকটা কবরস্থানেই থাকত এবং শিকল দিয়েও কেউ আর তাকে বেঁধে রাখতে পারত না। তার হাত-পা প্রায়ই শিকল দিয়ে বাঁধা হত, কিন্তু সে শিকল ছিঁড়ে ফেলত এবং পায়ের বেড়ী ভেংগে ফেলত। কেউই তাকে সামলাতে পারত না। সে দিনরাত কবরে কবরে ও পাহাড়ে পাহাড়ে চিৎকার করে বেড়াত এবং পাথর দিয়ে নিজেই নিজের শরীর কাটত। সে এই কথা বলল কারণ ঈসা তাকে বলেছিলেন, “ভূত, এই লোকটির মধ্য থেকে বের হয়ে যাও।” ঈসা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কি?” সে বলল, “আমার নাম বাহিনী, কারণ আমরা অনেকে আছি।” সে ঈসাকে বারবার কাকুতি-মিনতি করে বলল যেন তিনি সেই এলাকা থেকে তাদের বের করে না দেন। সেই সময় সেই জায়গার কাছে পাহাড়ের গায়ে খুব বড় এক পাল শূকর চরছিল। ভূতেরা ঈসাকে মিনতি করে বলল, “ঐ শূকরের পালের মধ্যে আমাদের পাঠিয়ে দিন; ওদের মধ্যে আমাদের ঢুকতে দিন।” ঈসা অনুমতি দিলে পর সেই ভূতেরা বের হয়ে শূকরগুলোর মধ্যে গেল। তাতে সমস্ত শূকর ঢালু পার দিয়ে জোরে দৌড়ে গেল এবং সাগরের মধ্যে পড়ে ডুবে মরল। সেই পালের মধ্যে প্রায় দু’হাজার শূকর ছিল। যারা শূকর চরাচ্ছিল তারা তখন পালিয়ে গিয়ে গ্রামে এবং তার আশেপাশের সব জায়গায় এই খবর দিল। তখন লোকেরা দেখতে আসল কি হয়েছে। তারা ঈসার কাছে এসে দেখল, যাকে অনেকগুলো ভূতে পেয়েছিল সেই লোকটা কাপড়-চোপড় পরে সুস্থ মনে বসে আছে। এ দেখে লোকেরা ভয় পেল। এই ঘটনা যারা দেখেছিল তারা সেই ভূতে পাওয়া লোকটার বিষয় ও সেই শূকরগুলোর বিষয় লোকদের জানাল। এতে লোকেরা ঈসাকে অনুরোধ করতে লাগল যেন তিনি তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যান। ঈসা যখন নৌকায় উঠছিলেন তখন যাকে ভূতে পেয়েছিল সেই লোকটি তাঁর সংগে যাবার জন্য মিনতি করতে লাগল। কিন্তু ঈসা তাঁকে এই বলে বিদায় করলেন, “তুমি তোমার বাড়ীতে ফিরে যাও এবং মাবুদ তোমার জন্য কত বড় কাজ করেছেন ও তোমার উপর কত দয়া দেখিয়েছেন তা গিয়ে তোমার বাড়ীর লোকদের বল।” লোকটি তখন চলে গেল এবং ঈসা তার জন্য কত বড় কাজ করেছেন তা দেকাপলি এলাকায় বলে বেড়াতে লাগল। তাতে সবাই আশ্চর্য হল। ঈসা যখন নৌকায় করে আবার সাগরের অন্য পারে গেলেন তখন তাঁর চারপাশে অনেক লোক এসে ভিড় করল। তিনি তখনও সাগরের পারে ছিলেন। সেই সময় যায়ীর নামে ইহুদী মজলিস-খানার একজন নেতা সেখানে আসলেন এবং ঈসাকে দেখে তাঁর পায়ের উপর উবুড় হয়ে পড়লেন। তিনি ঈসাকে মিনতি করে বললেন, “আমার মেয়েটা মারা যাবার মত হয়েছে। আপনি এসে তার উপর আপনার হাত রাখুন; তাতে সে সুস্থ হয়ে উঠবে।” তখন ঈসা তাঁর সংগে চললেন। অনেক লোক ঈসার সংগে সংগে যাচ্ছিল এবং তাঁর চারপাশে ঠেলাঠেলি করছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক ছিল যে বারো বছর ধরে রক্তস্রাব রোগে ভুগছিল। অনেক ডাক্তারের হাতে সে অনেক কষ্ট পেয়েছিল, আর তার যা কিছু ছিল সবই সে খরচ করেছিল, কিন্তু ভাল হবার বদলে দিন দিনই তার অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। ঈসার বিষয় শুনে সে ভিড়ের মধ্যেই ঈসার ঠিক পিছনে এসে তাঁর চাদরটা ছুঁলো, কারণ সে ভেবেছিল যদি কেবল তাঁর কাপড় সে ছুঁতে পারে তাহলেই সে ভাল হয়ে যাবে। ঈসার চাদরটা ছোঁয়ার সংগে সংগেই তার রক্তস্রাব বন্ধ হল এবং সে তার নিজের শরীরের মধ্যেই বুঝল তার অসুখ ভাল হয়ে গেছে। ঈসা তখনই বুঝলেন তাঁর মধ্য থেকে শক্তি বের হয়েছে। সেইজন্য তিনি ভিড়ের চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে আমার কাপড় ছুঁলো?” তাঁর সাহাবীরা বললেন, “আপনি তো দেখছেন লোকে আপনার চারপাশে ঠেলাঠেলি করছে, আর তবুও আপনি বলছেন, কে আপনাকে ছুঁলো?” এই কাজ কে করেছে তা দেখবার জন্য তবুও ঈসা চারদিকে তাকাতে লাগলেন। সেই স্ত্রীলোকটির যা হয়েছে তা বুঝে সে কাঁপতে কাঁপতে এসে ঈসার পায়ে পড়ল এবং সব বিষয় জানাল। ঈসা তাঁকে বললেন, “মা, তুমি বিশ্বাস করেছ বলে সুস্থ হয়েছ। শান্তিতে চলে যাও, তোমার আর এই কষ্ট না হোক।” ঈসা তখনও কথা বলছিলেন, এমন সময় সেই মজলিস-খানার নেতা যায়ীরের ঘর থেকে কয়েকজন লোক এসে যায়ীরকে বলল, “আপনার মেয়েটা মারা গেছে; হুজুরকে আর কষ্ট দেবেন না।” সেই লোকগুলোর কথা শুনে ঈসা যায়ীরকে বললেন, “ভয় করবেন না, কেবল বিশ্বাস করুন।” ঈসা কেবল পিতর, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের ভাই ইউহোন্নাকে তাঁর সংগে নিলেন। পরে যায়ীরের বাড়ীতে এসে তিনি দেখলেন খুব গোলমাল হচ্ছে। লোকেরা জোরে জোরে কান্নাকাটি করছে। ঈসা ভিতরে গিয়ে লোকদের বললেন, “আপনারা কেন গোলমাল ও কান্নাকাটি করছেন? মেয়েটি মারা যায় নি, ঘুমাচ্ছে।” এই কথা শুনে লোকেরা হাসাহাসি করতে লাগল। তখন ঈসা তাদের সবাইকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। তারপর তিনি মেয়েটির মা-বাবা এবং তাঁর সংগের সাহাবীদের নিয়ে মেয়েটি যে ঘরে ছিল সেই ঘরে ঢুকলেন। এই ঘটনার কথা কাউকে না জানাবার জন্য ঈসা কড়া হুকুম দিলেন এবং মেয়েটিকে কিছু খেতে দিতে বললেন। এর পর ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে নিজের গ্রামে গেলেন, আর তাঁর সাহাবীরাও তাঁর সংগে গেলেন। বিশ্রামবারে তিনি মজলিস-খানায় গিয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। অনেক লোক তাঁর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল, “এই লোক কোথা থেকে এই সব পেল? এই যে জ্ঞান তাকে দেওয়া হয়েছে, এ-ই বা কি? আবার সে অলৌকিক চিহ্ন-কাজও করছে। এ কি সেই ছুতার মিস্ত্রি নয়? এ কি মরিয়মের ছেলে নয়? ইয়াকুব, ইউসুফ, এহুদা ও শিমোনের ভাই নয়? তার বোনেরা কি এখানে আমাদের মধ্যে নেই?” এইভাবে ঈসাকে নিয়ে লোকদের মনে বাধা আসতে লাগল। তখন ঈসা তাদের বললেন, “নিজের গ্রাম, নিজের আত্মীয়-স্বজন ও নিজের বাড়ী ছাড়া আর সব জায়গাতেই নবীরা সম্মান পান।” তারপর তিনি কয়েকজন অসুস্থ লোকের উপর হাত রেখে তাদের সুস্থ করলেন, কিন্তু সেখানে আর কোন অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করা সম্ভব হল না। লোকেরা তাঁর উপর ঈমান আনল না দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হলেন। এর পরে ঈসা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। পরে তিনি তাঁর সেই বারোজন সাহাবীকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং তবলিগ করবার জন্য দু’জন দু’জন করে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ভূতদের উপরে তাঁদের ক্ষমতা দিলেন। যাত্রাপথের জন্য একটা লাঠি ছাড়া আর কিছুই তিনি সাহাবীদের নিতে দিলেন না। রুটি, থলি, কোমর-বাঁধনিতে পয়সা পর্যন্ত নিতে তিনি তাঁদের নিষেধ করলেন। তিনি তাঁদের জুতা পরতে বললেন বটে, কিন্তু একটার বেশী কোর্তা পরতে নিষেধ করলেন। তিনি তাঁদের আরও বললেন, “তোমরা যে বাড়ীতে ঢুকবে সেই গ্রাম ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেই বাড়ীতেই থেকো। কোন জায়গার লোকেরা যদি তোমাদের গ্রহণ না করে কিংবা তোমাদের কথা না শোনে, তবে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাবার সময়ে তোমাদের পায়ের ধুলা ঝেড়ে ফেলো যেন সেটাই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়।” তখন সাহাবীরা গিয়ে তবলিগ করতে লাগলেন যেন লোকেরা তওবা করে। তাঁরা অনেক ভূত ছাড়ালেন এবং অনেক অসুস্থ লোকের মাথায় তেল দিয়ে তাদের সুস্থ করলেন। ঈসার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে বাদশাহ্‌ হেরোদ ঈসার কথা শুনতে পেয়েছিলেন। কোন কোন লোক বলছিল, “উনিই সেই তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া। তিনি মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছেন বলে এই সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করছেন।” কেউ কেউ বলছিল, “উনি ইলিয়াস নবী”; আবার কেউ কেউ বলছিল, “অনেক দিন আগেকার নবীদের মত উনিও একজন নবী।” এই সব কথা শুনে হেরোদ বললেন, “উনি ইয়াহিয়া, যাঁর মাথা কেটে ফেলবার হুকুম আমি দিয়েছিলাম। আবার উনি বেঁচে উঠেছেন।” এইজন্য ইয়াহিয়ার উপর হেরোদিয়ার খুব রাগ ছিল। সে ইয়াহিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু হেরোদ ইয়াহিয়াকে ভয় করতেন বলে সে তা করতে পারছিল না। ইয়াহিয়া যে একজন আল্লাহ্‌ভক্ত ও পবিত্র লোক হেরোদ তা জানতেন, তাই তিনি ইয়াহিয়াকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতেন। ইয়াহিয়ার কথা শুনবার সময় মনে খুব অস্বস্তি বোধ করলেও হেরোদ তাঁর কথা শুনতে ভালবাসতেন। শেষে হেরোদিয়া একটা সুযোগ পেল। হেরোদ নিজের জন্মদিনে তাঁর বড় বড় রাজকর্মচারী, সেনাপতি ও গালীল প্রদেশের প্রধান লোকদের জন্য একটা মেজবানী দিলেন। হেরোদিয়ার মেয়ে সেই মেজবানীসভায় নাচ দেখিয়ে হেরোদ ও ভোজে দাওয়াতী লোকদের সন্তুষ্ট করল। তখন বাদশাহ্‌ মেয়েটিকে বললেন, “তুমি যা চাও আমি তোমাকে তা-ই দেব।” হেরোদ মেয়েটির কাছে কসম খেয়ে বললেন, “তুমি যা চাও আমি তা-ই তোমাকে দেব। এমন কি, আমার রাজ্যের অর্ধেক পর্যন্তও দেব।” মেয়েটি গিয়ে তার মাকে বলল, “আমি কি চাইব?” তার মা বলল, “তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়ার মাথা।” মেয়েটি তখনই গিয়ে বাদশাহ্‌কে বলল, “একটা থালায় করে আমি এখনই তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়ার মাথাটা চাই।” এই কথা শুনে বাদশাহ্‌ হেরোদ খুব দুঃখিত হলেন, কিন্তু ভোজে দাওয়াতী লোকদের সামনে কসম খেয়েছিলেন বলে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন না। এই খবর পেয়ে ইয়াহিয়ার সাহাবীরা এসে তাঁর লাশটা নিয়ে গিয়ে দাফন করলেন। ঈসা যে বারোজন সাহাবীকে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা ফিরে আসলেন এবং যা যা করেছিলেন ও শিক্ষা দিয়েছিলেন সবই তাঁকে জানালেন। সেই সময় অনেক লোক সেখানে যাওয়া-আসা করছিল বলে সাহাবীরা কিছু খাওয়ার সুযোগও পেলেন না। সেইজন্য ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা আমার সংগে কোন একটা নির্জন জায়গায় এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর।” তাঁরা নৌকায় করে একটা নির্জন জায়গায় গেলেন। তাঁদের যেতে দেখে অনেকেই কিন্তু তাঁদের চিনতে পারল এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে দৌড়ে গিয়ে তাঁদের আগেই সেখানে উপস্থিত হল। ঈসা নৌকা থেকে নেমে অনেক লোকের ভিড় দেখতে পেলেন। এই লোকদের জন্য ঈসার খুব মমতা হল কারণ এদের দশা রাখালহীন ভেড়ার মত ছিল। ঈসা তাদের অনেক বিষয় শিক্ষা দিতে লাগলেন। যখন দিন শেষ হয়ে আসল তখন সাহাবীরা এসে ঈসাকে বললেন, “জায়গাটা নির্জন, বেলাও প্রায় ডুবে গেছে। লোকদের বিদায় করে দিন যেন তারা আশেপাশের পাড়ায় ও গ্রামে গিয়ে নিজেদের জন্য কিছু খাবার কিনতে পারে।” ঈসা বললেন, “তোমরাই ওদের খেতে দাও।” সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “আমরা গিয়ে দু’শো দীনারের রুটি কিনে এনে কি তাদের খেতে দেব?” ঈসা বললেন, “তোমাদের কাছে কয়টা রুটি আছে গিয়ে দেখ।” সাহাবীরা দেখে এসে বললেন, “পাঁচটা রুটি আর দু’টা মাছ আছে।” তখন ঈসা সাহাবীদের হুকুম দিলেন যেন তাঁরা সবুজ ঘাসের উপর লোকদের বসিয়ে দেন। লোকেরা একশো একশো করে, পঞ্চাশ পঞ্চাশ জন করে সারি সারি বসে গেল। ঈসা সেই পাঁচটা রুটি আর দু’টা মাছ নিয়ে বেহেশতের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন, আর লোকদের দেবার জন্য রুটি ভেংগে সাহাবীদের হাতে দিলেন। এইভাবে তিনি সবাইকে মাছও ভাগ করে দিলেন। তারা সকলে পেট ভরে খেল। তার পরে সাহাবীরা বাকী রুটি ও মাছের টুকরা তুলে নিয়ে বারোটা টুকরি ভরতি করলেন। যারা খেয়েছিল তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই ছিল পাঁচ হাজার। ঈসা এর পরেই তাঁর সাহাবীদের তাগাদা দিলেন যেন তাঁরা নৌকায় উঠে তাঁর আগে সাগরের অন্য পারে বৈৎসৈদা গ্রামে যান, আর এদিকে তিনি লোকদের বিদায় করতে লাগলেন। লোকদের বিদায় দিয়ে তিনি মুনাজাত করবার জন্য পাহাড়ে উঠে গেলেন। যখন রাত হল তখন সাহাবীদের নৌকাটা সাগরের মাঝখানে ছিল এবং ঈসা একা ডাংগায় ছিলেন। ঈসা দেখলেন সাহাবীরা খুব কষ্ট করে দাঁড় বাইছেন, কারণ বাতাস তাঁদের উল্টাদিকে ছিল। প্রায় শেষ রাতের দিকে ঈসা সাগরের উপর দিয়ে হেঁটে সাহাবীদের কাছে আসলেন এবং তাঁদের ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সাহাবীরা কিন্তু তাঁকে সাগরের উপর দিয়ে হাঁটতে দেখে ভূত মনে করে চিৎকার করে উঠলেন, কারণ তাঁকে দেখে সবাই ভয় পেয়েছিলেন। ঈসা তখনই সাহাবীদের সংগে কথা বললেন। তিনি তাঁদের বললেন, “এ তো আমি; ভয় কোরো না, সাহস কর।” ঈসা সাহাবীদের নৌকায় উঠলে পর বাতাস থেমে গেল। এতে সাহাবীরা খুব অবাক হয়ে গেলেন, কারণ এর আগে রুটি খাওয়াবার ব্যাপারটা তাঁরা বুঝতে পারেন নি; তাঁদের মন কঠিন হয়েই রইল। ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা সাগর পার হয়ে গিনেষরৎ এলাকায় এসে নৌকা বাঁধলেন। শহরে, গ্রামে বা পাড়ায়, যেখানেই তিনি যেতেন সেখানকার লোকেরা রোগীদের এনে বাজারের মধ্যে জড়ো করত। তারা ঈসাকে মিনতি করত যেন রোগীরা তাঁর চাদরের কিনারাটা কেবল ছুঁতে পারে, আর যারা তাঁকে ছুঁতো তারা সুস্থ হত। যাঁরা জেরুজালেম থেকে এসেছিলেন এমন কয়েকজন ফরীশী ও আলেম ঈসার কাছে একত্র হলেন। তাঁরা দেখলেন, ঈসার সাহাবীদের মধ্যে কয়েকজন হাত না ধুয়ে নাপাকভাবে খেতে বসেছেন। ফরীশীরা ও সমস্ত ইহুদীরা পুরানো দিনের আলেমদের দেওয়া যে নিয়ম চলে আসছে সেই নিয়ম মত হাত না ধুয়ে খান না। বাজার থেকে এসে তাঁরা হাত-পা না ধুয়ে কিছু খান না। এছাড়া তাঁরা আরও অনেক রকম নিয়ম পালন করে থাকেন, যেমন বাসন-কোসন, পেয়ালা ইত্যাদি ধোয়া। সেইজন্য ফরীশী ও আলেমেরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “পুরানো দিনের আলেমদের দেওয়া যে নিয়ম চলে আসছে আপনার সাহাবীরা তা মেনে চলে না কেন? তারা তো হাত না ধুয়েই খায়।” ঈসা জবাব দিলেন, “আপনারা ভণ্ড! আপনাদের বিষয়ে নবী ইশাইয়া ঠিক কথাই বলেছিলেন। তাঁর কিতাবে লেখা আছে: এই লোকেরা মুখেই আমাকে সম্মান করে, কিন্তু তাদের দিল আমার কাছ থেকে দূরে থাকে। তারা মিথ্যাই আমার এবাদত করে, তাদের দেওয়া শিক্ষা মানুষের তৈরী কতগুলো নিয়ম মাত্র। আপনারা তো আল্লাহ্‌র দেওয়া হুকুমগুলো বাদ দিয়ে মানুষের দেওয়া চলতি নিয়ম পালন করছেন।” ঈসা তাঁদের আরও বললেন, “আল্লাহ্‌র হুকুম বাদ দিয়ে নিজেদের চলতি নিয়ম পালন করবার জন্য খুব ভাল উপায়ই আপনাদের জানা আছে। যেমন ধরুন, মূসা বলেছেন, ‘মা-বাবাকে সম্মান কোরো’ এবং ‘যার কথায় মা-বাবার প্রতি অসম্মান থাকে তাকে অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে।’ কিন্তু আপনারা বলে থাকেন, যদি কেউ তার মা কিংবা বাবাকে বলে, ‘আমার যে জিনিসের দ্বারা তোমার সাহায্য হতে পারত তা কোরবান,’ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কাছে কোরবানী করা হয়েছে, তবে মা-বাবার জন্য তাকে আর কিছু করতে হয় না। এইভাবে আপনারা আপনাদের চলতি নিয়ম শিক্ষা দিয়ে আল্লাহ্‌র কালাম বাতিল করেছেন। এছাড়া আপনারা আরও এই রকম অনেক কাজ করে থাকেন।” এর পরে ঈসা লোকদের আবার তাঁর কাছে ডেকে বললেন, “আপনারা সবাই আমার কথা শুনুন ও বুঝুন। এর পরে ঈসা যখন লোকদের ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন, তখন সাহাবীরা সেই কথার মানে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা কি এতই অবুঝ? তোমরা কি বোঝ না যে, বাইরে থেকে যা মানুষের ভিতরে ঢোকে তা তাকে নাপাক করতে পারে না? এর কারণ হল, তা তো তার অন্তরে ঢোকে না কিন্তু পেটে ঢোকে এবং পরে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।” এই কথাতেই ঈসা বুঝিয়ে দিলেন যে, সব খাবারই হালাল। ঈসা আরও বললেন, “মানুষের ভিতর থেকে যা বের হয়ে আসে তা-ই মানুষকে নাপাক করে, কারণ মানুষের ভিতর, অর্থাৎ অন্তর থেকেই খারাপ চিন্তা, সমস্ত রকম জেনা, চুরি, খুন, লোভ, অন্যের ক্ষতি করবার ইচ্ছা, ছলনা, লমপটতা, হিংসা, নিন্দা, অহংকার এবং মূর্খতা বের হয়ে আসে। এই সব খারাপী মানুষের ভিতর থেকেই বের হয়ে আসে এবং মানুষকে নাপাক করে।” এর পরে ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে টায়ার এলাকায় গেলেন। তিনি একটা ঘরে ঢুকলেন এবং চাইলেন যেন কেউ তা জানতে না পারে, কিন্তু তিনি লুকিয়ে থাকতে পারলেন না। সেখানে এমন একজন স্ত্রীলোক ছিল যার মেয়েকে ভূতে পেয়েছিল। সেই স্ত্রীলোকটি ঈসার বিষয় শুনতে পেয়ে তখনই এসে ঈসার পায়ে পড়ল। স্ত্রীলোকটি ছিল অ-ইহুদী এবং সিরিয়া-ফিনিশিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিল। সে ঈসার কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যেন তিনি তার মেয়েটির মধ্য থেকে ভূত দূর করে দেন। ঈসা তাকে বললেন, “আগে ছেলেমেয়েরা পেট ভরে খাক, কারণ ছেলেমেয়েদের খাবার নিয়ে কুকুরের সামনে ফেলা ভাল নয়।” তাতে সেই স্ত্রীলোকটি বলল, “হুজুর, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু ছেলেমেয়েদের খাবারের যে সব টুকরা টেবিলের নীচে পড়ে তা তো কুকুরেই খায়।” ঈসা তাকে বললেন, “কথাটা তুমি খুব ভাল বলেছ। এখন যাও; গিয়ে দেখ, ভূত তোমার মেয়েটির মধ্য থেকে বের হয়ে গেছে।” সেই স্ত্রীলোকটি তখন বাড়ীতে ফিরে গিয়ে দেখল, তার মেয়েটি বিছানায় শুয়ে আছে এবং ভূত তার মধ্য থেকে বের হয়ে গেছে। এর পরে ঈসা টায়ার এলাকা ছেড়ে সিডন শহরের মধ্য দিয়ে গালীল সাগরের কাছে দেকাপলি এলাকার গ্রামগুলোতে গেলেন। সেখানে কয়েকজন লোক একটা বধির ও তোতলা লোককে ঈসার কাছে নিয়ে আসল এবং কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যেন তিনি সেই লোকটির উপরে তাঁর হাত রাখেন। ঈসা ভিড়ের মধ্য থেকে সেই লোকটিকে একপাশে নিয়ে গিয়ে তার দুই কানের মধ্যে নিজের আংগুল দিলেন। পরে থুথু ফেলে লোকটার জিভ্‌ ছুঁলেন। তারপর তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে লোকটিকে বললেন, “এপ্‌ফাথা,” অর্থাৎ “খুলে যাও।” তাতে লোকটার কানও খুলে গেল, জিভও খুলে গেল এবং সে স্পষ্টভাবে কথা বলতে লাগল। ঈসা এই বিষয়ে কাউকে বলতে লোকদের নিষেধ করলেন। কিন্তু তিনি যতই তাদের নিষেধ করলেন ততই তারা সেই বিষয়ে আরও বেশী করে বলাবলি করতে লাগল। এই ঘটনায় লোকেরা খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, “ইনি সব কাজ কত নিখুঁতভাবে করেন। ইনি বধিরদের শুনবার শক্তি ও বোবাদের কথা বলবার শক্তি দেন।” পরে আবার একদিন অনেক লোকের ভিড় হল। এই সব লোকদের কাছে কোন খাবার ছিল না বলে ঈসা তাঁর সাহাবীদের ডেকে বললেন, “এই লোকদের জন্য আমার মমতা হচ্ছে, কারণ আজ তিন দিন হল এরা আমার সংগে সংগে আছে, আর এদের কাছে কোন খাবার নেই। যদি আমি এই অবস্থায় এদের বাড়ী পাঠিয়ে দিই তবে তারা পথেই অজ্ঞান হয়ে পড়বে, কারণ এদের মধ্যে অনেকেই অনেক দূর থেকে এসেছে।” সাহাবীরা বললেন, “কিন্তু এই নির্জন জায়গায় এদের খাওয়াবার জন্য কে কোথা থেকে এত রুটি পাবে?” ঈসা জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের কাছে কয়টা রুটি আছে?” তাঁরা বললেন, “সাতখানা।” তিনি লোকদের মাটিতে বসতে হুকুম দিলেন। পরে সেই রুটি সাতখানা নিয়ে তিনি আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে ভাংলেন এবং লোকদের দেবার জন্য সাহাবীদের হাতে দিলেন আর সাহাবীরা তা লোকদের হাতে দিলেন। সাহাবীদের কাছে কয়েকটা ছোট মাছও ছিল। ঈসা সেই মাছগুলোর জন্যও শুকরিয়া জানালেন এবং তা লোকদের ভাগ করে দেবার জন্য সাহাবীদের বললেন। লোকেরা পেট ভরে খেল। পরে যে টুকরাগুলো পড়ে রইল সাহাবীরা তা তুলে নিয়ে সাতটা টুকরি ভরতি করলেন। সেখানে ফরীশীরা এসে ঈসার সংগে তর্ক করতে লাগলেন এবং তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য বেহেশত থেকে কোন একটা চিহ্ন দেখতে চাইলেন। এতে ঈসা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এই কালের লোকেরা চিহ্নের তালাশ করে কেন? আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, কোন চিহ্নই এদের দেখানো হবে না।” তারপর তিনি তাঁদের ছেড়ে আবার নৌকায় উঠে সাগরের অন্য পারে গেলেন। সাহাবীরা সংগে করে রুটি নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। নৌকার মধ্যে তাঁদের কাছে মাত্র একখানা রুটি ছিল। এই সময় ঈসা বললেন, “তোমরা সতর্ক থাক, ফরীশীদের ও হেরোদের খামি থেকে সাবধান হও।” এতে সাহাবীরা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলেন, “আমাদের কাছে রুটি নেই বলে উনি এই কথা বলছেন।” সাহাবীরা কি বিষয়ে বলছেন তা বুঝতে পেরে ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা কেন বলছ যে, তোমাদের রুটি নেই? তোমরা কি এখনও জান না বা বোঝ না? তোমাদের অন্তর কি কঠিন হয়ে গেছে? তোমাদের চোখ থাকতেও কি দেখতে পাও না? কান থাকতেও কি শুনতে পাও না? মনেও কি পড়ে না, যখন আমি পাঁচ হাজার লোকের জন্য পাঁচখানা রুটি ভেংগেছিলাম তখন কত টুকরি রুটির টুকরা তোমরা কুড়িয়ে তুলেছিলে?” সাহাবীরা জবাব দিলেন, “বারো টুকরি।” ঈসা আবার বললেন, “আমি যখন চার হাজার লোকের জন্য সাতখানা রুটি ভেংগেছিলাম তখন কত টুকরি রুটির টুকরা তোমরা কুড়িয়ে তুলেছিলে?” তাঁরা বললেন, “সাত টুকরি।” তখন তিনি তাঁদের বললেন, “তাহলে তোমরা কি এখনও বোঝ না?” পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা বৈৎসৈদা গ্রামে গেলেন। সেখানকার লোকেরা একজন অন্ধ লোককে তাঁর কাছে নিয়ে আসল এবং লোকটির গায়ে হাত রাখবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করতে লাগল। ঈসা সেই অন্ধ লোকটিকে হাত ধরে গ্রামের বাইরে নিয়ে গেলেন। তার পরে লোকটির চোখে থুথু দিলেন এবং তার গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?” লোকটি তাকিয়ে দেখে বলল, “আমি লোক দেখতে পাচ্ছি; তারা দেখতে গাছের মত, আবার হেঁটেও বেড়াচ্ছে।” ঈসা আর একবার লোকটির চোখের উপরে হাত দিলেন। এইবার তার চোখ খুলে গেল এবং সে দেখবার শক্তি ফিরে পেল। সে পরিষ্কার ভাবে সব কিছু দেখতে লাগল। ঈসা তাকে তার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেবার সময় বললেন, “বৈৎসৈদা গ্রামে যেয়ো না।” তারপর ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা সিজারিয়া-ফিলিপি শহরের আশেপাশের গ্রামে গেলেন। যাবার পথে তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কে, এই বিষয়ে লোকে কি বলে?” সাহাবীরা বললেন, “কেউ কেউ বলে আপনি তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া; কেউ কেউ বলে ইলিয়াস নবী; আবার কেউ কেউ বলে আপনি নবীদের মধ্যে একজন।” তখন ঈসা বললেন, “কিন্তু তোমরা কি বল, আমি কে?” পিতর জবাব দিলেন, “আপনি সেই মসীহ্‌।” ঈসা তাঁদের সাবধান করে দিলেন যেন তাঁরা তাঁর সম্বন্ধে কাউকে কিছু না বলেন। পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের এই বলে শিক্ষা দিতে লাগলেন যে, ইব্‌ন্তেআদমকে অনেক দুঃখভোগ করতে হবে। বৃদ্ধ নেতারা, প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা তাঁকে অগ্রাহ্য করবেন। তাঁকে হত্যা করা হবে এবং তিন দিন পরে তাঁকে মৃত্যু থেকে আবার জীবিত হয়ে উঠতে হবে। এই সব কথা তিনি স্পষ্টভাবেই বললেন। তখন পিতর ঈসাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে অনুযোগ করতে লাগলেন। ঈসা মুখ ফিরিয়ে সাহাবীদের দিকে তাকালেন এবং পিতরকে ধমক দিয়ে বললেন, “শয়তান, আমার কাছ থেকে দূর হও। আল্লাহ্‌র যা, তা তুমি ভাবছ না, কিন্তু মানুষের যা, তা-ই ভাবছ।” এর পরে তিনি সাহাবীদের আর অন্য লোকদের তাঁর কাছে ডেকে বললেন, “যদি কেউ আমার পথে আসতে চায় তবে সে নিজের ইচ্ছামত না চলুক; নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে সে আমার পিছনে আসুক। যে কেউ তার নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চায় সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে; কিন্তু যে কেউ আমার জন্য এবং আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদের জন্য তার প্রাণ হারায়, সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে। যদি কেউ সমস্ত দুনিয়া লাভ করে তার বিনিময়ে তার সত্যিকারের জীবন হারায় তবে তার কোন লাভ নেই, কারণ সত্যিকারের জীবন ফিরে পাবার জন্য তার দেবার মত কি আছে? এই কালের বেঈমান ও গুনাহ্‌গার লোকদের মধ্যে যদি কেউ আমাকে নিয়ে আর আমার কথা নিয়ে লজ্জাবোধ করে, তবে ইব্‌ন্তেআদম যখন পবিত্র ফেরেশতাদের সংগে করে তাঁর পিতার মহিমায় আসবেন, তখন তিনিও সেই লোকের সম্বন্ধে লজ্জাবোধ করবেন।” তারপর ঈসা সাহাবীদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এখানে এমন কয়েকজন আছে যাদের কাছে আল্লাহ্‌র রাজ্য মহাশক্তিতে দেখা না দেওয়া পর্যন্ত তারা কোনমতেই মারা যাবে না।” এর ছয় দিন পরে ঈসা কেবল পিতর, ইয়াকুব ও ইউহোন্নাকে সংগে নিয়ে একটা উঁচু পাহাড়ে গেলেন। এই সাহাবীদের সামনে তাঁর চেহারা বদলে গেল। তাঁর কাপড়-চোপড় এমন চোখ ঝলসানো সাদা হল যে, দুনিয়ার কোন ধোপার পক্ষে তেমন করে কাপড় কাচা সম্ভব নয়। সাহাবীরা সেখানে নবী ইলিয়াস ও নবী মূসাকে দেখতে পেলেন। তাঁরা ঈসার সংগে কথা বলছিলেন। তখন পিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, ভালই হয়েছে যে, আমরা এখানে আছি। আমরা এখানে তিনটা কুঁড়ে-ঘর তৈরী করি- একটা আপনার, একটা মূসার ও একটা ইলিয়াসের জন্য।” কি যে বলা উচিত তা পিতর বুঝলেন না, কারণ তাঁরা খুব ভয় পেয়েছিলেন। এই সময় একটা মেঘ এসে তাঁদের ঢেকে ফেলল, আর সেই মেঘ থেকে এই কথা শোনা গেল, “ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমরা এঁর কথা শোন।” সাহাবীরা তখনই চারদিকে তাকালেন কিন্তু ঈসা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলেন না। পরে পাহাড় থেকে নেমে আসবার সময় ঈসা তাঁদের হুকুম দিলেন, “তোমরা যা দেখলে তা ইব্‌ন্তেআদম মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কাউকে বোলো না।” সাহাবীরা ঈসার হুকুম পালন করলেন, কিন্তু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠার অর্থ কি তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন। তাঁরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আলেমেরা কেন বলেন প্রথমে ইলিয়াস নবীর আসা দরকার?” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “এই কথা সত্যি যে, প্রথমে ইলিয়াস এসে সব কিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। তবে ইব্‌ন্তেআদমের বিষয়ে কেমন করেই বা পাক-কিতাবে লেখা আছে যে, তাঁকে খুব কষ্টভোগ করতে হবে এবং লোকে তাঁকে অগ্রাহ্য করবে? কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, ইলিয়াসের বিষয়ে পাক-কিতাবে যা লেখা আছে সেইভাবে তিনি এসেছিলেন, আর লোকেরা তাঁর উপর যা ইচ্ছা তা-ই করেছে।” ঈসা ও সেই তিনজন সাহাবী অন্য সাহাবীদের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, তাঁদের চারপাশে অনেক লোক জমায়েত হয়েছে এবং কয়েকজন আলেম তাঁদের সংগে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। লোকেরা ঈসাকে দেখেই খুব আশ্চর্য হয়ে গেল এবং দৌড়ে গিয়ে তাঁকে সালাম জানাল। ঈসা আলেমদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা ওদের সংগে কি বিষয়ে তর্ক করছেন?” ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লোক জবাব দিল, “হুজুর, আমার ছেলেকে আপনার কাছে এনেছিলাম। তাকে বোবা ভূতে পেয়েছে। সেই ভূত যখনই তাকে ধরে তখনই আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে। তার মুখ থেকে ফেনা বের হয় আর সে দাঁতে দাঁত ঘষে এবং শক্ত হয়ে যায়। আমি আপনার সাহাবীদের সেই ভূতকে ছাড়িয়ে দিতে বললাম, কিন্তু তাঁরা পারলেন না।” তখন ঈসা বললেন, “বেঈমান লোকেরা! আর কতদিন আমি তোমাদের সংগে থাকব? কতদিন তোমাদের সহ্য করব? ছেলেটিকে আমার কাছে আন।” লোকেরা তখন ছেলেটিকে ঈসার কাছে আনল। তাঁকে দেখেই সেই ভূত ছেলেটিকে খুব জোরে মুচড়ে ধরল। ছেলেটি মুখ থেকে ফেনা বের করতে করতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। ঈসা তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কতদিন হল তার এই রকম হয়েছে?” লোকটি বলল, “ছেলেবেলা থেকে। এই ভূত তাকে মেরে ফেলবার জন্য প্রায়ই আগুনে আর পানিতে ফেলে দিয়েছে। তবে আপনি যদি আমাদের কোন উপকার করতে পারেন তবে দয়া করে তা করুন।” ঈসা তাকে বললেন, “‘যদি করতে পারেন,’ এই কথার মানে কি? যে বিশ্বাস করে তার জন্য সব কিছুই সম্ভব।” তখনই ছেলেটির বাবা চিৎকার করে বলল, “আমি বিশ্বাস করছি; আমার মধ্যে এখনও যে অবিশ্বাস আছে তা দূর করে দিন।” অনেক লোক দৌড়ে আসছে দেখে ঈসা সেই ভূতকে ধমক দিয়ে বললেন, “ওহে বধির ও বোবা ভূত, আমি তোমাকে হুকুম দিচ্ছি, এর মধ্য থেকে বের হও; আর কখনও এর মধ্যে ঢুকো না।” তখন সেই ভূত চিৎকার করে ছেলেটাকে জোরে মুচড়ে ধরল এবং তার মধ্য থেকে বের হয়ে গেল। তাতে ছেলেটি মরার মত পড়ে রইল দেখে অনেকে বলল, “ও মারা গেছে।” ঈসা কিন্তু তার হাত ধরে তুললে পর সে উঠে দাঁড়াল। এর পরে ঈসা ঘরের ভিতরে গেলেন। তখন সাহাবীরা গোপনে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা তাকে ছাড়াতে পারলাম না কেন?” ঈসা বললেন, “মুনাজাত ছাড়া আর কোন মতেই এই রকম ভূত ছাড়ানো যায় না।” পরে তাঁরা সেই জায়গা ছেড়ে গালীল প্রদেশের মধ্য দিয়ে চলে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন কেউ জানতে না পারে যে, তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কারণ তখন তিনি তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁদের বলছিলেন, “ইব্‌ন্তেআদমকে লোকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তারা তাঁকে হত্যা করবে এবং তিন দিনের দিন আবার তিনি জীবিত হয়ে উঠবেন।” সাহাবীরা কিন্তু তাঁর কথার মানে বুঝতে পারলেন না এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেও তাঁদের ভয় হল। তারপর ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা কফরনাহূমে গেলেন। তিনি ঘরের মধ্যে গিয়ে সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা পথে কি নিয়ে তর্ক করছিলে?” সাহাবীরা চুপ করে রইলেন, কারণ কে সবচেয়ে বড় তা নিয়ে পথে তাঁরা তর্কাতর্কি করছিলেন। ঈসা বসলেন এবং সেই বারোজন সাহাবীকে নিজের কাছে ডেকে বললেন, “কেউ যদি প্রধান হতে চায় তবে তাকে সবার শেষে থাকতে হবে এবং সকলের সেবাকারী হতে হবে।” পরে তিনি একটা শিশুকে নিয়ে সাহাবীদের সামনে দাঁড় করালেন। তাকে কোলে নিয়ে তিনি বললেন, “যে কেউ আমার নামে এর মত কোন শিশুকে গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে, আর যে আমাকে গ্রহণ করে সে কেবল আমাকে গ্রহণ করে না, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁকেই গ্রহণ করে।” ইউহোন্না ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা একজন লোককে আপনার নামে ভূত ছাড়াতে দেখে তাকে নিষেধ করলাম, কারণ সে আমাদের দলের লোক নয়।” ঈসা বললেন, “তাকে নিষেধ কোরো না। আমার নামে অলৌকিক কাজ করবার পরে কেউ ফিরে আমার নিন্দা করতে পারে না, কারণ যে আমাদের বিপক্ষে থাকে না সে তো আমাদের পক্ষেই আছে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা মসীহের লোক বলে যে কেউ তোমাদের এক পেয়ালা পানি খেতে দেয় সে কোনমতে তার পুরস্কার হারাবে না। “আমার উপর ঈমানদার এই ছোটদের মধ্যে কাউকে যদি কেউ গুনাহের পথে নিয়ে যায় তবে তার গলায় একটা বড় পাথর বেঁধে তাকে সাগরে ফেলে দেওয়া বরং তার পক্ষে ভাল। তোমার হাত যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। দুই হাত নিয়ে জাহান্নামে যাবার চেয়ে বরং নুলা হয়ে জীবনে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল। তোমার চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা তুলে ফেল। দুই চোখ নিয়ে জাহান্নামে পড়বার চেয়ে বরং কানা হয়ে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢোকা তোমার পক্ষে ভাল। সেই জাহান্নামে মরা মানুষের গোশ্‌ত খাওয়া পোকারা কখনও মরে না, আর সেখানকার আগুন কখনও নেভে না। “লবণ দেওয়ার মত প্রত্যেকের উপর আগুন দেওয়া হবে। “লবণ ভাল জিনিস, কিন্তু যদি লবণের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় তবে তা কেমন করে আবার নোনতা করা যাবে? তোমাদের অন্তরের মধ্যে লবণ রাখ এবং তোমরা একে অন্যের সংগে শান্তিতে থাক।” পরে ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে এহুদিয়া প্রদেশে এবং জর্ডান নদীর অন্য পারে গেলেন। অনেক লোক আবার তাঁর কাছে এসে জমায়েত হল। তখন তিনি তাঁর নিয়ম মতই লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। এই সময় কয়েকজন ফরীশী এসে তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য বললেন, “মূসার শরীয়ত মতে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া কি কারও পক্ষে উচিত?” ঈসা তাঁদের বললেন, “মূসা আপনাদের কি হুকুম দিয়েছেন?” তাঁরা বললেন, “তিনি তালাক-নামা লিখে স্ত্রীকে তালাক দেবার অনুমতি দিয়েছেন।” ঈসা বললেন, “আপনাদের মন কঠিন বলেই মূসা এই হুকুম লিখেছিলেন। কিন্তু এ-ও লেখা আছে যে, সৃষ্টির শুরুতে ‘আল্লাহ্‌ তাদের পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে সৃষ্টি করেছিলেন। এইজন্যই মানুষ পিতা-মাতাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে, আর তারা দু’জন এক শরীর হবে।’ সেইজন্য তারা আর দুই নয়, কিন্তু এক শরীর। তাহলে আল্লাহ্‌ যা একসংগে যোগ করেছেন মানুষ তা আলাদা না করুক।” এর পরে তাঁরা ঘরে ঢুকলেন আর সাহাবীরা ঈসাকে আবার সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তিনি তাঁদের বললেন, “যে কেউ নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য স্ত্রীলোককে বিয়ে করে সে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে জেনা করে। আর স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিয়ে অন্য লোককে বিয়ে করে তবে সেও জেনা করে।” পরে লোকেরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঈসার কাছে নিয়ে আসল যেন তিনি তাদের উপর হাত রাখেন। কিন্তু সাহাবীরা সেই লোকদের বকুনি দিতে লাগলেন। ঈসা তা দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে সাহাবীদের বললেন, “ছেলেমেয়েদের আমার কাছে আসতে দাও, বাধা দিয়ো না; কারণ আল্লাহ্‌র রাজ্য এদের মত লোকদেরই। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, ছোট ছেলেমেয়ের মত করে আল্লাহ্‌র শাসন মেনে না নিলে কেউ কোনমতেই আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকতে পারবে না।” তারপর ঈসা সেই ছেলেমেয়েদের কোলে নিলেন এবং তাদের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। ঈসা আবার যখন পথে বের হলেন তখন একজন লোক দৌড়ে তাঁর কাছে আসল এবং তাঁর সামনে হাঁটু পেতে বলল, “হে ওস্তাদ, আপনি একজন ভাল লোক। আমাকে বলুন, অনন্ত জীবন লাভ করবার জন্য আমি কি করব?” ঈসা তাকে বললেন, “আমাকে ভাল বলছ কেন? আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউই ভাল নয়। তুমি তো হুকুমগুলো জান্ত ‘খুন কোরো না, জেনা কোরো না, চুরি কোরো না, মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না, ঠকিয়ো না, পিতা-মাতাকে সম্মান কোরো।’ ” লোকটি ঈসাকে বলল, “ওস্তাদ, ছোটবেলা থেকে আমি এই সব পালন করে আসছি।” এতে ঈসা তার দিকে চেয়ে দেখলেন এবং মহব্বতে পূর্ণ হয়ে তাকে বললেন, “একটা জিনিস তোমার বাকী আছে। যাও, তোমার যা কিছু আছে তা বিক্রি করে গরীবদের দান কর। তাতে তুমি বেহেশতে ধন পাবে। তার পরে এসে আমার উম্মত হও।” এই কথা শুনে লোকটির মুখ ্নান হয়ে গেল। তার অনেক ধন-সম্পত্তি ছিল বলে সে দুঃখিত হয়ে চলে গেল। তখন ঈসা চারদিকে তাকিয়ে তাঁর সাহাবীদের বললেন, “ধনীদের পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢোকা কত কঠিন!” সাহাবীরা তাঁর কথা শুনে আশ্চর্য হলেন। ঈসা আবার বললেন, “সন্তানেরা, যারা ধন-সম্পদের উপর নির্ভর করে তাদের পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢোকা কত কঠিন। ধনীর পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকবার চেয়ে বরং সূচের ফুটা দিয়ে উটের যাওয়া সহজ।” এতে সাহাবীরা আরও আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “তাহলে কে নাজাত পেতে পারে?” ঈসা তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌র পক্ষে অসম্ভব নয়; তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব।” পিতর তাঁকে বললেন, “দেখুন, আমরা তো সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আপনার সাহাবী হয়েছি।” জবাবে ঈসা বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যে কেউ আমার জন্য ও আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদের জন্য বাড়ী-ঘর, ভাই-বোন, মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে ও জায়গা-জমি ছেড়ে দিয়েছে, সে এই যুগেই তার একশো গুণ বেশী বাড়ী-ঘর, ভাই-বোন, মা, ছেলে-মেয়ে ও জায়গা-জমি পাবে এবং সংগে সংগে অত্যাচারও ভোগ করবে; আর আগামী যুগে সে অনন্ত জীবন লাভ করবে। কিন্তু যারা প্রথম সারিতে আছে তাদের মধ্যে অনেকে শেষে পড়বে, আর যারা শেষ সারিতে আছে তাদের মধ্যে অনেকে প্রথম হবে।” এর পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা জেরুজালেমের পথে চললেন। ঈসা তাঁদের আগে আগে হাঁটছিলেন; সাহাবীরা অবাক হয়ে তাঁর সংগে যাচ্ছিলেন এবং যে লোকেরা পিছনে আসছিল তারা ভয়ে ভয়ে হাঁটছিল। ঈসা আবার তাঁর বারোজন সাহাবীকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজের উপর কি হতে যাচ্ছে তা তাঁদের বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “দেখ, আমরা জেরুজালেমে যাচ্ছি। সেখানে ইব্‌ন্তেআদমকে প্রধান ইমামদের ও আলেমদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরা তাঁর বিচার করে তাঁকে মৃত্যুর উপযুক্ত বলে স্থির করবেন এবং অ-ইহুদীদের হাতে দেবেন। অ-ইহুদীরা তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে, তাঁর গায়ে থুথু দেবে, তাঁকে ভীষণভাবে চাবুক মারবে এবং হত্যা করবে। তিন দিনের দিন আবার তিনি জীবিত হয়ে উঠবেন।” পরে সিবদিয়ের ছেলে ইয়াকুব ও ইউহোন্না ঈসার কাছে এসে বললেন, “হুজুর, আমাদের ইচ্ছা এই যে, আমরা যা চাইব আমাদের জন্য আপনি তা-ই করবেন।” ঈসা বললেন, “তোমাদের জন্য আমি কি করব? তোমরা কি চাও?” তাঁরা বললেন, “আপনি যখন মহিমার সংগে রাজত্ব করবেন তখন যেন আমাদের একজন আপনার ডানপাশে ও অন্যজন বাঁপাশে বসতে পারে।” ঈসা বললেন, “তোমরা কি চাইছ তা জান না। যে দুঃখের পেয়ালায় আমি খেতে যাচ্ছি তাতে কি তোমরা খেতে পার? কিংবা যে তরিকাবন্দী আমি নিতে যাচ্ছি তা কি তোমরা নিতে পার?” তাঁরা বললেন, “জ্বী, পারি।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “যে দুঃখের পেয়ালায় আমি খাব তোমরা অবশ্য তাতে খাবে, আর যে তরিকাবন্দী আমি নেব তা তোমরাও নেবে, কিন্তু আমার ডান বা বাঁপাশে বসতে দেবার অধিকার আমার নেই। ঐ জায়গাগুলো যাদের জন্য ঠিক করা আছে তারাই তা পাবে।” বাকী দশজন সাহাবী এই সব কথা শুনে ইয়াকুব ও ইউহোন্নার উপর বিরক্ত হলেন। তখন ঈসা সবাইকে একসংগে ডেকে বললেন, “তোমরা জান যে, অ-ইহুদীদের শাসনকর্তারা অ-ইহুদীদের প্রভু হয় এবং তাদের নেতারা তাদের উপর হুকুম চালায়। কিন্তু তোমাদের মধ্যে তা হওয়া উচিত নয়, বরং তোমাদের মধ্যে যে বড় হতে চায় তাকে তোমাদের সেবাকারী হতে হবে, আর যে প্রথম হতে চায় তাকে সকলের গোলাম হতে হবে। মনে রেখো, ইব্‌ন্তেআদম সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন।” পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা জেরিকো শহরে গেলেন। যখন তিনি সাহাবীদের ও অনেক লোকের সংগে শহর থেকে চলে যাচ্ছিলেন তখন তীময়ের ছেলে বরতীময় নামে একজন অন্ধ ভিখারী পথের পাশে বসে ছিল। “উনি নাসরত গ্রামের ঈসা,” এই কথা শুনে সে চিৎকার করে বলতে লাগল, “দাউদের বংশধর ঈসা, আমাকে দয়া করুন।” এতে অনেকে তাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলল, কিন্তু সে আরও চিৎকার করে বলল, “দাউদের বংশধর, আমাকে দয়া করুন।” ঈসা থেমে বললেন, “ওকে ডাক।” লোকেরা অন্ধ লোকটিকে ডেকে বলল, “ভয় নেই, ওঠো। উনি তোমাকে ডাকছেন।” তখন সে তার গায়ের চাদরটা ফেলে লাফ দিয়ে উঠল এবং ঈসার কাছে গেল। ঈসা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি তোমার জন্য কি করব? তুমি কি চাও?” অন্ধ লোকটি বলল, “হুজুর, আমি যেন দেখতে পাই।” ঈসা বললেন, “যাও, তুমি ঈমান এনেছ বলে ভাল হয়েছ।” তাতে লোকটি তখনই দেখতে পেল এবং পথ দিয়ে ঈসার পিছনে পিছনে চলতে লাগল। তাঁরা জেরুজালেমের কাছাকাছি পৌঁছে জৈতুন পাহাড়ের গায়ে বৈৎফগী ও বেথানিয়া গ্রামের কাছে আসলেন। সেখানে পৌঁছে ঈসা তাঁর দু’জন সাহাবীকে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা ঐ সামনের গ্রামে যাও। গ্রামে ঢুকবার সময় দেখতে পাবে একটা গাধার বাচ্চা সেখানে বাঁধা আছে। তার উপরে কেউ কখনও চড়ে নি। তোমরা ওটা খুলে এখানে নিয়ে এস। যদি কেউ তোমাদের জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন তোমরা এটা করছ?’ তবে বোলো, ‘হুজুরের দরকার আছে; তিনি ওটাকে তাড়াতাড়ি করে ফিরিয়ে দেবেন।’ ” তখন তাঁরা গিয়ে দেখলেন গাধার বাচ্চাটা রাস্তার উপর ঘরের দরজার কাছে বাঁধা আছে। তাঁরা যখন গাধাটার বাঁধন খুলছিলেন, তখন যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তারা বলল, “তোমরা কি করছ? গাধার বাচ্চাটা খুলছ কেন?” ঈসা যা বলতে বলেছিলেন সাহাবীরা লোকদের তা-ই বললেন। তখন লোকেরা গাধাটা নিয়ে যেতে দিল। তাঁরা সেই গাধার বাচ্চাটা ঈসার কাছে এনে তার উপর তাঁদের গায়ের চাদর পেতে দিলেন। ঈসা তার উপরে বসলেন। অনেক লোক তাদের গায়ের চাদর রাস্তার উপরে বিছিয়ে দিল, আর অন্যেরা মাঠের গাছপালা থেকে পাতা সুদ্ধ ডাল কেটে এনে পথে ছড়িয়ে দিল। যারা ঈসার সামনে ও পিছনে যাচ্ছিল তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, “মারহাবা! মাবুদের নামে যিনি আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক। আমাদের পিতা দাউদের যে রাজ্য আসছে তার প্রশংসা হোক। বেহেশতেও মারহাবা!” ঈসা জেরুজালেমে গিয়ে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকলেন এবং চারদিকের সব কিছুই লক্ষ্য করলেন, কিন্তু বেলা গিয়েছিল বলে তাঁর বারোজন সাহাবীকে নিয়ে তিনি বেথানিয়াতে চলে গেলেন। পরের দিন যখন তাঁরা বেথানিয়া ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন ঈসার খিদে পেল। তখন ডুমুর ফল পাকবার সময় ছিল না, কিন্তু তবুও তিনি দূর থেকে পাতায় ঢাকা একটা ডুমুর গাছ দেখে তাতে কোন ফল আছে কিনা তা দেখতে গেলেন। কাছে গিয়ে তিনি তাতে পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। সেইজন্য তিনি সেই গাছটাকে বললেন, “আর কখনও কেউ যেন তোমার ফল না খায়।” সাহাবীরা তাঁর এই কথা শুনতে পেলেন। জেরুজালেমে পৌঁছে ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকলেন এবং সেখানে যারা বেচা-কেনা করছিল তাদের তাড়িয়ে দিলেন। তিনি টাকা বদল করে দেবার লোকদের টেবিল ও যারা কবুতর বিক্রি করছিল তাদের বসবার জায়গা উল্টে ফেললেন। বায়তুল-মোকাদ্দসের উঠানের মধ্য দিয়ে তিনি কোন বেচা-কেনার জিনিস নিয়ে যেতে দিলেন না। পরে শিক্ষা দেবার সময় তিনি সেই লোকদের বললেন, “কিতাবে কি এই কথা লেখা নেই যে, ‘আমার ঘরকে সমস্ত জাতির মুনাজাতের ঘর বলা হবে’? কিন্তু তোমরা এটাকে ডাকাতের আড্ডাখানা করে তুলেছ!” প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা এই কথা শুনে ঈসাকে হত্যা করবার উপায় খুঁজতে লাগলেন। তাঁরা তাঁকে ভয় করতেন, কারণ লোকেরা তাঁর শিক্ষায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা হলে পর সাহাবীদের নিয়ে তিনি শহরের বাইরে চলে গেলেন। সকালবেলায় সেই পথ দিয়ে আসবার সময় সাহাবীরা দেখলেন সেই ডুমুর গাছটা শিকড়সুদ্ধ শুকিয়ে গেছে। ঈসার কথা মনে করে পিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, দেখুন, যে ডুমুর গাছটাকে আপনি বদদোয়া দিয়েছিলেন সেটা শুকিয়ে গেছে।” তখন ঈসা বললেন, “আল্লাহ্‌র উপরে বিশ্বাস রাখ। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি কেউ অন্তরে কোন সন্দেহ না রেখে এই পাহাড়টাকে বলে, ‘উঠে সাগরে গিয়ে পড়,’ আর বিশ্বাস করে যে, সে যা বলল তা-ই হবে, তবে তার জন্য তা-ই করা হবে। সেইজন্য আমি তোমাদের বলছি, মুনাজাতের মধ্যে তোমরা যা কিছু চাও, বিশ্বাস কোরো তোমরা তা পেয়েছ, আর তোমাদের জন্য তা-ই হবে। পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা আবার জেরুজালেমে গেলেন। তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন এমন সময় প্রধান ইমামেরা, আলেমেরা ও বৃদ্ধ নেতারা তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছ? কে তোমাকে এই অধিকার দিয়েছে?” জবাবে ঈসা বললেন, “আমি আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনারা যদি আমাকে উত্তর দিতে পারেন তবে আমিও আপনাদের বলব আমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছি। বলুন দেখি, তরিকাবন্দী দেবার অধিকার ইয়াহিয়া আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পেয়েছিলেন, না মানুষের কাছ থেকে পেয়েছিলেন?” তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই আলোচনা করলেন, “আমরা যদি বলি, ‘আল্লাহ্‌র কাছ থেকে,’ তাহলে সে বলবে, ‘তবে আপনারা তাঁকে বিশ্বাস করেন নি কেন?’ আবার যদি বলি, ‘মানুষের কাছ থেকে,’ তবে?” তাঁরা লোকদের ভয় করতেন, কারণ সবাই ইয়াহিয়াকে সত্যিই একজন নবী বলে মনে করত। সেইজন্য তাঁরা বললেন, “আমরা জানি না।” তখন ঈসা বললেন, “তাহলে আমিও আপনাদের বলব না আমি কোন্‌ অধিকারে এই সব করছি।” এর পর ঈসা গল্পের মধ্য দিয়ে তাঁদের কাছে শিক্ষা দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, “একজন লোক একটা আংগুর ক্ষেত করে তার চারদিকে বেড়া দিলেন। পরে তিনি আংগুর-রস করবার জন্য একটা গর্ত খুঁড়লেন এবং একটা উঁচু পাহারা-ঘর তৈরী করলেন। পরে তিনি কয়েকজন চাষীর কাছে ক্ষেতটা ইজারা দিয়ে বিদেশে চলে গেলেন। ফল পাকবার সময়ে তিনি সেই ফলের ভাগ নিয়ে আসবার জন্য একজন গোলামকে সেই চাষীদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই চাষীরা সেই গোলামকে ধরে মারল এবং খালি হাতে পাঠিয়ে দিল। তখন মালিক আর একজন গোলামকে তাদের কাছে পাঠালেন। চাষীরা তার মাথায় আঘাত করল এবং তার সংগে খুব খারাপ ব্যবহার করল। তিনি তবুও আর একজনকে পাঠালেন। তাকে চাষীরা মেরে ফেলল। পরে তিনি আরও অনেকজনকে পাঠালেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজনকে তারা মারধর করল আর অন্যদের মেরেই ফেলল। “সেখানে পাঠাতে মালিকের মাত্র আর একজন বাকী ছিল। সে ছিল তাঁর প্রিয় পুত্র। তিনি সব শেষে পুত্রটিকে পাঠিয়ে দিলেন; ভাবলেন, ‘তারা অন্ততঃ আমার ছেলেকে সম্মান করবে।’ কিন্তু সেই চাষীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘এ-ই তো পরে সম্পত্তির মালিক হবে। চল, আমরা ওকে মেরে ফেলি, তাহলে আমরাই সম্পত্তির মালিক হব।’ তারা ছেলেটিকে ধরে মেরে ফেলল এবং আংগুর ক্ষেতের বাইরে ফেলে দিল। “তাহলে বলুন দেখি, আংগুর ক্ষেতের মালিক কি করবেন? তিনি এসে সেই চাষীদের মেরে ফেলবেন এবং আংগুর ক্ষেতটা অন্যদের হাতে দেবেন। আপনারা কি পাক-কিতাবে পড়েন নি, ‘রাজমিস্ত্রিরা যে পাথরটা বাতিল করে দিয়েছিল সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল; মাবুদই এটা করলেন, আর তা আমাদের চোখে খুব আশ্চর্য লাগে’?” তখন সেই ধর্ম-নেতারা ঈসাকে ধরতে চাইলেন, কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে, গল্পটা ঈসা তাঁদের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু তাঁরা লোকদের ভয়ে ঈসাকে ছেড়ে চলে গেলেন। পরে সেই ধর্ম-নেতারা ঈসাকে তাঁর কথার ফাঁদে ধরবার জন্য কয়েকজন ফরীশী ও হেরোদীয়কে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ঈসার কাছে এসে বললেন, “হুজুর, আমরা জানি আপনি একজন সৎ লোক। লোকে কি মনে করবে না করবে, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না, কারণ আপনি কারও মুখ চেয়ে কিছু করেন না। আপনি সত্যভাবে আল্লাহ্‌র পথের বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এখন আপনি বলুন, মূসার শরীয়ত অনুসারে রোম-সম্রাটকে কি খাজনা দেওয়া উচিত? আমরা তাঁকে খাজনা দেব কি দেব না?” ঈসা তাঁদের ভণ্ডামি বুঝতে পেরে বললেন, “আপনারা কেন আমাকে পরীক্ষা করছেন? আমাকে একটা দীনার এনে দেখান।” তাঁরা একটা দীনার আনলে পর ঈসা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “এর উপরে এই ছবি ও নাম কার?” তাঁরা বললেন, “রোম-সম্রাটের।” ঈসা তাঁদের বললেন, “যা সম্রাটের তা সম্রাটকে দিন, আর যা আল্লাহ্‌র তা আল্লাহ্‌কে দিন।” ঈসার এই কথায় তাঁরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কয়েকজন সদ্দূকী ঈসার কাছে আসলেন। সদ্দূকীদের মতে মৃতদের জীবিত হয়ে ওঠা বলে কিছু নেই। এইজন্য তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, মূসা আমাদের জন্য এই কথা লিখে গেছেন, ‘যদি কোন লোকের ভাই সন্তানহীন অবস্থায় স্ত্রী রেখে মারা যায় তবে সেই লোক তার ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করবে এবং ভাইয়ের হয়ে তার বংশ রক্ষা করবে।’ খুব ভাল, তারা সাত ভাই ছিল। প্রথমজন বিয়ে করে সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেল। তখন দ্বিতীয়জন ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করল, কিন্তু সেও সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেল। তৃতীয়জনের অবস্থাও তা-ই হল। এইভাবে সাতজনের কারও ছেলেমেয়ে হল না। শেষে সেই স্ত্রীলোকটিও মারা গেল। তাহলে মৃত লোকেরা যখন জীবিত হয়ে উঠবে তখন সে কার স্ত্রী হবে? কারণ সাতজনের প্রত্যেকেই তো তাকে বিয়ে করেছিল।” জবাবে ঈসা বললেন, “আপনারা ভুল করছেন, কারণ আপনারা কিতাবও জানেন না এবং আল্লাহ্‌র শক্তির বিষয়েও জানেন না। মৃত লোকেরা যখন জীবিত হয়ে উঠবে তখন তারা বিয়েও করবে না এবং তাদের বিয়ে দেওয়াও হবে না; তারা তখন ফেরেশতাদের মত হবে। মৃতদের জীবিত হয়ে উঠবার বিষয়ে নবী মূসার কিতাবে লেখা জ্বলন্ত ঝোপের কথা কি আপনারা পড়েন নি যে, আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, ‘আমি ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, ইসহাকের আল্লাহ্‌ ও ইয়াকুবের আল্লাহ্‌’? আল্লাহ্‌ তো মৃতদের আল্লাহ্‌ নন, তিনি জীবিতদেরই আল্লাহ্‌। আপনারা খুব ভুল করছেন।” একজন আলেম সেখানে এসে তাঁদের তর্কাতর্কি শুনলেন। ঈসা যে তাঁদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন তা লক্ষ্য করে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোন্‌টা?” জবাবে ঈসা বললেন, “সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, ‘বনি-ইসরাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে।’ তার পরের দরকারী হুকুম হল এই, ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।’ এই দু’টা হুকুমের চেয়ে বড় হুকুম আর কিছুই নেই।” তখন সেই আলেম বললেন, “হুজুর, খুব ভাল কথা। আপনি সত্যি কথাই বলেছেন যে, আল্লাহ্‌ এক এবং তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আর সমস্ত দিল, সমস্ত বুদ্ধি ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে মহব্বত করা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করা পশু ও অন্য সব কোরবানীর চেয়ে অনেক বেশী দরকারী।” ঈসা যখন দেখলেন সেই আলেমটি খুব বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছেন তখন তিনি তাঁকে বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্য থেকে আপনি বেশী দূরে নন।” সেই সময় থেকে ঈসাকে আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে কারও সাহস হল না। ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে শিক্ষা দেবার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, “আলেমেরা কেমন করে বলেন মসীহ্‌ দাউদের বংশধর? দাউদ তো পাক-রূহের পরিচালনায় বলেছেন, ‘মাবুদ আমার প্রভুকে বললেন, যতক্ষণ না আমি তোমার শত্রুদের তোমার পায়ের তলায় রাখি, ততক্ষণ তুমি আমার ডান দিকে বস।’ দাউদ নিজেই তো তাঁকে প্রভু বলেছেন, তবে কেমন করে মসীহ্‌ তাঁর বংশধর হতে পারেন?” অনেক লোক খুশী মনে ঈসার কথা শুনছিল। শিক্ষা দিতে দিতে ঈসা বললেন, “আলেমদের সম্বন্ধে সাবধান হও। তাঁরা লম্বা লম্বা জুব্বা পরে বেড়াতে এবং হাটে-বাজারে সম্মান পেতে চান। তাঁরা মজলিস-খানায় প্রধান প্রধান আসনে ও মেজবানীর সময়ে সম্মানের জায়গায় বসতে চান। এক দিকে তাঁরা লোককে দেখাবার জন্য লম্বা লম্বা মুনাজাত করেন, অন্য দিকে বিধবাদের সম্পত্তি দখল করেন। এই লোকদের অনেক বেশী আজাব হবে।” এর পর ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসের দান্তবাক্সের কাছে বসে লোকদের টাকা-পয়সা দান করা লক্ষ্য করছিলেন। অনেক ধনী লোক অনেক টাকা-পয়সা দিল। পরে একজন গরীব বিধবা এসে মাত্র দু’টা পয়সা রাখল। তখন ঈসা তাঁর সাহাবীদের ডেকে বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এই গরীব বিধবা অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশী এই দান্তবাক্সে রাখল। সেই লোকেরা তাদের প্রচুর ধন থেকে দান করেছে, কিন্তু এই স্ত্রীলোকটির অভাব থাকলেও বেঁচে থাকবার জন্য তার যা ছিল সমস্তই দিয়ে দিল।” ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর একজন সাহাবী তাঁকে বললেন, “হুজুর, দেখুন, কত বড় বড় পাথর, আর কি সুন্দর সুন্দর দালান!” ঈসা তাঁকে বললেন, “তুমি তো এই সব বড় বড় দালান দেখছ, কিন্তু এর একটা পাথরও আর একটা পাথরের উপরে থাকবে না; সমস্তই ভেংগে ফেলা হবে।” পরে ঈসা যখন বায়তুল-মোকাদ্দসের উল্টাদিকে জৈতুন পাহাড়ের উপরে বসে ছিলেন তখন পিতর, ইয়াকুব, ইউহোন্না ও আন্দ্রিয় তাঁকে গোপনে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আমাদের বলুন, কখন এই সব হবে? কোন্‌ চিহ্ন দেখে আমরা বুঝতে পারব এই সব পূর্ণ হবার সময়ে এসেছে?” ঈসা তাঁদের বললেন, “দেখো, কেউ যেন তোমাদের না ঠকায়। অনেকেই আমার নাম নিয়ে এসে বলবে, ‘আমিই সেই’ এবং অনেককে ঠকাবে। যখন তোমরা যুদ্ধের আওয়াজ ও যুদ্ধের খবরাখবর শুনবে তখন ভয় পেয়ো না। এই সব হবেই, কিন্তু তখনও শেষ নয়। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে, এক রাজ্য অন্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অনেক জায়গায় ভূমিকমপ ও দুর্ভিক্ষ হবে। কিন্তু এই সব কেবল যন্ত্রণার শুরু। “তোমরা সতর্ক থেকো। লোকে তোমাদের বিচার-সভার লোকদের হাতে ধরিয়ে দেবে এবং মজলিস-খানায় বেত মারবে। আমার জন্য দেশের শাসনকর্তা ও বাদশাহ্‌দের সামনে তোমাদের দাঁড়াতে হবে। তাঁদের সামনে আমার বিষয়ে তোমাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। সমস্ত জাতির কাছে প্রথমে আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করতে হবে। যখন তোমাদের ধরে বিচারের জন্য নিয়ে যাবে তখন কি বলতে হবে তা আগে থেকে চিন্তা কোরো না। সেই সময়ে যে কথা তোমাদের বলে দেওয়া হবে তোমরা তা-ই বলবে, কারণ তোমরাই যে বলবে তা নয় বরং পাক-রূহ্‌ই কথা বলবেন। “ভাই ভাইকে, পিতা ছেলেকে মেরে ফেলবার জন্য ধরিয়ে দেবে। ছেলেমেয়েরা মা-বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের খুন করাবে। আমার জন্য সবাই তোমাদের ঘৃণা করবে, কিন্তু যে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকবে সে উদ্ধার পাবে। “সর্বনাশা ঘৃণার জিনিস যেখানে থাকা উচিত নয়, তোমরা যখন তা সেখানে থাকতে দেখবে- যে পড়ে সে বুঝুক- তখন যারা এহুদিয়াতে থাকবে তারা পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যাক। যে ছাদের উপরে থাকবে সে কিছু নেবার জন্য নীচে নেমে ঘরে না ঢুকুক। যে ক্ষেতের মধ্যে থাকবে সে গায়ের চাদর নেওয়ার জন্য না ফিরুক। তখন যারা গর্ভবতী আর যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ায় তাদের অবস্থা কি ভীষণই না হবে! মুনাজাত কর যেন এই সমস্ত শীতকালে না হয়, কারণ সেই সময় এমন কষ্ট হবে যা দুনিয়ার সৃষ্টি থেকে এই পর্যন্ত হয় নি এবং তার পরেও আর হবে না। মাবুদ যদি সেই দিনগুলো কমিয়ে না দিতেন তবে কেউই বাঁচত না। কিন্তু তাঁর বাছাই করা বান্দাদের জন্য সেই দিনগুলো আল্লাহ্‌ কমিয়ে দিয়েছেন। সেই সময় যদি কেউ তোমাদের বলে, ‘দেখ, মসীহ্‌ এখানে,’ বা ‘দেখ, মসীহ্‌ ওখানে,’ তোমরা বিশ্বাস কোরো না; কারণ ভণ্ড মসীহেরা ও ভণ্ড নবীরা আসবে এবং চিহ্ন ও কুদরতি দেখাবে, যেন আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদের সম্ভব হলে ঠকাতে পারে। তোমরা কিন্তু সতর্ক থেকো। আমি তোমাদের আগেই সব কিছু বলে রাখলাম। “সেই সময়ের কষ্টের ঠিক পরেই সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে, চাঁদ আর আলো দেবে না, তারাগুলো আসমান থেকে খসে পড়ে যাবে এবং চাঁদ-সূর্য-তারা আর স্থির থাকবে না। সেই সময়ে লোকেরা ইব্‌ন্তেআদমকে মহাশক্তি ও মহিমার সংগে মেঘের মধ্যে দুনিয়াতে আসতে দেখবে। তিনি তাঁর ফেরেশতাদের পাঠিয়ে দুনিয়ার এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত চারদিক থেকে আল্লাহ্‌র সব বাছাই করা বান্দা জমায়েত করবেন। “ডুমুর গাছ দেখে শিক্ষা লাভ কর। যখন তার ডালপালা নরম হয়ে তাতে পাতা বের হয় তখন তোমরা জানতে পার যে, গরমকাল এসেছে। সেইভাবে যখন তোমরা দেখবে এই সব ঘটছে তখন বুঝতে পারবে যে, ইব্‌ন্তেআদম কাছে এসে গেছেন, এমন কি, দরজায় উপস্থিত। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যখন এই সব হবে তখনও এই কালের কিছু লোক বেঁচে থাকবে। আসমান ও জমীন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকবে। “সেই দিন ও সেই সময়ের কথা কেউই জানে না- বেহেশতের ফেরেশতারাও না, পুত্রও না, কেবল পিতাই জানেন। তোমরা সাবধান হও, সতর্ক থাক ও মুনাজাত কর, কারণ সেই দিন কখন আসবে তা তোমরা জান না। সেই দিনটা আসবে এমন একজন লোকের মত করে যিনি বিদেশে যাচ্ছেন। বাড়ী ছেড়ে যাবার আগে তিনি গোলামদের হাতে সব দায়িত্ব দিলেন। তিনি প্রত্যেক গোলামকে তার কাজ দিলেন এবং দারোয়ানকে জেগে থাকতে বললেন। “তোমরাও এইভাবে জেগে থাক, কারণ বাড়ীর কর্তা সন্ধ্যায়, কি দুপুর রাতে, কি ভোর রাতে, কি সকালে আসবেন তা তোমরা জান না। হঠাৎ তিনি এসে যেন না দেখেন তোমরা ঘুমিয়ে রয়েছ। তোমাদের যা বলছি তা সবাইকে বলি, জেগে থাক।” উদ্ধার-ঈদ ও খামিহীন রুটির ঈদের তখন মাত্র আর দু’দিন বাকী। প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা গোপনে ঈসাকে ধরে হত্যা করবার উপায় খুঁজছিলেন। তাঁরা বললেন, “ঈদের সময়ে নয়; লোকদের মধ্যে গোলমাল হতে পারে।” ঈসা তখন বেথানিয়াতে চর্মরোগী শিমোনের বাড়ীতে ছিলেন। তিনি যখন খাচ্ছিলেন তখন একজন স্ত্রীলোক একটা সাদা পাথরের পাত্রে করে খুব দামী ও খাঁটি আতর আনল। পাত্রটা ভেংগে সে ঈসার মাথায় সেই আতর ঢেলে দিল। সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিরক্ত হয়ে একে অন্যকে বলতে লাগলেন, “এইভাবে আতরটা নষ্ট করা হল কেন? এটা বিক্রি করলে তো তিনশো দীনারেরও বেশী হত এবং তা গরীবদের দেওয়া যেত।” এই বলে তাঁরা স্ত্রীলোকটিকে বকাবকি করতে লাগলেন। তখন ঈসা বললেন, “থাম, কেন তোমরা ওকে দুঃখ দিচ্ছ? ও তো আমার জন্য ভাল কাজই করেছে। গরীবেরা সব সময় তোমাদের মধ্যে আছে, আর যখন ইচ্ছা তখনই তোমরা তাদের সাহায্য করতে পার, কিন্তু আমাকে তোমরা সব সময় পাবে না। ও যা পেরেছে তা করেছে। আমাকে কবরের জন্য প্রস্তুত করতে ও আগেই আমার গায়ের উপর আতর ঢেলে দিয়েছে। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, দুনিয়ার যে কোন জায়গায় আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করা হবে, সেখানে এই স্ত্রীলোকটির কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য ওর এই কাজের কথাও বলা হবে।” এর পর এহুদা ইষ্কারিয়োৎ নামে সেই বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন ঈসাকে ধরিয়ে দেবার জন্য প্রধান ইমামদের কাছে গেল। ইমামেরা এহুদার কথা শুনে খুশী হলেন এবং তাকে টাকা দেবেন বলে কথা দিলেন। তখন এহুদা ঈসাকে ধরিয়ে দেবার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল। খামিহীন রুটির ঈদের প্রথম দিনে উদ্ধার-ঈদের মেজবানীর জন্য ভেড়ার বাচ্চা জবাই করা হত। তাই সাহাবীরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার জন্য উদ্ধার-ঈদের মেজবানী কোথায় গিয়ে আমাদের প্রস্তুত করতে বলেন?” তখন ঈসা তাঁর দু’জন সাহাবীকে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা শহরে যাও। সেখানে এমন একজন পুরুষ লোকের দেখা পাবে, যে একটা কলসীতে করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা তার পিছনে পিছনে যেয়ো। সে যে বাড়ীতে ঢুকবে সেই বাড়ীর কর্তাকে বোলো, ‘ওস্তাদ বলছেন, সাহাবীদের সংগে যেখানে আমি উদ্ধার-ঈদের মেজবানী খেতে পারি আমার সেই মেহমান্তখানাটা কোথায়?’ এতে সে তোমাদের উপরতলার একটা সাজানো বড় ঘর দেখিয়ে দেবে। সব কিছু সেখানেই প্রস্তুত কোরো।” তখন সাহাবীরা গিয়ে শহরে ঢুকলেন, আর ঈসা যেমন বলেছিলেন সব কিছু তেমনই দেখতে পেলেন এবং উদ্ধার-ঈদের মেজবানী প্রস্তুত করলেন। সন্ধ্যা হলে পর ঈসা সেই বারোজনকে নিয়ে সেখানে গেলেন। তাঁরা যখন বসে খাচ্ছিলেন তখন ঈসা বললেন, “আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তোমাদের মধ্যে একজন আমাকে ধরিয়ে দেবে, আর সে আমার সংগে খাচ্ছে।” সাহাবীরা দুঃখিত হলেন এবং একজনের পরে আর একজন বলতে লাগলেন, “সে কি আমি, হুজুর?” ঈসা তাঁদের বললেন, “সে এই বারোজনের মধ্যে একজন, যে আমার সংগে পাত্রের মধ্যে রুটি ডুবাচ্ছে। ইব্‌ন্তেআদমের মৃত্যুর বিষয়ে পাক-কিতাবে যা লেখা আছে তিনি সেভাবেই মারা যাবেন বটে, কিন্তু হায় সেই লোক, যে তাঁকে ধরিয়ে দেয়! সেই লোকের জন্ম না হলেই বরং তার পক্ষে ভাল হত।” খাওয়া-দাওয়া চলছে, এমন সময় ঈসা রুটি নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং তা টুকরা টুকরা করে সাহাবীদের হাতে দিয়ে বললেন, “এই নাও, এটা আমার শরীর।” তারপর তিনি পেয়ালা নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং সাহাবীদের দিলেন। তাঁরা সবাই সেই পেয়ালা থেকে খেলেন। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “এ আমার রক্ত যা অনেকের জন্য দেওয়া হবে। মানুষের জন্য আল্লাহ্‌র নতুন ব্যবস্থা আমার এই রক্তের দ্বারাই বহাল করা হবে। তোমাদের সত্যি বলছি, যতদিন আমি আল্লাহ্‌র রাজ্যে আংগুর ফলের রস আবার নতুন ভাবে না খাই ততদিন পর্যন্ত আর আমি তা খাব না।” এর পরে তাঁরা একটা কাওয়ালী গেয়ে বের হয়ে জৈতুন পাহাড়ে গেলেন। ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমাকে নিয়ে তোমাদের সকলের মনে বাধা আসবে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘আমি পালককে মেরে ফেলব, তাতে মেষগুলো ছড়িয়ে পড়বে।’ তবে আমাকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হলে পর আমি তোমাদের আগেই গালীলে যাব।” তখন পিতর বললেন, “সবার মনে বাধা আসলেও আমার মনে বাধা আসবে না।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে সত্যিই বলছি, আজ ভোর রাতে মোরগ দু’বার ডাকবার আগেই তুমি তিন বার বলবে যে, তুমি আমাকে চেনো না।” কিন্তু পিতর আরও জোর দিয়ে বললেন, “যদি আমাকে আপনার সংগে মরতেও হয় তবুও আমি কখনও বলব না যে, আমি আপনাকে চিনি না।” সাহাবীরা সবাই সেই একই কথা বললেন। এর পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা গেৎশিমানী নামে একটা জায়গায় গেলেন। সেখানে ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি যতক্ষণ মুনাজাত করি ততক্ষণ তোমরা এখানে বসে থাক।” এই বলে তিনি পিতর, ইয়াকুব ও ইউহোন্নাকে নিজের সংগে নিলেন এবং মনে খুব ব্যথা ও কষ্ট পেতে লাগলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “দুঃখে যেন আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমরা এখানে জেগে থাক।” তার পরে তিনি কিছু দূরে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে মুনাজাত করলেন যেন সম্ভব হলে এই দুঃখের সময়টা তাঁর কাছ থেকে দূর হয়। তিনি বললেন, “আব্বা, পিতা, তোমার কাছে তো সবই সম্ভব। এই দুঃখের পেয়ালা আমার কাছ থেকে তুমি নিয়ে যাও। তবুও আমার ইচ্ছামত না হোক, কিন্তু তোমার ইচ্ছামত হোক।” এর পরে তিনি সাহাবীদের কাছে ফিরে এসে দেখলেন তঁাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি পিতরকে বললেন, “শিমোন, তুমি ঘুমা"ছ? এক ঘণ্টাও কি জেগে থাকতে পার নি? জেগে থাক ও মুনাজাত কর যেন পরীক্ষায় না পড়। অন্তরের ইচ্ছা আছে বটে, কিন্তু শরীর দুর্বল।” পরে ঈসা আবার গিয়ে সেই একই মুনাজাত করলেন। ফিরে এসে তিনি দেখলেন আবার তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন, কারণ তাঁদের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে গিয়েছিল। সাহাবীরা ঈসাকে কি জবাব দেবেন বুঝলেন না। তৃতীয় বার ফিরে এসে তিনি তাঁদের বললেন, “এখনও তোমরা ঘুমা"ছ আর বিশ্রাম করছ? যথেষ্ট হয়েছে। সময় এসে পড়েছে। দেখ, ইব্‌ন্তেআদমকে এখন গুনাহ্‌গারদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওঠো, চল আমরা যাই। যে আমাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে সে এসে পড়েছে।” ঈসা তখনও কথা বলছেন, এমন সময় এহুদা সেখানে আসল। সে সেই বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন ছিল। তার সংগে অনেক লোক ছোরা ও লাঠি নিয়ে আসল। প্রধান ইমামেরা, আলেমেরা ও বৃদ্ধ নেতারা এই লোকদের পাঠিয়েছিলেন। ঈসাকে যে ধরিয়ে দিয়েছিল সে ঐ লোকদের সংগে একটা চিহ্ন ঠিক করেছিল। সে বলেছিল, “যাকে আমি চুমু দেব, সে-ই সেই লোক। তোমরা তাকেই ধোরো এবং পাহারা দিয়ে নিয়ে যেয়ো।” তাই এহুদা সোজা ঈসার কাছে গিয়ে বলল, “হুজুর!” এই কথা বলেই সে তাঁকে চুমু দিল। তখন সেই লোকেরা ঈসাকে ধরল। যাঁরা ঈসার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর ছোরা বের করলেন এবং মহা-ইমামের গোলামকে আঘাত করে তার একটা কান কেটে ফেললেন। ঈসা সেই লোকদের বললেন, “আমি কি ডাকাত যে, আপনারা ছোরা ও লাঠি নিয়ে আমাকে ধরতে এসেছেন? আমি তো প্রত্যেক দিনই আপনাদের মধ্যে থেকে বায়তুল-মোকাদ্দসে শিক্ষা দিতাম, কিন্তু তখন তো আপনারা আমাকে ধরেন নি। অবশ্য কিতাবের কথা পূর্ণ হতে হবে।” সেই সময় সাহাবীরা সবাই তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। একজন যুবক কেবল একটা চাদর পরে ঈসার পিছনে পিছনে যাচ্ছিল। লোকেরা যখন তাকে ধরল তখন সে চাদরখানা ছেড়ে দিয়ে উলংগ অবস্থায় পালিয়ে গেল। সেই লোকেরা ঈসাকে নিয়ে মহা-ইমামের কাছে গেল। সেখানে প্রধান ইমামেরা, বৃদ্ধ নেতারা ও আলেমেরা একসংগে জমায়েত হলেন। পিতর দূরে দূরে থেকে ঈসার পিছনে যেতে যেতে মহা-ইমামের উঠানে গিয়ে ঢুকলেন। সেখানে রক্ষীদের সংগে বসে তিনি আগুন পোহাতে লাগলেন। প্রধান ইমামেরা এবং মহাসভার সমস্ত লোকেরা ঈসাকে হত্যা করবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যের খোঁজ করছিলেন, কিন্তু কোন সাক্ষ্যই তাঁরা পেলেন না। ঈসার বিরুদ্ধে অনেকেই মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল কিন্তু তাদের সাক্ষ্য মিলল না। তখন কয়েকজন উঠে তাঁর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা সাক্ষ্য দিল, “আমরা ওকে বলতে শুনেছি, ‘মানুষের তৈরী এই এবাদত-খানা আমি ভেংগে ফেলব এবং তিন দিনের মধ্যে এমন একটা এবাদত-খানা তৈরী করব যা মানুষের তৈরী নয়।’ ” কিন্তু তবুও তাদের সাক্ষ্য মিলল না। তখন মহা-ইমাম সকলের সামনে দাঁড়িয়ে ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কোন জবাবই দেবে না? তোমার বিরুদ্ধে এই লোকেরা এই সব কি সাক্ষ্য দিচ্ছে?” ঈসা কিন্তু জবাব না দিয়ে চুপ করেই রইলেন। মহা-ইমাম আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি গৌরবময় আল্লাহ্‌র পুত্র মসীহ্‌?” ঈসা বললেন, “আমিই সেই। আপনারা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র ডান দিকে ইব্‌ন্তেআদমকে বসে থাকতে দেখবেন এবং আসমানের মেঘের সংগে আসতে দেখবেন।” এতে মহা-ইমাম তাঁর কাপড় ছিঁড়ে বললেন, “আর সাক্ষীর আমাদের কি দরকার? আপনারা তো শুনলেনই যে, ও কুফরী করল। আপনারা কি মনে করেন?” তাঁরা সবাই ঈসাকে মৃত্যুর শাস্তি পাবার উপযুক্ত বলে স্থির করলেন। তখন কয়েকজন তাঁর গায়ে থুথু দিলেন এবং তাঁর মুখ ঢেকে তাঁকে ঘুষি মেরে বললেন, “তুই না নবী? কিছু বল্‌ দেখি!” তারপর রক্ষীরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে চড় মারতে লাগল। পিতর যখন নীচে উঠানে ছিলেন তখন মহা-ইমামের একজন চাকরাণী সেখানে আসল। সে পিতরকে আগুন পোহাতে দেখল এবং ভাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখে বলল, “আপনিও তো ঐ নাসরতের ঈসার সংগে ছিলেন।” পিতর কিন্তু অস্বীকার করে বললেন, “তুমি কি বলছ তা আমি জানিও না, বুঝিও না।” এই বলে পিতর বাইরের দরজার কাছে গেলেন, আর তখনই একটা মোরগ ডেকে উঠল। চাকরাণীটা পিতরকে সেখানে দেখে যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের আবার বলল, “এই লোকটি ওদের একজন।” পিতর আবার অস্বীকার করলেন। যারা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তারাও কিছুক্ষণ পর পিতরকে বলল, “নিশ্চয়ই তুমি ওদের একজন, কারণ তুমি তো গালীলের লোক।” পিতর তখন নিজেকে বদদোয়া দিলেন এবং কসম খেয়ে বললেন, “তোমরা যার সম্বন্ধে বলছ তাকে আমি চিনি না।” আর তখনই দ্বিতীয় বার মোরগ ডেকে উঠল। ঈসা যে বলেছিলেন, “মোরগ দু’বার ডাকবার আগেই তুমি তিন বার বলবে যে, তুমি আমাকে চেনো না,” সেই কথা তখন পিতরের মনে পড়ল। তাতে তিনি কান্নায় ভেংগে পড়লেন। প্রধান ইমামেরা খুব ভোরে বৃদ্ধ নেতাদের, আলেমদের ও মহাসভার সমস্ত লোকদের সংগে একটা পরামর্শ করলেন। তারপর তাঁরা ঈসাকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে তাঁকে রোমীয় প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের হাতে দিলেন। তখন পীলাত ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ইহুদীদের বাদশাহ্‌?” ঈসা জবাব দিলেন, “আপনি ঠিক কথাই বলছেন।” প্রধান ইমামেরা তাঁর নামে অনেক দোষ দিলেন। এতে পীলাত আবার ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি জবাব দেবে না? দেখ, তারা তোমাকে কত দোষ দিচ্ছে।” ঈসা কিন্তু আর কোন জবাবই দিলেন না। এতে পীলাত আশ্চর্য হলেন। উদ্ধার-ঈদের সময়ে লোকেরা যে কয়েদীকে চাইত পীলাত তাকে ছেড়ে দিতেন। সেই সময় বারাব্বা নামে একজন লোক জেলখানায় বন্দী ছিল। বিদ্রোহের সময় সে বিদ্রোহীদের সংগে থেকে খুন করেছিল। লোকেরা পীলাতের কাছে এসে বলল, “আপনি সব সময় যা করে থাকেন এখন তা-ই করুন।” পীলাত তাদের বললেন, “তোমরা কি চাও যে, আমি ইহুদীদের বাদশাহ্‌কে ছেড়ে দিই?” প্রধান ইমামেরা যে হিংসা করেই ঈসাকে তাঁর হাতে দিয়েছেন পীলাত তা জানতেন। কিন্তু প্রধান ইমামেরা লোকদের উস্‌কিয়েছিলেন যেন তারা ঈসার বদলে বারাব্বাকে চেয়ে নেয়। পীলাত আবার লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে তোমরা যাকে ইহুদীদের বাদশাহ্‌ বল তাকে নিয়ে আমি কি করব?” লোকেরা চেঁচিয়ে বলল, “ওকে ক্রুশে দিন।” পীলাত বললেন, “কেন, সে কি দোষ করেছে?” কিন্তু লোকেরা আরও জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “ওকে ক্রুশে দিন।” তখন পীলাত লোকদের সন্তুষ্ট করবার জন্য বারাব্বাকে তাদের কাছে ছেড়ে দিলেন, আর ঈসাকে ভীষণভাবে চাবুক মারবার হুকুম দিয়ে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য দিলেন। তারপর সৈন্যেরা ঈসাকে নিয়ে প্রধান শাসনকর্তার বাড়ীর ভিতরে গেল। সেখানে তারা অন্য সব সৈন্যদের একত্র করল। তারা ঈসাকে বেগুনে কাপড় পরাল, আর কাঁটা-লতা দিয়ে একটা তাজ গেঁথে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিল। তার পরে তারা ঈসাকে বলতে লাগল, “ইহুদী-রাজ, মারহাবা!” তারা একটা লাঠি দিয়ে ঈসার মাথায় বারবার মারতে লাগল এবং তাঁর গায়ে থুথু দিল, আর হাঁটু পেতে তাঁকে সম্মান দেখাবার ভান করল। এইভাবে তাঁকে ঠাট্টা-তামাশা করবার পর তারা সেই বেগুনে কাপড় খুলে নিয়ে তাঁকে তাঁর নিজের কাপড় পরিয়ে দিল এবং ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য নিয়ে চলল। সেই সময় শিমোন নামে কূরীণী শহরের একজন লোক গ্রামের দিক থেকে এসে সেই পথে যাচ্ছিলেন। ইনি ছিলেন আলেকজাণ্ডার ও রূফের পিতা। সৈন্যেরা তাঁকে ঈসার ক্রুশটা বয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করল। তারা ঈসাকে গল্‌গথা, অর্থাৎ মাথার খুলির স্থান নামে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। পরে তারা ঈসাকে গন্ধরস মিশানো সিরকা খেতে দিল, কিন্তু তিনি তা খেলেন না। এর পরে তারা ঈসাকে ক্রুশে দিল। সৈন্যেরা তাঁর কাপড়-চোপড় ভাগ করবার জন্য গুলিবাঁট করে দেখতে চাইল কার ভাগ্যে কি পড়ে। সকাল ন’টার সময় তারা তাঁকে ক্রুশে দিয়েছিল। ঈসার বিরুদ্ধে দোষ-নামাতে লেখা ছিল, “ইহুদীদের বাদশাহ্‌।” তারা দু’জন ডাকাতকেও ঈসার সংগে ক্রুশে দিল, একজনকে ডান দিকে ও অন্যজনকে বাঁ দিকে। তাতে পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হল: “তাঁকে অন্যায়কারীদের সংগে গোণা হল।” যারা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা মাথা নেড়ে ঈসাকে ঠাট্টা করে বলল, “ওহে, তুমি না বায়তুল-মোকাদ্দস ভেংগে আবার তিন দিনের মধ্যে তা তৈরী করতে পার! এখন ক্রুশ থেকে নেমে এসে নিজেকে রক্ষা কর!” প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরাও ঈসাকে ঠাট্টা করবার উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “ও অন্যদের রক্ষা করত, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ঐ যে মসীহ্‌, বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌! ক্রুশ থেকে ও নেমে আসুক যেন আমরা দেখে ঈমান আনতে পারি।” ঈসার সংগে যাদের ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তারাও তাঁকে টিট্‌কারি দিল। পরে দুুপুর বারোটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত সারা দেশ অন্ধকার হয়ে রইল। বেলা তিনটার সময় ঈসা জোরে চিৎকার করে বললেন, “এলোই, এলোই, লামা শবক্তানী,” অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ আমার, আল্লাহ্‌ আমার, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ?” যারা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের কয়েকজন এই কথা শুনে বলল, “শোন, শোন, ও নবী ইলিয়াসকে ডাকছে।” তখন একজন লোক দৌড়ে গিয়ে একটা সপঞ্জ সিরকায় ভিজাল এবং একটা লাঠির মাথায় লাগিয়ে তা ঈসাকে খেতে দিল। সে বলল, “থাক্‌, দেখি ইলিয়াস ওকে নামিয়ে নিতে আসেন কি না।” এর পরে ঈসা জোরে চিৎকার করে প্রাণত্যাগ করলেন। তখন বায়তুল-মোকাদ্দসের পর্দাটা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত চিরে দু’ভাগ হয়ে গেল। যে সেনাপতি ঈসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে ঈসাকে এইভাবে মারা যেতে দেখে বলল, “সত্যিই ইনি ইব্‌নুল্লাহ্‌ ছিলেন।” কয়েকজন স্ত্রীলোক দূরে দাঁড়িয়ে এই সব দেখছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মগ্‌দলীনী মরিয়ম, দুই ইয়াকুবের মধ্যে ছোট ইয়াকুব ও ইউসুফের মা মরিয়ম আর শালোমী। ঈসা যখন গালীলে ছিলেন তখন এই স্ত্রীলোকেরা তাঁর সংগে সব জায়গায় যেতেন এবং তাঁর সেবা করতেন। আরও অনেক স্ত্রীলোক, যাঁরা তাঁর সংগে সংগে জেরুজালেমে এসেছিলেন, তাঁরাও সেখানে ছিলেন। সেই দিনটা ছিল আয়োজনের দিন, অর্থাৎ বিশ্রামবারের আগের দিন। যখন সন্ধ্যা হয়ে আসল তখন অরিমাথিয়া গ্রামের ইউসুফ সাহস করে পীলাতের কাছে গিয়ে ঈসার লাশটি চাইলেন। তিনি মহাসভার একজন নাম-করা সদস্য ছিলেন এবং তিনি নিজে আল্লাহ্‌র রাজ্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পীলাত আশ্চর্য হলেন যে, ঈসা এত তাড়াতাড়ি মারা গেছেন। সত্যি সত্যি ঈসার মৃত্যু হয়েছে কি না, তা সেনাপতিকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। যখন সেনাপতির কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন যে, সত্যিই তাঁর মৃত্যু হয়েছে তখন লাশটি ইউসুফকে দিলেন। ইউসুফ গিয়ে কাপড় কিনে আনলেন এবং ঈসার লাশটি নামিয়ে সেই কাপড়ে জড়ালেন, আর পাহাড় কেটে তৈরী করা একটা কবরে সেই লাশটি রাখলেন। তারপর তিনি কবরের মুখে একটা পাথর গড়িয়ে দিলেন। ঈসার লাশটি কোথায় রাখা হল তা মগ্‌দলীনী মরিয়ম ও ইউসুফের মা মরিয়ম দেখলেন। বিশ্রামবার পার হয়ে গেলে পর মগ্‌দলীনী মরিয়ম, ইয়াকুবের মা মরিয়ম এবং শালোমী ঈসার লাশে মাখাবার জন্য খোশবু মলম কিনে আনলেন। সপ্তার প্রথম দিনের খুব সকালে, সূর্য উঠবার সংগে সংগেই তাঁরা কবরের কাছে গেলেন। সেই সময় তাঁরা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, “কবরের মুখ থেকে কে ঐ পাথরটা সরিয়ে দেবে?” কিন্তু তাঁরা চেয়ে দেখলেন যে, পাথরখানা সরানো হয়েছে। সেই পাথরটা খুব বড় ছিল। কবরের গুহায় ঢুকে তাঁরা দেখলেন, সাদা কাপড়-পরা একজন যুবক ডান দিকে বসে আছেন। এতে তাঁরা খুব অবাক হলেন। সেই যুবকটি বললেন, “অবাক হয়ো না। নাসরত গ্রামের ঈসা, যাঁকে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল, তাঁকেই তোমরা খুঁজছো তো? তিনি এখানে নেই, তিনি জীবিত হয়ে উঠেছেন। যেখানে তারা তাঁকে রেখেছিল সেই জায়গা দেখ। তারপর তোমরা গিয়ে তাঁর সাহাবীদের ও পিতরকে এই কথা বল যে, তিনি তাদের আগে গালীলে যাচ্ছেন। তিনি যেমন বলেছিলেন তেমনই তারা তাঁকে সেখানে দেখতে পাবে।” সেই স্ত্রীলোকেরা কিছু বুঝতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে কবরের গুহা থেকে বের হয়ে আসলেন এবং সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। তাঁরা এত ভয় পেয়েছিলেন যে, কাউকে কিছু বললেন না। সপ্তার প্রথম দিনের ভোর বেলায় ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলেন। পরে তিনি মগ্‌দলীনী মরিয়মকে প্রথমে দেখা দিলেন। এই মরিয়মের ভিতর থেকে ঈসা সাতটা ভূত ছাড়িয়েছিলেন। তাঁকে দেখবার পর মরিয়ম গিয়ে যাঁরা ঈসার সংগে থাকতেন তাঁদের কাছে খবর দিলেন। সেই সময় তাঁরা মনের দুঃখে কাঁদছিলেন। ঈসা জীবিত হয়েছেন ও মরিয়ম তাঁকে দেখেছেন, এই কথা শুনে তাঁরা বিশ্বাস করলেন না। এর পরে তাঁর দু’জন সাহাবী যখন হেঁটে গ্রামের দিক যাচ্ছিলেন তখন ঈসা অন্য রকম চেহারায় তাঁদের দেখা দিলেন। তাঁরা ফিরে গিয়ে বাকী সবাইকে সেই খবর দিলেন, কিন্তু তাঁদের কথাও অন্য সাহাবীরা বিশ্বাস করলেন না। এর পরে ঈসা তাঁর এগারোজন সাহাবীকে দেখা দিলেন। তখন তাঁরা খাচ্ছিলেন। বিশ্বাসের অভাব ও অন্তরের কঠিনতার জন্য তিনি তাঁদের বকলেন, কারণ তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার পরে যাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন তাঁদের কথা তাঁরা বিশ্বাস করেন নি। ঈসা সেই সাহাবীদের বললেন, “তোমরা দুনিয়ার সব জায়গায় যাও এবং সব লোকদের কাছে আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ কর। যে কেউ ঈমান আনে এবং তরিকাবন্দী নেয় সে-ই নাজাত পাবে; কিন্তু যে ঈমান আনে না আল্লাহ্‌ তাঁকে দোষী বলে স্থির করে শাস্তি দেবেন। যারা ঈমান আনে তাদের মধ্যে এই চিহ্নগুলো দেখা যাবে- আমার নামে তারা ভূত ছাড়াবে, তারা নতুন নতুন ভাষায় কথা বলবে, তারা হাতে করে সাপ তুলে ধরবে, যদি তারা ভীষণ বিষাক্ত কিছু খায় তবে তাদের কোন ক্ষতি হবে না, আর তারা রোগীদের গায়ে হাত দিলে রোগীরা ভাল হবে।” সাহাবীদের কাছে এই সব কথা বলবার পরে হযরত ঈসাকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হল। সেখানে তিনি আল্লাহ্‌র ডান দিকে বসলেন। পরে সাহাবীরা গিয়ে সব জায়গায় তবলিগ করতে লাগলেন। হযরত ঈসা তাঁদের মধ্য দিয়ে তাঁদের সংগে কাজ করতে থাকলেন এবং তাঁদের অলৌকিক কাজ করবার শক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, তাঁরা যা তবলিগ করছেন তা সত্যি। ॥ভব সেই সব বিষয় সম্বন্ধে প্রথম থেকে ভালভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে আপনার জন্য তা একটা একটা করে লেখা আমিও ভাল মনে করলাম। এর ফলে আপনি যা জেনেছেন তা সত্যি কি না জানতে পারবেন। হেরোদ যখন এহুদিয়া প্রদেশের বাদশাহ্‌ ছিলেন সেই সময়ে ইমাম অবিয়ের দলে জাকারিয়া নামে ইহুদীদের একজন ইমাম ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল এলিজাবেত। তিনিও ছিলেন ইমাম হারুনের একজন বংশধর। তাঁরা দু’জনেই আল্লাহ্‌র চোখে ধার্মিক ছিলেন। মাবুদের সমস্ত হুকুম ও নিয়ম তাঁরা নিখুঁতভাবে পালন করতেন। তাঁদের কোন ছেলেমেয়ে হয় নি কারণ এলিজাবেত বন্ধ্যা ছিলেন। এছাড়া তাঁদের বয়সও খুব বেশী হয়ে গিয়েছিল। একবার নিজের দলের পালার সময় জাকারিয়া ইমাম হিসাবে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করছিলেন। ইমামের কাজের চলতি নিয়ম অনুসারে গুলিবাঁট দ্বারা তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল, যেন তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের পবিত্র স্থানে গিয়ে ধূপ জ্বালাতে পারেন। ধূপ জ্বালাবার সময় বাইরে অনেক লোক মুনাজাত করছিল। এমন সময় ধূপগাহের ডানদিকে মাবুদের একজন ফেরেশতা হঠাৎ এসে জাকারিয়াকে দেখা দিলেন। ফেরেশতাকে দেখে তাঁর মন অস্থির হয়ে উঠল এবং তিনি ভয় পেলেন। ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “জাকারিয়া, ভয় কোরো না, কারণ আল্লাহ্‌ তোমার মুনাজাত শুনেছেন। তোমার স্ত্রী এলিজাবেতের একটি ছেলে হবে। তুমি তার নাম রেখো ইয়াহিয়া। সে তোমার জীবনে মহা আনন্দের কারণ হবে এবং তার জন্মের দরুন আরও অনেকে আনন্দিত হবে, কারণ মাবুদের চোখে সে মহান হবে। সে কখনও আংগুর-রস বা কোন রকম মদানো রস খাবে না এবং মায়ের গর্ভে থাকতেই সে পাক-রূহে পূর্ণ হবে। বনি-ইসরাইলদের অনেককেই সে তাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে ফিরিয়ে আনবে। নবী ইলিয়াসের মত মনোভাব ও শক্তি নিয়ে সে মাবুদের আগে আসবে। সে পিতার মন সন্তানের দিকে ফিরাবে এবং অবাধ্য লোকদের মনের ভাব বদলে আল্লাহ্‌ভক্ত লোকদের মনের ভাবের মত করবে। এইভাবে সে মাবুদের জন্য এক দল লোককে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করবে।” তখন জাকারিয়া ফেরেশতাকে বললেন, “কিভাবে আমি তা বুঝব? আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি এবং আমার স্ত্রীর বয়সও অনেক বেশী হয়ে গেছে।” ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “আমার নাম জিবরাইল; আমি আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার সংগে কথা বলবার জন্য ও তোমাকে এই সুসংবাদ দেবার জন্য আল্লাহ্‌ আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখ, আমার কথা সময়মতই পূর্ণ হবে, কিন্তু তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর নি বলে বোবা হয়ে থাকবে। যতদিন না এই সব ঘটে ততদিন তুমি কথা বলতে পারবে না।” এদিকে লোকেরা জাকারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। বায়তুল-মোকাদ্দসের পবিত্র স্থানে তাঁর দেরি হচ্ছে দেখে তারা ভাবতে লাগল। পরে জাকারিয়া যখন বের হয়ে আসলেন তখন লোকদের সংগে কথা বলতে পারলেন না। এতে লোকেরা বুঝতে পারল পবিত্র স্থানে তিনি কোন দর্শন পেয়েছেন। তিনি লোকদের কাছে ইশারায় কথা বলতে থাকলেন এবং বোবা হয়ে রইলেন। ইমামের কাজের পালা শেষ হবার পরে জাকারিয়া বাড়ী চলে গেলেন। এর পরে তাঁর স্ত্রী এলিজাবেত গর্ভবতী হলেন এবং পাঁচ মাস পর্যন্ত বাড়ী ছেড়ে বাইরে গেলেন না। তিনি বললেন, “এটা মাবুদেরই কাজ। মানুষের কাছে আমার লজ্জা দূর করবার জন্য তিনি এখন আমার দিকে চোখ তুলে চেয়েছেন।” ফেরেশতা মরিয়মের কাছে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, “মাবুদ তোমার সংগে আছেন এবং তোমাকে অনেক দোয়া করেছেন।” এই কথা শুনে মরিয়মের মন খুব অস্থির হয়ে উঠল। তিনি ভাবতে লাগলেন এই রকম সালামের মানে কি। ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “মরিয়ম, ভয় কোরো না, কারণ আল্লাহ্‌ তোমাকে খুব রহমত করেছেন। শোন, তুমি গর্ভবতী হবে আর তোমার একটি ছেলে হবে। তুমি তাঁর নাম ঈসা রাখবে। তিনি মহান হবেন। তাঁকে আল্লাহ্‌তা’লার পুত্র বলা হবে। মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর পূর্বপুরুষ বাদশাহ্‌ দাউদের সিংহাসন তাঁকে দেবেন। তিনি ইয়াকুবের বংশের লোকদের উপরে চিরকাল ধরে রাজত্ব করবেন। তাঁর রাজত্ব কখনও শেষ হবে না।” তখন মরিয়ম ফেরেশতাকে বললেন, “এ কেমন করে হবে? আমার তো বিয়ে হয় নি।” ফেরেশতা বললেন, “পাক-রূহ্‌ তোমার উপরে আসবেন এবং আল্লাহ্‌তা’লার শক্তির ছায়া তোমার উপরে পড়বে। এইজন্য যে পবিত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন তাঁকে ইব্‌নুল্লাহ্‌ বলা হবে। দেখ, এই বুড়ো বয়সে তোমার আত্মীয়া এলিজাবেতের গর্ভেও ছেলের জন্ম হয়েছে। লোকে বলত তার ছেলেমেয়ে হবে না, কিন্তু এখন তার ছয় মাস চলছে। আল্লাহ্‌র কাছে অসম্ভব বলে কোন কিছুই নেই।” মরিয়ম বললেন, “আমি মাবুদের বাঁদী, আপনার কথামতই আমার উপর সব কিছু হোক।” এর পরে ফেরেশতা মরিয়মের কাছ থেকে চলে গেলেন। তারপর মরিয়ম তাড়াতাড়ি করে এহুদিয়া প্রদেশের একটা গ্রামে গেলেন। গ্রামটা পাহাড়ী এলাকায় ছিল। মরিয়ম সেখানে জাকারিয়ার বাড়ীতে ঢুকে এলিজাবেতকে সালাম জানালেন। আমার প্রভুর মা আমার কাছে এসেছেন, এ কেমন করে সম্ভব হল? যখনই আমি তোমার কথা শুনলাম তখনই আমার গর্ভের শিশুটি আনন্দে নেচে উঠল। তুমি ধন্যা, কারণ তুমি বিশ্বাস করেছ যে, মাবুদ তোমাকে যা বলেছেন তা পূর্ণ হবে।” তখন মরিয়ম বললেন, “আমার হৃদয় মাবুদের প্রশংসা করছে; আমার নাজাতদাতা আল্লাহ্‌কে নিয়ে আমার দিল আনন্দে ভরে উঠছে, কারণ তাঁর এই সামান্যা বাঁদীর দিকে তিনি মনোযোগ দিয়েছেন। এখন থেকে সব লোক আমাকে ধন্যা বলবে, কারণ শক্তিমান আল্লাহ্‌ আমার জন্য কত না মহৎ কাজ করেছেন। তিনি পবিত্র। যারা তাঁকে ভয় করে তাদের প্রতি তিনি মমতা করেন, বংশের পর বংশ ধরেই করেন। তিনি হাত বাড়িয়ে মহাশক্তির কাজ করেছেন; যাদের মন অহংকারে ভরা তাদের তিনি চারদিকে দূর করে দিয়েছেন। সিংহাসন থেকে বাদশাহ্‌দের তিনি নামিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সাধারণ লোকদের তুলে ধরেছেন। যাদের অভাব আছে, ভাল ভাল জিনিস দিয়ে তিনি তাদের অভাব পূরণ করেছেন, কিন্তু ধনীদের খালি হাতে বিদায় করেছেন। প্রায় তিন মাস এলিজাবেতের কাছে থাকবার পর মরিয়ম নিজের বাড়ীতে ফিরে গেলেন। সময় পূর্ণ হলে পর এলিজাবেতের একটি ছেলে হল। তাঁর উপর মাবুদের প্রচুর মমতার কথা শুনে প্রতিবেশীরা ও আত্মীয়রা তাঁর সংগে আনন্দ করতে লাগল। ইহুদীদের নিয়ম মত আট দিনের দিন তারা ছেলেটির খৎনা করাবার কাজে যোগ দিতে আসল। তারা ছেলেটির নাম তার পিতার নামের মত জাকারিয়া রাখতে চাইল, কিন্তু তার মা বললেন, “না, এর নাম ইয়াহিয়া রাখা হবে।” তারা এলিজাবেতকে বলল, “আপনার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তো কারও ঐ নাম নেই।” তারা ইশারা করে ছেলেটির পিতার কাছ থেকে জানতে চাইল তিনি কি নাম দিতে চান। জাকারিয়া লিখবার জিনিস চেয়ে নিয়ে লিখলেন, “ওর নাম ইয়াহিয়া।” এতে তারা সবাই অবাক হল, আর তখনই জাকারিয়ার মুখ ও জিভ্‌ খুলে গেল এবং তিনি কথা বলতে ও আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগলেন। এ দেখে প্রতিবেশীরা সবাই ভয় পেল, আর এহুদিয়ার সমস্ত পাহাড়ী এলাকার লোকেরা এই সব বিষয়ে বলাবলি করতে লাগল। যারা এই সব কথা শুনল তারা প্রত্যেকেই মনে মনে তা ভাবতে লাগল আর বলল, “বড় হয়ে এই ছেলেটি তবে কি হবে!” তারা এই কথা বলল, কারণ মাবুদের শক্তি এই ছেলেটির উপর দেখা গিয়েছিল। পরে ছেলেটির পিতা জাকারিয়া পাক-রূহে পূর্ণ হয়ে নবী হিসাবে এই কথা বলতে লাগলেন, “ইসরাইলের মাবুদ আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, কারণ তিনি তাঁর নিজের বান্দাদের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন আর তাদের মুক্ত করেছেন। তিনি আমাদের জন্য তাঁর গোলাম দাউদের বংশ থেকে একজন শক্তিশালী নাজাতদাতা তুলেছেন। এই কথা তাঁর পবিত্র নবীদের মুখ দিয়ে তিনি অনেক দিন আগেই বলেছিলেন। তিনি শত্রুদের হাত থেকে আর যারা ঘৃণা করে তাদের সকলের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন। তিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের মমতা করবার জন্য আর তাঁর পবিত্র ব্যবস্থা, অর্থাৎ তাঁর কসম পূর্ণ করবার জন্য আমাদের রক্ষা করেছেন। সন্তান আমার, তোমাকে আল্লাহ্‌তা’লার নবী বলা হবে, কারণ তুমি তাঁর পথ ঠিক করবার জন্য তাঁর আগে আগে চলবে। যাতে অন্ধকারে ও মৃত্যুর ছায়ায় যারা বসে আছে তাদের নূর দিতে পারেন, আর শান্তির পথে আমাদের চালাতে পারেন।” পরে ইয়াহিয়া বেড়ে উঠতে লাগলেন এবং দিলে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলেন। বনি-ইসরাইলদের সামনে খোলাখুলিভাবে উপস্থিতির আগ পর্যন্ত তিনি মরুভূমিতে ছিলেন। সেই সময়ে সম্রাট অগাস্টাস সিজার তাঁর রাজ্যের সব লোকদের নাম লেখাবার হুকুম দিলেন। সিরিয়ার শাসনকর্তা কুরীণিয়ের সময়ে এই প্রথমবার আদমশুমারীর জন্য নাম লেখানো হয়। নাম লেখাবার জন্য প্রত্যেকে নিজের নিজের গ্রামে যেতে লাগল। সেখানে তাঁর প্রথম ছেলের জন্ম হল, আর তিনি ছেলেটিকে কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে রাখলেন, কারণ হোটেলে তাঁদের জন্য কোন জায়গা ছিল না। বেথেলহেমের কাছে মাঠের মধ্যে রাতের বেলায় রাখালেরা তাদের ভেড়ার পাল পাহারা দিচ্ছিল। এমন সময় মাবুদের একজন ফেরেশতা হঠাৎ তাদের সামনে উপস্থিত হলেন। তখন মাবুদের মহিমা তাদের চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল। এতে রাখালেরা খুব ভয় পেল। ফেরেশতা তাদের বললেন, “ভয় কোরো না, কারণ আমি তোমাদের কাছে খুব আনন্দের খবর এনেছি। এই আনন্দ সব লোকেরই জন্য। আজ দাউদের গ্রামে তোমাদের নাজাতদাতা জন্মেছেন। তিনিই মসীহ্‌, তিনিই প্রভু। এই কথা যে সত্যি তোমাদের কাছে তার চিহ্ন হল এই- তোমরা কাপড়ে জড়ানো এবং যাবপাত্রে শোয়ানো একটি শিশুকে দেখতে পাবে।” এই সময় সেই ফেরেশতার সংগে হঠাৎ সেখানে আরও অনেক ফেরেশতাকে দেখা গেল। তাঁরা আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলতে লাগলেন, “বেহেশতে আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক, দুনিয়াতে যাদের উপর তিনি সন্তুষ্ট তাদের শান্তি হোক।” ফেরেশতারা তাদের কাছ থেকে বেহেশতে চলে যাবার পর রাখালেরা একে অন্যকে বলল, “চল, আমরা বেথেলহেমে যাই এবং যে ঘটনার কথা মাবুদ আমাদের জানালেন তা গিয়ে দেখি।” তারা তাড়াতাড়ি গিয়ে মরিয়ম, ইউসুফ ও যাবপাত্রে শোয়ানো সেই শিশুটিকে তালাশ করে বের করল। তাদের কাছে ঐ শিশুর বিষয়ে যা জানানো হয়েছিল, শিশুটিকে দেখবার পরে তারা তা বলল। রাখালদের কথা শুনে সবাই আশ্চর্য হল; কিন্তু মরিয়ম সব কিছু মনে গেঁথে রাখলেন, কাউকে বললেন না; তিনি সেই বিষয়ে চিন্তা করতে থাকলেন। ফেরেশতারা রাখালদের কাছে যা বলেছিলেন সব কিছু সেইমত দেখে ও শুনে তারা আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও গৌরব করতে করতে ফিরে গেল। জন্মের আট দিনের দিন ইহুদীদের নিয়ম মত যখন শিশুটির খৎনা করাবার সময় হল তখন তাঁর নাম রাখা হল ঈসা। মায়ের গর্ভে আসবার আগে ফেরেশতা তাঁর এই নামই দিয়েছিলেন। পরে মূসার শরীয়ত মতে তাঁদের পাক-সাফ হবার সময় হল। তখন ইউসুফ ও মরিয়ম ঈসাকে মাবুদের সামনে উপস্থিত করবার জন্য তাঁকে জেরুজালেম শহরে নিয়ে গেলেন, কারণ মাবুদের শরীয়তে লেখা আছে, “প্রথমে জন্মেছে এমন প্রত্যেকটি পুরুষ সন্তানকে মাবুদের বলে ধরা হবে।” এছাড়াও “এক জোড়া ঘুঘু কিংবা দু’টা কবুতরের বাচ্চা” কোরবানী দেবার কথা যেমন মাবুদের শরীয়তে লেখা আছে সেইভাবে তাঁরা তা কোরবানী দিতে গেলেন। পাক-রূহের দ্বারা চালিত হয়ে শামাউন সেই দিন বায়তুল-মোকাদ্দসে আসলেন। মূসার শরীয়ত মতে যা করা দরকার তা করবার জন্য ঈসার মা-বাবা শিশু ঈসাকে নিয়ে সেখানে আসলেন। তখন শামাউন তাঁকে কোলে নিলেন এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বললেন, “মাবুদ, তুমি তোমার কথামত তোমার গোলামকে এখন শান্তিতে বিদায় দিচ্ছ, অন্য জাতির কাছে এটা পথ দেখাবার নূর, আর তোমার ইসরাইল জাতির কাছে এটা গৌরবের বিষয়।” শামাউন শিশুটির বিষয়ে যা বললেন তাতে শিশুটির মা-বাবা আশ্চর্য হলেন। এর পরে শামাউন তাঁদের দোয়া করলেন এবং ঈসার মা মরিয়মকে বললেন, “আল্লাহ্‌ এটাই স্থির করেছেন যে, এই শিশুটির জন্য বনি-ইসরাইলদের মধ্যে অনেকেরই পতন হবে, আবার অনেকেই উদ্ধার পাবে। ইনি এমন একটা চিহ্ন হবেন যাঁর বিরুদ্ধে অনেকেই কথা বলবে, আর তাতে তাদের মনের চিন্তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। এছাড়া ছোরার আঘাতের মত দুঃখ তোমার দিলকে বিঁধবে।” তিনিও ঠিক সেই সময় এগিয়ে এসে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন, আর আল্লাহ্‌ জেরুজালেমকে মুক্ত করবেন বলে যারা অপেক্ষা করছিল তাদের কাছে সেই শিশুটির কথা বলতে লাগলেন। মাবুদের শরীয়ত মতে সব কিছু শেষ করে মরিয়ম ও ইউসুফ গালীলে তাঁদের নিজেদের গ্রাম নাসরতে ফিরে গেলেন। শিশু ঈসা বয়সে বেড়ে শক্তিমান হয়ে উঠলেন এবং জ্ঞানে পূর্ণ হতে থাকলেন। তাঁর উপরে আল্লাহ্‌র দোয়া ছিল। উদ্ধার-ঈদের সময়ে ঈসার মা-বাবা প্রত্যেক বছর জেরুজালেমে যেতেন। ঈসার বয়স যখন বারো বছর তখন নিয়ম মতই তাঁরা সেই ঈদে গেলেন। ঈদের শেষে তাঁরা যখন বাড়ী ফিরছিলেন তখন ঈসা জেরুজালেমেই থেকে গেলেন। তাঁর মা-বাবা কিন্তু সেই কথা জানতেন না। তিনি সংগের লোকদের মধ্যে আছেন মনে করে তাঁরা এক দিনের পথ চলে গেলেন। পরে তাঁরা তাঁদের আত্মীয় ও জানাশোনা লোকদের মধ্যে ঈসার তালাশ করতে লাগলেন। কিন্তু তালাশ করে না পেয়ে তাঁকে তালাশ করতে করতে তাঁরা আবার জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। শেষে তিন দিন পরে তাঁরা তাঁকে বায়তুল-মোকাদ্দসে পেলেন। তিনি আলেমদের মধ্যে বসে তাঁদের কথা শুনছিলেন ও তাঁদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিলেন। যাঁরা ঈসার কথা শুনছিলেন তাঁরা সবাই তাঁর বুদ্ধি দেখে ও তাঁর জবাব শুনে অবাক হচ্ছিলেন। তাঁর মা-বাবা তাঁকে দেখে আশ্চর্য হলেন। তাঁর মা তাঁকে বললেন, “বাবা, তুমি আমাদের সংগে কেন এমন করলে? তোমার পিতা ও আমি কত ব্যাকুল হয়ে তোমার তালাশ করছিলাম।” ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা কেন আমার তালাশ করছিলে? তোমরা কি জানতে না যে, আমার পিতার ঘরে আমাকে থাকতে হবে?” ঈসা যা বললেন তাঁর মা-বাবা তা বুঝলেন না। এর পরে তিনি তাঁদের সংগে নাসরতে ফিরে গেলেন এবং তাঁদের বাধ্য হয়ে রইলেন। তাঁর মা এই সব বিষয় মনে গেঁথে রাখলেন। ঈসা জ্ঞানে, বয়সে এবং আল্লাহ্‌ ও মানুষের মহব্বতে বেড়ে উঠতে লাগলেন। রোম-সম্রাট টিবেরিয়াস সিজারের রাজত্বের পনের বছরের সময় এহুদিয়া প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন পন্তীয় পীলাত। তখন হেরোদ গালীল প্রদেশ ও তাঁর ভাই ফিলিপ যিতূরিয়া প্রদেশ ও ত্রাখোনীতিয়া শাসন করছিলেন। লুষানিয়া ছিলেন অবিলীনীর শাসনকর্তা, আর হানন ও কাইয়াফা ছিলেন ইহুদীদের মহা-ইমাম। ঠিক এই সময়ে আল্লাহ্‌ মরুভূমিতে জাকারিয়ার পুত্র ইয়াহিয়ার উপর তাঁর কালাম নাজেল করলেন। তখন ইয়াহিয়া জর্ডান নদীর চারদিকের সমস্ত জায়গায় গিয়ে তবলিগ করতে লাগলেন যেন লোকে গুনাহের মাফ পাবার জন্য তওবা করে এবং তার চিহ্ন হিসাবে তরিকাবন্দী নেয়। নবী ইশাইয়ার কিতাবে যা লেখা আছে ঠিক সেইভাবে এই সব হল। লেখা আছে, “মরুভূমিতে একজনের কন্ঠস্বর চিৎকার করে জানাচ্ছে, ‘তোমরা মাবুদের পথ ঠিক কর, তাঁর রাস্তা সোজা কর। সমস্ত উপত্যকা ভরা হবে, পাহাড়-পর্বত সমান করা হবে। আঁকাবাঁকা পথ সোজা করা হবে, অসমান রাস্তা সমান করা হবে। মানুষকে নাজাত করবার জন্য আল্লাহ্‌ যা করেছেন, সব লোকেই তা দেখতে পাবে।’ ” তখন তরিকাবন্দী নেবার জন্য অনেক লোক ইয়াহিয়ার কাছে আসতে লাগল। ইয়াহিয়া তাদের বললেন, “সাপের বংশধরেরা! আল্লাহ্‌র যে গজব নেমে আসছে তা থেকে পালিয়ে যাবার এই বুদ্ধি তোমাদের কে দিল? তোমরা যে তওবা করেছ তার উপযুক্ত ফল তোমাদের জীবনে দেখাও। নিজেদের মনে ভেবো না যে, তোমরা ইব্রাহিমের বংশের লোক। আমি তোমাদের বলছি, এই পাথরগুলো থেকে আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমের বংশধর তৈরী করতে পারেন। গাছের গোড়াতে কুড়াল লাগানোই আছে। যে গাছে ভাল ফল ধরে না তা কেটে আগুনে ফেলে দেওয়া হবে।” তখন লোকেরা ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, “তা হলে আমরা কি করব?” ইয়াহিয়া তাদের বললেন, “যদি কারও দু’টা কোর্তা থাকে তবে যার কোর্তা নেই সে তাকে একটা দিক। যার খাবার আছে সেও সেই রকম করুক।” কয়েকজন খাজনা-আদায়কারী তরিকাবন্দী নেবার জন্য এসে ইয়াহিয়াকে বলল, “হুজুর, আমরা কি করব?” তিনি তাদের বললেন, “আইনে যা আছে তার বেশী আদায় কোরো না।” কয়েকজন সৈন্যও তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “আর আমরা কি করব?” তিনি সেই সৈন্যদের বললেন, “জুলুম করে বা অন্যায়ভাবে দোষ দেখিয়ে কারও কাছ থেকে কিছু আদায় কোরো না এবং তোমাদের বেতনেই সন্তুষ্ট থেকো।” লোকেরা খুব আশা নিয়ে মনে মনে ভাবছিল হয়ত বা ইয়াহিয়াই মসীহ্‌। এমন সময় ইয়াহিয়া তাদের সবাইকে বললেন, “আমি তোমাদের পানিতে তরিকাবন্দী দিচ্ছি, কিন্তু যিনি আমার চেয়ে শক্তিশালী তিনি আসছেন। আমি তাঁর জুতার ফিতা খুলবারও যোগ্য নই। তিনি পাক-রূহ্‌ ও আগুনে তোমাদের তরিকাবন্দী দেবেন। কুলা তাঁর হাতেই আছে; তা দিয়ে তিনি তাঁর ফসল মাড়াবার জায়গা পরিষ্কার করে ফসল গোলায় জমা করবেন, কিন্তু যে আগুন কখনও নেভে না তাতে তিনি তুষ পুড়িয়ে ফেলবেন।” ইয়াহিয়া আরও অনেক উপদেশের মধ্য দিয়ে লোকদের মনে উৎসাহ জাগিয়ে আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করলেন। শাসনকর্তা হেরোদের ভাইয়ের স্ত্রী হেরোদিয়ার সংগে হেরোদের সম্পর্কে র দরুন এবং তাঁর আরও অনেক খারাপ কাজের দরুন ইয়াহিয়া তাঁর দোষ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি ইয়াহিয়াকে বন্দী করে জেলে দিলেন। এতে তাঁর অন্য সব খারাপ কাজের সংগে এই খারাপ কাজটাও যোগ হল। যে সমস্ত লোক ইয়াহিয়ার কাছে এসেছিল তারা তরিকাবন্দী নেবার সময় ঈসাও তরিকাবন্দী নিলেন। তরিকাবন্দীর পরে ঈসা যখন মুনাজাত করছিলেন তখন আসমান খুলে গেল। সেই সময় পাক-রূহ্‌ কবুতরের আকার নিয়ে তাঁর উপর নেমে আসলেন, আর বেহেশত থেকে এই কথা শোনা গেল, “তুমিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমার উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট।” প্রায় তিরিশ বছর বয়সে ঈসা তাঁর কাজ শুরু করলেন। লোকে মনে করত তিনি ইউসুফের ছেলে। ইউসুফ আলীর ছেলে; আলী মত্ততের ছেলে, মত্তত লেবির ছেলে, লেবি মল্কির ছেলে, মল্কি যান্নায়ের ছেলে, যান্নায় ইউসুফের ছেলে; ইউসুফ মত্তথিয়ের ছেলে, মত্তথিয় আমোজের ছেলে, আমোজ নাহূমের ছেলে, নাহূম ইষ্‌লির ছেলে, ইষ্‌লি নগির ছেলে; নগি মাটের ছেলে, মাট মত্তথিয়ের ছেলে, মত্তথিয় শিমিয়ির ছেলে, শিমিয়ি যোষেখের ছেলে, যোষেখ যূদার ছেলে; যূদা যোহানার ছেলে, যোহানা রীষার ছেলে, রীষা সরুব্বাবিলের ছেলে, সরুব্বাবিল শল্টীয়েলের ছেলে, শল্টীয়েল নেরির ছেলে; নেরি মল্কির ছেলে, মল্কি অদ্দীর ছেলে, অদ্দী কোষমের ছেলে, কোষম ইল্‌মাদমের ছেলে, ইল্‌মাদম এরের ছেলে; এর ইউসার ছেলে, ইউসা ইলীয়েষরের ছেলে, ইলীয়েষর যোরীমের ছেলে, যোরীম মত্ততের ছেলে, মত্তত লেবির ছেলে; লেবি শামাউনের ছেলে, শামাউন যূদার ছেলে, যূদা ইউসুফের ছেলে, ইউসুফ যোনমের ছেলে, যোনম ইলিয়াকীমের ছেলে; ইলিয়াকীম মিলেয়ার ছেলে, মিলেয়া মিন্নার ছেলে, মিন্না মত্তথের ছেলে, মত্তথ নাথনের ছেলে, নাথন দাউদের ছেলে; দাউদ ইয়াসির ছেলে, ইয়াসি ওবেদের ছেলে, ওবেদ বোয়সের ছেলে, বোয়স সল্‌মোনের ছেলে, সল্‌মোন নহশোনের ছেলে; নহশোন অম্মীনাদবের ছেলে, অম্মীনাদব অদমানের ছেলে, অদমান অর্ণির ছেলে, অর্ণি হিষ্রোণের ছেলে, হিষ্রোণ পেরসের ছেলে, পেরস এহুদার ছেলে; এহুদা ইয়াকুবের ছেলে, ইয়াকুব ইসহাকের ছেলে, ইসহাক ইব্রাহিমের ছেলে, ইব্রাহিম তারেখের ছেলে, তারেখ নাহুরের ছেলে; নাহুর সারূজের ছেলে, সারূজ রাউর ছেলে, রাউ ফালেজের ছেলে, ফালেজ আবেরের ছেলে, আবের শালেখের ছেলে; শালেখ কীনানের ছেলে, কীনান আরফাখশাদের ছেলে, আরফাখশাদ সামের ছেলে, সাম নূহের ছেলে, নূহ লামাকের ছেলে; লামাক মুতাওশালেহের ছেলে, মুতাওশালেহ ইনোকের ছেলে, ইনোক ইয়ারুদের ছেলে, ইয়ারুদ মাহলাইলের ছেলে, মাহলাইল কীনানের ছেলে; কীনান আনুশের ছেলে, আনুশ শিসের ছেলে, শিস আদমের ছেলে, আদম আল্লাহ্‌র ছেলে। তখন ইবলিস ঈসাকে বলল, “তুমি যদি ইব্‌নুল্লাহ্‌ হও তবে এই পাথরটাকে রুটি হয়ে যেতে বল।” ঈসা ইবলিসকে বললেন, “পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘মানুষ কেবল রুটিতেই বাঁচে না।’ ” এখন তুমি যদি আমাকে সেজদা কর তবে এই সবই তোমার হবে।” ঈসা তাকে জবাব দিলেন, “পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘তুমি তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌কেই ভয় করবে, কেবল তাঁরই এবাদত করবে।’ ” তখন ইবলিস ঈসাকে জেরুজালেমে নিয়ে গেল আর বায়তুল-মোকাদ্দসের চূড়ার উপরে তাঁকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তুমি যদি ইব্‌নুল্লাহ্‌ হও তবে এখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়, কারণ পাক-কিতাবে লেখা আছে, তিনি তাঁর ফেরেশতাদের তোমার বিষয়ে হুকুম দেবেন যেন তাঁরা তোমাকে রক্ষা করেন। তাঁরা তোমাকে হাত দিয়ে ধরে ফেলবেন যাতে তোমার পায়ে পাথরের আঘাত না লাগে।” ঈসা তাকে বললেন, “পাক-কিতাবে বলা হয়েছে, ‘তোমার মাবুদ আল্লাহ্‌কে তুমি পরীক্ষা করতে যেয়ো না।’ ” সমস্ত রকম লোভ দেখানো শেষ করে ইবলিস অল্প সময়ের জন্য ঈসার কাছ থেকে চলে গেল। পরে ঈসা পাক-রূহের শক্তিতে পূর্ণ হয়ে গালীল প্রদেশে ফিরে গেলেন। ঈসার খবর সেই এলাকার সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। সেখানকার ভিন্ন ভিন্ন মজলিস-খানায় ঈসা শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। তখন সবাই তাঁর প্রশংসা করতে লাগল। এর পরে ঈসা নাসরতে গেলেন। এখানেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তিনি নিজের নিয়ম মত বিশ্রামবারে মজলিস-খানায় গেলেন, তারপর কিতাব তেলাওয়াত করবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে নবী ইশাইয়ার লেখা কিতাবখানা দেওয়া হল। গুটিয়ে-রাখা কিতাবখানা খুলেই তিনি সেই জায়গাটা পেলেন যেখানে লেখা আছে, “আল্লাহ্‌ মালিকের রূহ্‌ আমার উপরে আছেন, কারণ তিনিই আমাকে নিযুক্ত করেছেন যেন আমি গরীবদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করি। তিনি আমাকে বন্দীদের কাছে স্বাধীনতার কথা, অন্ধদের কাছে দেখতে পাবার কথা ঘোষণা করতে পাঠিয়েছেন। যাদের উপর জুলুম হচ্ছে, তিনি আমাকে তাদের মুক্ত করতে পাঠিয়েছেন। এছাড়া মাবুদ আমাকে ঘোষণা করতে পাঠিয়েছেন যে, এখন তাঁর রহমত দেখাবার সময় হয়েছে।” তারপর তিনি কিতাবখানা আবার গুটিয়ে কর্মচারীর হাতে দিয়ে বসে পড়লেন। মজলিস-খানার প্রত্যেকটি লোকের চোখ তাঁর উপরে পড়ল। তখন ঈসা লোকদের বললেন, “পাক-কিতাবের এই কথা আজ আপনারা শুনবার সংগে সংগেই তা পূর্ণ হল।” লোকেরা সবাই তাঁর প্রশংসা করল এবং তাঁর মুখে এই সব সুন্দর সুন্দর কথা শুনে আশ্চর্য হল। তারা বলল, “এ কি ইউসুফের ছেলে নয়?” ঈসা তাদের বললেন, “আপনারা এই চলতি কথাটা নিশ্চয়ই আমাকে বলবেন, ‘ডাক্তার, নিজেকে সুস্থ কর।’ আরও বলবেন, ‘কফরনাহূমে যে সব কাজ করবার কথা আমরা শুনেছি সেই সব এখন নিজের গ্রামেও করে দেখাও।’ ” তিনি আরও বললেন, “আমি আপনাদের সত্যি বলছি, কোন নবীকেই তাঁর নিজের গ্রামের লোক গ্রাহ্য করে না। এই কথা সত্যি যে, নবী ইলিয়াসের সময়ে যখন সাড়ে তিন বছর বৃষ্টি হয় নি এবং সমস্ত দেশে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তখন ইসরাইল দেশে অনেক বিধবা ছিল। কিন্তু তাদের কারও কাছে ইলিয়াসকে পাঠানো হয় নি, কেবল সিডন এলাকার সারিফত গ্রামের বিধবা স্ত্রীলোকটির কাছে পাঠানো হয়েছিল। নবী আল-ইয়াসার সময়ে ইসরাইল দেশে অনেক চর্মরোগী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে সুস্থ করা হয় নি, কেবল সিরিয়া দেশের নামানকেই সুস্থ করা হয়েছিল।” এই কথা শুনে মজলিস-খানার সমস্ত লোক রেগে আগুন হল। তারা উঠে ঈসাকে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে চলল, আর তাঁকে নীচে ফেলে দেবার জন্য তাদের গ্রামটা যে পাহাড়ের গায়ে ছিল সেই পাহাড়ের চূড়ায় তাঁকে নিয়ে গেল। কিন্তু তিনি সেই লোকদের মধ্য দিয়েই চলে গেলেন। পরে ঈসা গালীল প্রদেশের কফরনাহূম শহরে গেলেন এবং বিশ্রামবারে লোকদের শিক্ষা দিলেন। তাঁর শিক্ষায় লোকেরা আশ্চর্য হল, কারণ তিনি এমন লোকের মত কথা বলছিলেন যাঁর অধিকার আছে। সেই মজলিস-খানায় এমন একটি লোক ছিল যাকে ভূতে পেয়েছিল। সে চিৎকার করে বলল, “ওহে নাসরত গ্রামের ঈসা, আমাদের সংগে আপনার কি দরকার? আপনি কি আমাদের ধ্বংস করতে এসেছেন? আমি জানি আপনি কে; আপনিই তো আল্লাহ্‌র সেই পবিত্রজন।” ঈসা সেই ভূতকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর, ওর মধ্য থেকে বের হয়ে যাও।” সেই ভূত তখন লোকটিকে সকলের মাঝখানে আছড়ে ফেলল এবং তার কোন ক্ষতি না করে তার মধ্য থেকে বের হয়ে গেল। এতে সবাই আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, “এ কেমন কথা! অধিকার ও ক্ষমতা নিয়ে তিনি ভূতদের হুকুম দেন আর তারা বের হয়ে যায়!” সেই এলাকার সব জায়গায় ঈসার কথা ছড়িয়ে পড়ল। এর পরে ঈসা মজলিস-খানা ছেড়ে শিমোনের বাড়ীতে গেলেন। শিমোনের শাশুড়ীর খুব জ্বর হয়েছিল। তাঁকে ভাল করবার জন্য ঈসাকে অনুরোধ করা হল। তখন ঈসা শিমোনের শাশুড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে জ্বরকে ধমক দিলেন। তাতে তাঁর জ্বর ছেড়ে গেল, আর তিনি তখনই উঠে তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। বেলা ডুবে যাবার সময়ে লোকেরা সব রোগীদের ঈসার কাছে নিয়ে আসল। তারা নানা রকম রোগে ভুগছিল। ঈসা তাদের প্রত্যেকের গায়ে হাত দিয়ে তাদের সুস্থ করলেন। অনেক লোকের মধ্য থেকে ভূতও বের হয়ে গেল। সেই ভূতগুলো চিৎকার করে বলল, “আপনি ইব্‌নুল্লাহ্‌।” তিনি যে মসীহ্‌ তা তারা জানত। এইজন্য তিনি ধমক দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিলেন। খুব ভোরে ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে একটা নির্জন জায়গায় চলে গেলেন। লোকেরা তাঁর তালাশ করতে করতে তাঁর কাছে গেল এবং যাতে তিনি তাদের কাছ থেকে চলে না যান সেইজন্য তাঁকে তাদের কাছে ধরে রাখতে চেষ্টা করল। তখন ঈসা তাদের বললেন, “আরও অনেক জায়গায় আমাকে আল্লাহ্‌র রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করতে হবে, কারণ এরই জন্য আল্লাহ্‌ আমাকে পাঠিয়েছেন।” এর পরে তিনি ইহুদীদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন মজলিস-খানায় তবলিগ করতে থাকলেন। এক সময়ে ঈসা গিনেষরৎ সাগরের পারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লোকেরা আল্লাহ্‌র কালাম শুনবার জন্য তাঁর চারপাশে ঠেলাঠেলি করছিল। এমন সময় তিনি সাগরের পারে দু’টা নৌকা দেখতে পেলেন। জেলেরা সেই নৌকা দু’টা থেকে নেমে তাদের জাল ধুচ্ছিল। তখন ঈসা শিমোনের নৌকায় উঠলেন এবং তাঁকে পার থেকে একটু দূরে নৌকাটা নিয়ে যেতে বললেন। তারপর তিনি নৌকায় বসে লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। কথা শেষ হলে পর ঈসা শিমোনকে বললেন, “গভীর পানিতে গিয়ে মাছ ধরবার জন্য তোমাদের জাল ফেল।” শিমোন বললেন, “হুজুর, সারা রাত খুব পরিশ্রম করেও কিছুই ধরতে পারি নি; তবুও আপনার কথাতে আমি জাল ফেলব।” জাল ফেললে পর তাতে এত মাছ পড়ল যে, তাঁদের জাল ছিঁড়বার মত হল। তখন তাঁরা সাহায্যের জন্য ইশারা করে অন্য নৌকার সংগীদের ডাকলেন। তাঁরা এসে দু’টা নৌকায় এত মাছ বোঝাই করলেন যে, সেগুলো ডুবে যাবার মত হল। এ দেখে শিমোন্তপিতর ঈসার সামনে উবুড় হয়ে পড়ে বললেন, “হুজুর, আমি গুনাহ্‌গার; আমার কাছ থেকে চলে যান।” এত মাছ ধরা পড়েছে দেখে শিমোন্তপিতর ও তাঁর সংগীরা সবাই আশ্চর্য হলেন। শিমোনের ব্যবসার ভাগীদার ইয়াকুব ও ইউহোন্না নামে সিবদিয়ের দুই ছেলেও আশ্চর্য হলেন। তখন ঈসা শিমোনকে বললেন, “ভয় কোরো না; এখন থেকে তুমি আল্লাহ্‌র জন্য মানুষ ধরবে।” তারপর তাঁরা নৌকাগুলো পারে আনলেন এবং সব কিছু ফেলে রেখে ঈসার সংগে চললেন। ঈসা একবার একটা গ্রামে গেলেন। সেখানে একজন লোকের সারা গায়ে খারাপ চর্মরোগ ছিল। ঈসাকে দেখে সে উবুড় হয়ে পড়ে কাকুতি-মিনতি করে বলল, “হুজুর, আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ভাল করতে পারেন।” ঈসা হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে বললেন, “আমি তা-ই চাই, তুমি পাক-সাফ হও।” আর তখনই সে ভাল হয়ে গেল। ঈসা তাকে এই হুকুম দিলেন, “এই কথা কাউকে বোলো না বরং ইমামের কাছে গিয়ে নিজেকে দেখাও। তার পর পাক-সাফ হওয়া সম্বন্ধে মূসা যা কোরবানী দেবার হুকুম দিয়েছেন তা কোরবানী দাও। তাতে লোকদের কাছে প্রমাণ হবে তুমি ভাল হয়েছ।” তবুও ঈসার খবর আরও ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর কথা শুনবার জন্য ও রোগ থেকে সুস্থ হবার জন্য অনেক লোক তাঁর কাছে আসতে লাগল। ঈসা প্রায়ই নির্জন জায়গায় গিয়ে মুনাজাত করতেন। একদিন ঈসা যখন শিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন ফরীশীরা এবং আলেমেরা সেখানে বসে ছিলেন। গালীল প্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম এবং এহুদিয়া প্রদেশ ও জেরুজালেম শহর থেকে এঁরা এসেছিলেন। রোগীদের সুস্থ করবার জন্য মাবুদের কুদরত ঈসার মধ্যে ছিল। তখন কয়েকজন লোক একজন অবশ-রোগীকে খাটে করে বয়ে আনল। তারা তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ঈসার সামনে রাখবার চেষ্টা করল, কিন্তু ভিড়ের জন্য ভিতরে যাবার পথ পেল না। তখন তারা ছাদে উঠল এবং ছাদের টালি সরিয়ে বিছানা সুদ্ধ তাকে লোকদের মাঝখানে ঈসার সামনে নামিয়ে দিল। তারা ঈমান এনেছে দেখে ঈসা বললেন, “বন্ধু, তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল।” এতে আলেম ও ফরীশীরা মনে মনে ভাবতে লাগলেন, “এই লোকটা কে, যে কুফরী করছে? আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কে গুনাহ্‌ মাফ করতে পারে?” তাঁরা মনে মনে কি চিন্তা করছিলেন ঈসা তা বুঝতে পেরে বললেন, “আপনারা মনে মনে কেন ঐ কথা ভাবছেন? কোন্‌টা বলা সহজ, ‘তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হল,’ না ‘তুমি উঠে হেঁটে বেড়াও’? কিন্তু আপনারা যেন জানতে পারেন দুনিয়াতে গুনাহ্‌ মাফ করবার ক্ষমতা ইব্‌ন্তেআদমের আছে”- এই পর্যন্ত বলে তিনি সেই অবশ-রোগীকে বললেন, “আমি তোমাকে বলছি, ওঠো, তোমার বিছানা তুলে নিয়ে বাড়ী চলে যাও।” সেই লোকটি তখনই সকলের সামনে উঠে দাঁড়াল এবং যে বিছানার উপরে সে শুয়ে ছিল তা তুলে নিয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে করতে বাড়ী চলে গেল। তাতে সবাই খুব আশ্চর্য হল এবং ভয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলল, “আজ আমরা কি আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম!” এর পরে ঈসা বাইরে গেলেন এবং খাজনা আদায় করবার ঘরে লেবি নামে একজন খাজনা-আদায়কারীকে বসে থাকতে দেখলেন। ঈসা লেবিকে বললেন, “এস, আমার সাহাবী হও।” তাতে লেবি উঠলেন এবং তাঁর সব কিছু ফেলে রেখে ঈসার সংগে গেলেন। পরে লেবি ঈসার জন্য তাঁর বাড়ীতে একটা বড় মেজবানী দিলেন। তাঁদের সংগে অনেক খাজনা-আদায়কারী ও অন্য লোকেরা খেতে বসল। তখন ফরীশীরা ও তাঁদের দলের আলেমেরা বিরক্ত হয়ে ঈসার সাহাবীদের বললেন, “তোমরা কর-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের সংগে খাওয়া-দাওয়া কর কেন?” ঈসা তাঁদের বললেন, “সুস্থদের জন্য ডাক্তারের দরকার নেই বরং অসুস্থদের জন্যই দরকার আছে। তওবা করবার জন্য আমি ধার্মিকদের ডাকতে আসি নি বরং গুনাহ্‌গারদেরই ডাকতে এসেছি।” পরে সেই ধর্ম-নেতারা ঈসাকে বললেন, “ইয়াহিয়ার সাহাবীরা প্রায়ই রোজা ও মুনাজাত করে এবং ফরীশীদের শাগরেদেরাও তা করে, কিন্তু আপনার সাহাবীরা কখনও খাওয়া-দাওয়া বাদ দেয় না।” ঈসা তাঁদের বললেন, “বর সংগে থাকতে কি বরের সংগের লোকদের রোজা রাখাতে পারা যায়? কিন্তু এমন সময় আসবে যখন তাদের কাছ থেকে বরকে নিয়ে যাওয়া হবে, আর সেই সময়েই তারা রোজা রাখবে।” তারপর ঈসা শিক্ষা দেবার জন্য তাঁদের কাছে এই উদাহরণ দিলেন: “নতুন কোর্তার টুকরা ছিঁড়ে নিয়ে কেউ পুরানো কোর্তায় তালি দেয় না, কারণ তা করলে সেই নতুন কোর্তাটা তো সে ছিঁড়ে ফেলে; আর সেই নতুন টুকরাটাও পুরানো কোর্তার সংগে মানায় না। টাটকা আংগুর-রস কেউ পুরানো চামড়ার থলিতে রাখে না, রাখলে টাটকা রসে থলিগুলো ফেটে যায়। তাতে রসও পড়ে যায়, থলিগুলোও নষ্ট হয়। টাটকা আংগুর-রস নতুন চামড়ার থলিতেই রাখা উচিত। পুরানো আংগুর-রস খাবার পরে কেউ টাটকা আংগুর-রস খেতে চায় না, কারণ সে বলে, ‘পুরানোটাই ভাল।’ ” কোন এক বিশ্রামবারে ঈসা শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সাহাবীরা শীষ ছিঁড়ে হাতে ঘষে ঘষে খেতে লাগলেন। তখন কয়েকজন ফরীশী বললেন, “শরীয়ত মতে বিশ্রামবারে যা করা উচিত নয়, তোমরা তা করছ কেন?” ঈসা বললেন, “নবী দাউদ ও তাঁর সংগীদের যখন খিদে পেয়েছিল তখন তিনি কি করেছিলেন তা কি আপনারা পড়েন নি? তিনি তো আল্লাহ্‌র ঘরে ঢুকে পবিত্র-রুটি নিয়ে খেয়েছিলেন এবং তাঁর সংগীদেরও দিয়েছিলেন। কিন্তু কেবল মাত্র ইমামেরা ছাড়া আর কারও তা খাবার নিয়ম ছিল না।” শেষে ঈসা সেই ফরীশীদের বললেন, “ইব্‌ন্তেআদমই বিশ্রামবারের মালিক।” আর এক বিশ্রামবারে ঈসা মজলিস-খানায় গিয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক ছিল যার ডান হাত শুকিয়ে গিয়েছিল। আলেমেরা ও ফরীশীরা ঈসাকে দোষ দেবার একটা অজুহাত খুঁজছিলেন। তাই বিশ্রামবারে তিনি কাউকে সুস্থ করেন কি না তা দেখবার জন্য তাঁরা ঈসার উপর ভালভাবে নজর রাখতে লাগলেন। ঈসা কিন্তু তাঁদের মনের চিন্তা জানতেন। সেইজন্য যার হাত শুকিয়ে গিয়েছিল তিনি সেই লোকটিকে বললেন, “উঠে সকলের সামনে এসে দাঁড়াও।” তাতে সে উঠে দাঁড়াল। ঈসা আলেম ও ফরীশীদের বললেন, “আমি আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বিশ্রামবারে ভাল কাজ করা উচিত, না খারাপ কাজ করা উচিত? প্রাণ রক্ষা করা উচিত, না নষ্ট করা উচিত?” তারপর ঈসা চারপাশের সকলের দিকে তাকিয়ে লোকটিকে বললেন, “তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।” সে তা করলে পর তার হাত একেবারে ভাল হয়ে গেল। তখন সেই ধর্ম-নেতারা ভীষণ রাগ করলেন এবং ঈসাকে নিয়ে কি করা যায় তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন। এর পরে ঈসা মুনাজাত করবার জন্য একটা পাহাড়ে গেলেন এবং সারা রাত আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করে কাটালেন। সকাল হলে পর তিনি তাঁর সাহাবীদের নিজের কাছে ডাকলেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে বারোজনকে বেছে নিয়ে তাঁদের সাহাবী-পদ দিলেন। তাঁরা হলেন শিমোন, যাকে তিনি পিতর নামও দিলেন; শিমোনের ভাই আন্দ্রিয়; ইয়াকুব ও ইউহোন্না; ফিলিপ ও বর্থলময়; মথি ও থোমা; আল্‌ফেয়ের ছেলে ইয়াকুব; শিমোন, যাঁকে মৌলবাদী বলা হয়; ইয়াকুবের ছেলে এহুদা এবং এহুদা ইষ্কারিয়োৎ, যে ঈসাকে পরে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ঈসা তাঁর সাহাবীদের সংগে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে একটা সমান জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে তাঁর অনেক উম্মত জড়ো হয়েছিলেন। এছাড়া এহুদিয়া, জেরুজালেম এবং টায়ার ও সিডন নামে সাগর পারের দু’টা শহরের এলাকা থেকেও অনেক লোক সেখানে ছিল। তারা তাঁর কথা শুনবার জন্য এবং রোগ থেকে সুস্থ হবার জন্য সেখানে এসেছিল। যারা ভূতের দ্বারা কষ্ট পাচ্ছিল তারা ভাল হচ্ছিল। তখন সব লোক তাঁকে ছোঁবার চেষ্টা করতে লাগল, কারণ তাঁর মধ্য থেকে শক্তি বের হয়ে সকলকে সুস্থ করছিল। পরে ঈসা সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “ধন্য তোমরা, যারা গরীব, কারণ আল্লাহ্‌র রাজ্য তোমাদেরই। ধন্য তোমরা, যাদের এখন খিদে আছে, কারণ তোমরা তৃপ্ত হবে। ধন্য তোমরা, যারা এখন কাঁদছ, কারণ তোমরা হাসবে। “ধন্য তোমরা, যখন ইব্‌ন্তেআদমের দরুন লোকে তোমাদের ঘৃণা করে, সমাজ থেকে বের করে দেয় ও নিন্দা করে এবং তোমাদের নাম শুনলে থুথু ফেলে। সেই সময় তোমরা খুশী হয়ো ও আনন্দে নেচে উঠো, কারণ বেহেশতে তোমাদের জন্য মহা পুরস্কার আছে। ঐ সব লোকদের পূর্বপুরুষেরা নবীদের উপরও এই রকম করত। “কিন্তু ঘৃণ্য ধনী লোকেরা! তোমরা পরিপূর্ণভাবেই সুখ ভোগ করছ। ঘৃণ্য তৃপ্ত লোকেরা! তোমাদের তো খিদে পাবে। ঘৃণ্য যারা হাসছ! তোমরা দুঃখ করবে ও কাঁদবে। ঘৃণ্য তোমরা, যখন সব লোকে তোমাদের প্রশংসা করে। এই সব লোকদের পূর্বপুরুষেরা ভণ্ড নবীদেরও প্রশংসা করত। “তোমরা যারা শুনছ তাদের আমি বলছি, তোমাদের শত্রুদের মহব্বত কোরো। যারা তোমাদের ঘৃণা করে তাদের উপকার কোরো। যারা তোমাদের অবনতি চায় তাদের উন্নতি চেয়ো। যারা তোমাদের সংগে খারাপ ব্যবহার করে তাদের জন্য মুনাজাত কোরো। যে তোমার এক গালে চড় মারে তাকে অন্য গালেও মারতে দিয়ো। যে তোমার চাদর নিয়ে যায় তাকে কোর্তাও নিতে দিয়ো। যারা তোমার কাছে চায় তাদের দিয়ো। কেউ তোমার কোন জিনিস নিয়ে গেলে তা আর ফেরৎ চেয়ো না। লোকের কাছ থেকে তোমরা যেমন ব্যবহার পেতে চাও তোমরাও তাদের সংগে তেমনই ব্যবহার কোরো। “যারা তোমাদের মহব্বত করে তোমরা যদি তাদেরই কেবল মহব্বত কর তবে তাতে প্রশংসার কি আছে? খারাপ লোকেরাও তো এইভাবে মহব্বত করে থাকে। যারা তোমাদের উপকার করে তোমরা যদি তাদেরই উপকার করতে থাক তবে তাতে প্রশংসার কি আছে? খারাপ লোকেরাও তো তা করে থাকে। যাদের কাছ থেকে তোমরা ফিরে পাবার আশা কর, যদি তাদেরই টাকা ধার দাও তবে তাতে প্রশংসার কি আছে? পাবে বলেই তো খারাপ লোকেরা খারাপ লোকদের ধার দিয়ে থাকে। কিন্তু তোমরা তোমাদের শত্রুদের মহব্বত কোরো এবং তাদের উপকার কোরো। কিছুই ফেরৎ পাবার আশা না রেখে ধার দিয়ো। তাহলে তোমাদের জন্য মহা পুরস্কার আছে, আর তোমরা আল্লাহ্‌তা’লার সন্তান হবে, কারণ তিনি অকৃতজ্ঞ এবং দুষ্টদেরও দয়া করেন। তোমাদের পিতা যেমন দয়ালু তোমরাও তেমনি দয়ালু হও। “অন্যদের দোষ ধরে বেড়িয়ো না, তাতে তোমাদেরও দোষ ধরা হবে না। অন্যদের শাস্তি পাবার যোগ্য বলে মনে কোরো না, তাতে তোমাদেরও শাস্তি পাবার যোগ্য বলে মনে করা হবে না। অন্যদের মাফ কোরো, তাতে তোমাদেরও মাফ করা হবে। দান কোরো, তাতে তোমাদেরও দেওয়া হবে; অনেক বেশী করে, চেপে চেপে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে, উপ্‌চে পড়বার মত করে তোমাদের কোঁচড়ে দেওয়া হবে, কারণ যেভাবে তোমরা মেপে দাও সেইভাবে তোমাদের জন্য মাপা হবে।” পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা দেবার জন্য এই উদাহরণ দিলেন: “একজন অন্ধ কি অন্য আর একজন অন্ধকে পথ দেখাতে পারে? তা হলে কি তারা দু’জনেই গর্তে পড়বে না? ছাত্র তার শিক্ষকের উপরে নয়, কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে প্রত্যেকটি ছাত্র তার শিক্ষকের মতই হয়ে ওঠে। “তোমার ভাইয়ের চোখে যে কূটা আছে তা-ই কেবল দেখছ, অথচ তোমার নিজের চোখে যে কড়িকাঠ আছে তা লক্ষ্য করছ না কেন? তোমার নিজের চোখে যে কড়িকাঠ আছে তা যখন লক্ষ্য করছ না তখন কেমন করে তোমার ভাইকে বলতে পার, ‘ভাই, তোমার চোখে যে কূটা আছে, এস, তা বের করে দিই’? ভণ্ড, প্রথমে তোমার নিজের চোখ থেকে কড়িকাঠটা বের করে ফেল, তাহলে তোমার ভাইয়ের চোখে যে কূটাটা আছে তা বের করবার জন্য স্পষ্ট দেখতে পাবে। “ভাল গাছে খারাপ ফল ধরে না, আবার খারাপ গাছেও ভাল ফল ধরে না। ফল দিয়েই গাছ চেনা যায়। লোকে কাঁটাঝোপ থেকে ডুমুর এবং কাঁটাগাছ থেকে আংগুর তোলে না। ভাল লোক তার অন্তর-ভরা ভাল থেকে ভাল কথাই বের করে আনে, আর খারাপ লোক তার অন্তর-ভরা খারাপী থেকে খারাপ কথা বের করে আনে। মানুষের অন্তর যা দিয়ে পূর্ণ থাকে মুখ তো সেই কথাই বলে। “তোমরা কেন আমাকে ‘প্রভু, প্রভু’ বলে ডাক, অথচ আমি যা বলি তা কর না? যে কেউ আমার কাছে এসে আমার কথা শোনে এবং সেইমত কাজ করে সে কার মত আমি তা তোমাদের বলি। সে এমন একজন লোকের মত, যে ঘর তৈরী করবার জন্য গভীর করে মাটি কেটে পাথরের উপর ভিত্তি গাঁথল। পরে বন্যা আসল এবং নদীর পানির স্রোত সেই ঘরের উপর এসে পড়ল, কিন্তু ঘরটা নাড়াতে পারল না, কারণ সেটা শক্ত করেই তৈরী করা হয়েছিল। যে আমার কথা শোনে অথচ সেইমত কাজ না করে সে এমন একজন লোকের মত, যে মাটির উপর ভিত্তি ছাড়াই ঘর তৈরী করল। পরে নদীর পানির স্রোত যখন সেই ঘরের উপর এসে পড়ল তখনই সেই ঘরটা পড়ে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।” ঈসা লোকদের কাছে এই সব কথা বলা শেষ করে কফরনাহূম শহরে গেলেন। সেখানে একজন রোমীয় শত-সেনাপতির গোলাম অসুস্থ হয়ে মরবার মত হয়েছিল। এই গোলামকে সেই সেনাপতি খুব ভালবাসতেন। তিনি ঈসার বিষয় শুনে ইহুদীদের কয়েকজন বৃদ্ধনেতাকে ঈসার কাছে অনুরোধ করতে পাঠালেন যেন তিনি এসে তাঁর গোলামকে সুস্থ করেন। সেই নেতারা ঈসার কাছে এসে তাঁকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে বললেন, “আপনি যাঁর জন্য এই কাজ করবেন তিনি এর উপযুক্ত, কারণ তিনি আমাদের লোকদের ভালবাসেন এবং আমাদের মজলিস-খানা তিনিই তৈরী করিয়ে দিয়েছেন।” তখন ঈসা তাঁদের সংগে চললেন। তিনি সেই বাড়ীর কাছে আসলে পর সেই সেনাপতি তাঁর বন্ধুদের দিয়ে বলে পাঠালেন, “হুজুর, আর কষ্ট করবেন না, কারণ আপনি যে আমার বাড়ীতে ঢোকেন তার যোগ্য আমি নই। সেইজন্য আপনার কাছে যাবার উপযুক্তও আমি নিজেকে মনে করি নি। আপনি কেবল মুখে বলুন, তাতেই আমার গোলাম ভাল হয়ে যাবে। আমি এই কথা জানি, কারণ আমাকেও অন্যের কথামত চলতে হয় এবং সৈন্যেরাও আমার কথামত চলে। আমি একজনকে ‘যাও’ বললে সে যায়, অন্যজনকে ‘এস’ বললে সে আসে, আর আমার গোলামকে ‘এটা কর’ বললে সে তা করে।” এই কথা শুনে ঈসা আশ্চর্য হলেন এবং যে সব লোকেরা ভিড় করে তাঁর পিছনে আসছিল তাদের দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আমি আপনাদের বলছি, বনি-ইসরাইলদের মধ্যেও এত বড় বিশ্বাস আমি কখনও দেখি নি।” সেনাপতি যাদের পাঠিয়েছিলেন তারা তাঁর ঘরে ফিরে গিয়ে সেই গোলামকে সুস্থ দেখতে পেল। এর কিছু পরে ঈসা নায়িন্‌ নামে একটা গ্রামের দিকে চললেন। তাঁর সাহাবীরা এবং আরও অনেক লোক তাঁর সংগে সংগে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি সেই গ্রামের দরজার কাছে পৌঁছালেন তখন লোকেরা একজন মৃত লোককে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। যে লোকটি মারা গিয়েছিল সে ছিল তার মায়ের একমাত্র সন্তান, আর সেই মা-ও ছিল বিধবা। গ্রামের অনেক লোক সেই বিধবার সংগে ছিল। সেই বিধবাকে দেখে ঈসা মমতায় পূর্ণ হয়ে বললেন, “আর কেঁদো না।” তারপর তিনি কাছে গিয়ে খাট ছুঁলেন। এতে যারা লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তারা দাঁড়াল। ঈসা বললেন, “যুবক, আমি তোমাকে বলছি, ওঠো।” তাতে যে মারা গিয়েছিল সেই লোকটি উঠে বসল এবং কথা বলতে লাগল। ঈসা তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এতে সকলের দিল ভয়ে পূর্ণ হল। তারা আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলতে লাগল, “আমাদের মধ্যে একজন মহান নবী উপস্থিত হয়েছেন। আল্লাহ্‌ রহমত করে তাঁর বান্দাদের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।” ঈসার বিষয়ে এই কথা এহুদিয়া প্রদেশ ও তার আশেপাশের সব জায়গায় ছড়িয়ে গেল। সেই লোকেরা ঈসার কাছে এসে বলল, “তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া আপনার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা করতে পাঠিয়েছেন, ‘যাঁর আসবার কথা আছে আপনিই কি তিনি, না আমরা অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করব?” তখন ঈসা অনেক লোককে রোগ থেকে ও ভীষণ যন্ত্রণা থেকে সুস্থ করলেন এবং ভূতে পাওয়া লোকদের ভাল করলেন আর অনেক অন্ধ লোককেও দেখবার শক্তি দিলেন। এই সব করবার পরে ঈসা ইয়াহিয়ার সাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, “তোমরা যা দেখলে ও শুনলে তা গিয়ে ইয়াহিয়াকে বল। তাঁকে জানাও যে, অন্ধেরা দেখছে, খোঁড়ারা হাঁটছে, চর্মরোগীরা পাক-সাফ হচ্ছে, বধির লোকেরা শুনছে, মৃতেরা বেঁচে উঠছে এবং গরীবদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করা হচ্ছে। আর ধন্য সে-ই, যে আমাকে নিয়ে মনে কোন বাধা না পায়।” ইয়াহিয়া যাদের পাঠিয়েছিলেন সেই লোকেরা চলে গেলে পর ঈসা লোকদের কাছে ইয়াহিয়ার বিষয়ে বলতে লাগলেন, “আপনারা মরুভূমিতে কি দেখতে গিয়েছিলেন? বাতাসে দোলা নল-খাগড়া? তা না হলে কি দেখতে গিয়েছিলেন? সুন্দর কাপড় পরা একজন লোককে কি? যারা দামী দামী কাপড় পরে ও জাঁকজমকের সংগে বাস করে তারা তো রাজবাড়ীতে থাকে। তা না হলে কি দেখতে গিয়েছিলেন? কোন নবীকে কি? জ্বী, আমি আপনাদের বলছি, তিনি নবীর চেয়েও বড়। ইয়াহিয়াই সেই লোক যাঁর বিষয়ে পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘দেখ, আমি তোমার আগে আমার সংবাদদাতাকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার আগে গিয়ে তোমার পথ প্রস্তুত করবে।’ আমি আপনাদের বলছি, মানুষের মধ্যে কেউই ইয়াহিয়ার চেয়ে বড় নয়; তবুও আল্লাহ্‌র রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট সেও ইয়াহিয়ার চেয়ে মহান।” (সমস্ত সাধারণ লোকেরা ও খাজনা-আদায়কারীরা ইয়াহিয়ার তবলিগ শুনেছিল এবং তাঁর কাছে তরিকাবন্দী গ্রহণ করে আল্লাহ্‌কে ন্যায়বান বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু ফরীশীরা ও আলেমেরা ইয়াহিয়ার কাছে তরিকাবন্দী গ্রহণ করেন নি বলে নিজেদের জন্য আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যকে তাঁরা অগ্রাহ্য করেছিলেন)। ঈসা আরও বললেন, “তা হলে এই কালের লোকদের আমি কাদের সংগে তুলনা করব? তারা কি রকম? তারা এমন ছেলেমেয়েদের মত যারা বাজারে বসে একে অন্যকে ডেকে বলে, ‘আমরা তোমাদের জন্য বাঁশী বাজালাম কিন্তু তোমরা নাচলে না; আমরা বিলাপের গান গাইলাম কিন্তু তোমরা কাঁদলে না।’ তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া এসে রুটি বা আংগুর-রস খেলেন না বলে আপনারা বলছেন, ‘তাকে ভূতে পেয়েছে।’ আর ইব্‌ন্তেআদম এসে খাওয়া-দাওয়া করলেন বলে আপনারা বলছেন, ‘দেখ, এই লোকটা পেটুক ও মদখোর, খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকদের বন্ধু।’ কিন্তু জ্ঞানের অধীনে যারা চলে তাদের জীবনই প্রমাণ করে যে, জ্ঞান খাঁটি। একজন ফরীশী ঈসাকে তাঁর সংগে খাবার দাওয়াত করলেন। তখন ঈসা তাঁর বাড়ীতে গিয়ে ভোজে যোগ দিলেন। সেই গ্রামে একজন খারাপ স্ত্রীলোক ছিল। সেই ফরীশীর ঘরে ঈসা ভোজে যোগ দিয়েছেন জানতে পেরে সে একটা সাদা পাথরের পাত্রে করে আতর নিয়ে আসল। পরে সে ঈসার পিছনে তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল এবং কেঁদে কেঁদে চোখের পানিতে তাঁর পা ভিজাতে লাগল। তারপর সে তার মাথার চুল দিয়ে তাঁর পা মুছিয়ে দিল এবং তাঁর পায়ের উপর চুমু দিয়ে সেই আতর ঢেলে দিল। যে ফরীশী ঈসাকে দাওয়াত করেছিলেন তিনি এ দেখে মনে মনে বলতে লাগলেন, “যদি এই লোকটা নবী হত তবে জানতে পারত, কে এবং কি রকম স্ত্রীলোক তার পা ছুঁচ্ছে; স্ত্রীলোকটা তো খারাপ।” ঈসা সেই ফরীশীকে বললেন, “শিমোন, তোমাকে আমার কিছু বলবার আছে।” শিমোন বললেন, “হুজুর, বলুন।” ঈসা বললেন, “কোন এক মহাজনের কাছে দু’জন লোক টাকা ধারত। একজন ধারত পাঁচশো দীনার আর অন্যজন পঞ্চাশ দীনার। তাদের কারও ঋণ শোধ দেবার ক্ষমতা ছিল না বলে তিনি দয়া করে দু’জনকেই মাফ করলেন। তা হলে বল দেখি, তাদের দু’জনের মধ্যে কে সেই মহাজনকে বেশী ভালবাসবে?” শিমোন বললেন, “আমার মনে হয়, যার বেশী ঋণ মাফ করা হল সে-ই।” ঈসা তাঁকে বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ।” তারপর ঈসা সেই স্ত্রীলোকটির দিকে মুখ ফিরিয়ে শিমোনকে বললেন, “তুমি এই স্ত্রীলোকটিকে তো দেখছ। আমি তোমার ঘরে আসলে পর তুমি আমার পা ধোবার পানি দাও নি, কিন্তু সে চোখের পানিতে আমার পা ভিজিয়ে তার চুল দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছে। তুমি আমাকে চুমু দাও নি, কিন্তু আমি ঘরে আসবার পর থেকেই সে আমার পায়ে চুমু দিচ্ছে। তুমি আমার মাথায় তেল দাও নি, কিন্তু সে আমার পায়ের উপর আতর ঢেলে দিয়েছে। তাই আমি তোমাকে বলছি, সে বেশী ভালবাসা দেখিয়েছে বলে বুঝা যাচ্ছে যে, তার গুনাহ্‌ অনেক হলেও তা মাফ করা হয়েছে। যার অল্প মাফ করা হয় সে অল্পই ভালবাসা দেখায়।” পরে ঈসা সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তোমার গুনাহ্‌ মাফ করা হয়েছে।” যারা ঈসার সংগে খেতে বসেছিল তারা মনে মনে বলতে লাগল, “এ কে, যে গুনাহ্‌ও মাফ করে?” ঈসা তখন সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তুমি ঈমান এনেছ বলে নাজাত পেয়েছ। শান্তিতে চলে যাও।” বাদশাহ্‌ হেরোদের কর্মচারী কূষের স্ত্রী যোহানা; শোশন্না এবং আরও অনেক স্ত্রীলোক। ঈসা ও তাঁর সাহাবীদের সেবা-যত্নের জন্য এঁরা সবাই নিজের টাকা-পয়সা থেকে খরচ করতেন। সেই সময় ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক লোক ঈসার কাছে এসে ভিড় করল। তখন তিনি তাদের শিক্ষা দেবার জন্য এই গল্পটা বললেন: “একজন চাষী বীজ বুনতে গেল। বীজ বুনবার সময় কতগুলো বীজ পথের পাশে পড়ল। লোকেরা সেগুলো পায়ে মাড়াল এবং পাখীরা এসে খেয়ে ফেলল। কতগুলো বীজ পাথুরে জমিতে পড়ে গজিয়ে উঠল, কিন্তু রস না পেয়ে শুকিয়ে গেল। আবার কতগুলো বীজ কাঁটাবনের মধ্যে পড়ল। পরে কাঁটাগাছ সেই চারাগুলোর সংগে বেড়ে উঠে সেগুলো চেপে রাখল। আবার কতগুলো বীজ ভাল জমিতে পড়ল এবং বেড়ে উঠে একশো গুণ ফসল দিল।” এই কথা বলবার পরে ঈসা জোরে বললেন, “যার শুনবার কান আছে সে শুনুক।” এর পরে তাঁর সাহাবীরা তাঁকে সেই গল্পের অর্থ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন ঈসা বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্যের গোপন সত্যগুলো তোমাদেরই জানতে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যদের কাছে আমি তা গল্পের মধ্য দিয়ে বলি, যেন তারা দেখেও না দেখে আর শুনেও না বোঝে। “গল্পটার মানে এই: বীজ হল আল্লাহ্‌র কালাম। পথের পাশে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শোনে বটে, কিন্তু পরে ইবলিস এসে তাদের দিল থেকে তা তুলে নিয়ে যায়। তাতে তারা তার উপর ঈমান আনতে পারে না বলে নাজাত পায় না। পাথুরে জমিতে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সেই কালাম শুনে আনন্দের সংগে গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে তার শিকড় ভাল করে বসে না। তাই তারা অল্প দিনের জন্য ঈমান রাখে, কিন্তু যখন পরীক্ষা আসে তখন পিছিয়ে যায়। কাঁটাবনের মধ্যে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা তা শোনে, কিন্তু জীবন্তপথে চলতে চলতে সংসারের চিন্তা-ভাবনা, ধন-সম্পত্তি এবং সুখভোগের মধ্যে তারা চাপা পড়ে যায়। তাতে তাদের জীবনে কোন পাকা ফল দেখা দেয় না। ভাল জমিতে পড়া বীজের মধ্য দিয়ে তাদের সম্বন্ধেই বলা হয়েছে যারা সৎ ও সরল মনে সেই কালাম শুনে শক্ত করে ধরে রাখে এবং তাতে স্থির থেকে জীবনে পাকা ফল দেখায়। “কেউ বাতি জ্বালিয়ে কোন পাত্র দিয়ে তা ঢেকে রাখে না বা খাটের নীচে রাখে না। সে তা বাতিদানের উপরেই রাখে যেন ভিতরে যারা আসে তারা আলো দেখতে পায়। এমন কিছু লুকানো নেই যা প্রকাশিত হবে না, বা এমন কিছু গোপন নেই যা জানা যাবে না কিংবা প্রকাশ পাবে না। এইজন্য কিভাবে শুনছ সেই বিষয়ে মনোযোগ দাও, কারণ যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে, কিন্তু যার নেই তার যা আছে বলে সে মনে করে, তাও তার কাছে থেকে নিয়ে নেওয়া হবে।” পরে ঈসার মা ও ভাইয়েরা তাঁর কাছে আসলেন কিন্তু ভিড়ের জন্য তাঁর সংগে দেখা করতে পারলেন না। তখন একজন লোক তাঁকে বলল, “আপনার মা ও ভাইয়েরা আপনার সংগে দেখা করবার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।” এতে ঈসা লোকদের বললেন, “যারা আল্লাহ্‌র কালাম শুনে সেইমত কাজ করে তারাই আমার মা ও আমার ভাই।” একদিন ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা একটা নৌকায় উঠলেন। তিনি সাহাবীদের বললেন, “চল, আমরা সাগরের ওপারে যাই।” সাহাবীরা নৌকা ছাড়লেন। নৌকা চলতে থাকলে ঈসা ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই সময় হঠাৎ সাগরে ঝড় উঠল এবং নৌকাটা পানিতে পূর্ণ হতে লাগল। এতে তাঁরা খুব বিপদে পড়লেন। তাঁরা ঈসার কাছে গিয়ে তাঁকে জাগিয়ে বললেন, “হুজুর, হুজুর, আমরা যে মরলাম!” তখন ঈসা উঠে বাতাস ও পানির ঢেউকে ধমক্‌ দিলেন। তাতে বাতাস আর ঢেউ থামল এবং সব কিছু শান্ত হয়ে গেল। তিনি সাহাবীদের বললেন, “তোমাদের ঈমান কোথায়?” সাহাবীরা ভয়ে আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “ইনি কে, যিনি বাতাস ও পানিকে হুকুম দিলে পর তারাও তাঁর কথা শোনে?” এর পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা সাগর পার হয়ে গালীল প্রদেশের উল্টা দিকে গাদারীয়দের এলাকায় গেলেন। তিনি যখন নৌকা থেকে নামলেন তখন সেখানকার গ্রামের একজন লোক তাঁর কাছে আসল। সেই লোকটিকে অনেকগুলো ভূতে পেয়েছিল বলে সে অনেক দিন ধরে কাপড়-চোপড় পরত না এবং বাড়ীতে না থেকে কবরস্থানে থাকত। ঈসাকে দেখে সে চিৎকার করে উঠল এবং তাঁর সামনে মাটিতে পড়ে জোরে জোরে বলল, “আল্লাহ্‌তা’লার পুত্র ঈসা, আমার সংগে আপনার কি সম্বন্ধ? দয়া করে আপনি আমাকে যন্ত্রণা দেবেন না।” লোকটি এই কথা বলল কারণ ঈসা সেই ভূতকে তার মধ্য থেকে বের হয়ে যেতে হুকুম দিয়েছিলেন। সেই ভূত বার বার লোকটিকে আঁকড়ে ধরত। যদিও তখন তার হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা থাকত এবং তাকে পাহারা দেওয়া হত তবুও সে সেই শিকল ছিঁড়ে ফেলত, আর সেই ভূত তাকে নির্জন জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে যেত। ঈসা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কি?” সে বলল, “বাহিনী,” কারণ অনেকগুলো ভূত তার ভিতরে ঢুকেছিল। তখন সেই ভূতগুলো ঈসাকে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যেন তিনি তাদের হাবিয়া-দোজখে না পাঠান। যারা শূকর চরাচ্ছিল তারা এই ঘটনা দেখে দৌড়ে গিয়ে সেই গ্রামে ও তার আশেপাশের সব জায়গায় এই খবর দিল। কি হয়েছে তা দেখবার জন্য তখন লোকেরা বের হয়ে আসল। ঈসার কাছে এসে তারা দেখল, যার মধ্য থেকে ভূতগুলো বের হয়ে গেছে সে কাপড়-চোপড় পরে সুস্থ মনে ঈসার পায়ের কাছে বসে আছে। এ দেখে তারা ভয় পেল। যারা সেই ঘটনা দেখেছিল তারা ঐ লোকদের কাছে বলল কেমন করে লোকটা সুস্থ হয়েছে। তখন গাদারীয়দের এলাকার সমস্ত লোক ঈসাকে তাদের কাছ থেকে চলে যেতে অনুরোধ করল, কারণ তারা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তখন ঈসা ফিরে যাবার জন্য নৌকায় উঠলেন। যে লোকটির মধ্য থেকে ভূতগুলো বের হয়ে গিয়েছিল সেই লোকটি ঈসাকে অনুরোধ করল যেন সে তাঁর সংগে যেতে পারে। ঈসা কিন্তু তাকে এই কথা বলে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন, “তুমি বাড়ী ফিরে যাও এবং আল্লাহ্‌ তোমার জন্য কত বড় কাজ করেছেন তা প্রচার কর।” সেই লোকটি তখন গ্রামে গেল এবং ঈসা তার জন্য কত বড় কাজ করেছেন তা সমস্ত জায়গায় বলে বেড়াতে লাগল। ঈসা অন্য পারে ফিরে যাবার পর সেখানকার লোকেরা তাঁকে খুশী মনে গ্রহণ করল, কারণ তারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। পরে যায়ীর নামে মজলিস-খানার একজন নেতা এসে ঈসার পায়ের উপর পড়লেন। তিনি ঈসাকে তাঁর বাড়ীতে আসবার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন, কারণ তাঁর বারো বছরের একমাত্র মেয়েটি মরবার মত হয়েছিল। ঈসা যখন যাচ্ছিলেন তখন লোকেরা তাঁর চারদিকে ভিড় করে ঠেলাঠেলি করছিল। তাদের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক বারো বছর ধরে রক্তস্রাব রোগে ভুগছিল। ডাক্তারদের পিছনে সে তার সব কিছুই খরচ করেছিল, কিন্তু কেউই তাকে ভাল করতে পারে নি। সে পিছন দিক থেকে ঈসার কাছে এসে তাঁর চাদরের কিনারা ছুঁলো, আর তখনই তার রক্তস্রাব বন্ধ হল। তখন ঈসা বললেন, “কে আমাকে ছুঁলো?” সবাই অস্বীকার করলে পর পিতর ও তাঁর সংগীরা ঈসাকে বললেন, “হুজুর, লোকেরা আপনার চারপাশে চাপাচাপি করে আপনার উপর পড়ছে।” তবুও ঈসা বললেন, “আমি জানি কেউ আমাকে ছুঁয়েছে, কারণ আমি বুঝতে পারলাম আমার মধ্য থেকে শক্তি বের হল।” সেই স্ত্রীলোকটি যখন দেখল সে ধরা পড়েছে তখন কাঁপতে কাঁপতে ঈসার সামনে সে উবুড় হয়ে পড়ল। পরে সকলের সামনেই সে ঈসাকে বলল কেন সে তাঁকে ছুঁয়েছিল, আর কেমন করে সে তখনই ভাল হয়েছে। এতে ঈসা সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “মা, তুমি বিশ্বাস করেছ বলে ভাল হয়েছ। শান্তিতে চলে যাও।” ঈসা তখনও কথা বলছেন এমন সময় সেই মজলিস-খানার নেতার বাড়ী থেকে একজন এসে বলল, “আপনার মেয়েটি মারা গেছে; ওস্তাদকে আর কষ্ট দেবেন না। এই কথা শুনে ঈসা যায়ীরকে বললেন, “ভয় করবেন না; কেবল বিশ্বাস করুন, তাতেই সে বাঁচবে।” ঈসা যায়ীরের বাড়ীতে পৌঁছে পিতর, ইউহোন্না ও ইয়াকুব এবং মেয়েটির মা-বাবা ছাড়া আর কাউকে ঘরের ভিতরে আসতে দিলেন না। সবাই মেয়েটির জন্য কান্নাকাটি ও বিলাপ করছিল। তখন ঈসা বললেন, “আর কেঁদো না। মেয়েটি মারা যায় নি, ঘুমাচ্ছে।” লোকেরা ঠাট্টা করতে লাগল, কারণ তারা জানত মেয়েটি মারা গেছে। পরে ঈসা মেয়েটির হাত ধরে ডেকে বললেন, “খুকী, ওঠো।” এতে মেয়েটির প্রাণ ফিরে আসল, আর সে তখনই উঠে দাঁড়াল। তখন ঈসা হুকুম দিলেন যেন মেয়েটিকে কিছু খেতে দেওয়া হয়। মেয়েটির মা-বাবা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঈসা তাঁদের নিষেধ করে দিলেন যেন এই ঘটনার কথা তাঁরা কাউকে না বলেন। এর পরে ঈসা সেই বারোজন সাহাবীকে ডেকে একত্র করলেন এবং সব ভূতের উপরে ক্ষমতা ও অধিকার দান করলেন। তিনি তাঁদের রোগ ভাল করবার ক্ষমতাও দিলেন। তারপর তিনি তাঁদের আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে তবলিগ করতে ও রোগীদের সুস্থ করতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “তোমরা পথের জন্য লাঠি, থলি, রুটি বা টাকা কিছুই নিয়ো না, এমন কি, দু’টা করে কোর্তাও না। যে বাড়ীতে তোমরা ঢুকবে সেই গ্রাম না ছাড়া পর্যন্ত সেই বাড়ীতেই থেকো। যদি লোকে তোমাদের গ্রহণ না করে তবে তাদের গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় তোমাদের পায়ের ধুলা ঝেড়ে ফেলো, যেন সেটাই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।” তখন সাহাবীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে আল্লাহ্‌র রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করতে এবং রোগ ভাল করতে লাগলেন। ঈসা যা করছিলেন সেই সব কথা শুনে শাসনকর্তা হেরোদ কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। এর কারণ হল, কেউ কেউ বলছিল নবী ইয়াহিয়া মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছেন; কেউ কেউ বলছিল নবী ইলিয়াস দেখা দিয়েছেন; আবার কেউ কেউ বলছিল অনেক দিন আগেকার একজন নবী বেঁচে উঠেছেন। হেরোদ বললেন, “আমি তো ইয়াহিয়ার মাথা কেটে ফেলেছি। তবে যার বিষয়ে আমি এই সব শুনছি, সে কে?” হেরোদ ঈসাকে দেখবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ঈসা যে সাহাবীদের পাঠিয়েছিলেন তাঁরা ফিরে আসলেন এবং কি কি করেছেন সব কিছু তাঁরা ঈসাকে বললেন। তখন ঈসা তাঁদের নিয়ে বৈৎসৈদা গ্রামের কাছে একটা নির্জন জায়গায় গেলেন। সেই খবর জানতে পেরে অনেক লোক ঈসার পিছনে পিছনে চলল। তিনি সেই লোকদের গ্রহণ করলেন এবং তাদের কাছে আল্লাহ্‌র রাজ্যের কথা বললেন। এছাড়া যাদের সুস্থ হবার দরকার ছিল তিনি তাদের সুস্থ করলেন। যখন বেলা শেষ হয়ে আসল তখন সেই বারোজন সাহাবী এসে ঈসাকে বললেন, “আমরা যেখানে আছি সেটা একটা নির্জন জায়গা। তাই এই লোকদের বিদায় দিন যেন তারা কাছের পাড়ায় এবং গ্রামগুলোতে গিয়ে খাবার এবং থাকবার জায়গা খুঁজে নিতে পারে।” ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরাই ওদের খেতে দাও।” তাঁরা বললেন, “কিন্তু আমাদের কাছে কেবল পাঁচটা রুটি আর দু’টা মাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। কেবল যদি আমরা গিয়ে এই সব লোকদের জন্য খাবার কিনে আনতে পারতাম তবেই তাদের খাওয়ানো যেত।” সেখানে কমবেশি পাঁচ হাজার পুরুষ লোক ছিল। ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “পঞ্চাশজন পঞ্চাশজন করে এক এক দলে লোকদের বসিয়ে দাও।” সাহাবীরা সেই ভাবেই সব লোকদের বসিয়ে দিলেন। তখন ঈসা সেই পাঁচটা রুটি আর দু’টা মাছ নিয়ে আসমানের দিকে তাকালেন এবং সেগুলোর জন্য আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাবার পর টুকরা টুকরা করলেন। তারপর তিনি লোকদের দেবার জন্য সেগুলো সাহাবীদের হাতে দিলেন। লোকেরা সবাই পেট ভরে খেল। পরে যে টুকরাগুলো পড়ে রইল তা বারোটা টুকরিতে তুলে নেওয়া হল। একবার ঈসা একটা নির্জন জায়গায় মুনাজাত করছিলেন। তাঁর সংগে কেবল তাঁর সাহাবীরাই ছিলেন। তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কে, এই বিষয়ে লোকে কি বলে?” সাহাবীরা বললেন, “কেউ কেউ বলে আপনি তরিকাবন্দীদাতা ইয়াহিয়া; কেউ কেউ বলে নবী ইলিয়াস; আবার কেউ কেউ বলে অনেক দিন আগেকার একজন নবী বেঁচে উঠেছেন।” ঈসা তাঁদের বললেন, “কিন্তু তোমরা কি বল, আমি কে?” পিতর বললেন, “আপনি আল্লাহ্‌র সেই মসীহ্‌।” তখন ঈসা তাঁদের সাবধান করলেন এবং হুকুম দিলেন যেন তাঁরা কাউকে এই কথা না বলেন। তিনি তাঁদের আরও বললেন, ইব্‌ন্তেআদমকে অনেক দুঃখভোগ করতে হবে। বৃদ্ধনেতারা, প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা তাঁকে অগ্রাহ্য করবেন। তাঁকে হত্যা করা হবে এবং তিন দিনের দিন তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠতে হবে। তারপর তিনি সবাইকে বললেন, “যদি কেউ আমার পথে আসতে চায়, তবে সে নিজের ইচ্ছামত না চলুক; প্রত্যেক দিন নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে সে আমার পিছনে আসুক। যে কেউ তার নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চায় সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে; কিন্তু যে আমার জন্য তার প্রাণ হারায় সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে। যদি কেউ সমস্ত দুনিয়া লাভ করে তার বিনিময়ে তার সত্যিকারের জীবন হারায় তবে তার কি লাভ হল? যদি কেউ আমাকে নিয়ে ও আমার কথা নিয়ে লজ্জা বোধ করে, তবে ইব্‌ন্তেআদম যখন নিজের মহিমা এবং পিতা ও পবিত্র ফেরেশতাদের মহিমায় আসবেন তখন তিনিও সেই লোকের সম্বন্ধে লজ্জা বোধ করবেন। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এখানে এমন কয়েকজন আছে যাদের কাছে আল্লাহ্‌র রাজ্য দেখা না দেওয়া পর্যন্ত তারা কোনমতেই মারা যাবে না।” এই সব কথা বলবার প্রায় এক সপ্তা পরে ঈসা মুনাজাত করবার জন্য পিতর, ইউহোন্না ও ইয়াকুবকে নিয়ে একটা পাহাড়ে গেলেন। মুনাজাত করবার সময় ঈসার মুখের চেহারা বদলে গেল এবং তাঁর কাপড়-চোপড় উজ্জ্বল সাদা হয়ে গেল, আর দু’জন লোককে তাঁর সংগে কথা বলতে দেখা গেল। সেই দু’জন ছিলেন নবী মূসা এবং নবী ইলিয়াস। তাঁরা মহিমার সংগে দেখা দিলেন। জেরুজালেমে যে মৃত্যুর সামনে ঈসা উপস্থিত হতে যাচ্ছিলেন তাঁরা সেই বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। পিতর ও তাঁর সংগীরা সেই সময় অঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁরা জেগে উঠে ঈসার মহিমা দেখতে পেলেন এবং তাঁর সংগে দাঁড়ানো সেই দু’জন লোককেও দেখলেন। সেই দু’জন যখন ঈসার কাছ থেকে চলে যাচ্ছিলেন তখন পিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, ভালই হয়েছে যে, আমরা এখানে আছি। আমরা এখানে তিনটা কুঁড়ে-ঘর তৈরী করি- একটা আপনার, একটা মূসার ও একটা ইলিয়াসের জন্য।” তিনি যে কি বলছিলেন তা নিজেই বুঝলেন না। পিতর যখন কথা বলছিলেন তখন একটা মেঘ এসে তাঁদের ঢেকে ফেলল। তাঁরা সেই মেঘের মধ্যে ঢাকা পড়লে পর সাহাবীরা ভয় পেলেন। সেই মেঘ থেকে এই কথা শোনা গেল, “ইনিই আমার পুত্র যাঁকে আমি বেছে নিয়েছি; তোমরা এঁর কথা শোন।” যখন কথা থেমে গেল তখন দেখা গেল ঈসা একাই আছেন। সাহাবীরা যা দেখেছিলেন সেই বিষয়ে সেই সময় কাউকে কিছু না বলে তাঁরা চুপ করে রইলেন। পরের দিন ঈসা ও সেই তিনজন সাহাবী পাহাড় থেকে নেমে আসলে পর অনেক লোক ঈসার সংগে দেখা করতে আসল। তখন ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লোক চিৎকার করে ঈসাকে বলল, “হুজুর, দয়া করে আমার ছেলেটাকে দেখুন। সে আমার একমাত্র ছেলে। তাকে একটা ভূতে ধরে এবং সে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। সেই ভূত যখন তাকে মুচড়ে ধরে তখন তার মুখ থেকে ফেনা বের হয়; তারপর সে তাকে খুব কষ্ট দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ছেড়ে দেয়। আমি আপনার সাহাবীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলাম যেন তাঁরা সেই ভূতকে ছাড়িয়ে দেন, কিন্তু তাঁরা পারলেন না।” তখন ঈসা বললেন, “বেঈমান ও দুষ্ট লোকেরা! আর কতদিন আমি তোমাদের সংগে থাকব ও তোমাদের সহ্য করব? তোমার ছেলেকে এখানে আন।” ছেলেটা যখন আসছিল তখন সেই ভূত তাকে আছাড় মেরে মুচড়ে ধরল। এতে ঈসা সেই ভূতকে ধমক দিলেন এবং ছেলেটিকে সুস্থ করে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহ্‌ যে কত মহান তা দেখে সবাই আশ্চর্য হল। ঈসা যা করছিলেন সেই বিষয়ে সবাই যখন আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল তখন তিনি তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমার এই কথা মন দিয়ে শোন, ইব্‌ন্তেআদমকে লোকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে।” সাহাবীরা কিন্তু সেই কথা বুঝলেন না। আল্লাহ্‌ তাঁদের কাছ থেকে তা গোপন রেখেছিলেন যেন তাঁরা বুঝতে না পারেন। এই নিয়ে কোন কথা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহাবীদের ভয় হল। সাহাবীদের মধ্যে কে সবচেয়ে বড় সেই বিষয়ে তাঁদের মধ্যে তর্ক হচ্ছিল। ঈসা তাঁদের মনের চিন্তা বুঝতে পেরে একটা শিশুকে নিয়ে নিজের পাশে দাঁড় করালেন। তারপর তিনি তাঁদের বললেন, “যে কেউ আমার নামে এই শিশুকে গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে। যে আমাকে গ্রহণ করে, আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন সে তাঁকেই গ্রহণ করে। তোমাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট, সে-ই বড়।” ইউহোন্না বললেন, “হুজুর, আপনার নামে আমরা একজনকে ভূত ছাড়াতে দেখেছি। সে আমাদের দলের লোক নয় বলে আমরা তাকে নিষেধ করেছি।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আর নিষেধ কোরো না, কারণ যে তোমাদের বিপক্ষে থাকে না সে তো তোমাদের পক্ষেই আছে।” যখন ঈসার বেহেশতে যাবার সময় হয়ে আসল তখন তিনি জেরুজালেমে যাবার জন্য মন স্থির করলেন। তিনি আগেই সেখানে লোকদের পাঠিয়ে দিলেন। তারা ঈসার জন্য সব কিছু ব্যবস্থা করতে সামেরীয়দের একটা গ্রামে ঢুকল, কিন্তু ঈসা জেরুজালেমে যাচ্ছেন বলে সেই গ্রামের লোকেরা তাঁকে গ্রহণ করল না। তা দেখে তাঁর সাহাবী ইয়াকুব ও ইউহোন্না বললেন, “হুজুর, আপনি কি চান যে, নবী ইলিয়াসের মত আমরা এদের ধ্বংস করবার জন্য বেহেশত থেকে আগুন নেমে আসতে বলব?” ঈসা তাঁদের দিকে ফিরে তাঁদের ধমক দিলেন। তারপর তাঁরা অন্য গ্রামে গেলেন। তাঁরা পথে যাচ্ছেন এমন সময় একজন লোক ঈসাকে বলল, “আপনি যেখানে যাবেন আমিও আপনার সংগে সেখানে যাব।” ঈসা তাকে বললেন, “শিয়ালের গর্ত আছে এবং পাখীর বাসা আছে, কিন্তু ইব্‌ন্তেআদমের মাথা রাখবার জায়গা কোথাও নেই।” পরে তিনি অন্য আর একজনকে বললেন, “আমার সংগে চল।” কিন্তু সেই লোক বলল, “হুজুর, আগে আমার বাবাকে দাফন করে আসতে দিন।” ঈসা তাকে বললেন, “মৃতেরাই তাদের মৃতদের দাফন করুক, কিন্তু তুমি এসে আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে তবলিগ কর।” আর একজন বলল, “হুজুর, আমি আপনার সংগে যাব, কিন্তু আগে আমার বাড়ী থেকে আমাকে বিদায় নিয়ে আসতে দিন।” ঈসা তাকে বললেন, “লাংগলে হাত দিয়ে যে পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে সে আল্লাহ্‌র রাজ্যের উপযুক্ত নয়।” এর পরে হযরত ঈসা আরও সত্তরজন সাহাবীকে তবলিগে পাঠাবার জন্য বেছে নিলেন। তিনি নিজে যে যে গ্রামে ও যে যে জায়গায় যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন সেই সব জায়গায় যাবার আগে সাহাবীদের দু’জন দু’জন করে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি সাহাবীদের বললেন, “সত্যিই ফসল অনেক, কিন্তু কাজ করবার লোক কম। এইজন্য ফসলের মালিকের কাছে অনুরোধ কর যেন তিনি তাঁর ফসল কাটবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেন। তোমরা যাও; নেকড়ে বাঘের মধ্যে ভেড়ার মতই আমি তোমাদের পাঠাচ্ছি। টাকার থলি, ঝুলি বা জুতা সংগে নিয়ো না এবং রাস্তায় কাউকে সালাম জানায়ো না। তোমরা যে বাড়ীতে যাবে প্রথমে বলবে, ‘এই বাড়ীতে শান্তি হোক।’ শান্তি ভালবাসে এমন কেউ যদি সেখানে থাকে তবে তোমাদের শান্তি তার উপরে থাকবে, কিন্তু যদি সেই রকম কেউ না থাকে তবে তোমাদের শান্তি তোমাদের কাছেই ফিরে আসবে। সেই বাড়ীতেই থেকো এবং তারা যা দেয় তা-ই খেয়ো, কারণ যে কাজ করে সে বেতন পাবার যোগ্য। এক বাড়ী ছেড়ে অন্য বাড়ীতে যেয়ো না। “যদি কোন গ্রামে যাও এবং সেখানকার লোকেরা তোমাদের গ্রহণ করে তবে তোমাদের যা খেতে দেওয়া হয় তা-ই খেয়ো। সেই গ্রামের অসুস্থদের সুস্থ কোরো এবং তাদের বোলো, ‘আল্লাহ্‌র রাজ্য তোমাদের কাছে এসেছে।’ কিন্তু যদি কোন গ্রামে যাও এবং সেখানকার লোকেরা তোমাদের গ্রহণ না করে তবে সেই গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে এই কথা বোলো, ‘তোমাদের গ্রামের যে ধুলা আমাদের পায়ে লেগেছে তাও আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে ঝেড়ে ফেললাম। তবুও তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহ্‌র রাজ্য কাছে এসে গেছে।’ আমি তোমাদের বলছি, রোজ হাশরে সেই গ্রামের চেয়ে বরং সাদুম শহরের লোকদের অবস্থা অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে। “ঘৃণ্য কোরাসীন! ঘৃণ্য বৈৎসৈদা! যে সব অলৌকিক কাজ তোমাদের মধ্যে করা হয়েছে তা যদি টায়ার ও সিডন শহরে করা হত, তবে তারা অনেক দিন আগেই চট পরে ছাইয়ের মধ্যে বসে তওবা করত। সত্যিই, রোজ হাশরে টায়ার ও সিডনের অবস্থা বরং তোমাদের চেয়ে অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে। আর তুমি, কফরনাহূম, তুমি নাকি বেহেশত পর্যন্ত উঁচুতে উঠবে? কখনও না, তোমাকে নীচে কবরে ফেলে দেওয়া হবে।” ঈসা আবার তাঁর সাহাবীদের বললেন, “যারা তোমাদের কথা শোনে তারা আমারই কথা শোনে। যারা তোমাদের অগ্রাহ্য করে তারা আমাকেই অগ্রাহ্য করে। যারা আমাকে অগ্রাহ্য করে, আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তারা তাঁকেই অগ্রাহ্য করে।” সেই সত্তরজন সাহাবী আনন্দের সংগে ফিরে এসে বললেন, “হুজুর, আপনার নাম করে বললে ভূতেরা পর্যন্ত আমাদের কথা শোনে।” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি শয়তানকে বেহেশত থেকে বিদ্যুৎ চম্‌কাবার মত করে পড়ে যেতে দেখেছি। দেখ, আমি তোমাদের সাপ ও বিছার উপর দিয়ে হেঁটে যাবার ক্ষমতা দিয়েছি এবং তোমাদের শত্রু শয়তানের সমস্ত শক্তির উপরেও ক্ষমতা দিয়েছি। কোন কিছুই তোমাদের ক্ষতি করবে না। কিন্তু ভূতেরা তোমাদের কথা শোনে বলে আনন্দিত হয়ো না বরং বেহেশতে তোমাদের নাম লেখা হয়েছে বলে আনন্দিত হয়ো।” তখন ঈসা পাক-রূহের দেওয়া আনন্দে আনন্দিত হয়ে বললেন, “হে পিতা, তুমি বেহেশত ও দুনিয়ার মালিক। আমি তোমার প্রশংসা করি, কারণ তুমি এই সব বিষয় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছ কিন্তু শিশুর মত লোকদের কাছে প্রকাশ করেছ। জ্বী পিতা, তোমার ইচ্ছামতই এটা হয়েছে। “আমার পিতা আমার হাতে সব কিছুই দিয়েছেন। পিতা ছাড়া আর কেউ জানে না পুত্র কে, আবার পুত্র ছাড়া আর কেউ জানে না পিতা কে। এছাড়া পুত্র যার কাছে পিতাকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করেন কেবল সে-ই জানে। পরে তিনি সাহাবীদের দিকে ফিরে তাঁদের গোপনে বললেন, “তোমরা যা যা দেখছ, তা যারা দেখতে পায় তারা ধন্য। আমি তোমাদের বলছি, তোমরা যা যা দেখছ, অনেক নবী ও বাদশাহ্‌ তা দেখতে চেয়েও দেখতে পান নি; আর তোমরা যা যা শুনছ, তা শুনতে চেয়েও শুনতে পান নি।” একবার একজন আলেম ঈসার কাছে আসলেন। ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য সেই আলেম বললেন, “হুজুর, কি করলে আমি অনন্ত জীবন লাভ করতে পারব?” ঈসা তাঁকে বললেন, “তৌরাত শরীফে কি লেখা আছে? সেখানে কি পড়েছেন?” সেই আলেম ঈসাকে জবাব দিলেন, “তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত শক্তি ও সমস্ত মন দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে; আর তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আপনি ঠিক জবাব দিয়েছেন। যদি আপনি তা করতে থাকেন তবে জীবন পাবেন।” সেই আলেম নিজের সম্মান রক্ষা করবার জন্য ঈসাকে বললেন, “আমার প্রতিবেশী কে?” ঈসা জবাব দিলেন, “একজন লোক জেরুজালেম থেকে জেরিকো শহরে যাবার সময় ডাকাতদের হাতে পড়ল। তারা লোকটির কাপড় খুলে ফেলল এবং তাকে মেরে আধমরা করে রেখে গেল। পরে একজন ইমাম সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সেই লোকটিকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। ঠিক সেইভাবে একজন লেবীয় সেই জায়গায় আসল এবং তাকে দেখতে পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তারপর সামেরিয়া প্রদেশের একজন লোকও সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে ঐ লোকটির কাছাকাছি আসল। তাকে দেখে তার মমতা হল। লোকটির কাছে গিয়ে সে তার আঘাতের উপর তেল আর আংগুর-রস ঢেলে দিয়ে বেঁধে দিল। তারপর তার নিজের গাধার উপর তাকে বসিয়ে একটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে তার সেবা-যত্ন করল। পরের দিন সেই সামেরীয় দু’টা দীনার বের করে হোটেলের মালিককে দিয়ে বলল, ‘এই লোকটিকে যত্ন করবেন। যদি এর চেয়ে বেশী খরচ হয় তবে আমি ফিরে এসে তা শোধ করব।’ ” শেষে ঈসা বললেন, “এখন আপনার কি মনে হয়? এই তিনজনের মধ্যে কে সেই ডাকাতদের হাতে পড়া লোকটির প্রতিবেশী?” সেই আলেম বললেন, “যে তাকে মমতা করল সেই লোক।” তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “তা হলে আপনিও গিয়ে সেই রকম করুন।” এর পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা পথ চলতে চলতে কোন একটা গ্রামে ঢুকলেন। সেখানে মার্থা নামে একজন স্ত্রীলোক খুশী হয়ে তাঁর ঘরে ঈসাকে গ্রহণ করলেন। মরিয়ম নামে মার্থার একটি বোন ছিলেন। তিনি ঈসার পায়ের কাছে বসে তাঁর কথা শুনছিলেন। মার্থা কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তিনি এসে বললেন, “হুজুর, আপনি কি দেখেন না, আমার বোন সমস্ত কাজ একা আমার উপর ফেলে দিয়েছে? আপনি ওকে বলুন যেন ও আমাকে সাহায্য করে।” তখন ঈসা মার্থাকে বললেন, “মার্থা, মার্থা, তুমি অনেক বিষয়ে চিনি-ত ও ব্যস্ত, কিন্তু একটাই মাত্র দরকারী বিষয় আছে। মরিয়ম সেই ভাল বিষয়টাই বেছে নিয়েছে। ওটা তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে না।” এক সময়ে ঈসা কোন একটা জায়গায় মুনাজাত করছিলেন। মুনাজাত শেষ হলে পর তাঁর একজন সাহাবী তাঁকে বললেন, “হুজুর, ইয়াহিয়া যেমন তাঁর সাহাবীদের মুনাজাত করতে শিখিয়েছিলেন তেমনি আমাদেরও আপনি মুনাজাত করতে শিখান।” ঈসা তাঁদের বললেন, “যখন তোমরা মুনাজাত কর তখন বোলো, ‘হে আমাদের বেহেশতী পিতা, তোমার নাম পবিত্র বলে মান্য হোক। তোমার রাজ্য আসুক। প্রত্যেক দিনের খাবার তুমি আমাদের প্রত্যেক দিন দাও। আমাদের গুনাহ্‌ মাফ কর, কারণ যারা আমাদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করে আমরা তাদের মাফ করি। আমাদের তুমি পরীক্ষায় পড়তে দিয়ো না।’ ” তারপর ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “মনে কর, মাঝ রাতে তোমাদের মধ্যে একজন তার বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে বলল, ‘বন্ধু, আমাকে তিনটা রুটি ধার দাও। আমার এক বন্ধু পথে যেতে যেতে আমার কাছে এসেছে। তাকে খেতে দেবার মত আমার কিছুই নেই।’ তখন ঘরের ভিতর থেকে তার বন্ধু জবাব দিল, ‘আমাকে কষ্ট দিয়ো না। দরজা এখন বন্ধ আর আমার ছেলেমেয়েরা বিছানায় আমার কাছে শুয়ে আছে। আমি উঠে তোমাকে কিছুই দিতে পারব না।’ আমি তোমাদের বলছি, সে যদি বন্ধু হিসাবে উঠে তাকে কিছু না-ও দেয়, তবু লোকটি বারবার অনুরোধ করছে বলে সে উঠবে এবং তার যা দরকার তা তাকে দেবে। “এইজন্য আমি তোমাদের বলছি, চাও, তোমাদের দেওয়া হবে; তালাশ কর, পাবে; দরজায় আঘাত কর, তোমাদের জন্য খোলা হবে। যারা চায় তারা প্রত্যেকে পায়; যে তালাশ করে সে পায়; আর যে দরজায় আঘাত করে তার জন্য দরজা খোলা হয়। তোমাদের মধ্যে এমন পিতা কে আছে, যে তার ছেলে রুটি চাইলে তাকে পাথর দেবে, কিংবা মাছ চাইলে সাপ দেবে, কিংবা ডিম চাইলে বিছা দেবে? তাহলে তোমরা খারাপ হয়েও যদি তোমাদের ছেলেমেয়েদের ভাল ভাল জিনিস দিতে জান, তবে যারা বেহেশতী পিতার কাছে চায়, তিনি যে তাদের পাক-রূহ্‌কে দেবেন এটা কত না নিশ্চয়!” অন্য এক সময়ে ঈসা একটা বোবা ভূত দূর করছিলেন। ভূত দূর হয়ে গেলে পর বোবা লোকটা কথা বলতে লাগল। এতে লোকেরা আশ্চর্য হল, কিন্তু কয়েকজন বলল, “ভূতদের বাদশাহ্‌ বেল্‌সবূলের সাহায্যে সে ভূত ছাড়ায়।” অন্য লোকেরা ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য বেহেশত থেকে একটা চিহ্ন দেখাতে বলল। তাদের মনের কথা বুুঝতে পেরে ঈসা বললেন, “যে রাজ্য নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সেই রাজ্য ধ্বংস হয়, আর তাতে সেই রাজ্যের পরিবারগুলোও ভাগ হয়ে যায়। শয়তানও যদি নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তবে কেমন করে তার রাজ্য টিকবে? আপনারা বলছেন আমি বেল্‌সবূলের সাহায্যে ভূত ছাড়াই। খুব ভাল, আমি যদি বেল্‌সবূলের সাহায্যেই তাদের ছাড়াই তবে আপনাদের লোকেরা কার সাহায্যে ভূত ছাড়ায়? আপনারা ঠিক কথা বলছেন কিনা আপনাদের লোকেরাই তা বিচার করবেন। কিন্তু আমি যদি আল্লাহ্‌র শক্তিতে ভূত ছাড়াই তবে আল্লাহ্‌র রাজ্য তো আপনাদের কাছে এসে গেছে। “একজন বলবান লোক সব রকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যখন নিজের ঘর পাহারা দেয় তখন তার জিনিসপত্র নিরাপদে থাকে। কিন্তু তার চেয়ে বলবান কেউ এসে যদি তাকে হামলা করে হারিয়ে দেয় তবে যে অস্ত্রশস্ত্রের উপর সে ভরসা করেছিল, অন্য লোকটি সেগুলো কেড়ে নেয় আর লুট-করা জিনিসগুলো ভাগ করে নেয়। “যদি কেউ আমার পক্ষে না থাকে তবে তো সে আমার বিপক্ষে আছে। যে আমার সংগে কুড়ায় না সে ছড়ায়। “কোন ভূত যখন একজন লোকের মধ্য থেকে বের হয়ে যায় তখন সে বিশ্রামের তালাশে শুকনা জায়গার মধ্য দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। পরে তা না পেয়ে সে বলে, ‘আমি যে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি আবার আমি সেই ঘরেই ফিরে যাব।’ ফিরে এসে সেই ঘরটা সে খালি, পরিষ্কার এবং সাজানো দেখতে পায়। তখন সে গিয়ে নিজের চেয়েও খারাপ অন্য আরও সাতটা ভূত সংগে করে নিয়ে আসে এবং সেখানে ঢুকে বাস করতে থাকে। তার ফলে সেই লোকটার প্রথম দশা থেকে শেষ দশা আরও খারাপ হয়।” ঈসা যখন কথা বলছিলেন তখন ভিড়ের মধ্য থেকে একজন স্ত্রীলোক চিৎকার করে বলল, “ধন্য সেই স্ত্রীলোক, যিনি আপনাকে গর্ভে ধরেছেন এবং বুকের দুধ খাইয়েছেন।” কিন্তু ঈসা বললেন, “এর চেয়ে বরং ধন্য তারা, যারা আল্লাহ্‌র কালাম শোনে এবং সেইমত কাজ করে।” আরও লোক ঈসার চারদিকে জমায়েত হতে থাকল। তখন ঈসা বললেন, “এই কালের লোকেরা খারাপ। তারা চিহ্নের তালাশ করে কিন্তু নবী ইউনুসের চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্ন তাদের দেখানো হবে না। নিনেভে শহরের লোকদের জন্য ইউনুস যেমন নিজেই চিহ্ন হয়েছিলেন ঠিক তেমনি করে এই কালের লোকদের জন্য ইব্‌ন্তেআদম চিহ্ন হবেন। রোজ হাশরে দক্ষিণ দেশের রাণী উঠে এই কালের লোকদের দোষ দেখিয়ে দেবেন, কারণ সোলায়মান বাদশাহ্‌র জ্ঞানের কথাবার্তা শুনবার জন্য তিনি দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে এসেছিলেন; আর দেখুন, এখানে সোলায়মানের চেয়েও আরও মহান একজন আছেন। রোজ হাশরে নিনেভে শহরের লোকেরা উঠে এই কালের লোকদের দোষ দেখিয়ে দেবে, কারণ নবী ইউনুসের তবলিগের ফলে নিনেভের লোকেরা তওবা করেছিল; আর দেখুন, এখানে ইউনুসের চেয়েও আরও মহান একজন আছেন। “কেউ বাতি জ্বেলে কোন গোপন জায়গায় বা ঝুড়ির নীচে রাখে না বরং বাতিদানের উপরেই রাখে, যেন ভিতরে যারা ঢোকে তারা আলো দেখতে পায়। আপনার চোখ হল আপনার শরীরের বাতি। যদি আপনার চোখ ভাল হয় তবে আপনার সমস্ত শরীর আলোতে পূর্ণ হবে, কিন্তু চোখ খারাপ হলে আপনার শরীরও অন্ধকারে পূর্ণ হবে। আপনার মধ্যে যে আলো আছে তা আসলে অন্ধকার কি না সেই বিষয়ে সাবধান হোন। আপনার সারা শরীর যদি আলোতে পূর্ণ হয় এবং একটুও অন্ধকার না থাকে তবে তা সম্পূর্ণ আলোময় হবে, ঠিক যেমন বাতির আলো আপনার উপর পড়লে আপনার শরীর আলোময় হয়।” ঈসা কথা বলা শেষ করলে পর একজন ফরীশী ঈসাকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। তখন ঈসা ভিতরে গিয়ে খেতে বসলেন। সেই ফরীশী যখন দেখলেন খাওয়ার আগে ঈসা শরীয়ত মত হাত ধুলেন না তখন তিনি অবাক হলেন। ঈসা তাঁকে বললেন, “তবে শুনুন, আপনারা, অর্থাৎ ফরীশীরা বাসন-কোসনের বাইরের দিকটা পরিষ্কার করে থাকেন, কিন্তু আপনাদের ভিতরটা লোভ ও খারাপীতে ভরা। আপনারা মূর্খ! যিনি বাইরের দিক তৈরী করেছেন তিনি কি ভিতরের দিকও তৈরী করেন নি? আপনাদের বাসন-কোসনের ভিতরে যা আছে তা-ই বরং ভিক্ষার মত দান করুন; দেখবেন, সব কিছুই আপনাদের কাছে পাক-সাফ হবে। “ঘৃণ্য ফরীশীরা! আপনারা আল্লাহ্‌কে পুদিনা, তেজপাতা ও সব রকম শাকের দশ ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন, কিন্তু ন্যায়বিচার ও আল্লাহ্‌র প্রতি মহব্বতের দিকে মনোযোগ দেন না। আগেরগুলো পালন করবার সংগে সংগে পরেরগুলোও পালন করা আপনাদের উচিত। “ঘৃণ্য ফরীশীরা! মজলিস-খানার প্রধান প্রধান আসনে বসতে এবং হাটে-বাজারে সম্মান পেতে আপনারা ভালবাসেন। ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা তো চিহ্ন না দেওয়া কবরের মত। লোকে না জেনে তার উপর দিয়ে হেঁটে যায়।” তখন আলেমদের মধ্যে একজন ঈসাকে বললেন, “হুজুর, এই কথা বলে আপনি আমাদেরও অপমান করছেন।” ঈসা বললেন, “ঘৃণ্য আলেমেরা! আপনারা লোকদের উপর ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, কিন্তু তাদের সাহায্য করবার জন্য নিজেরা একটা আংগুলও নাড়ান না। “ঘৃণ্য আপনারা! নবীদের কবর আপনারা নতুন করে গেঁথে থাকেন, অথচ আপনাদের পূর্বপুরুষেরাই তো তাঁদের খুন করেছিল। সেইজন্য আপনাদের পূর্বপুরুষদের কাজের সাক্ষী আপনারাই এবং তাদের সেই কাজ আপনারা মেনেও নিচ্ছেন। একদিকে তারা নবীদের খুন করেছে, অন্যদিকে আপনারা সেই নবীদের কবর গাঁথছেন। এইজন্য আল্লাহ্‌ তাঁর উদ্দেশ্য অনুসারে এই কথা বলেছেন, ‘আমি তাদের কাছে নবীদের ও প্রেরিত্‌দের পাঠিয়ে দেব। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে তারা খুন করবে এবং অন্যদের উপর জুলুম করবে।’ এর ফল হল, দুনিয়া সৃষ্টির সময় থেকে শুরু করে যতজন নবীকে খুন করা হয়েছে, তাঁদের রক্তের দায়ী হবে এই কালের লোকেরা। জ্বী, আমি আপনাদের বলছি, হাবিলের খুন থেকে শুরু করে যে জাকারিয়াকে কোরবানগাহ্‌ এবং পবিত্র স্থানের মধ্যে হত্যা করা হয়েছিল সেই জাকারিয়ার খুন পর্যন্ত সমস্ত রক্তের দায়ী হবে এই কালের লোকেরা। “ঘৃণ্য আলেমেরা! আপনারা জ্ঞানের চাবি নিয়ে গেছেন। নিজেরাও ভিতরে ঢোকেন নি এবং যারা ভিতরে ঢুকতে চাইছিল তাদের ও ঢুকতে দেন নি।” এর মধ্যে হাজার হাজার লোক এমনভাবে জমায়েত হল যে, তারা ঠেলাঠেলি করে একে অন্যের উপর পড়তে লাগল। তখন ঈসা প্রথমে তাঁর সাহাবীদের বললেন, “ফরীশীদের খামি থেকে সাবধান হও। সেই খামি হল তাঁদের ভণ্ডামি। লুকানো সব কিছুই প্রকাশ পাবে এবং গোপন সব কিছুই জানানো হবে। তোমরা অন্ধকারে যা বলেছ তা লোকে আলোতে শুনবে। ভিতরের ঘরে যা কানে কানে বলেছ তা ছাদের উপর থেকে প্রচার করা হবে। “বন্ধুরা আমার, আমি তোমাদের বলছি, যারা শরীর ধ্বংস করবার পরে আর কিছুই করতে পারে না তাদের ভয় কোরো না। কাকে ভয় করবে আমি তোমাদের তা বলে দিচ্ছি। তোমাদের হত্যা করবার পরে জাহান্নামে ফেলে দেবার ক্ষমতা যাঁর আছে তাঁকেই ভয় কোরো। জ্বী, আমি তোমাদের বলছি, তাঁকেই ভয় কোরো। “পাঁচটা চড়াই পাখী কি সামান্য দামে বিক্রি হয় না? তবুও আল্লাহ্‌ সেগুলোর একটাকেও ভুলে যান না। এমন কি, তোমাদের মাথার চুলগুলোও তাঁর গোণা আছে। ভয় কোরো না, অনেক অনেক চড়াই পাখীর চেয়েও তোমাদের মূল্য অনেক বেশী। “আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ লোকদের সামনে আমাকে স্বীকার করে ইব্‌ন্তেআদমও তাকে আল্লাহ্‌র ফেরেশতাদের সামনে স্বীকার করবেন। কিন্তু যে কেউ আমাকে লোকদের সামনে অস্বীকার করে তাকে আল্লাহ্‌র ফেরেশতাদের সামনে অস্বীকার করা হবে। ইব্‌ন্তেআদমের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে তাকে মাফ করা হবে, কিন্তু যদি কেউ পাক-রূহের বিরুদ্ধে কুফরী করে তাকে মাফ করা হবে না। লোকে তোমাদের যখন মজলিস-খানায় এবং শাসনকর্তা ও ক্ষমতাশালী লোকদের সামনে নিয়ে যাবে, তখন কিভাবে নিজের পক্ষে কথা বলবে বা কি জবাব দেবে সেই বিষয়ে চিনি-ত হোয়ো না। কি বলতে হবে পাক-রূহ্‌ই সেই মুহূর্তে তা তোমাদের শিখিয়ে দেবেন।” ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লোক ঈসাকে বলল, “হুজুর, আমাদের বাবা যে সম্পত্তি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, আমার ভাইকে তা আমার সংগে ভাগ করে নিতে বলুন।” ঈসা তাকে বললেন, “বিচার করবার বা আপনাদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দেবার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে?” তারপর ঈসা লোকদের বললেন, “সাবধান! সব রকম লোভের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করুন, কারণ অনেক বিষয়-সম্পত্তি থাকাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে দরকারী বিষয় নয়।” এর পরে ঈসা লোকদের শিক্ষা দেবার জন্য এই উদাহরণ দিলেন: “কোন একজন ধনী লোকের জমিতে অনেক ফসল হয়েছিল। এইজন্য সে মনে মনে বলতে লাগল, ‘এত ফসল রাখবার জায়গা তো আমার নেই; আমি এখন কি করি? আচ্ছা, আমি একটা কাজ করব। আমার গোলাঘরগুলো ভেংগে ফেলে বড় বড় গোলাঘর তৈরী করব এবং আমার সমস্ত ফসল ও ধন সেখানে রাখব। পরে আমি নিজেকে বলব, অনেক বছরের জন্য অনেক ভাল ভাল জিনিস জমা করা আছে। আরাম কর, খাওয়া-দাওয়া কর, আমোদ-আহ্‌লাদে দিন কাটাও।’ আল্লাহ্‌ কিন্তু তাকে বললেন, ‘ওহে বোকা, আজ রাতেই তোমাকে মরতে হবে। তাহলে যে সব জিনিস তুমি জমা করেছ সেগুলো কে ভোগ করবে?’ ” শেষে ঈসা বললেন, “যে লোক নিজের জন্য ধন-সম্পত্তি জমা করে অথচ আল্লাহ্‌র চোখে ধনী নয়, তার অবস্থা ঐ রকমই হয়।” এর পর ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “এইজন্যই আমি তোমাদের বলছি, কি খাবে বলে বেঁচে থাকবার বিষয়ে কিংবা কি পরবে বলে গায়ের বিষয়ে চিনি-ত হোয়ো না। প্রাণটা কেবল খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার নয়, আর শরীরটা কেবল কাপড়-চোপড়ের ব্যাপার নয়। কাকগুলোর দিকে চেয়ে দেখ, তারা বীজও বোনে না ফসলও কাটে না। তাদের গুদাম-ঘর বা গোলাঘরও নেই, তবুও আল্লাহ্‌ তাদের খাইয়ে থাকেন। তোমরা এই পাখীদের চেয়ে আরও বেশী মূল্যবান। তোমাদের মধ্যে কে চিন্তা-ভাবনা করে নিজের আয়ু এক ঘণ্টা বাড়াতে পারে? তা হলে এই সামান্য কাজটাও যদি তোমরা করতে না পার তবে অন্যান্য বিষয়ের জন্য কেন চিন্তা কর? “ভেবে দেখ, ফুল কেমন করে বেড়ে ওঠে। তারা পরিশ্রমও করে না সুতাও কাটে না। কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, সোলায়মান বাদশাহ্‌ এত জাঁকজমকের মধ্যে থেকেও এগুলোর একটারও মত নিজেকে সাজাতে পারেন নি। মাঠে যে ঘাস আজ আছে আর কাল চুলায় ফেলে দেওয়া হবে, আল্লাহ্‌ তা যখন এইভাবে সাজান তখন ওহে অল্প বিশ্বাসীরা, তিনি যে তোমাদের সাজাবেন তা কত না নিশ্চয়! কি খাওয়া-দাওয়া করবে ভেবে ব্যস্ত হয়ো না বা অস্থির হয়ো না। এই দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা ঐ সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়; এছাড়া তোমাদের পিতা তো জানেন যে, তোমাদের এগুলোর দরকার আছে। তার চেয়ে বরং আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে ব্যস্ত হও, তা হলে এগুলোও তোমরা পাবে। “হে আমার মেষের ছোট দল, ভয় কোরো না, কারণ তোমাদের পিতার ইচ্ছা এই যে, তাঁর রাজ্য তিনি তোমাদের দেবেন। তোমাদের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে ভিক্ষা হিসাবে দান কর। যে টাকার থলি কখনও পুরানো হয় না তা-ই নিজেদের জন্য তৈরী কর, অর্থাৎ যে ধন চিরদিন টিকে থাকে তা-ই বেহেশতে জমা কর। সেখানে চোরও আসে না এবং পোকায়ও নষ্ট করে না। তোমাদের ধন যেখানে থাকবে তোমাদের মনও সেখানে থাকবে। “কোমরে কাপড় জড়িয়ে এবং তোমাদের বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে প্রস্তুত থাক। তোমরা এমন লোকদের মত হও যারা তাদের মালিকের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, যেন তিনি বিয়ের মেজবানী থেকে ফিরে এসে দরজায় আঘাত করলেই তারা দরজা খুলে দিতে পারে। মালিক যে গোলামদের জেগে থাকতে দেখবেন, ধন্য তারাই। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, সেই মালিক কোমরে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে তাদের বসাবেন এবং এসে নিজেই তাদের খাওয়াবেন। ধন্য সেই সব গোলাম, যাদের তিনি এসে জেগে থাকতে দেখবেন, তা মাঝ রাতে হোক বা শেষ রাতে হোক। এই কথা তোমরা জেনো, চোর কোন্‌ সময় আসবে তা যদি বাড়ীর কর্তা জানতেন তা হলে জেগে থাকতেন আর সেই চোরকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দিতেন না। সেইভাবে তোমরাও প্রস্তুত থাক, কারণ যে সময়ের কথা তোমরা চিন্তাও করবে না সেই সময়েই ইব্‌ন্তেআদম আসবেন।” তখন পিতর বললেন, “হুজুর, আপনি এই শিক্ষা কি আমাদের দিচ্ছেন, না সকলকে দিচ্ছেন?” জবাবে হযরত ঈসা বললেন, “সেই বিশ্বস্ত ও জ্ঞানী কর্মচারী কে, যাকে তার মালিক তাঁর গোলামদের ঠিক সময়ে খাবার ভাগ করে দেবার ভার দেবেন? ধন্য সেই গোলাম, যাকে তাঁর মালিক এসে বিশ্বস্তভাবে কাজ করতে দেখবেন। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, সেই মালিক তাঁকে তাঁর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার দেবেন। কিন্তু ধর, সেই গোলাম মনে মনে বলল, ‘আমার মালিক আসতে দেরি করছেন।’ সেই সুযোগে সে গোলাম ও বাঁদীদের মারধর করতে শুরু করল এবং খাওয়া-দাওয়া করবার পরে মদানো রস খেয়ে মাতাল হল। তাহলে যেদিন ও যে সময়ের কথা সে চিন্তাও করবে না, সেই দিন ও সেই সময়েই তার মালিক এসে হাজির হবেন। তিনি তাঁকে কেটে দু’টুকরা করে কাফেরদের মধ্যে তার স্থান ঠিক করবেন। “যে গোলাম তার মালিকের ইচ্ছা জেনেও প্রস্তুত থাকে নি কিংবা মালিক যা চান তা করে নি তাকে ভীষণভাবে মার খেতে হবে। কিন্তু না জেনে যে শাস্তি পাবার কাজ করেছে তার অল্পই শাস্তি হবে। যাকে বেশী দেওয়া হয় তার কাছে থেকে বেশী দাবি করা হবে; আর লোকে যার কাছে বেশী রেখেছে তার কাছে তারা বেশীই চাইবে। “আমি দুনিয়াতে আগুন জ্বালাতে এসেছি; যদি তা আগেই জ্বলে উঠত তবে কত না ভাল হত! আমাকে একটা তরিকাবন্দী নিতে হবে, আর যতদিন পর্যন্ত তা না হয় ততদিন পর্যন্ত আমার দুঃখের শেষ নেই। তোমাদের কি মনে হয় যে, আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে এসেছি? না, তা নয়। আমি শান্তি দিতে আসি নি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। এখন থেকে এক বাড়ীর পাঁচজন ভাগ হয়ে যাবে, তিনজন দু’জনের বিরুদ্ধে আর দু’জন তিনজনের বিরুদ্ধে। তারা এইভাবে ভাগ হয়ে যাবে- বাবা ছেলের বিরুদ্ধে ও ছেলে বাবার বিরুদ্ধে, মা মেয়ের বিরুদ্ধে ও মেয়ে মায়ের বিরুদ্ধে, শাশুড়ী বউয়ের বিরুদ্ধে ও বউ শাশুড়ীর বিরুদ্ধে।” তারপর ঈসা লোকদের বললেন, “আপনারা পশ্চিম দিকে মেঘ করতে দেখলেই বলেন, ‘ঝড় আসছে,’ আর তা-ই হয়। আবার দখিনা বাতাস বইতে দেখলে বলেন, ‘গরম পড়বে,’ আর তা-ই হয়। আপনারা ভণ্ড! আপনারা দুনিয়া ও আকাশের চেহারার অর্থ বুঝতে পারেন, অথচ এ কেমন যে, আপনারা এখনকার সময়ে অর্থ বোঝেন না? “যা ঠিক তা আপনারা নিজেরা ভেবে স্থির করেন না কেন? আপনারা বিপক্ষের সংগে বিচারকের কাছে যাবার সময়ে পথেই তার সংগে একটা মীমাংসার চেষ্টা করবেন। তা না হলে সে আপনাকে বিচারকের কাছে টেনে নিয়ে যাবে। তখন বিচারক আপনাকে পুলিশের হাতে দেবে এবং পুলিশ আপনাকে জেলে দেবে। আমি আপনাকে বলছি, শেষ পয়সাটা না দেওয়া পর্যন্ত আপনি কিছুতেই জেল থেকে ছাড়া পাবেন না।” সেই সময় সেখানে উপস্থিত কয়েকজন লোক ঈসাকে গালীল প্রদেশের কয়েকজন লোকের বিষয়ে বলল। তারা বলল যে, রোমীয় শাসনকর্তা পীলাত এই গালীলীয়দের কেটে তাদের কোরবানী-করা পশুর রক্তের সংগে তাদের রক্তও মিশিয়েছিলেন। এই কথা শুনে ঈসা বললেন, “আপনাদের কি মনে হয় যে, সেই গালীলীয়রা ঐভাবে যন্ত্রণা ভোগ করেছে বলে তারা অন্য সব গালীলীয়দের চেয়ে বেশী গুনাহ্‌গার ছিল? আমি আপনাদের বলছি, তা নয়, তবে তওবা না করলে আপনারাও সবাই বিনষ্ট হবেন। শীলোহের উঁচু ঘরটা পড়ে যাওয়ার দরুন যে আঠারোজনের মৃত্যু হয়েছিল, আপনাদের কি মনে হয় যে, জেরুজালেমের বাকী লোকদের চেয়ে তাদের বেশী দোষ ছিল? আমি আপনাদের বলছি, তা নয়, কিন্তু তওবা না করলে আপনারাও সবাই বিনষ্ট হবেন।” তারপর শিক্ষা দেবার জন্য ঈসা এই কথা বললেন: “কোন একজন লোকের ফলের বাগানে একটা ডুমুর গাছ লাগানো হয়েছিল। একবার তিনি এসে ফলের তালাশ করলেন কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি মালীকে বললেন, ‘দেখ, তিন বছর ধরে এই ডুমুর গাছে আমি ফলের তালাশ করছি কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না। এইজন্য তুমি গাছটা কেটে ফেল। কেন এটা শুধু শুধু জমি নষ্ট করবে?’ মালী জবাব দিল, ‘হুজুর, এই বছরও ওটা থাকতে দিন। আমি ওটার চারপাশে খুঁড়ে সার দেব। তারপর যদি ফল ধরে তো ভাল তা না হলে আপনি ওটা কেটে ফেলবেন।’ ” কোন এক বিশ্রামবারে ঈসা একটা মজলিস-খানায় শিক্ষা দিচ্ছিলেন। সেখানে এমন একজন স্ত্রীলোক ছিল যাকে একটা ভূত আঠারো বছর ধরে অসুখে ভোগাচ্ছিল। সে কুঁজা ছিল এবং একেবারেই সোজা হতে পারত না। ঈসা তাকে দেখলেন এবং তাকে কাছে ডেকে বললেন, “মা, তোমার অসুখ থেকে তুমি মুক্ত হলে।” এই কথা বলে ঈসা তার উপর হাত রাখলেন, আর তখনই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। ঈসা বিশ্রামবারে সুস্থ করেছেন বলে মজলিস-খানার নেতা বিরক্ত হয়ে লোকদের বললেন, “কাজ করবার জন্য ছয় দিন তো আছেই। সেইজন্য বিশ্রামবারে না এসে ঐ ছয় দিনের মধ্যে এসে সুস্থ হয়ো।” তখন হযরত ঈসা সেই নেতাকে বললেন, “আপনারা ভণ্ড! বিশ্রামবারে আপনারা সবাই কি আপনাদের বলদ বা গাধাকে গোয়াল ঘর থেকে খুলে পানি খাওয়াতে নিয়ে যান না? তবে ইব্রাহিমের বংশের এই যে স্ত্রীলোকটিকে আঠারো বছর ধরে শয়তান বেঁধে রেখেছিল, সেই বাঁধন থেকে বিশ্রামবারে কি তাকে মুক্ত করা উচিত নয়?” তিনি এই কথা বললে পর যারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিল তারা সবাই লজ্জা পেল। কিন্তু অন্য লোকেরা তাঁর এই সমস্ত মহান কাজ দেখে আনন্দিত হল। এর পরে ঈসা বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্য কিসের মত? কিসের সংগে আমি এর তুলনা করব? আল্লাহ্‌র রাজ্য এমন একটা সরিষা-দানার মত যা একজন লোক নিয়ে তার বাগানে লাগাল। পরে চারা বেড়ে উঠে একটা গাছ হয়ে উঠল। তখন পাখীরা এসে তার ডালপালায় বাসা বাঁধল।” ঈসা আবার বললেন, “কিসের সংগে আমি আল্লাহ্‌র রাজ্যের তুলনা করব? আল্লাহ্‌র রাজ্য খামির মত। একজন স্ত্রীলোক তা নিয়ে আঠারো কেজি ময়দার সংগে মিশাল, ফলে সব ময়দাই ফেঁপে উঠল।” গ্রামে গ্রামে ও শহরে শহরে শিক্ষা দিতে দিতে ঈসা জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে চললেন। একজন লোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “হুজুর, নাজাত কি কেবল অল্প লোকেই পাবে?” তখন ঈসা লোকদের বললেন, “সরু দরজা দিয়ে ঢুকতে প্রাণপণে চেষ্টা করুন। আমি আপনাদের বলছি, অনেকেই ঢুকতে চেষ্টা করবে কিন্তু পারবে না। ঘরের কর্তা যখন ওঠে দরজা বন্ধ করবেন তখন আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় ঘা দিতে দিতে বলবেন, ‘হুজুর, আমাদের জন্য দরজা খুলে দিন।’ কিন্তু তিনি আপনাদের এই জবাব দেবেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছ আমি জানি না।’ তখন আপনারা বলবেন, ‘আমরা আপনার সংগে খাওয়া-দাওয়া করেছি, আর আপনি তো আমাদের রাস্তায় রাস্তায় শিক্ষা দিতেন।’ তখন তিনি বলবেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছ আমি জানি না। দুষ্ট লোকেরা, তোমরা সবাই আমার কাছ থেকে দূর হও।’ “যখন আপনারা দেখবেন, ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব ও নবীরা সবাই আল্লাহ্‌র রাজ্যের মধ্যে আছেন এবং আপনাদের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, তখন আপনারা কান্নাকাটি করবেন ও যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকবেন। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ থেকে লোকেরা এসে আল্লাহ্‌র রাজ্যে খেতে বসবে। যারা এখন শেষে আছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্র্রথম হবে, আর যারা এখন প্রথমে আছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ শেষে পড়বে।” সেই সময় কয়েকজন ফরীশী ঈসার কাছে এসে বললেন, “আপনি এখান থেকে চলে যান, কারণ হেরোদ আপনাকে হত্যা করতে চাইছেন।” ঈসা তাদের বললেন, “আপনারা গিয়ে সেই শিয়ালকে বলুন, ‘আর কয়েকদিন আমি ভূত ছাড়াব এবং রোগীদের সুস্থ করব আর তারপর আমার কাজ শেষ করব। যাহোক, আর কয়েকদিন পরে আমাকে চলে যেতে হবে, কারণ এক জেরুজালেম ছাড়া আর কোথাও কোন নবীর মৃত্যু হতে পারে কি? “জেরুজালেম, হায় জেরুজালেম! নবীদের তুমি খুন করে থাক এবং তোমার কাছে যাঁদের পাঠানো হয় তাঁদের পাথর মেরে থাক। মুরগী যেমন নিজের বাচ্চাদের তার ডানার নীচে জড়ো করে ঠিক তেমনি আমি কতবার তোমার লোকদের আমার কাছে জড়ো করতে চেয়েছি, কিন্তু তোমরা রাজী হও নি। দেখ, তোমাদের বাড়ী তোমাদের সামনে খালি হয়ে পড়ে থাকবে। আমি তোমাদের বলছি, যতদিন না তোমরা বলবে, ‘যিনি মাবুদের নামে আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক,’ ততদিন তোমরা আর আমাকে দেখতে পাবে না।” এক বিশ্রামবারে ঈসা একজন ফরীশী নেতার বাড়ীতে খেতে গেলেন। ফরীশীরা খুব ভাল করেই ঈসাকে লক্ষ্য করছিলেন। ঈসার সামনে একজন রোগী ছিল যার সমস্ত শরীরটা শোথ রোগে ফুলে গিয়েছিল। ঈসা আলেম ও ফরীশীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “মূসার শরীয়ত মতে বিশ্রামবারে কি কাউকে সুস্থ করা উচিত?” ধর্ম-নেতারা চুপ করে রইলেন। তখন ঈসা লোকটির গায়ে হাত দিয়ে তাকে ধরে সুস্থ করে বিদায় দিলেন। তারপর তিনি সেই ধর্ম-নেতাদের বললেন, “বিশ্রামবারে যদি আপনাদের কারও ছেলে বা বলদ কূয়ায় পড়ে যায় তবে আপনারা কি তাকে তখনই তোলেন না?” কিন্তু সেই ধর্ম-নেতারা এর জবাব দিতে পারলেন না। যে লোকদের দাওয়াত করা হয়েছিল, তারা কিভাবে সম্মানের জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে তা দেখে ঈসা তাদের শিক্ষা দেবার জন্য এই কথা বললেন, “যখন কেউ আপনাকে বিয়ের ভোজে দাওয়াত করে তখন আপনি সম্মানের জায়গায় গিয়ে বসবেন না, কারণ আপনার চেয়ে হয়তো আরও সম্মানিত কাউকে দাওয়াত করা হয়েছে। তাহলে যিনি আপনাকে ও তাঁকে দাওয়াত করেছেন তিনি এসে আপনাকে বলবেন, ‘এই জায়গাটা ওনাকে ছেড়ে দিন।’ তখন তো আপনি লজ্জা পেয়ে সবচেয়ে নীচু জায়গায় বসতে যাবেন। আপনি যখন দাওয়াত পাবেন তখন বরং সবচেয়ে নীচু জায়গায় গিয়ে বসবেন। তাহলে দাওয়াত-কর্তা এসে আপনাকে বলবেন, ‘বন্ধু, আরও ভাল জায়গায় গিয়ে বসুন।’ তখন অন্য সব মেহমানদের সামনে আপনি সম্মান পাবেন। যে নিজেকে উঁচু করে তাকে নীচু করা হবে, আর যে নিজেকে নীচু করে তাকে উঁচু করা হবে।” যিনি তাঁকে দাওয়াত করেছিলেন পরে ঈসা তাঁকে বললেন, “যখন আপনি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করবেন বা মেজবানী দেবেন তখন আপনার বন্ধুদের বা ভাইদের কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের বা ধনী প্রতিবেশীদের দাওয়াত করবেন না। তা করলে হয়ত তাঁরাও এর বদলে আপনাকে দাওয়াত করবেন আর এইভাবে আপনার দাওয়াত শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি যখন মেজবানী দেবেন তখন গরীব, নুলা, খোঁড়া এবং অন্ধদের ডাকবেন। তাতে আপনি আল্লাহ্‌র দোয়া পাবেন, কারণ তারা আপনার সেই দাওয়াতের শোধ দিতে পারবে না। যখন মৃত্যু থেকে ধার্মিক লোকদের জীবিত করা হবে তখন আপনি এর শোধ পাবেন।” যারা খেতে বসেছিল তাদের মধ্যে একজন এই কথা শুনে ঈসাকে বলল, “যিনি আল্লাহ্‌র রাজ্যে খেতে বসবেন তিনি ধন্য।” ঈসা বললেন, “কোন একজন লোক একটা বড় মেজবানী দিলেন এবং অনেককে দাওয়াত দিলেন। মেজবানীর সময় হলে পর তিনি তাঁর গোলামকে দিয়ে যে লোকদের দাওয়াত করা হয়েছিল, তাদের বলে পাঠালেন, ‘আসুন, এখন সবই প্রস্তুত হয়েছে।’ কিন্তু তারা সবাই একজনের পর একজন অজুহাত দেখাতে লাগল। প্রথম জন সেই গোলামকে বলল, ‘আমি কিছু জমি কিনেছি, আমাকে গিয়ে তা দেখতে হবে। দয়া করে আমাকে মাফ কর।’ আর একজন বলল, ‘আমি পাঁচ জোড়া বলদ কিনেছি, সেগুলো পরীক্ষা করতে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে মাফ কর।’ অন্য আর একজন বলল, ‘আমি বিয়ে করেছি, এইজন্য যেতে পারছি না।’ “সেই গোলাম ফিরে গিয়ে তার মালিককে এই সব কথা জানাল। তাতে বাড়ীর কর্তা রাগ করে তাঁর গোলামকে বললেন, ‘তুমি তাড়াতাড়ি শহরের রাস্তায় রাস্তায় ও গলিতে গলিতে যাও এবং গরীব, নুলা, অন্ধ ও খোঁড়াদের এখানে নিয়ে এস।’ এই সব করবার পরে সেই গোলাম বলল, ‘হুজুর, আপনার হুকুম মতই সব করা হয়েছে, কিন্তু এখনও জায়গা আছে।’ এতে কর্তা গোলামকে বললেন, ‘শহরের বাইরে রাস্তায় রাস্তায় ও পথে পথে যাও এবং এখানে আসবার জন্য লোকদের জোর কর, যেন আমার বাড়ী ভরে যায়। আমি তোমাদের বলছি, যাদের দাওয়াত করা হয়েছিল তাদের কেউই আমার এই মেজবানী খেতে পাবে না।’ ” ঈসার সংগে সংগে অনেক লোক যাচ্ছিল। ঈসা সেই লোকদের দিকে ফিরে বললেন, “যে আমার কাছে আসবে সে যেন নিজের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন, এমন কি, নিজেকে পর্যন্ত আমার চেয়ে কম প্রিয় মনে করে। তা না হলে সে আমার উম্মত হতে পারে না। যে লোক নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে আমার পিছনে না আসে সে আমার উম্মত হতে পারে না। “আপনাদের মধ্যে যদি কেউ একটা উঁচু ঘর তৈরী করতে চায় তবে সে আগে বসে খরচের হিসাব করে। সে দেখতে চায়, ওটা শেষ করবার জন্য তার যথেষ্ট টাকা আছে কি না। তা না হলে সে ভিত্তি গাঁথবার পরে যদি সেই উঁচু ঘরটা শেষ করতে না পারে, তবে যারা সেটা দেখবে তারা সবাই তাকে ঠাট্টা করবে। তারা বলবে ‘লোকটা গাঁথতে শুরু করেছিল কিন্তু শেষ করতে পারল না।’ “যদি একজন বাদশাহ্‌ অন্য আর একজন বাদশাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যান তবে তিনি প্রথমে বসে চিন্তা করবেন, ‘বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে যিনি আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছেন, মাত্র দশ হাজার সৈন্য নিয়ে আমি তাঁকে বাধা দিতে পারব কি?’ যদি তিনি তা না পারেন তবে সেই অন্য বাদশাহ্‌ দূরে থাকতেই লোক পাঠিয়ে তিনি তাঁর সংগে সন্ধির কথা আলাপ করবেন।” শেষে ঈসা বললেন, “সেইভাবে আপনাদের মধ্যে যদি কেউ ভেবে-চিন্তে তার সব কিছু ছেড়ে না আসে তবে সে আমার উম্মত হতে পারে না। “লবণ ভাল জিনিস, কিন্তু যদি তার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় তবে তা আবার কি করে নোন্‌তা করা যাবে? তখন তা জমির জন্যও উপযুক্ত হয় না, সারের গাদার জন্যও উপযুক্ত হয় না; লোকে তা ফেলে দেয়। যার শুনবার কান আছে, সে শুনুক।” তখন অনেক খাজনা-আদায়কারী ও খারাপ লোকেরা ঈসার কথা শুনবার জন্য তাঁর কাছে আসল। এতে ফরীশীরা ও আলেমেরা এই বলে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন, “এই লোকটা খারাপ লোকদের সংগে মেলামেশা ও খাওয়া-দাওয়া করে।” তখন ঈসা তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্য এই কথা বললেন: “মনে করুন, আপনাদের মধ্যে কোন একজনের একশোটা ভেড়া আছে। যদি সেই ভেড়াগুলোর মধ্যে একটা হারিয়ে যায়, তবে কি সে নিরানব্বইটা মাঠে ছেড়ে দিয়ে সেই একটাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তার তালাশ করে না? সেটা খুঁজে পেলে পর সে খুশী হয়ে তাকে কাঁধে তুলে নেয়। পরে বাড়ী গিয়ে তার বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে ডেকে বলে, ‘আমার সংগে আনন্দ কর, কারণ আমার হারানো ভেড়াটা আমি খুঁজে পেয়েছি।’ আমি আপনাদের বলছি, ঠিক সেইভাবে যারা তওবা করবার দরকার মনে করে না তেমন নিরানব্বইজন ধার্মিক লোকের চেয়ে বরং একজন গুনাহ্‌গার তওবা করলে বেহেশতে আরও বেশী আনন্দ হয়। “আবার ধরুন, একজন স্ত্রীলোকের দশটা রূপার টাকা আছে। যদি সে তার মধ্য থেকে একটা হারিয়ে ফেলে, তবে বাতি জ্বেলে ঘর ঝাড় দিয়ে তা না পাওয়া পর্যন্ত কি ভাল করে তালাশ করতে থাকে না? যখন সে তা খুঁজে পায় তখন তার বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের ডেকে বলে, ‘আমার সংগে আনন্দ কর, কারণ যে টাকাটা হারিয়ে গিয়েছিল তা পেয়েছি।’ আমি আপনাদের বলছি, ঠিক সেইভাবে একজন গুনাহ্‌গার তওবা করলে আল্লাহ্‌র ফেরেশতাদের মধ্যে আনন্দ হয়।” তারপর ঈসা বললেন, “একজন লোকের দু’টি ছেলে ছিল। ছোট ছেলেটি তার বাবাকে বলল, ‘আব্বা, আমার ভাগের সম্পত্তি আমাকে দিন।’ তাতে সেই লোক তাঁর দুই ছেলের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন। কিছু দিন পরে ছোট ছেলেটি তার সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিয়ে দূর দেশে চলে গেল। সেখানে সে খারাপ ভাবে জীবন কাটিয়ে তার সব টাকা-পয়সা উড়িয়ে দিল। যখন সে তার সব টাকা খরচ করে ফেলল তখন সেই দেশের সমস্ত জায়গায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তাতে সে অভাবে পড়ল। তখন সে গিয়ে সেই দেশের একজন লোকের কাছে চাকরি চাইল। লোকটি তাকে তার শূকর চরাতে মাঠে পাঠিয়ে দিল। শূকরে যে শুঁটি খেত সে তা খেয়ে পেট ভরাতে চাইত, কিন্তু কেউ তাকে তাও দিত না। “পরে একদিন তার চেতনা হল। তখন সে বলল, ‘আমার বাবার কত মজুর কত বেশী খাবার পাচ্ছে, অথচ আমি এখানে খিদেতে মরছি। আমি উঠে আমার বাবার কাছে গিয়ে বলব, আব্বা, আল্লাহ্‌ ও তোমার বিরুদ্ধে আমি গুনাহ্‌ করেছি। কেউ যে আর আমাকে তোমার ছেলে বলে ডাকে তার যোগ্য আমি নই। তোমার মজুরদের একজনের মত করে আমাকে রাখ।’ “এই বলে সে উঠে তার বাবার কাছে গেল। সে দূরে থাকতেই তাকে দেখে তার বাবার খুব মমতা হল। তিনি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন। তখন ছেলেটি বলল, ‘আব্বা, আমি আল্লাহ্‌ ও তোমার বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছি। কেউ যে আর আমাকে তোমার ছেলে বলে ডাকে তার যোগ্য আমি নই।’ “কিন্তু তার বাবা তার গোলামদের বললেন, ‘তাড়াতাড়ি করে সবচেয়ে ভাল জুব্বাটা এনে ওকে পরিয়ে দাও। ওর হাতে আংটি ও পায়ে জুতা দাও, আর মোটাসোটা বাছুরটা এনে জবাই কর। এস, আমরা খাওয়া-দাওয়া করে আনন্দ করি, কারণ আমার এই ছেলেটা মরে গিয়েছিল কিন্তু আবার বেঁচে উঠেছে; হারিয়ে গিয়েছিল পাওয়া গিয়েছে।’ তারপর তারা আমোদ-প্রমোদ করতে লাগল। “সেই সময় তাঁর বড় ছেলেটি মাঠে ছিল। বাড়ীর কাছে এসে সে নাচ ও গান-বাজনার শব্দ শুনতে পেল। তখন সে একজন চাকরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এসব কি হচ্ছে?’ “চাকরটি তাকে জবাব দিল, ‘আপনার ভাই এসেছে। আপনার বাবা তাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেয়েছেন বলে মোটাসোটা বাছুরটা জবাই করেছেন।’ “তখন বড় ছেলেটি রাগ করে ভিতরে যেতে চাইল না। এতে তার বাবা বের হয়ে এসে তাকে ভিতরে যাবার জন্য সাধাসাধি করতে লাগলেন। সে তার বাবাকে বলল, ‘দেখ, এত বছর ধরে আমি তোমার সেবা-যত্ন করে আসছি; একবারও আমি তোমার অবাধ্য হই নি। তবুও আমার বন্ধুদের সংগে আমোদ-প্রমোদ করবার জন্য তুমি কখনও আমাকে ছাগলের একটা বাচ্চা পর্যন্ত দাও নি। কিন্তু তোমার এই ছেলে, যে বেশ্যাদের পিছনে তোমার টাকা-পয়সা উড়িয়ে দিয়েছে, সে যখন আসল তুমি তার জন্য মোটাসোটা বাছুরটা জবাই করলে।’ “তার বাবা তাকে বললেন, ‘বাবা, তুমি তো সব সময় আমার সংগে সংগে আছ। আমার যা কিছু আছে সবই তো তোমার। খুশী হয়ে আমাদের আমোদ-প্রমোদ করা উচিত, কারণ তোমার এই ভাই মরে গিয়েছিল আবার বেঁচে উঠেছে; হারিয়ে গিয়েছিল আবার তাকে পাওয়া গেছে।’ ” ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “কোন এক ধনী লোকের প্রধান কর্মচারীকে এই বলে দোষ দেওয়া হল যে, সে তার মালিকের ধন-সম্পত্তি নষ্ট করছে। তখন ধনী লোকটি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সম্বন্ধে আমি এ কি শুনছি? তোমার কাজের হিসাব দাও, কারণ তুমি আর প্রধান কর্মচারী থাকতে পারবে না।’ “তখন সেই কর্মচারী মনে মনে বলল, ‘আমি এখন কি করি? আমার মালিক তো আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। মাটি কাটবার শক্তি আমার নেই, আবার ভিক্ষা করতেও লজ্জা লাগে। যা হোক, চাকরি থেকে বরখাস- হলে পর লোকে যাতে আমাকে তাদের বাড়ীতে থাকতে দেয় সেইজন্য আমি কি করব তা আমি জানি।’ “এই বলে যারা তার মালিকের কাছে ধার করেছিল তাদের প্রত্যেককে সে ডাকল। তারপর সে প্রথম জনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার মালিকের কাছে তোমার ধার কত?’ সে বলল, ‘দু’হাজার চারশো লিটার তেল।’ সেই কর্মচারী তাকে বলল, ‘যে কাগজে তোমার ধারের কথা লেখা আছে সেটা নাও এবং শীঘ্র বসে এক হাজার দু’শো লেখ।’ সেই কর্মচারী তারপর আর একজনকে বলল, ‘তোমার ধার কত?’ সে বলল, ‘আঠারো টন গম।’ কর্মচারীটি বলল, ‘তোমার কাগজে সাড়ে চৌদ্দ টন লেখ।’ সেই কর্মচারী অসৎ হলেও বুদ্ধি করে কাজ করল বলে মালিক তার প্রশংসা করলেন। এতে বুঝা যায় যে, এই দুনিয়ার লোকেরা নিজেদের মত লোকদের সংগে আচার-ব্যবহারে নূরের রাজ্যের লোকদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। আমি তোমাদের বলছি, এই খারাপ দুনিয়ার ধন দ্বারা লোকদের সংগে বন্ধুত্ব কর, যেন সেই ধন ফুরিয়ে গেলে পর চিরকালের থাকবার জায়গায় তোমাদের গ্রহণ করা হয়। সামান্য ব্যাপারে যে বিশ্বাসযোগ্য সে বড় ব্যাপারেও বিশ্বাসযোগ্য হয়। সামান্য ব্যাপারে যাকে বিশ্বাস করা যায় না তাকে বড় ব্যাপারেও বিশ্বাস করা যায় না। এই দুনিয়ার ধন-সম্পত্তির ব্যাপারে যদি তোমাদের বিশ্বাস করা না যায় তবে কে তোমাদের বিশ্বাস করে আসল ধন দেবে? অন্যের অধিকারে যা আছে তা ব্যবহার করবার ব্যাপারে যদি তোমাদের বিশ্বাস করা না যায়, তবে তোমাদের নিজেদের অধিকারের জন্য কেউ কি তোমাদের কিছু দেবে? “কোন গোলাম দু’জন কর্তার সেবা করতে পারে না, কারণ সে একজনকে ঘৃণা করবে ও অন্যজনকে ভালবাসবে, কিংবা সে একজনের প্রতি মনোযোগ দেবে ও অন্যজনকে তুচ্ছ করবে। আল্লাহ্‌ ও ধন-সম্পত্তি এই দু’য়েরই সেবা তোমরা একসংগে করতে পার না।” এই সব কথা শুনে ফরীশীরা ঈসাকে ঠাট্টা করতে লাগলেন, কারণ তারা টাকা-পয়সা বেশী ভালবাসতেন। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা লোকদের সামনে নিজেদের ধার্মিক দেখিয়ে থাকেন, কিন্তু আল্লাহ্‌ আপনাদের মনের অবস্থা জানেন। মানুষ যা সম্মানিত মনে করে আল্লাহ্‌র চোখে তা ঘৃণার যোগ্য। “ইয়াহিয়ার সময় পর্যন্ত তৌরাত শরীফ এবং নবীদের কিতাব চলত। তারপর থেকে আল্লাহ্‌র রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করা হচ্ছে এবং সবাই আগ্রহী হয়ে জোরের সংগে সেই রাজ্যে ঢুকছে। তবে তৌরাত শরীফের একটা বিন্দু বাদ পড়বার চেয়ে বরং আসমান ও জমীন শেষ হওয়া সহজ। “যে কেউ নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে আর একজনকে বিয়ে করে সে জেনা করে। স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে সেই রকম স্ত্রীকে যে বিয়ে করে সেও জেনা করে। “একজন ধনী লোক ছিল। সে বেগুনে কাপড় ও অন্যান্য দামী দামী কাপড়-চোপড় পরত। প্রত্যেক দিন খুব জাঁকজমকের সংগে সে আমোদ-প্রমোদ করত। সেই ধনী লোকের দরজার কাছে লাসার নামে একজন ভিখারীকে প্রায়ই এনে রাখা হত। লাসারের সারা গায়ে ঘা ছিল। সেই ধনী লোকের টেবিল থেকে যে খাবার পড়ত তা-ই খেয়ে সে পেট ভরাতে চাইত, আর কুকুরেরা তার ঘা চেটে দিত। “একদিন সেই ভিখারীটি মারা গেল। তখন ফেরেশতারা এসে তাকে নবী ইব্রাহিমের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর একদিন সেই ধনী লোকটিও মারা গেল এবং তাকে দাফন করা হল। কবরে খুব যন্ত্রণার মধ্যে থেকে সে উপরের দিকে তাকাল এবং দূর থেকে ইব্রাহিম ও তাঁর পাশে লাসারকে দেখতে পেল। তখন সে চিৎকার করে বলল, ‘পিতা ইব্রাহিম, আমাকে দয়া করুন। লাসারকে পাঠিয়ে দিন যেন সে তার আংগুলের আগাটা পানিতে ডুবিয়ে আমার জিভ্‌ ঠাণ্ডা করে। এই আগুনের মধ্যে আমি বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।’ “কিন্তু ইব্রাহিম বললেন, ‘মনে করে দেখ, তুমি যখন বেঁচে ছিলে তখন কত সুখ ভোগ করেছ আর লাসার কত কষ্ট ভোগ করেছে। কিন্তু এখন সে এখানে সান্ত্বনা পাচ্ছে আর তুমি কষ্ট পাচ্ছ। এছাড়া তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এমন একটা বিরাট ফাঁক রয়েছে যাতে ইচ্ছা করলেও কেউ এখান থেকে পার হয়ে তোমাদের কাছে যেতে না পারে এবং ওখান থেকে পার হয়ে আমাদের কাছে আসতে না পারে।’ “তখন সেই ধনী লোকটি বলল, ‘তাহলে পিতা, দয়া করে লাসারকে আমার পিতার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিন, যেন সে আমার পাঁচটি ভাইকে সাবধান করতে পারে; তা না হলে তারাও তো এই যন্ত্রণার জায়গায় আসবে।’ “কিন্তু ইব্রাহিম বললেন, ‘মূসা ও নবীদের লেখা কিতাব তো তাদের কাছে আছে। ওরা তাঁদের কথায় মনোযোগ দিক।’ “সেই ধনী লোকটি বলল, ‘না, না, পিতা ইব্রাহিম, মৃতদের মধ্য থেকে কেউ তাদের কাছে গেলে তারা তওবা করবে।’ “তখন ইব্রাহিম বললেন, ‘মূসা ও নবীদের কথা যদি তারা না শোনে তবে মৃতদের মধ্য থেকে কেউ উঠলেও তারা বিশ্বাস করবে না।” ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “গুনাহের পথে নিয়ে যাবার জন্য উসকানি আসবেই আসবে, কিন্তু ঘৃণ্য সেই লোক, যার মধ্য দিয়ে সেই উসকানি আসে! এই ছোটদের মধ্যে একজনকে যদি কেউ গুনাহের পথে নিয়ে যায়, তবে তার গলায় বড় পাথর বেঁধে তাকে সাগরে ফেলে দেওয়া বরং তার পক্ষে ভাল। “তোমরা সাবধান হও। যদি তোমার ভাই তোমার বিরুদ্ধে অন্যায় করে তাকে বকুনি দাও। যদি সে সেই অন্যায় থেকে মন ফিরায় তবে তাকে মাফ কর। যদি দিনের মধ্যে সাতবার তোমার বিরুদ্ধে সে অন্যায় করে এবং সাতবারই এসে বলে, ‘আমি এই অন্যায় থেকে মন ফিরিয়েছি,’ তাহলে তাকে মাফ করতে হবে।” সেই বারোজন সাহাবী হযরত ঈসাকে বললেন, “আমাদের বিশ্বাস বাড়িয়ে দিন।” ঈসা বললেন, “একটা সরিষা-দানার মতও যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে তবে তোমরা এই তুঁত গাছটাকে বলতে পারবে, ‘শিকড়সুদ্ধ উঠে গিয়ে নিজেকে সাগরে পুঁতে রাখ’; তাতে সেই গাছটি তোমাদের কথা শুনবে। “মনে কর, তোমাদের একজনের গোলাম হাল বাইছে বা ভেড়া চরাচ্ছে। যখন সেই গোলাম মাঠ থেকে আসবে তখন কি তার মালিক তাকে বলবেন, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে খেতে বস’? না, তা বলবেন না, বরং বলবেন, ‘আমার খাওয়ার আয়োজন কর, আর আমি যতক্ষণ খাওয়া-দাওয়া করি ততক্ষণ কোমরে কাপড় জড়িয়ে আমার সেবা-যত্ন কর। তারপর তুমি খাওয়া-দাওয়া করবে।’ সেই গোলাম তাঁর হুকুম মত কাজ করেছে বলে কি তিনি তাকে শুকরিয়া জানাবেন? সেইভাবে আল্লাহ্‌র হুকুম মত সমস্ত কাজ করবার পরে তোমরা বোলো, ‘আমরা অপদার্থ গোলাম; যা করা উচিত আমরা কেবল তা-ই করেছি।’ ” সেই রোগীদের দেখে ঈসা বললেন, “ইমামদের কাছে গিয়ে নিজেদের দেখাও।” তারা পথে যেতে যেতেই সুস্থ হয়ে গেল। তখন ঈসা বললেন, “দশজনকে কি সুস্থ করা হয় নি? তবে বাকী ন’জন কোথায়? আল্লাহ্‌র প্রশংসা করবার জন্য এই বিদেশী লোকটি ছাড়া আর কেউ কি ফিরে আসল না?” তারপর ঈসা লোকটিকে বললেন, “উঠে চলে যাও। বিশ্বাস করেছ বলে তুমি ভাল হয়েছ।” কয়েকজন ফরীশী ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন কবে আল্লাহ্‌র রাজ্য আসবে। জবাবে ঈসা বললেন, “আল্লাহ্‌র রাজ্য আসবার সময় কোন চিহ্ন দেখা যায় না। কেউই বলবে না, “দেখ, আল্লাহ্‌র রাজ্য এখানে,’ বা ‘দেখ, আল্লাহ্‌র রাজ্য ওখানে,’ কারণ আপনাদের মধ্যেই তো আল্লাহ্‌র রাজ্য আছে।” এর পরে তিনি তাঁর সাহাবীদের বললেন, “এমন দিন আসছে যখন তোমরা চাইবে যেন ইব্‌ন্তেআদমের সময়কার একটা দিন তোমরা দেখতে পাও, কিন্তু তা দেখতে পাবে না। লোকে তোমাদের বলবে, ‘ওখানে দেখ,’ বা ‘এখানে দেখ।’ বাইরে যেয়ো না বা তাদের পিছনে দৌড়িও না। বিদ্যুৎ চমকালে যেমন আকাশের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত আলো হয়ে যায়, ইব্‌ন্তেআদমের আসা সেইভাবে হবে। কিন্তু প্রথমে তাঁকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে। তা ছাড়া এই কালের লোকেরা তাঁকে অগ্রাহ্য করবে। “নূহের সময়ে যেমন হয়েছিল ইব্‌ন্তেআদমের সময়েও তেমনি হবে। যে পর্যন্ত না নূহ্‌ জাহাজে উঠলেন এবং বন্যা এসে লোকদের সবাইকে ধ্বংস করল সেই পর্যন্ত লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করছিল, বিয়ে করছিল ও বিয়ে দিচ্ছিল। আবার লুতের সময়ে যেমন হয়েছিল তেমনি হবে। সেই সময়ে লোকে খাওয়া-দাওয়া, বেচা-কেনা, চাষ-বাস এবং ঘর-বাড়ী তৈরী করছিল। কিন্তু যেদিন লুত সাদুম ছেড়ে আসলেন সেই দিন আসমান থেকে আগুন ও গন্ধকের বৃষ্টি পড়ে লোকদের সবাইকে ধ্বংস করল। যেদিন ইব্‌ন্তেআদম প্রকাশিত হবেন সেই দিন এই রকমই হবে। “সেই দিন ছাদের উপরে যে থাকবে সে ঘর থেকে জিনিসপত্র নেবার জন্য নীচে না নামুক। তেমনি করে ক্ষেতের মধ্যে যে থাকবে সে ফিরে না আসুক। লুতের স্ত্রীর কথা মনে করে দেখ। যে কেউ তার জীবন রক্ষা করতে চেষ্টা করে সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে, আর যে কেউ তার প্রাণ হারায় সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে। আমি তোমাদের বলছি, সেই রাতে এক বিছানায় দু’জন থাকবে; একজনকে নেওয়া হবে আর অন্যজনকে ফেলে যাওয়া হবে। সাহাবীরা বললেন, “হুজুর, কোথায়?” জবাবে ঈসা বললেন, “লাশ যেখানে থাকে সেখানেই তো শকুন এসে জড়ো হয়।” সেই শহরে একজন বিধবা ছিল। সে বারবার এসে তাঁকে বলত, ‘ন্যায়বিচার করে আমার বিপক্ষের বিরুদ্ধে রায় দিন।’ সেই বিচারক কিছু দিন পর্যন্ত কিছুই করলেন না। কিন্তু শেষে তিনি মনে মনে বললেন, ‘যদিও আমি আল্লাহ্‌কে ভয় করি না এবং মানুষকেও গ্রাহ্য করি না, তবুও এই বিধবা আমাকে বিরক্ত করছে বলে আমি তার পক্ষে ন্যায়বিচার করব। তা না হলে সে বারবার আসবে আর তাতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব।’ ” এর পর ঈসা আরও বললেন, “ন্যায় বিচারক না হলেও তিনি কি বললেন তা ভেবে দেখ। তাহলে যারা আল্লাহ্‌কে দিন রাত ডাকে, আল্লাহ্‌ কি তাঁর সেই বাছাই-করা বান্দাদের পক্ষে ন্যায়বিচার করবেন না? তিনি কি তা করতে দেরি করবেন? আমি তোমাদের বলছি, তিনি তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার করতে দেরি করবেন না। কিন্তু ইব্‌ন্তেআদম যখন আসবেন তখন কি তিনি দুনিয়াতে ঈমান দেখতে পাবেন?” যারা নিজেদের ধার্মিক মনে করে অন্যদের তুচ্ছ করত তাদের শিক্ষা দেবার জন্য ঈসা এই কথা বললেন: “দু’জন লোক মুনাজাত করবার জন্য বায়তুল-মোকাদ্দসে গেলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ফরীশী ও অন্যজন খাজনা-আদায়কারী। সেই ফরীশী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের বিষয়ে এই মুনাজাত করলেন, ‘হে আল্লাহ্‌, আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাই যে, আমি অন্য লোকদের মত ঠগ, অসৎ ও জেনাকারী নই, এমন কি, ঐ খাজনা-আদায়কারীর মতও নই। আমি সপ্তায় দু’বার রোজা রাখি এবং আমার সমস্ত আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ তোমাকে দিই।’ সেই সময় সেই খাজনা-আদায়কারী কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আসমানের দিকে তাকাবারও তার সাহস হল না; সে বুক চাপ্‌ড়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্‌! আমি গুনাহ্‌গার; আমার প্রতি মমতা কর।’ “আমি তোমাদের বলছি, সেই খাজনা-আদায়কারীকে আল্লাহ্‌ ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন আর সে বাড়ী ফিরে গেল। কিন্তু সেই ফরীশীকে তিনি ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন না। যে কেউ নিজেকে উঁচু করে তাকে নীচু করা হবে এবং যে নিজেকে নীচু করে তাকে উঁচু করা হবে।” লোকেরা ছোট ছেলেমেয়েদের ঈসার কাছে নিয়ে আসল যেন তিনি তাদের উপর হাত রাখেন। সাহাবীরা এ দেখে সেই লোকদের বকুনি দিতে লাগলেন। কিন্তু ঈসা সেই ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে ডেকে নিলেন। তারপর তিনি সাহাবীদের বললেন, “ছেলেমেয়েদের আমার কাছে আসতে দাও, বাধা দিও না; কারণ আল্লাহ্‌র রাজ্য এদের মত লোকদেরই। আমি তোমাদের সত্যি বলছি, ছোট ছেলেমেয়ের মত আল্লাহ্‌র শাসন মেনে না নিলে কেউ কোনমতেই আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকতে পারবে না।” সমাজের একজন নেতা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, আপনি একজন ভাল লোক। আমাকে বলুন, কি করলে আমি অনন্ত জীবন লাভ করতে পারব?” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমাকে ভাল বলছেন কেন? একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউই ভাল নয়। আপনি তো হুকুমগুলো জানেন, ‘জেনা কোরো না, খুন কোরো না, চুরি কোরো না, মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না, তোমার পিতা-মাতাকে সম্মান কোরো।’ ” সেই নেতা বললেন, “ছোটবেলা থেকে আমি এই সব পালন করে আসছি।” এই কথা শুনে ঈসা তাঁকে বললেন, “এখনও একটা কাজ আপনার বাকী আছে। আপনার যা কিছু আছে বিক্রি করে গরীবদের বিলিয়ে দিন, তাহলে আপনি বেহেশতে ধন পাবেন। তারপর এসে আমার উম্মত হন।” এই কথা শুনে সেই নেতা খুব দুঃখিত হলেন, কারণ তিনি খুব ধনী ছিলেন। সেই নেতার দিকে তাকিয়ে ঈসা বললেন, “ধনীদের পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢোকা কত কঠিন! ধনীর পক্ষে আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকবার চেয়ে বরং সুচের ছিদ্র দিয়ে উটের যাওয়া সহজ।” ঈসার এই কথা যারা শুনল তারা বলল, “তাহলে কে নাজাত পেতে পারে?” ঈসা বললেন, “মানুষের পক্ষে যা অসম্ভব আল্লাহ্‌র পক্ষে তা সম্ভব।” তখন পিতর বললেন, “আমরা তো সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আপনার সাহাবী হয়েছি।” ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যারা আল্লাহ্‌র রাজ্যের জন্য বাড়ী-ঘর, স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-বাবা বা ছেলেমেয়ে ছেড়ে এসেছে, তারা প্রত্যেকে এই যুগেই অনেক বেশী পাবে এবং আগামী যুগে অনন্ত জীবন লাভ করবে।” ঈসা তাঁর বারোজন সাহাবীকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “দেখ, আমরা জেরুজালেমে যাচ্ছি। ইব্‌ন্তেআদমের বিষয়ে নবীরা যা যা লিখে গেছেন তা সবই পূর্ণ হবে। তাঁকে অ-ইহুদীদের হাতে দেওয়া হবে। লোকে তাঁকে ঠাট্টা ও অপমান করবে এবং তাঁর গায়ে থুথু দেবে। ভীষণভাবে চাবুক মারবার পরে তারা তাঁকে হত্যা করবে, আর তৃতীয় দিনে তিনি জীবিত হয়ে উঠবেন।” সাহাবীরা কিন্তু এই সব বিষয় কিছুৃই বুঝলেন না। সেই কথার অর্থ তাঁদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল বলে ঈসা যে কি বলছিলেন তা তাঁরা বুঝলেন না। ঈসা যখন জেরিকো শহরের কাছে আসলেন তখন একজন অন্ধ লোক পথের ধারে বসে ভিক্ষা করছিল। অনেক লোকের গলার আওয়াজ শুনে সে ব্যাপার কি তা জিজ্ঞাসা করল। লোকেরা তাকে জানাল যে, নাসরতের ঈসা ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছেন। তখন সে চিৎকার করে বলল, “দাউদের বংশধর ঈসা, আমাকে দয়া করুন!” যে লোকেরা ভিড়ের সামনে ছিল তারা তাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলল। কিন্তু সে আরও চিৎকার করে বলল, “দাউদের বংশধর, আমাকে দয়া করুন।” ঈসা থামলেন এবং সেই অন্ধকে তাঁর কাছে আনতে বললেন। সে কাছে আসলে পর তিনি বললেন, “তুমি কি চাও? তোমার জন্য আমি কি করব?” সে বলল, “হুজুর, আমি যেন দেখতে পাই।” ঈসা তাকে বললেন, “আচ্ছা, তা-ই হোক। তুমি বিশ্বাস করেছ বলে ভাল হয়েছ।” লোকটি তখনই দেখতে পেল এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে করতে ঈসার পিছনে পিছনে চলল। এ দেখে সমস্ত লোক আল্লাহ্‌র প্রশংসা করল। ঈসা জেরিকো শহরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে সক্কেয় নামে একজন লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রধান খাজনা-আদায়কারী এবং একজন ধনী লোক। ঈসা কে, তা তিনি দেখতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বেঁটে ছিলেন বলে ভিড়ের জন্য তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি ঈসাকে দেখবার জন্য সামনে দৌড়ে গিয়ে একটা ডুমুর গাছে উঠলেন, কারণ ঈসা সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। ঈসা সেই ডুমুর গাছের কাছে এসে উপরের দিকে তাকালেন এবং সক্কেয়কে বললেন, “সক্কেয়, তাড়াতাড়ি নেমে এস, কারণ আজ তোমার বাড়ীতে আমাকে থাকতে হবে।” সক্কেয় তাড়াতাড়ি নেমে আসলেন এবং আনন্দের সংগে ঈসাকে গ্রহণ করলেন। এ দেখে সবাই বক্‌বক করে বলল, “উনি একজন গুনাহ্‌গার লোকের মেহমান হতে গেলেন।” সক্কেয় সেখানে দাঁড়িয়ে ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমি আমার ধন-সম্পত্তির অর্ধেক গরীবদের দিয়ে দিচ্ছি এবং যদি কাউকে ঠকিয়ে থাকি তবে তার চারগুণ ফিরিয়ে দিচ্ছি।” তখন ঈসা বললেন, “এই বাড়ীতে আজ নাজাত আসল, কারণ এও তো ইব্রাহিমের বংশের একজন। যারা হারিয়ে গেছে তাদের তালাশ করতে ও নাজাত করতেই ইব্‌ন্তেআদম এসেছেন।” ঈসা তখন যেখানে ছিলেন সেখান থেকে জেরুজালেম বেশী দূরে ছিল না, আর যারা তাঁর কথা শুনছিল তারা ভাবছিল আল্লাহ্‌র রাজ্য শীঘ্রই প্রকাশ পাবে। তাই ঈসা তাদের শিক্ষা দেবার জন্য এই কথা বললেন: “একজন উঁচু বংশের লোক রাজ-পদ নিয়ে ফিরে আসবেন বলে দূর দেশে গেলেন। যাবার আগে তিনি তাঁর দশজন গোলামকে ডাকলেন এবং প্রত্যেক জনকে একশো দীনার করে দিয়ে বললেন, ‘আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এ দিয়ে ব্যবসা কর।’ “তাঁর দেশের লোকেরা কিন্তু তাঁকে ঘৃণা করত। এইজন্য তারা তাঁর পিছনে লোক পাঠিয়ে খবর দিল, ‘আমরা চাই না এই লোকটা আমাদের উপর রাজত্ব করুক।’ “তবুও তিনি বাদশাহ্‌ নিযুক্ত হয়ে ফিরে আসলেন এবং যে দশজন গোলামকে টাকা দিয়েছিলেন তাদের ডেকে আনতে হুকুম দিলেন। তিনি জানতে চাইলেন ব্যবসা করে তারা কে কত লাভ করেছে। প্রথম জন এসে বলল, ‘হুজুর, আপনার টাকা দিয়ে আমি দশগুণ লাভ করেছি।’ “বাদশাহ্‌ তাকে বললেন, ‘শাবাশ! তুমি ভাল গোলাম। তুমি সামান্য বিষয়ে বিশ্বস্ত হয়েছ বলে আমি তোমাকে দশটা গ্রামের ভার দিলাম।’ “দ্বিতীয় গোলামটি এসে বলল, ‘হুজুর, আপনার টাকা দিয়ে আমি পাঁচগুণ লাভ করেছি।’ “তিনি সেই গোলামকে বললেন, ‘তুমি পাঁচটা গ্রামের ভার পাবে।’ “তার পরে অন্য আর একজন গোলাম এসে বলল, ‘হুজুর, আমি আপনার টাকা রুমালে বেঁধে রেখে দিয়েছিলাম। আপনার সম্বন্ধে আমার ভয় ছিল কারণ আপনি খুব কড়া লোক; আপনি যা জমা করেন নি তা নিয়ে থাকেন এবং যা বোনেন নি তা কাটেন।’ “তখন বাদশাহ্‌ বললেন, ‘ওরে দুষ্ট গোলাম! তোর মুখের কথা দিয়েই আমি তোর বিচার করব। তুই তো জানতিস্‌ যে, আমি কড়া লোক; যা জমা করি নি তা নিয়ে থাকি এবং যা বুনি নি তা কাটি। তবে আমার টাকা তুই মহাজনের কাছে রাখলি না কেন? তাহলে তো আমি এসে টাকাটাও পেতাম এবং সংগে কিছু সুদও পেতাম।’ “যারা বাদশাহ্‌র কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বাদশাহ্‌ তাদের বললেন, ‘ওর কাছ থেকে ঐ একশো দীনার নিয়ে নাও এবং যার এক হাজার দীনার আছে তাকে দাও।’ “তখন সেই লোকেরা বাদশাহ্‌কে বলল, ‘হুজুর, ওর তো এক হাজার দীনার আছে।’ “বাদশাহ্‌ বললেন, ‘আমি তোমাদের বলছি, যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে, কিন্তু যার নেই তার যা আছে তা-ও তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আমার শত্রুরা যারা চায় নি আমি বাদশাহ্‌ হই, তাদের এখানে নিয়ে এস এবং আমার সামনে মেরে ফেল।’ ” এই সব কথা বলবার পরে ঈসা তাঁদের আগে আগে জেরুজালেমের দিকে চললেন। যখন তিনি জৈতুন পাহাড়ের গায়ে বৈৎফগী ও বেথানিয়া গ্রামের কাছে আসলেন তখন তাঁর দু’জন সাহাবীকে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা সামনের ঐ গ্রামে যাও। সেখানে ঢুকবার সময় দেখতে পাবে একটা গাধার বাচ্চা বাঁধা আছে। ওর উপরে কেউ কখনও চড়ে নি। ওটা খুলে এখানে নিয়ে এস। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন ওটা খুলছ?’ তবে বোলো, ‘হুজুরের দরকার আছে।’ ” যে সাহাবীদের পাঠানো হয়েছিল তাঁরা গিয়ে ঈসার কথামতই সব কিছু দেখতে পেলেন। তাঁরা যখন সেই বাচ্চাটা খুলছিলেন তখন মালিকেরা তাঁদের জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা বাচ্চাটা খুলছ কেন?” তাঁরা বললেন, “হুজুরের দরকার আছে।” তারপর সাহাবীরা সেই গাধার বাচ্চাটা ঈসার কাছে আনলেন এবং তার উপরে তাঁদের গায়ের চাদর পেতে দিয়ে ঈসাকে বসালেন। তিনি যখন যাচ্ছিলেন তখন লোকেরা নিজেদের গায়ের চাদর পথে বিছিয়ে দিতে লাগল। এইভাবে ঈসা জেরুজালেমের কাছে এসে যে রাস্তাটা জৈতুন পাহাড় থেকে নেমে গেছে সেই রাস্তায় আসলেন। ঈসার সংগে তাঁর অনেক সাহাবী ছিলেন। সেই সাহাবীরা তাঁর যে সব অলৌকিক কাজ দেখেছিলেন সেগুলোর জন্য আনন্দে চিৎকার করে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলতে লাগলেন, “মাবুদের নামে যে বাদশাহ্‌ আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক! বেহেশতেই শান্তি, আর সেখানে আল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশিত।” ভিড়ের মধ্য থেকে কয়েকজন ফরীশী ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনার সাহাবীদের চুপ করতে বলুন।” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি আপনাদের বলছি, এরা যদি চুপ করে থাকে তবে পাথরগুলো চেঁচিয়ে উঠবে।” তাঁরা যখন জেরুজালেমের কাছে আসলেন তখন ঈসা শহরটা দেখে কাঁদলেন। তিনি বললেন, “হায়, শান্তি পাবার জন্য যা দরকার, তুমি, জ্বী তুমি যদি আজ তা বুঝতে পারতে! কিন্তু এখন তা তোমার চোখের আড়ালে রয়েছে। এমন সময় তোমার আসবে যখন শত্রুরা তোমার বিরুদ্ধে বাধার দেয়াল তুলবে এবং তোমাকে ঘিরে রাখবে ও সমস্ত দিক থেকে তোমাকে চেপে ধরবে। তারা তোমাকে ও তোমার ভিতরের সমস্ত লোকদের ধরে মাটিতে আছাড় মারবে এবং একটা পাথরের উপরে আর একটা পাথর রাখবে না, কারণ আল্লাহ্‌ যে সময়ে তোমার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন সেই সময়টা তুমি চিনে নাও নি।” এর পরে ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকে ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিলেন। তিনি সেই ব্যবসায়ীদের বললেন, “পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘আমার ঘর মুনাজাতের ঘর হবে,’ কিন্তু তোমরা তা ডাকাতের আড্ডাখানা করে তুলেছ।” ঈসা প্রত্যেক দিনই বায়তুল-মোকাদ্দসে গিয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। প্রধান ইমামেরা, আলেমেরা এবং লোকদের নেতারা তাঁকে হত্যা করতে চাইলেন, কিন্তু কিভাবে তা করবেন তার কোন উপায় তাঁরা খুঁজে পেলেন না, কারণ লোকেরা মন দিয়ে তাঁর প্রত্যেকটি কথা শুনত। জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “আমিও আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। বলুন দেখি, তরিকাবন্দী দেবার অধিকার ইয়াহিয়া আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পেয়েছিলেন, না মানুষের কাছ থেকে পেয়েছিলেন?” তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই আলোচনা করতে লাগলেন, “যদি আমরা বলি, ‘আল্লাহ্‌র কাছ থেকে,’ তবে সে বলবে, ‘তা হলে তাঁকে বিশ্বাস করেন নি কেন?’ কিন্তু যদি বলি, ‘মানুষের কাছ থেকে,’ তাহলে লোকেরা আমাদের পাথর মারবে, কারণ তারা ইয়াহিয়াকে নবী বলে বিশ্বাস করে।” এইজন্য তাঁরা বললেন, “সেই অধিকার কোথা থেকে এসেছিল তা আমরা জানি না।” ঈসা তাঁদের বললেন, “তবে আমিও বলব না কোন্‌ অধিকারে আমি এই সব করছি।” এর পরে ঈসা লোকদের শিক্ষা দেবার জন্য এই কথা বললেন: “একজন লোক একটা আংগুর-ক্ষেত করলেন এবং চাষীদের কাছে সেটা ইজারা দিয়ে অনেক দিনের জন্য বিদেশে চলে গেলেন। পরে তিনি সেই ক্ষেতের আংগুর ফলের ভাগ পাবার জন্য সময়মতই একজন গোলামকে চাষীদের কাছে পাঠালেন। কিন্তু চাষীরা তাকে মারধর করে খালি হাতেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিল। তখন তিনি আর একজন গোলামকে পাঠালেন, কিন্তু চাষীরা তাকেও মারল ও অপমান করল এবং খালি হাতে পাঠিয়ে দিল। পরে তিনি তৃতীয় গোলামকে পাঠালেন, কিন্তু চাষীরা তাকেও ভীষণ মারধর করে তাড়িয়ে দিল। “তখন আংগুর-ক্ষেতের মালিক বললেন, ‘কি করি? আচ্ছা, আমি আমার প্রিয় পুত্রকে পাঠাব। হয়তো তারা তাকে সম্মান করবে।’ “কিন্তু চাষীরা তাঁকে দেখে একে অন্যকে বলল, ‘এ-ই তো পরে সম্পত্তির মালিক হবে। সম্পত্তিটা যেন আমাদেরই হয় সেইজন্য এস, আমরা ওকে মেরে ফেলি।’ এই বলে তারা তাঁকে ধরে ক্ষেতের বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। “এখন আংগুর-ক্ষেতের মালিক সেই চাষীদের কি করবেন? তিনি এসে তাদের হত্যা করবেন এবং ক্ষেতটা অন্যদের ইজারা দেবেন।” লোকেরা ঈসার কথা শুনে বলল, “এমন না হোক।” তখন ঈসা তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে এই যে কথা পাক-কিতাবের মধ্যে লেখা আছে, ‘রাজমিস্ত্রিরা যে পাথরটা বাতিল করে দিয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল’- এর অর্থ কি? যে কেউ সেই পাথরের উপরে পড়বে সে ভেংগে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে এবং যার উপর সেই পাথর পড়বে সে চুরমার হয়ে যাবে।” এই সময়ে আলেমেরা ও প্রধান ইমামেরা ঈসাকে ধরতে চাইলেন, কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে, ঐ কথা ঈসা তাঁদের বিরুদ্ধেই বলেছেন; কিন্তু তাঁরা লোকদের ভয় পেলেন। আলেম ও প্রধান ইমামেরা ঈসাকে চোখে চোখে রাখলেন এবং গোয়েন্দা পাঠিয়ে দিলেন। ঈসাকে তাঁর নিজের কথার ফাঁদে ফেলবার জন্য সেই গোয়েন্দারা ভাল মানুষের ভাণ করতে লাগল, যেন তারা তাঁকে প্রধান শাসনকর্তার বিচার-ক্ষমতার অধীনে ফেলতে পারে। সেইজন্য তারা তাঁকে বলল, “হুজুর, আমরা জানি যে, আপনি যা বলেন ও শিক্ষা দেন তা ঠিক। আপনি সবাইকে সমান চোখে দেখেন এবং সত্য ভাবেই আল্লাহ্‌র পথের বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আচ্ছা, মূসার শরীয়ত অনুসারে রোম-সম্রাটকে কি খাজনা দেওয়া উচিত?” ঈসা তাদের চালাকি বুঝতে পেরে বললেন, “আমাকে একটা দীনার দেখাও। এর উপরে কার ছবি ও কার নাম আছে?” তারা বলল, “রোম-সম্রাটের।” ঈসা তাদের বললেন, “তা হলে যা সম্রাটের তা সম্রাটকে দাও এবং যা আল্লাহ্‌র তা আল্লাহ্‌কে দাও।” লোকদের সামনে ঈসা যা বলেছিলেন তাতে সেই গোয়েন্দারা তাঁকে তাঁর কথার ফাঁদে ফেলতে পারল না। তাঁর জবাবে আশ্চর্য হয়ে তারা চুপ হয়ে গেল। সদ্দূকীদের মধ্যে কয়েকজন ঈসার কাছে আসলেন। সদ্দূকীদের মতে মৃতদের জীবিত হয়ে উঠা বলে কিছু নেই। তাঁরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, মূসা আমাদের জন্য এই কথা লিখে গেছেন, সন্তানহীন অবস্থায় যদি কোন লোক তার স্ত্রীকে রেখে মারা যায়, তবে তার ভাই তার স্ত্রীকে বিয়ে করে ভাইয়ের হয়ে তার বংশ রক্ষা করবে। খুব ভাল, ধরুন, সাতজন ভাই ছিল। প্রথম জন বিয়ে করে সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেল। শেষে সেই স্ত্রীলোকটিও মারা গেল। তাহলে যেদিন মৃতেরা জীবিত হয়ে উঠবে সেই দিন সে কার স্ত্রী হবে? সাতজনের প্রত্যেকেই তো তাকে বিয়ে করেছিল।” ঈসা তাঁদের বললেন, “এই কালের লোকেরা বিয়ে করে এবং তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে আগামী যুগে পার হয়ে যাবার যোগ্য বলে যাদের ধরা হবে, তারা বিয়ে করবে না এবং তাদের বিয়ে দেওয়াও হবে না। তারা আর মরতে পারে না, কারণ তারা ফেরেশতাদের মত। তারা আল্লাহ্‌র সন্তান কারণ মৃত্যু থেকে তাদের জীবিত করা হয়েছে। জ্বলন্ত ঝোপের বিষয়ে যেখানে লেখা আছে সেখানে মূসা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, মৃতেরা সত্যিই জীবিত হয়ে ওঠে। সেখানে মূসা মাবুদকে ‘ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌, ইসহাকের আল্লাহ্‌ ও ইয়াকুবের আল্লাহ্‌’ বলে ডেকেছেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ তো মৃতদের আল্লাহ্‌ নন, তিনি জীবিতদেরই আল্লাহ্‌। তাঁরই উদ্দেশ্যে সব লোক বেঁচে থাকে।” তখন কয়েকজন আলেম বললেন, “হুজুর, আপনি ভালই বলেছেন।” তাঁরা আর কোন কিছু ঈসাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলেন না। ঈসা সেই আলেমদের বললেন, “লোকে কি করে বলে যে, মসীহ্‌ দাউদের বংশধর? দাউদ তো মসীহ্‌কে প্রভু বলে ডেকেছিলেন; তাহলে মসীহ্‌ কেমন করে দাউদের বংশধর হতে পারেন?” লোকেরা যখন ঈসার কথা শুনছিল তখন ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আলেমদের বিষয়ে সাবধান হও। তাঁরা লম্বা লম্বা কোর্তা পরে ঘুরে বেড়াতে চান এবং হাটে-বাজারে সম্মান পেতে ভালবাসেন। তাঁরা মজলিস-খানায় প্রধান প্রধান আসনে ও মেজবানীর সময়ে সম্মানের জায়গায় বসতে ভালবাসেন। এক দিকে তাঁরা লোককে দেখাবার জন্য লম্বা লম্বা মুনাজাত করেন, অন্য দিকে বিধবাদের সম্পত্তি দখল করেন। এই লোকদের অনেক বেশী শাস্তি হবে।” এর পরে ঈসা চেয়ে দেখলেন, ধনী লোকেরা বায়তুল-মোকাদ্দসের দানের বাক্সে তাদের দান রাখছে। তিনি দেখলেন, একজন গরীব বিধবা এসে দু’টা পয়সা রাখল। তখন ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এই গরীব বিধবা অন্য সকলের চেয়ে অনেক বেশী রাখল, কারণ অন্যেরা সবাই তাদের প্রচুর ধন থেকে দান করেছে, কিন্তু এই স্ত্রীলোকটির অভাব থাকলেও বেঁচে থাকবার জন্য তার যা ছিল সমস্তই দিয়ে দিল।” সাহাবীদের মধ্যে কয়েকজন বায়তুল-মোকাদ্দসের বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, সুন্দর সুন্দর পাথর ও দানের জিনিস দিয়ে দালানটা কেমন সাজানো হয়েছে। তখন ঈসা বললেন, “তোমরা তো এই সব দেখছ, কিন্তু এমন দিন আসবে যখন এর একটা পাথরের উপরে আর একটা পাথর থাকবে না; সমস্তই ভেংগে ফেলা হবে।” সাহাবীরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, কখন এই সব হবে এবং কোন্‌ চিহ্ন দেখে আমরা বুঝতে পারব যে, এই সব ঘটবার সময় এসেছে?” জবাবে ঈসা বললেন, “দেখো, কেউ যেন তোমাদের না ঠকায়, কারণ অনেকে আমার নাম নিয়ে এসে বলবে, ‘আমিই মসীহ্‌’ এবং ‘সময় কাছে এসেছে।’ তাদের পিছনে যেয়ো না। তোমরা যখন যুদ্ধের ও বিদ্রোহের খবর শুনবে তখন ভয় পেয়ো না, কারণ প্রথমে এই সব হবেই; কিন্তু তখনই যে শেষ সময় আসবে তা নয়।” তারপর ঈসা তাঁদের বললেন, “এক জাতি আর এক জাতির বিরুদ্ধে এবং এক রাজ্য অন্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ভীষণ ভূমিকমপ হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী হবে। এছাড়া আসমানে এমন সব ঘটনা ঘটবে ও চিহ্ন দেখা যাবে যা ভীষণ ও ভয়ংকর। “এই সব হবার আগে লোকেরা তোমাদের ধরবে এবং তোমাদের উপর জুলুম করবে। বিচারের জন্য তারা তোমাদের মজলিস-খানায় নিয়ে যাবে এবং জেলে দেবে। আমার জন্য বাদশাহ্‌দের ও শাসনকর্তাদের সামনে তোমাদের নেওয়া হবে, আর তাতে আমার সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্য তোমাদের সুযোগ হবে। তোমরা এখনই মনে মনে ঠিক করে ফেল, তখন নিজের পক্ষে কথা বলবার জন্য তোমরা আগে থেকে তৈরী হবে না, কারণ আমি তোমাদের এমন কথা ও এমন জ্ঞান যুগিয়ে দেব যার জবাবে তোমাদের শত্রুরা কিছু বলতেও পারবে না এবং তা অস্বীকারও করতে পারবে না। তোমাদের মা-বাবা, ভাই-বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনেরা তোমাদের ধরিয়ে দেবে। তারা তোমাদের কাউকে কাউকে হত্যাও করবে। আমার জন্য সবাই তোমাদের ঘৃণা করবে, কিন্তু কোনমতেই তোমাদের একটা চুলও ধ্বংস হবে না। তোমরা স্থির থাকলে তোমাদের সত্যিকারের জীবন পূর্ণতা লাভ করবে। “যখন তোমরা দেখবে জেরুজালেমকে সৈন্যেরা ঘেরাও করেছে তখন বুঝবে যে, জেরুজালেমের ধ্বংস হবার সময় কাছে এসেছে। সেই সময় যারা এহুদিয়াতে থাকবে তারা পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যাক। যারা শহরের মধ্যে থাকবে তারা শহরের বাইরে চলে যাক। যারা গ্রামের দিকে থাকবে তারা কোনমতেই শহরে না আসুক, কারণ এই দিনগুলো হবে গজবের দিন, আর এতে পাক-কিতাবে যা লেখা আছে তা পূর্ণ হবে। তখন যারা গর্ভবতী আর যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ায় তাদের অবস্থা কি ভীষণই না হবে! দেশে ভীষণ কষ্ট উপস্থিত হবে এবং ইহুদী লোকদের উপরে আল্লাহ্‌র গজব নেমে আসবে। তলোয়ার দিয়ে তাদের হত্যা করা হবে এবং সমস্ত জাতির মধ্যে তারা বন্দী হিসাবে ছড়িয়ে থাকবে। যতদিন না অ-ইহুদীদের সময় পূর্ণ হয় ততদিন পর্যন্ত অ-ইহুদীরা জেরুজালেমকে তাদের পায়ের নীচে মাড়াতে থাকবে। “তখন সূর্য, চাঁদ ও তারাগুলোর মধ্যে অনেক চিহ্ন দেখা যাবে। দুনিয়াতে সমস্ত জাতি কষ্ট পাবে এবং সমুদ্রের গর্জন ও ঢেউয়ের জন্য তারা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠবে। দুনিয়াতে কি আসছে ভেবে ভয়ে লোকে অজ্ঞান হয়ে পড়বে, কারণ চাঁদ-সূর্য-তারা ইত্যাদি আর স্থির থাকবে না। সেই সময় মহাশক্তি ও মহিমার সংগে ইব্‌ন্তেআদমকে তারা মেঘের মধ্যে আসতে দেখবে। এই সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলে পর তোমরা উঠে দাঁড়ায়ো এবং মুখ তুলো, কারণ তোমাদের মুক্তির সময় কাছে এসেছে।” এর পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা দেবার জন্য এই কথা বললেন, “ডুমুর গাছ ও অন্যান্য গাছগুলোকে লক্ষ্য কর। পাতা বের হতে দেখলে পর তোমরা বুঝতে পার যে, গরমকাল কাছে এসেছে। সেইভাবে যখন তোমরা এই সব ঘটতে দেখবে তখন বুঝতে পারবে যে, আল্লাহ্‌র রাজ্য কাছে এসে গেছে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যখন এই সব হবে তখনও এই কালের কিছু লোক বেঁচে থাকবে। আসমান ও জমীনের শেষ হবে, কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকবে। সজাগ থেকো এবং সব সময় মুনাজাত কোরো যেন যা কিছু ঘটবে তা পার হয়ে যেতে এবং ইব্‌ন্তেআদমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তোমরা শক্তি পাও।” সেই সময় ঈসা প্রত্যেক দিনই বায়তুল-মোকাদ্দসে শিক্ষা দিতেন, কিন্তু রাতের বেলা বাইরে গিয়ে জৈতুন পাহাড়ে থাকতেন। সমস্ত লোক তাঁর কথা শুনবার জন্য খুব সকালেই বায়তুল-মোকাদ্দসে উপস্থিত হত। সেই সময় ইহুদীদের খামিহীন রুটির ঈদ কাছে এসে গিয়েছিল। এটাকে উদ্ধার-ঈদও বলা হয়। প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা ঈসাকে গোপনে হত্যা করবার উপায় খুঁজছিলেন, কারণ তাঁরা লোকদের ভয় করতেন। এই সময় এহুদা, যাকে ইষ্কারিয়োৎ বলা হত, তার ভিতরে শয়তান ঢুকল। এই এহুদা ছিল ঈসার বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন। কেমন করে ঈসাকে প্রধান ইমামদের ও বায়তুল-মোকাদ্দসের কর্মচারীদের হাতে ধরিয়ে দেবে এই বিষয়ে সে গিয়ে তাঁদের সংগে পরামর্শ করল। এতে তাঁরা খুব খুশী হয়ে এহুদাকে টাকা দিতে স্বীকার করলেন। তখন এহুদা রাজী হয়ে উপযুক্ত সুযোগ খুঁজতে লাগল যাতে লোকদের অনুপস্থিতিতে ঈসাকে ধরিয়ে দিতে পারে। তাঁরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কোথায় এই মেজবানী আমাদের প্রস্তুত করতে বলেন?” তখন সে তোমাদের উপরতলার একটা সাজানো বড় ঘর দেখিয়ে দেবে; সেখানেই সব কিছু প্রস্তুত কোরো।” ঈসা তাঁদের যেমন বলেছিলেন, তাঁরা গিয়ে সব কিছু সেই রকমই দেখতে পেলেন এবং উদ্ধার-ঈদের মেজবানী প্রস্তুত করলেন। তারপর সময় মত ঈসা সাহাবীদের সংগে খেতে বসলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “আমি কষ্টভোগ করবার আগে তোমাদের সংগে উদ্ধার-ঈদের এই মেজবানী খাবার আমার খুবই ইচ্ছা ছিল। আমি তোমাদের বলছি, আল্লাহ্‌র রাজ্যে এর উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি আর কখনও এই মেজবানী খাব না।” এর পর ঈসা পেয়ালা নিলেন এবং আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এটা ভাগ করে নাও, কারণ আমি তোমাদের বলছি, এখন থেকে আল্লাহ্‌র রাজ্য না আসা পর্যন্ত আমি আর কখনও আংগুর ফলের রস খাব না।” তারপর তিনি রুটি নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন। পরে সেই রুটি টুকরা টুকরা করে সাহাবীদের দিয়ে বললেন, “এটা আমার শরীর যা তোমাদের জন্য দেওয়া হবে। আমাকে মনে করবার জন্য এই রকম কোরো।” খাওয়ার পরে সেইভাবে তিনি পেয়ালাটা তাঁদের দিয়ে বললেন, “আমার রক্তের দ্বারা আল্লাহ্‌র যে নতুন ব্যবস্থা বহাল করা হবে সেই ব্যবস্থার চিহ্ন হল এই পেয়ালা। আমার এই রক্ত তোমাদের জন্য দেওয়া হবে। দেখ, যে আমাকে ধরিয়ে দেবে তার হাত আমার হাতের সংগে এই টেবিলের উপরেই আছে। আল্লাহ্‌ যা ঠিক করে রেখেছেন সেই ভাবেই ইব্‌ন্তেআদম মারা যাবেন বটে; কিন্তু হায় সেই লোক, যে তাঁকে ধরিয়ে দেয়!” সাহাবীরা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে, তাঁদের মধ্যে কে এমন কাজ করবেন। কাকে সবচেয়ে বড় বলা হবে এ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হল। ঈসা তাঁদের বললেন, “অ-ইহুদীদের মধ্যেই বাদশাহ্‌রা প্রভুত্ব করেন আর তাদের শাসনকর্তাদের উপকারী নেতা বলা হয়, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এই রকম হওয়া উচিত নয়। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, সে বরং সবচেয়ে যে ছোট তারই মত হোক, আর যে নেতা, সে সেবাকারীর মত হোক। কে বড়, যে খেতে বসে, না যে চাকর পরিবেশন করে? যে খেতে বসে, সে নয় কি? কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সেবাকারীর মত হয়েছি। “আমার সব দুঃখ-কষ্টের সময়ে তোমরা আমাকে ছেড়ে যাও নি। আমার পিতা যেমন আমাকে শাসন্তক্ষমতা দান করেছেন তেমনি আমিও তোমাদের ক্ষমতা দান করছি। এতে আমার রাজ্যে তোমরা আমার সংগে খাওয়া-দাওয়া করবে এবং সিংহাসনে বসে ইসরাইলের বারোটি গোষ্ঠীর বিচার করবে। “শিমোন, শিমোন, দেখ, শয়তান তোমাদের গমের মত করে চালুনি দিয়ে চেলে দেখবার অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু আমি তোমার জন্য মুনাজাত করেছি যেন তোমার ঈমানে ভাংগন না ধরে। তুমি যখন আমার কাছে ফিরে আসবে তখন তোমার এই ভাইদের শক্তিশালী করে তুলো।” পিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনার সংগে আমি জেলে যেতে এবং মরতেও প্রস্তুত আছি।” জবাবে ঈসা বললেন, “পিতর, আমি তোমাকে বলছি, আজ মোরগ ডাকবার আগে তুমি তিন বার আমাকে অস্বীকার করে বলবে যে, তুমি আমাকে চেন না।” তারপর ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি যখন তোমাদের টাকার থলি, ঝুলি ও জুতা ছাড়া পাঠিয়েছিলাম তখন কি তোমাদের কোন অভাব হয়েছিল?” সাহাবীরা বললেন, “জ্বী না, হয় নি।” ঈসা বললেন, “কিন্তু এখন আমি বলছি, যার টাকার থলি বা ঝুলি আছে সে তা নিয়ে যাক। যার ছোরা নেই সে তার চাদর বিক্রি করে একটা ছোরা কিনুক। পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘তাঁকে গুনাহ্‌গারদের সংগে গোণা হল’। আমি তোমাদের বলছি, এই কথা আমার মধ্যেই পূর্ণ হতে হবে, কারণ আমার বিষয়ে যা লেখা আছে তা পূর্ণ হতে যাচ্ছে।” তখন সাহাবীরা বললেন, “হুজুর, দেখুন, এখানে দু’টা ছোরা আছে।” ঈসা জবাব দিলেন, “থাক্‌, আর নয়।” ঈসা সেই জায়গা ছেড়ে নিজের নিয়ম মত জৈতুন পাহাড়ে গেলেন। তাঁর সাহাবীরা তাঁর পিছনে পিছনে গেলেন। ঠিক জায়গায় পৌঁছাবার পর ঈসা তাঁদের বললেন, “মুনাজাত কর যেন পরীক্ষায় না পড়।” তারপর ঈসা সাহাবীদের কাছ থেকে কিছু দূরে গিয়ে হাঁটু পেতে মুনাজাত করতে লাগলেন, “পিতা, যদি তুমি চাও তবে এই দুঃখের পেয়ালা আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও। তবুও আমার ইচ্ছামত নয়, তোমার ইচ্ছামতই হোক।” তখন বেহেশত থেকে একজন ফেরেশতা এসে ঈসাকে শক্তি দান করলেন। মনের কষ্টে ঈসা আরও আকুলভাবে মুনাজাত করলেন। তাঁর গায়ের ঘাম রক্তের ফোঁটার মত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। ঈসা তখনও কথা বলছেন এমন সময় অনেক লোক সেখানে আসল। এহুদা নামে তাঁর বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন সেই লোকদের আগে আগে আসছিল। এহুদা ঈসাকে চুমু দেবার জন্য তাঁর কাছে আসল। তখন ঈসা তাকে বললেন, “এহুদা, চুমু দিয়ে কি ইব্‌ন্তেআদমকে ধরিয়ে দিচ্ছ?” যাঁরা ঈসার চারপাশে ছিলেন তাঁরা বুঝলেন কি হতে যাচ্ছে। এইজন্য তাঁরা ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা কি ছোরা দিয়ে আঘাত করব?” সাহাবীদের মধ্যে একজন ছোরার আঘাতে মহা-ইমামের গোলামের ডান কানটা কেটে ফেললেন। ঈসা বললেন, “থাক্‌, আর নয়।” এই বলে তিনি লোকটির কান ছুঁয়ে তাকে ভাল করলেন। যে সব প্রধান ইমামেরা, বায়তুল-মোকাদ্দসের কর্মচারীরা এবং বৃদ্ধ নেতারা ঈসাকে ধরতে এসেছিলেন ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি কি ডাকাত যে, আপনারা ছোরা ও লাঠি নিয়ে এসেছেন? বায়তুল-মোকাদ্দসে দিনের পর দিন আমি আপনাদের সামনে ছিলাম, কিন্তু তখন তো আপনারা আমাকে ধরেন নি। তবে এখন অবশ্য আপনাদেরই সময়; অন্ধকারের ক্ষমতা এখন দেখা যাচ্ছে।” তখন তাঁরা ঈসাকে ধরে মহা-ইমামের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। পিতর দূরে থেকে পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন। উঠানের মাঝখানে যারা আগুন জ্বেলে বসে ছিল পিতর এসে তাদের মধ্যে বসলেন। একজন চাকরাণী সেই আগুনের আলোতে পিতরকে দেখতে পেল এবং ভাল করে তাকিয়ে দেখে বলল, “এই লোকটাও ওর সংগে ছিল।” পিতর অস্বীকার করে বললেন, “আমি ওকে চিনি না।” কিছুক্ষণ পরে আর একজন লোক তাঁকে দেখে বলল, “তুমিও তো ওদের একজন।” পিতর বললেন, “না, আমি নই।” এক ঘণ্টা পরে আর একজন জোর দিয়ে বলল, “এই লোকটি নিশ্চয়ই ওর সংগে ছিল, কারণ এ তো গালীল প্রদেশের লোক।” পিতর বললেন, “দেখ, তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।” পিতরের কথা শেষ হতে না হতেই একটা মোরগ ডেকে উঠল। তখন ঈসা মুখ ফিরিয়ে পিতরের দিকে দেখলেন। এতে যে কথা ঈসা তাঁকে বলেছিলেন সেই কথা পিতরের মনে পড়ল, “আজ মোরগ ডাকবার আগে তুমি তিন বার বলবে যে, তুমি আমাকে চেন না।” তখন পিতর বাইরে গিয়ে খুব কাঁদতে লাগলেন। যারা ঈসাকে পাহারা দিচ্ছিল তারা তাঁকে ঠাট্টা করতে ও মারতে লাগল। তারা ঈসার চোখ বেঁধে দিয়ে বলল, “বল্‌ তো দেখি, কে তোকে মারল?” এইভাবে তারা আরও অনেক কথা বলে তাঁকে অপমান করল। সকাল হলে পর ইহুদীদের বৃদ্ধনেতারা, প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা একসংগে জমায়েত হলেন এবং ঈসাকে তাঁদের মহাসভার সামনে এনে বললেন, কিন্তু ইব্‌ন্তেআদম এখন থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র ডানপাশে বসে থাকবেন।” তখন সকলে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে তুমি কি ইব্‌নুল্লাহ্‌?” তিনি তাঁদের বললেন, “আপনারা ঠিকই বলছেন যে, আমিই সে-ই।” তখন নেতারা বললেন, “আমাদের আর সাক্ষ্যের কি দরকার? আমরা নিজেরাই তো ওর মুখে শুনলাম।” তখন সেই সভার সকলে উঠে ঈসাকে রোমীয় প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁরা এই বলে ঈসার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে লাগলেন, “আমরা দেখেছি, এই লোকটা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লোকদের নিয়ে যাচ্ছে। সে সম্রাটকে খাজনা দিতে নিষেধ করে এবং বলে সে নিজেই মসীহ্‌, একজন বাদশাহ্‌।” পীলাত ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ইহুদীদের বাদশাহ্‌?” ঈসা বললেন, “আপনি ঠিক কথাই বলছেন।” তখন পীলাত প্রধান ইমামদের ও সমস্ত লোকদের বললেন, “আমি তো এই লোকটির কোন দোষই দেখতে পাচ্ছি না।” কিন্তু তাঁরা জিদ করে বলতে লাগলেন, “এহুদিয়া প্রদেশের সব জায়গায় শিক্ষা দিয়ে এ লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। গালীল প্রদেশ থেকে সে শুরু করেছে, আর এখন এখানে এসেছে।” এই কথা শুনে পীলাত জিজ্ঞাসা করলেন ঈসা গালীল প্রদেশের লোক কি না। শাসনকর্তা হেরোদের শাসনের অধীনে যে প্রদেশ আছে, ঈসা সেই জায়গার লোক জানতে পেরে পীলাত তাঁকে হেরোদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সময় হেরোদও জেরুজালেমে ছিলেন। ঈসাকে দেখে হেরোদ খুব খুশী হলেন। তিনি ঈসার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন, তাই তিনি অনেক দিন ধরে তাঁকে দেখতে চাইছিলেন। হেরোদ আশা করেছিলেন ঈসা তাঁকে কোন অলৌকিক কাজ করে দেখাবেন। তিনি ঈসাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ঈসা কোন কথারই জবাব দিলেন না। প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ঈসাকে দোষ দিতে লাগলেন। তখন হেরোদ ঈসাকে অপমান ও ঠাট্টা করলেন, আর তাঁর সৈন্যেরাও তা-ই করল। তার পরে ঈসাকে জমকালো একটা পোশাক পরিয়ে তিনি তাঁকে পীলাতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এর আগে হেরোদ ও পীলাতের মধ্যে শত্রুতা ছিল, কিন্তু সেই দিন থেকে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হল। পীলাত তখন প্রধান ইমামদের, নেতাদের এবং সাধারণ লোকদের ডেকে একত্র করে বললেন, “আপনারা এই লোকটিকে এই দোষ দিয়ে আমার কাছে এনেছেন যে, লোকদের সে সরকারের বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে আমি আপনাদের সামনেই জেরা করেছি। আপনারা তার বিরুদ্ধে যে সব দোষ দিচ্ছেন তার একটাতেও সে দোষী বলে আমি প্রমাণ পাই নি। হেরোদও নিশ্চয় তার কোন দোষ পান নি, কারণ তিনি তাকে আমাদের কাছে ফেরৎ পাঠিয়েছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, হত্যা করবার মত এমন কোন অন্যায় কাজও সে করে নি। তাই আমি তাকে শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেব।” তিনি এই কথা বললেন কারণ উদ্ধার-ঈদের সময়ে প্রত্যেক বারই তাঁকে একজন কয়েদীকে ছেড়ে দিতে হত। কিন্তু লোকেরা একসংগে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “ওকে দূর করুন, বারাব্বাকে আমাদের কাছে ছেড়ে দিন।” এই বারাব্বাকে শহরের মধ্যে বিদ্রোহ ও খুনাখুনির জন্য জেলে দেওয়া হয়েছিল। পীলাত কিন্তু ঈসাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেইজন্য তিনি লোকদের আবার সেই একই কথা বললেন। কিন্তু লোকেরা এই বলে চেঁচাতেই থাকল, “ওকে ক্রুশে দিন, ক্রুশে দিন।” পীলাত তৃতীয়বার লোকদের বললেন, “কেন, এই লোকটি কি দোষ করেছে? আমি তো তার কোন দোষই দেখতে পাচ্ছি না যাতে তাকে মৃত্যুর শাস্তি দেওয়া যায়। সেইজন্য তাকে আমি অন্য শাস্তি দেবার পর ছেড়ে দেব।” কিন্তু লোকেরা ঈসাকে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য চিৎকার করতে থাকল এবং শেষে তারা চেঁচিয়েই জয়ী হল। পীলাত লোকদের কথা মেনে নেওয়া ঠিক করলেন। সৈন্যেরা যখন ঈসাকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন শিমোন নামে কুরীণী শহরের একজন লোক গ্রামের দিক থেকে আসছিল। সৈন্যেরা তাকে জোর করে ধরে ক্রুশটা তার কাঁধে তুলে দিল যেন সে ঈসার পিছনে তা বয়ে নিয়ে যেতে পারে। অনেক লোক ঈসার পিছনে পিছনে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে অনেক স্ত্রীলোকও ছিল। তারা বুক চাপ্‌ড়ে কাঁদছিল। ঈসা তাদের দিকে ফিরে বললেন, “জেরুজালেমের মেয়েরা, আমার জন্য কেঁদো না। তোমাদের নিজেদের জন্য এবং তোমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কাঁদ, কারণ এমন দিন আসছে যখন লোকে বলবে, ‘যাদের কখনও ছেলেমেয়ে হয় নি এবং যারা কখনও বুকের দুধ শিশুদের খাওয়ায় নি সেই বন্ধ্যা স্ত্রীলোকেরা ধন্যা।’ সেই সময়ে লোকে বড় বড় পাহাড়কে বলবে, ‘আমাদের উপর পড়,’ আর ছোট ছোট পাহাড়কে বলবে, ‘আমাদের ঢেকে রাখ।’ গাছ সবুজ থাকতে যদি লোকে এই রকম করে তবে গাছ শুকনা হলে পর কিনা হবে!” সৈন্যেরা দু’জন দোষী লোককেও হত্যা করবার জন্য ঈসার সংগে নিয়ে চলল। যে জায়গাটাকে মাথার খুলি বলা হত সেখানে পৌঁছে তারা ঈসাকে ও সেই দু’জন দোষীকে ক্রুশে দিল- একজনকে ঈসার ডান দিকে ও অন্যজনকে বাঁদিকে। তখন ঈসা বললেন, “পিতা, এদের মাফ কর, কারণ এরা কি করছে তা জানে না।” তারা গুলিবাঁট করে ঈসার কাপড়-চোপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখছিল। ধর্ম-নেতারা ঈসাকে ঠাট্টা করে বললেন, “সে তো অন্যদের রক্ষা করত। যদি সে আল্লাহ্‌র মসীহ্‌, তাঁর বাছাই-করা বান্দা হয় তবে নিজেকে রক্ষা করুক!” সৈন্যেরাও তাঁকে ঠাট্টা করতে লাগল। তারা ঈসাকে খেতে দেবার জন্য তাঁর কাছে সিরকা নিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যদি ইহুদীদের বাদশাহ্‌ হও তবে নিজেকে রক্ষা কর।” ক্রুশে তাঁর মাথার উপরের দিকে একটা ফলকে এই কথা লেখা ছিল, “এই লোকটি ইহুদীদের বাদশাহ্‌।” যে দু’জন দোষী লোককে সেখানে ক্রুশে টাংগানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ঈসাকে টিট্‌কারি দিয়ে বলল, “তুমি নাকি মসীহ্‌? তাহলে নিজেকে ও আমাদের রক্ষা কর।” তখন অন্য লোকটি তাকে বকুনি দিয়ে বলল, “তুমি কি আল্লাহ্‌কে ভয় কর না? তুমি তো একই রকম শাস্তি পাচ্ছ। আমরা উচিত শাস্তি পাচ্ছি। আমাদের যা পাওনা আমরা তা-ই পাচ্ছি, কিন্তু এই লোকটি তো কোন দোষ করে নি।” তারপর সে বলল, “ঈসা, আপনি যখন রাজত্ব করতে ফিরে আসবেন তখন আমার কথা মনে করবেন।” জবাবে ঈসা তাকে বললেন, “আমি তোমাকে সত্যি বলছি, তুমি আজকেই আমার সংগে জান্নাতুল-ফেরদৌসে উপস্থিত হবে।” ঈসা চিৎকার করে বললেন, “পিতা, আমি তোমার হাতে আমার রূহ্‌ তুলে দিলাম।” এই কথা বলে তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। এই সব দেখে রোমীয় শত-সেনাপতি আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বললেন, “সত্যিই লোকটি ধার্মিক ছিল।” যে লোকেরা সেখানে জমায়েত হয়েছিল তারা এই সমস্ত ঘটনা দেখে বুক চাপ্‌ড়াতে চাপ্‌ড়াতে সেখান থেকে ফিরে গেল। যাঁরা ঈসাকে চিনতেন এবং যে স্ত্রীলোকেরা গালীল থেকে তাঁর সংগে সংগে এসেছিলেন তাঁরা সবাই দূরে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলেন। ইউসুফ নামে একজন সৎ ও ধার্মিক লোক মহাসভার সদস্য ছিলেন। তিনি অরিমাথিয়া নামে ইহুদীদের একটা গ্রামের লোক। ঈসার বিষয়ে সভার লোকদের সংগে তিনি একমত হতে পারেন নি। তিনি আল্লাহ্‌র রাজ্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পীলাতের কাছে গিয়ে তিনি ঈসার লাশটি চেয়ে নিলেন। পরে লাশটি ক্রুশ থেকে নামিয়ে কাফন দিয়ে জড়ালেন এবং পাথর কেটে তৈরী করা একটা কবরের মধ্যে দাফন করলেন। সেই কবরে আর কখনও কাউকে দাফন করা হয় নি। সেই দিনটা ছিল বিশ্রামবারের আয়োজনের দিন। বিশ্রামবার প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে স্ত্রীলোকেরা ঈসার সংগে গালীল থেকে এসেছিলেন তাঁরা ইউসুফের পিছনে পিছনে গিয়ে কবরটি দেখলেন এবং ঈসার লাশ কিভাবে দাফন করা হল তাও দেখলেন। তারপর তাঁরা ফিরে গিয়ে তাঁর লাশের জন্য খোশবু মসলা এবং মলম তৈরী করলেন। এর পরে তাঁরা মূসার হুকুম মত বিশ্রামবারে বিশ্রাম করলেন। সপ্তার প্রথম দিনের খুব সকালবেলা সেই স্ত্রীলোকেরা সেই খোশবু মসলা নিয়ে কবরের কাছে গেলেন। তাঁরা দেখলেন কবরের মুখ থেকে পাথরখানা সরিয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু কবরের ভিতরে গিয়ে তাঁরা হযরত ঈসার লাশ দেখতে পেলেন না। যখন তাঁরা অবাক হয়ে সেই বিষয়ে ভাবছিলেন তখন বিদ্যুতের মত ঝক্‌ঝকে কাপড় পরা দু’জন লোক তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এতে স্ত্রীলোকেরা ভয় পেয়ে মাথা নীচু করলেন। লোক দু’টি তাঁদের বললেন, “যিনি জীবিত তাঁকে মৃতদের মধ্যে তালাশ করছ কেন? তিনি এখানে নেই; তিনি জীবিত হয়ে উঠেছেন। তিনি যখন গালীলে ছিলেন তখন তিনি তোমাদের কাছে যা বলেছিলেন তা মনে করে দেখ। তিনি বলেছিলেন, ইব্‌ন্তেআদমকে গুনাহ্‌গার লোকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তার পরে তাঁকে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হবে এবং তৃতীয় দিনে তাঁকে আবার জীবিত হয়ে উঠতে হবে।” তখন তাঁদের সেই কথা মনে পড়ল। তাঁরা কবর থেকে ফিরে গিয়ে সেই এগারোজন সাহাবী এবং অন্য সকলকে এই সব কথা জানালেন। সেই স্ত্রীলোকদের মধ্যে ছিলেন মগ্‌দলীনী মরিয়ম, যোহানা ও ইয়াকুবের মা মরিয়ম। তাঁদের সংগে আর অন্য যে স্ত্রীলোকেরা ছিলেন তাঁরাও এই সমস্ত কথা সাহাবীদের কাছে বললেন। কিন্তু সেই সব কথা তাঁদের কাছে বাজে কথার মতই মনে হল। সেইজন্য সেই স্ত্রীলোকদের কথা তাঁরা বিশ্বাস করলেন না। পিতর কিন্তু উঠে দৌড়ে কবরের কাছে গেলেন এবং নীচু হয়ে কেবল কাপড়গুলোই দেখতে পেলেন। যা ঘটেছে তাতে আশ্চর্য হয়ে তিনি ফিরে আসলেন। সেই দিনেই দু’জন সাহাবী ইম্মায়ূ নামে একটা গ্রামে যাচ্ছিলেন। গ্রামটা জেরুজালেম থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে ছিল। যা ঘটেছে তা নিয়ে তাঁরা আলাপ-আলোচনা করছিলেন। সেই সময় ঈসা নিজেই সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সংগে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁদের চোখ যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই তাঁরা ঈসাকে চিনতে পারলেন না। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা কি কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন?” সেই দু’জন উম্মত ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন ক্লিয়পা নামে তাঁদের মধ্যে একজন ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনিই কি জেরুজালেমের একমাত্র লোক যিনি জানেন না এই কয়দিনে সেখানে কি কি ঘটছে?” ঈসা তাঁদের বললেন, “কি কি ঘটেছে?” তাঁরা বললেন, “নাসরত গ্রামের ঈসাকে নিয়ে যা যা ঘটেছে। তিনি নবী ছিলেন। তিনি কাজে ও কথায় আল্লাহ্‌ ও সমস্ত লোকের চোখে শক্তিশালী ছিলেন। আমাদের প্রধান ইমামেরা ও ধর্ম-নেতারা তাঁকে রোমীয়দের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন যাতে তারা তাঁর বিচার করে তাঁকে মৃত্যুর শাস্তি দেয়। পরে সেই ইহুদী নেতারা তাঁকে ক্রুশে দিয়েছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম তিনিই ইসরাইল জাতিকে মুক্ত করবেন। কেবল তা-ই নয়, আজ তিন দিন হল এই সব ঘটনা ঘটেছে। আবার আমাদের দলের কয়েকজন স্ত্রীলোক আমাদের অবাক করেছেন। তাঁরা খুব সকালে ঈসার কবরে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তাঁর লাশ দেখতে পান নি। তাঁরা ফিরে এসে বললেন, তাঁরা ফেরেশতাদের দেখা পেয়েছেন আর সেই ফেরেশতারা তাঁদের বলেছেন যে, ঈসা বেঁচে আছেন। তখন আমাদের সংগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কবরে গিয়ে স্ত্রীলোকেরা যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনি দেখতে পেলেন, কিন্তু ঈসাকে দেখতে পেলেন না।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা কিছুই বোঝেন না। আপনাদের মন এমন অসাড় যে, নবীরা যা বলেছেন তা আপনারা বিশ্বাস করেন না। এই সমস্ত কষ্ট ভোগ করে কি মসীহের মহিমা লাভ করবার কথা ছিল না?” এর পরে তিনি মূসার এবং সমস্ত নবীদের কিতাব থেকে শুরু করে গোটা পাক-কিতাবের মধ্যে তাঁর নিজের বিষয়ে যা যা লেখা আছে তা সবই তাঁদের বুঝিয়ে বললেন। তাঁরা যে গ্রামে যাচ্ছিলেন সেই গ্রামের কাছাকাছি আসলে পর ঈসা আরও দূরে যাবার ভাব দেখালেন। তখন তাঁরা খুব সাধাসাধি করে তাঁকে বললেন, “এখন বেলা গেছে, সন্ধ্যা হয়েছে। আপনি আমাদের সংগে থাকুন।” এতে তিনি তাঁদের সংগে থাকবার জন্য ঘরে ঢুকলেন। যখন তিনি তাঁদের সংগে খেতে বসলেন তখন রুটি নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং তা টুকরা করে তাঁদের দিলেন। তখন তাঁদের চোখ খুলে গেল; তাঁরা ঈসাকে চিনতে পারলেন, কিন্তু তার সংগে সংগেই তাঁকে আর দেখা গেল না। তখন তাঁরা একে অন্যকে বললেন, “রাস্তায় যখন তিনি আমাদের সংগে কথা বলছিলেন এবং পাক-কিতাব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তখন আমাদের অন্তর কি জ্বলে জ্বলে উঠছিল না?” তখনই সেই দু’জন উঠে জেরুজালেমে গেলেন এবং সেই এগারোজন সাহাবী ও তাঁদের সংগে অন্যদেরও এক জায়গায় দেখতে পেলেন। হযরত ঈসা যে সত্যিই জীবিত হয়ে উঠেছেন এবং শিমোনকে দেখা দিয়েছেন তা নিয়ে তখন তাঁরা আলোচনা করছিলেন। সেই দু’জন সাহাবী রাস্তায় যা হয়েছিল তা তাঁদের জানালেন। তাঁরা আরও জানালেন, তিনি যখন রুটি টুকরা টুকরা করছিলেন তখন কেমন করে তাঁরা তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। সেই সাহাবীরা যখন এই কথা বলছিলেন তখন ঈসা নিজে তাঁদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের সবাইকে বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম।” তাঁরা ভূত দেখছেন ভেবে খুব ভয় পেলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “কেন তোমরা অস্থির হচ্ছ আর কেনই বা তোমাদের মনে সন্দেহ জাগছে? আমার হাত ও পা দেখ। দেখ, এ আমি। আমাকে ছুঁয়ে দেখ, কারণ ভূতের তো আমার মত হাড়-মাংস নেই।” এই কথা বলে ঈসা তাঁর হাত ও পা তাঁদের দেখালেন। কিন্তু তাঁরা এত আশ্চর্য ও আনন্দিত হয়েছিলেন যে, বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমাদের এখানে কি কোন খাবার আছে?” তাঁরা তাঁকে এক টুকরা ভাজা মাছ দিলেন। তিনি তা নিয়ে তাঁদের সামনেই খেলেন। তারপর তিনি তাঁদের বললেন, “আমি যখন তোমাদের সংগে ছিলাম তখন বলেছিলাম, মূসার তৌরাত শরীফে, নবীদের কিতাবে ও জবুর শরীফের মধ্যে আমার বিষয়ে যে যে কথা লেখা আছে তার সব পূর্ণ হতেই হবে।” আরও লেখা আছে, জেরুজালেম থেকে শুরু করে সমস্ত জাতির কাছে মসীহের নামে এই খবর তবলিগ করা হবে যে, তওবা করলে গুনাহের মাফ পাওয়া যায়। তোমরাই এই সমস্ত বিষয়ের সাক্ষী। দেখ, আমার পিতা যা দেবার ওয়াদা করেছেন তা আমি তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব। বেহেশত থেকে শক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা এই শহরেই থেকো।” পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের নিয়ে বেথানিয়া পর্যন্ত গেলেন। সেখানে তিনি হাত তুলে তাঁদের দোয়া করলেন। দোয়া করতে করতেই তিনি তাঁদের ছেড়ে গেলেন এবং তাঁকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হল। তখন তাঁরা উবুড় হয়ে তাঁকে সেজদা করলেন এবং খুব আনন্দের সংগে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। তাঁরা সব সময় বায়তুল-মোকাদ্দসে উপস্থিত থেকে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগলেন। প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহ্‌র সংগে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ্‌ ছিলেন। আর প্রথমেই তিনি আল্লাহ্‌র সংগে ছিলেন। সব কিছুই সেই কালামের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল, আর যা কিছু সৃষ্ট হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কোন কিছুই তাঁকে ছাড়া সৃষ্ট হয় নি। তাঁর মধ্যে জীবন ছিল এবং সেই জীবনই ছিল মানুষের নূর। সেই নূর অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে কিন্তু অন্ধকার নূরকে জয় করতে পারে নি। আল্লাহ্‌ ইয়াহিয়া নামে একজন লোককে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নূরের বিষয়ে সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন যেন সকলে তাঁর সাক্ষ্য শুনে ঈমান আনতে পারে। তিনি নিজে সেই নূর ছিলেন না কিন্তু সেই নূরের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। সেই আসল নূর, যিনি প্রত্যেক মানুষকে নূর দান করেন, তিনি দুনিয়াতে আসছিলেন। তিনি দুনিয়াতেই ছিলেন এবং দুনিয়া তাঁর দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছিল, তবু দুনিয়ার মানুষ তাঁকে চিনল না। তিনি নিজের দেশে আসলেন, কিন্তু তাঁর নিজের লোকেরাই তাঁকে গ্রহণ করল না। তবে যতজন তাঁর উপর ঈমান এনে তাঁকে গ্রহণ করল তাদের প্রত্যেককে তিনি আল্লাহ্‌র সন্তান হবার অধিকার দিলেন। এই লোকদের জন্ম রক্ত থেকে হয় নি, শারীরিক কামনা বা পুরুষের বাসনা থেকেও হয় নি, কিন্তু আল্লাহ্‌ থেকেই হয়েছে। সেই কালামই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন এবং আমাদের মধ্যে বাস করলেন। পিতার একমাত্র পুত্র হিসাবে তাঁর যে মহিমা সেই মহিমা আমরা দেখেছি। তিনি রহমত ও সত্যে পূর্ণ। ইয়াহিয়া তাঁর বিষয়ে জোর গলায় সাক্ষ্য দিয়ে বললেন, “উনিই সেই লোক যাঁর বিষয়ে আমি বলেছিলাম, যিনি আমার পরে আসছেন তিনি আমার চেয়ে মহান, কারণ তিনি আমার অনেক আগে থেকেই আছেন।” আমরা সকলে তাঁর সেই পূর্ণতা থেকে রহমতের উপরে আরও রহমত পেয়েছি। মূসার মধ্য দিয়ে শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে রহমত ও সত্য এসেছে। আল্লাহ্‌কে কেউ কখনও দেখে নি। তাঁর সংগে থাকা সেই একমাত্র পুত্র, যিনি নিজেই আল্লাহ্‌, তিনিই তাঁকে প্রকাশ করেছেন। যখন ইহুদী নেতারা জেরুজালেম শহর থেকে কয়েকজন ইমাম ও লেবীয়কে ইয়াহিয়ার কাছে পাঠালেন তখন ইয়াহিয়া তাঁদের কাছে সাক্ষ্য দিলেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কে?” জবাবে ইয়াহিয়া অস্বীকার করলেন না বরং স্বীকার করে বললেন, “আমি মসীহ্‌ নই।” তখন তাঁরা ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে কে? আপনি কি নবী ইলিয়াস?” তিনি বললেন, “না, আমি ইলিয়াস নই।” তাঁরা বললেন, “তাহলে আপনি কি সেই নবী?” জবাবে তিনি বললেন, “না।” তখন তাঁরা তাঁকে বললেন, “তাহলে আপনি কে? যাঁরা আমাদের পাঠিয়েছেন ফিরে গিয়ে তাঁদের তো আমাদের জবাব দিতে হবে। আপনার নিজের সম্বন্ধে আপনি নিজে কি বলেন?” ইয়াহিয়া বললেন, “আমিই সেই কণ্ঠস্বর, যার বিষয়ে নবী ইশাইয়া বলেছেন, মরুভূমিতে একজনের কণ্ঠস্বর চিৎকার করে জানাচ্ছে, তোমরা মাবুদের পথ সোজা কর।” ইয়াহিয়ার কাছে যাঁদের পাঠানো হয়েছিল তাঁরা ছিলেন ফরীশী। তাঁরা ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আপনি মসীহ্‌ও নন, ইলিয়াসও নন কিংবা সেই নবীও নন, তবে কেন আপনি তরিকাবন্দী দিচ্ছেন?” ইয়াহিয়া জবাবে সেই ফরীশীদের বললেন, “আমি পানিতে তরিকাবন্দী দিচ্ছি বটে, কিন্তু আপনাদের মধ্যে এমন একজন আছেন যাঁকে আপনারা চেনেন না। উনিই সেই লোক যাঁর আমার পরে আসবার কথা ছিল। আমি তাঁর জুতার ফিতাটা পর্যন্ত খুলে দেবার যোগ্য নই।” জর্ডান নদীর অন্য পারে বেথানিয়া গ্রামে যেখানে ইয়াহিয়া তরিকাবন্দী দিচ্ছিলেন সেখানে এই সব ঘটেছিল। পরের দিন ইয়াহিয়া ঈসাকে তাঁর নিজের দিকে আসতে দেখে বললেন, “ঐ দেখ আল্লাহ্‌র মেষ-শাবক, যিনি মানুষের সমস্ত গুনাহ্‌ দূর করেন। ইনিই সেই লোক যাঁর বিষয়ে আমি বলেছিলাম, আমার পরে একজন আসছেন যিনি আমার চেয়ে মহান, কারণ তিনি আমার অনেক আগে থেকেই আছেন। আমি তাঁকে চিনতাম না, কিন্তু তিনি যেন বনি-ইসরাইলদের কাছে প্রকাশিত হন সেইজন্য আমি এসে পানিতে তরিকাবন্দী দিচ্ছি।” তারপর ইয়াহিয়া এই সাক্ষ্য দিলেন, “আমি পাক-রূহ্‌কে কবুতরের মত হয়ে আসমান থেকে নেমে এসে তাঁর উপরে থাকতে দেখেছি। আমি তাঁকে চিনতাম না, কিন্তু যিনি আমাকে পানিতে তরিকাবন্দী দিতে পাঠিয়েছেন তিনিই আমাকে বলে দিয়েছেন, ‘যাঁর উপরে পাক-রূহ্‌কে নেমে এসে থাকতে দেখবে, তিনিই সেই জন যিনি পাক-রূহে তরিকাবন্দী দেবেন।’ আমি তা দেখেছি আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ইনিই ইব্‌নুল্লাহ্‌।” পরের দিন ইয়াহিয়া ও তাঁর দু’জন সাহাবী আবার সেখানে ছিলেন। এমন সময় ঈসাকে হেঁটে যেতে দেখে ইয়াহিয়া বললেন, “ঐ দেখ, আল্লাহ্‌র মেষ-শাবক।” ইয়াহিয়াকে এই কথা বলতে শুনে সেই দু’জন সাহাবী ঈসার পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। ঈসা পিছন ফিরে তাঁদের আসতে দেখে বললেন, “তোমরা কিসের তালাশ করছ?” ইয়াহিয়ার সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “রব্বি (অর্থাৎ ওস্তাদ), আপনি কোথায় থাকেন?” ঈসা তাঁদের বললেন, “এসে দেখ।” তখন তাঁরা গিয়ে ঈসা যেখানে থাকতেন সেই জায়গাটা দেখলেন এবং সেই দিন তাঁর সংগেই রইলেন। তখন প্রায় বিকাল চারটা। ইয়াহিয়ার কথা শুনে যে দু’জন ঈসার পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন তাঁদের একজনের নাম ছিল আন্দ্রিয়। ইনি ছিলেন শিমোন্তপিতরের ভাই। আন্দ্রিয় প্রথমে তাঁর ভাই শিমোনকে খুঁজে বের করলেন এবং বললেন, “আমরা মসীহের দেখা পেয়েছি।” আন্দ্রিয় শিমোনকে ঈসার কাছে আনলেন। ঈসা শিমোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ইউহোন্নার ছেলে শিমোন, কিন্তু তোমাকে কৈফা বলে ডাকা হবে।” এই নামের অর্থ পিতর, অর্থাৎ পাথর। পরের দিন ঈসা ঠিক করলেন তিনি গালীল প্রদেশে যাবেন। সেই সময় ঈসা ফিলিপের খোঁজ পেয়ে তাঁকে বললেন, “এস, আমার উম্মত হও।” ফিলিপ ছিলেন বৈৎসৈদা গ্রামের লোক। আন্দ্রিয় আর পিতরও ঐ একই গ্রামের লোক ছিলেন। ফিলিপ নথনেলকে খুঁজে বের করে বললেন, “মূসা যাঁর কথা তৌরাত শরীফে লিখে গেছেন এবং যাঁর বিষয়ে নবীরাও লিখেছেন আমরা তাঁর দেখা পেয়েছি। তিনি ইউসুফের পুত্র ঈসা, নাসরত গ্রামের লোক।” নথনেল ফিলিপকে বললেন, “নাসরত থেকে কি ভাল কোন কিছু আসতে পারে?” ফিলিপ তাঁকে বললেন, “এসে দেখ।” ঈসা নথনেলকে নিজের দিকে আসতে দেখে তাঁর বিষয়ে বললেন, “ঐ দেখ, একজন সত্যিকারের ইসরাইলীয়। তার মনে কোন ছলনা নেই।” নথনেল ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কেমন করে আমাকে চিনলেন?” ঈসা জবাবে তাঁকে বললেন, “ফিলিপ তোমাকে ডাকবার আগে যখন তুমি সেই ডুমুর গাছের তলায় ছিলে, আমি তখনই তোমাকে দেখেছিলাম।” এতে নথনেল ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনিই ইব্‌নুল্লাহ্‌, আপনিই বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌।” ঈসা তাঁকে বললেন, “তোমাকে সেই ডুমুর গাছের তলায় দেখেছি, এই কথা বলবার জন্যই কি ঈমান আনলে? এর চেয়ে আরও অনেক মহৎ ব্যাপার তুমি দেখতে পাবে।” পরে ঈসা বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা বেহেশত খোলা দেখবে, আর দেখবে আল্লাহ্‌র ফেরেশতারা ইব্‌ন্তেআদমের কাছ থেকে উঠছেন এবং তাঁর কাছে নামছেন।” এর দু’দিন পরে গালীলের কান্না গ্রামে একটা বিয়ে হয়েছিল। ঈসার মা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই বিয়েতে ঈসা এবং তাঁর সাহাবীরাও দাওয়াত পেয়েছিলেন। পরে যখন সমস্ত আংগুর-রস ফুরিয়ে গেল তখন ঈসার মা ঈসাকে বললেন, “এদের আংগুর-রস নেই।” ঈসা তাঁর মাকে বললেন, “এই ব্যাপারে তোমার সংগে আমার কি সম্বন্ধ? আমার সময় এখনও হয় নি।” তাঁর মা তখন চাকরদের বললেন, “ইনি তোমাদের যা করতে বলেন তা-ই কর।” ইহুদী শরীয়ত মত পাক-সাফ হবার জন্য সেই জায়গায় পাথরের ছয়টা জালা বসানো ছিল। সেগুলোর প্রত্যেকটাতে কমবেশ পঁয়তাল্লিশ লিটার করে পানি ধরত। ঈসা সেই চাকরদের বললেন, “এই জালাগুলোতে পানি ভরে দাও। চাকরেরা তখন জালাগুলো কানায় কানায় পানি ভরে দিল। তারপর ঈসা তাদের বললেন, “এবার ওখান থেকে অল্প তুলে মেজবানীর কর্তার কাছে নিয়ে যাও।” চাকরেরা তা-ই করল। সেই আংগুর-রস, যা পানি থেকে হয়েছিল, মেজবানীর কর্তা তা খেয়ে দেখলেন। কিন্তু সেই রস কোথা থেকে আসল তা তিনি জানতেন না; তবে যে চাকরেরা পানি তুলেছিল তারা জানত। তাই মেজবানীর কর্তা বরকে ডেকে বললেন, “প্রথমে সকলে ভাল আংগুর-রস খেতে দেয়। তারপর যখন লোকের ইচ্ছামত খাওয়া শেষ হয় তখন যে রস দেয় তা আগের চেয়ে কিছু খারাপ। কিন্তু তুমি ভাল আংগুর-রস এখনও পর্যন্ত রেখেছ।” ঈসা গালীল প্রদেশের কান্না গ্রামে চিহ্ন হিসাবে এই প্রথম অলৌকিক কাজ করে নিজের মহিমা প্রকাশ করলেন। এতে তাঁর সাহাবীরা তাঁর উপর ঈমান আনলেন। তারপর ঈসা, তাঁর মা, তাঁর ভাইয়েরা ও তাঁর সাহাবীরা কফরনাহূম শহরে গেলেন, কিন্তু বেশী দিন তাঁরা সেখানে থাকলেন না। ইহুদীদের উদ্ধার-ঈদের সময় কাছে আসলে পর ঈসা জেরুজালেমে গেলেন। তিনি সেখানে দেখলেন, লোকেরা বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে গরু, ভেড়া আর কবুতর বিক্রি করছে এবং টাকা বদল করে দেবার লোকেরাও বসে আছে। এই সব দেখে তিনি দড়ি দিয়ে একটা চাবুক তৈরী করলেন, আর তা দিয়ে সমস্ত গরু, ভেড়া এবং লোকদেরও সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। টাকা বদল করে দেবার লোকদের টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি তাদের টেবিলগুলো উল্টে ফেললেন। যারা কবুতর বিক্রি করছিল ঈসা তাদের বললেন, “এই জায়গা থেকে এই সব নিয়ে যাও। আমার পিতার ঘরকে ব্যবসার ঘর কোরো না।” এতে পাক-কিতাবে লেখা এই কথাটা তাঁর সাহাবীদের মনে পড়ল: তোমার ঘরের জন্য আমার যে গভীর ভালবাসা, সেই ভালবাসাই আমার দিলকে জ্বালিয়ে তুলবে। তখন ইহুদী নেতারা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এই সব করবার অধিকার যে তোমার সত্যিই আছে তার প্রমাণ হিসাবে তুমি কি অলৌকিক কাজ আমাদের দেখাতে পার?” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “আল্লাহ্‌র ঘর আপনারা ভেংগে ফেলুন, তিন দিনের মধ্যে আবার আমি তা উঠাব।” এই কথা শুনে ইহুদী নেতারা তাঁকে বললেন, “এই এবাদত-খানাটি তৈরী করতে ছেচল্লিশ বছর লেগেছিল, আর তুমি কি তিন দিনের মধ্যে এটা উঠাবে?” ঈসা কিন্তু আল্লাহ্‌র ঘর বলতে নিজের শরীরের কথাই বলছিলেন। তাই ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলে পর তাঁর সাহাবীদের মনে পড়ল যে, তিনি ঐ কথাই বলেছিলেন। তখন সাহাবীরা পাক-কিতাবের কথায় এবং ঈসা যে কথা বলেছিলেন তাতে বিশ্বাস করলেন। উদ্ধার-ঈদের সময় ঈসা জেরুজালেমে থেকে যে সব অলৌকিক কাজ করছিলেন তা দেখে অনেকেই তাঁর উপর ঈমান আনল। ঈসা কিন্তু তাদের কাছে নিজেকে ধরা দিলেন না, কারণ তিনি সব মানুষকে জানতেন। মানুষের বিষয়ে কারও সাক্ষ্যের দরকারও তাঁর ছিল না, কারণ মানুষের মনে যা আছে তা তাঁর জানা ছিল। ফরীশীদের মধ্যে নীকদীম নামে ইহুদীদের একজন নেতা ছিলেন। একদিন রাতে তিনি ঈসার কাছে এসে বললেন, “হুজুর, আমরা জানি আপনি একজন শিক্ষক হিসাবে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছেন, কারণ আপনি যে সব অলৌকিক কাজ করছেন, আল্লাহ্‌ সংগে না থাকলে কেউ তা করতে পারে না।” ঈসা নীকদীমকে বললেন, “আমি আপনাকে সত্যিই বলছি, নতুন করে জন্ম না হলে কেউ আল্লাহ্‌র রাজ্য দেখতে পায় না।” তখন নীকদীম তাঁকে বললেন, “মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কেমন করে তার আবার জন্ম হতে পারে? দ্বিতীয় বার মায়ের গর্ভে ফিরে গিয়ে সে কি আবার জন্মগ্রহণ করতে পারে?” জবাবে ঈসা বললেন, “আমি আপনাকে সত্যিই বলছি, পানি এবং পাক-রূহ্‌ থেকে জন্ম না হলে কেউই আল্লাহ্‌র রাজ্যে ঢুকতে পারে না। মানুষ থেকে যা জন্মে তা মানুষ, আর যা পাক-রূহ্‌ থেকে জন্মে তা রূহ্‌। আমি যে আপনাকে বললাম, আপনাদের নতুন করে জন্ম হওয়া দরকার, এতে আশ্চর্য হবেন না। বাতাস যেদিকে ইচ্ছা সেই দিকে বয় আর আপনি তাঁর শব্দ শুনতে পান, কিন্তু কোথা থেকে আসে এবং কোথায়ই বা যায় তা আপনি জানেন না। পাক-রূহ্‌ থেকে যাদের জন্ম হয়েছে তাদেরও ঠিক সেই রকম হয়।” নীকদীম ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ কেমন করে হতে পারে?” তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “আপনি বনি-ইসরাইলদের শিক্ষক হয়েও কি এই সব বোঝেন না? আপনাকে সত্যিই বলছি, আমরা যা জানি তা-ই বলি এবং যা দেখেছি সেই সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিই, কিন্তু আপনারা আমাদের সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করেন। আমি আপনাদের কাছে দুনিয়াবী বিষয়ে কথা বললে যখন বিশ্বাস করেন না তখন বেহেশতী বিষয়ে কথা বললে কেমন করে বিশ্বাস করবেন? “যিনি বেহেশতে থাকেন এবং বেহেশত থেকে নেমে এসেছেন সেই ইব্‌ন্তেআদম ছাড়া আর কেউ বেহেশতে ওঠে নি। মূসা নবী যেমন মরুভূমিতে সেই সাপকে উঁচুতে তুলেছিলেন তেমনি ইব্‌ন্তেআদমকেও উঁচুতে তুলতে হবে, যেন যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে অনন্ত জীবন পায়। “আল্লাহ্‌ মানুষকে এত মহব্বত করলেন যে, তাঁর একমাত্র পুুত্রকে তিনি দান করলেন, যেন যে কেউ সেই পুত্রের উপর ঈমান আনে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়। আল্লাহ্‌ মানুষকে দোষী প্রমাণ করবার জন্য তাঁর পুত্রকে দুনিয়াতে পাঠান নি, বরং মানুষ যেন পুত্রের দ্বারা নাজাত পায় সেইজন্য তিনি তাঁকে পাঠিয়েছেন। যে সেই পুত্রের উপর ঈমান আনে তার কোন বিচার হয় না, কিন্তু যে ঈমান আনে না তাকে দোষী বলে আগেই স্থির করা হয়ে গেছে, কারণ সে আল্লাহ্‌র একমাত্র পুত্রের উপর ঈমান আনে নি। তাকে দোষী বলে স্থির করা হয়েছে কারণ দুনিয়াতে নূর এসেছে, কিন্তু মানুষের কাজ খারাপ বলে মানুষ নূরের চেয়ে অন্ধকারকে বেশী ভালবেসেছে। যে কেউ অন্যায় কাজ করতে থাকে সে নূর ঘৃণা করে। তার অন্যায় কাজগুলো প্রকাশ হয়ে পড়বে বলে সে নূরের কাছে আসে না। কিন্তু যে সত্যের পথে চলে সে নূরের কাছে আসে যেন তার কাজগুলো যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত করা হয়েছে তা প্রকাশ পায়।” এর পরে ঈসা ও তাঁর সাহাবীরা এহুদিয়া প্রদেশে গেলেন। সেখানে তিনি তাঁর সাহাবীদের সংগে কিছু দিন থাকলেন এবং লোকদের তরিকাবন্দী দিতে লাগলেন। শালীম নামে একটা গ্রামের কাছে ঐনোন বলে একটা জায়গায় তখন ইয়াহিয়াও তরিকাবন্দী দিচ্ছিলেন, কারণ সেই জায়গায় অনেক পানি ছিল আর লোকেরাও এসে তরিকাবন্দী নিচ্ছিল। তখনও ইয়াহিয়াকে জেলখানায় বন্দী করা হয় নি। সেই সময় শরীয়ত মত পাক-সাফ হওয়ার বিষয় নিয়ে ইয়াহিয়ার সাহাবীরা একজন ইহুদীর সংগে তর্ক শুরু করেছিলেন। পরে তাঁরা ইয়াহিয়ার কাছে এসে বললেন, “হুজুর, যিনি জর্ডানের অন্য পারে আপনার সংগে ছিলেন এবং যাঁর বিষয়ে আপনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, দেখুন, তিনি তরিকাবন্দী দিচ্ছেন আর সবাই তাঁর কাছে যাচ্ছে।” এর জবাবে ইয়াহিয়া বললেন, “বেহেশত থেকে দেওয়া না হলে কারও পক্ষে কোন কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। তোমরাই আমাকে বলতে শুনেছ যে, আমি মসীহ্‌ নই, কিন্তু আমাকে তাঁর আগে পাঠানো হয়েছে। যার হাতে কন্যাকে দেওয়া হয়েছে, সে-ই বর। বরের বন্ধু দাঁড়িয়ে বরের কথা শোনে এবং তাঁর গলার আওয়াজ শুনে খুব খুশী হয়। ঠিক সেইভাবে আমার আনন্দও আজ পূর্ণ হল। তাঁকে বেড়ে উঠতে হবে আর আমাকে সরে যেতে হবে।” যিনি উপর থেকে আসেন তিনি সকলের উপরে। যে দুনিয়া থেকে আসে সে দুনিয়ার, আর সে দুনিয়ার কথাই বলে। কিন্তু যিনি বেহেশত থেকে আসেন তিনিই সকলের উপরে। তিনি যা দেখেছেন আর শুনেছেন তারই সাক্ষ্য দেন, কিন্তু কেউ তাঁর সাক্ষ্য গ্রাহ্য করে না। যে তাঁর সাক্ষ্য গ্রাহ্য করেছে সে তার দ্বারাই প্রমাণ করেছে যে, আল্লাহ্‌ যা বলেন তা সত্য। আল্লাহ্‌ যাঁকে পাঠিয়েছেন তিনি আল্লাহ্‌রই কথা বলেন, কারণ আল্লাহ্‌ তাঁকে পাক-রূহ্‌ মেপে দেন না। পিতা পুত্রকে মহব্বত করেন এবং তাঁর হাতে সমস্তই দিয়েছেন। যে কেউ পুত্রের উপর ঈমান আনে সে তখনই অনন্ত জীবন পায়, কিন্তু যে পুত্রকে অমান্য করে সে সেই জীবন কখনও পাবে না, বরং আল্লাহ্‌র গজব তার উপরে থাকবে। ঈসা যে ইয়াহিয়ার চেয়ে অনেক বেশী সাহাবী করছেন এবং তরিকাবন্দী দিচ্ছেন তা ফরীশীরা শুনেছিলেন। (অবশ্য ঈসা নিজে তরিকাবন্দী দিচ্ছিলেন না, তাঁর সাহাবীরাই দিচ্ছিলেন।) ঈসা তা জানতে পেরে এহুদিয়া প্রদেশ ছেড়ে আবার গালীলে চলে গেলেন। গালীলে যাবার সময় তাঁকে সামেরিয়া প্রদেশের মধ্য দিয়ে যেতে হল। তিনি শুখর নামে সামেরিয়ার একটা গ্রামে আসলেন। ইয়াকুব তাঁর ছেলে ইউসুফকে যে জমি দান করেছিলেন এই গ্রামটা ছিল তারই কাছে। সেই জায়গায় ইয়াকুবের কূয়া ছিল। পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ঈসা সেই কূয়ার পাশে বসলেন। তখন বেলা প্রায় দুপুর। সেই সামেরীয় স্ত্রীলোকটি তাঁকে বলল, “আমি তো সামেরীয় স্ত্রীলোক। আপনি ইহুদী হয়ে কেমন করে আমার কাছে পানি চাইছেন?” স্ত্রীলোকটি এই কথা বলল কারণ ইহুদী এবং সামেরীয়দের মধ্যে ধরা-ছোঁয়ার বাছ-বিচার ছিল। ঈসা সেই স্ত্রীলোকটিকে জবাব দিলেন, “তুমি যদি জানতে আল্লাহ্‌র দান কি আর কে তোমার কাছে পানি চাইছেন তবে তুমিই তাঁর কাছে পানি চাইতে আর তিনি তোমাকে জীবন্ত পানি দিতেন।” স্ত্রীলোকটি বলল, “কিন্তু আপনার কাছে পানি তুলবার কিছুই নেই আর কূয়াটাও গভীর। তবে সেই জীবন্ত পানি কোথা থেকে পেলেন? আপনি আমাদের পূর্বপুরুষ ইয়াকুবের চেয়ে তো বড় নন। এই কূয়া তিনিই আমাদের দিয়েছেন। তিনি নিজে ও তাঁর ছেলেরা এই কূয়ার পানিই খেতেন আর তাঁর পশুপালও খেত।” তখন ঈসা বললেন, “যে কেউ এই পানি খায় তার আবার পিপাসা পাবে। কিন্তু আমি যে পানি দেব, যে তা খাবে তার আর কখনও পিপাসা পাবে না। সেই পানি তার দিলের মধ্যে উথলে-ওঠা ঝর্ণা মত হয়ে অনন্ত জীবন দান করবে।” এতে স্ত্রীলোকটি ঈসাকে বলল, “আমাকে তবে সেই পানি দিন যেন আমার পিপাসা না পায় আর পানি তুলতে এখানে আসতে না হয়।” ঈসা তাকে বললেন, “তবে যাও, তোমার স্বামীকে এখানে ডেকে আন।” স্ত্রীলোকটি বলল, “কিন্তু আমার স্বামী নেই।” ঈসা তাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ তোমার স্বামী নেই, কারণ এর মধ্যেই তোমার পাঁচজন স্বামী হয়ে গেছে, আর এখন যে তোমার সংগে আছে সে তোমার স্বামী নয়। তুমি সত্যি কথাই বলেছ।” তখন স্ত্রীলোকটি ঈসাকে বলল, “আমি এখন বুঝতে পারলাম আপনি একজন নবী। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই পাহাড়ে এবাদত করতেন, কিন্তু আপনারা বলে থাকেন জেরুজালেমেই লোকদের এবাদত করা উচিত।” ঈসা তাঁকে বললেন, “শোন, আমার কথায় ঈমান আন, এমন সময় আসছে যখন পিতার এবাদত তোমরা এই পাহাড়েও করবে না, জেরুজালেমেও করবে না। তোমরা যা জান না তার এবাদত করে থাক, কিন্তু আমরা যা জানি তারই এবাদত করি, কারণ নাজাত পাবার উপায় ইহুদীদের মধ্য দিয়েই এসেছে। কিন্তু এমন সময় আসছে, এমন কি, এখনই সেই সময় এসে গেছে যখন আসল এবাদতকারীরা রূহে ও সত্যে পিতার এবাদত করবে। পিতাও এই রকম এবাদতকারীদেরই খোঁজেন। আল্লাহ্‌ রূহ্‌; যারা তাঁর এবাদত করে, রূহে ও সত্যে তাদের সেই এবাদত করতে হবে।” তখন সেই স্ত্রীলোকটি বলল, “আমি জানি মসীহ্‌ আসছেন। তিনি যখন আসবেন তখন সবই আমাদের জানাবেন।” ঈসা তাকে বললেন, “আমিই তিনি, যিনি তোমার সংগে কথা বলছেন।” এমন সময় তাঁর সাহাবীরা এসে একজন স্ত্রীলোকের সংগে ঈসাকে কথা বলতে দেখে আশ্চর্য হলেন। কিন্তু তবুও তাঁরা কেউই বললেন না, “আপনি কি চাইছেন?” বা “কেন আপনি ওর সংগে কথা বলছেন?” সেই স্ত্রীলোকটি তখন তার কলসী ফেলে রেখে গ্রামে গেল আর লোকদের বলল, “তোমরা একজন লোককে এসে দেখ। আমি জীবনে যা করেছি সবই তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন। তাহলে উনিই কি সেই মসীহ্‌?” এতে লোকেরা গ্রাম থেকে বের হয়ে ঈসার কাছে আসতে লাগল। এর মধ্যে তাঁর সাহাবীরা তাঁকে অনুরোধ করে বললেন, “হুজুর, কিছু খান।” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমার কাছে এমন খাবার আছে যার কথা তোমরা জান না।” তাতে সাহাবীরা বলাবলি করতে লাগলেন, “তাহলে কি কেউ তাঁকে কোন খাবার এনে দিয়েছে?” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর ইচ্ছা পালন করা এবং তাঁর কাজ শেষ করাই হল আমার খাবার। তোমরা কি বল না, ‘আর চার মাস বাকী আছে, তার পরেই ফসল কাটবার সময় হবে’? কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, চোখ তুলে একবার ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দেখ, ফসল কাটবার মত হয়েছে। যে ফসল কাটে সে এখনই বেতন পাচ্ছে এবং অনন্ত জীবনের জন্য ফসল জড়ো করে রাখছে। তার ফলে যে বীজ বোনে আর যে ফসল কাটে, দু’জনই সমানভাবে খুশী হয়। এতে এই কথা প্রমাণ হয় যে, ‘একজন বোনে আর অন্য একজন কাটে।’ আমি তোমাদের এমন ফসল কাটতে পাঠালাম যার জন্য তোমরা পরিশ্রম কর নি। অন্যেরা পরিশ্রম করেছে আর তোমরা সেই পরিশ্রমের ফসল কেটেছ।” যে স্ত্রীলোকটি এই বলে সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, সে যা করেছে সবই তিনি তাকে বলে দিয়েছেন, তার কথা শুনে সেই গ্রামের অনেক সামেরীয় লোক ঈসার উপর ঈমান আনল। তারা ঈসার কাছে গিয়ে তাঁকে তাদের সংগে থাকতে অনুরোধ করল। সেইজন্য ঈসা সেখানে দু’দিন থাকলেন। তখন তাঁর কথা শুনে আরও অনেক লোক ঈমান আনল। সেই স্ত্রীলোকটিকে তারা বলল, “এখন যে আমরা ঈমান এনেছি তা তোমার কথাতে নয়, কিন্তু আমরা নিজেরাই তাঁর কথা শুনে বুঝতে পেরেছি যে, উনি সত্যিই মানুষের নাজাতদাতা।” ঈদের সময় ঈসা জেরুজালেমে যা কিছু করেছিলেন, গালীলের লোকেরা সেই ঈদে গিয়েছিল বলে সব দেখতে পেয়েছিল। এইজন্য ঈসা যখন গালীলে গেলেন তখন সেখানকার লোকেরা তাঁকে গ্রহণ করল। পরে ঈসা আবার গালীলের সেই কান্না গ্রামে গেলেন। এখানেই তিনি পানিকে আংগুর-রস করেছিলেন। গালীলের কফরনাহূম শহরে একজন রাজকর্মচারীর ছেলে অসুখে ভুগছিল। ঈসা এহুদিয়া থেকে গালীলে এসেছেন শুনে সেই রাজকর্মচারী তাঁর কাছে গেলেন এবং অনুরোধ করলেন যেন তিনি কফরনাহূমে গিয়ে তাঁর ছেলেকে সুস্থ করেন। তাঁর ছেলেটা তখন মরবার মত হয়েছিল। ঈসা সেই রাজকর্মচারীকে বললেন, “কোন অলৌকিক চিহ্ন বা কোন কুদরতি কাজ না দেখলে আপনারা কোনমতেই ঈমান আনবেন না।” তখন সেই রাজকর্মচারী বললেন, “দয়া করে আমার ছেলেটি মারা যাবার আগেই আসুন।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আপনি যান, আপনার ছেলেটি বাঁচল।” এতে তিনি ঈসার কথাতে বিশ্বাস করে চলে গেলেন। সেই কর্মচারী যখন বাড়ী ফিরে যাচ্ছিলেন তখন পথেই তাঁর গোলামেরা তাঁর কাছে গিয়ে বলল, “আপনার ছেলেটি ভাল হয়ে গেছে।” তিনি সেই গোলামদের জিজ্ঞাসা করলেন, “সে কখন ভাল হয়েছে?” তারা বলল, “গতকাল দুপুর একটার সময় তার জ্বর ছেড়েছে।” এতে ছেলেটির পিতা বুঝতে পারলেন, ঠিক সেই সময়েই ঈসা তাঁকে বলেছিলেন, “আপনার ছেলেটি বাঁচল।” তখন সেই রাজকর্মচারী ও তাঁর পরিবারের সবাই ঈসার উপর ঈমান আনলেন। এহুদিয়া থেকে গালীলে আসবার পর ঈসা এই দ্বিতীয় অলৌকিক কাজ করলেন। এই সব ঘটনার পরে ঈসা জেরুজালেমে গেলেন, কারণ সেই সময় ইহুদীদের একটা ঈদ ছিল। জেরুজালেমে মেষ-দরজার কাছে একটা পুকুর আছে; সেখানে পাঁচটা ছাদ-দেওয়া জায়গা আছে। হিব্রু ভাষায় পুকুরটার নাম বেথেস্‌দা। সেই সব জায়গায় অনেক রোগী পড়ে থাকত। অন্ধ, খোঁড়া, এমন কি শরীর যাদের একেবারে শুকিয়ে গেছে তেমন লোকও তাদের মধ্যে ছিল। একজন ফেরেশতা সময়ে সময়ে ঐ পুকুরে নেমে এসে পানি কাঁপাতেন, আর তার পরেই যে প্রথমে পানির মধ্যে নামত তার যে কোন রোগ ভাল হয়ে যেত। ঐ সব রোগীরা পানি কাঁপবার অপেক্ষায় সেখানে পড়ে থাকত। আটত্রিশ বছর ধরে রোগে ভুগছে তেমন একজন লোকও সেখানে ছিল। অনেক দিন ধরে সে এইভাবে পড়ে আছে জেনে ঈসা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কি ভাল হবার ইচ্ছা আছে?” রোগীটি জবাব দিল, “আমার এমন কেউ নেই যে, পানি কেঁপে উঠবার সংগে সংগে আমাকে পুকুরে নামিয়ে দেয়। আমি যেতে না যেতেই আর একজন আমার আগে নেমে পড়ে।” ঈসা তাকে বললেন, “ওঠো, তোমার বিছানা তুলে নিয়ে হেঁটে বেড়াও।” তখনই সেই লোকটি ভাল হয়ে গেল ও তার বিছানা তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। সেই দিনটা ছিল বিশ্রামবার। এইজন্য যে লোকটিকে ভাল করা হয়েছিল তাকে ইহুদী নেতারা বললেন, “আজ বিশ্রামবার; শরীয়ত মতে বিছানা তুলে নেওয়া তোমার উচিত নয়।” তখন সে সেই নেতাদের বলল, “কিন্তু যিনি আমাকে ভাল করেছেন তিনিই আমাকে বলেছেন, ‘তোমার বিছানা তুলে নিয়ে হেঁটে বেড়াও।’ ” তাঁরা সেই লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে সেই লোক, যে তোমাকে বলেছে, ‘তোমার বিছানা তুলে নিয়ে হেঁটে বেড়াও’?” কিন্তু যে লোকটি ভাল হয়েছিল সে জানত না তিনি কে, কারণ সেই জায়গায় অনেক লোক ভিড় করেছিল বলে ঈসা চলে গিয়েছিলেন। এর পরে ঈসা সেই লোকটিকে বায়তুল-মোকাদ্দসে দেখতে পেয়ে বললেন, “দেখ, তুমি ভাল হয়েছ। গুনাহে জীবন আর কাটায়ো না, যেন তোমার আরও ক্ষতি না হয়।” তখন সেই লোকটি গিয়ে ইহুদী নেতাদের বলল যে, তাকে যিনি ভাল করেছেন তিনি ঈসা। বিশ্রামবারে ঈসা এই সব কাজ করছিলেন বলে ইহুদী নেতারা তাঁকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করলেন। তখন তিনি সেই নেতাদের বললেন, “আমার পিতা সব সময় কাজ করছেন এবং আমিও করছি।” ঈসার এই কথার জন্য ইহুদী নেতারা তাঁকে হত্যা করবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন, কারণ তিনি যে কেবল বিশ্রামবারের নিয়ম ভাংছিলেন তা নয়, আল্লাহ্‌কে নিজের পিতা বলে ডেকে নিজেকে আল্লাহ্‌র সমানও করছিলেন। এতে ঈসা সেই নেতাদের বললেন, “আমি সত্যিই আপনাদের বলছি, পুত্র নিজ থেকে কিছুই করতে পারেন না। পিতাকে যা করতে দেখেন কেবল তা-ই করতে পারেন, কারণ পিতা যা করেন পুত্রও তা-ই করেন। পিতা পুত্রকে মহব্বত করেন এবং তিনি নিজে যা কিছু করেন সমস্তই পুত্রকে দেখান। তিনি এগুলোর চেয়ে আরও মহৎ মহৎ কাজ পুত্রকে দেখাবেন, যেন পুত্রকে সেই সব কাজ করতে দেখে আপনারা আশ্চর্য হন। পিতা যেমন মৃতদের জীবন দিয়ে উঠান ঠিক তেমনি পুত্রও যাকে ইচ্ছা করেন তাকে জীবন দেন। পিতা কারও বিচার করেন না, কিন্তু সমস্ত বিচারের ভার পুত্রকে দিয়েছেন, যেন পিতাকে যেমন সবাই সম্মান করে তেমনি পুত্রকেও সম্মান করে। পুত্রকে যে সম্মান করে না, যিনি তাঁকে পাঠিয়েছেন সেই পিতাকেও সে সম্মান করে না। “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, আমার কথা যে শোনে এবং আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর কথায় ঈমান আনে, তার অনন্ত জীবন আছে। তাকে দোষী বলে স্থির করা হবে না; সে তো মৃত্যু থেকে জীবনে পার হয়ে গেছে। আমি আপনাদের সত্যি বলছি, এমন সময় আসছে, বরং এখনই এসেছে, যখন মৃতেরা ইব্‌নুল্লাহ্‌র গলার আওয়াজ শুনবে এবং যারা শুনবে তারা জীবিত হবে। এর কারণ হল, পিতা নিজে যেমন জীবনের অধিকারী তেমনি তিনি পুত্রকেও জীবনের অধিকারী হতে দিয়েছেন। পিতা পুত্রকে মানুষের বিচার করবার অধিকার দিয়েছেন, কারণ তিনি ইব্‌ন্তেআদম। এই কথা শুনে আশ্চর্য হবেন না, কারণ এমন সময় আসছে, যারা কবরে আছে তারা সবাই ইব্‌ন্তেআদমের গলার আওয়াজ শুনে বের হয়ে আসবে। যারা ভাল কাজ করেছে তারা জীবন পাবার জন্য উঠবে, আর যারা অন্যায় কাজ করে সময় কাটিয়েছে তারা শাস্তি পাবার জন্য উঠবে। আমি নিজ থেকে কিছুই করতে পারি না; যেমন শুনি তেমনই বিচার করি। আমি ন্যায়ভাবে বিচার করি, কারণ আমি আমার ইচ্ছামত কাজ করতে চাই না কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁরই ইচ্ছামত কাজ করতে চাই। “আমিই যদি আমার নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিই তবে আমার সেই সাক্ষ্য সত্যি নয়। অন্য একজন আছেন যিনি আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, আর আমি জানি আমার বিষয়ে তিনি যে সাক্ষ্য দেন তা সত্য। আপনারা ইয়াহিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করে পাঠিয়েছিলেন, আর তিনি সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অবশ্য আমি মানুষের সাক্ষ্যের উপর ভরসা করি না, কিন্তু যেন আপনারা নাজাত পান সেইজন্য এই সব কথা বলছি। ইয়াহিয়াই ছিলেন সেই জ্বলন্ত বাতি যা আলো দিচ্ছিল; আপনারা কিছু সময়ের জন্য তাঁর সেই আলোতে আনন্দ করতে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার সাক্ষ্যের চেয়ে আরও বড় সাক্ষ্য আমার আছে, কারণ পিতা আমাকে যে কাজগুলো করতে দিয়েছেন সেগুলোই আমি করছি। আর সেগুলো আমার বিষয়ে এই সাক্ষ্য দেয় যে, পিতাই আমাকে পাঠিয়েছেন। সেই পিতা, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি নিজেই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আপনারা কখনও তাঁর গলার আওয়াজও শোনেন নি, চেহারাও দেখেন নি। তা ছাড়া তাঁর কালাম আপনাদের দিলে থাকে না, কারণ তিনি যাঁকে পাঠিয়েছেন তাঁর উপর আপনারা ঈমান আনেন নি। আপনারা পাক-কিতাব খুব মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত করেন, কারণ আপনারা মনে করেন তার দ্বারা অনন্ত জীবন পাবেন। কিন্তু সেই কিতাব তো আমারই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়; তবুও আপনারা জীবন পাবার জন্য আমার কাছে আসতে চান না। “আমি মানুষের প্রশংসা পাবার চেষ্টা করি না, কিন্তু আমি আপনাদের জানি। আমি জানি আপনাদের দিলে আল্লাহ্‌র প্রতি মহব্বত নেই। আমি আমার পিতার নামে এসেছি আর আপনারা আমাকে গ্রহণ করছেন না; কিন্তু অন্য কেউ যদি তার নিজের নামে আসে তাকে আপনারা গ্রহণ করবেন। আপনারা একজন অন্যজনের কাছ থেকে প্রশংসা পাবার আশা করেন, কিন্তু যে প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পাওয়া যায় তার চেষ্টাও করেন না। এর পরে আপনারা কেমন করে ঈমান আনতে পারেন? মনে করবেন না যে, পিতার কাছে আমি আপনাদের দোষী করব; কিন্তু যে মূসার উপরে আপনারা আশা করে আছেন সেই মূসাই আপনাদের দোষী করছেন। যদি আপনারা মূসাকে বিশ্বাস করতেন তবে আমাকেও বিশ্বাস করতেন, কারণ মূসা নবী তো আমারই বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু যখন তাঁর লেখায়ই আপনারা বিশ্বাস করেন না তখন কেমন করে আমার কথায় বিশ্বাস করবেন?” এর পরে ঈসা গালীল সাগরের অন্য পারে চলে গেলেন। এই সাগরকে টিবেরিয়াস সাগরও বলা হয়। অনেক লোক ঈসার পিছনে পিছনে যেতে লাগল, কারণ রোগীদের উপর তিনি চিহ্ন হিসাবে যে সব অলৌকিক কাজ করছিলেন তারা তা দেখেছিল। ঈসা তাঁর সাহাবীদের নিয়ে একটা পাহাড়ের উপরে উঠে বসলেন। সেই সময় ইহুদীদের উদ্ধার-ঈদ কাছে এসেছিল। ঈসা চেয়ে দেখলেন অনেক লোক তাঁর কাছে আসছে। তিনি ফিলিপকে বললেন, “এই লোকদের খাওয়াবার জন্য আমরা কোথা থেকে রুটি কিনব?” ফিলিপকে পরীক্ষা করবার জন্য তিনি ঐ কথা বললেন, কারণ কি করবেন তা তিনি জানতেন। ফিলিপ ঈসাকে বললেন, “ওরা যদি প্রত্যেকে অল্প করেও পায় তবু দু’শো দীনারের রুটিতেও কুলাবে না।” ঈসার সাহাবীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল আন্দ্রিয়। ইনি ছিলেন শিমোন্তপিতরের ভাই। আন্দ্রিয় ঈসাকে বললেন, “এখানে একটা ছোট ছেলের কাছে পাঁচটা যবের রুটি আর দু’টা মাছ আছে, কিন্তু এত লোকের মধ্যে ওতে কি হবে?” ঈসা বললেন, “লোকদের বসিয়ে দাও।” সেই জায়গায় অনেক ঘাস ছিল। লোকেরা তারই উপর বসে গেল। সেখানে পুরুষের সংখ্যাই ছিল কমবেশি পাঁচ হাজার। এর পরে ঈসা সেই রুটি কয়খানা নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং যারা বসে ছিল তাদের ভাগ করে দিলেন। সেইভাবে তিনি মাছও দিলেন। যে যত চাইল তত পেল। লোকেরা পেট ভরে খেলে পর ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “যে টুকরাগুলো বাকী আছে সেগুলো একসংগে জড়ো কর যেন কিছুই নষ্ট না হয়।” লোকেরা খাবার পরে সেই পাঁচখানা রুটির যা বাকী ছিল সাহাবীরা তা জড়ো করে বারোটা টুকরি ভর্তি করলেন। ঈসার এই অলৌকিক কাজ দেখে লোকেরা বলতে লাগল, “দুনিয়াতে যে নবীর আসবার কথা আছে ইনি সত্যিই সেই নবী।” এতে ঈসা বুঝলেন, লোকেরা তাঁকে জোর করে তাদের বাদশাহ্‌ করবার জন্য ধরতে আসছে। সেইজন্য তিনি একাই আবার সেই পাহাড়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যা হলে পর ঈসার সাহাবীরা সাগরের ধারে গেলেন, আর নৌকায় উঠে কফরনাহূম শহরে যাবার জন্য সাগর পার হতে লাগলেন। সেই সময় অন্ধকার হয়েছিল, আর তখনও ঈসা তাঁদের কাছে আসেন নি। খুব জোরে বাতাস বইছিল বলে সাগরেও বড় বড় ঢেউ উঠছিল। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার নৌকা বেয়ে যাবার পর তাঁরা দেখলেন, ঈসা সাগরের উপর দিয়ে হেঁটে তাঁদের নৌকার কাছে আসছেন। এ দেখে সাহাবীরা খুব ভয় পেলেন। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “ভয় কোরো না; এ আমি।” সাহাবীরা তাঁকে নৌকায় তুলে নিতে চাইলেন, আর তাঁরা যেখানে যাচ্ছিলেন নৌকাটা তখনই সেখানে পৌঁছে গেল। সাগরের অন্য পারে যে লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিল, পরদিন তারা বুঝতে পারল যে, আগের দিন সেখানে একটা নৌকা ছাড়া আর অন্য কোন নৌকা ছিল না। তারা আরও বুঝতে পারল যে, ঈসা তাঁর সাহাবীদের সংগে সেই নৌকায় ওঠেন নি বরং সাহাবীরা একাই চলে গিয়েছিলেন। তবে যেখানে ঈসা শুকরিয়া জানাবার পর লোকেরা রুটি খেয়েছিল সেই জায়গার কাছে তখন টিবেরিয়াস শহর থেকে কয়েকটা নৌকা আসল। এইজন্য লোকেরা যখন দেখল যে, ঈসা বা তাঁর সাহাবীরা কেউই সেখানে নেই তখন তারা সেই নৌকাগুলোতে উঠে ঈসাকে খুঁজবার জন্য কফরনাহূমে গেল। সেখানে পৌঁছে তারা ঈসাকে খুঁজে পেয়ে বলল, “হুজুর, আপনি কখন এখানে এসেছেন?” ঈসা জবাব দিলেন, “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, আপনারা অলৌকিক কাজ দেখেছেন বলেই যে আমার খোঁজ করছেন তা নয়, বরং পেট ভরে রুটি খেতে পেয়েছেন বলেই খোঁজ করছেন। কিন্তু যে খাবার নষ্ট হয়ে যায় সেই খাবারের জন্য ব্যস্ত হয়ে লাভ কি? যে খাবার নষ্ট হয় না বরং অনন্ত জীবন দান করে তারই জন্য ব্যস্ত হন। সেই খাবারই ইব্‌ন্তেআদম আপনাদের দেবেন, কারণ পিতা আল্লাহ্‌ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, এই কাজ করবার অধিকার কেবল তাঁরই আছে। এতে লোকেরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে আল্লাহ্‌র কাজ করবার জন্য আমাদের কি করতে হবে?” ঈসা তাদের বললেন, “আল্লাহ্‌ যাঁকে পাঠিয়েছেন তাঁর উপর ঈমান আনাই হল আল্লাহ্‌র কাজ।” তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে কি এমন অলৌকিক কাজ আপনি করবেন যা দেখে আমরা আপনার উপর ঈমান আনতে পারি? আপনি কি কাজ করবেন? আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো মরুভূমিতে মান্না খেয়েছিলেন। পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘আল্লাহ্‌ বেহেশত থেকে তাদের রুটি খেতে দিলেন।’ ” ঈসা তাদের বললেন, “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, বেহেশত থেকে যে রুটি আপনারা পেয়েছিলেন তা মূসা নবী আপনাদের দেন নি, কিন্তু আমার পিতা সত্যিকারের রুটি বেহেশত থেকে আপনাদের দিচ্ছেন। বেহেশত থেকে নেমে এসে যিনি মানুষকে জীবন দেন তিনিই আল্লাহ্‌র দেওয়া রুটি।” লোকেরা তাঁকে বলল, “হুজুর, তাহলে সেই রুটিই সব সময় আমাদের দিন।” ঈসা তাদের বললেন, “আমিই সেই জীবন্তরুটি। যে আমার কাছে আসে তার কখনও খিদে পাবে না। যে আমার উপর ঈমান আনে তার আর কখনও পিপাসাও পাবে না। আমি তো আপনাদের বলেছি যে, আপনারা আমাকে দেখেছেন কিন্তু তবুও ঈমান আনেন নি। পিতা আমাকে যাদের দেন তারা সবাই আমার কাছে আসবে। যে আমার কাছে আসে আমি তাকে কোনমতেই বাইরে ফেলে দেব না, কারণ আমি আমার ইচ্ছামত কাজ করতে আসি নি, বরং যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁরই ইচ্ছামত কাজ করতে বেহেশত থেকে নেমে এসেছি। যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর ইচ্ছা এই যে, যাদের তিনি আমাকে দিয়েছেন তাদের একজনকেও যেন আমি না হারাই বরং শেষ দিনে জীবিত করে তুলি। আমার পিতার ইচ্ছা এই- আপনাদের মধ্যে যাঁরা পুত্রকে দেখে তাঁর উপর ঈমান আনেন তাঁরা যেন অনন্ত জীবন পান। আর আমিই তাঁদের শেষ দিনে জীবিত করে তুলব।” তখন ইহুদী নেতারা ঈসার বিরুদ্ধে বকবক করতে লাগলেন, কারণ তিনি বলেছিলেন, “বেহেশত থেকে যে রুটি নেমে এসেছে আমিই সেই রুটি।” সেই নেতারা বলতে লাগলেন, “এ কি ইউসুফের ছেলে ঈসা নয়? এর পিতা-মাতাকে তো আমরা চিনি। তবে এ কেমন করে বলে, ‘আমি বেহেশত থেকে নেমে এসেছি’?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা নিজেদের মধ্যে বকবক করবেন না। আমার পিতা, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি টেনে না আনলে কেউই আমার কাছে আসতে পারে না। আর আমিই তাকে শেষ দিনে জীবিত করে তুলব। নবীদের কিতাবে লেখা আছে, ‘তারা সবাই আল্লাহ্‌র কাছে শিক্ষা পাবে।’ যে কেউ পিতার কাছ থেকে শুনে শিক্ষা পেয়েছে সে-ই আমার কাছে আসে। পিতাকে কেউ দেখে নি, কেবল যিনি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছেন তিনিই তাঁকে দেখেছেন। আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, যে কেউ আমার উপর ঈমান আনে সে তখনই অনন্ত জীবন পায়।” “আমিই জীবন্তরুটি। আপনাদের পূর্বপুরুষেরা মরুভূমিতে মান্না খেয়েছিলেন, আর তবুও তাঁরা মারা গেছেন। কিন্তু এ সেই রুটি যা বেহেশত থেকে নেমে এসেছে, যাতে মানুষ তা খেয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায়। আমিই সেই জীবন্ত রুটি যা বেহেশত থেকে নেমে এসেছে। এই রুটি যে খাবে সে চিরকালের জন্য জীবন পাবে। আমার শরীরই সেই রুটি। মানুষ যেন জীবন পায় সেইজন্য আমি আমার এই শরীর দেব।” এই কথা শুনে ইহুদী নেতাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হল। তাঁরা বলতে লাগলেন, “কেমন করে এই লোকটা তার শরীর আমাদের খেতে দিতে পারে?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি সত্যিই আপনাদের বলছি, ইব্‌ন্তেআদমের গোশ্‌ত ও রক্ত যদি আপনারা না খান তবে আপনাদের মধ্যে জীবন নেই। যদি কেউ আমার গোশ্‌ত ও রক্ত খায় সে অনন্ত জীবন পায়, আর আমি শেষ দিনে তাকে জীবিত করে তুলব। আমার গোশ্‌তই হল আসল খাবার আর আমার রক্তই আসল পানীয়। যে আমার গোশ্‌ত ও রক্ত খায় সে আমারই মধ্যে থাকে আর আমিও তার মধ্যে থাকি। জীবন্ত পিতা আমাকে পাঠিয়েছেন আর তাঁরই দরুন আমি জীবিত আছি। ঠিক সেইভাবে যে আমাকে খায় সেও আমার দরুন জীবিত থাকবে। এ সেই রুটি যা বেহেশত থেকে নেমে এসেছে। আপনাদের পূর্বপুরুষেরা যে রুটি খেয়েও মারা গেছেন এ সেই রকম রুটি নয়। এই রুটি যে খাবে সে চিরকালের জন্য জীবন পাবে।” কফরনাহূমের মজলিস-খানায় শিক্ষা দেবার সময় ঈসা এই কথা বলেছিলেন। তাঁর সাহাবীদের মধ্যে অনেকে এই কথা শুনে বলল, “এ বড় কঠিন শিক্ষা। কে এটা গ্রহণ করতে পারে?” ঈসা নিজের মনে বুঝতে পারলেন যে, তাঁর সাহাবীরা এই বিষয় নিয়ে বকবক করছে। সেইজন্য তিনি তাঁদের বললেন, “এতে কি তোমরা মনে বাধা পাচ্ছ? তবে ইব্‌ন্তেআদম আগে যেখানে ছিলেন তাঁকে সেখানে উঠে যেতে দেখলে তোমরা কি বলবে? মানুষের শরীর কোন কাজের নয়; পাক-রূহ্‌ই জীবন দেন। আমি তোমাদের যে কথাগুলো বলেছি তা রূহানী জীবন দান করে, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে যারা আমার উপর ঈমান আনে নি।” কে কে ঈসার উপর ঈমান আনে নি আর কে-ই বা তাঁকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে, ঈসা প্রথম থেকেই তা জানতেন। সেইজন্য তিনি বললেন, “তাই আমি তোমাদের বলেছি যে, পিতা শক্তি না দিলে কেউই আমার কাছে আসতে পারে না।” ঈসার এই কথার জন্য সাহাবীদের মধ্যে অনেকে ফিরে গেল এবং তাঁর সংগে চলাফেরা বন্ধ করে দিল। এইজন্য ঈসা সেই বারোজন সাহাবীকে বললেন, “তোমরাও কি চলে যেতে চাও?” শিমোন্তপিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা কার কাছে যাব? অনন্ত জীবনের বাণী তো আপনারই কাছে আছে। আমরা ঈমান এনেছি আর জানতেও পেরেছি যে, আপনিই আল্লাহ্‌র সেই পবিত্রজন।” তখন ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি তোমাদের বারোজনকে কি বেছে নিই নি? অথচ তোমাদেরই মধ্যে একজন শত্রু আছে।” এখানে ঈসা শিমোন ইষ্কারিয়োতের ছেলে এহুদার কথা বলছিলেন, কারণ সে-ই পরে ঈসাকে ধরিয়ে দেবে। সে ছিল সেই বারোজনের মধ্যে একজন। এর পরে ঈসা গালীল প্রদেশের মধ্যেই চলাফেরা করতে লাগলেন। ইহুদী নেতারা তাঁকে হত্যা করতে চাইছিলেন বলে তিনি এহুদিয়া প্রদেশে চলাফেরা বন্ধ করে দিলেন। তখন ইহুদীদের কুঁড়ে-ঘরের ঈদের সময় প্রায় কাছে এসেছিল। এইজন্য ঈসার ভাইয়েরা তাঁকে বললেন, “এই জায়গা ছেড়ে এহুদিয়াতে চলে যাও, যেন তুমি যে সব কাজ করছ তোমার সাহাবীরা তা দেখতে পায়। যদি কেউ চায় লোকে তাকে জানুক তবে সে গোপনে কিছু করে না। তুমি যখন এই সব কাজ করছ তখন লোকদের সামনে নিজেকে দেখাও।” আসলে ঈসার ভাইয়েরাও তাঁর উপর ঈমান আনেন নি। এতে ঈসা তাঁদের বললেন, “আমার সময় এখনও হয় নি, কিন্তু তোমাদের তো অসময় বলে কিছু নেই। দুনিয়ার লোকেরা তোমাদের ঘৃণা করতে পারে না কিন্তু আমাকেই ঘৃণা করে, কারণ আমি তাদের বিষয়ে এই সাক্ষ্য দিই যে, তাদের সব কাজই খারাপ। তোমরাই ঈদে যাও। আমার সময় এখনও পূর্ণ হয় নি বলে আমি এখন যাব না।” এই সব কথা বলে ঈসা গালীলেই থেকে গেলেন। কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা ঈদে চলে যাবার পর তিনিও সেখানে গেলেন, তবে খোলাখুলিভাবে গেলেন না, গোপনে গেলেন। ঈদের সময়ে ইহুদী নেতারা ঈসার খোঁজ করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, “সেই লোকটা কোথায়?” ভিড়ের মধ্যে লোকেরা ঈসার বিষয়ে বিড়বিড় করে নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলতে লাগল। কেউ কেউ বলল, “তিনি ভাল লোক।” আবার কেউ কেউ বলল, “না, সে লোকদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।” কিন্তু ইহুদী নেতাদের ভয়ে খোলাখুলিভাবে কেউই তাঁর বিষয়ে কিছু বলল না। সেই ঈদের মাঝামাঝি সময়ে ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে গিয়ে শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। এতে ইহুদী নেতারা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “এই লোকটি কোন শিক্ষা লাভ না করে কিভাবে এই সব সম্বন্ধে জানে?” জবাবে ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি যে শিক্ষা দিই তা আমার নিজের নয়, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তাঁরই। যদি কেউ তাঁর ইচ্ছা পালন করতে চায় তবে সে বুঝতে পারবে যে, এই শিক্ষা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছে, না আমি নিজ থেকে বলছি। যে নিজ থেকে কথা বলে সে তার নিজের প্রশংসারই চেষ্টা করে, কিন্তু যিনি পাঠিয়েছেন, কেউ যদি তাঁরই প্রশংসার চেষ্টা করে তবে সে সত্যবাদী এবং তার মনে কোন ছলনা নেই। মূসা নবী কি আপনাদের শরীয়ত দেন নি? কিন্তু আপনাদের মধ্যে কেউ সেই শরীয়ত পালন করেন না। তবে কেন আপনারা আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করছেন?” লোকেরা জবাব দিল, “তোমাকে ভূতে পেয়েছে; কে তোমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে?” ঈসা তাদের বললেন, “আমি একটা কাজ করেছি বলে আপনারা সবাই অবাক হচ্ছেন। মূসা আপনাদের খৎনা করাবার নিয়ম দিয়েছেন, আর সেই খৎনা আপনারা বিশ্রামবারেও করিয়ে থাকেন। অবশ্য এই নিয়ম মূসার কাছ থেকে আসে নি, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই এসেছে। খুব ভাল, মূসা নবীর নিয়ম না ভাংবার জন্য যদি বিশ্রামবারেও ছেলেদের খৎনা করানো যায়, তবে আমি বিশ্রামবারে একটি মানুষকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করেছি বলে আপনারা আমার উপর রাগ করছেন কেন? বাইরের চেহারা দেখে বিচার না করে বরং ন্যায়ভাবে বিচার করুন।” তখন জেরুজালেমের কয়েকজন লোক বলল, “যাকে নেতারা হত্যা করতে চান, এ কি সেই লোক নয়? কিন্তু সে তো খোলাখুলিভাবে কথা বলছে অথচ নেতারা কেউ তাকে কিছুই বলছেন না। তাহলে সত্যিই কি তাঁরা জানতে পেরেছেন যে, এই লোকটিই মসীহ্‌? তবে আমরা তো জানি এ কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু মসীহ্‌ যখন আসবেন তখন কেউ জানবে না তিনি কোথা থেকে এসেছেন।” তারপর ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসে শিক্ষা দেবার সময় জোরে জোরেই বললেন, “আপনারা আমাকেও জানেন, আর আমি কোথা থেকে এসেছি তা-ও জানেন। তবে আমি নিজে থেকে আসি নি, কিন্তু সত্য আল্লাহ্‌ আমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁকে আপনারা জানেন না কিন্তু আমি জানি, কারণ আমি তাঁরই কাছ থেকে এসেছি আর তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন।” এতে সেই লোকেরা ঈসাকে ধরতে চাইল, কিন্তু তখনও তাঁর সময় হয় নি বলে কেউ তাঁর গায়ে হাত দিল না। তবে লোকদের মধ্যে অনেকে ঈসার উপর ঈমান এনে বলল, “ইনি তো অনেক অলৌকিক কাজ করেছেন। মসীহ্‌ এসে কি এর চেয়েও বেশী অলৌকিক কাজ করবেন?” লোকেরা যে ঈসার সম্বন্ধে এই সব কথা বলাবলি করছে তা ফরীশীরা শুনতে পেলেন। তখন প্রধান ইমামেরা ও ফরীশীরা ঈসাকে ধরবার জন্য কয়েকজন কর্মচারী পাঠিয়ে দিলেন। ঈসা বললেন, “আমি আর বেশী দিন আপনাদের মধ্যে নেই। তারপর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন আমি তাঁর কাছে চলে যাব। আপনারা আমাকে তালাশ করবেন কিন্তু পাবেন না, আর আমি যেখানে থাকব আপনারা সেখানে আসতেও পারবেন না।” ঈসার এই কথাতে ইহুদী নেতারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “এই লোকটা কোথায় যাবে যে, আমরা তাকে তালাশ করে পাব না? অ-ইহুদীদের মধ্যে যে ইহুদীরা ছড়িয়ে রয়েছে, সে কি সেখানে গিয়ে অ-ইহুদীদের শিক্ষা দেবে? সে যে বলল, ‘আপনারা আমাকে তালাশ করবেন কিন্তু পাবেন না, আর আমি যেখানে থাকব আপনারা সেখানে আসতেও পারবেন না,’ এই কথার মানে কি?” ঈদের শেষের দিনটাই ছিল প্রধান দিন। সেই দিন ঈসা দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললেন, “কারও যদি পিপাসা পায় তবে সে আমার কাছে এসে পানি খেয়ে যাক। যে আমার উপর ঈমান আনে, পাক-কিতাবের কথামত তার দিল থেকে জীবন্ত পানির নদী বইতে থাকবে।” ঈসার উপর ঈমান এনে যারা পাক-রূহ্‌কে পাবে সেই পাক-রূহের বিষয়ে ঈসা এই কথা বললেন। পাক-রূহ্‌কে তখনও দেওয়া হয় নি কারণ তখনও ঈসা তাঁর মহিমা ফিরে পান নি। এই সব কথা শুনে লোকদের মধ্যে কয়েকজন বলল, “সত্যি ইনিই সেই নবী।” অন্যেরা বলল, “ইনিই মসীহ্‌।” কিন্তু কেউ কেউ বলল, “মসীহ্‌ কি গালীল প্রদেশ থেকে আসবেন? পাক-কিতাব কি বলে নি, দাউদ যে গ্রামে থাকতেন সেই বেথেলহেমে এবং তাঁরই বংশে মসীহ্‌ জন্মগ্রহণ করবেন?” এইভাবে ঈসাকে নিয়ে লোকদের মধ্যে একটা মতের অমিল দেখা দিল। কয়েকজন ঈসাকে ধরতে চাইল কিন্তু কেউই তাঁর গায়ে হাত দিল না। যে কর্মচারীদের পাঠানো হয়েছিল তারা প্রধান ইমামদের ও ফরীশীদের কাছে ফিরে আসল। তখন তাঁরা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তাকে আন নি কেন?” সেই কর্মচারীরা বলল, “লোকটা যেভাবে কথা বলে সেইভাবে আর কেউ কখনও বলে নি।” এতে ফরীশীরা সেই কর্মচারীদের বললেন, “তোমরাও কি ঠকে গেলে? নেতাদের মধ্যে বা ফরীশীদের মধ্যে কেউ তো তার উপর ঈমান আনে নি। কিন্তু এই যে সাধারণ লোকেরা, এরা তো মূসার শরীয়ত জানে না; এদের উপর বদদোয়া রয়েছে।” নীকদীম, যিনি আগে ঈসার কাছে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন এই সব ফরীশীদের মধ্যে একজন। তিনি বললেন, “কারও মুখের কথা না শুনে এবং সে কি করেছে তা না জেনে কাউকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা কি আমাদের শরীয়তে রয়েছে?” ফরীশীরা নীকদীমকে জবাব দিলেন, “তুমিও কি গালীলের লোক? পাক-কিতাবে খুঁজে দেখ, গালীলে কোন নবীর জন্মগ্রহণ করবার কথা নেই।” এর পরে লোকেরা প্রত্যেকে যে যার বাড়ীতে চলে গেল, কিন্তু ঈসা জৈতুন পাহাড়ে গেলেন। পরের দিন খুব সকালে ঈসা আবার বায়তুল-মোকাদ্দসে গেলে পর সমস্ত লোক তাঁর কাছে আসল। তখন তিনি বসে তাদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। তৌরাত শরীফে মূসা এই রকম স্ত্রীলোকদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে আমাদের হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু আপনি কি বলেন?” তাঁরা ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্যই এই কথা বললেন, যাতে তাঁকে দোষ দেবার একটা কারণ তাঁরা খুঁজে পান। তখন ঈসা নীচু হয়ে আংগুল দিয়ে মাটিতে লিখতে লাগলেন। কিন্তু তাঁরা যখন কথাটা বারবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন তখন তিনি উঠে তাঁদের বললেন, “আপনাদের মধ্যে যিনি কোন গুনাহ্‌ করেন নি তিনিই প্রথমে ওকে পাথর মারুন।” এর পরে তিনি নীচু হয়ে আবার মাটিতে লিখতে লাগলেন। এই কথা শুনে সেই নেতাদের মধ্যে বুড়ো লোক থেকে শুরু করে একে একে সবাই চলে গেলেন। ঈসা কেবল একা রইলেন আর সেই স্ত্রীলোকটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈসা উঠে সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তাঁরা কোথায়? কেউ কি তোমাকে শাস্তির উপযুক্ত মনে করেন নি?” স্ত্রীলোকটি জবাব দিল, “জ্বী না হুজুর, কেউই করেন নি।” তখন ঈসা বললেন, “আমিও করি না। আচ্ছা যাও; গুনাহে জীবন আর কাটায়ো না।” পরে ঈসা আবার লোকদের বললেন, “আমিই দুনিয়ার নূর। যে আমার পথে চলে সে কখনও অন্ধকারে পা ফেলবে না, বরং জীবনের নূর পাবে।” এতে ফরীশীরা ঈসাকে বললেন, “তোমার সাক্ষ্য সত্যি নয়, কারণ তুমি নিজের পক্ষে নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছ।” ঈসা তাঁদের জবাব দিলেন, “যদিও আমি নিজের পক্ষে নিজে সাক্ষ্য দিই তবুও আমার সাক্ষ্য সত্যি, কারণ আমি কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় যাচ্ছি তা আমি জানি। কিন্তু আমি কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় যাচ্ছি তা আপনারা জানেন না। মানুষ যেভাবে বিচার করে আপনারা সেইভাবে বিচার করে থাকেন, কিন্তু আমি কারও বিচার করি না। কিন্তু যদি আমি কখনও বিচার করি তবে আমার সেই বিচার সত্যি, কারণ আমি একা নই। আমি তো আছিই আর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সেই পিতাও আমার সংগে আছেন। আপনাদের শরীয়তে লেখা আছে, দু’জন যদি একই সাক্ষ্য দেয় তবে তা সত্যি। আমিই আমার নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিই, আর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সেই পিতাও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।” ফরীশীরা তাঁকে বললেন, “তোমার পিতা কোথায়?” ঈসা জবাব দিলেন, “আপনারা আমাকেও জানেন না আর আমার পিতাকেও জানেন না। যদি আমাকে জানতেন তবে আমার পিতাকেও জানতেন।” বায়তুল-মোকাদ্দসে শিক্ষা দেবার সময়ে দান দেবার জায়গায় ঈসা এই সব কথা বললেন। কিন্তু তখনও তাঁর সময় হয় নি বলে কেউই তাঁকে ধরল না। ঈসা আবার ফরীশীদের বললেন, “আমি চলে যাচ্ছি। আপনারা আমাকে তালাশ করবেন, কিন্তু আপনারা আপনাদের গুনাহের মধ্যে মরবেন। আমি যেখানে যাচ্ছি আপনারা সেখানে আসতে পারবেন না।” তখন ইহুদী নেতারা বললেন, “সে আত্মহত্যা করবে নাকি? কারণ সে বলছে, ‘আমি যেখানে যাচ্ছি আপনারা সেখানে আসতে পারবেন না।’ ” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি উপর থেকে এসেছি আর আপনারা নীচ থেকে এসেছেন। আপনারা এই দুনিয়ার, কিন্তু আমি এই দুনিয়ার নই। তাই আমি আপনাদের বলেছি, আপনারা আপনাদের গুনাহের মধ্যে মরবেন। যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন যে, আমিই সেই, তবে আপনাদের গুনাহের মধ্যেই আপনারা মরবেন।” এতে নেতারা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে?” তিনি তাঁদের বললেন, “প্রথম থেকে আমি আপনাদের যা বলছি আমি তা-ই। আপনাদের সম্বন্ধে বলবার আর বিচার করে দেখবার আমার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর মধ্যে মিথ্যা নেই; আমি তাঁর কাছে যা শুনেছি তা-ই মানুষকে বলি।” তাঁরা বুঝলেন না ঈসা পিতার বিষয়েই তাঁদের কাছে বলছিলেন। এইজন্য ঈসা বললেন, “যখন আপনারা ইব্‌ন্তেআদমকে উঁচুতে তুলবেন তখন বুঝতে পারবেন যে, আমিই সেই। আর এও বুঝতে পারবেন যে, আমি নিজে থেকে কোন কিছুই করি না, বরং পিতা আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন আমি সেই সব কথাই বলি। যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তিনিই আমার সংগে আছেন। তিনি আমাকে একা ছেড়ে দেন নি, কারণ যে কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন আমি সব সময় সেই কাজই করি।” ঈসা যখন এই সব কথা বলছিলেন তখন অনেকেই তাঁর উপর ঈমান আনল। যে ইহুদীরা তাঁর উপর ঈমান এনেছিল ঈসা তাদের বললেন, “আমার কথামত যদি আপনারা চলেন তবে সত্যিই আপনারা আমার উম্মত। তা ছাড়া আপনারা সত্যকে জানতে পারবেন, আর সেই সত্যই আপনাদের মুক্ত করবে।” ইহুদী নেতারা তখন ঈসাকে বললেন, “আমরা ইব্রাহিমের বংশের লোক; আমরা কখনও কারও গোলাম হই নি। তুমি কি করে বলছ যে, আমাদের মুক্ত করা হবে?” ঈসা তাঁদের এই জবাব দিলেন, “আমি সত্যিই আপনাদের বলছি, যারা গুনাহে পড়ে থাকে তারা সবাই গুনাহের গোলাম। গোলাম চিরদিন বাড়ীতে থাকে না কিন্তু পুত্র চিরকাল থাকে। তাই পুত্র যদি আপনাদের মুক্ত করেন তবে সত্যিই আপনারা মুক্ত হবেন। আমি জানি আপনারা ইব্রাহিমের বংশের লোক, কিন্তু তবুও আপনারা আমাকে হত্যা করতে চাইছেন, কারণ আমার কথা আপনাদের দিলে কোন স্থান পায় না। আমি আমার পিতার কাছে যা দেখেছি সেই বিষয়েই বলি, আর আপনারা আপনাদের পিতার কাছ থেকে যা শুনেছেন তা-ই করে থাকেন।” এতে সেই ইহুদী নেতারা ঈসাকে বললেন, “ইব্রাহিমই আমাদের পিতা।” ঈসা তাঁদের বললেন, “যদি আপনারা ইব্রাহিমের সন্তান হতেন তবে ইব্রাহিমের মতই কাজ করতেন। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে সত্য আমি জেনেছি তা-ই আপনাদের বলেছি, আর তবুও আপনারা আমাকে হত্যা করতে চাইছেন; কিন্তু ইব্রাহিম এই রকম করেন নি। আপনাদের পিতা যা করে আপনারা তা-ই করছেন।” তাঁরা ঈসাকে বললেন, “আমরা তো জারজ নই। আমাদের একজনই পিতা আছেন, সেই পিতা হলেন আল্লাহ্‌।” ঈসা তাঁদের বললেন, “সত্যিই যদি আল্লাহ্‌ আপনাদের পিতা হতেন তবে আপনারা আমাকে মহব্বত করতেন, কারণ আমি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছি আর এখন আপনাদের মধ্যে আছি। আমি নিজ থেকে আসি নি, কিন্তু তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন। কেন আপনারা আমার কথা বোঝেন না? তার কারণ এই যে, আপনারা আমার কথা সহ্য করতে পারেন না। ইবলিসই আপনাদের পিতা আর আপনারা তারই সন্তান; সেইজন্য আপনারা তার ইচ্ছা পূর্ণ করতে চান। ইবলিস প্রথম থেকেই খুনী। সে কখনও সত্যে বাস করে নি, কারণ তার মধ্যে সত্য নেই। সে যখন মিথ্যা কথা বলে তখন সে তা নিজে থেকেই বলে, কারণ সে মিথ্যাবাদী আর সমস্ত মিথ্যার জন্ম তার মধ্য থেকেই হয়েছে। কিন্তু আমি সত্যি কথা বলি, আর তাই আপনারা আমাকে বিশ্বাস করেন না। আপনাদের মধ্যে কে আমাকে গুনাহ্‌গার বলে প্রমাণ করতে পারেন? যদি আমি সত্যি কথাই বলি তবে কেন আপনারা আমাকে বিশ্বাস করেন না? যে লোক আল্লাহ্‌র, সে আল্লাহ্‌র কথা শোনে। আপনারা আল্লাহ্‌র নন বলে আল্লাহ্‌র কথা শোনেন না।” তখন ইহুদী নেতারা ঈসাকে বললেন, “আমরা কি ঠিক বলি নি যে, তুমি একজন সামেরীয় আর তোমাকে ভূতে পেয়েছে?” জবাবে ঈসা বললেন, “আমাকে ভূতে পায় নি। আমি আমার পিতাকে সম্মান করি, কিন্তু আপনারা আমাকে অসম্মান করেন। আমি আমার নিজের প্রশংসার চেষ্টা করি না, কিন্তু একজন আছেন যিনি আমাকে সম্মান দান করেন, আর তিনিই বিচারকর্তা। আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, যদি কেউ আমার কথার বাধ্য হয়ে চলে তবে সে কখনও মরবে না।” ইহুদী নেতারা তাঁকে বললেন, “এবার আমরা সত্যি বুঝলাম যে, তোমাকে ভূতেই পেয়েছে। ইব্রাহিম ও নবীরা মারা গেছেন, আর তুমি বলছ, ‘যদি কেউ আমার কথার বাধ্য হয়ে চলে সে কখনও মরবে না।’ তুমি কি পিতা ইব্রাহিম থেকেও বড়? তিনি তো মারা গেছেন এবং নবীরাও মারা গেছেন। তুমি নিজেকে কি মনে কর?” জবাবে ঈসা বললেন, “যদি আমি নিজের প্রশংসা নিজেই করি তবে তার কোন দাম নেই। আমার পিতা, যাঁকে আপনারা আপনাদের আল্লাহ্‌ বলে দাবি করেন তিনিই আমাকে সম্মান দান করেন। আপনারা কখনও তাঁকে জানেন নি, কিন্তু আমি তাঁকে জানি। যদি আমি বলি আমি তাঁকে জানি না তবে আপনাদেরই মত আমি মিথ্যাবাদী হব। কিন্তু আমি তাঁকে জানি এবং তাঁর কথার বাধ্য হয়ে চলি। আপনাদের পিতা ইব্রাহিম আমারই দিন দেখবার আশায় আনন্দ করেছিলেন। তিনি তা দেখেছিলেন আর খুশীও হয়েছিলেন।” ইহুদী নেতারা তাঁকে বললেন, “তোমার বয়স এখনও পঞ্চাশ বছর হয় নি, আর তুমি কি ইব্রাহিমকে দেখেছ?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি আপনাদের সত্যি বলছি, ইব্রাহিম জন্মগ্রহণ করবার আগে থেকেই আমি আছি।” এই কথা শুনে সেই নেতারা তাঁকে মারবার জন্য পাথর কুড়িয়ে নিলেন। কিন্তু ঈসা নিজেকে গোপন করে বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে বের হয়ে গেলেন। পথ দিয়ে যাবার সময় ঈসা একজন অন্ধ লোককে দেখতে পেলেন। সে জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল। তখন সাহাবীরা ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, কার গুনাহে এই লোকটি অন্ধ হয়ে জন্মেছে? তার নিজের, না তার মা-বাবার?” ঈসা জবাব দিলেন, “গুনাহ্‌ সে নিজেও করে নি, তার মা-বাবাও করে নি। এটা হয়েছে যেন আল্লাহ্‌র কাজ তার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, বেলা থাকতে থাকতে তাঁর কাজ করা আমাদের দরকার। রাত আসছে, তখন কেউই কাজ করতে পারবে না। যতদিন আমি দুনিয়াতে আছি আমি দুনিয়ার নূর।” এই কথা বলবার পরে তিনি মাটিতে থুথু ফেলে কাদা করলেন। তারপর সেই কাদা তিনি লোকটির চোখে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও, শীলোহের পুকুরে গিয়ে ধুয়ে ফেল।” শীলোহ মানে পাঠানো হল। লোকটি গিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলল এবং চোখে দেখতে পেয়ে ফিরে আসল। এ দেখে তার প্রতিবেশীরা আর যারা তাকে আগে ভিক্ষা করতে দেখেছিল তারা সবাই বলতে লাগল, “এ কি সেই লোকটি নয়, যে বসে বসে ভিক্ষা করত?” কেউ কেউ বলল, “জ্বী, এ-ই সেই লোক।” আবার কেউ কেউ বলল, “যদিও দেখতে তারই মত তবুও সে নয়।” কিন্তু লোকটি নিজে বলল, “জ্বী, আমিই সেই লোক।” তারা তাকে বলল, “কিন্তু কেমন করে তোমার চোখ খুলে গেল?” সে জবাব দিল, “ঈসা নামে সেই লোকটি কাদা করে আমার চোখে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শীলোহের পুকুরে গিয়ে ধুয়ে ফেল।’ আমি গিয়ে ধুয়ে ফেললাম আর দেখতে পেলাম।” তারা তাকে বলল, “সেই লোকটি কোথায়?” সে বলল, “আমি জানি না।” যে লোকটি অন্ধ ছিল লোকেরা তাকে ফরীশীদের কাছে নিয়ে গেল। যেদিন ঈসা কাদা করে তার চোখ খুলে দিয়েছিলেন সেই দিনটা ছিল বিশ্রামবার। এইজন্য তাকে ফরীশীরাও আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কেমন করে দেখতে পেলে?” সে ফরীশীদের বলল, “তিনি আমার চোখের উপরে কাদা লাগিয়ে দিলেন, আর আমি তা ধুয়ে ফেলতেই দেখতে পেলাম।” এতে ফরীশীদের মধ্যে কয়েকজন বললেন, “ঐ লোকটি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আসে নি, কারণ সে বিশ্রামবার পালন করে না।” অন্য ফরীশীরা বললেন, “যে লোক গুনাহ্‌গার সে কেমন করে এই রকম অলৌকিক কাজ করতে পারে?” এইভাবে তাঁদের মধ্যে মতের অমিল দেখা দিল। তখন তাঁরা সেই লোকটিকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি তার সম্বন্ধে কি বল? কারণ সে তো তোমারই চোখ খুলে দিয়েছে।” লোকটি বলল, “তিনি একজন নবী।” ইহুদী নেতারা কিন্তু লোকটির পিতা-মাতাকে ডেকে জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত বিশ্বাস করলেন না যে, সেই লোকটি আগে অন্ধ ছিল আর এখন দেখতে পাচ্ছে। তাঁরা লোকটির পিতা-মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ-ই কি তোমাদের সেই ছেলে যার সম্বন্ধে তোমরা বল যে, সে অন্ধ হয়ে জন্মেছিল? এখন তবে সে কেমন করে দেখতে পাচ্ছে?” তার মা-বাবা জবাব দিল, “আমরা জানি এ আমাদেরই ছেলে, আর এ অন্ধ হয়েই জন্মেছিল। কিন্তু কেমন করে সে এখন দেখতে পাচ্ছে তা আমরা জানি না; আর কে যে তার চোখ খুলে দিয়েছে তাও জানি না। ওর বয়স হয়েছে, ওকেই জিজ্ঞাসা করুন। ও নিজের বিষয় নিজেই বলুক।” তার মা-বাবা ইহুদী নেতাদের ভয়ে এই সব কথা বলল, কারণ ইহুদী নেতারা আগেই ঠিক করেছিলেন যে, কেউ যদি ঈসাকে মসীহ্‌ বলে স্বীকার করে তবে তাকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হবে। সেইজন্যই তার মা-বাবা বলেছিল, “ওর বয়স হয়েছে, ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।” যে লোকটি আগে অন্ধ ছিল নেতারা তাকে দ্বিতীয় বার ডেকে বললেন, “তুমি সত্যি কথা বলে আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর। আমরা তো জানি ঐ লোকটা গুনাহ্‌গার।” সে জবাব দিল, “তিনি গুনাহ্‌গার কি না তা আমি জানি না; তবে একটা বিষয় জানি যে, আগে আমি অন্ধ ছিলাম আর এখন দেখতে পাচ্ছি।” নেতারা বললেন, “সে তোমাকে কি করেছে? কেমন করে সে তোমার চোখ খুলে দিয়েছে?” জবাবে লোকটি তাঁদের বলল, “আমি তো আগেই আপনাদের বলেছি, কিন্তু আপনারা শোনেন নি। কেন তবে আপনারা আবার শুনতে চান? আপনারাও কি তাঁর উম্মত হতে চান?” এতে নেতারা লোকটিকে খুব গালাগালি দিয়ে বললেন, “তুই সেই লোকের উম্মত, কিন্তু আমরা মূসার উম্মত। আমরা জানি আল্লাহ্‌ মূসা নবীর সংগে কথা বলেছিলেন, কিন্তু ঐ লোকটা কোথা থেকে এসেছে তা আমরা জানি না।” তখন সেই লোকটি তাঁদের জবাব দিল, “কি আশ্চর্য! আপনারা জানেন না তিনি কোথা থেকে এসেছেন অথচ তিনিই আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমরা জানি আল্লাহ্‌ গুনাহ্‌গারদের কথা শোনেন না। কিন্তু যদি কোন লোক আল্লাহ্‌ভক্ত হয় ও তাঁর ইচ্ছামত কাজ করে তবে আল্লাহ্‌ তার কথা শোনেন। দুনিয়া সৃষ্টির পর থেকে কখনও শোনা যায় নি, জন্ম থেকে অন্ধ এমন কোন লোকের চোখ কেউ খুলে দিয়েছে। যদি উনি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে না আসতেন তবে কিছুই করতে পারতেন না।” জবাবে নেতারা বললেন, “তোর জন্ম হয়েছে একেবারে গুনাহের মধ্যে, আর তুই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছিস?” এই বলে তাঁরা তাকে সমাজ থেকে বের করে দিলেন। ঈসা শুনলেন যে, নেতারা লোকটিকে বের করে দিয়েছেন। পরে তিনি সেই লোকটিকে খুঁজে পেয়ে বললেন, “তুমি কি ইব্‌ন্তেআদমের উপর ঈমান এনেছ?” সে জবাব দিল, “হুজুর, তিনি কে? আমাকে বলুন যাতে আমি তাঁর উপর ঈমান আনতে পারি।” ঈসা তাকে বললেন, “তুমি তাঁকে দেখেছ, আর তিনিই তোমার সংগে কথা বলছেন।” তখন লোকটি বলল, “হুজুর, আমি ঈমান আনলাম।” এই বলে সে ঈসাকে সেজদা করল। ঈসা বললেন, “আমি এই দুনিয়াতে বিচার করবার জন্য এসেছি, যেন যারা দেখতে পায় না তারা দেখতে পায় এবং যারা দেখতে পায় তারা অন্ধ হয়।” কয়েকজন ফরীশীও ঈসার সংগে ছিলেন। তাঁরা এই কথা শুনে তাঁকে বললেন, “তবে আপনি কি বলতে চান যে, আমরা অন্ধ?” ঈসা তাঁদের বললেন, “আপনারা যদি অন্ধ হতেন তাহলে আপনাদের কোন দোষ থাকত না। কিন্তু আপনারা বলেন যে, আপনারা দেখতে পান, সেইজন্যই আপনাদের দোষ রয়েছে। “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, যে কেউ মেষের খোঁয়াড়ের দরজা দিয়ে না ঢুকে অন্য দিক দিয়ে ঢোকে সে চোর ও ডাকাত। কিন্তু যে কেউ দরজা দিয়ে ভিতরে যায় সে-ই মেষদের পালক। মেষের খোঁয়াড় যে পাহারা দেয় সে সেই পালককেই দরজা খুলে দেয়। মেষগুলো তার ডাক শোনে, আর সেই পালক তার নিজের মেষগুলোর নাম ধরে ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। তার নিজের সব মেষগুলো বের করবার পরে সে তাদের আগে আগে চলে, আর মেষগুলো তার পিছনে পিছনে যায় কারণ তারা তার ডাক চেনে। তারা কখনও অচেনা লোকের পিছনে যাবে না বরং তার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে, কারণ তারা অচেনা লোকের গলার আওয়াজ চেনে না।” সেই ফরীশীদের শিক্ষা দেবার জন্য ঈসা এই কথা বললেন কিন্তু তিনি যে কি বলছিলেন তা তাঁরা বুঝলেন না। সেইজন্য ঈসা আবার বললেন, “আমি আপনাদের সত্যিই বলছি, মেষগুলোর জন্য আমিই দরজা। আমার আগে যারা এসেছিল তারা সবাই চোর আর ডাকাত, কিন্তু মেষগুলো তাদের কথা শোনে নি। আমিই দরজা। যদি কেউ আমার মধ্য দিয়ে ভিতরে ঢোকে তবে সে নাজাত পাবে। সে ভিতরে আসবে ও বাইরে যাবে আর চরে খাবার জায়গা পাবে। চোর কেবল চুরি, খুন ও নষ্ট করবার উদ্দেশ্য নিয়েই আসে। আমি এসেছি যেন তারা জীবন পায়, আর সেই জীবন যেন পরিপূর্ণ হয়। “আমিই উত্তম মেষপালক। উত্তম মেষপালক তার মেষদের জন্য নিজের জীবন দেয়। আরও মেষ আমার কাছে আছে যেগুলো এই খোঁয়াড়ের নয়; তাদেরও আমাকে আনতে হবে। তারা আমার ডাক শুনবে, আর তাতে একটা মেষপাল ও একজন পালক হবে। পিতা আমাকে এইজন্য মহব্বত করেন, কারণ আমি আমার প্রাণ দেব যেন তা আবার ফিরিয়ে নিতে পারি। কেউই আমার প্রাণ আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে না, কিন্তু আমি নিজেই তা দেব। প্রাণ দেবারও ক্ষমতা আমার আছে, আবার প্রাণ ফিরিয়ে নেবারও ক্ষমতা আমার আছে। এই দায়িত্ব আমি আমার পিতার কাছ থেকে পেয়েছি।” ঈসার এই কথার জন্য ইহুদীদের মধ্যে আবার মতের অমিল দেখা দিল। তাদের মধ্যে অনেকে বলল, “তাকে ভূতে পেয়েছে, সে পাগল; তোমরা তার কথা কেন শুনছ?” অন্যেরা বলল, “কিন্তু এ তো ভূতে পাওয়া লোকের মত কথা নয়। ভূত কি অন্ধের চোখ খুলে দিতে পারে?” এর পরে জেরুজালেমে বায়তুল-মোকাদ্দস প্রতিষ্ঠার ঈদ উপস্থিত হল। তখন শীতকাল। ঈসা বায়তুল-মোকাদ্দসের মধ্যে বাদশাহ্‌ সোলায়মানের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেই সময় ইহুদী নেতারা ঈসার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললেন, “আর কত দিন তুমি আমাদের সন্দেহের মধ্যে রাখবে? তুমি যদি মসীহ্‌ হও তবে স্পষ্ট করে আমাদের বল।” ঈসা জবাবে বললেন, “আমি তো আপনাদের বলেছি, কিন্তু আপনারা ঈমান আনেন নি। আমার পিতার নামে আমি যে সব কাজ করি সেগুলোও আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু আপনারা ঈমান আনেন নি, কারণ আপনারা আমার ভেড়া নন। আমার মেষগুলো আমার ডাক শোনে। আমি তাদের জানি আর তারা আমার পিছনে পিছনে চলে। আমি তাদের অনন্ত জীবন দিই। তারা কখনও বিনষ্ট হবে না এবং কেউই আমার হাত থেকে তাদের কেড়ে নেবে না। আমার পিতা, যিনি তাদের আমাকে দিয়েছেন, তিনি সকলের চেয়ে মহান। কেউই পিতার হাত থেকে কিছু কেড়ে নিতে পারে না। আমি আর পিতা এক।” তখন ইহুদী নেতারা তাঁকে মারবার জন্য আবার পাথর কুড়িয়ে নিলেন। ঈসা তাঁদের বললেন, “পিতার হুকুম মত অনেক ভাল ভাল কাজ আমি আপনাদের দেখিয়েছি। সেগুলোর মধ্যে কোন্‌ কাজের জন্য আপনারা আমাকে পাথর মারতে চান?” নেতারা জবাবে বললেন, “ভাল কাজের জন্য আমরা তোমাকে পাথর মারি না, কিন্তু তুমি কুফরী করছ বলেই মারি। মানুষ হয়েও তুমি নিজেকে আল্লাহ্‌ বলে দাবি করছ।” ঈসা বললেন, “আপনাদের শরীয়তে কি লেখা নেই যে, ‘আমি বললাম, তোমরা যেন আল্লাহ্‌’? আল্লাহ্‌র কালাম যাদের কাছে এসেছিল তাদের তো তিনি আল্লাহ্‌র মত বলেছিলেন। পাক-কিতাবের কথা কি বাদ দেওয়া যেতে পারে? পারে না। তাহলে পিতা নিজের উদ্দেশ্যে যাঁকে আলাদা করলেন এবং দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিলেন সেই আমি যখন বললাম, ‘আমি ইব্‌নুল্লাহ্‌,’ তখন আপনারা কেমন করে বলছেন, ‘তুমি কুফরী করছ’? আমার পিতার কাজ যদি আমি না করি তবে আপনারা আমার উপর ঈমান আনবেন না। কিন্তু যদি করি তবে আমার উপর ঈমান না আনলেও আমার কাজগুলো অন্ততঃ বিশ্বাস করুন। তাতে আপনারা জানতে ও বুঝতে পারবেন যে, পিতা আমার মধ্যে আছেন আর আমি পিতার মধ্যে আছি।” তখন ইহুদী নেতারা আবার ঈসাকে ধরবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি তাঁদের হাত এড়িয়ে চলে গেলেন। এর পরে তিনি আবার জর্ডান নদীর ওপারে গিয়ে থাকতে লাগলেন। সেখানেই ইয়াহিয়া প্রথমে তরিকাবন্দী দিতেন। অনেক লোক ঈসার কাছে গেল এবং বলাবলি করতে লাগল, “ইয়াহিয়া নবী কোন অলৌকিক কাজ করেন নি বটে, কিন্তু তবুও তিনি এই লোকটির বিষয়ে যা যা বলেছিলেন তা সবই সত্যি।” আর সেখানে অনেক লোক ঈসার উপর ঈমান আনল। লাসার নামে বেথানিয়া গ্রামের একজন লোকের অসুখ হয়েছিল। মরিয়ম ও তাঁর বোন মার্থা সেই গ্রামে থাকতেন। ইনি সেই মরিয়ম যিনি ঈসার পায়ে খোশবু আতর ঢেলে দিয়ে নিজের চুল দিয়ে তাঁর পা মুছিয়ে দিয়েছিলেন। যে লাসারের অসুখ হয়েছিল তিনি ছিলেন এই মরিয়মের ভাই। এইজন্য তাঁর বোনেরা ঈসাকে এই কথা বলে পাঠালেন, “হুজুর, আপনি যাকে মহব্বত করেন তার অসুখ হয়েছে।” এই কথা শুনে ঈসা বললেন, “এই অসুখ তার মৃত্যুর জন্য হয় নি বরং আল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশের জন্যই হয়েছে, যেন এর মধ্য দিয়ে ইব্‌নুল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশ পায়।” মার্থা, তাঁর বোন ও লাসারকে ঈসা মহব্বত করতেন। যখন ঈসা লাসারের অসুখের কথা শুনলেন তখন তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই আরও দু’দিন রয়ে গেলেন। তারপর তিনি সাহাবীদের বললেন, “চল, আমরা আবার এহুদিয়াতে যাই।” সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “হুজুর, এই কিছুদিন আগে নেতারা আপনাকে পাথর মারতে চেয়েছিলেন, আর আপনি আবার সেখানে যাচ্ছেন?” ঈসা জবাব দিলেন, “দিনে কি বারো ঘণ্টা নেই? কেউ যদি দিনে চলাফেরা করে সে উচোট খায় না, কারণ সে এই দুনিয়ার আলো দেখে। কিন্তু যদি কেউ রাতে চলাফেরা করে সে উচোট খায়, কারণ তার মধ্যে আলো নেই।” এই সব কথা বলবার পরে ঈসা সাহাবীদের বললেন, “আমাদের বন্ধু লাসার ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি তাকে জাগাতে যাচ্ছি।” এতে সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “হুজুর, যদি সে ঘুমিয়েই থাকে তবে সে ভাল হবে।” ঈসা লাসারের মৃত্যুর কথা বলছিলেন, কিন্তু তাঁর সাহাবীরা ভাবলেন তিনি স্বাভাবিক ঘুমের কথাই বলছেন। ঈসা তখন স্পষ্ট করেই বললেন, “লাসার মারা গেছে, কিন্তু আমি তোমাদের কথা ভেবে খুশী হয়েছি যে, আমি সেখানে ছিলাম না যাতে তোমরা বিশ্বাস করতে পার। চল, আমরা লাসারের কাছে যাই।” তখন থোমা, যাঁকে যমজ বলা হয়, তাঁর সংগী-সাহাবীদের বললেন, “চল, আমরাও যাই, যেন তাঁর সংগে মরতে পারি।” ঈসা সেখানে পৌঁছে জানতে পারলেন যে, চার দিন আগেই লাসারকে দাফন করা হয়েছে। জেরুজালেম থেকে বেথানিয়া প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ছিল। ইহুদীদের মধ্যে অনেকেই মার্থা ও মরিয়মকে তাঁদের ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। ঈসা আসছেন শুনে মার্থা তাঁর সংগে দেখা করতে গেলেন, কিন্তু মরিয়ম ঘরে বসে রইলেন। মার্থা ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনি যদি এখানে থাকতেন তবে আমার ভাই মারা যেত না। কিন্তু আমি জানি, আপনি এখনও আল্লাহ্‌র কাছে যা চাইবেন আল্লাহ্‌ তা আপনাকে দেবেন।” ঈসা তাঁকে বললেন, “তোমার ভাই আবার জীবিত হয়ে উঠবে।” তখন মার্থা তাঁকে বললেন, “আমি জানি, শেষ দিনে মৃত লোকেরা যখন জীবিত হয়ে উঠবে তখন সেও উঠবে।” ঈসা মার্থাকে বললেন, “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন। যে আমার উপর ঈমান আনে সে মরলেও জীবিত হবে। আর যে জীবিত আছে এবং আমার উপর ঈমান আনে সে কখনও মরবে না। তুমি কি এই কথা বিশ্বাস কর?” মার্থা তাঁকে বললেন, “জ্বী হুজুর, আমি ঈমান এনেছি যে, দুনিয়াতে যাঁর আসবার কথা আছে আপনিই সেই মসীহ্‌ ইব্‌নুল্লাহ্‌।” এই কথা বলে মার্থা গিয়ে তাঁর বোন মরিয়মকে গোপনে ডেকে বললেন, “হুজুর এখানে আছেন ও তোমাকে ডাকছেন।” মরিয়ম এই কথা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে ঈসার কাছে গেলেন। ঈসা তখনও গ্রামে এসে পৌঁছান নি; মার্থা যেখানে তাঁর সংগে দেখা করেছিলেন সেখানেই ছিলেন। যে ইহুদীরা মরিয়মের সংগে ঘরে থেকে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তারা মরিয়মকে তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে যেতে দেখে তাঁর পিছনে পিছনে গেল। তারা ভাবল, মরিয়ম কবরের কাছে কাঁদতে যাচ্ছেন। ঈসা যেখানে ছিলেন মরিয়ম সেখানে গেলেন আর তাঁকে দেখতে পেয়ে তাঁর পায়ের উপর পড়ে বললেন, “হুজুর, আপনি যদি এখানে থাকতেন তবে আমার ভাই মারা যেত না।” ঈসা মরিয়মকে এবং তাঁর সংগে যে ইহুদীরা এসেছিল তাদের কাঁদতে দেখে দিলে খুব অস্থির হলেন। তিনি তাদের বললেন, “লাসারকে কোথায় রেখেছ?” তারা বলল, “হুজুর, এসে দেখুন।” তখন ঈসা কাঁদলেন। তাতে ইহুদীরা বলল, “দেখ, উনি লাসারকে কত মহব্বত করতেন।” কিন্তু ইহুদীদের মধ্যে কেউ কেউ বলল, “অন্ধের চোখ যিনি খুলে দিয়েছেন তিনি কি এমন কিছু করতে পারতেন না যাতে লোকটি মারা না যেত?” এতে ঈসা দিলে আবার অস্থির হলেন এবং কবরের কাছে গেলেন। কবরটা ছিল একটা গুহা। সেই গুহার মুখে একটা পাথর বসানো ছিল। ঈসা বললেন, “পাথরখানা সরাও।” যিনি মারা গেছেন তাঁর বোন মার্থা ঈসাকে বললেন, “হুজুর, এখন দুর্গন্ধ হয়েছে, কারণ চার দিন হল সে মারা গেছে।” ঈসা মার্থাকে বললেন, “আমি কি তোমাকে বলি নি, যদি তুমি বিশ্বাস কর তবে আল্লাহ্‌র মহিমা দেখতে পাবে?” তখন লোকেরা পাথরখানা সরিয়ে দিল। ঈসা উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পিতা, তুমি আমার কথা শুনেছ বলে আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করি। অবশ্য আমি জানি সব সময়ই তুমি আমার কথা শুনে থাক। কিন্তু যে সব লোক চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা যেন বিশ্বাস করতে পারে যে, তুমি আমাকে পাঠিয়েছ, সেইজন্যই এই কথা বললাম।” এই কথা বলবার পরে ঈসা জোরে ডাক দিয়ে বললেন, “লাসার, বের হয়ে এস।” যিনি মারা গিয়েছিলেন তিনি তখন কবর থেকে বের হয়ে আসলেন। তাঁর হাত-পা কবরের কাপড়ে জড়ানো ছিল এবং তাঁর মুখ রুমালে বাঁধা ছিল। ঈসা লোকদের বললেন, “ওর বাঁধন খুলে দাও আর ওকে যেতে দাও। মরিয়মের কাছে যে সব ইহুদীরা এসেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই ঈসার এই কাজ দেখে তাঁর উপর ঈমান আনল। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফরীশীদের কাছে গিয়ে ঈসা যা করেছিলেন তা বলল। তখন প্রধান ইমামেরা ও ফরীশীরা মহাসভার লোকদের একত্র করে বললেন, “আমরা এখন কি করি? এই লোকটা তো অনেক অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করছে। আমরা যদি তাকে এইভাবে চলতে দিই তবে সবাই তার উপর ঈমান আনবে, আর রোমীয়রা এসে আমাদের এবাদত-খানা এবং আমাদের জাতিকে ধ্বংস করে ফেলবে।” তাঁদের মধ্যে কাইয়াফা নামে একজন সেই বছরের মহা-ইমাম ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “তোমরা কিছুই জান না, আর ভেবেও দেখ না যে, গোটা জাতিটা নষ্ট হওয়ার চেয়ে বরং সমস্ত লোকের বদলে একজন মানুষের মৃত্যু অনেক ভাল।” কাইয়াফা যে নিজে থেকে এই কথা বলেছিলেন তা নয় কিন্তু তিনি ছিলেন সেই বছরের মহা-ইমাম। সেইজন্য তিনি ভবিষ্যতের কথা বলেছিলেন যে, ইহুদী জাতির জন্য ঈসাই মরবেন। কেবল ইহুদী জাতির জন্যই নয়, কিন্তু আল্লাহ্‌র যে সন্তানেরা চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের জমায়েত করে এক করবার জন্যও তিনি মরবেন। সেই দিন থেকে ইহুদী নেতারা ঈসাকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। সেইজন্য ঈসা খোলাখুলিভাবে ইহুদীদের মধ্যে চলাফেরা বন্ধ করে দিলেন, আর সেই জায়গা ছেড়ে মরুভূমির কাছে আফরাহীম নামে একটা গ্রামে চলে গেলেন। সেখানে তিনি তাঁর সাহাবীদের নিয়ে থাকতে লাগলেন। তখন ইহুদীদের উদ্ধার-ঈদ কাছে এসেছিল। ঈদের আগে নিজেদের পাক-সাফ করবার জন্য অনেক লোক গ্রাম থেকে জেরুজালেমে গিয়েছিল। এই লোকেরা ঈসার তালাশ করতে লাগল। তারা বায়তুল-মোকাদ্দসে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “তিনি কি এই ঈদে একেবারেই আসবেন না? তোমাদের কি মনে হয়?” প্রধান ইমামেরা ও ফরীশীরা হুকুম দিয়েছিলেন যে, ঈসা কোথায় আছে তা যদি কেউ জানে তবে সে যেন খবরটা তাঁদের জানায় যাতে তাঁরা ঈসাকে ধরতে পারেন। উদ্ধার-ঈদের ছয় দিন আগে ঈসা বেথানিয়াতে গেলেন। যাঁকে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন সেই লাসার বেথানিয়াতে বাস করতেন। সেখানে তাঁরা ঈসার জন্য খাওয়ার আয়োজন করলেন। মার্থা পরিবেশন করছিলেন। যারা ঈসার সংগে খেতে বসেছিলেন তাঁদের মধ্যে লাসারও ছিলেন। এমন সময় মরিয়ম কমবেশ তিনশো গ্রাম খুব দামী, খাঁটি খোশবু আতর নিয়ে আসলেন এবং ঈসার পায়ে তা ঢেলে দিয়ে নিজের চুল দিয়ে তাঁর পা মুছে দিলেন। সেই আতরের সুগন্ধে সারা ঘর ভরে গেল। ঈসার সাহাবীদের মধ্যে একজন, যে তাঁকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে, সেই এহুদা ইষ্কারিয়োৎ বলল, “এই আতর তিনশো দীনারে বিক্রি করে গরীব-দুঃখীদের দেওয়া যেত। কেন তা করা হল না?” এহুদা যে গরীবদের বিষয়ে চিন্তা করে এই কথা বলেছিল তা নয়। আসলে সে ছিল চোর। টাকার বাক্স তার কাছে থাকত বলে যা কিছু জমা রাখা হত তা থেকে সে চুরি করত। ঈসা বললেন, “তোমরা ওর মনে কষ্ট দিয়ো না। আমাকে দাফন করবার সময়ে সাজাবার জন্যই ও এটা রেখেছিল। গরীবেরা তো সব সময় তোমাদের মধ্যে আছে, কিন্তু আমাকে তোমরা সব সময় পাবে না।” ঈসা বেথানিয়াতে আছেন জানতে পেরে ইহুদীদের মধ্য থেকে অনেক লোক সেখানে আসল। তারা যে কেবল ঈসার জন্য সেখানে এসেছিল তা নয়, কিন্তু যাঁকে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন সেই লাসারকেও দেখতে আসল। তখন প্রধান ইমামেরা লাসারকেও হত্যা করবেন বলে ঠিক করলেন, কারণ লাসারের জন্য ইহুদীদের মধ্যে অনেকেই নেতাদের ছেড়ে ঈসার উপর ঈমান এনেছিল। যে সব লোক ঈদে গিয়েছিল তারা পরদিন শুনতে পেল ঈসা জেরুজালেমে আসছেন। তখন তারা খেজুর পাতা নিয়ে তাঁকে এগিয়ে আনতে গেল আর চিৎকার করে বলতে লাগল, “মারহাবা, যিনি মাবুদের নামে আসছেন তাঁর প্রশংসা হোক। তিনিই ইসরাইলের বাদশাহ্‌।” পাক-কিতাবের কথামত ঈসা একটা গাধা দেখতে পেয়ে তার উপরে বসলেন। কিতাবে লেখা আছে, “হে সিয়োন্তকন্যা, ভয় কোরো না। চেয়ে দেখ, তোমার বাদশাহ্‌ গাধার বাচ্চার উপরে চড়ে আসছেন।” ঈসার সাহাবীরা প্রথমে এই সব বুঝতে পারলেন না। পরে ঈসার মহিমা যখন প্রকাশিত হল তখন তাঁদের মনে পড়ল পাক-কিতাবের ঐ কথা তাঁর বিষয়েই লেখা হয়েছিল। তাঁদের আরও মনে পড়ল লোকেরা ঈসার জন্যই ঐ সব করেছিল। লাসারকে কবর থেকে ডেকে জীবিত করে তুলবার সময় যে সব লোক ঈসার কাছে ছিল তারাই লাসারের জীবিত হয়ে উঠবার বিষয় সাক্ষ্য দিতে লাগল। সেইজন্যই লোকেরা ঈসাকে এগিয়ে আনতে গিয়েছিল, কারণ তারা শুনেছিল ঈসাই সেই অলৌকিক কাজটা করেছেন। এ দেখে ফরীশীরা একে অন্যকে বললেন, “আমাদের কোন লাভই হচ্ছে না। দেখ, সারা দুনিয়া তার দলে চলে গেছে।” সেই ঈদে যারা এবাদত করতে এসেছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন গ্রীকও ছিল। তারা ফিলিপের কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করে বলল, “এই যে শুনুন, আমরা ঈসাকে দেখতে চাই।” ফিলিপ ছিলেন গালীল প্রদেশের বৈৎসৈদা গ্রামের লোক। ফিলিপ গিয়ে কথাটা আন্দ্রিয়কে বললেন। পরে আন্দ্রিয় আর ফিলিপ গিয়ে ঈসাকে বললেন। ঈসা তখন আন্দ্রিয় ও ফিলিপকে বললেন, “ইব্‌ন্তেআদমের মহিমা প্রকাশিত হবার সময় এসেছে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, গমের বীজ মাটিতে পড়ে যদি না মরে তবে একটাই বীজ থাকে, কিন্তু যদি মরে তবে প্রচুর ফসল জন্মায়। যে নিজের প্রাণকে বেশী ভালবাসে সে তার সত্যিকারের জীবন হারায়, কিন্তু যে এই দুনিয়াতে তা করে না সে তার সত্যিকারের জীবন অনন্ত জীবনের জন্য রক্ষা করবে। কেউ যদি আমার সেবা করতে চায় তবে সে আমার পথে চলুক। আমি যেখানে আছি আমার সেবাকারীও সেখানে থাকবে। কেউ যদি আমার সেবা করে তবে পিতা তাকে সম্মান দান করবেন। “আমার মন এখন অস্থির হয়ে উঠেছে। আমি কি এই কথাই বলব, ‘পিতা, যে সময় এসেছে সেই সময়ের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর’? কিন্তু এরই জন্য তো আমি এই সময় পর্যন্ত এসেছি। পিতা, তোমার মহিমা প্রকাশ কর।” বেহেশত থেকে তখন এই কথা শোনা গেল, “আমি আমার মহিমা প্রকাশ করেছি এবং আবার তা প্রকাশ করব।” যে লোকেরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তারা তা শুনে বলল, “ওটা মেঘের ডাক।” কেউ কেউ আবার বলল, “কোন ফেরেশতা উনার সংগে কথা বললেন।” এতে ঈসা বললেন, “এই কথা আমার জন্য বলা হয় নি, কিন্তু আপনাদের জন্যই বলা হয়েছে। এই দুনিয়ার লোকদের বিচারের সময় এবার এসেছে, আর দুনিয়ার কর্তার হাত থেকে এখন প্রভুত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। আমাকে যখন মাটি থেকে উঁচুতে তোলা হবে তখন আমি সবাইকে আমার কাছে টেনে আনব।” তাঁর কি রকমের মৃত্যু হবে তা বুঝাবার জন্য তিনি এই কথা বললেন। তখন লোকেরা ঈসাকে বলল, “আমরা পাক-কিতাব থেকে শুনেছি মসীহ্‌ চিরকাল থাকবেন। তবে আপনি কি করে বলছেন যে, ইব্‌ন্তেআদমকে উঁচুতে তুলতে হবে? তাহলে এই ইব্‌ন্তেআদম কে?” ঈসা তাদের বললেন, “আর অল্প সময়ের জন্য নূর আপনাদের সংগে সংগে আছে। নূর আপনাদের কাছে থাকতে থাকতেই চলতে থাকুন যেন অন্ধকার আপনাদের জয় করতে না পারে। যে অন্ধকারে চলে সে কোথায় যাচ্ছে তা জানে না। নূর আপনাদের কাছে থাকতে থাকতেই নূরের উপর ঈমান আনুন যেন আপনারা সেই নূরের লোক হতে পারেন।” এই সব কথা বলবার পর ঈসা লোকদের কাছ থেকে চলে গিয়ে নিজেকে গোপন করলেন। যদিও তিনি তাদের সামনে চিহ্ন হিসাবে এতগুলো অলৌকিক কাজ করেছিলেন তবুও লোকেরা তাঁর উপর ঈমান আনে নি। এটা হয়েছিল যেন নবী ইশাইয়ার বলা এই কথা পূর্ণ হয়: মাবুদ, আমাদের দেওয়া খবরে কে বিশ্বাস করেছে? কার কাছেই বা মাবুদের শক্তিশালী হাত প্রকাশিত হয়েছেন? সেই লোকেরা এইজন্যই ঈমান আনতে পারে নি, কারণ ইশাইয়া নবী যেমন বলেছেন সেই অনুসারে “আল্লাহ্‌ তাদের চোখ বন্ধ করেছেন আর দিল অসাড় করেছেন, যাতে তারা চোখ দিয়ে না দেখে ও দিল দিয়ে না বোঝে, আর সুস্থ হবার জন্য তাঁর কাছে ফিরে না আসে।” নবী ইশাইয়া ঈসার মহিমা দেখেছিলেন বলে তাঁর বিষয়ে এই কথা বলেছিলেন। তবুও নেতাদের মধ্যে অনেকে তাঁর উপর ঈমান আনলেন, কিন্তু ফরীশীরা সমাজ থেকে তাঁদের বের করে দেবেন সেই ভয়ে তাঁরা তা স্বীকার করলেন না। তাঁরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার চেয়ে মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে বেশী ভালবাসতেন। পরে ঈসা জোরে জোরে বললেন, “যে আমার উপর ঈমান আনে সে যে কেবল আমার উপর ঈমান আনে তা নয়, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর উপরও ঈমান আনে। যে আমাকে দেখে, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সে তাঁকেই দেখে। আমি এই দুনিয়াতে নূর হিসাবে এসেছি যেন আমার উপর যে ঈমান আনে সে অন্ধকারে না থাকে। যদি কেউ আমার কথা শুনে সেইমত না চলে তবে আমি নিজে তার বিচার করি না, কারণ আমি মানুষকে দোষী প্রমাণ করতে আসি নি বরং মানুষকে নাজাত দিতে এসেছি। যে আমাকে অগ্রাহ্য করে এবং আমার কথা না শোনে তার জন্য বিচারকর্তা আছে। যে কথা আমি বলেছি সেই কথাই শেষ দিনে তাকে দোষী বলে প্রমাণ করবে; কারণ আমি তো নিজে থেকে কিছু বলি নি, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সেই পিতা নিজেই আমাকে হুকুম দিয়েছেন কি কি বলতে হবে। আমি জানি তাঁর হুকুমই অনন্ত জীবন। এইজন্য আমি যে সব কথা বলি তা আমার পিতার হুকুম মতই বলি।” উদ্ধার-ঈদের কিছু আগের ঘটনা। ঈসা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই দুনিয়া ছেড়ে পিতার কাছে যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে। এই দুনিয়াতে যাঁরা তাঁর নিজের লোক ছিলেন তাঁদের তিনি মহব্বত করতেন এবং শেষ পর্যন্তই মহব্বত করেছিলেন। তখন খাবার সময়। এর আগেই ইবলিস শিমোনের ছেলে এহুদা ইষ্কারিয়োতের মনে ঈসাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবার ইচ্ছা জাগিয়ে দিয়েছিল। ঈসা জানতেন, পিতা তাঁর হাতে সব কিছুই দিয়েছেন। তিনি আরও জানতেন যে, তিনি আল্লাহ্‌রই কাছ থেকে এসেছেন এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাচ্ছেন। এইজন্য তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠলেন আর উপরের কাপড় খুলে ফেলে একটা গামছা নিয়ে কোমরে জড়ালেন। তারপর তিনি গামলায় পানি ঢেলে সাহাবীদের পা ধোয়াতে লাগলেন এবং কোমরে জড়ানো গামছা দিয়ে তা মুছে দিতে লাগলেন। এইভাবে ঈসা যখন শিমোন্তপিতরের কাছে আসলেন তখন পিতর তাঁকে বললেন, “হুজুর, আপনি কি আমার পা ধুইয়ে দেবেন?” ঈসা জবাব দিলেন, “আমি যা করছি তা এখন তুমি বুঝতে পারছ না কিন্তু পরে বুঝতে পারবে।” পিতর তাঁকে বললেন, “আপনি কখনও আমার পা ধুইয়ে দেবেন না।” ঈসা পিতরকে বললেন, “যদি আমি তোমাকে ধুইয়ে না দিই তবে আমার সংগে তোমার কোন সম্বন্ধ নেই।” তখন শিমোন্তপিতর বললেন, “হুজুর, তাহলে কেবল আমার পা নয়, আমার হাত আর মাথাও ধুইয়ে দিন।” ঈসা তাঁকে বললেন, “যে গোসল করেছে তার পা ছাড়া আর কিছুই ধোয়ার দরকার নেই, কারণ তার আর সব কিছু পরিষ্কার আছে। তোমরা অবশ্য পরিষ্কার আছ, কিন্তু সকলে নও।” কে তাঁকে ধরিয়ে দেবে তা তিনি জানতেন। সেইজন্যই তিনি বললেন, “তোমরা সকলে পরিষ্কার নও।” সাহাবীদের সকলের পা ধোয়াবার পরে ঈসা তাঁর উপরের কাপড় পরে আবার বসলেন এবং তাঁদের বললেন, “আমি কি করলাম তা কি তোমরা বুঝতে পারলে? তোমরা আমাকে ওস্তাদ ও প্রভু বলে ডাক, আর তা ঠিকই বল কারণ আমি তা-ই। কিন্তু আমি প্রভু আর ওস্তাদ হয়েও যখন তোমাদের পা ধুইয়ে দিলাম তখন তোমাদেরও একে অন্যের পা ধোয়ানো উচিত। আমি তোমাদের কাছে এটা করে দেখিয়েছি, যেন তোমাদের প্রতি আমি যা করলাম তোমরাও তা কর। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, গোলাম তার মালিক থেকে বড় নয়। যাকে পাঠানো হয়েছে সে তাঁর চেয়ে বড় নয় যিনি তাকে পাঠিয়েছেন। এই সব জেনে যদি তা পালন কর তবে তোমরা ধন্য। “আমি তোমাদের সকলের কথা বলছি না। আমি যাদের বেছে নিয়েছি তাদের তো আমি জানি। কিন্তু পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হতেই হবে, ‘যে আমার সংগেই খাওয়া-দাওয়া করে, সে-ও আমার বিরুদ্ধে পা উঠিয়েছে।’ এটা ঘটবার আগেই আমি তোমাদের বলছি, যেন ঘটলে পর তোমরা বিশ্বাস করতে পার যে, আমিই সেই। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আমি যাকে পাঠাই, যে তাকে গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে, আর যে আমাকে গ্রহণ করে, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সে তাঁকেই গ্রহণ করে।” এই সব কথা বলবার পরে ঈসা দিলে অস্থির হলেন। তিনি খোলাখুলিভাবে বললেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমাদেরই মধ্যে একজন আমাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে।” ঈসা কার কথা বলছেন তা বুঝতে না পেরে সাহাবীরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁকে ঈসা মহব্বত করতেন তিনি ঈসার বুকের কাছেই ছিলেন। শিমোন্তপিতর তাঁকে ইশারা করে বললেন, “উনি কার কথা বলছেন জিজ্ঞাসা কর।” সেই সাহাবী তখন ঈসার দিকে ঝুঁকে বললেন, “হুজুর, সে কে?” ঈসা জবাব দিলেন, “এই রুটির টুকরাটা গামলাতে ডুবিয়ে যাকে দেব সে-ই সেই লোক।” আর তিনি রুটির টুকরাটা গামলাতে ডুবিয়ে শিমোন ইষ্কারিয়োতের ছেলে এহুদাকে দিলেন। রুটির টুকরাটা নেবার পরেই শয়তান এহুদার মধ্যে ঢুকল। ঈসা তাকে বললেন, “যা করবে তাড়াতাড়ি কর।” যাঁরা ঈসার সংগে খাচ্ছিলেন তাঁরা কেউই বুঝলেন না কেন তিনি এহুদাকে এই কথা বললেন। কেউ কেউ ভাবলেন, ঈদের জন্য যা দরকার ঈসা এহুদাকে তা কিনে আনতে বললেন কিংবা গরীবদের কিছু দিতে বললেন, কারণ তাঁদের টাকার বাক্স এহুদার কাছেই থাকত। রুটির টুকরাটা নেওয়ার সংগে সংগে এহুদা বাইরে চলে গেল। তখন রাত হয়েছে। এহুদা বাইরে চলে যাওয়ার পর ঈসা বললেন, “ইব্‌ন্তেআদমের মহিমা প্রকাশিত হবার সময় এসেছে এবং তাঁর মধ্যে আল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশ পাবে। আল্লাহ্‌র মহিমা যখন তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হবে তখন আল্লাহ্‌ও ইব্‌ন্তেআদমের মহিমা নিজের মধ্যে প্রকাশ করবেন এবং তা তিনি শীঘ্রই করবেন। “সন্তানেরা, আর অল্প সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি। তোমরা আমাকে খুঁজবে, কিন্তু আমি ইহুদী নেতাদের যেমন বলেছিলাম, ‘আমি যেখানে যাচ্ছি আপনারা সেখানে আসতে পারেন না,’ তেমনি তোমাদেরও এখন তা-ই বলছি। একটা নতুন হুকুম আমি তোমাদের দিচ্ছি- তোমরা একে অন্যকে মহব্বত কোরো। আমি যেমন তোমাদের মহব্বত করেছি তেমনি তোমরাও একে অন্যকে মহব্বত কোরো। যদি তোমরা একে অন্যকে মহব্বত কর তবে সবাই বুঝতে পারবে তোমরা আমার সাহাবী।” শিমোন্তপিতর ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” ঈসা জবাব দিলেন, “আমি যেখানে যাচ্ছি তোমরা এখন আমার সংগে সেখানে আসতে পার না, কিন্তু পরে তোমরা আসবে।” পিতর তাঁকে বললেন, “হুজুর, কেন এখন আপনার সংগে যেতে পারি না? আপনার জন্য আমি আমার প্রাণও দেব।” তখন ঈসা বললেন, “সত্যিই কি আমার জন্য তুমি তোমার প্রাণ দেবে? আমি তোমাকে সত্যিই বলছি, মোরগ ডাকবার আগেই তুমি তিনবার বলবে যে, তুমি আমাকে চেন না। “তোমাদের মন যেন আর অস্থির না হয়। আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস কর, আমার উপরেও বিশ্বাস কর। আমার পিতার বাড়ীতে থাকবার অনেক জায়গা আছে। তা না থাকলে আমি তোমাদের বলতাম, কারণ আমি তোমাদের জন্য জায়গা ঠিক করতে যাচ্ছি। আমি গিয়ে তোমাদের জন্য জায়গা ঠিক করে আবার আসব আর আমার কাছে তোমাদের নিয়ে যাব, যেন আমি যেখানে থাকি তোমরাও সেখানে থাকতে পার। আমি কোথায় যাচ্ছি তার পথ তো তোমরা জান।” থোমা ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আপনি কোথায় যাচ্ছেন তা-ই আমরা জানি না, তবে পথ কি করে জানব?” ঈসা থোমাকে বললেন, “আমিই পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না। তোমরা যদি আমাকে জানতে তবে আমার পিতাকেও জানতে। এখন তোমরা তাঁকে জেনেছ আর তাঁকে দেখতেও পেয়েছ।” ফিলিপ ঈসাকে বললেন, “হুজুর, পিতাকে আমাদের দেখান, তাতেই আমরা সন্তুষ্ট হব।” ঈসা তাঁকে বললেন, “ফিলিপ, এতদিন আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি, তবুও কি তুমি আমাকে জানতে পার নি? যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকেও দেখেছে। তুমি কেমন করে বলছ, ‘পিতাকে আমাদের দেখান’? তুমি কি বিশ্বাস কর না যে, আমি পিতার মধ্যে আছি আর পিতা আমার মধ্যে আছেন? যে সব কথা আমি তোমাদের বলি তা আমি নিজে থেকে বলি না, কিন্তু পিতা, যিনি আমার মধ্যে আছেন, তিনিই তাঁর কাজ করছেন। আমার কথায় বিশ্বাস কর যে, আমি পিতার মধ্যে আছি আর পিতা আমার মধ্যে আছেন। তা না হলে অন্ততঃ আমার এই সব কাজের জন্য আমাকে বিশ্বাস কর। “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি কেউ আমার উপর ঈমান আনে তবে আমি যে সব কাজ করি সেও তা করবে। আর আমি পিতার কাছে যাচ্ছি বলে সে এই সবের চেয়েও আরও বড় বড় কাজ করবে। তোমরা আমার নামে যা কিছু চাইবে তা আমি করব, যেন পিতার মহিমা পুত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আমার নামে যদি আমার কাছে কিছু চাও তবে আমি তা করব। “তোমরা যদি আমাকে মহব্বত কর তবে আমার সমস্ত হুকুম পালন করবে। আমি পিতার কাছে চাইব, আর তিনি তোমাদের কাছে চিরকাল থাকবার জন্য আর একজন সাহায্যকারীকে পাঠিয়ে দেবেন। সেই সাহায্যকারীই সত্যের রূহ্‌। দুনিয়ার লোকেরা তাঁকে গ্রহণ করতে পারে না, কারণ তারা তাঁকে দেখতে পায় না এবং তাঁকে জানেও না। তোমরা কিন্তু তাঁকে জান, কারণ তিনি তোমাদের সংগে সংগে থাকেন আর তোমাদের দিলে বাস করবেন। “আমি তোমাদের এতিম অবস্থায় রেখে যাব না; আমি তোমাদের কাছে আসব। অল্প সময় পরে দুনিয়ার লোকেরা আর আমাকে দেখতে পাবে না, কিন্তু তোমরা দেখতে পাবে। আমি জীবিত আছি বলে তোমরাও জীবিত থাকবে। সেই দিন তোমরা জানতে পারবে যে, আমি পিতার সংগে যুক্ত আছি আর তোমরা আমার সংগে যুক্ত আছ এবং আমি তোমাদের সংগে যুক্ত আছি। যে আমার সব হুকুম জানে ও পালন করে সে-ই আমাকে মহব্বত করে। যে আমাকে মহব্বত করে আমার পিতা তাকে মহব্বত করবেন। আমিও তাকে মহব্বত করব আর তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করব।” তখন এহুদা (ইষ্কারিয়োৎ নয়) তাঁকে বললেন, “হুজুর, কেন আপনি কেবল আমাদেরই কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন, দুনিয়ার লোকদের কাছে করবেন না?” ঈসা তাঁকে জবাব দিলেন, “যদি কেউ আমাকে মহব্বত করে তবে সে আমার কথার বাধ্য হয়ে চলবে। আমার পিতা তাকে মহব্বত করবেন এবং আমরা তার কাছে আসব আর তার সংগে বাস করব। যে আমাকে মহব্বত করে না সে আমার কথার বাধ্য হয়ে চলে না। যে কথা তোমরা শুনছ তা আমার কথা নয় কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সেই পিতারই কথা। তোমাদের সংগে থাকতে থাকতেই এই সব কথা আমি তোমাদের বলেছি। সেই সাহায্যকারী, অর্থাৎ পাক-রূহ্‌ যাঁকে পিতা আমার নামে পাঠিয়ে দেবেন, তিনিই সব বিষয়ে তোমাদের শিক্ষা দেবেন, আর আমি তোমাদের যা কিছু বলেছি সেই সব তোমাদের মনে করিয়ে দেবেন। “আমি তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, আমারই শান্তি আমি তোমাদের দিচ্ছি; দুনিয়া যেভাবে দেয় আমি সেইভাবে দিই না। তোমাদের মন যেন অস্থির না হয় এবং মনে ভয়ও না থাকে। তোমরা শুনেছ আমি তোমাদের বলেছি, ‘আমি চলে যাচ্ছি এবং আবার তোমাদের কাছে আসব।’ তোমরা যদি আমাকে মহব্বত করতে তবে আমি আমার পিতার কাছে যাচ্ছি বলে খুশী হতে, কারণ পিতা আমার চেয়েও মহান। এই সব ঘটবার আগেই আমি তোমাদের বলে রাখলাম যেন ঘটলে পর তোমরা বিশ্বাস করতে পার। আমি তোমাদের সংগে আর বেশীক্ষণ কথা বলব না, কারণ দুনিয়ার কর্তা আসছে। আমার উপরে তার কোন অধিকার নেই। কিন্তু এ ঘটছে যেন লোকেরা জানতে পারে যে, আমি পিতাকে মহব্বত করি এবং পিতা আমাকে যেমন হুকুম দিয়েছেন আমি সব কিছু তেমনই করে থাকি। এবার ওঠো, আমরা এখান থেকে যাই। “আমিই আসল আংগুর গাছ আর আমার পিতা মালী। আমার যে সব ডালে ফল ধরে না সেগুলো তিনি কেটে ফেলেন, আর যে সব ডালে ফল ধরে সেগুলো তিনি ছেঁটে পরিষ্কার করেন যেন আরও অনেক ফল ধরতে পারে। আমি যে কথা তোমাদের বলেছি তার জন্য তোমরা আগেই পরিষ্কার হয়েছ। আমার মধ্যে থাক আর আমিও তোমাদের দিলে থাকব। আংগুর গাছে যুক্ত না থাকলে যেমন ডাল নিজে নিজে ফল ধরাতে পারে না তেমনি আমার মধ্যে না থাকলে তোমরাও নিজে নিজে ফল ধরাতে পার না। “আমিই আংগুর গাছ, আর তোমরা তার ডালপালা। যদি কেউ আমার মধ্যে থাকে এবং আমি তার মধ্যে থাকি তবে তার জীবনে অনেক ফল ধরে, কারণ আমাকে ছাড়া তোমরা কিছুই করতে পার না। যদি কেউ আমার মধ্যে না থাকে তবে কাটা ডালের মতই তাকে বাইরে ফেলে দেওয়া হয় আর তা শুকিয়ে যায়। তখন সেই ডালগুলো কুড়িয়ে আগুনে ফেলে দেওয়া হয় এবং সেগুলো পুড়ে যায়। যদি তোমরা আমার মধ্যে থাক আর আমার কথাগুলো তোমাদের দিলে থাকে তবে তোমাদের যা ইচ্ছা তা-ই চেয়ো; তোমাদের জন্য তা করা হবে। যদি তোমাদের জীবনে প্রচুর ফল ধরে এবং এইভাবে তোমরা নিজেদের আমার সাহাবী বলে প্রমাণ কর তবে আমার পিতার প্রশংসা হবে। পিতা যেমন আমাকে মহব্বত করেছেন আমিও তেমনি তোমাদের মহব্বত করেছি। আমার মহব্বতের মধ্যে থাক। আমি আমার পিতার সমস্ত হুকুম পালন করে যেমন তাঁর মহব্বতের মধ্যে রয়েছি, তেমনি তোমরাও যদি আমার হুকুম পালন কর তবে তোমরাও আমার মহব্বতের মধ্যে থাকবে। “এই সব কথা আমি তোমাদের বললাম যেন আমার আনন্দ তোমাদের অন্তরে থাকে ও তোমাদের আনন্দ পূর্ণ হয়। আমার হুকুম এই, আমি যেমন তোমাদের মহব্বত করেছি তেমনি তোমরাও একে অন্যকে মহব্বত কোরো। কেউ যদি তার বন্ধুদের জন্য নিজের প্রাণ দেয় তবে তার চেয়ে বেশী মহব্বত আর কারও নেই। যে সব হুকুম আমি তোমাদের দিই তা যদি তোমরা পালন কর তবেই তোমরা আমার বন্ধু। আমি তোমাদের আর গোলাম বলি না, কারণ মালিক কি করেন গোলাম তা জানে না; বরং আমি তোমাদের বন্ধু বলেছি, কারণ আমি পিতার কাছ থেকে যা কিছু শুনেছি তা তোমাদের জানিয়েছি। তোমরা আমাকে বেছে নাও নি, কিন্তু আমিই তোমাদের বেছে নিয়ে কাজে লাগিয়েছি যাতে তোমাদের জীবনে ফল ধরে আর তোমাদের সেই ফল যেন টিকে থাকে। তাহলে আমার নামে পিতার কাছে যা কিছু চাইবে তা তিনি তোমাদের দেবেন। এই হুকুম আমি তোমাদের দিচ্ছি যে, তোমরা একে অন্যকে মহব্বত কোরো। “দুনিয়ার লোকেরা তোমাদের ঘৃণা করে, কিন্তু মনে রেখো, তার আগে তারা আমাকেই ঘৃণা করেছে। যদি তোমরা এই দুনিয়ার হতে তবে লোকেরা তাদের নিজেদের বলে তোমাদের ভালবাসত। কিন্তু তোমরা এই দুনিয়ার নও, বরং আমি তোমাদের দুনিয়ার মধ্য থেকে বেছে নিয়েছি বলে দুনিয়ার লোকেরা তোমাদের ঘৃণা করে। আমার এই কথাটা তোমরা ভুলে যেয়ো না যে, গোলাম তার মালিকের চেয়ে বড় নয়। সেইজন্য লোকেরা যদি আমাকে হত্যা করবার চেষ্টা করে থাকে তবে তোমাদেরও তা-ই করবে; যদি তারা আমার কথা শুনে থাকে তবে তোমাদের কথাও শুনবে। তারা আমার জন্য তোমাদের প্রতি এই সব করবে, কারণ যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তারা তাঁকে জানে না। “আমি যদি না আসতাম ও তাদের কাছে কথা না বলতাম তবে তাদের দোষ হত না; কিন্তু এখন গুনাহের জন্য তাদের কোন অজুহাত নেই। যে আমাকে ঘৃণা করে সে আমার পিতাকেও ঘৃণা করে। যে সব কাজ আর কেউ কখনও করে নি সেই কাজ যদি আমি তাদের মধ্যে না করতাম তবে তাদের দোষ হত না। কিন্তু এখন তারা আমাকে আর আমার পিতাকে দেখেছে এবং ঘৃণাও করেছে। এটা হয়েছে যাতে তাদের শরীয়তে লেখা এই কথা পূর্ণ হয়, ‘তারা অকারণে আমাকে ঘৃণা করেছে।’ “যে সাহায্যকারীকে আমি পিতার কাছ থেকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব, তিনি যখন আসবেন তখন তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। ইনি হলেন সত্যের রূহ্‌ যিনি পিতার কাছ থেকে আসবেন। আর তোমরাও আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবে, কারণ প্রথম থেকেই তোমরা আমার সংগে সংগে আছ। “আমি তোমাদের এই সব কথা বললাম যেন তোমরা মনে বাধা না পাও। লোকেরা মজলিস-খানা থেকে তোমাদের বের করে দেবে; এমন কি, সময় আসছে যখন তোমাদের যারা হত্যা করবে তারা মনে করবে যে, তারা আল্লাহ্‌র এবাদতই করছে। তারা এই সব করবে কারণ তারা পিতাকেও জানে নি, আমাকেও জানে নি। আমি তোমাদের এই সব বললাম যেন সেই সময় আসলে পর তোমাদের মনে পড়ে যে, আমি তোমাদের এই কথা বলেছিলাম। “আমি প্রথম থেকে এই সব কথা তোমাদের বলি নি, কারণ আমি তোমাদের সংগে সংগেই ছিলাম। যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন আমি এখন তাঁর কাছে যাচ্ছি, আর তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসাও করছে না, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ আমি তোমাদের এই সব বলেছি বলে বরং তোমাদের মন দুঃখে পূর্ণ হয়েছে। তবুও আমি তোমাদের সত্যি কথা বলছি যে, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল, কারণ আমি না গেলে সেই সাহায্যকারী তোমাদের কাছে আসবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই তবে তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব। তিনি এসে গুনাহ্‌ সম্বন্ধে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলা সম্বন্ধে এবং আল্লাহ্‌র বিচার সম্বন্ধে লোকদের চেতনা দেবেন। তিনি গুনাহ্‌ সম্বন্ধে চেতনা দেবেন, কারণ লোকেরা আমার উপর ঈমান আনে না; আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলা সম্বন্ধে চেতনা দেবেন, কারণ আমি পিতার কাছে যাচ্ছি ও তোমরা আমাকে আর দেখতে পাবে না; বিচার সম্বন্ধে চেতনা দেবেন, কারণ দুনিয়ার কর্তার বিচার হয়ে গেছে। “তোমাদের কাছে আরও অনেক কথা আমার বলবার আছে, কিন্তু এখন তোমরা সেগুলো সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু সেই সত্যের রূহ্‌ যখন আসবেন তখন তিনি তোমাদের পথ দেখিয়ে পূর্ণ সত্যে নিয়ে যাবেন। তিনি নিজ থেকে কথা বলবেন না, কিন্তু যা কিছু শোনেন তা-ই বলবেন, আর যা কিছু ঘটবে তাও তিনি তোমাদের জানাবেন। সেই সত্যের রূহ্‌ আমারই মহিমা প্রকাশ করবেন, কারণ আমি যা করি ও বলি তা-ই তিনি তোমাদের কাছে প্রকাশ করবেন। পিতার যা আছে তা সবই আমার। সেইজন্যই আমি বলেছি, আমি যা করি ও বলি তা-ই তিনি তোমাদের কাছে প্রকাশ করবেন। “কিছু কাল পরে আর তোমরা আমাকে দেখতে পাবে না, আবার কিছু কাল পরে তোমরা আমাকে দেখতে পাবে।” এই কথা শুনে ঈসার সাহাবীদের মধ্যে কয়েকজন বলাবলি করতে লাগলেন, “ইনি আমাদের এ কি বলছেন, ‘কিছু কাল পরে তোমরা আর আমাকে দেখতে পাবে না, আবার কিছু কাল পরে তোমরা আমাকে দেখতে পাবে’? আবার তিনি বলছেন, ‘আমি পিতার কাছে যাচ্ছি।’ যে কিছু কালের কথা ইনি বলছেন, তা কি? আমরা বুঝতে পারছি না তিনি কি বলছেন।” সাহাবীরা যে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইছেন, তা বুঝতে পেরে ঈসা তাঁদের বললেন, “আমি যে বলেছি, ‘কিছু কাল পরে তোমরা আমাকে আর দেখতে পাবে না, আবার কিছু কাল পরে তোমরা আমাকে দেখতে পাবে,’ এই বিষয়েই কি তোমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছ? আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা কাঁদবে আর দুঃখে ভেংগে পড়বে কিন্তু দুনিয়ার লোকেরা আনন্দ করবে। তোমরা দুঃখ পাবে, কিন্তু পরে তোমাদের সেই দুঃখ আর থাকবে না; তার বদলে তোমরা আনন্দিত হবে। সন্তান হওয়ার সময় স্ত্রীলোক কষ্ট পায়, কারণ তার সময় এসে পড়েছে। কিন্তু সন্তান হওয়ার পরে দুনিয়াতে একটি নতুন মানুষ আসবার আনন্দে তার আর সেই কষ্টের কথা মনে থাকে না। সেইভাবে তোমরাও এখন দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছ; কিন্তু আবার তোমাদের সংগে আমার দেখা হবে, আর তখন তোমাদের মন আনন্দে ভরে উঠবে এবং সেই আনন্দ কেউ তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে না। সেই দিনে তোমরা আমাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করবে না। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, তোমরা আমার নামে পিতার কাছে যা কিছু চাইবে তা তিনি তোমাদের দেবেন। এখনও পর্যন্ত তোমরা আমার নামে কিছুই চাও নি। চাও, তোমরা পাবে যেন তোমাদের আনন্দ পূর্ণ হয়। “এই সব শিক্ষার কথা আমি তোমাদের কাছে উদাহরণের মধ্য দিয়েই বললাম। তবে এমন সময় আসছে যখন আমি আর উদাহরণের মধ্য দিয়ে তোমাদের কাছে কথা বলব না, কিন্তু খোলাখুলিভাবেই পিতার বিষয়ে বলব। সেই দিনে তোমরা নিজেরাই আমার নামে চাইবে, আর আমি বলছি না যে, আমিই তোমাদের পক্ষ হয়ে পিতার কাছে অনুরোধ করব। পিতা নিজেই তো তোমাদের মহব্বত করেন, কারণ তোমরা আমাকে মহব্বত করেছ ও বিশ্বাস করেছ যে, আমি পিতার কাছ থেকে এসেছি। সত্যিই আমি পিতার কাছ থেকে এই দুনিয়াতে এসেছি, আবার আমি এই দুনিয়া ছেড়ে পিতার কাছেই যাচ্ছি।” তখন ঈসার সাহাবীরা তাঁকে বললেন, “দেখুন, এখন তো আপনি খোলাখুলিভাবেই কথা বলছেন, উদাহরণের মধ্য দিয়ে বলছেন না। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, আপনার অজানা কিছুই নেই, আর কেউ যে আপনাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করে তার দরকারও আপনার নেই। এইজন্যই আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছেন।” ঈসা তাঁর সাহাবীদের বললেন, “এখন কি তাহলে বিশ্বাস হচ্ছে? দেখ, সেই সময় আসছে, এমন কি এসেই গেছে, যখন তোমরা দলছাড়া হয়ে আমাকে একলা ফেলে যে যার জায়গায় চলে যাবে। তবুও আমি একা নই, কারণ পিতা আমার সংগে সংগে আছেন। আমি তোমাদের এই সব বললাম যেন তোমরা আমার সংগে যুক্ত আছ বলে মনে শান্তি পাও। এই দুনিয়াতে তোমরা কষ্ট ও চাপের মুখে আছ, কিন্তু সাহস হারায়ো না; আমিই দুনিয়াকে জয় করেছি।” এই সব কথা বলবার পরে ঈসা আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পিতা, সময় এসেছে। তোমার পুত্রের মহিমা প্রকাশ কর যেন পুত্রও তোমার মহিমা প্রকাশ করতে পারেন। তুমি তাঁকে সমস্ত মানুষের উপরে অধিকার দিয়েছ, যেন যাদের তুমি তাঁর হাতে দিয়েছ তাদের সবাইকে তিনি অনন্ত জীবন দিতে পারেন। তোমাকে, অর্থাৎ একমাত্র সত্য আল্লাহ্‌কে আর তুমি যাঁকে পাঠিয়েছ সেই ঈসা মসীহ্‌কে জানতে পারাই অনন্ত জীবন। তুমি যে কাজ আমাকে করতে দিয়েছ তা শেষ করে এই দুনিয়াতে আমি তোমার মহিমা প্রকাশ করেছি। পিতা, দুনিয়া সৃষ্ট হবার আগে তোমার সংগে আমার যে মহিমা ছিল সেই মহিমা তুমি আবার আমাকে দাও। “দুনিয়ার মধ্য থেকে যাদের তুমি আমাকে দিয়েছ আমি তাদের কাছে তোমাকে প্রকাশ করেছি। তারা তোমারই ছিল, আর তুমি তাদের আমাকে দিয়েছ। তারা তোমার কথার বাধ্য হয়ে চলেছে। তারা এখন বুঝতে পেরেছে, যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তা তোমারই কাছ থেকে এসেছে। এর কারণ এই, তুমি যা যা আমাকে বলতে বলেছ তা আমি তাদের বলেছি। তারা তা গ্রহণ করে সত্যিই জানতে পেরেছে যে, আমি তোমার কাছ থেকে এসেছি, আর বিশ্বাসও করেছে যে, তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ। “আমি সকলের জন্য অনুরোধ করছি না, কিন্তু যাদের তুমি আমার হাতে দিয়েছ তাদের জন্যই অনুরোধ করছি, কারণ তারা তো তোমারই। যা কিছু আমার তা সবই তোমার আর যা কিছু তোমার তা সবই আমার। তাদের মধ্য দিয়ে আমার মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। আমি আর এই দুনিয়াতে নেই, কিন্তু তারা তো এই দুনিয়াতে আছে; আর আমি তোমার কাছে আসছি। পবিত্র পিতা, তুমি আমাকে তোমার যে নাম দিয়েছ সেই নামের গুণে এদের রক্ষা কর, যেন আমরা যেমন এক, এরাও তেমনি এক হতে পারে। আমি যতদিন তাদের সংগে ছিলাম ততদিন তোমার যে নাম তুমি আমাকে দিয়েছ সেই নামের গুণে আমি তাদের রক্ষা করে এসেছি। আমি তাদের পাহারা দিয়েছি, তাদের মধ্যে কেউই বিনষ্ট হয় নি। কেবল যার বিনষ্ট হবার কথা ছিল সে-ই বিনষ্ট হয়েছে, যেন পাক-কিতাবের কথা পূর্ণ হয়। “এখন আমি তোমার কাছে আসছি, আর আমার আনন্দে যেন তাদের দিল পূর্ণ হয় সেইজন্য দুনিয়াতে থাকতেই এই সব কথা বলছি। তুমি যা বলেছ আমি তাদের তা-ই জানিয়েছি। দুনিয়ার লোকেরা তাদের ঘৃণা করেছে, কারণ আমি যেমন এই দুনিয়ার নই তারাও তেমনি এই দুনিয়ার নয়। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি না তুমি এই দুনিয়া থেকে তাদের নিয়ে যাও, বরং অনুরোধ করছি যে, শয়তানের হাত থেকে তাদের রক্ষা কর। আমি যেমন এই দুনিয়ার নই তারাও তেমনি এই দুনিয়ার নয়। “সত্যের দ্বারা তুমি তাদের পাক-পবিত্র কর। তোমার কালামই সেই সত্য। তুমি যেমন আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলে তেমনি আমিও তাদের দুনিয়াতে পাঠিয়েছি। তাদের জন্য আমি নিজেকে পাক-পবিত্র করছি যেন সত্যের দ্বারা তাদেরও পাক-পবিত্র করা হয়। “আমি যে কেবল এদের জন্য অনুরোধ করছি তা নয়, কিন্তু যারা এদের কথার মধ্য দিয়ে আমার উপর ঈমান আনবে তাদের জন্যও অনুরোধ করছি, যেন তারা সকলে এক হয়। পিতা, তুমি যেমন আমার সংগে যুক্ত আছ আর আমি তোমার সংগে যুক্ত আছি তেমনি তারাও যেন আমাদের সংগে যুক্ত থাকতে পারে। তাতে দুনিয়ার লোকেরা বিশ্বাস করতে পারবে যে, তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ। যে মহিমা তুমি আমাকে দিয়েছ তা আমি তাদের দিয়েছি যেন আমরা যেমন এক তারাও তেমনি এক হতে পারে, অর্থাৎ আমি তাদের সংগে যুক্ত ও তুমি আমার সংগে যুক্ত, আর এইভাবে যেন তারা পূর্ণ হয়ে এক হতে পারে। তাতে দুনিয়ার লোকেরা জানতে পারবে যে, তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ, আর আমাকে যেমন তুমি মহব্বত কর তেমনি তাদেরও মহব্বত কর। “পিতা, আমি চাই যাদের তুমি আমাকে দিয়েছ, আমার মহিমা দেখবার জন্য তারা যেন আমি যেখানে আছি সেখানে আমার সংগে থাকতে পারে। সেই মহিমা তুমিই আমাকে দিয়েছ, কারণ দুনিয়া সৃষ্ট হবার আগে থেকেই তুমি আমাকে মহব্বত করেছ। ন্যায়বান পিতা, দুনিয়ার লোকেরা তোমাকে জানে না কিন্তু আমি তোমাকে জানি। আর তুমিই যে আমাকে পাঠিয়েছ এরা তা বুঝতে পেরেছে। আমি তাদের কাছে তোমাকে প্রকাশ করেছি এবং আরও প্রকাশ করব, যেন তুমি আমাকে যেভাবে মহব্বত কর সেই রকম মহব্বত তাদের দিলে থাকে, আর আমি যেন তাদের সংগে যুক্ত থাকি।” এই সব কথা বলবার পরে ঈসা তাঁর সাহাবীদের সংগে কিদ্রোণ নামে একটা উপত্যকার ওপাশে গেলেন। সেখানে একটা বাগান ছিল। ঈসা আর তাঁর সাহাবীরা সেই বাগানে গেলেন। ঈসাকে শত্রুদের হাতে যে পরে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই এহুদাও এই জায়গাটা চিনত, কারণ ঈসা প্রায়ই তাঁর সাহাবীদের সংগে সেখানে এক সংগে মিলিত হতেন। প্রধান ইমামেরা ও ফরীশীরা এহুদাকে এক দল সৈন্য এবং কয়েকজন কর্মচারী দিলেন। তখন এহুদা তাদের সংগে বাতি, মশাল আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। তাঁর নিজের উপর যা ঘটবে ঈসা তা সবই জানতেন। এইজন্য তিনি বের হয়ে এসে সেই লোকদের বললেন, “আপনারা কাকে খুঁজছেন?” তারা বলল, “নাসরতের ঈসাকে।” ঈসা তাদের বললেন, “আমিই সেই।” ঈসাকে যে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই এহুদাও তাদের সংগে দাঁড়িয়েছিল। ঈসা যখন তাদের বললেন, “আমিই সেই,” তখন তারা পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঈসা আবার তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কাকে খুঁজছেন?” তারা বলল, “নাসরতের ঈসাকে।” তখন ঈসা বললেন, “আমি তো আপনাদের বলেছি যে, আমিই সেই। যদি আপনারা আমারই খোঁজে এসে থাকেন তবে এদের চলে যেতে দিন।” এটা ঘটল যাতে ঈসার বলা এই কথাটা পূর্ণ হয়, “যাদের তুমি আমাকে দিয়েছ তাদের একজনকেও আমি হারাই নি।” শিমোন্তপিতরের কাছে একটা ছোরা ছিল। পিতর সেই ছোরাটা বের করে তার আঘাতে মহা-ইমামের গোলামের ডান কানটা কেটে ফেললেন। সেই গোলামের নাম ছিল মল্ক। এতে ঈসা পিতরকে বললেন, “তোমার ছোরা খাপে রাখ। পিতা আমাকে যে দুঃখের পেয়ালা দিয়েছেন তা কি আমি গ্রহণ করব না?” তখন সেই সৈন্যেরা আর তাদের সেনাপতি ও ইহুদী নেতাদের কর্মচারীরা ঈসাকে ধরে বাঁধল। প্রথমে তারা ঈসাকে হাননের কাছে নিয়ে গেল, কারণ যে কাইয়াফা সেই বছরের মহা-ইমাম ছিলেন হানন ছিলেন তাঁর শ্বশুর। এই কাইয়াফাই ইহুদী নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, গোটা জাতির বদলে বরং একজনের মৃত্যু হওয়াই ভাল। শিমোন্তপিতর এবং আর একজন সাহাবী ঈসার পিছনে পিছনে গেলেন। সেই অন্য সাহাবীকে মহা-ইমাম চিনতেন। সেই সাহাবী ঈসার সংগে সংগে মহা-ইমামের উঠানে ঢুকলেন, কিন্তু পিতর বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন মহা-ইমামের চেনা সেই সাহাবী বাইরে গিয়ে দরজার পাহারাদার মেয়েটিকে বলে পিতরকে ভিতরে আনলেন। সেই মেয়েটি পিতরকে বলল, “তুমিও কি এই লোকটির সাহাবীদের মধ্যে একজন?” পিতর বললেন, “না, আমি নই।” তখন খুব শীত পড়েছিল। এইজন্য গোলামেরা এবং কর্মচারীরা কাঠকয়লার আগুন জ্বেলে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আগুন পোহাচ্ছিল। পিতরও তাদের সংগে দাঁড়িয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন। মহা-ইমাম তখন ঈসাকে তাঁর সাহাবীদের বিষয়ে আর তাঁর শিক্ষার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। ঈসা জবাবে বললেন, “আমি লোকদের কাছে খোলাখুলিভাবেই কথা বলেছি। যেখানে ইহুদীরা সবাই এক সংগে মিলিত হয় সেই সব মজলিস-খানায় ও বায়তুল-মোকাদ্দসে আমি সব সময় শিক্ষা দিয়েছি। আমি তো গোপনে কিছু বলি নি; তবে কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন? আমার কথা যারা শুনেছে তাদেরই জিজ্ঞাসা করুন আমি তাদের কি বলেছি। আমি যা বলেছি তা তাদের অজানা নেই। ঈসা যখন এই কথা বললেন তখন যে কর্মচারীরা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মধ্যে একজন তাঁকে চড় মেরে বলল, “তুমি মহা-ইমামকে এইভাবে জবাব দিচ্ছ?” ঈসা তাকে বললেন, “আমি যদি খারাপ কিছু বলে থাকি তবে তা দেখিয়ে দিন। কিন্তু যদি ভাল বলে থাকি তবে কেন আমাকে মারছেন?” তখন হানন ঈসাকে বাঁধা অবস্থায়ই মহা-ইমাম কাইয়াফার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। যখন শিমোন্তপিতর দাঁড়িয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন তখন লোকেরা তাঁকে বলল, “তুমিও কি ওর সাহাবীদের মধ্যে একজন?” পিতর অস্বীকার করে বললেন, “না, আমি নই।” পিতর যার কান কেটে ফেলেছিলেন তার এক আত্মীয় মহা-ইমামের গোলাম ছিল। সে বলল, “আমি কি তোমাকে বাগানে তার সংগে দেখি নি?” পিতর আবার অস্বীকার করলেন, আর তখনই একটা মোরগ ডেকে উঠল। ইহুদী নেতারা ভোর বেলায় ঈসাকে কাইয়াফার কাছ থেকে রোমীয় প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। তাঁরা কিন্তু সেই বাড়ীর ভিতরে ঢুকলেন না যেন পাক-সাফ থেকে উদ্ধার-ঈদের মেজবানী খেতে পারেন। তখন পীলাত বাইরে তাঁদের কাছে এসে বললেন, “এই লোকটিকে তোমরা কি দোষে দোষী করছ?” ইহুদী নেতারা বললেন, “এ যদি খারাপ কাজ না করত তবে আমরা তাকে আপনার কাছে আনতাম না।” পীলাত তাঁদের বললেন, “একে তোমরা নিয়ে গিয়ে তোমাদের শরীয়ত মতে বিচার কর।” এতে ইহুদী নেতারা পীলাতকে বললেন, “কিন্তু কাউকে মৃত্যুর শাস্তি দেবার ক্ষমতা তো আমাদের হাতে নেই।” কিভাবে নিজের মৃত্যু হবে ঈসা আগেই তা বলেছিলেন। এটা ঘটল যাতে তাঁর সেই কথা পূর্ণ হয়। তখন পীলাত আবার বাড়ীর মধ্যে ঢুকলেন এবং ঈসাকে ডেকে বললেন, “তুমিই কি ইহুদীদের বাদশাহ্‌?” ঈসা বললেন, “আপনি কি নিজে থেকেই এই কথা বলছেন, না অন্যেরা আমার বিষয়ে আপনাকে বলেছে?” পীলাত জবাব দিলেন, “আমি কি ইহুদী? তোমার জাতির লোকেরা আর প্রধান ইমামেরা তোমাকে আমার হাতে দিয়েছে। তুমি কি করেছ?” ঈসা বললেন, “আমার রাজ্য এই দুনিয়ার নয়। যদি আমার রাজ্য এই দুনিয়ার হত তবে আমি যাতে ইহুদী নেতাদের হাতে না পড়ি সেইজন্য আমার লোকেরা যুদ্ধ করত; কিন্তু আমার রাজ্য তো এখানকার নয়।” পীলাত ঈসাকে বললেন, “তাহলে তুমি কি বাদশাহ্‌?” ঈসা বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আমি বাদশাহ্‌। সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্য আমি জন্মেছি আর সেইজন্যই আমি দুনিয়াতে এসেছি। যে কেউ সত্যের সে আমার কথা শোনে।” পীলাত তাঁকে বললেন, “সত্য কি?” এই কথা বলে তিনি আবার বাইরে ইহুদী নেতাদের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি এর কোনই দোষ দেখতে পাচ্ছি না। তবে তোমাদের একটা নিয়ম আছে, উদ্ধার-ঈদের সময়ে আমি তোমাদের একজন কয়েদীকে ছেড়ে দিই। তোমরা কি চাও যে, আমি ইহুদীদের বাদশাহ্‌কে ছেড়ে দিই?” এতে সকলে চেঁচিয়ে বলল, “ওকে নয়, বারাব্বাকে।” সেই বারাব্বা একজন ডাকাত ছিল। তখন পীলাত ঈসাকে নিয়ে গিয়ে ভীষণ ভাবে চাবুক মারবার হুকুম দিলেন। সৈন্যেরা কাঁটা-লতা দিয়ে একটা তাজ গেঁথে ঈসার মাথায় পরিয়ে দিল। পরে তাঁকে বেগুনে কাপড় পরাল এবং তাঁর কাছে গিয়ে বলল, “ওহে ইহুদীদের বাদশাহ্‌, মারহাবা!” এই বলে সৈন্যেরা তাঁকে চড় মারতে লাগল। পীলাত আবার বাইরে এসে লোকদের বললেন, “দেখ, আমি ওকে তোমাদের কাছে বের করে আনছি যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, আমি ওর কোন দোষই পাচ্ছি না।” ঈসা সেই কাঁটার তাজ আর বেগুনে কাপড় পরা অবস্থায় বাইরে আসলেন। তখন পীলাত লোকদের বললেন, “এই দেখ, সেই লোক।” ঈসাকে দেখে প্রধান ইমামেরা আর কর্মচারীরা চেঁচিয়ে বললেন, “ক্রুশে দিন, ওকে ক্রুশে দিন।” পীলাত লোকদের বললেন, “তোমরাই ওকে নিয়ে গিয়ে ক্রুশে দাও, কারণ আমি ওর কোন দোষই দেখতে পাচ্ছি না।” ইহুদী নেতারা পীলাতকে বললেন, “আমাদের একটা আইন আছে, সেই আইন মতে তার মৃত্যু হওয়া উচিত, কারণ সে নিজেকে ইব্‌নুল্লাহ্‌ বলেছে।” পীলাত যখন এই কথা শুনলেন তখন তিনি আরও ভয় পেলেন। তিনি আবার বাড়ীর মধ্যে গিয়ে ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোথা থেকে এসেছ?” ঈসা কিন্তু পীলাতকে কোন জবাব দিলেন না। এইজন্য পীলাত ঈসাকে বললেন, “তুমি কি আমার সংগে কথা বলবে না? তুমি কি জান যে, তোমাকে ছেড়ে দেবার বা ক্রুশের উপরে হত্যা করবার ক্ষমতা আমার আছে?” ঈসা জবাব দিলেন, “উপর থেকে আপনাকে ক্ষমতা দেওয়া না হলে আমার উপরে আপনার কোন ক্ষমতাই থাকত না। সেইজন্য যে আমাকে আপনার হাতে দিয়েছে তারই গুনাহ্‌ বেশী।” এই কথা শুনে পীলাত ঈসাকে ছেড়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু ইহুদী নেতারা চেঁচিয়ে বললেন, “আপনি যদি এই লোকটাকে ছেড়ে দেন তবে আপনি সম্রাট সিজারের বন্ধু নন। যে কেউ নিজেকে বাদশাহ্‌ বলে দাবি করে সে তো সম্রাট সিজারের শত্রু।” এই কথা শুনে পীলাত ঈসাকে বাইরে আনলেন এবং পাথরে বাঁধানো নামে একটা জায়গায় বিচারের আসনে বসলেন। হিব্রু ভাষায় সেই জায়গাটাকে গাব্বাথা বলা হত। সেই দিনটা ছিল উদ্ধার-ঈদের আয়োজনের দিন। তখন বেলা প্রায় দুপুর। পীলাত ইহুদী নেতাদের বললেন, “এই দেখ, তোমাদের বাদশাহ্‌।” এতে তাঁরা চিৎকার করে বললেন, “দূর করুন, দূর করুন! ওকে ক্রুশে দিন!” পীলাত তাঁদের বললেন, “তোমাদের বাদশাহ্‌কে কি আমি ক্রুশে দেব?” প্রধান ইমামেরা জবাব দিলেন, “সম্রাট সিজার ছাড়া আমাদের আর কোন বাদশাহ্‌ নেই।” তখন পীলাত ঈসাকে ক্রুশের উপরে হত্যা করবার জন্য তাঁদের হাতে দিয়ে দিলেন। তখন সৈন্যেরা ঈসাকে নিয়ে গেল। ঈসা নিজের ক্রুশ নিজে বয়ে নিয়ে মাথার খুলির স্থান নামে একটা জায়গায় গেলেন। সেই জায়গার হিব্রু নাম ছিল গল্‌গথা। সেখানে তারা ঈসাকে ক্রুশে দিল- ঈসাকে মাঝখানে আর তাঁর দু’পাশে অন্য দু’জনকে দিল। পীলাত একটা দোষনামা লিখে ঈসার ক্রুশের উপরে লাগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, “নাসরতের ঈসা, ইহুদীদের বাদশাহ্‌।” যেখানে ঈসাকে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল সেই জায়গাটা শহরের কাছে ছিল বলে ইহুদীদের অনেকেই সেই দোষনামা পড়ল। সেটা হিব্রু, রোমীয় আর গ্রীক ভাষায় লেখা ছিল। তখন ইহুদীদের প্রধান ইমামেরা পীলাতকে বললেন, “ ‘ইহুদীদের বাদশাহ্‌,’ এই কথা লিখবেন না, বরং লিখুন, ‘এ বলত, আমি ইহুদীদের বাদশাহ্‌।’ ” পীলাত বললেন, “আমি যা লিখেছি তা লিখেছি।” ঈসাকে ক্রুশে দেবার পর সৈন্যেরা তাঁর কাপড়-চোপড় নিয়ে নিজেদের মধ্যে চার ভাগে ভাগ করল। পরে তারা ঈসার কোর্তাটাও নিল। সেই কোর্তায় কোন সেলাই ছিল না, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবটাই বোনা ছিল। তা দেখে সৈন্যেরা একে অন্যকে বলল, “এটা না ছিঁড়ে বরং গুলিবাঁট করে দেখি এটা কার হবে।” এটা ঘটেছিল যাতে পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হয়, তারা নিজেদের মধ্যে আমার কাপড়-চোপড় ভাগ করছে, আর আমার কাপড়ের জন্য তারা গুলিবাঁট করছে। আর সত্যিই সৈন্যেরা এই সব করেছিল। ঈসার মা, তাঁর মায়ের বোন, ক্লোপার স্ত্রী মরিয়ম আর মগ্‌দলীনী মরিয়ম ঈসার ক্রুশের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঈসা তাঁর মাকে এবং যে সাহাবীকে মহব্বত করতেন তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। প্রথমে তিনি মাকে বললেন, “ঐ দেখ, তোমার ছেলে।” তার পরে সেই সাহাবীকে বললেন, “ঐ দেখ, তোমার মা।” তখন থেকেই সেই সাহাবী ঈসার মাকে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। এর পরে সব কিছু শেষ হয়েছে জেনে পাক-কিতাবের কথা যাতে পূর্ণ হয় সেইজন্য ঈসা বললেন, “আমার পিপাসা পেয়েছে।” সেই জায়গায় সিরকায় পূর্ণ একটা পাত্র ছিল। তখন তারা একটা সপঞ্জ সেই সিরকায় ভিজাল এবং এসোব গাছের ডালের মাথায় তা লাগিয়ে ঈসার মুখের কাছে ধরল। ঈসা সেই সিরকা খাওয়ার পরে বললেন, “শেষ হয়েছে।” তারপর তিনি মাথা নীচু করে তাঁর রূহ্‌ সমর্পণ করলেন। সেই দিনটা ছিল ঈদের আয়োজনের দিন। পরের দিন ছিল বিশ্রামবার, আর সেই বিশ্রামবারটা একটা বিশেষ দিন ছিল বলে ইহুদী নেতারা চেয়েছিলেন যেন সেই দিনে লাশগুলো ক্রুশের উপরে না থাকে। এইজন্য তাঁরা পীলাতের কাছে অনুরোধ করলেন যেন ক্রুশে যারা আছে তাদের পা ভেংগে ক্রুশ থেকে তাদের সরিয়ে ফেলা হয়। তখন সৈন্যেরা এসে ঈসার সংগে যাদের ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তাদের দু’জনের পা ভেংগে দিল। পরে ঈসার কাছে এসে সৈন্যেরা তাঁকে মৃত দেখে তাঁর পা ভাংল না। কিন্তু একজন সৈন্য তাঁর পাঁজরে বর্শা দিয়ে খোঁচা মারল, আর তখনই সেখান থেকে রক্ত আর পানি বের হয়ে আসল। যিনি নিজের চোখে এটা দেখেছিলেন তিনিই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আর তাঁর সাক্ষ্য সত্যি। তিনি জানেন যে, তিনি যা বলছেন তা সত্যি, যেন তোমরাও বিশ্বাস করতে পার। এই সব ঘটেছিল যাতে পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হয়, “তাঁর একখানা হাড়ও ভাংগা হবে না।” আবার কিতাবের আর একটা কথা এই- “যাঁকে তারা বিঁধেছে তাঁর দিকে তারা তাকিয়ে দেখবে।” এই সমস্ত ঘটনার পরে অরিমাথিয়া গ্রামের ইউসুফ ঈসার লাশটা নিয়ে যাবার জন্য পীলাতের কাছে অনুমতি চাইলেন। ইউসুফ ছিলেন ঈসার গোপন সাহাবী, কারণ তিনি ইহুদী নেতাদের ভয় করতেন। পীলাত অনুমতি দিলে পর তিনি এসে ঈসার লাশ নিয়ে গেলেন। আগে যিনি রাতের বেলায় ঈসার কাছে এসেছিলেন সেই নীকদীমও প্রায় তেত্রিশ কেজি গন্ধরস ও অগুরু মিশিয়ে নিয়ে আসলেন। পরে তাঁরা ঈসার লাশটি নিয়ে ইহুদীদের দাফন করবার নিয়ম মত সেই সমস্ত খোশবু জিনিসের সংগে লাশটি কাপড় দিয়ে জড়ালেন। ঈসাকে যেখানে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল সেই জায়গায় একটা বাগান ছিল আর সেখানে একটা নতুন কবর ছিল। সেই কবরের মধ্যে কাউকে কখনও দাফন করা হয় নি। সেই দিনটা ছিল ইহুদীদের ঈদের আয়োজনের দিন, আর কবরটাও কাছে ছিল বলে তাঁরা ঈসাকে সেই কবরেই দাফন করলেন। সপ্তার প্রথম দিনের ভোর বেলায়, অন্ধকার থাকতেই মগ্‌দলীনী মরিয়ম সেই কবরের কাছে গেলেন। তিনি দেখলেন, কবরের মুখ থেকে পাথরখানা সরানো হয়েছে। সেইজন্য তিনি শিমোন্তপিতর আর যে সাহাবীকে ঈসা মহব্বত করতেন সেই সাহাবীদের কাছে দৌড়ে গিয়ে বললেন, “লোকেরা হুজুরকে কবর থেকে নিয়ে গেছে। তাঁকে কোথায় রেখেছে আমরা তা জানি না।” পিতর আর সেই অন্য সাহাবীটি তখন বের হয়ে কবরের দিকে যেতে লাগলেন। দু’জন একসংগে দৌড়াচ্ছিলেন। অন্য সাহাবীটি পিতরের আগে আগে আরও তাড়াতাড়ি দৌড়ে প্রথমে কবরের কাছে আসলেন, কিন্তু তিনি কবরের ভিতরে গেলেন না। তিনি নীচু হয়ে দেখলেন, ঈসার লাশে যে কাপড়গুলো জড়ানো হয়েছিল সেগুলো পড়ে আছে। শিমোন্তপিতরও তাঁর পিছনে পিছনে এসে কবরের ভিতরে ঢুকলেন এবং কাপড়গুলো পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি আরও দেখলেন, তাঁর মাথায় যে রুমালখানা জড়ানো ছিল তা অন্য কাপড়ের সংগে নেই, কিন্তু আলাদা করে এক জায়গায় গুটিয়ে রাখা হয়েছে। যে সাহাবী প্রথমে কবরের কাছে পৌঁছেছিলেন তিনিও তখন ভিতরে ঢুকলেন এবং দেখে বিশ্বাস করলেন। মৃত্যু থেকে ঈসার জীবিত হয়ে উঠবার যে দরকার আছে, পাক-কিতাবের সেই কথা তাঁরা আগে বুঝতে পারেন নি। এর পরে সাহাবীরা ঘরে ফিরে গেলেন, কিন্তু মরিয়ম কবরের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে নীচু হয়ে কবরের ভিতরে চেয়ে দেখলেন, ঈসার লাশ যেখানে শোয়ানো ছিল সেখানে সাদা কাপড় পরা দু’জন ফেরেশতা বসে আছেন্ত একজন মাথার দিকে আর অন্যজন পায়ের দিকে। তাঁরা মরিয়মকে বললেন, “কাঁদছ কেন?” মরিয়ম তাঁদের বললেন, “লোকেরা আমার প্রভুকে নিয়ে গেছে এবং তাঁকে কোথায় রেখেছে জানি না।” এই কথা বলে মরিয়ম পিছনে ফিরে দেখলেন ঈসা দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তিনি যে ঈসা তা বুঝতে পারলেন না। ঈসা তাঁকে বললেন, “কাঁদছ কেন? কাকে খুঁজছ?” ঈসাকে বাগানের মালী ভেবে মরিয়ম বললেন, “দেখুন, আপনি যদি তাঁকে নিয়ে গিয়ে থাকেন তবে বলুন কোথায় রেখেছেন। আমিই তাঁকে নিয়ে যাব।” ঈসা তাঁকে বললেন, “মরিয়ম।” তাতে মরিয়ম ফিরে দাঁড়িয়ে আরামীয় ভাষায় ঈসাকে বললেন, “রব্বুনি।” রব্বুনি মানে ওস্তাদ। ঈসা মরিয়মকে বললেন, “আমাকে ধরে রেখো না, কারণ আমি এখনও উপরে পিতার কাছে যাই নি। তুমি বরং ভাইদের কাছে গিয়ে বল, যিনি আমার ও তোমাদের পিতা, যিনি আমার ও তোমাদের আল্লাহ্‌, আমি উপরে তাঁর কাছে যাচ্ছি।” তখন মগ্‌দলীনী মরিয়ম সাহাবীদের কাছে গিয়ে সংবাদ দিলেন, তিনি ঈসাকে দেখেছেন আর ঈসাই তাঁকে এই সব কথা বলেছেন। সেই একই দিনে, সপ্তার প্রথম দিনের সন্ধ্যাবেলায় সাহাবীরা ইহুদী নেতাদের ভয়ে ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ করে এক জায়গায় মিলিত হয়েছিলেন। তখন ঈসা এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম।” এই কথা বলে তিনি তাঁর দুই হাত ও পাঁজরের দিকটা তাঁর সাহাবীদের দেখালেন। ঈসাকে দেখতে পেয়ে সাহাবীরা খুব আনন্দিত হলেন। পরে ঈসা আবার তাঁদের বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম। পিতা যেমন আমাকে পাঠিয়েছেন আমিও তেমনি তোমাদের পাঠাচ্ছি।” এই কথা বলে তিনি সাহাবীদের উপর ফুঁ দিয়ে বললেন, “পাক-রূহ্‌কে গ্রহণ কর। তোমরা যদি কারও গুনাহ্‌ মাফ কর তবে তার গুনাহ্‌ মাফ করা হবে, আর যদি কারও গুনাহ্‌ মাফ না কর তবে তার গুনাহ্‌ মাফ করা হবে না।” ঈসা যখন এসেছিলেন তখন থোমা নামে সেই বারোজন সাহাবীদের মধ্যে একজন তাঁদের সংগে ছিলেন না। এই থোমাকে যমজ বলা হত। অন্য সাহাবীরা পরে থোমাকে বললেন, “আমরা হুজুরকে দেখেছি।” থোমা তাঁদের বললেন, “আমি তাঁর দুই হাতে যদি পেরেকের চিহ্ন না দেখি, সেই চিহ্নের মধ্যে আংগুল না দিই এবং তাঁর পাঁজরে হাত না দিই, তবে কোনমতেই আমি বিশ্বাস করব না।” এর এক সপ্তা পরে সাহাবীরা আবার ঘরের মধ্যে মিলিত হলেন, আর থোমাও তাঁদের সংগে ছিলেন। যদিও সমস্ত দরজা বন্ধ ছিল তবুও ঈসা এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম।” পরে তিনি থোমাকে বললেন, “তোমার আংগুল এখানে দিয়ে আমার হাত দু’খানা দেখ এবং তোমার হাত বাড়িয়ে আমার পাঁজরে রাখ। অবিশ্বাস কোরো না বরং বিশ্বাস কর।” তখন থোমা বললেন, “প্রভু আমার, আল্লাহ্‌ আমার।” ঈসা তাঁকে বললেন, “থোমা, তুমি কি আমাকে দেখেছ বলে ঈমান এনেছ? যারা না দেখে ঈমান আনে তারা ধন্য।” ঈসা সাহাবীদের সামনে চিহ্ন হিসাবে আরও অনেক অলৌকিক কাজ করেছিলেন; সেগুলো এই কিতাবে লেখা হয় নি। কিন্তু এই সব লেখা হল যাতে তোমরা ঈমান আন যে, ঈসাই মসীহ্‌, ইব্‌নুল্লাহ্‌, আর ঈমান এনে যেন তাঁর মধ্য দিয়ে জীবন পাও। এর পরে টিবেরিয়াস সাগরের পারে সাহাবীদের কাছে আবার ঈসা দেখা দিলেন। ঘটনাটা এইভাবে ঘটেছিল: শিমোন্তপিতর, থোমা (যাঁকে যমজ বলে) গালীল প্রদেশের কান্না গ্রামের নথনেল, সিবদিয়ের ছেলেরা এবং ঈসার অন্য দু’জন সাহাবী একসংগে ছিলেন। শিমোন্তপিতর তাঁদের বললেন, “আমি মাছ ধরতে যাচ্ছি।” তাঁরা বললেন, “আমরাও তোমার সংগে যাব।” তখন তাঁরা বের হয়ে নৌকায় উঠলেন, কিন্তু সেই রাতে কিছুই ধরতে পারলেন না। সকাল হয়ে আসছে এমন সময় ঈসা সাগরের পারে এসে দাঁড়ালেন। সাহাবীরা কিন্তু চিনতে পারলেন না যে, তিনি ঈসা। তিনি সাহাবীদের বললেন, “সন্তানেরা, কিছুই কি পাও নি?” তাঁরা বললেন, “জ্বী না, পাই নি।” ঈসা তাঁদের বললেন, “নৌকার ডানদিকে জাল ফেল, পাবে।” তখন তাঁরা জাল ফেললেন, আর এত বেশী মাছ উঠল যে, তাঁরা তা টেনে তুলতে পারলেন না। ঈসা যে সাহাবীকে মহব্বত করতেন সেই সাহাবী পিতরকে বললেন, “উনি হুজুর।” সেই সময় শিমোন্তপিতরের গায়ে কোন কাপড় ছিল না। তাই যখন তিনি শুনলেন, “উনি হুজুর,” তখন গায়ে কাপড় জড়িয়ে সাগরে ঝাঁপ দিলেন। তাঁরা পার থেকে বেশী দূরে ছিলেন না, কমবেশ দু’শো হাত দূরে ছিলেন। এইজন্য অন্য সাহাবীরা মাছে ভরা জালটা টানতে টানতে নৌকায় করে পারে আসলেন। পারে নেমে এসে তাঁরা কাঠকয়লার আগুন এবং আগুনের উপরে মাছ দেখতে পেলেন; সেখানে রুটিও ছিল। তখন ঈসা তাদের বললেন, “এখন যে মাছ ধরলে তা থেকে কয়েকটা আন।” শিমোন্তপিতর নৌকায় গিয়ে জালটা পারে টেনে আনলেন। একশো তিপ্পান্নটা বড় মাছে জালটা ভরা ছিল। যদিও এত মাছ ছিল তবুও জালটা ছিঁড়ল না। ঈসা তাঁদের বললেন, “এস, খাও।” সাহাবীদের মধ্যে কারও সাহস হল না যে, জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কে?” কারণ তাঁরা জানতেন, তিনি ঈসা। পরে ঈসা এসে রুটি নিয়ে তাঁদের দিলেন, আর সেইভাবে মাছও দিলেন। মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার পর ঈসা এই তৃতীয় বার সাহাবীদের দেখা দিলেন। তাঁদের খাওয়া শেষ হলে পর ঈসা শিমোন্তপিতরকে বললেন, “ইউহোন্নার ছেলে শিমোন, ওদের মহব্বতের চেয়ে কি তুমি আমাকে বেশী মহব্বত কর?” শিমোন্তপিতর তাঁকে বললেন, “জ্বী, প্রভু, আপনি জানেন আপনি আমার কত প্রিয়।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমার শিশু-ভেড়াগুলো চরাও।” ঈসা দ্বিতীয় বার তাঁকে বললেন, “ইউহোন্নার ছেলে শিমোন, তুমি কি আমাকে মহব্বত কর?” শিমোন্তপিতর তাঁকে বললেন, “জ্বী, প্রভু, আপনি তো জানেন আপনি আমার কত প্রিয়।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমার ভেড়াগুলো লালন-পালন কর।” পরে তিনি তৃতীয়বার শিমোন্তপিতরকে বললেন, “ইউহোন্নার ছেলে শিমোন, সত্যিই কি আমি তোমার প্রিয়?” পিতর এবার দুঃখিত হলেন, কারণ ঈসা এই তৃতীয় বার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি সত্যিই তোমার প্রিয়?” এইজন্য পিতর ঈসাকে বললেন, “প্রভু, আপনি সব কিছুই জানেন; আপনি তো জানেন যে, আপনি আমার খুবই প্রিয়।” ঈসা তাঁকে বললেন, “আমার ভেড়াগুলো চরাও। আমি তোমাকে সত্যিই বলছি, যখন তুমি যুবক ছিলে তখন তুমি নিজেই তোমার কোমর বাঁধতে আর যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে। কিন্তু যখন তুমি বুড়ো হবে তখন তুমি তোমার হাত বাড়িয়ে দেবে এবং অন্য একজন তোমাকে বাঁধবে আর তুমি যেখানে যেতে চাও না সেখানেই নিয়ে যাবে।” আল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশ করবার জন্য পিতর কিভাবে মরবেন তা বুঝাতে গিয়ে ঈসা এই কথা বললেন। এই কথা বলবার পর ঈসা পিতরকে বললেন, “আমার সংগে এস।” পিতর পিছন ফিরে দেখলেন, ঈসা যাঁকে মহব্বত করতেন সেই সাহাবী পিছনে পিছনে আসছেন। ইনি সেই সাহাবী, যিনি খাবার সময়ে ঈসার দিকে ঝুঁকে বলেছিলেন, “হুজুর, আপনাকে যে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেবে, সে কে?” পিতর তাঁকে দেখে ঈসাকে বললেন, “প্রভু, এর কি হবে?” ঈসা পিতরকে বললেন, “আমি যদি চাই এ আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত থাকে, তাতে তোমার কি? তুমি আমার সংগে এস।” এইজন্য ভাইদের মধ্যে এই কথা ছড়িয়ে গেল যে, সেই সাহাবী মরবেন না। ঈসা কিন্তু পিতরকে বলেন নি সেই সাহাবী মরবেন না। তিনি বরং বলেছিলেন, “আমি যদি চাই সে আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত থাকে, তাতে তোমার কি?” সেই সাহাবীই এই সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন আর এই সব লিখেছেন। আমরা জানি তাঁর সাক্ষ্য সত্যি। ঈসা আরও অনেক কিছু করেছিলেন। যদি সেগুলো এক এক করে লেখা হত তবে এত কিতাব হত যে, আমার মনে হয় সেগুলো এই দুনিয়াতে ধরত না। ॥ভব তাঁর দুঃখভোগের পরে এই লোকদের কাছে তিনি দেখা দিয়েছিলেন এবং তিনি যে জীবিত আছেন তার অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়েছিলেন। চল্লিশ দিন পর্যন্ত তিনি সাহাবীদের দেখা দিয়ে আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয় বলেছিলেন। সেই সময় একদিন ঈসা যখন সাহাবীদের সংগে ছিলেন তখন তাঁদের এই হুকুম দিয়েছিলেন, “তোমরা জেরুজালেম ছেড়ে যেয়ো না, বরং আমার পিতার ওয়াদা করা যে দানের কথা তোমরা আমার কাছে শুনেছ তার জন্য অপেক্ষা কর। ইয়াহিয়া পানিতে তরিকাবন্দী দিতেন, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে পিতার সেই ওয়াদা অনুসারে পাক-রূহে তোমাদের তরিকাবন্দী হবে।” পরে সাহাবীরা একসংগে মিলিত হয়ে ঈসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রভু, এই সময় কি আপনি বনি-ইসরাইলদের হাতে রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন?” ঈসা তাঁদের বললেন, “যে দিন বা সময় পিতা নিজের অধিকারের মধ্যে রেখেছেন তা তোমাদের জানতে দেওয়া হয় নি। তবে পাক-রূহ্‌ তোমাদের উপরে আসলে পর তোমরা শক্তি পাবে, আর জেরুজালেম, সারা এহুদিয়া ও সামেরিয়া প্রদেশে এবং দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত তোমরা আমার সাক্ষী হবে।” এই কথা বলবার পরে সাহাবীদের চোখের সামনেই ঈসাকে তুলে নেওয়া হল এবং তিনি একটা মেঘের আড়ালে চলে গেলেন। ঈসা যখন উপরে উঠে যাচ্ছিলেন তখন সাহাবীরা একদৃষ্টে আসমানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এমন সময় সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক সাহাবীদের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “গালীলের লোকেরা, এখানে দাঁড়িয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে রয়েছ কেন? যাঁকে তোমাদের কাছ থেকে তুলে নেওয়া হল সেই ঈসাকে যেভাবে তোমরা বেহেশতে যেতে দেখলে সেইভাবেই তিনি ফিরে আসবেন।” তখন সাহাবীরা জৈতুন পাহাড় থেকে জেরুজালেমে ফিরে আসলেন। জেরুজালেম শহর থেকে এই পাহাড়টা এক কিলোমিটার দূরে ছিল। শহরে পৌঁছে তাঁরা উপরের তলার যে ঘরে তখন থাকতেন সেখানে গেলেন। এই সাহাবীদের নাম ছিল পিতর, ইউহোন্না, ইয়াকুব ও আন্দ্রিয়, ফিলিপ ও থোমা, বর্‌থলময় ও মথি, আলফেয়ের ছেলে ইয়াকুব ও মৌলবাদী শিমোন এবং ইয়াকুবের ছেলে এহুদা। তাঁরা সবাই ঈমানদার স্ত্রীলোকদের সংগে এবং ঈসার মা মরিয়ম ও তাঁর ভাইদের সংগে সব সময় একমন হয়ে মুনাজাত করতেন। সেই সময় পিতর একদিন মসীহের উপর ঈমানদার প্রায় একশো কুড়িজন লোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, “ভাইয়েরা, পাক-রূহ্‌ অনেক দিন আগে নবী দাউদের মুখ দিয়ে এহুদার বিষয়ে যা বলেছিলেন পাক-কিতাবের সেই কথা পূর্ণ হবার দরকার ছিল। যারা ঈসাকে ধরেছিল, এই এহুদাই তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সে আমাদেরই একজন ছিল এবং আমাদের সংগে কাজ করবার জন্য তাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।” খারাপ কাজের দ্বারা এহুদা যে টাকা পেয়েছিল তা দিয়ে সে এক খণ্ড জমি কিনল, আর সেখানে পড়ে তার পেট ফেটে গেল এবং নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে পড়ল। জেরুজালেমের সবাই সেই কথা শুনেছিল। এইজন্য তাদের ভাষায় এই জমিকে তারা আকেল্‌দামা বা রক্তের ক্ষেত বলে। পরে পিতর বললেন, “জবুর শরীফ নামে কিতাবটিতে লেখা আছে, তার বাড়ী খালি থাকুক; সেখানে কেউ বাস না করুক। আরও লেখা আছে, তার উঁচু পদ অন্য লোক নিয়ে যাক। তখন সাহাবীরা ইউসুফ, যাঁকে বর্‌শাব্বা ও যুষ্ট বলা হত, তাঁর এবং মত্তথিয়ের, এই দু’জনের নাম বললেন। তাঁরা গুলিবাঁট করলে পর মত্তথিয়ের নাম উঠল। এইজন্য মত্তথিয় সেই এগারোজন সাহাবীদের সংগে যোগ দিলেন। এর কিছু দিন পরে পঞ্চাশত্তমী-ঈদের দিনে সাহাবীরা এক জায়গায় মিলিত হলেন। তখন হঠাৎ আসমান থেকে জোর বাতাসের শব্দের মত একটা শব্দ আসল এবং যে ঘরে তাঁরা ছিলেন সেই শব্দে সেই ঘরটা পূর্ণ হয়ে গেল। সাহাবীরা দেখলেন আগুনের জিভের মত কি যেন ছড়িয়ে গেল এবং সেগুলো তাঁদের প্রত্যেকের উপর এসে বসল। তাতে তাঁরা সবাই পাক-রূহে পূর্ণ হলেন এবং সেই রূহ্‌ যাঁকে যেমন কথা বলবার শক্তি দিলেন সেই অনুসারে তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। সেই সময় দুনিয়ার নানা দেশ থেকে আল্লাহ্‌ভক্ত ইহুদী লোকেরা এসে জেরুজালেমে বাস করছিল। তারা সেই শব্দ শুনল এবং অনেকেই সেখানে জমায়েত হল। নিজের নিজের ভাষায় সাহাবীদের কথা বলতে শুনে সেই লোকেরা যেন বুদ্ধিহারা হয়ে গেল। তারা খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, “এই যে লোকেরা কথা বলছে, এরা কি সবাই গালীলের লোক নয়? যদি তা-ই হয় তাহলে আমরা প্রত্যেকে কি করে নিজের নিজের মাতৃভাষা ওদের মুখে শুনছি? পার্থীয়, মিডীয়, এলমীয় লোক এবং মেসোপটেমিয়ায় বাসকারী লোকেরা, এহুদিয়া ও কাপ্পাদকিয়া, পন্ত ও এশিয়া প্রদেশ, ফরুগিয়া ও পাম্‌ফুলিয়া, মিসর ও কুরীণীর কাছাকাছি লিবিয়ার কয়েকটা জায়গার লোকেরা, রোম শহর থেকে যে ইহুদীরা ও ইহুদী ধর্মে ঈমানদার অ-ইহুদীরা এসেছে তারা, ক্রীট দ্বীপের লোকেরা ও আরবীয়রা- আমরা সকলেই তো আমাদের নিজের নিজের ভাষায় আল্লাহ্‌র মহৎ কাজের কথা ওদের বলতে শুনছি।” তাঁরা আশ্চর্য ও বুদ্ধিহারা হয়ে একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “এর মানে কি?” আবার অন্যেরা সাহাবীদের ঠাট্টা করে বললেন, “ওরা মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে।” তখন পিতর সেই এগারোজন সাহাবীদের সংগে দাঁড়িয়ে জোরে সেই সব লোকদের বললেন, “ইহুদী লোকেরা আর যাঁরা আপনারা জেরুজালেমে বাস করছেন, আপনারা জেনে রাখুন এবং মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। আপনারা মনে করেছেন এরা মাতাল হয়েছে, কিন্তু তা নয়; কারণ এখন তো মাত্র সকাল ন’টা। এটা সেই ঘটনার মত যার কথা নবী যোয়েল বলেছিলেন যে, আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘শেষকালে সব লোকের উপরে আমি আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব; তাতে তোমাদের ছেলেরা ও মেয়েরা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলবে, তোমাদের যুবকেরা দর্শন পাবে, তোমাদের বুড়ো লোকেরা স্বপ্ন দেখবে। এমন কি, সেই সময়ে আমার গোলাম ও বাঁদীদের উপরে আমি আমার রূহ্‌ ঢেলে দেব, আর তারা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলবে। আমি উপরে আসমানে আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা দেখাব, আর নীচে দুনিয়াতে নানা রকম চিহ্ন দেখাব, অর্থাৎ রক্ত, আগুন ও প্রচুর ধোঁয়া দেখাব। মাবুদের সেই মহৎ ও মহিমাপূর্ণ দিন আসবার আগে সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে ও চাঁদ রক্তের মত হবে। রক্ষা পাবার জন্য যে কেউ মাবুদকে ডাকবে সে রক্ষা পাবে।’ “বনি-ইসরাইলরা, এই কথা শুনুন। নাসরতের ঈসার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ আপনাদের মধ্যে মহৎ কাজ, চিহ্ন ও কুদরতি কাজ করে আপনাদের কাছে প্রমাণ করেছিলেন যে, তিনি ঈসাকে পাঠিয়েছিলেন; আর এই কথা তো আপনারা জানেন। আল্লাহ্‌, যিনি আগেই সব জানেন, তিনি আগেই ঠিক করেছিলেন যে, ঈসাকে আপনাদের হাতে দেওয়া হবে। আর আপনারাও দুষ্ট লোকদের দ্বারা তাঁকে ক্রুশের উপরে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে তাঁকে জীবিত করে তুলেছেন, কারণ তাঁকে ধরে রাখবার সাধ্য মৃত্যুর ছিল না। নবী দাউদ তাঁর বিষয়ে বলেছেন, ‘আমার চোখ সব সময় মাবুদের দিকে আছে; তিনি আমার ডান পাশে আছেন বলে আমি স্থির থাকব। এইজন্য আমার মন খুশীতে ভরা, আমার জিভ্‌ আনন্দের কথা বলে, আমার শরীরও আশা নিয়ে বাঁচবে; কারণ তুমি আমাকে কবরে ফেলে রাখবে না, তোমার ভক্তের শরীরকে তুমি নষ্ট হতে দেবে না। জীবনের পথ তুমি আমাকে জানিয়েছ; তোমার কাছে থাকায় আছে পরিপূর্ণ আনন্দ।’ “ভাইয়েরা, এই কথা আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি যে, রাজবংশের পিতা দাউদ মারা গেছেন, তাঁকে দাফন করা হয়েছে আর তাঁর কবর আজও এখানে রয়েছে। তিনি একজন নবী ছিলেন এবং তিনি জানতেন আল্লাহ্‌ কসম খেয়ে এই ওয়াদা করেছেন যে, তাঁর সিংহাসনে তাঁরই একজন বংশধরকে তিনি বসাবেন। পরে কি হবে তা দাউদ দেখতে পেয়েছিলেন বলে মৃত্যু থেকে মসীহের আবার জীবিত হয়ে ওঠা সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, কবরে মসীহ্‌কে ফেলে রাখা হয় নি এবং তাঁর শরীরও নষ্ট হয় নি। আল্লাহ্‌ সেই ঈসাকেই জীবিত করে তুলেছেন, আর আমরা সবাই তার সাক্ষী। আল্লাহ্‌র ডান দিকে বসবার গৌরব তাঁকেই দান করা হয়েছে এবং ওয়াদা করা পাক-রূহ্‌কে তিনিই পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন; আর এখন আপনারা যা দেখছেন ও শুনতে পাচ্ছেন তা ঈসাই দিয়েছেন। “এইজন্য সমস্ত ইসরাইল জাতি এই কথা নিশ্চিত ভাবে জানুন যে, যাঁকে আপনারা ক্রুশের উপরে হত্যা করেছিলেন আল্লাহ্‌ সেই ঈসাকেই প্রভু এবং মসীহ্‌- এই দুই পদেই নিযুক্ত করেছেন।” এই কথা শুনে লোকেরা মনে আঘাত পেল। তারা পিতর ও অন্য সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করল, “ভাইয়েরা, আমরা কি করব?” জবাবে পিতর বললেন, “আপনারা প্রত্যেকে গুনাহের মাফ পাবার জন্য তওবা করুন এবং ঈসা মসীহের নামে তরিকাবন্দী গ্রহণ করুন। আপনারা দান হিসাবে পাক-রূহ্‌কে পাবেন। আপনাদের জন্য, আপনাদের ছেলেমেয়েদের জন্য এবং যারা দূরে আছে, এক কথায় আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের বান্দা হবার জন্য যাদের ডাকবেন, তাদের সকলের জন্য এই ওয়াদা করা হয়েছে।” এছাড়া আরও অনেক কথা বলে পিতর সাক্ষ্য দিতে লাগলেন। তিনি তাদের এই বলে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, “এই যুগের বিবেকহীন লোকদের থেকে নিজেদের রক্ষা করুন।” যারা তাঁর কথায় ঈমান আনল তারা তরিকাবন্দী নিল এবং সাহাবীদের দলের সংগে সেই দিন আল্লাহ্‌ কমবেশ তিন হাজার লোককে যুক্ত করলেন। সেই লোকেরা সাহাবীদের শিক্ষা শুনত, তাঁদের সংগে এক হয়ে মসীহের মেজবানী গ্রহণ করত এবং মুনাজাত করে সময় কাটাত। সবাই ভয়ে পূর্ণ হল, আর সাহাবীরা অনেক অলৌকিক কাজ ও চিহ্ন-কাজ করতে লাগলেন। সব ঈমানদারই একসংগে থাকত ও সব কিছু যার যার দরকার মত ব্যবহার করত। তারা নিজেদের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে যার যেমন দরকার সেইভাবে তাকে দিত। তারা প্রত্যেক দিন বায়তুল-মোকাদ্দসে একসংগে মিলিত হত, আর ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীতে আনন্দের সংগে ও সরল মনে একসংগে খাওয়া-দাওয়া করত। তারা সব সময় আল্লাহ্‌র প্রশংসা করত এবং সব লোক তাদের সম্মান করত। যারা নাজাত পাচ্ছিল প্রভু ঈমানদার দলের সংগে প্রত্যেক দিনই তাদের যোগ করতে লাগলেন। একদিন বেলা তিনটায় মুনাজাতের সময়ে পিতর ও ইউহোন্না বায়তুল-মোকাদ্দসে যাচ্ছিলেন। লোকেরা প্রত্যেক দিন একজন লোককে বয়ে এনে বায়তুল-মোকাদ্দসের সুন্দর নামে দরজার কাছে রাখত। সে জন্ম থেকেই খোঁড়া ছিল। যারা বায়তুল-মোকাদ্দসে যেত তাদের কাছে ভিক্ষা চাইবার জন্য তাকে সেখানে রাখা হত। পিতর ও ইউহোন্নাকে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকতে দেখে সে তাঁদের কাছে ভিক্ষা চাইল। পিতর ও ইউহোন্না সোজা তার দিকে তাকালেন। তার পরে পিতর বললেন, “আমাদের দিকে তাকাও।” তখন সেই লোকটি তাঁদের কাছ থেকে কিছু পাবার আশায় তাঁদের দিকে তাকাল। তখন পিতর বললেন, “আমার কাছে সোনা-রূপা কিছু নেই, কিন্তু যা আছে তা-ই তোমাকে দিচ্ছি। নাসরতের ঈসা মসীহের নামে উঠে দাঁড়াও ও হাঁট।” পরে তিনি লোকটির ডান হাত ধরে তাকে তুললেন আর তখনই তার পা ও গোড়ালি শক্ত হল। সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং হাঁটতে লাগল। পরে সে হাঁটতে হাঁটতে, লাফাতে লাফাতে এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে করতে তাঁদের সংগে বায়তুল-মোকাদ্দসে গেল। ভিখারীটি কিন্তু পিতর ও ইউহোন্নার পিছু ছাড়ল না। লোকেরা পিতরের সেই কাজে আশ্চর্য হয়ে তাঁদের কাছে দৌড়ে আসল। সোলায়মানের নামে যে বারান্দা ছিল তাঁরা তখন সেখানে ছিলেন। এই ব্যাপার দেখে পিতর লোকদের বললেন, “বনি-ইসরাইলরা, এতে আপনারা আশ্চর্য হচ্ছেন কেন? আমাদের নিজেদের শক্তিতে বা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ের গুণে একে চলবার শক্তি দিয়েছি মনে করে কেনই বা আপনারা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন? ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহ্‌, অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ এই কাজের দ্বারা নিজের গোলাম ঈসার মহিমা প্রকাশ করেছেন। আপনারা তো ঈসাকে হত্যা করবার জন্য ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পীলাত তাঁকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনারা পীলাতের সামনে তাঁকে অস্বীকার করেছিলেন। আপনারা সেই পবিত্র ও ন্যায়বান লোকটিকে অস্বীকার করে একজন খুনীকে আপনাদের কাছে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। যিনি জীবনদাতা তাঁকেই আপনারা হত্যা করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্‌ মৃত্যু থেকে তাঁকে জীবিত করে তুলেছেন; আর আমরা তার সাক্ষী। এই যে লোকটিকে আপনারা দেখছেন এবং যাকে আপনারা চেনেন, ঈসার উপর ঈমান আনবার ফলে, ঈসার নামের গুণে সে শক্তি লাভ করেছে। ঈসার মধ্য দিয়ে যে ঈমান আসে সেই ঈমানই আপনাদের সকলের সামনে তাকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে তুলেছে। “এখন ভাইয়েরা, আমি জানি আপনাদের নেতাদের মত আপনারাও না বুঝেই ঈসাকে ক্রুশের উপরে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ অনেক দিন আগে সমস্ত নবীদের মধ্য দিয়ে বলেছিলেন তাঁর মসীহ্‌কে কষ্টভোগ করতে হবে; আর সেই কথা আল্লাহ্‌ এইভাবেই পূর্ণ করলেন। এইজন্য আপনারা তওবা করে আল্লাহ্‌র দিকে ফিরুন যেন আপনাদের গুনাহ্‌ মুছে ফেলা হয়; আর এতে যেন আল্লাহ্‌ সেই মসীহ্‌কে, অর্থাৎ ঈসাকে পাঠিয়ে দিয়ে আপনাদের সজীব করে তুলতে পারেন। আপনাদের জন্য তাঁকেই নিযুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ সব কিছু যে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন তা অনেক দিন আগেই পবিত্র নবীদের মধ্য দিয়ে বলেছিলেন। তিনি যতদিন না তাঁর সেই কথা পূর্ণ করেন ততদিন পর্যন্ত ঈসাকে বেহেশতে থাকতে হবে। নবী মূসা বলেছিলেন, ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন। তাঁর কথামত তোমাদের চলতে হবে। যে তাঁর কথা শুনবে না তাকে তার লোকদের মধ্য থেকে একেবারে ধ্বংস করা হবে।’ “এছাড়া নবী শামুয়েল থেকে শুরু করে যে সব নবীরা কোন কিছু বলে গেছেন তাঁরাও এই সময়ের কথা আগেই বলে গেছেন, আর আপনারা তো সেই নবীদেরই বংশধর। আপনাদের পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহ্‌ যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন, আপনারা তো তারই ভাগীদার। আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে এই কথা বলে সেই ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন, ‘তোমার বংশের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত জাতিই দোয়া পাবে।’ আপনাদের প্রত্যেককে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে দোয়া করবার জন্যই আল্লাহ্‌ তাঁর গোলাম ঈসাকে ঠিক করে প্রথমে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন।” পিতর ও ইউহোন্না যখন লোকদের সংগে কথা বলছিলেন সেই সময় ইমামেরা, বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কর্মচারী ও সদ্দূকীরা তাঁদের কাছে আসলেন। এঁরা খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন, কারণ পিতর ও ইউহোন্না লোকদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং ঈসার মধ্য দিয়ে মৃতদের আবার জীবিত হয়ে উঠবার বিষয় তবলিগ করছিলেন। তাঁরা পিতর ও ইউহোন্নাকে ধরলেন এবং সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে পরের দিন পর্যন্ত হাজতে রাখলেন। কিন্তু যারা পিতরের কথা শুনেছিল তাদের মধ্যে অনেকে ঈমান আনল; তাতে ঈমানদারদের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে কমবেশ পাঁচ হাজারে দাঁড়াল। পরের দিন ইহুদীদের প্রধান ইমামেরা, বৃদ্ধ নেতারা এবং আলেমেরা এক সংগে জেরুজালেমে মিলিত হলেন। সেখানে মহা-ইমাম হানন উপস্থিত ছিলেন। তা ছাড়া কাইয়াফা, ইউহোন্না, আলেকজাণ্ডার আর মহা-ইমামের পরিবারের অন্যান্য লোকেরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পিতর আর ইউহোন্নাকে তাঁদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কিসের শক্তিতে বা কার নামে এই কাজ করেছ?” তখন পিতর পাক-রূহে পূর্ণ হয়ে তাঁদের বললেন, “প্রধান ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা, একজন খোঁড়া লোকের উপকার করবার জন্য আজ আপনারা এই নিয়ে আমাদের জেরা করছেন যে, লোকটি কেমন করে ভাল হল। তাহলে আপনারা এবং সমস্ত বনি-ইসরাইল এই কথা জেনে রাখুন যে, নাসরতের সেই ঈসা মসীহ্‌, যাঁকে আপনারা ক্রুশের উপরে হত্যা করেছিলেন এবং যাঁকে আল্লাহ্‌ মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছেন, তাঁরই শক্তিতে এই লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাক-কিতাবের কথামত ঈসা মসীহ্‌ই ‘সেই পাথর, যাঁকে রাজমিস্ত্রিরা, অর্থাৎ আপনারা বাদ দিয়েছিলেন; আর সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল।’ নাজাত আর কারও কাছে পাওয়া যায় না, কারণ সারা দুনিয়াতে আর এমন কেউ নেই যার নামে আমরা নাজাত পেতে পারি।” পিতর আর ইউহোন্নার সাহস দেখে এবং তাঁরা যে অশিক্ষিত ও সাধারণ লোক তা জানতে পেরে সেই নেতারা আশ্চর্য হয়ে গেলেন, আর তাঁরা যে ঈসার সংগী ছিলেন তাও বুঝতে পারলেন। যে লোকটি সুস্থ হয়েছিল তাকে পিতর ও ইউহোন্নার সংগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁদের বিরুদ্ধে বলবার আর কিছুই রইল না। এইজন্য তাঁরা মহাসভা থেকে তাঁদের বাইরে যেতে হুকুম দিলেন। তারপর তাঁরা একসংগে মিলে পরামর্শ করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, “এই লোকদের নিয়ে আমরা কি করব? যারা জেরুজালেমে বাস করে তারা সবাই জানে যে, এরা একটা বিশেষ অলৌকিক কাজ করেছে, আর আমরা তা অস্বীকারও করতে পারি না। কিন্তু লোকদের মধ্যে যেন কথাটা আরও ছড়িয়ে না পড়ে সেইজন্য এই লোকদের ভয় দেখাতে হবে, যাতে তারা কাউকেই ঈসার বিষয়ে আর কোন কথা না বলে।” এর পরে তাঁরা পিতর ও ইউহোন্নাকে আবার ভিতরে ডেকে আনলেন এবং হুকুম দিলেন যেন তাঁরা ঈসার বিষয়ে আর কোন কথা না বলেন বা শিক্ষা না দেন। জবাবে পিতর ও ইউহোন্না বললেন, “আপনাদের হুকুম পালন করব, না আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করব? আল্লাহ্‌র চোখে কোন্‌টা ঠিক, আপনারাই তা বিচার করে দেখুন। আমরা যা দেখেছি আর শুনেছি তা না বলে তো থাকতে পারি না।” তখন তাঁরা পিতর আর ইউহোন্নাকে আরও ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিলেন। লোকদের ভয়ে তাঁরা ঠিক করতে পারছিলেন না কিভাবে তাঁদের শাস্তি দেওয়া যায়, কারণ যা ঘটেছিল তাতে সব লোক আল্লাহ্‌র প্রশংসা করছিল। যে লোকটি আশ্চর্য ভাবে ভাল হয়েছিল তার বয়স ছিল চল্লিশ বছরেরও বেশী। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে পিতর ও ইউহোন্না তাঁদের নিজেদের লোকদের কাছে গেলেন এবং প্রধান ইমামেরা ও বৃদ্ধ নেতারা তাঁদের যা যা বলেছিলেন সবই তাদের জানালেন। এই কথা শুনে তারা সবাই মিলে এক প্রাণে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করে বলল, “হে মালিক, তুমি আসমান, দুনিয়া, সমুদ্র এবং ঐগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি করেছ। তুমি পাক-রূহের মধ্য দিয়ে তোমার গোলাম আমাদের পূর্বপুরুষ দাউদের মুখ দিয়ে বলেছ, ‘কেন অস্থির হয়ে চেঁচামেচি করছে সমস্ত জাতির লোক? কেন লোকেরা মিছামিছি ষড়যন্ত্র করছে? মাবুদ ও তাঁর মসীহের বিরুদ্ধে দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা একসংগে দাঁড়াচ্ছে, আর শাসনকর্তারা করছে গোপন বৈঠক।’ “তোমার পবিত্র গোলাম ঈসা, যাঁকে তুমি মসীহ্‌ হিসাবে নিযুক্ত করেছিলে, বাদশাহ্‌ হেরোদ ও পন্তীয় পীলাত এই শহরেই তাঁর বিরুদ্ধে অ-ইহুদীদের সংগে এবং বনি-ইসরাইলদের সংগে সত্যিই হাত মিলিয়েছিলেন। তোমার কুদরত ও ইচ্ছাতে যা ঘটবে বলে তুমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলে তাঁরা তা-ই করেছিলেন। আর এখন, হে মাবুদ, এঁরা আমাদের কিভাবে ভয় দেখাচ্ছেন তা তুমি লক্ষ্য কর। তোমার গোলামদের এমন শক্তি দাও যাতে খুব সাহসের সংগে তারা তোমার কালাম বলতে পারে। তোমার হাত বাড়িয়ে দাও যেন তোমার পবিত্র গোলাম ঈসার নামে তারা লোকদের সুস্থ করতে পারে এবং অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি কাজ করতে পারে।” যে জায়গায় তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন, মুনাজাত করবার পর সেই জায়গাটা কেঁপে উঠল। আর তাঁরা সবাই পাক-রূহে পূর্ণ হয়ে সাহসের সংগে আল্লাহ্‌র কালাম বলতে লাগলেন। ঈমানদারেরা সবাই মনেপ্রাণে এক ছিল। কোন কিছুই তারা নিজের বলে দাবি করত না বরং সব কিছুই যার যার দরকার মত ব্যবহার করত। সাহাবীরা মহাশক্তিতে সাক্ষ্য দিতে থাকলেন যে, হযরত ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন, আর তাদের সকলের উপর আল্লাহ্‌র অশেষ রহমত ছিল। ইউসুফ নামে লেবির বংশের একজন লোক ছিলেন। সাইপ্রাস দ্বীপে তাঁর বাড়ী ছিল। তাঁকে সাহাবীরা বার্নাবাস, অর্থাৎ উৎসাহদাতা বলে ডাকতেন। তাঁর এক খণ্ড জমি ছিল; তিনি সেটা বিক্রি করে টাকা এনে সাহাবীদের পায়ের কাছে রাখলেন। তখন অননিয় নামে একজন লোক ও তার স্ত্রী সাফীরা একটা সম্পত্তি বিক্রি করল। তার স্ত্রীর জানামতেই বিক্রির টাকার কিছু অংশ সে নিজের জন্য রেখে বাকী টাকা সাহাবীদের দিল। তখন পিতর বললেন, “অননিয়, কি করে শয়তান তোমার মন এমনভাবে অধিকার করল যে, তুমি পাক-রূহের কাছে মিথ্যা কথা বললে এবং জমি বিক্রির টাকা থেকে কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে দিলে? বিক্রির আগে জমিটা কি তোমারই ছিল না? আর বিক্রির পরেও কি টাকাগুলো তোমার হাতেই ছিল না? তবে তুমি কেন এমন কাজ করবে বলে ঠিক করলে? তুমি মানুষের কাছে মিথ্যা বল নি, কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছে মিথ্যা কথা বলেছ।” এই কথা শোনামাত্র অননিয় মাটিতে পড়ে মারা গেল। এই ঘটনার কথা যারা শুনল তারা সবাই ভীষণ ভয় পেল। পরে যুবকেরা উঠে তার গায়ে কাফন দিয়ে জড়াল এবং বাইরে নিয়ে গিয়ে তাকে দাফন করল। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে অননিয়ের স্ত্রী সেখানে আসল, কিন্তু কি ঘটেছে তা সে জানত না। তখন পিতর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বল দেখি, তুমি আর অননিয় সেই জমিটা কি এত টাকাতে বিক্রি করেছিলে?” সে বলল, “জ্বী, এত টাকাতেই।” তখন পিতর তাকে বললেন, “মাবুদের রূহ্‌কে পরীক্ষা করবার জন্য কেন তোমরা একমত হলে? দেখ, যে লোকেরা তোমার স্বামীকে দাফন করেছে তারা দরজার কাছে এসে পৌঁছেছে, আর তারা তোমাকেও বাইরে নিয়ে যাবে।” সাফীরা তখনই পিতরের পায়ের কাছে পড়ে মারা গেল। আর ঐ যুবকেরা ভিতরে এসে তাকে মৃত অবস্থায় দেখল এবং তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর পাশে দাফন করল। তখন জামাতের সব লোক এবং অন্য যারা সেই কথা শুনল সবাই ভীষণ ভয় পেল। সাহাবীরা লোকদের মধ্যে অনেক কুদরতি ও চিহ্ন-কাজ কাজ করতেন; আর ঈমানদারেরা সবাই বায়তুল-মোকাদ্দসের সোলায়মানের বারান্দায় একসংগে মিলিত হত। যদিও লোকেরা তাদের খুব সম্মান করত তবুও আর কেউ তাদের সংগে যোগ দিতে সাহস করল না। তাহলেও অনেক পুরুষ ও স্ত্রীলোক প্রভুর উপর ঈমান আনল এবং ঈমানদার দলের সংগে যুক্ত হল। সাহাবীরা যা করছিলেন তা দেখে লোকেরা খাটের উপরে ও মাদুরের উপরে করে রোগীদের এনে রাস্তায় রাস্তায় রাখতে লাগল, যেন রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পিতরের ছায়াটুকু অন্ততঃ তাদের কারও কারও উপরে পড়ে। জেরুজালেমের আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে অনেক লোক তাদের রোগীদের এবং ভূতের হাতে কষ্ট-পাওয়া লোকদের এনে ভিড় করতে লাগল, আর তারা সবাই সুস্থ হল। তখন মহা-ইমাম ও তাঁর সংগের সদ্দূকী দলের লোকেরা হিংসায় জ্বলে উঠলেন। তাঁরা সাহাবীদের ধরে সরকারী জেলে দিলেন। কিন্তু রাতের বেলায় মাবুদের একজন ফেরেশতা জেলের দরজাগুলো খুলে তাঁদের বাইরে এনে বললেন, “যাও, বায়তুল-মোকাদ্দসে দাঁড়িয়ে লোকদের কাছে অনন্ত জীবন সম্বন্ধে সমস্ত কথা বল।” তাঁরা সেই কথামত খুব ভোরে বায়তুল-মোকাদ্দসে ঢুকে লোকদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। এদিকে মহা-ইমাম ও তাঁর সংগের সদ্দূকীরা মহাসভা ডাকলেন, অর্থাৎ ইসরাইলীয় বৃদ্ধ নেতাদের গোটা দলটিকে ডাকলেন। তারপর তাঁরা সাহাবীদের নিয়ে আসবার জন্য কয়েকজন কর্মচারী পাঠালেন, কিন্তু সেই কর্মচারীরা জেলখানায় গিয়ে সেখানে তাঁদের পেল না। তখন তারা ফিরে গিয়ে এই খবর দিল, “আমরা দেখলাম জেলের দরজায় শক্ত করেই তালা দেওয়া আছে এবং দরজায় দরজায় পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দরজা খুলে কাউকেই ভিতরে দেখতে পেলাম না।” এই কথা শুনে বায়তুল-মোকাদ্দসের প্রধান কর্মচারী ও প্রধান ইমামেরা বুদ্ধিহারা হয়ে ভাবতে লাগলেন এর ফল কি হবে। তখন একজন লোক এসে বলল, “দেখুন, যে লোকদের আপনারা জেলে দিয়েছিলেন তারা বায়তুল-মোকাদ্দসে দাঁড়িয়ে লোকদের শিক্ষা দিচ্ছে।” তখন প্রধান কর্মচারী তাঁর অধীন কর্মচারীদের নিয়ে গিয়ে সাহাবীদের ধরে আনলেন। কিন্তু লোকেরা সেই কর্মচারীদের পাথর মারতে পারে সেই ভয়ে তারা সাহাবীদের উপর কোন জবরদস্তি করে নি। সাহাবীদের এনে তারা মহাসভার সামনে দাঁড় করাল। তখন মহা-ইমাম সাহাবীদের বললেন, “ঐ লোকের বিষয় শিক্ষা না দেবার জন্য আমরা তোমাদের কড়া হুকুম দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা তোমাদের শিক্ষায় জেরুজালেম পূর্ণ করেছ এবং সেই লোকের মৃত্যুর জন্য আমাদের দায়ী করতে চাইছ।” তখন পিতর এবং অন্য সাহাবীরা জবাব দিলেন, “মানুষের হুকুম পালন করবার চেয়ে বরং আল্লাহ্‌র হুকুমই আমাদের পালন করা উচিত। যাঁকে আপনারা ক্রুশে টাংগিয়ে হত্যা করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ সেই ঈসাকেই মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছেন। আল্লাহ্‌ তাঁকেই বাদশাহ্‌ ও নাজাতদাতা হিসাবে নিজের ডান পাশে বসবার গৌরব দান করেছেন, যাতে তিনি বনি-ইসরাইলদের তওবা করবার সুযোগ দিয়ে গুনাহের মাফ দান করতে পারেন। আমরা এই সবের সাক্ষী এবং যারা আল্লাহ্‌র বাধ্য হয়, আল্লাহ্‌ তাদের যে পাক-রূহ্‌ দিয়েছেন সেই পাক-রূহ্‌ও তার সাক্ষী।” এই কথা শুনে সেই নেতারা রেগে আগুন হয়ে গেলেন এবং সাহাবীদের হত্যা করতে চাইলেন, কিন্তু গমলীয়েল নামে ফরীশী দলের একজন লোক মহাসভার মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একজন আলেম ছিলেন এবং সবাই তাঁকে সম্মান করত। তিনি সাহাবীদের কিছুক্ষণের জন্য বাইরে রাখতে হুকুম দিলেন। তার পরে তিনি মহাসভার লোকদের বললেন, “বনি-ইসরাইলরা, এই লোকদের উপরে তোমরা যা করতে যাচ্ছ সেই বিষয়ে সাবধান হও। এই তো কিছু দিন আগে থুদা নামে একজন লোক এসে নিজেকে বিশেষ একজন বলে দাবি করেছিল, আর কমবেশ চারশো লোক তার সংগে যোগ দিয়েছিল। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার সব সংগীরা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে তার সব কিছুই বিফল হয়েছে। তারপর আদমশুমারীর সময়ে গালীলের এহুদা এসে এক দল লোককে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। সেও মারা গেছে, আর তার সংগীরাও সবাই ছড়িয়ে পড়েছে। সেইজন্য এই অবস্থায় আমি তোমাদের বলছি, তোমরা এই লোকদের উপর কিছু কোরো না। এদের ছেড়ে দাও, কারণ এদের উদ্দেশ্য ও কাজকর্ম যদি মানুষ থেকে হয়ে থাকে তবে তা ধ্বংস হবে। কিন্তু যদি আল্লাহ্‌ থেকে হয়ে থাকে তবে তোমরা এদের থামাতে পারবে না। হয়তো দেখবে তোমরা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছ।” তখন গমলীয়েলের কথায় নেতারা একমত হলেন। তাঁরা সাহাবীদের ভিতরে ডেকে এনে বেত মারতে হুকুম দিলেন। তার পরে তাঁরা তাঁদের ছেড়ে দিলেন এবং হুকুম দিলেন যেন তাঁরা ঈসার বিষয়ে কোন কথা না বলেন। এতে ঈসার নামের জন্য সাহাবীরা যে অপমান ভোগ করবার যোগ্য হয়েছেন সেইজন্য আনন্দ করতে করতে তাঁরা মহাসভা ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁরা প্রত্যেক দিন বায়তুল-মোকাদ্দসে এবং বাড়ী বাড়ী গিয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং ঈসাই যে মসীহ্‌ এই সুসংবাদ তবলিগ করতে থাকলেন। সেই সময়ে উম্মতদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। তখন উম্মতদের মধ্যে যে ইহুদীরা গ্রীক ভাষায় কথা বলত তারা হিব্রু ভাষায় কথা বলা ইহুদীদের এই বলে দোষ দিতে লাগল যে, রোজই খাবার দেবার সময়ে তাদের বিধবা স্ত্রীলোকেরা কিছুই পায় না। এতে সেই বারোজন সাহাবী সব উম্মতদের এক জায়গায় ডেকে বললেন, “আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করা ছেড়ে খাবার দেওয়ার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকা আমাদের পক্ষে ঠিক নয়। দলের সকলেরই এই কথা ভাল লাগল। বিশ্বাসে ও পাক-রূহে পূর্ণ স্তিফানকে তারা বেছে নিল। এছাড়া তারা ফিলিপ, প্রখর, নীকানর, তীমোন, পার্মিনা ও এণ্টিয়ক শহরের নিকলায়কেও বেছে নিল। এই নিকলায় অ-ইহুদী হয়েও ইহুদী ধর্ম পালন করতেন। পরে তারা এই লোকদের সাহাবীদের কাছে নিয়ে গেল। তখন সাহাবীরা মুনাজাত করলেন এবং কাজে নিযুক্ত করবার জন্য তাঁদের উপর হাত রাখলেন। এইভাবে আল্লাহ্‌র কালাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর জেরুজালেমে উম্মতদের সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যেতে লাগল এবং ইমামদের মধ্যে অনেকে ঈসায়ী ঈমানকে মেনে নিলেন। স্তিফান আল্লাহ্‌র রহমত ও শক্তিতে পূর্ণ হয়ে লোকদের মধ্যে অনেক কুদরতি ও চিহ্ন-কাজ করতে লাগলেন। যে মজলিস-খানাকে মুক্ত-করা লোকদের মজলিস-খানা বলা হত সেই মজলিস-খানার কয়েকজন লোক স্তিফানের পিছনে লাগল। তারা ছিল কুরীণী ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরের এবং কিলিকিয়া ও এশিয়া প্রদেশের কয়েকজন ইহুদী। তারা স্তিফানের সংগে তর্ক জুড়ে দিল, কিন্তু স্তিফান পাক-রূহের মধ্য দিয়ে খুব জ্ঞানের সংগে কথা বলছিলেন। সেইজন্য তারা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছিল না। তখন সেই ইহুদীরা গোপনে কয়েকজন লোককে এই কথা বলতে উস্‌কিয়ে দিল, “আমরা স্তিফানকে নবী মূসা ও আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কুফরী করতে শুনেছি।” এইভাবে তারা লোকদের, বৃদ্ধ নেতাদের ও আলেমদের ক্ষেপিয়ে তুলল আর স্তিফানকে ধরে মহাসভার সামনে আনল। তারা কয়েকজন মিথ্যা সাক্ষী দাঁড় করাল। এই মিথ্যা সাক্ষীরা বলল, “এই লোকটা সব সময় বায়তুল-মোকাদ্দসের বিরুদ্ধে ও মূসার শরীয়তের বিরুদ্ধে কথা বলে। আমরা তাকে এই কথা বলতে শুনেছি যে, সেই নাসরত গ্রামের ঈসা এই এবাদত-খানা ভেংগে ফেলবে এবং মূসা যে চলতি নিয়মগুলো আমাদের দিয়ে গিয়েছেন সেগুলোও বদলে ফেলবে।” যাঁরা সেই মহাসভায় বসে ছিলেন তাঁরা সবাই তখন স্তিফানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর মুখ একজন ফেরেশতার মুখের মত হয়ে গেছে। তখন মহা-ইমাম স্তিফানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই সব কথা কি সত্যি?” জবাবে স্তিফান বললেন, “হে আমার ভাইয়েরা ও পিতারা, আমার কথা শুনুন। আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম হারণ শহরে বাস করবার আগে যখন মেসোপটেমিয়া দেশে ছিলেন তখন গৌরবময় আল্লাহ্‌ তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার দেশ ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আমি যে দেশ তোমাকে দেখাব সেই দেশে যাও।’ “সেইজন্য তিনি ক্যালডীয়দের দেশ ছেড়ে হারণ শহরে গিয়ে বাস করলেন। যে দেশে এখন আপনারা বাস করছেন আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের অধিকারের জন্য আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে সেখানে কিছুই দিলেন না, একটা পা রাখবার মত জমি পর্যন্তও না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, তাঁকে ও তাঁর পরে তাঁর বংশধরদের অধিকার হিসাবে তিনি সেই দেশ দেবেন। অবশ্য সেই সময় ইব্রাহিমের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, ‘তোমার বংশধরেরা বিদেশে বাস করবে। লোকে তাদের গোলাম করে রাখবে এবং চারশো বছর ধরে তাদের উপর জুলুম করবে।’ আল্লাহ্‌ আরও বললেন, ‘যে জাতি তাদের গোলাম করবে সেই জাতিকে আমি শাস্তি দেব। পরে তারা সেই দেশ থেকে বের হয়ে এসে এই জায়গায় আমার এবাদত করবে।’ তারপর আল্লাহ্‌ তাঁর ব্যবস্থার চিহ্ন হিসাবে খৎনা করাবার নিয়ম দিলেন। এর পরে ইব্রাহিমের ছেলে ইসহাকের জন্ম হল এবং জন্মের আট দিনের দিন তিনি তাঁর খৎনা করালেন। পরে ইসহাক ইয়াকুবের খৎনা করালেন এবং ইয়াকুব সেই বারোজন গোষ্ঠী-পিতাদের খৎনা করালেন। “তার পরে সারা মিসর ও কেনান দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তাতে যখন খুব কষ্ট উপস্থিত হল তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা খাবার পেলেন না। কিন্তু মিসরে খাবার আছে শুনে ইয়াকুব আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রথমে একবার সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় বারে ইউসুফ ভাইদের জানালেন তিনি কে। সেই সময় ফেরাউন ইউসুফের পরিবারের বিষয় জানতে পারলেন। এর পরে ইউসুফ তাঁর পিতা ইয়াকুব ও পরিবারের অন্য সবাইকে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা সংখ্যায় মোট পঁচাত্তরজন ছিলেন। ইয়াকুব মিসরে গেলেন, আর সেখানে তিনি ও আমাদের পূর্বপুরুষেরা ইন্তেকাল করলেন। তাঁদের মৃতদেহ শিখিমে এনে দাফন করা হল। এই কবরস্থান ইব্রাহিম শিখিম শহরের হমোরের ছেলেদের কাছ থেকে রূপা দিয়ে কিনেছিলেন। “ইব্রাহিমের কাছে আল্লাহ্‌ যে ওয়াদা করেছিলেন তা পূর্ণ হবার সময় যখন কাছে আসল তখন দেখা গেল মিসরে আমাদের লোকসংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। এর পরে মিসরে আর একজন বাদশাহ্‌ হলেন। তিনি ইউসুফের বিষয় কিছুই জানতেন না। সেই বাদশাহ্‌ আমাদের লোকদের ঠকাতেন এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর খুব জুলুম করতেন। এমন কি, তাঁদের যে সব শিশু জন্মগ্রহণ করত তারা যাতে মারা যায় সেইজন্য সেই শিশুদের বাইরে ফেলে রাখতে তাঁদের বাধ্য করতেন। “সেই সময়ে মূসার জন্ম হল। তিনি দেখতে খুবই সুন্দর ছিলেন। তিন মাস পর্যন্ত তিনি তাঁর পিতার বাড়ীতেই লালিত-পালিত হলেন। পরে যখন তাঁকে বাইরে ফেলে রাখা হল তখন ফেরাউনের মেয়ে তাঁকে নিয়ে গিয়ে নিজের ছেলের মতই মানুষ করে তুললেন। মূসা মিসরীয়দের সমস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন, আর তিনি কথায় ও কাজে শক্তিশালী ছিলেন। “মূসার বয়স যখন চল্লিশ বছর তখন তিনি তাঁর ইসরাইলীয় ভাইদের সংগে দেখা করতে চাইলেন। একজন মিসরীয়কে একজন ইসরাইলীয়ের প্রতি খারাপ ব্যবহার করতে দেখে তিনি সেই ইসরাইলীয়কে সাহায্য করতে গেলেন এবং সেই মিসরীয়কে হত্যা করে তার শোধ নিলেন। মূসা মনে করেছিলেন, তাঁর নিজের লোকেরা বুঝতে পারবে আল্লাহ্‌ তাঁর দ্বারাই তাদের উদ্ধার করবেন, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারল না। পরের দিন মূসা দু’জন ইসরাইলীয়কে মারামারি করতে দেখলেন। তখন তিনি তাদের মিলন করাবার জন্য বললেন, ‘ওহে, তোমরা তো ভাই ভাই; তবে একে অন্যের সংগে কেন এমন খারাপ ব্যবহার করছ?’ “কিন্তু যে লোকটি খারাপ ব্যবহার করছিল সে মূসাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাদের উপরে কে তোমাকে শাসনকর্তা ও বিচারকর্তা করেছে? গতকাল যেভাবে সেই মিসরীয়কে হত্যা করেছ, আমাকেও কি সেইভাবে হত্যা করতে চাও?’ এই কথা শুনে মূসা পালিয়ে গিয়ে মাদিয়ান দেশে বাস করতে লাগলেন। সেখানেই তাঁর দু’টি ছেলের জন্ম হল। “তারপর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেল। তুর পাহাড়ের কাছে যে মরুভূমি আছে সেখানে একটা জ্বলন্ত ঝোপের আগুনের মধ্যে একজন ফেরেশতা মূসাকে দেখা দিলেন। এ দেখে মূসা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ভাল করে দেখবার জন্য কাছে গেলে পর তিনি মাবুদের এই কথা শুনতে পেলেন, ‘আমি তোমার পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌- ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহ্‌।’ তখন মূসা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন; তাকিয়ে দেখবার সাহস পর্যন্ত তাঁর হল না। “তখন মাবুদ তাঁকে বললেন, ‘তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেল, কারণ যে জায়গায় তুমি দাঁড়িয়ে আছ তা পবিত্র। মিসর দেশে আমার বান্দাদের উপরে যে জুলুম হচ্ছে তা আমি দেখেছি। আমি তাদের কাতরোক্তি শুনেছি এবং তাদের উদ্ধার করবার জন্য নেমে এসেছি। এখন আমি তোমাকে মিসর দেশে ফিরে পাঠাব।’ “ইনি সেই একই মূসা যাঁকে বনি-ইসরাইলরা এই বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল, ‘কে তোমাকে শাসনকর্তা ও বিচারকর্তা করেছে?’ যে ফেরেশতা সেই ঝোপের মধ্যে মূসাকে দেখা দিয়েছিলেন সেই ফেরেশতার দ্বারা আল্লাহ্‌ নিজে এই মূসাকেই বনি-ইসরাইলদের শাসনকর্তা ও উদ্ধারকর্তা হিসাবে মিসরে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে এনেছিলেন এবং মিসর দেশে, লোহিত সাগরে ও চল্লিশ বছর ধরে মরুভূমিতে অনেক কুদরতি ও চিহ্ন-কাজ করেছিলেন। ইনিই সেই মূসা যিনি বনি-ইসরাইলদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের আল্লাহ্‌ তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন।’ তিনিই মরুভূমিতে বনি-ইসরাইলদের সেই দলের মধ্যে আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগে ছিলেন। যে ফেরেশতা তুর পাহাড়ে কথা বলেছিলেন তিনিই সেই ফেরেশতার সংগে সেখানে ছিলেন এবং আমাদের দেবার জন্য জীবন্ত বাণী তিনিই সেখানে পেয়েছিলেন। এই সময়েই তাঁরা বাছুরের মত করে একটা মূর্তি তৈরী করেছিলেন। তাঁরা সেই মূর্তির কাছে পশু উৎসর্গ করেছিলেন এবং নিজেদের হাতে যা তৈরী করেছিলেন তা নিয়ে তাঁরা একটা আনন্দ-উৎসব করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ মুখ ফিরালেন এবং আসমানের চাঁদ-সূর্য-তারার পূজাতেই তাঁদের ফেলে রাখলেন। এই একই কথা নবীদের কিতাবে লেখা আছে: হে ইসরাইলের লোকেরা, মরুভূমিতে সেই চল্লিশ বছর তোমরা কি আমার উদ্দেশে কোন পশু বা অন্য জিনিস কোরবানী দিয়েছিলে? না, বরং পূজা করবার জন্য যে মূর্তি তোমরা তৈরী করেছিলে সেই মোলক দেবের মূর্তি আর তোমাদের রিফণ দেবতার তারা তোমরা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। কাজেই আমি ব্যাবিলন দেশের ওপাশে বন্দী হিসাবে তোমাদের পাঠিয়ে দেব। “সাক্ষ্য-তাম্বুটি মরুভূমিতে আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগে ছিল। আল্লাহ্‌ মূসাকে যেভাবে হুকুম দিয়েছিলেন এবং মূসা যে নমুনা দেখেছিলেন সেইভাবেই এই তাম্বু তৈরী করা হয়েছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই তাম্বু পেয়ে তাঁদের নেতা ইউসার অধীনে তা নিজেদের সংগে আমাদের এই দেশে এনেছিলেন। আল্লাহ্‌ সেই সময় তাঁদের সামনে থেকে অন্য জাতিদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁরা এই দেশ অধিকার করেছিলেন। দাউদের সময় পর্যন্ত সেই তাম্বু এই দেশেই ছিল। দাউদ আল্লাহ্‌র রহমত পেয়ে ইয়াকুবের আল্লাহ্‌র থাকবার ঘর তৈরী করবার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন; কিন্তু সোলায়মানই তাঁর জন্য ঘর তৈরী করেছিলেন। “কিন্তু আল্লাহ্‌তা’লা মানুষের তৈরী ঘর-বাড়ীতে থাকেন না। নবী বলেছেন যে, মাবুদ বলেন, ‘বেহেশত আমার সিংহাসন, দুনিয়া আমার পা রাখবার জায়গা; আমার জন্য কি রকম ঘর তুমি তৈরী করবে? আমার বিশ্রামের স্থান কোথায় হবে? এই সব জিনিস কি আমি নিজের হাতে তৈরী করি নি?’ “হে একগুঁয়ে জাতি! অ-ইহুদীদের মতই আপনাদের কান ও দিল, আর আপনারাও ঠিক আপনাদের পূর্বপুরুষদের মত। আপনারা সব সময় পাক-রূহ্‌কে বাধা দিয়ে থাকেন। এমন কোন নবী আছেন কি, যাঁকে আপনাদের পূর্বপুরুষেরা জুলুম করেন নি? এমন কি, যাঁরা সেই ন্যায়বান লোকের, অর্থাৎ মসীহের আসবার কথা আগেই বলেছেন তাঁদেরও তাঁরা হত্যা করেছেন। আর এখন আপনারা ঈসাকেই শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে খুন করিয়েছেন। ফেরেশতাদের মধ্য দিয়ে আপনাদের কাছেই তো শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আপনারা তা পালন করেন নি।” এই সব কথা শুনে সেই নেতারা রেগে আগুন হয়ে গেলেন এবং স্তিফানের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন। কিন্তু স্তিফান পাক-রূহে পূর্ণ হয়ে বেহেশতের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্‌র মহিমা দেখতে পেলেন। তিনি ঈসাকে আল্লাহ্‌র ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “দেখুন, আমি দেখছি বেহেশত খোলা আছে এবং আল্লাহ্‌র ডান দিকে ইব্‌ন্তেআদম দাঁড়িয়ে রয়েছেন।” এতে তাঁরা কানে আংগুল দিলেন এবং খুব জোরে চিৎকার করে একসংগে স্তিফানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরে তাঁরা তাঁকে পাথর মারবার জন্য টেনে শহরের বাইরে নিয়ে গেলেন, আর সাক্ষীরা তাদের উপরের কাপড় খুলে শৌল নামে একজন যুবকের পায়ের কাছে রাখল। যখন সাক্ষীরা স্তিফানকে পাথর মারছিল তখন তিনি মুনাজাত করে বললেন, “হযরত ঈসা, আমার রূহ্‌কে গ্রহণ কর।” পরে তিনি হাঁটু পেতে চেঁচিয়ে বললেন, “প্রভু, এদের এই গুনাহ্‌ ধোরো না।” এই কথা বলে তিনি মারা গেলেন। শৌল সেখানে স্তিফানের খুনের পক্ষে সায় দিচ্ছিলেন। সেই দিন জেরুজালেমের ঈসায়ী জামাতের লোকদের উপর ভীষণ জুলুম শুরু হল। তাতে সাহাবীরা ছাড়া বাকী সব ঈমানদারেরা এহুদিয়া ও সামেরিয়া প্রদেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন আল্লাহ্‌ভক্ত লোক স্তিফানকে দাফন করলেন এবং তাঁর জন্য খুব বিলাপ করলেন। কিন্তু শৌল সেই জামাতকে ধ্বংস করবার চেষ্টায় ঘরে ঘরে গিয়ে সেই জামাতের পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের টেনে এনে জেলে দিতে লাগলেন। যে ঈমানদারেরা ছড়িয়ে পড়েছিল তারা চারদিকে গিয়ে মসীহের সুসংবাদের কথা তবলিগ করতে লাগল। সেই সময় ফিলিপ সামেরিয়া প্রদেশের একটা শহরে গিয়ে মসীহের বিষয় তবলিগ করলেন। লোকেরা তাঁর কথা শুনে এবং তিনি যে সব অলৌকিক চিহ্ন-কাজ করছিলেন তা দেখে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনল। অনেকের মধ্য থেকে ভূত চিৎকার করে বের হয়ে গেল এবং অনেক অবশ রোগী ও খোঁড়া সুস্থ হল। তাতে সেই শহরের লোকেরা খুব আনন্দিত হল। সেই শহরে শিমোন নামে একজন লোক অনেক দিন থেকেই জাদু দেখাচ্ছিল। তাতে সামেরিয়ার সব লোক আশ্চর্য হয়েছিল। সে নিজেকে একজন বিশেষ লোক বলে দাবি করত, আর ধনী-গরীব সবাই তার কথায় কান দিত। লোকে বলত, “আল্লাহ্‌র যে কুদরতকে মহৎ কুদরত বলা হয় এই লোকটিই সেই কুদরত।” লোকে তার কথামত চলত, কারণ অনেক দিন ধরেই সে তার জাদু দেখিয়ে তাদের আশ্চর্য করেছিল। কিন্তু ফিলিপ যখন আল্লাহ্‌র রাজ্য ও ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করলেন তখন লোকেরা তাঁর কথায় ঈমান আনল এবং পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা তরিকাবন্দী নিতে লাগল। সেই শিমোনও ঈমান এনে তরিকাবন্দী নিল, আর সে ফিলিপের পিছনে পিছনে সব জায়গায় গেল এবং চিহ্ন-কাজ ও বড় বড় অলৌকিক কাজ দেখে অবাক হল। জেরুজালেমের সাহাবীরা যখন শুনলেন যে, সামেরিয়ার লোকেরা আল্লাহ্‌র কালামের উপর ঈমান এনেছে তখন তাঁরা পিতর ও ইউহোন্নাকে সেই লোকদের কাছে পাঠালেন। পিতর ও ইউহোন্না এসে তাদের জন্য মুনাজাত করলেন যেন তারা পাক-রূহ্‌ পায়, কারণ তখনও তাদের উপর পাক-রূহ্‌ আসেন নি; কেবল হযরত ঈসার নামে তাদের তরিকাবন্দী হয়েছিল। তখন পিতর ও ইউহোন্না তাদের উপর হাত রাখলেন, আর তারা পাক-রূহ্‌ পেল। যখন শিমোন দেখল যে, সাহাবীদের হাত রাখবার মধ্য দিয়ে পাক-রূহ্‌কে দেওয়া হল তখন সে তাঁদের কাছে টাকা এনে বলল, “আমাকেও এই শক্তি দিন যেন আমি কারও উপরে হাত রাখলে সে পাক-রূহ্‌ পায়।” তখন পিতর তাকে বললেন, “তোমার টাকা তোমার সংগেই ধ্বংস হোক, কারণ তুমি মনে করেছ আল্লাহ্‌র দান টাকা দিয়ে কেনা যায়। আমাদের এই কাজে তোমার কোন ভাগ বা অধিকার নেই, কারণ আল্লাহ্‌র চোখে তোমার দিল ঠিক নয়। এই খারাপী থেকে তুমি তওবা কর ও মাবুদের কাছে মুনাজাত কর; তাহলে তোমার মনের এই খারাপ চিন্তা হয়তো তিনি মাফও করতে পারেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার মন লোভে ভরা এবং তুমি গুনাহের কাছে বন্দী হয়ে আছ।” তখন শিমোন বলল, “আপনারাই মাবুদের কাছে আমার জন্য দোয়া করুন যেন আপনারা যা বললেন তা আমার উপর না ঘটে।” এর পরে পিতর ও ইউহোন্না প্রভুর বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে ও তাঁর কালাম তবলিগ করে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। যাবার পথে তাঁরা সামেরীয়দের অনেক গ্রামে সুসংবাদ তবলিগ করলেন। একদিন মাবুদের একজন ফেরেশতা ফিলিপকে বললেন, “ওঠো, দক্ষিণ দিকের যে পথ জেরুজালেম থেকে গাজা শহরের দিকে গেছে সেই পথে যাও।” পথটা ছিল মরুভূমির মধ্যে। তখন ফিলিপ সেই দিকে গেলেন। পথে ইথিওপিয়া দেশের একজন বিশেষ রাজকর্মচারীর সংগে তাঁর দেখা হল। সেই কর্মচারী ছিলেন খোজা। ইথিওপিয়ার কান্দাকী রাণীর ধনরত্নের দেখাশোনা করবার ভার ছিল এই লোকটির উপর। আল্লাহ্‌র এবাদত করবার জন্য সেই কর্মচারী জেরুজালেমে গিয়েছিলেন। বাড়ী ফিরবার পথে তিনি রথে বসে নবী ইশাইয়ার কিতাবখানা তেলাওয়াত করছিলেন। তখন পাক-রূহ্‌ ফিলিপকে বললেন, “ঐ রথের কাছে যাও এবং তার সংগে সংগে চল।” এতে ফিলিপ দৌড়ে সেই রথের কাছে গেলেন এবং শুনতে পেলেন লোকটি নবী ইশাইয়ার কিতাবখানা তেলাওয়াত করছেন। ফিলিপ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি যা তেলাওয়াত করছেন তা বুঝতে পারছেন কি?” সেই কর্মচারী বললেন, “কেউ বুঝিয়ে না দিলে কেমন করে বুঝতে পারব?” তিনি ফিলিপকে রথে উঠে তাঁর কাছে বসতে অনুরোধ করলেন। সেই কর্মচারী পাক-কিতাবের যে অংশটুকু তেলাওয়াত করছিলেন তা এই: জবাই করবার জন্য যেমন ভেড়া নেওয়া হয়, তেমনি তাঁকে নেওয়া হল। লোম ছাঁটাইকারীর সামনে ভেড়ার বাচ্চা যেমন চুপ করে থাকে, তেমনি তিনি মুখ খুললেন না। তিনি অপমানিত হলেন, তাঁর উপর ন্যায়বিচার করা হয় নি। তাঁর বংশের কথা বলা সম্ভব নয়, কারণ তাঁর জীবন এই দুনিয়া থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই কর্মচারী ফিলিপকে বললেন, “বলুন না, নবী কার বিষয়ে এই কথা বলেছেন? নিজের বিষয়ে, না অন্য কারও বিষয়ে?” তখন ফিলিপ পাক-কিতাবের সেই অংশ থেকে শুরু করে তাঁর কাছে ঈসার বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করলেন। তিনি রথ থামাতে বললেন। তার পরে ফিলিপ এবং সেই কর্মচারী পানির মধ্যে নামলেন ও ফিলিপ তাঁকে তরিকাবন্দী দিলেন। যখন তাঁরা পানি থেকে উঠে আসলেন তখন মাবুদের রূহ্‌ হঠাৎ ফিলিপকে নিয়ে গেলেন। সেই কর্মচারী আর তাঁকে দেখতে পেলেন না। তখন তিনি আনন্দ করতে করতে বাড়ীর পথে চললেন। ফিলিপকে কিন্তু অস্‌দোদ শহরে দেখতে পাওয়া গেল। তিনি গ্রামে গ্রামে সুসংবাদ তবলিগ করতে করতে শেষে সিজারিয়াতে গেলেন। পথে যেতে যেতে যখন তিনি দামেস্কের কাছে আসলেন তখন আসমান থেকে হঠাৎ তাঁর চারদিকে আলো পড়ল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং শুনলেন কে যেন তাঁকে বলছেন, “শৌল, শৌল, কেন তুমি আমার উপর জুলুম করছ?” শৌল জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রভু, আপনি কে?” তিনি বললেন, “আমি ঈসা, যাঁর উপর তুমি জুলুম করছ। এখন তুমি উঠে শহরে যাও। কি করতে হবে তা তোমাকে বলা হবে।” যে লোকেরা শৌলের সংগে যাচ্ছিল তারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা কথা শুনেছিল কিন্তু কাউকে দেখতে পায় নি। পরে শৌল মাটি থেকে উঠলেন, কিন্তু চোখ খুললে পর কিছুই দেখতে পেলেন না। তখন তাঁর সংগীরা হাত ধরে তাঁকে দামেস্কে নিয়ে গেল। তিন দিন পর্যন্ত শৌল চোখে দেখতে পেলেন না এবং কিছুই খেলেন না। দামেস্ক শহরে অননিয় নামে একজন উম্মত ছিলেন। প্রভু তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, “অননিয়।” জবাবে তিনি বললেন, “প্রভু, এই যে আমি।” অননিয় বললেন, “প্রভু, আমি অনেকের মুখে এই লোকের বিষয় শুনেছি যে, জেরুজালেমে তোমার বান্দাদের উপর সে কত জুলুম করেছে। এছাড়া যারা তোমার নামে মুনাজাত করে তাদের ধরবার জন্য প্রধান ইমামদের কাছ থেকে অধিকার নিয়ে সে এখানে এসেছে।” কিন্তু প্রভু অননিয়কে বললেন, “তুমি যাও, কারণ অ-ইহুদীদের ও তাদের বাদশাহ্‌দের এবং বনি-ইসরাইলদের কাছে আমার সম্বন্ধে তবলিগ করবার জন্য আমি এই লোককেই বেছে নিয়েছি। আমার জন্য কত কষ্ট যে তাকে পেতে হবে তা আমি তাকে দেখাব।” তখন অননিয় গিয়ে সেই বাড়ীর মধ্যে ঢুকলেন আর শৌলের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই শৌল, এখানে আসবার পথে যিনি তোমাকে দেখা দিয়েছিলেন তিনি হযরত ঈসা। তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন যেন তুমি তোমার দেখবার শক্তি ফিরে পাও এবং পাক-রূহে পূর্ণ হও।” তার পরে সময় নষ্ট না করে তিনি ভিন্ন ভিন্ন মজলিস-খানায় এই কথা তবলিগ করতে লাগলেন যে, ঈসাই ইব্‌নুল্লাহ্‌। যারা তাঁর কথা শুনত তারা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করত, “জেরুজালেমে যারা ঈসার নামে মুনাজাত করে তাদের যে জুলুম করত এ কি সেই লোক নয়? এখানেও যারা তা করে তাঁদের বেঁধে প্রধান ইমামদের কাছে নিয়ে যাবার জন্যই কি সে এখানে আসে নি?” শৌল কিন্তু আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলেন এবং ঈসাই যে মসীহ্‌ তা প্রমাণ করলেন। এতে দামেস্কের ইহুদীরা বুদ্ধিহারা হয়ে গেল। এর অনেক দিন পরে ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করতে লাগল, কিন্তু শৌল তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলেন। তাঁকে হত্যা করবার জন্য ইহুদীরা শহরের দরজাগুলো দিনরাত পাহারা দিতে লাগল। কিন্তু একদিন রাতের বেলা শৌলের শাগরেদেরা একটা ঝুড়িতে করে দেয়ালের একটা জানালার মধ্য দিয়ে তাঁকে নীচে নামিয়ে দিল। শৌল জেরুজালেমে এসে উম্মতদের সংগে যোগ দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারা সবাই তাঁকে ভয় করতে লাগল। তারা বিশ্বাস করতে পারল না যে, শৌল সত্যিই একজন উম্মত হয়েছেন। কিন্তু বার্নাবাস তাঁকে সংগে করে সাহাবীদের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁদের জানালেন, দামেস্কের পথে শৌল কিভাবে হযরত ঈসাকে দেখতে পেয়েছিলেন এবং ঈসা তাঁর সংগে কিভাবে কথা বলেছিলেন, আর দামেস্কে ঈসার সম্বন্ধে তিনি কিভাবে সাহসের সংগে তবলিগ করেছিলেন। এর পরে শৌল জেরুজালেমে উম্মতদের সংগে রইলেন এবং তাঁদের সংগে চলাফেরা করতেন ও প্রভুর বিষয়ে সাহসের সংগে তবলিগ করে বেড়াতেন। যে ইহুদীরা গ্রীক ভাষা বলত তাদের সংগে তিনি কথা বলতেন ও তর্ক করতেন, কিন্তু এই ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করবার চেষ্টা করতে লাগল। ঈমানদার ভাইয়েরা এই কথা শুনে তাঁকে সিজারিয়া শহরে নিয়ে গেলেন এবং পরে তাঁকে তার্ষ শহরে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সময় এহুদিয়া, গালীল ও সামেরিয়া প্রদেশের জামাতগুলোতে শান্তি ছিল, আর সেই জামাতগুলো গড়ে উঠছিল। ফলে প্রভুর প্রতি ভয়ে ও পাক-রূহের উৎসাহে তাদের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছিল। পিতর সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে লুদ্দা গ্রামে আল্লাহ্‌র যে বান্দারা ছিলেন তাঁদের কাছে আসলেন। সেই গ্রামে ঐনিয় বলে একজন লোক ছিল। সে অবশ রোগে আট বছর ধরে বিছানায় পড়ে ছিল। পিতর তাকে দেখে বললেন, “ঐনিয়, ঈসা মসীহ্‌ তোমাকে ভাল করলেন। ওঠো, তোমার বিছানা তুলে নাও।” আর তখনই ঐনিয় উঠে দাঁড়াল। তখন লুদ্দা ও শারোণ গ্রামের সমস্ত লোক ঐনিয়কে দেখে প্রভুর দিকে ফিরল। জাফা শহরে টাবিথা নামে একজন উম্মত ছিলেন। গ্রীক ভাষায় এই নামের অর্থ দর্কা। তিনি সব সময় অন্যদের উপকার করতেন ও গরীবদের সাহায্য করতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন, আর লোকেরা তাঁকে গোসল করিয়ে উপরের কামরায় রেখেছিল। জাফা ছিল লুদ্দার কাছে; এইজন্য উম্মতেরা যখন শুনল যে, পিতর লুদ্দাতে আছেন তখন তারা দু’জন লোক তাঁর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে এই অনুরোধ জানাল, “আপনি তাড়াতাড়ি করে আমাদের কাছে আসুন।” তখন পিতর তাদের সংগে গেলেন। তিনি সেখানে পৌঁছালে পর সেই উপরের কামরায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল। সমস্ত বিধবারা তখন পিতরের চারদিকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল এবং দর্কা বেঁচে থাকতে যে সব কোর্তা ও অন্যান্য কাপড়-চোপড় তৈরী করেছিলেন তা পিতরকে দেখাতে লাগল। তখন পিতর তাদের সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে হাঁটু পেতে মুনাজাত করলেন। তারপর সেই মৃত স্ত্রীলোকটির দিকে ফিরে বললেন, “টাবিথা, ওঠো।” তাতে দর্কা চোখ খুললেন এবং পিতরকে দেখে উঠে বসলেন। পিতর তখন তাঁর হাত ধরে তাঁকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। পরে তিনি আল্লাহ্‌র বান্দাদের ও বিধবাদের ডেকে তাদের দেখালেন যে, দর্কা বেঁচে উঠেছেন। এই কথা জাফা শহরের সবাই জানতে পারল এবং অনেকেই প্রভুর উপর ঈমান আনল। পিতর জাফাতে শিমোন নামে একজন লোকের বাড়ীতে বেশ কিছু দিন কাটালেন। এই শিমোন চামড়ার কাজ করত। সিজারিয়া শহরে কর্ণীলিয় নামে একজন লোক ইটালীয় সৈন্যদলের শত-সেনাপতি ছিলেন। ইহুদী না হলেও তিনি আল্লাহ্‌ভক্ত ছিলেন এবং তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই আল্লাহ্‌র এবাদত করতেন। তিনি গরীবদের অনেক টাকা-পয়সা দান করতেন এবং আল্লাহ্‌র কাছে প্রায়ই মুনাজাত করতেন। একদিন বেলা তিনটার সময় তিনি একটা দর্শন পেলেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতা এসে তাঁকে ডাকছেন, “কর্ণীলিয়।” কর্ণীলিয় ভয় পেয়ে সেই ফেরেশতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলুন, হুজুর।” ফেরেশতা বললেন, “তোমার মুনাজাত ও গরীবদের তোমার দানের কথা বেহেশতে পৌঁছেছে এবং আল্লাহ্‌ তা মনে রেখেছেন। এখন তুমি জাফা শহরে লোক পাঠাও, আর শিমোন, যার আর এক নাম পিতর, তাকে ডেকে আন। সমুদ্রের ধারে আর একজন শিমোন থাকে। সে চামড়ার কাজ করে। পিতর সেই শিমোনের বাড়ীতে আছে।” যে ফেরেশতা কর্ণীলিয়ের সংগে কথা বলছিলেন তিনি চলে গেলে পর কর্ণীলিয় দু’জন চাকর ও একজন সাহায্যকারী সৈন্যকে ডাকলেন। এই সৈন্যটি আল্লাহ্‌ভক্ত ছিল। সমস্ত কথা বুঝিয়ে বলবার পরে কর্ণীলিয় তাদের জাফাতে পাঠিয়ে দিলেন। পরের দিন যখন সেই লোকেরা জাফা শহরের দিকে আসছিল তখন বেলা প্রায় দুপুর। পিতর মুনাজাত করবার জন্য সেই সময় ছাদে উঠলেন। তখন পিতরের খুব খিদে পেয়েছিল এবং তিনি কিছু খেতে চাইছিলেন। যখন খাবার তৈরী হচ্ছিল তখন পিতর তন্দ্রার মত অবস্থায় ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি দেখলেন, আসমান খুলে গেছে এবং বড় চাদরের মত কোন একটা জিনিসকে চার কোণা ধরে দুনিয়াতে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই চাদরের মধ্যে আছে সব রকম পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং পাখী। তার পরে তিনি শুনলেন কে যেন তাঁকে বলছেন, “পিতর, ওঠো, মেরে খাও।” পিতর বললেন, “না, না, প্রভু, কিছুতেই না। অপবিত্র বা নাপাক কোন কিছু আমি কখনও খাই নি।” তখন তিনি আবার শুনলেন, “আল্লাহ্‌ যা পাক-সাফ করেছেন তাকে তুমি অপবিত্র বোলো না।” এই রকম তিন বার হবার পরে সেই চাদরটা আসমানে তুলে নেওয়া হল। যে দর্শন পিতর পেয়েছিলেন তার অর্থ কি হতে পারে তা তিনি তখনও ভাবছিলেন; এমন সময় কর্ণীলিয়ের পাঠানো লোকেরা শিমোনের বাড়ী খুঁজে পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর তারা ডেকে জিজ্ঞাসা করল, “শিমোন, যাঁকে পিতরও বলা হয়, তিনি কি এখানে থাকেন?” পিতর তখনও দর্শনের কথা ভাবছিলেন, এমন সময় পাক-রূহ্‌ তাঁকে বললেন, “দেখ, তিনজন লোক তোমার তালাশ করছে। উঠে নীচে যাও। কোন সন্দেহ না করে তাদের সংগে যাও, কারণ আমিই তাদের পাঠিয়েছি।” তখন পিতর নেমে এসে সেই লোকদের বললেন, “আপনারা যার তালাশ করছেন আমিই সেই লোক। আপনারা কেন এসেছেন?” সেই লোকেরা বলল, “শত-সেনাপতি কর্ণীলিয় আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি একজন ধার্মিক লোক এবং তিনি আল্লাহ্‌কে ভয় করেন। সমস্ত ইহুদীরা তাঁর সুনাম করে। আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতা তাঁকে হুকুম দিয়েছেন যেন তিনি আপনাকে তাঁর বাড়ীতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আপনার কথা শোনেন।” তখন পিতর বাড়ীর মধ্যে সেই লোকদের ডেকে আনলেন এবং তাদের থাকবার ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পরের দিন পিতর সেই লোকদের সংগে রওনা হলেন। জাফা শহরের কয়েকজন ঈমানদার ভাইও তাঁর সংগে গেলেন। পরদিন তাঁরা সিজারিয়াতে পৌঁছালেন। সেই সময় কর্ণীলিয় তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বিশেষ বন্ধু-বান্ধবদের একত্র করে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পিতর যখন ঘরে ঢুকলেন তখন কর্ণীলিয় তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ের উপর উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সেজদা করলেন। কিন্তু পিতর তাঁকে উঠিয়ে বললেন, “উঠুন, আমি নিজেও তো কেবল একজন মানুষ।” কর্ণীলিয়ের সংগে কথা বলতে বলতে পিতর ভিতরে গিয়ে দেখলেন সেখানে অনেক লোক জমায়েত হয়েছে। তখন তিনি তাদের বললেন, “আপনারা তো জানেন যে, একজন ইহুদীর পক্ষে একজন অ-ইহুদীর সংগে মেলামেশা করা বা তার সংগে দেখা করা আমাদের শরীয়তের বিরুদ্ধে। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন, কাউকে অপবিত্র বা নাপাক বলা আমার উচিত নয়। সেইজন্য যখন আপনারা আমাকে ডেকে পাঠালেন তখন আমি কোন আপত্তি না করেই এসেছি। এখন আমি জিজ্ঞাসা করছি, আপনারা কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?” তখন কর্ণীলিয় বললেন, “চার দিন আগে ঠিক এই সময়ে বেলা তিনটায় আমি আমার ঘরে মুনাজাত করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ উজ্জ্বল কাপড় পরা একজন লোক আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কর্ণীলিয়, আল্লাহ্‌ তোমার মুনাজাত শুনেছেন এবং গরীবদের তোমার দানের কথা তিনি মনে রেখেছেন। এখন তুমি জাফাতে লোক পাঠাও, আর শিমোন, যাকে পিতরও বলা হয়, তাকে ডেকে আন। সমুদ্রের ধারে যে শিমোন থাকে এবং চামড়ার কাজ করে পিতর তারই বাড়ীতে মেহমান হয়ে আছে।’ সেইজন্য আমি তখনই আপনাকে ডেকে আনবার জন্য লোক পাঠিয়ে দিলাম, আর আপনি এসে ভালই করেছেন। এখানে আমরা সবাই এখন আল্লাহ্‌র সামনে আছি। প্রভু আপনাকে আমাদের কাছে যা বলতে হুকুম দিয়েছেন আমরা তা সবই শুনব।” তখন পিতর বলতে শুরু করলেন, “আমি এখন সত্যিই বুঝতে পারলাম আল্লাহ্‌র চোখে সবাই সমান। প্রত্যেক জাতির মধ্য থেকে যারা তাঁকে ভয় করে এবং তাঁর চোখে যা ঠিক তা-ই করে তিনি তাদের গ্রহণ করেন। আল্লাহ্‌ বনি-ইসরাইলদের কাছে এই সুসংবাদ পাঠিয়েছিলেন যে, ঈসা মসীহ্‌, যিনি সকলের প্রভু, তাঁরই মধ্য দিয়ে শান্তি পাওয়া যায়। লোকদের যে তরিকাবন্দী নেওয়া উচিত ইয়াহিয়া সেই কথা তবলিগ করবার পরে গালীল থেকে শুরু করে সমস্ত এহুদিয়াতে যা ঘটেছিল তা আপনারা নিজেরাই জানেন। আপনারা এও জানেন যে, আল্লাহ্‌ নাসরতের ঈসাকে পাক-রূহ্‌ ও শক্তি দিয়ে অভিষেক করেছিলেন। আল্লাহ্‌ তাঁর সংগে ছিলেন বলে তিনি ভাল কাজ করে বেড়াতেন এবং ইবলিসের হাতে যারা কষ্ট পেত তাদের সবাইকে সুস্থ করতেন। “ইহুদীদের দেশে এবং জেরুজালেমে তিনি যা কিছু করেছিলেন আমরা তার সাক্ষী। লোকেরা তাঁকে ক্রুশে টাংগিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌ তৃতীয় দিনে তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুললেন এবং এমন করলেন যাতে লোকেরা তাঁকে দেখতে পায়। তবে সকলে তাঁকে দেখতে পায় নি, কিন্তু আল্লাহ্‌ যে সাক্ষীদের আগেই বেছে রেখেছিলেন তারাই তাঁকে দেখতে পেয়েছিল, অর্থাৎ তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার পরে আমরা যারা তাঁর সংগে খাওয়া-দাওয়া করেছি আমরাই তাঁকে দেখতে পেয়েছি। তিনি আমাদের হুকুম দিয়েছেন যেন আমরা ইহুদীদের কাছে তবলিগ করি এবং সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ্‌ তাঁকেই জীবিত ও মৃতদের বিচারকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। সব নবীরাই তাঁর বিষয়ে এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তাঁর উপর যারা ঈমান আনে তারা প্রত্যেকে তাঁর গুণে গুনাহের মাফ পায়।” পিতর তখনও কথা বলছেন, এমন সময় যারা সেই কথা শুনছিল তাদের সকলের উপরে পাক-রূহ্‌ আসলেন। যে ইহুদী ঈমানদারেরা পিতরের সংগে এসেছিল তারা অ-ইহুদীদের উপরেও পাক-রূহ্‌কে দান হিসাবে ঢেলে দেওয়া হল দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা তা বুঝতে পারল কারণ এই অ-ইহুদীদের তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে ও আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে শুনল। তখন পিতর বললেন, “পানিতে তরিকাবন্দী নিতে কি এই লোকদের কেউ বাধা দিতে পারে? তারা তো আমাদেরই মত পাক-রূহ্‌কে পেয়েছে।” তখন তিনি সেই লোকদের ঈসা মসীহের নামে তরিকাবন্দী দেবার হুকুম দিলেন। পরে তারা পিতরকে তাঁদের কাছে কয়েক দিন থাকতে অনুরোধ করল। অ-ইহুদীরাও যে আল্লাহ্‌র কালামের উপর ঈমান এনেছে সেই কথা সাহাবীরা এবং সমস্ত এহুদিয়ার ঈমানদার ভাইয়েরা শুনলেন। এইজন্য পিতর যখন জেরুজালেমে আসলেন তখন সেই ঈমানদারদের মধ্যে যারা খৎনা করানো ছিল তারা তাঁকে দোষ দিয়ে বলল, “আপনি খৎনা-না-করানো লোকদের ঘরে গিয়ে তাদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করেছেন।” তখন পিতর প্রথম থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছিল তা এক এক করে বুঝিয়ে বললেন, “আমি জাফা শহরে মুনাজাত করছিলাম, এমন সময় তন্দ্রার মত অবস্থায় পড়ে একটা দর্শন পেলাম। আমি দেখলাম বড় চাদরের মত কি একটা জিনিস চার কোণা ধরে আসমান থেকে আমার কাছে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম তার মধ্যে নানা রকম পশু, বুনো জানোয়ার, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং পাখী আছে। পরে আমি শুনলাম কেউ যেন বলছেন, ‘পিতর, ওঠো, মেরে খাও।’ “আমি বললাম, ‘না, না, প্রভু, কিছুতেই না। অপবিত্র বা নাপাক কোন কিছু কখনও আমি মুখে দিই নি।’ “এর পরে আসমান থেকে দ্বিতীয় বার বলা হল, ‘আল্লাহ্‌ যা পাক-সাফ করেছেন তাকে তুমি অপবিত্র বোলো না।’ এই রকম তিনবার হল, তার পরে সব কিছু আবার আসমানে তুলে নেওয়া হল। “এর প্রায় সংগে সংগে আমি যে বাড়ীতে ছিলাম সেই বাড়ীতে তিনজন লোক এসে দাঁড়াল। সিজারিয়া থেকে তাদের পাঠানো হয়েছিল। তখন পাক-রূহ্‌ আমাকে কোন সন্দেহ না করে তাদের সংগে যেতে বললেন। এই ছয়জন ভাইও আমার সংগে গিয়েছিলেন। পরে আমরা সেই লোকের বাড়ীতে ঢুকলাম যিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি একজন ফেরেশতাকে কেমন ভাবে তাঁর বাড়ীতে দেখেছিলেন তা আমাদের বললেন। সেই ফেরেশতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘শিমোন, যাকে পিতরও বলা হয়, তাকে ডেকে আনতে তুমি জাফা শহরে লোক পাঠাও। সে তোমার কাছে যে কথা বলবে সেই কথার দ্বারা তুমি ও তোমার পরিবারের সমস্ত লোক নাজাত পাবে।’ “পাক-রূহ্‌ যেভাবে প্রথমে আমাদের উপরে এসেছিলেন আমি কথা বলতে শুরু করলে পর ঠিক সেইভাবে তাদেরও উপরে আসলেন। তখন প্রভু যা বলেছিলেন সেই কথা আমার মনে পড়ল, ‘ইয়াহিয়া পানিতে তরিকাবন্দী দিতেন, কিন্তু তোমাদের তরিকাবন্দী হবে পাক-রূহে।’ তাহলে হযরত ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনলে পর আল্লাহ্‌ আমাদের যে দান দিয়েছিলেন সেই একই দান যখন তিনি তাদেরও দিলেন তখন আমি কে যে, আল্লাহ্‌কে বাধা দিতে পারি?” এই কথা শুনে এহুদিয়ার ঈমানদারেরা আর আপত্তি না করে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে বলল, “তাহলে আল্লাহ্‌ অ-ইহুদীদেরও জীবন পাবার জন্য তওবা করতে সুযোগ দিলেন।” স্তিফানকে কেন্দ্র করে ঈমানদারদের উপর জুলুমের দরুন যারা ছড়িয়ে পড়েছিল তারা ফিনিশিয়া, সাইপ্রাস ও এণ্টিয়ক পর্যন্ত গিয়ে কেবল ইহুদীদের কাছেই আল্লাহ্‌র কালাম বলল। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজন এণ্টিয়কে গিয়ে গ্রীক ভাষায় কথা বলা লোকদের কাছেও হযরত ঈসার বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করতে লাগল। এরা ছিল সাইপ্রাস দ্বীপ ও কুরীণী শহরের লোক। আল্লাহ্‌র শক্তি তাদের উপর ছিল বলে অনেক লোক প্রভুর উপর ঈমান এনে তাঁর দিকে ফিরল। এই খবর জেরুজালেমের জামাতের লোকদের কানে গেলে পর তারা বার্নাবাসকে এণ্টিয়ক শহরে পাঠিয়ে দিল। আল্লাহ্‌ যে কিভাবে এণ্টিয়কের লোকদের রহমত করেছেন বার্নাবাস এসে তা দেখে খুব আনন্দিত হলেন। তারা যেন সমস্ত দিল দিয়ে প্রভুর কাছে বিশ্বস্ত থাকে সেইজন্য তিনি তাদের সকলকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। বার্নাবাস একজন ভাল লোক ছিলেন এবং তিনি পাক-রূহে ও বিশ্বাসে পূর্ণ ছিলেন। তখন প্রভু অনেককেই তাঁর নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। এর পরে বার্নাবাস শৌলের খোঁজে তার্ষ শহরে গেলেন, আর তাঁকে খুঁজে পেয়ে এণ্টিয়কে আনলেন। বার্নাবাস আর শৌল এক বছর পর্যন্ত জামাতের লোকদের সংগে মিলিত হয়ে অনেক লোককে শিক্ষা দিলেন। এণ্টিয়কেই মসীহের উম্মতদের ঈসায়ী নামে প্রথম ডাকা হল। এর মধ্যে কয়েকজন নবী জেরুজালেম থেকে এণ্টিয়কে আসলেন। তাঁদের মধ্যে আগাব নামে একজন উঠে দাঁড়িয়ে পাক-রূহের পরিচালনায় বললেন যে, সারা রোম সাম্রাজ্যে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ হবে। (সম্রাট ক্লাডিয়াসের রাজত্বের সময়ে সেই কথা পূর্ণ হয়েছিল।) তখন উম্মতেরা ঠিক করল, এহুদিয়া প্রদেশের ঈমানদার ভাইদের সাহায্যের জন্য তারা প্রত্যেকে নিজের নিজের সাধ্য অনুসারে টাকা পাঠাবে। তারা তা করেছিল। তারা বার্নাবাস ও শৌলের হাতে এহুদিয়ার জামাতগুলোর বৃদ্ধ নেতাদের কাছে সেই সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় বাদশাহ্‌ হেরোদ জুলুম করবার জন্য ঈসায়ী জামাতের কয়েকজন লোককে ধরে এনেছিলেন। তিনি ইউহোন্নার ভাই ইয়াকুবকে ছোরা দিয়ে খুন করিয়েছিলেন। যখন তিনি দেখলেন ইহুদীরা তাতে খুশী হয়েছে তখন তিনি পিতরকেও ধরতে গেলেন। এই ঘটনা খামিহীন রুটির ঈদের সময়ে হয়েছিল। তিনি পিতরকে ধরে জেলে দিলেন। চারজন চারজন করে চার দল সৈন্যের উপর পিতরকে পাহারা দেবার ভার দেওয়া হল। হেরোদ ঠিক করলেন, উদ্ধার-ঈদের পরে বিচার করবার জন্য পিতরকে লোকদের কাছে বের করে আনবেন। এইজন্যই পিতরকে জেলখানায় আটক রাখা হল। জামাতের লোকেরা কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছে পিতরের জন্য আকুলভাবে মুনাজাত করছিল। যেদিন হেরোদ বিচারের জন্য পিতরকে বের করে আনবেন তার আগের রাতে দু’জন সৈন্যের মাঝখানে পিতর ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে দু’টা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং পাহারাদারেরা দরজায় পাহারা দিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ মাবুদের একজন ফেরেশতা সেখানে এসে দাঁড়ালেন। তাতে জেলখানার সেই ঘরটা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ফেরেশতা পিতরের গায়ে জোরে ঠেলা দিয়ে তাঁকে জাগিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি ওঠো।” এতে পিতরের দু’হাত থেকে শিকল খুলে পড়ে গেল। তখন ফেরেশতা পিতরকে বললেন, “তোমার কোমরে কোমর-বাঁধনি লাগাও, পায়ে জুতা দাও।” পিতর তা-ই করলেন। ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “তোমার চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে আমার পিছনে পিছনে এস।” পিতর তাঁর পিছনে পিছনে জেলখানা থেকে বাইরে আসলেন, কিন্তু ফেরেশতা যা করছিলেন তা যে সত্যিসত্যিই ঘটছে তার কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না। তিনি মনে করলেন দর্শন দেখছেন। তাঁরা প্রথম ও দ্বিতীয় পাহারাদারদের দল পার হয়ে শহরে ঢুকবার লোহার সদর দরজার কাছে আসলেন। সদর দরজাটা তাঁদের জন্য নিজে নিজেই খুলে গেল এবং তাঁরা তার মধ্য দিয়ে বের হয়ে গেলেন। তাঁরা একটা রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছেন এমন সময় ফেরেশতা হঠাৎ পিতরকে ছেড়ে চলে গেলেন। তখন পিতর যেন চেতনা ফিরে পেলেন আর বললেন, “এখন আমি সত্যি বুঝতে পারলাম যে, মাবুদ তাঁর ফেরেশতাকে পাঠিয়ে হেরোদের হাত থেকে এবং ইহুদীরা যা করবার জন্য ষড়যন্ত্র করছিল তা থেকে আমাকে রক্ষা করলেন।” এই কথা বুঝতে পেরে তিনি ইউহোন্নার মা মরিয়মের বাড়ীতে গেলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক বলেও ডাকা হত। সেই বাড়ীতে অনেকে একসংগে মিলিত হয়ে মুনাজাত করছিল। পিতর বাইরের দরজায় আঘাত করলে পর রোদা নামে একজন চাকরাণী মেয়ে দরজা খুলতে আসল। পিতরের গলার আওয়াজ চিনতে পেরে সে এত আনন্দিত হল যে, দরজা না খুলেই দৌড়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে সংবাদ দিল, “পিতর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।” তখন উম্মতেরা সেই মেয়েটিকে বলল, “তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।” কিন্তু সে বার বার জোর দিয়ে বলাতে তারা বলল, “তবে এ পিতরের রক্ষাকারী-ফেরেশতা।” এদিকে পিতর দরজায় আঘাত করতেই থাকলেন। তখন উম্মতেরা দরজা খুলে পিতরকে দেখে অবাক হয়ে গেল। পিতর তাদের চুপ করাবার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করলেন এবং জেলখানা থেকে প্রভু তাঁকে কিভাবে বের করে এনেছেন তা জানালেন। শেষে তিনি বললেন, “এই খবর ইয়াকুব ও অন্য ভাইদেরও দিয়ো।” এই কথা বলে তিনি বের হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। সকাল হলে পর পিতর কোথায় গেল তা নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে হুলস'ূল পড়ে গেল। হেরোদ খুব ভাল করেই তাঁর তালাশ করলেন, কিন্তু তাঁকে না পেয়ে পাহারাদারদের জেরা করলেন এবং পরে সেই পাহারাদারদের হত্যা করবার হুকুম দিলেন। এর পরে হেরোদ এহুদিয়া থেকে সিজারিয়াতে গেলেন ও সেখানে কিছু দিন থাকলেন। সেই সময় হেরোদ টায়ার ও সিডন শহরের লোকদের উপর রেগে আগুন হলেন। তখন সেখানকার লোকেরা একসংগে মিলে হেরোদের সংগে দেখা করতে গেল। ব্লাস- নামে বাদশাহ্‌র শোবার ঘরের বিশ্বস্ত কর্মচারীকে নিজেদের পক্ষে এনে তারা বাদশাহ্‌র সংগে একটা মীমাংসা করতে চাইল, কারণ বাদশাহ্‌ হেরোদের দেশ থেকেই তাদের দেশে খাবার আসত। তখন হেরোদ একটা দিন ঠিক করলেন। তিনি সেই দিন রাজপোশাক পরে সিংহাসনে বসে সেই লোকদের কাছে কথা বলতে লাগলেন। তাঁর কথা শুনে তারা চিৎকার করে বলল, “এ দেবতার কথা, মানুষের কথা নয়।” হেরোদ আল্লাহ্‌র গৌরব করেন নি বলে তখনই মাবুদের একজন ফেরেশতা তাঁকে আঘাত করলেন, আর ক্রিমির উৎপাতে তিনি মারা গেলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র কালাম ছড়িয়ে পড়তে থাকল এবং অনেক লোক তার উপর ঈমান আনতে লাগল। এদিকে বার্নাবাস ও শৌলের কাজ শেষ হওয়াতে তাঁরা ইউহোন্নাকে সংগে নিয়ে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক নামেও ডাকা হত। এণ্টিয়ক শহরের জামাতে কয়েকজন নবী ও ওস্তাদ ছিলেন। তাঁদের নাম বার্নাবাস, নীগের নামে পরিচিত শিমোন, কুরীণী শহরের লুকিয়, শাসনকর্তা হেরোদের সংগে লালিত-পালিত মনহেম এবং শৌল। তাঁরা যখন রোজা রেখে মাবুদের এবাদত করছিলেন তখন পাক-রূহ্‌ তাঁদের বললেন, “বার্নাবাস আর শৌলকে আমি যে কাজের জন্য ডেকেছি আমার সেই কাজের জন্য এখন তাদের আলাদা কর।” তখন তাঁরা রোজা রেখে ও মুনাজাত করে সেই দু’জনের উপর হাত রাখলেন এবং তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন। পাক-রূহ্‌ এইভাবে বার্নাবাস ও শৌলকে পাঠালে পর সেই দু’জন সিলূকিয়াতে গেলেন। পরে সেখান থেকে তাঁরা জাহাজে করে সাইপ্রাস দ্বীপে গেলেন। সালামীতে পৌঁছে তাঁরা ইহুদীদের মজলিস-খানায় আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করলেন। তখন সাহায্যকারী হিসাবে ইউহোন্না তাঁদের সংগে ছিলেন। সমস্ত দ্বীপটা ঘুরে শেষে তাঁরা পাফোতে আসলেন এবং সেখানে ইব্‌ন্তেঈসা নামে একজন ইহুদী জাদুকর ও ভণ্ড নবীর দেখা পেলেন। তখন পাক-রূহে পূর্ণ হয়ে শৌল, যাঁকে পৌল বলেও ডাকা হত, ইলুমার দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, “তুমি ইবলিসের সন্তান ও যা কিছু ভাল তার শত্রু। তোমার মধ্যে সব রকম ছলনা ও ঠকামি রয়েছে। মাবুদের সোজা পথকে বাঁকা করবার কাজ কি তুমি কখনও থামাবে না? দেখ, মাবুদের হাত তোমার বিরুদ্ধে উঠেছে। তুমি অন্ধ হয়ে যাবে এবং কিছু দিন পর্যন্ত সূর্র্যের আলো দেখতে পাবে না।” তখনই কুয়াশা আর অন্ধকার তাকে ঢেকে ফেলল এবং কেউ যেন তাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে পারে এইজন্য তখন সে হাত্‌ড়ে বেড়াতে লাগল। এই সব দেখে সেই শাসনকর্তা ঈমান আনলেন, কারণ প্রভুর বিষয়ে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তাতে তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন। এর পরে পৌল ও তাঁর সংগীরা পাফো ছেড়ে জাহাজে করে পাম্‌ফুলিয়া প্রদেশের পর্গা শহরে গেলেন। ইউহোন্না তখন তাঁদের ছেড়ে জেরুজালেমে ফিরে গেলেন। পরে তাঁরা পর্গা থেকে পিষিদিয়া প্রদেশের এণ্টিয়কে শহরে গেলেন এবং বিশ্রামবারে মজলিস-খানায় গিয়ে বসলেন। তৌরাত ও নবীদের কিতাব থেকে তেলাওয়াত করা শেষ হলে পর মজলিস-খানার নেতারা তাঁদের বলে পাঠালেন, “ভাইয়েরা, লোকদের উৎসাহ দেবার জন্য যদি কোন কথা থাকে তবে বলুন।” তখন পৌল উঠে দাঁড়ালেন এবং হাত তুলে বললেন, “বনি-ইসরাইলরা ও আল্লাহ্‌ভক্ত অ-ইহুদীরা, আপনারা শুনুন। তার পরে তিনি কেনান দেশের সাতটা জাতিকে ধ্বংস করে তাঁর নিজের বান্দাদের সেই দেশের উপরে অধিকার দিয়েছিলেন। এই সমস্ত ঘটনা ঘটতে প্রায় চারশো পঞ্চাশ বছর লেগেছিল। “এর পরে নবী শামুয়েলের সময় পর্যন্ত আল্লাহ্‌ কয়েকজন শাসনকর্তা দিয়েছিলেন। তার পরে লোকেরা বাদশাহ্‌ চাইল। তখন তিনি তাদের বিন্‌ইয়ামীন বংশের কীশের পুত্র তালুতকে দিয়েছিলেন। তালুত চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তারপর আল্লাহ্‌ তালুতকে সরিয়ে দিয়ে দাউদকে বাদশাহ্‌ করেছিলেন। তিনি দাউদের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ইয়াসির পুত্র দাউদের মধ্যে আমার মনের মত লোকের খোঁজ পেয়েছি। আমি যা চাই সে তা-ই করবে।’ আল্লাহ্‌ তাঁর ওয়াদা অনুসারে এই লোকের বংশধরদের মধ্য থেকে নাজাতদাতা ঈসাকে বনি-ইসরাইলদের কাছে উপস্থিত করেছিলেন। ঈসা আসবার আগে সমস্ত বনি-ইসরাইলদের কাছে ইয়াহিয়া এই কথা তবলিগ করেছিলেন যে, তওবা করে লোকদের তরিকাবন্দী নেওয়া উচিত। কাজ শেষ করবার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আমি কে, তোমরা কি মনে কর? আমি সেই মসীহ্‌ নই। তিনি আমার পরে আসবেন, আর আমি তাঁর জুতা খুলবারও যোগ্য নই।’ “ভাইয়েরা, ইব্রাহিমের বংশধরেরা ও আল্লাহ্‌ভক্ত অ-ইহুদীরা, নাজাতের এই যে খবর তা আমাদের কাছেই পাঠানো হয়েছে। জেরুজালেমের লোকেরা ও তাদের নেতারা ঈসাকে চেনে নি। এছাড়া নবীদের যে কথা প্রত্যেক বিশ্রামবারে তেলাওয়াত করা হয় সেই কথা তারা বুঝতে পারে নি; সেইজন্য তারা ঈসাকে দোষী করে সেই কথা পূর্ণ করেছে। যদিও ঈসাকে মৃত্যুর শাস্তি দেবার কোন কারণ তারা পায় নি তবুও পীলাতকে বলেছে যেন তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর বিষয়ে পাক-কিতাবে যা কিছু লেখা ছিল তার সমস্তই পূর্ণ করবার পরে তারা তাঁকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে দাফন করেছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌ মৃত্যু থেকে তাঁকে জীবিত করে তুলেছেন। গালীল থেকে যাঁরা তাঁর সংগে জেরুজালেমে এসেছিলেন তাঁরা অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে দেখতে পেয়েছিলেন। আমাদের লোকদের কাছে তাঁরাই এখন তাঁর বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। “আমরা আপনাদের কাছে এই সুসংবাদ দিচ্ছি যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আল্লাহ্‌ যে ওয়াদা করেছিলেন, তা তিনি তাঁদের বংশধরদের জন্য, অর্থাৎ আমাদের জন্য ঈসাকে মৃত্যু থেকে জীবিত করে পূর্ণ করেছেন। এই বিষয়ে জবুর কিতাবের দ্বিতীয় রুকুতে এই কথা লেখা আছে: তুমি আমার পুত্র, আজই আমি তোমার পিতা হলাম। আল্লাহ্‌ যে তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছেন এবং তাঁর শরীর যে আর কখনও নষ্ট হবে না তা এই কথাগুলোতে আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘পবিত্র ও নিশ্চিত দোয়ার যে ওয়াদা আমি দাউদের কাছে করেছি তা আমি তোমাকে দেব।’ সেই বিষয়ে আর এক জায়গায় লেখা আছে: তোমার ভক্তের শরীরকে তুমি নষ্ট হতে দেবে না। “দাউদ তখনকার লোকদের মধ্যে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্য পূর্ণ করবার পরে ইন্তেকাল করলেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের সংগে তাঁকে দাফন করা হলে পর তাঁর শরীর নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু আল্লাহ্‌ যাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন তাঁর শরীর নষ্ট হয় নি। এইজন্য আমার ভাইয়েরা, আপনাদের জানা দরকার যে, ঈসার মধ্য দিয়েই আপনাদের কাছে গুনাহের মাফ পাবার বিষয়ে তবলিগ করা হচ্ছে। আপনারা মূসার শরীয়ত দ্বারা গুনাহের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারেন নি, কিন্তু যে কেউ ঈসার উপর ঈমান আনে সে গুনাহের শাস্তি থেকে রেহাই পায়। এইজন্য আপনারা সাবধান হন, যেন নবীদের বলা এই সব আপনাদের উপর না ঘটে: তোমরা যারা আল্লাহ্‌কে নিয়ে তামাশা করে থাক, তোমরা শোন্ত তোমরা হতভম্ব হও ও ধ্বংস হও; কারণ তোমাদের সময়কালেই আমি এমন একটা কিছু করতে যাচ্ছি যার কথা তোমরা কোনমতেই বিশ্বাস করবে না, কেউ বললেও করবে না।” পৌল আর বার্নাবাস মজলিস-খানা ছেড়ে যাবার সময়ে লোকেরা তাঁদের অনুরোধ করল যেন তাঁরা পরের বিশ্রামবারে এই বিষয়ে আরও কিছু বলেন। লোকেরা মজলিস-খানা থেকে চলে যাবার পরে অনেক ইহুদী ও ইহুদী ধর্মে ঈমানদার আল্লাহ্‌ভক্ত অ-ইহুদী পৌল আর বার্নাবাসের সংগে সংগে গেল। তখন সেই লোকদের সংগে পৌল ও বার্নাবাস কথা বললেন এবং তাদের উৎসাহ দিলেন যেন তারা আল্লাহ্‌র রহমতের মধ্যে স্থির থাকে। পরের বিশ্রামবারে শহরের প্রায় সব লোক আল্লাহ্‌র কালাম শুনবার জন্য একসংগে মিলিত হল। এত লোকের ভিড় দেখে ইহুদীরা হিংসায় পূর্ণ হল এবং পৌল যা বলছিলেন তার বিরুদ্ধে নানা কথা বলে তাঁর নিন্দা করতে লাগল। তখন পৌল ও বার্নাবাস সাহসের সংগে তাদের এই জবাব দিলেন, “আল্লাহ্‌র কালাম প্রথমে আপনাদের কাছে বলা আমাদের দরকার ছিল, কিন্তু আপনারা যখন তা অগ্রাহ্য করছেন এবং অনন্ত জীবন পাবার যোগ্য বলে নিজেদের মনে করেন না তখন অ-ইহুদীদের দিকে আমরা ফিরছি। এর কারণ হল, মাবুদ আমাদের এই কথা বলেছেন, ‘আমি অন্য জাতিদের কাছে তোমাকে আলোর মত করেছি, যেন তোমার মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়ার লোক নাজাত পায়।’ ” অ-ইহুদীরা এই কথা শুনে খুশী হল এবং মাবুদের কালামের গৌরব করল; আর অনন্ত জীবন পাবার জন্য আল্লাহ্‌ যাদের ঠিক করে রেখেছিলেন তারা ঈমান আনল। মাবুদের কালাম সেই এলাকার সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ইহুদীরা আল্লাহ্‌র এবাদতকারী ভদ্র মহিলাদের এবং শহরের প্রধান প্রধান লোকদের উস্‌কিয়ে দিল। এইভাবে তারা পৌল ও বার্নাবাসের উপর জুলুম করিয়ে সেই এলাকা থেকে তাঁদের বের করে দিল। তখন পৌল ও বার্নাবাস সেই লোকদের বিরুদ্ধে তাঁদের পায়ের ধুলা ঝেড়ে ফেলে কোনিয়া শহরে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানকার উম্মতেরা আনন্দে ও পাক-রূহে পূর্ণ হল। কোনিয়া শহরে পৌল ও বার্নাবাস তাঁদের নিয়ম মতই ইহুদীদের মজলিস-খানায় গেলেন। সেখানে তাঁরা এমনভাবে কথা বললেন যে, ইহুদী ও আল্লাহ্‌ভক্ত অ-ইহুদী অনেকেই ঈমান আনল। কিন্তু যে ইহুদীরা ঈমান আনে নি তারা অ-ইহুদীদের উস্‌কিয়ে দিয়ে তাদের মন ঈমানদার ভাইদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলল। পৌল ও বার্নাবাস সেই শহরে বেশ কিছুদিন রইলেন এবং সাহসের সংগে প্রভুর কথা বলতে থাকলেন। প্রভুর রহমত সম্বন্ধে তাঁরা যা প্রচার করছিলেন সেই কথা যে বিশ্বাসযোগ্য প্রভু তা প্রমাণ করবার জন্য পৌল ও বার্নাবাসকে অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখাবার শক্তি দিলেন। এতে শহরের লোকেরা ভাগ হয়ে গেল; কেউ কেউ ইহুদীদের পক্ষে, আবার কেউ কেউ সাহাবীদের পক্ষে গেল। তখন অ-ইহুদী ও ইহুদী এই দু’দলই তাদের নেতাদের সংগে মিলে পৌল ও বার্নাবাসকে অত্যাচার করবার ও পাথর মারবার জন্য ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু পৌল ও বার্নাবাস তা টের পেয়ে লুকায়নিয়া প্রদেশের মধ্যে লুস্ত্রা ও দর্বী শহরে এবং তার আশেপাশের জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। সেই সব জায়গায় তাঁরা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করতে লাগলেন। লুস্ত্রা শহরে একজন খোঁড়া লোক বসে থাকত। সে জন্ম থেকেই খোঁড়া ছিল এবং কখনও হাঁটে নি। পৌল যা করলেন তা দেখে লোকেরা লুকায়নীয় ভাষায় চিৎকার করে বলল, “দেবতারা মানুষ হয়ে আমাদের কাছে নেমে এসেছেন।” সেইজন্য লোকেরা বার্নাবাসের নাম দিল জিউস এবং পৌল কথা বলছিলেন বলে তাঁর নাম দিল হার্মিস। জিউস দেবতার মন্দিরটা ছিল শহরের বাইরে। শহরের সদর দরজার কাছে জিউস দেবতার পুরোহিত ষাঁড় ও মালা নিয়ে আসল, কারণ সেই পুরোহিত ও সমস্ত লোকেরা পৌল ও বার্নাবাসের কাছে পশু উৎসর্গ করতে চাইল। বার্নাবাস আর পৌল সেই কথা শুনে নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে দৌড়ে লোকদের মধ্যে গেলেন এবং চিৎকার করে বললেন, “বন্ধুরা, আপনারা কেন এই সব করছেন? আমরা তো কেবল মানুষ, আপনাদেরই মত আমাদের স্বভাব। আমরা আপনাদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করছি যেন আপনারা এই সব বাজে জিনিস ছেড়ে জীবন্ত আল্লাহ্‌র দিকে ফেরেন। তিনিই আসমান, জমীন, সমুদ্র এবং সেগুলোর মধ্যে যা আছে সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন। আগেকার দিনে সব জাতিকেই তিনি তাদের ইচ্ছামত চলতে দিয়েছেন, কিন্তু তবুও তিনি সব সময় নিজের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি আসমান থেকে বৃষ্টি দিয়ে এবং সময়মত ফসল দান করে তাঁর দয়া আপনাদের দেখিয়েছেন। তিনি প্রচুর খাবার দান করে আপনাদের মনকে আনন্দে পূর্ণ করেছেন।” এই সব কথা বলেও তাঁদের কাছে পশু উৎসর্গ করা থেকে লোকদের থামাতে তাঁদের অনেক কষ্ট হল। পরে এণ্টিয়ক ও কোনিয়া থেকে কয়েকজন ইহুদী এসে পৌল ও বার্নাবাসের বিরুদ্ধে লোকদের উস্‌কিয়ে দিল। তখন লোকেরা পৌলকে পাথর মারল এবং তিনি মরে গেছেন মনে করে শহরের বাইরে তাঁকে টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু পরে ঈসায়ী ঈমানদারেরা তাঁর চারদিকে জমায়েত হলে পর তিনি উঠে শহরে ফিরে গেলেন। পরদিন তিনি ও বার্নাবাস দর্বী শহরে চলে গেলেন। তাঁরা প্রত্যেক জামাতে প্রধান নেতাদের কাজে বহাল করলেন এবং যে প্রভুর উপর তারা ঈমান এনেছিল, মুনাজাত করে ও রোজা রেখে সেই প্রভুর হাতেই জামাতের লোকদের তুলে দিলেন। পরে পৌল ও বার্নাবাস পিষিদিয়া প্রদেশের মধ্য দিয়ে পাম্‌ফুলিয়া প্রদেশে পৌঁছালেন। তাঁরা পর্গা শহরে আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করে আন্তোলিয়া বন্দরে গেলেন। পরে আন্তোলিয়া থেকে জাহাজে করে এণ্টিয়কে ফিরে আসলেন। যে কাজ তাঁরা এখন শেষ করলেন সেই কাজের জন্য এই এণ্টিয়কেই আল্লাহ্‌র রহমতের হাতে তাঁদের তুলে দেওয়া হয়েছিল। এণ্টিয়কে পৌঁছে জামাতের সবাইকে তাঁরা এক জায়গায় জমায়েত করলেন এবং আল্লাহ্‌ তাঁদের মধ্য দিয়ে যা করেছেন তা সবই বললেন। আল্লাহ্‌ কিভাবে অ-ইহুদীদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন যাতে তারা মসীহের উপর ঈমান আনতে পারে তাও বললেন। তার পরে পৌল ও বার্নাবাস উম্মতদের সংগে সেখানে অনেক দিন রইলেন। এহুদিয়া প্রদেশ থেকে কয়েকজন লোক এণ্টিয়কে আসলেন এবং ঈমানদার ভাইদের এই বলে শিক্ষা দিতে লাগলেন, “মূসার শরীয়ত মতে তোমাদের খৎনা করানো না হলে তোমরা কোনমতেই নাজাত পেতে পার না।” তাতে পৌল ও বার্নাবাসের সংগে এই লোকদের ভীষণ কথা কাটাকাটি হল। পরে ঠিক হল যে, পৌল ও বার্নাবাস এণ্টিয়কের কয়েকজন ঈমানদারকে সংগে নিয়ে জেরুজালেমে যাবেন এবং সাহাবীদের ও জামাতের নেতাদের সংগে এই বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন। এণ্টিয়কের জামাত তাঁদের যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। ফিনিশিয়া আর সামেরিয়া প্রদেশের মধ্য দিয়ে যাবার সময়ে পৌল ও বার্নাবাস লোকদের জানালেন, অ-ইহুদীরা কিভাবে আল্লাহ্‌র দিকে ফিরেছে। এই খবর শুনে ঈমানদার ভাইয়েরা সকলেই খুব খুশী হলেন। যখন পৌল ও বার্নাবাস জেরুজালেমে আসলেন তখন জামাতের লোকেরা, নেতারা এবং সাহাবীরা আগ্রহের সংগে তাঁদের গ্রহণ করলেন। তাঁদের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ যা করেছিলেন তা সবই তাঁরা সবাইকে বললেন। ফরীশী দলের কয়েকজন লোক ঈমানদার হয়েছিলেন। সেই ঈমানদারেরা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “অ-ইহুদীদের খৎনা করানো দরকার এবং তারা যেন মূসার শরীয়ত পালন করে সেইজন্য তাদের হুকুম দেওয়া দরকার।” তখন সাহাবীরা ও জামাতের নেতারা এই বিষয় চিন্তা করবার জন্য এক জায়গায় মিলিত হলেন। অনেক আলোচনার পর পিতর উঠে তাঁদের বললেন, “ভাইয়েরা, আপনারা তো জানেন যে, অনেক দিন আগে আপনাদের মধ্য থেকে আল্লাহ্‌ আমাকে বেছে নিয়েছিলেন যাতে অ-ইহুদীরা আমার মুখ থেকে সুসংবাদের কথা শুনে ঈমান আনে। আল্লাহ্‌ সকলের দিল জানেন। তিনি আমাদের যেমন পাক-রূহ্‌ দান করেছিলেন, অ-ইহুদীদেরও সেইভাবে পাক-রূহ্‌ দান করে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তারাও নাজাত পেয়েছে। তিনি আমাদের ও তাদের মধ্যে আলাদা বলে কিছুই রাখেন নি, কারণ তারা ঈমান এনেছে বলে তিনি তাদেরও দিল পরিষ্কার করেছেন। তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বা আমরা যে বোঝা বইতে পারি নি সেই বোঝা অ-ইহুদী ঈমানদারদের কাঁধে তুলে দিয়ে কেন আপনারা আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করবার চেষ্টা করছেন? আমরা বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসার রহমতে অ-ইহুদী ঈমানদারেরা যেমন নাজাত পেয়েছে তেমনি আমরাও নাজাত পেয়েছি।” তখন সভার সবাই চুপ হয়ে গেলেন এবং পৌল ও বার্নাবাসের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ অ-ইহুদীদের মধ্যে যে সব চিহ্ন-কাজ ও কুদরতি কাজ করেছিলেন তা তাঁদেরই মুখে শুনতে লাগলেন। তাঁদের কথা বলা শেষ হলে পর ইয়াকুব বললেন, “ভাইয়েরা, শুনুন। আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের বান্দা হবার জন্য অ-ইহুদীদের মধ্য থেকে কিছু লোককে বেছে নিয়ে দেখিয়েছেন যে, অ-ইহুদীদের জন্যও তাঁর চিন্তা আছে। এই কথাই শিমোন্তপিতর আমাদের বলেছেন। এই কথার সংগে নবীদের কথারও মিল আছে, কারণ কিতাবে লেখা আছে: ‘এর পরে আমি এসে দাউদের পড়ে যাওয়া ঘর আবার তৈরী করব। যা ধ্বংস হয়ে গেছে তা আবার গাঁথব, আবার তা ঠিক করব; যেন অন্য সব লোকেরা, অর্থাৎ যে সব অ-ইহুদীদের আমার বলে ডাকা হয়েছে তাঁরা আমার তালাশ করতে পারে।’ মাবুদ, যিনি এই সব কাজ করেন তিনি এই কথা বলছেন। অনেক দিন আগে থেকে এ তাঁর মনের মধ্যে ছিল।” ইয়াকুব আরও বললেন, “এইজন্য আমার মতে যে অ-ইহুদীরা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরছে তাদের কষ্ট দেওয়া আমাদের উচিত নয়। তার চেয়ে বরং আমরা তাদের কাছে এই কথা লিখি যে, তারা যেন প্রতিমার সংগে যুক্ত সব কিছু থেকে এবং সমস্ত রকম জেনা থেকে দূরে থাকে, আর গলা টিপে মারা পশুর গোশ্‌ত এবং রক্ত যেন তারা না খায়। এই হুকুমগুলো তাদের দেওয়া ভাল, কারণ মূসা যা বলেছেন তা প্রত্যেক শহরে অনেক অনেক দিন আগে থেকে তবলিগ করা হচ্ছে এবং তিনি যা লিখে গেছেন তা প্রত্যেক বিশ্রামবারে মজলিস-খানাগুলোতে তেলাওয়াত করা হচ্ছে।” তখন সাহাবীরা, জামাতের নেতারা এবং জামাতের অন্য সব লোকেরা ঠিক করলেন যে, তাঁরা নিজেদের কয়েকজন লোককে বেছে নিয়ে পৌল ও বার্নাবাসের সংগে এণ্টিয়কে পাঠিয়ে দেবেন। তাঁরা এহুদা ও সীলকে বেছে নিলেন। এই এহুদাকে বর্‌শাব্বা বলে ডাকা হত। ঈমানদার ভাইদের মধ্যে এই দু’জন ছিলেন নেতা। তাঁদের সংগে এই চিঠি পাঠানো হল: এণ্টিয়ক, সিরিয়া ও কিলিকিয়ার অ-ইহুদী ঈমানদার ভাইদের কাছে আমরা সাহাবীরা ও জামাতের নেতারা, অর্থাৎ আপনাদের ভাইয়েরা এই চিঠি লিখছি। আমাদের সালাম গ্রহণ করুন। “আমরা শুনতে পেলাম যে, আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন গিয়ে অনেক কথা বলে আপনাদের মন অস্থির করে তুলে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু আমরা তাদের এই রকম কাজ করতে বলি নি। এইজন্য আমরা সবাই একমত হয়ে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে আমাদের প্রিয় বন্ধু বার্নাবাস ও পৌলের সংগে আপনাদের কাছে তাঁদের পাঠালাম। বার্নাবাস ও পৌল আমাদের হযরত ঈসা মসীহের জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। আমরা এহুদা ও সীলকে পাঠালাম যেন আমরা যা লিখছি তা তাঁরা আপনাদের কাছে মুখেও বলেন। পাক-রূহ্‌ আর আমরা এটাই ভাল মনে করলাম যে, এই দরকারী বিষয়গুলো ছাড়া আর কোন কিছুর দ্বারা আপনাদের উপর যেন বোঝা চাপানো না হয়। সেই দরকারী বিষয়গুলো হল- আপনারা মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবার খাবেন না, রক্ত খাবেন না, গলা টিপে মারা পশুর গোশ্‌ত খাবেন না এবং কোন রকম জেনা করবেন না। এই সব করা থেকে দূরে থাকলে আপনারা ভাল করবেন। বিদায়।” পৌল, বার্নাবাস ও সেই লোকদের পাঠানো হলে পর তাঁরা এণ্টিয়কে গেলেন। সেখানে তাঁরা জামাতের লোকদের একত্র করে সেই চিঠিখানা তাদের দিলেন। লোকেরা চিঠিটা পড়ল এবং তার মধ্যে যে সান্ত্বনার কথা ছিল তাতে খুশী হল। এহুদা আর সীল নিজেরাও ছিলেন নবী; সেইজন্য তাঁরা অনেক কথা বলে সেখানকার ভাইদের উৎসাহ দিলেন এবং তাদের ঈমান বাড়িয়ে তাদের শক্তিশালী করে তুললেন। কিন্তু পৌল আর বার্নাবাস এণ্টিয়কেই রইলেন। সেখানে তাঁরা আরও অনেকের সংগে মাবুদের কালাম শিক্ষা দিতে ও তবলিগ করতে থাকলেন। কিছু দিন পরে পৌল বার্নাবাসকে বললেন, “যে সব জায়গায় আমরা মাবুদের কালাম তবলিগ করেছি, চল, এখনই সেই সব জায়গায় ফিরে গিয়ে ঈমানদার ভাইদের সংগে দেখা করি এবং তারা কেমন ভাবে চলছে তা দেখি।” তখন বার্নাবাস ইউহোন্নাকে সংগে নিতে চাইলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক বলেও ডাকা হত। পৌল কিন্তু তাঁকে সংগে নেওয়া ভাল মনে করলেন না, কারণ মার্ক পাম্‌ফুলিয়াতে তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের সংগে আর কাজ করেন নি। তখন পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে এমন মতের অমিল হল যে, তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। বার্নাবাস মার্ককে নিয়ে জাহাজে করে সাইপ্রাস দ্বীপে গেলেন, আর পৌল সীলকে বেছে নিলেন। তখন এণ্টিয়কের ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে মাবুদের রহমতের হাতে তুলে দিলে পর তাঁরা রওনা হলেন। পৌল সিরিয়া ও কিলিকিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সমস্ত জামাতগুলোর ঈমান বাড়িয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তুললেন। পরে পৌল দর্বী ও লুস্ত্রা শহরে গেলেন। সেখানে তীমথিয় নামে একজন উম্মত থাকতেন। তাঁর মা ছিলেন মসীহের উপর ঈমানদার একজন ইহুদী মহিলা, কিন্তু তাঁর পিতা জাতিতে গ্রীক ছিলেন। লুস্ত্রা ও কোনিয়া শহরের ঈমানদার ভাইয়েরা তীমথিয়ের খুব প্রশংসা করত। পৌল তীমথিয়কে সংগে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর খৎনা করালেন, কারণ ঐ সব জায়গায় যে ইহুদীরা থাকত তারা জানত তীমথিয়ের পিতা একজন গ্রীক। পরে তাঁরা সেই সব শহরগুলোর মধ্য দিয়ে গেলেন এবং জেরুজালেমের সাহাবীরা ও জামাতের নেতারা যে কয়েকটা নিয়ম ঠিক করেছিলেন তা লোকদের জানালেন আর সেই সব নিয়ম পালন করতে বললেন। এইভাবে জামাতগুলোর লোকেরা ঈসায়ী ঈমানে সবল হয়ে উঠতে লাগল এবং তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল। পাক-রূহ্‌ পৌল আর তাঁর সংগীদের এশিয়া প্রদেশে তবলিগ করতে দিলেন না। তখন তাঁরা ফরুগিয়া ও গালাতিয়া প্রদেশের সমস্ত জায়গায় গেলেন। পরে মুশিয়ার সীমানায় এসে তাঁরা বিথুনিয়া প্রদেশে যেতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঈসার রূহ্‌ তাঁদের যেতে দিলেন না। এইজন্য তাঁরা মুশিয়ার মধ্য দিয়ে ত্রোয়া শহরে চলে গেলেন। রাতের বেলায় পৌল একটা দর্শনে দেখলেন, ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশের একজন লোক দাঁড়িয়ে তাঁকে মিনতি করে বলছে, “ম্যাসিডোনিয়াতে এসে আমাদের সাহায্য করুন।” পৌল এই দর্শন দেখবার পর আমরা ম্যাসিডোনিয়াতে যাবার জন্য তখনই প্রস্তুত হলাম, কারণ আমরা বুঝতে পারলাম ম্যাসিডোনিয়ার লোকদের কাছে মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করবার জন্যই আল্লাহ্‌ আমাদের ডেকেছেন। পরে আমরা ত্রোয়া ছেড়ে জাহাজে করে সোজা সামথ্রাকী দ্বীপে গেলাম এবং পরের দিন নিয়াপলি শহরে আসলাম। সেখান থেকে আমরা ফিলিপী শহরে গেলাম। এই ফিলিপীই ম্যাসিডোনিয়ার সেই এলাকার প্রধান শহর। সেখানকার লোকেরা রোম রাজ্যের প্রজা ছিল। আমরা কিছু দিন সেই শহরে রইলাম। বিশ্রামবারে আমরা শহরের সদর দরজার বাইরে নদীর কাছে গেলাম; মনে করলাম সেখানে ইহুদীদের মুনাজাত করবার জায়গা আছে। সেখানে যে স্ত্রীলোকেরা মিলিত হয়েছিলেন আমরা তাঁদের কাছে বসে কথা বলতে লাগলাম। যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের মধ্যে থুয়াতীরা শহরের লুদিয়া নামে একজন স্ত্রীলোক ছিলেন। তিনি বেগুনী রংয়ের কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ইহুদী না হলেও তিনি আল্লাহ্‌র এবাদত করতেন। প্রভু লুদিয়ার দিল এমনভাবে খুলে দিলেন যাতে তিনি পৌলের কথা মন দিয়ে শুনে ঈমান আনেন। এতে তিনি ও তাঁর বাড়ীর সকলে তরিকাবন্দী নিলেন। এর পরে তিনি এই বলে আমাদের দাওয়াত করলেন, “যদি আমাকে আপনারা প্রভুর উপর ঈমানদার বলে মনে করেন তবে আমার বাড়ীতে এসে থাকুন।” এই কথা বলে তিনি আমাদের সাধাসাধি করে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। একদিন যখন আমরা সেই মুনাজাতের জায়গায় যাচ্ছিলাম তখন একজন বাঁদীর সংগে আমাদের দেখা হল। তাকে একটা ভূতে পেয়েছিল যার ফলে সে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারত। তাতে তার মালিকদের লাভ হত। সেই মেয়েটি পৌল এবং আমাদের পিছনে যেতে যেতে চিৎকার করে বলত, “এই লোকেরা আল্লাহ্‌তা’লার গোলাম। কি করে নাজাত পাওয়া যায় এঁরা তা-ই আপনাদের কাছে বলছেন।” সে অনেক দিন পর্যন্ত এই রকম করল। শেষে পৌল এত বিরক্ত হলেন যে, তিনি পিছন ফিরে সেই ভূতকে বললেন, “ঈসা মসীহের নামে আমি তোমাকে হুকুম দিচ্ছি, এই মেয়েটির মধ্য থেকে বের হয়ে যাও।” আর তখনই সেই ভূত বের হয়ে গেল। লাভের আশা চলে গেল দেখে মেয়েটির মালিকেরা পৌল আর সীলকে ধরে শহর-চকে নেতাদের কাছে টেনে নিয়ে গেল। তার পরে তারা শাসনকর্তাদের কাছে তাঁদের নিয়ে গিয়ে বলল, “এই লোকেরা আমাদের শহরে গোলমাল বাধিয়েছে। এরা ইহুদী। এরা এমন সব আচার-ব্যবহারের বিষয় শিক্ষা দিচ্ছে যা রোমীয় হিসাবে আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা বা পালন করা আইন্তবিরুদ্ধ কাজ।” অন্যান্য লোকেরাও পৌল ও সীলের বিরুদ্ধে তাদের সংগে যোগ দিল। তখন শাসনকর্তারা হুকুম দিলেন যেন তাঁদের কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে বেত মারা হয়। ভীষণভাবে বেত মারবার পরে তাঁদের জেলখানায় রাখা হল, আর ভাল করে পাহারা দেবার জন্য জেল-রক্ষককে হুকুম দেওয়া হল। জেল-রক্ষক সেই হুকুম পেয়ে পৌল ও সীলকে জেলের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং হাড়িকাঠ দিয়ে তাঁদের পা আটকে রাখলেন। তখন প্রায় রাত দুপুর। পৌল ও সীল মুনাজাত করছিলেন এবং আল্লাহ্‌র উদ্দেশে প্রশংসা-কাওয়ালী করছিলেন। অন্য কয়েদীরা তা শুনছিল। এমন সময় হঠাৎ এক ভীষণ ভূমিকমপ হল এবং তাতে জেলখানার ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। তখনই জেলের সমস্ত দরজা ও কয়েদীদের শিকল খুলে গেল। জেল-রক্ষক জেগে উঠলেন এবং জেলের দরজাগুলো খোলা দেখতে পেয়ে ছোরা বের করে আত্মহত্যা করতে চাইলেন। তিনি মনে করলেন সমস্ত কয়েদীই পালিয়ে গেছে। তখন পৌল চিৎকার করে বললেন, “থামুন, নিজের ক্ষতি করবেন না; আমরা সবাই এখানে আছি।” তখন সেই জেল-রক্ষক একজনকে বাতি আনতে বলে নিজে ছুটে ভিতরে গেলেন এবং ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পৌল ও সীলের পায়ে পড়লেন। তার পরে তিনি পৌল ও সীলকে বাইরে এনে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলুন, নাজাত পাবার জন্য আমাকে কি করতে হবে?” তাঁরা বললেন, “আপনি ও আপনার পরিবার হযরত ঈসার উপর ঈমান আনুন, তাহলে নাজাত পাবেন।” পৌল আর সীল তখন জেল-রক্ষক ও তাঁর বাড়ীর সকলের কাছে মাবুদের কালাম বললেন। জেল-রক্ষক সেই রাতেই পৌল আর সীলকে নিয়ে গিয়ে তাঁদের শরীরের কাটা জায়গাগুলো ধুয়ে দিলেন, আর তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্য সবাই তখনই তরিকাবন্দী নিলেন। তার পরে তিনি পৌল ও সীলকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে খেতে দিলেন। আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনে তাঁর পরিবারের সবাই খুব আনন্দিত হলেন। পরের দিন সকালবেলায় শাসনকর্তারা তাঁদের কর্মচারীদের দিয়ে বলে পাঠালেন, “ঐ লোকদের ছেড়ে দাও।” তখন জেল-রক্ষক পৌলকে বললেন, “আপনাকে ও সীলকে ছেড়ে দেবার জন্য শাসনকর্তারা বলে পাঠিয়েছেন। আপনারা এখন বের হয়ে আসুন এবং শান্তিতে চলে যান।” তখন পৌল সেই কর্মচারীদের বললেন, “আমরা রোমীয়, আমাদের বিচার না করেই সকলের সামনে বেত মারা হয়েছে এবং জেলে দেওয়া হয়েছে। এখন কি শাসনকর্তারা আমাদের গোপনে ছেড়ে দিতে চান? তা হবে না; তাঁরা নিজেরা এসে আমাদের বাইরে নিয়ে যান।” সেই কর্মচারীরা তখন এই কথা শাসনকর্তাদের জানাল। শাসনকর্তারা যখন শুনলেন পৌল আর সীল রোমীয় তখন তাঁরা ভয় পেলেন। তাঁরা পৌল আর সীলের কাছে গিয়ে মাফ চাইলেন এবং তাঁদের জেলের বাইরে এনে শহর ছেড়ে যেতে অনুরোধ করলেন। পৌল আর সীল জেলখানা থেকে বাইরে এসে লুদিয়ার বাড়ীতে গেলেন। সেখানে ঈমানদার ভাইদের সংগে তাঁদের দেখা হল। ভাইদের উৎসাহ দেবার পর তাঁরা সেখান থেকে চলে গেলেন। পৌল ও সীল আম্‌ফিপলি ও আপল্লোনিয়া শহরের মধ্য দিয়ে থিষলনীকি শহরে গেলেন। সেখানে ইহুদীদের একটা মজলিস-খানা ছিল। পৌল তাঁর নিয়ম মতই সেই মজলিস-খানায় গেলেন এবং পর পর তিন বিশ্রামবারে লোকদের সংগে পাক-কিতাব থেকে আলোচনা করলেন। তিনি লোকদের বুঝালেন এবং প্রমাণ করলেন যে, মসীহের কষ্টভোগ করবার এবং মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার দরকার ছিল। তিনি বললেন, “যে ঈসার কথা আমি আপনাদের কাছে তবলিগ করছি সেই ঈসাই হলেন মসীহ্‌।” এই কথা শুনে কয়েকজন ইহুদী ঈমান এনে পৌল ও সীলের সংগে যোগ দিল। এছাড়া আল্লাহ্‌ভক্ত অনেক গ্রীক এবং অনেক বিশেষ বিশেষ মহিলাও তাঁদের সংগে যোগ দিলেন। ইহুদীরা কিন্তু হিংসা করে বাজার থেকে কিছু দুষ্ট লোক যোগাড় করে এনে ভিড় জমাল এবং শহরের মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দিল। তারপর পৌল ও সীলের তালাশ করে বাইরে লোকদের কাছে তাঁদের আনবার জন্য তারা যাসোনের বাড়ীর উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু সেখানে তারা তাঁদের পেল না। তখন তারা যাসোন ও কয়েকজন ঈমানদার ভাইকে টেনে নিয়ে শহর-প্রশাসকদের কাছে গেল এবং চিৎকার করে বলল, “যে লোকেরা সারা দুনিয়া তোলপাড় করে তুলেছে তারা এখন এখানেও উপস্থিত হয়েছে; আর যাসোন তার নিজের বাড়ীতে ওদের জায়গা দিয়েছে। ওরা সবাই সম্রাট সিজারের হুকুম অমান্য করে বলছে যে, তিনি ছাড়া ঈসা নামে আরও একজন বাদশাহ্‌ আছেন।” এই সব কথা বলে সেই ইহুদীরা প্রশাসকদের ও লোকদের অস্থির করে তুলল। কিন্তু যাসোন ও অন্যেরা জামিনের টাকা দিলে পর তারা তাঁদের ছেড়ে দিল। রাত হলে পর ঈমানদার ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে বিরয়াতে পাঠিয়ে দিল। সেখানে পৌঁছে তাঁরা ইহুদীদের মজলিস-খানায় গেলেন। থিষলনীকির ইহুদীদের চেয়ে বিরয়া শহরের ইহুদীদের মন অনেক বেশী খোলা ছিল। তারা খুব আগ্রহের সংগে আল্লাহ্‌র কালাম শুনে তা গ্রহণ করল। পৌল যা বলেছেন তা সত্যি কিনা দেখবার জন্য প্রত্যেক দিন তারা কিতাবের মধ্যে খোঁজ করত। অনেক ইহুদী ঈসার উপর ঈমান আনল; এছাড়া অনেক বিশেষ গ্রীক মহিলা ও পুরুষও ঈমান আনলেন। থিষলনীকির ইহুদীরা যখন শুনতে পেল পৌল বিরয়াতে আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করছেন তখন তারা সেখানেও গেল এবং লোকদের উত্তেজিত করে গোলমাল বাধিয়ে দিল। ঈমানদার ভাইয়েরা তখনই পৌলকে সাগরের ধারে পাঠিয়ে দিল, কিন্তু সীল আর তীমথিয় বিরয়াতেই রইলেন। যে লোকেরা পৌলকে সংগে করে নিয়ে যাচ্ছিল তারা তাঁকে এথেন্স শহরে আনল। তারপর সেই লোকেরা সীল ও তীমথিয়ের জন্য এই হুকুম নিয়ে বিরয়াতে ফিরে গেল যে, সীল আর তীমথিয় যত শীঘ্র সম্ভব গিয়ে যেন পৌলের সংগে যোগ দেন। পৌল এথেন্স শহরে সীল ও তীমথিয়ের জন্য অপেক্ষা করবার সময় সেই শহর প্রতিমাতে পূর্ণ দেখলেন। তাতে তাঁর মন খুব ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি মজলিস-খানার মধ্যে ইহুদীদের ও আল্লাহ্‌ভক্ত গ্রীকদের সংগে আলোচনা করতে লাগলেন। এছাড়া যারা বাজারে আসত তাদের সংগেও তিনি দিনের পর দিন আলোচনা করতে থাকলেন। তখন এপিকিউরীয় ও স্টোয়িকীয় দলের কয়েকজন শিক্ষক পৌলের সংগে তর্ক জুড়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বললেন, “এই বাচালটা কি বলতে চাইছে?” আবার অন্যেরা বললেন, “বোধহয় সে বিদেশী দেব-দেবীর কথা প্রচার করছে।” তাঁরা এই কথা বললেন কারণ পৌল ঈসার বিষয় এবং মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার বিষয় তবলিগ করছিলেন। তখন সেই শিক্ষকেরা পৌলকে এরিওপেগসের সভার সামনে উপস্থিত করলেন। সেখানে তাঁরা পৌলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যে নতুন শিক্ষা আপনি দিচ্ছেন সেটা কি, তা কি আমরা জানতে পারি? কারণ আপনি এমন কতগুলো কথা বলছেন যা আমাদের কানে অদ্ভুত শোনাচ্ছে। সেইজন্য এই সব কথার মানে কি তা আমরা জানতে চাই।” তাঁরা এই কথা বললেন কারণ এথেন্সের সব লোকেরা এবং সেই শহরে যে বিদেশীরা থাকত তারা কেবল নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কথা বলে এবং শুনে সময় কাটাত। তখন পৌল এরিওপেগসের সভার মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এথেন্স শহরের লোকেরা, শুনুন। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আপনারা সব দিক থেকেই খুব ধর্মভীরু, কারণ আমি ঘুরে বেড়াবার সময় আপনাদের উপাসনার জিনিসগুলো যখন দেখছিলাম তখন এমন একটা বেদী দেখতে পেলাম যার উপরে লেখা আছে, ‘অজানা দেবতার উদ্দেশে।’ আপনারা না জেনে যাঁর উপাসনা করছেন তাঁর সম্বন্ধে আমি আপনাদের কাছে প্রচার করছি। “আল্লাহ্‌, যিনি এই দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে সব কিছু তৈরী করেছেন, তিনিই বেহেশত ও দুনিয়ার মালিক। তিনি হাতে তৈরী কোন মন্দিরে বাস করেন না। তাঁর কোন অভাব নেই, সেইজন্য মানুষের হাত থেকে সেবা গ্রহণ করবারও তাঁর দরকার নেই, কারণ তিনিই সব মানুষকে জীবন, প্রাণবায়ু আর অন্যান্য সব কিছু দান করেন। তিনি একজন মানুষ থেকে সমস্ত জাতির লোক সৃষ্টি করেছেন যেন তারা সারা দুনিয়াতে বাস করে। তারা কখন কোথায় বাস করবে তাও তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ এই কাজ করেছেন যেন মানুষ হাতড়াতে হাতড়াতে তাঁকে পেয়ে যাবার আশায় তাঁর তালাশ করে। কিন্তু আসলে তিনি আমাদের কারও কাছ থেকে দূরে নন, কারণ তাঁর শক্তিতেই আমরা জীবন কাটাই ও চলাফেরা করি এবং বেঁচেও আছি। আপনাদের কয়েকজন কবিও বলেছেন, ‘আমরাও তাঁর সন্তান।’ “তাহলে আমরা যখন আল্লাহ্‌র সন্তান তখন আল্লাহ্‌কে মানুষের হাত ও চিন্তাশক্তি দিয়ে তৈরী সোনা, রূপা বা পাথরের মূর্তি মনে করা আমাদের উচিত নয়। আগেকার দিনে মানুষ জানত না বলে আল্লাহ্‌ এই সব দেখেও দেখেন নি। কিন্তু এখন তিনি সব জায়গায় সব লোককে তওবা করতে হুকুম দিচ্ছেন, কারণ তিনি এমন একটা দিন ঠিক করেছেন যে দিনে তাঁর নিযুক্ত লোকের দ্বারা তিনি ন্যায়ভাবে মানুষের বিচার করবেন। তিনি সেই লোককে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলে সব মানুষের কাছে এর প্রমাণ দিয়েছেন।” মৃতদের আবার জীবিত হয়ে উঠবার কথা শুনে লোকদের মধ্যে কয়েকজন মুখ বাঁকাল, কিন্তু অন্যেরা বলল, “এই বিষয়ে আপনার কথা আমরা আবার শুনব।” তখন পৌল সেই সভা ছেড়ে চলে গেলেন। কয়েকজন লোক পৌলের সংগে যোগ দিল এবং ঈমান আনল। সেই ঈমানদারদের মধ্যে দিয়নুষিয় নামে এরিওপেগসের সভার একজন সদস্য, দামারিস্‌ নামে একজন স্ত্রীলোক এবং তাঁদের সংগে আরও কয়েকজন ছিলেন। এর পরে পৌল এথেন্স ছেড়ে করিন্থ শহরে গেলেন। সেখানে আকিলা নামে একজন ইহুদীর সংগে তাঁর দেখা হল। পন্ত প্রদেশে আকিলার জন্ম হয়েছিল। সম্রাট ক্লাডিয়াস সমস্ত ইহুদীদের রোম ছেড়ে যেতে হুকুম দিয়েছিলেন। সেইজন্য কিছু দিন আগে আকিলা তাঁর স্ত্রী প্রিষ্কিল্লাকে নিয়ে ইতালী থেকে করিনে' এসেছিলেন। পৌল তাঁদের কাছে গেলেন। তাঁদের মত তিনিও তাম্বু তৈরীর কাজ করতেন বলে তাঁদের সংগে থেকে কাজ করতে লাগলেন। প্রত্যেক বিশ্রামবারে পৌল মজলিস-খানায় গিয়ে ঈসার বিষয় আলোচনা করতেন এবং গ্রীক ও ইহুদীদের মসীহের পথে আনতে চেষ্টা করতেন। সীল ও তীমথিয় ম্যাসিডোনিয়া থেকে আসলে পর পৌল কেবল আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করে তাঁর সমস্ত সময় কাটাতে লাগলেন। তিনি ইহুদীদের কাছে সাক্ষ্য দিতেন যে, ঈসাই মসীহ্‌। কিন্তু ইহুদীরা যখন পৌলের বিরুদ্ধে কথা বলে তাঁকে অপমান করতে লাগল তখন পৌল তাদের বিরুদ্ধে তাঁর কাপড়-চোপড় ঝেড়ে ফেললেন এবং বললেন, “আপনাদের রক্তের দায় আপনাদের নিজেদের মাথার উপরেই থাকুক। এই বিষয়ে আমার কোন দোষ নেই। এখন থেকে আমি অ-ইহুদীদের কাছে যাব।” এর পরে পৌল মজলিস-খানা ছেড়ে তিতিয়-যুষ্ট নামে একজন লোকের ঘরে গেলেন। এই লোকের বাড়ী মজলিস-খানার পাশেই ছিল এবং ইনি অ-ইহুদী হয়েও আল্লাহ্‌র এবাদত করতেন। মজলিস-খানার কর্তা ক্রীষ্প ও তাঁর বাড়ীর সবাই প্রভুর উপর ঈমান আনলেন। এছাড়া করিন্থীয়দের মধ্যে অনেকেই পৌলের কথা শুনে ঈমান আনল এবং তরিকাবন্দী নিল। একদিন রাতের বেলা প্রভু একটা দর্শনের মধ্য দিয়ে পৌলকে এই কথা বললেন, “ভয় কোরো না, কথা বলতে থাক, চুপ করে থেকো না; কারণ আমি তোমার সংগে সংগে আছি। তোমাকে আক্রমণ করে কেউ তোমার ক্ষতি করবে না, কারণ এই শহরে আমার অনেক লোক আছে।” এতে পৌল দেড় বছর সেই শহরে থেকে লোকদের আল্লাহ্‌র কালাম শিক্ষা দিলেন। গাল্লিয়ো যখন আখায়া প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন তখন ইহুদীরা সবাই মিলে পৌলকে ধরে বিচারের জন্য আদালতে আনল। তারা বলল, “এই লোকটা এমনভাবে আল্লাহ্‌র এবাদত করতে উস্‌কে দিচ্ছে যা শরীয়তের বিরুদ্ধে।” পৌল কথা বলতে যাবেন এমন সময় গাল্লিয়ো ইহুদীদের বললেন, “ইহুদীরা, এটা যদি কোন অন্যায় বা ভীষণ কোন দোষের ব্যাপার হত তবে তোমাদের কথা শোনা আমার পক্ষে ঠিক কাজ হত। কিন্তু এটা যখন বিশেষ কোন কথার ব্যাপার, কারও নামের ব্যাপার ও তোমাদের শরীয়তের ব্যাপার, তখন তোমরাই এর মীমাংসা কর। আমি ঐ সব ব্যাপারের বিচার করব না।” এই কথা বলে তিনি আদালত থেকে তাদের বের করে দেবার হুকুম দিলেন। তখন সেই ইহুদীরা সবাই মিলে মজলিস-খানার কর্তা সোসি'নীকে ধরে আদালতের সামনে মারধর করল; গাল্লিয়ো কিন্তু তা চেয়েও দেখলেন না। বেশ কিছু দিন করিনে' কাটাবার পরে পৌল ঈমানদার ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং আকিলা ও পিষ্কিল্লার সংগে সমুদ্রপথে সিরিয়া দেশে আসলেন। পৌল একটা মানত করেছিলেন বলে যাত্রা করবার আগে কিংক্রিয়া বন্দরে তাঁর মাথার চুল কেটে ফেলেছিলেন। ইফিষ শহরে পৌঁছে তিনি প্রিষ্কিল্লা ও আকিলার সংগ ছাড়লেন। পরে তিনি নিজেই মজলিস-খানায় গিয়ে ইহুদীদের সংগে ঈসার বিষয় আলোচনা করতে লাগলেন। ইহুদীরা তাঁকে তাদের সংগে কিছু দিন থাকতে বলল, কিন্তু তিনি রাজী হলেন না। তবে সেখান থেকে চলে যাবার সময় তিনি বললেন, “ইন্‌শা-আল্লাহ্‌ আমি আবার ফিরে আসব।” তারপর তিনি ইফিষ থেকে জাহাজে করে রওনা হলেন। তিনি সিজারিয়া শহরে পৌঁছে জাহাজ থেকে নেমে জেরুজালেমে গেলেন। সেখানে জামাতের লোকদের সালাম জানাবার পরে তিনি এণ্টিয়কে গেলেন। এণ্টিয়কে কিছু দিন কাটাবার পর তিনি সেখান থেকে যাত্রা করলেন এবং গালাতিয়া ও ফরুগিয়া প্রদেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে ঘুরে উম্মতদের ঈমান বাড়িয়ে তাদের শক্তিশালী করে তুললেন। এর মধ্যে আপল্লো নামে একজন ইহুদী ইফিষে আসলেন। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে তাঁর বাড়ী ছিল। তিনি একজন ভাল বক্তা ছিলেন এবং পাক-কিতাব খুব ভাল করে জানতেন। প্রভুর পথের বিষয় তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি খুব আগ্রহের সংগে কথা বলতেন এবং ঈসার বিষয় ঠিকভাবে শিক্ষা দিতেন, কিন্তু ইয়াহিয়ার তরিকাবন্দী ছাড়া আর কোন তরিকাবন্দীর কথা তিনি জানতেন না। তিনি খুব সাহসের সংগে মজলিস-খানায় কথা বলতে শুরু করলেন। তখন প্রিষ্কিল্লা ও আকিলা আপল্লোর কথা শুনে তাঁকে তাঁদের বাড়ীতে দাওয়াত করলেন এবং আল্লাহ্‌র পথের বিষয় আরও ভাল করে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন। পরে আপল্লো যখন আখায়াতে যেতে চাইলেন তখন ইফিষের ঈমানদার ভাইয়েরা তাঁকে উৎসাহ দিল। আখায়ার উম্মতেরা যেন আপল্লোকে গ্রহণ করে এইজন্য ইফিষীয় ভাইয়েরা আখায়াতে চিঠি লিখল। আল্লাহ্‌র রহমতে আখায়াতে যারা ঈমানদার হয়েছিল আপল্লো সেখানে পৌঁছে তাদের খুব সাহায্য করলেন। ঈসাই যে মসীহ্‌ তা তিনি পাক-কিতাবের মধ্য থেকে প্রমাণ করলেন এবং সকলের সামনেই খুব জোরালো যুক্তি দিয়ে তর্কে ইহুদীদের হারিয়ে দিলেন। আপল্লো যখন করিনে' ছিলেন সেই সময় পৌল এশিয়া প্রদেশের মধ্য দিয়ে ইফিষে আসলেন। সেখানে তিনি কয়েকজন উম্মতের দেখা পেয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা যখন ঈমান এনেছিলেন তখন কি পাক-রূহ্‌ পেয়েছিলেন?” তারা তাঁকে বলল, “পাক-রূহ্‌ যে আছেন সেই কথা আমরা শুনিই নি।” তখন পৌল বললেন, “তবে আপনারা কোন্‌ তরিকাবন্দী পেয়েছিলেন?” তারা বলল, “ইয়াহিয়ার তরিকাবন্দী।” পৌল বললেন, “তওবা করে যে তরিকাবন্দী গ্রহণ, সেটাই ছিল ইয়াহিয়ার তরিকাবন্দী। ইয়াহিয়া লোকদের বলেছিলেন, তাঁর পরে যিনি আসছেন তাঁর উপর, অর্থাৎ ঈসার উপর ঈমান আনতে হবে।” এই কথা শুনে সেই উম্মতেরা হযরত ঈসার নামে তরিকাবন্দী নিল। তখন পৌল তাদের উপর হাত রাখলে পর তাদের উপর পাক-রূহ্‌ আসলেন, আর তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে ও নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলতে লাগল। সেই উম্মতেরা সংখ্যায় কমবেশ বারোজন ছিল। এর পরে পৌল মজলিস-খানায় গেলেন এবং তিন মাস পর্যন্ত খুব সাহসের সংগে কথা বললেন। আল্লাহ্‌র রাজ্য সম্বন্ধে তিনি যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে লোকেরা যাতে ঈমান আনে তার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজনের মন কঠিন হয়ে গিয়েছিল বলে তারা ঈমান আনতে চাইল না এবং সকলের সামনে ঈসার পথের বিষয়ে অনেক নিন্দা করতে লাগল। তখন পৌল তাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি উম্মতদের সংগে নিয়ে তুরান্ন নামে একজন শিক্ষকের বক্তৃতা দেবার ঘরে গিয়ে প্রত্যেক দিন যুক্তি-তর্কের সংগে আলোচনা করতে লাগলেন। দু’বছর এইভাবেই চলল। তাতে যে ইহুদী ও গ্রীকেরা এশিয়া প্রদেশে থাকত তারা সবাই মাবুদের কালাম শুনতে পেল। আল্লাহ্‌ পৌলের মধ্য দিয়ে খুব আশ্চর্য্য অলৌকিক কাজ করতে লাগলেন। তাঁর ব্যবহার করা গামছা ও গায়ের কাপড় রোগীদের কাছে নিয়ে গেলে পর তাদের অসুখ ভাল হয়ে যেত এবং ভূতেরাও ছেড়ে যেত। কয়েকজন ইহুদী ভূত ছাড়িয়ে বেড়াত। হযরত ঈসার নাম ব্যবহার করে তারা ভূতে পাওয়া লোকদের সুস্থ করবার চেষ্টা করতে লাগল। তারা বলত, “পৌল যাঁর বিষয় তবলিগ করেন সেই ঈসার নামে আমি তোমাদের বের হয়ে যাবার হুকুম দিচ্ছি।” তাদের মধ্যে স্কিবা নামে একজন ইহুদী প্রধান ইমামের সাতটি ছেলে ঐ রকম করত। একবার যখন তারা ঐ রকম করছিল তখন ভূত তাদের বলল, “আমি ঈসাকেও চিনি, পৌলকেও চিনি, কিন্তু তোমরা কারা?” যে লোকটিকে ভূতে পেয়েছিল সে তখন সেই সাতজনের উপর লাফিয়ে পড়ল আর তাদের সবাইকে এমনভাবে আঘাত করল যে, তারা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উলংগ অবস্থায় সেই বাড়ী থেকে পালিয়ে গেল। এই খবর যখন ইফিষে বাসকারী ইহুদী ও গ্রীকেরা জানতে পারল তখন তারা সবাই খুব ভয় পেল, আর হযরত ঈসার নামের খুব প্রশংসা হল। যারা হযরত ঈসার উপর ঈমান এনেছিল এমন অনেক লোক তখন এসে খোলাখুলিভাবেই তাদের খারাপ কাজের বিষয় স্বীকার করল। যারা জাদুর খেলা দেখাত তাদের মধ্যে অনেকে তাদের বই-পুঁথি একসংগে জড়ো করে সবার সামনেই সেগুলো পুড়িয়ে দিল। বইগুলোর দাম হিসাব করলে দেখা গেল পঞ্চাশ হাজার দীনার। মাবুদের কালাম এইভাবে ছড়িয়ে পড়ল এবং তার শক্তি লোকদের মনে আরও বেশী করে কাজ করতে লাগল। এই সব ঘটবার পর পৌল ঠিক করলেন তিনি ম্যাসিডোনিয়া ও আখায়া হয়ে জেরুজালেমে যাবেন। তিনি বললেন, “জেরুজালেমে যাবার পরে আমাকে রোম শহরেও যেতে হবে।” পরে তিনি তীমথিয় ও ইরাস- নামে তাঁর দু’জন সাহায্যকারীকে ম্যাসিডোনিয়াতে পাঠিয়ে দিলেন, আর এদিকে তিনি আরও কিছু দিন এশিয়া প্রদেশে রইলেন। সেই সময়ে ঈসার পথের বিষয় নিয়ে খুব গোলমাল শুরু হল। দীমীত্রিয় নামে একজন স্বর্ণকার দেবী আর্তেমিসের মন্দিরের মত ছোট ছোট রূপার মন্দির তৈরী করত। এতে মিস্ত্রিদের খুব লাভ হত। দীমীত্রিয় সেই মিস্ত্রিদের ও তাদের মত অন্যান্য কারিগরদের এক জায়গায় ডেকে বলল, “ভাইয়েরা, তোমরা তো জান যে, এই ব্যবসা দিয়ে আমাদের আয় বেশ ভালই হয়। কিন্তু তোমরা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছ যে, পৌল নামে ঐ লোকটা আমাদের এই ইফিষে এবং বলতে গেলে প্রায় সমস্ত এশিয়া প্রদেশের অনেক লোকদের ঈমান জন্মিয়ে তাদের ভুল পথে নিয়ে গেছে। সে বলে যে, হাতে তৈরী দেব-দেবী কিছুই নয়। এতে কেবল যে আমাদের ব্যবসার সুনাম যাবে তা নয়, কিন্তু মহান দেবী আর্তেমিসের মন্দিরও মিথ্যা হয়ে যাবে। আর এশিয়া প্রদেশের সব লোকেরা, এমন কি, দুনিয়ার সবাই যে দেবীর উপাসনা করে তিনি নিজেও মহান থাকবেন না।” এই কথা শুনে সেই লোকেরা রেগে আগুন হয়ে গেল এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, “ইফিষীয়দের আর্তেমিস দেবীই মহান।” আর দেখতে না দেখতে সমস্ত শহরটা হট্টগোলে পূর্ণ হয়ে গেল। গাইয় ও আরিষ্টার্খ নামে ম্যাসিডোনিয়ার যে দু’জন লোক তখন পৌলের সংগে যাচ্ছিলেন লোকেরা তাদের ধরল এবং সবাই একসংগে সভা বসবার স্থানে ছুটে গেল। পৌল ভিড়ের সামনে যেতে চাইলেন কিন্তু উম্মতেরা তাঁকে যেতে দিল না। সেই প্রদেশের কয়েকজন রাজকর্মচারী পৌলের বন্ধু ছিলেন। তাঁরাও পৌলকে খবর পাঠিয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন যেন তিনি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সেই সভার স্থানে না যান। এর মধ্যে সভাতে গোলমাল হতেই থাকল। কিছু লোক এক কথা বলে চিৎকার করছিল, আবার কিছু লোক অন্য কথা বলে চিৎকার করছিল। বেশীর ভাগ লোক জানতই না কেন তারা সেই সভাতে উপস্থিত হয়েছে। ইহুদীরা আলেকজাণ্ডারকে সামনে ঠেলে দিলে পর কয়েকজন লোক তাকে বলে দিল কি বলতে হবে। তখন আলেকজাণ্ডার লোকদের সামনে নিজের পক্ষে কথা বলবার জন্য হাতের ইশারায় লোকদের চুপ করাতে চেষ্টা করল। কিন্তু লোকেরা যখন জানতে পারল যে, আলেকজাণ্ডার ইহুদী তখন সবাই একসংগে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এই বলে চিৎকার করল, “ইফিষীয়দের আর্তেমিস দেবীই মহান।” শেষে শহরের একজন বিশেষ সরকারী কর্মচারী লোকদের চুপ করিয়ে বললেন, “ইফিষীয় লোকেরা, এই কথা সবাই জানে যে, মহান আর্তেমিস দেবীর মন্দিরের এবং আকাশ থেকে তাঁর যে মূর্তি পড়েছে তার রক্ষাকারী হল ইফিষ শহর। এই সত্যি কথা যখন অস্বীকার করা যায় না তখন বোকার মত কাজ না করে তোমাদের চুপ করে থাকাই উচিত। যদিও এই লোকেরা আমাদের মন্দিরগুলো থেকে চুরিও করে নি এবং আমাদের দেবীর নিন্দাও করে নি, তবুও এই লোকদের তোমরা এখানে এনেছ। যদি দীমীত্রিয় ও তার সংগী-মিস্ত্রিরা কারও বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে চায় তবে আদালত তো খোলাই আছে আর শাসনকর্তারাও সেখানে আছেন। তারা সেখানে মকদ্দমা করতে পারে। কিন্তু তোমরা যদি আরও বেশী কিছু বলতে চাও তবে সাধারণ সভার মধ্যে তার মীমাংসা করতে হবে। আজকের ঘটনায় দাংগা-হাংগামা বাধাবার জন্য আমাদেরই উপর দোষ পড়বার ভয় আছে। যদি তা-ই হয় তবে আমরা এই গোলমালের কোন কারণ দেখাতে পারব না, কারণ এই গোলমালের কোন কারণই নেই।” এই বলে তিনি সভা ভেংগে দিলেন। গোলমাল থামলে পর পৌল উম্মতদের ডেকে পাঠালেন। তাদের উৎসাহ দেবার পরে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ম্যাসিডোনিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। বিরয়া থেকে পুর্হের ছেলে সোপাত্র, থিষলনীকি থেকে আরিষ্টার্খ ও সিকুন্দ, দর্বী থেকে গাইয়, তীমথিয় এবং এশিয়া থেকে তুখিক ও ত্রফিম পৌলের সংগে গেলেন। এই লোকেরা আগে গিয়ে ত্রোয়া শহরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করলেন। খামিহীন রুটির ঈদের পরে আমরা সমুদ্রপথে ফিলিপী থেকে যাত্রা করলাম এবং পাঁচ দিন পরে ত্রোয়াতে তাঁদের সংগে যোগ দিলাম। ত্রোয়াতে আমরা সাত দিন ছিলাম। সপ্তার প্রথম দিনে মসীহের মেজবানী গ্রহণ করবার জন্য আমরা একসংগে মিলিত হলাম। তখন পৌল লোকদের কাছে তবলিগ করতে লাগলেন। পরের দিন তাঁর চলে যাবার কথা ছিল বলে তিনি মাঝরাত পর্যন্ত কথা বলতেই থাকলেন। আমরা উপরতলার যে ঘরে মিলিত হয়েছিলাম সেখানে অনেকগুলো বাতি ছিল। উতুখ্‌ নামে একজন যুবক সেই ঘরের জানালার উপর বসে ছিল। পৌল অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন বলে সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম গভীর হলে পর সে তিনতলা থেকে নীচে পড়ে গেল এবং তাকে মৃত অবস্থায় তুলে নেওয়া হল। তখন পৌল নীচে নেমে গেলেন এবং সেই যুবকের উপর ঝুঁকে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমরা ভয় কোরো না, সে বেঁচে আছে।” এর পরে পৌল আবার উপরতলায় গিয়ে মসীহের মেজবানী গ্রহণ করলেন এবং অনেকক্ষণ ধরে ভোর পর্যন্ত কথা বলবার পর তিনি চলে গেলেন। লোকেরা সেই যুবককে জীবিত অবস্থায় বাড়ী নিয়ে গেল এবং খুব সান্ত্বনা পেল। আমরা আগে গিয়ে জাহাজে উঠে আঃস বন্দরের দিকে যাত্রা করলাম। সেখান থেকে পৌলকে তুলে নেবার কথা ছিল। তাঁকে তুলে নেবার কথা তিনি আমাদের বলেছিলেন কারণ তিনি হাঁটা-পথে সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। আঃসে আমাদের সংগে তাঁর দেখা হলে পর আমরা তাঁকে জাহাজে তুলে নিলাম ও মিতুলীনীতে আসলাম। পরের দিন আমরা সেখান থেকে যাত্রা করে খীয় দ্বীপের কাছে পৌঁছালাম। তার পরের দিন আমরা সাগর পার হয়ে সামঃ দ্বীপে গেলাম। এর পরের দিন আমরা মিলেটাস বন্দরে গিয়ে পৌঁছালাম। এশিয়া প্রদেশে পৌলকে যাতে দেরি করতে না হয় সেইজন্য তিনি ঠিক করেছিলেন যে, তিনি ইফিষে না থেমে তার কাছ দিয়ে চলে যাবেন। জেরুজালেমে পৌঁছাবার জন্য তিনি তাড়াহুড়া করছিলেন যেন সম্ভব হলে পঞ্চাশত্তমী-ঈদের দিনে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন। পৌল মিলেটাস থেকে ইফিষে লোক পাঠিয়ে সেখানকার জামাতের নেতাদের ডেকে পাঠালেন। তাঁরা সেখানে পৌঁছালে পর পৌল তাঁদের বললেন, “এশিয়া প্রদেশে আসবার পরে প্রথম দিন থেকে সব সময় আপনাদের সংগে আমি কিভাবে কাটিয়েছি তা তো আপনারা জানেন। ইহুদীদের নানা ষড়যন্ত্রের দরুন আমাকে ভীষণ পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হয়েছিল, কিন্তু আমি খুব নম্রভাবে চোখের পানির সংগে প্রভুর গোলাম হয়ে তাঁর সেবা করেছি। আপনাদের যাতে সাহায্য হয় এমন কোন কিছুই আমি আপনাদের কাছে না বলে চুপ করে থাকি নি, বরং বাইরে খোলাখুলিভাবে এবং আপনাদের ঘরে ঘরে শিক্ষা দিয়েছি ও তবলিগ করেছি। ইহুদী ও গ্রীকদের কাছে আমি বিশেষ জোর দিয়ে জানিয়েছি যে, গুনাহ্‌ থেকে মন ফিরিয়ে আল্লাহ্‌র দিকে তাদের ফিরতে হবে এবং আমাদের হযরত ঈসার উপর ঈমান আনতে হবে। “এখন আমি পাক-রূহের বাধ্য হয়ে জেরুজালেমে যাচ্ছি। সেখানে আমার উপর কি ঘটবে তা আমি জানি না। আমি কেবল এই কথা জানি, পাক-রূহ্‌ প্রত্যেক শহরে আমাকে এই কথা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আমাকে জেল খাটতে ও কষ্ট পেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে আমার প্রাণের কোন দাম নেই। আমার একমাত্র ইচ্ছা এই, যেন আমি শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে পারি, অর্থাৎ হযরত ঈসা যে কাজের ভার আমাকে দিয়েছেন তা শেষ করতে পারি। সেই কাজ হল আল্লাহ্‌র রহমতের সুসংবাদের বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়া। “এখন আমি এই কথা জানি যে, আপনাদের যাঁদের কাছে আমি গিয়ে আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে তবলিগ করেছি তাঁদের কেউই আমাকে আর দেখতে পাবেন না। সেইজন্য আজ আমি আপনাদের পরিষ্কার ভাবে বলছি, কারও রক্তের দায়ী আমি নই, কারণ আল্লাহ্‌ কি চান তা আপনাদের জানাতে আমি কখনও পিছপা হই নি। আপনারা নিজেদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকুন, আর পাক-রূহ্‌ যে ঈমানদার দলের ভার পরিচালক হিসাবে আপনাদের উপর দিয়েছেন তাদের সম্বন্ধেও সতর্ক থাকুন। রাখাল যেমন তার ভেড়ার পালের দেখাশোনা করে ঠিক তেমনি করে আপনারাও ইমাম হিসাবে আল্লাহ্‌র জামাতের দেখাশোনা করুন। আল্লাহ্‌ সেই জামাতকে নিজের রক্ত দিয়ে কিনেছেন। আমি জানি যে, আমি চলে যাবার পর লোকেরা হিংস্র নেকড়ে বাঘের মত করে আপনাদের মধ্যে আসবে এবং ভেড়ার পালের ক্ষতি করবে। এমন কি, আপনাদের নিজেদের মধ্য থেকে লোকেরা উঠে আল্লাহ্‌র সত্যকে মিথ্যা বানাবার চেষ্টা করবে যেন ঈমানদারদের নিজেদের দলে টানতে পারে। এইজন্য আপনারা সাবধান থাকুন। মনে রাখবেন, তিন বছর ধরে দিনরাত চোখের পানির সংগে আমি আপনাদের প্রত্যেককে সাবধান করেছিলাম, কখনও চুপ করে থাকি নি। “আল্লাহ্‌ ও তাঁর কালামের হাতে এখন আমি আপনাদের তুলে দিচ্ছি। আল্লাহ্‌র কালাম তাঁর রহমতের বিষয় বলে, আর আপনাদের গড়ে তুলবার ক্ষমতা সেই কালামের আছে। এছাড়া আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের বান্দাদের জন্য যা কিছু রেখেছেন সেই কালাম আপনাদের তাও দিতে পারবে। কারও সোনা, রূপা বা কাপড়-চোপড়ের উপরে আমি লোভ করি নি। আপনারা নিজেরাই তো জানেন যে, আমার এই দুই হাত আমার ও আমার সংগীদের সমস্ত অভাব মিটিয়েছে। আমি যা করেছি তা সব কিছুতেই আপনাদের দেখিয়েছি যে, এই রকম কঠিন পরিশ্রমের দ্বারা দুর্বলদের সাহায্য করা উচিত এবং হযরত ঈসার এই কথা আমাদের মনে রাখা উচিত যে, ‘পাওয়ার চেয়ে দেওয়াতে আরও বেশী দোয়া রয়েছে।’ ” এই কথা বলবার পর পৌল সবার সংগে হাঁটু পেতে মুনাজাত করলেন। পরে জামাতের নেতারা সবাই পৌলকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। পৌলের মুখ আর তাঁরা দেখতে পাবেন না, বিশেষ করে এই কথার জন্য তাঁরা খুব বেশী দুঃখ পেলেন। এর পরে তাঁরা তাঁর সংগে সংগে জাহাজ পর্যন্ত গেলেন। ইফিষের জামাতের নেতাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা জাহাজে করে সোজা কো দ্বীপে গেলাম। পরের দিন আমরা রোডস দ্বীপে আসলাম। তারপর সেখান থেকে পাতারা শহরে গেলাম। সেখানে আমরা ফিনিশিয়া যাবার একটা জাহাজ পেলাম। তখন আমরা সেই জাহাজে উঠে রওনা হলাম। পরে সাইপ্রাস দ্বীপ দেখতে পেয়ে তার দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে আমরা সিরিয়া দেশের টায়ার শহরে গিয়ে জাহাজ থেকে নামলাম। সেখানে আমাদের জাহাজের মালপত্র নামাবার কথা ছিল। সেখানকার উম্মতদের খুঁজে পেয়ে আমরা তাদের সংগে সাত দিন রইলাম। সেই উম্মতেরা পাক-রূহের মধ্য দিয়ে পৌলকে অনুরোধ করল যেন তিনি জেরুজালেমে না যান। কিন্তু সেই দিনগুলো কেটে গেলে পর আমরা তাদের ছেড়ে আমাদের পথে রওনা হলাম। সব উম্মতেরা এবং তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আমাদের সংগে সংগে শহরের বাইরে আসল। পরে সাগরের কিনারে আমরা হাঁটু পেতে মুনাজাত করলাম। তারপর একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা জাহাজে উঠলাম এবং তারা বাড়ী ফিরে গেল। টায়ার থেকে যাত্রা করে আমরা তলিমায়িতে পৌঁছালাম। সেখানে ঈমানদার ভাইদের সালাম জানিয়ে তাদের সংগে এক দিন রইলাম। পরদিন আমরা যাত্রা করে সিজারিয়াতে পৌঁছালাম এবং সুসংবাদ তবলিগকারী ফিলিপের বাড়ীতে রইলাম। ইনি ছিলেন জেরুজালেম জামাতের সেই সাতজন খেদমতকারীর মধ্যে একজন। তাঁর চারজন অবিবাহিতা মেয়ে ছিল। তাঁরা লোকদের কাছে নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলতেন। আমরা সেখানে বেশ কয়েকদিন থাকবার পর এহুদিয়া থেকে আগাব নামে একজন নবী আসলেন। তিনি আমাদের কাছে এসে পৌলের কোমর-বাঁধনি খুলে নিলেন এবং তা দিয়ে নিজের হাত-পা বেঁধে বললেন, “পাক-রূহ্‌ বলছেন, ‘জেরুজালেমের ইহুদীরা এই কোমর-বাঁধনির মালিককে এইভাবে বাঁধবে এবং অ-ইহুদীদের হাতে দেবে।’ ” এই কথা শুনে সেখানকার লোকেরা এবং আমরা পৌলকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলাম যেন তিনি জেরুজালেমে না যান। তখন পৌল বললেন, “তোমরা কেঁদে আমার মনে দুঃখ দিচ্ছ কেন? হযরত ঈসার জন্য আমি জেরুজালেমে কেবল বন্দী হতে নয়, মরতেও প্রস্তুত আছি।” তাঁকে থামাতে না পেরে আমরা চুপ করলাম এবং পরে বললাম, “মাবুদের ইচ্ছামত হোক।” এর পরে আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে জেরুজালেমে গেলাম। সিজারিয়ার কয়েকজন উম্মত আমাদের সংগে চলল এবং ম্নাসোন নামে সাইপ্রাস দ্বীপের একজন লোকের বাড়ীতে নিয়ে গেল। এঁরই বাড়ীতে আমাদের থাকবার কথা ছিল। ইনি ছিলেন প্রথম উম্মতদের মধ্যে একজন। জেরুজালেমে পৌঁছালে পর ঈমানদার ভাইয়েরা খুশী হয়ে আমাদের গ্রহণ করল। পরদিন পৌল আমাদের সংগে ইয়াকুবকে দেখতে গেলেন। সেখানে জামাতের সব নেতারা উপস্থিত ছিলেন। পৌল তাঁদের সালাম জানালেন এবং তাঁর তবলিগের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ কিভাবে অ-ইহুদীদের মধ্যে কাজ করেছেন তা এক এক করে বললেন। এই কথা শুনে সেই নেতারা আল্লাহ্‌র গৌরব করলেন এবং পৌলকে বললেন, “ভাই, তুমি তো দেখছ, কত হাজার হাজার ইহুদী ঈসার উপর ঈমান এনেছে, আর তারা সবাই মূসার শরীয়ত পালন করবার জন্য খুবই আগ্রহী। তারা খবর পেয়েছে, অ-ইহুদীদের মধ্যে যে সব ইহুদীরা থাকে তাদের তুমি মূসার শরীয়ত বাদ দিয়ে চলতে শিক্ষা দিয়ে থাক, অর্থাৎ তুমি তাদের ছেলেদের খৎনা করাতে এবং ইহুদীদের চলতি নিয়ম পালন করতে নিষেধ করে থাক। এখন আমরা কি করি? তারা তো নিশ্চয়ই শুনবে যে, তুমি এসেছ। আমরা এখন তোমাকে যা বলি তুমি তা-ই কর। আমাদের মধ্যে এমন চারজন লোক আছে যারা একটা মানত করেছে। এই লোকদের তুমি তোমার সংগে নিয়ে যাও এবং তাদের সংগে তুমি নিজেও পাক-সাফ হও আর তাদের মাথার চুল কামাবার পয়সা দাও। তখন সবাই জানবে যে, তোমার সম্বন্ধে তারা যে খবর পেয়েছে তা মিথ্যা এবং তুমি শরীয়ত পালন করছ। কিন্তু যে অ-ইহুদীরা ঈমানদার হয়েছে তাদের জন্য আমরা যা ঠিক করেছি সেই সম্বন্ধে তাদের কাছে এই কথা লিখে জানিয়েছি যে, মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবার তারা খাবে না, রক্ত খাবে না, গলা টিপে মারা কোন পশুর গোশ্‌ত খাবে না আর কোন রকম জেনা করবে না।” তখন পৌল সেই লোকদের নিয়ে গিয়ে তাদের সংগে নিজেকেও পাক-সাফ করলেন। পরের দিন তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসে গেলেন, আর তাদের পাক-সাফ হবার কাজ কবে শেষ হবে এবং প্রত্যেকের জন্য কবে পশু-কোরবানী দেওয়া হবে তা জানিয়ে দিলেন। পাক-সাফ হবার সেই সাত দিন প্রায় শেষ হয়ে আসলে পর এশিয়া প্রদেশের কয়েকজন ইহুদী পৌলকে বায়তুল-মোকাদ্দসে দেখল। তারা সেখানকার সব লোকদের উস্‌কিয়ে দিল এবং পৌলকে ধরল। পরে তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, “বনি-ইসরাইলরা, এগিয়ে এস। সব জায়গার মানুষের কাছে আমাদের জাতি এবং আমাদের শরীয়ত ও বায়তুল-মোকাদ্দসের বিরুদ্ধে যে লোক শিক্ষা দিয়ে বেড়ায়, এ-ই সেই লোক। তা ছাড়া সে বায়তুল-মোকাদ্দসে গ্রীকদের এনে এই পবিত্র জায়গা নাপাক করেছে।” তারা এই কথা বলল কারণ তারা আগে ইফিষীয় ত্রফিমকে পৌলের সংগে শহরের মধ্যে দেখেছিল। সেইজন্য তারা ভেবেছিল, পৌল ত্রফিমকে বায়তুল-মোকাদ্দসেও এনেছেন। তখন সারা শহর উত্তেজিত হয়ে উঠল। লোকেরা একসংগে দৌড়ে এসে পৌলকে ধরে বায়তুল-মোকাদ্দস থেকে টেনে বের করে আনল এবং সংগে সংগেই বায়তুল-মোকাদ্দসের দরজাগুলো বন্ধ করে দিল। লোকেরা পৌলকে হত্যা করবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় রোমীয় সৈন্যদের প্রধান সেনাপতির কাছে খবর গেল যে, সারা জেরুজালেম শহরে একটা হুলস'ূল পড়ে গেছে। সেই প্রধান সেনাপতি তখনই কয়েকজন শতপতি ও সৈন্যদের নিয়ে দৌড়ে ভিড়ের কাছে গেলেন। লোকেরা প্রধান সেনাপতি ও সৈন্যদের দেখে পৌলকে মারা বন্ধ করল। তখন প্রধান সেনাপতি এসে পৌলকে বন্দী করলেন এবং দু’টা শিকল দিয়ে তাঁকে বাঁধবার হুকুম দিলেন। তার পরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকটি কে? সে কি করেছে?” তখন লোকদের মধ্য থেকে কয়েকজন চিৎকার করে এক রকম কথা বলল, আবার কয়েকজন অন্য রকম কথা বলল। তাতে প্রধান সেনাপতি গোলমালের জন্য আসল ব্যাপার জানতে না পেরে পৌলকে সেনানিবাসে নিয়ে যাবার হুকুম দিলেন। পৌল সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছালে পর লোকদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সৈন্যদের তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে হল। লোকেরা তাঁর পিছনে পিছনে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওকে হত্যা কর।” সৈন্যেরা পৌলকে নিয়ে সেনানিবাসে ঢুকতে যাবে এমন সময় পৌল প্রধান সেনাপতিকে বললেন, “আপনাকে কি কিছু বলতে পারি?” প্রধান সেনাপতি বললেন, “তুমি দেখছি গ্রীক ভাষা জান! মিসর দেশের যে লোকটা কিছু দিন আগে বিদ্রোহ শুরু করে চার হাজার খুনী বিদ্রোহীকে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছিল, তুমি কি তবে সেই লোক নও?” তখন পৌল জবাব দিলেন, “আমি ইহুদী, কিলিকিয়া প্রদেশের তার্ষ শহরের লোক। আমি যে-সে শহরের লোক নই। দয়া করে আমাকে লোকদের কাছে কথা বলতে দিন।” প্রধান সেনাপতির অনুমতি পেয়ে পৌল সিঁড়ির উপরে দাঁড়ালেন এবং হাত তুলে লোকদের চুপ করবার জন্য ইশারা করলেন। লোকেরা চুপ করলে পর পৌল হিব্রু ভাষায় তাদের বললেন, “ভাইয়েরা ও পিতারা, এখন আমি আমার নিজের পক্ষে কথা বলি, শুনুন।” লোকেরা তাঁকে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে শুনে একেবারে চুপ হয়ে গেল। তখন পৌল বললেন, “আমি একজন ইহুদী। কিলিকিয়ার তার্ষ শহরে আমার জন্ম, তবে আমি এই শহরেই বড় হয়েছি। গমলীয়েলের পায়ের কাছে বসে আমি আমাদের পূর্বপুরুষদের শরীয়ত সম্পূর্ণভাবে শিক্ষালাভ করেছি। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে আজ আপনারা যেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন আমি নিজেও তেমনি আগ্রহী ছিলাম। ঈসার পথে যারা চলত আমি তাদের জুলুম করে অনেককে হত্যা করতাম আর পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের ধরে জেলখানায় দিতাম। এই কথা যে সত্যি, তার সাক্ষী মহা-ইমাম ও মহাসভার সবাই। এমন কি, আমি তাঁদের কাছ থেকে দামেস্ক শহরের ধর্ম-নেতাদের দেবার জন্য চিঠি নিয়েছিলাম এবং ঐ ধরনের লোকদের বন্দী হিসাবে জেরুজালেমে এনে শাস্তি দেবার জন্য সেখানে যাচ্ছিলাম। “তখন বেলা প্রায় দুপুর। আমি দামেস্কের কাছাকাছি আসলে পর হঠাৎ আমার চারদিকে আসমান থেকে একটা উজ্জ্বল আলো পড়ল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এবং শুনলাম কেউ যেন আমাকে বলছেন, ‘শৌল, শৌল, কেন তুমি আমার উপর জুলুম করছ?’ “আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘প্রভু, আপনি কে?’ “তিনি বললেন, ‘আমি নাসরতের ঈসা, যাঁর উপর তুমি জুলুম করছ।’ যারা আমার সংগে ছিল তারা সেই আলো দেখল, কিন্তু যিনি আমার সংগে কথা বলছিলেন তাঁর কথা তারা বুঝল না। “তখন আমি বললাম, ‘প্রভু, আমি কি করব?’ “প্রভু বললেন, ‘ওঠো, দামেস্কে যাও। তোমার জন্য যা ঠিক করে রাখা হয়েছে তা সেখানেই তোমাকে বলা হবে।’ আমার সংগীরা হাত ধরে আমাকে দামেস্কে নিয়ে চলল, কারণ সেই উজ্জ্বল আলোতে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। “পরে অননিয় নামে একজন লোক আমার কাছে আসলেন। তিনি মূসার শরীয়ত ভয়ের সংগে পালন করতেন, আর সেখানকার সব ইহুদীরা তাঁকে খুব সম্মান করত। তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাই শৌল, তোমার দেখবার শক্তি ফিরে আসুক।’ আর তখনই আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। “তখন অননিয় বললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌ তোমাকে বেছে নিয়েছেন যেন তুমি তাঁর ইচ্ছা জানতে পার, আর সেই ন্যায়বান বান্দাকে, অর্থাৎ ঈসা মসীহ্‌কে দেখতে পাও এবং তাঁর মুখের কথা শুনতে পাও। তুমি তাঁরই সাক্ষী হবে এবং যা দেখেছ আর শুনেছ সব মানুষের কাছে তা বলবে। এখন তুমি কেন দেরি করছ? উঠে তরিকাবন্দী নাও এবং নাজাত পাবার জন্য ঈসাকে ডেকে তোমার সব গুনাহ্‌ ধুয়ে ফেল।’ “পরে আমি জেরুজালেমে ফিরে এসে যখন একদিন বায়তুল-মোকাদ্দসে মুনাজাত করছিলাম তখন আমি তন্দ্রার মত অবস্থায় পড়লাম। সেই অবস্থায় আমি দেখলাম প্রভু আমার সংগে কথা বলছেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কর, এখনই জেরুজালেম ছেড়ে চলে যাও, কারণ আমার বিষয়ে তোমার সাক্ষ্য লোকে গ্রহণ করবে না।’ “আমি বললাম, ‘প্রভু, এই লোকেরা জানে, যারা তোমার উপর ঈমান আনত তাদের মারধর করে জেলে দেবার জন্য আমি এক মজলিস-খানা থেকে অন্য মজলিস-খানায় যেতাম। যখন তোমার সাক্ষী স্তিফানকে খুন করা হচ্ছিল তখন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে সায় দিচ্ছিলাম, আর যারা তাঁকে খুন করছিল তাদের কাপড়-চোপড় পাহারা দিচ্ছিলাম।’ “তখন প্রভু আমাকে বললেন, ‘তুমি যাও, আমি তোমাকে দূরে অ-ইহুদীদের কাছে পাঠাব।’ ” লোকেরা এতক্ষণ পর্যন্ত পৌলের কথা শুনছিল, কিন্তু যখন তিনি অ-ইহুদীদের কথা বললেন তখন লোকেরা জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওকে দুনিয়া থেকে দূর করে দাও; ও বেঁচে থাকবার উপযুক্ত নয়।” লোকেরা যখন চিৎকার করছিল এবং কাপড়-চোপড় ছুঁড়ে আকাশে ধুলা ছড়াচ্ছিল, তখন প্রধান সেনাপতি পৌলকে সেনানিবাসে নিয়ে যাবার হুকুম দিলেন। কেন লোকেরা পৌলের বিরুদ্ধে এইভাবে চিৎকার করছে তা জানবার জন্য তিনি তাঁকে চাবুক মেরে জেরা করতে হুকুম দিলেন। পৌলকে যখন চাবুক মারবার জন্য বাঁধা হল, তখন যে শতপতি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন পৌল তাঁকে বললেন, “যাকে দোষী বলে এখনও ঠিক করা হয় নি এমন একজন রোমীয়কে চাবুক মারা কি আপনাদের পক্ষে আইন মত কাজ হচ্ছে?” এই কথা শুনে সেই শতপতি প্রধান সেনাপতির কাছে সেই খবর দিয়ে বললেন, “আপনি কি করতে যাচ্ছেন? এই লোকটি তো রোমীয়।” তখন প্রধান সেনাপতি পৌলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে বল দেখি, তুমি কি রোমীয়?” পৌল বললেন, “জ্বী।” প্রধান সেনাপতি বললেন, “অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে রোমীয় হবার অধিকার আমি কিনেছি।” পৌল বললেন, “কিন্তু আমি রোমীয় হয়ে জন্মেছি।” এই কথা শুনে যারা তাঁকে জেরা করতে যাচ্ছিল তারা তখনই চলে গেল। যখন প্রধান সেনাপতি বুঝতে পারলেন যে, তিনি একজন রোমীয়কে বেঁধেছিলেন তখন তিনি ভয় পেলেন। ইহুদীরা কেন পৌলকে দোষ দিচ্ছে তা ঠিকভাবে জানবার জন্য পরের দিন প্রধান সেনাপতি পৌলের বাঁধন খুলে দিলেন এবং প্রধান ইমামদের ও মহাসভার লোকদের একসংগে মিলিত হবার হুকুম দিলেন। তারপর তিনি পৌলকে নিয়ে এসে তাঁদের সামনে দাঁড় করালেন। পৌল সোজা মহাসভার লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার ভাইয়েরা, আমি আজ পর্যন্ত পরিষ্কার বিবেকে আল্লাহ্‌র প্রতি আমার কর্তব্য পালন করছি।” এই কথা শুনে মহা-ইমাম অননিয় পৌলের কাছে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের তাঁর মুখের উপর আঘাত করতে হুকুম দিলেন। তখন পৌল অননিয়কে বললেন, “ভণ্ড, আল্লাহ্‌ আপনাকেও আঘাত করবেন। আইন মত আমার বিচার করবার জন্য আপনি ওখানে বসেছেন, কিন্তু আমাকে মারতে হুকুম দিয়ে তো আপনি নিজেই আইন ভাংছেন।” যারা পৌলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তারা তাঁকে বলল, “তুমি আল্লাহ্‌র মহা-ইমামকে অপমান করছ!” তখন পৌল বললেন, “ভাইয়েরা, আমি জানতাম না যে, উনি মহা-ইমাম। যদি জানতাম তাহলে ঐ কথা বলতাম না, কারণ পাক-কিতাবে লেখা আছে, ‘তোমার জাতির নেতাকে অসম্মান কোরো না।’ ” সেই মহাসভার এক দল যে সদ্দূকী ও অন্য দল ফরীশী, এই কথা জেনে পৌল মহাসভার মধ্যে জোরে বললেন, “আমার ভাইয়েরা, আমি একজন ফরীশী ও ফরীশীর সন্তান। আমার বিচার হচ্ছে কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, মৃতেরা আবার জীবিত হয়ে উঠবে।” তাঁর এই কথাতে ফরীশী ও সদ্দূকীদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল। এতে মহাসভার লোকেরা ভাগ হয়ে গেলেন, কারণ সদ্দূকীরা বলেন, “মৃতেরা আর জীবিত হয়ে উঠবে না।” এছাড়া তাঁরা আরও বলেন যে, ফেরেশতাও নেই, কোন রূহ্‌ও নেই; কিন্তু ফরীশীরা এ সবই বিশ্বাস করেন। তখন ভীষণ গোলমাল শুরু হল এবং ফরীশী দলের কয়েকজন আলেম উঠে খুব জোর তর্কাতর্কি শুরু করে দিলেন। তাঁরা বললেন, “আমরা এই লোকটির কোন দোষ দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো কোন রূহ্‌ বা কোন ফেরেশতা এর সংগে কথা বলেছেন।” সেই ঝগড়া এমন ভীষণ হয়ে উঠল যে, প্রধান সেনাপতির ভয় হল তাঁরা পৌলকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলবেন। তিনি সৈন্যদের হুকুম দিলেন যেন তারা গিয়ে লোকদের হাত থেকে পৌলকে ছাড়িয়ে এনে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। পরদিন রাতে প্রভু পৌলের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “সাহসী হও, জেরুজালেমে যেমন তুমি আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছ সেইভাবে রোমেও তোমাকে সাক্ষ্য দিতে হবে।” পরদিন সকালবেলা ইহুদীরা একটা ষড়যন্ত্র করল এবং পৌলকে হত্যা না করা পর্যন্ত কিছুই খাবে না বলে কসম খেল। চল্লিশজনেরও বেশী লোক এই ষড়যন্ত্র করল। তারা প্রধান ইমামদের ও ইহুদী বৃদ্ধ নেতাদের কাছে গিয়ে বলল, “পৌলকে হত্যা না করা পর্যন্ত কিছুই খাব না বলে আমরা কঠিন কসম খেয়েছি। এখন আপনারা ও মহাসভার লোকেরা এই ব্যাপারে আরও ভাল করে তদন্ত করবার অজুহাতে পৌলকে আপনাদের সামনে আনবার জন্য প্রধান সেনাপতির কাছে খবর পাঠান। সে এখানে পৌঁছাবার আগেই আমরা তাঁকে শেষ করে ফেলবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলাম।” কিন্তু পৌলের বোনের ছেলে এই ষড়যন্ত্রের কথা শুনতে পেয়ে সেনানিবাসে গেল এবং পৌলকে সেই খবর জানাল। তখন পৌল একজন শতপতিকে ডেকে বললেন, “এই যুবককে প্রধান সেনাপতির কাছে নিয়ে যান। তাঁর কাছে এর কিছু বলবার আছে।” তখন সেই শতপতি সেই যুবককে নিয়ে প্রধান সেনাপতির কাছে গিয়ে বললেন, “বন্দী পৌল আমাকে ডেকে পাঠিয়ে এই যুবককে আপনার কাছে নিয়ে আসতে বলল, কারণ আপনার কাছে তার নাকি কিছু বলবার আছে।” প্রধান সেনাপতি তখন সেই যুবকের হাত ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললেন, “আমাকে তুমি কি বলতে চাও?” সেই যুবক বলল, “ইহুদীরা ঠিক করেছে, পৌলের বিষয় আরও ভাল করে খবর নেবার অজুহাতে তাঁকে আগামী কাল মহাসভার সামনে নিয়ে যাবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করবে। আপনি তাদের কথায় রাজী হবেন না, কারণ চল্লিশজনেরও বেশী লোক লুকিয়ে থেকে পৌলের জন্য অপেক্ষা করে আছে। পৌলকে খুন না করা পর্যন্ত এই লোকেরা কিছু খাবে না বলে কসম খেয়েছে। তারা প্রস্তুত হয়ে এখন কেবল আপনার রাজী হবার অপেক্ষায় আছে।” প্রধান সেনাপতি সেই যুবককে বিদায় করবার সময় এই হুকুম দিলেন, “এই কথা যে তুমি আমাকে জানিয়েছ তা কাউকে বোলো না।” পরে প্রধান সেনাপতি তাঁর দু’জন শতপতিকে ডেকে বললেন, “দু’শো সাধারণ সৈন্য, সত্তরজন ঘোড়সওয়ার সৈন্য এবং দু’শো বর্শাধারী সৈন্যকে আজ রাত ন’টার সময় সিজারিয়াতে যাবার জন্য প্রস্তুত রাখ। আর পৌলের জন্যও ঘোড়ার ব্যবস্থা কোরো যাতে তাকে নিরাপদে প্রধান শাসনকর্তা ফীলিক্সের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়।” প্রধান সেনাপতি এই চিঠি লিখলেন: “আমি, ক্লাডিয়াস লুসিয়াস, মহান শাসনকর্তা ফীলিক্সের কাছে এই চিঠি লিখছি। আমার সালাম গ্রহণ করুন। “ইহুদীরা এই লোকটিকে ধরে প্রায় খুন করে ফেলেছিল, কিন্তু আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এনেছি, কারণ আমি জানতে পারলাম সে একজন রোমীয়। পরে আমি জানতে চাইলাম কেন লোকেরা তাকে দোষী করছে। সেইজন্য তাদের মহাসভার কাছে আমি তাকে নিয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, তাদের শরীয়তের বিষয় নিয়ে তারা তাকে দোষী করছে, কিন্তু মরবার বা জেলে যাবার মত এমন কোন দোষ তার নেই। যখন আমি জানতে পারলাম লোকেরা এই লোকটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে তখনই আমি তাকে আপনার কাছে পাঠালাম। যারা তাকে দোষী করছে তাদেরও আমি হুকুম দিলাম যেন তারা এর দোষের বিষয়ে আপনার কাছে বলে।” তখন সৈন্যেরা প্রধান সেনাপতির হুকুম মত পৌলকে রাতের বেলায় তাদের সংগে করে আনি-পাত্রি শহর পর্যন্ত নিয়ে গেল। পরের দিন তারা ঘোড়সওয়ার সৈন্যদের সংগে পৌলকে পাঠিয়ে দিয়ে সেনানিবাসে ফিরে গেল। ঘোড়সওয়ার সৈন্যেরা সিজারিয়াতে পৌঁছে চিঠিখানা ও পৌলকে প্রধান শাসনকর্তার হাতে দিল। প্রধান শাসনকর্তা চিঠিখানা পড়ে পৌল কোন্‌ জায়গার লোক তা জিজ্ঞাসা করলেন। পৌল যে কিলিকিয়া প্রদেশের লোক সেই কথা জানতে পেরে তিনি বললেন, “তোমাকে যারা দোষী করছে তারা এখানে পৌঁছালে পর আমি তোমার কথা শুনব।” পরে তিনি বাদশাহ্‌ হেরোদের বাড়ীর হাজতে পৌলকে পাহারা দিয়ে রাখতে বললেন। পাঁচ দিন পরে মহা-ইমাম অননিয় কয়েকজন ইহুদী বৃদ্ধ নেতা ও তর্তুল্ল নামে একজন উকিলকে নিয়ে সিজারিয়াতে গেলেন এবং পৌলের বিরুদ্ধে প্রধান শাসনকর্তার কাছে নালিশ জানালেন। কিন্তু আপনার সময় যেন আর নষ্ট না হয় এইজন্য আমি এই অনুরোধ করি, আপনি দয়া করে আমাদের কথা শুনুন। আমরা অল্প কথায় সব বলব। “আমরা দেখেছি এই লোকটা একটা আপদ; সব সময় সে গোলমালের সৃষ্টি করে থাকে। সারা দুনিয়ার ইহুদীদের মধ্যে সে গোলমাল বাধিয়ে বেড়ায়। সে নাসারা নামে একটা ধর্ম-বিরুদ্ধ দলের নেতা। আমরা তাকে যে সব দোষ দিচ্ছি, আপনি নিজে তাকে জেরা করলে সব কিছুই জানতে পারবেন।” এই সব কথা যে সত্যি তাতে ইহুদীরাও সায় দিল। তখন প্রধান শাসনকর্তা পৌলকে ইশারা করলে পর পৌল বলতে লাগলেন, “আমি জানি, বেশ কয়েক বছর ধরে আপনি এই ইহুদী জাতির বিচার করে আসছেন; সেইজন্য আমি খুব খুশী হয়েই নিজের পক্ষে কথা বলছি। আজ বারো দিনের বেশী হয় নি আমি এবাদত করবার জন্য জেরুজালেমে গিয়েছিলাম। আপনি খোঁজ নিলে তা সহজেই জানতে পারবেন। আমাকে যাঁরা দোষ দিচ্ছেন তাঁরা বায়তুল-মোকাদ্দসে আমাকে কারও সংগে তর্কাতর্কি করতে দেখেন নি বা মজলিস-খানায় কিংবা শহরের অন্য কোথাও লোকদের উসকানি দিতে দেখেন নি। আমার বিরুদ্ধে এখন তাঁরা যে দোষ দেখাচ্ছেন তার প্রমাণ তাঁরা আপনার কাছে দিতে পারবেন না। যাহোক, এই কথা আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি যে, ঈসা মসীহের পথ, যাকে তাঁরা ধর্ম-বিরুদ্ধ পথ বলেন, আমি সেই পথেই আমার পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্‌র এবাদত করে থাকি। তৌরাত শরীফের সংগে যা কিছুর মিল আছে তাতে এবং নবীদের কিতাবে আমি ঈমান রাখি। তাঁরা যেমন আশা করেন তেমনি আমারও আল্লাহ্‌র উপর এই আশা আছে যে, সৎ কিংবা অসৎ সবাইকে আবার জীবিত করা হবে। সেইজন্য আমি আল্লাহ্‌ ও মানুষের কাছে সব সময় আমার বিবেককে পরিষ্কার রাখবার চেষ্টা করি। “অনেক বছর পরে আমি জেরুজালেমে গিয়েছিলাম যেন আমার জাতির গরীব লোকদের কিছু টাকা-পয়সা দিতে পারি এবং পশু-কোরবানী দিতে পারি। নিজেকে পাক-সাফ করবার পর যখন আমি সেই কাজ করছিলাম তখনই তাঁরা আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসে দেখতে পেয়েছিলেন। আমার কাছে লোকজনের ভিড়ও হয় নি বা আমাকে নিয়ে কোন গোলমালও হয় নি। কিন্তু এশিয়া প্রদেশের কয়েকজন ইহুদী সেখানে ছিল। আপনার কাছে সেই ইহুদীদেরই আসা উচিত ছিল এবং আমাকে দোষ দেবার যদি কিছু থাকে তবে তাদেরই তা দেওয়া উচিত ছিল। কিংবা এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন তাঁরাই বলুন, আমি যখন মহাসভার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন তাঁরা আমার কি দোষ পেয়েছিলেন। কেবল এই একটি বিষয়ে তাঁরা আমার দোষ দিতে পারেন যে, আমি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলেছিলাম, ‘মৃতদের আবার জীবিত হয়ে উঠবার বিষয় নিয়ে আজ আপনাদের সামনে আমার বিচার হচ্ছে।’ ” ঈসার পথের বিষয়ে ফীলিক্স খুব ভাল করেই জানতেন। তিনি বিচার করা বন্ধ করে বললেন, “প্রধান সেনাপতি লুসিয়াস আসলে পর আমি তোমাদের বিচার শেষ করব।” তিনি পৌলকে পাহারা দেবার জন্য শতপতিকে হুকুম দিলেন, কিন্তু তাঁকে কিছুটা স্বাধীনভাবে রাখতে বললেন। তিনি অনুমতি দিলেন যেন পৌলের বন্ধুরা এসে দরকার মত তাঁর দেখাশোনা করতে পারে। কয়েক দিন পরে ফীলিক্স তাঁর ইহুদী স্ত্রী দ্রুষিল্লাকে সংগে করে আসলেন। তিনি পৌলকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর কাছে মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানের কথা শুনলেন। পৌল যখন সৎভাবে চলা, নিজেকে দমনে রাখা এবং রোজ হাশরের বিষয়ে বললেন, তখন ফীলিক্স ভয় পেয়ে বললেন, “তুমি এখন যাও; সময়-সুযোগ মত আমি তোমাকে ডেকে পাঠাব।” তিনি আশা করেছিলেন পৌল তাঁকে ঘুষ দেবেন। সেইজন্য বারবার পৌলকে ডাকিয়ে এনে তিনি তাঁর সংগে কথা বলতেন। দু’বছর পার হয়ে গেলে পর ফীলিক্সের জায়গায় পর্কীয় ফীষ্ট আসলেন। ফীলিক্স ইহুদীদের খুশী করবার জন্য পৌলকে জেলখানাতেই রেখে গেলেন। সেই প্রদেশে আসবার তিন দিন পরে ফীষ্ট সিজারিয়া থেকে জেরুজালেমে গেলেন। তখন প্রধান ইমামেরা ও ইহুদী নেতারা তাঁর কাছে গিয়ে পৌলের বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন। তাঁরা ফীষ্টকে বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাঁদের উপর দয়া করে পৌলকে জেরুজালেমে ডেকে পাঠান। এর কারণ এই যে, তাঁরা পথের মধ্যে লুকিয়ে থেকে পৌলকে খুন করবার ষড়যন্ত্র করছিলেন। তখন ফীষ্ট বললেন, “পৌলকে সিজারিয়াতে আটক রাখা হয়েছে এবং আমি নিজেই শিগ্‌গির সেখানে যাচ্ছি। তোমাদের কয়েকজন ক্ষমতাশালী লোক আমার সংগে যাক এবং যদি সেই লোক কোন দোষ করে থাকে তবে তা দেখিয়ে দিক।” ফীষ্ট তাঁদের মধ্যে আট-দশ দিন কাটিয়ে সিজারিয়াতে ফিরে গেলেন। পরের দিন তিনি বিচার-সভায় বসে পৌলকে তাঁর সামনে আনবার হুকুম দিলেন। যে ইহুদীরা জেরুজালেম থেকে এসেছিলেন পৌল সেখানে আসলে পর তাঁরা তাঁর চারদিকে দাঁড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক ভীষণ রকমের দোষ দিলেন, কিন্তু সেগুলোর কোন প্রমাণ দিতে পারলেন না। তখন পৌল নিজের পক্ষে এই কথা বললেন, “আমি ইহুদীদের শরীয়ত বা বায়তুল-মোকাদ্দস কিংবা রোম-সম্রাটের বিরুদ্ধে কোন অন্যায় করি নি।” ফীষ্ট ইহুদীদের খুশী করবার জন্য পৌলকে বললেন, “এই সব দোষের বিচার আমি যেন জেরুজালেমে করতে পারি সেইজন্য তুমি কি সেখানে যেতে রাজী আছ?” তখন পৌল বললেন, “আমি এখন রোমীয় বিচার-সভায় দাঁড়িয়ে আছি এবং রোমীয় সরকারের কাছেই আমার বিচার হওয়া উচিত। আপনি নিজে তো ভাল করেই জানেন যে, আমি ইহুদীদের উপর কোন অন্যায় করি নি। যাহোক, যদি আমি মৃত্যুর উপযুক্ত কোন দোষ করে থাকি তবে মরতে আমি রাজী আছি। কিন্তু এই ইহুদীরা আমার বিরুদ্ধে যে দোষ দিচ্ছেন তা যদি সত্যি না হয় তবে এঁদের হাতে আমাকে ছেড়ে দেবার অধিকার কারও নেই। আমি সম্রাটের কাছে আপীল করছি।” ফীষ্ট তাঁর পরামর্শদাতাদের সংগে পরামর্শ করে বললেন, “তুমি সম্রাটের কাছে যখন আপীল করেছ তখন সম্রাটের কাছেই যাবে।” এর কিছু দিন পরে ইহুদীদের বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প ও তাঁর স্ত্রী বর্ণীকী ফীষ্টকে সালাম জানাবার জন্য সিজারিয়াতে আসলেন। তাঁরা অনেক দিন সেখানে ছিলেন বলে ফীষ্ট পৌলের বিষয় বাদশাহ্‌কে জানালেন। তিনি বললেন, “ফীলিক্স একজন লোককে এখানে বন্দী হিসাবে রেখে গেছেন। আমি যখন জেরুজালেমে গিয়েছিলাম তখন প্রধান ইমামেরা ও ইহুদী বৃদ্ধ নেতারা এই লোকের বিরুদ্ধে অনেক নালিশ জানিয়েছিল এবং দোষী হিসাবে একে শাস্তি দিতে বলেছিল। “আমি তাদের বললাম, ‘কোন লোকের বিরুদ্ধে যদি কোন নালিশ করা হয় তবে যারা নালিশ করেছে তাদের সামনে নিজেকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করবার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে শাস্তি দেবার কথা রোমীয়দের চলতি নিয়মে নেই।’ “সেই ইহুদীরা আমার সংগে আসলে পর আমি দেরি না করে পরদিনই বিচার করতে বসলাম এবং সেই লোককে আনতে হুকুম করলাম। যে লোকেরা তাকে দোষ দিচ্ছিল তারা যখন কথা বলবার জন্য উঠে দাঁড়াল তখন আমি যেমন ভেবেছিলাম সেই রকম কোন নালিশ তারা করল না, বরং তাদের ধর্ম-মত এবং ঈসা বলে একজন মৃত লোক সম্বন্ধে তাকে দোষী করল। পৌল নামে সেই লোকটা দাবি করে যে, সেই ঈসা বেঁচে আছে। এই সব ব্যাপারের তালাশ কি করে নেব তা বুঝতে না পেরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এই সব দোষের যেন বিচার করা যায় সেইজন্য সেই লোক জেরুজালেমে যেতে রাজী আছে কিনা। কিন্তু সে যখন সম্রাটের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে আমার কাছে আপীল করল তখন সম্রাটের কাছে না পাঠানো পর্যন্ত তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে আমি হুকুম দিয়েছি।” তখন আগ্রিপ্প ফীষ্টকে বললেন, “আমি নিজে এই লোকের কথা শুনতে ইচ্ছা করি।” ফীষ্ট বললেন, “কালকে শুনতে পাবেন।” পরদিন বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প ও বর্ণীকী প্রধান সেনাপতিদের ও শহরের প্রধান প্রধান লোকদের নিয়ে মহা জাঁকজমকের সংগে সভা-ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। ফীষ্টের হুকুমে পৌলকে সেখানে আনা হল। তখন ফীষ্ট বললেন, “বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প এবং আর যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনারা এই লোকটাকে দেখছেন। সমস্ত ইহুদীরা জেরুজালেমে ও সিজারিয়াতে আমার কাছে আপীল করেছে এবং চিৎকার করে বলেছে যে, এই লোকটার আর বেঁচে থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমি দেখলাম, মৃত্যুর শাস্তি দেবার মত কোন দোষ সে করে নি। তবে সে নিজেই যখন সম্রাটের কাছে আপীল করেছে তখন আমি তাকে সম্রাটের কাছে পাঠানোই ঠিক করলাম, কিন্তু মহান সম্রাটের কাছে লিখবার মত এমন সঠিক কিছুই পেলাম না। সেইজন্য আমি আপনাদের সকলের সামনে, বিশেষ করে বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প আপনার সামনে তাকে এনেছি যাতে তাকে জেরা করে কিছু অন্ততঃ আমি লিখতে পারি; কারণ আমার মতে, কোন বন্দীকে চালান দেবার সময় তার দোষগুলোও জানানো উচিত।” তখন আগ্রিপ্প পৌলকে বললেন, “তোমার নিজের পক্ষে কথা বলবার জন্য তোমাকে অনুমতি দেওয়া গেল।” তখন পৌল হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পক্ষে এই কথা বললেন, “হে বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প, ইহুদীরা আমাকে যে সব দোষ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে আপনার সামনে আজ আমার নিজের পক্ষে কথা বলবার সুযোগ পেয়েছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি, বিশেষ করে যখন ইহুদীদের চলতি নিয়ম এবং তর্কের বিষয়গুলো সম্বন্ধে আপনার ভাল করেই জানা আছে। এইজন্য ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতে আমি আপনাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করছি। “ছেলেবেলা থেকে, অর্থাৎ আমার জীবনের শুরু থেকে আমার নিজের দেশের এবং পরে জেরুজালেমের লোকদের মধ্যে আমি কিভাবে জীবন কাটিয়েছি ইহুদীরা সবাই তা জানে। তারা অনেক দিন ধরেই আমাকে চেনে এবং ইচ্ছা করলে এই সাক্ষ্য দিতে পারে যে, আমাদের ধর্মের ফরীশী নামে যে গোঁড়া দল আছে আমি সেই ফরীশীর জীবনই কাটিয়েছি। আল্লাহ্‌ আমার পূর্বপুরুষদের কাছে যে ওয়াদা করেছিলেন তাতে আমি আশা রাখি বলে এখন আমার বিচার করা হচ্ছে। আমাদের বারো গোষ্ঠীর লোকেরা দিনরাত মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহ্‌র এবাদত করে সেই ওয়াদার পূর্ণতা দেখবার আশায় আছে। মহারাজ, সেই আশার জন্যই ইহুদীরা আমাকে দোষ দিচ্ছে। আল্লাহ্‌ যে মৃতদের জীবিত করেন এই কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে আপনারা কেন মনে করছেন? “আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম, নাসরতের ঈসার বিরুদ্ধে যা করা যায় তার সবই আমার করা উচিত, আর ঠিক তা-ই আমি জেরুজালেমে করছিলাম। প্রধান ইমামদের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে আমি ঈসায়ী ঈমানদার অনেককে জেলে দিতাম এবং তাদের হত্যা করবার সময় তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিতাম। তাদের শাস্তি দেবার জন্য আমি প্রায়ই এক মজলিস-খানায় থেকে অন্য মজলিস-খানায় যেতাম এবং ঈসার বিরুদ্ধে কথা বলবার জন্য আমি তাদের উপর জোর খাটাতাম। তাদের উপর আমার এত রাগ ছিল যে, তাদের উপর জুলুম করবার জন্য আমি বিদেশের শহরগুলোতে পর্যন্ত যেতাম। “এইভাবে একবার প্রধান ইমামদের কাছ থেকে ক্ষমতা ও হুকুম নিয়ে আমি দামেস্কে যাচ্ছিলাম। মহারাজ, তখন বেলা প্রায় দুপুর। পথের মধ্যে সুর্য থেকেও উজ্জ্বল একটা আলো আসমান থেকে আমার ও আমার সংগীদের চারদিকে জ্বলতে লাগল। আমরা সবাই মাটিতে পড়ে গেলাম এবং আমি শুনলাম হিব্রু ভাষায় কে যেন আমাকে বলছেন, ‘শৌল, শৌল, কেন তুমি আমার উপর জুলুম করছ? কাঁটা বসানো লাঠির মুখে লাথি মেরে কি তুমি নিজের ক্ষতি করছ না?’ “তখন আমি বললাম, ‘প্রভু, আপনি কে?’ “প্রভু বললেন, ‘আমি ঈসা, যাঁর উপর তুমি জুলুম করছ। এখন ওঠো, তোমার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াও। সেবাকারী ও সাক্ষী হিসাবে তোমাকে নিযুক্ত করবার জন্য আমি তোমাকে দেখা দিলাম। তুমি আমাকে যেভাবে দেখলে এবং আমি তোমাকে যা দেখাব তা তুমি অন্যদের কাছে বলবে। “বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প, এইজন্য বেহেশত থেকে এই দর্শনের মধ্য দিয়ে আমাকে যা বলা হয়েছে তার অবাধ্য আমি হই নি। যারা দামেস্কে আছে প্রথমে তাদের কাছে, তার পরে যারা জেরুজালেমে এবং সমস্ত এহুদিয়া প্রদেশে আছে তাদের কাছে এবং অ-ইহুদীদের কাছেও আমি তবলিগ করেছি যে, তওবা করে আল্লাহ্‌র দিকে তাদের ফেরা উচিত, আর এমন কাজ করা উচিত যার দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তারা তওবা করেছে। এইজন্যই ইহুদীরা আমাকে বায়তুল-মোকাদ্দসে ধরে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌ আজ পর্যন্ত আমাকে সাহায্য করে আসছেন এবং সেইজন্যই আমি এখানে দাঁড়িয়ে ছোট-বড় সবার কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছি। নবীরা এবং মূসা যা ঘটবার কথা বলে গেছেন তার বাইরে আমি কিছুই বলছি না। সেই কথা হল এই যে, মসীহ্‌কে কষ্টভোগ করতে হবে এবং তাঁকেই মৃত্যু থেকে প্রথমে জীবিত হয়ে উঠে তাঁর নিজের জাতির লোকদের ও অ-ইহুদীদের কাছে নূরের রাজ্যের বিষয়ে ঘোষণা করতে হবে।” পৌল এইভাবে যখন নিজের পক্ষে কথা বলছিলেন তখন ফীষ্ট তাঁকে বাধা দিয়ে চিৎকার করে বললেন, “পৌল, তুমি পাগল হয়ে গেছ। তুমি অনেক পড়াশোনা করেছ আর সেই পড়াশুনাই তোমাকে পাগল করে তুলেছে।” তখন পৌল বললেন, “মাননীয় ফীষ্ট, আমি পাগল নই। আমি যা বলছি তা সত্যি এবং যুক্তিপূর্ণ। বাদশাহ্‌ তো এই সব বিষয় জানেন এবং আমি তাঁর সংগে খোলাখুলিই সব কথা বলতে পারি। আর এই কথা আমি নিশ্চয় জানি যে, এর কিছুই তাঁর চোখ এড়ায় নি, কারণ এই সব ঘটনা তো গোপনে ঘটে নি। বাদশাহ্‌ আগ্রিপ্প, আপনি কি নবীদের কথা বিশ্বাস করেন? আমি জানি আপনি করেন।” তখন আগ্রিপ্প পৌলকে বললেন, “তুমি কি এত অল্প সময়ের মধ্যেই আমাকে ঈসায়ী করবার চেষ্টা করছ?” পৌল বললেন, “সময় অল্প হোক বা বেশী হোক, আমি আল্লাহ্‌র কাছে এই মুনাজাত করি যে, কেবল আপনি নন, কিন্তু যাঁরা আজ আমার কথা শুনছেন তাঁরা সবাই যেন আমার মত হন্ত কেবল এই শিকল ছাড়া।” তখন বাদশাহ্‌ উঠলেন এবং তাঁর সাথে সাথে প্রধান শাসনকর্তা ফীষ্ট ও বর্ণীকী এবং যাঁরা তাঁদের সংগে বসে ছিলেন সবাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তাঁরা সেই ঘর ছেড়ে চলে গেলেন এবং একে অন্যকে বলতে লাগলেন, “এই লোকটি মৃত্যুর শাস্তি পাবার বা জেল খাটবার মত কিছুই করে নি।” আগ্রিপ্প ফীষ্টকে বললেন, “এই লোকটি যদি সম্রাটের কাছে আপীল না করত তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া যেত।” জাহাজে করে আমাদের ইতালীতে নিয়ে যাওয়া স্থির হলে পর পৌল এবং আরও কয়েকজন বন্দীকে যুলিয় নামে একজন শত-সেনাপতির হাতে দেওয়া হল। যুলিয় ছিলেন সম্রাটের নিজের সৈন্যদলের একজন শত-সেনাপতি। আমরা আদ্রামুত্তীয় বন্দরের একটা জাহাজে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন বন্দরে যাবার জন্য জাহাজখানা প্রস্তুত হয়েই ছিল। ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশের থিষলনীকি শহরের আরিষ্টার্খ আমাদের সংগে ছিলেন। আমাদের জাহাজ পরের দিন সিডনে থামল। যুলিয় পৌলের সংগে বেশ ভাল ব্যবহার করলেন এবং তাঁকে তাঁর বন্ধুদের কাছে যাবার অনুমতি দিলেন যেন তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দরকারী জিনিসপত্র দিতে পারে। পরে সেখান থেকে আবার আমাদের জাহাজ ছাড়ল। বাতাস আমাদের উল্টাদিকে থাকাতে সাইপ্রাস দ্বীপের যে দিকটাতে বাতাস ছিল না আমরা সেই দিক ধরে চললাম। পরে আমরা কিলিকিয়া ও পাম্‌ফুলিয়ার সামনে যে সাগর ছিল সেই সাগর পার হয়ে লুকিয়া প্রদেশের মুরা শহরে উপস্থিত হলাম। শত-সেনাপতি সেখানে আলেকজান্দ্রিয়ার একটা জাহাজ পেলেন। সেই জাহাজটা ইতালী দেশে যাচ্ছিল বলে তিনি আমাদের নিয়ে সেই জাহাজে উঠলেন। আমাদের জাহাজখানা অনেক দিন ধরে খুব আস্তে আস্তে চলে খুব কষ্টে ক্লীদোন শহরের কাছাকাছি উপস্থিত হল, কিন্তু বাতাস আমাদের আর এগিয়ে যেতে দিল না। তখন আমরা ক্রীট দ্বীপের যে দিকে বাতাস ছিল না সেই দিক ধরে সল্‌মোনীর পাশ দিয়ে চললাম। সাগরের কিনার ধরে কষ্ট করে চলে আমরা সুন্দর পোতাশ্রয় বলে একটা জায়গায় আসলাম। তার কাছেই ছিল লাসেয়া শহর। এইভাবে অনেক দিন কেটে গেল। তখন রোজা-ঈদ শেষ হয়ে শীতকাল প্রায় এসে গেছে। কাজেই জাহাজে করে যাওয়া তখন একটা বিপদের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। এইজন্য পৌল জাহাজের লোকদের সাবধান করবার জন্য বললেন, “দেখুন, আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের এই যাত্রায় খুব ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতি যে কেবল জাহাজ আর মালপত্রের হবে তা নয়, আমাদের জীবনেরও ক্ষতি হবে।” শত-সেনাপতি কিন্তু পৌলের কথা না শুনে জাহাজের কাপ্তেন ও জাহাজের মালিকের কথা শুনলেন। বন্দরটা শীতকাল কাটাবার উপযুক্ত জায়গা নয় বলে বেশীর ভাগ লোক ঠিক করল যে, সেখান থেকে যাত্রা করে সম্ভব হলে ফৈণীকে গিয়ে শীতকাল কাটানো হবে। ফৈণীক ছিল ক্রীট দ্বীপের জাহাজ থামাবার জায়গা। এই জায়গাটার দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক খোলা ছিল। পরে যখন আস্তে আস্তে দখিনা বাতাস বইতে লাগল তখন তারা মনে করল তারা যা চেয়েছিল তা-ই হয়েছে। এইজন্য তারা জাহাজের নোংগর তুলে ক্রীট দ্বীপের কিনার ধরে চলল। কিন্তু একটু পরেই সেই দ্বীপ থেকে উরাকুলো বলে এক ভীষণ তুফান শুরু হল, আর জাহাজখানা সেই তুফানে পড়ল। আমরা বাতাসের মুখে এগিয়ে যেতে পারলাম না; সেইজন্য এগিয়ে যাবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে জাহাজখানা বাতাসে ভেসে যেতে দিলাম। পরে কৌদা নামে একটা ছোট দ্বীপের যে দিকে বাতাস ছিল না আমরা সেই দিক ধরে চললাম এবং জাহাজে যে নৌকা থাকে সেই নৌকাখানা খুব কষ্ট করে ধ্বংসের হাত থেকে আমরা বাঁচালাম। লোকেরা নৌকাখানা জাহাজে টেনে তুলল এবং তার পরে দড়ি দিয়ে জাহাজের খোলটা বাঁধল যেন তার তক্তাগুলো আলাদা হয়ে না পড়ে। সুর্তী নামে সাগরের চরে জাহাজ আট্‌কাবার ভয়ে পালগুলো নামিয়ে ফেলে জাহাজখানা বাতাসে চলতে দেওয়া হল। ঝড়ের ভীষণ আঘাতে আমাদের জাহাজখানা এমনভাবে দুলতে লাগল যে, পরের দিন লোকেরা জাহাজের মালপত্র পানিতে ফেলে দিতে লাগল। তৃতীয় দিনে তারা নিজের হাতে জাহাজের সাজ-সরঞ্জামও ফেলে দিল। অনেক দিন ধরে সূর্য বা তারা কিছুই দেখা গেল না এবং ভীষণ ঝড় বইতেই থাকল। শেষে আমরা রক্ষা পাবার সব আশাই ছেড়ে দিলাম। লোকেরা অনেক দিন ধরে কিছু খায় নি বলে পৌল তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখুন, আমার কথা শুনে ক্রীট দ্বীপ থেকে জাহাজ না ছাড়া আপনাদের উচিত ছিল। তাহলে এই বিপদ ও ক্ষতির হাত থেকে আপনারা রক্ষা পেতেন। কিন্তু এখন আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা মনে সাহস রাখুন, কারণ আপনাদের কেউই মরবেন না; কেবল এই জাহাজখানাই নষ্ট হবে। আমি যাঁর লোক এবং যাঁর এবাদত আমি করি সেই আল্লাহ্‌র একজন ফেরেশতা গত রাতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘পৌল, ভয় কোরো না। তোমাকে সম্রাট সিজারের সামনে দাঁড়াতে হবে। এই জাহাজে যারা তোমার সংগে যাচ্ছে তাদের সকলের জীবন আল্লাহ্‌ দয়া করে তোমাকে দান করেছেন।’ এইজন্য আপনারা মনে সাহস রাখুন। আল্লাহ্‌র উপর আমার এই বিশ্বাস আছে যে, তিনি আমাকে যা বলেছেন তা-ই হবে। তবে আমরা কোন দ্বীপের উপর গিয়ে পড়ব।” আমরা আদ্রিয়া সাগরের উপর দিয়ে এইভাবে চলতে থাকলাম। ঝড়ের চৌদ্দ দিনের দিন মাঝরাতে নাবিকদের মনে হল তারা ডাংগার কাছে এসেছে। তারা মেপে দেখল সেখানকার পানি আশি হাত গভীর। এর কিছুক্ষণ পরে তারা আবার মেপে দেখল যে, সেখানে পানি ষাট হাত। পাথরের গায়ে ধাক্কা লাগবার ভয়ে জাহাজের পিছন দিক থেকে তারা চারটা নোংগর ফেলে দিল এবং দিনের আলোর জন্য মুনাজাত করতে লাগল। পরে জাহাজের নাবিকেরা পালিয়ে যাবার চেষ্টায় জাহাজের সামনের দিক থেকে নোংগর ফেলবার ভান করে জাহাজের নৌকাখানা সাগরে নামিয়ে দিল। তখন পৌল শত-সেনাপতি ও সৈন্যদের বললেন, “এই নাবিকেরা জাহাজে না থাকলে আপনারা রক্ষা পাবেন না।” তখন সৈন্যেরা নৌকার দড়ি কেটে দিল যাতে নৌকাটা পানিতে পড়ে যায়। সকাল হবার আগে পৌল সকলকে কিছু খাওয়ার অনুরোধ করে বললেন, “আজ চৌদ্দ দিন হল, কি হবে না হবে সেই চিন্তা করে আপনারা না খেয়ে আছেন্ত কোন খাবারই খান নি। এখন আমি আপনাদের কিছু খেয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করছি। বেঁচে থাকবার জন্য আপনাদের তো কিছু খাওয়া দরকার। দেখবেন, আপনাদের মাথার একটা চুল পর্যন্ত নষ্ট হবে না।” এই কথা বলে পৌল রুটি নিয়ে তাদের সকলের সামনেই আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং তা ভেংগে খেতে লাগলেন। তখন তারা সবাই সাহস পেয়ে খেতে লাগল। আমরা জাহাজে মোট দু’শো ছিয়াত্তরজন ছিলাম। সবাই পেট ভরে খেলে পর জাহাজের ভার কমাবার জন্য সমস্ত গম সাগরে ফেলে দেওয়া হল। সকালবেলায় তারা জায়গাটা চিনতে পারল না, কিন্তু এমন একটা ছোট উপসাগর দেখতে পেল যার কিনার বালিতে ভরা ছিল। তখন তারা ঠিক করল, সম্ভব হলে জাহাজখানা সেই কিনারে তুলে দেবে। এইজন্য তারা জাহাজের নোংগরগুলো কেটে সাগরেই ফেলে দিল এবং হালের বাঁধনের দড়িগুলো খুলে দিল। এর পরে তারা বাতাসের মুখে সামনের পাল খাটিয়ে দিল এবং কিনারের দিকে এগিয়ে গিয়ে চরে আটকে গেল। সামনের অংশটা তাড়াতাড়ি বসে যাওয়াতে জাহাজটা অচল হল আর ঢেউয়ের আঘাতে পিছন দিকটা টুকরা টুকরা হয়ে ভেংগে যেতে লাগল। তখন সৈন্যেরা বন্দীদের হত্যা করবে বলে ঠিক করল, যেন তাদের মধ্যে কেউ সাঁতার দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু শত-সেনাপতি পৌলের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন বলে সৈন্যদের ইচ্ছামত কাজ করতে দিলেন না। তিনি হুকুম দিলেন, যারা সাঁতার জানে তারা প্রথমে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে পারে গিয়ে উঠুক, আর বাকি সবাই জাহাজের তক্তা বা অন্য কোন টুকরা ধরে সেখানে যাক। এইভাবে সবাই নিরাপদে ডাংগায় পৌঁছাল। আমরা নিরাপদে পারে পৌঁছে জানতে পারলাম দ্বীপটার নাম মাল্টা। সেই দ্বীপের লোকেরা আমাদের সংগে খুব ভাল ব্যবহার করল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল এবং ঠাণ্ডা ছিল বলে তারা আগুন জ্বেলে আমাদের সবাইকে ডাকল। পৌল এক বোঝা শুকনা কাঠ জড়ো করে আগুনে দেবার সময় একটা বিষাক্ত সাপ আগুনের তাপে সেই বোঝা থেকে বের হয়ে পৌলের হাত কামড়ে ধরল। সাপটাকে পৌলের হাতে ঝুলতে দেখে সেই দ্বীপের লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, “এই লোকটা নিশ্চয়ই খুনী, কারণ সাগরের হাত থেকে রক্ষা পেলেও ন্যায়দেবতা তাকে বাঁচতে দিলেন না।” কিন্তু পৌল যখন হাত ঝাড়া দিয়ে সাপটা আগুনে ফেলে দিলেন তখন তাঁর কোনই ক্ষতি হল না। লোকেরা ভাবছিল তাঁর শরীর ফুলে উঠবে বা হঠাৎ তিনি মারা যাবেন। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তাঁর কিছু হল না দেখে তারা মত বদলে বলতে লাগল, “উনি দেবতা।” সেই জায়গার কাছেই পুব্লিয় নামে সেই দ্বীপের প্রধান লোকের একটা জমিদারি ছিল। পুব্লিয় তাঁর বাড়ীতে আমাদের ডাকলেন এবং তিন দিন ধরে খুব আদরের সংগে আমাদের সেবা-যত্ন করলেন। সেই সময় পুব্লিয়ের পিতা জ্বর ও আমাশা রোগে বিছানায় পড়ে ভুগছিলেন। পৌল ভিতরে তাঁর কাছে গিয়ে মুনাজাত করলেন এবং তাঁর গায়ে হাত দিয়ে তাঁকে সুস্থ করলেন। এই ঘটনার পরে সেই দ্বীপের বাকি সব রোগীরা এসে সুস্থ হল। তারা নানা ভাবেই আমাদের সম্মান দেখাল এবং পরে জাহাজ ছাড়বার সময় আমাদের দরকারী সমস্ত জিনিসপত্র জাহাজে বোঝাই করে দিল। এর তিন মাস পরে আমরা একটা জাহাজে করে যাত্রা করলাম। জাহাজটা সেই দ্বীপেই শীতকাল কাটিয়েছিল। সেটা ছিল আলেকজান্দ্রিয়া শহরের জাহাজ এবং তার মাথায় যমজ দেবের মূর্তি খোদাই করা ছিল। আমরা সুরাকুষে জাহাজ বেঁধে সেখানে তিন দিন রইলাম। সেখান থেকে যাত্রা করে আমরা রেজিওতে পৌঁছালাম। পরের দিন দখিনা বাতাস উঠল এবং তার পরের দিন আমরা পূতিয়লীতে পৌঁছালাম। সেখানে আমরা কয়েকজন ঈমানদার ভাইয়ের দেখা পেলাম। তাদের সংগে সপ্তাখানেক কাটাবার জন্য তারা আমাদের অনুরোধ করল। এইভাবে আমরা রোমে আসলাম। সেখানকার ঈমানদার ভাইয়েরা আমাদের আসবার খবর শুনেছিল। পথে আমাদের সংগী হওয়ার জন্য তাদের কেউ কেউ আপ্পিয়হাট, কেউ কেউ তিন্তসরাই গ্রাম পর্যন্ত এসেছিল। এই লোকদের দেখে পৌল আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানালেন এবং তিনি নিজে উৎসাহ পেলেন। আমরা রোমে পৌঁছালে পর পৌল আলাদা ঘরে থাকবার অনুমতি পেলেন। একজন সৈন্য তাঁকে পাহারা দিত। তিন দিন পরে পৌল সেখানকার ইহুদী নেতাদের ডেকে একসংগে মিলিত করলেন। তাঁরা মিলিত হলে পর পৌল তাঁদের বললেন, “আমার ভাইয়েরা, যদিও আমি আমাদের জাতির বিরুদ্ধে বা পূর্বপুরুষদের চলতি নিয়মের বিরুদ্ধে কিছুই করি নি, তবুও জেরুজালেমে আমাকে ধরা হয়েছে এবং রোমীয়দের হাতে দেওয়া হয়েছে। রোমীয়রা আমাকে জেরা করে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কারণ মৃত্যুর উপযুক্ত কোন দোষ আমি করি নি। কিন্তু ইহুদীরা এতে বাধা দেওয়াতে বাধ্য হয়ে আমি সম্রাটের কাছে আপীল করেছি। অবশ্য আমি আমার নিজের লোকদের কোন দোষ দিতে আসি নি। এইজন্যই আমি আপনাদের সংগে দেখা করতে ও কথা বলতে চেয়েছি। ইসরাইল জাতির যে আশা আছে সেই আশার জন্যই আমাকে এই শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে।” তখন ইহুদী নেতারা বললেন, “আপনার সম্বন্ধে এহুদিয়া থেকে আমরা কোন চিঠি পাই নি। যে ভাইয়েরা সেখান থেকে এসেছেন তাঁরাও কেউ আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানান নি বা কোন খারাপ কথা বলেন নি। তবে আমরা আপনার মতামত শুনতে চাই, কারণ আমরা জানি সব জায়গাতেই লোকেরা সেই দলের বিরুদ্ধে কথা বলে।” পৌলের সংগে মিলিত হবার জন্য তাঁরা একটা দিন ঠিক করলেন। পৌল যেখানে থাকতেন সেখানে তাঁরা ছাড়া আরও অনেকে আসলেন। তখন পৌল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে তাঁদের জানালেন ও বুঝালেন। মূসার তৌরাত ও নবীদের কিতাবের মধ্য থেকে ঈসার বিষয় দেখিয়ে তাঁর সম্বন্ধে তাঁদের ঈমান জন্মাতে চেষ্টা করলেন। তিনি যা বলেছিলেন তাতে কেউ কেউ ঈমান আনলেন, আবার কেউ কেউ ঈমান আনলেন না। পৌলের কথায় তাঁদের মধ্যে মতের অমিল হল আর তাঁরা সেখান থেকে চলে গেলেন। তাঁরা চলে যাবার আগে পৌল বললেন, “পাক-রূহ্‌ নবী ইশাইয়ার মধ্য দিয়ে আপনাদের পূর্বপুরুষদের কাছে সত্যি কথাই বলেছিলেন যে, এই লোকদের কাছে গিয়ে বল, ‘তোমরা শুনতে থাকবে কিন্তু কোনমতেই বুঝবে না; দেখতে থাকবে কিন্তু কোনমতেই জানবে না। এই সব লোকদের দিল অসাড় এবং কান বন্ধ হয়ে গেছে, আর তারা তাদের চোখও বন্ধ করে রেখেছে, যেন তারা চোখ দিয়ে না দেখে, কান দিয়ে না শোনে এবং দিল দিয়ে না বোঝে, আর ভাল হবার জন্য আমার কাছে ফিরে না আসে।’ পুরো দু’বছর ধরে পৌল তাঁর নিজের ভাড়াটে বাড়ীতে ছিলেন এবং যারা তাঁর সংগে দেখা করতে আসত তিনি তাদের সবাইকে গ্রহণ করতেন। তিনি সাহসের সংগে বিনা বাধায় আল্লাহ্‌র রাজ্যের বিষয়ে তবলিগ করতেন এবং হযরত ঈসা মসীহের বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। ॥ভব আমি মসীহ্‌ ঈসার গোলাম পৌল রোম শহরের ঈমানদারদের কাছে এই চিঠি লিখছি। তাঁর সাহাবী হবার জন্য আল্লাহ্‌ আমাকে ডেকেছেন এবং তাঁর দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করবার জন্য বেছে নিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাঁর নবীদের মধ্য দিয়ে পাক-কিতাবের মধ্যে আগেই এই সুসংবাদের ওয়াদা করেছিলেন। তাঁরই মধ্য দিয়ে তাঁরই নামের জন্য আমরা রহমত ও সাহাবী-পদ পেয়েছি, যেন সব জাতির মধ্য থেকে লোকে ঈমান এনে আল্লাহ্‌র বাধ্য হতে পারে। সেই লোকদের মধ্যে তোমরাও আছ। ঈসা মসীহের লোক হবার জন্য আল্লাহ্‌ তোমাদের ডেকেছেন। রোম শহরে যে লোকদের আল্লাহ্‌ মহব্বত করেন এবং তাঁর নিজের বান্দা হবার জন্য ডেকেছেন তাদের সকলের কাছে, অর্থাৎ তোমাদেরই কাছে আমি এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ্‌ ও হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। প্রথমেই আমি ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে তোমাদের সকলের জন্য আমার আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাচ্ছি, কারণ তোমাদের ঈমানের কথা সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ছে। ইব্‌নুল্লাহ্‌র বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করে আমার সমস্ত দিল দিয়ে আমি আল্লাহ্‌র এবাদত করছি। আমি যতবার মুনাজাত করি ততবারই যে তোমাদের কথা মনে করে থাকি, তিনিই তার সাক্ষী। আমার মুনাজাত এই যে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছাতে আমি যেন এইবার কোন রকমে তোমাদের কাছে যেতে পারি। তোমাদের শক্তিশালী করে তুলবার জন্য কোন রূহানী দান যেন তোমরা আমার মধ্য দিয়ে পেতে পার সেইজন্যই আমি তোমাদের সংগে দেখা করতে চাই। তার মানে, আমরা সবাই যেন একে অন্যের ঈমান থেকে উৎসাহ পাই। ভাইয়েরা, এই কথা জেনো যে, অনেক বারই আমি তোমাদের কাছে যাবার ইচ্ছা করেও এই পর্যন্ত বাধা পেয়ে আসছি। অন্যান্য জায়গায় অ-ইহুদীদের মধ্যে তবলিগ করে যেমন ফল লাভ করেছি, ঠিক সেইভাবে তোমাদের মধ্যেও কিছু ফল দেখবার আশায় আমি তোমাদের কাছে যেতে চেয়েছি। সভ্য-অসভ্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সবার কাছেই আমি ঋণী। সেইজন্য তোমরা যারা রোমে আছ তোমাদের কাছেও ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করতে আমি আগ্রহী। ঈসা মসীহের বিষয়ে এই যে সুসংবাদ তাতে আমার কোন লজ্জা নেই, কারণ এই সুসংবাদই হল আল্লাহ্‌র শক্তি যার দ্বারা তিনি সব ঈমানদারদের নাজাত করেন্ত প্রথমে ইহুদীদের, তারপর অ-ইহুদীদের। আল্লাহ্‌ কেমন করে মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন সেই কথা এই সুসংবাদের মধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল ঈমান আনবার মধ্য দিয়েই মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “যাকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় সে ঈমান আনবার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।” মানুষ আল্লাহ্‌র সত্যকে অন্যায় দিয়ে চেপে রাখে, আর তাই তাঁর প্রতি ভয়ের অভাব ও সমস্ত অন্যায় কাজের জন্য বেহেশত থেকে মানুষের উপর আল্লাহ্‌র গজব প্রকাশ পেয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে যা জানা যেতে পারে তা মানুষের কাছে স্পষ্ট, কারণ আল্লাহ্‌ নিজেই তাদের কাছে তা প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্‌র যে সব গুণ চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ তাঁর চিরস্থায়ী ক্ষমতা ও তাঁর খোদায়ী স্বভাব সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর সৃষ্টি থেকেই মানুষ তা খুব বুঝতে পারে। এর পরে মানুষের আর কোন অজুহাত নেই। মানুষ তাঁর সম্বন্ধে জানবার পরেও আল্লাহ্‌ হিসাবে তাঁর প্রশংসাও করে নি, তাঁকে কৃতজ্ঞতাও জানায় নি। তাদের চিন্তাশক্তি অসার হয়ে গেছে এবং তাদের বুদ্ধিহীন দিল অন্ধকারে পূর্ণ হয়েছে। যদিও তারা নিজেদের জ্ঞানী বলে দাবি করেছে তবুও আসলে তারা মুর্খই হয়েছে। চিরস্থায়ী, মহিমাপূর্ণ আল্লাহ্‌র এবাদত ছেড়ে দিয়ে তারা অস্থায়ী মানুষ, পাখী, পশু ও বুকে-হাঁটা প্রাণীর মূর্তির পূজা করেছে। এইজন্য আল্লাহ্‌ মানুষকে তার দিলের কামনা-বাসনা অনুসারে জঘন্য কাজ করতে ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তারা একে অন্যের সংগে জঘন্য কাজ করে নিজেদের শরীরের অসম্মান করেছে। আল্লাহ্‌র সত্যকে ফেলে তারা মিথ্যাকে গ্রহণ করেছে। সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে তারা তাঁর সৃষ্ট জিনিসের পূজা করেছে, কিন্তু সমস্ত প্রশংসা চিরকাল সেই সৃষ্টিকর্তারই। আমিন। মানুষ এই সব করেছে বলে আল্লাহ্‌ লজ্জাপূর্ণ কামনার হাতে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। স্ত্রীলোকেরা পর্যন্ত পুরুষদের সংগে তাদের স্বাভাবিক ব্যবহারের বদলে অন্য স্ত্রীলোকদের সংগে অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ কাজ করেছে। পুরুষেরাও ঠিক তেমনি করে স্ত্রীলোকদের সংগে তাদের স্বাভাবিক ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে পুরুষদের সংগে কামনায় জ্বলে উঠেছে; পুরুষ পুরুষের সংগে লজ্জাপূর্ণ খারাপ কাজ করেছে। ফলে তারা প্রত্যেকেই তার অন্যায় কাজের পাওনা শাস্তি নিজের মধ্যেই পেয়েছে। এইভাবে মানুষ আল্লাহ্‌কে মানতে চায় নি বলে আল্লাহ্‌ও গুনাহ্‌পূর্ণ মনের হাতে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন, আর সেইজন্যই মানুষ অনুচিত কাজ করতে থাকে। সব রকম অন্যায়, খারাপী, লোভ, নীচতা, হিংসা, খুন, মারামারি, ছলনা ও অন্যের ক্ষতি করবার ইচ্ছায় তারা পরিপূর্ণ। তারা অন্যের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, অন্যের নিন্দা করে এবং আল্লাহ্‌কে ঘৃণা করে। তারা বদমেজাজী, অহংকারী ও গর্বিত। অন্যায় কাজ করবার জন্য তারা নতুন নতুন উপায় বের করে। তারা মা-বাবার অবাধ্য, ভাল-মন্দের জ্ঞান তাদের নেই, আর তারা বেঈমান। পরিবারের প্রতি তাদের ভালবাসা নেই এবং তাদের দিলে দয়ামায়া নেই। আল্লাহ্‌র এই বিচারের কথা তারা ভাল করেই জানে যে, এই রকম কাজ যারা করে তারা মৃত্যুর শাস্তির উপযুক্ত। এই কথা জেনেও তারা যে কেবল এই সব কাজ করতে থাকে তা নয়, কিন্তু অন্য যারা তা করে তাদের সায়ও দেয়। কেউ যদি এতে অন্যদের দোষ দেয় তাহলে আমি তাকে বলব, তোমার নিজের অজুহাতটা কোথায়? যখন তুমি অন্যদের দোষ দাও তখন কি তুমি নিজেকেই দোষী বলে প্রমাণ কর না? তুমি অন্যদের দোষ দাও অথচ তুমি সেই একই কাজ করে থাক। আমরা জানি যারা এই রকম কাজ করে আল্লাহ্‌ তাদের ন্যায্য বিচারই করেন। যে কাজের জন্য তুমি অন্যদের দোষ দিচ্ছ সেই একই কাজ যখন তুমি নিজেও কর তখন কি আল্লাহ্‌র শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে বলে মনে কর? তুমি তো আল্লাহ্‌র অশেষ দয়া, সহ্যগুণ ও ধৈর্যকে তুচ্ছ করছ। তুমি ভুলে গেছ আল্লাহ্‌র এই দয়ার উদ্দেশ্য হল তোমাকে তওবা করবার পথে নিয়ে আসা। কিন্তু তোমার মন কঠিন; তুমি তো তওবা করতে চাও না। সেইজন্য যেদিন আল্লাহ্‌র গজব প্রকাশ পাবে সেই দিনের জন্য তুমি তোমার পাওনা শাস্তি জমা করে রাখছ। সেই সময়েই আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার প্রকাশ পাবে। তিনি প্রত্যেকজনকে তার কাজ হিসাবে ফল দেবেন। যারা ধৈর্যের সংগে ভাল কাজ করে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে প্রশংসা, সম্মান এবং ধ্বংসহীন জীবন পেতে চায়, আল্লাহ্‌ তাদেরই অনন্ত জীবন দেবেন। কিন্তু যারা নিজেদের ইচ্ছামত চলে আর সত্যকে না মেনে অন্যায়কে মেনে চলে আল্লাহ্‌ তাদের ভীষণ শাস্তি দেবেন। যারা গুনাহ্‌ করে বেড়ায় তাদের প্রত্যেকের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা হবে- প্রথমে ইহুদীদের, তার পরে অ-ইহুদীদের। কিন্তু যারা ভাল কাজ করে তারা প্রশংসা, সম্মান ও শান্তি লাভ করবে- প্রথমে ইহুদীরা, তারপর অ-ইহুদীরা। এতে দেখা যায়, আল্লাহ্‌র চোখে সবাই সমান। মূসার শরীয়তের বাইরে থাকা অবস্থায় যারা গুনাহ্‌ করে তারা শরীয়ত ছাড়াই ধ্বংস হবে। কিন্তু যারা শরীয়তের ভিতরে থাকা অবস্থায় গুনাহ্‌ করে তাদের বিচার শরীয়তের দ্বারাই হবে। যারা কেবল শরীয়তের কথা শোনে তারা আল্লাহ্‌র চোখে ধার্মিক নয়, কিন্তু যারা শরীয়ত পালন করে আল্লাহ্‌ তাদেরই ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন। অ-ইহুদীরা মূসার শরীয়ত পায় নি, কিন্তু তবুও তারা যখন নিজে থেকেই শরীয়ত মত কাজ করে তখন শরীয়ত না পেয়েও তারা নিজেরাই নিজেদের শরীয়ত হয়ে ওঠে। এতে দেখা যায় যে, শরীয়ত মতে যা করা উচিত তা তাদের দিলেই লেখা আছে। তাদের বিবেকও সেই একই সাক্ষ্য দেয়। তাদের চিন্তা কোন কোন সময় তাদের দোষী করে, আবার কোন কোন সময় তাদের পক্ষেও থাকে। আল্লাহ্‌ যেদিন ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে মানুষের গোপন সব কিছুর বিচার করবেন সেই দিনই তা প্রকাশ পাবে। আমি যে সুসংবাদ তবলিগ করি সেই অনুসারেই এই বিচার হবে। তুমি নিজেকে ইহুদী বলে থাক, তাই না? তুমি মূসার শরীয়তের উপর ভরসা কর এবং নিজে আল্লাহ্‌র বান্দা বলে গর্ববোধ কর। আল্লাহ্‌ কি চান তা তুমি জান এবং যা ভাল তা মেনে নাও, কারণ শরীয়ত থেকে তুমি সেই শিক্ষাই লাভ করেছ। তুমি মনে কর তুমি অন্ধদের পথ দেখা"ছ। তুমি ভাব, যারা অন্ধকারে আছে তাদের কাছে তুমি নূরের মত। তোমার ধারণা, যারা বিবেচনাহীন তাদের তুমি সংশোধন করে থাক ও যারা শরীয়তের বিষয়ে শিক্ষা পায় নি তাদের তুমি শিক্ষা দিয়ে থাক। শরীয়তের মধ্যে জ্ঞান ও সত্য আছে বলেই তোমার এই সব ধারণা আছে। খুব ভাল, তুমি যখন অন্যদের শিক্ষা দিয়ে থাক তখন নিজেকেও শিক্ষা দাও না কেন? তুমি তবলিগ করছ, “চুরি কোরো না,” কিন্তু তুমি নিজেই কি চুরি করছ না? তুমি বলে থাক, “জেনা কোরো না,” কিন্তু তুমি নিজেই কি জেনা করছ না? তুমি তো মূর্তি ঘৃণা কর, কিন্তু তুমি কি নিজেই মূর্তির মন্দিরে গিয়ে চুরি করছ না? শরীয়ত নিয়ে তুমি গর্ববোধ কর, কিন্তু তুমি নিজেই কি শরীয়ত অমান্য করে আল্লাহ্‌কে অসম্মান করছ না? পাক-কিতাবে এই কথা লেখা আছে, “তোমাদেরই জন্য অ-ইহুদীরা আল্লাহ্‌র নামের বিরুদ্ধে কুফরী করে।” তুমি যদি শরীয়ত মেনে চল তবে খৎনা করাবার মূল্য আছে, কিন্তু যদি শরীয়ত অমান্য কর তবে খৎনা করানো হলেও আল্লাহ্‌র কাছে তুমি খৎনা-না-করানো লোকেরই মত। এইজন্য কোন খৎনা-না-করানো লোক যদি শরীয়তের দাবি-দাওয়া মেনে চলে তবে আল্লাহ্‌ কি তাকে খৎনা করানো হয়েছে বলেই ধরবেন না? তোমার কাছে তো লেখা শরীয়ত আছে এবং তোমার খৎনা করানোও হয়েছে। কিন্তু তুমি যদি শরীয়ত অমান্য কর তবে যার খৎনা করানো হয় নি অথচ শরীয়ত পালন করছে, সে কি আইন অমান্য করবার জন্য তোমাকে দোষী করবে না? কেবল বাইরের দিক থেকে যে ইহুদী সে আসল ইহুদী নয়। শরীরের বাইরে খৎনা করানো হলেই যে আসল খৎনা করানো হল তাও নয়। কিন্তু দিলে যে ইহুদী সে-ই আসল ইহুদী। আসল খৎনা করানোর কাজ দিলের মধ্যেই হয়। ওটা রূহানী ব্যাপার, লিখিত আইন মানার ব্যাপার নয়। এই রকম লোক মানুষের প্রশংসা পায় না বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রশংসা পায়। তা-ই যদি হয় তবে ইহুদীদের বিশেষ কি লাভ হয়েছে? খৎনা করাবারই বা মূল্য কি? সব দিকেই যথেষ্ট লাভ হয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহ্‌ তাঁর কালাম ইহুদীদেরই দিয়েছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে কিছু লোক বেঈমানী করেছে, কিন্তু তাতে কি? তারা বেঈমানী করেছে বলে কি আল্লাহ্‌ও বেঈমানী করবেন? নিশ্চয় না। সব মানুষ মিথ্যাবাদী হলেও আল্লাহ্‌ সব সময় সত্যবাদী। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “কাজেই তোমার রায় ঠিক, তোমার বিচার নিখুঁত।” কিন্তু আমাদের অন্যায় কাজ থেকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্‌ সব সময় ন্যায় কাজ করেন। তাহলে আমরা কি বলব যে, তিনি যখন আমাদের শাস্তি দেন তখন অন্যায় করেন? অবশ্য কথাটা আমি মানুষ হিসাবে বলছি, আসলে তিনি কখনও অন্যায় করেন না। আল্লাহ্‌ যদি অন্যায় করেন তবে তিনি কেমন করে মানুষের বিচার করবেন? কেউ হয়তো বলবে, “আমার মিথ্যা কথা বলবার দরুন আরও ভালভাবে প্রকাশ পায় যে, আল্লাহ্‌ সত্যবাদী। এতে যখন আল্লাহ্‌ গৌরব লাভ করেন তখন গুনাহ্‌গার বলে আমাকে দোষী করা হয় কেন?” খুব ভাল, তাহলে কি আমরা এই কথাই বলব, “চল, আমরা খারাপ কাজ করতে থাকি যাতে সেই খারাপীর মধ্য দিয়ে ভাল আসতে পারে”? কোন কোন লোক আমাদের নিন্দা করে বলে যে, আমরা এই রকম কথাই বলে থাকি। তাদের পাওনা শাস্তি তারা পাবে। এখন আমরা কি বলব? ইহুদী হিসাবে আমাদের অবস্থা কি অ-ইহুদীদের চেয়ে ভাল? মোটেই না। আমরা তো আগেই বলেছি, ইহুদী-অ-ইহুদী সবাই গুনাহের অধীন। পাক-কিতাবে লেখা আছে: ধার্মিক কেউ নেই, একজনও নেই; কেউ সত্যিকারের জ্ঞান নিয়ে চলে না, কেউ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত কাজ করে না। সবাই ঠিক পথ থেকে সরে গেছে, সবাই একসংগে খারাপ হয়ে গেছে। ভাল কাজ করে এমন কেউ নেই, একজনও নেই। তাদের মুখ যেন খোলা কবর, জিভ্‌ দিয়ে তারা খোশামোদের কথা বলে। তাদের ঠোঁটের নীচে যেন সাপের বিষ আছে। তাদের মুুখ বদদোয়া ও তেতো কথায় ভরা। খুন করবার জন্য তাদের পা তাড়াতাড়ি দৌড়ে, তাদের পথে ধ্বংস ও সর্বনাশ থাকে। শান্তির পথ তারা জানে না, তারা আল্লাহ্‌কে ভয়ও করে না। আমরা জানি মূসার শরীয়ত তাদেরই জন্য যারা সেই শরীয়তের অধীন। ফলে ইহুদী কি অ-ইহুদী কারও কিছু বলবার নেই, সব মানুষই আল্লাহ্‌র কাছে দোষী হয়ে আছে। শরীয়ত পালন করলেই যে আল্লাহ্‌ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন তা নয়, কিন্তু শরীয়তের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের গুনাহের বিষয়ে চেতনা লাভ করে। আল্লাহ্‌ মানুষকে এখন শরীয়ত ছাড়াই কেমন করে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন তা প্রকাশিত হয়েছে। তৌরাত শরীফ ও নবীদের কিতাব সেই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। যারা ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনে তাদের সেই ঈমানের মধ্য দিয়েই আল্লাহ্‌ তাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন। ইহুদী ও অ-ইহুদী সবাই সমান, কারণ সবাই গুনাহ্‌ করেছে এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা পাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু মসীহ্‌ ঈসা মানুষকে গুনাহের হাত থেকে মুক্ত করবার ব্যবস্থা করেছেন এবং সেই মুক্তির মধ্য দিয়েই রহমতের দান হিসাবে ঈমানদারদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়। আল্লাহ্‌ প্রকাশ করেছিলেন যে, যারা ঈমান আনে তাদের জন্য ঈসা মসীহ্‌ তাঁর রক্তের দ্বারা, অর্থাৎ তাঁর জীবন্তকোরবানীর দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন। এইভাবেই আল্লাহ্‌ দেখিয়েছেন, যদিও তিনি তাঁর সহ্যগুণের জন্য মানুষের আগেকার গুনাহের শাস্তি দেন নি তবুও তিনি ন্যায়বান। তিনি যে ন্যায়বান তা তিনি এখন দেখিয়েছেন যেন প্রমাণ হয় যে, তিনি নিজে ন্যায়বান এবং যে কেউ ঈসার উপর ঈমান আনে তাকেও তিনি ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন। এর পর মানুষের গর্ব করবার আর কি আছে? কিছুই নেই। কিন্তু কেন নেই? মানুষ শরীয়ত পালন করে বলে কি তার গর্ব করবার কিছু নেই? তা নয়। আসল কথা হল, ঈমানের মধ্যে গর্বের জায়গা নেই, কারণ আমরা জানি, আল্লাহ্‌ মানুষকে তার ঈমানের জন্য ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন, শরীয়ত পালন করবার জন্য নয়। আল্লাহ্‌ কি তবে কেবল ইহুদীদেরই, অ-ইহুদীদের নয়? জ্বী, নিশ্চয় তিনি অ-ইহুদীদেরও আল্লাহ্‌, কারণ আল্লাহ্‌ তো মাত্র একজন। তিনি ইহুদীদের যেমন ঈমানের মধ্য দিয়ে ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন তেমনি অ-ইহুদীদেরও করবেন। এই ঈমানের জন্য কি আমরা তাহলে শরীয়ত বাতিল করে দিচ্ছি? কখনও না, বরং শরীয়তের কথা যে সত্যি তা-ই আমরা প্রমাণ করছি। তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের বিষয়ে আমরা কি বলব? এই ব্যাপারে তিনি কি দেখেছিলেন? কাজের জন্যই যদি ইব্রাহিমকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়ে থাকে তবে তো তাঁর গর্ব করবার কিছু আছেই। কিন্তু আল্লাহ্‌র সামনে তাঁর গর্ব করবার কিছুই নেই। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “ইব্রাহিম আল্লাহ্‌র কথার উপর ঈমান আনলেন আর সেইজন্য আল্লাহ্‌ তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” কাজ করে যে বেতন পাওয়া যায় তা দান নয়, পাওনা। কিন্তু যে নিজের চেষ্টার উপর ভরসা না করে কেবল আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনে আল্লাহ্‌ তার সেই ঈমানের জন্য তাকে ধার্মিক বলে ধরেন, কারণ তিনিই গুনাহ্‌গারকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করতে পারেন। দাউদও সেই লোককে ধন্য বলেছেন যাকে আল্লাহ্‌ কোন কাজ ছাড়াই ধার্মিক বলে ধরেছেন। দাউদ বলেছেন, ধন্য সেই লোকেরা, যাদের আল্লাহ্‌র প্রতি বিদ্রোহ মাফ করা হয়েছে, যাদের গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হয়েছে। ধন্য সেই লোক, যার অন্যায় মাবুদ মাফ করেছেন। এখানে কি কেবল তাদেরই ধন্য বলা হয়েছে যাদের খৎনা করানো হয়েছে? খৎনা-না-করানো লোকদেরও কি বলা হয় নি? জ্বী, তাদেরও ধন্য বলা হয়েছে, কারণ আমরা বলছি, “ইব্রাহিমের ঈমানের জন্য তাঁকে ধার্মিক বলে ধরা হয়েছিল।” কোন্‌ অবস্থায় ধরা হয়েছিল? খৎনা করাবার আগে, না পরে? খৎনা করাবার আগেই ধরা হয়েছিল, পরে নয়। খৎনা-না-করানো অবস্থায় ঈমানের জন্যই যে আল্লাহ্‌ তাঁকে ধার্মিক বলে ধরেছিলেন তাঁর খৎনা করানোটা ছিল তারই প্রমাণ এবং চিহ্ন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, খৎনা করানো না হলেও কেবল ঈমানের জন্যই যাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়, ইব্রাহিম তাদের সকলের পিতা। এছাড়া, খৎনা করাবার আগে ইব্রাহিম যেভাবে ঈমানের পথে চলতেন, যে সব খৎনা করানো লোক সেইভাবে চলে ইব্রাহিম তাদেরও পিতা। ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরদের কাছে আল্লাহ্‌ ওয়াদা করেছিলেন যে, এই দুনিয়া ইব্রাহিমেরই হবে। শরীয়ত পালন করবার ফলে এই ওয়াদা তাঁর কাছে করা হয় নি, কিন্তু তাঁর ঈমানের মধ্য দিয়েই তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছিল আর সেইজন্যই সেই ওয়াদা করা হয়েছিল। শরীয়ত পালন করেই যদি কেউ দুনিয়ার অধিকার পেয়ে যায় তবে তো ঈমান অকেজো হয়ে পড়ে আর আল্লাহ্‌র সেই ওয়াদারও কোন মূল্য থাকে না, কারণ শরীয়ত আল্লাহ্‌র গজবকে ডেকে আনে। আর সত্যি বলতে কি, যেখানে শরীয়ত নেই সেখানে শরীয়ত অমান্য করবার প্রশ্নও নেই। সেইজন্য মানুষের ঈমানের মধ্য দিয়ে এই ওয়াদা পূর্ণ করা হয়, যেন এটা আল্লাহ্‌র রহমতের দান হতে পারে। আর তাই ইব্রাহিমের বংশধরদের সকলের জন্যই এই ওয়াদা নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে। শরীয়তের অধীন লোকদের জন্যই যে কেবল এই ওয়াদা পূর্ণ হবে তা নয়, যে সব লোক ইব্রাহিমের মত একই ঈমানে ঈমানদার তাদের জন্যও নিশ্চয়ই এই ওয়াদা পূর্ণ হবে। পাক-কিতাবে যেমন লেখা আছে, “আমি তোমাকে অনেকগুলো জাতির আদিপিতা করে রেখেছি,” সেই অনুসারে আল্লাহ্‌র চোখে ইব্রাহিম আমাদের সকলেরই পিতা। যিনি মৃতকে জীবন দেন এবং যা নেই তা আছে বলে ঘোষণা করেন সেই আল্লাহ্‌র উপর ইব্রাহিম ঈমান এনেছিলেন। যখন পিতা হবার কোন আশাই ছিল না তখনও ইব্রাহিম আল্লাহ্‌র উপর আশা রেখে ঈমান এনেছিলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার বংশধরেরা আসমানের তারার মত অসংখ্য হবে।” আর সেই কথামতই ইব্রাহিম অনেক জাতির পিতা হয়েছিলেন। যদিও প্রায় একশো বছরের বুড়ো ইব্রাহিম বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর শরীর অকেজো হয়ে গেছে আর বিবি সারারও সন্তান হবার বয়স আর নেই, তবুও ইব্রাহিমের ঈমান দুর্বল ছিল না। আল্লাহ্‌র ওয়াদা সম্বন্ধে তাঁর মনে কখনও কোন সন্দেহ আসে নি, বরং তিনি ঈমানে আরও বলবান হয়ে উঠে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতেন। ইব্রাহিম সম্পূর্ণভাবে এই বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ্‌ যা ওয়াদা করেছেন তা করবার ক্ষমতাও তাঁর আছে। এইজন্যই ইব্রাহিমের ঈমানের দরুন তাঁকে ধার্মিক বলে ধরা হয়েছিল। “ধার্মিক বলে ধরা হয়েছিল,” এই কথাটা কেবল ইব্রাহিমকেই লক্ষ্য করে লেখা হয় নি, আমাদেরও লক্ষ্য করে লেখা হয়েছে। আমাদের ঈমানের জন্য আল্লাহ্‌ আমাদেরও ধার্মিক বলে ধরবেন, কারণ যিনি আমাদের হযরত ঈসাকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন আমরা তাঁরই উপর ঈমান এনেছি। আমাদের গুনাহের জন্য ঈসাকে মৃত্যুর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল এবং আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করবার জন্য তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছিল। ঈমানের মধ্য দিয়েই আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে আর তার ফলেই হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ ও আমাদের মধ্যে শান্তি হয়েছে। আল্লাহ্‌র এই যে রহমতের পথে এখন আমরা চলছি সেখানে আমরা মসীহের মধ্য দিয়ে ঈমানের দ্বারাই পৌঁছেছি। আল্লাহ্‌র মহিমা পাবার আশায় আমরা আনন্দ বোধ করছি। কেবল তা-ই নয়, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আমরা আনন্দ বোধ করছি, কারণ আমরা জানি দুঃখ-কষ্টের ফল ধৈর্য, ধৈর্যের ফল খাঁটি স্বভাব এবং খাঁটি স্বভাবের ফল আশা। এই আশা আমাদের লজ্জায় ফেলে না, কারণ আল্লাহ্‌ তাঁর দেওয়া পাক-রূহের দ্বারা আমাদের দিল তাঁরই মহব্বত দিয়ে পূর্ণ করেছেন। যখন আমাদের কোন শক্তিই ছিল না তখন ঠিক সময়েই মসীহ্‌ আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন মানুষের জন্য, অর্থাৎ আমাদের জন্য প্রাণ দিলেন। কোন সৎ লোকের জন্য কেউ প্রাণ দেয় না বললেই চলে। যিনি অন্যের উপকার করেন সেই রকম লোকের জন্য হয়তো বা কেউ সাহস করে প্রাণ দিলেও দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্‌ যে আমাদের মহব্বত করেন তার প্রমাণ এই যে, আমরা গুনাহ্‌গার থাকতেই মসীহ্‌ আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তাহলে মসীহের রক্তের দ্বারা যখন আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে তখন আমরা মসীহের মধ্য দিয়েই আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে নিশ্চয়ই রেহাই পাব। আমরা যখন আল্লাহ্‌র শত্রু ছিলাম তখন তাঁরই পুত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর সংগে আমাদের মিলন হয়েছে। এইভাবে মিলন হয়েছে বলে মসীহের জীবন দ্বারা আমরা নিশ্চয়ই নাজাত পাব। কেবল তা-ই নয়, যাঁর দ্বারা আল্লাহ্‌র সংগে আমাদের মিলন হয়েছে সেই হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌কে নিয়ে আমরা আনন্দও বোধ করছি। একটি মানুষের মধ্য দিয়ে গুনাহ্‌ দুনিয়াতে এসেছিল ও সেই গুনাহের মধ্য দিয়ে মৃত্যুও এসেছিল। সব মানুষ গুনাহ্‌ করেছে বলে এইভাবে সকলের কাছেই মৃত্যু উপস্থিত হয়েছে। মূসার শরীয়ত দেবার আগেই দুনিয়াতে গুনাহ্‌ ছিল, কিন্তু শরীয়ত না থাকলে তো গুনাহ্‌কে গুনাহ্‌ বলে ধরা হয় না। তবুও আদমের সময় থেকে শুরু করে মূসার সময় পর্যন্ত সকলের উপরেই মৃত্যু রাজত্ব করছিল। এমন কি, আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করে যারা আদমের মত গুনাহ্‌ করে নি তাদের উপরেও মৃত্যু রাজত্ব করছিল। যাঁর আসবার কথা ছিল আদম ছিলেন একদিক থেকে সেই ঈসা মসীহেরই ছবি। কিন্তু আদমের গুনাহ্‌ যে রকম, আল্লাহ্‌র বিনামূল্যের দান সেই রকম নয়। যখন একজন লোকের গুনাহের ফলে অনেকে মরল তখন আল্লাহ্‌র রহমতের এবং আর একজন মানুষের দয়ার মধ্য দিয়ে যে দান আসল, তা সেই অনেকের জন্য আরও কত না বেশী করে উপ্‌চে পড়ল! সেই আর একজন মানুষ হলেন ঈসা মসীহ্‌। আল্লাহ্‌র দান আদমের গুনাহের ফলের মত নয়, কারণ একটা গুনাহের বিচারের ফলে সব মানুষকেই শাস্তির যোগ্য বলে ধরা হয়েছে, কিন্তু ধার্মিক বলে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হওয়ার এই যে রহমতের দান, তা অনেক গুনাহের ফলে এসেছে। একজন মানুষের গুনাহের দরুন মৃত্যু সেই একজনের মধ্য দিয়েই রাজত্ব করতে শুরু করেছিল। কিন্তু যারা প্রচুর পরিমাণে আল্লাহ্‌র রহমত ও ধার্মিক বলে তাঁর গ্রহণযোগ্য হওয়ার দান পায়, তারা সেই একজন মানুষের, অর্থাৎ ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে জীবনের পরিপূর্ণতা নিয়ে নিশ্চয়ই রাজত্ব করবে। তাহলে একটা গুনাহের মধ্য দিয়ে যেমন সব মানুষকেই শাস্তির যোগ্য বলে ধরা হয়েছে, তেমনি একটা ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে সব মানুষকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এবং তার ফল হল অনন্ত জীবন। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই গুনাহ্‌গার বলে ধরা হয়েছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে। শরীয়ত দেওয়া হল যাতে অন্যায় বেড়ে যায়, কিন্তু যেখানে অন্যায় বাড়ল সেখানে আল্লাহ্‌র রহমতও আরও অনেক পরিমাণে বাড়ল। সেই রহমত এইজন্য বাড়ল যাতে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেমন গুনাহ্‌ রাজত্ব করেছিল, তেমনি মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করবার মধ্য দিয়ে এখন তাঁর রহমত রাজত্ব করতে পারে; আর তারই ফল হল আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবন লাভ। তাহলে কি আমরা এই বলব যে, আল্লাহ্‌র রহমত যেন বাড়ে সেইজন্য আমরা গুনাহ্‌ করতে থাকব? নিশ্চয়ই না। গুনাহের দাবি-দাওয়ার কাছে তো আমরা মরে গেছি; তবে কেমন করে আমরা আর গুনাহের পথে চলব? এই কথা কি জান না যে, আমরা যারা মসীহ্‌ ঈসার মধ্যে তরিকাবন্দী নিয়েছি, আমরা তাঁর মৃত্যুর মধ্যে অংশ গ্রহণ করেই তা নিয়েছি? আর সেইজন্য সেই তরিকাবন্দীর দ্বারা মসীহের সংগে মরে আমাদের দাফন করাও হয়েছে, যেন পিতা তাঁর মহাশক্তি দ্বারা যেমন মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন তেমনি আমরাও যেন নতুন জীবনের পথে চলতে পারি। মসীহের সংগে মরে যখন তাঁর সংগে আমরা যুক্ত হয়েছি তখন তিনি যেমন মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনি করে আমরা তাঁর সংগে জীবিতও হব। আমরা জানি যে, আমাদের গুনাহ্‌-স্বভাবকে অকেজো করবার জন্যই আমাদের পুরানো ‘আমি’কে মসীহের সংগে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছে যেন গুনাহের গোলাম হয়ে আর আমাদের থাকতে না হয়; কারণ যে মরেছে সে গুনাহের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে। আমরা যখন মসীহের সংগে মরেছি তখন ঈমান রাখি যে, তাঁর সংগে জীবিতও থাকব। আমরা জানি মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছিল বলে তিনি আর কখনও মরবেন না, অর্থাৎ তাঁর উপরে মৃৃত্যুর আর কোন হাত নেই। তিনি যখন মরলেন তখন গুনাহের দাবি-দাওয়ার কাছেও মরলেন; তাঁর উপর গুনাহের আর কোন দাবি-দাওয়া রইল না। আর এখন তিনি জীবিত হয়ে আল্লাহ্‌র জন্য বেঁচে আছেন। ঠিক সেইভাবে এই কথার উপর ভরসা কোরো যে, মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়েছ বলে গুনাহের দাবি-দাওয়ার কাছে তোমরাও মরেছ, আর এখন আল্লাহ্‌র জন্য তোমরাও বেঁচে আছ। এইজন্য তোমাদের এই মৃত্যুর অধীন শরীরের উপর গুনাহ্‌কে আর রাজত্ব করতে দিয়ো না। যদি দাও তবে তোমাদের শরীরের খারাপ ইচ্ছার অধীনেই তোমরা চলতে থাকবে। শরীরের কোন অংশকে অন্যায় কাজ করবার হাতিয়ার হিসাবে গুনাহের হাতে তুলে দিয়ো না। মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠা লোক হিসাবে তোমরা বরং আল্লাহ্‌র হাতে নিজেদের তুলে দাও এবং ন্যায় কাজ করবার হাতিয়ার হিসাবে তোমাদের সম্পূর্ণ শরীরকেই আল্লাহ্‌কে দিয়ে দাও। তোমরা তো গুনাহের গোলাম নও, কারণ তোমরা আল্লাহ্‌র রহমতের অধীন, শরীয়তের অধীন নও। কিন্তু শরীয়তের অধীনে না থেকে রহমতের অধীন হয়েছি বলে কি আমরা গুনাহ্‌ করব? নিশ্চয় না। তোমরা কি জান না যে, গোলামের মত যখন তোমরা কারও হাতে নিজেদের তুলে দাও এবং তার হুকুম পালন করতে থাক তখন তোমরা আসলে তার গোলামই হয়ে পড়? সেইভাবে হয় তোমরা গুনাহের গোলাম হয়ে মরবে, নয় আল্লাহ্‌র গোলাম হয়ে ন্যায় কাজ করবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র শুকরিয়া হোক, কারণ যদিও তোমরা গুনাহের গোলাম ছিলে তবুও যে শিক্ষা তোমাদের দেওয়া হয়েছে সমস্ত দিল দিয়ে তোমরা তার বাধ্য হয়েছ। গুনাহের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে তোমরা তো ন্যায়ের গোলাম হয়েছ। মানুষের দুর্বলতার জন্য আমি কথাগুলো মানুষ যেভাবে বুঝবে সেইভাবে বলছি। আগে তোমরা যেমন আরও বেশী করে অন্যায় কাজ করবার জন্য নিজেদের শরীরকে অপবিত্রতার ও অন্যায়ের গোলাম করে তুলেছিলে, ঠিক সেইভাবে এখন পবিত্রতায় বেড়ে উঠবার জন্য তোমাদের শরীরকে ন্যায় কাজের গোলাম করে তোলো। যখন তোমরা গুনাহের গোলাম ছিলে তখন ন্যায়ের গোলাম ছিলে না। আগেকার যে সব কাজের কথা ভেবে এখন তোমরা লজ্জা পাও সেই সব কাজ থেকে তোমাদের কি লাভ হত? তার শেষ ফল হল মৃত্যু। কিন্তু এখন তোমরা গুনাহের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আল্লাহ্‌র গোলাম হয়েছ। তাতে লাভ হল এই যে, তোমরা পবিত্রতায় বেড়ে উঠছ, আর তার শেষ ফল হল অনন্ত জীবন। গুনাহ্‌ যে বেতন দেয় তা মৃত্যু, কিন্তু আল্লাহ্‌ যা দান করেন তা আমাদের হযরত মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবন। ভাইয়েরা, তোমরা তো শরীয়ত জান। তোমরা কি জান না যে, যতদিন মানুষ জীবিত থাকে ততদিনই শরীয়তের দাবি তার উপরে থাকে? যতদিন স্বামী বেঁচে থাকে ততদিনই স্ত্রী আইন দ্বারা তার সংগে বাঁধা থাকে। কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর সেই আইনের বাঁধন থেকে স্ত্রী মুক্ত হয়। সেইজন্য স্বামী বেঁচে থাকতে সেই স্ত্রী যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে তাকে জেনাকারিণী বলা হয়। কিন্তু যদি তার স্বামী মারা যায় তবে সে সেই আইনের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়। আর তখন যদি সে অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে সে জেনাকারিণী হয় না। ঠিক সেইভাবে আমার ভাইয়েরা, মসীহের শরীরের মধ্য দিয়ে মূসার শরীয়তের দাবি-দাওয়ার কাছে তোমরাও মরেছ। তার ফলে যাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছে তোমরা সেই ঈসা মসীহেরই হয়েছ, যেন আল্লাহ্‌র জন্য তোমাদের জীবন ফলবান হয়ে ওঠে। আমরা যখন গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন ছিলাম তখন শরীয়ত আমাদের মধ্যে গুনাহের কামনা-বাসনা জাগিয়ে তুলত এবং সেই কামনা-বাসনা আমাদের শরীরের মধ্যে কাজ করত; তাই আমাদের জীবন মৃত্যুর জন্য ফলবান হত। তখন আমাদের যা বেঁধে রাখত তার দাবি-দাওয়ার কাছে আমরা মরেছি। সেইজন্য শরীয়ত থেকে এখন আমরা মুক্ত। তার ফলে আমরা এখন লেখা শরীয়তের সেই পুরানো জীবন পথের গোলাম নই, কিন্তু পাক-রূহের দেওয়া নতুন জীবন পথের গোলাম হয়েছি। তবে কি আমরা বলব যে, শরীয়ত খারাপ? নিশ্চয়ই না; বরং এই কথা ঠিক যে, শরীয়ত না থাকলে গুনাহ্‌ কি তা আমি জানতে পারতাম না। “লোভ কোরো না,” শরীয়ত যদি এই কথা না বলত তবে লোভ কি তা আমি জানতাম না। কিন্তু গুনাহ্‌ সেই হুকুমের সুযোগ নিয়ে আমার মধ্যে সব রকম লোভ জাগিয়েছে, কারণ শরীয়ত না থাকলে গুনাহ্‌ যেন মরার মত পড়ে থাকে। আমার জীবনে শরীয়ত আসবার আগে আমি বেঁচেই ছিলাম, কিন্তু সেই হুকুম আসবার সংগে সংগে গুনাহ্‌ও বেঁচে উঠল, আর আমারও মৃত্যু ঘটল। যে হুকুমের ফলে জীবন পাবার কথা তা আমার জন্য মৃত্যু নিয়ে আসল, কারণ সেই হুকুমের সুযোগ নিয়ে গুনাহ্‌ আমাকে ঠকাল, আর সেই হুকুমের দ্বারাই গুনাহ্‌ আমাকে হত্যা করল। তবে এই কথা ঠিক যে, মূসার শরীয়ত পবিত্র এবং তার হুকুমও পবিত্র, ন্যায্য ও উপকারী। তাহলে যা উপকারী তার দ্বারাই কি আমার মৃত্যু হল? কখনও না, বরং যা উপকারী তার দ্বারাই গুনাহ্‌ আমার মৃত্যু ঘটাল, যেন গুনাহ্‌ যে সত্যিই গুনাহ্‌ তা বুঝা যায়। গুনাহ্‌ যে কত জঘন্য তা হুকুমের দ্বারাই ধরা পড়ে। আমরা জানি শরীয়ত রূহানী, কিন্তু আমি গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন বলে গুনাহের গোলাম হয়েছি। আমি যে কি করি তা আমি নিজেই বুঝি না, কারণ আমি যা করতে চাই তা করি না বরং যা ঘৃণা করি তা-ই করি। যা চাই না তা-ই যখন আমি করি তখন আমি এটাই স্বীকার করি যে, শরীয়ত ভাল। তাহলে দেখা যায়, আমি নিজেই এই সব করছি না, কিন্তু আমার মধ্যে যে গুনাহ্‌ বাস করে, সে-ই আমাকে দিয়ে তা করাচ্ছে। আমি জানি আমার মধ্যে, অর্থাৎ আমার গুনাহ্‌-স্বভাবের মধ্যে ভাল বলে কিছু নেই। যা সত্যিই ভাল তা করবার আমার ইচ্ছা আছে কিন্তু শক্তি নেই। যে সব ভাল কাজ আমি করতে চাই তা করি না, বরং তার বদলে যা চাই না সেই সব খারাপ কাজই আমি করতে থাকি। যা করতে চাই না তা-ই যখন আমি করি তখন আসলে আমি নিজে তা করি না, বরং আমার মধ্যে যে গুনাহ্‌ বাস করে সে-ই আমাকে দিয়ে তা করাচ্ছে। তাহলে আমি নিজের মধ্যে একটা নিয়মকে কাজ করতে দেখতে পাচ্ছি। সেই নিয়মটা হল এই- যা ভাল তা যখন আমি করতে চাই তখন খারাপী সব সময় আমার মধ্যে উপস্থিত থাকে। আমার দিল আল্লাহ্‌র শরীয়তে আনন্দিত হয়; তবুও আমি দেখতে পাচ্ছি যে, একটা অন্য রকমের নিয়ম আমার শরীরের মধ্যে কাজ করছে। যা ভাল আমার মন তা ভাল বলেই গ্রহণ করে, কিন্তু এই অন্য নিয়মটি আমার মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং আমাকে বন্দী করে রাখছে। আমার মধ্যে যে গুনাহ্‌ আছে এই নিয়মটা তারই। কি হতভাগা মানুষ আমি! আমার মধ্যে এই যে গুনাহ্‌-স্বভাব যা মৃত্যু আনে, তার হাত থেকে কে আমাকে রক্ষা করবে? আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে আমি আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাই যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। তাহলে দেখা যায় যে, মনের দিক থেকে আমি আল্লাহ্‌র শরীয়তের গোলাম, কিন্তু গুনাহ্‌-স্বভাবের দিক থেকে আমি গুনাহের নিয়মের গোলাম। যারা মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়েছে আল্লাহ্‌ তাদের আর শাস্তির যোগ্য বলে মনে করবেন না। জীবনদাতা পাক-রূহের নিয়মই মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে আমাকে গুনাহ্‌ ও মৃত্যুর নিয়ম থেকে মুক্ত করেছে। মানুষের গুনাহ্‌-স্বভাবের দরুন শরীয়ত শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল, আর সেইজন্য শরীয়ত যা করতে পারে নি আল্লাহ্‌ নিজে তা করেছেন। তিনি গুনাহ্‌ দূর করবার জন্য নিজের নিষ্পাপ পুত্রকে মানুষের স্বভাব দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন এবং তাঁর পুত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গুনাহের বিচার করে তার শক্তিকে বাতিল করে দিলেন। তিনি তা করলেন যেন গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীনে না চলে পাক-রূহের অধীনে চলবার দরুন আমাদের মধ্যে শরীয়তের দাবি-দাওয়া পূর্ণ হয়। যারা গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন তাদের মন গুনাহ্‌-স্বভাব যা চায় তাতে আগ্রহী; আর যারা পাক-রূহের অধীন তাদের মন পাক-রূহ্‌ যা চান তাতে আগ্রহী। গুনাহ্‌-স্বভাব যা চায় তাতে আগ্রহী হবার ফল হল মৃত্যু, আর পাক-রূহ্‌ যা চান তাতে আগ্রহী হবার ফল হল জীবন ও শান্তি। যে মন গুনাহ্‌-স্বভাব যা চায় তাতে আগ্রহী, সেই মন আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে, কারণ তা আল্লাহ্‌র শরীয়ত মানতে চায় না, মানতে পারেও না। কাজেই যারা গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন তারা আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্‌র রূহ্‌ যদি তোমাদের দিলে বাস করেন তবে তোমরা তো গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন নও বরং পাক-রূহের অধীন। যার দিলে মসীহের রূহ্‌ নেই সে মসীহের নয়। কিন্তু মসীহ্‌ যদি তোমাদের দিলে থাকেন তবে গুনাহের দরুন তোমাদের শরীরের উপর মৃত্যু কাজ করতে থাকলেও তোমাদের রূহ্‌ জীবিত, কারণ আল্লাহ্‌ তোমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করেছেন। যিনি ঈসাকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছেন সেই আল্লাহ্‌র রূহ্‌ যদি তোমাদের দিলে বাস করেন, তবে আল্লাহ্‌ তাঁর সেই রূহের দ্বারা তোমাদের মৃত্যুর অধীন শরীরকেও জীবন দান করবেন। সেইজন্য ভাইয়েরা, আমরা ঋণী, কিন্তু সেই ঋণ গুনাহ্‌-স্বভাবের কাছে নয়। গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন হয়ে আর আমাদের চলবার দরকার নেই। যদি তোমরা গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীনে চল তবে তোমরা চিরকালের জন্য মরবে। কিন্তু যদি পাক-রূহের দ্বারা শরীরের সব অন্যায় কাজ ধ্বংস করে ফেল তবে চিরকাল জীবিত থাকবে, কারণ যারা আল্লাহ্‌র রূহের পরিচালনায় চলে তারাই আল্লাহ্‌র সন্তান। তোমরা তো গোলামের মনোভাব পাও নি যার জন্য ভয় করবে; তোমরা আল্লাহ্‌র রূহ্‌কে পেয়েছ যিনি তোমাদের সন্তানের অধিকার দিয়েছেন। সেইজন্যই আমরা আল্লাহ্‌কে আব্বা, অর্থাৎ পিতা বলে ডাকি। পাক-রূহ্‌ও নিজে আমাদের দিলে এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আমরা আল্লাহ্‌র সন্তান। আমরা যদি সন্তানই হয়ে থাকি তবে আল্লাহ্‌ তাঁর সন্তানদের যা দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন আমরা তা পাব। মসীহ্‌ই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তা পাবেন আর আমরাও তাঁর সংগে তা পাব, কারণ আমরা যদি মসীহের সংগে কষ্টভোগ করি তবে তাঁর সংগে মহিমারও ভাগী হব। আমি জানি, আমরা যে মহিমা পরে পাব তার তুলনায় আমাদের এই জীবনের কষ্টভোগ কিছুই নয়। আল্লাহ্‌র সন্তানেরা কখন সেই মহিমায় প্রকাশিত হবেন তার জন্য সমস্ত সৃষ্টি আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করে আছে, কারণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যটাই বিফল হয়ে গেছে। অবশ্য নিজের ইচ্ছায় তা হয় নি, আল্লাহ্‌ তাঁকে বিফলতার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তার সংগে সংগে এই আশ্বাসও দিয়েছেন যে, ধ্বংসের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে এই সৃষ্টি একদিন আল্লাহ্‌র সন্তানদের গৌরবময় স্বাধীনতার ভাগী হতে পারবে। আমরা জানি যে, গোটা সৃষ্টিটাই যেন এক ভীষণ প্রসব-বেদনায় এখনও কাতরাচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, কিন্তু যে মহিমা আমরা পরে পাব তার প্রথম ফল হিসাবে পাক-রূহ্‌কে পেয়ে আমরা নিজেরাও দিলে কাতরাচ্ছি। আর সেই সংগে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করে আছি যখন আল্লাহ্‌র সন্তান হিসাবে আমাদের প্রকাশ করা হবে, অর্থাৎ ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের শরীরকে মুক্ত করা হবে। নাজাত পেয়ে আমরা এই আশাই পেয়েছি। আমরা যার জন্য আশা করে আছি যদি তা পাওয়া হয়ে যায় তবে তো সেই আশা আর আশাই রইল না। যা পাওয়া হয়ে গেছে, তার জন্য কে আশা করে থাকে? কিন্তু যা পাওয়া হয় নি তার জন্য যদি আমাদের আশা থাকে তবে তার জন্য আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষাও করি। এছাড়া আমাদের দুর্বলতায় পাক-রূহ্‌ আমাদের সাহায্য করেন। কি বলে মুনাজাত করা উচিত তা আমরা জানি না, কিন্তু যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না সেই রকম আকুলতার সংগে পাক-রূহ্‌ নিজেই আমাদের হয়ে অনুরোধ করেন। যিনি মানুষের দিল তালাশ করে দেখেন তিনি পাক-রূহের মনের কথাও জানেন, কারণ পাক-রূহ্‌ আল্লাহ্‌র ইচ্ছামতই আল্লাহ্‌র বান্দাদের জন্য অনুরোধ করেন। আমরা জানি যারা আল্লাহ্‌কে মহব্বত করে, অর্থাৎ আল্লাহ্‌ নিজের উদ্দেশ্যমত যাদের ডেকেছেন তাদের ভালোর জন্য সব কিছুই একসংগে কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহ্‌ যাদের আগেই বাছাই করেছিলেন তাদের তিনি তাঁর পুত্রের মত হবার জন্য আগেই ঠিক করেও রেখেছিলেন, যেন সেই পুত্র অনেক ভাইদের মধ্যে প্রধান হন। যাদের তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন তাদের তিনি ডাকও দিলেন; যাদের ডাক দিলেন তাদের তিনি ধার্মিক বলে গ্রহণও করলেন; যাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন তাদের তিনি নিজের মহিমাও দান করলেন। তাহলে এই সব ব্যাপারে আমরা কি বলব? আল্লাহ্‌ যখন আমাদের পক্ষে আছেন তখন আমাদের ক্ষতি করবার কে আছে? আল্লাহ্‌ নিজের পুত্রকে পর্যন্ত রেহাই দিলেন না বরং আমাদের সকলের জন্য তাঁকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিলেন। তাহলে তিনি কি পুত্রের সংগে আর সব কিছুও আমাদের দান করবেন না? আল্লাহ্‌ যাদের বেছে নিয়েছেন কে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে? আল্লাহ্‌ নিজেই তো তাদের নির্দোষ বলে গ্রহণ করেছেন। কে তাদের দোষী বলে স্থির করবে? যিনি মরেছিলেন এবং যাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করাও হয়েছে সেই মসীহ্‌ ঈসা এখন আল্লাহ্‌র ডান পাশে আছেন এবং আমাদের জন্য অনুরোধ করছেন। কাজেই এমন কি আছে যা মসীহের মহব্বত থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেবে? যন্ত্রণা? মনের কষ্ট? জুলুম? খিদে? কাপড়-চোপড়ের অভাব? বিপদ? মৃত্যু? পাক-কিতাবে লেখা আছে, তোমার জন্য সব সময় আমাদের কাউকে না কাউকে হত্যা করা হচ্ছে; জবাই করার ভেড়ার মতই লোকে আমাদের মনে করে। কিন্তু যিনি তোমাদের মহব্বত করেন তাঁর মধ্য দিয়ে এই সবের মধ্যেও আমরা সম্পূর্ণভাবে জয়লাভ করছি। আমি এই কথা ভাল করেই জানি, মৃত্যু বা জীবন, ফেরেশতা বা শয়তানের দূত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোন কিছু কিংবা অন্য কোন রকম শক্তি, অথবা আসমানের উপরের বা দুনিয়ার নীচের কোন কিছু, এমন কি, সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কোন ব্যাপারই আল্লাহ্‌র মহব্বত থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না। আল্লাহ্‌র এই মহব্বত আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্যে রয়েছে। আমার ভাইদের বদলে, অর্থাৎ যারা আমার জাতির লোক তাদের বদলে যদি সম্ভব হত তবে আমি নিজেই মসীহের কাছ থেকে দূর হয়ে যাবার বদদোয়া গ্রহণ করতাম। তারা তো ইসরাইল জাতির লোক। আল্লাহ্‌ তাদের পুত্রের অধিকার দিয়েছেন, নিজের মহিমা দেখিয়েছেন, তাদের জন্য ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন, শরীয়ত দিয়েছেন, তাঁর এবাদতের উপায় করেছেন এবং অনেক ওয়াদাও করেছেন। আল্লাহ্‌র মহান ভক্তেরা ছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষ এবং মানুষ হিসাবে মসীহ্‌ তাদেরই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই আল্লাহ্‌, যিনি সব কিছুরই উপরে; সমস্ত প্রশংসা চিরকাল তাঁরই। আমিন। আল্লাহ্‌র কালাম যে মিথ্যা হয়ে গেছে তা নয়, কারণ যারা ইসরাইল জাতির মধ্যে জন্মেছে তারা সবাই সত্যিকারের ইসরাইল নয়। ইব্রাহিমের বংশের বলেই যে তারা তাঁর সত্যিকারের সন্তান তা নয়, বরং পাক-কিতাবের কথামত, “ইসহাকের বংশকেই তোমার বংশ বলে ধরা হবে।” এর অর্থ হল, ইসরাইল জাতির মধ্যে জন্ম হয়েছে বলেই কেউ যে আল্লাহ্‌র সন্তান তা নয়, কিন্তু আল্লাহ্‌র ওয়াদা মত যাদের জন্ম হয়েছে তাদেরই ইব্রাহিমের বংশের বলে ধরা হবে। সেই ওয়াদা এই- “ঠিক সময়ে আমি ফিরে আসব এবং সারার একটি ছেলে হবে।” আর তাই পাক-কিতাবে লেখা আছে, “ইয়াকুবকে আমি মহব্বত করেছি, কিন্তু ইস্‌কে অগ্রাহ্য করেছি।” তাহলে আমরা কি বলব আল্লাহ্‌ অন্যায় করেন? মোটেই না। তিনি মূসাকে বলেছিলেন, “আমার যাকে ইচ্ছা তাকে দয়া করব, যাকে ইচ্ছা তাকে মমতা করব।” এটা তাহলে কারও চেষ্টা বা ইচ্ছার উপর ভরসা করে না, আল্লাহ্‌র দয়ার উপরেই ভরসা করে। পাক-কিতাবে আল্লাহ্‌ ফেরাউনকে এই কথা বলেছিলেন, “আমি তোমাকে বাদশাহ্‌ করেছি যেন তোমার প্রতি আমার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমার কুদরত দেখাতে পারি এবং সমস্ত দুনিয়াতে যেন আমার নাম প্রচারিত হয়।” তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্‌ নিজের ইচ্ছামত কাউকে দয়া করেন এবং কারও দিল কঠিন করেন। হয়তো তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, “তবে আল্লাহ্‌ মানুষের দোষ ধরেন কেন? কেউ কি আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যকে বাধা দিতে পারে?” তার জবাবে আমি বলব যে, তুমি মানুষ; আল্লাহ্‌র কথার উপর কথা বলবার তুমি কে? কোন লোক যদি একটা জিনিস তৈরী করে তবে সেই তৈরী করা জিনিসটা কি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, “কেন আমাকে এই রকম তৈরী করলে?” একই মাটি থেকে কি কুমারের ভিন্ন ভিন্ন রকমের পাত্র তৈরী করবার অধিকার নেই- কোনটা সম্মানের কাজের জন্য বা কোনটা নীচু কাজের জন্য? ঠিক সেইভাবে আল্লাহ্‌ তাঁর গজব ও কুদরত দেখাতে চেয়েছিলেন; তবুও যে লোকদের উপরে তাঁর গজব নাজেল করবেন, খুব ধৈর্যের সংগে তিনি তাদের সহ্য করলেন। এই লোকদের একমাত্র পাওনা ছিল ধ্বংস। আবার তিনি তাঁর অশেষ মহিমার কথাও জানাতে চেয়েছিলেন। যারা তাঁর দয়ার পাত্র তাদের তিনি তাঁর মহিমা পাবার জন্য আগেই তৈরী করে রেখেছিলেন। আমরাই সেই দয়ার পাত্র। তিনি আমাদের কেবল ইহুদীদের মধ্য থেকে ডাকেন নি, অ-ইহুদীদের মধ্য থেকেও ডেকেছেন। নবী হোসিয়ার কিতাবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “যারা আমার নয় তাদের আমি আমার বান্দা বলে ডাকব, আর যাকে আমি মহব্বত করি নি তাকে আমি আমার প্রিয়া বলে ডাকব। যে জায়গায় তাদের বলা হয়েছিল, ‘তোমরা আমার বান্দা নও,’ সেখানে তাদের জীবন্ত আল্লাহ্‌র সন্তান বলে ডাকা হবে।” নবী ইশাইয়া ইসরাইল জাতির বিষয়ে বলেছিলেন, “বনি-ইসরাইলরা যদিও সংখ্যায় সমুদ্র-পারের বালির মত তবুও কেবল তার বিশেষ একটা অংশই উদ্ধার পাবে। মাবুদ শীঘ্রই দুনিয়াকে তার পাওনা শাস্তি পুরোপুরিভাবেই দেবেন।” নবী ইশাইয়া আরও বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন যদি কিছু বংশধর আমাদের জন্য রেখে না যেতেন তবে আমাদের অবস্থা সাদুম ও আমুরা শহরের মত হত।” তাহলে আমরা এই কথাই বলব যে, অ-ইহুদীরা যদিও আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হবার চেষ্টাও করে নি তবুও তাদের ঈমানের মধ্য দিয়েই তারা আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা শরীয়ত পালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা তা হতে পারে নি। কেন পারে নি? কারণ তারা ঈমানের উপর ভরসা না করে কাজের উপর ভরসা করেছিল। যে পাথরে লোকে উচোট খায় তাতেই তারা উচোট খেয়েছিল। এই বিষয়ে পাক-কিতাবে লেখা আছে, দেখ, আমি সিয়োনে এমন একটা পাথর রাখছি যাতে লোকে উচোট খাবে এবং যা লোকের উচোট খাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু যে তাঁর উপরে ঈমান আনে সে নিরাশ হবে না। ভাইয়েরা, বনি-ইসরাইলদের জন্য আমার দিলের গভীর ইচ্ছা ও আল্লাহ্‌র কাছে আমার মুনাজাত এই যে, তারা যেন নাজাত পায়। তাদের সম্বন্ধে আমি এই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌র প্রতি তাদের গভীর আগ্রহ আছে, কিন্তু কি করে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হওয়া যায় তা তারা জানে না। আল্লাহ্‌ মানুষকে কেমন করে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন সেই কথায় মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের চেষ্টায় তারা তাঁর গ্রহণযোগ্য হতে চাইছিল। সেইজন্যই আল্লাহ্‌ যে উপায়ে মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন তা তারা মেনে নেয় নি। মসীহ্‌ই শরীয়ত পূর্ণ করে তার শক্তি বাতিল করেছেন, যেন তাঁর উপর যারা ঈমান আনে তারা আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হয়। শরীয়ত পালন করে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্বন্ধে মূসা লিখেছেন, “যে লোক শরীয়ত মতে চলে সে তার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।” কিন্তু ঈমানের দ্বারা কিভাবে মানুষ আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হয় সেই বিষয়ে পাক-কিতাবে বলা হয়েছে, “মনে মনে এই কথা বোলো না, ‘কে বেহেশতে যাবে?’ ” এর অর্থ হল, বেহেশত থেকে মসীহ্‌কে নামিয়ে আনবার জন্য কে বেহেশতে যাবে? “কিংবা বোলো না, ‘কে নীচে মৃতদের জায়গায় যাবে?’ ” অর্থাৎ মৃত্যু থেকে মসীহ্‌কে উঠিয়ে আনবার জন্য কে মৃতদের জায়গায় যাবে? আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হবার বিষয়ে কিতাব আরও বলে, “আল্লাহ্‌ যা বলেছেন তা তোমার সংগেই রয়েছে, অর্থাৎ তোমার মুখে ও তোমার দিলে রয়েছে।” যে ঈমানের কথা আমরা তবলিগ করছি তা হল আল্লাহ্‌র সেই কথা। সেই কথা হল, যদি তুমি ঈসাকে প্রভু বলে মুখে স্বীকার কর এবং দিলে ঈমান আন যে, আল্লাহ্‌ তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছেন তবেই তুমি নাজাত পাবে; কারণ দিলে ঈমান আনবার ফলে আল্লাহ্‌ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন আর মুখে স্বীকার করবার ফলে নাজাত দেন। পাক-কিতাব বলে, “যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে নিরাশ হবে না।” ইহুদী ও অ-ইহুদীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, কারণ সকলের একই প্রভু। যারা তাঁকে ডাকে তিনি তাদের উপর প্রচুর দোয়া ঢেলে দেন। পাক-কিতাবে আছে, “উদ্ধার পাবার জন্য যে কেউ প্রভুকে ডাকে সে নাজাত পাবে।” কিন্তু যাঁর উপর তারা ঈমান আনে নি তাঁকে কেমন করে ডাকবে? যাঁর বিষয় তারা শোনে নি তাঁর উপর কেমন করে ঈমান আনবে? তবলিগকারী না থাকলে তারা কেমন করেই বা শুনবে? তা ছাড়া কেউ না পাঠালে কেমন করে তবলিগকারীরা তবলিগ করবে? পাক-কিতাবে লেখা আছে, “ধন্য তাদের পা যারা উপকারের সুসংবাদ তবলিগ করতে আসে।” কিন্তু সবাই সেই সুসংবাদে সাড়া দেয় নি। নবী ইশাইয়া বলেছেন, “মাবুদ, আমাদের দেওয়া সুসংবাদের উপর কে ঈমান এনেছে?” তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্‌র কালাম শুনবার ফলেই ঈমান আসে, আর মসীহের বিষয় তবলিগের মধ্য দিয়ে সেই কালাম শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমি বলি, বনি-ইসরাইলরা কি সেই কালাম শুনতে পায় নি? নিশ্চয় শুনেছে। পাক-কিতাব বলে, তাদের ডাক সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে তাদের কথা পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত। আমি আবার বলি, বনি-ইসরাইলরা কি সেই কালাম বুঝতে পারে নি? প্রথমে নবী মূসার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেছেন, যে জাতি কোন জাতিই নয়, সেই জাতিকে দিয়েই আমি তোমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলব; একটা অবুঝ জাতিকে দিয়ে তোমাকে রাগিয়ে তুলব। তারপর নবী ইশাইয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ আরও জোর দিয়ে বলেছেন, “আমি তাদের কাছেই ছিলাম, কিন্তু তারা কোন সাহায্যের জন্য আমার কাছে আসে নি। আমি এই লোকদের আমার কাছে অনুরোধ জানাবার সুযোগ দিয়েছি, কিন্তু তারা আমার কাছে কোন অনুরোধ জানায় নি।” কিন্তু বনি-ইসরাইলদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, “অবাধ্য ও একগুঁয়ে লোকদের দিকে আমি সারা দিন আমার হাত বাড়িয়েই রয়েছি।” আমি তবে জিজ্ঞাসা করি, আল্লাহ্‌ কি তাঁর বান্দাদের অগ্রাহ্য করেছেন? কখনও না। আমি নিজেই একজন ইসরাইলীয়, ইব্রাহিমের বংশের এবং বিন্যামীন-গোষ্ঠীর লোক। আল্লাহ্‌ তাঁর যে সব বান্দাদের আগেই বাছাই করেছিলেন তাদের অগ্রাহ্য করেন নি। নবী ইলিয়াসের বিষয় পাক-কিতাব কি বলে তা কি তোমরা জান না? তিনি বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌র কাছে বলেছিলেন, “মাবুদ, এরা তোমার নবীদের হত্যা করেছে ও তোমার কোরবানগাহ্‌গুলো ভেংগে ফেলেছে। কেবল আমিই বাকী আছি, আর আমাকেও তারা হত্যা করবার চেষ্টা করেছে।” কিন্তু আল্লাহ্‌ নবী ইলিয়াসকে কি জবাব দিয়েছিলেন? তিনি বলেছিলেন, “সাত হাজার লোককে আমি আমার জন্য রেখে দিয়েছি যারা বাল দেবতার কাছে হাঁটু পাতে নি।” আল্লাহ্‌ সেই একইভাবে এখনও রহমত করে বনি-ইসরাইলদের বিশেষ একটা অংশকে বেছে রেখেছেন। আল্লাহ্‌ যদি রহমত করেই বেছে রেখেছেন তবে তো তা কোন কাজের ফল নয়। যদি তা-ই হত তবে রহমত আর রহমত থাকত না। তাহলে বুঝা যায়, বনি-ইসরাইলরা যা পাবার চেষ্টা করছিল তা তারা পায় নি, কিন্তু আল্লাহ্‌ যাদের বেছে রেখেছিলেন তারাই তা পেয়েছে, আর অন্য সকলের মন পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “আল্লাহ্‌ তাদের মন এমন অসাড় করলেন যে, তারা আজও পর্যন্ত তাদের চোখ দিয়ে দেখেও দেখে না এবং কান দিয়ে শুনেও শোনে না।” নবী দাউদও বলেছিলেন, তাদের মেজবানীর উৎসবগুলো ফাঁদ ও জালের মত হোক; সেগুলো যেন তাদের উচোট খাওয়ার কারণ হয়, আর তাদের যা পাওনা তারা যেন তা-ই পায়। তাদের চোখ অন্ধ হোক যেন তারা দেখতে না পায়, আর সব সময় তাদের কোমরে খিঁচুনি ধরে যাক। তাহলে ইহুদীরা উচোট খেয়ে কি চিরকালের জন্য পড়ে গেল? মোটেই না, বরং তাদের গুনাহের দরুনই অ-ইহুদীরা নাজাত পাবার সুযোগ পেল যেন ইহুদীরা আগ্রহে জেগে ওঠে। তাহলে দেখা যায়, ইহুদীদের গুনাহের দরুন দুনিয়ার লোকদের অনেক লাভ হল। জ্বী, তাদের ক্ষতির দরুন অ-ইহুদীদের অনেক লাভ হল। সেইজন্য ইহুদীদের উপর আল্লাহ্‌র পূর্ণ দোয়া যখন নেমে আসবে তখন তার সংগে অ-ইহুদীদের জন্য আরও কত না বেশী দোয়া আসবে! অ-ইহুদীরা, আমি তোমাদের বলছি, অ-ইহুদীদের কাছে সাহাবী হিসাবে আমি আমার কাজকে খুব সম্মানের চোখে দেখছি। এতে যেন আমি আমার নিজের জাতির লোকদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলে তাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে উদ্ধার করতে পারি। আল্লাহ্‌ ইহুদীদের অগ্রাহ্য করেছেন বলে যদি আল্লাহ্‌র সংগে দুনিয়ার অন্য লোকদের মিলন হল তবে তিনি যখন ইহুদীদের গ্রহণ করবেন তখন অবস্থাটা কি হবে? সে কি মৃতের জীবন পাওয়ার মত অবস্থা হবে না? রুটির ময়দার তাল থেকে তৈরী প্রথম রুটিটা যদি পবিত্র হয় তবে তো গোটা তালটাই পবিত্র। জলপাই গাছের মূলটাই যদি পবিত্র হয় তবে তার ডালপালাগুলোও তো পবিত্র। যদি সেই জলপাই গাছের কতগুলো ডালপালা ভেংগে ফেলে সেই জায়গায় তোমার মত বুনো জলপাই গাছের ডাল জুড়ে দেওয়া হয় এবং তুমি আসল জলপাই গাছের মূল থেকে রস টেনে নাও, তবে ভেংগে ফেলা ডালপালাগুলোর চেয়ে নিজেকে বড় মনে কোরো না। যদি কর তবে মনে রেখো, তুমি মূলকে ধরে রাখছ না বরং মূলই তোমাকে ধরে রাখছে। তুমি হয়তো বলবে, “আমাকে জুড়ে দেবার জন্যই ডালপালাগুলো ভেংগে ফেলা হয়েছিল।” খুব ভাল। কিন্তু তাদের ভেংগে ফেলা হয়েছে কারণ তারা ঈমান আনে নি, আর তুমি সেখানে যুক্ত হয়ে আছ তোমার ঈমানের জন্য। এতে অহংকার কোরো না বরং ভয় কর, কারণ আল্লাহ্‌ যখন আসল ডালগুলোকে রেহাই দেন নি তখন তোমাকেও রেহাই দেবেন না। সেইজন্য আল্লাহ্‌ যে কত দয়ালু আর কঠিন তা একবার ভেবে দেখ। যারা পড়ে গেছে তাদের প্রতি তিনি কঠিন, কিন্তু তোমার প্রতি তিনি দয়ালু- অবশ্য যদি তুমি তার দয়ার মধ্যে থাক। তা না হলে তোমাকেও কেটে ফেলা হবে। আর যদি তারা ঈমান আনে তবে তাদের নিজের গাছের সংগে আবার জুড়ে দেওয়া হবে, কারণ এই জুড়ে দেওয়ার কাজ আল্লাহ্‌ করতে পারেন। আসলে তুমি একটা বুনো জলপাই গাছের ডাল ছিলে, আর সেই গাছ থেকে তোমাকে কেটে নিয়ে বাগানের জলপাই গাছে অস্বাভাবিক ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে যারা সেই গাছের আসল ডালপালা ছিল, কত সহজেই না তাদের নিজের গাছের মধ্যে আবার জুড়ে দেওয়া হবে! ভাইয়েরা, তোমরা যেন নিজেদের জ্ঞানী মনে না কর সেইজন্য আমি একটা গোপন সত্য তোমাদের জানিয়ে রাখতে চাই। সেই সত্য এই- অ-ইহুদীদের সংখ্যা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বেশীর ভাগ বনি-ইসরাইলদের অন্তর কঠিন হয়েই থাকবে। আর এইভাবেই গোটা ইসরাইল জাতি নাজাত পাবে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, সিয়োন থেকে নাজাতদাতা আসবেন; তিনি ইয়াকুবের বংশের লোকদের মধ্য থেকে আমার প্রতি ভয়হীনতা দূর করবেন। আমি যখন তাদের গুনাহ্‌ দূর করব তখন এটাই হবে তাদের জন্য আমার দোয়াযুক্ত ব্যবস্থা। সুসংবাদের দিক থেকে তোমাদের ভালোর জন্যই তারা এখন আল্লাহ্‌র শত্রু। কিন্তু আল্লাহ্‌র বেছে নেবার দিক থেকে পূর্বপুরুষদের জন্য তারা আল্লাহ্‌র মহব্বতের পাত্র। আল্লাহ্‌ যা দান করেন এবং যাকে ডাকেন সেই বিষয়ে তাঁর মন তিনি বদলান না। যেমন তোমরা এক সময় আল্লাহ্‌র অবাধ্য ছিলে কিন্তু ইহুদীদের অবাধ্যতার জন্য এখন আল্লাহ্‌র দয়া পেয়েছ, ঠিক তেমনি করে তোমরা দয়া পেয়েছ বলে তারাও এখন অবাধ্য হয়েছে যেন তারাও এখন দয়া পেতে পারে। আল্লাহ্‌ যেন সকলকে দয়া দেখাতে পারেন সেইজন্য তিনি সবাইকে অবাধ্যতার মধ্যে বন্দী করে রেখেছেন। আল্লাহ্‌র ধন অসীম। তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধি কত গভীর! তাঁর বিচার ও তাঁর সমস্ত কাজ বুঝা অসম্ভব। কে মাবুদের মন বুঝতে পেরেছে? আর কে-ই বা তাঁর পরামর্শদাতা হয়েছে? আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কার দাবি আছে যে, তার দাবি তাঁকে মানতে হবে? সব কিছু তো তাঁরই কাছ থেকে ও তাঁরই মধ্য দিয়ে আসে এবং সব কিছু তাঁরই উদ্দেশে। চিরকাল তাঁরই প্রশংসা হোক। আমিন। তাহলে ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌র এই সব দয়ার জন্যই আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, তোমরা তোমাদের শরীরকে জীবিত, পবিত্র ও আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য কোরবানী হিসাবে আল্লাহ্‌র হাতে তুলে দাও। সেটাই হবে তোমাদের উপযুক্ত এবাদত। এখানকার খারাপ দুনিয়ার চালচলনের মধ্যে তোমরা নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ো না, বরং আল্লাহ্‌কে তোমাদের মনকে নতুন করে গড়ে তুলতে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে ওঠো, যেন তোমরা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানতে পার। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ভাল, সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং তাতে আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট হন। আমি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে বিশেষ রহমত পেয়েছি তার মধ্য দিয়ে আমি তোমাদের প্রত্যেককে বলছি, নিজেকে যতটুকু বড় মনে করা উচিত তার চেয়ে বেশী বড় তোমরা নিজেকে মনে কোরো না, বরং যতটুকু উপযুক্ত ততটুকুই মনে কোরো। আল্লাহ্‌ যাকে যতটা ঈমানের শক্তি দিয়েছেন তার বেশী কেউ যেন নিজেকে মনে না করে। আমাদের প্রত্যেকের শরীরের অনেকগুলো অংশ আছে, কিন্তু সব অংশগুলো একই কাজ করে না; ঠিক সেইভাবে আমরা সংখ্যায় অনেক হলেও মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে একটা শরীরই হয়েছি। আমাদের সকলের একে অন্যের সংগে যোগ আছে। আল্লাহ্‌র রহমত অনুসারে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দান পেয়েছি। সেই দান যদি নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলবার ক্ষমতা হয় তবে বিশ্বাস অনুসারে সে আল্লাহ্‌র কালাম বলুক। যদি তা সেবা করবার ক্ষমতা হয় তবে সে সেবা করুক। যে শিক্ষা দেবার ক্ষমতা পেয়েছে সে শিক্ষা দিক; যে উৎসাহিত করবার ক্ষমতা পেয়েছে সে উৎসাহিত করুক; যে অন্যকে দান করবার ক্ষমতা পেয়েছে সে সরল মনে দিক; যে নেতা হবার ক্ষমতা পেয়েছে সে আগ্রহের সংগে পরিচালনা করুক; যে অন্যদের সাহায্য করবার ক্ষমতা পেয়েছে সে খুশী মনে তা করুক। মহব্বতের মধ্যে ভণ্ডামি না থাকুক। যা খারাপ তা ঘৃণা কর; যা ভাল তা শক্তভাবে ধরে রাখ। একে অন্যকে ভাইয়ের মত গভীরভাবে মহব্বত কর। নিজের চেয়ে অন্যকে বেশী সম্মান কর। আল্লাহ্‌র প্রতি সব সময় তোমাদের আগ্রহ থাকুক। তোমাদের দিল ভয়ে ভরা থাকুক। তোমরা প্রভুর কাজে লেগে থাক। তোমাদের সামনে যে আশা রয়েছে তার জন্য আনন্দ কর। দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধর। অনবরত মুনাজাত কর। আল্লাহ্‌র বান্দাদের অভাবের সময় সাহায্য কর। মেহমানদের সেবা করতে আগ্রহী হও। যারা তোমাদের জুলুম করে তাদের ক্ষতি চেয়ো না বরং ভাল চেয়ো। যারা আনন্দ করে তাদের সংগে আনন্দিত হও; যারা কাঁদে তাদের সংগে কাঁদ। তোমাদের একের প্রতি অন্যের মনোভাব যেন একই রকম হয়। বড়লোকের ভাব না দেখিয়ে বরং যারা বড়লোক নয় তাদের সংগে মেলামেশা কর। নিজেকে জ্ঞানী মনে কোরো না। খারাপীর বদলে কারও খারাপ কোরো না। সমস্ত লোকের চোখে যা ভাল সেই বিষয়ে মনোযোগ দাও। তোমাদের দিক থেকে যতদূর সম্ভব সমস্ত লোকের সংগে শান্তিতে বাস কর। প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা নিজেরা প্রতিশোধ নিয়ো না, বরং আল্লাহ্‌কেই শাস্তি দিতে দাও। পাক-কিতাবে মাবুদ বলেন, “অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকার কেবল আমারই আছে; যার যা পাওনা আমি তাকে তা-ই দেব।” কিতাবের কথামত বরং “তোমার শত্রুর যদি খিদে পায় তাকে খেতে দাও; যদি তার পিপাসা পায় তাকে পানি দাও। এই রকম করলে তুমি তার মাথায় জ্বলন্ত কয়লা গাদা করে রাখবে।” খারাপীর কাছে হেরে যেয়ো না, বরং ভাল দিয়ে খারাপীকে জয় কর। প্রত্যেকেই দেশের শাসনকর্তাদের মেনে চলুক, কারণ আল্লাহ্‌ যাঁকে শাসনকর্তা করেন তিনি ছাড়া আর কেউই শাসনকর্তা হতে পারেন না। আল্লাহ্‌ শাসনকর্তাদের নিযুক্ত করেছেন; এইজন্য শাসনকর্তার বিরুদ্ধে যে দাঁড়ায় সে আল্লাহ্‌র শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়। যারা এই রকম করে তারা নিজেদের উপরে শাস্তি ডেকে আনে। যারা ভাল কাজ করে শাসনকর্তাদের ভয় করবার কোন কারণ তাদের থাকে না, কিন্তু যারা অন্যায় করে তারাই ভয় করে। শাসনকর্তাকে ভয় না করে কি তোমরা চলতে চাও? তাহলে যা ভাল তা-ই করতে থাক। তাতে তোমরা তাঁর কাছ থেকে প্রশংসা পাবে। তোমাদের ভালোর জন্যই তিনি আল্লাহ্‌র সেবাকারী হিসাবে কাজ করেন। তোমরা যদি অন্যায় কর তাহলে ভয় কর, কারণ অন্যায়কারীদের শাস্তি দেবার অধিকার তাঁর আছে। তিনি তো আল্লাহ্‌র সেবাকারী; যারা অন্যায় কাজ করে তাদের তিনি আল্লাহ্‌র হয়ে শাস্তি দেন। এইজন্য তোমরা শাসনকর্তাদের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য। আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয়েই যে কেবল তাঁদের অধীনতা স্বীকার করবে তা নয়, তোমাদের বিবেক পরিষ্কার রাখবার জন্যও তা করবে। আর সেইজন্যই তো তোমরা খাজনা দিয়ে থাক, কারণ খাজনা-আদায়কারীরা তাঁদের কাজের দ্বারা আল্লাহ্‌র সেবা করছেন। যাঁর যা পাওনা তাঁকে তা দাও। যিনি খাজনা আদায় করেন তাঁকে খাজনা দাও; যিনি শুল্ক আদায় করেন তাঁকে শুল্ক দাও; যাঁকে শ্রদ্ধা করা উচিত তাঁকে শ্রদ্ধা কর; যাঁকে সম্মান করা উচিত তাঁকে সম্মান কর। অন্যের কাছে এক মহব্বতের ঋণ ছাড়া আর অন্য কোন ঋণ যেন তোমাদের না থাকে। যারা অন্যকে মহব্বত করে তারা মূসার শরীয়ত মেনে চলেছে। হুকুম আছে, “জেনা কোরো না, খুন কোরো না, চুরি কোরো না, লোভ কোরো না।” এই সব এবং এই রকম আরও অন্যান্য হুকুম মিলিয়ে এক কথায় বলা হয়েছে, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত কোরো।” মহব্বত করলে কেউ কারও ক্ষতি করে না। তাহলে দেখা যায়, মহব্বতের মধ্য দিয়েই সমস্ত শরীয়ত পালন করা হয়। এতক্ষণ যা বললাম, এখনকার সময় বুঝে সেইভাবেই চল। ঘুম থেকে জাগবার সময় হয়েছে, কারণ যখন আমরা ঈমান এনেছিলাম তখনকার চেয়ে বরং এখনই নাজাত পাবার সময় কাছে এসে গেছে। রাত প্রায় শেষ, ভোর হয়ে আসছে; এইজন্য এস, আমরা অন্ধকারের কাজ ছেড়ে দিয়ে নূরের অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিই। হৈ-হল্লা করে মদ খাওয়া এবং মাতলামিতে নয়, জেনা ও বিশৃঙ্খল জীবনে নয়, ঝগড়াঝাঁটি ও হিংসাতে নয়, কিন্তু যারা দিনের আলোয় চলাফেরা করে, এস, আমরা তাদের মত উপযুক্ত ভাবে জীবন কাটাই। তোমরা কাপড়ের মত করে হযরত ঈসা মসীহ্‌কে দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেল; গুনাহ্‌-স্বভাবের ইচ্ছা পূর্ণ করবার দিকে মন দিয়ো না। ঈমানে যে দুর্বল তাকে আপন করে নাও; তার মতামত নিয়ে তার সংগে তর্কাতর্কি কোরো না। কেউ মনে করে সে সব কিছুই খেতে পারে, কিন্তু যে ঈমানে দুর্বল সে কেবল শাক-সবজীই খায়। আমিষভোজী যেন নিরামিষভোজীকে তুচ্ছ না করে এবং নিরামিষভোজী যেন আমিষভোজীর দোষ না ধরে, কারণ আল্লাহ্‌ তো সেই দু’জনকেই আপন করে নিয়েছেন। তুমি কে, যে অন্যের চাকরের বিচার কর? সে দাঁড়িয়ে আছে, না পড়ে গেছে, তা তার মালিকই বুঝবেন। কিন্তু সে দাঁড়িয়েই থাকবে, কারণ প্রভুই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন। কারও কাছে কোন একটা দিন অন্য একটা দিনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আবার কেউ সব দিনকেই সমান মনে করে। এই ব্যাপারে কে কি করবে না করবে, তাতে যেন তার মন পুরোপুরিভাবে সায় দেয়। বিশেষ কোন একটা দিন যে পালন করে সে তো প্রভুকে খুশী করবার জন্যই তা করে। যে সব কিছু খায় সে প্রভুকে খুশী করবার জন্যই খায়, কারণ সে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানায়। যে সব কিছু খায় না সে প্রভুকে খুশী করবার জন্যই খায় না, আর সেও আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানায়। আমাদের মধ্যে কেউই নিজের জন্য বেঁচে থাকে না এবং কেউই নিজের জন্য মরে না। আমরা যদি বাঁচি তবে প্রভুর জন্যই বেঁচে থাকি, আর যদি মরি তবে প্রভুর জন্যই মরি। তাহলে আমরা বাঁচি বা মরি আমরা প্রভুরই। মসীহ্‌ মরেছিলেন এবং আবার জীবিতও হয়েছিলেন যেন তিনি জীবিত ও মৃত এই দু’য়েরই প্রভু হতে পারেন। তাহলে কেন তুমি তোমার ভাইয়ের দোষ ধরছ? আর কেনই বা তোমার ভাইকে তুচ্ছ করছ? বিচারের জন্য আমরা সবাই তো আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়াব। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “মাবুদ বলেন, ‘আমি আমার নাম করে বলছি, আমার সামনে প্রত্যেকেই হাঁটু পাতবে এবং আমাকে আল্লাহ্‌ বলে স্বীকার করবে।’ ” তাহলে দেখা যায়, আমাদের প্রত্যেককেই নিজের বিষয়ে আল্লাহ্‌র কাছে হিসাব দিতে হবে। এইজন্য আমরা যেন আর একে অন্যের দোষ না ধরি, বরং এমন কোন কাজ করব না বলে ঠিক করি, যা দেখে কোন ভাই মনে বাধা পেতে পারে বা গুনাহে পড়তে পারে। হযরত ঈসার সংগে যুক্ত হয়েছি বলে আমি ভাল করেই জানি যে, আসলে কোন খাবারই হারাম নয়, কিন্তু কেউ যদি কোন খাবারকে হারাম মনে করে তবে তা তারই কাছে হারাম। কোন খাবারের জন্য যদি তুমি তোমার ভাইয়ের মনে দুঃখ দাও তবে তো তুমি আর মহব্বতের মনোভাব নিয়ে চলছ না। যে ভাইয়ের জন্য মসীহ্‌ মরেছিলেন, খাবারের জন্য তার সর্বনাশ কোরো না। তোমাদের কাছে যা ভাল, কেউ যেন তার নিন্দা করতে না পারে। আল্লাহ্‌র রাজ্যে খাওয়া-দাওয়া বড় কথা নয়; বড় কথা হল, পাক-রূহের মধ্য দিয়ে সৎ পথে চলা আর শান্তি ও আনন্দ। যে এইভাবে মসীহের সেবা করে আল্লাহ্‌ তার উপর সন্তুষ্ট হন এবং লোকেও তাকে ভাল মনে করে। এইজন্য যা করলে শান্তি হয় এবং যার দ্বারা আমরা একে অন্যকে গড়ে তুলতে পারি, এস, আমরা তারই চেষ্টা করি। কোন খাবারের জন্য আল্লাহ্‌র কাজ নষ্ট কোরো না। সব খাবারই হালাল, কিন্তু কেউ কিছু খেয়ে যদি অন্যের মনে বাধার সৃষ্টি করে তবে তা খাওয়া তার পক্ষে অন্যায়। গোশ্‌ত খাওয়া, আংগুর-রস খাওয়া বা এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে তোমার কোন ভাই মনে বাধা পায়। এই বিষয়ে তুমি যা ভাল বলে বিশ্বাস কর তা আল্লাহ্‌ ও তোমার মধ্যেই রাখ। ভাল মনে করে কিছু করবার সময় যদি কারও বিবেক তাকে দোষী না করে তবে সে ধন্য। কিন্তু যদি কেউ সন্দেহ করে কোন কিছু খায় তবে সে দোষী, কারণ সে তার ঈমান মত কাজ করছে না। ঈমানের বিরুদ্ধে কোন কিছু করাই গুনাহ্‌। আমরা যারা ঈমানে সবল, আমরা যেন নিজেদের সন্তুষ্ট করবার দিকে লক্ষ্য না রেখে দুর্বল ঈমানদারদের দুর্বলতা সহ্য করি। ঈমানদার ভাইকে গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে আমরা প্রত্যেকেই যেন তার উপকারের জন্য তাকে সন্তুষ্ট করি। মসীহ্‌ও নিজেকে সন্তুষ্ট করেন নি। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “যারা তোমাকে অপমান করে তাদের করা সব অপমান আমার উপরেই পড়েছে।” পাক-কিতাবে যা কিছু আগে লেখা হয়েছিল তা আমাদের শিক্ষার জন্যই লেখা হয়েছিল, যাতে আমরা ধৈর্য ও উৎসাহ লাভ করি এবং তার ফলে আশ্বাস পাই। মসীহ্‌ ঈসার সংগে চলবার পথে ধৈর্য ও উৎসাহদাতা আল্লাহ্‌ তোমাদের সকলের মন এক করুন। তাহলে তোমরা মনে ও মুখে এক হয়ে আমাদের হযরত ঈসা মসীহের আল্লাহ্‌ ও পিতার প্রশংসা করতে পারবে। আল্লাহ্‌র গৌরব যাতে প্রকাশিত হয়, সেইজন্য মসীহ্‌ যেমন তোমাদের আপন করে নিয়েছেন তেমনি তোমরাও একে অন্যকে আপন করে নাও। আবার বলা হয়েছে, হে সমস্ত জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহ্‌র বান্দাদের সংগে তাঁর প্রশংসা কর। আবার আছে, হে সমস্ত জাতি, মাবুদের গৌরব কর; সমস্ত লোক তাঁর প্রশংসা করুক। আবার নবী ইশাইয়া বলেছেন, যিনি ইয়াসির মূল তিনি আসবেন, সব জাতিকে শাসন করবার জন্য তিনি দাঁড়াবেন। তাঁর উপরেই সব জাতির লোকেরা আশা রাখবে। যিনি আশা দান করেন সেই আল্লাহ্‌ তোমাদের ঈমানের মধ্য দিয়ে অসীম আনন্দ ও শান্তিতে তোমাদের পরিপূর্ণ করুন। তাহলে পাক-রূহের শক্তিতে তোমাদের দিলে আশা উপ্‌চে পড়বে। আমার ভাইয়েরা, আমি তোমাদের সম্বন্ধে এই কথা বিশ্বাস করি যে, তোমাদের দিল ভাল-ইচ্ছায় পূর্ণ, তোমাদের সব রকম জ্ঞান আছে, আর তোমরা একে অন্যকে উপদেশ দিতে পার। আমি আল্লাহ্‌র জন্য যে কাজ করছি তাতে মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে আমার গৌরব করবার অধিকার আছে। যেখানে মসীহের নাম কখনও বলা হয় নি সেখানে সুসংবাদ তবলিগ করাই আমার জীবনের লক্ষ্য, যেন অন্যের গাঁথা ভিত্তির উপরে আমাকে গড়ে তুলতে না হয়। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “যাদের কাছে তাঁর বিষয় বলা হয় নি তারা তা দেখতে পাবে, আর যারা কখনও শোনে নি তারা বুঝতে পারবে।” এইজন্যই আমি তোমাদের কাছে অনেক বার যেতে চেয়েও বাধা পেয়েছি। কিন্তু এখন এই সব এলাকায় আমার কাজ করবার আর জায়গা নেই। অনেক বছর ধরেই তোমাদের কাছে আমার যাবার ইচ্ছা, তাই এখন সেপন দেশে যাবার পথে আমি তোমাদের কাছে যেতে চাইছি। আমি আশা করি যে, ঐ পথ দিয়ে যাবার সময়ে তোমাদের কাছে যেতে পারব এবং তোমাদের সংগে কিছু সময় আনন্দে কাটাবার পর তোমরাই আমাকে সেপন দেশে যাবার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু এখন আমি আল্লাহ্‌র বান্দাদের সাহায্য করবার জন্য জেরুজালেমে যাচ্ছি, কারণ জেরুজালেমে আল্লাহ্‌র বান্দাদের মধ্যে যে সব গরীব লোক আছেন তাঁদের জন্য ম্যাসিডোনিয়া ও আখায়ার জামাতগুলোর লোকেরা কিছু চাঁদা তুলেছেন। এই চাঁদা তাঁরা খুশী হয়েই তুলেছেন। এছাড়া এই জামাতগুলো জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র বান্দাদের কাছে ঋণী, কারণ ইহুদীরা যখন তাদের রূহানী দোয়ার ভাগ অ-ইহুদীদের দিয়েছে তখন অ-ইহুদীদেরও উচিত সাংসারিক বিষয়ে ইহুদীদের সাহায্য করা। আমার এই কাজ শেষ হলে পর আমি যখন জানব যে, সেই চাঁদা ঠিকমত পৌঁছেছে তখন তোমাদের কাছ হয়ে আমি সেপনে যাব। আমি জানি যখন আমি তোমাদের কাছে যাব তখন মসীহের পরিপূর্ণ দোয়া নিয়েই যাব। ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে এবং পাক-রূহের দেওয়া মহব্বতের মধ্য দিয়ে আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, তোমরা আল্লাহ্‌র কাছে আমার জন্য আমার সংগে মুনাজাতের যুদ্ধ চালাতে থাক। তোমরা মুনাজাত কর, এহুদিয়াতে যারা আল্লাহ্‌কে অমান্য করে তাদের হাত থেকে যেন আমি রক্ষা পাই, আর জেরুজালেমের আল্লাহ্‌র বান্দারা যেন আমার এই সাহায্য গ্রহণ করেন। তখন ইন্‌শা-আল্লাহ্‌ আমি খুশী মনেই তোমাদের কাছে যেতে পারব এবং তোমাদের সংগে থেকে প্রাণ জুড়াব। শান্তিদাতা আল্লাহ্‌ তোমাদের সকলের সংগে সংগে থাকুন। আমিন। এবার আমি আমাদের বোন ফৈবীর বিষয় তোমাদের কাছে সুপারিশ করছি। তিনি কিংক্রিয়া শহরের জামাতের খেদমতকারিণী। আল্লাহ্‌র বান্দাদের যেভাবে আপন করে নেওয়া উচিত তাঁকে তোমরা প্রভুর নামে সেইভাবেই আপন করে নিয়ো। কোন ব্যাপারে যদি ফৈবী তোমাদের সাহায্য চান তবে তাঁকে সাহায্য কোরো, কারণ তিনি অনেক লোককে, এমন কি, আমাকেও সাহায্য করেছেন। প্রিষ্কিল্লা ও আকিলাকে আমার সালাম জানায়ো। তাঁরা মসীহ্‌ ঈসার কাজে আমার সংগে পরিশ্রম করেছেন। আমার প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের মৃত্যুর মুখে ফেলেছিলেন। কেবল আমি নই, কিন্তু সমস্ত অ-ইহুদী জামাতগুলোও তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁদের বাড়ীতে যারা জামাত হিসাবে একসংগে মিলিত হয় তাদেরও সালাম জানায়ো। এশিয়া প্রদেশে প্রথম যিনি মসীহ্‌কে গ্রহণ করেছিলেন আমার সেই প্রিয় বন্ধু ইপেনিতকে সালাম জানায়ো। মরিয়ম, যিনি তোমাদের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন, তাঁকে সালাম জানায়ো। আন্দ্রনীক্‌ ও যূনিয়কে সালাম জানায়ো। তাঁরা আমারই মত ইহুদী এবং আমার সংগে তাঁরাও জেলে বন্দী ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে তাঁরা খুব সম্মানিত লোক। তাঁরা আমার আগেই মসীহের উপর ঈমান এনেছিলেন। প্রভুর সংগে যুক্ত আমার প্রিয় বন্ধু আম্‌প্লিয়াতকে সালাম জানায়ো। উর্বাণ, যিনি আমাদের সংগে মসীহের জন্য কাজ করেন, তাঁকে আর আমার প্রিয় বন্ধু স্তাখিস্‌কে সালাম জানায়ো। আপিল্লিস্‌কে সালাম জানায়ো। মসীহের লোক হিসাবে তাঁকে যাচাই করে দেখা হয়েছে। আরিষ্টবুলের বাড়ীর লোকদের সালাম জানায়ো। হেরোদিয়োন, যিনি আমার মতই ইহুদী, তাঁকে সালাম জানায়ো। নার্কিসের বাড়ীর মধ্যে যাঁরা প্রভুর বান্দা তাঁদের সালাম জানায়ো। ত্রুফেণা ও ত্রুফোষাকে সালাম জানায়ো। এই স্ত্রীলোকেরা প্রভুর জন্য পরিশ্রম করেন। স্নেহের পর্ষিসকেও সালাম জানায়ো। এই স্ত্রীলোকটিও প্রভুর জন্য অনেক কাজ করেছেন। মসীহের উপর ভাল ঈমানদার বলে যাঁর সুনাম আছে সেই রূফকে ও তাঁর মাকে সালাম জানায়ো। তাঁর মা আমার কাছে আমার মায়ের মতই। অসুংক্রিত, ফ্লিগোন, হের্মেস, পাত্রোবাস, হের্মাস্‌ এবং তাঁদের সংগে অন্যান্য ঈমানদার ভাইদেরও সালাম জানায়ো। ফিললগ ও যুলিয়া, নিরীয় ও তাঁর বোন, ওলুমপ ও তাঁদের সংগে আল্লাহ্‌র যে সব বান্দা আছেন তাঁদের সবাইকে সালাম জানায়ো। মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা একে অন্যকে সালাম জানায়ো। মসীহের সমস্ত জামাতগুলো তোমাদের সালাম জানাচ্ছে। ভাইয়েরা, তোমরা যে শিক্ষা পেয়েছ তার বিরুদ্ধে শিক্ষা দিয়ে যারা দলাদলি ও বাধার সৃষ্টি করে, তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। তোমরা তাদের কাছ থেকে দূরে থেকো, কারণ এই সব লোকেরা আমাদের হযরত মসীহের সেবা না করে বরং নিজেদের পেটের সেবাই করছে। মিষ্টি ও খোশামোদের কথা বলে তারা সরলমনা লোকদের ঠকাচ্ছে। তোমাদের বাধ্যতার কথা সবাই শুনেছে, আর সেইজন্য আমি তোমাদের উপর খুশী হয়েছি। আমি চাই যেন তোমরা ভালকে চিনে গ্রহণ কর এবং খারাপী থেকে দূরে থাক। শান্তিদাতা আল্লাহ্‌ শীঘ্রই শয়তানকে তোমাদের পায়ের নীচে ফেলে গুঁড়িয়ে দেবেন। আমাদের হযরত ঈসার রহমত তোমাদের উপরে থাকুক। আমার সংগে যিনি কাজ করেন সেই তীমথিয় তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন; লুকিয়, যাসোন ও সোষিপাত্রও তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। তাঁরাও আমার মত ইহুদী জাতির লোক। আমি, তর্তিয়, পৌলের এই চিঠিখানা লিখছি। প্রভুর বান্দা হিসাবে আমিও তোমাদের সালাম জানাচ্ছি। ঈসা মসীহের বিষয়ে যে সুসংবাদ আমি তবলিগ করি সেই সুসংবাদের মধ্য দিয়ে তোমাদের স্থির রাখবার ক্ষমতা আল্লাহ্‌র আছে। অনেক যুগ ধরে আল্লাহ্‌ তাঁর গোপন উদ্দেশ্যের বিষয় কাউকে বলেন নি, কিন্তু এখন সুসংবাদের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত হয়েছে এবং সেইমত আমি তবলিগ করছি। অনন্ত আল্লাহ্‌র হুকুম মত নবীদের লেখার মধ্য দিয়ে সব জাতির লোকদের কাছে তা জানানো হয়েছে, যেন তারা মসীহের উপর ঈমান এনে আল্লাহ্‌র বাধ্য হতে পারে। একমাত্র তিনিই আল্লাহ্‌, তিনিই জ্ঞানী। ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে চিরকাল তাঁরই প্রশংসা হোক। আমিন। ॥ভব আমাদের পিতা আল্লাহ্‌ আর হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমি সব সময় তোমাদের জন্য আমার আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে থাকি, কারণ মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে তোমরা আল্লাহ্‌র রহমত পেয়েছ। সেই রহমত এই যে, তোমরা মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে সব দিক থেকে, অর্থাৎ সব কিছু বলবার ক্ষমতায় ও জ্ঞানে বেড়ে উঠেছ, কারণ মসীহের সম্বন্ধে আমাদের সাক্ষ্য তোমাদের দিলে গাঁথা হয়ে আছে। সেইজন্যই যখন তোমরা আমাদের হযরত ঈসা মসীহের প্রকাশিত হবার জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করে আছ তখন আল্লাহ্‌র দেওয়া কোন দানের অভাব তোমাদের হচ্ছে না। আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ই শেষ পর্যন্ত তোমাদের স্থির রাখবেন, যার ফলে তাঁর আসবার দিনে তোমরা সব রকম নিন্দার বাইরে থাকবে। আল্লাহ্‌ বিশ্বাসযোগ্য; তিনিই তোমাদের ডেকেছেন যেন তাঁর পুত্র আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ ও তোমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ থাকে। ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের হয়ে আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি যে, তোমরা সকলে এক হও। তোমাদের মধ্যে কোন দলাদলি না থাকুক, বরং তোমরা একমন ও একমত হও। আমার ভাইয়েরা, তোমাদের সম্বন্ধে ক্লোয়ীর বাড়ীর লোকদের কাছে এই খবর পেলাম যে, তোমাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ রয়েছে। আমি এই কথা বলতে চাইছি যে, তোমাদের মধ্যে কেউ বলে, “আমি পৌলের দলের”; কেউ বলে, “আমি আপল্লোর দলের”; কেউ বলে, “আমি পিতরের দলের”; আবার কেউ বলে, “আমি মসীহের দলের।” কিন্তু মসীহ্‌কে কি ভাগ করা হয়েছে? পৌলকে কি তোমাদের জন্য ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল? তোমরা কি পৌলের নামে তরিকাবন্দী নিয়েছ? আমি আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞ যে, ক্রীষ্প আর গাইয় ছাড়া তোমাদের আর কাউকেই আমি তরিকাবন্দী দিই নি, যাতে কেউ বলতে না পারে যে, তোমরা আমার নামে তরিকাবন্দী নিয়েছ। অবশ্য স্তিফানের পরিবারের লোকদেরও আমি তরিকাবন্দী দিয়েছি, কিন্তু তা ছাড়া আর কাউকে তরিকাবন্দী দিয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। মসীহ্‌ আমাকে তরিকাবন্দী দিতে পাঠান নি বরং সুসংবাদ তবলিগ করবার জন্যই পাঠিয়েছেন। সেই সুসংবাদ তিনি আমাকে জ্ঞানীদের ভাষায় তবলিগ করতে পাঠান নি, যেন মসীহের ক্রুশীয় মৃত্যু শক্তিহীন হয়ে না পড়ে। যারা ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে মসীহের সেই ক্রুশীয় মৃত্যুর কথা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়; কিন্তু আমরা যারা নাজাতের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের কাছে তা আল্লাহ্‌র শক্তি। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “আমি জ্ঞানীদের জ্ঞান নষ্ট করব, বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি বিফল করব।” কিন্তু জ্ঞানী লোক কোথায়? আলেমই বা কোথায়? আর যার তর্ক করবার ক্ষমতা আছে এই যুগের সেই রকম লোকই বা কোথায়? এই দুনিয়ার জ্ঞান যে কেবল মূর্খতা তা কি আল্লাহ্‌ দেখান নি? আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের জ্ঞানে স্থির করেছেন বলেই দুনিয়া তার নিজের জ্ঞান দিয়ে আল্লাহ্‌কে জানতে পারে নি। এইজন্য সুসংবাদের মূর্খতা দিয়ে ঈমানদারদের নাজাত করা আল্লাহ্‌ ভাল মনে করলেন। ইহুদীরা চিহ্ন হিসাবে অলৌকিক কাজ দেখতে চায়, গ্রীকেরা জ্ঞানের তালাশ করে, কিন্তু আমরা ক্রুশের উপরে হত্যা করা মসীহের কথা তবলিগ করি। সেই কথা ইহুদীদের কাছে একটা বাধা আর অ-ইহুদীদের কাছে মূর্খতা, কিন্তু ইহুদী হোক আর গ্রীকই হোক, আল্লাহ্‌ যাদের ডেকেছেন তাদের কাছে সেই মসীহ্‌ই আল্লাহ্‌র শক্তি আর আল্লাহ্‌র জ্ঞান। আল্লাহ্‌র মধ্যে যা মূর্খতা বলে মনে হয় তা মানুষের জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশী জ্ঞানপূর্ণ, আর যা দুর্বলতা বলে মনে হয় তা মানুষের শক্তির চেয়ে অনেক বেশী শক্তিপূর্ণ। ভাইয়েরা, তোমাদের যখন ডাকা হয়েছিল তখন তোমরা কি রকমের লোক ছিলে সেই কথা ভেবে দেখ। মানুষের বিচারে তোমাদের মধ্যে অনেকেই যে জ্ঞানী বা ক্ষমতাশালী বা উঁচু বংশের তা নয়। কিন্তু দুনিয়া যা মূর্খতা বলে মনে করে আল্লাহ্‌ তা-ই বেছে নিয়েছেন যেন জ্ঞানীরা লজ্জা পায়। দুনিয়া যা দুর্বল বলে মনে করে আল্লাহ্‌ তা-ই বেছে নিয়েছেন যেন যা শক্তিশালী তা শক্তিহীন হয়। দুনিয়া যা নীচ ও তুচ্ছ বলে মনে করে, এমন কি, দুনিয়ার চোখে যা কিছুই নয় আল্লাহ্‌ তা-ই বেছে নিয়েছেন যেন দুনিয়ার চোখে যা মূল্যবান তা মূল্যহীন হতে পারে। তিনি ঐ সব বেছে নিয়েছেন যেন তাঁর সামনে কোন মানুষ গর্ব করতে না পারে। মসীহ্‌ ঈসার সংগে তোমরা যে যুক্ত আছ তা আল্লাহ্‌ থেকেই হয়েছে। ঈসা মসীহ্‌ই আমাদের কাছে আল্লাহ্‌র দেওয়া জ্ঞান; তিনিই আমাদের ধার্মিকতা, পবিত্রতা ও মুক্তি। এইজন্য পাক-কিতাবের কথামত, “যে গর্ব করে সে মাবুদকে নিয়েই গর্ব করুক।” ভাইয়েরা, তোমাদের কাছে গিয়ে আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ করবার সময় আমি সুন্দর ভাষা ব্যবহার করি নি বা খুব জ্ঞানী লোকের মত কথা বলি নি। আমি ঠিক করেছিলাম, তোমাদের কাছে থাকবার সময়ে আমি ঈসা মসীহ্‌কে, অর্থাৎ ক্রুশের উপরে হত্যা করা ঈসা মসীহ্‌কে জানা ছাড়া আর কিছুই জানব না। যখন তোমাদের কাছে ছিলাম তখন আমি নিজেকে দুর্বল মনে করতাম এবং ভয়ে খুবই কাঁপতাম। আমার তবলিগ ও আমার দেওয়া সংবাদের মধ্যে লোকদের ভাসিয়ে নেবার মত কোন জ্ঞানপূর্ণ যুক্তি-তর্ক ছিল না বরং পাক-রূহের শক্তিই তাতে দেখা গিয়েছিল, যাতে তোমাদের ঈমান মানুষের জ্ঞানের উপর ভরসা না করে আল্লাহ্‌র শক্তির উপর ভরসা করে। যারা ঈসায়ী জীবনে পরিপক্ক তাদের কাছে অবশ্য আমরা জ্ঞানের কথা বলি; কিন্তু সেই জ্ঞান এই দুনিয়ার নয়, কিংবা এই দুনিয়ার নেতাদেরও নয় যারা ক্ষমতাশূন্য হয়ে পড়ছে। আসলে আমরা আল্লাহ্‌র জ্ঞানপূর্ণ গোপন উদ্দেশ্যের কথাই বলি। সেই উদ্দেশ্য লুকানো ছিল এবং দুনিয়া সৃষ্টির আগেই আল্লাহ্‌ তা স্থির করে রেখেছিলেন যেন আমরা তাঁর মহিমার ভাগী হতে পারি। এই যুগের নেতাদের মধ্যে কেউই তা বোঝে নি; যদি তা বুঝত তাহলে সেই মহিমাপূর্ণ প্রভুকে ক্রুশের উপরে হত্যা করত না। কিন্তু পাক-কিতাবের কথামত, “আল্লাহ্‌কে যারা মহব্বত করে তাদের জন্য তিনি যা যা ঠিক করে রেখেছেন, সেগুলো কেউ চোখেও দেখে নি, কানেও শোনে নি এবং মনেও ভাবে নি।” কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর রূহের মধ্য দিয়ে সেগুলো আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন, কারণ পাক-রূহের অজানা কিছুই নেই; এমন কি, তিনি আল্লাহ্‌র গভীর বিষয়ও জানেন। মানুষের মধ্যে এমন কে আছে, যে অন্য মানুষের মনের কথা জানতে পারে? মানুষের মধ্যে যে রূহ্‌ আছে সে-ই কেবল তার নিজের মনের কথা জানে। সেই রকম, আল্লাহ্‌র রূহ্‌ ছাড়া আল্লাহ্‌র মনের কথা অন্য কেউ জানতে পারে না। আমরা দুনিয়ার রূহ্‌কে পাই নি, বরং আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তাঁর রূহ্‌কে পেয়েছি, যেন আল্লাহ্‌ আমাদের যে সব দান দিয়েছেন তা বুঝতে পারি; আর সেই দানগুলোর কথাই আমরা বলি। তা বলবার জন্য আমরা যে সব কথা ব্যবহার করি তা মানুষের জ্ঞান থেকে শিক্ষা পেয়ে বলি না, কিন্তু পাক-রূহের দ্বারা শিক্ষা পেয়েই বলি। রূহানী সত্য ব্যাখ্যা করবার জন্য আমরা রূহানী কথাই ব্যবহার করি। যে লোক রূহানী নয় সে আল্লাহ্‌র রূহের কাছ থেকে যা আসে তা গ্রহণ করে না, কারণ সেগুলো তার কাছে মুর্খতা। সেগুলো সে বুঝতে পারে না, কারণ পাক-রূহ্‌ শিক্ষা না দিলে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় না। যে লোক রূহানী সে সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখে, কিন্তু কেউ তাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারে না। পাক-কিতাবে লেখা আছে, কে মাবুদের মন বুঝতে পেরেছে যে, সে তাঁকে উপদেশ দিতে পারে? কিন্তু মসীহের মন আমাদের দিলে রয়েছে। ভাইয়েরা, যারা রূহানী সেই রকম লোকদের কাছে যেভাবে কথা বলা উচিত, আমি তোমাদের কাছে সেইভাবে কথা বলতে পারি নি, বরং যারা গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীনে আছে তাদের কাছে যেভাবে কথা বলা উচিত, সেইভাবেই তোমাদের কাছে কথা বলেছিলাম। ঈসায়ী জীবনে তোমরা তো একেবারে শিশুর মত, তাই তোমাদের কাছে সেইভাবেই কথা বলেছিলাম। শক্ত খাবার না দিয়ে আমি তোমাদের দুধ খেতে দিয়েছিলাম, কারণ তখন তোমরা সেই শক্ত খাবার গ্রহণ করবার অবস্থায় ছিলে না। আর এখনও তোমরা সেই অবস্থায় নেই, কারণ তোমরা এখনও গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীনে আছ। তোমাদের মধ্যে যখন হিংসা আর ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে তখন কি তোমরা গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন নও? আর তোমাদের চালচলন কি একেবারে সাধারণ লোকদের মতই নয়? তোমাদের মধ্যে যখন একজন বলে সে পৌলের দলের এবং আর একজন বলে সে আপল্লোর দলের তখন তোমরা কি একেবারে সাধারণ লোকদের মত নও? আপল্লো কে? আর পৌলই বা কে? আমরা তো সেবাকারী মাত্র যাদের মধ্য দিয়ে তোমরা ঈমানের পথে এসেছ। প্রভুই আমাদের প্রত্যেককে যার যার কাজ দিয়েছেন। আমি বীজ লাগিয়েছিলাম, আপল্লো তাতে পানি দিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্‌ তা বাড়িয়ে তুলেছিলেন। সেইজন্য যে বীজ লাগায় বা যে তাতে পানি দেয় সে কিছুই নয়; কিন্তু আল্লাহ্‌, যিনি বাড়িয়ে তোলেন, তিনিই সব। যে বীজ লাগায় আর যে পানি দেয় তাদের উদ্দেশ্য একই, কিন্তু প্রত্যেকে যার যার পরিশ্রম হিসাবে পুরস্কার পাবে, কারণ আমরা দু’জনই আল্লাহ্‌র সংগে কাজ করছি। তোমরা আল্লাহ্‌রই ক্ষেত, আল্লাহ্‌রই তৈরী দালান। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে বিশেষ রহমত আমি পেয়েছি তার দ্বারাই ওস্তাদ রাজমিস্ত্রির মত আমি ভিত্তি গেঁথেছি, আর তার উপরে অন্যেরা দালান তৈরী করছে। কিন্তু কে কিভাবে তৈরী করছে সেই বিষয়ে সে সাবধান হোক। যে ভিত্তি আগেই গাঁথা হয়ে গেছে সেটা ছাড়া আর কোন ভিত্তি কেউ গাঁথতে পারে না। ঈসা মসীহ্‌ই হলেন সেই ভিত্তি। সেই ভিত্তির উপরে সোনা, রূপা, দামী পাথর, কাঠ, খড় বা বিচালি দিয়ে যদি লোকে গড়ে তোলে, তবে কে কি রকম কাজ করেছে তা ভাল করে দেখা যাবে। রোজ হাশরেই তা প্রকাশিত হবে, কারণ সেই দিনের প্রকাশ আগুনের মধ্য দিয়েই হবে। কার কাজ কি রকম তা আগুনই যাচাই করবে। যে যা গড়ে তুলেছে তা যদি টিকে থাকে তবে সে পুরস্কার পাবে; আর যদি তা পুড়ে যায় তবে তার ক্ষতি হবে। অবশ্য সে নিজে নাজাত পাবে, কিন্তু তার অবস্থা এমন লোকের মত হবে যে আগুনের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসেছে। তোমরা কি জান না যে, তোমরা আল্লাহ্‌র থাকবার ঘর আর আল্লাহ্‌র রূহ্‌ তোমাদের মধ্যে বাস করেন? যদি কেউ আল্লাহ্‌র থাকবার ঘর নষ্ট করে তবে আল্লাহ্‌ও তাকে নষ্ট করবেন, কারণ তাঁর থাকবার ঘর পবিত্র, আর তোমরাই সেই ঘর। তোমরা কেউ নিজেকে ফাঁকি দিয়ো না। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এই যুগের চিন্তাধারা অনুসারে নিজেকে জ্ঞানী মনে করে তবে সে মূর্খ হোক যেন সে সত্যিকারের জ্ঞানী হতে পারে, কারণ আল্লাহ্‌র চোখে এই দুনিয়ার জ্ঞান কেবল মূর্খতা। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “আল্লাহ্‌ জ্ঞানীদের তাদের ছল-চাতুরীতে ধরেন।” আবার লেখা আছে, “জ্ঞানীদের সমস্ত চিন্তাই যে নিষ্ফল তা মাবুদ জানেন।” সেইজন্য তোমরা কেউ কোন মানুষকে নিয়ে গর্ব কোরো না, কারণ সবই তো তোমাদের। পৌল, আপল্লো, পিতর, এই দুনিয়া, জীবন, মৃত্যু, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সব কিছু, সবই তোমাদের; তোমরা মসীহের আর মসীহ্‌ আল্লাহ্‌র। লোকে আমাদের মনে করুক যে, আমরা মসীহের সেবাকারী এবং আমাদের উপর আল্লাহ্‌র গোপন সত্য জানাবার ভার দেওয়া হয়েছে। যাদের উপর ভার দেওয়া হয়েছে তাদের দেখাতে হবে যে, তারা বিশ্বাসযোগ্য। আমার বিচার তোমরাই কর বা আদালত করুক, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না; এমন কি, আমিও আমার নিজের বিচার করি না। আমার বিবেক পরিষ্কার, কিন্তু তাতে এটা প্রমাণ হচ্ছে না যে, আমি নির্দোষ। প্রভুই আমার বিচার করেন। সেইজন্য প্রভুর আসবার আগে, অর্থাৎ সেই ঠিক করা সময়ের আগে তোমরা কোন কিছুরই দোষ ধরতে যেয়ো না। অন্ধকারে যা লুকানো আছে তিনিই তখন তা আলোতে আনবেন এবং মানুষের দিলের গোপন উদ্দেশ্যগুলোও প্রকাশ করবেন। সেই সময়ে আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই যে যার পাওনা প্রশংসা পাবে। ভাইয়েরা, তোমাদের উপকারের জন্য আমি আমার নিজের আর আপল্লোর উদাহরণ দিয়ে এই সব কথা বললাম, যেন তোমরা আমাদের কাছ থেকে শিখতে পার যে, পাক-কিতাবে যা লেখা আছে তার বাইরে যেতে নেই। তাহলে তোমরা একজনকে ফেলে আর একজনকে নিয়ে অহংকারে ফুলে উঠবে না। তুমি যে অন্যদের চেয়ে বিশেষ কিছু তা তো কেউ মনে করে না। তোমার এমন কি আছে যা তুমি দান হিসাবে পাও নি? আর যদি তুমি তা পেয়েই থাক তবে পাও নি বলে কেন গর্ব করছ? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা আগেই সব কিছু পেয়ে গেছ, আগেই ধনী হয়েছ, আর আমাদের বাদ দিয়েই বাদশাহ্‌ হয়ে বসে আছ। অবশ্য তোমরা বাদশাহ্‌ হলে ভালই হত, তাহলে আমরাও তোমাদের সংগে বাদশাহ্‌ হতে পারতাম। হত্যা করা হবে বলে যাদের মিছিলের শেষে রাখা হয়, আমার মনে হয় আল্লাহ্‌ আমাদের, অর্থাৎ সাহাবীদের ঠিক তেমনি সকলের শেষে রেখেছেন। আমরা সারা দুনিয়ার কাছে, অর্থাৎ ফেরেশতা আর লোকদের কাছে যেন ঠাট্টার পাত্র হয়েছি। আমরা মসীহের জন্য মূর্খ হয়েছি, আর তোমরা মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে বুদ্ধিমান হয়েছ। আমরা দুর্বল কিন্তু তোমরা বলবান। তোমরা অনেক সম্মান পেয়েছ আর আমরা অসম্মান পেয়েছি। এই মুহূর্ত পর্যন্তও আমরা খিদে আর পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের কাপড়ের অভাব আছে, আমাদের সংগে নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হচ্ছে, আমাদের ঘর-বাড়ী নেই। আমরা নিজের হাতে কঠিন পরিশ্রম করছি। যখন লোকে আমাদের গালাগালি দেয় তখন আমরা তাদের উন্নতি কামনা করি; যখন তারা আমাদের কষ্ট দেয় তখন আমরা তা সহ্য করি; যখন তারা আমাদের নিন্দা করে তখন নম্রভাবে আমরা তাদের জবাব দিই। এখনও পর্যন্ত আমরা দুনিয়ার আবর্জনার মত, দুনিয়ার জঞ্জাল হয়েই রয়েছি। আমি তোমাদের লজ্জা দেবার জন্য এই সব লিখছি না, বরং আমার প্রিয় সন্তান হিসাবে সাবধান করবার জন্যই লিখছি। মসীহের বিষয়ে শিক্ষা দেবার লোক হয়তো তোমাদের হাজার হাজার থাকতে পারে, কিন্তু পিতা তোমাদের অনেক নেই; আমিই সুসংবাদের মধ্য দিয়ে ঈসায়ী জীবনে তোমাদের পিতা হয়েছি। সেইজন্যই আমি বিশেষভাবে তোমাদের অনুরোধ করছি, আমি যা করি তোমরাও তা-ই কর; আর এইজন্যই আমি তীমথিয়কে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি। ঈমানদার হিসাবে তিনি আমার প্রিয় আর বিশ্বস্ত সন্তান। ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে আমার শিক্ষা ও কাজ কি রকম, তিনি তা তোমাদের মনে করিয়ে দেবেন। প্রত্যেক জায়গার প্রত্যেক জামাতে আমি সেই সব বিষয়ে একই রকম শিক্ষা দিয়ে থাকি। আমি তোমাদের কাছে আসব না মনে করে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অহঙ্কারে ফুলে উঠেছে। কিন্তু আমি শীঘ্রই তোমাদের কাছে আসব, ইন্‌শা-আল্লাহ্‌। যারা অহঙ্কারে ফুলে উঠেছে তাদের কথাবার্তা শুনতে আসব না, কিন্তু তাদের শক্তি কতখানি তা দেখতে আসব। আল্লাহ্‌র রাজ্য তো কথার ব্যাপার নয়, তা শক্তির ব্যাপার। তোমাদের ইচ্ছা কি? আমি তোমাদের কাছে কি নিয়ে আসব- বেত, না ভালবাসা আর নরম মনোভাব? শোনা যাচ্ছে, তোমাদের মধ্যে জেনার গুনাহ্‌ আছে, আর সেই জেনা এমন জঘন্য রকমের যে, অ-ইহুদীরা পর্যন্ত তা করে না। এমন কি, একজন তার সৎমাকে নিজের স্ত্রীর মত করে রেখেছে। আর এর পরেও তোমরা অহঙ্কার করছ! এর চেয়ে তোমাদের কি দুঃখ করা এবং যে এই কাজ করেছে তাকে তোমাদের মধ্য থেকে বের করে দেওয়া উচিত ছিল না? আমি শরীরে উপস্থিত না থাকলেও রূহে তোমাদের সংগে আছি। যে এই রকম কাজ করেছে, উপস্থিত থাকা লোকের মতই আমি তার বিচার আগেই করে রেখেছি। আমার বিচার এই যে, আমাদের হযরত ঈসার নামে যখন তোমরা এক জায়গায় মিলিত হবে আর আমিও রূহে তোমাদের সংগে থাকব এবং হযরত ঈসার শক্তি আমাদের উপর থাকবে, তখন সেই লোককে শয়তানের হাতে দিয়ে দিতে হবে, যেন তার শরীর ধ্বংস হয় কিন্তু রূহ্‌ হযরত ঈসার আসবার দিনে নাজাত পায়। গর্ব করা তোমাদের পক্ষে ভাল নয়। তোমরা কি জান না যে, একটুখানি খামি একটা গোটা ময়দার তালকে ফাঁপিয়ে তোলে? তোমাদের মধ্য থেকে সেই পুরানো খামি ফেলে দাও, যেন তোমরা একটা নতুন খামিহীন ময়দার তাল হতে পার; আর আসলেও তোমরা তা-ই। আমাদের উদ্ধার-ঈদের মেষ-শাবক মসীহ্‌কে কোরবানী দেওয়া হয়েছে। সেইজন্য পুরানো খামি, অর্থাৎ হিংসা ও খারাপী দিয়ে নয়, বরং এস, আমরা খামিহীন রুটি, অর্থাৎ সরলতা ও সত্য দিয়ে ঈদটি পালন করি। আমার চিঠিতে আমি তোমাদের কাছে লিখেছিলাম, তোমরা যেন খারাপ চরিত্রের লোকদের সংগে মেলামেশা না কর। এই দুনিয়ার খারাপ চরিত্রের লোক, লোভী, জো"েচার বা যারা মূর্তি পূজা করে তাদের কথা অবশ্য আমি বলি নি, কারণ তাহলে তোমাদের তো এই দুনিয়ার বাইরে চলে যেতে হয়। আসলে আমি যা লিখেছিলাম তার অর্থ এই- যদি কেউ নিজেকে ঈমানদার ভাই বলে অথচ সে খারাপ চরিত্রের লোক বা লোভী হয়, মূর্তি পূজা করে, অন্যের নিন্দা করে, মাতাল বা জো"েচার হয়, তবে তার সংগে মেলামেশা কোরো না। এমন কি, তার সংগে খাওয়া-দাওয়াও কোরো না। জামাতের বাইরের লোকদের বিচার করবার জন্য আমার কি দায় পড়েছে? কিন্তু জামাতের ভিতরের লোকদের বিচার করা কি তোমাদেরই উচিত নয়? যারা বাইরের তাদের বিচার আল্লাহ্‌ করবেন। পাক-কিতাবের কথামত, “তোমাদের মধ্য থেকে সেই খারাপ লোককে বের করে দাও।” তোমাদের মধ্যে কারও যদি কোন ঈমানদার ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করবার কোন কারণ থাকে, তবে সে কোন্‌ সাহসে আল্লাহ্‌র বান্দাদের কাছে না গিয়ে যারা আল্লাহ্‌র নয় তাদের কাছে গিয়ে বিচার চায়? তোমরা কি জান না যে, আল্লাহ্‌র বান্দারাই দুনিয়ার বিচার করবে? যখন তোমরা দুনিয়ার বিচার করবে তখন তোমরা কি সামান্য বিষয়ের বিচার করতে পার না? তোমরা কি জান না আমরা ফেরেশতাদেরও বিচার করব? তা-ই যদি হয় তবে এই দুনিয়ার বিষয় তো সামান্য কথা! যদি তোমাদের এই রকম কোন নালিশ থাকে তবে যারা জামাতের লোক নয় তাদেরই কি তোমরা বিচারক হবার জন্য ঠিক করে থাক? তোমাদের লজ্জা দেবার জন্য আমি এই কথা বলছি। তোমাদের মধ্যে সত্যিই কি এমন কোন জ্ঞানী লোক নেই, যে ভাইদের মধ্যে গোলমালের মীমাংসা করে দিতে পারে? তার বদলে ভাই কিনা ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে যায়, আর তাও আবার অ-ঈমানদারদের সামনে! আসলে তোমরা যে একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা করছ তাতে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, তোমরা হেরে গেছ। তার চেয়ে বরং অন্যায় সহ্য কর না কেন? ঠকে যাও না কেন? তার বদলে তোমরাই অন্যায় করছ, তোমরাই ঠকা"ছ, আর তা তোমাদের ভাইদের প্রতিই করছ! যারা অন্যায় করে তারা যে আল্লাহ্‌র রাজ্যের অধিকারী হবে না, তা কি তোমরা জান না? তোমরা ভুল কোরো না। যাদের চরিত্র খারাপ, যারা মূর্তি পূজা করে, যারা জেনা করে, যারা পুরুষ-বেশ্যা, যে পুরুষেরা সমকামী, যারা চোর, লোভী, মাতাল, যারা পরের নিন্দা করে এবং যারা জো"েচার তারা আল্লাহ্‌র রাজ্যের অধিকারী হবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই রকমই ছিলে, কিন্তু হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে আর আমাদের আল্লাহ্‌র রূহের মধ্য দিয়ে তোমাদের ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে, পবিত্র করা হয়েছে এবং ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলে, “কোন কিছু করা আমার পক্ষে হারাম নয়।” তা ঠিক, তবে সব কিছুই যে মানুষের উপকার করে, তা নয়। কোন কিছু করা আমার পক্ষে হারাম নয় বটে, কিন্তু আমি কোন কিছুরই গোলাম হব না। আবার কেউ কেউ এই কথাও বলে, “খাবার পেটের জন্য আর পেট খাবারের জন্য।” খুব ভাল কথা, কিন্তু এই দু’টাই একদিন আল্লাহ্‌ বাতিল করে দেবেন। শরীর জেনা করবার জন্য নয় বরং তা প্রভুরই জন্য, আর প্রভু শরীরের জন্য। আল্লাহ্‌ তাঁর শক্তির দ্বারা প্রভুকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছেন এবং তিনি আমাদেরও জীবিত করবেন। তোমরা কি জান না যে, তোমাদের শরীর মসীহের শরীরের অংশ? তাহলে আমি কি মসীহের শরীরের অংশ নিয়ে বেশ্যার শরীরের সংগে যুক্ত করব? কখনও না। তোমরা কি জান না, বেশ্যার সংগে যে যুক্ত হয় সে তার সংগে এক শরীর হয়? কারণ কিতাবে লেখা আছে, “তারা দু’জন এক শরীর হবে।” কিন্তু যে কেউ প্রভুর সংগে যুক্ত হয় সে তাঁর সংগে রূহে এক হয়। সমস্ত রকম জেনা থেকে পালিয়ে যাও। মানুষ অন্য যে সব গুনাহ্‌ করে তা তার শরীরের বাইরে করে, কিন্তু যে জেনা করে সে নিজের শরীরের বিরুদ্ধেই গুনাহ্‌ করে। তোমরা কি জান না, তোমাদের দিলে যিনি বাস করেন এবং যাঁকে তোমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পেয়েছ, সেই পাক-রূহের থাকবার ঘরই হল তোমাদের শরীর? তোমরা তোমাদের নিজেদের নও; অনেক দাম দিয়ে তোমাদের কেনা হয়েছে। তাই আল্লাহ্‌র গৌরবের জন্য তোমাদের শরীর ব্যবহার কর। তোমরা আমাকে যে সব বিষয় সম্বন্ধে লিখেছ এবার তার জবাব দিচ্ছি। যদি কেউ বিয়ে না করে তবে সে ভালই করে; কিন্তু চারদিকে অনেক জেনা হচ্ছে, সেইজন্য প্রত্যেক পুরুষের নিজের স্ত্রী থাকুক আর প্রত্যেক স্ত্রীর নিজের স্বামী থাকুক। শরীরের দিক থেকে স্ত্রীর যা পাওনা, তার স্বামী তাকে তা দিক; সেইভাবে স্ত্রীও স্বামীকে দিক। স্ত্রীর শরীর তার নিজের নয়, তার স্বামীর। একইভাবে স্বামীর শরীর তার নিজের নয়, তার স্ত্রীর। একে অন্যের সংগে সহবাস করতে অস্বীকার কোরো না; তবে কেবল মুনাজাত করতে সুযোগ পাবার জন্য একমত হয়ে কিছুকাল আলাদা থাকতে পার। তার পরে আবার একসংগে মিলিত হয়ো, যেন নিজেদের দমনের অভাবে শয়তান তোমাদের গুনাহের দিকে টানতে না পারে। এই কথা আমি তোমাদের হুকুম দিয়ে বলছি না বরং অনুমতি দিয়েই বলছি। যদি সবাই আমার মত হত! কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এক একজন এক একটা দান পেয়েছে। একজনের দান এক রকম, আবার অন্যজনের দান আর এক রকম। অবিবাহিত আর বিধবাদের আমি বলছি, তারা যদি আমার মত থাকতে পারে তবে তাদের পক্ষে তা ভাল। কিন্তু যদি তারা নিজেদের দমন করতে না পারে তবে বিয়ে করুক, কারণ শরীরের কামনায় জ্বলে-পুড়ে মরবার চেয়ে বরং বিয়ে করা অনেক ভাল। যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের আমি এই হুকুম দিচ্ছি- অবশ্য আমি দিচ্ছি না, প্রভুই দিচ্ছেন্ত স্ত্রী যেন স্বামীর কাছ থেকে চলে না যায়। কিন্তু যদি সে চলেই যায় তবে আর বিয়ে না করুক কিংবা স্বামীর সংগে আবার মিলিত হোক। স্বামীও তার স্ত্রীকে তালাক না দিক। অন্য সবাইকে অবশ্য প্রভু বলছেন না কিন্তু আমি বলছি, যদি কোন ভাইয়ের অ-ঈমানদার স্ত্রী থাকে আর সেই স্ত্রী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামী যেন তাকে তালাক না দেয়। আবার যদি কোন স্ত্রীলোকের অ-ঈমানদার স্বামী থাকে আর সেই স্বামী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামীকে যেন সে তালাক না দেয়; কারণ স্ত্রীর মধ্য দিয়ে সেই অ-ঈমানদার স্বামীকে আর স্বামীর মধ্য দিয়ে সেই অ-ঈমানদার স্ত্রীকে আল্লাহ্‌ বিশেষ চোখে দেখেন। তা না হলে তোমাদের ছেলেমেয়েরা তো নাপাক হত; কিন্তু আসলে আল্লাহ্‌ তাদের বিশেষ চোখে দেখেন। কিন্তু যদি সেই অ-ঈমানদার স্বামী বা স্ত্রী চলে যেতে চায় তবে সে চলে যাক। এই রকম অবস্থায় সেই ঈমানদার ভাই বা বোন কোন বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকে না। আল্লাহ্‌ তো আমাদের শান্তিতে থাকবার জন্যই ডেকেছেন। স্ত্রী, তুমি কি করে জান যে, তোমার স্বামীকে তুমি নাজাত করতে পারবে না? স্বামী, তুমি কি করে জান যে, তোমার স্ত্রীকে তুমি নাজাত করতে পারবে না? কাজেই, প্রভু যাকে যে অবস্থায় রেখেছেন এবং আল্লাহ্‌ যাকে যে জন্য ডেকেছেন, সেই অনুসারেই সে চলুক। এই হুকুম আমি সমস্ত জামাতে দিয়ে থাকি। কোন খৎনা-করানো লোককে কি ডাকা হয়েছে? তবে সে খৎনার চিহ্ন মুছে না ফেলুক। কোন খৎনা-না-করানো লোককে কি ডাকা হয়েছে? তবে তার খৎনা করানো না হোক। খৎনা করালেই বা কি আর না করালেই বা কি, আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করাই হল আসল কথা। আল্লাহ্‌ যাকে যে অবস্থায় ডেকেছেন সে সেই অবস্থাতেই থাকুক। তোমাকে যখন ডাকা হয়েছিল তখন কি তুমি গোলাম ছিলে? সেইজন্য দুঃখ কোরো না; অবশ্য যদি স্বাধীন হবার সুযোগ পাও তবে তা গ্রহণ কোরো। গোলাম থাকা অবস্থায় প্রভু যাকে ডেকেছেন সে প্রভুর দ্বারা স্বাধীন হয়েছে। সেইভাবে যাকে স্বাধীন অবস্থায় ডাকা হয়েছে সে মসীহের গোলাম হয়েছে। অনেক দাম দিয়ে তোমাদের কেনা হয়েছে; মানুষের গোলাম হয়ো না। ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌ যাকে যে অবস্থায় ডেকেছেন সে আল্লাহ্‌র সামনে সেই অবস্থাতেই থাকুক। অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য প্রভুর কাছ থেকে কোন হুকুম আমি পাই নি। তবে আল্লাহ্‌র রহমত পেয়ে আমি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছি বলে আমার মত জানাচ্ছি। যে ভীষণ দুঃখ-কষ্টের সময় আসছে তার জন্য আমার মনে হয় তোমরা যে যেমন আছ তেমন থাকাই ভাল। তোমার কি স্ত্রী আছে? তবে স্ত্রীকে তালাক দিতে চেষ্টা কোরো না। তোমার কি স্ত্রী নেই? তবে বিয়ে করবার চেষ্টা কোরো না। কিন্তু বিয়ে যদি তুমি করই তাতে তোমার কোন গুনাহ্‌ হয় না। কোন অবিবাহিতা মেয়ে যদি বিয়ে করে তাহলে তারও গুনাহ্‌ হয় না। কিন্তু যারা বিয়ে করে তারা এই সংসারে কষ্ট পাবে, আর আমি এই সব থেকে তোমাদের রেহাই দিতে চাইছি। ভাইয়েরা, যে কথা আমি তোমাদের বলতে চাইছি তা এই- সময় খুবই কম। সেইজন্য এখন থেকে এমনভাবে চলবার দরকার যে, যাদের স্ত্রী আছে তাদের যেন স্ত্রী নেই; যারা দুঃখ করছে তারা যেন দুঃখ করছে না; যারা আনন্দ করছে তারা যেন আনন্দ করছে না; যারা কেনা-কাটা করছে তাদের যেন সেই সব জিনিসের উপর অধিকার নেই; যারা দুনিয়ার বিষয়ে জড়িত তারা যেন সম্পূর্ণভাবে জড়িত নয়; কারণ দুনিয়ার রূপ বদলে যাচ্ছে। আমি চাই যেন তোমরা ভাবনা-চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পার। অবিবাহিত লোক প্রভুর বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। বিবাহিত লোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করবে। এইভাবে দুই দিকই তাকে টানতে থাকে। যে মেয়ের স্বামী নেই এবং অবিবাহিতা মেয়ে প্রভুর বিষয়ে চিন্তা করে যাতে সে শরীরে আর দিলে প্রভুর হতে পারে। কিন্তু বিবাহিতা স্ত্রীলোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কেমন করে সে স্বামীকে সন্তুষ্ট করবে। এই কথা আমি তোমাদের উপকারের জন্যই বলছি। আমি তোমাদের ধরাবাঁধার মধ্যে রাখবার জন্য তা বলছি না, বরং যা করা উচিত ও ভাল তা করবার জন্য তোমাদের উৎসাহ দিচ্ছি, যেন তোমরা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে প্রভুর সেবা করতে পার। যদি কেউ মনে করে সে তার অবিবাহিতা মেয়ের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করছে না, যদি মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবার মত হয় আর যদি সে তাকে বিয়ে দেবার দরকার মনে করে, তবে সে নিজের ইচ্ছামতই কাজ করুক। মেয়েটির বিয়ে হোক, তাতে কোন গুনাহ্‌ হয় না। কিন্তু যে লোকের মন স্থির, যার উপর কোন চাপ নেই বলে সে নিজের ইচ্ছামতই কাজ করতে পারে, সে যদি তার মেয়েকে অবিবাহিতা রাখবে বলেই ঠিক করে থাকে তবে সে ভালই করে। তাহলে দেখা যায়, যে তার মেয়েকে বিয়ে দেয় সে ভাল করে, আর যে তাকে বিয়ে না দেয় সে আরও ভাল করে। স্বামী যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই স্ত্রী তার কাছে বাঁধা থাকে। কিন্তু যদি স্বামী মারা যায় তবে সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে, অবশ্য সেই লোক যেন প্রভুর হয়। কিন্তু আমার মতে সে যেমন আছে যদি তেমনই থাকে তবে সে আরও সুখী হয়। আমার মনে হয় যে, আমি আল্লাহ্‌র রূহের মধ্য দিয়েই এই কথা বলছি। এবার আমি মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবারের বিষয়ে বলছি। আমরা জানি, আমাদের সকলের জ্ঞান আছে। জ্ঞান মানুষকে অহংকারী করে, কিন্তু মহব্বত মানুষকে গড়ে তোলে। যে কিছু জানে বলে মনে করে, সে যেভাবে জানা উচিত সেইভাবে এখনও জানে না। কিন্তু যে আল্লাহ্‌কে মহব্বত করে আল্লাহ্‌ তাকে জানেন। এবার মূর্তির কাছে কোরবানী করা খাবার খাওয়ার বিষয়ে বলছি। আমরা জানি, দুনিয়াতে মূর্তি আসলে কিছুই নয় আর আল্লাহ্‌ও মাত্র একজন ছাড়া আর নেই। বেহেশতে হোক বা দুনিয়াতে হোক, দেব-দেবী বলে যদি কিছু থেকেই থাকে- অবশ্য দেবতাও অনেক, প্রভুও অনেক- তবুও আমাদের জন্য আল্লাহ্‌ মাত্র একজনই আছেন। তিনিই পিতা; তাঁরই কাছ থেকে সব কিছু এসেছে আর তাঁরই জন্য আমরা বেঁচে আছি। আর প্রভুও আমাদের মাত্র একজন, তিনি ঈসা মসীহ্‌। তাঁরই মধ্য দিয়ে সব কিছু এসেছে এবং তাঁরই মধ্য দিয়ে আমরা বেঁচে আছি। এই সব জ্ঞান কিন্তু সকলের নেই। মূর্তি পূজার অভ্যাস ছিল বলে মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবার এখনও পর্যন্ত কেউ কেউ সেই হিসাবেই খেয়ে থাকে। তাতে তাদের বিবেক দুর্বল বলে নাপাক হয়। কিন্তু খাবারের দ্বারা আমরা আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হই না। আমরা যদি না খাই তবে আমাদের কোন ক্ষতিও হয় না, আর যদি খাই তবে আমাদের কোন লাভও হয় না। তবে সাবধান! যাদের ঈমান দুর্বল, তোমাদের এই স্বাধীনতা তাদের কাছে যেন গুনাহের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। তোমার তো জ্ঞান আছে, কিন্তু যার বিবেক দুর্বল সে যদি তোমাকে দেবতার মন্দিরে বসে খেতে দেখে তবে সেও কি মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবার খেতে উৎসাহ পাবে না? সেই দুর্বল লোক, সেই ভাই, যার জন্য মসীহ্‌ মরেছিলেন, তোমার জ্ঞানের দ্বারাই তার মহা ক্ষতি হয়। এইভাবে তোমরা তোমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করে যখন তাদের দুর্বল বিবেকে আঘাত দাও তখন তোমরা আসলে মসীহের বিরুদ্ধেই গুনাহ্‌ কর। তাই খাবারের জন্য যদি আমার ভাই গুনাহে পড়ে তবে আমার ভাই যাতে গুনাহে না পড়ে সেইজন্য আমি গোশ্‌ত খাওয়াই ছেড়ে দেব। আমি কি স্বাধীন নই? আমি কি সাহাবী নই? আমাদের হযরত ঈসাকে কি আমি দেখি নি? প্রভুর জন্য আমি যে কাজ করেছি তোমরা কি তারই ফল নও? অন্যেরা যদি আমাকে সাহাবী বলে স্বীকার না-ও করে তবু তোমরা অন্ততঃ তা স্বীকার করবে। তোমরা যে প্রভুর বান্দা হয়েছ সেটাই আমার সাহাবী-পদের প্রমাণ। যারা আমার সাহাবী হওয়া সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলে তাদের কাছে আমার জবাব এই- আমাদের খাওয়া-দাওয়া করবার অধিকার কি নেই? অন্য সব সাহাবীরা, প্রভুর ভাইয়েরা আর পিতর যেমন নিজের নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তবলিগে বের হন, সেইভাবে ঈসায়ী ঈমানদার নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তবলিগে বের হবার অধিকার কি আমাদের নেই? বার্নাবাস আর আমাকেই কি কেবল কাজ করে খেতে হবে? নিজের পয়সা খরচ করে কে সৈনিকের কাজ করে? আংগুর ক্ষেত যে করে সে কি তার ফল খায় না? পশুর পাল যে চরায় সে কি তার দুধ খায় না? আমি কি কেবল সাধারণ বুদ্ধিতে এই কথা বলছি? তৌরাত শরীফও কি সেই একই কথা বলে না? তাতে লেখা আছে, “শস্য মাড়াই করবার সময়ে বলদের মুখে জাল্‌তি বেঁধো না।” আল্লাহ্‌ কি কেবল বলদের কথা চিন্তা করেন? আসলে তিনি তো আমাদেরই জন্য এই কথা বলছেন, নয় কি? জ্বী, এই কথা আমাদের জন্যই লেখা হয়েছিল, কারণ যে চাষ করে এবং যে শস্য মাড়াই করে, ফসলের ভাগ পাবার আশা নিয়েই তাদের তা করা উচিত। আমরা যখন তোমাদের মধ্যে রূহানী বীজ বুনেছি তখন তোমাদের কাছ থেকে যদি জাগতিক খাওয়া-পরা জোগাড় করি তবে সেটা কি খুব বেশী কিছু? এই ব্যাপারে তোমাদের উপর যদি অন্যদের দাবি থাকে তবে আমাদের কি তা আরও বেশী করে থাকবে না? আমরা কিন্তু সেই দাবি কাজে লাগাই নি বরং সব কিছু সহ্য করছি, যেন মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগের পথে আমরা কোন বাধা হয়ে না পড়ি। তোমরা কি জান না, যারা বায়তুল-মোকাদ্দসের কাজকর্ম করে তারা বায়তুল-মোকাদ্দস থেকেই খাবার পায়, আর যারা কোরবানগাহের কাজকর্ম করে তারা কোরবানগাহে যা কোরবানী দেওয়া হয় তার ভাগ পায়? ঠিক সেইভাবে প্রভু হুকুম দিয়েছেন, যারা সুসংবাদ তবলিগ করে তারা যেন তা থেকেই খাওয়া-পরা পায়। আমি কিন্তু এর কিছুই ভোগ করি নি। তোমরা যাতে আমার জন্য এই রকম ব্যবস্থা কর সেইজন্য আমি এই কথা লিখছি না। আসলে আমার এই গর্ব যদি কেউ মিথ্যা করে দেয় তবে তার চেয়ে আমার মৃত্যু অনেক ভাল। আমি সুসংবাদ তবলিগ করছি বটে, কিন্তু তাতে আমার গৌরব করবার কিছুই নেই, কারণ আমাকে তা করতেই হবে। দুর্ভাগ্য আমার, যদি আমি সেই সুসংবাদ তবলিগ না করি! যদি আমি নিজের ইচ্ছায় তবলিগ করি তবে তো আমার পুরস্কার আছেই, আর যদি নিজের ইচ্ছায় না-ও করি তবুও আমার উপর সেই ভার রয়েছে বলেই আমি তা করি। তাহলে আমার পুরস্কার কি? সেই পুরস্কার এই যে, আমি যখন সুসংবাদ তবলিগ করি তখন তার বদলে আমার যা পাওনা আছে তা ভোগ না করে বিনা পয়সায় আমি সেই কাজ করতে পারি। যদিও আমি কারও গোলাম নই তবুও আমি নিজেকে সকলের গোলাম করেছি, যেন অনেককে মসীহের জন্য জয় করতে পারি। ইহুদীদের জয় করবার জন্য আমি ইহুদীদের কাছে ইহুদীদের মত হয়েছি। যদিও আমি মূসার শরীয়তের অধীনে নই তবুও যারা শরীয়তের অধীনে আছে তাদের জয় করবার জন্য আমি তাদের মত হয়েছি। আবার শরীয়তের বাইরে যারা আছে তাদের জয় করবার জন্য আমি শরীয়তের বাইরে থাকা লোকের মত হয়েছি। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, আমি আল্লাহ্‌র দেওয়া শরীয়তের বাইরে আছি; আমি তো মসীহের শরীয়তের অধীনেই আছি। ঈমানে যারা দুর্বল তাদের কাছে আমি সেই রকম লোকের মতই হয়েছি, যেন মসীহের জন্য তাদের সম্পূর্ণভাবে জয় করতে পারি। মোট কথা, আমি সকলের কাছে সব কিছুই হয়েছি যেন যে কোন উপায়ে কিছু লোককে উদ্ধার করতে পারি। এই সব আমি সুসংবাদের জন্যই করছি যেন এর দোয়ার ভাগী হতে পারি। তোমরা কি জান না দৌড়ের খেলায় সবাই দৌড়ায়, কিন্তু একজনই কেবল পুরস্কার পায়? তোমরা এমনভাবে দৌড়াও যেন পুরস্কার পেতে পার। যারা দৌড়ে যোগ দেয় তারা প্রত্যেকে আগে থেকেই কঠিন নিয়মের অধীনে চলে। যে জয়ের মালা নষ্ট হয়ে যায় সেই মালা পাবার জন্যই তারা তা করে, কিন্তু আমরা তা করি সেই পুরস্কারের জন্য যা কখনও নষ্ট হবে না। তাই উদ্দেশ্য ছাড়া আমি দৌড়াচ্ছি না। যারা শূন্যে আঘাত করে মুষ্টিযুদ্ধ করে আমি তাদের মত নই। আমি বরং শরীরকে কষ্ট দিয়ে নিজের অধীনে রাখছি, যেন অন্যদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করবার পর আমি নিজে পুরস্কার পাবার অযোগ্য হয়ে না পড়ি। ভাইয়েরা, আমি চাই যেন তোমরা জানতে পার, আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই সেই মেঘের ছায়ায় ছিলেন এবং সবাই লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন। মূসার সংগে এক হবার জন্য মেঘ এবং সমুদ্রের মধ্যে তাদের সকলের তরিকাবন্দী হয়েছিল। তবুও আল্লাহ্‌ সেই লোকদের মধ্যে বেশীর ভাগ লোকের উপরে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেইজন্য তাঁদের লাশ মরুভূমিতে পড়ে রইল। আমরা যাতে দেখে শিখতে পারি সেইজন্যই এই সব ঘটেছিল, যেন তাঁরা যেমন খারাপ বিষয়ে লোভ করেছিলেন আমরা সেই রকম না করি। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন মূর্তি পূজা করেছিলেন তোমরা তেমন কোরো না। পাক-কিতাবে লেখা আছে, লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করতে বসল, পরে হৈ-হল্লা করে আমোদ-প্রমোদ করবার জন্য উঠে দাঁড়াল। তাঁদের মধ্যে অনেকে জেনা করবার ফলে একই দিনে তেইশ হাজার লোক মারা গিয়েছিলেন। আমরা যেন সেইভাবে জেনা না করি। তাঁদের মধ্যে অনেকে প্রভুকে পরীক্ষা করে যেমন সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন সেইভাবে আমরা যেন প্রভুর পরীক্ষা না করি। তাঁদের মধ্যে অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করে যেমন ধ্বংসকারী ফেরেশতার দ্বারা ধ্বংস হয়েছিলেন সেইভাবে তোমরা বিরক্তি প্রকাশ কোরো না। অন্য লোকেরা যাতে দেখে শিখতে পারে সেইজন্যই তাঁদের উপর এই সব ঘটেছিল। আর আমরা যারা সমস্ত যুগের শেষ সময়ে এসে পড়েছি, সেই আমাদের সাবধান করবার জন্যই এই সব লেখা হয়েছে। এইজন্য যদি কেউ মনে করে সে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে তবে সে সাবধান হোক যেন পড়ে না যায়। মানুষের জীবনে যে সব পরীক্ষা হয়ে থাকে তা ছাড়া আর অন্য কোন পরীক্ষা তো তোমাদের উপর হয় নি। আল্লাহ্‌ বিশ্বাসযোগ্য; সহ্যের অতিরিক্ত পরীক্ষা তিনি তোমাদের উপর হতে দেবেন না, বরং পরীক্ষার সংগে সংগে তা থেকে বের হয়ে আসবার একটা পথও তিনি করে দেবেন যেন তোমরা তা সহ্য করতে পার। এইজন্য আমার প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা মূর্তিপূজা থেকে পালিয়ে যাও। তোমাদের বুদ্ধিমান জেনেই আমি এই সব কথা বলছি। আমি যা বলি তা তোমরা নিজেরা বিচার করে দেখ। মসীহের মেজবানীর সময়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে যে দোয়ার পেয়ালা থেকে আমরা খাই, সেটা কি মসীহের রক্তের অংশ গ্রহণ করবার মত নয়? আর যে রুটি আমরা টুকরা করে খাই তাও কি মসীহের শরীরের অংশ গ্রহণ করবার মত নয়? আমরা অনেক হলেও একই শরীর, কারণ মাত্র একটাই রুটি আছে, আর আমরা সবাই সেই একটা রুটিরই অংশ গ্রহণ করি। ইসরাইল জাতির কথা চিন্তা কর। তাদের মধ্যে যারা কোরবানীর জিনিস খেয়ে থাকে তারা কি সেই কোরবানগাহের সব কিছুতে অংশ গ্রহণ করে না? আমার এই কথাতে কি এটাই বুঝা যায় যে, মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা খাবার বিশেষ কিছু বা মূর্তি বিশেষ কিছু? তা নয়, বরং আমি বলছি, অ-ইহুদীরা যা উৎসর্গ করে তা আল্লাহ্‌র কাছে করে না, ভূতদের কাছেই করে। আমি চাই না যে, ভূতদের সংগে তোমাদের কোন যোগাযোগ-সম্বন্ধ থাকে। প্রভুর পেয়ালা আর ভূতদের পেয়ালা, এই দুই পেয়ালা থেকেই তোমরা খেতে পার না। প্রভুর টেবিলের উপরে আর ভূতদের টেবিলের উপরে যা আছে, এই দু’য়েরই অংশ তোমরা গ্রহণ করতে পার না। এটা করে কি আমরা সত্যিই প্রভুর দিলের জ্বালা জাগিয়ে তুলতে চাইছি? আমরা কি তাঁর চেয়ে বলবান? কেউ কেউ বলে, “কোন কিছু করা হারাম নয়।” তা ঠিক, কিন্তু সব কিছুই যে মানুষের উপকার করে তা নয়। কোন কিছু করা হারাম নয় বটে, কিন্তু সব কিছুই যে মানুষকে গড়ে তোলে তা নয়। কেউ তার নিজের উন্নতির চেষ্টা না করুক বরং প্রত্যেকে অন্যের উন্নতির চেষ্টা করুক। বাজারে যে কোন গোশ্‌ত বিক্রি হয় তা খেয়ো; বিবেককে শান্ত রাখবার জন্য কোন কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না, কারণ পাক-কিতাবের কথামত, “দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সব কিছু মাবুদেরই।” যদি কোন অ-ঈমানদার তোমাদের দাওয়াত করে আর তোমরা যেতেও চাও, তবে বিবেককে শান্ত রাখবার জন্য কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করে তোমাদের সামনে যা দেওয়া হয় তা খেয়ো। কিন্তু যদি কেউ তোমাদের বলে, “এটা মূর্তির কাছে উৎসর্গ করা হয়েছে,” তবে যে তা বলেছে তার জন্য আর বিবেকের জন্য তা খেয়ো না। আমি তোমাদের বিবেকের কথা বলছি না, অন্য লোকটির বিবেকের কথা বলছি। কিন্তু অন্য একজন লোকের বিবেকের জন্য কেন আমার স্বাধীনতায় হাত দেওয়া হবে? আমি যদি আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে খাই তবে যে খাবারের জন্য আমি শুকরিয়া আদায় করছি তার জন্য কেন আমার নিন্দা করা হবে? সেইজন্য তোমরা খাওয়া-দাওয়া কর আর যা-ই কর, সব কিছু আল্লাহ্‌র গৌরবের জন্য কোরো। আমি যেমন মসীহের মত চলছি তোমরাও তেমনি আমার মত চল। আমি তোমাদের প্রশংসা করছি, কারণ তোমরা সব ব্যাপারেই আমার কথা মনে করে থাক, আর আমি তোমাদের যে শিক্ষা দিয়েছি তা ধরে রাখছ। আমি চাই যেন তোমরা বুঝতে পার যে, মসীহ্‌ই প্রত্যেক পুরুষের মাথার মত, স্বামী তার স্ত্রীর মাথার মত, আর আল্লাহ্‌ মসীহের মাথার মত। যে পুরুষ মাথা ঢেকে মুনাজাত করে বা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলে সে তার মাথার অসম্মান করে। যে স্ত্রীলোক মাথা না ঢেকে মুনাজাত করে বা নবী হিসাবে কথা বলে সে তার মাথার অসম্মান করে, কারণ তাতে সে মাথা কামানো স্ত্রীলোকের মতই হয়ে পড়ে। যদি কোন স্ত্রীলোক মাথা না ঢাকে তবে সে তার চুলও কেটে ফেলুক। কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে চুল কেটে ফেলা বা মাথা কামিয়ে ফেলা লজ্জার বিষয় বলে সে তার মাথা ঢেকে রাখুক। মাথা ঢেকে রাখা পুরুষের উচিত নয়, কারণ আল্লাহ্‌ পুরুষকে নিজের মত করে সৃষ্টি করেছিলেন আর পুরুষের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র গৌরব প্রকাশ পায়; কিন্তু স্ত্রীলোকের মধ্য দিয়ে পুরুষের গৌরব প্রকাশ পায়। পুরুষ স্ত্রীলোক থেকে আসে নি কিন্তু স্ত্রীলোক পুরুষ থেকে এসেছে। স্ত্রীলোকের জন্য পুরুষের সৃষ্টি হয় নি কিন্তু পুরুষের জন্য স্ত্রীলোকের সৃষ্টি হয়েছে। সেইজন্য এবং ফেরেশতাদের জন্য অধীনতার চিহ্ন হিসাবে মাথা ঢাকা স্ত্রীলোকের উচিত। অবশ্য প্রভুর সংগে যুক্ত হয়ে স্ত্রী তার স্বামীর উপর নির্ভর করে, আবার স্বামীও তার স্ত্রীর উপর নির্ভর করে; কারণ যেমন পুরুষ থেকে স্ত্রীলোক এসেছিল তেমনি আবার স্ত্রীলোকের মধ্য দিয়ে পুরুষের জন্ম হয়। কিন্তু সমস্তই আল্লাহ্‌ থেকে হয়। তোমরা নিজেরাই বিচার করে দেখ। মাথায় কাপড় না দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করা কি স্ত্রীলোকের মানায়? স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে কি এটা বুঝা যায় না যে, পুরুষ যদি লম্বা চুল রাখে তবে তাতে তার অসম্মান হয়, কিন্তু স্ত্রীলোক যদি লম্বা চুল রাখে তবে তাতে তার গৌরব হয়? নিজেকে ঢাকবার জন্যই তো স্ত্রীলোককে লম্বা চুল দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ এই নিয়ে তর্ক করতে চায় তবে আমি এই বলব যে, অন্য কোন নিয়ম আমাদের মধ্যেও নেই বা আল্লাহ্‌র জামাতগুলোর মধ্যেও নেই। এবার আমি যে বিষয় নিয়ে হুকুম দিতে যাচ্ছি সেই বিষয়ে আমি তোমাদের প্রশংসা করি না, কারণ তোমরা যেভাবে জামাতে মিলিত হও তাতে তোমাদের উপকার না হয়ে অপকারই হয়। প্রথমতঃ আমি শুনতে পাচ্ছি, তোমরা যখন জামাত হিসাবে একসংগে মিলিত হও তখন তোমাদের মধ্যে দলাদলি থাকে, আর আমি তা কতকটা বিশ্বাসও করি। অবশ্য তোমাদের মধ্যে মতের অমিল হবেই যেন আল্লাহ্‌র চোখে তোমাদের মধ্যে যোগ্য লোক কে, তা ধরা পড়ে। জামাত হিসাবে এক জায়গায় মিলিত হয়ে যা খাও তা আসলে মসীহের মেজবানী নয়, কারণ তোমরা কেউ কারও জন্য অপেক্ষা না করেই খেয়ে ফেল। আর তাতে একজনের খিদে থেকে যায়, আর অন্যজন মাতাল হয়। খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য তোমাদের কি ঘর-বাড়ী নেই? নাকি তোমরা আল্লাহ্‌র জামাতকে তুচ্ছ করছ এবং যাদের কিছু নেই তাদের লজ্জা দিচ্ছ? আমি তোমাদের কি বলব? আমি কি এতে তোমাদের প্রশংসা করব? নিশ্চয়ই না। আমি তোমাদের যে শিক্ষা দিয়েছি তা আমি প্রভুর কাছ থেকে পেয়েছি। যে রাতে হযরত ঈসাকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই রাতে তিনি রুটি নিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়েছিলেন এবং তা টুকরা টুকরা করে বলেছিলেন, “এটা আমার শরীর যা তোমাদেরই জন্য দেওয়া হবে; আমাকে মনে করবার জন্য এই রকম কোরো।” খাওয়া হলে পর সেইভাবে তিনি পেয়ালা নিয়ে বলেছিলেন, “আমার রক্তের দ্বারা আল্লাহ্‌র যে নতুন ব্যবস্থা বহাল করা হবে সেই ব্যবস্থার চিহ্ন হল এই পেয়ালা। তোমরা যতবার এর থেকে খাবে আমাকে মনে করবার জন্য এই রকম কোরো।” সেইজন্য তিনি না আসা পর্যন্ত যতবার তোমরা এই রুটি খাবে আর এই পেয়ালা থেকে খাবে ততবারই প্রভুর মৃত্যুর কথা প্রচার করবে। সেইজন্য যে কেউ অযোগ্য ভাবে এই রুটি আর প্রভুর পেয়ালা থেকে খায় সে প্রভুর শরীরের আর রক্তের বিরুদ্ধে গুনাহ্‌ করেছে বলে দোষী হয়। সেই রুটি আর সেই পেয়ালা থেকে খাবার আগে মানুষ নিজেকে পরীক্ষা করে দেখুক, কারণ খাবার সময় সে যদি প্রভুর শরীরের বিষয়ে না বোঝে তবে সেই খাওয়াতে সে তার নিজের উপরেই শাস্তি ডেকে আনে। সেইজন্যই তোমাদের মধ্যে অনেকে দুর্বল আর অসুস্থ হয়েছে, আবার অনেকে মারাও গেছে। যদি আমরা নিজেদের বিচার করে দেখি তবে আমরা প্রভুর বিচারের হাত থেকে রেহাই পাই। কিন্তু আমাদের বিচার যখন প্রভু করেন তখন তিনি আমাদের শাসন করেন, যাতে দুনিয়ার সকলের সংগে আমাদের দোষী বলে স্থির করা না হয়। সেইজন্য আমার ভাইয়েরা, যখন খাওয়ার জন্য তোমরা জামাত হিসাবে এক জায়গায় মিলিত হও তখন একজন আর একজনের জন্য অপেক্ষা কোরো। যদি কারও খিদে পায় তবে সে বাড়ী থেকে খেয়ে আসুক, যেন জামাত হিসাবে এক জায়গায় মিলিত হবার ফলে শাস্তি পেতে না হয়। অন্য সব ব্যাপারে আমি যখন আসব তখন উপদেশ দেব। ভাইয়েরা, আমি চাই না যে, পাক-রূহের দেওয়া দান সম্বন্ধে তোমাদের অজানা থাকে। তোমরা জান, যখন তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে না তখন এমন সব মূর্তির দিকে তোমাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হত যারা কথা বলতে পারে না। আমি তোমাদের জানাচ্ছি, আল্লাহ্‌র রূহের দ্বারা কথা বললে কেউ বলে না, “ঈসার উপর বদদোয়া পড়ুক।” আবার পাক-রূহের মধ্য দিয়ে না হলে কেউ বলতে পারে না, “ঈসাই প্রভু।” একই পাক-রূহের দেওয়া বিশেষ দান ভিন্ন ভিন্ন রকমের। আমরা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে একই প্রভুর সেবা করি। আমাদের প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু একই আল্লাহ্‌ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে কাজ করে থাকেন। সকলের উপকারের জন্যই এক এক মানুষের মধ্যে এক এক রকম করে পাক-রূহ্‌ প্রকাশিত হন। কাউকে কাউকে সেই পাক-রূহের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের কথা বা বুদ্ধির কথা বলতে দেওয়া হয়। এই সমস্ত কাজ সেই একই পাক-রূহ্‌ করে থাকেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেইভাবেই এই সব দান প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে দেন। একটি শরীরের যেমন অনেকগুলো অংশ থাকে আর সেই অংশগুলো অনেক হলেও যেমন সব মিলে একটিমাত্র শরীর হয়, মসীহ্‌ ও ঠিক সেই রকম। আমরা ইহুদী কি অ-ইহুদী, গোলাম কি স্বাধীন, সকলেরই একই পাক-রূহের দ্বারা একই শরীরের মধ্যে তরিকাবন্দী হয়েছে। আমরা সকলেই সেই একই পাক-রূহ্‌কে পেয়েছি। শরীর কেবল একটিমাত্র অংশ দিয়ে গড়া নয়, তা অনেক অংশ দিয়েই গড়া। পা যদি বলে, “আমি হাত নই, তাই শরীরের অংশও নই,” তাহলে সেটা যে শরীরের অংশ নয় এমন নয়। কান যদি বলে, “আমি চোখ নই বলে শরীরের অংশও নই,” তাহলে সেটা যে শরীরের অংশ নয় এমন নয়। যদি সমস্ত শরীরটাই চোখ হত তবে শুনবার শক্তি কোথায় থাকত? আর যদি সমস্ত শরীরটাই কান হত তবে শুঁকবার শক্তি কোথায় থাকত? আল্লাহ্‌ যেমন ভাবে চেয়েছেন ঠিক তেমন ভাবেই শরীরের অংশগুলোকে তিনি এক এক করে শরীরের মধ্যে বসিয়েছেন। যদি সব অংশগুলো একই রকম হত তবে শরীর কোথায় থাকত? অংশ অনেক বটে কিন্তু শরীর একটিই। চোখ হাতকে বলতে পারে না, “তোমাকে আমার দরকার নেই,” আবার মাথা পা দু’টিকে বলতে পারে না, “তোমাদের আমার দরকার নেই।” আসলে শরীরের যে অংশগুলোকে দুর্বল বলে মনে হয় সেগুলোই বেশী দরকারী। শরীরের যে অংশগুলোকে আমরা কম সম্মানের যোগ্য বলে মনে করি সেই অংশগুলোকে বেশী সম্মান দেখাই। যে অংশগুলোকে বাইরে দেখানো যায় না সেগুলোকে আমরা যত্নের সংগে ঢেকে রাখি, কিন্তু যে অংশগুলো বাইরে দেখানো যায় সেগুলো আর ঢাকবার দরকার হয় না। শরীরের যে অংশগুলোর কোন সম্মান নেই আল্লাহ্‌ সেগুলোকে অনেক বেশী সম্মান দান করেছেন এবং সমস্ত অংশগুলোকে একসংগে যুক্ত করেছেন, যেন শরীর ভাগ হয়ে না যায় বরং অংশগুলো যেন একে অন্যের জন্য সমান ভাবে চিন্তা করে। যদি একটা অংশের কষ্ট হয় তবে তার সংগে সমস্ত অংশই কষ্ট পায়। যদি একটা অংশ সম্মান পায় তবে সমস্ত অংশই তার সংগে আনন্দিত হয়। তোমরাই মসীহের শরীর আর এক একজন সেই শরীরের এক একটি অংশ। আল্লাহ্‌ জামাতে প্রথমতঃ সাহাবী, দ্বিতীয়তঃ নবী, তৃতীয়তঃ ওস্তাদ নিযুক্ত করেছেন। তারপর এই সব লোকদের নিযুক্ত করেছেন্ত যারা অলৌকিক কাজ করবার ক্ষমতা পেয়েছে, যারা রোগ ভাল করবার ক্ষমতা পেয়েছে, যারা সাহায্য করবার ক্ষমতা পেয়েছে, যারা পরিচালনা করবার ক্ষমতা পেয়েছে, আর যারা বিভিন্ন ভাষা বলবার ক্ষমতা পেয়েছে। সকলেই কি সাহাবী? সকলেই কি নবী? সকলেই কি ওস্তাদ? সকলেরই কি অলৌকিক কাজ করবার ক্ষমতা আছে? সকলেরই কি রোগ ভাল করবার ক্ষমতা আছে? সকলেই কি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে? সকলেই কি তার মানে বুঝিয়ে দেয়? নিশ্চয়ই না! আমি বরং বলি, তোমরা সবচেয়ে দরকারী দানগুলো পাবার জন্য আগ্রহী হও। আমি তোমাদের এবার আরও ভাল একটা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি: আমি যদি মানুষের এবং ফেরেশতাদের ভাষায় কথা বলি কিন্তু আমার মধ্যে মহব্বত না থাকে, তবে আমি জোরে বাজানো ঘণ্টা বা ঝনঝন করা করতাল হয়ে পড়েছি। যদি নবী হিসাবে কথা বলবার ক্ষমতা আমার থাকে, যদি আমি সমস্ত গোপন সত্যের বিষয় বুঝতে পারি, আর যদি আমার সব রকম জ্ঞান থাকে, এমন কি, পাহাড়কে পর্যন্ত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেবার মত পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, কিন্তু আমার মধ্যে মহব্বত না থাকে, তবে আমার কোনই মূল্য নেই। আমার যা কিছু আছে তা যদি আমি গরীবদের খাওয়াবার জন্য দান করি, এমন কি, শরীরটাও পোড়াবার জন্য দিয়ে দিই, কিন্তু আমার মধ্যে যদি মহব্বত না থাকে, তবে আমার কোনই লাভ নেই। মহব্বত সব সময় ধৈর্য ধরে, দয়া করে, হিংসা করে না, গর্ব করে না, অহংকার করে না, খারাপ ব্যবহার করে না, নিজের সুবিধার চেষ্টা করে না, রাগ করে না, কারও খারাপ ব্যবহারের কথা মনে রাখে না, খারাপ কিছু নিয়ে আনন্দ করে না বরং যা সত্য তাতে আনন্দ করে। মহব্বত সব কিছুই সহ্য করে, সকলকেই বিশ্বাস করতে আগ্রহী, সব কিছুতে আশা রাখে আর সব অবস্থায় স্থির থাকে। এই মহব্বত কখনও শেষ হয় না। নবী হিসাবে কথা বলবার যে ক্ষমতা আছে তা শেষ হয়ে যাবে; বিভিন্ন ভাষায় কথা বলবার যে ক্ষমতা আছে তা চলে যাবে; জ্ঞান আছে, তাও শেষ হয়ে যাবে; কারণ আমরা সব বিষয় পুরোপুরি ভাবে জানি না, নবী হিসাবেও পুরোপুরি ভাবে কথা বলতে পারি না। কিন্তু যা পূর্ণ তা যখন আসবে তখন যা পূর্ণ নয় তা শেষ হয়ে যাবে। আমি যখন শিশু ছিলাম তখন শিশুর মত কথা বলতাম, শিশুর মত চিন্তা করতাম আর শিশুর মত বিচারও করতাম। এখন আমার বয়স হয়েছে, তাই শিশুর আচার-ব্যবহারগুলো বাদ দিয়েছি। আমরা এখন যেন আয়নায় অস্পষ্ট দেখছি, কিন্তু তখন সামনাসামনি দেখতে পাব। আমি এখন যা জানি তা অসম্পূর্ণ, কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে যেমন সম্পূর্ণভাবে জানেন তখন আমি তেমনি সম্পূর্ণভাবে জানতে পারব। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বাস, আশা আর মহব্বত- এই তিনটিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে; কিন্তু এগুলোর মধ্যে মহব্বতই সবচেয়ে বড়। এই মহব্বতের জন্য তোমরা বিশেষভাবে চেষ্টা কর, আর পাক-রূহের দেওয়া দান, বিশেষভাবে নবী হিসাবে কথা বলবার ক্ষমতা পাবার জন্য তোমাদের আগ্রহ থাকুক। অন্য কোন ভাষায় যে লোক কথা বলে সে মানুষের কাছে কথা বলে না কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছে কথা বলে, কারণ কেউ তা বুঝতে পারে না। সে রূহ্‌ দিয়ে গোপন সত্যের কথা বলে। কিন্তু নবী হিসাবে যে কথা বলে সে মানুষের কাছে এমন কথা বলে যা তাদের গড়ে তোলে এবং উৎসাহ ও সান্ত্বনা দেয়। অন্য কোন ভাষায় যে লোক কথা বলে সে নিজেকেই গড়ে তোলে, কিন্তু নবী হিসাবে যে কথা বলে সে জামাতের লোকদের গড়ে তোলে। আমি চাই যেন তোমরা সকলেই বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পার, কিন্তু আরও বেশী করে চাই যেন তোমরা নবী হিসাবে কথা বলতে পার। অন্য কোন ভাষায় যে লোক কথা বলে, জামাতের লোকদের গড়ে তুলবার জন্য যদি সে তার কথার মানে বুঝিয়ে না দেয়, তবে তার চেয়ে নবী হিসাবে যে কথা বলে সে-ই বরং বড়। সেইজন্য ভাইয়েরা, আমি যদি তোমাদের কাছে এসে কেবল অন্য ভাষায় কথা বলি, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র সত্য প্রকাশের কথা বা জ্ঞানের কথা বা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বা শিক্ষার কথা না বলি, তবে আমি তোমাদের কি উপকার করতে পারব? এমন কি, বাঁশী বা বীণার মত প্রাণহীন বাজনা যদি পরিষ্কার আলাদা আলাদা সুরে না বাজে, তবে বাঁশী বা বীণাতে কি সুর বাজছে তা কেমন করে জানা যাবে? যুদ্ধের শিংগা যদি পরিষ্কার ভাবে না বাজে তবে কে যুদ্ধে যাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে? ঠিক সেইভাবে যে ভাষা লোকেরা বোঝে না তোমরা যদি সেই ভাষায় কথা বল তবে তোমরা যা বল তা কেমন করে বুঝা যাবে? কারণ তখন যে কথা তোমরা বল তা তো বাতাসের কাছেই বল। এই দুনিয়াতে অনেক রকমের ভাষা আছে; সেগুলোর মধ্যে কোনটাই অর্থহীন নয়। এইজন্য আমি যদি কোন ভাষার মানে না বুঝি তবে যে লোক কথা বলছে তার কাছে তো আমি অজানা বিদেশীর মত হব, আর সেও আমার কাছে তা-ই হবে। তোমাদের বেলায়ও এই কথা খাটে। তোমরা যখন পাক-রূহের দেওয়া দান পাবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হচ্ছ তখন যে যে দানের দ্বারা জামাতকে গড়ে তোলা যায় সেগুলোই বেশী করে পাবার চেষ্টা কর। এইজন্য অন্য কোন ভাষায় যে লোক কথা বলে সে মুনাজাত করুক যেন তার মানে সে বুঝিয়ে দিতে পারে। আমি যদি অন্য কোন ভাষায় মুনাজাত করি তবে আমার রূহ্‌ই মুনাজাত করে কিন্তু আমার মন কোন কাজ করে না। তাহলে আমার কি করা উচিত? আমি রূহ্‌ দিয়ে মুনাজাত করব, বুদ্ধি দিয়েও মুনাজাত করব; আমি রূহ্‌ দিয়ে প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব, বুদ্ধি দিয়েও প্রশংসা-কাওয়ালী গাইব। তা না হলে যদি তুমি রূহে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাও তবে সেই ভাষা বুঝতে পারে না এমন কোন লোক যদি সেখানে উপস্থিত থাকে, তবে সে কেমন করে তোমার শুকরিয়াতে আমিন বলে সায় দেবে? সে তো জানে না তুমি কি বলছ। তুমি হয়তো ঠিকভাবেই শুকরিয়া জানা"ছ, কিন্তু তাতে সেই অন্য লোকটিকে তো গড়ে তোলা হচ্ছে না। আমি তোমাদের সকলের চেয়ে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে বেশী পারি বলে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাই। তবে জামাতের মধ্যে বিভিন্ন ভাষায় হাজার হাজার কথা বলবার বদলে অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য আমি বুদ্ধি দিয়ে বরং মাত্র পাঁচটা কথা বলব। ভাইয়েরা, ছেলে মানুষের মত আর চিন্তা কোরো না। খারাপ বিষয়ে তোমাদের মন শিশুর মত সরল হোক, কিন্তু চিন্তাতে তোমরা বয়স্ক লোকের মত হও। তৌরাত শরীফে মাবুদ বলেন, “অন্য ভাষার লোকদের দিয়ে ও অন্যদের মুখ দিয়ে আমি এই জাতির কাছে কথা বলব, কিন্তু তবুও তারা আমার কথা শুনবে না।” তাহলে দেখা যায়, ঈমানদারদের জন্য বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা কোন চিহ্ন নয়, বরং অ-ঈমানদারদের জন্য ওটা একটা চিহ্ন; কিন্তু অ-ঈমানদারদের জন্য নবী হিসাবে কথা বলা কোন চিহ্ন নয়, বরং ঈমানদারদের জন্য ওটা একটা চিহ্ন। জামাতের সমস্ত লোক এক জায়গায় মিলিত হলে পর যদি সবাই বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে থাকে আর তখন সেই জামাতের বাইরের লোকেরা এবং অ-ঈমানদারেরা ভিতরে আসে, তবে কি তারা তোমাদের পাগল বলবে না? কিন্তু যদি সবাই নবী হিসাবে কথা বলে আর তখন কোন অ-ঈমানদার বা জামাতের বাইরের লোক ভিতরে আসে, তবে সেই লোক সকলের কথার মধ্য দিয়ে নিজের গুনাহ্‌ সম্বন্ধে চেতনা পাবে এবং সেই সব কথার দ্বারাই তার দিলের বিচার হবে। তাতে তার দিলের গোপন বিষয়গুলো বের হয়ে পড়বে, আর সে তখন মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে আল্লাহ্‌র গৌরব করে বলবে, “সত্যিই, আল্লাহ্‌ আপনাদের মধ্যে আছেন।” ভাইয়েরা, তবে কি বলব? তোমরা যখন জামাতে এক জায়গায় মিলিত হও তখন তোমাদের মধ্যে কেউ প্রশংসা-কাওয়ালী গায়, কেউ শিক্ষা দেয়, কেউ আল্লাহ্‌র সত্য প্রকাশ করে, কেউ অন্য ভাষায় কথা বলে, আবার কেউ তার মানে বুঝিয়ে দেয়। যে যা-ই করুক না কেন সমস্তই যেন জামাতকে গড়ে তুলবার জন্য করা হয়। যদি কেউ অন্য ভাষায় কথা বলে তবে দু’জন বা বেশী হলে তিনজন এক একজন করে কথা বলুক, আর অন্য একজন তার মানে বুঝিয়ে দিক। যদি মানে বুঝাবার কেউ না থাকে তবে তারা জামাতে কথা না বলুক; তারা একা একা নিজের সংগে আর আল্লাহ্‌র সংগে কথা বলুক। যারা নবী হিসাবে কথা বলে তারা দুইজন বা তিনজন কথা বলুক আর অন্যেরা তার বিচার করে দেখুক। যে বসে আছে তার কাছে যদি আল্লাহ্‌র সত্য প্রকাশিত হয় তবে যে কথা বলছে সে কথা বলা বন্ধ করুক, কারণ তোমরা সবাই এক এক করে নবী হিসাবে কথা বলতে পার যেন সবাই শিক্ষা এবং উৎসাহ পায়। নবীদের রূহ্‌ তাদের নিজেদের অধীনে থাকে। আল্লাহ্‌ বিশৃঙ্খলার আল্লাহ্‌ নন, তিনি শান্তির আল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌র বান্দাদের সব জামাতে যেমন হয়ে থাকে, সেইভাবে স্ত্রীলোকেরা জামাতে চুপ করে থাকুক, কারণ কথা বলবার অনুমতি তাদের দেওয়া হয় নি। তৌরাত শরীফ যেমন বলে তেমনি তারা বরং বাধ্য হয়ে থাকুক। যদি তারা কিছু জানতে চায় তবে বাড়ীতে তাদের স্বামীকে জিজ্ঞাসা করুক, কারণ জামাতে কথা বলা একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে লজ্জার বিষয়। আল্লাহ্‌র কালাম কি তোমাদের মধ্য থেকেই বের হয়েছিল কিংবা তা কি কেবল তোমাদেরই কাছে এসেছে? যদি কেউ নিজেকে নবী বলে বা রূহানী লোক বলে মনে করে তবে সে স্বীকার করুক যে, আমি তোমাদের কাছে যা কিছু লিখলাম তা সবই প্রভুর হুকুম। যদি কেউ তা অগ্রাহ্য করে তবে তাকেও অগ্রাহ্য করা হবে। সেইজন্যই আমার ভাইয়েরা, নবী হিসাবে কথা বলবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হও এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে বাধা দিয়ো না। সব কিছুই যেন উপযুক্তভাবে আর শৃঙ্খলার সংগে করা হয়। ভাইয়েরা, যে সুসংবাদ আমি তোমাদের কাছে তবলিগ করেছিলাম, সেই সুসংবাদের কথা তোমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। তোমরা তা গ্রহণ করেছ আর তাতে স্থিরও আছ। যে কালাম আমি তোমাদের কাছে তবলিগ করেছিলাম তা যদি তোমরা শক্তভাবে ধরে রেখে থাক তবেই তোমরা সেই সুসংবাদের মধ্য দিয়ে নাজাত পাচ্ছ- অবশ্য যদি তোমাদের ঈমান কেবল বাইরের না হয়। আমি নিজে যা পেয়েছি তা সব চেয়ে দরকারী বিষয় হিসাবে তোমাদেরও দিয়েছি। সেই বিষয় হল এই- পাক-কিতাবের কথামত মসীহ্‌ আমাদের গুনাহের জন্য মরেছিলেন, তাঁকে দাফন করা হয়েছিল, কিতাবের কথামত তিন দিনের দিন তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছে, আর তিনি পিতরকে ও পরে তাঁর সাহাবীদের দেখা দিয়েছিলেন। এর পরে তিনি একই সময়ে পাঁচশোরও বেশী ভাইদের দেখা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেলেও বেশীর ভাগ লোক এখনও বেঁচে আছেন। তার পরে তিনি ইয়াকুবকে ও পরে সব সাহাবীদের দেখা দিয়েছিলেন। অসময়ে জন্মেছি যে আমি, সেই আমাকেও তিনি সবার শেষে দেখা দিয়েছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে নীচু, এমন কি, সাহাবী বলে কেউ যে আমাকে ডাকে তার যোগ্যও আমি নই, কারণ আল্লাহ্‌র জামাতের উপর আমি জুলুম করতাম। কিন্তু এখন আমি যা হয়েছি তা আল্লাহ্‌র রহমতেই হয়েছি। আমার উপর তাঁর সেই রহমত নিষ্ফল হয় নি। আমি অন্য সাহাবীদের সকলের চেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছি; তবে পরিশ্রম যে আমিই করেছি তা নয়, বরং আমার উপর আল্লাহ্‌র যে রহমত আছে সেই রহমতই তা করেছে। সেইজন্য আমিই তবলিগ করি বা অন্য সাহাবীরাই করেন, আমরা এই বিষয়েই তবলিগ করি আর তোমরা তাতেই ঈমান এনেছ। কিন্তু যদি তবলিগ করা হয় যে, মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছে তবে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ কেমন করে বলছে যে, মৃতদের জীবিত হয়ে ওঠা বলে কিছু নেই? মৃতেরা যদি জীবিত হয়ে না-ই ওঠে তাহলে তো মসীহ্‌কেও জীবিত করা হয় নি; আর মসীহ্‌কে যদি জীবিত করা না হয়ে থাকে তবে আমাদের তবলিগও মিথ্যা আর তোমাদের ঈমানও মিথ্যা। এছাড়া তাতে এই কথাই প্রমাণ হচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র বিষয়ে আমরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছি, কারণ আমাদের সাক্ষ্য এই যে, আল্লাহ্‌ মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছেন। কিন্তু যদি মৃতদের জীবিত করে তোলা না-ই হয় তবে তিনি মসীহ্‌কেও জীবিত করে তোলেন নি, কারণ মৃতদের যদি জীবিত করা না হয় তবে মসীহ্‌কেও জীবিত করা হয় নি। যদি মসীহ্‌কেই জীবিত করা না হয়ে থাকে তবে তোমাদের ঈমান নিষ্ফল আর এখনও তোমরা গুনাহের মধ্যেই পড়ে রয়েছ। তাহলে মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে যারা মারা গেছে তারা তো বিনষ্ট হয়েছে। মসীহের উপর আমাদের যে আশা তা যদি কেবল এই জীবনের জন্যই হয় তবে সমস্ত মানুষের মধ্যে আমাদেরই বেশী দুর্ভাগ্য। মসীহ্‌কে কিন্তু সত্যিসত্যিই মৃত্যু থেকে জীবিত করে তোলা হয়েছে। তিনি প্রথম ফল, অর্থাৎ মৃত্যু থেকে যাদের জীবিত করা হবে তাদের মধ্যে তিনিই প্রথমে জীবিত হয়েছেন। একজন মানুষের মধ্য দিয়ে মৃত্যু এসেছে বলে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠাও একজন মানুষেরই মধ্য দিয়ে এসেছে। আদমের সংগে যুক্ত আছে বলে যেমন সমস্ত মানুষই মারা যায়, তেমনি মসীহের সংগে যারা যুক্ত আছে তাদের সবাইকে জীবিত করা হবে; তবে তার মধ্যে পালা রয়েছে- প্রথম ফলের মত প্রথমে মসীহ্‌, তারপর যারা মসীহের নিজের। মসীহের আসবার সময়ে তাদের জীবিত করা হবে। এর পরে মসীহ্‌ যখন সমস্ত শাসন্তব্যবস্থা, অধিকার আর ক্ষমতা ধ্বংস করে পিতা আল্লাহ্‌র হাতে রাজ্য দিয়ে দেবেন তখনই শেষ সময় আসবে। আল্লাহ্‌ যে পর্যন্ত না মসীহের সমস্ত শত্রুকে তাঁর পায়ের তলায় রাখেন সেই পর্যন্ত মসীহ্‌কে রাজত্ব করতে হবে। শেষ শত্রু যে মৃত্যু, তাকেও ধ্বংস করা হবে। কিতাবের কথামত, “তিনি সব কিছুই তাঁর পায়ের তলায় রেখেছেন।” সব জিনিসই অধীনে রাখা হয়েছে বললে স্পষ্টই বুঝা যায়, যিনি সব জিনিস মসীহের অধীনে রেখেছেন সেই আল্লাহ্‌ নিজেকে বাদ দিয়েই তা করেছেন। যখন সব কিছুই মসীহের অধীনে রাখা হয়ে যাবে, তখন যিনি সব কিছু মসীহের অধীনে রেখেছিলেন সেই আল্লাহ্‌ যাতে একমাত্র মালিক হতে পারেন সেইজন্য পুত্রও নিজে আল্লাহ্‌র অধীন হবেন। কিন্তু মৃতদের জন্য যারা তরিকাবন্দী নেয় তাদের কি হবে? মৃতদের যদি জীবিত করে তোলা না-ই হয় তবে কেন তারা মৃতদের জন্য তরিকাবন্দী নেয়? আর কেনই বা আমরা সব সময় বিপদের মুখে পড়ছি? ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের কাজে তোমাদের নিয়ে আমার যে গর্ব, সেই গর্বে আমি নিশ্চয় করে বলছি যে, প্রত্যেক দিনই আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি। ইফিষে বুনো জানোয়ারদের সংগে আমাকে যে লড়াই করতে হয়েছিল, তা যদি কেবল জাগতিক উদ্দেশ্য নিয়েই করে থাকি তবে তাতে আমার কি লাভ হয়েছে? মৃতদের যদি না-ই জীবিত করে তোলা হয় তবে চলতি কথা মতে, “এস, আমরা খাওয়া-দাওয়া করি, কারণ কালকে আমরা মরে যাব।” তোমরা ভুল কোরো না। কথায় বলে, “খারাপ সংগী ভাল লোককেও খারাপ করে দেয়।” কাজেই তোমরা তোমাদের মনকে জাগিয়ে তোল এবং আর গুনাহ্‌ কোরো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌কে চেনেই না; আমি তোমাদের লজ্জা দেবার জন্য এই কথা বলছি। কেউ হয়তো বলবে, “মৃতদের কেমন করে জীবিত করে তোলা হবে? কেমন শরীর নিয়েই বা তারা উঠবে?” তুমি তো মুর্খ! তুমি নিজে যে বীজ লাগাও তা না মরলে তো চারা গজিয়ে ওঠে না। তোমার লাগানো বীজ থেকে যে চারা হয় তা তুমি লাগাও না বরং একটা মাত্র বীজই লাগাও- সেই বীজ গমের হোক বা অন্য কোন শস্যের হোক। কিন্তু আল্লাহ্‌ নিজের ইচ্ছামতই সেই বীজকে শরীর দিয়ে থাকেন। তিনি প্রত্যেক বীজকেই তার উপযুক্ত শরীর দান করে থাকেন। সব গোশ্‌তই এক রকম নয়। মানুষের গোশ্‌ত এক রকম, পশুর এক রকম, পাখীর এক রকম এবং মাছের এক রকম। আসমানে অনেক শরীর আছে, দুনিয়াতেও অনেক শরীর আছে, কিন্তু আসমানের শরীরগুলোর উজ্জ্বলতা এক রকম এবং দুনিয়ার শরীরগুলোর উজ্জ্বলতা আর এক রকম। সূর্যের উজ্জ্বলতা এক রকম, চাঁদের এক রকম এবং তারাগুলোর আর এক রকম। এমন কি, উজ্জ্বলতার দিক থেকে একটা তারা অন্য আর একটার চেয়ে আলাদা। মৃতদের জীবিত হয়ে ওঠাও ঠিক সেই রকম। লাশ দাফন করলে পর তা নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু সেই লাশ এমন অবস্থায় জীবিত করে তোলা হবে যা আর কখনও নষ্ট হবে না। তা অসম্মানের সংগে মাটিতে দেওয়া হয়, কিন্তু সম্মানের সংগে উঠানো হবে; দুর্বল অবস্থায় মাটিতে দেওয়া হয়, কিন্তু শক্তিতে উঠানো হবে; সাধারণ শরীর মাটিতে দেওয়া হয়, কিন্তু অসাধারণ শরীর উঠানো হবে। যখন সাধারণ শরীর আছে তখন অসাধারণ শরীরও আছে। কিতাবে এইভাবে লেখা আছে, “প্রথম মানুষ আদম জীবন্ত প্রাণী হলেন।” আর শেষ আদম জীবনদানকারী রূহ্‌ হলেন। কিন্তু যা অসাধারণ তা প্রথম নয়, বরং যা সাধারণ তা-ই প্রথম, তার পরে অসাধারণ। প্রথম মানুষ মাটি থেকে এসেছিলেন্ত তিনি মাটিরই তৈরী; কিন্তু দ্বিতীয় মানুষ বেহেশত থেকে এসেছিলেন। দুনিয়ার মানুষেরা সেই মাটির তৈরী মানুষের মত, আর যারা বেহেশতে যাবে তারা সেই বেহেশতের মানুষের মত। আমরা যেমন সেই মাটির মানুষের মত হয়েছি ঠিক তেমনি সেই বেহেশতের মানুষের মতও হব। ভাইয়েরা, আমি যা বলছি তা এই- মানুষ তার রক্তমাংসের শরীর নিয়ে আল্লাহ্‌র রাজ্যের অধিকারী হতে পারে না। যা নষ্ট হয়ে যাবে তা এমন কিছুর অধিকারী হতে পারে না যা নষ্ট হবে না। আমি তোমাদের একটা গোপন সত্যের কথা বলছি, শোন। আমরা সবাই যে মারা যাব তা নয়, কিন্তু বদলে যাব। এক মুহূর্র্তের মধ্যে, চোখের পলকে, শেষ সময়ের শিংগার আওয়াজের সংগে সংগে আমরা সবাই বদলে যাব। সেই শিংগা যখন বাজবে তখন মৃতেরা এমন অবস্থায় জীবিত হয়ে উঠবে যে, তারা আর কখনও নষ্ট হবে না; আর আমরাও বদলে যাব। যা নষ্ট হয় তাকে কাপড়ের মত করে এমন কিছু পরতে হবে যা কখনও নষ্ট হয় না। আর যা মরে যায় তাকে এমন কিছু পরতে হবে যা কখনও মরে না। যা নষ্ট হয় আর যা মরে যায়, সেগুলো যখন ঐভাবে বদলে যাবে তখন পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হবে যে, মৃত্যু ধ্বংস হয়ে জয় এসেছে। “মৃত্যু, তোমার জয় কোথায়? মৃত্যু, তোমার হুল কোথায়?” মৃত্যুর হূল গুনাহ্‌, আর গুনাহের শক্তিই মূসার শরীয়ত। কিন্তু আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের জয় দান করেন। সেইজন্যই, আমার প্রিয় ভাইয়েরা, শক্ত হয়ে দাঁড়াও; কোন কিছুই যেন তোমাদের নড়াতে না পারে। সব সময় প্রভুর কাজের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দিয়ে দাও, কারণ তোমরা জান, তাঁর কাজে তোমাদের পরিশ্রম নিষ্ফল নয়। এবার আমি আল্লাহ্‌র বান্দাদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলবার বিষয়ে বলছি। গালাতিয়া প্রদেশের জামাতগুলোর লোকদের আমি যে নির্দেশ দিয়েছি তোমরাও সেই রকম কর। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের আয় অনুসারে সপ্তার প্রথম দিনে কিছু তুলে রেখে জমা কোরো, যেন আমি আসলে পর চাঁদা তুলতে না হয়। আমি যখন তোমাদের কাছে আসব তখন তোমাদের সেই দান জেরুজালেমে নিয়ে যাবার জন্য তোমরা যাদের যোগ্য মনে করবে, আমি চিঠি দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেব। যদি আমারও যাওয়া দরকার মনে কর তবে তারা আমার সংগে যেতে পারবে। ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশ হয়ে আমি তোমাদের কাছে আসব, কারণ আমি ম্যাসিডোনিয়ার মধ্য দিয়েই যাব। হয়তো তোমাদের কাছে কিছু দিন থাকব, কিংবা শীতকালটা তোমাদের সংগেই কাটাব, যেন আমি যেখানেই যাই না কেন তোমরা আমার যাবার ব্যবস্থা করে দিতে পার। যাবার পথে এখন আমি তোমাদের সংগে দেখা করতে চাই না, কারণ আমি আশা করি আমি তোমাদের সংগে বেশ কিছু দিন থাকব, ইন্‌শা-আল্লাহ্‌। পঞ্চাশত্তমী-ঈদ পর্যন্ত আমি ইফিষেই থাকব, কারণ যে কাজে প্রচুর ফল পাওয়া যায় সেই রকম কাজের জন্য একটা মস্ত বড় সুযোগ আমার সামনে এসেছে; অবশ্য অনেকে এতে বাধাও দিচ্ছে। তীমথিয় যদি আসেন তবে দেখো যেন তিনি তোমাদের মধ্যে নির্ভয়ে থাকতে পারেন, কারণ আমি যেমন প্রভুর কাজ করছি তিনিও তেমনি করছেন। এইজন্য কেউ যেন তাঁকে তুচ্ছ না করে। তোমরা তাঁকে শান্তিতে পাঠিয়ে দিয়ো, যেন তিনি আমার কাছে আসতে পারেন। তিনি ভাইদের সংগে আসবেন বলে আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি এবার ভাই আপোল্লোর সম্বন্ধে বলছি। আমি তাঁকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম যেন তিনি ভাইদের সংগে তোমাদের কাছে যান, কিন্তু এখন তিনি কোনমতেই যেতে চাইলেন না। পরে সুযোগ পেলেই তিনি যাবেন। তোমরা সতর্ক থাক, ঈমানে স্থির থাক, সাহসী ও বলবান হও। তোমরা যা কিছু কর না কেন মহব্বতের মনোভাব নিয়েই কোরো। ভাইয়েরা, তোমরা তো জান, স্তিফানের পরিবারের লোকেরাই আখায়া প্রদেশের প্রথম ঈমানদার। আল্লাহ্‌র বান্দাদের সেবা করবার জন্য তাঁরা নিজেদের কোরবানী দিয়েছেন। সেইজন্য এই রকম লোকদের অধীনতা স্বীকার করতে আমি তোমাদের অনুরোধ করছি। আর অন্য যাঁরা এই কাজে যোগ দিয়ে কঠিন পরিশ্রম করেন তাঁদেরও অধীনতা স্বীকার কর। স্তিফান, ফর্তুনাত আর আখায়িক এসেছেন বলে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ তোমরা না থাকবার অভাব তাঁরাই পূরণ করেছেন। তাঁরা আমার আর তোমাদের দিলে উৎসাহ এনেছেন। তোমরা এই রকম লোকদের সম্মান কোরো। এশিয়া প্রদেশের জামাতগুলোর লোকেরা তোমাদের সালাম জানাচ্ছে। আকিলা, প্রিষ্কিল্লা আর তাঁদের ঘরের জামাতের লোকেরা প্রভুর মহব্বতের সংগে তোমাদের আন্তরিক সালাম জানাচ্ছেন। সমস্ত ভাইয়েরাও তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা একে অন্যকে সালাম জানায়ো। আমি পৌল আমার নিজের হাতে এই সালামের কথা লিখলাম। যদি কেউ প্রভুকে মহব্বত না করে তবে তার উপর বদদোয়া পড়ুক। আমাদের প্রভু আসুন। হযরত ঈসার রহমত তোমাদের উপরে থাকুক। তোমাদের সকলের জন্যই আমার ঈসায়ী মহব্বত রইল। ॥ভব আমি পৌল, আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় মসীহ্‌ ঈসার একজন সাহাবী হয়েছি। আমি এবং আমাদের ঈমানদার ভাই তীমথিয় করিন্থ শহরের আল্লাহ্‌র জামাত এবং আখায়া প্রদেশের আল্লাহ্‌র সব বান্দাদের কাছে এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ ও হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের আল্লাহ্‌ ও পিতার প্রশংসা হোক। তিনিই মমতায় পূর্ণ পিতা; তিনিই সমস্ত সান্ত্বনার আল্লাহ্‌। আমাদের সব দুঃখ-কষ্টে তিনি সান্ত্বনা দান করেন, যেন তাঁর কাছ থেকে পাওয়া সান্ত্বনা আমরা অন্যদের দুঃখ-কষ্টের সময়েও দিতে পারি। মসীহের মত করে আমরা যেমন অনেক কষ্ট সহ্য করছি তেমনি তাঁর মধ্য দিয়ে অনেক সান্ত্বনাও পাচ্ছি। আমরা যে কষ্ট ভোগ করি তা তোমাদের সান্ত্বনা ও উদ্ধারের উদ্দেশ্যেই করি। আমরা যে সান্ত্বনা পাই তা তোমাদের সান্ত্বনার উদ্দেশ্যেই পাই। যখন তোমরা আমাদের মত করে একই কষ্ট ভোগ করবে তখন এ সান্ত্বনা সেই কষ্ট ধৈর্যের সংগে সহ্য করতে সাহায্য করবে। তোমাদের সম্বন্ধে আমাদের স্থির বিশ্বাস আছে, কারণ তোমরা যেমন আমাদের কষ্টের ভাগী তেমনি আমাদের সান্ত্বনারও ভাগী। এশিয়া প্রদেশে আমরা যে কষ্টে পড়েছিলাম, আমরা চাই তা যেন তোমরা জানতে পার। সেখানে সহ্যের অতিরিক্ত এমন চাপ আমাদের উপর পড়েছিল যে, বাঁচবার আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম যে, এবার আমরা নিশ্চয়ই মারা যাব। কিন্তু এই অবস্থা আমাদের এইজন্য হয়েছিল যেন আমরা নিজেদের উপর ভরসা না করে আল্লাহ্‌, যিনি মৃতদের জীবিত করে তোলেন, তাঁর উপর ভরসা করি। এক ভীষণ মৃত্যুর হাত থেকে তিনি আমাদের রক্ষা করেছিলেন এবং এখনও করছেন। আমরা তাঁর উপর এই আশা রাখি যে, তিনি সব সময়ই আমাদের রক্ষা করতে থাকবেন। আর তোমরাও আমাদের জন্য মুনাজাত করে আমাদের সাহায্য কোরো। তাহলে অনেকের মুনাজাতের ফলে আমরা যে দোয়া পাব তার দরুন আমাদের জন্য অনেকেই আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাবে। আমরা যে জন্য গর্ব বোধ করি তা এই- আমাদের বিবেক এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র দেওয়া পবিত্রতায় এবং সরলতায় আমরা সব মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে জীবন কাটিয়েছি। সেই জীবন আমরা জাগতিক জ্ঞানের পরিচালনায় কাটাই নি বরং আল্লাহ্‌র রহমতের পরিচালনায় কাটিয়েছি। এই কথা যে সত্যি তা জেনে আমি আগেই তোমাদের কাছে যাব বলে ঠিক করেছিলাম, যেন তোমরা দু’বার দোয়া পেতে পার। আমি ঠিক করেছিলাম যে, ম্যাসিডোনিয়া যাবার পথে তোমাদের সংগে দেখা করে যাব এবং ম্যাসিডোনিয়া থেকে আবার তোমাদের কাছেই ফিরে আসব, যেন তোমরা আমাকে এহুদিয়াতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পার। তোমরা কি মনে কর আমি কোন তামাশার মনোভাব নিয়ে এটা ঠিক করেছিলাম? সাধারণ মানুষ যেমন একই সময়ে “জ্বী” আবার “না” বলে, আমি কি তেমনি করে কোন কিছু ঠিক করি? আল্লাহ্‌ বিশ্বাসযোগ্য, এই কথা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি যে, তোমাদের কাছে আমাদের কথা একই সময়ে “জ্বী” এবং “না” হয় না। যাঁর কথা সীলবান, তীমথিয় এবং আমি তোমাদের কাছে তবলিগ করেছি সেই ঈসা মসীহ্‌ ইব্‌নুল্লাহ্‌, একই সময়ে “জ্বী” এবং “না” নন; তিনি সব সময় “জ্বী”। আল্লাহ্‌র সমস্ত ওয়াদা মসীহের মধ্য দিয়ে “জ্বী” হয়ে ওঠে। তাই আল্লাহ্‌র গৌরবের জন্য মসীহেরই মধ্য দিয়ে আমরা “আমিন” বলি। যিনি মসীহের সংগে আমাদের ও তোমাদের যুক্ত করে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তিনি হলেন আল্লাহ্‌। তিনিই আমাদের অভিষেক করেছেন, অর্থাৎ তাঁর নিজের সম্পত্তি হিসাবে তিনি আমাদের সীলমোহর করে রেখেছেন; আর যা কিছু আমাদের দেবেন তার প্রথম অংশ হিসাবে তিনি আমাদের দিলে পাক-রূহ্‌কে দিয়েছেন। আমার জীবনের কসম খেয়ে আমি আল্লাহ্‌কে সাক্ষী রেখে বলছি, শাস্তি থেকে তোমাদের রেহাই দেবার জন্যই আমি করিনে' ফিরে যাই নি। মালিকের মত করে আমরা যে তোমাদের ঈমানের উপর হাত দিচ্ছি তা নয়, বরং তোমরা যেন আনন্দ পাও সেইজন্যই তোমাদের সংগে কাজ করছি, কারণ ঈমানে তোমরা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছ। তাই আমি মনে মনে ঠিক করলাম, আবার তোমাদের দুঃখ দেবার জন্য তোমাদের কাছে যাব না, কারণ তোমাদেরই যদি আমি দুঃখ দিই তবে আমাকে আনন্দ দেবে কে? যাদের আমি দুঃখ দেব সেই তোমরা ছাড়া আমাকে আনন্দ দেবার যে আর কেউ নেই। যখন আমি যাব তখন যাদের কাছ থেকে আমার আনন্দ পাবার কথা তাদের কাছ থেকে আমি যেন দুঃখ না পাই, সেইজন্যই আমি এই কথা লিখেছিলাম। তোমাদের উপর আমার এই বিশ্বাস আছে যে, আমি যাতে আনন্দ পাই তোমরাও তাতে আনন্দ পাও। অনেক দুঃখ ও মনের ব্যথায় চোখের পানির ভিতর দিয়ে আমি তোমাদের কাছে লিখেছিলাম। তোমাদের দুঃখ দেবার জন্য আমি লিখি নি, বরং তোমাদের প্রতি আমার মহব্বত যে কত গভীর তা জানাবার জন্যই লিখেছিলাম। কেউ যদি আমাকে দুঃখ দিয়ে থাকে তবে কথাটা কড়া করে না বলে শুধু এটুকুই বলি যে, সে কেবল আমাকে দুঃখ দেয় নি, কিন্তু কিছু পরিমাণে তোমাদের সবাইকে দুঃখ দিয়েছে। তোমাদের বেশীর ভাগ লোক মিলে তাকে যে শাস্তি দিয়েছে তা-ই তার পক্ষে যথেষ্ট। তোমরা বরং এখন তাকে মাফ কর এবং সান্ত্বনা দাও, যেন অতিরিক্ত দুঃখে সে হতাশ হয়ে না পড়ে। তাই আমি বিশেষভাবে তোমাদের অনুরোধ করছি, তাকে যে তোমরা মহব্বত কর তা প্রমাণ করে দেখাও। আমি যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলাম তোমরা সব বিষয়ে বাধ্য আছ কিনা, আর এইজন্যই আমি তোমাদের কাছে লিখেছিলাম। কোন ব্যাপারে যদি কাউকে তোমরা মাফ কর তবে আমিও তাকে মাফ করি। আর সত্যিই যদি আমি কোন কিছু মাফ করে থাকি তবে মসীহের সামনে তোমাদের জন্যই তা করেছি, যেন শয়তান আমাদের উপরে কোন সুযোগ-সুবিধা না পায়। তার মতলবের কথা তো আমাদের অজানা নেই। আমি ত্রোয়া শহরে মসীহের বিষয় সুসংবাদ তবলিগ করতে গিয়ে দেখলাম যে, সেখানে কাজ করবার জন্য প্রভু আমাকে একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু তবুও আমি মনে শান্তি পাই নি, কারণ আমার ঈমানদার ভাই তীত সেখানে ছিলেন না। সেইজন্য ত্রোয়ার লোকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ম্যাসিডোনিয়ায় চলে গেলাম। আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া যে, আমরা মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছি বলে আল্লাহ্‌ তাঁর জয়-যাত্রায় সব সময় আমাদের চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মসীহ্‌কে জানা একটা সুগন্ধের মত। আল্লাহ্‌ তাঁর জয়-যাত্রায় সেই সুগন্ধ আমাদের মধ্য দিয়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে দেন। যারা নাজাত পাচ্ছে এবং যারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে আল্লাহ্‌র পক্ষে আমরা সত্যিসত্যিই মসীহের সুগন্ধ। কিন্তু যারা ধ্বংস হচ্ছে তাদের কাছে আমাদের সুগন্ধ হল মৃত্যুর গন্ধ, যার ফল হল অনন্ত মৃত্যু; আর যারা নাজাত পাচ্ছে তাদের কাছে আমরা জীবনের সুগন্ধ, যার ফল হল অনন্ত জীবন। এই কাজের যোগ্য কে? নিজেদের লাভের জন্য যারা আল্লাহ্‌র কালাম নিয়ে ব্যবসা করে আমরা সেই সব লোকদের মত নই; বরং মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে আল্লাহ্‌র সামনে আল্লাহ্‌র পাঠানো লোক হিসাবে আমরা খাঁটি দিল থেকে কথা বলি। আমরা এই সব কথা বলে কি আবার নিজেদের প্রশংসা করতে শুরু করছি? কোন কোন লোকের যেমন দরকার হয়ে থাকে, আমাদেরও কি সেই রকম তোমাদের কাছে বা তোমাদের কাছ থেকে প্রশংসার চিঠির দরকার হয়ে পড়েছে? কখনও না। আমাদের দিলের মধ্যে লেখা তোমরাই তো আমাদের চিঠি। সেই চিঠির কথা সবাই জানে এবং সবাই তা পড়েছে। তোমরাই যে মসীহের লেখা চিঠি আর আমাদের কাজের ফল তা পরিষ্কার দেখা যায়। এই চিঠি কালি দিয়ে লেখা হয় নি বরং জীবন্ত আল্লাহ্‌র রূহ্‌ দিয়েই লেখা হয়েছে। এটা কোন পাথরের ফলকের উপরে লেখা হয় নি, মানুষের দিলের উপরেই তা লেখা হয়েছে। মসীহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র উপর এই রকমের নিশ্চিত বিশ্বাসই আমাদের হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের নিজেদের কোন কিছু করবার শক্তি আছে বলে আমরা দাবি করতে পারি, বরং আমাদের সেই যোগ্যতা আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই আসে। একটা নতুন ব্যবস্থার কথা জানাবার জন্য তিনিই আমাদের যোগ্য করে তুলেছেন। এই ব্যবস্থা অক্ষরে অক্ষরে শরীয়ত পালনের ব্যাপার নয়, কিন্তু পাক-রূহের পরিচালনায় অন্তরের বাধ্যতার ব্যাপার; কারণ শরীয়ত মৃত্যু আনে, কিন্তু পাক-রূহ্‌ জীবন দান করেন। পাথরে লেখা যে ব্যবস্থার ফলে মৃত্যু আসে সেই ব্যবস্থা দেবার সময় আল্লাহ্‌র মহিমা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে মূসার মুখও আল্লাহ্‌র মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছিল। সেই উজ্জ্বলতা যদিও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিল তবুও বনি-ইসরাইলরা মূসার মুখের দিকে তাকাতে পারে নি। যদি এই ব্যবস্থার ফল এত মহিমাপূর্ণ হতে পারে, তবে পাক-রূহের কাজের ফল কি আরও মহিমাপূর্ণ হবে না? যে ব্যবস্থার দ্বারা মানুষকে দোষী বলে স্থির করা হয় তার কাজ যদি এত মহিমাপূর্ণ, তবে যে ব্যবস্থার দ্বারা মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় তার কাজ আরও কত না বেশী মহিমাপূর্ণ! আর সত্যিই, যা আগে মহিমাপূর্ণ ছিল, আসলে এখন তার কোন মহিমা নেই বললেই হয়, কারণ তার তুলনায় এখনকার ব্যবস্থার মহিমা আরও অনেক বেশী। যা শেষ হয়ে যাচ্ছিল তা যখন এত মহিমাপূর্ণ ছিল তখন যা চিরকাল থাকে তা আরও কত না বেশী মহিমাপূর্ণ! আমাদের এই রকম আশা আছে বলেই আমরা খোলাখুলিভাবে কথা বলি। আমরা মূসার মত নই, কারণ মূসা তাঁর মুখের উপর ঢাকা দিয়েছিলেন যেন তাঁর মুখের উজ্জ্বলতা কমে যাওয়া বনি-ইসরাইলরা দেখতে না পায়। কিন্তু সেই লোকদের মন কঠিন হয়েছিল। সেইজন্য আজও যখন সেই পুরানো ব্যবস্থার কথা তেলাওয়াত করা হয় তখন তাদের দিলের উপর সেই একই রকমের পর্দা থেকেই যায়, কারণ কেবল মসীহের সংগে যুক্ত হলেই সেই পর্দা সরে যায়। কিন্তু আজও মূসার তৌরাত শরীফ তেলাওয়াত করবার সময় বনি-ইসরাইলদের দিল সেই পর্দায় ঢাকা থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ যখন প্রভুর দিকে ফেরে তখন সেই পর্দা সরে যায়। এই প্রভুই হলেন পাক-রূহ্‌; আর যেখানেই প্রভুর রূহ্‌ সেখানেই স্বাধীনতা। এইজন্য আমরা যারা মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছি, আমরা সবাই খোলা মুখে আয়নায় দেখা ছবির মত করে প্রভুর মহিমা দেখতে দেখতে নিজেরাও মহিমায় বেড়ে উঠে বদলে গিয়ে তাঁরই মত হয়ে যাচ্ছি। প্রভুর, অর্থাৎ পাক-রূহের শক্তিতেই এটা হয়। এই ব্যবস্থার কথা জানাবার ভার আল্লাহ্‌ দয়া করে আমাদের দিয়েছেন বলে আমরা নিরাশ হই না। লোকে গোপনে যে সব লজ্জাপূর্ণ কাজ করে তা আমরা একেবারেই করি না। আমরা কোন কাজে ছলনা করি না, আল্লাহ্‌র কালামে কোন ভুলের ভেজাল দিই না। আমরা বরং আল্লাহ্‌র সত্য প্রকাশ করে তাঁরই সামনে সব মানুষের বিবেকের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য বলে তুলে ধরি। আমাদের সুসংবাদ যদি ঢাকা থাকে তবে যারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছেই ঢাকা থাকে। অ-ঈমানদার লোকদের মন এই যুগের দেবতা অন্ধ করে দিয়েছে যেন তারা সুসংবাদের নূর দেখতে না পায়। এই সুসংবাদে মসীহের মহিমা ফুটে উঠেছে, আর এই মসীহ্‌ই হলেন আল্লাহ্‌র হুবহু প্রকাশ। আমরা তো নিজেদের বিষয় তবলিগ করছি না, বরং তবলিগ করছি যে, ঈসা মসীহ্‌ই প্রভু এবং ঈসার জন্যই আমরা তোমাদের গোলাম হয়েছি। আমরা এই কথা তবলিগ করছি, কারণ যিনি বলেছিলেন, “অন্ধকার থেকে আলো হোক,” সেই আল্লাহ্‌ আমাদের দিলে জ্বলেছিলেন, যাতে তাঁর মহিমা বুঝবার নূর প্রকাশ পায়। এই মহিমাই মসীহের মুখমণ্ডলে রয়েছে। কিন্তু এই ধন মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে, আর আমরাই সেই মাটির পাত্র। মাটির পাত্রে তা রাখা হয়েছে যেন লোকে বুঝতে পারে যে, এই অসাধারণ মহাশক্তি আমাদের নিজেদের কাছ থেকে আসে নি বরং আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই এসেছে। সব দিক থেকেই আমাদের উপর চাপ পড়ছে, তবু আমরা ভেংগে পড়ছি না। বুদ্ধিহারা হলেও আমরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ছি না; অত্যাচারিত হলেও আল্লাহ্‌ আমাদের ত্যাগ করছেন না; মাটিতে আছড়ে ফেললেও আমরা ধ্বংস হচ্ছি না। আমরা সব সময় হযরত ঈসার মৃত্যু আমাদের শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, যেন আমাদের শরীরের মধ্যে ঈসার জীবনও প্রকাশিত হয়। আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের সব সময়ই ঈসার জন্য মৃত্যুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যেন আমাদের মৃত্যুর অধীন শরীরে ঈসার জীবনও প্রকাশিত হয়। সেইজন্য আমাদের মধ্যে মৃত্যু কাজ করছে কিন্তু তোমাদের মধ্যে জীবন কাজ করছে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “আমি ঈমান এনেছি বলেই কথা বলেছি।” এই একই রকম ঈমানের মনোভাব নিয়ে আমরাও ঈমান এনেছি বলে কথা বলছি, কারণ আমরা জানি, যিনি হযরত ঈসাকে জীবিত করেছিলেন তিনি তাঁর সংগে আমাদেরও জীবিত করবেন এবং তোমাদের সংগে আমাদেরও নিজের সামনে উপস্থিত করবেন। সব কিছু তোমাদের উপকারের জন্যই হয়েছে, যেন আল্লাহ্‌র যে রহমত অনেক লোকের উপর ঢেলে দেওয়া হয়েছে সেই রহমতের জন্য অনেকেই আল্লাহ্‌কে আরও বেশী করে শুকরিয়া জানায় এবং এইভাবে আল্লাহ্‌র গৌরব হয়। এইজন্য আমরা হতাশ হই না। যদিও আমাদের বাইরের শরীর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তবুও আমাদের ভিতরের মানুষ দিনে দিনে নতুন হয়ে উঠছে। এখন আমরা অল্পকালের জন্য যে সামান্য কষ্টভোগ করছি তার ফলে আমরা চিরকালের মহিমা লাভ করব। এই মহিমা এত বেশী যে, তা মাপা যায় না। যা দেখা যায় আমরা তার দিকে দেখছি না, বরং যা দেখা যায় না তার দিকেই দেখছি। যা দেখা যায় তা মাত্র অল্প দিনের, কিন্তু যা দেখা যায় না তা চিরদিনের। আমরা এই কথা জানি যে, এই দুনিয়াতে যে তাম্বুতে আমরা বাস করি, অর্থাৎ যে দুর্বল শরীরে আমরা আছি তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তবুও আল্লাহ্‌র দেওয়া একটা ঘর আমাদের আছে। এই ঘর মানুষের হাতের তৈরী নয়, তা বেহেশতে চিরকাল ধরেই আছে। এই শরীরে থাকা অবস্থায় আমরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছি এবং সমস্ত দিল দিয়ে চাইছি যেন বেহেশতের সেই নতুন শরীর দিয়ে আমাদের ঢাকা হয়; কারণ এই কথা সত্যি যে, সেই শরীর পেলে পর দেখা যাবে যে, আমরা উলংগ নই। সত্যিই এই দুর্বল শরীরে থাকা অবস্থায় আমরা বোঝার ভারে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছি। আমরা যে শরীরহীন হতে চাই তা নয়, বরং সেই নতুন শরীর দিয়ে ঢাকা হতে চাই, যেন আমাদের মৃত্যুর অধীন শরীর চিরকাল জীবিত থাকা শরীরে বদলে যায়। এরই জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তারই প্রথম অংশ হিসাবে তিনি পাক-রূহ্‌কে আমাদের দিয়েছেন। এইজন্য কখনও আমাদের সাহসের অভাব হয় না, আর আমরা বুঝতে পারছি যে, যতদিন আমরা এই শরীরের ঘরে বাস করব ততদিন প্রভুর কাছ থেকে দূরে থাকব। যা দেখা যায় আমরা তো তার দ্বারা চলি না, বরং ঈমানের দ্বারা চলাফেলা করি। আমাদের সাহস আছে আর আমরা শরীরের ঘর থেকে দূর হয়ে প্রভুর সংগে বাস করাই ভাল মনে করি। সেইজন্য আমরা শরীরের ঘরে বাস করি বা না করি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রভুকে খুশী করা। এর কারণ হল, মসীহের বিচার-আসনের সামনে আমাদের সকলের সব কিছু প্রকাশ করা হবে, যেন আমরা প্রত্যেকে এই শরীরে থাকতে যা কিছু করেছি, তা ভাল হোক বা খারাপ হোক, সেই হিসাবে তার পাওনা পাই। প্রভুকে ভয় করি বলে আমরা নিজেদের সম্বন্ধে মানুষের মনে ঈমান জন্মাবার চেষ্টা করি। আমরা যা, তা তো আল্লাহ্‌র কাছে স্পষ্ট এবং আমি আশা করি তোমাদের বিবেকের কাছেও তা স্পষ্ট। এতে অবশ্য আমরা তোমাদের কাছে আবার নিজেদের প্রশংসা করছি না বরং আমাদের নিয়ে তোমাদের গর্ববোধ করবার কারণ দেখাচ্ছি, যেন দিল না দেখে যারা বাইরের চেহারা দেখে গর্ববোধ করে তাদের তোমরা একটা জবাব দিতে পার। যদি আমরা পাগল হয়ে গিয়ে থাকি তবে তা আল্লাহ্‌র জন্যই হয়েছি, আর যদি সুস্থ মনে থাকি তবে তা তোমাদের জন্যই রয়েছি। মসীহের মহব্বতই আমাদের বশে রেখে চালাচ্ছে, কারণ আমরা নিশ্চয় করে বুঝেছি যে, সকলের হয়ে একজন মরলেন, আর সেইজন্য সকলেই মরল। তিনি সবার হয়ে মরেছিলেন যেন যারা জীবিত আছে তারা আর নিজেদের জন্য বেঁচে না থাকে, বরং যিনি তাদের জন্য মরেছিলেন ও জীবিত হয়েছেন তাঁরই জন্য বেঁচে থাকে। সেইজন্য এখন থেকে মানুষকে আমরা আর তার বাইরের অবস্থা দেখে বিচার করি না। অবশ্য মসীহ্‌কে আমরা আগে সেইভাবেই বিচার করেছিলাম, কিন্তু এখন আর তা করি না। যদি কেউ মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে থাকে তবে সে নতুনভাবে সৃষ্ট হল। তার পুরানো সব কিছু মুছে গিয়ে সব নতুন হয়ে উঠেছে। এই সব আল্লাহ্‌ থেকেই হয়। তিনি মসীহের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের সংগে আমাদের মিলিত করেছেন, আর তাঁর সংগে অন্যদের মিলন করিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাদের উপর দিয়েছেন। এর অর্থ হল, আল্লাহ্‌ মানুষের গুনাহ্‌ না ধরে মসীহের মধ্য দিয়ে নিজের সংগে মানুষকে মিলিত করছিলেন, আর সেই মিলনের খবর জানাবার ভার তিনি আমাদের উপর দিয়েছেন। সেইজন্যই আমরা মসীহের দূত হিসাবে তাঁর হয়ে কথা বলছি। আসলে আল্লাহ্‌ যেন নিজেই আমাদের মধ্য দিয়ে লোকদের কাছে অনুরোধ করছেন। তাই মসীহের হয়ে আমরা এই মিনতি করছি, “তোমরা আল্লাহ্‌র সংগে মিলিত হও।” ঈসা মসীহের মধ্যে কোন গুনাহ্‌ ছিল না; কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাদের গুনাহ্‌ তাঁর উপর তুলে দিয়ে তাঁকেই গুনাহের জায়গায় দাঁড় করালেন, যেন মসীহের সংগে যুক্ত থাকবার দরুন আল্লাহ্‌র পবিত্রতা আমাদের পবিত্রতা হয়। আল্লাহ্‌র সহকর্মী হিসাবে আমরা তোমাদের এই অনুরোধ করছি, তোমরা যখন আল্লাহ্‌র রহমত পেয়েছ তখন তা নিষ্ফল হতে দিয়ো না। আল্লাহ্‌ পাক-কিতাবে বলেছেন, “উপযুক্ত সময়ে আমি তোমার কথা শুনেছি এবং নাজাত পাবার দিনে আমি তোমাকে সাহায্য করেছি।” দেখ, এখনই উপযুক্ত সময়, আজই নাজাত পাবার দিন। মসীহের জন্য আমরা যে কাজ করি তার যেন নিন্দা না হয় সেইজন্য আমরা এমন কিছু করি না যার দ্বারা কেউ কোন রকমে মনে বাধা পায়। তার চেয়ে বরং সব ব্যাপারেই আল্লাহ্‌র সেবাকারী বলে আমরা নিজেদের প্রমাণ করি। জুলুম, বিপদ ও কষ্টের মধ্যে অনেক ধৈর্য ধরে আমরা এই প্রমাণই দিচ্ছি। কতবার আমাদের মারধর করা হয়েছে, কতবার জেলে দেওয়া হয়েছে, কত দাংগা-হাংগামা আমাদের উপর দিয়ে গেছে, কত পরিশ্রম করেছি, কত রাত আমরা না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি এবং কতবার না খেয়ে থেকেছি। এছাড়া আমাদের খাঁটি জীবন দ্বারা, আমাদের জ্ঞান, সহ্যগুণ ও দয়া দ্বারা, পাক-রূহ্‌ দ্বারা, আমাদের খাঁটি মহব্বত দ্বারা, সত্যের তবলিগ দ্বারা এবং আল্লাহ্‌র শক্তি দ্বারা আমরা প্রমাণ দিচ্ছি যে, আমরা আল্লাহ্‌র সেবাকারী। আবার দুই হাতে ন্যায়ের অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিয়ে আমরা প্রমাণ করছি যে, আমরা আল্লাহ্‌র সেবাকারী। লোকে আমাদের সম্মান করুক বা অসম্মান করুক, আমাদের বিষয়ে ভাল বলুক বা খারাপ বলুক, আমরা প্রমাণ করছি যে, আমরা আল্লাহ্‌র সেবাকারী। লোকে আমাদের ঠগ বলে, কিন্তু আসলে আমরা সত্যের পথে চলি। লোকে আমাদের চিনতে চায় না, কিন্তু সবাই আমাদের চেনে। আমরা মরবার মত হচ্ছি, তবুও বেঁচে আছি। আমাদের মারধর করা হচ্ছে, তবুও হত্যা করা হচ্ছে না। আমরা অনেক দুঃখ পাচ্ছি. তবুও আমাদের দিল সব সময় আনন্দে ভরা। আমরা নিজেরা গরীব, তবুও আমরা অনেককে ধনী করছি। আমাদের কিছুই নেই, তবুও আমরা সব কিছুর অধিকারী। এইভাবেই আমরা প্রমাণ করছি যে, আমরা আল্লাহ্‌র সেবাকারী। করিন্থীয় ঈমানদারেরা, আমরা তোমাদের কাছে খোলাখুলিভাবেই কথা বলেছি এবং তোমাদের কাছে আমাদের দিল সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরেছি। আমরা আমাদের দিল তোমাদের জন্য খুলে রেখেছি, কিন্তু তোমরা তোমাদের দিল আমাদের বিরুদ্ধে বন্ধ করে রেখেছ। আমার সন্তান হিসাবে আমি তোমাদের বলছি, আমরা যেমন তোমাদের জন্য আমাদের দিল খুলে রেখেছি তোমরাও তেমনি তোমাদের দিল আমাদের জন্য খুলে দাও। তোমরা অ-ঈমানদারদের সংগে একই জোয়ালে কাঁধ দিয়ো না। ন্যায়ের সংগে অন্যায়ের যোগ কোথায়? নূর ও অন্ধকারের মধ্যে কি যোগাযোগ আছে? মসীহের সংগে বলীয়ালের, অর্থাৎ শয়তানের মিলই বা কোথায়? আল্লাহ্‌র বান্দা হিসাবে ঈমানদারের যে অধিকার তাতে অ-ঈমানদারের অংশ কি? আর আল্লাহ্‌র থাকবার ঘরে প্রতিমার স্থান কোথায়? আমরা তো জীবন্ত আল্লাহ্‌র থাকবার ঘর। পাক-কিতাবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আমি আমার লোকদের মধ্যে বাস করব, আর তাদেরই সংগে চলাফেরা করব। আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব, আর তারা আমার নিজের বান্দা হবে।” আল্লাহ্‌ আরও বলেছেন, “এইজন্য তোমরা অ-ঈমানদারদের মধ্য থেকে বের হয়ে এস ও আলাদা হও। কোন হারাম জিনিস ছুঁয়ো না, তাহলে আমি তোমাদের গ্রহণ করব।” এছাড়া “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আমি তোমাদের পিতা হব আর তোমরা আমার ছেলেমেয়ে হবে।’ ” প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের জন্য এই সব ওয়াদা করা আছে বলে এস, আমরা শরীর ও দিলের সমস্ত নাপাকী থেকে নিজেদের পাক-সাফ করি এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ে পরিপূর্ণ পবিত্রতার পথে এগিয়ে চলি। তোমাদের দিলে আমাদের জন্য জায়গা কর। আমরা তো কারও প্রতি অন্যায় করি নি, কারও ক্ষতি করি নি এবং কাউকে ঠকাই নি। অবশ্য এই কথা আমি তোমাদের দোষী করবার জন্য বলছি না। আমি তো আগেই বলেছি, তোমরা আমাদের কাছে এত প্রিয় যে, আমরা তোমাদের সংগে মরতেও রাজী, বাঁচতেও রাজী। তোমাদের উপর আমার খুব বিশ্বাস আছে এবং তোমাদের জন্য আমি খুব গর্ববোধ করছি। আমাদের সব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আমার আনন্দ উপ্‌চে পড়ছে এবং আমি খুব সান্ত্বনা পেয়েছি। ম্যাসিডোনিয়ায় পৌঁছেও আমাদের শরীর বিশ্রাম পায় নি; সব দিক থেকেই আমরা কষ্ট পেয়েছি- চারদিকে ছিল গণ্ডগোল আর দিলে ছিল ভয়। তবে আল্লাহ্‌, যিনি দুঃখিতদের সান্ত্বনা দান করেন, তিনি তীতের আসবার মধ্য দিয়ে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। কেবল তা-ই নয়, তীত নিজে তোমাদের দ্বারা সান্ত্বনা পেয়েছেন বলে আমরাও সান্ত্বনা পেয়েছি। তোমাদের আগ্রহ ও দুঃখের কথা তিনি আমাদের বলেছেন এবং জানিয়েছেন যে, তোমরা আমার জন্য খুব চিন্তা-ভাবনা করছ, আর তাতে আমি আরও আনন্দ পেয়েছি। যদিও আমি আমার আগের চিঠির দ্বারা তোমাদের দুঃখ দিয়েছিলাম তবুও আমি দুঃখিত নই। যখন আমি দেখলাম যে, ঐ চিঠি কিছুকালের জন্য হলেও তোমাদের দুঃখ দিয়েছে তখন অবশ্য আমি কিছুটা দুঃখিত হয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি আনন্দিত। তোমরা দুঃখ পেয়েছিলে বলে আমি আনন্দিত নই, বরং তোমরা দুঃখিত হয়ে তওবা করেছ বলে আনন্দিত হয়েছি। আল্লাহ্‌র ইচ্ছামতই তোমরা এই দুঃখ পেয়েছিলে, আর সেইজন্য আমাদের দ্বারা তোমাদের কোন ক্ষতি হয় নি। আল্লাহ্‌ যে দুঃখ দেন তাতে গুনাহ্‌ থেকে মন ফেরে এবং তার ফলে নাজাত পাওয়া যায়, আর তাতে দুঃখ করবার কিছু থাকে না। কিন্তু দুনিয়ার দেওয়া দুঃখ মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। ভেবে দেখ, আল্লাহ্‌ যখন তোমাদের দুঃখ দিয়েছিলেন তখন তোমরা পিছিয়ে পড় নি, তখন নির্দোষ বলে নিজেদের প্রমাণ করবার জন্য তোমাদের কত ইচ্ছা হয়েছিল, গুনাহের প্রতি কত ঘৃণা জেগেছিল, মনে কত ভয় হয়েছিল, কত আগ্রহ জেগেছিল, কত চিন্তা-ভাবনা হয়েছিল এবং গুনাহের শাস্তি দেবার জন্য কত ইচ্ছা হয়েছিল। এইভাবে সব দিক থেকেই তোমরা প্রমাণ করেছিলে যে, সেই ব্যাপারে তোমরা নির্দোষ। আমি সেই চিঠি লিখেছিলাম বটে, কিন্তু যে অন্যায় করেছে বা যার উপর অন্যায় করা হয়েছে তার জন্য লিখি নি, বরং লিখেছিলাম যেন আল্লাহ্‌র সামনে তোমাদের কাছে প্রকাশিত হয় যে, তোমরা সত্যিই আমাদের মহব্বত কর। এর মধ্য দিয়ে আমরা সান্ত্বনা পেয়েছি। সেই সান্ত্বনার সংগে তীতের আনন্দ দেখে আমরাও আনন্দিত হয়েছি, কারণ তোমাদের সকলের কাছ থেকে তিনি মনে খুব শান্তি পেয়েছেন। আমি খুশী হয়েছি, কারণ তোমাদের নিয়ে আমি তাঁর কাছে গর্ব করেছিলাম, আর তাতে আমাকে লজ্জা পেতে হয় নি। তার বদলে তোমাদের কাছে বলা আমাদের সব কথা যেমন সত্যি ছিল, তেমনি তীতের কাছে তোমাদের নিয়ে আমাদের গর্বও সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। তোমরা সবাই যেভাবে ভয় ও সম্মানের সংগে তাঁকে গ্রহণ করে বাধ্যতা দেখিয়েছিলে, তা মনে করে তোমাদের প্রতি তাঁর মহব্বত আরও বেড়ে গেছে। আমি খুশী হয়েছি, কারণ সব ব্যাপারেই আমি তোমাদের উপর ভরসা করতে পারি। ভাইয়েরা, ম্যাসিডোনিয়ার জামাতগুলো আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে বিশেষ রহমত পেয়েছে সেই বিষয়ে আমরা তোমাদের জানাচ্ছি। অনেক কষ্টভোগ করবার মধ্য দিয়ে যদিও তাদের খুব পরীক্ষা চলছিল এবং যদিও তারা খুব গরীব ছিল, তবুও তাদের মনে এত আনন্দ ছিল যে, তারা খোলা হাতে দান করেছিল। আমি তাদের পক্ষে এই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তারা ইচ্ছা করেই নিজেদের সাধ্যমত, এমন কি, সাধ্যের অতিরিক্তও দান করেছিল। তারা খুব আগ্রহের সংগে আমাদের কাছে অনুরোধ করেছিল যেন আল্লাহ্‌র যে লোকেরা অভাবের মধ্যে আছে তাদের অভাব মিটাবার কাজে তারা অংশগ্রহণ করবার সুযোগ পায়। আমাদের আশার অতিরিক্ত তারা দান করেছিল- তারা নিজেদেরই প্রথমে প্রভুর কাছে ও পরে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত আমাদের কাছে দিয়ে দিয়েছিল। এ দেখে আমরা তীতকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম, দান করবার যে কাজ তিনি তোমাদের মধ্যে শুরু করেছিলেন তা যেন তিনি শেষ করেন। সব কিছু, অর্থাৎ বিশ্বাস, আল্লাহ্‌র বিষয়ে বলবার ক্ষমতা, জ্ঞান, আগ্রহ এবং আমাদের প্রতি মহব্বত যেমন তোমাদের প্রচুর পরিমাণে আছে ঠিক তেমনি দান করবার গুণও যেন তোমাদের উপ্‌চে পড়ে। এই কথা যে আমি হুকুম হিসাবে বলছি তা নয়, কিন্তু অন্যদের আগ্রহের কথা তোমাদের জানিয়ে আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই তোমাদের মহব্বত কতখানি খাঁটি। তোমরা তো আমাদের হযরত ঈসা মসীহের রহমতের দানের কথা জান যে, তিনি নিজে ধনী হয়েও তোমাদের জন্য গরীব হলেন, যেন তাঁর গরীব হওয়ার মধ্য দিয়ে তোমরা ধনী হতে পার। তোমাদের পক্ষে যা ভাল সেই সম্বন্ধে আমি আমার মতামত জানাচ্ছি। তোমরাই গত বছর এই চাঁদা তুলতে শুরু করেছিলে এবং সেই কাজে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলে। এখন সেই কাজ শেষ কর। তোমরা যে আগ্রহ নিয়ে সেই কাজ করতে ইচ্ছা করেছিলে সেই একই আগ্রহ নিয়ে তোমাদের সাধ্যমত তা শেষ কর। যদি কারও দেবার ইচ্ছা থাকে তবে তার যা আছে সেই হিসাবেই তার দান আল্লাহ্‌ গ্রহণ করেন, তার যা নেই সেই হিসাবে নয়। আমি চাই না যে, অন্যেরা সুখে থাকে আর তোমরা কষ্টে থাক, বরং আমি চাই যেন তোমাদের সকলের অবস্থা সমান থাকে। এখন তোমাদের যা বেশী আছে তার দ্বারা তাদের অভাব মিটবে, আবার যখন তাদের বেশী হবে তখন তারা তোমাদের অভাব মিটাবে। এইভাবে সকলের অবস্থা সমান হবে। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “যারা অনেক কুড়ালো তাদের বেশী হল না আর যারা অল্প কুড়ালো তাদের কম পড়ল না।” তোমাদের জন্য আমার দিলে যে আগ্রহ আছে, ঠিক সেই আগ্রহ আল্লাহ্‌ তীতের দিলেও দিয়েছেন বলে আমি আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করি। তীত আমাদের অনুরোধ মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এই যে, তিনি নিজের ইচ্ছায় খুব আগ্রহের সংগে তোমাদের কাছে যাচ্ছেন। তীতের সংগে আমরা আর এক ভাইকেও পাঠাচ্ছি। ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগের কাজে সব জামাতই এই ভাইয়ের প্রশংসা করে থাকে। এই জামাতগুলো কেবল যে তাঁর প্রশংসা করেছে তা নয়, আমাদের সংগে এই দান নিয়ে যাবার জন্য জামাতগুলো তাঁকে বেছেও নিয়েছে। প্রভুর গৌরবের জন্য এবং অন্যদের সাহায্য করবার কাজে আগ্রহ দেখাবার জন্য আমরা এই দান নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি। এই বিরাট দান বিলি করবার ব্যাপারে কেউ যেন আমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারে সেইজন্য আমরা এই ভাইকেও পাঠাচ্ছি। আমরা কেবল প্রভুর সামনে নয়, কিন্তু মানুষের সামনেও সৎভাবে চলবার দিকে মনোযোগ দিই। তা ছাড়া তাঁদের সংগে আমরা আমাদের অন্য আর এক ভাইকেও পাঠাচ্ছি। তিনি যে আগ্রহী তা তিনি অনেক ব্যাপারে অনেক বার আমাদের কাছে প্রমাণ করেছেন। এখন তোমাদের উপর তাঁর খুব বেশী বিশ্বাস হয়েছে বলে তিনি আরও আগ্রহী হয়েছেন। তীতের সম্বন্ধে আমার যা বলবার আছে তা এই- তিনি আমার সংগী এবং আমার সংগে তিনি তোমাদের জন্য কাজ করেন। আর অন্য ভাইদের সম্বন্ধে আমার যা বলবার আছে তা এই- জামাতগুলো তাঁদের বেছে নিয়ে পাঠাচ্ছে। এই ভাইদের মধ্য দিয়ে মসীহের গৌরব হয়। তাই বলি, তাঁদের কাছে খোলাখুলিভাবেই তোমাদের মহব্বতের প্রমাণ দিয়ো এবং তাঁদের দেখায়ো কেন তোমাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, যাতে জামাতগুলো তা দেখতে পায়। আল্লাহ্‌র বান্দাদের জন্য দান দেবার যে কাজ চলছে সেই সম্বন্ধে তোমাদের কাছে লেখবার অবশ্য কোন দরকার নেই, কারণ এই কাজে তোমাদের আগ্রহের কথা আমার জানা আছে। আমি তোমাদের নিয়ে ম্যাসিডোনিয়ার লোকদের কাছে এই বলে গর্ব করি যে, গত বছর থেকে আখায়ার লোকেরা, অর্থাৎ তোমরা এই দানের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছ। তোমাদের এই আগ্রহ তাদের বেশীর ভাগ লোককে জাগিয়ে তুলেছে। আমি এই ভাইদের পাঠাচ্ছি যেন এই ব্যাপারে তোমাদের নিয়ে আমাদের যে গর্ব তা তাঁদের কাছে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, আর আমি যেভাবে বলেছি সেইভাবে যেন সত্যিই তোমরা প্রস্তুত থাকতে পার। তা না হলে ম্যাসিডোনিয়ার লোকেরা যদি আমার সংগে গিয়ে দেখে যে, তোমরা প্রস্তুত নও তবে তোমাদের উপর আমাদের এত ঈমানের জন্য আমরা লজ্জা পাব; অবশ্য তোমরাও লজ্জা পাবে। তাই আমি এই ভাইদের আগে তোমাদের কাছে যাবার জন্য অনুরোধ করা দরকার মনে করলাম, যেন তোমরা যে বিরাট দান দিতে ওয়াদা করেছিলে তার ব্যবস্থা তাঁরা আগেই করে রাখতে পারেন। এতে তোমাদের কাছ থেকে জোর করে আমাদের কিছু আদায় করতে হবে না, বরং তোমরা যা দেবে তা দান হিসাবে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে। মনে রেখ, যে অল্প বীজ বোনে সে অল্প ফসলই কাটবে আর যে বেশী বীজ বোনে সে বেশী ফসল কাটবে। প্রত্যেকে মনে মনে যা ঠিক করে রেখেছে সে যেন তা-ই দেয়। কেউ যেন মনে দুঃখ নিয়ে না দেয় বা দিতে হবে বলে না দেয়, কারণ যে খুশী মনে দেয় আল্লাহ্‌ তাকে মহব্বত করেন। তোমাদের সব রকম ভাবে রহমত করবার ক্ষমতা আল্লাহ্‌র আছে, যাতে তোমাদের যা কিছু দরকার তার সবই সব সময় তোমাদের থাকে; আর তার ফলে যেন তোমরা সব রকম ভাল কাজের জন্য খোলা হাতে দান করতে পার। পাক-কিতাবে লেখা আছে, সে খোলা হাতে গরীবদের দান করেছে; তার সততা চিরকাল স্থায়ী। যিনি চাষীর জন্য বীজ ও খাবারের জন্য রুটি যোগান তিনি তোমাদের বুনবার জন্য বীজও যোগাবেন এবং তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন। আর তিনি তোমাদের সৎ কাজের ফল প্রচুর পরিমাণে দেবেন। তোমরা সব দিক থেকেই ধনী হবে যাতে তোমরা খোলা হাতে দান করতে পার, আর তাতেই আমাদের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানানো হবে। তোমাদের এই কাজের ফলে যে কেবল আল্লাহ্‌র বান্দাদের অভাব পূরণ হবে তা নয়; আল্লাহ্‌র প্রতি অনেক লোকের কৃতজ্ঞতাও উপ্‌চে পড়বে। তোমরা যে বিশ্বস্ত, তোমাদের এই দান করা তা প্রমাণ করবে, আর তা দেখে তারা আল্লাহ্‌র গৌরব করবে, কারণ তোমরা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদের উপর ঈমান এনে তার বাধ্য হয়েছ এবং তোমরা খোলা হাতে তাদের ও অন্য সবাইকে দান করেছ। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তোমরা যে অশেষ রহমত পেয়েছ তার জন্য তারা সমস্ত দিল দিয়ে তোমাদের জন্য মুনাজাত করবে। যে দানের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না আল্লাহ্‌র সেই দানের জন্য তাঁর প্রশংসা হোক। মসীহের নম্র ও দয়ালু দিলের কথা মনে রেখে আমি পৌল নিজেই তোমাদের অনুরোধ করছি। লোকে বলে, আমি যখন তোমাদের কাছে থাকি তখন নাকি ভয়ে ভয়ে কাটাই, কিন্তু যখন থাকি না তখন সাহসী হই। যারা মনে করে আমরা সাধারণ মানুষের মত জীবন কাটাচ্ছি, তাদের বিরুদ্ধে যতখানি সাহস দেখানো আমি দরকার বলে মনে করি, আমি চাই যেন আমি আসলে পর ততখানি সাহস আমাকে দেখাতে না হয়। যদিও আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ তবুও আমরা যে যুদ্ধ করছি তা রক্ত-মাংসের যুদ্ধ নয়। সাধারণ মানুষ যে সব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে আমরা তা দিয়ে যুদ্ধ করছি না, কিন্তু আল্লাহ্‌র শক্তিতে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কেল্লা পর্যন্ত ভেংগে ফেলতে পারে। আমরা মানুষের মিথ্যা যুক্তি নষ্ট করি এবং আল্লাহ্‌কে জানবার পথে বাধা হিসাবে যে সব চিন্তা অহংকারে মাথা তুলে দাঁড়ায় তা ধ্বংস করি; আর মনের প্রত্যেকটি চিন্তাকে বন্দী করে মসীহের বাধ্য করি। যখন তোমরা পূর্ণ বাধ্যতায় আসবে তখনও যারা অবাধ্য থাকবে তাদের আমরা শাস্তি দিতে প্রস্তুত হব। তোমরা তো বাইরের চেহারা দেখছ। কেউ যদি নিজেকে মসীহের বলে বিশ্বাস করে তবে এটাও তার চিন্তা করা উচিত যে, সে যেমন মসীহের তেমনি আমরাও মসীহের লোক। প্রভু আমাদের যে অধিকার দিয়েছেন সেই অধিকারের উদ্দেশ্য হল তোমাদের গড়ে তোলা, তোমাদের ক্ষতি করা নয়। যদিও আমি এই অধিকার নিয়ে কিছুটা গর্ব করে থাকি তবুও তার জন্য আমি লজ্জা পাব না। আমার এই কথার জন্য মনে কোরো না যে, আমি চিঠির মধ্য দিয়ে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছি। কোন কোন লোক বলে, “তার চিঠিগুলো মনে দাগ কাটে এবং তা শক্তিশালীও বটে, কিন্তু সে কাছে থাকলে দেখা যায়, সে দুর্বল এবং তার কথা শোনবার মত এমন কিছু নয়।” এই রকম লোক বুঝুক যে, আমরা অনুপসি'ত থেকে আমাদের চিঠির মধ্য দিয়ে যে কথা বলছি, উপস্থিত হলে পর ঠিক তা-ই করব। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রশংসা করে থাকে। আমরা তাদের দলে নিজেদের ফেলতে বা তাদের সংগে নিজেদের তুলনা করতে সাহস করি না। কি মুর্খ তারা! কারণ তারা নিজেরা যা ভাল মনে করে তার সংগেই নিজেদের তুলনা করে ও তা দিয়েই নিজেদের বিচার করে। কিন্তু যতটুকু গর্ব করা উচিত তার বাইরে আমরা গর্ব করব না, বরং আল্লাহ্‌ আমাদের কাজের যে সীমানা ঠিক করে দিয়েছেন তার মধ্য থেকেই গর্ব করব; আর সেই সীমানার মধ্যে তোমরাও আছ। সেইজন্য তোমাদের কথা বলে যখন আমরা গর্ব করি তখন সীমার বাইরে কিছু বলি না। যদি আমরা তোমাদের কাছে না যেতাম তবে আমাদের এই রকম গর্ব করা সীমার বাইরে হত। কিন্তু আমরা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করতে করতে তোমাদের কাছেও গিয়েছিলাম। তা ছাড়া অন্যদের কাজ নিয়েও আমরা গর্ব করছি না- যদি করতাম তবে তা সীমার বাইরে হত। আমরা এই আশা করি যে, তোমাদের ঈমান বাড়বার সংগে সংগে আমরা তোমাদের মধ্যে আরও অনেক কাজ করতে পারব। তাতে তোমাদের কাছ থেকে গিয়ে আরও দূরের জায়গাগুলোতেও সুসংবাদ তবলিগ করতে পারব। এর ফলে কেউ বলতে পারবে না যে, অন্য লোকে যেখানে কাজ করেছে তাদের সেখানকার কাজের জন্য আমরা গর্ব করছি। কিন্তু কিতাবের কথামত, “যে গর্ব করে সে প্রভুকে নিয়েই গর্ব করুক”; কারণ নিজের প্রশংসা করবার দরুন কেউ ভাল বলে প্রমাণিত হয় না, বরং প্রভু যার প্রশংসা করেন সে-ই ভাল বলে প্রমাণিত হয়। আমি চাই তোমরা আমার একটুখানি বোকামি সহ্য কর। অবশ্য তোমরা তো সহ্য করছই। আমি তোমাদের জন্য আমার দিলে আল্লাহ্‌র দেওয়া এক গভীর জ্বালায় জ্বলছি, কারণ আমি মাত্র একজন বরের সংগে, অর্থাৎ মসীহের সংগে তোমাদের বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে রেখেছি, যেন সতী কনে হিসাবে তাঁর কাছেই তোমাদের তুলে দিতে পারি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যে, সেই সাপ তার দুষ্ট বুদ্ধি খাটিয়ে যেমন বিবি হাওয়াকে ভুলিয়েছিল সেইভাবে মসীহের প্রতি খাঁটি ও আন্তরিক ভয় থেকে কেউ হয়তো তোমাদেরও ভুলিয়ে নিয়ে যাবে। যে ঈসার কথা আমরা তবলিগ করেছি কেউ যখন তাঁকে ছাড়া অন্য কোন ঈসার কথা তোমাদের কাছে তবলিগ করে, কিংবা যে পাক-রূহ্‌কে তোমরা পেয়েছ তাঁকে ছাড়া আলাদা কোন রকম রূহ্‌ যখন তোমরা পাও, কিংবা যে সুসংবাদ তোমরা গ্রহণ করেছ তা থেকে আলাদা কোন রকম সুসংবাদ যখন তোমরা পাও, তখন তো দেখছি খুশী হয়েই সেই সব মেনে নাও। কিন্তু আমার তো মনে হয় না যে, আমি কোন দিক দিয়ে ঐ সব “বিশেষ” সাহাবীদের চেয়ে পিছনে পড়ে আছি। যদিও আমি খুব ভাল করে কথা বলতে পারি না তবুও আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে এবং তা সব রকম ভাবে সব কিছুতেই তোমাদের কাছে প্রকাশ করেছি। আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদের কথা আমি বিনামূল্যে তোমাদের কাছে তবলিগ করে নিজেকে নীচু করেছি যেন তোমাদের বড় করে দেখাতে পারি। এতে কি আমি গুনাহ্‌ করেছি? তোমাদের সেবা করবার জন্য আমি অন্যান্য জামাতের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছি, বলতে গেলে তাদের লুটই করেছি। তোমাদের কাছে থাকবার সময়ে যখন আমার অভাব হয়েছিল তখনও আমি কারও বোঝা হই নি, কারণ যে ভাইয়েরা ম্যাসিডোনিয়া থেকে এসেছিল তারাই আমার অভাব পূরণ করেছিল। কোন ব্যাপারেই আমি তোমাদের বোঝা হই নি এবং হবও না। আমার মধ্যে মসীহের যে সত্য আছে সেই অনুসারে আমি বলি যে, আখায়া প্রদেশের কোন জায়গাতেই আমার এই গর্ব করা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। কেন আমি এই কথা বলছি? তোমাদের মহব্বত করি না বলেই কি? আল্লাহ্‌ জানেন যে, আমি তোমাদের মহব্বত করি। যারা তাদের গর্বের বিষয় নিয়ে নিজেদের আমাদের সমান বলে দেখাতে চায় তারা যেন সেই সুযোগ না পায় সেইজন্যই আমি যা করছি তা করতেই থাকব। আসলে ঐ রকম লোকেরা তো ভণ্ড সাহাবী এবং ঠগ কর্মচারী। নিজেদের মসীহের সাহাবী বলে দেখাবার উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের বদলে ফেলে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ শয়তানও নিজেকে নূরে পূর্ণ ফেরেশতা বলে দেখাবার উদ্দেশ্যে নিজেকে বদলে ফেলে। তাহলে যারা শয়তানের সেবা করে তারা যদি নিজেদের বদলে ফেলে দেখায় যে, তারা ন্যায়ের সেবা করছে তবে তাতে আশ্চর্য হবার কি আছে? তাদের কাজের যা পাওনা শেষে তারা তা-ই পাবে। আমি আবার বলি, কেউ যেন আমাকে বোকা মনে না করে। অবশ্য যদি তোমরা তা-ই মনে করে থাক তবে বোকা হিসাবেই আমাকে গ্রহণ কর, যেন আমি একটুখানি গর্ব করতে পারি। আমি এখন যা বলছি তা প্রভুর হুকুম মত বলছি না, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে গর্ব করতে গিয়ে বোকার মতই বলছি। মানুষ যা নিয়ে গর্ব করে, অনেকেই যখন তা নিয়ে গর্ব করছে তখন আমিও করব না কেন? তোমরা জ্ঞানী বলে খুশী হয়ে বোকাদের সহ্য কর। শুধু তা-ই নয়, যদি কেউ তোমাদের গোলাম বানায়, তোমাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, তোমাদের ফাঁদে ফেলে, তোমাদের মালিক হয়ে দাঁড়ায় কিংবা তোমাদের গালে চড় মারে, তোমরা সেই সবও সহ্য কর। আমি লজ্জার সংগে স্বীকার করছি যে, এই সব ব্যাপারে আমরা তোমাদের প্রতি দুর্বল ছিলাম। যা নিয়ে অন্যেরা গর্ব করতে সাহস করে আমিও তা নিয়ে গর্ব করতে সাহস করি; এই কথা আমি বোকার মতই বলছি। যারা গর্ব করে তারা কি ইবরানী? আমিও তা-ই। তারা কি ইসরাইলীয়? আমিও তা-ই। তারা কি ইব্রাহিমের বংশধর? আমিও তা-ই। তারা কি মসীহের সেবাকারী? আমি আরও বেশী করে তা-ই। মনে রেখো, আমি মাথা-খারাপ লোকের মত কথা বলছি। মসীহের সেবা করতে গিয়ে আমি তাদের চেয়ে অনেক বেশী পরিশ্রম করেছি, আরও অনেক বার জেল খেটেছি, আরও অনেক বার মার খেয়েছি, অনেক বার মৃত্যুর মুখে পড়েছি। ইহুদীদের হাতে পাঁচ বার আমি ঊনচল্লিশ আঘাত চাবুক খেয়েছি, বেত দিয়ে তিন বার আমাকে মারা হয়েছে। এক বার আমাকে পাথর মারা হয়েছিল। তিন বার আমার জাহাজ-ডুবি হয়েছিল। একদিন ও একরাত আমি সমুদ্রের পানির মধ্যে ছিলাম। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। বন্যা, ডাকাত, নিজের জাতির লোক এবং অ-ইহুদীদের দরুন আমি বিপদে পড়েছি। তা ছাড়া শহরে, মরুভূমিতে, সমুদ্রে এবং ভণ্ড ভাইদের মধ্যেও আমি বিপদে পড়েছি। মসীহের সেবা করতে গিয়ে আমি কষ্টের মধ্যেও কঠিন পরিশ্রম করেছি। আমি অনেক রাত জেগেছি, খিদে ও পিপাসায় কষ্ট পেয়েছি, না খেয়ে থেকেছি, ঠাণ্ডায় ও কাপড়-চোপড়ের অভাবে কষ্ট পেয়েছি। বাইরের এই সব ব্যাপার ছাড়াও সব জামাতগুলোর জন্য রোজই আমার উপর চিন্তার চাপ পড়ছে। কেউ দুর্বল হলে আমি কি তার দুর্বলতার ভাগী হই না? কারও দরুন কেউ গুনাহে পড়লে আমি কি দিলে জ্বালা বোধ করি না? যদি আমাকে গর্ব করতেই হয় তবে আমি আমার দুর্বলতা নিয়েই গর্ব করব। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের আল্লাহ্‌ ও পিতা, যিনি চিরকাল গৌরব পাবার যোগ্য, তিনি জানেন আমি মিথ্যা কথা বলছি না। দামেস্কে বাদশাহ্‌ আরিতার নিযুক্ত শাসনকর্তা আমাকে ধরবার জন্য দামেস্কবাসীদের শহর পাহারা দেবার হুকুম দিয়েছিলেন। কিন্তু দেয়ালের মধ্যে যে জানালা ছিল তার মধ্য দিয়ে আমাকে ঝুড়িতে করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর এইভাবেই আমি তাঁর হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে আরও একটু গর্ব করতে হচ্ছে। যদিও তাতে কোন লাভ নেই তবুও প্রভু যে সব দর্শন আমাকে দেখিয়েছেন এবং যা কিছু আমার কাছে প্রকাশ করেছেন সেই বিষয়ে আমি এখন বলব। ঈসায়ী ঈমানদার একজন লোককে আমি চিনি। চৌদ্দ বছর আগে বেহেশত পর্যন্ত তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তখন সে তার শরীরের মধ্যে ছিল কি ছিল না তা আমি জানি না, আল্লাহ্‌ জানেন। এই লোকের সম্বন্ধে আমি গর্ব করব, কিন্তু আমার নিজের সম্বন্ধে গর্ব করব না, কেবল আমার দুর্বলতার বিষয়ে করব। অবশ্য যদি আমি গর্ব করতে চাই তবে বোকামি করব না, কারণ আমি সত্যি কথাই বলব। তবুও আমি গর্ব করব না, কারণ আমার কাজ দেখে বা আমার কথা শুনে লোকে আমাকে যা মনে করে তার চেয়ে বেশী যেন কেউ আমাকে মনে না করে। অনেক কিছু আমার কাছে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমি যেন অহংকারী না হই, সেই উদ্দেশ্যে আমাকে কষ্ট দেবার জন্য আমার শরীরে একটা কাঁটা, অর্থাৎ শয়তানের দূত দেওয়া হয়েছিল। প্রভুকে আমি তিন বার অনুরোধ করেছিলাম যেন তিনি আমার কাছ থেকে তা দূর করেন। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, “আমার রহমতই তোমার পক্ষে যথেষ্ট, কারণ দুর্বলতার মধ্য দিয়েই আমার শক্তি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়।” সেইজন্য আমার দুর্বলতা সম্বন্ধে আমি খুব খুশী হয়েই গর্ব করব, যেন মসীহের শক্তি আমার উপর থাকে। তাই মসীহের জন্য দুর্বলতায়, অপমানে, যন্ত্রণায়, অত্যাচারে এবং অসুবিধা-ভোগে আমি সন্তুষ্ট, কারণ যখন আমি দুর্বল তখনই আমি শক্তিশালী। আমি বোকা হয়েছি বটে, কিন্তু তোমরাই আমাকে তা হতে বাধ্য করেছ, কারণ তোমাদেরই উচিত ছিল আমার প্রশংসা করা। যদিও আমি কিছুই নই তবুও তোমাদের ঐ “বিশেষ” সাহাবীদের চেয়ে কোনমতেই ছোট নই। অনেক ধৈর্যের সংগে তোমাদের মধ্যে নানা রকম মহৎ চিহ্ন-কাজ ও কুদরতি কাজ করে আমি নিজেকে একজন সাহাবী বলে প্রমাণ করেছি। অন্যান্য জামাতের চেয়ে তোমরা কোন দিক দিয়েই ছোট নও; কেবল একটা বিষয়ে তোমরা ছোট, আর তা হল এই যে, আমি তোমাদের বোঝা হই নি। এই ভুলের জন্য আমাকে মাফ কর। আমি এখন এই তৃতীয় বার তোমাদের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। আমি তোমাদের বোঝা হব না, কারণ আমি তোমাদের কোন কিছু পেতে চাই না, তোমাদের পেতে চাই। ছেলেমেয়েরা যে তাদের মা-বাবার জন্য টাকা-পয়সা জমাবে তা নয় বরং ছেলেমেয়েদের জন্য টাকা-পয়সা জমানো মা-বাবারই উচিত। আমি খুব খুশী হয়েই তোমাদের জন্য আমার সব কিছু খরচ করব এবং নিজেকেও দিয়ে দেব। যদি আমি তোমাদের বেশী ভালবাসি তবে কি তোমরা আমাকে কম ভালবাসবে? যাহোক, আমি তোমাদের বোঝা হই নি, কিন্তু হয়তো কেউ তাতে বলবে যে, আমি চালাক বলে ছলনা করে তোমাদের ভুলিয়েছি। আমি যাদের তোমাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম তাদের কারও দ্বারা কি তোমাদের ঠকিয়েছি? আমি তীতকে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, আর তাঁর সংগে সেই ভাইকেও পাঠিয়েছিলাম। তীত কি তোমাদের ঠকিয়েছেন? কখনও না। আমি আর তীত কি একই মনোভাব নিয়ে একইভাবে কাজ করি নি? তোমাদের কি মনে হয় যে, এই চিঠির মধ্য দিয়ে আমরা তোমাদের কাছে নিজেদের পক্ষে কথা বলছি? মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে আমরা আল্লাহ্‌র সামনে কথা বলছি। প্রিয় বন্ধুরা, তোমাদের গড়ে তুলবার জন্যই আমরা এই সব বলছি। আমার ভয় হচ্ছে, আমি যখন তোমাদের কাছে আসব তখন আমি তোমাদের যে রকম দেখতে চাই হয়তো সেই রকম দেখতে পাব না, আর তোমরাও আমাকে যে রকম দেখতে চাও সেই রকম দেখতে পাবে না। আমার ভয় হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে ঝগড়া, হিংসা, মেজাজ দেখানো, দলাদলি, নিন্দা, পরের কথা নিয়ে আলোচনা, অহংকার এবং গোলমাল থাকবে। আমার ভয় হচ্ছে যে, আমি যখন আবার তোমাদের কাছে যাব তখন আমার আল্লাহ্‌ তোমাদের সামনে আমাকে লজ্জা দেবেন, আর যারা আগে গুনাহ্‌ করেছিল অথচ তাদের নাপাকী, জেনা ও লমপটতা থেকে তওবা করে নি, তাদের অনেকের জন্য আমি দুঃখ পাব। আমি এই তৃতীয় বার তোমাদের কাছে আসছি। কিতাবে লেখা আছে, “দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথায় এই সব বিষয় সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।” দ্বিতীয় বার আমি যখন তোমাদের কাছে ছিলাম তখন যারা আগে গুনাহ্‌ করেছিল তাদের এবং অন্যান্য সবাইকে আমি সাবধান করেছিলাম। এখন আমি উপস্থিত না থেকেও আবার তোমাদের সাবধান করে বলছি যে, আমি যখন আবার আসব তখন কাউকেই রেহাই দেব না, কারণ মসীহ্‌ যে আমার মধ্য দিয়ে কথা বলছেন তার প্রমাণ তোমরা চাইছ। তিনি তোমাদের ব্যাপারে দুর্বল নন, বরং তাঁর শক্তি তিনি তোমাদের মধ্যে দেখান। তাঁকে দুর্বল অবস্থায় ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌র শক্তিতে তিনি জীবিত আছেন। আমরা তাঁর সংগে যুক্ত হয়ে দুর্বল হয়েছি, কিন্তু তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌র শক্তিতে তাঁর সংগে আমরা জীবিত থাকব। তোমরা নিজেদের পরীক্ষা করে দেখ তোমরা সত্যি করে মসীহের উপর ঈমান এনেছ কি না। তোমরা নিজেদের যাচাই করে দেখ। তোমরা কি বোঝ না যে, মসীহ্‌ ঈসা তোমাদের দিলে আছেন? অবশ্য যাচাই করবার ফলে তোমরা যদি অখাঁটি বলে ধরা না পড়। কিন্তু আমি আশা করি তোমরা বুঝতে পারবে যে, আমরা খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়েছি। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করি যেন তোমরা কোন খারাপ কাজ না কর। অন্যেরা যাতে আমাদের খাঁটি বলে মনে করে সেইজন্যই যে আমরা এটা চাইছি তা নয়। আমরা চাই, তারা আমাদের খাঁটি বলে মনে না করলেও তোমরা যেন যা ভাল তা-ই কর। সত্যের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষমতা নেই কিন্তু সত্যের পক্ষে আছে। যখন আমরা দুর্বল হই আর তোমরা বলবান হও তখন আমরা আনন্দিত হই। আর আমরা মুনাজাত করি যেন তোমরা সব কিছু শুধ্‌রে নিয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাও। এইজন্য আমার অনুপসি'ত থাকবার সময়েই আমি তোমাদের কাছে এই সব লিখছি, যেন উপস্থিত হলে পর প্রভু আমাকে যে অধিকার দিয়েছেন তা কঠিনভাবে ব্যবহার করতে না হয়। সেই অধিকারের উদ্দেশ্য হল তোমাদের গড়ে তোলা, তোমাদের ক্ষতি করা নয়। ভাইয়েরা, এবার বিদায়। তোমরা তোমাদের সব কিছু শুধ্‌রে নিয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাও। আমার কথায় মনোযোগ দাও, তোমাদের একই মনোভাব হোক, আর তোমরা শান্তিতে থাক। তাহলে মহব্বত ও শান্তির আল্লাহ্‌ তোমাদের সংগে থাকবেন। মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা একে অন্যকে সালাম জানায়ো। আল্লাহ্‌র সব বান্দারা তোমাদের সালাম জানাচ্ছে। হযরত ঈসা মসীহের রহমত, আল্লাহ্‌র মহব্বত এবং পাক-রূহের যোগাযোগ-সম্বন্ধ তোমাদের সকলের দিলে থাকুক। ॥ভব আমি পৌল মসীহের একজন সাহাবী। এই সাহাবী-পদ কোন মানুষের কাছ থেকে বা কোন মানুষের মধ্য দিয়ে আমি পাই নি, বরং ঈসা মসীহ্‌ এবং পিতা আল্লাহ্‌, যিনি মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্য দিয়েই আমি তা পেয়েছি। আমি এবং আমার সংগে যে সব ঈমানদার ভাইয়েরা আছেন, আমরা সবাই গালাতিয়া জামাতগুলোর কাছে লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ্‌ এবং হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমাদের আল্লাহ্‌ ও পিতার ইচ্ছামত মসীহ্‌ আমাদের গুনাহের জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন, যেন তিনি এখনকার এই খারাপ দুনিয়ার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন। চিরকাল আল্লাহ্‌র গৌরব হোক। আমিন। মসীহের রহমতে যিনি তাঁর নিজের বান্দা হবার জন্য তোমাদের ডেকেছিলেন, তোমরা এত তাড়াতাড়ি তাঁকে ছেড়ে দিয়ে অন্য রকম সুসংবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছ দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। আসলে ওটা তো কোন সুসংবাদই নয়। তবুও কিছু লোক আছে যারা তোমাদের স্থির থাকতে দিচ্ছে না, আর মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ বদলাতে চাইছে। কিন্তু যে সুসংবাদ আমরা তোমাদের কাছে তবলিগ করেছি তা থেকে আলাদা কোন সুসংবাদ যদি তোমাদের কাছে তবলিগ করা হয়, তা আমরা নিজেরাই করি বা কোন ফেরেশতাই করেন, তবে তার উপর বদদোয়া পড়ুক। আমি যেমন আগেও বলেছি তেমনি এখন আবার বলছি, যে সুসংবাদ তোমরা গ্রহণ করেছ তা থেকে আলাদা কোন সুসংবাদ যদি কেউ তবলিগ করে তবে তার উপর বদদোয়া পড়ুক। আমি এতে কার প্রশংসা পাবার চেষ্টা করছি, মানুষের না আল্লাহ্‌র? না কি মানুষকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করছি? আমি যদি এখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করি তবে তো আমি মসীহের গোলাম নই। ভাইয়েরা, আমি তোমাদের জানাচ্ছি, আমি যে সুসংবাদ তবলিগ করেছি তা কোন মানুষের বানানো কথা নয়। আমি কোন লোকের কাছ থেকে তা পাই নি বা কেউ আমাকে তা শেখায় নি, বরং ঈসা মসীহ্‌ নিজেই আমার কাছে তা প্রকাশ করেছিলেন। ইহুদী ধর্ম পালন করবার সময় কিভাবে আমি জীবন কাটাতাম তা তো তোমরা শুনেছ। আর তোমরা এও শুনেছ যে, কি ভীষণ ভাবে আমি আল্লাহ্‌র জামাতের উপরে জুলুম করতাম ও তা ধ্বংস করবার চেষ্টা করতাম। আমার বয়সের অনেক ইহুদীর চেয়েও আমি সেই ধর্মে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এছাড়া আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যে সব নিয়ম চলে আসছে সেই বিষয়েও আমি খুবই উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমার জন্মের সময় থেকেই আমাকে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন এবং তাঁরই রহমতে সাহাবী হবার জন্য তিনি আমাকে ডেকেছিলেন। আমি যেন অ-ইহুদীদের কাছে মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করি, এইজন্য আল্লাহ্‌ যখন তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর পুুত্রকে আমার কাছে প্রকাশ করলেন তখন আমি কোন লোকের সংগে পরামর্শ করি নি। এমন কি, যাঁরা আমার আগে সাহাবী হয়েছিলেন আমি জেরুজালেমে তাঁদের কাছেও যাই নি। আমি তখন আরব দেশে চলে গিয়েছিলাম এবং পরে আবার দামেস্ক শহরে ফিরে এসেছিলাম। এর তিন বছর পরে আমি প্রথম বার পিতরের সংগে দেখা করবার জন্য জেরুজালেমে গিয়েছিলাম, আর সেখানে তাঁর সংগে পনেরো দিন ছিলাম। তখন প্রভুর ভাই ইয়াকুব ছাড়া অন্য কোন সাহাবীর সংগে আমার দেখা হয় নি। আল্লাহ্‌ সাক্ষী যে, আমি তোমাদের কাছে যা লিখছি তার কিছুই মিথ্যা নয়। তারপর আমি সিরিয়া ও কিলিকিয়ার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলাম। এহুদিয়ার ঈসায়ী জামাতগুলো আমাকে চিনত না। তারা কেবল এই কথা শুনেছিল, “যে লোক আমাদের উপর জুলুম করত সে এখন মসীহের উপর ঈমানের কথা তবলিগ করছে, অথচ তা সে আগে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।” আর তারা আমার দরুন আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। চৌদ্দ বছর পরে আমি বার্নাবাসের সংগে আবার জেরুজালেমে গেলাম, আর তীতকেও সংগে নিলাম। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা প্রকাশিত হবার পরে আমি সেখানে গেলাম। যে সুসংবাদ আমি অ-ইহুদীদের কাছে তবলিগ করে থাকি তা বললাম। জামাতের গণ্যমান্য লোকদের কাছে সেই সব গোপনেই বললাম, কারণ আমার ভয় হচ্ছিল যে, হয়তো আমি অনর্থক পরিশ্রম করছি বা করেছি। কিন্তু অ-ইহুদী হলেও আমার সংগী তীতকে খৎনা করাবার জন্য বাধ্য করা হয় নি। কয়েকজন ভণ্ড ভাই গোপনে ঢুকে পড়বার দরুন কথাটা উঠেছিল। মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানদার হিসাবে আমাদের যে স্বাধীনতা আছে সেই স্বাধীনতার দোষ ধরবার জন্যই এরা গোপনে ঢুকেছিল যেন আমাদের গোলাম বানাতে পারে। কিন্তু সুসংবাদের সত্য যেন তোমাদের জন্য রক্ষা করতে পারি তাই এক মুহুর্তের জন্যও আমরা তাদের কথা মেনে নিই নি। জামাতের গণ্যমান্য লোকেরা সুসংবাদের বিষয়ে নতুন কোন কিছুই আমাকে জানান নি। আসলে তাঁরা যা-ই হন না কেন তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আল্লাহ্‌ বাইরের চেহারা দেখে বিচার করেন না। যাহোক, তাঁরা দেখলেন, ইহুদীদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করবার ভার যেমন পিতরের উপর দেওয়া হয়েছিল, তেমনি অ-ইহুদীদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করবার ভার আল্লাহ্‌ আমার উপর দিয়েছেন। তাঁরা এটা দেখতে পেলেন, কারণ ইহুদীদের কাছে পিতরের সাহাবী-কাজের পিছনে যিনি ছিলেন সেই আল্লাহ্‌ অ-ইহুদীদের কাছে আমার সাহাবী-কাজের পিছনেও ছিলেন। সেই গণ্যমান্য লোকেরা, অর্থাৎ ইয়াকুব, পিতর ও ইউহোন্না এই সব দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বিশেষ রহমত পেয়েছি। তাঁদের ও আমাদের মধ্যে যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ আছে তা দেখাবার জন্য তাঁরা আমার ও বার্নাবাসের সংগে ডান হাত মিলালেন। তাঁরা রাজী হলেন যে, আমরা অ-ইহুদীদের কাছে যাব এবং তাঁরা নিজেরা ইহুদীদের কাছে যাবেন। তাঁদের একটা মাত্র অনুরোধ ছিল যে, আমরা যেন গরীবদের কথা মনে রাখি; অবশ্য আমারও সেই আগ্রহ ছিল। পিতর যখন এণ্টিয়ক শহরে আসলেন তখন তাঁর মুখের উপরেই আমি আপত্তি জানালাম, কারণ তিনি অন্যায় করেছিলেন। ঈমানদার ইহুদীদের যে দলটি অ-ইহুদীদের খৎনা করাবার উপর জোর দেয়, তাদের কয়েকজন ইয়াকুবের কাছ থেকে আসবার আগে পিতর অ-ইহুদীদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করতেন। কিন্তু যখন সেই দলের লোকেরা আসল তখন তিনি তাদের ভয়ে অ-ইহুদীদের সংগ ছেড়ে দিয়ে নিজেকে আলাদা করে নিলেন। এণ্টিয়কের অন্যান্য ঈমানদার ইহুদীরাও পিতরের সংগে এই ভণ্ডামিতে যোগ দিয়েছিল। এমন কি, বার্নাবাসও তাদের ভণ্ডামির দরুন ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন দেখলাম যে, সুসংবাদের সত্যের সংগে তাদের কাজের কোন মিল নেই তখন আমি সবার সামনে পিতরকে বললাম, “আপনি ইহুদী হয়েও যখন ইহুদীদের মত না চলে অ-ইহুদীদের মত চলেছেন তখন কেমন করে অ-ইহুদীদের ইহুদীদের মত চলতে বাধ্য করছেন? “আমরা ইহুদী, গুনাহ্‌গার অ-ইহুদী হয়ে জন্মগ্রহণ করি নি। কিন্তু তবুও আমরা এই কথা জানি যে, শরীয়ত পালনের জন্য আল্লাহ্‌ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন না, বরং ঈসা মসীহের উপর ঈমানের জন্যই তা করেন। সেইজন্য আমরাও মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমান এনেছি, যেন শরীয়ত পালনের জন্য নয় বরং মসীহের উপর ঈমানের জন্যই আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়; কারণ শরীয়ত পালন করবার ফলে কাউকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে না। “মসীহের মধ্য দিয়ে ধার্মিক বলে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হবার চেষ্টায় যদি দেখা যায়, অ-ইহুদীদের মত আমরাও গুনাহ্‌গার, তাহলে তার মানে কি এই যে, মসীহ্‌ গুনাহের সেবা করেন? কখনও না। যে জিনিস আমি ভেংগে ফেলেছি তা যদি আমি আবার তৈরী করি তবে তো আমি নিজেই নিজেকে দোষী বলে প্রমাণ করি। শরীয়তের দাবি-দাওয়ার কাছে শরীয়ত দ্বারাই আমার মৃত্যু হয়েছে যেন আমি আল্লাহ্‌র জন্য বেঁচে থাকতে পারি। আমাকে মসীহের সংগে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছে। তাই আমি আর জীবিত নই, মসীহ্‌ই আমার মধ্যে জীবিত আছেন। এখন এই শরীরে আমি যে জীবন কাটাচ্ছি তা ইব্‌নুল্লাহ্‌র উপর ঈমানের মধ্য দিয়েই কাটাচ্ছি। তিনি আমাকে মহব্বত করে আমার জন্য নিজেকে দান করেছিলেন। আল্লাহ্‌র এই রহমতকে আমি বাতিল করব না, কারণ মানুষ যদি শরীয়ত পালনের মধ্য দিয়েই আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হতে পারে তবে মসীহ্‌ মিথ্যাই মরেছিলেন।” ওহে অবুঝ গালাতীয়রা! কে তোমাদের জাদু করেছে? তোমাদের কাছে তো স্পষ্টভাবেই তবলিগ করা হয়েছে যে, ঈসা মসীহ্‌কে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল। আমি কেবল তোমাদের কাছ থেকে জানতে চাই, তোমরা শরীয়ত পালন করে কি পাক-রূহ্‌কে পেয়েছিলে, না সুসংবাদ শুনে ঈমান এনে পেয়েছিলে? তোমরা কি এতই অবুঝ? পাক-রূহের মধ্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু করে কি এখন নিজের চেষ্টায় পূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছ? তোমরা কি মিথ্যাই এত দুঃখভোগ করেছ? আমি আশা করি তোমাদের সেই দুঃখভোগ অনর্থক হয় নি। আল্লাহ্‌ কেন তোমাদের পাক-রূহ্‌ দিয়েছেন এবং তোমাদের মধ্যে এত অলৌকিক কাজ করছেন তা ভেবে দেখ। তোমরা শরীয়ত পালন করছ বলেই কি তিনি এই সব করছেন, নাকি সুসংবাদ শুনে ঈমান এনেছ বলে করছেন? ইব্রাহিমের কথা ভেবে দেখ। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “ইব্রাহিম আল্লাহ্‌র কথার উপর ঈমান আনলেন আর আল্লাহ্‌ সেইজন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” এইজন্য তোমরা এই কথা জেনো, যারা ঈমান আনে কেবল তারাই ইব্রাহিমের বংশধর। পাক-কিতাবে আগেই লেখা হয়েছিল, ঈমানের জন্যই আল্লাহ্‌ অ-ইহুদীদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন। ইব্রাহিমের কাছে এই কথা বলে আগেই সুসংবাদ জানানো হয়েছিল, “তোমার মধ্য দিয়েই সব জাতি দোয়া পাবে।” তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্‌র কথার উপর ঈমান এনে ইব্রাহিম যেমন দোয়া পেয়েছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর পর থেকে যারা ঈমান আনে তারাও সেই দোয়া পায়। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে শরীয়তে লেখা প্রত্যেকটি কথা পালন করে না।” তাহলে দেখা যায়, যারা শরীয়ত পালন করবার উপর ভরসা করে তাদের সকলের উপরে এই বদদোয়া রয়েছে। তা ছাড়া এটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, শরীয়ত পালন করবার জন্য আল্লাহ্‌ কাউকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন না, কারণ পাক-কিতাবের কথামত, “যাকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় সে ঈমানের মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।” ঈমানের সংগে শরীয়তের কোন সম্বন্ধ নেই। শরীয়ত বরং বলে, “যে লোক শরীয়ত মতে চলে সে তার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।” শরীয়ত অমান্য করবার দরুন যে বদদোয়া আমাদের উপর ছিল, মসীহ্‌ সেই বদদোয়া নিজের উপর নিয়ে আমাদের মুক্ত করেছেন। পাক-কিতাবে এই কথা লেখা আছে, “যাকে গাছে টাংগানো হয় সে বদদোয়াপ্রাপ্ত।” আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমকে যে দোয়া করেছিলেন সেই দোয়া মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে যেন অ-ইহুদীরাও পেতে পারে, আর যেন আমরা ঈমানের মধ্য দিয়ে ওয়াদা-করা পাক-রূহ্‌কে পেতে পারি, সেইজন্যই মসীহ্‌ সেই বদদোয়া নিজের উপর নিয়েছিলেন। ভাইয়েরা, আমি একটা সাধারণ কথা দিয়ে বিষয়টা বুঝাচ্ছি। একবার যখন মানুষের মধ্যে কোন চুক্তি পাকা করে ফেলা হয় তখন সেই চুক্তি কেউ বাতিল করতে পারে না বা তার সংগে কিছু যোগও দিতে পারে না। ইব্রাহিম ও তাঁর বংশের কাছে আল্লাহ্‌ ওয়াদা করেছিলেন। পাক-কিতাব বলে নি, “বংশগুলোর কাছে,” অর্থাৎ অনেক বংশের কাছে, বরং বলেছে, “তোমার বংশের কাছে,” অর্থাৎ একটি বংশের কাছে, আর সেই বংশের বংশধর হলেন মসীহ্‌। আমার কথার মানে হল, আল্লাহ্‌ ইব্রাহিমের সময়ে একটা ওয়াদাপূর্ণ ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন। তার চারশো ত্রিশ বছর পরে শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে আগের সেই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল না; কাজেই তার ওয়াদা টিকেই রইল। আল্লাহ্‌র দোয়া পাওয়া যদি শরীয়ত পালনের উপর ভরসা করে তাহলে তো আর ওয়াদার উপর তা ভরসা করছে না। কিন্তু আল্লাহ্‌ রহমত করে একটা ওয়াদার মধ্য দিয়ে ইব্রাহিমকে দোয়া করেছিলেন। তাহলে শরীয়ত কেন দেওয়া হয়েছিল? মানুষ গুনাহ্‌ করতে থাকবার দরুন আল্লাহ্‌র ওয়াদার সংগে শরীয়ত যুক্ত করা হয়েছিল। যাঁর বিষয় আল্লাহ্‌ ওয়াদা করেছিলেন ইব্রাহিমের সেই বংশধর না আসা পর্যন্ত বহাল থাকবার জন্যই শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল। ফেরেশতাদের মধ্য দিয়ে একজন মধ্যসে'র দ্বারা এই শরীয়ত বহাল করা হয়েছিল। কিন্তু কেবল একজন থাকলে মধ্যসে'র দরকার হয় না; আর আল্লাহ্‌ মাত্র একজনই। তাহলে শরীয়ত কি আল্লাহ্‌র ওয়াদাগুলোর বিরুদ্ধে? নিশ্চয়ই না। আল্লাহ্‌ যদি এমন শরীয়ত দিতেন যা জীবন দিতে পারে তবে তা পালনের দ্বারা নিশ্চয় মানুষ আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হত। কিন্তু পাক-কিতাব সব মানুষকেই গুনাহের জন্য দোষী বলে স্থির করেছে, যেন ঈসা মসীহের উপর যারা ঈমান আনে তারা তাদের সেই ঈমানের ফলে ওয়াদা-করা দোয়া পেতে পারে। ঈমান আসবার আগে শরীয়ত আমাদের পাহারা দিয়ে রেখেছিল এবং যতদিন না ঈমান প্রকাশিত হল ততদিন পর্যন্ত আমাদের বন্দী করে রেখেছিল। তাহলে দেখা যায়, মসীহের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য এই শরীয়তই আমাদের পরিচালনাকারী, যেন ঈমানের মধ্য দিয়ে আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এখন ঈমান এসেছে বলে আমরা আর শরীয়তের পরিচালনার অধীন নই। মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা সবাই আল্লাহ্‌র সন্তান হয়েছ, কারণ তোমাদের যাদের মসীহের মধ্যে তরিকাবন্দী হয়েছে, তোমরা কাপড়ের মত করে মসীহ্‌কে দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলেছ। ইহুদী ও অ-ইহুদীর মধ্যে, গোলাম ও স্বাধীন লোকের মধ্যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, কারণ মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে তোমরা সবাই এক হয়েছ। তোমরা যখন মসীহের হয়েছ তখন ইব্রাহিমের বংশধরও হয়েছ। আর আল্লাহ্‌ যা দেবার ওয়াদা ইব্রাহিমের কাছে করেছিলেন তোমরাও সেই সবের অধিকারী হয়েছ। আমার কথার অর্থ এই- বাবার সব কিছুর উপর সন্তানের অধিকার থাকলেও যতদিন সে নাবালক থাকে ততদিন তার এবং গোলামের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না। তার পিতা যে সময় ঠিক করে দেন সেই সময় পর্যন্ত তাকে অভিভাবক ও ভারপ্রাপ্ত লোকদের অধীনে থাকতে হয়। সেই একইভাবে আমরাও যখন ছোট ছিলাম তখন দুনিয়ার নানা রীতিনীতির গোলাম ছিলাম। কিন্তু সময় পূর্ণ হলে পর আল্লাহ্‌ তাঁর পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন। সেই পুত্র স্ত্রীলোকের গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন এবং শরীয়তের অধীনে জীবন কাটালেন, যেন শরীয়তের অধীনে থাকা লোকদের তিনি মুক্ত করতে পারেন, আর আল্লাহ্‌র সন্তান হিসাবে আমাদের গ্রহণ করতে পারেন। তোমরা সন্তান বলেই আল্লাহ্‌ তাঁর পুত্রের রূহ্‌কে তোমাদের দিলে থাকবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই রূহ্‌ আল্লাহ্‌কে আব্বা, অর্থাৎ পিতা বলে ডাকেন। ফলে তোমরা আর গোলাম নও বরং সন্তান। যদি তোমরা সন্তানই হয়ে থাক তবে আল্লাহ্‌ যা দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন তোমরা তার অধিকারী। আগে যখন তোমরা আল্লাহ্‌কে চিনতে না তখন তোমরা যাদের সেবা করতে তারা আসলে কোন দেবতাই নয়। কিন্তু এখন তোমরা আল্লাহ্‌কে চিনেছ; তার চেয়ে বরং এই কথা বললে ঠিক হবে যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের চিনেছেন। তাহলে কেমন করে তোমরা আবার দুনিয়ার সেই নানা দুর্বল ও নিষ্ফল রীতিনীতির দিকে ফিরছ? তোমরা কি আবার সেই সবের গোলাম হতে চাইছ? তোমরা বিশেষ বিশেষ দিন, মাস, ঋতু ও বছর পালন করছ। তোমাদের জন্য আমার এই ভয় হচ্ছে যে, তোমাদের মধ্যে হয়তো আমি মিথ্যাই পরিশ্রম করেছি। ভাইয়েরা, আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা আমার মত হও, কারণ আমিও তোমাদের মত হয়েছি। তোমরা আমার উপর কোন অন্যায় কর নি। তোমরা জান যে, আমার শরীর অসুস্থ ছিল বলে আমি প্রথম বার তোমাদের কাছে সুসংবাদ তবলিগ করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার অসুস্থতা যদিও তোমাদের কষ্ট দিয়েছিল তবুও তোমরা আমাকে তুচ্ছ বা ঘৃণা কর নি, বরং আল্লাহ্‌র ফেরেশতাকে কিংবা মসীহ্‌ ঈসাকে যেভাবে গ্রহণ করতে সেইভাবেই তোমরা আমাকে গ্রহণ করেছিলে। কিন্তু এখন নিজেদের সেই ধন্য মনে করবার ভাব তোমাদের কোথায় গেল? আমি তোমাদের সম্বন্ধে এই সাক্ষ্য দিতে পারি যে, সম্ভব হলে তখন তোমরা তোমাদের চোখ তুলে নিয়ে আমাকে দিতে। এখন সত্যি কথা বলবার জন্য কি আমি তোমাদের শত্রু হয়ে গেছি? সেই অন্য লোকেরা তোমাদের জন্য আগ্রহী হয়েছে, কিন্তু সেটা কোন ভাল উদ্দেশ্যের জন্য নয়। তারা আমার দিক থেকে তোমাদের ফিরাতে চায়, যেন তোমরা তাদের প্রতি আগ্রহী হও। অবশ্য সৎ উদ্দেশ্যের জন্য আগ্রহ থাকা ভাল। আমি যখন তোমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকি কেবল তখন নয়, কিন্তু সব সময়েই আগ্রহ থাকা ভাল। আমার সন্তানেরা, যতদিন না তোমরা মসীহের মত হও ততদিন পর্যন্ত আমি আবার তোমাদের জন্য প্রসব-বেদনার মত কষ্ট ভোগ করছি। আমার এমন ইচ্ছা হচ্ছে যে, এই চিঠি লেখার বদলে আমি এখনই তোমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে তোমাদের সংগে কথা বলি, কারণ তোমাদের সম্বন্ধে আমি কি করব তা বুঝতে পারছি না। তোমরা যারা শরীয়তের অধীনে থাকতে চাইছ, তোমরা আমাকে বল দেখি, শরীয়ত যা বলে তা কি তোমরা শুনতে পাও না? কিতাবে লেখা আছে ইব্রাহিমের দু’টি ছেলে ছিল, তাদের একজনের মা ছিল এক বাঁদী ও আর একজনের মা ছিলেন ইব্রাহিমের আসল স্বাধীন স্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই সেই বাঁদীর সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, কিন্তু যিনি স্বাধীন ছিলেন তাঁর সন্তানটি আল্লাহ্‌র ওয়াদার ফলে জন্মগ্রহণ করেছিল। আমি রূপক অর্থে এই সব কথা বলছি। এই দু’জন স্ত্রীলোক দু’টি ব্যবস্থাকে বুঝায়। একটা ব্যবস্থা তুর পাহাড় থেকে এসেছে এবং তা তার অধীন মানুষকে গোলাম হবার পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ হল সেই বাঁদী হাজেরা। হাজেরা আরব দেশের তুর পাহাড়কে বুঝায়। হাজেরা এখনকার জেরুজালেমের একটা ছবিও বটে, কারণ জেরুজালেম তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাঁদী হয়েছে। কিন্তু যে জেরুজালেম বেহেশতের, সে স্বাধীন; সে-ই আমাদের মা। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “হে বন্ধ্যা স্ত্রীলোক, যার কখনও সন্তান হয় নি, তুমি আনন্দে গান কর; তুমি, যার কখনও প্রসব-বেদনা হয় নি, তুমি গানে ফেটে পড়, আনন্দে চিৎকার কর; কারণ যার স্বামী আছে তার চেয়ে যার কেউ নেই তার সন্তান অনেক বেশী হবে।” ভাইয়েরা, তোমরা ইসহাকের মতই আল্লাহ্‌র ওয়াদার ফলে জন্মেছ। কিন্তু সেই সময় যার স্বাভাবিক ভাবে জন্ম হয়েছিল সে জুলুম করত তার উপর যার পাক-রূহের শক্তিতে জন্ম হয়েছিল। আর এখনও তা-ই হচ্ছে। কিন্তু পাক-কিতাব কি বলে? পাক-কিতাব বলে যে, বাঁদী ও তার ছেলেকে যেন বের করে দেওয়া হয়, কারণ বাঁদীর ছেলে কোনমতেই স্বাধীন স্ত্রীর ছেলের সংগে বিষয়-সম্পত্তির ভাগ পেতে পারে না। ভাইয়েরা, তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা বাঁদীর সন্তান নই, বরং আমরা স্বাধীন স্ত্রীর সন্তান। মসীহ্‌ আমাদের স্বাধীন করেছেন যেন আমরা স্বাধীন থাকতে পারি। সেইজন্য তোমরা স্থির থাক, যেন কেউ আবার তোমাদের গোলাম বানাতে না পারে। আমি পৌল তোমাদের বলছি, শোন্ত যদি তোমাদের খৎনা করানোই হয় তবে তোমাদের কাছে মসীহের কোন মূল্য নেই। আমি সকলের কাছে আবার এই সাক্ষ্য দিচ্ছি, যাকে খৎনা করানো হয় সে সমস্ত শরীয়ত পালন করতে বাধ্য। তোমরা যারা শরীয়ত পালন করে আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য হতে চাইছ তোমরা তো মসীহের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছ, আল্লাহ্‌র রহমত থেকে সরে গেছ। কিন্তু আমাদের যে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে, সেই নিশ্চয়তায় ঈমানের দ্বারা পাক-রূহের মধ্য দিয়ে আমরা অপেক্ষা করে আছি; কারণ যারা মসীহ্‌ ঈসার, তাদের কাছে খৎনা করানো বা না করানোর কোন দাম নেই, বরং যে ঈমান মহব্বতের মধ্য দিয়ে কাজ করে সেই ঈমানই আসল জিনিস। তোমরা তো বেশ ভালভাবেই চলছিলে; তবে সত্যের বাধ্য হতে কে তোমাদের বাধা দিল? যে মতামত তোমরা মেনে নিয়েছ, যিনি তোমাদের ডেকেছেন সেই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তা আসে নি। একটুখানি খামি একটা গোটা ময়দার তালকে ফাঁপিয়ে তোলে। তোমাদের সম্বন্ধে প্রভুর উপর আমার এই বিশ্বাস আছে যে, তোমরা আর অন্য কোন মতামত গ্রহণ করবে না। কিন্তু যে তোমাদের স্থির থাকতে দিচ্ছে না, সে যে-ই হোক না কেন, সে তার পাওনা শাস্তি ভোগ করবে। ভাইয়েরা, যদি আমি এখনও তবলিগ করি যে, লোকদের খৎনা করানো উচিত তবে কেন আমাকে এখনও জুলুম করা হচ্ছে? ক্রুশের উপর মসীহের মৃত্যুর বাধা তো তাহলে দূর হয়ে গেছে। যারা তোমাদের গোলমালে ফেলছে, আমি চাই তারা যেন নিজেদের একেবারে খোজা-ই করে ফেলে। ভাইয়েরা, স্বাধীন হবার জন্যই তো আল্লাহ্‌ তোমাদের ডেকেছেন। কিন্তু তোমাদের গুনাহ্‌-স্বভাবের ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করবার জন্য এই স্বাধীনতা ব্যবহার কোরো না। তার চেয়ে বরং মহব্বতের মনোভাব নিয়ে একে অন্যের সেবা কর, কারণ সমস্ত শরীয়ত মিলিয়ে এক কথায় বলা হয়েছে, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।” কিন্তু যদি তোমরা একে অন্যের সংগে ঝগড়াঝাঁটি ও হিংসাহিংসি কর তবে সাবধান! এই রকম করলে তোমরা তো একে অন্যকে ধ্বংস করে ফেলবে। আমি যা বলছি তা এই- তোমরা পাক-রূহের অধীনে চলাফেরা কর। তা করলে তোমরা গুনাহ্‌-স্বভাবের ইচ্ছা পূর্ণ করবে না। গুনাহ্‌-স্বভাব যা চায় তা পাক-রূহের বিরুদ্ধে এবং পাক-রূহ্‌ যা চান তা গুনাহ্‌-স্বভাবের বিরুদ্ধে। গুনাহ্‌-স্বভাব ও পাক-রূহ্‌ একে অন্যের বিরুদ্ধে বলে তোমরা যা করতে চাও তা কর না। তোমরা যদি পাক-রূহের দ্বারাই পরিচালিত হও তবে তোমরা শরীয়তের অধীনে নও। গুনাহ্‌-স্বভাবের কাজগুলো স্পষ্টই দেখা যায়। সেগুলো হল- জেনা, নাপাকী, লমপটতা, মূর্তিপূজা, জাদুবিদ্যা, শত্রুতা, ঝগড়া, লোভ, রাগ, স্বার্থপরতা, অমিল, দলাদলি, হিংসা, মাতলামি, হৈ-হল্লা করে মদ খাওয়া, আর এই রকম আরও অনেক কিছু। আমি যেমন এর আগে তোমাদের সতর্ক করেছিলাম এখনও তা-ই করে বলছি, যারা এই রকম কাজ করে আল্লাহ্‌র রাজ্যে তাদের জায়গা হবে না। কিন্তু পাক-রূহের ফল হল- মহব্বত, আনন্দ, শান্তি, সহ্যগুণ, দয়ার স্বভাব, ভাল স্বভাব, বিশ্বস্ততা, নম্রতা ও নিজেকে দমন। এই সবের বিরুদ্ধে কোন আইন নেই। যারা মসীহ্‌ ঈসার, তারা তাদের গুনাহ্‌-স্বভাবকে তার সমস্ত কামনা-বাসনা সুদ্ধ ক্রুশে দিয়ে শেষ করে ফেলেছে। যদি আমরা পাক-রূহের মধ্য দিয়ে জীবন পেয়ে থাকি তবে এস, আমরা পাক-রূহের অধীনেই চলাফেরা করি। আমরা যেন মিথ্যা বড়াই না করি এবং একে অন্যকে বিরক্ত ও হিংসা না করি। ভাইয়েরা, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি হঠাৎ কোন গুনাহে পড়ে যায়, তবে তোমরা যারা পাক-রূহের অধীনে চলাফেরা করছ তোমরা তাকে তুলে এনো। তবে খুব নরম মনোভাব নিয়ে তোমরা এই কাজ কোরো এবং নিজের বিষয় সতর্ক থেকো, যাতে তোমরাও গুনাহে না পড়। তোমরা একে অন্যের ভার বয়ে নিয়ো। এইভাবেই তোমরা মসীহের আইন পালন করতে পারবে। কিছু না হয়েও যদি কেউ নিজেকে বিশেষ কিছু বলে মনে করে তবে তো সে নিজেকে ঠকায়। প্রত্যেকে নিজের কাজ পরীক্ষা করে দেখুক। তাহলে অন্যের সংগে নিজের তুলনা না করে তার নিজের কাজের জন্য সে গর্ববোধ করতে পারবে, কারণ প্রত্যেকেরই উচিত নিজের দায়িত্ব বয়ে নেওয়া। যাকে আল্লাহ্‌র কালাম শিক্ষা দেওয়া হয় সে যেন তার ওস্তাদকে তার সব ভাল জিনিসের ভাগ দেয়। তোমরা ভুল কোরো না, আল্লাহ্‌র সংগে তামাশা চলে না; কারণ যে যা বুনবে সে তা-ই কাটবে। গুনাহ্‌-স্বভাবকে খুশী করবার বীজ বুনলে তা থেকে ধ্বংসের ফসল আসবে। কিন্তু পাক-রূহ্‌কে খুশী করবার বীজ বুনলে তা থেকে অনন্ত জীবনের ফসল আসবে। আমরা যেন সৎকাজ করতে করতে ভেংগে না পড়ি, কারণ তা ছেড়ে না দিয়ে করতে থাকলে আমরা ঠিক সময়ে তার ফসল পাব। সুযোগ পেলেই আমরা যেন সকলের, বিশেষভাবে আল্লাহ্‌র পরিবারের লোকদের উপকার করি। দেখ, কত বড় বড় অক্ষরে আমি নিজের হাতে তোমাদের কাছে লিখছি। যারা বাইরে নিজেদের ভাল দেখাতে চায় তারাই খৎনা করাবার জন্য তোমাদের বাধ্য করতে চেষ্টা করছে। মসীহের ক্রুশের জন্য যেন তাদের উপর জুলুম না আসে সেইজন্যই তারা এই রকম করছে। যাদের খৎনা করানো হয়েছে তারাও তো শরীয়ত পালন করে না। তবুও তারা তোমাদের খৎনা করাতে চায় যেন এই বলে গর্ব করতে পারে যে, তোমরাও তাদের দলে এসেছ। হযরত ঈসা মসীহের ক্রুশ ছাড়া আমি যেন আর কিছুতে গর্ববোধ না করি। এই ক্রুশের মধ্য দিয়েই দুনিয়া আমার কাছে মরে গেছে এবং আমিও দুনিয়ার কাছে মরে গেছি। খৎনা করানো বা না করানোর কোন দামই নেই, মসীহের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠাই হল বড় কথা। যারা এই নিয়মে চলে তাদের, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র আসল ইসরাইলীয়দের তিনি শান্তি ও মমতা দান করুন। শেষে বলি, কেউ আমাকে কষ্ট না দিক, কারণ ঈসার আঘাতের চিহ্ন আমি আমার শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের রহমত তোমাদের দিলে থাকুক। আমিন। ॥ভব আমি পৌল আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় মসীহ্‌ ঈসার একজন সাহাবী। ইফিষ শহরে যারা আল্লাহ্‌র বান্দা ও মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানদার তাদের কাছে আমি এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ ও হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের পিতা ও আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। আমরা মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছি বলে বেহেশতের প্রত্যেকটি রূহানী দোয়া আল্লাহ্‌ আমাদের দান করেছেন। তিনি এটা করেছিলেন যেন তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রের মধ্য দিয়ে বিনামূল্যে যে মহিমাপূর্ণ রহমত আমাদের দান করেছেন তাঁর প্রশংসা হয়। আল্লাহ্‌র অশেষ রহমত অনুসারে মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে তাঁর রক্তের দ্বারা আমরা মুক্ত হয়েছি, অর্থাৎ গুনাহের মাফ পেয়েছি। এই রহমত আল্লাহ্‌ তাঁর মহা জ্ঞান ও বুদ্ধির সংগে খোলা হাতে আমাদের দান করেছেন। ঠিক যেমন তিনি চেয়েছিলেন এবং মসীহের মধ্য দিয়ে আগেই স্থির করে রেখেছিলেন, সেই অনুসারেই তিনি তাঁর গোপন উদ্দেশ্য আমাদের জানিয়েছিলেন। তিনি স্থির করে রেখেছিলেন যে, সময় পূর্ণ হলে পর সেই উদ্দেশ্য কার্যকর করবার জন্য তিনি বেহেশতের ও দুনিয়ার সব কিছু মিলিত করে মসীহের শাসনের অধীনে আনবেন। আল্লাহ্‌ তাঁর বিচারবুদ্ধি অনুসারে নিজের ইচ্ছামতই সব কাজ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য অনুসারে তিনি আগেই যা ঠিক করে রেখেছিলেন সেইমতই মসীহের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের বান্দা হবার জন্য তিনি আমাদের বেছে নিয়েছেন। আমরা যারা আগেই মসীহের উপর আশা রেখেছি, সেই আমাদেরই মধ্য দিয়ে যেন আল্লাহ্‌র মহিমার প্রশংসা হয় সেইজন্যই তিনি আমাদের বেছে নিয়েছেন। আর তোমরাও সত্যের কালাম, অর্থাৎ নাজাত পাবার সুসংবাদ শুনে মসীহের উপর ঈমান এনেছ। মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছ বলে আল্লাহ্‌ তাঁর ওয়াদা করা পাক-রূহ্‌ দিয়ে তোমাদের সীলমোহর করে রেখেছেন। যারা আল্লাহ্‌র নিজের সম্পত্তি তাদের তিনি একটা অধিকার দেবার ওয়াদা করেছেন। তাদের যতদিন না সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা হয় ততদিন পর্যন্ত সেই অধিকারের প্রথম অংশ হিসাবে পাক-রূহ্‌কে তাদের দেওয়া হয়েছে। আর এই সবের দ্বারাই আল্লাহ্‌র মহিমার প্রশংসা হবে। এইজন্য যখন আমি হযরত ঈসার উপর তোমাদের ঈমান এবং আল্লাহ্‌র সমস্ত বান্দাদের প্রতি তোমাদের মহব্বতের কথা শুনলাম, তখন থেকে তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করা আমি কখনও বন্ধ করি নি। মুনাজাত করবার সময় আমি তোমাদের কথা ভুলে যাই না। আমি মুনাজাত করি যেন আমাদের হযরত ঈসা মসীহের আল্লাহ্‌, অর্থাৎ সেই গৌরবময় পিতা তোমাদের রূহানী জ্ঞান ও বুঝবার ক্ষমতা দান করেন, যাতে তোমরা তাঁকে আরও ভাল করে জানতে পার। যার দ্বারা তিনি মৃত্যু থেকে মসীহ্‌কে জীবিত করে তুলেছেন এবং বেহেশতে তাঁর ডান দিকে বসিয়েছেন। আসমানে যাদের হাতে সমস্ত শাসন, ক্ষমতা, শক্তি এবং কর্তৃত্ব রয়েছে তাদের তিনি মসীহের অধীন করেছেন। আর যাকে যে নামই দেওয়া হোক না কেন, তা সে এই যুগেই হোক কিংবা আগামী যুগেই হোক, সব নামের উপরে মসীহের নাম। আল্লাহ্‌ সব কিছু মসীহের পায়ের তলায় রেখেছেন এবং তাঁকে সব কিছুর অধিকার দিয়েছেন, আর তাঁকেই জামাতের মাথা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। এই জামাত আসলে মসীহেরই শরীর। যিনি সব দিক থেকে সব কিছু পূর্ণ করেন সেই মসীহের পূর্ণতা হল এই জামাত। অবাধ্যতা আর গুনাহের দরুন তোমরা মৃত ছিলে। দুনিয়ার চিন্তাধারা অনুসারে তোমরাও এক সময় সেই অবাধ্যতা আর গুনাহের মধ্যে চলাফেরা করতে। যে রূহ্‌ আসমানের ক্ষমতাশালীদের বাদশাহ্‌ সেই দুষ্ট রূহ্‌ আল্লাহ্‌র অবাধ্য লোকদের মধ্যে কাজ করছে, আর তোমরা সেই রূহের পিছনে পিছনে চলতে। আমরা সবাই আমাদের গুনাহ্‌-স্বভাবের কামনা পূর্ণ করে সেই লোকদের মধ্যে এক সময় জীবন কাটাতাম। গুনাহ্‌-স্বভাব থেকে যে সব ইচ্ছা এবং চিন্তা জাগে আমরা সেই অনুসারে কাজ করতাম। এই স্বভাবের জন্য আমরাও অন্য সকলের মত আল্লাহ্‌র গজবের অধীন ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্‌ মমতায় পূর্ণ; তিনি আমাদের খুব মহব্বত করেন। এইজন্য অবাধ্যতার দরুন যখন আমরা মৃত অবস্থায় ছিলাম তখন মসীহের সংগে তিনি আমাদের জীবিত করলেন। আল্লাহ্‌র রহমতে তোমরা নাজাত পেয়েছ। আমরা মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়েছি বলে আল্লাহ্‌ আমাদের মসীহের সংগে জীবিত করে মসীহের সংগেই বেহেশতে বসিয়েছেন। তিনি এই কাজ করেছেন যেন তিনি তাঁর তুলনাহীন অশেষ রহমত আগামী যুগ যুগ ধরে দেখাতে পারেন। তিনি মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে আমাদের উপর দয়া করে যা করেছেন তাতেই তাঁর এই রহমত প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ্‌র রহমতে ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা নাজাত পেয়েছ। এটা তোমাদের নিজেদের দ্বারা হয় নি, তা আল্লাহ্‌রই দান। এটা কাজের ফল হিসাবে দেওয়া হয় নি, যেন কেউ গর্ব করতে না পারে। আমরা আল্লাহ্‌র হাতের তৈরী। আল্লাহ্‌ মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত করে আমাদের নতুন করে সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা সৎ কাজ করি। এই সৎ কাজ তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, যেন আমরা তা করে জীবন কাটাই। জন্মের দিক থেকে তোমরা তো অ-ইহুদী। হাত দিয়ে শরীরের মধ্যে যাদের খৎনা করানো হয়েছে, অর্থাৎ যারা নিজেদের খৎনা-করানো লোক বলে থাকে তারা তোমাদের খৎনা-না-করানো লোক বলে। মনে রেখো, আগে তোমরা মসীহের কাছ থেকে আলাদা ছিলে; জাতি হিসাবে বনি-ইসরাইলদের যে অধিকার তোমরা সেই অধিকারের বাইরে ছিলে; আল্লাহ্‌ ইসরাইল জাতির জন্য যে কয়টি ওয়াদাযুক্ত ব্যবস্থা করেছিলেন তার সংগে তোমাদের কোন সম্বন্ধ ছিল না; তোমাদের কোন আশা ছিল না; আর এই দুনিয়াতে তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়াই ছিলে। তোমরা এক কালে দূরে ছিলে, কিন্তু মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়েছ বলে তোমাদের এখন তাঁর রক্তের দ্বারা কাছে আনা হয়েছে। এটাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে, তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই দু’টিকে তিনি এক শরীরে আল্লাহ্‌র সংগে আবার মিলিত করেন, কারণ এই দু’য়ের মধ্যে যে শত্রুতার ভাব ছিল তা তিনি তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর দ্বারা ধ্বংস করেছেন। তোমরা যারা দূরে ছিলে এবং তারা যারা কাছে ছিল, সকলের কাছেই তিনি এসে শান্তির সুসংবাদ তবলিগ করেছিলেন। তাঁরই মধ্য দিয়ে একই পাক-রূহের দ্বারা পিতার কাছে যাবার অধিকার আমাদের সকলের আছে। এইজন্য তোমরা আর অচেনাও নও, বিদেশীও নও; কিন্তু আল্লাহ্‌র বান্দাদের সংগে তোমরাও তাঁর রাজ্যের ও তাঁর পরিবারের লোক হয়েছ। সাহাবী আর নবীরা হলেন ভিত্তি, আর সেই ভিত্তির প্রধান পাথর মসীহ্‌ ঈসা নিজে। সেই ভিত্তির উপরেই তোমাদের গাঁথা হয়েছে। মসীহের সংগে যোগ থাকবার দরুন দালানের সমস্ত অংশ একসংগে যুক্ত হয়ে প্রভুর থাকবার জন্য একটা পবিত্র ঘর গড়ে উঠছে। তোমরা তাঁরই সংগে যুক্ত হয়েছ এবং সেইজন্য তোমাদেরও একসংগে গেঁথে তোলা হচ্ছে, যেন পাক-রূহের মধ্য দিয়ে তোমরা আল্লাহ্‌র থাকবার জায়গা হতে পার। এইজন্য আমি পৌল আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত করছি। তোমরা যারা অ-ইহুদী তোমাদের জন্যই আমি মসীহ্‌ ঈসার বন্দী হয়েছি। তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ যে, আল্লাহ্‌ তাঁর রহমতের ব্যবস্থা তোমাদের জানাবার ভার আমার উপর দিয়েছেন। তাঁর গোপন উদ্দেশ্য তিনি ওহী দ্বারা আমাকে জানিয়েছেন, আর এই বিষয় আমি তোমাদের কাছে অল্প কথায় লিখলাম। তোমরা তা পড়লে বুঝতে পারবে যে, মসীহের বিষয়ে সেই গোপন উদ্দেশ্য আমার বুঝবার ক্ষমতা রয়েছে। সেই গোপন উদ্দেশ্য পাক-রূহের দ্বারা এখন যেভাবে তাঁর পবিত্র সাহাবী ও নবীদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে, আগের সব যুগের লোকদের কাছে সেইভাবে প্রকাশিত হয় নি। সেই গোপন উদ্দেশ্য হল এই-সুসংবাদের মধ্য দিয়ে অ-ইহুদীরা মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে ইহুদীদের সংগে একই সুযোগের অধিকারী হবে, একই শরীরের অংশ হবে, আর একই ওয়াদা করা দোয়ার ভাগী হবে। আল্লাহ্‌ তাঁর মহাশক্তি অনুসারে আমাকে যে রহমত করেছেন সেই রহমতের দান হিসাবে তিনি আমাকে সুসংবাদ তবলিগ করবার কাজ দিয়েছেন। আল্লাহ্‌র সমস্ত বান্দাদের মধ্যে আমার চেয়ে নীচু আর কেউ নেই, তবুও মসীহের যে সম্পদের কথা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা যায় না, অ-ইহুদীদের কাছে সেই সম্পদের সুসংবাদ জানাবার কাজ আল্লাহ্‌ রহমত করে আমাকেই দিয়েছেন। এছাড়া তাঁর গোপন উদ্দেশ্য যে কিভাবে কাজে লাগানো হবে তা প্রকাশ করবার ভারও তিনি আমার উপর দিয়েছেন। সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌ এত কাল ধরে তাঁর সেই উদ্দেশ্য গোপন রেখেছিলেন। তিনি তা করেছিলেন যেন মসীহের জামাতের মধ্য দিয়ে বেহেশতের সমস্ত শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের কাছে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত আল্লাহ্‌র জ্ঞান এখন প্রকাশ পায়। এটাই ছিল তাঁর চিরকালের ইচ্ছা, আর সেই ইচ্ছা তিনি আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে পূরণ করেছেন। মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে তাঁর উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহ্‌র সামনে সাহসের সংগে উপস্থিত হবার অধিকার পেয়েছি। তাই আমি অনুরোধ করছি, তোমাদের জন্য আমি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছি বলে তোমরা সাহস হারায়ো না, কারণ সেই সব তোমাদের গৌরবের জন্যই হচ্ছে। আমি মুনাজাত করি যেন আল্লাহ্‌র অশেষ মহিমা অনুসারে তিনি তোমাদের এমন শক্তি দেন যাতে পাক-রূহের মধ্য দিয়ে তোমাদের দিল শক্তিশালী হয়, আর ঈমানের মধ্য দিয়ে মসীহ্‌ তোমাদের দিল পরিপূর্ণভাবে অধিকার করেন। আমি আরও মুনাজাত করি যেন মসীহের মহব্বতের মধ্যে তোমরা গভীরভাবে ডুবে গিয়ে স্থির হও, আর আল্লাহ্‌র সব বান্দাদের সংগে তোমরাও বুঝতে পার যে, মসীহের সেই মহব্বতের কোন কূল-কিনারা নেই, কোন দিক-সীমানা নেই। মসীহের সেই মহব্বত বুদ্ধি দিয়ে জানা যায় না; তবুও আমি মুনাজাত করি যেন তোমরা সেই মহব্বত বুঝতে পার, যাতে আল্লাহ্‌র সমস্ত পূর্ণতায় তোমরা পরিপূর্ণ হও। আমাদের দিলে আল্লাহ্‌র যে শক্তি কাজ করে সেই শক্তি অনুসারে তিনি আমাদের চাওয়া ও চিন্তার চেয়েও অনেক বেশী করতে পারেন। মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে এবং জামাতের মধ্য দিয়ে পুরুষের পর পুরুষ ধরে চিরদিন আল্লাহ্‌র গৌরব হোক। আমিন। তাই প্রভুর জন্য বন্দী অবস্থায় আমি তোমাদের কাছে এই অনুরোধ করছি, আল্লাহ্‌ যে জন্য তোমাদের ডেকেছেন তার উপযুক্ত হয়ে চল। তোমাদের স্বভাব যেন সম্পূর্ণভাবে নম্র ও নরম হয়। ধৈর্য ধর এবং মহব্বতের মনোভাব নিয়ে একে অন্যকে সহ্য কর। যে শান্তি আমাদের একসংগে যুক্ত করেছে সেই শান্তির মধ্য দিয়ে পাক-রূহের দেওয়া একতা রক্ষা করতে বিশেষভাবে চেষ্টা কর। আল্লাহ্‌ তোমাদের ডেকেছেন বলে তোমাদের মধ্যে কেবল একটাই আশা আছে, মাত্র একটিই শরীর আছে, একজনই পাক-রূহ্‌ আছেন, একজনই প্রভু আছেন, একই ঈমান আছে, একই তরিকাবন্দী আছে, আর সকলের আল্লাহ্‌ ও পিতা মাত্র একজনই আছেন। তিনিই সকলের উপরে; তিনিই সকলের মধ্যে ও সকলের দিলে আছেন। কিন্তু মসীহ্‌ যেভাবে ঠিক করে রেখেছেন সেই পরিমাণ অনুসারে আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ রহমত পেয়েছি। পাক-কিতাবে এইজন্য লেখা আছে, তিনি যখন বেহেশতে উঠলেন, তখন বন্দীদের চালিয়ে নিয়ে গেলেন, আর তিনি লোকদের অনেক দানও দিলেন। “তিনি উঠলেন,” এই কথা থেকে কি এটাই বুঝা যায় না যে, মসীহ্‌ দুনিয়ার গভীরে নেমেছিলেন? যিনি নেমেছিলেন তিনিই সব কিছু পূর্ণ করবার জন্য আবার আসমান থেকেও অনেক উপরে উঠেছেন। তিনিই কিছু লোককে সাহাবী, কিছু লোককে নবী, কিছু লোককে সুসংবাদ তবলিগকারী এবং কিছু লোককে জামাতের ইমাম ও ওস্তাদ হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। তিনি এঁদের নিযুক্ত করেছেন যেন আল্লাহ্‌র সব বান্দারা তাঁরই সেবা-কাজ করবার জন্য প্রস্তুত হয় এবং এইভাবে মসীহের শরীর গড়ে ওঠে। এর উদ্দেশ্য হল, আমরা যেন সবাই ইব্‌নুল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনে এবং তাঁকে ভাল করে জানতে পেরে এক হই; আর মসীহ্‌ যেমন সমস্ত গুণে পূর্ণ, আমরাও যেন তেমনি সমস্ত গুণে পূর্ণ হয়ে পরিপূর্ণ হই। তখন আমরা আর শিশুর মত থাকব না। লোকে দুষ্ট বুদ্ধি খাটিয়ে অন্যদের ভুল পথে নিয়ে যাবার জন্য যে ভুল শিক্ষা দেয়, সেই ভুল শিক্ষার মধ্যে আমরা বাতাসে দুলে ওঠা ঢেউয়ের মত এদিকে সেদিকে দুলতে থাকব না। আমরা বরং মহব্বতের মনোভাব নিয়ে মসীহের বিষয়ে সত্য কথা বলব এবং সব কিছুতে বেড়ে উঠে মসীহের মত হব। তিনিই তো শরীরের মাথা। গোটা শরীরটা এমন ভাবে বাঁধা আছে যে, প্রত্যেকটি অংশ যার যার জায়গায় থেকে শরীরের সংগে যুক্ত থাকে। প্রত্যেকটি অংশ যখন ঠিকভাবে কাজ করে তখন গোটা শরীরটাই মাথার পরিচালনায় বেড়ে ওঠে এবং মহব্বতের মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে। এইজন্য আমি বলছি, আর প্রভুর হয়ে বিশেষ জোর দিয়েই বলছি- অ-ইহুদীরা যেভাবে বাজে চিন্তার মধ্যে তাদের জীবন কাটায় তোমরা আর সেইভাবে জীবন কাটায়ো না। তাদের মন অন্ধকারে পড়ে আছে। দিল কঠিন বলে তারা আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে কিছু জানে না, আর সেইজন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া জীবন থেকে তারা অনেক দূরে আছে। তাদের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে, তাই তৃপ্তিহীন আগ্রহ নিয়ে সব রকম নাপাক কাজ করবার জন্য তারা লাগামছাড়া কামনার হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমরা তো মসীহের বিষয়ে এইরকম শিক্ষা পাও নি। তোমরা তাঁর বিষয় শুনেছিলে, আর তাঁর সংগে যুক্ত হয়ে তাঁর মধ্যে যে সত্য আছে সেই অনুসারে শিক্ষা পেয়েছিলে। তোমরা এই শিক্ষা পেয়েছিলে যে, তোমাদের পুরানো জীবনের পুরানো “আমি”কে পুরানো কাপড়ের মতই বাদ দিতে হবে, কারণ ছলনার কামনা দ্বারা সেই পুরানো “আমি” নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার বদলে আল্লাহ্‌কে তোমাদের মনকে নতুন করে গড়ে তুলতে দাও, আর আল্লাহ্‌র দেওয়া নতুন “আমি”কে নতুন কাপড়ের মতই পর। সত্যের ধার্মিকতা ও পবিত্রতা দিয়ে এই নতুন “আমি”কে আল্লাহ্‌র মত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এইজন্য তোমরা মিথ্যা ছেড়ে দাও এবং একে অন্যের কাছে সত্যি কথা বল, কারণ আমরা সবাই একে অন্যের সংগে যুক্ত। যদি রাগ কর তবে সেই রাগের দরুন গুনাহ্‌ কোরো না; সূর্য ডুববার আগেই তোমাদের রাগ ছেড়ে দিয়ো, আর ইবলিসকে কোন সুযোগ দিয়ো না। যে চুরি করে সে আর চুরি না করুক, বরং নিজের হাতে সৎভাবে পরিশ্রম করুক যেন অভাবী লোকদের দেবার জন্য তার কিছু থাকে। তোমাদের মুখ থেকে কোন বাজে কথা বের না হোক, বরং দরকার মত অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই বের হোক, যেন যারা তা শোনে তাতে তাদের উপকার হয়। তোমরা আল্লাহ্‌র পাক-রূহ্‌কে দুঃখ দিয়ো না, যাঁকে দিয়ে আল্লাহ্‌ মুক্তি পাবার দিন পর্যন্ত তোমাদের সীলমোহর করে রেখেছেন। সব রকম বিরক্তি প্রকাশ, মেজাজ দেখানো, রাগ, চিৎকার করে ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি, আর সব রকম হিংসা তোমাদের কাছ থেকে দূর কর। তোমরা একে অন্যের প্রতি দয়ালু হও, অন্যের দুঃখে দুঃখী হও, আর আল্লাহ্‌ যেমন মসীহের মধ্য দিয়ে তোমাদের মাফ করেছেন তেমনি তোমরাও একে অন্যকে মাফ কর। আল্লাহ্‌র প্রিয় সন্তান হিসাবে তোমরা আল্লাহ্‌র মত করে চল। মসীহ্‌ যেমন আমাদের মহব্বত করেছিলেন এবং আমাদের জন্য আল্লাহ্‌র উদ্দেশে সুগন্ধযুক্ত কোরবানী হিসাবে নিজেকে দিয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবে তোমরাও মহব্বতের পথে চল। কোন রকম জেনা, নাপাকী আর লোভের কথা পর্যন্ত যেন তোমাদের মধ্যে শোনা না যায়, কারণ এই সব কথা আল্লাহ্‌র বান্দাদের মানায় না। কোন রকম লজ্জাপূর্ণ আচার-ব্যবহার এবং বাজে ও নোংরা ঠাট্টা-তামাশার কথাবার্তা যেন তোমাদের মধ্যে না হয়, কারণ এগুলোও মানায় না। তার চেয়ে বরং তোমরা আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাও। তোমরা নিশ্চয়ই জান, যারা জেনা করে, যারা নাপাক এবং যারা লোভী, অর্থাৎ যাদের এক রকমের প্রতিমাপূজাকারী বলা যায় মসীহের ও আল্লাহ্‌র রাজ্যে তাদের কোন অধিকার নেই। অসত্য কথাবার্তার দ্বারা যেন কেউ তোমাদের ভুল পথে নিয়ে না যায়, কারণ যারা অবাধ্য হয়ে ঐ সব কাজ করে আল্লাহ্‌র গজব তাদের উপরে নেমে আসে। এই রকম লোকদের সংগে যোগ দিয়ো না, কারণ তোমরা আগে অন্ধকারে থাকলেও এখন প্রভুর সংগে যুক্ত হয়ে নূরে এসেছ। নূরে পূর্ণ লোকের যেভাবে চলা উচিত তোমরা সেইভাবে চল, কারণ যা ভাল, ধার্মিক ও সত্য তা-ই হল নূরের ফল। তাতে তোমরা যাচাই করে দেখতে পারবে কোন্‌ কোন্‌ কাজে প্রভু খুশী হন। অন্ধকারের নিষ্ফল কাজের সংগে তোমাদের যোগ না থাকুক; তোমরা বরং সেগুলোর দোষ দেখিয়ে দাও, কারণ মানুষের গোপনে করা এই সব কাজের কথা বলাও লজ্জার বিষয়। নূরের দ্বারা কোন কাজের দোষ দেখিয়ে দিলে পর তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, কারণ নূরই সব কিছু প্রকাশ করে। এইজন্য পাক-কিতাবে লেখা আছে, “হে ঘুমন্ত লোক, জাগো, মৃত্যু থেকে জীবিত হও; তাতে তোমার উপরে মসীহ্‌ নূর দেবেন।” তোমরা কিভাবে চলছ সেই বিষয়ে ভাল করে ভেবে দেখ। বুদ্ধিহীন লোকদের মত না চলে জ্ঞানীদের মত চল। তোমাদের হাতে সৎ কাজ করবার যে সুযোগ আছে তা পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাও, কারণ এই কাল খারাপ। তাই বলি, তোমরা বুদ্ধিহীন হয়ো না, বরং প্রভুর ইচ্ছা কি তা বুঝে নাও। মাতাল হয়ো না, তাতে উ"ছৃঙ্খল হয়ে পড়বে। তার চেয়ে বরং সম্পূর্ণভাবে পাক-রূহের অধীনে থাক, আর জবুর শরীফের কাওয়ালী, প্রশংসা ও রূহানী গজলের মধ্য দিয়ে তোমরা একে অন্যের সংগে কথা বল; তোমাদের দিলে প্রভুর উদ্দেশে কাওয়ালী গাও। সব সময় সব কিছুর জন্য আমাদের হযরত ঈসা মসীহের নামে পিতা আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাও। মসীহের প্রতি ভয়ের দরুন তোমরা একে অন্যকে মেনে নেওয়ার মনোভাব নিয়ে চল। তোমরা যারা স্ত্রী, প্রভুর প্রতি বাধ্যতার চিহ্ন হিসাবে তোমরা নিজের নিজের স্বামীর অধীনতা মেনে নাও, কারণ মসীহ্‌ যেমন জামাতের, অর্থাৎ তাঁর শরীরের মাথা, স্বামীও তেমনি স্ত্রীর মাথা। তা ছাড়া মসীহ্‌ই এই শরীরের উদ্ধারকর্তা। আর জামাত যেমন মসীহের অধীনে আছে তেমনি স্ত্রীরও সব বিষয়ে স্বামীর অধীনে থাকা উচিত। তোমরা যারা স্বামী, মসীহ্‌ যেমন জামাতকে মহব্বত করেছিলেন এবং তার জন্য নিজেকে দান করেছিলেন ঠিক তেমনি তোমরাও প্রত্যেকে স্ত্রীকে মহব্বত কোরো। স্বামী যেমন নিজের শরীরকে মহব্বত করে ঠিক সেইভাবে নিজের স্ত্রীকেও তার মহব্বত করা উচিত। যে নিজের স্ত্রীকে মহব্বত করে সে নিজেকেই মহব্বত করে। কেউ তো কখনও নিজের শরীরকে ঘৃণা করে না, বরং সে তার শরীরের ভরণ-পোষণ ও যত্ন করে। ঠিক সেইভাবে মসীহ্‌ ও তাঁর জামাতের যত্ন করেন, কারণ আমরা তাঁর শরীরের অংশ। পাক-কিতাবে লেখা আছে, “এইজন্যই মানুষ পিতা-মাতাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন এক শরীর হবে।” এটা একটা মহান গোপন সত্য- কিন্তু আসলে আমি মসীহ্‌ এবং তাঁর জামাতের কথা বলছি। কিন্তু যাক সেই সব কথা। তোমরা প্রত্যেকে নিজের স্ত্রীকে নিজের মত মহব্বত কোরো, আর স্ত্রীরও উচিত যেন সে নিজের স্বামীকে সম্মান করে। ছেলেমেয়েরা, প্রভু যেভাবে চান সেইভাবেই তোমরা মা-বাবার বাধ্য হয়ে চল, কারণ সেটাই হওয়া উচিত। পাক-কিতাবে প্রথম যে হুকুমের সংগে ওয়াদা রয়েছে তা এই- “তোমার পিতা-মাতাকে সম্মান কর, যেন তোমার উন্নতি হয় এবং তুমি অনেক দিন পর্যন্ত এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পার।” তোমরা যারা বাবা, তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের বিরক্ত করে তুলো না, বরং প্রভুর শাসন ও শিক্ষায় তাদের মানুষ করে তোল। তোমরা যারা গোলাম, তোমরা যেমন মসীহের বাধ্য তেমনি ভয় ও সম্মানের সংগে দিল থেকে তোমাদের এই দুনিয়ার মালিকদের বাধ্য হয়ো। মানুষকে খুশী করবার মনোভাব নিয়ে তোমাদের মালিকদের চোখের সামনেই কেবল তাদের বাধ্য হয়ো না; তার চেয়ে বরং মসীহের গোলাম হিসাবে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা মনেপ্রাণে পালন করে তোমরা মালিকদের বাধ্য হয়ো। তোমরা যেন মানুষের সেবা করছ না কিন্তু প্রভুর সেবা করছ সেইভাবে সন্তুষ্ট মনে তোমাদের মালিকদের সেবা কোরো, কারণ তোমরা জান যে, প্রত্যেকেই তার সব ভাল কাজের জন্য প্রভুর কাছ থেকে পুরস্কার পাবে- তা সে গোলামই হোক, আর স্বাধীনই হোক। তোমরা যারা মালিক, তোমরাও তোমাদের গোলামদের প্রতি ঠিক সেই রকম ব্যবহার কর। তাদের ভয় দেখানো ছেড়ে দাও, কারণ তোমরা তো জান যে, তাদের ও তোমাদের একই মালিক এবং তিনি বেহেশতে আছেন; তাঁর চোখে সবাই সমান। শেষে বলি, প্রভুর সংগে যুক্ত হয়ে তাঁরই দেওয়া মহা শক্তিতে শক্তিমান হও। যুদ্ধের জন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া সমস্ত সাজ-পোশাক পরে নাও, যেন তোমরা ইবলিসের সব চালাকির বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পার। আমাদের এই যুদ্ধ তো কোন মানুষের বিরুদ্ধে নয়, বরং তা অন্ধকার রাজ্যের সব শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের বিরুদ্ধে, অন্ধকার দুনিয়ার শক্তিশালী রূহ্‌দের বিরুদ্ধে, আর আকাশের সমস্ত ভূতদের বিরুদ্ধে। তাই তোমরা যুদ্ধের জন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া সমস্ত সাজ-পোশাক পরে নাও, যেন ইবলিস যেদিন আক্রমণ করবে সেই দিন তোমরা তাকে রুখে দাঁড়াতে পার এবং সব কিছু শেষ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পার। এইজন্য সত্য দিয়ে কোমর বেঁধে, বুক রক্ষার জন্য সৎ জীবন দিয়ে বুক ঢেকে, আর শান্তির সুসংবাদ তবলিগের জন্য পা প্রস্তুত রেখে দাঁড়িয়ে থাক। এছাড়া ঈমানের ঢালও তুলে নাও; সেই ঢাল দিয়ে তোমরা ইবলিসের সব জ্বলন্ত তীর নিভিয়ে ফেলতে পারবে। মাথা রক্ষার জন্য আল্লাহ্‌র দেওয়া নাজাত মাথায় দিয়ে পাক-রূহের ছোরা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালাম গ্রহণ কর। পাক-রূহের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মনেপ্রাণে সব সময় মুনাজাত কর। এইজন্য সজাগ থেকে আল্লাহ্‌র সমস্ত বান্দাদের জন্য সব সময় মুনাজাত করতে থাক। আমার জন্যও মুনাজাত কর যেন আমি যখন কথা বলি তখন আল্লাহ্‌ আমাকে এমন ভাষা যুগিয়ে দেন যাতে আমি সাহসের সংগে তাঁর দেওয়া সুসংবাদের গোপন সত্য তবলিগ করতে পারি। এই সুসংবাদ তবলিগের জন্য আমি শিকলে বাঁধা পড়েও মসীহের দূতের কাজ করছি। মুনাজাত কর যেন জেলের মধ্যে থেকে যেভাবে সেই সুসংবাদ আমার তবলিগ করা উচিত সেইভাবে সাহসের সংগে তা করতে পারি। আমি কেমন আছি এবং আমার দিন কিভাবে কাটছে তা প্রিয় ভাই ও প্রভুর বিশ্বস্ত সেবাকারী তুখিকের কাছ থেকে জানতে পারবে। আমাদের সম্বন্ধে যেন তোমরা জানতে পার আর তিনি যেন তোমাদের উৎসাহ দিতে পারেন সেইজন্যই আমি তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠালাম। পিতা আল্লাহ আর হযরত ঈসা মসীহ্‌ ভাইদের শান্তি, বিশ্বাস ও মহব্বত দান করুন। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের প্রতি যাদের স্থির মহব্বত আছে তাদের সকলের উপর আল্লাহ্‌র রহমত থাকুক। তীমথিয় আর আমি পৌল- আমরা মসীহ্‌ ঈসার গোলাম। মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত আল্লাহ্‌র যে সব বান্দা ফিলিপী শহরে আছে আমরা তাদের কাছে এবং তাদের পরিচালকদের ও খেদমতকারীদের কাছে লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ এবং হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমি যতবার তোমাদের কথা মনে করি ততবারই আমার আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাই। তোমাদের জন্য মুনাজাতের সময়ে আমি সব সময় আনন্দের সংগে মুনাজাত করে থাকি, কারণ ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগের কাজে তোমরা প্রথম দিন থেকে এই পর্যন্ত আমাকে সাহায্য করে আসছ। আমার এই বিশ্বাস আছে, তোমাদের দিলে যিনি ভাল কাজ করতে শুরু করেছেন তিনি মসীহ্‌ ঈসার আসবার দিন পর্যন্ত তা চালিয়ে নিয়ে শেষ করবেন। তোমাদের সকলের সম্বন্ধে আমার মনের ভাব এই রকম হওয়াই উচিত, কারণ তোমরা আমার প্রিয়। আমি জেলে থাকি বা সুসংবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার সত্যতা প্রমাণ করি, তাতে তোমরা সবাই আমার সংগে আল্লাহ্‌র রহমতের ভাগী। মসীহ্‌ ঈসার মহব্বত দিলে রেখে আমি যে তোমাদের কত মহব্বত করি তার সাক্ষী আল্লাহ্‌। আমি মুনাজাত করি তোমাদের মহব্বত যেন জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির সংগে মিলিত হয়ে বেড়েই চলে। ভাইয়েরা, আমি চাই যেন তোমরা জানতে পার যে, আমার উপর যা ঘটেছে তার ফলে সুসংবাদ তবলিগের কাজ আরও এগিয়ে গেছে। আর তাতে এখানকার রাজবাড়ীর সৈন্যদল ও অন্য সকলে জানতে পেরেছে যে, মসীহের জন্যই আমি বন্দী অবস্থায় আছি। এছাড়া আমার এই বন্দী অবস্থায় থাকবার দরুন বেশীর ভাগ ভাইয়েরা প্রভুর উপর আরও বেশী করে ভরসা করতে শিখেছে এবং সেইজন্যই তারা নির্ভয়ে আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ করতে আরও সাহসী হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য হিংসা ও দলাদলির মনোভাব নিয়ে মসীহের বিষয় তবলিগ করে, আবার অন্যেরা ভাল উদ্দেশ্য নিয়েই তা করে। এই লোকদের মনে মহব্বত আছে বলেই তারা মসীহের বিষয় তবলিগ করে, কারণ এরা জানে যে, সুসংবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলবার জন্যই আমি নিযুক্ত। কিন্তু ঐ প্রথম দলের লোকেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য মসীহের বিষয় তবলিগ করে থাকে, কোন ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে তা করে না। ওরা মনে করে, এতে আমার বন্দী অবস্থায় ওরা আমাকে কষ্ট দিতে পারবে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? আসল কথা হল, এতে যেভাবেই হোক মসীহের বিষয় প্রচারিত হচ্ছে- তা ছলনার উদ্দেশ্যেই হোক আর সৎ উদ্দেশ্যেই হোক; আর তাতেই আমার আনন্দ। আমার এই আনন্দ কখনও শেষ হবে না, কারণ আমি জানি, আমার উপর যা ঘটেছে তার শেষ ফল হবে আমার মুক্তি; আর তা তোমাদের মুনাজাতের দ্বারা ও ঈসা মসীহের রূহের সাহায্যেই হবে। আমার স্থির বিশ্বাস আছে যে, আমি কোন কিছুতেই লজ্জা পাব না বরং আমার যথেষ্ট সাহস থাকবে, যাতে আগে যেমন আমার মধ্য দিয়ে মসীহের গৌরব প্রকাশ হত তেমনি এখনও হবে- তা আমি বাঁচি বা মরি; কারণ আমার পক্ষে জীবন হল মসীহ্‌ এবং মরণ হল লাভ। কিন্তু যদি আমি বেঁচেই থাকি তবে সেটা আমাকে এমন একটা কাজের সুযোগ দেবে যাতে যথেষ্ট ফল হয়। কোন্‌টা আমি বেছে নেব তা জানি না। দু’দিকই আমাকে টানছে। আমি মরে গিয়ে মসীহের সংগে থাকতে চাই, কারণ সেটা অনেক ভাল। তবুও তোমাদের জন্য আমার বেঁচে থাকবার দরকার আরও বেশী। আমি নিশ্চয় করে জানি আমি বেঁচে থাকব এবং তোমাদের সকলের সংগেই থাকব, যেন তোমাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তাতে তোমরা আনন্দিত হও। ফলে তোমাদের মধ্যে আমার আবার আসবার দরুন তোমরা মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে আমাকে নিয়ে আনন্দে উপ্‌চে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা হল, তোমরা এমনভাবে তোমাদের জীবন কাটাও যা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদের উপযুক্ত। তাহলে আমি নিজে এসে তোমাদের দেখি বা দূর থেকে তোমাদের কথা শুনি, আমি জানব যে, তোমরা মনেপ্রাণে এক হয়ে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছ এবং যে ঈমান সুসংবাদের মধ্য দিয়ে আসে তার জন্য একসংগে পরিশ্রম করছ। যারা তোমাদের বিরুদ্ধে আছে তাদের দিক থেকে কোন কিছুতে তোমরা ভয় পেয়ো না। এতেই প্রমাণ হবে যে, তারা ধ্বংস হতে যাচ্ছে আর তোমরা নাজাত পেতে যাচ্ছ; আর এই নাজাত আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই আসে। তোমাদের রহমত দান করা হয়েছে যেন তোমরা যে কেবল মসীহের উপর ঈমান আনতে পার এমন নয়, তাঁর জন্য কষ্টভোগও করতে পার। তোমরা আগে আমাকে যেভাবে কষ্ট স্বীকার করতে দেখেছ এবং এখনও সেই সম্বন্ধে যা শুনছ, তোমরাও সেই একই রকম কষ্টের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। তাহলে মসীহের সংগে যুক্ত হবার ফলে যখন উৎসাহ পাওয়া যায়, মসীহের মহব্বতের ফলে যখন সান্ত্বনা পাওয়া যায়, পাক-রূহ্‌ ও তোমাদের মধ্যে যখন যোগাযোগ-সম্বন্ধ আছে, তোমাদের দিলে যখন স্নেহ ও দয়ামায়া আছে, তখন তোমরা এইভাবে আমার আনন্দ পূর্ণ কর- তোমাদের সকলের মন এক হোক, তোমরা একে অন্যকে মহব্বত কর এবং মনেপ্রাণে এক হও। নিজের লাভের আশায় বা অহংকারের বশে কিছু কোরো না, বরং নম্রভাবে অন্যকে নিজের চেয়ে বড় স্থান দাও। কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকো না, বরং একে অন্যের জন্য চিন্তা কর। মসীহ্‌ ঈসার যে মনোভাব ছিল তা যেন তোমাদের দিলেও থাকে। আসলে তিনি আল্লাহ্‌ রইলেন, কিন্তু আল্লাহ্‌র সমান থাকা তিনি আঁকড়ে ধরে রাখবার মত এমন কিছু মনে করেন নি। তিনি বরং গোলাম হয়ে এবং মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করে নিজেকে সীমিত করে রাখলেন। এছাড়া চেহারায় মানুষ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, এমন কি, ক্রুশের উপরে মৃত্যু পর্যন্ত বাধ্য থেকে তিনি নিজেকে নীচু করলেন। আল্লাহ্‌ এইজন্যই তাঁকে সবচেয়ে উঁচুতে উঠালেন এবং এমন একটা নাম দিলেন যা সব নামের চেয়ে মহৎ, যেন বেহেশতে, দুনিয়াতে এবং দুনিয়ার গভীরে যারা আছে তারা প্রত্যেকেই ঈসার সামনে হাঁটু পাতে, আর পিতা আল্লাহ্‌র গৌরবের জন্য স্বীকার করে যে, ঈসা মসীহ্‌ই প্রভু। আমার প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা তো সব সময় বাধ্য হয়েই আছ। তেমনি করে কেবল আমার উপস্থিতির সময়ে নয়, কিন্তু বিশেষ করে এখন আমার অনুপসি'তির সময়েও তোমরা ভয়ের সংগে তোমাদের কাজের মধ্য দিয়ে দেখাও যে, তোমরা গুনাহ্‌ থেকে নাজাত পেয়েছ। আল্লাহ্‌ তোমাদের দিলে এমনভাবে কাজ করছেন যার ফলে তিনি যে কাজে সন্তুষ্ট হন সেই রকম কাজ করবার ইচ্ছা ও ক্ষমতা তোমাদের হয়। যে ঈমানের কোরবানী দ্বারা তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করছ তার উপর যদি আমার রক্ত কোরবানী হিসাবে ঢেলে দেওয়া হয় তাহলেও আমি সুখী এবং তোমাদের সংগে আনন্দিত। তোমাদেরও ঠিক সেইভাবে আমার সংগে সুখী এবং আনন্দিত হওয়া উচিত। আমি আশা করি, হযরত ঈসার ইচ্ছা হলে আমি তীমথিয়কে শীঘ্রই তোমাদের কাছে পাঠাব, যেন তোমাদের খবর পেয়ে আমিও উৎসাহ পাই। আমার সংগে এমন আর কেউ নেই, যে তীমথিয়ের মত করে সত্যিই তোমাদের জন্য চিন্তা করে। অন্য সকলে ঈসা মসীহের ব্যাপারে ব্যস্ত না থেকে নিজেদের ব্যাপারেই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তোমরা জান যে, তীমথিয় তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, কারণ যেভাবে ছেলে পিতার সংগে কাজ করে সেইভাবেই তিনি আমার সংগে ঈসা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগের কাজে পরিশ্রম করেছেন। সেইজন্য আমার অবস্থা কি হবে তা জানবার সংগে সংগেই আমি তাঁকে পাঠিয়ে দেব বলে আশা করি। তবে আমি প্রভুর উপর এই বিশ্বাস রাখি যে, শীঘ্রই আমিও আসতে পারব। আমি ইপাফ্রদীতকে তোমাদের কাছে পাঠানো দরকার মনে করলাম। তিনি আমার ঈমানদার ভাই। আমরা একসংগেই কাজ করি ও মসীহের জন্য যুদ্ধ করি। সেবাকারী হিসাবে আমার প্রয়োজন মিটাবার জন্য তাঁকেই তোমরা আমার কাছে পাঠিয়েছিলে। তিনি তোমাদের সবাইকে দেখতে চান বলে আমি তাঁকে ফিরে পাঠাচ্ছি। তা ছাড়া তোমরা তাঁর অসুস্থতার কথা শুনেছ বলে তিনি খুব চিনি-ত। আর সত্যিই তাঁর এমন অসুখ হয়েছিল যে, তিনি প্রায় মারা যাবার মত হয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর উপর দয়া করেছেন্ত কেবল যে তাঁর উপর দয়া করেছেন তা নয়, আমার উপরও দয়া করেছেন যেন আমি দুঃখের উপর দুঃখ না পাই। সেইজন্য খুব আগ্রহের সংগেই আমি তাঁকে পাঠাচ্ছি যেন তাঁকে দেখে তোমরা আনন্দিত হও এবং আমারও ভাবনা কমে। এইজন্য প্রভুর বান্দা হিসাবে পরিপূর্ণ আনন্দের সংগে তোমরা তাঁকে গ্রহণ কোরো, আর এই রকম লোকদের তোমরা সম্মান কোরো। মসীহের কাজের জন্য তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তোমরা অনুপসি'ত থাকবার দরুন আমার জন্য যা করতে পার নি তা করবার জন্য তিনি তাঁর প্রাণ দিতেও রাজী ছিলেন। শেষে বলি, আমার ভাইয়েরা, তোমরা প্রভুর সংগে যুক্ত আছ বলে আনন্দ কর। তোমাদের কাছে আবার একই কথা লিখতে আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না, আর তোমাদের সতর্ক করবার জন্য তা করা ভাল। ঐ কুকুরগুলো থেকে, অর্থাৎ যারা খারাপ কাজ করে এবং শরীরের কাটা-ছেঁড়া করাবার উপর জোর দেয় তাদের থেকে সাবধান! আমরাই সত্যিকারের খৎনা-করানো লোক, কারণ আমরা আল্লাহ্‌র রূহের সাহায্যে তাঁর এবাদত করি এবং মসীহ্‌ ঈসাকে নিয়ে গর্ব বোধ করি আর বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের উপর ভরসা করি না। আমি অবশ্য তা করতে পারতাম। যদি কেউ মনে করে যে, আচার-অনুষ্ঠানের উপর ভরসা করবার তার কারণ আছে তবে সে জানুক যে, আমার তার চেয়ে আরও বেশী কারণ আছে। আট দিনের দিন আমাকে খৎনা করানো হয়েছিল; ইসরাইল জাতির মধ্যে বিন্‌ইয়ামীনের বংশে আমার জন্ম; আমি একজন খাঁটি ইবরানী; মূসার শরীয়ত পালনের ব্যাপারে আমি একজন ফরীশী; ধর্মের ব্যাপারে আমি এমন গোঁড়া ছিলাম যে, মসীহের জামাতের উপর আমি জুলুম করতাম; আর আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগা্য হবার আশায় মূসার শরীয়ত পালনের ব্যাপারে কেউ আমার নিন্দা করতে পারত না। কিন্তু তাতে আমার যে সব লাভ হয়েছিল মসীহের জন্য আমি এখন সেগুলোকে ক্ষতি বলেই মনে করি। আমি মসীহ্‌কে জানতে চাই এবং যে শক্তির দ্বারা তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছিল সেই শক্তিকে জানতে চাই। আমি তাঁর দুঃখ-কষ্টের ভাগী হতে চাই। মোট কথা, যে মনোভাব নিয়ে তিনি মরেছিলেন আমিও সেই রকম মনোভাব পেতে চাই। সেইজন্য যা-ই হোক না কেন আমি নিশ্চয়ই মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠব। আমি যে জন্য চেষ্টা করছি তা এখনই যে পেয়ে গেছি কিংবা পূর্ণতা লাভ করে ফেলেছি এমন নয়। কিন্তু যে জন্য মসীহ্‌ ঈসা আমাকে ধরেছিলেন সেটাই ধরবার জন্য আমি ছুটে চলেছি। এইজন্য আমরা যারা পূর্ণতার দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছি আমাদের সেই একই রকম মনোভাব থাকা উচিত। আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের অন্য রকম মনোভাব থাকে তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের তাও দেখিয়ে দেবেন। যাহোক, আমরা পূর্ণতার দিকে যতদূর এগিয়ে গেছি সেই অনুসারেই আমাদের চলা উচিত। ভাইয়েরা, তোমরা সবাই আমার মত করে চল, আর যারা এইভাবে চলাফেরা করে তাদের চিনে রাখ। কিভাবে চলতে হয় তা আমরা তোমাদের দেখিয়েছি। আমি তোমাদের বারবারই বলেছি আর এখন চোখের পানির সংগে আবার বলছি যে, এমন অনেকে আছে যারা মসীহের ক্রুশের শত্রুর মত চলাফেরা করছে। তাদের ভাগ্যে আছে ধ্বংস; পেটই তাঁদের আল্লাহ্‌; যা লজ্জার বিষয় তা-ই নিয়ে তারা গর্ব করে; আর কেবল জাগতিক ব্যাপারেই তাদের মন পড়ে আছে। কিন্তু আমাদের আসল বাসস্থান তো বেহেশত; সেখান থেকে আমাদের নাজাতদাতা হযরত ঈসা মসীহের আসবার জন্য আমরা আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করছি। তিনি আমাদের দুর্বলতায় ভরা শরীর বদলিয়ে তাঁর মহিমাপূর্ণ শরীরের মত করবেন। যে শক্তির দ্বারা তিনি সব কিছু নিজের অধীনে আনেন সেই শক্তির দ্বারাই তিনি এই কাজ করবেন। আমার ভাইয়েরা, আমি তোমাদের মহব্বত করি আর তোমাদের দেখতে চাই। তোমরাই আমার আনন্দ, আমার জয়ের মালা। তোমরা প্রভুর সংগে যুক্ত হয়ে স্থির থাক। উবদিয়া ও সুন্তখী, আমি তোমাদের বিশেষভাবে এই অনুরোধ করছি- প্রভুর সংগে যুক্ত হয়েছ বলে তোমাদের মন যেন এক হয়। আর আমার আসল সহকর্মী, আমি তোমাকেও অনুরোধ করছি- তুমি এই স্ত্রীলোকদের সাহায্য কর। তাঁরা মসীহের বিষয়ে সুসংবাদের জন্য আমার সংগে এবং ক্লীমেন্ত ও আমার অন্যান্য সহকর্মীদের সংগে কষ্ট স্বীকার করেছিলেন। এঁদের নাম জীবন্তকিতাবে লেখা আছে। প্রভুর সংগে যুক্ত হয়েছ বলে তোমরা সব সময় আনন্দিত থাক। আমি আবার বলি, তোমরা আনন্দিত থাক। তোমাদের নরম স্বভাব যেন সকলে দেখতে পায়। প্রভু শীঘ্রই আসছেন। কোন বিষয় নিয়ে উতলা হোয়ো না, বরং তোমাদের সমস্ত চাওয়ার বিষয় শুকরিয়ার সংগে মুনাজাতের দ্বারা আল্লাহ্‌কে জানাও। তার ফলে, আল্লাহ্‌র দেওয়া যে শান্তির কথা মানুষ চিন্তা করেও বুঝতে পারে না, মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে সেই শান্তি তোমাদের দিল ও মনকে রক্ষা করবে। শেষে বলি, ভাইয়েরা, যা সত্যি, যা উপযুক্ত, যা সৎ, যা খাঁটি, যা সুন্দর, যা সম্মান পাবার যোগ্য, মোট কথা যা ভাল এবং প্রশংসার যোগ্য, সেই দিকে তোমরা মন দাও। তোমরা আমার কাছে যা শিখেছ ও ভাল বলে গ্রহণ করেছ এবং আমার মধ্যে যা দেখেছ ও আমার মুখে যা শুনেছ, তা-ই নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখ। তাতে শান্তিদাতা আল্লাহ্‌ তোমাদের সংগে সংগে থাকবেন। প্রভু আমাকে খুব আনন্দ দান করেছেন, কারণ অনেক দিন পরে তোমরা আবার আমার জন্য চিন্তা করছ। অবশ্য আমার জন্য সব সময়ই তোমাদের চিন্তা ছিল, কিন্তু তা তোমরা দেখাবার সুযোগ পাও নি। আমার কোন অভাবের জন্য যে আমি এই কথা বলছি তা নয়, কারণ যে কোন অবস্থায় আমি সন্তুষ্ট থাকতে শিখেছি। অভাবের মধ্যে এবং প্রচুর থাকবার মধ্যে আমি সন্তুষ্ট থাকতে জানি। ভরা পেটে হোক বা খালি পেটে হোক, প্রচুর থাকবার মধ্যে হোক বা অভাবের মধ্যে হোক- সব অবস্থাতেই কিভাবে সন্তুষ্ট থাকা যায় আমি তা শিখেছি। যিনি আমাকে শক্তি দান করেন তাঁর মধ্য দিয়েই আমি সব কিছু করতে পারি। তবুও তোমরা আমার কষ্টের ভাগী হয়ে ভালই করেছ। ফিলিপীয় জামাতের লোকেরা, তোমরা তো নিজেরাই জান যে, তোমরা প্রথমে সুসংবাদ শুনবার পরে যখন আমি ম্যাসিডোনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তখন তোমরা ছাড়া আর কোন জামাতই আমার সংগে দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে যোগ দেয় নি। যখন আমি থিষলনীকীতে ছিলাম তখনও তোমরা কয়েক বার সাহায্য পাঠিয়ে আমার অভাব পূরণ করেছিলে। কোন উপহার যে আমি চাইছি তা নয়, কিন্তু আমি এমন ফলের আশা করছি যা তোমাদের নামে জমা হতে থাকবে। আমার সব পাওনাই আমি পেয়েছি। আসলে আমার যা দরকার তার চেয়েও বেশী আমার আছে। ইপাফ্রদীতের হাতে তোমাদের পাঠানো উপহার পেয়ে এখন আমার যথেষ্ট হয়েছে। এই উপহারগুলো সুগন্ধযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য কোরবানী, আর এতে আল্লাহ্‌ খুশী হন। আমার আল্লাহ্‌ তাঁর গৌরবময় অশেষ ধন অনুসারে মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে তোমাদের সব অভাব পূরণ করবেন। যুগ যুগ ধরে চিরকাল আমাদের পিতা আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক। আমিন। মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত আল্লাহ্‌র প্রত্যেক বান্দাকে আমার সালাম জানায়ো। আমার সংগে যে ভাইয়েরা আছেন তাঁরা তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। আল্লাহ্‌র সব বান্দারা যাঁরা এখানে আছেন, বিশেষভাবে সম্রাট সিজারের বাড়ীর লোকেরা তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। হযরত ঈসা মসীহের রহমত তোমাদের দিলে থাকুক। বেহেশতে তোমাদের জন্য যা জমা করা আছে তা পাবার আশা থেকেই তোমাদের মধ্যে এই ঈমান ও মহব্বত জন্মেছে। যে সুসংবাদ, অর্থাৎ সত্যের কালাম তোমাদের কাছে পৌঁছেছে তার মধ্যেই তোমরা এই আশার কথা শুনেছ্‌। এই সুসংবাদ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে ফল জন্মাচ্ছে এবং দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। যেদিন তোমরা এই সুসংবাদ শুনেছ এবং আল্লাহ্‌র রহমতের কথা সত্যি করে জেনেছ সেই দিন থেকে তা তোমাদের মধ্যেও ঠিক তেমনিভাবে কাজ করছে। সেই সুসংবাদের কথা তোমরা আমাদের প্রিয় সহ-গোলাম ইপাফ্রার কাছে শুনেছ। তিনি তোমাদের পক্ষ থেকে মসীহের একজন বিশ্বস্ত সেবাকারী। পাক-রূহ্‌ তোমাদের যে মহব্বতের মনোভাব দান করেছেন তার সম্বন্ধে ইপাফ্রা আমাদের জানিয়েছেন। এইজন্য তোমাদের সম্বন্ধে শুনবার পর থেকেই আমরা সব সময় তোমাদের জন্য মুনাজাত করছি। রূহানী জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা যেন তোমরা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পার আমরা তা-ই আল্লাহ্‌র কাছে চাইছি। এতে যেন তোমরা সৎ কাজ করে ফলবান হও এবং আল্লাহ্‌কে আরও ভাল করে জানতে পার; আর এইভাবে যেন সব কিছুতে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তাঁর যোগ্য হয়ে চলতে পার। কারণ তিনি অন্ধকারের রাজ্য থেকে আমাদের উদ্ধার করে তাঁর প্রিয় পুত্রের রাজ্যে এনেছেন। এই পুত্রের সংগে যুক্ত হয়ে আমরা মুক্ত হয়েছি, অর্থাৎ আমরা গুনাহের মাফ পেয়েছি। এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য আল্লাহ্‌র হুবহু প্রকাশ। সমস্ত সৃষ্টির আগে তিনিই ছিলেন এবং সমস্ত সৃষ্টির উপরে তিনিই প্রধান, কারণ আসমান ও জমীনে, যা দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, সব কিছু তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। আসমানে যাদের হাতে রাজত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের সবাইকে তাঁকে দিয়ে তাঁরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনিই সব কিছুর আগে ছিলেন এবং তাঁরই মধ্য দিয়ে সব কিছু টিকে আছে। এছাড়া তিনিই তাঁর শরীরের, অর্থাৎ জামাতের মাথা। তিনিই প্রথম আর তিনিই মৃত্যু থেকে প্রথম জীবিত হয়েছিলেন, যেন সব কিছুতে তিনিই প্রধান হতে পারেন। আল্লাহ্‌ চেয়েছিলেন যেন তাঁর সব পূর্ণতা মসীহের মধ্যেই থাকে। তা ছাড়া দুনিয়াতে হোক বা বেহেশতে হোক, মসীহের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের সংগে সব কিছুর মিলনও তিনি চেয়েছিলেন। মসীহ্‌ ক্রুশের উপর তাঁর রক্ত দান করে শান্তি এনেছিলেন বলেই এই মিলন হতে পেরেছে। এক সময় তোমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে দূরে ছিলে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের মনে শত্রুভাব ছিল। তোমাদের খারাপ কাজের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু মসীহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর শরীরের দ্বারা আল্লাহ্‌ নিজের সংগে এখন তোমাদের মিলিত করেছেন, যেন তিনি তোমাদের পবিত্র, নিখুঁত ও নির্দোষ অবস্থায় নিজের সামনে উপস্থিত করতে পারেন। অবশ্য এর জন্য মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ থেকে যে নিশ্চিত আশা তোমরা পেয়েছ তা থেকে দূরে সরে না গিয়ে তোমাদের ঈমানে স্থির থাকতে হবে। সেই সুসংবাদ সারা দুনিয়াতে তবলিগ করা হয়েছে এবং তোমরা তা শুনেছ। আমি পৌল এই সুসংবাদের তবলিগকারী হয়েছি। তোমাদের জন্য আমি যে কষ্ট ভোগ করছি তাতে আমি আনন্দই পাচ্ছি। মসীহের শরীরের, অর্থাৎ জামাতের জন্য তাঁর যে দুঃখভোগ এখনও বাকী আছে তা আমি আমার শরীরেই পূর্ণ করছি। আল্লাহ্‌ তাঁর কালাম তোমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে তবলিগ করবার ভার আমার উপর দিয়েছেন বলেই আমি জামাতের একজন সেবাকারী হয়েছি। আল্লাহ্‌র কালামের মধ্যে যে গোপন সত্য আগেকার লোকদের কাছে যুগ যুগ ধরে লুকানো ছিল, এখন তাঁর বান্দাদের কাছে তা প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহ্‌ চাইলেন, অ-ইহুদীদের মধ্যেও তাঁর এই গোপন সত্যের মহা গৌরব যে কি, তা যেন তাঁর সব বান্দারা জানতে পারে। সেই সত্য এই-মসীহ্‌ তোমাদের দিলে আছেন বলে তোমরা মহিমা পাবার আশ্বাস পেয়েছ। আর সেই মসীহের বিষয় আমরা তবলিগ করি, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র দেওয়া অসীম জ্ঞানের সংগে আমরা প্রত্যেক লোককে সতর্ক করি ও শিক্ষা দিই, যেন প্রত্যেককেই আমরা মসীহের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করে তুলতে পারি। এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ্‌র যে মহাশক্তি আমার মধ্যে কাজ করছে সেই শক্তি অনুসারে আমি প্রাণপণ পরিশ্রম করছি। আমি তোমাদের জানাতে চাই যে, তোমাদের জন্য এবং লায়দিকেয়া শহরের জামাতের লোকদের জন্য, আর যারা আমাকে দেখে নি তাদের সকলের জন্য আমি প্রাণপণ পরিশ্রম করছি। আমি চাই যেন তারা দিলে উৎসাহ পায় এবং মহব্বতে এক হয়, আর মসীহের বিষয় বুঝবার ফলে যে নিশ্চয়তা পাওয়া যায় সেই পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রচুর পরিমাণে লাভ করে। তার ফলে আল্লাহ্‌র গোপন সত্যকে, অর্থাৎ মসীহ্‌কে তারা জানতে পারবে। মসীহের মধ্যে সব জ্ঞান ও বুদ্ধি লুকানো আছে। আমি তোমাদের এই কথা বলছি যাতে কেউ মন ভুলানো যুক্তিতর্ক দিয়ে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে না পারে। আমি শরীরে তোমাদের মধ্যে উপস্থিত না থাকলেও রূহে উপস্থিত আছি এবং তোমাদের ভাল চালচলন ও মসীহের উপর তোমাদের স্থির ঈমান দেখে আনন্দ পাচ্ছি। তোমরা যেভাবে মসীহ্‌ ঈসাকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছ ঠিক সেইভাবে তাঁর সংগে যুক্ত হয়ে তোমাদের জীবন কাটাও। মসীহের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে গিয়ে তাঁরই মধ্যে তোমরা গড়ে উঠতে থাক। তোমরা শিক্ষা পেয়ে যাতে ঈমান এনেছ তাতে স্থির থাক এবং আল্লাহ্‌কে সব সময় শুকরিয়া জানাতে থাক। তোমরা সাবধান হও, যেন কেউ মানুষের ফাঁপা ছলনাপূর্ণ দর্শনের শিক্ষা দ্বারা তোমাদের বন্দী হিসাবে টেনে নিতে না পারে। মসীহের সংগে সেই শিক্ষার কোন সম্বন্ধ নেই; মানুষের গড়া চলতি নিয়ম এবং দুনিয়ার নানা রীতিনীতির উপরেই তা ভরসা করে। আল্লাহ্‌র সমস্ত পূর্ণতা মসীহের মধ্যে শরীর নিয়ে বাস করছে, আর মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে তোমরাও সেই পূর্ণতা পেয়েছ। তিনি আসমানের সমস্ত শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের উপরে। এছাড়া তোমরা মসীহের সংগে যুক্ত হয়েছ বলে তোমাদের খৎনাও করানো হয়েছে। এই খৎনা কোন মানুষের হাতে করানো হয় নি, মসীহ্‌ নিজেই তা করেছেন; অর্থাৎ শরীরের উপর গুনাহ্‌-স্বভাবের যে শক্তি ছিল সেই শক্তি থেকে তিনি তোমাদের মুক্ত করেছেন। তরিকাবন্দীর মধ্য দিয়ে মসীহের সংগে তোমাদের দাফন করা হয়েছে; শুধু তা-ই নয়, যিনি মৃত্যু থেকে মসীহ্‌কে জীবিত করে তুলেছেন সেই আল্লাহ্‌র শক্তির উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমাদের মসীহের সংগে জীবিত করে তোলাও হয়েছে। তোমরা তো গুনাহের দরুন এবং খৎনা-না-করানোর দরুন মৃত ছিলে, কিন্তু আল্লাহ্‌ তোমাদের মসীহের সংগে জীবিত করেছেন। তিনি আমাদের সব গুনাহ্‌ মাফ করেছেন, আর আমাদের বিরুদ্ধে যে দলিল ছিল তার সমস্ত দাবি-দাওয়া সুদ্ধ তা বাতিল করে দিয়েছেন। সেই দলিল তিনি ক্রুশে পেরেক দিয়ে গেঁথে নাকচ করে ফেলেছেন। তিনি আসমানের সমস্ত খারাপ শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের ক্ষমতা নষ্ট করেছেন। আর এইভাবে তিনি মসীহের ক্রুশের মধ্য দিয়ে তাদের উপর জয়লাভ করেছেন এবং সকলের সামনে তাদের অসম্মানিত করেছেন। সেইজন্য খাওয়া-দাওয়া বা কোন ঈদ কিংবা অমাবস্যা বা বিশ্রামবার নিয়ে তোমাদের দোষ দেবার অধিকার কারও নেই। এগুলো তো ছিল ভবিষ্যতে যা হবে তার ছায়া, কিন্তু যা আসল তা মসীহের মধ্যেই আছে। নিজেদের শরীরকে কষ্ট দেওয়া ও ফেরেশতাদের এবাদত করা যারা দরকারী বলে মনে করে তারা যেন তোমাদের পুরস্কার পাবার পথে বাধা না জন্মায়। এই রকমের লোক যা দেখেছে বলে ভান করে সেই বিষয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে এবং বিনা কারণেই অহংকারে ফুলে ওঠে, কারণ তাদের মন গুনাহ্‌-স্বভাবের অধীন। তারা শক্তভাবে মাথাকে, অর্থাৎ ঈসা মসীহ্‌কে ধরে রাখে না, অথচ সেই মাথার পরিচালনায়ই গোটা শরীরটা হাড়-মাংসের বাঁধনে যুক্ত হয়ে ও স্থির থেকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত বেড়ে ওঠে। মসীহের সংগে মরে তোমরা যখন দুনিয়ার নানা রীতিনীতির কাছ থেকে দূরে সরে এসেছ তখন দুনিয়ার লোকদের মতই তোমরা কেন আবার দুনিয়ার নিয়মের অধীন হচ্ছ? এই সব নিয়মগুলো দেখতে মনে হয় বেশ জ্ঞানে পূর্ণ, কারণ কি করে এবাদত করা যায়, কিভাবে নিজেদের নীচু করা যায়, কিভাবে নিজের শরীরকে কষ্ট দেওয়া যায়, তা এই নিয়মগুলো লোকদের জানায়, কিন্তু গুনাহ্‌-স্বভাবকে বশ করবার ব্যাপারে এগুলোর কোন মূল্যই নেই। তাহলে তোমরা যখন মসীহের সংগে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছ তখন মসীহ্‌ বেহেশতে যেখানে আল্লাহ্‌র ডান দিকে বসে আছেন সেই বেহেশতী বিষয়গুলোর জন্য আগ্রহী হও। জাগতিক বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে বরং বেহেশতী বিষয়ে মনোযোগ দাও। তোমরা তো মরে গেছ এবং তোমাদের জীবন মসীহের সংগে আল্লাহ্‌র মধ্যে লুকানো আছে। যিনি তোমাদের জীবন সেই মসীহ্‌ যখন প্রকাশিত হবেন তখন তোমরাও তাঁর সংগে তাঁর মহিমার ভাগী হয়ে প্রকাশিত হবে। সেইজন্য তোমাদের গুনাহ্‌-স্বভাবের মধ্যে যা কিছু আছে তা ধ্বংস করে ফেল। তাতে আছে সব রকম জেনা, নাপাকী, কুবাসনা, খারাপ ইচ্ছা এবং লোভ যাকে এক রকম প্রতিমাপূজা বলা যায়। যারা আল্লাহ্‌র অবাধ্য তাদের উপর এই সব কারণেই আল্লাহ্‌র গজব নেমে আসছে। তোমরাও আগে ঐ রকম ভাবেই চলতে, কিন্তু এখন রাগ, মেজাজ দেখানো, হিংসা, গালাগালি এবং খারাপ কথাবার্তা তোমাদের কাছ থেকে দূর কর। এই অবস্থায় অ-ইহুদী বা ইহুদীর মধ্যে, খৎনা-করানো বা খৎনা-না-করানো লোকের মধ্যে, অশিক্ষিত, নীচজাতি, গোলাম বা স্বাধীন লোকের মধ্যে কোন তফাৎ নেই; সেখানে মসীহ্‌ই প্রধান এবং তিনি প্রত্যেকের মধ্যেই আছেন। এইজন্য আল্লাহ্‌ যাদের বেছে নিয়ে নিজের জন্য আলাদা করে রেখেছেন তাঁর সেই প্রিয় বান্দা হিসাবে তোমরা আন্তরিক মায়া-মমতা, দয়া, নম্রতা, নরম স্বভাব ও ধৈর্য দিয়ে নিজেদের সাজাও। একে অন্যকে সহ্য কর এবং যদি কারও বিরুদ্ধে তোমাদের কোন দোষ দেবার কারণ থাকে তবে তাকে মাফ কর। প্রভু যেমন তোমাদের মাফ করেছেন তেমনি তোমাদেরও একজন অন্যজনকে মাফ করা উচিত। আর এই সবের উপরে মহব্বত দিয়ে নিজেদের সাজাও। মহব্বতই ঐ সব গুণগুলোকে একসংগে বেঁধে পূর্ণতা দান করে। মসীহ্‌ যে শান্তি দেন সেই শান্তি তোমাদের দিলে থেকে তোমাদের পরিচালনা করুক। শান্তিতে থাকবার জন্যই তো তোমাদের সবাইকে একশরীর হিসাবে ডাকা হয়েছে। তোমরা কৃতজ্ঞ থাক। মসীহের কালামকে তোমাদের দিলে পরিপূর্ণভাবে বাস করতে দাও। আল্লাহ্‌র দেওয়া জ্ঞানে একে অন্যকে শিক্ষা ও পরামর্শ দাও এবং অন্তরে কৃতজ্ঞতার সংগে আল্লাহ্‌র উদ্দেশে জবুর শরীফের কাওয়ালী এবং রূহানী ও প্রশংসার গজল কর। তোমরা যা কিছু বল বা কর না কেন তা হযরত ঈসার নামে কোরো এবং তাঁর মধ্যে দিয়েই পিতা আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানায়ো। তোমরা যারা স্ত্রী, তোমরা প্রত্যেকে স্বামীর অধীনতা মেনে নাও, কারণ প্রভুর বান্দা হিসাবে এটাই উপযুক্ত। তোমরা যারা স্বামী, তোমরা প্রত্যেকে স্ত্রীকে মহব্বত কোরো এবং তার সংগে কঠোর ব্যবহার কোরো না। ছেলেমেয়েরা, তোমরা সব বিষয়ে মা-বাবার বাধ্য থেকো, কারণ এতে প্রভু খুশী হন। তোমরা যারা পিতা, তোমাদের ছেলেমেয়েদের মন তেতো করে তুলো না, যেন তারা উৎসাহহীন হয়ে না পড়ে। তোমরা যারা গোলাম, তোমরা সব বিষয়ে তোমাদের এই দুনিয়ার মালিকদের বাধ্য থেকো। যখন তাঁরা তোমাদের লক্ষ্য করেন কেবল তখনই যে তাঁদের খুশী রাখবার জন্য তাঁদের বাধ্য থাকবে তা নয়, বরং খাঁটি দিলে প্রভুর উপর ভয় রেখে তাঁদের বাধ্য থেকো। তোমরা যা-ই কর না কেন, তা মানুষের জন্য নয় বরং প্রভুর জন্য করছ বলে মনপ্রাণ দিয়ে কোরো, কারণ তোমরা তো জান, প্রভু তাঁর বান্দাদের জন্য যা রেখেছেন তা তোমরা পুরস্কার হিসাবে তাঁরই কাছ থেকে পাবে। তোমরা যাঁর সেবা করছ তিনি হযরত মসীহ্‌। যে অন্যায় করে সে তার ফল পাবে। প্রভুর চোখে সবাই সমান। মালিকেরা, বেহেশতে তোমাদেরও একজন মালিক আছেন জেনে তোমরা তোমাদের গোলামদের সংগে সৎ এবং ন্যায় ব্যবহার কোরো। তোমরা কৃতজ্ঞ ও সতর্ক হয়ে মুনাজাতে নিজেদের ব্যস্ত রেখো; আর সেই সংগে আমাদের জন্যও মুনাজাত কোরো যেন মসীহ্‌ সম্বন্ধে গোপন সত্যের কথা তবলিগ করবার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের সুযোগ করে দেন। সেই গোপন সত্যের জন্যই তো আমাকে বন্দী করা হয়েছে। যে রকম স্পষ্টভাবে আমার এই বিষয় বুঝিয়ে বলা উচিত, মুনাজাত কোরো আমি যেন সেইভাবে বলতে পারি। যারা আল্লাহ্‌র বান্দা নয় তাদের সংগে বুদ্ধি ব্যবহার করে চোলো এবং মসীহের বিষয়ে সাক্ষ্য দেবার প্রত্যেকটা সুযোগ কাজে লাগায়ো। তোমাদের কথাবার্তা সব সময় মধুর এবং লবণ দেওয়া খাবারের মত গ্রহণযোগ্য হোক, যেন কাকে কিভাবে জবাব দেবে তা তোমরা বুঝতে পার। আমাদের প্রিয় ভাই ও বিশ্বস্ত সেবাকারী এবং প্রভুর কাজে আমাদের সহ-গোলাম তুখিক আমার সমস্ত সংবাদ তোমাদের দেবেন। তোমরা যেন আমাদের সম্বন্ধে জানতে পার আর তিনি যেন তোমাদের উৎসাহ দিতে পারেন সেইজন্য আমি তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠালাম। তুখিকের সংগে আমি আমাদের বিশ্বস্ত ও প্রিয় ভাই ওনীষিমকেও পাঠালাম। তিনি তোমাদেরই একজন। তাঁরা এখানকার সব কিছুই তোমাদের জানাবেন। আমার সংগে বন্দী ভাই আরিষ্টার্খ আর বার্নাবাসের আত্মীয় মার্কও তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। মার্কের বিষয় তোমরা তো আগেই হুকুম পেয়েছ যে, তিনি যদি তোমাদের কাছে আসেন তবে তাঁকে আদরের সংগে গ্রহণ কোরো। যাঁকে যুষ্ট বলে ডাকা হয় সেই ইউসাও তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। ইহুদীদের মধ্য থেকে কেবল এই তিনজনই আল্লাহ্‌র রাজ্যের জন্য আমার সংগে কাজ করেন। তাঁরা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। ইপাফ্রাও তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। তিনি তোমাদের নিজেদের লোকদের মধ্যে একজন এবং তিনি মসীহ্‌ ঈসার গোলাম। তিনি সব সময় তোমাদের জন্য মুনাজাতের যুদ্ধ চালাচ্ছেন যেন তোমরা পূর্ণতা লাভ করে এবং সব কিছুতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা নিশ্চয় করে জেনে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পার। ইপাফ্রার সম্বন্ধে আমি এই বলতে পারি যে, তোমাদের জন্য এবং যারা লায়দিকেয়া ও হিয়রাপলি শহরে আছে তাদের জন্য তিনি খুব পরিশ্রম করেন। প্রিয় ডাক্তার লূক এবং দীমা তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। লায়দিকেয়ার ঈমানদার ভাইদের এবং নুম্ফা ও তাঁর বাড়ীতে যে লোকেরা জামাত হিসাবে জমায়েত হয়, তাঁদেরও সালাম জানায়ো। তোমাদের মধ্যে এই চিঠি পড়া শেষ হলে পর লায়দিকেয়ার জামাতকেও এই চিঠি পড়তে দিয়ো, আর লায়দিকেয়া জামাতকে যে চিঠি পাঠানো হবে সেটাও তোমরা পোড়ো। আর্খিপ্পকে এই কথা বল, “প্রভুর সেবার জন্য তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে তা শেষ করবার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দাও।” আমি পৌল নিজের হাতে এই সালামের কথা লিখছি। মনে রেখো, আমি বন্দী আছি। আল্লাহ্‌ তোমাদের রহমত দান করুন। পিতা আল্লাহ আর হযরত ঈসা মসীহের সংগে যুক্ত থিষলনীকীয় জামাতের কাছে সীলবান, তীমথিয় আর আমি পৌল এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ আর হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমরা সব সময় মুনাজাতে তোমাদের সকলের কথা মনে করে আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে থাকি। ঈমানের দরুন তোমরা যে কাজ করছ, মহব্বতের দরুন যে পরিশ্রম করছ এবং আমাদের হযরত ঈসা মসীহের উপর আশার দরুন যে ধৈর্য ধরছ, সেই কথা আমরা সব সময়ই আমাদের পিতা ও আল্লাহ্‌র সামনে মুনাজাতে মনে করে থাকি। আল্লাহ্‌র প্রিয় আমার ভাইয়েরা, আমরা জানি তিনিই তোমাদের বেছে নিয়েছেন, কারণ আমাদের প্রচারিত সুসংবাদ কেবলমাত্র কথার মধ্য দিয়ে তোমাদের কাছে আসে নি, কিন্তু তা শক্তি, পাক-রূহ্‌ ও পূর্ণ নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এসেছিল। তোমাদের সংগে থাকবার সময়ে তোমাদের ভালোর জন্য আমরা কিভাবে চলাফেরা করেছি তা তোমরা জান। অনেক অত্যাচারের মধ্যেও পাক-রূহের দেওয়া আনন্দের সংগে সেই সুসংবাদ গ্রহণ করে তোমরা আমাদের আর প্রভুর মত করে চলছ। এতে ম্যাসিডোনিয়া আর আখায়া প্রদেশের সব ঈমানদারদের কাছে তোমরা একটা আদর্শ হয়েছ। কেবলমাত্র ম্যাসিডোনিয়া আর আখায়া প্রদেশেই যে তোমাদের কাছ থেকে মাবুদের কালাম ছড়িয়ে পড়েছে এমন নয়, কিন্তু আল্লাহ্‌র উপর তোমাদের ঈমানের কথাও সব জায়গাতেই গিয়ে পৌঁছেছে। এই ব্যাপারে আমাদের কিছুই বলবার দরকার নেই, কারণ তোমরা কিভাবে আমাদের গ্রহণ করেছিলে লোকেরা তা আমাদের জানাচ্ছে। তারা আরও জানাচ্ছে যে, তোমরা কিভাবে দেব-দেবীদের কাছ থেকে ফিরে জীবন্ত ও সত্য আল্লাহ্‌র কাছে এসেছ যেন তাঁর এবাদত করতে পার, আর বেহেশত থেকে তাঁর পুত্রের আসবার জন্য অপেক্ষা করতে পার। সেই পুত্রই হলেন ঈসা, যাঁকে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছিলেন। আল্লাহ্‌র যে গজব নেমে আসছে সেই গজব থেকে এই ঈসাই আমাদের রক্ষা করবেন। ভাইয়েরা, তোমরা নিজেরাই জান যে, তোমাদের কাছে আমাদের যাওয়া নিষ্ফল হয় নি। তোমরা এই কথাও জান যে, এর আগে ফিলিপী শহরে আমরা জুলুম ভোগ করেছিলাম এবং অসম্মানিতও হয়েছিলাম। কিন্তু এই সব বাধা-বিপত্তি থাকলেও আমাদের আল্লাহ্‌র কাছ থেকে সাহস পেয়ে তাঁর সুসংবাদের কথা আমরা খোলাখুলিভাবেই তোমাদের কাছে বলেছিলাম। আমাদের উপদেশ ভুল শিক্ষা থেকে নয়, অসৎ উদ্দেশ্য থেকেও নয়, কিংবা আমরা ছলনা করেও কোন কথা বলছি না; বরং যোগ্য মনে করে সুসংবাদ জানাবার ভার আল্লাহ্‌ আমাদের উপর দিয়েছেন বলেই আমরা সেই হিসাবে কথা বলছি। মানুষকে সন্তুষ্ট করবার জন্য আমরা এই কথা বলছি না, কিন্তু যিনি আমাদের দিল যাচাই করে দেখেন সেই আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করবার জন্যই বলছি। তোমরা জান আমরা কখনও তোষামোদ করে কথা বলি নি, আর লোভকে ঢেকে রেখেও যে ছলনা করে কোন কথা আমরা বলি নি, আল্লাহ্‌ তার সাক্ষী। মানুষের কাছ থেকে, অর্থাৎ তোমাদের বা অন্য কারও কাছ থেকে আমরা প্রশংসা পাবার চেষ্টা করি নি। মসীহের সাহাবী হিসাবে আমাদের অধিকার অবশ্য আমরা তোমাদের উপর খাটাতে পারতাম, কিন্তু তার বদলে মা যেমন তাঁর নিজের সন্তানদের আদর-যত্ন করেন, তোমাদের মধ্যে থাকবার সময়ে আমরাও তোমাদের সংগে সেই রকমই নরম ব্যবহার করেছিলাম। তোমাদের উপর গভীর মায়া-মমতা থাকাতে তোমাদের কেবল আল্লাহ্‌র সুসংবাদ দিতে নয়, তোমাদের জন্য নিজেদের প্রাণ দিতেও আমরা রাজী ছিলাম, কারণ আমাদের কাছে তোমরা খুবই প্রিয়। ভাইয়েরা, আমাদের পরিশ্রম আর কষ্টের কথা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে। তোমাদের কাছে আল্লাহ্‌র সুসংবাদ তবলিগ করবার সময় আমরা দিনরাত পরিশ্রম করেছি, যাতে আমরা তোমাদের কারও উপরে বোঝা হয়ে না পড়ি। তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের সংগে আমাদের ব্যবহার যে পবিত্র, সৎ ও নিখুঁত ছিল, তার সাক্ষী তোমরাও আছ আর আল্লাহ্‌ও আছেন। আমরা সব সময় আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানাচ্ছি, কারণ আল্লাহ্‌র কালাম আমাদের কাছ থেকে শুনে যখন তোমরা ঈমান এনেছিলে তখন তোমরা তা মানুষের বলে নয়, কিন্তু আল্লাহ্‌র কালাম বলেই গ্রহণ করেছিলে। আর সত্যিই তা আল্লাহ্‌রই কালাম। তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের দিলে সেই কালামই কাজ করছে। ভাইয়েরা, এহুদিয়া প্রদেশে মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত আল্লাহ্‌র যে জামাতগুলো আছে, তোমাদের অবস্থা তাদের মতই। ইহুদীদের হাতে তারা যে সব দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে, তোমরাও নিজের দেশের লোকদের হাতে সেই একই রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছ। ঐ ইহুদীরাই হযরত ঈসাকে ও নবীদের হত্যা করেছিল, আর আমাদের উপরও তারা জুলুম করেছে। তারা আল্লাহ্‌কে অসন্তুষ্ট করে, আর সমস্ত মানুষের উপর তাদের শত্রুভাব আছে। তারা আমাদের বাধা দেয় যেন অ-ইহুদীদের নাজাতের জন্য তাদের কাছে আমরা কোন কথা বলতে না পারি। এইভাবেই ঐ ইহুদীরা সব সময় গুনাহের উপর গুনাহ্‌ বোঝাই করছে, আর আল্লাহ্‌র গজব সম্পূর্ণভাবে তাদের উপর এসে পড়েছে। ভাইয়েরা, মনের দিক থেকে না হলেও শরীরের দিক থেকে আমরা অল্প সময়ের জন্য তোমাদের কাছ থেকে দূরে আছি। তাই আমরা খুব আগ্রহের সংগে চেষ্টা করেছিলাম যাতে আবার তোমাদের সংগে আমাদের দেখা হয়। সেইজন্য আমরা, বিশেষ করে আমি পৌল অনেক বারই তোমাদের কাছে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শয়তান আমাদের বাধা দিয়েছিল। আমাদের হযরত ঈসা যখন আসবেন তখন তাঁর সামনে তোমরাই কি আমাদের আশা, আনন্দ ও গৌরবের জয়ের মালা হবে না? সত্যি, তোমরাই আমাদের গৌরব, তোমরাই আমাদের আনন্দ। যাতে এই সব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তোমরা কেউ পিছিয়ে না যাও। তোমরা নিজেরাই জান যে, দুঃখ-কষ্ট আমাদের জন্য ঠিক করাই আছে। দুঃখ-কষ্ট যে আমাদের উপর আসবেই সেই কথা তোমাদের সংগে থাকবার সময়ে আমরা বারবারই বলেছিলাম, আর তোমরা জান যে, ঠিক তা-ই ঘটেছে। সেইজন্য আমি যখন আর সহ্য করতে পারলাম না তখন ঈমানের দিক থেকে তোমরা কি অবস্থায় আছ তা জানবার জন্যই তীমথিয়কে পাঠিয়েছিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল, হয়তো শয়তান তোমাদের লোভ দেখিয়েছে আর আমাদের পরিশ্রম সব নিষ্ফল হয়ে গেছে। এখন তীমথিয় তোমাদের কাছ থেকে আমাদের কাছে ফিরে এসে তোমাদের মহব্বত ও ঈমান সম্বন্ধে ভাল খবরই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা সব সময় আমাদের মনে করে থাক, আর আমরা যেমন তোমাদের দেখতে চাইছি তেমনি তোমরাও আমাদের দেখতে চাইছ। এইজন্য ভাইয়েরা, তীমথিয়ের মুখে তোমাদের ঈমানের কথা শুনে আমাদের সব যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যেও আমরা সান্ত্বনা পেয়েছি। প্রভুর উপর তোমাদের ঈমান স্থির থাকলেই আমাদের জীবন ধন্য। তোমাদের দরুন আল্লাহ্‌র সামনে আমাদের যে আনন্দ, তার বদলে কেমন করে যে তাঁকে তোমাদের জন্য শুকরিয়া জানাব তা আমরা জানি না। আমরা দিনরাত আল্লাহ্‌র কাছে দিল থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন আমরা তোমাদের দেখতে পাই এবং তোমাদের ঈমানের মধ্যে যে অভাব আছে তা পূরণ করতে পারি। আমাদের পিতা ও আল্লাহ্‌ নিজে এবং আমাদের হযরত ঈসা যেন তোমাদের কাছে যাবার পথ ঠিক করে দেন। প্রভু করুন, আমরা যেমন তোমাদের মহব্বত করি ঠিক তেমনি করে তোমাদেরও একের প্রতি অন্যের, এমন কি, সকলের প্রতি মহব্বত যেন বেড়ে উঠে উপ্‌চে পড়ে। তাহলে তিনি তোমাদের দিল স্থির করবেন, যাতে আমাদের হযরত ঈসা যখন তাঁর নিজের সমস্ত বান্দাদের সংগে নিয়ে আসবেন তখন আমাদের পিতা ও আল্লাহ্‌র সামনে তোমরা নিখুঁত এবং পবিত্র হও। আরও বলি ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করবার জন্য কিভাবে চলা উচিত সেই শিক্ষা তো তোমরা আমাদের কাছে পেয়েছ, আর সত্যিই তোমরা সেইভাবেই চলছ। তবুও হযরত ঈসার হয়ে আমরা তোমাদের অনুরোধ করছি ও উপদেশ দিচ্ছি যেন তোমরা আরও বেশী করে সেইভাবে চল। হযরত ঈসার কাছ থেকে অধিকার পেয়ে আমরা তোমাদের কি কি হুকুম দিয়েছি তা তোমাদের জানা আছে। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এই- তোমরা পবিত্র হও, অর্থাৎ সব রকম জেনা থেকে দূরে থাক, এই ব্যাপারে অন্যায় করে কেউ যেন কোন ভাইকে না ঠকায়। আমরা আগেই তোমাদের বলেছি এবং সাবধান করে দিয়েছি যে, এই সব অন্যায়ের জন্য প্রভুই শাস্তি দেবেন, কারণ আল্লাহ্‌ অপবিত্র ভাবে চলবার জন্য আমাদের ডাকেন নি, পবিত্রভাবে চলবার জন্যই ডেকেছেন। সেইজন্য এই শিক্ষা যে অগ্রাহ্য করে সে মানুষকে অগ্রাহ্য করে না, বরং যিনি তাঁর পাক-রূহ্‌কে তোমাদের দান করেছেন সেই আল্লাহ্‌কেই অগ্রাহ্য করে। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের মহব্বত সম্বন্ধে তোমাদের কাছে কিছু লিখবার দরকার নেই, কারণ আল্লাহ্‌ তোমাদের একে অন্যকে মহব্বত করতে শিখিয়েছেন। আর সত্যিই তোমরা ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশের সব ভাইদের মহব্বত কর। কিন্তু ভাইয়েরা, তোমাদের কাছে আমাদের বিশেষ অনুরোধ হল তোমাদের এই মহব্বত যেন আরও বেড়ে যায়। আমরা তোমাদের যে হুকুম দিয়েছি সেইমত শান্ত জীবন কাটাতে, নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতে এবং নিজের হাতে পরিশ্রম করতে বিশেষভাবে আগ্রহী হও, যেন বাইরের লোকদের চোখে তোমাদের চলাফেরা উপযুক্ত হয় এবং অন্যের উপর ভরসা করতে না হয়। ভাইয়েরা, আমরা চাই না যারা মারা গেছে তাদের কি হবে সেই সম্বন্ধে তোমাদের অজানা থাকে, যেন যাদের মনে কোন আশা নেই তাদের মত করে তোমরা দুঃখে ভেংগে না পড়। আমরা যখন বিশ্বাস করি ঈসা মরেছিলেন এবং আবার জীবিত হয়ে উঠেছেন তখন আমরা এও বিশ্বাস করি, যারা ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে মারা গেছে আল্লাহ্‌ তাদেরও ঈসার সংগে নিয়ে যাবেন। প্রভুর শিক্ষামতই আমরা তোমাদের বলছি, আমরা যারা জীবিত আছি এবং প্রভুর ফিরে আসা পর্যন্ত জীবিত থাকব, আমরা কোনমতেই সেই মৃতদের আগে যাব না। জোর গলায় হুকুমের সংগে এবং প্রধান ফেরেশতার ডাক ও আল্লাহ্‌র শিংগার ডাকের সংগে প্রভু নিজেই বেহেশত থেকে নেমে আসবেন। মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে যারা মারা গেছে তখন তারাই প্রথমে জীবিত হয়ে উঠবে। তার পরে আমরা যারা জীবিত ও বাকী থাকব, আমাদেরও আকাশে প্রভুর সংগে মিলিত হবার জন্য তাদের সংগে মেঘের মধ্যে তুলে নেওয়া হবে। আর এইভাবে আমরা চিরকাল প্রভুর সংগে থাকব। সেইজন্য তোমরা এই সব কথা বলে একে অন্যকে সান্ত্বনা দাও। ভাইয়েরা, কোন্‌ সময় আর কি রকম সময়ে তা ঘটবে সেই সম্বন্ধে তোমাদের কাছে কিছু লিখবার দরকার নেই। তোমরা নিজেরাই ভাল করে জান যে, রাতের বেলায় যেভাবে চোর আসে প্রভুর সেই দিনটিও সেইভাবেই আসবে। যখন লোকে বলবে, “শান্তি হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই,” তখন গর্ভবতী স্ত্রীলোকের হঠাৎ প্রসব-বেদনা উঠবার মত করে ঐ লোকদের সর্বনাশ হবে। তারা কিছুতেই রক্ষা পাবে না। কিন্তু ভাইয়েরা, তোমরা তো অন্ধকারে বাস করছ না যে, সেই দিনটা চোরের মত তোমাদের উপর এসে পড়বে। তোমরা তো সবাই নূরের ও দিনের লোক। আমরা রাতের বা অন্ধকারের লোক নই। সেইজন্য অন্যদের মত যেন আমরা না ঘুমাই, বরং জেগে থাকি এবং নিজেদের দমনে রাখি। যারা ঘুমায় তারা রাতেই ঘুমায়, আর যারা মাতাল হয় তারা রাতেই মাতাল হয়। আমরা কিন্তু দিনের লোক; কাজেই বুক রক্ষার জন্য ঈমান ও মহব্বত দিয়ে বুক ঢেকে এবং মাথা রক্ষার জন্য নাজাতের নিশ্চয়তা মাথায় দিয়ে এস, আমরা নিজেদের দমনে রাখি। শাস্তি পাবার জন্য নয় বরং আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে নাজাত পাবার জন্যই আল্লাহ্‌ আমাদের ঠিক করে রেখেছেন। মসীহ্‌ আমাদের জন্য মরেছিলেন, যাতে আমরা বাঁচি বা মরি, আমরা যেন তাঁরই সংগে জীবিত থাকতে পারি। এইজন্য তোমরা এখন যেমন করছ তেমনি করে একে অন্যকে উৎসাহ দান করতে ও একে অন্যকে গড়ে তুলতে থাক। ভাইয়েরা, আমরা তোমাদের অনুরোধ করছি, যাঁরা তোমাদের মধ্যে পরিশ্রম করেন, প্রভুর হয়ে তোমাদের পরিচালনা করেন এবং তোমাদের উপদেশ দিয়ে থাকেন, তাঁদের সম্মান কোরো। তাঁরা যা করছেন তার জন্য মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তাঁদের তোমরা বিশেষভাবে শ্রদ্ধা কোরো। তোমরা নিজেদের মধ্যে শান্তিতে থেকো। ভাইয়েরা, আমরা তোমাদের এই উপদেশ দিচ্ছি- যারা অলস তাদের সাবধান কোরো; যাদের সাহস নেই তাদের সাহস দিয়ো; যারা দুর্বল তাদের সাহায্য কোরো এবং সকলকে ধৈর্যের সংগে সহ্য কোরো। দেখো, অন্যায়ের বদলে কেউ যেন অন্যায় না করে। তোমরা সব সময় একে অন্যের, এমন কি, অন্য সকলের উপকার করবার চেষ্টা কোরো। পাক-রূহ্‌কে নিভিয়ে ফেলো না। যাঁরা নবী হিসাবে আল্লাহ্‌র কালাম বলেন তাঁদের কথা তুচ্ছ কোরো না, বরং সব কিছু যাচাই করে দেখো। যা ভাল তা ধরে রেখো, আর সব রকম খারাপী থেকে দূরে থেকো। শান্তিদাতা আল্লাহ্‌ নিজেই তোমাদের সম্পূর্ণভাবে পবিত্র করুন, আর আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ আসবার সময়ে তোমাদের সম্পূর্ণ দেহ-রূহ্‌-মন নির্দোষ রাখুন। মনে রেখো, যিনি তোমাদের ডেকেছেন তিনি নির্ভরযোগ্য; তিনি নিশ্চয়ই তা করবেন। ভাইয়েরা, আমাদের জন্য মুনাজাত কোরো। মহব্বতের মনোভাব নিয়ে সকলকে সালাম জানায়ো। আমি প্রভুর নামে তোমাদের এই হুকুম দিচ্ছি যে, এই চিঠি যেন সব ভাইদের কাছে পড়ে শুনানো হয়। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের রহমত তোমাদের উপরে থাকুক। পিতা আল্লাহ আর হযরত ঈসা মসীহের সংগে যুক্ত থিষলনীকীয় জামাতের কাছে সীলবান, তীমথিয় আর আমি পৌল এই চিঠি লিখছি। পিতা আল্লাহ আর হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। ভাইয়েরা, তোমাদের জন্য সব সময়ই আল্লাহ্‌কে আমাদের শুকরিয়া জানানো উচিত। তোমাদের বিশ্বাস খুব বাড়ছে এবং তোমাদের একের প্রতি অন্যের মহব্বত উপ্‌চে পড়ছে বলেই আমাদের পক্ষে সেই শুকরিয়া জানানো উপযুক্ত। আর এইজন্যই আল্লাহ্‌র জামাতগুলোর সামনে তোমাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করছি, কারণ যে সব জুলুম ও দুঃখ-কষ্ট তোমরা সহ্য করছ তার মধ্যেও তোমাদের ধৈর্য আর ঈমান টিকে আছে। এই সবই আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচারের প্রমাণ। আর এর উদ্দেশ্য হল, তোমাদের যেন আল্লাহ্‌র রাজ্যের উপযুক্ত বলে ধরা হয়। এর জন্যই তো তোমরা এত কষ্টভোগ করছ। আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার এই- যারা তোমাদের কষ্ট দেয় তিনি তাদের কষ্ট দেবেন; তাই আমরা সব সময় তোমাদের জন্য মুনাজাত করে থাকি যেন আমাদের আল্লাহ্‌ তোমাদের তাঁর ডাকের যোগ্য বলে মনে করেন, আর যেন তাঁর শক্তির দ্বারা তোমাদের ভাল কাজ করবার সমস্ত ইচ্ছা তিনি পূর্ণ করেন এবং ঈমানের ফলে তোমরা যে কাজ করছ তিনি যেন তাতে পূর্ণতা দান করেন। তাহলে আমাদের আল্লাহ্‌ এবং হযরত ঈসা মসীহের রহমতের দরুন আমাদের হযরত ঈসার গৌরব তোমাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে, আর তোমরাও তাঁর মধ্য দিয়ে গৌরব পাবে। ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ আসবেন এবং আমাদের একসংগে মিলিত করে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। এই বিষয়ে আমরা তোমাদের এই অনুরোধ করছি- “প্রভুর দিন এসে পড়েছে,” এই অর্থে নবী হিসাবে বলা কারও কথা বা অন্য কারও কথা কিংবা আমাদের লেখা মনে করে কোন চিঠির দরুন তোমরা সহজে চঞ্চল হয়ো না বা ভয় পেয়ো না। কেউ যেন কোন ভাবেই তোমাদের ভুল পথে নিয়ে না যায়, কারণ সেই দিন আসবার আগে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে ভীষণ বিদ্রোহ হবে, আর সেই অবাধ্যতার পুরুষ, যে জাহান্নামী, সে প্রকাশিত হবে। “মাবুদ” বলে যা কিছু আছে সেই সমসে-র বিরুদ্ধে আর এবাদত করবার মত সব কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বড় করে দেখাবে; এমন কি, সে আল্লাহ্‌র এবাদত-খানায় বসে নিজেকে আল্লাহ্‌ বলে দাবি করবে। আমি যখন তোমাদের কাছে ছিলাম তখন এই সব কথা যে তোমাদের বলতাম, তা কি তোমাদের মনে পড়ে না? সেই অবাধ্যতার পুরুষ যাতে ঠিক সময়ের আগে প্রকাশিত হতে না পারে সেইজন্য যা এখন তাকে বাধা দিয়ে রাখছে তা তো তোমরা জান। তোমরা এও জানতে পেরেছ যে, অবাধ্যতার পুরুষের গোপন কার্যকলাপ এখনও চলছে, কিন্তু যিনি তাকে বাধা দিয়ে রাখছেন তিনি সরে না যাওয়া পর্যন্ত বাধা দিতেই থাকবেন। তারপরে সেই অবাধ্যতার পুরুষ প্রকাশিত হবে। হযরত ঈসা তাঁর মুখের নিঃশ্বাসে তাকে ধ্বংস করবেন এবং তাঁর মহিমাপূর্ণ উপস্থিতির দ্বারা তার শক্তি শেষ করে দেবেন। সেই অবাধ্যতার পুরুষ যখন আসবে তখন তার সংগে থাকবে শয়তানের শক্তি। সেই শক্তি প্রকাশ পাবে সব রকম মিথ্যা চিহ্ন এবং কেরামতী ও শক্তির কাজের মধ্যে, আর ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়া লোকদের ঠকাবার সব রকম দুষ্ট ছলনার মধ্যে। এই লোকেরা ধ্বংস হবে, কারণ নাজাত পাবার জন্য তারা সত্যকে ভালবাসে নি এবং তা গ্রহণও করে নি। এইজন্য আল্লাহ্‌ তাদের কাছে এমন এক শক্তি পাঠাবেন যা তাদের ভুল পথে নিয়ে যাবে, যেন তারা মিথ্যায় বিশ্বাস করে। ফলে যারা সত্যের উপর ঈমান না এনে অন্যায় কাজে আনন্দ পেয়েছে তাদের সকলকে হাশরে দোষী বলে ধরা হবে। প্রভুর প্রিয় আমার ভাইয়েরা, তোমাদের জন্য সব সময়ই আল্লাহ্‌কে আমাদের শুকরিয়া জানানো উচিত, কারণ নাজাত পাবার জন্য আল্লাহ্‌ প্রথম থেকেই তোমাদের বেছে রেখেছেন। পাক-রূহের দ্বারা তোমাদের পবিত্র করবার মধ্য দিয়ে এবং সুসংবাদের সত্যের উপর তোমাদের ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা নাজাত পেয়েছ। আমরা যে সুসংবাদ তবলিগ করছি তার মধ্য দিয়েই সেই নাজাত পাবার জন্য তিনি তোমাদের ডেকেছেন, যাতে তোমরা আমাদের হযরত ঈসা মসীহের মহিমার ভাগী হও। সেইজন্য ভাইয়েরা, স্থির থাক, আর চিঠির দ্বারা বা কথার দ্বারা যে শিক্ষা আমরা তোমাদের দিয়েছি তা ধরে রাখ। শেষে বলি ভাইয়েরা, আমাদের জন্য মুনাজাত কোরো যেন প্রভুর কালাম তোমাদের মধ্যে যেমন তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল সেইভাবেই তা ছড়িয়ে পড়তে ও গৌরব পেতে থাকে। আরও মুনাজাত কোরো যেন আমরা বিবেকহীন ও দুষ্ট লোকদের হাত থেকে রক্ষা পাই, কারণ সব লোকেরই যে ঈমান আছে তা নয়। কিন্তু প্রভু বিশ্বাসযোগ্য; তিনিই তোমাদের স্থির রাখবেন এবং শয়তানের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন। প্রভুর সংগে যুক্ত বলে তোমাদের সম্বন্ধে আমাদের এই বিশ্বাস আছে যে, আমরা তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি সেইমতই তোমরা কাজ করছ এবং করতেও থাকবে। প্রভু যেন তোমাদের দিল আল্লাহ্‌র মহব্বতের পথে আর মসীহের ধৈর্যের পথে চালিয়ে নিয়ে যান। ভাইয়েরা, আমাদের হযরত ঈসা মসীহের নামে আমরা তোমাদের এই হুকুম দিচ্ছি- যদি কোন ভাই অলস ভাবে চলে এবং আমাদের কাছ থেকে তোমরা যে শিক্ষা পেয়েছ তা পালন না করে, তবে তোমরা তার সংগে মেলামেশা কোরো না। কিভাবে আমাদের মত হয়ে চলা উচিত তা তোমরা নিজেরাই জান। তোমাদের মধ্যে থাকবার সময়ে আমরা অলস ভাবে চলি নি, কিংবা দাম না দিয়ে কারও খাবার খাই নি। আমরা দিনরাত পরিশ্রম আর কষ্ট করেছি যাতে আমরা তোমাদের কারও বোঝা হয়ে না পড়ি। তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য নেবার অধিকার যে আমাদের নেই তা নয়, কিন্তু তোমরা যেন আমাদের মত হয়ে চল সেইজন্যই আমরা এইভাবে কাজ করে তোমাদের দেখিয়েছিলাম। তোমাদের কাছে থাকবার সময়েই আমরা তোমাদের হুকুম দিয়ে বলেছিলাম যে, কেউ যদি কাজ করতে না চায় তবে সে যেন না খায়। আমরা শুনতে পাচ্ছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অলস ভাবে চলছে আর একেবারেই কাজকর্ম করছে না, বরং অন্যের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের হয়ে আমরা এই রকম লোকদের হুকুম ও উপদেশ দিচ্ছি, তারা যেন শান্ত ভাবে কাজকর্ম করে নিজেদের খাবার নিজেরা যোগাড় করে। ভাইয়েরা, ভাল কাজে ক্লান্ত হয়ো না। এই চিঠির মধ্যে লেখা আমাদের কথা যদি কেউ না মানে তাহলে সেই লোককে চিনে রাখ। তার সংগে মেলামেশা কোরো না যাতে সে লজ্জা পায়। কিন্তু তাকে শত্রু বলেও মনে কোরো না, বরং ভাই হিসাবে তাকে সাবধান কর। শান্তিদাতা প্রভু নিজে সব সময় সব রকমে তোমাদের শান্তি দান করুন। প্রভু তোমাদের সকলের সংগে থাকুন। এই সালামের কথা আমি পৌল নিজের হাতে লিখছি। এটাই আমার প্রত্যেক চিঠির চিহ্ন; আমি এইভাবেই লিখে থাকি। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের রহমত তোমাদের সকলের উপরে থাকুক। আমাদের নাজাতদাতা আল্লাহ্‌ ও মসীহ্‌ ঈসার হুকুমে আমি পৌল ঈসা মসীহের একজন সাহাবী হয়েছি। মসীহ্‌ ঈসার উপরেই আমাদের সব আশা। ঈমানদার হিসাবে আমার সত্যিকারের সন্তান তীমথিয়ের কাছে আমি এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ ও আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাকে রহমত, মমতা ও শান্তি দান করুন। ম্যাসিডোনিয়াতে যাবার সময় আমি তোমাকে যা বলেছি এখনও তা-ই বলছি- তুমি ইফিষ শহরেই থাক, যাতে কতগুলো লোককে নির্দেশ দিতে পার যেন তারা আর ভুল শিক্ষা না দেয়। তাদের এই নির্দেশও দিয়ো যেন তারা গল্প-কথায় ও বড় বড় বংশ-তালিকার দিকে মনোযোগ না দেয়। এগুলো আল্লাহ্‌র কাজ বাদ দিয়ে নানা তর্কাতর্কির সৃষ্টি করে কিন্তু আল্লাহ্‌ কিভাবে তাঁর কাজ পরিচালনা করেন তা ঈমানের মধ্য দিয়ে জানা যায়। এই নির্দেশের উদ্দেশ্য হল মহব্বত জাগিয়ে তোলা। এই মহব্বত খাঁটি দিল, পরিষ্কার বিবেক ও সত্যিকারের ঈমানের মধ্য থেকে আসে। কিছু লোক এই সব থেকে সরে গিয়ে বাজে কথাবার্তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা যদিও নিজেদের কথা নিজেরাই বোঝে না এবং যে বিষয়ে জোর দিয়ে বলছে সেই বিষয় সম্বন্ধেও জানে না তবুও তারা মূসার শরীয়তের ওস্তাদ হতে চায়। আমরা জানি শরীয়ত ভাল, অবশ্য তা যদি ঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়। আমরা এও জানি, কোন সৎ লোকের জন্য এই শরীয়ত দেওয়া হয় নি; তা দেওয়া হয়েছিল তাদেরই জন্য যারা আইন অমান্য করে ও অবাধ্য হয়, যারা ভয়হীন ও গুনাহ্‌গার, যারা অপবিত্র ও অধার্মিক, যারা মা-বাবাকে হত্যা করে, যারা খুন করে, যারা জেনা করে, যারা সমকামী, যারা গোলাম-ব্যবসা করে, যারা মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, আর যারা সত্য শিক্ষার বিরুদ্ধে অন্য কোন কাজ করে। গৌরবময় আল্লাহ্‌র মহান সুসংবাদ অনুসারে যে শিক্ষা, সেই শিক্ষাই হল সত্য শিক্ষা। এই সুসংবাদ তবলিগের ভার তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। মসীহ্‌ ঈসা, যিনি আমাদের প্রভু, তিনি আমাকে শক্তি দান করেছেন, তাঁকে আমি শুকরিয়া জানাই, কারণ তিনি আমাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাঁর এবাদত-কাজে নিযুক্ত করেছেন। যদিও আমি আগে মসীহের নিন্দা করতাম আর জুলুমবাজ ও বদরাগী ছিলাম তবুও আমাকেই তিনি এই কাজে নিযুক্ত করেছেন। আমাকে তিনি দয়া করেছেন, কারণ আমি ঈমান আনি নি বলে আমি না জেনেই সেই সব করতাম। আমাদের প্রভু আমাকে অশেষ দয়া করেছেন এবং মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হবার ফলে যে বিশ্বাস ও মহব্বত আসে তা দান করেছেন। এই কথা বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণেরও যোগ্য যে, গুনাহ্‌গারদের নাজাত করবার জন্যই মসীহ্‌ ঈসা দুনিয়াতে এসেছিলেন। সেই গুনাহ্‌গারদের মধ্যে আমিই প্রধান। আর সেইজন্যই আল্লাহ্‌ আমাকে মমতা করেছেন, যেন প্রধান গুনাহ্‌গার যে আমি, আমার মধ্য দিয়েই মসীহ্‌ ঈসা তাঁর অসীম ধৈর্য দেখাতে পারেন। তাঁর উপর ঈমানের ফলে যারা অনন্ত জীবন পাবে তারা যেন আমাকে দেখে শিখতে পারে সেইজন্যই তিনি আমার প্রতি এই রকম করেছেন। যিনি সমস্ত যুগের বাদশাহ্‌, যাঁর কোন ক্ষয় নেই এবং যাঁকে দেখা যায় না, চিরকাল সেই একমাত্র আল্লাহ্‌র সম্মান ও গৌরব হোক। আমিন। স্নেহের সন্তান তীমথিয়, তোমার সম্বন্ধে অন্যেরা নবী হিসাবে যে কথা বলেছিলেন সেই কথা অনুসারে আমি তোমাকে এই নির্দেশ দিচ্ছি। সেই কথা মনে রেখে তুমি মসীহের পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ করে যাও, আর সেই সংগে ঈমান ও পরিষ্কার বিবেক রক্ষা কর। কিছু লোক বিবেকের কথা না শুনে তাদের ঈমানে ভাংগন ধরিয়েছে। সেই লোকদের মধ্যে আছে হুমিনায় আর আলেকজাণ্ডার। তাই আমি শয়তানের হাতে তাদের ছেড়ে দিয়েছি, যেন তারা এই শিক্ষা পায় যে, কুফরী করতে নেই। প্রথমেই আমি বলছি, সকলের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে যেন মিনতি, মুনাজাত, অনুরোধ ও শুকরিয়া জানানো হয়। এইভাবে বাদশাহ্‌দের জন্য আর যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তাদের সকলের জন্য মুনাজাত করতে হবে, যাতে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় দেখিয়ে এবং সৎ ভাবে চলে আমরা স্থির ও শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে পারি। আমাদের নাজাতদাতা আল্লাহ্‌র চোখে তা ভাল এবং এতেই তিনি খুশী হন। তিনি চান যেন সবাই নাজাত পায় এবং মসীহের বিষয়ে সত্যকে গভীরভাবে বুঝতে পারে। আল্লাহ্‌ মাত্র একজনই আছেন এবং আল্লাহ্‌ ও মানুষের মধ্যে মধ্যস'ও মাত্র একজন আছেন। সেই মধ্যস' হলেন মানুষ মসীহ্‌ ঈসা। তিনি সব মানুষের মুক্তির মূল্য হিসাবে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র ঠিক করা সময়ে সেই বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, আর এই সাক্ষ্য দেবার জন্য আল্লাহ্‌ আমাকে তবলিগকারী, সাহাবী ও অ-ইহুদীদের কাছে ঈমান এবং সত্যের ওস্তাদ হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। আমি সত্যি কথা বলছি, মিথ্যা বলছি না। আমি চাই যেন সব জায়গায় পুরুষেরা রাগ বা ঝগড়ার মনোভাব না রেখে খাঁটি দিলে দু’হাত তুলে মুনাজাত করে। আমি এটাও চাই যেন স্ত্রীলোকেরা ভদ্রভাবে ও ভাল বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে উপযুক্ত কাপড়-চোপড় পরে। তারা যেন নানা রকমে চুলের বেনী বেঁধে, সোনা ও মুক্তার গয়না পরে আর দামী দামী কাপড়-চোপড় দিয়ে নিজেদের না সাজায়। তার বদলে যেন তারা ভাল ভাল কাজ দিয়ে নিজেদের সাজায়। যে স্ত্রীলোকেরা নিজেদের আল্লাহ্‌ভক্ত বলে থাকে সেই স্ত্রীলোকদের পক্ষে সেটাই হবে উপযুক্ত কাজ। কথা না বলে এবং সম্পূর্ণভাবে বাধ্য থেকে স্ত্রীলোকেরা শিক্ষালাভ করুক। শিক্ষা দেবার ও পুরুষের উপর কর্তা হবার অনুমতি আমি কোন স্ত্রীলোককে দিই না। তার বরং চুপ করে থাকাই উচিত, কারণ প্রথমে আদমকে ও পরে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা ছাড়া আদম ছলনায় ভোলেন নি, কিন্তু স্ত্রীলোক সম্পূর্ণভাবে ভুলেছিলেন এবং আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করেছিলেন। তবে তিনি সন্তান জন্ম দেবার মধ্য দিয়ে নাজাত পাবেন; অবশ্য স্ত্রীলোকদের ভাল বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে ঈমান, মহব্বত ও পবিত্রতায় চলতে হবে। এই কথা বিশ্বাসযোগ্য যে, যদি কেউ জামাতের পরিচালক হতে চায় তবে সে একটা ভাল কাজ করবার ইচ্ছাই করে। পরিচালককে সেইজন্য এমন হতে হবে যেন কেউ তাঁকে দোষ দিতে না পারে। তাঁর মাত্র একজন স্ত্রী থাকবে। তিনি নিজেকে দমনে রাখবেন এবং তাঁর ভাল বিচারবুদ্ধি থাকবে। তিনি ভদ্র হবেন ও মেহমানদারী করতে ভালবাসবেন। অন্যদের শিক্ষাদান করবার ক্ষমতা তাঁর থাকবে। তিনি যেন মাতাল ও বদমেজাজী না হন, বরং তাঁর স্বভাব যেন নম্র হয় এবং তিনি যেন ঝগড়াটে বা টাকার লোভী না হন। তিনি যেন উপযুক্তভাবে তাঁর নিজের বাড়ীর সব কিছু পরিচালনা করেন এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা যেন বাধ্য ও ভদ্র হয়। যিনি তাঁর নিজের বাড়ীর ব্যাপার পরিচালনা করতে জানেন না তিনি কি করে আল্লাহ্‌র জামাতের দেখাশোনা করবেন? জামাতের পরিচালক যেন নতুন ঈমানদার না হন, কারণ নতুন ঈমানদার হলে তিনি হয়তো অহংকারে ফুলে উঠবেন এবং ইবলিসকে দেওয়া শাস্তির যোগ্য হবেন। বাইরের লোকদের কাছে তাঁর সুনাম থাকা দরকার, যেন তিনি দুর্নামের ভাগী না হন এবং ইবলিসের ফাঁদে না পড়েন। তেমনি করে খেদমতকারীরাও যেন সম্মান পাবার যোগ্য এবং এক কথার লোক হন। তাঁরা যেন মাতাল না হন, আর অন্যায় লাভের দিকে যেন তাঁদের ঝোঁক না থাকে। তাঁরা যেন পরিষ্কার বিবেকে ঈসায়ী ঈমানের গোপন সত্য ধরে রাখেন। তাঁদের আগে যাচাই করে দেখতে হবে, তারপর যদি তাঁরা নির্দোষ বলে প্রমাণিত হন তবে খেদমতকারী হতে পারবেন। ঠিক সেইভাবে তাঁদের স্ত্রীরাও যেন সম্মানের যোগ্যা হন। তাঁরা যেন অন্যের দুর্নাম করে না বেড়ান এবং নিজেদের দমনে রাখেন। সব বিষয়ে যেন তাঁদের বিশ্বাস করা যায়। খেদমতকারীরও মাত্র একজন স্ত্রী থাকবে। তিনি যেন ভাল ভাবে তাঁর ছেলেমেয়েদের ও সংসার পরিচালনা করেন। যে খেদমতকারী ভাল ভাবে কাজ করেন তিনি সম্মান লাভ করেন এবং মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানের দরুন তাঁর দিল সাহসে পূর্ণ হয়। ঈসায়ী ঈমানের গোপন সত্য যে মহান তা অস্বীকার করা যায় না। সেই সত্য এই- তিনি মানুষ হিসাবে প্রকাশিত হলেন; তিনি যে নির্দোষ পাক-রূহ্‌ তা প্রমাণ করলেন; ফেরেশতারা তাঁকে দেখেছিলেন; সমস্ত জাতির কাছে তাঁর বিষয় তবলিগ করা হয়েছিল; দুনিয়াতে তাঁর উপর লোকেরা ঈমান এনেছিল; বেহেশতে তাঁকে মহিমার সংগে তুলে নেওয়া হয়েছিল। পাক-রূহ্‌ পরিষ্কার ভাবে বলেছেন, ভবিষ্যতে কিছু লোক ঈসায়ী ঈমান থেকে দূরে সরে যাবে এবং ছলনাকারী রূহ্‌ ও ভূতদের শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়বে। বিবেক অসাড় হয়ে গেছে এমন সব মিথ্যাবাদী লোকদের ভণ্ডামির জন্য এই রকম হবে। এরা মানুষকে বিয়ে না করবার হুকুম দেয় এবং কোন কোন খাবার খেতে নিষেধ করে। কিন্তু ঈমানদারেরা, যারা আল্লাহ্‌র সত্যকে জেনেছে, তারা যেন আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে খায় সেইজন্যই তো আল্লাহ্‌ এই সব খাবার সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌র সৃষ্ট প্রত্যেকটি জিনিস ভাল, তাই কোন জিনিস হারাম মনে করে বাদ দেওয়া উচিত নয়; কিন্তু তা যেন আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে গ্রহণ করা হয়, কারণ আল্লাহ্‌র কালাম ও মুনাজাতের মধ্য দিয়ে তা পাক-সাফ হয়। যদি তুমি এই সব বিষয় ভাইদের বুঝিয়ে দাও তবে ঈসায়ী ঈমানের যে সত্য ও নির্ভুল শিক্ষা তুমি মেনে চলেছ, তাতে পাকা হয়ে মসীহ্‌ ঈসার একজন উপযুক্ত সেবাকারী হবে। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন গল্প-কথা থেকে দূরে থাক; ওগুলো তো বুড়ীদের বানানো গল্পের মত। তার চেয়ে বরং আল্লাহ্‌-ভয়ের অভ্যাস কর। শারীরিক ব্যায়ামে কিছু লাভ হয় বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌-ভয়ে সব দিক থেকে লাভ হয়; তাতে এই জীবন এবং পরজীবনের জন্য আশ্বাস রয়েছে। এই কথা বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্পূর্ণভাবে গ্রহণেরও যোগ্য। এইজন্যই আমরা প্রাণপণে পরিশ্রম করছি এবং আগ্রহের সংগে কাজ করছি, কারণ জীবন্ত আল্লাহ্‌র উপরে আমরা আশা রেখেছি। তিনিই সব মানুষের নাজাতদাতা, বিশেষভাবে তাদের যারা তাঁর উপর ঈমান আনে। তুমি এই সব বিষয়ে হুকুম ও শিক্ষা দাও। তুমি যুবক বলে কেউ যেন তোমাকে তুচ্ছ না করে। কথায়, চালচলনে, মহব্বতে, বিশ্বাসে এবং পবিত্রতায় তুমি ঈমানদারদের কাছে আদর্শ হও। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি ঈমানদারদের পাক-কিতাব তেলাওয়াত করা, তবলিগ করা ও শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখ। জামাতের নেতারা যখন তোমার উপরে তাঁদের হাত রেখেছিলেন তখন নবী হিসাবে কথা বলবার মধ্য দিয়ে যে বিশেষ দান তোমাকে দেওয়া হয়েছিল সেই দান তুমি অবহেলা কোরো না। এই সব বিষয়ে মনোযোগী হও; নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখ, যেন সবাই দেখতে পায় যে, তুমি এগিয়ে যাচ্ছ। তোমার নিজের বিষয়ে এবং তোমার শিক্ষার বিষয়ে সতর্ক থাক। এই সব করতে থাক, কারণ তাতে তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে এবং যারা তোমার কথা শুনবে তাদেরও রক্ষা করতে পারবে। যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁদের দোষ দেখাতে গিয়ে কড়া ভাষা ব্যবহার কোরো না; বাবার মত মনে করে তাঁদের সংশোধন কোরো। যুবকদের ভাইয়ের মত মনে করে তাদের সংশোধন কোরো। বয়স্কা স্ত্রীলোকদের মায়ের মত মনে করে সংশোধন কোরো এবং যুবতীদের বোনের মত মনে করে পবিত্রভাব বজায় রেখে সংশোধন কোরো। যে সব বিধবাদের কেউ নেই তাদের যত্নের সংগে দেখাশোনা কোরো। কিন্তু কোন বিধবার যদি ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাত্‌নী থাকে তবে সেই ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাত্‌নীরাই যেন প্রথমে নিজের নিজের পরিবারের প্রতি কর্তব্য করে আল্লাহ্‌-ভয় দেখাতে শেখে। এইভাবে তারা তাদের বাপ-দাদাদের স্নেহের ঋণ শোধ করতে পারবে, আর এতেই আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট হন। যে বিধবার কেউ নেই সে আল্লাহ্‌র উপরেই তার আশা রেখে দিনরাত আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাত ও অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু যে বিধবা যেভাবে খুশী জীবন কাটায় সে জীবিত অবস্থায়ও মরার মত। এই সব বিষয়ে নির্দেশ দাও যাতে কেউ তাদের দোষ দিতে না পারে। যে নিজের আত্মীয়দের, বিশেষ করে নিজের পরিবারের দেখাশোনা করে না সে তার দ্বারা তার ঈমানকে অস্বীকার করেছে; সে অ-ঈমানদারের চেয়েও খারাপ। বিধবাদের নামের তালিকায় কোন বিধবার নাম যোগ করবার আগে দেখতে হবে যে, তার বয়স ষাট বছরের কম নয় এবং সে স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। এছাড়া ভাল কাজের জন্য তার সুনাম থাকতে হবে। এই সব ভাল কাজের মধ্যে রয়েছে- ছেলেমেয়ে মানুষ করা, মেহমানদারী করা, আল্লাহ্‌র বান্দাদের পা ধোয়ানো, যারা কষ্টে পড়েছে তাদের সাহায্য করা, আর অন্যান্য সৎ কাজে যোগ দেওয়া। যুবতী বিধবাদের নাম বিধবার তালিকায় লিখো না, কারণ যখন তাদের শরীরের কামনা-বাসনা চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং মসীহের প্রতি তাদের ভয় কমে আসে তখন তারা বিয়ে করতে চায়। এতে তারা তাদের আগের ওয়াদা ভাংগে বলে নিজেদের উপর শাস্তি ডেকে আনে। এছাড়া তারা বাড়ী বাড়ী ঘুরে অলস হতে শেখে। তারা যে কেবল অলস হয় তা নয়, কিন্তু বাজে কথা বলতে ও পরের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শেখে এবং যা তাদের বলা উচিত নয় সেই সব কথা বলে। সেইজন্য আমি এই উপদেশ দিই যে, যুবতী বিধবারা বিয়ে করুক, সন্তানের মা হোক, নিজের নিজের সংসারের দেখাশোনা করুক এবং নিন্দা করবার জন্য শত্রুদের কোন সুযোগ না দিক। এর মধ্যেই তো কয়েকজন বিধবা ফিরে গিয়ে শয়তানের পথে চলছে। ঈসায়ী ঈমানদার কোন স্ত্রীলোকের ঘরে কয়েকজন বিধবা থাকলে সেই স্ত্রীলোকই তাদের দেখাশোনা করুক। এই সব বিধবার ভার জামাতের উপর চাপানো উচিত নয়, যাতে যে সব বিধবার কেউ নেই জামাত তাদের দেখাশোনা করতে পারে। জামাতের যে সব প্রধান নেতারা ভালভাবে জামাতের পরিচালনা করেন, বিশেষ করে যাঁরা আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ ও শিক্ষা দান করবার জন্য পরিশ্রম করেন, তাঁদের পাওনা দ্বিগুণ হওয়া উচিত। পাক-কিতাবে আছে, “শস্য মাড়াই করবার সময়ে বলদের মুখে জাল্‌তি বেঁধো না।” আরও লেখা আছে, “যে কাজ করে সে বেতন পাবার যোগ্য।” দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথা ছাড়া জামাতের কোন প্রধান নেতার বিরুদ্ধে কোন দোষের কথায় কান দিয়ো না। যে সব প্রধান নেতারা গুনাহ্‌ করতেই থাকেন জামাতের সমস্ত লোকদের সামনে তাঁদের দোষ দেখিয়ে দিয়ো যাতে অন্যান্য নেতারাও ভয় পান। আল্লাহ্‌ ও মসীহ্‌ ঈসা এবং বাছাই করা ফেরেশতাদের সামনে আমি তোমাকে এই হুকুম দিচ্ছি- কারও পক্ষ না নিয়ে এই সব কোরো এবং একচোখা হয়ে কোন কাজ কোরো না। তাড়াতাড়ি করে কারও উপর হাত রেখে কাউকে কোন পদে নিযুক্ত কোরো না। অন্যেরা যখন গুনাহ্‌ করে তখন তাদের সংগে যোগ দিয়ো না। নিজেকে খাঁটি রেখো। তোমার প্রায়ই অসুখ হয় বলে হজমের জন্য অল্প অল্প করে আংগুর-রস খেয়ো; কেবল পানি খেয়ো না। কোন কোন লোকের গুনাহ্‌ এত স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, তার বিচার আগেই হয়ে যায়। আবার কোন কোন লোকের গুনাহ্‌ পরে দেখা যায়। তেমনি করে সৎ কাজ স্পষ্টভাবে দেখা যায়, আর যেগুলো স্পষ্ট নয় সেগুলোও লুকানো থাকে না। যে সব গোলামদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তারা সবাই তাদের মালিকদের সমস্ত সম্মান পাবার যোগ্য বলে মনে করুক, যেন কেউ আল্লাহ্‌র নামের এবং আমাদের শিক্ষার নিন্দা করতে না পারে। যে গোলাম ঈসায়ী ঈমানদার মালিকের অধীন সে যেন ঈমানদার ভাই বলেই সেই মালিককে তুচ্ছ না করে বরং আরও ভালভাবে তাঁর সেবা করে, কারণ তার সেবায় যিনি উপকার পাচ্ছেন তিনি তো ঈমানদার এবং তার প্রিয়। এই সব বিষয় শিক্ষা দাও এবং উপদেশ দাও। কেউ যদি অন্য রকম শিক্ষা দেয় এবং সত্য উপদেশ, অর্থাৎ আমাদের হযরত ঈসা মসীহের শিক্ষা ও আল্লাহ্‌-ভয়ের শিক্ষা মেনে না নেয় তবে সে অহংকারী। সে কিছুই বোঝে না; ঝগড়া এবং তর্কাতর্কি করা যেন তার একটা রোগে দাঁড়িয়ে যায়। এই সবের ফল হল- হিংসা, ঝগড়া, নিন্দা, কুসন্দেহ, আর নীচমনা লোকদের মধ্যে অনবরত গোলমাল। এই লোকদের মধ্যে আল্লাহ্‌র সত্য নেই; তারা ঈসায়ী ঈমানকে একটা জাগতিক লাভের উপায় বলে মনে করে। কিন্তু আসলে সন্তুষ্ট মনে ঈসায়ী ঈমান অনুসারে চললে মহা লাভ হয়। দুনিয়াতে আমরা তো কিছুই সংগে নিয়ে আসি নি আর দুনিয়া থেকে কিছুই সংগে নিয়ে যেতে পারব না। তবে খাবার ও কাপড় থাকলেই আমরা সন্তুষ্ট থাকব। কিন্তু যারা ধনী হতে চায় তারা নানা পরীক্ষায় এবং ফাঁদে পড়ে, আর এমন সব বাজে ও অনিষ্টকর ইচ্ছা তাদের মনে জাগে যা লোককে ধ্বংস ও সর্বনাশের তলায় ডুবিয়ে দেয়। সব রকম খারাপীর গোড়াতে রয়েছে টাকা-পয়সার প্রতি ভালবাসা। অনেকে টাকা-পয়সার লোভে ঈসায়ী ঈমান থেকে সরে গিয়ে নিজেদের উপর অনেক দুঃখ ডেকে এনেছে। কিন্তু তুমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা; এই সব থেকে তুমি পালাও। সৎ জীবন, আল্লাহ্‌-ভয়, বিশ্বাস, মহব্বত, ধৈর্য ও নরম স্বভাবের জন্য আগ্রহী হও। মসীহের উপর ঈমানের জন্য তাঁর পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাও। যে অনন্ত জীবনের জন্য আল্লাহ্‌ তোমাকে ডেকেছিলেন সেই অনন্ত জীবন ধরে রাখ। তুমি অনেক লোকের সামনেই তোমার ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছিলে। আল্লাহ্‌, যিনি সব কিছুকে জীবন দান করেন আর মসীহ্‌ ঈসা, যিনি পন্তীয় পীলাতের সামনে সত্যের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, সেই আল্লাহ্‌ ও মসীহ্‌ ঈসার সামনে আমি তোমাকে এই হুকুম দিচ্ছি- আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত নিখুঁত ভাবে আমার হুকুম পালন করে যাও, যেন কেউ তোমার নিন্দা করতে না পারে। সেই গৌরবময় আল্লাহ্‌, যিনি একমাত্র শাসনকর্তা, যিনি বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌ ও প্রভুদের প্রভু, তিনিই তাঁর উপযুক্ত সময়ে মসীহ্‌কে প্রকাশ করবেন। একমাত্র আল্লাহ্‌ মৃত্যুর অধীন নন। তিনি এমন নূরে বাস করেন যেখানে কোন মানুষ যেতে পারে না। কোন মানুষ কোন দিন তাঁকে দেখেও নি, দেখতে পায়ও না। সম্মান এবং ক্ষমতা চিরকাল তাঁরই। আমিন। যারা এই দুনিয়াতে ধনী তাদের এই নির্দেশ দাও যেন তারা অহংকার না করে ও অস্থায়ী ধনের উপর ভরসা না করে আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে। তিনিই ভোগের জন্য সব জিনিস খোলা হাতে আমাদের দান করেন। ধনীদের নির্দেশ দাও যেন তারা অন্যের উপকার করে, সৎ কাজে ব্যস্ত থাকে, খোলা হাতে দান করে এবং তাদের ধন-সম্পত্তির ভাগ অন্যদেরও দেয়। এতে তারা নিজেদের জন্য এমন ধন জমা করবে যা ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে একটা শক্ত ভিত্তির মত হবে, যেন সত্যিকারের যে জীবন তা তারা শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। হে তীমথিয়, যা রক্ষা করবার জন্য তোমাকে দেওয়া হয়েছে তা ভাল করে রক্ষা কর। মিথ্যা জ্ঞানের ভয়হীন বাজে কথা ও স্ববিরোধী শিক্ষা থেকে দূরে থাক। কোন কোন লোক এই রকম জ্ঞানের দাবি করে ঈসায়ী ঈমান থেকে দূরে সরে গেছে। আল্লাহ্‌ তোমাদের রহমত দান করুন। মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবনের ওয়াদা অনুসারে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আমি পৌল মসীহ্‌ ঈসার একজন সাহাবী হয়েছি। এই চিঠি আমি আমার প্রিয় সন্তান তীমথিয়ের কাছে লিখছি। পিতা আল্লাহ ও আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাকে রহমত, মমতা ও শান্তি দান করুন। আমার পূর্বপুরুষেরা যেমন আল্লাহ্‌র এবাদত করতেন তেমনি আমিও পরিষ্কার বিবেকে আল্লাহ্‌র এবাদত করে থাকি; আর তোমার জন্য দিনরাত অনবরত মুনাজাত করবার সময় আমি তাঁকে শুকরিয়া জানিয়ে থাকি। তুমি যে কাঁদছিলে সেই কথা মনে করে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে, যেন আমার মন আনন্দে ভরে ওঠে। তোমার দিলে যে সত্যিকারের ঈমান আছে সেই কথাও আমার মনে আছে। এই ঈমান আগে তোমার নানী লোয়ীর ও তোমার মা উনীকীর দিলে ছিল, আর আমি নিশ্চয় জানি, এই ঈমান তোমার দিলেও আছে। এইজন্য আমি তোমাকে আবার এই কথা বলতে চাই- তোমার উপর আমার হাত রাখবার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ তোমাকে যে বিশেষ দান দিয়েছেন তা আবার জাগিয়ে তোলো। আল্লাহ্‌ আমাদের ভয়ের মনোভাব দেন নি; তিনি আমাদের এমন মনোভাব দিয়েছেন যার মধ্যে শক্তি, মহব্বত ও নিজেকে দমনে রাখবার ক্ষমতা রয়েছে। সেইজন্য আমাদের প্রভুর বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে লজ্জা বোধ কোরো না, আর তাঁর জন্য বন্দী যে আমি, আমাকে নিয়েও লজ্জা বোধ কোরো না। তার বদলে আল্লাহ্‌ তোমাকে যে শক্তি দিয়েছেন সেই শক্তি অনুসারে তাঁর সুসংবাদ তবলিগের জন্য আমার সংগে কষ্টভোগ কর। আল্লাহ্‌ আমাদের নাজাত করেছেন এবং পবিত্রভাবে জীবন কাটাবার জন্য ডেকেছেন। আমাদের কোন কাজের জন্য তিনি তা করেন নি, বরং তাঁর উদ্দেশ্য এবং রহমতের জন্যই করেছেন। দুনিয়া সৃষ্ট হবার আগে মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর রহমত আমাদের দান করেছিলেন, কিন্তু এখন আমাদের নাজাতদাতা মসীহ্‌ ঈসার এই দুনিয়াতে আসবার মধ্য দিয়ে তিনি সেই রহমত প্রকাশ করেছেন। মসীহ্‌ মৃত্যুকে ধ্বংস করেছেন এবং সুসংবাদের মধ্য দিয়ে ধ্বংসহীন জীবনের কথা প্রকাশ করেছেন। আর এই সুসংবাদ জানাবার জন্যই আমাকে তবলিগকারী, সাহাবী ও ওস্তাদ হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এইজন্যই আমি এই সব কষ্ট ভোগ করছি; তবুও আমি লজ্জিত নই, কারণ আমি জানি আমি কার উপর ভরসা করেছি। আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমি তাঁর কাছে যা রেখেছি মসীহের আসবার দিনের জন্য তা রক্ষা করবার ক্ষমতা তাঁর আছে। তুমি আমার কাছ থেকে যা শুনেছ সেই সত্য শিক্ষা তোমার আদর্শ হিসাবে ধরে রাখ; আর মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হবার ফলে আমাদের দিলে যে মহব্বত ও বিশ্বাস জেগেছে তাও ধরে রাখ। আল্লাহ্‌ তোমাকে যা রক্ষা করবার জন্য দিয়েছেন তা পাক-রূহের দ্বারা রক্ষা কর, যিনি আমাদের অন্তরে থাকেন। তুমি জান এশিয়া প্রদেশের সবাই আমার কাছ থেকে সরে পড়েছে। তাদের মধ্যে আছে ফুগিল্ল ও হর্মগিনি। অনীষিফরের পরিবারের উপর প্রভু মমতা করুন; তিনি অনেক বার আমাকে সতেজ করে তুলেছেন, আর আমি কয়েদী হয়েছি বলে তিনি লজ্জিত হন নি। তিনি যখন রোমে ছিলেন তখন আমার অনেক তালাশ করে আমাকে পেয়েছিলেন। ইফিষে কিভাবে তিনি আমার সেবা করেছেন তা তোমার ভাল করে জানা আছে। প্রভু করুন, যেন মসীহের আসবার দিনে তিনি প্রভুর কাছ থেকে দয়া লাভ করেন। সন্তান আমার, মসীহ্‌ ঈসার রহমতে তুমি শক্তিশালী হও। অনেক সাক্ষীর সামনে আমার মুখে যে সব শিক্ষার কথা তুমি শুনেছ সেই শিক্ষা ধরে রাখবার জন্য তুমি তা এমন সব বিশ্বস্ত লোকদের দাও যাদের অন্যদের শিক্ষা দেবার যোগ্যতা আছে। মসীহ্‌ ঈসার একজন উপযুক্ত সৈনিকের মত তুমি আমাদের সংগে কষ্ট সহ্য কর। যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ সংসারের মধ্যে নিজেকে জড়ায় না, যেন সৈন্য হিসাবে যিনি তাকে ভর্তি করেছেন তাঁকে সে সন্তুষ্ট করতে পারে। তেমনি করে প্রতিযোগিতার খেলায় যোগ দিয়ে কেউ যদি নিয়ম মত না খেলে তবে সে জয়ের মালা পায় না। যে চাষী পরিশ্রম করে তারই প্রথমে ফসলের ভাগ পাওয়া উচিত। আমি যা বলছি তা তুমি চিন্তা করে দেখো, কারণ প্রভুই তোমাকে সব বিষয় বুঝবার ক্ষমতা দান করবেন। ঈসা মসীহ্‌ সম্বন্ধে এই কথা মনে রেখো যে, তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তোলা হয়েছিল এবং তিনি দাউদের বংশের লোক ছিলেন। যে সুসংবাদ আমি তবলিগ করি তার মধ্যে এই কথা আছে, আর এই সুসংবাদ তবলিগের জন্যই আমি কষ্ট ভোগ করছি; এমন কি, অপরাধীর মত আমাকে বাঁধাও হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র কালামকে তো বাঁধা হয় নি। তাই আল্লাহ্‌ যাদের বেছে নিয়েছেন তাদের জন্য আমি সব কিছু সহ্য করছি, যেন তারাও মসীহ্‌ ঈসার মধ্য দিয়ে নাজাত পায় এবং চিরকালের মহিমা লাভ করে। এই কথা বিশ্বাসযোগ্য যে, মসীহের সংগে যদি আমরা মরে থাকি, তবে তাঁরই সংগে আমরা জীবিতও থাকব। আমরা যদি ধৈর্য ধরে সহ্য করি, তবে তাঁর সংগে রাজত্বও করব। যদি তাঁকে আমরা অস্বীকার করি, তবে তিনিও আমাদের অস্বীকার করবেন। আমরা অবিশ্বস্ত হলেও তিনি বিশ্বস্ত থাকেন, কারণ তিনি নিজেকে অস্বীকার করতে পারেন না। এই সব কথা লোকদের মনে করিয়ে দিতে থাক। আল্লাহ্‌র সামনে তাদের সাবধান করে দাও যেন তারা বাজে কথা নিয়ে তর্কাতর্কি না করে। এর কোন দামই নেই, বরং যারা তা শোনে তাদের তা সর্বনাশ করে। যার উপর আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট, অর্থাৎ যার লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই সেই রকম কাজের লোক হিসাবে এবং যে নির্ভুল ভাবে সত্যের কালাম শিক্ষা দেয় সেই রকম লোক হিসাবে নিজেকে আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত করবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হও। আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন ও বাজে কথাবার্তা থেকে দূরে থাক, কারণ এই রকম কথাবার্তার জন্য লোকদের মনে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়ের ভাব কমে যেতে থাকবে। যারা এই রকম কথাবার্তা বলে তাদের শিক্ষা পচা ঘায়ের মত করে ছড়িয়ে পড়বে। এই রকম লোকদের মধ্যে আছে হুমিনায় ও ফিলীত। এরা আল্লাহ্‌র সত্য থেকে দূরে সরে গেছে। এরা বলে, ঈমানদারদের মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠা আগেই হয়ে গেছে। এরা কারও কারও ঈমানকে নষ্ট করে ফেলেছে। তবু আল্লাহ্‌র গাঁথা শক্ত ভিত্তি দাঁড়িয়েই আছে, আর তার উপর সীলমোহরের মত করে এই কথাগুলো লেখা আছে, “প্রভু জানেন, কারা তাঁর,” আর “যে কেউ মসীহ্‌কে প্রভু বলে ডাকে সে সমস্ত গুনাহ্‌ থেকে দূরে যাক।” বড় বাড়ীতে কেবল যে সোনা-রূপার পাত্র থাকে তা নয়, কিন্তু কাঠের ও মাটির পাত্রও থাকে। তার মধ্যে কতগুলো পাত্র সম্মানের কাজে আর কতগুলো পাত্র নীচু কাজে ব্যবহার করা হয়। যারা এই সব নীচু কাজের পাত্রের মত, তাদের থেকে সরে এসে যদি কেউ নিজেকে পাক-সাফ করে তবে সে এমন পাত্রের মত হবে যা সম্মানের কাজে ব্যবহার করা হয়। পবিত্র উদ্দেশ্যে তাকে আলাদা করে রাখা হবে, সে প্রভুর কাজে লাগবে এবং সব রকম ভাল কাজ করবার জন্য সে প্রস্তুত থাকবে। যৌবনের খারাপ কামনা-বাসনা থেকে তুমি পালাও এবং যাঁরা খাঁটি দিলে প্রভুকে ডাকে তাদের সংগে সৎ জীবন, বিশ্বাস, মহব্বত ও শান্তির জন্য আগ্রহী হও। বাজে, মূর্খ তর্কাতর্কিতে যোগ দিয়ো না, কারণ তুমি তো জান সেগুলো শেষ পর্যন্ত ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি করে। যিনি প্রভুর গোলাম, তাঁর ঝগড়া করা উচিত নয়, বরং তাঁকে সকলের প্রতি দয়ালু হতে হবে। তাঁর অন্যদের শিক্ষাদানের ক্ষমতা এবং সহ্যগুণ থাকতে হবে। যারা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের তাঁকে নম্রভাবে শিক্ষা দিতে হবে। সেই শিক্ষা যেন তিনি এই আশায় দেন যে, আল্লাহ্‌ তাদের তওবা করবার সুযোগ দেবেন যাতে আল্লাহ্‌র সত্যকে তারা গভীর ভাবে বুঝতে পারে। তার ফলে তারা ইবলিসের ফাঁদ থেকে পালিয়ে আসবে, কারণ ইবলিস তার ইচ্ছা পালন করবার জন্য তাদের ধরেছিল। এই কথা মনে রেখো যে, শেষ কালে ভীষণ সময় উপস্থিত হবে। মানুষ কেবল নিজেকেই ভালবাসবে, টাকার লোভী হবে, গর্ব করবে, সবাইকে তুচ্ছ করবে, সকলের দুর্নাম করবে, আর মা-বাবার অবাধ্য হবে। তারা অকৃতজ্ঞ ও ভয়হীন হবে, তাদের মধ্যে স্নেহ-ভালবাসা থাকবে না, আর তারা ঝগড়া করে আপোস করবে না। তারা পরের নিন্দা করবে, নিজেকে দমন করতে পারবে না, নিষ্ঠুর হবে, আর যা ভাল তা ঘৃণা করবে। তারা বেঈমান, অন্যায়কারী ও অহংকারে পূর্ণ হবে। আল্লাহ্‌কে ভাল না বেসে তারা জাগতিক সুখকে ভালবাসবে। বাইরের চেহারা দেখলে মনে হবে যেন আল্লাহ্‌কে তারা কত না ভয় করে, কিন্তু আসলে আল্লাহ্‌-ভয়ের শক্তিকেই তারা অস্বীকার করে। এই রকম লোকদের কাছ থেকে দূরে থেকো। এই রকম লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ঘরে ঘরে ঢুকে দুর্বল-মনা স্ত্রীলোকদের বিপথে নিয়ে যায়। এই স্ত্রীলোকদের উপর গুনাহ্‌ বোঝাই করা আছে; তারা নানা কামনা-বাসনার দ্বারা পরিচালিত। তারা সব সময় শিক্ষার কথা শুনছে, কিন্তু কখনও আল্লাহ্‌র সত্যকে গভীরভাবে বুঝতে পারছে না। যেভাবে যান্নি ও যাম্ব্রি মূসা নবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেইভাবে এই লোকেরাও সেই সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এদের মন জঘন্য এবং ঈসায়ী ঈমানের কোন প্রমাণ তাদের মধ্যে পাওয়া যায় নি। কিন্তু তারা আর এগিয়ে যেতে পারবে না, কারণ যান্নি ও যাম্ব্রির মূর্খতা যেমন সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি তাদের মূর্খতাও সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তুমি আমার শিক্ষা, চালচলন, উদ্দেশ্য, বিশ্বাস, সহ্যগুণ, মহব্বত ও ধৈর্য ভাল করেই লক্ষ্য করেছ। এছাড়া এণ্টিয়কে, কোনিয়ায় ও লুস্ত্রাতে আমি যে সব জুলুম ও কষ্টভোগ করেছি সেই সব অত্যাচারের কথাও তুমি জান, কিন্তু প্রভু সেই সব থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলেন। আসলে যারা মসীহ্‌ ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়পূর্ণ জীবন কাটাতে চায় তারা অত্যাচারিত হবেই। কিন্তু দুষ্ট লোকেরা ও ভণ্ডেরা দিন দিন আরও খারাপ হবে। তারা অন্যদের ভুল পথে নিয়ে যাবে আর নিজেরাও ভুল পথে চালিত হবে। কিন্তু তুমি যা শিখেছ এবং নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেছ তাতে স্থির থাক, কারণ কাদের কাছ থেকে তুমি সেগুলো শিখেছ তা তো তুমি জান। ছেলেবেলা থেকে তুমি পাক-কিতাব থেকে শিক্ষালাভ করেছ। আর এই পাক-কিতাবই তোমাকে মসীহ্‌ ঈসার উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে নাজাত পাবার জ্ঞান দিতে পারে। পাক-কিতাবের প্রত্যেকটি কথা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছে এবং তা শিক্ষা, চেতনা দান, সংশোধন এবং সৎ জীবনে গড়ে উঠবার জন্য দরকারী, যাতে আল্লাহ্‌র বান্দা সম্পূর্ণভাবে উপযুক্ত হয়ে ভাল কাজ করবার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। মসীহের ফিরে আসা ও তাঁর রাজ্যের বিষয় মনে রেখে আল্লাহ্‌র সামনে এবং যিনি জীবিত ও মৃতদের বিচার করবেন সেই মসীহ্‌ ঈসার সামনে আমি তোমাকে এই হুকুম দিচ্ছি- আল্লাহ্‌র কালাম তবলিগ কর; সময়ে হোক বা অসময়ে হোক, সব সময়েই তবলিগের জন্য প্রস্তুত থাক; খুব ধৈর্যের সংগে শিক্ষা দিয়ে লোকদের দোষ দেখিয়ে দাও, তাদের সাবধান কর ও উপদেশ দাও। এমন সময় আসবে যখন সত্য শিক্ষা লোকের সহ্য হবে না, বরং নিজেদের ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য তারা এমন অনেক ওস্তাদ যোগাড় করবে যারা তাদের খুশী করবার মত শিক্ষা দেবে। তারা আল্লাহ্‌র সত্যের বিষয় না শুনে গল্প-কথা শুনতে চাইবে। কিন্তু তুমি সব কিছুতে নিজেকে দমনে রাখ, কষ্ট সহ্য কর এবং মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করতে থাক, আর আল্লাহ্‌ তোমাকে যে কাজ করতে দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ কর। আমাকে এখন কোরবানী হিসাবে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে; আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়েছে। মসীহের পক্ষে আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করেছি, আমার জন্য ঠিক করা পথের শেষ পর্যন্ত দৌড়েছি এবং ঈসায়ী ঈমানকে ধরে রেখেছি। তাই আমার জন্য সৎ জীবনের পুরস্কার তোলা রয়েছে। রোজ হাশরে ন্যায়বিচারক প্রভু আমাকে সেই পুরস্কার হিসাবে জয়ের মালা দান করবেন। তবে যে তিনি কেবল আমাকেই দান করবেন তা নয়, যারা তাঁর ফিরে আসবার জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করেছে তাদের সবাইকে দান করবেন। তুমি খুব চেষ্টা কর যাতে আমার কাছে শীঘ্র আসতে পার, কারণ দীমা এখনকার দুনিয়াকে ভালবেসে আমাকে ছেড়ে থিষলনীকিতে চলে গেছে। এছাড়া ক্রীষ্কেন্ত গালাতিয়াতে এবং তীত দালমাতিয়াতে গেছেন; কেবল লূক আমার কাছে আছেন। তুমি মার্ককে সংগে করে নিয়ে এস, কারণ আমার কাজে তাঁকে খুব দরকার। আমি তুখিককে ইফিষে পাঠিয়েছি। ত্রোয়াতে কার্পের কাছে আমি যে গায়ের কাপড়টা ফেলে এসেছি, আসবার সময় তুমি সেটা নিয়ে এস। তা ছাড়া গুটিয়ে-রাখা কিতাবগুলো, বিশেষ করে যেগুলো চামড়ার উপর লেখা, সেগুলো সংগে করে নিয়ে এস। যে আলেকজাণ্ডার তামার কাজ করে সে আমার অনেক ক্ষতি করেছে। সে যা করেছে তার শোধ প্রভুই নেবেন। তুমিও তার বিষয়ে সাবধান থেকো, কারণ সে আমাদের তবলিগের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লেগেছিল। প্রথম বার যখন আমার বিচার হয়েছিল তখন কেউ আমাকে সাহায্য করে নি, বরং সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল; তবে এটা যেন তাদের বিরুদ্ধে ধরা না হয়। কিন্তু প্রভু আমার সংগে ছিলেন এবং আমাকে শক্তি দান করেছিলেন। তার ফলে আমি সম্পূর্ণভাবে সুসংবাদ তবলিগ করতে পেরেছিলাম আর অ-ইহুদীরা সবাই তা শুনেছিল। আল্লাহ্‌ আমাকে সিংহের মুখ থেকে রক্ষা করেছিলেন। প্রভু আমাকে সমস্ত খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করবেন এবং নিরাপদে তাঁর বেহেশতী রাজ্যে নিয়ে যাবেন। যুগে যুগে চিরদিন তাঁর প্রশংসা হোক। আমিন। প্রিষ্কিল্লা ও আকিলা এবং অনীষিফরের পরিবারকে আমার সালাম জানায়ো। ইরাস- করিনে' রয়ে গেছেন এবং ত্রফিমকে আমি অসুস্থ অবস্থায় মিলেটাসে রেখে এসেছি। তুমি খুব চেষ্টা কর যাতে শীত পড়বার আগে এখানে আসতে পার। উবুল, পুদেন্ত, লীন, ক্লাডিয়া এবং সব ভাইয়েরা তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন। প্রভু তোমার সংগে সংগে থাকুন। আল্লাহ্‌ তোমাদের রহমত দান করুন। আমি পৌল আল্লাহ্‌র গোলাম ও ঈসা মসীহের একজন সাহাবী হয়েছি, যেন আমি আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদের ঈমানের পথে নিয়ে আসতে পারি, আর আল্লাহ্‌-ভয়ের সংগে যে সত্যের যোগ আছে সেই সত্যকে জানতে তাদের সাহায্য করতে পারি। অনন্ত জীবন পাবার আশা নিয়ে আমি মসীহের সেবা করে যাচ্ছি। দুনিয়া সৃষ্ট হবার আগেই আল্লাহ্‌, যিনি মিথ্যা বলেন না, তিনি এই জীবন দেবার ওয়াদা করেছিলেন। আমাদের নাজাতদাতা আল্লাহ্‌র হুকুম মত আমি যা তবলিগ করি তার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ তাঁর কালাম ঠিক সময়েই নাজেল করেছেন। মসীহের উপর ঈমানে যে আমার সংগে এক হয়ে গেছে, আমার সেই সত্যিকারের সন্তান তীতের কাছে আমি এই চিঠি লিখছি। পিতা আল্লাহ ও আমাদের নাজাতদাতা মসীহ্‌ ঈসা তোমাকে রহমত ও শান্তি দান করুন। ক্রীট দ্বীপে যে কাজ এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে তা ঠিক করবার জন্যই আমি তোমাকে ক্রীট দ্বীপে রেখে এসেছি। আমি তোমাকে যে হুকুম দিয়েছিলাম সেই অনুসারে প্রত্যেক শহরের জামাতে প্রধান নেতাদের কাজে বহাল কোরো। জামাতের প্রধান নেতাকে এমন হতে হবে যেন কেউ তাঁকে দোষ দিতে না পারে। তাঁর মাত্র একজনই স্ত্রী থাকবে। তাঁর ছেলেমেয়েরা যেন ঈসায়ী ঈমানদার হয়, যেন তারা নিজেদের খুশীমত না চলে এবং অবাধ্য না হয়। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে দায়িত্বভার পাওয়া লোক হিসাবে সেই পরিচালককে এমন হতে হবে যাতে কেউ তাঁর নিন্দা করতে না পারে। তিনি যেন একগুঁয়ে, রাগী, মাতাল বা বদমেজাজী না হন। অন্যায় লাভের দিকে যেন তাঁর ঝোঁক না থাকে; তার বদলে মেহমানদারী ও দয়ার কাজ করতে তিনি যেন ভালবাসেন। তাঁর ভাল বিচারবুদ্ধি থাকবে, তিনি সৎ ও আল্লাহ্‌র বাধ্য হবেন এবং নিজেকে দমনে রাখবেন। আল্লাহ্‌র বিশ্বাসযোগ্য কালাম, যা আমি শিক্ষা দিয়েছি, তাঁকে তা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে, যেন সত্য শিক্ষার বিষয় তিনি তবলিগ করতে পারেন এবং যারা বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের ভুল দেখিয়ে দিতে পারেন। এমন অনেক লোক আছে যারা অবাধ্য, যারা বাজে কথা বলে ও যারা ছলনা করে বেড়ায়। যারা খৎনা করানোর উপর জোর দেয়, বিশেষ করে আমি তাদের কথাই বলছি। এই লোকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া দরকার, কারণ অন্যায় লাভের জন্য তারা এমন শিক্ষা দেয় যা তাদের দেওয়া উচিত নয়; আর এইভাবে তারা কতগুলো পরিবারকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তাদের নিজেদেরই একজন নবী এই কথা বলেছেন, “ক্রীট দ্বীপের লোকেরা বরাবরই মিথ্যাবাদী, বুনো পশুর মত এবং অলস ও পেটুক।” কথাটা সত্যি। এইজন্য খুব কড়াকড়ি ভাবে তাদের দোষ দেখিয়ে দাও যেন তারা ঈসায়ী ঈমানকে ঠিকভাবে ধরে রাখে, আর ইহুদীদের গল্প-কথায় ও যারা আল্লাহ্‌র সত্যের কাছ থেকে ফিরে গেছে তাদের হুকুমে কান না দেয়। যাদের দিল পাক-পবিত্র তাদের কাছে সব কিছুই পবিত্র, কিন্তু যাদের দিল নোংরা ও যারা অ-ঈমানদার তাদের কাছে কিছুই পবিত্র নয়; এমন কি, তাদের মন ও বিবেক পর্যন্ত নোংরা। মুখে তারা বলে তারা আল্লাহ্‌কে জানে, কিন্তু তাদের কাজ দ্বারা তারা তাঁকে অস্বীকার করে। তারা ঘৃণার যোগ্য ও অবাধ্য; তারা কোন ভাল কাজেরই উপযুক্ত নয়। তুমি এমনভাবে শিক্ষা দেবে যাতে তোমার কথার সংগে সত্য শিক্ষার মিল থাকে। যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁদের বলবে যেন তাঁরা সব ব্যাপারে নিজেদের দমনে রাখেন; তাঁরা যেন সম্মান পাবার যোগ্য হন; তাঁদের যেন ভাল বিচারবুদ্ধি, খাঁটি ঈমান, মহব্বত ও ধৈর্যগুণ থাকে। তেমনি করে বয়স্কা স্ত্রীলোকদের বলবে, তাঁদের চালচলনে যেন আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় থাকে এবং তাঁরা যেন ভাল শিক্ষা দেন। পরের নিন্দা করা বা মাতাল হওয়া তাঁদের উচিত নয়। তাহলে তাঁরা যুবতী মেয়েদের শিখাতে পারবেন যেন তারা স্বামী ও ছেলেমেয়েদের ভালবাসে, নিজেদের দমনে রাখে, সতী থাকে, সংসারের দিকে খেয়াল করে, দয়ালু হয় এবং স্বামীর অধীনে থাকে, যাতে কেউ আল্লাহ্‌র কালামের অসম্মান করতে না পারে। তেমনি করে যুবকদের উপদেশ দাও যেন তারা নিজেদের দমনে রাখে। সব কিছুতেই তুমি তাদের কাছে ভাল কাজের একটা আদর্শ হও। তোমার শিক্ষার মধ্যে যেন সৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাতে যেন হালকা মনোভাব না থাকে। কেউ যাতে তোমার দোষ ধরতে না পারে সেই রকম সত্য শিক্ষা দাও, যেন তোমাদের বিপক্ষের লোকেরা লজ্জা পায়, কারণ আমাদের বিষয়ে খারাপ বলবার তো তাদের কিছুই থাকবে না। যারা গোলাম, তাদের বলবে যেন সব ব্যাপারে তারা মালিকদের অধীনে থাকে, তাদের খুশী করতে চেষ্টা করে, কথার উপর কথা না বলে, আর মালিকদের জিনিস চুরি না করে, বরং তারা যে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য তা প্রমাণ করে, যেন তারা আমাদের নাজাতদাতা আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে যে শিক্ষা আছে তা সব দিক থেকে সুন্দর করে তুলতে পারে। আল্লাহ্‌র যে রহমত দ্বারা নাজাত পাওয়া যায় তা সব মানুষের কাছেই প্রকাশিত হয়েছে। এই রহমতই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যেন আমরা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীনতা ও দুনিয়ার কামনা-বাসনাকে অগ্রাহ্য করে এই দুনিয়াতেই নিজেদের দমনে রেখে আল্লাহ্‌-ভয়ের সংগে সৎ জীবন কাটাই, আর আমাদের আল্লাহ্‌তা’লা এবং নাজাতদাতা ঈসা মসীহের মহিমাপূর্ণ প্রকাশের আনন্দ-ভরা আশা পূর্ণ হবার জন্যই আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করি। ঈসা মসীহ্‌ আমাদের জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন, যেন সমস্ত গুনাহ্‌ থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারেন এবং তাতে এমন একদল লোককে পাক-সাফ করতে পারেন যারা কেবল তাঁরই হবে এবং যারা অন্যদের উপকার করতে আগ্রহী হবে। সেইজন্য পূর্ণ অধিকার নিয়ে তুমি এই সব বিষয়ে শিক্ষা দাও, উপদেশ দাও ও দোষ দেখিয়ে দাও। কেউ যেন তোমাকে তুচ্ছ না করে। আল্লাহ্‌র বান্দাদের মনে করিয়ে দাও যেন তারা শাসনকর্তা ও যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তাদের অধীনে থাকে, বাধ্য হয় ও লোকদের সব রকম উপকার করবার জন্য প্রস্তুত থাকে। তারা যেন কারও নিন্দা না করে বা ঝগড়াঝাঁটি না করে, বরং তারা যেন শান্ত স্বভাবের হয় এবং সকলের সংগে খুব নম্র ব্যবহার করে। আমরাও আগে বুদ্ধিহীন ও অবাধ্য ছিলাম, ভুল পথে চলতাম, আর সুখভোগ ও নানা রকম কামনা-বাসনার গোলাম ছিলাম। আমরা অন্যের প্রতি হিংসা করতাম এবং অনিষ্ট করবার চিন্তায় জীবন কাটাতাম। নিজেরা ঘৃণার যোগ্য হলেও আমরা একে অন্যকে ঘৃণা করতাম। কিন্তু যখন আমাদের নাজাতদাতা আল্লাহ্‌র রহমত ও মহব্বত প্রকাশিত হল তখন তিনি আমাদের নাজাত দিলেন। কোন সৎ কাজের জন্য তিনি আমাদের নাজাত দেন নি, তাঁর মমতার জন্যই তা দিলেন। পাক-রূহের দ্বারা নতুন জন্ম দান করে ও নতুন ভাবে সৃষ্টি করে তিনি আমাদের দিল ধুয়ে পরিষ্কার করলেন, আর এইভাবেই তিনি আমাদের নাজাত দিলেন। আমাদের নাজাতদাতা ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে তিনি খোলা হাতে পাক-রূহ্‌কে আমাদের দিলেন, যেন আমরা অনন্ত জীবনের আশ্বাস পেয়ে আল্লাহ্‌র সব কিছুর অধিকারী হই। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ আল্লাহ্‌র রহমতের মধ্য দিয়ে আমাদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এই কথা বিশ্বাসযোগ্য। আমি চাই, তুমি এই সব বিষয়ের উপর জোর দাও, যাতে আল্লাহ্‌র উপরে যারা ঈমান এনেছে তারা অন্যদের উপকার করবার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখবার দিকে মন দেয়। মানুষের পক্ষে এই সব ভাল এবং উপকারী। মূর্খের মত তর্কাতর্কি, বংশ-তালিকা, ঝগড়া-বিবাদ ও শরীয়ত নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে তুমি দূরে থাক, কারণ এগুলো করে কোন লাভ নেই; এ সবই অর্থহীন। যে লোক ভুল শিক্ষা দিয়ে দলাদলির সৃষ্টি করে তাকে প্রথমে একবার, পরে আর একবার সাবধান কোরো। এতে কাজ না হলে তার সংগে মেলামেশা একেবারেই বন্ধ করে দাও। তুমি তো জান যে, এই রকম লোকের মনের চিন্তা খারাপ। সে গুনাহ্‌গার; সে নিজেকে নিজেই দোষী বলে প্রমাণ করে। আমি আর্তিমা কিংবা তুখিককে তোমার কাছে পাঠালেই তুমি নীকপলিতে আমার কাছে আসবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা কোরো, কারণ আমি নীকপলিতেই শীতকাল কাটাব বলে ঠিক করেছি। উকিল সীনা ও আপল্লোর যাত্রাপথের জন্য যতটা সম্ভব সাহায্য কোরো, যেন তাঁদের কোন কিছুর অভাব না হয়। অন্যদের উপকার করবার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে আমাদের লোকদের শিখতে হবে, যেন তারা অন্যদের অভাব মিটাতে পারে। এই রকম করলে তাদের জীবন ফলবান হয়ে উঠবে। আমার সংগে যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন। মসীহের উপর ঈমানের জন্য যাঁরা আমাদের মহব্বত করেন তাঁদের সালাম জানায়ো। তোমাদের সকলের উপর আল্লাহ্‌র রহমত থাকুক। আমি পৌল মসীহ্‌ ঈসার বন্দী হয়েছি। আমি ও আমাদের ঈমানদার ভাই তীমথিয় আমাদের প্রিয় বন্ধু ও সহকর্মী ফিলীমনের কাছে, আমাদের বোন আপ্পিয়ার কাছে, আমাদের সহযোদ্ধা আর্খিপ্পের কাছে এবং তোমার বাড়ীতে যারা জামাত হিসাবে মিলিত হয় তাদের কাছে এই চিঠি লিখছি। আমাদের পিতা আল্লাহ ও হযরত ঈসা মসীহ্‌ তোমাদের রহমত ও শান্তি দান করুন। আমি সব সময় মুনাজাতে তোমার কথা মনে করে তোমার জন্য আল্লাহ্‌কে শুকরিয়া জানিয়ে থাকি, কারণ হযরত ঈসার উপর তোমার ঈমান ও আল্লাহ্‌র সব বান্দাদের প্রতি তোমার মহব্বতের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। আমি এই মুনাজাত করি যে, তোমার ঈমানের দরুন তোমার দান করবার মধ্য দিয়ে যেন মসীহ্‌ গৌরব পান। এছাড়া মসীহের সংগে যুক্ত হয়ে আমরা যে সব দোয়া পেয়েছি তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরে তোমার দান করবার কাজ যেন আরও বেড়ে যায়। ভাই, তোমার মহব্বত দেখে আমি খুব আনন্দ ও উৎসাহ পেয়েছি, কারণ তুমি আল্লাহ্‌র বান্দাদের দিলে নতুন উৎসাহ জাগিয়ে তুলেছ। এইজন্য যদিও আমি মসীহের মধ্য দিয়ে তোমাকে তোমার কর্তব্যের সম্বন্ধে খুব সাহসের সংগে হুকুম দিতে পারতাম, এক সময় ছিল যখন তোমার কাছে তার কোন মূল্য ছিল না, কিন্তু এখন সে তোমার ও আমার দু’জনের কাছেই মুল্যবান। যা হোক, আমি তাকে তোমার কাছে ফিরে পাঠাচ্ছি; সে আমার প্রাণের মতই প্রিয়। আমি তাকে আমার নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিলাম, যেন সুসংবাদ তবলিগ করবার দরুন আমার এই বন্দী অবস্থায় সে তোমার হয়ে আমার সেবা করতে পারে। কিন্তু তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতে চাই নি, যেন জোর করে তোমার দয়া আদায় করতে না হয়, বরং তুমি যেন নিজে থেকেই দয়া কর। তুমি যাতে চিরকালের জন্য তাকে ফিরে পেতে পার, হয়তো সেইজন্যই সে অল্প কালের জন্য তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে আর গোলাম হিসাবে পাবে না বরং গোলামের চেয়ে বেশী, অর্থাৎ প্রিয় ভাই হিসাবে পাবে। সে আমার কাছে খুবই প্রিয়, কিন্তু মানুষ ও ঈমানদার ভাই হিসাবে তোমার কাছে আরও প্রিয়। সেইজন্য যদি তুমি আমাকে একই ঈমানে ঈমানদার বলে মনে কর তবে আমাকে যেভাবে গ্রহণ করতে ওনীষিমকেও ঠিক সেইভাবে গ্রহণ কর। যদি সে তোমার কোন ক্ষতি করে থাকে বা তোমার কাছে কোন বিষয়ে ঋণী থাকে তবে তা আমার ঋণ বলেই ধোরো। আমি পৌল নিজের হাতেই লিখছি যে, আমি সেই ঋণ শোধ করে দেব। অবশ্য এই কথা আমার বলবার দরকার নেই যে, মসীহের উপর ঈমানের ব্যাপারে তুমি নিজেই আমার কাছে ঋণী আছ। ভাই, আমরা প্রভুর হয়েছি বলে আমি চাই যে, তুমি আমার একটা উপকার কর। ঈমানদার ভাই হিসাবে তুমি আমার দিলে নতুন উৎসাহ জাগিয়ে তোলো। তুমি আমার কথা মেনে নেবে জেনেই আমি তোমার কাছে এই চিঠি লিখছি। অবশ্য আমি জানি, আমি যা বলছি তুমি তার চেয়েও বেশী করবে। আর একটা কথা বলছি- মেহমান্তখানা আমার জন্য প্রস্তুত রেখো, কারণ আমি আশা রাখি যে, তোমাদের মুনাজাতের ফলে আমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ইপাফ্রা তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন; তিনি মসীহ্‌ ঈসার জন্য আমার সংগে বন্দী আছেন। এছাড়া মার্ক, অরিষ্টার্খ, দীমা ও লূক- আমার এই সহকর্মীরাও তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের রহমত তোমাদের দিলে থাকুক। অনেক দিন আগে নবীদের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌ আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে নানা ভাবে অনেক বার অল্প অল্প করে কথা বলেছিলেন। কিন্তু এই দিনগুলোর শেষে তিনি তাঁর পুত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে কথা বলেছেন। আল্লাহ্‌ তাঁর পুত্রকে সব কিছুর অধিকারী হওয়ার জন্য নিযুক্ত করলেন। পুত্রের মধ্য দিয়েই তিনি সব কিছু সৃষ্টি করলেন। আল্লাহ্‌র সব গুণ সেই পুত্রের মধ্যেই রয়েছে; পুত্রই আল্লাহ্‌র পূর্ণ ছবি। পুত্র তাঁর শক্তিশালী কালামের দ্বারা সব কিছু ধরে রেখে পরিচালনা করেন। মানুষের গুনাহ্‌ দূর করবার পরে পুত্র বেহেশতে আল্লাহ্‌তা’লার ডান পাশে বসলেন। তাঁর পিতার কাছ থেকে তিনি যে নাম পেয়েছেন তা যেমন ফেরেশতাদের নামের চেয়ে মহান, তেমনি তিনি নিজেও ফেরেশতাদের চেয়ে অনেক মহান হয়েছেন। আল্লাহ্‌ কখনও কি কোন ফেরেশতাকে এই কথা বলেছেন, “তুমি আমার পুত্র, আজই আমি তোমার পিতা হলাম”? আবার তিনি কি বলেছেন, “আমি হব তার পিতা আর সে হবে আমার পুত্র”? না, তিনি তা বলেন নি। আল্লাহ্‌ তাঁর প্রধান সন্তানকে এই দুনিয়াতে পাঠাবার সময় বলছেন, “আল্লাহ্‌র সব ফেরেশতারা তাঁকে সেজদা করুক।” ফেরেশতাদের বিষয়ে আল্লাহ্‌ বলছেন, “তিনি বাতাসকে তাঁর ফেরেশতা করেছেন; জ্বলন্ত আগুনকে করেছেন তাঁর গোলাম।” কিন্তু পুত্রের বিষয়ে আল্লাহ্‌ বলছেন, “হে আল্লাহ্‌, তোমার সিংহাসন চিরস্থায়ী; তোমার শাসন ন্যায়ের শাসন। তুমি ন্যায় ভালবাস আর অন্যায়কে ঘৃণা কর; সেইজন্য আল্লাহ্‌, তোমার আল্লাহ্‌, তোমার সংগীদের চেয়ে অনেক বেশী আনন্দ তেলের মত করে তোমার উপর ঢেলে দিয়েছেন।” আল্লাহ্‌ আরও বলেছেন, “প্রভু, তুমি অনেক কাল আগেই দুনিয়ার ভিত্তি গেঁথেছিলে; আসমানও তোমার হাতে গড়া। সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু তুমি চিরকাল থাকবে। কাপড়ের মতই সেগুলো পুরানো হয়ে যাবে। সেগুলোকে তুমি কাপড়ের মতই গুটিয়ে রাখবে, আর কাপড়ের মত সেগুলোকে বদল করা হবে। কিন্তু তুমি একই রকম থাকবে, আর তোমার জীবনকাল কখনও শেষ হবে না।” আল্লাহ্‌ কখনও কি কোন ফেরেশতাকে এই কথা বলেছেন, “যতক্ষণ না আমি তোমার শত্রুদের তোমার পায়ের তলায় রাখি, ততক্ষণ তুমি আমার ডানদিকে বস”? ফেরেশতারা কি সকলেই সেবাকারী রূহ্‌ নন? যারা নাজাত পাবে তাদের সেবা করবার জন্যই তো তাঁদের পাঠানো হয়। এইজন্য আমরা যা শুনেছি তা পালন করবার দিকে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত, যেন তা থেকে আমরা দূরে সরে না যাই। ফেরেশতাদের দ্বারা যে কালাম বলা হয়েছিল তার তো কোন নড়চড় হয় নি; তা ছাড়া যে কেউ আল্লাহ্‌র হুকুম অমান্য করেছে এবং তাঁর কথা শুনতে চায় নি সে তার উচিত শাস্তি পেয়েছে। তাহলে নাজাতের জন্য আল্লাহ্‌ এই যে মহান ব্যবস্থা করেছেন তা যদি আমরা অবহেলা করি তবে কি করে আমরা রেহাই পাব? নাজাত পাবার কথা প্রথমে হযরত ঈসাই বলেছিলেন এবং যাঁরা তা শুনেছিলেন তাঁরা আমাদের কাছে সেই নাজাতের সত্যতা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। সেই সংগে আল্লাহ্‌ও অনেক চিহ্ন এবং কুদরতি ও শক্তির কাজ দ্বারা আর নিজের ইচ্ছা অনুসারে পাক-রূহের দেওয়া দান দ্বারা সেই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ভবিষ্যতের যে দুনিয়ার কথা আমরা বলছি, আল্লাহ্‌ তা ফেরেশতাদের অধীনে রাখেন নি। পাক-কিতাবের মধ্যে এক জায়গায় কোন একজন এই কথা বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন: মানুষ এমন কি যে, তুমি তার বিষয় চিন্তা কর? মানুষের সন্তানই বা কি যে, তুমি তার দিকে মনোযোগ দাও? তুমি মানুষকে ফেরেশতাদের চেয়ে সামান্য নীচু করেছ। রাজতাজ হিসাবে তুমি তাকে দান করেছ গৌরব ও সম্মান, আর তার পায়ের তলায় রেখেছ সব কিছু। যখন আল্লাহ্‌ সব কিছুই মানুষের অধীন করলেন তখন তিনি কোন কিছুই তা থেকে বাদ দিলেন না। অবশ্য সব কিছুই যে আমরা এখন মানুষের অধীনে দেখতে পাচ্ছি তা নয়, কিন্তু ঈসাকে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাঁকে ফেরেশতাদের চেয়ে সামান্য নীচু করা হয়েছিল, যেন আল্লাহ্‌র রহমতে প্রত্যেকটি মানুষের হয়ে তিনি নিজেই মরতে পারেন। তিনি কষ্টভোগ করে মরেছিলেন বলে জয়ের মালা হিসাবে গৌরব ও সম্মান তাঁকে দান করা হয়েছে। সব কিছু আল্লাহ্‌র জন্যই এবং সব কিছু তাঁরই দ্বারা হয়েছে। সেইজন্য অনেক সন্তানকে তাঁর মহিমার ভাগী করবার উদ্দেশ্যে নাজাতের ভিত্তি ঈসাকে কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করে তোলা আল্লাহ্‌র পক্ষে ঠিক কাজই হয়েছে। যিনি লোকদের পবিত্র করেন সেই ঈসা নিজে এবং যাদের তিনি পবিত্র করেন সেই লোকেরা সকলেই আল্লাহ্‌র পরিবারের লোক। এইজন্য ঈসা সেই লোকদের ভাই বলে ডাকতে লজ্জা পান না। পাক-কিতাবে তিনি আল্লাহ্‌কে বলছেন, “ভাইদের কাছে আমি তোমার বিষয় প্রচার করব আর সমাজের মধ্যে তোমার গুণগান করব।” ঈসা আবার বলছেন, “আমি আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা করব।” আর এক জায়গায় তিনি বলছেন, “এই দেখ, আমি এবং সেই সন্তানেরা যাদের আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়েছেন।” সেই সন্তানেরা হল রক্ত-মাংসের মানুষ। সেইজন্য ঈসা নিজেও রক্ত-মাংসের মানুষ হলেন, যাতে মৃত্যুর ক্ষমতা যার হাতে আছে সেই ইবলিসকে তিনি নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শক্তিহীন করেন, আর মৃত্যুর ভয়ে যারা সারা জীবন গোলামের মত কাটিয়েছে তাদের মুক্ত করেন। ঈসা ফেরেশতাদের সাহায্য করেন না, বরং ইব্রাহিমের বংশধরদেরই তিনি সাহায্য করেন। সেইজন্য ঈসাকে সব দিক থেকে তাঁর ভাইদের মত হতে হল, যেন তিনি একজন দয়ালু ও বিশ্বস্ত মহা-ইমাম হিসাবে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করতে পারেন। এর উদ্দেশ্য হল, তিনি যেন নিজের মৃত্যুর দ্বারা মানুষের গুনাহ্‌ দূর করে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করেন। তিনি নিজেই পরীক্ষা সহ্য করে কষ্টভোগ করেছিলেন বলে যারা পরীক্ষার সামনে দাঁড়ায় তাদের তিনি সাহায্য করতে পারেন। সেইজন্য পবিত্র ভাইয়েরা, তোমরা যারা বেহেশতের অধিকারী হবার জন্য তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছ, তোমরা ঈসার বিষয়ে মনোযোগী হও। যাঁর উপর আমরা ঈমান এনেছি তিনিই আল্লাহ্‌র সেই পাঠানো বান্দা এবং সেই মহা-ইমাম। আল্লাহ্‌র পরিবারের লোকদের দেখাশোনার কাজে মূসা যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন তেমনি ঈসাকে যিনি নিযুক্ত করেছিলেন সেই আল্লাহ্‌র কাছে তিনিও বিশ্বস্ত ছিলেন। যে লোক ঘর তৈরী করে সে যেমন সেই ঘরের চেয়ে বেশী সম্মান লাভ করে, সেই অনুসারে আল্লাহ্‌ ঈসাকে মূসার চেয়ে আরও বেশী গৌরব পাবার অধিকারী বলে মনে করলেন। প্রত্যকটা ঘর কেউ না কেউ তৈরী করে থাকে, কিন্তু আল্লাহ্‌ই সব কিছু তৈরী করেছেন। সত্যিই মূসা আল্লাহ্‌র পরিবারে সেবাকারী হিসাবে বিশ্বস্ত ছিলেন, যেন ভবিষ্যতে যা বলা হবে তার সম্বন্ধে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারেন। কিন্তু মসীহ্‌ সেই পরিবারের ভার-পাওয়া পুত্র হিসাবে বিশ্বস্ত ছিলেন। আমাদের নিশ্চিত আশার ফলে মনে যে সাহস ও আনন্দ আসে, তাতে যদি আমরা শেষ পর্যন্ত স্থির থাকি তবে দেখা যাবে যে, আমরাই আল্লাহ্‌র পরিবারের লোক। সেইজন্য পাক-রূহ্‌ বলেছিলেন, “আহা, আজ যদি তোমরা তাঁর কথায় কান দাও! তিনি বলছেন, তোমাদের পূর্বপুরুষদের মত তোমাদের দিল তোমরা কঠিন কোরো না। তারা মরুভূমির মধ্যে বিদ্রোহী হয়ে আমার পরীক্ষা করেছিল। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা সেখানে আমাকে যাচাই করেছিল, আর চল্লিশ বছর ধরে সেই সময়কার লোকেরা আমার কাজ দেখেছিল। আমি তাদের উপর খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘এই লোকদের দিল বিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তারা আমার পথ জানল না।’ সেইজন্য আমি রাগে কসম খেয়ে বলেছিলাম, ‘আমার দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় তারা যেতে পারবে না।’ ” ভাইয়েরা, সাবধান! তোমাদের মধ্যে কারও মন যেন খারাপ ও অ-ঈমানদার না হয়। এই রকম মন জীবন্ত আল্লাহ্‌র কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এর চেয়ে যতদিন পাক-কিতাবের “আজ” কথাটা বলা যায়, তার প্রত্যেক দিনই তোমরা একে অন্যকে উৎসাহ দাও, যাতে তোমাদের কারও মন গুনাহের ছলনায় পড়ে কঠিন না হয়; কারণ প্রথমে যে নিশ্চয়তা আমাদের ছিল, যদি আমরা তাতে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকি তবে দেখা যাবে যে, আমরা মসীহের সংগে অংশীদার হয়েছি। একটু আগে বলা হয়েছে, আহা, আজ যদি তোমরা তাঁর কথায় কান দাও! তিনি বলেছেন, “তোমাদের পূর্বপুরুষদের মত তোমাদের দিল তোমরা কঠিন কোরো না।” কারা আল্লাহ্‌র কথা শুনেও তাঁকে বিরক্ত করেছিল? তারা কি সেই সব লোক নয় যাদের মূসা মিসর দেশ থেকে বের করে এনেছিলেন? আর চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহ্‌ কাদের উপর বিরক্ত ছিলেন? তারা কি সেই সব লোক নয় যারা গুনাহ্‌ করেছিল এবং যাদের লাশ মরুভূমিতে পড়ে ছিল? আর কাদের কাছেই বা আল্লাহ্‌ কসম খেয়ে বলেছিলেন যে, তারা তাঁর দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যেতে পারবে না? তারা কি সেই সব লোক নয় যারা তাঁর কথায় ঈমান না এনে অমান্য করেছিল? এতে দেখা যায় যে, তাদের ঈমান না আনবার জন্যই তারা আল্লাহ্‌র দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যেতে পারে নি। আল্লাহ্‌র দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যাবার যে ওয়াদা ছিল সেই ওয়াদা আমাদের জন্যও খাটে। সেইজন্য আমাদের সাবধান হতে হবে, যেন কাউকে সেই ওয়াদা করা দোয়ার অযোগ্য বলে দেখা না যায়। বনি-ইসরাইলদের কাছে যেমন সুসংবাদ তবলিগ করা হয়েছিল তেমনি আমাদের কাছেও করা হয়েছে। কিন্তু সেই সুসংবাদে বনি-ইসরাইলদের কোনই লাভ হয় নি, কারণ তারা তা শুনে ঈমান আনে নি। কিন্তু আমরা ঈমান এনেছি এবং আল্লাহ্‌র সেই ওয়াদা করা বিশ্রামের জায়গায় এসেছি। এই বিশ্রাম সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “সেইজন্য আমি রাগে কসম খেয়ে বলেছিলাম, ‘আমার দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় তারা যেতে পারবে না।’ ” কিন্তু এতে কোন ভুল নেই যে, দুনিয়া সৃষ্টির পরে আল্লাহ্‌র কাজ শেষ হয়ে বিশ্রাম শুরু হয়েছিল। পাক-কিতাবের এক জায়গায় সপ্তম দিন সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “আল্লাহ্‌ সপ্তম দিনে কোন সৃষ্টির কাজ করেন নি।” তিনি আবার বলেছেন, “আমার দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় তারা যেতে পারবে না।” এখন এই কথা ঠিক যে, কিছু লোক তাঁর দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যেতে পারবে; কিন্তু যে ইসরাইলীয়দের কাছে আগে সুসংবাদ তবলিগ করা হয়েছিল তাদের অবাধ্যতার জন্যই তারা আল্লাহ্‌র দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যেতে পারে নি। এইজন্য আল্লাহ্‌ যেমন আগে বনি-ইসরাইলদের কাছে বলেছিলেন ঠিক তেমনি অনেক দিন পরে নবী দাউদের মধ্য দিয়ে আবার বলেছেন, আহা, আজ যদি তোমরা তাঁর কথায় কান দাও! তিনি বলেছেন, “তোমাদের দিল তোমরা কঠিন কোরো না।” এই কথা বলে তাঁর দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যাবার জন্য আল্লাহ্‌ আর একটা সময় ঠিক করেছিলেন এবং তিনি তাঁর নাম দিয়েছিলেন “আজ”। যদি নবী ইউসা বনি-ইসরাইলদের সেই বিশ্রামের জায়গায় নিয়ে যেতেন তবে আল্লাহ্‌ পরে আর একটা সময়ের কথা বলতেন না। তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্‌র বান্দাদের জন্য বিশ্রামের সুযোগ আছে, কারণ আল্লাহ্‌ যেমন তাঁর সৃষ্টির কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি যে লোক আল্লাহ্‌র দেওয়া বিশ্রামের জায়গায় যায়, সেও তার কাজ থেকে বিশ্রাম পায়। এইজন্য এস, আমরা সেই বিশ্রাম পাবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হই। কেউ যেন সেই অবাধ্য ইসরাইলীয়দের মত আল্লাহ্‌কে অমান্য করে তাঁর দেওয়া বিশ্রাম থেকে বাদ না পড়ে। আল্লাহ্‌র কালাম জীবন্ত ও কার্যকর এবং দু’দিকেই ধার আছে এমন ছোরার চেয়েও ধারালো। এই কালাম মানুষের দিল-রূহ্‌ ও অসি'-মজ্জার গভীরে কেটে বসে এবং মানুষের দিলের সমস্ত ইচ্ছা ও চিন্তা পরীক্ষা করে দেখে। সৃষ্টির কিছুই আল্লাহ্‌র কাছে লুকানো নেই। যাঁর কাছে আমাদের হিসাব দিতে হবে তাঁর চোখের সামনে সব কিছুই খোলা এবং প্রকাশিত। এইজন্য এস, আমরা খোলাখুলিভাবে ঈসা ইব্‌নুল্লাহ্‌র উপর আমাদের ঈমানকে স্বীকার করে যাই, কারণ তিনিই আমাদের মহান মহা-ইমাম যিনি বেহেশতে গিয়ে এখন আল্লাহ্‌র সামনে আছেন। আমাদের মহা-ইমাম এমন কেউ নন যিনি আমাদের দুর্বলতার জন্য আমাদের সংগে ব্যথা পান না, কারণ আমাদের মত করে তিনিও সব দিক থেকেই গুনাহের পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অথচ গুনাহ্‌ করেন নি। সেইজন্য এস, আমরা সাহস করে আল্লাহ্‌র রহমতের সিংহাসনের সামনে এগিয়ে যাই, যেন দরকারের সময় সেখান থেকে আমরা তাঁর মমতা ও রহমত পেতে পারি। লোকদের পক্ষ হয়ে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করবার জন্য প্রত্যেক মহা-ইমামকে মানুষের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে নিযুক্ত করা হয়, যেন তিনি মানুষের গুনাহের জন্য পশু কোরবানী দেন এবং অন্যান্য জিনিসও কোরবানী দেন। যারা না জেনে গুনাহ্‌ করে এবং বিপথে যায় তাদের সংগে তিনি নরম ব্যবহার করতে পারেন, কারণ তাঁর মধ্যেও দুর্বলতা আছে। তিনি যেমন অন্য লোকদের গুনাহের জন্য পশু কোরবানী দেন তেমনি নিজে দুর্বল বলে নিজের গুনাহের জন্যও তাঁকে সেই কোরবানী দিতে হয়। মহা-ইমাম হবার সম্মান কেউ নিজে নিতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ্‌ যাঁকে ডাকেন তিনিই সেই সম্মান পান, যেমন মহা-ইমাম হবার জন্য আল্লাহ্‌ হারুনকে ডেকেছিলেন। কথাটা মসীহের বেলায়ও খাটে। মসীহ্‌ নিজের ইচ্ছায় মহা-ইমাম হবার জন্য নিজেকে বড় করে তোলেন নি; আল্লাহ্‌ই এই বলে তাঁকে সেই সম্মান দান করেছিলেন, তুমি আমার পুত্র, আজই আমি তোমার পিতা হলাম। তেমনি করে আল্লাহ্‌ আর এক জায়গায় বলেছিলেন, তুমি চিরকালের জন্য মাল্‌কীসিদ্দিকের মত ইমাম। যিনি তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন সেই আল্লাহ্‌র কাছে ঈসা এই দুনিয়াতে থাকবার সময় জোরে চিৎকার করে কেঁদে অনুরোধ করেছিলেন এবং ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তাঁর ভয়ের সংগে বাধ্যতা ছিল বলে আল্লাহ্‌ তাঁর মুনাজাত শুনেছিলেন। কিন্তু ইব্‌নুল্লাহ্‌ হয়েও তিনি দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে বাধ্যতা শিখেছিলেন। এইভাবে যখন তিনি পূর্ণতা পেলেন তখন তাঁর বাধ্য সকলের জন্য তিনি অনন্ত নাজাতের পথ হলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে মাল্‌কীসিদ্দিকের মত মহা-ইমাম বলে ঘোষণা করলেন। এই বিষয়ে অনেক কথা আমাদের বলবার আছে কিন্তু তা বুঝিয়ে বলা শক্ত, কারণ রূহানী সত্য তোমরা সহজে বুঝতে পার না। এত দিনে তোমাদের ওস্তাদ হয়ে ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু তার বদলে আল্লাহ্‌র কালামের গোড়ার কথাগুলোই আবার তোমাদের শিক্ষা দেবার জন্য ওস্তাদের দরকার হয়ে পড়েছ্‌ে। শক্ত খাবারের বদলে ছোট ছেলেমেয়েদের মত আবার তোমাদের দুধ খাওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। যে দুধ খেয়ে বাঁচে সে তো এখনও শিশু, আর সৎ জীবন সম্বন্ধে যে শিক্ষা আছে তাতে সে কাঁচা। যাদের বয়স হয়েছে কেবল তারাই শক্ত খাবার খেতে পারে, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালামের কঠিন শিক্ষাগুলো বুঝতে পারে। অনেক অভ্যাসের ফলে তারা ভাল-মন্দ বিচার করতে শিখেছে। এইজন্য মসীহের বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা পেয়েছি, এস, তা ছাড়িয়ে আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই। নিষ্ফল কাজকর্ম থেকে মন ফিরানো, আল্লাহ্‌র উপর ঈমান, বিভিন্ন তরিকাবন্দীর বিষয়ে শিক্ষা, হাত-রাখা, মৃতদের জীবিত হয়ে ওঠা ও চিরকালের আজাব-এই সব গোড়ার কথা নিয়ে আমরা যেন আবার নতুন করে ভিত্তি না গাঁথি। অবশ্য আমরা পরিপূর্ণ হয়ে উঠব ইন্‌শা-আল্লাহ্‌; কারণ যারা একবার নূর দেখেছে, বেহেশতী দানের স্বাদ ও পাক-রূহের ছোঁয়া পেয়েছে, আল্লাহ্‌র সুন্দর কালামের স্বাদ পেয়েছে এবং যে যুগ আসছে তার শক্তির বিষয়ে জেনেছে, আর তার পরে মসীহের কাছ থেকে ফিরে গেছে, তাদের আবার নতুন করে তওবা করবার পথে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এটা সম্ভব নয়, কারণ তারা নিজেরাই ইব্‌নুল্লাহ্‌কে আবার ক্রুশের উপরে হত্যা করছে এবং সকলের সামনে তাঁকে অসম্মান করছে। যে মাটি বার বার বৃষ্টির পানি চুষে নিয়ে চাষীদের দরকারী শাক-সবজী জন্মায় সেই মাটি আল্লাহ্‌র দোয়া পায়। কিন্তু যে মাটি কাঁটাঝোপ আর শিয়ালকাঁটা জন্মায় সেই মাটি অকেজো হয়ে যায় এবং তাতে বদদোয়া পড়বার ভয় থাকে। শেষে লোকে তা পুড়িয়ে ফেলে। প্রিয় বন্ধুরা, যদিও আমরা এই সব কথা বলছি তবুও আমরা বিশ্বাস করি যে, তোমাদের অবস্থা ঐ রকম নয়; নাজাতের ফল তোমাদের জীবনে দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারক; তাই তোমাদের কাজ আর তাঁর বান্দাদের সেবা-যত্ন করে তোমরা তাঁকে যে মহব্বত দেখিয়েছ এবং দেখা"ছ, তা তিনি ভুলে যাবেন না। আমরা চাই, তোমরা প্রত্যেকে যেন শেষ পর্যন্ত একই রকম আগ্রহ দেখাও। তাতে তোমরা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হবে যে, তোমাদের আশা পূর্ণ হবে। আমরা চাই না তোমরা অলস হও; আমরা চাই, যারা ঈমান ও অটল ধৈর্যের দ্বারা আল্লাহ্‌র ওয়াদা করা দোয়ার অধিকারী হয় তোমরা তাদের মত হও। আল্লাহ্‌ যখন ইব্রাহিমের কাছে ওয়াদা করেছিলেন তখন তিনি নিজের নামেই কসম খেয়েছিলেন, কারণ তাঁর চেয়ে বড় এমন আর কেউ নেই যার নামে তিনি কসম খেতে পারেন। তিনি এই বলে ওয়াদা করেছিলেন, “আমি নিশ্চয়ই তোমাকে দোয়া করব এবং তোমার বংশ বাড়াব।” এইজন্য ইব্রাহিম যখন অটলভাবে ধৈর্য ধরলেন তখন আল্লাহ্‌ যা দিতে ওয়াদা করেছিলেন তা তিনি পেলেন। নিজের চেয়ে যিনি মহান তাঁর নামেই মানুষ কসম খায়। তাতে সেই কসম এই নিশ্চয়তা দান করে যে, যা বলা হয়েছে তা সত্যি, আর এতে সব গোলমাল থেমে যায়। আল্লাহ্‌ যা দেবার ওয়াদা করেছিলেন, যারা তা পাবে তাদের তিনি এই কসমের মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি যা ঠিক করেছেন তার আর বদল হয় না। এইজন্য তিনি কসমের দ্বারা প্রমাণ করলেন যে, তিনি যা ঠিক করেছেন তা হবেই হবে। আল্লাহ্‌র ওয়াদা ও কসম কখনও বদলায় না। আল্লাহ্‌, যাঁর পক্ষে মিথ্যা বলা সম্ভব নয়, তিনিই এই ওয়াদা করে কসম খেয়েছেন, যেন আমাদের সামনে যে আশা আছে তা আঁকড়ে ধরবার জন্য দৌড়াতে গিয়ে আমরা প্রচুর উৎসাহ পাই। এই আশা আমাদের জীবনে নোংগরের মত নিশ্চিত ও স্থির, আর তা মহাপবিত্র স্থানের পর্দার পিছনে, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সামনে গিয়ে পৌঁছায়। ঈসাই আমাদের হয়ে আমাদের আগে সেই জায়গায় গেছেন। তিনি চিরকালের জন্য মাল্‌কীসিদ্দিকের মত মহা-ইমাম হয়েছেন। এই মাল্‌কীসিদ্দিক শালেমের বাদশাহ্‌ ও আল্লাহ্‌তা’লার ইমাম ছিলেন। ইব্রাহিম যখন বাদশাহ্‌দের হারিয়ে দিয়ে ফিরে আসছিলেন তখন তাঁর সংগে এই মাল্‌কীসিদ্দিকের দেখা হয়েছিল। মাল্‌কীসিদ্দিক ইব্রাহিমকে দোয়া করেছিলেন, আর ইব্রাহিম সব জিনিসের দশ ভাগের এক ভাগ তাঁকে দিয়েছিলেন। মাল্‌কীসিদ্দিক শব্দটার অর্থ হল ন্যায়ের বাদশাহ্‌। মাল্‌কীসিদ্দিক আবার শালেমেরও বাদশাহ্‌ ছিলেন, আর তার অর্থ হল শান্তির বাদশাহ্‌। মাল্‌কীসিদ্দিকের মা-বাবা বা কোন বংশ-তালিকা ছিল না। ইব্‌নুল্লাহ্‌র মত তাঁর জীবনের শুরুও ছিল না, শেষও ছিল না; তিনি চিরকালের ইমাম। দেখ, মাল্‌কীসিদ্দিক কত মহান! আমাদের মহান পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমও তাঁকে সব কিছুর দশ ভাগের এক ভাগ দিয়েছিলেন। লেবির বংশের মধ্যে যাঁরা ইমাম হন, বনি-ইসরাইলদের কাছ থেকে, অর্থাৎ তাঁদের ভাইদের কাছ থেকে আইন মত দশ ভাগের এক ভাগ তাঁদের আদায় করতে হয়। এই ভাইয়েরা ইব্রাহিমের বংশধর হলেও তা করতে হয়। কিন্তু এই মাল্‌কীসিদ্দিক লেবির বংশধর না হয়েও ইব্রাহিমের কাছ থেকে দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করেছিলেন এবং যাঁর কাছে আল্লাহ্‌ ওয়াদা করেছিলেন সেই ইব্রাহিমকে দোয়াও করেছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, দোয়া যে পায় তার চেয়ে যিনি দোয়া করেন তিনিই মহান। একদিকে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর অধীন লেবীয়রাই দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করে; কিন্তু অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে, যিনি জীবিত আছেন বলে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে তিনি, অর্থাৎ মাল্‌কীসিদ্দিকই দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করছেন। এতে এমনও বলা চলে যে, লেবির বংশের যিনি দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করেন তিনিও ইব্রাহিমের মধ্য দিয়ে মাল্‌কীসিদ্দিককে দশ ভাগের এক ভাগ দিয়েছিলেন; কারণ ইব্রাহিমের সংগে যখন মাল্‌কীসিদ্দিকের দেখা হয়েছিল তখন এই লেবি তাঁর পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের শরীরের মধ্যে ছিলেন। যাঁরা ইমামের কাজ করতেন সেই লেবির বংশধরদের কাজের উপর ভিত্তি করে আল্লাহ্‌ ইসরাইলীয়দের তাঁর শরীয়ত দিয়েছিলেন। লেবির বংশের ইমামদের কাজের মধ্য দিয়ে যদি পূর্ণতা লাভ করা যেত, তবে প্রথম লেবীয় ইমাম হারুনের বদলে মাল্‌কীসিদ্দিকের মত অন্য আর একজন ইমামের আসবার কি দরকার ছিল? যখন ইমামের পদ বদলানো হয় তখন শরীয়তও বদলাবার দরকার হয়। যাঁর বিষয়ে আমি এই সব কথা বলছি সেই ঈসা লেবির বংশ থেকে আসেন নি বরং অন্য এক বংশ থেকে এসেছিলেন। সেই বংশের কেউ কখনও ইমাম হিসাবে কোরবানগাহের উপর পশু কোরবানী দেন নি। এটা স্পষ্ট যে, আমাদের প্রভু এহুদার বংশ থেকে এসেছিলেন। এই বংশ থেকে কোন লোক যে ইমাম হবে সেই কথা নবী মূসা কখনও বলেন নি। তাহলে যখন মাল্‌কীসিদ্দিকের মত আর একজন ইমাম উপস্থিত হয়েছেন তখন আমরা যা বলেছি তা আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝা যাচ্ছে। তাঁর এই ইমাম হবার ব্যাপার বংশ সম্বন্ধে কোন নিয়মের উপর ভরসা করে না, তা তাঁর ধ্বংসহীন জীবনের শক্তির উপর ভরসা করে। পাক-কিতাব এই সাক্ষ্য দেয়, তুমি চিরকালের জন্য মাল্‌কীসিদ্দিকের মত ইমাম। ঈসার ইমাম-পদ আল্লাহ্‌ কসম খেয়ে ঠিক করেছিলেন। লেবির বংশধরেরা ইমাম হবার সময় আল্লাহ্‌ কোন কসম খান নি, কিন্তু তিনি ঈসাকে মহা-ইমাম করবার সময় কসম খেয়েছিলেন। পাক-কিতাবে এই সম্বন্ধে লেখা আছে, মাবুদ কসম খেয়েছেন, “তুমি চিরকালের জন্য ইমাম।” এই বিষয়ে তিনি তাঁর মন বদলাবেন না। এর থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, ঈসা আরও মহান একটা ব্যবস্থার জামিন হয়েছেন। লেবীয়দের মধ্যে অনেকেই ইমাম হয়েছিলেন, কারণ মৃত্যুর দ্বারা বাধা পেয়ে তাঁরা কেউ চিরকাল ইমামের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন নি। কিন্তু ঈসা চিরকাল জীবিত আছেন বলে তাঁর ইমাম-পদ কখনও বদলাবে না। এইজন্য যারা তাঁর মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে আসে তাদের তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নাজাত করতে পারেন, কারণ তাদের পক্ষে অনুরোধ করবার জন্য তিনি সব সময় জীবিত আছেন। এই রকম একজন পবিত্র, দোষশুন্য ও খাঁটি মহা-ইমামেরই আমাদের দরকার ছিল। তিনি গুনাহ্‌গার মানুষের চেয়ে আলাদা এবং আল্লাহ্‌ তাঁকে আসমানের চেয়েও উপরে তুলেছেন। অন্যান্য মহা-ইমামেরা যেমন প্রথমে নিজের ও পরে অন্যদের গুনাহের জন্য পশু কোরবানী দিতেন, সেইভাবে এই ইমামের তা করবার দরকার ছিল না, কারণ তিনি চিরকালের মত একবারই নিজের জীবন কোরবানী দিয়ে সেই কাজ শেষ করেছেন। শরীয়ত দুর্বল-মনা লোকদেরই মহা-ইমামের পদে নিযুক্ত করে; কিন্তু শরীয়তের পরে যে কসম খাওয়া হয়েছিল সেই কসম চিরকালের জন্য পূর্ণতা পাওয়া ইব্‌নুল্লাহ্‌কে মহা-ইমামের পদে নিযুক্ত করেছে। আমরা যা বলছি তার আসল কথা হল এই যে, আমাদের এমন একজন মহা-ইমাম আছেন যিনি বেহেশতে আল্লাহ্‌তা’লার সিংহাসনের ডান দিকে বসেছেন। তিনি মহাপবিত্র স্থানে, অর্থাৎ আসল এবাদত-তাম্বুতে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করছেন। সেই এবাদত-তাম্বু মানুষে খাটায় নি, তা মাবুদই খাটিয়েছেন। প্রত্যেক মহা-ইমাম পশু-কোরবানী ও অন্যান্য জিনিস কোরবানী দেবার জন্য নিযুক্ত হন, তাই এই মহা-ইমামেরও কোন কিছু কোরবানী দেবার দরকার। কিন্তু তিনি যদি এখন এই দুনিয়াতে থাকতেন তবে ইমাম হতে পারতেন না, কারণ এখানে শরীয়ত মতে কোরবানী দেবার জন্য ইমাম তো আছেনই। ইমাম হিসাবে তাঁদের এই কাজ বেহেশতের কাজের মাত্র একটা নমুনা ও ছায়া। সেইজন্য মূসা যখন সেই এবাদত-তাম্বুটা তৈরী করতে যাচ্ছিলেন তখন আল্লাহ্‌ এই বলে মূসাকে সতর্ক করেছিলেন, “তুর পাহাড়ের উপরে তোমাকে যে নমুনা দেখানো হল ঠিক সেইমতই যেন সব কিছু তৈরী করা হয় তা দেখো।” কিন্তু এখন আমরা দেখছি, ঈসা যে ইমামের কাজ পেয়েছেন তা ঐ ইমামদের কাজের চেয়েও অনেক উপরে, যেমন করে যে ব্যবস্থার মধ্যস' তিনি হয়েছেন সেই ব্যবস্থা আগের ব্যবস্থার চেয়েও অনেক উপরে; কারণ এই ব্যবস্থা আরও ভাল ভাল ওয়াদার উপর ভরসা করছে। প্রথম ব্যবস্থাটা যদি নিখুঁত হত তবে তো দ্বিতীয় ব্যবস্থার কোন দরকার হত না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের দোষ দেখাবার জন্য পাক-কিতাবে বলেছেন: মাবুদ বলেন, “সময় আসছে যখন আমি ইসরাইল ও এহুদার লোকদের জন্য একটা নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করব। মিসর দেশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের আমি হাত ধরে বের করে আনবার সময় তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম এই নতুন ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থার মত হবে না। তারা আমার সেই ব্যবস্থা মত চলে নি বলে আমি তাদের দিকে মনোযোগ দিই নি।” মাবুদ এই কথা বলেন। মাবুদ আরও বলেন, “পরে আমি বনি-ইসরাইলদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করব। তা হল, আমার শরীয়ত আমি তাদের মনের মধ্যে রাখব এবং তাদের দিলেও তা লিখে রাখব। আমি তাদের আল্লাহ্‌ হব আর তারা আমারই বান্দা হবে। নিজের প্রতিবেশীকে এবং নিজের ভাইকে কেউ এই বলে আর কখনও শিক্ষা দেবে না, ‘মাবুদকে চিনতে শেখ,’ কারণ সবাই আমাকে চিনবে। সেইজন্য আমি তাদের অন্যায় মাফ করব, তাদের গুনাহ্‌ আর কখনও মনে রাখব না।” আল্লাহ্‌ এই ব্যবস্থাকে নতুন ঘোষণা করে আগের ব্যবস্থাকে পুরানো বলে অচল করে দিলেন। যা পুরানো এবং অনেক দিনের বলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌র এবাদতের জন্য প্রথম ব্যবস্থাটিতে কতগুলো নিয়ম দেওয়া হয়েছিল এবং এই দুনিয়াতে এবাদতের জন্য বিশেষ একটা জায়গার কথাও তাতে ছিল। আর সেই অনুসারে একটা তাম্বু তৈরী করা হয়েছিল। সেই তাম্বুর প্রথম অংশে থাকত বাতিদান, টেবিল এবং পবিত্র-রুটি। এই প্রথম অংশটির নাম ছিল পবিত্র স্থান। দ্বিতীয় পর্দার পিছনে তাম্বুটির আর একটা অংশ ছিল; তার নাম ছিল মহাপবিত্র স্থান। এই অংশে ধূপ জ্বালাবার জন্য সোনার ধূপগাহ্‌ ও সাক্ষ্য-সিন্দুক ছিল। তার চারদিক সোনা দিয়ে মুড়ানো ছিল। তার মধ্যে ছিল সোনার পাত্রে রাখা মান্না, হারুনের যে লাঠিতে ফুল ফুটেছিল সেই লাঠিটা, আর ব্যবস্থা-লেখা দু’টা পাথরের ফলক। সেই সিন্দুকের উপরে আল্লাহ্‌র মহিমায় পূর্ণ দু’টি সোনার কারুবী ছিল। তাদের ডানাগুলো সেই সিন্দুকের ঢাকনার উপরে মেলে দেওয়া ছিল। এই ঢাকনার উপর গুনাহ্‌ ঢাকা দেওয়া হত। অবশ্য এই সবের খুঁটিনাটির কথা বলা এখন সম্ভব নয়। এইভাবে সব কিছু তৈরী হবার পর ইমামেরা প্রায়ই তাম্বুর প্রথম অংশটিতে ঢুকে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করতেন; কিন্তু দ্বিতীয় অংশটিতে, অর্থাৎ মহাপবিত্র স্থানে কেবলমাত্র মহা-ইমামই ঢুকতেন। বছরে মাত্র একবারই তিনি কোরবানী করা পশুর রক্ত নিয়ে সেখানে ঢুকতেন। তাঁর নিজের গুনাহের জন্য এবং লোকেরা না জেনে যে সব গুনাহ্‌ করেছে তার জন্য তিনি এই রক্ত কোরবানী দিতেন। এতে পাক-রূহ্‌ দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, যতদিন এই এবাদত-তাম্বুটা থাকবে ততদিন সেই মহাপবিত্র স্থানে ঢুকবার পথ খোলা থাকবে না। বর্তমান কালের জন্য এটা একটা চিহ্ন যা আমাদের বলে দিচ্ছে যে, কোরবানী দেওয়া পশু এবং অন্যান্য জিনিস এবাদতকারীর বিবেককে পরিষ্কার করতে পারে না। সেগুলো কেবল শরীরের ব্যাপার, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়া ও শরীয়ত মত পাক-সাফ হবার ব্যাপার মাত্র। কেবল সব কিছু সংশোধনের সময় পর্যন্ত সেগুলো কাজে লেগেছিল। কিন্তু মসীহ্‌ এসেছিলেন ভবিষ্যতের সব উন্নতির বিষয়ের মহা-ইমাম হয়ে। আরও মহৎ ও আরও ভাল এবাদত-তাম্বুতে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করবার জন্য তিনি এসেছিলেন। এই তাম্বু মানুষের হাতে তৈরী নয়, অর্থাৎ তা দুনিয়ার কোন জিনিস নয়। ছাগল ও বাছুরের রক্ত নিয়ে মসীহ্‌ সেই মহাপবিত্র স্থানে ঢোকেন নি। তিনি নিজের রক্ত নিয়ে একবারই সেখানে ঢুকেছিলেন। এইভাবে তিনি চিরকালের জন্য গুনাহ্‌ থেকে মুক্তির উপায় করলেন। যারা নাপাক হত তাদের উপর ছাগল ও ষাঁড়ের রক্ত বা বাছুর-পোড়ানো ছাই ছিটানো হত; তাতে তাদের বাইরের শরীরটাই কেবল পাক-সাফ হয়ে পরিষ্কার হত। কিন্তু যিনি অনন্ত পাক-রূহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে নিখুঁত কোরবানী হিসাবে দান করলেন সেই ঈসার রক্ত আমাদের বিবেককে নিষ্ফল কাজকর্ম থেকে আরও কত না বেশী করে পাক-সাফ করবে, যাতে আমরা জীবন্ত আল্লাহ্‌র এবাদত করতে পারি! আল্লাহ্‌ যাদের ডেকে চিরকালের অধিকার দেবার ওয়াদা করেছিলেন তারা যেন তা পায় সেইজন্যই মসীহ্‌ একটা নতুন ব্যবস্থার মধ্যস' হয়েছেন। এই অধিকার পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, কারণ প্রথম ব্যবস্থা বহাল থাকবার সময়ে মানুষ যে সব গুনাহ্‌ করেছিল সেই সব গুনাহের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করবার মূল্য হিসাবে মসীহ্‌ প্রাণ দিয়েছিলেন। উইল কাজে লাগাতে হলে উইল যে করেছে তার মৃত্যুর প্রমাণের দরকার, কারণ মানুষ মরলে পরেই উইল কাজে লাগানো যায়। যে উইল করেছে সে বেঁচে থাকতে সেই উইল কাজে লাগানো যায় না। ঠিক সেইভাবে প্রথম ব্যবস্থাটিও রক্ত ছাড়া কাজে লাগানো হয় নি। সব লোকদের কাছে শরীয়তের প্রত্যেকটি হুকুম ঘোষণা করবার পর মূসা বাছুর ও ছাগলের রক্ত নিলেন এবং তার সংগে পানি মিশিয়ে লাল রংগে রাংগানো ভেড়ার লোম আর এসোব গাছের ডাল দিয়ে তা শরীয়তের কিতাবের উপরে ও লোকদের উপরে ছিটিয়ে দিলেন। তা করবার সময়ে তিনি বলেছিলেন, “এই সেই ব্যবস্থার রক্ত, যে ব্যবস্থা অনুসারে কাজ করতে আল্লাহ্‌ তোমাদের হুকুম দিয়েছেন।” এবাদত-তাম্বু এবং এবাদতের কাজে ব্যবহার করবার সব জিনিসের উপরেও মূসা ঐ একইভাবে রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। মূসার শরীয়ত মতে প্রায় প্রত্যেক জিনিসই রক্তের দ্বারা পাক-সাফ করা হয় এবং রক্তপাত না হলে গুনাহের মাফ হয় না। যা বেহেশতী জিনিসের নকলমাত্র সেগুলো পশু কোরবানীর দ্বারা পাক-সাফ করবার দরকার ছিল কিন্তু যা আসলেই বেহেশতী জিনিস সেগুলো পাক-সাফ করবার জন্য আরও মহান কোরবানীর দরকার। আসল পবিত্র স্থানের নকল হিসাবে মানুষের হাতে তৈরী কোন পবিত্র স্থানে মসীহ্‌ ঢোকেন নি, বরং তার বদলে তিনি বেহেশতে ঢুকেছেন যেন তিনি আমাদের হয়ে আল্লাহ্‌র সামনে এখন উপস্থিত হতে পারেন। মহা-ইমাম পশুর রক্ত নিয়ে যেমন প্রত্যেক বছর মহাপবিত্র স্থানে ঢোকেন, মসীহ্‌ নিজেকে বারবার কোরবানী দেবার জন্য সেইভাবে বেহেশতে ঢোকেন নি। তা-ই যদি করতে হত তবে দুনিয়া সৃষ্টির সময় থেকে শুরু করে তাঁকে অনেকবারই কষ্টভোগ করে মরতে হত; কিন্তু এখন সমস্ত যুগের শেষে তিনি একবারই প্রকাশিত হয়েছেন যেন নিজেকে কোরবানী দিয়ে তিনি গুনাহ্‌ দূর করতে পারেন। আল্লাহ্‌ ঠিক করে রেখেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ একবার মরবে এবং তার পরে তার বিচার হবে। ঠিক সেইভাবে অনেক লোকের গুনাহের বোঝা বইবার জন্য মসীহ্‌কেও একবারই কোরবানী দেওয়া হয়েছে। তিনি দ্বিতীয় বার আসবেন, কিন্তু তখন গুনাহের জন্য মরতে আসবেন না, বরং যারা তাঁর জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করে আছে তাদের সম্পূর্ণ ভাবে নাজাত করবার জন্য আসবেন। শরীয়তের মধ্যে যা আছে তা ভবিষ্যতের সব উন্নতির বিষয়ের ছায়ামাত্র; তাতে সত্যিকারের মহান বিষয়গুলো নেই। সেইজন্য যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে আসে শরীয়ত কখনও বছরের পর বছর এই একই রকম ভাবে পশু-কোরবানীর দ্বারা তাদের পূর্ণতা দান করতে পারে না। শরীয়ত যদি তাদের পূর্ণতা দান করতেই পারত তবে তো পশু-কোরবানী বন্ধ হয়ে যেত, কারণ এবাদতকারীরা যদি একবারেই পাক-সাফ হতে পারত তাহলে গুনাহের জন্য আর নিজেদের দোষী মনে করত না। কিন্তু এই পশু-কোরবানীগুলো প্রত্যেক বছরই নিজেদের গুনাহের কথা তাদের মনে করিয়ে দেয়, কারণ ষাঁড় ও ছাগলের রক্ত কখনই গুনাহ্‌ দূর করতে পারে না। সেইজন্য মসীহ্‌ এই দুনিয়াতে আসবার সময় আল্লাহ্‌কে বলেছিলেন, “পশু ও অন্যান্য কোরবানী তুমি চাও না, কিন্তু আমার জন্য একটা শরীর তুমি তৈরী করেছ। পোড়ানো কোরবানীতে এবং গুনাহের কোরবানীতে তুমি সন্তুষ্ট হও নি। পরে আমি বলেছিলাম, ‘এই যে, আমি এসেছি; কিতাবে আমার আসার বিষয় লেখা আছে। হে আল্লাহ্‌, তোমার ইচ্ছা পালন করতে আমি এসেছি।’ ” উপরের কথাগুলোর মধ্যে প্রথমে মসীহ্‌ বলেছেন, “পশু ও অন্যান্য কোরবানী, পোড়ানো-কোরবানী ও গুনাহের কোরবানী তুমি চাও নি এবং তাতে সন্তুষ্টও হও নি।” যদিও এই কোরবানীগুলো শরীয়তের হুকুম মতই দেওয়া হত তবুও তিনি এই কথা বলেছিলেন। তারপর মসীহ্‌ বলেছেন, “দেখ, আমি তোমার ইচ্ছা পালন করতে এসেছি।” দ্বিতীয় ব্যবস্থাটা বহাল করবার জন্য তিনি আগের ব্যবস্থাটা বাতিল করে দিলেন। আল্লাহ্‌র সেই ইচ্ছামতই ঈসা মসীহের শরীর একবারই কোরবানী দেবার দ্বারা আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে আমাদের পাক-পবিত্র করা হয়েছে। প্রত্যেক ইমাম প্রত্যেক দিন দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করেন ও বারবার একইভাবে কোরবানী দেন, কিন্তু এই রকম কোরবানী কখনও গুনাহ্‌ দূর করতে পারে না। ঈসা কিন্তু গুনাহের জন্য চিরকালের মত একটি মাত্র কোরবানী দিয়ে আল্লাহ্‌র ডান দিকে বসলেন। আর তখন থেকে যতদিন না তাঁর শত্রুদের তাঁর পায়ের তলায় রাখা হয় ততদিন পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করছেন, কারণ যাদের পাক-পবিত্র করা হয়েছে ঐ একটি কোরবানীর দ্বারা তিনি চিরকালের জন্য তাদের পূর্ণতা দান করেছেন। পাক-রূহ্‌ও এই বিষয়ে আমাদের কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন, মাবুদ বলেন, “পরে আমি তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করব তা হল, আমার শরীয়ত আমি তাদের দিলে রাখব এবং তাদের মনের মধ্যে তা লিখে রাখব।” এর পরে পাক-রূহ্‌ বলেছেন, “আমি তাদের গুনাহ্‌ ও অন্যায় আর কখনও মনে রাখব না।” তাই আল্লাহ্‌ যখন গুনাহ্‌ ও অন্যায় মাফ করেন তখন গুনাহের জন্য কোরবানী বলে আর কিছু নেই। ভাইয়েরা, ঈসা মসীহের রক্তের গুণে সেই মহাপবিত্র স্থানে ঢুকবার সাহস আমাদের আছে। মসীহ্‌ আমাদের জন্য একটা নতুন ও জীবন্ত পথ খুলে দিয়েছেন, যেন আমরা পর্দার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ তাঁর শরীরের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত হতে পারি। এছাড়া আমাদের একজন মহান ইমামও আছেন, যাঁর উপরে আল্লাহ্‌র পরিবারের লোকদের ভার দেওয়া হয়েছে। সেইজন্য ঈমানের মধ্য দিয়ে যে নিশ্চয়তা আসে, এস, আমরা সেই পরিপূর্ণ নিশ্চয়তায় খাঁটি দিলে আল্লাহ্‌র সামনে যাই; কারণ দোষী বিবেকের হাত থেকে আমাদের দিলকে রক্ত ছিটিয়ে পাক-সাফ করা হয়েছে এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে আমাদের শরীরকে ধোয়া হয়েছে। ঈমানদার হিসাবে আমাদের যে আশা আছে, এস, আমরা স্থির হয়ে তার কথা স্বীকার করতে থাকি, কারণ যিনি ওয়াদা করেছেন তিনি বিশ্বাসযোগ্য। এস, আমরা একে অন্যের সম্বন্ধে চিন্তা করি যেন আমরা মহব্বত করতে ও ভাল কাজ করতে একে অন্যকে উৎসাহ দিতে পারি। কোন কোন লোকের যেমন অভ্যাস আছে তাদের মত আমরা যেন সভায় একসংগে মিলিত হওয়া বাদ না দিই, বরং মসীহের আসবার দিন যতই কাছে আসবে ততই যেন আমরা একে অন্যকে আরও উৎসাহ দিতে থাকি। আল্লাহ্‌র সত্যকে জানবার পরে যদি আমরা ইচ্ছা করে গুনাহ্‌ করতে থাকি তবে গুনাহের জন্য আমাদের আর কোন কোরবানী নেই; আছে কেবল বিচারের জন্য ভীষণ ভয়ে অপেক্ষা করে থাকা এবং আল্লাহ্‌র শত্রুদের ছাই করে ফেলবার মত জ্বলন্ত গজব। কেউ মূসার শরীয়ত অস্বীকার করলে কোন মমতা না পেয়েই দুই বা তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ফলে তাকে মরতে হয়। তাহলে ইব্‌নুল্লাহ্‌কে যে ঘৃণা করেছে, যে রক্তে সে পাক-সাফ হয়েছে আল্লাহ্‌র সেই ব্যবস্থার রক্তকে যে অপবিত্র মনে করেছে এবং যিনি রহমত করেন সেই পাক-রূহ্‌কে যে অপমান করেছে, ভেবে দেখ, সে আরও কত বেশী শাস্তির যোগ্য! আমরা তাঁকে জানি যিনি বলেছেন, “অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকার কেবল আমারই আছে; যার যা পাওনা আমি তাকে তা-ই দেব।” তিনি আর এক জায়গায় বলেছেন, “মাবুদই তাঁর বান্দাদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন।” জীবন্ত আল্লাহ্‌র হাতে পড়া কি ভয়ংকর ব্যাপার! আগের দিনগুলোর কথা মনে করে দেখ। তখন নূর পেয়ে দুঃখভোগের ভীষণ কষ্টের মধ্যেও তোমরা স্থির ছিলে। কোন কোন সময় সকলের সামনে অপমান ও অত্যাচার সহ্য করে তোমরা ঠাট্টার পাত্র হয়ে দুঃখভোগ করেছিলে; যাদের উপর ঐ রকম ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের সংগে দুঃখভোগ করেছিলে; আর যারা জেলে গিয়েছিল তাদের দুঃখে দুঃখী হয়েছিলে। তোমাদের জিনিসপত্র লুট হয়ে যাওয়া তোমরা আনন্দের সংগেই মেনে নিয়েছিলে, কারণ তোমরা জানতে যে, আরও ভাল ও স্থায়ী ধন তোমাদের জন্য রয়েছে। সেইজন্য তোমরা সাহস হারায়ো না, কারণ এর পুরস্কার খুব মহৎ। তোমাদের স্থির থাকা দরকার, যাতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত কাজ করবার পরে আল্লাহ্‌ যা দিতে ওয়াদা করেছেন তা তোমরা পাও; কারণ আল্লাহ্‌র কথামত, “যাঁর আসবার কথা আছে তিনি খুব অল্প দিনের মধ্যেই আসবেন, দেরি করবেন না। আর যে লোককে আমি ধার্মিক বলে গ্রহণ করেছি সে ঈমানের দ্বারা জীবন পাবে; কিন্তু কেউ যদি ফিরে যায় তবে তার উপর আমি সন্তুষ্ট হব না।” যারা ফিরে গিয়ে ধ্বংস হয় আমরা তো সেই দলের নই; যারা ঈমান এনে নাজাত পায় আমরা সেই দলেরই। আমরা যা পাব বলে আশা করে আছি তা যে আমরা পাবই এই নিশ্চয়তাই হল ঈমান। আর সেই ঈমানের দ্বারা আমরা নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারি যে, আমরা যা দেখতে পাচ্ছি না তা আসলে আছে। ঈমানের জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষেরা আল্লাহ্‌র প্রশংসা পেয়েছিলেন। ঈমানের দ্বারাই আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ্‌র মুখের কথাতে এই দুনিয়া সৃষ্ট হয়েছিল। তাতে বুঝা যায়, যা আমরা দেখতে পাই তা কোন দেখা জিনিস থেকে সৃষ্ট হয় নি। ঈমানের জন্য কাবিলের চেয়ে হাবিলের কোরবানী আল্লাহ্‌র চোখে আরও ভাল ছিল। তাঁর ঈমানের জন্যই আল্লাহ্‌ তাঁর কোরবানী কবুল করে তাঁর বিষয়ে এই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তিনি ধার্মিক। যদিও হাবিল মারা গেছেন তবুও তাঁর ঈমানের মধ্য দিয়েই তিনি এখনও কথা বলছেন। ঈমানের জন্যই ইনোক মারা যান নি; তাঁকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ্‌ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ইনোককে নিয়ে যাবার আগে আল্লাহ্‌ এই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ইনোক তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন। ঈমান ছাড়া আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ আল্লাহ্‌র কাছে যে যায়, তাকে ঈমান আনতে হবে যে, আল্লাহ্‌ আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়। যা তখনও দেখা যায় নি সেই বিষয়ে আল্লাহ্‌ নূহ্‌কে সাবধান করেছিলেন। নূহ্‌ আল্লাহ্‌ভক্ত ছিলেন বলে আল্লাহ্‌র কথায় ঈমান এনে একটা জাহাজ তৈরী করেছিলেন, যেন তাঁর পরিবার রক্ষা পায়। নূহ্‌ তাঁর ঈমানের দ্বারাই দুনিয়াকে দোষী বলে প্রমাণ করেছিলেন এবং আল্লাহ্‌র কাছে ধার্মিক বলে গ্রহণযোগ্য হবার অধিকার পেয়েছিলেন, যা কেবল ঈমানের ফলেই পাওয়া যায়। আল্লাহ্‌ যখন ইব্রাহিমকে ডেকেছিলেন তখন ঈমানের জন্যই তিনি আল্লাহ্‌র কথার বাধ্য হয়েছিলেন এবং সম্পত্তি হিসাবে যে জায়গাটা তাঁর পাবার কথা ছিল সেই জায়গায় তিনি গিয়েছিলেন। যদিও তখন বুঝতে পারেন নি তিনি কোথায় যাচ্ছেন তবুও তিনি রওনা হয়েছিলেন। আল্লাহ্‌ যে দেশ ইব্রাহিমকে দেবার ওয়াদা করেছিলেন তিনি ঈমানের জন্যই বিদেশী হিসাবে সেখানে বাস করেছিলেন। তাঁর সংগে যাঁরা সেই একই ওয়াদার দোয়ার ভাগী ছিলেন সেই ইসহাক ও ইয়াকুবের মত করে তিনিও তাম্বুতে তাম্বুতে বাস করতেন; কারণ যে শহর চিরস্থায়ী তিনি সেই শহরের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই শহরের নক্‌শা তৈরী ও গেঁথে তুলবার কাজ আল্লাহ্‌ই করেছেন। যদিও সারার সন্তান হবার বয়স পার হয়ে গিয়েছিল তবুও ঈমানের জন্যই তিনি ইব্রাহিমের সন্তান গর্ভে ধরবার শক্তি পেয়েছিলেন, কারণ তিনি ঈমান এনেছিলেন, যিনি ওয়াদা করেছেন তিনি বিশ্বাসযোগ্য। এইজন্য বয়সের দরুন অকেজো শরীর নিয়েও ইব্রাহিম আসমানের তারার মত এবং সাগর পারের বালুকণার মত অসংখ্য সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। এই সব লোকেরা ঈমানের মধ্যে জীবন কাটিয়ে ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ্‌ তাঁদের যা দেবার ওয়াদা করেছিলেন তা তাঁরা পান নি, কিন্তু দূর থেকে তা দেখেছিলেন এবং খুশীও হয়েছিলেন। এই দুনিয়াতে যে তাঁরা বিদেশী এবং পরদেশে বাসকারী তা তাঁরা স্বীকারও করেছিলেন। যাঁরা তা স্বীকার করেন তাঁরা পরিষ্কার ভাবে বুঝান যে, তাঁরা নিজেদের জন্য একটা দেশের তালাশ করছেন। যে দেশ থেকে তাঁরা বের হয়ে এসেছিলেন যদি সেই দেশের কথা তাঁরা চিন্তা করতেন তবে তো সেই দেশে ফিরে যাবার সব সুযোগই তাঁরা পেতেন। কিন্তু তাঁরা আরও ভাল একটা দেশের, অর্থাৎ বেহেশতের তালাশ করছিলেন। সেইজন্যই আল্লাহ্‌ নিজেকে তাঁদের আল্লাহ্‌ বলতে লজ্জা বোধ করেন না, কারণ তিনি তাঁদেরই জন্য একটা শহর তৈরী করেছিলেন। ইব্রাহিমকে পরীক্ষা করবার সময় তিনি আল্লাহ্‌র উপর ঈমানের জন্যই ইসহাককে কোরবানী দিয়েছিলেন। যাঁর কাছে আল্লাহ্‌ ওয়াদা করেছিলেন তিনিই তাঁর অদ্বিতীয় ছেলেকে কোরবানী দিতে যাচ্ছিলেন। এ সেই ছেলে যাঁর বিষয়ে আল্লাহ্‌ বলেছিলেন, “ইসহাকের বংশকেই তোমার বংশ বলে ধরা হবে।” ইব্রাহিম তাঁকে কোরবানী দিতে রাজী হলেন, কারণ তাঁর ঈমান ছিল যে, আল্লাহ্‌ মৃতকে জীবিত করতে পারেন। আর বলতে কি, ইব্রাহিম তো মৃত্যুর দুয়ার থেকেই ইসহাককে ফিরে পেয়েছিলেন। ঈমান এনেই ইসহাক ভবিষ্যতের জন্য ইয়াকুব ও ইস্‌কে দোয়া করেছিলেন। ঈমান এনেই ইয়াকুব ইন্তেকাল করবার সময় ইউসুফের দুই ছেলেকে দোয়া করেছিলেন আর লাঠির উপর ভর করে আল্লাহ্‌র এবাদত করেছিলেন। ঈমান এনেই ইউসুফ ইন্তেকাল করবার সময়ে মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের চলে যাবার কথা বলেছিলেন এবং তাঁর মৃতদেহ কি করতে হবে তা-ও বলেছিলেন। মূসার জন্মের পর তাঁর মা-বাবা ঈমান এনেই তিন মাস তাঁকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, কারণ তাঁরা দেখেছিলেন ছেলেটি সুন্দর আর তাঁরা বাদশাহ্‌র হুকুমের ভয় করলেন না। ঈমানের জন্যই মূসা বড় হবার পর চাইলেন না, কেউ তাঁকে ফেরাউনের মেয়ের ছেলে বলে ডাকে। তিনি গুনাহের অস্থায়ী আনন্দ বাদ দিয়ে আল্লাহ্‌র বান্দাদের সংগে অত্যাচার ভোগ করাই বেছে নিলেন। তিনি মিসরের ধন-সম্পত্তির চেয়ে মসীহের জন্য অপমানিত হওয়ার মূল্য অনেক বেশী মনে করলেন, কারণ তাঁর চোখ ছিল পুরস্কারের দিকে। আল্লাহ্‌র উপর তাঁর ঈমানের জন্যই তিনি বাদশাহ্‌র রাগের ভয় না করে মিসর দেশ ছেড়েছিলেন, কারণ যাঁকে দেখা যায় না তাঁকে যেন দেখতে পাচ্ছেন সেইভাবে তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন। তিনি ঈমান এনেই উদ্ধার-ঈদ এবং রক্ত ছিটাবার নিয়ম পালন করেছিলেন, যাতে যে ধ্বংসকারী ফেরেশতা প্রথম সন্তানদের হত্যা করবেন তিনি বনি-ইসরাইলদের না ধরেন। ঈমান এনেই বনি-ইসরাইলরা শুকনা মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যাবার মত করে লোহিত সাগর পার হয়েছিল কিন্তু মিসরীয়রা তা করতে গিয়ে ডুবে মরল। ঈমান এনেই বনি-ইসরাইলরা সাত দিন ধরে জেরিকো শহরের দেয়ালের চারদিকে ঘুরলে পর তা পড়ে গেল। ঈমানের জন্যই রাহব বেশ্যা জেরিকো শহরে বাসকারী অবাধ্য লোকদের সংগে ধ্বংস হন নি, কারণ তিনি সেই গোয়েন্দাদের বন্ধুর মত গ্রহণ করেছিলেন। এর বেশী আমি আর কি বলব? গিদিয়োন, বারক, শামাউন, যিপ্তহ, দাউদ, শামুয়েল আর নবীদের কথা বলবার সময় আমার নেই। ঈমানের দ্বারাই তাঁরা রাজ্য জয় করেছিলেন, ন্যায়বিচার করেছিলেন, আল্লাহ্‌র ওয়াদার পূর্ণতা লাভ করেছিলেন, সিংহদের মুখ বন্ধ করেছিলেন, ভীষণ আগুনের তেজ কমিয়ে দিয়েছিলেন, ছোরার আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন, দুর্বল হয়েও শক্তিশালী হয়েছিলেন, যুদ্ধে শক্তি দেখিয়েছিলেন এবং বিদেশী সৈন্যদলগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্ত্রীলোকেরা তাঁদের মৃত লোকদের আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলেন। অন্যেরা নিজের ইচ্ছায় জেল থেকে খালাস না নিয়ে নির্যাতন ভোগ করেছিলেন, যেন তাঁরা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে আরও ভাল জীবনের অধিকারী হন। আবার অন্যেরা ঠাট্টা-তামাশা ও ভীষণ মারধর, এমন কি, হাতকড়া ও জেল খাটা পর্যন্ত সহ্য করেছিলেন। লোকে তাঁদের পাথর মেরেছিল, করাত দিয়ে দু’টুকরা করে কেটেছিল এবং ছোরা দিয়ে খুন করেছিল। তাঁরা অত্যাচার ও খারাপ ব্যবহার পেয়েছিলেন, আর অভাবে পড়ে ভেড়া ও ছাগলের চামড়া পরে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁরা মরুভূমিতে মরুভূমিতে, পাহাড়ে পাহাড়ে, গুহায় গুহায় এবং গর্তে গর্তে পালিয়ে বেড়াতেন। এই লোকদের স্থান দেবার যোগ্যতা দুনিয়ার ছিল না। ঈমানের জন্যই তাঁরা সবাই প্রশংসা পেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্‌ যা দেবার ওয়াদা করেছিলেন তা তাঁরা পান নি; কারণ আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য আরও ভাল কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন যে, আমাদের বাদ দিয়ে তাঁদের পূর্ণতা দান করা হবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বস্ততার সাক্ষী হিসাবে অনেক লোক আমাদের চারদিকে ভিড় করে আছে। এইজন্য এস, আমরা প্রত্যেকটি বাধা ও যে গুনাহ্‌ সহজে আমাদের জড়িয়ে ধরে তা দূরে ঠেলে দিয়ে সামনের প্রতিযোগিতার দৌড়ে ধৈর্যের সংগে দৌড়াই। আর এস, আমাদের চোখ ঈসার উপর স্থির রাখি যিনি ঈমানের ভিত্তি ও পূর্ণতা। তাঁর সামনে যে আনন্দ রাখা হয়েছিল তারই জন্য তিনি অসম্মানের দিকে না তাকিয়ে ক্রুশীয় মৃত্যু সহ্য করলেন এবং এখন আল্লাহ্‌র সিংহাসনের ডান দিকে বসে আছেন। যিনি গুনাহ্‌গারদের এত বড় শত্রুতা সহ্য করলেন তোমরা তাঁর বিষয়ে চিন্তা কর, যেন তোমাদের মন দুর্বল ও নিরাশ হয়ে না পড়ে। গুনাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে তোমাদের তো এখনও রক্তপাত হবার মত অবস্থা হয় নি। আল্লাহ্‌ তাঁর সন্তান হিসাবে তোমাদের উৎসাহ দিয়ে যে কথা বলেছেন তা তোমরা ভুলে গেছ। তিনি বলেছেন, ছেলে আমার, মাবুদের শাসনকে তুচ্ছ কোরো না, আর তিনি যখন বকুনি দেন তখন নিরাশ হোয়ো না; কারণ মাবুদ যাকে মহব্বত করেন তাকেই শাসন করেন, আর সন্তান হিসাবে যাদের গ্রহণ করেন, তাদের প্রত্যেককে তিনি শাস্তি দেন। তোমরা এই সব কষ্ট শাসন হিসাবে ভোগ করছ। আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি পিতার মতই ব্যবহার করছেন। এমন ছেলে কি কেউ আছে যাকে তার বাবা শাসন করেন না? প্রত্যেক ছেলেকেই শাসন করা হয়। তোমরা যদি শাসন না পেয়ে থাক তবে তো তোমরা জারজ, সত্যিকারের সন্তান নও। এছাড়া আমরা দেখেছি, আমাদের জাগতিক পিতারা আমাদের শাসন করতেন এবং আমরা তাঁদের সম্মান করতাম। তাহলে যিনি সমস্ত রূহ্‌দের পিতা তাঁর অধীন থাকা কি আমাদের আরও উচিত নয়, যাতে আমরা জীবন পাই? আমাদের জাগতিক পিতারা যা ভাল মনে করতেন সেই অনুসারে আমাদের শাসন করেছেন, আর তা অল্প দিনের জন্য; কিন্তু আমাদের ভালোর জন্যই আল্লাহ্‌ আমাদের শাসন করেন যেন আমরা তাঁর পবিত্রতা লাভ করি। শাসনকে আমরা আনন্দের ব্যাপার বলে মনে করি না, বরং দুঃখের ব্যাপার বলেই মনে করি; কিন্তু আল্লাহ্‌র শাসন মেনে নেবার ফল হল শান্তিপূর্ণ সৎ জীবন। সেইজন্য তোমাদের অবশ হাত ও দুর্বল হাঁটু সবল কর। তোমাদের চলার পথ সোজা কর, যেন খোঁড়া লোকের অবস্থা আরও খারাপ না হয়, বরং সে সুস্থ হয়ে ওঠে। সব লোকের সংগে শান্তিতে থাকতে এবং পবিত্র হতে আগ্রহী হও। পবিত্র না হলে কেউ প্রভুকে দেখতে পাবে না। দেখো, কেউ যেন আল্লাহ্‌র রহমত থেকে বাদ না পড়ে। দেখো, বিষাক্ত তেতো গাছের শিকড়ের মত গজিয়ে উঠে কেউ যেন কষ্টের সৃষ্টি করে অনেককে নাপাক না করে। দেখো, কেউ যেন ইসের মত নীতিহীন বা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন না হয়। ইস্‌ এক বেলার খাবারের জন্য বড় ছেলের অধিকার বিক্রি করে দিয়েছিল। তোমরা জান, পরে যদিও সে কেঁদে কেঁদে দোয়া ভিক্ষা করেছিল তবুও তাঁকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, কারণ মন ফিরাবার সুযোগ তখন আর তার ছিল না। কারণ তারা এই নির্দেশ সহ্য করতে পারে নি- “কোন পশুও যদি সেই পাহাড় ছোঁয় তবে তাকে পাথর মারা হবে।” যা দেখা গিয়েছিল তা এমন ভয়ংকর ছিল যে, মূসা বলেছিলেন, “আমি ভয়ে কাঁপছি।” তোমরা তো সিয়োন পাহাড় ও জীবন্ত আল্লাহ্‌র শহরের কাছে এসেছ। সেই শহর হল বেহেশতের জেরুজালেম। তোমরা হাজার হাজার ফেরেশতাদের আনন্দ উৎসবের কাছে এসেছ; প্রথম সন্তানের অধিকার পাওয়া লোক হিসাবে যাঁদের নাম বেহেশতে লেখা আছে তাঁদের দ্বারা গড়া জামাতের কাছে এসেছ; যিনি সব লোকদের বিচারক সেই আল্লাহ্‌র কাছে এসেছ; যে সব লোকেরা পূর্ণতা লাভ করেছে সেই সব ধার্মিক লোকদের রূহ্‌র কাছে এসেছ; যিনি একটি নতুন ব্যবস্থার মধ্যস' সেই ঈসার কাছে এসেছ; আর হাবিলের রক্তের চেয়ে যে রক্ত আরও মহৎ কথা বলে, তোমরা সেই ছিটানো রক্তের কাছে এসেছ। সাবধান! যিনি কথা বলছেন তাঁর কথা অগ্রাহ্য কোরো না। মূসা আল্লাহ্‌র সাবধানবাণী দুনিয়াতে জানাবার পর লোকেরা তাঁর কথা অগ্রাহ্য করেছিল বলে যখন রেহাই পায় নি, তখন যিনি বেহেশত থেকে আমাদের সাবধান করছেন তাঁর কথা অগ্রাহ্য করলে আমরা যে কিছুতেই রেহাই পাব না তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেই সময় আল্লাহ্‌র মুখের কথাই দুনিয়াকে নাড়া দিয়েছিল, কিন্তু এখন তিনি এই ওয়াদা করেছেন, “আমি যে কেবল আর একবার দুনিয়াকে নাড়াব তা নয়, কিন্তু আসমানকেও নাড়াব।” “আর একবার,” এই শব্দ দু’টি থেকে বুঝা যাচ্ছে, যে জিনিসগুলো নাড়ানো যায়, অর্থাৎ যা সৃষ্টি করা হয়েছে তা বাদ দেওয়া হবে, যেন যে জিনিসগুলো নাড়ানো যায় না সেগুলো স্থির থাকে। সেইজন্য যে রাজ্যকে নাড়ানো যায় না আমরা যখন সেই রাজ্য পেতে যাচ্ছি তখন এস, আমরা আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞ হই। তাহলে আল্লাহ্‌ যেভাবে খুশী হন সেইভাবে আমরা সম্মান ও ভয়ের সংগে তাঁর এবাদত করতে পারব। আমাদের আল্লাহ্‌ ধ্বংসকারী আগুনের মত। তোমরা একে অন্যকে ভাইয়ের মতো মহব্বত কোরো। মেহমানদারী করতে ভুলো না; কেউ কেউ না জেনেই এইভাবে ফেরেশতাদের মেহমানদারী করেছেন। যারা জেলখানায় আছে তাদের সংগে যেন তোমরাও কয়েদী হয়েছ, আর যারা অত্যাচারিত হচ্ছে তাদের সংগে যেন তোমরাও অত্যাচারিত হচ্ছ, এইভাবে তাদের কথা মনে কোরো। প্রত্যেকে যেন বিয়ের ব্যাপারটাকে সম্মানের চোখে দেখে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ পবিত্র রাখা উচিত, কারণ যে কোন রকম জেনা হোক না কেন, যারা সেই দোষে দোষী আল্লাহ্‌ তাদের শাস্তি দেবেন। টাকা-পয়সার লোভ থেকে নিজেদের দূরে রেখো। তোমাদের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো। আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না বা কখনও তোমাকে ত্যাগ করব না।” এইজন্য আমরা সাহস করে বলতে পারি, মাবুদ আমার সাহায্যকারী, আমি ভয় করব না; মানুষ আমার কি করতে পারে? যাঁরা তোমাদের কাছে আল্লাহ্‌র কালাম বলতেন তোমাদের সেই নেতাদের কথা মনে রেখো। তাঁদের জীবনের শেষ ফলের কথা ভাল করে চিন্তা কোরো এবং তাঁদের মত করে তোমরাও ঈমান রেখো। ঈসা মসীহ্‌ কালকে যেমন ছিলেন, আজকেও তেমনি আছেন এবং চিরকাল তেমনি থাকবেন। নানা রকম নতুন নতুন শিক্ষা যেন তোমাদের ভুল পথে নিয়ে না যায়। আমাদের মন কোরবানীর খাবারের উপর না থেকে যেন আল্লাহ্‌র রহমতের উপর স্থির হয়ে বসে। যারা সেই খাবারের উপর ভরসা করে চলত, সেই খাবার থেকে তাদের কোন লাভ হয় নি। আমাদের একটা কোরবানগাহ্‌ আছে এবং যাঁরা বনি-ইসরাইলদের সেই এবাদত-তাম্বুতে কাজ করেন, আমাদের সেই কোরবানগাহের উপরে কোরবানী দেওয়া কোন কিছু খাওয়ার অধিকার তাঁদের নেই। গুনাহের জন্য কোরবানী দেওয়া পশুর রক্ত নিয়ে ইসরাইলীয় মহা-ইমাম মহাপবিত্র স্থানে যান, কিন্তু সেই পশুগুলোর দেহ বনি-ইসরাইলদের থাকবার এলাকার বাইরে নিয়ে পোড়ানো হয়। সেইভাবে ঈসাও জেরুজালেম শহরের বাইরে কষ্টভোগ করে মরেছিলেন, যেন তাঁর নিজের রক্তের দ্বারা মানুষকে গুনাহ্‌ থেকে পাক-সাফ করতে পারেন। সেইজন্য এস, তাঁর অসম্মান নিজেরা গ্রহণ করে আমরা শহরের বাইরে তাঁর কাছে যাই, কারণ এখানে আমাদের কোন স্থায়ী শহর নেই; কিন্তু যে শহর আসবে তার জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি। এইজন্য মসীহের মধ্য দিয়ে এস, আমরা আল্লাহ্‌র কাছে অনবরত প্রশংসা-কোরবানী করি, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র বান্দা বলে যারা নিজেদের স্বীকার করে তারা তাদের মুখ দিয়ে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুক। সৎ কাজ করতে ও অন্যদের অভাবের সময় সাহায্য করতে ভুলো না, কারণ আল্লাহ্‌ এই রকম কোরবানীতে সন্তুষ্ট হন। তোমাদের নেতাদের কথা মেনে চোলো এবং তাঁদের বাধ্য হয়ো, কারণ যাঁরা আল্লাহ্‌র কাছে হিসাব দেবেন সেই রকম লোক হিসাবেই তো তাঁরা তোমাদের দেখাশোনা করেন। তাঁদের বাধ্য হয়ো যাতে তাঁরা তাঁদের কাজ আনন্দের সংগে করতে পারেন, দুঃখের সংগে নয়। যদি দুঃখের সংগেই তা করতে হয় তবে তাতে তোমাদের কোন লাভ হবে না। আমাদের জন্য মুনাজাত কোরো। সব বিষয়ে আমরা সৎ ভাবে চলতে চাই বলে আমরা জানি যে, আমাদের বিবেক পরিষ্কার। কিন্তু আমি তোমাদের বিশেষভাবে মুনাজাত করতে অনুরোধ করি, যেন আমি আরও শীঘ্র তোমাদের সংগে মিলিত হতে পারি। যে রক্তে শান্তিদাতা আল্লাহ্‌র চিরস্থায়ী ব্যবস্থা বহাল হয়েছে তার দ্বারা আল্লাহ্‌ আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌কে, অর্থাৎ মেষদের সেই মহান পালককে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলেছেন। যা কিছু ভাল তা দিয়ে তিনি তাঁর ইচ্ছামত চলবার জন্য তোমাদের সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করে তুলুন। তাঁর চোখে যা ভাল ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে আমাদের দিলের মধ্যে তিনি তা-ই করুন। চিরকাল আল্লাহ্‌র গৌরব হোক। আমিন। ভাইয়েরা, তোমাদের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ এই যে, আমার এই শিক্ষার কথা তোমরা মেনে নাও। আমি তো তোমাদের কাছে বেশী কথা লিখলাম না। আমি তোমাদের জানাতে চাই যে, আমাদের ভাই তীমথিয় খালাস পেয়েছেন। তিনি যদি শীঘ্র আসেন তবে তাঁকে সংগে করে তোমাদের দেখতে আসব। তোমাদের সব নেতাদের ও আল্লাহ্‌র বান্দাদের আমাদের সালাম জানায়ো। ইতালী দেশের আল্লাহ্‌র বান্দারা তোমাদের সালাম জানাচ্ছেন। তোমাদের সকলের উপরে আল্লাহ্‌র রহমত থাকুক। আমি আল্লাহ্‌ ও হযরত ঈসা মসীহের গোলাম ইয়াকুব দুনিয়ার সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ইহুদী জাতির বারোটি গোষ্ঠীর লোকদের সালাম জানাচ্ছি। আমার ভাইয়েরা, তোমরা যখন নানা রকম পরীক্ষার মধ্যে পড় তখন তা খুব আনন্দের বিষয় বলেই মনে কোরো, কারণ তোমরা জান তোমাদের ঈমানের পরীক্ষা তোমাদের ধৈর্যগুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই ধৈর্যগুণকে তোমাদের জীবনে পুরোপুরিভাবে কাজ করতে দাও, যাতে তোমরা পাকা ও নিখুঁত হয়ে উঠতে পার, অর্থাৎ তোমাদের স্বভাবের মধ্যে যেন কোন রকম অভাব না থাকে। তোমাদের মধ্যে যদি কারও জ্ঞানের অভাব থাকে তবে সে যেন আল্লাহ্‌র কাছে চায়, আর আল্লাহ্‌ তাকে তা দেবেন, কারণ তিনি বিরক্ত না হয়ে প্রত্যেককে প্রচুর পরিমাণে দান করেন। তবে কোন সন্দেহ না করে তাকে বিশ্বাস করেই চাইতে হবে, কারণ যে সন্দেহ করে সে বাতাসে দুলে ওঠা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত; বাতাসই তাকে ঠেলে নিয়ে যায়। এই রকম লোক যে প্রভুর কাছ থেকে কিছু পাবে তা যেন সে আশা না করে। সে দু’মনা লোক এবং তার সব কাজেই সে অস্থির। যে ঈমানদার ভাই গরীব, আল্লাহ্‌ তাঁকে উঁচু করেছেন বলে সে নিজেকে ধন্য মনে করুক। আর যে ধনী, আল্লাহ্‌ তাকে নম্র করেছেন বলে সেও নিজেকে ধন্য মনে করুক, কারণ সে ঘাসের ফুলের মতই ঝরে পড়ে যাবে। সূর্য যখন জ্বলন্ত তাপ নিয়ে ওঠে তখন সেই ঘাস শুকিয়ে যায়, ফুল ঝরে যায় ও তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। ধনী লোকও ঠিক তেমনি করে তার জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ধন্য সে, যে পরীক্ষার সময়ে ধৈর্য ধরে, কারণ যোগ্য প্রমাণিত হলে পর জয়ের মালা হিসাবে সে জীবন পাবে। আল্লাহ্‌কে যারা মহব্বত করে তাদের তিনি এই জীবন দেবার ওয়াদা করেছেন। দিলে গুনাহের টান বোধ করলে কেউ যেন না বলে, “আল্লাহ্‌ আমাকে গুনাহের দিকে টানছেন।” কোন খারাপীই আল্লাহ্‌কে গুনাহের দিকে টানতে পারে না, আর আল্লাহ্‌ও কাউকে গুনাহের দিকে টানেন না। মানুষের দিলের কামনাই মানুষকে গুনাহের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং ফাঁদে ফেলে। তারপর কামনা পরিপূর্ণ হলে পর গুনাহের জন্ম হয়, আর গুনাহ্‌ পরিপূর্ণ হলে পর মৃত্যুর জন্ম হয়। আমার প্রিয় ভাইয়েরা, ভুল কোরো না। জীবনের প্রত্যেকটি সুন্দর ও নিখুঁত দান বেহেশত থেকে নেমে আসে, আর তা আসে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে, যিনি সমস্ত নূরের পিতা। চঞ্চল ছায়ার মত করে তিনি বদলে যান না। তাঁর নিজের ইচ্ছায় সত্যের কালামের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের তাঁর সন্তান করেছেন, যেন তাঁর সৃষ্ট জিনিসের মধ্যে আমরা এক রকম প্রথম ফলের মত হই। আমার প্রিয় ভাইয়েরা, আমার এই কথাটা লক্ষ্য কর- তোমরা প্রত্যেকে শুনবার জন্য আগ্রহী হও, কিন্তু তাড়াতাড়ি করে কথা বলতে যেয়ো না বা রাগ কোরো না; কারণ আল্লাহ্‌ আমাদের কাছ থেকে যে সৎ জীবন আশা করেন তা রাগের মধ্য দিয়ে আসে না। এইজন্য সব রকম অপবিত্রতা এবং যে সব খারাপী এখনও তোমাদের জীবনে রয়েছে তা দূর কর। আল্লাহ্‌র কালামের বীজ যা তোমাদের দিলের মধ্যে বোনা হয়েছে তা নম্রভাবে গ্রহণ কর। তোমাদের নাজাত করবার ক্ষমতা এই কালামেরই আছে। কেবল আল্লাহ্‌র কালাম শুনলেই চলবে না, সেইমত কাজও করতে হবে। যদি তোমরা কেবল আল্লাহ্‌র কালাম শোন কিন্তু সেইমত কাজ না কর তবে তোমরা নিজেদের ঠকা"ছ। কিন্তু যে পরিপূর্ণ আইন মানুষকে স্বাধীনতা দান করে তার দিকে যে ভাল করে চেয়ে দেখে এবং মনোযোগ দেয়, সে সেই আইনের কথা শুনেই ভুলে যায় না বরং সেইমত কাজও করে। ফলে সে তার সব কাজে দোয়া পায়। কেউ যদি নিজেকে ধার্মিক মনে করে অথচ নিজের জিভ্‌কে না সামলায় সে নিজেকে ঠকায়। তার ধর্মকর্ম মিথ্যা। বিধবা ও এতিমদের দুঃখ-কষ্টের সময়ে তাদের দেখাশোনা করা আর দুনিয়ার সব নোংরামি থেকে নিজেকে পরিষ্কার রাখাই হল পিতা আল্লাহ্‌র চোখে খাঁটি ও সত্য ধর্ম। আমার ভাইয়েরা, তোমরা যখন আমাদের মহিমাপূর্ণ হযরত ঈসা মসীহের উপর ঈমান এনেছ, তখন প্রত্যেককে সমান চোখে দেখ। মনে কর, একজন লোক সুন্দর কাপড়-চোপড় পরে ও হাতে সোনার আংটি দিয়ে তোমাদের মজলিস-খানায় আসল; আবার একজন গরীব লোকও আসল ময়লা কাপড়-চোপড় পরে। তোমরা যদি সেই সুন্দর কাপড় পরা লোকটিকে বেশী সম্মান দেখিয়ে বল, “আপনি এই ভাল জায়গাটায় বসুন,” আর সেই গরীব লোকটিকে বল, “তুমি ঐখানে দাঁড়াও” বা “এখানে আমার পায়ের কাছে বস,” তাহলে তোমরা নিজেদের মধ্যে কি ছোট-বড় ভাবের সৃষ্টি করছ না এবং খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার করছ না? আমার প্রিয় ভাইয়েরা, শোন। এই দুনিয়ার চোখে যারা গরীব, ঈমানে ধনী হবার জন্য আল্লাহ্‌ কি তাদের বেছে নেন নি? যারা আল্লাহ্‌কে মহব্বত করে তাদের তিনি যে রাজ্য দেবার ওয়াদা করেছেন সেই রাজ্যের অধিকারী হবার জন্য এই গরীব লোকদের কি তিনি বেছে নেন নি? অথচ সেই গরীর লোকদেরই তোমরা অপমান করেছ। কিন্তু ধনী লোকেরাই কি তোমাদের কষ্ট দেয় না এবং আদালতে টেনে নিয়ে যায় না? যাঁর নাম অনুসারে তোমাদের ডাকা হয় ধনীরা কি সেই সম্মানিত নামের বিরুদ্ধে কুফরী করে না? পাক-কিতাবে লেখা আছে, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।” তোমরা যদি সত্যিই মসীহের রাজ্যের এই আইন মেনে চল তবে ভালই করছ। কিন্তু তোমরা যদি সবাইকে সমান চোখে না দেখ তবে তোমরা গুনাহ্‌ করছ। এই আইনই তখন তোমাদের আইন্তঅমান্যকারী বলে দোষী করে। যে লোক সমস্ত শরীয়ত পালন করেও মাত্র একটা বিষয়ে গুনাহ্‌ করে সে সমস্ত শরীয়ত অমান্য করেছে বলতে হবে। যিনি বলেছেন, “জেনা কোরো না,” তিনিই আবার বলেছেন, “খুন কোরো না।” তাহলে যদি তোমরা জেনা না করে খুন কর তবে কি তোমরা আইন্তঅমান্যকারী হলে না? যে আইন মানুষকে স্বাধীনতা দান করে সেই আইন দ্বারা যাদের বিচার করা হবে, তাদের মতই কথা বল ও চলাফেরা কর; কারণ যে দয়া করে নি, বিচারের সময়ে সেও দয়া পাবে না। বিচারের উপর দয়া জয়লাভ করে। আমার ভাইয়েরা, যদি কেউ বলে তার ঈমান আছে কিন্তু কাজে তা না দেখায় তবে তাতে কি লাভ? সেই ঈমান কি তাকে নাজাত করতে পারে? ধরে নাও, তোমাদের কোন ভাই কিংবা বোনের ঘরে খাবারও নেই, পরবার কাপড়ও নেই। এই অবস্থায় যদি তোমাদের কেউ তাকে বলে, “তোমার ভাল হোক, খেয়ে-পরে ভাল থাক,” অথচ তার অভাব মিটাবার কোন ব্যবস্থাই না করে তবে তাতে তার কি উপকার হবে? ঠিক সেইভাবে, যে ঈমানের সংগে কাজ যুক্ত নেই সেই ঈমান মৃত। কেউ হয়তো বলতে পারে, “তোমার ঈমান আছে আর আমার আছে সৎ কাজ।” খুব ভাল কথা। কাজ ছাড়া তোমার ঈমান আমাকে দেখাও আর আমি কাজের মধ্য দিয়ে আমার ঈমান তোমাকে দেখাব। তুমি বিশ্বাস কর যে আল্লাহ্‌ এক, তাই না? খুব ভাল! কিন্তু ভূতেরাও তো তা বিশ্বাস করে এবং ভয়ে কাঁপে। হায় মূর্খ! কাজ ছাড়া ঈমান যে নিষ্ফল তার প্রমাণ কি তুমি চাও? আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম যখন তাঁর ছেলে ইসহাককে কোরবানগাহের উপর কোরবানী দিয়েছিলেন তখন কি সেই কাজের জন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় নি? তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ যে, তাঁর ঈমান ও কাজ সেই সময় একসংগে কাজ করছিল এবং তাঁর কাজই তাঁর ঈমানকে পূর্ণতা দান করেছিল। এইভাবে পাক-কিতাবের এই কথা পূর্ণ হয়েছিল, “ইব্রাহিম আল্লাহ্‌র কথার উপর ঈমান আনলেন আর সেইজন্য আল্লাহ্‌ তাকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” সেইজন্য তাঁকে আল্লাহ্‌র বন্ধু বলে ডাকা হয়েছিল। তাহলে তোমরা দেখতে পাচ্ছ, কেবল মাত্র ঈমানের জন্যই যে আল্লাহ্‌ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন তা নয়, কিন্তু ঈমান এবং কাজ এই দু’য়ের জন্যই আল্লাহ্‌ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন। আর বেশ্যা রাহবকে কিভাবে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছিল? তিনি ইহুদী গোয়েন্দাদের লুকিয়ে রেখে পরে অন্য পথ দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, আর এই কাজের জন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রাণ ছাড়া শরীর যেমন মৃত ঠিক তেমনি কাজ ছাড়া ধার্মিকও মৃত। আমার ভাইয়েরা, তোমাদের মধ্যে সকলেই ওস্তাদ হতে যেয়ো না, কারণ তোমরা তো জান, আমরা ওস্তাদ বলে অন্যদের চেয়ে আমাদের আরও কঠিন ভাবে বিচার করা হবে। আমরা সবাই নানা ভাবে অন্যায় করে থাকি। যদি কেউ কথা দ্বারা অন্যায় না করে তবে সে নির্দোষ; তার সারা শরীরকে সে সামলাতে পারে। ঘোড়াকে বশে রাখবার জন্য আমরা তার মুখে লাগাম দিই, আর তখন তাকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে চালিয়ে নিতে পারি। আবার দেখ, জাহাজ যদিও অনেক বড় আর জোর বাতাস সেটা ঠেলে নিয়ে যায় তবুও মাত্র ছোট একটা হাল দিয়ে নাবিক সেটাকে যেদিকে খুশী সেই দিকে নিয়ে যেতে পারে। জিভ্‌ও তেমনি; শরীরের একটা ছোট অংশ হলেও তা অনেক বড় বড় কথা বলে। আবার অল্প একটুখানি আগুন কিভাবে একটা বড় জংগলকে জ্বালিয়ে ফেলতে পারে! তেমনি জিভ্‌ও ঠিক আগুনের মত। আমাদের শরীরে যতগুলো অংশ আছে তাদের মধ্যে জিভ্‌ যেন একটা খারাপীর দুনিয়া। জাহান্নামের আগুনে জ্বলে উঠে সে গোটা শরীরকেই নষ্ট করে এবং জীবন্তপথে আগুন ধরিয়ে দেয়। মানুষ সব রকম পশু, পাখী, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও সাগরের প্রাণীকে দমন করে রাখতে পারে এবং রেখেছে, কিন্তু কোন মানুষ জিভ্‌কে দমন করে রাখতে পারে না। ওটা অস্থির ও খারাপ এবং ভয়ংকর বিষে ভরা। এই জিভ্‌ দিয়ে আমরা আমাদের প্রভু ও পিতার প্রশংসা করি, আবার এই জিভ্‌ দিয়ে আল্লাহ্‌র মত করে গড়া মানুষকে বদদোয়া দিই। আমাদের একই মুখ দিয়ে প্রশংসা আর বদদোয়া বের হয়ে আসে। আমার ভাইয়েরা, এই রকম হওয়া উচিত নয়। একই জায়গা থেকে বের হয়ে আসা স্রোতের মধ্যে কি একই সময়ে মিষ্টি আর তেতো পানি থাকে? আমার ভাইয়েরা, ডুমুর গাছে কি জলপাই ধরে? কিংবা আংগুর লতায় কি ডুমুর ধরে? তেমনি করে নোনা পানির মধ্যে মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না। তোমাদের মধ্যে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান কে? সে তার সৎ জীবন দিয়ে জ্ঞান থেকে বের হয়ে আসা নম্রতা-ভরা কাজ দেখাক। কিন্তু তোমাদের দিল যদি হিংসায় তেতো হয়ে ওঠে এবং স্বার্থপরতায় ভরা থাকে তবে জ্ঞানের গর্ব কোরো না, সত্যকে মিথ্যা বানায়ো না। এই রকম জ্ঞান বেহেশত থেকে নেমে আসে না, বরং দুনিয়ার, খারাপ ইচ্ছার এবং ভূতদের সংগেই তার সম্বন্ধ; কারণ যেখানে হিংসা ও স্বার্থপরতা থাকে সেখানেই গোলমাল ও সব রকমের অন্যায় থাকে। কিন্তু যে জ্ঞান বেহেশত থেকে আসে তা প্রথমতঃ খাঁটি, তারপর শান্তিপূর্ণ; তাতে থাকে সহ্যগুণ ও নম্রতা; তা মমতা ও সৎ কাজে পূর্ণ, স্থির ও ভণ্ডামিশূন্য। যারা শান্তির চেষ্টা করে তারা শান্তিতে বীজ বোনে এবং তার ফল হল সৎ জীবন। তোমাদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি কোথা থেকে আসে? যে সব কামনা-বাসনা তোমাদের শরীরের মধ্যে যুদ্ধ করে তার মধ্য থেকেই কি সেগুলো বের হয়ে আসে না? তোমরা কামনা কর, কিন্তু পাও না। তোমরা খুন কর এবং লোভ কর, কিন্তু যা চাও তা পাও না। তোমরা ঝগড়া ও মারামারি কর, তবুও তোমাদের কিছুই থাকে না, কারণ তোমরা আল্লাহ্‌র কাছে চাও না। তোমরা চেয়েও পাও না, কারণ তোমরা খারাপ উদ্দেশ্যে চেয়ে থাক, যেন তোমাদের কামনা-বাসনা তৃপ্ত হয়। বেঈমান লোকেরা! তোমরা কি জান না, দুনিয়ার বন্ধু হওয়া মানে আল্লাহ্‌র শত্রু হওয়া? সেইজন্য যে কেউ দুনিয়ার বন্ধু হতে ইচ্ছা করে সে নিজেকে আল্লাহ্‌র শত্রু করে তোলে। তোমরা কি মনে কর যে, পাক-কিতাব মিথ্যাই এই কথা বলে যে, পাক-রূহ্‌, যাঁকে আল্লাহ্‌ আমাদের দিলে দিয়েছেন, তিনি আমাদের এবাদত পাওয়ার জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করে আছেন? কিন্তু আল্লাহ্‌র রহমত আরও বেশী। সেইজন্য কিতাবে লেখা আছে, “আল্লাহ্‌ অহংকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কিন্তু নম্রদের রহমত করেন।” এইজন্য আল্লাহ্‌র অধীনে থাক। ইবলিসকে রুখে দাঁড়াও, তাহলে সে তোমাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। আল্লাহ্‌র কাছে এগিয়ে যাও, তাহলে তিনিও তোমাদের কাছে এগিয়ে আসবেন। গুনাহ্‌গারেরা, তোমরা নিজেদের পাক-সাফ কর। দু’মনা লোকেরা, তোমাদের দিল খাঁটি কর। দুঃখে ভেংগে পড় এবং শোক কর ও কাঁদ। তোমাদের হাসির বদলে শোক প্রকাশ কর এবং আনন্দের বদলে দুঃখ কর। প্রভুর সামনে নিজেদের নীচু কর, তাহলে তিনিই তোমাদের তুলে ধরবেন। ভাইয়েরা, তোমরা একে অন্যের নিন্দা কোরো না। যে কেউ ভাইয়ের বিরুদ্ধে কথা বলে বা ভাইয়ের দোষ খুঁজে বেড়ায় সে শরীয়তের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং শরীয়তের দোষ খুঁজে বেড়ায়। যদি তুমি শরীয়তের দোষ খুঁজে বেড়াও তবে তো তুমি তা পালন করছ না বরং তার বিচার করছ। মাত্র একজনই আছেন যিনি শরীয়ত দেন ও বিচার করেন। তিনিই রক্ষা করতে পারেন এবং ধ্বংস করতে পারেন। তুমি কে যে তোমার প্রতিবেশীর দোষ খুঁজে বেড়া"ছ? তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকে, “আজ বা কাল আমরা অমুক শহরে গিয়ে এক বছর কাটাব এবং সেখানে ব্যবসা করে লাভ করব।” কিন্তু কালকে কি হবে তা তোমরা জান না। তোমাদের জীবনই বা কি? তোমরা তো বাষ্প মাত্র, যা কিছুক্ষণের জন্য থাকে আর তারপর মিলিয়ে যায়। তার চেয়ে বরং তোমাদের এই কথা বলা উচিত, “ইন্‌শা-আল্লাহ্‌, আমরা বেঁচে থাকব এবং এটা বা ওটা করব।” তার বদলে দেখা যাচ্ছে, তোমরা খুব অহংকারী ও গর্বে পূর্ণ। এই রকম সব গর্বই খারাপ। তাহলে দেখা যায়, সৎ কাজ করতে জেনেও যে তা না করে সে গুনাহ্‌ করে। ধনীরা, তোমরা শোন। তোমাদের উপর যে কষ্ট আসছে তার জন্য কাঁদ ও হাহাকার কর। তোমাদের ধন নষ্ট হয়ে গেছে এবং তোমাদের কাপড়-চোপড় পোকায় কেটেছে। তোমাদের সোনা ও রূপাতে মরচে ধরেছে, আর সেই মরচে তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং আগুনের মত করে তোমাদের গোশ্‌ত খেয়ে ফেলবে। এই শেষ দিনগুলোতে তোমরা ধন-সম্পত্তি জমা করেছ। তোমাদের ক্ষেতে যে মজুরেরা ফসল কেটেছে তোমরা তাদের মজুরি দাও নি; আর দেখ, সেই মজুরি এখন চিৎকার করে তোমাদের দোষী করছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কানে সেই মজুরদের চিৎকার গিয়ে পৌঁছেছে। এই দুনিয়াতে তোমরা খুব আরামের মধ্যে দিন কাটিয়েছ এবং উ"ছৃংখলতার হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছ। জবাই করবার দিনের জন্য তোমরা নিজেদের কেবল তাজাই করেছ। তোমরা নির্দোষীদের দোষী করেছ এবং হত্যা করেছ, আর তারা তোমাদের বাধা দেয় নি। এইজন্য ভাইয়েরা, যে পর্যন্ত না প্রভু আসেন সেই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে সব সহ্য কর। ক্ষেতের দামী ফসলের জন্য চাষী কেমন ভাবে অপেক্ষা করে এবং প্রথম ও শেষ বর্ষার জন্য ধৈর্য ধরে, তা দেখেছ? তোমরাও তেমনি করে ধৈর্য ধর আর দিল স্থির রাখ, কারণ প্রভু শীঘ্রই আসছেন। ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌ যেন তোমাদের দোষ না ধরেন এইজন্য তোমরা একে অন্যকে দোষ দিয়ো না। দেখ, বিচারকর্তা দরজার কাছাকাছি এসে পড়েছেন। ভাইয়েরা, যে নবীরা প্রভুর পক্ষ হয়ে কথা বলেছেন, কষ্টের সময়ে কিভাবে তাঁরা ধৈর্য ধরতেন সেই কথা চিন্তা করে দেখ। যাঁরা ধৈর্য ধরে সহ্য করেছেন তাঁদের আমরা ধন্য বলি। তোমরা নবী আইয়ুবের ধৈর্যের কথা শুনেছ এবং প্রভুর কাজের শেষ ফল যে ভাল তা-ও দেখেছ। প্রভুর রহমত ও মমতার শেষ নেই। আমার ভাইয়েরা, আমি বিশেষভাবে এই কথা বলি, তোমরা আসমান, জমীন বা অন্য কোন জিনিসের নামে কসম খেয়ো না। তার চেয়ে বরং তোমাদের “হ্যাঁ,” “হ্যাঁ”-ই হোক এবং “না,” “না”-ই হোক, যেন তোমরা বিচারের দায়ে না পড়। তোমাদের মধ্যে কেউ কি কষ্টভোগ করছে? সে মুনাজাত করুক। কেউ কি সুখী? সে প্রশংসা-কাওয়ালী করুক। কেউ কি অসুস্থ? সে জামাতের প্রধান নেতাদের ডাকুক। তাঁরা প্রভুর নামে তাঁর মাথায় তেল দিয়ে তার জন্য মুনাজাত করুন। বিশ্বাসপূর্ণ মুনাজাত সেই অসুস্থ লোককে সুস্থ করবে; প্রভুই তাকে ভাল করবেন। সে যদি গুনাহ্‌ করে থাকে তবে আল্লাহ্‌ তাকে মাফ করবেন। এইজন্য তোমরা একে অন্যের কাছে গুনাহ্‌ স্বীকার কর এবং একে অন্যের জন্য মুনাজাত কর, যেন তোমরা সুস্থ হতে পার। আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত যে চলে তার মুনাজাতের জোর আছে বলে তা ফল দেয়। নবী ইলিয়াস আমাদের মতই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি আকুল ভাবে মুনাজাত করলেন যেন বৃষ্টি না হয়, আর সাড়ে তিন বছর দেশে বৃষ্টি হয় নি। পরে তিনি আবার মুনাজাত করলেন; তখন আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ল আর মাটিতে ফসল হল। আমার ভাইয়েরা, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ সত্য থেকে দূরে সরে যায় আর তোমরা কেউ তাকে ফিরিয়ে আন, তবে এই কথা জেনে রেখো- যদি কেউ একজন গুনাহ্‌গারকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনে তবে সে তাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করে এবং অনেক গুনাহ্‌ ঢেকে রাখে। আল্লাহ্‌র যে সব বাছাই করা বান্দা পন্ত, গালাতিয়া, কাপ্পাদকিয়া, এশিয়া ও বিথুনিয়া প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশী হিসাবে বাস করছে, তাদের কাছে আমি ঈসা মসীহের সাহাবী পিতর এই চিঠি লিখছি। পিতা আল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে তোমাদের বেছে নিয়েছেন, আর পাক-রূহ্‌ তোমাদের পবিত্র করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, যাতে তোমরা ঈসা মসীহের বাধ্য হও আর তাঁর রক্ত ছিটানোর দ্বারা তোমাদের পাক-সাফ করা হয়। আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রচুর রহমত ও শান্তি দান করুন। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের আল্লাহ্‌ এবং পিতার প্রশংসা হোক। ঈসা মসীহ্‌কে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রচুর মমতায় আমাদের নতুন জন্ম দান করেছেন। তার ফলে আমরা একটা জীবন্ত আশ্বাস পেয়েছি, অর্থাৎ ভবিষ্যতে এমন একটা সম্পত্তি পাবার আশ্বাস আমরা পেয়েছি যা কখনও ধ্বংস হবে না, যাতে খারাপ কিছু থাকবে না এবং যা চিরকাল নতুন থাকবে। এই সম্পত্তি তোমাদের জন্য বেহেশতে জমা করা আছে। তোমরা সম্পূর্ণভাবে নাজাত না পাওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্‌র শক্তিতে ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমাদের নিরাপদে রাখা হচ্ছে। শেষ সময়ে প্রকাশিত হবার জন্য সেই নাজাতের আয়োজন করে রাখা হয়েছে। অবশ্য যদিও কিছুকালের জন্য নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে হয়তো এখন তোমাদের দুঃখ পেতে হচ্ছে, তবুও নাজাত পাবার আশায় তোমাদের মন আনন্দে ভরে উঠছে। এই সব পরীক্ষা আসে যেন তোমাদের ঈমান খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়, আর তার ফলে ঈসা মসীহ্‌ প্রকাশিত হবার সময়ে তোমরা প্রশংসা, গৌরব ও সম্মান পাও। যে সোনা ক্ষয় হয়ে যাবে তাকেও আগুনে খাঁটি করে নেওয়া হয়; কিন্তু তোমাদের ঈমানের দাম তো সেই সোনার চেয়ে আরও বেশী। যদিও তোমরা মসীহ্‌কে দেখ নি তবুও তোমরা তাঁকে মহব্বত কর; যদিও এখন তোমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছ না তবুও তোমরা তাঁর উপর বিশ্বাস করছ, আর যে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ও যা বেহেশতী মহিমায় পরিপূর্ণ, সেই আনন্দে তোমরা আনন্দিত হচ্ছ; কারণ তোমাদের ঈমানের শেষ ফল তোমরা পেতে যাচ্ছ, আর তা হল তোমাদের সম্পূর্ণ নাজাত। যে দোয়া তোমাদের পাবার কথা তার বিষয়ে যে সব নবীরা অনেক আগে বলে গেছেন, তাঁরা এই নাজাতের বিষয় জানবার জন্য অনেক খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন এবং জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তাঁদের দিলে মসীহের রূহ্‌ আগেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন যে, মসীহ্‌কে কষ্টভোগ করতে হবে ও তারপর তিনি মহিমা লাভ করবেন। নবীরা জানতে চেয়েছিলেন মসীহের সেই রূহ্‌ কোন্‌ সময় এবং কোন্‌ অবস্থার কথা তাঁদের জানাচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যে সব কথা বলছিলেন তার দ্বারা তাঁরা নিজেদের সেবা না করে তোমাদের সেবাই করছিলেন। বেহেশত থেকে পাঠানো পাক-রূহের পরিচালনায় যাঁরা তোমাদের কাছে মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করেছেন তাঁরা নবীদের সেই সব কথাই তোমাদের জানিয়েছেন। এমন কি, ফেরেশতারা পর্যন্ত এই সব বিষয়ে জানতে আগ্রহী। এইজন্য তোমাদের মনকে জাগিয়ে তোল ও নিজেদের দমনে রাখ। ঈসা মসীহ্‌ যখন প্রকাশিত হবেন তখন তোমরা যে দোয়া পাবে সেই দোয়া পাওয়ার পূর্ণ আশা নিয়ে অপেক্ষা কর। আল্লাহ্‌র বাধ্য সন্তান হিসাবে তোমরা তোমাদের আগেকার খারাপ ইচ্ছা অনুসারে জীবন কাটায়ো না; তখন তো তোমরা আল্লাহ্‌কে চিনতে না। তার চেয়ে বরং যিনি তোমাদের ডেকেছেন তিনি যেমন পবিত্র, তোমরাও তোমাদের সমস্ত চালচলনে ঠিক তেমনি পবিত্র হও। পাক-কিতাবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আমি পবিত্র বলে তোমাদেরও পবিত্র হতে হবে।” আল্লাহ্‌ প্রত্যেক মানুষের কাজ অনুসারে তার বিচার করেন, কারও মুখের দিকে চেয়ে তা করেন না। এইজন্য তাঁকে যদি তোমরা পিতা বলে ডাক তবে এই দুনিয়াতে যতদিন বিদেশী হিসাবে আছ ততদিন তাঁর প্রতি ভয়ে তোমাদের জীবন কাটাও। তোমরা জান, জীবন পথে চলবার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বাজে আদর্শ থেকে সোনা বা রূপার মত ক্ষয় হয়ে যাওয়া কোন জিনিস দিয়ে তোমাদের মুক্ত করা হয় নি; তোমাদের মুক্ত করা হয়েছে নির্দোষ ও নিখুঁত মেষ-শাবক ঈসা মসীহের অমূল্য রক্ত দিয়ে। দুনিয়া সৃষ্টির আগেই আল্লাহ্‌ এর জন্য তাঁকে ঠিক করে রেখেছিলেন, কিন্তু এই শেষ সময়ে তোমাদের জন্যই তিনি প্রকাশিত হয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করে তুলে মহিমা দান করেছেন এবং তাঁরই মধ্য দিয়ে তোমরা আল্লাহ্‌র উপরে ঈমান এনেছ; আর সেইজন্যই তোমাদের ঈমান ও আশা আল্লাহ্‌র উপরেই আছে। এখন সত্যকে মেনে নিয়ে তোমরা তোমাদের দিলকে পাক-সাফ করেছ, আর সেইজন্য ঈমানদার ভাইয়েরা তোমাদের কাছে এত প্রিয়। তাই বলি, তোমরা একে অন্যকে দিল দিয়ে গভীর ভাবে মহব্বত কোরো। যে বীজ ধ্বংস হয়ে যায় এমন কোন বীজ থেকে তোমাদের নতুন জন্ম হয় নি, বরং যে বীজ কখনও ধ্বংস হয় না তা থেকেই তোমাদের জন্ম হয়েছে। সেই বীজ হল আল্লাহ্‌র জীবন্ত ও চিরস্থায়ী কালাম। পাক-কিতাবে লেখা আছে, সব মানুষ ঘাসের মত, আর ঘাসের ফুলের মতই তাদের সব সৌন্দর্য; ঘাস শুকিয়ে যায়, আর ফুলও ঝরে যায়, কিন্তু প্রভুর কালাম চিরকাল থাকে। আর এই কালামই সেই সুসংবাদ, যা তোমাদের কাছে তবলিগ করা হয়েছে। এইজন্য অন্যদের ক্ষতি করবার সব রকম ইচ্ছা, সব রকম ছলনা, ভণ্ডামি, হিংসা এবং সব রকম নিন্দার কথাবার্তা তোমাদের দিল থেকে দূর করে দাও। এইমাত্র জন্মেছে এমন শিশুর মত তোমাদের রূহানি বৃদ্ধির জন্য খাঁটি দুধ পেতে তোমরা খুব আগ্রহী হও, যেন তার দ্বারা বেড়ে উঠতে উঠতে তোমরা নাজাতের পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পার। প্রভুর দয়ার স্বাদ তো তোমরা পেয়েছ। পাক-কিতাবে লেখা আছে, দেখ, একটা খুব দামী পাথর আমি বেছে নিয়েছি; আর সেটা সিয়োনের কোণের ভিত্তির পাথর হিসাবে স্থাপন করেছি। যে তাঁর উপরে ঈমান আনে সে কোনমতেই নিরাশ হবে না। এইজন্য তোমরা ঈমান এনেছ বলে তোমাদের কাছে সেই পাথর খুব মূল্যবান; কিন্তু যারা ঈমান আনে নি তাদের পক্ষে কিতাবের এই কথাটা খাটে, রাজমিস্ত্রিরা যে পাথরটা বাতিল করে দিয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে দরকারী পাথর হয়ে উঠল। আবার কিতাবের এই কথাও খাটে, সেটা এমন পাথর যাতে লোকে উচোট খাবে, আর যা লোকের উচোট খাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। লোকে আল্লাহ্‌র কালাম অমান্য করে বলেই উচোট খায়, আর এরই জন্য তারা ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু তোমরা তো “বাছাই করা বংশ হয়েছ; তোমাদের দিয়ে গড়া হয়েছে ইমামদের রাজ্য; তোমরা পবিত্র জাতি ও তাঁর নিজের বান্দা হয়েছ;” যেন অন্ধকার থেকে যিনি তোমাদের তাঁর আশ্চর্য নূরের মধ্যে ডেকে এনেছেন তোমরা তাঁরই গুণগান কর। এক সময় তোমরা আল্লাহ্‌র বান্দা ছিলে না, কিন্তু এখন হয়েছ; এক সময় তোমরা মমতা পাও নি, কিন্তু এখন পেয়েছ। প্রিয় বন্ধুরা, এই দুনিয়াতে তোমরা বিদেশী এবং পরদেশে অল্পকাল বাসকারী বলে আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি যে, তোমরা গুনাহ্‌-স্বভাবের কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাক, কারণ সেগুলো তোমাদের রূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আল্লাহ্‌কে যারা জানে না তাদের মধ্যে তোমরা সৎ ভাবে চল যাতে অন্যায়কারী বলে তারা তোমাদের নিন্দা করলেও তোমাদের ভাল কাজগুলো লক্ষ্য করে এবং রোজ হাশরে তোমাদের সেই কাজগুলোর জন্য আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে। তোমরা প্রভুর প্রতি বাধ্য হয়ে মানুষের নিযুক্ত শাসনকর্তাদের অধীনতা স্বীকার কর। সম্রাট সকলের প্রধান বলে তাঁর অধীনে থাক; অন্যায়কারীদের শাস্তি দেবার জন্য এবং যারা ভাল কাজ করে তাদের প্রশংসা করবার জন্য সম্রাট যে শাসনকর্তাদের পাঠান তাঁদেরও অধীনে থাক। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এই যে, তোমরা যেন ভাল কাজ করে মুর্খ লোকদের বুদ্ধিহীন কথাবার্তা বন্ধ করে দাও। স্বাধীন লোক হিসাবে জীবন কাটাও, কিন্তু দুষ্টতা ঢাকবার জন্য সেই স্বাধীনতা ব্যবহার কোরো না। তার বদলে আল্লাহ্‌র গোলাম হিসাবে জীবন কাটাও। সব লোককে সম্মান কর, তোমাদের ঈমানদার ভাইদের মহব্বত কর, আল্লাহ্‌কে ভয় কর, সম্রাটকে সম্মান কর। বাড়ীর চাকর-বাকরেরা, তোমরা তোমাদের মালিকদের সম্মান করে তাঁদের অধীনে থাক। যে মালিকেরা ভাল ও দয়ালু কেবল যে তাঁদের অধীনতা স্বীকার করবে তা নয়, কিন্তু যাঁরা কর্কশ ব্যবহার করেন তাঁদেরও অধীনতা স্বীকার কর। যদি কেউ অন্যায় ভাবে কষ্ট ভোগ করে এবং আল্লাহ্‌কে মনে রেখে তা সহ্য করে তবে সে আল্লাহ্‌র চোখে প্রশংসার যোগ্য। অন্যায় কাজের জন্য মার খেয়ে যদি তোমরা তা সহ্য কর তবে তাতে প্রশংসা করবার কি আছে? কিন্তু ভাল কাজ করেও যদি তোমরা তার জন্য কষ্ট পেয়ে তা সহ্য কর, তবে সেটাই আল্লাহ্‌র চোখে প্রশংসার যোগ্য। এরই জন্য আল্লাহ্‌ তোমাদের ডেকেছেন, কারণ মসীহ্‌ তোমাদের জন্য কষ্ট ভোগ করে তোমাদের কাছে আদর্শ রেখে গেছেন, যেন তোমরাও তাঁরই মত চল, যিনি কোন গুনাহ্‌ করেন নি কিংবা যাঁর মুখে কোন ছলনার কথা ছিল না। লোকে তাঁকে যখন অপমান করেছে তখন তিনি তাদের ফিরে অপমান করেন নি, আর কষ্টভোগের সময় প্রতিশোধ নেবার ভয়ও দেখান নি, বরং যিনি ন্যায়বিচার করেন তাঁর হাতে তিনি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ক্রুশের উপরে নিজের শরীরে আমাদের গুনাহের বোঝা বইলেন, যেন আমরা গুনাহের দাবি-দাওয়ার কাছে মরে আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলবার জন্য বেঁচে থাকি। তাঁর গায়ের ক্ষত তোমাদের সুস্থ করেছে। ভুল পথে যাওয়া ভেড়ার মত তোমরাও ভুল পথে যাচ্ছিলে, কিন্তু যে পালক তোমাদের দিলের দেখাশোনা করেন তোমরা তাঁর কাছে ফিরে এসেছ। সেইভাবে তোমরা যারা স্ত্রী, তোমরা প্রত্যেকে স্বামীর অধীনতা মেনে নাও, যেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌র কালামে ঈমান না আনলেও তোমাদের চালচলন মসীহের দিকে তাদের টানে। এতে তোমাদের একটি কথাও বলতে হবে না, কারণ তারা নিজেরাই তোমাদের পবিত্র জীবন আর আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় দেখতে পাবে। নানা রকম চুলের বেণী, গয়নাগাটি বা সুন্দর সুন্দর কাপড়- এই সব বাইরের সাজ-পোশাক দিয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ো না, বরং যার সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাবে না সেই নরম ও শান্ত স্বভাব দিয়ে তোমাদের দিলকে সাজাও। আল্লাহ্‌র চোখে সেটাই বেশী দামী। আগেকার যে আল্লাহ্‌ভক্ত স্ত্রীলোকেরা আল্লাহ্‌র উপরে আশা রাখতেন তাঁরা নিজের নিজের স্বামীর অধীনে থেকে এভাবেই নিজেদের সাজাতেন; যেমন বিবি সারা নবী ইব্রাহিমের বাধ্য ছিলেন এবং তাঁকে প্রভু বলে ডাকতেন। তোমরা যদি কোন রকম ভয়কে নিজের উপর কাজ করতে না দিয়ে যা ভাল তা-ই কর তবে এটাই প্রমাণ হবে যে, তোমরা বিবি সারার যোগ্য সন্তান। ঠিক সেইভাবে তোমরা যারা স্বামী, তোমরা বুদ্ধি-বিবেচনা করে স্ত্রীর সংগে বাস কর। তারা তোমাদের দুর্বল সাথী, আর তারাও তোমাদের সংগে আল্লাহ্‌র রহমতের দান হিসাবে জীবন পাবে। সেইজন্য তাদের সম্মান কোরো যেন তোমাদের মুনাজাত বাধা না পায়। শেষে বলি, তোমাদের সকলের মন যেন একই রকম হয়। তোমরা একে অন্যের দুঃখে দুঃখ বোধ কর, ভাইয়ের মত ভালবাসার ভাব রাখ এবং দয়ালু ও নম্র হও। অন্যায়ের বদলে কারও উপর অন্যায় কোরো না বা কেউ গালাগালি দিলে তাকে ফিরে গালাগালি দিয়ো না, বরং তাদের জন্য দোয়া চেয়ো; কারণ দোয়া পাবার জন্যই আল্লাহ্‌ তোমাদের ডেকেছেন। পাক-কিতাবে লেখা আছে, যে সুখী জীবন কাটাতে চায় আর সুদিন দেখবার আশা করে, খারাপ কথা থেকে তার জিভ্‌কে, ছলনার কথা থেকে তাঁর ঠোঁটকে সে সামলাক। খারাপ কাজ থেকে সে দূরে থাকুক, আর ভাল কাজ করুক; শান্তির জন্য আগ্রহী হয়ে সে তার পিছু না ছাড়ুক। যারা ন্যায়ের পথে চলে তাদের উপর মাবুদের চোখ আছে, তাদের মুনাজাত শুনবার জন্য তাঁর কান খোলাই রয়েছে; কিন্তু যারা খারাপ কাজ করে, মাবুদ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ভাল কাজ করতে যদি তোমাদের আগ্রহ থাকে তবে কে তোমাদের ক্ষতি করবে? আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত চলতে গিয়ে যদি তোমাদের কষ্টভোগও করতে হয়, তবে ধন্য তোমরা। যারা তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দেয় তাদের তোমরা ভয় কোরো না বা দুঃখ-কষ্টের সময়ে অস্থির হয়ো না, বরং মসীহ্‌কে তোমাদের দিলে প্রভু হিসাবে স্থান দাও। তোমাদের আশা-ভরসা সম্বন্ধে যদি কেউ প্রশ্ন করে তবে তাকে উত্তর দেবার জন্য সব সময় প্রস্তুত থেকো, কিন্তু এই উত্তর নম্রতা ও ভয়ের সংগে দিয়ো। তোমাদের বিবেক পরিষ্কার রেখো, যেন মসীহের লোক হিসাবে তোমাদের ভাল চালচলনের যারা নিন্দা করে তারা তোমাদের নিন্দা করেছে বলে লজ্জা পায়। খারাপ কাজ করে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বরং আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ভাল কাজ করে কষ্ট পাওয়া অনেক ভাল। অনেক দিন আগে নবী নূহের সেই জাহাজ তৈরীর সময়ে আল্লাহ্‌ যখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন তখন যারা অবাধ্য হয়েছিল এই রূহ্‌গুলো তাদেরই। সেই জাহাজে উঠে মাত্র অল্প কয়েকজন, অর্থাৎ মাত্র আটজন সেই পানির মধ্য থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এটা হল তরিকাবন্দীর একটা ছবি যা এখন তোমাদের নাজাত দেয়। তরিকাবন্দী যে তোমাদের শরীর থেকে ময়লা দূর করে তা নয়; আল্লাহ্‌র কাছে এটা একটা পরিষ্কার বিবেকের সাড়া। ঈসা মসীহের মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে তোমাদের নাজাত দেওয়া হয়। মসীহ্‌ বেহেশতে গেছেন এবং এখন আল্লাহ্‌র ডান দিকে আছেন, আর আসমানের ফেরেশতারা, ক্ষমতার অধিকারীরা ও শাসনকর্তারা তাঁর অধীনে আছেন। সেইজন্য মসীহ্‌ শরীরে কষ্ট সহ্য করেছিলেন বলে তোমরাও নিজেদের দিলে সেই একই মনোভাব গড়ে তোল, কারণ শরীরে যে কষ্ট ভোগ করেছে সে গুনাহের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে। তার ফলে এই দুনিয়ার বাকী জীবনটা সে আর দুনিয়ার কামনা-বাসনা তৃপ্ত করে কাটায় না, বরং আল্লাহ্‌র ইচ্ছা পালন করেই কাটায়। যারা আল্লাহ্‌কে জানে না তাদের মত তোমরাও আগে লমপটতা করে, খারাপ কামনা-বাসনার মধ্যে থেকে, মাতলামি করে, হৈ-হল্লা করে মদ খেয়ে ও খাওয়া-দাওয়া করে এবং জঘন্য প্রতিমাপূজা করে অনেক সময় কাটাতে। কিন্তু এখন সেই লোকেরাই দেখে আশ্চর্য হয় যে, তোমরা তাদের সেই ভীষণ উ"ছৃঙ্খলতায় আর যোগ দিচ্ছ না, আর সেইজন্য তারা তোমাদের বিরুদ্ধে নিন্দার কথা বলে। কিন্তু যিনি জীবিত ও মৃত সকলের বিচার করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন তাঁর কাছে তাদের হিসাব দিতে হবে। মৃতদের কাছেও তো সেইজন্য মসীহের বিষয়ে সুসংবাদ তবলিগ করা হয়েছিল, যেন শরীরের দিক থেকে মানুষের মতই তাদের বিচার হলেও রূহে তারা আল্লাহ্‌র মত জীবিত থাকতে পারে। এখন সব কিছুর শেষ সময় কাছে এসে গেছে। সেইজন্য তোমাদের মন স্থির কর এবং নিজেদের দমনে রাখ যেন মুনাজাত করতে পার। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, তোমরা একে অন্যকে গভীর ভাবে মহব্বত কোরো, কারণ মহব্বত অনেক গুনাহ্‌কে ঢেকে রাখে। কোন রকম বিরক্তি প্রকাশ না করে তোমরা একে অন্যকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ কর। বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত আল্লাহ্‌র রহমত পেয়ে যে লোক বিশ্বস্ত ভাবে তা কাজে লাগিয়েছে, সেই রকম লোক হিসাবে তোমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে যেরকম দান পেয়েছ তা একে অন্যের সেবা করবার জন্য ব্যবহার কর। যদি কেউ প্রচার করে তবে সে এইভাবে প্রচার করুক যেন সে আল্লাহ্‌র নিজের মুখের কথা বলছে। যদি কেউ সেবা করে তবে আল্লাহ্‌র দেওয়া শক্তিতে সে সেবা করুক, যেন ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে সব কিছুতে আল্লাহ্‌ প্রশংসা পান। প্রশংসা ও শক্তি চিরকাল তাঁরই। আমিন। প্রিয় বন্ধুরা, তোমাদের যে এখন অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে আশ্চর্য হয়ে মনে কোরো না যে, তোমাদের উপর অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে। তার চেয়ে বরং তোমরা যে মসীহের দুঃখভোগের ভাগ নি"ছ তাতে আনন্দিত হও, যেন তাঁর মহিমা যখন প্রকাশিত হবে তখন তোমরা আনন্দে পূর্ণ হও। মসীহের জন্য যদি তোমরা অপমানিত হও তবে ধন্য তোমরা, কারণ আল্লাহ্‌র মহিমাপূর্ণ রূহ্‌ তোমাদের উপর আছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ খুনী, চোর, অন্যায়কারী হয়ে বা অন্যায়ভাবে অন্যের ব্যাপারে হাত দিয়ে কষ্ট ভোগ না করুক। কিন্তু ঈসায়ী হিসাবে যদি কেউ কষ্ট ভোগ করে তবে সে লজ্জা না পাক, বরং তার সেই নাম আছে বলে সে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করুক। বিচার শুরু হবার সময় হয়েছে এবং তা আল্লাহ্‌র পরিবারের লোকদের থেকেই শুর করা হবে। আর যদি সেই বিচার আমাদের থেকেই শুরু করা হয় তবে যারা আল্লাহ্‌র দেওয়া সুসংবাদ মেনে নেয় নি তাদের অবস্থা কি হবে? কিতাবে আছে, আল্লাহ্‌ভক্ত লোকের নাজাত পাওয়া যদি এত শক্ত হয়, তবে যারা গুনাহ্‌গার আর আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন, তাদের অবস্থা কি হবে? তাহলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছাতে যারা কষ্টভোগ করছে, তারা তাদের বিশ্বস্ত সৃষ্টিকর্তার হাতে নিজেদের তুলে দিক এবং ভাল কাজ করতে থাকুক। আমি মসীহের দুঃখভোগের সাক্ষী এবং তাঁর যে মহিমা প্রকাশিত হবে তার ভাগী। সেইজন্য তোমাদের মধ্যে যারা জামাতের প্রধান নেতা তাদের আমি আর একজন প্রধান নেতা হিসাবে এই উপদেশ দিচ্ছি- তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্‌র যে ভেড়ার দল আছে তোমরা তার রাখাল হও। দেখাশোনা করতে হবে বলে যে তাদের দেখাশোনা করবে তা নয়, বরং নিজের ইচ্ছাতেই তা কর, কারণ আল্লাহ্‌ তোমাদের কাছে তা-ই চান। লাভের আশায় এই কাজ কোরো না, কিন্তু আগ্রহের সংগে কর; তোমাদের অধীনে যারা আছে তাদের উপর প্রভু হয়ো না, বরং এমন হও যাতে তোমাদের দেখে তারা শিখতে পারে। তাহলে যখন প্রধান রাখাল দেখা দেবেন তখন তোমরা জয়ের মালা হিসাবে তাঁর মহিমার ভাগী হবে, আর তা কখনও ্নান হবে না। সেইভাবে যুবকেরা, তোমরা প্রধান নেতাদের অধীনে থাক। তোমরা সবাই নম্র হয়ে একে অন্যের সেবা কর, কারণ পাক-কিতাবের কথামত, “আল্লাহ্‌ অহংকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কিন্তু নম্রদের রহমত করেন।” সেইজন্য আল্লাহ্‌র ক্ষমতার সামনে নিজেদের নীচু কর, যেন ঠিক সময়ে তিনি তোমাদের উঁচু করেন। তোমাদের সব চিন্তা-ভাবনার ভার তাঁর উপর ফেলে দাও, কারণ তিনি তোমাদের বিষয়ে চিন্তা করেন। নিজেদের দমনে রাখ ও সতর্ক থাক, কারণ তোমাদের শত্রু ইবলিস গর্জনকারী সিংহের মত করে কাকে খেয়ে ফেলবে তার খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। ঈমানে স্থির থেকে ইবলিসকে রুখে দাঁড়াও, কারণ তোমরা তো জান যে, সারা দুনিয়ার মধ্যে তোমাদের ঈমানদার ভাইয়েরা একই রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। যিনি সব রকম ভাবে রহমত করবার আল্লাহ্‌ তিনি তাঁর চিরস্থায়ী মহিমার ভাগী হবার জন্য তোমাদের ডেকেছেন, কারণ মসীহের সংগে তোমরা যুক্ত হয়েছ। তোমরা কিছুদিন কষ্টভোগ করবার পরে আল্লাহ্‌ নিজেই তোমাদের পূর্ণ করবেন ও স্থির রাখবেন, শক্তি দেবেন এবং শক্ত ভিত্তির উপর তোমাদের দাঁড় করাবেন। তাঁর ক্ষমতা চিরকাল থাকুক। আমিন। সীলবান, যাঁকে আমি আমার বিশ্বস্ত ভাই মনে করি, তাঁকে দিয়ে এই চিঠি আমি অল্প কথায় তোমাদের কাছে লিখলাম, যেন আমি তোমাদের উৎসাহ দিতে পারি এবং আল্লাহ্‌র সত্যিকারের রহমতের সাক্ষ্য দিতে পারি। তোমরা আল্লাহ্‌র এই রহমতের মধ্যে স্থির হয়ে বাস কর। আল্লাহ্‌ তোমাদের সংগে যাদের বেছে নিয়েছেন ব্যাবিলনের সেই জামাতের লোকেরা তোমাদের সালাম জানাচ্ছে, আর আমার সন্তান মার্কও তোমাদের সালাম জানাচ্ছে। মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা একে অন্যকে সালাম জানায়ো। তোমরা যারা মসীহের নিজের হয়েছ, তোমাদের শান্তি হোক। আমি শিমোন্তপিতর ঈসা মসীহের একজন গোলাম ও সাহাবী। আমাদের আল্লাহ্‌ ও নাজাতদাতা ঈসা মসীহ্‌ ন্যায়বান, আর সেইজন্য তোমরাও আমাদেরই মত একই অমূল্য ঈমান লাভ করেছ। এইজন্য আমি তোমাদের কাছে এই চিঠি লিখছি। আল্লাহ্‌ ও আমাদের হযরত ঈসাকে গভীর ভাবে জানবার মধ্য দিয়ে তোমাদের উপর প্রচুর রহমত ও শান্তি থাকুক। যিনি তাঁর মহিমা ও তাঁর গুণের দ্বারা আমাদের ডেকেছেন, তাঁকে গভীর ভাবে জানবার মধ্য দিয়েই তাঁর কুদরত আমাদের এমন সব দান দিয়েছে যার দ্বারা আমরা আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়পূর্ণ জীবন কাটাতে পারি। তিনি নিজের মহিমায় ও গুণে আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান ও মহান ওয়াদা করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, মানুষের খারাপ ইচ্ছার দরুন দুনিয়াতে যে সব নোংরামি জমা হয়েছে তা থেকে তোমরা রক্ষা পেয়ে যেন আল্লাহ্‌র স্বভাবের ভাগী হও। এইজন্য খুব আগ্রহী হয়ে তোমাদের ঈমানের সংগে ভাল স্বভাব, ভাল স্বভাবের সংগে জ্ঞান, জ্ঞানের সংগে নিজেকে দমন এবং নিজেকে দমনের সংগে ধৈর্য, ধৈর্যের সংগে আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়, ভয়ের সংগে ভাইদের প্রতি ভালবাসা এবং সেই ভালবাসার সংগে গভীর মহব্বতের মনোভাব যোগ কর। যদি তোমাদের এই সব গুণ থাকে এবং তা উপ্‌চে পড়তে থাকে, তাহলে আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌কে গভীর ভাবে জানবার কাজে তোমরা বিফল ও নিষ্ফল হবে না। যে লোকের ভিতরে এই গুণগুলো নেই সে বেশী দূর দেখতে পায় না, সে অন্ধ। তাকে যে তার আগেকার গুনাহ্‌ থেকে পাক-সাফ করা হয়েছে তা সে ভুলে গেছে। এইজন্য ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌ যে সত্যিই তোমাদের ডেকেছেন এবং বেছে নিয়েছেন তা নিশ্চিত করে তুলবার জন্য আরও বেশী আগ্রহী হও। এই সব করলে তোমরা কখনও উচোট খাবে না। এতে আমাদের প্রভু এবং নাজাতদাতা ঈসা মসীহের চিরস্থায়ী রাজ্যে আগ্রহের সংগে তোমাদের গ্রহণ করা হবে। এইজন্যই আমি সব সময় এই বিষয়গুলো তোমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। অবশ্য তোমরা তো এই সব জানই এবং যে সত্য তোমাদের দিলে আছে তাতে স্থিরও আছ। কিন্তু আমি মনে করি, যতদিন আমি এই তাম্বুর মত অস্থায়ী শরীরে বেঁচে থাকব ততদিন এই বিষয়গুলো মনে করিয়ে দিয়ে তোমাদের জাগিয়ে রাখা আমার উচিত; কারণ আমি যে আর বেশী দিন এই শরীর-তাম্বুতে থাকব না তা আমাদের হযরত ঈসা মসীহ্‌ আমাকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আমার মৃত্যুর পরেও যাতে তোমরা এই সব বিষয় সব সময় মনে রাখ, আমি তার ব্যবস্থা করতে খুব চেষ্টা করব। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের শক্তি ও তাঁর আসবার বিষয় তোমাদের কাছে জানাতে গিয়ে আমরা কোন বানানো গল্প বলি নি; আমরা তাঁর মহিমা নিজেদের চোখেই দেখেছি। “ইনি আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপরে আমি খুব সন্তুষ্ট,” বেহেশত থেকে বলা এই কথার মধ্য দিয়ে মসীহ্‌ পিতা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে সম্মান ও গৌরব লাভ করেছিলেন। আমরা যখন তাঁর সংগে সেই পবিত্র পাহাড়ে ছিলাম তখন বেহেশত থেকে বলা এই কথাগুলো শুনেছিলাম। কিতাবের মধ্যে নবীরা যা বলেছেন তা আমাদের কাছে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। অন্ধকারে যেমন তোমাদের চোখ বাতির দিকে থাকে ঠিক তেমনি করে, যতক্ষণ সকাল না হয় এবং তোমাদের দিলে শুকতারা না ওঠে, ততক্ষণ পর্যন্ত নবীদের কথায় মনোযোগ দিলে তোমরা ভাল করবে। তবে সব কিছুর উপরে এই কথা মনে রেখো যে, কিতাবের মধ্যেকার কোন কথা নবীদের মনগড়া নয়, কারণ নবীরা তাঁদের ইচ্ছামত কোন কথা বলেন নি; পাক-রূহের দ্বারা পরিচালিত হয়েই তাঁরা আল্লাহ্‌র দেওয়া কথা বলেছেন। কিন্তু বনি-ইসরাইলদের মধ্যে যেমন ভণ্ড নবী ছিল তেমনি তোমাদের মধ্যেও ভণ্ড শিক্ষক থাকবে। তারা চুপি চুপি এমন সব ভুল শিক্ষা নিয়ে আসবে যা মানুষকে ধ্বংস করে দেবে; এমন কি, যিনি তাদের কিনেছেন সেই প্রভুকে পর্যন্ত তারা অস্বীকার করবে। এইভাবে তারা শীঘ্রই নিজেদের উপরে ধ্বংস ডেকে আনবে। অনেকেই তাদের দেখাদেখি লমপট হয়ে উঠবে। তাদের জন্যই লোকেরা সত্যের পথের নিন্দা করবে। লোভের বশে ছলনার কথা বলে তারা নিজেদের লাভের জন্য তোমাদের কাজে লাগাবে। তাদের শাস্তি অনেক দিন ধরে তাদের উপরে ঝুলছে, আর তাদের ধ্বংস চুপচাপ বসে নেই। ফেরেশতারা যখন গুনাহ্‌ করেছিল তখন আল্লাহ্‌ তাদের ছেড়ে দেন নি বরং হাবিয়া-দোজখের অন্ধকার গর্তে ফেলে দিয়ে বিচারের জন্য রেখে দিয়েছেন। আর তিনি সেই পুরানো দুনিয়াকেও ছেড়ে দেন নি, বরং আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন লোকদের উপর বন্যা এনেছিলেন; কিন্তু নবী নূহ্‌ এবং অন্য সাতজনকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। নবী নূহ্‌ আল্লাহ্‌-ভয় সম্বন্ধে তবলিগ করতেন। সাদুম এবং আমুরা শহর আগুন দিয়ে ধ্বংস করে আল্লাহ্‌ সেই শহরের লোকদের শাস্তি দিয়েছিলেন এবং এইভাবে তিনি দেখিয়েছিলেন, যারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে না তাদের অবস্থা কি হবে; কিন্তু লুতকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। লুত আল্লাহ্‌ভক্ত লোক ছিলেন। সেখানকার আইন্তঅমান্যকারী লোকদের লমপটতায় তিনি কষ্ট পেতেন। সেই আল্লাহ্‌ভক্ত লোকটি তাদের মধ্যে বাস করে দিনের পর দিন তাদের কাজ দেখতেন ও তাদের কথা শুনতেন, আর শরীয়তের বিরুদ্ধে তাদের কাজ করতে দেখে তাঁর আল্লাহ্‌ভক্ত দিলে খুব বেদনা পেতেন। অথচ ফেরেশতারা শক্তি ও ক্ষমতায় মহান হলেও প্রভুর কাছে তাঁদের সম্বন্ধে এমন কোন নালিশ করেন না যাতে নিন্দার কথা আছে। কিন্তু যে বুদ্ধিহীন জীব-জানোয়ারেরা তাদের স্বাভাবিক ইচ্ছার অধীন এবং ধরে মেরে ফেলবার জন্যই যাদের জন্ম, এই ভণ্ড শিক্ষকেরা তাদেরই মত। তারা যা বোঝে না তার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে। নিজেদের নোংরামির মধ্যেই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের খারাপ কাজের পাওনা হিসাবে তারা কষ্ট ভোগ করবে। এই লোকেরা দিনের বেলায় মেজবানী সভায় হৈ-হল্লা করে মদ খেতে আনন্দ পায়। যখন তারা তোমাদের সংগে খেতে বসে তখন হৈ-হল্লা করে মদ খেতে খেতে তাদের কামনায় তারা সেই খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে লজ্জা ও অসম্মান আনে। তাদের চোখ জেনায় ভরা এবং তারা গুনাহ্‌ কাজ করা কখনও বন্ধ করে না। যারা অস্থিরমনা তাদের তারা লোভ দেখিয়ে ভুল পথে নিয়ে যায়। তাদের দিল কেবল লোভ করতেই শিখেছে। তাদের উপর বদদোয়া রয়েছে। তারা সোজা পথ ছেড়ে ভুল পথে গেছে। তারা বাউরের ছেলে বালামের পথ ধরেছে। বালাম খারাপ কাজের পুরস্কার পেতে চেয়েছিল, কিন্তু তার খারাপ কাজের জন্য সে একটা বোবা গাধার কাছ থেকে ধমক্‌ খেয়েছিল। সেই গাধা মানুষের মত কথা বলে তার পাগলামিতে বাধা দিয়েছিল। এই লোকেরা শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণার মত এবং ঝড়ো হাওয়ায় বয়ে নিয়ে যাওয়া কুয়াশার মত। ভীষণ অন্ধকার তাদের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে। তারা অসার ও বড় বড় কথা বলে এবং মানুষের গুনাহ্‌-স্বভাবের কামনাপূর্ণ ইচ্ছা জাগিয়ে তুলে তারা এমন লোকদের ভুল পথে নিয়ে যায় যারা অন্যায়ের মধ্যে বাসকারী লোকদের মধ্য থেকে বের হয়ে আসবার পথে ছিল। সেই ভণ্ড শিক্ষকেরা সেই লোকদের স্বাধীনতা দেবার ওয়াদা করে বটে, কিন্তু নিজেরা জঘন্য কাজের গোলাম হয়ে থাকে; কারণ কেউ যদি কোন কিছুর কাছে হার মানে তবে সে তার গোলাম হয়। আমাদের প্রভু ও নাজাতদাতা ঈসা মসীহ্‌কে গভীর ভাবে জানবার ফলে দুনিয়ার খারাপী থেকে পালিয়ে গিয়েও যখন তারা আবার সেই একই খারাপীর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে তার কাছে হার মেনেছে, তখন তাদের প্রথম দশা থেকে শেষ দশা আরও খারাপ হয়েছে। যদিও তারা সৎ জীবনের পথ জানত তবুও যে পবিত্র হুকুম তাদের দেওয়া হয়েছিল তা তারা অগ্রাহ্য করেছিল। এই অবস্থায় তাদের পক্ষে বরং ঠিক পথ না জানাই ভাল ছিল। তাদের সম্বন্ধে এই চলতি কথা সত্যি হয়ে উঠেছে, “কুকুর নিজের বমির দিকে ফেরে,” আর “শূকরকে ধোয়ানো হলেও সে কাদায় গড়াগড়ি দেয়।” প্রিয় ভাইয়েরা, তোমাদের কাছে এটাই আমার দ্বিতীয় চিঠি। দু’টা চিঠিতেই আমি তোমাদের কতগুলো বিষয় মনে করিয়ে দিয়ে তোমাদের খাঁটি মনকে নাড়া দেবার চেষ্টা করেছি। পবিত্র নবীরা যে সব কথা আগে বলে গেছেন সেগুলো এবং তোমাদের সাহাবীদের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রভু ও নাজাতদাতা যে হুকুম দিয়ে গেছেন, আমি চাই যেন তোমরা তা মনে রাখ। প্রথমে এই কথা মনে রেখো যে, ভাল বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাই যাদের স্বভাব তারা শেষকালে এসে ঠাট্টা-বিদ্রূপই করবে। তারা নিজেদের কামনা-বাসনা অনুসারেই চলবে, আর বলবে, “তাঁর আসবার যে ওয়াদা ছিল তার কি হল? দুনিয়া সৃষ্টির সময় থেকে যেমন চলছিল ঠিক তেমনি আমাদের পূর্বপুরুষদের মৃত্যুর পর থেকে সব কিছু তো সেই একইভাবে চলছে।” এই লোকেরা ইচ্ছা করেই ভুলে যায় যে, অনেক দিন আগে আল্লাহ্‌র কালামের দ্বারা আসমান সৃষ্ট হয়েছিল এবং পানি দিয়ে ও পানির মধ্য থেকে দুনিয়ারও সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার সেই দুনিয়া বন্যার পানিতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর আল্লাহ্‌র সেই একই কালামের দ্বারা এখনকার আসমান ও দুনিয়া আগুনে পুড়িয়ে দেবার জন্য রাখা হয়েছে; আল্লাহ্‌র প্রতি ভয়হীন লোকদের বিচার ও ধ্বংসের দিন পর্যন্ত তা রক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রিয় ভাইয়েরা, এই কথাটা ভুলে যেয়ো না যে, প্রভুর কাছে এক দিন এক হাজার বছরের সমান এবং এক হাজার বছর এক দিনের সমান। কোন কোন লোক মনে করে প্রভু তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করতে দেরি করছেন, কিন্তু তা নয়। আসলে তিনি তোমাদের প্রতি ধৈর্য ধরছেন, কারণ কেউ যে ধ্বংস হয়ে যায় এটা তিনি চান না, বরং সবাই যেন তওবা করে এটাই তিনি চান। কিন্তু প্রভুর দিন চোরের মত করে আসবে। সেই দিন আসমান হুহু শব্দ করে শেষ হয়ে যাবে এবং চাঁদ-সূর্য-তারা সবই পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তা সবই পুড়ে যাবে। কিন্তু আমরা আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে নতুন আসমান ও নতুন জমীনের জন্য অপেক্ষা করছি। সেখানে সব কিছু আল্লাহ্‌র ইচ্ছামত হবে। প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা এখন এই সবের জন্য অপেক্ষা করছ বলে প্রাণপণ চেষ্টা কর যাতে তিনি এসে তোমাদের নিখুঁত হয়ে নির্দোষ অবস্থায় শান্তিতে বাস করতে দেখতে পান। মনে রেখো, মানুষকে নাজাত পাবার সুযোগ দেবার জন্য আমাদের প্রভু ধৈর্য ধরে আছেন। এই একই কথা আমাদের প্রিয় ভাই পৌলও আল্লাহ্‌র দেওয়া জ্ঞানে তোমাদের কাছে লিখেছেন। তাঁর সব চিঠিতেই তিনি এই সব বিষয় সম্বন্ধে এই একই কথা লিখে থাকেন। সেগুলোর মধ্যে অবশ্য কতগুলো বিষয় আছে যা বোঝা কঠিন। সেইজন্য যারা উম্মত হবার শিক্ষা পায় নি ও যাদের মন অস্থির তারা অন্যান্য কিতাবের মত এগুলোর মানেও ঘুরিয়ে বলে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা এই কথা আগেই জানতে পেরেছ বলে সাবধান হও, যেন এই সব উ"ছৃঙ্খল লোকদের ভুল তোমাদের ভুল পথে নিয়ে না যায়, আর তোমাদের মনের স্থিরতা থেকে তোমরা সরে না পড়। তোমরা আমাদের প্রভু ও নাজাতদাতা ঈসা মসীহের রহমতে ও তাঁর সম্বন্ধে জ্ঞানে বেড়ে উঠতে থাক। এখন এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত তাঁরই গৌরব হোক। আমিন। ॥ভব সেই প্রথম থেকেই যিনি ছিলেন, যাঁর মুখের কথা আমরা শুনেছি, যাঁকে নিজেদের চোখে দেখেছি, যাঁকে ভাল করে লক্ষ্য করেছি, যাঁকে নিজেদের হাতে ছুঁয়েছি, এখানে সেই জীবন্তকালামের কথাই লিখছি। সেই জীবন প্রকাশিত হয়েছিলেন। আমরা তাঁকে দেখেছি এবং তাঁর বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি। যিনি পিতার কাছে ছিলেন আর আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন সেই অনন্ত জীবনের কথাই তোমাদের জানাচ্ছি। যাঁকে আমরা দেখেছি এবং যাঁর মুখের কথা আমরা শুনেছি তাঁর বিষয়েই তোমাদের জানাচ্ছি। আমরা তা জানাচ্ছি যেন তোমাদের ও আমাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ-সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। এই যোগাযোগ হল পিতা ও তাঁর পুত্র ঈসা মসীহ্‌ এবং আমাদের মধ্যে। আমাদের আনন্দ যাতে পরিপূর্ণ হয় সেইজন্যই আমরা এই সমস্ত লিখছি। যে কথা আমরা ঈসা মসীহের কাছ থেকে শুনে তোমাদের জানাচ্ছি তা এই- আল্লাহ্‌ নূর; তাঁর মধ্যে অন্ধকার বলে কিছুই নেই। যদি আমরা বলি যে, আল্লাহ্‌ ও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ আছে অথচ অন্ধকারে চলি তবে আমরা মিথ্যা কথা বলছি, সত্যের পথে চলছি না। কিন্তু আল্লাহ্‌ যেমন নূরে আছেন আমরাও যদি তেমনি নূরে চলি তবে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ থাকে আর তাঁর পুত্র ঈসার রক্ত সমস্ত গুনাহ্‌ থেকে আমাদের পাক-সাফ করে। যদি আমরা বলি আমাদের মধ্যে গুনাহ্‌ নেই তবে আমরা নিজেদের ফাঁকি দিই। তাতে এটাই বুঝা যায় যে, আমাদের অন্তরে আল্লাহ্‌র সত্য নেই। যদি আমরা আমাদের গুনাহ্‌ স্বীকার করি তবে তিনি তখনই আমাদের গুনাহ্‌ মাফ করেন এবং সমস্ত অন্যায় থেকে আমাদের পাক-সাফ করেন, কারণ তিনি নির্ভরযোগ্য এবং কখনও অন্যায় করেন না। যদি বলি আমরা গুনাহ্‌ করি নি তবে আমরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বানাই, আর তাঁর কালাম আমাদের অন্তরে নেই। আমার প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা যাতে গুনাহ্‌ না কর সেইজন্যই আমি তোমাদের কাছে এই সব কথা লিখছি। তবে যদি কেউ গুনাহ্‌ করেই ফেলে তাহলে পিতার কাছে আমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলবার জন্য একজন আছেন; তিনি ঈসা মসীহ্‌, যিনি নির্দোষ। আমাদের গুনাহ্‌ দূর করবার জন্য মসীহ্‌ তাঁর নিজের জীবন কোরবানী করে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করেছেন। কেবল আমাদের গুনাহ্‌ নয়, কিন্তু সমস্ত মানুষের গুনাহ্‌ দূর করবার জন্য তিনি তা করেছেন। যদি আমরা তাঁর সব হুকুম পালন করে চলি তবে আমরা নিশ্চয় করে বুঝি যে, আমরা তাঁকে জানতে পেরেছি। যে বলে “আমি তাঁকে জানি,” অথচ তাঁর হুকুম পালন করে না সে মিথাবাদী; তার মধ্যে সত্য নেই। প্রিয় সন্তানেরা, আমি তোমাদের কাছে কোন নতুন হুকুমের কথা লিখছি না, বরং প্রথম থেকেই যে হুকুম ছিল সেই পুরানো হুকুমের কথাই লিখছি। তোমরা যে কথা আগে শুনেছ সেটাই সেই পুরানো হুকুম। তবে এই যে হুকুমের কথা এখন আমি তোমাদের কাছে লিখছি তা পুরানো হলেও নতুন। এই হুকুমের সত্যতা ঈসা মসীহের মধ্যে ও তোমাদের জীবনে দেখা গেছে, কারণ অন্ধকার কেটে যাচ্ছে এবং সেই আসল নূর এখন জ্বলছে। যে লোক বলে সে নূরে আছে অথচ তার ভাইকে ঘৃণা করে সে এখনও অন্ধকারেই রয়েছে। যে তার ভাইকে মহব্বত করে সে নূরে থাকে এবং তার মধ্যে উচোট খাওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু যে তার ভাইকে ঘৃণা করে সে অন্ধকারে আছে এবং অন্ধকারেই চলাফেরা করছে। সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, কারণ অন্ধকার তার চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা, মসীহের জন্য তোমাদের গুনাহ্‌ মাফ করা হয়েছে বলেই আমি তোমাদের কাছে লিখছি। পিতারা, সেই প্রথম থেকেই যিনি আছেন তোমরা তাঁকে জেনেছ বলেই তোমাদের কাছে লিখছি। যুবকেরা, ইবলিসের উপর তোমরা জয়লাভ করেছ বলেই তোমাদের কাছে লিখছি। ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের কাছে লিখলাম, কারণ তোমরা পিতাকে জান। পিতারা, আমি তোমাদের কাছে লিখলাম, কারণ সেই প্রথম থেকেই যিনি আছেন তোমরা তাঁকে জেনেছ। যুবকেরা, আমি তোমাদের কাছে লিখলাম, কারণ তোমরা বলবান এবং আল্লাহ্‌র কালাম তোমাদের অন্তরে রয়েছে, আর তোমরা ইবলিসের উপর জয়লাভ করেছ। তোমরা দুনিয়া এবং দুনিয়ার কোন কিছু ভালবেসো না। যদি কেউ দুনিয়াকে ভালবাসে তবে সে পিতাকে ভালবাসে না, কারণ দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে- শরীরের কামনা, চোখের লোভ এবং সাংসারিক বিষয়ে অহংকার- এর কোনটাই পিতার কাছ থেকে আসে না, দুনিয়া থেকেই আসে। দুনিয়া ও দুনিয়ার কামনা-বাসনা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আল্লাহ্‌র ইচ্ছা যে পালন করে সে চিরকাল থাকবে। সন্তানেরা, এ-ই শেষ সময়। তোমরা তো শুনেছ যে, দজ্জাল আসছে, কিন্তু তাঁর আরও অনেক দজ্জাল এরই মধ্যে এসে গেছে। তাই আমরা বুঝতে পারছি যে, এ-ই শেষ সময়। এই দজ্জালেরা আমাদের মধ্য থেকে বের হয়ে গেছে। তারা কিন্তু আমাদের লোক ছিল না। যদি তারা আমাদেরই হত তবে আমাদের সংগেই থাকত, কিন্তু তারা বের হয়ে গেছে বলে বুঝা যাচ্ছে, তারা কেউই আমাদের নয়। তোমরা কিন্তু সেই পবিত্রজনের কাছ থেকে অভিষেক পেয়েছ, অর্থাৎ পাক-রূহ্‌কে পেয়েছ এবং তোমরা সকলে সত্যকে জানতে পেরেছ। সত্যকে জান না বলে যে আমি তোমাদের কাছে লিখলাম তা নয়, কিন্তু তোমরা সত্যকে জান এবং এ-ও জান যে, সত্য থেকে মিথ্যা আসে না; আর সেইজন্যই আমি তোমাদের কাছে লিখলাম। যে বলে, ঈসা মসীহ্‌ নন, সে মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কি? পিতা ও পুত্রকে যে অস্বীকার করে সে-ই তো দজ্জাল। পুত্রকে যে অস্বীকার করে তার সংগে পিতার কোন সম্বন্ধ নেই, কিন্তু পুত্রকে যে স্বীকার করে তার সংগে পিতারও সম্বন্ধ আছে। প্রথম থেকে যা তোমরা শুনে আসছ তা যেন তোমাদের অন্তরে থাকে। প্রথম থেকে যা তোমরা শুনে আসছ তা যদি তোমাদের অন্তরে থাকে তবে তোমরা পুত্র ও পিতার সংগে যুক্ত থাকবে। এটাই হল অনন্ত জীবন, যা মসীহ্‌ আমাদের দেবার ওয়াদা করেছেন। যারা তোমাদের বিপথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে তাদের সম্বন্ধে আমি তোমাদের কাছে এই সব লিখলাম। কিন্তু তোমরা মসীহের কাছ থেকে অভিষেক পেয়েছ, অর্থাৎ পাক-রূহ্‌কে পেয়েছ। তিনি তোমাদের অন্তরে থাকেন। এইজন্য অন্য কারও শিক্ষার তোমাদের দরকার নেই। সমস্ত বিষয়ে পাক-রূহ্‌ই তোমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি সত্য, মিথ্যা নন। সেইজন্যই যেভাবে তিনি তোমাদের মসীহের মধ্যে থাকতে শিক্ষা দেন সেইভাবেই মসীহের মধ্যে থাক। সন্তানেরা, তাই বলছি, তোমরা মসীহের মধ্যেই থাক যাতে তিনি যখন প্রকাশিত হবেন তখন আমাদের সাহস থাকে এবং তিনি যখন আসবেন তখন তাঁর সামনে আমাদের লজ্জা পেতে না হয়। যদি তোমরা জান যে, তিনি কখনও অন্যায় করেন না তবে এও জেনে রেখো- যারা ন্যায় কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখে, আল্লাহ্‌ থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে। দেখ, পিতা আমাদের কত মহব্বত করেন! তিনি আমাদের তাঁর সন্তান বলে ডাকেন, আর আসলে আমরা তা-ই। এইজন্য দুনিয়া আমাদের জানে না, কারণ দুনিয়া পিতাকেও জানে নি। প্রিয় সন্তানেরা, এখন আমরা আল্লাহ্‌র সন্তান, কিন্তু পরে কি হব তা এখনও প্রকাশিত হয় নি। তবে আমরা জানি, মসীহ্‌ যখন প্রকাশিত হবেন তখন আমরা তাঁরই মত হব, কারণ তিনি আসলে যা, সেই চেহারাতেই আমরা তাঁকে দেখতে পাব। যে কেউ মসীহের উপর এই আশা রাখে সে নিজেকে খাঁটি করতে থাকে যেমন মসীহ্‌ খাঁটি। যারা গুনাহ্‌ করে তারা আল্লাহ্‌র কালাম অমান্য করে। গুনাহ্‌ হল আল্লাহ্‌র কালাম অমান্য করা। তোমরা তো জান যে, আমাদের গুনাহ্‌ দূর করবার জন্যই মসীহ্‌ প্রকাশিত হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে কোন গুনাহ্‌ নেই। যারা মসীহের মধ্যে থাকে তারা গুনাহে পড়ে থাকে না। যারা গুনাহে পড়ে থাকে তারা মসীহ্‌কে দেখেও নি এবং জানেও নি। সন্তানেরা, কেউ যেন তোমাদের বিপথে নিয়ে না যায়। মসীহ্‌ অন্যায় করেন না, আর যে কেউ ন্যায় কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সেও অন্যায় করে না। যে গুনাহ্‌ করতেই থাকে সে ইবলিসের, কারণ ইবলিস প্রথম থেকেই গুনাহ্‌ করে চলেছে। ইবলিসের কাজকে ধ্বংস করবার জন্যই ইব্‌নুল্লাহ্‌ প্রকাশিত হয়েছিলেন। আল্লাহ্‌ থেকে যার জন্ম হয়েছে সে গুনাহে পড়ে থাকে না, কারণ আল্লাহ্‌র স্বভাব তার মধ্যে থাকে। আল্লাহ্‌ থেকে জন্ম হয়েছে বলে সে গুনাহে পড়ে থাকতে পারে না। যারা ন্যায় কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখে না এবং ভাইকে মহব্বত করে না, তারা আল্লাহ্‌র নয়। এতেই প্রকাশ পায়, কারা আল্লাহ্‌র সন্তান আর কারাই বা ইবলিসের সন্তান। যে কথা তোমরা প্রথম থেকে শুনে আসছ তা এই- আমাদের একে অন্যকে মহব্বত করা উচিত। সেইজন্য আমি বলছি, আমরা যেন কাবিলের মত না হই। কাবিল শয়তানের লোক ছিল এবং তার ভাইকে সে খুন করেছিল। কেন সে তাকে খুন করেছিল? কারণ সে খারাপ কাজ করত, আর তার ভাই ন্যায় কাজ করত। ভাইয়েরা, দুনিয়ার লোকেরা যদি তোমাদের ঘৃণা করে তাতে আশ্চর্য হয়ো না। আমরা ভাইদের মহব্বত করি বলেই বুঝতে পারছি, আমরা মৃত্যু থেকে জীবনে পার হয়ে এসেছি। যারা মহব্বত করে না তারা মৃত্যুর মধ্যে থাকে। ভাইকে যে ঘৃণা করে সে খুনী। কোন খুনীর মধ্যে যে অনন্ত জীবন থাকে না, তা তোমাদের অজানা নেই। মসীহ্‌ আমাদের জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন, তাই মহব্বত কি তা আমরা জানতে পেরেছি। তাহলে ভাইদের জন্য নিজের প্রাণ দেওয়া আমাদেরও উচিত। এই দুনিয়াতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবার মত অবস্থা যার আছে, সে তার ভাইদের অভাব দেখেও যদি চোখ বন্ধ করে রাখে তবে কেমন করে তার অন্তরে আল্লাহ্‌র প্রতি মহব্বত থাকতে পারে? সন্তানেরা, আমরা যেন শুধু মুখের মহব্বত না দেখিয়ে কাজের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের মহব্বত দেখাই। প্রিয় সন্তানেরা, আমাদের অন্তর যদি আমাদের দোষী না করে তবে আল্লাহ্‌র সামনে আমাদের সাহস থাকবে। তার ফলে আমরা যা কিছু চাইব তা তাঁর কাছ থেকে পাব, কারণ তিনি যে সব হুকুম দিয়েছেন সেগুলো আমরা পালন করি এবং তিনি যে সব কাজে সন্তুষ্ট হন আমরা তা-ই করি। তাঁর হুকুম এই- আমরা যেন তাঁর পুত্র ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনি এবং একে অন্যকে মহব্বত করি। এই হুকুমই তিনি আমাদের দিয়েছেন। তাঁর হুকুম যে পালন করে সে তাঁর মধ্যে থাকে এবং তিনিও তার মধ্যে থাকেন। যে পাক-রূহ্‌ তিনি আমাদের দিয়েছেন সেই পাক-রূহের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি আমাদের অন্তরে থাকেন। প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা সব রূহ্‌কে বিশ্বাস কোরো না, বরং যাচাই করে দেখ তারা আল্লাহ্‌ থেকে এসেছে কি না, কারণ দুনিয়াতে অনেক ভণ্ড নবী বের হয়েছে। আল্লাহ্‌র রূহ্‌কে তোমরা এই উপায়ে চিনতে পারবে- যে রূহ্‌ স্বীকার করে ঈসা মসীহ্‌ মানুষ হয়ে এসেছিলেন সেই রূহ্‌ই আল্লাহ্‌ থেকে এসেছেন; কিন্তু যে রূহ্‌ এই ঈসাকে অস্বীকার করে সেই রূহ্‌ আল্লাহ্‌ থেকে আসে নি। এ সেই দজ্জালের রূহ্‌। সেই রূহ্‌ যে আসছে তা তো তোমরা শুনেছ, আর আসলে সেই রূহ্‌ এখনই দুনিয়াতে আছে। কিন্তু সন্তানেরা, তোমরা আল্লাহ্‌র। তোমরা সেই ভণ্ডদের উপর জয়ী হয়েছ, কারণ এই দুনিয়াতে যে আছে, তার চেয়ে যিনি তোমাদের অন্তরে আছেন তিনি মহান। সেই ভণ্ডেরা এই দুনিয়ার; সেইজন্য তারা এই দুনিয়ার কথা বলে এবং দুনিয়া তাদের কথা শোনে। আমরা আল্লাহ্‌র; যে আল্লাহ্‌কে জানে সে আমাদের কথা শোনে, কিন্তু যে আল্লাহ্‌র নয় সে আমাদের কথা শোনে না। এর দ্বারাই আমরা সত্যের রূহ্‌ ও ছলনার রূহ্‌কে চিনতে পারি। প্রিয় সন্তানেরা, আমরা যেন একে অন্যকে মহব্বত করি, কারণ মহব্বত আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই আসে। যাদের অন্তরে মহব্বত আছে, আল্লাহ্‌ থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে এবং তারা আল্লাহ্‌কে জানে। যাদের অন্তরে মহব্বত নেই তারা আল্লাহ্‌কে জানে না, কারণ আল্লাহ্‌ নিজেই মহব্বত। আমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র মহব্বত এইভাবে প্রকাশিত হয়েছে- তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যেন আমরা তাঁর মধ্য দিয়ে জীবন পাই। আমরা যে আল্লাহ্‌কে মহব্বত করেছিলাম তা নয়, কিন্তু তিনি আমাদের মহব্বত করে তাঁর পুত্রকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যেন পুত্র তাঁর নিজের জীবন্তকোরবানীর দ্বারা আমাদের গুনাহ্‌ দূর করে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করেন। এটাই হল মহব্বত। প্রিয় সন্তানেরা, আল্লাহ্‌ যখন এইভাবে আমাদের মহব্বত করেছেন তখন আমাদেরও একে অন্যকে মহব্বত করা উচিত। কেউ কখনও আল্লাহ্‌কে দেখে নি। যদি আমরা একে অন্যকে মহব্বত করি তাহলে বুঝা যাবে যে, আল্লাহ্‌ আমাদের অন্তরে আছেন এবং তাঁর মহব্বত আমাদের অন্তরে পুরোপুরি ভাবে কাজ করছে। তাঁর রূহ্‌ তিনি আমাদের দান করেছেন, আর এতেই আমরা জানতে পারি যে, আমরা তাঁর মধ্যে আছি আর তিনিও আমাদের অন্তরে আছেন। আমরা দেখেছি ও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, পিতা পুত্রকে মানুষের নাজাতদাতা হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। যে কেউ স্বীকার করে ঈসা ইব্‌নুল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ তার মধ্যে থাকেন এবং সেও আল্লাহ্‌র মধ্যে থাকে। আমরা জানি আল্লাহ্‌ আমাদের মহব্বত করেন, আর তাঁর মহব্বতের উপর আমাদের বিশ্বাস আছে। আল্লাহ্‌ নিজেই মহব্বত। মহব্বতের মধ্যে যে থাকে সে আল্লাহ্‌র মধ্যেই থাকে এবং আল্লাহ্‌ তার মধ্যে থাকেন। এইভাবেই মহব্বত আমাদের অন্তরে পূর্ণতা লাভ করে, যেন রোজ হাশরে আমরা সাহস পাই, কারণ এই দুনিয়াতে আমাদের জীবন তাঁরই জীবনের মত। এই মহব্বতের মধ্যে ভয় নেই, বরং পরিপূর্ণ মহব্বত ভয়কে দূর করে দেয়, কারণ ভয়ের সংগে শাস্তির চিন্তা জড়ানো থাকে। যে ভয় করে সে মহব্বতে পূর্ণতা লাভ করে নি। তিনি আমাদের প্রথমে মহব্বত করেছিলেন বলেই আমরা মহব্বত করি। যে বলে সে আল্লাহ্‌কে মহব্বত করে অথচ তার ভাইকে ঘৃণা করে সে মিথ্যাবাদী; কারণ চোখে দেখা ভাইকে যে মহব্বত করে না সে অদেখা আল্লাহ্‌কে কেমন করে মহব্বত করতে পারে? আমরা তাঁর কাছ থেকে এই হুকুম পেয়েছি যে, আল্লাহ্‌কে যারা মহব্বত করে তারা যেন ভাইকেও মহব্বত করে। যারা ঈমান এনেছে ঈসা-ই সেই মসীহ্‌, আল্লাহ্‌ থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে। যারা পিতাকে মহব্বত করে তারা তাঁর সন্তানকেও মহব্বত করে। যখন আমরা আল্লাহ্‌কে মহব্বত করি এবং তাঁর হুকুম পালন করি তখন জানি যে, আল্লাহ্‌র সন্তানদেরও আমরা মহব্বত করি। আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করাই হল আল্লাহ্‌র প্রতি মহব্বত। তাঁর হুকুম ভারী বোঝার মত নয়, কারণ আল্লাহ্‌র প্রত্যেকটি সন্তান দুনিয়ার উপর জয়লাভ করে থাকে। দুনিয়ার উপর যা জয়লাভ করেছে তা হল আমাদের ঈমান। যারা ঈমান এনেছে ঈসা আল্লাহ্‌র পুত্র, একমাত্র তারাই দুনিয়ার উপর জয়লাভ করে। ইনিই ঈসা মসীহ্‌, যিনি পানি ও রক্তের মধ্য দিয়ে এসেছিলেন। কেবল পানির মধ্য দিয়ে নয়, কিন্তু পানি ও রক্তের মধ্য দিয়ে এসেছিলেন। পাক-রূহ্‌ এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেন, কারণ তিনি নিজেই সত্য। আমরা মানুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করে থাকি, কিন্তু আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য তার চেয়েও বড়; আর তিনি তাঁর পুত্রের বিষয়ে সেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইব্‌নুল্লাহ্‌র উপর যে ঈমান আনে তার অন্তরে সেই সাক্ষ্য আছে। যারা আল্লাহ্‌র কথায় ঈমান আনে নি তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী বানিয়েছে, কারণ আল্লাহ্‌ তাঁর পুত্রের বিষয়ে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা তারা ঈমান আনে নি। সেই সাক্ষ্য এই যে, আল্লাহ্‌ আমাদের অনন্ত জীবন দিয়েছেন এবং সেই জীবন তাঁর পুত্রের মধ্যে আছে। ইব্‌নুল্লাহ্‌কে যে পেয়েছে সে সেই জীবনও পেয়েছে; কিন্তু ইব্‌নুল্লাহ্‌কে যে পায় নি সে সেই জীবনও পায় নি। তোমরা যারা ইব্‌নুল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছ, তোমাদের কাছে আমি এই সমস্ত লিখলাম যাতে তোমরা জানতে পার যে, তোমরা অনন্ত জীবন পেয়েছ। আল্লাহ্‌র উপর আমাদের এই নিশ্চয়তা আছে যে, তাঁর ইচ্ছামত যদি আমরা কিছু চাই তবে তিনি আমাদের কথা শোনেন। যদি আমরা জানি, আমরা যা কিছু চাই তা তিনি শোনেন তবে এও জানি যে, আমরা তাঁর কাছ থেকে যা চেয়েছি তা আমাদের পাওয়া হয়ে গেছে। যদি কেউ তার ভাইকে এমনভাবে গুনাহ্‌ করতে দেখে যা মৃত্যুমুখী নয়, তবে সে আল্লাহ্‌র কাছে চাইবে আর তাতে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আমি এখানে তাদের কথাই বলছি যারা গুনাহ্‌ করছে অথচ তাদের গুনাহ্‌ মৃত্যুমুখী নয়। কিন্তু মৃত্যুমুখী গুনাহ্‌ও আছে। সেই বিষয়ে অনুরোধ করবার কথা আমি তোমাদের বলছি না। সব রকমের অন্যায়ই গুনাহ্‌, তবে সব গুনাহ্‌ মৃত্যুমুখী নয়। আমরা জানি, আল্লাহ্‌ থেকে যার জন্ম হয়েছে সে গুনাহে পড়ে থাকে না। যিনি আল্লাহ্‌ থেকে জন্মেছিলেন তিনিই তাকে রক্ষা করেন, আর ইবলিস তাকে ছুঁতে পারে না। আমরা জানি আমরা আল্লাহ্‌র, আর সমস্ত দুনিয়া ইবলিসের ক্ষমতার নীচে পড়ে আছে। আমরা আরও জানি যে, ইব্‌নুল্লাহ্‌ এসে আমাদের বুঝবার শক্তি দিয়েছেন যেন সত্য আল্লাহ্‌কে আমরা জানতে পারি। যিনি সত্য আল্লাহ্‌ আমরা তাঁর সংগে যুক্ত, অর্থাৎ তাঁর পুত্র ঈসা মসীহের সংগে যুক্ত। তিনিই সত্য আল্লাহ্‌ এবং তিনিই অনন্ত জীবন। সন্তানেরা, প্রতিমার সংগে তোমাদের কোন সম্বন্ধ না থাকুক। ॥ভব আল্লাহ্‌ যাকে বেছে নিয়েছেন সেই মহিলা ও তার সন্তানদের কাছে সেই বুড়ো নেতা আমি এই চিঠি লিখছি। আল্লাহ্‌র সত্যের দরুন আমি তোমাদের সবাইকে মহব্বত করি। কেবল যে আমি তোমাদের মহব্বত করি তা নয়, কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র সত্য জানতে পেরেছে তারা সবাই তোমাদের মহব্বত করে। যে সত্য আমাদের অন্তরে আছে এবং চিরকাল ধরে আমাদের সংগে থাকবে সেই সত্যের জন্যই আমরা তোমাদের মহব্বত করি। পিতা আল্লাহ এবং সেই পিতার পুত্র ঈসা মসীহের কাছ থেকে সত্য ও মহব্বতের মধ্য দিয়ে রহমত, মমতা আর শান্তি আমাদের সংগে থাকবে। পিতা আমাদের যে হুকুম দিয়েছেন সেই অনুসারেই তোমার কয়েকটি ছেলেমেয়ে আল্লাহ্‌র সত্যের পথে চলছে দেখে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আমরা যেন একে অন্যকে মহব্বত করি, এটাই হল তোমার কাছে আমার অনুরোধ। প্রিয় বোন, আমি যা লিখছি তা কোন নতুন হুকুম নয়, বরং এই হুকুম আমরা প্রথম থেকেই পেয়েছিলাম। মহব্বত হল আল্লাহ্‌র হুকুম মত চলা। তোমরা প্রথম থেকেই যে হুকুমের কথা শুনে এসেছ সেইমতই তোমরা মহব্বতের পথে চল। দুনিয়াতে এমন অনেক লোক বের হয়েছে যারা ছলনা করে বেড়ায়। ঈসা মসীহ্‌ যে মানুষ হয়ে এসেছিলেন তারা তা স্বীকার করে না। এই রকম লোকেরাই ছলনাকারী ও দজ্জাল। তোমরা সতর্ক থাক, যাতে তোমাদের পরিশ্রমের ফল না হারিয়ে তোমরা পুরস্কারের সবটাই লাভ করতে পার। যারা মসীহের দেওয়া শিক্ষার সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং সেই শিক্ষায় স্থির থাকে না তাদের অন্তরে আল্লাহ্‌ নেই। কিন্তু যে সেই শিক্ষায় স্থির থাকে তার অন্তরে পিতা এবং পুত্র দু’জনেই আছেন। যদি কেউ তোমাদের কাছে এসে সেই শিক্ষা না দেয় তবে তোমাদের বাড়ীতে তাকে গ্রহণ কোরো না এবং সালামও জানায়ো না। যে তাকে সালাম জানায় সে তার খারাপ কাজেরও ভাগ নেয়। যদিও তোমাদের কাছে আমার অনেক কথা লিখবার ছিল তবুও কাগজ ও কালিতে তা লিখতে চাই না। তার চেয়ে আমি তোমাদের কাছে গিয়ে মুখোমুখি কথা বলবার আশা করি, যেন আমাদের আনন্দ পূর্ণ হয়। আল্লাহ্‌র বাছাই করা তোমার বোনের ছেলেমেয়েরা তোমাকে সালাম জানাচ্ছে। আল্লাহ্‌র সত্যের দরুন আমি যাকে মহব্বত করি আমার সেই প্রিয় বন্ধু গাইয়ের কাছে সেই বুড়ো নেতা আমি এই চিঠি লিখছি। প্রিয় বন্ধু, আমি মুনাজাত করি যেন তোমার সব কিছুই ভালভাবে চলে এবং রূহের দিক থেকে তুমি যেমন ভালভাবে চলছ ঠিক তোমার শরীরও যেন ভাল চলে। আমি খুবই আনন্দিত হলাম যখন কয়েকজন ঈমানদার ভাই এসে তোমার বিষয় এই সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ্‌র সত্যের প্রতি তুমি বিশ্বস্ত আছ এবং তার মধ্যেই চলছ। আমার সন্তানেরা যে আল্লাহ্‌র সত্যের মধ্যে চলাফেরা করছে, এই কথা শোনার চেয়ে বড় আনন্দ আমার আর নেই। প্রিয় বন্ধু, না চিনেও ঈমানদার ভাইদের জন্য তুমি যা করছ তা বিশ্বস্ত ভাবেই করছ। জামাতের সকলের সামনে তারা তোমার মহব্বতের কথা বলেছে। আল্লাহ্‌ যাতে সন্তুষ্ট হন সেইভাবে তুমি তাদের যাত্রার ব্যবস্থা করে দিলে ভাল করবে। তারা মসীহের জন্যই বের হয়েছে এবং অ-ঈমানদারদের কাছ থেকে কিছুই গ্রহণ করে নি। সেইজন্য এই রকম লোকদের সাহায্য করা আমাদের উচিত, যেন আল্লাহ্‌র সত্যের জন্য আমরাও তাদের কাজের সংগী হই। আমি জামাতের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু দিয়ত্রিফেস্‌ জামাতের মধ্যে প্রধান হতে চায় বলে আমাদের কথা মানে না। সেইজন্য সে যা করছে আমি আসলে পর তা সবাইকে জানাব। সে আমাদের বিরুদ্ধে হিংসা করে অনেক মিথ্যা কথা বলেছে। তাতেও সুখী না হয়ে সে নিজেও ভাইদের গ্রহণ করছে না এবং যারা তাদের গ্রহণ করতে চাইছে তাদেরও বাধা দিচ্ছে এবং জামাত থেকে বের করে দিচ্ছে। প্রিয় বন্ধু, খারাপীর পিছনে না গিয়ে বরং ভালোর পিছনে চল। যে ভাল কাজ করে সে আল্লাহ্‌র বান্দা, আর যে খারাপ কাজ করে সে আল্লাহ্‌কে দেখে নি। সবাই দীমীত্রিয়ের প্রশংসা করছে, এমন কি, আল্লাহ্‌র সত্যও তা করছে। আমরাও তাঁর প্রশংসা করছি। তুমি তো জান আমরা যা বলি তা সত্য। আমার অনেক কথাই তোমাকে লিখবার ছিল, কিন্তু কালি-কলমে আমি তা লিখতে চাই না। আশা করি শীঘ্রই তোমাকে দেখতে পাব, আর তখন মুখোমুখি হয়ে আমরা কথা বলতে পারব। তোমার শান্তি হোক। তোমার বন্ধুরা তোমাকে সালাম জানাচ্ছে। ওখানকার বন্ধুদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে আমাদের সালাম জানায়ো। আমি ঈসা মসীহের গোলাম ও ইয়াকুবের ভাই এহুদা। পিতা আল্লাহ্‌ যাদের ডেকেছেন ও মহব্বত করেছেন এবং ঈসা মসীহ্‌ যাদের রক্ষা করেছেন তাদের কাছে আমি এই চিঠি লিখছি। আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রচুর রহমত, শান্তি এবং মহব্বত দান করুন। প্রিয় বন্ধুরা, গুনাহ্‌ থেকে যে নাজাত আমরা সবাই পেয়েছি সেই নাজাত সম্বন্ধে আমি তোমাদের কাছে লিখবার জন্য খুবই আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তবুও ঈসায়ী ঈমান, যা আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের চিরকালের জন্য দিয়েছেন, তার পক্ষে যেন তোমরা প্রাণপণে যুদ্ধ কর সেই উৎসাহ দেবার জন্য আমি তোমাদের কাছে লেখা দরকার মনে করলাম। এর দরকার আছে, কারণ যে লোকদের আজাব সম্বন্ধে আগেই কিতাবে লেখা হয়েছিল তারা তোমাদের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে। আল্লাহ্‌র প্রতি এই লোকদের ভয় নেই; আমাদের আল্লাহ্‌র রহমতকে তারা লমপটতার একটা অজুহাত মনে করে এবং যিনি আমাদের একমাত্র মালিক ও প্রভু সেই ঈসা মসীহ্‌কে তারা অস্বীকার করে। তোমরা অবশ্য এই সব বিষয় ভাল করেই জান; তবুও আমি তোমাদের এই কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের উদ্ধার করে আনবার পরে যারা ঈমান আনে নি প্রভু তাদের ধ্বংস করেছিলেন। এছাড়া যে ফেরেশতারা নিজেদের অধিকার রক্ষা না করে নিজেদের জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের কথা মনে কর। সেই মহা দিনের বিচারের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্‌ তাদের চিরকালের জন্য অন্ধকারে বেঁধে রেখেছেন। সাদুম, আমুরা এবং তাদের আশেপাশের সব শহরের লোকেরাও ঠিক তাদের মতই জেনা, এমন কি, অস্বাভাবিক জেনা করেছিল। যারা চিরকালের আগুনে পুড়বার আজাব পাবে এরা তাদেরই নমুনা হয়ে আছে। তবুও এই ভণ্ড শিক্ষকেরা তেমনি করে খারাপ স্বপ্নের বশে নিজেদের শরীর নাপাক করছে, ফেরেশতাদের শাসন অগ্রাহ্য করছে এবং সেই গৌরবের পাত্রদের বিরুদ্ধে কুফরী করছে। প্রধান ফেরেশতা মিকাইল যখন মূসার মৃতদেহ নিয়ে ইবলিসের সংগে তর্ক করছিলেন তখন তিনি তার বিরুদ্ধে কোন কুফরী করে তাকে দোষী করতে সাহস করেন নি। তিনি বরং বলেছিলেন, “প্রভু যেন তোমাকে বাধা দেন।” কিন্তু এই ভণ্ড ওস্তাদেরা যা বোঝে না সেই সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে এবং বুদ্ধিহীন পশুদের মত নিজে থেকেই যা বোঝে তাতেই ধ্বংস হয়। ঘৃণ্য সেই লোকেরা! তারা কাবিলের পথে গেছে, লাভের জন্য বালামের ভুলের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে আর কারুনের মত বিদ্রোহ করে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই লোকেরা যখন দুঃসাহস নিয়ে তোমাদের প্রীতি-ভোজে যোগ দেয় তখন তোমাদের সেই মেজবানীর মধ্যে তারা ময়লার মত হয়। এরা কেবল নিজেদের বিষয়েই চিন্তা করে। এরা বাতাসে বয়ে নিয়ে যাওয়া পানিহীন মেঘের মত। ফল পাড়বার সময়ে ফলহীন বলে শিকড়সুদ্ধ উপ্‌ড়ে ফেলা গাছের মত এরা দু’দিক থেকেই মৃত। এরা ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত; সমুদ্রের ফেনার মতই এদের লজ্জার কাজগুলো ভেসে ওঠে। এরা ঘুরে বেড়ানো তারার মতই; চিরকালের জন্য ভীষণ অন্ধকার এদের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে। এই সব লোকেরা সব সময় অসন্তুষ্টির ভাব দেখায়, নিজেদের ভাগ্যের দোষ দেয় এবং অন্তরের খারাপ কামনা-বাসনা অনুসারে চলাফেরা করে। তারা নিজেদের নিয়ে গর্ব করে এবং লাভের জন্য লোকদের খোশামোদ করে। কিন্তু প্রিয় বন্ধুরা, যে সব কথা আমাদের হযরত ঈসা মসীহের সাহাবীরা আগে বলেছিলেন তা তোমরা মনে করে দেখ। তাঁরা তোমাদের এই কথা বলতেন, “ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাই যাদের স্বভাব তারা শেষ সময়ে আসবে এবং তাদের ভয়হীন কামনা-বাসনা অনুসারে চলবে।” এই লোকেরা দলাদলির সৃষ্টি করে এবং তারা নিজেদের ইচ্ছামত চলে। তাদের অন্তরে পাক-রূহ্‌ নেই। কিন্তু প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা তোমাদের পরম পবিত্র ঈমানের উপর ভিত্তি করে নিজেদের গড়ে তোল এবং পাক-রূহের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মুনাজাত কর। আমাদের হযরত ঈসা মসীহের দয়া যেন তোমাদের অনন্ত জীবনে নিয়ে যায় তারই অপেক্ষায় তোমরা আল্লাহ্‌র মহব্বতের মধ্যে থাক। তোমাদের মধ্যে যাদের ঈমান স্থির নয় তাদের দয়া কর। আগুন থেকে তুলে এনে অন্যদের রক্ষা কর। গুনাহ্‌-স্বভাবের দ্বারা যাদের জীবন নোংরা হয়েছে তাদের নাপাক কাপড় পর্যন্ত ঘৃণা কর এবং নিজেদের সাবধানে রেখে তাদের দয়া কর। এই কিতাবের মধ্যে যা লেখা হয়েছে তা ঈসা মসীহ্‌ই প্রকাশ করেছেন। এই সব বিষয় আল্লাহ্‌ মসীহের কাছে প্রকাশ করেছিলেন, যেন যে সব ঘটনা কিছুকালের মধ্যেই অবশ্যই ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি তাঁর গোলামদের জানান। মসীহ্‌ তাঁর ফেরেশতা পাঠিয়ে তাঁর গোলাম ইউহোন্নাকে এই সব বিষয় জানিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র কালাম ও ঈসা মসীহের সাক্ষ্য সম্বন্ধে ইউহোন্না যা দেখেছিলেন, সেই সব বিষয়েই তিনি এখানে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আল্লাহ্‌র কালাম যা এখানে লেখা হয়েছে, যে তা তেলাওয়াত করে সে ধন্য এবং যারা তা শোনে ও পালন করে তারাও ধন্য, কারণ সময় কাছে এসে গেছে। তিনি আমাদের নিয়ে একটা রাজ্য গড়ে তুলেছেন এবং তাঁর পিতা ও আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজের জন্য ইমাম করেছেন। চিরকাল ধরে ঈসা মসীহের গৌরব হোক এবং চিরকাল ধরে তাঁর শক্তি থাকুক। আমিন। দেখ, তিনি মেঘের সংগে আসছেন। প্রত্যেকটি চোখ তাঁকে দেখবে; যারা তাঁকে বিঁধেছিল তারাও দেখবে এবং দুনিয়ার সমস্ত জাতি তাঁর জন্য জোরে জোরে কাঁদবে। তা-ই হোক, আমিন। মাবুদ আল্লাহ্‌ বলছেন, “আমিই সেই আল্‌ফা এবং ওমিগা যিনি আছেন, যিনি ছিলেন ও যিনি আসছেন। আমিই সর্বশক্তিমান।” আমি তোমাদের ভাই ইউহোন্না; ঈসার সংগে যুক্ত হয়ে আমি তোমাদের সংগে একই কষ্ট, একই রাজ্য এবং একই ধৈর্যের ভাগী হয়েছি। আল্লাহ্‌র কালাম ও ঈসার সাক্ষ্য প্রচার করেছিলাম বলে আমাকে পাট্‌ম দ্বীপে নিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রভুর দিনে আমি বিশেষভাবে পাক-রূহের বশে ছিলাম। এমন সময়ে আমার পিছনে শিংগার আওয়াজের মত একজনের জোর গলার আওয়াজ শুনলাম। তিনি আমাকে বললেন, “যা দেখবে তা একটা কিতাবে লেখ, আর তা ইফিষ, ইজমির, পর্গাম, থুয়াতীরা, সার্দ্দি, ফিলাদেলফিয়া ও লায়দিকেয়া- এই সাতটা শহরের সাতটা জামাতের কাছে পাঠিয়ে দাও।” যিনি কথা বলছিলেন তাঁকে দেখবার জন্য আমি ঘুরে দাঁড়ালাম এবং সোনার সাতটা বাতিদান দেখলাম। সেই বাতিদানগুলোর মাঝখানে ইব্‌ন্তেআদমের মত কেউ একজন ছিলেন। তাঁর পরনে পা পর্যন্ত লম্বা পোশাক ছিল এবং তাঁর বুকে সোনার পটি বাঁধা ছিল। তাঁর মাথার চুল ভেড়ার লোমের ও বরফের মত সাদা ছিল এবং তাঁর চোখ আগুনের শিখার মত ছিল। তাঁর পা ছিল আগুনে পুড়িয়ে পরিষ্কার করা খুব চক্‌চকে পিতলের মত, আর তাঁর গলার আওয়াজ ছিল জোরে বয়ে যাওয়া স্রোতের আওয়াজের মত। তিনি তাঁর ডান হাতে সাতটা তারা ধরে রেখেছিলেন এবং তাঁর মুখ থেকে একটা ধারালো ছোরা বের হয়ে আসছিল যার দু’দিকেই ধার ছিল। পূর্ণ তেজে জ্বলন্ত সূর্যের মতই তাঁর মুখের চেহারা ছিল। তাঁকে দেখে আমি মরার মত তাঁর পায়ের কাছে পড়ে গেলাম। তখন তিনি তাঁর ডান হাত আমার উপরে রেখে বললেন, “ভয় কোরো না। আমিই প্রথম ও শেষ, আমিই চিরজীবন্ত। আমি মরেছিলাম, আর দেখ, এখন আমি যুগ যুগ ধরে চিরকাল জীবিত আছি। আমার কাছে মৃত্যু ও কবরের চাবি আছে। এইজন্য তুমি যা দেখলে, যা এখন ঘটছে এবং এই সবের পরে যা ঘটবে সেই সব লিখে রাখ। যে সাতটা সোনার বাতিদান ও আমার ডান হাতে যে সাতটা তারা তুমি দেখলে তার গোপন অর্থ এই- সেই সাতটা তারা হল সেই সাতটা জামাতের সাতজন ফেরেশতা এবং সাতটা বাতিদান হল সেই সাতটা জামাত। “ইফিষ শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- যিনি তাঁর ডান হাতে সাতটা তারা ধরে সোনার সাতটা বাতিদানের মাঝখানে ঘুরে বেড়ান তিনি এই কথা বলছেন: আমি তোমার কাজ, পরিশ্রম ও ধৈর্যের কথা জানি। আমি জানি তুমি খারাপ লোকদের সহ্য করতে পার না, আর যারা সাহাবী না হয়েও নিজেদের সাহাবী বলে দাবি করে তাদের পরীক্ষা করে দেখেছ এবং তারা যে মিথ্যাবাদী তার প্রমাণও পেয়েছ। তোমার ধৈর্য আছে এবং তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছ, ক্লান্ত হয়ে পড় নি। তবুও তোমার বিরুদ্ধে আমার এই কথা বলবার আছে যে, আমার প্রতি প্রথমে তোমার যে রকম মহব্বত ছিল তা তুমি হারিয়ে ফেলেছ। ভেবে দেখ, তুমি কত উঁচু থেকে কত নীচে নেমে গেছ। এই অবস্থা থেকে তুমি মন ফিরাও এবং প্রথমে যে সব কাজ করতে তাতে ফিরে যাও। যদি তুমি মন না ফিরাও তাহলে আমি তোমার কাছে এসে তোমার বাতিদানটা তার জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলব। তবে এই একটা গুণ তোমার আছে যে, নীকলায়তীয়রা যা করে তা তুমি ঘৃণা কর, আর আমিও তা ঘৃণা করি। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। যে জয়ী হবে তাকে আমি আল্লাহ্‌র জান্নাতুল-ফেরদৌসের জীবন্তগাছের ফল খেতে দেব। “ইজমির শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- যিনি প্রথম ও শেষ, যিনি মরেছিলেন ও জীবিত হয়েছেন, তিনি এই কথা বলছেন: তোমার কষ্ট ও অভাবের কথা আমি জানি, কিন্তু তবুও তুমি ধনী। নিজেদের ইহুদী বললেও যারা ইহুদী নয় বরং শয়তানের দলের লোক, তারা তোমার বিরুদ্ধে যা বলে তা আমি জানি। তুমি যে সব কষ্ট ভোগ করতে যাচ্ছ তাতে মোটেই ভয় পেয়ো না। শোন, ইবলিস তোমাদের মধ্যে কয়েকজনকে পরীক্ষা করবার জন্য জেলে দেবে, আর দশ দিন ধরে তোমরা কষ্ট ভোগ করবে। তুমি মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত থেকো, তাহলে জয়ের মালা হিসাবে আমি তোমাকে জীবন দেব। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। যে জয়ী হবে দ্বিতীয় মৃত্যু কোনমতেই তার ক্ষতি করবে না। “পর্গাম শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- যে ধারালো ছোরার দু’দিকেই ধার আছে তার অধিকারী এই কথা বলছেন: তুমি কোথায় বাস করছ তা আমি জানি; সেখানে শয়তানের সিংহাসন আছে। তবুও তুমি আমার প্রতি বিশ্বস্ত আছ এবং আমার উপর তোমার ঈমানকে অস্বীকার কর নি। এমন কি, যেখানে শয়তান বাস করে সেখানে যখন আমার বিশ্বস্ত সাক্ষী আনি-পাস্‌ তোমাদের সামনে খুন হয়েছিল তখনও তুমি তোমার ঈমানকে অস্বীকার কর নি। কিন্তু তবুও তোমার বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার আছে। তোমার ওখানে এমন লোকেরা আছে যারা বালামের শিক্ষা অনুসারে চলে। বালাক বাদশাহ্‌কে বালাম শিক্ষা দিয়েছিল যেন সে মূর্তির সামনে উৎসর্গ-করা খাবার খাওয়া ও জেনা করবার মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলদের গুনাহের দিকে নিয়ে যায়। তা ছাড়া নীকলায়তীয়দের শিক্ষা অনুসারে যারা চলে এমন কয়েকজনও তোমার ওখানে আছে। কাজেই এই অবস্থা থেকে মন ফিরাও। যদি মন না ফিরাও তবে আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসব এবং আমার মুখের ছোরা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। যে জয়ী হবে তাকে আমি লুকানো মান্না থেকে কিছু মান্না এবং একটা সাদা পাথর দেব। সেই পাথরের উপরে এমন একটা নতুন নাম লেখা থাকবে যা কেউ জানে না; কেবল যে সেটা পাবে সে-ই তা জানবে। “থুয়াতীরা শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- ইব্‌নুল্লাহ্‌, যাঁর চোখ আগুনের শিখার মত এবং পা খুব চক্‌চকে পিতলের মত তিনি এই কথা বলছেন: আমি তোমার কাজ, তোমার মহব্বত, তোমার বিশ্বাস, তোমার সেবা এবং তোমার ধৈর্যের কথা জানি। আর তুমি প্রথমে যে সব কাজ করেছিলে তার চেয়ে এখন যে আরও বেশী কাজ করছ সেই কথাও আমি জানি। তবুও তোমার বিরুদ্ধে আমার এই কথা বলবার আছে যে, তুমি ঈষেবল নামে সেই স্ত্রীলোকের অন্যায় সহ্য করছ। এই ঈষেবল নিজেকে নবী বলে। তার শিক্ষার দ্বারা সে আমার গোলামদের ভুলায় যেন তারা জেনা করে এবং মূর্তির কাছে উৎসর্গ-করা খাবার খায়। জেনা থেকে মন ফিরাবার জন্য আমি তাকে সময় দিয়েছিলাম কিন্তু সে মন ফিরাতে রাজী হয় নি। সেইজন্য আমি তাকে বিছানায় ফেলে রাখব, আর যারা তার সংগে জেনা করে তারা যদি জেনা থেকে মন না ফিরায় তবে তাদের ভীষণ কষ্টের মধ্যে ফেলব। তার ছেলেমেয়েদেরও আমি মেরে ফেলব। তাতে সব জামাতগুলো জানতে পারবে যে, আমিই মানুষের দিল ও মন খুঁজে দেখি। আমি কাজ অনুসারে তোমাদের প্রত্যেককে ফল দেব। হে থুয়াতীরার বাকী লোকেরা, তোমরা যারা সেই শিক্ষামত চল না এবং যাকে শয়তানের সেই গভীর শিক্ষা বলা হয় তা জান না, তোমাদের আমি বলছি: তোমাদের উপর আমি অন্য কোন ভার দেব না। কেবল যা তোমাদের আছে, আমি না আসা পর্যন্ত তা শক্ত করে ধরে রাখ। যে জয়ী হবে তাকে আমি ভোরের তারাও দেব। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। “সার্দি শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- আল্লাহ্‌র সাতটি রূহ্‌ এবং সাতটি তারা যিনি ধরে আছেন তিনি এই কথা বলছেন: আমি তোমার কাজের কথা জানি। জীবিত আছ বলে তোমার বেশ সুনাম আছে, কিন্তু আসলে তুমি মৃত। তুমি জেগে ওঠো এবং বাদবাকী যা মরবার মত হয়েছে তা শক্তিশালী করে তোল, কারণ আমার আল্লাহ্‌র সামনে তোমার কোন কাজই আমি শেষ হতে দেখি নি। এইজন্য যা তুমি পেয়েছ এবং শুনেছ তা মনে কর ও পালন কর, আর এই অবস্থা থেকে মন ফিরাও। যদি তুমি জেগে না ওঠো তবে আমি চোরের মত আসব, আর আমি কোন্‌ সময় তোমার কাছে আসব তা তুমি জানতেও পারবে না। কিন্তু সার্দিতে তোমার এমন কয়েকজন লোক আছে যারা তাদের কাপড়-চোপড়, অর্থাৎ চালচলন নোংরা করে নি। তারা যোগ্য বান্দা বলেই সাদা পোশাক পরে আমার সংগে চলাফেরা করবে। যে জয়ী হবে সে এই রকম সাদা পোশাক পরবে। জীবন্তকিতাব থেকে তার নাম আমি কখনও মুছে ফেলব না, বরং আমার পিতা ও তাঁর ফেরেশতাদের সামনে আমি তাকে স্বীকার করে নেব। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। “ফিলাদেলফিয়া শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- যিনি পবিত্র ও সত্য, যাঁর কাছে দাউদের চাবি আছে, যিনি খুললে কেউ বন্ধ করতে পারে না এবং বন্ধ করলে কেউ খুলতে পারে না, তিনি এই কথা বলছেন: আমি তোমার কাজের কথা জানি। দেখ, আমি তোমার সামনে একটা খোলা দরজা রাখলাম যা বন্ধ করবার ক্ষমতা কারও নেই। আমি জানি তোমার শক্তি খুবই কম, কিন্তু তবুও তুমি আমার কালাম পালন করেছ এবং আমাকে অস্বীকার কর নি। যারা নিজেদের ইহুদী বলে অথচ ইহুদী নয়, শয়তানের দলের সেই মিথ্যাবাদী লোকদের আমি তোমার কাছে আনাব এবং তোমার পায়ে কদমবুসি করাব, আর তাদের জানিয়ে দেব যে, আমি তোমাকে মহব্বত করি। ধৈর্য ধরবার যে হুকুম আমি দিয়েছিলাম তা তুমি পালন করেছ; সেইজন্য এই দুনিয়ার উপরে যে কষ্টের সময় আসছে সেই সময় থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করব। যারা এই দুনিয়ার তাদের পরীক্ষা করবার জন্য এই কষ্টের সময় আসবে। আমি শীঘ্রই আসছি। তোমার যা আছে তা শক্ত করে ধরে রাখ, যেন কেউ তোমার জয়ের পুরস্কার কেড়ে না নেয়। যে জয়ী হবে তাকে আমি আমার আল্লাহ্‌র ঘরের একটা থাম করব; সে আর কখনও বাইরে যাবে না। আমি তার উপরে আমার আল্লাহ্‌র নাম এবং আমার আল্লাহ্‌র শহরের নাম লিখব। নতুন জেরুজালেমই সেই শহর। বেহেশতের মধ্য থেকে আমার আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এই শহর নেমে আসবে। যে জয়ী হবে আমি তার উপর আমার নতুন নামও লিখব। যার শুনবার কান আছে সে শুনুক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন। “লায়দিকেয়া শহরের জামাতের ফেরেশতার কাছে এই কথা লেখ- যিনি আমিন, যিনি বিশ্বস্ত ও সত্য সাক্ষী, যিনি আল্লাহ্‌র সৃষ্টির মূল, তিনি এই কথা বলছেন: আমি তোমার কাজের কথা জানি। তুমি ঠাণ্ডাও না, গরমও না। তুমি হয় ঠাণ্ডা না হয় গরম হলে ভাল হত। কিন্তু তুমি না ঠাণ্ডা না গরম, সেইজন্য আমি তোমাকে আমার মুখ থেকে থুথুর মত করে ফেলে দেব। তুমি বলছ, ‘আমি ধনী; আমি বড় লোক হয়েছি, তাই আমার কোন কিছুর অভাব নেই।’ খুব ভাল, কিন্তু তুমি তো জান না যে, তুমি দুঃখী, দয়ার পাত্র, গরীব, অন্ধ ও উলংগ। তাই আমি তোমাকে এই উপদেশ দিচ্ছি- তুমি আমার কাছ থেকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করা সোনা কিনে নাও যেন তুমি ধনী হতে পার। আমার কাছ থেকে সাদা পোশাক কিনে পর যেন তোমার উলংগতার লজ্জা দেখা না যায়। আমার কাছ থেকে চোখে দেবার মলম কিনে নাও যেন তুমি দেখতে পাও। আমি যাদের মহব্বত করি তাদেরই দোষ দেখিয়ে দিই ও শাসন করি। সেইজন্য এই অবস্থা থেকে মন ফিরাতে আগ্রহী হও। দেখ, আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঘাত করছি। কেউ যদি আমার গলার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয় তবে আমি ভিতরে তার কাছে যাব এবং তার সংগে খাওয়া-দাওয়া করব, আর সে-ও আমার সংগে খাওয়া-দাওয়া করবে। “আমি জয়ী হয়ে যেমন আমার পিতার সংগে তাঁর সিংহাসনে বসেছি, ঠিক তেমনি যে জয়ী হবে তাকে আমি আমার সংগে আমার সিংহাসনে বসবার অধিকার দেব। যার শুনবার কান আছে সে শুনক, পাক-রূহ্‌ জামাতগুলোকে কি বলছেন।” এর পরে আমি বেহেশতের একটা দরজা খোলা দেখতে পেলাম। শিংগার আওয়াজের মত যাঁর গলার আওয়াজ আগে আমি শুনেছিলাম তিনি আমাকে বললেন, “তুমি এখানে উঠে এস। এই সবের পরে যা কিছু অবশ্যই ঘটতে যাচ্ছে তা আমি তোমাকে দেখাব।” আর তখনই আমি পাক-রূহের বশে বেহেশতে একটা সিংহাসন দেখতে পেলাম। আমি দেখলাম, সেই সিংহাসনে একজন বসে আছেন। তাঁর চেহারা ঠিক হীরা ও সার্দীয় মণির মত। সিংহাসনটার চারদিকে একটা রংধনু ছিল; সেটা দেখতে ঠিক একটা পান্নার মত। সেই সিংহাসনের চারদিকে আরও চব্বিশটা সিংহাসন ছিল, আর সেই সিংহাসনগুলোতে চব্বিশজন নেতা বসে ছিলেন। তাঁদের পোশাক ছিল সাদা এবং তাঁদের মাথায় সোনার তাজ ছিল। সেই সিংহাসনটা থেকে বিদ্যুৎ, ভয়ংকর আওয়াজ ও বাজের আওয়াজ বের হচ্ছিল। সিংহাসনের সামনে সাতটা বাতি জ্বলছিল। সেই বাতিগুলো আল্লাহ্‌র সাতটি রূহ্‌। সেই সিংহাসনের সামনে যেন স্ফটিকের মত পরিষ্কার একটা কাচের সমুদ্র ছিল। সেই সিংহাসনগুলোর মাঝখানের সিংহাসনটার চারপাশে চারজন প্রাণী ছিলেন। তাঁদের সামনের ও পিছনের দিক চোখে ভরা ছিল। প্রথম প্রাণীটির চেহারা সিংহের মত, দ্বিতীয়টির বাছুরের মত, তৃতীয়টির মানুষের মত এবং চতুর্থটির উড়ন্ত ঈগল পাখীর মত। এই চারজন প্রাণীর প্রত্যেকের ছয়টা করে ডানা ছিল এবং সব জায়গা চোখে ভরা ছিল। সেই প্রাণীরা দিনরাত এই কথাই বলছিলেন, “সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি ছিলেন, যিনি আছেন ও যিনি আসছেন, তিনি পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র।” চিরজীবন্ত মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি সিংহাসনে বসে আছেন, এই প্রাণীরা যখনই তাঁকে প্রশংসা, সম্মান ও শুকরিয়া জানান, তখন সেই চব্বিশজন নেতা সিংহাসনের অধিকারী, অর্থাৎ যিনি চিরকাল ধরে জীবিত আছেন তাঁকে উবুড় হয়ে সেজদা করেন। এই নেতারা তখন সেই সিংহাসনের সামনে তাঁদের তাজ খুলে রেখে বলেন, “আমাদের মাবুদ ও আল্লাহ্‌, তুমি প্রশংসা, সম্মান ও ক্ষমতা পাবার যোগ্য, কারণ তুমিই সব কিছু সৃষ্টি করেছ; আর তোমারই ইচ্ছাতে সেই সব সৃষ্ট হয়েছে এবং টিকে আছে।” যিনি সেই সিংহাসনের উপর বসে ছিলেন তাঁর ডান হাতে আমি একটা কিতাব দেখলাম। কিতাবটার ভিতরে ও বাইরে লেখা ছিল এবং সাতটা মোহর দিয়ে সীলমোহর করা ছিল। পরে আমি একজন শক্তিশালী ফেরেশতাকে জোর গলায় এই কথা বলতে শুনলাম, “কে এই সীলমোহরগুলো ভেংগে কিতাবটা খুলবার যোগ্য?” কিন্তু বেহেশতে বা দুনিয়াতে কিংবা দুনিয়ার গভীরে কেউই সেই কিতাবটা খুলতে পারল না, ভিতরে দেখতেও পারল না। তখন আমি খুব কাঁদতে লাগলাম, কারণ এমন কাউকে পাওয়া গেল না যে ঐ কিতাবটা খুলবার বা দেখবার যোগ্য। পরে নেতাদের মধ্যে একজন আমাকে বললেন, “কেঁদো না। এহুদা বংশের সিংহ, যিনি দাউদের বংশধর, তিনি জয়ী হয়েছেন। তিনিই ঐ সাতটা সীলমোহর ভেংগে কিতাবটা খুলতে পারেন।” চারজন প্রাণী এবং নেতাদের মাঝখানে যে সিংহাসনটি ছিল তার উপর একটি মেষ-শাবককে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমার মনে হচ্ছিল যেন সেই মেষ-শাবককে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঐ মেষ-শাবকের সাতটা শিং ও সাতটা চোখ ছিল। আল্লাহ্‌র যে সাতটি রূহ্‌কে দুনিয়ার সব জায়গায় পাঠানো হয় এই চোখগুলো ছিল সেই সাতটি রূহ্‌। পরে সেই মেষ-শাবক এসে যিনি সিংহাসনে বসে ছিলেন তাঁর ডান হাত থেকে কিতাবটা নিলেন। কিতাবটা নেবার পর সেই চারজন প্রাণী ও চব্বিশজন নেতা মেষ-শাবকের সামনে উবুড় হলেন। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বীণা ও একটা করে ধূপে পূর্ণ সোনার পেয়ালা ছিল। সেই ধূপে পূর্ণ পেয়ালাগুলো হল আল্লাহ্‌র বান্দাদের মুনাজাত। তাঁরা এই নতুন কাওয়ালীটি গাইছিলেন: “তুমিই ঐ কিতাবটা নিয়ে তার সীলমোহরগুলো খুলবার যোগ্য, কারণ তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তুমিই তোমার রক্ত দিয়ে প্রত্যেক বংশ, ভাষা, দেশ ও জাতির মধ্য থেকে আল্লাহ্‌র জন্য লোকদের কিনেছ। তুমি তাদের নিয়ে একটা রাজ্য গড়ে তুলেছ এবং আমাদের আল্লাহ্‌র এবাদত-কাজ করবার জন্য ইমাম করেছ। দুনিয়াতে তারাই রাজত্ব করবে।” পরে আমি চেয়ে দেখলাম; আর আমি সেই সিংহাসন, প্রাণী ও নেতাদের চারদিকে অনেক ফেরেশতার কণ্ঠস্বর শুনলাম। সেই ফেরেশতারা ছিলেন সংখ্যায় হাজার হাজার, কোটি কোটি। তাঁরা জোরে জোরে এই কথা বলছিলেন: “যে মেষ-শাবককে মেরে ফেলা হয়েছিল, তিনিই ক্ষমতা, ধন, জ্ঞান, শক্তি, সম্মান, গৌরব ও প্রশংসা পাবার যোগ্য।” তারপর বেহেশতে, দুনিয়াতে, দুনিয়ার গভীরে ও সমুদ্রে যত প্রাণী আছে, এমন কি, সেগুলোর মধ্যে আর যা কিছু আছে সকলকে আমি এই কথা বলতে শুনলাম: “সিংহাসনের উপরে যিনি বসে আছেন তাঁর এবং সেই মেষ-শাবকের প্রশংসা, সম্মান, গৌরব ও ক্ষমতা চিরকাল থাকুক।” সেই চারজন প্রাণী বললেন, “আমিন।” তারপর সেই নেতারা উবুড় হয়ে সেজদা করলেন। মেষ-শাবক যখন ঐ সাতটা সীলমোহরের প্রথমটা ভাংছিলেন তখন আমি চেয়ে দেখলাম; আর আমি সেই চারজন প্রাণীর মধ্যে একজনকে বাজ পড়বার মত আওয়াজে বলতে শুনলাম, “এস।” তখন আমি একটা সাদা ঘোড়া দেখতে পেলাম। যিনি তার উপরে বসে ছিলেন তাঁর হাতে একটা ধনুক ছিল। তাঁকে একটা তাজ দেওয়া হল আর তিনি জয়ীর মত বের হয়ে জয় করতে করতে চললেন। মেষ-শাবক যখন দ্বিতীয় সীলমোহর ভাংলেন তখন আমি দ্বিতীয় প্রাণীকে বলতে শুনলাম, “এস।” তখন আগুনের মত লাল অন্য একটা ঘোড়া বের হয়ে আসল। যিনি সেই ঘোড়ার উপর বসে ছিলেন তাঁকে দুনিয়া থেকে শান্তি তুলে নেবার ক্ষমতা দেওয়া হল, যাতে লোকে একে অন্যকে হত্যা করে। তাঁকে একটা বড় তলোয়ারও দেওয়া হল। মেষ-শাবক যখন তৃতীয় সীলমোহর ভাংলেন তখন আমি তৃতীয় প্রাণীকে বলতে শুনলাম, “এস।” তারপর আমি একটা কালো ঘোড়া দেখতে পেলাম। যিনি সেই ঘোড়াটার উপরে বসে ছিলেন তাঁর হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা ছিল। আর আমি সেই চারজন প্রাণীদের মাঝখানে কাউকে বলতে শুনলাম, “একজন দিনমজুরের এক দিনের আয়ে মাত্র এক কেজি গম বা তিন কেজি যব পাওয়া যায়। তেল আর আংগুর-রস তুমি নষ্ট কোরো না।” মেষ-শাবক যখন চতুর্থ সীলমোহর ভাংলেন তখন আমি চতুর্থ প্রাণীকে বলতে শুনলাম, “এস।” তখন আমি একটা ফ্যাকাশে রংয়ের ঘোড়া দেখতে পেলাম। যিনি সেই ঘোড়ার উপরে বসে ছিলেন তাঁর নাম মৃত্যু; আর কবরটি ঠিক তাঁর পিছনে পিছনে চলছিল। দুনিয়ার চার ভাগের এক ভাগের উপরে তাঁদের ক্ষমতা দেওয়া হল, যেন তাঁরা তলোয়ার, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ও দুনিয়ার বুনো জন্তু দিয়ে লোকদের হত্যা করেন। যখন তিনি পঞ্চম সীলমোহর ভাংলেন তখন আমি একটা কোরবানগাহের নীচে এমন সব লোকের রূহ্‌ দেখতে পেলাম যাদের আল্লাহ্‌র কালামের জন্য এবং সাক্ষ্য দেবার জন্য হত্যা করা হয়েছিল। তারা জোরে চিৎকার করে বলল, “হে পবিত্র ও সত্যময় মালিক, যারা এই দুনিয়ার, তাদের বিচার করতে ও তাদের উপর আমাদের রক্তের শোধ নিতে তুমি আর কত দেরি করবে?” তখন তাদের প্রত্যেককে একটা করে সাদা পোশাক দেওয়া হল আর বলা হল, তাদের সহ-গোলাম ও ভাইদের, যাদের তাদেরই মত করে হত্যা করা হবে তাদের সংখ্যা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন আরও কিছুকাল অপেক্ষা করে। তারপর আমি দেখলাম, তিনি যখন ষষ্ঠ সীলমোহর ভাংলেন তখন ভীষণ ভূমিকমপ হল। সূর্য একেবারে কালো হয়ে গেল আর গোটা চাঁদটাই রক্তের মত লাল হয়ে উঠল। জোর বাতাস বইলে যেমন ডুমুর গাছ থেকে ডুমুর অসময়ে পড়ে যায় ঠিক তেমনি করে আসমানের তারাগুলো দুনিয়ার উপর খসে পড়ল। গুটিয়ে রাখা কাগজের মতই আসমান গুটিয়ে গেল; আর প্রত্যেকটা পাহাড় ও দ্বীপ নিজের নিজের জায়গা থেকে সরে গেল। দুনিয়ার সমস্ত বাদশাহ্‌ ও প্রধান লোক, সেনাপতি, ধনী ও শক্তিশালী লোক এবং প্রত্যেক গোলাম ও স্বাধীন লোক পাহাড়ের গুহায় গুহায় এবং পাথরের আড়ালে আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলল। তারা পাহাড় ও পাথরগুলোকে বলল, “আমাদের উপরে পড় এবং যিনি সেই সিংহাসনে বসে আছেন তাঁর মুখের সামনে থেকে এবং মেষ-শাবকের গজব থেকে আমাদের লুকিয়ে রাখ, কারণ তাঁদের গজব নাজেলের সেই মহান দিন এসে পড়েছে, আর কে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?” এর পর আমি চারজন ফেরেশতাকে দুনিয়ার চার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাঁরা দুনিয়ার চার কোণের বাতাস আট্‌কে রাখছিলেন, যেন দুনিয়া, সমুদ্র কিংবা কোন গাছের উপরে বাতাস না বয়। পরে আমি আর একজন ফেরেশতাকে পূর্ব দিক থেকে উঠে আসতে দেখলাম। তাঁর কাছে জীবন্ত আল্লাহ্‌র সীলমোহর ছিল। যে চারজন ফেরেশতাকে দুনিয়া ও সমুদ্রের ক্ষতি করবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সেই চারজন ফেরেশতাকে তিনি খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, “আমাদের আল্লাহ্‌র গোলামদের কপালে সীলমোহর না দেওয়া পর্যন্ত দুনিয়া, সমুদ্র বা গাছপালার ক্ষতি কোরো না।” তারপর আমি সেই সীলমোহর করা লোকদের সংখ্যা শুনলাম। বনি-ইসরাইলদের সমস্ত বংশের মধ্য থেকে মোট এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার লোককে সীলমোহর করা হয়েছিল: এহুদার বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। রূবেণের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। গাদের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। আশেরের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। নপ্তালির বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। মানশার বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। শিমিয়োনের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। লেবির বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। ইষাখরের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। সবূলূনের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। ইউসুফের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। বিন্‌ইয়ামীনের বংশের মধ্য থেকে বারো হাজার। এর পরে আমি প্রত্যেক জাতি, বংশ, দেশ ও ভাষার মধ্য থেকে এত লোকের ভিড় দেখলাম যে, তাদের সংখ্যা কেউ গুণতে পারল না। সাদা পোশাক পরে তারা সেই সিংহাসন ও মেষ-শাবকের সামনে খেজুর পাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা জোরে চিৎকার করে বলছিল: “যিনি সিংহাসনে বসে আছেন, আমাদের সেই আল্লাহ্‌ এবং মেষ-শাবকের হাতেই গুনাহ্‌ থেকে নাজাত রয়েছে।” তারপর ফেরেশতারা সকলেই সেই সিংহাসনের, নেতাদের ও চারজন প্রাণীর চারপাশে দাঁড়ালেন। তাঁরা সিংহাসনের সামনে উবুড় হয়ে আল্লাহ্‌কে সেজদা করে বললেন, “আমিন। প্রশংসা, গৌরব, জ্ঞান, শুকরিয়া, সম্মান, ক্ষমতা ও শক্তি চিরকাল ধরে আমাদের আল্লাহ্‌রই হোক। আমিন।” তখন একজন নেতা আমাকে বললেন, “সাদা পোশাক পরা এই সব লোক কারা? আর কোথা থেকেই বা তারা এসেছে?” আমি তাঁকে বললাম, “দেখুন, তা আপনিই জানেন।” তিনি আমাকে বললেন, “সেই মহাকষ্টের মধ্য থেকে যারা এসেছে এরা তারাই। এরা এদের পোশাক মেষ-শাবকের রক্তে ধুয়ে সাদা করেছে। সেইজন্য এরা আল্লাহ্‌র সিংহাসনের সামনে আছে আর বেহেশতের এবাদত-খানায় এরা দিনরাত তাঁর এবাদত করছে। যিনি সিংহাসনের উপরে বসে আছেন তিনিই এদের উপরে তাঁর তাম্বু খাটাবেন। এদের আর খিদে পাবে না, পিপাসাও পাবে না; সূর্যের তেজ এদের গায়ে আর লাগবে না, ভীষণ গরমও লাগবে না, কারণ সেই মেষ-শাবক যিনি সিংহাসনের উপরে আছেন তিনিই এদের রাখাল হবেন। জীবন্ত পানির ঝর্ণা কাছে তিনি এদের নিয়ে যাবেন, আর আল্লাহ্‌ এদের চোখের পানি মুছে দেবেন।” তারপর মেষ-শাবক যখন সপ্তম সীলমোহর ভাংলেন তখন বেহেশতে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কোন রকম আওয়াজ শোনা গেল না। যে সাতজন ফেরেশতা আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আমি তাঁদের দেখতে পেলাম। তাঁদের হাতে সাতটা শিংগা দেওয়া হল। এর পর আর একজন ফেরেশতা এসে কোরবানগাহের সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে একটা সোনার ধূপদানী ছিল। তাঁকে প্রচুর পরিমাণে ধূপ দেওয়া হল যাতে তিনি সিংহাসনের সামনের সোনার ধূপগাহের উপরে আল্লাহ্‌র সব বান্দাদের মুনাজাতের সংগে সেই ধূপ কোরবানী করেন। সেই ফেরেশতার হাত থেকে ধূপের ধোঁয়া আল্লাহ্‌র বান্দাদের মুনাজাতের সংগে উপরে আল্লাহ্‌র সামনে উঠে গেল। তখন সেই ফেরেশতা কোরবানগাহ্‌ থেকে আগুন নিয়ে সেই ধূপদানীটা ভরলেন এবং দুনিয়াতে ফেলে দিলেন। তাতে বাজ পড়বার আওয়াজ ও অন্যান্য ভয়ংকর আওয়াজ হল, আর বিদ্যুৎ চম্‌কাল ও ভূমিকমপ হল। যে সাতজন ফেরেশতার হাতে সাতটা শিংগা ছিল, এর পরে তাঁরা সেগুলো বাজাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। প্রথম ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালে পর রক্ত মিশানো শিল ও আগুন দুনিয়াতে ফেলা হল। তাতে তিন ভাগের এক ভাগ দুনিয়া, তিন ভাগের এক ভাগ গাছপালা এবং সমস্ত সবুজ ঘাস পুড়ে গেল। এর পর দ্বিতীয় ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালেন। তখন বিরাট জ্বলন্ত পাহাড়ের মত একটা জিনিস সমুদ্রে ফেলা হল। তাতে সমুদ্রের তিন ভাগের এক ভাগ পানি রক্ত হয়ে গেল, সমুদ্রের তিন ভাগের এক ভাগ প্রাণী মরে গেল, আর তিন ভাগের এক ভাগ জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেল। পরে তৃতীয় ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালেন। তখন একটা বড় তারা বাতির মত জ্বলতে জ্বলতে আসমান থেকে পড়ল। সেই তারার নাম ছিল সোমরাজ। তিন ভাগের এক ভাগ নদী এবং ঝর্ণার উপরে তারাটা পড়ল। তাতে তিন ভাগের এক ভাগ পানি তেতো হয়ে গেল এবং সেই তেতো পানির জন্য অনেক লোক মারা গেল। এর পরে চতুর্থ ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালেন। তাতে সূর্যের তিন ভাগের এক ভাগ, চাঁদের তিন ভাগের এক ভাগ এবং তারাগুলোর তিন ভাগের এক ভাগ অন্ধকার হয়ে গেল। দিনের তিন ভাগের এক ভাগে এবং রাতের তিন ভাগের এক ভাগে কোন আলো রইল না। পরে আমি একটা ঈগল পাখীকে আসমানে অনেক উঁচুতে উড়তে দেখলাম, আর সেই ঈগলটাকে জোরে বলতে শুনলাম, “অন্য যে তিনজন ফেরেশতা শিংগা বাজাতে যাচ্ছেন, তাঁদের শিংগার আওয়াজ হলে যারা এই দুনিয়ার তাদের বিপদ, বিপদ, বিপদ হবে।” তারপর পঞ্চম ফেরেশতা শিংগা বাজালেন, আর আমি একটা তারা দেখতে পেলাম। তারাটা আসমান থেকে দুনিয়াতে পড়েছিল। সেই তারাটাকে হাবিয়া-দোজখের চাবি দেওয়া হল। তারাটা হাবিয়া-দোজখ খুলল; তখন বিরাট চুলা থেকে যেমন ধোঁয়া বের হয়, ঠিক সেইভাবে হাবিয়া-দোজখ থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগল। হাবিয়া-দোজখের ধোঁয়ায় সূর্য আর আসমান অন্ধকার হয়ে গেল, আর সেই ধোঁয়ার মধ্য থেকে অনেক পংগপাল দুনিয়াতে বের হয়ে আসল। সেই পংগপালগুলোকে দুনিয়ার কাঁকড়া বিছার মত ক্ষমতা দেওয়া হল। তাদের বলা হল যেন তারা দুনিয়ার কোন ঘাস বা সবুজ কোন কিছু অথবা কোন গাছের ক্ষতি না করে; কেবল যে লোকদের কপালে আল্লাহ্‌র সীলমোহর নেই তাদেরই ক্ষতি করে। এই সব লোকদের মেরে ফেলবার কোন ক্ষমতা তাদের দেওয়া হল না বটে, তবে পাঁচ মাস পর্যন্ত যন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হল। কাঁকড়া বিছা যখন কোন মানুষকে হুল ফুটায় তখন যেমন যন্ত্রণা হয় এই পংগপালদের দেওয়া যন্ত্রণা ঠিক সেই রকমই। সেই সময় লোকে মৃত্যুর খোঁজ করবে কিন্তু কোনমতেই তা পাবে না; তারা মরতে চাইবে কিন্তু মৃত্যু তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। সেই পংগপালগুলো দেখতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা ঘোড়ার মত। তাদের মাথায় সোনার তাজের মত এক রকম জিনিস ছিল, আর তাদের মুখের চেহারা ছিল মানুষের মত। তাদের চুল মেয়েদের চুলের মত আর তাদের দাঁত সিংহের দাঁতের মত। তাদের বুকে লোহার বুক রক্ষার পোশাকের মত পোশাক ছিল। অনেকগুলো ঘোড়া একসংগে যুদ্ধের রথ টেনে নিয়ে ছুটে গেলে যেমন আওয়াজ হয়, তাদের ডানার আওয়াজ ঠিক সেই রকমই ছিল। তাদের লেজ ও হুল কাঁকড়া বিছার লেজ ও হুলের মত ছিল। পাঁচ মাস পর্যন্ত লোকদের ক্ষতি করবার শক্তি তাদের লেজে ছিল। হাবিয়া-দোজখের ফেরেশতাই ছিল এই পংগপালদের বাদশাহ্‌। হিব্রু ভাষায় সেই ফেরেশতার নাম ছিল আবদ্দোন আর গ্রীক ভাষায় আপল্লুয়োন, অর্থাৎ ধ্বংসকারী। প্রথম বিপদ শেষ হল। দেখ, এর পরে আরও দু’টা বিপদ আসছে। তারপর ষষ্ঠ ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালেন। আল্লাহ্‌র সামনে যে সোনার ধূপগাহ্‌ আছে সেই ধূপগাহের চারটা শিংয়ের কাছ থেকে আমি একজনকে কথা বলতে শুনলাম। যাঁর কাছে শিংগা ছিল সেই ষষ্ঠ ফেরেশতাকে তিনি বললেন, “যে চারজন ফেরেশতা মহানদী ফোরাতের মধ্যে বাঁধা রয়েছে তাদের ছেড়ে দাও।” তখন সেই চারজন ফেরেশতাকে ছেড়ে দেওয়া হল। এই বছরের এই মাস, এই দিন ও এই ঘণ্টার জন্য সেই ফেরেশতাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছিল যেন তারা তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে হত্যা করে। পরে আমি শুনতে পেলাম, ঘোড়ায় চড়া সৈন্যের সংখ্যা ছিল বিশ কোটি। দর্শনে যে ঘোড়াগুলো এবং সেগুলোর উপর যাদের আমি দেখলাম তাদের চেহারা এই রকম ছিল- তাদের বুক রক্ষার পোশাক ছিল আগুনের মত লাল, নীল ও গন্ধকের মত হলুদ রংয়ের। ঘোড়াগুলোর মাথা ছিল সিংহের মাথার মত আর সেগুলোর মুখ থেকে আগুন, ধোঁয়া আর গন্ধক বের হচ্ছিল। আগুন, ধোঁয়া ও গন্ধক- এই তিনটি আঘাতের দ্বারা তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে হত্যা করা হল। সেই ঘোড়াগুলোর মুখ ও লেজের মধ্যেই তাদের শক্তি ছিল, কারণ তাদের লেজগুলো ছিল সাপের মত। সেই লেজগুলোর মাথা দিয়ে তারা মানুষের ক্ষতি করছিল। কিন্তু এই সব আঘাতের পরেও যে সব মানুষ বেঁচে রইল তারা নিজেদের হাতে তৈরী মূর্তিগুলো থেকে মন ফিরাল না। তারা ভূতদের এবং যারা দেখতে, শুনতে বা হাঁটতে পারে না এমন সব সোনা, রূপা, পিতল, পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরী মূর্তির পূজা করতেই থাকল। এছাড়া খুন, জাদুবিদ্যা, জেনা ও চুরি- এই সমস্ত থেকেও তারা মন ফিরাল না। তার পরে আমি আর একজন শক্তিশালী ফেরেশতাকে বেহেশত থেকে নেমে আসতে দেখলাম। তাঁর পোশাক ছিল মেঘ, আর তাঁর মাথার উপরে ছিল রংধনু। তাঁর মুখ সূর্যের মত আর তাঁর পা ছিল আগুনের থামের মত। যখন সাতটা বাজ পড়বার আওয়াজ হল তখন আমি লিখবার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু বেহেশত থেকে আমাকে এই কথা বলা হল, “সাতটা বাজ যে কথা বলল তা গোপন রাখ, লিখো না।” যে ফেরেশতাকে আমি সমুদ্র ও ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তিনি তাঁর ডান হাত আসমানের দিকে তুললেন। যিনি চিরকাল ধরে জীবিত আছেন এবং আসমান, জমীন, সমুদ্র ও সেগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে তা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর নামে কসম খেয়ে সেই ফেরেশতা বললেন, “আর দেরি হবে না। কিন্তু সপ্তম ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজাবার দিনে আল্লাহ্‌র গোপন উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হবে। আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের গোলামদের কাছে, অর্থাৎ নবীদের কাছে যা জানিয়েছিলেন ঠিক সেই মতই এটা হবে।” যাঁকে আমি বেহেশত থেকে কথা বলতে শুনেছিলাম তিনি আবার আমাকে বললেন, “যে ফেরেশতা সমুদ্র ও ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর হাত থেকে খোলা কিতাবটা নাও।” তখন আমি সেই ফেরেশতার কাছে গিয়ে সেই কিতাবটা আমাকে দিতে বললাম। তিনি আমাকে বললেন, “এটা নিয়ে খেয়ে ফেল। তোমার পেটকে এটা তেতো করে তুলবে, কিন্তু মুখে মধুর মত মিষ্ট লাগবে।” তখন ফেরেশতার হাত থেকে আমি সেই ছোট কিতাবটা নিয়ে খেয়ে ফেললাম। আমার মুখে তা মধুর মত মিষ্ট লাগল, কিন্তু খেয়ে ফেললে পর আমার পেট তেতো হয়ে গেল। তারপর আমাকে এই কথা বলা হল, “তোমাকে আবার অনেক দেশ, জাতি, ভাষা ও বাদশাহ্‌র বিষয়ে ভবিষ্যতের কথা বলতে হবে।” তারপর মাপকাঠির মত একটা নলের লাঠি আমাকে দেওয়া হল এবং বলা হল, “বায়তুল-মোকাদ্দস ও কোরবানগাহ্‌ মাপ এবং যারা সেখানে আল্লাহ্‌র এবাদত করে তাদের সংখ্যা গোণ। কিন্তু বায়তুল-মোকাদ্দসের বাইরে যে উঠান আছে ওটা বাদ দিয়ো, মেপো না, কারণ ওটা অ-ইহুদীদের দেওয়া হয়েছে। তারা বিয়াল্লিশ মাস ধরে পবিত্র শহরটা পায়ে মাড়াবে। কিন্তু আমি আমার দু’জন সাক্ষীকে এমন ক্ষমতা দেব যার ফলে তারা চট পরে এক হাজার দু’শো ষাট দিন ধরে নবী হিসাবে কথা বলবে।” সেই দু’জন সাক্ষী হলেন দু’টি জলপাই গাছ ও দু’টি বাতিদান, যাঁরা দুনিয়ার মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ যদি তাঁদের ক্ষতি করতে চায় তবে তাঁদের মুখ থেকে আগুন বের হয়ে সেই শত্রুদের পুড়িয়ে ফেলবে। যে কেউ তাঁদের ক্ষতি করতে চাইবে তাকে এইভাবে মরতে হবে। এই লোকেরা যতদিন নবী হিসাবে কথা বলবেন ততদিন যেন বৃষ্টি না হয় সেইজন্য আসমান বন্ধ করে দেবার ক্ষমতা তাঁদের থাকবে। পানিকে রক্ত করবার এবং যতবার ইচ্ছা ততবার যে কোন গজব দিয়ে দুনিয়ার ক্ষতি করবার ক্ষমতাও তাঁদের থাকবে। তাঁদের সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হলে পর হাবিয়া-দোজখ থেকে একটা জন্তু উঠে এসে তাঁদের সংগে যুদ্ধ করবে এবং তাঁদের পরাজিত করে হত্যা করবে। তাঁদের প্রভুকে যে শহরে ক্রুশের উপরে হত্যা করা হয়েছিল সেই মহা শহরের রাস্তায় তাঁদের লাশ পড়ে থাকবে। সেই শহরের নাম আসলে সাদুম ও মিসর নয়, তবুও একই রকম বলে সেই শহরকে সাদুম ও মিসর বলা হয়। তখন সব দেশ, বংশ, ভাষা ও জাতির মধ্য থেকে লোকেরা সাড়ে তিন দিন ধরে ঐ লাশগুলো দেখবে। তারা তাঁদের লাশগুলো দাফন করতে দেবে না। তাঁরা মারা গেছেন বলে যারা এই দুনিয়ার তারা খুশী হবে এবং আনন্দ করবে। লোকেরা একে অন্যের কাছে উপহার পাঠাবে, কারণ যারা এই দুনিয়ার তারা এই দু’জন নবীর দরুন কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু এই সাড়ে তিন দিন পরে আল্লাহ্‌র দেওয়া প্রাণবায়ু তাঁদের মধ্যে ঢুকল। তাতে তাঁরা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তখন যারা তাঁদের দেখল তারা খুব ভয় পেল। পরে সেই দু’জন সাক্ষী বেহেশত থেকে জোরে বলা এই কথা শুনলেন, “এখানে উঠে এস।” তখন তাঁরা তাঁদের শত্রুদের চোখের সামনেই একটা মেঘে করে বেহেশতে উঠে গেলেন। সেই সময় ভীষণ ভূমিকমপ হল এবং সেই শহরের দশ ভাগের এক ভাগ ভেংগে পড়ে গেল। সেই ভূমিকমেপ সাত হাজার লোক মারা গেল। তাতে বাকী সকলে ভয় পেয়ে বেহেশতের আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে লাগল। এইভাবে দ্বিতীয় বিপদ শেষ হল। দেখ, শীঘ্রই তৃতীয় বিপদ আসছে। পরে সপ্তম ফেরেশতা তাঁর শিংগা বাজালেন। তখন বেহেশতে জোরে জোরে বলা হল, “দুনিয়ার রাজ্য এখন আমাদের মাবুদ ও তাঁর মসীহের হয়েছে। তিনি চিরকাল ধরে রাজত্ব করবেন।” যে চব্বিশজন নেতা আল্লাহ্‌র সামনে তাঁদের সিংহাসনের উপর বসে ছিলেন তাঁরা উবুড় হয়ে আল্লাহ্‌কে সেজদা করে বললেন, “সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌, তুমি আছ এবং তুমি ছিলে। আমরা তোমার শুকরিয়া আদায় করি, কারণ তুমি তোমার মহা ক্ষমতা হাতে নিয়ে রাজত্ব করতে শুরু করেছ। সব জাতি রাগ করেছে, আর তোমার গজব নাজেল করবার সময় হয়েছে। মৃতদের বিচার করবার সময় এসেছে, আর তোমার গোলামদের, অর্থাৎ নবীদের ও তোমার বান্দাদের এবং ছোট-বড় সবাই যারা তোমাকে ভয় করে তাদের পুরস্কার দেবার সময় এসেছে। এছাড়া যারা দুনিয়ার ক্ষতি করছে, তাদের ধ্বংস করবার সময়ও এসেছে।” তারপর বেহেশতের এবাদত-খানাটি খোলা হল এবং সেখানে আল্লাহ্‌র সাক্ষ্য-সিন্দুকটি দেখা গেল। তখন বিদ্যুৎ চম্‌কাতে ও ভয়ংকর আওয়াজ হতে আর বাজ পড়তে এবং ভূমিকমপ ও ভীষণ শিলাবৃষ্টি হতে লাগল। পরে আসমানে একটা মহান চিহ্ন দেখা গেল- একজন স্ত্রীলোক, যার পরনে ছিল সূর্য আর পায়ের নীচে ছিল চাঁদ। বারোটা তারা দিয়ে গাঁথা একটা তাজ তার মাথায় ছিল। সে গর্ভবতী ছিল এবং প্রসব-বেদনায় চিৎকার করছিল। তারপর আসমানে আর একটা চিহ্ন দেখা গেল- আগুনের মত লাল একটা বিরাট দানব। তার সাতটা মাথা ও দশটা শিং, আর মাথাগুলোতে সাতটা তাজ ছিল। তার লেজ দিয়ে সে আসমানের তিন ভাগের এক ভাগ তারা টেনে এনে দুনিয়াতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। যে স্ত্রীলোকটির সন্তান হতে যাচ্ছিল দানবটা তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল যেন সন্তানের জন্ম হলেই সে খেয়ে ফেলতে পারে। স্ত্রীলোকটির একটি ছেলে হল। সেই ছেলেই লোহার দণ্ড দিয়ে সমস্ত জাতিকে শাসন করবেন। সেই সন্তানকে আল্লাহ্‌ ও তাঁর সিংহাসনের কাছে তুলে নেওয়া হল, আর সেই স্ত্রীলোকটি মরুভূমিতে পালিয়ে গেল। আল্লাহ্‌ সেই মরুভূমিতে তার জন্য একটা জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন যেন এক হাজার দু’শো ষাট দিন সে সেখানে যত্ন পায়। তারপর বেহেশতে যুদ্ধ হল। মিকাইল ও তাঁর অধীন ফেরেশতারা সেই দানব ও তাঁর দূতদের সংগে যুদ্ধ করলেন। সেই দানব জয়ী হতে পারল না এবং বেহেশতে তাদের আর থাকতেও দেওয়া হল না। তখন সেই বিরাট দানবকে ও তাঁর সংগে তার দূতদের দুনিয়াতে ফেলে দেওয়া হল। এই দানব হল সেই পুরানো সাপ যাকে ইবলিস বা শয়তান বলা হয়। সে দুনিয়ার সমস্ত লোককে ভুল পথে নিয়ে যায়। তারপর আমি বেহেশত থেকে জোরে জোরে একজনকে বলতে শুনলাম, “এখন নাজাত, শক্তি ও আমাদের আল্লাহ্‌র রাজ্য আর তাঁর মসীহের ক্ষমতা উপস্থিত হয়েছে, কারণ যে আমাদের ভাইদের দোষ দিত তাকে বেহেশত থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের আল্লাহ্‌র সামনে সে দিনরাত তাদের দোষ দেখাত। মেষ-শাবকের রক্ত ও নিজেদের সাক্ষ্য দ্বারা তারা তাকে হারিয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের অতিরিক্ত ভালবাসে নি বলেই তাদের জীবন দিতে তারা রাজী ছিল। “সেইজন্য হে বেহেশত, আনন্দিত হও; তোমরা যারা সেখানে বাস কর, আনন্দিত হও। কিন্তু দুনিয়া ও সমুদ্র, ঘৃণ্য তোমরা! কারণ ইবলিস তোমাদের উপর নেমে এসেছে। ইবলিস রাগে ফুলে উঠেছে, কারণ সে জানে তার সময় আর বেশী নেই।” সেই দানব যখন দেখল যে, তাকে দুনিয়াতে ফেলে দেওয়া হয়েছে তখন যে স্ত্রীলোকটির সন্তান হয়েছিল দানবটা তার পিছনে লাগল। তখন সেই স্ত্রীলোকটিকে একটা মস্ত বড় ঈগলের দু’টা ডানা দেওয়া হল যেন সে মরুভূমিতে তার জায়গায় উড়ে যেতে পারে। সেখানে সেই সাপের চোখের আড়ালে সাড়ে তিন বছর তার যত্ন নেওয়া হবে। তখন সেই সাপটা সেই স্ত্রীলোকটির পিছন থেকে তাকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তার মুখ থেকে পানি বের করে একটা নদীর সৃষ্টি করে ফেলল, এর পরে আমি একটা জন্তুকে সমুদ্রের মধ্য থেকে উঠে আসতে দেখলাম। সেই জন্তুটার দশটা শিং আর সাতটা মাথা ছিল। সেই শিংগুলোর উপরে দশটা তাজ ছিল আর মাথাগুলোর উপরে কুফরী করবার জন্য বিভিন্ন নাম লেখা ছিল। সেই জন্তুটা দেখতে ছিল চিতাবাঘের মত, আর তার পাগুলো ছিল ভল্লুকের পায়ের মত এবং মুখটা ছিল সিংহের মুখের মত। সেই দানবটা তার শক্তি, সিংহাসন ও মহা ক্ষমতা সেই জন্তুটাকে দিল। জন্তুটার একটা মাথায় এমন একটা আঘাত ছিল যার ফলে সে মরবার মত হয়েছিল, কিন্তু সেই আঘাতটা ভাল হয়ে গিয়েছিল। তাতে দুনিয়ার সব লোক আশ্চর্য হয়ে সেই জন্তুটার পিছনে পিছনে চলল। দানবটা সেই জন্তুটাকে ক্ষমতা দিয়েছিল বলে লোকেরা সেই দানবকে সেজদা করল, আর জন্তুটাকেও সেজদা করে বলল, “এই জন্তুর মত কে আছে? আর কে-ই বা তার সংগে যুদ্ধ করতে পারে?” গর্ব ও কুফরী করবার জন্য সেই জন্তুটাকে কথা বলবার শক্তি দেওয়া হল। সেই জন্তুটা যেন বিয়াল্লিশ মাস ধরে তার অধিকার খাটাতে পারে সেইজন্য তাকে অনুমতি দেওয়া হল। তখন সেই জন্তুটা আল্লাহ্‌র ও তাঁর নামের বিরুদ্ধে কুফরী করতে লাগল। এ ছাড়া, তাঁর বাসস্থানের বিরুদ্ধে এবং বেহেশতে যাঁরা থাকেন তাঁদের বিরুদ্ধে খুব অপমানের কথা বলতে লাগল। আল্লাহ্‌র বান্দাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের জয় করে নেবার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হল এবং প্রত্যেক বংশ, দেশ, ভাষা ও জাতির লোকদের উপরে তাকে অধিকার দেওয়া হল। যারা এই দুনিয়ার, অর্থাৎ যাদের নাম মেষ-শাবকের জীবন্তকিতাবে লেখা নেই তারা সবাই সেই জন্তুটাকে সেজদা করবে। এই মেষ-শাবককে দুনিয়া সৃষ্টির আগেই হত্যা করবার জন্য ঠিক করা হয়েছিল। যার শুনবার কান আছে, সে পাক-কিতাবের এই কালাম শুনুক: যার বন্দী হবার কথা আছে সে বন্দী হবে। যার তলোয়ারের আঘাতে খুন হবার কথা আছে সে খুন হবে। এইজন্য আল্লাহ্‌র বান্দাদের ধৈর্য ও বিশ্বাসের দরকার। এর পরে আমি ভূমি থেকে আর একটা জন্তুকে উঠে আসতে দেখলাম। ভেড়ার মত তার দু’টা শিং ছিল, কিন্তু সেই দানবের মত সে কথা বলত। এই জন্তুটা প্রথম জন্তুটার হয়ে তার সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে লাগল; আর যারা এই দুনিয়ার তাদের দিয়ে সে সেই প্রথম জন্তু, অর্থাৎ যার ভীষণ আঘাত ভাল হয়ে গিয়েছিল তাকে সেজদা করাল। সে বড় বড় অলৌকিক কাজ করতে লাগল, এমন কি, লোকদের চোখের সামনে আসমান থেকে জমীনে আগুন নামিয়ে আনল। সেই প্রথম জন্তুর হয়ে যে সব কেরামতী কাজ করবার জন্য তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সে সেগুলো করে লোকদের ভুল পথে নিয়ে যেতে লাগল। প্রথম যে জন্তুটা ছোরার আঘাত পেয়েও বেঁচে ছিল, দ্বিতীয় জন্তুটা লোকদের বলল যেন তারা তার একটা মূর্তি তৈরী করে। সেই মূর্তিকে প্রাণ দেবার শক্তিও তাকে দেওয়া হল, যাতে সেই মূর্তিটা কথা বলতে পারে এবং যারা সেই মূর্তিকে সেজদা করবে না তাদের হত্যা করতে পারে। সে ছোট-বড়, ধনী-গরীব, স্বাধীন ও গোলাম, সকলকেই ডান হাতে বা কপালের উপর একটা চিহ্ন গ্রহণ করতে বাধ্য করল। ফলে সেই চিহ্ন ছাড়া কেউ কিছু কিনতে বা বিক্রি করতে পারল না। সেই চিহ্ন হল সেই জন্তুটার নাম বা তার নামের সংখ্যা। এই সব বুঝতে বুদ্ধির দরকার। যার বুদ্ধি আছে সে সেই জন্তুটার সংখ্যা গুণে দেখুক, কারণ ওটা একটা মানুষের নামের সংখ্যা। আর সেই সংখ্যা হল ছ’শো ছেষট্টি। তারপর আমি চেয়ে দেখলাম, সেই মেষ-শাবক সিয়োন পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সংগে আছে এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার লোক। তাদের কপালে মেষ-শাবক ও তাঁর পিতার নাম লেখা রয়েছে। তারপর আমি বেহেশত থেকে জোরে বয়ে যাওয়া স্রোতের আওয়াজের মত ও জোরে বাজ পড়বার আওয়াজের মত একটা আওয়াজ শুনলাম। যে আওয়াজ আমি শুনলাম তা ছিল বীণা বাদকদের বীণার আওয়াজের মত। সেই সিংহাসন ও সেই চারজন প্রাণী এবং সেই নেতাদের সামনে তারা একটা নতুন কাওয়ালী গাইছিল। কেউ সেই কাওয়ালী শিখতে পারল না; কেবল সেই এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার লোক, যাদের দুনিয়ার লোকদের মধ্য থেকে কিনে নেওয়া হয়েছিল তারাই শিখতে পারল। এরা সেই লোকেরা, যারা স্ত্রীলোকদের সংগে জেনা করে নিজেদের নাপাক করে নি। যেখানে মেষ-শাবক যান তারা তাঁর পিছনে পিছনে যায়। আল্লাহ্‌ এবং মেষ-শাবকের কাছে প্রথম ফল হিসাবে কোরবানী দেবার জন্য লোকদের মধ্য থেকে তাদের কিনে নেওয়া হয়েছিল। তারা কখনও মিথ্যা কথা বলে নি, আর তাদের মধ্যে কোন দোষ পাওয়া যায় নি। তারপর আমি আর একজন ফেরেশতাকে আসমানের অনেক উঁচুতে উড়তে দেখলাম। দুনিয়াতে বাসকারী লোকদের কাছে, অর্থাৎ প্রত্যেক জাতি, বংশ, ভাষা ও দেশের লোকদের কাছে প্রচার করবার জন্য তাঁর কাছে চিরকালের সুসংবাদ ছিল। তিনি জোরে জোরে এই কথা বলছিলেন, “আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং তাঁর প্রশংসা কর, কারণ বিচার করবার সময় এসে গেছে। যিনি আসমান, জমীন, সমুদ্র ও ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন তাঁর এবাদত কর।” পরে দ্বিতীয় আর একজন ফেরেশতা তাঁর পিছনে পিছনে এসে বললেন, “সেই নাম-করা ব্যাবিলন শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। যে শহর তার জেনার ভয়ংকর মদ সব জাতিকেই খাইয়েছে সেই শহরটা ধ্বংস হয়ে গেছে।” এর পরে তৃতীয় আর একজন ফেরেশতা তাঁদের পিছনে পিছনে এসে জোরে বললেন, “কেউ যদি সেই জন্তু এবং তার মূর্তির পূজা করে এবং তার চিহ্ন কপালে বা হাতে গ্রহণ করে, তবে তাকে আল্লাহ্‌র গজবের মদ খেতে হবে। এই মদের সংগে পানি না মিশিয়ে আল্লাহ্‌র গজবের পেয়ালায় ঢেলে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র ফেরেশতাদের এবং মেষ-শাবকের সামনে আগুন ও গন্ধকের দ্বারা সেই লোককে যন্ত্রণা দেওয়া হবে। যে আগুন এই লোকদের যন্ত্রণা দেবে সেই আগুনের ধোঁয়া চিরকাল ধরে উঠতে থাকবে। যে লোক সেই জন্তু ও তার মূর্তির পূজা করবে এবং তার নামের চিহ্ন গ্রহণ করবে সে দিনে বা রাতে কখনও বিশ্রাম পাবে না।” যারা আল্লাহ্‌র হুকুম পালন করে এবং ঈসার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে আল্লাহ্‌র সেই বান্দাদের এই অবস্থার মধ্যে ধৈর্যের দরকার। তারপর আমি একজনকে বেহেশত থেকে বলতে শুনলাম, “এই কথা লেখ- এখন থেকে যারা প্রভুর সংগে যুক্ত হয়ে মারা যাবে তারা ধন্য।” পাক-রূহ্‌ এই কথা বলছেন, “জ্বী, তারা ধন্য। তাদের পরিশ্রম থেকে তারা বিশ্রাম পাবে, কারণ তাদের কাজের ফল তাদের সংগে থাকবে।” পরে আমি তাকিয়ে একটা সাদা মেঘ দেখলাম, আর সেই মেঘের উপরে ইব্‌ন্তেআদমের মত কেউ একজন বসে ছিলেন। তাঁর মাথায় জয়ের সোনার তাজ ছিল আর হাতে ছিল ধারালো কাসে-। তারপর আর একজন ফেরেশতা এবাদত-খানা থেকে বের হয়ে আসলেন এবং যিনি সেই মেঘের উপরে বসে ছিলেন তাঁকে জোরে চিৎকার করে বললেন, “আপনার কাসে- লাগান, ফসল কাটুন, কারণ ফসল কাটবার সময় হয়েছে; দুনিয়ার ফসল পুরোপুরি পেকে গেছে।” তখন যিনি সেই মেঘের উপরে বসে ছিলেন তিনি দুনিয়াতে তাঁর কাসে- লাগালেন, আর দুনিয়ার ফসল কাটা হল। পরে বেহেশতের এবাদত-খানা থেকে আর একজন ফেরেশতা বের হয়ে আসলেন। তাঁর কাছেও একটা ধারালো কাসে- ছিল। তারপর কোরবানগাহের কাছ থেকে আর একজন ফেরেশতা বের হয়ে আসলেন। আগুনের উপরে তাঁর ক্ষমতা ছিল। যে ফেরেশতার কাছে ধারালো কাসে- ছিল তাঁকে এই ফেরেশতা জোরে ডেকে বললেন, “তোমার ধারালো কাসে- লাগাও আর দুনিয়ার আংগুর গাছ থেকে আংগুরের থোকাগুলো কেটে জড়ো কর, কারণ আংগুর পেকে গেছে।” তখন সেই ফেরেশতা দুনিয়াতে তাঁর কাসে- লাগালেন এবং দুনিয়ার আংগুর গাছ থেকে সব আংগুর কেটে জড়ো করলেন। পরে সেগুলো আংগুর মাড়াই করবার গর্তের মধ্যে ফেলে দিলেন। এই আংগুর মাড়াই করবার গর্ত হল আল্লাহ্‌র ভয়ংকর গজব। শহরের বাইরে আংগুর মাড়াই করবার গর্তে সেই আংগুরগুলো মাড়াই করা হলে পর তা থেকে রক্ত বের হয়ে আসল ও ঘোড়াগুলোর লাগাম পর্যন্ত উঠল। তাতে প্রায় তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত সব জায়গা রক্তে ডুবে গেল। পরে আমি বেহেশতে আর একটা মহান ও আশ্চর্য চিহ্ন দেখলাম। দেখলাম, সাতজন ফেরেশতা আর তাঁদের হাতে শেষ সাতটা গজব। এগুলোকে শেষ গজব বলা হচ্ছে, কারণ এগুলো দিয়ে আল্লাহ্‌র রাগেরও শেষ হবে। তারপর আমি আগুন মেশানো কাচের একটা সমুদ্রের মত দেখলাম, আর যারা সেই জন্তু ও তার মূর্তি এবং তার নামের সংখ্যার উপরে জয়লাভ করেছে তাদেরও দেখলাম। আল্লাহ্‌র দেওয়া বীণা হাতে করে তারা সেই কাচের সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আল্লাহ্‌র গোলাম মূসার এবং সেই মেষ-শাবকের এই কাওয়ালীটি গাইছিল: “হে সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌, কত মহান ও আশ্চর্য তোমার কাজ! হে সমস্ত জাতির বাদশাহ্‌, কত ন্যায় ও সত্য তোমার পথ! হে মাবুদ, কে না তোমাকে ভয় করবে? কে না তোমার নামের প্রশংসা করবে? কেবল তুমিই তো পবিত্র। সমস্ত জাতি তোমার কাছে আসবে, সবাই তোমার এবাদত করবে; কারণ তোমার ন্যায়বিচার প্রকাশিত হয়েছে।” এর পরে আমি দেখলাম, বেহেশতে সেই এবাদত-খানাটি, অর্থাৎ সাক্ষ্য-তাম্বুটা খোলা হল। তখন সেই সাতজন ফেরেশতা সাতটা গজব নিয়ে এবাদত-খানা থেকে বের হয়ে আসলেন। তাঁদের পরনে ছিল পরিষ্কার ঝক্‌ঝকে কাপড় আর বুকে বাঁধা ছিল সোনার পটি। সেই চারজন প্রাণীর একজন সেই সাতজন ফেরেশতাকে সাতটা সোনার পেয়ালা দিলেন। আল্লাহ্‌, যিনি যুগ যুগ ধরে চিরকাল জীবিত আছেন, সেই পেয়ালাগুলো তাঁর রাগে পূর্ণ ছিল। আল্লাহ্‌র মহিমা ও কুদরত থেকে যে ধোঁয়া বের হচ্ছিল সেই ধোঁয়ায় এবাদত-খানাটি পূর্ণ হল। সেই সাতজন ফেরেশতার সাতটা গজব শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ সেই এবাদত-খানায় ঢুকতে পারল না। পরে আমি শুনলাম, সেই এবাদত-খানা থেকে সেই সাতজন ফেরেশতাকে একজন জোরে জোরে বলছেন, “তোমরা গিয়ে আল্লাহ্‌র গজবে ভরা সাতটা পেয়ালা দুনিয়ার উপর উবুড় করে ঢেলে দাও।” তখন প্রথম ফেরেশতা গিয়ে তাঁর পেয়ালাটা দুনিয়ার উপর উবুড় করলেন। তার ফলে যাদের উপর সেই জন্তুটার চিহ্ন ছিল এবং যারা তার মূর্তির পূজা করত তাদের গায়ে খুব খারাপ ও বিষাক্ত এক রকমের ঘা দেখা দিল। দ্বিতীয় ফেরেশতা তাঁর পেয়ালাটা সমুদ্রের উপরে উবুড় করলেন। তখন সমুদ্রের পানি মরা মানুষের রক্তের মত হল, আর সমুদ্রের সব প্রাণী মরে গেল। পরে তৃতীয় ফেরেশতা নদী আর ঝর্ণার উপরে তাঁর পেয়ালাটা উবুড় করলেন। তাতে সেগুলো রক্তের নদী ও ঝর্ণা হয়ে গেল। পানির উপরে যে ফেরেশতার ক্ষমতা ছিল আমি তাঁকে এই কথা বলতে শুনলাম: “হে আল্লাহ্‌ পাক, তুমি আছ এবং তুমি ছিলে। তুমি ন্যায়বান, কারণ তুমি এই সব শাস্তি দিয়েছ। এই লোকেরা আল্লাহ্‌র বান্দাদের ও নবীদের খুন করেছে। তাই তুমি তাদের এই রক্ত খেতে দিয়েছ আর এটাই তাদের পক্ষে উপযুক্ত হয়েছে।” আমি কোরবানগাহ্‌ থেকে একজনকে এই কথা বলতে শুনলাম: “সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌, তোমার সব বিচার সত্য ও ন্যায়ে পূর্ণ।” চতুর্থ ফেরেশতা সূর্যের উপরে তাঁর পেয়ালাটা উবুড় করলেন। তাতে লোকদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবার জন্য সূর্যকে ক্ষমতা দেওয়া হল। তখন ভীষণ তাপে লোকদের গা পুড়ে গেল, আর এই সমস্ত গজবের উপর যাঁর ক্ষমতা আছে তারা সেই আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কুফরী করতে লাগল। কিন্তু তবুও তারা মন ফিরাল না এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসা করল না। তারপর ষষ্ঠ ফেরেশতা মহানদী ফোরাতের উপরে তাঁর পেয়ালাটা উবুড় করলেন। তাতে পূর্ব দেশের বাদশাহ্‌দের যাবার পথ তৈরী হবার জন্য সেই নদীর পানি শুকিয়ে গেল। তখন আমি ব্যাঙের মত তিনটা ভূত দেখতে পেলাম। সেগুলো সেই দানব, সেই জন্তু এবং সেই ভণ্ড নবীর মুখ থেকে বের হয়ে আসছিল। সেই ভূতগুলো কেরামতী কাজ করছিল। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র সেই মহান দিনে যুদ্ধ করবার জন্য তারা সারা দুনিয়ার বাদশাহ্‌দের একসংগে জমায়েত করল। ঈসা বলছেন, “দেখ, আমি চোরের মত আসব। ধন্য সেই লোক, যে জেগে থাকে এবং নিজের পোশাক পরে থাকে, যেন তাকে উলংগ হয়ে ঘুরতে না হয় আর লোকে তার লজ্জা দেখতে না পায়।” হিব্রু ভাষায় যে জায়গার নাম হরমাগিদোন, ভূতেরা সেই বাদশাহ্‌দের সেখানে জড়ো করল। পরে সপ্তম ফেরেশতা তাঁর পেয়ালাটা বাতাসে উবুড় করলেন। তখন এবাদত-খানার সিংহাসন থেকে জোরে এই কথাগুলো বলা হল, “যা হবার তা হয়ে গেছে।” তখন বিদ্যুৎ চম্‌কাতে লাগল, ভয়ংকর আওয়াজ হতে ও বাজ পড়তে লাগল এবং এমন ভীষণ ভূমিকমপ হল যা দুনিয়াতে মানুষ সৃষ্টির পর থেকে আর কখনও দেখা যায় নি। সেই ভূমিকমপ খুবই সাংঘাতিক ছিল। সেই নাম-করা শহরটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং বিভিন্ন জাতির শহরগুলো ভেংগে পড়ে গেল। পরে সেই নাম-করা ব্যাবিলনের কথা আল্লাহ্‌র মনে পড়ল, আর তিনি তাঁর গজবের ভয়ংকর মদে পেয়ালা পূর্ণ করে ব্যাবিলনকে খেতে দিলেন। তখন প্রত্যেকটা দ্বীপ পালিয়ে গেল এবং পাহাড়গুলো আর দেখা গেল না। আসমান থেকে মানুষের উপর বড় বড় পাথরের মত শিল পড়তে লাগল। তার প্রত্যেকটার ওজন ছিল ছত্রিশ কেজি। এতে লোকে শিলের আঘাতের জন্য আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে কুফরী করতে লাগল, কারণ সেই শিলের আঘাত ছিল ভয়ংকর। যে সাতজন ফেরেশতার হাতে সাতটা পেয়ালা ছিল তাঁদের মধ্যে একজন এসে আমাকে বললেন, “অনেক পানির উপরে যে মহাবেশ্যা বসে আছে, এস, আমি তার শাস্তি তোমাকে দেখাই। দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা তার সংগে জেনা করেছিল, আর যারা এই দুনিয়ার তারা তার জেনার আংগুর-রসে মাতাল হয়েছিল।” তারপর সেই ফেরেশতা আমাকে মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন। তখন আমি পাক-রূহের বশে ছিলাম। সেখানে আমি একজন স্ত্রীলোককে একটা লাল রংয়ের জন্তুর উপরে বসে থাকতে দেখলাম। কুফরী করবার জন্য অনেকগুলো নাম সেই জন্তুটার উপর লেখা ছিল। তার সাতটা মাথা আর দশটা শিং। সেই স্ত্রীলোকটা বেগুনী ও লাল রংয়ের পোশাক পরে ছিল এবং তার গায়ে সোনা, দামী দামী পাথর ও মুক্তার গহনা ছিল। জঘন্য জিনিসে ও তার জেনার ময়লায় ভরা একটা সোনার পেয়ালা তার হাতে ছিল। তার কপালে এমন নাম লেখা ছিল যার বিষয়ে একটা গোপন সত্য আছে। সেই নামটা হল, “নাম-করা ব্যাবিলন, বেশ্যাদের এবং দুনিয়ার সব জঘন্য জিনিসের মা।” আমি দেখলাম, সেই স্ত্রীলোকটা আল্লাহ্‌র বান্দাদের রক্ত এবং যারা ঈসার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের রক্ত খেয়ে মাতাল হয়ে আছে। আমি তাকে দেখে খুব আশ্চর্য হলাম। তখন সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “তুমি আশ্চর্য হচ্ছ কেন? স্ত্রীলোকটার এবং যে জন্তুটা তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সেই জন্তুটার গোপন অর্থ তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এ সেই জন্তু যার সাতটা মাথা আর দশটা শিং ছিল। যে জন্তুটাকে তুমি দেখেছিলে সে আগে ছিল কিন্তু এখন নেই। পরে সে হাবিয়া-দোজখ থেকে উঠে এসে অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভোগ করবে। তখন যারা এই দুনিয়ার, অর্থাৎ দুনিয়া সৃষ্টির সময় থেকে যাদের নাম জীবন্তকিতাবে লেখা নেই তারা সেই জন্তুটাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে; কারণ জন্তুটা আগে ছিল, এখন নেই, অথচ আবার দেখা দেবে। “এখন যা বলা হবে তা বুঝবার জন্য বুদ্ধির দরকার। সেই সাতটা মাথা হল সাতটা পাহাড় যার উপর স্ত্রীলোকটা বসে আছে। সেই সাতটা মাথা আবার সাতজন বাদশাহ্‌ও বটে। সেই বাদশাহ্‌দের মধ্যে পাঁচজন আগেই শেষ হয়ে গেছে, একজন এখনও আছে আর অন্যজন এখনও আসে নি। সেই বাদশাহ্‌ আসবার পর তাকে কিছুকাল থাকতেই হবে। যে জন্তুটা আগে ছিল কিন্তু এখন নেই সে ঐ সাতজনের মধ্যে একজন হলেও সে অষ্টম বাদশাহ্‌; সে অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভোগ করবে। “যে দশটা শিং তুমি দেখেছ ওগুলো হল দশজন বাদশাহ্‌। তারা এখনও রাজত্ব করতে শুরু করে নি, কিন্তু তারা সেই জন্তুর সংগে অল্প সময়ের জন্য বাদশাহ্‌ হিসাবে রাজত্ব করবার ক্ষমতা পাবে। এই বাদশাহ্‌দের উদ্দেশ্য একই, আর তারা সবাই তাদের ক্ষমতা ও অধিকার সেই জন্তুটাকে দেবে। এরা মেষ-শাবকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে আর মেষ-শাবক তাদের হারিয়ে দেবেন, কারণ তিনি প্রভুদের প্রভু ও বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌। যাদের ডাকা হয়েছে আর বেছে নেওয়া হয়েছে এবং যারা বিশ্বস্ত তারাই তাঁর সংগে থাকবে।” তারপর সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “তুমি যে পানি দেখেছ, যার উপর সেই বেশ্যা বসে আছে, তা হল অনেক দেশ, অনেক লোক, অনেক জাতি ও অনেক ভাষা। তুমি যে দশটা শিং দেখেছ সেগুলো আর সেই জন্তুটা সেই বেশ্যাকে ঘৃণা করবে। তারা তাকে ধ্বংস ও উলংগ করবে এবং তার গোশ্‌ত খাবে; তারপর তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। এর কারণ হল, আল্লাহ্‌ তাদের দিলে এমন ইচ্ছা দিয়েছেন যাতে তাঁর কালাম সফল হয়। তার ফলে তারা একমন হয়ে সেই জন্তুটার কাছে তাদের সমস্ত ক্ষমতা দান করবে, যাতে আল্লাহ্‌র কালাম পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সে রাজত্ব করতে পারে। যে স্ত্রীলোকটাকে তুমি দেখেছিলে সে হল সেই নাম-করা শহর, যে দুনিয়ার সমস্ত বাদশাহ্‌দের উপরে রাজত্ব করছে।” এর পরে আমি আর একজন ফেরেশতাকে বেহেশত থেকে নেমে আসতে দেখলাম। তাঁর মহা ক্ষমতা ছিল এবং দুনিয়া তাঁর মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে গেল। তিনি জোরে চিৎকার করে বললেন, “ধ্বংস হয়েছে, সেই নাম-করা ব্যাবিলন ধ্বংস হয়েছে! ওটা এখন ভূতদের থাকবার জায়গা হয়েছে আর প্রত্যেকটি ভূতের আড্ডাখানা আর নাপাক ও জঘন্য পাখীর বাসা হয়েছে, কারণ সে তার জেনার ভয়ংকর মদ সব জাতিকেই খেতে দিয়েছে। দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা তার সংগে জেনা করেছে, আর দুনিয়ার ব্যবসায়ীরা তার লাগাম-ছাড়া কামনার দ্বারা ধনী হয়েছে।” তারপর আমি বেহেশত থেকে আর একজনকে বলতে শুনলাম, “আমার বান্দারা, তোমরা ব্যাবিলন থেকে বের হয়ে এস যেন তার গুনাহের ভাগী তোমরা না হও, আর যে সব গজব তার উপরে পড়বে তার কোনটাই যেন তোমাদের ভোগ করতে না হয়। তার গুনাহ্‌ আসমান পর্যন্ত উঁচু হয়েছে আর তার খারাপ কাজের কথা আল্লাহ্‌ মনে করেছেন। সে অন্যদের সংগে যেমন ব্যবহার করেছে তার সংগেও তেমনি ব্যবহার কর; তার কাজের পুরোপুরি ফল তাকে দাও। যে পেয়ালার মধ্যে সে অন্যদের জন্য খারাপী মিশাত, তাতে তার পুরোপুরি শাস্তি মিশিয়ে তাকে খেতে দাও। সে নিজের বিষয়ে যত বেশী গর্ব করেছে, যত বেশী উ"ছৃঙ্খল ভাবে বাস করেছে, ঠিক ততটা যন্ত্রণা ও দুঃখ তাকে দাও; কারণ তার দিলে সে ভাবে, ‘আমি তো রাণী হয়ে বসে আছি, আমি বিধবা নই; কোনমতেই আমি দুঃখ বোধ করব না।’ তাই এক দিনেই সব গজব তার উপরে পড়বে; সেগুলো হল মৃত্যু, দুঃখ আর দুর্ভিক্ষ। আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে, কারণ যিনি তার বিচার করবেন সেই মাবুদ আল্লাহ্‌ শক্তিমান।” দুনিয়ার যে সব বাদশাহ্‌রা তার সংগে জেনা করেছে এবং উ"ছৃঙ্খল ভাবে তার সংগে বাস করেছে তারা তাকে পুড়িয়ে ফেলবার সময় ধোঁয়া দেখে কাঁদবে এবং তার জন্য দুঃখ করবে। তারা তার যন্ত্রণা দেখে ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বলবে, “হায়, ব্যাবিলন, হায়! সেই নাম-করা শহর, ক্ষমতায় পূর্ণ সেই শহর! এত অল্প সময়ের মধ্যেই তোমার শাস্তি এসে গেছে!” দুনিয়ার ব্যবসায়ীরাও তার জন্য কাঁদবে আর দুঃখ করবে, কারণ তাদের জিনিসপত্র আর কেউ কিনবে না। তাদের সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে আছে- সোনা, রূপা, দামী পাথর ও মুক্তা; মিহি মসীনার কাপড়, বেগুনী রংয়ের কাপড়, রেশমী ও লাল কাপড়; অনেক রকম খোশবু কাঠ ও হাতীর দাঁতের তৈরী নানা জিনিস; খুব দামী কাঠ দিয়ে তৈরী এবং পিতল, লোহা ও মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী নানা জিনিস; দারচিনি, এলাচ, ধূপ, আতর ও গন্ধরস; আংগুর-রস, জলপাইয়ের তেল, ময়দা আর গম; গরু ও ভেড়া, ঘোড়া ও গাড়ী আর কেনা গোলাম। সেই ব্যবসায়ীরা বলবে, “যে ফল তুমি লাভ করতে চেয়েছিলে তা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে; তোমার সব ধন ও জাঁকজমক ধ্বংস হয়ে গেছে। লোকে আর কখনও সেই সব পাবে না।” যারা এই সব জিনিসের ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছিল সেই ব্যবসায়ীরা তার যন্ত্রণা দেখে ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা কেঁদে কেঁদে দুঃখ করে বলবে, “হায়, হায়! মিহি মসীনার কাপড় আর বেগুনী ও লাল কাপড় পরা এবং সোনা, দামী পাথর ও মুক্তা দিয়ে সাজ-গোজ করা সেই নাম-করা শহর! এত অল্প সময়ের মধ্যেই তোমার এমন মহা ধন-সম্পদ সব নষ্ট হয়ে গেছে!” জাহাজের প্রধান কর্মচারীরা, সমুদ্রপথের যাত্রীরা, নাবিকেরা এবং সমুদ্রে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে তারা সবাই দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। তাকে পোড়াবার সময় ধোঁয়া দেখে তারা চিৎকার করে বলল, “আর কোন্‌ শহর এই নাম-করা শহরের মত?” তারা তাদের মাথায় ধুলা দিয়ে চিৎকার করতে থাকবে এবং কেঁদে কেঁদে দুঃখ করে বলবে, “হায়, সেই নাম-করা শহর, হায়! সমুদ্রে যাদের জাহাজ আছে তারা তার ধনের দ্বারাই বড়লোক হয়েছিল; আর দেখ, অল্প সময়েই সে ধ্বংস হয়ে গেল!” তখন সেই ফেরেশতা বললেন, “হে বেহেশত, ঐ শহরের ধ্বংসের জন্য আনন্দিত হও। আল্লাহ্‌র বান্দারা, সাহাবীরা আর নবীরা, আনন্দিত হও। তোমাদের বিরুদ্ধে সে যা করেছিল তার জন্য আল্লাহ্‌ তার বিচার করেছেন।” পরে একজন শক্তিশালী ফেরেশতা বড় জাঁতার মত একটা পাথর নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে বললেন, “এমনি করেই সেই নাম-করা ব্যাবিলন শহরটাকে ফেলে দেওয়া হবে। তাকে আর কখনও পাওয়া যাবে না। যারা বীণা বাজায়, গান গায় এবং বাঁশী বা শিংগা বাজায় তাদের আওয়াজ আর কখনও তোমার মধ্যে শোনা যাবে না। আর কখনও তোমার মধ্যে কোন রকম দক্ষ মিস্ত্রি পাওয়া যাবে না। কোন জাঁতার আওয়াজ আর কখনও তোমার মধ্যে শোনা যাবে না। বাতির আলো আর কখনও তোমার মধ্যে জ্বলবে না। বর-কনের গলার আওয়াজও আর তোমার মধ্যে কখনও শোনা যাবে না। তোমার ব্যবসায়ীরা দুনিয়াতে বিখ্যাত ছিল, আর সব জাতিই তোমার জাদুর ছলনায় ভুলত। নবীদের, আল্লাহ্‌র বান্দাদের আর যে সব লোকদের এই দুনিয়াতে হত্যা করা হয়েছে তাদের রক্ত এই ব্যাবিলনেই পাওয়া গেছে।” এর পরে আমি বেহেশতে অনেক লোকের ভিড়ের আওয়াজ শুনলাম। তাঁরা বলছিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌! নাজাত, প্রশংসা এবং ক্ষমতা, সবই আমাদের আল্লাহ্‌র, কারণ তাঁর বিচার সত্য ও ন্যায্য। যে তার জেনা দিয়ে সারা দুনিয়াকে নাপাক করেছিল সেই মহাবেশ্যাকে আল্লাহ্‌ শাস্তি দিয়েছেন এবং তাঁর গোলামদের রক্তের প্রতিশোধ তিনি তার উপর নিয়েছেন।” তাঁরা দ্বিতীয় বার বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌! তার মধ্য থেকে চিরকাল ধরে ধোঁয়া উঠতে থাকবে।” আল্লাহ্‌, যিনি সিংহাসনে বসে আছেন তাঁকে সেই চব্বিশজন নেতা ও সেই চারজন প্রাণী সেজদা করে বললেন, “আমিন। আলহামদুলিল্লাহ্‌!” তখন সিংহাসন থেকে একজন বললেন, “আল্লাহ্‌র গোলামেরা এবং তোমরা যারা আল্লাহ্‌কে ভয় কর, তোমরা ছোট-বড় সবাই আমাদের আল্লাহ্‌র প্রশংসা কর।” তারপর আমি অনেক লোকের ভিড়ের আওয়াজ, জোরে বয়ে যাওয়া স্রোতের আওয়াজ ও জোরে বাজ পড়বার আওয়াজের মত করে বলা এই কথা শুনলাম, “আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমাদের সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌ রাজত্ব করতে শুরু করেছেন। এস, আমরা মনের খুশীতে খুব আনন্দ করি আর তাঁর প্রশংসা করি, কারণ মেষ-শাবকের বিয়ের সময় হয়েছে এবং তাঁর কনে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। উজ্জ্বল, পরিষ্কার ও মিহি মসীনার কাপড় তাকে পরতে দেওয়া হয়েছে। সেই কাপড় হল আল্লাহ্‌র বান্দাদের বাধ্যতা।” তারপর সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “এই কথা লেখ, ‘মেষ-শাবকের বিয়ের ভোজে যাদের দাওয়াত করা হয়েছে তারা ধন্য।’ ” তিনি এই কথাও বললেন, “এগুলো আল্লাহ্‌রই কথা এবং তা সত্য।” তখন আমি সেই ফেরেশতার পায়ের কাছে উবুড় হয়ে তাঁকে সেজদা করলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, “এ কি করছ? আমি তোমার সহ-গোলাম। আল্লাহ্‌কেই সেজদা কর। তোমার ঈমানদার ভাইয়েরা, যারা ঈসার শিক্ষা ধরে রাখে, আমি তাদেরই একজন। ঈসার শিক্ষাই ছিল নবীদের শিক্ষার মূল কথা।” পরে আমি দেখলাম বেহেশত খোলাই আছে, আর সেখানে একটা সাদা ঘোড়া রয়েছে। যিনি সেই ঘোড়ার উপরে বসে ছিলেন তাঁর নাম হল বিশ্বস্ত ও সত্য। তিনি ন্যায়ভাবে বিচার ও যুদ্ধ করেন। তাঁর চোখ জ্বলন্ত আগুনের মত আর তাঁর মাথায় অনেক তাজ ছিল। তাঁর গায়ে এমন একটা নাম লেখা ছিল, যে নাম তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। তাঁর পরনে ছিল রক্তে ডুবানো কাপড়, আর তাঁর নাম হল “আল্লাহ্‌র কালাম।” বেহেশতের সৈন্যদল সাদা পরিষ্কার মসীনার কাপড় পরে সাদা ঘোড়ায় চড়ে তাঁর পিছনে পিছনে যাচ্ছিল। তিনি যেন সমস্ত জাতিকে আঘাত করতে পারেন সেইজন্য তাঁর মুখ থেকে একটা ধারালো ছোরা বের হয়ে আসছিল। তিনি লোহার দণ্ড দিয়ে সব জাতিকে শাসন করবেন এবং আংগুর মাড়াই করবার গর্তে তিনি আংগুর পায়ে মাড়াবেন। এই আংগুর মাড়াই করবার গর্ত হল সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র ভয়ংকর গজব। তাঁর পোশাকে ও রানে এই নাম লেখা আছে, “বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌, প্রভুদের প্রভু।” পরে আমি একজন ফেরেশতাকে সূর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যে সব পাখী আসমানে উড়ছিল তিনি তাদের সবাইকে জোরে চিৎকার করে বললেন, “এস, আল্লাহ্‌র মহা মেজবানী খাবার জন্য একসংগে জড়ো হও, যেন তোমরা বাদশাহ্‌, সেনাপতি, শক্তিশালী লোক, ঘোড়া ও সেই ঘোড়ায় চড়া লোকদের, স্বাধীন ও গোলামদের এবং ছোট-বড় সব মানুষের গোশ্‌ত খেতে পার।” তারপর আমি দেখলাম, যিনি সেই ঘোড়ার উপর বসে ছিলেন তাঁর ও তাঁর সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য সেই জন্তুটা আর দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা তাদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে একসংগে জমায়েত হয়েছে। সেই জন্তুটাকে ধরা হল এবং যে ভণ্ড নবী তার হয়ে কেরামতী কাজ করত তাকেও ধরা হল। যারা সেই জন্তুর চিহ্ন গ্রহণ করেছিল এবং তার মূর্তির পূজা করত সেই ভণ্ড নবী সেই সব অলৌকিক কাজ দিয়ে তাদের ভুলিয়ে রেখেছিল। জ্বলন্ত গন্ধকের আগুনের হ্রদে জীবিত অবস্থায় এই দু’জনকে ফেলে দেওয়া হল। যিনি সেই সাদা ঘোড়ার উপরে বসে ছিলেন তাঁর মুখ থেকে যে ছোরা বের হয়ে এসেছিল তা দিয়ে তাদের অন্য সব সংগীদের হত্যা করা হল। তার ফলে পাখীরা পেট ভরে তাদের গোশ্‌ত খেল। এর পরে আমি একজন ফেরেশতাকে বেহেশত থেকে নেমে আসতে দেখলাম। তাঁর হাতে ছিল হাবিয়া-দোজখের চাবি আর একটা মস্ত শিকল। তারপর আমি কতগুলো সিংহাসন দেখলাম, আর যাঁরা সেগুলোর উপরে বসে ছিলেন তাঁদের হাতে বিচার করবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ্‌র কালাম ও ঈসার শিক্ষা অনুসারে চলবার দরুন যাঁদের মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল, আমি তাঁদের রূহ্‌গুলোকে দেখতে পেলাম। তাঁরা সেই জন্তুটাকে বা তার মূর্তির পূজা করেন নি এবং কপালে বা হাতে তার চিহ্নও গ্রহণ করেন নি। তাঁরা জীবিত হয়ে উঠলেন এবং এক হাজার বছর ধরে মসীহের সংগে রাজত্ব করলেন। সেই হাজার বছর শেষ হয়ে গেলে পর শয়তানকে তার জেলখানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সে তখন গিয়ে সারা দুনিয়ার জাতিদের, অর্থাৎ ইয়াজুজ-মাজুজকে ভুল পথে নিয়ে যাবে এবং যুদ্ধের জন্য তাদের একসংগে জড়ো করবে। এদের সংখ্যা হবে সমুদ্রের বালুকণার মত অসংখ্য। তখন আমি দেখলাম, তারা এগিয়ে গিয়ে আল্লাহ্‌র বান্দাদের থাকবার এলাকা এবং তাঁর সেই প্রিয় শহরটা ঘেরাও করল। কিন্তু বেহেশত থেকে আগুন নেমে এসে তাদের পুড়িয়ে ফেলল। যে তাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল সেই ইবলিসকে জ্বলন্ত গন্ধকের হ্রদে ফেলে দেওয়া হল। সেই জন্তু আর ভণ্ড নবীকে আগেই সেখানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তারা চিরকাল ধরে দিনরাত যন্ত্রণা ভোগ করবে। তারপর আমি একটা বড় সাদা সিংহাসন এবং তার উপরে একজনকে বসে থাকতে দেখলাম। তাঁর সামনে থেকে দুনিয়া ও আসমান পালিয়ে গেল, তাদের জায়গা আর কোথাও রইল না। তারপর আমি দেখলাম, ছোট-বড় সব মৃত লোকেরা সেই সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এর পর কতগুলো কিতাব খোলা হল। তার পরে আর একটা কিতাব খোলা হল। ওটা ছিল জীবন্তকিতাব। এই মৃত লোকদের কাজ সম্বন্ধে সেই কিতাবগুলোতে যেমন লেখা হয়েছিল সেই অনুসারেই তাদের বিচার হল। যে সব মৃত লোকেরা সমুদ্রের মধ্যে ছিল, সমুদ্র তাদের তুলে দিল। এছাড়া মৃত্যু ও কবরের মধ্যে যে সব মৃত লোকেরা ছিল, মৃত্যু ও কবর তাদেরও ফিরিয়ে দিল। প্রত্যেককে তার কাজ অনুসারে বিচার করা হল। পরে মৃত্যু ও কবরকে আগুনের হ্রদে ফেলে দেওয়া হল। এই আগুনের হ্রদে পড়াই হল দ্বিতীয় মৃত্যু। যাদের নাম সেই জীবন্তকিতাবে পাওয়া গেল না, তাদেরও আগুনের হ্রদে ফেলে দেওয়া হল। তারপর আমি একটা নতুন আসমান ও একটা নতুন জমীন দেখলাম। প্রথম আসমান ও প্রথম জমীন শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সমুদ্রও আর ছিল না। পরে আমি সেই পবিত্র শহরকে, অর্থাৎ নতুন জেরুজালেমকে বেহেশতের মধ্য থেকে এবং আল্লাহ্‌র কাছ থেকে নেমে আসতে দেখলাম। কনেকে যেমন তার বরের জন্য সাজানো হয়, এই শহরকেও ঠিক সেইভাবে সাজানো হয়েছিল। তারপর আমি একজনকে সেই সিংহাসন থেকে জোরে এই কথা বলতে শুনলাম, “এখন মানুষের মধ্যে আল্লাহ্‌র থাকবার জায়গা হয়েছে। তিনি মানুষের সংগেই থাকবেন এবং তারা তাঁরই বান্দা হবে। তিনি নিজেই মানুষের সংগে থাকবেন এবং তাদের আল্লাহ্‌ হবেন। তিনি তাদের চোখের পানি মুছে দেবেন। মৃত্যু আর হবে না; দুঃখ, কান্না ও ব্যথা আর থাকবে না, কারণ আগেকার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।” যিনি সেই সিংহাসনে বসে ছিলেন তিনি বললেন, “দেখ, আমি সব কিছুই নতুন করে তৈরী করছি।” পরে তিনি আবার বললেন, “এই কথা লেখ, কারণ এই কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য ও সত্য।” তিনি আমাকে আরও বললেন, “শেষ হয়েছে। আমি আল্‌ফা এবং ওমিগা- শুরু ও শেষ। যার পিপাসা পেয়েছে তাকে আমি জীবন্তপানির ঝর্ণা থেকে বিনামূল্যে পানি খেতে দেব। যে জয়ী হবে সে এই সবের অধিকারী হবে। আমি তার আল্লাহ্‌ হব এবং সে আমার পুত্র হবে। কিন্তু জ্বলন্ত আগুন ও গন্ধকের হ্রদের মধ্যে থাকাই হবে ভীতু, বেঈমান, ঘৃণার যোগ্য, খুনী, জেনাকারী, জাদুকর, মূর্তিপূজাকারী এবং সব মিথ্যাবাদীদের শেষ দশা। এটাই হল দ্বিতীয় মৃত্যু।” যে সাতজন ফেরেশতার হাতে শেষ সাতটা গজব-ভরা সাতটা পেয়ালা ছিল তাঁদের মধ্যে একজন আমার কাছে এসে বললেন, “এস, আমি তোমাকে কনে, অর্থাৎ মেষ-শাবকের স্ত্রীকে দেখাই।” পরে সেই ফেরেশতা আমাকে একটা বড় ও উঁচু পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। তখন আমি পাক-রূহের বশে ছিলাম। আল্লাহ্‌র মহিমাতে উজ্জ্বল যে পবিত্র শহর জেরুজালেম বেহেশতের মধ্য থেকে এবং আল্লাহ্‌র কাছ থেকে নেমে আসছিল তিনি আমাকে তা দেখালেন। সেই শহরের উজ্জ্বলতা খুব দামী পাথরের উজ্জ্বলতার মত, স্ফটিকের মত পরিষ্কার হীরার মত। সেই শহরের একটা বড় উঁচু দেয়াল ছিল ও তাতে বারোটা দরজা ছিল, আর সেই দরজাগুলোতে বারোজন ফেরেশতা ছিলেন। ইসরাইল জাতির বারো বংশের নাম ঐ দরজাগুলোর উপরে লেখা ছিল। দরজাগুলোর মধ্যে তিনটা পূর্ব দিকে, তিনটা উত্তর দিকে, তিনটা দক্ষিণ দিকে এবং তিনটা পশ্চিম দিকে ছিল। সেই শহরের দেয়ালের বারোটা ভিত্তি ছিল এবং সেগুলোর উপর মেষ-শাবকের বারোজন সাহাবীর বারোটা নাম লেখা ছিল। যিনি আমার সংগে কথা বলছিলেন তাঁর হাতে একটা সোনার মাপকাঠি ছিল, যেন তিনি সেই শহরটা, তার দরজাগুলো ও তার দেয়ালটা মাপতে পারেন। শহরটা চারকোনা বিশিষ্ট- লম্বা ও চওড়ায় সমান। পরে তিনি সেই মাপকাঠি দিয়ে শহরটা মাপলে পর দেখা গেল সেটা লম্বা, চওড়া ও উচ্চতায় দু’হাজার চারশো কিলোমিটার। পরে তিনি দেয়ালটা মাপলে পর সেটার উচ্চতা একশো চুয়াল্লিশ হাত হল। মানুষ যেভাবে মাপে সেই ফেরেশতা সেইভাবেই মেপেছিলেন। হীরা দিয়ে দেয়ালটা তৈরী ছিল আর শহরটা ছিল পরিষ্কার কাচের মত খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরী। সেই শহরের দেয়ালের ভিত্তিগুলোতে সব রকম দামী পাথর বসানো ছিল। প্রথম ভিত্তিটা হীরার, দ্বিতীয়টা নীলকান্তমণির, তৃতীয়টা তাম্রমণির, চতুর্থটা পান্নার, পঞ্চমটা সূর্যকান্তমণির, ষষ্ঠটা সার্দীয়মণির, সপ্তমটা পোখরাজের, অষ্টমটা বৈদুর্যমণির, নবমটা পীতমণির, দশমটা উপলের, একাদশটা ফিরোজামণির এবং দ্বাদশটা পদ্মরাগের। বারোটা দরজা ছিল বারোটা মুক্তা। প্রত্যেক দরজা এক একটা মুক্তা দিয়ে তৈরী ছিল। শহরের রাস্তাটা পরিষ্কার কাচের মত খাঁটি সোনায় তৈরী ছিল। আমি সেই শহরে কোন এবাদত-খানা দেখলাম না, কারণ সর্বশক্তিমান মাবুদ আল্লাহ্‌ এবং মেষ-শাবকই ছিলেন সেই শহরের এবাদত-খানা। সেই শহরে আলো দেবার জন্য সূর্য বা চাঁদের কোন দরকার নেই, কারণ আল্লাহ্‌র মহিমাই সেখানে আলো দেয় এবং মেষ-শাবকই সেখানকার বাতি; আর সব জাতি সেই আলোতে চলাফেরা করবে। দুনিয়ার বাদশাহ্‌রা তাঁদের জাঁকজমক নিয়ে সেই শহরে আসবেন। দিনের বেলা শহরের দরজাগুলো কখনও বন্ধ থাকবে না আর সেখানে রাতও হবে না। সমস্ত জাতির গৌরব ও সম্মান সেখানে আনা হবে। নাপাক কোন কিছু কিংবা জঘন্য কাজ করে বা মিথ্যা কথা বলে এমন কোন লোক সেখানে কখনও ঢুকতে পারবে না; যাদের নাম মেষ-শাবকের জীবন্তকিতাবে লেখা আছে তারাই কেবল সেখানে ঢুকতে পারবে। আল্লাহ্‌র ও মেষ-শাবকের সিংহাসন সেই শহরে থাকবে এবং তাঁর গোলামেরা তাঁর এবাদত করবে। তারা তাঁর মুখ দেখতে পাবে এবং তাঁর নাম তাদের কপালে লেখা থাকবে। রাত আর থাকবে না এবং তাদের আর বাতির আলো বা সূর্যের আলোর দরকার হবে না, কারণ মাবুদ আল্লাহ্‌ নিজেই তাদের আলো হবেন। তারা চিরকাল ধরে রাজত্ব করবে। পরে সেই ফেরেশতা আমাকে বললেন, “এই সব কথা বিশ্বাসযোগ্য ও সত্য। মাবুদ আল্লাহ্‌, যিনি নবীদের মধ্য দিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যেন কিছুকালের মধ্যে যা অবশ্যই ঘটতে যাচ্ছে তা সেই ফেরেশতা তাঁর গোলামদের দেখাতে পারেন।” ঈসা বলছেন, “দেখ, আমি শীঘ্রই আসছি। এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালাম যে পালন করে সে ধন্য।” আমি ইউহোন্না এই সব শুনেছি ও দেখেছি। সব শুনবার ও দেখবার পরে, যে ফেরেশতা আমাকে এই সব দেখালেন আমি তাঁকে সেজদা করবার জন্য তাঁর পায়ের উপর উবুড় হলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, “থাম, আমি তোমার ও তোমার ঈমানদার ভাইদের, অর্থাৎ নবীদের এবং যারা এই কিতাবের সব কথা পালন করে তাদের সহ-গোলাম। আল্লাহ্‌কেই সেজদা কর।” তারপর তিনি আমাকে বললেন, “এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালাম তুমি গোপন রেখো না, কারণ সময় কাছে এসে গেছে। যে অন্যায়কারী, সে এর পরেও অন্যায় করুক; যে জঘন্য, সে এর পরেও জঘন্য থাকুক। সৎ লোক এর পরেও সৎ কাজ করতে থাকুক এবং যে লোক পবিত্র, সে এর পরেও পবিত্র থাকুক।” ঈসা বলছেন, “দেখ, আমি শীঘ্রই আসছি এবং প্রত্যেককে তার কাজ অনুসারে দেবার পুরস্কার আমার সংগেই আছে। আমি আল্‌ফা এবং ওমিগা, প্রথম ও শেষ, শুরু ও শেষ। “ধন্য তারা, যারা তাদের পোশাক ধুয়ে ফেলে যেন তারা জীবন্তগাছের ফল খাবার অধিকারী হয় এবং দরজার মধ্য দিয়ে শহরে ঢুকতে পারে। কুকুরের মত জঘন্য লোক, জাদুকর, জেনাকারী, খুনী, মূর্তিপূজাকারী, আর যারা মিথ্যা ভালবাসে ও মিথ্যার মধ্যে চলে, তারা সবাই বাইরে পড়ে আছে। “আমি ঈসা আমার ফেরেশতাকে পাঠিয়েছি যেন সে তোমাদের কাছে জামাতগুলোর জন্য এই সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আমি দাউদের মূল এবং বংশধর, ভোরের উজ্জ্বল তারা।” পাক-রূহ্‌ এবং কনে বলছেন, “এস।” আর যে এই কথা শুনছে সেও বলুক, “এস।” যার পিপাসা পেয়েছ সে আসুক এবং যে পানি খেতে চায় সে বিনামূল্যে জীবন্তপানি খেয়ে যাক। যে লোক এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালাম শোনে আমি তার কাছে এই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কেউ যদি এর সংগে কিছু যোগ করে তবে আল্লাহ্‌ও এই কিতাবে লেখা সমস্ত গজব তার জীবনে যোগ করবেন। আর এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কালাম থেকে যদি কেউ কিছু বাদ দেয় তবে আল্লাহ্‌ও এই কিতাবে লেখা জীবন্তগাছ ও পবিত্র শহরের অধিকার তার জীবন থেকে বাদ দেবেন। যিনি এই সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তিনি বলছেন, “সত্যিই আমি শীঘ্র আসছি।” আমিন। হযরত ঈসা, এস। হযরত ঈসার রহমত আল্লাহ্‌র সব বান্দাদের উপর থাকুক। আমিন।